৩. ঘর হতে শুধু
নির্মল একটি চারমিনার ধরাইয়া, একটান ধুম্র গিলিয়া আমায় হস্তান্তর করিল, সম্ভবত আতঙ্কের হিমঘাম ও পরাজয়বোধের অসহায়তাকে দূরীভূত করিবার জন্য । জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহাই কি অতুলের কুখ্যাত ফ্যাগ, যাহা সকালে ফুঁকিয়াছি ?
না না, নির্মলের দ্রুত উত্তর, সকালে যাহা পান করিয়াছেন ইহা সেই বস্তুই, তবে অতুলের ফ্যাগ নহে । ইহা চারমিনার তামাকের সহিত মিশ্রিত দেশজ গাঁজা ও সামান্যমাত্র চরসগুঁড়া দেয়া, মারিহুয়ানাও নহে । মণিকর্ণিকা যাইবার পথে লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকানে গাঁজার পুরিয়া সরকার নির্ধারিত দামে প্রতি সন্ধ্যায় বিক্রয় হয় , যদিও হিপিগণ ও ছাইমাখা সাধুগণ ওই দুই ঘন্টায় বিরক্তিকর ভিড় জমাইয়া তোলে । সংকটমোচনের নিকটবর্তী দোকানটি সে-তুলনায় শ্রেয় । কলকাতায় খালাসিটোলা নামক দেশি মদ্যের দোকানের পাশেও আছে একটি সরকারি দোকান, একবার গিয়াছিলাম কলকাতাস্হ চিত্রশিল্পীগণের সহিত, আমার সোলো প্রদর্শনীকালে ; লেডি রাণু মুখার্জি উদ্ঘাটন করিয়াছিলেন প্রদর্শনীটি ।
উপেন সরদার কহিল, প্রথমবার ফ্যাগ ফুঁকিলে, যদি অভ্যাস নাথাকে, ডিগবাজি খাইবেন । প্রথমবার আমিই দিব আপনাকে, একখানা পড়িয়া আছে, আইসক্রিম খাইতে-খাইতে ফুঁকিবেন, মহানন্দ পাইবেন । প্রণব কহিল, না না, এমনিই ফুঁকিবেন, নতুবা আইসক্রিমে অভিজ্ঞতা চাপা পড়িয়া যাইবে ; প্রথমবারটি সর্ববিষয়ে স্মরণীয় থাকা উচিত । প্রণবের ইশারা বুঝিতে পারিলাম ; আমার তো প্রতিবারই প্রথমবার প্রতীয়মান হয় , বলিলাম ।
কয়েকটি সুখটান দিবার পর আত্মস্হ হইলে, উল্লাসকে দিতে, সে প্রণবকে দিল এবং আমার দিকে তাকাইয়া বলিল, আমি নেশা-নারী ইত্যাদির গোলকধাঁধায় নাই ।
প্রণব ফুঁকিতে-ফুঁকিতে তাচ্ছিল্য করিল, ও এখনও ভারজিন ; ভারতবর্ষের একমাত্র চিরকুমার চিত্রকর এবং ভাস্কর । সে কারণে নিউড আঁকে নাই আজও, নগ্ননারী মূর্তিও গড়ে নাই । উল্লাস কহিল, নগ্ন নারী দেখিতে-দেখিতে কী করিয়া আঁকিব জানি না, কেননা আমি উত্তেজিত হইয়া পড়িব, আমার দ্বারা আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে, একাগ্র হইতে পারিব না । বিশ্বখ্যাত চিত্রকরগণ কী করিয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতেন জানি না ; হয়ত আমি দক্ষ চিত্রকর ও ভাস্কর হইতে পারিব না ।
আপাতত এশহরে থাকুন, তীর্থ করিতে আসিয়াছেন, পূণ্য লাভ না করিয়া ফিরিবেন কেন ? হোটেলে থাকা চলিবে না ; তাহা সম্ভবপর নহে । হোটেলগুলি দুই-তিন দিনের চেয়ে বেশি বসবাসযোগ্য নহে । ঘর ভাড়া করিতে হইবে । চওক, গোধোলিয়া, বাঙালিটোলা, মাহমুরগঞ্জ, কামাচ্ছা, সিগরা সর্বত্রই ঘর ভাড়া পাইবেন । শবদাহের গন্ধ সহ্য করিতে পারিলে মণিকর্ণিকা যাইবার পথে যে ঘরগুলি পাওয়া যায়, তথায় থাকিলে পোস্টকার্ডে লিখিত ইষ্টলাভ করিবেন । ওই এলাকায় মাত্রাহীন যথেচ্ছাচারও স্বাভাবিকতার মাত্রা পাইয়া থাকে । আশ্বস্তকারী দীর্ঘ বক্তৃতার পর নির্মল কহিল, ঘর না পাওয়া পর্যন্ত আমার গেস্টরুমটিতেই থাকুন ; আমি ভৃত্যকে বলিয়া দিব, তাহাকে টাকা দিলে সে বাজার হইতে চা-খাবার আনিয়া দিবে । কলকাতা হইতে আমার পরিচিত চিত্রশিল্পী ও ভাস্করগণ আসিলে ওই ঘরটিতেই কয়েকদিন আশ্রয় লন ।
সবাই পুনরায় চুপচাপ । নেশা করিলে দেহের ভিতরেই বার্তার চোরাস্রোত বহিতে থাকে বলিয়া কাহারও সহিত সেসময়ে কথা বলিবার প্রয়োজন হয় না । বালকবয়স হইতে পূঞ্জীভূত কথাবার্তা ভাসিয়া উঠিতে থাকে সংলগ্ন দৃশ্যাবলীর সহিত । পনেরো মিনিট পরে উল্লাস বিদায়-সৌজন্য না জানাইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল ।
হিন্দি ভাষার প্রখ্যাত কবি নাগার্জুন স্নান করিয়া ফিরিতে ছিলেন, যাঁহার সঙ্গী যুবগণের দিকে হাত তুলিয়া অভিবাদন জানাইল আমার সঙ্গী চিত্রকরগণ । নাগার্জুন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন, বলিল নির্মল । ভাবিলাম, ধর্মের কোনো প্রয়োজন আছে কি মানবজীবনে ! ধর্ম লইয়া কী করিব ? কেহই মহাপুরুষগণের ন্যায় হইতে পারে না, তাঁহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে পারে না, কেবল পরস্পরের সহিত ঝগড়া করিয়া মরে ।
প্রণব বলিল, নাগার্জুনের সঙ্গীদের মধ্যে চশমা পরা যুবকটি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, আমুখ নামে সশস্ত্র বিপ্লবপন্হী পত্রিকার সম্পাদক, সকলে উহাকে কাঞ্চনকুমার বলিয়া ডাকে ; নকশালপন্হীগণ পিতৃদত্ত নাম পরিত্যাগ করিয়া থাকেন, অনেকটা সন্ন্যাসীদের ন্যায় ; ময়লা কোঁকড়াচুল স্বাস্হ্যবান যুবকটি সুবিমল বসাক, আমাদের গেরিলা পেইনটার্সের হ্যাপেনিঙে কয়েকদিন পূর্বে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন ।
