৩. গস্পেল
রোমানরা মন্দির ধ্বংস না করলে ক্রিশ্চানিটির চেহারা কেমন হতো তার কোনও ধারণা আমাদের নেই। নিউ টেস্টামেন্ট গড়ে তোলা ঐশীগ্রন্থের পরতে পরতে হারানোর ধ্বনি বাজছে। এর অনেক অংশই ওই ট্র্যাজিডির প্রতি সাড়া হিসাবে রচিত হয়েছিল।’ বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দিরের সময় কালে জেসাস আন্দোলন ছিল ভীষণভাবে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অসংখ্য গোষ্ঠীর একটি। এর কিছু স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ছিল, কিন্তু অন্যান্য গ্রুপের বেশ কয়েকটির মতো আদি ক্রিশ্চানরা নিজেদের প্রকৃত ইসরায়েল মনে করত, ইহুদিবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনও ইচ্ছাই তাদের ছিল না। আমাদের হাতে তেমন একটা প্রত্যক্ষ তথ্য না থাকলেও পন্তিয়াস পিলেতের হাতে জেসাসের মৃত্যুদণ্ড লাভ করার পর কেটে যাওয়া চল্লিশ বছরে আমরা এই গোষ্ঠীটির ইতিহাস সম্পর্কে একটা সঠিক ধারণা করতে পারি।
স্বয়ং জেসাস হেঁয়ালিই রয়ে গেছেন। ‘ঐতিহাসিক’ জেসাসকে উন্মোচন করার কৌতূহলোদ্দীপক প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, এক ধরনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ শিল্পে পরিণত হয়েছে এই প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, আমরা যে জেসাসকে চিনি, তিনি নিউ টেস্টামেন্টের বর্ণিত জেসাসই, যা বৈজ্ঞানিকভাবে বস্তুগত ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী নয়। তাঁর ব্রত ও মৃত্যু সম্পর্কে আর কোনও সমসাময়িক বিবরণ পাওয়া যায় না। আমরা এমনকি তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল কেন সেটাই নিশ্চিত করে বলতে পারি না। গস্পেল বিবরণী ইঙ্গিত দেয় যে, তাঁকে ইহুদিদের রাজা ভাবা হয়েছিল। তিনি স্বর্গীয় রাজ্যের সহসা আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলে কথিত আছে, তবে এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে সেটা এই জগতের হবে না। বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দিরের আমলের সাহিত্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে এই সময়ে কিছু কিছু লোক ডেভিডের বংশে একজন ন্যায়পরায়ণ রাজার আগমনের প্রত্যাশা করছিল যিনি এক চিরন্তন রাজ্যের পত্তন ঘটাবেন। এই ধারণাটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়া উত্তেজনার কালে অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জোসেফিয়াস, তেসিতাস ও স্যুতোনিয়াস, সবাই বিপ্লবী ধার্মিকতার গুরুত্বের কথা লিখেছেন। এই সময় কোনও কোনও মহলে ডেভিডের বংশে একজন মেসায়াহ’র (গ্রিকে ক্রিস্তোস), ‘মনোনীত’ রাজার আগমনের তীব্র প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল যিনি ইসরায়েলকে উদ্ধার করবেন। জেসাস নিজেকে এই মেসায়াহ হিসাবে দাবি করেছিলেন কিনা আমরা জানি না-গস্পেলসমূহ এই ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থবোধক। জেসাস নয়, বরং তাঁর তরফে অন্য লোকজনই এই দাবি করে থাকবেন। কিন্তু তাঁর পরলোকগমনের পর তাঁর কিছু কিছু অনুসারী দিব্যদর্শনে তাঁকে দেখতে পেয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাঁকে সমাধি থেকে পুনরুত্থিত করা হয়েছে– ঈশ্বর এই পৃথিবীর বুকে তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠা করার সময় সকল কবরবাসীর পুনরুত্থানের বার্তাবহ ঘটনা।[৫]
জেসাস ও তাঁর অনুসারীরা উত্তর প্যালেস্তাইনের গালিলি থেকে এসেছিলেন। তাঁর পরলোকগমনের পর তারা জেরুজালেমে চলে যায়, সম্ভবত রাজ্যের আগমনের মুহূর্তে প্রত্যক্ষদর্শী হবার আশায়, যেহেতু সব পয়গম্বরই ঘোষণা করেছিলেন যে মন্দিরই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র হবে। তাদের আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘দ্য টুয়েলভ’ নামে পরিচিত ছিলেন: রাজ্যে তাঁরা নবগঠিত ইসরায়েলের বারটি গোত্রকে শাসন করবেন।’ জেসাস আন্দোলনের সদস্যরা রোজ মন্দিরে সমবেতভাবে প্রার্থনা করত, তবে তারা সমবেত খাবার গ্রহণ করতেও মিলিত হতো, যেখানে রাজ্যের আসন্ন আবির্ভাবে তাঁদের বিশ্বাসের নিশ্চিয়তা দিত।’ ‘ধর্মপ্রাণ, অর্থডক্স ইহুদি’ হিসাবে জীবন যাপন অব্যাহত রেখেছিল তারা। এসীনদের মতো তাদের নিজস্ব কোনও সম্পদ ছিল না, সমস্ত পণ্য সমানভাবে ভাগ করে ব্যবহার করত ও শেষ দিনগুলোর জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল। মনে হয়, জেসাস স্বেচ্ছা-দারিদ্র্য ও দরিদ্রের প্রতি বিশেষ যত্নের সুপারিশ করেছেন; দলের প্রতি আনুগত্যকে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে বেশি মূল্য দিয়েছেন এবং অহিংস ও প্রেমময় পদ্ধতিতে অশুভের মোকাবিলা করার কথা বলেছেন।১১ ক্রিশ্চানদের উচিত কর পরিশোধ করা, রোমান কর্তৃপক্ষকে সমীহ করা এবং এমনকি সশস্ত্র সংঘর্ষের কথা মনেও না আনা। ১২ জেসাসের অনুসারীরা তোরাহ অনুসরণ অব্যাহত রেখেছিল,১৩ সাব্বাথ ধরে রেখেছে,” ও খাদ্য সংক্রান্ত বিধানের পরিপালন ছিল তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।১৫ জেসাসের প্রবীন সমসাময়িক ফারিজি হিল্লেলের মতো তারা স্বর্ণবিধির এক রূপের শিক্ষা দিয়েছে, একে ইহুদি বিশ্বাসের মুল ভিত্তি মনে করেছে। ‘অতএব, সর্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি সেই রূপ করিও; কেননা ইহাই ব্যবস্থার ও ভাববাদী গ্রন্থের সার।’১৬
এসীনদের মতো জেসাস গোষ্ঠীর সদস্যদের মন্দিরের সাথে এক দ্ব্যর্থবোধক সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয়। কথিত আছে, জেসাস হেরোদের অনন্যসুন্দর উপাসনাগৃহ শিগগিরই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ‘তুমি কি এই সকল বড় বড় গাঁথানি দেখিতেছ?’ শিষ্যকে প্ৰশ্ন করেছিলেন তিনি। ‘ইহার একখানি পাথর আর একখানি পাথরের উপরে থাকিবে না, সকলই ভূমিসাৎ হইবে।১৭ বিচারের সময় তিনি মন্দির ধ্বংস করে তিনদিনের ভেতর আবার নির্মাণ করার শপথ নিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এসীনদের মতোই জেসাসের অনুসারীরা মন্দিরে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে এবং এই দিক থেকে তারা বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির কালের আধ্যাত্মিকতার সাথে একাত্ম ছিল।
অবশ্য অন্যান্য দিক থেকে ক্রিশ্চানিটি দারুণভাবে উৎকেন্দ্রিক ও বিতর্কিত ছিল। মেসায়াহর পুনরুত্থানের ব্যাপারে কোনও সাধারণ প্রত্যাশা ছিল না। আসলে জেসাসের মারা যাওয়ার ধরণ ছিল এক ধরনের অস্বস্তির উৎস। সাধারণ অপরাধীর মতো মৃত্যুবরণকারী এক ব্যক্তি কীভাবে ঈশ্বরের মনোনীতজন হতে পারেন? অনেকেই জেসাসের পক্ষে মেসিয়ানিক দাবি কেলেঙ্কারীমূলক মনে করেছে।১৮ অন্যান্য গোত্রের মতো এই আন্দোলনের নৈতিক শক্তিরও অভাব ছিল। এদের দাবি ছিল পাপী, বারবণিতা ও রোমানদের পক্ষে কর সংগ্রহকারীরা পুরোহিতদের আগেই রাজ্যে পা রাখবে। ১৯ ক্রিশ্চান মিশনারিরা সামারা ও গাযার মতো প্যালেস্তাইনের ধর্মীয়ভাবে সন্দেহজনক অঞ্চলে জেসাসের আসন্ন প্রত্যাবর্তনের শুভ সংবাদ বা ‘গস্পেল’ প্রচার করতেন। তাঁরা ডায়াসপোরায়-দামাস্কাস, ফোনিশিয়া, সিলিসিয়া ও অ্যান্টিওকে”-বিভিন্ন সমাবেশেরও আয়োজন করেন; এসব জায়গায় তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য লাভ করেছিলেন।
যদিও মিশনারিরা প্রথম দিকে তাদের অনুসারী ইহুদিদের মাঝে প্রচারণা চালাতেন, কিন্তু তারা লক্ষ করেন যে জেন্টাইল, বিশেষ করে গডফিয়ারারদেরও তারা আকৃষ্ট করছেন।২১ ডায়াসপোরায় ইহুদিরা এইসব প্যাগান সহানুভূতি- শীলদের স্বাগত জানিয়েছে ও ইহুদি উৎসবে অংশগ্রহণে উৎসাহী বহু জেন্টাইলদের স্থান করে দিতে হেরোদের মন্দিরের বাইরের বিরাট এলাকা পরিকল্পিতভাবে নকশা করা হয়েছিল। প্যাগান উপাসকরা তখনও একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেনি। তারা তখনও অন্য দেবতাদের পূজা করছিল ও স্থানীয় কাল্টে অংশ নিচ্ছিল। অধিকাংশ ইহুদি এতে আপত্তি করেনি, কারণ ঈশ্বর কেবল ইসরায়েলের একক উপাসনা চেয়েছেন। কিন্তু কোনও জেন্টাইল ইহুদিবাদে দীক্ষা নিলে তাঁকে খত্না করাতে হতো, গোটা তোরাহ পালন করতে হতো ও প্রতিমা পূজা এড়িয়ে যেতে হতো। তো তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক জেন্টাইল দীক্ষিতদের সমাবেশে আগমন জেসাস গোত্রের নেতাদের এক বিভ্ৰান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিল। কেউই জেন্টাইলদের বাদ দেওয়ার প্রয়োজন বলে ভাবেনি যেন, কিন্তু তাদের জায়গা করে দেওয়ার বেলায় শর্ত নিয়ে বেশ মতানৈক্য ছিল। কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে, জেন্টাইল ক্রিশ্চানদের ইহুদিবাদে দীক্ষা নেওয়া উচিত, তোরাহ মেনে চলা উচিত ও খৎনার বিপজ্জনক ঝামেলার মোকাবিলা করা উচিত; কিন্তু অন্যরা মনে করেছে, যেহেতু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা বিদায় নিতে চলেছে, পরিবর্তন অপ্রয়োজনীয়। বিতর্ক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা মেনে নেওয়া হয় যে, জেসাসকে যারা মেসায়াহ হিসাবে মেনে নিয়েছে সেইসব জেন্টাইলদের ইহুদিবাদে দীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন নেই, কেবল প্রতিমাপূজা বর্জন করে খাবারের পরিমার্জিত বিধি অনুসরণ করলেই চলবে। ২২
কিন্তু এইসব জেন্টাইল ধর্মান্তরিতদের সমস্যামূলক হিসাবে দেখার বদলে কিছু কিছু অত্যুৎসাহী আসলে তাদের খুঁজে বের করে জেন্টাইল বিশ্বে উচ্চাভিলাষী মিশন শুরু করেছিল। বার জনের অন্যতম পিটার রোমান গ্যারিসন শহর সিসেরায় ধর্মান্তর করেছিলেন; সাইপ্রাসের গ্রিকভাষী ইহুদি বার্নাবাসের অ্যান্টিওকের এক্কলেসিয়ায় (চার্চ) অনেক জেন্টাইল অনুসারী ছিল। এই শহরের যারা জেসাসকে ক্রিস্তোস মনে করত তারাই প্রথম ‘ক্রিশ্চান’।২৪ কেউ একজন-আমরা জানি না কে-রোমে এমনকি একটা চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ক্রিশ্চানদের কোনও কোনও জমায়েত, বিশেষ করে জেসাসের ভাই জেমস একে অস্বস্তিকর আবিষ্কার করেন। এইসব জেন্টাইল লক্ষণীয় অঙ্গীকার দেখিয়েছিল। অনেক ইহুদি প্যাগানদের বিভিন্ন ভয়ঙ্কর অভ্যাসে আক্রান্ত মনে করত, ওদের অনেকেই তাদের ইহুদি গোষ্ঠীর উঁচু পর্যায়ের মান অনুসরণ করতে পারার ক্ষমতা এটাই বোঝায় যে ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাদের মাঝে কর্মরত আছেন। কেন তিনি এমন করছেন? জেন্টাইল ধর্মান্ত রিতরা কোনও প্যাগান শহরে সামাজিক জীবনের ভিত্তি ছিল যেসব কাল্ট তার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে প্রস্তুত ছিল, ফলে নিজেদের তারা এক অনিবার্য শূন্যতায় আবিষ্কার করেছিল: দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা পশুর মাংস খেতে পারত না তারা, তো প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের সাথে মেলামেশা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল।২৬ পুরোনো পরিচিত জগৎ হারালেও নতুন জগতে নিজেদের পুরোপুরি গ্রহণীয় আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মান্তরিত জেন্টাইলরা আসছিলই। কী ছিল এর মানে?
ইহুদি-ক্রিশ্চানরা উত্তরের খোঁজে ঐশীগ্রন্থ তালাশ করেছে। কামরান সম্প্রদায়ের মতো নিজস্ব পেশার ব্যাখ্যা গড়ে তুলেছিল তারা, জেসাস ও জেন্টাইলদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর খোঁজে তোরাহ ও প্রফেটস তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেছে। তারা জানতে পারে যে, কোনও কোনও পয়গম্বর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গোয়িমদের ইসারায়েলের ঈশ্বরের উপাসনা করতে বাধ্য করার ভবিষ্যদ্বাণী করলেও, অন্যরা বিশ্বাস করত তারা ইসরায়েলের বিজয়ের অংশীদার হবে ও স্বেচ্ছায় মূর্তি ত্যাগ করবে।২৭ তো কিছু সংখ্যক ক্রিশ্চান স্থির করে যে, জেন্টাইলদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে অন্তিম যুগ এসে পড়েছে। পয়গম্বরদের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। জেসাস প্রকৃতই মোসায়াহ ছিলেন এবং রাজ্য অত্যাসন্ন।
এই নতুন পরকালতত্ত্বের জোরাল সমর্থকদের ভেতর অন্যতম ছিলেন সিলিসিয়ার তরাসের গ্রিকভাষী ইহুদি পল, জেসাসের পরলোকগমনের প্রায় তিন বছর পর জেসাস আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে জেসাসকে কোনওদিনই চিনতেন না তিনি। প্রথম দিকে এই গোষ্ঠীর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন, কিন্তু এক প্রত্যাদেশের কারণে ধর্মান্তরিত হন, যা তাঁকে ক্রিস্তোস তাঁকে জেন্টাইলদের প্রতি দূত মনোনীত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। ডায়াসপোরায় ব্যাপক ভ্রমণ করেন পল; সিরিয়া, এশিয়া মাইনর ও গ্রিসে সংঘ গঠন করেন, জেসাসের প্রত্যাবর্তনের আগেই সারা বিশ্বে গস্পেল প্রচার শেষ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ধর্মান্তরিতদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, তাদের নানাভাবে তাগিদ দিয়ে, ধর্মবিশ্বাস ব্যাখ্যা করে চিঠিপত্র লিখেছেন। এক মুহূর্তের জন্যে পলের মনে এ ভাবনা আসেনি যে তিনি ‘ঐশীগ্রন্থ’ রচনা করছেন, কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তাঁর জীবদ্দশাতেই জেসাস ফিরে আসবেন, তিনি কল্পনাও করেননি যে আগামী প্রজন্মগুলো তাঁর চিঠিপত্র নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাঁকে একজন বিশিষ্ট প্রচারক হিসাবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু তাঁর ভয়ঙ্কর রগচটা স্বভাবের কারণে ব্যাপকভাবে যে জনপ্রিয় নন সে ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। তা সত্ত্বেও রোম, করিন্থ, গালাশিয়া, ফিলিপ্পি ও তেসালোনিকার৯ বিভিন্ন চার্চে পাঠানো তাঁর চিঠি সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাঁর পরলোকগমনের পর ৬০ দশকের গোড়ার দিকে পলকে সম্মানকারী ক্রিশ্চান লেখকগণ তাঁর নামে রচনা করেন ও তাঁর বিভিন্ন ধারণাকে এফিসাস ও কলোসাসের চার্চে পাঠানো চিঠির মাধ্যমে উন্নত করেন। পলের সহযোগী তিমোথি ও তিতুসের কাছে তাঁরা মরণোত্তর চিঠিও পাঠিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
পল জোরের সাথে বলেছেন, ধর্মান্তরিত জেন্টাইলরা সমস্ত প্যাগান কাল্ট অস্বীকার করে কেবল ইসরায়েলের ঈশ্বরের উপাসনা করে। কিন্তু তাদের ইহুদিবাদে দীক্ষিত করতে হবে বলে বিশ্বাস করেননি, কারণ জেসাস আগেই তাদের খত্না ও তোরাহ ছাড়াই ‘ঈশ্বর সন্তানে’ পরিণত করে গেছেন। তাদের অবশ্যই এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যেন রাজ্য এসে গেছে, দরিদ্রের সেবা করতে হবে, দান, সৌজন্য ও ভদ্র আচরণ করতে হবে। জেন্টাইল ক্রিশ্চানরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করছে, অলৌকিক ঘটনা ঘটাচ্ছে ও ঘোর লাগা অবস্থায় অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে-সবই মেসিয়ানিক যুগের বৈশিষ্ট্য–তা প্রমাণ করেছে যে, ঈশ্বরের আত্মা তাদের মাঝে জীবিত আছেন ও খুবই নিকট ভবিষতে রাজ্যের আবির্ভাব ঘটবে।
কিন্তু পল কখনওই ইহুদিদের তোরাহ অনুসরণ বাদ দিতে হবে, এমন বোঝাননি। তার কারণ তাতে কোভেন্যান্টের আওতার বাইরে পড়ে যেতেন তিনি। ইসরায়েল সিনাই পর্বতে প্রত্যাদশের মূল্যবান উপহার মন্দির কাল্ট, ও ঈশ্বরের ‘পুত্র’ হওয়ার অধিকার গ্রহণ করেছিল, তাঁর সাথে বিশেষ আন্তরিকতা উপভোগ করেছে, এসব কিছুকেই পল মূল্য দিতেন।” তিক্ততার সাথে ‘জুদাইযারদের’ বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর সময় ইহুদি বা ইহুদি ধর্মমতের কোনওটাকেই আসলে নিন্দা করছিলেন না তিনি, বরং সেইসব ইহুদি-ক্রিশ্চানের বিরোধিতা করেছেন যারা চেয়েছে জেন্টাইলদের গোটা তোরাহ অনুসরণ করতে হবে ও খত্না করাতে হবে। বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির কালের অন্যান্য উগ্র দলীয় সদস্যের মতো পল তিনিই যে কেবল আসল সত্য ধারণ করেন, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। মেসিয়ানিক যুগে তাঁর ইহুদি ও জেন্টাইলদের মিশ্র জমায়েতগুলো ছিল প্রকৃত ইসরায়েল।
পল ঐশীগ্রন্থসমূহও অনুসন্ধান করছেন, ক্রিস্তোসের আবির্ভাবের পর এসবের অর্থ বদলে গেছে বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। ডেভিডের কথা বোঝায় বলে মনে হওয়া এমন কোনও শ্লোক আসলে জেসাসের কথা বলছিল। ‘পূর্বকালে যাহা যাহা লিখিত হইয়াছিল, সেসকল আমাদের শিক্ষার নিমিত্তে লিখিত হইয়াছিল, যেন শাস্ত্র মূলক ধৈর্য্য ও সান্ত্বনা দ্বারা আমরা প্রত্যাশা প্রাপ্ত হই।’৩৬ আইন ও প্রফেটসের আসল তাৎপর্য কেবল আলোর মুখ দেখেছে, তো যেসব ইহুদি এখনও জেসাসকে মেসায়াহ মেনে নিতে অস্বীকার করছে তারা এসব বুঝতে পারছে না। সিনাই আর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর আগে পর্যন্ত ইসরায়েলের জনগণ বুঝতে পারেনি যে মোজেসের কোভেন্যান্ট ছিল নেহাতই সাময়িক, অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা, তো তাদের মনে ‘পর্দা’ লাগানো ছিল, তারা ঐশীগ্রন্থ কী বলছে বুঝতে পারেনি। এখনও তাদের মনের উপর সেই পর্দা রয়ে গেছে, যখন তারা সিনাগগে তোরাহর পাঠ শোনে। ইহুদিদের ‘দীক্ষিত’, অর্থাৎ ঘোরাতে হবে, যাতে সঠিকভাবে দেখতে পারে। তখন তারাও বদলে যাবে, তাদের ‘অনাবৃত মুখে প্রভুর তেজ দর্পণের ন্যায় প্রতিফলিত করিতে করিতে তেজ হইতে তেজ পৰ্য্যন্ত যেমন প্রভু হইতে, আত্মা হইতে হইয়া থাকে, তেমনি সেই মূর্তিতে স্বরূপান্তরীকৃত হবে।
এর ভেতর ধর্মদ্রোহীতামূলক কিছু ছিল না। অনেক দিন থেকেই ইহুদিরা প্রাচীন লেখায় নতুন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিল। কামরান গোষ্ঠী একই ধরনের পেশার চর্চা করছিল, ঐশীগ্রন্থে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়ের কথা বলা বাণীর সন্ধান লাভ করছিল তারা। ধর্মান্তরিতদের নির্দেশনা দিতে পল যখন বাইবেলিয় কাহিনী পাঠ করতেন, সেগুলোকে সম্পূর্ণই ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতেন তিনি। আদম এখন জেসাসের আগে স্থান পাচ্ছেন, কিন্তু আদম যেখানে জগতে পাপ নিয়ে এসেছিলেন, জেসাস সেখানে মানবজাতিকে ঈশ্বরের সাথে সঠিক সম্পর্কে স্থাপন করেছেন। আদম কেবল ইহুদি জাতির পিতাই রইলেন না, সমস্ত বিশ্বাসীর পূর্বপুরুষে পরিণত হলেন। তাঁর ‘বিশ্বাস’ (গ্রিকে পিস্তিস, এমন একটি শব্দ, এখানে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে ‘বিশ্বাসে’র পরিবর্তে ‘আস্থা’ হিসাবেই অনূদিত হওয়া ভালো) মেসায়াহর আগমনের শত শত বছর আগে তাঁকে আদর্শ ক্রিশ্চানে পরিণত করেছে। ঐশীগ্রন্থ আব্রাহামের ধর্মবিশ্বাসের প্রশংসা করার সময় তা ‘আমাদের কথাও বোঝায়। ‘ঐশীগ্রন্থে আগেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে ঈশ্বর প্যাগানদের যৌক্তিক করার জন্যে বিশ্বাসের প্রয়োগ ঘটাবেন, অনেক আগেই শুভসংবাদ ঘোষণা করেছিল, যখন আব্রাহামকে বলা হয়েছিল : ‘তোমাতে সমস্ত জাতি আশীর্বাদপ্রাপ্ত হইবে। ৪১ ঈশ্বর যখন আব্রাহামকে তাঁর উপপত্নী হ্যাঁগার ও তাঁদের ছেলে ইশমায়েলকে বুনো এলাকায় ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা ছিল একটা অ্যালেগোরিয়া: হ্যাঁগার সিনাই কোভেন্যান্টের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, ইহুদিদের যা আইনের দাসত্বে আবদ্ধ করেছিল; অন্যদিকে আব্রাহামের মুক্ত স্ত্রী সারাহ নতুন কোভেন্যান্টের অনুরূপ, জেন্টাইলদের যা তোরাহ বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করেছে।৪২
সম্ভবত একই সময় রচনায় ব্যস্ত হিব্রুদের কাছে লিখিত চিঠিপত্রের লেখক আরও রেডিক্যাল ছিলেন। তিনি ইহুদি-ক্রিশ্চানদের সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছিলেন যারা জোরের সাথে ক্রাইস্ট তোরাহকে অতিক্রম করে গেছেন বলে তিনি মোজেসের চেয়েও মহান এবং উৎসর্গের কাল্ট স্রেফ জেসাসের মানুষের জন্যে জীবন দেওয়ার পুরোহিত সুলভ কর্মকাণ্ডকে আচ্ছন্ন করেছে যুক্তি দেখাতে গিয়ে হতাশ বোধ করতে শুরু করেছিল এক অসাধারণ অনুচ্ছেদে লেখক গোটা ইসরায়েলের ইতিহাস ‘বর্তমানে অদৃশ্য বাস্তবতায়’৪৫ বিশ্বাস রাখা পিস্তিসের গুণাগুণকে তুলে ধরেছে বলে লক্ষ করেছেন। আবেল, ইনোখ, নোয়াহ, আব্রাহাম, মোজেস, গিদিয়ন, বারক, স্যামসন, জেপতথাহ, ডেভিড, সামুয়েল এবং পয়গম্বরগণ সকলেই এই ‘বিশ্বাস’ প্রকাশ করেছেন: এটাই ছিল তাদের সর্বোত্তম, প্রকৃতপক্ষে একমাত্র সাফল্য।৪৬ কিন্তু উপসংহার টেনেছেন লেখক, ‘তাহারা যাহার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল তাহা গ্রহণ করেন নাই, যেহেতু ঈশ্বর আমরা যাহাতে আরও ভালো কিছু পাই তার ব্যবস্থা রাখিয়াছেন এবং আমাদের বাদ দিয়া তাহারা সম্পূর্ণতা অর্জন করিতে পারিবেন না।
অসাধারণ ব্যাখ্যামূলক সফরে গোটা ইসরায়েলের ইতিহাস নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা হলো, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রাচীন কাহিনীগুলো, যেগুলো পিত্তিসের চেয়ে বেশি কিছু ছিল, সমৃদ্ধ জটিলতার অনেকটাই হারিয়ে বসল। তোরাহ, মন্দির ও কাল্ট স্রেফ এক ভবিষ্যৎ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে, কারণ ঈশ্বর সব সময়ই ভালো কিছুর কথা ভেবে রেখেছেন। পল এবং হিব্রুর রচয়িতা ক্রিশ্চানদের আগামী প্রজন্মগুলোকে হিব্রু বাইবেল নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে আপন করে নেওয়ার উপায় দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। নিউ টেস্টামেন্ট লেখকরা এই পেশার গড়ে তুলে একে এমন কঠিন করে তুলবেন যে ক্রিশ্চানরা ইহুদি ঐশীগ্রন্থকে খ্রিস্ট ধর্মের সূচনা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবে না।
এমনকি ৭০-এর বিপর্যয়ের আগে থেকেই জেসাস আন্দোলন বিতর্কিত হয়ে উঠেছিল। ৪৮ অন্য সব ইহুদি দলের মতো ক্রিশ্চানরা হেরোদের অনন্যসাধারণ উপাসনালয়কে ভস্মীভূত দুর্গন্ধময় ইটপাথরের স্তূপে পরিণত হতে দেখে অন্তরের অন্তস্তলে কেঁপে উঠেছিল। তারা হেরোদের মন্দিরের প্রতিস্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিল হয়তো, কিন্তু কেউই মন্দির বিহীন জীবনের কথা চিন্তাও করেনি। কিন্তু ক্রিশ্চানরা অ্যাপোক্যালিপ্সিস, ‘প্রত্যাদেশ’ বা আগে কখনও দেখা যায়নি কিন্তু সব সময় অস্তিত্ববান কোনও বাস্তবতার ‘উন্মোচন’ হিসাবে এর ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেছিল–অর্থাৎ ইহুদিবাদ শেষ হয়ে গেছে। মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এর করুণ তিরোধান প্রতীকায়িত করেছে এবং এটা ছিল শেষ সময়ের আগমনের নিদর্শন। ঈশ্বর এবার অবশিষ্ট নিষ্ক্রিয় জগতকে ধ্বংস করবেন ও রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।
৫৮৬ সালে প্রথম মন্দিরের বিনাশ বাবিলনের নির্বাসিতদের মাঝে বিস্ময়কর সৃজনশীলতার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। দ্বিতীয় মন্দিরের ধ্বংস ক্রিশ্চানদের ভেতরও একই রকম সাহিত্যিক প্রয়াস সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি নিউ টেস্টামেন্টের বিশটি পুস্তকের প্রায় সবগুলোই লেখা হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায় এরই মধ্যে এমনভাবে পলের চিঠিগুলোর উদ্ধৃতি দিচ্ছিল যেন সেগুলো ঐশীগ্রন্থ, এবং জেসাসের প্রচলিত একটা জীবনী থেকে পাঠ করছিল যা প্রতি রোববারে উপাসনার সময় পাঠ করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। ম্যাথ্যু, মার্ক, ল্যূক ও জনের নামে পরিচিতি গস্পেলসমূহ শেষ পর্যন্ত অনুশাসনের জন্যে নির্বাচিত হবে, কিন্তু আরও অনেকে ছিলেন। তোমাসের (c. ১৫০) গস্পেল ছিল জেসাসের গোপন বাণীর একটা সংকলন যা ত্রাণের ‘জ্ঞান’ (নোসিস) যোগাত। এখন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ইবিওনাইট, নাযারিন ও হিব্রু গস্পেল ছিল, ইহুদি-ক্রিশ্চান জমায়েতকে লালন করত তা। অনেক ‘নস্টিক’ গস্পেল ছিল যেগুলো ক্রিশ্চানিটির প্রতিনিধিত্ব করত যা নসিস এর উপর গুরুত্ব দিয়ে সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক ঈশ্বর (যিনি জেসাসকে তাঁর দূত হিসাবে পাঠিয়েছেন), ও দূষিত বস্তুজগৎ সৃষ্টিকারী, দেমিওগোস এর পার্থক্য বোঝাত।[৫০] অন্যান্য রচনা টিকে থাকেনিঃ পণ্ডিতদের কাছে ম্যাথু ও ল্যূকের উৎস ছিল বলে ‘Q’ (জার্মান: কুয়েলি) নামে পরিচিত একটা গস্পেল; জেসাসের শিক্ষার বিভিন্ন সংকলন ও তাঁর বিচার, নির্যাতন ও মৃত্যুর বিবরণ।
অবশ্য দ্বিতীয় শতাব্দীতে কোনও নির্দিষ্ট টেক্সটের বিধি ছিল না, কারণ তখন পর্যন্ত ক্রিশ্চানিটির কোনও প্রমিত রূপ ছিল না। বহু নস্টিক ধারণার অধিকারী মারসিওন (c. ১০০-১৬৫) ক্রিশ্চানিটি ও হিব্রু বাইবেলের সম্পর্ক ছেদ করতে চেয়েছিলেন, কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্রিশ্চানিটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম। মারসিওন পলের চিঠিপত্রের উপর ভিত্তি করে নিজস্ব গস্পেল ও ল্যকের পরিমার্জিত ও সম্পাদিত ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এটা ইহুদিবাদের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে ক্রিশ্চানদের গভীরভাবে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। বিশপ অভ লিয়ন ইরেনাস (c. ১৪০-২০০) মারসিওন ও নস্টিকদের কারণে ভীত হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রাচীন ও নতুন ঐশীগ্রন্থের সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছেন। অনুমোদিত টেক্সটের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন তিনি যার মাঝে আমরা ভবিষ্যৎ নিউ টেস্টামেন্টের ভ্রূণকে দেখতে পাই। গস্পেল অভ মার্ক, ম্যাথ্যু, ল্যুক ও জন দিয়ে এর শুরু হয়ে এই পর্যায়ক্রমে-অ্যাক্টস অভ অ্যাপসলস (আদি চার্চের ইতিহাস) হয়ে অগ্রসর হয়েছে, পল, জেমস, পিটার ও জনের চিঠিপত্র অন্তর্ভুক্ত করে দুটো শেষ রেভেলেশন ও শেফার্ড অভ হার্মেস এই দুটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বিবরণ দিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর বেশ কিছুকাল অতিক্রমের আগে বিধি সম্পূর্ণ হয়নি। ইরেনাসের মনোনীত কিছু পুস্তক, যেমন শেফার্ড অভ হারমেস, উৎক্ষিপ্ত হবে ও হিব্রু ও এপিসল অভ জুদের মতো অন্যান্য রচনা ইরেনাসের তালিকায় যোগ হবে।
বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে একেবারেই ভিন্ন ভিন্ন শ্রোতাদের উদ্দেশে ক্রিশ্চান ঐশীগ্রন্থসমূহ রচিত হয়েছে, কিন্তু এগুলোর আইন ও প্রফেটস এবং বিধ্বস্ত দ্বিতীয় মন্দির টেক্সট থেকে উদ্ভূত একটা সাধারণ ভাষা ও বিশেষ কিছু প্রতীক ছিল। এগুলোই মূলত একটার সাথে অন্যটির সম্পর্কহীন বিভিন্ন ধারণাকে–ঈশ্বরের পুত্র, মনুষ্য পুত্র, মেসায়াহ ও রাজ্য-এক সংশ্লেষে একসূত্রে গেঁথেছিল।৫১ লেখকরা এনিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য তুলে ধরেননি, বরং এইসব ইমেজকে এত ঘনঘন স্রেফ প্রতিস্থাপন করেছেন যে তা পাঠকের মনে একসাথে মিশে গেছে।৫২ জেসাস সম্পর্কে কোনও সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। পল তাঁকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ আখ্যায়িত করতেন, কিন্তু পদবীটিকে তিনি প্রচলিত ইহুদি অর্থে ব্যবহার করেছেন: জেসাস মানুষ ছিলেন প্রাচীন ইসরায়েলের রাজাদের মতো ঈশ্বরের সাথে যাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল, এবং তিনিই তাঁকে এমন উচ্চস্থানে তুলেছেন।৫৩ পল কখনওই জেসাসই ঈশ্বর এমন দাবি করেননি। একসাথে সব কিছু দেখেছিলেন বলে ‘সিনোপ্টিকস’ নামে পরিচিত ম্যাথ্যু, মার্ক ও ল্যুকও এইভাবেই ‘ঈশ্বরের পুত্র’ উপাধি ব্যবহার করেছেন, তবে তাঁরা জেসাস আবার দানিয়েলের ‘মনুষ্য পুত্রও’ বুঝিয়েছেন, যা তাঁকে এক ধরনের পরলোকতাত্ত্বিক মাত্রা দিয়েছিল। এক ভিন্ন ক্রিশ্চান ঐতিহ্যের প্রতিনিধি জন জেসাসকে ঈশ্বরের বাণী ও প্রজ্ঞার অবতার হিসাবে দেখেছেন, পৃথিবীর সৃষ্টির আগেও যার অস্তিত্ব ছিল।৫৫ নিউ টেস্টামেন্টের চূড়ান্ত সম্পাদকগণ এইসব টেক্সট সমন্বিত করার সময় এসব বৈষম্য দেখে অস্বস্তি বোধ করেছেন। জেসাস ক্রিশ্চানদের মনে এমন এক বিশাল ঘটনায় পরিণত হয়েছিলেন যে তাঁকে কোনও একটা বিশেষ সংজ্ঞায় বেঁধে রাখা সম্ভব ছিল না।
‘মেসায়াহ’ উপাধিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জেসাসকে ঈশ্বরের ‘মনোনীত (ক্রিস্তোস) হিসাবে সংজ্ঞায়িত করার পর ক্রিশ্চান লেখকগণ একে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ প্রদান করেন। তাঁরা গ্রিক ভাষায় হিব্রু ঐশীগ্রন্থ ব্যবহার করেছেন এবং যেখানেই ক্রিস্তোসের উল্লেখ পেয়েছেন-তা সে রাজা, পয়গম্বর বা পুরোহিত যাই হোক না কেন–সাথে সাথে তা জেসাসের সাঙ্কেতিক উল্লেখ হিসাবে তর্জমা করেছেন। দ্বিতীয় ইসায়াহর দাসের রহস্যময় চরিত্রের কারণেও আকৃষ্ট হয়েছেন তারা, যাঁর ভোগান্তি জগৎক নিষ্কৃতি দিয়েছিল। এই দাস কোনও মেসিয়ানিক চরিত্র ছিলেন না, কিন্তু জেসাস ক্রিস্তোসের সাথে দাসের অবিরাম তুলনার ভেতর দিয়ে এই ‘ধোঁয়াটে’ কৌশল কাজে লাগিয়ে তাঁরা প্রথমবারের মতো কষ্ট সওয়া মেসায়াহর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। এভাবে তিনটি ভিন্ন চরিত্র-দাস, মেসায়াহ ও জেসাস-ক্রিশ্চান ভাবনায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে যায়।৫৬
ক্রিশ্চান পেশার ব্যাখ্যাগুলো এতটাই পরিপূর্ণ ছিল যে নিউ টেস্টামেন্টে এমন একটা পঙক্তি খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে প্রাচীন ঐশীগ্রন্থের উল্লেখ করা হয়নি। চার ইভেঞ্জালিস্ট জেসাসের জীবনীর অন্য উৎস হিসাবে সেপ্টাজিন্ট ব্যবহার করেন বলে মনে হয়। ফলে সত্যি থেকে ব্যাখ্যা আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাঁর মৃত্যুদণ্ড সম্পন্নকারীরা কি সত্যি তাকে ভিনেগার খেতে দিয়েছিল এবং তাঁর পোশাকের জন্যে বাজি ধরেছিল নাকি এই ঘটনাটি শ্লোকের কোনও বিশেষ পঙক্তি থেকে ধারণা লাভ করেছে?৫৭ ম্যাথ্যু কি ভার্জিন বার্থের কাহিনী বলেছেন কেবল ইসায়াহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে জনৈকা ‘কুমারী’ ইম্যানুয়েল নামে এক সন্তান ধারণ ও জন্ম দেবেন, শুধু এই কারণেই (সেপ্টাজিন্ট হিব্রু আলমাহ’র-’তরুণী’-অনুবাদ করেছে পার্থেনোস –’কুমারী’ –হিসাবে)?৫৮ কোনও কোনও পণ্ডিত এতদূরও বোঝাতে চেয়েছেন যে, স্বয়ং জেসাসের একটা কথাও উদ্ধৃত না করে একজন বহিরাগতের পক্ষে গোটা একটা গস্পেল রচনা সম্ভব।
আমরা জানি না কে গস্পেল রচনা করেছেন। প্রথম আবির্ভাবের পর বেনামে এগুলো বিলিবণ্টন হয়েছে। কেবল পরেই আদি চার্চের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে চালানো হয়। লেখকগণ ইহুদি-ক্রিশ্চান ছিলেন, ৬১ যারা গ্রিক ভাষায় লিখতেন ও রোমান সাম্রাজ্যের হেলেনিস্টিক সংস্কৃতিতে বাস করতেন। এরা কেবল সৃজনশীল লেখকই ছিলেন না-প্রত্যেকেরই নিজস্ব পক্ষপাত ছিল-সুদক্ষ সম্পাদকও ছিলেন, এরা প্রাথমিক উপাদান সম্পাদনা করেছেন। ৭০ দশকের দিকে লিখেছেন মার্ক এবং ম্যাথু ও ল্যূক লিখেছেন ৮০-র দশকের দিকে, জন ৯০-র দশকে। চারটি গস্পেলই এই আচ্ছন্ন সময়ের শঙ্কা প্রতিফলিত করে। ইহুদি জনগণ ছিল বিক্ষুব্ধ অবস্থায়। রোমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিবার ও সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, বিভিন্ন গোত্রকে মন্দির ট্র্যাডিশনের সাথে তাদের সম্পর্ক নতুন করে ভাবতে হচ্ছিল। কিন্তু বিধ্বস্ত উপাসনালয়ের অ্যাপোক্যালিন্সিস ক্রিশ্চানদের কাছে এতটাই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে যে তারা জেসাসের মেসায়াহরূপ দাবি করতে অনুপ্রাণিত হয়েছে, যাঁর ব্রত, তাদের বিশ্বাস ছিল, মন্দিরের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
যুদ্ধের অব্যবহিত পরপর লিখছিলেন মার্ক, তিনি বিশেষভাবে এই থিমে আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁর সম্প্রদায় গভীর সংকটে ছিল। মন্দিরের ধ্বংস নিয়ে উল্লাস করার অভিযোগ উঠেছিল ক্রিশ্চানদের বিরুদ্ধে। মার্ক দেখিয়েছেন, তাঁর এক্কলেসিয়ার সদস্যদের সিনাগগের ভেতরে প্রহার করা হচ্ছে, টেনেহিঁচড়ে ইহুদি প্রবীনদের সামনে নিয়ে সর্বসমক্ষে নিন্দা করা হচ্ছে। অনেকেই বিশ্বাস হারিয়েছিল। জেসাসের শিক্ষা যেন কঠিন জমিনে মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে মনে হয়েছে, আর ক্রিশ্চান নেতাদের ত্রিশঙ্কু অবস্থা হয়েছিল ঠিক বারজনের মতো, যারা মার্কের গস্পেলে বিরল ক্ষেত্রে জেসাসকে বুঝতে পেরেছেন। মূল ধারার ইহুদিবাদের সাথে বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের গভীর একটা বোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ‘পুরাতন কাপড়ে কেউ কোরা কাপড়ের তালি দেয় না; দিলে সেই নতুন তালীতে ঐ পুরাতন কাপড় ছিঁড়িয়া যায়, এবং আরও মন্দ ছিদ্র হয়। আর পুরাতন কুপায় কেহ টাটকা দ্রাক্ষারস রাখে না, রাখিলে দ্রাক্ষা রসে কুপাগুলি ফাটিয়া যায়; তাহাতে দ্রাক্ষারস নষ্ট হয়, কুপাগুলিও নষ্ট হয়। অনুসারী হওয়ার মানে ভোগান্তি, দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে অন্তহীন লড়াই। ক্রিশ্চানদের অবশ্যই স্থায়ীভাবে সতর্ক থাকতে হবে!
মন্দির অক্ষত থাকার সময় রচনা করেছেন পল, তিনি মন্দিরের কথা তেমন একটা উল্লেখ করেননি। কিন্তু জেসাস সম্পর্কে মার্কের দৃষ্টিভঙ্গিতে মন্দির কেন্দ্রিয় বিষয়।৬৬ এর ধ্বংস স্রেফ আসন্ন প্রলয়ের প্রথম অধ্যায়। অনেক আগেই দানিয়েল এই ‘বিষণ্নকারী অপবিত্রকরণের’ পূর্বাভাস পেয়েছিলেন; তো মন্দির ছিল অভিশপ্ত। ৬৮ জেসাস বিদ্রোহী ছিলেন না, যেমনটা তাঁর শত্রুরা দবি করে, বরং অতীতের মহান সব চরিত্রের কাতারে ছিলেন। তিনি জেরেমিয়াহ ও ইসায়াহ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মন্দির ইহুদিসহ সকল জাতির জন্যেই ছিল।৬৯ জেন্টাইলদের অনুমোদনকারী মার্কের এক্কলেসিয়া এইসব প্রাচীন ভবিষ্যদ্বাণী পূরণ করেছে, কিন্তু মন্দির ঈশ্বরের পরিকল্পনার সাথে মানাসই ছিল না। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে এটা ধ্বংস করা হয়েছে।
জেসাসের মৃত্যু কোনও কেলেঙ্কারী ছিল না, বরং আইন ও প্রফেটসে এর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল: ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে তিনি তাঁর আপন অনুসারীদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবেন” ও শিষ্যরা তাঁকে ত্যাগ করবে। কিন্তু তারপরেও গস্পেল ত্রাসের সুর দিয়ে শেষ হয়েছে। মহিলারা মৃতদেহে মলম মাখাতে গিয়ে সমাধি শূন্য আবিষ্কার করে। এমনকি একজন দেবদূত তাদের বলেছেন যে, জেসাসকে পুনরুত্থিত করা হয়েছে। ‘মহিলারা বাহির হইয়া কবর হইতে পলায়ন করিলেন, কারণ তাহারা কম্পান্বিতা ও বিস্ময়াপন্না হইয়াছিলেন; আর তাহারা কাহাকেও কিছু বলিলেন না; কেননা তাহারা ভয় পাইয়াছিলেন।৭৩ এখানেই শেষ হয়েছে মার্কের কাহিনী, এই সময়ে ক্রিশ্চানদের অনুভূত ভীতিকর উত্তেজনাকে মূর্ত করে তুলেছেন তিনি। তবু মার্কের তীর্যক, নিষ্ঠুর কাহিনী ‘সুসমাচার’ ছিল, কারণ ‘ইতিমধ্যে’ রাজ্যের ‘আগমন ঘটেছে।’[৭৪]
কিন্তু ৮০-র দশকের শেষের দিকে যখন ম্যাথ্যু লিখছিলেন, এইসব আশা তিরোহিত হতে শুরু করেছিল। কিছুই বদলায়নিঃ কেমন করে রাজ্যের আগমন ঘটল? ম্যাথ্যু জবাব দিয়েছেন যে, অলক্ষে আসছে তা, ইতিমধ্যে ময়দার তালে ইয়েস্টের মতো নীরবে কাজ করে চলেছে।” তাঁর গোষ্ঠী ছিল সন্ত্রস্ত ও ক্ষুব্ধ। প্রতিবেশী ইহুদিরা তাদের বিরুদ্ধে তোরাহ ও প্রফেটস ত্যাগ করার অভিযোগ তুলেছিল, ৬ সিনাগগে তাদের আঘাত করা হয়েছে, প্রবীনদের সামনে বিচারের জন্যে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ৭৭ এবং সমাপ্তির আগেই নির্যাতন করে তাদের হত্যা করা হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে। সুতরাং ম্যাথ্য বিশেষভাবে ক্রিশ্চান ধর্ম কেবল ইহুদি ঐতিহ্যেরই অংশ নয় বরং এর পরিণতি দেখাতে উদগ্রীব ছিলেন। জেসাসের জীবনের প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে ‘ঐশীগ্রন্থকে পরিপূর্ণ’ করার জন্যে। ইশমায়েল, স্যামসন ও ইসাকের মতো একদল দেবদূত তাঁর জন্মের ঘোষণা দিয়েছিলেন 1 বুনো এলাকায় তাঁর চল্লিশ দিনের প্রলোভন ইসরায়েলিদের চল্লিশ বছর মরুপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর সমান্তরাল ঘটনা; ইসায়াহ এই অলৌকিক ঘটনার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এবং-সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-জেসাস ছিলেন মহান তোরাহ শিক্ষক। পাহাড় চূড়ায় তিনি নতুন আইন পালন করেছেন’-মোজেসের মতো-জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি আইন ও প্রফেটদের রদ করতে নয় বরং তাকে পূর্ণতা দিতে এসেছেন।৮২ ইহুদিদের এখন অবশ্যই আগের চেয়ে আরও কঠোরভাবে তোরাহ অনুসরণ করতে হবে। এখন ইহুদিদের কেবল হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত থাকলেই যথেষ্ট হবে না, তাদের ক্রুদ্ধও হওয়াও চলবে না। ব্যাভিচারই কেবল নিষিদ্ধ নয়, কোনও পুরুষ এমনকি কামনার চোখে কোনও মেয়ের দিকে তাকাতেও পারবে না। ৩ প্রতিশোধের প্রাচীন বিধান- চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত-রদ করা হয়েছে। ইহুদিদের এখন অবশ্যই শত্রুকে অপর গাল পেতে দিতে হবে, ভালোবাসতে হবে।” হোসিয়ার মতো জেসাস যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আচরিক অনুসরণের চেয়ে আবেগ ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হিল্লেলের মতোই তিনি স্বর্ণবিধি শিক্ষা দিয়েছেন।৮৬ জেসাস ছিলেন সলোমন, জোনাহ ও মন্দিরের চেয়েও মহান। ৭ ম্যাথ্যুর আমলের ফারিজিরা দাবি করত যে, তোরাহ পাঠ ইহুদিদের স্বর্গীয় সত্তার (শেখিনাহ) সাথে পরিচিত করিয়ে দেবে যার সাথে মন্দিরে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল: ‘দুজন ব্যক্তি একত্রে বসিয়া থাকিবার মুহূর্তে তাহাদের মাঝে তোরাহর বাণী থাকিলে শেখিনাহ তাহাদের মাঝে অবস্থান করে।৮৮ কিন্তু জেসাস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন: ‘যখন দুই কি তিনজন আমার নামে একত্র হয়, সেইখানে আমি তাহাদের মধ্যে আছি। জেসাসের মাধ্যমে ক্রিশ্চানরা শেখিনাহর সাক্ষাৎ লাভ করবে, এখন যিনি তোরাহ ও মন্দিরকে প্রতিস্থাপিত করেছেন।
ল্যূক গস্পেলের পাশাপাশি বেশ কিছূ অ্যাক্টস অভ অ্যাপসলেরও রচয়িতা ছিলেন। তিনি এটা দেখাতে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে জেসাস ও তাঁর অনুসারীরা ধর্মপ্রাণ ইহুদি বটে; কিন্তু তিনিও এটাও জোরের সাথে বলেছেন, গস্পেল সবার জন্যেই। ইহুদি, জেন্টাইল, নারী-পুরুষ, দরিদ্র, করসংগ্রাহক, সামারিতান ও উড়ণচণ্ডী ছেলে। ল্যূক আমাদের আদি ক্রিশ্চানদের পেশার ব্যাখ্যাকারীরা যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দান করেছেন তার অমূল্য আভাস দিয়েছেন। তিনি জেসাসের দুই শিষ্য সম্পর্কে একটি প্রতীকী কাহিনী বলেছেন, ক্রুসিফিকশনের তিন দিন পরে জেরুজালেম থেকে পায়ে হেঁটে ইম্মায়ূসে যাচ্ছিলেন। ল্যুকের নিজস্ব সময়ের আরও অনেক ইহুদির মতো তাঁরা ছিলেন দিশাহারা ও হতাশ, কিন্তু পথে এক আগন্তুকের সাথে তাদের দেখা হয়। আগন্তুক ওদের এই দুরবস্থার কারণ জানতে চান। তখন তাঁরা বলেন, তাঁরা জেসাসের অনুসারী এবং তিনি যে মেসায়াহ এতে তাঁদের কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলার জন্যে ওদের সাথের মহিলারা শূন্য সমাধি ও দেবদূত দেখার গুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে। আগন্তুক মৃদু ভাষায় তাদের ভর্ৎসনা করেন: ওরা কি এটা বুঝতে পারেননি যে মহত্ম অর্জনের আগে মেসায়াহকে কষ্ট সহ্য করতে হবে? মোজেসকে দিয়ে শুরু করে তিনি প্রফেটদের ‘পূর্ণাঙ্গ বাণী’ ব্যাখ্যা করলেন। সেদিন সন্ধ্যায় শিষ্যরা যখন গন্তব্যে পৌঁছালেন, আগন্তুককে তাদের সাথে থাকার আবেদন জানালেন তাঁরা। পরে খাবার সময় আগন্তুক যখন রুটি ছিঁড়ছেন, সহসা তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, গোটা সময়টায় তাঁরা জেসাসের সাথেই ছিলেন, কিন্তু তাদের ‘চোখে ছানি দেওয়া’ ছিল, তাঁকে চিনতে পারেননি। তিনি চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে তাঁরা বুঝতে পারলেন কেমন করে তিনি ‘ঐশীগ্রন্থ উন্মোচন’ করার পর তাঁদের হৃদয় ‘অন্তরে জ্বলছিল।
ক্রিশ্চান পেশার ছিল, বিষাদ ও বিস্ময়ে প্রোথিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন, হৃদয়ের মাঝে সরাসরি অবস্থান করে তাকে প্রজ্জ্বলিত করে। ক্রিশ্চানরা দুই কি তিনজন মিলিত’ হয়ে জেসাসের সাথে আইন ও প্রফেটদের সম্পর্ক আলোচনা করবে। একসাথে কথা বলার সময় টেক্সট ‘উন্মুক্ত’ হয় ও ক্ষণিকের আলোকন এনে দেয়। ঠিক জেসাস যেমন তাঁকে চেনার সাথে সাথে মিলিয়ে গিয়েছিলেন, এটাও তেমনিভাবে মিলিয়ে যাবে, কিন্তু পরে আপাত বিরোধী বিষয় সমগ্রের এক নুমিনাস সম্পর্কে একসাথে মিলিত হয়। আগন্তুক এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আগে দেখেননি এমন কারও কাছে যখন নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করছিলেন, এক ধরনের বিশ্বাসের (পিস্তিস) পরিচয় রেখেছিলেন শিষ্যরা। ল্যকের এক্কলেসিয়ায় ইহুদি ও জেন্টাইলরা একে ‘অন্যের’ দিকে আগ্রসর হয়ে শেখিনাহর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে বলে আবিষ্কার করেছে, যাকে ক্রমবর্ধমানভাবে ক্রিস্তোসের সাথে এক করে দেখেছে ওরা।
এশিয়া মাইনরের বেশ কিছু চার্চ জনের নামে প্রচলিত গস্পেল ও তিনটি চিঠি এবং রেভেলেশনের পরকালতাত্ত্বিক পুস্তকের উপর ভিত্তি করে জেসাসের ভিন্ন উপলব্ধি গড়ে তুলছিল। এই সমস্ত ‘জোয়ানিয়’ টেক্সট জেসাসকে লোগোসের অবতার হিসাবে দেখেছে, যিনি ঈশ্বরের একান্ত প্রকাশ হিসাবে পৃথিবীতে অবতরণ করেছেন। ১ জেসাস ছিলেন ঈশ্বরের মেষ, উৎসর্গের শিকার যিনি পৃথিবী থেকে পাপ অপসারণ করেছেন, পাসওভারে মন্দিরে আচরিকভাবে উৎসর্গ করা মেষের মতো।৯২ পরস্পরকে ভালোবাসাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করত তারা,” কিন্তু অচেনা লোকদের কাছে টানেনি। এই সম্প্রদায় নিজেদের দলছাড়া ভেবে ‘জগতের’৪ বিরুদ্ধে জোট বেঁধে ছিল। গোটা অস্তিত্বই যেন পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন দলে মেরুকৃত হয়েছিল: অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো, আত্মার বিরুদ্ধে জগৎ, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবন এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভ। চার্চগুলো সম্প্রতি এক বেদনাদায়ক বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল: এদের কোনও কোনও সদস্য এসবের শিক্ষাকে ‘অসহনীয়’ আবিষ্কার করে ‘জেসাসের সাথে চলা’ বাদ দিয়েছিল।[৯৫] বিশ্বাসীরা এইসব ধর্মদ্রোহীকে মেসায়াহর প্রতি জঘন্য ঘৃণায় পরিপূর্ণ ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ বিবেচনা করেছে।[৯৬]
ক্রিশ্চান গোত্রের সদস্যরা নিশ্চিত ছিল যে কেবল তারাই সঠিক পথে আছে এবং গোটা বিশ্ব ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।৯৭ বিশেষ করে জনের গস্পেল এক ‘অন্তদলের’ উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিল, যার নিজস্ব প্রতীকীবাদ বহিরাগতের কাছে ছিল দুর্বোধ্য। জেসাসকে বারবার ‘ইহুদিদে’র বলতে হচ্ছিল, তারা তাঁকে অন্বেষণ করবে, কিন্তু পাবে নাঃ ‘আমি যেখানে যাইতেছি সেখানে তোমরা আসিতে পার না। তাঁর শ্রোতারা অবিরাম হতবিহ্বল হচ্ছিল, কিন্তু জেসাস যেহেতু ঈশ্বরের পরম প্রকাশ, এই গ্রহণে অনীহা ছিল একটা রায়: তাঁকে যারা অস্বীকার করেছে তারা শয়তানের সন্তান, তারা অন্ধকারেই থেকে যাবে।
জনের চোখে ইহুদিবাদ বেশ ভালোভাবেই অতীত। তিনি পদ্ধতিগতভাবে জেসাসকে ইসরায়েলের পক্ষে ঈশ্বরের প্রতিটি প্রত্যাদেশ প্রতিস্থাপিত করছেন বলে বর্ণনা করেছেন। এখন থেকে ইহুদিরা যেখানে ঐশী সত্তার উপস্থিতি বোধ করবে সে জায়গাই হবে উদিত লোগোস: লোগোস জেসাস বিধ্বস্ত মন্দিরের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নেবেন; এবং সেই জায়গায় পরিণত হবেন সেখানে ইহুদিরা স্বর্গীয় সত্তাকে অনুভব করবে।” সে যখন মন্দির থেকে বের হয়ে আসবে, শেখিনাহও তার সাথে বাইরে আসবে।১০ সে সুক্কোসের উৎসব পালন করার সময়, যখন বেদীতে আনুষ্ঠানিকভাবে পানি ঢালা হয় ও মন্দিরের বিশাল মশাল জ্বালানো হয়, জেসাস তখন-প্রজ্ঞার মতো-চিৎকার করে বলেন যে, তিনিই জগতের জীবিত জল ও আলো। ১০১ অখণ্ড রুটির উৎসবে তিনি নিজেকে ‘জীবনের রুটি’ দাবি করেছেন। তিনি কেবল মোজেস[১০২] ও আব্রাহামের চেয়েই মহান নন, বরং স্বর্গীয় সত্তাকে মূর্ত করে তুলেছেন: তাঁরই ঈশ্বরের নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণের সাহস ছিল: ‘আব্রাহামের জন্মের পূর্ব্বাবধি আমি আছি [আনি ওয়াহো]।[১০৩] সিনোপ্টিকদের বিপরীতে জন কখনওই জেসাসকে অ-ইহুদি ধর্মান্তরিতদের আকৃষ্ট করছেন বলে দেখাননি। গোড়ার দিকে তাঁর এক্কলেসিয়া সম্ভবত সম্পূর্ণ ইহুদিদের জন্যে ছিল এবং অ্যাপসলরা হয়তো ইহুদি-ক্রিশ্চান ছিলেন, যারা সম্প্রদায়ের বিতর্কিত ও সম্ভাব্য ব্লাসফেমাস খৃস্টতত্ত্বকে ‘অসহনীয়’ আবিষ্কার করেছিলেন। ১০৪
বুক অভ রেভেলেশন জোয়ানিয় ক্রিশ্চান ধর্মমতের তিক্ততা তুলে ধরে। এখানে জনের গস্পেলের পুনরাবৃত্ত মটিফ শুভ ও অশুভ শক্তির ভেতরকার মহাজাগতিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। স্যাটান ও তার স্যাঙ্গাত্রা স্বর্গের মাইকেল ও স্বর্গীয় দেবদুত বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছে, দুষ্টজনেরা পৃথিবীতে হামলা করেছে সৎ মানুষদের। বিপদাপন্ন এক্কলেসিয়ার কাছে নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল যে অশুভই জয় লাভ করবে, কিন্তু রেভেলেশনের লেখক জন অভ পাতমোস জোর দিয়ে বলছেন, ঈশ্বর গুরুত্বপূর্ণ একটা মুহূর্তে হস্তক্ষেপ করে তাদের প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করবেন। তিনি এক বিশেষ ‘প্রত্যাদেশ’ (অ্যাপোক্যালিপ্সিস) লাভ করেছিলেন, যা পরিস্থিতির ‘উন্মোচন’ ঘটাবে, যাতে বিশ্বাসী জানতে পারে কীভাবে শেষ সময়ে নিজেদের চালাতে হবে। অ্যাপোক্যালিপ্স আগাগোড়া আতঙ্কে পরিপূর্ণ: রোমান সাম্রাজ্য, স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায় ও অশুভ ক্রিশ্চান দলগুলোর কারণে ভীত ছিল চার্চ। কিন্তু লেখক তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত শয়তান পশুকে তার ক্ষমতা তুলে দেবে, সাগরের গভীর থেকে উঠে আসবে সে, সারা বিশ্বের আনুগত্য দাবি করবে। তখন উদ্ধার করার জন্যে এগিয়ে আসবেন মেষ। এমনকি বাবিলনের বেশ্যাও শহীদ ক্রিশ্চানদের রক্ত পান করে মাতাল আবস্থায় হাজির হবে, দেবদূতের দল পৃথিবীর উপর সাতটি ভয়ানক প্লেগ বর্ষণ করবেন এবং পশুর বিরুদ্ধে লড়াই করে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করার জন্যে শ্বেত ঘোড়ার পিঠে আসীন হয়ে যুদ্ধে নামবেন বাণী। হাজার বছর ধরে জেসাস সাধুদের সাথে নিয়ে জগৎ শাসন করবেন, কিন্তু তারপর কারাগার থেকে স্যাটানকে মুক্ত করে দেবেন ঈশ্বর। শান্তি পুনঃস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত আরও প্রলয়, আরও লড়াইয়ের ঘটনা ঘটবে, স্বর্গ থেকে বিয়ের কনের মতো মেষের সাথে মিলিত হতে নতুন জেরুজালেম অবতীর্ণ হবে।
অন্য সমস্ত জোয়ানিয় রচনার মতো রেভেলেশন পরিকল্পিতভাবে অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন, এর প্রতীকসমূহ বহিরাগতের চোখে বোধের অতীত। এটা একটা বিষাক্ত বই; আমরা দেখব সেইসব লোকের কাছে আবেদন সৃষ্টি করেছিল যারা জোয়ানিয় চার্চের মতো নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও অসন্তুষ্ট আবিষ্কার করেছিল। বিতর্কিতও ছিল এটা, কোনও কোনও ক্রিশ্চান একে অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত করতে অনীহ ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সম্পাদকবৃন্দ একে নিউ টেস্টামেন্টের শেষে স্থান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে হিব্রু ঐশীগ্রন্থের পেশার ব্যাখ্যাকারীদের বিজয়ের ফিনালেতে পরিণত হয়েছিল। এটা খৃস্টধর্মের উত্থানের ঐতিহাসিক কাহিনীকে ভবিষ্যৎমুখী অ্যাপোক্যালিপ্সে রূপান্তরিত করেছে। নিউ টেস্টামেন্ট পুরোনোকে প্রতিস্থাপিত করবে: ‘আর আমি নগরের মধ্যে কোন মন্দির দেখিলাম না; কারণ সর্ব্বশক্তিমান প্রভু ঈশ্বর এবং মেষশাবক স্বয়ং তাহার মন্দিরস্বরূপ।’ ইহুদিবাদ ও এর সবচেয়ে পবিত্র প্রতীকসমূহ এক বিজয়ী উগ্র ক্রিশ্চান ধর্মে প্রতিস্থাপিত হয়।১০৫
নিউ টেস্টামেন্টে ঘৃণার একটা সুর ধ্বনিত হয়েছে। ক্রিশ্চান ঐশীগ্রন্থগুলোকে অ্যান্টি-সেমিটিক বলা ঠিক হবে না, কারণ খোদ এর রচয়িতাগণ ছিলেন ইহুদি, তবে তাঁদের অনেকেই ইহুদি ধর্মে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। পল ইহুদিবাদের প্রতি এই বৈরিতার বাহক নন, তবে নিউ টেস্টামেন্টের অধিকাংশই মন্দির ধ্বংসের অব্যবহিত পরবর্তী সেই সময়ের ব্যাপক বিস্তৃত সন্দেহ, উৎকণ্ঠা ও উত্তাল অবস্থা তুলে ধরেছে, যখন ইহুদিরা তিক্তভাবে বিভক্ত ছিল। জেন্টাইল বিশ্বের দিকে হাত বাড়াতে উদ্বিগ্ন সিনাগগগুলো রোমানদের জোসাসের মৃত্যুদণ্ডের দায় থেকে নিষ্কৃতি দিতে উদগ্রীব ছিল এবং ক্রমবর্ধমান জোরের সাথে দাবি করছিল যে, ইহুদিদেরই এই দায়িত্ব নিতে হবে। এমনকি ইহুদিবাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালনকারী ল্যুক পর্যন্ত পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন যে, একটা ভালো ইসরায়েলের অস্তিত্ব ছিল (জেসাসের অনুসারীদের মাধ্যমে প্রতিপলিত) এবং একটা ‘খারাপ’ ইসরায়েল; আপনাভালো ফারিজিদের মাধ্যমে মূৰ্ত। ১০৬ ম্যাথ্যু ও জনের গস্পেলে এই পক্ষপাতিত্ব আরও গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ম্যাথ্যু ইহুদি জনতাকে দিয়ে জেসাসের মৃত্যুর জন্যে চিৎকার করিয়েছেন, ‘উহার রক্ত আমাদের উপরেও আমাদের সন্তানদের উপরে বর্ত্তক,১০৭ এইসব কথা শত শত বছর ধরে এমন সব হত্যাকাণ্ডকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে যা অ্যান্টিসেমিটিজমকে ইউরোপের দূরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত করেছে।
ম্যাথ্যু বিশেষ করে ফারিজিদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন: ওরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, কপটাচারী, আত্মাকে নিদারুণ অবহেলা করে কেবল আইনের অক্ষর নিয়ে আচ্ছন্ন, ওরা ‘অন্ধ পরিচালক’, ‘কালসর্পের বংশধর’, ধর্মান্ধের মতো ক্রিশ্চান চার্চ ধ্বংস করার জন্যে ক্ষেপে আছে। ১০৮ জনও ফারিজিদের শত্রুভাবাপন্ন, নির্যাতনকারী ও অশুভের প্রতি পৌনঃপৌনিক আসক্ত বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন; ফারিজিরাই জেসাসের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তাঁর মৃত্যু ডেকে এনেছে।১০৯ ফারিজিদের প্রতি কেন এই ভয়ানক ঘৃণা? মন্দির ধ্বংসের পর ক্রিশ্চানরাই প্রথম প্রকৃত ইহুদি কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছিল এবং প্রথম দিকে তাদের কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিপক্ষ আছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু ৮০ ও ৯০-র দশকে ক্রিশ্চানরা অস্বস্তিকরভাবে সজাগ হয়ে উঠতে শুরু করে যে অস্বাভাবিক একটা কিছু ঘটছে: ফারিজিরা বিস্ময়কর পুনর্জাগরণ ফিরে পাচ্ছে।