চট্টগ্রাম বন্দর। শনিবার সকাল আটটা। এখান থেকেই টেকনাফের স্টীমার ছাড়বে। ঐ দিনটির কথা এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা।
স্টীমার ছাড়বে বেলা নটায় কিন্তু রাখালদা ভোর চারটের সময় উঠে সোরগোল করে সবাইকে উঠিয়েছেন। ঠাকুরকে দিয়ে তিন-চার ভাগে রান্না করিয়েছেন এবং খাওয়ার কোনো রকম ইচ্ছা না থাকলেও জোর করে আমাকে খাইয়ে সদলবলে জেটিতে এনে হাজির করেছেন।
কপট অভিমান করে বললাম–তোমরা আমায় বিদেয় করতে পারলেই বুঝি বাঁচো রাখালদা?
একটু চুপ করে থেকে রাখালদা জবাব দিলেন–সত্যিই ভাই। এখানে থাকলে তুমি একটা বিপদের মধ্যে পড়তে ধীরাজ। মুলা ভয়ানক চটে আছে। ছুতোয়-নাতায় একদিন না একদিন একটা পানিশমেন্ট দিয়ে দিতোই। ওপরওয়ালা তুই না থাকলে নিরাপদে কি চাকরি করা যায় ভাই? তার চেয়ে এ তোমার ভালোই হয়েছে জেনো। মনে করো হাওয়া বদলাতে চেঞ্জে যাচ্ছো নয় তো এ্যাডভেঞ্চারও মনে করতে পারে।
এতো দুঃখের মধ্যেও না হেসে পারলাম না। বললাম সেখানেও যদি এ রকম একটা এ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ি রাখালদা? তাহলে সেখান থেকে পালিয়ে কোথায় যাবো বলতে পারো? সে দ্বীপ থেকে তো পালাবার পথও নেই।
রাখালদা কিছু বলবার আগেই হঠাৎ দেখি বেশ ভিড় জমে উঠেছে জেটিতে। দু-তিনটে লোকাল ক্লাবের ছেলেরা এসেছে আমায় বিদায় দিতে। বোঝা গেল আমার ভাগ্য বিপর্যয়ের সংবাদ চট্টগ্রামের মতো ছোট্ট শহরে আর কারও জানতে বাকি নেই। কিছু পরেই দেখি, খাতা পেন্সিল হাতে অনেকগুলো স্কুলের ছেলেও এসেছে, অভিভূত হয়ে গেলাম। এমনি সময়ে একখানা মোটরে হেমদা কোতোয়ালির দলবল নিয়ে হাজির। গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের ভিড় দেখে হেমদ প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেন। তারপর বললেন–না, মুলাও ঠিক কথাই বলেছে। এই ক’দিনে তুমি যে রকম পপুলার হয়ে উঠেছে, তাতে এখানে তোমাকে রাখলে কাজকর্ম তুমি কিছুই করতে না। খালি প্রেম করে আর আড্ডা দিয়ে বেড়াতে।
আগেই বলেছি, হেমার মুখটা একটু বেশি রকম আলগা। লজ্জা পেয়ে শুধু বললাম–যাঃ, কি হচ্ছে হেমদা। বড় বড় অফিসার রয়েছেন, তাছাড়া স্কুলের ছেলেরাও রয়েছে।
সদানন্দবাবু এই সময় ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন–আমি খুব খুশি হয়েছি ধীরাজ। আমি এখনও বলছি, এর জন্য কোনো দিন তোমায় অনুতাপ করতে হবে না।
হেমদা বললে–বহুদিনের মধ্যে জাহাজঘাটে এতো ভিড় আর দেখেছেন স্যার? এ যেন কোন রাজা-মহারাজাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে সবাই এসেছি। বলেই প্রকাণ্ড এক চড় আমার পিঠে কষিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন হেমা।
রাখালদা বললে–চলো, একটু সময় থাকতে থাকতে জাহাজে ওঠা যাক। নইলে জায়গা পাওয়া মুশকিল হবে।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। প্রকাণ্ড ডেকের উপর তিল ধারণের স্থান নেই। বিচিত্র পোশাকে অগুন্তি নরনারী এক দুর্বোধ্য ভাষায় কিচিরমিচির করছে আর একটা উৎকট পচা গন্ধ সমস্ত ডেক মশগুল করে রেখেছে।
নাকে রুমাল দিয়ে রাখালদাকে বললাম–শিগগীর এখান থেকে কেবিনে চলুন রাখালদা, আমার বমি আসছে।
পাশ থেকে হেমদা উচ্চৈঃস্বরে হেসে বললেন–কেবিন? এ জাহাজে ওসব কিছু নেই ভায়া! সবেধন নীলমনি এই ডেক। আর গন্ধ? ও তো শুঁটকির গন্ধ! এই জাহাজে করে শুঁটকি মাছ চালান যায় আর আসে।
হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে রাখালদা বললেন–ভয় পাচ্ছে। কেন ভাই? এদেশে বলে, শুঁটকি মাছের গন্ধ খুব স্বাস্থ্যকর। দু’দিন বাদেই সব সয়ে যাবে।
আমার বেডিং আর সুটকেশটা নিয়ে রাখালদা ডেকের মাঝখানে একটা বড় চিমনির পাশে রাখলে। তারপর হেমদার। দিকে ফিরে বললেন–হেম, একটা দড়ি চাই যে।
হেমদা কিছু দূরে গিয়ে একটা কনস্টেবলকে চুপি চুপি কি বলতেই একটু বাদে দেখি জাহাজের ইঞ্জিনরুমের দিক থেকে কালি-কুলি-মাখা একটা লোক খানিকটা দড়ি হাতে করে এনে দিলে। হেমা চট্টগ্রামের ভাষায় তাকে বললেন–বাবু আমাদের নিজের মোক। দেখবে, কোনো কষ্ট যেন না হয়। সেলাম করে সে চলে গেল।
রাখালদা দড়ি নিয়ে সুটকেসটা চিমনির সঙ্গে তখনই বেঁধে ফেলেছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম–ওটাকে বাঁধছো কেন রাখালদা?
কোনো জবাব না দিয়ে রাখালদা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে হেমার দিকে চাইলে। হেমদা আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন–এর আগে কখনো সমুদ্রযাত্রা করেনি তো তাই অবাক হচ্ছে। দেখবে, জাহাজ যখন মাঝ-সমুদ্রে পড়বে তখন মোচার খোলার মতো দুলবে। তাছাড়া বড় বড় ঢেউ হঠাৎ হয়তো ডেকের উপর দিয়েই চলে গেল। ঢেউ চলে গেলে দেখবে তোমার স্যুটকেস বেডিং সব সেই সঙ্গে চলে গিয়েছে। এইজন্যই বেঁধে রাখা, বুঝলে?
বুঝলাম। কিন্তু কি জবাব দেবে? এর মধ্যে হেমদা আরও দু’ তিনজন জাহাজের কর্মচারিকে আমার কথা বলে দিলেন। জাহাজ ছাড়ার ঘণ্টা পড়লো, শুরু হলো বিদায়ের পালা। হেমদ, রাখালদা, আমার আর আর সব পরিচিত অপরিচিত সবাই এগিয়ে এল। কারো মুখে হাসি নেই, শুধু আমি হাসিমুখে সবাইকে ধন্যবাদ জানালাম। চেষ্টা করলেও তখন কথা কইতে পারতাম না।
একে-একে সবাই নেমে গেল। খালাসীরা কাঠের সিঁড়ি তুলে নিতেই ডেকের ধারে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। একটু একটু করে জাহাজ জেটি ছেড়ে এগুতে লাগলো।
চৈত্র মাসের প্রচণ্ড রোদ বঙ্গোপসাগরের উন্মাদ নোনা ঢেউ-এর সঙ্গে মাতামাতি শুরু করে দিলে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখ ঝলসে যায়; তবু চেয়ে থাকি। তখনও দেখতে পাচ্ছি, হাত তুলে হেমা চিৎকার করে কি যেন বলছেন, কিন্তু প্রচণ্ড হাওয়া সে কথাগুলোকে উল্টো দিকে চালান করে দিচ্ছে, এক বর্ণও শুনতে পেলাম না।
ঐ তো একপাশে রাখালদা, রমেশ, যতীন, ব্যানার্জি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আর ঐ তো ছেলের দল হাত তুলে খাতা নাড়ছে, ঐ তো…
আর দেখতে পাচ্ছি না, চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে আবার জোর করে তাকাই, শুধু দেখা যায় তীররেখা অস্পষ্ট ধোঁয়ায় ঘেরা।
কতোক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। চমক ভাঙতে দেখি চারদিকে শুধু জল আর জল, উপরে অসীম অনন্ত নীলাকাশ। ছোট মোচার খোলর মত আমাদের স্টীমারখানা পাগলা ঢেউ-এর অনুকম্পা ভিক্ষা করে মাথা খুঁড়তে খুড়তে একটু একটু করে এগোচ্ছে।
এইবার মনে হলো সত্যিই অকূলে ভাসলাম। স্টীমার মাঝ-সমুদ্রে ভীষণ দুলছিলো। টলতে টলতে কোনোমতে এসে বাঁধা সুটকেসটার উপর থেকে বেডিংটাকে তুলে নিয়ে অতি কষ্টে ডেকের উপর পেতেই মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে হঠাৎ পাঁচ বছরের অসহায় শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম।
***
পরদিন বেলা আন্দাজ এগারোটায় স্টীমার কক্সবাজার পৌঁছলো। কক্সবাজার চট্টগ্রামের একটি প্রসিদ্ধ স্বাস্থ্যকর স্থান। দূর-দূরান্ত থেকে হৃতস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য লোকে এখানে আসতো–বিশেষ করে টি-বি. রুগীর দল। অনেক যাত্রীই এখানে নেমে গেল, আমি স্টীমারেই রেলিং ধরে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখে নিতে লাগলাম। মনের অবস্থা তখন অনেকটা শান্ত-খানিকটা বেপরোয়া ভাব। হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাত্রে কিছুই খাওয়া হয়নি এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা উদগ্র খিদের জ্বালা আমাকে অস্থির করে তুললো। তাড়াতাড়ি করে মাথাটা দু’তিন মগ জল দিয়ে বেশ করে ধুয়ে ডেকের শেষপ্রান্তে বাবুর্চিখানায় গিয়ে হাজির হলাম।
ঘরটা অন্ধকার, হঠাৎ বাইরে থেকে গেলে ভিতরের কিছুই দেখা যায় না। ভাবছি ভিতরে ঢুকবো, না, এখান থেকেই কাউকে ডাকবেহঠাৎ কানে এল–সেলাম-সাব। চেয়ে দেখি মিশমিশে কালো প্রায় সাড়ে ছ’ফুট এক মূর্তি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তার সমস্ত মুখটা কালো দাড়িতে চাকা, খালি গা, পরনে চৌকো ঘর-কাটা নানা রঙের বিচিত্র লুঙ্গি, আনকোরা নতুন বলেই মনে হলো। মাথায় তেল কুচকুচে নোংরা এক টুকরো কাপড় বাঁধা, বোধ হয় আগে রুমাল বা ঝাড়ন ছিলো। হাতে প্রকাণ্ড ধারালো একটা ছুরি, তাতে টাটকা রক্ত লেগে রয়েছে। বেশ ভড়কে গেলাম। মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা বলবার জন্য ইতস্তত করছি, এমন সময় সেই দাড়ির জঙ্গল নড়ে উঠলো, তার ভিতরে দেখলাম সাদা ধবধবে দু’পাটি দাঁত। এতোক্ষণে খানিকটা ভরসা পেলাম। নিঃশব্দে হেসে আবার সেলাম করে সে চট্টগ্রামের বাঙলায় যা বলে গেল, তার মানে হচ্ছে–কোতোয়ালির বড়বাবু তাকে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন যে, সাহেব এই প্রথম সমুদ্র যাত্রা করছেন। যাতে কোনো কষ্ট না হয়, সব সময় সেদিকে নজর রাখতে। গত রাতে সে দু’বার সাহেবকে খাবার জন্যে ডেকেছে, কিন্তু সাহেবের মন খারাপ, কান্নাকাটি করছেন দেখে সে প্রথমবার ফিরে এসেছে। অনেক রাত্রে আবার ডেকেছে, কিন্তু সাহেব বলে দিয়েছেন খিদে নেই। সুতরাং বান্দা আবদুলের কনুর মাফ হুজুর নিশ্চয়ই করেছেন।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। শুধু একটা কথা কাঁটার মতো বিধতে লাগলো যে, ও আমার কান্নাকাটির কথাটা একগাল হাসিমুখ নিয়ে কেন বললো। বেশ বুঝতে পারলাম, যে ক’দিন স্টীমারে থাকবে সে ক’দিন মুখে হুজুর হুজুর করলেও মনে মনে আবদুল আমাকে একটা অসহায় জীব ছাড়া কিছুই মনে করবে না। বললাম–খুবু খিদে পেয়েছে। রান্নার কতো দেরি আবদুল?
বিস্ময়ে চোখ দুটো কপালে তুলে আবদুল বললে–রান্না? এখন কি হুজুর, এই তো সবে মুরগী জবাই করে উঠলাম।
প্রকাণ্ড ছুরিটার দিকে চোখ পড়লো। কি এক অজানা ভয়ে শিউরে উঠলাম। ভাবলাম, আবদুল যদি হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে মুরগী মনে করে আমার গলাটা কেটে মাংসের ডেকচির মধ্যে ফেলে দেয়? ঐ বিকটাকার দৈত্যের পাশে নিজেকে অসহায় ক্ষুদ্র একটা শিকার ছাড়া জোর করেও আর কিছু মনে করতে পায়ছিলাম না। চমক ভাগুলো আবহুলের কথায়। রান্নাঘরের ভিতর থেকে একটা টুল এনে বললেন হুজুর। মিনিট তিনেক বাদে একটা প্লেটে ডবল ডিমের অমূলেট আর প্রকাণ্ড দু’ শ্লাইস রুটি এনে দিলে। খেয়ে বাঁচলুম। প্লেটটা নিতে এসে আবদুল বললে–আপনি ততক্ষণ ডেকে পায়চারি করুন হুজুর, আমি চা করে নিয়ে আসছি।
ডেকের উপর পায়চারি করতে করতে দেখলাম আমার সহযাত্রীরা বেশিরভাগ মগ। পরনে ময়লা রঙিন লুঙ্গি, গায়ে রঙিন ফতুয়া, মাথায় রঙিন রুমাল বা কাপড়ের টুকরো বাধা, মুখে বর্মা চুরুট। পুরুষ-নারী সবারই ঐ এক অবস্থা। তখন খাবার সময়, তাই এক একটি সংসার ছেলেপুলে নিয়ে গোল হয়ে খেতে বসেছে। যাত্রীদের সংখ্যা অনুমানে মনে হলো প্রায় দু’ শ’র উপর হবে। পায়চারি করতে করতে কাছে গিয়ে দেখলাম বেশিরভাগই খাচ্ছে বাসি ভাত, মুরগীর মাংস, আর একটা কাগজের ঠোঙা থেকে হলদে একটা গুড়ো। পরে জেনেছিলাম, সেটা শুঁটকি মাছের গুড়ো। আমার তো গন্ধে বমি আসবার অবস্থা; কিন্তু ওরা পরমানন্দে তাই খাচ্ছে। সমস্ত ডেকের উপর থেকে একটা বিচিত্র গুঞ্জন ভেসে আসছে–চিং লুং মিং চু, রিমিহি, লং ফু–যার এক বর্ণও বুঝতে পারলাম না, শুধু বুঝলাম ঐটিই ওদের ভাষা। এই বিচিত্র পরিবেশের মধ্যে আর কতোক্ষণ কাটতো বলতে পারি না, যদি না আবদুল এসে বলতো-খানা তৈরি হুজুর।
ঐ নোংরা স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরের একপাশে একটা টুলের উপর বসে আর একটা টুলকে টেবিল করে কলাই-করা থালায় মুরগীর ঝোল আর ভাত খেলাম। জীবনে বহু জায়গায় বহু ভালো ভালো রাধুনীর হাতে খেয়েছি; কিন্তু সেদিন বে অব বেঙ্গলের বুকে ছোট্ট একটা স্টীমারের একটা নোংরা ঘরে বসে যা খেয়েছিলাম, তার স্বাদ আজও আমার জিভে জড়িয়ে আছে, হয় তো চিরদিন থাকবে।
খাওয়া শেষ করে ডেকে এসে বেডিং-এর উপর বসে পড়লাম। ততোক্ষণে আমার মগ সহযাত্রীর দলও আহারাদি শেষ করে বিশ্রাম করছে। দূরে কক্সবাজারের দিকে তাকালাম। ঝাপসা ধোঁয়ায় ঢাকা, তটভূমি, প্রকাণ্ড ঢেউ দূর থেকে তাল ঠুকে এগোতে এগোতে শেষকালে তীরে গিয়ে আছাড় খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে লজ্জায় ফিরে আসছে, আবার যাচ্ছে আবার আসছে। ওদের ঐ অবিরাম আসা-যাওয়ার খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।
ঘুম ভাঙলে আবদুলের ডাকে। চেয়ে দেখি সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, এক কাপ চা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে আবদুল–আর কতো ঘুমোবেন হুজুর, দু’বার এসে ফিরে গিয়েছি।
লজ্জা পেলাম। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম–জাহাজ কখন ছাড়বে আবদুল?
–রাত ঠিক দশটায়।–বললে আবদুল।
স্টীমার ছাড়লো ক’টায় ঠিক বলতে পারবে না। আবার অকূলে ভাসলাম।
.
অনেক রাতে একটা বিকট কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি বে অব বেঙ্গলের মাঝখানে জাহাজ থেমে আছে, আর ডেকের উপর আমার মগ সহযাত্রীরা এক সঙ্গে কান্না শুরু করে দিয়েছে। সেই কান্নার মধ্যে একটি কথা বারবার করুণভাবে আমার কানে এসে ঘা দিচ্ছিলো-লুংচু উ-উ-উ-ব্যাপার কি? কাকেই বা জিজ্ঞাসা করি। কি এক দুর্বোধ্য ভাষায় ছেলে, বুড়ো, মেয়ে সবাই হাউমাউ করে কাঁদছে, আর একবার করে লংচু বলছে। হাসবো না কাদবো, বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-ওদিক ঘোরা-ফেরা করার পর এক-পা এক-পা করে এগিয়ে চললাম আমার অগতির গতি আবদুলের রান্নাঘরের দিকে। সেখানেও দেখলাম, বেশ জটলা চলছে। আবদুলকে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা যা শুনলাম, তা হলে এই আধ ঘণ্টা আগে একটা দমকা হাওয়ায় স্টীমারটা খুব দুলে ওঠে। সেই দোলানির সময় চার বছর বয়েসের একটি মগের ছেলে লংচু গড়িয়ে রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যায়। নিয়ম হচ্ছে, বেশ শক্ত দড়ি দিয়ে ছোট ছেলেমেয়ে আর বাক্স-বিছানা বেঁধে রাখা। ওরা সে নিয়ম মানেনি, তাই এই বিপর্যয়।
রাখালদার কথা মনে পড়লো। স্টীমারে উঠেই দড়ির খোঁজ কেন করেছিলেন, এইবার বুঝলাম। স্টীমার কেন থামানো হলো জানতে চাইলাম। একটু ম্লান হেসে আবদুল বললে–ওটা হুজুর ওর মা-বাপকে শুধু একটু সান্ত্বনা দেওয়া। ওদের ধারণা জাহাজ থামলেই লুংচুকে ওরা ঢেউ-এর মাথা থেকে ছিনিয়ে নেবে।
মিনিট দশেক পরে হুইসল দিয়ে স্টীমার ছেড়ে দিলে। আস্তে আস্তে গিয়ে বেডিংটার উপর বসলাম। দেখলাম, লুংচু’র মাকে তিন-চার জন স্ত্রী-পুরুষ ধরে বসে আছে। এক অদ্ভুত ভাষায় সবাই এক সঙ্গে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আর হতভাগিনী মা জলভরা চোখে বঙ্গোপসাগরের নিষ্ঠুর ঢেউগুলোর দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আজ আত্মীয়স্বজনবিহীন অকূল সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা স্টীমারে বসে এই কথাটাই বার বার মনে হচ্ছিলো–ভাষা যার যতো দুর্বোধ্যই হোক, সন্তানের বিয়োগ-ব্যথা প্রকাশের ভাষা সব দেশের মায়েদের এক এবং ওটা বুঝতে এতোটুকুও কষ্ট হয় না। হঠাৎ আমার মায়ের কথা মনে পড়লো। অজান্তে চোখ ঝাপসা হয়ে এল, ঝাপসা চোখে মরা চাঁদের আবছা আলোয় দেখলাম যেখানে লুংচু’র মা বসেছিলেন সেখানে বসে আছেন আমার মা; মুখের ভাব হুবহু এক। মনে হলো লুংচু নয়, ঐ রেলিং-এর ফঁক দিয়ে আমিই পড়ে গিয়েছি বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলে।
***
পরদিন বেলা এগারোটার সময় স্টীমার থামলো। বুঝলাম গন্তব্যস্থানে এসে গিয়েছি। ডেকের ধারে রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। দূরে অস্পষ্ট তীর-রেখা দেখা যায়। স্টীমারের ডান দিক থেকে একটা নদী বেরিয়ে গিয়েছে, তার নাম নাফ। একটু বাদে দেখি অনেকগুলো ছোট ছোট নৌকো স্টীমারের দিকে এগিয়ে আসছে নদীর মাঝপথ দিয়ে। ঢেউ নেই, উচ্ছ্বাস নেই, অদ্ভুত নদী। নৌকোগুলো একে একে এসে স্টীমারের পাশে ভিড়লো। দড়ির সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সহযাত্ৰীর দল পোটলা-পুটলি নিয়ে নামতে শুরু করলো। কি করবো না করবো ভাবছি, হঠাৎ নজর পড়লো একটা নৌকোর উপর দু’জন কনস্টেবলের পোশাক-পরা লোক কাকে যেন খুঁজছে। আমার দিকে নজর পড়তেই চট্টগ্রামের বাঙলায় জিজ্ঞাসা করলো–থানায় যাবেন কি কর্তা?
ঘাড় নেড়ে জানালাম–হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে অন্য নৌকো সরিয়ে দিয়ে দড়ির সিঁড়ির পাশে নৌকো ভিড়িয়ে একজন বাদুড়ের মতো ঐ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। যথারীতি স্যালুট করে বললে– স্টীমার আজ অনেক লেট করেছে হুজুর। আমরা প্রায় দু’তিন ঘণ্টা নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছি। আপনার জিনিসপত্তোরগুলো কোথায়?
দেখিয়ে দিতেই সে চটপট করে সেগুলো বাঁধাছাদা করে কাঁধে তুলে নিলে। আমি আস্তে আস্তে দড়ির সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি অপর কনস্টেবলটি দু’হাতে সিঁড়িটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে আমার মামতে অসুবিধা না হয়। কোনোরকমে সিঁড়ি বেয়ে নৌকোয় নামলাম, নৌকো ছেড়ে দিলো। খানিকদূর এগিয়ে এসে স্টীমারটার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখি, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিরাটাকার আবদুল, মুখে সেই হাসি। আমার সঙ্গে চোখোঁচাখি হতেই একটা হাত কপালে ঠেকিয়ে চিৎকার করে বললে–সেলাম হুজুর।
আশ্চর্য! আবদুলের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। এই হয়। দীর্ঘ স্টীমার-যাত্ৰায় ঐ আবদুলই ছিলো আমার একমাত্র সহায় বন্ধু এবং কথা কইবার লোক। অথচ নামবার আগে তার সঙ্গে দেখা করে আসবার কথাটাও মনে হয়নি। প্ৰতিনমস্কার করে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আমাদের নৌকো ততক্ষণে সমুদ্র ছেড়ে শান্ত নাফ নদীর মাঝখান দিয়ে চলেছে। সঙ্গী কনস্টেবল দু’জনের সঙ্গে আলাপ জমালাম। ওদের মধ্যে একজন হচ্ছে মগ, নাম হরকিরাম বড়ুয়া। অপরজন বাঙালী, নাম রমেশ দত্ত, চট্টগ্রামেই বাড়ি।
রমেশকে জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, সমুদ্র থেকে বেরিয়েও এই নদীটা এতো শান্ত মরা নদীর মতো কেন?
রমেশ সভয়ে জিভ কেটে কান মলে আর্তস্বরে বলে উঠলো–অমন কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন না বাবু। এ নদী এমনি ঠাণ্ডা; কিন্তু সমুদ্রে একটু জোরে হাওয়া উঠলেই রুদ্র মূর্তি ধরে। তখন যদি কোনো নৌকো তীরের কাছাকাছি থাকে, তার আর রক্ষে নেই, আছড়ে ভেঙে চুরমার করে দেবে। এর নিচে সবটাই পাথর। দেখছেন না, সব নৌকো মাঝনদী দিয়ে চলেছে?
হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম, হে বাবা বা মা নাফ, অর্বাচীনের অনিচ্ছাকৃত অপরাধে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না। অন্ততঃ আমরা তীরে ওঠা পর্যন্ত তুমি একটু প্রসন্ন থেকো, দয়া করে আছাড়-টাছাড় মেরো না।
নিরাপদে তীরে উঠলাম। টেকনাফ অদ্ভুত দ্বীপ। লম্বা, মাইল দেড়েকের বেশি হবে না, চওড়া প্রায় এক মাইল। নাফ নদীর পুবদিকে হলো আকিয়াব, আর পশ্চিমদিকে টেকনাফ। একদিকে আরকান হিলস, অপরদিকে চিটাগাং হিল্স, আর সমস্ত দ্বীপটাকে বেড়াজালে ঘিরে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।
ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছি। কিছুদূর গিয়েই বিস্ময়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এখানকার ঘরবাড়ির চেহারা। একেবারে ঝকঝকে তকতকে নতুন, যেন কাল কি আজ তৈরি হয়েছে। বাঁশের খুঁটি, বাঁশের বেড়া আর চালাটা তাল বা নারকেলের পাতার মতো পাতা দিয়ে ছাওয়া। দু’-একখানা টিনের চালাও নজরে পড়ে, তবে খুবই কম। রমেশকে প্রশ্ন করতেই একটু হেসে বললে–আগে চলুন থানায়, পরে সব শুনবেন।
থানায় এসেও দেখি সেই একই অবস্থা,-নতুনের হাট বসে গিয়েছে। থানা নতুন, অফিসার-ইন-চার্জ মহেন্দ্র বড়য়ার কোয়ার্টার্স নতুন, আমার কোয়ার্টার্সও নতুন। একখানা পুরানো তাপোশ এক পাশে পাতা আছে, আর কিছুই নেই। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোতেই ছোট্ট একটা দাওয়া, তারপর ছোট্ট একফালি উঠোন। সেই উঠোনের শেষদিকে আরো ছোট একটা ঘর বা ঝুপড়ি, বুঝলাম রান্নাঘর। উঠোনের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা মাচা, চারিদিকে ঘেরা। বুঝলাম পায়খানা। মোটামুটি এই হলো আমার বাড়ি বা কোয়ার্টার্স। তক্তাপোশের উপর জিনিসপত্তোর রেখে থানা ঘরের দিকে রওনা হলাম। বড় দারোগা মহেন্দ্রবাবু বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। পাশের চেয়ারে আর একজন বসে আছেন, সামনের বেঞ্চিতে তিন-চারজন কনেস্টবলও হাজির।
ঘরে ঢুকে নমস্কার জানাতেই প্রতিনমস্কার জানিয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন–বসুন ধীরাজবাবু। পথে খুব কষ্ট পেয়েছেন তো? পাবারই কথা, এ সময়টা সমুদ্র খুব রাফ। প্রাণ নিয়ে যে পৌঁছতে পেরেছেন, এই ঢের।
চুপ করে রইলাম। মহেন্দ্রবাবু রমেশকে ডেকে পাঠালেন। একটু পরে এক কাপ চা ও একটা প্লেটে ডবল ডিমের অমলেট নিয়ে ঘরে ঢুকলো রমেশ।
মহেন্দ্রবাবু বললেন–রমেশ, সতীশকে বলে দাও আজ এবেলা ধীরাজবাবু আমার এখানেই খাবেন। রাত থেকে তুমি সব ব্যবস্থা করে দিও।
অমলেট খেতে খেতে হঠাৎ গলায় আটকে গেল মহেন্দ্রবাবুর পরের কথা শুনে। রান্নাটান্না নিজেই করবেন তো?
তাড়াতাড়ি খানিকটা চা গিলে অমলেটটা গলা থেকে নামিয়ে আমতা আমতা করে বললাম–আজ্ঞে রান্না? মানে নিজে
মহেন্দ্রবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন–হুঁ! বুঝেছি, রাঁধতে জানেন না। তাহলে একজন কনস্টেবলকে দিয়ে বাঁধাতে হবে, তাতে খরচ একটু বেশিই হবে–
বললাম–তা হোক। কত দিতে হবে?
অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন—কিছুই না, শুধু দু বেলা খেতে দিতে হবে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ঠিক হলো রমেশই আমার রান্নাটান্ন সব করে দেবে।
বেলা অনেক হয়ে গিয়েছে দেখে মহেন্দ্রবাবু বললেন–যান আপনি কাপড় চোপড় ছেড়ে মুখ হাত ধুয়ে আসুন, রান্না হয়ে গিয়েছে।
উঠতে যাচ্ছিলাম। বললাম–একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো স্যার?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহেন্দ্রবাবু আমার দিকে তাকালেন।
বললাম–পথে আসতে আসতে দেখলাম বাজারে সবগুলো ঘরই নতুন। তারপর জেলেপাড়ায়, সেখানেও ঐ। থানায় এসে দেখছি সবই নতুন তৈরি। এর মানে কি?
একটু বিস্মিত হয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন–এসব না জেনেই এসেছেন টেকনাফে চাকরি করতে?
এসব জানার সঙ্গে টেকনাফের চাকরির কি সম্পর্ক বুঝতে না পেরে চুপ করেই রইলাম।
এবারে জবাব দিলেন পাশের ভদ্রলোকটি,–মানে হচ্ছে, রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে দিব্যি ঘুমিয়ে আছেন, সকালবেলায় দেখলেন আপনি মাঠে শুয়ে।
ঘর শুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। রাগ হলো লোকটির উপর। আমার সঙ্গে এখনো আলাপ পর্যন্ত হয়নি অথচ এরকম অভদ্র রসিকতা করতে ওর এতোটুকু সঙ্কোচ হলো না।
বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই ভদ্রলোক বললেন ভাবছেন, অকারণ রসিকতা করছে এ অভদ্র লোকটি কে? আমিও আপনার মতো একজন এ.এস.আই., নাম যতীন দাস। আমিও প্রথমে এখানে বদলি হয়ে এসে আপনার মতোই হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যাপারটা হলো এই–বঙ্গোপসাগরের পাড়েই এ দ্বীপটি। মাঝে মাঝে একটা হাওয়া সমুদ্র থেকে উঠে হঠাৎ যদি এ দ্বীপটির উপর দিয়ে বয়ে যায়, তাহলে এর বাড়িঘরের আর চিহ্নই থাকে না। আজ দিন কুড়ি হলো এইরকম একটি ঝোড়ো হাওয়া এই দ্বীপের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে বলেই আবার সব নতুন করে গড়তে হয়েছে। এবার বুঝলেন?
বুঝলাম। কি অদ্ভুত জায়গায় এসেছি রে বাবা। আমাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখে মহেন্দ্রবাবু বললেন–আর মন খারাপ করে কি হবে। যান হাতমুখ ধুয়ে আসুন, বেলা দুটো বেজে গিয়েছে।
***
পরদিন সকালে চা খেতে খেতে রমেশের কাছে টেকনাফ সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য অনেক কিছুই শুনলাম। বছরে মাত্র পাঁচ মাস চট্টগ্রাম থেকে এখানে স্টীমার চলাচল করে, তাও সপ্তাহে একদিন। বাকি সাত মাস বাইরের জগতের সঙ্গে এই ছোট্ট দ্বীপটির কোনও যোগাযোগ থাকে না। এর কারণ হচ্ছে শীতকাল থেকে কয়েক মাস সমুদ্র বেশ শান্ত থাকে। ঐ সময় স্টীমার নিরাপদে আসতে পারে। বাকি ছ’ মাস সমুদ্র ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, স্টীমার চলাচল একেবারেই বন্ধ। আমি যে স্টীমারে এলাম তার এ সময়ে আসার কথা ছিলো না, শুধু শুঁটকি মাছের চালান নেবার জন্য হঠাৎ এসে গিয়েছে। এখান থেকে কলকাতায় চিঠি যেতে লাগে বারো চৌদ্দ দিন, টেলিগ্রাম যায় সাত দিনে। এ দ্বীপের বাসিন্দারা সবাই মগ, শুধু বাজারে কয়েকটি চট্টগ্রামের বাঙালী আছে, তারাও প্রায় মগ হয়ে উঠেছে। জিনিসপত্রের দাম এখানে অসম্ভব সস্তা। টাকায় আঠারোটা মুরগী, একটা পাঁঠার দাম দু’ আনা। এক আনার মাছ কিনলে : থানা সুদ্ধ, ভরপেট খাইয়েও কিছু ফেলা যায়। শুনে প্রথমটা আজগুবি মনে হয়েছিলো কিন্তু পরে দেখলাম, রমেশ এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলেনি।
থানায় ঢুকে দেখি কেউ নেই, বড় টেবিলটার উপর কতকগুলো কাগজপতোর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। ওরই মধ্যে দেখলাম একখানা পনেরো দিন আগের দৈনিক বসুমতী, সেইটে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। একটু পরেই মহেন্দ্রবাবু এলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ছিপছিপে রোগা চেহারা, মুখে হিটলারী গোফ। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাতেই প্রতিনমস্কার করেই বললেন–বসুন।
বললাম–আমায় আপনি তুমি বলেই ডাকবেন স্যার। বুঝলাম খুশি হয়েছেন।
সমবেদনার, সুরে মহেন্দ্রবাবু বললেন–এতো জায়গা থাকতে তোমাকে এখানে বদলি করলো কেন বলতে পারে? তোমার মতো smart young ছেলের পক্ষে এখানে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। কাল রাত থেকে শুধু এই কথাটাই ভাবছি।
কোতোয়ালির পার্টি থেকে শুরু করে আমার এখানে আসার ইতিহাস সব পর পর বলে গেলাম, শুধু বাদ দিলাম মিসেস মুলাণ্ডের প্রসঙ্গ। সব শুনে খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন মহেন্দ্রবাবু। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, বড় সাহেব আমাদের বদরাগী আর খামখেয়ালি শুনেছি। কিন্তু এতোখানি একগুয়ে তা তো জানা ছিলো না।
দু’জনেই চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে আমি সেই থমথমে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে বললাম–থানার কাজ তো কিছুই জানা নেই। যদি দয়া করে আমাকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নেন
হো হো করে হেসে উঠলেন মহেন্দ্রবাবু। সে হাসি আর থামতেই চায় না। মনে মনে বিরক্ত হলাম। ভাবলাম, এর মধ্যে হাসির কথাটা কি হলো! একটু দম নিয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন থানার কাজ শিখতে তুমি এসেছে। টেকনাফ? আবার হাসি। এরই মধ্যে কখন যে যতীনবাবু এসে দাঁড়িয়েছেন দেখিনি। তিনিও অবাক হয়ে মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন।
–ব্যাপার কি স্যার? বললেন যতীনবাবু।
মহেন্দ্রবাবু সোজা হয়ে চেয়ারে বসে বললেন–শুনেছে যতীন, ধীরাজ থানার কাজ শিখতে টেকনাফ এসেছে।
ইচ্ছে হচ্ছিলো বলি–নয় তো কি ছুতোরের কাজ শিখতে? বললাম না, চুপ করেই রইলাম। ভাবলাম, এবার বোধ হয় হাসবার পালা যতীনের। যতীন কিন্তু হাসলে না; অনুকম্পা ভরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু বললো– বেচারা!
