চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল এতোয়ারি। রাস্তাটি কিছুটা দূরে। কাউকে সেখানে যেতে আসতে দেখলে সে একটু নিচু হয়ে গেলেই হল। কারও নজরে পড়বে না। হঠাৎ বেশ উত্তেজিত হল সে। কাজটা করতে বেশ রোমাঞ্চ বোধ করছে। যদিও দূরের গাড়ি যাওয়ার রাস্তায় এখন কেউ নেই, তবু সে কোনও ঝুঁকি নিচ্ছিল না। গাড়ি না-আসুক সাইকেল চালিয়ে কেউ না-কেউ তো যেতেই পারে। হঠাৎ থমকে গেল এতোয়ারি।
সামনের শেড ট্রি-তে একটা বড় সাপ দোল খাচ্ছে। ওটা যেমন লম্বা তেমনই মোটা। নিচু হয়ে বসে পড়ল এতোয়ারি। দোল খেতে খেতে সাপটা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল চা-গাছের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে একটা শেয়াল ছটফটিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে। সাপটা ধীরে ধীরে চা-বাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। সতর্ক পায়ে জায়গাটা পেরিয়ে এল এতোয়ারি।
হাসপাতালে ফিরে এসে মাকে দেখতে পেয়ে স্বস্তি হল। সে জিজ্ঞাসা করার আগে মা-ই জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গিয়েছিলি?”
“ডাক্তারবাবুর বাড়িতে,” মুখ ফসকে বেরিয়ে এল শব্দ দুটো।
“ওর ঘরে তো বউ আছে, নেই?”
“আছে। না থাকলেই-বা কী হত?”
“কিছু হলে তুই তো জানতেই পারতিস,” মা আবার হাসল।
এই হাসিটা একটুও ভাল লাগল না এতোয়ারির। মা যেন এখন অন্যরকম হয়ে আছে।
বড় নার্সকে প্যাকেট ফেরত দিতেই প্রশ্ন হল, “কে রে?”
সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হল এতোয়ারি, “মানে?”
“কার জন্যে ওগুলো নিয়ে গেলি?”
“জানি না তো। ডাক্তারবাবুর বউ নিয়েছিল।”
“ডাক্তারবাবুর বউ?” খুব অবাক হলেন বড় নার্স। তারপর কিছু ভেবে আর প্রশ্ন করলেন না।
বিকেলে পেশেন্টদের দেখতে এলেন ডাক্তারবাবু, রোজ যেমন আসেন। সঙ্গে দুই নার্স। এতোয়ারি লক্ষ করল তার দিকে ডাক্তারবাবু একবারও তাকালেন না। ডাক্তারবাবু যখন একজন পেশেন্টকে বুকে স্টেথো চেপে পরীক্ষা করছেন, তখন দু’-দুটো গাড়ি এসে হাসপাতালের সামনে দাঁড়াল। গাড়ি দুটো থেকে নেমে এলেন এই চা-বাগানের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এবং পুলিশের পোশাক পরা ভারতীয় অফিসার। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, “হোয়ার ইজ ডক্টর? ডক্টর কিধার?”
ছোট নার্স দৌড়ে বাইরের দরজায় গিয়ে উঁকি মেরে ফিরে এসে উত্তেজিত হয়ে বলল, “সেকেন্ড ম্যানেজার পুলিশকে নিয়ে এসে আপনাকে ডাকছেন।”
ডাক্তারবাবু বড় নার্সকে রোগীর দায়িত্ব দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ওঁদের দেখতে পেয়ে বললেন, “গুড আফটারনুন স্যার। আসুন, ভেতরে আসুন।”
চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, “এঁকে নিশ্চয়ই আপনি চিনবেন না। আমিও আজ প্রথম দেখলাম। উনি বাজারহাট পুলিশ স্টেশনের চার্জ নিয়েছেন।”
ডাক্তার বললেন, “গ্ল্যাড টু মিট ইউ।”
তাঁর বাড়ানো হাত আলতো স্পর্শ করে অফিসার বললেন, “আমাদের কাছে খবর আছে একজন ভয়ংকর ক্রিমিনাল এদিকের চা-বাগানগুলোতে শেল্টার নিয়েছে। গত রাতে একটা এনকাউন্টারে ওর শরীরে গুলি লেগেছে বলে আমি রিপোর্ট পেয়েছি। আপনাদের এই হাসপাতালে কোনও অজানা লোক উন্ডেড হয়ে ভরতি হয়েছে?”
মাথা নাড়লেন ডাক্তার, “না, আমার জানা নেই।”
পেছনে দাঁড়ানো ছোট নার্স বলল, “না স্যার। এরকম কেউ আসেনি।”
অফিসার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে বললেন, “আমি একবার হাসপাতালটা ঘুরে দেখতে চাই। আপনাদের সঙ্গে আসতে হবে না।”
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, “আপনার গাইড হিসেবে এই নার্স গেলে সুবিধেই হবে।”
অফিসার ছোট নার্সকে ইশারা করে সামনে যেতে বলে তাকে অনুসরণ করলেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, “গুলিতে উন্ডেড হয়ে কেউ হাসপাতালে ভরতি হলে আপনি নিশ্চয়ই জানতে পারতেন!”
“নিশ্চয়ই।”
“আমাদের এদিককার চা-বাগানগুলোতে সো কলড বিপ্লবীদের আসা-যাওয়ার কথা আগে কখনও শুনিনি। আশ্চর্য! এরা আমাদের এদেশ থেকে তাড়াতে চাইছে। আরে, আমরা চলে গেলে দেশটাকে চালাতে পারবে? এই চা-বাগানের কথাই ধরুন, আমরা ম্যানেজাররা যেভাবে বাগানের প্রোডাকশন, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করি, আমরা চলে গেলে ইন্ডিয়ানরা তা পারবে? ডাক্তার, আমাদের পরে ইন্ডিয়াতে টি ইন্ডাস্ট্রি থাকবে না।”
ডাক্তার কথা বলছিলেন না। সেটা লক্ষ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার এই কথাগুলো কি ভাল লাগছে না?”
ডাক্তারবাবুকে উত্তর দিতে হল না। তার আগেই থানার দারোগা ফিরে এলেন, পেছনে ছোট নার্স। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন, “দেখলেন?”
