জাগ্রত ব্যক্তিত্ব
“আমাদের মন হলো এমন এক যন্ত্র যার সাহায্যেই আমরা কাজ করি। তাই আমাদের নির্ভুলভাবে চিন্তা করতে হবে, যাতে কোন্টি গুরুত্বপূর্ণ আমরা যেন মনে রাখতে পারি এবং কোন্টি মূল্যহীন ভুলে যেতে পারি। আর এমন আবেগে আপ্লুত হতে হবে যাতে আমরা কার্যকরী কিছু করতে পারি এবং যন্ত্রণাময় বা অপ্রয়োজনীয় সব কিছুই দূর করতে পারি। আমাদের রাত্রিতে শান্তিতে নিদ্রা যেতে হবে আর দিনের আলোয় সুষ্ঠুভাবে চিন্তাও করতে হবে। আমাদের অবশ্যই বিতর্কিত বিষয়ের সঠিক বিচার করতে হবে আর এটা করতে গিয়ে কোন ভাবেই সংস্কার বা অযৌক্তিক আবেগে তাড়িত হওয়া চলবে না এবং আমাদের চারিত্রিক সেই বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, মন আমাদের প্রকৃতই ভালো কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করবে আর মানুষের সেবায় ব্যবহৃত হবে।”
রবার্ট টুলেস-’দি কন্ট্রোল অব দি মাইন্ড’।
.
এক. জ্ঞানের শক্তি
প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা বহু মানুষের সংস্পর্শে আসি যারা সব কিছু ভণ্ডুল করে দেয়।
কাজগুলো করার সময় তারা বলে এর চেয়ে ভালো তাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর ভালোভাবে করাও সম্ভবপর নয়।
কিন্তু যে ছাপ তারা রেখে যায় সেটা তারা যা আশা করে তার চেয়েও অনেক বেশি আশাতীত। তারা এরপরেই নানা বিষয়ের উপর দোষারোপ করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত তাদের অবশ্য স্বীকার করতেই হয় সমস্ত গোলমালের মূলে তারা নিজেরাই। তারা বিশ্রিভাবে কাজ করেছে। যে আবেগ আর ধারণার তারা বশবর্তী হয়েছিল, যা তাদের চালনা করেছিল অবস্থার সঙ্গে সেটা মানানসই ছিলো না। দুঃখের বিষয় হলো এই, তারা প্রায়শঃই সব গোলমালের মূল কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ …সেটা হলো তারা মানুষের চরিত্র সম্পর্কে ধারণাহীন।
এই পৃথিবীতে যে মানুষ এগিয়ে চলতে চায় সে অনবরতই সব রকম মানুষকে ধাক্কা দিয়ে, ঠেলে এগিয়ে চলে।
সে যতদিন বেঁচে থাকে ততই তার মনে আলোড়ন আনে এই কথাগুলো : ‘কোন পাঁচিলের মধ্য দিয়ে বাইরের পৃথিবীর দিকে কিছুতেই তাকালে চলবে না। আমাকে দরজা উন্মুক্ত করে কোলাহল মুখরিত রাস্তায় নেমে এসে যতটা সম্ভব মানুষকে জানতে হবে। আমাকে খুশি মনে মিশতে হবে। আমাকে জানতে হবে মানুষের মন কিভাবে কাজ করে।’
এই ধরনের জ্ঞানই শক্তি জোগান দেয়। এটাই হলো জীবনের কলাশিল্প। একে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান বা পক্কতা যাই বলুন না কেন।
জীবন যাপন করার কাজটি আপনারও যে রকম আমারও তাই। যখন খুশি ইচ্ছে মত আমরা আমাদের এই দোকানটি বন্ধ করে দিতে পারি না। অথবা শ্রেফ অজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সব কিছু এলোমেলোও করে দিতে পারি না।
যে কোন মূল্যেই আসুন আমরা শক্তি নামে এই জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করি।
প্রথম কাজ হলো, কথাটা যতই অদ্ভুত শোনাক, নিজেকে বিস্মৃত হওয়া। প্রথমেই ‘আমি’ কথাটা ভুলে যান, ভুলে যান যে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন আপনিই।
আপনি নিজে একটা বিন্দু ছাড়া কিছুই নন, আর আপনি কেন্দ্রের অভিমুখে চলেছেন যেটা হলো সব জিনিসেরই মূল প্রশ্ন কেন?
একথা ভোলার চেষ্টা করুন আপনার মনে যা জাগছে তারই কেবল মূল্য আছে। যেটির প্রকৃতই দাম আছে তা হলো বাস্তবতা। এটা আপনার মনের বাহিরে রয়েছে।
যা মনে হতে চায় আর যা প্রকৃত, এ দুটির মধ্যে অনেকটাই ফারাক। আপনি একটা থেকে অন্যটার ফাঁকটুকু লাফিয়ে পার হতে পারেন না। মন সে চেষ্টা করে বটে, তবে সে ব্যর্থ হবেই।
আমরা সর্বদাই ভুল করে চলেছি। এটাই বোঝার চেষ্টা করুন। এ ব্যাপারে মন খোলা রাখুন।
যতখানি সম্ভব আলোয় আনার চেষ্টা করুন। সব জিনিসকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে চেষ্টা করুন …. বাস্তবে সব কিছু যে রকম।
অনবরত সকলের সঙ্গে মিশতে চেষ্টা চালান। যতদূর সম্ভব হয় অন্যের সঙ্গে মনের মিশ্রণ ঘটান। জীবন নামে উত্তেজনার বস্তুটি পাঠ করার চেষ্টা করুন … জীবনের প্রতিটি কথা, শব্দ, প্রতিটি লাইন। প্রতিটি পৃষ্ঠাই পড়ে নিন। এ কাজ সারা জীবনের। এটাই আপনার বা আমার কাছে সব কিছু আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতও।
সব রকম মানুষকে জেনে নেবার চেষ্টা করুন-ধনী, দরিদ্র, তরুণ, বৃদ্ধ, বুদ্ধিমান, বোকা, সোজা আর সাধারণ মানুষকে। তারা সবাই মুখোশ পরে আছেন। আমরা সবাই তাই করি। সকলের মুখোশ উন্মোচন করে দিন। তাদের আসল মুখ এই ভাবেই দেখার চেষ্টা করুন।
এই মানুষদের কেউ কেউ তাদের নিজেদের বইয়ের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। এই বিখ্যাত বইগুলি জীবন্ত। এর প্রতিটি শব্দও। তাই এই সব বইয়ের প্রত্যেকটিই পাঠ করে ফেলুন–যতগুলি সম্ভব। এই সব বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোও মুখোশের আড়ালে থাকে। তাদের ছিঁড়ে ফেলে প্রকাশ করুন। তারা যা কিছু আড়াল করতে চাইছে তাদের আলোর মাঝখানে নিয়ে আসুন।
যে সব স্ত্রী পুরুষ জীবনের সেরা নির্যাস আহরণ করে থাকেন তাঁরা সবাই এই উজ্জ্বল ছবিই, তাদের জীবনের বাইরের ছবিগুলোই সারাক্ষণ ব্যবহার করে চলেন।
আসলে যে কথা বলতে চাইছিলাম, কোন কাজ করার আগে তারা দেখে নিতে চান কি ঘটতে চলেছে।
তারা কল্পনা করতে পারেন, দূরদৃষ্টিতে ভবিষ্যতও দেখতে পান। তারা বর্তমানকে ভেদ করেন আর মানসিক ভাবে অনেক দূরে এগুতে পারেন।
এটা হলো সম্ভবতঃ সাফল্যের গোপনতম রহস্য। পৰ্বতশৃঙ্গে ওঠা মন ভবিষ্যতের পক্ষে এগিয়ে চলার পথে নানান বাঁক নিতে থাকে। আসুন, আমরা এরকম একটা মন গড়ে তুলি :
এটাই স্থির করে ফেলুন যে–প্রতিদিন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে–সারাদিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাগুলো নিয়ে ভাববেন আর নিজেকে জিজ্ঞাসা করবেন : আজকে আমি কি শিখলাম? কি কি ভুল আমি করেছি? সঠিক কি করা উচিত ছিল? এরপর আগামী দিনটির কথা ভাবুন। দেখে নিন কি আসছে। মনে মনে ঠিক করে ফেলুন কি করা সবচেয়ে ভালো।
.
