চাণক্য সূত্র – তৃতীয় অধ্যায়
ধৃত্যা জয়তি রোগান ॥ ১ ॥
নাস্ত্য ধৃতে রৈহিকা মুজ্ঞিকর্ম ॥ ২॥
গুণবানপি ক্ষুদ্র পক্ষ স্ত্যজ্যতে ॥ ৩ ॥
ন দুর্জনৈঃ সহ সংসর্গঃ কর্তব্যঃ ॥ ৪
শৌন্ড হস্তগংপয়োহপ্যমন্যেত ॥ ৫ ॥
অনুবাদ : ধৃতি, শক্তিকে জয় করলে রোগসমূহ বিনাশ হয়। ১।।
মর্মার্থ : ধৃতি, ধৈর্য ধারণাশক্তি এই সকল শব্দ একার্থবোধক। যার ধৈর্য শক্তি প্রবল, সে দেহস্থ রোগসমূহকে দূরীভূত করতে পারে। ধৈর্য দ্বারা অনেক সময় ক্রোধ ও হিংসাকে দমন করতে সমর্থ হয়, তাতে বহু বিপদ হতে উদ্ধার পাওয়া যায়। ১।
অনুবাদ : ধৈর্যহীনের ঐহিক কার্য ও পারত্রিক কার্য হয় না। ২॥
মর্মার্থ : মানবের সকল কার্যে কার্যোচিত ধৈর্য থাকা একান্ত প্রয়োজন, ধৈর্যশূন্য লোকের কার্য ও তার ফল লাভ হয় না। যার ধীরতা নেই, তার চঞ্চল্য নিবন্ধন প্রম, প্রমাদ, অকর্মণ্যতা প্রভৃতি কার্য নাশ করে অসাধু বৃত্তি জন্মিয়ে অতঃপর তাকে বিপদগামী করে। ২।
অনুবাদ : গুণবাহ ব্যক্তি, ক্ষুদ্রপক্ষ ত্যাগ করে থাকে। ৩।
মর্মার্থ : গুণিজনের ক্ষুদ্র নীচ পক্ষ ত্যাগ করা বিধেয়, হীনপক্ষ গ্রহণে গুণী বানের গৌরব হানি ও দুর্নাম ঘোষিত হয়। একাধিকবার সেরূপ কার্য করলে, স্বীয় প্রবৃত্তিও হীন হয়, নীচ সংসর্গে মহতের নীচতা প্রাপ্তির কথা পূর্বে উক্ত হয়েছে, যেমন স্বভাব মধুর দুগ্ধ অম্নের সহিত মিশ্রিত হলে দধিরূপে পরিণত হয়। ৩।
অনুবাদ : দুষ্টলোকের সহিত সংসর্গ করা অনুচিত। ৪।
মর্মার্থ : যে যার সঙ্গে মিলিত হয়, তার দোষগুণ সংযুক্ত ব্যক্তিতে সংক্রামিত হয়, অতএব সৎসঙ্গে সাধুতা অর্জন করা যায়, অসৎ সঙ্গ অসাধুতা অর্জন হয়, এই নিমিত্ত দুইজনের সংসর্গ ত্যাগ করতে সূত্রকার উপদেশ প্রদান করেছেন, যেমন শর্করা তিক্তযোগে মাধুর্য শূন্য হয়ে তিক্তরূপে পরিণত হয় ॥ ৪ ॥
অনুবাদ : পবিত্র দুগ্ধ বা জল, যদি শৌণ্ডিকের হস্তে পড়ে তা উপেক্ষার যোগ্য। ৫।
মর্মার্থ : শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্টের সহিত মিলিত হলে তার উত্তমতা থাকে না, যেমন পবিত্র দুগ্ধ বা জল সুরাপাত্র বা সুরালয়ের কোনো ব্যক্তির হাতে পতিত হলেও তা অপবিত্র হয়। ৫।
কাৰ্য্য সঙ্কটেস্বর্ণ ব্যবসায়িনী বুদ্ধি ॥ ৬ ॥
মিত-ভোজনং স্বাস্থ্যম্ ॥ ৭ ॥
ভক্ষ্যমপ্য পথ্যং নাশ্ননীয়াৎ ॥ ৮ ॥
জীর্ণভোজিনং ব্যাধির্নোপসপর্তি ॥ ৯ ॥
অনুবাদ : কার্য ও সঙ্কট (বিষয় বিপদ) উপস্থিত হলে, অর্থ বিষয়ে নিশ্চয়াত্মক বৃদ্ধির একান্ত প্রয়োজন। ৬।
মর্মার্থ : কোনো কার্যে যখন সঙ্কট (বহু বিঘ্ন) উপস্থিত হয়, সে সময় প্রখরমতি লোকের সঙ্গে পরামর্শ পূর্বক বৃদ্ধির স্থিরতা সাধন করবে। অনিশ্চিত বুদ্ধির দ্বারা কার্য সাধিত হয় না। কার্যকালে উপস্থিত বুদ্ধি অপেক্ষা প্রথমে বুদ্ধির দৃঢ়তা সম্পাদন করলে তা দ্বারা সহজে (নির্বিঘ্নে) কার্য সম্পন্ন হয়। ৬।
অনুবাদ : পরিমিত আহার মানবের স্বাস্থ্যবর্ধক। ৭।
মর্মার্থ : মানবের সময়ে নিষিদ্ধহার, অনাহার, অল্পহার, অসময়ে অপরিমিত হার, বিষমাহার, ঘৃণিতাহার প্রভৃতি দেহের হানিকারক, রোগজনক। যথেচ্ছ আহারই রোগের হেতু হয়ে থাকে। অতএব হিত, মেধ্য, বিহিত ভোজনযোগ্য। তা শরীর ও মনের অনকূল। চিকিৎসাশাস্ত্ৰেৎ ভক্ষ দ্রব্য প্রশস্ত, সামিষ ও নিরামিষ আহারের মধ্যে নিরামিষ আহার রোগশূন্য। জীবদেহে যেরূপ রোগের সম্ভাবনা আছে, শাকসবজিতে সেরূপ নেই। ৭।
অনুবাদ : আহারযোগ্য দ্রব্য যদি অপথ্য হয়, তা আহার করবে না। ৮।
মর্মার্থ : আহার্য দ্রব্য পেলেই যে খেতে হবে তা ঠিক নয়। পাকাশয়ের অবস্থা ও শারীরিক অবস্থানুসারে আহার করা উচিত। যথেষ্ট আহারে শরীরে অলক্ষিতভাবে রোগ প্রবেশ করে শরীরকে ধ্বংস করে। যেমন দুগ্ধ অতি উপাদেয় দ্রব্য হলেও তা উদরাময়ে নিষিদ্ধ, সেরূপ উপাদেয় দ্রব্য প্রচুর আহার করাও নিষিদ্ধ। সুতরাং বিরুদ্ধ আহার নিষিদ্ধ। ৮
অনুবাদ : ভুক্ত দ্রব্য জীর্ণ হলে যে ব্যক্তি আহার করে, তাকে কোনো রোগ আক্রমন করে না। ৯।
মর্মার্থ : ভুক্ত দ্রব্য পরিপাক হলে পুনঃ যে সময় ক্ষুধার উদ্রেক হয়, সে সময় আহার করা উচিত। এই নিয়মে আহার করলে তাকে কোনো রোগ আক্রমণ করতে পারে না, বিষম ও আহার ও অপাচ্য ও দুষ্পচ্য আহার, অসময়ে আহার, বহু আহার, অনাহার, বিরুদ্ধাহার (মাছের সহিত দুগ্ধ প্রভৃতি) করলে অচিরে রোগাক্রান্ত হতে হয়। দেহ ধারণের উপায় আহার, শরীর নাশের হেতু অবৈধ আহার। এই বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ সুশ্রুত সংহিতায় আছে। ৯।
অজীর্ণে ভোজনং বিষম্ ॥ ১০ ॥
শরীরে বর্ধমানো ব্যাধির্নোপেক্ষ্যত ॥ ১১ ॥
শত্রোরপি বিশিষ্যতে ব্যাধিঃ ॥ ১২ ॥
দানংনিধান মনুগামি ॥ ১৩ ॥
পটুতরে তৃষ্ণাপরে সুলভমতি সন্ধানম্ ॥ ১৪ ॥
অনুবাদ : ভুক্তদ্রব্য পরিপাক না হলে যে ভোজন করা হয়, তা বিষতুল্য হয়। ১০।
মর্মার্থ : ভুক্ত অন্ন পরিপাক হলে পুনঃ ভোজন করা উচিত, অন্যথা অপাকজনিত উদরাময় উৎপন্ন হয়, বিষের ন্যায় শরীর ক্ষয় করে। লঘুচাণক্যেও ইহা উক্ত হয়েছে যথা– অতি ক্রেশ সহকারে (দুরদেশে) বিদ্যা অভ্যাস করতে যাওয়া বিষের ন্যায়, অজীর্ণ অবস্থায় ভোজন করাও বিষবত, দরিদ্রের বহু পরিবার বিষতুল্য, যুদ্ধের পক্ষে তরুণী স্ত্রী বিষবৎ জানবে। ১০।
অনুবাদ : শরীরে রোগে বৃদ্ধি পেলে কখনো তা উপেক্ষা করবে না। ১১।