“নাঃ। পেশেন্টরা বলছে তেমন কাউকে আসতে দেখেনি। আপনাদের এই বাগান না-হোক অন্য বাগানের হাসপাতালে গিয়ে থাকতে পারে।”
মাথা নেড়ে দারোগা বললেন, “ওয়েল, আপনাদের সবাইকে বলছি, অজ্ঞাতপরিচয় কোনও লোক যদি আহত অবস্থায় আসে তা হলে তার চিকিৎসা করা, আশ্রয় দেওয়া মারাত্মক অপরাধ হবে। তেমন কেউ এলে তাকে আটকে রেখে সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দেবেন।”
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, “অনেক ধন্যবাদ অফিসার। আপনারা আছেন বলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এদেশে সুরক্ষিত।”
অফিসার মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস স্যার,” দু’পা এগিয়ে ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন, “খুব সাবধানে সবাই থাকবেন স্যার। যে-লোকটিকে আমরা খুঁজছি, সে খুব বিপজ্জনক বিপ্লবী। বাঙালি হলে বুঝতাম। কিন্তু লোকটা মদেশিয়া। সন্দেহ করা হচ্ছে ওকে চা-বাগানের শ্রমিকরা শেল্টার দিতে পারে। যদি ধরা পড়ার পরে লোকটা পালাতে চায়, তা হলে ওকে আটকাতে না-পারলে খুন করলেও সরকার আপনাদের পুরস্কৃত করবে। আচ্ছা…” অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দারোগাবাবু গাড়িতে উঠলেন।
অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বললেন, “ডক্টর, খুব সাবধানে থেকো। আমরা বাগানের লেবারদের খুশি করার জন্যে একটা কাজ করার কথা ভাবছি। সেটা করতে পারলে এই বাগানের কুলিলাইন শান্ত থাকবে।”
ডাক্তারবাবু যখন একা তাঁর চেয়ারে বসে ভাবছেন তখন বড় নার্স কাছে এসে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “ও কি চলে যেতে পেরেছে?”
ডাক্তারবাবু বললেন, “জানি না।”
“আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম স্যার।”
“এসব কথা থাক।”
“আপনি যদি সাহায্য না-করতেন তা হলে ও মরে যেত।”
“ঠিক আছে। এসব কথা থাক,” ডাক্তারবাবু নিচু স্বরে বললেন, “ওর কথা তুমি হাসপাতালের কাউকে বলোনি তো?”
“না। শুধু এতোয়ারি জানে। মনে হয় ও কাউকে বলবে না। একটু পরে ওকে নিয়ে যেতে লোক আসবে। অন্ধকারে বেরিয়ে যেতে পারবে।”
“তুমি বলেছিলে ও তোমার ভাই হয়…”
“হ্যাঁ। আমার মামার ছেলে। ওর নাম নোয়াম, তাই বলেছে তো?”
মাথা নাড়লেন ডাক্তারবাবু।
কিন্তু তাঁর খুব স্বস্তি হচ্ছিল না। সাধারণত কেউ খুন না-হলে চা-বাগানে পুলিশ আসে না। শ্রমিকদের মধ্যে মারামারি হয়েছে, রক্ত ঝরেছে তবু পুলিশ আসেনি, ক্ষুব্ধ শ্রমিকরাই থানায় গিয়েছে। আজ থানার বড়বাবু সটান চলে এলেন চা-বাগানে, হাসপাতালে ঢুকে আহত লোকটির খোঁজ নিলেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই ওপর মহলের চাপ আছে। দশটা খুনিকে ধরলে হয়তো একটু বেতনবৃদ্ধি হয়, কিন্তু একজন বিপ্লবীকে ধরলে চাকরিতে প্রোমোশনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়। বিশেষ করে সেই বিপ্লবী যদি যদি কোনও ইংরেজকে আহত বা খুন করে থাকে, তা হলে কথাই নেই। ডাক্তারবাবু চিন্তিত হলেন।
এই তল্লাটে হাতে গোনা কয়েকজন ডাক্তার আছেন। তাঁদের অধিকাংশই বিভিন্ন চা-বাগানের কর্মী। একশো মাইলের মধ্যে গুনলে তিনজনের বেশি হবে না। চা-বাগানের বাইরে গঞ্জের মানুষদের চিকিৎসার জন্যে দু’জন আধা ডাক্তার আছেন। এঁদের সবাই এখন নিশ্চয়ই পুলিশের নজরে পড়েছেন। ডাক্তারবাবুর মনে হল, তাঁর কোয়ার্টার্সের ওপর পুলিশের লোক নজর দিচ্ছে না তো!
এতোয়ারি দরজায় এসে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার জানাল। প্রতিদিন ছুটির পরে ঘরে ফেরার আগে সে এটা করে। ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, মুখে কিছু বললেন না। তারপরই তাঁর খেয়াল হল। বললেন, “তুমি একবার আমার কোয়ার্টার্সে যেতে পারবে?”
“কিছু আনতে হবে?” এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল।
“না, আনতে হবে না, তুমি তো এখন লাইনে ফিরে যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। মাকে নিয়ে ফিরে যাব।”
“ও। তা হলে থাক,” ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন।
“বলুন না। আমার কোনও অসুবিধে হবে না,” এতোয়ারি বলল।
একটু ভাবলেন ডাক্তারবাবু। মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে। নোয়ামের পা থেকে গুলি বের করতে দেখেও যে হাসপাতালে ফিরে এসে কাউকে সেকথা বলেনি। কিন্তু এখন অন্য কোনও পথ তাঁর সামনে নেই। ভেবেছিলেন পুলিশ এই বাগানে নজর দেবে না। বাগান পত্তন হওয়ার পর থেকে কখনও কোনও ব্যাপারে পুলিশকে এখানে নাক গলাতে হয়নি। সাধারণ অপরাধগুলোর ব্যাপারে বড় ম্যানেজার যা সিদ্ধান্ত নিতেন, তাই সবাই মেনেছে এতকাল। এখন দিন বদলাচ্ছে। দশ বছর আগে কেউ কি ভেবেছে সাদা চামড়ার মানুষগুলোকে এই দেশ থেকে তাড়ানোর জন্য কালো চামড়ার ভারতীয়রা মরিয়া হয়ে উঠবে? এই ব্যাপারে বাঙালি, বিহারি, মদেশিয়া, ওঁরাও এক হয়ে যাবে!
ডাক্তারবাবু বললেন, “তুমি তোমার মাকে নিয়ে আমার কোয়ার্টার্সে যাও। আমার স্ত্রীকে বলবে আমি তোমাদের পাঠিয়েছি। আমি না-ফেরা পর্যন্ত তোমরা অপেক্ষা করবে।”
মাথা নেড়ে চলে গেল এতোয়ারি।
রাতের বেলায় হাসপাতালের সব ঠিকঠাক থাকবে কি না নজর বুলিয়ে যখন কোয়ার্টার্সে ফেরার জন্যে ডাক্তারবাবু পা বাড়িয়েছেন, তখন বড়সাহেবের গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল।
হুডখোলা গাড়ির জানলা থেকে মুখ বের করে বড়সাহেব বললেন, “গুড ইভনিং, ডক্টর। হসপিটালে কোনও প্রবলেম নেই তো?”
