৩. গ্রহগুলোর মাঝে

তৃতীয় পর্ব : গ্রহগুলোর মাঝে

অধ্যায় ১৫. ডিসকভারি

শিপটা সবে পৃথিবী থেকে ত্রিশ দিনের দূরত্ব পেরিয়েছে; কিন্তু এখনি ডেভিড বোম্যানের মনে হয় যেন সে কোনোকালে এ একাকী দুনিয়া ছাড়া আর কোনো বিশ্বে ছিল না। এই একলা পৃথিবীর নাম ডিসকভারি।

তার ট্রেনিংয়ের সবগুলো বছর; চাঁদ আর মঙ্গলের বুকে করা আগের যত্তসব অভিযান, তার বাদবাকি সব স্মৃতি যেন অন্য কারো, অন্য কোনো জন্মের কথা।

ফ্র্যাক পোল একই মতবাদে বিশ্বাসী। সে মাঝেমধ্যেই আফসোস করে, এটা মনোরোগ। আর এর চিকিৎসক এখান থেকে শত মিলিয়ন মাইল দূরে বসে। কিন্তু এই একাকিত্ব একদম ন্যায্য, এখানে কোনো অসুস্থতার চিহ্ন নেই। কারণটা সোজা, মানুষের মহাকাশ বিচরণের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এমন অভিযানের একটা নমুনা খুঁজে পাওয়া যাবে না।

পাঁচ বছর আগে প্রজেক্ট জুপিটার আকারে এ মিশনের শুরু- গ্রহশ্রেষ্ঠের কাছে মানুষের প্রথম ধর্ণা দেয়ার চেষ্টা। দু-বছর ধরে শিপ প্রস্তুত হয়ে বসে থাকার পর হঠাৎ করেই মিশনের দিক বদলে গেল।

এখনো ডিসকভারি বৃহস্পতির দিকে যেতে পারে, কিন্তু থামবে না সেখানে। এমনকি বৃহস্পতি জগতের বিশাল উপগ্রহ-সাম্রাজ্যের কোথাও দৃষ্টিক্ষেপ করবে না মুহূর্তের জন্য, বরং গ্র্যাভিটিশনাল ফিল্ড কাজে লাগিয়ে নিজেকে সূর্যের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে অনেক অনেক দূরে। সে নিজেকে বানাবে একটা উল্কা, তারপর সৌর জগতের ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে এগিয়ে চলবে বাইরের এলাকায়, নিজের চরম উদ্দেশ্যে। আঙটি পরা শনিগ্রহ তার আরাধ্য। সে আসবে না আর ফিরে।

ডিসকভারির জন্য এ এক ওয়ান ওয়ে জানি। তবু, এখনো এ মহাকাশ রথের ক্রুদের আত্মহত্যা করানোর কোনো মতলব আঁটা হয়নি। সব ঠিকঠাক চললে তারা ফিরবে আরো সাত বছর পর। এর মধ্যে পাঁচটা বছর চলে যাবে এক লহমায়, স্বপ্নহীন নিদ্রায়। এর নাম হাইবারনেশন, শীতন্দ্রিা। বাড়বে না বয়স তাদের। আসবে স্বপ্নের ডিসকভারি-টু। ঘুমের মধ্যেই তুলে নেবে তাদের দেবতার কল্পরথ।

‘উদ্ধার’ শব্দটা বেশ সতর্কতার সাথে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সব অ্যাস্ট্রোনটিক্স এজেন্সির ডকুমেন্ট আর বিবৃতি থেকে। এই শব্দটা পরিকল্পনায় কিছু দুর্বলতা দুর্বলতা ভাব এনে দেয়। তাই বৈধ শব্দটা হল, ফিরিয়ে আনা। আসলেই, বিপদ হলেই না উদ্ধারের প্রশ্ন। আর বিপদ যদি হয়েই যায় তো পৃথিবী থেকে বিলিয়ন মাইল দূরে উদ্ধারের আশা তো বহুদূর, প্রশ্নই ওঠে না।

অজানার প্রতি আর সব অভিযানের মতো এটাতেও কিছু হিসেবনিকেশ করে বের করে নেয়া হয়েছে ঝুঁকির বাস্তব পরিমাণটা। অর্ধ শতাব্দীর গবেষণা আজ হাইবারনেশনকে করেছে পরিপূর্ণ, এর ফলেই মহাকাশ অভিযানের নতুনতম অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুধু এ মিশন নয়, এর ফলে আরো অনেক মিশনের স্বর্ণদ্বার খুলেছে এই কল্পলোকের সোনার কাঠি-রূপার কাঠি।

সার্ভে টিমে আছে তিন সদস্য। এরা শনির চক্ৰবাকে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো কাজেই লাগবে না। তাই তাদের পুরো পথটায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এর ফলে তাদের বয়স বেঁচে যাবে কয়েক মাস, বেঁচে যাবে টন টন খাবার আর দৈনন্দিন জিনিসপাতি। আরো বড় ব্যাপার হল, তারা দশ মাসের যাত্রা শেষে চরম বিরক্ত-অবসন্ন থাকবে না।

শনির একটা পার্কিং অর্বিটে ঢোকার তালে থাকবে ডিসকভারি। সে হবে দৈত্য গ্রহের নব অতিথি-উপগ্রহ। আজীবন ঘুরে চলবে বিশ লক্ষ মাইলের ডিম্বাকার পথ ধরে যেটা তাকে একবার শনির কাছাকাছি এনে ফেলবে, আরেকবার নিয়ে যাবে বেশ কয়েকটা উপগ্রহের পেছনে। কিন্তু তার আগে সে প্রথমে একটা চক্কর মারবে শনিকে। তারপর যাবে প্রত্যেক বড় উপগ্রহের অর্বিটে।

তাদের শত দিন পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর চেয়ে আশি গুণ বড় দুনিয়া দেখতে দেখতে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মুখিয়ে থাকবে পনেরটা পরিচিত উপগ্রহ, কে জানে, আরো উপগ্রহ আছে কিনা! তাদের একটা আবার আকার আকৃতিতে খোদ শুক্রের মতো বড়।

সেখানে নিশ্চয়ই শতাব্দী ধরে দেখার মতো সুযোগ পড়ে আছে। প্রথম অভিযানটা স্রেফ আবছা আবছা ধারণা দেবে। এখানে যা পাওয়া যায় তার সবটুকুই পাঠানো হবে পৃথিবীতে। অভিযাত্রীদল না ফিরুক, তাদের কাজ ঠিকই ফিরে আসবে।

একশো দিনের কাজ শেষে ডিসকভারি থেমে যাবে। সব কু চলে যাবে হাইবারনেশনে। নিতান্ত দরকারি সিস্টেমগুলো থাকবে সক্রিয়। দেখভাল করবে শিপের ক্লান্তিহীন ইলেক্ট্রনিক ব্রেন। তারপর সে এমন এক অতি পরিচিত অর্বিটে ঘুরপাক খাবে যেখানে হাজার বছর পরেও মানুষ তাকে খুঁজে নেবে সহজেই। কিন্তু প্রয়োজন মাত্র পাঁচটা বছর, তারপর খবরদারির দায়িত্ব নিচ্ছে ডিসকভারি-টু। এমনকি যদি ছ-সাত বা আট বছরও লেগে যায়, ঘুমন্ত সৈনিকেরা যুদ্ধক্ষেত্রের নিষ্ঠুরতা টের পাবে না। কারণ এরিমধ্যে হোয়াইটহেড, কামিনস্কি আর হান্টারের জন্য ঘড়ির কাঁটা থেমে গেছে।

বোম্যান ডিসকভারির ফার্স্ট ক্যাপ্টেন। মাঝে মধ্যে সে নিজের তিন সহকর্মীকে নিতান্তই হিংসা করে। হাইবারনেকুলামের বরফ শীতল নীরবতায় থেকে ওরা আর সবকিছু থেকেই দারুণভাবে মুক্ত থাকতে পারছে। ওদের কোনো দায়িত্ব নেই, জেগে ওঠার পর নেই কোনো একাকিত্ব।

কিন্তু এই বাহ্যিক দুনিয়া তাদের তদারকিতে ব্যস্ত। পাঁচটা ক্যাপসুলে পাঁচ নাম বোম্যান, পোল, হোয়াইটহেড, কামিনস্কি আর হান্টার। প্রথম দুটি ক্যাপসুল মৃত। আরো বছরখানেকের মধ্যে জীবিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনটা ছোট্ট সবুজ বাতি সারাক্ষণ জ্বালিয়ে রাখে; এর মানে-চিন্তা নেই, সব চলছে ঠিকঠাক। পাশে আছে খুদে ডিসপ্লে, সেই ডিসপ্লেতে দীর্ঘায়িত হার্টবিট, সামান্য পালসরেট আর সংকুচিত ব্রেন অ্যাকটিভিটি প্রকাশ পায়।

বোম্যান জানে, অপ্রয়োজনীয় একটা ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তাকে। আদৌ এমন পরিস্থিতি হবে না। যদি কখনো বিপদ ঘটে, তো লাল বাতি জ্বলবে, অ্যালার্ম বাজবে, সে শুনতে পাবে অতি ধীর লয়ের হৃদস্পন্দন। এমনকি সেই স্ক্রিনের উপর রেখাগুলো কী বোঝায় তাও সে জানে ট্রেনিংয়ের বদৌলতে।

সবচে ঝকমারি আর মেজাজ গন্ধ করা ডিসপ্লে হল ই ই জি স্ক্রিন। তিন ব্যক্তিত্বের এক স্থির, ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর। এটা একবারই স্থির হয়ে আছে, আবার চলবে তারা জেগে উঠলে। কিছুই যদি না দেখার থাকে তো কী দরকার ছিল এ জিনিসটা বসানোর? এখানে কোনো উঁচু-নিচু খাঁজ নেই। থাকবে কী করে, এটা জেগে থাকা মস্তিষ্কের অবস্থা বর্ণনা করে, বড়জোর স্বাভাবিক ঘুম। এ ঘুমে মস্তিষ্ক আদৌ কোনো উদ্দীপনা দেখাবে না। আর যদি কোনো অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ঘটেই, তা হবে যন্ত্র-এমনকি স্মৃতিরও অতীত।

শেষের ব্যাপারটা বোম্যান নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করেছে। মিশনের জন্য বেছে নেয়ার আগে তার হাইবারনেশন সক্রিয়তা মেপে দেখা হয়। সে বুঝতেই পারেনি জীবন থেকে একটা সপ্তাহ হারিয়ে গেল, নাকি সে সময়টা শুধুই শীতল মৃত্যুময় একটা অভিজ্ঞতা।

স্লিপ জেনারেটর চালু হওয়ার পর ইলেক্ট্রোডগুলো কপালে লাগানোর সাথে সাথেই সে কিম্ভুত কিছু আকৃতি দেখতে পায়, দেখতে পায় চলন্ত তারকা। তারপর সেগুলো মিইয়ে যায় এক সময়, আলোকহীনতা জাপ্টে ধরে অষ্টেপৃষ্ঠে। সে কখনোই ইঞ্জেকশনগুলো অনুভব করেনি, অনুভব করেনি শূন্যের মাত্র কয়েক ডিগ্রি উপরের শীতল তাপমাত্রা।

.

একসময় ডেভ বোম্যান জেগে ওঠে। জেগেই বুঝতে পারে, এইমাত্র তাকে শোয়ানো হয়েছে। কিন্তু সে জানত, এ এক মায়া; মিথ্যা ইন্দ্রজাল। বছর কেটে গেছে।

মিশন কি শেষ? তারা কি এখন শনিতে? কাজ শেষ করে ঘুমানোর পর ডিসকভারি-টু কি পৃথিবীর পথে তাকে বয়ে নিয়ে যাবে?

সে এক স্বপ্নময় ঘোরের দেশের বাসিন্দা। এখন আর সত্যি-মিথ্যা স্মৃতির কোনো তফাৎ করতে পারছে না। চোখ খোলার পর একদল মৃদুমন্দ আলোর ঝলক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। এ সামান্য আলোই বহুক্ষণ তন্দ্রাহত করে রাখে তাকে। এবার বোম্যান বুঝতে পারে তার চোখ একটা শিপ সিচুয়েশন বোর্ডের ইন্ডিকেটরে আটকে আছে। কিন্তু এত অসম্ভব। কয়েক মুহূর্ত পরেই ধারণাটাকে বাতিল করে দেয় নিজে নিজে।

উষ্ণ বাতাস বয়ে যাচ্ছে গায়ের উপর দিয়ে। শরীরের তন্ত্রে তন্ত্রে জমে থাকা শতাব্দীর শীতলতাকে টেনে বের করে দিচ্ছে। চারদিক সুমসাম। শুধু মাথার পেছনের কোনো স্পিকার থেকে ঐন্দ্রজালিক সুরলহরী খেলে চলেছে ক্যাপসুল জুড়ে। ধীরে ধীরে এর তীব্রতা বাড়ে, বাড়ে মধুর ঝংকার।

এরপর একটা শান্ত, বন্ধুভাবাপন্ন কণ্ঠ ভেসে আসে। বোম্যান জানে সেটা কম্পিউটার জেনারেটেড ভয়েস।

‘তুমি কার্যকর হয়ে উঠছ, ডেভ। উঠে বসো না। নড়াচড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, কথা বলার চেষ্টা করোনা।’

‘উঠে বসো না!’ ভাবল বোম্যান। কী মজার কথা! একটা আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও তার নেই। ঠাণ্ডা ভাবটা কাটেনি এখনো।

একটু পরে সে বেশ সন্তুষ্ট হয়। সে জানে রেসকিউ শিপ অবশ্যই এসেছে। একমাত্র সান্ত্বনা, অটোম্যাটিক ট্রিগারে যেহেতু চাপ পড়েছে, খুব শীঘ্রই সে মানবজাতির সদস্যদের দেখবে। ব্যাপারটা চমৎকার, কিন্তু কেন যেন খুব একটা উৎফুল্প বোধ করে না।

এখন খিদেটাই মূল ব্যাপার। কম্পিউটার অবশ্যই ব্যাপারটা বোঝে।

‘ডান হাতের পাশে একটা বোম দেখতে পাবে, ডেভ। খিদে পেয়ে থাকলে কষ্ট করে চেপে দাও।’

নিজের আঙুলগুলো নড়ানোর চেষ্টা করতে করতে সে ডানে একটা বাল্ব দেখতে পায়। বেমালুম ভুলে গেছে এর কথা। কিন্তু এ নিয়ে অবশ্যই তার বিস্তর পড়াশোনা ছিল! আর কী কী ভুলেছে ও? হাইবারনেশন কি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্মৃতিও ধুয়ে দিয়েছে?

এবার সে বাটনটা চেপে ধরে। কয়েক মিনিট পর একটা ধাতব হাত বাঙ্ক দিয়ে প্রবেশ করলে প্লাস্টিকের নিপল নেমে আসে ঠোঁটের দিকে। ব্যগ্রভারে সেটা শুষে নেবার সময় বোম্যান টের পায় পুষ্টিকর উষ্ণ তরল তার ভিতরটাকে আরো সতেজ করে তুলছে।

নিপলটা চলে যাবার পর আবারো বিরামের পালা। এবার হাত-পা বেশ নাড়ানো যাচ্ছেতো! এখন হাঁটা আর কোনো অবাস্তব স্বপ্ন নয়।

যদিও তার শক্তি ফিরে আসছে বেশ তাড়াতাড়ি তবু একটা চিন্তা পীড়া দিতে শুরু করল। চিরকাল এখানে শুয়ে থাকতে হবে যদি বাইরে থেকে কেউ না ওঠায়।

এবার আরেক কণ্ঠ কথা বলছে। পুরোপুরি মানবিক কণ্ঠস্বর। আর কোনো ইলেক্ট্রনিক মেমোরি নয়, নয় মানুষের-চেয়েও-বেশি-কিছু। এ কষ্ঠ পুরোপুরি পরিচিত, কিন্তু কে বলছে তা বোঝা দায়।

‘হ্যালো, ডেভ। ঠিক হয়ে যাচ্ছ বেশ দ্রুত। এবার কথা বলতে পার। তুমি কি জানো কোথায় আছ এখন?’

সে এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। যদি সত্যি সত্যি শনির চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে তো পৃথিবী ছাড়ার পরে এতগুলো মাসে কী হল? কবে ডিসকভারিতে উঠল? সব স্মৃতি কি শেষ? অ্যামনেসিয়ায়[২৯] ভুগছে নাতো? আবার বৈপরীত্য নিয়ে ভাবনা দেখা দেয়। যদি সে সহী-শুদ্ধভাবে অ্যামনেসিয়া শব্দটা মনে করতে পারে তো বাকী সব ভোলার যুক্তিটা কোথায়….

এখনো ডেভিড বোম্যান জানে না আসলে সে আছে কোথায়। কিন্তু সেপাশের কথক নিশ্চয়ই তার বেগতিক অবস্থা বুঝতে পারছে, ‘ভয় পাবার কিস্যু নেই, ডেভ। ফ্র্যাঙ্ক পোল বলছি। আমি তোমার হৃদপিণ্ড আর শ্বসন দেখছি। সব চলছে একদম ঠিকমতো। একটু বিরাম দরকার, বিশ্রাম নাও। এখুনি দরজা খুলে বের করে আনব তোমাকে।’

নরম আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চেম্বারটা। সামনে কিছু দেখতে পেল সে, সাথে সাথেই সবটুকু স্মৃতি ফিরে এল তড়িৎ গতিতে। এবার সে জানে ঠিক কোথায় আছে এখন।

ঘুমের দূরতম প্রান্তে আর মৃত্যুর নিকটতম সীমান্তে গেলেও কেটেছে মাত্র একটা সপ্তাহ। হাইবারনেকুলাম ছেড়ে যাবার পর শনির শীতল আকাশ দেখবে না, সেতো যোজন যোজন দূরে। সে এখনো গরম সূর্যের নিচে তপ্ত টেক্সাস শহরের হিউস্টন স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ট্রেনিং কোর্সের একজন সদস্য।

অধ্যায় ১৬. হাল

কিন্তু এখন টেক্সাস আর নেই। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের খোঁজ লাগানোও নিতান্ত কঠিন। লো থ্রাস্ট প্লাজমা ড্রাইভ কতদিন আগেইতো বন্ধ হয়ে গেছে। ডিসকভারি আজো তার তীরের মতো শরীরটা নিয়ে পৃথিবীর দিকে পেছন দিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। নিরন্তর। তার সব অপটিক্যাল যন্ত্র বাইরের দিকের প্ল্যানেটগুলোর দিকে তাক করা, যেদিকে তার লক্ষ্য।

পৃথিবীর দিকে তাক করানো একটা টেলিস্কোপতো ছিলই। শিপের দৈত্যাকার লং রেঞ্জ অ্যান্টেনার প্রান্তে বসানো টেলিস্কোপটা যেন কোনো বন্দুকের দূরবীন। একটা ব্যাপার আগে থেকেই ঠিক করা, এই দানো-অ্যান্টেনা সব সময় তার দূরবর্তী সুনির্দিষ্ট টার্গেটের দিকে ফেরানো থাকবে। এর ক্রসওয়্যারগুলোর কেন্দ্র একেবারে পৃথিবীর দিকে। যোগাযোগটা সজীব, সার্বক্ষণিক। যোগাযোগের অদৃশ্য সুতোর দৈর্ঘ্য বিশ লাখ মাইল; তার সাথে প্রতি মুহূর্তের দূরত্বও যুক্ত হয়।

প্রতি ওয়াচ পিরিয়ডে অন্তত একবার বোম্যান টেলিস্কোপটা দিয়ে আকাশ খুঁড়ে পৃথিবী বের করার চেষ্টা করে। এখন পৃথিবীটা সূর্যের অনেক কাছাকাছি চলে গেছে, তাই বসুন্ধরার কালো দিকটা সারাক্ষণ মুখ ব্যাদান করে থাকে ডিসকভারির দিকে। টেলিস্কোপের চোখে এখন গ্ৰহটার চন্দ্রকলার মতো গড়ন ধরা পড়ে, দেখায় আরেক শুক্রের মতো।