নির্মল কহিল, অদ্যরাত্রে তো আপনি আমার গেস্টরুমে থাকিবেনই, ইচ্ছে হইলে অংশগ্রহণ করিবেন ।
পাঁচজনে পুনরায় কথাবার্তার বিষয়হীনতায় আক্রান্ত হইয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলাম । মানুষ একত্রিত হইয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে । চুপচাপ বসিয়া থাকিবার জন্যই একত্রিত হয় । হয়ত ইহা আদি মানবের অবদান বা তাহারও পূর্বের স্মৃতিভার । তখন মানুষ মুখ বুজিয়া ঘাসে চরিত, হরিণের মতো, বা ডাঙায় রৌদ্রস্নানরত কুমিরের ন্যায় ।
বরুণা ও অসি নদীগুলি কোথায়, যাহাদের সঙ্গমে এই বারাণসী তীর্থ, বর্তমানে অর্ধচন্দ্রাকৃতি গঙ্গার তীরে অবস্হান করিয়া ভূখন্ডটি অতুল, কেকা বউদি, জোসেফিন, উপেন, মোহিত, নির্মল, প্রণব ও আমার মতো শতশত মানুষের কার্যকলাপে প্রশ্রয় দিতেছে ! একদা ধন্বন্তরির পুত্র দিবোদাস এই শহরকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিলেন । যখন এই এলাকাটি গৌড়ের রাজা মহীপালের রাজত্বের অন্তর্গত ছিল, কত বাঙালি বৌদ্ধ আসিয়াছিলেন । তাঁহাদের বংশধররা কোথায় ? তীর্থটি কনৌজ-রাজ দখল করিলে, যে কনৌজিয়া বাঙালি শৈবধর্মীগণ আসিয়াছেলেন, তাঁহারা কোথায় ? কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়, যিনি নকশাল কাঞ্চনকুমার নামে খ্যাত, তিনি কি সেই শৈবগণের বংশধর ? নির্মলের পুর্বপুরুষগণ কি বৌদ্ধ ছিলেন ? ধার্মিক রাজনীতি বোধহয় রাজনৈতিক ধর্মরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে ! যোনির ভিতর প্রবিষ্ট লিঙ্গ এ-শহরে পূজ্য । নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রশ্রয় দিতে তাই থাকিয়াই যাইব এই তীর্থক্ষেত্রের প্রাচীন মানুষগণের ভিড়ে । এক মাস না হউক, অন্তত এক সপ্তাহ তো থাকিয়া যাইতেই পারি । কত যে দেবী-দেবতার মন্দির এই শহরটিতে নির্মাণ করা হইয়াছে, বোধহয় হাজার বৎসর ধরিয়া, তাহার ইয়ত্তা নাই । একজন খুচরো দেবতারূপে টকিয়া থাকিব কয়েকদিন, পিঁপড়া বা আরশুলা যেভাবে এই তীর্থক্ষেত্রে টিকিয়া আছে রাজা হরিশচন্দ্রেরও পূর্ব হইতে ।
নির্মলের কথায়, মিশ্র সিগারেটের নেশার তন্দ্রা বিঘ্নিত হইল । আমরা যাইতেছি শিশির ; আপনি ঘোরাঘুরি করিয়া অঞ্চলটি দর্শন করুন । ক্লান্ত হইলে নিকটবর্তী কোনো হোটেলে খাইয়া-দাইয়া রিকশয় চাপিয়া চলিয়া আসিবেন । গেস্টরুমে কতিপয় নেশার চারমিনার টেবিলের উপর রক্ষিত আছে ; ইচ্ছা হইলে ফুঁকিবেন, একা-একা নেশাচ্ছন্ন থাকিবার পরমানন্দের বৈশিষ্ট্যটি উপভোগ করিতে পারিবেন । উহারা সদলে উঠিয়া প্যান্টের পিছন দিক ঝাড়িতে ঝাড়িতে চলিয়া গেল । এদিক-ওদিক তাকাইয়া বুঝিলাম, আমরা ভিখারিগণের কাতারে বসিয়াছিলাম । এই স্হানটিও কোনো ভিখারির জন্য নির্দিষ্ট । ফুটপাতের ওই পারে দণ্ডায়মান ভিখারিটিকে দেখিয়া অনুমান করিলাম সে অপেক্ষা করিতেছে কখন আমরা তাহার সিংহাসনটি খালি করিব । লোকটি তো পঙ্গু নহে, কেন সে কাঞ্চনকুমারদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে চাহে নাই ! রাষ্ট্রের বিরোধীতা করা কি প্রতিটি ভিখারির জন্মসিদ্ধ অধিকার নহে ?
নির্মল প্রমুখ যাইবার কিয়ৎক্ষণ পর আমিও উঠিয়া পড়িলাম । নিচে নামিয়া গঙ্গার তীর ধরিয়া হাঁটিতে লাগিলাম । একটি ঘাটে দেখিলাম আকাশি রঙের সালোয়ার-কুর্তা পরিহিত এক যুবতী উপর হইতে দ্রুতবেগে আমার দিকেই ছুটিয়া আসিতেছে । কে মেয়েটি ! সে তো আমার পরিচিত নহে । বেনারসে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষের অভাব নাই । এই মেয়েটিও অমন কোনো গোপন বৈশিষ্ট্য লইয়া তীর্থক্ষেত্রটিতে আসিয়া থাকিবে । প্রমাদ গণিয়া কয়েক পা পিছু হটিতে, মেয়েটি গঙ্গায় নামিয়া পাঁচ-ছয়বার ডুব দিয়া একইভাবে তড়বড় করিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল । অজানা ভয়ে পুনরায় আক্রান্ত হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া ঘাটের ছাউনিতে গিয়া চটি খুলিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলাম । মনস্হ করিলাম, ভয় ও নেশা কাটিয়া গেলে কোনো পরিচ্ছন্ন রেস্তরাঁয় গিয়া মাছ-ভাত খাইব । আমি মাত্র কয়েক ফুঁকেই নেশায় উড়িতেছি, মস্তিষ্কের ভ্রমরগুলি ভোঁ-ভোঁ করিতেছে, চক্ষের সন্মুখে অজস্র প্রজাপতি ভাসিতেছে, আতসবাজির ফুলকি ছড়াইয়া পড়িতেছে, অথচ নির্মলগণ কী করিয়া ফুঁকের পর ফুঁক মারিয়া সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করিতে পারে !