“গুড ইভনিং স্যার। সব ঠিক আছে,” হাসলেন ডাক্তারবাবু।
“উঠে এসো। তোমাকে আজ হাঁটতে হবে না। আমি নামিয়ে দিচ্ছি।”
গাড়িতে উঠে বসলেন ডাক্তারবাবু। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে বড়সাহেব বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ আমাদের এই দেশ থেকে তাড়াতে যে-আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার ছোঁয়া ডুয়ার্সের চা-বাগানগুলোতে লেগেছে। অথচ দ্যাখো, ব্রিটিশরা যদি এই অঞ্চলে চা-বাগান তৈরি না-করত, তা হলে জায়গাটা জন্তু জানোয়ারদের রাজত্ব হয়ে থাকত। স্বাধীনতা আন্দোলন, সাহেব খুন করে দেশ স্বাধীন করবে। নিজের দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই অথচ দৌড়োবার স্বপ্ন দেখছে। তুমি কি শুনেছ একজন ম্যানেজারকে গুলি করে মারতে গিয়ে তার ড্রাইভারকে ওরা মেরে ফেলেছে? যে-লোকটা মারা গেল সে কী দোষ করেছিল? বলো!”
ডাক্তারবাবু মাথা নাড়লেন, কথা বললেন না।
“অথচ দ্যাখো ডক্টর, চা-বাগানে কাজ পেয়ে যারা দু’বেলা খেতে পাচ্ছে, আরামে থাকছে তাদের পূর্বপুরুষরা বিহারে কীভাবে বেঁচে ছিল, তা নিশ্চয়ই ওরা জানে না,” অন্ধকার চা-বাগানের মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বড়সাহেব কথা বলছিলেন। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় কিছু চোখে পড়ায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, “দেখতে পাচ্ছ?”
ডাক্তারবাবু দেখতে পেলেন। একটা চিতাবাঘ ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ির হেডলাইট পছন্দ না-হওয়ায় চিতাবাঘ পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল।
বড়সাহেব বললেন, “আমি যখন প্রথম এই চা-বাগানে চাকরি করতে এসেছিলাম, তখন বাঘের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সেটা তিরিশ বছর আগের কথা। যাকগে, আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, আমাদের কুলিলাইনের কিছু মানুষকে ওদের পূর্বপুরুষের দেশে পাঠাই। গিয়ে দেখে আসুক, সেখানে ওদের আত্মীয়রা কেমনভাবে বেঁচে আছে,” হাসলেন ম্যানেজার, “অবশ্য তারা যদি এখনও বেঁচে থাকে তবেই জানা যাবে।”
ডাক্তারবাবু হেসে ফেললেন। বড়সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি হাসছেন?”
“হাসছি কারণ, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, সবকিছু আবার গোড়ায় ফিরে যায়। আপনি যা ভেবেছেন তা সত্যি অভিনব। যারা যাবে, তারা ফিরে এসে পূর্বপুরুষের দেশের গল্প শোনাতে পারবে।”
“ঠিক তাই। তখন এরা কমপেয়ার করতে পারবে ওখানে থাকলে সুখে থাকত না, এখানে সুখে আছে। বড়সাহেব বললেন, “এটা দেখলে স্বাধীনতার ভূত আর মাথায় উঠবে না।”
ক্রমশ গাড়ি চা-বাগান ঘেঁষা কোয়ার্টার্সগুলোর সামনে পৌঁছে গেল। ডাক্তারবাবু বড়সাহেবকে ধন্যবাদ জানালে তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন। এখনও অন্ধকার হালকা, খানিকটা দূরের গাছপালা ভাল দেখা যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবুকে দেখে একটা লোক এগিয়ে এল, কপালে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, “সেলাম ডকদর সাব। আপনি এসে গিয়েছেন এবার আমি যেতে পারি।”
“তুমি কী করছিলে এখানে?”
“অর্ডার ছিল, বাইরের লোক এখানে লুকিয়ে আছে কি না তা দেখা। রাত্রে বাঘের ভয়ে কেউ আসবে না। দিনের বেলাতেও কেউ আসেনি,” কপালে আঙুল ছুঁইয়ে লোকটা বড়রাস্তা ধরে চলে গেল।
বাইরের দরজায় শব্দ করতেই ডাক্তারবাবুর স্ত্রী দরজা খুলে বললেন, “এসো। চা হয়ে গিয়েছে।”
ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ডাক্তারবাবু নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “যে-মেয়েটি দুপুরে এসেছিল, সে কি ওর মাকে নিয়ে এসেছে?”
“এসেছিল। আবার চলেও গিয়েছে।”
“সে কী! ওকে যে আমি থাকতে বলেছিলাম।”
“শুনেছি। কিন্তু আমি ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। অযথা ওদের বিপদে ফেলে কী হবে। মেয়েটা কিন্তু খুব সিরিয়াস ধরনের!”
“কীরকম?”
“বলে গেছে ও পেছনের নদীর ধারে রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি দরকার হয়ে ওকে…”
“বাঃ,” ডাক্তারবাবু ভেতরের ঘরে ঢুকে দেখলেন হারিকেন জ্বলছে। তাঁদের বসার এবং শোওয়ার ঘরগুলোতে হ্যাজাক জ্বলে। নদীর স্রোত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শুধু ফ্যাক্টরির ইঞ্জিন চালানো হয়। শোনা যাচ্ছে, খুব শিগগির শক্তিশালী ডায়নামো এনে ম্যানেজারদের বাংলো, বাবুদের কোয়ার্টার্সে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ডাক্তারবাবু লোকটাকে দেখলেন। খাটের পাশে টুলের ওপর বসে আছে।
ডাক্তারবাবুকে দেখেই নোয়াম কপালে আঙুল ছুঁইয়ে নমস্কার জানাল।
“কেমন আছ এখন?”
“খুব ব্যথা, তবে আগের চেয়ে ভাল। আমাকে যে পৌঁছে দিয়েছিল, সে কি এসেছে? আমি একা হেঁটে যেতে বোধহয় পারব না,” নোয়াম বলল।
“না। এলেও আমার সঙ্গে দেখা করেনি,” ডাক্তারবাবু বললেন।
“ওঃ,” নোয়ামের মুখে হতাশা ছড়িয়ে গেল।
“চিন্তা কোরো না। নিশ্চয়ই আসবে। কিছু খেয়েছ?”