ক্ষেপে গেলাম। বললাম–এসব কি ব্যাপার, দয়া করে একটু খুলে বলবেন কি?
মহেন্দ্রবাবু বললেন–শোনো ধীরাজ, এখানে কাজকর্ম নেই বললেই হয়, আর কাজ থাকলেও আমরা তা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। ধর, ছোটো খাটো চুরি, ডাকাতি, মারপিট, এস কেস হাতে নিলে অনেক ফ্যাসাদ। কোর্ট হচ্ছে কক্সবাজারে। কাজেই মামলার দিন পড়লে চারদিন আগে হাঁটা পথে আসামী নিয়ে তোমাকে কক্সবাজার রওনা হতে হবে, কেননা, স্টীমার বন্ধ। অতি দুর্গম পথ, মাঝে তিন চারটে ছোট নদী, নৌকো করে পেরিয়ে দু’ তিনটে থানায় অতিথি হয়ে চতুর্থ দিনে আধমরা হয়ে কোর্টে হাজির হলে মামলার দিন পড়লে দশবারো দিন বাদে। সুতরাং আবার যাও, আবার ফিরে এসো, আবার দিন পড়লো এইভাবে মাস দুই হয়রানির পর তবে কেটার নিষ্পত্তি হলো। অবস্থাটা একবার ভেবে দেখো। তাই আমরা ঠিক করেছি, নেহাত খুন-খারাপি বা বড় কে ছাড়া ডাইরিতে এটিই করি না। একটা ভুয়ো কাগজে কেটা লিখে নিয়ে তারপর আপোসে মিটিয়ে ফেলবার ব্যবস্থা করি। তাতে আমাদেরও দু পয়সা হয় আর অনর্থক হয়রানির হাত থেকেও বাঁচা যায়। কাজেই বুঝে দেখো, কাজ এখানে কী থাকতে পারে। বরং কাজকর্ম জানা কোনো লোক এখানে এলে কাজ ভুলে যায়। কোনো ঝঞ্ঝাট নেই, খাও দাও ঘুমোও, ব্যস্।
অফিসার-ইন-চার্জ মহেন্দ্রবাবু দিব্যজ্ঞান দান করলেন। হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।
যতীনবাবু বললেন–শোনো ভাই, বয়সে তুমি অনেক ছোট, কাজেই তুমি বললাম বলে রাগ করে না। এই দ্বীপের বেশির ভাগ অধিবাসী হলো মগ। লেখাপড়া কিছুই জানে না। তার উপর ভয়ানক গরীব। কাজেই আইন-কানুন আমরা যা তৈরি করে দিই তাই মানতে হয়। বই-এ পড়া আইন এখানে চলে না।
এর পরে দু’জনে মিলে প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাকে তালিম দিলেন, যা পুলিশ লাইন কেন কোনো লাইনেই জীবনে শুনতে পাবো ভাবিনি। হঠাৎ দেখি, মহেন্দ্রবাবু টেবিল থেকে একটা ডেলি রিপোর্টের খাতা টেনে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে শুরু করে দিলেন। যতীনবাবুও একটা পুরানো খবরের কাগজ টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলে। ব্যাপার কি? অবাক হয়ে চারিদিকে বলে দিলেন, আমাদের আর একজন নতুন অফিসার এসেছেন, কিছু ‘বেশি না দিলে তদ্বিরের অসুবিধে হবে।
.
বিকেলের দিকে কনস্টেবল হকিকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বার হলাম। থানা ছাড়িয়ে উত্তর দিকের পথ ধরে একটু এগোলেই বাজার। ওখানকার বাঙালী দোকানদারদের সঙ্গে আলাপ হলো, সবাই বললে আমার মতে ছেলেমানুষ অফিসার নাকি এর আগে আর টেকনাফ থানায় আসেনি। একটু বসে গল্পগুজব করে পান সিগারেট খেয়ে উঠতে যাচ্ছি, হঠাৎ নজরে পড়লো একটা পুরানো হারমোনিয়াম একপাশে অযত্নে পড়ে আছে। দোকানদারকে অনুরোধ করলাম যদি অসুবিধা না হয় ওটা আমার কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে। দোকানি ধন্য হয়ে গেল। জানালে সন্ধ্যের পরই লোক দিয়ে ওটা সে আমার বাসায় পাঠিয়ে দেবে। চলতে শুরু করলাম। বাজার ছাড়িয়ে একটু দূরে দেখি একটা অদ্ভুত ঘর। আকারে গোল, মাটি থেকে সাড়ে ছ’ ফুট উঁচু, তার উপর পুরু তক্তা। মাটি থেকে আট দশটা মোটা শাল গাছের খুটি উপরের তক্তা ভেদ করে আরও প্রায় আট দশ ফুট উপরে উঠে গিয়েছে। তার উপরে পুরু খড় দিয়ে ছাওয়া। এক পাশে কাঠের একটা সিঁড়ি রয়েছে মাটি থেকে ওই তক্তায় উঠবার জন্যে। বুঝলাম ঐ তক্তাটাই ঘরের মেজে। তক্তার চারধারে মোটা কাঠের গুঁড়ি লাগানো, সেই গুঁড়ির উপর মাথা দিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে শুয়ে আছে বারো চৌদ্দটি যুবা মগের ছেলে। পরনে রঙিন লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া, মাথায় বিচিত্র বর্ণের কাপড়ের ফেটি বাঁধা, মুখে বর্মা চুরেট। অবাক হয়ে চারদিকে ঘুরে দেখতে লাগলাম। দেখলাম কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ পাশের যুবকটির সঙ্গে গল্প করছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম কেউ চোখ খুলে নেই, সবারই চোখ বন্ধ। এ যেন জ্যান্ত একটা গোলকধাঁধা! হরকির শরণাপন্ন হলাম।
হরকি বললে–এই ঘরটির নাম হলো ক্যাংঘর, এটা সাধারণের সম্পত্তি। এ দ্বীপে মদ আর তাড়ি একরকম বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। পাকা কলা পচিয়ে এরা ঘরেই মদ তৈরি করে, আর তাড়ি পয়সায় দু’তিন ভাড় পাওয়া যায়। ঐ মগ ছেলেগুলো সকাল থেকে মদ আর তাড়ি খেয়ে এই ক্যাংঘরে এসে বিশ্রাম করে। এদের আলোচনার মুখ্য বিষয় হলো পরনিন্দা আর স্ত্রীলোক ঘটিত ব্যাপার। মগদের মধ্যে ছেলেরা কোনো কাজই করে না, শুধু খেয়েদেয়ে, নেশা করে কাটিয়ে দেয়। যাবতীয় কাজ করতে হয় মেয়েদের। নদী থেকে মাছ ধরে সেই মাছ মাটিতে পুঁতে আর রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা, হাটে বাজারে কেনা-বেচা করা, রান্না করা, অবসর সময়ে রেশমি লুঙ্গি বোনা, তামাক থেকে বর্মা চুরোট তৈরি করা এসব কাজ তো আছেই, তাছাড়া আবার সময় মতো পতিদেবতাকে ক্যাংঘর থেকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দেওয়াও আছে।
মগের মুলুক কথাটা এতোদিন কানেই শুনে এসেছিলাম আজ স্বচক্ষে দেখে জীবন ধন্য হলো।
মগদের জীবনযাত্রার এই বিচিত্র কথা শুনতে শুনতে এক পা দু পা করে ঢুকে পড়লাম মগ পল্লীতে। পাতার ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট ঘর, ক্যাংঘরের মতো উঁচু মাচার উপর তার মেজে। তফাত শুধু ক্যাংঘরের চারদিক খোলা, আর এগুলো চেরা বাঁশ আর নারকেল বা সুপারি পাতার মতো একরকম পাতা দিয়ে ঘেরা। এক-একটি পরিবার ছেলেপুলে নিয়ে ঐ ছোট্ট একখানি ঘরে দিব্যি বাস করে। এরই মধ্যে রান্না, খাওয়া দাওয়া, হাত মুখ ধধাওয়া সব চলে। তক্তার ফাঁক দিয়ে জল এটো ভাত তরকারি সব পড়ে মাচার নিচে। তক্তা মুছে নিয়ে তার উপর বিছানা পাতে, শোবার ঘর হয়ে যায়। দেখলাম মাচার নিচে নোংরা আবর্জনা, পচা ভাত আর জল পড়ে পড়ে নরককুণ্ডু হয়ে গিয়েছে; ভাপসা দুর্গন্ধে কাছে যেতেও ঘেন্না করে।
মগ পল্লীতে আর একটা জিনিস পেলাম, একটা বিকট উগ্র দুর্গন্ধ যাতে পেট ঘুলিয়ে ওঠে, শুনলাম ওটা শুঁটকি মাছের গন্ধ। চেয়ে দেখি প্রায় প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে দূরে দূরে দুটো বাঁশের খুটিতে দড়ি বাঁধা। আর তাতে ঝোলানো রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় সমুদ্রের মাছ। হরকি বললে–বড় বড় মাছ সাধারণতঃ ওরা মাটিতে পুঁতে রাখে, তারপর রোদে শুকোয়। এটা হলো শুঁটকি মাছের সীজন। এসময় দ্বীপে কোনো অসুখ বিসুখ বড় একটা হয় না, শুঁটকি মাছের গন্ধ নাকি খুব স্বাস্থ্যকর। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। একটু এগিয়ে দেখি, সামনে একটা ছোট মাটির পাহাড়, নানা রকম গাছও আগাছায় ঢাকা। ওই মধ্যে দিয়ে একটা সরু পথ একে-বেঁকে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। হরকি বললে–ওপরে রয়েছে নানা কারুকার্য করা কাঠের একটি বৌদ্ধ মন্দির, মগেরা বলে জাদিমুরা।
স্থানমাহাত্ম্য কি না বলতে পারবো না মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। শুঁটকির বিকট গন্ধ নেই, দুর্বোধ্য মগি ভাষার কিচির-মিচির নেই, কেমন একটা শান্ত সমাহিত মৌনতা ছোট্ট পাহাড়টার চারপাশে ঘিরে রয়েছে।
হরকি বললে–উপরে উঠবেন?
বললাম–আজ থাক, সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। আর একদিন বেলাবেলি এসে দেখে যাবো।
থানায় ফিরতে রাত আটটা বাজলো।
রমেশ বললে–দু তিনজন বাঙালী বাবু আপনাকে খুজছিলেন। ওরা থানা ঘরে বসে বড় সাহেবের সঙ্গে গল্প করছেন।
ব্যাপার কি? এই সুদূর মগের মুল্লুকে আমার খোঁজে বাঙালী বাবু? তাও একজন নয় দু’জন নয় একেবারে তিনজন!
থানায় ঢুকতেই মহেন্দ্রবাবু বললেন–এই যে, এসো ধীরাজ, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এরা চিটাগং হিলস-এ থাকেন, নাম সুধীর দত্ত, অরুণ মুখার্জি আর ইনি নির্মল দাস।
চিটাগং হিল্স-এ মানুষের বসতি আছে জানা ছিলো না। তা ছাড়া এতো জায়গা থাকতে এরকম স্মার্ট যুবার দল চিটাগং হিলস-এ কেন আত্মগোপন করে আছে বুঝলাম না। তবে কি এরা খুনে, পলাতক আসামী? না স্বদেশী বিপ্লবী দলের কেউ? তাই বা কি করে সম্ভব! তাহলে বুক ফুলিয়ে এভাবে থানায় বসে গল্প করতে পারতো না। সন্দেহ, সংশয় ও কৌতূহল মনটাকে ঝাঁকানি দিচ্ছিলো, তবুও হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানালাম।
মিঃ মুখার্জি আমার মুখের অবস্থা দেখে বোধ হয় মনের ভাবটাও আঁচ করে নিয়েছিলেন। বললেন–আচ্ছা মহেন্দ্রবাবু, আপনি একজন ঝানু পুলিস অফিসার হয়ে এরকম ঠিকে ভুল করে বসলেন কেন বলুন তো? শুনুন ধীরাজবাবু, আমাদের পরিচয় রহস্যটা আমিই ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। আমরা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কাজ করি, কাজেই বনে-জঙ্গলে পাহাড়ে ছাড়া লোকালয়ে বাস ভাগ্যে ঘটে না। চিটাগং হিলস-এর গভীর জঙ্গলে বড় বড় শাল সেগুন মেহগনি গাছ আছে। সেগুলো কেটে চালান করা, মাটি কেটে চলাচলের পথ তৈরি করা ইত্যাদি আরো অনেক রকম কাজ আমাদের করতে হয়। এ নির্জন পাহাড়ের গভীর জঙ্গলের মধ্যে কাঠের বাংলো, আর একটি আর্দালি নিয়েই থাকি। প্রতিবেশী হলো বাঘ, ভালুক, হাতি, সাপ। অবস্থাটা একবার ভাবুন তো?
বললাম–সত্যি। আপনাদের দেখে হিংসে হয় না এটা ঠিক, দুঃখই হয়। তবু ওরই মধ্যে সান্ত্বনা যে, আপনারা তিন বন্ধু এক সঙ্গে থাকেন।
কথা শেষ হবার আগেই তিনজনে হো হো করে হেসে উঠলেন। মিঃ দাস বললেন–হ্যাঁ অদৃষ্ট! তা হলে তো বর্তে যেতাম মশাই। আমার বাংলো থেকে মুখার্জির বাংলো সাত আট মাইল দূরে আর দত্ত থাকে আরো দূরে। আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় চিৎ কখনো। তিন চার মাস অন্তর আমরা একবার করে কাজ উপলক্ষে বাইরে আসবার সুযোগ পাই দু’-একদিনের জন্যে। সেজন্যেই বেঁচে আছি, নইলে কবে পাগল হয়ে যেতাম।
মিঃ মুখার্জি বললেন–আর বাইরে এলেই আমরা টেকনাফ থানায় অতিথি হই। আজ এসে শুনলাম আপনার কথা। কলকাতা থেকে আসছেন শুনে আলাপের ইচ্ছেটা আরো প্রবল হয়ে উঠলো।
এই সব আলাপের মধ্যেই আমাদের পরিচয়টা আরো নিবিড় ও সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তাই সঙ্কোচ কাটিয়ে বললাম–আমিও আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে পেয়ে বেঁচে গেলাম মশাই। শহরেই মানুষ, এরকম নির্জনতার সঙ্গে কোনো দিন পরিচয় ছিলো না। আজ আমাদের এই অপ্রত্যাশিত পরিচয়টাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা ছোট্ট অনুরোধ করবো।-আজ রাতে আপনারা আমার অতিথি। উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম–আপনিও স্যার।
কারো সম্মতির অপেক্ষা না করেই ডাকলাম–রমেশ।
রমেশ এসে দাঁড়াতেই জজ সাহেবের ভঙ্গিতে যথাসাধ্য গম্ভীর হবার ভান করে অম্লান বদনে পাঁচটি নিরীহ মুরগীর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়ে বললাম–আজ রাত্রে এরা আমার অতিথি, সুতরাং ঘি-ভাত আর মুরগীর কারি।
খুশি মনে স্যালুট করে রমেশ চলে গেল। চেয়ারে বসে অতিথিদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার রায়ে জুরি অতিথিদের দ্বিমত বা আপত্তি তো নেই-ই বরং পূর্ণসম্মতিসূচক আনন্দে সবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
.
সে রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে গল্প গুজব করতে রাত অনেক হয়ে গেল। পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম বেল আটটায়। আমার ফরেস্টার বন্ধুরা ঘুম থেকে উঠেই যাই যাই শুরু করে দিলো। অনেক বুঝিয়েও যখন কিছু হলো না, তখন অগত্যা চা টোস্ট অমলেট খাইয়ে বিদায় দিলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম বিদেশে একদিনের আলাপে এমন গাঢ় বন্ধুত্ব হয়, যা শহরে দশ বছর পাশাপাশি থেকেও হয় না।
থানাঘরে ঢুকে দেখি, একটি মগ বসে রয়েছে। পরনে ময়লা ছেঁড়া লুঙ্গি, গায়েও ততোধিক ময়লা ফতুয়া। ধুলোমাখা খালি পা দুটো বেঞ্চির উপর তুলে নিশ্চিন্ত আরামে একটা আধপোড়া চুরোট টানছে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম করে মগি ভাষায় কি সব অনর্গল বলে যেতে লাগলো, থামতেই চায় না। অতো কথার মধ্যে একটি কথা শুধু বার চারেক বললে–ফিং লু। মনে মনে প্রমাদ গণলাম, উঁকি দিয়ে দেখি, মহেন্দ্রবাবুর কোয়ার্টারের দরজা জানলা সব বন্ধু, যতীনবাবুও আগের দিন বিকেলে কি একটা কেস নিয়ে কক্সবাজার রওনা হয়ে গিয়েছেন। এখন উপায়? অসহায়ের মতো চারদিক চাইছি এমন সময় দেখি, উঠোনের পাতকুয়োর ধারে কনস্টেবল সতীশ ব্যানার্জি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে বলে রাখি, সম টেকনাফ দ্বীপের মধ্যে ঐ একটি পাতকুয়ো, থানা ও থানার কোয়ার্টারের মধ্যে। সতীশের সঙ্গে ভালো আলাপ ছিলো না, তবুও ইশারা করে ওকেই ভাকলাম। ঘটিটা রেখে গামছায় হাত মুছতে মুছতে সতীশ এসে নমস্কার করে দাঁড়াতেই বললাম–দেখো তো, আমি এর কথা এক বর্ণও বুঝতে পারছি না। কোনো কথা না বলে সতীশ মগটির দিকে রুক্ষ দৃষ্টিতে চেয়ে শুরু করলো–নামে জালে?
মগ–আং চু।
সতীশ–আপ্পা নামে জালে?
মগ–ওয়াং চু।
সতীশ–পাইছি রোয়াজা?
মগ–ওছে রোয়াজা।
এইটুকু এগোনোর পরেই আগন্তুক মগি ভাষায় মেল ট্রেন চালিয়ে দিলে আর আমি হতভম্ব হয়ে একবার সতীশ একবার মগটির দিকে চাইতে লাগলাম। মিনিট তিনেক বাদে কথার তোড় থামলো। সতীশ একটু হেসে আমাকে বললেব্যাপারটা কি হয়েছে জানেন স্যার? ‘আং চু’ মানে এই লোকটি একজন গরীব চাষী। সামান্য একফালি ধানের জমি চাষ করে আর মুরগী বিক্রি করে কোনো রকমে দিন চালায়। ওর প্রতিবেশী ‘ফিং লু’র সঙ্গে ওর অনেক দিনের ঝগড়া। আজ সকালে বাজারে বিক্রি করবে বলে মুরগী নিতে গিয়ে দেখে, বড় বড় তিনটে মুরগী নেই। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ফিং লু-ই ওর মুরগী চুরি করেছে অথবা খেয়ে ফেলেছে। ও কেস লেখাতে এসেছে।
চুপ করে আছি দেখে সতীশ টেবিলের বাঁ ধারের ডেস্কটা খুলতে বললে। ড্রয়ারটা টেনেই দেখি কেস-ডায়েরির মতো লম্বা দু’খানা খাতা রয়েছে। সতীশেরই নির্দেশে নিচের খাতাখানা টেনে বার করলাম। খাতা খুলে দেখি, কেস-ডায়েরির মতো দেখতে হলেও খাতাটা তা নয়, আজে বাজে কি সব লেখায় প্রথম দু তিন পাতা ভর্তি।
একখানা সাদা পাতা বার করে সতীশ বললে–এইবার আমি যা যা বলে যাই, লিখে যান।
দোয়াত কলম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসলাম। সতীশ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলে-নামে জালে?
উত্তর এল–আং চু উ-উ-উ।
সতীশ–লিখুন, নাম হচ্ছে আং চু।
আপ্পা নামে জালে?
উত্তর এল-ওয়াং চু উ-উ-উ-উ-উ।
লিখলাম বাপের নাম–ওয়াং চু।
তারপর আবার সতীশের প্রশ্ন–পাইছি রোয়াজা (কোন পাড়ায় বাড়ি)?
উত্তর–ওছে রোয়াজা-আ-আ-আ-আ (জেলেপাড়ায় বাড়ি)।
তারপর লিখলাম প্রতিবেশী ফিং লু’র বিরুদ্ধে মুরগী চুরির অভিযোগ।
লেখা শেষ হলে সতীশ মগি ভাষায় বললে–দারোগাবাবু তোমার অভিযোগ কেস-ডায়েরিতে লিখে নিয়েছেন, আজ বিকেল চারটের সময় দারোগাবাবুকে নিয়ে আমি তোমার বাড়িতে এনকোয়ারিতে যাবো। বাড়ি থেকো।
খুশি মনে সেলাম করে আং চু চলে গেল।
বললাম–কিছুই তো বুঝলাম না সতীশ?
একটু হেসে সতীশ বললে–না বুঝবার কি আছে স্যার। এই সব আজে-বাজে ছুটকো কেস হাতে নিলে কি আর রক্ষে ছিলো? আসামী নিয়ে কক্সবাজার ছুটতে ছুটতে জান হয়রান হয়ে যেতো।
মহেন্দ্রবাবুর সাবধানবাণী মনে পড়ে গেল। বললাম–বুঝলাম সতীশ, কিন্তু ও যে অভিযোগটা করে গেল, তার বিচারের কি হবে?
একটু হেসে সতীশ জবাব দিলে–কিছু একটা হবেই। নতুন এয়েছেন কিনা, আজকেই দেখতে পাবেন।
এর পর সতীশের সঙ্গে অনেক বিষয়ে আলোচনা হলো। মগের রীতি-নীতি আচার-ব্যবহার। জিজ্ঞেস করলাম–আচ্ছা সতীশ, মগের শেষ কথাটা অতো টেনে বলে কেন বলতে পারে? ব্যাটা নাম বললো–আং চু-উ-উ-উ-উ, সোজা আং চু বললেই তো ফুরিয়ে যায়।
সতীশ হেসে বললেন–না, যায় না। মগদের একটি রীতি হচ্ছে মানী লোকের কাছে কথা বলতে গেলে শেষের অক্ষরটাকে টেনে বলতে হবে। নইলে শ্রদ্ধা ও বিনয় প্রকাশ করা হয় না। ধরুন, আপনাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, মাং তামাসা রেল-আ-আ-আ? (আপনি ভাত খেয়েছেন?) উত্তরে আপনাকে বলতে হবে, রেলা-আ-আ-আ (খেয়েছি)।
দেখলাম, সব বিষয়ে সতীশ একেবারে চৌকশ। যতোই আলাপ করি ততই মুগ্ধ হই। এইখানে সতীশের একটু বিশদ পরিচয় দিয়ে রাখি। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, গায়ের রং বেশ ফর্সা। দাড়ি-গোঁফ কামানো, কর্মঠ দেহ, মুখের মাংস অকারণে কুঁকড়ে একটা বীভৎস ছাপ এনে দিয়েছে, দেখলে ভয় হয়। কোটরগত ছোট্ট চোখ দুটো সাপের চোখের মতো হিংস্র ও তীক্ষ্ণ, হাসলে আর দেখা যায় না। জিজ্ঞেস করলাম–কতে দিন পুলিসে আছছ?
বীভৎস মুখখানা হাসলে আরো ভয়ানক দেখায়।
সতীশ হেসে জবাব দিলে–তা বাইশ তেইশ বছর হলো স্যার।
বিস্মিত হয়ে বললাম–বলো কি? এই তেইশ বছর তুমি কনস্টেবল হয়েই রইলে, প্রমোশন হয়নি কখনও?
কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়েই সতীশ জবাব দিলে–না। মাঝে ক’বার প্রমোশনের কথা হয়েছিলো, কিন্তু আমি তদ্বির করে তা বন্ধ করে দিয়েছি।
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো, অবাক হলাম। বললাম–বলে কি সতীশ, তদ্বির করে তুমি নিজের প্রমোশন বন্ধ করেছো?
সতীশ–হ্যাঁ। কি জানেন স্যার? লেখাপড়া কিছুই জানিনে। দারোগ হলে দায়িত্ব বাড়বে অনেক, অথচ ঐ বাঁধা মাইনের বেশি উপরি রোজগারগুলো সহজে হজম করতে পারবো না, ধরা পড়বোই। তখন দেবে আবার কনস্টেবল করে। তার চেয়ে বেশ আছি। দু’পয়সা হচ্ছেও বেশ আর ধরা পড়লেও বড় জোর ওয়ার্নিং নয় তো সার্ভিস বই-এ একটা ব্ল্যাক মার্ক, ব্যস। কনস্টেবলের নিচে তো আর কোনো পোস্ট নেই যে, নামিয়ে দেবে।
নিজের রসিকতায় সতীশ নিজেই হেসে উঠলো। সতীশের পুলিস হাসির একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম। এ হাসির কোনো আওয়াজ নেই, মুখের কুঞ্চিত মাংসপেশিগুলো আরো কুঞ্চিত হয়ে থর-থর করে কাঁপতে থাকে আর ধবধবে দু’পাটি দাঁতের মধ্যে জিভটা, কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে মরে! এ যে কী হাসি না দেখলে বোঝানো অসম্ভব। আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে সতীশের পারিবারিক পরিচয় যা পেলাম, তাতে আরো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঘুষের পর ঘুষ খেয়ে এবং ধরা পড়ে সতীশের সাভিস বুক কালো দাগে ভর্তি হয়ে গেলেও আমাদের আশীর্বাদে সতীশ চট্টগ্রাম শহরের উপর দু’খানা বাড়ি করেছে। একখানা ভাড়া দিয়েছে, অন্যটিতে চারটি ছেলে তিনটি মেয়ে নিয়ে সতীশের পরিবার বাস করে। বড় ছেলেটিকে সতীশ পুলিসে ঢুকিয়েছে। এল. সি.’ অর্থাৎ লিটারেট কনস্টেবল হয়ে সে ঢাকায় আছে। অন্য ছেলেরা স্কুলে পড়ে, মেয়ে তিনটিরও বেশ ভালো বিয়ে দিয়েছে। কোনো রকমে মা কালীর দয়ায় আরো দুটো বছর কাটিয়ে দিতে পারলেই সতীশ পেনশন নিয়ে বাড়ি বসে একটা দোকান টোকান করে বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দেবে।–এই ইচ্ছা।
ভাবলাম, শুধু টেকনাফ দ্বীপে নয়, সমগ্র পুলিস ডিপার্টমেন্টে সতীশ একটি স্মরণীয় চরিত্র। চিরদিন মনে রাখবার মতো। রেখেছিও।
.
বিকেল আন্দাজ চারটে সতীশকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম মুরগী চুরির এনকোয়ারিতে। থানায় ঢুকে দেখি, মহেন্দ্রবাবু নেই।
সতীশ বললে–কাল রাতে যা মুরগী খাইয়েছেন, এ বয়সে তা হজম করতে মহেন্দ্রবাবুর অন্তত দু’দিন লাগবে।
বললাম–কিন্তু সতীশ, এঁকে না জানিয়ে আমাদের যাওয়াটা ঠিক হবে কি?
সতীশ–কেন মিছিমিছি ভাবছেন বাবু। আমি যখন সঙ্গে আছি, তখন ভাববার কিছুই নেই। আপনি জানেন না, তেমন শক্ত কেস এলে মহেন্দ্রবাবু আমার পরামর্শ না নিয়ে এক পাও এগোন না। তা ছাড়া দুপুরে মহেন্দ্রবাবুর বাসায় গিয়ে দেখা করে সব বলে এসেছি। চলুন বেরিয়ে পড়ি।
থানা থেকে বেরিয়ে তিন চারটে বাঁশঝাড় পেরিয়ে জেলেপাড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললাম। দেখলাম, দ্বীপের এ অংশটায় প্রচুর বাঁশ গাছ–যেদিকে ফিরাই আঁখি, বাঁশ আর বাঁশ দেখি। স্রষ্টার রসিকতায় মনে মনে হাসলাম। ভাবলাম, লোকাভাব বলেই এখানে বাঁশের প্রাচুর্য। অথচ যেখানে
চিন্তায় বাঁধা পড়লে সতীশের কথায়; বললে–এসে গিয়েছি স্যার, এই হলো আং চু-র বাড়ি। দেখলাম জোর করেও এটাকে বাড়ি বলা চলে না, ঝুপড়ি বললেই ঠিক হয়। মাটি থেকে হাত চারেক উঁচু, গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া, চার পাশে মাটির দেওয়াল। সামনে ছোট একটা গর্ত, সেই গর্তের মধ্যে দিয়েই যাওয়া আসা করতে হয়। এর মধ্যে যে মানুষ বাস করে তা না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। ছোট্ট ময়লা উঠোনের দু’পাশে এই রকম দুটি ঝুপড়ি ঘর। চার পাঁচটা নোংরা উলঙ্গ ছেলেমেয়ে ধুলো-কাদা মেখে কতকগুলো মুরগীর বাচ্চাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে, না খেলা করছে বুঝলাম না। সতীশ উঠোনে দাঁড়িয়ে আং চু-র নাম করে ডাক দিতেই ঝুপড়ির ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল আং চু। আমাদের সেলাম জানিয়েই তাড়াতাড়ি অপর ঝুপড়িটার ভিতর ঢুকলো। একটু পরে নড়বড়ে বেতের একটা আধভাঙা মোড়া এনে উঠোনের মাঝখানে রাখলল। সতীশ আমায় ইশারা করে বসতে বললে, আমি বসলাম। আং চু সতীশের সঙ্গে মগী ভাষায় আস্তে আস্তে দু’-একটা কথা বলে গুঁড়ি মেরে আবার ঝুপড়ির ভিতর ঢুকলো। দেখলাম, মগী ছেলেমেয়েগুলো খেলা থামিয়ে অবাক হয়ে একদৃষ্টে আমাদের দেখছে। একটু পরে ময়লা একখানা রেকাবিতে গোটা চারেক আস্তো পান, তার উপর এক দলা চুন ও একটা প্রকাণ্ড সুপারি এনে আমার সামনে মাটিতে রেখে হাতজোড় করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো আং চু। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সতীশের দিকে চাইলাম। সতীশ বললে–ওটা হলো আপনার সম্মানী। বাড়িতে কোনো মানী অতিথি এলে বাটায় করে পান দেওয়াই হচ্ছে মগেদের রীতি। বাটা থেকে একটা পান তুলে নিয়ে তাতে খানিকটা চুন লাগিয়ে সুপারিটা তার মধ্যে দিয়ে তালগোল পাকিয়ে গালে ফেলে দিন।
ফরিয়াদী আং চু আর আসামী ফিং লুকে নিয়ে যখন থানার দিকে পা বাড়ালাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়।
থানায় ঢুকে দেখি, চেয়ারে বসে সামনের টেবিলটার উপর পা তুলে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত আরামে সিগারেট টানছেন মহেন্দ্রবাবু। টেবিলে দেখলাম দু’ প্যাকেট কঁচি সিগারেট পড়ে আছে। বুঝলাম, একটু আগে নিশ্চয়ই কোনো মকেল এসেছিলো। আমাদের দেখে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন মহেন্দ্রবাবু। সব শুনে আং চু আর ফিং লুকে মগী ভাষায় জেরা শুরু করে দিলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা বিচার চলবার পর সতীশ ফিং লুকে থানার বাইরে ডেকে নিয়ে গেল।
আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মহেন্দ্রবাবু–বুঝছো কিছু?
মাথা নাড়লাম।
একটু হেসে মহেন্দ্রবাবু বললেন–পারবে, একটু পরে।
একটু পরেই সতীশ ফিং লুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। তারপর মহেন্দ্রবাবুর কাছে এসে চাপা গলায় বললে–ও রাজী হয়েছে স্যার। আপনি কেসটা তুলে নিন।
দেখলাম, আং চু আর ফিং লু চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কি বলাবলি করছে। মহেন্দ্রবাবু আং চুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন সে রাজী আছে কি না। একটু ইতস্তত করে সতীশের দিকে চেয়ে নিয়ে সে জানালে–হ্যাঁ রাজী।
মহেন্দ্রবাবু ড্রয়ার খুলে false diary-র খাতাখানা বার করলেন। সকালে মুরগী চুরির যে কেসটা আমি লিখে নিয়েছিলাম, সেইখানটা খুলে একবার পড়লেন, তারপর আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে কলম দিয়ে সমস্ত পাতাটায় একটা চিকে কেটে দিলেন।
আং চু আর ফিং লু-র দিকে চেয়ে মগী ভাষায় সতীশ বললে দেখলে তো? বাবু আমাদের দেবতা। তোমাদের ভাগ্য ভালো যে বাবু থানায় ছিলেন, তাই কেসটা আপোসে মিটে গেল, নইলে ছোট বাবু তো তোমাদের নির্ঘাৎ কক্সবাজার চালান দিতেন। অম্লানবদনে এই কথা বলে সতীশ আঙুল দিয়ে আমায় দেখিয়ে দিলে।
হাসবো না কাঁদবব ভাবছি। দেখি, মহেন্দ্রবাবু আর সতীশের উপর কৃতজ্ঞতায় আং চু আর ফিং লু-র চোখ দুটো বড় হয়ে উঠেছে। তারপর ছেঁড়া ফতুয়ার পকেট থেকে দু’জনে তিনটে করে রূপোর টাকা বার করে মহেন্দ্রবাবুর সামনে টেবিলের উপর রেখে আভূমি নত হয়ে সেলাম করে খুশি মনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সতীশের কাছে ব্যাপারটা যা শুনলাম তা হলো এই আং চুকে সতীশ বুঝিয়েছে, কোর্টে গেলে অনেক হাঙ্গামা। উকিলের ফি, পথ-খরচ, হয়রানি তো আছেই, তারপর প্রমাণাভাবে আসামী শেষ পর্যন্ত হয়তো খালাস পেয়ে গেল। কেননা, নিজের চোখে সে তো আর ফিং লুকে মুরগী চুরি করতে দেখেনি। আর ফিং লুকে বোঝালে কোর্ট খরচা, হয়রানি তার উপর শেষ পর্যন্ত জেল না হলেও মোটা ফাইন হবেই। তার চেয়ে দু’জনে কিছু কিছু নজর বড়বাবুকে দিয়ে কেসটা আপোসে মিটিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কাজির বিচার হয়ে গেল।
টাকা ছ’টি পকেটে পুরতে পুরতে হেসে মহেন্দ্রবাবু বললেন তোমার হাতে আজ প্রথম বউনিটা বেশ ভালোই বলতে হবে, কি বলো ধীরাজ।
কোনো জবাব না দিয়ে পকেট থেকে চারটে টাকা বের করে মহেন্দ্রবাবুর সামনে রাখলাম।
প্রথমটা একটু অবাক হয়ে পরক্ষণেই টাকা চারটে পকেটে রেখে বললেন–ও, ভুলে গিয়েছিলাম এটা তোমার নজর। তা নজরে নাকাল হয়ে হয়ে আমরা বেশ আরামেই টেকনাফে আছি কি বলল? নিজের রসিকতায় উচ্চকণ্ঠে হো হো করে হেসে উঠলেন মহেন্দ্রবাবু।
কেন জানিনে হাসি পেলোলা না আমার। থানা ঘরের মিটমিটে হ্যারিকেনের আলোতে দেখি, নিঃশব্দ হাসিতে সতীশের বীভৎস ক্রর মুখখানা আরো ভয়ানক দেখাচ্ছে।
***
পরদিন সকালে একাধিক নারীকণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ঘুম ভাঙলো। প্রথমে মনে হলো, জনবহুল কোনো শহরের একটি বিয়ে বাড়িতে শুয়ে আছি। চোখ পড়লো ঘরের চেরা বাঁশের বেড়ার দিকে আর কানে ভেসে এল বে অব বেঙ্গলের চাপা হুঙ্কার। রূঢ় বাস্তবে ফিরে আসতে দেরি হলো না। এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠেই দরজা খুলে থানার দিকের ছোট্ট বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম, পঞ্চাশ-ষাটটি মগী যুবতী রঙ বেরঙের লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে পাতকুয়োর চারধারে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে থানা প্রাঙ্গণ মুখরিত করে তুলেছে। বেশির ভাগই গরীব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, পোশাক দেখে অন্ততঃ তাই মনে হলো। সুঠাম সুন্দর দেহ, গায়ের রং ফর্সা, গোলাকৃতি মুখ, চাপা নাক আর ছোট্ট চোখ। অনেকটা বর্মী ধরনের মঙ্গোলিয়ান চেহারা। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে দেখবার জিনিস হচ্ছে ওদের খোঁপা। এ রকম সুন্দর খোঁপা এর আগে কোথাও দেখিনি। দেখলাম, প্রত্যেকের হাতে বা কাঁখে রয়েছে একটা মাটির কলসী; দু-একটা পিতলের কলসীও দেখলাম। আমায় দেখে ওদের মধ্যে একটা চাপা হাসির ঢেউ খেলে গেল তাও বেশ বুঝতে পারলাম। আমার তখন ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা; হঠাৎ নজরে পড়লো বৃন্দাবনে অসংখ্য গোপিনী পরিবেষ্টিত লীলাময় শ্রীকৃষ্ণের মতো ওদের মধ্যে বসে কনস্টেবল হকি বড়য়া দিব্যি আসর জমিয়ে তুলেছে। বেশ খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে একটু উঁচু গলায় ডাকলাম–হরকি।
হরকি আমাকে দেখতে পায়নি। হাসির গুঞ্জন হঠাৎ থেমে যেতেই ও উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমাকে দেখে লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেল। একটি মেয়ে চুপি চুপি কি বলতেই হরকি এক পা দু পা করে আমার কাছে এসে স্যালুট করে দাঁড়ালো। ততোক্ষণে পাতকুয়ো থেকে জল ভোলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মেয়ের দল কৌতূহলী চোখ মেলে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকক্ষণ এইভাবেই কাটলো, চমক ভাঙলো হরকির কথায়। বললে–আমায় কিছু বলবেন হুজুর?
লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম হ্যাঁ, ঘর থেকে চেয়ারটা এনে দাও আর আমার সুটকেসের উপর থেকে খবরের কাগজটাও আনো।
চেয়ারে বসে প্রায় মাসখানেকের পুরানো খবরের কাগজটার উপর মিথ্যে চোখ বুলিয়ে আড়চোখে চেয়ে দেখি হকি দাওয়ায় মাটিতে বসে একটা বাঁশের খুঁটি হেলান দিয়ে মেয়েগুলোর দিকে চেয়ে দিব্যি মুচকি হাসছে।
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে অথচ কিছু বলতে পারছি না। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটলো। ভাবলাম, এভাবে চুপচাপ বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। কাগজটা সরিয়ে রেখে হরকিকে বললাম–ওরা এখানে জল নিতে আসে কেন?
হরকি উত্তর দেয়–আর কোথায় যাবে হুজুর? সমস্ত দ্বীপটায় এই একটিমাত্র পাতকুয়ো।
বললাম–না, না, মানে–ওদের বাড়ির ব্যাটাছেলেরাও তো আসতে পারে।
একটু হেসে হরকি বললে–আপনাকে তো আগেই বলেছি হুজুর, এখানে পরিশ্রমের কাজ সব করে মেয়েরা। ধরুন, যদি কোনও মেয়ে তার স্বামীকে এক কলসী জল এনে দিতে বলে তাহলে স্বামী তখনই দেড় হাত লম্বা দাও দিয়ে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
টুকরো টুকরো করে কাটা হতভাগিনী স্ত্রীর উদ্দেশে একটা সমবেদনার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। চুপ করেই থাকি। পাতকুয়োর দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখি, পাঁচ ছ’টি মেয়ে জল নিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রথমেই নজরে পড়লে তাদের অদ্ভুত মনোরম খোঁপা। ওদের মধ্যে চারটি মেয়ের খোঁপা ফুল দিয়ে সাজানো, আর দুটির খোঁপা খালি, ফুল নেই। জিজ্ঞাসা করলাম-আচ্ছা হরকি, এর মানে কি! এদের কারো কারো খোঁপায় নানা রঙ-এর ফুল গোঁজা রয়েছে, আবার অনেকের নেই।
হরকি বললে–যাদের খোঁপায় ফুল নেই দেখছেন তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তারা সধবা। আর যাদের ফুল রয়েছে তার। হয় কুমারী নয় বিধবা।
অবাক হয়ে বললাম–বিধবা?
হরকি–হ্যাঁ হুজুর, এখানে বিধবা মানে যার স্বামী সব সম্বন্ধ চুকিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে অথবা মরে গিয়েছে। সে অনায়াসে আবার বিয়ে করতে পারে।
বিশ্বের টেকনাফ থানারই আর একটি হিন্দুস্থানী কনস্টেবল। লম্বা চওড়া নাদুসনুদুস চেহারা, প্রচুর ঘি-দুধ খেয়ে ভুড়িটা প্রকাও জালার মতো করে তুলেছে। চওড়া মুখে মোষের শিং-এর মতো দুটো গোঁফ, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, তার মাঝে শাল গাছের মতো দীর্ঘ এক টিকি, তাতে আবার ফুল বাঁধা। বিশ্বেশ্বরের কপালে বাহুতে ভুড়িতে চন্দনের ফোঁটা, বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেও কম মনে হয়। রাশভারি লোক, কম কথা বলে। থানার কাজকর্ম বিশেষ থাকে না বলে বেশির ভাগ সময় পুজো আর্চা নিয়েই কাটায়। চেয়ে দেখি, উঠোনের দক্ষিণদিকে নিজের ঘরের দরজায় বসে সর্বাঙ্গে ফোঁটা কেটে কনস্টেবল বিশ্বেশ্বর পাড়ে পুজো করতে করতে লোলুপ দৃষ্টিতে যোগীন দাসের কুমারী স্ত্রীর দিকে বারবার চাইছে।
হরকি বললে–-ব্যাটা ভণ্ড! জানেন বাবু, অনেকদিন ধরেই ঐ মেয়েটার উপর নজর, চুক চুক করে বেড়ায়। কেবল আমাদের ঠাট্টার ভয়ে কিছু করে উঠতে পারে না।
বিশ্বেশ্বর পাড়ের চরিত্র সম্বন্ধে আরো অনেক কিছুই হয় তো শুনতে পেতাম, কিন্তু থানার দিকে চেয়ে দেখি একটি বারো তেরো বছরের ছেলেকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে একটি আধবয়সী মুসলমান পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক বুক-ফাটা কান্নায় আকাশ বাতাস ভরিয়ে থানা ঘরে ঢুকলো। আমি আর হরকি তাড়াতাড়ি থানার দিকে পা বাড়ালাম। ততক্ষণে পাতকুয়োর ধারের ভিড় অনেক কমে গিয়েছে, চার পাঁচটি মেয়ে জল ভোলা বন্ধ করে থানা ঘরের দিকে কৌতূহলী চোখ মেলে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘরে ঢুকে দেখলাম, মহেন্দ্রবাবু চেয়ারে বসে আছেন আর তার পাশেই সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে কনস্টেবল সতীশ ব্যানার্জি। ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে সেই ফুটফুটে কিশোর ছেলেটি আর তার বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে বুক-ফাটা কান্না কাঁদছে সেই মুসলমান দম্পতি। ছেলেটির দিকে ভালো করে চাইলাম। ধবধবে সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা। মাথায় এক রাশ কোঁকড়া ঈষৎ সোনালী চুল, এক গুচ্ছ কপালে এসে পড়েছে। এক কথায় এরকম সুন্দর ছেলে কদাচিৎ নজরে পড়ে, দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মনে হলো, ছেলেটি নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার হতভম্ব ভাব দেখে সতীশ ইশারায় আমাকে থানা ঘরের শেষপ্রান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে–ছেলেটির বাপ মা আজ এক বছর হলো নাফ নদীর ঝড়ে নৌকা ডুবে মারা গিয়েছে। আপনার বলতে ঐ খুড়ো আর খুড়ী ছাড়া আর কেউ নেই, ওদেরও কোনো ছেলেপিলে নেই। আজ সকালে পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা পাড়তে গিয়ে উঁচু ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়।
দেখি খুড়ে খুড়ীর কান্নার বেগ কিছুটা কমে এসেছে। মহেন্দ্রবাবু জেরা শুরু করলেন মগী ভাষায়। বুঝলাম, জাতে মুসলমান হলেও এই মগের মুলুকে থেকে ওরাও প্রায় মগ হয়ে গিয়েছে। দু চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে মহেন্দ্রবাবু হরকিকে বললেন–যাও তো, জামাল মিঞার বাড়িতে যে গাছ থেকে ছেলেটা পড়ে গিয়েছে, তার তলায় কিছু দেখতে পাও কিনা।
হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই বললেন–তুমিও সঙ্গে যাও ধীরাজ। শুধু দেখে আসবে এরা যা বলছে সত্যিই তাই কিনা। উঁচু গাছ থেকে পড়লে নিচে মাটিতে নিশ্চয়ই কোনো দাগ দেখতে পাবে।
হরকিকে সঙ্গে নিয়ে তখনি বেড়িয়ে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে জামাল মিঞা যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু মহেন্দ্রবাবু নিষেধ করলেন।
পথে নেমে হরকিকে বললামপুলিস লাইনটাই এই! সবতাতেই মানুষকে সন্দেহ করে বসে আছে।
হরকি বললে–আপনার কি বিশ্বাস ও গাছ থেকেই পড়ে মারা গিয়েছে?
বললাম–নিশ্চয়ই। অন্য কিছু হলে গায়ে আঘাতের চিহ্ন থাকতো। তাছাড়া ওকে মেরে কার কি লাভ বলতে পারে?
হরকি বললে–ওর বাপ বেশ কিছু টাকা-কড়ি রেখে গিয়েছে শুনেছি।
এবার রেগে গেলাম। বললাম–তুমি বলতে চাও টাকার লোভে খুড়ো খুড়ী ওকে মেরে ফেলেছে? কিন্তু তাতে ওদের লাভ? ওদেরও তো কোনো ছেলেপিলে নেই, তাছাড়া ওদের কান্না দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, কতো বড় আঘাত ওরা পেয়েছে!
এবার হরকি আর কোনো জবাব দিলো না। বাকি পথটুকু চুপচাপ কাটিয়ে মুসলমান পাড়ায় ঢুকলাম। দ্বীপের দক্ষিণদিকে মুসলমান পাড়া। জামালের বাড়ি হরকি চিনতো। ঢুকে দেখি, উঠোনে অনেকগুলো প্রতিবেশী স্ত্রী-পুরুষ জটলা করছে। আমাদের দেখে সব চুপ হয়ে গেল। দেখলাম, জামাল বেশ অবস্থাপন্ন মুসলমান। উঠোনে দুটো ধানের গোল, গোয়ালে চার পাঁচটি চাষের গরু। তাছাড়া অনেকগুলো ছাগল মুরগীও রয়েছে। উঠোনের চারিদিকে বেশ বড় বড় চারখানা ঘর। হরকি একজন প্রতিবেশীকে পেয়ারা গাছের কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে হাত দিয়ে পুবদিকের ঘরের পিছনটা দেখিয়ে দিলে। গিয়ে দেখি, শুধু পেয়ারা নয়, নানারকমের গাছপালায় ছোট্ট বাগানটা ঠাসা। এমন কি দিনের আলোও সেখানে ভালো করে ঢুকতে পায় না, মাটি সঁতসেঁতে নরম। পেয়ারা গাছের তলায় গিয়ে উপরের দিকে
তাকালাম। অনেক উঁচুতে একটা পলকা সরু ডাল ভেঙে দুমড়ে আছে। দৃষ্টি নামিয়ে ঠিক তার নিচে দেখি নরম মাটিতে উঁচু থেকে পড়া একটা মানুষের দেহের ছাপ বেশ পরিষ্কার আঁকা রয়েছে। দেখলাম, যেখানে ছেলেটি গাছ থেকে পড়েছে সে জায়গায় নরম মাটি দু’ তিন ইঞ্চি গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। হরকির দিকে তাকালাম।
আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই হরকি বললে–আপনার কথাই ঠিক বাবু! চলুন ফেরা যাক।
থানায় ঢুকে দেখি মহেন্দ্রবাবু নেই, প্রাতঃকৃত্য সারতে বাড়ি গিয়েছেন। মেজেয় একখানা কাঁথার উপর ছেলেটি শুয়ে আছে– আর জামাল-দম্পতি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। শুধু সতীশ একটা চেয়ারে উবু হয়ে বসে বাজপাখির মতো মরা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে। হরকি মহেন্দ্রবাবুকে খবর দিতে চলে গেল। সতীশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, ওর খেয়ালই নেই। ঠায় বসেই আছে। ডাকলাম–সতীশ!
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো সতীশ। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললে–আমি জানতেই পারিনি বাবু।
মহেন্দ্রবাবু ঘরে ঢুকলেন, সঙ্গে হরকি। বুঝলাম সব শুনেছেন। ভয়ার থেকে কেস ডাইরীটা বার করে আমার দিকে চেয়ে বললেন জানাই ছিলো, তবুও তোমায় পাঠালাম যাতে আর সন্দেহের কোনোও অবকাশ না থাকে। আনন্যাচরল ডেথ কেস ( অপমৃত্যু। বলে রিপোর্টটা আমি লিখে ফেলছি। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার হিসেবে তুমি এতে একটা সই করে দাও।
মহেন্দ্রবাবু লিখতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে সতীশ বললে–দাঁড়ান।
বিস্মিত হয়ে চেয়ে দেখি মহেন্দ্রবাবুর চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেশশূন্য মুখে সতীশ। বিরক্ত হয়ে মহেন্দ্ৰবাবু তাকাতেই সতীশ ঝুঁকে পড়ে মহেন্দ্রবাবুর কানে কানে কি বললে শুনতে পেলাম না।
মহেন্দ্রবাবু অবাক হয়ে বললেন–বলো কি? না, না, এ কখনই হতে পারে না।
সতীশ–আমার অনুমান কখনো মিথ্যে হয়েছে বড়বাবু?
মহেন্দ্রবাবু তবুও সংশয়ভরে মাথা নাড়ছেন দেখে সতীশ বললে–আমায় মিনিট পনেরো সময় দিন স্যার, তারপর আপনার যা খুশি করবেন।
কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারছিলাম না। মহেন্দ্রবাবুর টেবিলে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করলাম–ব্যাপার কি স্যার?
ফিস ফিস করে মহেন্দ্রবাবু বললেন–সতীশ বলছে গাছ থেকে পড়ে ছেলেটি মারা যায়নি, ওকে খুন করা হয়েছে।
তড়াং করে লাফিয়ে উঠলাম। কিছু বলবার আগেই সতীশ ইশারা করে কিছু বলতে বারণ করে দিলে, তারপর নির্লিপ্ত মুখখানা আমার কানের কাছে এনে আস্তে আস্তে বললে– ছেলেটার গলার নিচে কণ্ঠনালীর দু পাশে দুটো অস্পষ্ট আঙুলের ছাপ রয়েছে দেখেছেন?
হাঁ করে একবার সতীশের দিকে একবার মরা ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছি।
সতীশ বললে–পনেরো মিনিট বাদেই সব বুঝতে পারবেন।
জামাল-দম্পতির দিকে তাকিয়ে দেখি ওরা এরই মধ্যে কথন উঠে দাঁড়িয়েছে, আতঙ্কে ও ভয়ে মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
সতীশ বললে–তাহলে হুকুম করুন স্যার, ব্যাটাকে ঠাণ্ডা ঘরে নিয়ে যাই।
একটু ইতস্তত করে মহেন্দ্রবাবু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন, হরকিকে ডেকে জামালের স্ত্রীকে বাইরে নিয়ে যেতে বললেন। আর্তনাদ করে জামালের স্ত্রী মহেন্দ্রবাবুর পায়ের উপর পড়লো। সে কী কান্না! কিন্তু কোনো ফল হলো না। নিষ্ঠুর হাতে হরকি টানতে টানতে বাইরে নিয়ে গিয়ে দূরে এক গাছ তলায় তাকে বসিয়ে রাখলো। দেখলাম সেখানে রমেশ, বিশ্বেশ্বর এবং আরও চার পাঁচটি কনস্টেবল জটলা করছে।
ঠাণ্ডা ঘর? এই টেকনাফ থানায় ঠাণ্ডা ঘর রয়েছে অথচ এই ক’দিনের মধ্যে আমি তার অস্তিত্বও জানতে পারিনি? আকাশ পাতাল ভাবছি–দেখি সতীশ জামালের ঘাড় ধরে ধাক্কা দিতে দিতে ঘরের দক্ষিণ দিকে একটা ছোট্ট পার্টিশন দেওয়া ঘরে ঢুকলো। রাইফেল বন্দুক এই সব থাকতে বলে ঘরটি প্রায় সব সময় বন্ধই থাকতো। আজ বুঝলাম উনিই ঠাণ্ডা ঘর, সময় বিশেষে ওঁরও মস্ত প্রয়োজন রয়েছে।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে সতীশ। দু’ তিন মিনিট চুপ চাপ তারপর শুরু হলো জামালের মর্মভেদী আর্তনাদ; অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে যেন একটা লোককে কেউ মেরে ফেলছে, বেশিক্ষণ শুনলে পাগল হয়ে যেতে হয়। আমার সর্বাঙ্গ তখন থর থর করে কাঁপছে, বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। মহেন্দ্রবাবুর দিকে চাইলাম, ভদ্রলোক নির্লিপ্তভাবে চোখ বুজে বসে একটি সিগারেট টানছেন আর পা দোলাচ্ছেন। একরকম ছুটে থানা থেকে বেরিয়ে নিজের কোয়ার্টার্সে এসে বিছানার উপর শুয়ে পড়লাম।
.
আধ ঘণ্টা পরে।
কৌতূহল বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে দিলে না। কান খাড়া করে শুনি থানার দিক থেকে কোনো কান্নার আওয়াজ আসছে কিনা। শুনতে পেলাম না। উঠে আস্তে আস্তে থানার দিকে পা বাড়ালাম। দেখলাম মহেন্দ্রবাবু একমনে কি সব লিখে চলেছেন, ঘরের মেজেতে আধমরা জামাল স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আর জামালের স্ত্রী তার বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছু দূরে ভাবলেশশূন্য মুখে দাঁড়িয়ে আছে সতীশ। মহেন্দ্রবাবুর পাশের চেয়ারটিতে চুপ করে বসে পড়লাম। নিস্তব্ধ ঘরে শুধু কাগজের উপর কলমের একঘেয়ে খস খস আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। এইভাবে আরও পাঁচ মিনিট কাটলো।
লেখা শেষ করে মহেন্দ্রবাবু আমার দিকে চেয়ে বললেন–সতীশ ইজ রাইট। পড়ে দেখো।
জামালের স্বীকারোক্তি পড়ে থ’ হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হচ্ছে এই–মন্নুর (মৃত ছেলেটি) বাবা সওকৎ বেশ সঙ্গতিপন্ন চাষী ও হিসেবী লোক ছিলো। ধানের জমি, গোল, নগদ টাকা এসবই তার রোজগারের সঞ্চয়। ছোট ভাই জামাল ছেলেবেলা থেকেই বাউণ্ডুলে, রাতদিন মদ আর তাড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিতে। কাজকর্ম কিছুই করতো না। সওকৎ হঠাৎ নৌকাডুবিতে মারা যাওয়ায় জামাল হাতে পেলে সব কিছুই। কিন্তু ঐ পথের কাঁটা মনু, বেঁচে থাকলে নিশ্চিন্ত হয়ে কিছুই ভোগ করা চলবে না। বড় হয়ে ও যেদিন ওর ন্যায্য পাওনা দাবি করে বসবে তখন? কাজেই এক বছর ধরে অনেক জল্পনা-কল্পনা করে গত রাত্রে জামাল ওর গলা টিপে মেরে পেয়ারা গাছের উঁচু ডাল থেকে নিচে ফেলে দেয়, যাতে নরম মাটিতে দেহের দাগ পড়ে। সব দিক বাঁচিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলো না জামাল। তীরে এসে তরী ডুবলো। গলার নিচে আঙুলের দাগ সাধারণ লোকের চোখে পড়বার কথা নয়, কিন্তু সতীশের শ্যেন দৃষ্টিকে কঁকি দিতে পারেনি। ঠাণ্ডা ঘরের ঠাণ্ডি দাওয়াই খেয়ে জামাল বেসামাল হয়ে সব স্বীকার করে ফেলেছে।
পড়া শেষ করে সতীশের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি সতীশ ঘরে নেই, এরই মধ্যে কখন জামালকে ডেকে নিয়ে থানার বারান্দায় এক পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কি বলছে।
একটু পরে সতীশ ফিরে এল। মহেন্দ্রবাবুর কানের কাছে মুখ এনে কি যেন বলতেই মহেন্দ্রবাবু রাজী হয়ে গেলেন। সতীশ বারান্দা থেকে জামালকে ডেকে নিয়ে এলে পুর ব্যাপারটা বুঝলাম। সতীশ জামালকে জানিয়েছে এখন তার মাত্র দুটি ব্যাঙ খোলা। হয় নগদ পাঁচ হাজার টাকা এনে মহেন্দ্রবাবুর পাদপয়ে প্রণামী দেওয়া, নয় তো এখনই সস্ত্রীক পুলিশ পাহারায় মড়া, নিয়ে কক্সবাজার রওনা হওয়া। একটু ইতস্তত করে জামাল প্রথম পথটাই বেছে নিয়েছে।
এর পর এক ঘণ্টার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে গেল। দু তিনজন কনস্টেবল সঙ্গে করে জামাল বাড়ি থেকে টাকা এনে দিলে। মহেন্দ্রবাবু আনন্যাচরল ডেথ কেস বলে একটা রিপোর্ট লিখে নিলেন আর জামালের পথের কাঁটা মনুকে কবর দেওয়ার অনুমতি দিলেন।
নিশ্চিন্ত মনে মহেন্দ্রবাবু, সতীশ ও আর সবাই নাওয়া খাওয়া করতে কোয়ার্টার্সে চলে গেলেন। ঠায় বসে রইলাম চেয়ারে। কতোক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না, চেয়ে দেখি থানা-ঘরের পশ্চিম দিকের বাঁশের বেড়ার ফঁক দিয়ে অপরাহ্রে পড়ন্ত রোদের কতকগুলো টুকরো ঘরের মেজেতে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছে। মনু, যেখানটায় শুয়েছিল সেখানেও দেখলাম একটুকরো রোদ। মনে হলো থানা-ঘরের মাটির মেজেতে শত শত মনুকে কবর দেওয়া হয়েছে আর ওগুলো রোদের টুকরো নয়, সতীশের চেয়ে শত সহস্র গুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে আর একজন মেজের শক্ত মাটি ভেদ করে কবরগুলো দেখছে।
আর বসতে পারলাম না। আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে গেলাম।