খোদেজার মৃত্যু কীভাবে ঘটেছিল কে জানে; হয়তো সে ঘাট থেকে বেকায়দায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল আর উঠতে পারে নি, হয়তো পানিতে নাবার পর কোনো রহস্যময় কারণে সহসা তার জীবন-প্রদ্বীপ নিভে গিয়েছিল। তবে মুহাম্মদ মুস্তফার চিঠি আসার কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু ঘটেছিল বলে তাদের মনে এই ধারণা জন্মেছে সে চিঠিই মেয়েটির মৃত্যুর কারণ। মুহাম্মদ মুস্তফা লিখেছিল, তসলিম নামক একজন অন্তরঙ্গ সুহৃদ বন্ধুর ঘটকালিতে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেবের তৃতীয়া কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ ঠিক হয়েছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে আশরাফ হোসেন চৌধুরী সাহেব হজে রওনা হবেন। তার ঐকান্তিক বাসনা প্রস্থানপূর্বে জাগতিক-পারিবারিক সমস্ত দেনা-পাওনা, দায়-দায়িত্ব চুকিয়ে নেবেন। এই কারণে আগামী জুমাবারেই বিবাহের দিন নির্ধারিত হয়েছে। চিঠিটা এসে পৌঁছায় দুপুরের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যে চৌধুরীদের ছেলেটিকে ধরে আনা হয়; সে-দিনও আমি বাড়ি ছিলাম না। তারপর উঠানে দাঁড়িয়ে ছেলেটি সকলের অনুরোধে একবার নয় দু-বার নয় তিন-তিন বার ইস্কুলের পাঠপড়ার ভঙ্গিতে উচ্চস্বরে চিঠিটা পড়ে শোনায়। যাতে সকলেই তার বিষয়বস্তু নির্ভুলভাবে শুনবার এবং উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। চিঠির বিষয়বস্তু খোদেজাও শুনেছিল; উত্তর-ঘরের গা-ঘেঁষে-ওঠা বড়ই গাছের তলে সে দাঁড়িয়ে ছিল। চিঠি পড়া শেষ হলে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির পশ্চাতে শ্যাওলা-আবৃত পুকুর অভিমুখে সে রওনা হয়। সে-পুকুর থেকে জীবিত অবস্থায় মেয়েটি ফিরে আসে নি। কিন্তু চিঠির সঙ্গে মেয়েটির মৃত্যুর কোনো সম্বন্ধ থাকবে কেন? নিঃসন্দেহে ধারণাটি নিতান্ত ভিত্তিহীন। তবে এমন একটা ধারণা যে নিতান্ত ভিত্তিহীন তা বললেও মেয়েটির আকস্মিক মৃত্যুর কারণটি পরিষ্কার হয়ে উঠবে না। বরঞ্চ সে চিঠিই মৃত্যুর কারণ-তেমন একটি কথা বিশ্বাস করতে পারলে বাড়ির লোকেরা হয়তো দুর্বোধ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন দুনিয়ায় সামান্য আলো দেখতে পাবে, একটু সান্ত্বনা পাবে, ভয় বা অসহায়ভাব কিছু লাঘব হবে।
এ-সময়ে প্রতিশ্রুতিটির কথাও কে যেন তোলে। বড় চাচী নয়, অন্য কেউ কথাটি তুলে থাকবে। তার উত্থাপনে মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু চমকিত হয়, এবং তার ফুফু অর্থাৎ মৃত মেয়েটির মা সহসা মুখে আঁচল খুঁজে অদম্যভাবে সমগ্র দেহে থরথর করে কেঁপে কাঁদতে শুরু করলে কয়েক মুহূর্তের জন্যে প্রতিশ্রুতিটি একটি মহাসত্যের রূপ ধারণ করে, ক্ষণকালের জন্যে মুহাম্মদ মুস্তফা তার বুকে কোথাও ঈষৎ একটা বেদনাও বোধ করে।
প্রতিশ্রুতিটির কথা অসত্য নয়। বিধবা হয়ে ছয়-সাত বছরের খোদেজাকে নিয়ে ছোট ফুফু যখন উত্তর-ঘরে আশ্রয় নেয় তখন মুহাম্মদ মুস্তফার বাপ খেদমতুল্লা বোনের দুঃখে দুঃখপরবশ হয়ে স্থির করে মুহাম্মদ মুস্তফা বড় হয়ে থোদেজাকে বিয়ে করবে। তখন ওয়াদা করার বয়স হয় নি মুহাম্মদ মুস্তফার, হলেও তার মতামতের জন্যে কেউ অপেক্ষা করত কিনা সন্দেহ। তবে নিঃসন্দেহে সে-সময়ে বাড়ির লোকেরা গুরুতরভাবেই প্রতিশ্রুতিটি গ্রহণ করেছিল, এবং হয়তো মুহাম্মদ মুস্তফাও তারই অজান্তে সেটি তার ভবিষ্যৎ জীবনের একটি চুক্তি বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। সে জন্যেই কি বড় হয়ে প্রতিবার দেশের বাড়িতে আসবার সময়ে খোদেজার জন্যে সে টুকিটাকি উপহার নিয়ে আসত না-একটি রঙিন ফিতা, ছোট একটি আয়না, চিরুনি, সুগন্ধ তেলের শিশি? তবে এ-কথাও সত্য যে খোদেজার জন্যে সে-সব উপহার আনা বন্ধ না করলেও ক্রমশ একটি নীরবতার মধ্যে সে প্রতিশ্রুতি একদিন সারশূন্য উক্তিতে পর্যবসিত হয়ে পড়ে; যা একসময়ে গভীরভাবে ভারি হয়ে মানুষের মনে বিরাজ করেছে, যা অলঙ্ঘনীয়ও মনে হয়েছে-তা সহসা একদিন বাস্তবের উগ্র আলোয় এবং অবস্থান্তরিত সত্যের তীক্ষ্মদৃষ্টির নিচে বুদবুদের মতো উড়ে গিয়েছে পশ্চাতে কোনো দীর্ঘশ্বাসের ক্ষীণ রেশও না রেখে। বস্তুত বহুদিন কথাটি কেউ তোলে নি; যে-মানুষ ইতিমধ্যে কী-একটা রহস্যময় উচ্চাশায় অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের বাড়ির ক্ষুদ্র গণ্ডি অতিক্রম করে উচ্চশিক্ষার্থে দূরে চলে গিয়েছে, সে-মানুষের দিকে তাকিয়ে কথাটি তুলতে কারো হয়তো সাহস হয় নি। কিছুদিন আগেও বড় চাচী খোদেজার বিয়ের কথা তুলেছিল। ঈদের উপলক্ষে পাওয়া চাঁপাফুলের মতো হলদে শাড়ি পরে খোদেজা উঠান অতিক্রম করে দক্ষিণ-ঘরের দিকে যাচ্ছিল, সে-সময়ে তার বড় চাচী সহসা তার বিয়ের কথা পাড়ে। তবে সে-দিনও সে প্রতিশ্রুতিটার কোনো উল্লেখ করে নি। সত্যি, একদিন প্রতিশ্রুতিটার কিছু আর থাকে নি। সেটি সমস্ত অর্থ হারিয়ে না ফেললে মুহাম্মদ মুস্তফা যখন বন্ধু তসলিমের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে তখন ক্ষণকালের জন্যেও কি দেশের বাড়ির দিকে তার মন ফিরে যেত না, কোনো দায়িত্ববোধের স্মৃতি হঠাৎ জেগে উঠে তাকে ঈষৎ বিচলিত করত না?
কয়েক মুহূর্তের জন্যে মুহাম্মদ মুস্তফার মনে একটি সন্দেহের ছায়া দেখা দেয় : সবাই ভুললেও হয়তো খোদেজা প্রতিশ্রুতিটি ভুলতে পারে নি, বরঞ্চ সমগ্র অন্তর দিয়ে তা গ্রহণ করেছিল এবং তাই মুহাম্মদ মুস্তফা প্রতিশ্রুতি রাখবে না দেখে গভীরভাবে আঘাত পেয়েছিল। সেটা অসম্ভব নয়। তবু সে-জন্যে সে কি আত্মহত্যা করবে? যেখানে তার জন্ম, যে-পরিবেশে সে বড় হয়েছে, সেখানে এমন একটি কাজ কি সম্ভব? না, কাদায় ফুল ফোটে না। তাছাড়া যে-মানুষ আত্মহত্যা করবার ক্ষমতা রাখে সে মানুষ দশজনের মতো নয়, এবং তেমন মানুষের মন সযত্নে ঢাকা থাকলেও ক্বচিৎ কখনো বিদ্যুৎঝলকের মতো আত্মপ্রকাশ করে থাকে, যে-বিদ্যুৎঝলক অন্ধের চোখেও ধরা পড়ে। মুহাম্মদ মুস্তফা এমন কোনো বিদ্যুৎঝলক কখনো লক্ষ করে নি। আরেকটি প্রশ্নও তার মনে জাগে। কী জানি, হঠাৎ হয়তো সাময়িকভাবে মেয়েটির মতিভ্রম হয়েছিল। কিন্তু তা-ও কি সম্ভব? উত্তর-ঘর দক্ষিণ-ঘর, ক্ষুদ্র লেপাজোকা উঠান, পশ্চাতে ডোবার মতো ছায়াচ্ছন্ন ছোট পুকুর-এ-সবের মধ্যে যার জীবনের সীমাবদ্ধ সে মানুষ একটি জিনিস কখনো হারায় না : তা মনের সুস্থতা। দুঃখ-দুর্দশা নিরাশা নিষ্ফলতায় জর্জরিত জীবনে মনের সুস্থতা হারালে বাকি থাকে কী? কখনো-কখনো এমন মেয়ের ঘাড়ে ভূত চাপে, যে-ভূত ওঝা এসে তাড়ায়। তবে ভূত যত বড় হোক না কেন, যতই দিশেহারা করে ফেলার ক্ষমতা রাখুক না কেন, ভূতচাপা মেয়ের বাবার বা আত্মরক্ষার প্রবল ইচ্ছা দমন করতে পারে না। প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে এমন মেয়ের মনে নিদারুণ আঘাতের সৃষ্টি করলেও সে কখনো আত্মহত্যা করবে না।
যারা প্রতিশ্রুতিটির উল্লেখ করেছিল, তারা সে-বিষয়ে শীঘ্র নীরব হয়ে পড়ে। হয়তো তারা বুঝতে পারে, যুক্তিটা এমনই যা নিয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা সহজ নয়। প্রতিশ্রুতি দিলে প্রতিশ্রুতি রাখতেই হয়, একবার প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভাঙ্গা একটি গর্হিত কাজ-এসব কথা দাবি করতে তাদের সাহস হয় না। এসব দাবি জানালে মানুষের দাবির কি আর অন্ত থাকবে। অতএব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে মৃত মেয়েটির অন্তর নিয়ে তারা নানাপ্রকারে কিচ্ছাকাহিনীর জাল বুনতে শুরু করে। পরদিন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। কখনো প্রবল ধারায় কখনো টিপটিপ করে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে অবিশ্রান্তভাবে বৃষ্টি পড়ে, নদী-খাল-বিল কানায় কানায় ভরে ওঠে, ঝোপঝাড় লতাপাতা শোকার্ত কোনো বধুর ছায়াচ্ছন্ন অশ্রুসজল চোখের রূপ ধারণ করে। বৃষ্টির সঙ্গীতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাড়ির মেয়েরা নূতন-নূতন তথ্য আবিষ্কার করে নানাপ্রকারের বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মৃত মেয়েটিকে নিয়ে তাদের কল্পনাপ্রসূত কাহিনীটি অলঙ্কৃত করে। সবাই সেদিন রৌদ্রউত্তপ্ত দুপুরে বরইগাছের তলে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখতে পায়। চৌধুরীদের ছেলে মুহাম্মদ মুস্তফার চিঠি পড়ছে। চিঠির মর্মার্থ বুঝতে মেয়েটির যেন কিছু সময় লাগে, নিষ্ঠুর সত্য গ্রহণ করতে তার মন যেন কিছুতেই রাজি হয় না। তারপর সহসা তার মুখ বজ্রাহত মানুষের মতো নিথর হয়ে পড়ে। তারা মেয়েটিকে পুকুরের দিকে যেতেও দেখে, এবং এত কিছু বুঝে থাকলে বা দেখে থাকলে মেয়েটির গর্ভধারিনীর মনেও কেন ঈষৎ আশঙ্কা জাগে নি-এমন প্রশ্ন না জিজ্ঞাসা করে তারা বলে, মেয়েটি যখন পুকুর অভিমুখে রওনা হয় তখন তার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল সে যেন সহসা ইহজগতের সমস্ত মায়া কাটিয়ে উঠেছে, বেঁচে থাকার সাধ আর নেই।
শুধু সে-দিনের কথা নয়, আগের অনেক কথা নিয়ে তাদের কাহিনী ধীরে-ধীরে বিকশিত হতে-থাকা পুষ্পের মতো পুষ্পিত হয়, কন্টক নিয়ে, সৌরভ নিয়ে। কেবল সে-কন্টক মুহাম্মদ মুস্তফাকে বিদ্ধ করে না, ব্যথা দেয় না, সে-সৌরভও তাকে মোহিত করে না : কাহিনীটি রূপকথার মতো শোনালেও রূপকথা নয়। কত কথা। মুহাম্মদ মুস্তফা বাড়ি আসছে খবর পেলে খোদেজা অধীর হয়ে দিন গুণত, অকারণে থেকে থেকে তার দৃষ্টি ছুটে যেত উঠানের প্রান্তে বেড়ার ফাঁকের দিকে। একবার আসবে বলেও না এলে তার চিন্তার অন্ত থাকে নি, বিনিদ্র চোখে কতবার-না বিছানা ছেড়ে মধ্যরাতে উঠানে গিয়ে স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে। মুহাম্মদ মুস্তফা শহরে ফিরে গেলে ক-দিন সে বিরহবেদনায় ম্রিয়মাণ হয়ে থাকত, রাতে গোপন ক্ষতে বার-বার ভিজে উঠত তার বালিশ। একবার তার অসুখের খবর এলে মেয়েটি আশঙ্কা-দুশ্চিন্তায় এমন দিশেহারা হয়ে পড়ে যে আরোগ্য-সংবাদ না আসা পর্যন্ত মুখে দানা তোলে নি।
এ-সব যে সত্য নয়, সে-বিষয়ে মুহাম্মদ মুস্তফার কোনো সন্দেহ থাকে না। তার প্রতি খোদেজার হৃদয়ে যদি তেমন স্নেহমমতার শতাংশও থেকে থাকত তবে সে কি জানতে পেত না? মেয়েমানুষ মনের কথা লুকাতে পারে সত্য, তবে এমন গভীর স্নেহমমতা যা প্রত্যাখাত হলে মানুষ আত্মহত্যার মতো ভীষণ কাণ্ড করে বসে, তা সম্পূর্ণভাবে লুকানো সম্ভব নয়। সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই খোদেজার আচরণ ভাবভঙ্গি স্মরণ করে দেখে কিন্তু বাড়ির মেয়েমানুষদের কাহিনীর সমর্থনে কিছুই খুঁজে পায় না। প্রতিবার দেশের বাড়িতে ফিরে এলে সকলের মতো খোদেজাও তার সেবাযত্ন করত, সে-ব্যাপারে তার হিস্যা কম ছিল না বেশিও ছিল না। কোনো-কোনো বিষয়ে সে যদি একাই খাতির-যত্নের অধিকার রাখত তার কারণ এই যে, বয়সের জন্যে কারো হাতে কোনো কাজ শোভা পায় কারো হাতে পায় না। সেজন্যেই হাত-মুখ ধোয়ার সময়ে উঠানে বদনা ধরত বা খাওয়ার সময়ে কোনোদিন হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করত। তবে সে যখন বদনা থেকে পানি ঢালত বা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করত তখন কখনো এক মুহূর্তের জন্যেও মুহাম্মদ মুস্তফার এ-কথা মনে হয় নি যে সে বেশ একটু আদর করেই পানিটা ঢালছে বা বিশেষ মমতার সঙ্গে হাতপাখাটা নাড়ছে। কোথায় ছিল তার সেই গভীর স্নেহমমতা ভালোবাসার প্রমাণ?
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পর সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার মনে ঈষৎ ক্রোধভাবের সঞ্চার হয়। আপন মনে সে বলে, রূপকথার জন্যে সদা ক্ষুধিত মানুষেরা হঠাৎ একটি রূপকথা সৃষ্টি করে ফেলে তার নেশায় এমন নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে সত্যাসত্য ন্যায়-অন্যায় বিচারজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, এক-কথা বুঝতে পারছে না যে তারা তাকেই খোদেজার মৃত্যুর জন্যে দায়ী করছে। ক্রোধউষ্ণ মনে এ-সবের মধ্যে সে গুঢ় অভিসন্ধিও খুঁজে পায়। একবার মনে হয়, সে যে তাদের পশ্চাতে ফেলে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে এ কথা তার মঙ্গল কামনা করলেও তারা গ্রহণ করতে পারছে না বলে একটি বিকৃত উপায়ে তার কাছে তাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে, এবং এত শ্রম-সাধনার সাহায্যে যে জীবনের দেহলিতে সে এসে পৌঁছেছে সে-দেহলি যদি তার ফলে ছায়াচ্ছন্ন হয় তাতেও তাদের আপত্তি নেই। আরেকবার মনে হয়, সে যে পিতৃদত্ত প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করে নি সে-কথা জোর গলায় বলবার সাহস না পেলেও সে-জন্যেই তারা তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত। অন্য ধরনের কথাও মনে জাগে। তার মনে হয়, এই কাহিনীতে তার অংশ নিতান্ত নগণ্য, সে একটি উছিলামাত্র। মৃত মেয়েটিই কাহিনীটির উদ্দেশ্য, সেই তাদের লক্ষ্যস্থল, এবং একটি ঘোরালো উপায়ে মৃত মেয়েটিকে জীবিত করার চেষ্টা করছে তারা, মৃত্যুর পর একটি অতিশয় স্নেহশীল দরদী আত্মা সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছে। স্নেহান্ধ লোকেরা কেবল এ-কথা বুঝতে পারছে না যে মেয়েটিকে সৃষ্টি করতে গিয়ে তাকেই ধ্বংস করছে।
তবে এ-সব মনে-মনেই সে বলে, মুখে কিছু বলা হয়ে ওঠে না। বাড়ির লোকেদের সরল, বিমর্ষ, কাল্পনিক কাহিনীতে আত্মমগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে এ-কথাও বুঝতে পারে যে, মেয়েটি তার জন্যে আত্মহত্যা করেছে বিশ্বাস করলেও তার বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই, কোনো ক্রোধও নেই, যেন দোষ তার নয় অন্য কারো, আসল অপরাধী দৃশ্যগত জীবন-মঞ্চের অন্তরালেই কোথাও লুকিয়ে। হয়তো এ-জন্যে সে শেষ পর্যন্ত ক্ষীণতম প্রতিবাদও জানাতে সক্ষম হয় না। তার ক্রোধ পড়ে, সে শান্তও বোধ করে।
তৃতীয় দিন ছাতা মাথায় জুতা বগলে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সে যখন চাঁদবরণঘাট অভিমুখে রওনা হয় তখন সহসা স্থির করে, খোদেজার মৃত্যুর জন্যে বিয়েটা কিছুদিন স্থগিত রাখা শোভনীয় হবে। এ-টুকু না করে যেন পারা যায় না।
তবারক ভুইঞা বলে চলে :
সেদিন উকিল কফিলউদ্দিন সহসা জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় চড়া পড়েছে, কেই বা বলেছে চড়া পড়েছে? তবে প্রশ্নটি উচ্চকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে বৈঠকখানায় উপস্থিত লোকেদের মনে বিষম একটা কৌতূহলের সৃষ্টি করলেও সে-প্রশ্নের অর্থ কী তা তখন বলে নিঃ সে-প্রশ্নের যে-উত্তরটি দেখতে পায় তা হয়তো সে-সময়ে তার নিজের বিশ্বাস হয় নি। তবে কথাটি যতই ভেবে দেখে ততই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। সত্যি, চড়া যদি পড়ে থাকে, কোথায় সে চড়া? এ-পর্যন্ত কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা স্বচক্ষে কোনো চড়া দেখে নি। চড়ার কথা বলেছে তারা যারা স্টিমার চালায়, যারা সে স্টিমারের আসা-যাওয়া হঠাৎ বিনা খবরে বন্ধ করে দিয়েছে। পরদিন সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে, কপালে সুগভীর রেখা, মুখে একাগ্র ভাব, যেন সমস্ত চিন্তাধারা নিয়োজিত করে কী একটা দুরূহ সমস্যার সমাধান কার্যে রত। তবে সন্ধ্যার দিকে তার মুখ পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
উকিল কফিলউদ্দিন সে-দিন সন্ধ্যার পর তাড়াতাড়ি করে একটি সভা ডাকে এবং কয়েকজন উকিল-মোক্তার, হেকিম-ডাক্তার এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা যখন তার বৈঠকখানায় উপস্থিত হয় তখন তার আবিষ্কারের কথাটি তাদের জানাবার জন্যে সে অধৈর্যপ্রায় হয়ে উঠেছে। আজে বাজে কথায় কালক্ষেপ না করে সে সরাসরি আসল কথা পাড়ে।
বুঝলেন, কথাটি আগাগোড়া একটি ধোঁকা মাত্র। চড়ার কথা বলে তারা আমাদের ধোঁকা দিতে চায়। আসল কথা কী জানেন? কামালপুরের পথে যত পয়সা তত পয়সা এ-পথে নেই, তাই এখান থেকে স্টিমার তুলে দিয়ে কামালপুরের পথে চালু করেছে।
কামালপুর যে একটি বর্ধিষ্ণু শহর তা কুমুরডাঙ্গার লোকেদের অজানা নেই। সে শহরের নিকটে একটি বড় পাটের কারখানা বসেছে, সে-পথে লোকেদের যাওয়া-আসা এবং আমদানি-রপ্তানিও বেশ বেড়েছে গত কয়েক বছরের মধ্যে।
ব্যাপারটার গোড়ায় ঐ কথা। কথাটা কামালপুর। তবে সেই কারণে এ-শহর থেকে স্টিমার তুলে দিলে আমরা ক্ষেপে যাব এই ভয়ে স্টিমারের লোকেরা চড়ার কিচ্ছা কেঁদেছে। চড়া পড়লে মানুষ আর কী করতে পারে?
কথাটি সকলের বিশ্বাস না হতে পারে এই ভেবে উকিল কফিলউদ্দিন সহসা কিছু আশঙ্কিত হয়ে উঠে একটি মিথ্যা কথা বলবে বলে স্থির করে। কণ্ঠে অত্যধিক গাম্ভীর্য এনে বলে, খবরটি বিশ্বস্তসূত্রেই জানতে পেয়েছি। কিছুদিন আগে সদর থেকে আমার জামাই লিখেছিল। সে কী করে জানতে পেয়েছিল এমন একটি পরিকল্পনা চলছে। তবে ভুলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ সে-সময়ে মনে পড়ল।
উকিল কফিলউদ্দিনের কথা সবাইকে স্তম্ভিত করে থাকবে, কারণ ঘরময় একটি নীরবতা দেখা দেয় কয়েক মুহূর্তের জন্যে। নদীতে চড়া পড়েছে, এবং সে-জন্যে স্টিমার-চলাচল বন্ধ হয়েছে-একথা সকলে ইতিমধ্যে মেনে নিয়েছিল, হঠাৎ তাদের মনে বয়োজেষ্ঠ্য প্রবীণ উকিল একটা সন্দেহের সৃষ্টি করে। তবে কি চড়ার কথাটি সত্য নয়, সে কি একটি প্রচণ্ড ধোঁকামাত্র, নিছক ফাঁকি ছাড়া কিছু নয়?
নীরবতা ভঙ্গ করে ডাক্তার বোরহানউদ্দিন অবশেষে সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, এমন ধোঁকা কি সম্ভব?
ডাক্তার বোরহানউদ্দিন অকালবৃদ্ধ। চল্লিশে পৌঁছেই তার শিড়দাঁড়া বাঁকা হয়ে পড়েছিল, মাথার চুলও অর্ধেক সাদা হয়ে গিয়েছিল। বেশভূষার দিকে তেমন খেয়াল নেই, মুখে সদাসর্বদা নিরানন্দ ভাব, অকালে বার্ধক্যের আক্রমণ সম্বন্ধে তাকে সচেতনও মনে হয় না; যে-বার্ধক্য একদিন অনিবার্য, জীবনপরিক্রমা অসময়ে শেষ না হলে যা এড়ানো যায় না, সে-বার্ধক্য কিছু আগে এসে উপস্থিত হয়েছে বলে আফসোস-আক্ষেপ করা তার কাছে হয়তো অহেতুক মনে হয়। তার মনে কোনো কুটিলতা নেই, এবং সে যখন রোগীর পরীক্ষা শেষ করে কেমন এক দৃষ্টিতে রোগীর দিকে তাকিয়ে পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে বিস্মৃত হয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে তখন সে যে নিতান্ত ভালোমানুষ সে ধারণাটি আপনা থেকেই মানুষের মনে জেগে ওঠে। তবে রোগীর পরীক্ষা শেষ হলে একদিন যে-সব কথা ভাবত সে-সব কথা আর ভাবে না : রোগীর অবস্থা যে বড় গুরুতর তা তাকে বা তার আত্মীয়-স্বজনকে কী করে বলে, রোগীর ওষুধপথ্য করার সামর্থ আছে কিনা, বা চিকিৎসার উত্তম উপায়টি কী। সে-সব আর ভাবে না, কারণ ক্ষুদ্র মফস্বল শহরের চিকিৎসক অনেক কিছু ভাবা ছেড়ে দেয় একদিন। সে-সব ভেবে লাভ কী? ক্রমশ একদিন রোগীর আয়ু কিছু বৃদ্ধি করার চেষ্টাও তার কাছে বৃথা মনে হয়। তাতে কেবল দুঃখ-যন্ত্রণা বাড়ানো হয়, কষ্টের জীবনকে বিলম্বিত করা হয়, শান্তির দিনটি পিছিয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি কথাও সে বোঝে। চিকিৎসার অর্থ আজরাইলের সঙ্গে একপক্ষীয় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, যে-যুদ্ধের শেষে পরাজয় নিশ্চিত; রোগীর অবস্থা চিকিৎসার বাইরে চলে গেলেই সচরাচর চিকিৎসকের তলব পড়ে। কোনো চিকিৎসক সাফল্য বা কৃতিত্বের প্রত্যাশাও করতে পারে না, এবং যে-কাজে সাফল্য বা কৃতিত্বের সম্ভাবনা নেই সে-কাজে মানুষের আনন্দও নেই। অতএব ডাক্তার বোরহানউদ্দিন যখন স্টেথোস্কোপ যন্ত্রটি গলায় ঝুলিয়ে ক্ষিপ্রপদে কোনো রোগীর বাড়ি-অভিমুখে রওনা হয় তখন তার পদক্ষেপে একটি বেসুরো ধ্বনি ধরা পড়ে, তার কপালের চিন্তাসূচক রেকাগুলিতে ঈষৎ অসামঞ্জস্যতা প্রকাশ পায়। তবে সে-বেসুরো ধ্বনি বা অসামঞ্জস্যতা কেউ লক্ষ্য করে না; গভীর নিরাশাচ্ছন্ন মনে ডাক্তার রোগী দেখতে চলেছে-তেমন কথা কে বিশ্বাস করতে চায়?
উকিল কফিলউদ্দিন সাহেব এমন একটি প্রশ্নের জন্যে যে প্রস্তুত ছিল না, তা নয়। বস্তুত ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের প্রশ্নটি অন্যায্য নয়। স্টিমার-কোম্পানির কাজটি সত্যিই অবিশ্বাস্য; অর্থলিলায় প্রণোদিত হয়ে মানুষ এতদূর যেতে পারে তা কি বিশ্বাসযোগ্য? তবে অবিশ্বাস্য কথাও সত্য হয়; মানুষের ধাপ্পাবাজি, প্রবঞ্চনা এবং নির্দয়তার অন্ত নেই।
শান্তকণ্ঠে উকিল কফিলউদ্দিন উত্তর দেয়, এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে দুঃখের বিষয় এই যে, তা সত্য।
এবার উকিল সাহেব ডাক্তার বোরহানউদ্দিন সম্বন্ধে বিস্মৃত হয়ে স্টিমারের লোকদের প্রবঞ্চনা যদি কার্যকরী হয় তবে কুমুরডাঙ্গা শহরের কী ভীষণ অবস্থা হবে-তা নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করে। ডাক্তার বোরহানউদ্দিন গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে তার বক্তৃতা। তবে তার মনটা কোথায় যেন খচখচ করে। স্টিমারঘাট বন্ধ হলে দরিদ্র শহরের কী পরিণতি হবে তা বক্তার নাটকীয় উচ্ছ্বাস বা শব্দালঙ্কার-বিভূষিত ভাষার বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও সে বুঝতে পারে; সে-সব দুর্বোধ্য নয়, অসত্যও নয়। তবে পূর্বের উক্তিটি এখনো ঠিক বুঝতে পারে না।
একটু পরে সে নির্বোধের মতো আবার বলে ওঠে, চড়ার কথাটি কেন সত্য হবে?
তখনো উকিল সাহেবের বক্তৃতা শেষ হয় নি। বক্তৃতায় বাধা পড়লে হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে পড়ে, একটু পরে ঝলক দিয়ে মুখে যেন রক্ত চড়ে, তারপর কয়েক মুহূর্ত স্থিরনেত্রে ডাক্তারের দিকে চেয়ে তার মুখাবয়বের সবকিছু যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করে দেখে। ডাক্তারের আধা-পাকা চুলে কদাচিৎ হাজ্জামের হাতের বা চিরুনির স্পর্শ পড়ে বলে সারাদিন এলোমেলো হয়ে থাকে। কানের ওপর, তারপর পশ্চাতে ঘাড় ঢেকে সদাময়লা কুঞ্চিত কলারের ওপর সে-চুল ঝুলে থাকে। তার গোঁফও দীর্ঘ। সে-গোঁফ ওপরের ঠোঁট অতিক্রম করে নিচের স্কুল, চিড়খাওয়া ঠোঁট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়, যার সূচাগ্র প্রান্ত এড়াবার জন্যই যেন সে সামনের মস্ত দাঁতের পাটি উন্মুক্ত করে মুখটা খুলে রাখে। কখনো-কখনো অন্যমনস্কভাবে দাঁত দিয়ে গোঁফের প্রান্ত কাটে, কখনো সহসা জিহ্বা বের করে তা ভিজিয়ে নমনীয় করে তোলে, কিন্তু কখনো ঘটে না। মধ্যে-মধ্যে তাতে খাদ্যকণা দেখতে পাওয়া যায় এবং সর্দি লাগলে এখানে-সেখানে জটও বেঁধে যায়। একবার বহুদিন ধরে গোঁফের প্রান্ত অর্ধচন্দ্রের মতো বাঁকা হয়েছিল, দেখে মনে হত যেন লম্বা-লম্বা ঘাসে আবৃত চরের মাথায় চাঁদ উঠেছে।
উকিল কফিলউদ্দিন অবশেষে ঘরের অস্পষ্ট আলোতেও দেখতে পায় ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের গোঁফের প্রান্তে ডালের মতো কিছু একটা লেগে রয়েছে। কয়েক মুহূর্ত ডাক্তারের দিকে চেয়ে থেকে তারই সন্ধান করেছিল যেন। এবার তা দেখতে পেলে ঘৃণার মধ্যে দিয়ে ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতার জন্যে তার প্রতি একটি পরম অবজ্ঞার ভাব দেখা দেয় উকিল কফিলউদ্দিনের মনে।
ঈষৎ তিক্ত-কঠিন স্বরে সে বলে, চড়ার কথাটি যে নিছক ধোকা তা যেন কোনো কারণে ডাক্তার বিশ্বাস করতে পারছেন না।
কোনো বিষয়ে অনেক চিন্তা করে একবার নিশ্চিত হবার পর কেউ সে-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে উকিল কফিলউদ্দিনের সহ্য হয় না, তাই তিক্ত উক্তিটি করেও সে মনে শান্তি পায় না। বক্তৃতা শুরু করতে গিয়ে চুপ করে যায়, যেন কথার খেই হারিয়ে ফেলেছে। তারপর সহসা তার চোখে কী যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠে।
এমনভাবে তার চোখ জ্বলে ওঠাও কাছারি-আদালতে সুপরিচিত, তার অর্থও সবাই জানে। এমনটা ঘটলে সবাই বুঝতে পারে উকিল কফিলউদ্দিন সহসা একটি মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেছে। কায়ক্লেশে আইনের বইপত্র ঘেঁটে সযত্নে-সাজানো যুক্তিতর্কের সাহায্যে নয়, বিদ্যুৎঝলকের ক্ষিপ্রতায় উপলব্ধ তথ্যের সাহায্যেই সে মামলা-মকদ্দমা জিতে থাকে, পাপিষ্ঠ আসামিরও খালাসের ব্যবস্থা করে থাকে। এখন সে বুঝতে পারে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের নির্বুদ্ধিতার কারণ। ডাক্তার কি সত্যই এমন নির্বোধ হাবাগোবা মানুষ? প্রথমবার সে যখন প্রশ্ন করেছিল তখনই মনে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। তবে তখন মনে হয়েছিল স্টিমার-চলাচল বন্ধ হবার মধ্যে কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি দেখতে পাচ্ছে না বলেই চড়ার কথাটা বিশ্বাস করতে ডাক্তারের আপত্তি নেই, সে ভাবছে, যারা চিকিৎসার জন্যে নৌকায় করে কুমুরডাঙ্গায় আসে তারা পূর্ববৎ তেমনিই আসবে। এখন উকিল কফিলউদ্দিন বুঝতে পারে ব্যাপারটি আরো গভীর, এলোমলো চুল বেশভূষার বিষয়ে উদাসীন ডাক্তারটি অতিশয় গভীর পানির মানুষ-স্টিমার-চলাচল বন্ধ হবার মধ্যে সে আর্থিক লাভের সম্ভাবনাই সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। যারা স্টিমারে চড়ে চিকিৎসার জন্যে অন্য কোথাও যেত তাদের অনেকেই কি এবার তার শরণাপন্ন হবে না?
ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের বিচিত্র আচরণের রহস্য ভেদ করতে পেরে নিজের চতুরতার নিদর্শন দেখে উকিল সাহেব মনে-মনে তৃপ্তি বোধ করে। উকিল কফিলউদ্দিনের বিশ্বাস, তার কাছে মনের কথা গোপন করতে পারে-এমন মানুষের এখনো জন্ম হয় নি। সে জানে, মানুষের দুই মুখ-একটি বাইরের, অন্যটি ভেতরের। বাইরেরটি সমাজ-ধর্মের নির্দেশ মাফিক সাজানো-বানানো, ভেতরটি নির্ভেজাল স্বার্থে তৈরি, সর্ব মহৎ উদ্দেশ্যবিবর্জিত। প্রথমটি নকল, দ্বিতীয়টি খাঁটি একটি সুন্দর, অন্যটি কদাকার। অনেকের যেমন তাসবাজি বা মেয়েমানুষ নিয়ে মারাত্মক নেশা, তেমনি কফিলউদ্দিনের ঘোর নেশা মানুষের সে-খাঁটি কদাকার ভেতরের দিকটা উদঘাটন করা। তার এখন সন্দেহ থাকে না, সযত্নে লুকানো ডাক্তারের মনের কথাটি উদঘাটন করতে সে সক্ষম হয়েছে।
ডাক্তার রোগীর খওয়াব দেখছেন, সে বলে, আস্তে, এত আস্তে যে, উক্তিটি নয়, ঘূর্ণবিদ্বেষই কেবল শোনা যায়।
বোরহানউদ্দিন এই কথাটিও ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু তার যে রোগীর প্রয়োজন নেই-সে-কথা সরলচিত্তে বলতে গিয়েও থেমে যায়। সে-কথা কি সবাই জানে না? স্বাধীনতার পর হিন্দু ডাক্তাররা একে-একে দেশছাড়া হয়ে যায়। তখন থেকে সে এত রোগী দেখছে যে রোগীতে তার আর সাধ নেই। সে অনেক বছর হল। সে-অবধি সুস্থ মানুষের চেহারা আর দেখে নি যেন। অবশেষে সে কিছুই বলে না, সে যে রোগী কামনা করে না, রোগীতে সব সাধ মিটেছে-এ-সব সত্য কথাও বলে না। তাছাড়া সে জানে, ঝানু উকিলের সঙ্গে তর্ক করার ক্ষমতা তার নেই; রোগী-হাসপাতাল ওষুধপত্র-চিকিৎসা ইত্যাদির বাইরে যে-জীবন সে-জীবনে আটঘাট বেঁধে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রহাতিয়ার তার সত্যিই নেই। সেজন্যেও সে ভালো মানুষ; সে নিরস্ত্র।
ততক্ষণে উকিল কফিলউদ্দিন স্থির করেছে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনকে উপেক্ষা করবে, তবে মনে একটু অস্বস্তি বোধ করে। তার কেমন মনে হয়, ডাক্তারের অযথার্থ উক্তি-প্রশ্নে উপস্থিত অন্যান্য লোকদের মনে তার বক্তব্যবিষয় সম্বন্ধে অবিশ্বাস না হলেও কিছু সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তার মনে যে-কথাটি এসেছে তার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের কোনোই কারণ দেখতে পায় না। সে জানে, অনেক সময় এমন দুর্বোধ্য কোনো উপায়ে মানুষ সত্য কথা জানতে পারে। মানুষ একা হলেও একা নয়; তার অন্তরে ফেরেশতা-শয়তান দুই-এরই বাস। হয়তো তারাই জানায় সে-সব কথা। তবে দুনিয়ায় মানুষেরা আবার সাক্ষীপ্রমাণ চায়। যে-মানুষ ওকালতি করে সে মানুষ কথাটি ভালো করে জানে। কখনো-কখনো উকিল কফিলউদ্দিনের মনে হয়, সত্য নয়, সাক্ষীপ্রমাণের আবরণে মানুষ মিথ্যাই কামনা করে।
তবে শীঘ্র সে অস্বস্তি ভাবটি কাটিয়ে ওঠে। সাক্ষীপ্রমাণ সময়মত পাবে; সত্যের জয় নির্ধারিত।
সার-কথা এই, সে বলে, বাকাল নদীতে চড়া পড়ে নি, অন্ততপক্ষে এমন চড়া যার জন্যে স্টিমার চলাচল বন্ধ করা প্রয়োজন। হ্যাঁ, নদীর একধারে কিছু অগভীরতা আছে, কিন্তু কোন নদীতে নেই? পদ্মা বলেন, মেঘনা বলেন যমুনা বলেন, কোনো নদী আগাগোড়া সুগভীর নয়। সব নদীতে চড়া পড়ে চর জাগে কিন্তু আবার স্টিমার-চলারও উপায় থাকে। একটু থেমে উকিল সাহেব আবার বলে, চড়ার উছিলায়ই স্টিমার বন্ধ করা হয়েছে। এ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা যদি প্রতিবাদ না করি, তবে স্থায়ীভাবে স্টিমার বন্ধ হয়ে যাবে। কনিষ্ঠ উকিল আরবাব খানের প্রতি সে দৃষ্টি দেয়। তুমি একটা খসড়া তৈরি করো। জোর কলমে সরকারের কাছে পত্র লিখতে হবে। এ-অন্যায় কী করে আমরা সহ্য করতে পারি?
একটু পরে উকিল সাহেবের একটা কথা স্মরণ হয়। আপনারা জানেন, কুমুরডাঙ্গার লোকেরা কোম্পানির স্টিমারের কী দশা করেছিল। দেখে নেব কার বাপের সাধ্য এ-ঘাটে স্টিমার চলাচল বন্ধ করে, সে বলে।
মুহাম্মদ মুস্তফার বাল্যজীবনের বিষয়ে ভাবতে গিয়ে তেঁতুলগাছের সামনে সে ঘটনাটির কথা মনে পড়ে যায়।
বাড়ির পশ্চাতে শ্যাওলা-আবৃত বন্ধ ডোবার মতো পুকুরের ওধারে তেঁতুলগাছটি অতিক্রম করার সাহস কোনো ছেলেরই হত না, কারণ সেখান থেকে কালুগাজির রাজত্ব শুরু হত। কালুগাজিও নাকি সে-সীমানা অতিক্রম করে এদিকে কখনো আসত না। কেন আসত না, তারও একটি আজগুবি উত্তর ছিল। তবে মনে হয় যে-কালুগাজি হাওয়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে বিদ্যুৎগতিতে মুক্তভাবে চলাফেরার ক্ষমতা রাখত, সে আসলে মানুষ নয় দেহকায়াহীন একটি আত্মাই ছিল, সে-ও যে অনধিকার প্রবেশ করত না, অন্যের এলাকায় পা দিত না-এর মধ্যে সকলের জন্যে একটি অপ্রত্যক্ষ উপদেশ নিহিত থেকে থাকবে। আমাদের গ্রামে কেউ কারো জোতজমির সীমানা-সরহদ্দ মানত না। এ নিয়ে মামলা-মকদ্দমা না হলেও অহর্নিশি ঝগড়া-ফ্যাসাদ দাঙ্গা-হাঙ্গামা হত, কালেভদ্রে এক আধটা খুন-জখমও ঘটে যেত।
কালুগাজিকে কেউ কখনো দেখতে পেত না বলে তার চেহারাটি কী রকম সে বিষয়ে কেউ একমত ছিল না। কেউ বলত সে দশ হাত লম্বা, মুখে তার ঝুরিমূলের মতো দাড়ি, চোখে টাটকা খুন। কেউ আবার বলত, সে অনেকটা সাধারণ ফকির দরবেশের মতোই দেখতে, তবে এমন ফকির-দরবেশ যে কোনো কারণে সর্ব শান্তি থেকে বঞ্চিত। শান্তি পাওয়ার জন্যে সে কোনো বিচিত্র এবাদতে সর্বক্ষণ আত্মমগ্ন হয়ে থাকত, এবং মানুষের সামনে দেখা দিতে যেমন পছন্দ করত না তেমনি চাইত না মানুষ তার এবাদতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। মানুষ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় বা প্রবৃত্তি তার ছিল না।
কালুগাজির রাজস্ব কতদূর বিস্তৃত বা কত বড় এ-সব বিষয়ে কেউ কখনো নিশ্চিত ছিল না বটে, তবে কারো সন্দেহ ছিল না তা পুকুরের ওধারে যে-তেঁতুলগাছের পাশে সে-রাজত্ব শেষ হত সে-তেঁতুলগাছের তলাই সে বসতে ভালোবাসত। মেয়েরা বলত, জায়গাটির ওপর তার মায়া পড়ে গিয়েছে। অতএব একদিন শরঙ্কালের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল বেলায় তেঁতুলগাছের দিকে গ্রামের একটি লোকের দৃষ্টি পড়তেই তার অন্তরাত্মা থরথর কেঁপে ওঠে, কারণ সে দেখতে পায় কে যেন সে-গাছের তলে স্থির নিশ্চল হয়ে বসে। কালুগাজি কি কোনো কারণে সশরীরে দেখা দিয়েছে, অদৃশ্য জগৎ থেকে আর্বিভূত হয়েছে দৃশ্যমান জগতে? অপলক দৃষ্টিতে লোকটি গাছের তলে মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ধীরে-ধীরে একটি আকৃতি, একটি চেহারা। স্পষ্ট হয়ে ওঠে : ছোটখাটো মধ্যবয়সী মানুষ, মুখে কিছু দাড়ি, এত শীতেও দেহের উপরাংশ নগ্ন। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর লোকটি স্থির করে, অপরিচিত লোকটি কালুগাজি নয়। ফকির-দরবেশের মতো মনে হলেও সে নিতান্ত মাটির মানুষ, কেবল চোখে-মুখে ক্ষুধার্ত মানুষের শ্রান্ত তীক্ষ্মতা। কালুগাজি যখন খোশমেজাজে থাকে তখনো তার কপাল থেকে লাঙ্গল-দেয়া জমির মতো গভীর কুটির রেখাগুলি নাকি কখনো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না, তার চোখের আগুন কখনো স্তিমিত হয় না। কালুগাজি অতিশয় অস্থির প্রকৃতির লোকও গাছের তলায় এবাদতে বসে স্থির হয়ে থাকলেও তার মধ্যে আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরের উষ্ণ-তরলতা অস্থিরতা নাকি কখনো শান্ত হয় না। লোকটির মধ্যে কালুগাজির সে-সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কোনো চিহ্ন ছিল না।
গাছের তলায় বসে অপরিচিত লোকটি কয়েক দিন কাটায়। এ-বাড়ি থেকে লোকেরা খাদ্যবস্তু এনে তার ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করে, পুকুরের সামনে তার উপস্থিতি মেয়েদের গোসলের ব্যাপারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলেও কেউ তাকে সরে যেতে বলে নি। বয়স্ক লোকেরা দূর থেকে দেখে তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করত, তবে ছেলেরা বেশ সকালেই তার নিকটে হাজি হয়ে তার চতুষ্পার্শ্বে ঘিরে দাঁড়াত। এত ছেলের মধ্যে কোনো কারণে মুহাম্মদ মুস্তফাকে তার পছন্দ হয়েছিল, এবং মুহাম্মদ মুস্তফা দেখা দিলে বৃক্ষতলে আসনাধীন অপরিচিত লোকটির চোখ প্রথমে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তারপর সে উজ্জ্বলতা ঢেকে যেত স্নেহে, পাতলা পর্দার মতোই যে-স্নেহ নেবে আসত। লোকটি একদিন লক্ষ্য করে, মুহাম্মদ মুস্তফা বা অন্যান্য ছেলেরা সর্বদা যেন একটি অদৃশ্য সীমারেখার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো তা অতিক্রম করে না। একদিন সে মুহাম্মদ মুস্তফাকে বলে, যাও, যাও ওদিকে, কোনো ভয় নেই। প্রথমে মুহাম্মদ মুস্তফার শিশু-সরল চোখে গভীর ভীতি জাগে, মন-প্রাণ পাথরের মতো জমে শক্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু শীঘ্র সহসা কোত্থেকে একটা বিচিত্র সাহস দেখা দেয় তার মধ্যে, যে-সীমারেখা সে কখনো অতিক্রম করে নি সে-সীমারেখা অনায়াসে পেরিয়ে যায়।
সেজন্যেই কি মুহাম্মদ মুস্তফা গ্রামের গণ্ডিতে বন্দী হয়ে থাকে নি, চাঁদবরণ ঘাটের সামনে বৃহৎ নদীটিও তার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে নি।
আরেকটি দিনের কথা মনে পড়ে। ভরা বর্ষার দিন। কয়েকটি সমবয়সী ছেলে স্থির করে গ্রাম থেকে কিছু দূরে সুভন্দ্রা নদীটি সাঁতার কেটে পার হবে। নদী কোথায়, খাল বলাই ভালো; এ-পাড়ে পঁড়িয়ে ও-পাড়ের স্নানরতা বধূদের হাতের চুড়ি বা সূর্যালোকে ঝিকমিক করতে-থাকা নথ দেখা সম্ভব। সাঁতার কাটতে শুরু করে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে এমন সময়ে সহসা মুহাম্মদ মুস্তফার মনে হয়, নদীটি অতল এবং সে-অতল পানিতে না জানি কত কিম্ভুতকিমাকার হিংস্র দৈত্যদানব। ভয়টি নিতান্ত অহেতুক তা বুঝতে পারলেও সে-ভয় দমন করতে সক্ষম হয় না এবং দেখতে-না-দেখতে তার হাত-পা অবশ হয়ে পড়বার উপক্রম হয়। অপর পাড়টিও হঠাৎ যেন বহু দূরে সরে যায়, সেখানে একটু আগে যে-সব বাড়িঘর বা ঘাটে বাঁধা নৌকা দেখতে পেয়েছিল সে-সব দূরত্বে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অতখানি পথ কি সে অতিক্রম করতে পারবে? তার আগেই কি পানির মধ্যে থেকে একটি বিচিত্র জন্তু তার পা কামড়ে ধরে তাকে অতলে টেনে নিয়ে যাবে না? সে বুঝতে পারে, ফিরে গেলেই হয়তো সে প্রাণে বাঁচবে, উলটো পথ না ধরে উপায় নেই। কিন্তু শেষপর্যন্ত ফিরে যেতে পারে নি। এজন্যে নয় যে অন্যছেলেরা, যাদের কেউ-কেউ ততক্ষণে বেশ এগিয়ে গিয়েছে, তারা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে; অকৃতকার্যতার জন্যে বা তার ভীত মনের পরিচয় পেয়ে কেউ হাসি-ঠাট্টা করলে সে হাসি-ঠাট্টায় কখনো সে বিব্ৰত বোধ করত না। ফিরে যায় নি এই কারণে যে, যখন সে উলটো পথ ধরবে তখন তার মনে হয় পেছনের দিকে তাকালে দেখতে পাবে নদীর যে তীর সবেমাত্র ছেড়ে এসেছে সে-তীরও নিকটে নয়, সামনের তীরের মতো সে-তীরও বহু দূরে সরে গিয়েছে। কে জানে, হয়তো কল্পনার দৈত্যদানবের ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেও আসলে সে ফিরে যেতে চায় নি। হয়তো একবার চলতে শুরু করলে পেছনের দিকে কখনো তাকায় নি এ-জন্যে যে পেছনে ফিরে যাওয়াই সহজ। মানুষ পেছনের পথ চেনে; পেছনের পথ কখনো দূরের নয়, কঠিনও নয়। তবু বালক বয়সে মুহাম্মদ মুস্তফার ভয়ের সীমা ছিল না। মানুষ মাত্রই ভীতি বোধ করে-যার কখনো কারণ থাকে, কখনো থাকে না। মানুষ দোজখকে ভয় করে, ভয় করে ভূতপ্রেত দস্যু-ডাকাতকে, ভয় করে রোগব্যাধি শারীরিক যন্ত্রণাকে, মৃত্যুকে, দারিদ্রকে, অপ্রশমিত ক্ষুধাকে। আবার সে ভয় করে কেন ভয় করে সে-কথা না বুঝে, এবং যে-ভয়ের কারণ নেই বা যে ভয়ের কারণ সে বুঝতে পারে না, সে-ভয়ই তাকে সর্বাপেক্ষা ভীত করে। সূর্যালোকের আলোকিত উজ্জ্বল দিনে যখন অবাধে চতুর্দিকে মানুষের দৃষ্টি যায় সেদিনও তার মনে হয় এই স্বচ্ছ প্রখর উজ্জ্বলতার অন্তরালে কোথায় যেন অস্বচ্ছতা, কেমন একটা অন্ধকার। তখন এত আলোর মধ্যেও সে অসহায় বোধ করে কারণ কোথাও আশ্রয় দেখতে পায় না। কিন্তু যেখানে আলো নেই সেখানেও কি সে নিরাপদ বোধ করে?
কারণে-অকারণে মুহাম্মদ মুস্তফার মনে ভয় দেখা দিত। এবার গ্রামের হামজা মিঞা নামক মোল্লা-মৌলভি গোছের একটি লোকের কথায় ভীষণ ভয় দেখা দিয়েছিল তার মনে। লোকটি বলত ঈমানে মুফাচ্ছাল বাল্যবয়সেই পাকা হওয়া উচিত। একদিন মুহাম্মদ মুস্তফাকে হাতে পেয়ে নিজের শীর্ণ উরুতে বাঘা থাবা মেরে ব্যাঘ্রকণ্ঠে হুঙ্কার দিয়ে প্রশ্ন করেছিল : খোদা ভিন্ন কি মাবুদ আছে, তার সমতুল্য কেউ কি আছে, তার কি কোনো শরিক বা প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, তার কি নিদ্রা-তন্দ্রা আছে, ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ক্লান্তি আছে, ক্ষয় আছে? সে-সব প্রশ্নে কী ছিল, বা সে-সব প্রশ্ন বালক-মনে কী চিত্র জাগিয়ে তুলেছিল কে জানে, কিন্তু হামজা মিঞার প্রশ্নের গোলাগুলি শেষ হবার আগেই মুহাম্মদ মুস্তফা অজানা ভয়ে সমগ্র অন্তরে হিমশীতল হয়ে পড়ে, তার মনে হয় আকাশ অন্ধকার করে কেয়ামতি ঝড়-তুফান আসতে দেরি নেই, শীঘ্র কোথাও সহস্রাধিক হিংস্র ক্রুদ্ধ সিংহও কান-বধির-করা আওয়াজে গর্জন শুরু করবে। চোখ বুজে সে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। পরে একটি নির্বোধ মেয়েমানুষের কাছে শুনতে পায়, খোদা নাকি দেখতে কলিজার মতো, এবং কলিজার মতো প্রতি মুহূর্তে থরথর করে কাঁপে। কথাটি কী কারণে তাকে আশ্বস্ত করে, এবং যদিও তার মনে হয় আকাশে ভাসমান অদৃশ্য সে-কলিজার কাঁপুনিতে গোটা পৃথিবী থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে, তার দুর্বোধ্য ভয়টি কিছু প্রশমিত হয়। আরেকবার একদিন কয়েকজন দুষ্টু ছেলে ষড়যন্ত্র করে সমবয়সী আরেকটি রোগ-গোছের ছেলেকে শক্ত কাছি দিয়ে বেঁধে গাছ থেকে মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ছেলেটি তখন তারস্বরে সকলকে এই বল শাসিয়েছিল যে, তাদের ওপর খোদার গজব পড়বে, বালা দেখা দেবে তাদের জীবনে। দুই ছেলেদের সঙ্গে থাকলেও মুহাম্মদ মুস্তফা রোগা ছেলেটির নির্যাতনে কোনো অংশ নেয় নি, সে দর্শকই ছিল। তবু তার কথায় সে একটি অব্যক্ত ভয়ে হিমশিম খেয়ে যায়, এবং সে-রাতেই একটি বিচিত্র ধারণা দেখা দেয় তার মনে। ধারণাটি এই যে, কালো মাটির দলার মতো নাক-চোখ-মুখ-কান-শূন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন একটি জন্তু গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে গ্রামের জনশূন্য পথেঘাটে ছুটোছুটি করছে কিসের সন্ধানে। সে-বিচিত্র ভয়াবহ নামহীন জন্তুটি বারবার তার মনে দেখা দিয়ে বেশ কিছুদিন তাকে নিপীড়িত করে। কেবল আমাদের ছোট চাচার দ্বিতীয়া বউটির মৃত্যুর পর হয়তো সে নিদারুণ ভীতির কবল থেকে মুক্তি পায়।
ছোট চাচা বদর শেখ অতিশয় অলস প্রকৃতির লোক ছিল। সে আমাদের উত্তর ঘরের পাশে থাকত, দু-বাড়ির মধ্যে ছিল একটি বেড়া মাত্র। সংসারের কাজকর্মে মন ছিল না, বাপের মৃত্যুর পর ভাগাভাগি করে যে-সামান্য জমিজমা হাতে পেয়েছিল সে জমিজমা দেখাশুনা করলে পেটে খেয়ে তার নিশ্চিন্তে দিন কাটত, নুন-তেল তো বটেই কখনো-কখনো পোশাক-আশাকের পয়সাও উঠত। তবে জমিজমার চেয়ে তার আলস্যই ছিল বেশি। অন্যান্য লোকেরা যখন রত্তিপ্রমাণ সামান্য জমি থেকেও শুধু ধান নয়, শাকসবজি সর্ষে খেসারি কলাই তুলত, সে তার জমি থেকে যৎসামান্য ধান পেয়েই সন্তুষ্ট থাকত। অন্য বাড়ির ছাদে সোনালি রঙের মস্তমস্ত চালকুমড়া শোভা পেত তার ঘরের চাল অভাগিনী নারীর হাতের মতো শূন্যতায় ধু-ধু করত। ঈদের দিনে অন্যের ছেলেমেয়েরা রঙদার কাপড় পরে আনন্দে কলরব করত, তার ঘরের দুটি ছেলে ছেঁড়া কাপড় গায়ে কিছু ঈর্ষান্বিত কিছু অবুঝ চোখে সকলের দিকে চেয়ে থাকত, আনন্দের কারণ বুঝত না। তারপর একদিন সে যে অলস নয় সে-বিষয়ে সকলকে এবং নিঃসন্দেহে নিজেকে আশ্বস্ত করবার জন্যেই যেন সহসা দ্বিতীয় বার বিয়ে করে বসে। চাচা বদর শেখের বড়-বড় দাঁত ছিল। ক-দিন ধরে সে-দাঁতগুলি অহর্নিশি উন্মুক্ত হয়ে থাকে একটি নির্বোধ হাসিতে। তবে চাচা বদর শেখ একটি অতিশয় রুগ্ণা মেয়েকেই স্ত্রী হিসেবে ঘরে এনেছিল। প্রথম ক-দিন টানা-ঘোমটা এবং লজ্জাশরম-রঙমেহেদির জন্যে তা নজরে পড়ে নি, কিন্তু শীঘ্র তার বীভৎসপ্রায় রুগ্ণতার কথা সকলে জানতে পায়, ঘোমটার নিচে সবই দেখতে পায় একটি মিষ্টি কিন্তু রক্তহীন প্রাণহীন মুখ। দেহের হাড়সর্বস্ব শীর্ণতাও আবিষ্কার করতে দেরি হয় না : শুকিয়ে-যাওয়া নদীর মতোই সে দেহের রূপ। এবং চোখে জীবনের সাধ তখনো মেটে নি, তবে তাতে আজরাইলের ছায়া। নূতন বউ-এর স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে চাচা বদর শেখ বিশেষ চিন্তিত হয় নি, কারণ তার মনে হয় দু-দিন খেয়েদেয়ে গা-এ হাওয়া লাগিয়ে বেড়ালেই বানের পানির মতো তার দেহে স্বাস্থ্য ফিরে আসবে। তবে ধারণাটি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়, কারণ দিনে-দিনে নূতন বউ-এর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পড়ে। চাচা বদর শেখ তার চিরদিনের আলস্য বর্জন করে কেমন দিশেহারা মানুষের মতো মেয়েটির চিকিৎসা এবং ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করে, চাঁদবরণঘাট থেকে ভালো ডাক্তারও ডেকে আনে। সেবার ভালো ফসল হয় নি, বর্ষার আগেই ধান শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন ধান-চাল কিনে চলেছে, আর ধান-চাল কেনার পয়সা নেই। অতএব চাচা বদর শেখকে কাইন্দাপাড়ার দক্ষিণদিকে ডোবা জমিটাও বিক্রি করতে হয়েছিল।
তবে মেয়েটি বাঁচে নি, বিয়ের মাস তিনেক পরে একদিন ঝোড়ো সন্ধ্যায় অশ্রান্ত হাওয়ার গর্জনের মধ্যে সকলের অলক্ষিতে সে তার শেষনিঃশ্বাস ছাড়ে। কেউ তার জন্যে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে নি। চাচা বদর শেখ তার জন্যে এত কিছু করলেও তার মৃত্যুর পর কেবল অর্ধেক দিন কেমন স্তম্ভিত হয়ে থাকে, তার চোখেও ঈষৎ সজলতা দেখা যায় নি।
তারপর কেউ বলে, ঘরে বলা এসেছিল, সে-বলা দূর হয়েছে। সেদিন থেকেই যেন মাটির দলার মতো বিচিত্র জন্তুটির ছায়া দূর হয় মুহাম্মদ মুস্তফার মন থেকে।
তবারক ভুইঞা বলছিল : স্টিমার-চলাচল কেন বন্ধ হয়েছে-সে-বিষয়ে গণ্যমান্য উকিল কফিলউদ্দিনের ধারণাটি কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা আগ্রহভরেই গ্রহণ করে, এবং দেখতে-না-দেখতে যা প্রথমে সত্য বলে মনে হয়েছিল তা অবিশ্বাস্য একটি কথায় পরিণত হয়, যে-চড়া শুধু নদীতে নয়, শহরবাসীদের বুকেও ভার হয়ে জেগে উঠেছিল, সে-চড়া ভার উত্তোলন করে নিমিষে অদৃশ্য হয়ে যায়। একটি লোক নয় অনেক লোক, অনেক লোক নয় গোটা পাড়া, একটি পাড়া নয় সমস্ত শহর যখন একজোট হয়ে কোনো সত্য অস্বীকার করে এবং সে-সত্যের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য কঠিন ব্যুহ সৃষ্টি করে তখন অবরুদ্ধ দুর্গের বাইরে সত্যটি হাওয়ার মতোই নিষ্ফলভাবে গোঙিয়ে ফেরে, প্রবেশের পথ পায় না। কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা সহসা আশান্বিত হয়ে ওঠে : যে-প্রতিপাদপত্র ইতিমধ্যে সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে তার ফলে দু-একদিনের মধ্যেই ঘাটে আবার স্টিমার দেখা দেবে।
কিন্তু শীঘ্র প্রথমে কানাঘুষায়, তারপর সুস্পষ্টভাবে স্টিমার না আসার অন্যান্য কারণও শোনা যেতে থাকে। তবে শহরবাসীরা কি উকিল কফিলউদ্দিনের ধারণাটি অন্তরে-অন্তরে গ্রহণ করে নি? অথবা, তা কি তাদের কাছে আইনজ্ঞের যুক্তিতর্কের মতোই ঠেকেছিল যে-যুক্তিতর্কের সাহায্যে বিচক্ষণ উকিল আদালতে বিপক্ষদলকে পরাভূত করে, কিন্তু যে-সব যুক্তিতর্কের সত্যাসত্য সম্বন্ধে জনসাধারণ কোনো স্পষ্ট ধারণা করতে সক্ষম হয় না? না, তা ঠিক নয়, কুমুরডাঙ্গার জনসাধারণ উকিল কফিলউদ্দিনের ধারণাটি সত্যিই গ্রহণ করেছিল, কেবল কুমুরডাঙ্গার ঘাট থেকে যে স্টিমার অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সে-স্টিমার ফিরিয়ে আনবার জন্যে তারা যে-প্রবল অধীরতা বোধ করে সে-অধীরতার জন্য হয়তো তা যথেষ্ট মনে হয় নি; পড়ন্ত দেয়ালকে রক্ষা করার জন্যে একাধিক ঠেস-পোস্তের প্রয়োজন হয়। অতএব স্টিমার না-আসার যে-কারণ উকিল কফিলউদ্দিনের নিকট জানতে পায় তার ওপর অন্যান্য অনেক কারণও তারা আবিষ্কার করে এবং স্টিমার যে শীঘ্র আবার কুমুরডাঙ্গার ঘাটে দেখা দেবে-এমন একটি বিশ্বাস সুনিশ্চিতকণ্ঠে প্রকাশ করতে থাকে নানাপ্রকারের জতির মধ্যে দিয়ে। কেবল কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীরা স্টিমারকে ফিরিয়ে আনার অধীরতার জন্যে এ-কথা বুঝতে পারে নি যে জনশ্রুতির বহুলতা স্টিমারকে দূরেই রাখছিল, কাছে আনছিল না। হয়তো ততদিনে যা-সত্য তা তাদেরই অজ্ঞাতসারে তারা মেনে নিয়েছিল, কেবল আশা ছাড়তে পারে নি। মানুষের আশা এক স্তরে পৌঁছাবার পর যুক্তি বা যথার্থতার ধার ধারে না।
কোথায় তার উৎপত্তি কে-বা চালু করে-তা সঠিকভাবে কখনো জানা সম্ভব না হলেও একবার একটি জনশ্রুতি শোনা গেলে বিদ্যুৎগতিতে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রত্যেকবার শহরবাসীদের মনে গভীর আশার সঞ্চার করে। কখনো তাদের মনে হয় একটি খবর বিশ্বস্ত সূত্রেই জানতে পেরেছে, পরে অনুসন্ধান করে দেখলে বোঝা যায় সে-সূত্রের পশ্চাতে আরেকটি সূত্র যেন, সে-ও আবার কোথায় যেন শুনেছে খবরটি। কখনো একটি খবরের পশ্চাতে কোনো মুখ দেখতে পায় না, দেখতে পায় কেবল একটি স্থান। যেমন স্টিমার দুটি মেরামতের জন্যে গিয়েছে সে-কথা কে বলেছিল সে-বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হতে না পারলেও কোথায় শোনা গিয়েছিল তা নিয়ে তর্কের অবকাশ হয় না: খবরটি শোনা গিয়েছিল কাছারি আদালতের সামনে ধুলাচ্ছন্ন নেড়া মাঠের পর অশ্বখগাছের তলে নিত্য যে-ভিড় বসে সে-ভিড়ের মধ্যে। শুধু সেই ভিড়-কোনো মুখ নজরে পড়ে না, কোনো কণ্ঠও শোনা যায় না। কিন্তু জনশ্রুতিগুলির উৎসসন্ধানে কেউ কালক্ষেপ করে না, যা শোনে তা অবান্তর মনে না হলেই নির্বিবাদে গ্রহণ করে। তাই স্টিমার দুটি মেরামতে গিয়েছে সে-খবর শোনামাত্র অবিলম্বে তা তারা বিশ্বাস করে নেয়। কথাটি নেহাৎ যুক্তিযুক্ত : স্টিমার কলের জিনিস হলেও মানুষের দেহের মতোই তা বিগড়ে যেতে পারে। কতদিন ধরে স্টিমার দুটি এ-পথে আসা যাওয়া করেছে, একদিনের জন্যে না থেমে একটু বিশ্রাম না করে। তবে যারা এই নিশ্চিত বিশ্বাসে অপেক্ষা করতে শুরু করে যে মেরামত শেষ হলেই বংশীধ্বনি করে পূর্বের মতো স্টিমার দুটি ঘাটে এসে উপস্থিত হবে, তাদের বিশ্বাসটি তাদেরই অজান্তে কখন অন্য একটি বিশ্বাসে স্থানান্তরিত হয়; যে-জনশ্রুতির কোথাও কোনো ভিত্তি নেই সে-জনশ্রুতি হাওয়া-তাড়িত মেঘের মতো সদাচঞ্চল, এ-মুহূর্তে এখানে আছে অন্য মুহূর্তে নেই, যা ঘনঘটার রূপ ধারণ করে তা আবার দেখতে-না-দেখতে শূন্য নীলাকাশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এবার যে-জনশ্রুতি তাদের বিশ্বাসে শিকড় গাড়ে, তা সর্বপ্রথম চড়ার সম্ভাবনাকে স্বীকার করে। তবে চড়ার অস্তিত্ব গ্রহণ করলেও সেটি তাদের মনে দুরতিক্ৰমণীয় প্রতিবন্ধকের রূপ গ্রহণ করে না। তারা বলে, চড়া পড়েছে কথাটা সত্য এবং সে জন্যেই ঘাটটি বর্তমান স্থান থেকে সরিয়ে শহরের উত্তরদিকে একটি নূতন স্থানে বসানো হবে, কেবল যতদিন পর্যন্ত ঘাটটি সেখানে সরানোনা হয় ততদিন পর্যন্ত স্টিমার চলাচল বন্ধ থাকবে। এ-জনশ্রুতির উদ্ভাবক চড়াটি বর্তমান ঘাটের সামনেই দেখতে পায়। তাই-বা কী করে অবিশ্বাস করা যায়? শহরের বৃদ্ধদের এখনো স্মরণ আছে, কুমুরডাঙ্গায় ঘাট স্থাপিত হবার কয়েক বছরের মধ্যে সে-ঘাট তিনটে বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। প্রথমে কাছারি-আদালতের ঘাটটি বসানো হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় উকিল কফিলউদ্দিনের বর্তমান বাড়ির কিছু দক্ষিণে। সেখানেও ঘাটটি বেশিদিন টিকে থাকে নি, বছর দুই-তিনেক পরে আবার স্থানচ্যুত হয় সেখান থেকে। তবে তারপর থেকে ঘাটটি আর নড়ে নি, সে-সময়ে ঘাটে ফ্ল্যাটটিরও প্রবর্তন হয়।