“হ্যাঁ, মা চা দিয়েছেন। চা আর মুড়ি।”
পকেট থেকে কতগুলো ট্যাবলেট বের করে নোয়ামকে দিলেন ডাক্তারবাবু, “এখন একটা ট্যাবলেট খেয়ে নাও। আর-একটা রাতের খাবার খেয়ে খাবে। মনে হয়, দু’দিনেই তুমি অনেকটা ঠিক হয়ে যাবে।”
শুনে নোয়াম হাসল। ডাক্তারবাবু সেটা লক্ষ করেও কিছু বললেন না।
নোয়াম বলল, “আমার পক্ষে তো বেশি দূরে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হবে না, কেউ যদি না-নিতে আসে, তা হলে আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না!”
“তুমি যে আমার এখানে আছ, তা তোমার দলের লোকেরা নিশ্চয়ই জানে। তারা নিশ্চয়ই তোমাকে নিরাপদে নিয়ে যাবে। তবে তোমার খোঁজে এই বাগানেও পুলিশের চর ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারো তত ভাল।”
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই একটা হুইসলের আওয়াজ ভেসে এল। পর পর দু’বার।
সঙ্গে সঙ্গে নোয়াম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, “আমি এবার যেতে পারি।”
“ওই শব্দ কি তোমার দলের লোক করল?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু তুমি তো হেঁটে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অপেক্ষা করো, ওরা নিশ্চয়ই এখানে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে,” কথাগুলো বলে ডাক্তারবাবু ভেতরে চলে গেলেন।
কিন্তু মিনিট দশেকের মধ্যেও কারও সাড়া পাওয়া গেল না। আধঘণ্টা পরে ডাক্তারবাবু যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তখন উঠোনের পেছনের দরজায় শব্দ হল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ভেতরের বারান্দায় গিয়ে চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কে?”
“আমি!” কাঁপা স্বর বেরিয়ে এল মহিলাকণ্ঠ থেকে। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী টর্চ জ্বাললেন, “এ কী! তুমি?”
পায়ে পায়ে এতোয়ারি সামনে এসে দাঁড়াল, “আমি।”
“ওহ! কী ব্যাপার? এত রাতে কেন ফিরে এলে?”
“ডক্টরসাব এসেছেন?”
উত্তর দিতে হল না। তার আগেই ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন, “কী হয়েছে?”
“ওকে নদীর ধারে নিয়ে যেতে বলল,” এতোয়ারি বলল।
“কে বলল?”
“ওর বন্ধু। এদিকে আসতে ভয় পাচ্ছে। বলল, ওকে শাড়ি পরিয়ে নিয়ে গেলে বিপদ হবে না। বলল, তাড়াতাড়ি করতে।”
“তোমাকে কি লোকটা চেনে?”
“না। বড় নার্স ওকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। বললেন, লোকটা এখানে এলে বিপদ হতে পারে। আমি যদি নদীর ধারে পৌঁছে দিই, ও লাইনের পাশ দিয়ে নিয়ে যেতে পারবে,” এতোয়ারি বলল।
ডাক্তারবাবুর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি যে-কাজটা করতে এসেছ, তার জন্যে পুলিশ তোমাকে ধরে জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারে, তা কি জানো?”
একটু চুপ করে থেকে এতোয়ারি বলল, “কাজটা নিশ্চয়ই ভাল কাজ, না-হলে ডক্টরসাব বলতেন না।”
এতোয়ারিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ওঁরা ভেতরে চলে গেলেন। এতোয়ারি আকাশের দিকে তাকাল। আজ আকাশে আলো নেই। মেঘের পরে মেঘ জড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে। ঘরে ফিরে ওরা বাবাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছিল। এতোয়ারিকে অবাক করে ওর মা জিজ্ঞাসা করেছিল বাবার সামনে দাঁড়িয়ে, “খিদে পেয়েছে?” বাবা যতটা অবাক হয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছিল এতোয়ারি। মা এতোয়ারির দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল, “আজ আমি ভাত চাপাই।”
শাড়ি পালটে মা যখন হাতমুখ ধুতে গেল, তখন এতোয়ারির মনে হচ্ছিল আজ মা যেন অন্যরকম, একটু খুশি খুশি ভাবভঙ্গি! শেষ কবে মাকে এইরকম সে দেখেছে মনে পড়ল না।
ডাক্তারবাবুর গলা কানে এল, “এই মেয়েটির সঙ্গে যাও।”
এতোয়ারি দেখল একটা সাধারণ শাড়ি পরা ঘোমটা মাথায় দেওয়া মহিলাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু বললেন, “ওর নাম এতোয়ারি। ওকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার পা থেকে যখন গুলি বের করছিলাম, তখন ওর সাহায্য দরকার হয়েছিল। এতোয়ারি, ওকে সাবধানে নিয়ে যাও।”
ঘোমটার আড়াল থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন করল, “যে পাঠিয়েছে তার নাম কী? তোমাদের বড় নার্সের সঙ্গে কে ছিল?”
“একজন ছিল। নাম বলেনি আমাকে।”
একটু যেন দ্বিধায় পড়ল শাড়ির আড়ালে থাকা লোকটা। তারপর পা বাড়াল। বোঝা যাচ্ছিল পা ফেলতে কষ্ট হলেও সেটা সহ্য করছে সে।
খুঁড়িয়ে হাঁটলেও নদীর ধারে পৌঁছাতে ছ’মিনিটের বেশি লাগল না। এতোয়ারির মনে হচ্ছিল লোকটাকে বলে, সুবিধে হলে তার কাঁধ ধরতে পারে। কিন্তু সংকোচে বলতে পারছিল না। নদীর ধারে পৌঁছনো মাত্র অন্ধকার ফুঁড়ে দুটো লোক বেরিয়ে এল। চাপা গলায় নোয়ামের সঙ্গে কথা বলে একজন এগিয়ে এল এতোয়ারির সামনে, “অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি এবার ঘরে ফিরে যাও।”
মাথা নেড়ে নদীর জলের দিকে পা বাড়াচ্ছিল এতোয়ারি, পেছন থেকে মাথার ঘোমটা সরিয়ে নোয়াম ডাকল, “তোমার কী নাম তা বলে যাও।”
একটু ইতস্তত করে নিজের নাম বলল এতোয়ারি। তারপর অন্ধকারে হাঁটুজলের নদী পার হয়ে ঘরের পথ ধরল।
ঘরে ঢুকে এতোয়ারি দেখল বাবা ডাল-ভাত-আলুসেদ্ধ খাচ্ছে। তাকে দেখে মা বলল, “তোর জন্যে বসে আছি, কোথায় গিয়েছিলি?”
“নদীর ধারে।”
“কেন? কে আছে ওখানে?” মায়ের ঠোঁটে হাসি ফুটল।
“আশ্চর্য! কে থাকবে ওখানে!”
“কী জানি বাবা! যাকগে, ভাত ডাল আলু আর ডিমসেদ্ধ রেঁধেছি। খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে।”
“ডিম কোথায় পেলে?”
“দুটো ডিম হাসপাতাল থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম।”
“ঠিক করোনি। হাসপাতালের জিনিস বাড়িতে আনা ঠিক নয়।”
কথাটা শুনে মা ঠোঁট মোচড়াল।
“আমাকে আস্ত ডিম দিয়েছ কেন? তুমি কি অর্ধেক নিয়েছ?”
“অর্ধেক কেন নেব! তুই আর আমি গোটা গোটা।”
“বাবাকে দাওনি?”
“নাঃ,” মা ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
শ্বাস ফেলল এতোয়ারি। সে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই বাবার সঙ্গে চোখাচোখি হল। অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে বাবা। সে নিজের থালা থেকে ডিমসেদ্ধটা তুলে উঠে গিয়ে বাবার পাতে দিয়ে এল। বাবা মাথা ঝাঁকাল, মুখে খুশি ফুটল। ডিম তুলে অতি ক্ষুদ্র একটা টুকরো কেটে চোখ বন্ধ করে চিবোতে লাগল। তার দাড়ি-গোঁফ ভরতি মুখে খুশি ফুটে উঠল।
মধ্যরাতে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। এতোয়ারির মা উঠে বসে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে? বাইরে গিয়ে দেখ তো!”
এতোয়ারি দরজা খুলতে লাইনের স্ত্রী-পুরুষদের ঘরের বাইরে এসে কান্নাকাটি করতে দেখল। তারপরই টর্চ হাতে পুলিশদের ওপর চোখ পড়ল তার। লোকগুলো এক হাতে টর্চ অন্যহাতে লাঠি উঁচিয়ে কুলি বস্তি তছনছ করতে করতে এগিয়ে আসছে। অন্ধকার এখন অনেক পাতলা হয়ে এসেছে। লোকগুলো পাশের ঘর ভাঙচুর করে এগিয়ে আসতেই এতোয়ারি গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করল, “অ্যাই! খবরদার!”
গোটা পাঁচেক লাঠিধারী পুলিশ যারা এতক্ষণ ঘরভাঙার উল্লাসে মেতে ছিল, তারা থমকে দাঁড়াল। এতোয়ারি চিৎকার করল, “সবাই ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকো। যা খুঁজছ, তা দেখতে শুধু একজন ঘরের ভেতরে আসতে পারো।”
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কথা বলল। একজন জিজ্ঞাসা করল, “এই, তুমি কে?”
“আমি হাসপাতালে কাজ করি। একজন আসতে পারো।”
নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করে একজন এগিয়ে এলে এতোয়ারি দেখল পুলিশটির বয়স হয়েছে। ঘরের ভেতর লোকটা ঢোকামাত্র মায়ের আর্তনাদ শোনা গেল। দরজার কাছে ছুটে গিয়ে এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে।”
যে ঢুকেছিল, সে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল, “কিছু করিনি, মাইরি বলছি বুড়ি কেন যে ভয় পেল জানি না।”
ততক্ষণে মা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। চিৎকার করে বলল, “অ্যাই! তুই কাকে বুড়ি বলছিস? তোর বউ বুড়ি, তোর মেয়ে বুড়ি! রাতদুপুরে শোওয়ার ঘরে ঢুকে হামলা করছিস, লজ্জা করে না?”
এতোয়ারি অবাক হয়ে দেখল লোকটা কথা না-বলে তার দলের কাছে চলে গেল। দলের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কোনও বাইরের লোককে আজ লাইনে ঢুকতে দেখেছ?”
কেউ জবাব দিল না। লোকটি বলল, “জবাব না-দিলে সবাইকে ধরে জেলে ঢোকাবার অর্ডার আছে।”
একজন মিনমিন করে বলল, “কোনও নতুন লোক লাইনে আসেনি।”
“বেশ। নতুন কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দেবে!”
পুলিশগুলো চলে যাওয়ার পর সবাই যে যার ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু ঘরে ঘরে তখন এতোয়ারিকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত কোন কুলির মেয়ে-বউ পুলিশকে ধমক দিয়ে কথা বলার সাহস করেনি। হাসপাতালে চাকরি পাওয়ার পর থেকে এতোয়ারির মধ্যে একটু একটু করে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা কেউ কেউ বলতে লাগল।
এতোয়ারি মায়ের দিকে তাকাতে মা হাসল, “চল, শুয়ে পড়ি। এখনও রাত শেষ হতে ঢের দেরি আছে,” মা ভেতরে ঢুকে গেলেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এতোয়ারি। মা যেন অনেক বদলে যাচ্ছে।
কয়েকদিন ধরে সমস্ত চা-বাগান থমথমে হয়ে রইল। কাজকর্ম মানুষ করে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো। পাতি তুলতে যারা ঝুড়ি পিঠে নিয়ে বাগানের বিভিন্ন অংশে রোজ সকালে ছড়িয়ে পড়ে, তারাও হাসিঠাট্টা করছে না নিজেদের মধ্যে। মাঝে-মাঝেই একটা পুলিশের জিপ টহল দিতে চা-বাগানের ভেতরের রাস্তায় ঢুকে পড়ছে। কাজে যাওয়ার পথে সেই জিপ দেখে এতোয়ারি বুঝতে পারে এখনও নোয়াম ধরা পড়েনি।
নোয়াম নিশ্চয়ই একা সাহেবদের সঙ্গে, পুলিশের সঙ্গে লড়াই করছে না। পুলিশ যে নোয়ামকে ধরতে কাল রাত থেকে এভাবে খোঁজাখুঁজি করছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে লোকটা সাধারণ মানুষ নয়।
হাসপাতালে এসে অবাক হল এতোয়ারি। আজ আউটডোরে ওষুধ নিতে খুব কম রোগী এসেছে। ডাক্তারবাবুর আসার সময় এখনও হয়নি। তাকে একলা পেয়ে বড় নার্স ডেকে বললেন, “তোর জন্যে কাল নোয়াম পালিয়ে যেতে পারল। তুই যে কাল কী উপকার করেছিস জানিস না।”
মনের মধ্যে যে-প্রশ্ন বুজকুড়ি কাটছিল, সেটা উগরে দিল এতোয়ারি, “ওকে পুলিশ খুঁজছে কেন?”
“পুলিশ হল ইংরেজদের চাকর। ইংরেজরা হল বিদেশি। জোর করে আমাদের দেশ দখল করে মালিক হয়ে আছে। ওদের তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করতে আন্দোলন শুরু করেছে নোয়ামরা। মুশিকল হল, আমাদের এই দেশের কিছু লোক ইংরেজদের পা-চাটা হয়ে আছে,” মাথা নাড়লেন বড় নার্স।
একটু একটু মাথায় ঢুকছিল। এতদিন সে ধনুবুড়োর মুখে শুনে এসেছে তাদের একটা দেশ আছে। সেটা অনেক দূরে। সেই দেশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের ট্রেনে চাপিয়ে এখানে আনা হয়েছিল। ধনুবুড়ো সেই দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত। বেচারার স্বপ্ন বাস্তব হয়নি। ধনুবুড়োর কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে এইসব চা-বাগানে যারা কাজ করে, তাদের নিজেদের দেশ অনেক দূরে ছিল। কথাটা যদি সত্যি হয়, তা হলে নোয়ামরা কেন এই দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে। উত্তরটা মাথায় ঢুকছিল না এতোয়ারির। বরং মনে প্রশ্ন জাগছিল, যে-দেশ ছেড়ে তাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে এসেছিল, সেই দেশটাকেও কি ইংরেজরা দখল করে আছে?
তিনদিন পরে বড় নার্স ফিসফিস করে খবরটা দিলেন, “নোয়ামকে পুলিশ ধরতে পারেনি। ও এখন আসামের চা-বাগানে চলে গিয়েছে।”
শোনামাত্র নোয়ামের পায়ের কথা মনে এল। এতোয়ারি জিজ্ঞাসা করল, “ওর পা ঠিক হয়ে গেছে?”
“নিশ্চয়ই কিছুটা ঠিক হয়েছে। না-হলে গেল কী করে!” বড় নার্স গলা আরও নামিয়ে বললেন, “এসব কথা কাউকে যেন বলে ফেলিস না।”
তিনদিন পরে পুলিশের গাড়ি চা-বাগানে ঢোকা বন্ধ হল। ফলে একটু স্বস্তি ফিরে এল মানুষের মনে। কিন্তু সমস্যায় পড়ল এতোয়ারি। খালিগায়ে ঘরের বাইরে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে বুকে সর্দি বসেছে বাবার, সেই সঙ্গে জ্বর। দুম করে জ্বর এত বেড়ে গেল যে, তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে হল।
মেয়েদের ঘরে বেড খালি থাকলেও ছেলেদের ঘরে বেড খালি না-থাকায় মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়াতে হয়েছে। বাবা সুস্থ না-হওয়া পর্যন্ত বড় নার্স এতোয়ারিকে হাসপাতালেই থেকে যেতে বললেন। মা এল না। সকালবেলায় পাতি তুলতে যাওয়ার সময় বলে গেল, “এত লোকের থাকার কোনও দরকার নেই, তুই তো আছিস!”
খুব অবাক হয়েছিল এতোয়ারি। বাবা যতই খারাপ কাজ করে থাকুক, এটা শোনার পর লোকটার জন্যে তার মায়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় রাতে দু’জন মহিলা আর চারজন লোক রিকশায় এক মহিলাকে নিয়ে হাসপাতালে এল। মহিলাটির প্রসববেদনা উঠেছে। লাইনের ঘরেই ধাই দিয়ে প্রসব করানোর চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা সফল হয়নি।
মহিলাকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। ঘিরে দেওয়া হল খাটটা সাদা পরদা দিয়ে। ছোট নার্স চেঁচিয়ে বলল, “সঙ্গে কে এসেছে? বাবা না স্বামী? যে-ই এসে থাকো অফিসে চলো, নাম ঠিকানা লেখাতে হবে।”
স্বামী লোকটি লম্বাচওড়া কিন্তু কণ্ঠস্বর মেয়েদের মতো। এক সঙ্গীকে নিয়ে সে অফিসে গেল। নাম-ঠিকানা লেখাল। তখন দুই মহিলা আর এক পুরুষ ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে গর্ভবতী মহিলাকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছিল। লোকটি বলছিল, “তোর আর কোনও ভয় নেই। হাসপাতালে এসে গিয়েছিস যখন—তখন ডাক্তারবাবু ঠিক বাচ্চা বের করে আনবে।”
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল গর্ভবতী। শ্বাস নিয়ে বলল, “চুপ করো। চুপ করো। তোমার জন্যে, তোমার জন্যেই এত কষ্ট আমার…”
“কী করব! তুমিই চেয়েছিলে!” লোকটি মিনমিন করল।
উলটোদিকে বসা মহিলাদের একজন ধমক দিল, “চুপ কর। কী কথা বলছিস? মেয়েটার কি মাথাখারাপ হয়ে গেল?”
গর্ভবতী চোখ খুলল, “কাকে বলছি?”
“শুকরাকে। তোর বরের বন্ধু,” অন্য মহিলা চাপা গলায় বলল।
“ও,” গর্ভবতী চোখ বন্ধ করল।
এই সময় ছোট নার্স এসে বলল, “আপনারা সবাই বাইরে যান,” ডাক্তারবাবু এখনই এসে যাবেন।
সেই পুরুষ সঙ্গী বলল, “দিদি, কোনও ভয় নেই তো!”
ছোট নার্স লোকটির দিকে তাকাল, “আপনি কে?”
মহিলাদের একজন বলল, “ওর স্বামীর বন্ধু।”
“অ! ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করবেন। তিনিই বলতে পারবেন। এখন আপনারা বাইরে যান, আর এখানে থাকবেন না,” ছোট নার্স চড়া গলায় বলল।
এতোয়ারি গর্ভবতী মহিলার মাথার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চমকে উঠল। না, তার ভুল হচ্ছে না। এই লোকটিকে সে নদীর ধারে আবছা আলোয় একজন গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেখেছিল। মেয়েটির দ্বিধা ছিল, কিন্তু তাকে বাধ্য করেছিল। এতোয়ারি পায়ে পায়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। না, বেদনা কমলে গর্ভবতীর মুখ যখন স্বাভাবিক হচ্ছিল, তখন তাকে দেখে আর চিনতে অসুবিধে হল না। মেয়েটির সঙ্গে এই মহিলাকেই সে নদীর ধারে রাতের বেলায় দেখেছিল। লোকটির দ্বিধা হওয়া সত্ত্বেও এই লোকটি ওর কাছে শরীরের আনন্দ আদায় করে নিয়েছিল। আজ ছোট নার্সের সঙ্গে গিয়ে যে-লোকটি পরিচয় লিখিয়ে এসেছে, সে যদি এই নারীর স্বামী হয়, তা হলে এই উদ্বিগ্ন লোকটি কে? লোকটির মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল না।
ছোট নার্স বলল, “এতোয়ারি, সবাইকে সরিয়ে দাও। আপনারা চলে যান, বাইরে যান।” ছোট নার্স বাইরে বেরিয়ে গেলে এতোয়ারি প্রায় জোর করেই সবাইকে বের করে আনল। সে দেখল সেই লম্বাচওড়া লোকটি সঙ্গীর সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার নজর এদিকে। যে-লোকটি বেডের পাশে বসেছিল, সে ধীরে ধীরে লোকটির পাশে গিয়ে মাথা নেড়ে কিছু বলতে লাগল।
এতোয়ারি আবার ঘেরাটোপের ভেতর ঢুকল। গর্ভবতীর প্রসববেদনা এখন আগের মতো বোধহয় তীব্র নয়। সে বলল, “আর-একটু অপেক্ষা করো, ডাক্তারবাবু এসে তোমার ব্যথা কমিয়ে দেবেন।”
“আমার পেট থেকে যদি না বের হয়…”
“কেন বের হবে না। সব বাচ্চাই বেরিয়ে আসে।”
“অনেক সময় বেরুতে চায় না। তা হলে আমি কি মরে যাব?”
“না না, কিছু হবে না।”
এইসময় ডাক্তারবাবু আর ছোট নার্স ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকে হাসলেন ডাক্তারবাবু, “ভয় পেয়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ছোট নার্স সঙ্গে একটা ট্রে এনেছিল। তাতে মায়ের পেট থেকে বাচ্চাকে বের করে আনার জন্যে যেসব যন্ত্র দরকার হয়, তা তোয়ালে দিয়ে মোড়া আছে। ইশারায় এতোয়ারিকে সাহায্য করতে বলল ছোট নার্স। বিড়বিড় করে বলল, “কপালে কী লেখা আছে কে জানে।”
ডাক্তারবাবু কাজ শুরু করলেন। গর্ভবতী যাতে হাত পা না-ছুড়তে পারে, তার দাঁত যাতে ঠোঁটে না-বসে যায় তার ব্যবস্থা করে ডাক্তারবাবু শিশুকে মায়ের গর্ভ থেকে বের করে আনার চেষ্টা শুরু করলেন যন্ত্রের সাহায্যে। বেশ সময় লাগলেও শেষপর্যন্ত শিশুকে পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন ডাক্তারবাবু। গর্ভবতী সমানে শরীর মুচড়ে যাচ্ছিল। শিশু বেরিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে স্থির হল। ডাক্তারবাবুর হাত থেকে শিশু নিয়ে ছোট নার্স নানারকম চেষ্টা করার পর কান্নার আওয়াজ বের হল। তখন এতোয়ারিকে বাকি সব কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দিল ছোট নার্স।
সদ্য মা হয়েছে যে, সে একপাশে মাথা হেলিয়ে শুয়েছিল। ছোট নার্স তার মুখের কাছে গিয়ে বলল, “এই যে, চোখ খুলে দ্যাখো, তোমার ছেলে হয়েছে। ফুটফুটে ছেলে।”
স্ত্রীলোকটি চোখ খুলল। তার মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট, তবু সে যেন কিছু জানতে চাইল। ছোট নার্স আবার বলল, “ছেলে হয়েছে, ছেলে।”
স্ত্রীলোকটির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটল। তারপর একটা বড় শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল।
ছোট নার্স শিশুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে গলা তুলে বলল, “বাবা কে? এদিকে এসে দেখুন, ছেলে হয়েছে।”
লম্বা চেহারার লোকটিকে তার সঙ্গী বলল, “যান, ডাকছে।”
লোকটি এগিয়ে যেতে ছোট নার্স শিশুকে উঁচু করে তুলে দেখাল। লোকটি ঝুঁকে দেখল, তারপর হাসল। ছোট নার্স বলল, “খুশি তো? আমাদের মিষ্টি খাওয়ার টাকা না-দিলে একে বাড়িতে নিয়ে যেতে দেব না।”
স্বামী কী বলবে তা বোধহয় ভেবে পাচ্ছিল না, পাশে এসে দাঁড়িয়ে যে-লোকটা তাকে ইশারা করল হ্যাঁ বলতে, সে একটু আগে গর্ভবতীর সঙ্গে কথা বলছিল। এবার স্বামী জোর পেয়ে বারবার মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। এতোয়ারি দেখল পরামর্শ দেওয়া লোকটি দাঁত বের করে হাসল।
এতোয়ারি হতভম্ব। তার বারবার সেই রাতে দেখা দুটি মানুষকে মনে পড়ছিল। যাদের একজন যে-কোনওদিন মা হতে পারে, এমন শরীর নিয়েও যার সঙ্গে মিলিত হতে নদীর ধারে এসেছিল, সে স্বামী নয়, প্রেমিক। আজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় সে যখন প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিল, তখন তার জন্যে উদ্বিগ্ন মুখে পাশে বসেছিল সেই প্রেমিকই। স্বামী আছে কিন্তু থেকেও নেই। সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপার, স্ত্রীর প্রেমিককে মেনে নিতে স্বামীর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। যে-সন্তান আজ জন্মগ্রহণ করল তার বাবা স্বামী নয়, প্রেমিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ধড়পাকড় চলছিল। মাঝে-মাঝেই দেশের অন্য জায়গায় যে-স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠছিল, তার আঁচ ডুয়ার্স এবং অসমের চা-বাগানেও এসে পড়ছিল। তবে বেশির ভাগ মানুষ তাদের নিরীহ জীবনযাপনের অভ্যেসে ভয়ে গুটিয়ে থাকছিল। তবে আর যেখানে যাই হোক, এতোয়ারি শুধু তার গল্পই শুনতে পাচ্ছিল, তাদের চা-বাগানের কাউকে সাহেবদের সামনে দাঁড়িয়ে গালাগালি দেওয়ার সাহস দেখাতে দেখেনি। কিন্তু হাসপাতালে এসে ডাক্তারবাবুর জন্যে অপেক্ষায় থাকায় রোগীরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলত, তখন নিচু স্বরে ওদের গল্পই বলত, যারা ইংরেজদের এই দেশ থেকে তাড়িয়ে স্বাধীনতা আনতে চায়। কিন্তু স্বাধীনতা, সেটা নিয়ে এলে সাধারণ মানুষের কী হবে, সে সম্পর্কে ওইসব মানুষের মতো এতোয়ারিরও স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
ডাক্তারবাবু যেখানে বসে রোগী দেখেন, কাগজে ওষুধের নাম লিখে কম্পাউন্ডারবাবুর কাছে পাঠান, তার পেছনের দেওয়ালে একটা বড় কাগজ বাঁধানো আছে। কোনও মানুষ বা প্রকৃতির ছবি সেই কাগজে ছাপা নেই, একটা রেখার ভেতরে অনেক ফুটকি, ফুটকির গায়ে জায়গায় জায়গায় নাম লেখা আছে। ছোট নার্স বুঝিয়ে বলেছিল, ওটাকে ম্যাপ বলে। এই দেশটার নাম কিন্তু হিন্দুস্তান, যার ইংরেজি ইন্ডিয়া। ওটা ইন্ডিয়ার ছবি। ইন্ডিয়ায় যত বড় শহর আছে, তার নাম লেখা আছে ওখানে। প্রথম দিন শোনামাত্র এতোয়ারির মনে প্রশ্ন এসেছিল, কেন এই দেশটার নাম হিন্দুস্তান। তাদের তো খ্রিস্টান বলা হয়। যিশু তাদের দেবতা। তা হলে কি শুধুই হিন্দুদের দেশ, খ্রিস্টানদের নয়? আবার লাইনের বাইরে যেখানে চা-বাগান শেষ হয়ে হাট বসার জায়গা, তার গায়ে দশ-বারো ঘর মুসলমান থাকে। দেশটা যদি হিন্দুস্তান হয়, তা হলে কি খ্রিস্টান বা মুসলমানদের নয়?
