ঘটকমশাই আজ রাত্রে ফিরে যাবেন না। সতীশ রায় পাত্রী পছন্দ করলে আজকের রাতটা এখানেই আনন্দ করে যাবেন। একথা আগেই ঠিক ছিল। হরিপদ তাঁকে যে ঘরে থাকতে দিয়েছিল সেই ঘরে হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মানিকজোড় গিয়েছে যে যার বাড়িতে। বলে গেছে, এই যাব আর এই আসব। ঘটক মশাই আজ একটা কথাও বলতে পারেননি। তাঁর চোখের সামনে অন্তত কুড়িখানা বড় বড় মিষ্টি ওরা পেটের ভেতর ফেলে দিল? ভেবেছিলেন, গিন্নির জন্যে নিয়ে যাবেন মিষ্টির প্যাকেটটা কিন্তু ওই হাঘরেদের জন্যে হল না।
ঘরের দরজায় একজন এসে দাঁড়াল। পুরোপুরি সামনে নয়, দরজার পাল্লার আড়ালে শরীর রেখে এলোকেশী জিজ্ঞাসা করল, চা এনে দেব?
চা? মাথা নাড়লেন ঘটকমশাই। না। সন্ধে পেরিয়ে গেছে, থাক। বরং পাখাটা কমিয়ে দিলে ভালো হয়।
অতএব এলোকেশী ঘরে ঢুকে পাখার রেগুলেটার ঘোরাল। ঘুরিয়ে চলে গেল। তাকে দেখলেন ঘটকমশাই। এরকম সুন্দর স্বাস্থ্যের উজ্জ্বল শ্যামা রমণী যে সতীশ রায়ের বাড়িতে আছে তা তার জানা ছিল না। সতীশ রায় বিপত্নীক। এই রমণী কি এবাড়ির কাজের লোক? বিশ্বাস হয় না। দিনহাটার হরিশ মণ্ডল চল্লিশ বছর বয়সে বিপত্নীক হওয়ার পর এই বয়সের পাত্রী খুঁজছে। বলেছে, বিধবা হলে ভালো হয়।
এই সময় হরিপদ ঢুকল, বড়বাবু ডাকছেন।
ওহো! উঠে দাঁড়ালেন ঘটকমশাই।
আচ্ছা ঘটকমশাই, বাড়ির সবাই জানতে চাইছে পাত্রী যখন পছন্দ হয়েছে। তখন তাকে দেখতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী? হরিপদ জিজ্ঞাসা করল।
অবশ্যই।
মতির মা জানতে চাইছিল, স্বভাব খুব নরম তো?
মিত্রর রক্ষক শত্রুর যম। ও হ্যাঁ, একটি মহিলা চা খাব কিনা জানতে এই ঘরে এসেছিল, বড়বাবুর আত্মীয় কেউ?
না না। ও হল এলোকেশী। ওর বাবা ব্লক অফিসে কাজ করত। খুব ভালো রান্না করে। বিধবা বলে বাড়িতে বোঝা হয়ে ছিল। মতির মা বড়বাবুকে বলে এ-বাড়িতে চাকরি দিয়েছে। এর আগে কখনও এমন কাজ করেনি, ভদ্রলোকের মেয়ে।
*
ওরা এসে গিয়েছিল। গ্লাসে পানীয় ঢালা হয়েছে। সঙ্গে কাজু এবং চিনে বাদাম। নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, আজ এমন আনন্দের দিন, এদিনেও দুরকম বোতল টেবিলে থাকা কি ঠিক হবে বড়বাবু?
তাহলে তোমাদেরটা টেবিল থেকে নামিয়ে রাখ। হাঁটু সব সময় শরীরের নিচের দিকেই থাকে, ও-দুটোকে তো কাঁধে তুললে এক পা-ও হাঁটা যাবে না।
সতীশ রায় বললেন, ঘটকবাবু কোথায়? ঘুমাচ্ছে নাকি?
ঘটকমশাই ঘরে ঢুকলেন। তাকে দেখে সতীশ রায় বললেন, এসো হে, খাও, যত পারো। কিন্তু দেখো, বমি না হয়।
ঘটকমশাই লজ্জা পেলেন, নো না। ওদিন প্রথমবার ছিল তো-। তবে গলার স্বর জড়িয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দেব।
গোরক্ষ বলল, তাহলে শুরু হোক। চীয়ার্স।
সবাই চীয়ার্স বললে গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, একটা কথা জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি ঘটকবাবুকে বলেছিলেন এমন মেয়ে চাই যার মধ্যে একটু নষ্টামির ঝোঁক আছে। ছেলের জন্যে এই প্রথমবার মেয়ে দেখতে গেলেন। গিয়েই পছন্দ করলেন। তার মানে ওর মধ্যে নষ্টামির ঝোঁক দেখেছেন আপনি। সেটা কী?
সতীশ রায় মাথা নাড়লেন, এসব তোমাদের না জানলেও চলবে। শুধু জেনে রেখো এ-মেয়ে সাধারণ নয়। সাদাসাপটা ভালো মেয়ে যারা তারা সেবা করতে পারে, স্নেহ ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারে কিন্তু যাকে দিচ্ছে সে যদি নিতে না জানে তাহলে বেনো বনে মুক্তো ছড়ানো ছাড়া কিছু হবে না। বুনো ওলের জন্যে কী দরকার?
নাগেশ্বর বলল, বাঘা তেঁতুল।
হ্যাঁ। এ বাড়িতে যে বউ হয়ে আসবে সে যদি লবঙ্গ লতিকা কিংবা সাতচড়ে রা না কাড়া মেয়ে হয় তাহলে আমি চোখ বোজার পর এই ঘরে শেয়াল ডাকবে। তাই চেয়েছিলাম নষ্ট নয় কিন্তু সেদিকে একটু ঝোঁক আছে এমন মেয়েকে ঘরে আনব। ঘটকবাবুর দৌলতে আজ পেয়েও গেলাম। সতীশ রায় বললেন।
কিন্তু কীভাবে পেলেন? কী করে যাচাই করলেন? নাগেশ্বর অস্থির।
অ্যাই! চুপ করো। বড়বাবু সেটা জানাবেন না বলেছেন শুনিসনি? গোরক্ষ চাপা গলায় ধমক দিল।
হরিপদ এল, বড়বাবু।
তাকালেন সতীশ রায়। হরিপদ বলল, মাছের বড়া ভাজা হচ্ছে, এনে দেব?
মাছের বড়া? বাঃ। সতীশ রায় বললেন, মুখ বদলানো যাক। মতির মা তাহলে নতুন নতুন রান্না শিখছে। আনন।
আজ্ঞে মতির মা নয়, এলোকেশী। চলে গেল হরিপদ।
সঙ্গে সঙ্গে নাগেশ্বর বলে ফেলল, এই নামটা আগেও একদিন শুনেছিলাম। বড়বাবু, এলোকেশী কে?
একজন বিধবা। শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিতা, আবার বাবা মা এখন মনে করে গলগ্রহ। রাঁধে ভালো বলে মতির মা কাজে নিয়েছে। সন্তানও নেই।
গোরক্ষ জিজ্ঞাসা করল, বয়স কেমন?
আমি জানতে চাইনি। সতীশ রায় বিরক্ত হলেন।
আমি দেখেছি একটু আগে। সাতাশ-আঠাশ হবে। বড়বাবু, একটা কথা বলছিলাম। যদি অনুমতি দেন।
আজ তুমি যা খুশি বলতে পারো।
দিনহাটায় আমার এক মক্কেল আছে। নাম হরিশ মণ্ডল। জমিজমা দু-দুটো মুদির দোকান, অবস্থা খুব ভালো। স্ত্রী গত হয়েছেন কয়েক বছর। বয়স চল্লিশ পার হলেও স্বাস্থ্য ভালো। বিয়ের ইচ্ছে হয়েছে আবার। শর্ত এক, পাত্রীকে বিধবা এবং নিঃসন্তান হতে হবে। এলোকেশীকে যেটুকু দেখলাম মণ্ডল মশাই।
ঘটকমশাইকে কথা থামিয়ে দিলেন সতীশ রায়, তুমি কি এরপর হরিপদ অথবা মতির মায়ের বিয়ের সম্বন্ধ করবে? এলোকেশী-বিয়ে করবে কি করবে না সেটা ঠিক করবে সে আর তার বাবা। আমাকে জিজ্ঞাসা করছ কেন?
গোরক্ষ বলল, হক কথা। আপনি মশাই যেখানে ঢোকেন সেখানেই পাত্রপাত্রী খোঁজেন নাকি? ভয়ঙ্কর লোক।
এইসময় তিনটি প্লেটে মাছের বড়া নিয়ে এল হরিপদ আলাদা করে। এক একটি প্লেটে দুটো করে।
সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, একটা প্লেট কম কেন?
হরিপদ মুখ নিচু করল। বিরক্ত সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?
কথাটা এলোকেশীর কানে যাওয়ায় সে খুব রেগে গেছে। হরিপদ বলল।
কোন্ কথাটা?
আজ্ঞে, ঘটকমশাই কোন্ দোজবরের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাইছেন–।
সে তো নিশ্চয়ই রান্নাঘরে বসে ভাজাভাজি করছে। শুনতে পেল কী করে?
আজ্ঞে, মতির মা দরজার কাছে এসেছিল। শুনে সে গিয়ে বলেছে।
হো হ করে হাসতে লাগলেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, ঘটকবান, এবাড়িতে একজন শত্রু তৈরি করলে হে। তুমি চিনেবাদাম খাও।
অন্যায় হয়ে গেছে। আর ওকথা বলব না।
মানিকজোড় মাছের বড়ার খুব প্রশংসা করতে লাগল। সতীশ রায়েরও বেশ ভালো লাগল। হরিপদ চলে গিয়েছিল ঘর থেকে, এবার ফিরে এল চতুর্থ প্লেটটি নিয়ে। তাতে সদ্য-ভাজা দুটো বড়া আছে। ঘটকমশাইকে বলল সে, নিন। আপনি আর বলবেন না শুনে পাঠিয়ে দিল।
হাসিমুখে হাত বাড়ালেন ঘটকমশাই।
বড়া খেতে খেতে নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, বড়বাবু, ম্যাদামারা কথাটার মানে এখনও বললেন না–।
তাই নাকি। আমাকে বলতে হবে না। তোমরা স্বচক্ষে দেখে নাও। হরিপদ, তোমাদের ছোটবাবুকে এঘরে আসতে বললো। হুকুম করলেন সতীশ রায়।
হরিপদ মাথা নাড়ল, ছোটবাবু বাড়িতে নেই।
অ্যাঁ! এতরাত্রে সে বাড়িতে নেই। দিনের বেলায় যাকে বাইরে পাঠানো যায় না সে এসময় কোথায় গেল? যাও, খুঁজে বের করা তাকে?
হরিপদ চলে যেতেই দরজায় শব্দ হল। সতীশ রায় কে জিজ্ঞাসা করতে আড়ালে থাকা মতির মায়ের গলা পাওয়া গেল, খোকাবাবুকে কিছু বলবেন না বড়বাবু।
উঃ। যাও, ভেতরে যাও। এসময়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছ?
গোরক্ষ বলল, ছোটবাবু বোধহয় বিয়ের খবরে খুশি হয়ে বন্ধুদের জানাতে গেছে।
ওর কোনও বন্ধু নেই। থাকতে পারে না।
এইসময় বাইরে খুব চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল, নেহি যায়েগা। হাম কিসিসে কম নেহি হ্যায়। হঠ যাও।
সতীশ রায় অবাক হয়ে সোজা হয়ে বসলেন, কে? আমার বাড়িতে এসে চেঁচাচ্ছে এত সাহস হল কার? গোরক্ষ দ্যাখো তো–।
গোরক্ষকে উঠতে হল না। হরিপদ ধরাধরি করে নিয়ে এল, ছোটখোকার পা টলছে, দাঁড়াতে পারছে না। সতীশ রায় চমকে উঠলেন, একি! তুমি মদ খেয়েছ?
ইয়েস। খেয়েছি।
কোথায় পেলে মদ?
হরেকৃষ্ণের ভাটিখানায়। জিজ্ঞাসা করল, বেকার কিনা? বললাম, নো। জিজ্ঞাসা করল, অ্যাডাল্ট কিনা? বললাম, ইয়েস। দিয়ে দিল।
ছি ছি ছি। তুমি চোলাই খেয়ে এসেছ? বাট হোয়াই? কেন? চেঁচালেন সতীশ রায়।
আমি, আমি দেবদাস হতে চাই। টলল সত্যচরণ।
দেবদাস? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব?
নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল, কেন তুমি দেবদাস হবে ছোটখোকা?
কেন হব না? পাখিরা কথা বলে না এখানে, পাখি নেই বলে। আজ রাত্রে আমার পাখির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কেঁদে ফেলল সত্যচরণ।
পাখির বিয়ে? তোমার পাখি মানে? কে পাখি?
গোরক্ষ মাথা নাড়ল, বুঝতে পেরেছি। ছোটখোকা, তুমি কি পোস্টমাস্টারের মেয়ে পাখির কথা বলছ?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সত্যচরণ।
গোরক্ষ বলল, ওই যে বড়বাবু, মেয়েকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছে মাস্টার বিয়ে দিতে। এ হে হে। তোমাদের মধ্যে এত ইয়ে ছিল তার খবর এই নাগেশ্বর পর্যন্ত যখন জানত না তখন বলতেই হবে বড্ড চেপে রেখেছিলে।
সতীশ রায় ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এবার জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়ি থেকে বেরুতে না, বাড়িতে কেউ আসততা না, তবু এসব হল কী করে?
জবাব দিল না সত্যচরণ। সে দাঁড়াতে পারছিল না, হরিপদ ধরে রেখেছিল তাকে।
জবাব দাও।
আজ্ঞে, মনে মনে।
এখন তুমি দেবদাস হতে চাও?
হুঁ,
আচমকা খুব জোরে হেসে উঠলেন সতীশ রায়। হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের আমি ম্যাদামারা দেখাতে চেয়েছিলাম হে, পারলাম না। তার বদলে ঢ্যামনা কাকে বলে দেখে নাও।
ঘটকমশাই হঠাৎ উত্তেজিত হলেন, ও হো, তাই–।
চুপ। একদম চুপ। তাকে ধমকালেন সতীশ রায়। তারপর বললেন, ওকে ভেতরে নিয়ে যা। ঘটকবাবু, মহাদেব সেনকে বলো, বিয়ের তারিখ তাড়াতাড়ি ঠিক করতে। ওর মা ওপরে চলে গিয়ে আমাকে অনেক শেকলে আটকে গেছেন।
আমি পারছি না। যে পারবে তার তাড়াতাড়ি আসা দরকার।
নাগেশ্বর বলল, কী পারবে বড়বাবু?
আমি সোজা আঙুলে ঘি তুলছি। উঠছে না। শুধু আঙুলে লেগে থাকছে। সে এসে বাঁকা আঙুলে ঘি তুলবে। নাও, শেষ করো। আমার রাতের খাওয়ার সময় হল। সতীশ রায় গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়লেন। ঘড়িতে নটা বাজল।
*
জেলাশাসক সময় দিতে পারলেন না। মুখ্যমন্ত্রী সফরে আসছেন, তাকে ব্যস্ত থাকতে হবে কিন্তু তিনি তাঁর শুভেচ্ছাবাণী পাঠালেন। এস.ডি.ও., বি.ডি.ও., কোঅপারেটিভ সোসাইটির বড় কর্তারা ঠিক সময়ে এসে গেলেন।
ডুড়ুয়ার খেলার মাঠে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। বিকেলের আগেই হাজার দুয়েক মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে। মঙ্গল তার বাহিনী নিয়ে খুব ব্যস্ত সেই ভিড় সামলাতে। এস.ডি.ও, সাহেবকে প্রধান অতিথি করে ডুডুয়ার তরুণ সঙেঘর ছেলেদের নিয়ে তৈরি কো-অপারেটিভের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হল।
প্রত্যেক বক্তাই জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। আজ যখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে অথচ চাকরির সংখ্যা সীমিত তখন ডুডুয়ার তরুণ সম্প্রদায় হাপিত্যেশ করে বসে না থেকে রোজগার করার যে অভিনব পদক্ষেপ নিতে চলেছে তাকে সাধুবাদ জানালেন সবাই। কে বলে বাঙালি ব্যবসাবিমুখ? কে বলে বাঙালি পরিশ্রম করতে জানে না? এই কো-অপারেটিভের ছেলেরা প্রমাণ করে দেবে পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। তারা ডুডুয়া নদী থেকে মাছ ধরে বিক্রি করবে। এই কারণে ইতিমধ্যে তারা হাতেকলমে মাছধরা শিখেছে। ক্রমশ তারা ডেয়ারি ফার্ম, হাঁসমুরগির লালন এবং বিক্রি করবে। এর সবটাই হবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নয়। কো-অপারেটিভের মাধ্যমে। কো-অপারেটিভের সব সদস্য যেহেতু তরুণ সঙঘ ক্লাবের সদস্য, তাই তাদের দায়িত্ব আজ থেকে অনেক বেড়ে গেল।
কো-অপারেটিভের পক্ষ থেকে বলতে উঠে মঙ্গল বলল, আজ যে নতুন দিনের সূচনা হচ্ছে তার জন্যে আমরা সব ভাবেই কৃতজ্ঞ বড়বাবুর কাছে। ডুডুয়ার সতীশ রায় যদি আমাদের স্বপ্ন দেখতে না সাহায্য করতেন তাহলে কিছুতেই আমরা এই কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম না। উনি যতদিন আমাদের মধ্যে থাকবেন ততদিন ডুডুয়ার মানুষেরা সুখে থাকবেন। বলেই সে চিৎকার করল, সতীশ রায়।
তার বন্ধুরা একসঙ্গে বলল, যুগযুগ জীও।
মঙ্গল আবার চিৎকার করল, সতীশ রায়।
এবার জনতা গর্জন করল, যুগ যুগ জীও।
সতীশ রায় মঞ্চেওঠেননি। প্রথম থেকেই তিনি বসেছিলেন প্রথম সারির একটি চেয়ারে। অনেক অনুরোধেও মঞ্চে উঠতে রাজি হননি।
এস.ডি.ও. সাহেব বলতে উঠলেন, আজ আমি এখানে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। তরুণ সঙেঘর ছেলেরা শুধু ফুটবল খেলত। কিন্তু তাদের সামনে কোনও স্থির ভবিষ্যৎ ছিল না। শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়, যাকে আমরা ডুডুয়ার সতীশ রায় বলে জানি, তাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সাহায্য করলেন, এই কো অপারেটিভ সতীশবাবুর মানসসন্তান। আমার আক্ষেপ, যদি দেশের প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে এরকম মানুষ আরও থাকতেন তাহলে কী দারুণ ব্যাপার হত। সরকারি সাহায্যের দিকে না তাকিয়ে তিনি তরুণদের উৎসাহিত করেছেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে। আমরা এই উদ্যোগের নাম দিতে পারি, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ান। আমি শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়কে অনুরোধ করছি কিছু বলার জন্যে–।
চুপচাপ বসেছিলেন সতীশ রায়। পেছন থেকে নাগেশ্বর চাপাগলায় বলল, বড়বাবু, এস.ডি.ও. সাহেব ডাকছেন–।
মঙ্গলরা কাছে চলে এল তাকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন সতীশ রায়। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও যে মহামান্য অতিথিরা আমাদের কাছে এসেছেন বলে আমরা কৃতজ্ঞ। যে ছেলেরা আজ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছে আপনাদের আশীর্বাদ তাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। আপনাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি আজকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন বলে। নমস্কার। ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নেমে এসে মঙ্গলকে বললেন, এস.ডি.ও, সাহেবকে দিয়ে ফিতে কাটাও। তারপর ওদের সসম্মানে নিয়ে এসো আমার বাড়িতে। ওখানে চা খেয়ে তবে যাবেন।
বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল মতির মা এবং এলোকেশী। তাঁকে দেখামাত্র মতির মা উধাও হল। হরিপদ গেট খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, বারান্দায় চেয়ার দেব?
না। বসার ঘরে। বারান্দায় উঠে তাকালেন তিনি এলোকেশীর দিকে, কিছু বলবে?
কজন আসবেন?
তিনজন আর ক্লাবের ছেলেরা। ধর জনা কুড়ি। উত্তর দিলেন সতীশ রায়।
দেখলে হরিপদদা, আমি ঠিক ধরেছিলাম। হরিপদর দিকে তাকাল এলোকেশী।
কী ব্যাপার? জানতে চাইলেন সতীশ রায়।
আপনি তো বলেননি কতজন খাবে, আন্দাজে কুড়িজনের জন্যে খাবার করেছি।
কী খাবার?
ফিশফ্রাই, সন্দেশ আর চা। এলোকেশী মুখ নিচু কবে বলল।
ফিশফ্রাই? এখানে কোথায় পেলে?
আজ্ঞে সবই ও নিজে বানিয়েছে। হরিপদ জানাল।
তাই নাকি? দ্যাখো, এরা শহরের লোক, ওসব অনেক খেয়েছেন। ভালো না হলে! তার চেয়ে লুচি বেগুন ভাজা দিলেই হত।
ছোটখোকা দুটো খেয়েছে। বলেছে ভালো লেগেছে।
অ। সন্দেশ কোত্থেকে আনলি হরিপদ? এখানকারটা তো মুখে দেওয়া যায় না।
সন্দেশও ওই বানিয়েছে বড়বাবু। হরিপদ জবাব দিল।
বাঃ। তুমি তো বেশ গুণী মেয়ে। হরিপদ, মতির মাকে চটপট আমার কাছে আসতে বল। সতীশ রায় নিজের ঘরে চলে গেল।
চেয়ারে বসে হাসলেন তিনি। আজ তার খুব ভালো লাগছে। শেষপর্যন্ত ছেলেগুলোকে যদি উৎসাহ দিয়ে যাওয়া যায় তাহলে একটা কাজের কাজ হবে। মতির মা দরজায় ঘোমটা টেনে দাঁড়াতেই তার দিকে তাকালেন তিনি, সে কোথায়?
আজ্ঞে, ঘরে ছিল।
ছিল মানে?
এখন মাঠের মেলায় গিয়েছে।
মেলা? এখানে মেলা কোথায় দেখলে?
ওই যে সবাই আপনার জয়ধ্বনি দিল?
হুঁঃ। কখন গেল? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, মেলা ভাঙার পরে?
মতির মা নিচু গলায় বলল, প্রথম প্রথম তো।
দু-দুটো ফিশফ্রাই খেয়েছে?
আজ্ঞে আমি বলেছিলাম সন্দেশ বেশি করে খেতে, ওটা একটা।
ওকে আজ রাত্রে খেতে দেবে না।
না খেলে যে ওর পেটে ব্যথা হয়।
হয় হোক। হরিপদকে দিয়ে ডাকিয়ে আনে। এখনই। একটু পরে এই বাড়িতে গণ্যমাণ্য লোকজন আসবেন। ওকে বলবে আমি চাই ও নিজের হাতে খাবারের প্লেটগুলো নিয়ে আসবে। বুঝতে পেরেছ? যাও।
তখনই বাইরে চেঁচামেচি শুরু হল। সতীশ রায় বারান্দায় এসে দেখলেন, ছোট একটা ভিড় এস.ডি.ও. সাহেবকে নিয়ে এগিয়ে আসছে।
হাতজোড় করে আপ্যায়ন করলেন সতীশ রায়। তিনজনকে ভেতরের বসার ঘরে বসিয়ে মঙ্গলকে দায়িত্ব দিলেন ক্লাবের ছেলেদের বারান্দায় বসিয়ে জলখাবার খাওয়াতে।
এস.ডি.ও. সাহেব বললেন, আমি শুধু এক কাপ চা খেতে পারি এবং সেটা চিনি এবং দুধ ছাড়া। ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলছি।
সতীশ রায় বললেন, তা কী হয়? আপনারা প্রথম এই বাড়িতে এলেন, একটু ফিশফ্রাই আর সন্দেশের ব্যবস্থা করেছি–।
অসম্ভব! দোকানের জিনিস খেতে নিষেধ করেছেন ডাক্তার। এস.ডি.ও বললেন।
আপনাকে দোকানের জিনিস আমি খাওয়াচ্ছি না। হরিপদ। ডাকলেন সতীশ রায়।
হরিপদ বোধহয় তৈরি ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রে নিয়ে ঢুকল, পেছনে চোরের মত সত্যচরণ। একটু অবাক হলেন সতীশ রায়। কিন্তু ছেলেকে না দেখার ভান করে বললেন, বাড়িতে তৈরি, তেমন ভালো তো হওয়ার কথা নয়। খারাপ লাগলে খাবেন না।
বি.ডি.ও. বললেন, সন্দেশ যে দোকানের নয় তা বোঝা যাচ্ছে।
কো-অপারেটিভের কর্তা বললেন, এরকম পাড়াগাঁয়ে শহরের খাবার আশা করা বৃথা।
এস.ডি.ও. চামচ দিয়ে একটুকরো ফিশফ্রাই তুলে মুখে পুরে বললেন, কী বলছেন মিস্টার রায়? এ জিনিস বাড়িতে তৈরি হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বাঃ। এ তো বড় হোটেলের নামী ফ্রিশফ্রাইকেও হার মানিয়েছে।
ততক্ষণে বাকি দুজন মুখে তুলেছেন ফিশফ্রাই। তারাও খুব প্রশংসা করলেন। এস.ডি.ও. বললেন, আপনার কাজের লোক নিশ্চয়ই এটা বানায়নি? আপনার স্ত্রী?
তিনি গত হয়েছেন পনেরো বছর আগে। এটিকে রেখে গেছেন। ছেলেকে দেখিয়ে দিলেন সতীশ রায়।
বি.ডি.ও. বললেন, ও! কি নাম তোমার?
সত্যচরণ।
তুমিও তো কো-অপারেটিভের মেম্বার?
না।
সতীশ রায় বললেন, পরিশ্রমে ওর খুব আপত্তি। তারপর হাসলেন, এই কো-অপারেটিভ অত্যন্ত গরিব পরিবারের উদ্যোগী ছেলেদের নিয়ে তৈরি। ও মেম্বার হলে একজনকে বঞ্চিত করা হত। হরিপদ চা নিয়ে ঢুকছে দেখে সতীশ রায় বললেন, এত তাড়াতাড়ি চা আনতে গেল কেন? এঁদের আরও একটা করে ফ্রাই এনে দে।
সঙ্গে সঙ্গে তিনজনই আপত্তি করলেন। একটা খেয়েই তাদের পেট ভরে গেছে। ওঁরা চায়ের কাপে হাত দিলে সত্যচরণ বলল, আমি যাই?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বি.ডি.ও. মাথা নাড়লেন।
আপনার এই ছেলে কী করে? কো-অপারেটিভের কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন।
এতদিন কিছু করত না, এখন আমাকে ব্যবসায় সাহায্য করছে।
ওরে ব্বাবা! তাহলেই তো হয়ে গেল। অন্য কিছু এর কাছে লাগে না। পড়াশুনা করেছে কতদূর? ভদ্রলোকের দ্বিতীয় প্রশ্ন।
হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়েনি।
অ। ব্যাচেলারস ডিগ্রিটা নিয়ে রাখলে ভালো করত। আজকাল তো সব মেয়েই বিয়ের আগে বি.এ. পাশ করে নেয়।
এস.ডি.ও. বললেন, আচ্ছা এবার উঠি। খুব ভালো লাগল এখানে এসে। বাকিরাও একই কথা বললেন।
.
তখনও সন্ধ্যা নামেনি। ঘটকমশাই-এর ফোন এল।
সতীশ রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, তুমি কি হে? আর সময় পেলে না? এই সন্ধের মুখে ফোন করলে? নিশ্চয়ই কোনও খবর দেবে?
আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারিনি, পরে করব?
ঘটকমশাই নার্ভাস। করেছ যখন বলেই ফেলল।
সেনমশাই যদি আগামীকাল বিকেলে আসতে চান তাহলে অসুবিধে হবে?
এভাবে হুট করে বললে কার সুবিধে হয়?
কিছু মনে করবেন না বড়বাবু, আমরাও কিন্তু হুট করে গিয়েছিলাম।
হজম করলেন সতীশ রায়, অ। বেশ আসতে বলল। বারোটার মধ্যে যেন আসেন।
আর একটা কথা–।
আবার কি হল?
পাত্রী বলছে তার নাকি আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
হেঁ হেঁ। মেয়েটি বড় ভালো।
কিন্তু আপনার ছেলেকে দেখে যদি তার দাদুর পছন্দ না হয় তাহলে ওই সোনার চেনটা তো ফেরত দিতে হবে–।
তাই নাকি? অপছন্দ হতে পারে? অবশ্য না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
তাই তার ইচ্ছে সে দাদুর সঙ্গে আসবে, যে বাড়িতে তাকে ভবিষ্যতে থাকতে হবে, যাকে বিয়ে করবে তাকেও স্বচক্ষে দেখে যাবে। ঘটকমশাই কে গিললেন, যদি দুজনেরই অপছন্দ হয় তাহলে চেন কালই ফেরত দিয়ে যাবে।
মহাদেব সেন এই আবদার মেনে নিয়েছেন?
নাতনি অন্ত প্রাণ তো, না মেনে উপায় নেই। তাছাড়া বাড়িতে কোনও ছেলে নেই যে সঙ্গে নিয়ে আসবেন পাত্র দেখতে।
আমি তো ছেলে থাকা সত্ত্বেও নিয়ে যাইনি। সতীশ রায় বললেন, বেশ, তাই হবে। আসতে বলো ওঁদের।
রিসিভার নামিয়ে একটু ভাবলেন সতীশ রায়। নাঃ। হাজার হোক এই বংশের মা-মরা ছেলে। শক্ত প্রশ্ন করলে একেবারে ল্যাজেগোবরে হবে। একটু সতর্ক করে রাখা দরকার। তিনি চিৎকার করলেন, হরিপদ।
হরিপদ এসে দাঁড়াতেই বললেন, ছোট খোকাকে ডাকো।
এখন খাচ্ছে।
খাচ্ছে? এই একটু আগে দু-দুটো ফ্রাই পেঁদিয়েছে গুণনাথ?
ফ্রাই তো শেষ হয়ে গেছে, তাই এখন সন্দেশ খাচ্ছে।
শেষ হয়ে গেছে মানে? আমি বাড়ির কর্তা, আমি খেলাম না আর তোমরা সব সাবাড় করে দিলে। এলোকেশী কোথায়?
কাঁদছে।
সেকি? কেন?
ছোট খোকার জন্যে কেন আর একটা ফ্রাই আলাদা লুকিয়ে রাখেনি বলে মতির মা বকেছিল, তাই।
অসম্ভব, ওই বুড়িকে এবাড়ি থেকে না তাড়ালে ইডিয়েটটার মেরুদণ্ড সোজা হবে না। যাও। গিয়ে বলে এক্ষুনি এখানে আসতে। সতীশ রায় সিগারেট ধরালেন। ধরাতেই তাঁর চোখ চলে গেল দেওয়ালে টাঙানো স্ত্রীর ছবির দিকে। বিড় বিড় করলেন, এক্সাইটমেন্ট! তুমি ঠিক বুঝবে না।
সত্যচরণ এসে দাঁড়াল।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সতীশ রায় বললেন, শোন আগামীকাল বিকেল তিনটের মধ্যে ভালো জামাকাপড় পরে বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। কোথাও যাবে না। তুমি যে হাবা-বোবা-কালা-অন্ধ নও তা দেখতে তোমার ভাবী দাদাশ্বশুর আসবেন। আমার কথা কি বুঝতে পারছ?।
এখন কেন? বিড়বিড় করল সত্যচরণ।
তার মানে?
মায়ের মৃত্যুমাস–।
তোমার মা বাংলা মতে মাস বিচার করতেন। মৃত্যুমাস বাংলামতে শেষ হয়ে গিয়েছে। বাংলা ইংরাজি একসঙ্গে করলে মাস পঁয়তাল্লিশ দিনে শেষ হয়। আমার সঙ্গে চালাকির চেষ্টা করবে না। সতীশ রায় বললেন।
কী জিজ্ঞাসা করবে?
এনিথিংগ। তৈরি হয়ে থেকো। আমি চাই জিজ্ঞাসা করা মাত্রই ফটাফট উত্তর দেবে তুমি। আচ্ছা, যদি জিজ্ঞাসা করে ছেলেদের জুতো কত রকমের হয়? কী জবাব দেবে তুমি?
জু-জুতো? হকচকিয়ে গেল সত্যচরণ। তারপর নিজের পায়ের দিকে তাকাল, হাওয়াই।
আর?
হ্যাঁ, বুটজুতো মানে শু। চটি জুতো। স্ট্র্যাপ দেওয়া জুতো। আর–আর কে। বলে মাথা নাড়ল সত্যচরণ।
কেডস? কেন? নাগরাজুতোর নাম শোননি? খেঁকিয়ে উঠলেন সতীশ রায়।
আজ্ঞে না।
শোননি?
আপনি তো আমাকে কিনে দেননি–।
গেট আউট। বিদায় হও সামনে থেকে। চেঁচিয়ে উঠলেন সতীশ রায়, এলোকেশীকে এঘরে আসতে বলল।
সত্যচরণ লাফ দিয়ে বিদায় নিল।
একটু পরেই এলোকেশী এল, চোখ মুখ লাল, ফোলা ফোলা।
শোন। তোমার ফিশফ্রাই-এর খুব প্রশংসা করেছেন সাহেবরা। তুমি যে এত ভালো করতে পারবে তা আমিও ভাবিনি। হ্যাঁ, কাল বিকেলে ওই সত্যচরণকে দেখতে পাত্রীপক্ষ আসছেন। তাদের কী ভাবে আপ্যায়ন করবে তা তুমিই ঠিক করো।
কজন আসবেন? এলোকেশীর গলা ধরা ধরা।
সেরকম কিছু বলেনি। তিন কি চারজন, তার বেশি নয়।
লুচি বেগুনভাজা, তরকারি, মুরগির মাংস আর পায়েস?
খুব ভালো কথা। কিন্তু প্রথম পাতে তোমার ফিশফ্রাই চাই।
একটু বেশি হয়ে যাবে না?
হলে হবে। সবাই ভালো বলছে কিন্তু আমি স্বাদ পেলাম না। না না, তোমার কোনও দোষ নেই। এস্টিমেটের থেকে লোক বেশি হয়ে গেলে তুমি কী করবে। এক-একজন দু-দুটো করে খেয়েছে নাকি?
না। তা ঠিক নয়। লোক বেশি হয়ে গিয়েছিল।
অ। তাহলে কাকে ফেরাবে? সত্যি তো। সত্য কটা খেয়েছে?
ভাজার সময় দুটো খেয়েছিল। পরে আবার খেতে চেয়েছিল, নেই বলে দিতে পারিনি। গলা ভেঙে গেল, ঠোঁট টিপলে এলোকেশী।
আর তাই মতির মা তোমাকে যাচ্ছেতাই করে বলেছে। সেটা শুনে তুমি কাঁদতে বসে গেলে। কেন? তুমি জিজ্ঞাসা কেন করলে না, ও দু-দুটো খেয়েছে, বড়বাবুকে একটাও দিতে পেরেছি যে ওর জন্যে রাখব? সতীশ রায় বললেন, এত সামান্য কারণে তুমি কাঁদতে বসে গেলে।
ছেলেটা খেতে চাইল আর আমি দিতে পারলাম না। কথা শেষ করল না এলোকেশী। চমকে তার দিকে তাকালেন সতীশ রায়। তার মানে এলোকেশী মতির মায়ের বকুনির জন্যে কাঁদেনি, সত্যচরণকে ফ্রাই বেশি খাওয়াতে না পেরে মনের কষ্টে কেঁদেছে! অদ্ভুত কাণ্ড।
*
সন্ধ্যাবেলায় আজও আসর বসল। কো-অপারেটিভের মিটিং নিয়ে কথা হচ্ছিল।
নাগেশ্বর বলল, ওঃ। আপনি, যাকে বলে ফাটিয়ে দেওয়া, তাই দিয়েছেন। এত প্রশংসা এত জয়ধ্বনি অথচ তার জবাবে আপনি বেশি কথা না বলে শুধু ধন্যবাদ জানালেন। শোনার মতো ব্যাপার। মাথা নাড়ল সে।
আরশোলার পাখা আছে বলে তাকে কেউ পাখি বলে না নাগেশ্বর।
গোরক্ষ বলল, শিখে কী করবে? কেউ কি তোমার নামে জয়ধ্বনি দেবে এই জীবনে?
সতীশ রায় বললেন, ছাড়ো তো। আমি মরছি নিজের জ্বালায়?,
কী হয়েছে বড়বাবু। আমরা থাকতে আপনি জুলবেন, এ তো ভালো কথা না। নাগেশ্বর বলল, ওরা শুনলাম বুধরার, মাছধরা শুরু করবে। সেদিন দেওখালির হাট। মঙ্গলে উষা বুধে পা, যথা ইচ্ছে তথা যা। বুধবার শুরু করছে, চিন্তার কারণ নেই।
মাছ ধরা নিয়ে আমি চিন্তিত তা তোমাকে, কে বলল?
তাহলে?
কাল পাত্রীপক্ষ পাত্র দেখতে আসবেন। সতীশ রায় বললেন।
কী দরকার? আপনাকে দেখেছে তারপর পাত্রকে দেখার কী দরকার? হিরের আংটি বেঁকা হলেও দোষ কী? নাগেশ্বর বলল।
না নাগেশ্বর। গোরক্ষ মাথা নাড়ল, মেয়ে কোন্ ছেলের হাতে পড়ছে তা যে কোনও বাবা মা জানতে চান। বাবা নেই, দাদু তো চাইবেনই।
তাহলে আসছে যখন আসুক। চিন্তার কী আছে? নাগেশ্বর বলল।
আছে। স্বয়ং পাত্রী আসছে তার দাদুর সঙ্গে। সতীশ রায় বলল।
সেকি? এটা কী করে সম্ভব? গোরক্ষ বলল।
বাপের জন্মে শুনিনি পাত্রী বিয়ের আগে হবু শ্বশুরবাড়ি দেখতে আসে! এ কেমন পাত্রী? নাগেশ্বর উত্তেজিত।
তাহলে স্বীকার করছ, চিন্তার কারণ আছে। সতীশ রায় বললেন।
অবশ্যই। আমাদের পাত্র তাদের দেখতে গেল না আর পাত্রী আসবে? লোকে কী বলবে? না না, আপনি রাজি হবেন না। গোরক্ষ বলল।
ঘটকবাবু ফোন করে বলতে আমি রাজি হয়ে গেলাম। সতীশ রায় বললেন।
গোরক্ষ বলল, চিন্তা করে দেখলে এটা হতে দেওয়া উচিত। আমাদের দেশের রেওয়াজ হচ্ছে ছেলে মেয়ে দেখতে যাবে। সেইসঙ্গে মেয়ের বাড়ি, মেয়ের আত্মীয় স্বজনদেরও দেখে আসবে। অথচ সে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের পর থাকছে না। কিন্তু মেয়ে এসে থাকবে শ্বশুরবাড়িতে। তারই তো বিয়ের আগে এসে সবকিছু দেখে যাওয়া উচিত।
এত স্বাধীনতা মেয়েদের দেওয়া হয়নি। যাক গে, পাঁচ কান না করলেই হল। আসুক পাত্রী। নাগেশ্বর প্রসঙ্গটা পালটাল, ও হ্যাঁ। শুনলাম আজ নাকি আপনার বাড়িতে এত ভালো ফিশফ্রাই হয়েছিল যা এখানকার ছেলেরা কখনও খায়নি!
সতীশ রায় হাসলেন, ঠিক শুনেছ। এস. ডি. ও. সাহেব নিজে প্রশংসা করেছেন।
আচ্ছা! তা হরিপদর উচিত ছিল আমাদের এইসময় টেস্ট করতে দেওয়া। গ্লাসে চুমুক দিল নাগেশ্বর, ও হরিপদ।
ডেকে লাভ নেই নাগেশ্বর। গোটা কুড়ি ফিশফ্রাই বিকেলেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি পর্যন্ত তার স্বাদ পাইনি। সতীশ রায় বললেন।
হরিপদ ঢুকল, আজ্ঞে, ডেকেছেন?
কী হে! হরিপদ। এ তোমার কী ব্যবহার? আমাদের জন্যে তো দূরের কথা, খোদ বড়বাবুর জন্যেও ফিশফ্রাই রাখোনি? নাগেশ্বর জিজ্ঞাসা করল।
খুব ভুল হয়ে গিয়েছে।
তা ওটা বানাল কে? গোরক্ষ তাকাল।
এলোকেশী।
অ্যাঁ। সে এত জানে?
সতীশ রায় বললেন, ঠিক আছে। এলোকেশীকে বল কাল যখন সেনবাবুদের জন্য খাবার করবে তখন এদের কথা মাথায় রাখতে।
হরিপদ ভেতরে গেল।
রান্নাঘরের সামনে বেঞ্চিতে বসে বাইরের অন্ধকার দেখছিল এলোকেশী। হরিপদ এসে তাকে ঘটনাটা জানাল। জিভ কাটল এলোকেশী, ছি ছি।
কাল করে দিয়ো। পালিয়ে যাচ্ছে না তো সময়!
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল এলোকেশী, ওঁরা কতক্ষণ থাকবেন হরিপদদা?
কতক্ষণ আর! আটটা পর্যন্ত। বড়জোর।
যাই হাত চালাই। রান্নাঘরের দিকে এগোল এলোকেশী।
তার মানে? হরিপদ বুঝতে পারছিল না ও কী করতে যাচ্ছে।
ফ্রাই-এর মশলা বেশি ছিল, মাছ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন চটপট ডিম সেদ্ধ করে ওই দিয়ে ডেভিল তৈরি করে দেব।
ডেভিল? হরিপদ শব্দটা প্রথম শুনল।
ওপাশের ঘর থেকে সত্যচরণ বেরিয়ে এল, কী বানাচ্ছ এলোদি?
ডেভিল। হাসল এলোকেশী।
বাঃ। আমার জন্যে দুটো থাকে যেন!
মতির মা শুনতে পেয়ে এগিয়ে এল, ডেভিল মানে কী?
ডেভিল মানে শয়তান। সত্যচরণ হাসল।
সেকি? তুমি বাড়িতে শয়তান বানাবে? আর সেগুলো থোকাকে খাওয়াবে? কক্ষনো নয়। ও খোকা, তুমি ওসব খেয়ো না। কাল তোমাকে দেখতে আসছে, আজ ওসব খেয়ে পেট খারাপ হলে কী হবে? মতির মা মাথা নাড়তে লাগল।
কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল এলোকেশী।
*
সবে দু-গ্লাস শেষ হয়েছে, সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন। হরিপদ তিনটি প্লেট আর চামচ নিয়ে ঘরে এল, প্লেটে দুটো করে গরম ডেভিল।
সতীশ রায় বললেন, ওটা কী?
হরিপদ বলল, আজ্ঞে, এলোকেশী বলল এর নাম ডেভিল।
গোরক্ষর মুখ উদ্ভাসিত হল, ডিমের ডেভিল? এ জিনিস বহু বছর আগে শিলিগুড়ির রেলের ক্যান্টিনে খেয়েছিলাম। দেখি দেখি। প্লেট তুলে নিয়ে চামচে একটা টুকরো তুলে মুখে দিল গোরক্ষ। চোখ বন্ধ করল একটু। তারপর মাথা নেড়ে চিবোতে চিবোতে বলল, খাসা, ও বড়বাবু, এ দেখছি রন্ধনে দ্রৌপদী।
নাগেশ্বর চামচের বদলে হাতেই তুলে নিয়ে কামড়াল, ফাস্টিক্লাশ।
অতএব সতীশ রায় চামচ ব্যবহার করলেন, মুখে দিয়ে বুঝলেন খুব উপাদেয় হয়েছে। খেতে খেতে বললেন, কখন বানাল?
এই তো এইমাত্র।
অবাক কাণ্ড! ও হা। খোকা যেন এখন না খায়, রাত্রের খাবারের সঙ্গে দিতে বলবে। বুঝলে? সতীশ রায় খেতে খেতে বললেন।
আজ্ঞে! এতক্ষণে ওর দুটো খাওয়া হয়ে গিয়েছে। হরিপদ মুখ নিচু করল।
নাগেশ্বর বলল, আচ্ছা, খেয়ে নিক। এ জিনিস আমিও দশটা খেতে পারি।
দশটায় পাঁচটা ডিম। খেয়ে হাসপাতালে নিজেই আগেভাগে চলে যেয়ো। গোরক্ষ বলল, নিজের বয়সটার কথা আর কবে খেয়াল করবে?
সতীশ রায় ঘড়ি দেখলেন। আজ কিছু বলার আগেই নাগেশ্বর উঠে দাঁড়াল, বড়বাবু, কাল কখন আসব?
হঠাৎ। সতীশ রায় তাকালেন।
না অতিথিরা আসবেন, আপনি একা মানুষ!
এসো। ওঁরা চারটের মধ্যে আসবেন। সতীশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।
*
দুপুরের একটু পরেই অবনীদা এসে গেলেন। সতীশ রায়ের খেয়াল ছিল না। ওকে বাসস্টপ থেকে নিয়ে এল মঙ্গলরা। অবনীদা যে আসবেন তা ওদের মনে ছিল।
অবনীদা বললেন, চলে এলাম। আজকের রাতটা এখানেই থাকব। কাল বিকেলের পর ফিরব। তার মানে তিনবেলা হাতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, প্র্যাকটিসের পর তোমরা কিছু খাও তো?
মঙ্গল মাথা নিচু করল।
তাহলে তো চলবে না। পরিশ্রম করবে, ঘাম বেরুবে শরীর থেকে অথচ শরীরকে কিছু দেবে না। এটা কি ঠিক? কেন? এখানে এখন পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে নিশ্চয়ই। পেয়ারা কেটে বিট নুন দিয়ে রেখে দাও, সঙ্গে একটা করে হাফবয়েলড ডিম। প্র্যাকটিসের পরেই খেয়ে নেবে সবাই।
কেউ একজন নিচু গলায় বলল, এখানে ডিম ছয়টাকা জোড়া।
সতীশ রায় বললেন, ওটা নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। রোজ এখান থেকে ডিমসেদ্ধ নিয়ে যাস।
তাহলে এক কাপ করে দুধও দিয়ে দেবেন।
বেশ। কিন্তু অবনীদা, আজ আমি আপনার সঙ্গে থাকতে পারছি না। আমার বাড়িতে কয়েকজন আসছেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তাদের সঙ্গেই থাকতে হবে।
নিশ্চয়ই। আপনি মাঠে গিয়ে কী করবেন? শুধু রাতে থাকার ব্যবস্থাটা করে দিলেই আপনার দায়িত্ব শেষ। অবনীদা ঘড়ি দেখলেন।
*
সাড়ে তিনটের সময় অবনীদাকে নিয়ে ছেলেরা মাঠে চলে গেল। হরিপদকে ডাকলেন সতীশ রায়, সে কি করছে?
