৩. কেনোসিস (সি. ৮০০ থেকে ৭০০ বিসিই)
অষ্টম শতাব্দী ছিল ইসরায়েল ও জুদাহ রাজ্যের পক্ষে ধর্মীয় পরিবর্তনের কাল। এই সময়ে আমরা প্রায় দুশো বছর পরে পরিণত হয়ে ওঠা অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতার প্রথম আলোড়ন লক্ষ করি। বৈদিক ভারতীয়রা যেখানে উৎসর্গের আচার নিয়ে ধ্যানের ভেতর দিয়ে নতুন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেছিল ইসরায়েল ও জুদাহর জনগণ সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান ঘটনাপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করেছে এবং অঞ্চলের উন্মোচিত ইতিহাস ঐশ্বরিকতা সম্পর্কে তাদের বহু ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করেছে বলে আবিষ্কার করেছে। কেউ কেউ আবার আচার-অনুষ্ঠানের বেলায় সমালোচনা মুখর হয়ে অধিকতর নৈতিকতা ভিত্তিক ধর্মের খোঁজ করছিল। অষ্টম শতাব্দীতে পশ্চিম সেমিটিক বিশ্বে ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় লেখার কৌশল বিস্তার লাভ করে। এর আগপর্যন্ত লেখালেখির বিষয়টি প্রধানত বাস্তব, প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু এখন লিপিকাররা প্রাচীন কাহিনী ও রেওয়াজ ধরে রাখার উদ্দেশ্যে রাজকীয় মহাফেজখানা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন। সম্ভবত শতাব্দীর শেষদিকে বাইবেলের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থ পেন্টাটিওকের আদি অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, অ্যাক্সিয়াল যুগের সকল ধর্মীয় ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা আত্মত্যাগের বীজ লক্ষ করি আমরা। এখানেও অঞ্চলে সহিংসতার বিস্ফোরণই ছিল পরিবর্তনের অনুঘটক।
অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য ছিল তুঙ্গে। অসিরিয়া ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, এবং অচিরেই গোটা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করবে: রাজা দ্বিতীয় জেরোবোয়ামের (৭৮৬-৭৪৬) অধীনে অসিরিয়ার অনুগত করদ রাজ্য ইসরায়েল অর্থনৈতিক অগ্রগতি উপভোগ করছিল। মিশর ও অসিরিয়ার জলপাই রপ্তানি করে রাজ্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, জনসংখ্যারও লক্ষণীয় বৃদ্ধি ঘটে। জেরোবোয়াম ট্রান্সজর্দানে নতুন এলাকা দখল এবং মেগিদ্দো, হাযোর ও গেযারে প্রধান নির্মাণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় রাজ্যটির অত্যাধুনিক আমলাতন্ত্র আর পেশাদার সেনবাহিনী ছিল। সামারিয়ায় অভিজাত গোষ্ঠী জটিল হাতির দাঁতের প্যানেলের নকশা করা বিলাসবহুল বাড়িতে বাস করত।
কিন্তু যেকোনও কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রের মতোই সম্পদ উচ্চবিত্তের হাতে সীমাবদ্ধ ছিল, ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান হতাশাব্যাঞ্জকভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রাজার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ যোগানদার পল্লী অঞ্চলের কৃষক সমাজ প্রচণ্ড করভারে আক্রান্ত ছিল, বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হতো তাদের। শহরে কারুশিল্পীদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। এমনি পদ্ধতিগত অবিচার একাধারে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে দুস্থদের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখানো রাজা ছিলেন দেবতাদের নির্দেশ লঙ্ঘনকারী, তাঁর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ত, সুতরাং ইয়াহওয়েহর নামে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে পয়গম্বরদের আবির্ভাব মোটেই বিস্ময়কর ছিল না। আমোস ও হোসেয়া প্রথম সাহিত্যিক হিব্রু পয়গম্বর ছিলেন। শিষ্যরা তাঁদের শিক্ষাকে মৌখিকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন; অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ বাণীসমূহ সংকলিত করেছেন। চূড়ান্ত টেক্সট পরবর্তীকালের পয়গম্বরদের বাণীকেও অন্তর্ভূক্ত করেছে বলে কোনও ব্যক্তি বিশেষের বাণীর সত্যতা নিশ্চিত করা কঠিন, তবে এটা স্পষ্ট যে, আমোস ও হোসেয়া উভয়ই তাঁদের আমলের সামাজিক সংকটের কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন।
৭৮০ সালের দিকে দক্ষিণের জুদাহ রাজ্যের তেকোয়ার একজন রাখাল সহসা ইয়াহওয়েহর ক্ষমতার প্রতাপে আচ্ছন্ন বোধ করেন। এ জন্যে তৈরি ছিলেন না তিনি। ‘তখন আমোষ উত্তর করিয়া অমিৎসিয়কে কহিলেন, আমি নিজে ভাববাদী ছিলাম না, ভাববাদীর সন্তানও ছিলাম না, কেবল গোপালক ও ডুমুর ফুল সংগ্রাহক ছিলাম,’ পরে প্রতিবাদ করেছেন আমোস। ‘কিন্তু সদাপ্রভু আমাকে পশুপালের অনুগমন হইতে লইলেন, এবং সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, যাও আমার প্রজা ইস্রায়েলের কাছে ভাববাণী বল।” তাঁকে এমনকি জুদাহয়ও থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি, বরং তাঁর চোনাজানা সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন ইয়াহওয়েহ। তাঁর আর কোনও উপায় নেই বলে হয়েছে। ‘সিংহ গর্জ্জন করিল, কে না ভয় করিবে?’ বলেছেন তিনি, ‘প্রভু সদাপ্রভু কথা কহিলেন, কে না ভাববাণী বলিবে?” হিব্রু পয়গম্বররা মরমী ছিলেন না। দীর্ঘ শৃঙ্খলাবদ্ধ অনুসন্ধানের শেষে নিজেদের ভেতর সূচিত নিজেদের অন্তরে আলোকন বোধ করেননি তাঁরা। আমরা যেমন দেখব, আমোসের অভিজ্ঞতা ভারত বা চীনের অ্যাক্সিয়াল যুগের বৈশিষ্ট্যে পরিণত আলোকন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। নিজেকে বহিরাগত মনে হওয়া এক শক্তির অধীন মনে করেছেন তিনি; সচেতন জীবনের স্বাভাবিক ধরন তা এতটাই বিগড়ে দিয়েছিল যে নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ইয়াহওয়েহ তাঁর নিয়ন্ত্রণের জায়গাটুকু দখল করে নিয়েছিলেন, উদ্দেশ্যপূর্ণ অহম সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে ছুঁড়ে দিয়েছে আমোসকে। হিব্রু পয়গম্বররা ঐশী শক্তিকে বিচ্ছেদ, উন্মুলতা এবং প্রবল আঘাত হিসাবে উপলব্ধি করবেন; তাঁদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা প্রায়শঃই চাপ ও দুর্ভোগের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
এই সময় ইসরায়েল ও জুদাহর ধর্ম প্রবলভাবে দর্শন নির্ভর ছিল। শ্লোকবাদীরা ইয়াহওয়েহকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন ছিলেন, ‘এই রূপে আমি পবিত্র স্থানে তোমার মুখে চাহিয়া থাকিতাম, তোমার পরাক্রম ও তোমার গৌরব দেখিবার জন্যে।৬ আমোস উত্তরে আসার পর ইসরায়েলের অন্যতম উপাসনালয় বেথেলের মন্দিরে ইয়াহওয়েহর দিব্যদর্শনের মুখোমুখি হন। ইয়াহওয়েহকে বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বর্গীয় সভার সদস্যদের মন্দির ও ইসরায়েলের জাতিকে ধ্বংসের নির্দেশ দিতে দেখেন তিনি: ‘তিনি কহিলেন, তুমি মাখলাতে আঘাত কর, দ্বারের গোবরাট বিকম্পিত হউক, তুমি সকলের মস্তকে তাহা ভাঙ্গিয়া ফেল; আর তাহাদের শেষাংশকে আমি খড়গে বধ করিব, তাহাদের মধ্যে একজনও পালাইতে পারিবে না।” আমোস সান্ত্বনার কোনও বাণী বয়ে আনেননি: জেরোবোয়াম দরিদ্রের প্রতি দায়িত্বে অবহেলা করেছেন, তাঁকে হত্যা করা হবে, ইসরায়েলকে ধ্বংস করা হবে এবং ‘আর ইস্রায়েল স্বদেশ হইতে অবশ্য নির্বাসিত হইবে’।
আসলে এমনি ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্যে আমোসের ঐশী অনুপ্রেরণার কোনও প্রয়োজন ছিল না। অসিরিয়া শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে, বুঝতে পারছিলেন তিনি, এলাকার ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে করদ রাজ্যে পরিণত করছে। অনুগত রাজাকে আনুগত্যের শপথ নিতে হতো, অভিজাতগোষ্ঠীকে দেশান্তরী করে অবাধ্যতার শাস্তি দেওয়া হতো। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ আধুনিককালের রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকারদের মতো ছিলেন। আমোস বুঝতে পারছিলেন, পরাশক্তির দলে যোগ দিয়ে জেরোবোয়াম এক বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছেন। সামান্য ভ্রান্তিই ইসরায়েল রাজ্যের উপর অসিরিয়দের প্রবল আক্রোশ টেনে আনতে পারত। এই ভয়ঙ্কর খবর নিয়েই এসেছেন তিনি! অভিবাসনের সময় যেমন ছিলেন, ইয়াহওয়েহ এখন আর নিজে থেকে ইসরায়েলের পক্ষে নেই। অসিরিয়ার রাজাকে ব্যবহার করে গরিবদের প্রতি জেরোবোয়ামের অবহেলার প্রতিশোধ নেবেন তিনি। রাজাকে আমোসের প্রচারণার কথা জানানো হলো; তখন প্রধান পুরোহিত বেথেল থেকে বহিষ্কার করলেন তাঁকে। কিন্তু এতটুকু দ্বিধান্বিত না হয়েই প্রচারণা চালিয়ে যেতে লাগলেন আমোস। অবশ্য তাঁর কোনও বিকল্প ছিল না, কারণ ইয়াহওয়েহ তাঁকে কথা বলতে বাধ্য করেছেন। অসংখ্য প্রচলিত নিশ্চয়তাকে বাতিল করে দেওয়ায় তাঁর শিক্ষা ছিল ভয়ানক। ইসরায়েল বরাবর ইয়াহওয়েহকে স্বর্গীয় যোদ্ধা হিসাবে দেখে এসেছে; আদিকাল থেকে তারা ভেবে এসেছে যে, তাদের ঈশ্বর দক্ষিণের পাহাড় থেকে তাদের সাহায্য করার জন্যে তেড়ে আসছেন। এখন আবার যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছেন ইয়াহওয়েহ। দামাস্কাস, ফিলিস্তিয়া, টায়ার, মোয়াব আর আম্মোর রাজ্যগুলো তছনছ করে ফেলবেন তিনি, কিন্তু এযাত্রা ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ করবেন না। অসিরিয়াকে তাঁর প্রিয় অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল ও জুদাহর বিরুদ্ধে এক পবিত্র যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি।
অ্যাক্সিয়াল যুগের আধ্যাত্মিকতাকে প্রায়শঃই প্রতিমাবিরোধী মনে হতে পারে। ধর্ম স্রেফ লালিত আনুশীলন আর বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকা ছিল না; প্রায়শঃই লোকে যেন তাদের ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন করে, নিজস্ব আচরণের সমালোচনা করে, সেটাই দাবি করত। স্বর্গীয় যোদ্ধা ইয়াহওয়ের প্রতি প্রাচীন ভক্তিকে ওলট-পালট করে দেওয়ার পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রিয় সব আচারের প্রতিও ভর্ৎসনা ঢেলে দিয়েছেন আমোস। ‘আমি তোমাদের উৎসব সকল ঘৃণা করি,’ অভিযোগ করেছেন ইয়াহওয়েহ, ‘অগ্রাহ্য করি।’ তিনি তাঁর জাতির শোরগোলময় ভজন আর হার্পের বেসুরো বাদনে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গেছেন। তার বদলে ন্যায় বিচার চান তিনি যেন ‘বিচার জলবৎ প্রবাহিত’ হয়; ‘ধাৰ্ম্মিকতা চিরপ্রবহমান স্রোতের ন্যায়’ বয়ে চলে।° শেষে ইয়াহওয়েহর সঙ্গে ইসরায়েলের অনন্য সম্পর্কের গর্বকে খাটো করেছেন আমোস। অন্যান্য জাতিকেও ইয়াহওয়েহ মুক্তি দিয়েছেন; কাপসর থেকে ফিলিস্তিয়াকে, আরামানদের কির থেকে মুক্ত করে তাদের প্রতিশ্রুত দেশে থিতু করেছেন তিনি।১১ এখন মানচিত্ৰ থেকে ইসরায়েল রাজ্যকে মুছে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ইসরায়েলের আত্ম-তুষ্টির প্রতি এক প্রবল আঘাত হেনেছিলেন আমোস। জাতীয় গর্বকে ফুটো করে দিতে চেয়েছেন তিনি। এটা ছিল ইসরায়েলে আত্ম- বিসর্জনের আধ্যাত্মিকতার অন্যতম আদিম প্রকাশ, যা ছিল অ্যাক্সিয়াল আদর্শের মুল কথা। আত্মমূল্য বাড়ানোর জন্যে ধর্মকে কাজে লাগানোর বদলে ইসরায়েলিদের স্বার্থপরতার বাইরে গিয়ে ন্যায় বিচার ও সাম্যের মাধ্যমে শাসন করা শিখতে হয়েছে। গ্রিকরা যাকে কেনোসিস-শূন্যকরণ’-বলবে তারই জীবন্ত নজীর ছিলেন পয়গম্বর। আমোস তাঁর আত্মনিষ্ঠতা ঈশ্বর গ্রহণ করেছেন বলে উপলব্ধি করেছিলেন। নিজের কথা নয়, ইয়াহওয়েহর কথা বলছিলেন তিনি; পয়গম্বর তাঁর সত্তাকে আবেগময় সহানুভূতিতে ইসরায়েলের অন্যায় অবিচারকে ব্যক্তিগত অসম্মান হিসাবে বিবেচনাকারী ঈশ্বরের সঙ্গে পিছে ফেলে এসেছেন ১৩ এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এটা। অ্যাক্সিয়াল যুগের ধর্ম মানুষকে অন্যের জন্যে অনুভব করতে সক্ষম করে তোলা সহানুভূতির শর্তাধীন থাকবে। আমোস নিজের পক্ষ থেকে ক্রোধ বোধ করেননি; খোদ ইয়াহওয়েহর ক্রোধ অনুভব করেছেন তিনি।
আমোসের মতো মোটামুটি একই সময়ে উত্তরের রাজ্যে তৎপর ছিলেন হোসেয়া, স্ত্রী গোমার বালের উর্বরতার কাল্টে পবিত্র বারবণিতায় পরিণত হলে নিজের জীবনে এক করুণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ইয়াহওয়েহর সঙ্গে সহাভূতির শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি।” হোসেয়া উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইসরায়েলের পবিত্র জন ইয়াহওয়েহও তাঁর জাতি অন্য দেবতাদের সঙ্গে বেশ্যাবৃত্তি করার সময় এমনই বোধ করেছিলেন। গোমারকে ফিরে পেতে নিজের আকাঙ্ক্ষাকে ইয়াহওয়েহও যে আবার অবিশ্বস্ত ইসরায়েলকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করছেন, একে আরেকটি সুযোগ দিতে প্রস্তুত আছেন, তারই ইঙ্গিত বলে মনে হয়েছে।১৫ এখানেও আবার হোসেয়া একটি লালিত ঐতিহ্যকে-এক্ষেত্রে বা’লের উপাসনা-আক্রমণ করছিলেন। তাঁর জাতিকে বোঝাতে হয়েছিল যে ইয়াহওয়েহ স্রেফ যুদ্ধের দেবতা নন, বরং তাদের জন্যে ভালো ফসলও এনে দেবেন তিনি। এলাইযার মতো বা’লকে উৎখাত করে ইসরায়েলিদের কেবল ইয়াহওয়েহর উপাসনায় রাজি করাতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু এলাইযা যেখানে প্রথাকে পরিশুদ্ধ করার দিকে নজর দিয়েছিলেন, হোসেয়ার উদ্বেগ ছিল নৈতিক। বা’লের উপাসনা নৈতিক অবক্ষয় ডেকে এনেছে—”শপথ মিথ্যাবাক্য, নরহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, চলিতেছে, লোকেরা অত্যাচার করে, এবং রক্তপাতের উপর রক্তপাত হয়’।১৬ সবাই ঘনঘন পবিত্র বেশ্যাদের কাছে যাচ্ছিল আর উৎসর্গের ভোজের পর মাতাল হয়ে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ফলে যৌন অনাচার চলছিল। আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনা দেওয়ার বদলে পুরোহিতরা স্রেফ কাঠের গুড়ি প্রতিমাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছেন।১৭
ইসরায়েলিদের ধর্মের অন্তর্মুখীনতার ঘাটতির কারণেই ঘটেছে এইসব। লোকে কেবল ইয়াহওয়েহকে ঠিকমতো জানে না বলেই অন্য দেবতাদের অনুসরণ করে এসেছে। তাদের ধর্মের উপলব্ধি ছিল উপরিগত। ভারতের শাস্ত্রজ্ঞদের মতো বৃহত্তর সচেতনতার দাবি করছিলেন হোসেয়া। ধর্মীয় অনুশীলনসমূহকে আর নিশ্চিত ধরে নেওয়া যাবে না, মুখস্থ পালন করা চলবে না; লোকজনকে অবশ্যই তারা কি করছে সে-ব্যাপারে আরও সজাগ হয়ে উঠতে হবে। কেবল মতবাদগত জ্ঞানের কথা বলছিলেন না হোসেয়া; ক্রিয়া পদ ইয়াদা (‘জানা’) ইয়াহওয়েহর প্রতি আবেগীয় সংশ্লিষ্টতা এবং ঐশীর এক ধরনের অন্তস্থঃ আত্মীকরণ বোঝায়। কেবল উৎসর্গের অনুষ্ঠান বা উৎসবে যোগ দেওয়াই বড় কথা নয়। ‘কারণ আমি দয়াই চাই বলীদান নহে,’ অভিযোগ করেছেন ইয়াহওয়েহ, ‘এবং হোম অপেক্ষা ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞান চাই।১৯ ইসরায়েলিদের অবিরাম ঈশ্বরের অন্তস্থঃ জীবন সম্পর্কে সচেতন করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন হোসেয়া। উদাহরণ স্বরূপ, যাত্রা কেবল ইয়াহওয়েহর তরফ থেকে ক্ষমতার প্রকাশ ছিল না। চল্লিশ বছর ধরে ইসরায়েলিদের সঙ্গে বনে-বাদারে বাস করার সময় শিশুদের হাঁটতে শেখানো বাবা-মায়ের মতো অনুভব করেছেন ইয়াহওয়েহ, তাদের কোলে করে বয়েছেন, হাঁটি-হাঁটি পায়ে হাঁটতে শেখানোর মতো পথ দেখিয়েছেন, ‘মানুষ্যের বন্ধন দ্বারা আকর্ষণ করিতাম, প্রেমরজ্জু দ্বারাই করিতাম।’ ইয়াহওয়েহ ছিলেন ‘সেই লোকদের ন্যায়, যাহারা হনু হইতে যোঁয়ালি উঠাইয়া লয়’; তিনি ‘লোকদিগকে খাদ্য দেওয়ার সময় উবু হইতেন। লোকজনকে প্রাচীন গল্পকাহিনীর গভীরে দৃষ্টি দিয়ে ঈশ্বরের মনোভাব উপলব্ধি করাতে চাইছিলেন হোসেয়া।
আমোস ও হোসেয়া ইসরায়েলি ধর্মে এক গুরুত্বপূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ভালো নৈতিক আচরণ ছাড়া, জোর দিয়েছেন তাঁরা, কেবল আচার- অনুষ্ঠান অর্থহীন। ধর্মকে সাম্প্রদায়িক অহংকার ও আত্মগর্বকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার কাজে লাগানো নয়, বরং অহমবাদকে বিসর্জন দেওয়ার অনুপ্রেরণার কাজে ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে ইসরায়েলিদের অন্তস্থঃ জীবন পর্যালোচনা করতে, নিজেদের অনুভূতি বিশ্লেষণ করতে ও অন্তর্বীক্ষণের আলোকে গভীর দর্শন গড়ে তোলার তাগিদ দিয়েছেন হোসেয়া। এইসব গুণের কিছু কিছু মোটামুটি এই সময়ে ইসরায়েল ও জুদাহয় গড়ে উঠতে থাকা পেন্টাটিওকের আদি ভাষ্যে আবির্ভূত হয়েছিল।
পণ্ডিতরা অনেক আগেই পেন্টাটিওকের বিভিন্ন পর্যায় আবিষ্কার করেছিলেন। আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক ও গণনাপুস্তকে প্রথমে দুটি আদি টেক্সট এক সঙ্গে করা হয়েছিল বলে মনে হয় এবং পরে ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে জনৈক পুরোহিত স্থানীয় লেখক সম্পাদনা করার সময় নিজস্ব ঐতিহ্য যোগ করেছেন। লেখক তাঁর ঈশ্বরকে ‘ইয়াহওয়েহ’ ডাকতেন বলে অন্যতম আদি উৎসের একজন J নামে পরিচিত ছিলেন; আর দ্বিতীয় লেখক আরও আনুষ্ঠানিক সম্বোধন ইলোহিম পছন্দ করতেন বলে এই উৎস E নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু J ও E মূল রচনা ছিল না; এগুলো স্রেফ আদি ইসরায়েলের কোভেন্যান্ট উৎসবে বাউলদের কণ্ঠে গাওয়া ও মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে হস্তান্তরিত বিভিন্ন প্রাচীন কাহিনীকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বিবরণে একসঙ্গে করেছিল। ইসরায়েল ও জুদাহ রাজ্য দুটি লেখালেখিকে প্রশাসনিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেও রাষ্ট্রের ইতিহাস ও আদর্শকে লিপিবদ্ধ করার কাজে তা ব্যবহার করেনি। অষ্টম শতাব্দীর আগে লেখাকে সাধারণ মানুষের পক্ষে সাধারণভাবেই বিপজ্জনক ঐশী, অলৌকিক দক্ষতা বলে বিশ্বাস করা হতো।২১ সম্প্রদায়ের প্রজ্ঞা ছিল সবার হেফাযতে, একে স্বাক্ষর সংখ্যালঘুর সম্পত্তি হতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে নিকট প্রাচ্যে স্বাক্ষরতা আরও বিস্তার লাভ করে এবং নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি রাজাদের লাইব্রেরি ও লিখিত টেক্সটে তাঁদের শাসনের পক্ষে অনুকূল বিভিন্ন ঐতিহ্য নথিবদ্ধ করতে প্ররোচিত করে।
আমরা J ও E-এর সঠিক সময় নির্ধারণ করতে না পারলেও অষ্টম শতাব্দীর আগপর্যন্ত ইসরায়েল বা জুদাহয় প্রবল লেখালেখির কোনও চিহ্ন ছিল না। দুটোই প্রাচীন উপাদান ধারণ করলেও ঐতিহ্যের দুটি ভিন্ন সূত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে হয়-একটি দক্ষিণের, অন্যটি উত্তরের-অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে তা একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করা হয় ও জেরুসালেমের রাজকীয় মহাফেজখানায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।২২ ঐতিহাসিক রচনার আদি পর্যায় ছিল এগুলো, কিন্তু প্রধানত আসলে কি ঘটেছিল এবং কখন জানতেই বেশি আগ্রহী কোনও আধুনিক ইতিহাসবিদকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। J ও E-র বিবরণ ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। এক দীর্ঘ সময় জুড়ে এগুলো বিবর্তিত হয়েছে, কেবল অতীতের ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত বর্ণনা দিতেই আগ্রহী ছিল না, বরং সেগুলোর অর্থ আবিষ্কার করতে চেয়েছে বলে উভয়ই তাদের অধিকতর ঐতিহাসিক বর্ণনার পাশাপাশি পৌরাণিক উপাদানও যোগ করেছেন। আদি বাইবেলিয় লেখকদের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের জীবন কেবল জাগতিক বিশ্বেই সীমিত ছিল না, বিভিন্ন ঘটনার গভীরতর মাত্রায় আলো ফেলা এবং সেগুলোকে আদিআদর্শ নজীরের তাৎপর্য যোগানো একটা দুয়ে মাত্রাও ছিল। কিন্তু কেউই কল্পনা করতে পারেনি যে, J ও E টেক্সটই চূড়ান্ত। এগুলোই শেষ কথা ছিল না। পরবর্তী প্রজন্মগুলো স্বাধীনভাবে এইসব শাস্ত্রে যোগ করেছে এবং এমনকি এগুলোর সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করেছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে ইসরায়েল ও জুদাহর ধর্মীয় বিভিন্ন ধারণা নিয়ে ভেবেছেন J ও E, কিন্তু সপ্তম, ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীতে অন্য লেখকরা মূল কাহিনীতে সংযোজন করেছেন, নতুন উপাদান যোগ করেছেন এবং তাঁদের নিজস্ব কালের অবস্থার প্রতি সাড়া দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে লিখেছেন ইসরায়েলের ইতিহাস।
J ও E-তে বর্ণনা করা বিভিন্ন কাহিনী সম্ভবত ইসরায়েলের প্রাথমিক কালের কান্টে ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টম শতাব্দী নাগাদ কোভেন্যান্ট উৎসবের জায়গায় জেরুসালেম ও সামরিয়ার রাজকীয় শাস্ত্রাচার স্থান করে নিয়েছিল। এতে এইসব বিবরণ তাদের কাল্টিক পটভূমি থেকে মুক্ত হয়ে যায় ও চারণ কবি ও অন্যন্য বর্ণনাকারীদের আদি ইসরায়েলের ইতিহাসের অধিকতর স্থিতিশীল ক্রমবিবরণ গড়ে তুলতে সক্ষম করে তুলেছিল।২৩ J ও E-র ক্ষেত্রে মূল কাহিনী সূত্র মোটামুটি একই। ইয়াহওয়েহর গোষ্ঠীপিতাদের- আব্রাহাম, ইসাক ও জাকব- ভেতর একটি নিবিড় সম্পর্কে আহবান করার ভেতর দিয়ে শুরু হয়েছে কাহিনী। এক মহান জাতির পিতায় পরিণত হবেন তাঁরা এবং একদিন কানান দেশের অধিকার লাভে করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ইসরায়েলিদের মিশরে অভিবাসন, সী অভ রীডসে মিশরের বিরুদ্ধে জয়লাভ, সিনাই পাহাড়ে/হোরেবে চুক্তিভিত্তিক দলের সূচনা এবং প্রতিশ্রুত ভূমিতে যাত্রার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে কাহিনী। কিন্তু এই মৌল কাঠামোর ভেতরে J ও E-র ভিন্ন গুরুত্ব ছিল, স্থানীয় যা ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
এভাবে J প্রায় নিশ্চিতভাবেই দক্ষিণের জুদাহ রাজ্যে গড়ে উঠেছিল। J-র বিবরণে মোজেসের চেয়ে বরং আব্রাহামই মূল চরিত্র। আদিপুস্তকের ১-১১ (বিশ্বের সৃষ্টি, আদম ও হাওয়ার পতন, ভাই কেইনের হাতে আবেলের মৃত্যু, প্লাবন, বাবেল টাওয়ারের বিদ্রোহ) লিপিবদ্ধ আদিম ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করেননি E, কিন্তু J-র কাছে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে আব্রাহামের আগে ইতিহাস ছিল উপর্যুপরি বিপর্যয়ের ধারা; মানবজাতি যেন বিদ্রোহ, পাপ আর সাজার পতনমুখী সর্পিল ধারায় বাঁধা পড়েছিল, কিন্তু আব্রাহাম ইতিহাসের বিষণ্ণ প্রবণতা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। আব্রাহামের সঙ্গে কোভেন্যান্ট ছিল ইতিহাসের বাঁক বদলের বিন্দু। দক্ষিণের মানুষ হওয়ায় J-র কাছে আব্রাহাম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। হেব্রনে বসতি করেছিলেন তিনি, তাঁর ছেলে জাকব বীরশেবায় বাস করেছেন; এবং সালেম/জেরুসালেমের রাজা মেলচিদযেকের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন আব্রাহাম। আব্রাহামের জীবনধারা দক্ষিণের বেথেলহেম শহরে জন্ম লাভকারী এবং হেব্রনে ইসরায়েলে ও জুদাহর রাজা হিসাবে আসীন হওয়া রাজা ডেভিডের প্রতি আকাঙ্ক্ষাও দেখিয়েছে। জেরুসালেমকে রাজধানী করেছিলেন তিনি। জুদাহর জনগণের কাছে ডেভিডের বংশের সঙ্গে সম্পাদিত ঈশ্বরের চিরন্তন কোভেন্যান্ট সিনাই পাহাড়ে মোজেসের সঙ্গে সম্পাদিত কোভেন্যান্টের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।২৪ J-র কাছে সিনাই কোভেন্যান্টের চেয়ে আব্রাহামকে দেওয়া ঈশ্বরের মহান জাতির পিতায় পরিণত হওয়ার প্রতিশ্রুতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গোষ্ঠীপিতাদের সম্পর্কে E-র বিবরণ অবশ্য আব্রাহামের সঙ্গে কোভেন্যান্টের প্রসঙ্গ উল্লেখই করেনি, বরং তাঁর পৌত্র জাকবের প্রতি বেশি প্রাধান্য দিয়েছে, ঈশ্বর যাঁকে ‘ইসরায়েল’ হিসাবে নতুন নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু E -র গল্পে তারচেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে যাত্রার কাহিনী, যেখানে স্বল্প পরিচিত দেবতা ইয়াহওয়েহ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মিশরকে পরাস্ত করেছেন। এখানে দেখানো হয়েছে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষেও নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভ ও অস্পষ্টতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব, যেমন নবম শতাব্দীতে ছোট রাজ্য ইসরায়েল নিকট প্রাচ্যে একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।২৫ E-র কাছে মোজেস অনন্য পয়গম্বর ছিলেন। আব্রাহাম নন, তিনিই ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক সময় J মোজেসের বেশ সমালোচনামুখর, অন্যদিকে E বুনো প্রান্তরের ভেতর দিয়ে প্রতিশ্রুত ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় তাঁর নায়কের প্রতি দারুণ সহানুভূতিতে পরিপূর্ণ। আপন জাতির প্রতি মোজেসের ক্রোধ বিস্ফোরিত হলে E করুণভাবে মোজেসের যন্ত্রণার কথা ফুটিয়ে তোলেন: “তুমি কি নিমিত্তে আপন দাসকে এত ক্লেশ করিয়াছ?’ দেবতাকে প্রশ্ন করেছেন তিনি। ‘এই সমস্ত লোকদের দিবার জন্য আমি কোথায় মাংস পাইব? ইহারা ত আমার কাছে রোদন করিয়া বলিতেছে, আমাদিগকে মাংস দেও, আমরা খাইব। এত লোকের ভার সহ্য করা একাকী আমার পক্ষে অসাধ্য; কেননা তাহা আমার শক্তির অতিরিক্ত। তুমি যদি আমার প্রতি এরূপ ব্যবহার কর, তবে বিনয় করি, আমি তোমার দৃষ্টিতে যদি অনুগ্রহ পাইয়া থাকি, আমাকে একেবারে বধ কর; আমি যেন আমার দুর্গতি না দেখি!২৭ মোজেসের J-র বিবরণে এধরনের কিছুই নেই।
J বা E, এদের কেউই মোজেসকে মহান আইন প্রণেতা হিসাবে তুলে ধরেননি। সিনাই পাহাড়ের কোভেন্যান্টের কথা বলার সময় এমনকি দশ নির্দেশনার কথাও উল্লেখ করেননি তাঁরা। J-র বিবরণে কোনও বিধিবিধান নেই, অন্যদিক E স্রেফ দরিদ্র ও দুর্বলদের প্রতি ন্যায়বিচারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রায়শঃই কোভেন্যান্ট বিধি নামে আখ্যায়িত নবম শতাব্দীর কিছু আইনের সংকলন করেছেন।২৮ ইসরায়েল ও জুদাহয় আইন তখনও ঐশ্বরিক হয়ে
। ওঠেনি। J ও E-র কাছে সিনাই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কারণ মোজেস ও প্রবীনগণ ইয়াহওয়েহকে সেখানে দেখেছিলেন। তাঁরা তাঁদের দেবতার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে পাহাড়ে উঠেছিলেন বলে বর্ণনা দিয়েছেন। ‘আর তাহারা ইস্রায়েলের ঈশ্বরকে দর্শন করিলেন; তাঁহার চরণতলের স্থান নীলকান্তমণি-নির্ম্মিত শিলাস্তরের কার্য্যবৎ, এবং নিৰ্ম্মলতায় সাক্ষাৎ আকাশের তুল্য ছিল…তাঁহারা ঈশ্বরকে দর্শন করিয়া ভোজন এবং পান করিলেন।২৯ এটাই সিনাই আবির্ভাবের প্রাচীনতম বিবরণ এবং সম্ভবত সম্মিলিত ভোজ অন্তর্ভুক্ত করা দিব্যদর্শনের কোনও প্রাচীন শাস্ত্রীয় পুনরাভিনয়ের কথা বুঝিয়ে থাকতে পারে।
এনিয়ে J-র কোনও সমস্যা ছিল না, ঈশ্বরকে জোরাল মানব রূপে বর্ণনা করেছেন তিনি। তাঁর বর্ণনায় কোনও নৃপতির মতো স্বর্গোদ্যানে পায়চারি করে বেড়িয়েছেন ইয়াহওয়েহ, সন্ধ্যার শীতল হাওয়া উপভোগ করছেন; নোয়ার আর্কের দুয়ার বন্ধ করেছেন তিনি; প্লাবনের পর নোয়ার উৎসর্গের সুস্বাদু সুবাস গ্রহণ করেছেন; আব্রাহাম ইয়াহওয়েহকে তাঁর শিবিরে প্রবেশকারী একজন আগন্তুক হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু E-তে আরও দুর্জ্ঞেয় হয়ে উঠছিলেন ঈশ্বর। মানুষের সামনে সরাসরি উপস্থিত হননি তিনি, বরং মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তাঁর ‘দূত’-কে পাঠিয়েছেন। জ্বলন্ত ঝোপে মোজেসের ঈশ্বর দর্শন ইসরায়েলের ইলোহিমের আত্মপ্রকাশের একটি নতুন পর্যায় তুলে ধরেছে বলে বিশ্বাস করতেন E। ‘আপনার নাম কি?’ তাঁকে জ্বলন্ত ঝোপে তলবকারী দেবতাকে প্রশ্ন করেছেন মোজেস। আব্রাহাম, ইসাক, এবং জাকব তাঁকে এল ডেকেছেন, উত্তর দিয়েছেন ইয়াহওয়েহ, কিন্তু এখন জাতির কাছে নিজের আসল নাম প্রকাশে তিনি প্রস্তুত। তাঁর নাম এহিয়েহ আশার এহিয়েছ: ‘আমি যে আছি সেই আছি।৩২ এই হেঁয়ালিভরা পূর্ণ বাক্যটি ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা তৈরির একটি হিব্রু বাগধারা, যার সত্যিকার অর্থ ‘আমি কে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই!’ বা ‘নিজের চরকায় তেল দাও!’ প্রাচীন বিশ্বে কারও নাম জানার অর্থ ছিল তাঁর উপর আপনার ক্ষমতা আছে। ঈশ্বরকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার কথা ছিল না।
J ও E উভয়তেই কেনোসিসের আধ্যাত্মিকতা দেখতে পাই আমরা। ব্রেনের কাছে মেমরের এলোন বনে আব্রাহামের ইয়াহওয়েহর দর্শনে এটা খুবই পরিষ্কার। আব্রাহাম চোখ তুলে তাকিয়ে তিনজন লোককে তাঁর তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পান। নিমেষে তাঁদের কাছে ছুটে যান তিনি, ‘এবং ভূমিতে প্রাণিপাত করিলেন।” আগন্তুকরা সাধারণভাবে বিপজ্জনক ছিলেন, স্থানীয় প্রতিশোধের আইনের অধীন ছিলেন না তাঁরা। বিনা শাস্তিতে মারতে বা মরতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু নিজের পরিবারকে রক্ষা করার স্বার্থে তাঁদের আক্রমণ করার বদলে আব্রাহাম যেন তাঁরা দেবতা এভাবে প্রণত হয়েছেন। এরপর যাত্রাপথে অতিথিদের চাঙা করে তোলার জন্যে অনেক খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি। তিনজন নেহাতই অচেনা লোকের প্রতি বাস্তব সহনুভূতিসহ ব্যক্তিগত আত্মসমর্পণের এই কাজ এক স্বর্গীয় সাক্ষাতের দিকে চালিত করেছে : পরবর্তী আলাপচারিতায় এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আগন্তুকদের একজন ইয়াহওয়েহ ছাড়া আর কেউ নন।
ইসাকের বাঁধা পড়ার E-র কাহিনী আরও বেশি চমকপ্রদ ৫ আব্রাহাম এক মহান জাতির পিতায় পরিণত হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু মাত্র একজন ছেলে অবশিষ্ট ছিল তাঁর। তারপর E আমাদের বলছেন, ‘এই সকল ঘটনার পর ঈশ্বর (ইলোহিম) আব্রাহামের পরীক্ষা করিলেন।’ তিনি তাঁকে নাম ধরে সম্বোধন করলেন, আব্রাহাম আর্তনাদ করে বললেন, হিনেনি! ‘আমি হাজির!’ গোষ্ঠীপিতা ও পয়গম্বররা প্রায়ই তাঁদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি ও উপস্থিতির ইঙ্গিত দেওয়া আর্তনাদ করে ঈশ্বরের প্রতি সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু এরপর এক ভয়ঙ্কর নির্দেশ দেন ঈশ্বর, ‘তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, যাহাকে তুমি ভালোবাসো, সেই ইসাককে লইয়া মোরিয়া দেশে যাও, এবং তথাকার এক পর্ব্বতের কথা আমি তোমাকে বলিব, তাহার উপর তাহাকে হোমার্থে বলিদান কর। ৩৬ এই কাহিনী ঈশ্বর সম্পর্কে এক নতুন ধারণা তুলে ধরে। প্রাচীন বিশ্বে প্রথম জন্মানো সন্তানকে প্রায়শঃই কোনও দেবতার সম্পদ মনে করা হতো, মানবীয় উৎসর্গের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে হতো তাকে। তরুণ রক্ত উপাস্যের ক্ষয়িত শক্তিকে ভরে তুলত এবং মহাবিশ্বে শক্তির সঞ্চালন নিশ্চিত করত। কিন্তু এখানে তেমন কোনও যুক্তির অস্তিত্ব ছিল না। সম্পূর্ণ খামখেয়ালি একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেলেন ইলোহিম, কেবল বিশ্বাসের ভেতর দিয়েই যা মেনে নিতে পারতেন আব্রাহাম।৩৭ এই দেবতা স্পষ্টই এলাকার অন্যান্য দেবতার চেয়ে ভিন্ন; মানবীয় বিপদের অংশীদার ছিলেন না তিনি, নারী-পুরুষের কাছ থেকে শক্তি যোগাড়ের দরকার ছিল না তাঁর, বরং তাঁর যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন।
আব্রাহাম দ্বিধায় ভোগেননি। অচিরে গাধার পিঠে জিন চাপিয়ে ছেলে ইসাক ও দুজন ভৃত্যকে নিয়ে ছেলেকে হত্যার ছুরি আর হোমের জন্যে লাকড়ি নিয়ে মোরিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে গেছেন। ইসাককে বাঁধলেন তিনি, বেদীতে শুইয়ে তারপর ছুরি বের করলেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত তাৎপর্য রহিত করে দেওয়ার হুমকি সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ আনুগত্যের প্রকাশ। দীর্ঘ দিন ধরে যে ঈশ্বরের সেবা করে এসেছেন তিনি, দেখা যাচেছ সেই ঈশ্বর একজন প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী ও নিষ্ঠুর শিশুঘাতক। একেবারে শেষমুহূর্তে হত্যা ঠেকাতে একজন দেবদূত পাঠিয়ে আব্রাহামকে তার বদলে একটি ভেড়া উৎসর্গ করার নির্দেশ দিলেন ইলোহিম। এই কাহিনীর একটি প্রথাগত পরিবর্তনের কথা তুলে ধরার কথা, যখন নরবলীর স্থান দখল করেছিল পশুবলী। কিন্তু এই কাহিনীর বেদনা শাস্ত্রীয় প্রাসঙ্গিকতা থেকে বহুদূরে যায়। ইসরায়েলের ইলোহিম কেবল বন্ধুসুলভ, উদার সত্তাই ছিলেন না, বরং অনেক সময় ভীতিকর ও নিষ্ঠুরও ছিলেন, অনুসারীদের অর্থহীনতার উপান্তে নিয়ে যেতেন তিনি। কাহিনীটি আব্রাহাম ও তাঁর ঈশ্বর, উভয়কেই সন্দেহের আলোয় ফেলেছে। এটা দৈহিক বা মানসিক যেকোনও ধরনের সহিংসতা পবিত্রের সঙ্গে বেমানান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কোনও ঐশী অভিজ্ঞতার বিধ্বংসী সম্ভাবনা তুলে ধরে।
মানবীয় বিশ্ব ও ঐশী জগতের ভেতর এর আগে অস্তিত্বহীন একটি ফারাক তৈরি হতে যাচ্ছিল। ৭৪০ সালে এক নতুন পয়গম্বর জেরুসালেম মন্দিরে ইয়াহওয়েহর দিব্যদর্শন লাভ করেন।৩৮ J-র মতো জেরুসালেম রাজ পরিবারের একজন সদস্য ইসায়া দক্ষিণের লোক ছিলেন, ঈশ্বরকে মানব রূপে দেখতে তাঁর কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু ইয়াহওয়েহ আর সেই আন্তরিক দেবতা ছিলেন না, যাঁর সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবার খাওয়া যেতে পারে। ধূপের ধোঁয়া কাল্ট হল ভরে তোলার পর মন্দিরের আচারের পেছনে অবস্থান করা এক ভীতিকর বাস্তবতার দেখা পান ইসায়া। স্বর্গীয় সিংহাসনে বসে আছেন ইয়াহওয়েহ, পবিত্রজনদের সভা তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। দুপাশে দুজন দেবদূত তাঁদের মুখ ঢেকে রেখেছেন: ‘সৈন্যবাহিনীর ঈশ্বর ইয়াহওয়েহ পবিত্র [কাদ্দোশ]। তাঁহার প্রতাপ সমগ্র পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করিয়াছে।’ মন্দিরের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠেছিল, আর হল ধোঁয়ায় ভরে উঠে দুর্ভেদ্য মেঘের আড়ালে গ্রাস করে নিয়েছে ইয়াহওয়েহকে। তিনি আর ইসরায়েলের পবিত্র জন ছিলেন না, বরং বিশ্বের শাসকে পরিণত হয়েছেন। সবার উপরে, তিনি ছিলেন মানবজাতি থেকে কাদ্দোশ, সম্পূর্ণ ‘ভিন্ন’ ও ‘আলাদা’। ভীতিতে ভরে উঠেছিলেন ইসায়া। ‘হায়, আমি নষ্ট হইলাম!’ আর্তনাদ করেছেন তিনি, ‘কেননা আমি অশুচি-ওষ্ঠাধর মনুষ্য। ‘অশুচি-ওষ্ঠাধর জাতির’ ভেতর বাস করে বাহিনীগণের সদাপ্রভুকে দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। সেরাফদের একজন জ্বলন্ত অঙ্গারে তাঁর ঠোঁট পবিত্র করে দিলেন। তখন ইয়াহওয়েহ জানতে চাইলেন, ‘আমি কাহাকে পাঠাইব? আমাদের পক্ষে কে যাইবে?’ সঙ্গে সঙ্গে ইসায়া জবাব দিলেন, ‘এই আমি (হিনেনি!), আমাকে পাঠাও!’
স্বর্গীয় বাণী ছিল বিষণ্ণ। লোকে ইয়াহওয়েহর কথায় কান দিতে দিতে অনেক দেরি হয়ে যাবে:
যাবৎ নগর সকল নিবাসবিহীন
ও বাটী সকল নরশূন্য হইয়া উৎসন্ন না হয়,
এবং ভূমি ধ্বংস স্থান হইয়া একেবারে উৎসন্ন না হয়,
আর সদাপ্রভু মনুষ্যকে দূর না করেন,
এবং দেশের মধ্যে অনেক ভূমি অধিকার শূন্য না হয়।
যদ্যপি তাহার দশমাংশও না থাকে,
তথাপি তাহাকে পুনর্বার গ্রাস করা যাইবে।৩৯
ইসায়া এই বাণী প্রচার করার সময়, এক বিরান জনহীন দেশের এই ভীতিকর বিবরণ মধ্যপ্রাচ্যের দৈনন্দিন বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছিল। ৭৪৫ সালে তৃতীয় তিগলাত-পিলসার অসিরিয়ার রাজা হিসাবে ক্ষমতায় বসেছিলেন, ক্রমশঃ করদ রাজ্যের প্রাচীন ব্যবস্থা রদ করে প্রজাদের প্রত্যক্ষভাবে বিশাল অসিরিয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন তিনি। হাল নাগাদ যুদ্ধ-রথ সজ্জিত একটি দারুণ দক্ষ পেশাদার সেনাবাহিনী ছিল তাঁর, আর গোটা অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা খুবই দক্ষ অশ্বারোহী বাহিনী। বিদ্রোহের প্রথম আলামতেই কোনও করদ রাজ্যের রাজাকে অসিরিয় গভর্নর দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হতো, সেনাবাহিনী সেই দেশে আক্রমণ চালাত এবং গোটা শাসক গোষ্ঠীকে দেশান্তরে পাঠিয়ে সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গা থেকে লোকজন এনে বসতি করানো হতো। তিগলাত-পিলসারের প্রথম সাফল্য ছিল বাবিলোনিয়াকে বশ করা; এরপর পশ্চিমে মনোযোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় জোরোবোয়ামের মৃত্যুর পর ইসরায়েল রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়েছে দেখে ৭৩৮ সালে অসিরিয় সেনাবাহিনী এই দেশে প্রবেশ করে ও উত্তরের এলাকা দখল করে নেয়।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্য কখনও এই মাত্রার সামরিক শক্তি প্রত্যক্ষ করেনি, এই অঞ্চল আর কখনওই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। গোটা জনগোষ্ঠীকেই জোর করে পুরো সাম্রাজ্যে ঘোরানো হতো বলে দেশান্তরকরণ ব্যাপকবিস্তৃত আধ্যাত্মিক ও দৈহিক স্থানচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অসিরিয় বাহিনী কোনও দেশে আক্রমণ চালালে চলার পথে ধ্বংসের ছাপ রেখে যেত, এবং পল্লী এলাকার লোকজন আশ্রয় নিতে শহরের দিকে পালিয়ে যাওয়ায় গ্রামগুলো বিরান হয়ে যেত। অসিরিয়া কেবল সামরিক দিক থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে প্রাধান্য বিস্তারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল না, বরং একটি সমরূপ সংস্কৃতিও গড়ে তুলতে চেয়েছিল। একটি মাত্র সাম্রাজ্য, একটি অর্থনীতি আর একটিই ভাষা থাকবে। আরামিয় ভাষা ও হরফ বেছে নিয়েছিলেন তিগলাত-পিলসার, ক্রমপ্রসারমান সাম্রাজ্যের প্রশাসনকে সহজ করে তোলার জন্যে অসিরিয় কুনিফর্মের চেয়ে সহজ রপ্তানিযোগ্য ছিল তা। প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে লেখালেখি ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠছিল, বেশি সংখ্যক লোকজন লিখতে শিখেছিল। এটা মৌখিকভাবে হস্তান্তরিত টেক্সটের চেয়ে লিখিত রূপকে বেশি সহায়তা যোগাবে।
অসিরিয়ার উত্থান একটি ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। প্রতিটি করদ রাজ্যের লোকদের একজন করে জাতীয় দেবতা, এর সীমানার তত্ত্বাবধানকারী, ইয়াহওয়েহর মতো একজন ‘পবিত্রজন’ ছিলেন। রাজ্যগুলো যতদিন স্বাধীনতা বজায় রেখেছে ততদিন এই ব্যবস্থা কাজে এসেছে, কিন্তু এক এলাকার দেবতা অন্য এলাকা দখল করে নিলে, এলাইযা ও আহাব যেমনটা আবিষ্কার করেছিলেন, সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অসিরিয়া একে একে রাজ্যগুলোকে গ্রাস করে নিতে শুরু করলে দেবতাদের ভেতর ভারসাম্যও বদলে যেতে শুরু করে। অঞ্চলের অন্যান্য রাজার মতো অসিরিয় রাজা জাতীয় দেবতা আশুরের যাজক ছিলেন, তিগলাত-পিলসারের বংশ চিরকাল টিকে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ‘তুমি তাঁহার রাজকীয় নিয়তিকে ক্ষমতা দান করিয়াছ আর বলিয়াছিলে যে তাঁহার উচ্চ-বংশ চিরকাল টিকিয়া থাকিবে। আশুরের যাজক ইসরায়েল রাজ্য অধিকার করে নিলে, তাহলে কি এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা না যে আশুর ইয়াহওয়েহর চেয়েও শক্তিশালী?
৭৪০ সালে ইসায়া দিব্যদর্শন লাভ করার সময় ছোট জুদাহ রাজ্য তখনও অসিরিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো তেমন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না এবং অসিরিয়ার পশ্চিম দিকে অভিযানের বিরোধিতা করতে একটি কোয়ালিশন গড়ে তুলেছিল দামাস্কাস। জুদাহর রাজা আহাজ তাদের সঙ্গে যোগ দিতে অস্বীকার করলে তারা জেরুসালেম অবরোধের জন্যে সৈন্য পাঠিয়ে আহাজকে ক্ষমতাচ্যুত করে জুদাহর সিংহাসনে আরও আন্তরিক একজন রাজাকে বসায়। তিলগাত-পিলসারের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে অসিরিয়ার আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হওয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না আহাজের জুদাহর দীর্ঘদিনের শান্তিপূর্ণ অস্পষ্ট অস্তিত্বের অবসান ঘটেছিল; প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একে অঞ্চলের চলমান ট্র্যাজিডিতে টেনে আনা হয়েছিল। বিদ্রোহী করদ রাজ্যগুলোকে শাস্তি দিতে গিয়ে সময় নষ্ট করেননি তিলগাত-পিলসার। দামাস্কাসের উপর হামলে পড়েন তিনি, রাজা রেজিনকে হত্যা করেন এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে হামলা চালিয়ে পক্ষত্যাগ করছে বলে মনে হওয়া যেকোনও শহরকে ধ্বংস করে দেন। অবশেষে ইসরায়েলের পালা এলো। ৭৩২ সালে অসিরিয় সেনাবাহিনী গালিলি ও জেজরিল উপত্যকা দখল করে নেয়, জর্দানের পুব পারের ইসরায়েলি এলাকায় হামলা চালায়। রাতারাতি এককালের শক্তিশালী ইসরায়েল উত্তরের পাহাড়ী এলাকার একটি ক্ষুদে রাষ্ট্রাংশে পরিণত হয়, সিংহাসনে বসেন একজন পুতুল রাজ। জুদাহর লোকজন সঘৃণায় সেটা প্রত্যক্ষ করে।
কিন্তু ইসায়া উদ্বিগ্ন বোধ করেননি। ইয়াহওয়েহকে গোটা বিশ্বের রাজা হিসাবে সিংহাসনে আসীন দেখেছেন তিনি, জানতেন জেরুসালেম নিরাপদ থাকবে। আমোস ও হোসেয়ার চেয়ে এক ভিন্ন ধর্মীয় জগতের মানুষ ছিলেন তিনি, উত্তরের রাজ্যে কাজ করেছিলেন। কখনওই মিশর থেকে যাত্রার কথা বা মরুভূমিতে দীর্ঘ বছর ধরে ঘুরে বেড়ানোর কথা উল্লেখ করেননি। জুদাহর রাজ দরবার এইসব উত্তরাঞ্চলীয় ঐতিহ্যে স্বস্তির খোঁজ করেনি, বরং রাজা ডেভিডের সঙ্গে ইয়াহওয়েহর সম্পাদিত চিরন্তন কোভেন্যান্ট ও জেরুসালেম মন্দিরের ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করেছে। ইয়াহওয়েহ ছিলেন জেরুসালেমের রাজা, ডেভিডিয় রাজা তাঁর পার্থিব প্রতিভূ। ইয়াহওয়েহ যতদিন জেরুসালেমে শাসন করে যাবেন—ইসায়া নিজের চোখে তাঁকে সেটা করতে দেখেছেন—এই নগরী কখনওই হাতছাড়া হবে না:
ঈশ্বর তাহার মধ্যবর্তী,
তাহা বিচলিত হইবে না;
প্রভাতেই ঈশ্বর তাহার সাহায্যে করিবেন।
জাতিগণ গৰ্জ্জন করিল, রাজ্য সকল বিচলিত হইল;
তিনি আপন রব ছাড়িলেন,
পৃথিবী গলিয়া গেল। ৪২
জুদাহর জনগণকে অবশ্যই কেবল ইয়াহওয়েহর উপর বিশ্বাস রাখতে হবে; অস্ত্র ও কূটনীতি নিয়ে অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিল বলেই উত্তরে রাজ্যের পতন ঘটেছে। জেরুসালেম দরিদ্রদের পক্ষে আশ্রয় ছিল, তাই এর জনগণকে অবশ্যই সম্পদ ও সামরিক শক্তির বদলে কেবল ইয়াহওয়েহর উপরই আস্থা রাখতে হবে।
ইসায়া জনগণকে বলেছেন যে, স্বর্গীয় যোদ্ধা আরও একবার যুদ্ধে নেমেছেন- আপন জাতির পক্ষে যুদ্ধ করছেন। জুদাহর অসিরিয়াকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, স্রেফ ইয়াহওয়েহর উপায় মাত্র সেটা, ‘সে আমার ক্রোধের দণ্ড! সে সেই যষ্টি, যাহার হস্তে আমার কোপ। ইয়াহওয়েহর তাঁর জাতির সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রাচীন ইমেজ জাগিয়ে তুলেছেন ইসায়া, যেখানে তাদের শত্রুরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। ‘সদাপ্রভুর ভয়ানকত্ব প্রযুক্ত ও তাঁহার মহিমার আদরণীয়তা প্রযুক্ত,’ যখন তিনি ভূমিকম্প ঘটাতে উত্থিত হন,
সামান্য লোকের উচ্চ দৃষ্টি অবনত হইবে,
মান্য লোকদের গর্ব্ব খৰ্ব্ব হইবে,
আর সেইদিন কেবল সদাপ্রভূই উন্নত হইবেন।
বস্তুতঃ যাহা কিছু গৰ্ব্বিত ও উদ্ধৃত এবং
যাহা কিছু উচ্চীকৃত, সেই সমস্তের প্রতিকূলে
বাহিনীগণের সদাপ্রভুর দিন আসিতেছে;
সে সকল নত হইবে।৪৬
শুধু জাতীয় দেবতা নন, বরং ইতিহাসের দেবতায় পরিণত হচ্ছিলেন ইয়াহওয়েহ। তবে ইয়াহওয়েহর এই উন্নতি আগ্রাসীও ছিল। পরাশক্তির মতো আচরণ করছিলেন তিনি, শত্রুদের বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করার ভেতর দিয়ে অঞ্চলে শান্তি বয়ে আনছিল যা :
তিনি পৃথিবীর প্রান্ত পর্য্যন্ত যুদ্ধ নিবৃত্ত করেন,
তিনি ধনু ভঙ্গ করেন, বড়শা খণ্ড খণ্ড করে,
তিনি রথসকল আগুনে পোড়াইয়া দেন।৪৭
অন্যান্য জাতি ইয়াহওয়েহর রাজত্ব মেনে নিতে বাধ্য হবে এবং তাদের তলোয়ারকে লাঙ্গলের ফলা আর বর্শাকে কাস্তেতে পরিণত করবে। ৪৮
চূড়ান্ত বিজয় লাভের জন্যে আহাজের পার্থিব রাজনীতিকে কাজে লাগানো উচিত হবে না, বরং কেবল ইয়াহওয়েহর প্রতিই আস্থা স্থাপন করতে হবে। যায়ন কাল্টে জেরুসালেম ‘দরিদ্রদের’ শহর ছিল। কিন্তু দারিদ্র্য বস্তুগত বঞ্চনা বোঝায়নি। ‘দরিদ্র্যের’ বিপরীত ‘ধনী’ ছিল না, বরং ছিল ‘গর্ব। যায়ন পাহাড় বেয়ে মন্দিরের দিকে ওঠার সময় লোকে এই শ্লোক গাইত :
সদাপ্রভু, আমার চিত্ত গৰ্ব্বিত নয়,
আমার দৃষ্টি উচ্চ নয়,
আমি ব্যাপৃত হই নাই মহৎ বিষয়ে,
আমার বোধের অতীত আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য বিষয়ে,
আমি আপন প্রাণকে শান্ত দাস্ত করিয়াছি,
সেই শিশুর ন্যায়, যে স্তন্য ছাড়িয়া আমার সঙ্গে আছে,
আমার প্রাণ ত্যক্ত স্তন্যশিশুর ন্যায় আমার সঙ্গে আছে।
হে ইস্রায়েল, সদাপ্রভুতে প্রত্যাশা কর
এখন অবধি অনন্তকাল পর্যন্ত। ৪৯
ইসায়া এবার আহাজকে বললেন যে মানবীয় শক্তি, বিদেশী মৈত্রী বা সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের উপর নির্ভর করা উচিত হবে না তাঁর, নির্ভর করতে হবে ইয়াহওয়েহর উপর। কেবল মানবীয় সেনাদল ও দুর্গের উপর নির্ভর করে থাকা বহুঈশ্বরবাদীতা। কেবল ইয়াহওয়েহর উপর এই নির্ভরতা ইয়াহওয়েহকে এককভাবে উপাসনা করার উত্তরের কান্টিক আন্দোলনের জুদাহ ভাষ্য ছিল। বিনয় ও আত্মসমর্পণের প্রতি ইসায়ার জোর দেওয়াকে প্রথমে কেনোসিসের অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতার অনুরূপ বলে মনে হয়। কিন্তু তারপরেও ইতিহাসের এক সংকট মুহূর্তে জুদাহর জাতীয় গর্বকে তা স্ফীত করে তুলেছিল। ইয়াহওয়েহ কেবল ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষক দেবতা নন, বরং অন্য জাতির দেবতাদেরও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, ইসায়ার বিপ্লবী এই ধারণা উদ্ধত দেশপ্রেমের উপর নির্ভরশীল ছিল। নানাভাবে প্রাচীন প্রথাগত বিশ্বের মানুষ ছিলেন ইসায়া। সেই কালের আগ্রাসী রাজনীতিকে সমর্থন ও আত্মীকরণ করা এক সহিংস, বৈরী দর্শন প্রচার করেছেন তিনি। এটা আবার আবিশ্যিকভাবে জাদুকরী ধর্মতত্ত্বও ছিল, স্বর্গীয় ক্ষমতাই জেরুসালেমকে অপরাজেয় করে তুলেছে বলে লোকজনকে বিশ্বাস করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। কেবল ইয়াহওয়েহর উপর ভরসা করা বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে খুবই বিপজ্জনক ভিত্তি হিসাবে প্রমাণিত হবে।
উত্তরের রাজ্য সবকিছু ইয়াহওয়েহর হাতে ছেড়ে দিতে চায়নি। ৭২৪ সালে তিলগাত-পিলসার মারা গেলে এক প্রতিরোধ আন্দোলনে অন্যান্য করদ রাজ্যের সঙ্গে যোগ দেন ইসরায়েলের রাজা হোশিয়া, খাজনা দিতে অস্বীকার করেন এবং সমর্থনের জন্যে মিশরের কাছে আবেদন জানান। সঙ্গে সঙ্গে অসিরিয় রাজা পঞ্চম শালমানেসার হোশিয়াকে কারাবন্দি করেন, সামারিয়াকে অবরোধ করে ফেলেন। ৭২২ সালে পতন ঘটে শহরের, শাসক শ্রেণীকে অসিরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয় ও নতুন বসতি স্থাপনকারীদের অসিরিয় বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী এলাকাকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত করা হয়। এবার দুটি সরকারি ইয়াহওয়েহ ঐতিহ্যের বদলে একটায় পণিত হয়। অসিরিয় অভিযানের পর কিছু পরিমাণ স্বাধীনতা বজায় রাখা অল্প কটি দেশের একটি ছিল জুদাহ। প্রত্নতাত্ত্বিক নথি দেখায় যে, অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে জেরুসালেম নাটকীয়ভাবে বিস্তার পাচ্ছিল।° উত্তর থেকে আসা ইসরায়েলি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্যে নতুন নতুন বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছিল। মাত্র কয়েক বছরের ভেতরই জেরুসালেম মাঝারি আয়তনের দশ থেকে বার একর এলাকার শহর থেকে ১৫০ একরের নিবিড় বাড়িঘর আর সরকারি দালানকোঠার নগরে পরিণত হয়েছিল। নগরের আশপাশের পল্লী এলাকাও ভালোভাবে উন্নত হয়ে উঠেছিল।
শরণার্থীরা সম্ভবত তাদের সঙ্গে ৭২২ সালের বিপর্যয়ের আগাম ভবিষ্যদ্বাণী কারী আমোস ও হোসেয়ার ভবিষ্যদ্বাণীসহ নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে এসেছিল। ইসরায়েল রাজ্যের ধ্বংস ছিল বেদনাদায়ক সাম্প্রতিক স্মৃতি, এই সময় উত্তরের ঐতিহ্যগুলোকে সংরক্ষণের একটা আকাঙ্ক্ষা কাজ করছিল। এলাকার অন্যান্য রাজার মতো জুদাহর রাজারা একটি রাজকীয় লাইব্রেরি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন এবং সম্ভবত সেই সময় নাগাদ একটি একক টেক্সটে পরিণত হওয়া J ও E-কে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইসরায়েলের অবশিষ্টাংশের সঙ্গে বিদ্রোহী জুদাহ রাজ্যকে একীভূত করে ডেভিড ও সলোমনের ঐক্যবদ্ধ রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা কাজ করছিল।
৭১৫ সালে সিংহাসনে আসীন রাজা হেযেকিয়ার সংস্কারে এই জিনিসটি প্রতিফলিত হয়েছে।৫১ আমাদের হাতে সমসাময়িক কোনও বিবরণ নেই, তবে কেবল জেরুসালেম মন্দিরে উপাসনার অনুমতি দিয়ে আচরিক উপাসনাগৃহগুলো ধ্বংস করে হেযেকিয়া কাল্টকে কেন্দ্রিভূত করতে চেয়েছিলেন বলে বাইবেলিয় ঐতিহ্য ইঙ্গিত দেয়। সংস্কার ছিল স্বল্পায়ুর, প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে, সাধারণ মানুষ অন্যান্য দেবতার উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল, কিন্তু তাঁর ধর্মীয় সংস্কারের কারণে বাইবেলিয় ইতিহাসবিদরা হেযেকিয়াকে জুদাহর অন্যতম মহান রাজা হিসাবে স্মরণ করেন। অবশ্য তাঁর বিদেশ নীতি বিপর্যয়কর ছিল। ৭০৫ সালে অসাধারণ অসিরিয় রাজা দ্বিতীয় সারগন তাঁর অপরীক্ষিত ছেলে সেনাচেরিবকে উত্তরাধিকারী হিসাবে রেখে মারা যান। পরবর্তী উত্তাল পরিস্থিতিতে যখন দেখা গেল অসিরিয়া হয়তো প্রান্তিক অঞ্চলগুলোকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না, বোকার মতো এক অসিরিয় বিরোধী কোয়ালিশনে যোগ দিয়ে জেরুসালেমকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করেন হেযেকিয়া। ৭০১ সালে এক ভয়ঙ্কর সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সেন্নাচেরিব জেরুসালেমে পৌঁছান এবং পদ্ধতিগতভাবে পল্লী অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালাতে শুরু করেন। অবশেষে তাঁর সৈন্যরা খোদ জেরুসালেমকেই ঘিরে ফেলে। মনে হয়েছিল বুঝি নগর হয়তো টিকবে না, কিন্তু শেষমুহূর্তে বিলম্ব হলো। বাইবেলিয় লেখকরা আমাদের বলছেন যে, ‘পরে সেই রাত্রিতে সদাপ্রভুর দূত যাত্রা করিয়া অশূরীয়দের শিবিরে এক লক্ষ পঁচাশি হাজার লোককে বধ করিলেন এবং প্রত্যুষে লোকেরা উঠিল, আর দেখ সমস্তই মৃতদেহ। অতএব অশূর রাজ সনহেরিব ত্যাগ করিলেন। ৫২ কি ঘটেছিল তার কোনও ধারণা নেই আমাদের। অসিরিয় সেনাবাহিনীর ভেতর সহসা প্লেগের আক্রমণ হয়ে থাকতে পারে, এবং আপাত অলৌকিক মুক্তি জেরুসালেম প্রকৃতই অপরাজেয় হওয়ার ইতিবাচক প্রমাণ মনে হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা জুদাহর আশপাশের এলাকায় যেধরনের ধ্বংসলীলার প্রমাণ আবিষ্কার করেছেন সেটা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। জুদাহর দ্বিতীয় নগরী লাচিশকে ভূমিস্যাৎ করে ফেলা হয়েছিল: পনের শো পুরুষ, নারী ও শিশুকে গণকবর দেওয়া হয়। একটি সমৃদ্ধ রাজ্য লাভ করেছিলেন হেযেকিয়া, কিন্তু তাঁর অপ্রাজ্ঞ বিদেশ নীতি কেবল একটি ছোট নগর-রাষ্ট্র জেরুসালেম দিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। দেশপ্রেমমূলক আহঙ্কার ও অন্ধস্বদেশভক্তিমূলক ধর্মতত্ত্ব একটি জাতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। অষ্টম শতাব্দী গ্রিসের পক্ষে এক বিস্ময়কর সময় ছিল। লক্ষণীয় স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গ্রিকরা অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে এসে তাদের অনন্য সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ওদের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে, যেমন জুদাহর চলছিল শনির দশা। এজিয়ানের দিকে অসিরিয়দের কোনও আগ্রহ ছিল না, ফলে কোনওরকম সামরিক আগ্রাসনের হুমকি ছাড়াই গ্রিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলতে পেরেছিল। পুবের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে তারা ও বিদেশীদের কাছ থেকে শিখতে উন্মুখ ছিল। তাদের রাজনীতি বিপ্লবাত্মক ও উদ্ভাবনীতে পরিণত হয়েছিল, বিভিন্ন ধরনের সরকার পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিল তারা, কিন্তু সেটা তাদের ধর্মকে স্পর্শ করেনি। ইহুদি পয়গম্বররা যখন একেশ্বরবাদ অর্থাৎ, একমাত্র ঈশ্বরের উপাসনার প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, এমন একটা সময়ে গ্রিকরা গোঁড়া বহুদেবতার পূজারিতে পরিণত হয়। ধর্মের প্রাচীন ধরন থেকে সরে যাওয়ার বদলে গ্রিকরা আরও বেশি করে পদ্ধতিগতভাবে ঐতিহ্যপন্থী হয়ে উঠছিল।
ছোট, স্বাধীন নগর-রাষ্ট্র পোলিস-এর পত্তন ছিল অষ্টম শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, নাগরিকরা যেখানে স্ব-শাসনের কৌশল শিখেছিল। অন্ধকার যুগের পর পুরোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ফলে একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করতে পেরেছিল গ্রিকরা।৫৪ অষ্টম শতাব্দী কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনে সক্ষম করে তোলা জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধি ও কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি প্রত্যক্ষ করে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফসলি জমিন পাহারা দেওয়ার জন্যে তাদের প্রয়োজন ছিল নিরাপত্তা ও কোনও ধরনের সামাজিক সংগঠন। এই সময় গ্রিকরা তাদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন বাণিজ্যের জন্যে কাজে লাগাতে পারছিল, বিভিন্ন নাগরিক প্রকল্পে অর্থ যোগান দিতে পারছিল এবং গোড়া থেকেই গোটা জনগোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারছিল।৫৫ শতাব্দীর শেষদিকে গোটা হেলেনিক বিশ্বে পোলিসগুলো প্রতিষ্ঠা লাভ করে, সবগুলোরই লক্ষণীয় মিল ছিল। পোলিসের নগর-প্রাচীর, একটি মন্দির, একটি সমাবেশস্থল আর বন্দর থাকা অনিবার্য ছিল।৫৬ অর্থনীতি যার উপর নির্ভরশীল ছিল সেই পল্লী অঞ্চল ও সামাজিক পরিচয়ের মূল নগর-কেন্দ্রের ভেতর কোনও পার্থক্য ছিল না। কৃষক সমাজ ও নগরবাসীদের সমান অধিকার ও দায়দায়িত্ব ছিল, একই সরকারি সংসদে আসন গ্রহণ করত তারা। সকল নাগরিকই সরকারি ভবন আর প্রতিটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত উন্মুক্ত স্থান আগোরা ব্যবহার করতে পারত, এখানে ব্যবসা এবং আলাপ-আলোচনা করতে পারত তারা। প্রতিটি নগরেরই নিজস্ব পৃষ্ঠপোষক দেবতা ছিলেন, প্রত্যেক নাগরিককে একসূত্রে গাঁথতে সাহায্য করা ভিন্ন ভিন্ন উৎসর্গ ও উৎসবের বিকাশ ঘটিয়েছিল।
পোলিস সাম্যবাদী সমাজ ছিল। একেবারে গোড়া থেকেই কৃষকরা প্রাচীন অভিজাত সমাজের ব্যাপারে দারুণ সমালোচনামুখর ছিল এবং অধীনস্থের ভূমিকা মেনে নিতে অস্বীকার গেছে। প্রত্যেকেই দাস ও নারীরা ছাড়া-নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা রাখত। পোলিস প্রকটভাবে পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল। অন্ধকার যুগে নারীরা আরও উন্নত অবস্থানে ছিল, কিন্তু নতুন গড়ে ওঠা শহরে প্রান্তিকায়িত হয় তারা, বিচ্ছিন্ন পল্লী এলাকার পারিবারিক বাসস্থানে আলাদা হয়ে যায়, পথেঘাটে খুব কমই দেখা যেত তাদের। দাস হত্যারও বিস্তার ঘটেছিল। বেশির ভাগ নাগরিকেরই নিজস্ব জমি-জিরাত ছিল, অন্যের জন্যে কাজ করা বা দাসত্বকে অপমানকর বলে মনে করা হতো। প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্যে রাজাদের নাগরিক স্বাধীনতাকে সীমিত করতে হয়েছিল। কিন্তু গ্রিক কৃষক সমাজ প্রচলিত স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে অস্বীকার গেছে। অভিজাত গোষ্ঠী স্থানীয় শাসককূলের কোনও একজন অধিরাজের বশ্যতা স্বীকারের প্রয়োজন হয় এমন বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ে তোলার বদলে স্বায়ত্বশাসিত নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বাধীনতার এই আদর্শ গ্রিকদের আবিষ্কার ছিল না। গ্রিকরা সম্ভবত অন্যান্য জাতি তাদের বৃহৎ রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সময় ত্যাগ করা প্রাচীন গোত্রীয় সমাবেশ ও পরিষদ সংরক্ষণ করেছিল ৫৭
হোমারের মহাকাব্যগুলোতে আমরা যেমন দেখি, অষ্টম শতাব্দীর একজন অভিজাতের জন্যে সাধারণ মানুষের সামনে বক্তব্য রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৫৮ মাইসিয়ান আমলে রাজা ছিলেন স্রেফ আলঙ্কারিক প্রধান, জমিদারদের পরামর্শ শুনতে হতো তাঁকে। পোলিসগুলোতে সরকারি নীতি সংক্রান্ত আলোচনা অব্যাহত ছিল এবং কৃষকরা সরকারে অংশ নিত বলে তারাও বিতর্কের কৌশল রপ্ত করেছিল। যত সামান্য পর্যায়েই হোক না কেন, বাস্তব বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় প্রত্যেককেই ন্যায় বিচার ও নৈতিকতরা বিমূর্ত নীতিমালা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করা হতো। কৃষকরা অনেকটা অভিজাত গোষ্ঠীর মতোই হয়ে উঠছিল; পোলিসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল যে নাগরিকদের সবাই ক্রমে প্রাচীন অভিজাত রীতিনীতি রপ্ত করে নিত।৫৯
বিতর্ক ছিল যুদ্ধ (অ্যাগন), বিভিন্ন বক্তার ভেতর প্রতিযোগিতা, সেরা যুক্তিদাতাই বিজয়ী হতো। গ্রিকরা কোনও কোনও বৈদিক ভারতীয়দের বিসর্জন দিতে চলা প্রতিযোগিতার প্রতি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপিয় আবেগ ধরে রেখেছিল। অ্যাগন ছিল জীবনের বিধি, বিপরীত দিক থেকে অভিজাত গোষ্ঠী পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে এক ধরনের সংহতির বোধ অর্জন করেছিল। এখন গোটা পোলিসই অভিজাত, যোদ্ধা সমাজে পরিণত হতে চলছিল বলে কৃষকরাও এই যুদ্ধংদেহী চেতনা অর্জন করতে শুরু করেছিল। হোমার দেখাচ্ছেন যে, গ্রিক যুদ্ধবাজরা অন্যের ক্ষতি করে হলেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে তাড়িত ছিল। প্রত্যেক জমিদার তার নিজের ব্যক্তিগত নিয়তি বাস্তবায়ন করতে চাইতেন বলে এস্পিরিট দে কোর বলে কিছু ছিল না। সবাই অনন্য হবে, এই প্রত্যাশা করা হতো এবং এর মানে ছিল সমস্ত কর্মকাণ্ডকে অনুপ্রাণিতকারী একত্ব লাভের যুদ্ধে একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। সুতরাং, আত্ম-সমর্পণের বদলে পোলিসে দারু অহমবাদ ছিল। এক ধরনের সহজাত আগ্রাসী মনোভাবও ছিল। পোলিসগুলোর সৃষ্টি অনেক সময় সহিংস ছিল। প্রতিবেশী ও শত্রুদের প্রতিহত করতে পারবে এমন পরিষদগুলো সবসময় শান্তিপূর্ণ ছিল না। প্রায়শঃই গ্রামের সম্প্রদায়গুলোকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পোলিসে যোগ দিতে বাধ্য করা হতো। ‘ঐক্যবদ্ধকরণ’(সিনোইসিজম)-এর মানে ছিল উৎখাত, প্রতিরোধ ও উল্লেখযোগ্য দুর্ভোগ-পোলিসগুলোর প্রতিষ্ঠার মিথে প্রতিফলিত এক ধরনের প্রসব বেদনা। ১ নগর লোকজনকে কাছাকাছি টেনে আনত, কিন্তু প্রায়শঃই দারুণ সহিংসভাবে তা অর্জিত হতো। প্রতিটি পোলিসকে ক্ষমতা ও সম্পদের জন্যে অবশ্যই ক্রমাগত অন্যান্য পোলিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো।
কিন্তু গ্রিকরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য নিয়ে গর্বিত ছিল, প্যানহেলিনিক উৎসব ও প্রতিষ্ঠানে এর উদযাপন করত। অন্যতম বিখ্যাত অনুষ্ঠান ছিল ৭৭৬ সালে প্রথম নথিবদ্ধ করা সারা গ্রিসের সমস্ত অভিজাতদের অংশ নেওয়া অলিম্পিয়ার অ্যাথলিটিক প্রতিযোগিতা। খেলায় প্রতিযোগিতা করা ছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড: আপনার পোলিসকে তা মানচিত্রে স্থাপন করত; এবং একজন অলিম্পিক বিজয়ী বাড়ি ফেরার পর কিংবদন্তীসুলভ খ্যাতি অর্জন করত। কিন্তু অন্য সব গ্রিক বিষয়ের মতো খেলারও রহস্যময়, থোনিয় বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রাচীনতম অ্যাথলিটিক প্রতিযোগিতাগুলো কোনও এক মহান যোদ্ধার অন্তেষ্টির সময় অনুষ্ঠিত হতো।৬২ শোককারীদের দেখানো অসাধারণ শারীরিক কসরৎ ছিল মৃত্যুর উপস্থিতিতে জীবনের স্পর্ধিত নিশ্চয়তা, এবং শোকার্তদের ক্রোধ, হতাশা আর দুঃখ তুলে ধরত। শেষপর্যন্ত এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা স্থানীয় বীরের সম্মানে কোনও স্যাংকচুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া একটি ধর্মীয় আচারে পরিণত হয়। পোসাইদনের কিংবদন্তী প্রেমিক পেলোপসের সম্মানে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হতো, তিনিও মহান অ্যাথলিট ছিলেন।
অলিম্পিয়ায় অ্যাথলিটরা স্রেফ ব্যক্তিগত নামডাকের খাতিরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন না, বরং মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে এক ধরনের প্রতীকী পরিবর্তনের পালা শেষ করতেন। ৬৩ স্টেডিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে পৃথিবীর গভীরে নেমে যাওয়া একটি অন্ধকার গহ্বর ছিল পেলোপসের সমাধি। পুবের অসংখ্য উৎসর্গের চিতার অবশেষ মাটি আর ছাইয়ের এক বিশাল স্তূপ যিউসের বেদীর মুখোমুখি থাকত সেটা। দেবতা ও বীর ছিলেন দিন আর রাতের মতো, জীবন আর মৃত্যুর মতো। প্রতিযোগিতার আগের রাতে অ্যাথলিটরা পেলোপসের আঙিনায় ভেড়া উৎসর্গ করত, চথোনানিয়ান গহ্বরে রক্ত ঢেলে দিত তারা। পরদিন সকালে পেলোপসের সমাধি থেকে যিউসের বেদীর চূড়ায় উদীয়মান সূর্যের দিকে, মৃত্যু ও রক্তাক্ত উৎসর্গ থেকে দূরে শুদ্ধকারী আগুনের দিকে দৌড়ে যেত তারা। পেলোপসের মতো অলিম্পিয়ান চ্যাম্পিয়ন শেষপর্যন্ত মারা যাবে, কিন্তু অ্যাগনে তার বিজয় বিজয়ীকে মহিমা (ক্লিওস) দান করত, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলোর স্মৃতিতে জেগে থাকবে।
বীরের প্রথা গ্রিক ধর্মে অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। মরণশীল বীর ছিল অমর দেবতাদের চুথোনিয়ান প্রতিরূপ। অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ বেশির ভাগ পোলিসে কোনও অসাধারণ যোদ্ধার সমাধি একটি সম্মানের জায়গা দখল করে নিয়েছিল। বীরের যুগের মরণশীলদের একটি উন্নত জাতির সার্বক্ষণিক স্মারক এই বীর একজন নর দেবতার মতোই পূজিত হতো। মারা যাওয়ায় এখন পৃথিবীর গভীরে এক ছায়াসুলভ জীবন কাটাচ্ছে সে, কিন্তু তার আত্মা এখনও সম্প্রদায়ে সক্রিয় রয়েছে; তাকে এমন অসাধারণ করে তোলা সমস্ত গুণ এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু তার মৃত্যু বীরকে ক্রোধে ভরে তুলেছে, এক অপ্রত্যাশিত অস্বস্তিকর আভা উৎসারিত হচ্ছে তার কবর থেকে, লোকে একে শ্রদ্ধা মেশানো নীরবতায় পাশ কাটিয়ে যায়। অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ার বাসিন্দা দেবতাদের বিপরীতে মরণশীল বীর ছিল একেবারে হাতের কাছে। তার ক্রোধকে প্রশমিত করতে আর সাহায্য পেতে তার সমাধির আচারগুলোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। উপাসকরা কেনওরকম পুষ্পাঞ্জলি ছাড়াই অগোছাল, অবিন্যস্ত চুলে তার সমাধিতে যেত, কিন্তু তারপরেও প্রতিটি পোলিস এর বিশেষ গুণকে তুলে ধরা তার বীরকে নিয়ে গর্বিত ছিল। প্রায়শঃই পৃষ্ঠপোষক দেবতার মন্দিরের পাশেই এর অন্ধকার চথোনিয়ান সম্পূরক হিসাবে তার সমাধি স্থাপন করা হতো।
অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে দেলফিতে নির্মিত একটি স্যাংকচুয়ারি, কবিতা ও সঙ্গীতের দেবতা অ্যাপোলোর আনন্দমুখর কাল্টকে কাঠের ঘোড়ায় চেপে ট্রয় নগরীতে প্রবেশ করা অন্যতম যোদ্ধা অ্যাকিলিসের ছেলে পিরথাসের করুণ স্মৃতিতে সমতা বিধান করা হয়েছে। কথিত আছে, যুদ্ধের পর অ্যাপোলোর কাছে বিচার দাবি করতে দেলফিতে প্রবেশ করেছিলেন পিরথাস, বাবার মৃত্যুর জন্যে তাঁকেই দায়ী করেছিলেন তিনি, কিন্তু কোনও উৎসর্গের মাংস নিয়ে বিবাদে লিপ্ত মন্দির সেবকরা তাঁকে পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের পাশে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। মন্দিরের চৌকাঠের নিচে কবর দেওয়া হয় তাঁকে। দেলফির উৎসর্গের আচার তাঁর মৃত্যুর সহিংসতা তুলে ধরেছে। শিকার নিহত হওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ছুরি হাতে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকত। পশু মারা যাওয়ামাত্র সামনে বেড়ে উন্মত্তের মতো যে যতটুকু পারে মাংস কেড়ে নিত, প্রায়শঃই পুরোহিতের জন্যে একটুকরো মাংসও থাকত না। পোলিসের সভ্য মূল্যবোধের লঙ্ঘন উৎসর্গের বন্যতা শৃঙ্খলা ও মিতাচারের দেবতা অ্যাপোলোর আলোকিত কাল্টের ভয়ঙ্কর প্রতিরূপ গড়ে তুলেছে।
দেলফিতে এক দানবীয় মাদী ড্রাগনের সঙ্গে লড়াই করে সেটাকে হত্যা করেছিলেন অ্যাপোলো, চথোনিয়ান শক্তির বিরুদ্ধে অলিম্পিয়ানদের বিজয়কে প্রতীকায়িত করা বিজয়। ড্রাগনকে পাইথন বলেছিলেন তিনি, কারণ ওটার শব পৃথিবীতে (পিথিয়েন) পচে গিয়েছিল। পরে তাঁর স্মরণে পিথিয়ান ক্রীড়া চালু করেন, আর সমস্ত গ্রিক বিশ্ব থেকে লোকজন অ্যাপোলোর দৈবজ্ঞা পিথিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করতে হাজির হতো।৬৬ পবিত্র অন্দর মহলে পবিত্র আগুনের পাশে একটি তেপায়ার উপর বসতেন তিনি। অ্যাপোলোর প্রভাবে যন্ত্রণায় কেঁপে উঠতেন, কিংবা এমনকি আর্তনাদ করে অনুপ্রাণিত বাণী উচ্চারণ করতেন, কিন্তু আসলে তাঁর পরামর্শ প্রায়শঃই নেহাতই বাস্তব ও যুক্তিযুক্ত ছিল।
বেশির ভাগ অন্যান্য উপাসনালয়ের বিপরীতে দেলফি কোনও পোলিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না, বরং চাষযোগ্য জমি থেকে বেশ দূরে খাড়া পাহাড়ের উপর বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল সেটা। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে বরং অন্তর্দৃষ্টির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল এটা। দেলফির নিজস্ব কোনও এজেন্ডা ছিল না, এবং তা আগোরায়-’উন্মুক্ত স্থান’-পরিণত হয়েছিল যেখানে আবেদনকারী ও তীর্থযাত্রীরা বেশিরভাগ পোলিসের ক্ষেত্রেই একরকম বলে আবিষ্কার করা বিভিন্ন সমস্যা আর আদর্শ নিয়ে আলোচনা করতে মিলিত হতে পারত। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি শুরু হওয়া উপনিবেশীকরণের নতুন ধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল দেলফি।৬৭ বাড়ি ছাড়ার আগে উপনিবেশবাদীরা প্রায়শঃই পিথিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করত, তাদের একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সাহায্য করতেন তিনি। শতাব্দীর শেষ নাগাদ গোটা এজিয়ান জুড়ে নতুন নতুন গ্রিক বসতি গড়ে উঠেছিল। আবার জেগে উঠছিল গ্রিস। উদীয়মান উত্তেজনা ছিল, এক ধরনের আবিষ্কার, বাণিজ্য, প্রসারিত দিগন্তের বোধ, নতুন নতুন সম্ভাবনা আর বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রেরণা কাজ করছিল।
বাণিজ্য বৃদ্ধি পুবের সঙ্গে নতুন নতুন চুক্তি সম্পাদনে সাহায্য করেছে। গ্রিক বণিকরা মধ্যপ্রাচ্যে সফর করেছে, অসিরিয় আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট শরণার্থীরা গ্রিক পোলিসগুলোয় অভিবাসন করেছে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে নতুন দক্ষতা আর শিল্প। গ্রিকরা নিজেদের ব্যবহারের জন্যে ফোনেশিয় লিপি আত্মস্থঃ করে, এভাবে ইউফ্রেতিস থেকে ইতালি অবধি বিস্তৃত অঞ্চলের নতুন সাহিত্যিক সংস্কৃতিতে অংশ গ্রহণে সক্ষম হয়ে ওঠে তারা। পুবের ধর্মীয় ধারণারও আমদানি ঘটিয়েছিল গ্রিকরা। অষ্টম শতাব্দীতে দেবতার প্রতিমা স্থাপনের জন্যে নিকট প্রাচ্যের আদলে বড় আকারের মন্দির বানাতে শুরু করেছিল তারা। পিথিয়ার কাল্ট হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের নিগূঢ় ভবিষ্যদ্বাণী প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। পাতাল রাজ্য সংক্রান্ত কবিদের বিবরণ মেসোপোটেমিয় মৃতের জগতের সঙ্গে মিলে যেতে শুরু করেছিল। তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় বেশ কয়েকজন দেবতা হয়তো পুব থেকে এসে থাকতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ, সকল গ্রিক দেবদেবীর ভেতর সবচেয়ে প্রতীকীভাবে গ্রিক হয়ে ওঠা দেবতা অ্যাপোলো আসলে এশিয়া মাইনর থেকে আগত। গ্রিকরা সম্ভবত সাইপ্রাস দ্বীপে মধ্যপ্রাচ্যীয় দেবতা ইস্তারের দেখা পেয়েছিল এবং তাদের নিজেদের দেবনিচয়ে তাঁকে ভালোবাসা ও উর্বরতার দেবী আফ্রোদাইত হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। আফ্রোদাইতের প্রেমিক অ্যাদোনিসের করুণ চরিত্র প্রায় নিশ্চিতভাবেই কৃষি দেবতা তাম্মুয, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নারীরা যার মৃত্যুতে প্রবলভাবে শোক প্ৰকাশ করে এবং তাঁকে আদোম-’প্রভু!’৬৯—সম্বোধন করে থাকে।
কিন্তু হোমারের মতো আর কারওই গ্রিক ধর্মের উপর গঠনমূলক প্রভাব ছিল না। অষ্টম শতাব্দীর শেষদিকে মৌখিকভাবে প্রচারিত ঐতিহ্যকে লিখিত রূপ দিয়েছিলেন হোমার, মোটামুটি যে সময় J E কাহিনী জেরুসালেমে একত্রিত করা হচ্ছিল। শত শত বছর ধরে চারণ কবিরা এইসব প্রাচীন কাহিনী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বিভিন্ন উৎসবে আবৃত্তি করে এসেছে: হোমারের কাল আসতে আসতে এগুলোর কোনও কোনওটা হাজার বছরেরও পুরোনো হয়ে গিয়ে থাকবে।” তাঁর দুটি কাব্য- ইলিয়াড ও অডিসি-আরও বৃহত্তর মহাকাব্যিক চক্রের খুবই সামান্য অংশ সংরক্ষণ করেছে; ট্রোজান যুদ্ধ নিয়ে অন্তত পক্ষে আটটি কাব্য থাকতে পারে। আবার অন্যান্য মহাকাব্যিক গাথাও আছে: একটি থেবসের রাজা ঈদিপাসের ইতিহাস ও তাঁর দুর্ভাগা পরিবারের সুলুক সন্ধান করেছে; অন্য একটি হেরাক্লিয়াসের রোমাঞ্চকর অভিযানের বিবরণ দিয়েছে; এবং তৃতীয় একটি সোনালি পশমের খোঁজে জেসনের অভিযানের বর্ণনা দিয়েছে।
এইসব প্রাচীন মহাকাব্য শত শত বছরের পরিক্রমায় পরিবর্তিত ও উন্নত হয়েছে, কিন্তু একবার লিখিত হয়ে যাওয়ার পর ইলিয়াড ও অডিসি অনন্তকালের জন্যে স্থির হয়ে গেছে। অন্য সব মহাকাব্যের মতো এগুলো বেশ কিছু খুবই প্রাচীন উপাদান ব্যবহার করলেও সেগুলো হোমারের আমলের অবস্থাও তুলে ধরেছে। পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে জীবন যাপন করেছিলেন তিনি। অন্ধকার যুগের পর গ্রিসে আবির্ভূত হতে চলা নতুন সভ্যতা মাত্র দু-এক প্রজন্মের পুরোনো ছিল। মাইসিয়ান আমলের শেষদিকে ট্রোজান যুদ্ধের (সি. ১২০০) পটভূমিকায় হোমারের দীর্ঘ বর্ণনামূলক কবিতা প্রাচীন সংস্কৃতিতে নতুন সংস্কৃতিকে স্থাপন করেছে। ‘হোমার’ একজন নাকি দুজন কবি ছিলেন-নাকি এমনকি দুটো ভিন্ন কাব্য কৌশলের অনুসারী-আমরা কোনওদিনই হয়তো জানতে পারব না; কিন্তু তাঁর প্রভাব নিয়ে বাড়িয়ে বলা অসম্ভব। এগুলোর আদর্শ ও মূল্যবোধ হেলেনিক সংস্কৃতির উপর অনেপনীয় প্রভাব রেখে গেছে বলে ইলিয়াড ও অডিসিকে গ্রিক বাইবেল আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ট্রোজান যুদ্ধের একটি ছোট ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে ইলিয়াড মাইসিনার রাজা ও গ্রিক সেনাবাহিনীর নেতা আগামেনন এবং এর একটি অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক অ্যাকিলিসের মধ্যে ঝগড়া, অহমের তিক্ত বিরোধের কথা। তাঁর সম্মানহানি হয়েছে, এটা নিশ্চিত হয়ে যুদ্ধ থেকে সব লোকজনকে প্রত্যাহার করে গোটা গ্রিক আদর্শকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেন অ্যাকিলিস। পরবর্তী বিরোধে অ্যাকিলিসের শ্রেষ্ঠ বন্ধু পেত্রোক্লাস করুণভাবে ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের ছেলে হেক্তরের হাতে নিহত হন। যুদ্ধের পরবর্তী পটভূমিকায় অডিসি রচিত, শেষ পর্যন্ত ইথাকায় স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত বহু বিচিত্র দেশ ভ্রমণ করে আসা অডিসিয়াসের দশ বছর ব্যাপী ভ্রমণের বর্ণনা দিয়েছে এটা। দুটো কাব্যই যুদ্ধের উত্তেজনা, বন্ধুত্বের আনন্দ আর অ্যারিস্তেইয়ার-যোদ্ধা যখন নিজেকে এক ‘বিজয়ের ধ্বংসলীলায় হারিয়ে ফেলে’-এবং অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়, সামনে যা কিছু আছে উড়িয়ে নিয়ে যায়-গুণ গেয়েছেন হোমার। যুদ্ধে, হোমার যেন বোঝাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়, পুরুষরা আরও প্রবলভাবে বেঁচে থাকে। মহাকাব্যে তার মহান কর্মকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করা হলে বীর মৃত্যুর অস্তিত্বহীনতাকে জয় করতে পারে এবং মরণশীল মানুষের পক্ষে সম্ভবপর একমাত্র অমরত্ব অর্জন করতে পারে।
এভাবে খ্যাতি ছিল খোদ জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং কাব্যগুলো দেখায় যে, যোদ্ধারা এটা অর্জন করতে মরিয়া হয়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। মহত্বের অনুসন্ধানে প্রতিটি মানুষ নিজের হয়ে লড়াই করেছে। বীর একজন আত্মপ্রচারক, সম্মান আর মর্যাদার প্রশ্নে আচ্ছন্ন, নিজের বীরত্বের কথা জোর গলায় উচ্চারণ করে, এবং নিজের সম্মান বাড়াতে বাকি সবার সমস্ত ভালো বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। এখানে কোনও কেনোসিস, আত্মসমর্পণের কোনও ব্যাপার ছিল না; যোদ্ধার পক্ষে সত্তার সীমা থেকে ‘বেরিয়ে আসার একমাত্র যে উপায়টি ছিল সেটি হচ্ছে হত্যার একতাসিস। যুদ্ধের দেবতা আরেসের প্রভাবে থাকার সময় সে জীবনের প্রাচুর্য উপলব্ধি করে এবং পরিণত হয় স্বর্গীয়তে, নিজেকে অ্যারিস্তেইয়ায় হারিয়ে ফেলে, তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সবকিছু হত্যা করে। সুতরাং যুদ্ধ জীবনকে অর্থ দিতে পারার মতো একমাত্র কর্মকাণ্ড ছিল। প্রত্যেক যোদ্ধা সেরা হবে বলে প্রত্যাশা করা হতো, কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠ’(অ্যারিস্তোস) হওয়ার মানে ছিল যুদ্ধে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া।৭২ আর কোনও গুণ বা মেধার কোনও গুরুত্ব ছিল না। অ্যারিস্তেইয়ার তুঙ্গ অবস্থায় বীর মৃত্যুর অসন্তোষের মুখে দারুণ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা জীবনের অতিপ্রাচুর্য বোধ করত।
ভারতে পুরোহিত ও যোদ্ধা নির্বিশেষে ধীরে ধীরে অহিংসার (‘সহিংসতাহীনতা’) আদর্শের দিকে অগসর হচ্ছিলেন। এটাও অ্যাক্সিয়াল আধ্যাত্মিকতাকে বৈশিষ্ট্যায়িত করবে। কিন্তু গ্রিকরা কখনওই পুরোপুরিভাবে বীরের রেওয়াজ বর্জন করেনি: তাদের অ্যাক্সিয়াল যুগ হবে রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক-কিন্তু ধর্মীয় নয়। সবাই যাঁকে আকাঙ্ক্ষা করবে, অ্যাকিলিসের মতো একজন যোদ্ধাকে এমন শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ হিসাবে তুলে ধরার বেলায় হোমারের যেন অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনার সঙ্গে কোনও মিলই ছিল না। তারপরেও এক নতুন যুগের উপান্তে দাঁড়িয়ে হোমার বীরত্বব্যাঞ্জক কর্মকাণ্ডের দিকে সমালোচনার চোখে তাকাতে পেরেছিলেন। যোদ্ধার নিয়তিতে ভয়ঙ্কর মর্মভেদীতা লক্ষ করেছেন তিনি, কারণ তার রেইজন দে’এতরে মরণোত্তর মাহাত্ম্য লাভের জন্যে বীরকে মরতেই হতো। মৃত্যুর সঙ্গে পরিণয় হতো তার, ঠিক কাল্টে যেমন মরণশীলতায় অত্যাচারিত হয়ে অন্ধকার চথোনিয়ান অঞ্চলে বন্দি ছিল সে। হোমারের কাছেও মৃত্যু ছিল বিপর্যয়।
ইলিয়াড মৃত্যু সংক্রান্ত কাব্য, এর চরিত্রগুলো মারা যাওয়া বা হত্যা করার বাধ্যবাধকতার অধীন। নির্মমভাবে অনিবার্য সমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে কাহিনী: পেত্রোক্লাস, হেক্তর, অ্যাকিলিস এবং খোদ সুন্দর নগরী ট্রয়ের মৃত্যু। অডিসিতেও মৃত্যু ছিল অশুভ দুয়ে, অনির্বচনীয় ও বোধের অতীত। অডিসিয়াস পাতাল রাজ্য ভ্রমণ করার সময় বিড়বিড় করা মৃতদের কিলবিলে দৃশ্য দেখে ভীতবিহ্বল হয়ে উঠেছেন, যাদের মনুষ্যত্ব অশ্লীলভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও অ্যাকিলিসের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তাঁকে শোক না করার জন্যে মিনতি করেছেন অডিসিয়াস: ‘অতীতে তোমার মতো আর কোনও পুরুষই আশীর্বাদ লাভ করেনি, আগামীতেও করবে না। কারণ তোমার মৃত্যুর আগে, অ্যাচিয়ানরা তোমাকে দেবতার মতো সম্মান দিয়েছে, এখন এখানে তুমি মৃতদের মাঝে রাজত্ব করছ। কিন্তু এসবে তুষ্ট হওয়ার ছিলেন না অ্যাকিলিস। ‘আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে মৃত্যুকে মাহাত্ম্য দিয়ো না,’ এমন ভাষায় জবাব দিয়েছেন তিনি যা সম্পূর্ণভাবে অভিজাত যোদ্ধার রীতিকে হেয় করেছে। তারপরেও প্রাণহীন মৃতদের রাজত্ব করার চেয়ে আমি বরং মাটির উপরেই থাকতে চাইব এবং কোনও গরিব কৃষকের জন্যে খাটব।৪ বীরের আদর্শের গভীরে ভীতিকর শূন্যতা ছিল।
ইলিয়াডে সহিংসতা ও যোদ্ধার মৃত্যুকে প্রায়শঃই অর্থহীন, তবে পুরোপুরি আত্মবিধ্বংসী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। কাব্যে নিহত হতে চলা তৃতীয় পুরুষটি হচ্ছে ট্রোজান সিমোয়সিস, পরিবারের আদর সোহাগের মাঝে থাকার কথা ছিল তার, কিন্তু তার জায়গায় যুদ্ধে গ্রিক বীর আয়াক্সের পিটুনি খেয়েছে সে
তখন কালো পপলারের মতোই জমিনে লুটিয়ে পড়েছে সে
একা বিরাট জলাভূমি ঘিরে থাকা নিচু জমিনে জন্মেছে সেটা
মসৃণভাবে কাটা হলেও এখনও ডগায় ডালপালা গজাচ্ছে:
রথ প্রস্তুতকারী এক পুরুষ একটা দারুণভাবে বানানো রথে জুতে
দেওয়ার জন্যে চাকা বানাতে চকচকে তলোয়ার নিয়ে লেগে পড়েছে
আর গাছটা নদী তীরে পড়ে কঠিন হয়ে উঠছে।
ঠিক এমনি ছিল অছেমিয়নের ছেলে সিমোইসিওস,
যাকে কীর্তিমান আয়াক্স হত্যা করেছে। ৭৫
হোমার এর সমস্ত করুণ দিকের উপর নজর দিয়েছেন; তরুণের জীবন নিষ্ঠুরভাবে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে, নিষ্ঠুরভাবে প্রাকৃতিক বলয় থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে এবং হত্যার উপায়ে পরিণত করা হয়েছে।
অ্যাচিয়ানদের ভেতর সেরা হিসাবে সম্মানিত অ্যাকিলিসের চরিত্রেও এক রকম কাঠিন্য ও বিকৃতি রয়েছে। দারুণ প্রেমময় (ফিলোতে) ও কোমল ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে তাঁকে; তাঁর মা পেত্রোক্লাস ও বয়স্ক শিক্ষকের আচরণে সেটা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু আগামেননের সঙ্গে তাঁর বিবাদের পরিক্রমায় এই ভালোবাসা তাঁকে ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া ক্রোধ, এক কঠিন আত্ম-ন্যায়ের কোপে বিনাশ হয়ে যায়। ‘আপন দেহের ভেতর সহৃদয় চেতনাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে সে,’ ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর সহকর্মী আয়াক্স। কঠিন ও করুণাহীনে পরিণত হয়েছেন তিনি। সহিংস, ক্ষতিকর রেওয়াজে বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন অ্যাকিলিস, যাকে নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ত্যাগ করতে পারেননি তিনি। পেত্রোক্লাসের মৃত্যুর পর, যার জন্যে তিনিও বিশেষভাবে দায়ী ছিলেন, তাঁর ফিলোতেস অমানবীয় ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। বন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে হেক্তরের সঙ্গে যুদ্ধে দানবে পরিণত হন তিনি। হেক্তর কবর দেওয়ার জন্যে তাঁর মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বললে অ্যাকিলিস জবাব দিয়েছেন যে, তারচেয়ে বরং নিজের কাঁচা মাংস খাবেন তিনি।৭৯ তারপর হেক্তরের লাশ ভয়াবহভাবে বিকৃত করেছেন, তাঁকে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে পেত্রোক্লাসের সমাধির চারপাশে অবিরাম ঘুরিয়েছেন। পুরোনো সজ্জন অ্যাকিলিস কখনওই এমন আচরণ করতেন না। অহমের সংঘাতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। অ্যাপোলো স্বর্গীয় সভায় যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, এক নৈর্ব্যক্তিক, বিধ্বংসী শক্তিতে পরিণত হয়েছেন তিনি, করুণা বা বিচার ছিল না তাঁর ভেতর, এবং মানুষকে জঘন্য নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন থেকে বিরত রাখা লজ্জা পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছিলেন। কিন্তু কি অর্জন করেছিলেন তিনি? ‘কিছু না,’ বলেছেন অ্যাপোলো, তাঁর ভালো বা সম্মানের পক্ষে কিছুই না।৮০
কিন্তু কবিতার একেবারে শেষে ট্রয়ের রাজা প্রিয়াম ছেলে হেক্তরের মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন জানাতে এলে এক অনন্য দৃশ্যে অ্যাকিলিস তাঁর প্রেমময় হৃদয় ফিরে পান। প্রবীণ ব্যক্তিটি ট্রয় ছেড়ে পায়ে হেঁটে সবার অলক্ষে শত্রুশিবিরে প্রবেশ করেন এবং অ্যাকিলিসের সঙ্গীদের বিস্মিত করে নীরবে তাঁর তাঁবুতে হাজির হন। ‘দুই হাতে অ্যাকিলিসের হাঁটু আঁকড়ে ধরে বিপজ্জনক ও নরঘাতক এবং তাঁর বহু পুত্রের হত্যাকারী হাতে চুমু খান।৮১ একসঙ্গে কাঁদলে পুরুষদের ভেতর গুরুত্বপূর্ণ বাঁধন সৃষ্টি হয় বলে বিশ্বাস করত গ্রিকরা। বয়স্ক লোকের চরম আত্মঅবমাননা অ্যাকিলিসের ভেতর ‘নিজের বাবার জন্যে শোকের আবেগ সৃষ্টি’ করে। প্রিয়ামের হাত নিজের হাতে তুলে নেন তিনি,
… প্রিয়াম অ্যাকিলিসের পায়ের কাছে জবুথুবু হয়ে বসে কাঁদার সময়
দুজনে ঘাতক হেক্তরকে স্মরণ করলেন,
আর নিজের বাবার কথা ভেবে কাঁদলেন অ্যাকিলিস, এবার
আবার পেত্রোক্লাসের জন্যে। তাঁদের শোকের মাতম তখন বাড়ির
ভেতর প্রবেশ করল
তারপর
মহান অ্যাকিলিস যখন শোকে সম্পূর্ণ সন্তোষ লাভ করলেন
আর এর জন্যে আবেগ মন আর দেহ থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নিল, তারপর
আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রবীণের হাত ধরলেন তিনি, আর
ধূসর চুল আর ধূসর দাড়ির জন্যে করুণাবশে
তাঁকে আবার নিজের পায়ের কাছে বসালেন। ৮২
বন্ধুর ঘাতক একজন লোকের বাবার প্রতি সহানুভূতি থেকে নিজের মনুষ্যত্ব আর ফিলোতেস ফিরে পেয়েছিলেন অ্যাকিলিস। প্রবীণের পক্ষে ভারি মৃতদেহ বহন করা কষ্টকর হবে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে যারপরনাই যত্ন আর কোমলতার সঙ্গে হেক্তরের মৃতদেহ হস্তান্তর করলেন তিনি। তারপর একসঙ্গে খাবার খাওয়ার সময় সাবেক শত্রুরা নীরব বিস্ময়ে পরস্পরকে নিয়ে ভাবেন।
দারনদানোসের ছেলে প্রিয়াম,
চেয়ে থাকেন অ্যাকিলিসের দিকে,
তাঁর আকার আর সৌন্দর্য দেখে অবাক,
কারণ তাঁকে দেখে পুরোদস্তুর দেবতাদের দিব্যদর্শনের
মতো লাগছে। অ্যাকিলিসও পালা করে
দারদানিয়ান প্রিয়ামের দিকে তাকাচ্ছেন
আর তাঁর কথা শোনার সময় তাঁর
সাহসী চেহারা দেখে বিস্মিত হচ্ছেন।৮৩
নিজেকে শূন্য করে দেওয়া সহনুভূতির এই কর্মকাণ্ড সবাইকে প্রত্যেককে পরস্পরের ভেতর ঐশী ও ঈশ্বরতুল্যতা দেখতে সক্ষম করে তুলেছিল। কবিতার বাকি অংশে না হলেও এই দৃশ্যে হোমার নিখুঁতভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগের চেতনা প্রকাশ করেছেন।
অবশ্য হোমারের দেবতারা কোনওরকম সহানুভূতি বোধ করেননি। কোনও কোনও হিব্রু পয়গম্বর যখন ঈশ্বরের করুণ রসের সন্ধান শুরু করেছেন, হোমার তখন মানবজাতির দুর্ভোগের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ অলিম্পিয়ানদের তুলে ধরেছেন। যিউস হেক্তরের জন্যে চকিত বেদনা বোধ করে থাকলে, সেটা কেবল একটা ক্ষণিকের শিহরণ, এবং সেটা স্থায়ী কোনও বেদনা সৃষ্টি করেনি। দেবতারা ছিলেন দর্শকমাত্র, যাঁরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অভিজাতরা যেভাবে প্রতিযোগিতা দেখত ঠিক সেভাবে নারী-পুরুষের বিচিত্র আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন।৮৫ পেত্রোক্লাসের মৃত্যুর পর অ্যাকিলিসের স্বর্গীয় ঘোড়াগুলো পতিত বীরের জন্যে কেঁদেছে, তাদের উষ্ণ অশ্রু বিন্দু ঝরে পড়েছে জমিনে। যিউস চকিত করুণা বোধ করেছেন, ওদের ভেতর নতুন তেজ ফুঁকে দিয়েছেন আর অমনি কেশর থেকে ধূলি ঝেড়ে আবার মাঠে ফিরে গেছে তারা, তাদের ক্ষণস্থায়ী বেদনা লক্ষণীয়ভাবে অ্যাকিলিসের তীব্র কুৎসিত শোকের বিপরীত ছিল।
ফলে কাব্যে দেবতাদের মানুষের চেয়ে কম গুরুগম্ভীর মনে হয়েছে। দেবতারা আবিশ্যিক কোনও কিছুরই ঝুঁকি নেননি, কোনও কিছুই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যুদ্ধে এক গ্রিক যোদ্ধার হাতে আরেস আহত হলে, তাঁর ক্ষত দ্রুত ভালো হয়ে যায়, ক্ষণিকের অপমানের পর ‘বিজয়ের মহিমায়’ উল্লসিত’৮৬ হয়ে যিউসের পাশে আসন গ্রহণে সক্ষম হয়ে ওঠেন তিনি। যিউস আর হেরা ঝগড়া করলেও তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। আর গ্রিক ও ট্রোজানদের সমর্থক দেবতাদের ভেতর যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর তেমন কোনও মারাত্মক পরিণতি সৃষ্টি হয়নি; মর্ত্যে ঘটে যাওয়া মানুষের ভেতেরর লড়াইয়ের তুলনায় যুদ্ধটাকে হাস্যকরই বলা চলে। দেবতাদের সহজ জীবন মানবীয় জীবনের করুণ, সীমাবদ্ধ ও মরণমুখী জীবনকে মর্মভেদী স্বস্তিতে ছুঁড়ে দিয়েছে।
তাসত্ত্বেও, হোমারের অলিম্পিয়ার দেবতাদের সজীব চিত্রায়ন চিরকালের জন্যে তাঁদের ব্যক্তিত্বকে স্থির করে দিয়েছে। তাঁদের স্পষ্টতা এবং আগে ছিল না দেবনিচয়কে এমন সামঞ্জস্যতা দিয়েছেন তিনি। অন্যান্য অ্যাক্সিয়াল জাতি যখন হয় প্রাচীন দেবতাদের অসন্তোষজনক আবিষ্কার করছিল বা ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণায় পরিবর্তন আনছিল, এমন একটা সময়ে ধর্মের প্রাচীন ধরনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হচ্ছিল গ্রিকরা। ঈশ্বরকে দুয়ে হিসাবে দেখার বদলে তারা তাদের দেবতাদের প্রথাগত সর্বব্যাপীতাকে আবার নিশ্চিত করেছে। ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোনও বিপর্যয়কর ধাক্কা ছিল না; তার বদলে একজন গ্রিক দেবতাকে মানুষের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই মনে করা হতো। যেকোনও অসাধারণ সাফল্য বা ব্যতিক্রমী অর্জনে দেবতা বা দেবীকে বোধ করা যেত যোদ্ধা যুদ্ধের পরম আনন্দে ভেসে যাওয়ার সময় জানত যে আরেস উপস্থিত আছেন। ইন্দ্রিয়জ প্রেমে তার বিশ্ব বদলে গেলে সে তাকে বলত ‘আফ্ৰোদাইত।’ স্বর্গীয় কারুশিল্পী হেপাস্থিয়াস শিল্পীর অনুপ্রেরণায় প্রকাশিত ছিলেন, প্রতিটি সাংস্কৃতিক সাফল্যে অ্যাথেনা।
দেবতাদের একটি সমাজ ঐশ্বরিকতার জটিলতা প্রতীকায়িত করেছে। কানানীয় স্বৰ্গীয় সভায় ‘ঈশ্বর পুত্রদের’ কেউই একা স্থায়ী হতে পারেননি। কেবল সতীর্থ উপাস্যদের সাপেক্ষেই যুক্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। দেবতাদের অলিম্পিয়ান পরিবারও গ্রিকদের চারপাশের জগতে অনুভব করা পবিত্র শক্তির স্বাধীনতা ও আন্তনির্ভরতা প্রকাশকারী স্বর্গীয় ঐক্যের একটি অভিব্যক্তি ছিল। একমাত্র যে বিষয়টি গ্রিক দেবনিচয়কে আলাদা করেছে সেটা হলো সামঞ্জস্যতা ও সংগঠনের উঁচু মাত্রা। ধ্রুপদী কালের গ্রিকরা কখনওই প্রাচীন প্যাগানবাদ থেকে সরে যায়নি। বরং প্রাচীন দর্শনকে প্রসারিত করার জন্যে অসাধারণ মেধাকে কাজে লাগিয়েছে, পদ্ধতি আর যুক্তি দিয়েছে একে। অলিম্পিয়ান পরিবারের প্রীতিকর সামঞ্জস্যতা আর ভারসাম্য ছিল; এর অভিভাবক (যিউস ও হেরা); চাচা ও চাচী (পোসাইদোন ও দিমিতার); তিন ছেলে (অ্যাপোলো, আরেস, ও হেফায়েস্তাস); এবং তিন মেয়ে (অ্যাথেনা, আর্তিমিস ও আফ্রোদাইত) ছিল। বাইরের লোকজন ছিলেন: দেবতাদের বার্তাবাহক হার্মেস, জাদুর দেবী হেকেত; এবং দিওনিসাস, যার কাজ ছিল অলিম্পিয়ারদের ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা।
দেবতাদের স্বাধীনভাবে, ভিন্ন ব্যক্তিসত্তা, বিচ্ছিন্ন চরিত্র হিসাবে দেখার উপায় ছিল না। প্রত্যেকেই সমগ্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান ছিলেন, কেবল পরিবারের অপরাপর সদস্যদের পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যেতে পারে। গ্রিক দেবনিচয়কে ভাষার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি শব্দের শাব্দিক অর্থ অভিধানের অন্যান্য শব্দের সঙ্গে এর মিল বা অমিলের শর্তাধীন।৮৯ আসলে কেবল এক জন দেবতার উপাসনা করে অন্যদের কাল্টকে উপেক্ষা করা বিপজ্জনক ছিল। গ্রিক বিশ্বে একেশ্বরবাদীতা ছিল ট্যাবু, তাতে করে মারাত্মক শাস্তির ব্যবস্থা হতে পারত। কোনও দেবতাই অন্যের উপাসনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি এবং প্রিয় দেবতাকে বেছে নিয়ে দেবনিচয়ের অন্য কোনও একজনের কাল্টকে অবহেলা ছিল নিষিদ্ধ। দেবতারা মারামারি বা ঝগড়া করতে পারেন, কিন্তু প্রত্যেকেই বাস্তবতার একটি প্রকৃত বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করতেন, যা না হলে বিশ্ব জগৎ স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যেত। দেবতাদের সমগ্রকে শ্রদ্ধা করে বিভিন্ন স্ববিরোধিতাকে একসূত্রে গাঁথার ঝলক দর্শন সম্ভব ছিল। কোনও উৎসবে উৎসর্গ বিরল ক্ষেত্রেই একজন মাত্র দেবতার উদ্দেশ্যে করা যেত আর সাধারণত কোনও স্যাঙ্কচুয়ারি একাধিক দেবতাকে নিবেদিত ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, অ্যাথেনসে অ্যাক্রোপলিসে পৃষ্ঠপোষক দেবতা অ্যাথেনার পাশাপাশি পোসাইদোনও উপাসিত হতেন।
দেবতাদের প্রায়ই এমনভাবে জোড়া বাঁধা হতো যাতে তা জীবনের টানাপোড়েন আর বৈপরীত্য ডেকে আনে। আদিআদর্শ বিবাহিত দম্পতি যিউস ও হেরার ঝগড়া-বিবাদ বিপরীত লিঙ্গের বিরোধের ভেতর দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহজাত সমস্যাই নিশ্চিত করেছে। আরেস ও অ্যাথেনা যুদ্ধের দেবতা ছিলেন, কিন্তু আরেস যুদ্ধের নিষ্ঠুর ঘৃণিত দিক তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে বিজয়ের মাহাত্ম্য মূর্ত করেছেন অ্যাথেনা।` পোসাইদোন ও অ্যাথেনাকে প্রায়ই জোড়া হিসাবে উপাসনা করা হতো: আদিম, মৌল উপাদান তুলে ধরা সাগরের দেবতা পোসাইদোনকে সভ্যতার দেবতা অ্যাথেনা পোষ মানাতে, নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মানুষের গম্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। পোসাইদোন ঘোড়াকে জন্ম দিয়েছেন আর অ্যাথেনা নির্মাণ করেছেন জাহাজ। কিন্তু তারপরেও যুদ্ধেরও দেবী ছিলেন বলে সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে উপস্থিত সহিংসতা আর বেঁচে থাকার জন্যে কোনও পোলিসের সংগ্রাম তুলে ধরেছেন অ্যাথেনা।
পোসাইদোনকে আবার অ্যাপোলোর সঙ্গে জুটি হিসাবে দেখানো হয়েছে: একসঙ্গে বিপরীত মেরুর কিন্তু আবার সম্পূরক বার্ধক্য ও তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাঁরা। হেরা ও দিওনিসাস গভীরভাবে পরস্পরের বিরোধী; কিন্তু উভয়ই পাগলামির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা স্বৰ্গীয় ভোগান্তির উৎস বা মুক্তিদায়ী তুরীয় আনন্দ হতে পারে। অ্যাপোলো ও দিওনিসাস ছিলেন ভাই, পরস্পরকে ভারসাম্য ও পাল্টা ভারসাম্য দিয়েছেন তাঁরা। আকার, স্পষ্টতা, সংজ্ঞা আরদ্ধতার প্রতীক অ্যাপোলো; আর দিওনিসাস ধ্বংসের শক্তির প্রতিমূর্তি-দেলফিতে তাঁকে অ্যাপোলোর রক্ষিতা, চথোনিয় সঙ্গী হিসাবে সম্মান দেখানো হতো। প্রত্যেক গ্রিক দেবতার অশুভ ও বিপজ্জনক বৈশিষ্ট্য ছিল। কেউই অবিমিশ্র ভালো ছিলেন না; কেউই নৈতিকতার ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। বৈপরীত্য না এড়িয়েই বা বিশ্বের কোনও অংশকে অস্বীকার না করে একসঙ্গে সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য আর জীবনের জটিলতা প্রকাশ করেছেন তাঁরা। গ্রিকরা ধর্মের নতুন ধরন গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেনি বরং অ্যাক্সিয়াল যুগ শেষ হওয়ার পরেও সাত শো বছর টিকে থাকা প্রাচীন প্রথাতেই সন্তুষ্ট বোধ করেছে। চীনের পক্ষেও অষ্টম শতাব্দী ক্রান্তিকাল ছিল। ৭৭১ সালে পঞ্চাশ বছর ধরে ঝোউদের দরবারকে হয়রানি করে চলা কোং রাং বর্বররা ঝোউঝুয়াংয়ের রাজধানী বিধ্বস্ত করে রাজা ইয়োনকে হত্যা করে। অবশ্য, এটাই রাজবংশের অবসান ছিল না। রাজা পিং। (৭৭০-৭২০) বাবার উত্তরাধিকারী হন এবং পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী চ্যাংঝোউতে স্বর্গীয় ক্ষমতার অধিকার লাভ করেন। কিন্তু ঝোউ রাজারা ছিলেন তাঁদের অতীত সত্তার ছায়ামাত্র। রাজা পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানীর আশপাশে তাঁর ছোট দরিদ্র রাজত্বটি ধরে রেখেছিলেন, আচরিক দায়িত্ব পালন করেছেন, কিন্তু সত্যিকারের কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এমনি ক্ষীণ দশায় রাজবংশটি প্রায় পাঁচ শো বছর টিকে ছিল। রাজারা নামমাত্র শাসক হিসাবে ছিলেন, কিন্তু কার্যত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শহরের রাজকুমাররা। তাঁদের ক্ষুদে রাজ্যগুলো ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে উঠছিল। ক্রমবর্ধমান হারে রাজার প্রতি আনুগত্যের চেয়ে আচার (লি) ক্ষুদেরাজ্যগুলোর ভেতরকার সম্পর্ক নির্ধারণ করছিল, সরকারিভাবে মিত্র হলেও কার্যত প্রায়শঃই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এগুলো। প্রাচীন রীতি যুদ্ধ, প্রতিশোধ আর বিভিন্ন চুক্তি নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য ও সেবার বিনিময় তত্ত্বাবধানের এক ধরনের আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে রাজকীয় কর্তৃত্বের স্থান দখল করে নিচ্ছিল। এটা এমন এক যুগের সূচনা ছিল যাকে ইতিহাসবিদরা বলেন চানকিই (বসন্ত ও শরৎ), ৭২২ থেকে ৪৮১ সময়কালকে তুলে ধরা ক্ষুদে রাজ্য লু-র ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত নাম। এই সময় বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতার বিশৃঙ্খল একটা কাল বলে মনে হয়েছিল একে; কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি প্রাচীন রাজতন্ত্র থেকে ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্যের দিকে এক জটিল যাত্রা করছিল চীন। অষ্টম শতাব্দীর চীন সম্পর্কে খুবই কম জানি আমরা, তবে মনে হয় যে এই বছরগুলো এক নতুন বিচক্ষণতার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করেছে।
এই সময়ের অস্বস্তিকর পরিবর্তনগুলোর অন্যতম ছিল রাজতন্ত্রের পতন। ঝোউদের অধীনে চীনারা জমি উদ্ধার, বন পরিষ্কার ও কৃষিকাজের জন্যে বেশি জমি উন্নয়নে ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছিল। তবে এই ইতিবাচক উন্নয়নের উদ্বেগজনক পরিণতিও ছিল। এই সময় শিকার ও ভেড়া ও গবাদিপশুর জন্মদানের জায়গার পরিমাণ কমে গিয়েছিল। বহু প্রজাতির প্রাকৃতিক আবাস ধ্বংস করে নির্বনকরণ অঞ্চলের সমৃদ্ধ বুনো জীবনও নষ্ট করে দিচ্ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে চীনারা শিকার অভিযান থেকে আগের দিনের প্রচুর পশুর জায়গায় অনেক কম পশু নিয়ে ফিরে আসছিল। ভেড়া ও গবাদিপশুর জন্মও অনেক কমে গিয়েছিল। শ্যাং ও আদি ঝোউরা কোনও চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তাদের উৎসর্গ অনুষ্ঠানে দরাজভাবে শত শত পশু হত্যা করেছিলেন, তাঁদের বিশ্বাস ছিল এগুলোর উৎস অক্ষয়। এতটুকু উদ্বেগ বোধ না করে প্রচুর উপহার বিলিয়েছেন তাঁরা, ভোজসভায় বিপুল পরিমাণ মাংস খেয়েছেন।
কিন্তু নতুন ঘাটতি লোকজনকে যেন বিলাসিতার দিকে তীর্যক দৃষ্টি হানতে বাধ্য করেছে। উৎসর্গের পশুর আর পাইকারী হত্যা চলছিল না; আচরিক আইনের মাধ্যমে পশুর সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। শাস্ত্রজ্ঞরা শিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিলেন, সযত্নে নির্ধারিত মৌসুমে একে সীমিত রাখার চেষ্টা চলছিল। ৭৭১ সাল নাগাদ শেষকৃত্যানুষ্ঠান ইতিমধ্যে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং প্রাচীন জাঁকজমককে ভ্রূকুটি করা হচ্ছিল। মিতাচারের এক নতুন চেতনা শহরগুলোয় অভিজাত পরিবারগুলোকে বদলে দিচ্ছিল। শিকারের সংখ্যা ও গবাদি পশুর পরিমাণ কম থাকায় তাদের সম্পদ শিকার ও আক্রমণের বদলে এখন কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। অভিজাতগোষ্ঠী মনে-প্রাণে যোদ্ধাই রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, তাদের যুদ্ধগুলো অনেক বেশি আচরিক ও আগের তুলনায় কম সহিংস ছিল। শিকার ও সামরিক অভিযানের সংখ্যা কম থাকায় জুনযিরা (‘ভদ্রলোক’) ক্রমবর্ধমানহারে শিষ্টাচারবিধি, ভব্যতা আর আচারের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়েদরবারেই সময় কাটাত।৯৪
সংযম, নিয়ন্ত্রণ আর মিতাচারই ছিল এই সময়ের মোদ্দা কথা। জীবনকে আরও যত্নের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার দরকার ছিল। পটল্যাচ ধারায় উপহার দেওয়ার প্রাচীন বুনো উৎসবের বদলে অতীত নজীরের পক্ষে লিখিত, দালিলিক সাক্ষীসহ বিনিময়ের সূক্ষ্মভাবে সংগঠিত ব্যবস্থার দরকার ছিল।৫ অভিজাত গোষ্ঠীর সকল কর্মকাণ্ড এক বিস্তারিত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আপনি যাই করুন না কেন, সেটা করার একটা সঠিক পদ্ধতি ছিল। সময়ের পরিক্রমায় ঝোউ শহরগুলোর অভিজাতরা সামাজিক সম্প্রীতি বাড়াতে ও দলের কল্যাণের লক্ষ্যে রীতিনীতি গড়ে তোলে। সকল সমাজের মতোই সচেতন আলোচনার ভেতর দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় এইসব ঐতিহ্য আরও উন্নত হয়ে উঠেছে। আচরণের এই ধরন বিকশিত হতে সম্ভবত কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছে, এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়েছে।৬ জুনযি এখন আাচরণের বিস্তারিত বিধি মেনে চলত: এখন বসন্ত ও শরতে রীতি সংক্রান্ত বিধানগুলো লিপিবদ্ধ হতে শুরু করে এবং একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়। পরিবর্তন ও অনিশ্চয়তার এই সময়ে লোকে স্পষ্ট নির্দেশনা চেয়েছে। আবার নতুন করে ধর্ম নিয়ে ভাবতে হয়েছে তাদের। রাজা প্রাচীন শাস্ত্রের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তিনিই যেখানে এখন অসহায় পুতুলে পরিণত হয়েছেন সেখানে কেমন করে প্রজারা তাঁকে শ্রদ্ধা করতে পারে? কেমন করে আপনি অভাবের কালে প্রাচীন কালের উৎসর্গ বজায় রাখতে পারবেন?
বিশাল প্রান্তরের ক্ষুদেরাজ্যগুলোয় লিপিকার, গণক, জ্যোতির্বিদ ও মহাফেজখানার তত্ত্বাবধায়কদের হাতে নতুন শাস্ত্রাচার গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। কিছু সময়ের জন্যে নিচু স্তরের অভিজাত গোষ্ঠী শি শহরগুলোয় আরও প্রাধান্য লাভ করছিল। অপেক্ষাকৃত ছোট ছেলে বা দ্বিতীয় শ্রেণীর স্ত্রীদের সন্তানরা ছিল ব্যারন আর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের নিচে। অপেক্ষাকৃত কম সম্মানজনক কাজ-ম্যান-অ্যাট-আর্মস, লিখিত ঐতিহ্যের সংরক্ষক আর জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিশেষজ্ঞ-করত তারা। লিপিকারদের কেউ কেউ সংকলন গ্রন্থিত করেছিলেন যা চীনা ধ্রুপদী সাহিত্যে পরিণত হবে: ক্লাসিক অভ ডক্যুমেন্ট, ক্লাসিক অভ ওদেস, ক্লাসিক অভ চেঞ্জেস (ইইজিং), ক্লাসিক অভ মিউজিক (যা টিকে থাকেনি), আর চানকিই, দ্য স্প্রিং অ্যান্ড অটাম অ্যানালস। এই সময় শিদের কেউ কেউ অভিজাত পরিবারগুলোর আনুষ্ঠানিক ও রেওয়াজের রীতিনীতি লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞরা (রু) সবার কাছে অভিজাতদের নীতিমালা সহজবোধ্য করে তোলেন। একজন জুনযিকে অবশ্যই সামন্ত সমাবেশে কোথায় দাঁড়াতে হবে, কিভাবে তিনি দাঁড়াবেন, লোকজনকে অভ্যর্থনা জানাবেন, নিজেকে আরামদায়ক করবেন, এসব জানতে হবে। ঠিক কখন কথা বলতে হবে এবং কখন চুপ থাকতে হবে সেটা অবশ্যই জানতে হবে তাঁকে। অবশ্যই সঠিক পোশাক পরতে হবে, সঠিক ভঙ্গি কাজে লাগাতে হবে এবং প্রতিটি উপলক্ষ্যের জন্যে সঠিক অভিব্যক্তি ধারণ করতে হবে। সবকিছুরই ধর্মীয় মূল্য ছিল। আদি ঝোউদের আমলে প্রাকৃতিক নিয়ম রক্ষার লক্ষ্যে রাজকীয় অনুষ্ঠানমালা প্রণীত হয়েছিল। এখন রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় বিশাল প্রান্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রু-রা গোটা জীবনকে একটি আচরিক কর্মকাণ্ডে পরিণত করেছিলেন?
প্রত্যেক রাজকুমার সরকারি উৎসর্গ নিশ্চিত করতে পারার মতো তাঁর একদল ভালো আচরিক উপদেষ্টা প্রয়োজন থাকা উচিত বলে আবিষ্কার করেছিলেন। পূর্বসুরিদের (বিন) জন্যে ভোজসভার ‘আয়োজেন’ করা আর আচরিক নাচ যেন সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে সেটা নিশ্চিত করবে তারা। রু-রা রাজকুমার ও মন্ত্রীদের আচার-অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে সাহায্য করেছেন, যাতে সেগুলো সামন্ত সমাবেশে নিন্দনীয় না হয়, যাতে একজন জুনযি নিজের যুক্তি তুলে ধরতে, বিরোধিতার ক্ষেত্রে কিভাবে কণ্ঠস্বর চড়া করতে হয় সেটা জানতে পারেন। ক্রমবিবরণী দেখায় যে, লির জ্ঞান কূটনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একবার এক ছোট শহরের রাজকুমার আরও গুরুত্বপূর্ণ এক রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, এই সফরের সময়ই সেই রাজকুমার মারা যান। মন্ত্রীরা অতিথিকে মৃতদেহ সাজাতে বাধ্য করেন-যেহেতু এটা প্রজার কাজ ছিল, তার মানে হিসাব করা চাল। সেটা মেনে নিলে অতিথি অপেক্ষাকৃত বড় রাজ্যের কাছে নিজের রাজনৈতিক স্বাধীনতা তুলে দিতেন, কিন্তু সৌজন্যের সঙ্গে কিভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন তিনি? পরামর্শকরা সমস্যার সমাধান বাৎলে দিলেন। ছোট জমিদার মৃতদেহ সাজাতে গেলেন, কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গেলেন একজন জাদুকর। লি অনুযায়ী রাজকুমার তাঁর রাজ্যে কোনও প্রজার বাড়িতে শোক প্রকাশ করতে গেলে এমনই করেন। লির নিপুণ কায়দা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে এবং ষড়যন্ত্রী মন্ত্রীদের পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়েছে। এই গল্প দেখায় যে, আপাত বিনয় দেখালেও এইসব আচারে আসলে কোনও কেনোসিস ছিল না। অভিজাতদের আচরিত জীবনযাত্রা তাদের আপাত সম্মান ও ভদ্রতার সঙ্গে আচরণ শিখিয়েছে, কিন্তু লিসমূহ সাধারণত স্বার্থপরতায় অনুপ্রাণিত ছিল। সবকিছুই সম্মানের ব্যাপার ছিল। অভিজাতরা তাদের সুবিধা ও সম্মানের ব্যাপারে ঈর্ষাপরায়ণ ছিল, লি-কে তাদের মর্যাদার বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেছে।৮
সবচেয়ে দক্ষ ও কর্তৃত্বমূলক আচরিক পদ্ধতি লু ছিল ক্ষুদেরাজ্য ভিত্তিক, নিজেকে সবসময় পবিত্র ঐতিহ্যের রক্ষক ভেবে এসেছে এই শহরটি। শাস্ত্রজ্ঞ ও লিপিকাররা ক্রমে ষষ্ঠ চৈনিক ক্লাসিকে পরিণত হতে চলা আচরিক বিধি লিজিং গড়ে তোলেন।* লু শাস্ত্রজ্ঞরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি সৃষ্টি করেছিলেন: প্রথমত, আচারের কার্যকারিতা নির্ভর করে এতে অবদান রাখা প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অংশের নিখুঁত সম্পাদনের উপর; দ্বিতীয়ত, এই নিখুঁত অবস্থা তখনই সম্ভব হবে যখন অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেকে সামগ্রিকভাবে আচারের মূল্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকবে। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকে লু-র একজন শাস্ত্রজ্ঞ এই দুটো নীতিকে সূচনা-বিন্দু ধরে চীনা অ্যাক্সিয়াল যুগের সূচনা ঘটাবেন এবং এই আপাত স্বার্থপর ও নিষ্ফলা অনুশীলনের সুপ্ত আধ্যাত্মিক ক্ষমতা প্রকাশ করবেন।
কিন্তু এই প্রাথমিক কালে কিছু সংখ্যক লু শাস্ত্রজ্ঞ আত্মসমর্পণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।১০০ প্রাচীন কালের সাধু রাজা ইয়াও ও শানকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন তারা, এবং সম্ভবত ক্লাসিক অভ ডক্যুমেন্টের অন্যতম প্রাচীন ইতিহাস ‘ক্যানন অভ ইয়াও অ্যান্ড শান’-এর জন্যে দায়ী। অন্যান্য সাংস্কৃতিক বীরের বিপরীতে কোনও জাদুকরী তৎপরতা দেখাননি ইয়াও ও শান। তাঁরা দানবের সঙ্গে লড়াই করেননি, হলদে সম্রাট বা জিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা উইর মতো বন্যা নিয়ন্ত্রণ করেননি। কেবল কারিশমা দিয়েই প্রজাদের শাসন করেছেন তাঁরা। সামরিক প্রাধান্যের সাহায্যে শাসন করা যোদ্ধাদের প্রাধান্য লাভের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল এটা। অনুশাসন আমাদের বলছে, অকৃত্রিম সুজন ছিলেন ইয়াও: ‘তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল, বুদ্ধিমান, সফল, আন্তরিক এবং কোমল। আন্তরিকভাবে সম্মানজনক ও সৌজন্যে পারঙ্গম ছিলেন। ১০১ এইসব গুণের সহজাত শক্তি পৃথিবীর চারকোণে উৎসারিত হয়, পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ স্বর্গে আর পৃথিবীর গভীরে। চীনের সব পরিবার আর ক্ল্যানের কাছে পৌঁছায়, একসঙ্গে সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম করে তোলে তাদের এবং মহাশাস্তি (দাই পিং) প্রতিষ্ঠা করে। রাজকীয় স্বক্ষমতা দাওদে বদলে যেতে শুরু করেছিল। নেহাতই জাদুকরী ফলপ্রসুতার বদলে লোকজনের পক্ষে আধ্যাত্মিক সুবিধা নিয়ে আসা নৈতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছিল তা।
শানের উৎস ছিল সত্যিই নেহাত অখ্যাত। কেউ কেউ বলে পুবের এক বর্বর পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি; অন্যরা দাবি করেছে যে, তিনি ছিলেন কৃষক, কুমার, বা জেলে। তাঁর বাবা ও বড় ভাই তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শান পালাতে সক্ষম হন; তাঁদের প্রতি কোনও নিন্দা পুষে রাখেননি তিনি, বরং বাৎসল্যের আদর্শ হিসাবে তাদের সঙ্গে ভদ্র ও সম্মানজনক আচরণ করেছেন। সামান্য অবস্থা সত্ত্বেও শানের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও মিতাচারের কথা উত্তরাধিকার নিয়ে ভাবিত খোদ সম্রাট ইয়াও-এর কানে পৌঁছে যায়। ইয়াও-র আপন ছেলে ঝু ঠগ ও বিবাদপ্রিয় ছিলেন। কেমন করে স্বর্গীয় ক্ষমতা পেতে পারেন তিনি? এমনি বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ইয়াও দেবতাদের সঙ্গে পরামর্শ করলে চার পাহাড়ের আত্মা শান সম্পর্কে জানান তাঁকে: এক অন্ধ লোকের ছেলে তিনি। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই উদ্ধত। কিন্তু তারপরেও এপর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে বাস করতে পেরেছেন এবং তিনি পারিবার বৎসল। নিজের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আছে, অশুভ কিছুর সঙ্গে জাড়াননি। ১০২
শান সত্যিই ভালো মানুষ নিশ্চিত হওয়ার জন্যে তাঁকে পরখ করার পর আপন ছেলেকে এড়িয়ে তাঁর হাতে সাম্রাজ্য তুলে দেন ইয়াও। নিজেকে অনুপযুক্ত মনে হয়েছিল শানের, ইয়াও-র মৃত্যুর পর ইয়াও-র ছেলেকে সিংহাসনের দায়িত্ব দিয়ে চীনের দাক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় চলে যান তিনি। কিন্তু সাম্রাজ্যের সামন্ত জমিদার শানের সাথেই পরামর্শ করতে আসতেন, ইয়াও-র ছেলের সঙ্গে নয়। আর কবিরা কেবল শানেরই প্রশংসা গীত গাইতেন। তো শেষপর্যন্ত স্বর্গের ক্ষমতা মেনে নেন শান। এমনকি সম্রাট হিসাবেও বাবার সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতে থাকেন; অবসরে যাওয়ার সময় ইয়াও-র নজীর অনুসরণ করে আপন ছেলেকে বাদ দিয়ে পূর্তমন্ত্রী ইউর পক্ষে ক্ষমতা ত্যাগ করেন তিনি, যিনি জিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন।
ইয়াও ও শান শান্তির এক স্বর্ণযুগের প্রতিষ্ঠাকারী দয়া আর মনুষ্যত্বের অধিকারী সান্ন্যাসীতে পরিণত হয়েছিলেন। ক্লাসিক অভ ডক্যুমেন্টে তাঁদের কিংবদন্তী শক্তি ও নির্যাতনের উপর ভিত্তি করে ও বংশপরম্পরায় পরিচালিত শাসনের তীর্যক সমালোচনা ছিল। আপন মর্যাদা ও অবস্থান আঁকড়ে থাকার বদলে ইয়াও ও শান তাঁদের স্বাভাবিক পছন্দের চেয়ে জনগণের কল্যাণকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন মিতাচার, সৌজন্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ আর সম্মানকে মূর্ত করে তোলা আদিআদর্শ, লির যা চর্চা করার কথা ছিল। চীনের জীবনযাত্রা আরও বেশি করে স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার পরও ইয়াও শানের কিংবদন্তী অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ছিল। অ্যাক্সিয়াল যুগ সাধুরা প্রতিটি মানুষেরই এইসব মহান ব্যক্তির মতো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল বলে যুক্তি দেখাবেন।
নতুন আচরিক মিতাচার ক্রমে বিশাল প্রান্তরের বিভিন্ন ক্ষুদেরাজ্যে শেকড় গেড়ে বসে। সময়ের টানাপোড়েন সত্ত্বেও এটা লিকর্তৃক প্রকাশিত রাজকীয় চীনা আদর্শের প্রতি অনুগত রয়ে যওয়া এইসব প্রাচীন নগরের শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। তবে নুতন আগ্রাসী প্রতিপক্ষ ছিল তাদের। অষ্টম শতাব্দীতে প্রান্তরের উপকণ্ঠের তিনটি রাজ্য বর্বর এলাকায় অনুপ্রবেশ করে বিশাল এলাকা দখল করে নিচ্ছিল: পাহাড়ী উত্তরাঞ্চলে জিন; উত্তর পশ্চিমের সমৃদ্ধ পার্বত্য এলাকায় কি; এবং মধ্য ইয়াংতযেতে চু। এই তিনটি রাজ্য তখনও চৈনিক ঐতিহ্য রক্ষা করে চলছিল, কিন্তু এই সময় এদের স্বদেশী জনগণ ছিল, যারা লি- র সঙ্গে মেশেনি। চু-রাই প্রথম প্রাচীন ঝোউ ঐতিহ্য বিসর্জন দেবে। সংঘাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল চীন সভ্যতা।
.
উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় এলাকায় জীবন আরও স্থিতিশীল হয়ে উঠছিল, সংসারী লোকজনই পরিণত হচ্ছিল সমাজের প্রধান অবলম্বনে। বিয়ের পরপরই একজন গৃহস্থ নিজ বাড়িতে পবিত্র অগ্নি পাওয়ার অনুমতি পেত, সংস্কৃত আনুষ্ঠানিক শাস্ত্রের পরিবর্তিত ভাষ্য দৈনন্দিন আচার পালন করতে পারত। তার বাড়িই পরিণত হয়েছিল একান্ত উৎসর্গ এলাকা, যেখানে সে এমন এক সত্তা গড়ে তুলতে পারত যা মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকবে, প্রবেশ করবে দেবতাদের জগতে। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক সমাজের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সংসার ছেড়ে যাওয়ার অসাধারণ পদক্ষেপ নেয়, আশ্রয় নেয় বনে। সংসারকে জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু বানানোর বদলে স্বেচ্ছায় গৃহহারা হয়ে পড়ে। কর্কশ জীবন যাপন করত তারা, কোনও সাহয়সম্পদ ছিল না, ভিক্ষা করে খাবার খেত। কেউ কেউ তাদের চুল বেড়ে উঠতে দেয়, জট পাকিয়ে যায় তাতে, কেউ কেউ হলদে জোব্বা গায়ে দেয়, অন্যরা থাকত দিগম্বর। এইসব ‘সংসারত্যাগী’ (সন্ন্যাসী) নিজেদের সমাজের বাইরে নিয়ে গেলেও ভারতের আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলেন তাঁরাই।। এরপর থেকে গৃহস্থ নয়, গৃহত্যাগীরাই ধর্মীয় পরিবর্তনের অনুঘটকে পরিণত হবেন।১০৩ ব্রাহ্মণ পুরোহিত নন, ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন পর্যায়ের রূপ দেবেন তিনিই।
সঠিক করে এই পরিবর্তনের দিনক্ষণ স্থির করা কঠিন, তবে ব্যাপারটা অষ্টম শতকে সূচিত হয়েছিল বলে মনে হয়। ১০৪ ঘর ছাড়ার ব্যাপারটা হয়তো আরও আগের রেওয়াজের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, আর্যদের আগমনের আগে থেকেই দেশীয় অধিবাসীরা এর চর্চা করত, আবার অন্যরা হয় এটা বৈদিক আচরিক কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক বিকাশের অংশ, কিংবা সম্পূর্ণ নতুন মতাদর্শ১০৭ বলে যুক্তি দেখান। ঋগ বেদে ‘দীর্ঘ শিথিল চুল’ আর ‘মলিন হলদে বসন’ ভবঘুরেদের উল্লেখ আছে, যারা শূন্যে ভাসতে পারতেন, ‘এর আগে দেবতারা যেখানে গেছেন সেখানে যেতে পারতেন,’ এবং অনেক দূর থেকে সব দেখতে পেতেন। পাহাড়-বনে বাস করা এবং শিশু ও জন্তুজানোয়ার শিকারী দীর্ঘ বেণী পাকানো ভীতিকর দেবতা রুদ্রের প্রতি নিবেদিত ছিলেন তাঁরা। ১০৮ ঋগ বেদে রুদ্রের সামান্যই উল্লেখ রয়েছে, হয়তো স্থানীয় বাসিন্দাদের একজন দেবতা হয়ে থাকবেন। গৃহত্যাগীদের সঙ্গে ব্রাত্য যোদ্ধাদেরও মিল আছে, বৈদিক সমাজের প্রান্তে অবিরাম ঘুরে বেড়াতে পারত তারা ১০৯ এক ধরনের ইন্দো-ইউরোপিয় টানে তারা কথা বলত, কখনওই বৈদিক ধর্ম মেনে না নেওয়া আদি আর্য অভিবাসী হয়ে থাকতে পারে। ব্রাত্যদের খাবারের প্রয়োজন হলে জনবসতি থেকে চুরি করত। তাদের জোব্বার রঙ ছিল কালো (রুদ্রে’র রঙ); কাঁধের উপর ভেড়ার চামড়া জড়িয়ে রাখত, নিজস্ব আচার পালন করত আর সচেতনতায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কায়দা ‘ত্রয়ী দম’ চর্চা করত। পরে সংসারত্যাগীদের আধ্যাত্মিকতার মূলে পরিণত হওয়া যোগের এই আদি রূপ ব্রাত্য ও নতুন নিগূঢ়বাদীদের ভেতর আদর্শগত সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়।
শাস্ত্রজ্ঞরা সহিংসতাকে শাস্ত্রাচার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন, অধিকতর অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলতে শুরু করেছিলেন তাঁরা; এই সময়ে প্রাচীন যোদ্ধাদলগুলো ভবঘুরে সাধুদের অহিংস সম্প্রদায়ের পক্ষে অনুপযুক্ত আদর্শে পরিণত হয়েছিল। পশু ছিনতাইকারীদের প্রাচীন ভবঘুরে জীবনযাত্রায় ফিরে যাচ্ছিল গৃহত্যাগীরা। পূর্বসুরিরা যেখানে নতুন নতুন দিগন্তের বিস্তার ঘটিয়েছে, তারা সেখানে অন্তস্থঃ জগতে অভিযান চালিয়ে প্রাচীন যুদ্ধগুলোকে আলোকনের অন্তস্থঃ সংগ্রামে পরিণত করবে। ১১০ ভারতীয় অ্যাক্সিয়াল যুগে যুদ্ধের নীতিকে অনেক সময় শান্তিপূর্ণ, আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত রেওয়াজে পরিণত করা হয়েছে। পরিবার ছেড়ে বেদ শিক্ষার জন্যে গুরুর আবাসে চলে যাওয়া এবং ব্রাত্যদের অনুরূপ যার জীবন যাপনকারী তরুণ ব্রহ্মচারীর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট ১১১ পবিত্র টেক্সট মুখস্থ করার পাশাপাশি গুরুর অগ্নিকুণ্ডের দেখভাল করতে হতো তাকে, বন থেকে জ্বালানি যোগাড় করতে হতো আর খাবার মাংতে হতো। ব্রহ্মচারীকে ব্রাত্যদের মতোই চামড়ার পোশাক পরে ছড়ি বহন করতে হতো। বিশ্বের অন্যান্য অংশে ইন্দো-ইউরোপিয় তরুণদের প্রায়শঃই যোদ্ধার রীতিনীতিতে পাওয়ার জন্যে জীবনের একটা অংশ বনে জঙ্গলে কাটাতে হতো-বিপদের ভেতর দিয়ে শিকার, স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন আর বেঁচে থাকার অন্যান্য কায়দাকানুন শিখত তারা। সাবালক জীবনে পা রাখার অংশ হিসাবে বনের ভেতর একাকী দীক্ষার একটা অংশও কাটাতে হতো ব্রহ্মচারীকে, কিন্তু তার উপর স্পষ্ট করে শিকার, জন্তুজানোয়ারের ক্ষতি করা বা যুদ্ধ রথ হাঁকানোর উপর নিষধাজ্ঞা আরোপ করা হতো ১১২
ব্রহ্মচার্য (‘পবিত্র জীবন’) ছিল বৈদিক জীবনে দীক্ষা লাভ। পবিত্র হয়ে সহিংসতার আশ্রয় না নেওয়ার শপথ নিতে হতো শিষ্যকে। মাংস খেতে পারত না সে, তাপসের কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হতো, অগ্নিকুণ্ডের ধারে বসে ঘর্মাক্ত কলেবরে শ্বাসপ্রশ্বাসের চর্চা করতে হতো। ঋগ বেদ মুখস্থ করে উৎসর্গের সঠিক কায়দা কানুন শিখতে হতো তাকে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভাষায় প্রকাশে অক্ষম অর্জিত জ্ঞান (বিদ্যা)। ভারতে শিক্ষা কখনওই বাস্তবভিত্তিক তথ্য লাভের উপায় ছিল না। শিষ্য কাজের-মন্ত্র উচ্চারণ, কর্ম, আচার বা কৃচ্ছ্রতা সাধন-ভেতর দিয়ে শিক্ষা লাভ করত, যেগুলো মূলপাঠের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সময়ের পরিক্রমায় তাকে বদলে দিত, যাতে জগৎকে ভিন্ন চোখে দেখতে পেত সে। পবিত্র ও তুচ্ছ জগতের মাঝামাঝি এক শূন্যতায় বাসকারী ব্রহ্মচারীকে পবিত্র ব্যক্তি হিসাবে সমীহ করা হতো। তার শিক্ষক ছিলেন অপরিহার্য। অষ্টম শতাব্দী নাগাদ একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত ‘দৃশ্যমান উপাস্য’ হিসাবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিলেন।১১৩ বৈদিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ায় আচারের সময় প্রকাশিত ব্রাহ্মণের শক্তিতে পরিপূর্ণ থাকতেন তিনি। লাগাতার আপন ইন্দ্রিয়গুলোকে শৃঙ্খলার ভেতর এনে, সবসময় সত্যি কথা বলে, অহিংসার চর্চা করে এবং সবার সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক সমতার আচরণ করে ব্রাহ্মণ গুরু ‘পবিত্র জীবন’-কে মূর্ত করে তুলতেন। গুরুর খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয়ে অনুকরণ করে শিষ্য তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত এবং বৈদিক জ্ঞানের অন্তস্থঃ অর্থ জানতে পারত। এভাবে গুরু ছিলেন তার ধাত্রী, দিনের পর দিন খেটেখুটে শিষ্যের নতুন সত্তাকে (আত্মা) জন্ম দিতেন, যা পাহাড়কেও টলিয়ে দিতে পারত।১৪ দীক্ষা শেষ হয়ে গেলে একজন ব্রাহ্মণ আবার জগতে ফিরে আসতে পারতেন, বিয়ে করে পবিত্র অগ্নি জ্বালাতে, আপন শ্রেণীর দায়িত্ব পালন করতে এবং সংসার শুরু করতে পারতেন।
কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর কোনও এক পর্যায়ে নবীশি পর্ব অনেক পেছনে ফেলে আসা সাবালক ব্রাহ্মণরা গুরু বাদেই নিঃসঙ্গ ব্রহ্মাচার্য গ্রহণের বাধ্যবাধকতা বোধ করে; এতে তাদের আচরিক চর্চা আরও বেশি কার্যকর হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস ছিল তাদের।১১৫ ফের পবিত্র জীবনে বনে ফিরে গেছে তারা। কেউ কেউ স্রেফ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে এটা করেছে, কিন্তু অন্যরা আজীবন ব্রহ্মাচারীতে পরিণত হয়। বৈদিক আচারের সময় উৎসর্গকারী ও পুরোহিত স্বর্গের পথে অতীন্দ্রিয় যাত্ৰা করলেও খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে সেখানে থাকতে পারতেন। জাগতিক ও স্বর্গীয় জীবন পরস্পর সঙ্গতিহীন ছিল। স্বর্গ ভ্রমণের পরপরই আবার মর্ত্যে নেমে এলে উৎসর্গকারী সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবে বলে মনে করা হতো। নিরাপদে লৌকিক জগতে ফিরে আসার লক্ষ্যে অপবিত্রকরণের বিশেষ আচার পালন করতে হতো তাকে। কিন্তু গৃহত্যাগী পুনঃপ্রবেশ করতে চায়নি; সারাক্ষণই ব্রাহ্মণার বলয়ে থাকতে চেয়েছে সে, এবং তার মানে ছিল, তার পক্ষে আর এই জগতে বাস করা সম্ভব নয়। উৎসর্গকারী কেবল আচারের সময়টুকুই সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন, কিন্তু গৃহত্যাগী চিরকালের জন্যে একে প্রত্যাখ্যান করেছে।১১৬
আদি গৃহত্যাগীরা পবিত্রকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে। কেউ কেউ সম্প্রদায়ে বাস করেছে, বনের আশ্রয়ে পবিত্র আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে তারা, সেখানে আচার পালন করেছে। অন্যরা নিঃসঙ্গ বাস করেছে, সময়ে সময়ে উৎসর্গে অংশ নিতে গ্রামে ফিরে এসেছে। অবশ্য, কোনও কোনও গৃহত্যাগী বাহ্যিক কান্টের প্রতি ইতিবাচকভাবে বৈরী অনুভব করতে শুরু করেছিল।
১৯৭ বনে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ার আগের রাতে এই চরমপন্থী গৃহত্যাগীদের একজন তার সমস্ত উৎসর্গের উপাচার এক সঙ্গে করে নতুন করে আগুন জ্বালাত। পরদিন গোসল করে, দাড়িগোঁফ কামিয়ে শেষবারের মতো অগ্নিকুণ্ডে মাখন বা দুধ উৎসর্গ করে অগ্নিশিখা নিভিয়ে দিত সে। এই আচারটিকে এরপর থেকে সংসারত্যাগীর সঙ্গে করে বয়ে চলা পবিত্র আগুনের ‘অন্তস্থঃকরণ’ বলা হতো। এটা ছিল সকল আচার অবসানের আচার, চিরকালের জন্যে গ্রাম ছাড়ার আগে শেষ কাজ। এরপর হলদে জোব্বা গায়ে চাপিয়ে নতুন জীবনের প্রাথমিক শিক্ষা দানের গুরুর খোঁজে পথে নামত সে। ১১৮
সংসারত্যাগী তার ব্রহ্মাচার্যকে উৎসর্গের উচ্চতর ধরন মনে করত। পবিত্র অগ্নি অন্তরে জ্বলছে, জীবনদায়ী প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসে তা স্বপ্রকাশিত। তার প্রতি বারের খাবার এই অদৃশ্য, অন্তস্থঃ আগুনের কাছে বলী। কোনও সত্যিকারের আগুনে জ্বালানি ছুঁড়ে দেওয়ার আর প্রয়োজন ছিল না। আচরিক সংস্কারকরা একজন মানুষের আত্মা, তার অন্তস্থঃ সত্তাই প্রজাপতি বলে শিক্ষা দিয়েছিলেন; এটাই উৎসর্গ, তাহলে আর বাহ্যিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে যাওয়া কেন? সংসারত্যাগী উৎসর্গকে বাদ দিচ্ছিল না, বরং একে অন্তস্থঃ কর্মকাণ্ডে পরিণত করছিল। কার্যত সে প্রশ্ন করছিল: সত্যিকারের উৎসর্গ কি? কে প্রকৃত ব্রাহ্মণ-বাহ্যিক আচার পালনকারী পুরোহিত, নাকি চলার পথে সঙ্গে করে পবিত্র অগ্নি বয়ে চলা উৎসর্গকারী? ১১৯ নিজেকে বাহ্যিকভাবে ধারণা করা ধর্ম থেকে সত্তার ভেতর গড়ে ওঠা ধর্মে পরিবর্তিত করেছে সে। গৃহত্যাগীরাই ছিল প্রথম অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধর্মের অন্তস্থঃকরণ অর্জনকারীদের অন্যতম। শাস্ত্রজ্ঞরা দীর্ঘদিন আগেই উৎসর্গের বিভিন্ন আচার এক স্বর্গীয়, চিরন্তন সত্তার সৃষ্টি করে বলে দাবি করেছিলেন; উৎসর্গই আত্মা; এবং বিভিন্ন আচার ব্রাহ্মণের শক্তি ধারণ করে। গৃহত্যাগীরা একে আরও এক কদম এগিয়ে নিয়েছিল। আত্মা গোটা বিশ্বকে একসঙ্গে ধারণকারী শক্তি লাভ করার ক্ষমতা দিতে পারে। গৃহত্যাগ, কৃচ্ছ্রতা সাধন আর পবিত্র জীবনের চর্চা গৃহত্যাগীকে রহস্যজনকভাবে আত্মায় ধারণ করা সত্তার মূল ব্রাহ্মণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে।
বনের জীবন কঠিন ও কষ্টকর ছিল-এক অন্তহীন উৎসর্গ। ধীরে ধীরে পাশাপাশি দুই ধরনের অতীন্দ্রিয়বাদীর আবির্ভাব ঘটেছিল, নতুন নতুন সদস্য পাওয়ার জন্যে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিল তারা। তপস্বী নিজেকে দৈহিকভাবে মানব সমাজ ও গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতেন, শেকড়-বাকড় খেয়ে বনে জীবন যাপন করতেন, তপস্যা করতেন। কেউ কেউ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পবিত্র অগ্নিকুণ্ডকে ঘিরে তৈরি বসতিতে থাকতেন। তপস্বী বসতিতে উৎপন্ন খাবার গ্রহণ করতে পারতেন না, তবে অন্য শিকারী পশুর হাতে নিহত প্রাণীর মাংস খেতে পারতেন। তার সম্পূর্ণ আচার-আচরণ বনের জীবনে অংশ নিত। বনচারী ছিলেন তিনি, বসতি স্থাপনকারীর সম্পূর্ণ অপর পিঠ। লম্বা লম্বা অবিন্যস্ত চুল রাখতেন তিনি, গাছের বাকলে বানানো পোশাক পরতেন, মানবীয় সংস্কৃতির প্রতীক কর্ষিত কৃষি জমির উপর দিয়ে হাঁটার অধিকার তার ছিল না।
সংসারত্যাগী ছিল আরও বেশি চরমভারাপন্ন, দৈহিকের চেয়ে বরং আদর্শিক ছিল তার প্রত্যাহার। গ্রামে খাবার ভিক্ষা করার অনুমতি থাকলেও তার কোনও বাড়ি ঘর থাকতে পারত না-এমনকি বনের একটা কুঁড়েঘরও নয়-পরিবার না, যৌন জীবন নয়, আগুন নয়, কোনও সম্পদও নয়। বর্ষার সময় কোনও একটি জায়গায় থাকার অনুমতি ছিল, তা না হলে চলার উপরই থাকতে হতো, এক জায়গায় কখনওই দুই রাতের বেশি কাটাতে পারতেন না। কঠোর আত্মসংযম পালন করতে হতো তাকে, বাক্য ও ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হতো। বুনো জট পাকানো চুল তপস্বীর বিপরীতে সংসারত্যাগী মাথা মুড়িয়ে ফেলতেন, অহিংসার চর্চা করতেন, আর ‘তার ক্ষতি করুক বা দয়াময় আচরণ করুক, সকল প্রাণীর প্রতি সমান আচরণ করে’১২০ ‘ক্ষতিকর বীজ’ থেকে বিরত থাকতেন। কথার অতীতে অবস্থান করা বাস্তবতাকে অর্জনের জন্যে সংগ্রাম করার সময় ব্রাহ্মদ্য প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষকে নীরবতায় পর্যবসিতকারী ব্রাহ্মণের মতো গৃহত্যাগীকে অবশ্যই ‘নীরব সাধু’ (মুণি) হতে হতো।
প্রাচীন আচারের নিগূঢ় ব্যাখ্যা গড়ে তোলা আরণ্যক বা ‘বনের টেক্সটে’ এই কঠোর কৃচ্ছ্রতার সাধনার মৌল যুক্তি দেওয়া হয়েছে। উপবাস, কৌমার্যব্ৰত, তপস্যা, প্রাচীন বৈদিক ধর্মে যেমন ছিল সেভাবে এসব আর আচারের প্রস্তুতিমাত্র ছিল না; খোদ আচারে পরিণত হয়েছিল। কৃচ্ছতা সাধন তপস্যার আগুনে ব্যক্তিকে উৎসর্গের পশুর মতো ‘উত্তপ্ত’ করে তুলত; ব্রাহ্মণের পরম বাস্তবতাকে ধারণ করা উৎসর্গকারীর গভীরতম সত্তাই ছিল উৎসর্গ। ব্রাহ্মণের অন্তরেই যেহেতু দেবতাদের বাস, তাঁরাও ব্যক্তি সত্তার কেন্দ্রে বাস করতে পারেন। সুতরাং তার আধ্যাত্মিক উৎসর্গকে অন্তরে পরিচালিত করে মৌন সাধু অন্তস্থঃ ও বাহ্যিক দেবাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছিলেন, যারা আসলে একই। ১২১ প্রাচীন আধ্যাত্মিকতা থেকেই জৈবিক ও যৌক্তিকভাবে নতুন আধ্যাত্মিকতা গড়ে উঠেছিল। প্রথমত, শাস্ত্রজ্ঞরা প্রাচীন উত্তাল উৎসর্গের প্রতিযোগিতাগুলোকে সংস্কৃত করেছেন, যেখানে উৎসর্গের চৌহদ্দী অংশগ্রহণকারীতে ভরে থাকত। নতুন আচারে উৎসর্গকারী পরিণত নিঃসঙ্গ ব্যক্তিতে হয়েছিল, আচারের সময় মর্ত্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকত সে। গৃহত্যাগী এইবার এই একাকীত্বকে আরেক ধাপ সামনে নিয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তীকালের সাহিত্য গৃহত্যাগীকে আদর্শ ব্রাহ্মণ হিসাবে তুলে ধরলেও এবং তাকে বৈদিক সনাতন বিশ্বাসে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস পেলেও আসলে গোটা ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ করেছিল সে। ১২২ লোকে সংসার বৈরাগীর তারিফ করত, সাহসের সঙ্গে এক নতুন আধ্যাত্মিক পথে যাত্রা করা আধ্যাত্মিক বীর মনে করত তাদের। গৃহত্যাগী গ্রাম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে তার নিজের সৃষ্টি এক বিশ্বে বাস করত, কোনও আচার-অনুষ্ঠানের ধার ধারত না, মামুলি কোনও সামাজিক দায়িত্বই পালন করত না, এবং চরম মুক্তিকে আলিঙ্গন করেছিল সে। যে সময় পুরুষের জীবনযাত্রা তার জন্মের শ্রেণী দিয়ে নির্ধারিত হতো, সংসারত্যাগী তখন তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গৃহস্থ যেখানে সামাজিক নেটওয়ার্ক, পোষ্য আর সন্তান দিয়ে সংজ্ঞায়িত হতো, সেখানে গৃহত্যাগী ছিল কেবল নিজের জন্যে বেঁচে থাকা ব্যক্তি। অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন নায়ক বস্তুগত শক্তি নিয়ে গর্বিত বীরোচিত যোদ্ধা নয়, বরং অহিংসার প্রতি নিবেদিত, আপন সত্তার মূল সম্পর্কে সজাগ হয়ে পরমকে আবিষ্কার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাধু ছিলেন। গৃহত্যাগীরা যথাভূত, অর্থাৎ, এমন এক ‘আলোকনের’ সন্ধান করছিল যা আবার তাদের প্রকৃত সত্তার ‘জাগরণ’ও ছিল।