ছাউনিতে পৌঁছাইয়া মনে হইল, এই ঘাটটি মহিলাগণের জন্য নির্ধারিত । শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া ফেলিয়াছি বলিয়া ঘাটটি ছাড়িয়া অন্যত্র যাইবার সাহস পাইলাম না । মহিলাগণ যাইবার-আসিবার সময়ে একপলক দেখিয়া ভ্রুপল্লবে সন্দেহের ঢেউ তুলিতেছেন । সেই আকাশবসনা সিক্ত দেহ লইয়া যে স্হলটিতে হয়ত ক্ষণিক স্হির হইয়া শ্বাস লইয়াছিল, আমি সেই লক্ষ-লক্ষ নারী পদচিহ্ণ-আঁকা ক্ষয়িত পাথরে বসিয়া পড়িলাম । য়ুঝিতে পারিলাম যে প্যান্টটি পিছনদিকে সম্পূর্ণ ভিজিয়া গেল । নেশাগ্রস্ত অবস্হায় পশ্চাৎদিক ভিজাইয়া ভালোই লাগিল । টের পাইলাম যে ক্লান্ত ও হাতাশাচ্ছন্ন আমার মাথাটি কাঁধ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, বাতাসে ভাসমান অবস্হায় ইতি-উতি তাকাইয়া মিটিমিটি হাসিতেছে । মাথাটি আর ঘাড়ের উপর ফিরিয়া না আসিলে কি করিয়া নির্মলের গৃহে যাইব সে দুশ্চিন্তায় পড়িলাম । বেনারস হইতে বাড়িই বা ফিরিব কী করিয়া ? কেবল ধড় দেখিয়া বাড়ির কেউ কি বিশ্বাস করিবে যে আমি শিশির !
দেখিলাম জনৈকা স্হূলকায়া প্রৌঢ়াকে, যাঁহার এক হস্তে গঙ্গাজল ভর্তি পিতলের চকচকে ঘটি ও অপর হস্তে ফুলে সজ্জিত রূপার ডালি, মুণ্ডটি তাঁহাকে প্রশ্ন করিয়া বসিল, মাতাজি আপনি তো প্রতিদিন আসিয়া, বহু বৎসর হইতে পূনভস্নান করিতেছেন ; আপনি কি ভাগবানকে দেখিয়াছেন ? হতচকিত পৌঢ়া সেদিকে চাউনি মেলিয়া প্রস্হান করিতে, মুণ্ডটি নিমীলিত চক্ষে আমার গলার উপর স্বস্হানে আসিয়া বসিতে আশ্বস্ত হইলাম ।
কিয়ৎক্ষণ পর যৎসামান্য সম্বিত ফিরিল, এবং মনে হইল, কেহ আমার কোলে মাথা রাখিয়া আমার দুই পা ধরিয়া আছে, ফোঁপাইতে-ফোঁপাইতে বলিতেছে, বাবা আমাকে ক্ষমা করুণ, আমি আপনাকে চিনিতে পারি নাই মহারাজ, কবে হইতে আমি আপনার দর্শনাভিলাষী, আপনার সাধারণ পোশাক দেখিয়া বুঝিতে পারি নাই আপনি নগন্য মানবদেহ আশ্রয় করিয়া আমার আস্হা পরীক্ষা করিবেন ।
বুঝিলাম আমার হিমঘাম ফিরিতেছে । শিরায় লুক্কায়িত আতঙ্ক মহাউল্লসে গিয়া আছাড় খাইতেছে হৃৎপিণ্ডে । কোলে রক্ষিত মাথার কম্পিত ক্রন্দন, ও ক্রমে উচ্চরবে ক্ষমা যাচনায় নেশা, অন্তত কিছুটা, বিলীয়মান হইতে থাকিলে, বুঝিতে পারিলাম, সেই প্রৌঢ়া, ফিরিয়া আসিয়াছেন ; তাঁহার সিক্ত ও আলুলায়িত কাঁচাপাকা চুলে আমার ছাইরঙা প্যান্ট ও বুশশার্টের কিয়দংশ আরও ভিজিয়া গিয়াছে । ত্বকের উপরে চোরকাঁটার আকারে দেখা দিতেছে ত্রসন ।
নিজেকে ধাতস্থ করিবার প্রয়াস করিলাম । শুনিলাম, আমার সন্ত্রস্ত ও অভিশঙ্কিত কন্ঠ ভঙ্গ-হিন্দি মিশ্রিত বাংলায় বলিতেছে, মাতাজি, এ আপনি কী করিতেছেন, উঠুন, উঠুন, আপনি আমার দ্বিগুণ বয়সী, পায়ে হাত দিবেন না, উঠুন উঠুন, কাঁদিবেন না, কাঁদিবেন না, ছি ছি ছি, এ আপনি কী করিতেছেন !
আমার স্বকীয় অন্তর্কলহের কলুষ আমায় বারংবার এইরূপ বিপদে আনিয়া আছড়ায়, এবং ততই নিজেকে তামসিক অন্ধকারে আহ্লাদিত করিতে চাহিয়াছি । অসুখিত, বেদনাতুর, অভিসন্তপ্ত হইয়াছি তজ্জন্য , কিন্তু গ্লানি ও পাপবোধ হয় নাই । কিছু-কিছু কাজ কেন করি, সেই স্কুল জীবন হইতে, তাহার ব্যাখ্যা আমার নিকট কেবল একটিই । আমি অভিজ্ঞতার বুভুক্ষু । সকালে, সিগারেটে ম্যাডেলিনের লালায় আমি প্রাণোচ্ছল সজীবতা অর্জন করিয়াছিলাম । কেকা বউদির মুখ ্ইতে ধুম্রপানের গন্ধ নির্গত হওয়ায়, আমি ইশারা পাইয়াও, ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়া ধরি নাই– সে সময়ে নারীমুখ-গহ্বরের উৎকন্ঠিত শ্বাসে সিগারেটের সুবাসটিই ছিল আমার অভিজ্ঞতার কেন্দ্র ।
এই প্রৌঢ়ার ধর্মভাবনায় না জানি কোথায় আঘাত দিয়া ফেলিয়াছি যে তাঁহার পীড়া আমার কোলে ক্রন্দন হইয়া প্রকাশিত হইতেছে । এক্ষণে আমি কী করিব ! তাঁহার বাহু ধরিয়া তুলিবার প্রয়াসে বুঝিলাম, ইতোপূর্বে ডালির ফুলগুলি আমার মাথার উপর উপুড় করিয়া দিয়াছেন , গঙ্গাজলও যথাষ্ট ছিটাইয়াছেন আমার মাথায়, যাহা আমার নেশাকে ক্ষীণ করিতে সাহায্য করিয়া থাকিবে ।
প্রৌঢ়া একইপ্রকার অনুনয় ও ক্ষমা যাচনা করিতেছেন । স্নানার্থিনীদিগের ভিড় জমিতেছে আমাকে ঘিরিয়া । ইহার পর অসাধুবৃত্তির জন্য অবধারিত মার খাইব । প্যান্ট বুশশার্ট চশমা পরিহিত একজন ছিপছিপে বাঙালি যুবক কোন প্রক্রিয়ায় নমস্য ও শ্রদ্ধেয় হইয়া উঠিলেন , উপস্হিত সবায়ের মস্তিষ্কে অমন চিন্তা নিশ্চয়ই জাগিতেছে । প্রহার আরম্ভ হইলে আমার দুই পাশপকেট ও ওয়াচপকেটে রক্ষিত দুই মাসের মাহিনা লুন্ঠিত হইবে । নির্মলের গেস্টরুমে শতচ্ছিন্ন পোশাক ও প্রহারচিহ্ণ লইয়া ফিরিব ।
স্হূলকায়া প্রৌঢ়ার থলথলে বাহুদুটি তুলিতে আমি অক্ষম , তাঁহাকে দাঁড় করানো তো অসম্ভব । ক্রন্দন ও মর্মপীড়া তাঁহাকে আরও ভারি করিয়া তুলিয়াছে । হঠাৎ মাথা উঁচু করিয়া তিনি জানকীরাম জানকীরাম নামে কাহাকে চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন, এবং অজানা তরাসের চিত্তোদ্বেগে এবার আমিই মৃদু কাঁপিতে লাগিলাম ।
প্রৌঢ়া নিজেই উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং ডান হাত দিয়া আমার কোমর এমনভাবে ধরিলেন যেন আমি মুমূর্ষু বৃদ্ধ । অনাবিল সুগন্ধের মোড়াক খুলিয়া আমাকে তাহার ভিতর আশ্রয় দিলেন মনে হইল । কথা শুনিয়া আঁচ করিয়াছিলাম তিনি মারোয়াড়ি । তিনি যে অত্যন্ত ধনী পরিবারের সদস্যা, তাহা অনুমান করিলাম সুগন্ধ হইতে, যাহা গঙ্গাস্নান সত্ত্বেও ত্বকে মিশিয়া আছে । নিজের আনন্দবিহ্বলতায় তিনি আমার ঘর্মাক্ত পোশাক ও তামাকু-গঞ্জিকাদির দুর্গন্ধ সম্ভবত পাইতেছেন না ।
একজন শ্যামবর্ণ পালোয়ান, ধুতি-ফতুয়া পরহিত, সম্ভবত জানকীরাম, উদ্বিগ্ন মুখে ছুটিয়া আসিয়াছিল, এবং মাটি হইতে পিতলের ঘটি তুলিয়া রূপার সাজিতে রাখিতেছিল, তাহাকে প্রৌঢ়া নির্দেশ দিলেন অপরদিক হইতে আমাকে বেষ্টন করিয়া গাড়িতে লইয়া যাইতে । স্পষ্ট শুনিলাম, নেশার আলোছায়া সত্ত্বেও, প্রৌঢ়া আমার নামকরণ করিয়া ফেলিয়াছেন ভগবানজি মহারাজ ।
আমি বলিতে লাগিলাম, মাতাজি আমি রক্তমাংসের একজন নগণ্য মানুষ, ধর্মাধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ, আপনি ভুল করিতেছেন, এ জগতের কোনও ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণে শ্রেয় । কিন্তু প্রৌঢ়ার কানে কিছুই যাইতেছে না । তৎপরিবর্তে তিনি জানকীরামকে বলিতেছেন, ভগবানজি মহারাজকে সাবধানে লইয়া যাইতে, কেননা সদ্য গঙ্গা হইতে আবির্ভূত হইয়াছি । জানকীরামের মুখভাব দেখিয়া মনে হইল, সে প্রৌঢ়ার কথা বিশ্বাস করিতেছে ।
জানকীরাম, যদিও বাঁহাতে আমার কোমর আঁকড়াইয়া, আমাকে প্রায় দুই-তিন ইঞ্চ মাটি হইতে উপরে, ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছিল । সঙ্গে ডানহাতে জাপটাইয়া প্রৌঢ়া । পলায়নের উপায় নাই । হয়ত সমবেত স্নানার্থী নারীগণের যৌথ প্রহারের তুলনায় ইহাই আপাতত ভালো । চটি জোড়া পড়িয়া রহিল । আমাকে ঢোকানো হইল একটি গাড়ির পিছনের সিটে, কালো রঙের শেভ্রলে বা ফোর্ড বা হিন্দুস্হান প্রতিভাত হইল । প্রৌঢ়া আমার পাশে বসিয়া, আমার কোমর দুই হাতে জাপটাইয়া, পুনরায় ক্রন্দন আরম্ভ করিলেন ।
অপ্রকৃতিস্হতার স্হিতি, নাকি ধর্মোন্মাদনার ভারসাম্যহীনতা, কিসে যে মহিলা আক্রান্ত ঠাহর করিতে না পারিয়া, সিক্ত মাথায় হাত বুলাইতে, তাঁহার ক্রন্দন প্রশমিত হইলেও, ফোঁপানির মৃদুমন্দ কম্পন বজায় রহিল । জানকীরাম গাড়িটি স্টার্ট করিলে, বুঝিলাম, সে-ই ড্রাইভার ।
মায়ের কথা মনে পড়িয়া গেল । একান্নবর্তী পরিবারে তাঁহার অধিকাংশ সময় রান্নাঘর ও তাহার যোগানের প্রয়াসে কাটিয়াছে । তাঁহার সিক্ত পাকা চুলের স্পর্শ ও সুবাস মনে নাই । একত্রে মাতা-পুত্রের বার্তালাপ ও ভালো-সময় শৈশবেও ঘটে নাই ।
কে জানে আমার কী করণীয় । জানি না কোথায় চলিয়াছি । আমার পকেটের পোস্টকার্ডটি নৈতিকতার পতাকারূপে বুকের উপর পতপত করিতেছে । এই পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের ভিতরই ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে আরেকজন মানুষের প্রশ্নাতীত-উত্তরহীন আনুগত্য ও শ্রদ্ধা ; প্রায় শ্বাসরুদ্ধকর ; আমার পায়ে বেড়ি । কাঁচের কারাগারে যেন আমি আবদ্ধ । এই তীর্থস্হানের প্রধান দেবতার মতোই মাটিতে চিরকালের জন্য প্রোথিত , পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত একই স্হানে নির্বাক দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে ।
মোটরগাড়িটি কতক্ষণ চলিয়াছিল জানি না । আমার মনে হইতেছিল, এই ভুতগ্রস্ত পথের শেষ নাই । সারাজীবন চলিতে থাকিব । প্রকাশ টকিজের দরোজায় জনগণের মারকাট হইচই ; কোনও ভোজপুরি ফিলমের বিপুল দর্শনার্থী, পথে উপচাইয়া পড়িতেছে । গাড়ির গতি শ্লথ হইলে, চকিতে ভাবিলাম, নামিয়া দ্রুত পলাইয়া যাই । পুনরায় মনে হইল, জানকীরাম চিৎকারসহ আমাকে ধরিতে ধাবমান হইলে, সিনেমা দর্শনার্থী জনগণের হাত হইতে, টিকিট পায় নাই বলিয়া যাহারা ফুঁসিতেছে, নিস্তার পাইব না ।
অদৃষ্টে আমার বিশ্বাস নাই , কিসে যে বিশ্বাস আছে তাহাই তো অন্তর্কলহের বিচার্য প্রশ্ন । একজন ঘোর অবিশ্বাসীকে আঁকড়াইয়া আছেন আরেকজন পরিপূর্ণ বিশ্বাসী । এই অভিজ্ঞতাও সংগ্রহযোগ্য । অজ্ঞান হইতে জ্ঞানের দিকে অজানা যাত্রা । আপাতত ইহাতে মজিয়া থাকি । ধুতি পরিহিত এবং কাঁধে একখানি উত্তরীয় থাকিলে অসততার ষোলোকলা পূর্ণ হইত ; শ্রীশ্রী একশতআট রাক্ষসজিউ অথবা খোক্কোসজি মহারাজ অথবা বাবাশয়তানশ্রী রূপে শিষ্যশিষ্যা পরিবৃত হইয়া শোষণ ও শাসন করিতাম । কিন্তি ওই গুরুজিউগুলিও তো স্বাধীনতাহীন— কীভাবে জীবন অতিবাহিত করে তাহারা ? ইচ্ছানুযায়ী চলার বলার স্বাধীনতা নাই ! আজীবন একটি নকল জোব্বায় নিজেকে পুরিয়া সকলের প্রণাম গ্রহন করিতে থাকো !
