গন্ধটা সন্দেহজনক
—এই… থামাও এবার…
না থামিয়ে উপায়ও ছিল না অবশ্য। ড্রাইভার ব্রেক কষতে বাধ্য হলেন গন্তব্যের অন্তত দেড়শো মিটার আগে। ভিড় বলে ভিড়! সকাল পৌনে আটটা থেকে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। পুরো কাঁচড়াপাড়া অঞ্চলটাই যেন রাস্তায় নেমে এসেছে। পুলিশ সুপার হাঁটতে শুরু করেন গাড়ি থেকে নেমে। স্থানীয় বীজপুর থানার অফিসাররা তো বটেই, স্পটে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছেন এসডিপিও ব্যারাকপুর। এসে গিয়েছেন অ্যাডিশনাল এসপি ব্যারাকপুরও।
উগ্র জনতার বিক্ষোভ উগ্রতর হয় এসপি-কে দেখে। একাধিক দাবি ছিটকে আসতে থাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে। ‘চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি না দিলে ব্লকেড উঠবে না! আজকের মধ্যেই বীজপুর থানার আইসি (ইনস্পেকটর-ইন-চার্জ)-কে বদলি করতে হবে! থানার দুশো মিটারের মধ্যে এই ঘটনা কীভাবে ঘটল, এসপি-কে প্রকাশ্যে তার জবাবদিহি করতে হবে, নয়তো বডি তুলতে দেওয়া হবে না!…’ ইত্যাদি।
অস্বাভাবিক কিছু নয়। যা ঘটেছে, যেভাবে ঘটেছে, এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফেটে না পড়লেই বরং অবাক হওয়ার ছিল। এসব ক্ষেত্রে যা প্রাথমিক করণীয়, সেটাই করলেন পুলিশ সুপার। জনতার বক্তব্য প্রায় আধঘণ্টা ধরে শুনলেন ধৈর্য ধরে। অন্নপ্রাশনের ভাত মুখে উঠে আসবে, এমন গালিগালাজ… পুলিশের চোদ্দোপুরুষের বাপ-বাপান্ত… শুনলেন মাথায় বরফ চাপিয়ে। জানতেন, ক্ষোভের বাষ্পটা যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবে, তত দ্রুত বডিটা তুলে পোস্টমর্টেমে পাঠানো যাবে। শুরু করা যাবে তদন্তের কাজ।
এসপি প্রতিশ্রুতি দিলেন, থানার টহলদারি ব্যবস্থা রাত থেকেই ঢেলে সাজানোর। নিশ্চয়তা দিলেন, মামলার তদন্তে পদস্থ আধিকারিকদের নেতৃত্বে আজই গঠন করা হবে ‘সিট’ (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম)। অবরোধ উঠল প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের কথা-চালাচালির পর। রাস্তা একটু ফাঁকা হওয়ার পর এগোতে পারলেন পুলিশ সুপার। ‘বডি’ অবধি যেতেই পারেননি এতক্ষণ।
বছর চল্লিশের মহিলার দেহটা গলিতে পড়ে আছে নিথর। আটপৌরে শাড়ি পরনে। মাথা চুরমার হয়ে গেছে আঘাতের তীব্রতায়। অস্ত্রের আঘাত নয়। অনেক উঁচু থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার আঘাত। মৃত্যু যে এসেছে মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, সেটা বুঝতে অন্তত ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয় না। শরীরের অন্য কোথাও কোনও আঘাতের আভাস নেই।
রক্তাক্ত দেহটা যখন পুলিশ গাড়িতে তুলছে, মিডিয়া ছবি তুলছে খচখচ, জনতার ভিড়কে কোনওক্রমে ঠেকিয়ে রাখছে পুলিশি ব্যারিকেড, এসপি-র মনে পড়ে যায় সেই মাঝবয়সি ভদ্রলোকের কথা। যিনি একটু আগেই বিক্ষোভ চলাকালীন উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছিলেন, ‘শুনুন সাহেব, আমি জন্মেছি এই পাড়ায়। এমন ঘটনা এই এলাকায় কখনও ঘটেনি। আপনার পুলিশ আছে কী করতে?’
সত্যি বলতে, ভদ্রলোক একটু কমিয়েই বলেছেন। এই কাঁচড়াপাড়ায় কেন, রাজ্যেই এমন ঘটনা অদূর বা সুদূর অতীতে ঘটেছে আর?
.
বীজপুর থানা। কেস নম্বর ৩২/২০০৮। তারিখ, ২১ ফেব্রুয়ারি। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৯৬ ধারায়। ডাকাতি এবং তার সঙ্গে খুনও।
কাঁচড়াপাড়া বাজারের একেবারে কেন্দ্রস্থলেই বিমল দাসের চারতলা বাড়ি। পঁয়তাল্লিশ বছরের বিমল পেশায় স্বর্ণব্যবসায়ী। এই বাড়িটা কিনেছেন তা প্রায় সাত-আট মাস হল। খোলনলচে বদলে দিয়ে বাড়িটা সাজাচ্ছেন নতুন করে। মাসখানেক ধরে মিস্ত্রিদের নিত্য যাওয়া-আসা। দিনভর ছুতোরের ঠুকঠাক।
একতলায় ‘বি দাস অ্যান্ড সন্স’ নামে সোনার দোকান। দোকানের একেবারে লাগোয়াই ওয়ার্কশপ, যেখানে কারিগররা কাজ করে। দোকানের শেষ প্রান্তে একটা দরজা। যেটা খুললে উপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। দোকানের মধ্যে দিয়ে ছাড়া উপরে যাওয়ার রাস্তা নেই আপাতত।
বাড়ির লোক বলতে বিমল নিজে, স্ত্রী চন্দনা আর দুই ছেলেমেয়ে। দু’তলা আর তিনতলায় এখন কেউ থাকে না। ওখানে কাঠের কাজ চলছে। কাজ চলছে আসবাবপত্র পালিশেরও। চারতলায় সপরিবারে থাকেন বিমল। তিনটে ঘর। সঙ্গে ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং। একটা ঘরে বিমল আর চন্দনার সঙ্গে শোয় আট বছরের ছেলে বিদ্যুৎ। অন্য একটা ঘরে থাকে আঠারো বছরের মেয়ে অনিন্দিতা। একটা ঘর খালিই পড়ে থাকে। আত্মীয়স্বজন এসে পড়লে ব্যবহার হয় কদাচিৎ। চারতলাটাও যে পুরোপুরি তৈরি, এমন নয়। এখনও অসম্পূর্ণই। বিমলদের থাকার অংশটার পাশে অনেকটা জায়গা এখনও খোলা ছাদ। ঘরে ঢোকার দরজাটা ছাদ-সংলগ্ন। দরজার সামনে কোলাপসিবল গেট।
শোয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দাতেও এখনও গ্রিল বসানো হয়নি। স্রেফ ঢালাই হয়েছে। ভারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাজ করছে দিনরাত। বিমলের ভাবাই আছে, দু’তলা-তিনতলাটা তৈরি হয়ে গেলে নীচে নেমে আসবেন সপরিবার। ওয়ার্কশপটা প্রয়োজনে চারতলায় তুলে আনবেন।
দোকান আর বাড়ি মিলিয়ে কুড়িজন কর্মচারী। যারা বাড়ির কাজকর্ম করে, তারা কেউ স্থায়ী নয়। রোজকার কাজ করে চলে যায়। কর্মচারীরাও রাত সাড়ে আটটা-ন’টার মধ্যে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে যে যার বাড়ি চলে যায়। শুধু বহুদিনের পুরনো কর্মচারী কাম ম্যানেজার নিরঞ্জন পাল প্রায় প্রতি রাতই ওয়ার্কশপের ঘরে কাটান। ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে রোজকার মতোই দোকানের ঝাঁপ পড়ার পর নিরঞ্জন সব তালা বন্ধ করে চাবির গোছা বিমলকে চারতলায় দিয়ে আসেন সোয়া ন’টা নাগাদ। তারপর এসে শুয়ে পড়েন ওয়ার্কশপে। আরেকজন কর্মচারী, অভিজিৎ ভৌমিকও সে-রাতে ওয়ার্কশপে থেকে গিয়েছিলেন কাজের চাপ বেশি থাকায়।
রাত সাড়ে দশটার মধ্যে বিমলদের খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গিয়েছিল। স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে বিমল শুয়ে পড়েছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনে, মেয়ে তাই নিজের ঘরে রাত জেগে পড়াশুনো করছিল। এর পরের ঘটনাক্রম? থাকুক বিমলের নিজের বয়ানে।
‘আমার ঘুম ভেঙে গেছিল কুকুরের চিৎকারে। একটানা ঘেউঘেউ করেই চলেছিল কুকুরগুলো। বিছানা থেকে উঠলাম। ভাবলাম, একবার বাথরুম থেকে ঘুরে আসি। ঘরের আর ছাদের দিকের আলো জ্বালিয়ে ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুমে গেলাম। বেরিয়ে দেওয়াল-ঘড়িটা দেখলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। ছাদের দিকের কোলাপসিবল গেটের কাছে কেমন যেন একটা খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পেলাম। কারা যেন ফিসফাস কথাবার্তাও বলছে। সন্দেহ হল। ঘরের দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারতেই দেখি, গেটের সামনে চার-পাঁচজন লোক। হাতে পিস্তল-বন্দুক। শাবল দিয়ে কোলাপসিবল গেটের তালা ভাঙার চেষ্টা করছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ‘‘ডাকাত! ডাকাত!’’ বলে চিৎকার করে ঘুম ভাঙালাম চন্দনার। ছেলেও উঠে পড়ল হইহল্লায়। আমি চন্দনাকে বললাম শোয়ার ঘরের বারান্দা দিয়ে ‘‘ডাকাত! ডাকাত!’’ চিৎকার করতে, যাতে পাড়াপ্রতিবেশী শুনতে পায়। চন্দনা ব্যালকনির দিকের দরজা খুলে বেরতেই দেখলাম বারান্দাতেও তিনজন লোক দাঁড়িয়ে। ওদের হাতেও পিস্তল। চন্দনা আঁতকে উঠে ‘‘ডাকাত’’ বলে চিৎকার করতেই ওরা চন্দনার মুখ চেপে ধরল।
‘চন্দনা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি ভয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেছিলাম। ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছিল। তারপর যা ঘটল, দেখে আমরা কথা হারিয়ে ফেললাম। ধস্তাধস্তির মধ্যে ওদের একজন চন্দনাকে বারান্দার ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে উপর থেকে নীচে ঠেলে ফেলে দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল পুরোটা। চন্দনা আমাদের চোখের সামনে চারতলা থেকে পড়ে গেল।
‘বারান্দায় দাঁড়ানো ওই তিনজন হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকে মূল দরজাটা খুলে দিল। ততক্ষণে বাইরের কোলাপসিবল গেটের তালা ডাকাতরা ভেঙে ফেলেছে। আরও চার-পাঁচজন খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক বা পিস্তল… যে কোনও একটা আর্মস ছিল। একজনের বুকের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে গুলি-লাগানো বেল্ট ছিল। চম্বলের ডাকাতদের যেমন থাকে সিনেমায়, অনেকটা সেরকমই।
‘ঘরে যে ক’জন ছিল, তাদের তিন-চারজনের মুখে কাপড় বাঁধা ছিল। বাকিদের মুখ খোলা। ওদের মধ্যে একজন আমার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে বলল, ‘‘দুকান কি চাবি দো জলদি… নেহি তো জান সে মার ডালুঙ্গা।’’ ওদের বেশিরভাগই জড়ানো হিন্দিতে কথা বলছিল। দু’-একজন অবশ্য স্পষ্ট বাংলা বলছিল।
‘ডাকাতরা আমাকে আর ছেলেকে বন্দুক ঠেকিয়ে নীচে নিয়ে গেল। ওয়ার্কশপের ঘরের সামনে এনে বলল ঘরটা খুলে দিতে। আমি ওয়ার্কশপের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নিরঞ্জনকে ডাকাডাকি করলাম। নিরঞ্জন ভিতরে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলল। ডাকাতরা ঢুকে পড়ে ওয়ার্কশপ তছনছ করা শুরু করল। অনেকটা সময় থাকল ভিতরে। ওখানে যা গয়নাগাটি ছিল, নিয়ে নিল।
‘এরপর আমাকে নিয়ে দোকানের শাটারের কাছে এল। সেখানে এসে দেখি, আরও তিন-চারজন ডাকাত আগে থেকেই মজুত। এবং তারা শাটার ভেঙে ফেলেছে। ভাঙা শাটারের নীচ দিয়ে ডাকাতরা আমাকে আর ছেলেকে নিয়ে দোকানে ঢুকল। আমাকে আলো জ্বালতে বলল দোকানের। আমি জ্বেলে দিই। এরপর আমাকে একজন পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘‘শালা সিন্দুকের চাবি চিনিয়ে দে, না হলে তোর সামনেই ছেলেকে গুলি করে মারব।’’
‘ওরা যা বলছিল, আমি যন্ত্রের মতো করে যাচ্ছিলাম। সিন্দুকের চাবি দেখিয়ে দিলাম। ওরা সিন্দুক আর শোকেসের ড্রয়ার খুলে সমস্ত সোনা এবং রুপোর গয়না বের করে পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিল। কিচ্ছু বাদ রাখল না। অন্তত ঘণ্টাখানেক ধরে সব হাঁটকাল। তারপর দোকানের বাইরে নিয়ে এসে আমাদের শাসাল একবার। স্টেশনের দিকে তারপর চলে গেল পায়ে হেঁটে। ভোর হয়ে গেছে তখন। আমি, নিরঞ্জন আর অভিজিৎ ছুটলাম বাড়ির পিছনদিকে। দেখলাম, বাড়ির পিছন দিকের গলিতে রক্তাক্ত অবস্থায় চন্দনা পড়ে আছে।
‘দেখে যা মনে হয়েছিল, ওদের বেশিরভাগের বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের কাছাকাছি হবে। আমি কয়েকজন ডাকাতকে ভালভাবে দেখেছি, যাদের মুখ ঢাকা ছিল না। একজনের অবশ্য বয়স তুলনায় কমের দিকে ছিল। মুখটা বেশ বাচ্চা-বাচ্চা। একজন ছিল চৌকোটে মুখের। আরেকজনের চোখদুটো মনে আছে। যেন কোটরে ঢোকা। একটা লোক সামান্য ভারী চেহারার ছিল। বেঁটে। চুল পাতলা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। এ বারান্দায় ছিল। এর মুখটা স্পষ্ট মনে আছে। এই লোকটাই চন্দনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। একেই দলটার লিডার মনে হয়েছিল। বাকিদের সঙ্গে ধমকে কথা বলছিল।’
নিরঞ্জন আর অভিজিতের বয়ানও হুবহুই মিলে গেল বিমলের সঙ্গে। বিদ্যুতের সঙ্গে কথা বলার প্রশ্নই ছিল না। আট বছরের ছেলে। চোখের সামনে মা-কে বারান্দা থেকে ঠেলে ফেলে দিতে দেখেছে ডাকাতদের। প্রায় বাক্রুদ্ধ হয়ে গেছে। কেঁদেই চলেছে দিদির কোলে মাথা রেখে। ‘দিদি’কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘রাত্রে কিছু টের পাওনি?’
—না… প্রায় রাত দুটো অবধি পড়াশুনো করে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার কানে আসেনি কিছু।
দোকান আর ওয়ার্কশপ একরকম ফাঁকাই করে দিয়ে গেছে ডাকাতরা। কত টাকার গয়না লুঠ হয়েছে? এফআইআর-এ বিমল যা লিস্ট দিয়েছেন, কমপক্ষে লাখ বিশেক টাকার মাল তো গেছেই। শোয়ার ঘরের টেবিলে পড়ে থাকা চন্দনার মোবাইল ফোনটাও নিয়ে গেছে ডাকাতরা। বিমলের ফোনটা বেঁচে গেছে। অত গয়নাগাটি লুঠের ফাঁকে ডাকাতরা বিমলের ফোনটা নেওয়ার কথা খেয়াল করেনি সম্ভবত।
কীভাবে চারতলায় উঠেছিল ডাকাতরা, সেটা স্পষ্ট। বাড়ির পিছনের দিকে বাঁশের ভারা বাঁধা ছিল মাসদেড়েক ধরে। ডাকাতরা ছাদে উঠেছিল সেখান দিয়েই। উঠে একটা দল ছাদের খোলা অংশ দিয়ে চলে গিয়েছিল শোয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। আরেক দল চারতলার কোলাপসিবল গেট ভাঙার চেষ্টা করছিল। বিমলের বয়ান অনুযায়ী, সবাই উপরে ওঠেনি। একতলায় দোকানের শাটার ভাঙার কাজে হাত লাগিয়েছিল আরও জনাচারেক।
ঘটনাস্থল খুঁটিয়ে দেখে আরও বোঝা গেল, চন্দনাদেবীর দেহ বাড়ির পিছনের যে গলিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল, আদতে সেখানে তিনি পড়েননি। পড়েছিলেন বড় রাস্তার উপর। সেখানে রক্তের দাগ ছিল জমাট বেঁধে। বেরিয়ে এসেছিল ঘিলুর কিছু অংশ। পালিয়ে যাওয়ার সময় দেহটাকে টেনে-হিঁচড়ে ডাকাতরাই গলিতে রেখে গিয়েছিল। রাস্তার রক্তের রেখায় সে গতিপথ স্পষ্ট।
ফরেনসিক টিম পৌঁছে গেছে। চারতলা বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জরিপ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিস্তারিত সিজ়ার লিস্ট তৈরির। জেলা পুলিশের ‘এভিডেন্স রিকভারি ভ্যান’-ও এসে গেছে। কিন্তু ‘এভিডেন্স’ অক্ষত থাকলে তবে না ‘রিকভারি’? ঘটনাস্থলের পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক পরীক্ষার আগেই যদি শ’খানেক বাইরের লোক সেখানে চলাফেরা করে যত্রতত্র, জিনিসপত্র ছুঁয়ে দেখে ইচ্ছেমতো, অপরাধীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফুটপ্রিন্ট পাওয়ার সম্ভাবনার বারোটা বেজে যায়। বহু লোকের হাত-পায়ের ছাপে তালগোল পাকিয়ে যায় সব। ঠিক যেমনটা হল বাড়ির ফরেনসিক পরীক্ষার সময়।
পুরো বাড়িটায় স্থানীয় কৌতূহলী জনতা যেমন খুশি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়িয়েছে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর। দোকানের শোকেস বা ওয়ার্কশপের মেশিনে অসংখ্য হাত পড়েছে অসংখ্যবার। নষ্ট হয়ে গেছে নির্দিষ্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট চিহ্নিত করে সংগ্রহ করার সুযোগ। তন্নতন্ন করে খুঁজে সম্ভাব্য অপরাধীদের হাতের আর পায়ের ছাপ কিছু পাওয়া গেল চারতলার ফ্রিজে, আলমারিতে। কিছু সংগ্রহ করা হল দোকানের শোকেসের একেবারে উপরের দিকের র্যাকগুলো থেকে, যেখানে ঘটনা-পরবর্তী ভিড়ের হাত পৌঁছয়নি।
চারতলার কোলাপসিবল গেট আর নীচে দোকানের ভাঙা শাটার থেকে সংগৃহীত হল ‘tool marks’। সহজ ভাষায় বলি। ধরুন, একটা হাতুড়ি দিয়ে কোনও কিছুর উপর আঘাত করা হল। ধরুন, তালা ভাঙার জন্যই হাতুড়ি-পেটা। ভেঙে যাওয়া তালার উপর একটা দাগ থেকে যাবেই হাতুড়ির। বিজ্ঞানের একেবারে স্বাভাবিক নিয়ম। যা দিয়ে কোনও কিছুর উপর আঘাত করা হয়, তার একটা চিহ্ন থেকেই যায় লক্ষ্যবস্তুর উপর। সেই দাগ বা চিহ্নই হল ‘টুল মার্কস’। যা থেকে ফরেনসিক পরীক্ষায় আন্দাজ করা যায়, ঠিক কী জাতীয় বস্তু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। সুবিধে হয় তদন্তে। সুবিধে হয় কিনারা-উত্তর পর্যায়ে অভিযুক্তের দোষ প্রমাণে।
সিজ়ার লিস্ট তৈরি করা হল সময় নিয়ে। লম্বা তালিকা। যার মধ্যে তিনটে জিনিস বিশেষ উল্লেখের দাবি করে।
এক, চারতলায় ফ্রিজের উপর পড়ে থাকা একটা তেলের শিশি। যার উপরে হিন্দি লেবেলে লেখা ‘হিমতাজ’। লেবেলে বাকি যা কিছু লেখা, অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের নাম-টাম পড়া গেল না কিছু। শুধু হিন্দিতে ‘উত্তরপ্রদেশ’ শব্দটা ছাড়া। শিশি খুলতেই একটা উৎকট গন্ধ ছিটকে এল। বীজপুর থানার যে অফিসাররা তৈরি করছিলেন সিজ়ার লিস্ট, তাঁদের একজন বলেই ফেললেন, ‘এ জিনিস লোকে গায়ে-মাথায় মাখে কী করে? গন্ধেই তো ভূত পালানোর জোগাড়!’
এই ব্র্যান্ডের তেল ব্যবহার করেননি কস্মিনকালেও, জানালেন বিমল। এমন কি হতে পারে, বাড়িতে যে মিস্ত্রিরা কাজ করছে, শিশিটা তাদের কারও? বিমল বললেন, ‘কোনও চান্স নেই। চারতলায় মিস্ত্রিরা কাজ করে ঘরের বাইরে। ছাদের অংশে মূলত। ভিতরে ঢোকার দরকার প্রায় পড়েই না।’ আর ঢুকলেও তেলের শিশি নিয়ে ঢুকবেই বা কেন, আর ঢুকলেও ফেলেই বা রেখে যাবে কেন? এই শিশি ছিল না কাল রাতে ফ্রিজের উপর, বিমল বললেন একশো শতাংশ নিশ্চিত ভঙ্গিতে। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই, তেলের শিশি ডাকাতরাই সঙ্গে এনেছিল নির্ঘাত। ফেলে গেছে তাড়াহুড়োয়।
দুই, ওয়ার্কশপের এককোণে পড়ে থাকা দুটো শাবল। একটা পলিথিনের ব্যাগ। নিশ্চিত, ডাকাতদেরই ফেলে যাওয়া। শাবল দুটোয় পাওয়া গেল ফিঙ্গারপ্রিন্ট।
তিন, দোকানের একটা আলমারির পাশে পড়ে থাকা একটা ভাঁজ করা কাগজ। ভাঁজ খুলে দেখা গেল, ওটা আসলে ম্যাপ। কাঁচা হাতে পেনসিলে আঁকা। কিসের ম্যাপ? বিমলের চারতলা বাড়ির। কোন তলায় কোথায় কী, ম্যাপে চোখ বোলালে জলবৎ তরলং।
ও হ্যাঁ, বলা হয়নি, ব্যারাকপুরের পুলিশ ট্রেনিং কলেজ থেকে সকালেই তলব করা হয়েছিল ডগ-স্কোয়াড-এর পিঙ্কিকে। পিঙ্কি ঘুরেছিল পুরো চত্বরটা। শুঁকে দেখেছিল ডাকাতদের ফেলে যাওয়া পলিথিন ব্যাগ আর ‘হিমতাজ’ তেলের শিশি। বাড়ির সামনের যে রাস্তাটা সোজা চলে যাচ্ছে কাঁচড়াপাড়া স্টেশনের দিকে, পিঙ্কি ছুটেছিল সেদিকে। স্টেশনের কাছাকাছি গিয়ে থমকে গিয়েছিল। ডাকাতরা যে রেলপথেই পালিয়েছে, সেটা এমনিতেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। পিঙ্কির গতিবিধি সেই আন্দাজকে আরও জোরালো করেছিল।
ডাকাতিতে বাধা দিতে গিয়ে গৃহবধূ খুন। শুধু খুন নয়, চারতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নৃশংসতম খুন। স্থানীয় থানা থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরত্বে! শোরগোল পড়ে গিয়েছিল রাজ্যে। মিডিয়ার দৈনন্দিন হইহই তো ছেড়েই দিলাম, পুলিশের উপর উত্তুঙ্গ চাপ তৈরি হচ্ছিল স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির তরফেও। ঘটনার দ্রুত সমাধানের দাবি নিয়ে থানা ঘেরাও, এসপি-র অফিসে ডেপুটেশন, এলাকায় ব্যবসায়ী ধর্মঘটের ডাক দেওয়া, ‘পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে একজোট হন’ জাতীয় লিফলেট বিলি করা—কিছুই বাকি ছিল না।
অ্যাডিশনাল এসপি আর এসডিপিও-র নেতৃত্বে জেলার বাছাই করা অফিসারদের নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেও সামলানো যাচ্ছিল না ওই বহুমুখী চাপ। যা হট্টগোল চলছিল চন্দনা-হত্যা নিয়ে, আঁচ পৌঁছেছিল রাইটার্সেও। ঘটনার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে জারি হয়েছিল আইসি বীজপুরের বদলির আদেশ। নতুন আইসি হিসেবে ২৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছিলেন ইনস্পেকটর প্রবীর সান্যাল। সিআইডি-তে অনেকটাই কেটেছে যাঁর কর্মজীবন, যাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল বহু জটিল কেসের সমাধানে।
শুরুর দিনতিনেক তদন্তের ভার ছিল বীজপুর থানার সাব-ইনস্পেকটর মনিরুল ইসলাম সরকারের উপর। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে থানার চার্জ নেওয়ার দিনই তদন্তভার প্রবীরকে দিয়েছিলেন পুলিশ সুপার, ‘এমন কেস তো রোজ রোজ হয় না প্রবীর… তাই আপনাকে দিলাম… বুঝতেই তো পারছেন, এই কেসটা দ্রুত ডিটেক্ট করে কনভিকশন না করাতে পারলে আমরা কেউই মুখ দেখানোর জায়গায় থাকব না। যারা এভাবে মেরে ফেলল এক মহিলাকে, তাদের যদি শাস্তি না দেওয়া যায়…।’ কথা শেষ করেননি এসপি। করার দরকারও ছিল না। প্রবীর দিব্যি শুনতে পেয়েছিলেন না-বলা শব্দগুলো, ‘তা হলে আর চাকরি করে কী লাভ?’
স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিমের সঙ্গে ঘটনার দিন থেকেই রোজ অন্তত ঘণ্টাতিনেক বসছিলেন পুলিশ সুপার। বীজপুর থানাতেই দিনের সিংহভাগ কাটাচ্ছিলেন। কী কী জানা যাচ্ছে আপাতত, কী কী জানার আছে আরও, কী কী করণীয় এখন, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছিল সবটা।
প্রথম কথা, বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎদের বয়ান থেকে পাওয়া যাচ্ছে, গ্যাংটা ছিল মোটামুটি বারো-চোদ্দো জনের। কিছু লোক হিন্দিতে কথা বলছিল। কয়েকজন বাংলায়। তিন-চারজনের মুখ ঢাকা ছিল। অর্থাৎ, যদি ভিনরাজ্যের গ্যাংই হয়, সঙ্গে বঙ্গভাষী দুষ্কৃতীও ছিল, যাদের স্থানীয় হওয়ারই সম্ভাবনা। লোকাল গ্যাং হলেই সাধারণত মুখ বেঁধে ক্রাইম করে। যাতে চেহারার বর্ণনা শুনে পুলিশ চট করে ‘আইডেন্টিফাই’ না করতে পারে।
তা ছাড়া বিমলের বাড়ির নকশা যখন পাওয়া গেছে, এমন কেউ বা কারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত আছে, যার বা যাদের যাতায়াত ছিল বাড়িতেও। যে বা যারা জানত নিখুঁত, কোথায় কী আছে। কে বা কারা? বাড়ির কাজের লোক হতে পারে। দোকানের কর্মচারী হতে পারে। বাড়িতে কাজ হচ্ছিল দু’মাস ধরে। রোজ অনেক মিস্ত্রির যাতায়াত ছিল। তাদেরও কেউ হতে পারে।
তালিকা তৈরি করতে হবে সবার, যাদের পক্ষে সম্ভব বাড়ির নকশা বানানো বা বানাতে সাহায্য করা। বাড়ির কাজের মাসি, দুধওয়ালা, খবরের কাগজওয়ালা, জমাদার… কেউ যেন বাদ না যায়। প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। মিস্ত্রিদের তালিকা তৈরি করে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ দরকার। কল ডিটেলসও নিতে হবে সবার। কোনও কর্মচারীকে কি বিমল সাম্প্রতিক অতীতে ছাঁটাই করেছিলেন? সেই থেকে কোনও শত্রুতার অ্যাঙ্গল? খবর নেওয়া দরকার আত্মীয়-পরিজন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপারে। কাদের কাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বিমলদের বাড়িতে, সেটুকু অন্তত জানতেই হবে।
দ্বিতীয়ত, শুধু তিন-চারজনের বর্ণনা আপাতত পাওয়া যাচ্ছে তিনজনের বয়ানে, যার ভিত্তিতে ‘পোর্ট্রেট পার্লে’, অর্থাৎ ছবি আঁকানোর চেষ্টা করা যায়। দেখলে বাচ্চা-বাচ্চা মনে হয় এমন একজন। চৌকোটে মুখ একজনের। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের আরেকজন। ভারী চেহারা, পাতলা চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির একজন। বাকিদের মধ্যে যাদের মুখ বাঁধা ছিল না, তাদের ব্যাপারে জানতে চাইলে মোটামুটি একই উত্তর আসছে তিনজনের থেকে, ‘এত ভয় পেয়ে গেছিলাম, ডিটেলে খেয়াল করার মতো অবস্থা ছিল না।’ বেশ, কিন্তু যাদের বর্ণনা দিতে পারছেন, তাদেরই বা ডিটেল কোথায় সেভাবে? চৌকোটে মুখ বা বাচ্চা-বাচ্চা দেখতে বা অল্প চুলের ভারী চেহারার লোক… এমন শ’খানেক লোক তো এই কাঁচড়াপাড়াতেই খুঁজলে পাওয়া যাবে। তবু যা পাওয়া গেছে, তা-ই সই। বর্ণনা অনুযায়ী ছবি আঁকানো হোক সিআইডি-তে বিমলদের পাঠিয়ে। সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হোক সোর্সদের মধ্যে।
তিন নম্বর, চন্দনার মোবাইলটা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। তারপর থেকেই বন্ধ। প্রত্যাশিতভাবেই। আইএমইআই (international mobile equipment identity। প্রতিটি মোবাইল ফোনের জন্য নির্দিষ্ট ‘ইউনিক’ বা অনন্য নম্বর, যা সাধারণত ফোনের ব্যাটারির পিছনে লেখা থাকে) সার্চে দিয়ে রাখতে হবে লুঠ হওয়া মোবাইলের নম্বরটা। আজ-কাল-পরশু-তরশু বা এক-দু’মাস পরে, মোবাইলটা খুলে যখনই কেউ ওতে অন্য সিম ভরে ফোন চালু করবে, আইএমইআই নম্বরের সূত্রে জানা যাবে ফোনের অবস্থান।
মোবাইল ফোনের ঘাঁতঘোঁত সবাই মোটামুটি জেনেই গেছে আজকাল। সিম না বদলে চুরি করা ফোন ব্যবহার করার বোকামো ছিঁচকে মোবাইল চোররাও করে না। আর এরা তো ডাকাতদের গ্যাং পুরোদস্তুর। সুতরাং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, ফোন কখন চালু হয়, কখন ঢোকানো হয় অন্য সিম। মোবাইলটা যে নিয়ে গেছে, এটা একদিক থেকে খুবই আশাপ্রদ তদন্তের পক্ষে। ভাল হয়েছে, নিয়ে গেছে। একবার ফোনটা চালু হলেই তৎক্ষণাৎ চালু হবে প্রযুক্তি-প্রহরা।
চার নম্বর, এই ধরনের দুঃসাহসিক ডাকাতি কোনও নতুন আনকোরা গ্যাংয়ের কাজ নয়। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, অন্য রাজ্যের কোনও পেশাদার ডাকাতদল স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতীকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করেছে। বিমলরা বলেছেন, ডাকাতদের একজনের গায়ে টোটাভরতি চামড়ার বেল্ট ছিল। যেমনটা দেখা যায় সিনেমায়, চম্বলের ডাকাতদের শরীরে। বন্দুক নিয়ে, গব্বর সিং স্টাইলে গুলিভরতি বেল্ট নিয়ে এভাবে ডাকাতি শেষ কবে হয়েছে এ রাজ্যে? আদৌ হয়েছে? যদি বা হয়েও থাকে, কোথায় হয়েছে? কিনারা হয়েছিল? খোঁজ নিতে হবে। দলটা যে অত্যন্ত বেপরোয়া, সন্দেহাতীত। না হলে সামান্যতম প্রতিরোধেই এভাবে নির্মম নির্বিকার ছুড়ে ফেলে দেয় এক মহিলাকে!!! কোথাকার গ্যাং এরা?
ফ্রিজের উপর ডাকাতদের ফেলে যাওয়া তেলের শিশি ইঙ্গিত দিচ্ছে, গ্যাং সম্ভবত উত্তরপ্রদেশের। শুধু হিন্দিতে কথা বলছিল বলে নয়। শিশির লেবেলের উপর ‘উত্তরপ্রদেশ’ লেখা আছে বলে নয়। অভিজ্ঞ তেল-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, শিশির উপর ‘হিমতাজ’-এর যে লেবেলটা আছে, সেটা আসল ‘হিমতাজ’ তেলের নয়। ডুপ্লিকেট। এবং সেটা এ রাজ্যে বিক্রি হয় না। ব্র্যান্ডের জাল লেবেল বানিয়ে এই তেল অনেক কম দামে যথেচ্ছ বিকোয় উত্তরপ্রদেশ-বিহারে।
পয়েন্ট নম্বর পাঁচ, উত্তরপ্রদেশ হোক, বিহার হোক, যে রাজ্যই হোক, স্থানীয় দুষ্কৃতীদের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে যখন ন্যূনতম সংশয়ও নেই, আপাতত ‘ফোকাস’ করতে হবে উত্তর ২৪ পরগনা এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর উপর। হাওড়া-হুগলি-নদিয়া-দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এমনকী বর্ধমান-বীরভূমেও গত চার-পাঁচ বছরে যা যা ডাকাতি হয়েছে, সিআইডি-তে গিয়ে রেকর্ড ঘেঁটে দেখতে হবে। ক’টার কিনারা হয়েছিল? কারা করেছিল? তারা এখন কোথায়? জেলে, না জামিনে বাইরে? বাইরে থাকলে সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে খবর নিতে হবে।
সিটের সদস্যদের তো বটেই, জেলার সমস্ত ওসি-কেও বলা হল, যার যেখানে যা সোর্স আছে, সবাইকে কাজে লাগাতে হবে মরণবাঁচন ক্ষিপ্রতায়। যেভাবেই হোক, ‘ব্রেক-থ্রু’ চাই। জেলায় এবং সিআইডি-র ক্রাইম রেকর্ডস সেকশনে পুরনো দাগি ডাকাতদের যত ছবি আছে, দেখানো হল বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎকে, ‘এদের মধ্যে কেউ ছিল কি?’ বিমলরা চিনতে পারলেন না।
অবশ্য বিমল যা বলছেন, সেটাকেও ধ্রুবসত্য বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছিল না আর। ‘ক্রাইম রিকন্সট্রাকশন’ এই জাতীয় মামলায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা যাতে নির্ভুল হয়, তাই ডাকাতির দিনই শুধু নয়, তার পরের দু’দিনও বিমলকে একাধিকবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিবারই বয়ানের কিছু না কিছু বদলাচ্ছিলেন। ঘটনার দিন বলেছিলেন, তিন-চারজনের মুখ বাঁধা ছিল। তার দু’দিন পর বললেন, ‘সাত-আটজনের মুখে কাপড় ছিল।’ আগে যে অন্য কথা বলেছিলেন?—‘মাথার ঠিক ছিল না ওভাবে ডাকাতি হওয়াতে। ওভাবে স্ত্রী-কে চোখের সামনে ফেলে দিতে দেখে। শকের মধ্যে ছিলাম।’
‘শক’ পাওয়ার মতোই ঘটনা, কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু এত কিছু যে ঘটে গেল, মেয়ের ঘুম ভাঙল না? পাড়াপ্রতিবেশীরাও আঁচ পেলেন না কিছু? বিমলের জবাব, ‘মেয়ে অনেক রাত অবধি পড়ার পর অঘোরে ঘুমচ্ছিল। আমরা তো দু’-তিনবার ‘‘ডাকাত ডাকাত’’ বলার পর আর কিছু বলার সুযোগই পাইনি।’ বেশ, হতেই পারে। কিন্তু স্থানীয় সোর্স মারফত একটা খবর আসছিল, মাসকয়েক আগে চন্দনার নামে নাকি আশি লক্ষ টাকার লাইফ ইনশিয়োরেন্স করেছেন বিমল। এত টাকার বিমা হঠাৎ? বিমল সরাসরি অস্বীকার করলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না এমন কোনও ইনশিয়োরেন্সের! এসব আমার শত্রুপক্ষ রটাচ্ছে।’
শত্রুপক্ষ বলতে? বিমলের ব্যাখ্যা, প্রচুর পরিশ্রমের ফলে তাঁর ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে। চারতলা বাড়ি কিনেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একাংশ প্রবল ঈর্ষান্বিত। তারাই রটাচ্ছে যত আজগুবি খবর।
যা রটে, তার কিছু কি বটে? ডাকাতিটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিমল কি জানতেন, ডাকাতিটা হবে? চেয়েছিলেন, ডাকাতিটা হোক? চন্দনাকে তো আঘাত করেও চুপ করিয়ে দেওয়া যেত। ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। বা মুখ বন্ধ করে দেওয়া যেত প্রাণের ভয় দেখিয়ে, যেমন বিমলকে করা হয়েছিল। একেবারে নীচে ছুড়ে ফেলার মতো মরিয়া কাজ ডাকাতরা করতে গেল কেন? সত্যি-মিথ্যে এখনও যাচাই করা যায়নি, তবে বিমলের পরকীয়াজনিত কিছু খবরও বাতাসে ভাসছে। চন্দনার বেঁচে থাকা কি অসুবিধেজনক হয়ে উঠছিল অন্য কোনও সম্পর্কের কারণে?
আর হ্যাঁ, গয়নাগাটি সবই নিয়ে গেছে ডাকাতরা, কিন্তু তাতে আর কতটা ক্ষতি হবে বিমলের? নিজেই তো বলেছেন, ‘ইনশিয়োর’ করা ছিল প্রায় সবটাই। আর একটা খটকা, চন্দনার মোবাইল নিয়ে গেল ডাকাতরা। বিমলেরটা কেন নিয়ে গেল না? অস্বাভাবিক নয়?
বিমল-বিদ্যুৎ বাদে ডাকাতির আর দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী, অভিজিৎ আর নিরঞ্জনের ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে না। বারবার জেরা করা হয়েছে ওঁদের। বয়ান বারবার ওঁরাও বদলেছেন। আগে-পরের বয়ানে অসংগতির ব্যাখ্যা সেই একই, ‘এত ভয় পেয়ে গেছিলাম যে, সব কিছু ভাল করে খেয়াল করার অবস্থাতেই ছিলাম না। যখন যেমন মনে পড়ছে, তেমনই তো বলছি স্যার।’
নিরঞ্জন লোকটি বিমলের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে আছে। পরিবারের অংশই বলা যেতে পারে। যদি সত্যিই ডাকাতি ঘটানো হয়ে থাকে বিমলের জ্ঞাতসারে, তা হলে নিরঞ্জনেরও পুরো পরিকল্পনার শরিক হওয়াটা স্বাভাবিক। আর অভিজিৎ? তিরিশ বছরের যুবক। তিন বছর হল বিমলের ওয়ার্কশপে কাজ করছেন কারিগর হিসেবে। সেই রাতে সত্যিই কি এতটা কাজের চাপ ছিল, যে বাড়ি না ফিরে ওয়ার্কশপেই থেকে যেতে হয়েছিল? না অন্য কারণ আছে, যা এখনও অজানা? অভিজিতের ব্যাপারে আরও খোঁজখবর প্রয়োজন।
মোট আটটা ‘রেইড পার্টি’ ঘটনার দিন রাতেই গঠন করে দিয়েছিলেন এসপি। যার প্রতিটির নেতৃত্বে ছিলেন পোড়খাওয়া ইনস্পেকটররা। টিমগুলো কোথায় কখন যাবে, কোন সোর্স ইনপুটটা কখন ফলো-আপ করবে, তার সমন্বয়ে ছিলেন এসডিপিও ব্যারাকপুর সুমনজিৎ রায়। পুলিশ সুপারের অগাধ আস্থা ছিল সুমনজিতের উপর। কারণও ছিল। মেধাবী এবং পরিশ্রমী এই অফিসারকে ক্রাইম ওয়ার্কে বরাবর সহজাত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে দেখেছেন।
জেলার এবং আশেপাশের সমস্ত সক্রিয় ডাকাতদলের তালিকা তৈরি করে শুরু হল নির্বিচার ‘রেইড’। সামান্যতম সন্দেহ হলেই থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ। প্রতিটা টিমের সঙ্গে থাকছিল বাছাই করা সোর্সরা। ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঘটনা ঘটেছিল। পরের বাহাত্তর ঘণ্টায় জেলা পুলিশের তল্লাশি-বাহিনী চষে ফেলেছিল জেলার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম। চষে ফেলেছিল হাওড়া-হুগলি-নদিয়া-দক্ষিণ ২৪ পরগনারও একটা বিস্তীর্ণ অংশ। অন্তত কুড়ি-বাইশ জন সন্দেহভাজনকে তুলে আনা হয়েছিল, যারা দাগি ডাকাত হিসেবে পরিচিত। লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ করেও যাদের কারও বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না কাঁচড়াপাড়ার ঘটনায় জড়িত থাকার।
প্রথম ‘ব্রেক থ্রু’-র আভাস মিলল ২৬ ফেব্রুয়ারির রাতে। সোর্সের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে ঘোলা থানার তালবান্দা এলাকার একটা ভাড়াবাড়ি থেকে গভীর রাতের রেইডে গ্রেফতার হল ছয়জনের একটা গ্যাং। সূর্য গোলদার, বাবর আলি মণ্ডল, রতন তরাই, সুরজিৎ দাস, বিশ্বজিৎ মণ্ডল আর তাপস বিশ্বাস। ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত হল চারটে শাবল, দুটো দেশি পিস্তল এবং আটটা কার্তুজ। তবে আগ্নেয়াস্ত্র বা কার্তুজ নয়, উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠার উপাদান ছিল অন্যত্র। সূর্য গোলদারের একটা মাঝারি সাইজ়ের টিনের সুটকেসে। যেটা খুলতেই বেরল চামড়ার বেল্ট, টোটা রাখার। ঠিক যেমনটা বলেছিলেন বিমল, ‘একজনের গায়ে আড়াআড়িভাবে টোটাভরতি চামড়ার বেল্ট ছিল…।’ এই বেল্টটায় অবশ্য টোটা ছিল না একটাও।
কেস তা হলে সমাধানের পথে? স্থানীয় গ্যাং বলতে তা হলে এরাই? কিন্তু লুঠের মাল? তন্নতন্ন করে খুঁজেও ঘর থেকে পাওয়া গেল না কিছু। গ্রেফতার করে বীজপুর থানায় নিয়ে গিয়ে চলল ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিশি জেরার যাবতীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেও স্বীকারোক্তি এল না। হাজার চাপের মুখেও ভাঙা তো দূরের কথা, সামান্য মচকালও না কেউ, ‘আমরা কিছু জানি না এই ডাকাতির ব্যাপারে, বিশ্বাস করুন স্যার।’ সূর্য গোলদারকে চেপে ধরা হল, ‘চামড়ার বেল্টটা তোর কাছে কী করে এল?’ সূর্য একই কথা বলে চলল, ‘এটা অনেকদিনের পুরনো। কল্যাণীতে একটা ডাকাতিতে কাজে এসেছিল। চাঁদনি মার্কেট থেকে শখ করে কিনেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু কাঁচড়াপাড়ার ডাকাতিতে ছিলাম না স্যার।’
ধৃত ছ’জনের ক্লোজ়-আপ ছবি দেখানো হল বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎকে। তিনজনের থেকেই একটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের উত্তর এল, ‘মনে তো হচ্ছে এই দুটো লোক ছিল। তবে শিয়োর নই। আসলে কয়েকজনের মুখ বাঁধা ছিল তো… আর ভয়ে তো ওদের মুখের দিকে তাকাতেই পারিনি বেশিক্ষণ… যা করতে বলছিল, করে যাচ্ছিলাম শুধু।’ দেখানো হল বেল্টটাও। যেটা দেখামাত্রই অবশ্য বিমল বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবিকল এইরকমই তো ছিল!’ নিরঞ্জন-অভিজিৎ অত নিশ্চিত করে বলতে পারলেন না, ‘ঠিক এমনটাই ছিল কি না মনে পড়ছে না স্যার!’
ছ’জনের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন নেওয়া হল সে-রাতের। আশ্চর্য, কাঁচড়াপাড়ার ধারেকাছেও নেই কারও ফোনের অবস্থান! ২০ ফেব্রুয়ারির রাত থেকে ২১ ফেব্রুয়ারির ভোর পর্যন্ত সবার ফোনের লোকেশন ওই নিউ ব্যারাকপুর-ঘোলার আশেপাশেই।
সূর্য আর বাবর আলির বাড়ি নদিয়ার হরিণঘাটায়। ঘোলা থানার সাজিরহাটে বাকি চারজনের। ছ’জনকেই পুলিশি হেফাজতে নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হল। কিন্তু ফিরতে হল শূন্য হাতেই। ‘রিকভারি’ নেই। স্বীকারোক্তিও নেই। পুলিশ কাস্টডির মেয়াদশেষে সূর্যদের ঠাঁই হল জেলে, এই কেসে গ্রেফতার হওয়া সন্দেহভাজন হিসেবে।
চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির কেসে সমাধানের মূল কথাই হল ‘ফলেন পরিচয়তে’। মোদ্দা কথা, ধৃতদের কাছ থেকে চুরি-ছিনতাই হওয়া জিনিস উদ্ধার হলে তবেই নিশ্চিত হওয়া যায়, হ্যাঁ, কাজটা এরাই করেছে। ‘রিকভারি’ না হলে দাঁড়ায়ই না মামলা, সে যতই সন্দেহের কারণ থাকুক।
ঠিক সেটাই ঘটছিল সূর্যদের গ্রেফতারি নিয়েও। ওই চামড়ার বেল্ট উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ ধরে নিয়েছিল, গ্যাং চিহ্নিতকরণের কাজটা হয়ে গেছে। এবার স্বীকারোক্তি আদায়, বাকিদের জালে তোলা এবং লুঠের মাল উদ্ধার স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বেল্ট উদ্ধারের খবর ফলাও করে প্রচার হয়েছিল মিডিয়াতেও, ‘চন্দনা হত্যাকাণ্ডে ধৃত ছয়, উদ্ধার সেই বেল্ট’। কিন্তু মালপত্র কিছুই উদ্ধার না হওয়ায় সাধারণ মানুষ তো বটেই, পুলিশও ধন্দে পড়ে যাচ্ছিল। তা হলে কি এরা সত্যিই যুক্ত ছিল না? ভুল লোককে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এই কেসে?
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল। ঘুরে যাচ্ছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ। সূর্য গোলদারদের গ্রেফতারির পর তদন্তের অগ্রগতি একরকম থমকে গিয়েছিল বললেই চলে। ‘রেইড’ হচ্ছিল বটে এদিক-সেদিক। সোর্সরা যে যখন যা খবর দিচ্ছিল, যাচাই করা হচ্ছিল প্রত্যেকটাই। কিন্তু ‘লিড’ আর পাওয়া যাচ্ছিল কই?
এই ‘কিছুতেই কিছু হচ্ছে না’-র সময়টায় যখন পুলিশ সুপার বিশেষ তদন্তকারী দলের কাজকর্মের পর্যালোচনা-বৈঠকে বসতেন, বুঝতে পারতেন, হতাশার ভাইরাসে ক্রমে আক্রান্ত হচ্ছে টিম। এবং একটাই কথা আউড়ে যেতেন নিয়মিত, ‘ইংরেজিতে একটা কথা আছে। সবাই শুনেছ তোমরা। Fortune favours the brave. ভাগ্য বীরেরই সহায় হয়। পুলিশি তদন্তের ক্ষেত্রে কিন্তু ‘fortune favours the perseverant.’
কথাটা নতুন নয়। জানাই আছে, জটিল মামলার তদন্তে ভাগ্য তাদেরই সহায় হয় যারা ধৈর্যের ফিক্সড ডিপোজ়িটে হাত দেয় না চরম সংকটেও। শুনতে শুনতে এক একসময় সুমনজিতের মনে হত, এসপি নেহাতই ‘ভোকাল টনিক’ দিচ্ছেন টিমের মনোবল অটুট রাখতে। আবার কখনও মনে হত, ভুল তো কিছু বলছেন না। মনে পড়ত কবীর সুমনের ‘তিন তালের গান’-এর সেই লাইনটা, ‘কখন কী ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না!’ পরক্ষণেই আবার ভাবতেন, মাসদেড়েক হয়ে গেল ঘটনার পর। আশাব্যঞ্জক কিছু ঘটছে আর কোথায়? ঘটবে আদৌ?
ঘটল। ভাগ্য সহায় হল এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের বিকেলে। যখন সুমনজিৎ রোজকার ফাইলে চোখ বুলোচ্ছেন অফিসে বসে। সাধারণত মোবাইল ভাইব্রেশন মোডে রাখেন। ফাইলে সই করতে করতেই টেবিলে রাখা ফোনে কম্পন টের পেলেন। চোখ রাখলেন স্ক্রিনে। ‘আইসি বীজপুর কলিং’।
—হ্যাঁ, প্রবীর?
এত উচ্চগ্রামে প্রবীর কথা শুরু করলেন, ফোন রেখে দিয়ে ‘হ্যালো’ বললেও বোধহয় শোনা যেত বীজপুর থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত।
—স্যার, একবার থানায় আসবেন?
—এখন? কেন, কী হল হঠাৎ?
—যে ফোনটা ডাকাতরা নিয়ে গেছিল, মানে চন্দনাদেবীর ফোনটা, সেটা বোধহয় অ্যাকটিভাইজ়ড হয়েছে। যে দোকান থেকে বিমল ফোনটা কিনেছিলেন, তার মালিকের ফোনে একটা অদ্ভুত এসএমএস এসেছে লুঠ হওয়া ফোনটার নম্বর থেকে।’
—‘প্লিজ় হেল্প মি, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার’।
—মানে?
—মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না স্যার… হু ইজ় ইন ডেঞ্জার… কী হেল্প চাইছে… দোকানের মালিকের কাছেই বা কেন চাইছে… ভুতুড়ে ব্যাপার স্যার!’
—আসছি এখনই।
—আসুন স্যার… দোকানের মালিককে বসিয়ে রেখেছি।
সুমনজিৎ ছুটলেন বীজপুর থানায়। ফোনের দোকানের মালিক এমন কাঁচুমাচু মুখে বসে আছেন, মনে হবে ডাকাতিটা উনিই করেছেন বা করিয়েছেন। থানায় আসার অভিজ্ঞতা নেই, বেশ বোঝা যাচ্ছে হাবভাবে। তার উপর প্রবীর সহ অন্য অফিসাররা ভদ্রলোকের দিকে ঘনঘন কড়া দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।
দোকানের মালিককে একটু ধাতস্থ হওয়ার সময় দিলেন সুমনজিৎ। কথা শুরু করলেন তারপর, ‘এই মেসেজটা আপনার ফোনে…চন্দনাদেবীর লুঠ হয়ে যাওয়া ফোন থেকে… কী ব্যাপার বলুন তো?’
ব্যাপারটা যে কী, পরিষ্কার হয়ে গেল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এবং রক্তকণিকায় একশো মিটার স্প্রিন্টের ছটফটানি টের পেলেন সুমনজিৎ। ফোনে তৎক্ষণাৎ ধরলেন এসপি-কে। চেপে রাখতে পারলেন না উচ্ছ্বাস, ‘স্যার! ফাইনালি লিড পাওয়া গেছে একটা। ডেফিনিট লিড!’
কী লিড? কেন ‘ডেফিনিট’?
চন্দনার যে ফোনটা ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছিল, সেটা স্যামসাং কোম্পানির। কাঁচড়াপাড়ারই দোকান থেকে কেনা। যে মডেলের ফোন, সেটা ‘লঞ্চ’ হয়েছিল সবে গত বছর, নানান অভিনব ফিচার্স সহ। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপিত ছিল ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’।
সেটা কী?
ধরুন আপনি ওই মডেলের ফোন কিনলেন। এবং ফোনটা চুরি হয়ে গেল। এখন চুরি যাওয়া ফোনে যে মুহূর্তে চোর অন্য সিম ভরে চালু করবে, ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’র সৌজন্যে একটা এসএমএস আসবে এমন একটা পূর্বনির্ধারিত নম্বরে, কেনার সময় যে নম্বরটা আপনার ফোন-মেমরিতে ভরে দেওয়া হয়েছিল। এসএমএসে অটোম্যাটিকালি বার্তা আসবে মেমরিতে ভরে রাখা টেমপ্লেটের—‘প্লিজ় হেল্প মি, আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার’। যে নতুন সিম ভরা হয়েছে চুরি যাওয়া ফোনে, তার নম্বর তো বটেই, সিমের আইইএমআই নম্বরও জানা যাবে এসএমএস মারফত। এবার পুলিশকে জানালে টাওয়ার লোকেশন দিয়ে সহজেই ট্র্যাক করা যাবে ফোনের অবস্থান।
এই পূর্বনির্ধারিত নম্বরটা কী হবে, সেটা আপনি অর্থাৎ খদ্দের ঠিক করে দেবেন ফোনটা কেনার সময়। খদ্দের স্বাভাবিকভাবেই নিজের পরিচিত কারও নম্বরই ঢোকাবেন মেমরিতে। বিমল যখন ফোনটা কিনেছিলেন, দোকানের মালিক সোৎসাহে বুঝিয়েছিলেন এই প্রযুক্তির কথা। জানতে চেয়েছিলেন, পূর্বনির্ধারিত কোন নম্বরটা বিমল মেমরিতে ঢোকাতে চান। বিমলের প্রযুক্তি বিষয়ক ধ্যানধারণা অতি সীমিত, বোঝেনওনি পুরো ব্যাপারটা। বলেছিলেন, ‘আপনিও তো পাড়ারই লোক… আমার অনেকদিনের পরিচিত… আপনার নম্বরটাই ভরে দিন না হয়।’ দোকানি সেটাই করেছিলেন। আজ দুপুরে চন্দনার ফোন থেকে ওই টেমপ্লেট-মেসেজ ঢুকেছে তাঁর ফোনে। দোকানি ভদ্রলোক নিমেষে বুঝেছেন, লুঠ হওয়া মোবাইল চালু করা হয়েছে অন্য সিম ভরে। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছেন বিমলকে। পরামর্শ দিয়েছেন একটুও দেরি না করে পুলিশকে জানাতে। জানামাত্রই বীজপুর থানার পুলিশ একরকম তুলেই নিয়ে গেছে দোকানদারকে। এই হল গল্প।
ঝটিতি ‘সিট’-এর সদস্যদের নিয়ে বসলেন পুলিশ সুপার। কিনারা-সূত্রের আভাসে রাতারাতিই যেন চাঙ্গা হয়ে গেছে টিম। অ্যাড্রিনালিনের বাড়তি ক্ষরণ ধরা পড়ছে সুমনজিৎ-প্রবীরদের নড়াচড়ায়।
যে সিমটা ভরা হয়েছে ফোনে, সেটার ‘সাবস্ক্রাইবার ডিটেলস’ নেওয়া হল দ্রুত। সিমটা বাদাম সিং বলে একজনের নামে। ঠিকানা? পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বাদাউন জেলা। এর বেশি নির্দিষ্ট তথ্য নেই সার্ভিস প্রোভাইডারের নথিতে। ফোনের অবস্থান? বাদাউন জেলারই ‘কাদের চক’ ব্লকের ধানুপুরা গ্রামের কাছাকাছি ঘুরপাক খাচ্ছে।
বেশ, এবার পরের ধাপ। সিমটা আজই চন্দনার ফোনে ভরেছে। নিজের মোবাইলে তো নিশ্চয়ই এই সিমই ব্যবহার করত এতদিন। এই সিম-নম্বরের কল ডিটেলস রেকর্ড নেওয়া যাক তা হলে। নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে ভিনরাজ্যের সঙ্গীসাথীদের নাম।
বেরল না ভিনরাজ্যের সম্ভাব্য দুষ্কৃতীদের নাম। কল রেকর্ডসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বরং চিহ্নিত করা হল এ রাজ্যেরই দু’জনকে। যাদের সঙ্গে সম্প্রতি রোজই ঘনঘন কথা বলেছে বাদাম সিং। একজনের নাম অনিন্দ্য ঘোষ। খড়দায় বাড়ি। দ্বিতীয়, সুকান্ত রুইদাস। বাড়ি, বর্ধমানের জামালপুর। সার্ভিস প্রোভাইডার সংস্থার থেকে জোগাড় করা হল দু’জনের সিমকার্ড-সংক্রান্ত নথিপত্র। আরও সহজ করে বললে, ‘Customer Application Form’ বা ‘ক্যাফ’।
দিনে অন্তত সাত-আটবার করে খড়দা আর জামালপুরের এই দু’জনের সঙ্গে কিসের এত কথা বাদাম সিংয়ের? সেই বাদাম সিংয়ের, যার কাছে চন্দনার ফোনটা আছে এবং সুতরাং ডাকাতি আর খুনের সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত? অনিন্দ্য-সুকান্তই কি ‘লোকাল কনট্যাক্ট’? স্থানীয় গ্যাংয়ের সদস্য, যারা যুক্ত ছিল ঘটনায়? সূর্য গোলদারদের গ্যাং নয়? ‘বাদাম সিং’ আদৌ ঠিক নাম কিনা জানা নেই। এমনও হতে পারে, অন্য নামে কেউ ওই সিম ব্যবহার করছে।
সে যা-ই হোক, সিদ্ধান্ত হল, এই ‘বাদাম সিং’-কে তো তুলতে হবেই। তবে মোটামুটি একই সময়ে এই অনিন্দ্য-সুকান্তকেও আটক করতে হবে জেরার জন্য। গ্যাং বারো-চোদ্দো জনের। সূর্য গোলদার সহ ছ’জন এই ঘটনায় জড়িত কিনা, নিশ্চিত নয় এখনও। যদি ধরে নেওয়া যায় যে ওই ছ’জন যুক্ত ছিল, তা হলেও বাকি থাকে আরও ছয় থেকে আটজন। সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তিন সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের। বাদাম সিং, অনিন্দ্য ঘোষ আর সুকান্ত রুইদাস। এদের মোটামুটি একই সময়ে তুলতে হবে। আগে-পরে হলে মুশকিল। ‘খবর’ হয়ে যাবে। ফোনে রোজ অনেকবার কথা হয় তিনজনের মধ্যে। আরও একাধিকের হয়তো ফোন-যোগাযোগ আছে এদের সঙ্গে। ফোনে না হলেও হয়তো অন্যভাবে আছে। পুরো নেটওয়ার্কটা এখনও স্পষ্ট নয়। বাদাউন থেকে বাদাম সিং গ্রেফতার হয়েছে, এই খবর হয়তো দ্রুতই পৌঁছবে অনিন্দ্য-সুকান্তর কাছে। সতর্ক হয়ে যাবে। গা-ঢাকা দেবে। আবার উলটোটাও সত্যি। অনিন্দ্যরা এখানে আটক হলে খবর হয়তো সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাবে বাদাউনে। চম্পট দেবে বাদাম সিং।
তা হলে করণীয়? অনিন্দ্য-সুকান্তের ঘরবাড়ি চিহ্নিত করে রাখা হল। চালু হল নজরদারিও। ওদের তোলা যাবে যখন-তখন। আগে বাদাম সিংকে ধরতে হবে। সেটা তুলনায় ঢের বেশি কঠিন কাজ। যেটা সম্পন্ন হলে কালবিলম্ব না করে অনিন্দ্য-সুকান্তের বাড়িতে হানা দেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হল, একটা টিম রওনা দেবে বাদাউনে। প্রবীর থাকলেন নেতৃত্বে। সঙ্গে জেলার আরও জনাপাঁচেক অফিসার-কনস্টেবল। সিআইডি সরকারি ভাবে কেসের দায়িত্ব নেয়নি ঠিকই, কিন্তু সহায়ক-শক্তি হিসেবে সক্রিয় ছিল শুরু থেকেই। প্রবীরের সঙ্গী হলেন সিআইডি-র কয়েকজন অভিজ্ঞ অফিসার।
টিম রওনা হল ১৯ এপ্রিল। তার আগে পুলিশ সুপার ফোনে আলোচনা করে নিলেন বাদাউনের এসপি-র সঙ্গে। যিনি স্পষ্ট জানালেন, যে অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট নম্বরের বর্তমান অবস্থান, সেই ধানুপুরা গ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে পরিচিত। দাগি ক্রিমিনাল-অধ্যুষিত। ওখানে ‘রেইড’ করতে গেলে স্থানীয় পুলিশও রাজ্যের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর সাহায্য নেয়। এই অভিযানেও ইউপি পুলিশের এসটিএফ-এর প্রয়োজন পড়বে। প্রাথমিক হোমওয়ার্ক পুলিশ সেরেই রাখবে, আশ্বস্ত করলেন এসপি।
হোমওয়ার্ক যে বাস্তবিকই অনেকটাই সেরে রেখেছে জেলা পুলিশ, বাদাউন পৌঁছে এসপি-র সঙ্গে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গেই টের পেলেন প্রবীর। এসপি শুরুতেই বললেন, ‘যাকে ধরতে এসেছেন, তার নাম বাদাম সিং নয়। বাদাম সিং-ও ডাকাত, দাগি আসামি। কিন্তু এখন জেলে আছে। ওর নাম ব্যবহার করে সিমটা নেওয়া হয়েছে। যে নিয়েছে, তার নাম শিশুপাল। এরও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। গ্রেফতারও হয়েছে আগে বেশ কয়েকবার। ডাকাতির কেসেই। ছবিও আছে আমাদের রেকর্ডে। ধানুপুরা গ্রামে বাড়ি। এখান থেকে একুশ কিলোমিটার দূরে। আমাদের জেলার বর্ডার। ওই গ্রামের পরেই অন্য জেলার এলাকা শুরু। কাঁসিরাম নগর। ট্রাস্ট মি, ধানুপুরা ইজ় আ নটোরিয়াস ভিলেজ। একশো পুলিশ নিয়ে রেইড করলেও ওখান থেকে কাউকে ধরা একটু মুশকিলই। ছোট গ্রাম। হাজার দুয়েক লোক। পুলিশ হোক বা অন্য কেউ, বাইরের কেউ ঢুকলেই ‘‘খবর’’ হয়ে যায়। ওভাবে ধরা যাবে না শিশুপালকে।’
—তা হলে?
এসপি আশ্বস্ত করলেন, ‘গ্রামের বাইরে এলে ধরতে হবে। আগে বের করতে হবে গ্রাম থেকে। আমাদের এসটিএফ-এর অফিসাররা লেগে আছেন। শিশুপালের সঙ্গে একসময় খুচরো চুরি-ছিনতাই করেছে, এমন সোর্স লাগানো হয়েছে। সেই সোর্সকে দিয়ে আজ রাতে গ্রামের বাইরে একটা মদের ঠেকে ডেকে পাঠানোর প্ল্যান আছে। সোর্সের সঙ্গে কথাও হয়েছে শিশুপালের। পেয়ে যাবেন রাতের মধ্যেই, সব যদি ঠিকঠাক থাকে।’
সব ঠিকঠাকই থাকল। ধানুপুরা থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে ভোজপুর-নারায়ণপুর গ্রাম। সেখানে রাত আটটা নাগাদ সাইকেলে করে শিশুপালের আবির্ভাব ঘটল। সোর্সকে নিয়ে সন্ধে ছ’টা থেকেই ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল বাদাউন জেলা পুলিশের টিম, এসটিএফ-এর অফিসাররা এবং সদলবলে প্রবীর। ‘শিশুপাল-বধ’ সম্পন্ন হল অনায়াসে। পকেট থেকে উদ্ধার হল চন্দনাদেবীর মোবাইল। ধন্দের আর জায়গা নেই কোনও। শিয়োর শট ডিটেকশন। ঘটনার ঠিক দু’মাস পর, এপ্রিলের একুশে। উচ্ছ্বসিত প্রবীর ফোন করলেন পুলিশ সুপারকে, ‘স্যার! মিশন সাকসেসফুল!’
‘মিশন’ আসলে শুরু হয়েছিল সবে। শিশুপালকে পেলেই তো শুধু হল না। প্ল্যানমাফিক রাতেই তুলতে হবে সম্ভাব্য দুই শাগরেদ অনিন্দ্য-সুকান্তকে। ঠিক হল, প্রথমে সুকান্তকে তোলা হবে জামালপুর থেকে। অনিন্দ্যর বাড়িতে তারপর হানা দেওয়া হবে সুকান্তকে সঙ্গে নিয়েই। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে সুমনজিতের নেতৃত্বে জামালপুর পৌঁছে গেল উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের টিম। সুমনজিতের সঙ্গী হলেন আইসি জগদ্দল সুবীর চ্যাটার্জি সহ ‘সিট’-এর বাছাই করা কয়েকজন কর্মী-অফিসার।
সুকান্তকে পাওয়া গেল বাড়িতেই। বছর তিরিশের যুবক। নেহাতই সাদামাটা চেহারা। মধ্যবিত্ত সংসার। মা-বাবার একমাত্র ছেলে। ঘুমনোর তোড়জোড় করছিলেন। পুলিশের টিম দেখে ভীষণই ঘাবড়ে গেলেন। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কথাবার্তার আওয়াজে ওঁদেরও ঘুম ভেঙে গেল এবং ঘরে পুলিশ দেখে দৃশ্যতই আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন।
সুমনজিৎ প্রথম প্রশ্নটাই করলেন, ‘আপনার ক’টা মোবাইল?’
—একটাই স্যার।
শোয়ার ঘরে চার্জে বসানো ছিল ফোনটা। বিনা বাক্যব্যয়ে সুকান্ত মোবাইল তুলে দিলেন সুমনজিতের হাতে।
—হ্যাঁ, নম্বরটা বলুন ফোনের।
সুকান্ত বললেন নম্বর। যাতে ‘কল’ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যাচাই করেও নেওয়া হল, ঠিক বলছেন কিনা। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! এই নম্বর তো মিলছে না সেই নম্বরের সঙ্গে, যে নম্বরে দিনে অন্তত আটবার করে কথা বলেছে শিশুপাল গত দেড়মাস ধরে। মিলছে না তো! সুমনজিৎ ফের চেপে ধরেন সুকান্তকে।
—আর ক’টা ফোন আছে আপনার?
—এই একটাই স্যার।
—দেখুন সুকান্তবাবু, কোনও জোরজবরদস্তি করতে চাই না। অন্য ফোনটা দিন।
—বিশ্বাস করুন স্যার, আমার এই একটাই ফোন।
—কী করেন আপনি?
—বিশেষ কিছু না স্যার, টুকটাক সাপ্লাইয়ের কাজ।
—শিশুপাল বলে কাউকে চেনেন?
—না স্যার।
সুমনজিৎ তাকান সুবীরের দিকে, ‘এভাবে হবে না। একে থানায় নিয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে। তার আগে ঘরটা ভাল করে সার্চ করা দরকার।’ তল্লাশি হল তন্নতন্ন করে। না পাওয়া গেল দ্বিতীয় কোনও মোবাইল, না পাওয়া গেল কোনওরকম অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণ। যখন তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসছে পুলিশ, মা কান্নাকাটি জুড়েছেন, বাবা দাঁড়িয়ে আছেন স্তব্ধবাক, তখনও সুকান্ত চিৎকার করে যাচ্ছেন, ‘আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? সামান্য সাপ্লাইয়ের কাজ করে খাই। জীবনে কখনও কোনও দু’নম্বরি কাজে জড়াইনি, বিশ্বাস করুন। মাক্কালীর দিব্যি স্যার…বিশ্বাস করুন!’
বিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখছিল না পুলিশ। ইয়ারকি নাকি? বললেই হল, আর ফোন নেই? যে নম্বরের সঙ্গে শিশুপালের কথা হচ্ছে, তার ‘কাস্টমার অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম’ আগেই জোগাড় করা হয়েছে সার্ভিস প্রোভাইডারের থেকে। সেই ফর্মে সুকান্তের ভোটার আইডেন্টিটি কার্ডের ছবি জ্বলজ্বল করছে। এখন বললেই হল, নেই? নেই, তো গেল কোথায়? থানায় এনে একটু ‘যত্নআত্তি’ করার উপক্রম করলেই দ্বিতীয় মোবাইল সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে, নিশ্চিত ছিলেন সুমনজিৎরা।
নিশ্চিত থাকা কিন্তু গেল না জামালপুর থানায় সুকান্তকে নিয়ে এসে ঘণ্টাদেড়েক ধরে নানা কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদের পর। সুকান্ত অবিচল থাকলেন নিজের বয়ানে, ‘আমাকে মেরে ফেললেও একই কথা বলব স্যার, যে নম্বরের কথা আপনারা বলছেন, ওই নম্বরের কোনও মোবাইল আমার নেই। আমার এই একটাই ফোন।’ সুমনজিৎ এবং টিমের অন্যদেরও খটকা লাগতে শুরু করল এবার। প্রতিকূল পরিবেশে প্রবল পুলিশি চাপ সহ্য করে নিজের নির্দোষিতার ব্যাপারে এতটা আত্মবিশ্বাসী থাকাটা একজন অপরাধীর পক্ষে বেশ অস্বাভাবিকই। কোথাও গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে বড়সড়! নতুন করে ফের ভাবা দরকার ঠান্ডা মাথায়।
ভাবা হল। সুকান্তের কাছে যে মোবাইলটা ছিল, সেটার টাওয়ার লোকেশন দেখা হল। ডাকাতির আগে বা পরে কাঁচড়াপাড়ার ত্রিসীমানাতেও ছিল না। ফোনের অবস্থান ছিল জামালপুরেই। এবং সুকান্তের এই ফোনের থেকে শিশুপালের নম্বরের কোনও যোগাযোগ হয়নি কখনও। শুধু তাই নয়, সুকান্তর কাছে পাওয়া ফোনের থেকে কখনও কোনও যোগাযোগ হয়নি ওই সন্দেহজনক নম্বরেরও, যে নম্বরে শিশুপাল নিয়মিত কথা বলেছে, যে নম্বরের ফোন সুকান্তের কাছে পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত ছিল পুলিশ। এসবের একটাই মানে দাঁড়ায়। সুকান্ত সম্ভবত মিথ্যে বলছেন না। সত্যিই তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই এ ডাকাতির সঙ্গে।
সুকান্ত যে ফোনটা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন, তার ‘ক্যাফ’ আনানো হল পরদিন সকালে। এখানেও প্রত্যাশিতভাবেই সুকান্তের ছবি। ‘ভুতুড়ে’ সিমকার্ডের ‘ক্যাফ’-এ যে ছবি ছিল সুকান্তের, সেই একই ভোটার আইডি কার্ডের ছবি। দুটো সিমকার্ডের ‘ক্যাফ’ পাশাপাশি রেখে দেখা হল খুঁটিয়ে। এবং দেখতে গিয়েই চমক! যে দোকান বা এজেন্সি থেকে সিম বিক্রি হয়, নথিপত্রে ‘সিল’ থাকে সেই দোকানের। এ তো দেখা যাচ্ছে, দুটো সিমই বিক্রি হয়েছে একই দোকান থেকে। নেহাতই সমাপতন?
সুমনজিতের হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, ওই অনিন্দ্যের সঙ্গে যে নম্বরে শিশুপাল কথা বলছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, তার ‘ক্যাফ’-টাও তো জোগাড় করা ছিল। ওটা দেখা যাক একবার। দেখা হল। আরে! এ কী! এই সিমকার্ডও বিক্রি হয়েছে ধনেখালির ওই এজেন্সি থেকেই। এটাও সমাপতন? হতেই পারে না! ইম্পসিবল!
দুটো সন্দেহজনক নম্বর, দুটো সন্দেহজনক সিম। যাদের নামে নথিভুক্ত, তাদের একজন সুকান্ত। যিনি বলছেন, তাঁর কাছে এমন কোনও সিমই নেই। অন্যজন, অনিন্দ্যকে নিয়ে আসা হল থানায়। এবং যেমনটা আঁচ করতে শুরু করেছিলেন অফিসাররা, সেটাই ঘটল। অনিন্দ্য সেলস রিপ্রেজ়েন্টেটিভের কাজ করেন। আকাশ থেকে পড়লেন সব শুনে। যে সিম বিক্রি হয়েছে তাঁর ছবি এবং অন্যান্য নথিপত্রের ভিত্তিতে, এমন সিম নেই-ই তাঁর কাছে। একটাই মোবাইল তাঁরও। অনিন্দ্যর কল ডিটেলস এবং টাওয়ার লোকেশন পরীক্ষা করেও দূরতম আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া গেল না তাঁর এই ডাকাতিতে জড়িত থাকার।
মোদ্দা ব্যাপারটা কী দাঁড়াল তা হলে? একই দোকান থেকে দুটো সিম কার্ড বিক্রি হয়েছে এমন দু’জনের নথি ব্যবহার করে, যাঁরা সেই সিম কেনেনই নি। নথি স্বাভাবিক নিয়মে দোকানির কাছেই ছিল। কারণ, অনিন্দ্য-সুকান্ত দু’জনেই ওই দোকান থেকে সিম কিনেছিলেন, যেগুলো এখন নিজেরা ব্যবহার করেন। সাপ্লাইয়ের কাজে সুকান্তকে প্রায়ই ধনেখালি যেতে হয়। আর অনিন্দ্যর শ্বশুরবাড়ি ধনেখালিতে। দু’জনেই ঘটনাচক্রে সিম কিনেছিলেন ওই দোকান থেকেই।
দোকানের কোনও কর্মচারীর এই জাতীয় অসাবধানতাজনিত ভুল? একবার নয়, দু’-দু’বার? হয় কখনও? এখন প্রশ্ন, কাদের কাছে বিক্রি হয়েছে ওই দুই সন্দেহজনক সিম? উত্তর যেখানে লুকিয়ে আছে, দুপুর গড়ানোর আগেই সেখানে রওনা দিল টিম।। ধনেখালি।
ছোটখাটো এজেন্সি ধনেখালি বাজারের কাছে। মালিকের নাম রাহুল। বয়স ওই পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের মধ্যে। সুমনজিৎ সরাসরি দুটো সন্দেহজনক সিমকার্ডের নথি সামনে রাখলেন রাহুলের, ‘এগুলো আপনার দোকান থেকে বিক্রি হয়েছে । কিন্তু যাঁদের নথি ব্যবহার করে বিক্রি হয়েছে, তঁাদের ফোনে এই সিম নেই। এটা কী করে হল?’
রাহুলের চোখেমুখে বিস্ময়ের আঁকিবুকি, ‘এমন তো হওয়ার কথা নয় স্যার!’
—সে তো আমরাও জানি, হওয়ার কথা নয়। সেজন্যই তো জানতে চাইছি। সেজন্যই তো আসা।
—বুঝলাম স্যার। কিন্তু আজ পর্যন্ত এমনটা হয়নি কখনও আমার দোকানে…
—‘আজ পর্যন্ত’ তো আজকেই শেষ রাহুলবাবু… কালকে কী হবে সে আর কে জানে বলুন…ঘটনাটা আপনার দোকান থেকেই ঘটেছে… জবাবটাও ন্যাচারালি আপনাকেই দিতে হবে।
রাহুলকে সামান্য নার্ভাস দেখায় এবার, ‘এভাবে বলছেন কেন স্যার? কত সিম বিক্রি হয় দোকান থেকে… কর্মচারীরা সবসময় ডকুমেন্টস চেক করে নেয়। হয়তো ভুল করে…’
সুমনজিৎ গলা চড়ান এবার, ‘এভাবে বলব না তো কীভাবে বলব? বলছেন ভুল করে হয়তো হয়ে গেছে? মজা পেয়ে গেছেন? একাধিকবার যখন এমন গুরুতর ভুল হয়েছে, ধরে নিতে হবে, সেটা ইচ্ছাকৃতই।’
রাহুলের ডিফেন্স এবার আরও নড়বড়ে দেখায়, ‘বিশ্বাস করুন স্যার…’
—থানায় চলুন তো আগে… বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফয়সালা না হয় ওখানেই হবে।
ধনেখালি থানায় যখন রাহুলকে নিয়ে পৌঁছল পুলিশ, বেলা গড়িয়ে গেছে অনেকটা। মাঝবৈশাখের রোদ তার তেজ হারিয়েছে। বিকেল ক্রমে সন্ধ্যাকালীন।
পুলিশের গাড়িতে ওঠার পর থেকেই ঘামছিলেন রাহুল। ধনেখালি থানার বড়বাবুর ঘরে ঢুকে যখন একঝাঁক পুলিশ অফিসারের মুখোমুখি বসানো হল, সুমনজিৎ বুঝতে পারলেন, দম ফুরিয়ে এসেছে রাহুলের। হাত কাঁপছে সামান্য। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছেন ঘনঘন।
স্বীকারোক্তি এল দ্রুতই। সিম কিনতে গেলে যে যে প্রামাণ্য নথি বা ‘ডকুমেন্টস’ প্রয়োজন, অনেকেরই থাকে না। যাদের ডকুমেন্টস নেই, অথচ সিম চাই, তাদের ডবল দামে সিমকার্ড বেচত রাহুল। কী ভাবে? সিম কিনতে গেলে ‘কাস্টমার অ্যাপলিকেশন ফর্ম’ (ক্যাফ) ভরতি করতে হয় গ্রাহককে। নিজের পরিচয় সংক্ৰান্ত প্রামাণ্য তথ্যসমেত। কেউ পাসপোর্টের জেরক্স কপি দেয়, কেউ ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড, কেউ-বা অন্য কিছু। সিম-বিক্রেতা দোকান বা এজেন্সিকে সেই ফর্ম পাঠাতে হয় সংশ্লিষ্ট মোবাইল পরিষেবা সরবরাহকারী সংস্থাকে।
যে গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিয়ে সিম কিনতেন, তাঁদের নথির জেরক্স করে রাখতেন রাহুল। এবং যখন কেউ এসে বলত, সিম লাগবে, কিন্তু ডকুমেন্টস নেই, তখন ওই গ্রাহকদের জেরক্স করা নথি ব্যবহার করতেন। ডকুমেন্ট-হীন ক্রেতাকে আশ্বস্ত করতেন, ‘পেপার্স জোগাড় হয়ে যাবে, তবে টাকাটা ডাবল লাগবে।’
রাহুল জেরায় খোলাখুলি আরও বললেন, ‘এমনটা শুধু আমি নয়, অনেক এজেন্সি করছে স্যার… দেখুন একটু খোঁজ নিয়ে।’
অন্যরা কে কী করছে, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার সময় পড়ে আছে অনেক। বোঝাই যাচ্ছে, একটা চক্র তৈরি হয়েছে উদোর নথিপত্র নিয়ে বুধোকে সিম দেওয়ার। সুমনজিৎ ভাবছিলেন, সমস্ত মোবাইল পরিষেবা সংস্থার সঙ্গে একটা মিটিং করা দরকার শীঘ্রই। সার্ভিস প্রোভাইডাররা হয়তো জানেই না এই নয়া জালিয়াতির ব্যাপারে, সেভাবে হয়তো এখনও কোনও সিস্টেমই তৈরি হয়নি এটা প্রতিহত করার। কিন্তু এসব তো পরে। আপাতত যেটা জানা দরকার, অনিন্দ্য-সুকান্তের নথি ব্যবহার করে ওই দুটো সিম রাহুল বেচেছিলেন কাদের?
কাদের বেচেছিলেন, দিব্যি মনে ছিল রাহুলের। দু’জন হিন্দিভাষী লোক। রাহুল মুখ চিনতেন। ধনেখালির দশঘরায় রাহুলের বাড়ি। বাড়ির কাছেই সাত-আটজন লোক তিন-চার মাস হল একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। বাড়িটা স্থানীয় একটা প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের। যাঁর পাশাপাশি দুটো বাড়ি। একটা দোতলা, যেটায় নিজে থাকেন সপরিবারে। আরেকটা একতলা। যেটা ভাড়া দিয়ে আসছেন বহুদিন ধরেই। পাড়ার লোক জানত, ওই সাত-আটজন হিন্দিভাষী ভাড়াটে উত্তর ভারতের লোক। এ রাজ্যে ব্যবসার কাজে এসেছে। নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করতে হয়। ঠিক কিসের ব্যবসা, স্থানীয় মানুষ জানত না। জানার আগ্রহও বিশেষ ছিল না। ওই সাত-আটজনের মধ্যেই দু’জন মাসতিনেক আগে রাহুলের দোকানে এসেছিল। বলেছিল, লোকাল সিম দরকার, কিন্তু ডকুমেন্ট নেই। এমন খদ্দেরদেরই অপেক্ষায় থাকতেন রাহুল। অনিন্দ্য-সুকান্তের নথির জেরক্স কপি ব্যবহার করে ডবল দামে বেচে দেন সিম। ওঁদের নামেই রেজিস্টার্ড হয়ে যায় সিম-নম্বর।
—নাম জানেন ওই দু’জনের?
—না স্যার, তা কী করে জানব? ওই একবারই দু’জনের সঙ্গে কথা হয়েছিল, যেদিন দোকানে এসেছিল। তারপর এক-দু’বার বাজারে দেখেছি। কথা হয়নি।
—বাড়িটা তো চেনেন বললেন…
—হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, চিনি না আবার! একদম চিনি।
—এখন তো সন্ধে হয়ে গেছে। এখন গেলে পাওয়া যেতে পারে ওদের?
প্রাথমিক ভয় আর জড়তা কেটে গিয়ে রাহুল তখন প্রায় সোর্সের ভূমিকায়, আমাকে দুটো ফোন করতে দিন স্যার। আমি জেনে নিচ্ছি, এখন ওরা আছে কি না।
ফোন করতে দেওয়া হল রাহুলকে। পালটা ফোন এল মিনিট পনেরোর মধ্যেই। হ্যাঁ, এখন ওই বাড়িতেই আছে ওরা। ফোনে এসপি-কে পুরোটা জানালেন সুমনজিৎ। সবুজ সংকেত এল রেইডের। রাহুলের সঙ্গে গিয়ে বাড়িটা ‘রেকি’ করে আসা হল। পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল।
জনবহুল মহল্লার মধ্যেই বাড়ি। ঢোকা-বেরনোর একটাই দরজা। ধনেখালি থানায় একটা সশস্ত্র বাহিনী তৈরি রইল। যারা ফোনে বা ওয়ারলেসে বার্তা পেলেই ছুটবে ওই বাড়িতে। মূল ‘রেইড’-এ থাকবে সুমনজিতের নেতৃত্বে সাদা পোশাকের টিম। সঙ্গে ধনেখালি থানার ওসি এবং তাঁর টিমের ছ’জন। সবাই প্লেন ড্রেসে। প্রত্যেকের কোমরে গোঁজা নাইন এমএম পিস্তল। লোডেড। যাদের খোঁজে যাওয়া, তারা বেপরোয়া প্রকৃতির ডাকাত। সামান্যতম বিপদের আঁচ পেলে যে-কোনও মুহূর্তে গুলি চালাতেই পারে। বারবার ‘ব্রিফ’ করে দেওয়া হল সবাইকে। চূড়ান্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
সতর্কতার তেমন প্রয়োজনই হল না অবশ্য। ধনেখালির ওসি কড়া নাড়লেন দরজায়। খুলল এক মাঝবয়সি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঘুমচোখ। এবং দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নাকে যে তীব্র গন্ধটা ছিটকে এল, তাতেই সুমনজিৎ বুঝলেন, ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন। এ গন্ধ ভোলার নয়! এ সেই ‘হিমতাজ’ তেলের বিকট গন্ধ! যে তেলের শিশি বিমলের বাড়ির ফ্রিজের উপর ফেলে গিয়েছিল ডাকাতরা। ওই টেনশনের মধ্যেও ক্ষণিকের জন্য ছোটবেলায় পড়া ওই গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল সুমনজিতের। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জাদুকরী কলমে লেখা। ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’!
দুদ্দাড় ঢুকে পড়েছে পুলিশের টিম। যে দরজা খুলেছিল, তার বুকে দু’জন অফিসার ঠেকিয়ে দিয়েছেন পিস্তল। সাকুল্যে দুটো ঘর। অগোছালো, নোংরা। একটা ঘরে চাটাই পাতা। তাতে দু’জন ঘুমচ্ছিল। উঠে বসেছে ধড়মড়িয়ে। পাশের ঘরটা তুলনায় বড়। কিন্তু একই রকম অপরিচ্ছন্ন। সেখানে একটা তক্তপোশ। যাতে শুয়েছিল চারজন। হইচই শুনে যাদের ঘুম ভেঙেছে। এবং ভাঙার পর দেখেছে, খেল খতম! প্রতিরোধ করার মতো প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই! ওয়ারলেস বার্তা পেয়ে উল্কাগতিতে চলে এসেছে ধনেখালি থানায় অপেক্ষারত সশস্ত্র টিম। শুরু হয়ে গিয়েছে তল্লাশি।
ওই চৌখুপ্পি সাইজ়ের দুটো ঘরের তল্লাশিতে কতক্ষণই বা সময় লাগে? তক্তপোশের নীচে গোটা চারেক জংধরা ট্রাঙ্ক। যার মধ্যে দুটো থেকে বেরল প্রচুর সোনারুপোর গয়না। যার চেহারা-ছবি মিলে যাচ্ছে বিমল-বর্ণিত খোয়া-যাওয়া গয়নার তালিকার সঙ্গে। আরেকটা ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার হল চারটে শাবল, দুটো বন্দুক, তিনটে ওয়ান শটার আর দুটো নাইন এমএম পিস্তল, যেমনটা মুঙ্গেরে তৈরি হয়।
সাত ডাকাত। বাবুলাল সিং, গণপত রাম, প্রেম পাল, ভগবান সিং, বনওয়ারি সিং, বলবীর সিং, সতীশ গৌতম। সাতজনের মধ্যে সতীশ আর বলবীর ছাড়া সবাই ওই ধানুপুরারই বাসিন্দা। সতীশ আর বলবীর, দু’জনে সম্পর্কে আত্মীয়। দু’জনেরই বাড়ি রাজস্থানে। ধানুপুরা অঞ্চলে সতীশের বোনের বিয়ে হয়েছে। সেই সূত্রে সতীশ-বলবীরের যাতায়াত ধানুপুরায়।
সিজ়ার লিস্ট বানাতে লেগে গেল ঘণ্টাদুয়েক। রাত দশটা নাগাদ যখন ‘সপ্তরথী’-কে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলে উত্তর ২৪ পরগনার দিকে রওনা দিচ্ছে পুলিশ, সামনের গাড়িতে গা এলিয়ে দেন সুমনজিৎ। টানা প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেল, টিম একরকম নিদ্রাহীনই। অথচ কারও ঘুম পাচ্ছে না। কখন ব্যারাকপুরে পৌঁছনো হবে, কখন শিশুপালকে নিয়ে ফিরবেন প্রবীর, কখন বসা হবে এদের নিয়ে, কখন জানা যাবে ডাকাতিটার আদি থেকে অন্ত, তর সইছিল না যেন। কথায় বলে, দুঃসময় একা আসে না। হয়তো ঠিক। কিন্তু উলটোটাও সত্যি। সুসময়ও একা আসে না। সঙ্গে নিয়ে আসে সাময়িকভাবে ক্ষুধা-তৃষ্ণা-শ্রান্তি-ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার টোটকা।
ব্যারাকপুর ফিরতে ফিরতে রাত সোয়া বারোটা হয়ে গেল। থানায় তার অনেক আগেই এসে গিয়েছেন এসপি এবং অ্যাডিশনাল এসপি। প্রবীর কাল সকালে ফিরছেন শিশুপালকে ‘ট্র্যানজিট রিমান্ড’-এ নিয়ে।
জিজ্ঞাসাবাদ-পর্ব শেষ হতে হতে রাত কাবার হয়ে গেল প্রায়। ঠিক কীভাবে চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল দুঃসাহসিক ডাকাতির, জানা গেল বিস্তারিত। জানা গেল, একজনকে ধরা বাকি আছে এখনও। ‘দে বাবু’। টিম বেরিয়ে গেল সকালেই। ‘দে বাবু’-কে দুপুরের মধ্যেই তুলে আনা হল হুগলি জেলার হরিপালের বাড়ি থেকে।
কে ‘দে বাবু’? শ্রীকান্ত দে। হরিপালেই যার ছোটখাটো সোনার দোকান আছে। এই শ্রীকান্ত লোকটির মূল ব্যবসাই ছিল চোরাই সোনা কেনাবেচার। ডাকাতির মূল চক্রী ছিল এই শ্রীকান্তই।
হরিপালে শ্রীকান্তের এক প্রতিবেশী ছিল। নাম রামলোচন। আলুর কোল্ড স্টোরেজের কর্মী। উত্তরপ্রদেশের লোক। বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত হরিপালে। রামলোচনের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল শ্রীকান্তের। এই রামলোচন আবার শিশুপালের দেশোয়ালি ভাই। ধানুপুরা গ্রামেই বাড়ি।
মাস সাত-আটেক আগে শিশুপাল আসে রামলোচনের কাছে। আলাপ-পরিচয় হয় শ্রীকান্তের সঙ্গে। চোরে চোরে মাসতুতো-পিসতুতো বা খুড়তুতো ভাই হতে সময় লাগেনি বিশেষ। শিশুপাল নিজেদের গ্যাংয়ের ব্যাপারে সব খুলে বলে শ্রীকান্তকে। বেরিলিতে করা একটা ডাকাতির কিছু সোনা বিক্রির ব্যাপারে আলোচনাও করে। মাসখানেক পরে এসে সেই সোনা বিক্রিও করে যায়। বাড়ে ঘনিষ্ঠতা।
ভবঘুরে-জাতীয় গ্যাং এদের। আট-ন’জনের টিম। বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে বেড়ায়। স্থানীয় যোগাযোগ থাকলে কাজের সুবিধা হয়। মূলত আর্থিক সংস্থার অফিস বা সম্পন্ন সোনার দোকানকেই টার্গেট করত এরা। গত বছরের পুজোর আগে রামলোচনের ভাইঝির বিয়েতে শ্রীকান্ত নিমন্ত্রিত হিসেবে যায় ধানুপুরায়। পরিচয় হয় গণপত-বাবুলাল-বনওয়ারিদের সঙ্গে। শ্রীকান্তকে কথায় কথায় বলেছিল বাবুলাল, ‘বাঙ্গাল মে কোই কামধান্দা হো তো জরুর বাতানা।’
‘কামধান্দা’-র ব্যাপারে বেশি ভাবতে হয়নি শ্রীকান্তকে। তার এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি কাঁচড়াপাড়ায়। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত আছে শ্রীকান্তের। বিমলের বাড়ি থেকে বন্ধুর বাড়িটা হাঁটাপথে মিনিট চারেক। বন্ধুরও গয়নার দোকান আছে একটা। বিমলের সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক আছে এই বন্ধুটির। সেই সূত্রেই বন্ধুর সঙ্গে শ্রীকান্ত একাধিকবার গিয়েছেন বিমলের বাড়িতে। ছবির মতো মনে আছে বাড়িটার কোথায় কী।
বিমলের ব্যবসায় যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, দেখে তীব্র হিংসে হত শ্রীকান্তের। বছরদুয়েক আগেও যার কিনা ছোট্ট একরত্তি দোকান ছিল, তার এত বড় শোরুম-ওয়ার্কশপ-চারতলা বাড়ি হয় কোন ভোজবাজিতে? শুধু পরিশ্রম? নাকি অন্য গল্প আছে? হয়তো এ ব্যাটাও চোরাই সোনা কেনে! তার নিজের মতো অল্প টুকটাক নয়, কোনও স্টেডি সাপ্লাই আছে চোরাই মালের। এই বলবন্ত-গণপত-শিশুপালরা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ গ্যাং। এদেরকে দিয়ে বিমলের বাড়িতে ডাকাতি করিয়ে দিলে কিছু না হলেও কুড়ি-পঁচিশ লাখের মাল তো পাওয়া যাবেই। তারপর অল্প দামে কিনে নিয়ে ঘষামাজা করে ফের বেচে দেওয়া। লালে লাল হয়ে যাওয়া আটকাতে পারবে না কেউ। হরিপালের দোকানটাকে বড় করার ইচ্ছে বহুদিনের। পুঁজিতে কুলোচ্ছে না। বলবীররা যদি কাজটা করতে পারে, তা হলে আর…।
ভিনরাজ্যের কোনও গ্যাংয়ের পক্ষে একটা সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা জায়গায় এই মাপের ‘অপারেশন’ করা তো সোজা নয়। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে। শ্রীকান্ত ভেবে রেখেছিল আগাম করণীয়। সূর্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সূর্য গোলদার। চাকদায় বাড়ি। কল্যাণী আর হরিণঘাটায় দুটো ডাকাতির মাল বেচেছিল শ্রীকান্তের কাছে বছরখানেক আগেই। শিশুপালের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল শ্রীকান্ত জানুয়ারির মাঝামাঝি, ‘বড়া কাম হ্যায়, টিম লে কে আ যাও তুরন্ত।’
চলে এসেছিল আটজনের গ্যাং। ধনেখালিতে বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল শ্রীকান্তই। সূর্যের গ্যাংয়ের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল বাবুলালদের। নিজে এঁকে দিয়েছিল বিমলের বাড়ির ঘরগুলোর ছবি। গভীর রাতে সবাই মিলে গিয়ে জরিপ করেও এসেছিল বাড়িটা। কীভাবে উপরে ওঠা হবে বাঁশের ভারা দিয়ে, ‘অপারেশন’-এর সময় কে কোথায় থাকবে, ছকের খুঁটিনাটি ঠিক হয়েছিল শ্রীকান্তের হরিপালের বাড়িতে।
এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি, নৃশংসতার ভোর। আগের রাতে আড়াইটে নাগাদ সবাই জড়ো হওয়া কাঁচড়াপাড়া স্টেশনে। আড়াই-তিন ঘণ্টার ডাকাতি, চন্দনাদেবীকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া চারতলা থেকে। শ্রীকান্ত নিজে উপরে ওঠেনি। একতলার ওয়ার্কশপের কাছে দাঁড়িয়ে উপর-নীচের অপারেশনের সমন্বয় করেছিল। মুখে কাপড় বাঁধা ছিল। না হলে বিমল চিনে ফেলতেন অবধারিত।
বাবুলালরা বুদ্ধি দিয়েছিল সূর্যদের, কাজের সময় ফোন সঙ্গে না রাখতে। যদি কোনওভাবে তাড়াহুড়োয় পড়েটড়ে যায়, পুলিশ খুঁজে পেয়ে যায়, ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সূর্যের টিম ফোন রেখে এসেছিল তালবান্দার ডেরায়।
কিন্তু উদ্দেশ্য তো ছিল ডাকাতি, খুন করতে হল কেন? ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যেত না? চারতলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে হল এক নির্দোষ মহিলাকে, যিনি ডাকাতদের অকস্মাৎ হানায় আতঙ্কিত হয়ে চেঁচিয়েছিলেন শুধু? ধাক্কাটা কে দিয়েছিল? পাতলা চুল আর ভারী চেহারার বাবুলাল নির্বিকারভাবে বলেছিল, ‘হাম নে ফেকা… শালি বহুৎ চিল্লা রহি থি, ইসি লিয়ে ফেক দিয়া।’ চিৎকার করছিলেন বলে ‘ফেক দিয়া’? বলছে এমন ভাবে, যেন একটা দেশলাই বাক্স বা জলের বোতল ছুড়ে ফেলার কথা হচ্ছে।
শুনে প্রবীরের মনে পড়ছিল বাদাউনের সেই ডিএসপি-র কথা, ধানুপুরার রেইডের আগে যিনি বলেছিলেন, ‘এক্সট্রিমলি ফেরোশাস এরা। সামান্যতম রেজিস্ট্যান্সেও এরা গুলি চালিয়ে দেয়। বর্ন ক্রিমিনালস… অ্যান্ড ভেরি ডেসপারেট… অল অফ দেম।’
চন্দনার মৃত্যুটা অবশ্য একেবারেই শ্রীকান্তদের হিসেবের মধ্যে ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল ডাকাতিই। মৃত্যুটা ঘটে যায় স্রেফ বাবুলালদের গ্যাংয়ের বেপরোয়া স্বভাবের জন্য। শুধু ডাকাতি হলে যা হইচই হত, চন্দনার মৃত্যুতে তার একশোগুণ বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায় ঘটনাটা। আর এখানেই ডাকাতি-পরবর্তী ভাগবাঁটোয়ারার ছকটা ওলটপালট হয়ে যায় শ্রীকান্তদের।
কথা ছিল, ডাকাতির পরের দিন শ্রীকান্তের বাড়িতে লুঠের মাল নিয়ে বসা হবে। তারপর কেনাবেচার হিসেবনিকেশ। কিন্তু পরের দিনই এমন তোলপাড় শুরু হয় রাজ্যজুড়ে, এমন ‘রেইড’ শুরু করে পুলিশ, শ্রীকান্তই পরামর্শ দেয়, এখন কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকাই ভাল। হাওয়া ঠান্ডা হোক একটু, তারপর দেখা যাবে। সেইমতোই ধনেখালিতে বাবুলাল-বনওয়ারিদের ভাড়াবাড়িতে লুঠের মালপত্রের সিংহভাগ রাখা ছিল। অল্প কিছু সোনাদানা ছিল শ্রীকান্তের কাছে। সূর্যদের বলা হয়েছিল, টাকাপয়সার ভাগ পরে হবে। একটু থিতিয়ে যাক সব।
নামী ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের শখ ছিল শিশুপালের। চন্দনার ফোনটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহে কিছুদিনের জন্য ধানুপুরায় ফিরে গিয়েছিল এক আত্মীয়ের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পেয়ে। দেড় মাসেরও বেশি ফোনটা বন্ধ রাখার পর এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আর লোভ সামলাতে পারেনি। নিজে যে ফোনটা ব্যবহার করত, তার সিমটা ভরে নিয়েছিল চন্দনার ফোনে। চালু করেছিল ফোন। ভাগ্যিস সেই ফোনটায় ছিল সবে গত বছর চালু হওয়া ‘মোবাইল ট্র্যাকার টেকনোলজি’!
.
চার্জশিট তৈরির সময় নিজের দীর্ঘদিনের তদন্ত-অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণটা উজাড় করে দিয়েছিলেন প্রবীর। প্রমাণ একত্রিত করেছিলেন অখণ্ড মনোযোগে। শিশুপালের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চন্দনার মোবাইল তো ছিলই। লুঠ হওয়া গয়নার প্রায় সবটাই উদ্ধার হয়েছিল বাবুলাল-বনওয়ারিদের দশঘরার ডেরা থেকে। বাকিটা শ্রীকান্তের বাড়ি থেকে। উদ্ধার হওয়া গয়নাগাটি যে বিমলের দোকানেরই, তা প্রমাণিত হয়েছিল তর্কাতীত। দোকানের সমস্ত গয়নাতে নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদায় করে দিতেন বিমল, ‘B.D’। উদ্ধার হওয়া সব গয়নাতেই ছিল ওই আদ্যক্ষর।
রাহুল আদালতে চিহ্নিত করেছিলেন বনওয়ারি আর সতীশকে, যাদের সিম বেচেছিলেন অনিন্দ্য-সুকান্তের নথিপত্র ব্যবহার করে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর ফুটপ্রিন্ট যা পাওয়া গিয়েছিল, তার একাধিক মিলে গিয়েছিল অভিযুক্তদের কারও না কারও সঙ্গে। ‘টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড’-এ বিমল-নিরঞ্জন-অভিজিৎ শনাক্ত করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের আট ডাকাতকে। সূর্য গোলদার, রতন তরাই আর বাবর আলি মণ্ডলকেও চিহ্নিত করেছিলেন ওঁরা। বিমল আদালতে শনাক্ত করেছিলেন সূর্যের সেই চামড়ার বেল্ট।
সূর্যদের এবং বাবুলালদের ডেরা থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া শাবলে যা ‘tool marks’ ছিল, তার ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছিল, বাড়ির চারতলার কোলাপসিবল গেট আর ওয়ার্কশপের শাটার ভাঙতে ওই শাবলগুলোই ব্যবহৃত হয়েছিল। সুরজিৎ-বিশ্বজিৎ-তাপসকে চিহ্নিত করা যায়নি শনাক্তকরণ প্যারেডে।
মামলার কিনারা হওয়ার পর বিশেষ ‘ট্রায়াল মনিটরিং’ টিম গঠন করেছিলেন পুলিশ সুপার। যে টিমের নেতৃত্বে ছিলেন সুমনজিৎ এবং প্রবীর, সঙ্গে ছিলেন বিচারপ্রক্রিয়ার সম্পর্কে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে, জেলার এমন কিছু অফিসার। টিমের কাজ ছিল চার্জশিট পেশের পর বিচারের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়ে দৈনন্দিন নজর রাখা। উদ্দেশ্য একটাই, পদ্ধতিগত নানা বিলম্বে যেভাবে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায় বহু মামলা, এক্ষেত্রে যেন কোনওভাবেই না হয়।
সাপ্তাহিক বিভাগীয় পর্যালোচনা হত বিচার চলাকালীন। প্রতি পনেরো দিন অন্তর ‘স্ট্যাটাস রিপোর্ট’ জমা পড়ত অ্যাডিশনাল এসপি আর এসপি-র কাছে। নিয়মিত বৈঠক হত সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে। বিবাদী পক্ষের সম্ভাব্য স্ট্র্যাটেজি ভোঁতা করে দেওয়ার কলাকৌশল তৈরি হত নিবিড় অধ্যবসায়ে।
ফলও মিলেছিল এত খাটাখাটনির। বিচারপর্ব সম্পন্ন হয়েছিল আশাতীত দ্রুততায়, ব্যারাকপুর দায়রা আদালতের ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্টে। ২০১০-এর ৮ জানুয়ারি রায়দানের দিন ধার্য হয়েছিল। কিছুটা বিপত্তি অবশ্য ঘটে গিয়েছিল রায়দানের সপ্তাহদুয়েক আগে। আসামিদের হাজিরার দিন ছিল ব্যারাকপুর কোর্টে। জেল থেকে আদালতে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পড়ে ব্যারাকপুর পুলিশের প্রিজ়ন ভ্যান। জোর ধাক্কা লাগে একটা টেম্পোর সঙ্গে। ভ্যানের পিছনের দরজাটা ভেঙে যায়। ডামাডোলের মধ্যে লাফ দিয়ে পালায় গণপত, সতীশ আর বনওয়ারি।
চিরুনিতল্লাশি শুরু হয়েছিল অবিলম্বে। পালাতে হলে রেলপথেই পালাবে, এই আন্দাজে হাওড়া আর শিয়ালদা জিআরপি-কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। মেইল করে দেওয়া হয়েছিল পলাতকদের ছবি। দুই স্টেশনে পৌঁছে গিয়েছিল জেলা পুলিশের টিমও। আন্দাজটা মিলে গিয়েছিল সতীশের ক্ষেত্রে। যে ওই রাতেই হাওড়া স্টেশন থেকে দূরপাল্লার ট্রেনে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্ম থেকেই ফের গ্রেফতার হয়েছিল। গণপত আর বনওয়ারিকে ধরা যায়নি। অনেক চেষ্টা হয়েছিল ধরার। ফের টিম পাঠানো হয়েছিল ধানুপুরায়। পাওয়া যায়নি। ফেরারই থেকে গিয়েছিল দু’জন।
রায় বেরিয়েছিল নির্দিষ্ট দিনেই। সূর্য গোলদার, রতন তরাই, বাবর আলি মণ্ডল, শ্রীকান্ত দে এবং শিশুপাল-বলবীর-বাবুলাল-সতীশ-ভগবান-প্রেম পালকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল আদালত। প্রমাণাভাবে খালাস পেয়েছিল সুরজিৎ দাস, বিশ্বজিৎ মণ্ডল এবং তাপস বিশ্বাস।
রায়ে বিচারপতি লিখেছিলেন, ‘I hold that this case belongs to the rarest of the rare category and death sentence for all the convicts would be the adequate punishment in this case, and they are harmful to the society and the society does not require them any more for their dreadful activities, and if the sentence for life imprisonment is given to them, they would do similar harm against the society in future’.
মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছিল সাজাপ্রাপ্তরা। উচ্চ আদালতে শাস্তির মাত্রা কমে দাঁড়িয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাসে।
.
ধরা পড়ার পর পুরো গ্যাংটা যখন ছিল চোদ্দোদিনের পুলিশি হেফাজতে, এক সন্ধেয় ডিআইজি প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ এসেছিলেন বীজপুর থানায়। সঙ্গে পুলিশ সুপার সহ অন্য পদস্থ আধিকারিকরা। আলোচনা চলছিল কেসটা নিয়ে।
একসময় প্রবীর একটু ইতস্তত করেই বললেন এসপি-কে, ‘স্যার, বিদ্যুৎকে, মানে বিমলবাবুর ছেলেকে একবার থানায় আনা যায়?’ এসপি-র জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে প্রবীর বললেন, ‘আসলে হয়েছে কী স্যার, ডাকাতরা ধরা পড়েছে, এটা তো বিদ্যুৎও শুনেছে সবার মুখে। বিমলবাবু সকাল থেকে তিনবার ফোন করেছেন। বলছেন, ছেলে বায়না ধরেছে, মা-কে যে লোকটা ধাক্কা দিয়েছিল, আমি দেখেছিলাম। আমাকে দেখাতে নিয়ে চলো।’ একটু থেমে প্রবীর যোগ করলেন, ‘আসলে ছেলেটা এখনও ট্রমার মধ্যে আছে তো… স্কুল যাচ্ছে না। চুপচাপ হয়ে গেছে ঘটনার পর থেকে। লোকটাকে দেখলে যদি মনটা একটু…।’
এসপি এক মিনিট ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘নিয়ে এসো।’
প্রবীর নিজে গাড়ি নিয়ে গেলেন। নিয়ে এলেন আট বছরের বিদ্যুৎকে। সঙ্গে এলেন বিমলও। থানারই একটা ঘরে শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার চটজলদি ব্যবস্থা করা হল। বাবুলালকে দাঁড় করানো হল ঘরটায়। ওই ঘরেরই বাইরে একটা জানালা একটু ফাঁক করে বিদ্যুৎকে দেখানো হল ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুলালকে। প্রায় এক মিনিট একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বিদ্যুৎ। তারপরই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিমলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল, ‘ও মা-কে মারল কেন বাবা?’
প্রবীর ওদের দু’জনকে নিয়ে এলেন ওসি-র চেম্বারে। কান্না থামার পর বিদ্যুৎ একটু শান্ত হয়েছে যখন, এসপি বললেন প্রবীরকে, ‘বাবুলালকে নিয়ে আসুন এখানে। আর লাঠি আনুন তো একটা।’ বাবুলাল আসার পর এসপি উঠে গিয়ে বিদ্যুতের কাঁধে হাত রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুমি এই লোকটাকে চাইলে শাস্তি দিতে পারো। এই নাও লাঠি।’ বিদ্যুৎ তাকিয়েছিল এসপি-র মুখের দিকে। লাঠিটা হাতেও নিয়েছিল। তিরিশ সেকেন্ড পর রেখে দিয়েছিল টেবলে। পুলিশ সুপারের হাত চেপে ধরে বলেছিল, ‘তোমরা ওকে জিজ্ঞেস করো, মা-কে ও নীচে ফেলে দিল কেন? মা তো কিছু করেনি! কেন মেরে ফেলল?’ বলে ফের কেঁদে ফেলেছিল অঝোরে।
কী উত্তর দিতেন পুলিশ সুপার? কী বলতেন ডিআইজি? কী-ই বা বলার ছিল উপস্থিত অফিসার-কর্মীদের? কিছু দৃশ্য থাকে, ভিতরটা একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে চৌচির করে দেয়। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে আচমকা। কিছু মুহূর্ত আসে, যখন আবেগ অবাধ্যতা করে। এ ছিল তেমন দৃশ্য, তেমন মুহূর্ত। ডিআইজি-এসপি থেকে শুরু করে থানার সেন্ট্রি কনস্টেবল, চোখের জল আটকাতে পারেননি কেউই। চেষ্টাও করেননি।
পুলিশ তো পরে। উর্দি তো পরে। পেশাদার তো পরে। আগে তো মানুষ!
একটু নাটকীয় শোনাল হয়তো শেষ দু’-তিনটে বাক্য। শোনাক।