৩. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

৩. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

স্থান ও কাল…অজানা।

.

প্রথমে এল দর্শনের অনুভূতি। চোখ খুলে প্রথমা দেখল, উলটে রাখা জামবাটির মতো আকাশ। আকাশের রং কুচকুচে কালো। ওড়নার গায়ে যেভাবে লেগে থাকে সলমা-চুমকির ঝিকিমিকি, জামবাটির গায়ে তেমনই ঝিকোচ্ছে অজস্র তারা। আজ যত তারা, সব আকাশে? আগে কখনও দেখেনি প্রথমা। আকাশ বলে চিনতে না-ও পারত। নেহাত পায়ের দিকের আকাশ থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে পূর্ণিমার চাঁদ, তাই সুবিধে হল।

দর্শনের পরে এল শ্রবণের অনুভূতি। আশ্চর্য নীরবতা চারিদিকে। সেই নৈ:শব্দ্য ভাঙছে কুকুরের ডাক আর চড়চড় শব্দ। ওটা কীসের আওয়াজ? কিছু পুড়ছে নাকি? পোড়া পোড়া গন্ধও আসছে!

গন্ধের সঙ্গে এল একাধিক অনুভূতি। বন্যার মতো তারা প্রথমাকে ভাসিয়ে দিল। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে প্রথমা বুঝতে পারল তার ভয়ানক শীত করছে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা, সে একটা মাঠের মাঝখানে শুয়ে রয়েছে। তার সারা গায়ে জল, কাদা আর রক্ত মাখা, তার কিছু মনে পড়ছে না।

শীত করছে কেন? এটা কী মাস? মনে করতে পারল না প্রথমা। আজ কত তারিখ? কী বার? কোন সাল? মনে নেই। তার নাম প্রথমা। পদবি মনে নেই। বাবার নাম? ওহ! তার তো বাবা-মা নেই। সে অনাথ আশ্রমে থাকে। অনাথ আশ্রমের কী নাম? মনে নেই। স্কুলের খাতায় তার নাম প্রথমা। কী স্কুল? মনে নেই। সে পড়ে ক্লাস টেনে। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। আর…আর…আর…না:! আর কিসসু মনে নেই।

স্মৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা পরে করলেও চলবে। শরীর নিয়ে ব্যস্ত হল প্রথমা। শীতের অনুভূতি দ্রুত কমছে। কাঁপুনি আগের মতো নেই। ভোর হবে বলে পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়ছে বোধ হয়। পায়ের দিকের আকাশে চাঁদ আর নেই। গাঢ়, কালো আঁধার নিজেকে বদলে ধূসর হচ্ছে। একটু বাদে আকাশে লালের ছোঁয়া পড়বে।

শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা বাড়ছে। সারা শরীর জুড়ে যন্ত্রণা শেকড় চারিয়ে দিচ্ছে। উহ। বাবাগো! কী কষ্ট! শুয়ে শুয়ে প্রথমা খেয়াল করল তার সারা শরীরে ব্যথা। ডান হাত অনেক কষ্টে নেড়ে মাথা আর বাঁ-হাত স্পর্শ করে প্রথমা। চ্যাটচ্যাটে তরলে ডান হাতের তালু ভিজে যায়। চোখের সামনে তালু এনে প্রথমা বুঝতে পারে, রক্ত লেগে রয়েছে। নীল শার্টে রক্ত মুছে উঠে বসার চেষ্টা করে সে।

অনেকক্ষণ পরিশ্রমের শেষে বসে প্রথমা। আকাশ এখন ধূসর। সূর্যোদয় না হলেও দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না। কেন না তার মাথার দিকে, ফুট বিশেক দূরে রয়েছে অন্য এক আলোর উৎস। শুয়ে থাকার কারণে দেখতে পায়নি। উৎস দেখে নিজের অবস্থা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হল প্রথমার।

আলোর উৎস একটি অ্যাম্বুল্যান্স। চারচাকা ওপর দিকে। ড্রাইভারের আসনসহ সামনের দিকটা তুবড়ে চ্যাপটা হয়ে গেছে। বাতানুকূল, হাইটেক অ্যাম্বুল্যান্স অনেকক্ষণ ধরে জ্বলছে। চড়চড় আওয়াজ এখান থেকেই আসছে। নীল আর হলুদ আগুন, কালো আর সাদা ধোঁয়া, উলটোনো গাড়ির জ্বলন্ত কঙ্কালের পটভূমিতে পড়ে রয়েছে দু’টো মৃতদেহ। নীল শার্ট, নীল পাজামা পরা দুজন মানুষ অনেক আগেই মারা গেছে। পোড়া গন্ধ ওদের শরীর থেকে আসছে। তিন-চারটে কুকুর সবকিছু শুঁকছে আর ঘেউ ঘেউ করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে।

প্রথমার পেট গুলিয়ে উঠল। গলায় আর জিভে টোকো স্বাদ। বসে থাকা অবস্থায় ডানদিক ফিরে গলগল করে বমি করল। অম্ল ঝাঁঝে নাক-মুখ জ্বলে উঠল। উফ! বাবাগো!

ডানদিকে ফিরল বলেই ট্রাকটা দেখতে পেল। এর চাকাগুলো আকাশমুখো। ট্রাকের আশেপাশে ছড়ানো, কফিনের সাইজের দুটো কন্টেনার। ধাতুর তৈরি। একটার ডালা খোলা। সেটা থেকে হিশহিশ করে সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অন্যটা গুঁড়িয়ে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে ট্রাকের তলায় মাথা গুঁজে পড়ে রয়েছে। নীল রঙের কন্টেনার দুটোর গায়ে লেখা, ‘রি-লাইফ’। চকচকে রুপোলি রঙের ওপরে লাল দিয়ে লেখা। পাশে লোগো। নীল রঙের গোল বৃত্তের মধ্যে লাল রঙের রক্তের ফোঁটা।

রি-লাইফ? পুনর্জন্ম? না পুর্নজীবন? পুর্নজীবন বলে কোনও শব্দ হয়? কে জানে! তবে রি-লাইফ শব্দটা প্রথমার জানা। ওই শব্দটা একটা ক্লু। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে আরও ক্লু। কফিনের মতো দেখতে পাত্রের নীল রং, দুটি মৃতদেহের নীল শার্ট আর পাজামা, তার নিজের নীল শার্ট—এগুলো ক্লু। মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের পোশাক দেখে প্রথমা। সে পরে আছে বোতামবিহীন নীল ফুলহাতা শার্ট আর নীল পাজামা। পায়ে নীল হাওয়াই চপ্পল। শার্টের বুকের বাঁ-দিকে রি-লাইফের নাম ও লোগো। চপ্পলেও রি-লাইফের লেগো।

সে যে অনাথ আশ্রমে থাকে তার নাম রি-লাইফ। এই লোগোটা অনাথ আশ্রমের লেগো।

কন্টেনার দুটো তাহলে অ্যাম্বুল্যান্সে ছিল। সে-ও কি অ্যাম্বুল্যান্সে ছিল? ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় বাকিরা মরে গেছে আর সে একা বেঁচে রয়েছে?

তাই হবে। নিজের থিয়োরিকে সত্যি প্রমাণ করার জন্যে উঠে দাঁড়ায় প্রথমা। ওহ কী কষ্ট! সারা শরীর ঝনঝন করে উঠল। সমস্ত মনোবল এক জায়গায় করে প্রথমা খোঁড়াতে খোঁড়াতে মৃতদেহ দুটির কাছে যায়। একটি দেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে নীল শার্ট আর প্যান্টের অস্তিত্বটুকু বোঝা যাচ্ছে। লোগো দেখা যাচ্ছে না। অন্য মৃতদেহটি দেখে প্রথমা নিশ্চিত হল। হ্যাঁ। সেই রি-লাইফের লোগো। যা তার শার্টে অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে, চপ্পলে, কন্টেনারের গায়ে আঁকা রয়েছে।

ট্রাকে কারা ছিল? খোঁড়াতে খোঁড়াতে উলটানো ট্রাকের কাছে যায় প্রথমা। সামান্য ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে ড্রাইভারের আসনে যে ছিল, তার কী অবস্থা।

ওয়াক! আবার বমি করে প্রথমা। মাথায় পাগড়ি পরা পাঞ্জাবি ট্রাক ড্রাইভার আর রোগা পাতলা খালাসির মৃতদেহ দুমড়ে মুচড়ে মাংসের তাল হয়ে গেছে। কাটা হাত-পা ছড়িয়ে রয়েছে এদিকে-ওদিকে।

বমি করে ফতুয়ার হাতায় মুখ মুছতে গিয়ে থমকায় প্রথমা। আশেপাশে যা যা পড়ে আছে, তার মধ্যে একটা খবরের কাগজ দেখা যাচ্ছে। ফতুয়ায় মুখ না মুছে কাগজে মোছা যাক।

‘আজ সকাল’ পত্রিকা। ১ অক্টোবর, বুধবার, ২০১৪। কাগজে মুখ না মুছে শার্টের হাতায় মুখ মোছে প্রথমা। এই কাগজ মুখ মুছে নষ্ট করা যাবে না। কাগজটায় অদ্ভুত সব কথা লেখা রয়েছে।

যেমন, সাল। লেখা রয়েছে, ২০১৪ সাল? কিন্তু এটা তো ২০০৯ সাল। কনফিউজড হয়ে প্রথমা ঠিক করল, খবরের কাগজটা নষ্ট করা যাবে না। এই কাগজ তাকে হেল্প করবে। মাথার মধ্যে যেসব শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, কাগজের নানা তথ্য সাজিয়ে প্রথমা সেগুলো পূর্ণ করবে। মাথায় একটা কিছু হয়েছে। সে অনেক জিনিস ভুলে গেছে। ভুলে যে গেছে, এটা যখন বুঝতে পারছে তখন খুব বড় চোট লাগেনি। মাঠে পড়ে থাকা ওই চারজনের থেকে সে ভাগ্যবান।

কাগজ পড়া যাচ্ছে মানে সূর্য উঠেছে। পূর্ব দিকে তাকায় প্রথমা। ওই দিকে মাথা করে পড়েছিল, তাই খেয়াল করেনি যে একটু দূরে পাকা রাস্তা রয়েছে। রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ বাদে বাদে লরি বা ট্রাক হুশহাশ করে চলে যাচ্ছে।

আজ বোধহয় দু’তারিখ। কেন না, কাগজটা গতকালের। এত ভোরে, দুমড়োনো মুচড়োনো চেহারায় আজকের কাগজ পাওয়া সম্ভব নয়। আবার কাগজটা অতটা দুমড়োনো নয় যে মনে হবে আরও পুরোনো। যাই হোক, হেডলাইনে চোখ রাখে প্রথমা। ‘সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে, বললেন, রাষ্ট্রপতি।’ খবরে মনোনিবেশ করে প্রথমা। ‘গাঁধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে আমদাবাদের বণিকসভার এক ভাষণে রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জি জানিয়েছেন যে প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র ওয়ারিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে। ওয়ারিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিকের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার শেষে দুই রাষ্ট্রনায়কই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।’ এই অবধি পড়ে থমকাল প্রথমা। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি পুরুষ? সে তো জানত, মহিলা। খবরের কাগজ ভালো করে উলটে পালটে দেখে সে। কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে।

নাহ। কোথাও কোনও গণ্ডগোল নেই। ১ অক্টোবর, বুধবার, ২০১৪। ‘আজ সকাল’ পত্রিকার এটা মেদিনীপুর সংস্করণ। ভেতরের পাতায় জেলার নানান খবর রয়েছে।

জেলার খবর? মেদিনীপুর? প্রথমা তাহলে এখন কলকাতায় নেই? কলকাতা থেকে এখানে এল কী করে?

এত ধাঁধার সমাধান একসঙ্গে করা যাবে না। হাল ছেড়ে দিয়ে প্রথমা কাগজের পাতা উলটোয়।

বিদেশের খবরে চোখ বোলায় প্রথমা। ‘লন্ডনে বসবাসকারী অনাবাসী ভারতীয় মেয়েদের পনেরো-ষোলো বছরে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কম বয়সে বিয়ে লন্ডনে বেআইনি বলে মেয়ের বাড়ির লোক জোর করে তাদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা রুখতে লন্ডন পুলিশ মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছে, তারা যেন প্লেনে ওঠার আগে অন্তর্বাসের মধ্যে স্টিলের চামচ লুকিয়ে রাখে। সিকিয়োরিটি চেকিঙের সময় ধাতব চামচ স্ক্যানারে দেখা যাবে। তাহলেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক বুঝে যাবে যে মেয়েটিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাচার করা হচ্ছে।’

স্থানীয় খবরে বলছে, ‘জগন্নাথ ঘাটে ফুলব্যবসাকে আধুনিক করার জন্যে চারতলা এসি ফ্লাওয়ার মল হবে। এই নিয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রী অন্তরা দেবনাথের সঙ্গে হল্যান্ডের ফুল কোম্পানির বিশেষ চুক্তি সাক্ষর অনুষ্ঠান আছে।’

ধুস! আজেবাজে খবর। কাগজ রেখে প্রথমা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে। পাশের মাঠে অজস্র কাশফুল ফুটে রয়েছে। একসঙ্গে এত কাশফুল কখনও দেখেনি প্রথমা। না-না! দেখেছে। রেসকোর্সের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখেছে ভিতরে কাশফুলের বন্যা।

রেসকোর্সের পাশ দিয়ে সে কীভাবে যেত? মাথায় একটা ছবি তৈরি হচ্ছে। ট্যাক্সি করে সে যাচ্ছে। সঙ্গে তার বয়সি একটা ছেলে আর একটা লোক। ওরা কারা? মনে নেই। তবে হঠাৎই অন্য কয়েকটা কথা ঝুপ করে মনে পড়ল। একনম্বর, তার পদবি লাহিড়ি। দু’নম্বর, সে হেস্টিংসের কর্পোরেশানের স্কুলে পড়ে। তিন নম্বর, ক্লাস টেনের সে ফার্স্ট গার্ল।

আকাশের দিকে তাকাল প্রথমা। সবে সুযযিমামা উঁকি দিয়েছেন। ভোর হতে দেরি নেই। কাশফুলের এই সমারোহের মধ্যে দুটো গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে পড়ে আছে, চারজন লোক মৃত—এই খবর এখনও কেউ জানে না।

ট্র্যাকের আশপাশ দেখল প্রথমা। ভাঙা কাচের বোতল পড়ে রয়েছে। একটা গামছা, বলিউডের হিরোইনের ছবি, ভাঙা সিডি প্লেয়ার, কৃপাণ ও কড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রথমার মনে পড়ল, ট্রাক ড্রাইভারটি শিখ সম্প্রদায়ের ছিল। কৃপাণ ও হাতের কড়া ওরই। কীরকম দুর্ঘটনা ঘটলে হাত থেকে কড়া খুলে বেরিয়ে আসে সেটা ভেবে শিউরে উঠে প্রথমা নিজের কবজি চেপে ধরে।

তার কবজিতে একটা কিছু রয়েছে। বালা বা চুড়ি। ফুলহাতা শার্টের জন্য এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। তাড়াতাড়ি হাতা গুটিয়ে দেখে প্রথমা। সূর্যের প্রথম আলোয় বাঁ-কবজিতে ঝলমল করছে একটা চুড়ি। সোনালি রঙের চুড়ির গায়ে লেখা, ‘প্রথমা। রি-লাইফ।’

যাক! আত্মপরিচয় নিয়ে নিশ্চিন্ত হল প্রথমা। যতই মাথায় আঘাত লাগুক না কেন, যতই স্মৃতি প্রতারণা করুক না কেন, সে কয়েকটা ব্যাপারে নিশ্চিত। তার নাম প্রথমা লাহিড়ি, সে থাকে কলকাতার রি-লাইফ অনাথ আশ্রমে, কর্পোরেশানের স্কুলের ক্লাস টেনের সে ফার্স্ট গাল। আজ ২ অক্টোবর। মেদিনীপুরের কোথাও কোনও হাইওয়ের ধারে অ্যাম্বুল্যান্সের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষের পরে সে-ই একমাত্র জীবিত।

প্রথমা অ্যাম্বুল্যান্সের চারদিকে ঘুরপাক খায়। বিড়ির বান্ডিল, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে প্যাক করা খাবারের বাক্স, ফার্স্ট এড কিট…

ফার্স্ট এড কিট হাতে নেয় প্রথমা। কী আছে দেখা যাক।

ওব্বাবা! এতে সব কিছু আছে। তুলো, গজকাপড়, জীবাণুনাশক তরল, ছুরি, কাঁচি, চিমটে, ওষুধপত্তর। স্কুলে ফার্স্ট এড শিখেছে প্রথমা। নিজের শুশ্রূষা নিজে করে নিতে পারবে।

জীবাণুনাশক তরলে তুলো ডুবিয়ে সে বাঁ-হাত, বাঁ-পা আর মাথার বাঁ-দিকের ক্ষত পরিষ্কার করে। উরেব্বাবা! কী জ্বালা করছে! দাঁতে দাঁত চিপে কষ্ট সহ্য করে প্রথমা। জীবাণুনাশক ক্রিম ক্ষতস্থানে বুলিয়ে তার ওপরে তুলো লাগায়। গজকাপড়ে ক্ষতস্থান ঢেকে দেয়। এবার ডাক্তারখানা যেতে হবে।

ডাক্তারখানা? কোথায় পাবে? পরিস্থিতির জটিলতা এতক্ষণে প্রথমার মাথায় অল্প অল্প করে ঢুকছে। প্রাণের ভয় কেটে যাওয়ার পরে আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলো মাথায় কিলবিল করতে শুরু করেছে।

তার বাবা মা নেই। ভাইবোন নেই। এ জগতে তার আপন কেউ নেই। আজ যদি সে এখানে মরে পড়ে থাকত, তাহলে কেউ কাঁদত না। এরকম বেঁচে থাকার মানে কী? সে যে বাড়ি ফিরছে না, এই নিয়ে অনাথ আশ্রমের অন্য সদস্যরা কি চিন্তিত? কী যেন নাম ওদের? মনে পড়েছে! মেয়েদের ডরমিটরিতে প্রথমার পাশের খাটে শোয় তিন্নি। ছেলেদের ডরমিটরিতে প্রথমার বেস্ট ফ্রেন্ড হল ষষ্ঠীচরণ। ষষ্ঠী কি তার জন্য কাঁদছে?

প্রথমা জানে না। জানতে চায়ও না। তার জীবনীশক্তি খতম হয়ে গেছে। হাইওয়েতে পৌঁছে হাত নেড়ে ট্রাক বা লরি থামানোর মতো শক্তিও শরীরে নেই। আবার বসে পড়ে প্রথমা। দু’হাটু এক করে, মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে…

কোলাঘাট থেকে দেউলটি। ২ অক্টোবর।

ভোর ছ’টা থেকে সকাল দশটা।

.

‘অ্যাই মেয়ে, এখানে কী করছিস?’ কড়া গলার প্রশ্ন ভেসে এল প্রথমার দিকে। সে ধড়মড় করে উঠে বসল।

প্রথমা বেশিক্ষণ ঘুমোয়নি। সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন আকাশে আলো সবে ফুটছে। এখনও ভালো করে সকাল হয়নি। চোখ মুছতে মুছতে সে প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে তাকাল।

পানপাতার মতো মুখ, কপালে সিঁদুরের টিপ, টানাটানা চোখ, কানে দুল, নাকে নথ। একমাথা চুল পিছন দিকে টেনে খোঁপা করা। জংলাডুরে শাড়ি গাছকোমর করে পরা। বছর চল্লিশের মহিলার কাঁখে একটা ঝুড়ি। ঝুড়ি ভরতি পদ্মফুল। জংলাডুরে শাড়িটির কোমর পর্যন্ত ভিজে সপসপ করছে। প্রথমা বলে, ‘তুমি ফুল তুলে ফিরছ?’

প্রথমার পাশে বসে, ঝুড়ি মাটিতে নামিয়ে বউটা বলে, ‘কী করে বুঝলি?’

‘ভিজে শাড়ি আর পদ্মফুলের ঝুড়ি দেখে।’ বলে প্রথমা।

বউটা বলে, ‘কোলাঘাটের এইখানটায় খুব অ্যাক্সিডেন্ট হয়। ড্রাইভারগুলো আজেবাজে জিনিস খেয়ে গাড়ি চালায়।’

এই জায়গাটার নাম তাহলে কোলাঘাট। সে কোথায় রয়েছে, এটা জেনে খুশি হল প্রথমা। বউটা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর নাম কী?’

‘প্রথমা। তোমার কী নাম?’

‘আমার নাম জেনে তুই কী করবি?’ ধমক দেয় বউটা, ‘বাড়ি কোথায়?’

‘আমার বাড়ি নেই। অনাথ আশ্রমে থাকি।’

‘অনাথ আশ্রম? তোর বাবা-মা নেই?’ প্রথমার মাথায় হাত বুলোয় বউটা।

‘না।’

‘অনাথ আশ্রম কোথায় সেটা মনে আছে?’

‘কলকাতায়। আচ্ছা, এখান থেকে কলকাতা কত দূরে?’

‘রূপনারায়ণ পেরোলেই তো হাওড়া। ট্রেনে দেড় ঘণ্টার রাস্তা।’

‘তোমার নাম কী? তোমার বাড়ি কোথায়?’ পুরোনো প্রশ্নের সঙ্গে এবার নতুন একটা প্রশ্ন যোগ করেছে প্রথমা।

বউটা প্রথমার মাথায় চাঁটি মেরে বলে, ‘আমার নাম ধুয়ে জল খাবি? বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই নাকি? কাজের কথা বল। তা না…’ প্রথমার বাচনভঙ্গি নকল করে বউটা বলে, ‘ ”তোমার নাম কী? তোমার বাড়ি কোথায়?” কেন রে? তোর কী দরকার? কলকাতার মেয়েগুলো বেঁড়েপাকা হয়। এত বড় হলি, নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা হয়নি?’

প্রথমা জানে কেন সে ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আসলে সে তথ্য সংগ্রহ করছে। স্মৃতির ভাঁড়ার শূন্য। কিছুটা হলেও ভরতি করার জন্য এই প্রশ্নমালা।

‘আমার নাম উমা। এবার প্রাণে শান্তি হল? তুই আমায় উমামাসি বলে ডাকিস।’ পদ্মফুলের ঝুড়ি কাঁখে নিয়ে দাঁড়িয়েছে উমা। ‘আমার বাড়ি চল। এই শ্মশানপুরীতে বসে থাকতে হবে না। এক্ষুনি গাঁয়ের লোকজন এসে পড়বে। তারা তোকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাবে।’

‘পুলিশ কেন?’

‘তোর খোঁজপাত্তা লাগানোর জন্য থানায় নিয়ে যাবে। জেরা করবে। ওই জন্যই বলছি, চল, এখান থেকে পালাই।’

উমার পিছন পিছন খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রথমা হাঁটা লাগাল। পুলিশকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সে কোনও অন্যায় করেনি! কিন্তু থানাপুলিশ শুনলেই বুকের ভেতরে ধড়ফড় করে।

কাশফুলের ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উমা বলল, ‘বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া কর। তারপর কথাবার্তা হবে।’

আধঘণ্টা হাঁটার পরে বাড়ি পৌঁছোল উমা। একতলা, পাকা বাড়ি। সামনে একফালি বাগান। কলা, বাতাবিলেবু, বেল—এইসব গাছ রয়েছে। রয়েছে রঙ্গন, দোপাটি, জবা, টগর, গন্ধরাজের মতো ফুলগাছ। প্রথমাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে চ্যাঁচাবেড়ার গেট টেনে উমা বলল, ‘সবে সাড়ে ছ’টা বাজে। এখনও লোকজন বাড়ির বাইরে বেরোয়নি। চটপট ঢুকে পড়। তোকে কেউ দেখে ফেললে আমাকে হাজার কৈফত দিতে হবে।’

উমার বর লুঙ্গি আর জামা পরে দুটো ঝুড়ি নিয়ে বাইরের তক্তপোষে বসে পা দোলাচ্ছিল। উমাকে ঢুকতে দেখে বলল, ‘এত দেরি করলে হয়? মেচেদা লোকাল মিস হয়ে গেল।’

‘শশশ!’ ঠোঁটের ওপরে তর্জনী রেখে স্বামীকে চুপ করায় উমা। প্রথমাকে ঘরে ঢুকিয়ে বলে, ‘ফুলের কথা পরে হবে। তুমি ভেতরে এসো।’

উমার বর চোখ গোল গোল করে তক্তপোষ থেকে উঠে ভেতরে এল। দরজা বন্ধ করে উমা বলল, ‘কোথায় কোথায় লেগেছে দেখি।’

লাল সিমেন্টের মেঝেতে বসে প্রথমা বলল, ‘মাথায়, হাতে আর পায়ে। আমিই ব্যান্ডেজ করেছি।’

উমা ব্যান্ডেজ খুলে মাথা, হাত-পা দেখে বলল, ‘সামান্য কেটেছে। আর ব্যান্ডেজ না করলেও চলবে। চান করে আয়।’

‘চান করে উঠে কী পরব?’ কাঁদোকাঁদো গলায় বলে প্রথমা।

উমা বলে, ‘গেল পুজোয় শখ করে একটা সালোয়ার কামিজ কিনেছিলাম। পরা হয় না। ওইটে তোকে দেব।’

‘তোমার সালোয়ার কামিজ আমার ঢলঢল করবে।’ আপত্তি করে প্রথমা।

তোরঙ্গ থেকে হলুদ-সবুজের আঁকিবুঁকি কাটা পোশাক বার করে প্রথমার দিকে ছুড়ে উমা বলে, ‘তুই আর কচি খুকিটি নেই। কুড়ি-একুশ বছর বয়স হল।’ অন্তর্বাস হাতে গুঁজে বলে, ‘এইগুলো দিব্যি ফিট করবে।’

‘আমার বয়স ষোলো।’ আপত্তি করে প্রথমা, ‘আমি ক্লাস টেনে পড়ি।’

‘আগে চান করে আয়। পরে বিদ্যে ফলাবি।’ প্রথমাকে বাড়ির পিছনদিকের কুয়োতলায় পাঠিয়ে দেয় উমা।

অ্যাসবেস্টসের ছাদওয়ালা বাথরুম। লাল সিমেন্টের মেঝে। টিনের দরজা। নীল শার্ট আর পাজামা খুলে সাবান রগড়ে গা থেকে কাদা আর রক্ত তুলল প্রথমা। উমার দেওয়া পোশাক গলাল। সব কিছু ফিট করে গেছে। প্রথমা দেখে নিল, কামিজের হাতার আড়ালে চুড়িটা ঢাকা পড়েছে কি না। উমা যতই তার প্রাণ বাঁচাক না কেন, এটা ওকে দেখানো যাবে না।

কুয়োতলা থেকে বেরিয়ে প্রথমা দেখল, উমা তার বরের সঙ্গে শোওয়ার ঘরে বসে রয়েছে। এতক্ষণে নির্ঘাত তাকে নিয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। উমার বর ভুরু কুঁচকে প্রথমাকে দেখে বলল, ‘চোট তেমন নেই। একে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিলেই হয়। একা চলে যেতে পারবে।’

উমা বাটিতে দুধমুড়ি মেখে রেখেছে। এক চামচ মুখে দিতেই প্রথমার গা গুলিয়ে উঠল। মনে হল সব বমি হয়ে যাবে। ওয়াক তুলল সে। উমা ধমক দিল, ‘কাল কখন খেয়েছিলি?’

গতকাল কখন প্রথমা খেয়েছিল? মনে পড়ছে না। গতকাল তার জীবনে এসেছিল কি না, সেটাই স্মৃতিতে নেই। প্রথমা কথা না বলে দুধমুড়ি খেতে থাকে। একটু পরে গা গুলোনো ভাব চলে যায়। আসে সর্বগ্রাসী খিদের অনুভূতি। হাপুসহুপুস শব্দে পুরোটা শেষ করে উমার বরকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার নাম কী?’

লোকটা এক ছড়া কলা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কৃষ্ণকান্ত।’

কলার খোলা ছাড়াতে ছাড়াতে কৃষ্ণকান্তকে আড়চোখে দেখে প্রথমা। লম্বা-চওড়া চেহারা। মাথার চুল পাতলা হয়ে আসছে, তবে পাকেনি। পুরু গোঁফের জন্য গেরামভারি লাগছে। ঠোঁটের আর চোখের কোণে হাসি লেগে রয়েছে। উমার মতোই তার বর কৃষ্ণকান্তকেও ভরসা করা যায়।

‘তুই রি-লাইফে থাকিস? ওখানকার ফোন নম্বর মনে আছে?’ জানতে চায় কৃষ্ণকান্ত।

প্রথমা বলে, ‘তুমি রি-লাইফ চেনো?’

‘রি-লাইফের মেঘনাদ লাহিড়ি বিরাট নামকরা ডাক্তার। তার নাম সবাই জানে।’

কৃষ্ণকান্তর মুখে মেঘনাদ লাহিড়ির নাম শুনে প্রথমার মাথায় স্মৃতির ফ্লাডগেট খুলে গেল। একগাদা ছবি, দৃশ্য, সংলাপ, ঘটনা—যা এতক্ষণ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, হুড়মুড়, করে আছড়ে পড়ল চেতনায়। প্রথমা গড়গড় করে বলল, ‘মেঘনাদ লাহিড়িকে আমরা বাবা বলে ডাকি। রি-লাইফ অনাথ আশ্রম আর রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট—দুটোই হেস্টিংসের মোড়ে। ফোন নম্বর মনে আছে।’

মোবাইল ফোন বার করে কৃষ্ণকান্ত বলে, ‘নম্বর বল।’

কলা খেতে খেতে প্রথমা নম্বর আওড়ায়।

সেই নম্বরে ফোন করে, কানে মোবাইল দিয়ে কিছুক্ষণ শোনে কৃষ্ণকান্ত। ফোন কেটে বলে, ‘বলছে, এই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই।’

‘তাই আবার হয় নাকি?’ বিরক্ত হয়ে বলে প্রথমা, ‘গতকাল ওই নম্বর থেকে ষষ্ঠীকে ফোন করা হয়েছিল।’

‘ষষ্ঠী কে?’ জানতে চায় কৃষ্ণকান্ত।

সম্মোহিতের মতো প্রথমা বলতে থাকে, ‘ষষ্ঠী আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমার সঙ্গে অনাথআশ্রমে থাকে। আমাদের ওয়ার্ডেন গণেশদার সঙ্গে গত রাতে আমি বাবার চেম্বারে গিয়েছিলাম। চেম্বারের ফোন থেকে আশ্রমের নম্বরে ডায়াল করে গণেশদা বলেছিল যে আমাদের ফিরতে দেরি হবে। আজ নম্বরটার অস্তিত্ব নেই? এ আবার হয় নাকি?’

‘দ্যাখ প্রথমা,’ হাত বাড়িয়ে চুল ঘেঁটে দিয়ে কৃষ্ণকান্ত বলে, ‘আমি জানি যে তোকে থানায় নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু থানাপুলিশে আমার বডডো ভয়।’

‘আমারও খুব ভয়।’ কলা খাওয়া বন্ধ রেখে কামিজের হাতা টানাটানি করছে প্রথমা। চুড়িটা ঢাকা আছে তো!

কষ্ণকান্ত বলে, ‘তোর হাতে কী হল?’

‘কিছু না!’ কথা ঘুরোতে প্রথমা বলে, ‘উমামাসি ফুল বিককিরি করে। তুমি কী করো?’

‘আমি কোলাঘাট শ্যামাচরণ বিদ্যাপীঠের সায়েন্সের মাস্টারমশাই।’ প্রথমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কৃষ্ণকান্ত পালটা প্রশ্ন করে, ‘তোদের আশ্রমে আর কে কে থাকে?’

‘মেয়েদের দিকটায় আমি আর তিন্নি। ছেলেদের দিকটায় ষষ্ঠীচরণ, দু’কড়ি, সাত্তার, চার্বাক আর পাঁচু।’

‘ষষ্ঠীচরণ কি খেলার ছলে হাতি লুফত?’ মুচকি হেসে প্রশ্ন করে উমা।

‘হাতি? কই, না তো।’ সিরিয়াসলি জবাব দেয় প্রথমা। উমা অবাক হয়ে বলে, ‘তুই আবোলতাবোল পড়িসনি।’

প্রথমা ঘাড় নাড়ে। ‘কার লেখা বই? তোমার কাছে আছে? আমায় দেবে?’

উমা মাথা নীচু করে বলে, ‘বইটা আছে। কিন্তু দেব না! ওটা আমার ছেলের বই।’

‘আহ।’ এখন পুরোনো প্রসঙ্গ তোলার কী দরকার? কৃষ্ণকান্ত বিরক্ত। ‘আমাদের কাজ হল টিকিট কেটে মেয়েটাকে ট্রেনে তুলে দেওয়া।’

প্রথমা উমাকে বলে, ‘তোমার ছেলে কোথায়?’

‘ ”সে আর নেই রে! হার্টের অসুখ নিয়ে জন্মেছিল। চিকিৎসার খরচ আমাদের সামর্থের বাইরে। চোখের সামনে কষ্ট পেয়ে পেয়ে মারা গেল। আবোলতাবোল ওর মুখস্থ ছিল। ‘খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ, হাতি লোফেন যখন তখন…” ‘ হাউহাউ করে কাঁদছে উমা।

কৃষ্ণকান্ত ধরা গলায় বলল, ‘প্রথমার পুরোনো পোশাক একটা ঝোলায় ভরে দাও। আমি ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি। আর দেরি করলে, গাঁয়ের লোক পাঁচরকম কথা বলবে।’

পলিথিনের প্যাকেটে নীল শার্ট আর পাজামা ঢুকিয়ে উমা বলল, ‘সাড়ে ন’টা বাজে। স্টেশান পৌঁছোতে পৌঁছোতে দশটা বাজবে। তখন আপিস টাইমের ভিড় কমে যাবে। তুই ফাঁকা ট্রেনে বসে বসে যেতে পারবি।’

‘তোমার ফুল সাপ্লাইয়ের কী হবে?’ উমাকে বলে কৃষ্ণকান্ত।

প্রথমার কামিজের পকেটে দশটা দশ টাকার নোট গুঁজে উমা বলে, ‘ভেন্ডার কামরায় চেনা লোক থাকবে। তার হাতে তুলে দেব।’

‘আমাকে টাকা দিচ্ছ কেন?’ নোটগুলো উমাকে ফেরত দেয় প্রথমা।

উমা বলে, ‘পাকামি করিস না। রাস্তায় টাকা লাগবে। আর এই কাগজটা রাখ। এতে ওর মোবাইল নম্বর আছে। অসুবিধে হলে ফোন করিস।’

কাগজ আর টাকা কামিজের পকেটে ঢুকিয়ে, কৃষ্ণকান্তকে টাটা করে বাড়ি থেকে বেরোল প্রথমা। উমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘ট্রেন থেকে কোথায় নামব?’

‘সাঁত্রাগাছি স্টেশনে নেমে জিগ্যেস করবি, হেস্টিংস যাবার বাস কোথা থেকে ছাড়ে। যে-কেউ বলে দেবে। ওখান থেকে হেস্টিংস বাসে করে পনেরো মিনিটের রাস্তা।’

রাস্তায় দু’একজন লোক প্রথমাকে দেখলেও কেউ কিছু বলল না। স্টেশানে এসে সাঁত্রাগাছির টিকিট কাটল উমা। টিকিট প্রথমার হাতে ধরিয়ে দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে দাঁড়াল। হাওড়া যাবার ট্রেন আসছে।

মেচেদা লোকাল ফাঁকা। ভেন্ডার কামরায় একটা লোকের হাতে পদ্মফুলের ঝুড়ি ধরিয়ে উমা বলল, ‘বাজারে দিয়ে দিয়ো। টাকাপয়সার কথা কাল হবে।’ তারপর প্রথমাকে নিয়ে লেডিস কামরার দিকে দৌড় দিল।

প্রথমার পায়ে ব্যথা। সে দৌড়োতে পারছে না। ট্রেন ছেড়ে দিল।

হাতের কাছে যে দরজাটা পেল, তার হাতল ধরে ট্রেনে উঠে পড়ল প্রথমা। পিছন ফিরে দেখল, কোলাঘাট স্টেশান হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে উমা। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ওঠে প্রথমার। চোখ জ্বালা করতে থাকে। ফাঁকা কামরায়, জানলার ধারে বসে, রডে মাথা দিয়ে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *