ওরা যখন কোহিমা থেকে ডিমাপুরের দিকে বোরোল তখন প্রায় দুটো বাজে।
কোহিমা থেকে গড়ানো রাস্তা নেমে গেছে এঁকেবেঁকে। মাইল কয়েক আসার পরই রাস্তাটা ডিফু নদীর পাশে পাশে চলতে লাগল। এসব অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় জঙ্গল এমন ঘন হয় যে তা না দেখলে ঠিক বোঝা যায় না। নদীটা পাহাড়ের উপর দিয়েই বয়ে চলেছে বলে চওড়া নয় মোটেই। সরু, গভীর এবং প্রচণ্ড বেগে ধাবমানা। দু’পাশে নিচ্ছিদ্র জঙ্গল ঝুঁকে রয়েছে।
যখন ওরা কোহিমা ছাড়ে তখন বেশ রোদ ছিল। একটা পাহাড় নামতেই সূর্যটা পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল।
এখন শুধু গাড়ির এঞ্জিনের লো-গীয়ারের শব্দ এবং নদীর একটানা ঝরঝর। বাবলি নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, কি মশাই? কথা বলছেন না কেন?
–ভাবছি। সব সময় কি কথা বলতে ভালো লাগে।
–কি ভাবছেন?
–ভাবনা এখনো দানা বাঁধে নি। মানে, বলার মতো ভাবনা নয়।
–বাবাঃ হাসালেন। আপনার মতো দানাদার ভাবনার কথা তো কখনো শুনি নি।
–আসলে আমি খুব টেন্স হয়ে আছি–যতক্ষণ না ডিমাপুরে পৌঁছই। পথে কোনোরকমে গাড়ি খারাপ হলে যে কি হবে এই ভাবনাটা ভীষণ নার্ভাস করে রেখেছে আমাকে।
বাবলি তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, আপনি একটুতেই নার্ভাস। মসলা খাবেন?
–নাঃ। অভী উদাসীন গলায় বলল।
–না খেলেন। আমি একাই খাচ্ছি বলে বাবলি ওর হ্যান্ড ব্যাগ খুলে মসলা বের করে এক মুঠো মসলা খেল।
এমন সময় হঠাৎ অভীর গাড়ি একটা বাঁকের মুখে অদ্ভুত কোঁ-কোঁ-কোঁ একটা আওয়াজ করে উঠল।
মোটা লোককে ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরলে তারা যেমন আওয়াজ করেন, তেমন আওয়াজ। বাবলি খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল, ও কি? ও কি?–কিসের আওয়াজ?
বলতে বলতেই গাড়িটা বন্ধ হয়ে গেল।
অভীর মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বলল, দেখলেন তো, বললাম আপনাকে–আপনি শুনলেন না, জেদ করলেন।
বাবলি উত্তর দিল না। যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে দরজা খুলে বাইরে নেমে দু’হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, দারুণ। সত্যি জায়গাটা দারুণ। আপনার বাহাদুরী আছে। গাড়িটা যদি বা খারাপ করলেন, তাও এমন একটা দারুণ জায়গায়।
অভী উত্তর না দিয়ে বনেট খুলে বনেটের নিচে মুখ ঢুকিয়ে এটা ওটা নিয়ে টানাটানি করতে লাগল।
বাবলি নদীর পাশে একটা পাথরের উপর বসে নদীর মধ্যে ছোট ছোট পাথর ছুঁড়তে লাগল। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, আচ্ছা এই নদীতে মাছ আছে?
অভী উত্তর না দিয়ে বলল, এ-সি পাম্পের গণ্ডগোল হয়েছে! তেল আসছে না বোধহয়। বলে বনেটের মধ্য থেকে মাথা বের করে বাবলির দিকে তাকাল।
বাবলি একটা ছোট্ট পাথর লোফালুফি করতে করতে বলল, বোধহয় তেল আসছে না। কিন্তু জোঁক নিশ্চয়ই আসছে।
–মানে? বলে অভী ভুরু তুলল।
বাবলি নিরুদ্বেগ শান্ত গলায় বলল, আপনার জুতো বেয়ে দুটো আমার মতো মোটা জোঁক আপনার প্যান্টের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
–কোথায়? কোথায়? বলে অভী লাফাতে লাগল।
তারপর হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে জোঁক দুটোকে বের করে মাড়িয়ে দিল।
বাবলি বলল, গাড়ির কিছু বোঝেন? গাড়ি কেন খারাপ হয়?
অভী বলল, কিছু বুঝি না বলেই তো বিকেলে কোহিমা থেকে নামতে চাই নি।
বাবলি বলল, গাড়ি চালান, গাড়ির মন বোঝেন না।
–আপনি কিছুর বা কারুরই মন বোঝেন না।
গাড়ির পেছনে গিয়ে গুনে গুনে বারোটা লাথি মারুন আর বলুন আব্রাকাডাব্রা। প্রত্যেকবার লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে বলুন আব্রাকাডাব্রা, দেখবেন গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে।
গাড়ি কি করলে ভালো হতে পারে তা জানা ছিল না অভীর। তাই অগত্যা আস্তে আস্তে গাড়ির পেছনে গেল। একবার ওর মনে হল বাবলি ঠাট্টা করছে না তো?
তারপরই ভাবল এ তো ঠাট্টা করার সময় নয়! অতএব ও লাথি মারল গাড়ির বাম্পারে, মুখে বলল, আব্রাকাডাব্রা।
বাবলি বলল, সত্যি আশ্চর্য আপনি। লাথি মারছেন না যেন মনে হচ্ছে। আদর করছেন। জোরে মারুন, খুব জোরে।
অভী জোরে জোরে লাথি মারতে লাগল, আর বলতে লাগল আব্রাকাডাব্রা। আর বাবলি গুনতে লাগল,–এক, দুই, তিন, চার…
বারোটা লাথি মারার পর, বাবলি এবার বলল, বনেট বন্ধ করুন। চলুন যাওয়া যাক।
ভাবল, ও ঠাট্টা করছে। বাবলি আবার বলল, কি? দাঁড়িয়ে দেখছেন কি? চলুন।
বনেট বন্ধ করে অভী এসে স্টিয়ারিং-এ বসল। বাবলি বাঁদিকের দরজা বন্ধ করল। চাবি ঘোরাতেই গাড়ি দিব্যি স্টার্ট নিল এবং তর তর করে চলতে লাগল।
বাবলি, যেন কিছুই হয় নি, এমনিভাবে বাইরে চেয়ে রইল জানালা দিয়ে।
সেই নাগা পাহাড়, ডিফু নদীর ঝরঝরানি শব্দের মধ্যে আসন্ন রাতে অভীর গা ছমছম করতে লাগল। ওর মনে হল ও কোনো ডাইনীর কবলে পড়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে একবার আড়চোখে ও বাবলির দিকে তাকালো। দেখলো, বাবলি নিজের মনে মসলা চিবোচ্ছে।
অনেকক্ষণ পর অভী বলল, আচ্ছা, আব্রাকাডাব্রা মানে কি?
বাবলি বলল, ওটা একটা গুপ্তিমন্ত্র। ম্যাজিসিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার আগে বলেন। তাদের কাছ থেকে শুনেছি।
–আপনি এসব মন্ত্রে-তন্ত্রে বিশ্বাস করেন? অভী বলল।
বাবলি মুখ না ঘুরিয়েই বলল, দেখলেনই তো করি।
প্রয়োজন পড়লে সব কিছুতেই বিশ্বাস করি। তারপরই বলল, কি নাম বললেন যেন? রসিদ আলি? সাদা দাড়ি। ইস্, কখন যে পৌঁছব না।
একটু পরেই দিনের আলো মুছে যাবে। ঐ উত্রাইয়ের রাস্তায় অভী যত জোরে পারে গাড়ি চালাচ্ছে। অন্ধকার হবার আগে সমতলে নেমে ডিফু নদী পেরিয়ে ডিফু শহরকে ডানে রেখে জোরে চলে যাবে ডিমাপুরের দিকে। কিন্তু সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই। এখানে আবার গাড়ির কিছু হলে আর উপায় নেই। বৈরীনাগা ছাড়াও জংলী জানোয়ারের ভয় আছে। এখানে নেই এমন জানোয়ার ভারতবর্ষে নেই।
বাবলি ওর হ্যান্ডব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে গাড়ির আয়নাটা ওর দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল।
ওকে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে অভী। বাবলির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ও অভীকে বছর দশেক হল চেনে।
বাবলি চুল আঁচড়ানো শেষ করে সবে চিরুনিটা ব্যাগে ঢুকিয়েছে, এমন সময় গাড়িটা আবার সেরকম কোঁ-কোঁ-কোঁ-কোঁ আওয়াজ করে একটু গড়িয়ে গিয়ে থেমে গেল।
অভী কোনো কথা না বলে বাবলির মুখের দিকে চাইল।
বাবলি বলল, ডিমাপুর কত দূর?
–প্রায় কুড়ি মাইল।
–ওয়ান্ডারফুল। চলুন, গাড়িটাকে ঠেলে পথের বাঁদিকে সরিয়ে রাখি। আলো থাকতে থাকতে রাত কাটানোর মতো একটা আস্তানা খুঁজতে হয়।
অভী অবাক হয়ে বলল, কেন আব্রাকাডাব্রা?
বাবলি হো হো করে হেসে উঠল।
বলল, একবার লটারী জিতেছি বলে কি বার বার?
হাসির মতো অবস্থা ছিল না তখন অভীর। গাড়িটা ঠেলতে হল না। ব্রেক থেকে পা ওঠাতেই আপনিই গড়িয়ে গেল। বাঁদিকে একেবারে রাস্তা ঘেঁষে গাড়িটা রেখে, বাইরে চারদিকে ভালো করে দেখল। কোথাও জনমানবের চিহ্ন বা বাড়ি-ঘর কিছুই দেখা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ আগে একটা গাড়ি ওদের ঐশ করে কোহিমার দিকে গেছিল। তারপর কোনো গাড়িও চোখে পড়ে নি।
ওরা দুজনে এদিক ওদিক হাঁটল। এদিকে আলো নেভার আর দেরি নেই। সঙ্গে একটা টর্চ পর্যন্ত নেই। বাবলির উপর খুব রাগ হচ্ছিল অভীর এবং বার বার বড় সাহেবের মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। বড় সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, ‘ইরেসপন্সিবল, বড্ড ইরেসপন্সিব তুমি অভী।’
হঠাৎ বাবলি চেঁচিয়ে উঠল, পাওয়া গেছে। খুব উল্লাসের সঙ্গে বলল, পাওয়া গেছে। ওর উল্লাস শুনে মনে হল, জঙ্গলের মধ্যে বুঝি বা কোনো ফাইভ-স্টার হোটেলই পাওয়া গেল।
এগিয়ে পাহাড়ের দিকে কিছুটা উঠে অভী দেখল একটা কুঁড়ে ঘর। একচালা ঘর। ঘরের দুদিক বন্ধ, দুদিক খোলা। সামনে কেটে রাখা অনেক কাঠ স্থূপীকৃত করে রাখা আছে। ঘরের মধ্যে একটা বাঁশের তৈরি মাচা। মালিকের শোওয়ার জন্যে বোধহয়।
এক কোণায় একটি মাটির হাঁড়ি। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। কতকগুলো বাঁশের খোল ঝুলছে বৃষ্টির জল ভরে রাখার জন্যে। মাচাটা এক কোমর উঁচু। একজন লোক স্বচ্ছন্দে শুতে পারে। বাবলির জন্যে একটা বন্দোবস্ত হলেই হল। এদিক ওদিকে চেয়ে অভী নিজের মনেই বলল, মালিক ফিরবেন কি না রাতে, তা কে জানে।
বাবলি বলল, মালিক ফিরবেন না। অন্তত আজ রাতে ফিরবেন না।
–কি করে বুঝলেন?
–বাঃ, কোনান ডয়েল পড়েন নি? হাঁড়ির গায়ে রাজ্যের মাকড়সার জাল। বাইরের কাঠগুলোও প্রায় মাসখানেক আগে কাটা হয়েছে। এ তো কমনসে। বাইরে আগুন জ্বালাবার কোনোরকম চিহ্ন নেই। অতএব বোঝা যাচ্ছে, মালিক এ জায়গাতে কখনো কখনো এলেও রাতে থাকেন না।
অভী বলল, আপনি মাচায় বসুন। আমি গাড়ি থেকে জিনিসগুলো নিয়ে আসি।
অভী গাড়ি থেকে কম্বলটি, বাবলির ব্যাগ এবং ওর ব্রীফ কেসটা নামিয়ে নিল। আরেকবার চেষ্টা করল স্টার্ট নেওয়ার। গাড়ি কোনো কথা বলল না। ঠিক করল, এপথে যদি কোনো ট্রাক বা গাড়ি যায়, তাতে করে ডিমাপুরে ওদের অফিসে খবর পাঠাবে যাতে ভোরে ভোরে ট্যাক্সি নিয়ে তারা আসে। এই রাতে মিস্ত্রি যোগাড় করে, ট্যাক্সি যোগাড় করে এ-পথে এতদূর আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
অভী নিজের থেকে চেঁচিয়ে বলল, কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনলেই আপনি ঘরের ভিতরে ঢুকে যাবেন। এভাবে অসহায় অবস্থায় আমরা আছি জানলে রাতে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। আপনাকে নিয়েই সবচেয়ে বিপদ।
বাবলি অভীর দিকে চেয়ে চুপ করে থাকল একটু। তারপর বলল, তাই বুঝি?
দেখতে দেখতে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু তখনো পুরো অন্ধকার নয়। চারধার থেকে ঝিঁঝি ডাকতে লাগল। কী একটা বড় চতুস্পদ জানোয়ার উপরের পাহাড়ে আওয়াজ করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মিংথুও হতে পারে।
বাবলি বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কি আর পথের গাড়ি আপনার কাছে উড়ে আসবে? গাড়ি এলে তো আধ মাইল দূর থেকে আওয়াজই পাবেন।
–আসুন, লেটস্ সেলিব্রেট। কফি খাওয়া যাক।
এই বলে অভীর লাইটারটা চেয়ে খড়কুটো যোগাড় করে একটা পাথরের আড়ালে আগুন জ্বালাবার বন্দোবস্ত করে, ওর ব্যাগ খুলে দুটি এনামেলের গ্লাস ও নেসকাফের টিন বের করল। বিস্কিটের প্যাকেটটাও বের করল।
তারপর আগুন জ্বেলে বাঁশের খোলে জমে থাকা পরিষ্কার বৃষ্টির জল গ্লাসে ঢেলে জল গরম করে কফি বানালো।
অভীকে দিল এবং নিজেও নিল।
বলল, দারুণ হয়েছে, তাই না?
ওরা যেখানে বসে কফি খাচ্ছিল, সেখান থেকে ডান দিকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল অনেকদূর অবধি।
চারদিকে আবছা অন্ধকার, ঝিঁঝির ডাক, নদীর শব্দ, নানারকম পোকার কটর কটর কুটুর কুটুর শব্দ–এ সমস্ত কিছু ছাপিয়ে ডিফু নদীর শব্দ।
কেমন ভয় ভয় করছিল অভীর। ইম্ফলে অনেকদিন আছে যদিও, তবুও এরকমভাবে নাগা হিসের ভিতরে একজন মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে রাত কাটাতে হবে, কখনো ভাবে নি।
বাবলি অস্ফুটে বলল, সত্যি! আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো জানি না।
অভী লজ্জিত হল। বলল, ঠাট্টা করছেন? কি করব বলুন, আপনি জোর করলেন, নইলে আমি তো এইরকম গাড়ি নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাই নি।
বাবলি বলল, না, না, ঠাট্টা নয়। বিশ্বাস করুন, ছোটবেলা থেকে কত রাত কত জায়গায় কাটিয়েছি, কিন্তু এ রাতের কথা, মানে, এ রাত যদি কাটে, তবে চিরদিন মনে থাকবে।
আমার না, ছোটবেলা থেকেই এরকম জীবন ভারী ভালো লাগে। বিদেশী ছবিতে দেখি, ওদেশের মেয়েরা ইচ্ছে করলে যা খুশি তাই করতে পারে। অথচ আমরা? এই তো আপনার মুখের দিকে চাওয়াই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমি সিন্ধবাদের মতো আপনার পিঠে চড়ে রয়েছি। আমার জন্য আপনার কী ভীষণ চিন্তা। অবলা মহিলা না ভেবে নিছক একজন, অন্য একজন মানুষ বলে আমাদের মেয়েদের কবে যে আপনারা ভাবতে শিখবেন জানি না। আপনাদের এরকম ব্যবহারে মাঝে মাঝে সত্যিই অপমান বোধ হয়।
অভী বলল, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি আমার কেউ নন, সম্পূর্ণ অপরিচিতর মতই। আপনার কিছু একটা হলে আমার দায়িত্ব কতখানি আপনি বুঝতে পারছেন না।
–আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এই রাতের কথা আপনার মনে হয়তো থাকবে। আপনি সবাইকে বলবেন, ওঃ, কী বিপদেই না পড়েছিলাম এক রাতে। আমি আর আমার এক বন্ধু নাগা হিল্সে।
অভী কথা বলল না। চুপ করে অন্ধকারে বাবলির মুখের দিকে চেয়ে রইল।
একটু পরে অভী বলল, একটু আগুন করি। আপনার মুখ দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে।
বাবলি অন্ধকারের মধ্যে হাসল। বলল, আমার মুখ কি দেখার মতো?
অভী জবাব দিল না কথার।
খড়কুটো এনে কুঁড়ের বাইরে পথের উল্টোদিকে আগুন করল অভী একটা।
আগুনের আলোয় ঐ পরিবেশে বাঁশের মাচায় বেগুনী আর গোলাপী টেরিকট শাড়ি পরা বাবলিকে দারুণ দেখাচ্ছিল।
অনেক, অনেকক্ষণ পর অভীর বেশ ভালো লাগতে লাগল। অভী বলল, আপনার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে? কি খাবেন? রাতে?
বাবলি একটুক্ষণ ঠোঁট কামড়ালো, বেশি কিছু খাবো না। রসিদ আলিকে বলুন বিরিয়ানি পোলাউ করতে, মাংস যেন একটু আন্ডারডান থাকে। সঙ্গে মুরগীর টিক কাবাব এবং রাইত।
অভী বলল, ব্যস্। আর কিছুই না!
–নাঃ, আজ আর কিছুই খাবো না।
বলেই বাবলি হাসতে লাগল।
অভীও যোগ দিল সেই হাসিতে। অনেকক্ষণের গুমট টেনসন কেটে গেল অভীর মন থেকে।
এমন সময় কোহিমার দিক থেকে একটা গাড়ি আসার আওয়াজ শোনা গেল।
অভী লাফিয়ে উঠল। বলল, আপনি চুপ করে ওখানে বসুন। পথ থেকে আপনাকে যেন দেখা না যায়। কথা বলবেন না কোনো। কেমন? বলেই অভী তরতরিয়ে নেমে গেল পথের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে আলোর বন্যা বইয়ে একটা জীপকে আসতে দেখা গেল বাঁকের মুখে। অভী হাত দেখালো। জীপটা থামা মাত্র জীপের মধ্যে অন্ধকার থেকে কে যেন বলল, ‘হ্যান্ডস্-আপ।
অভী হাত তুলল, একজন একটা রিভলবার ওর দিকে ধরল। ওরা নাগাল্যান্ড পুলিশের লোক।
ডিমাপুরে পৌঁছে অভীদের অফিসে একটা ফোন করে দিতে বলল ওদের, যদি পারে। অভীদের কোম্পানির নাম শুনে বলল, খবর দিয়ে দেবে। তবে আজ রাতে কোনো হে আসতে পারবে না। ট্যাক্সিও না। আজ রাতে আর্মি কনভয় আসবে ডিমাপুর থেকে কোহিমা। সিভিলিয়ান ট্রাফিক বন্ধ। ওরা বলল, গাড়িতেই থাকবেন। কাল অফিসের লোক এলে গাড়ি নিয়েই একেবারে ডিমাপুর পৌঁছবেন।
ওরা গুড-নাইট করে চলে গেল।
একটু গিয়ে আবার ব্যাক করে এসে বলল, এ জায়গাটাতে হাতির বড় উপদ্রব। সাবধানে থাকবেন।
ওরা চলে গেলে অভীতরতরিয়ে উপরে উঠে এল।কুঁড়েতে পৌঁছে দেখল বাবলি নেই। অভীর বুকের স্পন্দন থেমে গেল। বাবলিকে খুঁজতে কোনদিকে যাবে, ভাবতে ভাবতেই অন্ধকার থেকে বাবলি এসে কুঁড়েতে ঢুকল।
অভী বলল, এমন ভয় পাইয়ে দেন না। বিরক্তির সঙ্গে বলল, কি করতে গেছিলেন একা একা জঙ্গলে, অন্ধকারে? বাঘ আছে, হাতি আছে। কোনো মানে হয়!
বাঁশের খোল থেকে জল ঢেলে মুখ-চোখ-হাত-পা ধুতে ধুতে বাবলি বলল, যা করতে গেছিলাম, তা সবাই একা একাই করে।
অভী লজ্জা পেল। বলল, ওঃ, সরি।
এখন ঠাণ্ডাটা আগের থেকে অনেক বেশি হয়েছে। ডিফু নদী থেকে ধোঁয়া উঠছে। ফ্রিজ খুললে যেমন ঠাণ্ডা ধোঁয়া ওঠে তেমনি। অভী বলল, বিস্কুট-টিস্কুট খেয়ে আপনি শুয়ে পড়ুন।
–আর আপনি?
–আমি আগুনের পাশে বসে পাহারা দেবো। হাতি আছে, বাঘ আছে, বৈরী নাগারা আছে।
বাবলি বলল, এটা আপনার কাছে রাখুন।
–কি।
হাতের চুড়ি থেকে খুলে বাবলি একটা সেটিপিন দিল অভীকে। বলল, হাতি এলে হাতির কান চুলকে দিতে পারেন।
অভী বলল, বাবা, আপনি পারেনও! আপনার কি ভয়ডর বলে কিছু নেই, সত্যি আপনার মতো দস্যি মেয়ে আমি দেখি নি।
বাবলি জবাব না দিয়ে বলল, আগুনটা একটু জোর করুন। ঠাণ্ডায় বসা। যাচ্ছে না। কম্বল তো একটা। আপনি কি গায়ে দেবেন?
আমি তো আগুনের পাশেই বসে থাকবো। অভী বলল।
আগুনটা জোর করে দিল অভী। বাইরের গাদা থেকে অনেকগুলো কাঠ বয়ে এনে কুঁড়ের সামনে রাখলো। আগুনে আরেকবার এনামেলের গ্লাসে কফি বানালো বাবলি। তারপর কুটুর কুটুর করে বিস্কুটের প্যাকেটটি শেষ করল দুজনে মিলে।
কফি খাওয়ার পর, অভী ব্রীফ কেসটা মাচার মাথার কাছে রেখে দিয়ে বলল, এই হল বালিশ। এবার শুয়ে পড়ুন। কম্বলটা চারিদিকে ভালো করে গুঁজে নিন। পোকামাকড় আসতে পারে।
–ঈ-রে–যেন আমার মা এসেছেন। বলল বাবলি।
–নিশ্চয়ই, আপনার মা এখানে থাকলে এসব কি বলতেন না?
বাবলি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, হয়তো বলতেন, জানি না। জানেন, আমি আমার মাকে কখনো দেখিনি। ছবিতে দেখেছি। আমি জন্মাবার সময়ই আমার মা মারা যান। এরকম সব রাতে, যখন খুব ইচ্ছে করে কাছে কেউ থাকুক, কেউ আদরে সোহাগে আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরুক, তখন মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।
অভী চুপ করে রইল।
অনেকক্ষণ পর বলল, কি হল? শুয়ে পড়ুন।
–হ্যাঁ, শুচ্ছি।
ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল। ঠাণ্ডাটাও বাড়তে লাগল। কোহিমাল দিক থেকে একটা হাওয়া আসতে নাগল হ হু করে। সন্ধ্যের সময় যে চতুষ্পদ জানোয়ারটার আওয়াজ শোনা গেছিল, সেটা তেমনি ঘোরাফেরা করতে লাগল অন্ধকারে। নক্ষত্রখচিত উজ্জ্বল আকাশ নিচের অন্ধকারকে আরো ভারী করে তুলল। আগুনটা জোর করে দিয়ে অভী কুঁড়ের বাঁশের খোঁটায় হেলান দিয়ে বসে রইল।
বাবলি মাচায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। মাচাটায় ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ উঠতে লাগল। বলল, ঘুম আসছে না।
তারপর রাতের কোনো এক সময়ে বাবলি ঘুমিয়ে পড়ল।
অভী সামনে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে বসেছিল। ওরও মাঝে মাঝে ঢুলুনি আসছিল। মাঝে মাঝে উঠে আগুনে নতুন কাঠ গুঁজে দিয়ে আসছিল।
মাঝরাতে একফালি চাঁদ উঠেছিল আকাশে।
তারপর ঢুলুনির মাঝে মাঝে অভী দেখছিল যে আকাশ মেঘে মেঘে ঢেকে গেল। তারপর কখন যে ও বাঁশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই ওর।
হঠাৎ অভীর ঘুম ভেঙে গেল ঠাণ্ডা জলের ছিটেয়।
চোখ মেলে দেখল। আকাশে একটিও তারা নেই।
বৃষ্টিতে আগুন নিভে গেছে। ওর গায়েও বৃষ্টির ছিটে লাগছে। ওর ভীষণ শীত করতে লাগল। আধো ঘুমে ওর হঠাৎ বাবলির কথা মনে হল। মুখ ঘুরিয়ে দেখল বাবলি মাচার উপর উঠে বসেছে।
অন্ধকারে বাবলি বলল, আগুনটা নিভে গেল কেন?
–বৃষ্টি পড়ছে বাইরে।
–খুব শীত, না? খুব শীত করছে আপনার?
–হ্যাঁ।
–আপনি এখানে আসুন।
–ওখানে দুজনের জায়গা হবে না।
–হবে, আপনি শীগগির করে আসুন, নইলে ভালো হবে না। আপনি কি বলুন তো? এত কষ্ট পাচ্ছেন, তবু আমার কাছে আসতে এত লজ্জা, এত সংকোচ!
অভী উঠে এসে কাঁপতে কাঁপতে মাচার পাশে এসে বসল।
বাবলি বলল, আপনি আমার কাছে আসুন।
অভী বসেই রইল।
বাবলি ওর কাছে সরে গিয়ে ওকে দু’হাতে কাছে টেনে নিল। বলল, কম্বলটা দিয়ে আপনি আমাদের দুজনকে ঢেকে রাখুন। আমি আপনাকে জড়িয়ে থাকছি। দেখবেন শীত এখুনি পালাবে। লজ্জা করছেন কেন, আমাকে আপনিও জড়িয়ে থাকুন।
কিছুক্ষণ পর আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ওরা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে পড়ল। বাইরে বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ী হাওয়া হু হু করে গাছপালায় বইতে লাগল। বাবলির শরীরের উষ্ণতায়, ওর বুকের সুগন্ধে, অভী শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। এই অবস্থাতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল ওরা দুজনেই জানে না।
ডিমাপুর থেকে ট্যাক্সি করে দুজন লোক এসেছিল অফিসের। মেকানিকও এসেছিল। গাড়ি ঠিক করে ওখান থেকে বেরোতে বেরোতে সকাল ন’টা হল।
সকালে উঠে বাঁশের খোলের টাকা জলে মুখ ধুয়ে শাড়ি-টাড়ি ঠিকঠাক করে নিয়ে বাবলি অভীর পাশে এসে বসল।
গাড়িটা স্টার্ট করে অভী বলল, জায়গাটা দেখে রাখুন। জায়গাটার কথা মনে থাকবে? এই রাতের কথা?
গাড়িটা ডিফু নদীর পাশে পাশে আবার গড়িয়ে চলল।
বাবলি খোঁপা থেকে গতকালের বাসি ফুলটা নিয়ে নদীতে ছুঁড়ে দিল।
মাইল দশেক যেতে-না-যেতেই ওরা পাহাড় থেকে সমতলে নেমে এল। এখন আর দু’ধারে জঙ্গল নেই। সোজা রাস্তাটা চলে গেছে ডিমাপুরের দিকে।
বাবলি বাবলি বলল, বেশ কাটল সময়টা আমাদের। কালকের রাতটা, আমার ট্রেন তো বিকেলে না?
অভী বলল, হাঁ।
বাবলি বলল, আপনি কি করবেন আমি চলে যাবার পর?
অভী হাসল, বলল, তাই ভাবছিলাম। গত তিরিশ ঘণ্টায় আমি আমার নিজের ইচ্ছেয় কিছুই করি নি। আপনি যা যা বলেছিলেন তাই করেছিলাম। এখন কি করব, তাই ভাবছি।
বাবলি বলল, বেশি ভাববেন না। আপনি বড় বেশি ভাবেন।
অভী বলল, তবু মাঝে মাঝে ভাবতে হয়।
তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবলি বলল, চিঠি লিখলে কি জবাব দেবেন? না, দেবেন না?
–দেব। অভী বলল।
–জবাব দেবেন, কিন্তু জবাবে আবার প্রেম-ট্রেম নিবেদন করে বসবেন। আপনাকে আমার বড় ভয় করে।
–আপনাকেও আমার খুব ভয় করে। অভী বলল।
আমার কিন্তু আপনাকে খুব ভালো লেগেছে। বাবলি বলল। তারপর বলল, আমি চাই, সত্যিই চাই, এ ভালো লাগাটা যেন বজায় থাকে। জানি না হয়তো আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল। কিন্তু বলা হল না। এই ঘর ছাড়া, এইরকম বৃষ্টির শীতের রাত ছাড়া সেকথা আর বলা যাবে, ভাবলে অবাক লাগে। কতগুলো কথা থাকে, হয়তো প্রত্যেকের জীবনেই থাকে; সেগুলো বিশেষ জায়গা ও বিশেষ মুহূর্তে বলতে না পারলে বলাই হয়ে ওঠে না। সারা জীবন বয়েই বেড়াতে হয়।
তারপর অনেকক্ষণ ওরা চুপ করে থাকল।
অভী বলল, ঐ যে ডিমাপুরের বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে।
বাবলি বলল, সত্যি? আহা রসিদ আলি–বদরপুরী রসিদ আলি। তোমাকে আমি বড় ভালোবাসি। তুমি আমাদের কি খাওয়াবে গো?
তারপরই হঠাৎ বলল, শুনুন ভালো ছেলে, আমাদের যাত্রা শেষ হয়ে এল, আবার দেখা হবে কি না জানি না। আমি যেমন করে কালকের বাসি ফুলটা ছুঁড়ে ফেললাম, আপনিও আমার বাসি স্মৃতিকে তেমনি করেই ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, কোনো স্মৃতি-ফিতি নিয়ে বাঁচার কিছু মানে নেই। কেবলমাত্র ভবিষ্যতের জন্যই বাঁচবেন। বুঝলেন?
হুঁ। অভী বলল।
কিছুই বোঝেন নি, চোখ নাচিয়ে বাবলি বলল।
ইম্ফল থেকে কোহিমা হয়ে ডিমাপুরে যখন ওরা সত্যিই এসে পৌঁছলো তখন সকাল দশটা।
ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলোটা নিরিবিলি, তবে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো যতখানি নিরিবিলি হওয়া উচিত ততটা নয়। ডিমাপুর শহরেরই এক প্রান্তে।
বাবলি গাড়ি থেকে নেমেই বলল, সত্যি! বেশ বাংলোটা। কিন্তু রসিদ আলি কোথায়?
বলতে বলতে বাংলোর পেছন দিকের রান্নাঘর ছোট্ট খাওয়ার ঘর পেরিয়ে সাদা দাড়ি দিয়ে রসিদ আলি এসে হাজির হল।
ওকে দেখেই বাবলি বলল, অভী, আপনি মালপত্র নামানোর বন্দোবস্ত করুন। আমি রসিদ আলির সঙ্গে লাঞ্চে কি কি খাওয়া যায় তার বন্দোবস্ত করছি গিয়ে।
তারপরই একটু থেমে বলল, আপনি মুরগী খান তো? না, পিসীমার বারণ আছে?
অভী হাসল। বলল, আমার কোনো পিসীমা নেই।
বাবলি বলল, মাসীমা তো আছেন?
অভী হাসল। বলল, না, মাসীমাও নেই। কিন্তু আমার মাসীপিসীকে নিয়ে পড়া কেন?
বাবলিকে গতকাল সকালে-পরা শাড়ি-জামাতে রাতে নাগাপাহাড়ের বিপদের মধ্যে রাত কাটানোর পর এবং গাড়ি খারাপ হওয়ার টেনশান ইত্যাদিতে খুবই ক্লান্ত ও শ্রান্ত দেখাবে ভেবেছিল অভী, কিন্তু বাবলির এই ক্লান্তিহীন সপ্রতিভ প্রগলভতাতে এখন সত্যিই ও অবাক হয়ে যাচ্ছে। অভীর অল্পবয়সী জীবনে বাবলি নিশ্চয়ই এক অভিজ্ঞতা। মণিপুরের লাক্ লেক প্রথমবার দেখে যেমন মনে হয়েছিল, নাগাপাহাড়ে মিথুং দেখে প্রথমবার যেমন আশ্চর্য হয়েছিল, বাবলিকে কাছ থেকে দেখে ও তেমনিই আশ্চর্য হয়েছিল। বাবলি সম্বন্ধে কোনোরকম বিশেষণ ও ওর সীমিত বাংলা জ্ঞানে খুঁজে পাচ্ছে না। খোঁজবার চেষ্টাও করলো না আর।
বাবলি এক মুহূর্ত অভীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ বলল, আপনাকে দেখার পর থেকেই আমার রবিঠাকুরের একটি চরিত্রের কথা মনে হচ্ছে।
অভী গাড়ির বুট খুলে, মাল নামাতে নামাতে ক্যাজুয়ালী, যেন ওর এসব পাগলের প্রলাপে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই; এমন গলায়, কি? কোন চরিত্র?
বাবলি দুষ্টুমির হাসি হাসল। বলল, রেবতাঁকে খুব মনে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ‘তিন সঙ্গী’র ল্যাবরেটরী গল্পের রেবতীর কথা। তার পিসীমার। আদরের ‘রেবু’র কথা।
অভী মনে মনে বিরক্ত হল।
কী ভাবে মেয়েটা? না হয় ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সার্ভিসে ঢুকছেই, না হয় পড়াশোনাতে ভালোই, তা বলে অভীকে ও ভেবেছে কী? নেহাত ওর ওপরওয়ালার শালীর মেয়ে বলে, বাবলি নিজেই কি ওর বস্ হয়ে গেছে নাকি? তাছাড়া, বাবলি না জানতে পারে না, কিন্তু বাবলির মাসী-মেসো জানে, অভীও কোনো দিক দিয়ে হেয় করার পাত্র নয়। বাবলির চেয়েও সে সব দিক দিয়ে ভালো।
মনে মনে অভী ভাবলো, এতখানি বাড়াবাড়িটা কুশিক্ষা। বাড়িতে বোধহয় কেউ শেখায় নি ছোটবেলায় কতখানি মানায়, কতখানি মানায় না। মা-মরা মেয়ে তো বখে গেছে অল্পবয়সে। তাছাড়া মেয়েরা ইন্দিরা গান্ধীর রাজত্বে নিজেদের কি যেন মনে করছে একেবারে। যেন উড়তে চাইছে। সকলেই ডানা মেলে। গতকাল আই-এ-এস কি আই-আর-এস পাস করলেই বুঝি ভাবছে, আমি কি হনু।
অভী গাড়ির বুটটা বন্ধ করতে করতে বলল, আমি যদি রেবতী হই, তবে আপনি কী? আপনি কে? আমার ওপর কিসের অধিকার আপনার?
বাবলি সপ্রতিভতার সঙ্গে বলল, আমি কেউ না, কেউ না। কোনো অধিকার নেই।
কিন্তু কথা শেষ হতে না-হতে ও যেন হঠাৎ এই এত ঠাট্টা, এত মজা, এত পরিহাসের কুয়াশার মধ্যে ওর ভেতরে কে ছিল, যে-ছিল তাকে দেখতে পেল।
ফরেস্টের কাঠের বাংলোর সুন্দর রং করা অস্তিত্বে, চারধারের শাল সেগুন গাছের পরিবেশে, বর্ষাদিনের ঝিলমিল করা রোদে, নানান পাখির ডাকে এই ডিমাপুরের আশ্চর্য সকালে কি যেন কি ঘটে গেল!
বাবলির এবং অভীরও মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা আটশো আশি ভভাল্টের আলোর মেইন-সুইচ নেভানো ছিল। এই সকালে, এই কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, ঠাট্টা করতে থাকা, হাসতে-থাকা, অন্যকে নিয়ে তামাশা করতে থাকা বাবলির বুকের মধ্যে যেন কি একটা জ্বলে উঠল, চোখের ওপর এমন একটা ছায়া নেমে এলো, যেন তার নিজের মধ্যে সে-ছায়ার অস্তিত্ব সম্বন্ধে বাবলি নিজেও বুঝি কখনও সচেতন ছিল না।
অভী দেখল, বাবলির মুখটা হঠাৎ এক আশ্চর্য আনন্দে ক্যামেরার ফ্ল্যাশলাইটের মতো এক ঝলক জ্বলে উঠে, দপ করে পরক্ষণেই নিভে যায়।
অভী চোখ নামিয়ে নিয়ে গাড়ির পিছনের সীটে এক আকাশ আলোর নিচে দাঁড়িয়েও যেন ফেলে রাখা কম্বলটা দেখতে পাচ্ছিল না। এমন করে খুঁজতে লাগল। বাবলিও বড় বড় গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে দৃশ্যমান রোদঝলমল নির্মেঘ আকাশে চেয়ে কি যেন খুঁজতে লাগল। যেন আকাশেই তার প্রার্থিত বস্তু আছে; ছিল।
একটু আগে যেটা ঠাট্টা ছিল, সেটা আর কোনো ক্রমেই ঠাট্টা রইল না। ওরা দুজনেই একই সঙ্গে, অদ্ভুতভাবে আবিষ্ট এক সীনক্রোনাইজেশানের মধ্যে বুঝতে পারল যে দুজনের মধ্যে এমন কিছু একটা হয়ে গেল, এই মুহূর্তে হয়ে গেছে; যা হবে বলে তাদের দুজনের কারোই জানা ছিল না।
সম্পূর্ণ আত্মসচেতন ও আত্মবিশ্বাসী বাবলির মুখটা কালো হয়ে গেল। বিদুষী, গর্বিতা, সপ্রতিভ, দুদিন বাদে ইনকামট্যাক্স অফিসার হতে যাওয়া বাবলির সব গর্ব, সব সপ্রতিভ মাটিতে মিশে গেল। ভালোবাসা, কারো প্রতি কারো সত্যিকারের ভালোবাসা যে কত তীব্র দুঃখময় অনুভূতি এ-কথার আভাস যেন বিদ্যুচ্চমকের মতো বাবলির বুকে বাজলো। জীবনে প্রথমবার।
বাবলি অভীর কথার উত্তর না দিয়ে আর কোনো কথা না বলে, রসিদ আলির পেছন পেছন রান্নাঘরের দিকে গেল।
অভী একে একে মালগুলো নামালো চৌকিদারকে ডেকে। ওপরের ঘরে বাবলির মালগুলো তুলে দিল। নিজেরগুলো, নিচের দিকে বাঁদিকের ঘরে। তারপর গাড়িটাকে বাইরের একটা বড় সেগুনগাছের নিচে পার্ক করিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে এসে ইজিচেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরালো। কাল সেই ভোরে দাড়ি কামিয়েছিল। তারপর দাড়িও কামায় নি, জামাকাপড়ও ছাড়ে নি। চেহারার অবস্থা হয়েছে চণ্ডালের মতো।
একা একা ইজিচেয়ারে বসে আঙুলে সিগারেটটা নাড়তে-চাড়তে জানালা দিয়ে বাইরে দূরে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়ে থেকে অভী নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল। অভীর খুব ভালো লাগতে লাগল, আবার কেমন দুঃখও লাগতে লাগল। এমন আশ্চর্য অনুভূতির শরিক আর হয় নি ও আগে।
এমন সময় পর্দার আড়ালে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, বাবলি নরম নরম গলায় বলল, আসবো?
–আসুন, আসুন–বলে অভী উঠে দাঁড়ালো।
মনে মনে ও অবাক হল। যে মেয়ে কাল রাতের অন্ধকারে সমস্ত সংস্কারমুক্ততায় নিজেই অভীকে শীতের যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে সেই কাঠুরের ঘরে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে ছিল সেই-ই আজ সকালের আলোয় তার ঘরে আসতে অনুমতি চাইছে।
বাবলি ঘরে ঢুকে চোখ নামিয়ে বলল, আমার ঘর কোন্টা? কোথায় থাকব আমি?
বাবলির মুখটা চোরের মতো দেখাচ্ছিল। বাবলি যেন কি চুরি করে নিয়েছে অভীর। সেই অপরাধে ও চোরের মতো, অপরাধীর মতো মুখ করে চোখ নামিয়ে রইলো। তবে ও-ও কি কিছু চুরি করেছে বাবলির?
অভী চেয়ার ছেড়ে উঠল, বলল, চলুন ওপরে আপনার ঘর। ঐ ঘরটাই সবচেয়ে ভালো ঘর।
তারপর কাছের সিঁড়ি বেয়ে উঠে অভী বাবলিকে ওর ঘরে পৌঁছে দিল।
বলল, বারান্দাটা চমৎকার, তাই না?
তারপর বলল, ভালো করে চান করুন, দেখবেন ভালো লাগছে। আমিও তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তারপর একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট খাবো। কেমন? আপনার হয়ে গেলে নীচে চলে আসবেন।
বাবলি মাথা নোয়াল। তারপর অভী সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করল।
চান-টান করে একটা হলুদ-কালো ডুরে তাঁতের শাড়ি জামা পরে গলায় কালো পুঁতির মালা ঝুলিয়ে যখন বাবলি নিচে নেমে এলো, তখন বাবলিকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।
ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় দুজনের কেউই বিশেষ কথা বলল না। একজন অন্যকে টোস্ট এগিয়ে দিল, অন্যজন-এর প্লেটের কর্নফ্লেসে দুধ ঢেলে দিল। কাটা-চামচের টুং-টাং শব্দ হচ্ছিল শুধু খাওয়ার ঘরে। একটি মিষ্টি ঝিরঝিরে হাওয়ায় পর্দাটা ওড়াউড়ি করছিল। ওরা কেউই কোনো কথা বলছিল না। গতকাল ও পরশু যে উচ্ছ্বসিত কলকল করা মেয়েটির সঙ্গে অভী কাটিয়ে ছিল, সেই মেয়েটি কোন মন্ত্রজ্ঞর মন্ত্রবলে যেন বিবশ হয়ে গেল। অভীর চোখে সেই মোটামুটি মোটাসোটা সাধারণ মেয়েটি যেন কী এক অসাধারণত্বের দাবি নিয়ে এসে দাঁড়াল।
ব্রেকফাস্ট খাবার পর বাবলি যত্ন করে কফি বানাল। তারপরে দুজনেই কফি হাতে করে বারান্দার চেয়ারে এসে বসল।
সেগুন গাছগুলোর ছায়া বাংলোর ঘন সবুজ ঘাস-গজানো হাতায় লম্বালম্বিভাবে পড়েছিল। কতগুলো শালিক এসে কিচির-মিচির করে নিজেদের মধ্যে কি সব বলাবলি করছিল। নিজেদের মধ্যে মান অভিমান ঝগড়া করে নিজেরাই তার নিষ্পত্তি করে আবার উড়ে যাচ্ছিল; ফিরে বসছিল।
কঁচা রাস্তা দিয়ে প্যাক-প্যাক আওয়াজ করে হর্ন বাজিয়ে চেনের কাঁচর কোঁচর আওয়াজ তুলে সাইকেল রিকশা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। পথচলতি নাগা ও অসমীয়াদের টুকরো-টাকরা কথাবার্তা ভেসে আসছিল এবং আবার হাওয়ায় ভেসে চলে যাচ্ছিল।
অনেক, অনেকক্ষণ ওরা চুপচাপ বসে রইলো। দুজনে দুদিকে তাকিয়ে। ওরা দুজনে দুজনের নিজস্ব ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিল। যখন মনে মনে অনেক কথা শেষ হয়ে গেছে অথবা মনে মনে অনেক কথা শুরু হবে, সেই মধ্যবর্তী একফালি নামহীন সময়টুকুতে ওরা দুজনেই থমকে দাঁড়িয়েছিল।
অনেকক্ষণ পর অভী বলল, আপনার ট্রেন কটায়?
বাবলি যেন ঘুম ভেঙে বলল, বিকেলে, ঠিক সময় জানি না, একবার খবর নিতে হবে স্টেশন থেকে। তারপর বলল, আপনি আমাকে তুলে দিয়ে আসবেন না?
অভী বলল, আপনার কি মনে হয়?
বাবলি হাসল। বলল, মনে হয় তুলে দিয়ে আসবেন।
তারপরই বলল, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম, এ দুদিন। বলুন?
অভী একটু চুপ করে থেকে বলল, জানি না।
এখনও অভী বুঝতে পারছিল না। যে-অনুভূতির মধ্যে এখন এই মুহূর্তে ও আছে, তাকে কষ্ট বলে কি না জানে না ও। তাকে কি বলে ও সত্যিই জানে না।
তারপরই বলল, আপনারও তো খুব কষ্ট হল, তাই না? আমি কেবল ভাবছি, গত রাত্রে কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলে, কোনো বিদ্রোহী নাগা বা হাতির উপদ্রবে পড়লে আপনার মাসীমা-মেসোমশাইয়ের কাছে কি করে মুখ দেখাতাম? ভাবতে ভয় লাগছে। ইম্ফলে ফিরে গিয়ে ওদের কি যে বলব, বুঝতে পারছি না।
বাবলি হাসল। বলল, আমার মাসীমা-মেলোমশায় আমাকে চেনেন। আমার দস্যিপনা জানেন। দোষ হলে আমারই হতো। আপনাকে কেউ দোষী করত না।
অভী বলল, অন্য কেউ না করলেও, আমি করতাম।
বাবলি অবাক চোখে তাকাল অভীর দিকে।
তারপর মুখ নীচু করে বলল, কেন? আমি আপনার বসের আত্মীয়া বৈ তো আর কিছুই নই, আমার জন্যে আপনার এত অপরাধবোধ বা দুশ্চিন্তা কেন! পরের জন্যে এত ভাবা ঠিক নয়; এতখানি কনসার্নড হওয়া ঠিক নয়।
–নয় বুঝি? অভী বলল।
বলে মুখ তুলে বাবলির দিকে তাকাল।
তারপর বলল, কি জানি? হয়তো নয়।
তারপর এলোমেলো হাওয়ায় রসিদ আলির সাদা লম্বা দাড়ি যেমন এলোমেলো হয়ে গেল, তেমন হল বাবলির আঁচল, অভীর চুল। তারপর দেখতে দেখতে কি করে যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, ওরা দুজনের কেউ তা বুঝতে পারল না।
অভীর একবার বেরোবার কথা ছিল ফাইল নিয়ে অফিসের দিকে–কিন্তু অভী বেরোল না। ঠিক করল কাল ব্রেকফাস্ট করে সকাল সকাল বেরিয়ে একেবারে সব কাজ শেষ করে রাতে ফিরবে বাংলোয়। তার পরদিন ভোর। চারটায় বেরিয়ে পড়বে ইম্ফলের দিকে কোহিমা হয়ে।
দেখতে দেখতে ট্রেনের সময় হয়ে গেল।
বাবলির মালপত্র নামিয়ে আনা হল নীচে।
অভী বলল, কিছু ফেলে যাচ্ছেন না তো? ঘরটা আর একবার দেখে। আসুন। ফেলে গেলে, এখানে কিছু হারিয়ে গেলে, আর কিন্তু পাওয়া যাবে না।
বাবলি একবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেল। দুপা উঠে নেমে এল।
বলল, না কিছু ফেলে যাই নি, কিছুই হারিয়ে যাবে না এ বাংলোর ঘরে। যদি কিছু হারিয়ে থাকি, তা হারিয়েই গেছে। তা কখনও আর পাওয়া যাবে না।
অভী অন্যমনস্ক ছিল। কথাটা ভালো করে শোনে নি। বলল, সত্যিই কিছু হারিয়ে গেছে নাকি?
বাবলি হাসল। বিকেলের আলোয় হাসিটা কেমন কান্নার মতো দেখাল। বলল, না। যা হারিয়ে গেছে তা ফিরে পাওয়ার নয়।
ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে এল। ডিমাপুর স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে ছিল। তখন অন্ধকার হয়ে গেছিল। অভী কম্পার্টমেন্টের ভেতরেই ছিল। বাবলি বলল, এবার আপনি নেমে দাঁড়ান।
অভী নেমে এসে কম্পার্টমেন্টের সামনে প্ল্যাটফর্মের ওপরে বাবলির সামনে দাঁড়াল।
বাবলি খুব সপ্রতিভ দেখাবার চেষ্টায় সচেষ্ট ছিল। দেখাচ্ছিল যে, সে মেয়ে হলেও ইমোশনাল মেয়ে নয়। আফটার অল ও রেভিনিউ সার্ভিসের মেয়ে। ওরা অত নরম হতে পারে না। পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দেওয়া কচি মেয়ের মতো অত আবেগ ওকে মানায় না। তবু এত সচেতন হওয়া সত্ত্বেও বাবলি ইচ্ছা করে অভীর মুখ থেকে মুখ সরিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর লক্ষ্যহীনভাবে চেয়ে রইল।
অভী কিন্তু বাবলির মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ও কেন জানে না, প্রবলভাবে চেষ্টা করেও ওঁর চোখদুটো বাবলির মুখ থেকে সরাতে পারল না।
এমন সময় সিগন্যাল হলুদ হল। বাঁশী বাজল গার্ডসাহেবের। ‘কু’ দিয়ে উঠল এঞ্জিন। অভীর বুকের মধ্যেও যেন কি একটা স্বর আর্তনাদের মতো বেজে উঠল।
জানালার শিকের ভেতর দিয়ে বাবলি ওর রিস্টওয়াচ পরা ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। বলল, চলোম।
কি হয়ে গেল অভী জানে না। ও বাবলির হাতটা নিজের হাতে ধরল। একজন নারীর কোমল হাত একজন পুরুষের শক্ত সবল হাতে মুহূর্তের আশ্রয় পেল।
অভী বাবলির হাতে একটু চাপ দিল। তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে, চোখ তুলে বলল, আবার আসবেন ইম্ফলে বেড়াতে। আপনাকে অনেক কিছু দেখাব। অনেক কিছু দেখার ছিল, জানার ছিল, এত অল্প সময় থাকলেন যে, কিছুই হল না।
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। অভী কিছুটা অবধি জানালার পাশে পাশে হেঁটে এল যতক্ষণ না ট্রেনের গতিটা দ্রুত হয়।
বাবলি জানালার শিকের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে বলল, আপনি দিল্লি আসবেন। আপনাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাব। আমার ভালো লাগবে। অনেক দেখার আছে। আসবেন?
ট্রেনের গতি ততক্ষণে দ্রুত হয়ে গেছে। বাবলির চোখ থেকে প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলো, লোকজনের মুখগুলো দ্রুত মুছে যাচ্ছে। প্লাটফর্ম থেকে মৌচাকে ঢিল-খাওয়া মরীয়া মৌমাছিদের ডানার মতো একটা গুঞ্জরণ উঠছে। উত্তরে অভী কি বলল, শোনা হল না বাবলির, কথাটা শোনা গেল না।
ট্রেনটা আলো ছাড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে পৌঁছে গেল।
এখন আর আলো নেই কোনো, আলো থাকবে না।
বাবলির বন্ধ করা চোখে একজন সরল সাদাসিধে, আন্তরিকতাভরা ভালোমানুষের অন্ধকারে-মুছে-যাওয়া মুখটি অনেকক্ষণ জেগে রইল।
বাবলি বুঝতে পারল না কতক্ষণ কতদিন এই মুখটা তার চোখে থাকবে। তার যা স্বভাব, তাতে যদি দু’ঘণ্টাও তা থাকে, তাহলেও অবাক হওয়ার কথা নিঃসন্দেহে। ওর মনে কিছু লেগে থাকে না। ওর মনের প্রকৃতিটা আশ্চর্য! ও তা জানে। তা জেনে ও গর্বিত।
কিছুক্ষণ পর বাবলি বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে এল।
জানালার পাশে ফিরে এসে বসাতে জোর ঠাণ্ডা হাওয়া লাগতে লাগল তার চোখেমুখে। বাবলির বেশ প্রকৃতিস্থ মনে হতে লাগল নিজেকে। এতক্ষণে মনে হল, ওর মনকে ও সম্পূর্ণ নিজের আয়ত্তে এনেছে। নিজের মনেই শূন্য কুপেতে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হেসে উঠল বাবলি।
বাবলি নিজের মনে বলল, বাবাঃ, সর্বনাশ হতে বসেছিল আমার। রিয়্যালি সিলি ব্যাপার। একটু হলে প্রেমে পড়ে গেছিলাম আর কি!
বাবলির মনে হল, যে ভদ্রলোক বলেছিলেন যে ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড’ তিনি কি দারুণ বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান ছেলেদের বুদ্ধিমত্তাকে ও ভালোবাসে, ভালোবাসতে পারে বাবলি। কিন্তু ওরকম বোকা-বোকা ছেলেকে ভালোবাসা বাবলির পক্ষে সম্ভব নয়।
অভী শুধুমাত্র বোকা নয়, ক্যাবলাও, নইলে কোহিমা থেকে ডিমাপুর আসার পথে যখন গাড়ি খারাপ হল, তখন বাবলির রসিকতা বুঝতে না পেরে গাড়ির পেছনে ম্যাজিসিয়ানদের মতো আব্রাকাডাব্রা বলতে বলতে লাথি মারতে পারে কখনও? কোনো বুদ্ধিমান ছেলে পারে?
বাবলি চটি দুটো থেকে পা আলগা করে সীটের ওপর দু’পা জোড়া করে আরাম করে বসে আবার বলল, বাবাঃ, খুব বেঁচে গেছি এ যাত্রা। পুরো ব্যাপারটা ভাবলেও হাসি পাচ্ছে এখন। অত সোজা নয়।
.
অন্ধকার থাকতে অভী বেরিয়ে পড়েছিল ডিমাপুর থেকে। তাড়াতাড়ি বেরোলে ইম্ফলে পৌঁছানো যাবে না। খুজ্মাতে নাগাল্যান্ডের বর্ডার দিনে দিনে পেরোতে না পারলে মুশকিল। বিদ্রোহী নাগাদের দৌরাত্ম্য আজকাল কমে গেছে বটে, কিন্তু কিছু বলা যায় না।
দেখতে দেখতে ডিমাপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ডিফু শহরকে বাঁদিকে রেখে ও ডিফু নদীর পাশে-পাশে-চলা পাহাড়ী নদীর ধারে এসে পড়ল।
তখন সবে ভোর হচ্ছে। ঝরঝর করে বয়ে চলেছে বর্ষার ঘোলা জলে ভরা ডিফু নদী পাহাড়ের বুক কেটে। এপাশে রাস্তা, ওপাশে ঘন গভীর জঙ্গ ল। নানারকম বাঁশ ঝোঁপ, জংলী কলাগাছের ঝাড়, বেত বন, আরো কত কি গাছ-গাছালি। নদীটা এখানে খুব সামান্যই চওড়া হয়ে গেছে সমতলে পড়ে। নদীর দু’পাশে কুমারি গাছ-গাছালি এমন চন্দ্রাতপের সৃষ্টি করেছে যে। ভরদুপুরেও আলো পড়ে না নদীতে। নদীর গায়ে-লাগা সবুজ লতা পাতায় তাই যেন কেমন একটা হলুদ ছোপ লেগেছে। লাল জলের গর্জন, ফিকে হলুদ আর গাঢ় সবুজে ভরা বন, আর তার পাশে চড়াইয়ে-ওঠা ডিমাপুর কোহিমা রোড। দারুণ।
একটু পরেই, প্রায় মিনিট পনরো-কুড়ি গাড়ি চালিয়ে আসার পর অভী সেই জায়গাটায় পৌঁছল। যেখানে ও বাবলির সঙ্গে রাত কাটিয়েছিল।
অভীর তাড়া ছিল। পথে দাঁড়াবার কথা ছিল না। তবু কি যেন হল ওর, ও গাড়িটাকে বা ধার ঘেঁসে দাঁড় করালো। তারপর পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে সেই নাগা কাঠুরের কাঠের ঘরে গিয়ে পৌঁছল। ঘরটার মধ্যে কিছুক্ষণ একা। দাঁড়িয়ে থাকল অভী।
ওরা যেখানে কাঠ এনে আগুন করেছিল, যেখানে বসে কফি বানিয়েছিল বাবলি, সেই পোড়া কাঠগুলো ঠিক তেমনি আছে। বাঁশের চোঙটা আবার বৃষ্টির জলে ভরে গেছে। ওখানে চতুর্দিকের মাথা-উঁচু নাগা পাহাড় আর দূরের নদীর ঝরঝরানি শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন অভী বাবলির অস্তিত্ব অনুভব করল। ওর মনে হল, এখুনি বুঝি সেই বেগুনেরঙা জংলা কাজের টেরিট শাড়ি পরা বাবলি ওর সঙ্গে নতুন কোনো রসিকতা করে ওকে অপ্রতিভ করে দেবে। বাঁশের মাচাটাকে আজ সকালে অবিশ্বাস্যরকম ছোট্ট দেখাল। এর ওপর শেষ রাতে বাবলি যখন ওকে ডেকে নিয়েছিল, তখন কি করে যে ওরা দুজনে এ মাচায় এঁটেছিল তা ভেবেও ওর আশ্চর্য লাগতে লাগল। লোকে কী একটা কথা বলে না? ভাব থাকলে তেঁতুলপাতেও দুজনের ঠাই হয়। অভী ভাবল, কথাটা বোকা বোকা। নাকি অভীই বোকা হয়ে গেছে?
আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করে অভী আবার গাড়িতে গিয়ে বসল। তারপর গাড়ি স্টার্ট করে এগিয়ে চলল। কোহিমার দিকে।
সামনে অনেক পথ বাকি। নাগাল্যান্ডের মধ্যে কোহিমা, জাখ্মা, খুজ্মা হয়ে মাও। তারপর কানকোপ্কি হয়ে অনেক-অনেক দূরে মণিপুরের মধ্যে ইল।
অভী এর আগে প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি ফালতু জোলো কথা অনেক নাটক-নভেলে পড়েছে। পড়তে পড়তে হাসি পেয়েছে। যারা এসব পানসে প্রেমের গল্প লেখে এবং যারা তা পড়ে, তাদের নির্বুদ্ধিতা সম্বন্ধে তার মনে কখনও কোনো সংশয় ছিল না। এই বিংশ শতাব্দীতে প্রেম নামক কোনো বস্তু আছে বলে ও সত্যি সত্যি কখনও বিশ্বাস করে নি। কিন্তু গতকাল থেকে ও যেন কেমন ঘোরের মধ্যে আছে। ওর কি করোনারি অ্যাটাক হবে?নইলে এমন ঘুম-ঘুম ঘোর-ঘোর লাগছে কেন সব সময়? পথের সব জংলী ফুল, সব পাখিকে, সকালের রোদ্দুরকে ওর হঠাৎ এত ভালো লেগে যাচ্ছে কেন? এতদিন চোখ খোলা থাকলেও যা কখনও চোখে পড়ে নি, সেইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ সামান্য-সামান্য জিনিস আজ সকালে হঠাৎ এমন অসামান্যতায় আবিষ্কৃত হচ্ছে কেন? দারুণ একটা ভালোলাগা এবং ভালো না-লাগাতেও কেন ও এমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে বার বার?
অভী জানে না কেন? অভীর তিরিশ বছরের জীবনে এরকম বোধ, এরকম অনুভূতি ওর এই-ই প্রথম। বুদ্ধিমান অভী, ব্রিলিয়ান্ট অভী জীবনে এই-ই প্রথম বোকা হয়ে গেছে।
.
বাবলি ডিমাপুর থেকে ট্রেনে চড়ে ভোরের দিকে এক সাহেবী চা বাগানে নেমে পড়েছিল। সে বাগানের ম্যানেজার ওর আত্মীয়। সেখান থেকে চা বাগানের ছোট্ট প্লেনে দমদম এসেছে আজই দুপুরে। এয়ারপো।র্ট থেকে আর যায় নি শহরে, কারণ, সন্ধ্যের ফ্লাইটে দিল্লির টিকিট পেয়েছিল। ও একটা। ভালোই হল। জয়েনিং ডেটের দুদিন আগেই পৌঁছে যাবে ও।
দমদম এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক লাউঞ্জে বসেছিল বাবলি। হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। তারপর সোফায় গা এলিয়ে বসে একটা পত্রিকা দেখছিল। এখনও প্রায় তিন ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে এখানে। তারপর ফ্লাইট অ্যানাউন্সড হলে চেকিংয়ে যেতে হবে। এই এক ঝামেলা হয়েছে আজকাল। হাই-জ্যাকিংয়ের জন্য প্রতিটি এয়ারপোর্টেই এই বিপত্তি।
কিছুক্ষণ পর ও উঠে গিয়ে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করল অরু মাসীকে।
বাবা কলকাতায় ছিলেন না, ট্যুরে গিয়েছিলেন। ও জানত বাড়ির চাকরকে ফোন করে বাবার খবর নিল বাবলি।
তারপর ফোন করলো দু’-একজন বন্ধুবান্ধবকে। ফোন শেষ করে ও যেখানে বসেছিল সেখানে ফিরে আসছে, এমন সময় হঠাৎ ঝুমার সঙ্গে দেখা। লালরঙা মেকআপ বক্স হাতে নিয়ে হনহনিয়ে কোথায় চলেছে যেন।
বাবলি নিচু গলায় ডাকল, এই ঝুমা।
ঝুমা ফিরে দাঁড়াল। কানের ঝুমকো দুলে উঠল। ঝুমা ওকে দেখতে পেয়েই অবাক আনন্দে চোখ বড় বড় করে বলল, ওমা বাবলি, তুই!– তারপরই বলল, তুই এখানেই থাক। আমি এখুনি আসছি।
ঝুমা এখন এয়ারহোস্টেস। দিল্লির বিখ্যাত মেয়ে কলেজ মিরান্ডা হাউসে ওরা একসঙ্গে পড়ত।
ঝুমার বাবা দিল্লির নামকরা ব্যবসাদার। ঝুমার আর কোনো ভাইবোন নেই। ও বাবার একমাত্র মেয়ে। ঝুমার বাবা বলেছিলেন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে। কিন্তু ঝুমা কেন যে এয়ারহোস্টেস হতে গেল, তা ও-ই জানে। ঝুমার চেহারাটা হিংসা করার মতো। যেমন লম্বা, তেমন মুখশ্রী, তেমনি ফিগার। দিল্লির কত বাঙালি ও অবাঙালি ছেলে যে ঝুমার জন্যে পাগল, তা বাবলি জানে। ও শুধু দেখতেই যে ভালো, তা নয়। পড়াশোনাতে এবং স্পোর্টসেও ভালো ছিল। ঝুমা বলতে গেলে বাবলিদের আইডল ছিল। ও সহজে কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসতে পারত এবং বসলে বলা যায় না, ফরেন সার্ভিসেও হয়তো সিলেকটেড হত। কিন্তু তা না করে, ও জেদ করে এয়ারহোস্টেস হল পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে। পাগলী মেয়ে একটা।
দেখতে দেখতে ঝুমা ফিরে এল। ফিরে এসে ওর পাশে বসল। বসেই বলল, অ্যাই বাবলি, তুই কি মুটিয়েছিস রে?
বাবলি হাসল। বলল, আমি কবেই বা সুন্দরী ছিলাম। তোর মতো ফিগার থাকলে তো হয়েই যেত। কি কি হত তাই-ই ভাবি।
ঝুমা বলল, না রে, ওরকম করে বলিস না। আমি এখন দারুণ মনঃকষ্টে আছি।
বাবলি হাসতে হাসতে বলল, কি রকম?
ঝুমা বলল, অবস্থা খুব খারাপ। একজনের জন্য পাগল হয়ে রয়েছি। তারপর বলল, চল, চা খাই। চা খেতে খেতে বলব।
বাবলি বলল, একটু আগে তো লাঞ্চ করলাম।
ঝুমা হাত ধরে টানল। বলল, চল না। ভাত হজম হয়ে যাবে।
বাবলি বুঝল, ঝুমার হাত এড়ানো সহজ নয়। বলল, চল। ওরা দুজন রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকতেই বারের দিক থেকে দু’জন ইয়াং হ্যান্ডসাম পাইলট হাত তুলে ঝুমাকে উইশ করল। ঝুমা বাঁ হাত ওপরে তুলে একসঙ্গে বারকয়েক নাড়িয়ে দুজনের অভিবাদনই একসঙ্গে গ্রহণ করল।
বাবলি বসতে বসতে বলল, বাবাঃ, তোর কত অ্যাডমায়ারার রে?
ঝুমা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, দূর দূর, এদের বেশির ভাগকেই আমার জানা! যে যার নিজের তালে ঘুরছে। কোনোরকমে নাইট হল্টে বাইরে আমায় মওকামত পেয়ে শুয়ে পড়ার তাল। বুঝলি না। পুরুষ জাতটা শুয়োরের মতো। কোনো রসকষ নেই জাতটার। ওরা খালি ঐ একটা জিনিস বোঝে।
বাবলির কান লাল হয়ে গেল। বলল, এই আস্তে বল, কি হচ্ছে? শুনতে পেলে?
ঝুমা বলল, আহা, বুড়ো খোকারা যেন কিছু জানে না? আমি যেন মিথ্যে কথা বলছি। একসঙ্গে কাজ করতে হয়, তাই হাত নাড়লাম, তাই ভালো ব্যবহার করি। এ ছাড়া কি?
বাবলি কথা ঘোরাল। বলল, তারপর তোর মনঃকষ্টের কারণটা বল?
ঝুমার মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, দাঁড়া দাঁড়া, বলছি। চায়ের অর্ডারটা দিয়ে নিই আগে। বলেই বেয়ারাকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিল। তারপর নিজের মনেই বলল, আমার আজকে ম্যাড্রাস ফ্লাইট। সে এক ঝকমারি। সমুদ্রের ওপরের ফ্লাইট হলে লাইফ বেল্ট আর অক্সিজেন মাস্কের ব্যবহার দেখাতে হবে প্যাসেঞ্জারদের। ডেমনস্টেশানে তো তাদের ভারী ইন্টারেস্ট-সব ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকবে বুকের দিকে, পেটের দিকে, যখন দু’হাত ওপরে তুলে ডেমনস্ট্রেট করব।
বাবলি খিলখিল করে হাসল। বলল, তুই ভীষণ খারাপ হয়ে গেছিস। বাবা, কেউ যদি তোর অমন ফিগার একটু চোখের দেখা দেখে আনন্দ পায়, তাতে তোর কি? তোকে তো আর খেয়ে ফেলছে না।
ঝুমা বলল, খেয়ে ফেলা এর চেয়ে ভালো ছিল। তুই জানিস না, কেমন সুড়সুড়ি লাগে। অন্য কেউ আমার দিকে অসভ্যের মতো তাকালেই আমার সুড়সুড়ি লাগে। পেছন দিকে তাকালেও আমি বুঝতে পারি।
বাবলি আবার হাসল। বলল, পারিসও বাবা তুই।
পরক্ষণেই ঝুমা খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
বলল, আমার ম্যাড্রাস, দিল্লি, বোম্বের ফ্লাইট ভালো লাগে না। আমি ইম্ফলের ফ্লাইট চাই।
বাবলি অবাক হয়ে তাকাল ঝুমার দিকে। বলল, হঠাৎ ইম্ফলের ওপর এত প্রীতি? জানিস, আমি ইম্ফল থেকে আসছি?
ঝুমা লাফিয়ে উঠল। বলল, ওমা, সত্যি! ঈশ, তোর কি মজা রে! তুই কি ওখানের কাউকে চিনিস? আমার সঙ্গে ইম্ফলের একজন লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে। পারবি? তোর কে থাকেন সেখানে বল না?
বাবলি অবাক চোখে হাসল। বলল, আমার মেসোমশায় থাকেন ওখানে। কিন্তু যার সঙ্গে আলাপ করবি, সে কে? মণিপুরী কোনো ভদ্রলোক না কি?
ঝুমা হড়বড় করে বলল, না রে না, বাঙালি। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু আলাপ হয় নি। মানে আলাপও হয়েছে, কিন্তু সে নিছকই হ্যাংলার আলাপ। কিন্তু কি বলব তোকে, আমি দেখেই, শুধু কথা শুনেই খুব বিপদে পড়ে গেছি। আলাপ হলে জানি না কি করব? হয়তো ভালো লাগায় মরেই যাব।
এই অবধি বলেই ঝুমা থামল। পরক্ষণেই ঝুমা বলল, ছবি দেখবি? হিংসা করিস না যেন। বলেই ওর হ্যান্ডব্যাগটা থেকে খামে মোড়া একটা ছবি বের করল।
বাবলি বলল, তোর সঙ্গে আলাপই হল না, আর তুই ছবি কোথায় পেলি?
ঝুমা চোখ নামিয়ে বলল, কলকাতায় এসেছিল সে, আমার পিসতুতো দাদা-বৌদির সঙ্গে রোজ সাঁতার কাটতে আসত সুইমিং ক্লাবে। ওখানেই সাঁতার কাটতে গিয়ে দেখা। আমার সঙ্গে জাস্ট ফর্মাল ইনট্রোডাকশান হয়েছে। মাত্র দুদিন ছিল এখানে। কি কাজে যেন এসেছিল। আমার দাদা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ-বলে, বহুদিন এত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে চোখে পড়ে নি। তাছাড়া ভালো ক্রিকেট খেলে, ভালো ইংরেজি গান গায়; ভালো নাচে। আরও জানিস? কবিতা লেখে।
বাবলি বিরক্তির গলায় বলল, যত ট্র্যাশ। এ যেন রূপকথার রাজপুত্র–কোনও দোষই নেই। এমন হতে পারে না। সবকিছুই এমন বাড়াবাড়ি ভালো বিশ্বাস হয় না। তারপর একটু থেমে বলল, আর দেখতে কেমন? তোর যা নাক-উঁচু, তোর পছন্দ হওয়া তো সোজা কথা নয়। রমেশ মালহোত্রার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেকে তুই আত্মহত্যা করিয়ে মারলি; তোর কপালে দুঃখ আছে।
ঝুমা চায়ের কাপে চিনি নাড়তে নাড়তে বলল, দুঃখ নেই, দুঃখ নেই। আমার কপালে এখন দারুণ সুখ। তুই দেখিস। একবার ইম্ফল যাই-ই-না। অপারেশনাল ম্যানেজারকে ধরে-পড়ে ফ্লাইটটা একবার ম্যানেজ করতে পারলেই ব্যস্-স্। তা না হলে ছুটি নিয়ে নেব। দরকার হলে চাকরিই ছেড়ে দেব। ইম্ফলে যাবার জন্যে আমি সব করতে পারি। স–ব-সব।
তারপরই একটু থেমে বলল, ঝুমা রায় কোনো পুরুষকে চাইলে, সত্যি সত্যিই পেতে চাইলে–সে পুরুষের সাধ্য কি যে তাকে প্রত্যাখ্যান করে?
ঝুমার রূপকথার সেই নায়কের ছবি দেখার কোনো ঔৎসুক্য ছিল না বাবলির। কিন্তু পাছে বন্ধু মনে দুঃখ পায়, তাই আস্তে আস্তে খাম থেকে ছবিটা বের করল বাবলি।
ছবিটা খাম থেকে সম্পূর্ণ বাইরে আসতেই বাবলির হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেল। বাবলি দেখল, অভী। কালো রঙা সুইমিং ট্যাস্ক পরে সুইমিং পুলের পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবলির হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেল দুটি কারণে।
প্রথমত ছবিটি অভীর বলে। দ্বিতীয়ত সুইমিং টাস্ক-পরা অভীর পুরুষালী শরীরের চমৎকার গড়ন দেখে। বাবলি অভীর গুণ সম্বন্ধে এত কথা জানত না। আরও জানত না, কখনও জানে নি যে ঢোলা প্যান্ট পরা সাদা-সিধে ক্যাবলা মানুষটার ঝুলঝুলে পোশাকের আড়ালে এরকম একটা শরীর থাকতে পারে। এমন সুগঠিত পা, বুক, এমন কোমর। কোনো পুরুষ মানুষের শারীরিক সৌন্দর্য যে এমন করে ওর মনকে নাড়া দিতে পারে। বাবলি তা আগে জানত না। ভাবত, সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যের পুজো পাওয়া বুঝি মেয়েদেরই একচেটে।
বাবলি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। ও কথা বলছিল না।
ঝুমা ওর দিকে তাকিয়ে খুব খুশী খুশী গলায় বলল, কি রে? কি হল?
বাবলি খুব সপ্রতিভতার ভান করে বলল, ভাবছি।
কি ভাবছিস? ঝুমা উদগ্রীব হয়ে বলল।
বাবলি বলল, এই একটা সাধারণ চেহারার ছবির মধ্যে তোর মতো মেয়ে কি দেখলো এমন ভালোলাগার মতো? পুরুষদের মধ্যে অনেকে যেমন আছে, যারা মেয়েদের শরীর ছাড়া কিছুই বোঝে না, তেমন মেয়েদের মধ্যেও কিছু কিছু তেমনি আছে বইকি! তবে তুই যে কারো সুইমিং ট্যাস্ক পরা ছবি বুকে করে বেড়াবি, তা আমি ভাবতেও পারি নি।
ঝুমা এ কথায় দুঃখিত হল।
তারপর বলল, বিশ্বাস কর, এছাড়া আর কোনো ছবি পাওয়ার উপায় ছিল না আমার। তাছাড়া, বিশ্বাস কর, শরীর ব্যাপারটা জাস্ট ইনসিডেন্টাল। কোনো লেখাপড়া জানা মানুষ কি শুধুই অন্য একটা শরীর দেখে ভালোবাসতে পারে কাউকে? হা, হয়তো তার সঙ্গে শুতে চাইতে পারে, সেটা নেহাতই শরীরের কামনা। একাধিকবার শুতেও পারে হয়তো; কিন্তু শোওয়া আর ভালোবাসা কি এক? তুই-ই বল।
বাবলি বলল, জানি না। তোর মতো আমি অত জানি না। তবে যাই ই বলিস আমি তো মানুষটা কেমন জানি না। তবে ছবিতে শুধু চেহারাটাই দেখা যায়, আর তো কিছুই বোঝা যায় না। চেহারাও তোর যোগ্য নয়। রমেশ মালহোত্রা তোর জন্য স্লিপিং পিল খেলো, আর তুই এই লোকের জন্য পাগল! ভাবা যায় না। তোকে বুঝতে পারি না।
ঝুমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল।
বলল, তোকে হয়তো না বললেই ভালো করতাম। হয়তো ছবিটাও তোকে দেখানো উচিত হয় নি আমার। মিরান্ডা হাউসের দিনগুলোর পর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে অনেক বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে তোর ও আমার জীবনে–আমরা বান্ধবী থাকলেও সেই ফাস্ট ইয়ারের প্রিয় সখী যে আমরা নই আর, তা আমি বুঝতে পারি নি।
এই অবধি বলে ঝুমা বলল, দ্যাখ বাবলি, তুই কখনও আমাকে পুরোপুরি বুঝেছিলি বলে আমার মনে হয় না। তোর বরাবরই হয়তো ধারণা ছিল যে, যেহেতু আমি হাসিখুশি চঞ্চল, সুতরাং গভীরতা বলতে আমার মধ্যে কিছুই নেই। তোর এই ভাবনাটা ভুল কি ঠিক তা জানি না। তবে এটা ঠিক যে তুই মিরান্ডা হাউসে যে ঝুমাকে জানতিস, এই ঝুমা সে নয়। সে অনেক বদলে গেছে। তুইও হয়তো অনেক বদলে গেছিস। আজ হয়তো চেষ্টা করেও আমরা একে অন্যকে বুঝতে পারব না।
একটু চুপ করে থেকে ঝুমা আবার বলল, যাক অন্য কথা বল। কি কথা থেকে কি কথায় এসে যাচ্ছিস তুই। এতদিন পরে দেখা হল আর–! তুই কি দিল্লিতেই জয়েন করছিস নাকি?
বাবলি অবাক হয়ে বলল, তোকে কে বলল? তোর বয়ফ্রেন্ড কি তোকে ইম্ফল থেকে জানিয়েছে নাকি আমার সম্বন্ধে?
ঝুমা বিরক্ত হল। বলল, তুই কিরকম গ্রাম্য হয়ে গেছিস? তুই এত জেলাস কেন আমার বয়ফ্রেন্ড সম্বন্ধে? তাও বুঝতাম, তুই যদি বা চিনতিস তাকে। এবং সে যদি সত্যিই আমার বয়ফ্রেন্ড হত।
বাবলি কথা বলল না।
ঝুমা বলল, গত সপ্তাহে ইন্দিরা চাওলা দিল্লি থেকে চিঠি লিখেছিল, তার চিঠিতে সব খবর জানলাম।
বাবলি বলল, চল ওঠা যাক। বলে চায়ের দাম দিতে গেল।
ঝুমা বলল, আমিই দিই। আমিই তো তোকে ডাকলাম।
বাবলি বলল, দে।
বাবলি যেখানে বসেছিল সেখানে এসে বসল। ঝুমা বলল, আমার এখন রিপোর্ট করতে হবে। চলি রে বাবলি। আবার দেখা হবে।
ঝুমা চলে যেতে না যেতেই বাবলির শরীরটা খুব খারাপ লাগতে লাগল। অভীর ছবিটা চোখের উপর বার বার ভাসছিল। আর বাবলি ভেতরে ভেতরে শরীরে কি মনে জানে না, কোথায় কি এক দারুণ অস্বস্তি বোধ করছিল। বাবলির তখন খুব ইচ্ছা করছিল যে, ঝুমার কাছ থেকে ছবিটা কেড়ে নেয়। খুব ইচ্ছা করছিল।
ও বসে বসে ভাবছিল, লাউঞ্জের আলোর মধ্যে, ক্ষণে ক্ষণে মাইক্রোফোনের অ্যানাউন্সমেন্টের মধ্যে নানান লোকের নানান কথার মধ্যে বসে বসে বাবলি ভাবছিল, ইচ্ছে তো কত কিছুই করে। জীবনে কটা ইচ্ছেই বা সফল করা যায়? সফল হয়?
.
সন্ধ্যে হতে দেরি ছিল। এইমাত্র অভী খুজ্মার চেকপোস্ট পেরিয়ে এসেছে। কোহিমাতে সামান্য কাজ ছিল। সেই কাজ সারতে এবং খেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল একটু।
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের লাল আভা দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকের পাহাড় ঝরনা-ঘেরা ঘন সবুজ বর্ষণস্নিগ্ধ উপত্যকায় রোদের সোনার আঙুল এসে ছুঁয়েছে।
শীত-শীত লাগছে। অভী বাঁদিকের কঁচটা তুলে দিল। কোটের বোতামটা আটকে নিল। তারপর স্টিয়ারিং ধরে বসে এই বিষণ্ণ অথচ আশ্চর্য সুন্দর অপরাহের মতো এক বিষণ্ণ ও শান্ত ভাবনা বুকের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে ও গাড়ি চালাতে লাগল।
বোয়িং প্লেনটা টারম্যাকের ওপরে দাঁড়িয়েছিল।
দিল্লির ফ্লাইট।
দমদমের আকাশে বেলা পড়ে এসেছিল।
বাবলি স্টারবোর্ড সাইডে একেবারে সামনে জানলার পাশের এক সীটে বসেছিল। বেলা-শেষের ম্লান আলো এয়ারপোর্টের সীমানার পাশের নারকেল গাছের মাথায় কলাগাছের পাতায় লাল টালির ঘরে আলতো করে লেগেছিল। জেট এঞ্জিনগুলো স্টার্ট করাই ছিল। মাটিতে দাঁড়ানো স্কু। বুড়ো আঙুল তুলে দেখাল। প্লেনটা চলতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে ট্যাক্সিইং করে মেইন স্ট্রিপের দিকে এগোতে লাগল প্লেনটা। তারপর যশোর রোডের দিকে চলে গিয়ে ফিরে দাঁড়াল।
ভেতরে লাল আলোটা জ্বলছিল সীটবেল্ট বাঁধার সংকেত জানিয়ে, রবিশঙ্করের সেতার বাজছিল। এয়ার-হোস্টেস তাড়াতাড়িতে লজেন্স টফি মৌরি এবং তুলো নিয়ে সবশেষে বাবলির কাছে এলো। এখন এঞ্জিন দুটো ফুল থ্রটল-এ দিয়ে দিয়েছিল ক্যাপ্টেন। এখন টেক-অফ-এর জন্যে এগোবে প্লেন।
হঠাৎ এয়ারহোস্টেসের মুখে চোখ পড়ায় বাবলির ভুরু কুঁচকে উঠল। পৃথিবীর কোনো এয়ারহোস্টেসকেই বাবলির এখন অনেকদিন যে সহ্য হবে না, একথাটা বাবলি বোধহয় বুঝতে পারে নি। বুঝতে পেরে অস্বস্তি লাগল।
প্লেনটা দেখতে দেখতে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠল। ল্যান্ডিং হুইল দুটো আস্তে আস্তে এসে প্লেনের তলপেটে ঢুকে গেল। প্লেনটা একটু উঠে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল পশ্চিমে। তারপর সোজা মেঘ ফুঁড়ে উঠতে লাগল।
ইম্ফলের স্মৃতি, নাগাল্যান্ড মণিপুর ডিমাপুরের সব স্মৃতি নীচের সন্ধ্যের বাতিজ্বলা কলকাতা শহরের লক্ষ লক্ষ কম্পমান উজ্জ্বল বিন্দু এক শরীরে লীন হয়ে, এক আশ্চর্য, আনন্দময় দেয়ালী হয়ে নীচে ছড়িয়ে রইল।
বাবলি সীট-বেলটা খুলতে খুলতে নীচে তাকিয়ে নিজেকে বলল, ও এখনও যথেষ্ট বড় হয় নি। এখনও বেশ ছেলেমানুষ রয়ে গেছে। নিজেকে একটু শাসন করতে হবে।