৩. ক্যানিং জায়গা

০৩.

ক্যানিং জায়গা ভাল। ঘিঞ্জি বাজারটার ভিতরে মানিক সাহাব আটাকল। আটাকলের পিছনেই দমবন্ধ তিনটে ঘরে তার তিন-তিনটে জলজ্যান্ত বউ থাকে। ছেলেপুলে কত তা গুনে শেষ করতে পারিনি। যে ক দিন ছিলাম সেখানে প্রায় দিনই ছেলেপুলেদের মধ্যে দু-একটা নতুন মুখ দেখতাম। তার ক’টা ছেলেমেয়ে তা জিজ্ঞেস করলে মানিক নিজেও প্রায়ই গুলিয়ে ফেলত। এক দিন আমার চোখের সামনেই রাস্তায় ঘুগনিওলার ছেলে কাদা মাখছিল, মানিক সাহা তাকে নিজের ছেলে মনে করে নড়া ধরে তুলে এনে আচ্ছাসে পিটুনি দিয়ে দিল। ভুল ধরা পড়তেই জিভ কেটে বলল, মানকে বলে সাবাস।

বড় ভাল লোক মানিক সাহা। সে নিজেও সে কথা প্রায়ই বলত, বুঝলে হে উপল, আমি লোকটা বড় ভাল। লোকে আমারে ভয় দেখায়, বলে, একের অধিক বিবাহ বে-আইনি। একদিন নাকি আমারে জেল খাটতে হবে। কিন্তু আমি কই, জেল খাটাবা খাটাও, কিন্তু আমারে মন্দ কোয়ো না কেউ। আমি তো কোনও মেয়ের সঙ্গে নষ্টামি করি নাই। বদমাইশ লোক ঘরে বউ থুয়ে অন্যের সঙ্গে নষ্টামি করে। আমি বদমাইশ না। মেয়েছেলে দেখে মাথা খারাপ হলে আমি তারে বিয়ে করে ফেলি। এইটে সাহসের কাজ, না কি ড়ুব দিয়ে জল খাওয়াটা সাহসের?

ঘিঞ্জি বাজারটা পার হলেই বিপুল নদী, আকাশ, ব্রিটিশ আমলের কুঠিবাড়ি। হাজার রকমের মাল বোঝাই হয়ে নৌকো যায় বাসন্তী হয়ে গোসাবা। আরও ভিতরবাগে নানা নদীনালা ধরে ধরে গহিন সুন্দরবন পর্যন্ত। নৌকোয় থেকে থেকে জোয়ার-ভাটা, গাঙের চরিত্র, মেঘ, বর্ষা, শীত সবই চিনে গেলাম। নদীর জীবনে না থাকলে পৃথিবীর কত রূপ অদেখা থেকে যেত। লাট অঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই, মোটরগাড়ি নেই, রিকশা নেই, এমনকী সাইকেল বা গো-গাড়ি পর্যন্ত দেখা যায় না। মাইল মাইল চষা খেতের তফাতে এক-এক খানা গ্রাম। নৌকো ভিড়িয়ে প্রায়দিনই গাঁ দেখতে চলে গেছি গভীর দেশের মধ্যে। সেখানে নিঝুম এক আশ্চর্য জগৎ। ফিরে আসতে মন চাইত না।

আমার সে-জীবনটা ভণ্ডুল করে দিল মানিক সাহা নিজেই। বাসন্তী ছেড়ে ক্যানিংমুখো নৌকো। বড় গাঙে পড়তেই ঝড়। মাল গস্ত করতে সেবার মানিক সাহা নিজেই গিয়েছিল। খড় কিনে ফিরছে। পাহাড়-প্রমাণ বোঝাই নৌকো। মানিক হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় খালি গায়ে হালের কাছে বসে গুন গুন করে ঢপের গান গাইছে। সুরের জ্ঞান ছিল। একটু আগেই একটা পচা কাঠ কুমিরের মতো আধো ড়ুবন্ত ভেসে যাচ্ছিল দেখে কামঠ! কামঠ! বলে চেঁচিয়ে আমাদের সঙ্গে রঙ্গ করছিল। জোর বাতাস ছাড়তেই কিছু আলগা খড় উড়ে গেল ডাইনির চুলের মতো। আকাশে গুমগুম শব্দ। নৌকোর জোড় আর বাঁধনে একটা ক্যাচকোচ শব্দ উঠল বিপদের। জল ঘোর কালো। আকাশে ঘূর্ণি মেঘ উড়ে আসছে!

কেমনধারা অন্য রকম চোখে মানিক সাহা এক বার পিছু ফিরে দেখল। তার দু’হাত পিছনে আমি দাঁড়িয়ে, আমার পিছনে খড়ের গাদা। কিন্তু আমাকে বা খড়ের গাদাকে দেখল না মানিক সাহা। এমনকী গোঙানো জলে গহিন ছায়া ফেলে যে প্রকাণ্ড ঝড় আসছে তার দিকেও ভ্রুক্ষেপ করল না সে। তবু কী যেন দেখল। মাঝিরা চেঁচামেচি করছিল নৌকো সামলাতে।

মোজাম্মেল খড়ের গাদার ওপর থেকে একটা দড়ি ধরে ঝুল খেয়ে নেমে এসে মানিক সাহাকে বলল, সাহাবাবু, খোলের মধ্যে ঢুকে পড়ুন। ইদিক-সিদিক কিছু হলে তিন-তিনটে ঠাকরোন বিধবা হবেন।

খাকি হাফপ্যান্ট পরা মানিক সাহা উবু হয়ে যেমন বসে ছিল তেমনি রইল। পুরনো পালের কাপড় হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে ফেড়ে গিয়ে নিশেনের মতো উড়ছে। নৌকো কিছু বেসামাল। মাঝিরা ডাঙার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু একটা ঘোলায় পড়ে নৌকোটা এগোতে চাইছে না। ওদিকে দিকবিদিক একটা ধোঁয়াটে চাদরের মতো আড়াল করে বড় গাঙ ধরে উড়োজাহাজের শব্দ তুলে ঝড় আসছে। আলগা খড় মুঠো মুঠো উড়ে যায় বাতাসে, এদিক-সেদিক পাক খেয়ে জলে পড়ে। মানিক সাহা যেভাবে উবু হয়ে বসে আছে ধারে তাতে বাতাসের তেমন চোট এলে না উলটে জলে গিয়ে পড়ে।

ভাল ভেবে আমি গিয়ে পিছন থেকে মানিক সাহার বা কনুইয়ের ওপরটা চেপে ধরে বললাম, মানিকদা, চলো খোলে বসে কেত্তন গাই।

মানিক সাহা মুখ তুলে, ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখল। তার বাঁ হাতে রুপোর চেনে বাঁধা পীত পোখরাজ, গোমেদ, বৈদূর্যমণি, সিংহলের মুক্তো, চুনি নিয়ে পাঁচটা পাথর, তা ছাড়া তাগায় বাঁধা দুটি মাদুলি। আমি যেখানটায় ধরেছি তার হাত, সেখানে তাবিজ আর পাথর খজবজ করে উঠল। দেখি, মানিক সাহার দু চোখে টলমল করছে জল।

হাত বাড়িয়ে আমার গলা ধরে মাথাটা তার মুখের কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল, কাজগুলো সব খারাপ হয়ে গেছে। না?

কী কাজ খারাপ হয়েছে, কেনই বা হল, তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু বুঝতে পারছি, মানিক সাহার হঠাৎ কোনও কারণে বড় অনুতাপ এসে গেছে।

আন্দাজে বললাম, কেন, কাজ খারাপ হবে কেন? আমি তো কিছু খারাপ দেখি না।

মানিক সাহা কথা বলল না। সেই ঝড় বাতাসে খাকি হাফপ্যান্ট পরে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে উবু হয়ে বসে চোখের জলে গঙ্গার জল বাড়াতে থাকে, আর কেবল কী মনে করে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে।

ও সব কথার তখন সময় নেই। ঘুণে ধরা মাস্তুল পালের নিশেন সমেত মড়াৎ করে ভেঙে জলে ভেসে গেল। নন্দর মাথায় চোট হয়ে রক্ত গড়াচ্ছে গাল ভাসিয়ে। এই তক্কে নৌকো ঘোলা পেরিয়ে একখানা চক্কর মারল। ধড়াস ধড়াস করে তিন-চারজন আমরা কুমড়ো গড়াগড়ি দিয়ে উঠে দেখি, দুনিয়া মুছে গেছে। চার দিকে বাতাসের হাহাকার শব্দ। তাল-বেতাল জল ফুলে উঠছে গহিন আঁধার গাঙে। নৌকো আকাশে উঠে পাতালে পড়ছে।

এই সব গোলমালে যে যার সামলাতে যখন ব্যস্ত তখন মানিক সাহার হাফপ্যান্ট পরা শরীর পাটাতনে চিত হয়ে পড়ে আছে। মাল্লারা নৌকো একটা ঘাটের মাটির বাঁধে প্রচণ্ড ঘষটানি লাগিয়ে ভিড়িয়ে দিল। লাফিয়ে নেমে সব দড়িদড়া আর খোটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মানিক সাহা তখনও চিত হয়ে পড়ে আছে। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির ধারালো বর্শা ফুড়ছে চার দিক। আগুনের হলকা ছড়িয়ে দড়াম দড়াম করে বাজ পড়ে কাছেপিঠে। মানিক সাহা চোখ বুজে পড়ে আছে। তাগা ছিড়ে কয়েকটা তাবিজ আর কবচ ছিটকে পড়েছে চারধারে।

আমি তাকে নাড়া দিতেই সে সেই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই, যেন বিছানায় শুয়ে আছে, এমন আরামে পাশ ফিরে শুয়ে বলল, কাজগুলো সব খারাপ হয়ে গেছে।

এ অঞ্চলের ঝড় হঠাৎ এসে হঠাৎ যায়। ঝড় থেমে গেলে দেখা গেল, খড় ভিজে নৌকো তিন গুণ ভারী হয়ে জলের নীচে মাটিতে বসে গেছে। তার ওপর ভঁটিতে এখন উলটো স্রোত। মাল্লারা ওপরে উঠে খড়ের চাপান কমানোর জন্য ভেজা খড়ের আঁটি হাতে হাতে চালান করছিল ডাঙায়। ভিজে সবাই চুস। খড়গুলো পড়ে থাকবে এখানে, কাল অন্য নৌকো নিয়ে যাবে এসে।

খোলের ভিতর আমার একটা টিনের সুটকেস আছে। তার ভিতর থেকে সস্তার সিগারেট আর দেশলাই এনে পাটাতনে মানিক সাহার পাশে বসলাম। দিব্যি ঠান্ডা হাওয়া। পরিষ্কার আকাশে ফুটফুট করছে তারা। ভেজা গায়ে উঠে বসে মানিক সাহা একটা সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে বলল, উপলভাই, বড় অপরাধ করে ফেলেছি হে। মানকে বলে সাবাস।

কিছুই বুঝতে পারছি না। ধমক দিয়ে বললাম, ব্যাপারটা কী?

সে গম্ভীর হয়ে বলে, তখন তুমি ফচ করে এসে যদি হাতটা না-ধরতে তা হলে এতক্ষণে আমার লাশ গাঙে ভাসত। যেই না মনের জ্বালায় লাফিয়ে পড়ব বলে মন করেছি অমনি তুমি এসে

শুনে ভয় খেয়ে যাই। মানিক সাহা লাফিয়ে পড়লে আগামী কাল থেকে আমার গতি হত কী? বললাম, লাফাবে কেন?

ঝড়জলের ওই বিকট চেহারা দেখে হঠাৎ নিজের সব পাপের কথা মনে পড়ে গেল কিনা। কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

সারাক্ষণ মানিক সাহার সেই এক কথা। কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে। কী খারাপ হল, কেন খারাপ হল এ সব জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না। সে রাতে লঞ্চ ধরে ক্যানিং ফিরে এসে অবধি তার মাথার জট ছাড়ল না। তারপর তিন দিন, চার দিন করে সময় যেতে লাগল। মানিক সাহা খায় দায়, হাসে, গল্প করে, কিন্তু হঠাৎ সব কিছুর মাঝখানে একটা বড় শ্বাস বুক থেকে ছেড়ে বলে, কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

মাসখানেকের মধ্যে তিনটে নৌকো বেচে দিল সে জলের দরে। আটাকল আর দোকানঘর বউদের নামে লিখে দিল। বউরা কেউ মরাকান্না কাঁদে, কেউ বিকট চেঁচিয়ে গালমন্দ করে মানিক সাহাকে। কিন্তু লোকটা নির্বিকার, কেবল বলে, কাজগুলো সব খারাপ হয়েছে।

আরও ক’দিন বাদে আমার কাছে গোপনে সে ঝেড়ে কাশল। বললে, তিন বিয়ে ভাল নয়, বুঝলে? অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে এক বিয়ে ভাল। আর এই ব্যাবসা-ট্যাবসার কোনও মানে হয় না, আসল জিনিস হল চাষবাস।

আমি ঢাকের বাঁয়া হয়ে মাথা নাড়ি।

 কিছুদিন বাদে একদিন সকালে মানিক সাহা আমাকে নিয়ে দাঁতন করতে করতে বাঁধে হাঁটতে লাগল। সেদিনও তার পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, গা আদুড়। খানিক দূর গিয়ে দাঁতন জলে ফেলে দিয়ে পিছু ফিরে আমাকে বলল, দৌড়োও!

বলে সে নিজে হাঁসফাস করে ছুটতে থাকে। আমার জাগতিক অবলম্বনকে ছুটতে দেখে আমিও দৌড়োই। লঞ্চ তখন ছাড়ে-ছাড়ে অবস্থা। মানিক সাহা এক লম্ফে চড়ে গেল, পিছনে আমি।

একগাল হেসে সে বলল, খুব জোর পালিয়েছি হে। তিন-তিনটে বউ যার, জীবনে কি তার শান্তি আছে? বউগুলো চারটে শালাকে আমদানি করেছে আমাকে নজরে রাখার জন্য। মানকে বলে সাবাস।

আমি বেজার মুখে বললাম, কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?

মানিক সাহা সংক্ষেপে বলল, এক বিয়ে, আর চাষবাস। আর কোনও ফাঁদে পা দিচ্ছি না।

গোসাবায় নেমে মাইল পাঁচেক মাঠ বরাবর হেঁটে পাখিরালয় গাঁ। সেখান থেকে নদী পেরিয়ে দয়াপুর। সেখানে পৌছতে বেলা কাবার হয়ে গেল। গিয়ে দেখি, মানিক সাহা সেখানে আগেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে কবে থেকে। জমিজোত কেনা হয়ে গেছে, দিব্যি মাটির বাড়ি আর ঘেরা বাগান। লোকজন কাজকর্ম করছে। এমনকী সেখানে ডজন খানেক খাকি হাফপ্যান্টও মজুত রয়েছে।

পরদিনই মানিক সাহা বিয়ে বসল। বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে ছিল আগে থেকেই। গরিবের ঘরের শ্রীময়ি একটা কালো, অল্পবয়সি মেয়ে লাজুক হেসে মানিকের বউ হয়ে গেল। নাম ঝুমুর। মানিক আমাকে চুপি চুপি বলল, এক বিয়ে, বুঝলে? এখন থেকে আর বহু বিবাহ নয়।

আমি বুঝদারের মতো মাথা নাড়ি। তখন মানিক হঠাৎ ধর্মভয়ে কাতর হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে বলো তো, ধৰ্মত আমি কাউকে ঠকাইনি তো, জোচ্চুরি করিনি তো কারও সঙ্গে? সকলের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি তো? তারপর নিজেই কর গুনে হিসেব করে বলে, বউদের ছেলেপুলে, টাকা-পয়সার অভাব রাখিনি, এক, মহাজনের কাছেও বাকি বলে কিছু পড়ে নেই, দুই, কর্মচারীদের কারও এক পয়সা মারিনি, তিন…

দয়াপুরে দিব্যি আমার থাকা চলছিল। কাজকর্ম নেই, বসে খাও, আর চাষবাস একটু দেখাশোনা করো, কাজের লোকদের কিছু হাঁকডাক করো, বাস হয়ে গেল। সেই খিদের চিন্তাটা তেমন মাথা চাড়া দেয় না। ভাবলাম, আমার সেই খিদের ভূত বোধহয় রোজার হাতে পড়েছে।

কিন্তু মানিক সাহার নতুন বউ জ্বালালে। এক মাসের মাথায় সে আমার সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি শুরু করে। সেটা মন্দ লাগত না। মেয়েছেলের সঙ্গ তো খারাপ না, সময়টা কাটেও ভাল। কিন্তু দু’মাস যেতে না যেতেই সে নানা রকম ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল। রাত-বিরেতে উঠে আসত আমার বিছানায়।

আমি তাকে বলতাম, দেখো, মেয়েমানুষের চেয়ে আমার ঢের বেশি দরকার একটা আশ্রয়। তুমি অমন করলে একদিন ধরা পড়ব ঠিক, তখন মানকে আমাকে তাড়াবে।

ইস, তাড়ালেই হল?— বলে খুব দেমাক দেখাত। আবার কখনও বলত, চলো পালিয়ে যাই।

অত বোকা আমি নই। পালানোর কথায় পাশ কাটাতাম।

শেষতক ঝুমুরের মধ্যে একটা হন্যে ভাব দেখা দিল। কাঁচা অল্পবয়সি পুরুষমানুষের গন্ধে তার আর রাখ-ঢাক রইল না। মানিক সাহা খেত থেকে ফিরে এসে যখন জিরেন নিচ্ছে তখন আমি কত বার বলেছি, যাও বউঠান, একটু হাওয়া-টাওয়া করো, দুটো ডাব কেটে দাও?

সে তখন আমার সঙ্গে প্রায় মানকের চোখের সামনে ঢলাচ্ছে। বলত, ডাব ও নিজে কেটে নিতে পারবে না?

রাত-বিরেতে মানকে ভাল করে ঘুমোবার আগেই উঠে আসত। চোখের সামনেই দিন দুপুরে আমাকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে যেত বাগানের দিকে।

টের না-পাওয়ার কথা নয় মানকের। ভাল করে দেখেশুনে সে অবশেষে একদিন গর্জন করে উঠে বলল, অসতী! অসতী।

যাদের স্বভাব খারাপ তারা টপ করে পায়ে ধরতে পারে। ঝুমুরও পায়ে ধরে কান্নাকাটি করল। প্রথম বলল, ভুল দেখেছ। পরে স্বীকার হয়ে বলল, আর হবে না এ রকম।

কিন্তু তাই কি হয়! যা হওয়ার তাই হচ্ছিল ফের।

এবার মানিক সাহা কেঁদে উঠল এক রাতে। বউয়ের হাত-পায়ে ধরে বিস্তর বোঝাল। ঝুমুরও কাঁদল, আদর করে বলল, তোমায় ছুঁয়ে বলছি, আর হবে না।

আবার হল।

তৃতীয় দফায় মানিক সাহা একদিন বউকে ধরে বেধড়ক ঠেঙাল, তারপর দেড় বেলা বেঁধে রাখল ঘরে।

কী জানি কেন এ ব্যাপারে আমাকে তেমন কিছু বলত না মানিক। মাঝে মাঝে কেবল ছানি পড়া চোখের মতো যেন ভাল ঠাহর করতে পারছে না, এমনভাবে তাকাত। এক-আধবার করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করেছে, উপলভাই, এর চেয়ে কি তিন বিয়েই ভাল ছিল?

আমি তার কী জানি। চুপ করে থাকতাম।

সে নিজেই ভেবেচিন্তে বলত, তিনটে বউ থাকলে সুবিধে এই যে, তারা পরপুরুষের কথা ভাববার সময় পায় না, একটাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করে। হিংসুক জাত তো! এক বিয়ের দেখছি বিস্তর ঝামেলা।

ইদানীং খুব তাড়ি খাওয়া ধরেছিল মানকে। ঝুমুর কাঁকড়ার ঝাল, মাছের চচ্চড়ি করে দিত। আমি আর মানকে সেই চাট দিয়ে জ্যোৎস্নার উঠোনে বসে সন্ধের পর খেতাম।

ঝুমুর একদিন আধ টিন পোকামারার সাংঘাতিক বিষ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, আজ রাতেই নিকেশ করবে।

বোকা মেয়েমানুষ। ডাক্তার, থানা-পুলিশ, আদালত এ সব খেয়াল নেই। কিন্তু ঝুমুরের চোখ-মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, রাজি না হলে এ বিষ একদিন আমার ভিতরে কোনও কৌশলে চালান করে দেবে। একটা চরম অবস্থায় পৌঁছে গেছে ও।

টিন নিয়ে গ্যাঁজানো তাড়িতে মেশাতে হল।

কী বুদ্ধি!–ঝুমুর দেখে বলল, প্রথমটায় খেলেই তো গন্ধে টের পাবে। আগে ভাল তাড়ি দিয়ে নেশা করিয়ে নেবে তারপর এটা দিয়ো। নেশার ঝোঁকে কী খাচ্ছে টের পাবে না।

ঝুমুরের বুদ্ধি দেখে আমি তখন অবাক। মেয়েমানুষ একই সঙ্গে কত বোকা আর চালাক হতে পারে!

সন্ধেবেলা ঝুমুর বাপের বাড়ি গেল। কাল সকালে ফিরে এসে কান্নাকাটি করবে। বিধবা হবে তো!

আমি আর মানকে তাড়িতে বসলাম।

আকাশে চাঁদ ছিল না, উঠোনে একটা হারিকেন ছিল শুধু। চাঁদের অভাবে মানকে উদাস চোখে হারিকেনটার দিকে চেয়ে ভাঁড়ে চুমুক দিচ্ছে। আমি তাকে পা দিয়ে ছোট একটা আদুরে লাথি মেরে মুখটা কাছে আনতে ইশারা করলাম। সে হামাগুড়ি দিয়ে কাছে আসতেই বললাম, বোঝো কেমন?

কী বুঝব ভাই?

শোন মানিকদা, যখন-তখন না দেখেশুনে যা-তা খেয়ে বোস না এ বাড়িতে।

কেন বলো তো?

দু’ নম্বর হাঁড়িতে বিষ মেশানো আছে।

বিষ?

বলে হঠাৎ হাফপ্যান্ট পরা মানিক লাফিয়ে উঠে হাতের ভাঁড় ছুড়ে ফেলে পেল্লায় চেঁচাতে থাকল, বিষ দিছে! বিষ দিছে! মরে গেলাম, ও বাবা রে, মরে গেলাম। আমার বুকটা কেমন করে। আমার প্যাটটা কেমন করে।

এই বলে আর সারা উঠোন জুড়ে লাফিয়ে নৃত্য করে।

হুবহু সেই ট্রেনের কামরার দৃশ্য।

হাতের ভাঁড়টা শেষ করে আমি হারিকেনটা তুলে নিয়ে রওনা দিলাম। পুঁটুলি একটা বাঁধাই ছিল।

মাঠ পেরিয়ে যখন ঘাটের কাছে পৌঁছেছি তখন পিছন থেকে মানিকও হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির। কোনও কথা হল না দু’জনে। জোয়ারের জল এখন বেশ ফেঁপে আছে। পাড়ে তোলা নৌকোটা এঁটেল কাদায় ঠেলে নিয়ে জলে ফেলে দু’জনে উঠে বসলাম।

মানিক সাহা পাখিরালয়ে নেমে গেল অন্ধকারে। আমি তাকে হারিকেনটা ধরিয়ে দিলাম হাতে। সেই আলোতে দেখা গেল, তার মুখ-চোখ কেমন ভোম্বলপানা হয়ে আছে। পিছনে দিগন্তজোড়া অন্ধকার পৃথিবী, অচেনা। সেদিকে চাইল। তারপর আমাকে বলল, না ভাই, এবার পুরো ব্যাচেলার। চিরকুমার থাকব এখন থেকে।

এই বলে খাড়াই ভেঙে উঠে গেল। কোথায় গেল তা আমি আজও জানি না। আমি নৌকো বেঁধে রেখে গোসাবামুখো হাঁটা ধরলাম।