মর্মার্থ : রোগের স্থান শরীর, ধাতুবৈষম্যই রোগ, তা সকল সময় পরিহারের বিষয়। নীরোগ পুরুষ বিশেষ সুখী, দেহে রোগবুদ্ধি প্রাপ্ত হলে মণি, মন্ত্র, যোগ, ঔষধ, পরিচর্যা প্রভৃতি দ্বারা তার উপশম করবে, কখনো জীবনার্থী ব্যক্তি রোগকে উপেক্ষা করবে না। পৈতৃক রোগ সংক্রামক রোগ, ঋতু বিপর্যয় রোগ, আগন্তুক প্রভৃতি রোগ নানা প্রকার, সকল প্রকার উপায় দ্বারা রোগ দূরীভূত করবে। ১১।
অনুবাদ : ব্যাধি শত্রু হতেও অধিক অনিষ্টকারক জানবে। ১২।
মর্মার্থ : শত্রুও ব্যাধি এই দুই-এর মধ্যে ব্যাধি বিশেষ হানিকর, শত্রু বাইরে থেকে ধনরত্নাদি ক্ষতি করে, ব্যাধি শরীরস্থ হয়ে প্রাণের সঙ্গে শরীরের হানিকারক। রোগশূন্য হতে হলে যথা কালে স্থান, পান, স্বাস্থ্যকর স্থানে বাস, উপযুক্ত পবিত্র আহার ও ঐয়িক সংযম একান্ত প্রয়োজন। অসংযম ও অনিয়ম পানাহারে দেহে রোগ প্রকাশ করে। নিয়মিত পরিশ্রমও স্বাস্থ্যবর্ধক। ১২।
অনুবাদ : দানকার্য ধনের অনুযায়ী হওয়া উচিত। ১৩।
মর্মার্থ : সঞ্চিত বিত্তের অনুসারে দান করা উচিত, প্রচুর অর্থ থাকলে দানও বিপুল হওয়া চাই, নির্ধন ব্যক্তির যথেষ্ট দান করা অবিধেয়। দান দ্বারা সকলের হিত হয়, অস্থানে অপাত্রে দান করা কর্তব্য নয়। ধর্মার্থে যথাশক্তি দান করা সকলের পক্ষে হিতজনক। দান দ্বারা দেশ, সমাজ, দুঃস্থ, শিক্ষা, ধর্মের প্রভূত কল্যাণ হয়। ধন সঞ্চয় এবং তার দান করা পুরুষের শ্রেষ্ঠতার পরিচালক। ১৩।
অনুবাদ : নিপুণতর লোভ পরায়ণ ব্যক্তিকে অতি সহজ উপায়ে বশে আনা যায়। ১৪।
মর্মার্থ : যার অর্থ লিপ্সা প্রবল এরূপ নিপুণতর ব্যক্তিকে বিশেষ কার্যে অর্থ প্রভৃতি দ্বারা অতি সুলভ উপায়ে আয়ত্ত করতে পারা যায়। সেরূপ লোকের দ্বারা কঠোর ও গোপনীয় কার্য সাধিত হয়, নৈতিক বিষয়ে ঐরূপ কার্য সাধনে সেরূপ লোকের বিশেষ প্রয়োজন। ১৪।
তৃষ্ণায়া মতি শছাদ্যতে ॥ ১৫ ॥
কাৰ্যবহুত্বে বহুফল মায়তিকৎ বা কৃৰ্য্যাৎ ॥ ১৬ ॥
স্বয়মেবাসন্নং কার্যৎ নিরীক্ষেত ॥ ১৭ ॥
মুখে সাহসৎ নিয়তম্ ॥১৮ ॥
অনুবাদ : বিষয়তৃষ্ণা প্রবল হলে লোকের বৃদ্ধি আবৃত হয়। ১৫।
মর্মার্থ : যখন ধন লালসা প্রবল হয়, সে সময় মানবের ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান প্রবল ধনাশা দ্বারা ঢাকা পড়ে। প্রাচীন কবিও তাই বলেছেন মানবের লোভ দ্বারা বুদ্ধি বিচলিত হয়, লোভের দ্বারা তৃষ্ণা জন্মে। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি ইহকাল ও পরকালে দুঃখভাগী হয়। ১৫।
অনুবাদ : অনেক কার্য থাকলে যে কার্যের ভবিষ্যকালে ফল অধিক তা করবে। ১৬।
মর্মার্থ : এক সময় অনেক কার্য উপস্থিত হলে, যার ফল বহু কিংবা অচিরকাল মধ্যে সম্ভব হবে অগ্রে তাই করবে। আয়তি শব্দার্থ–উত্তর কাল বহু কার্যের মধ্যে যার যার ফল বিলম্বে সংঘটিত হয়, সে সে কার্যক্রমে অথবা বিলম্বে করলে কোনোরূপ ক্ষতি হতে পারে না, এইরূপ অগ্র পশ্চাৎ চিন্তাপূর্বক কার্য সম্পাদন করবে। ১৬।
অনুবাদ : রাজা স্বয়ং নিকটের কার্য সকল দেখবে। ১৭।
মর্মার্থ : যে সকল কার্য অতি নিকটে উপস্থিত হয় এবং যার ফল শীঘ্র প্রয়োজন, যা অন্য দ্বারা সম্ভব নয়, সে সকল কার্য রাজা স্বয়ং দেখবে। অতি দুরস্থ কার্য সকল মন্ত্রী প্রভৃতি দ্বারা সম্পাদন করবে। কার্যের গুরুত্ব ও ফল তারতম্য বুঝে তার পরিদর্শন ব্যবস্থা করা উচিত। কখনো কার্যের প্রতি অবহেলা করবে না। অন্য দ্বারা আক্রান্ত কার্যও রাজা স্বয়ং দেখবে, এই সূত্রের পাঠান্তর দ্বারা প্রতীতি হয়। ১৭।
অনুবাদ : মূর্খ লোকদের মধ্যে সাহস সবসময় থাকে। ১৮।
মর্মার্থ : সাহস কার্য সাধনের একটি প্রকৃষ্ট উপায়, অনেক সময় কৃতবিদ্য বুদ্ধিমানেরও সাহসের অভাবে কার্যহানি ঘটে। শিক্ষিত ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির সাহস চিন্তাপূর্বক দেখা যায়, অজ্ঞ লোকের সাহস প্রকাশ করে না। সেরূপ সাহসসম্পন্ন অজ্ঞ লোককে শ্রমসাধ্য ও দুষ্কর কার্যে নিযুক্ত করবে; সাহসা ভজতে লক্ষ্মীঃ। সাহসসম্পন্ন লোককে লক্ষ্মী আশ্রয় করে। ১৮।
মূর্খেষু বিবাদো নকৰ্তব্যঃ ॥ ১৯ ॥
মূর্খেরষু মুর্খবৎ কথয়েৎ ॥ ২০ ॥
আয়সৈরায়সশেছদ্যঃ ॥ ২১ ॥
নাস্ত্যধীমতঃ সখা ॥ ২২
ধর্মেণ ধাৰ্যতে লোকঃ ॥ ২৩ ॥
অনুবাদ : মূর্খদের সঙ্গে বিবাদ করা উচিত নয়। ১৯।
মর্মার্থ : অজ্ঞ লোকের সহিত বিবাদ করা অনুচিত, কেননা মূর্খ ব্যক্তি সদুপদেশকে অহিতজনক বলে মনে করে। তার সঙ্গে বিবাদ তো দূরের কথা। অজ্ঞের সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হলে, নিজের প্রাণও কখন বিপন্ন হওয়া সম্ভব। তাই স্বীয় লঘুচাণক্যে বলেছেন, মূর্খ লোকে কেবল দোষই প্রকাশ পায়। ১৯।
অনুবাদ : মূর্খ লোকের নিকট মূর্খের ন্যায় বলবে। ২০।
মর্মার্থ : সাধারণত অজ্ঞ লোকগণ কোনো বিষয়ে সূক্ষ্ম কথা বুঝতে পারে না, তারা প্রায়ই সহজ বা সরল বিষয়ই বুঝতে পারে সুতরাং তাদিগের কোনো বিষয়ে উপদেশ বা শিক্ষা দিতে হলে, সরলভাবে সহজ বিষয়ের উপদেশ দেবে। অর্থাৎ মূর্খগণ যা বুঝে, ভালোবাসে তাই তাদের বলবে। ২০।
অনুবাদ : লোহার দ্বারা লোহা ছেদন করবে। ২১।
মর্মার্থ : সরল বিষয়ে সারল্য ও কঠোর বিষয়ে কঠিনতা অবলম্বন করা প্রশস্ত নীতি, যেমন লোহ অতি কঠিন, সেরূপ ইস্পাত লোহা দ্বারা তৈরি করপত্র দ্বারা তা ছেদনযোগ্য, কাষ্ঠাদি দ্বারা নয়, তদ্রুপ যে স্থলে কার্যে বিশেষ জটিলতা উপস্থিত হয়, সে স্থলে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা কিংবা ক্রুরতা দ্বারা কার্য সাধন করবে। যেমন কন্টক দ্বারা কন্টক উদ্ধার করা। ২১।
অনুবাদ : অজ্ঞ লোকের কেউ বন্ধু থাকে না (১)। (২) ধর্মের সমান বন্ধু আর কেহই নয়, (সূত্রের পাঠান্তরহেতু দ্বিবিধ অর্থ)। ২২।
মর্মার্থ : বুদ্ধিহীন ব্যক্তি অজ্ঞতা দোষে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে পারে না। মিত্রতা রক্ষা করাও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। অজ্ঞতাহেতু প্রায়ই অসাধুকার্যে রত হয়ে নিজ মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। অথবা ধর্মের সমান বন্ধু ইহলোকে ও পরলোকে অপর কেউ হয় না। অপর সকল বিনাশশীল, ধর্মই ইহ-পরলোকে সহচর থাকে। ২২।
অনুবাদ : ধর্ম দ্বারা লোক সকল বিধৃত আছে। ২৩।
মর্মার্থ : যা সত্য ও অবিনশ্বর তাই সকলের বিধারক হয়। ধর্ম, সত্য ও নিত্য সুতরাং তা ভুবনবিধারক। ধর্মহীন জীবন সকল প্রকার অশান্তির আকর। সকল সময়ে দৈহিক বল, বুদ্ধি ও ধন দ্বারা সাংসারিক শৃঙ্খলা করা যায় না। তা এক ধর্ম দ্বারাই সম্পাদিত হয়, অতএব ধর্মের শ্রেষ্ঠতা ও জগতের বিধারকতা অনিবার্য। ২৩।
প্রেতমপি ধর্মাধর্মাবনুগচ্ছতঃ ॥ ২৪ ॥
দয়া ধর্মস্য জন্মভূমি ॥ ২৫ ॥
ধৰ্ম্মমূলে সত্যদানে ॥ ২৬ ॥
ধর্মেণ জয়তি লোকান ॥ ২৭ ॥
অনুবাদ : ধর্ম ও অধর্ম এই দুই মৃত্য ব্যক্তিরও অনুগামী হয়। ২৪।
মর্মার্থ : মানবের লোকান্তর প্রাপ্তি হলেও ধর্ম এবং অধর্ম তার অনুগমন করে। ইহকালে ধর্ম যে অপরিহার্য, তা বলাই বাহুল্য। এই দুঃখ বহুল সংসারে ধর্ম দ্বারা মানুষ শান্তি অনুভব করতে সমর্থ হয়। ধর্ম দ্বারা প্রচুর বিভ্রাটের সমাধান করা যায়। ধর্মেই বিশ্বাস অবস্থিত, বিশ্বাস দ্বারা প্রভূত কার্য অনায়াসে সাধন করতে পারা যায়। ২৪।
অনুবাদ : দয়াই ধর্মের জন্মভূমি (দয়া হতে ধর্ম উৎপন্ন হয়) ২৫।
মর্মার্থ : মানবের চিত্তে প্রসন্নতার উদ্রেক হলে পরে দয়ার উৎপত্তি হয়। দয়াই ধর্মের আকর, যে হৃদয়ে দয়া বা কৃপার উদ্রেক হয় না, তার (নির্দয় ব্যক্তির) ধর্ম হয় না। অহিংসাও দয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। দয়া ভিন্ন মৈত্রী, প্রসন্নতার উন্মে হয় না, মিত্রতাও পরিতোষ সত্ত্বগুণের কার্য। মৈত্রী, করুণা প্রভৃতি সকল ধর্মের সাধন। বৃহস্পতি বলেছেন, শত্রু, মিত্র, অনিষ্টকারী, বিদ্বেষ্টা প্রভৃতিতে যে নিজের ন্যায় (আত্মবৎ) সুখ দুঃখে সমানবোধ তাই দয়া’। ২৫।
অনুবাদ : ধর্ম সত্য ও দানের মূল জানবে। ২৬।
মর্মার্থ : দান ও সত্যের, ধর্ম, ধার্মিক ব্যক্তিরই দানে এবং সত্যাচরণে প্রবৃত্তি দেখা যায়। ধার্মিকই সত্য রক্ষা করে চলে। অসত্যকে ঘৃণ্য করে। সত্য ও ধর্ম দ্বারা জগতে শাস্তি এবং বহু কার্যের শৃঙ্খলা সাধন করা যায়, যেখানে এই দুই-এর অভাব, সে স্থলে প্রতি পদে সন্দেহ এবং বহু কার্যে বিঘ্নসমূহ বিদ্যমান থাকে, কঠোর পরিশ্রম কার্য সম্পন্ন হয় না। ২৬।
অনুবাদ : ধর্ম দ্বারা সকল লোক জয় করা যায়। ২৭।
মর্মার্থ : ধর্মাচরণ করলে সকলে তাকে শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করে। ধার্মিক ব্যক্তি স্বীয় অনুষ্ঠিত ধর্ম দ্বারা সকলকে বশীভূত করতে সমর্থ হয়। অধার্মিককে লোকের নিকট নানা বিষয়ে নতমস্তক হতে হয়, তোকও তার বাধ্য হয় না। ধার্মিকের প্রভাব সকলের উপর বিস্তার লাভ করে। ২৭।
মৃত্যুরপি ধাৰ্মিকং রক্ষতি ॥ ২৮ ॥
ধৰ্ম্মাদ্বিপরীতঃ পাপঃ ॥ ২৯ ॥
যত্র যত্ৰ প্ৰসজ্যতে অত্রতত্র ভ্রূবাস্মৃতিঃ ॥ ৩০ ॥
মহতী প্রসজ্যেত ॥ ৩১ ॥
অনুবাদ : মৃত্যুও ধার্মিক ব্যক্তিকে রক্ষা করে। ২৮।
মর্মার্থ : ধার্মিক ব্যক্তি ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা মৃত্যুকেও নিবারণ করতে পারে, যেহেতু ধর্ম যথাযথ অনুষ্ঠিত হলে, মর্ত্যধামে অপার কীতি অর্জনপূর্বক স্বর্গলোকে চিরকাল বাস করতে সমর্থ হয়। যথার্থ পূণ্যবান ব্যক্তি যমের অধিকার হতে অব্যাহতি পেয়ে অমরলোকে যায়। যেমন নচিকেতা ও মার্কণ্ডেয়। ২৮।
অনুবাদ : পাপ হলো ধর্মের বিপরীতি ১, দুরাচার ব্যক্তি ধর্ম কার্য হতে সকল সময় পৃথক থাকে (২) ২৯।
মর্মার্থ : পাপী ব্যক্তি, ধর্ম কার্য হতে স্বতন্ত্র পাপ যার আছে, সে পাপী। সূত্রে পাপ শব্দ ক্লীব লিঙ্গ বাচন না থাকাতে এরূপ অর্থ হলো। যদি ধর্ম হতে পাপ ভিন্ন এরূপ অর্থ হয়, তবে সূত্রে পাপম্ এইরূপ পাঠ থাকতো। ধর্মাচরণে রত থাকলে সে পাপ হতে বিরত হয় এবং সকলের নিকট প্রশংসা পায়। ২৯।
অনুবাদ : মানব যে যে কার্যে নিরত থাকে, যে সে কার্যে স্মৃতি অচল হয়। (১) ধর্ম হতে বিপরীত পাপ, পাপ বা পুণ্য কার্যে বিরত হলে পাপ কার্যের ফল দুর্নাম, পুণ্য কার্যের স্মৃতি সুকীতি থাকে (২) অতীত ও ভাবী কার্যে স্মৃতি অবিচলিত না থাকলে তাতে সাফল্য লাভ হয় না। (৩) ৩০।
মর্মার্থ : (১) মানব যেমন যেমন কার্যে রত হবে, তার সে সে কাষোচিত সুকৃতি দুষ্কৃতির স্মারক চিহ্ন থেকে যায়। সকার্যে পবিত্র স্মৃতি, অসাধু কার্যে পাপও অপযশ স্মৃতি। এমন কার্যানুষ্ঠান করা চাই, যাতে স্বয়ং দেশ ও সমাজ উপকৃত হয়। (২) অথবা ধর্ম বিষয়ে নিরত থাকলে ধার্মিক নামে চিরকীর্তি, অধর্ম বিষয়ে প্রযুক্ত হলে হীন প্রকৃতি বলে অখ্যাতি লাভ করে। ৩০।
অনুবাদ : পাপের প্রসার বুদ্ধিতে ধর্মের অবমাননা হয়। ৩১।
মর্মার্থ : পাপকে প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত, যেহেতু পাপ প্রসার লাভ করলে ধর্মের অমাননা অতি বিস্তরভাবে হয়, তার দ্বারা লোক সমাজে নানা দুর্নীতি স্থান পেয়ে সমাজের প্রচুর ক্ষতি করে। অথবা এই দুই সূত্রের একযোগে অর্থ হলে যে যে স্থলে অসদাচারীর প্রসক্তি হয়, সে সে স্থলে শ্রেষ্ঠ বিষয়েও অসৎ লোকের প্রবল ও দৃঢ় প্রবণতা জন্মে। ৩১।