বড় নার্স অবসর সময়ে গল্প করেন। তখন কথাটা তুলেছিল এতোয়ারি। বড় নার্স হেসে মাথা নাড়তে লাগলেন, “দূর বোকা, এই হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের নয়। হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান সবার দেশ। তবে আগে, ইংরেজরা এই দেশে আসার আগে প্রথমে শুধু হিন্দুরাই থাকত এখানে। তারপর মুসলমান এসেছিল। সাহেবরা, মানে খ্রিস্টানরা এদেশে এল এই সেদিন। তখন দেশের বেশির ভাগ মানুষ ছিল খুব গরিব। তাদের খাবারের লোভ দেখিয়ে, নিজেদের ধর্ম, নাম দিয়ে খ্রিস্টান বানিয়ে দিল। এই যেমন তোর নাম এতোয়ারি ব্রাউন। তুই খ্রিস্টান। আবার ডাক্তারবাবুর বউয়ের নাম জানিস? সরস্বতী মুখার্জি। ওরা হিন্দু। কিন্তু দেশটা তো আমাদের সবার।”
কিছুটা স্পষ্ট হয়, অনেকটাই অস্পষ্ট। কিন্তু বড় নার্সের মতো এত সুন্দরভাবে কেউ এতোয়ারিকে বুঝিয়ে বলেই না কথাগুলো।
সেই বিকেলে চৌকিদার চিৎকার করতে করতে এসে বলল, “আজ কেউ হাসপাতালের ভেতরে অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারবে না। দরজা বন্ধ থাকবে।”
ছোট নার্স উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেন? কী হয়েছে?”
“খুন হয়েছে। পুলিশ একজনকে পিটিয়ে খুন করেছে,” চৌকিদার উত্তেজিত।
“সে কী! কেন?” দু’-তিনজন একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করল।
“কেন আবার! লোকটা নাকি স্বাধীনতা চাইছিল। সব কিছু চাইতে নেই, লোকটা জানত না। না-জানলে তো দাম দিতে হবে,” হাসপাতালের মূল দরজা বন্ধ করে লাঠি হাতে ভেতরে ঢুকে পড়ল চৌকিদার।
এর কিছুক্ষণ আগে ডাক্তারবাবু তাঁর বিকেলের রাউন্ড দিতে হাসপাতালে এসেছিলেন। খবরটা তাঁর কানে গেল। তিনি চৌকিদারকে ডেকে পাঠালেন। চৌকিদার সামনে এসে মাথা নাড়তে লাগল, “সাব আমি লোকটাকে চিনতাম। ও যে সাহেবদের খতম করার দলে নাম লিখিয়েছে, আমি জানতাম না। দেখে মনেও হয়নি।”
“লোকটা কি এই বাগানে কাজ করে?”
“না না হাটে সবজি বিক্রি করে।”
“কী হয়েছিল? তুমি কী শুনেছ?”
“লোকটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। ও নাকি সাহেবমারা দলকে খাবার পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু লোকটা যেতে যেতে পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল বলে অন্য পুলিশরা ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। পুলিশরা চেঁচিয়ে বলেছে, ওর নাকি কয়েকজন সঙ্গী এখানে আছে। তাদের তিনদিনের মধ্যে ধরে ফাঁসি দেওয়া হবে।”
“বাজারে যারা সবজি বিক্রি করে তাদের আমি চিনি। তুমি কার কথা বলছ?” ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
“শনিচয়, সামনের দাঁত একটু উঁচু।”
ডাক্তারবাবু চিনতে পারলেন লোকটাকে। গোবেচারা চেহারার ওই লোকটিকে দেখে কল্পনা করা যায় না যে, ওর ভেতরে যে-আগুন ছিল, তাকে ভয় পেয়েছে ব্রিটিশ সরকার।
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, “হাসপাতালের দরজা বন্ধ করার কথা তোমাকে কে বলেছে?”
“সবাই দরজা-জানলা বন্ধ করছে, তাই…”
“তারা কি হাসপাতালে থাকে? হাসপাতালের দরজা কখনও বন্ধ হয় না। মন্দির গির্জা মসজিদের দরজা বন্ধ হয়, কিন্তু হাসপাতালের হয় না। যাও, দরজা খুলে দিয়ে পাহারায় থাকো,” ডাক্তারবাবু বললেন।
ঠিক তখনই বড়সাহেবের বেয়ারা এসে সেলাম করে বলল, “বড়াসাহেব আপকো সেলাম দিয়া।”
“কী ব্যাপার?” ডাক্তারবাবু অবাক হলেন। এরকম ডাক কদাচিৎ পড়ে।
“নেহি মালুম,” মাথা নেড়ে বলে চলে গেল লোকটা।
ডাক্তারবাবু শঙ্কিত হলেন। তাঁকে কি এখন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে?