৩. ছোট ফুপু

০৩.

টুকুনদের বাসায় ছোট ফুপু এসেছেন।

ছোট ফুপু পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কদিন পরেই তাঁর M.Sc পরীক্ষা। তাঁর দম ফেলার সময় নেই। তিনি বাসায় ঢুকেই বললেন, ও টুকুন, তোদের বাড়িতে দম ফেলতে এসেছি।

টুকুনের এত ভাল লাগল। ছোট ফুপুকে তার খুব ভাল লাগে। তার কাছে মনে হয় এরকম মেয়ে অন্য কোন গ্রহে হয়ত আছে। কিন্তু পৃথিবীতে আর নেই। আর দেখতেও কি সুন্দর। শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়।

ছোট ফুপু যখন বড়দের সঙ্গে কথা বলেন তখন তাঁকে বড়দের মত লাগে, যখন ছোটদের সঙ্গে কথা বলেন তখন ছোটদের মত লাগে। তিনি বাসায় এলে কিছুক্ষণ টুকুন এবং মৃদুলার সঙ্গে খেলবেন। মৃদুলাকে বলবেন, কই রে মৃদু, তোর বারবি নিয়ে আয়, এখন কিছুক্ষণ পুতুল খেলব। আয়, আমরা বারবিকে বিয়ে দিয়ে দি। মৃদুলা বারবি আনবে না কাগজ নিয়ে আসবে। ছোটফুপু কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কাগজ ছিঁড়বেন। মৃদুলা খিলখিল করে হাসবে, তিনিও হাসবেন। মৃদুলার সঙ্গে খেলা শেষ হলে টুকুনকে বলবেন, আয় টুকুন, এবার তোর সঙ্গে খেলি। কি খেলবি? টুকুন যদি বলে, চোর-পুলিশ খেলবে তাহলে ফুপু মুখ বাঁকিয়ে বললেন, দূর গাধা! চোর পুলিশ পুরনো খেলা, আয় নতুন কিছু খেলি। চোর-পুলিশের চেয়েও মারাত্মক– ডাকাত-পুলিশ। তুই হবি ডাকাত, আমি মহিলা পুলিশ।

এমন একজন মানুষ বাসায় এলে আনন্দে লাফাতে ইচ্ছা করে। টুকুন মনের আনন্দ চেপে রেখে বলল, কতক্ষণ থাকবে ছোট ফুপু?

দম ফেলতে যতক্ষণ লাগে ততক্ষণ থাকব। তারপর চলে যাব। এখনো কিছু পড়া হয়নি, পঁচিশ তারিখ থেকে পরীক্ষা।

দম কোথায় ফেলবে?

কোন একটা ভাল জায়গা দেখে ফেলতে হবে।

আমার ঘরে ফেলবে?

ফেলা যায়।

টুকুন এবং মৃদুলা ছোট ফুপুকে তাদের ঘরে নিয়ে এল। ছোট ফুপু ঘর দেখে আঁৎকে উঠে বললেন, ঘরটাকে তো আস্তাবল বানিয়ে রেখেছিস।

টুকুন বলল, আস্তাবল কি ছোটফুপু?

আস্তাবল হচ্ছে যেখানে ঘোড় থাকে। তোদের এই নোংরা ঘরে দম ফেলতে পারব না। দমটা বরং আটকে রাখি।

টুকুন বলল, তাই ভাল, আটকে রাখ ফুপু।

 দেয়ালে এটা কিসের ছবি রে টুকুন?

কাকের ছবি। ভাল হয়েছে না?

 মোটামুটি হয়েছে। দেয়ালে ছবি আঁকার জন্যে বকা খাসনি?

না।

ছবির নিচে এটা কি কবিতা নাকি?

হু।

কবিতাটাও তো অসাধারণ হয়েছে রে– অসাধারণ। তোর লেখা না রবীন্দ্রনাথের লেখা?

আমরা দুজনে মিলে লিখেছি।

ভাল হয়েছে অসাধারণ। এখন আমার কথা শোন –ঘর পরিষ্কার কর যাতে আরাম করে দমটা ফেলতে পারি। অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। এই ফাঁকে তোর মার সঙ্গে কথা বলে আসি।

মার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলবে না কিন্তু।

 পাগল হয়েছিস? বড়দের সঙ্গে কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।

অপলা মুনার সন্ধানে গেল। মুনা চা বানাচ্ছিলেন, অপলাকে দেখে বললেন, তুই নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিস পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবি না? আজ চলে এলি যে!

অপলা হাসিমুখে বলল, তোমার ছানাদের দেখতে এসেছি। কিছুদিন পর পর ওদের না দেখলে ভাল লাগে না।

অনেকদিন পর পর দেখিস বলে ভাল লাগে। আমার মত সারাক্ষণ দেখতে হলে মাথা খারাপ হয়ে যেত। ছশ টাকা খরচ করে দেয়াল ডিসটেম্পার করিয়েছি। কাকের ছবি এঁকে রেখেছে।

এত পাখি থাকতে কাক কেন?

সে তো আজকাল কাকের সঙ্গে কথা বলে! শুনিসনি কিছু?

না তো।

একটা কাক নাকি তার জানালার পাশে বসে গল্প-গুজব করে।

 বাহ, কি মজা!

মুনা বিরক্ত গলায় বললেন, মজার তুই কি দেখলি? এই বয়সে মিথ্যা কথা বলা শিখছে।

কল্পনা করতে শিখছে। মিথ্যা এক জিনিস, কম্পনা ভিন্ন জিনিস। তোমরা ওকে কিছু বলো না।

মুনা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, কল্পনা ভাল। খাপছাড়া কল্পনা ভাল না। দিনরাত কাক, কাক। বাড়িঘর ভরাচ্ছে ছবি এঁকে। তোর কথা মন দিয়ে। শুনে, তুই যাবার আগে টুকুনকে বুঝিয়ে যাবি।

আচ্ছা দেখি।

দেখাদেখি নয়, ভাল করে বুঝবি। দেয়ালে যেন ছবি আঁকা না হয় সেটাও বলবি।

এক্ষুণি বলছি।

অপলা চায়ের কাপ হাতে উঠে গেল।

টুকুন ঘর পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। অবশ্যি মৃদুলা এখনো কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। লেখা কাগজ তার ছিঁড়তে ভাল লাগে না। ধবধবে সাদা কাগজগুলি ছিঁড়তে ইচ্ছা করে। টুকুনের ধারণা, মৃদুলা বড় হয়ে বিরাট একটা কাগজের দোকান দেবে। সুন্দর কাগজে ঘর থাকবে ভর্তি। সে মনের আনন্দে ছিঁড়বে।

.

অপলা চায়ের কাপ হাতে খাটে বসতে বসতে বলল, ও টুকুন, তুই না কি কাকের সঙ্গে কথা বলিস?

বলি তো।

 তা কি নিয়ে তোদের কথাবার্তা হয়?

কোন ঠিক নেই। একেক দিন একেকটা। ঐ দিন বললেন, টুকুন, একটা গান গেয়ে শুনাও তো।

তোকে তুমি করে বলেন?

তা তো বলবেনই। বয়সে বড় না? উনার ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেছে।

তাহলে তো খুবই সিনিয়ার লোক! তুই তাঁকে কি ডাকিস –চাচা?

না, আমি ডাকি কাকা। চাচা ডাকতে চাচ্ছিলাম, উনি বললেন, চাচা ডাকবে না বরং কাকা ডাক। কাকা ডাকলে কাকের সঙ্গে মিল হয়, শুনতে ভাল লাগে।

অপলা গম্ভীর হয়ে বলল, উনাকে খুবই চিন্তাশীল মনে হচ্ছে।

ঠিক বলেছ, ফুপু। খুবই চিন্তশীল। প্রায়ই বলেন, দেশটার হচ্ছে কি? দেশটা তো রসাতলে যাচ্ছে।

অপলা চাপা হাসি হেসে বলল, এই কথা তো তোর বাবা সবসময় বলে। তোর বাবার কাছে শুনে শুনে শিখেনি তো?

শিখতেও পারেন। উনার স্মৃতিশক্তি ভাল। যখন যা শুনেন উনার মনে থাকে। অনেকদিন আগে একবার বলেছিলাম, ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ আমার জন্মদিন। উনার দেখি মনে আছে। আমাকে বললেন, কি খোকা, জন্মদিন হচ্ছে?

আমি বললাম, হচ্ছে।

উনি বললেন, প্রবলেম হয়ে গেল। ঐদিন রোববার পড়ে গেছে। ছুটির দিন। রোববার আমি আবার ঘুরে ফিরে বেড়াতে পছন্দ করি। আসতে পারি কি না বুঝতে পারছি না।

অপলা বলল, আসুক না আসুক, তুই দাওয়াত দিয়ে রাখ।

 দাওয়াত দিয়েছি ছোট ফুপু।

ভাল করেছিস। খালি হাতে নিশ্চয়ই আসবে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই আনবে।

টুকুন আগ্রহের সঙ্গে বলল, ছোট ফুপু, কি আনবে বলে তোমার মনে হয়?

অপলা গম্ভীর গলায় বলল, আমার ধারণা, মরা ইঁদুর-টুিদুর নিয়ে আসবে। মরা ইঁদুর ওরা খুব আনন্দ করে খায়। ওদের কাছে খুবই দামী জিনিস।

টুকুন বিস্মিত হয়ে বলল, মরা ইঁদুর দিয়ে আমি কি করব?

অপলা বলল, কি আর করবি, খাবি। তোর পেয়ারের একজন এত আগ্রহ করে একটা জিনিস দেবে, আর তুই ফেলে দিবি; তা তো হয় না।

টুকুন ছোট ফুপুর দিকে তাকিয়ে আছে। অপলা খুব চেষ্টা করছে হাসি চেপে রাখার। এক সময় আর পারল না। হো হো করে হেসে ফেলল। মৃদুলাও হাসতে শুরু করল। দুজনই হাসছে। ওদের দিকে দুঃখিত চোখে তাকিয়ে আছে টুকুন। আর তখন এক কাণ্ড হল –একটা দাঁড়কাক এসে ঝপ করে বসল জানালার শিকে। অপালার দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে থেকে ডাকল –কা কা।

হাসি থামিয়ে অপলা বলল, এই টুকুন, তোর আংকেল এসে গেছে মনে হয়। আমাকে কিছু বলছে নাকি?

টুকুন কিছু বলল না। কাকটা আবার ডাকল –কা কা কা।

অপলা বলল, চুপ করে আছিস কেন? ও বলছে কি?

তুমি কেন হাসছ তাই জানতে চাচ্ছে।

বলে দে আমি কেন হাসছি।

আমি কিছু বলব না।

বেশ, আমিই বলে দিচ্ছি। কি বলে উনাকে ডাকব তাই ভাবছি। তোর যখন কাকা হয়, তখন আমার হবে বড় ভাই। ভাইয়া ডাকব?

তোমার যা ইচ্ছা ডাক।

অপলা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যালো ভাইজান, আমি কোন কারণ ছাড়াই হাসছি। আপনার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগছে। আপনি মনে হয় টুকুনের জন্মদিনে আসবেন। খালি হাতে আসবেন না। উপহার নিয়ে আসবেন।

কাকটা বলল, কা কা কা।

অপলা বলল, আপনি আবার দলবল নিয়ে আসবেন না। একা আসবেন। এখন বরং বাড়ি চলে যান।

কাক সঙ্গে সঙ্গে উড়ে চলে গেল। অপলা দেখল টুকুন গম্ভীর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রাগ করেছে। তার বড় বড় চোখ ভিজে আছে। কেঁদে ফেলার আগে আগে টুকুনের চোখ এরকম হয়ে যায়। অপলা বলল, কি রে টুকুন, এরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার উপর রাগ করেছিস?

হু।

কেন! আমি কি করলাম?

তুমি আমার কথা বিশ্বাস করনি। এই জন্যে আমি রাগ করেছি। তুমি যা বল আমি তা বিশ্বাস করি। তুমি কেন আমার কথা বিশ্বাস কর না?

তুই চাস আমি তোর কথা বিশ্বাস করি?

হ্যাঁ।

শোন টুকুন, আমি অন্য বড়দের মত না। আমি ছোটদের কথা মন দিয়ে শুনি এবং বিশ্বাস করার চেষ্টা করি। কিন্তু তোর কথা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না?

কেন যাচ্ছে না?

বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, কারণ মানুষের পক্ষে কথা বলা সম্ভব, পাখির পক্ষে সম্ভব না। মানুষের মাথায় অনেকখানি মগজ। পাখির মগজ আর কতটুকু! এই একটুখানি। লবণের চামচে একচামচ। এত অল্প মগজ নিয়ে পাখির পক্ষে কথা বলা সম্ভব না।

ময়নাও তো কথা বলে। ময়নার মগজও তো একটুখানি।

ময়না বলে শেখানো কথা। তাও একট-দুটা বাক্য –কুটুম এসেছে পিড়ি দাও –এই রকম। এর বেশি না। তাছাড়া ময়না যখন কথা বলে আমরা সবাই তা শুনতে পাই এবং বুঝতে পারি। এখানে কাক কথা বলছে আর তুই একা শুধু বুঝতে পারছিস তা তো হয় না। তুই তো আলাদা কিছু না। তুই আমাদের মতই একজন। তোর দুটা হাত, দুটা পা, দুটা চোখ …. আমাদেরও তাই। বুঝতে পারছিস?

পারছি।

বুঝতে পেরে থাকলে আমার দিকে তাকিয়ে বিরাট একটা হাসি দে। দাঁত বের করে হাস।

টুকুন হাসল না, গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা ছোট ফু, কাকটা যদি আমার জন্মদিনে আমার জন্যে কোন উপহার নিয়ে আসে তাহলে কি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?

অপলা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি সত্যি সত্যি তোর জন্যে সে উপহার নিয়ে উপস্থিত হয় তাহলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আবার ভাবতে হবে। কোন কিছুই চট করে বিশ্বাস করতে নেই। বিশ্বাস করলে খুব সমস্যা। বিরাট সমস্যা। ভয়ংকর সমস্যা।

কি সমস্যা?

ধর, একজন লোক এসে বলল, ঢাকার নিউ এলিফেন্ট রোডে বাটার জুতার দোকানের সামনে এক ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েছে। একটা বাঘ বের হয়েছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই কামড়ে খেয়ে ফেলছে। এখন যদি লোকটার কথায় বিশ্বাস করে সবাই ঢাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে? এট কি ঠিক হবে টুকুন?

না, ঠিক হবে না।

তাহলে তুই এখন বুঝতে পারছিস যে আমাদের চট করে কিছু বিশ্বাস করতে নেই?

পারছি।

এই কারণেই আমি তোর কথা বিশ্বাস করছি না। তবে তোর জন্মদিন আসুক, দেখা যাক তোর কাক কি উপহার নিয়ে উপস্থিত হয়। তারপর আমরা না হয় আবার চিন্তা-ভাবনা করব। এখন একটু হাস তো লক্ষ্মী সোনা।

টুকুনের রাগ লাগছে। হাসতে ইচ্ছা করছে না। তবু ছোট ফুপুকে খুশি করার জন্যে সে হাসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *