গ্রাম গড়ে ওঠা: বালুচিস্তান থেকে হরিয়ানা ও গুজরাট
১ ভারতবর্ষে গ্রাম গড়ে ওঠার সাধারণ সমস্যাবলী
এই বৃহৎ অঞ্চলে গ্রাম গড়ে ওঠার মূলে গম ও যব চাষ, গরু-মহিষ, ভেড়া-ছাগল পালন, ইত্যাদি। চাষবাস বা পশুপালনের উৎপত্তির ধারাটা এক নয়; বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হতে পারে। যে অঞ্চল নিয়ে আমরা এই অধ্যায়ে আলোচনা করব, ভারতবর্ষে কৃষিজীবনের সূত্রপাতের ইতিহাস শুধু তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। গত অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় বাগোরে ও আদমগড়ে গরু-ভেড়া-ছাগল পোষ মানানো অর্থাৎ গৃহপালিত ছিল; উদ্ভিজ্জ দ্রব্য ব্যবহারও হয়তো এই কেন্দ্রগুলিতে জানা ছিল। এই ধারাটা কোথায় গেল? আবার, বেলান উপত্যকা এবং মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় পোষ মানানো জন্তুর হাড় পাওয়া যায়নি, কিন্তু উদ্ভিজ্জ পদার্থ ব্যবহার তো স্বচ্ছন্দে অনুমান করা চলে। এখানে যে গোল চাকতির মতো ভারী এবং ছিদ্রযুক্ত পাথরের উদাহরণ পাওয়া গেছে তা দেখে এও অনুমান করা যেতে পারে যে, ভারী ছুঁচলো লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে বীজ বোনার একটা ধারা থাকার সম্ভাবনা আছে। পরের একটি অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, বেলান উপত্যকাতেই কোলডিহাওয়া নামক একটি জায়গায় খনন করে যে কৃষিসংস্কৃতির তারিখ পাওয়া গেছে: তার কালের পরিধি অষ্টম-সপ্তম সহস্রাব্দ পর্যন্ত হতে পারে। হয়তো এই সংস্কৃতি ধানচাষ-ভিত্তিক ছিল। তারিখ নিয়ে গোলমাল আছে, কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই অঞ্চলের কৃষিসংস্কৃতির এত পুরনো তারিখ মানতে চান না; কিন্তু উড়িয়ে দেবারও বোধহয় কোনও বিশেষ যুক্তি নেই। যদি এটি প্রাচীন হয় তবে ধানচাষের এই প্রাচীন ধারাটিই বা কোথায় গেল? দক্ষিণ ভারতে খ্রি.পূ. ৩০০০ অব্দ নাগাদ কৃষিকাজের সূত্রপাত দেখা যায়। সম্ভবত তা ছিল জোয়ার-বাজরা ভিত্তিক। এই জোয়ার-বাজরা চাষের ইতিহাসটিই বা কী? সাঁওতাল পরগনার রাজমহল পাহাড়ে মাটি খুঁড়ে একজন ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় নিদর্শনের সঙ্গে হাতে গড়া মৃৎপাত্রর টুকরো পেয়েছিলেন; আপাতদৃষ্টিতে কৃষি জীবনের পরিচায়ক; তবে এর তারিখ নির্ণীত হয়নি। তারিখ না জানলেও কৃষিকাজের এই ধারাটিই বা এল কোত্থেকে?
মূল কথা: ভারতবর্ষে কৃষিজীবনের সূত্রপাত ও ব্যাপ্তির সব যুগেরই বা ধারারই কিছু হিসেব মেলেনি। একটি ধারা আর একটির সঙ্গে কতটা মিশে গিয়েছিল এবং কখন মিশে গিয়েছিল তাও পরিষ্কার নয়। গম-ব-চাষ ভিত্তিক ধারাটি অবশ্য এদের ভেতর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। বর্তমান অধ্যায়ে আমরা তার প্রথম ব্যাপ্তি—উৎপত্তি ও প্রসার—আলোচনা করব। আলোচনার ক্ষেত্র: বালুচিস্তান থেকে একদিকে হরিয়ানা আর অন্য দিকে গুজরাট—এই বিস্তৃত ভূভাগ।
২ বালুচিস্তান
দুটি পর্বতশ্রেণী—কীর্থার ও সুলেমান—বালুচিস্তানকে সিন্ধু উপত্যকা থেকে বিভক্ত করে রেখেছে। ওপরের অংশে সুলেমান আর নীচের অংশে কীর্থার—এই দুইয়ের মাঝখানে বোলান নদীর উপত্যকা, যা বোলান গিরিবর্ত্ম নামে খ্যাত। কোয়েটা অঞ্চল এখানে। বোলানের অংশেই সিন্ধু উপত্যকার একটি অংশ—কাচ্চি সমতলভূমি, শিবি ও জ্যাকবাবাদের মাঝে—বালুচিস্তানের ভেতরে ঢুকে এসেছে। উত্তরপূর্ব বালুচিস্তানের একদিকে সুলেমান পর্বত আর অন্যদিকে, অর্থাৎ আফগানিস্তানের দিকে, টোবাকাকর পর্বত। এই দুয়ের মাঝখানের জায়গাও পর্বতময়। এখানে দুটি মূল নদী গোমাল আর ঝোব, আর তাদের উপনদী আছে। কোয়েটা থেকে নীচের দিকে কালাত অধিত্যকা এবং তার দক্ষিণে সারি সারি পার্বত্যভূমি নীচে সমুদ্রের দিকে নেমে এসেছে। দুটি নদী ওই অঞ্চলে—হাব ও পোরালি। পশ্চিমদিকে পারস্যদেশের সীমানা পর্যন্ত ছড়ানো বালুচিস্তানের সমুদ্রোপকূলের নাম মাকরান সমুদ্রোপকূল। উপকূলের ঠিক পেছনেই মাকরান পর্বতসারি, তার পেছনে কেজ নদী উপত্যকা; পান্জগুর মরুদ্যান এই অঞ্চলের বিখ্যাত জায়গা। দু-তিনটি নদী এখানে সমুদ্রে মিশেছে—দাশ্ত, সাদি কাউর এবং হিংগোল। কেজ উপত্যকার পেছনে সিয়াহান পর্বতশ্রেণী এবং তারও পেছনে, আফগান সীমান্তের দিকে, চাগাই পর্বতমালা পর্যন্ত হামুন-ই-মাশকেল ও হামুন-ই-লোরা নামক মরু অঞ্চল। সীমিত কয়টি অপ্রশস্ত নদী উপত্যকা, পর্বতশ্রেণীর মাঝে মাঝে সমতল ভূমি, বিস্তৃত এক মরু অঞ্চল, আর পর্বতের সারি, সুলেমান ও টোবাকাকর অংশে যার উচ্চতা ১১০০০/৯০০০ ফুট বা ৩০০০/৩৫০০ মিটার পর্যন্ত। বৃষ্টিপাত কম—বাৎসরিক ১০ ইঞ্চির আশেপাশে। চাষবাস পার্বত্য উপত্যকাতে সীমিত; চাষবাস ছাড়াও যাযাবরভিত্তিতে পশুপালন প্রচলিত।
পুরো অঞ্চলটির গুরুত্ব মূলত আফগানিস্তান ও পারস্যদেশের সঙ্গে যোগাযোগের দিক থেকে। বোলান গিরিবর্ত্ম ও গোমাল উপত্যকা দিয়ে আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ। কেজ উপত্যকা দিয়ে পারস্যদেশে সহজেই যাওয়া যায়। তা ছাড়া চাগাই পাহাড়ের নীচ দিয়ে পারস্যের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা আছে। পারস্যের জাহিদান ও বালুচিস্তানের কোয়েটার মাঝখানে রেললাইন এই অঞ্চল দিয়ে গেছে। গোমাল উপত্যকা দিয়ে উত্তর সিন্ধু উপত্যকা অর্থাৎ পঞ্জাব (পাকিস্তানের) এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ। দক্ষিণ সিন্ধু উপত্যকা বা সিন্ধুপ্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ কীর্থার পেরিয়ে দু-একটি গিরিবর্ত্ম, যথা মূলা গিরিবর্ত্ম, দিয়ে; তবে উপকূলের কাছাকাছি পর্বতমালা নিচু ও বিক্ষিপ্ত; তাদের মাঝ দিয়ে মাকরান উপকূল দিয়ে করাচি অঞ্চলে সহজেই পৌঁছানো যায়। এই অঞ্চলে লাসবেলা পাহাড়ে বিস্তীর্ণ প্রাচীন তাখনির সন্ধান আছে; এ ছাড়া তামা আছে চাগাই পাহাড়ে। চাগাই পাহাড়েই লাপিস লাজুলি পাথর, যা প্রাচীনকালে বিস্তৃত ব্যবহৃত হত, তার খোঁজ আছে। পান্জগুর মরুদ্যানের খেজুর বিখ্যাত। পারস্য ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য এবং স্থানীয় লোকের যোগাযোগ এখনও আছে— প্রাচীনকালেও ছিল। প্রাচীনকালে বৃষ্টিপাত যে এখন যা হয় তার তুলনায় অনেক বেশি হত তা মনে করার কোনও কারণ নেই। যতটুকু বৃষ্টি হয় চাষের কাজে তার সম্যক ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা ছিল। পাহাড়ের ঢালে দেওয়াল দিয়ে গড়িয়ে আসা জলকে কিছুক্ষণ আটকে কিছু পলি ধরে রাখার বন্দোবস্তকে এখানে ‘গবরবন্দ’ সিঞ্চন ব্যবস্থা বলা হয়। প্রাচীনকালেও গবরবন্দ দেওয়াল ছিল। তা ছাড়া পাহাড়ের ঢালে ধরা জলকে লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে দূরে নীচে ক্ষেতে নিয়ে আসাকে ‘কারেজ’ ব্যবস্থা বলে। তবে, এই কারেজ ব্যবস্থা বালুচিস্তানে কোথাও কোথাও থাকলেও প্রাচীনকালে ছিল কিনা জানা যায় না। কোথাও কোথাও নদীর মাঝখানে পাথর, মাটি ইত্যাদি দিয়ে বাধা তৈরি করে বর্ষার জলকে নদীর পাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে চাষ হয়। শুধু বর্ষার ওপর নির্ভর করে বালুচিস্তানে চাষ এখন প্রায় অসম্ভব; প্রাচীনকালেও নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিল। বালুচিস্তানের প্রাচীন গ্রাম সংস্থান বোঝার সময় আমাদের এই কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন।
এই অঞ্চলের প্রাচীনতম গ্রামের ইতিহাস জানা গেছে কাচ্চি সমতলভূমিতে— বোলান নদীর পাড় থেকে বিস্তৃত সমভূমিতে মেহেরগড় নামক জায়গা থেকে।
কাচ্চি সমতলভূমিতে বছরে একটা সময় (জুলাই-অগাস্ট) ৩ ইঞ্চি মতো বৃষ্টি হয়। এই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে কৃষিকাজ যে খুব কঠিন—প্রায় অসম্ভব—তা বলাই বাহুল্য। পাহাড়ি যে সব নদী এই অঞ্চলে নামে তারা এখানে এসে ছোট ছোট অনেক ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। এদের মাঝখান দিয়ে বাঁধ তৈরি করে বর্ষার জল ওপরে তুলে দেওয়া হয়। এই সেচ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেই এই অঞ্চলে চাষবাস হয়। প্রাচীনকাল থেকে আবহাওয়া পালটানোর যেহেতু কোনও প্রমাণ নেই তাই মনে করে নিতে হবে যে আমরা যে সময়ের কথা এখানে আলোচনা করছি যে সময়েও এইভাবে চাষবাস হত।
মেহেরগড় কেন্দ্রটি বোলান নদীর পাড়ে। বস্তুত ঢিপিটির একটা অংশ নদীতে কেটেছে, যে কারণে নদীর খাড়াইতে বসতির স্তর-পরম্পরার চিত্রটি কিছু ধরা পড়ে। মেহেরগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক বসতি বহু হাজার বছর ধরে ছিল; নদীর পাড় থেকে দূরেও বসতি নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই কারণে প্রত্নতাত্ত্বিকরা তথ্য সংরক্ষণের সুবিধার জন্য কেন্দ্রটিকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেছেন। সবচেয়ে পুরনো বসতি পাওয়া গেছে এম-আর-৩ অঞ্চলে, যা নদীর পাড়ে। বসতিটির প্রথম পর্যায়ের তারিখ ৭০০০-৫৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সূত্রপাত কিছু আগেও হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এই পর্যায়কে আবার দুটো উপ-পর্যায়ে (‘এ’ এবং ‘বি’) ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীনতর ‘এ’ উপ-পর্যায়ে আমরা দেখছি একটির বেশি কক্ষবিশিষ্ট এবং কাদামাটির রৌদ্রে শুকনো কাঁচা ইটের তৈরি বাড়ি, চাষের প্রমাণ, পশুপালনের প্রমাণ, শিকার করার সাক্ষ্য এবং মাটিতে লম্বাটে গর্ত করে বিভিন্ন জিনিসপত্রের সঙ্গে মৃতদেহকে কুঁকড়ানো অবস্থায় রেখে সমাধি। ‘বি’ পর্যায়ের সাক্ষ্যও মোটামুটি এই। তবে এই উপ-পর্যায়ে দেখছি কৃষি ও পশুপালনের গুরুত্ব বেড়েছে, মৃৎপাত্রের প্রাথমিক প্রচলন, এবং মাটির কাঁচা ইটের বাড়িগুলোর আরও বিশদ বা বড় হওয়া এবং সমাধিগুলোতে গর্তের ভেতর একটি করে কাঁচা ইটের দেওয়াল তৈরি করা। দুটো উপ-পর্যায় মিলে এই আদি পর্যায়টির যা সাংস্কৃতিক সাক্ষ্য তা এই: কয়েকটি কক্ষে বিভক্ত কাঁচা ইটের বাড়ি; একটি কক্ষে (২ × ১.৮০ মি.) একটি ছোট শিলনোড়ার পাথর (‘শিল’) আর বেতজাতীয় জিনিসের দাগ (অর্থাৎ, মাটির তৈরি বাড়ির ছাদ ছিল লতাপাতা জাতীয় জিনিস দিয়ে ছাওয়া)। অন্য স্তরের একটি কক্ষে একটি উনুন বা আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরম করার জায়গা। ওপরের দিকের স্তরটিতে ৬.৭০ × ৬.৩০ মি. আয়তনের একটি বাড়ি—উত্তরদিকের অংশটিতে ৩টি কক্ষ (২.৭০ × ২.২৫ মি. আয়তনের), দক্ষিণের অংশেও ৩টি কক্ষ (৩.৩০ × ২.২৫ মি. আয়তনের)। একটি কক্ষের তিন দেয়াল ধরে নিচু ও সরু একটি মাচা তৈরি করা; একটি কক্ষে উনুন, অপর একটি কক্ষে কিছু ভাঙা নুড়ি পাথর। শিলনোড়া জাতীয় পাথর, ‘মাইক্রোলিথ’ শ্রেণীর পাথরের হাতিয়ার, হাড় দিয়ে তৈরি কিছু হাতিয়ার—সাধারণত কক্ষগুলি থেকে এইসব পাওয়া গেছে। সমাধির চিহ্ন বেশ কয়েকটি। শরীর সব সময়ই কুঁকড়ে শোয়ানো, কিন্তু মাথা সব ক্ষেত্রে একই দিকে নয়। সমাধিতে মৃতের সঙ্গে দেওয়া জিনিসের ভেতর পাওয়া গেছে সামুদ্রিক ঝিনুকজাতীয় জিনিসের লকেট, সামুদ্রিক ঝিনুক জাতীয় জিনিস, পাথরের পুঁতি ও ঝিনুক জাতীয় জিনিসের মালা, পাথরের লকেট, হাড় দিয়ে বানানো আংটি, অ্যাসফাল্ট বা পিচ জাতীয় জিনিস লাগানো বেতের ঝুড়ির অংশ, লাপিস লাজুলি, টার্কোয়েস এবং স্টিয়েটাইট পাথরের পুঁতি, পাথরের আর ঝিনুক জাতীয় জিনিসের বালা (হাতে পরার), কাদার ওপর কাপড়ের দাগ, পাথরের বাটি, নদীর ঝিনুকের লকেট (‘মাদার-অফ-পার্ল’ যাকে বলা হয়), ছোট তামার পুঁতি, পালিশ করা পাথরের কুড়াল, ‘মাইক্রোলিথ’ জাতীয় হাতিয়ার ইত্যাদি। একটি কবরে মৃতের পায়ের দিকে ৫টি ছাগলের কঙ্কাল। মৃতের সঙ্গে দেওয়া জিনিসের পার্থক্য থেকে অনুমান করা যায় যে কিছু সামাজিক পার্থক্যও ছিল। যেমন, আয়তনে সমাধি নং ১১৪ অন্যগুলির চাইতে বড় (২.২৫ × ০.৪০ মি.), এর ভেতর যে কাঁচা ইটের দেওয়াল তৈরি হয়েছিল তাও দৈর্ঘ্যে কবরের দেওয়ালের চাইতে বেশি।
চাষবাসের নিদর্শন স্পষ্ট। কয়েক ধরনের চাষ করা যব, তা ছাড়া বুনো যবও আছে। বুনো যব আর চাষ করা যব একসঙ্গে পাওয়ায় মনে করা যায় যে বুনো যব থেকে চাষ করা যাবে উত্তরণ এই অঞ্চলেই হয়েছিল। কয়েক ধরনের চাস করা গমও আছে, তবে বুনো গমের চিহ্ন কিছুটা অনিশ্চিত। যব চায় এই অঞ্চলে নিজস্ব ধারাতে শুরু হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু গম চাযের সম্পর্কে এটা এখনও জোর করে বলা যায় না। উদ্ভিজ্জ পদার্থের ভেতর কুল ও খেজুরও আছে। জন্তুজানোয়ারের হাড়ের বেশির ভাগ বুনো জীবজন্তুর, যেমন কয়েক ধরনের হরিণ, হাতি, নীলগাই, বুনো ভেড়া ও ছাগল, শুয়োর এবং গরু। পালিত জন্তুর তালিকায় গরু, ভেড়া ও ছাগল। মোষের হাড়ও পাওয়া গেছে, তবে শুয়োরের হাড়ের মতো, এটা গৃহপালিত না বুনো মোষের তা পরিষ্কারভাবে নির্ণীত হয়নি। গরু, ভেড়া, ছাগল বুনো এবং গৃহপালিত দুই অবস্থাতেই পাওয়া গেছে বলে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এদের গৃহপালিত পর্যায়ে উত্তরণ এই অঞ্চলেই হয়েছিল। আরও দেখা গেছে যে প্রথম পর্যায়ের শেষভাগে জন্তুজানোয়ারের বেশিরভাগই গরু, ভেড়া আর ছাগল। বোধহয় কুকুরও পোষ মানানো অবস্থায় ছিল।
মেহেরগড়ের এই আদি পর্যায় আবিষ্কারের আগে আমাদের ধারণা ছিল ভারতবর্ষে যব ও গম চাষের সূত্রপাত পশ্চিম এশিয়া থেকে (যথা, এই ক্ষেত্রে, আফগানিস্তান, পারস্য, তুর্কমেনিয়া) প্রভাবের ফলে হয়েছিল। গম নিয়ে এখনও একটু সন্দেহ থাকলেও ভারতবর্ষ ভূখণ্ডের এই অঞ্চল যে যব-গম চাষ ও গরু, ভেড়া, ছাগলভিত্তিক পশুপালন সংস্কৃতির গোড়াপত্তনের একটি প্রাথমিক অঞ্চল ছিল এটা মেনে নেওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্র হিসেবে মেহেরগড়ের গুরুত্ব এখানেই। তবে নিজস্ব এই বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও, অঞ্চলটির অন্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগও লক্ষণীয়। যেমন, সামুদ্রিক ঝিনুক দূরের সমুদ্রোপকূলের সঙ্গে যোগাযোগের ফলেই আসতে পারে; টার্কোয়েস ও লাপিস লাজুলি পাথরও দূর থেকেই আসতে পারে (হয় আফগানিস্তান এবং পারস্য; নইলে আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী চাগাই পাহাড় থেকে)। তামার যে পুঁতিটি আছে তা থেকে তামা গলানো হত কিনা তা বোঝা যায়নি। মৃতের দাঁতের অবস্থা দেখে একজন সিদ্ধান্ত করেছেন যে, খাবার খুব মসৃণ বা মিহি ছিল না। স্কুল ধরনের খাবারই খাওয়া হত। সমাধিতে গেরুমাটির টুকরোও পাওয়া গেছে; তাই মনে হয় সমাধির আগে মৃতকে লাল রং মাখানো হত।
মেহেরগড়ের এই প্রথম পর্যায় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০০ অব্দ পর্যন্ত। একেবারে শেষের দিকে খারাপভাবে পোড়ানো কিছু মৃৎপাত্রের টুকরো পাওয়া গেলেও, সাধারণভাবে এই পর্যায়ে মৃৎপাত্রের ব্যবহার ছিল না। মৃৎপাত্রের ব্যবহার মূলত দ্বিতীয় পর্যায় থেকে দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায় বোধহয় খ্রি.পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ এবং পঞ্চম সহস্রাব্দের শেষ পর্যন্ত। বাড়ি মোটামুটি একই রকম ছিল, যদিও এই পর্যায়ে শস্যাগারের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়েছে। এই পর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে একটি কাস্তের কথা উল্লেখ করা যায়। বিটুমেনের সাহায্যে কিছু পাথরের ছোট ‘ব্লেড’ ত্যারছা করে একটি হাতলের সঙ্গে লাগানো—এমনভাবে যে সরলরেখায় একটি ধারালো অংশ পাওয়া যায়। হাতলটি কীসের তা ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না—কাঠ বা হাড়ের হওয়াই সম্ভব। স্টিয়েটাইট পাথরের পুঁতি তৈরি করার একটি জায়গা পাওয়া গেছে, সামুদ্রিক এক জাতীয় ঝিনুক এবং অন্য কিছু বিকনির্মিত পুঁতিও পাওয়া গেছে। একটি খোলা জায়গায় হাড়ের ছুঁচলো জিনিস বানাবার চিহ্ন—কিছু পোড়া নুড়ি, ছাই আর অনেক হাড় একত্রিত হয়ে আছে। তামার একটি ছোট পুঁতি আর একটি আংটি—তামা গলানো বোধহয় এই পর্যায়ে শুরু হয়েছিল। দু ধরনের চাষ করা গম, দু ধরনের চাষ করা যব; তা ছাড়া খেজুর, কুল; সবচাইতে আকর্ষণীয় তুলার অস্তিত্বের প্রমাণ। বার্নিশ করা, ভঙ্গুর, লাল মৃৎপাত্র— প্রথমদিকে আস্তে আস্তে ঘোরে এমন কুমোরের চাকে তৈরি করা; শেষের দিকে সাধারণ দ্রুত-গতি চাকে তৈরি নমুনা; হাতে গড়া বেতের ঝুড়ির ছাপ লাগানো মৃৎপাত্রও আছে। দুটি কাঁচা মাটির ছোট মানবমূর্তির নিদর্শন।
তৃতীয় পর্যায় খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দের শেষ আর চতুর্থ সহস্রাব্দের গোড়া। চাকে বানানো হলদেটে আর লাল রঙের, কালো জ্যামিতিক নকশাবিশিষ্ট মৃৎপাত্রের বহুল প্রচলন; কুমোরের ভাটার নিদর্শন; পোড়ামাটির তামা গলানোর পাত্র, পুঁতি তৈরির নিদর্শন, লাপিস লাজুলি এবং অন্য অনেক পাথরের পুঁতি ইত্যাদি পাওয়া যায়। সামুদ্রিক ঝিনুক; মৃৎপাত্র দেখে বালুচিস্তানের মধ্য অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ অনুমান করা যায়। এই সময়ের ভেতর বালুচিস্তানের অন্যত্রও গ্রাম গড়ে উঠেছে। গম ও যব চাষের আরও বিস্তৃতি।
চতুর্থ পর্যায় হয়তো খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং তার কিছু পর পর্যন্ত। কক্ষগুলি এই সময় বড়—৩ থেকে ১৫ বর্গ মি. আয়তন; আঙিনাতে শস্যাদি জিনিস রাখা যায় এমন মৃৎপাত্র; মৃৎপাত্রের আরও ব্যাপক ব্যবহার; বহুরঙিন এবং দ্বিরঙিন মৃৎপাত্রের প্রচলন—সাধারণত কালো জ্যামিতিক নকশা। পোড়ামাটির নারী মূর্তি। পঞ্চম পর্যায় খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ ভাগ। ষষ্ঠ পর্যায়ে খ্রি. পূ. ৩০০০ অব্দের পর। সপ্তম পর্যায়ে যথেষ্ট বড় স্থাপত্যের নিদর্শন; ধূসর রঙের মৃৎপাত্র ইত্যাদি। বালুচিস্তানে গ্রামজীবনের ইতিহাসের প্রথম দিকের একটি স্তর-পরম্পরায় বিদ্ধ চিত্র মেহেরগড় থেকে পাওয়া যাচ্ছে।১ মেহেরগড়ের মতো এত প্রাচীন নিদর্শন বালুচিস্তানের অন্য অঞ্চল থেকে এখনও পাওয়া যায়নি, তবে খ্রি.পূ. ষষ্ঠ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে যে অন্য অঞ্চলগুলিতেও গ্রাম গড়ে উঠছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। এই অঞ্চলগুলির ভেতর প্রথমে উত্তরপূর্ব বালুচিস্তানে ঝোব উপত্যকায় রানা ঘুড়াই কেন্দ্রের উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘রানা ঘুন্ডাই’ লোরালাই ক্যান্টনমেন্টের ৮ মাইল পূর্বে; প্রায় ৪০ ফুট উঁচু আর ৪৭০ গজ পরিধির ঢিবি। একেবারে নীচের দিকে পাওয়া গেছে গৃহপালিত গরু/ষাঁড়, ভেড়া, ছাগল ও ঘোড়া (ঘঘাড়ার অস্তিত্ব নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকলেও, ঘোড়াই; ক্যান্টনমেন্টের ভেটেরানারি ডাক্তারের মতে ক্যান্টনমেন্টের ঘোড়া আর রানা-ঘুন্ডাই-এর নীচের স্তরের ঘোড়ার দাঁতের কোনও প্রভেদ নেই) একটি শিশুর কঙ্কালের টুকরো, কিছু মাইক্রোলিথ জাতীয় হাতিয়ার—তারিখ খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। দ্বিতীয় পর্যায়ের বিশেষ নিদর্শন সুন্দর এক ধরনের মৃৎপাত্র— সরু চাকতি বসানো তলা থেকে ছড়িয়ে উঠে গেছে; ভালভাবে মেনে নেওয়া মাটিতে তৈরি লালচে/হলদেটে রঙের ওপর কালো চিত্ৰণ—সমান্তরাল কিছু রেখার সঙ্গে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়ের জ্যামিতিক চিত্ররেখা। পর পর কয়েকটি ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। খুব সুন্দর তুলির কাজ। এই ধরনের মৃৎপাত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ঠিক এই ধরনের মৃৎপাত্রই পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব ইরান/পারস্য থেকে পাওয়া গেছে। সেখানে ষাঁড়ের বদলে ‘আইবেক্স’ নামক হরিণজাতীয় জীবের চিত্র। কোনও সন্দেহ নেই যে এই সময়ে বালুচিস্তানের এই অঞ্চলের সঙ্গে পারস্যের ভাল যোগাযোগ ছিল। রানা ঘুন্ডাই-এর তৃতীয় পর্যায়ে এই মৃৎপাত্ররীতির কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তবে এই নিয়ে বর্তমানে ভাবার কিছু নেই। উত্তর-পূর্ব বালুচিস্তানে রানা ঘুন্ডাই বাদ দিয়েও অন্য অনেক প্রাচীন গ্রামের ঢিবি লক্ষ করা গেছে।২
মধ্য বালুচিস্তানে দুটি অঞ্চল—কোয়েটা উপত্যকা আর তার দক্ষিণে কালাত অধিত্যকা। কোয়েটা উপত্যকাতে বেশ কয়েকটি প্রাচীন কেন্দ্রের ভেতর ‘কিলে-গুল-মোহাম্মদ’ ও ‘দাম্ব সাদাত’ নামক দুটি কেন্দ্রে খননকার্য করা হয়। প্রথম পর্যায়ে মৃৎপাত্রের কোনও নিদর্শন নেই; ৫ মি. গভীর বসতি নিদর্শন—মাটি অথবা লতাপাতা ও কাদার দেওয়াল দেওয়া বাড়ি, গৃহপালিত ভেড়া, ছাগল, গরু, মাইক্রোলিথ জাতীয় হাতিয়ার, কখনও ঘষে পালিশ করা পাথরের কুড়াল। দ্বিতীয় পর্যায়ে হাতে বানানো মৃৎপাত্র, কখনও বেতের ঝুড়ির ছাপ দেওয়া, কখনও কিছু ঢেউ-খেলানো রেখাতে চিত্রিত—কিছু হাড়ের হাতিয়ার। তৃতীয় পর্যায়ে লালের ওপর কালো চিত্রণবিশিষ্ট মৃৎপাত্রের বহুল প্রচলন। চতুর্থ পর্যায়ে পাথরের ভিতের ওপর মাটির বাড়ি, বহুরকম জ্যামিতিক কালো নকশায় চিত্রিত হলদেটে রঙের মৃৎপাত্র। এর পরের পর্যায়ে ধূসর রঙের চিত্রিত এক ধরনের মৃৎপাত্র, আলাবাস্টার পাথরের ব্যবহার; তামার প্রচলন, তন্দুরজাতীয় উনুনের প্রমাণ, মাঝখানে খোপ খোপ করা মাটির সিলমোহরজাতীয় জিনিস, পোড়ামাটির ছোট ছোট গরু/ষাঁড় আর স্ত্রী মূর্তি—মৃৎপাত্রের ওপরে কুমোরদের স্মারকচিহ্ন ইত্যাদি। শেষ পর্যায়ে পাথরের বড় স্থাপত্যের নিদর্শন, পোড়ামাটির বিভিন্ন জিনিস, সিলমোহর, তামা ও আলাস্টারের পাত্র। সময়কাল (সবগুলি পর্যায় নিয়ে) খ্রি. পূ. পঞ্চম-ষষ্ঠ সহস্রাব্দ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দ পর্যন্ত।৩
কালাত অধিত্যকায় আন্জিরা ও সিয়া দাম্ব নামক দুটি জায়গায় খননকার্য হয়। প্রথম পর্যায়ে লাল রঙের মৃৎপাত্র এবং ‘মাইক্রোলিথিক’ হাতিয়ার। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাথরের ভিতের ওপর কাঁচা ইটের বাড়ি—কখনও কালো রঙের, কখনও বেতের ঝুড়ির ছাপ দেওয়া মৃৎপাত্র। তৃতীয় পর্যায়ে দ্বিরঙা এবং লালের ওপর কালো রঙের হরিণের শিঙের জ্যামিতিক চিত্রবিশিষ্ট এক ধরনের মৃৎপাত্র। চতুর্থ পর্যায়ে স্থাপত্যের ভাল নিদর্শন। পঞ্চম ও শেষ পর্যায় কোয়েটা অঞ্চলের শেষ পর্যায়ের মতো। এই পর্যায়গুলির তারিখ আলাদাভাবে নির্ণীত হয়নি, তবে কোয়েটা অঞ্চলের মতোই তারিখ হতে পারে।৪
কালাতের দক্ষিণে, পার্বত্য উপত্যকাগুলির মাঝে, নাল এবং কুল্লি নামক দুটি আঞ্চলিক সংস্কৃতির ধারা আছে। নাল বোধহয় শুরু হয়েছিল খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা তার আগে, খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দেও এর তারিখ হতে পারে। নাল ঝালাওয়ান অঞ্চলে, কোয়েটা থেকে প্রায় ২৫০ মাইল দক্ষিণে। এখানে খনন করে সমাধির চিহ্নই বেশি পাওয়া যায়; পুরো শরীর এবং শুধু কিছু দেহাস্থি—এই দুই ধরনেরই সমাধি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে লাপিস লাজুলি এবং অন্যান্য পাথরের পুঁতি, বেশ কিছু তামার হাতিয়ার (কুড়াল ইত্যাদি) তামার—সিসা, নিকেল এবং আর্সেনিক মিশ্রণের চিহ্ন—পোড়ামাটির ছোট ছোট গরু ষাঁড়ের মূর্তি, রুপোর চিহ্ন, চুনাপাথর ও মার্বেল পাথরের ব্যবহার, বহুরং মৃৎপাত্র ইত্যাদি। এই মৃৎপাত্রের রং সাধারণত লাল, হলুদ ও সাদা। চিত্রণে কোথাও কোথাও মাছ দেখা যায়।৫
কুল্লি নামক কেন্দ্রটিও দক্ষিণ বালুচিস্তানে। এর দুটি মূল পর্যায়। একটি খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং তার পর, অন্যটি তার আগে। কত আগে ঠিক করে বলা সম্ভব নয়। বহু কক্ষবিশিষ্ট পাথরের খণ্ড দিয়ে বানানো বাড়ি, পাথরের পুঁতি, শিলনোড়াজাতীয় পাথরের টুকরো, তামা এবং সোনার ব্যবহার ইত্যাদি বাদ দিয়ে কুল্লি এবং কুল্লি-সম্পর্কিত কেন্দ্রগুলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের মৃৎপাত্র—বিশেষ করে লাল রঙের ওপর করা কালো চিত্রণ। সরু এবং লম্বা বা দীঘল আকৃতির ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে লতাপাতা/উদ্ভিদ আঁকা নকশার অনেকখানি জায়গা জুড়ে; বড় গোল চোখ। কুল্লি সংস্কৃতির নিদর্শন দক্ষিণ বালুচিস্তানের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে আছে। বালুচিস্তান আর সিন্ধু উপত্যকার মাঝামাঝি একটি অঞ্চল, যাকে কোহিস্তান বলা হয়, সেখানে এবং দক্ষিণ বালুচিস্তানের বিভিন্ন পার্বত্য উপত্যকা জুড়ে এই সংস্কৃতির কেন্দ্র ছড়ানো। পোরালি নদীর পাড়ে, মাটি ও পাথরের বড় বড় টুকরো দিয়ে বানানো পিরামিড আকৃতির স্থাপত্য—এক ধাপের ওপর আরেক ধাপ ক্রমশ ছোট হয়ে উঠে গেছে, চারপাশে অন্য বাড়িঘরের নিদর্শন—‘এডিথ শার’ অঞ্চলে ২৯ হেক্টর জায়গা জুড়ে এরকম ধ্বংসস্তূপ ছড়ানো। তা ছাড়া ওই অঞ্চলেই নিন্দোয়ারি নামে ৪৫ হেক্টরের একই জাতীয় কেন্দ্র। নিন্দোয়ারিতে পাথরের টুকরোগুলি এক টন পর্যন্ত ভারী। সময় খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি।
একই ধরনের সাক্ষ্য নিয়াইবুথি কেন্দ্রে। কুল্লি সংস্কৃতির আর একটি চিহ্ন পোড়ামাটির ছোট ছোট নারীমূর্তি ও চিত্রিত গরুর মূর্তি। নারীমূর্তিগুলির অলংকরণ ওপর থেকে টিপে টিপে মাটি লাগিয়ে হত।৬
লাসবেলা নামক অঞ্চলে সোনমিয়ানী উপসাগরের কূলে বালাকোট কেন্দ্রে খনন করে খ্রি.পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দের শেষভাগ থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম পর্যন্ত একটি সংস্কৃতির অবশেষ পাওয়া গেছে। ১০ × ২০ × ৪০ সে.মি. আয়তনের কাঁচা ইটের তৈরি বাড়িঘর—চাকে গড়া চিত্রিত মৃৎপাত্র, যার ভেতর ‘নাল’ মৃৎপাত্রের টুকরোও পাওয়া গেছে। [এই কারণেই ‘নাল’-এর তারিখ খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দ পর্যন্ত নেওয়া যায়]। এ ছাড়া, ষাঁড়ের ছোট ছোট পোড়ামাটির মূর্তি, মাইক্রোলিথ শ্রেণীর পাথরের হাতিয়ার, লাপিস লাজুলি এবং অন্যান্য পাথর, এবং ঝিনুকের পুঁতি; শিলনোড়াজাতীয় পাথরের টুকরো, কুমোরের দাগ দেওয়া চিহ্ন; গবাদি পশুর মাংসের ব্যবহার, যব, ডালজাতীয় শস্য, কুল, একজাতীয় শাক পাওয়া গেছে।
মাকরান উপকূলের উত্তরে কেজ উপত্যকায় মিরি কালাত নামক কেন্দ্র। এখানে বসতির সূত্রপাত হয় খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দে, কিন্তু এই প্রথম পর্যায়ের বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে পাথরের ভিত দেওয়া মাটির বাড়িঘর আছে, লাল এবং ধূসর, খয়েরি, কালো নকশায় চিত্রিত মৃৎপাত্র আছে, আর, পোড়ামাটির বালা, গুলতির গোলা, স্টিয়েটাইট পাথরের পাত্র ইত্যাদি আছে। পরের পর্যায়ে ‘নাল’ মৃৎপাত্রের টুকরো—কোথাও কোথাও এই পর্যায়ের ১০-১৫ মি. গভীর বসতিস্তর। চতুর্থ এবং শেষ পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন। মিরি কালাতে খননকার্য শেষ হয়নি।৭
সব মিলিয়ে বালুচিস্তানে গ্রাম গড়ে ওঠার ইতিহাস চিত্তাকর্ষক। এই গ্রামজীবনের ভিত্তি যব ও গম চাষ এবং গবাদি পশু ও ভেড়া-ছাগল পালন। আমরা শুধুমাত্র সেইসব বসতিকেন্দ্রেরই নাম করেছি যেগুলি খোঁড়া হয়েছে। কিন্তু এইসব কেন্দ্রের বাইরে সমসাময়িক বহু কেন্দ্র বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে। এদের বিস্তৃতি এবং সংখ্যা ভালভাবে বোঝা এখনও সম্ভব হয়নি। তবু, সামগ্রিক চিত্রটি অনেকাংশে পরিষ্কার। একবার, যব ও গম চাষের প্রচলন এবং গবাদি পশু, ভেড়া-ছাগল গৃহপালিত হওয়ার পর ক্রমশ সর্বত্রই গ্রাম গড়ে উঠল। চিত্রিত মৃৎপাত্র, কিছু তামার ব্যবহার, কাঁচা ইটের বাড়িঘর (কোথাও পাথরের ভিতের ওপর) মাইক্রোলিথ বা ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের ব্যাপক ব্যবহার, অন্যান্য অপেক্ষাকৃত দামি পাথরের পুঁতি ইত্যাদি অলংকার, নারী এবং গবাদি পশুর পোড়ামাটির ছোট ছোট মূর্তি: খ্রি. পূ. ৭০০০ অব্দ বা তার কিছু আগে থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই গ্রাম-সংস্কৃতির ইতিহাস। মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান এবং পারস্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগ ভাল বোঝা যায় মৃৎপাত্রগুলির কিছু ধরন এবং তাদের ওপর চিত্রণের মাধ্যমে। তা ছাড়া, টার্কোয়েস, লাপিস লাজুলি, সামুদ্রিক ঝিনুক ইত্যাদি উপাদানগুলি অনেক সময় বাণিজ্যের মাধ্যমে আহৃত হত। তামা, সিসা বালুচিস্তানেই পাওয়া যায়; তবু আফগানিস্তান থেকে কিছু আসতে পারত।
এখানে একটি কথা পরিষ্কার মনে রাখা প্রয়োজন। এই ধরনের যোগাযোগের চিহ্নের অর্থ এই নয় যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দলে দলে লোক এসে বসতি করছে। মধ্য এশিয়ার দক্ষিণভাগ অর্থাৎ আমুদরিয়া বা অকসাস নদীর উপত্যকা, উত্তরপূর্ব পারস্য যাকে খোরাসান বলা হয় এবং তুর্কমেনিয়াতে তার কিছু অংশ, পূর্ব পারস্যের সীমান্তঘেঁষা প্রান্ত (মানচিত্রে মেশেদ থেকে জাহিদান, জাবুল পর্যন্ত অপ্রশস্ত অঞ্চলটি; এই অঞ্চলটি অপ্রশস্ত এই কারণে যে, মধ্য পারস্যের মরুভূমি এর ঠিক পশ্চিমে, গা ঘেঁষে), পুরো আফগানিস্তান, কাশ্মীর-লাদাক ভূভাগ এবং সিন্ধু উপত্যকা—এই সমস্ত অঞ্চলটা জুড়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক যোগসূত্র ইতিহাসের সব পর্বেই রয়েছে। রাজনৈতিক যোগসূত্রও ছিন্ন হয়েছে মাত্র ঊনবিংশ শতকে, আর অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক যোগসূত্র এখনও ছিন্ন হয়নি, বহু রাজনৈতিক বাধা সত্ত্বেও। যাঁরা ভাবেন উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে শুধু বিজয়ী বাহিনীই ভারতবর্ষে এসেছে তাঁদের মনে করানো যেতে পারে যে মৌর্যসাম্রাজ্য দক্ষিণ আফগানিস্তান জুড়ে ছিল; মোগলরা দিল্লীতে বসে মধ্য এশিয়ার জন্য যুদ্ধ করেছেন; রণজিৎ সিং-এর শিখ রাজ্য উত্তর সিন্ধু উপত্যকা অর্থাৎ পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ জুড়ে ছিল। খ্রিস্টীয় অষ্টম-দশম-একাদশ শতাব্দীতে পেশোয়ারের কাছে হান্ড নামক জায়গা থেকে হিন্দু শাহি বংশের রাজারা মোটামুটি একই অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। বর্তমান সীমারেখা মেনে ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বের ইতিহাস চলেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে আফগানিস্তান সীমানায় ‘ডুরান্ড লাইন’ করার আগে, ইংরেজরা ভেবেছিলেন হিন্দুকুশের উত্তর পর্যন্ত সীমা টানা যায় কি না। রাজনৈতিক সীমানা ও ক্ষমতার পালাবদল ছাড়া এই অঞ্চলে আর যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে অর্থনৈতিক যোগাযোগ। প্রথাগত বাণিজ্য ছাড়াও এই অর্থনৈতিক যোগাযোগ রক্ষিত হত এবং হয়ে আসছে কিছু যাযাবর গোষ্ঠীর আনাগোনার মাধ্যমে। তারা দলে দলে শীতে হিন্দুকুশের থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত বাণিজ্যদ্রব্য নিয়ে ভারতবর্ষে নেমে আসত, আর, গ্রীষ্মের শুরুতে এদিক থেকে জিনিস নিয়ে ফিরে যেত। পুরো অঞ্চলটা জুড়ে এই যে বাণিজ্য তার ঐতিহাসিক হিসেবনিকেশ এখনও ভালভাবে হয়নি; তবে এতে ভারতবর্ষীয় বণিকেরা অথবা শ্ৰেষ্ঠীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই বাণিজ্যে আর্থিক দাদন দেওয়াতে এঁদের গুরুত্ব ছিল। এঁদের হুনডি মধ্য এশিয়ার সর্বত্র চলত। মধ্য এশিয়া পেরিয়ে বাকু এবং সেন্ট পিটারসবুর্গ পর্যন্ত ভারতীয় বণিকদের ভূমিকা আধুনিক সময়ের সূত্রপাতের আগে পর্যন্ত স্বীকৃত। বর্তমানকালেও আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে যাযাবরগোষ্ঠী পণ্য নিয়ে নামে; পারস্যের উত্তর-পূর্বে এবং পূর্বের অপ্রশস্ত অঞ্চলে বৃদ্ধ বাসচালক এখনও ‘হিন্দুস্থানি/উর্দু’ বোঝে এবং পারস্যের অন্তর্ভুক্ত বালুচিস্তানের লোক তো করাচি-গাল্ফ পর্যন্ত ব্যবসা করে। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটির গুরুত্ব হল যে—মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান বা পূর্ব পারস্যের কোনও জিনিস ভারতবর্ষে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত পাওয়া গেলেই যে তাকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আগমনের সাক্ষ্য হিসাবে নিতে হবে তা নয়; সাধারণ যোগাযোগের চিহ্ন হিসাবে সেটা ধরাই ঠিক হবে।
এই প্রসঙ্গেই আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করা যেতে পারে। হিন্দুকুশ ভারতবর্ষ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সীমারেখা। উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য ভূভাগটি নয়। এই পার্বত্য ভূভাগ এক দিক থেকে হিন্দুকুশেরই অংশ, তবে মূল হিন্দুকুশ আরও উত্তরে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে যাঁদের বিদেশি শক্তি বলা হয় তাঁদের সবারই উৎপত্তি হিন্দুকুশের উত্তর বা দক্ষিণ থেকে। উত্তর থেকে যাঁরা এসেছেন যেমন ইন্দো-গ্রিক, শক-কুষাণ, মহম্মদ ঘোরি, পরবর্তী যুগের মোগল, আফগানরা তাঁদের সকলেরই আক্রমণের কিছু ভৌগোলিক ক্রমপর্যায় ছিল। মধ্য এশিয়া থেকে প্রথমে দক্ষিণ আফগানিস্তান বা হিন্দুকুশের দক্ষিণে নিজেদের স্থাপন করা; এবং তারপর, যদি গাঙ্গেয় অঞ্চলের শক্তি প্রবল থাকে তবে উচ্চাভিলাষ সংবরণ করা; আর যদি গাঙ্গেয় অঞ্চলের শক্তি দুর্বল হয় তবে সিন্ধু নদীর উপত্যকা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকা। এঁরা গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষ না হতে পারেন কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসের ভৌগোলিক পরিধির পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিদেশি’ও নন। মধ্য এশিয়া থেকে সিন্ধু উপত্যকা একই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক (এবং কিছুটা ভৌগোলিক) বৃত্তে; এই বৃত্ত ভেতরের ভারতবর্ষের অর্থাৎ সিন্ধু উপত্যকার পূর্বের ভারতবর্ষের বৃত্তটির সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পর্কিত হয়েছে। কখনও প্রথম বৃত্তটি প্রভাবশালী হতে পেরেছে কখনও ভেতরের বৃত্তটি। ভারতবর্ষের ইতিহাসকে যদি আমরা এই দুটি মূল বৃত্তের সম্পর্কের মাপে অথবা পরিপ্রেক্ষিতে দেখি তবে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হব যে প্রাক-ইংরেজ পর্বে একটি তথাকথিত ‘বিদেশি’ শক্তিও ঠিক ‘বিদেশি’ নয়। ভারতবর্ষে যে ইসলাম এসেছে বা অনেকাংশে বিজয়ী হয়েছে তা আরবের ইসলাম নয়; দক্ষিণ আফগানিস্তানের এবং পরে মধ্য এশিয়ার ইসলাম। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক সান্নিধ্যটি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। পেশোয়ার বাজারে রাত্রে খাওয়াদাওয়া করে লরিতে উঠে কোনও লরিচালক যদি মাল নিয়ে সারা রাত লরি চালান তবে ভোরবেলা উত্তর আফগানিস্তান পেরিয়ে আমুদরিয়া উপত্যকায় ঢুকে যাবেন। পুরো অঞ্চলটা একদিক থেকে ভারতবর্ষ ভূখণ্ডের দ্বারপ্রান্ত। যখন ভেতরের ভূখণ্ড দুর্বল হয়েছে তখন এই দ্বারপ্রান্ত অঞ্চলের বৃত্তটির রাজনৈতিক শক্তি তাতে ঢোকার চেষ্টা করেছে বা কখনও ঢুকেছে। আবার, ভেতরের ভূখণ্ডের শক্তি প্রবল হলে তা দ্বারপ্রান্তে প্রভাব বিস্তার বা রাজত্ব করেছে। অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে অক্সাস-সিন্ধু বৃত্তটি ভেতরের ভূখণ্ড দিয়ে অনেকটা প্রভাবিত; তবে দুটি বৃত্ত থেকেই এই প্রভাব কাজ করেছে। এক সময় মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম যদি ভেতরের বৃত্তের হয় পরবর্তীকালে ভারতের ইসলাম বাইরের বৃত্তটির। এই ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে কোনও মধ্য এশিয়া বা উত্তর-পূর্ব পারস্য/তুর্কমেনিস্তানের কোনও জিনিস দেখালেই জনগোষ্ঠীর আগমন বলে ভাবতে হবে না, যা আগের অনেক পণ্ডিত ভেবেছেন।৮
৩ কোহিস্তান, গোমাল উপত্যকা, বান্নু
বালুচিস্তান থেকে আমরা যদি পূর্বদিকে আসি তবে সিন্ধুর সমতলে ঢোকার আগে একটি পার্বত্য বলয় আসবে—নীচের দিক থেকে, প্রথমে সিন্ধু কোহিস্তান, ওপর দিকে গোমাল উপত্যকা, আরও ওপরে বান্নু অঞ্চল। কোহিন্তানের বৈশিষ্ট্য নিচু এবং খোলা পাহাড়ি উপত্যকা (অর্থাৎ, এখানে কীর্থারের মূল শ্রেণী নিচু এবং ছড়ানো)— অনেক জায়গায় প্রাকৃতিক প্রস্রবণ। এখানে যে প্রাগৈতিহাসিক গ্রামীণ সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র তাকে আমরি সংস্কৃতি বলা হয়। আম্রি নামক কেন্দ্রটি সিন্ধু উপত্যকার প্রান্ত ঘেঁষে। এখানে খনন করে এক বিশেষ ধরনের দ্বিরঙিন মৃৎপাত্র পাওয়া যায়—ক্রিম বা লালচে রঙের ওপর কালো/খয়েরি রং দিয়ে চিত্রণ—প্লাম/লাল রঙের সমান্তরাল কিছু রেখার সঙ্গে। একেবারে প্রথমে থেকেই কাঁচা ইটের বাড়ি দেখা যায়; ধাতুর (তামা) টুকরো দেখা যায়—মৃৎপাত্রের চিত্রণ প্রথমে জ্যামিতিক, শেষ পর্যায়ে জন্তু জানোয়ারের চিত্রণও দেখা যায়। সংস্কৃতিটি শুরু হওয়ার তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি; হয়তো এর আগেও হতে পারে। কোহিস্তান অঞ্চলের ভেতর আম্রি সংস্কৃতির কেন্দ্র গাজি শা; তারিখ ওই রকমই, অর্থাৎ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি। একটা ছোট নালা কোনও প্রস্রবণের জলে তৈরি এবং কেন্দ্রটির পাশ দিয়ে গেছে। জুলাই-অগাস্টে প্রায় ৫ কি.মি. চওড়া জায়গা জুড়ে বন্যা হয় এবং পলি পড়ে। এর ভিত্তিতে গরমের সময় জোয়ার-বাজরা চাষ হয়। এ ছাড়া ৪ কিমি. দূরের একটি প্রস্রবণ থেকে খাল কেটে জল নিয়ে আসা হয়েছে—প্রায় ৮০ হেক্টর জমিতে এই সেচ ব্যবস্থায় শীতে চাষ হয়। সবচেয়ে নীচের ৩ মি. গভীর স্তর থেকে ছিদ্রযুক্ত পোড়ামাটির চাকতি, ষাঁড়ের ছোট পোড়ামাটির মূর্তি, হাড়ের সুঁচ, চার্ট পাথরের হাতিয়ার, গুলতির পাথর, শিলনোড়ার পাথর, পাথরের ভিতের ওপর কাঁচা ইটের বাড়ি, তামার পুঁতি, ঝিনুক, লাপিস, স্টিয়েটাইট, কার্নেলিয়ান এবং অন্য পাথরের পুঁতি, ঘুরিয়ে ছিদ্র করা যায় এমন পাথরের ‘ড্রিল’ বা তুরপুন ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এই অঞ্চলের এই পর্যায়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাথর এবং মাটি দিয়ে পিরামিড জাতীয় জিনিস বানানো, সাধারণ বসতির চাইতে যা উঁচু।৯
গোমাল উপত্যকার গোমাল নদী যেখানে সিন্ধু নদীতে মিশেছে সেই অঞ্চলটাকে ‘দেরাজাৎ’ বলা হয়। দেরা ইসমাইল খাঁ ও দেরা গাজি খাঁ অঞ্চলের বিখ্যাত জায়গা। গোমাল উপত্যকা দিয়ে একসময় অনেক সার্থবাহ নামত। এই অঞ্চলে দুটি জায়গায় খননকার্য হয়েছে—গুমলা এবং রহমান ধেরি। গুমলার প্রথম পর্যায়ে ছাইমাটি, গর্ত, শিলনোড়ার পাথর, ছোট ছোট পাথরের হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে, কিন্তু মৃৎপাত্র পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় পর্যায়ে চাকে বানানো চিত্রিত মৃৎপাত্র, তামার হাতিয়ার, হাড় দিয়ে বানানো হাতিয়ার, পোড়ামাটির ছোট ছোট নারী মূর্তি, চাকা, বালা এবং দাবা জাতীয় খেলার গুটি হিসেবে লাগে এমন জিনিস। তৃতীয় পর্যায়ে অন্য সব জিনিসের ভেতর, এক বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র যা ‘কোট ডিজি’ নামক একটি সংস্কৃতির পরিচায়ক এবং এমন এক ধরনের পোড়ামাটির ছোট ছোট নারীমূর্তি যাদের কোমরের নীচের অংশটি জোড়া এবং ছড়ানো। ‘কোট ডিজি’ সংস্কৃতির ছাপ রহমান ধেরির প্রথম থেকে; পুরো কেন্দ্রটি সেই সময় থেকেই দেওয়াল দিয়ে ঘিরে; বসতিটি প্রথম থেকেই সুসংবদ্ধ ছকে সাজানো। রহমান ধেরির বসতির শুরু বোধ হয় খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি হয়েছিল।১০
বান্নুতে ‘কোট ডিজি’ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্র লেওয়ান ও তারাকাই কিলা। লেওয়ানে পাথরের হাতিয়ার এবং অন্যান্য জিনিস তৈরি হত এবং সেখান থেকে বোধ হয় ব্যবসা হত। তারাকাই কিলাতে গম, যব, মসুর ও মটরের ডাল পাওয়া গেছে। এতে চাষবাসের প্রকৃতি বোঝা যায়। গবাদি পশু তো ছিলই। বান্নুতেই এর আগের পর্যায়ের বসতি নিদর্শন পাওয়া গেছে শেরি খান তারাকাই কেন্দ্রে। খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দের এই বসতিটিতে এখনও ধাতুর ব্যবহারের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। গম এবং যবের নিদর্শন আছে। আর তা ছাড়া পাথরের হাতিয়ার, পোড়ামাটির ছোট ছোট মূর্তি ইত্যাদি।১১
৪ সিন্ধু সমতল
সিন্ধু উপত্যকায়—বর্তমান সিন্ধুপ্রদেশে ও পাকিস্তানি পঞ্জাবে—যে কেন্দ্রগুলির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হওয়া দরকার, সেগুলি হল কোট ডিজি, জলিলপুর, হরপ্পা ও সরাইখোলা। কোট ডিজি খয়েরপুরের ২৫ কি.মি. দক্ষিণে; আম্রির মতো এর অবস্থানও ঠিক সিন্ধু সমতলভূমিতে নয়; কেন্দ্রটির দুটি অংশ—একটি দুর্গ-সদৃশ উঁচু জায়গা, আর তার নীচে সাধারণ বসতি। ওপরের দিকে তিনটি মূল স্তর হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন বহন করছে; একটি স্তরে এই সভ্যতা এবং তার আগের স্তরের চিহ্ন একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে; এবং নীচের স্তরগুলিতে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাদের ‘কোট ডিজি সংস্কৃতি’ বলা হয়েছে। এই সংস্কৃতির তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকে তৃতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি বা প্রথমভাগের শেষ পর্যন্ত। দুর্গের নিদর্শন স্পষ্ট। দুর্গের দেওয়াল পাথরের ভিতের ওপর কাঁচা ইট গেঁথে করা এবং মাঝে মাঝে দেওয়াল সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে (bastion) সুরক্ষার জন্য আরও উপযোগী করা হয়েছে। দুর্গের ভেতরের বাড়িগুলি দুর্গের দেওয়ালের ভেতরের দিকটি নিয়ে গড়া হয়েছিল। এর কিছু উদাহরণ পাওয়া গেছে। এই ভেতরের বাড়িগুলিও পাথরের টুকরো দিয়ে করা ভিতের ওপর কাঁচা ইটের দেওয়াল গেঁথে করা। কাঁচা ইটের দেওয়াল দিয়ে ভেতরের দিকটা গাঁথা এরকম বড় উনুন পাওয়া গেছে আর অন্তত একটি বড় ভাঁটা। এই সংস্কৃতির মৃৎপাত্রগুলি সাধারণত একটি গোল হাঁড়ির মতো। আর একটি ধরন হচ্ছে পা-ওয়ালা ডিশ বা কানাওয়ালা রেকাবি (‘ডিশ-অন-স্ট্যান্ড’ বলা হয় ইংরেজিতে)। মোটামুটি লাল রঙের ওপর কালো রঙে চিত্রণ জ্যামিতিক ঢঙে। একটি বিশিষ্ট নকশা হচ্ছে—মোষের শিং-এর মতো একটি নকশার নীচে, ঠিক মাঝখানে একটি ছোট মানুষের মুখ। কোনও ক্ষেত্রে আমরা পিপুল গাছের পাতা চিত্রিত দেখি বা মাছের আঁশের মতো দেখতে কোনও চিত্রকরণ। এই মৃৎপাত্রের বাইরে যা পাওয়া গেছে তা পাতার মতো দেখতে পাথরের তীর, সাধারণ মাইক্রোলিথ, পোড়ামাটির গোলা, ষাঁড়, চ্যাপটা ছোট ঢেলা (যাকে ইংরেজিতে ‘টেরাকোটা কেক’ বলা হয়) ইত্যাদি। ঝিনুক, ঝিনুকের বালা, পুঁতি এদেরও চিহ্ন আছে। এখানে আমার কিছু সামগ্রী খননে পাওয়া যায়নি, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তামার প্রচলন ছিল না। কোট ডিজি সংস্কৃতির বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে যে, এর পরই সিন্ধু সভ্যতা আসে। কোনও কোনও পণ্ডিত এটাকে প্রাক্ সিন্ধু সভ্যতা সংস্কৃতি বলেন, আবার কেউ কেউ বলেন যে এটিকে সিন্ধু সভ্যতারই প্রথম রূপ বলা সমীচীন হবে। যে সিন্ধু সভ্যতার পরিচয় আমরা এর পরবর্তী অধ্যায়ে পাব সেটা এই সভ্যতার ‘পরিপক্ক’ বা পরিণত রূপ বলা যেতে পারে। এই কোট ডিজি পর্যায়ে বা তৎসম্পর্কিত সাংস্কৃতিক ধারাটিকে সিন্ধু সভ্যতার প্রথম রূপ বললে ভুল করা হবে না। এর ভিত্তিতেই সিন্ধু সভ্যতার পরিণত রূপে গড়ে উঠেছিল।১২
জলিলপুর পঞ্জাবে মুলতানের কাছে রাভি নদীর উপত্যকায়। এখানে খনন করে দুটি পর্যায় পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পর্যায়টি কোট ডিজি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু প্রথম পর্যায়টি তার আগে। মৃৎপাত্র মূলত হাতে গড়া, সাধারণত লাল রঙের। একটি সোনার পুঁতি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া পোড়ামাটির পুঁতি, মাছ ধরার জালে লাগানোর জন্য ফুটো করা চাকতি, চার্ট পাথরের ‘ব্লেড’, হাড়ের ছুঁচলো জিনিস, গরু, ভেড়া-ছাগল ও হরিণের অজস্র হাড়। কোট ডিজি সংস্কৃতি যদি কোট ডিজিতে খ্রি. পৃ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি শুরু হয়ে থাকে, তবে জলিলপুরের এই প্রথম পর্যায় নিঃসন্দেহে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের প্রথম অর্ধে।১৩
পাকিস্তানি পঞ্জাবে, প্রাক্তন মন্টগোমারি এবং বর্তমান সাহিওয়াল জেলায়, রাভি নদীর একটি শুকনো খাতের ওপর হরপ্পা নামক প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রটি সিন্ধু সভ্যতার একটি বৃহৎ কেন্দ্র বলেই বেশি বিখ্যাত। তবে খননকার্যে এখানে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত রূপের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ব্যাপক সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। এই সাক্ষ্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম যখন লোক এখানে বসতি স্থাপন করে তখন চারপাশে মজা দহ এবং নদীর পুরনো খাতের চিহ্ন নিয়ে একটি নদী উপত্যকা কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। কোট ডিজি সংস্কৃতির ছাপ প্রথম থেকেই স্পষ্ট—ওই ধরনের মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির বালা, চার্ট ‘ব্লেড’, একটি পাথরের মসৃণ করা কুড়াল, লাপিস লাজুলি, স্টিয়েটাইট ও কার্নেলিয়ান নামক লাল রঙের পাথরের পুঁতি, পোড়ামাটির ছোট ছোট স্ত্রীমূর্তি বা সাধারণ মানব মূর্তি। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘর বা বসতির পরিধি ঘেরা বড় বড় কাঁচা ইটের দেওয়াল পাওয়া যাচ্ছে, সেই সঙ্গে পাঁচ-ছটি স্তর-পরম্পরায় বাড়িঘরের চিহ্ন। বসতির পেছনে পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া গেছে—উত্তর-দক্ষিণে একটা বড় রাস্তার চিহ্নও বেরিয়েছে, এতে গরুর গাড়ির চাকার চিহ্ন আছে। বেশি করে মৃৎপাত্র তৈরি হচ্ছে; বেশি করে পোড়ামাটির বালা, খেলনা, মূর্তি, চ্যাপটা ঢেলা (‘কেক’) চার্ট ব্লেড, সামুদ্রিক ঝিনুকের বালা—সব পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম পর্যায়টি বোধ হয় খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি শুরু; দ্বিতীয় পর্যায়টি বোধ হয় খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে।১৪
সরাইখোলা কেন্দ্রটি পঞ্জাবে রাওয়ালপিণ্ডির কাছে; প্রাচীন তক্ষশিলার ধ্বংসাবশেষের অদূরে। এখানে পাওয়া পর্যায়গুলির ভেতর নীচ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়টি কোট ডিজি সংস্কৃতির পর্যায়ভুক্ত। নীচ থেকে প্রথম পর্যায়টিতে তামার কোনও ব্যবহার পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার বা মাইক্রোলিথের সঙ্গে মসৃণ বা পালিশ করা পাথরের কুড়াল পাওয়া যাচ্ছে, এবং পোড়ামাটির মূর্তি এবং হাতে বানানো ধূসর রঙের কিছুটা বার্নিশ করা মৃৎপাত্র। এই পর্যায়ের তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি; কোট ডিজি পর্যায় বা দ্বিতীয় পর্যায়টি বোধহয় খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ পর্যায়ে এখানে শুরু হয়েছিল।১৫
৫ প্রাচীন সরস্বতীর বৃত্ত
সিন্ধুপ্রদেশে সিন্ধু নদীর বৃত্ত ছাড়িয়ে আমরা যদি পুব দিকে যাই তবে রাজস্থান সীমান্ত ঘেঁষে চোলিস্তানের মরুভূমি আসবে। এই চোলিস্তানের মরুভূমি বর্তমান ভারতের থর মরুভূমির অংশ। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে এই অঞ্চলটি সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আমাদের থরের উত্তর-পূর্ব দিকে আর পাকিস্তানে বাহাওয়ালপুর নামক করদ (ব্রিটিশ ভারতের) রাজ্যের সীমানার ভেতর চোলিস্তান মরুভূমি দিয়ে একটি প্রাচীন নদীর প্রবাহ ছিল। প্রবাহটি সাদা চোখেই এখনও স্পষ্ট বোঝা যায়—দুটি পাড় কয়েক কিলোমিটার তফাতে। যদি আমরা নদীর প্রবাহ ধরে ওপর দিকে উঠি তবে হরিয়ানার ভেতর দিয়ে আমরা সিমলার নীচের পাহাড় পর্যন্ত যাব। এই অঞ্চলেই নদীটির উৎপত্তি হয়েছিল। এখনও সরসুতি বা সরস্বতী নামে হরিয়ানার কিছু পর্যন্ত নদীর ধারাটি আছে। রাজস্থানে প্রবাহটি ঢোকার আগে এতে একটি বড় উপনদী মিশেছে; এটিও হরিয়ানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। এর নাম দৃষদ্বতী। তা ছাড়া, হরিয়ানাতে মূল সরস্বতীর কিছু ছোট ছোট শাখা নদী আছে। বর্তমান রাজস্থানে হনুমানগড়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অনুপগড়ের কাছাকাছি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে—চোলিস্তান মরুভূমির ভেতর দিয়ে নীচের দিকে যাচ্ছে। বর্ষায় হনুমানগড় পর্যন্ত জল নামে। তারপর থেকে এই প্রবাহের বৃত্তের বাইরে শুধু মরুভূমির বালিয়াড়ি। নদী কেন শুকিয়েছে এবং কবে শুকিয়েছে এখনও পরিষ্কার নয়। শুকিয়ে যাওয়া, আমরা পরে দেখব, সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই শুরু হয়েছিল, কিংবা আরও আগে। শুকিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে যা বলা হচ্ছে তা হল সাটলেজ বা শতদ্রু নদীর একটি পূর্ব রূপের সিন্ধু অববাহিকার অংশ হয়ে যাওয়া, আর যমুনা নদীর একটি পূর্ব রূপের গঙ্গা অববাহিকার অংশ হয়ে যাওয়া। এদের জলটা এক সময় সরস্বতী দিয়ে বইত। বলা বাহুল্য, শুকিয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। তবু, বহুদিন ধরে যে খাত দিয়ে নদী পলি টেনে নিয়ে গেছে, যে খাত ধরে নদী পলি জমা করেছে তার উর্বরতা এখনও নষ্ট হয়নি। বৃষ্টিপাত খুব কম মরুভূমি অঞ্চলে। এই শতাব্দীর প্রথমের এই অঞ্চলের বিশদ ম্যাপগুলি দেখলে বোঝা যায় চারপাশে বালিয়াড়ি ছাওয়া। আবার গত ৩০ বছর ধরে রাজস্থান খাল প্রকল্পে ওই অঞ্চলে জল নিয়ে যাওয়ার ফলে আবার বিপুলভাবে চাষবাস হচ্ছে। এই অঞ্চলটির অনেকটা রাজস্থানের গঙ্গানগর জেলা—উপমহাদেশের সমৃদ্ধতম জেলাগুলির অন্যতম। রাজস্থানে নদীর খাতটিকে বলা হয় ‘ঘগ্গর’, আর পাকিস্তানের চোলিস্তানে এর নাম ‘হাক্রা’। প্রত্নতাত্ত্বিক সাহিত্যে একে ঘগ্গর-হাক্রা প্রবাহ বলে উল্লেখ করা হয়। আবার মনে করানো দরকার যে এর প্রাচীন নাম সরস্বতী। দৃষদ্বতী নামে এর একটি বড় উপনদী ছিল।
নীচের দিকে, অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে এর কী অবস্থা ছিল? সম্প্রতি কালের যা ধারণা তা হচ্ছে এইনদী একসময় সিন্ধুর সঙ্গে মিলিত হত। তখন, সিন্ধুর প্রবাহ, এখন যেখান দিয়ে বইছে তার কিছু পূর্ব দিকে ছিল। দুটি নদীর মিলিত প্রবাহ এখন যেখানে কচ্ছের রান্ সেখানে এসে সমুদ্রে যেত। কচ্ছ, স্পষ্টতই, তখন দ্বীপসদৃশ ছিল। কাজেই, আমাদের এমন একটি ভৌগোলিক চিত্র ভেবে নিতে হবে যে এখন যেখানে সিন্ধু নদীর বদ্বীপ সেখানে তা নেই; তার আগেই সিন্ধু নদী সরস্বতী নদীতে মিশছে, এবং গুজরাটের কাছাকাছি সমুদ্রে যাচ্ছে। মরুসদৃশ অঞ্চলের ভেতর দিয়ে সরস্বতী প্রবাহিত; এই প্রবাহ ধরে হরিয়ানা পেরিয়ে সিমলা পাহাড়ে পৌঁছনো যেত। আবার, এই প্রবাহ ধরেই গুজরাটে পৌঁছনো অসুবিধে ছিল না। এর পশ্চিমে বিস্তৃত ভূভাগে সিন্ধু নদী প্রবাহিত। ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্বে সরস্বতী-দৃষদ্বতী অববাহিকার গুরুত্ব অপরিসীম। গত ৩০ বছর ধরে এটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
পাকিস্তানে বাহাওয়ালপুর অঞ্চলে এই সরস্বতী বা ঘগ্গর-হাক্রা প্রবাহ ধরে অনুসন্ধানের ফলে কয়েকটি পর্যায়ের ঘন বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রথম পর্যায় নিশ্চিতভাবে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের; হয়তো তার একটু আগেরও। এই পর্যায়কে বলা হয়েছে ‘হাক্রা মৃৎপাত্রের পর্যায়’। এই ‘হাকরা মৃৎপাত্র পর্যায়’ চোলিস্তান মরুভূমিতে হাক্রা প্রবাহ ধরে ৯৯টি জায়গায় লক্ষ করা গেছে। দেখেই চিনতে পারা যায় এ ধরনের মৃৎপাত্র দুটি—একটির গায়ে মাটিকাদা মাখানো; তৈরির পর ইচ্ছে করেই মাখানো হয়েছিল; আর দ্বিতীয়টিতে লাল রঙের ওপর কালো প্রলেপ দেওয়া। সীমান্ত পেরিয়ে রাজস্থানে এই পর্যায়ে মাত্র একটি কেন্দ্র পাওয়া গেছে। এই প্রায় ১০০ কেন্দ্রের ভেতর যেগুলির আয়তন মাপা গেছে, তাদের ভেতর ৪টির আয়তন ২৬ থেকে ৩০ হেক্টর (১ হেক্টর = ২.৪৭১ একর), ৭টি ১০ থেকে ২০ হেক্টর, ৫টি ৫ থেকে ১০ হেক্টর, ২১টি ১ থেকে ৫ হেক্টর। অবশ্যই তখনকার বসতিতে ছোট বড় তফাত ছিল। কোনও কেন্দ্রই খোঁড়া হয়নি, তবে জলিলপুরের প্রথম পর্যায়ে হাক্রা মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর অর্থ হচ্ছে এই হাক্রা মৃৎপাত্র পর্যায় নিঃসন্দেহে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের প্রথম অর্ধে। ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার, কিছু তামা, শিলনোড়ার পাথর পোড়ামাটির বালা, পা জোড়া অবস্থায় দেখানো পোড়ামাটির গবাদিপশুর ছোট ছোট মূর্তি ইত্যাদি কেন্দ্রগুলির ওপর থেকেই পাওয়া গেছে। নদীর সমতলভূমিতে হাতিয়ারের পাথর, বা তামা কিছুই পাওয়া যায় না; অথচ হাক্রা মৃৎপাত্র পর্যায়ে এগুলি আছে। বাণিজ্যিক আদানপ্রদানের মাধ্যমেই এগুলি আসতে পারত। তা ছাড়া এই পর্যায়ের শ’খানেক কেন্দ্রের উপস্থিতি এবং এদের আয়তনের ব্যাপক তারতম্য নিশ্চিতভাবে সূচনা করে যে, এই অঞ্চলে এই সংস্কৃতির মূল গভীর এবং সুসংবদ্ধ বাণিজ্যিক এবং সামাজিক জীবন (কোনও রাজনৈতিক কাঠামো থাকাও স্বাভাবিক) ছিল। এর উৎস হয়তো এই অঞ্চলেই ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানে পাওয়া যাবে। আরও মনে রাখা প্রয়োজন যে এই পর্যায়ে অন্তত ২টি কেন্দ্রে কুমোরের ভাটা ইত্যাদির চিহ্ন, অন্তত ৫২টি কেন্দ্রে স্থায়ী বসতির চিহ্ন সন্দেহজনক ও ৪৫টি কেন্দ্রে স্থায়ী বসতির চিহ্ন নিঃসন্দেহ।
এই অঞ্চলে বসতির দ্বিতীয় পর্যায় সাধারণভাবে যাকে কোট ডিজি সংস্কৃতি বা হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার প্রথম রূপ বলা হয়। এই পর্যায়ের ৪০টি কেন্দ্র লক্ষ করা গেছে; একটু আলাদা হলেও, এদের বিস্তৃতির অঞ্চল ‘হাক্রা মৃৎপাত্রের’ বিস্তৃতির অঞ্চলেই। যে ৩৭টি কেন্দ্রের আয়তন বিচার সম্ভব হয়েছে তাদের পরিমাপ ৫ হেক্টর পর্যন্ত ১৯টি; ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত ৮টি; ১০ থেকে ২০ হেক্টর পর্যন্ত ৩টি; ২০ থেকে ৩০ হেক্টর পর্যন্ত ২টি। মাত্র ৩টি কেন্দ্রে অস্থায়ী বসতি অনুমান করা হয়েছে আর কুমোরের ভাটা পাওয়া গেছে ১৪টি কেন্দ্রে।
এর পরের পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত রূপ। যদিও সিন্ধু সভ্যতার পরিণত রূপের কথা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব, তবু হাক্রা উপত্যকায় তার বিস্তৃতির সাক্ষ্য এখানে বোঝা দরকার। ১৭৪টি কেন্দ্র। প্রথম দুটি পর্যায়ে যে অঞ্চলে বিস্তৃতি, এই পর্যায়ে, হাক্রার প্রবাহ ধরেই, কিছুটা নীচের দিকে। এই প্রবাহ ধরে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়েরও যথেষ্ট চিহ্ন আছে, তবে তা পরের কোনও অধ্যায়ে আলোচনা করব।
রাজস্থান, হরিয়ানা, পঞ্জাবে আমাদের হাক্রা বা প্রাচীন সরস্বতী ধরেই উজিয়ে যেতে হবে। সিন্ধু সভ্যতার প্রথম, পরিণত আর শেষ রূপ তিনেরই সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। এই অধ্যায়ে আমাদের বিবেচ্য প্রথম রূপটি। যে কেন্দ্রটি খনন করে এর বিশদ পরিচয় পাওয়া গেছে তার নাম কালিবাঙ্গান—উচ্চারণের জন্য স্থানীয় লোকেদের কাছে ‘কালিবঙ্গা’। সরস্বতীর দক্ষিণ পাড়ে, একটা বাঁক ধরে একটি প্রাকারবদ্ধ জায়গা; দুটি স্তর প্রাকারে নির্মাণকার্যের পরিচয় পাওয়া গেছে। মোটামুটি ২৪০/২৫০ মি. × ১০ মি. জায়গা, প্রথম পর্যায়ে ১.৯ মি. চওড়া এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩-৪ মি. চওড়া কাঁচা ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। মূল ঢোকার পথ উত্তর-পশ্চিম খণ্ডে। ভেতরে তুষ-মেশানো মাটির প্রলেপ দেওয়া মাটির বাড়িঘর ছিল—একটা বাড়ি এক একটা খোলা আঙিনা নিয়ে। দেড় মিটার চওড়া একটি গলির সন্ধানও পাওয়া গেছে। আজকালকার ‘তন্দুরের’ মতো উনুন পাওয়া গেছে; তা ছাড়া সাধারণ চুলা তো আছেই। শিলনোড়া জাতীয় পাথর এবং শস্য রাখার জন্য চুনের প্রলেপ লাগানো মাটির গর্ত পাওয়া গেছে। মাইক্রোলিথ জাতীয় হাতিয়ার। তামার কুড়াল, ‘পরশু’ জাতীয় একটি তামার হাতিয়ার (যা কাঠের লাঠির ডগায় বেঁধে এখনও রাজস্থানে ঝোপঝাড় কাটা হয়), তামার বালা ও পুঁতি, ঝিনুক ও পোড়ামাটির বালা, ঝিনুক ও বিভিন্ন পাথরের পুঁতি ইত্যাদি এই পর্যায়ে পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্র সাধারণত ‘কোট ডিজি’ শ্রেণীভুক্ত এবং এই ধরনের মৃৎপাত্র দেখে অন্যান্য জায়গায় এই পর্যায় নির্ণয় করা যায়।
কালিবাঙ্গানে এই পর্যায়ের একটি বিশেষ আবিষ্কার একটি চষা ক্ষেতের অস্তিত্ব। উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম, দুইভাবেই লাঙল চালানো হয়েছিল। পুব-পশ্চিমের লাঙলের দাগ ৩০ সেন্টিমিটার করে তফাতে ছিল, আর উত্তর-দক্ষিণের দাগগুলি ১.৯ মি. করে তফাতে। স্থানীয় গ্রামের লোকদের কাছে অনুসন্ধান করে বোঝা গেছে পুব-পশ্চিমে ছোলা লাগানো হত, আর উত্তর-দক্ষিণে সরষে। ছোলা বা সরষে কোনও কিছুরই প্রত্যক্ষ অস্তিত্ব খননের ফলে না পাওয়া গেলেও, এদের এই অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ এবং আরও প্রমাণ করে যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সবরকম কিছুরই প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া যায় না।১৬
নদী ধরে আরও ওপরে হরিয়ানায় হিসার জেলায় বনোয়ালী নামক কেন্দ্র। কালিবাঙ্গানে যেরকম সিন্ধু সভ্যতার প্রাক্-পরিণতরূপের অর্থাৎ আদি বা প্রথম রূপের পরিচয় পাওয়া গেছে, বনোয়ালীতেও প্রায় ৩ মিটার গভীরতা জুড়ে সেই রূপের পরিচয় পাওয়া গেছে, এবং এখানেও এই রূপের সাক্ষ্য ব্যাপক। কালিবাঙ্গানের মতো এখানেও এই যুগের বসতি প্রকার ঘেরা। প্রাকারটি পরবর্তী যুগের পরিণত সিন্ধু সভ্যতার কালের প্রাকারের সোজা নীচে পড়ে গেছে। কিন্তু প্রাকারের নীচে, ভেতর দিকে, ২ মি. চওড়া একটি রাস্তা পাওয়া গেছে। বাড়িঘরে কাঁচা এবং পাকা দুরকম ইটই ব্যবহার হয়েছে। বেশির ভাগ বাড়ি এক ইটের দেওয়ালের (অর্থাৎ নিচু, একতলা এবং হালকা, খড় ইত্যাদি দিয়ে বানানো ছাদ), আবার একটির বেশি ইটেরও দেওয়াল আছে। একটি বাড়িতে পোড়ামাটির মেঝে এবং কয়েকটি উনুনের চিহ্ন পাওয়া গেছে—এটা কোনও তামার কারিগরের কাজ করার জায়গা হতে পারে। বাড়িগুলির উঠোনে বড় ছোট দু’রকমই পুরু করে লেপা মাটির গর্ত আছে (শস্য রাখার জন্য)। মৃৎপাত্র কালিবাঙ্গানের মতো। তামা বেশি পাওয়া যায়নি, তবে হাড়ের ছুঁচলো জিনিস অনেক পাওয়া গেছে। মাইক্রোলিথ জাতীয় হাতিয়ারও এখানে কম। সোনা, বিভিন্ন ধরনের পাথর, স্টিয়েটাইট ইত্যাদির পুঁতি এবং পোড়ামাটি, ঝিনুক, তামা ইত্যাদির বালা পাওয়া গেছে। পোড়ামাটির গবাদিপশুর ছোট মূর্তি, পাথরের নুড়ি, গুলতির জন্য মাটির গুলি ইত্যাদিও আছে। একটি মৃৎপাত্রের ওপর সাইকেলের চাকার মতো চাকা নিয়ে একটি ঢাকা এক্কার মতো গাড়ির ছবি আঁকা আছে। মৃৎপাত্রের ওপর কুমোরের নিশানা বোঝানো দাগ আছে এবং হয়তো একটি পাথরের বাটখারা জাতীয় জিনিসও আছে। অনুমিত বাটখারাটির ওজন ৮৭.৮৫৫ গ্রাম।১৭
হরিয়ানা ও ভারতের পঞ্জাবে বেশ কিছু আদি/প্রথম সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়ের কেন্দ্র আছে এবং তাদের কয়েকটি সীমিতভাবে খননও করা হয়েছে। কিন্তু এই অঞ্চলের যে কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য এসেছে তা কুনাল। স্থানটি হিসার জেলার রতিয়া তহসিলে, ভুনা বলে একটি ছোট শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে, সরস্বতীর পুরনো খাতের পাড়ে। পুরো বসতিটির আয়তন ৩ একরের বেশি নয়। যখন বসতি শুরু হয় তখন জমিটি কিছু নিচু ছিল। কাছাকাছি কোথাও থেকে লাল কাঁকুরে মাটি ফেলে প্রথমে জায়গাটি .৭১ মিটার উঁচু করে নেওয়া হয়। বাড়ির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— একটি গোল কুঁড়েঘর আর তার পাশে আবর্জনা ফেলার গর্ত। কুঁড়েঘরগুলির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে—২মি. ব্যাস আর ১.১০ মি. গভীর একটি গর্ত করে নিয়ে তার মেঝে পিটে পিটে পোক্ত করা হত এবং গর্তের দেওয়াল লেপে নেওয়া হত। ওপরে গর্তের মুখের চারদিকে খুঁটির দাগ দেখে বোঝা যায় যে লতাপাতা এবং তার ওপর কাঠি দিয়ে লেপে উঁচু দেওয়াল করে ঘর ছিল। মৃৎপাত্রেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। হাক্রা মৃৎপাত্রের সঙ্গে এর কিছু মৃৎপাত্রের সাদৃশ্য আছে। অন্য দিকে সবচাইতে বেশি পাওয়া গেছে এমন মৃৎপাত্র হচ্ছে ম্যাটম্যাটে লাল বা লাল রঙের হালকা প্রলেপ দেওয়া পাত্রের ওপর কালো রং দিয়ে নকশা এঁকে নকশার ভেতরটা সাদা রঙে ভরিয়ে দেওয়া। কিছু জ্যামিতিক কালো নকশা আছে, কিছু পিপুল পাতাও আঁকা আছে কোথাও, আর যাঁড়ের লম্বা, ছড়ানো শিং। হাড়ের হাতিয়ার আছে প্রচুর, চ্যালসিডোনি নামক পাথরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁতি, তামার তীর এবং মাছ ধরার বঁড়শি প্রথম পর্যায়েই পাওয়া গেছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বাড়িগুলির আয়তন বাড়ছে। গর্তগুলির ব্যাস এখন বেড়ে ২.৯২ মি. পর্যন্ত, তা ছাড়া গর্তের দেওয়াল এখন কাঁচা ইটের; কোথাও কাঁচা ইটের তৈরি চুলা। আগের মৃৎপাত্র আছে; নতুন করে পাওয়া কালিবাঙ্গানের প্রাক্-পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রাবলীর মতো মৃৎপাত্র। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রেরও সূচনা দেখা যাচ্ছে। মাটির চ্যাপটা ঢেলাও পাওয়া যাচ্ছে। তার পরের পর্যায়ে বাড়ি আর গর্ত-ভিত্তিক নয়; সোজা মাটির ওপর কাঁচা ইটের বাড়ি। কাঁচা ইটগুলি দুটি অনুপাতে বানানো—১:২:৩:, আর ১:২:৪:। দ্বিতীয় অনুপাতটি পরিণত-সিন্ধু সভ্যতায় ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। রাস্তায় গর্ত করে বড় হাঁড়িতে তলায় ফুটো করে বসিয়ে আবর্জনা ফেলা হত। চুন মেশানো কাদার প্রলেপ দেওয়া গর্ত শস্য রাখার কাজে লাগত। এই পর্যায়টিকে পরিণত-সিন্ধু সভ্যতার একেবারে দোরগোড়ায় অবস্থিত বলা যায়: তামার জিনিসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, তামা গলনের প্রত্যক্ষ চিহ্ন; কুমোরের ভাটা; ৬টা স্টিয়েটাইট পাথর এবং ১টি ঝিনুক দিয়ে তৈরি জ্যামিতিক নকশা-বিশিষ্ট সিলমোহর; তা ছাড়া বহু লাপিস লাজুলি পাথরের ছোট ছোট পুঁতি, ভাল অ্যাগেট (agate) পাথরের ৯২টি পুঁতি। স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ অর্থনীতির এবং রাজনৈতিক চিত্রেরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য এই পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে। একটি লাল হাঁড়িতে রূপার পাতের ওপর রাখা কিছু রূপা (ও সোনার?) গয়না একটি বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে। রূপার গয়নাগুলির ভেতর ২টি ‘টায়রা’, একটি বড়, একটি ছোট, তবে দুটোই খোলা ফুলের আকারে —পাপড়িগুলি ছড়িয়ে আছে আর প্রত্যেকটি পাপড়ির ডগার ওপর পিপুল পাতার মতো একটি নকশা। এই দুটি ‘টায়রা’ ছাড়া রূপারই একটি বড় ‘আর্মলেট’/বাজুবন্ধ পাওয়া গেছে। এরকম জিনিস দেখে মনে হয় যে কোনও রাজার মুকুট ও হাতের গয়না। আরেকটা বাড়ি থেকে বিভিন্ন আকৃতির সোনা দিয়ে বানানো পুঁতি পাওয়া গেছে।
খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের একেবারে শেষদিকে কুনালে বসতি শুরু হয় বলে মনে করা হয়েছে। কালিবাঙ্গানের প্রথম পর্যায় কুনালের দ্বিতীয় পর্যায়ের সমসাময়িক। খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে নিশ্চয়ই।১৮
৬ আরাবল্লী
খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষপাদের এই অঞ্চলেরই আর একটি কেন্দ্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। কেন্দ্রটির নাম গণেশ্বর, রাজস্থানে জয়পুরের কাছে নিমকাথানা থেকে কয়েক কিলোমিটার। গণেশ্বর পাহাড়ি জায়গায়; আরাবল্লীর এই অঞ্চলে যথেষ্ট প্রাচীন তামার খনি আছে এবং যা বোঝা গেছে তাতে বলা যায় এই তাম্রখনির সূত্রপাত খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ পাদে। এই অঞ্চলে আমরা পরের অধ্যায়গুলিতেও ঘুরে ফিরে আসব, কিন্তু এই অধ্যায়েও, প্রাক্-পরিণত সিন্ধু সভ্যতা যুগের সংস্কৃতির ধারাগুলি বুঝতে গেলে এর অবতারণা করতে হবে। গণেশ্বরে সাংস্কৃতিক পর্যায়ক্রম নিম্নরূপ। প্রথম পর্যায়ে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার এবং পোড়ানো অবস্থায় জন্তু জানোয়ারের হাড়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার এবং পশুর হাড় থাকছে, কিন্তু সঙ্গে যোগ হচ্ছে নুড়িপাথর এবং পাথরের টুকরো ছড়িয়ে মেজে নিয়ে গোল ঘরের চিহ্ন, হাতে গড়া আর কুমোরের চাকে গড়া দু ধরনেরই মৃৎপাত্র, আর তামা (৫টি তীর, ৩টি বড়শি, ১টি বল্লম, ১টি মোটা ছুঁচলো সূচ জাতীয় জিনিস; যদিও এতে ছিদ্র নেই)। তৃতীয় পর্যায়ে কয়েক শত তামার জিনিস (তীর, আংটি বা আংটিজাতীয় জিনিস, বালা, বল্লম, ছেনি, কুড়াল, গোলা ইত্যাদি), এবং প্রাক্-পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র গোত্রের গোত্রীয় অনেক ধরনের মৃৎপাত্র। এই পর্যায়ে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ার এবং জন্তুর হাড় সংখ্যায় কমে এসেছে। গণেশ্বর আয়তনে ৩/৪ একর এর বেশি বড় নয়; এখানে তামা গলিয়ে তামার জিনিস বানাবার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাওয়া যায়নি। অথচ, এখানে বিভিন্ন দফায় খননের ফলে বোধহয় ৫০০০ তামার জিনিস বেরিয়েছে (প্রকাশিত হিসেব মতে ২০০০ হবে, কিন্তু শুনেছি অপ্রকাশিত হিসেবও আছে)। আর, গণেশ্বরের মতো কেন্দ্র রাজস্থানের এই অঞ্চল জুড়ে ৮০টির বেশি পাওয়া গেছে, যেগুলি এখনও খোঁড়া হয়নি। এর তারিখ দুভাবে ঠিক করা যায়। গণেশ্বরে তৃতীয় পর্যায়ে পাওয়া মৃৎপাত্র দিল্লি-জয়পুর রাস্তার কাছে সাহিবী নদীর পাড়ে যোধপুর (স্থানীয় উচ্চারণে ‘যোধপুরা’) নামক কেন্দ্রে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। এখানে এই মৃৎপাত্রবিশিষ্ট স্তরের তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষ এবং খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমে। গণেশ্বরের দ্বিতীয় পর্যায়ের তারিখ অবশ্যই খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের দ্বিতীয় অর্ধেকে। দ্বিতীয় যে জিনিসটি এখানে ভাবার আছে তা হচ্ছে আমাদের পূর্বে আলোচিত ভিলওয়াড়া জেলায় (ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় কেন্দ্র) বাগোর-এ দ্বিতীয় পর্যায়। যেখানে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় হাতিয়ারের সঙ্গে তামার জিনিসও পাওয়া গেছে। আপাতদৃষ্টিতে বাগোরের দ্বিতীয় পর্যায়ের সঙ্গে গণেশ্বরের দ্বিতীয় পর্যায় মেলে, আর তা যদি হয়, তবে বাগোরের এই পর্যায়ের তারিখ (খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগ) গণেশ্বরের এই পর্যায় সম্পর্কে প্রয়োগ করা যায়। বর্তমান অধ্যায়ের দৃষ্টিতে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উত্তর-পূর্ব রাজস্থানে আরাবল্লী জুড়ে ব্যাপক তামার জিনিস তৈরি শুরু হয়েছিল এবং বাগোরের সাক্ষ্য অনুযায়ী, এটি শুধু উত্তর-পূর্ব রাজস্থানেই সীমাবদ্ধ ছিল না; পুরো আরাবল্লী জুড়েই ছড়িয়ে গিয়েছিল। মনে রাখা দরকার, আরাবল্লী পর্বত জুড়েই বহু ধাতুর খনি, বিশেষ করে তামা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, বিখ্যাত খেত্রি খনি রাজস্থানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেই।১৯
৭ গুজরাট
রাজস্থানের এই অঞ্চল থেকে আমাদের এবার দৃষ্টি সরাতে হবে গুজরাটে। প্রথম বিশদ সাক্ষ্য এসেছে কচ্ছে অবস্থিত ধোলাবি কেন্দ্র থেকে। এখানে ১২ মি. ৩০ সে.মি. গভীর বসতিচিহ্ন ৭টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে, যার ৪ নং পর্যায় থেকে পরিণত সিন্ধু সভ্যতা শুরু হয়েছে। আগের ৩টি পর্যায়ের সাক্ষ্য বর্তমান অধ্যায়ের প্রাসঙ্গিকতায় পড়ে। ৩ নং পর্যায়টিকে আবার ‘এ’ এবং ‘বি’ দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়েই ধোলাবিরার বসতি প্রাকারবদ্ধ ছিল—১১ মি. চওড়া পাথরখণ্ডের দেওয়াল—ভেতর এবং বাইরে দুদিক থেকেই নিচু থেকে ওপর পর্যন্ত ঢাল। সাধারণত পাথরের ভিতের ওপর কাঁচা ইট (অনুপাত ১:২:৪) দিয়ে বানানো ঘরবাড়ি। তামা গলানোর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। তা ছাড়া পাথরের ছোট ছোট হাতিয়ার, কিছুটা সিন্ধুপ্রদেশের আম্রির মৃৎপাত্র, ঝিনুক, স্টিয়েটাইট এবং অন্য পাথরের জিনিস। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রাকারের প্রস্থ ভেতরের দিকে কাঁচা ইট দিয়ে ৩ মি. বাড়ানো হয়। ভেতরের দিকে বার বার সাদা অথবা লালচে-সাদা চুনের প্রলেপ দেওয়া হয়, এরকম ১৩ বার প্রলেপ দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখনও এরকম কাঁচা ইটের ওপর চুনের প্রলেপ দেওয়ার প্রথা এই অঞ্চলে আছে। গ্রামের বাড়ি ভাল দেখায়, কাঁচা ইটকে রক্ষা করে, আর গরমের সময় ঘরের ভেতর ঠাণ্ডা রাখে। তামা গলানো বাড়ে, পুঁতি তৈরিও বাড়ে, ঝিনুক কাটার পরিচয় পাওয়া যায় এবং লালচে মৃৎপাত্রের ওপর কালো এবং সাদা রং দিয়ে জ্যামিতিক নকশা দেখা যায়।
তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম অংশে প্রকারের প্রস্থ ভেতর দিকে আরও বাড়ানো হল। এখন নীচের দিকে প্রকারের প্রস্থ ১৮ মি., আর ওপরে ১২ মি.। এই পর্যায়েই পরিণত সিন্ধু সভ্যতাকালীন ধোলাবিরার রূপ আসছে। বসতিটি ৩টি ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। একেবারে ওপরের প্রাচীর ঘেরা জায়গা; তার নীচের দিকে একটি প্রাচীর ঘেরা জায়গা; আর তারও নীচে সাধারণ মানুষের বসতি, বাইরের প্রাকারের ভেতর, কিছু খোলা জায়গা নিয়ে। চারদিকের প্রাকারের বাইরে সুবিধামতো জায়গায় বাঁধ দিয়ে ভেতরে জল নিয়ে আসা হচ্ছে। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার ধরনের কিছু মৃৎপাত্র পাওয়া যাচ্ছে; এ ছাড়া একটি মৃৎপাত্রের টুকরোর ওপর সিন্ধু সভ্যতার লিপির দুটি চিহ্ন, স্টিয়েটাইট পাথরের, পেছনে ফুটো করে ধরার বা ঝোলানোর জায়গা নিয়ে, চিত্রিত কিন্তু লিপিবিহীন তিনটি সিলমোহরের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় অংশে, প্রথম অংশের চিত্রটিই আছে; যদিও সাধারণ মানুষের থাকার অংশটুকু এইসময় খুব পরিষ্কার হয়ে উঠছে। ওপরের অংশ, মাঝের অংশ, নীচের সাধারণ মানুষের জায়গা এবং এদের মাঝে কিছু খোলা জায়গা—পরিণত সিন্ধু সভ্যতার সময়ের ধোলাবিরার এই নগরপরিকল্পনা এই সময়ের ভেতরেই প্রায় পূর্ণতা লাভ করে। দুঃখের বিষয় বোলাবিরা থেকে এখনও নির্ঝঞ্ঝাট রেডিওকার্বন তারিখ আসেনি।
কচ্ছ বাদ দিয়ে সৌরাষ্ট্র অন্তরীপেও একটি জায়গার নাম করা যায়—পাদ্রি। ২০ হেক্টর আয়তনের এই কেন্দ্রটির দুটি পর্যায়—দ্বিতীয় পর্যায়ে পরিণত সিন্ধু সভ্যতার রূপ, প্রথম পর্যায়ে আদি বা প্রথম রূপ। প্রথম পর্যায় সম্পর্কে বিশেষ কোনও প্রকাশনা হয়নি; তবে যিনি খননকারী তিনি ব্যক্তিগত আলাপে জানিয়েছেন যে, প্রথম পর্যায়েই তিনি সিন্ধু সভ্যতার কিছু লিপিচিহ্ন পাচ্ছেন। যে তারিখ পাদ্রির এই পর্যায় থেকে পাওয়া গেছে তার মধ্যে দুটি পরিষ্কার খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষার্ধে পড়ে।
উত্তর গুজরাটে মেহ্শানা জেলার লোটেশ্বর নামক কেন্দ্রে তারিখ এরকম, তবে লোটেশ্বরকে ঠিক আদি/প্রথম সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়ে মেলানো যায় না। প্রথম পর্যায়ে এখানে ক্ষুদ্রপ্রস্তরযুগীয় স্তর; দ্বিতীয় পর্যায়ে, খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষার্দ্ধে, একটি তাম্রপ্রস্তরযুগীয় সংস্কৃতির চিহ্ন। এই স্তর মাত্র ১০ থেকে ২০ সে.মি. গভীর। তা হলেও এখানে .৫ মি. থেকে ২ মি. ব্যাস বিশিষ্ট এবং ৫ মি. থেকে ২ মি. গভীর কিছু গর্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সবকটাতেই গৃহস্থালির আবর্জনা প্রক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এদের ভেতর মৃৎপাত্র, হাড়, ছাই বাদ দিয়ে স্টিয়েটাইটের খুব ছোট ছোট পুঁতি পাওয়া গেছে।২০
৮ পরিশেষের মন্তব্য
এই অধ্যায়ে আমরা একটি বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চলে—বালুচিস্তান থেকে গুজরাট এবং হরিয়ানা-পঞ্জাব পর্যন্ত—গ্রাম গড়ে ওঠার মূল কাঠামোটি আলোচনা করলাম। এই অঞ্চলের সঙ্গে আমরা যদি উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল— মিরাট পর্যন্ত জুড়ে দিই, তা হলেই আমরা পরিণত সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণ ভৌগোলিক বিস্তৃতি পাই। তাই, এই অধ্যায়ে আমাদের যা উপজীব্য তার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত রূপ বিকাশের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে। এ ছাড়া, আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা একটি স্তরের সংস্কৃতিকে যথা: ‘কোট ডিজি সংস্কৃতি’-কে—সিন্ধু সভ্যতার আদি বা প্রথম রূপের পরিচায়ক বলে উল্লেখ করেছি।
যে গ্রামজীবনের ঐতিহাসিক রেখার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি তা গম-যব-চাষ এবং গবাদি পশু ও ভেড়া-ছাগল প্রতিপালনকে ভিত্তি করে। যদি খ্রি. পূ. ৭০০০ সালের একটু আগে বা ওই সময় এর সূত্রপাত ধরে নিই তবে খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের গোড়া পর্যন্ত এর প্রবাহ অব্যাহত। সব নিয়ে ৪০০০ বছর বা তার কিছু বেশি বছরের ইতিহাস। মোটেই অল্পদিনের নয়; কথাটা মনে রাখা দরকার।
মেহেরগড় খননের পর যা বোঝা গেছে তা হচ্ছে যে ভারতবর্ষ ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিমে বালুচিস্তান অঞ্চল যব-গম চাষের একটি মূল কেন্দ্রীয় অঞ্চল। প্রথমে মনে করা হত যে, এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি পশ্চিম ইরান বা পারস্য দেশ এবং তুর্কমেনিস্তান অঞ্চলেই শেষ হয়ে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে এর পরিধি বালুচিস্তানকে নিয়ে ছিল। বহুদিন পর্যন্ত এই চাষবাস বালুচিস্তানের পার্বত্য উপত্যকাতেই সীমিত হয়েছে। অন্তত ৩০০০ বছর। খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের আগে নীচে সিন্ধু উপত্যকার সমতলে চাষবাসের সূত্রপাতের চিহ্ন এখনও পাওয়া যাচ্ছে না। এর ভেতর বালুচিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক চিত্রিত মৃৎপাত্রের ধারা, তামার ব্যবহার, মাটি এবং কাঁচা ইটের ঘরবাড়ি ইত্যাদি দেখছি। পারস্য দেশ, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া—এদের সমসাময়িক গ্রাম-পর্যায়ের সংস্কৃতির সঙ্গে এই বালুচি-সংস্কৃতি ধারার নিশ্চয় যোগাযোগ ছিল। আমরা দেখেছি যে, এই যুগে অঞ্চলটির অনেকটা ভাগই একই রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের বৃত্ততে ধৃত।
সিন্ধুর সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপন এবং তার পরের ইতিহাস এখনও জটিলতা মুক্ত নয়। ‘আম্রি’, ‘কোট ডিজি’, ‘জলিলপুর’, ‘হাক্রা মৃৎপাত্র পর্যায়’—এগুলির সূত্রপাত চোখ বুজে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এবং এদের ভেতর হাক্রা মৃৎপাত্র পর্যায়টি খ্রি. পূ. ৪০০০ বছর পর্যন্ত যেতে পারে। এখানে আরও কয়েকটি কথা বোঝা দরকার। প্রথমত যাকে আমরা আম্রি সংস্কৃতি বলি তার মূল বিস্তৃতি সিন্ধুর সমতলভূমিতে নয়; তৎসংলগ্ন কোহিস্তান অঞ্চলে। আর, যাকে আমরা কোট ডিজি সংস্কৃতি বা সিন্ধু সভ্যতার আদি/ প্রথম রূপ বলছি তার মূল বিস্তৃতি সিন্ধু ধরে নয়; এই মূল বিস্তৃতি ঘগ্গর-হাক্রা প্রবাহ অর্থাৎ প্রাচীন সরস্বতী ধরে। একসঙ্গে ৪০টি কোট ডিজি কেন্দ্র এই অঞ্চলের বাইরে অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি, যদিও যেখানে প্রথম খুঁড়ে এই সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া যায় সেই কোট ডিজি সিন্ধুপ্রবাহের কাছে। ঘগ্গর-হাক্রা প্রবাহ অঞ্চলে অবশ্য এই সংস্কৃতির আগেই ‘হাক্রা মৃৎপাত্র’ পর্যায় পাওয়া যাচ্ছে। এই পর্যায়ের মূল বিস্তৃতি সরস্বতী প্রবাহের সঙ্গেই যুক্ত। এখানে একসঙ্গে পাওয়া এর ৯৯টি কেন্দ্রও আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এই প্রসঙ্গেই আরও একটি তথ্য পেশ করা যেতে পারে। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার একসঙ্গে ১৭৪টি কেন্দ্র সরস্বতী প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত অবস্থাতেই পাওয়া গেছে; এবং একসঙ্গে এত পরিণত সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র অন্যত্র পাওয়া যায়নি। তা হলে ঘগগর-হাক্রার ধারা বা প্রাচীন সরস্বতীর ধারার সঙ্গে আমরা পর পর ৩টি পর্যায়ের মূল বিস্তৃতি পাচ্ছি—হাক্রা মৃৎপাত্র পর্যায়, কোট ডিজি পর্যায় বা সিন্ধু সভ্যতার আদি/প্রথম রূপের পর্যায় এবং পরিণত সিন্ধু সভ্যতার পর্যায়। অন্য কোনও অঞ্চলে এই ব্যাপকতা নিয়ে সিন্ধু সভ্যতা-সম্পর্কিত পর্যায়গুলির বিস্তৃতি নেই এবং সিন্ধু সভ্যতা উৎপত্তির মূল কেন্দ্র যে ঘগ্গর-হাক্রা বা প্রাচীন সরস্বতী উপত্যকা এ বিষয়ে কোনও সংশয় রাখা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। সিন্ধু সভ্যতা না বলে, একে সরস্বতী সভ্যতা বলা প্রত্নতত্ত্বের বিচারে অধিকতর যুক্তিযুক্ত; তবে এতদিনের প্রচলিত নাম বর্জন দুঃসাধ্য বলে একে সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা নিশ্চয় বলা যায়।
খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দে অনেক কিছু হচ্ছে। বালুচিস্তানে যে সংস্কৃতির ধারা বইছিল তা বইছে; গোমাল উপত্যকা এবং বান্নুতে তোচি উপত্যকাতে গুমলা, রহমানধেরী, শারি খান তারাকাইতে কৃষিসংস্কৃতির বিস্তৃত রূপ দেখি। যা আমরা পঞ্জাবের পটওয়ার অধিত্যকায় সরাইখোলাতেও পাচ্ছি। রাজস্থান হরিয়ানা-পঞ্জাবেও এই সময়ের শেষ দিক নাগাদ কৃষি সংস্কৃতির প্রসার দেখছি। তবে রাজস্থান-হরিয়ানা-পঞ্জাবে এর তারিখ খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের একেবারে শেষ থেকে—এটা খেয়াল রাখা দরকার। এর ভেতর আরাবল্লীতে ব্যাপকভাবে তামার কারিগরির প্রচলন; গুজরাটের সব অঞ্চলে কৃষিকার্যের সাক্ষ্য প্রবল। সব মিলিয়ে প্রবাহটি আমরা যাকে এখনও সিন্ধু সভ্যতা বলি, যার আদি সাক্ষ্য মোহেঞ্জোদারোতে বেরিয়েছিল, তার দিকে। যে গ্রামজীবনের ইতিহাস আমরা আলোচনা করলাম তা নগরজীবনের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।
.
তৃতীয় অধ্যায়
১। মেহেরগড়ের ওপর বহু প্রবন্ধ, জে এফ জ্যারিজ ও আর মেডো, ‘দ্য অ্যানটিসিডেন্টস অভ সিভিলাইজেশন ইন দ্য ইন্ডাস ভ্যালি’, সায়েন্টিফিক আমেরিকান (২৪৩ ভল্যুম, ১৯৮০), পৃ. ১০২-১০ গোড়ার দিকের প্রবন্ধ। তারপর, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি নামক দ্বিবাৎসরিক যে গ্রন্থমালাটি আছে তাতে ১৯৭৭ এর ভলিউম (অর্থাৎ সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি ১৯৭৭) থেকে বহু প্রবন্ধ আছে।
২। রানা ঘুন্ডাই এর ওপর এখনও গুরুত্বপূর্ণ, ই জে রস, ‘এ চালকোলিথিক সাইট ইন নর্দার্ন বালুচিস্তান’, জার্নাল অভ নিয়ার ইস্টার্ন স্টাডিজ ৫, ১৯৪৬, পৃ. ২৮৪-৩১৬।
৩। কোয়েটা অঞ্চলের ওপর উপাদান গ্রন্থ, ডবলিউ এ ফেয়ারসারভিস, এক্সকাভেশনস ইন দ্য কোয়েটা ভ্যালি, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৬।
৪। বি ডি কার্ডি, ‘এক্সকাভেশনস অ্যান্ড রিকয়েসাস ইন কালাত, ওয়েস্ট পাকিস্তান’, পাকিস্তান আর্কিওলজি ২, ১৯৬৫, পৃ. ৮৬-১৮২।
৫। জি পশেল, কুল্লি, ডারহাম, ১৯৮৬।
৬। এইচ হারগ্রিভস, এক্সকাভেশনস ইন বালুচিস্তান ১৯২৫, সামপুর মাউনড, মাসতুঙ্গ অ্যান্ড সোহর দামব, নাল, কলিকাতা ১৯২৯।
৭। বালাকোটের ওপর, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি ১৯৭৭, এ জি এফ ডেলস, আর এইচ মেডো এবং এস ডুরানটের প্রবন্ধ তিনটি দ্রষ্টব্য।
৮। এর ওপর আলোচনার জন্য, দিলীপ কে চক্রবর্তী, থিওরেটিকাল ইস্যুজ ইন ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি, দিল্লি, ১৯৮৮, পৃ. ৬২-৪। বিশদ আলোচনা, দিলীপ কে চক্রবর্তী, ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড ওয়েস্ট এশিয়া—অ্যান অলটারনেটিভ অ্যাপ্রোচ’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ১, ১৯৭৭।
৯। এল ফ্লাম, ‘এক্সকাভেশনস অ্যাট গাজি শাহ, সিন্ধ, পাকিস্তান’, জি পশেল (স.), হরপ্পান সিভিলাইজেশন (দ্বিতীয় সংস্করণ), দিল্লি, ১৯৯৩, পৃ. ৪৫৭-৬৭।
১০। এ এইচ দানী, ‘এক্সকাভেশনস ইন দ্য গোমাল ভ্যালি’, এনশেন্ট পাকিস্তান, ৫, ১৯৭০-৭১। রহমান ধেরীর জন্য, এনশেন্ট পাকিস্তান, সংখ্যা ৭ (১৯৯১) এবং ১০ (১৯৯৪-৯৫)।
১১। তারাকাই কিলার জন্য, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলজি ১৯৭৯, পৃ. ২৪৫-৫০; লেওয়ানের জন্য, এফ আর অলচিন এবং অন্যরা, লেওয়ান অ্যান্ড দ্য বান্নু বেসিন, অক্সফোর্ড, ১৯৮৬। শেরি খান তারাকাই : এফ খান এবং অন্যরা, এক্সপ্লোরেশনস অ্যান্ড এক্সকাভেশনস ইন বান্নু ডিস্ট্রিক্ট, নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিনস, পাকিস্তান ১৯৮৫-৮৮, লন্ডন, ১৯৯১।
১২। এফ এ খান, ‘এক্সকাভেশনস অ্যাট কোট ডিজি’, পাকিস্তান আর্কিওলজি ২ (১৯৬৫) পৃ. ১১-৮৫।
১৩। আর মুঘল, ‘নিউ এভিডেন্স অভ দ্য আর্লি হরপ্পান কালচার ফ্রম জলিলপুর, পাকিস্তান’, আর্কিওলজি, ২৭, ১৯৭৪, পৃ. ১০৬-১৩।
১৪। ইস্টার্ন অ্যানথ্রোপলজিস্ট ৪৫। ১৯৯২-তে হরপ্পার ওপর প্রবন্ধাবলী দ্রষ্টব্য।
১৫। ওপরের সংখ্যাটিতে আর মুঘলের প্রবন্ধটি দ্রষ্টব্য।
১৬। বি বি লাল, কালিবাঙ্গান অ্যান্ড দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, ডি পি অগ্রবাল ও দিলীপ কে চক্রবর্তী (স.), এসেজ ইন ইন্ডিয়ান প্রোটেহিস্টরি, দিল্লি, ১৯৭৯, পৃ. ৬৫-৯৭।
১৭। আর এস বিশট, ‘ফারদার এক্সকাভেশন অ্যাট বনোয়ালি : ১৯৮৩-৮৪’, বি ডি চট্টোপাধ্যায় ও বি এম পান্ডে (স.), আর্কিওলজি অ্যান্ড হিস্টরি, প্রথম খণ্ড, দিল্লি, ১৯৮৭, পৃ. ১৩৫-৫৬।
১৮। জে এস খাত্রি অ্যান্ড এম আচার্য, কুনাল : ‘এ নিউ ইন্ডাস সরস্বতী সাইট’, পুরাতত্ত্ব, বুলেটিন অভ দ্য ইন্ডিয়ান আর্কিওলজিকাল সোসাইটি ২৫, ১৯৯৪-৯৫, পৃ. ৮৪-৬।
১৯। গণেশ্বর সংক্রান্ত আলোচনার জন্য, দিলীপ কে চক্রবর্তী, দ্য আর্কিওলজি অভ এনশেন্ট ইন্ডিয়ান সিটিজ, দিল্লি, ১৯৯৫, পৃ. ৫২, ১৪৩-৫।
২০। ধোলাবিরার ওপর, আর এস বিশট, ধোলাবিরা; নিউ হরাইজন্স অভ দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, পুরাতত্ত্ব, ২০, ১৯৯১, পৃ. ৭১-৮২। এস পি গুপ্ত, দ্য ইন্ডাস-সরস্বতী সিভিলাইজেশন, দিল্লি, ১৯৯৬, পৃ. ৭৮-১০০। লোটেশ্বর ইত্যাদির ওপর, ভি এইচ সোনাওয়ানে ও পি অজিতপ্রসাদ, ‘হরপ্পা কালচার অ্যান্ড গুজরাট’, ম্যান অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ১৯, ১-২, ১৯৯৪, পৃ. ১২৯-৩৯।