২১.
তারা হাঁটতে লাগল। এখানকার গাছপালাগুলো আকাশছোঁয়া। গাছের গুঁড়িগুলো অনেক বেশি মোটা। ব্রাইডা লক্ষ করল, কোনো কোনো গাছের গোড়ায় একটা মই লাগানো। তেমন প্রতিটি গাছের ওপরে একটা করে ঘর।
এগুলো অবশ্যই চাঁদের রীতিনীতির সেই নিঃসঙ্গ হারমিটদের বাস করার জায়গা হবে। ব্রাইডা ভাবল।
ম্যাগাস খুব সাবধানে প্রতিটি কেবিন পরখ করে দেখতে লাগলেন। একটা ঘর পছন্দ হলো। তিনি ব্রাইডাকে সেখানে যেতে বললেন।
ব্রাইডা মই বেয়ে উঠতে লাগল। অর্ধেক পথ উঠে তার ভয় করতে লাগল। এখান থেকে নিচে পড়ে গেলে তা প্রাণঘাতি হতে পারে। যাই হোক, সে মই বেয়ে উঠতে লাগল। সে পবিত্র জায়গায় আছে। জঙ্গলের আত্মারা তাকে রক্ষা করছে। ম্যাগাস এ ব্যাপারে তার অনুমতির তোয়াক্কা করেননি। সম্ভবত চাঁদের রীতিনীতিতে এসব ব্যাপারকে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করা হয়।
গাছের ওপরে উঠে ব্রাইডা গভীরভাবে শ্বাস ছাড়ল। সে আরেকটা ভয়ের সমুদ্র জয় করে এসেছে।
তোমাকে সঠিক জিনিস শেখানোর জন্য এটা খুব ভালো জায়গা। ম্যাগাস বললেন,
অ্যামবুশ করার জায়গা।
অ্যামবুশ?
এই কেবিনগুলো শিকারিরা ব্যবহার করে। তারা এত উঁচুতে ওঠে, যাতে নিচের প্রাণীরা তাদের শরীর গন্ধ না পায়। সারা বছর ধরে শিকারিরা প্রাণীদের জন্য গাছের নিচে খাবার রেখে যায়, যাতে ওগুলো এখানে আসতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর একদিন, তারা তাদের হত্যা করে।
মেঝেতে অনেকগুলো খালি কার্তুজ পড়ে আছে।
ব্রাইডা চমকে উঠল।
নিচে তাকাও। ম্যাগাস বললেন।
ঘরের মধ্যে দুজন মানুষের জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই। ম্যাগাসের শরীর তার শরীর ঘেঁষে গেছে। সে ম্যাগাসের কথামতো নিচের দিকে তাকালো। এ গাছটা অবশ্যই লম্বা গাছগুলোর একটা, কারণ সে অন্য গাছের চূড়ো দেখতে। পাচ্ছে। এখান থেকে উপত্যকা, দিগন্তজোড়া তুষার আবৃত পাহাড়-পর্বত সবই দৃশ্যমান। অপরূপ শোভা! ম্যাগাসের বলতে হয়নি এই জায়গা থেকে লুকিয়ে কত অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায়!
ম্যাগাসের গাছ ঘরের ক্যানভ্যাস-ছাদ থেকে ক্যানভ্যাস সরিয়ে দিলেন। হঠাৎ করে গোটা গাছ-ঘর সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। বেশ ঠাণ্ডা। ব্রাইডার কাছে মনে হলো, জগতের একেবারে ওপরের দিকে জাদুকরী জায়গা আছে। তার আবেগ আবার বুনো ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল। কিন্তু সে আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইল।
তুমি যা জানতে চাও তা ব্যাখ্যা করার জন্য তোমাকে এখানে আনার কোনো দরকার ছিল না আমার। ম্যাগাস বললেন, কিন্তু এই জঙ্গল সমন্ধে যাতে আরেকটু বেশি জানতে পারে, মামি তাই চাইছিলাম। শীতকালে, যখন শিকার আর শিকারি উভয়েই অনেক দূরে থাকে, আমি এখানে এসে বসে, জগৎটাকে উপভোগ করি।
তিনি সত্যিই তার জগতের কথা ব্রাইডাকে বলতে চাইছেন। ব্রাইডার রক্তে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। শান্তিতে মন ভরে গেল। জীবনের এ রকম মুহূর্তে সম্ভবত জীবনের ওপর সব নিয়ন্ত্রণ মানুষ হারিয়ে ফেলে।
এই জগতে আমাদের সম্পর্ক পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আসে। জাদুবিদ্যার জগৎটাকে উস্কে দেয়ার অর্থই হচ্ছে, অন্য অপরিচি ও ইন্দ্রিয়ের আবিষ্কার। যৌনক্রিয়া আমাদের সেই দরজার দিকে পরিচালিত করে।
তিনি এখন আগের চেয়ে জোরে জোরে কথা বলছেন। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, একজন শিক্ষক জীববিদ্যার ক্লাস নিচ্ছেন। সম্ভবত তা পছন্দ করাই ভালো। ব্রাইডা ভাবল। যদিও এখনো সে প্রভাবিত হয়নি।
ওটা কোনো ব্যাপার নয়, তুমি প্রজ্ঞা বা আনন্দ যৌনতার শক্তির মাধ্যমে খুঁজে পাও কি না। ওটা সব সময় একটা সার্বিক অভিজ্ঞতা। কারণ ওটাই একমাত্র অভিজ্ঞতা, যেখানে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সবগুলোকে একসাথে স্পর্শ করতে হয়, অথবা স্পর্শিত হতে হয়। আমাদের সমস্ত দ্বার অন্য মানুষের দ্বারা প্রশস্ত হয়ে যায়।
অর্গাজম বা যৌনতৃপ্তির চরম মুহূর্তে, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় বিলীন হয়ে যায়। তুমি জাদুকরী জগতে প্রবেশ করো। তুমি আর দেখতে শুনতে, স্পর্শ করতে, স্বাদ নিতে অথবা গন্ধ নিতে পারো না। সেই দীর্ঘ মুহূর্তে সব কিছুই বিলীন হয়ে যায়, শুধু চরম পুলক জায়গা দখল করে নেয়। এ রকম পুলক শুধু আত্মত্যাগ আর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে আসে।
ব্রাইডার মনে হলো জিজ্ঞাসা করে, তাহলে এসব রহস্যময়তা কেন অর্গাজমের মাধ্যমে আসে না, তারপর তার মনে পড়ে গেল কোথাও না কোথাও দেবদূতেরা নেমে আসছে।
একজন মানুষকে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এ রকম পুলকের দিকে কী ধাবিত করে। যতই ইন্দ্রিয়গুলো উত্তেজিত করা হয়, ততই শক্তিশালীভাবে তা চরম পুলকের দিকে এগিয়ে যায়, অবশেষে তা লাভ করতে পারে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
অবশ্যই ব্রাইডা বুঝতে পারছিল। সে মাথা ওপর-নিচ করল। কিন্তু ওই প্রশ্ন তার আবেগকে বহুদূর নিয়ে গেল। সে আশা করছে ম্যাগাস এখনো জঙ্গলের মধ্যে তার পাশে পাশে আছে।
এই তো সব। ম্যাগাস উপসংহার টানলেন।
আমি এসব জানি। কিন্তু আমি এখনো তা করতে পারিনি। ব্রাইডা লরেন্সের নাম মুখে নেয়ার সাহস করল না। তার মনে হলো তা বিপজ্জনক হতে পারে।
আপনি আমাকে বলেছিলেন একটা উপায়ে তা অর্জন করা যায়।
ব্রাইডা বেশ নার্ভাস আর হতাশ হয়ে পড়ল। তার আবেগ আবার বুনন ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে।
ম্যাগাস আবার নিচে জঙ্গলের দিকে তাকাতে লাগলেন। ব্রাইডা বিস্মিত হলো, ম্যাগাসও তাহলে আবেগকে বশে আনতে নিজের সাথে লড়াই করছে। কিন্তু সে যা ভাবছে তা বিশ্বাস করতে তার মন চাইল না।
সূর্যের রীতিনীতির ব্যাপারে ব্রাইডা জানত। সে জানত তার শিক্ষক স্থান আর সময়ের ব্যাপারে শিক্ষা দিয়েছেন। ম্যাগাসকে খুঁজে বের করার আগে সে এসব ব্যাপারে ভেবেছে। কল্পনা করেছে, একদিন তারা খুব কাছাকাছি আসবে, যেমনটি আজ এসেছে। কেউ খুব কাছাকাছি নয়। সূর্যের রীতিনীতির শিক্ষক সব সময় এ পদ্ধতিতেই শিক্ষা দেন; সব সময় কার্যকরণের মাধ্যমে। কখনো তত্ত্ব অতটা গুরুত্ব পায়না। জঙ্গলে আসার আগে সে এসব ব্যাপারে ভেবেছে। কিন্তু যেভাবেই হোক সে এসেছে। কারণ তার পথ এখন অন্য যেকোনো কিছুর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ।
কিন্তু এখন ম্যাগাস উইক্কার মতো আচরণ করছে, শুধু কথা বলে শিক্ষা দিচ্ছে।
আমাকে শেখান। ব্রাইডা বলল।
ম্যাগাস নিচের গাছের নগ্ন বরফ আবৃত শাখা-প্রশাখার দিকে তাকালেন। এই মুহূর্তে তিনি যে একজন শিক্ষক, একজন জাদুকর তা ভুলে গেছেন। নিজেকে সাধারণ একজন মানুষের মতো মনে হচ্ছে। তিনি জানেন, তার আত্মার সঙ্গী সামনেই আছে। তিনি যে আলোকবিন্দু ওর মধ্যে দেখেছেন তা নিয়ে কথা বলতে পারেন। ব্রাইডা তাকে বিশ্বাস করবে। তাদের চক্র পূর্ণ হবে। মেয়েটি যদি কান্নায় ভেঙে পড়ে চলেও যায়, তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে। কারণ তিনি সত্যিটাই বলেছেন। মেয়েটার তাকে দরকার, যতটা তার মেয়েটাকে। আত্মার সঙ্গীর প্রজ্ঞা এমনই। তারা সব সময় একে অন্যকে চিনে নিতে পারে।
কিন্তু তিনি একজন শিক্ষক। একদিন স্পেনের এক গ্রামে বসে তিনি শপথ নিয়েছিলেন, কোন শিক্ষকই অন্য মানুষকে পছন্দ করে বেছে নেয়ার ব্যাপারে, জোর করতে পারবে না। তিনি একবার সে ভুল করেছেন, কারণ তিনি জীবনের এই বছরগুলো জগৎ থেকে দূরে থেকেছেন। এখন ব্যাপারটা ভিন্ন, কিন্তু তিনি এখনো সেই ঝুঁকি নিতে পারেন না। এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন, ওর জন্য আমি জাদুবিদ্যা ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন, কত বোকার মতো ভাবনা সেটা। ভালোবাসার এ রকম কোনো কিছুর দরকার হয় না। প্রকৃত ভালোবাসা প্রতিটি মানুষকে তাদের নিজের পথ বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়, কারণ তা জানে তারা কখনো তাদের আত্মার সঙ্গীর সংস্পর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।
তাকে অবশ্যই ধৈর্যধারণ করতে হবে। সেই রাখাল বালকের ধৈর্যের কথা মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ হোক কাল হোক, তারা এক হবে। এটাই নিয়ম। তিনি সারা জীবন আইনের প্রতি আস্থা রেখেছেন।
তুমি আমাকে যা জিজ্ঞাসা করেছ, তা খুবই সাধারণ ব্যাপার। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন। তিনি আবেগকে প্রাধান্য দিলেন। নিয়মানুবর্তিতা এড়ালেন না।
তুমি যখন অন্য আরেকজনকে স্পর্শ করবে, তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাজ করছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবে। কারণ যৌনতার নিজস্ব জীবন রয়েছে। যে মুহূর্তে শুরু করবে, তুমি আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। যৌনতা তোমার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। সেই সাথে তোমার ভয়, তোমার আকাঙ্ক্ষা, তোমার অনুভূতি বজায় থাকবে। মানুষজন এ কারণেই নপুংসক হয়। তুমি যখন যৌনতায় উপনীত হবে, বিছানায় শুধু ভালোবাসা আর তোমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিয়ে যাবে। শুধু তখনই তুমি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।
ব্রাইডা মেঝের কার্তুজের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মুহূর্তে তার অনুভূতির সাথে প্রতারণা করতে পারছে না সে। এখন কৌশলটা জানতে পেরেছে। তার আগ্রহের জায়গাটা বুঝতে পেরেছে।
আমি শুধু তোমাকে এটুকু শিক্ষা দিতে পারি।
ব্রাইডা নড়াচড়া করল না। বুনো ঘোড়া নীরবতার মাঝে পোষ মানবে।
সাতবার গভীরভাবে শ্বাস নাও। শারীরিক সংস্পর্শে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হও সবগুলো ইন্দ্রিয় সাড়া দিচ্ছে কিনা তোমার। তারপর সব কিছু তাদের পথে এগোতে দাও।
তিনি সূর্যের রীতিনীতির একজন শিক্ষক। তাকে এখন আরেকটা পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার আত্মার সঙ্গীও তাকে শিক্ষা দিচ্ছে।
ঠিক আছে। আমি এই উচ্চতা থেকে তোমাকে নিচের দৃশ্য দেখিয়েছি। আমরা এখন নিচে যেতে পারি।
.
২২.
ব্রাইডা বসে বসে স্কয়ারে বাচ্চাদের খেলা দেখছিল। কেউ একজন একবার তাকে বলেছিল, প্রত্যেক শহরেই একটা জাদুকরী জায়গা থাকে। সেই জায়গায় গিয়ে আমরা আমাদের জীবন নিয়ে ভাবতে পারি। ডাবলিনের এই স্কয়ার তার জন্য সেই জাদুকরী জায়গা। জায়গাটা তার ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে খুব কাছে। এই শহরে, স্বপ্ন আর আশা নিয়ে এসে এই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিল। পরিকল্পনা ছিল ট্রিনিটি কলেজের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। এমনকি সাহিত্যের প্রফেসরও হতে চেয়েছিল সে। এই বেঞ্চে বসে অনেক সময় কাটিয়েছে, কবিতা লিখেছে। যেভাবে সাহিত্যের মহারথীরা আচরণ করে, সেভাবে আচরণ করার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু বাবা তাকে যে টাকা পাঠাত তা যথেষ্ট ছিল না। নিজের প্রয়োজন মেটাতে একটা আমদানি-রপ্তানি কম্পানিতে চাকরি নেয়। এখনো সেখানে চাকরি করছে। এ রকম কাজে সে কিছু মনে করে না। সে যে কাজ করছে, তাতেই খুশি। প্রকৃতপক্ষে এই চাকরিটা তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারণ চাকরিতে ঢুকে সব কিছুর বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে। তাকে উন্মত্ত হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এ চাকরিটাই তার কাছে দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
বাচ্চারা খেলা করছে। তার মতোই এসব বাচ্চাও পরী আর ডাইনির গল্প শুনেছে। ডাইনিদের সারা শরীর কালো পোশাকে ঢাকা থাকা থাকে। জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া তরুণী মেয়েদের বিষাক্ত আপেল খেতে বলে। এই বাচ্চাদের মধ্যে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, একজন জীবিত ডাইনি বসে বসে এখন তাদের খেলা দেখছে।
সেই সন্ধ্যায়, উইক্কা তাকে চাঁদের রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কিছু কাজ করতে বলেছিল। যারা দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতুবন্ধ রাখতে চায়, তাদের জন্যই এ কাজগুলো জরুরি।
বেশ সহজ কাজ। তাকে চিৎ হয়ে শুয়ে, শহরের একটা বড় শপিং এরিয়ার কথা কল্পনা করতে হবে। তারপর নির্দিষ্ট একটা দোকানের জানালার দিকে মনোযোগ দিতে হবে তাকে। জানালার মধ্য দিয়ে ভেতরের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যাপার দেখতে হবে। জিনিসগুলো কোথায় আছে, এগুলোর কত দাম এসব দেখতে হবে।
ব্রাইডা এই দর্শনকল্প শেষ করলে, তাকে রাস্তায় গিয়ে দেখতে হবে সে ঠিক পথে আছে কি না।
এখন ব্রাইড স্কয়ারে বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। এইমাত্র শপিংমলের কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে এলো। যে রকমটি কল্পনা করেছিল, দোকানের জানালাটা ঠিক ও রকম ছিল। সে বিস্মিত সাধারণ মানুষও এভাবে কল্পনায়, দেখতে পায় কি না, নাকি এটা তার কয়েক মাসের প্রশিক্ষণের ফল। কখনো তা জানতে পারবে না সে।
কিন্তু তার কল্পনার শপিংমলের রাস্তাটা তার জাদুকরী জায়গা থেকে খুব কাছে। কোনো কিছু দৈবাত ঘটে না। ব্রাইডা ভাবল। তার হৃদয় এ রকম একটা সমস্যায় পড়েছে, যা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। ভালোবাসা। সে লরেন্সকে ভালোবাসে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে জানে চাঁদের রীতিনীতিতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেলে লরেন্সের বাম কাঁধের ওপর আলোকবিন্দু দেখতে পাবে। একদিন সন্ধ্যায়, তারা ক্যাফেতে হট চকোলেট কফি খেতে গিয়েছিল। এই ক্যাফেটা জেমস জয়েসের ইউলিসিসের অনুকরণে তৈরি টাওয়ারের পাশে, সেখানে লরেন্সের চোখে সেই আলো দেখেছিল সে।
ম্যাগাসের কথাই ঠিক। সূর্যের রীতিনীতি পুরুষ মানুষের পথ। যারা প্রার্থনা করতে জানে, জানে ধৈর্য ধরতে, তাদের এ ব্যাপারে শিক্ষা দেয়া হয়। যতই ব্রাইডা চাঁদের রীতিনীতির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, ততই সূর্যের রীতিনীতিকে বুঝতে পেরে প্রশংসা করছে।
জাদুকর ম্যাগাস! ব্রাইডা আবার ম্যাগাসের ব্যাপারে ভাবতে লাগল। এ সমস্যাই তাকে জাদুকরী জায়গায় নিয়ে এসেছে। শিকারি কেবিনে সময় কাটানোর পর থেকে সে প্রায়ই ম্যাগাসের কথা ভেবেছে। সে কী শিখেছে তা বলার জন্য এখনই সে জঙ্গলে ম্যাগাসের কাছে যেতে পারে। কিন্তু সে জানে, তা ভানে পর্যবসিত হবে। সে সত্যিই ম্যাগাসের কাছে যেতে চায়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে তার সাথে আবার হাঁটতে চায়। ব্রাইডা নিশ্চিত, তাকে দেখলে ম্যাগাস খুশি হবেন। আর সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, কোনো রহস্যময় কারণে, যে ব্যাপারে সে ভাবতেও সাহস করে না, তিনিও তার সঙ্গ পছন্দ করেন।
আমার কল্পনা অনেক বেশি বিস্তৃত। ব্রাইডা ভাবল। ম্যাগাসের চিন্তা মাথা থেকে দূর করতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে জানে, খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে।
ম্যাগাসের ব্যাপারে ভাবতে চায় না ব্রাইডা। কিন্তু সে মেয়ে। আর প্রেমে পড়ার উপসর্গগুলোর সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত, যতই তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন। সে লরেন্সকে ভালোবাসে। তার সাথেই জীবন কাটাতে চায়। ব্রাইডার জগৎ আগের চেয়ে অনেক বেশি বদলে গেছে।
.
২৩.
এক রবিবার সন্ধ্যায় লরেন্স ফোন করল।
চলো, খাড়ির দিক থেকে হেঁটে আসি। বলল সে।
ব্রাইডা পথে খাওয়ার জন্য খাবার বানিয়ে নিয়েছে। তারা বেশ গরম একটা বাসের মধ্যে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ করল। মধ্যদুপুরে গ্রামে গিয়ে পৌঁছাল।
ব্রাইডা বেশ উত্তেজনা বোধ করছে। সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে। ফাস্ট ইয়ারে, সে একজন কবির কথা পড়েছিল, যিনি এখানে বাস করতেন। তিনি বেশ রহস্যময় মানুষ ছিলেন। তিনি চাঁদের রীতিনীতির ব্যাপারে অনেক কিছু জানতেন। তিনি গোপন সংঘের একজন সদস্য ছিলেন। যারা আধ্যাত্মিক পথ খোঁজে, তাদের জন্য তার বইয়ে অনেক গোপন তথ্য লিখে রেখে গেছেন।
তিনি ডব্লিউ বি ইয়েটস।
ব্রাইডার তার সমন্ধে দুটো লাইন মনে পড়ে গেল।
তোমার পদতলে রেখেছি স্বপ্নের খামার
সাবধানে খরচ করো, বেচছ স্বপ্ন আমার।
তারা গ্রামের একমাত্র বারে গেল। ঠাণ্ডা এড়াতে হুইস্কি পান করল। তারপর বেরিয়ে এলো। ছোট্ট টারমাকের রাস্তা ওপরের দিকে উঠে গেছে। আধা ঘণ্টা পর তারা সেখানে পৌঁছাল, স্থানীয় লোকজন যাকে দ্য ক্লিফ বা খাড়ি নাম দিয়েছে। সাগরের তীর ঘেঁষে চলে গেছে। যাওয়ার মতো একটা পথ আছে। অলস ভাবে হেঁটে গেলে তারা চার ঘণ্টার কম সময়ে বেড়ানো সেরে আবার ডাবলিনের ফেরার বাস ধরতে পারবে।
ব্রাইডা বেশ খুশি। এসবের জন্য তার আবেগী জীবনকে মুলতবি রেখেছিল। শীতটা কাটাতে তার সব সময় কষ্ট হতো। সেই সময় সারা দিন ইউনিভার্সিটিতে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসত। সপ্তাহান্তে সিনেমা দেখতে যেত।
উইক্কা যেসব উপাসনা আর নৃত্যগীতি শিখিয়েছে, সেগুলো মনোযোগ দিয়ে করেছে। কিন্তু বাইরের জগতে বের হয়ে প্রকৃতিকে দেখার সময় হয়নি।
ওপরে মেঘ খুব নিচ দিয়ে চলেছে। শারীরিক দুর্বলতা আর ঠাণ্ডা কাটতে সাহায্য করছে হুইস্কি। পাশাপাশি চলার জন্য পথটা অনেক সরু, লরেন্স তাই এগিয়ে চলেছে। ব্রাইডা একটু পেছনে থেকে তাকে অনুসরণ করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কথা বলা কঠিন। তার পরও তারা দু-একটা বাক্য বিনিময় করে নিজেদের আনন্দের জানান দিচ্ছে, প্রকৃতির শোভা উপভোগ করছে।
শিশুদের মতো আনন্দে ব্রাইডা চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগল। হাজার হাজার বছর ধরে নিশ্চয় এই প্রাকৃতিক শোভা একই রকম ছিল। সেই যুগে যখন কোনো শহর ছিল না, হ্রদ ছিল না, কোনো কবি ছিল না, কোনো তরুণী চাঁদের রীতিনীতি খুঁজে ফিরত না। শুধু পাহাড় ছিল, পাথর ছিল, ছিল আছড়ে পড়া ঢেউ। নিচু মেঘদলের সাথে সি-গাল উড়ে বেড়াত। ব্রাইডার মাথা ঘুরতে লাগল। সাগর কী বলতে চাইছে তা সে বুঝতে পারছে না। সি-গালদের নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় উড়ে যাওয়া অনুসরণ করতে পারছে না। সে যেন এখনো আদিম যুগের সেই জগটাকে দেখছে। তার পড়া কোনো বইয়ে বা কোনো আচার-অনুষ্ঠানের সাথে যার কোনো মিল নেই। তারা হৃদের দিক থেকে সরে এলে, সব কিছুই ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে গুরুত্ব হারাতে থাকে তার স্বপ্ন, তার দৈনন্দিন জীবন, তার অনুসন্ধান। শুধু উইক্কার ভাষ্য মতে, ঈশ্বরের স্বাক্ষর বা গড়স সিগনেচারই আছে।
প্রকৃতির শক্তিই শুধু এই মুহূর্তে তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। সে এই অপূর্ব প্রকৃতির মধ্যে বেঁচে আছে। যাকে ভালোবাসে সে তার পাশে, আর কী চাই!
আরো ঘন্টা দুই হাঁটার পরে পথটা আরো প্রশ্বস্ত হয়ে এলো। বিশ্রাম নেয়ার জন্য একটু বসার সিদ্ধান্ত নিল ওরা। তবে খুব বেশি সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারবে না, তাতে ঠাণ্ডা আরো জাঁকিয়ে বসবে। তাদের এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ব্রাইডার মনে হলো অন্তত আরো কয়েকটা মিনিট লরেন্সের পাশে থাকা দরকার। আকাশের মেঘের দিকে তাকালো সে। সমুদ্রের গর্জন শুনতে লাগল।
ব্রাইডা সাগরের বাতাসের গন্ধ পাচ্ছে। মুখে লবণাক্ত একটা স্বাদ। মুখটা লরেন্সের জ্যাকেটের মধ্যে লুকিয়ে উষ্ণ করে নিল। সেই মহান মুহূর্তটি এসেছে। তার পঞ্চ ইন্দ্রিয় একত্রে কাজ করতে শুরু করেছে।
হ্যাঁ, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাজ করতে শুরু করেছে!
সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে, ম্যাগাসের চিন্তা তার মনের মধ্যে ঢুকে আবার অন্তর্হিত হলো। এখন শুধু তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দিকে মনোযোগ দেবে। এগুলোকে অবশ্যই কাজে রাখতে হবে। এই তো সেই মুহূর্ত!
তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার, লরেন্স।
লরেন্স বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। কিন্তু তার হৃদয় কম্পিত। যতই সে আকাশের মেঘ নিচের প্রকৃতির দিকে মনোযোগী হোক না কেন, বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে তার পাশে বসা এই মেয়েটিই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এত আনন্দের ব্যাখ্যা, এ মেয়েটিই। এই পাথরগুলোর অস্তিত্ব, এই আকাশ, এই শীত, সব কিছুর অস্তিত্বও ওই মেয়েটির কারণে। যদি মেয়েটি তার পাশে না থাকত, স্বর্গের অপ্সরীরা নিচে নেমে এসে তাকে আনন্দদানের চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হতো না- ও না থাকলে স্বর্গের কোনো অর্থই থাকে না!
আমি তোমাকে ভালোবাসি। ব্রাইডা নরম স্বরে বলল, কারণ, তুমি আমাকে ভালোবাসার আনন্দ দেখিয়েছ।
ব্রাইডার নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষ বলে মনে হতে লাগল। যেন সে গোটা প্রকৃতিকে আকণ্ঠ পান করেছে।
লরেন্স ব্রাইডার চুলে হাত বুলিয়ে দিল।
ব্রাইডা নিশ্চিত, একটু ঝুঁকি নিলেই সে ভালোবাসার এ রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে, যা আগে কখনো করেনি।
ব্রাইডা লরেন্সকে চুম্বন করল। সে লরেন্সের মুখের স্বাদ পেল, জিহ্বার স্পর্শ পেল। প্রতিটি নড়াচড়ার ব্যাপারে সে সচেতন। বুঝতে পারল, লরেন্সও একই রকম অনুভূতি উপভোগ করছে। কারণ সূর্যের রীতিনীতি সব সময় তাদের কাছেই নিজেকে উন্মোচিত করে, যারা প্রথমেই জগতে নিজেদের সঁপে দেয়।
আমি এখানেই তোমাকে ভালোবাসতে চাই, লরেন্স।
কয়েকটা ভাবনা মুহূর্তে লরেন্সের মনে খেলে গেল। তারা এখন পাবলিক ফুটপাথে আছে। যে কেউ যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে। অন্যরাও হয়তো এই মধ্য শীতে এখানে আসার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, যে কেউ বুঝতে পারবে, এ রকম মুহূর্তে, এ রকম শক্তিকে কখনো বাধা দিতে নেই।
লরেন্স ব্রাইডার সোয়েটারের মধ্যে হাত পুরে দিল। পীনোন্নত স্তনে চাপ দিতে লাগল। ব্রাইডা নিজেকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে আছে। জগতের শক্তি তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে উসকে দিচ্ছে। শক্তির রূপান্তর এবং প্রবাহ ঘটছে। তারা পাথরের ওপর শুয়ে পড়ল। নিচে সাগর। মাথার ওপর সি-গাল উড়ছে। নিচে পাথর সরে গিয়ে যেকোনো মু র দুয়ারে চলে যেতে পারে। বাধাহীন বেপরোয়াভাবে একে অন্যের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে তারা, যৌনক্রীড়ায় মত্ত হয়ে ওঠে, কারণ তারা জানে, ঈশ্বর নিষ্পাপদের রক্ষা করেন।
তারা আর কোনো শীত বোধ করছে না। তাদের রক্তপ্রবাহ এত বেড়ে গেছে যে গরম লাগতে শুরু করেছে। ব্রাইডা তার শরীরের কয়েকটা পোশাক– টেনে ছিঁড়ে ফেলল। লরেন্সও তাই করল। আর কোনো ব্যথা-বেদনা নেই। হাঁটু এবং পশ্চাৎদেশ পাথুরে জমিনে চাপ দিলেও কোনো ব্যথা পাচ্ছিল না। সেগুলোও যেন তাদের আনন্দের অংশ হয়ে তৃপ্তিকে পরিপূর্ণ করছে। ব্রাইডা জানে সে অর্গাজম বা চরম পুলকের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু এখনো অনেকখানি দূরাগত অনুভূতি। কারণ সে পুরোপুরি জগতের সাথে যুক্ত। তার শরীর আর লরেন্সের শরীর সাগর আর পাথরের মাঝামাঝি। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে। এ অবস্থায় যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণ থাকার চেষ্টা করতে লাগল, তার শরীরের কিছু অংশ কী করছে, সে ব্যাপারে সচেতন, যেমনটি আগে কখনো হয়নি। তার অনুভূতিতে ব্যাপক আলোড়ন তুলে, নিজেকে ফিরে পাওয়া আর জগতের মানে বোঝর অবস্থায় নিয়ে এলো। স্বর্গ উদ্যানে ফিরে যাওয়ার মতো অনুভূতি। এ রকম মুহূর্তেই হাওয়া আদমের শরীরের মধ্যে প্রথিত হয়েছিলেন। আর দুয়ে মিলে সৃষ্টি শুরু হলো।
শেষ পর্যন্ত, ব্রাইডার জগতের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ রইল না। তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে মুক্ত মনে হলো। তাদের ধরে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তি তার নেই। এই জগৎ, সি-গাল, লবণাক্ত স্বাদ, পাথুরে কঠোর জমিন, সমুদ্রের গন্ধ, মেঘরাজি সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সেখানে শুধু উজ্জ্বল বিস্তৃত সোনালি আলোকরাজি, যা বাড়তে বাড়তে মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে ছুঁয়ে ফেলল।
ব্রাইডা ধীরে ধীরে ওই অবস্থা থেকে ফিরে আসতে লাগল। সমুদ্র আর মেঘমালা দৃশ্যমান হলো। কিন্তু সব কিছুই যেন এক অমোঘ শান্তির দ্বারা পরিপূর্ণ। জগতের শান্তি এভাবেই পরিপূর্ণতা পায়। মুহূর্তের ব্যাপার হলেও অনুভূতিটা ভিন্ন। সে আরেকটা সেতুর সন্ধান পেয়েছে, যা দৃশ্যমান জগতের সাথে অদৃশ্যমান জগৎকে যুক্ত করে। কখনো এ পথকে আর ভুলে যাবে না।
.
২৪.
পরদিন ব্রাইডা উইক্কাকে ফোন করল। কী ঘটেছে বলল। মুহূর্তের জন্য, উইক্কা কিছুই বলল না।
অভিনন্দন। অবশেষে বলল সে, তুমি তা করতে পেরেছ। ব্রাইডা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল। যৌনতার শক্তি ব্রাইডার দেখার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছে। জগতের অভিজ্ঞতা বদলে গেছে।
তুমি এখন ইকুনক্সের বসন্ত উৎসব পালন করার জন্য তৈরি। শুধু আরেকটা জিনিস বাকি আছে।
আরেকটা জিনিস? কিন্তু আপনি বলেছিলেন এটাই তাই!
ব্যাপারটা খুব সহজ। তুমি সাধারণভাবেই একটা পোশাকের স্বপ্ন দেখ, সেদিন তুমি যে পোশাকটা পরবে।
আর আমি তা না পারলে কী হবে।
তুমি পারবে। তুমি সবচেয়ে কঠিন অংশটাই করতে পেরেছ।
তারপর উইক্কা প্রসঙ্গ বদলে ফেলল। ব্রাইডাকে বলল, সে একটা নতুন গাড়ি কিনেছে। তার কিছু কেনাকাটা করা দরকার। ব্রাইডা কি তার সাথে আসতে পারবে?
ব্রাইডা এ রকম আমন্ত্রণে গর্বিত। বসকে একটু আগে ছুটি দেয়ার জন্য অনুরোধ করবে। এই প্রথমবার উইক্কা তার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে। যদিও তা শুধু শপিংয়ে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ মাত্র। সে জানে অনেক ছাত্রছাত্রী শুধু উইক্কার জুতো বহন করতে পারলেই খুশি হবে।
সম্ভবত সেই সন্ধ্যায় ব্রাইডা উইক্কাকে দেখানোর সুযোগ পাবে সে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, আর কত গভীরভাবে সে উইক্কার বন্ধু হতে চায়। আধ্যাত্মিক খোঁজ থেকে ব্রাইডার বন্ধুত্বকে আলাদা করা বেশ কঠিন। সে কিছুটা আহত হয়েছে, কারণ এখনো পর্যন্ত তার শিক্ষক তার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তাদের কথোপকথন কখনো চাঁদের রীতিনীতি জানার ব্যাপারগুলো ছাপিয়ে অন্য কোনো দিকে মোড় নেয়নি।
নির্দিষ্ট সময়ে, উইক্কা একটা লাল রঙের কনভারটিবল গাড়ির পাশে অপেক্ষা করছিল। ব্রিটিশ ক্লাসিক গাড়িটা বেশ সোবর। বডি এবং পালিশ করা কাঠের ড্যাশবোর্ড চকচক করছে। এটা কত দামি হতে পারে ব্রাইডা তা চিন্তা করতেও ভয় পায়। একজন ডাইনি এ রকম দামি গাড়ির মালিক হতে পারে দেখে সে একটু ঘাবড়ে গেল। চাঁদের রীতিনীতির ব্যাপারে কোনো কিছু জানার আগে, সে শৈশব থেকে ডাইনির ব্যাপারে নানা প্রচলিত কথা শুনে এসেছে। ডাইনিরা শয়তানের সাহায্যে অর্থবিত্ত এবং অফুরন্ত শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে।
ছাদ খুলে গাড়ি চালালে ঠাণ্ডা লেগে যাবে, তাই না? ব্রাইডা গাড়ির ভেতরে চড়তে চড়তে জিজ্ঞাসা করল।
আমি গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না। উইক্কা বলল, এমন একটা গাড়ির জন্য আমি বহু বছর অপেক্ষা করে আছি।
ভালো কথা। অন্ততপক্ষে, এই দিক দিয়ে, উইক্কা যেকোনো সাধারণ মানুষের মতো।
তারা রাস্তা দিয়ে চালাতে লাগল। পথিকরা বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকাতে লাগল। কয়েকজন শিস বাজাল। পুরুষরা প্রশংসা করল।
পোশাকের স্বপ্নের ব্যাপারে চিন্তা করে যে তুমি সময় পার করোনি, সেটা খুব ভালো লক্ষণ। উইক্কা বলল। ব্রাইডা এরই মধ্যে তাদের ফোনের কথোপকথন ভুলে বসেছে।
সন্দেহ করা কখনো বন্ধ করবে না। তাহলে তুমি সামনের দিকে এখোনো থেকে পিছিয়ে আসবে। সেই সময়ে, ঈশ্বর এগিয়ে যাবে। তোমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে নেবে। কারণ পছন্দের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার এটাই ঈশ্বরের পন্থা। শেষ পর্যন্ত সব সময় নির্ধারিত পথেই গন্তব্য শেষ হবে। যদি কোনো কারণে আমরা বন্ধ করে দিই, জটিলতা বা অলসতার কারণে অথবা ভুল বিশ্বাসে, যা আমরা যথেষ্ট জানি, তখন তিনি জোর দেন।
অন্যদিকে তোমাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, কোনো সন্দেহ যেন তোমাকে অবশ না করে ফেলে। সব সময় তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিজে নেবে। এমনকি যদি তুমি সঠিক পথের ব্যাপারে নিশ্চিত না থাকো, তবুও। কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে, তুমি কখনো ভুল পথে যেতে পারবে না। একটা প্রাচীন জার্মান প্রবাদ আছে, যা চাঁদের রীতিনীতিতে বদলে নেয়া হয়েছে। শয়তানের সারমর্ম। প্রবাদটাকে স্মরণ রেখো। তাহলে তুমি সব সময় একটা ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক সিন্ধান্তে পরিণত করতে পারবে।
উইক্কা হঠাৎ করে একটা গ্যারেজের পাশে গাড়ি দাঁড় করাল।
এই প্রবাদের সাথে একটা কুসংস্কারও জড়িত আছে। উইক্কা বলল, আমাদের যখন দরকার হয়, তখনই সেই সাহায্য আসে। আমি কেবল এই গাড়িটা কিনেছি আর শয়তান কাজ শুরু করেছে।
মেকানিক উইক্কার কাছে এলে সে বেরিয়ে এলো।
গাড়ির হুডটা কি ভেঙে গেছে, ম্যাডাম?
উইক্কা উত্তর দিল না। সে মেকানিককে গাড়িটা আগাগোড়া পরীক্ষা করে দেখতে বলল। মেকানিকের কাজের ফাঁকে তারা দুজন রাস্তার ওপাশে গিয়ে ক্যাফেতে বসে হট চকোলেট খেল।
মেকানিক কী করছে লক্ষ করো। উইক্কা গ্যারেজের দিকে তাকিয়ে বলল।
মেকানিক গাড়ির হুড ওপরে তুলে দিয়েছে। গাড়ির ইঞ্জিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমনকি সামান্য নড়াচড়াও করছে না।
মেকানিক কোনো কিছু স্পর্শ করছে না। সে শুধু দেখছে। সে বছরের পর বছর ধরে এ কাজ করছে। সে জানে গাড়ি তার সাথে একটা বিশেষ ভাষায় কথা বলে। এ কারণে সে কাজ করছে না। কাজ করছে তার সহজাত বোধ
হঠাৎ করে মেকানিক সরাসরি ইঞ্জিনের একটা নির্দিষ্ট পার্টসে হাত দিয়ে টেনে বের করে আনল।
সে ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে। উইক্কা বলে চলল, সে এক মুহূর্তও নষ্ট করেনি। কারণ তার এবং গাড়ির মধ্যে একটা অপূর্ব সন্ধি হয়েছে। আমি যেসব মেকানিককে চিনি তাদের মাঝে সব ভালো মেকানিক, একইভাবে কাজ করে।
আমিও অনেক মেকানিককে চিনি। ব্রাইডা বলল। কিন্তু তার সব সময় ধারণা ছিল তারা ও রকম আচরণ করে, কারণ তারা জানে না কোথা থেকে শুরু করতে হবে। সে কখনো লক্ষ করে দেখেনি তারা সব সময় ঠিক জায়গা দিয়েই শুরু করে।
তাদের জীবনে যদি সূর্যের রীতিনীতির প্রজ্ঞা থাকত, তাহলে তারা কেন জগতের মৌলিক প্রশ্নের ব্যাপারে বোঝার চেষ্টা করত না? কেন গাড়ি মেরামত বা বারে কফি সার্ভ করার মতো কাজ করত?।
তুমি কি ভাবছ, আমরা, আমাদের পথ আর আমাদের দৃঢ় ইচ্ছা, জগতে অন্য সব মানুষের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে?
আমার অনেক ছাত্র আছে। তারা সবাই খুব সাধারণ মানুষ। দুঃখের সিনেমা দেখে কাঁদে। বাচ্চারা দেরিতে বাড়ি এলে চিন্তিত হয়ে পড়ে, যদিও তারা জানে মৃত্যুই জীবনের শেষ নয়। ডাইনিবিদ্যা সবোর্ড প্রজ্ঞার কাছাকাছি যাওয়ার একটা পথ। কিন্তু তুমি যা কিছু করো, তা তোমাকে ওখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে, যতক্ষণ তুমি হৃদয়ে ভালোবাসা রেখে কাজ করবে। আমরা ডাইনিরা জগতের আত্মাদের সাথে কথোপকথন চালাতে পারি। আমরা আমাদের আত্মার সঙ্গীদের বাম কাঁধে আলোকবিন্দু দেখতে পাই। মোমবাতির ঔজ্জ্বল্য ও নীরবতার মধ্যে আমরা অসীমতা খুঁজে পাই। কিন্তু আমরা গাড়ির ইঞ্জিনের ব্যাপার বুঝতে পারি না। মেকানিকদের আমাদের যে রকম দরকার, তাদেরও আমাদের দরকার। তারা তাদের অদৃশ্য জগতের সেতু একটা গাড়ির ইঞ্জিনের মাধ্যমে খুঁজে পায়। আমরা যে রকমটি চাঁদের রীতিনীতিতে পেয়ে থাকি। কিন্তু সেতু একইভাবে অদৃশ্যমান জগতের সাথে যোগাযোগ করে।
তোমার অংশের কাজ তুমি করে যাও। অন্যরা কী ভাবল তা নিয়ে চিন্তা করো না। বিশ্বাস করো, ঈশ্বর তাদের সাথেও কথা বলেন। তুমি যে রকম জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য ব্যস্ত, তারাও তেমনি।
গাড়ি ঠিক আছে। মেকানিক বলল। তারা গ্যারেজে ফিরে এসেছে। একটা হোজ খুলে গিয়েছিল, যা আরেকটু হলে বিস্ফোরিত হতো। তাতে আপনাদের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারত।
উইক্কা দরদাম নিয়ে কিছু কথা বলল। কিন্তু সে বেশ খুশি, তার প্রবাদটা মনে পড়েছে।
.
২৫.
ডাবলিনের একটা বড় শপিং স্ট্রিট। ব্রাইডা অনুশীলনের অংশ হিসেবে একবার এখানকার দৃশ্য মানশ্চক্ষে অবলোকন করেছিল। যখনই কথোপকথন ব্যক্তিগত বিষয়ে মোড় নিয়েছে, উইক্কা খুব একটা সাড়া দেয়নি। কিন্তু কেনাকেটার ব্যাপারগুলোতে খুব আগ্রহের সাথে কথা বলছে। দরদাম, কাপড়ের ধরনের, দোকান সহকারি রূঢ় ব্যবহার এসব নিয়ে বলছে। সেই সন্ধ্যায় উইক্কা যা কিছু কিনেছে সব কিছুতেই একটা আভিজাত্য এবং সুরুচির পরিচয় আছে।
ব্রাইডা জানে, টাকা কোথা থেকে পেয়েছে, তা জিজ্ঞাসা করা যায় না। কিন্তু তার কৌতূহল এত তীব্র যে সে বিনয়ের সকল নিয়ম-কানুন ভেঙে আরেকটু হলে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিল।
তারা একটা জাপানি রেস্টুরেন্টে এসে থামল। জাপানিজ ফুড শাশামি ডিসের অর্ডার দিল।
ঈশ্বর আমাদের খাবারে মঙ্গল করুন। উইক্কা বলল, আমরা সবাই অপরিচিত সাগরের নাবিক। তিনি আমাদের এই রহস্যময়তা গ্রহণ করার শক্তি দিন।
কিন্তু আপনি চাঁদের রীতিনীতির একজন শিক্ষক। ব্রাইডা বলল, আপনি এর রহস্য জানেন।
উইক্কা মুহূর্তের জন্য বসে রইল। খাবারের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, কীভাবে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে ভ্রমণ করতে হয় তা আমি জানি। আমি আত্মার জগৎ সমন্ধে জানি। আমি এসব শক্তির সাথে এমনভাবে মোগাযোগ করি, সেগুলোকে বিস্ময়করভাবে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা নেই। আমি হয়ত এভাবে বলতে পারি, আমি নীরব জ্ঞানকে ধারণ করে মানুষের যাত্রাকে এ পথে নিয়ে আসি।
কিন্তু আমি এসব জানি, কারণ আমি শিক্ষক। আরো জানি যে, আমরা আমাদের অস্তিত্বের প্রকৃত কারণ কখনো জানতে পারব না। আমরা সম্ভবত কীভাবে, কখন, কোথায় এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারি, কিন্তু কেন এ প্রশ্নের উত্তর সব সময় নিরুত্তর থেকে যাবে। জগতের এই স্থাপত্যের প্রধান লক্ষ্যই হলো ঈশ্বরকে একাকী জানা। আর কিছু নয়।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটল।
ঠিক এখন, আমরা যখন খাচ্ছি, ৯৯ শতাংশ মানুষ তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে মরছে, আমরা এখানে কেন? অনেকেই মনে করে, তারা ধর্মের মধ্যে অথবা বস্তুবাদিতায় এ উত্তর খুঁজে পাবে। অন্যরা আশা করে তাদের জীবনে অর্থই হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেবে। কতিপয় মানুষ প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার চেষ্টা না করে মুহূর্তের জন্য বাঁচে। তাতে ফলাফল যা-ই আসুক না কেন।
শুধু সাহসীরা আর যারা সূর্য এবং চাঁদের রীতিনীতি বুঝতে পারে, তারা জানে একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে, আমি জানি না।
প্রথমে ব্যাপারটাকে ভীতিকর মনে হতে পারে। জগতে আমাদের এভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, আমাদের অস্তিত্বের জন্য নিজের অনুভূতিগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। প্রাথমিক ভয়টা কেটে গেলে, আমরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, একমাত্র সমাধান হলো আমাদের স্বপ্নকে অনুসরণ করা। এ রকম পদক্ষেপ নেয়ার সাহসের জন্য আমাদের সব সময় ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।
যত তাড়াতাড়ি আমরা তা গ্রহণ করতে পারব, জীবন অর্থ খুঁজে পাবে। একই ধরনের আবেগের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় একজন কুমারীকে। একদিন অপরাহে তার সাধারণ জীবন যাপনে হঠাৎ একজন অপরিচিত পুরুষ তার কাছে আসে, আবেদন করে, শব্দের অনুসারী হও। কুমারী সায় দেয়। কারণ সে বুঝতে পারে মানুষের সবচেয়ে মহৎ আচরণটি হলো রহস্যময়তাকে গ্রহণ করা।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর উইক্কা আবার ছুরি কাঁটাচামচ তুলে নিয়ে খেতে শুরু করল। ব্রাইডা উইক্কার দিকে তাকালো। উইক্কার পাশে থাকার জন্য গর্বিত হলো মনে মনে। সে এখন উইক্কাকে প্রশ্ন করে বিরক্ত করবে না, জানতে চাইবে না উইক্কা এত টাকা কীভাবে উপার্জন করে। অথবা উইক্কা কাউকে ভালোবাসে কি না, কাউকে ঈর্ষা করে কি না। ব্রাইডা আত্মার মহত্ত্ব নিয়ে ভাবতে লাগল। কিছু মানুষ সারাটা জীবন এ রকম একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কাটিয়ে দেয়, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কোনো কিছু না থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ উত্তর আবিষ্কারের লোভ সামলাতে পারে না। পরিবর্তে, তারা এমন একটি জগতের অবতারণা করে, যা তারা কখনো বুঝে উঠতে পারে না। তারা শুধু একটা উপায়ে সত্যিকারের সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে, নিজেদের আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করে, যা তাদের নিজস্ব স্বপ্ন। এভাবেই মানুষ ঈশ্বরের ক্রীড়নকে পরিণত হয়।
তাহলে উত্তর খোঁজার কারণ কী থাকতে পারে?
আমরা কখনো উত্তর খুঁজি না। আমরা স্বীকার করে নিই। তাতে জীবন আরো সুন্দর, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কারণ আমরা প্রতিটি মুহূর্তকে বুঝতে পারি। আমাদের নেয়া প্রতিটি পদক্ষেপের একটা অর্থ থাকে। আমরা বুঝতে পারি। কোথাও না কোথাও সময় এবং স্থান সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর আছে। আমরা বুঝতে পারি আমাদের পৃথিবীতে আসার কোনো একটা কারণ রয়েছে। আর আমাদের জন্য তাই যথেষ্ট।
আমরা অন্ধকারে, রাত্রিতে বিশ্বাস রাখি। প্রাচীন আলকেমিস্টরা যা করত তাতে আমরা বিশ্বাস রাখি, আমরা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের কাছে আত্মসমর্পণ করি। জানি সব সময় আমাদের পথ দেখানোর জন্য কেউ না কেউ আছেন। তাই আমরা তা গ্রহণ করি বা না করি তা পুরোপুরি আমাদের হাতে।
সেই রাতে ব্রাইডা গান শুনে কাটাল। বেঁচে থাকার এই অলৌকিকতায় মনোযোগ দিল। তার প্রিয় লেখকদের কথা ভাবল। তাদের মধ্যে একজন ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক-প্রজ্ঞার খোঁজের ব্যাপারে খুব সুন্দর কথা বলেছেন
আজ যা প্রমাণিত সত্য, একদিন তা কল্পনা মাত্র ছিল।
উপাসনার নিয়ম-কানুন পালনের সময় হয়েছে। ব্রাইডা পরবর্তী কয়েক মিনিট মোমবাতির শিখার দিকে মনোযোগ দেবে। এ রকম করার সাথে সাথে ছোট্ট বেদিতে গিয়ে বসবে। এই উপাসনার প্রক্রিয়া যেন তাকে সেই সন্ধ্যায় নিয়ে গেল, লরেন্সের সাথে সেই দুরন্ত সঙ্গমের সময়টাতে। সেখানে মাথার ওপর সি-গাল উড়ছিল, নিচ দিয়ে সমুদ্র প্রবাহিত হচ্ছিল।
মাছেরা নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে পাখিরা কীভাবে ওড়ে। উড়ন্ত ওই রহস্যময় সৃষ্টজীব জগতের মধ্যে এসে পড়ে, তারপর আবার সেদিকে যায়।
পাখিরা অবশ্যই তাদের প্রশ্ন করে, তারা কীভাবে খায় আর পানির নিচে কীভাবে শ্বাস নিয়ে চলাচল করতে পারে।
পাখি আর মাছেদের অস্তিত্ব আছে। তারা এ রকম জগতে আছে যাদের প্রশ্নের মধ্যে বিরোধ আছে। কিন্তু তারা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। দু পক্ষেরই প্রশ্ন আছে, প্রশ্নের উত্তরও আছে।
ব্রাইডা তার সামনের মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মধ্যে জাদুকরী ক্ষমতা বাড়তে শুরু করেছে। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু সেই রাতে অনুভূতিটা অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ছিল।
তারও যদি প্রশ্ন করার উপায় থাকত অন্য জগতের কারো কাছে, প্রশ্নের জবাবও নিশ্চয় পাওয়া যেত। কেউ না কেউ তা জানে, তার জীবনের অর্থ জানার কোনো দরকার নেই, তাকে খুঁজে বের করাই যথেষ্ট। তার বাহুর মধ্যে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়াই যথেষ্ট। তোমার চেয়ে শক্তিশালী কেউ তোমাকে খারাপ আর বিপদ থেকে উদ্ধার করবে এটা জেনে রাখো।
উপাসনা শেষ হলে ব্রাইডা নিজের জন্য প্রার্থনা করল। সে কৃতজ্ঞ, কারণ প্রথম মানুষটার কাছে সে জাদুবিদ্যার কথা জানতে চেয়েছিল, তার কাছে জগতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেনি। তার বদলে তিনি ব্রাইডাকে গোটা রাত অন্ধকার জগতের মধ্যে কাটাতে বাধ্য করেছেন।
জাদুকর ম্যাগাসের কাছে গিয়ে যা শিখেছে তার জন্য ধন্যবাদ দেয়া দরকার।
যখনই ব্রাইডা ওই মানুষটার খোঁজে গিয়েছে, সে অন্য কিছু খোঁজ করেছে। আর যখনই সে কোনো কিছুর খোঁজ পেয়েছে, তখনই সে চলে এসেছে, এমনকি কোনো রকম বিদায় পর্যন্ত জানায়নি। কিন্তু তিনি তাকে সেই দরজা দেখিয়েছেন, যার মাধ্যমে সে পরবর্তী ইকুনক্সের দীক্ষা পাস করার আশা করতে পারে। অন্ততপক্ষে ম্যাগাসকে তার ধন্যবাদ জানানো উচিত।
না, ম্যাগাসের প্রেমে পড়ার ভয় সে পায় না। লরেন্সের চোখে তার নিজের আত্মার লুকায়িত অংশের দেখা পেয়েছে। পোশাকের ব্যাপারে সন্দেহ থাকার সময় ভালোবাসার ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে।
.
২৬.
আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ। ব্রাইডা বলল, গ্রামে তারা বসেছে। ওখানেই সে প্রথমে ম্যাগাসের চোখে অদ্ভুত আলো দেখেছিল।
ম্যাগাস কোনো কিছু বলছিলেন না। তিনি লক্ষ করলেন, ব্রাইডার প্রাণশক্তি এখন কিছুটা ভিন্ন রকমের। সে পরিষ্কারভাবে আপন শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে।
যে রাতে আপনি আমাকে ঘন গভীর জঙ্গলে একা ছেড়ে গিয়েছিলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ফিরে এসে হয় আপনাকে ধন্যবাদ দেব, না হয় অভিশাপ দেব। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার পথের দিশা পেলেই আমি ফিরে আসব। কিন্তু আমি সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি। আমি সব সময় সাহায্যের খোঁজে আপনার কাছে এসেছি। আর আপনি কখনো আমাকে নিরাশ করেননি। সেটা আমার অনুমান হতে পারে। কিন্তু আমি আপনাকে জানাতে চাই, আপনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। আজ রাতে আপনাকে আমার অতিথি হিসেবে পেতে চাই।
ঠিক যে মুহূর্তে ব্রাইডা দুই গ্লাস হুইস্কির অর্ডার দেবে ঠিক সেই সময়ে ম্যাগাস উঠে দাঁড়ালেন। বারের কাছে গিয়ে দুটো বোতল নিয়ে ফিরে এলেন। একটাতে ওয়াইন আরেকটাতে মিনারেল ওয়াটার। সাথে দুটো গ্লাস আনতেও ভুললেন না।
প্রাচীন পারস্যে তিনি বললেন, দুটো মানুষ একসাথে পান করতে চাইলে, তাদের মধ্যে একজন সেই রাতের রাজপানীয় বেছে নেয়। সাধারণ যে বিল মেটায়, সেই করে।
তিনি জানেন না তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক ছিল কি না। তিনি প্রেমে পড়েছেন। ব্রাইডার প্রাণশক্তি বদলে যাচ্ছে।
তিনি ওয়াইন ও মিনারেল ওয়াটার ব্রাইডার সামনে রাখলেন।
কিং অব দ্য নাইট কথোপকথনের ধরন ঠিক করে দেয়। যদি সে প্রথম গ্লাসে ওয়াইনের চেয়ে বেশি পানি ঢেলে দেয়, তার মানে বুঝতে হবে সে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে চায়। যদি দুটো পানীয়ই দুই গ্লাসে সমানভাবে ঢালে, বুঝতে হবে তারা দুজনই সিরিয়াস এবং আনন্দদায়ক কথা বলতে চায়। শেষ পর্যন্ত, যদি সে গ্লাস ওয়াইন দিয়ে পরিপূর্ণ করে আর মাত্র কয়েক ফোঁটা পানি যোগ করে, তাহলে বোঝয় রাতটা বেশ স্বস্তিদায়ক আর উপভোগ্য হবে।
ব্রাইডা উভয় গ্লাস ভর্তি করে ওয়াইন ঢেলে তার মধ্যে মাত্র কয়েক ফোঁটা পানি যোগ করল।
আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে এসেছি। ব্রাইডা আবার বলল, জীবন বিশ্বাসের কর্ম আমাকে এই শিক্ষা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি অনুসন্ধান করে সমৃদ্ধ হয়েছি। তা আমাকে আমার পছন্দের পথ বেছে নিতে খুব সাহায্য করেছে।
দুজনই প্রথম গ্লাস বেশ দ্রুত পান করল। ম্যাগাস দ্রুত পান করলেন, কারণ তিনি চিন্তিত ছিলেন। ব্রাইডা তা করল, কারণ সে বেশ রিল্যাক্স বোধ করছিল।
বেশ হালকা বিষয়ে, ঠিক আছে? ব্রাইডা বলল।
ম্যাগাস জানালেন, যেহেতু ব্রাইডার দায়িত্বে কিং অব নাইট আছে কাজেই ব্রাইডার ওপরই নির্ভর করছে তারা কোন বিষয়ে কথা বলবে।
আমি আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জানতে চাই। আমি জানতে চাই, আপনার সাথে কখনো উইক্কার কোনো অ্যাফেয়ার ছিল কি না।
ম্যাগাস মাথা ওপর-নিচ করে হ্যাঁ জানালেন। ব্রাইডা ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় কাঁপতে লাগল। কিন্তু সে নিশ্চিত নয় সে ম্যাগাস, নাকি উইক্কা, কার প্রতি ঈর্ষান্বিত।
কিন্তু আমরা কখনো একসাথে থাকিনি। ম্যাগাস বললেন। তারা দুজনই উভয় রীতিনীতি জানতেন। তারা দুজনই জানেন তারা একে অন্যের আত্মার সঙ্গী নন।
আমি কীভাবে আলোকবিন্দু দেখতে হয় তা শিখতে চাই না। ব্রাইডা ভাবল। কিন্তু সে দেখতে পেল ব্যাপারটা এড়ানো অসম্ভব। ডাইনিদের ভালোবাসা এ রকম হতে পারে।
ব্রাইডা আরেকটু বেশি পান করল। সে তার লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি এগিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে বসন্ত ইকুনক্সের আর খুব বেশি দেরি নেই। এখন সে একটু রিলাক্স করতে পারে। সে যতটুকু পান করতে পারে, ততটুকু কখনও পান করতে পারেনি। কিন্তু এখন সে একটা পোশাকের স্বপ্ন দেখতে পারে।
তারা পান করতে করতে কথা বলতে লাগল। ব্রাইডা উইক্কার কথাতে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু ম্যাগাসকে আরেকটু রিলাক্স অবস্থায় রাখা দরকার। ব্রাইডা দুটো গ্লাসই আবার পূর্ণ করল। ছোট একটা গ্রামে বাস করার ঝামেলাগুলো নিয়ে কথা বলার মাঝামাঝি প্রথম বোতল শেষ হয়ে গেল। গ্রামের সাধারণ লোকজন জাদুকরকে শয়তানের সহযোগী মনে করে।
জাদুকরের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় ব্রাইডা খুব খুশি। ম্যাগাস অবশ্যই বেশ নিঃসঙ্গ। হয়তো গ্রামের কেউ তার সাথে দু-একটা সৌজন্যমূলক কথা ছাড়া আর কিছু বলে না।
তারা আরেকটা বোতল খুলল। ব্রাইডা ম্যাগাসের পানের ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হলো। একজন জাদুকর, যিনি কি না সারা দিন জঙ্গলে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের পথ খুঁজে বেড়ান, তিনি বেশ ভালোই পান করে মাতাল হতে পারেন।
দ্বিতীয় বোতল শেষ করতে করতে ব্রাইডা ভুলেই গেল সে তার সামনে বসা মানুষটিকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিল। ম্যাগাসের সাথে তার সম্পর্ক বুঝতে পারল। সব সময় এক ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সে ম্যাগাসকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতে চায় না। কিন্তু বিপজ্জনকভাবে তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। সাধারণ মানুষের বদলে এ মানুষটার প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তিতুটাই বেশি পছন্দ করে। যে মানুষটা তাকে গাছের ওপরে কেবিনে চড়িয়েছে, বেশির ভাগ সময় সুর্যাস্ত দেখে কাটিয়েছে, তাকে সাধারণ মানুষ ভাবা যায় না।
ব্রাইডা আবার উইক্কার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করল। তিনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখান, তাই দেখতে চায়। উইক্কা যে কেমন অপূর্ব শিক্ষক তা জানালো; কীভাবে তার যা দরকার তাকে সব কিছু শিখিয়েছে। কিন্তু এ রকম পদ্ধতিতে শিখিয়েছে, যাতে তাকে সব সময়, যা শিখছে, তা জানতে হয়।
কিন্তু তোমার সে ক্ষমতা আছে, ম্যাগাস বললেন, সেটাই সূর্যের রীতি।
উইক্কা যে ভালো শিক্ষক উনি স্পষ্টত তা স্বীকার করতে চান না। ব্রাইডা ভাবল। আরেক গ্লাস ওয়াইন পান করল সে। উইক্কা সমন্ধে কথা বলতে শুরু করল আবার। কিন্তু ম্যাগাস আর কোনো মন্তব্য করলেন না।
আপনার ও তার ব্যাপারে বলুন। ব্রাইডা বলল। দেখতে চাইল ম্যাগাস তাকে তিরস্কার করেন কি না। সে তাদের সমন্ধে জানতে চায় না, সে সত্যিই জানতে চায় না। কিন্তু ম্যাগাসের প্রতিক্রিয়া পাওয়ার এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
তরুণ বয়সের ভালোবাসা। আমরা এ রকম প্রজন্মের সদস্য ছিলাম, যারা কোনো সীমানা জানত না। সেই বিটলস আর রোলিং স্টোনের প্রজন্ম আমরা।
এ কথা শুনে ব্রাইডা বিস্মিত হলো। তাকে রিলাক্স করা দূরে থাক ওয়াইন যেন আরো টেনস করে তুলছে। সে এখনো এসব বিষয়ে প্রশ্ন করতে চায়। কিন্তু এও বুঝতে পারছে, এসব উত্তর তাকে খুশী করতে পারছে না।
আমাদের যখন সাক্ষাৎ হয়। জাদুকর বলে চললেন, ব্রাইডার অনুভূতির ব্যাপারে সচেতন নন, আমরা দুজনই আমাদের সঠিক পথ খুঁজে চলছিলাম। আমরা একই শিক্ষকের কাছে গেলে, আমাদের পথ মিশে গেল। আমরা একসাথে সূর্যের রীতি এবং চাঁদের রীতি শিখলাম। আমরা দুজনই নিজেদের মতো শিক্ষক বনে গেলাম।
ব্রাইডা সিদ্ধান্ত নিল এ বিষয়ে পাশ কাটিয়ে যাবে। দুই বোতল ওয়াইন পুরোপুরি অদ্ভুত অনুভূতি এনে দিতে পারে। ওরা দুজনই শৈশব থেকে বন্ধু ছিল। ওয়াইন মানুষকে সাহসী করে তোলে।
আপনারা আলাদা হয়ে গেলেন কেন?
এবারের বোতল ম্যাগাসের আনার কথা। ব্রাইডা তা লক্ষ করে আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। ম্যাগাস যে এখনো উইক্কাকে ভালোবাসে তা বেরিয়ে এলে তার অন্তর ঘৃণায় ভরে যাবে।
আমরা আত্মার সঙ্গী সমন্ধে শেখার সময়ই আলাদা হয়ে গেলাম।
আপনি যদি সেই আলোকবিন্দু খুঁজে না পান, অথবা আপনার আত্মার সঙ্গীর চোখে বিশেষ আলো না দেখেন, আপনারা কি তারপরও একসাথে থাকবেন?
আমি জানি না। আমি শুধু জানি, যদি আমরা একসাথে থাকি, আমাদের দুজনের জন্যই তা কাজ করবে না। আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেলে আমরা শুধু জীবন আর জগৎ সমন্ধে বুঝতে পারি।
ব্রাইডা মুহূর্তের জন্য থামল। কথা খুঁজে পেল না। ম্যাগাসই কথোপকথন চালিয়ে গেল।
চলো যাই। ম্যাগাস বললেন। তিনি তিন নম্বর বোতল থেকে এক চুমুক ওয়াইন পান করলেন। আমার চোখে মুখে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া লাগান দরকার।
উনি মাতাল হয়ে গেছেন। ব্রাইডা ভাবল, আর ভয় পাচ্ছেন। ব্রাইডা গর্ব অনুভব করল, মদ সে ম্যাগাসের চেয়ে ভালো সামলাতে পারে। কোনো মতেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো নিয়ে ভীত নয় সে। আজ রাতে নিজেকে উপভোগ করতেই সে এসেছে।
আর একটু। সর্বোপরি, আমি আজ রাতের কিং অব দ্য নাইট।
ম্যাগাস আরেক গ্লাস পান করলেন। কিন্তু তিনি তার সীমাবদ্ধ জানেন।
আপনি আমার সমন্ধে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। ব্রাইডা বলল, আপনি কি আমার ব্যাপারে কৌতূহলী নন? অথবা আপনি কি আপনার শক্তি দিয়ে আমার ভেতর দিয়ে দেখতে পান?
মুহূর্তের জন্য ব্রাইডার মনে হলো সে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। কিন্তু তারপর সে ভাবনাটা সরিয়ে দিল। ম্যাগাসের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন লক্ষ করল। এখন সম্পূর্ণ অন্য আলো খেলা করছে। ব্রাইডার কাছে ম্যাগাসকে অনেক উদার মনে হলো। তার মনে হলো একটা দেয়াল নিচে নেমে আসছে। তারপর থেকে সব কিছুই গ্রহণযোগ্য মনে হয়। শেষবার তাদের একত্রে থাকার কথা মনে পড়ে গেল। ম্যাগাসের সাথে থাকার তার আকাক্ষা, ম্যাগাসের শীতল ভাব। এখন সে বুঝতে পারছে সেই রাতে সে ম্যাগাসকে ধন্যবাদ দিতে যায়নি। প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিল। তাকে বলতে গিয়েছিল, সে আরেকজন মানুষের মধ্যে সেই শক্তি আবিষ্কার করেছে। সেই মানুষটাকে সে ভালোবাসে।
আমার কেন প্রতিশোধ নেয়া দরকার? আমি কেন তার ওপর রেগে আছি? ব্রাইডা বিস্মিত। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওয়াইনের প্রভাবের কারণে কোনো উত্তর তার মাথায় এলো না।
.
২৭.
সামনে বসা তরুণী মেয়েটির দিকে ম্যাগাস তাকিয়ে রইলেন। তার মনের মধ্যে শক্তির প্রবাহ আসা-যাওয়া করছে। অনেক বছর আগে, এ রকম এক রাতে, তার গোটা জীবন বদলে গিয়েছিল। সম্ভবত বিটলস আর রোলিং স্টোনের সময়টাতে হবে। কিন্তু আরো অনেক মানুষ ছিল, যারা অজানা শক্তির খোঁজে ঘোরাফেরা করত। এমনকি যে শক্তি তারা হয়তো বিশ্বাসও করত না। জাদুকরী শক্তির ব্যবহার করত তারা। নিজেদের ম্যাজিক্যাল পাওয়ারের চেয়ে শক্তিশালী মনে করত। নিজেদের বোঝাত এই বলে যে, বিরক্ত হয়ে পড়লে, খুব তাড়াতাড়িই রীতিনীতির এই ব্যাপারস্যাপার ছেড়ে দিতে পারবে। তিনিও তাদের একজন ছিলেন। তিনি চাঁদের রীতির মাধ্যমে পবিত্র জগতে পদার্পণ করেছিলেন। উপসিনা শিখে দৃশ্যমান আর অদৃশ্যমান জগতের সেতু পার হয়েছিলেন।
প্রথমে, তিনি এই শক্তি নিজেই অর্জন করেছিলেন। কারো সাহায্য না নিয়েই। শুধু বই পড়ে। তারপর শিক্ষকের সাথে দেখা হলো। প্রথম সাক্ষাতেই, শিক্ষক তাকে বললেন, সূর্যের রীতিনীতি শিখলে ভালো করবেন তিনি। কিন্তু ম্যাগাস তা চাইছিলেন না। চাঁদের রীতিনীতির ব্যাপারস্যাপারগুলো অনেক বেশি মজার। এর সাথে প্রাচীনতম উপাসনা জড়িত। সময়ের প্রজ্ঞা শেখা যায়। তো শিক্ষক তাকে চাঁদের রীতিনীতি শিক্ষা দিলেন। বললেন, সম্ভবত এই পথ ঘটনাক্রমে সূর্যের রীতিনীতির কাছে নিয়ে যাবে তাকে।
সেই সময়ে, তিনি নিজের ব্যাপারে, নিজের অর্জনের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন। সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। চাঁদের রীতিনীতি ব্যবহার করে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। ডাইনিবিদ্যা চাইছিল, তিনি একজন শিক্ষক হন। এ কারণে তিনি কখনো চাঁদের রীতিনীতির শিক্ষকের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রাখেননি। আর একজন মানুষের ইচ্ছাশক্তির ব্যাপারে কখনো হস্ত ক্ষেপ করনেনি। জাদুকরী জ্ঞান দ্বারা তিনি হয়তো নিজের পথ খুঁজে নিতে পারতেন কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারেননি। কারণ এটাই তার পথ, এই পথে কেউ জোর করে নিয়ে আসেনি তাকে। এটাই তার বাধা ছিল। এটাই একমাত্র গাছ, যার ফল তিনি ভোগ করেননি।
সব কিছুই খুব ভালোভাবে চলছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়লেন। মেয়েটাও তার প্রেমে পড়ল। দুজনই রীতিনীতির ব্যাপারগুলো জানত। জানতেন, তিনি মেয়েটির পুরুষ নন। আর মেয়েটিও জানত সে তার মেয়েমানুষ নয়। তবু ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল তারা। জীবনই সময়মতো তাদের আলাদা করে দেয়। তাদের আবেগকে দমিয়ে রেখে এ রকমভাবে বাস করতে লাগল যেন প্রতিটি মুহূর্তই তাদের শেষ মুহূর্ত। দুজনের মধ্যকার ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পেয়েছিল, কারণ তারা মারা যাচ্ছে।
তারপর একদিন, মেয়েটির আরেকজন পুরুষের সাথে দেখা হয়। এই মানুষটা রীতিনীতির ব্যাপারে কোনো কিছু জানত না। এমনকি তার কাঁধের ওপর কোনো আলোকবিন্দু ছিল না। চোখেও কোনো বিশেষ আলো দেখা যায়নি। আত্মার সঙ্গী হওয়ার কোনো উপকরণ ছিল না। ভালোবাসা, যাই হোক, কোনো কারণ মানে না। মেয়েটি পুরুষটির প্রেমে পড়ে গেল। ম্যাগাসের সাথে মেয়েটির সময় শেষ হয়ে আসতে লাগল।
তারা ঝগড়া করত। লড়াই করত। ম্যাগাস ক্ষমা চাইতেন। প্রেমে পড়লে মানুষ যতভাবে অপমানিত হতে পারে, তার সবই সে হয়েছিলেন। তিনি এ রকম কিছু শিখেছিলেন, যা শিখবেন কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নি। আশা, ভয়, প্রত্যাশা।
ওই লোকটার বাম কাঁধের ওপর কোনো আলোকবিন্দু নেই। ম্যাগাস তর্ক জুড়ে দিতেন। তুমি নিজেই আমাকে তা বলেছিলে।
কিন্তু মেয়েটি তার পরোয়া করেনি। সে তার আত্মার সঙ্গীর খোঁজ পাওয়ার আগে, আরেকজন পুরুষ মানুষকে জানতে চেয়েছিল। জগতের অভিজ্ঞতা নিতে চেয়েছিল।
ম্যাগাস যন্ত্রণা কমাতে চেয়েছিলেন। তিনি সে বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি সেই সাধনায় পৌঁছে, মেয়েটির ব্যাপারে সব কিছু ভুলে গেলেন। ওকে আর মনে রাখেননি। কিন্তু তিনি ওকে ভুলে যাওয়ার বদলে আবিষ্কার করলেন, শিক্ষকের কথাই ঠিক আবেগ বুনো ঘোড়ার মতো। একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রজ্ঞার প্রয়োজন। এত বছর ধরে চাঁদের রীতিনীতির শিক্ষার চেয়ে, তার আবেগ অনেক বেশি শক্তিশালী। সে যে সমস্ত মন নিয়ন্ত্রণের কৌশল শিখেছে তার চেয়ে, আবেগের শক্তি অনেক বেশি। নিয়মানুবর্তিতার বেড়াজালে আটকে থাকার চেয়ে আবেগের শক্তি বেশি। আবেগ অন্ধ শক্তি। তা সব সময় কানের কাছে ফিসফিস করে জানিয়ে দেয়, ওই নারীকে হারানো উচিত হয়নি।
তিনি মেয়েটির বিরুদ্ধে কিছু করেননি। মেয়েটিও আর তার মতোই শিক্ষিক। শিক্ষা সে অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। কয়েকজন…। সে জানে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়।
যাই হোক, তৃতীয় আরেকজন তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ে। একজন পুরুষ ভাগ্যের রহস্যময় জালে ধরা পড়ে। এ রকম জাল, যা একজন ম্যাজাই বা ডাইনি বুঝতে পারে না। একজন সাধারণ মানুষ, সম্ভবত সে যেমনভাবে ভালোবাসত, সে রকম ভালোবাসতে থাকে। মানুষটি মেয়েটিকে সব সময় সুখী দেখতে চাইত। সর্বোচ্চ চেষ্টা করত তার জন্য। একজন সাধারণ মানুষ, যার রহস্যময় আচরণ দুজন মানুষের মধ্যে পড়ে যায়, যারা চাঁদের রীতি জানে।
এক রাতে, যন্ত্রণার আর কোনো অস্তিতুই নেই, ম্যাগাস নিষিদ্ধ ফল খেলেন। শক্তি আর জ্ঞানের ব্যবহার করে সময়ের প্রজ্ঞা তাকে যা শিখিয়েছিল, তাই প্রয়োগ করে, ভালোবাসার মেয়েটির কাছ থেকে মানুষটিকে সরিয়ে দিলেন তিনি।
ম্যাগাস জানত না এদিন তাকে দেখা যাবে না। কিন্তু এরই মধ্যে রমণী নুতন খোঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। যাই হোক, তার শিক্ষক জানতেন, সব সময় সব কিছুই জানতেন। চাঁদের রীতি তাদের ওপর প্রযোজ্য, যারা ব্ল্যাক ম্যাজিকে অভ্যস্ত। বিশেষত মানুষের সবচেয়ে ক্ষতিকর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবটির ক্ষেত্রে আর তা হল, ভালোবাসা।
ম্যাগাস শিক্ষকের কাছে অনুশোচনা করলে, তিনি বুঝতে পারলেন পবিত্র শপথ ভঙ্গ করা অসম্ভব। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি ভেবেছিলেন শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। বুঝতে পারলেন তার পছন্দনীয় পথেই আছেন, কিন্তু এই পথটা অন্য পথের মতো নয়। তিনি কখনো এই পথ ছেড়ে যেতে পারবেন না।
এখন তাকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষ পান করতে হচ্ছে–নিসঃঙ্গতা–যতক্ষণ না ভালোবাসার অনুভব তাকে ছুঁয়ে যায়। তারপর, সেই একই রকম ভালোবাসা, যা তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তাকে আবার মুক্ত করে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্তআত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি।
.
২৮.
আপনি আমার সমন্ধে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। আপনি কি কৌতূহলী নন? আপনি কি আপনার শক্তি ব্যবহার করে আমার ভেতরের সব দেখে ফেলেছেন?
মনের মধ্যে অতীত দেখে আসতে তার সেকেন্ডের বেশি সময় লাগল না। শুধু সিদ্ধান্ত নিতে যতটুকু সময় লাগে। সূর্যের রীতিতে কী ঘটেছে তাই দেখবেন; নাকি তার সাথে আলোকবিন্দু আর ভাগ্যের নিয়তি নিয়ে কথা বলবেন।
ব্রাইডা একজন ডাইনি হতে চায়। কিন্তু সে এখনো সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জন করেনি। ম্যাগ্যাসের গাছের ওপরে সেই কেবিনের কথা মনে পড়ে গেল। যখন ব্রাইডার খুব কাছাকাছি এসে তাকে বলতে চাইলেন, এখন আবার তিনি লালায়িত হচ্ছেন, কারণ তার প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। শয়তানের প্রভাবের কথা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। আমরা সবাই আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। খুব সহজেই একই ভুল বারবার করতে পারি। খুব সহজেই যা কিছু আকাক্ষা করি, তা থেকে সরে আসতে পারি আমরা।
বিপরীত দিকে, আমরা নিজেদের স্বর্গীয় ব্যাপারে আত্মসমর্পণ করতে পারি। ঈশ্বরের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে পারি। স্বপ্ন পূরণে লড়াই করতে পারি, বিশ্বাস করতে পারি, ঠিক সময়ে তা চলে আসবে।
চলো যাই। ম্যাগাস বললেন।
ব্রাইডা বুঝতে পারল ম্যাগাস এখন সিরিয়াস।
ব্রাইডা বারের বিল মিটিয়ে দিল, কারণ সে আজ রাতের কিং অব দ্য নাইট। তারা নিজেদের কোট গায়ে চড়ান, তারপর ঠাণ্ডার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। আগের চেয়ে কম ঠাণ্ডা পড়ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বসন্ত এসে যাবে।
তারা একসাথে হেঁটে বাস স্টেশনে এলো। কয়েক মিনিট পরে একটা বাস ছেড়ে যাবে। ঠাণ্ডার ভেতরেও, ব্রাইডার অনুভূতি অদ্ভুতভাবে এক ভয়ানক দ্বিধায় ডুবে গেল। যার কোনো ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। সে এই বাসে উঠতে চাইছিল না। সব কিছুই ওলটপালট লাগছে। মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যায় এখানে আসার প্রধান লক্ষ্য পূরণে সে ব্যর্থ হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে সব কিছু ঠিকঠাকভাবে করে যাওয়া দরকার। সে এখানে এসেছিল ম্যাগাসকে ধন্যবাদ জানাতে। কিন্তু এখন তার কাছে মনে হচ্ছে, আগের দুইবারের মতো সে একই রকম আচরণ করেছে।
ব্রাইডা বাসে উঠল না। জানালো তার শরীর খারাপ লাগছে।
আমি চলে যেতে চাই না। ব্রাইডা বলল, অনেক বেশি পান করে ফেলেছি, শরীর খারাপ লাগছে এ জন্য নয়। কারণ আমি সব কিছু গোলমাল করে ফেলেছি। আমি যেভাবে ভেবেছিলাম আপনাকে সেভাবে ধন্যবাদ জানানো হয়নি।
এটাই শেষ বাস। ম্যাগাস বললেন।
আমি পরে ট্যাক্সি ধরে যাব, যত খরচই পড়ক।
বাস ছেড়ে দিলে ব্রাইডা দুঃখ করতে লাগল কেন বাসে উঠে পড়েনি। সে বেশ দ্বিধার মধ্যে আছে। সে কী চায় সে সমন্ধে কোনো ধারণা নেই। আমি মাতাল হয়ে পড়েছি। সে ভাবল।
চলুন কিছুক্ষণ হাঁটা যাক। আমার একটু স্বাভাবিক হওয়া দরকার। ব্রাইডা বলল।
তারা ফাঁকা গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলছে। ঘরবাড়ির জানালা অন্ধকার। ব্যাপারটা সম্ভব নয়। আমি লরেন্সের চোখে বিশেষ আলো দেখেছি। আর এখনো ওর সাথেই থাকতে চাই। নিজেকে একজন সাধারণ চটুল মেয়েমানুষ বলে মনে হতে থাকে তার। ডাইনিবিদ্যার মাধ্যমে যা কিছু শিখেছিল, যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল, সব কিছুই মূল্যহীন মনে হয়। নিজের আচরণে লজ্জিত হয়ে পড়ে। কয়েক গ্লাস ওয়াইনের প্রভাব হতে পারে। লরেন্স– তার আত্মার সঙ্গী-চাঁদের রীতির মাধ্যমে সে যা কিছু শিখেছে হঠাৎ করে সব কিছু গুরুত্বহীন মনে হয়। সে বিস্মিত হয় এই ভেবে যে, হয়তো তার ধারণা ভুল। সম্ভবত লরেন্সের চোখের বিশেষ আলো সূর্যের রীতিতে বলা সেই আলো নয়। কিন্তু না, বোকার মতো ভাবলে হবে না। আত্মার সঙ্গীর চোখের বিশেষ আলো চিনতে কারো ভুল হয় না।
এমনকি যদি সে ভিড়ে পরিপূর্ণ থিয়েটার হলের মধ্যেও লরেন্সকে দেখে, তার সাথে আগে কোনো দিন কথা না বললেও, তাদের চোখাচোখি হওয়ার মুহূর্ত থেকে, সে জানতে পারবে এই মানুষটাই তার। তার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার একটা উপায় সে খুঁজে বের করবে। আর লরেন্সও তার অভিব্যক্তিকে স্বাগত জানাবে। কারণ রীতিনীতি কখনো ভুল করে না। শেষ পর্যন্ত আত্মার সঙ্গীরা একে অন্যকে খুঁজে পায়। আত্মার সঙ্গী সমন্ধে কোনো কিছু জানার অনেক আগে, সে সব সময় শুনত লোকজন অদ্ভুত একটা কথা বলে: প্রথম দর্শনেই প্রেম।
যেকোনো মানুষই সেই আলো চিনতে পারে। তার জন্য কোনো ম্যাজিক্যাল পাওয়ারের দরকার হয় না। এর অস্তিত্ব জানার আগেই সে এ সমন্ধে জানত। সে এই আলো দেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাগাসের চোখে। প্রথমবার যখন তারা একসাথে পাবে গিয়েছিল।
ব্রাইডা থমকে দাঁড়াল।
আমি মাতাল হয়ে গেছি। সে আবার ভাবল। তার এসব ভাবনা ভুলে যাওয়া উচিত। টাকা-পয়সা শুনে দেখা দরকার ট্যাক্সি ভাড়া করার মতো যথেষ্ট টাকা আছে কি না। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু সে ম্যাগাসের চোখে ওই বিশেষ আলো দেখেছে। ওই আলোই বলে দিচ্ছে জাদুকর তার আত্মার সঙ্গী।
তোমাকে অনেক বেশি বিবর্ণ দেখাচ্ছে। ম্যাগাস বললেন, তুমি অনেক বেশি পান করে ফেলেছ।
ঘোর কেটে যাবে। চলুন ঘোরটা না কাটা পর্যন্ত কোথাও বসি। তারপর আমি বাড়ি যাব।
তারা একটা বেঞ্চে বসল। ব্রাইডা ব্যাগ হাতড়ে টাকা খুঁজতে লাগল। সে উঠে দাঁড়িয়ে একটু ট্যাক্সি খুঁজে নিয়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে পারে। এই পথে কীভাবে যাত্রা করতে হবে সে জানে। তার আত্মার সঙ্গীকেও চেনে। যদি এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যায়, ঈশ্বর তার জন্য যে মিশন ঠিক করে রেখেছে তা পরিপূর্ণতা পাবে।
তার বয়স হয়তো মাত্র একুশ হতে পারে, কিন্তু সে এরই মধ্যে জেনে গেছে, একই জনে একই সাথে দুই আত্মার সঙ্গী থাকা সম্ভব। আর সে কারণেই তার ভেতরে যন্ত্রণা।
কীভাবে সে তা এড়িয়ে যাবে?
আমি বাসায় যাচ্ছি না। ব্রাইডা বলল, আমি এখানে থাকছি।
ম্যাগাসের চোখে অনিশ্চয়তার খেলা দেখা গেল।
.
২৮.
তারা হাঁটতে লাগল। ম্যাগাস লক্ষ করলেন ব্রাইডার জ্যোতির্ময়তা বেশ কয়েকবার বদলে গেল। আশা করছেন মেয়েটি ঠিক পথ বেছে নেবে। তার আত্মার সঙ্গীর মনের মধ্যে যে ঝড় বয়ে চলছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু তিনি জানেন, এটাই প্রকৃতির রূপান্তর। এভাবেই বিশ্বজগৎ, তারকারাজি, মানবকুল রূপান্তরিত হয়ে থাকে।
তারা গ্রাম ছাড়িয়ে কান্ট্রিসাইডের দিকে যেতে শুরু করল। তাদের সাক্ষাতের সেই পাহাড়ের দিকে যেতে লাগল। ব্রাইডা হঠাৎ করে থামতে বলল।
এইদিক দিয়ে চলুন ব্রাইডা বলল। একটা গমের ক্ষেতের দিকে ঘুরে গেল ও, যদিও জানে না কোন দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ করে প্রকৃতির শক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া দরকার মনে হলো। এই জগতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সৃষ্টিকর্তার মহিমা তাকে আবেগ তাড়িত করল। আকাশে মস্ত গোলাকার চাঁদ জোছনা বইয়ে দিচ্ছে। জোছনার আলোয় চারদিকে আলোকিত।
কোনো কথা না বলে ম্যাগাস তাকে অনুসরণ করতে লাগলেন। তার হৃদয়ের গভীরে বিশ্বাসের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন, একই ভুল আবার করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন।
তারা গমের ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল। চাঁদের আলোয় গমের ক্ষেতটাকে রূপালি সাগরের মতো লাগছে। ব্রাইডা লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটছিল। কোন দিকে যাচ্ছে সে সমন্ধে তার কোনো ধারণা নেই। তার ভেতরের একটা কণ্ঠস্বর তাকে সামনের দিকে যেতে বলছে। ভবিতব্যের মতো সেদিকেই এগিয়ে চলছে সে। দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। কারণ তারা তার প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে নজর রাখছে। তাকে সময়ের প্রজ্ঞার সাথে রক্ষা করছে।
গমক্ষেতের মাঝামাঝি গিয়ে তারা থামল। চারদিকে পাহাড় ঘেরা। একটা পাহাড়ের পাথরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়। ওদিকে একটা শিকারি কেবিনও আছে, সবার মাথা ছাড়িয়ে গাছের ওপরে উঠে আছে, এক রাতে ওই কেবিনে একজন তরুণী তার সামনে অন্ধকার আর ভয়ের কথা স্বীকার করেছিল।
আমি তৈরি। ব্রাইডা ভাবল, আমি প্রস্তুত আর আমি জানি আমাকে রক্ষা করা হবে। বাসায় জ্বালানো মোমবাতির শিখার কথা মনে করল। চাঁদের রীতির উপাসনা।
এখানে খুব ভালো জায়গা। ব্রাইডা থমকে দাঁড়িয়ে বলল।
ব্রাইডা গাছের একটা শাখা তুলে নিয়ে শিক্ষকের শেখানো পবিত্র নাম জপতে জপতে মাটিতে বড় একটা বৃত্ত অঙ্কন করল। উপাসনার ছুরিটা এই মুহূর্তে তার কাছে নেই। কোনো রকম পবিত্র বস্তু নেই। কিন্তু তার পূর্বসূরিরা এখানে আছে। তারা তাকে এ রকমটি করতে বলছে। কাঠিটাকে না পুড়িয়ে রান্নাঘরের ব্যবহার্য রাখতে হবে।
এই জগতের সব কিছুই পবিত্র। ব্রাইডা বলল। গাছের এই শাখাটাও পবিত্র।
হ্যাঁ। ম্যাগাস সাড়া দিলেন। জগতের সব কিছুই পবিত্র। বালির একটা ক্ষুদ্র কণাও অদৃশ্য জগতের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই মুহূর্তে অদৃশ্য জগতের সেতু বন্ধন আমার আত্মার সঙ্গী। ব্রাইডা বলল।
ম্যাগাসের চোখ জলে ভরে গেল।
তারা দুজন সেই বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ করল। ব্রাইডা বৃত্তটাকে বন্ধ করে দিল। ম্যাজাই আর ডাইনিদের মধ্যে অমরত্বের সময় থেকেই এই প্রতিরক্ষার রীতি পালন করা হয়।
আপনি যথেষ্ট ভাবে আপনার জগৎটা আমাকে দেখিয়েছেন। ব্রাইডা বলল, আমি এই উপাসনা পালন করছি, কোন জগতে বাস করি সেটা দেখাতে।
ব্রাইডা চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। জগতের জাদুকরী শক্তির সাথে একাত্ম হলো। সে দেখেছে, তারা জঙ্গলে গেলে তার শিক্ষক সব সময় এ রকমটি করত। কিন্তু এখন সে নিজেই তা করছে। কোনো কিছুই ভুল হবে না সে আত্মবিশ্বাস তার আছে। শক্তিটা তাকে বলছে, তার আর কোনো কিছু শেখার দরকার নেই। অনেকবার ডাইনিরা যা করেছে শুধু সেটুকু মনে রাখলেই হবে। তারপর সে প্রার্থনা করতে শুরু করল, শস্য খুব ভালো হবে, জমিন সব সময় উর্বর থাকবে। সেই প্রাচীন যুগের মতো জমিনের জ্ঞান, বীজের রূপান্তর আর তার পুরুষ মানুষটি যে ক্ষেতে কাজ করছে, সেই প্রার্থনা করল।
ম্যাগাস ব্রাইডাকে পরবর্তী পদক্ষেপ এগোতে দিলেন। তিনি জানতেন, এক পর্যায়ে তাকেই নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। কিন্তু সে জন্য এখানকার সময় ও স্থানের মধ্যে রেকর্ড থাকা দরকার, মেয়েটিই প্রথমে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ম্যাগাসের শিক্ষক, যিনি এই মুহূর্তে, কোনো গ্রহের জগতে পরবর্তী জীবনের জন্য অপেক্ষা করছেন, এই গমের ক্ষেতে ছিলেন, যেমনটি একটু আগে পাবে ছিলেন, ম্যাগাসের শেষ ইচ্ছা নিবারণের কাছে। শিক্ষক সন্দেহাতীতভাবে খুশি যে তার ছাত্র যন্ত্রণা থেকে শিখছে। ম্যাগাস নীরব হয়ে ব্রাইডার প্রার্থনা শুনছিল।
ব্রাইডা থামল।
আমি জানি না এসব কেন করছি। কিন্তু আমি জানি আমি আমার অংশটুকু করছি।
বাকিটা চালিয়ে নেব। ম্যাগাস বললেন।
তারপর তিনি উত্তরের দিকে তাকালেন। পাখিদের কান্না নকল করলেন, যেমনটি মিথ আর কিংবদন্তিতে শোনা যায়। শুধু এই ডিটেলসের কাজটুকুর ঘাটতি ছিল। উইক্কা খুব ভালো শিক্ষক। সে ব্রাইডাকে প্রায় সব কিছুই শিখিয়েছে। শুধু শেষটা শেখায়নি।
পবিত্র পেলিকেন আর ফিনিক্স পাখির ডাক নকল করা হলে, গোটা বৃত্তটাই আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। রহস্যময় আলো। কোনো কিছু আলোকিত না করলেও আলোর অস্তিত্ব প্রতিয়মান। ম্যাগাস তার আত্মার সঙ্গীর দিকে তাকালেন। ব্রাইডার সমস্ত শরীর সোনালি জোতিতে ভরপুর। আলোটা ব্রাইডার নাভি থেকে আসছে। ছড়িয়ে পড়ছে মাথার চারদিকে। তিনি জানতেন ব্রাইডাও একই জিনিস দেখছে। তার বাম কাঁধের ওপর আলোকবিন্দু দেখতে পাচ্ছে। প্রথমদিকে কিছুটা ঝাপসা মনে হতে পারে। সম্ভবত তাদের ওয়াইন পানের ফল।
আমার আত্মার সঙ্গী। ব্রাইডা আলোকবিন্দু দেখতে পেয়ে নরম স্বরে বলল।
আমি তোমার সাথে চাঁদের রীতিনীতিতে যেতে চাই। ম্যাগাস বললেন। আর হঠাৎ করে গোটা গমের ক্ষেতটা একটা ধুসর মরুভূমিতে পরিণত হলো। সেখানে মন্দিরের দরজার সামনে এক সাদা পোশাকের মহিলা নাচতে শুরু করল। ব্রাইডা আর ম্যাগাস দুজনেই তা দেখতে পেলেন। ব্রাইডা জানে না ওই লোকগুলো তাদের দেখতে পাচ্ছে কি না।
তার পাশে ম্যাগাসের উপস্থিতি ব্রাইডা অনুভব করতে পারছিল। ম্যাগাসকে জিজ্ঞাসা করতে চাইল ও রকম দৃশ্যের অর্থ কী হতে পারে। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
ম্যাগাস ব্রাইডার চোখে ভয়ের ছাপ দেখতে পেলেন। তারা আবার গম ক্ষেতের বৃত্তের মধ্যে ফিরে এলেন।
ওটা কী ছিল? ব্রাইডা জিজ্ঞাসা করল।
তোমার কাছে আমার বর্তমান। চাঁদের রীতির এগারোতম গোপন মন্দির ওটা। ভালোবাসার উপহার আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, তোমার অস্তিত্ব আছে। কারণ আমি তোমাকে খুঁজে পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি।
আমাকে আপনার সাথে নিয়ে নিন। ব্রাইডা বলল, আপনার জগতে কীভাবে পথ চলতে হয় আমাকে তা দেখান।
তারা একসাথে সময় এবং স্থান পরিভ্রমণ শুরু করল। যদিও দুই রীতির ভ্রমণ। ব্রাইডা ফুলে পরিপূর্ণ তৃণভূমি দেখতে পেল, যেসব প্রাণীর কথা শুধু বইয়ে পড়েছিল সেগুলো দেখতে পেল। রহস্যময় দুর্গ আর শহরগুলো যেন আকাশের মেঘের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশের আলো এমনভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে যেন ম্যাগাস তাকে সেখানে টেনে নিয়ে গেছে। গমের ক্ষেতের ওপর রীতিনীতির পবিত্র চিহ্ন পেল। এক পর্যায়ে, দুই মেরুর বরফ রাজ্যে গিয়ে পৌঁছাল। কিন্তু তা আমাদের জগতের নয়। সেখানে ছোট ছোট প্রাণী রয়েছে। যাদের লম্বা আঙুল আর অদ্ভুত চোখ, একটা বিশাল নভোযান নিয়ে কাজ করছে। যখনই ব্রাইডা ম্যাগাসকে কিছু বলতে চাইছে, দৃশ্যকল্পগুলো সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে আরেকটা ফুটে উঠছে। ব্রাইডা আত্মার মাধ্যমে বুঝতে পারল তার পাশে যে মানুষটি আছে, তিনি সারা জীবন ধরে যা শিখেছেন, তা তাকে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তিনি অবশ্যই সারা জীবন ধরে এই উপহারগুলো তার সামনে উপস্থাপন করবেন বলে অপেক্ষা করেছেন। ম্যাগাস এখন সব ভয়, শঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে তাকে দেখাতে পারছেন। কারণ ব্রাইডা তার আত্মার সঙ্গী। সে ম্যাগাসের সাথে এখন এলিসিয়ান ফিল্ডে ভ্রমণ করতে পারে, সেখানে আলোকিত আত্মারা বাস করে। আর অন্য আত্মারা আলোকিত হওয়ার খোঁজে আশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ব্রাইডা বলতে পারল না কতটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। তারা আবার সেই আলোকিত শস্যক্ষেতের বৃত্তের মধ্যে ফিরে এসেছে। সে এর আগে ভালোবাসার ব্যাপারে জানত। কিন্তু সেই রাতের আগে ভালোবাসা তার কাছে ভয়ের ব্যাপার মনে হতো। ভয়ের একটা পর্দা ছিল, তুমি সব কিছুই এর মধ্য দিয়ে দেখতে পাবে, কিন্তু কোনো রং দেখতে পাবে না। সেই মুহূর্তে, তার সামনে আত্মার সঙ্গী থাকার কারণে, সে বুঝতে পারল ভালোবাসা পুরোপুরি রঙের ব্যাপার, যেন হাজার হাজার রংধনু একটার ওপর আরেকটা বিস্তৃত হয়েছে।
এত রং, এত আয়োজন কখনও দেখিনি। দেখতে ভয় করত খুব। রংধনুর দিকে তাকিয়ে সে ভাবল।
ব্রাইডা শুয়ে পড়ল। আলোকবিন্দু এখন তার ওপরে। ম্যাগাসের বাম কাঁধের ওপরের আলো নাভি তার মাথার দিকে ধাবিত।
আমি আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। ব্রাইডা বলল।
ওয়াইনের প্রভাবের কারণে। ম্যাগাস উত্তর দিলেন।
পাব, ওয়াইন আর সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কথা ব্রাইডার স্মৃতিতে আলোড়ন তুলল।
এসব দৃশ্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ওগুলো দৃশ্য নয়। ম্যাগাস বললেন, তুমি যা দেখেছ তা এই জগৎ এবং দূরের গ্রহের প্রজ্ঞা।
ব্রাইডা এসব ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিল না। সে আর কোনো শিক্ষা নিতে চাইছে না। শুধু অভিজ্ঞতার ব্যাপারে জানতে চাইছিল।
আমি কি পুরোপুরি আলোকিত হয়েছি?
হ্যাঁ। আমার মতোই। একই রং, একই আলো। একই শক্তির স্ফুরণ।
সোনালি রং ছড়িয়ে পড়েছে। নাভি আর মাথা থেকে উজ্জ্বল ধূসর নীল রং উৎসরিত হচ্ছে।
আমার মনে হচ্ছিল, হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এখন আমরা নিরাপদ।ব্রাইডা বলল।
আমি ক্লান্ত। আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। আমিও অনেক পান করেছি।
ব্রাইডা জানত এ রকম একটা জগতে আছে যেখানে পাব আছে, আছে গমের ক্ষেত, আর বাস স্টেশন। কিন্তু সে আর সেই জগতে ফিরে যেতে চায় না। শুধু এই মাঠে সারা জীবনের জন্য থাকতে চায়। দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে তার কাছের আলো ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে যেতে লাগল। তারপর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। আকাশে চাঁদের জোছনা ভাসিয়ে দিচ্ছে। পুরো গ্রাম আলোকিত করে ফেলেছে। তারা দুজনই নগ্ন আর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। তাদের শীত করছে না, লজ্জাও নয়।
ম্যাগাস ব্রাইডাকে উপাসনা বন্ধ করতে বললেন, কারণ সেই শুরু করেছিল। ব্রাইডা যা জানত তাই উচ্চারণ করতে লাগল। দরকার বুঝে ম্যাগাস সাহায্য করতে লাগলেন। শেষ ফর্মুলাটা বলা হয়ে গেছে, ম্যাগাস ম্যাজিক সার্কেল খুলে দিলেন। পোশাক পরিধান করে মাটিতে বসে পড়ল তারা।
চলুন, এই জায়গা থেকে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরে ব্রাইডা বলল। ম্যাগাস উঠে দাঁড়ালে ব্রাইডা অনুসরণ করল। ব্রাইডা জানে না কী বলতে হবে। তারা দুজনই বেশ হতচকিত। তাদের ভালোবাসার কথা একে অন্যের কাছে স্বীকার করেছে। আর এখন, পরিস্থিতির শিকার দম্পতির মতো, তারা একে অন্যের চোখের দিকে তাকাতে বিব্রতবোধ করছে।
তারপর ম্যাগাস নীরবতা ভঙ্গ করলেন।
তুমি অবশ্যই ডাবলিনে ফিরে যাবে। আমি ট্যাক্সি ফার্মের নাম্বার জানি।
ব্রাইডা বুঝতে পারল না সে হতাশ হয়েছে, নাকি স্বস্তি পাচ্ছে। আনন্দের অনুভূতিতে ঝিমুনির মতো আসছে। মাথা দপদপ করছে। সে নিশ্চিত, সঙ্গী হিসেবে সে যাচ্ছেতাই।
ফাইন। ব্রাইডা বলল।
তারা গ্রামের পথে হাঁটতে লাগল। ম্যাগাস টেলিফোন বুথ থেকে ট্যাক্সি ফার্মে ফোন করলেন। তারপর রাস্তার পাশে বসে টাক্সিক্যাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
এই রাতের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই। ব্রাইডা বলল।
ম্যাগাস কিছুই বললেন না।
আমি জানি না, ইকুনক্স উৎসব শুধু ডাইনিদের জন্য কি না। কিন্তু সেই দিনটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন।
একটা পার্টি হবে।
আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।
ম্যাগাস এমনভাবে তাকালেন যেন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে চান। তিনিও তার মতো একই জিনিস ভাবছিলেন। আত্মার সঙ্গীকে খুঁজে পাওয়ার পর তাকে ছেড়ে যাওয়াটা কতটা কঠিন। ব্রাইডা কল্পনা করল ম্যাগাস একা বাড়িতে ফিরে যাবে, সে ফিরে এলে আশ্চর্যান্বিত হবে। কিন্তু সে ফিরে আসবে। কারণ তার হৃদয় তাই করতে বলছে। কিন্তু জঙ্গলের নীরবতা শহরের নিঃসঙ্গতার চেয়ে অনেক বেশি কঠোর।
আমি জানি না ভালোবাসা হঠাৎ করে আসে কি না। ব্রাইডা বলে চলল, কিন্তু আমি জানি আমি ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত। ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত।
ট্যাক্সি চলে এসেছে। ব্রাইডা আবার ম্যাগাসের দিকে তাকালো। ম্যাগাসকে দেখে মনে হলো সে তরুণ হয়ে গেছে।
আমিও ভালোবাসার জন্য তৈরি। ম্যাগাস বললেন।
.
৩০.
সূর্যের বিস্তৃত আলো রান্নাঘরের ভেতর পরিচ্ছন্ন জানালা দিয়ে আসতে লাগল।
তোমার ঘুম ভালো হয়েছে, সোনামনি?
মা টেবিলের ওপর এক মগ চা রাখলেন। সাথে কয়েকটা টোস্টও। তারপর তিনি কুকারের কাছে গেলেন। কুকারে ডিম আর বেকন ফ্রাই হচ্ছে।
হ্যাঁ, ভালো ঘুম হয়েছে, মা। আমার পোশাক কি রেডি হয়েছে? আগামী পরশুর পার্টির জন্য ড্রেসটা দরকার।
মা তার জন্য ডিম আর বেকন ফ্রাই এনে বসে পড়লেন। তিনি জানেন তার মেয়ের সাথে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না। তিনি মেয়ের সাথে এমন ভাবে আজ কথা বলতে চান, যেমনটি এর আগে কখনো বলেননি। কিন্তু তাতে তিনি খুব কম কথাই জানতে পারবেন। বাইরে নতুন জগৎ আছে, অন্য রকম জগৎ, যা তিনি জানেন না।
তিনি মেয়েকে নিয়ে ভীত, কারণ তিনি মেয়েকে ভালোবাসেন। ব্রাইডা নতুন এ জগতে একেবারে একা।
আমার ড্রেসটা তৈরি হয়ে যাবে, তাই না, মা?
হ্যাঁ, লাঞ্চ টাইমে। মা উত্তর দিলেন। পোশাক নিয়ে মেয়েটা খুশি। অন্ততপক্ষে কিছু জিনিস এ জগতে বদলায় না। কিছু সমস্যা আছে, যা সব সময় মায়েরা মেয়েদের জন্য সমাধান করে দেন।
তিনি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন:
লরেন্স কেমন আছে?
ফাইন। ও আগামীকাল বিকালে এসে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।
তিনি একইসাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং দুঃখিত হলেন। সমস্যাটা হলো, হৃদয় সব সময় আত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তার মেয়ের এ জাতীয় কোনো সমস্যা নেই। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে তিনি ওকে উপদেশ দিতে পারেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভালোবাসা খুব কমই বদলেছে।
ছোট্ট গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন তারা। ব্রাইড এখানে তার শৈশব কাটিয়েছে। বাড়িঘরগুলো একই রকম আছে। লোকজন আগেও যে কাজ করত এখনো সেই কাজই করছে। তার মেয়ে স্কুলের কয়েকজন পুরনো বান্ধবীর সাথে দেখা করল, যারা এখন গ্রামের ব্যাংকে অথবা স্টেশনারিতে কাজ করছে। তারা ওকে দেখে হ্যালো বলে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগল। কেউ ব্রাইডা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেছে, কত সুন্দর হয়েছে দেখতে, এসব বলতে লাগল। দশটার দিকে তারা একটা ক্যাফেতে গেল, সেখানে মা রবিবারে যান। স্বামীর সাথে দেখা হওয়ার আগ থেকেই তিনি ওখানে যেতেন।
তিনি আবার মেয়ের দিকে তাকালেন। গ্রামের লোকের সমন্ধে গল্প করতে লাগলেন। ব্রাইডা এখনো এসব শোনায় বেশ আগ্রহী। ব্যাপারটা তাকে খুশি করল।
আমি সত্যিই আজ ড্রেসটার ব্যাপারে আগ্রহী। ব্রাইডা বলল। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাল। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ হতে পারে না। সে জানে মা কখনো তা হতে দেবে না।
মা সিদ্ধান্ত নিলেন ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন করবেন, যে জাতীয় প্রশ্ন ছেলেমেয়েরা সব সময় এড়িয়ে যেতে চায়। কারণ তারা এখন স্বাধীন হয়ে গেছে। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারে।
কোনো কিছু কি তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে
মা, তুমি কি একসাথে কখনো দুজন মানুষের প্রেমে পড়েছ? তার গলার সরে এ রকম কিছু ছিল, যাতে মনে হতে পারে, জীবন এ রকম ফাঁদ শুধু তার জন্যই পেতে রেখেছে।
মা কেকে কামড় বসালেন। চোখের দৃষ্টিতে দূরাগত অতীতের রেখা ভেসে। উঠল। যে অতীতের কথা তিনি ভুলে গেছেন তার খোঁজে চলে গেল।
হ্যাঁ, পড়েছি।
ব্রাইডা আমুদে দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
মা হেসে আবার হাঁটার জন্য ইশারা করলেন।
ভোমার বাবা আমার প্রথম এবং মহৎ ভালোবাসা। মা বললেন। তারা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর আমি এখনো তাকে নিয়ে খুব সুখী। যখন আমি তোমার চেয়ে বয়সে তরুণ ছিলাম, অনেক কিছুর স্বপ্ন দেখতাম। সেই সময়ে, আমার বন্ধুরা আর আমি বিশ্বাস করতাম, ভালোবাসাই বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তুমি যদি কাউকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হও, তাহলে তুমি কখনো তোমার স্বপ্নের ব্যাপারে দোষ দিতে পারবে না।
আসল কথায় এসো, মা।ব্রাইডা অধৈর্য স্বরে বলল।
আমার অন্য স্বপ্নও ছিল। আমিও স্বপ্ন দেখতাম, উদাহরণস্বরূপ, তুমি এখন যেমনটি করছ, বড় শহরে গিয়ে কী আছে তা আবিষ্কার করতে চাইতাম। আমার বাবা-মাকে একমাত্র যে উপায়ে রাজি করিয়েছিলাম, তাদের জানিয়েছিলাম আমার পড়াশোনার জন্য এ রকম কয়েকটা কোর্স আছে, যা এখানে বসে করা সম্ভব নয়।
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, ভাবছিলাম কীভাবে বাবা-মায়ের কাছে সাবজেক্টগুলো তুলে ধরব। আমি কী বলতে চাইছি তাই নিয়ে পরিকল্পনা করলাম। তারা তার উত্তরে কী বলতে পারে। আর আমি কীভাবে তার উত্তর দিতে পারি।
মা আগে কখনো ব্রাইডার সাথে এভাবে বসে এসব বিষয়ে কথা বলেননি। ব্রাইডার মনের মধ্যে একই সাথে আবেগ এবং দুঃখের ভাব হলো। আর এ রকম মুহূর্তটা উপভোগ করতে পারত। কিন্তু তারা দুজনই নিজেদের নিজস্ব জগতে নিজস্ব মূল্যবোধে বন্দি হয়ে পড়েছে।
বাবা-মায়ের সাথে কথা বলার দুই দিন আগে তোমার বাবার সাথে আমার দেখা হলো। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে সেখানে বিশেষ আলো দেখতে পেলাম। যেন সেই মানুষটার সাথে দেখা হলো, যার জন্য আমি জগতে বেরিয়ে পড়তে চাইছিলাম।
হ্যাঁ, আমারও এ রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।
তোমার বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর, আমিও বুঝতে পারলাম, আমার খোঁজা সম্পন্ন হয়েছে। জগতের আর কোনো ব্যাখ্যার আমার দরকার নেই। তারপর এখানে থাকার জন্য আমি আর কোনো রকম হতাশা বোধ করলাম না। সব সময় একই মানুষজনকে দেখে এসেছি, একই রকম কাজ করেছি। কিন্তু প্রতিটি দিন ছিল ভিন্ন রকম। কারণ আমাদের দুজনের মধ্যে মহৎ ভালোবাসা ছিল।
আমরা একসাথে বাইরে যেতে শুরু করলাম, তারপর বিয়ে করলাম। আমি কখনো তোমার বাবাকে বড় শহরে যাওয়ার স্বপ্নের কথা বলিনি। অন্য জায়গা আর অন্য মানুষকে খোঁজার কথা বলিনি। কারণ হঠাৎ করে গোটা জগৎ আমার পায়ের কাছে এসে পড়েছে। ভালোবাসা আমার জীবনের ব্যাখ্যা হিসেবে ধরা দিয়েছে।
তুমি আরেকজনের কথা বলেছিলে, মা।
তোমাকে একটা জিনিস দেখাব। মা উত্তরে বললেন।
তারা হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের ক্যাথলিক চার্চের দিকে গেল। চাচটা একবার ধ্বসে পড়লে আবার নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। ব্রাইডা প্রতি রবিবারে সেখানে যেত। তার মনে পড়ে, শৈশবে গির্জার সিঁড়ির ধাপগুলো পার হতে খুব কষ্ট হতো। শুরুতেই দুপাশে দুজন সেইন্টের মূর্তি আছে। বায়ে সেইন্ট পল আর ডানদিকে সেইন্ট জেমস। সময় আর পর্যটক ওটাকে ধ্বংস করেছে। মাটি শুকনো পাতায় ভরা। যেন হেমন্তকালের পাতা ঝরার মৌসুম। বসন্তকাল নয়।
গির্জাটা পাহাড়ের ওপরে। তারা কোথায় তা দেখা প্রায় অসম্ভব। চারপাশে ঘন নিবিষ্ট বৃক্ষরাজি। মা প্রথম ধাপেই বসে পড়লেন। ব্রাইডাকেও বসতে বললেন পাশে।
এইখানে ঘটনাটা ঘটেছিল। মা বললেন, এক সন্ধ্যায়, কোনো কারণে বা অন্য কারণে, আমি এখানে প্রার্থনা করতে আসব বলে ঠিক করলাম। আমার একা হওয়ার দরকার ছিল। নিজের জীবন সমন্ধে ভাবতে চাইছিলাম। ভেবেছিলাম গির্জাই সবচেয়ে ভালো জায়গা হবে।
এখানে এসে একজন মানুষের সাথে দেখা হলো। তুমি যেখানে বসে আছো মানুষটা সেখানে বসে ছিল। তার পাশে দুটো সুটকেস। তাকে পুরোপুরি হতাশ দেখাচ্ছিল। বেপরোয়াভাবে হাতে ধরে রাখা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল। আমার মনে হলো, লোকটা টুরিস্ট হতে পারে, হোটেলের খোঁজ করছে। তো আমি লোকটার কাছে এগিয়ে গেলাম। এমনকি তার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। লোকটা প্রথমে চমকে উঠলেও পরে স্বস্তি পেল।
জানালো, সে হারিয়ে যায়নি। সে একজন আর্কিওলজিস্ট। উত্তরের দিকে যাচ্ছে। ওখানে কয়েকটা ধ্বংসপ্রাপ্ত জিনিস দেখতে যাবে। ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে দেরি হচ্ছে। একজন মেকানিক খুব তাড়াতাড়ি এসে পড়বে। তো অপেক্ষা করার ফাঁকে এই গির্জাটা দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাকে এই গ্রাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে সে। কাছাকাছি অন্য গ্রাম আর ঐতিহাসিক মনুমেন্ট সমন্ধে জানতে চায়।
হঠাৎ করে, যেসব সমস্যা আমাকে হতাশ করেছিল, মুহূর্তের মধ্যে সব ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে যায়। নিজেকে খুব কাজের মানুষ মনে হতে থাকে। আমি যা কিছু জানতাম সব বলতে শুরু করলাম, মনে হতে লাগল, অনেক বছর ধরে আমি এই অঞ্চলে বাস করছি, তা আজ সার্থকতা পেল। আমার সামনে এমন একজন মানুষ আছে যে লোকজন আর সমাজ নিয়ে পড়াশোনা করে। যে পরের প্রজন্মের জন্য কাজ করে। এ রকম কথা আমি শৈশবে শুনেছিলাম। লোকটা যে সিঁড়িতে বসেছিল তাতে বুঝতে পারলাম এই জগতে আর আমার নিজের দেশের ইতিহাসে আমিও একজন গুরুতুপূর্ণ মানুষ। নিজেকে দরকারি মনে হতে লাগল। সেটা একজন মানুষের জন্য দারুণ অনুভূতি।
গির্জার সমন্ধে আমার বলা শেষ হলে, আমরা অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলাম। নিজ গ্রামে আমি কতটা গর্বিত তা তাকে বললাম। সে একজন লেখকের লেখা থেকে কটা লাইন বলল। লেখকটার নাম আমার মনে নেই। কথাটা ছিল, নিজের গ্রামের কথা বুঝতে পারলে তুমি গোটা পৃথিবীকে বুঝতে পারবে।
টলস্টয়। ব্রাইডা বলল।
কিন্তু তার মা তখনো সেই স্মৃতিতে বিভোর। যে রকমটি সেও একদিন করেছিল। ব্যতিক্রম হলো তার মায়ের ক্যাথেড্রালের জায়গার দরকার নেই। দরকার নেই লাইব্রেরির ধুলো জমা বইয়ে। মায়ের শুধু সেই বসন্তকালীন সন্ধ্যার স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া দরকার। একজন মানুষ সিঁড়িতে সুটকেস নিয়ে বসে ছিল।
আমরা অল্প সময় কথা বললাম। গোটা সন্ধ্যাটা তার সাথে কাটানোর মতো সময় আমার ছিল। কিন্তু যেহেতু মেকানিক যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়তে পারে, সে কারণে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর সিদ্বান্ত নিলাম। আমি তার কাছে বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তার খোঁড়াখুড়ি, এমন চ্যালেরে জীবন সম্বন্ধে জানতে চাইলাম। সে আমার সাথে যোবাদের নিয়ে, জ্ঞানী মানুষ তার সদস্যদের নিয়ে কথা বলতে লাগল।
সব শোনার আগেই দেখলাম, সূর্য দিগন্তে হেলে পড়তে শুরু করেছে। আমার জীবনে আর কখনো সময় এত তাড়াতাড়ি অতিবাহিত হয়নি। আমার মনে হলো তার কাছেও একই রকম মনে হচ্ছে। সে কথোপকথন চালানোর জন্য আমাকে এনের পর প্রশ্ন করতে থাকে। আমাকে চলে যেতে হবে তা বলার সময় পর্যন্ত দেয় না। সে অনবরত কথা বলতে থাকে। তার অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলে। আমার সময়ে সব কিছু জানতে চায়। তার চোখের ভাষায় স্পষ্টত আমাকে নিয়ে তার আকাকা কামনা বাসনা ফুটে ওঠে। এমনকি আমার বাস তখন তোমার বয়সের দ্বিগুণ হলেও।
তখন ছিল বসন্তকাল। বাতাসে ভালোবাসার অন্য রকম প্রবাহ। নিজেকে আমার তরুণী মনে হচ্ছিল। ওইখানে এ রকম একটা ফুল ছিল, যা শুধু হেমন্তে ফুটত। নিজেকে সেই ফুলের মতো মনে হতে লাগল। যেন হঠাৎ করে আমার জীবনের হেমন্তকাল এসেছে, যখন মনে হচ্ছিল আমি সব কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, ওই মানুষটা সেই সময়ে এসে আমার অনুভূতির জগতে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। উদাহরণ ভালোবাসার কথা বলা যায়। শরীরের সাথে সাথে ভালোবাসা কখনো পুরনো হয় না। এ রকম একটা জগতের অনুভূতি হছিল, যার সাথে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু এই জগতে কোনো সময় নেই, স্থান নেই, সমুখপানে কিছু নেই।
মা কিছু সময়ের জন্য চুপ করে রইলেন। এখনো চোখ বন্ধ। দূরাগত অতীতের সেই বসন্তে মন নিবিষ্ট।
তখন আমার নিজেকে আটত্রিশ বছরের উঠতি বয়সী কিশোরী মনে হচ্ছিল। কেউ আমাকে কামনা করুক। সে আমাকে যেতে দিতে চাইছিল না। তারপর হঠাৎ করে সে কথা বন্ধ করে দিল। আমার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বসল। তবে মনে হলো আমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পেরেছে। আমি কী ভাবছি জেনে গেছে। আমাকে বলতে চাইছে ব্যাপারটা সত্য। তার কাছে আমার গুরুত্ব কতখানি। কিছু সময়, আমরা কিছুই বলছিলাম না। তারপর আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মেকানিক তখনো এসে পৌঁছায়নি।
অনেক দিন যাবত, আমার মনে হয়েছে আসলেই কি মানুষটার কোনো অস্তিত্ব ছিল? নাকি সে কোনো দেবদূত? ঈশ্বর আমার কাছে জীবনের গোপন শিক্ষা দিতে পাঠিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত, আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, সে সত্যিকারের মানুষ ছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল। এমনকি শুধু সেই সন্ধ্যাটুকুর জন্য হলেও। সেই সন্ধ্যায়, সে আমাকে সবটকু উজাড় করে দিয়েছিল। যা সে সারা জীবন সঞ্চিত করে রেখেছিল। তার লড়াই, তার আনন্দ, তার কাঠিন্য আর তার স্বপ্ন। সেই অপরাহে, আমিও আমার জীবনের সব কিছু তাকে উজাড় করে দিয়েছিলাম। আমি তার সঙ্গী হয়েছিলাম, তার স্ত্রী, তার শ্রোতা, তার প্রেমিকা। তা শুধু কয়েক ঘন্টার জন্য হোক না কেন। আমি সারা জীবনের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম।
মা মেয়ের দিকে তাকালেন। তিনি আশা করছেন, মেয়ে তার ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। কিন্তু মনের খুব গভীরে, তিনি অনুভব করলেন, ব্রাইডা এমন এক জগতে বাস করে যেখানে এ রকম ভালোবাসার কোনো স্থান নেই।
তোমার বাবাকে ভালোবাসা আমি কখনো থামাইনি। এক দিনের জন্যও না। তিনি উপসংহারে এলেন। ও সব সময় আমার পাশে ছিল। তার সর্বোত্তম করার চেষ্টা করেছে। আর আমিও শেষ পর্যন্ত তার সাথেই থাকতে চেয়েছি। কিন্তু হৃদয় বড় রহস্যময় ব্যাপার। আমি এখন বুঝতে পারি না সেই অপরাহে আমার কী হয়েছিল। আমি শুধু জানি, সেই সাক্ষাতের পর মানুষটা আমাকে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসের হাতে সমর্পণ করেছিল। দেখেয়েছিল আমি তখনো ভালোবাসতে পারি। ভালোবাসার মোগ্য হতে পারি। আমাকে এ রকম কিছু শিখিয়েছিল, যা কখনো ভুলতে পারব না। তোমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পাওয়া মানে, জীবনের অন্য সব জিনিসকে ছেড়ে দেয়া নয়।
আমি এখনো মাঝে মাঝে তার কথা ভাবি। আমি জানতে চাই সে কোথায় আছে। ওই অপরাহে সে যা খুঁজছিল, তা পেয়েছিল কিনা। সে এখনো বেঁচে আছে, নাকি ঈশ্বর তার আত্মাকে পরম শান্তিতে রেখেছেন। আমি জানি সে কখনো ফিরে আসবে না। আর সেই কারণেই আমি এখনো তাকে এ রকম বিশ্বাস আর শক্তিতে ভালোবাসতে পারি। কারণ আমি কখনো তাকে হারাতে পারি না। সে আমাকে সেই অপরাহে নিজেকে সমর্পণ করেছিল।
মা উঠে দাঁড়ালেন।
আমি বাড়িতে গিয়ে তোমার পোশাকটা শেষ করি। তিনি বললেন।
আমি আরেকটু এখানে থাকি। ব্রাইডা উত্তর দিল।
মা মেয়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।
আমার কথা শোনার জন্য ধন্যবাদ। এই প্রথমবার আমি এই গল্প কারোর কাছে করলাম। আমার সব সময় ভয় হত এ কথা কাউকে না বলেই হয়তো আমি মরে যেতে পারি। আর কথাটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে পারে। এখন তুমি আমার জন্যই তা ধারণ করে রাখবে।