শেষাবধি গাড়িটি ঢুকিল একটি পুরাতন দোতলা প্রশস্ত অট্টালিকায়, হর্নের সতর্কবার্তায় দারোয়ান গেট খুলিয়া দিবার পর । জানকীরাম ও প্রৌঢ়া আমাকে এমনভাবে নামাইলেন যান আমি পালকে নির্মিত । পোর্টিকোর ভিতর পঁহুচাইবামাত্র ঘোমটাঢাকা দুইজন বধু, তাহারাও স্হূলকায়া, ঘটির জল ঢালিয়া আমার পা ধুইল এবং শাড়ির আঁচল দ্বারা পুঁছিয়া দিল । খালি পায়ে কিয়দ্দূর হাঁটিবার দরুণ পা নোংরা হইয়া গিয়াছিল, তবুও তাহাদের চোখেমুখে নোংরা পদদ্বয় সম্পর্কে অভক্তি দেখিলাম না । এবার তাহারাই আমাকে দুইদিক হইতে জাপটাইয়া প্রথম ঘরটিতে, যাহার মেঝেয়, সুদৃশ্য পুরু কার্পেট বিছানো, লইয়া গিয়া একটি পূজাসনে বসাইল । আসনের সন্মুখে কারুকাজ-করা জলচৌকি । বধুগণের তপ্ত, যদিও সুগন্ধী, দেহের চাপ হইতে মুক্ত হইয়া বরং ভালো লাগিল– এত নিকট হইতে দুই অচেনা নারী জাপটাইয়া ধরিয়াছিল, তবুও আমার সামান্যও যৌনতার উদ্রেক হইল না বলিয়া আশ্চর্য লাগিল । সত্যই কি দেবত্বে উন্নীত হইয়া গিয়াছি !
নির্ণয় লইলাম কোনও কথা বলিব না । কেহ কোনও প্রস্ন করিলে, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিবার প্রয়াস করিব বা ঘাড় নাড়াইয়া ইশারা করিব । দুই চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মস্তিষ্ককে ফাঁকা ও যাবতীয় চিন্তা হইতে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিলাম । আকস্মাৎ মনশ্চক্ষে কন্ঠ ্ইতে হাঁটু পর্যন্ত পীতাভ, গোলাপী নারীদেহ ঝিলিক দিয়া উঠিল , বর্তুলাকার নিটোল দুই স্তনসহ, যাহা পার্থিব অভিকর্ষ এবং মানুষের হাত ও মুখের আদর সহ্য করিয়াও উদ্ধত । চোখ মেলিতে বাধ্য হইলাম ।
জলচৌকির উপর, সম্ভবত রূপার, বগিথালা । তাহাতে ধান্য দুর্বা হরিতকি হলুদ লালসুতা ইত্যাদি রাখা । কবেকটি বালক-বালিকা আসিয়া আমার শঅর্ট ও গেঞ্জি খুলিয়া লইল , বধু দুইজন মহার্ঘ মৃগতনাভিতে সিক্ত তোয়ালে দ্বারা হাতমুখ ও বুকপিঠ পুঁছিয়া দিল । প্রতিরোধ করিলাম না । নিজেকে মনে হইল অসহায় ও বোকা ক্রীড়নক বা পাথরের মূর্তি ।
এই গৃহের কর্ত্রী হয়ত কোনও বিকারে আক্রান্ত ; কিন্তু বালক-বালিকা হইতে চাকর-দারোয়ান সকলে সেই বিকারকে প্রশ্রয় দিতেছে কেন ? হয়ত ডাক্তার নিদান দিয়া থাকিবে । ঘরটিতে চক্ষু বুলাইলে পরিবারটির অপার বৈভবকে মনে হইল দৃষ্টিকটু । তাহা হইলে কিসের অভাব পূরণ করিতে না পারিয়া প্রৌঢ়া বিকারে আক্রান্ত ? হয়ত অভাবহীনতাই পরিবারটিকে আকুলতা আবিষ্কার করিতে শিখাইয়াছে, এবং দুর্ঘটনাক্রমে আমি সেই তোলপাড়ের কেন্দ্রে আসিয়া পড়িয়াসছি । অন্যান্য দিন কেহ না কেহ এই সংক্ষোভের শিকার হয় , প্রকৃত সাধুবৈরাগী ও গৃহত্যাগীর তো অভাব নাই এই তীর্থক্ষেত্রে, যাহারা জীবনের উদ্দেশ্যহীনতার উদ্দেশ্য খুজিয়া ফিরিতেছে, পথে নামিয়া জীবন নামক রহস্যটির চোরাসুড়ঙ্গে ঘুরিয়া ফিরিতেছে ।
আমার দাদু জীবিত থাকিলে যে বয়সের হইতেন, সেই বয়সের এক বৃদ্ধ ডানদিকের ঘর হইতে আসিয়া আমার সন্মুখের জলচৌকির পার্শ্বে উপবেশন করিয়া আমার দুই পা স্পর্শ করিয়া ডান হাতটি আমার দিকে আগাইয়া দিলেন । একজন বয়োবৃদ্ধ আমার পায়ে হাত দিয়া মাথায় ঠেকাইতেছে, এই অভিজ্ঞতা আমার নিকট বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হইবার ন্যায় । অগত্যা মুখ খুলিতে হইল, যদিও মনস্হ করিয়াছিলাম কোনও কথা কহিব না । এক পলক সবার দিকে তাকাইয়া গম্ভীরকন্ঠে বলিলাম, কেহ আমার পায়ে হাত দিবেন না ।
বৃদ্ধ মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত আগাইয়া বসিয়াছিলেন । ইহার যেটুকু অর্থ আমার বোধগম্য হইল, তাহাই করিলাম । ধান্য যব দুর্বা তুলিয়া বৃদ্ধের পক্ককেশ মাথায় রাখিলাম, এবং একটি হলুদে লালসুতা জড়াইয়া ডান হাতে বাঁথিয়া দিলাম । বৃদ্ধ এবার পায়ে হাত না দিয়া মাটিতে গড় করিলেন এবং ধুতির ট্যাঁক হইতে কয়েকটি একশো টাকার নোট থালার উপর রাখিলেন । দেখিয়া, আমার মস্তিষ্কে পুনরায় অজানা আতঙ্কের দপদপানি শুরু হইল ।
এতক্ষণে গৃহের, হয়ত সকল সদস্যই, পুরুষ যুবতী কিশোর কিশোরী মিলাইয়া প্রায় দশবারোজন, আসিয়া জড়ো হইয়াছিল, যাহারা একে-একে গড় করিল, এবং আমি মাথায় ধানদুর্বা রাখিয়া হাতে হলুদ-লাল সুতা বাঁধিলাম । সকলেই প্রণামান্তে টাকা রাখিতেছিল । কেবল বধু দুইটি রাজার মুখ আঁকা এক-এক মুষ্টি রৌপ্যমুদ্রা রাখিল । উহাদের দেহ সেসময়ে তপ্ত ছিল অধচ এক্ষণে বধুদুইটির নরম হাত বেশ ঠান্ডা লাগিল । জানি না কেন, তাহাদের হাতে হলুদ-সুতা বাঁধিবার সময়ে যৎসামান্য কম্পন ঘটিয়া গেল দেহের কানাচে । তাহাদের ক্ষেত্রে দ্রুত বাঁধিয়া দিলাম, কম্পনটিকে সীমিত রাখিবার প্রয়াসে । থালার দিকে যাহাতে তাকাইতে না হয় তাই চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রহিলাম ।
চক্ষু কিয়ৎক্ষণ মুদ্রিত রাখিবার পর পুনরায় স্পষ্ট হইয়া উঠিল ম্যাডেলিনের দেহখানি । বিভিন্ন নারী, অফিসের সহকর্মির্ণী, কলেজের সহপাঠিনী, বাংলা ও হিন্দি ফিলমের নায়িকাগণের নগ্নদেহ কল্পনায় আনার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াও সফল হইলাম না । পরিবর্তে ম্যাডেলিনের দেহ আরও দ্যুতিময় হইয়া উঠিল । হঠাৎ মনে হইল, উপস্হিত এই সকল মানুষের নিকট আমিই মনে-মনে নতজানু হইয়া প্রার্থনা করি । চক্ষু মুদিয়া হাতজোড় করিলাম, মৃদুস্বরে ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন ম্যাডেলিন জপিতে থাকিলাম ।
আমার তো কোনো আদর্শ নাই, ঈশ্বর নাই ; আমি সার্বভৌম অবিশ্বাসী । হাত জোড় করিয়া মুদ্রিত চক্ষে, বৃদ্ধটি হইতে বালক-বালিকা, সকলের নিকট আমি জোড়াহাত ঘুরাইয়া প্রার্থনা করিতে লাগিলাম, এবার নিঃশব্দে, যাহাতে কেহ টের না পায় যে আমি তাহাদের আশীর্বাদ করিবার পরিবর্তে তাহাদের নিকট ভিক্ষা চাহিতেছি । আমাকে আরেকবার, অন্তত আরেকবার, ওই দ্যুতিময় দেহধারিণীর সংস্পর্শে লইয়া চলো ; আরেকবার তাহার দেহখানি আমার সন্মুখে, নাগালের ভিতর, স্পর্শানুভূতির আয়ত্বে, আনিয়া দাও । অনুভব করিলাম, আমার যৌনাঙ্গ সাড়া দিতেছে । হয়ত ইহাদের মর্মে-মর্মে আমার প্রার্থনা প্রবেশ করিয়াছে এবং ইহারা আমাকে নিঃশব্দে আশীর্বাদ করিতেছেন । যৌনাঙ্গ শিথিল না হওয়া পর্যন্ত চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রহিলাম ।
চক্ষু মেলিয়া দেখিলাম যে তাঁহারাও আমার দিকে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছেন । এই দেখিলাম যে জলচৌকির উপর, রূপার থালার পরিবর্তে, পিতলের ঝকঝকে বগিথালা, তাহাতে কয়েকটি ফুলকো লুচি, জাফরানি ভাত, ছোট-ছোট পাঁচটি পাত্রে তরকারি, একটি পাত্রে দইয়ের কঢ়ি, একটি পাত্রে পায়সান্ন এবং কাঁসার বড় গ্লাসে ঘোল । একজন যুবক একটি গামলা মেঝেয় রাখিয়া ঘটি লইয়া দাঁড়াইয়া ছিল । আমার অনুমতির পূর্বেই সে আমার হাত দুটি নিজহস্তে লইয়া এক এক করিয়া ধুইয়া দিল । একজন বধু তোয়ালে দিয়া হাত মুছিয়া দিলে, আমি বলিলাম, আমি এত বেশি আহার করিতে অভ্যস্ত নহি ।
বৃদ্ধটি কহিল, ভগবানজি মহারাজ, আপনি যতটা পারেন ভক্ষণ করুন, অবশিষ্টাংশ আমরা প্রসাদরূপে গ্রহণ করিব । শুনিয়া, কন্ঠে বাকহীনতার শ্লেষ্মা আটকাইয়া গেল । এক ঢোঁক জল খাইলাম । জলটি শীতল ও সুগন্ধিত । কুকুর-বিড়াল ব্যতীত আর কেহ কখনও আমার উচ্ছিষ্ট খাইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না । কাজের লোক জঞ্জালের সহিত আঁস্তাকুড়ে ফেলিয়া দিয়া আসে । হয়ত কুকুর-বিড়ালের সহিত স্বাধীন দেশের ভিখারি নাগরিকগণ আমার অজানিতে ভক্ষণ করিয়া থাকিলেও থাকিতে পারে । বঙ্গদেশে অমন নাগরিকের সংখ্যা তো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াই চলিয়াছে , পঞ্চবার্ষিক যোজনার ঢালাও ব্যবস্হা সত্ত্বেও ।
কেন আমার সহিত এই গৃহে অঘটণগুলি ঘটিয়া চলিয়াছে, তাহা লইয়া চিন্তা করিব না মনস্হ করিয়াছি । খাওয়া আরম্ভ করিলাম । সন্দেহ নাই যে খাঁটি ঘিয়ে প্রস্তুত ; বেশ সুস্বাদু । সবায়ের সন্মুখে বসিয়া, যেহেতু রেস্তরাঁ নহে, খাওয়া কেমন যেন বিসদৃশ । আবার কখন খাওয়া হইবে নিশ্চিত নহি । পেট ভরিয়া খাইলাম । তিনচতুর্থাংশ অবশিষ্ট রহিল । পুনরায় একইভাবে মুখ ধোয়ানো হইল । শৈশবের পর এই প্রথম কেহ আমার হাত খাইবার আগে ও পরে ধুইয়া দিল । একটি বধু আসিয়া মুখও পুঁছিয়া দিল । অচেনা মনুষের যত্নআত্তি শরীরের কোন-কোন রসায়নে ক্রিয়া ঘটায় তাহা জানি না, তবে বহু প্রকার প্রতিক্রিয়া যে ঘটায় তা আজিকে জানিতে পারিলাম ।
এবার হয়ত কোনো ঘরে লইয়া গিয়া শয়ন করিতে বলিবে । অনুমান ঠিকই ।প্রৌঢ়া প্রস্তাব করিলেন, আমি পার্শ্ববর্তী শয়নক্ষে গিয়া বিশ্রাম লই । রাত্রে ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণীর ঠেসাঠসিতে ভালো করিয়া ঘুম হয় নাই । তদুপরি সকাল হইতে আপাদমস্তক জারিত হইতেছি বহুবিধ ইন্দ্রিয়-রসায়নে । স্বাদুভোজ্যের লোভে আহারের পরিমাণ বেশি হইয়া গিয়াছে । কেন যে সর্ববিষয়ে আমি এমন লোভী তাহার ব্যাখ্যা নিজের নিকটও স্পষ্ট নহে । আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতে পারি না । পদস্খলনের সম্ভাবনা রহিয়াছে জানিয়াও পা বাড়াইয়া দিই । স্খলনের আনন্দ উপভোগ করি ।
নির্মলের ভৃত্যটি দ্বিপ্রহরে থাকে কিনা জানা নাই । হয়ত নির্মল চিত্রকরসুলভ প্রয়াসে যত্রতত্র বিষয়ের সন্ধানে মাদাকাচ্ছন্ন হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ; তাহার গৃহে বৃদ্ধা মাতা ব্যতীত অন্যান্য আত্মীয় পরিজন কে কে আছেন জানি না ; আমার গেস্টরুমে উপস্হিতি সম্পর্কে তাঁহারা অবগত না-ও হইতে পারেন । এখানেই বরং আরাম করি ।
খালি গায়ে এতক্ষণ বিব্রত বোধ করি নাই । উঠিয়া দাঁড়াইয়া কিঞ্চিদধিক লজলায় আক্রান্ত হইলাম । বধু দুইটি দ্রুত নিকটে আসিয়া দুই পাশ হইতে পুনরায় সাহায্যার্থে আঁকড়াইয়া ধরিল । নিজের দেহভার তাহাদের নিয়ন্ত্রণে সমর্পণ করিলাম । মেদবহুল উন্মুক্ত কটিদেশ ও অন্তর্বাসহীন ব্লাউজে ঢাকা অতিকায় স্তনের স্পর্শ, যদিও এক্ষণে শীতল, স্পষ্ট অনুভব করিতেছি । অথচ দেহ উতরোল হইল না ।
বাম দিকের কক্ষটিতে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল । বিশাল শয়নকক্ষের সর্বত্র অ্যঅন্টিক আসবাব, পালঙ্কটিও । প্রতিটি বস্তু প্রতিদিন ঝাড়পোঁছ হয় , পিত্তল ও রৌপ্যবস্তু পালিশ হয় । গ্রামোফোনের পিতলের চোঙা, আলমারির ধাতব হাতল, সবই পালিশে ঝকঝক করিতেছে । বিছানাটি মেরুন মখমলের চাদরে ঢাকা ছিল, যাহা একজন যুবক, সম্ভবত ভৃত্য, তুলিয়া ফেলিতে, অনুমান করিলাম, মাথার ও কোলবালিশ দেখিয়া, গৃহের সদস্যগণ ইহা ব্যবহার করেন না । হয়ত অতিথি আসিলে, বা আমার মতো আকস্মিকতায় নির্বাচিত আগন্তুক, নয়মাসে ছয়মাসে শয়ন করে ।
যেনবা আমি নব্বইকোঠার বৃদ্ধ, তেমন করিয়া আমায় উঁচু পালঙ্কে শয়ন করাইয়া, ফ্যান চালাইয়া দেয়া হইল । অতিনরম বিছানায়, শিমুলতুলোর বালিশে মাথা রাখিয়া, ভাবিতেছিলাম, এতক্ষণে একা হইবার ও গা ছাড়িয়া দিবার সুযোগ হইল, কিন্তু বধু দুইটি দুই দিকে গিয়া পা টিপিবার উপক্রম করিল । অপ্রীতিকর ঠেকিতেছিল বলিয়া বারণ করিতে উদ্যত হইয়াও নিষেধ করিলাম না । এত সেবা যখন গ্রহণ করিতেছি তখন পা-ও টিপাইয়া লই । আর কখনও তো এই কুকার্যের আংশভাক হইবার সুযোগ জীবনে আসিবা না ; এই লোভটিই বা ঠেকাই কেন ! বধু দুইটি আমারই বয়সী হইবে । ঘি-মাখন খাইয়া দেহের আদরাকে বেঢপ করিয়া ফেলিয়াছে । টিপিতে-টিপিতে হাঁটুর উপরেও তাহাদের হস্তচাপ পৌঁছাইলেও , তাহাদের স্পর্শ তো কোনও যৌনতা উদ্রেক করিতেছে না চক্ষু মুদ্রিত করিলাম ।
ঘুম ভাঙিতে, সন্মুখের দেয়ালঘড়িতে, রোমান সংখ্যাচিহ্ণে বৈকালের সাড়ে চার ঘটিকার নির্দেশ দেখিয়া বুঝিলাম, টানা আড়াই ঘন্টা ঘুমাইয়াছি , এবং এই পুরাসময় জুড়িয়া, ছাদপাখা ঘুরিতে থাকিলেও, আমার শিয়রের নিকট টুলে বসিয়া , প্রৌঢ়াটি, রেশমি ঝালরদেয়া তালপাখার বাতাস দিয়াছেন । বধু দুইটি আমাকে ঘুম পাড়াইয়া, চশমা খুলিয়া পাশ্ববর্তী টেবিলে রাখিয়া, হয়তো বহুক্ষণ চলিয়া গিয়াছে ।
হিন্দু বাঙালির জীবনে আরাধ্যরূপে কোনো কিছু আর টিকে নেই । কেবল বাঙালিই বা বলি কেন ! বেনারসে তো ভারতের সবাই আসছেন । ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কালী, দুর্গা, সরস্বতী, জগদ্ধাত্রী, বিশ্বকর্মা প্রতিটি প্রতিমার পুজোর চেয়ে তাদের প্যান্ডেল এখন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ । সেসব প্যান্ডেল তৈরি, সাজানো, আলোকিত করার বিপুল খরচ তোলার জন্য ছলে-বলে-কৌশলে নাগরিকদের কাছ থেকে মোটা টাকা উশুল করা হয় । প্রাক-ঔপনিবেশিক কালখন্ডে, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সীমা অতিক্রম করাটা ছিল নৈতিক অধঃপতনের লক্ষণ, ঠাকুরদেবতা নামক প্রকৃতিজগতের গড়ে-দেয়া ব্যবস্হার সঙ্গে ছেলে-খেলা । নৈতিকতার উৎস ছিল আত্মিক ও ঐশ্বরিক পূর্ণতাপ্রাপ্তির যৌথ ও একক প্রয়াস । ব্যক্তিস্তরে নিখুঁত হয়ে ওঠার সর্বজনীন নকশা ছিল না । আত্মগণ্ডী মুছে গেলে তবেই তো সর্বজনীনতার ও সমরূপতার সম্ভাবনা । বলা বাহুল্য যে উপরোক্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল বেশ আগেই । তাতে জড়বাদ, ভোগবাদ বা উপযোগিতাবাদ নয়, এক ভিন্ন দার্শনিকতা কাজ করছিল ।
দার্শনিকতার ভিত্তি অনেকটা এরকম :-
মানুষকে তার জন্মের পর থেকে সামাজিকভাবে গড়েপিটে তৈরি না করলে সে অপূর্ণ থেকে যায় । পূর্ণতা তাকে আহরণ করতে হয় । এই পূর্ণতা, সনাতন ভারতীয় দর্শনের পূর্ণতা নয় । উপনিবেশবাদী ইউরোপিয় ভাবনা অনুযায়ী, আপূর্ণতা ব্যাপারটি প্রাকৃতিক ও জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত । মনুষ্যোচিত হয়ে ওঠা আদপে প্রকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্তির ফল , জ্ঞান যোগাড়ের ফল, প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি দমনের ফল । একদিকে যেমন শিক্ষা গ্রহণের কথা ভাবা হয়েছে, আরেকদিকে তেমন শিক্ষা দানের প্রয়োজন অনুভূত । স্কুল শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর । গুরু-শিষ্যের সনাতন ভারতীয় ভাবনা আজ অবলুপ্ত । আমি তো সেসময়ে বেঁচে থাকব না , কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এই সমস্ত মানুষ গড়ার কারিগরদের অধিকাংশই নেতিমানুষরূপে ক্ষতিকারক হয়ে উঠবে । মানুষ গড়া একটি ঘোলাটে ভাবকল্প । প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, কৌমবিশেষকে এবং ব্যক্তিকে ভূ-প্রকৃতি থেকে সংস্কৃতিতে স্হানান্তরণ । এই সাংস্কৃতিক প্রাণী অচিরে প্রকৃতিকে শোষণ, লুন্ঠন ও ধ্বংস করে ঘোর বিপদ ডেকে আনবে ।
এক ফুঁক টেনেই বোকা গবেট শিশুর এই হাল, গলা থেকে মাথা ম্যাজিকে উড়ে গেল আর ফিরে এল । শৈয়ানা নাকি আগের জন্মের পুণ্যি ? ক্যাবলা কামুকটা আগরওয়াল বুড়ির নেকনজরে পড়ে গিয়েছিল । বেনারসে সবাই চেনে আগরওয়াল বুড়িকে । তবে ভাগ্য ভাল যে বোকাটা কামুক ; ধর্ম-ফর্মের পাশ কাটিয়ে ঘুরত ।
আমি বেনারসে আসার বছর দুয়েক পরের ঘটনা , কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছিল । ঠিক যেন হিন্দি ফিলিম । সেই তখন থেকে, দুপুরে কাজকর্ম না থাকায়, ম্যাটিনি শো দেখা আরম্ভ করেছিলুম, যাকে বলে সিনেমার পোকা, ওইরকম এঁটুলি হয়ে গিয়েছিলুম ফিলিম দেখার । কোনো ফিলিম বাদ দিইনি , রোদ ঝড় যাই হোক । এখন কেবল টিভি হয়ে কত আয়েশ ।
আগরওয়াল বুড়ির ছেলেটার নাম মনে আছে, অশোক । প্রেমে পড়ল ওদের জাতের বাইরে একটা গরিব মেয়ের, তার নাম নিশা । কাগজে লিখেছিল, মেয়েটা বিধবা । মন্দিরে যারা ওই সময়ে আসত তাদের কেউ-কেউ বলেছিল যে নিশা ছিল আগরওয়াল বাড়ির চাকরানি । অশোক গৌঁ ধরে বসল নিশাকেই বিয়ে করবে । শুনেই ওই বুড়ি, অশোকের মা, মাঝরাতেই এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিলে নিশাকে, আর উঠে পড়ে লাগল অশোকের বিয়ে দেবার জন্যে । কোটিপতির ছেলে, মেয়ের কি আর অভাব ছিল ! মেয়ের বাপেদের গাড়ির লাইন লেগে যেত নাকি আগরওয়ালদের বাড়িতে । কিন্তু বেনারসি শিবলিঙ্গের ডায়রেক্টার ফিলিমের শেষটা অন্যরকম ভেবে রেখেছিল, যে ফিলিমে শেষে গিয়ে মিল হয় না তবুও ফিলিম হিট হয়ে যায়, এমন ।
অশোক আর নিশা দু’জনে গঙ্গার ধারে বসে বিষ খেল । হিন্দি দেণিক আজ-এ ওদের দুজনের জড়াজড়ি করে গঙ্গার ধারে পড়ে থাকা শবের ছবি বেরিয়েছিল ।
প্রেমে এরকম পাগল হবার কী আছে জানি না , যে আত্মহত্যা করতে হবে । আঞ্জাআঞ্জি করলি, হয়ে গেল, ব্যাস । দুজনে কিছুদিন সবুর করতে পারতিস তো । তারপর দেখতিস একজনকে আরেকজনের আর দরকার নেই । দিব্যি বেঁচে থাকতিস , আর জীবনের মজা নিতিস । জীবনের নানা মজার মধ্যে প্রেমও একটা মজা । সবরকম মঝা পাবার তো আর দরকার নেই ।
আগরওয়াল বুড়ি সেই থেকে পথেঘাটে কাউকে দেখে অশোকের মতন মনে হলে বাড়ি নিয়ে যায়, খাতির যত্ন করে, ক্ষমা-টমা চায় । বেচারি । বংশের নাম বাঁচাতে গিয়ে ডুবল । লোভী রাসকেলটার লেখা পড়ে বুঝতে পারছি কত আদর-ভক্তি পেয়েছে । অথচ সেখানেও শিশির ধ্যান করছে ল্যাংটো মেমের । হিপি মেমগুলো যবে থেকে আসা আরম্ভ করেছিল, এখানকার ভারতীয় মেয়েরা চোখেই পড়ছিল না ইডিয়েটগুলোর । লোকে বলে নারীমাংসের লোভী হয় পুরুষেরা । আমি বলব সেই মাংসের ওপর যে ত্বক, তার রঙেরও লোভ থাকে পুরুষগুলোর ।
অশোক মরে জামাই দুটোর পোয়া বারো । মেয়ে-জামাইরা বোধহয় বাধ্য হয়ে মা-বাপের পাগলামিতে অভিনয় করে, কেন না অশোক আর নিশাকে মেয়ে-জামাইরা ষড় করে মেরে ফেলে থাকতে পারে, এরকম সন্দেহ পুলিশের মাথায় এসেছিল । মেয়ে-জামাইরা হাজতেও ছিল দিনকতক ; পয়সা-ফয়সা খাইয়ে কেস চাপা দিয়ে দিয়েছে । সেই সুযোগে শিশিরটা বউ দুটোকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিলে ; নিত্যি একখানা তরতাজা যুবক পেলে কেনই বা টিপবে না , তাও একেবারে কুঁচকি পর্যন্ত ! শিশিরটা দেখতে-শুনতেও তো মন্দ নয় ।
আগরওয়ালদের কাছ থেকে অন্তত একটা ভাল ব্যাপার শিখেছিল শিশির । অন্যের গায়ে পারফিউম মাখিয়ে তাকে সন্মোহন করার মোক্ষম কায়দা । তখনকার দিনে বডি ডিওডোরেন্ট বেরোয়নি, রুম ফ্রেশেনার বেরোয়নি, রঙিন কনডোম বেরোয়নি, ফেলো কড়ি মাখো তেল ট্যাবলেট বেরোয়নি । এখন তো যেমন পরিবেশ চাই, তমনই সুগন্ধী একজন আরেকজনকে লাগাও । সেসময়ে মাউথওয়াশ বা মাউথস্প্রে ছিল না । কর্পূরজলে কুলকুচি করে ফোঁকার গন্ধ যেত না মুখ থেকে । এখন তো কাছাকাছি হবার জন্যে নানা সুগন্ধের মাউথসপ্রে ।