আজ্ঞে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।
আঃ। বই পড়ার অনেক সময় পরে পাবে, এখন তৈরি হতে বলো।
মাথা নেড়ে ভেতরে যাচ্ছিল হরিপদ, সতীশ রায় আবার ডাকলেন, প্যান্ট শার্ট পরতে বলবে। ধোপ ভাঙা।
ঠিক চারটের সময় গাড়িটা এসে দাঁড়াল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সতীশ রায় অবাক হয়ে দেখলেন গোরক্ষ আর নাগেশ্বর কোত্থেকে যেন উড়ে এসে গেটের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভারের পাশ থেকে নেমে ঘটকমশাই পেছনের দরজা খুলে দিতেই মহাদেব সেন নেমে ওদের নমস্কার করলেন। তার পেছনে নেমে দাঁড়াল প্রতিমা। নীল সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়নাটা জড়ানো। বেশ ভালো দেখাচ্ছে।
নাগেশ্বর বলল, স্বাগতম। আজ লক্ষ্মীর পা পড়বে এই বাড়িতে।
গোরক্ষ বলল, লক্ষ্মীর আগমনে শ্ৰী ফুটবে এই বাড়িতে।
মহাদেব সেন বললেন, না না। ডুডুয়ার সতীশ রায়ের ওপর লক্ষ্মীর আশীর্বাদ রয়েছে অনেকদিন থেকেই।
সতীশ রায় নেমে এসেছিলেন বাগানে। বললেন, আরে, গেট খুলে দাও।
নাগেশ্বর চটপট গেট খুলে দিতে তিনি বললেন, নমস্কার। আসুন, আসুন। পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
না। ঘটকমশাই পথ চিনিয়ে নিয়ে এলেন। মহাদেব সেন বললেন।
এসো মা। এই হল আমার মাথা গোঁজার জায়গা। পাড়াগাঁয়ে থাকি, তোমার পছন্দ হবে কিনা জানি না। ওই যে বাগানের যেখানে শেষ সেখানে গেলেই দেখতে পাবে ডুডুয়া নদী। বেশি চওড়া নয়, তবে জল আছে। এসো।
প্রতিমা বলল, এনারা?
ও। ইনি গোরক্ষ, ইনি নাগেশ্বর। বহুকাল একসঙ্গে আছি আমরা।
প্রতিমা এগিয়ে গেল প্রণাম করতে। ওরা লাফিয়ে সরে গেল না না বলে।
সতীশ রায় হাসলেন, থাক থাক। এসো ভেতরে এসো। আসুন।
বাইরের ঘরে ঢুকে সতীশ রায় অবাক হলেন। পরিপাটি সাজানো হয়েছে। ঘরটা। টেবিলে কভার দেওয়া হয়েছে, ফুলদানিতে ফুল। হরিপদ বা মতির মায়ের কর্ম যে নয় তা বুঝতে পারলেন।
বসুন। বসুন। বসো তোমরা।
মহাদেব সেন নাতনিকে নিয়ে বসলে খানিকটা দূরের চেয়ারে গোরক্ষ এবং নাগেশ্বর বসল।
মহাদেব সেন বললেন, সুন্দর বাড়ি!
আমার পিতৃদেব করে গিয়েছেন। আমি মাঝে মাঝে মেরামত করি। প্রথমে একটু শরবৎ-জাতীয় কিছু বলি? সতীশ রায় তাকালেন।
না না। যাওয়ার আগে একটু চা খেয়ে যাব।
সেকি! আমার বাড়িতে প্রথম এসে শুধু চা খেয়ে যাবেন নাকি?
বউভাতে এসে খাব। মহাদেব সেন হাসতে হাসতে বলতেই ঘটক মশাই হাসলেন, আপনার কথাই ফিরিয়ে দিচ্ছেন উনি।
আচ্ছা, আচ্ছা! হজম করলেন সতীশ রায়।
তা আপনার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? মহাদেব সেন জিজ্ঞাসা করলেন।
সতীশ রায় ডাকলেন, হরিপদ!
সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পাওয়া গেল, আজ্ঞে।
খোকাকে এঘরে আসতে বলো!
এই একটুখানি দেরি হবে। নিবেদন করল হরিপদ। সতীশ রায় বিরক্ত হয়ে তাকাতে চটজলদি বলল, একটু বাথরুমে গিয়েছেন।
কী আশ্চর্য! আর সময় পেল না। গিয়ে বলো তাড়াতাড়ি আসতে।
হরিপদ চলে গেলে প্রতিমা বলল, আপনি রাগ করবেন না। এরকম হয়।
মহাদেব সেন বলল, দিদিমণি, তোমার মা-দিদা এখানে যে শর্তে আসতে দিয়েছেন সেটা ভুলে গেলে চলবে না।
ওমা, তাই তো, ভুলেই গিয়েছিলাম। গম্ভীর হল প্রতিমা।
শর্তটা কী জানতে ইচ্ছে করছে। সতীশ রায় হাসলেন।
মহাদেব সেন বললেন, ওকে মুখ বন্ধ করে থাকতে বলেছে। বড়জোর একটা কী দুটো কথা বলতে পারে। মহাদেব সেন জানালেন।
না না। তুমি স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারো। কী বলছিলেন যেন–।
প্রতিমা দাদুর দিকে একবার তাকাল, তারপর বলল, আমারও হয়েছিল।
কী হয়েছিল?
যেদিন প্রথম আমাকে দেখতে পাত্রপক্ষ এসেছিল সেদিন হঠাৎ পেট মুচড়ে উঠেছিল। ওরা গাড়ি থেকে নামামাত্র আমি বড় বাথরুম ছুটেছিলাম। পরিষ্কার বলল প্রতিমা।
সেটা প্রথমবারই হয়েছিল, আর হয়নি। মহাদেব সেন বললেন, আপনার ছেলেকে নিশ্চয়ই আমরাই প্রথম দেখতে এসেছি?
নীরবে মাথা নাড়লেন সতীশ রায়!
নাগেশ্বর বলল, নার্ভাস হয়ে গেলে ওরকম হয়।
ভয়েও হয়। ভয়ের চোটে বাহ্যি করে ফেলে অনেকে। গোরক্ষ বলল।
আঃ। আর কোনও প্রসঙ্গ নেই? মৃদু ধমক দিলেন সতীশ রায়।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল প্রতিমা, যাঃ। খুব ভুল হয়ে গিয়েছে।
মহাদেব সেন অবাক হলেন, কী হল?
ওগুলো গাড়ি থেকে নামানো হয়নি।
মহাদেব সেনের মনে পড়তেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সতীশ রায় হাঁ হাঁ। করে উঠলেন, আপনি যাচ্ছেন কেন? কী নামাতে হবে বলুন, হরিপদ যাচ্ছে।
ঘটকমশাই বললেন, কাউকে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি। তিনি বেরিয়ে গেলে মহাদেব সেন বললেন, দয়া করে বাড়ি ফিরে গিয়ে একথাটা বলো না, তাহলে খুব বকুনি খেতে হবে।
দুটো বড় বড় মুখবন্ধ হাঁড়ি নিয়ে ঘটকমশাই ফিরে এসে টেবিলের ওপর রাখলেন। মহাদেব সেন বললেন, ওদুটো ভেতরে পাঠিয়ে দিন।
তাই বলুন। কী দরকার ছিল এসবের!
রাজভোগ বোধহয়। মালবাজারের রাজভোগ খুব বিখ্যাত। নাগেশ্বর বলল।
না না। রাজভোগ নয়। ক্ষীরের মণ্ডা, নরম পাকের তালশাঁস সন্দেশ। শুভকাজে নাকি মাটির পাত্র ব্যবহার করতে হয় তাই–।
এইসময় সত্যচরণকে নিয়ে হরিপদ এল। মহাদেব সেন বললেন, এসো দাদু, এসো। তোমার নামই তো সত্যচরণ?
নীরবে মাথা নাড়ল সত্যচরণ।
বসো বসো। সস্নেহে বললেন মহাদেব সেন।
মহাদেব সেনের একপাশে প্রতিমা বসেছিল। অন্যপাশের চেয়ারে সত্যচরণ বসল।
শুনলাম তুমি স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে ভর্তি হতে চাওনি? মহাদেব সেন তাকালেন।
কলেজে পড়েও তো বাবার ব্যবসায় বসতে হবে। তার চেয়ে বাড়িতেই পড়া ভালো।
ও। তাই বলো। তা বাড়িতে তুমি কী পড়ছ?
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সব লেখা পড়া হয়ে গিয়েছে, এখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়ছি। সত্যচরণ দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল।
বাঃ। খুব ভালো। তুমি কি লেখালেখি করো?
হুঁ। চেষ্টা করি। কিন্তু–। থেমে গেল সত্যচরণ।
হ্যাঁ, বলো। মহাদেব উৎসাহ দিলেন।
যাদের কাছে আমি অনুপ্রেরণা পেতে চাই তারা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। অনুপ্রেরণা ছাড়া কি ভালো লেখা হয়! সত্যচরণ বিমর্ষ মুখে বলল।
হাঁ হয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন সতীশ রায়। এসব কী বলছে ছোকরা? এত কথা যে ও বলতে পারে তাই জানা ছিল না তার। হঠাৎ তিনি শঙ্কিত হলেন। ও কি পোস্টামাস্টারের মেয়ের কথা ভেবে কথাগুলো বলল? ফস্ করে সেই মেয়ের নাম না বলে বসে। তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আপনার যদি ও অন্য প্রশ্ন করার থাকে তাহলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন!
না। কী আর প্রশ্ন করব! ভদ্র বিনয়ী ছেলে। মহাদেব সেন হাসলেন।
তাহলে আমি যাই। উঠতে যাচ্ছিল সত্যচরণ।
বসো। মৃদু ধমকালেন সতীশ রায়। তারপর গলা পালটে বললেন, মা, তোমার যদি কোনও প্রশ্ন করার থাকে করতে পারো।
মাথা নাড়ল প্রতিমা, আমাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
কে নিষেধ করেছে? সতীশ রায় অবাক।
মা, দিদিমা। মুখ না খুলে শুধু চোখ দিয়ে দেখতে বলেছে ওরা।
এ কেমন কথা? তাহলে তো মহা মুশকিল। সতীশ রায় বললেন।
প্রতিমা তার দাদুর দিকে তাকাল, কী করব?
ঠিক আছে। মহাদেব সেন মাথা নাড়লেন।
তুমি আবার ওদের বলে দেবে না তো?
অন্যায় কিছু জিজ্ঞাসা না করলে বলব না।
প্রতিমা সত্যচরণকে দেখার চেষ্টা করল। মাঝখানে মহাদেব সেন বসে থাকায় ঝুঁকে দেখতে হচ্ছে।
সতীশ রায় ছেলেকে বললেন, একটু এগিয়ে নাও চেয়ারটাকে। অত আড়াল খোঁজার কী দরকার?
বেজার মুখে চেয়ার এগিয়ে এসে বসল সত্যচরণ দেওয়ালের দিকে মুখ করে।
প্রতিমা জিজ্ঞাসা করল, সত্যচরণ নামটা আপনার খুব ভালো লাগে, না?
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে সত্যচরণ জবাব দিল, জানি না।
জানেন না কেন?
কখনও ভাবিনি। গুরুজনরা ভালো বলেই নামটা রেখেছিলেন।
আপনি কী খেতে ভালোবাসেন?
সত্যচরণ চুপ করে থাকল। বোঝা গেল সে ভেবেই বলেছে।
পাঁচটা খাবারের নাম বলুন।
ভাত, মাছ, মাছের ফ্রাই, সন্দেশ, ক্ষীর।
এখানে বুঝি মাছের ফ্রাই পাওয়া যায়!
এলোদি করে দেয়।
এলোদি কে? প্রতিমা সতীশ রায়ের দিকে তাকাল।
সতীশ রায় বলেন, একজন ভদ্রঘরের বিধবা মহিলা। আমাদের রান্নার দায়িত্ব নিয়েছেন।
মহাদেব সেন বললেন, দিদিমণি, এবার ওকে যেতে দাও, অনেক প্রশ্ন হয়ে গেছে।
ওমা! প্রশ্ন কোথায় করলাম! আমি তো সাধারণ কথা জানতে চেয়েছি। আচ্ছা, আপনি বলুন, আমি কি ওঁকে প্রশ্ন করেছি? আবার সতীশ রায়ের দিকে তাকাল প্রতিমা।
না না। মাথা নাড়লেন সতীশ রায়।
তাহলে এবার প্রশ্ন করি। আপনাকে আমি দুটো প্রশ্ন করব। মোগল সম্রাটদের নাম নিশ্চয়ই জানেন–।
কথা শেষ করতে না দিয়ে সত্যচরণ বলল, বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গির, শাজাহান, ঔরঙ্গজেব।
বাঃ। আমি কিন্তু প্রশ্নটা না করতেই আপনি প্রশ্ন ভেবে নিয়েছেন। যাক গে। আপনি যখন ঔরঙ্গজেবের চার পূর্বপুরুষের নাম জানেন তখন নিশ্চয়ই আপনার চার পূর্বপুরুষের নাম জানা। বলুন তো! প্রতিমা তাকাল।
মাথা নামাল সত্যচরণ, তারপর বলল, বাবা, দাদু।
ওঁদের কোনও নাম নেই বুঝি–! প্রতিমা থামিয়ে দিল।
শ্ৰীযুক্ত সতীশ রায়, স্বর্গীয় সত্যসিন্ধু রায়–। চোখ বন্ধ করল সত্যচরণ। আর কোনও নাম মনে পড়ছিল না।
আপনি ওঁকে বলে দিন। প্রতিমা অনুরোধ করল সতীশ রায়কে।
ও জানলে তো বলবে। মোগল সম্রাটদের নাম মুখস্থ রেখেছে কিন্তু–। যাক গে। সাতকড়ি রায়, শুদ্ধানন্দ রায়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন। আপনি আপনার বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করেন। তার মানে রোজগারের ব্যাপারে বাবার ওপর নির্ভরশীল। আচ্ছা ধরুন, বিয়ের পর আপনার বাবা আপনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন। আমাকে তো আপনার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে হবে। তখন আমরা কোথায় থাকব, কীভাবে খাওয়া দাওয়া করব?
বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সত্যচরণ।
–-আচ্ছা, যদি দেন–।
দিলে তো এতদিনে দিতেন। মুখ নামাল সত্যচরণ।
জবাব দাও। তোমাকে বেরিয়ে যেতে বলিনি বলে কোনদিন বলব না একথা ভাবার কোনও কারণ নেই। বলেই প্রতিমার দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়লেন।
একটা কিছু করতে হবে।
ব্যাস। এটাই শুনতে চেয়েছিলাম। আপনার মনে হচ্ছে এখানে বসে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। যান, ভেতরে যান।
প্রতিমা কথা শেষ করতেই মহাদেব সেনকে নমস্কার করে ভেতরে চলে গেল সত্যচরণ। সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝলে?
বেশ নিরীহ। বলেই হেসে ফেলল প্রতিমা।
হুম। কিন্তু তোমাকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। এমনটাইট দেরে যাতে চোখে সরষের ফুল দ্যাখে। সতীশ রায় হাসলেন।
না না। মহাদেব সেন বললেন, একে মা মনসা, আপনি তার ওপর–।
তুমি আমাকে মনসা বললে দাদু? মনসা তো ভগবান। প্রতিবাদ করল প্রতিমা।
হরিপদ ট্রে নিয়ে এল। তাতে নানান রকমের খাবার সাজানো মাছের বড়া, ফিশফ্রাই, সন্দেশ, রসগোল্লা।
মহাদেব সেন মাথা দোলালেন, এর সবকটাই আমার কাছে নিষিদ্ধ বস্তু।
কেন? সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন।
ভাজা খাওয়া বারণ হার্টের জন্যে। মিষ্টি নিষিদ্ধ ব্লাডসুগারের জন্যে।
ও। সতীশ রায় ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন।
হরিপদদা। দরজার বাইরে থেকে এলোকেশীর গলা ভেসে এল।
হরিপদ দ্রুত বাইরে চলে গেল। ফিরে এল আধ মিনিটের মধ্যেই। এসে বলল, আজ্ঞে, চিনিছাড়া সন্দেশ খেতে কি আপত্তি আছে?
চিনি ছাড়া সন্দেশ? সে তো কলকাতার বড় দোকানে পাওয়া যায়। মহাদেব সেন বললেন, মিষ্টি না থাকলে সন্দেশ কি সন্দেশ থাকে?
সতীশ রায় বললেন, এলোকেশী বলেছে যখন তখন নিয়ে এসো।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সন্দেশ চলে এল। গোটা চারেক।
ইতস্তত করে মুখে দিলেন মহাদেব সেন, চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে বললেন, চমৎকার মিষ্টি যা আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। কে বানাল?
আজ্ঞে এলোকেশী।
বাঃ। দুটো সন্দেশ খেয়ে নিলেন মহাদেব সেন।
হরিপদ এবার প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলল, মা, আপনি।
এম্মা! আমাকে আপনি বলছেন কেন? আমি কত ছোট। আপনি সত্যচরণবাবুকে কি আপনি বলেন?
না না। এইটুকু থেকে দেখে আসছি, তাই–।
আমাকে যদি এ বাড়িতে এসে থাকতে হয় তাহলে আপনি বলা চলবে না। হুঁ। আমি একটা ফ্রাই খাব। আর কিছু নয়। প্রতিমা বলল।
খাওয়া শেষ হলে সতীশ রায় হরিপদকে ডেকে বললেন, একবার এলোকেশীকে এখানে আসতে বলে।
মিনিট দুয়েক বাদে এলোকেশী এল। সতীশ রায় অবাক হয়ে দেখলেন শাড়ি-জামা এবং চুল বাঁধায় একটু সাজ সাজ ভাব এনেছে এলোকেশী। ঘরে ঢুকে নমস্কার করল হাতজোড় করে।
এই হল এলোকেশী।
খুব ভাল সন্দেশ খেলাম। মহাদেব সেন বললেন।
ফ্রাই-ও। প্রতিমা বলল।
সতীশ রায় বললেন, মা, তুমি তো আমাদের বাড়ি দেখতে এসেছ। যাও, এলোকেশীর সঙ্গে ঘুরে দ্যাখো বাড়িটা।
উঠে দাঁড়াল প্রতিমা। বলল, যাই।
ওরা বেরিয়ে যেতে মহাদেব সেন বললেন, নাতনির সব ভালো কিন্তু কবে যে ম্যাচিওরিটি আসবে কে জানে!
আপনি ভুল করছেন। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এমন সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে জানেই না। ম্যাচিওরিটি মানে মুখ বন্ধ করে যদি প্যাঁচ ক্য হয় তাহলে আমি চাইব সেটা যেন ওর কখনই না আসে। সতীশ রায় বললেন।
.
এইটে বাবুর শোওয়ার ঘর। সতীশ রায়ের বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল এলোকেশী।
বাবু কে? প্রতিমা তাকাল।
তোমার ভাবী শ্বশুরমশাই। এলোকেশী হাসল।
ওমা। তাঁকে তুমি বাবু বলো নাকি?
এখানে, এই ডুডুয়াতে সবাই ওঁকে বড়বাবু বলে।
বড়বাবু শুনতে ভালো। বাবু বোলা না।
এইটেতে অতিথি এলে থাকে। হরিপদ বলল।
ও।
ওদিকে আরও দুটো খালি ঘর আছে।
ও।
এই যে উঠোন। উঠোনের ওপাশে রান্নাঘর, এদিকের ছোট ঘর দুটোর একটা মোতির মা আর আমি থাকি, অন্যটায় হরিপদদা।
মোতির মা কে?
মাতির মা খোকাবাবুর জন্ম থেকে আছে। ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকেই খোকাবাবু যেমন মতির মা ছাড়া চলতে পারে না তেমনি মতির মা খোকাবাবুর কোনও দোষ দেখতে পায় না। খুব ভালোবাসে ওকে। কথা শেষ করে এলোকেশী ডাকল, মতির মা, ও মতির মা!
সলজ্জ ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল মতির মা। পরিষ্কার থান পরনে, মাথায় ঘোমটা। এলোকেশী বলল, এই হল মতির মা।
প্রতিমা দ্রুত এগিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করতেই মতির মা হাউমাউ শব্দ করে লাফিয়ে সরে গিয়ে বলতে লাগল, পাপ হবে, মহা পাপ হবে।
তার মানে? কার পাপ হবে? প্রতিমা অবাক।
আমার! ঘোমটা টেনে দিল সামনে মতির মা।
কেন?
আমি এ বাড়িতে কাজ করি, বাড়ির বউ যে হতে যাচ্ছে সে কেন আমাকে প্রণাম করবে? আমারই প্রণাম করা উচিত। হাত নিচু করে এগোল মতির
আপনি কি পাগল? হেসে ফেলল প্রতিমা। আমার মায়ের চেয়ে কতবড় আপনি! ছি ছি ছি।
হঠাৎ দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল মতির মা। এলোকেশী কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওকি! কাঁদছ কেন? কী হল?
কান্না জড়ানো গলায় মতির মা বলল, দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারতাম না। আজ যে কী ভালো লাগছে। এলো, আমার খোকাবাবু ভাগ্য করে এসেছিল, নইলে এমন মেয়ে এই ঘরে আসে!
যাচ্চলে! তুমি এখনও তোমার খোকাবাবুর কথা ভাবছ। এলোকেশী হেসে ফেলল, কার সঙ্গে বিয়ে হবে, সেই বউ কী রকম এই ভেবে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল মতির মায়ের। তোমাকে দেখে শান্তি পেয়েছে।
খুব নরম মন গো, কবিতা লেখে তো। মতির মা বলল।
অ্যাঁ! কবিতা লেখে নাকি!
না না, আগে লিখত না। এই এক মাস হল শখ হয়েছে। বিয়ের পর যদি নিষেধ করা হয় তাহলে লিখবে না। মতির মা বলল।
প্রতিমার খুব মজা লাগছিলমতির মায়ের কথা শুনে।
এলোকেশী বলল, সেসব পরে হবে। আগে ওকে বাড়িটাকে দেখতে দাও। এই হল রান্নাঘর। এটা খাবারের জায়গা। আর ওপাশে খোকাবাবুর ঘর। মানে এখন পর্যন্ত ঘরটার ওই নাম, পরে তোমার ঘর হয়ে যাবে। ঘরটা দেখবে নাকি?
মতির মা বলল, তোর কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে! এখনও কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি, এই অবস্থায় কি ওর ওই ঘরে যাওয়া উচিত?
প্রতিমা হাসল; সম্পর্ক তৈরি না হলে কি যাওয়া যায় না?
তুমি তো এখনও কুমারী, আইবুড়ো ছেলের ঘরে যাওয়া ঠিক নয়! বেশ গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল মতির মা।
বেশ। তাহলে ওই ঘরে যাব না। তোমাদের বাড়িতে ঠাকুরঘর কোথায়?
ছিল। খোকার মা মারা যাওয়ার পর বড়বাবু বাড়িতে পুজো বন্ধ করে দিয়েছেন। ওই ঘর তালাবন্ধ। তুমি এসে যদি পারো তাহলে তালা খুলিয়ো।
ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে মনে পড়ে যাওয়াতে প্রতিমা মতির মাকে বলল, তোমার খোকাবাবু শুনলাম পরিশ্রম করে না। ওকে কি খাইয়ে দাও তুমি?
না না। প্রতিবাদ করল মতির মা, নিজের হাতে খায়। মা-মরা ছেলে তো, বেশি পরিশ্রম করলে যদি কিছু হয়ে যায়, তাই!…
একি কথা! ব্যাটাছেলে ন্যাকাচৈতন্য হয়ে থাকবে নাকি! এতদিন যা করেছে করেছে, এরপর ওসব চলবে না বলে দিয়ে।
সতীশ রায়ের গলা ভেসে এল, হরিপদকে ডাকছেন।
হরিপদ বলল, খোঁজ পড়েছে, এবার ও ঘরে যেতে হয়।
ঘরে ঢুকতেই সতীশ রায় জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলে?
ভালো।
হরিপদরা যেমন রেখেছে তেমন আছে।
মহাদেব সেন বললেন, আজ তাহলে চলি।
সতীশ রায় বললেন, আপনি আমার পিতৃতুল্য। এই বাড়িতে আপনার নাতনিকে পেলে আমি শুধু একটি মেয়ের অভাব থেকে বঞ্চিত হব না, আপনার মতো মানুষকে মাথার ওপর পেয়ে ধন্য হব।
গাড়িতে ওঠার আগে মহাদেব সেন বললেন, সবই ভালো কিন্তু মনে একটু খুত রয়ে গেল।
কীরকম? সতীশ রায় উদ্বিগ্ন হলেন।
একমাত্র পুত্রের বিয়ে দিচ্ছেন অথচ কোনও দাবিদাওয়া নেই–।
কে বলল নেই? এই যে, ঘটকবাবুকে জিজ্ঞাসা করুন, আমার দাবি মেটাতে কীরকম নাকানিচুবুনি খেয়েছেন–। সতীশ রায় এতক্ষণ চুপচাপ থাকা ঘটকমশাইকে দেখিয়ে দিলেন।
ওঁদের সঙ্গে ঘটকমশাইকেও চলে যেতে দেখে খেয়াল হল সতীশ রায়ের। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে মানিকজোড়কে দেখতে পেলেন।
কী ব্যাপার? তোমরা তো আমাকে অবাক করলে হে!
কেন বড়বাবু, কোন ত্রুটি হয়েছে কি? গোরক্ষ বলল।
না না। তোমরা এতক্ষণ মুখ বন্ধ করে বসেছিলে কী করে? এ তো তোমাদের স্বভাব নয়! হাসলেন সতীশ রায়।
কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বড়বাবু। নাগেশ্বর বলল।
কেন?
মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। আহা, চোখে মুখে কথা ঠিকরে উঠেছিল মায়ের। সুন্দরী তো বটেই কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি। নাগেশ্বর বলতে বলতে মাথা দোলাচ্ছিল।
একটুও জড়তা নেই, যেন নিজের বাড়িতে এসেছে। আপনার ভয়ে ডুডুয়ায় বাঘ আর গরু একসঙ্গে জল খায়– বলে থেমে গেল গোরক্ষ।
ওর সামনে আপনি, মানে আপনাকে, মায়ের পাশে ছেলের মতো দেখাচ্ছিল। নাগেশ্বর বলল, এ মেয়ে এলে সংসার সুখের হবে।
গোরক্ষ বলল, কথাই আছে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।
হুম। সেটাই তো ভাবছি। আমাদের সন্ধ্যাহিক বন্ধ করে দিতে পারে এ বাড়িতে পা দিয়েই। ঝাড়ামোছা যখন শুরু করবে তখন কি আর আহ্নিককে রেহাই দেবে। বললেন সতীশ রায়।
সেকি! চিৎকার করে উঠল নাগেশ্বর।
একটা বাচ্চা মেয়ে এসে এতদিনকার অভ্যেস বন্ধ করে দেবে? একি মেনে নেওয়া যায়? না না, আপনি মহাদেব সেন মশাইকে জানিয়ে দিন। গোরক্ষ গম্ভীর গলায় বলল।
কী জানাব? পাত্রীর হবু শ্বশুর প্রতি সন্ধ্যায় দু-পেগ মদ্যপান করে স্যাঙাতদের সঙ্গে, বিয়ের পর সেটা মেনে নিতে হবে মেয়েকে? পাগল। ওই মেয়ের ওপর কিছু চাপিয়ে দিলে যে তা মানবে না। সতীশ রায় কথা বলার সময় দেখতে পেয়েছিলেন মঙ্গলরা অবনীবাবুকে নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। তিনি গেট খুলে বললেন, আসুন আসুন।
অবনীদা ভেতরে ঢুকে বললেন, এরা ফাঁকিবাজ নয়। সেদিন যা যা দেখিয়ে গিয়েছিলাম তা একেবারে ঠিকঠাক করতে পারছে। গুড। কিন্তু আমাকে এখনই শহরে ফিরে যেতে হবে।
সেকি! আপনার তো আজ রাত্রে ডুডুয়ায় থাকার কথা।
ঠিক। কিন্তু যাচ্ছি একজন কমপাউন্ডারকে ধরে নিয়ে আসতে। ফার্স্ট বাসে চলে আসব। তোমরা তার আগে শুরু করে দিয়ো। অবনীদা বললেন।
কম্পাউন্ডার কেন?
প্রেসার মাপাবে। প্রত্যেকের নামে আলাদা আলাদা কার্ড হবে। মেডিক্যাল কার্ডে প্রেসার, পালস-বিট কত লেখা থাকবে, ব্লাড গ্রুপও লিখে রাখতে হবে। ফুটবলে চোট পাওয়া তো রোজকার ব্যাপার, রক্তের গ্রুপ জানা না থাকলে অ্যাকসিডেন্টের সময় সমস্যা হয়। পালস-বিট যার ষাট পঁয়ষট্টি স্পোর্টসম্যান হিসেবে তার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অবনীদা বললেন।
শুনেছিলাম পালসবিট বাহাত্তর থাকাটাই নর্মাল।
সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে। যদি কোনও কারণে পালস-বিট আশি নব্বই হয়ে যায় তাহলে তাদের অসুস্থ বলা হয়। ওইসময় বেশি দৌড়াদৌড়ি ক্ষতিকর। কিন্তু যার পালস-বিট ষাট তার পক্ষে পনেরো বেশি হলেও কোন অসুবিধে হয় না। আচ্ছা, আমার ব্যাগটা–।
থাক না ওটা। আপনি তো কাল সকালেই আসছেন।
ও। তাহলে থাক। চলি। অবনীদা হাঁটতে লাগলেন বাস-রাস্তার দিকে। সঙ্গে ছেলেরা।
*
লেখকের আমি এক মস্ত বড় পাঠিকা। এ যেন চোখের সম্মুখে দেখছি।