দুই. চিন্তা-শক্তি
এগিয়ে চলতে গেলে আপনাকে আপনার মস্তিষ্ক চালনা করতে হবে। ভাগ্যের কথা আলোচনা করে লাভ নেই।
পৃথিবীতে বহু ব্যাপার আছে। এমন অনেক ব্যাপার আছে যা আপনার হতে পারে। কিন্তু সে সবের বিরুদ্ধে আপনি কিছুই করতে পারেন না। তারা আপনারা সামনের পথকে উড়িয়ে দিতে পারে–আবার নাও পারে।
আপনি একটা বিরাট সুযোগেরই অপেক্ষায় আছেন। ভাগ্য সহায় হোক চাই নাই হোক, আসল কেন্দ্রবিন্দু আপনিই।
ঝড়-বাতাসের কথা ভাববেন না। বাতাস যেভাবে যেখানেই খুশি আসুক তার মুখোমুখি হয়ে পড়ুন। আসল খেলা হলো বাতাস যেদিকে বয়ে চলেছে সেদিকেই নিজেকে এগিয়ে দিন।
আসলে এটা একটা বুদ্ধির লড়াই। বুদ্ধিমানেরাই জয়ী হয় এমন কথাই হয়তো আপনি ভাববেন। যার বুদ্ধি যত তীক্ষ্ণ, লাভের অংশও তার তত বেশি। উচ্চশিখরে যে সব মানুষ আছেন তারা তাদের বুদ্ধির উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকেন। তারা তাদের মস্তিষ্কের ধূসর কোষের উপরেই নির্ভর করেন।
মস্তিষ্কের শক্তি মানুষকে তুলে এনে এগিয়ে দেয়। স্রোতের অনুকূলেই চলুন। এই ভাবেই সবচেয়ে ভালো ভাবে পৌঁছানো সম্ভব।
আপনি আপনার মস্তিষ্ক নিয়ে কি করছেন? আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আপনার মস্তিষ্ক বলে কিছুই নেই বা উল্লেখ করার মত নেই। ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়। প্রত্যেকটি মানুষই মস্তিষ্ক নিয়েই জন্মান। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো সকলেই দেখতে পায় না যে মস্তিষ্ক বেড়ে উঠছে। আপনাকে শিখতে হবে এটি নিয়ে কাজ করতে। এটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। সারা জীবনেরই কাজ। আপনাকে মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে।
মনে রাখবেন, মস্তিষ্কের সব সময় চালু থাকার বদলে মানসিক দিক থেকে ভারাক্রান্ত বা অচেতন থাকা ঢের সহজ।
অবশ্যই আপনি মস্তিষ্ককে চালনা না করেও দিব্যি চালিয়ে যেতে পারেন, লক্ষ কোটি মানুষও তাই করেন।
তবে অন্যের চেয়ে আলাদা হতে গেলে আরও জয় করতে গেলে, নিজের যোগ্যতা আরও বাড়াতে হলে আপনাকে অবশ্যই মস্তিষ্কের শক্তিকে আরও অনেক বেশি করে কাজে লাগাতেই হবে।
মস্তিষ্ককে সজীব রাখুন। একে ব্যস্ত রাখুন।
দ্রুততার সঙ্গে সব শিখবার চেষ্টা করুন। সব কিছু লক্ষ্য করুন। বিখ্যাত মানুষেরা যেভাবে অতি ক্ষুদ্র জিনিসও খুঁটিয়ে লক্ষ করেন শুনলে অবাক হবেন।
শুধু লক্ষ্য রাখবেন যাতে আপনার প্রতিটি রিপু সজাগ, জাগ্রত আর তীক্ষ্ণ থাকে। এটাই হলো দক্ষতা অর্জনের প্রাথমিক কাজ। যে ব্যক্তি তার চোখ আর কানের উপর নির্ভর করতে পারে না তার পক্ষে সাফল্য লাভ করা খুবই কঠিন।
দুই আর দুই যোগ করুন। এটাই হলো বিরাট এক রহস্য। ঠিক এই পথেই একজন আর একজনকে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেয়।
সমস্ত ঘটনা এক সঙ্গে গ্রথিত করুন। নানা ধারণা মিলেমিশে থাকলে কোনভাবেই কিছু করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না।
সব কিছু বেছে নিন। তারপর সবকিছু সাজিয়ে তুলুন। দ্রুত চিন্তার কাজে এটাই হলো সঠিক পথ।
এই ভাবেই আপনার মধ্যে নতুন নতুন ভাবনার জন্ম হবে। আপনি হয়তো বা বলতে চাইবেন সবকিছুতে দ্রুততাই শেষ কথা নয়। হ্যাঁ, সেটা আমরাও স্বীকার করি।
তবে মনে রাখবেন, নির্দিষ্ট কোন একটা সময়ে শিক্ষিত মন, যে মন দ্রুত কাজ শেষ করতে পারে, সেই কিন্তু বেশি লভ্যাংশ আদায় করতে পারে।
আপনার মূল্যায়ন হবে আপনি কতখানি দিতে পারেন তারই উপর। তাই আপনার উদ্দেশ্য হোক, আরও ভালো, দ্রুত চিন্তাধারা।
.
তিন. পাদ প্রদীপের আলো
আপনি আরও ভালো করে সব খেলায় অংশ নিতে পারেন। শুধু যদি আপনি সঠিকভাবে যা করতে চলেছেন তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। এরই মধ্যে খুঁজে পাবেন অনেক বেশি মজা।
একটা উদাহরণ দিই।
আপনার কাজের মধ্য থেকে অনেক বেশি লাভ আদায় করতে পারবেন যদি আপনার চিন্তাধারা পথ থেকে দূরে সরে যায়। খেলা বা কাজ দুটোর কোনটাতেই আপনি তেমন মন দিয়ে অংশ নিতে পারবেন না বা সুখী হবেন না যদি আপনার মনে কাজের জন্য ভাবনা থেকে যায়। এটা হলে শুধু সময়েরই অপব্যবহার হবে। আপনি হলেন এমন একজন মানুষ যিনি জানেন না কোন্ পথে যেতে হবে। অতএব এটার অর্থই হলো সময়ের অপব্যবহার আর অপচয়।
কি করছেন সেটা বুঝে নেওয়া আপনার পক্ষে হয়তো কঠিন। আপনি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছেন না। আপনি মনে রাখতে পারেন না। আপনার উপরওয়ালা হয়তো বলছেন আপনি মনোযোগী নন, দক্ষ নন। আপনার বন্ধুরা হয়তো বললেন, ‘ওহ! ও কোনো কাজেই নজর দেয় না।’
অন্যদিকে আপনি যখন সত্যি সত্যিই আগ্রহী হন, সব কিছুই আপনি কেমন সহজ ভাবেই না গ্রহণ করেন। যে কাজ, বা যা কিছুই আপনি করুন না কেন যেন চোখের পলকে অর্ধেক সময়েই সেটা সম্পন্ন। হয়ে যায়। আপনি কখনই অনুভব করেন না। আপনি কোনভাবেই কাজে লাগান নি এমন। আপনি ক্লান্তি অনুভব করেন না। আপনি খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোও ভুলে যান না। কয়েক মাস পরেও আপনি সেগুলো মনে করতে পারেন।
আপনি অনুভব করেন নজর দেওয়াই ভালো।
মনকে নানা দিকে অর্থহীনভাবে ফেরানো একটা বাজে ব্যাপার। অত্যন্ত খারাপ অভ্যাস। এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
যত তাড়াতাড়ি এটা থেকে মুক্ত হবেন ততই ভালো।
বারবার কেবল একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবার অনবরত চেষ্টা করতে থাকুন। সেই একটি ব্যাপারেই আপনার সমস্ত নজর দিন।
সমস্ত মনকেই ওই একটা ব্যাপার সামলাতে দিন। তাতে আপনার পক্ষে প্রমাণ করা সহজ হবে আপনার একটি মাথা আছে আর তা আপনি ব্যবহার করতে জানেন।
সব ব্যাপারটা আপনাকে বেশ খুলে বলতে চাই।
আপনি উপরের বক্তব্য থেকে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নিয়েছেন আপনি আপনার মনে একটা সময়ে একটা ব্যাপারই মনে রাখবেন।
একটা উদাহরণ রাখছি।
ধরুন আপনি একটা চেয়ারের বিষয়ে ভাবছেন। আপনি হয়তো ধরে নেবেন যে আপনার মনে ওই ‘চেয়ার’ ছাড়া আর কোন বিষয় থাকা চলবে না।
এটা অনেকটা হাঁটতে শেখা শিশুর মতই হবে, সে তখন যা করতে চায়। সে দেখে সে একটা পায়ের পর আর একটা পা ফেলার ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছে না। সে বেশি দূরও স্বাভাবিকভাবেই যেতেও পারে না। এর কারণ আর কিছুই না, হাঁটা ব্যাপারটায় এর চেয়ে আরও কিছু দরকার। এর জন্য চাই সারা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা আর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকা।
এই ধরনের মনোযোগের (বা একগ্রতার) অর্থ হলো মনের সব ভাব উন্মুক্ত করে দেওয়া আর সেখানে একটা মাত্র চিন্তাই রেখে দেওয়া।
এ ধরনের চিন্তা বেশ ধীরগতির হয়। এটা বেশ ক্লান্তিকর। কোন মানুষ তার মন সঠিকভাবে কাজে লাগালে চিন্তার ফসল অবশ্য একটু কমই হয়।
মনোযোগের অর্থ হলো কোন বিষয় নিয়ে আগাগোড়া চিন্তা ভাবনা। আপনি যেন তার চারপাশে ঘুরে বেশ নজর দিয়ে সব রকমভাবেই দেখে নিচ্ছেন। অনেকগুলো পথের সংযোগস্থলের কথাটা একবার মনে করলেই বুঝবেন আমি কি বলতে চাইছি। আপনার মন কেন্দ্রে ব্যস্ত রয়েছে, কিন্তু সে বিভিন্ন পথগুলো লক্ষ করতে ভোলনি।
আপনি কোন একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছেন আর এরই সঙ্গে যতগুলো সম্ভব অন্যান্য চিন্তাভাবনাও এরই সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন।
এ ধরনের মনোযোগ সত্যিই কাজে আসে। এর ফলে আপনার ভাবনার বিষয় আগাগোড়া ভালোভাবে নিতে পারেন।
কোন মানুষ এই অর্থ করে থাকে যখন সে বলে : ‘অমুক লোককেই আমরা চাই। সে সব ব্যাপার পরিষ্কার করে দেবে। সে এই ব্যাপারের একেবারে নিচে পৌঁছতে পারবে।‘
অমুককে খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির, দ্রুত চিন্তাশীল, সদাজাগ্রত, নিখুঁত ইত্যাদি বিশেষণে অভিষিক্ত করা হয়। আসল রহস্য হলো এই যে তার সঠিক নজর দেওয়ার অভ্যাস আছে।
এ অভ্যাসটি চমৎকার। এতে আখেরে লাভ হয়। অতএব মন স্থির করে ফেলুন যদি এই গুণটি আয়ত্ত করতে চান। ইচ্ছার সঙ্গে মনোযোগ প্রদান। শুধু এই কাজটিই আপনাকে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে।
এটা হলো মানসিক এক পাদপ্রদীপের আলো। আপনার যখন যেমন খুশি সুইচ টিপলেই হলো। অসংখ্য বিষয়ের মাঝখানে একেবারে একটা বিষয় আলোকিত অবস্থায় এবার দেখুন। ওই আলোর পাশে অন্য সব বিষয় চাপা পড়ে যাবে। প্রয়োজনমত কাজ করুন, যা প্রয়োজন নেই অন্ধকারে ঠেলে দিন।
এ রকম করলেই আপনি আপনার মনকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারবেন। এতে আপনি আরও ভালোভাবে মনে রাখতে পারবেন। এতে আপনি সহজে ভুলেও যেতে পারবেন না। আপনি অনুভব করবেন আপনার বেশ সুক্ষ্ম বুদ্ধি আছে।
এটাই হলো ইচ্ছা-মনোযোগের পুরষ্কার।
.
চার. একাগ্রতা
চিন্তা আর কাজ : জীবন প্রধানত এ দুটি নিয়েই।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ আর শ্রেষ্ঠ দ্রুত কার্যশীল মানুষেরাই জীবনকে পেয়ে থাকেন সম্পদ, উজ্জ্বল আর সূর্যালোকিত করে। তারা অধিকাংশ সময়েই লাভ করে থাকেন সবচেয়ে বেশি লাভের অংশ। এগুলো কানায় কানায় পূর্ণ আর সত্যিকার দামী। এই সব মানুষ অনবরতই তাদের চিন্তার ভাণ্ডারে আর কাজে শক্তি সঞ্চয় করে চলেন। এ ছাড়াও তারা তাদের কাজে আরও দক্ষ হয়ে উঠতে চান।
আপনি কি এই শ্রেণীতে পড়েন?
না কি আপনি বেশি চিন্তা করতে পারেন না? আপনি কি নানা চিন্তায় হাবুডুবু খেতে অভ্যস্ত?
আপনি কি সঠিক চিন্তা করতে পারেন? যে যে বিষয় ভাবেন সেগুলি কি ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে আসে? আপনার স্মৃতি শক্তি কেমন–সেটা কি ভালোভাবে কাজ করে?
তা যদি না করে তাহলে আপনি আপনার ক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠতে থাকেন। অবস্থা আর সুযোগ সম্পর্কে আপনি ভীত হয়ে ওঠেন-কারণ আপনি এটিতে দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ।
সুযোগ আপনার হাতের কাছে, অথচ আপনি সেটা ধরতে পারছেন না। একজন ডাক্তারের মতই রোগের মূল আবিষ্কারের চেষ্টা করুন। আপনি নিজেকে সঠিকভাবে চিন্তা করতে শেখান নি।
কারণ চিন্তা করা কোন ভাবেই মানসিক বেড়িয়ে বেড়ানো অলসতা বা যা মনকে এলোমেলো করে দেয় এমন কোন কাজ নয়।
লাভ করার আশা বজায় রেখে চিন্তা করার অর্থ হলো সমস্ত বিষয় সংগ্রহ করে ঠিকমত সাজানো আর এটাই দেখা যেগুলি অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত।
চিন্তাশীল ব্যক্তি সব সময়েই সঠিক প্রশ্ন করে থাকেন। ঠিক উত্তর না মেলা পর্যন্ত তার বিশ্রাম নেই।
এরকম কাজ যিনি ভালোভাবে করতে পারেন, তাকে আমরা বলি সঠিক মাথা খাটাতে পারেন। তিনিই।
এরকম যিনি করেন তাঁর কাজ হলো একাগ্রতা। কারণ আপনি যা কল্পনা করেন একাগ্রতা সেই সময়ের অপচয় কখনই নয়। সম্ভবত আপনি ভাবেন এটা হল মানসিক দুর্বলতামাত্র, বিনা কারণে হৈ চৈ মাত্র।
এই রকম ধারণাই হয় বেশিরভাগ মানুষের। শুধু মাত্র একটা ব্যাপারের জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করায় লাভ কি? এরকম কথাই তারা বলে, তাদের অনুভূতি বলে অনেক কম পরিশ্রমেই আর কম সময়ে তারা এর চেয়ে দশগুণ বেশি খবরাখবর নিয়ে কাজ করতে পারেন।
অতএব, এই একাগ্রতার দরকার কি? কথাটা ঠিকই হয়তো।
এই ধরনের একাগ্রতা অর্থহীন। এটা কোন যোগ্য প্রস্তাব কখনই নয়। একাজ করতে আপনি যে কষ্ট করেন আর তার পরিবর্তে যা পান তা সত্যিই আনুপাতিক তো নয়ই। তাহলে এতেই দেখা যাচ্ছে একাগ্রতার ধারণাটাই একেবারে ভুল। কারণ, আসলে একাগ্রতা মনের যন্ত্রকে অত্যন্ত উচ্চশক্তিতে চালনা করে চলে। এ হলো মনোযোগের অন্য অর্থ, অনেকগুলো বিষয়কে এটি পাদপ্রদীপের আলোকে নিয়ে আসে। এ মনকে ঘুমিয়ে পড়তে দেয় না। এ তাকে স্থির হয়ে পড়তেও দেয় না।
অন্যদিকে যে মন একাগ্র হয়ে উঠছে সে মন দ্রুত কাজ করতে পারে, আর এর ফলে উন্নতমানের প্রচুর উৎপাদনই তাহলে মিলতে পারে।
এই ধরনের মন সম্পূর্ণভাবেই সবকিছু বুঝতে পারে, এ মন জানে সব কিছুই আর সহজেই স্মরণে রাখতেও পারে।
এ ধরনের মন তার শক্তি অনুভব করতে পারে। এই মন তাই সফলও হয়।
আপনি একাগ্রতা আনতে ভয় পাচ্ছেন। হয়তো কল্পনা করছেন কাজটি কঠিন। আর এটা করতে গেলে পরিশ্রান্ত, নিঃশেষ হয়ে পড়বেন।
আসলে ব্যাপারটা কখনই তা নয়।
আপনি আপনার পছন্দসই খেলায়, বইয়ে বা হবির বেলা কিন্তু কখনই ক্লান্তি অনুভব করতে চান না। সেগুলো আপনাকে একেবারে মগ্ন করে রাখে। এগুলো আপনাকে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু আপনি না জেনেই সে সবে মনোযোগ দিয়ে চলেন। আপনি সে সব বেশ উপভোগও করেন। আর সেটা দৃঢ় ভাবেই করেন। এই কাজে আপনি আপনার মনকে পুরোপুরি লাগিয়ে রাখেন। আপনি তাতেই একাগ্র হয়ে থাকেন। বাকি সবই আপনার মন থেকে মুছে যায়। তবুও শয়ে শয়ে নান বিষয়, নানা কল্পনা ইত্যাদি আপনার মনে জেগে উঠতেও চায়। এই একাগ্রতা আনন্দ মূচ্ছনা এনে দেয়। আপনি বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর ঠিক এই কারণেই আপনি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। আসলে এটাই হলো একাগ্রতা। আগ্রহের জন্য একাগ্রতা।
এ ব্যাপারটা কেবল হবি বা খেলাধুলার ব্যাপারেই ঠিক নয়। যে মানুষ মনোযোগ দিয়ে করেন তিনি সেটা করেন যেহেতু তিনি কাজে আগ্রহ বোধ করেন। তিনিতাকে আগ্রহী করে তোলেন।
এ ব্যাপারটা খুবই সহজ আর আনন্দদায়ক জিনিস–এই আগ্রহের কথাই বলছি। সব কিছু বড় বড় বিষয়েরই শুরু এটা থেকে।
কারণ আগ্রহ মানেই হলো মনোযোগ। এটাও শিশুবয়সের খেলা স্মরণে এনে দেয়। এমন স্মৃতিশক্তি যা কোন কিছুই না ভুলে যেতে দিয়ে আরও ভালো কাজ করতে সাহায্য করে, সব সেরা মানের কাজ।
সাফল্যই এর সঠিক পরিচয়। অতএব একাগ্রতা অনুশীলন করুন। আপনার এটি ছাড়া করণীয় আর কিছুই নেই।
.
পাঁচ. স্মৃতিশক্তি
এ জীবন প্রচুর সম্পদে ভর্তি। কাজ কর্ম প্রতিদিনই নানাভাবে জটিলতাময় হয়ে পড়েছে। আপনি যদি কোন ব্যাপার ভুলে যান, আপনি কোন দিকে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সঠিক সময়ে ভুলে যাওয়ায় কোন লাভ হয় না।
ভুলোমনা মানুষ আজকের দিনে একবারে অচল …এ দুনিয়ায় তার কোনরকম সুযোগই নেই।
স্মৃতিশক্তিই হলো আসল শক্তি। আর এটাই হলো শতকরা নিরানব্বই ভাগ ‘আপনি’।
এটা সরিয়ে নিন–আপনি হয়তো একটা অ্যামিবায় পরিণত হবেন। এটা তাই আপনার ডাক হাত। এটাই কাজ করে।
তাই লক্ষ্য রাখুন এ যেন ঠিক থাকে। আসুন এই শক্তিকে আরও উন্নত করার জন্য প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করি না কেন?
আপনি হয়তো বলতে চাইবেন, এ হলো একটা পুরস্কার। আমার এরকম শক্তি নেই। ইচ্ছে করলেই এ ক্ষমতা আমি অর্জন করতে পারি?
যে কথা তাই মনে রাখা দরকার তাহলে এই : স্মৃতিশক্তি নিয়ে যা ভাবছেন তার সবই ভুল। এটা কোন পুরস্কার নয়। তাহলে হয়তো কোনদিন বলে ফেলবেন আপনার লাভ ও পুরস্কার পাওয়া।
স্মৃতিশক্তির জন্য এমনই একটা ব্যাপারে আনন্দে আপনার মন কাজ করে। যতক্ষণ আপনি আপনার মনকে হারিয়ে ফেলেন নি, আপনি আপনার শেষ কপর্দক বাজি রাখতে পারেন আপনার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যায়নি। বিল্ডিং ফরমণ করেছে
‘ব্রেন বিল্ডিং ফর সাকসেস’ বইটিতে এনেভার এ কথাটাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন। হাজার হাজার ঘটনায় তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন মনে রাখার ব্যাপার নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলে। আমাদের স্মৃতিশক্তি যথাস্থানেই আছে। এর অর্থ হল আমাদের মন ঠিক জায়গাতেই আছে। ঠিক কাজ করলেই সবই ঠিক হয়।
তা হলে আমরা ভুলে যাই কেন? হ্যাঁ, এ একটা প্রশ্ন বটে। প্রশ্নটা তাহলে করতেও পারি।
একটু আগেই এনেভারের নাম উল্লেখ করেছি। তিনিই আমাদের দিয়েছেন। তিনি এটাকেই তাঁর গবেষণার বিশেষ বিষয় করেছিলেন …
কি করে মনে রাখা যায় না জানার চেয়ে, বরং কিভাবে কেন আমরা ভুলে যাই সেটাই তিনি আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গোলমালটা আমরা নিজেরাই কিন্তু করি।
আমরা আমাদের স্মৃতিশক্তিকে দূরে সরিয়ে দিই। ব্যাপারটা সেই রকমই আমরা প্রায়ই বলি : ‘এটা ঠিক ভুলে যাব’, ‘আমার মন অনেকটা চালুনির মতই মনে হয়। আমার স্মৃতি শক্তিকে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না, ইত্যাদি।
যে মুহূর্তে আপনি কথাটা বললেন তখনই আপনি সম্পূর্ণভাবেই আপনার স্মৃতিশক্তিকে নষ্ট করে ফেলছেন।
পরীদের সম্বন্ধে সেই প্রবাদের কথাটা ভাবুন। সেটা জানেন তো?
যতবারই আপনি বলেন পাখীর কথা আপনার বিশ্বাস হয় না, ততবারই পরীদের মৃত্যু হয়। স্মৃতিশক্তির ব্যাপারও ঠিক এই রকম। যতবারই আপনি এটায় অবিশ্বাস করবেন, সেটা ততবারই ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়বে।
অতএব, আপনার নিজের জন্য আর নিরাপত্তার কারণেও আপনার স্মৃতির উপর বিশ্বাস রাখুন। কোন বিষয় ভালো করে জানলে কিছুতেই কখনও আপনি ভুলে যাবেন না। গোলমালটা এখানেই বলেছেন এনেভার। আমরা ভাবি আমরা জানি। কিন্তু আসলে আমরা জানি না। প্রমাণ? প্রমাণ হলো আমরা ভুলে যাই।
তাহলে জানার কৌশলটা কি? সঠিক আর সেরা কৌশল?
মনকে উন্মুক্ত করে দিন। মনের সব দরজা, জানালা একদম খুলে দিন। আপনার মনকে জানার আর মনে রাখার জন্য তৈরি করুন। জানতে চেষ্টা করুন। জানার কাজে আগ্রহ দেখান।
পরের ব্যাপারটা অনায়াশে হয়ে যায়।
আপনি প্রায় উদগ্রীব হয়ে আছেন জানার জন্য, আপনার মন চনমন করছে, কান দুটো সব শোনার জন্য তৈরি। একটা দৃঢ় ইচ্ছার সঙ্গে সব ব্যাপারে মন দেবেন আপনি। আপনি আপনার ইচ্ছা দিয়ে মনে রাখার চেষ্টা চালাবেন। এরকম করলেই দেখতে পাবেন মনে না রেখে কিছুতেই পারবেন না।
অর্থাৎ আপনি যদি সব সময় মনে রাখতে ইচ্ছুক হন–তবে মনে রাখবেন সেটা কোন স্কুলের ছাত্রের মত হয়। সে তো মনে রাখতে চায় তার পরীক্ষার জন্য, আর তারপর, ভগবানের দোহাই, সে সব ভুলে খুশিতে মত্ত হতে পারে।
দ্রুত মনে করতে গেলে–বিশেষ করে যখন সেটা একান্ত দরকার সমস্ত ঘটনা পরম্পরা একত্রিত করার চেষ্টা করুন।
যত বেশি হবে, ততই দেখবেন বন্ধনটাও দৃঢ় হবে, আর তাতেই দেখবেন বিশেষ কোন ব্যাপার লছেন না।
কোন ড্রামবাজিয়ে একবার তার ড্রামটাই হারিয়ে বসেছিল। মৃতি কখনও এমন ব্যাপার করে না।
মাঝে মাঝেই সব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করুন। যখন তখন চর্চা চালান। স্মৃতি ব্যবহার না করলে অলস হয়ে উঠতে পারে। অতএব আপনাকে বারবার চর্চা করতে হবে।
.
ছয়. স্মৃতিকক্ষ আর ঘটনা
আপনি কতবারই বলে থাকেন : ‘আমার স্মৃতিশক্তি খুব কম। দিনে দিনে আরও কমে যাচ্ছে। কোন কিছুই মনে রাখতে পারি না।’
কথাটা মোটেও ঠিক নয়।
ধরুন আপনি ব্রিজ খেলতে খুবই ভালোবাসেন, খেলতে কখনও ক্লান্তি আসেনা। আপনি খেলার নিয়মগুলোও ভোলেন না কখনও। বা ধরুন, আপনি ক্রিকেট, টেনিস ভালোবাসেন বা পি জি. উডহাউসের বই পড়তে ভালো লাগে আপনার। এসব ব্যাপারের খুঁটিনাটি আপনার নজর এড়ায় না।
তবে আপনি বোধ হয় বলবেন, এটা আলাদা কথা। এ ধরনের স্মৃতিশক্তি নিয়ে কি হবে? আমার যা মনে রাখা দরকার তা আমার মনে থাকে না। এমন কত ব্যাপার আছে যা আমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তা সত্ত্বেও সে সব আমার মন থেকে উবে যায়, একদম ঢিলে ঢালা।
ব্যাপারটি হলো এই রকম :
আপনি আসলে একজন ছাত্র, কঠিন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। আপনি সেটায় লেগে থাকুন, ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে যান। দুই কি তিন সপ্তাহ পরে আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন কিছুই মনে করতে পারছেন না। তাহলে ভাবুন কি ধরণের সময় এতে নষ্ট হয়, আর ঝামেলাই বা কতখানি!
‘সম্ভবতঃ আপনি কোন ব্যবসাদার, নানা ধরণের ফাঁইল পত্র, ঘটনা, সংখ্যা রিপোর্ট, সাক্ষাৎকার, ছ মাসের পুরানো বিষয়-এতসব নিয়ে আপনি ব্যতিব্যস্ত। আপনি হয়তো বলতে চাইবেন : অবশ্যই সব কিছু মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এইরকম ভাবে সব ভুলে যাওয়াও চলবে না। আমি আমার কাজ শেষ করতে পারি না। কাজ করার সময় কি চেষ্টাই না করতে হয়–আর তাতেও কাজটা ভালো মত শেষ হয় না এই মনে রাখার ব্যাপারটা নিয়ে কিছু একটা করতেই হবে।
না ব্যাপারটা নিয়ে ভাববেন না। এটাই হলো এক নম্বর পরামর্শ। মনে রাখবেন আপনার স্মৃতি মোটেই নষ্ট হয়নি। তা কখনও হয় না, স্মৃতিশক্তি যথারীতি ঠিক জায়গাতেই আছে। তবে ব্যাপারটা হলো আপনার সব কাজ কর্ম এলোমেলো। ঠিক কায়দাটাই আপনার জানা নেই। আপনি কোন সুযোগ নিজেকে দিচ্ছেন না।
তাকে ঠিক মত কাজে লাগাচ্ছেন না। ব্যাপারটা বিশ্বাস করছেন না। তাহলে দেখুন।
আপনার স্মৃতিশক্তি যদি সত্যিই নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকতো তাহলে আপনি সহজ কাজও করতে পারতেন না।
এটাই সত্যিকার ঘটনা। যেমন ধরুন আপনার স্মৃতিশক্তি সত্যিই শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকলে আপনি কথাবার্তা বলতে, হাঁটতে চলতে, পোশাক পরতে বা খেলতেও পারতেন না কিছুতেই। আপনার স্মৃতি অতএব ঠিকই রয়েছে।
আসলে মিস্ত্রী হিসাবেই আপনি দোষী। মিছিমিছি আপনি যন্ত্রের দোষ ধরছেন। ছেলেমানুষী কথা ভাবছেন?
নিশ্চয়ই, আপনি প্রচুর কথা মনে রাখেন ভেবে দেখুন। এমন বহু বিষয় আছে যা আপনি কখনও ভুলতে পারেন না। যেমন সেবার চমৎকার ছুটির দিনগুলো কোথায় কাটিয়েছিলেন। যে চমৎকার বইটাতে ডুবে গিয়েছিলেন। যার ব্যবহার দারুণ ভাল লেগেছিলো।
এসব কথা আপনার মনে গেঁথে থাকে কেন? তাই নিজেকে এই প্রশ্নগুলো একবার করুন তো : ‘আমি ভুলে যাই কেন? না, বরং করুন, আমি কি ভুলে যাই?’
আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন যেগুলো আপনার মনে দাগ কাটে সেগুলো ঠিকই মনে থাকে। এগুলো ভুলতে পারা যায় না। তারা কখনও মিলিয়ে যায় না। এরকম কেন হয় জানেন?
এটা হয় এই জন্য :
এগুলো হলো গভীর ছাপ রাখবার বিষয়। এগুলো আপনাকে জাগ্রত করে দেয়। এগুলো সবসময়েই আপনার সত্তা, মন, শরীর, চোখ, কান, অনুভূতি আবেগ, বোধশক্তি, সবকিছুই জাগ্রত রাখে।
আপনি তাই পুরোপুরি জাগ্রত অবস্থায় মনোযোগী থাকেন। এটাই হলো কৌশল।
আপনাকে একটা ব্যাপারের কথা মনে রাখতে হবে, তা হলো, আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে আপনি কোন কিছু শুনবেন, আপনি পুরোপুরি জাগ্রত।
আপনি বলবেন, ‘অবশ্যই আমি জাগ্রত দেখতে পাচ্ছেন দৈনন্দিন কাজকর্ম, পড়াশুনা, সবই ঠিক ঠিক করে যাচ্ছি। আমার মনে হয় ব্যাপারটা এখানেই ইতি হওয়া উচিত।’
ঝামেলাটা হলো এখানেই।
আপনার মনের অর্ধেকটা ব্যস্ত আর বাকি অর্ধেকটা ক্লান্ত, বিষণ্ণ।
আপনি যখন সানন্দে কোন কিছু করেন ব্যাপারটা অন্যরকম হয়। সময় নিয়ে আপনি মাথা ঘামাতে চান না। আপনি আপনার খেলা বা বেড়ানো যায় ভালো লাগে তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আপনি যখন পুরোপুরি নিমগ্ন তখন আপনি পূর্ণ মনোযোগ দিতে চান। এটাই হলো আর একটা কৌশল।
যা করতে চলেছেন তাতে পুরোপুরি আগ্রহ আনুন। কাজটির আনন্দময় অংশটা লক্ষ্য করুন। অনুভব করে নিন এর ভালো দিকটা। অনুভব করুন আপনি উপভোগ করছেন। আপনার মত ওতে নিয়োজিত করুন। আপনার তাৎক্ষণিক চিন্তা ওতে লাগান।
এসবের মানে তাহলে কি? যখন আপনি কাজ করেন তখনকার কথাটা ভাবুন। আমি ঘুমিয়ে নেই। আমার মন সারাক্ষণই ব্যস্ত।
আসল কথাই হলো তাই। চিন্তা করা মানেই জেগে থাকার চেয়েও বেশি।
নানা ঘটনা আর বিষয় আমাদের কাছে অনবরত আসতে থাকে। এসব নিয়ে আপনি কি করবেন? পড়ে থাকতে দেবেন শুধু? তাহলে দরকারের সময় আর খুঁজে পাবেন না।
এগুলোকে মনের স্মৃতি কক্ষে ঢুকিয়ে রাখুন। তাদের গুছিয়ে রাখুন, ভাগে ভাগে সাজান। পরপর রেখে দিন। এমন ভাবে গুছিয়ে রাখুন যা আপনার চোখ দেখে বা কান শুনে নেয়। চোখে দেখলে যদি মনে আনা সহজ হয় তাহলে এটা আপনার চোখের স্মৃতি ভাণ্ডারে জমা রাখুন। ভেবে দেখুন। আপনার কি ধরণের স্মৃতি রয়েছে, এটা কি চোখের স্মৃতি? না কি শ্রবণের স্মৃতি? এর উপর বিশ্বাস রাখুন। একেই ঘটনার উদাহরণ হিসেবে রাখুন।
এটা সত্যি যে স্মৃতির সঙ্গে সময়ের একটা কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে।
আপনি আজ যা শিখলেন একপক্ষ পরে সেটা তত পরিষ্কার থাকে না। প্রতিবিম্বটা হালকা হয়ে আসে। এটায় আমাদের করার কিছুই নেই। স্মৃতির ব্যাপার কিছুটা স্নায়ুর সঙ্গে জড়িত। এটা মস্তিষ্কের ধূসর কোষে ছাপ রেখে চলে। এগুলো মিলিয়ে যায় আর অন্য ছাপ পড়ে তারই জায়গায়।
সব চেয়ে যা ভালো, তাই সদা সজীব, সুস্পষ্ট রাখারই চেষ্টা করুন।
সব সময় ঘটনার কথা ভাবতে চেষ্টা করুন। এই ভাবেই স্মৃতির কক্ষ চট করে চোখে দেখতে পারেন আর কোন কষ্ট ছাড়াই মনের মধ্যে যা চান সে কথার প্রতিফলন দেখতে পাবেন।
.
সাত. আবেগের চালনা শক্তি
সময়ের সঙ্গে আমরা যখন থেকে একাত্ম হয়ে জড়িয়ে পড়েছি, বলতে গেলে তখন থেকেই আমাদের যাত্রা আরম্ভ হয়েছে।
চরৈবেতি! চরৈবেতি! এটাই হলো আসল জীবন। আমাদের এই গতি কে কেন দেয়? বেশ ভালো প্রশ্ন।
একটা টেবিল ঘড়ি খুলে দেখি আসুন, দেখা যাক এটা কিভাবে কাজ করে। চেষ্টা করে দেখি আসুন (যদি পারি) ঘড়িটা কিভাবে কেন চলে।
এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষই বলতে চাইবে ইচ্ছাশক্তি মানুষকে গতিময় করে বা গতিহীনও করে তোলে।
কিন্তু এমন কোনদিন যখন আসবে, যখন আমরা দেখতে পাবো এই ইচ্ছাশক্তির আমাদের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ আর নেই?
তা যাই হোক, তাদের কথা হলো ইচ্ছাশক্তি না হলে মনই এটা করায়। আবার তাদের ভুল হলো।
প্রত্যেকেই জানে তাদের কাজ করে যেতে হবে। কিন্তু তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, যা করণীয় নয় তাই করতে হয় আর এগিয়েও চলতে হয়। কারণ, এ ছাড়া তার পথ থাকে না।
কথাটা ঠিকই।
এ থেকেই প্রমাণ হয় এমন কিছু আছে যা আমাদের ইচ্ছা বা মন থেকে আরও জোরালো ভাবে আমাদের আকর্ষণ করে।
মনুষ্য চরিত্র সম্পর্কে যদি সামান্য কিছুও জানেন, তাহলে বুঝবেন আমরা যদি এগুতে দিই তাহলে ভালোবাসা, ঘৃণা, ঈর্ষা, উচ্চাকাঙ্খা, ভয় ইত্যাদি আমাদের কাছে নিদারুণ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে। এগুলো আমাদের দিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে–এই সমস্ত অনুভূতি বা আবেগ। অবশ্য তাদের হাতে যদি শাসনের কর্তৃত্বটা তুলে দেয়া হয়।
এরা চিন্তার জন্ম দেয়। তারা কাজ করায়। আসলে আমরা যা কিছু করি তার পিছনেই এরা থাকে।
এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এটাই দেখা যে এগুলো আমাদের দিয়ে কোন বাড়াবাড়ি না করাতে পারে।
সঠিকভাবে বলতে গেলে আমরা এদের মানুষকে যেভাবে কাজে লাগাই সেইভাবেই কাজে লাগাতে পারি … আর সেটা আমাদের সাহায্য করে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে।
তবে তার আগে প্রথমেই ঠিক করতে হবে নিজেদের জীবনে আমরা কি কি করতে চাই। তাই আসুন, কোন নিশ্চিত উদ্দেশ্য নিয়ে জীবনের পরিকল্পনাকে ছকে নিই–এলোমেলো উদ্দেশ্যবিহীন হলে চলবে না। আমাদের একটা উদ্দেশ্য থাকতেই হবে–থাকা চাই এক উচ্চাঙক্ষা আর নিশানা। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা ধারণা আছে। সেটাই আবিষ্কার করতে হবে। পরের কাজ হবে স্বাভাবিক দক্ষতা আছে তাকে যথাসম্ভব কাজে লাগানো। এটাই হবে প্রাথমিক কাজ বাকি সব পরে।
প্রচেষ্টা চালানোর এই প্রকৃষ্ট সময়-পরিকল্পিত, সঠিক প্রচেষ্টা।
আর এটা আসে, কিছুক্ষণ আগে যা বলছিলাম সেই ইচ্ছা বা মন থেকে নয়, বরং আবেগের আর অনুভূতির খেলা থেকেই।
অতএব দেখতে পাচ্ছেন আপনি যা করতে যাচ্ছেন বা করছেন তার জন্য দরকার সঠিক অনুভূতির স্পর্শ।
কল্পনা আমাদের ইচ্ছেমত চালনা করতে পারে দেখা গেছে। অন্যভাবেও কথাটা বলা যায় : কল্পনাই আবেগকে বাঁচিয়ে রাখে। কোন কিছু ঘটতে গেলে বা কোন কিছু ব্যবহারের ফলে বা কাজের ফলে যে ছবি আমাদের মনের পরদায় ফুটে ওঠে সেটা আমাদের মধ্যে অনুভূতির জন্ম দেয়। আর তাই আমাদের কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
অতএব ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, অবশ্য যতোটা সম্ভব, আমাদের সাহায্য মিলতে পারে। আমরা ভবিষ্যতে কি হতে পারি সে স্বপ্ন সফল হলেই এ বক্তব্য বোঝা যাবে।
এটাই আমাদের মধ্যে জীবনের স্পন্দন জাগিয়ে রাখে। আমাদের আগ্রহী করে তুলে সময় নষ্ট না করে কাজে প্রেরণা দেয়। এটা আমাদের আশা, সাহস আর শক্তি দিতে পারে। দুর্বল চিত্ত না হয়ে এ আমাদের এগিয়ে চলতে সাহায্য করতে পারে। আমরা কিছুটা জীবন্ত তারের মত–কারণ আমরা আবেগের মত বিদ্যুতাড়িত হয়ে উত্তেজিত হতে পারি।
মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদের ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে আর অসম্ভব হতে চায় সবচেয়ে বেশি চাপে কাজ করে চলতে।
আমাদের মনের মধ্যে কিছু থাকে। ধরুন, আমরা বলি আমাদের যা করা উচিত সেইভাবে পরিশ্রম করে কাজ করতে পারি না। আমরা বড় তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমাদের মন অস্থির হয়। বেশিক্ষণ কোন বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারি না। ভিতরে যে কোন গলদ আছে সেটা পরিষ্কার হতে চায়। এর কারণ হলো দুটো বিপরীতমুখী প্রবাহ, দুটো পরস্পরবিরোধী সংঘাত কাজ করে চলে। এ আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার ফসল। দুটো অন্তর্নিহিত আবেগের ধারা পরস্পরের বিরুদ্ধে কাজ করে যায়। আমরা নিজেদের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়ি।
আর ঠিক এই কারণেই যত গণ্ডগোল।
মনস্তত্ববিদরা কি পরামর্শ দিয়ে থাকেন দেখুন। সব সময় আগের ব্যাপার চিন্তা করুন। যতক্ষণ না গোলমালের কারণ জানতে পারছেন চিন্তা করতে থাকুন। কখনই বলতে চাইবেন না : ভুলে যাওয়া যাক। বরং তার বদলে এটা কারও মনে গেঁথে গিয়ে সারা জীবন ধরেই জ্বালাতন করে যাবে। প্রয়োজন হলো সরাসরি এর মুখোমুখি হওয়া। এটা করতে ভয় পাবেন না।
আগাগোড়া দেখে নিন।
দেখে নিন যতোটা খারাপ মনে হয় ততটাই খারাপ কিনা। মনস্তত্ববিদরা বলেন, তাহলে এ আপনাকে আর জ্বালাতন করবে না।
নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সঠিকভাবে এটা করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
সাফল্যের এটাই হলো অন্যতম গোপন কথা।
.
আট. চাহিদা ও ইচ্ছা
সব কাজ ভালোভাবে শেষ করা উচিত। সাফল্যের অর্থই তাই। মানুষ তাই কাজের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেয়। কোন মানুষই অর্ধেক কাজ করে না। সম্পূর্ণ মানুষটিই নিজেকে অনুভব করায়।
আর এরকম করলেই সে একটা শক্তি হয়ে উঠতে পারে, যে জিনিসটি কিছু করিয়ে নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছতে সাহায্য করে।
সাফল্য হলো কাজ।
এটা চিন্তার অতিরিক্ত কিছু। দুশ্চিন্তা ব্যাপারটাই ঠিক লাভবিহীন কাজ। যে সব মানুষ কোন কাজ না করে শুধু চিন্তা করেছে তারা কোনকালেই এ দুনিয়াতে কিছু করতে পারে নি। চিন্তা করা এক জিনিস আর কাজ করা অন্য জিনিস।
মনই সাফল্যের সব কথা নয়।
বিশেষ একটা জিনিসই আমাদের কাজ করায়, আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা এক মুহূর্তও থেমে থাকতে পারি না। আমরা সব সময় কিছু না কিছু চাই।
আমরা যা চাই তাই যদি পেতাম তাহলে হাত গুটিয়ে কোন কিছু চিন্তা করারই দরকার হতো না। কিন্তু মজা হলো আমরা যা চাই তার সব পাই না।
এটা হলো সত্য।
আমাদের সারা জীবন ধরে আমরা খালি খাদ্য, পোশাক, আশ্রয়, ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা, নিরাপত্তা, পদ, আরাম, নিরবচ্ছিন্ন সুখ, আদর, সম্মান, বন্ধুত্ব, সহানুভূতি, ন্যায়বিচার আর সহ্যশক্তি চাই।
আমরা আমাদের জীবনে পরিপূর্ণতা, সৌন্দর্য আর সত্য যথেষ্ট পরিমাণে কখনই পাই না। যে কোন মানুষের জীবনেই এর চাহিদা প্রবল। এগুলি ছাড়া কোন কাজ বা জীবনই থাকে না। তাই এটা ভেবে দেখুন। আমরা বেঁচে থাকি এই কারণেই যে–আমরা বাঁচতে চাই।
সম্ভবতঃ আপনি বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মেনে নিয়েছেন। আপনি পৃথিবীতে এসেছেন। আপনার জন্মে আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। এ পৃথিবীতে আসার সময় কেউই আপনার মতামত চায়নি। আবার ইচ্ছে হলেই নিজেকে আপনি আড়াল করতেও পারেন না।
আসল কথাটা হলো : হা আপনি পারেন।
মনে করুন আচমকা কোন দুঃখ আপনাকে গ্রাস করেছে! আপনি অন্তরে শোকার্ত। জীবনের প্রতি আপনার আর কোন মোহ নেই। এ জীবন ত্যাগ করতে পারলেই বোধ হয় আপনার পক্ষে ভালো হতো।
এ ধরণের মনোবৃত্তির ফল কি হয় জানেন, আপনি যা ভাবছেন তার ঢের আগেই আপনি তলিয়ে যাবেন।
বেঁচে থেকে সঠিক জীবন কাটানোর ইচ্ছাই জীবনের মূল লক্ষ্য। এই চাহিদা আমাদের এগিয়ে নিয়ে চলে।
এই চাহিদা আমাদের দিয়ে যা করায় তা নির্ভর করে আমরা আসলে কি তারই উপর, আমাদের শরীর কি রকম আমাদের বাবা, মা, ঠাকুরদা কি রকম। সক্রেটিস আর পি. স্মিথ, দুজন মানুষ আলাদা আচরণ করেন। অথচ তাদের মধ্যে একই রকম তাড়না কাজ করে চলেছে।
আমাদের কাঠামোয় চাহিদাই বেশির ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে। এটাই বলটি গড়িয়ে দেয়।
মাঝে মাঝেই আমরা অসোয়াস্তি বোধ করি। আমাদের মনের মধ্যে কিছু রয়েছে। যতক্ষণ না কিছু করছি ততক্ষণ শান্তি নেই আমাদের।
(চাহিদাই আমাদের দিয়ে এটা করাতে চায়)।
আমরা প্রায়ই বলি, যে কোন মূল্যে শান্তি চাই। এটাই করে দেখা যাক।এতে কোনই কাজ হয়। তখন আবার আমরা অন্য কিছু করি। এই ভাবেই চলে। এরপর কখন যেন আমরা একফালি আলো দেখি, তখন মনে হয় এটাই আমরা চাই।
(অবশ্য ঠিক তা নয়। যদি তাই হতো তাহলে চাহিদা কবে মরে শুকিয়ে যেত। অবশ্য কখনই তা হয় না।)।
কামনাই যে কোন কাজের গোড়াপত্তন।
বাজি ধরে বলতে পারা যায় আপনারা সকলেই হয়তো ভাবছেন কাজ হলো এমন একটা বস্তু যা আপনি বা অন্য যে কেউ চোখ দেখতে পায়।
কথাটা খানিকটা সত্যি। শুরুটা কেউই অবশ্য দেখতে পায়নি। এটা এমনই কিছু যা অন্তরের মধ্যে আলোড়িত হতে থাকে। মনস্তত্ববিদদের কাছ থেকে আমরা অনেক কথাই জানতে পারি।
আমাদের দেখতে হবে যে এই চাহিদা যেন একসঙ্গে আকর্ষণ করতে থাকে। মাঝে মাঝে এর মধ্যে সংঘর্ষও লাগে। এর ফলে এরা আমাদের দিয়ে এমন কিছু অদ্ভুত ইচ্ছা করায় যা সত্যিই বিপরীতমুখী।
তাই আপনার কেকটি আপনি খেয়ে ফেলতে পারবেন না। একে সযতে রক্ষ করুন। কথাটা অনেক দিন আগেই আমরা জেনেছি।
কিন্তু আমরা শুধু বুঝতে পারি না অন্যেরা যে ধারণা পছন্দ করে সেটাই আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে কেন। এটা যখন হয় আমরা সত্যিই অসহায় হয়ে পড়ি।
আমাদের চাহিদার মধ্যে যখন সংঘাত বেধে যায় আমরা কাজ করতে পারি না। আমাদের সবকিছুকে সন্তুষ্ট করতে হয় আর সানন্দে একসঙ্গে কাজ করতে দিতেও হয়। ঠিক তাহলেই আমাদের কাজ আমাদের জন্য ভালো কিছু করে কোথাও পৌঁছে দিতে পারে।
.
নয়. অভ্যাস : গড়ে তোলা ও নষ্ট করা
আপনি আপনার নিজেকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে চলেছেন। সম্ভবতঃ আপনি কিছু কিছু কাজও সুরু করেছেন। কোন কাজকেই কখনও বেশি তাড়াতাড়ি বলে কিছু করতে নেই।
তা সত্ত্বেও আপনি হয়তো বলবেন : ওহ্ হ্যাঁ! ঝামেলা কাকে বলে আমার জানা আছে, আমি নিজেও কম ভুগছি না! কিন্তু কেউ পুরনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না। আমি একটা খানায় পড়ে আছি–উঠে আসার ক্ষমতা নেই। চেষ্টা করেও লাভ নেই। ঠিক এই হলো অবস্থা।
কিন্তু মা ভাবছেন ততোটা কিন্তু নয়–অর্থাৎ পুরনো অভ্যাস বদলে নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা।
শুধু আপনাকে কাজটা সুরু করতে হবে। কাজকে আপনার কাছে আনতে হবে।
আপনার নিজের সম্বন্ধে আপনাকে আরও জানতে হবে–যে কাজ আপনি করেন সেটা কেন করেন, খেলনাটা কিভাবে কাজ করে। কিভাবে সেটা চলে।
আপনি হয়তো বলবেন আপনার ইচ্ছা নষ্ট হয়ে গেছে। সে ইচ্ছা যেন নড়বড়ে পায়ে ভর রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু আমরা আজ জেনেছি শুধু ইচ্ছাতেই কাজটা সম্পন্ন হয় না।
একটা উদাহরণ রাখছি :
একখণ্ড তক্তা যদি মাটির উপর ফেলে রাখা হয় কে না তার উপর দিয়ে হাঁটতে পারে? একটা শিশুও পারবে। কিন্তু ওই তক্তাকেই যদি বিরাট একটা আকাশচুম্বী বাড়ি চল্লিশতলা উঁচুতে রাস্তার উপর শূন্যে ঝুলিয়ে হাঁটতে বলা হয়? একবার হাঁটুন তো! দেখি কি রকম সাহস আপনার! আপনার ইচ্ছাকে জাগ্রত করুন, যেমন খুশি বাজি রাখুন। কিন্তু আপনি একটা পাও রাখতে পারবেন না। আপনি দেখবেন আপনার পা নড়তেই চাইছে না।
আসল ব্যাপার হলো (ডা. কু যা বলেছেন) সে কল্পনাই হলো আসল মালিক।
আপনি কল্পনা করুন যে আপনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না, দেখতে পাবেন আপনার হাঁটু ভেঙে আসছে। ব্যাস! চল্লিশ তলা থেকে প্রপাত ধরণীতলে!
অভ্যাসের বেলাতেও সেই একই কথা।
কোন সময়ে হয়তো আপনি দেখছেন বিভিন্নভাবে নানা কাজ আপনি করতে পারছেন না। আপনি ভাবছেন না কাজটা করতে পারেন।
কিন্তু ভুলে যাবেন না কল্পনাই আসল মালিক–একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন নিজেই।
পরের পৃষ্ঠাগুলোয় অনেক ছোট ছোট পরামর্শ পাবেন যেগুলো নিশ্চয়ই আপনার কাজের বলে মনে হবে।
আর এটাও ঠিক যেসব লোক বারবার ব্যর্থ (যেমন আপনি আমি বা এরকম আরও অনেকেই) তারা দেখবেন আপনাদের কানে বাজতে চাইবে : এখনই সব বদলে ফেলুন! ভাবুন কাণ্ডটি! আকাশটাই যেন ভেঙে পড়তে চলেছে। আপনি এবার বাঁধা পড়েছেন! গ্যালিভারের করার কিছুই নেই–সে হাত পা বন্ধ হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে আর পিগমীদের মত অভ্যাসগুলো তার উপর কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।
ডঃ কু’র পরামর্শটা একবার দেখুন। যেসব অভ্যাস আপনার একেবারেই পছন্দ নয় সেই সব নোঙরা বাজে অভ্যাস জোর করে হেঁটে ফেলুন।
এরপর আপনার মনে নতুন পথের ছবিটা এঁকে নিয়ে আপনার কাছে যা গ্রহণীয় তাকে চিরকালের জন্য বরণ করে নিন।
এই কষ্টটুকু আপনাকে স্বীকার করতেই হবে।
যে ছবি এঁকেছেন সেটা সারা দিনরাত চোখের সামনে রাখুন, যতদিন না তার প্রতিটি অংশ আপনার একদম মুখস্থ হয়ে যায়।
এই ছবি আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠবে। যে কোন সময়ে যে কোন কাজই আপনি করুন সে ছবি আপনার মনে জ্বল জ্বল করতে থাকবে। আপনি দেখতে পাবেন সব সময় এই নতুন পথ আর আপনার নতুন সত্তা ছাড়া অন্য কিছুই আপনি ভাবতেই পারছেন না। দেখতে পাবেন আপনি যে কাজই করতে যাবেন তাতে আপনার ইচ্ছা কেমন ক্ষুরের মত ধারালো হয়ে উঠেছে। একবার তাই চেষ্টা করুন।
এরপর দেখুন আগের সেই বাজে অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠার আগে আপনার অবস্থা কেমন ছিলো। আপনি ছিলেন সুন্দর, নির্মল। আপনার কোন গ্লানি ছিল না। ছিলো না কোন কাঁটাও। হা, তখন আপনি এই রকমই ছিলেন। আর আবার আজও সেই রকমই হতে পারেন আপনি, এবং সেটা চিরকালের জন্য। সব ব্যাপারটা তাই আপনার একান্ত নিজস্ব। এ বিষয়ে কণামাত্র সন্দেহের কোন রকম জায়গা নেই।
পুরনো সেই বাজে অভ্যাসগুলো! এগুলো তো আপনি চেয়েছিলেন। তাই সেগুলো আপনার সব কিছু নষ্ট করতে চাইছিলো। অতি জঘন্য সব জিনিস! উঃ! এ সব ছুঁড়ে ফেলে দিন এবার, ধ্বংস করে দিন। এই সব নোংরা জিনিসকে চিরকালের মত বিসর্জন দিতে পিছ পা হবেন না। যেখানকার জিনিস সেখানেই সেগুলো ফেরত পাঠান।
ব্যাস, আপনি মুক্ত! মনে হচ্ছে যেন হাজার বছর কেটে গেছে।
আপনি যেন রাজা সলোমনের আটকে রাখা একটা দৈত্যকে মুক্তি দিয়েছেন! হ্যাঁ আপনার অসামান্য ক্ষমতা আছে, আপনি পারেন অসাধ্য সাধন করতে।
আপনি আবার মুক্তি পেতে পারেন।
এতক্ষণে আপনার চোখের সামনে একটা ছবি রূপ গ্রহণ করেছে। আপনি চাইছেন সে ছবি বাস্তব হয়ে উঠুক।
এবার চুয়ের কথাই ধরুন। তিনি বলেছেন সব বাতিল করে ভাবুন এই নতুন পথ নতুন সত্তা আপনার পক্ষে ভালো কেন।
এর জীবনীশক্তি কতখানি সেটা অবশ্য নির্ভরশীল আসলে আপনি কি ধরণের মানুষ তারই উপর।
আসল উদ্দেশ্য হলো এই : নিজেকে বিশ্বাস করান যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন সেটা আপনার পক্ষে সন্দেহাতীত ভাবেই সবচেয়ে ভালো।
আর সেই কদর্য অভ্যাস যা ত্যাগ করেছেন তারা যেন আর কোন ভাবেই ফিরে আসার সুযোগ না পায়।
হ্যাঁ, একাজ আপনি পারবেন। চু’ তাই বলেছেন, আপনার চেয়ে নিকৃষ্ট মানের মানুষ ও যখন পেরেছে আপনি পারবেন না কেন?
আপনার মধ্যে শক্তি রয়েছে। তার উপর বিশ্বাস রাখুন।