লোকে প্রশস্তঃ স মতিমান ॥ ৩২
সজ্জন গর্হিতে ন প্রসজ্যেত ॥ ৩৩ ॥
উপস্থিত বিনাশঃ প্রকৃত্যাকারেন-কাৰ্য্যেণ লক্ষ্যতে ॥৩৪ ॥
আত্ম-বিনাশং সূচয়তা ধর্মাবুদ্ধিঃ ॥ ৩৫ ॥
নাস্তি পিশুন বাদিনো রহস্যমঃ ৩৬ ॥
অনুবাদ : লোকসমাজে যার শ্রেষ্ঠতা প্রকাশ পায়, সে ব্যক্তি বুদ্ধিমান। ৩২।
মর্মার্থ : নিজের ধর্ম দক্ষতাহেতু শ্ৰেষ্ঠতা প্রকাশ পেলে, সে ব্যক্তিই মতিমান বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পূর্বে কর্ম নিপুনতা প্রদর্শন করতে না পারলে, সে বুদ্ধিমান বলে খ্যাতি লাভ করতে পারে না। সর্বাগ্রে কর্মকুশলতা চাই। ৩২।
অনুবাদ : সাধুদিগের নিন্দিত পথে যুদ্ধ হবে না। ৩৩।
মর্মার্থ : বহু লোক বা বিদ্বজ্জন যে বিষয়ের নিষেধ বা নিন্দা করে, সে বিষয়ে আগ্রহ কিংবা অগ্রসর হবে না, তাদৃশ কার্যেরত হলে অহিত ভিন্ন শুভের আশা বিরল। সকল সময় নিজের ও অন্যের হিতজনক বৈধ কার্যে প্রবৃত্ত থাকবে। ৩৩।
অনুবাদ : স্বভাব, স্বরূপ ও কার্য দ্বারা উপস্থিত বিষয়ের বিনাশ লক্ষিত হয়। ৩৪।
মর্মার্থ : (১) উপস্থিত বিষয়টি সিদ্ধ হবে কি বিনষ্ট হবে, তা বিষয়ের স্বভাব দ্বারাই নিরুপণ করা যায়। (২) বিষয়ের স্বরূপ দ্বারা তা নির্ণীত হতে পারে। আবার (৩) কাৰ্য্য দ্বারাও নির্ণয় করা যায়। যেমন কোনো নিন্দিত উপায়ে কার্যসিদ্ধির জন্য সচেষ্ট হলে ঐ উপায়ের স্বভাব, স্বরূপ ও তার কারকতা চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, সে কার্যসিদ্ধ হবে না বরং পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। ৩৪।
অনুবাদ : পাপবুদ্ধি, নিজেরও বিনাশ সূচনা করে। ৩৫।
মর্মার্থ : অধর্ম বুদ্ধি দ্বারা যে পরের অহিত সাধন হয়, এমন নয়, নিজেরও উচ্ছেদ সাধন হতে পারে, যেমন দুর্যোধন ও কীচক। এরা পরের অনিষ্ট সাধনে উদ্যত হয়ে অধর্ম বুদ্ধি দ্বারা আত্মবিনাশ ঘটিয়েছিলেন। নবনন্দ কুমারগণ, শিক্ষা জ্ঞানগরিষ্ঠ চাণক্যের গুরুতর অপমান করে স্বীয় নাশ ঘটিয়েছিল। অতএব অন্যায় বুদ্ধি পরিহারপূর্বক হিতাহিত বিবেকে কার্য করলে, আত্মোন্নতি অবধারিত। ৩৫।
অনুবাদ : পিশুন ব্যক্তির কিছুই গোপন থাকে না। ৩৬।
মর্মার্থ : পিশুন, সূচক বা খল প্রকৃতি ব্যক্তির কোনো বিষয় অজ্ঞাত থাকে যেহেতু সে সকল সময় অন্যের দোষ ও ছিদ্র অন্বেষণ করে বেড়ায়। অন্যের দোষ বা ছিদ্র অন্বেষণ করে সাধারণে প্রকাশ করা তার কার্য। অতএব মতিমাণ ব্যক্তি তাদৃশ লোকের নিকট গোপনীয় ও বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় প্রকাশ করবে না। ৩৬।
পর রহস্যং নৈব শ্রোতাব্যম্ ॥ ৩৭ ॥
বল্লভস্য কাতরত্বৰ্মধর্মযুক্তম্ ॥ ৩৮ ॥
স্বজনেস্বতি কাম্যে ন কর্তব্যঃ ॥ ৩৯ ॥
মাতাপি দুষ্টা তক্তব্যা ॥ ৪০ ॥
অনুবাদ : অন্যের গোপনীয় (রহস্য) বিষয় শুনবে না। ৩৭।
মর্মার্থ : অন্যের গুহ্য বিষয় গ্রহণ করার স্পৃহা বৃধিত হলে, তা শুনে ক্রমে ক্রোধ, নীচতা, পরানিষ্টের ইচ্ছা প্রবল হতে থাকে। সেরূপ কার্যে একাধিকবার রত হলে অন্যের স্বার্থহানিও ঘটতে পারে, তাতে বিপদের আশঙ্কা অনিবার্য, নিজ স্বার্থ সম্বন্ধে থাকলে, তা শুনে ধৈর্য সহকারে রক্ষা করা উচিত। ৩৭।
অনুবাদ : প্রভুর স্বকার্যে কাতরতা অধর্মসূচক হয়। ৩৮।
মর্মার্থ : যে কার্যে যার প্রভুত্ব অবশ্য কর্তব্যতা আছে, তার কার্যে অশক্ততা প্রকাশ অধর্মের ও কাৰ্য্য হানির ব্যঞ্জক হয়। রাজা কখনো স্বীয় কার্যে শক্তিমত্তা ভিন্ন দৈন্য প্রকাশ করবে না। কাতরতায় আলস্য ও কার্য পরামুখতা আসে। গীতাতে শ্রীভগবান অর্জনকে বলেছেন–তুমি যদি ভীরুতাবশত এই আরদ্ধ স্বকার্য না করো, তবে স্বধর্ম ও কীৰ্তিত্যাগ করে পাপী হবে। ৩৮।
অনুবাদ : আত্মীয়গণের মধ্যে অতি মাত্রায় ধন কামনা করা উচিত নয়। ৩৯।
মর্মার্থ : স্বজনগণের মধ্যে অতিশয় ধন লালসা বা প্রার্থনা করলে তারা বিরক্ত বা বিদ্বেষান্বিত হয়, তার দ্বারা সময়ে বিবাদ ও বিচ্ছেদের সম্ভাবনা। অথবা স্বজনগণের অতিক্রম করা বাঞ্ছনীয় নয়। কিংবা তাদের মধ্যে ঘৃণিত কাম বাসনা প্রকাশ করা অন্যায়। কাম ইন্দ্রিয়ের অসংযম, এটি মানবের শরীর স্থিত প্রবল শত্রু। ৩৯।
অনুবাদ : মাতা যদি দুষ্টা (আততায়িনী) হন, তাকে ত্যাগ করবে। ৪০।
মর্মার্থ : নীতিশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে আততায়িনী জননীকেও দূরে পরিহার করবে। তা না করলে তার দ্বারা স্বীয় এবং অপরের প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটতে পারে। আত্মরক্ষা ও দেশরক্ষা সর্ব প্রকারে কর্তব্য মাতাকে বধ, বা দৈহিক যন্ত্রণা প্রভৃতি দেওয়া অভিপ্রেত নয়। কেবল দূরে ত্যাগের উপদেশ দেওয়া হয়েছে মাত্র। অর্থশাস্ত্রে উক্ত আছে–গুরুজন যদি বিবেকহীন, বিপদগামী, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, তাকে পরিত্যাগ করবে। ৪০।
স্বহস্তোহপি বিষ দিগ্ধশেছদ্যঃ ॥ ৪১ ॥
পরোহপি চ হিতো বন্ধু ॥ ৪২ ॥
কক্ষাদপ্যেষধং গৃহ্যতে ॥ ৪৩ ॥
নাস্তি চোরেষু বিশ্বাসঃ ॥ ৪৪ ॥
অনুবাদ : স্বীয় হস্ত বিষ হলে তাও ছেদনযোগ্য। ৪১।
মর্মার্থ : নিজের হাতও যদি বিষাক্ত কিংবা সেরূপ কঠিন রোগাক্রান্ত হয়, তা ছেদনের উপযুক্ত। ছেদন না করলে সেই বিষাক্রান্ত হস্ত দ্বারা সকল শরীর ও প্রাণও নষ্ট হতে পারে। সেরকম গুরুজনও যদি অপ্রতীকার্য দোষাক্লান্ত বিপদগামী, গুরুতর অনিষ্টাচরণশীল হয়, তাকেও দূরে পরিত্যাগ করবে, একথা পূর্ব সূত্রের উদাহরণ রূপে ব্যক্ত হয়েছে। বহু কল্যাণকর বিষয়ের জন্য একে ত্যাগ সম্ভব, যেমন শ্রীরামচন্দ্রের সীতাপরিহার। ধর্ম শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অন্যরূপ। ইহা অর্থশাস্ত্রের সমাধান নিয়মে বলা হয়েছে। ৪১।
অনুবাদ : পর হয়েও যে হিতকারক হয়, সে বন্ধু নামে খ্যাত। ৪২।
মর্মার্থ : কার্যত কেউ কার শত্রু হয়, কেউ কারও মিত্র হয়। মানুষের মধ্যে জন্মগত কেউ কারও শত্রু মিত্র হয় না। যে শত্রু হয়ে মিত্রের কার্য করে, অর্থাৎ হিত করণে নিরত থাকে, সে বন্ধু নামে সাময়িক প্রসিদ্ধি লাভ করে। সময়ে সময়ে কার্যের ও স্বার্থের ফেরে মিত্রও শক্ত হয়। পরশব্দ শ্রেষ্ঠ, অন্য, শত্রু বাচক, এস্থলে শ্ৰেষ্ঠাৰ্থবাচক পরশব্দই গ্রহণীয় নয়। ৪২।
অনুবাদ : গৃহ কোণ থেকে ঔষধ গ্রহণ করবে (১) সর্প, তুষ, তৃণ হতেও ঔষধ সংগ্ৰহণীয় (২) ৪৩।
মর্মার্থ : কোনো বিষয়কে তুচ্ছ মনে করবে না, বিশেষ ফলদায়ক কার্য অতি ক্ষুদ্র হতেও সাধন করবে, ইহা সূত্রের তাৎপৰ্য্য। গৃহ কোণ হতে ঔষধ লাভ হলে তা নিমিত্ত বনে যাওয়া বৃথা। সূত্রে পাঠভেদ থাকতে দুইরূপ অর্থ হলো। (১) অক্ষসর্প, সুষ, তৃণ। (২) গৃহ কোণ, তৃষ, সৌবচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র দ্রব্য। ঔষধ রোগোপশমকারী জীবন রক্ষক দ্রব্য বিশেষ। (৩) যা ফল পাকলে মরে যায়, তাও ওষধি নামে খ্যাত। ৪৩।
অনুবাদ : চোর, দস্যু, দুর্দান্তদিগকে বিশ্বাস করবে না। ৪৪।
মর্মার্থ : যাদের প্রকৃতি সুশিক্ষাও সৎ সঙ্গ গঠিত নয়, সেরূপ স্বভাবের লোক প্রায়ই দুর্নীতি চৌর্য পরায়ণ হয়, তাদের বিশ্বাস করলে কার্যক্ষতি ও অনেক সময়ে বিপদে পড়তে হয়। সূত্রকার তা নিষেধ করেছেন। দুষ্ট, শঠ, দুর্দান্ত, দস্যু প্রভৃতির মধ্যে চোর প্রধান বলে চোরের উল্লেখ করেছেন, পরীক্ষাপূর্বক লোককে বিশ্বাস করা উচিত। ৪৪।
অপ্ৰতীকারেষু ব্যসনেষু অনাদরো ন কর্তব্যঃ ॥ ৪৫ ॥
ব্যনস-মনা বাধ্যতে ॥ ৪৬ ॥
অজরামরবদৰ্থ আৰ্জয়েৎ ॥৪৭ ॥
অর্থবান সৰ্ব্ব-লোস্য বহু মতঃ ॥ ৪৮ ॥
মহেন্দ্রমপার্থ হীনমবমন্যতে লোকঃ ॥ ৪৯ ॥
অনুবাদ : প্রতীকারের অযোগ্য ব্যসন সকল উপস্থিত হলে অনাদর করবে । ৪৫।
মর্মার্থ : বিপদ বা ব্যসন একাৰ্থ বোধক, সকল প্রকার ব্যসনের প্রতীকার করা অসম্ভব। যে সময় ব্যসন সকল উপস্থিত হয়, তখন তা সহ্য করে প্রতীকারের নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করবে। ব্যসনকে উপেক্ষা, হেলা, তুচ্ছজ্ঞান করবে না, তার দ্বারা বিশেষ আবিষ্টের সম্ভাবনা। অষ্টাদশ প্রকার ব্যসন মানব ধর্ম শাস্ত্রে উক্ত আছে। লৌকিক বিপদ ও দৈব বিপদ ব্যসনের মধ্যে পরিগণিত। ৪৫।
অনুবাদ :-(১) ব্যসনে আসক্ত পুরুষ প্রতি কার্যে বাধা পায়। (২) অল্প ব্যসনও পুরুষকে পীড়া দেয়। ৪৬।
মর্মার্থ : ব্যসনে আসক্ত চিত্ত-পুরুষ সকল কার্যে অমনোযোগহেতু বিফল মনোরথ হয়। দোষাবশত চিত্তের বুদ্ধিমান্ধ্য ঘটে থাকে। বুদ্ধিহীনের ক্লোশ ও কার্যে বিফলতা অনিবার্য। সূত্রের পাঠান্তর নিবন্ধন দুইরুপ অর্থ হলো। (১) ব্যসন অতি অল্প হলেও তা বিষের ন্যায় ত্যাজ্য (২) ব্যসনাসক্ত মানস যার, তার কার্যে বাধা ও অশান্তি নিশ্চিত। ৪৬।
অনুবাদ : (১) অজর ও অমর পুরুষের ন্যায় অর্থ উপার্জন করবে। (২) অমর (দেবতা) তুল্য হয়ে অর্থসমূহ অর্জন করা উচিত। ৪৭।
মর্মার্থ : অর্থোপর্জনে সকল সময়ে আলস্য ও শক্তিহীনতা প্রভৃতি ত্যাগ করবে। নিজকে জরা মৃত্যুবর্জিত ভেবে তাতে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত। নীতিবিদ প্রবর বিষ্ণুশর্মাও বলেছেন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি আপনাকে জরা মৃত্যু শূন্য জেনে বিদ্যা ও অর্থোপার্জনের চিন্তা করবে। যমরাজ যেন কেশসমূহ (নেওয়ার জন্য) গ্রহণ করে আছেন ভেবে নিত্য ধর্মাচিরণ করবে। ৪৭।
অনুবাদ : ধনী ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ বলে বহুলোকের অভিমত। ৪৮।
মমার্থ : ধনবান শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যে তাতে বহুলোকের সম্মতি দেখতে পাওয়া যায়। ধনের দ্বারা ব্যবহারিক জগতে প্রভূত কার্য সাধন করা যায়। ধনী ব্যসন বর্জিত হলে তার ধন অমৃত তুল্য। ব্যসনসক্তের ধন বিষ সদৃশ কার্য করে। ধন সুশিক্ষার সঙ্গে একত্র স্থিত হলে, অচিরকাল মধ্যে শ্রেষ্ঠতা আনয়ন করতে পারে। দরিদ্রের বহু গুণ ধনাভাবে তিমিরে আবৃত থাকে। ৪৮।
অনুবাদ : মহেন্দ্র সদৃশ শক্তিমান হলেও ধনহীনকে মানুষ অবজ্ঞা করে। ৪৯।
মর্মার্থ : অর্থ সম্মানলাভের একটি প্রধান উপায়, অর্থহীন ব্যক্তি যদি ইন্দ্র তুল্য হয় তথাপি তাকে লোকসমাজে তুচ্ছজ্ঞান করে। বৈষয়িক কার্যের সাধন অর্থ, দরিদ্রের অর্থাভাবে বহুঁকার্য সম্পন্ন হয় না। বিদ্যাও অর্থ সংযোগ মণিকাঞ্চনযোগের সমান। অর্থাভাব গুণবর্তাকেও পরাভূত করে। ৪৯।
বিরুপোহপ্যর্থবান্ সুপুরুষঃ ॥ ৫০ ॥
অদাতার মপ্যর্থবন্তমর্থিনো ন ত্যজন্তি ॥ ৫১ ॥
অকুলীনোহপি অর্থবান্ কুলীনাদ্বিশিষ্টা ॥ ৫২ ॥
দারিদ্র খলু পুরুষস্য জীবিত-মরণম্ ॥ ৫৩ ॥
অনুবাদ : অর্থবান লোক কুরূপ হলেও সুন্দর বলে খ্যাত। ৫০।
মর্মার্থ : যার প্রচুর অর্থ আছে, তার রূপ না থাকলেও সুন্দর বলে লোকে আদর করে। অর্থের গৌরবে ধনী গৌরবান্বিত হয় বলে তার রূপের বিশেষ প্রয়োজন হয় না। রূপবান ব্যক্তি নির্ধন হলে তার ধনাভাবজনিত ক্লেশ অনিবার্য। অর্থ দ্বারা বহুঁকার্য সাধিত হয় বলে রূপ হতে অর্থ শ্রেষ্ঠ। ৫০।
অনুবাদ : ধনার্থিগণ দানশক্তিহীন (কৃপণ) ধনীকেও ত্যাগ করে না। ৫১।
মর্মার্থ : যাচকগণ কৃপণ ধনীর নিকট বহুবার ধন প্রার্থনা করে থাকে, বারবার প্রার্থনায় দীনের দুঃখে কাতর হয়ে তার দানশক্তির উন্মেষ হতে পারে। ধনের গতি তিন প্রকার, দান, ভোগ ও নাশ। এই তিনের দানই শ্রেষ্ঠ। দান-সৎপাত্রে ও সকার্যে ত্যাগ। ভোগ নিজের ও কুটুম্বদিগের, সাধু, দীনান্ধ, পঙ্গু, অনাথ, বিদ্যার্থি প্রভৃতির জন্য ত্যাগ। নাশ-চোর, দস্যু, বিপদ বিবাদ প্রভৃতি দ্বারা সঞ্চিত ও অর্জিত অর্থের দান না হলে অসাধু পথে ধনব্যয় অবশ্যম্ভাবী। ৫১।
মর্মার্থ : অর্থবানের বিশিষ্টতা বংশ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে কম নয়, যেহেতু অনেক সময় দেখতে পাওয়া যায়, বিদ্যাও ধনের দ্বারা কুল লাভ হয়। সকুল সদ্ভুত ব্যক্তি কুলীন। কুলের নয়টি লক্ষণ; যথা-আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, বৃত্তি, তপস্যা ও দান। উৎকর্ষ বিশেষরূপ নব প্রকার গুণ বিশিষ্টত্বই কুলীনত্ব রূপধর্ম। উক্ত আচারাদি যার নেই সে অকুলীন। ৫২।
অনুবাদ : (১) দরিদ্রতা পুরুষকে জীবদ্দশাতে মৃতপ্রায় করে। (২) অথবা দৈন্যভাব লোকের জীবন থাকতেও মরণতুল্য কষ্ট দেয়। ৫৩।
মর্মার্থ : মানব এই দুঃখবহুল সংসারে সকল অবস্থায় সুখ প্রার্থনা করে, অর্থাভাব-রূপ দৈন্যদশা সেই সুখের বিশেষ ব্যাঘাতজনক। অর্থের অভাবে বহু কার্য সাধনে বিঘ্ন উপস্থিত হয়, এই নিমিত্ত দারিদ্র্য পুরুষের জীবিত অবস্থায় মরণতুল্য ক্লেশ আনয়ন করে। রাজা শূদ্রক-কৃত মৃচ্ছকটিক নাটকে মর্মবিদারক দারিদ্র্যের বর্ণনা অক্ষিত আছে। মহামনীষী ভীষ্মদেব অর্থাভাবেই কৌরবপক্ষ গ্রহণ করেছিলেন। ৫৩।
কস্যচিদং স্বমিব মন্যতে সাধুঃ ॥ ৫৪ ॥
পর বিভবেম্বদরোনৈব কর্তব্যঃ ॥ ৫৫ ॥
পরবিভবাদরো বিনা শমূলম্ ॥ ৫৬ ॥
পলালমপি পরদ্রব্যং নহর্তব্যম্ ॥ ৫৭ ॥
পরদ্ৰব্যাপহরণমাত্মদ্রব্যবিনাশহেতুঃ ॥ ৫৮ ॥
অনুবাদ : সজ্জন ব্যক্তি, অপরের অর্থ নিজের অর্থের ন্যায় জ্ঞান করে। ৫৪।
মর্মার্থ : সাধু নিজের অর্থের হানি হলে সেরূপ দুঃখ বোধ করেন, সেরূপ পরের অর্থ হানিতেও মনে করে থাকেন। স্বীয় অর্থ হতে পরের অর্থ ভিন্ন, তা নষ্ট হলে আমার কোনো ক্ষতি নেই–এরূপ জ্ঞান অসাধু ব্যক্তি করে থাকে এবং পরের। দ্রব্য হরণে প্রবৃত্ত হয়। অতএব নিজের স্বার্থের তুল্য পরের স্বার্থও জ্ঞান করা মহত্ত্বের পরিচায়ক, তদ্দ্বারা সমাজের কল্যাণ হয়। ৫৪
অনুবাদ : পরের ঐশ্বর্যের প্রতি সমাদর করা অনুচিত। ৫৫।
মর্মার্থ : কোনো কারণ না থাকলে পরের দ্রব্যের প্রতি সমাদর করবে না, অকারণ সমাদরে তাতে লাভ ও মনের মধ্যে অপর দুষ্টভাব আসতে পারে। পরদ্রব্যে নিজ দ্রবের তুল্য, ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান করবে, অথবা অন্যের বস্তু লোভজনক বলে, তা অতিতুচ্ছ ও স্বীয় অহিত জনক জ্ঞান করবে। মহর্ষি মনু বলেছেন–পরের দ্রব্যে অভিধ্যান ও লোভ করা পাপজনক। ৫৫৫।
অনুবাদ : পর ধর্মে সমাদর করা আত্মনাশের কারণ। ৫৬।
মর্মার্থ : অহেতু পর দ্রব্যে কিংবা ঐশ্বর্যে অতিশয় আগ্রহ, সমাদর এবং লোভ করলে তা দ্বারা বিবাদ হানি ও আত্মনাশ পর্যন্ত ঘটে থাকে। যার যা লব্ধ বস্তু, তাতে তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। অতি লোভ প্রভৃতি দোষে মানবের বিপদ অনিবার্য এবং রাবণ দুর্যোধন, কিচকের আত্মনাশ ঘটেছিল। অতএব বিনা কারণে অন্যের দ্রব্যে লোভ ও অত্যাগ্রহ করবে না। ৫৬।
অনুবাদ : চিটে ধানের খোসার তুল্য ও পরের দ্রব্য অপহরণ করবে না। ৫৭।
মর্মার্থ : পূর্বে দুটি সূত্রে পরের দ্রব্যে আগ্রহ না করা ও তাতে আত্মনাশের কথা উল্লেখ করে এখন এই সূত্রে দৃঢ়তার জন্য পুনঃ তুচ্ছ কিংবা অতি ক্ষুদ্র ও পর দ্রব্য অপহরণ করতে নিষেধ করছে। অর্থাৎ দ্রব্য ক্ষুদ্রই হোক, আর বিরাটই হোক, তাতে অন্যেরই। অতএব অপহরণ করলে অনিষ্ট সম্ভাবনা প্রবল। ক্ষুদ্র দ্রব্য হলেও তা লোভজনক হতে পারে এবং অন্যের নিকট তা অতি মূল্যবান। বস্তুর স্বামীর বিনা অনুমতিতে গ্রহণই অপহরণ। ৫৭।
অনুবাদ : অন্যের দ্রব্য অপহরণ করা স্বীয় বিনাশের কারণ। ৫৮।
মর্মার্থ : লোভও প্রমাদবশতঃ অন্যের কোনো বস্তু অপহরণ করলে, তা কালে স্বীয় দ্রব্য নাশের হেতু হয়ে থাকে। যার যা লব্ধ বস্তু তারই তা ভোগ্য, অপর কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে হস্তগত করলে তদ্রুপ দুর্নীতিতে তার দ্রব্যও অন্য একজন অপহরণ করতে প্রবৃত্ত হবে–এই নিমিত্ত তাদৃশ অবৈধ দ্রব্য গ্রহণ আত্মনাশের হেতু বলে উল্লিখিত হয়েছে। ৫৮।
ন চৌৰ্য্যাৎ পরং মৃত্যুপাশঃ ॥ ৫৯ ॥
যবাগুরপি প্রাণধারণং করোতি ক্যলে ॥ ৬০ ॥
না কালেন মৃতসৌষধং প্রয়োজনম্ ॥ ৬১ ॥
সকালে স্বল্পমপি প্রভূতত্বস্য প্রয়োজনম্ভবতি ॥ ৬২ ॥
অনুবাদ : চৌর্য বৃত্তি হতে মৃত্যু পাশ অধিক নয়। ৫৯।
মর্মার্থ : চৌর্য বৃত্তি যম পাশ হতেও অতিশয় কষ্টদায়ক। যম পাশ বন্ধন জীবনে একবার মাত্র অলিক্ষিতে হয়, চৌর্যাপরাধে যতবার চুরি ততবার রাজবন্ধনের আশঙ্কা, দুর্নাম, অর্থহানি, শারীরিক ক্লেশ এবং কারাবাস অবশ্যম্ভাবী। অতএব যম পাশবন্ধন হতেও চৌর্য চিত্ত দুঃখজনক। চোরকে সকলে ঘৃণা করে। ৫৯।
অনুবাদ : সময়ে ক্ষুদ্র যন্ত্র দ্বারাও প্রাণধারণ করা যায়। ৬০।
মর্মার্থ : যদি অতি ক্ষুদ্র ও অনায়াসলব্ধ দ্রব্য দ্বারা সময়ে প্রাণধারণ করা যায়, তবে জীবনধারণের জন্য গর্হিত ও পর পীড়াদায়ক কার্য করা অনুচিত। নীতিবিদ বলেছেন-অভি প্রায়ানুসারে সহজ লব্ধ বন্য শাক দ্বারা যদি ক্ষুধা নিবৃত্তি করা যায়, তবে এই পোড়া পেটের জনকে মহাপাপজনক কার্য করবে? এই সূত্রে পূর্বসংক্রান্ত বিষয়ে উদাহরণের সমর্থন পাওয়া যায়। ৬০।
অনুবাদ : উপযুক্তকালে মৃত ব্যক্তির ঔষধ দ্বারা কোনো ফল হয় না। ৬১।
মর্মার্থ : যার যে সময় মরণ ঘটে, তার সে সময়ই মৃত্যুর অবধারিত কাল। যত দিন বেঁচে থাকে, সে সময়ই আয়ু বা জীবনকাল। যোগ্যকালে মৃত ব্যক্তির (অর্থাৎ মরণের পূর্বে) ঔষধ প্রয়োগে কোনো ফলোদয় হয় না। সে সময়ে ঈশ্বর ভাব যাতে হৃদয়ে উনিষ্ট হয় তার চেষ্টা করাই বিধেয়। নিয়তি উপস্থিত হলে কেউই জীবিত থাকতে পারে না। ৬১।
অনুবাদ : কার্যের উপযুক্ত কালে অতি অল্প বস্তু ও প্রভূত বস্তুর প্রয়োজন সাধন করে থাকে। (১) এক সময়ে প্রভুত্বের আবশ্যক। (২) সূত্রের পাঠান্তরহেতু দ্বিবিধ অর্থ। ৬২।
মর্মার্থ : যার যা উপযুক্ত সাধন সামগ্রী, তা যদি অতি অল্পও হয়, তার দ্বারা প্রচুর কার্য সাধিত হয়। কার্যের যোগ্য দ্রব্য না হলে যথেষ্ট হলেও তাতে কার্য সাধন হয় না। উপযুক্ত কালে যোগ্য বস্তু দ্বারাই কার্য সম্পন্ন হয়। অথবা এককালে প্রভুত্বের আবশ্যকতা দেখা যায়, সকল সময় সকল কার্যে নয়। ৬২।
নীচস্য বিদ্যা পাপকর্মণা যোজয়তি ॥ ৬৩ ॥
ঐহিকামুত্রিকং বৃত্তম্ ॥ ৬৪ ॥
অকৃতেনিয়তা ক্ষুদ্বাধা ॥ ৬৫ ॥
নহি ধান্য-সমোহর্থঃ ॥ ৬৬ ॥
অনুবাদ : নিচ কিংবা হীন জনের বিদ্যা প্রায়ই গর্হিত কার্যে যোজনা করে।
৬৩।
মর্মার্থ : সৎপাত্রে আহিত গুণের প্রতিফলন অত্যুজ্জলে। যেমন মণিকে কিংবা স্ফটিকে সূর্যালোকের প্রতিফলন। ভিত্তিতে বা সাধারণ পাথরে তদ্রুপ ঔজ্জ্বল্য দেখা যায় না। বিদ্যা ও আভিজাত্যাদি গুণসম্পন্ন জনে দ্বিগুণ ফলিত হয়; নীচ, শঠ হীনজনে তেমন না হয়ে বিরূপ ভাব ধারণ করে। তাই কবি বলেছেন–অপাত্রে অর্পিত ক্রিয়া কখনো ফলবতী হয় না। মণিকাঞ্চনের যোগ যেমন, লৌহ মণির যোগ সেরূপ নয়। বিদ্যা ও ভাষা কত প্রকার, তা ছান্দ্যোগ্যে, স্মৃতি শাস্ত্রে, পুরাণে, শৈবতন্ত্রে, কামসূত্র টিকায়, দশকুমার চরিতে সাহিত্য দর্পণে, ললিত বিস্তরে উল্লিখিত আছে। ৬৩।
অনুবাদ : মানব চরিত্র, ইহকাল ও পরকালে ফলদান করে। ৬৪।
মর্মার্থ : লোক চরিত্র সৎ ও অসৎ দুইভাবে প্রকাশ পায়, সৎ হলে তার ফল ইহকালে ও পরকালে যশ ও ধর্ম প্রসব করে। অসৎ হলে ইহকালে দুর্নাম, দুঃখ এবং পরকালে নরক ভোগ পর্যন্ত জন্ম দেয়। অতএব সচ্চরিত্রতা নিতান্ত প্রয়োজন, তা উন্নতির প্রধান সোপান। ৬৪।
অনুবাদ : কার্যহীন লোকের ক্ষুধার্ততা নিতান্তই বর্তমান। ৬৫।
মর্মার্থ : যার কোনো কার্য নেই, এইরুপ উৎসাহহীন, আলস্যযুক্ত লোকে ক্ষুধা সকল সময়েই পীড়াদায়ক। যে উৎসাহ, উদ্যম, অধ্যবসায়সহ কর্মে নিযুক্ত আছে, সে তার দ্বারা নিজের ও পরের ক্ষুধা নিবৃত্তি সকল সময়েই স্বভাব; অর্থাভাবে ক্ষুধার যন্ত্রণা অনূভব করতে হয় না। ৬৫।
অনুবাদ : ধান্যের সমান অন্য কোনো অর্থই নয়। ৬৬।
মর্মার্থ : যত প্রকার ব্রীহিজাতীয় দ্রব্য দেখা যায়, তন্মধ্যে ধান্যই শ্রেষ্ঠ। মণি, কাঞ্চন ধারণে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় না, মাত্র অন্ন দ্বারা তা হয়। ধান্য, যব, গোধূম, কঙ্গু, নীবার, কোদ্রবাদি নানাপ্রকার ব্রীহি বা শস্য দেখা যায়। শস্য পঞ্চ, সপ্ত, সপ্তদশ; প্রকার। যথা-ব্রীহি, যব, মসুর, গোধূম মুগ্ধ, মাষ, তিন, চণক, অণু, প্রিয়ঙ্গ কোদ্রব, যকুষ্টক, কলায়, কুলখ, যষ্ঠ, সর্ষপ, অতসী (১৭) এই সকল ধন্যবর্গের মধ্যে পরিগণিত। তন্মধ্যে ধান্য দ্বারা প্রাণ ধারণ করা যায় বলেই তা বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠ। ৬৬।
ন ক্ষুধাসমঃ শত্রু ॥ ৬৭ ॥
নাস্ত্যভক্ষ্যং ক্ষুধিতস্য ॥ ৬৮ ॥
ইন্দ্রিয়াণি জরাবশং কুৰ্ব্বন্তি ॥ ৬৯ ॥
সানুক্রোশং ভর্তারমাজীবেৎ ॥ ৭০ ॥
লুক্কসেবী পাবকেচ্ছয়া খদ্যোতং ধমতি ॥ ৭১ ॥
অনুবাদ : ক্ষুধার তুল্য শত্রু নেই। ৬৭।
মর্মার্থ : শত্রু যেরূপ অনিষ্ট সাধন করতে সক্ষম, সেরূপ ক্ষুধাও মানুষের পক্ষে অনিষ্টকারী। শত্ৰু সময় বিশেষে ধন, মানের ক্ষতি করে, ক্ষুধা শরীর, ইন্দ্রিয় ও জীবনের হানিকারক। অতএব ক্ষুধার তুল্য শত্রু নেই। ৬৭।
অনুবাদ : ক্ষুধাপীড়িত ব্যক্তির কিছুই অভক্ষ নেই। ৬৮।
মর্মার্থ : যার ক্ষুধানলে উদয় দন্ধ, তার পক্ষে ভক্ষ অভক্ষ বিচার নেই। ভোজনেচ্ছা প্রবল হলে সে অপর সকল প্রবৃত্তিকে অপহরণ করে। মহাভারত উক্ত আছে ‘হে বাসুদেব। এই সংসারে বার্ধক্যক্লেশদায়ক, তা হতে ধন্যাভাব আরও দুখঃখকর, তা হতে অধিক পুত্রশোক, এই সকল কষ্টপ্রদ ব্যাপার হতে অধিক ক্লেশদায়ক ক্ষুধা। জীবমাত্রই ক্ষুধা ক্লেশে অতিপীড়িত। ৬৮।
অনুবাদ : ইন্দ্রিয়গণ, মানুষকে জরাবশীভূত করে ফেলে। (১) ক্ষুধার্তর্জনের ইন্দ্রিয়গণ দুর্বল হয়ে জরাবশীভূত করে থাকে। (২) ৬৯।
মর্মার্থ : অতি মাত্রায় ভোগ লোলুপতায় মানব ঐন্দ্রয়িক সেবাপরায়ণ হলে। শীঘ্র জরা দেখা দেয়। তার ফলে শক্তিশূন্য হয়ে জীর্ণতার বশীভূত হয়। অতিশয় ঐন্দ্রয়িক ভোগ অর্থাৎ স্ত্রী সেবনাদি মানবের পক্ষে নিষিদ্ধ। ধৈর্য সহকারে মানব নিয়মিত ও পরিমিত ভোগে আস্থাবান থাকবে। সংযমে বুদ্ধির বিকাশ ও দৈহিক শক্তি বর্ধিত হয়। অথবা ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গণ দুর্বল হয়ে পুরুষকে জরার বশীভূত করে থাকে।
অনুবাদ : দায়বান প্রভুর আশ্রয়গ্রহণপূর্বক জীবিকা অর্জন করবে। ৭০।
মমার্থ : যে প্রভুর দয়া ও ধন আছে, সেরূপ সুযোগ্য প্রভুর আশ্রয় গ্রহণপূর্বক জীবিকা অর্জন করা উচিত। নির্দয় ও ধনহীন প্রভুর সেবায় লাভের আশা থাকে না, কেবল ক্লেশ ভোগ মাত্র। সদয় প্রভুর যদিও দৈববশত ধন না থাকে, সুলভ দয়ার দ্বারা প্রীত হওয়া যায়। দয়া হৃদয়ের পরদুঃখ হানির ইচ্ছা না সাত্ত্বিক বৃত্তি। ইহা শান্ত হৃদয়ে নিঃস্বার্থেভাবে উদয় হয়। ৭০।
অনুবাদ : যে ব্যক্তি লোভপরায়ণ লোকের সেবা করে, সে অগ্নির আশায় জোনাকি শ্লোকাকে উদ্দীপিত করে। ৭১।
মর্মার্থ : পূর্বসূত্রে বলা হয়েছে, শক্তিমান ও সদয় প্রভুর আশ্রয় গ্রহণ করবে। এই সূত্রে তারই উদাহরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, শক্তিহীন লোভপর ব্যক্তির আশ্রিত হলে সে অগ্নি লাভের আশায় খদ্যোতকে উদ্দীপিত করে, অর্থাৎ অযোগ্য পাত্রের সেবায় তাকে নিষ্ফল কার্য হতে হয়, অতএব অভীষ্টদানে সমর্থ পাত্রেরই সেবা করবে। ৭১।
বিশেষজ্ঞং স্বামিনমাশ্রয়েৎ ॥ ৭২ ॥
স্ত্রীণামমৈথুনং জরা ॥ ৭৩ ॥
পুরুষস্য শৈমথুনম্ ॥ ৭৪ ॥
ন নীচোত্তময়য়ার্বিবাহঃ ॥ ৭৫ ॥
অনুবাদ : হিতেচ্ছু ব্যক্তি প্রাজ্ঞ স্বামীকে আশ্রয় করবে। ৭২।
মর্মার্থ : দূরদর্শী বিবেকসম্পন্ন প্রভুকে আশ্রয় করলে কার্য সাফল্য ও সুখভোগ অনিবার্য। অতএব গুণবান মহপ্রভুরই আশ্রয় গ্রহণ করবে। তাতে অর্থ লাভ না হলে সুখ, সম্মান অবশ্যম্ভাবী। ৭২।
অনুবাদ : স্ত্রীলোকের অমৈথুন জরা। ৭৩।
মর্মার্থ : যুবতী রমণীর অমৈথুনই জরার হেতু করে থাকে, কিন্তু কাম চরিতার্থের প্রবৃত্তি না থাকলে তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যৌবনসুলভ কাম প্রবৃত্তি তারুণ্যাবস্থায় বিকাশ প্রাপ্ত হয়। কিন্তু বার্ধক্যে বা শৈশবে তা হয় না; তখন অসঙ্গম জরার হেতুও হয় না। বৃদ্ধজনোচিত অঙ্গ শৈথিল্য ও দৌর্বল্য জরার লক্ষণ। কিন্তু মতান্তরে নিয়মিত সংযম পালনই সকলের পক্ষে স্বাস্থ্য বৃদ্ধি ও জরা নাশের হেতু। এই বিষয় কামসূত্র, পঞ্চসায়ক, কুমারতন্ত্র প্রভৃতিতে বিশেষ বর্ণিত আছে। নীতিশাস্ত্রে তা বিশেষ প্রপঞ্চিত করা নিষ্প্রয়োজন। ৭৩।
অনুবাদ : পুরুষের মৈথুনই জরার হেতু। ৭৪।
মর্মার্থ : মৈথুন ব্যাপারে প্রকৃতিভেদে স্ত্রী অপেক্ষা পুরুষের অধিক শক্তিক্ষয় হয় বলে সূত্রাকার, পুরুষের পক্ষে তা নিষেধ করেছে। শক্তিক্ষয় হতে সঞ্চয় শক্তি বৃদ্ধিও দীর্ঘজীবী হওয়ার কারণ। কামশাস্ত্রে এবং চরক সংহিতা প্রভৃতি চিকিত্সাশাস্ত্রে এই বিষয় বিস্তৃতভাবে বর্ণিত আছে। ৭৪।
অনুবাদ : নীচ ব্যক্তির সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির বিবাহ (সম্বন্ধ) শোভন নয়। ৭৫।
মর্মার্থ : সমান ব্যক্তিদ্বয়ের বিবাহ সম্বন্ধ ও বিবাদ শোভা পায়। অসমান ব্যক্তিদ্বয়ের বিবাহাদি শুভ ও সুখজনক নয়। যেমন দুগ্ধের সঙ্গে মলিন জলের মিলন দুগ্ধত্বের হানিকারক। এই নিমিত্তশাস্ত্রে বিবাহ বিষয়ে জাতি, ধর্ম, বয়স, আচরণ, গুণ প্রভৃতির বিচার বর্ণিত আছে। ৭৫।
অগম্যাগমনাদায়ুর্ষশঃ পুণ্যানি ক্ষীয়ন্তে ॥ ৭৬ ॥
নাস্ত্যহঙ্কার সমঃ শত্রুঃ ॥ ৭৭ ॥
সংসদি শত্ৰুং ন পরিক্রোশেৎ ॥ ৭৮ ॥
শত্রু-ব্যসনং শ্রবণ-সুখম্ ॥ ৯ ॥
অনুবাদ : অগম্যা গমনে পুরুষের আয়ু, যশ, পুণ্য ক্ষয় হয়। ৭৬।
মর্মার্থ : অগম্যা শাস্ত্র-নিষিদ্ধা স্ত্রী গমন করলে মানবের আয়ু, যশ, পুণ্য, মেধা স্মৃতি বিনাশপ্রাপ্ত হয়, ইহা সূক্ষ্মাদর্শী ঋষিগণের উপদেশ। অগম্যা স্ত্রী ব্রাহ্মণের শূদ্ৰপত্নী, শূদ্রের বিপ্রপত্নী। গুরুপত্নী, রাজপত্নী, সপত্নী-মাতা, জননী, কন্যা, পুত্রবধূ, শাশুড়ি, গর্ভবতী ভগিনীসতী, ভ্রাতৃবধূ, ভগিনী, ভ্রাতৃকন্যা, শিষ্যা, শিষ্যস্ত্রী, ভাগিনেয়-বধূ ভ্রাতৃপুত্র স্ত্রী, এই সকল স্ত্রী অগম্যা বলে ব্ৰহ্ম বৈবর্তপুরণে প্রকৃতি খণ্ডে এবং স্মৃতিশাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। ৭৬।
অনুবাদ : মানুষের অহংকারের সমান শত্রু নেই। ৭৭।
মর্মার্থ : অভিমান, গর্ব, অহংকার এক পযায়ভুক্ত। অভিমান বর্ধিত হলে ক্রোধের উদ্রেক হয়, ক্রুদ্ধ ব্যক্তি নিজের ও পরের অনিষ্ট সাধন করে। গর্বিত লোককে লোকে সমাদর করে না। অভিমানশূন্য ব্যক্তি সমাজে ‘অমায়িক বলে সকলের প্রতিপাত্র হয়। শত্রু বাইরের থেকে অহিত সাধন করে, অহংকাররূপ শত্রু শরীর মধ্যস্থ হয়ে অহিত করে। অহংকার-অন্তঃকরণে রজোগুণ উদ্রেকের পরিণামবিশেষ। ৭৭।
অনুবাদ : সভায় শত্রুর আক্রোশ বৃদ্ধিজনক কার্য করবে না। ৭৮।
মর্মার্থ : হিত সাধনের জন্য সুধীগণ সভায় সমবেত। তাতে সকলের পক্ষে সৌজন্য শিষ্টাচার পালিত হওয়া উচিত। শত্ৰু উপস্থিত থাকলেও তার আক্রোশ বৃদ্ধি করবে না। তাতে সভার কার্যহানি এবং নিজের ভবিষ্যতে অনিষ্টের পথ প্রসারিত হয়। সভা সমবেতভাবে হিত সাধন, সৎ শিক্ষা এবং সদুপদেশ লাভের স্থান। তাতে রাগ, হিংসা অনিষ্টজনক। ৭৮।
অনুবাদ : স্বভাবত মানুষের বন্ধুজনের শুভ সংবাদ, শত্রুজনের দুঃখবার্তা শ্রুতি সুখকর ও প্রীতিজনক হয়। এর বিপরীত বিষয় সকল সময়ে দুঃখপ্রদ হয়ে থাকে। যার সংসারে প্রবৃদ্ধির পথে বিচরণ করে, তাদের পক্ষেই এই নীতি উপদেশ। নিবৃতিবাদীদের কথা ইহার সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা শত্রু মিত্র উভয় পক্ষে উদাসীন। যেখানে সুখ বড়, সেখানে সুখের পশ্চাতে দুঃখও অতি মহৎ। ৭৯।
ইতি তৃতীয় অধ্যায়।