আস্তে আস্তে আলোর উৎস দূরে সরে যাচ্ছে, তারই সাথে সরে যাচ্ছে অন্ধকার গ্রহ, সেটাকে তুলে আনতে হয় টেলিস্কোপে। এ এক মহা ঝামেলা। কিন্তু টেলিস্কোপের দৌড়ও কম না, সে এই আঁধার পৃথিবীকেই যত্ন করে দেখিয়ে দেয়, রাতের আলোকোজ্জ্বল শহরগুলো কখনো দেখা যায় স্পষ্ট, কখনো বা আবহাওয়ার ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে পড়ে।

এর মধ্যে আবার পিরিয়ডিক ব্যাপারও থাকে। চাঁদ একবার ভেসে চলে যায় পেছনে, একবার সামনে, তখন পৃথিবীর অনেক অংশই অদৃশ্য হয়ে পড়ে। তবে পূর্ণ চন্দ্র পৃথিবীর মহাসাগর আর মহাদেশগুলোকে আলোয় ভাসিয়ে তুলতেও দ্বিধা করে না।

এমন সব রাতে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউগুলোও ধরা দেয় স্পষ্ট, দেখা যায় পরিচিত সব নৌবন্দর। চিরচেনা লেগুনের পাশে যে পাম গাছ তাকে ছায়া দিত সেগুলোর কথা মনে পড়ে খুব বেশি।

এখনো এ হারানো সৌন্দর্যের জন্য তার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে এই সৌন্দর্যের সবটুকুই চুটিয়ে উপভোগ করেছে পৃথিবীতে থাকার সময়। বোম্যান জানে, জীবনে পঁয়ত্রিশ বছরের দেখাই সব নয়; সে চায় ধনী হতে, চায় বিখ্যাত হতে, তারপর নতুন চোখ নিয়ে দেখতে চায় সেসব স্বর্গীয় সৌকর্য। স্বভাবতই দূরত্ব সেসবকে আরো আরো মূল্যবান করে তুলছে এখন।

তাদের ষষ্ঠ সদস্য এসবের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। কারণ সে মানুষ নয়। সে হল অত্যাধুনিক এইচ এ এল নাইন থাউজ্যান্ড কম্পিউটার। হাল ন’হাজার হলো এই শিপের মস্তিষ্ক, ডিসকভারির স্নায়ুতন্ত্র।

হাল মানে হিউস্টিরিক্যালি প্রোগ্রামড অ্যালগরিদমিক কম্পিউটার। এ হল কম্পিউটার প্রজন্মের শেষ বিস্ময়, তৃতীয় প্রজন্ম[৩০]। এ প্রজন্মগুলোর কাল অতিবাহিত হয়েছে বিশ বছর পর পর।

প্রথম সাফল্য আসে উনিশশো চল্লিশ সালে। এনিয়াক[৩১] কম্পিউটারের বিকট বিকট ভ্যাকুয়াম টিউবগুলো নির্দ্বিধায় করে ফেলত হিসাবের হাজারো কাজ। তারপর উনিশশো ষাটের দিকে সলিড স্টেট মাইক্রো ইস্ট্রেনিক্সের[৩২] উদ্ভব। সে থেকেই প্রমাণ হয়ে যায় যে অন্তত মানুষের সমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গড়ে তোলা সম্ভব। শুধু সময়ের প্রয়োজন। আর সে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে দেয়ার মতো জায়গা যে কোনো ছোট ডেস্ক বা টেবিলেই পাওয়া যাবে।

সম্ভবত কেউ জানত না যে, এ হিসাবটার আর প্রয়োজন নেই, উনিশশো আশির দিকে মিনস্কি আর গুড[৩৩] দেখান, কী করে নিউরাল নেটওয়ার্ক[৩৪] গুলোকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলা যায়। তারা সেই নেটওয়ার্কের স্বত:পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের রূপরেখাও তৈরি করার চেষ্টা করেন। বলেন যে এই সিস্টেম হবে মানুষেরই মতো ধীরে শেখা প্রোগ্রামযুক্ত, সে নিজে নিজে শিখবে।

কৃত্রিম মস্তিষ্ক মানুষের ব্রেনের চেয়ে অনেক দ্রুত অনেক বেশি তথ্য পাবে, শিখবে, জমা করবে। এর কাজের ধারা কখনোই বোঝা যাবে না। আর যদি যায়, তো সেটাও অন্য কোনো মেশিনের কাজ, কারণ এ ধারা মানুষের ব্রেনের ধারা থেকে লাখ গুণ জটিল হবে।

এর কাজ যেভাবেই হয়ে থাক না কেন, শেষ পরিণতি এই হাল। ফলে নতুনতর দর্শনের উদ্ভব হতে পারে, আসতে পারে নব দিগন্ত, যেখানে ‘শেখা’ শব্দটা আর ‘নকল করা’ কথাটার মধ্যে পার্থক্য পাওয়া যাবে। এখানে মানব মস্তিষ্কের প্রায় সব কাজই করা হবে, তফাৎ শুধু গতিতে। এ এক খরচান্ত ব্যাপার, আর তাই হাল ন’হাজার সিরিজের মাত্র কয়েকটা মেশিন তৈরি হয়েছে।

হাল তার মানব সাথীদের তুলনায় কোনো অংশে কম ট্রেনিং নেয়নি কারণ তার কোনো বিশ্রামের দরকার নেই। তার নেই মানুষের মস্তিষ্কের মতো সীমিত স্মৃতি ভাণ্ডার। এখানে হালের আসল কাজ লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম মনিটরিং করা। সারাক্ষণ অক্সিজেন, বাতাসের চাপ, জাহাজের খোলের ছিদ্র, রেডিয়েশন চেকিংসহ ভঙ্গুর মানব ক্রুদের জন্য আর যা যা করা দরকার– সেসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে তাকে। সে জাহাজের দিকনির্দেশও দিতে পারে প্রয়োজনমাফিক। হাল হাইবারনেটরদের দেখাশোনা করে, পাঠায় তাদের জীবন-অমৃত-তরল।

প্রথম জেনারেশন কম্পিউটারের ইনপুটে দরকার ছিল টাইপরাইটার অথবা কীবোর্ড, আর আউটপুট আসত প্রিন্টার-বড়জোর মনিটরে। প্রয়োজনে এ সব সুবিধাই হাল নিতে পারে, কিন্তু তার যোগাযোগ হয় কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে। বোম্যান আর পোল যখন খুশি হালকে মানুষ ভেবে কথা বলতে পারে। ইলেক্ট্রনিক ছেলেবেলার কয়েক হপ্তায় যে ইংরেজি শিখেছে সেই উচ্চারণে সে খুব সহজেই কাজ চালাতে পারে।

হাল নিয়ে মূল চিন্তা অন্যখানে, উনিশশো চল্লিশের দশকে ভুবনখ্যাত ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালান তুরিং যা বলেছিলেন তা কি তার বেলায় প্রযোজ্য? তুরিং একটা মজার কথা বলেছিলেন। যদি একটা মেশিনের সাথে দীর্ঘসময় কথা বলা যায় হোক কীবোর্ড দিয়ে, হোক মাইক্রোফোনে-যদি মেশিনটা সেই সময় ধরে একজন বুদ্ধিমান মানুষের মতো কথা বলে যায় তবে সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তবে তার সাথে বলা কথা আর প্রশ্ন তাকে শিখানো কথা আর প্রশ্ন থেকে কিছুটা হলেও আলাদা হতে হবে।

হাল এক তুড়িতে তুরিং টেস্ট পাশ করেছিল।

এমন সময়ও আসতে পারে যখন হাল নিজেই শিপের কমান্ড তুলে নিবে। যদি তার সিগন্যালের জবাব কেউ না দেয় জরুরী সময়ে, সাথে সাথে সে ঘুমিয়ে থাকা ক্রুদেরকে জাগানোর চেষ্টা করবে, তাতেও কাজ না হলে যোগাযোগ করবে পৃথিবীর সাথে, তার দাবী হবে পরের আদেশগুলো।

আর তাতেও কাজ না হলে নিজের হাতেই কমান্ড তুলে নিতে হবে, বাঁচাতে হবে শিপকে, চালাতে হবে মিশন। সেই মিশন-যার আসল উদ্দেশ্য কেবল সে জানে,

জানে না তার কোনো মানব কু।

বোম্যান আর পোল মাঝেমধ্যেই ঠাট্টা করে নিজেদেরকে এই শিপের সামান্য চাকরবাকর আর দারোয়ান বলে অভিহিত করে। তারা কল্পনাও করেনি তাদেরই রসিকতা কতটা নিষ্ঠুর সত্যি হয়ে দেখা দিতে পারে।

অধ্যায় ১৭. মহাকাশ বিহার

শিপের প্রতিদিনকার চলাচল খুব সতর্কতার সাথে বেছে নেয়া হয়েছে। আর তাত্ত্বিকভাবে বোম্যান ও পোল জানে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি সেকেন্ড

তাদের কী কী করে কাটাতে হবে। তাদের কাজ বারো ঘণ্টা করে ভাগ করা। বারো ঘণ্টা একজনের ডিউটি চলবে, অন্যজনের বন্ধ। কখনোই দুজনে একসাথে ঘুমায় না। অফিসার অন ডিউটি থাকবে কন্ট্রোল ডেস্কে। অন্যজন টুকটাক কাজ করবে, দেখভাল করবে আশপাশটা, নয়তো বিশ্রাম করবে নিজের কিউবিকলে।

বোম্যান এ শিপের ক্যাপ্টেন হলেও বাইরে থেকে দেখে কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। তারা এ সময়টায় সব কাজ ভাগ করে নেয়, নিজের পদমর্যাদাও বাদ পড়ে না।

বোম্যান দিন শুরু করে 0600 ঘণ্টায় সময়ের হিসাবটা অ্যাস্ট্রোনটিক্যাল। মহাকাশবিদরা এক স্থির সময় নিয়ে নিয়েছে সারা সৃষ্টি জগতের জন্য-যাতে সময় নিয়ে ঘাপলা না বাঁধে। ক্যাপ্টেন দেরি করলেও সব সামলে নেয় হাল। জাগিয়েও দেয় তাকে। কিন্তু মিশনে নামার পর আর এর প্রয়োজন পড়েনি, একদিন পোল পরীক্ষা করে দেখার জন্য অ্যালার্মটা বন্ধ রেখেছিল, একচুল নড়চড় হয়নি বোম্যানের জেগে ওঠার সময়ে।

প্রথম কাজ হল হাইবারনেশন টাইমারটাকে আরো বারো ঘন্টার জন্য এগিয়ে রাখা। ঘুমন্ত ক্রুদের শীতনিদ্রা আরো বারো ঘণ্টার জন্য বেড়ে যায়। দুজনেই ভুলে বসলে হাল ধরে নেবে কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না, সে জরুরী পদক্ষেপ নেবে সাথে সাথে। এর কারণ অন্য কোথাও লুকিয়ে। হালকে দিয়েই এ কাজ করানো যেত। কিন্তু মিশনের দণ্ডমুণ্ডের বিধাতারা চান সদা জাগ্রত কু দেখতে।

বোম্যান টয়লেট থেকে এসে চিরাচরিত ব্যায়াম সেরে নেয়। তারপর সকালের নাস্তা সারতে সারতে চোখ বুলায় ওয়ার্ল্ড টাইমসের সর্বশেষ রেডিও-ফ্যাক্সে। পৃথিবীতে থাকতে কস্মিনকালেও এত আগ্রহভরে সে সংবাদপত্র পড়েনি। এখন একেবারে সাধারণ সামাজিক গালগল্প আর রাজনৈতিক কচকচানিও তার চোখদুটোকে তন্দ্রাহত করে রাখে।

0700 বাজার সাথে সাথে সে আনুষ্ঠানিকভাবে পোলকে মুক্তি দেয়। সাথে দেয় একটা স্কুইজ কফি টিউব। সাধারণত রিপোর্ট করার মতো কোনো কিছু থাকে না। থাকলে সেটা সেরে নেয়। এরপর মনোযোগ দিতে হয় সব যন্ত্রাংশের পাঠে। ইন্সট্রুমেন্ট রিডিং শেষে কিছু টেস্ট সারার কাজ, এর ফলে অগ্রিম জানা যায় যন্ত্রপাতির হাল-হাকিকত। 1000টায় কাজ ফুরিয়ে যাবার কথা। তারপরই পড়ালেখার সময়।

সে জীবনের অর্ধেকটা পার করে দিয়েছে পড়তে পড়তে। অবসর পর্যন্ত তাই করতে হবে। বিংশ শতাব্দীর ট্রেনিং আর লার্নিং সিস্টেমকে অনেক ধন্যবাদ দেয়ার ইচ্ছা জাগে তার মনে। সে এরই মধ্যে দু-তিনটা কলেজের সমস্ত শিক্ষার সমান জ্ঞান অর্জন করেছে, আর মজার ব্যাপার হল, নব্বইভাগই তার মনে আছে।

অর্ধ শতাব্দী আগে হলে সে একই সাথে ফলিত মহাকাশবিজ্ঞান, সাইবারনেটিক্স আর মহাকাশ গতিবিদ্যার একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মান পেত। আর আজ নিজেকে যে কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দাবী করার ভাবনাটাকেও সলজ্জভাবে নাকচ করে দেয়। সে কোনোদিন একটা স্থির বিষয়ে মনোনিবেশের চেষ্টা করেনি। তাই নিজের শিক্ষকদের একদম হতাশ করে দিয়ে মাস্টার্সের বিষয় হিসেবে বেছে নেয় সাধারণ মহাকাশবিজ্ঞানের মতো একটা বিশাল, গাধা সাবজেক্টকে। এ বিষয়ের ছাত্ররা আই কিউর হিসাবে একশো ত্রিশের উপরে না যেতে পারলেও চলে, তারা সাধারণত কোনোদিন নিজের পেশার শীর্ষে যেতে পারে না।

অবশেষে তার পছন্দই ঠিক বলে বিবেচিত হয়েছে। কোনো এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হওয়ার কারণেই এখানে আসা সম্ভব হল। অন্যদিকে পোল নিজেকে ‘মহাকাশ জীববিদ্যার জেনারেল প্র্যাকটিশনার’ দাবি করে। এই দুজনের সাথে হালের অসীম স্মৃতি যুক্ত হয়ে মিশন পরিচালনাকে করে তুলেছে অপ্রতিরোধ্য।

1000 থেকে 1200 পর্যন্ত বোম্যান এক ইলেক্ট্রিক টিউটরের কাছে নিজের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা দেয়, অভিযানের জন্য প্রয়োজন এমন সব কথা জেনে নেয়। সে পুরো শিপের প্ল্যান, সার্কিট ডায়াগ্রাম, অভিযান প্রোফাইল আর বৃহস্পতি-শনির পুরো উপগ্রহ জগতের ব্যাপারে নিজের জানাশোনা নিয়ে দাপড়ে বেড়াতে পারে সহজেই।

ঠিক দুপুরে, লাঞ্চের সময় এলেই নিয়ন্ত্রণ হালের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়। লাউঞ্জ আর ডাইনিং স্পেসের জন্য এক রুমই বরাদ্দ। সেখানেও হুবহু একই রকম একটা সিচুয়েশন ডিসপ্লে প্যানেল আছে। হাল সারক্ষণ ওর সাথে যোগাযোগ রাখে। পোল তার ছ-ঘণ্টার ঘুমে যাবার আগে তার সাথে যোগ দেয়। এর সাথে প্রায় সব সময়ই থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রাম।

মিশনের আর সব দিকের মতো তাদের খাবারের দিকেও সমান যত্ন নেয়া হয়। খাবারের বেশিরভাগই শুকনো। ঠাণ্ডায় জমিয়ে রাখা হয় এগুলোকে। এমন চমৎকার খাবার সৃষ্টিকুলে কেউ হয়তো পায় না; শরীরের সাথে ঠিকমতো খাপ খেয়ে যায়। প্যাকেট খুলে অটো গ্যালিতে ফেলে দিলেই হলো। সময়মতো রান্নাঘর জানিয়ে দেবে, দেখিয়ে দেবে সত্যিকার অরেঞ্জ জুস বা নানা ধরনের ডিম। আর কত ধরনের খাবারের কথা তারা মনে করতে পারে? সবই পাওয়া যাবে।

1300 থেকে 1600 পর্যন্ত শিপ ট্যুর। ডিসকভারি একপাশ থেকে আরেকপাশে প্রায় চারশো ফুট লম্বা। কিন্তু এর ক্রুদের রাজত্ব কেবল চল্লিশ ফুটের প্রেশার শরীরের ভিতর।

এখানে সব ধরনের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম পাওয়া যায়। কন্ট্রোল ডেক হল শিপের হৃদপিণ্ড। এর নিচে আছে এক ছোট্ট স্পেস গ্যারেজ। ভিতরে তিন দরজা দিয়ে তিনটি অতি ছোট ক্যাপসুল ভেসে বেরিয়ে যেতে পারে। সেগুলো একজন মানুষের চেয়ে বেশি কিছু বয়ে নিতে পারবে না।

ডিসকভারির অক্ষে আছে পঁয়ত্রিশ ফিট ব্যাসের এক ড্রাম। সারাক্ষণ ঘোরে বলেই এখানে সৃষ্টি হয় একটু মাধ্যাকর্ষণ। চাঁদের মতো মাধ্যাকর্ষণ তোলার আশায় জিনিসটা সব সময় দশ সেকেন্ডে একবার ঘুরে চলে। ফলে নিতান্ত ওজনহীনতার ধকল থেকে বেশ ভালোভাবেই বেঁচে যায় ক্রুরা।

কয়রাসেলে আছে বেশ কিছু সুবিধা। কিচেন, ডাইনিং, ওয়াশিং আর টয়লেট রুমগুলো (অথবা বলা ভালো ব্যবস্থাগুলো) এখানে। একমাত্র এখানেই পানি ফুটানো নিরাপদ। অন্য কোথাও সে কাজ করতে গেলে পানির ভাসমান বুদবুদগুলো মহা তেলেসমাতি দেখাবে। দাড়ি কামাতে গিয়ে হাজারো টুকরোকে ভেসে বেড়াতে দেখতে হয় না। প্রান্তসীমা জুড়ে পাঁচটা ছোট্ট কিউবিকলে পাঁচ অভিযাত্রীর একমাত্র আপন ভুবন। তাদের মালসামানও সেখানেই থাকে। বর্তমানে মাত্র দুটি কিউবিক কাজে লাগছে।

প্রয়োজনে করোসেলের ঘূর্ণন থামানো যায়। সেক্ষেত্রে কৌণিক ভরবেগটা চলে যাবে একটা ফ্লাই হুইলে। কিন্তু থামানো হয় না কারণ এই ড্রামের ভিতর ঢোকা, সহজ। মই বেয়ে উঠতে হয়, সেখানে কোনো মাধ্যাকর্ষণ নেই। একটু চর্চা থাকলেই ব্যাপারটা কোনো চলন্ত এসকেলেটরে চড়ার মতো স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায়।

আর শিপের লম্বাটে অংশটা চিকণ, তীরের মতো দেখতে। আর সব গভীর মহাশূন্যযানের মতো ডিসকভারিও মহা ভঙ্গুর বস্তু। এটা কোনো গ্রহের আকর্ষণ ক্ষেত্রেই প্রবেশ করতে পারবে না।

সে গঠিত হয়েছে পৃথিবীর অর্বিটে, তার পরীক্ষা হয়েছে একটু বাইরের দিকে, তার উৎক্ষেপণ হয়েছে চাঁদের বাইরের কক্ষপথে। সুতরাং সে মহাশূন্যের একেবারে খাঁটি সন্তান।

এই গোল মনুষ্য-এলাকার ঠিক বাইরেই রয়েছে চারটা বিরাট ট্যাঙ্ক। সেগুলো তরল হাইড্রোজেনে পূর্ণ। ট্যাঙ্কের পেছনেই এক মস্ত ভি অক্ষর, যেটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর থেকে বেরুনো বাদবাকি তেজস্ক্রিয়তা শুষে নেয়। এরপর রিয়্যাক্টর ঠাণ্ডা করার জন্য যে তরল প্রবাহিত হয় তার এক বিশাল, প্যাচানো লেজ। একে খুব সুন্দরভাবেই কোনো গঙ্গাফড়িংয়ের লেজের সাথে তুলনা করা যায়। এদিক দিয়ে ডিসকভারি যেন খানিকটা পুরনো দিনের জাহাজ।

ডি এর একদম শেষ মাথায় লুকানো আছে সেই প্রাণভোমরা, পারমাণবিক চুল্লী। এলাকাটা ক্রুদের কেবিন থেকে তিনশ ফুট পেছনে। এখানে আছে বেশ কিছু ফুয়েল রড, সেই রড ধারণ করে নক্ষত্র-অমৃত। প্লাজমা সৃষ্টি হয়, চলে যায় প্লাজমা ড্রাইভে। এর কাজ বহু হপ্তা আগেই ফুরিয়ে গেছে, সে ডিসকভারিকে চাঁদের পার্কিং অর্বিট থেকে ঠেলে বের করে দিয়েছে সাফল্যের সাথে। এখন প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ যোগান দেয়ার জন্য টিমটিম করে জ্বলছে এই চুল্লী। ভিটা এখন কালো আর ঠাণ্ডা। এটাই একেবারে গনগনে লাল হয়ে যায় পূর্ণ শক্তিতে প্লাজমা ইঞ্জিন চলা শুরু করার পর।

শিপের এসব এলাকায় যাবার কথা কস্মিনকালেও কেউ ভাবে না। এজন্য সদা সতর্ক থাকে রিমোট টিভি ক্যামেরাগুলো। বোম্যান ভালো করেই জানে যে সে প্রতি ইঞ্চি এলাকা চোখ বন্ধ করে বর্ণনা করতে পারবে।

1600’র মধ্যে কাজ শেষ করে মিশন কন্ট্রোলের জন্য রিপোর্ট পাঠাতে হয়। জবাব আসার পর নিজের ট্রান্সমিশন বন্ধ করে 1800 টায় পোলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করার প্রস্তুতি নেবে।

তারা ডিউটির বাইরে ছঘন্টা সময় পায়। যা ইচ্ছা করে বেড়ানোর সেটাই আসল সময়। এর বেশিরভাগ কেটে যায় জাহাজের ইলেক্ট্রনিক লাইব্রেরিতে। বোম্যান সব সময় অতীতের বিশাল অভিযানগুলোর রোমাঞ্চ নিজের ভিতর অনুভব করে, সময়ের অনুপাতে সেসবের দূরত্বও ছিল কম। আজ সে স্বয়ং সবচে দূরবর্তী অভিযাত্রার যাত্রী।

কখনো বা সে হারকিউলিসের পিলার ছাড়িয়ে পাইথিয়াসে[৩৫] যাত্রা করতে উৎসাহী হয়। প্রস্তর যুগ থেকে মাথা ভাসানো আফ্রিকাকে সাগর তীর ধরে দেখার তার অদম্য স্পৃহা দেখার আশা জাগে দুই মেরু। অথবা দুহাজার বছর ফারাকে চলে গিয়ে সে ম্যানিলা গ্যালিয়ন[৩৬]গুলোতে চড়ে বেড়াতে চায় এ্যানসনকে সাথে নিয়ে। অথবা কুককে[৩৭] সঙ্গী করে পাল তুলে দিতে চায় শিহরণ ভোলা অস্ট্রেলীয় গ্রেট বেরিয়ার রিফের এলাকায়। সে ওডিসি[৩৮] পড়াও শুরু করেছে। সময় সাগর পাড়ি দিয়ে এই মহাকাব্যই তাকে বিস্ময়স্তম্ভিত করে রাখে।

বিশ্রামের জন্য সব সময় হাল তার সঙ্গী। গাণিতিক উপগাণিতিক গেমগুলো বেশ মজা দেয় তাকে। দাবা, চেকার্স, পলিওমিনাস গেমগুলো সব সময় খেলে তারা দুজন। হাল যদি নিজের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে খেলে, তাহলে কোনো মানুষের পক্ষে কখনোই জিতে যাওয়া সম্ভব হতো না। তাই এটাকে পঞ্চাশভাগ খেলা জেতার মতো করে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। তার মানব সাথীরা এ খবর জানে না।

বোম্যানের শেষ ঘণ্টাগুলো খুচরো কাজেই ব্যয় হয়ে যায়, তারপর 2000 টায় পোলের সাথে ডিনার সেরে শুতে যাওয়া। এরপর একটা ব্যক্তিগত ঘণ্টা। পৃথিবী থেকে খবর নেয়া বা দেয়ার কাজে এটা খরচ করে ওরা।

অন্য সব সঙ্গীর মতো বোম্যানও অবিবাহিত। এত লম্বা অভিযানে বিবাহিত মানুষ পাঠাবার কোন যুক্তি নেই। অনেক সুকন্যাই তাদের ফিরে আসার আশায় দিন গুনবে বলে রেখেছে, কিন্তু কেউ কথাটা বিশ্বাস করেনি। তারা সপ্তাহে একবার পার্সোনাল কল করত, কিন্তু অপর প্রান্তে শোনার মানুষের কোনো অভাব ছিল না। আর এখন, অভিযানের শুরুর দিকেই মেয়েদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। এমনই হবার কথা চিরকাল। তারা জানে। এ হল নভোচারীর চিরন্তন ভাগ্য, এমনই ছিল আগের দিনের পালতোলা জাহাজের বীর নাবিকের ললাট।

কথা সত্যি, সামুদ্রিক নাবিকেরা সাথী পেত, পেত ছোট্ট সব অভিযানের দায়িত্ব, সেগুলো বড়জোর বছরখানেকের মতো লম্বা। তাদের আছে অনেক অনেক নতুন নতুন বন্দর; দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, পৃথিবীর অর্বিটে কোনো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চমৎকার। দ্বীপদেশ নেই। স্পেস মেডিকরা এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে যথাসাধ্য করেছে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে বোম্যান তার ফাইনাল রিপোর্ট জমা দেয়, চেক করে নেয় হালের টেপগুলো। তারপর মন চাইলে কয়েক ঘণ্টা বই পড়া বা চলচ্চিত্র দেখা। মাঝরাতে ঘুমাতে গেলে তার সাধারণত ইলেক্ট্রোনারকোসিসের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে না।

পোলের কাজটাকে বলা চলে বোম্যানের কাজের প্রতিচ্ছবি। তারা দুজনেই অত্যন্ত বুদ্ধিমান, স্থির চিন্তার অধিকারী এবং নিয়মানুবর্তী। তাদের মধ্যে কাজে গাফলতি বা ঝগড়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। মিশন চলতে থাকে নিজের মতো।

ডিসকভারির ক্রুদের একটাই প্রত্যাশা, আগামী দিনগুলোতেও যেন এই রুটিনের কোনো ব্যত্যয় না হয়।

শুধু সময়ই এর জবাব দিতে পারে।

অধ্যায় ১৮. গ্রহাণুপুঞ্জের ভেতর দিয়ে

সপ্তাহের পর সপ্তাহ একটা পথচলতি গাড়ির মতো ডিসকভারি নিজের অতি পরিচিত পথ আর অর্বিট ধরে এগিয়ে চলে। কিছুদিন আগে সে পেরিয়ে এসেছে মঙ্গলের কক্ষপথ, এগিয়ে যাচ্ছে বৃহস্পতির দিকে। পৃথিবীর সাগর আর আকাশে চলা অন্য লাখো শিপের সাথে তার এক বিরাট তফাৎ আছে। সে তাদের মতো প্রতি মুহূর্তে শক্তি ব্যয় করে চলে না। কাজে লাগায় গ্রহগুলোর গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্সকে, মেনে চলে মহাকর্ষের অমোঘ কানুন। কোনো ডুবো চর বা পর্বত চূড়ায় ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা নেই, নেই অন্য কোনো বাহনের সাথে সংঘর্ষের আশঙ্কা। কারণ মঙ্গলের পর থেকে অসীমে মিলিয়ে যাওয়া তারার দলের মধ্যে কোথাও মানুষের তৈরি কোনো যান চলছে না।

কিন্তু সামনে একটা নো ম্যান্স ল্যান্ড পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। দশ লাখেরও বেশি গ্রহাণু এ পথ ধরে বিচরণ করে। এদের মধ্যে বড়জোর দশ হাজার খণ্ডকে পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা পুরোপুরি চিনতে পেরেছে, জানতে পেরেছে তাদের গতিপথ। তাদের মধ্যে মাত্র চারটির ব্যাস একশো মাইলের চেয়ে বেশি। পরিমাণে সবচে বেশি যারা আছে তারা হল মাঝারি আকারের পাথর-চাকতি। এরা এলোমেলোভাবে ভেসে বেড়ায় স্পেসের বুকে।

একদম ছোট্ট একটা গ্রহাণুও শিপটাকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু এদের নিয়ে কিছু করার নেই। সাধারণত হাজার মাইলের মধ্যে একটা অ্যাস্টেরয়েড খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম। কোনো এলাকার দশ লাখ মাইলের মধ্যে গড়ে মাত্র একটা গ্রহাণু পাওয়া যেতে পারে।

ছিয়াশিতম দিনে তারা পরিচিত কোনো অ্যাস্টেরয়েডের সবচে কাছ দিয়ে যাবে। এর নাম নেই, সাধারণ একটা নাম্বার আছে-৭৭৯৪। পঞ্চাশ গজ ব্যাসের জিনিসটা সাতানব্বইতে চান্দ্র অবজার্ভেটরির চোখে প্রথম ধরা পড়ে। আবিষ্কারের পরপরই ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়া হয়, শুধু রেকর্ড থেকে যায় মাইনর প্ল্যানেট ব্যুরোতে।

কাছাকাছি আসার সাথে সাথে হাল বোম্যানকে মনে করিয়ে দেয় গ্রহাণুটার কথা। কিন্তু পুরো ভয়েজে এই একটা বাহ্যিক কাজই তার করার কথা, এটা কি ভোলা সম্ভব? অ্যাস্টেরয়েডটার গতিপথ, এর সবচে কাছে আসার মুহূর্ত, এর ছবি তোলার সম্ভাবনা-সবই ডিসপ্লে স্ক্রিনে উঠে পড়েছে। ৭৭৯৪ যখন তাদের মাত্র ন’শো কিলোমিটার দূর দিয়ে যাবে তখন তারা একেবারে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। দুজনের আপেক্ষিক গতি হবে ঘণ্টায় আশি হাজার মাইল।

বোম্যান হালকে টেলিস্কোপিক ডিসপ্লে দিতে বললে একটা নক্ষত্র-মানচিত্র ভেসে উঠল চোখের সামনে। এর মধ্যে কোনোটাকেই গ্রহাণুর মতো দেখায় না। টেলিস্কোপের সর্বশক্তি নিয়োগের পরও একেবারে মাত্রাহীন আলোর বিন্দু ছাড়া আর কিসসু চোখে পড়ে না।

‘টার্গেটের দিকে তাক কর।’

সাথে সাথে চারটি ক্ষীণ রেখা উঠে আসে। এরপর কিছু না দেখে যখন সে হাল ভুল করেছে ভেবে বসছে তখনি দূরের একটা আলোকবিন্দুকে নড়তে দেখা গেল। তারার জগত থেকে এক নক্ষত্র যেন এগিয়ে আসছে একটু একটু করে। এটা এখনো হয়তো আধ মিলিয়ন মাইল দূরে।

ছ’ ঘণ্টা পর পোল তার সাথে যোগ দিল। এখন ৭৭৯৪ শত গুণ উজ্জ্বল। এত দ্রুত এগিয়ে আসছে যে তাকে দেখতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। এখন আর কোনো আলোকবিন্দু নয়, এগিয়ে আসছে এক স্পষ্ট চাকতি।

তারা যেন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর ছোট্ট পাথুরে দ্বীপের দেখা পেয়ে আনন্দে আটখানা হওয়া কোনো বুভুক্ষু নাবিক। সবাই জানে এটা এক প্রাণহীন, বাতাসহীন পাথরের চাঙর, তাতে কী? আরো দু’শ মিলিয়ন মাইলের মধ্যে এই একটা জিনিসই দেখা যাবে। তারপর আছে বৃহস্পতির দুনিয়া।

গ্রহাণুটা বেটপ আকৃতির। একপাশ থেকে আরেকপাশে ঘুরছে, যেন বলছে, আমিও গ্রহ, মেনে চলি গ্রহের নিয়ম। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন অ্যাস্টরয়েডরা আসলে কোনো এক বিশাল গ্রহের ভগ্নাবশেষ। সেই গ্রহেরই কক্ষপথ ধরে অথৈ শূন্যতায় ঘুরে চলেছে আজো।

কখনো এটাকে মনে হয় সমতল কোনো চতুষ্কোণ বস্তু, কখনো বাঁকানো ইট আবার কখনোবা আরো বিকৃত। প্রতি দু-মিনিটের একটু বেশি সময়ে সেখানে একটা পূর্ণ দিন আর রাত পেরিয়ে যায়, অর্থাৎ একটা চক্র সম্পন্ন হয়। কখনো আলো ছায়ায় এক দুর্বোধ্য চিত্র সে, কখনোবা দ্যুতিময়।

তাদের পাশ দিয়ে গ্রাহক সেকেন্ডে ত্রিশ মাইল বেগে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই দেখার জন্য তারা মাত্র কয়েকটা মিনিট হাতে পাবে। এর মধ্যেই ডজন ডজন ছবি তোলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ অভিযানের জন্য শব্দের প্রতিধ্বনি নেয়া হয়েছে, আর পূর্ণ পরীক্ষা করার সুযোগ মিলেছে মাত্র একবার।

যে প্রোবটা পাঠানো হয়েছে সেটায় কোনো যন্ত্রপাতি নেই। এমন মহাজাগতিক গতিতে চলার সময় কেউ সংঘর্ষ সয়ে যেতে পারবে না। আসলে প্রোবটা হল এক টুকরো ধাতু, সেটাকে ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে গ্রহাণুর দিকে।

ছুঁড়ে দেয়ার আগে দুজনে উত্তেজনার শেষ সীমায় চলে যায়, শত ফুটের কোনো টার্গেটে ঢিল ছোঁড়া কোনো ব্যাপার না হলেও হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ঘণ্টায় আশি হাজার মাইল বেগে চলা লক্ষ্যে এমন কাজ চালানো …

অ্যাস্টেরয়েডের আঁধার অংশে বিশাল আলোর বিস্ফোরণ হয়। অপার্থিব গতিতে সংঘর্ষের কারণে প্রোবের অনেকটা ভর আর সবটুকু গতি পরিণত হয় তাপশক্তিতে। জ্বলন্ত বাস্পে ছেয়ে যায় আশপাশ।

ডিসকভারিতে সাথে সাথে ক্যামেরাগুলো বর্ণালী রেখার ছবি তুলে নেয়। পৃথিবীতে বসে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে মাতামাতি করবে। এবং জ্বলন্ত পরমাণু ও অনুগুলোর খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথে প্রথমবারের মতো গ্রহাণুর গঠন-উপাদানের কথা পৃথিবীর মানুষ প্রমাণসহ জানতে পারবে।

একঘণ্টায় আবার সেটা টিমটিমে তারায় পরিণত হলো, পরের বার বোম্যান খোঁজ করতে এলে সেটার কোনো চিহ্নই দেখাতে পারেনি হাল।

তারা আবার একা। তিনমাস পর আসছে গ্রহরাজ বৃহস্পতি।

অধ্যায় ১৯. বৃহস্পতির পথে

দু’কোটি মাইল দূর থেকেও বৃহস্পতিকে আকাশের সবচে উজ্জ্বল জিনিস বলে মনে হয়। এখনি গ্রহরাজকে স্নানভাবে আলো ছড়ানো স্যামন মাছের পেটের মতো দেখাচ্ছে। পৃথিবী থেকে চাঁদকে যেমন লাগে তার অর্ধেক আকৃতি পেয়ে বসেছে সে। বৃহস্পতির বাইরের জগতে রাজত্ব করছে চার উপগ্রহ আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো। এ চারটা যদি বাইরে থাকত তবে নির্দ্বিধায় গ্রহ হিসেবে পরিগণিত হতো। কিন্তু দৈত্যাকার ম্রাট বৃহস্পতির কাছে এরা মামুলি প্রজা।

টেলিস্কোপে বৃহস্পতি এক বহুরঙা আকাশজোড়া গোলক হিসেবে ধরা দেয়। বারবার বোম্যান নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এর ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে এগার গুণ বড় আর এখন এ বিশালত্ব বুঝে ওঠার সাধ্য নেই তার।

নিজেকে হালের টেপ থেকে শিক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ কিম্ভুত একটা ব্যাপার নজরে পড়ে যায়। অদ্ভুত একটা আকৃতি, এই বৃহস্পতির বুকেও পৃথিবীর বুকে ভারতের মতো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেটা।

ঠিকমতো টেলিস্কোপে বড় করে তুলে ধরার পর দেখা গেল জিনিসটাকে। বৃহস্পতির মহাঘূর্ণনের সাথে সাথে বিশাল মেঘমালা যেন ঘুরছে। কিছু ফিতার মতো এলাকাও চোখে পড়ে, সেগুলো গ্যাসের ঘূর্ণনে প্যাঁচ খেয়ে যায় মাঝে মাঝে। বাস্পের বিশাল দল উঠে আসে। এগুলোর কোনো কোনোটা আবার সিঁড়ির মতো একটা আরেকটার সাথে যুক্ত। সেসব সিঁড়িও অস্থায়ী। সেই মেঘমালার নিচে আর কী লুকিয়ে আছে? ভাবে সে, ভেবে নিজের ভিতরই হোঁচট খায়, আর কী লুকিয়ে থাকতে পারে?

এই চিরঘূর্ণায়মান বিশাল মেঘের ছাদের নিচে চিরদিনের জন্য আসল উপরিতলটা ঢেকে রাখে মহামতি বৃহস্পতি। তার রাজকীয়তার সাথে রাজকীয় গোপনীয়তাও স্পষ্ট। সেই মেঘের দেশে আবার কালো আকৃতি চোখে পড়ে, ভিতরের দিকের ছোট উপগ্রহগুলো কোনো কোনোটা ছায়া ফেলে মেঘরাজ্যের উপর।

সেখান থেকে বোম্যান বৃহস্পতির অন্যান্য উপগ্রহও দেখতে পায়। কিন্তু সেগুলো সামান্য উড়ন্ত পাহাড় ছাড়া কিছু নয়, মাত্র কয়েক হাজার কিলোমিটার তাদের ব্যাস। এবার শিপ তাদের কোনো একটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবে। প্রতি মিনিটে রাডার তার শক্তি সঞ্চয় করে নীরব বজ্রাঘাত করবে সেসব উপগ্রহের গায়ে। শূণ্যতার মাঝ দিয়ে বেরিয়ে যায় তরঙ্গ, যেটুকু ফিরে আসে তা দিয়ে কোনো নতুন উপগ্রহের সন্ধান মেলে না।

বরং ফিরে আসে বৃহস্পতির গর্জনশীল রেডিও ভয়েস। উনিশশো পঞ্চান্ন সালকে বলা হয় মহাকাশবিদ্যার নবজন্মের কাল। তখন অ্যাস্ট্রোনোমাররা দেখতে পায় যে স্বয়ং বৃহস্পতি আকাশে লক্ষ লক্ষ হর্স পাওয়ারের দশ মিটার ব্যান্ড তরঙ্গ আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে। অবিরত।

এর বেশিরভাগই খুচরো শব্দ, আবার কোনো কোনোটা পৃথিবীর ভ্যান এ্যালেন *বিশেষ টিকা দ্রষ্টব্য বেল্টের মতো কিন্তু তার চেয়ে অনেক অনেক বড় আর ক্ষমতাবান বৃহস্পতীয় বেল্টের তর্জন-গর্জন।

মাঝে মাঝে ভালো না লাগলে বোম্যান একা একা এসব শব্দে ঘর ভরে তোলে। এ যেন লক্ষ আতঙ্কিত পাখির চিৎকার। যেন কোনো নির্জন সমুদ্রতীরে উন্মাতাল ঢেউ ভাঙছে আর ভাঙছে, যেন কোন সে দূরের পথে একের পর এক বজ্রপাতের শব্দে ভরে উঠছে আশপাশ।

অসহায়ের মতো সে শোনে। তার করার কিছুই নেই।

ঘণ্টায় লক্ষ মাইলেরও বেশি গতিতে চলতে থাকা ডিসকভারি পুরো বৃহস্পতি জগৎ পেরুতে সময় নেবে দু হপ্তারও বেশি। সূর্যের অনুগত গ্রহের চেয়ে বৃহস্পতির অনুগত উপগ্রহের সংখ্যা বেশি। চান্দ্র অবজার্ভেটরি প্রতি বছরই একটা করে নতুন স্যাটেলাইট আবিষ্কার করত, ভাগ্য ভালো, এক সময় আবিষ্কার করাটা বন্ধ হয়েছে। হিসাবটা ঠেকেছে ছত্রিশ পর্যন্ত এগিয়ে। সবশেষ উপগ্রহের নাম বৃহস্পতি-পঁচিশ। সেটা এক কোটি নব্বই লক্ষ মাইলের অস্থিতিশীল কক্ষপথে তার সাময়িক দেবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে।

এ হল সূর্য আর বৃহস্পতির চিরকালীন দ্বন্দ্ব। সাধারণত বৃহস্পতিই বেশি এগিয়ে থাকে, তবে কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে অন্তত একবার বৃহস্পতির কোনো না কোনো উপগ্রহ হারিয়ে যায় গ্রহাণুপুঞ্জের মেলায়। শুধু বাইরের দিকের উপগ্রহগুলোই তার নিজের সম্পদ।

এবার অকল্পনীয় অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের সাথে দুর্দান্ত একটা খেলা চলবে। ডিসকভারি এখন এগিয়ে যাচ্ছে একটা জটিল পথ ধরে। এ অর্বিট কয়েক মাস আগে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারের পর হাল পরীক্ষা করে দেখেছে ভালোমতো। তাদের ট্রাজেক্টরির সাথে মানিয়ে নিতে প্রতি মিনিটেই কন্ট্রোল জেটকে চালাতে হবে।

পৃথিবীর সাথে সারাক্ষণ যোগাযোগ চলছে। তারা আজ পৃথিবী থেকে এত দূরে যে আলোর গতিতে সিগন্যাল আসতেও পঞ্চান্ন মিনিট সময় নিবে। তাই পুরো পৃথিবী তাদের দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকলেও তারা যে খবরটা পাচ্ছে, যে দৃশ্যটা দেখছে তা একদম এক ঘণ্টার পুরনো।

প্রতিটা দৈত্যাকার ইনার স্যাটেলাইটের পাশ কেটে যাবার সময় টেলিস্কোপ মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে। লাখো ছবি তুলে নিতে দ্বিধা করে না হাল। সেসব উপগ্রহের প্রত্যেকটা আকৃতিতে চাঁদের চেয়ে বড়। রহস্যে একেবারে আবৃত। ট্রানজিটের তিন ঘণ্টা আগে বৃহস্পতির আরেক উপগ্রহ ইউরোপার মাত্র বিশ হাজার মাইল দূর দিয়ে এগিয়ে যায় স্পেসশিপটি। সূর্যের দিকে হারিয়ে যাবার আগে সেটা ছিল পূর্ণ এক গোলক, তারো আগে চিকণ চাঁদের মতো দেখা দিয়েছিল। তার দিকে সব যন্ত্রপাতি চেয়ে ছিল বুভুক্ষের মতো। একদৃষ্টে। সেটার বুকে এককোটি চল্লিশ লাখ বর্গ মাইল এলাকা আছে। যে তথ্যগুলো টুকে নেয়া হচ্ছে প্রতি মিনিটে সেগুলো বিস্তারিত ভেঙে দেখতে হলে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।

দূর থেকে ইউরোপা দেখতে যেন এক দৈত্যাকার তুষারের বল। দারুণভাবে সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে যাচ্ছে সব সময়। কাছ থেকে দেখে বোঝা গেল যে ইউরোপা আসলে চাঁদের মতো ধূলিধূসর নয়, বরং বিরাট বিরাট হিমবাহের কল্যাণে তুষার শুভ্র। সেখানে অ্যামোনিয়া আর পানির কোনো অভাব নেই। বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণ বল কীভাবে এগুলোকে একত্র করেছে কে জানে!

শুধু দুই মেরুতেই কোনো বরফ নেই। সেখানে নগ্ন পাথর বেরিয়ে আছে তাদের কালো মুখ ব্যাদান করে। কয়েকটা মৃত অগ্নিগিরিমুখ দেখা গেলেও আগ্নেয়গিরির কোনো লক্ষণ পাওয়া গেল না; ইউরোপার কোনোকালেই কোনো অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা উৎস ছিল না।

সেখানে বায়ুমণ্ডলের সূক্ষ্ম একটা লক্ষণ ধরা পড়ে। কোথাও কোথাও মেঘের ছোঁয়া। এ্যামোনিয়ার ধোয়া হতে পারে, মিথেন-বাতাসে এর জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

বৃহস্পতি এখন মাত্র দু-ঘন্টার পথ। হাল বারবার জাহাজের পথ দেখে নেয়। এখনো বিন্দুমাত্র সংশোধনের প্রয়োজন নেই। একটাই ভাবনা, বৃহস্পতি না টেনে নেয় তার অতল গর্ভে।

এবার অ্যাটমোস্ফিয়ারিক ভোব পাঠানোর পালা। আশা করা হয় এগুলো বেশ কিছুকাল টিকে থাকবে এবং খবরাখবর পাঠাবে পৃথিবী কিংবা ডিসকভারির বুকে।

দুটি বোমার আকৃতির বেঁটেখাট পোব ভদ্র মানুষের মতো ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ডিসকভারির অর্বিটে। সেগুলো কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ডিসকভারির পেছন পেছন যাবে, আগুন যাতে না ধরে যায় তাই তার সাথে আছে হিট শিল্ড।

হাল নজরদারী করছে তাদের উপর। এবার শিপ যাবে বৃহস্পতির একেবারে নিকটতম অর্বিটে। এই কক্ষপথের ঠিক নিচেই বৃহস্পতীয় বায়ুমণ্ডলের শুরু। মাত্র কয়েক লাখ মাইলের ব্যবধানে এ কাজ সারা একেবারে ভয়াল বলা চলে, কারণ গ্রহটার ব্যাসই নব্বই হাজার মাইল। কিন্তু এ দূরত্বকে যথেষ্ট বলা যায়।

এবার পুরো আকাশ জুড়ে বসেছে গ্রহরাজ বৃহস্পতি। এর বিশাল আকার চোখও ধারণ করতে পারছে না, পারছে না মনও। চলছে মোহনীয় আলোর খেলা। লাল, হলুদ, গোলাপি, আর স্যামন রঙের হোলি না থাকলে বোম্যানের মনে পড়ে যেত পৃথিবীর আকাশের কথা।

আর, পুরো অভিযানে প্রথমবারের মতো তারা সূর্যকে আড়াল করতে যাচ্ছে। এখন সে অনেক ম্লান, অথচ সেই পৃথিবী থেকেই বিশ্বস্ত সফরসঙ্গী হিসেবে পথ দেখিয়েছে আলো দিয়ে। কিন্তু এবার অর্বিট ডিসকভারিকে টেনে নিয়ে যাবে বৃহস্পতির আড়ালে। এগিয়ে আসছে সেই রাত।

হাজার মাইল সামনে থেকে গোধূলীর বাঁক তাদের দিকে এগুচ্ছে তড়িঘড়ি করে। অন্যদিকে সূর্যটা বৃহস্পতির মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাবার পথে। এর আলো যেন কোনো জ্বলন্ত মহিষের উল্টো করা শিং। একটু পরেই বিনা প্রতিবাদে পাঁচ মাস পর ডিসকভারির আকাশ থেকে বিদায় নিল সৌর জগতের অধিকারী। রাত নেমেছে।

এখনো নিচের বিশাল সাম্রাজ্য পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। নিচে ফসফরাসের আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। আলোর স্নান নদী প্রান্ত থেকে প্রান্তে বয়ে যাচ্ছে সবেগে। এখানে সেখানে তরল আগুনের মাতামাতি। বৃহস্পতির লুকানো হৃদয় থেকে উৎসরিত আলোময় গ্যাস ভাসিয়ে দিতে চায় চারদিক। পলক না ফেলে দেখার মতো দৃশ্য।

এগুলো খুবই সাধারণ কেমিক্যাল আর ইলেক্ট্রিক্যাল বিক্রিয়ার ফল, নাকি কোনো অপার্থিব প্রাণের পার্শ্ব-উপাদান? এই এক প্রশ্ন নিয়ে বিজ্ঞানীরা তর্ক চালিয়ে যাবে যে পর্যন্ত কোনো অভিযান দিয়ে এর সমাপ্তি না ঘটে।

তারা বৃহস্পতির রাতের আরো ভিতরে যেতে থাকলে নিচের উজ্জ্বলতা আরো বেড়ে চলে। একবার অরোরার ডিসপ্লের সময় বোম্যান উত্তর কানাডার উপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। সেই সুন্দর সৌর সৌকর্যময় এলাকায় বরফ থাকাতে আলোর দীপ্তি আরো বেড়ে যায়। কিন্তু তারা এখন যে এলাকায় ভেসে বেড়াচ্ছে সেটা একই রকম উজ্জ্বল হলেও শত ডিগ্রি নিচে হবে তার তাপমাত্রা।

‘পৃথিবীর সিগন্যাল দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে,’ বলল হাল, আমরা প্রবেশ করছি প্রথম ডিফ্রাকশন জোনে।

তারা জানে এমন হবে। তবু, প্রথমবারের মতো সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের একেবারে বিমূঢ় করে দেয় কিছুক্ষণের জন্য। রেডিও ব্ল্যাকআউট মাত্র একঘণ্টা চলবে। এই একটা ঘণ্টা তাদের জীবনের দীর্ঘতম প্রহরের মধ্যে অন্যতম।

অপেক্ষাকৃত কম বয়সের মধ্যেই পোল আর বোম্যান প্রায় এক ডজন মহাকাশ অভিযান সেরে ফেলেছে। কিন্তু আজ হঠাৎ করে তাদের একেবারে নবীসের মতো লাগে। কোনোকালে এই গতিতে কোনো শিপ মহাকাশ ভ্রমণ করেনি। তারা বৃহস্পতির আকর্ষণকে দোলনা হিসেবে ব্যবহার করছে। একচুল এদিক-সেদিক হলে হয় সৌর জগতের বাইরে গিয়ে পড়বে, নয়তো গ্রহরাজের বুকে। দুটোই মৃত্যুর অপর নাম।

ধীর মিনিটগুলো কাটতে চায় না। এখন তাদের উপর বৃহস্পতি যেন ফসফরাস আলোর এক অসীম দেয়াল। এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে দৈত্যাকার গ্রহটা তাদেরকে উপগ্রহ বানিয়ে ফেলেনি।

অবশেষে, অনেক দূরে আলোর একটা ঝলক খেলে গেল। সেই একই মুহূর্তে হাল সগর্বে ঘোষণা করে উঠল, ‘আমি পৃথিবীর সাথে রেডিও যোগাযোগ করতে পেরেছি। একই সাথে আমরা এই জটিল পথপরিক্রমাও শেষ করেছি। শনির পথে আমরা চলব একশো সাতষট্টি দিন, পাঁচ ঘণ্টা, এগারো মিনিট।

ডিসকভারি অবশেষে বৃহস্পতির সদা চলনশীল গ্র্যাভিটিশনাল ফিল্ড থেকে মুক্তি পেল। এক ফোঁটা ফুয়েল না পুড়িয়ে সে বাড়িয়ে নিয়েছে প্রতি ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল গতি।

কিন্তু এখানেও প্রকৃতির সাথে কোনো জুয়া খেলা সম্ভব নয়। প্রকৃতি ডিসকভারিকে যতটুকু বাড়তি মোমেন্টাম দিয়েছে ঠিক ততটুকু কেড়ে নিয়েছে বৃহস্পতি থেকে। গ্রহটির ভরবেগ একটু হ্রাস পেলেও এর আকার ডিসকভারির তুলনায় কয়েক সেক্সটিলিয়ন গুণ বেশি হওয়াতে অর্বিটের স্থানচ্যুতি অসম্ভব কম। আজো সে সময় আসেনি যেদিন মানুষ তার কাজের ছাপ ফেলবে পুরো সৌর সাম্রাজ্যে।

আলো ফিরে আসতে আসতে পোল আর বোম্যান মহানন্দে পরস্পরের হাত ঝাঁকানো শুরু করে।

কিন্তু এখন আর তাদের বিশ্বাস হতে মন চায় না যে মিশনের প্রথম অংশটা মাত্র শেষ হল।

পুরোটাই পড়ে আছে সামনে।

অধ্যায় ২০. ঈশ্বরদের ভুবন

কিন্তু বৃহস্পতির সাথে তাদের লেনদেন শেষ হয়নি। অনেক পেছনে ফেলে আসা পোবদুটো ডিসকভারির সাথে লালচে দানবটার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে।

একটা কোনো জবাবই পাঠায়নি। সম্ভবত ঢোকার পথেই জ্বলে গেছে। অন্য পোবটা একটু বেশি সাফল্য দেখানো শুরু করে। বৃহস্পতীয় আবহমণ্ডলের প্রথম স্তর ভেদ করে ভিতরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে বাইরে। পরিকল্পনামতো জিনিসটা এত বেশি গতি হারিয়েছে যে একটা বাঁকা পথ ধরে একে আবার বাইরে ফিরে আসতে হয়। দু-ঘণ্টা পর পোব গ্রহরাজের দিনের অংশে প্রবেশ করে ঘণ্টায় সতুর হাজার মাইল বেগে। সে এখন এক উপগ্রহ।

একটু পরই গ্যাসের একটা পাকচক্রে পড়ে গিয়ে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। ব্যগ্রভাবে অনেক মিনিট কাটানোর পর শিপের দর্শকরা নিশ্চিত হতে পারল না এ জিনিস আর কাজে লাগবে কিনা। সিরামিকের শিল্ডটা আবার যোগাযোগের আগেই পুড়ে গেলে সব আশা ভরসা ফুরিয়ে যাবে। কারণ ভিতরের যন্ত্রপাতির বাষ্পে পরিণত হতে দু-সেকেন্ড নাও লাগতে পারে।

কিন্তু শিল্ডটা কাজে লেগেছে। রোবট অ্যান্টেনা বেরিয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে চারপাশে। প্রথম খবর পৌঁছতে পৌঁছতে ডিসকভারি চলে গেছে আড়াই লাখ মাইল দূরে।

প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার পালসের বর্ষণ হচ্ছে বৃহস্পতির আবহ থেকে। ঘোষণা হচ্ছে বায়ুমণ্ডলীয় সংযুক্তি, চাপ, তাপমাত্রা, চৌম্বকক্ষেত্র, তেজস্ক্রিয়তা সহ আরো শত শত জটিল অবস্থা যা শুধু পৃথিবীর বুকে বসে থাকা এক্সপার্টের দল বুঝতে পারবে। একটা রিপোর্ট সাথে সাথে বোঝা যায়, কারণ তা আসছে টিভি মনিটরে, পুরোপুরি রঙিন চিত্রে।

প্রথম চিত্রটা আসে রোবটের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে। শুধু হলুদ একটা ধোঁয়াশা চোখে পড়ে। ধোয়াটা অসীম কোনো অন্ত:সলিলা নদীর ঝর্নার মতো উঠে আসে উপরে। এদিকে রোবট প্রতি ঘণ্টায় কয়েকশ কিলোমিটার বেগে পড়ে যাচ্ছে ভিতরে।

আরো গম্ভীর হয়ে গেল কুয়াশা, এবার বোঝা দায় প্রোবের দৃষ্টিসীমা। সে দশ ইঞ্চি দেখছে নাকি দশ মাইল তা ঠাহর করা অসম্ভব। কারণ কোনো কিছুর দিকে ফোকাস করার উপায় নেই, আদৌ ফোকাস করার মতো কোনো জিনিসই নেই সেখানে। দেখে শুনে মনে হয় মিশনটা বৃথা গেল।

এরপর হঠাৎ করেই কুয়াশা সরে গেল। পোব কোনো এক ভারি মেঘের মধ্য দিয়ে শত শত মাইল পড়ার পর স্পষ্ট কোনো এলাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। সম্ভবত এটা খাঁটি হাইড্রোজেনের কোনো স্তর, ক্রিস্টাল অ্যামোনিয়াও হতে পারে। এখনো ছবিগুলো বোঝা দায়, এটুকু বোঝা যায় যে ক্যামেরার ফোকাস বেশ কয়েক মাইল দূরে।

এবার ছবি এত অপরিচিত যে পার্থিব দৃশ্যে অভ্যস্ত কোনো চোখ একে সয়ে নিতে পারবে না। অনেক অনেক নিচে স্বর্ণালী কোনো এক অবয়ব শুয়ে আছে, তার নেই কোনো সীমা, নেই কোনো শুরু। শুধু দেখা যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ। যেন দানবীয় সব পর্বতের চূড়া। কিন্তু সেখানে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ নেই। সেই সোনালী এলাকাটা সমুদ্র না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু হতাশ হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে, সামনের সেই অপার্থিব ভূমিও কোনো ভূমি নয়। এ হল বৃহস্পতীয় বায়ুমণ্ডল। সেটা মেঘের নতুন স্তর, ব্যস।

এরপর হঠাৎ করেই ক্যামেরা দারুণ অস্পষ্ট হয়ে যায়। কোনো এক অদ্ভুতুড়ের খোঁজ পেয়েছে সে। অনেক মাইল নিচে সেই সোনালী মেঘসমুদ্র আড়াল করে আছে এক চতুষতলকীয় জিনিস। সেটার সাথে কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপারের তুলনা করা যাচ্ছে না, যদিও এই স্বর্গীয় বিশালত্বে প্রাকৃতিক’ কথাটার মানেই পাল্টে যেতে বসেছে।

তারপর বায়ুচাপের কারণে প্রোবটা আরেক প্রান্তে চলে যায়। সেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিচে দ্রুত সরতে থাকা সোনালী এলাকাকে হলদেটে পর্দার মতো দেখায়। এবার পরীক্ষাযন্ত্র স্থির হলে ‘সমুদ্র’ আরো এগিয়ে আসে। কিন্তু এমন মহাকাব্যিক ছবি মানবজাতির কোনো সদস্য কোনোদিন দেখেনি। এবার দেখা যাচ্ছে কালো কালো সব গর্ত, সেগুলো দিয়ে নিশ্চয়ই আরো নিচের স্তরের ছবি তোলা সম্ভব।

সেখানে প্রোবের যাবার কথা নয়। প্রতি মাইলে প্রেশার বাড়ছে, বাড়ছে গ্যাসের ঘনত্ব, এগিয়ে আসছে রহস্য-জগতের কঠিন ভূমি।

জিনিসটার পুরো জীবন ক্ষয় করে হয়তো গ্রহপতির লাখো ভাগের এক ভাগও দেখা আর বোঝা সম্ভব হবে না, তাতে কী, এ সামান্য তথ্যও মানুষ তার মহাকাশবিদ্যার পুরো ইতিহাসে সংগ্রহ করতে পারেনি। তারপর আরো গম্ভীর হয় মেঘ, পোল আর বোম্যান নিজেদের চোখ আটকে রাখে টিভি স্ক্রিনের প্রতি।

প্রাচীনেরা নিশ্চয়ই বর্তমানের মানুষদের চেয়ে এ গ্রহ সম্পর্কে বেশি জানত। নাহলে কোনো দুঃখে ঈশ্বর রাজের নামে নাম রাখবে? যদি নিচে প্রাণ থেকেও থাকে তা খুঁজে পেতে কতদিন লাগবে? নাহয় গেল প্রাণী পাওয়া, আর কত শতাব্দীর দরকার এই মেঘমন্দ্র ঈশ্বরভূমিতে পা ফেলতে, কীরকম শিপ তৈরি করতে হবে সে কাজের জন্য?

কিন্তু আজ সেসব নিয়ে ডিসকভারি আর তার কুদের ভাবার অবকাশ নেই। তাদের লক্ষ্য আরো আজব এক গ্রহকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। আরো অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে পাঁচ কোটি মাইলের নিরেট শূন্যতা ভেদ করে সেখানে পৌঁছতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *