৩. কালো-সবুজ ডুরে শাড়ি

গা-টা ধুয়ে শিলি একটি পরিষ্কার করে ধোওয়া কালো-সবুজ ডুরে শাড়ি পরেছিল। চোখে, কাজল দিয়েছিল। গলায় কুঁচফলের লাল-কালো মালা পরেছিল। উঠোনের কোণ থেকে তুলে গন্ধরাজ ফুল গুঁজেছিল খোঁপায়। লাল-কালো অথবা লাল কিংবা কালো কোনো ফুল-ই হাতের কাছে পায়নি যে, শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে খোঁপায় দেয়। কালো ব্লাউজ পরেছে একটি। সবচেয়ে ভালো ব্রাটি বের করে পরেছে আজ। তিনটি ব্রা আছে ওর সবসুদ্ধু। তার মধ্যে একটিই আস্ত। ওর চলে-যাওয়া মায়ের ব্রা আছে আলমারিতে, গোটা পাঁচেক। কিন্তু তার কুমারী বুকে তা ঢলঢল করে। ওর বুক যতদিনে মায়ের ব্রা-এর যোগ্য হয়ে উঠবে ততদিনে ব্রাগুলো ছিঁড়েই যাবে, নয়তো ইঁদুরে কেটে দেবে। ব্রা কাটলে কাটুক! ইঁদুরে-বাদুড়ে বুক না কাটলেই হল।

কোনো মেয়েই চায় না যে, তার সৌন্দর্যের মধ্যে সবচেয়ে যা সুন্দর, সেই বুক তাড়াতাড়ি মায়েদের মতো বড়ো হয়ে যাক।

বারান্দার দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছিল শিলি। বাবা, নগেন জ্যাঠাদের বাড়ি গেছেন। কাকা বাসস্ট্যাণ্ডে যায় এই সময়ে। রোজ-ই। পান খায়, গল্পটল্প করে। দু দিকের বাস ক্রসিং করে। নানা খবরাখবর চালাচালি হয়। ড্রাইভারদের দিয়ে কখনো-সখনো মুরগিটা, পাউরুটিটা আনিয়েও নেয়, আপ বা ডাউনের কোনো জায়গা থেকে।

চাঁদ উঠেছে এখন বাঁশঝাড়ের পেছনে। সন্ধের আগে একঝাঁক চাতকপাখি চমকে চমকে বেড়াচ্ছিল, ফটিক-জল, ফটিক-জল বলে। বছরের এই সময়টাতেই পাখিগুলোকে দেখা যায়। অন্য সময়ে কোথায় যে যায়, কী যে করে ওরা, তা কে জানে!

একটা লক্ষ্মীপেঁচা উড়ে এসে বসল, সিঁদুরে আমগাছটার ডালে।

চাঁদের আলোয় একটুক্ষণ বসে থেকেই উড়ে গেল।

লক্ষ্মীপেঁচা, লক্ষ্মীকে আনে ঘরে। এলে, ভালো হয় খুব।

একটা গান গাইতেন মা, লক্ষ্মী বন্দনার। মনে পড়ে শিলির। ভারি সুন্দর গানটি—

 এসো সোনার বরণ রানি গো, এসো শঙ্খ কমল করেএসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, থাকো মা লক্ষ্মী ঘরে

লক্ষ্মীকে তো ডাকে সকলেই, কিন্তু লক্ষ্মী কি সাড়া দেন সবার ডাকে?

শিলি লক্ষ্মীকে অবশ্যই চায়, কিন্তু এই দারিদ্রর জন্যেও তার এক বিশেষ অহংকার আছে। দারিদ্র্যমাত্রই প্রত্যাশায় ভরা, ভবিষ্যতের স্বপ্নে ভরা। তার গর্ভে যে, কী ঢেকে রাখে, তা শুধু দারিদ্রই জানে। দারিদ্র্যর মধ্যে বিন্দুমাত্র লজ্জা নেই। শিলি অন্তত করে না লজ্জাবোধ। লজ্জা, দারিদ্র্য লুকোনোর চেষ্টার মধ্যেই।

চারপাশ থেকে চৈত্রসন্ধ্যার গন্ধ উঠছে। পাঁচমিশেলি গন্ধ। তার সঙ্গে সাবান দিয়ে ভালো করে স্নান-করে ওঠা শিলির গায়ের সুগন্ধও মিশে গেছে। চৈত্রসন্ধ্যার গন্ধ শুধু ওঠে না, উঠেই পাগলামিভরা চৈতি হাওয়াতে ইতস্তত ছড়িয়ে যায়। ফতিমা দিদির বুকের ভাঁজের আতরের গন্ধর মতন তা ছড়িয়ে যায় চতুর্দিকে, সমানভাবে। মনটা পাগল-পাগল করে। শুধু মনটাই করে না শরীরটাও, কে জানে! কোনটা শরীরের পাগলামি আর কোনটা মনের, জানে না ও। আতরের গন্ধে নিজেকে কখনো-কখনো খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ওর।

আজ চান করে ওঠার পর যখন জামাকাপড় পরে কাজল আঁকছিল চোখে, দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন লণ্ঠনের আলোতে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল শিলিকে। নিজের-ই চোখে। বেশ, বউ বউ। যেদিন ও বউ হবে সস্তার বেনারসি পরে, সোনালি রুপোলি রিবন দিয়ে খোঁপা বাঁধবে, পায়ে আলতা পরবে, গায়ে-হলুদের হলুদ হলুদ

ছোপ লেগে থাকবে বুকের ভাঁজে, দুই কুঁচকির পাশে, নাভিতে, ক্যালকাটা কেমিকেলের কান্তা সেন্টের গন্ধে ভুরভুর করবে যেদিন তার গা, নিজের গায়ের মিষ্টি গন্ধের চেয়েও অনেক বেশি মিষ্টি হয়ে সেদিনকার সেই স্বপ্নের সুখের-ই মতন সুন্দর এক ভাব ফুটেছিল তার আলোকিত মুখখানিতে।

আজকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। বাড়িতে কেউই নেই এখন। ক্যাবলাটাও ছুটি নিয়ে গেছে গৌরীপুরে। এই চাঁদের রাতে, একা-বাড়িতে পুতনদা যদি আসত, যদি দু-হাতে তার এই মুখখানিকে আদরে ধরে তার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেত, বেশ হত তাহলে।

ও খুব ন্যাকামি করত, ঢং করে বলত, কয়রা কী? অসভ্য! ছাড়ো ছাড়ো! তোমার দাড়িতে লাগে। জ্বালা করে গাল। দাড়ি কামাও নাই ক্যান? জংলি!

পুতন বলত, কামাইছিলাম তো। তবে সেই সাতসকালে। আমি কি আর জানতাম ছাই যে, তোমারে চুমু দিমু আজ? তাইলে তো বিকালে আরও একবার কামাইয়াই আইতাম।

পুতনদা তাকে ছেড়ে দেওয়ার পরও অনেকক্ষণ তার ঠোঁট দু-টি জ্বলত। জ্বালাতেও কত ভালোলাগা। কতরকমের জ্বালাই না থাকে। সত্যি।

দেখতে দেখতে কখন যে, চাঁদের আলোতে ভরে গেছে চারপাশ, নিঃশব্দে, খেয়াল-ই করেনি শিলি। হিজল গাছটার মাথার ওপরে সন্ধ্যাতারাটা উঠে স্নিগ্ধ নীল দ্যুতিতে ফুটে রয়েছে, যেন কোনো নীলরঙা উজ্জ্বল ফুল।

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। টর্চের আলো এসে পড়ল গেটের কাছে। চাঁদের আলোতে ফিকে দেখাল সে আলো। পুতনের গলার স্বর না? তাই-ই তো৷ কার সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে আসছে।

–শিলি! শিলি আছস নাকি? কাকাবাবু? পরেশকাকু? আমি পুতন!

কে?

 শিলি, জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল দাওয়ায় হেলান-দেওয়া অবস্থা থেকে।

মুখে বলল, ভিতরে আইতাছে না ক্যান? বাবায়-কাকায় কেউই বাড়িতে নাই। আমি একাই আছি।

পুতনের সঙ্গের মানুষটি বলল, ফার্স্ট ক্লাস। চাপা গলাতে।

শুনল, শিলি।

মানুষটার গলার স্বরটা ভালো লাগল না ওর। গলার স্বরেও মানুষের অনেকখানি বোঝা যায় লোকটা ভালো নয়। এই কি সেই?

শিলি বলল, মনে মনে।

পুতন লোকটিকে নিয়ে চ্যাগারের দরজা দিয়ে ঢুকে এল।

বলল, দ্যাখ শিলি, কাকে এনেছি।

পুতনদার মুখে এমন কলকাতাইয়া ভাষা শুনে, ঘাবড়ে গেল শিলি।

পুতন আবারও বলল, অনেকক্ষণ আগেই আসতুম, কিন্তু আমার বন্ধু রাজেন, চান করতে, পাউডার মাখতে এতই সময় নিল যে কী বলব। কলকাতার মানুষ তো! বড়োলোকের ছেলে।

শিলি, তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে মাদুর এনে বিছিয়ে দিল, বড়োঘরের দাওয়াতে।

রাজেন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আছে। গা থেকে সেন্টের মিষ্টি নয়, ভীষণ উগ্র গন্ধ বেরোচ্ছে, ভুরভুর করে। গন্ধটাও ভালো নয়। সুগন্ধের মধ্যেও, কিছু সুগন্ধি কাছে টানে শিলিকে; আর কিছু সুগন্ধ দূরে সরায়। হয়তো সব মেয়ের-ই এমন হয়। হয়তো পুরুষেরও হয়, যারা সুগন্ধ ভালোবাসে। তা ছাড়া, ওদের দুজনের মুখ থেকেই ভকভক করে কীরকম একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। তাতে গা গুলিয়ে উঠল শিলির। গন্ধটা কীসের তা বুঝল না, তবে অনুমান করতে পারল। পেরেই, পুতনদার কথা ভেবে,ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগল বুকের মধ্যে।

পুতন বলল ও কী? দূরে কেন? আরও কাছে এসে বোসো। কলকাতা থেকে তোমার জন্যে নতুন বন্ধু আনলুম। কতা-বাতরা বলল।

পুতনের মুখে এই ভাষা শুনে শিলির ক্রমশই রাগ বাড়তে লাগল। বাকরোধ হয়ে গেল। সত্যিই। অনেক-ই বদলে গেছে মানুষটা। যেসব মানুষ নিজের ছেলেবেলা, নিজের মা-বাবা, নিজের পরিবেশ, অনুষঙ্গ, নিজের মুখের ভাষাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পারে, দুটো পয়সা বা দুটো বেশি পয়সা রোজগার করার জন্যে, সেইসব মানুষ কখনোই খাঁটি হয় না।

মেকি মানুষরাই এরকম করে। হীনম্মন্য মানুষেরা। অমন ভন্ড মানুষদের চিরদিন-ই ঘেন্না করে এসেছে শিলি।

মনটা হঠাৎ-ই খারাপ হয়ে গেল শিলির।

এমন সময় পুতনদার সেই বন্ধু রাজেন যার নাম, পুতনদাই বলছিল, ফস করে হাতের পাঁচ-ব্যাটারির টর্চটি ফোকাস করল শিলির মুখে। হঠাৎ-ই আলো পড়ায় দুটি চোখ-ই বুজে গেল শিলির।

রাজেন নিজের মনে বলল, খাসা! ভিলেজ বিউটি।

পুতন চাপা ধমক দিল। আঃ রাজেন।

-হলটা কী? বিউটি দেখে অ্যাপ্রিশিয়েট করব না?

পুতন সামলে নিয়ে বলল, বুজেচো শিলি, রাজেন কলকাতার খুব বড়োবাড়ির ছেলে। ও হচ্ছে আমাদের বাগানের ম্যানেজারের আত্মীয়। কোনোদিন গ্রাম-ই দেকেনি তো। তাই এয়েছে আমার সঙ্গে। গ্রামের মেয়েদের সৌন্দর্য সম্বন্ধে ওর দারুণ ইন্টারেস্ট। তোমাকে দেখে তো প্রেমেই পড়ে গেছে। অবশ্য পড়েছিল আগেই। আমার মুখে তোমার গল্প শুনে শুনে।

শিলি পাথরের মূর্তির মতো বসেছিল।

 লক্ষ্মীপেঁচাটা উড়ে গেছিল আমগাছ ছেড়ে, অনেকক্ষণ। শিলিকে ছেড়ে সব স্বপ্নও উড়ে গেছিল। অমন গন্ধভরা উদবেল চৈত্রর চাঁদের রাতে স্তব্ধ হয়ে এই নতুন পুতনের সামনে কাঠের পুতুলের মতন বসেছিল শিলি।

ভাবছিল, পুতন আসার স্বপ্নটা সত্যি না হলেই ভালো হত।

–একটা গান শুনিয়ে দাও তো শিলি, আমার ফ্রেণ্ডকে।

শিলি বিরক্ত গলায় বলল, যখন-তখন গান আসে না আমার।

–কখন আসে?

 রাজেন ভকভক করে গন্ধ ছড়িয়ে বলল।

যখন আমার ইচ্ছে হয়।

শিলি বলল।

শক্ত করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে।

–এখন একটু শোনালে হত না? আজ কী সুন্দর রাত মাইরি। গান গাইবার মতো রাত। ইচ্চেকে কি হওয়ানো যায় না?

–শিলি কিন্তু সত্যিই দারুণ গান গায়।

পুতন বলল, শিলিকে রাজি করাবার আশায়।

-কী গান গায়?

–কত গান, রবীন্দ্রসংগীত, অতুলপ্রসাদ, শ্যামাসংগীত।

–তুমি কাদের কুলের বউ গো তুমি কাদের কুলের বউ? যমুনায় জল আনতে যাচ্চো, সঙ্গে নেইকো কেউ?–এই গানটা জান নাকি গো?

অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে বলল, রাজেন।

শিলি মাদুর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, না। আমি জানি না। আর আমারে তুমি কইরা কইয়েন না আপনে। আপনে কইরাই কয়েন।

রাজেন হাসল, রসিকতা করে বলল, আচ্ছা! তাই কমু।

বলে, বাঙাল ভাষাটা ঠিক বলতে পারল কি না তা জানবার জন্যে পুতনের দিকে চাইল।

পুতন বলল, সাতবোশেখির মেলা তো এসে গেল। সামনের রবিবার। আমার বন্ধুকে নে। যাব দেখাতে। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে? শিলি?

-না

না কেন? তোমার বড়ো গুমোর হইয়েচে দেকচি।

 –গুমোর কথাটা শোনেনি আগে শিলি। কেউই বলেনি তাকে।

বুঝল, কথাটার মানে দেমাক। পুতনের মুখে ওইরকম বিজাতীয় ভাষা শুনে ও আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল। বেড়ালে যেমন করে কবুতরের পালক ছিটিয়ে রক্তের ফিনকি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে খায় তেমন করেই শিলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিল এই নতুন ক্যালকেশিয়ান কালচারের পুতন।

শিলি স্তব্ধ হয়ে ভাবছিল, কত অল্পদিনে কত্ত বদলে যেতে পারে একজন মানুষ।

তারপর ভাবল, হয়তো মানুষ-ই পারে। কুকুর-বেড়ালের পক্ষেও সম্ভব নয়।

পুতন বলল, শিলি আমার মুখ চেয়ে না কোরো না তুমি। আমি নরেশকাকাকে বলব। মাও তোমাকে বলবেন। মানে, আমার মা।

শিলি হঠাৎ বলল, না। আমি কোথাও যামু না। আর তোমাগো ভালোয় কইতাছি, বাবা কাকা আসনের আগেই তোমরা চইল্যা যাও পুতনদা। তোমার তো অনেক-ই উন্নতি হইছে দেহি! মদও খাইতাছ আজকাল। কাকা আইয়া পড়লে বিপদ অইব কিন্তু। গুলি কইর‍্যা মাইরাও ফ্যালাইতে পারে তোমাগো। একা বাড়িতে আমি, আর তোমরা মদ খাইয়া আইছ আমার লগে দেখা করনের লইগ্যা। তোমাগো সাহস তো কম না।

-কইচে কী পুতন? ও পুতন? ময়না কইতিচে কী? আরে ভিলেজ-বিউটি, মদ খেয়েই তো মানুষে মেয়েমানুষের কাছে আসে! তুমি তো অবাক করলে মাইরি। আমিই কি তোমার পত্তম নাগর? অ্যাঁ।

এমন সময় দূরে সাইকেলের ঘণ্টি বাজল।

টর্চের আলোর ঝলকও দেখা গেল।

আতঙ্কিত শিলি বলল, ওই কাকায় আইতাছে। তোমরা পিছনের দরজা দিয়া পালাও। কাকার সামনে মদ খাইয়া যদি যাও, তো বিপদ হইবনে।

পুতন বলল, ন্যাক্কামি কোরো না, কাকা যেন মাল খায় না।

পুতনের মুখে এমন ভাষা এবং সে ভাষা উচ্চারণ করার ভঙ্গি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল শিলি।

এমন সময় কাকা এসে ঢুকলেন, সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে।

-এই যে! পরেশকাকু। আমি এসেছি। সঙ্গে আমার বাগানের ম্যানেজারের আত্মীয় রাজেন চাটুজ্যে।

পরেশ কাছে এসে, শেয়ালের মতো নাক তুলে বাতাস শুঁকে বলল, বাবা : পুতন দেখি। লায়েক হইছ।

পুতনের ভাষার-নতুনত্বের ঘোর তখনও কাটেনি পরেশের।

সেই ঘোরের মধ্যেই বলল।

রাজেন বলল, পরেশকাকা, ওর দোষ নেই। আমিই খাইয়ে দিয়েছি ওকে। আপনি খাবেন?

–কী?

চমকিত পরেশ বলল।

–হুঁইস্কি। একটা আস্ত পাঁইট পকেটেই আছে। ব্ল্যাক-নাইট। বিলিতি মাল।

–মদ আমি খাই পুতন। কিন্তু বাড়িতে খাই না। সকলের সঙ্গেও নয়।

–এটা কি ভন্ডামি নয় পরেশকাকা?

 রাজেন বলল।

–সেটা আমি বুঝব।

তারপর পুতনের দিকে ফিরে বলল, মদ খাইয়া বাড়িতে আইস্যা শিলির লগ্যে কী গল্প করতাছিলি তুই?

পুতন একটু ঘাবড়ে গেল।

বলল, এই রাজেনকে নিয়ে সাত-বোশেখির মেলায় যাব। তাই শিলিকে বলতে এসেছিলাম। ও যদি যেত, তবে আমার কলকাতার ফ্রেণ্ড খুশি হত।

পুতন বলল।

পরেশ বলল, এখনও দেরি আছে সাতবোশেখির মেলার। তা শিলি কী কয়?

ও তো বলল, যাবে না। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন-না পরেশকাকা। ও গেলে রাজেনের ভালো লাগত। আমাদের এই গ্রামে তো বায়োস্কোপ-থিয়েটার কিছুই নেই। বেচারার সময়ই কাটছে না। শিলি গেলে বেশ এনজয় করত ও।

পরেশ বলল, শিলি তো আর খুকি নয়। মেলাতে তো ও যাইব নিশ্চয়ই। তবে তোমাগো লগে যাইব কী যাইব না, তা সম্পূর্ণ ওর-ই ইচ্ছা। ভাইবা দ্যাখনের সময় তো যথেষ্টই আছে। নাকি কও পুতন?

–হ্যাঁ, তা ত আচেই।

পুতনের চেহারা, চাল-চলন, মুখের ভাষা সব-ই আমূল বদলে গেছে। পড়াশুনো করে, বড়ো পরীক্ষা পাশ করে, বড়োমানুষ হতে গেলে যে, নিজেকে বদলাতে হয় তা জানত পরেশ এবং সেইজন্যে হয়তো, সবাই-ই যাকে বড়ো হওয়া বলে তা ও কোনোদিন-ই হতে চায়নি। সকলের মতো ও যে হয়নি, তা জেনে নতুন করে আশ্বস্ত হল পরেশ। পুতনটার জন্যে দুঃখ হল। ছেলেটা একেবারেই বয়ে গেছে, শহরের চোর-জোচ্চোরদের মতো হয়ে গেছে স্বভাব। কিরণমাসির একমাত্র বেঁচে-থাকা ছেলেটা পুরোপুরি বুঝি অমানুষ-ই হয়ে গেল! এর চেয়ে কিরণমাসির অন্য ছেলেগুলোর মতন ও-ও মরে গেলেই ভালো হত।

–কী ভাবছেন পরেশকাকা?

-ভাবতাছি। তা, ভাবনা তো আর দেখান যায় না। আইজ তোমরা ওঠো। আমি না হয় মদ টদ খাই। কিন্তু দাদা তো এসব একেবারেই পছন্দ করে না। জানোই তো তুমি। পথে দাদা আসতাছে দেইখ্যা আইলাম। তারিণীদার বাড়ি থিক্যা বাইরাতে দ্যাখলাম। আইয়া পইড়ল বইল্যা। দাদার আসনের আগেই তোমরা ওই পশ্চাতের চ্যাগারের দরজা দিয়া পলাও। নইলে, কীসে কী হয়, তা কহন যায় না। দাদায় তো হাই-প্রেশারের রোগী। হঠাৎ হঠাৎ রাইগ্যা যায়। জানোই তো। কী পুতন? জান নাকি?

–হ্যাঁ। হ্যাঁ। জানব না। নরেশকাকার মেজাজ তো নোটোরিয়াস। আমাকে দু-ঘা বসিয়ে দিলেই বা কী? কিন্তু আমার ফ্রেণ্ডের তো ইজ্জত বলে একটা ব্যাপার আছে।

বা : শুইন্যা বড়ো আনন্দ পাইলাম। ইজ্জত জ্ঞানসম্পন্ন লোক এ দ্যাশে, পেরায় গন্ডারের মতোই দুইপাপ্য হইয়া উঠছে। হত্যই আনন্দ পাইলাম।

এবার বাইরে নরেশবাবুর কাশির শব্দ আর টর্চের আলো শোনা এবং দেখা গেল।

 পরেশ বলল, ওই যে আইতাছে।

সঙ্গে সঙ্গে পুতন রাজেনকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ছায়াচ্ছন্ন বাঁশবনের নীচের পথে মিলিয়ে গেল।

বাইরে বেরিয়েই, কথা বলতে যাচ্ছিল রাজেন। পুতন মুখ চেপে ধরল। কিছুদূর ওকে মুখ চেপে নিয়ে গিয়ে, মুখ-থেকে হাত সরিয়ে নিল।

রাজেন বলল, তুমি কী মাইরি গুরু। শালা গা গরম করতে করতেই বিবি পালাল। তোমাকে তো বলেইচি গুরু, পেটে আমার মাল পড়লে মাগি আমার চাই-ই। তোমাদের গ্রামে খারাপ পাড়া-ফারা নেই কি? রেডলাইট এরিয়া। যেখানে শান্তির সঙ্গে ট্যাঁকের কড়ি গুনে দিয়ে মাগিদের খোমা দেখা যায়। নিজের খুপরিতে, নিজে সম্রাট হয়ে, নিজস্ব সুন্দরীকে নিয়ে যা খুশি করা যায়?

পুতন বলল, না। এই গ্রাম ভদ্রলোকদের গ্রাম।

–মরে যাই। মরে যাই! কী কতাই শোনালে মাইরি। এসব আমার জানা আছে। ঘোমটার তলায় খ্যামটা নাচে না, এমন মেয়েছেলে নেই কোনো ভদ্রলোকের গেরামে, এমন কথা আর যে-মক্কেলেই বিশ্বাস করুক, এই মক্কেল করবে না। আসলে বলো যে, তুমি ঝেড়ে কাশছ না।

পুতন একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, সত্যিই বলছি থাকলেও আমি জানি না।

যাঃ শালা! এখন কী করি? গা গরম হয়ে গেছে যে! এখন ঠাণ্ডা হই কী করে?

একটু এগিয়েই, ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল ওরা। সামনে হরিসভার বাঁধানো চাতাল। পাশে পুকুর। হরিসভার চারপাশে হাসনুহানার ঝাড়। মিষ্টি গন্ধ ভাসছে চাঁদ-মাখা আকাশে।

রাজেন হরিসভার চওড়া, সিমেন্ট-বাঁধানো, চাঁদের-আলোতে চকচক-করা চাতাল দেখে বলল, বাঃ এই তো মাল খাওয়ার জায়গা। তা গুরু, প্রথমেই এইকানে নিয়ে এলে না কেন? এসো, এই চাতালে বসে নতুন পাঁইটটাকে শেষ করি।

পুতন বলল, ছি :। এখানে অষ্টপ্রহর কেত্তন হয়। হরিনাম হয়। পালাগান সব। কখনো চব্বিশ প্রহরও হয়। হরিসভার চাতালে বসে মদ খাবে কী?

–যাঃ শালা। এ ক্যালানে বলে কি মাইরি! সেই শায়েরি জানো না? এক মাতাল মসজিদে বসে মাল খচ্ছিল। তো মৌলবি এসে বলল, এখানে বসে টানচো তুমি? কেমন বে আক্কেলে তোক হে? জানো না, এখানে খুদাহ থাকেন?

বলেই রাজেন হরিসভার চাতালে উঠে ভালো করে জোড়াসনে বসে পকেট থেকে পাঁইটটা

বের করল।

তারপর কী হল, শোনো। নিজেই বলল, আবার।

-কী হল?

বিরক্তির গলায় শুধোল পুতন।

–সে শালা মাতাল, মৌলবির দাড়ি নেড়ে দিয়ে বলল,

পিনে দে মুঝেমসজিদমে বৈঠকরাইয়ে উ জাগে বাতাঁদে যাহাঁ খুদাহ ন হো৷

-মানে?

পুতন শুধোল। তখন বিরক্ত গলায়।

রাজেনকে এখানে এনে যে, ও ভুল করেছে, তার নিজের ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি করেছে, তা ক্রমশই ও বুঝতে পারছে।

আবারও বলল পুতন, মানে কী হল তোমার ওই শায়রির?

শোনো গুরু, মানেটা হল, খুদাহ যদি একমাত্র মসজিদেই থাকেন তো ভালো কতা। আমি চলেই যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে এমন জায়গা দেখিয়ে দাও তো বাওয়া, যেখানে খুদাহ নেই। একটা জায়গা দেকাও। তাকেই বলল। সারা পৃথিবীটাই তো ইদগাহ। তোমার হরিসভা তো মসজিদের-ই মতো ধম্মেস্থান? নয় কি? আরে!

–কী হল? ঢালো মুখে এটু। মেজাজ বিগড়ে গেছে মনে হচ্ছে গুরুর।

–নাঃ। ওমনি।

-নাও, ঢালো।

–না, না। আমি আর খাব না।

–সে কী? কী হল?

–নাঃ

পুতন ভাবছিল, নিজের খারাপ হতে লজ্জা করে। সকলের-ই তো পরেশকাকার মতো বুকের পাটা নেই যে, যাই-ই করে তা বুক ফুলিয়ে করে। বাবা যখন বেঁচেছিলেন, বাবার মুখে শুনেছিল যে, অ্যামেরিকান আর টমি সৈন্যরা অথবা চা-বাগানের ম্যানেজারেরা যে বেলেল্লাপনা এদেশে এসে করেছে, তা নিজেদের দেশে করার কথা তারা চিন্তা পর্যন্ত করতে পারত না। পুতনও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে, নিজের শেকড়ের কাছাকাছি থেকে, নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-পরিচিত, নিজের আজন্ম পরিবেশের মধ্যে থেকে, একজন মানুষের খারাপ হয়ে যেতে অনেক বেশি খারাপত্ব লাগে। ভালো হতে যে-জোর লাগে, খারাপ হতেও তেমন-ই জোর লাগে। স্রোতের শ্যাওলা যারা, তাদের কথা অন্য। পুতন নিজের কাজের জায়গায়, চা-বাগানে কুলিবস্তিতে বা ওর নির্জন কোয়ার্টারে যা-কিছুই করতে পারে রাজেনের সঙ্গে, তা ও নিজের গ্রামে এসে করার কথা ভাবতেও পারে না। মনে হয়, ভাবলেও অপরাধবোধ জাগে একধরনের। এই বোধটা এখানে আসার আগে ওর ছিল না। এখানে এসে বুঝছে।

-কী হল গুরু? খাও এক চুমুক।

বলেই, জোর করেই পাঁইটের বোতলটা এবারে মুখে ধরে দিল পুতনের।

পুতন, আপত্তি সত্ত্বেও বড়োচুমুক লাগাল একটা।

 মদের এই দোষ। অথবা গুণ! বিবেক যখন চুলকোয়, মন বলে কাজটা ভালো হচ্ছে না, অন্যায় করছ খুব; তখন জোর করে মদ খেয়ে নিলে বিবেকের চুলকুনি কমে আসে। মন বলে, ঠিক আছে। ঠিক কোচ্চো বাওয়া।

ভালো উকিলের-ই মতো, মনও গেলাসের জলের দিকে যেন তাকিয়ে প্রয়োজনানুসারে প্রমাণ করতে বসে যায় যে; গেলাসটা আধভরতি? না আধখালি?

পেটের মধ্যে গিয়ে মস্তিষ্কে ক্রিয়া শুরু করল মদ। ধীরে ধীরে পুতনের জেগে ওঠা বিবেক, তার আশৈশব অনুষঙ্গর শালীনতা, তার মূল্যবোধ; গলে যেতে লাগল অ্যালকোহলের নিঃশব্দ প্রলয়ংকরী প্রক্রিয়াতে। ধীরে ধীরে।

পুতন একটি হেঁচকি তুলে বলল, কেমন দেখলে ভাই?

–কী?

একটু যেন অন্যমনস্ক, রাজেন বলল।

–শিলিকে?

সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ওঃ খাসা মাল। সুইট নাইনটিন ইয়েট আনকিসড।

একটু চুপ করে থেকে, রাজেন বলল, তবে কী জান? আসল ব্যাপারের সময় এইসব আনটাচড জিনিস বড়ই ন্যাকামি করে। অবশ্য পুরো মজাটাই আবার সেখানেই। রেজিস্টেন্স না থাকলে কোনো ভূখন্ডই জয় করে মজা নেই। কতাটা বলত, আমাদের নাদুদা। আমার গুরু।

বলেই, রাজেন হরিসভার চাতালে উঠে দাঁড়াল। তারপর চাঁদের আলোয় সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে পায়চারি করতে করতে, না, যেন চাঁদের আলোতে ভাসতে ভাসতে জোরে জোরে কথা বলতে লাগল পুতনের সঙ্গে।

পুতনের ভয় করতে লাগল। গ্রাম্য জায়গা। তার ওপরে কাছেই ঘোষেদের বাড়ি। সে বাড়ির ছোটোকর্তার কানে যদি, এই কথোপকথন যায়, তবে এক্ষুনি ওদের দুজনকে মেরে পুকুরে লাশ ফেলে দেবে। এ তো কলকাতা নয়। এখানে তো চেঁচিয়ে-বলা কথাকেও ঘরে ঘরে পাখা, আর রেডিয়ো-টিভি, ট্রাম আর বাস আর গাড়ির আওয়াজ ডুবিয়ে দেয় না, উড়িয়ে দেয় না। তা তো রাজেন জানে না। এখানে ফুলশয্যার রাতের স্বামী-স্ত্রীর ফিসফিসে কথাও পাশের বাড়ি থেকে শোনা যায়। নাঃ রাজেনকে নিয়ে এসে কাজটা ও ভালো করেনি আদৌ। এবারে সে নির্ঘাত-ই বিপদে পড়বে। বুঝতে পারছিল পুতন।

পুতন ভাবছিল যে, মা কিরণশশী জেগে বসে আছেন ওদের খাবার নিয়ে। হোন্দলের মা কি আর এতক্ষণ আছে? বেলাবেলিই তো চলে যায়। মুখে মদের গন্ধ নিয়ে মায়ের সামনে বসে খেতে হবে বলে বিবেক, রাজেনের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, খচখচ করছে একটু।

কিন্তু হলে কী হয়। শুধুমাত্র জন্মদাত্রীর অধিকার ছাড়া, অন্য কোনো অধিকার তো নেই মায়ের। এই বাড়িটাও বাবা তাকেই উইল করে দিয়ে গেছেন। কিরণশশীর তো কোনোই জোর নেই। পুতন যা বলবে, যা করবে; তাই-ই এখন নিয়ম। অশক্ত, বৃদ্ধা, পরনির্ভর সাধ্য কী? পুতনের মুখের ওপর কথা বলেন কোনো! শহরে কিছুদিন থেকে, বাগানে চাকরি করতে এসে, স্বার্থ ও সমৃদ্ধির স্বরূপ ও প্রক্রিয়া দেখে পুতন বুঝেছে যে, নিজের ভালো করতে গেলে পরের মন্দ করতে দু-বার ভাবলে চলে না। অত যারা ভাবে, তাদের সুখী হওয়া এই জীবনে আর হয়ে ওঠে না।

মায়ের সঙ্গে বাবা শুয়েছিল, দু-জন দুজনকে এনজয় করেছিল, তাই পুতন জন্মেছিল। তার মায়ের প্রতি পুতনের বিশেষ দায়দায়িত্ব তো থাকার কথা নয়।

-বসে বসে খাও না। অমন পায়চরি করার দরকার কী?

পুতন ফিসফিস করে বলল, রাজেনকে।

রাজেন বলল, বসে বসে মাল খাওয়া মানা। সায়েবরা কী বলে জানিসনি? বলে হাউ মেনি ড্রিঙ্কস ক্যান ইউ স্ট্যাণ্ড? যদি মাল বসে বসেই খাওয়ার ছেলে, তালে তো বলতেই পাত্তো হাউ মেনি ড্রিংকস ক্যান উ্য সিট? হু। হু। তা কি তারা বলেচে? এ কতাও আমার গুরুর কাছ থেকে শোনা। হুঁ বাবা! সায়েবদের সবসময়ই আমি মেনে চলি। সায়েবদের পায়ে জুতো পরিয়ে, তেল মাকিয়ে, আমার মোমের পুতুল ঠাকমাকে, পালকি করে সায়েবকে দিয়ে ব্রিডিং করাবার জন্যে ঠাকুদ্দা পাইটেচেলো। এমনিতে কি আর আমার গায়ের রং এমন সায়েবের মতো? সায়েব দিয়ে একবার করিয়ে নেওয়ায়, পুরো গুষ্টি কেমন ফর্সা বনে গেছে বলো। আমার জ্যাটার মাথার চুলও কটা রং। জ্যাটাকে পাড়ার লোকে শুধোত, এই যে হরেন। মাকে শুধিয়ো তো, ব্যাপারখানা কী?

জ্যাটা চটে গিয়ে বলত, তোদের মায়েরা সেকেনে গিয়ে পালঙ্কের ওপরে কেলিয়ে শুলেও সায়েব তাদের ইয়েতে মুতেও দিত না। বুয়েচিস।

হ্যাঁ কতা কইত বটে বাবা। বাবার কতার সামনে কোনো শালার দাঁড়াবার জো-টি ছিল না। মিত্যে কতাও বলতে পারত অনর্গল, চোখের পাতা একটুও না কাঁপিয়ে। ভালো উকিল হবার সবরকম গুণ-ই ছেলো। কিন্তু হল না কিছুই।

–কী করতেন তোমার বাবা?

জিজ্ঞেস করল, পুতন।

–তুমি হলে, আমার একবোতলের স্যাঙাত। তোমাকে ভাই বলতে বাধা নেই। অনেক কিছুই হত। তবে, শখ হিসেবে, মেয়ের দালালিও করত কখনো-সখনো বলে শুনিচি। তা বলে, সোনাগাচির মেয়ে নয়। বড়োঘরের সব ফাস্টোকেলাস মাল। সাপ্লাই করত সাহেব সুবোদের, তারপর দিশি সায়েবদের, ব্যাবসাদার ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তো দিল্লিই চলে গেসল। মাইরি! সুখ কত্তে হয়, তো দিল্লি চলো। কোটি কোটি টাকার ডিল হচ্ছে সেকেনে। মেয়েছেলে একহাতে দাও আর অন্যহাতে কনট্রাক্ট নাও; লাইসেন্স নাও। পেটে খাওয়া, জামাকাপড় পরা, মদ খাওয়াও সব-ই একসময় এসে বাস করতেই হয়। কিন্তু বিধাতা এই যে, হাড়বিহীন ওয়াণ্ডারফুল গুণী যন্তরটি দিয়েছে মাইরি সব পুরুষকে, এর গুণ হচ্ছে বিদ্যের-ই মতো। ক-জন পুরুষ শালা এই যন্ত্রের প্রপার ইভ্যালুয়েশন করল। শুধু বংশ রক্ষা করেই রিটায়ার করিয়ে দেয় নাইনটি-নাইন পার্সেন্ট পুরুষ। এর ভার্সেটাইলিটি সম্বন্ধে কতটুকু ধারণা আছে? ক-জনের আছে?

পুতনও, রাজনের এমন জ্বালাময়ী ভাষণে একটু ঘাবড়ে গিয়ে শুধোল, বিদ্যের-ই মতন মানে। মানে কী?

-মানে, যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে।

পুতন হেসে ফেলল, ওর কথা শুনে।

কিন্তু পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ কী ভাষা। কী সব আলোচনা! কিরণশশীর ছেলে সে। গরিব তারা হতে পারে কিন্তু মধ্যবিত্তর সব শালীনতা সভ্যতার গুণ তার মধ্যে তখনও কুঁই কুঁই করে হলেও একটুখানি বেঁচে ছিল। শিলির প্রেমিক ছিল সে। লেবুপাতার গন্ধ ছিল সেই প্রেমে, বৈশাখের ভোরের হাওয়ার পরশ ছিল। সব গোলমাল হয়ে গেল। তার চাকরি, তার ম্যানেজারের আত্মীয়কে খুশি করা, এসব কি চাকরির উন্নতির জন্যেই করতে হত? মাইনে একটু কম থাকলেই বা কী ক্ষতি হত?

এই কথা মনে হতেই তার মাথার মধ্যে কে যেন, গমগম করে বলে উঠল ধুলাবাড়ি! ধুলাবাড়ি। কত কী ইলেকট্রিক্যাল গুডস, কত সুগন্ধ, কত আরাম-বিলাসের উপকরণ, কত রঙিন নাইলনের প্যান্টি, ব্রেসিয়ার, কতরকম হুইস্কি। না না। উন্নতি তাকে করতেই হবে। পেছনে ফেরার উপায় নেই কোনোই। আত্মিক উন্নতি-ফুন্নতি বোকাদের ডিকশনারিতেই পাওয়া যায়। এখন আর্থিক উন্নতিই হচ্ছে একজন মানুষের পরমকামনা। যার অর্থ আছে আজ, তার সব-ই আছে। যার দু-নম্বর অর্থ আছে, তার সবেরও বেশি আছে। সেই রাজা। দন্ডমুন্ডের বাপ। সেই এক নম্বর দু-নম্বর মান যে-কোনো ফেরেলবাজি করেই, চুরি-জোচ্চুরি, স্মাগলিং করেই এককাট্টা করা হোক-না-কেন! একবার পকেটে ঢুকে এলেই বাসস।

রাজেন বলল, জিনিসটি কিমতি হবে।

বলেই বলল, কিন্তু কেন বলো তো গুরু?

পুতনের ভয় করতে শুরু করেছিল ইতিমধ্যেই, একটু শীত-শীতও। ও তুতলে বলল, কে কে কেন?

–নোনতা বলে। আর কেন! শালা মিষ্টি খেয়ে খেয়ে মুখ মরে গেছে। একটু নিমকিন না হলে; বলেই গোড়ালির ওপর দু-পাক ঘুরে নেচে নিয়ে বলল, নিমকিন না হলে জমে না। নোনতা স্বাদ হচ্ছে দুনিয়ার সেরা স্বাদ। পৃথিবীর সব সেরা জিনিসের স্বাদ-ই নোতা।

বলেই, গলা ছেড়ে গান ধরে দিল, নিজের পেছনে তাল ঠুকে, খেমটার সুরে।

বল, গোলাপ মোরে বল, তুই ফুটিবি কবে সখী, বল গোলাপ মোরে বল…

গান থামিয়েই বলল, কার গান বলো তো গুরু?

পুতন গান-ফান বিশেষ জানে না, শোনেওনি। শুনেছে ওই শিলির-ই কাছে, যা একটু আধটু। তাই চুপ করেই থাকল।

–তুমি কী ভাবছ? গহরজানের?

রাজেন নিজেই বলল আবার।

-কে গহরজান?

গহরজানের নাম শোনোনি। কী হে তুমি? তুমি একটি মাল! ছ্যা: যাকগে তার কথা বলতে বসলে রাত পোয়াবে। আম্মা অবশ্য তাকে চোকে দেকিনি। কাকা-জ্যাটাদের কাছে শুনিচি। কিন্তু এ গান গহরজান বাইজিরও নয়।

–তো কার?

–আমাদের-ই পাড়ার এক লোকের লেখা।

–সে কে? তোমাদের পাড়ার মানে?

–জোড়াসাঁকোর। রবীন্দ্রনাথ টেগোরের।

.

আলোকঝারিতে বিকেলে গেছিল পরেশ, বন্দুকটাকে কাঁধে নিয়ে। কাল রাতে পুতন আর পুতনের বন্ধু রাজেনকে খেতে বলেছে, গদাইকেও বলেছে, দাদা নরেশ। যদি মুরগি অথবা কোটরা হরিণ পায় তো ভালো হয়। পাঁঠা আর হাঁস-মুরগির মাংস তো ওরা রোজ-ই খায়। বুনো মোরগ অথবা হরিণ খাওয়াতে পারলে, সস্তাও পড়ে। তা ছাড়া, ওরাও নিশ্চয়ই খুশি হবে। শহরের লোক রাজেন তো বুনো পশুপাখির স্বাদ-ই জানে না।

বেলা হয়েছে, কিন্তু সন্ধে হতে এখনও ঘণ্টা দুই দেরি। সাইকেলটা রেখে এসেছে টুঙ বাগানের মধ্যেই। হরিণ পেলে, সঙ্গে কাউকে নিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। মুরগি পেলে তো সাইকেলের হ্যাঁণ্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। অসুবিধে নেই কোনোই।

পাহাড়ে কিছুটা চড়েই, নালাটার মধ্যে নেমে এল পরেশ। নালার শুকনো বালিতে জানোয়ারদের পায়ের দাগ পাবেই। তারপর ঠিক করবে কী করবে, না করবে।

নালাটায় নামার সময়েই ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় ওকে হঠাৎ-ই সাবধান হতে বলল। এরকম হয় কখনো-কখনো। কী করে হয়, তা ও ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না। কিন্তু হয়।

নালাটাতে নেমে একটু এগোতেই পরেশ দেখল মস্ত একটি মাদি বাঘের পায়ের দাগ। চিতা নয়, বড়োবাঘ। একেবারেই টাটকা। কিছুক্ষণ আগেই বাঘিনি গেছে শুকিয়ে-যাওয়া নদীর বালি-রেখে ধরে। মন খুব-ই খারাপ হয়ে গেল পরেশের। বাঘ যখন মারতে চায় না, তখন-ই বাঘের খোঁজ পায়। আর যখন চায়, তখন জঙ্গল হাঁকা করলেও টিকি দেখা যায় না। আজ ওর মন ওসব ঝামেলা-ঝক্কিতে যেতে চায় না। বাঘের মোকাবিলার মতো মন নিয়ে আজ বিকেলে ও বাড়ি থেকে বেরোয়নি আদৌ।

তবুও, সাবধানের মার নেই। যে-জঙ্গলে বিপজ্জনক জানোয়ার থাকতে পারে বলে মনে হয়, সেখানে ঢুকলে বন্দুকের ডান দিকের ব্যারেলে সবসময়ই এল.জি. রাখে, ছাত্তারের কথামতো। কখন যে, ইমার্জেন্সি হয়, কে বলতে পারে? কিন্তু এখন তো সম্ভাব্যতার কথা নয়, বাঘ যে আছেই, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। তাই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে, এক ব্যারেলে বুলেট আর অন্য ব্যারেলে এল.জি. পুরল। হরিণও মারা যাবে এল.জি. দিয়ে। দূরে থাকলে বলও চালাতে পারে।

এই শুকনো নালাটার মধ্যে আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলেই একটি দোলামতো জায়গা আছে ও জানে। তাতে মে মাসের শেষেও জল থাকে। ওইখানে পৌঁছে, ওই জলের পাশে, কোনো গাছের ওপরে উঠে বসে থাকলে কোনো-না-কোনো জানোয়ারের দেখা যে পাবেই, সেকথা ও জানত। মুরগি, ময়ূরও জল খেতে আসবেই। শুয়োরও আসবে তবে শহুরে রাজেন শুয়োর খায় কি না, জানা তো নেই!

তবে বাঘিনি, পরেশের আগে-আগেই গেছে। পরেশ তার একেবারে পায়ে পায়ে গিয়ে ঘাড়ে চড়তে রাজি নয়। আজকে বাঘিনির মোকাবিলা করতে আদৌ রাজি নয় পরেশ। আজ ওর মনে বাঘ নেই। মনে যেদিন বাঘ না থাকে, সেদিন বাঘের মোকাবিলা করা ঠিকও নয়। বাঘের শিকারে মন যদি পুরোপুরি কেন্দ্রীভূত না থাকে বাঘ-এরই ওপরে তাহলেই বিপদ। বিষম বিপদ।

কিছুটা এগিয়ে গেলেই ও পোঁছোবে, নালাটা বাঁক নিয়েছে যেখানে, সেইখানে ডানদিকে। সাবধানে, শুকনো পাতা এড়িয়ে বাটা কোম্পানির হান্টার শু পরে বালির ওপরে ওপরে ও নিঃশব্দে এগোতে লাগল।

কাঠঠোকরা ঠকঠক করে কাঠ ঠুকছে। কাঠবিড়ালি ডাকছে ল্যাজ তুলে তুলে, চিরির-র-র র, চিরি-র-র-র,করে। ময়ূর ডেকে উঠল নালার বাঁ-দিকের গভীর জঙ্গল থেকে কেঁয়া-আ আ-করে। বনমোরগের একটা মস্ত দল ডানদিকের জঙ্গলের গভীরে ঘুরে ঘুরে পোকা খাচ্ছে। শেষ-বিকেলের আলো লাল-কালো মোরগ আর মুরগিদের গায়ে পড়ে চমকে ঠিকরে যাচ্ছে। চারদিকে। মুরগিগুলো স্বগতোক্তি করছে পাতার মধ্যে, পাতা উলটে, পোকামাকড় খুঁটে খেতে খেতে।

বাঘিনি কাছাকাছি আছে, তাই গুলির শব্দ করা সম্ভব হল না।

আরও একটু এগোতেই, বাঘিনি একবার ডাকল উঁ-আ-ও করে।

এখন বাঘ-বাঘিনির মিলনের সময়। সঙ্গী খুঁজছে বাঘিনি। মেজাজ এখন খিঁচিয়ে আছে তার। রিঙ্কি মেমসাহেবের মতন। এই সময়ে মানুষীরা আর বাঘিনিরা করতে পারে না, এমন কম্মো নেই। মানুষ আর বাঘেরা এই সময়ে সাবধান না হলেই বিপদ।

বাঘিনি ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত বন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কাঠঠোকরা কাঠ ঠোকা বন্ধ করল। ময়ূর-মুরগি এবং অনান্য সব পাখিরাও হঠাৎ চুপ করে গেল। বনের রানি রোদে বেরিয়েছে। চুপ করে থেকেই সম্মান জানাতে হয় যে, সেকথা ওরা সকলেই জানে।

বাঘিনি ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই এক্কেবারেই ফ্রিজ করে গেল পরেশ। একটি খয়ের গাছের আড়াল নিয়ে। পোড়াকাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আরও একটু এগিয়ে যাওয়ার সময় দিল বাঘিনিকে। যেদিকে যেতে চায়, যাক।

তারপর-ই ওর মনে হল, বাঘিনি যদি জল খেয়ে, এই নালা ধরেই আসে তাহলে তার মুখোমুখি হতেই হবে। মুখোমুখি হতে তো আজকে চায় না পরেশ। তাই, তাড়াতাড়ি নালা ছেড়ে পরেশ বাঁ-দিকের জঙ্গলে উঠে গেল।

বেলা শেষ হয়েছে। কাল পয়লা বৈশাখ। নববর্ষ বলেই নেমন্তন্ন করেছে ওদের। কিছু শিকার না করে নিয়ে গেলেই নয়। বাঘ তো আর খাওয়াতে পারবে না। শালি! বাঘিনি মশকরা করার সময় পেল না আর।

মনে মনে বলল, পরেশ।

পাতা ঝরে গিয়ে গভীর বন এখন ন্যাড়া। যেসব গাছে পাতা আছে সেইসব গাছেও লালচে হলদেটে পাতারা ফুলের-ই মতো ফুটে আছে কালো কালো ডালে, হাওয়ার ছোঁওয়ায় ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায়। সামনেই এক দঙ্গল কুঁচফলের ঝাড়। লাল-কালোর দাঙ্গা লাগিয়েছে বনে। নীচে-ন্যাড়া, শালের বন। হাতির কানের মতো পাঁপড় ভাজার মতন মুচমুচে বড়ো বড়ো পাতা ঝরিয়ে দিয়ে সেগুন বন, এক আশ্চর্য বিধুর মৌনী ভেক ধরেছে। চৈত্রশেষের আর প্রথম বোশেখের বন, পরেশের মনকে উদাস করে দেয়। কিছুই ভালো লাগে না তার তখন।

কোনো গাছে উঠে বসলে, সেখান থেকে নালাটা ভালো করে ঠাহর করা যায়, তাই ঠাহর করছিল ভালো করে পরেশ, ঠিক সেই সময়ই ওর বাঁ-দিকে শুকনো পাতা মচমচিয়ে, কোনো কিছু নড়াচড়া করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে খয়ের গাছের পেছন থেকে সরে গিয়ে একটা শিমুল গাছের মোটা গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম চোখে চাইল সেদিকে। চেয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল ও। বাসরে বাস শঙ্খচূড় সাপের জোড় লেগেছে। প্রকান্ড বড়ো এক নাগ আর নাগিনি। মাটি থেকে চার-পাঁচ ফিট উঁচু হয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে একে অপরকে। হিসহিসানি শোনা যাচ্ছে তাদের।

এই দৃশ্য যে, দেখতে পায় সেই-ই নাকি রাজা হয়। শুনেছে অনেকেরই কাছে। এবার কি রাজা হবে পরেশ?

নিজেই বলল, নিজেকে নিরুচ্চারে, ওই দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে।

 এতদিন জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘুরছে, কিন্তু আগে কখনোই দেখেনি শঙ্খচূড়ের জোড় লাগা।

বন্দুকের বাঁ-নল থেকে বলটা বের করে একটা দু-নম্বর ছররা পুরল তাতে পরেশ। যদি নাগ বা নাগিনি হঠাৎ দেখে ফেলে তাকে, তবে তাদের হাত থেকে বাঁচতে হলে ছররা মারা ছাড়া উপায় নেই। বল বা এল.জি. দিয়ে হঠাৎ তেড়ে-আসা সাপকে ঠেকানো মুশকিল।

বন্দুকে ছররা পুরে, সে অনিমেষে নাগ-নাগিনির মিলন দেখতে লাগল। ছাত্তার মিয়ার ভাষাতে বললে বলতে হয়, ওর দিল খুশ হয়ে গেল।

কেন জানে না, হঠাৎ-ই ওর রিঙ্কি মেমসাহেবের কথা মনে পড়ে গেল, শরীরের মধ্যে সেই ছটফটানিটা হঠাৎ ফিরে এল। পরেশ ভাবছিল বাঘ বা সাপ বা অন্য সব জন্তু জানোয়ার-ই অন্য লিঙ্গর সঙ্গে মিলিত হয়-ই। তারা তাদের মায়ের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, না মেয়ের সঙ্গে, তার বাছ-বিচার তারা কখনোই করে না। এই বিচার থাকে কেবল মানুষের-ই। শুধুমাত্র মানুষ-ই মিলিত হয় না যন্ত্রের মতো, স্বজাতের যেকোনো স্ত্রীলিঙ্গের সঙ্গে। এবং শুধুমাত্র দু-একজন মানুষ-ই পারে, অথবা অবিবাহিত মানুষ পারে, না মিলিত হয়ে থাকতে। যেমন, পরেশ পেরেছে। মিলনের সঙ্গী, নিজের মনমতো পছন্দ করা শুধুমাত্র মানুষের-ই ধর্ম। এই পছন্দের পেছনে নানারকম সামাজিক এবং বিবেকজাত বাধাও থাকে। পছন্দ না হলে, সমাজের অনুমোদন না পেলে সারাজীবন একা একাই একজন মানুষ কাটিয়ে দিতে পারে, দেয়ও তো সত্যিই! কত পুরুষ ও নারীও!

সেই মুহূর্তে, ও যে, মানুষ হয়ে জন্মেছে, কোনো মনুষ্যেতর জীব হয়ে নয়; এই কথাটা নতুন করে জেনে খুব-ই ভালো লাগল পরেশের। এই একাকিত্বর আনন্দ এবং যন্ত্রণা শুধুমাত্র মানুষের-ই যে, একার। অন্য প্রাণীরা এই তীব্র আনন্দ এবং দুঃখ সম্বন্ধে কোনো ধারণাই যে, করতে পারে না। মেশিনের মতো তারা খায়, ঘুমোয়, জোড় লাগে, বংশবৃদ্ধি করে; তারপর একদিন মরে যায়। বেশি সময়েই তারা মরে, অন্যের খাদ্য হয়ে। কম সময়েই মানুষের মতো অসুখ-বিসুখে মৃত্যু হয় ওদের। জন্মায় অলক্ষ্যে যেমন, হঠাৎ করে; চলেও যায়, তেমনই করে।

একদৃষ্টে, জোড়া-লাগা নাগেদের দিকে চেয়েছিল পরেশ। এমন সময় ওর মনে হল, ওকে কেউ দেখছে পেছন থেকে।

জঙ্গলে নড়াচাড়া, কখনোই হঠাৎ-ই করতে নেই। হঠাৎ ঘাড়-ঘঘারাতে গেলে ঘাড়টিই খুইয়ে বসতে হয়। তাই খুব সন্তর্পণে পরেশ শরীর না ঘুরিয়ে নিজের ঘাড়টাকে আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল দুই গোড়ালির ওপরে পা রেখে। আধখানাও ঘোরেনি, তখুনি তার চোখের কোনায়, সে দেখতে পেল বাঘিনি নালার মধ্যে দাঁড়িয়ে জার্মান-জঙ্গলের ঝাড়ের আড়াল থেকে মুখ তুলে; একদৃষ্টে তাকে দেখছে নিশ্চল হয়ে।

বাঘিনিকে দেখতে পাওয়ামাত্র পরেশও স্থাণুর-ই মতো নিশ্চল হয়ে রইল। বাঁ-চোখের কোণে বাঘিনিকে নজর করতে লাগল সাবধানে একটুও নড়াচড়া না করে।

চোখের পাতা পর্যন্ত ফেলল না আর। পুরো দু-টি মিনিট বাঘিনি তাকে দেখল। তারপর-ই জার্মান-জঙ্গলের ঝাড়ের আড়ালে আড়ালেই চলতে শুরু করল নালার মধ্যে মধ্যে। শেষসূর্যের সোনা আলো, সেই ঝাড় ও গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দেখা-যাওয়া তার বাদামি-লাল-আর কালো ডোরাকাটা-সাদার ছোপলাগা শরীরে পড়ে, তাকে যেন আরও জমকালো করে তুলল। আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে গেল তার হেলতে-দুলতে যাওয়া শরীর, নালার অন্য প্রান্তে।

বাঘিনি অদৃশ্য হয়ে গেল, পরেশ সাবধানে, জোড়-লাগা নাগ-নাগিনির দৃষ্টি এড়িয়ে, নালায় নামল এসে। তারপর চলতে লাগল জলের দিকে। যেখান থেকে বাঘিনি সবে জল খেয়ে উঠে

কে জানে! সে আজ জোড়-লাগার সাথি খুঁজে পাবে কি না।

 বাঁকটা নিয়েছে যেই, অমনি দেখে একটা মস্ত শজারু চলেছে জলের দিকে। তাকে দেখেই, বন্দুক তুলল পরেশ। সেও পরেশকে দেখেছিল। দেখেই, সঙ্গে সঙ্গে গায়ের সাদা সাদা উলের কাঁটার চেয়েও অনেক মোটা আর লম্বা, কাঁটাগুলো ফুলিয়ে সে, পিঠ গুটিয়ে গোলাকৃতি হয়ে একটি প্রকান্ড সাদা-কালো বলের-ই মতো হয়ে গেল। হয়ে গিয়েই, ঝনঝন করে কাঁটা বাজিয়ে গভীর রাতে বল্লমের মাথায় ঘুঙুর বেঁধে, নির্জন গ্রামের পথে দৌড়ে-যাওয়া ডাক হরকরার-ই মতো ঝুমঝুমঝুম আওয়াজ তুলে বেগে দৌড়ে এল পরেশের-ই দিকে। তাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য।

পা-দুটি শক্ত করে দাঁড়াল পরেশ। খুশিতে ঝলমল করে উঠল ওর মুখ। মনে মনে বলল, আয় শালা! আরও কাছে আয়।

শজারুটি যখন খুব-ই কাছে এসে পৌঁছোল, শেষমুহূর্তে, হাস্যকর এবং শজারুর পক্ষে লজ্জাকর ভঙ্গিতে ঘুরে, সে চলে যেতে চেয়েছিল যদিও, পরেশ তখন-ই ভালো করে নিশানা নিয়ে গুলি করল। অতকাছ থেকে রোটাক্স-বল-এর থাপ্পড় খেয়ে মুখ থুবড়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ল শজারুটা কাঁটা-ছড়িয়ে, দিনশেষের গরম বালি আর নুড়ির ওপরে। খানিকক্ষণ থরথর করে কাঁপতে থাকল। কয়েকফোঁটা রক্ত বেরোল মুখ দিয়ে। ঝুমঝুম ফুলিয়ে-তোলা কাঁটা, তার দম্ভর প্রতীক, ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল শায়ীন ওর গায়ের ওপরে। তারপর এই জন্মের মতন স্থির হয়ে গেল। প্রবলের হাতে দুর্বল চিরদিন-ই এমন করেই মরে! এতে নতুনত্ব কিছু নেই। কী জঙ্গলে, কী শহরে! কী জানোয়ার, কী মানুষ। শেষাঙ্কটা একইরকম।

পেল্লায় সাইজের, প্রায় মন-খানেক ওজন হবে শজারুটার। ওই কাঁটাসমেত তাকে একা একা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না কোনোমতেই পরেশ। এতবড়ো শজারু, নিম্ন-আসামের এই অঞ্চলে যে, আদৌ আছে, তাও জানত না। আবু ছাত্তারকে বলতে হবে।

এখানে এখন তাকে রেখে গেলেও, শেয়াল বা হায়নার বা চিতার খাদ্য হয়ে যাবে। ফিরে আসার আগেই তারাই সাবড়ে দেবে পুরোপুরি। নিয়ে যেতে পারলেও নিয়ে গিয়ে লাভ ছিল না কোনো। শজারুর মাংস সকলে ভালোও বাসে না। মাটি-মাটি গন্ধ থাকে একরকম, খরগোশের মাংসর গন্ধর মতো। পরেশ নিজে যদিও ভালোবাসে। শিলিও। দাদা নরেশও শজারু ভালোবেসেই খায়। পুতনও খায় যদিও। আগে তো শজারু, বাড়ির মেয়েরাই মারত কলাগাছ ছুঁড়ে। কলাগাছ গেথে যেত কাঁটাতে। দৌড়ে পালাতে পারত না। তারপর অন্যেরা গিয়ে লাঠিপেটা করে শেষ করত।

পুতনের কলকাতার বন্ধু রাজেন হয়তো কোনোদিন শজারু খাওয়া দূরে থাকুক, শজারু কখনো চোখেও দেখেনি, চিড়িয়াখানায় ছাড়া। তার কাছেও এ এক নতুন অভিজ্ঞতাই হবে। এইসব ভেবে, কোমরের বেল্ট থেকে রেমিংটনের ছুরিটা বের করে ওখানেই বসে শজারুটাকে কাটল পরেশ। তারপর সবচেয়ে ভালো জায়গা থেকে সের পাঁচেক মাংসের একটা টুকরো কেটে, তাতে একটা ফুটো করে নিয়ে বন থেকে লতা ছিঁড়ে এনে বেঁধে ডান হাতে ঝুলিয়ে, বাঁ-হাতে বন্দুক নিয়ে ফিরে চলল।

এইরকম-ই হয়। ভাবছিল, শিকার করবে কোটরা হরিণ, ময়ূর, অথবা বনমুরগি। অথচ শিকার হল শজারু। জঙ্গলে এমন-ই হয়। যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায় না; আর যা, না চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়।

এখানের রকম-সকমই সব আলাদা।

সূর্য প্রায় ডুবে এসেছে। উঁচু-নীচু পথ বেয়ে চলেছে পরেশ, টুঙ বাগানের দিকে। গাছের ছায়ারা দীর্ঘতর হয়ে বসেছে। ঝিঁঝি ডাকতে আরম্ভ করেছে চারপাশ থেকে, একটানা, ঝুমঝুমির মতো। যেন হাজার হাজার শজারু কোনো মন্ত্রবলে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তাদের গায়ের লক্ষ লক্ষ কাঁটা বাজাচ্ছে কোনো অদৃশ্য শত্রুকে ভয় পাওয়ানোর জন্যে। এই শেষ বসন্তর আসন্ন সন্ধের বনপথে হাঁটতে হাঁটতে ঝিঁঝি-র ডাকের মধ্যে, শিমুলের আর পলাশের ঝিম-ধরা লাল রঙের মধ্যে, কালো পাথর আর লাল-হলুদ শুকনো পাতার রাশ, আর হলুদ, পিছল-পিছল, শুকনো বাঁশপাতার ওপরে ভেসে চলতে চলতে নেশা লাগে পরেশের। নেশা বলতে, ওর এইটিই প্রধান। মদ, মাঝে মাঝে খায় বটে ঠিক-ই; কিন্তু মদ কোনোদিনও ওকে খেতে পারেনি। অথচ এই বন আর পাহাড়, নদী আর বাদার নেশা কিন্তু তাকে খেয়েছে। পুরোপুরিই। সম্পূর্ণভাবেই খেয়েছে। ঘাড় মটকেছে ওর, বাঘে যেমন হরিণের ঘাড় মটকায়। কোনো মুক্তি নেই পরেশের আর এই জন্মে। এই সুন্দরীর হাতেই সে নিঃশর্তে হত হয়েছে, নিরুপায়ে।

বাড়ি পৌঁছোতেই দাদা নরেশ, শজারুর মাংস দেখে খুশি হল খুব-ই। একগোছা শজারুর কাঁটা এনেছিল পরেশ, শিলির জন্যে। এই কাঁটা, শখ করে শিলি কখনো-কখনো মাথার চুলে গোঁজে। বন্ধুদের দেয়।

জংলি জানোয়ারের মাংস একদিন ঝুলিয়ে রাখলে বা ধুয়ে দিয়ে রাখলে নরম হয়। খেতে ভালো লাগে। কিন্তু শিলি বলল, কাকা। আজ-ই ডুমা ডুমা কইর‍্যা কাইট্যা রাখুমানে।

হাত দুটো ধুয়ে এসেই জামাকাপড় না ছেড়েই বন্দুক পরিষ্কার করছিল বারান্দায় বসে, পরেশ। অন্যঘরের বারান্দায় বসে দাদা নরেশ, ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিল।

ক্লিনিং রড-এর মাথায় শিলির ভেঁড়া শাড়ির নরম টুকরো পেঁচিয়ে থ্রি-ইন-ওয়ান তেল দিয়ে মুছে রাখল এবারে। শুকনো কাপড় দিয়ে আগেই ফোঁটা কার্তুজের বারুদের ময়লা ঘষে ঘষে তুলেছিল। তারপর ক্লিনিং রড থেকে নোংরা ন্যাকড়া খুলে ফেলে ক্লিনিং-রড ও বন্দুক ঘরে তুলে রেখে সে, চান করতে যাচ্ছিল যখন, তখন-ই দাদা বলল, বুঝলি রে, ছাত্তার আইছিল।

-কখন?

ঘরের দাওয়ার খুঁটি ধরেই দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, পরেশ।

-এই, বেলা চারটা নাগাদ হইব।

–কইলো কী?

–কয় নাই কিছু। তরে এই খামটা দিয়া গেছে। কইলো, টাকা আছে।

–ক্যামেরন সাহেবের কথা কইলো কি কিছু?

পরেশ শুধোল।

–হ। কইলো, বাঘ মারাইয়া দিছে তারে ছাত্তারে। সাহেবে নাকি খুশি খুব-ই।

পরেশের খুব-ই ইচ্ছে হল, রিঙ্কি মেমসাহেবের কথা জিজ্ঞেস করে একবার দাদাকে। ছাত্তার মিয়া কিছু বলেছে কি না, তার সম্বন্ধে। কিন্তু লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারল না।

কেন যে লজ্জা হল নির্লজ্জ পরেশের, ভেবে পেল না।

লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে ইন্দারায় যাওয়ার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নামছে ও, সেই সময়ে দাদাই আবার বলল রিঙ্কি মেমসাহেব কেডা রে?

পরেশ চমকে উঠল।

আবারও লজ্জা হল খুব।

বলল, ক্যামেরন সাহেবের লগে আইছিল শিকার করনের লইগ্যা।

–ম্যাম নাকি?

দাদা শুধোল।

-হ! ম্যাম-ই বটে। তবে বিলাতি না। দিশি ম্যাম।

–দিশি ম্যামরাও আবার শিকার করতাছে নাহি আজকাল। আগে তো রাজারাজড়ার ঘরের মাইয়ারাই খালি শিকার করত বইল্যা জানি।

–আইজকাইল যার ঘরে পয়সা, হেই রাজারাজড়া। তাগোই দিন এহন। রাজাদের আর দাম লাই কোনোই। সব, মরা হাতি।

একটু চুপ করে থেকে বলল আবার পরেশ, ছাত্তারে, আর কইল কী? রিঙ্কি ম্যামসাহেবের কথা?

নারী-বিদ্বেষী পরেশের এই রিঙ্কি ম্যামসাহেবের প্রতি এত ঔৎসুক্যে অবাক হল দাদা নরেশ। পরেশ নিজেও কম হল না।

–ও। ভুইল্যাই গেছিলাম গিয়া। ছাত্তারে কইল, যে তর লইগ্যা একশত টাকা রিঙ্কি ম্যামসাহেবে দিছে। ক্যামেরন সাহেবের টাকার লগেই আছে হেই টাকা। ওই খামেই।

পরেশ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নরেশ বলল, আর তরে একবার দেখাও করতে কইছে সেই ম্যামে।

–আমারে? ক্যান? কোনখানে?

অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বলল পরেশ।

–আরও কয়দিন ধুবড়িতে থাকব ম্যাম। জিঞ্জিরাম নদীতে যাইব নাকি শুনি। কুমিরের ফোটো তুইলবার লইগ্যা। স্যা নদীটাই বা কোনখানে? নাম শুনি তো নাই কখনো।

নরেশ শুধোল।

পরেশ বলল, স্যা নদী গারো পাহাড়ের কোলে। ছোট্ট, মানে চওড়াতে ছোট্টই নদী, কিন্তু কুমিরে কুমিরে ভরতি। কিন্তু আমারে ডাকে ক্যান ম্যামে? ছাত্তার-ই তো যথেষ্ট। হ্যাঁ তো আর বাঘ শিকার না, যে দোসর লাগব।

-ম্যামেদের কথা, ম্যামেরাই জানে।

 দ্ব্যর্থক গলায় বলল, নরেশ।

পরেশ বলল, যাই, চানটা কইরাই আসি। চ্যাট-চ্যাট করতাছে গা ঘামে আর শজারুর

বাইরে ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। আমগাছে কাক ডাকছে। আর কদিন পরেই তো পূর্ণিমা। ইন্দারা থেকে বালতি বালতি জল তুলে ঝুপ ঝুপ করে চান করতে লাগল পরেশ।

হাসনুহানা আর বেলফুল ফুটেছে উঠোনে। ওর গায়ে-মাখা নিমসাবানের গন্ধের সঙ্গে হাসনুহানা আর বেলফুলের গন্ধ মিশে গেল। কিছু হাসনুহানা কেটে দিতে হবে। সাপ আসে, হাসনুহানার তীব্র গন্ধে।

পরেশ ভাবছিল যে, এই জ্যোৎস্না রাতের গায়েও একধরনের গন্ধ আছে, মেঠো ইঁদুরের গন্ধের মতো, বছরের এই সময়ের রাতে লিচু গাছে গাছে লিচু-খেয়ে-বেড়ানো বাদুড়ের গায়ের গন্ধের মতো। গ্রামের গায়ে একরকমের গন্ধ; বনের গায়ে অন্যরকমের। এই চাঁদনি রাতও কতরকম গন্ধের কারবার করে। এই জ্যোৎস্নারাতও যেন আর এক সাদা দাড়িঅলা মুসলমান আতরওয়ালা। রিঙ্কি মেমসাহেবের গায়ের গন্ধের সঙ্গে যেমন, শিলির গায়ের গন্ধের মিল নেই, তেমন শিলির গায়ের গন্ধের সঙ্গে আবার আলোকঝারি পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছোনো পর্বতজুয়ারের মেচ মেয়েদের গায়ের গন্ধের মিল নেই। যেমন জিঞ্জিরাম নদীর পারে দাঁড়িয়ে থাকা গারো বা রাভা মেয়েদের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মেচ মেয়েদের গায়ের গন্ধেরও মিল নেই। প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক নদী, প্রত্যেক মেয়ের গায়ের গন্ধ আলাদা। কোনো মেয়ের খুব কাছে না এসেও পরেশ জানে তা। নদীর গন্ধের-ই মতো, মেয়েদের গায়ের গন্ধও দূর থেকে পায় ও।

 হাওয়ায়, আর বৃষ্টিতে, জ্যোৎস্নায় আর কুয়াশায়, ভেসে আসে সেই গন্ধ।

কোয়াক। কোয়াক। কোয়াক করে, গম্ভীর গলায় মন খারাপ-করা ডাক ডাকতে ডাকতে একদল কেশরঅলা লম্বা-ঠ্যাং-এর সরু-গলা সাদা পাখি উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে, ময়নামারীর বিলের দিকে। আলোকঝারির পাহাড় থেকেই এল ওরা। ছাত্তার বলছিল, এই বকগুলোর ইংরিজি নাম নাকি হেরন।

ভালো করে সাবান মেখে, আবার জল ঢেলে ঢেলে হাপুস হুপুস করে চান করতে করতে পরেশ গায়ে সেই জ্বালাটা আবারও অনুভব করল। সেই যমদুয়ারের মাচায় বসে, রিঙ্কি মেমসাহেবের কাছে থাকার সময়ে, যেমন হয়েছিল। গা-ছমছম করে উঠল বীর শিকারির। তাকে ডেকেছে কেন রিঙ্কি মেমসাহেব কে জানে? নিশির ডাকের মতোই, সেই নিরুচ্চারিত ডাক তার বুকে এক অনামা ভয় জাগিয়ে তুলল। তাড়াতাড়ি, শুকনো গামছা দিয়ে গা মুছে, ভেজা গামছা ছেড়ে ফেলে, লুঙ্গিটা পরে ফেলল পরেশ। এই জ্যোত্সামাখা উদোম রাতে, একমুহূর্ত উদোম থাকলেই গা-শিরশির করে পরেশের। বিয়ে-করা মানুষ ও মানুষীরা অনেক সহজেই বোধ হয় নিজেদের নগ্নতাকে মেনে নিতে শিখে যায়। নগ্নতাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তারা। বিয়ে না করা লোকেরা পারে না। মুহূর্তের জন্যে নগ্ন হলেও হঠাৎ সামনাসামনি পড়ে যাওয়া বুনো শজারুর মতোই তাদের গায়ের সবকটি অদৃশ্য কাঁটা ঝমঝম করে বাজতে থাকে, গা-ময় কাঁটার-ই মতো, লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে।

এই চাঁদের রাত, হাসনুহানার গন্ধ, রাত-পাখির ডাক আর নিজের ক্ষণিক নগ্নতা মিলে মিশে গোঁড়, গেঁয়ো, আনপড় পরেশকে তারা যেন, হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় এক অচেনা পুরের দিকে। রিঙ্কি মেমসাহেবের কথা ভাবলেই, সে যেন এখনও কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। পরেশ ভাবে, পরেশও কি কোনোদিন তার এতদিনের নারী-বিদ্বেষ মুছে ফেলে অন্য দশজন ল্যাজে-গোবরে পুরুষমানুষের মতো, আবু ছাত্তারের-ই মতো, কাবিন নামাহ-তে সই করে বিবি আর আওলাদ নিয়ে ঘর করবে? জীবনের এই মধ্যাহ্নে এসে?

এখন যে, বড়ো তাপের সময়। শরীরে তাপ, সংসারে তাপ; বাজারে তাপ। ঘর বাঁধার মতো ভুল, প্রথম যৌবনের অবুঝ উচ্ছ্বাসেই করা যায়, এখন আর তা হয় না। কাবিন নিমাহ-র ওয়াক্ত চলে গেছে। এখন প্রত্যেক মানুষ ও মানুষী স্বরাট সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী। মেয়েরাই বোরখা আর পরতে চাইছে না। নিকাহ করে সারাজীবন বেঁধে রাখতে চাইছে না, তারাও আর নিজেদের, অন্য কোনোই পুরুষ গাধা-বোটের সঙ্গে।

জীবনের মানে ভেসে-যাওয়া, নদীর নিত্যনতুন বাঁকের নিত্যনতুন চমকের সৌন্দর্যর শিহরনে মুহুর্মুহু শিহরিত হতে থাকার-ই অভিজ্ঞতা। বিয়ে বা নিকাহ। সামাজিক বা শারীরিক প্রয়োজনীয়তা হয়তো ছিল পাঁচশো বছর আগেও। আজকে এই পুতুলখেলার কোনো অবকাশ-ই নেই। অন্তত পরেশের কাছে। বিয়ে না করা মানুষ, পরেশের মতো, রিঙ্কি মেমসাহেবের মতো, বিয়ে-করা মানুষদের চেয়ে অনেক-ই বেশি স্বাধীন। এবং খুশিও। তারা নিজেদের জন্যেই বাঁচে জীবনে, বিবি আর একপাল বাচ্চাদের নিয়ে হিমশিম হয়ে এই একটামাত্র জীবন, জীবনের মধ্যে থেবড়ে বসে, তাদের জীবনের মাছি ভন ভন আঠালো মুহূর্তগুলিকে কাঁঠালের প্যাতপ্যাতে কোয়ার মতো নেড়ে-চেড়ে, জীবনের মেয়াদ শেষ করে যায় না।

সেই জীবন, এক, একঘেয়ে রিক্ত রিয়াজের জীবন, সে-জীবন কোনোদিনও বন্দেগি হয়ে ওঠে না।

না, না। পরেশ অমন ভুল করবে না।

রিঙ্কি মেমসাহেবের কথা ভেবে, তার যতই রিকিঝিকি হোক-না-কেন শরীরে।

এত ভালো ভালো কথা পরেশ মুখে হয়তো বলে না, কিন্তু তার মাথার মধ্যে যে, ভাবনার অনুরণন ওঠে, তা ভালো ভালো শব্দে প্রকাশ করলে হয়তো এইরকম-ই শোনাত।

এ জন্মে হল না। অনেক কিছুই হল না। পরের জন্মে, ভালো করে লেখাপড়া শিখবে পরেশ। অনেক বড়োলোক হবে। ক্যামেরন সাহেবদের সমাজের কোরকের গন্ধ নেবে নাকে। মস্ত হয় থাকবে সারাক্ষণ। পরের জন্মে।

আজ পুতন এবং তার বন্ধু রাজেন খাবে।

সকাল থেকে শিলি রান্নাঘরেই আছে। শহরের ছেলেকে গ্রামের রান্না খাওয়াব, বলেছে পরেশ। কুচো মাছ ভাজা। শিঙি-বেগুন-আলু-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কার রসা, চিতলের পেটি, ধুবড়ি থেকে আনিয়েছে পরেশ, বাস-ড্রাইভারকে দিয়ে। রান্না করছে শিলি, ধনেপাতা কাঁচালঙ্কা দিয়ে। কাঁঠালের বিচিভাজা। বড়ো বড়ো কইয়ের হরগৌরী। একপাশে মিষ্টি, অন্য পাশে ঝাল। চালতার আর করমচার টক। মধুদার দোকানের রসগোল্লা। আর ঘন করে জ্বাল-দেওয়া দুধের লাল-থকথকে পায়েস। সেদ্ধ চালের। কিরণশশীকেও খেতে বলেছে রাতে শিলি। বুড়ির জন্যে লুচি করে দেবে ক-খানা। কুমড়ো, আলু আর ছোলার তরকারি করবে। নিরামিষ। পায়েস তো আছেই। গদাইও আসবে।

এতদিন গদাইকে সহ্য করতে পারত না শিলি। বদলে-যাওয়া পুতন আর তার বন্ধু রাজেনকে দেখার পর থেকে গদাইকে অতখানি খারাপ আর লাগে না। যাই হোক, গদাই গ্রামের ছেলে। শিলি ওকে তবু বোঝে। ওদের বোঝে না। পুতন এতটাই বদলে ফেলেছে নিজেকে, যে, তাকেও প্রায় অচেনা বলেই ঠেকছে শিলির চোখে।

রাজেন ছেলেটার চোখের দৃষ্টির মধ্যেই দারুণ এক অভব্যতা আছে। শিলিকে নদীপারের নগ্ন দেখার পরও গদাই-এর চোখে এমন বিচ্ছিরি কদর্য দৃষ্টি ছিল না। জানে শিলি।

রাজেনের দুটি চোখের যেন অনেকগুলো অসভ্য হাতও আছে। মাকড়সার হাতের মতো রোমশ, গা ঘিনঘিন হাত। তার চোখের যে, অদৃশ্য হাত দু-টি দিয়ে ও শিলিকে চকিতে নগ্ন করে ফেলে, তার সমস্ত লজ্জাস্থান-ই যেন অসভ্যর মতো অধৈর্যে স্পর্শ করে।

রাজেন ওর দিকে তাকালেই ভীষণ-ই অস্বস্তি বোধ করে শিলি। ভীষণ খারাপ লাগতে থাকে। নরকের কীট ও একটি। ওই রাজেন।

কাকা ওকে খেতে বলাতে তবু আপত্তি করেনি শিলি। কারণ, বাবা ও কাকার মুখের ওপর কিছু বলার মতো শিক্ষা ও পায়নি। রাজেনের জন্যেই এতপদ রান্না করতে হবে শুনে, দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল ও। তবু ভেবেছে, পুতনদার মতি যদি ফেরে। অনেক-ই বদলে গেছে তার পুতনদা। মতি আর ফিরবে বলে মনে হয় না। মুখের ভাষায়, ব্যবহারে, পোশাকে-আশাকে, চাউনিতে সেও অন্য এক রাজেন হয়ে উঠেছে। যে-পুতনদাকে দেখলেই, ভালোলাগায় মরে যেত একদিন, তাকে দেখেই এই ক-দিন কেমন এক শঙ্কা বোধ করেছে শিলি। খারাপ-লাগা।

একদিন দুপুরে কিরণশশীর কাছে গেছিল শিলি। পুতন আর রাজেন বাড়ি ছিল না। ধুবড়িতে গেছিল সিনেমা দেখতে।

শিলি বলেছিল, কী বুড়ি? ছাওয়াল আইছে বইল্যা কি আমারে ভুইল্যা যাওনটা ঠিক?

কিরণশশীও বদলে গেছেন। এই ক-দিনেই তাঁর চোখ কোটরে বসে গেছে। ছেলে-আসার আনন্দের বদলে, এক গভীর ভয় ও শঙ্কা তাঁকেও ঘিরে রয়েছে।

খুব-ই লজ্জিত গলায় কিরণশশী বলেছিল, কার ছাওয়াল? পুতন, আমার ছাওয়াল না।

–কও কী তুমি? পাগল হইল্যা নাকি?

-ঠিক-ই কই রে শিলি। পুতন আর সেই পুতন নাই। এক্কেরে গোল্লায় গেছে। আমার সামনেই ছিগারেট খায়, মদ খায়। বোঝছস?

একটু চুপ করে থেকে বললেন, একদিন তর কাকা পরেশরে, কতই কী না কইছি মদ খাওনের লইগ্যা। অথচ ওর কত বয়স হইছে। একদিনও আমারে অসম্মান করে নাই। আমার সামনে কখনো খায় নাই। গাল-মন্দ কইরলে, মাতা নীচু কইরাই খাড়াইয়া থাকছে। আর বলছে, আমি খারাপ মাসিমা। আমি একটা বকা। বাউণ্ডুইল্যা। আমার কথা ছাড়ান দেন। বাবা-মায়ের সম্মান কি সব পোলায় রাখে? আমি হইলাম গিয়া আমাগো পরিবারের কুলাঙ্গার।

-তাই-ই কয় নাকি কাকায়?

অবাক গলায় বলেছিল, শিলি।

-হ। তাই তো কইছে চিরডা দিন।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, আর আমার পুতন? ছিঃ ছিঃ কী ঔদ্ধত্য। কী কম আর। সঙ্গে ওই এক হারামজাদারে লইয়া আইছে। তরে কী কম আর শিলি। সেদিন হোন্দলের মায়ের বড়ো মাইয়াডা আইছিলো, মায়ের দেরি হইতাছে দেইখ্যা খোঁজ করণের লইগ্যা। ডাগর মাইয়া। ষোলো-সতেরো বছর বয়স হইব।

–জানি, পাঁচী নাম তো? দেখছি আমি তারে। তা হইছিল কী তাই কও।

 শিলি, জিজ্ঞেস করেছিল।

–আরে মাইয়াডা যখন ফিইর‍্যা যাইতাছে তখন বাঁশবাগানের মধ্যে তারে এক্কেরে পাইড়া ফ্যালাইছিলো ওই হারামজাদায়। কী লজ্জা! কী লজ্জা! পাঁচী আইয়া আমার কাছে কাইন্দা মরে। ইডা কেমন ভদ্দরলোকের পোলা, ক তো দেহি? আমি তহন-ই হারামজাদারে ডাইক্যা কইয়া দিছি যে, পরেশরে কইয়া দিলে পরেশ গুলি কইর‍্যা থুইব আনে। তার অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা নাই কোনো। আর যদি কহনও দেহি…

কইতেই আমার পোলার আমার ওপর কী গোসসা। সে কয়, তোমার এত্তবড় সাহস!

–কও কী বুড়ি?

–বোঝ তয়। মায়েরে কয় পোলায়! কয়, তুমি আমার অতিথিরে অপমান করো। তোমারে আমি আর এক পয়সাও পাঠাইম না। না-খাইয়া মরণ লাগব তোমার দেইখ অনে। কইয়া দিলাম আজ।

শিলি কাঁদতে থাকা কিরণশশীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তুমি কান্দো ক্যান বুড়ি? আমরা তো সবাই আছি নাকি, নাই আমরা? আমরা যদি দুগা খাই। নিজেরা যদি না-খাইয়া না মরি; তয় তোমারেও খাওয়াইমু। পুতনদার মাথাটাই এক্কেরে গেছে গিয়া। ভূত চাপছে মাথায়।

–নারে শিলি। মাথা-টাথা যায় নাই। ওডায় একনম্বরের শয়তান। এক্কেরে ওঁচা হইয়া গেছে। অরে প্যাটে ধরছিলাম ক্যান, তাই ভাইব্যাই ঘেন্না হয় বড়ো।

–ছাড়ান দাও। ছাড়ান দাও। তা ছাড়া পুতনদায় তো তোমার একমাত্র পোলা। তারে ফ্যালাইবাই বা কী কইর‍্যা তুমি? পারবা ফ্যালাইতে?

শিলি বলেছিল।

 কিরণশশীর মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠেছিল।

বলেছিলেন, পারি কিনা দেখিস তুই। আমি সব পারি। আমারে তরা অর্ধেক চিনছস। পুরা। চিনস নাই। এমন পোলা থাকনের চাইয়া, না থাকন-ই ঢের ভালো।

শিলি বলেছিল, কাইন্দো না বুড়ি।

 কিরণশশী বলেছিলেন, তরে আর পুতনরে লইয়া বুড়াবয়সে সুখে কয়ডা দিন কাটাইম, এই স্বপন বুকে লইয়াই এতগুলো বচ্ছর, প্রায় না-খাইয়াই কাটাইয়া দিছিরে শিলি! শুধাই কল্পনা আর স্বপ্ন খাইয়াই বাঁচছি। আর……

–কাইন্দো না বুড়ি।

শিলির গলা ধরে এসেছিল।

–তর কী হইবরে শিলি? ওই হারামজাদায় যে, তোরে এমন কইর‍্যা ফ্যালাইয়া দি তা আমি জানুম কী কইর‍্যা? ক। তর মতন ভালা, লক্ষ্মী একখান মাইয়া ওই হারামজাদার জীবন সুখে ভইরা দিত আনে। ছিঃ ছিঃ। পোলায় আমার কী হইয়া গেল! শহরে যেন কুননা গ্রামের ছাওয়ালরে কেউ না পাঠায় মানুষ কইরবার লইগ্যা। কী মানুষ-ই হইল। হায়। হায়!

ছিঃ ছিঃ কী বলল বুড়ি। তোমার একমাত্র সন্তান সে। আর সকলেই তো গেছে গিয়া। পুতনদা ছাড়া তোমার আর তো কেউই নাই। অমন শাপ দিয়ো না তারে। কে কইতে পারে, আবার বদলাইতেও পারে কুনোদিন। কুন কু-দেবতায় ভর করছে তার উপর। তার দৃষ্টি কাইট্যা যাইব গিয়া।

-যাউক। যাউক। এও যাউক। আমি অভিশপ্তা। বুঝছস? হতভাগী আমি। কাউরেই লাগব না আর আমার। গলায় দড়ি দিয়া মইর‍্যা থাকুম এক রাতে। দেখিসানে তুই।

শিলি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিল, বুড়ির গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে।

ফেরার পথে, শিলির নিজের দু-চোখও জলে ভরে গেছিল। বড়ো বড়ো ফোঁটা গাল গড়িয়ে পড়ে, বুকের ব্লাউজের সামনেটা ভিজে গেছিল একেবারে।

কী করবে শিলি? ওর চোখের জল মোছাবার তো কেউই নেই।

.

সাড়ে সাতটা নাগাদ এসে গেল ওরা সকলে।

 বড়োঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে তাকিয়া বের করে দিয়েছিল শিলি।

সন্ধের পর জোর হাওয়া বয় প্রথম বৈশাখে। গরমের গও থাকে না। তবুও হাতপাখা দিয়েছিল তিন-চারটি। রেকাবিতে মিছরি, জল, পান। বড়ো বড়ো কাঁসার গ্লাস। বাবার বিয়ের সময় পাওয়া। এসব-ই এক এক করে বের করেছিল শালকাঠের বড়োবাক্স থেকে। তেঁতুল দিয়ে মেজেছিল ভালো করে। সেইসব গ্লাসে খোদাই করে লেখা ছিল সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে।

শিলি লক্ষ করছিল যে, বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে ইংরিজিতে কথা বলছিল রাজেন। ইংরিজিতে কথা বলতে পারে এমন বেশি লোক দেখেনি শিলি। কথার মানে না বুঝলেও, অবাক হচ্ছিল।

পুতনদাও মাঝে মাঝেই ইংরিজি শব্দ, এমনকী বাক্যও বলছিল।

সবচেয়ে অবাক হল শিলি গদাইদাকেও কলকাতার সবজান্তা বাবুদের ওইসব রাজনীতি, ফুটবল, সিনেমার আলোচনাতে যোগ দিতে দেখে। গাঁইয়া গদাইও ওদের সঙ্গে তাল দিয়ে পটাপট ইংরিজি বলছিল দেখে তাজ্জব বনে গেল শিলি।

পুতন ধরল শিলিকে গান গাইতে হবে।

শিলির খুব-ই আপত্তি ছিল। কিন্তু পুতন-ই ঘরে গিয়ে ভাঙা হারমোনিয়ামটাকে বের করে নিয়ে এল। নিয়ে এসে রাজেনকে দিল।

রাজেন, জ্যাঠার মতো দু-টি পান মুখে দিয়ে হারমোনিয়ামটি নেড়ে-চেড়ে সুর বের করল।

বলল, ও বাবা! এ যে দেখি আমাদের ডোয়ার্কিন অ্যাণ্ড সন্স-এর। কলকাতার?

কাকা বলল, তা বটে। তবে এই হারমোনিয়াম থিক্যা সুরের থিকা ত্যালপোকাই বারাইব বেশি। সাবধানে নাড়া-চাড়া করণ-ই ভালো।

–হ। ডোয়ার্কিন অ্যাণ্ড সন্স-এরই বটে।

 লজ্জা-মাখা স্মৃতিচারণের সঙ্গে বলেছিলেন নরেশ, শিলির বাবা।

একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন, আমার বড়োশালা যেবার আইছিলেন, শিলির মায়ের জন্যে লইয়া আইছিলেন।

হারমোনিয়ামটা শিলির দিকে ঠেলে দিয়ে রাজেন বলেছিল, একটা গান হোক।

উঠোনে কাঁঠালগাছে, লিচুগাছে, গোলাপজামগাছের পাতাতে জ্যোৎস্না চকচক করছিল। ভালো করে চান করে, একটি-ফলসা রঙা খোল আর বেগনে রঙা পাড়ের টাঙ্গাইলের শাড়ি পরা, চোখে কাজল-দেওয়া, শিলিকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। গায়ে বোধ হয়, ক্যালকাটা কেমিকেল কান্তা সেন্ট মেখেছিল। কী সাবান, কে জানে? লাক্স কি?

ভাবছিল, রাজেন।

 শিলির হাঁটুসমান মিশমিশে কালো চুলে বোধ হয় আমলকীর তেল দিয়েছিল, চুলের গন্ধ ভাসছিল জ্যোৎস্নাতে। জ্যোৎস্নার গন্ধ, শিলির গায়ের গন্ধ, রাজেনের গায়ের আতরের উগ্র গন্ধ, হাসনুহানা আর বেলফুলের গন্ধে মাতালকরা বৈশাখী হাওয়ায়-ওড়া বাঁশবনের হলুদ পিছল-পিছল ফিনফিনে পাতাদের গন্ধ; সব মিলেমিশে রাত একেবারে গন্ধমাতাল হয়ে উঠেছিল।

চাঁদের আলোয়, গদাই চোরের মতো, শিলির চোখের দিকে তাকাচ্ছিল, হ্যাঁজাকের আলোতে সবকিছুই বড়োবেশি স্পষ্ট দেখায়, কল্পনার কোনো অবকাশ-ই থাকে না সেখানে।

বড়ো ভালো লাগছে গদাই-এর এই শিলিকে। যদি শিলিকে জীবনে পায়, তবে এমন চাঁদের রাতে, নদীপারের চাপ চাপ নরম ঘাসের ওপর শুইয়ে একদিন আদর করে দেবে ও! ভালোলাগায় শিলি বলে উঠবে উ-উ-উ-উ-উ।

গদাই মনে মনে বলল,আহা, এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো!

গদাই-এর স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে রাজেন বলল, বুঝেছি। তোমার লজ্জা ভেঙে দেবার জন্যে অন্য কারও গাইতে হবে তোমার আগে। তাই না? জানো, আমার ছোটোপিসির গানের খাতায় আমাদের পাড়ার গোপেন কাকা লিখে দিয়েছিল : লজ্জা নারীর ভূষণ কিন্তু গানের বেলায় নয়।

গোপেন কাকার লব ছিল ছোটোপিসির সঙ্গে।

 শিলি লজ্জায় বেগনে হয়ে গেছিল।

এমন সব কথা গুরুজনদের সামনে বলে কী করে লোকটা? কোনো সহবত-ই কি শেখেনি এই কলকাতার বাবু?

তারপরই রাজেন বলল, ঠিক আছে। আমিই শুরু করলুম তবে আগে।

বলেই, হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে, শুরু করল :

মাঝে মাঝে বেলো ছেড়ে, বাঁ-হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গাইতে শুরু করল। বাঁ-হাত দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর তালও দিতে লাগল মধ্যে মধ্যে। গলাটা বেশ ভালো। তবে গায়কিটা কেমন অসভ্য অসভ্য।

ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি,উড়ে গেল আর এল নাকু দিয়ে চলে গেলকোথায় আমার প্রাণময়না?

বলো সখী, কোথা যাবকোথা গেলে পাখি পাব?পুলিশে কি খবর দেববলো তো, জানাই গে থানায়।

ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল আর এল না।

এমন ধনী কে শহরে? আমার পাখি রাখলে ধরেদেকলে পরে, মেরে ধরেকেড়ে নেব প্রাণময়না।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইল গানটা রাজেন।

শিলি অবাক হয়ে গেল। অবাক হল বাবা এবং কাকাও। রান্নাঘরের দাওয়ায় বসা কিরণশশীও কম অবাক হলেন না।

বড়ো ভালো গান গায় রাজেন। যেমন গলার স্বর, তেমন-ই সুরজ্ঞান, তালের ওপরও তেমন-ইদখল।

রাজেনের ওপর যত বিরক্তি জমেছিল এ ক-দিনে দেখে-শুনে, সব-ই যেন, এই একটি গান ধুইয়ে দিয়ে গেল। আশ্চর্য। গান, বড়ো দারুণ শখের জনিস।

বুঝল শিলি।

শিলি ভাবছিল, পৃথিবীতে এমন কোনো লোক বোধ হয় নেই, যার সব-ই দোষ। এই খারাপ মানুষটা যে, এত ভালো গান গায় তা বিশ্বাস করতেও মন চায় না। শুধু গানের জন্যেই মানুষটাকে ভালোবাসা যায়। সব কিছুই দেওয়া যায়। যে-মেয়েদের মধ্যে সুর আছে, গান আছে, তারাই জানে গানের মহিমা। গানের প্রভাব।

 মন্ত্রমুগ্ধর মতো রাজেনের দিকে চেয়ে রইল শিলি।

 নরেশ বললেন, বাঃ বাঃ। এসব গান তুমি শিখলা কার কাছে?

রাজেন বলল, কাকাবাবু, আমাদের পাড়া তো গানের-ই পাড়া। বাইজিদের গান শুনেই তো বড়ো হয়েছি। তা ছাড়া, আমার মামারা সব ছিলেন গানের পোকা। কত সব বড়ো বড়ো গাইয়ে আসতেন মামাবাড়িতে। তেলিনীপাড়ার কালোবাবু, কালীপদ পাঠক, গহরজান বাইজি। মস্ত জমিদার ছিলেন তো মামারা। পায়রা ওড়াতেন, বেড়ালের বে দিতেন। খুব-ই রমরমা ছিল। হুইস্কি খেয়ে মৌজ হওয়ার পর আলবেলার নল হাত থেকে পড়ে গেলে, চাকরের পুরো নাম ধরে ডেকে কখনো মৌজ নষ্ট করতেন না। বলতেন, রে। রে রে।

অমনি চাকরেরা দৌড়ে এসে, নল তুলে দিত হাতে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি তো আমার পরিবারের কুলাঙ্গার।

হঠাৎ-ই বলল রাজেন কথাটা, হ্যারিকেনের আলোতে শিলির দিকে একঝলক চেয়েই।

–গানটা ভালো কইরাই করন উচিত ছিল রাজেন তোমার। বুঝছ। কথায় কয়, নরাণাং মাতুলক্রমঃ। মামাদের গুণগুলান সব-ই পাইছ দেহি।

রাজেন হেসে বলল, তা আজ্ঞে। তবে শুধু গুণগুলো পেলেই ভালো হত। শুধু গুণ নয়, দোষগুলোও যে, পুরোমাত্রাতেই পেয়েছি। ভালো করে কিছু করা যে, আমার চরিত্রেই নেই। আমার মন হচ্ছে, ঘাসফড়িং-এর মন। চিড়িক চিড়িক করে চমকে চমকে উড়ে বেড়ায়। কোনো কিছুতেই স্থির হয়ে বসতে চায় না। তাই-ই কিছুই ভালো করে করা হল না। না পড়াশুনো, না গান-বাজনা, না শেয়ারবাজার। আমি একটি ওয়েস্টার। ওয়ার্থলেস। তাই শুধুই লাথি-ঝাঁটা আর অপমান-ই জুটল কপালে। অবশ্য যার যেমন যোগ্যতা, তেমন-ই তো হবে প্রাপ্তি।

হেসে, বলল রাজেন।

শিলির কিন্তু মনে হল, যেন কেঁদে বলল।

 অনেক হাসির মধ্যেই কান্না থাকে। সকলের চোখে পড়ে না তা।

 কথাও কিন্তু চমৎকার বলে রাজেন। শিলি ভাবছিল।

শিলি তো কোন গাঁইয়া অশিক্ষিত মেয়ে। রাজেনের কথা আর গানে ভুলে যাবে পৃথিবীর যেকোনো রাজকুমারীই। কথা দিয়ে বোধ হয় জগৎ মাত করা যায়। হয়তো, শুধু কথার কথা হলেও। মনে মনে বলল শিলি, দিয়ে দেবে সহজেই ও রাজেন যা চায়। তা ছাড়া ওর যা কিছুই আছে। সে তো অন্য সব মেয়ের-ই আছে। বিশেষ কিছু বা বেশিকিছু ওর নেই দেমাক করার মতন।

ওর ফুলে, ওর নরম, সবুজ বর্ষা শেষের স্নিগ্ধ মাঠে। একটু বসবে হয়তো তারপর-ই ঘাসফড়িং আবারও হয়তো উড়ে যাবে অন্যদিকে।

কে জানে, শিলি হয়তো জানে না, কিছু ক্ষণিক মরণ থাকে, যা দারুণ সুখের। সেই ক্ষণিক মরণের গভীর আনন্দর স্মৃতি নিয়ে বাকিজীবনের অনেক দুঃখই হয়তো লাঘব করা যায়। পুতনদাকে আর ভালো লাগছিল না একটুও।

শিলি কেবল-ই ভাবছিল। ভাবনার যদি পা থাকত, তবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কত হাজার মাইল যে, পরিক্রম করে ফেলত ও, তা সে-ই জানে। ভাবছিল শিলি, মরারও অনেক রকম থাকে। কিছু কিছু মৃত্যু হয়তো থাকে, যা জীবনের চেয়েও অনেক বেশি প্রার্থনার।

কে জানে? কতটুকুই বা জানে শিলি?

গদাই বলল, এবার শিলির গান হোক একটা। কী বলেন নরেশকাকু?

রাজেন বলল, নরেশ কিছু বলার আগেই, নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।

–ওঁর গান হবে বলেই তো আমার উপক্রমণিকা। ওঁর গান শুনব বলেই তো বসে আছি। বলেই, হারমোনিয়ামটা ঠেলে দিতে যেতেই, শিলি বলল, আপনি আর একটা গান। আপনার এই গানের পর আমার গান হয় না।

–সে কী? একটা গান শুনেই। আমি কিন্তু এর চেয়ে ভালো গাই। আজ আমার গলাটা সত্যিই ভালো নেই।

গদাই পাতিহাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, রাজেনকে, খুব-ই ন্যাকার-ঠ্যাকার জানা আছে দেহি আপনের।

–ন্যাকার-ঠ্যাকার কথাটার মানে?

অবাক হয়ে রাজেন শুধোল।

নরেশ বলল, তুমি চুপ করবা গদাই। ন্যাকার-ঠ্যাকার কারে কয় জান তুমি?

গদাই অপ্রতিভ হয়ে পড়ল।

রাজেন পরিবেশ অপ্রিয় হয়ে ওঠে, সেই ভয়ে কথা ঘুরিয়ে শিলিকে বলল, নাও নাও, তুমি এবার গাও। না গাইলে আমি খাব না কিন্তু এখানে।

আর বলতে হল না শিলিকে। বাড়ির সামনে পাহাড় দেখা যাচ্ছে শূন্য খেতের পর। চাঁদের আলোতে রুপোঝুরি রুপোঝুরি হয়ে উঠেছে পুরো অঞ্চল। আলোকঝারি দিনের আলোয় সোনাঝুরি, আর অন্ধকারে মিশি-নিশি। ওইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, হারমোনিয়ামটাকে কোলের কাছে টেনে নিতে নিতে শিলি নিজেই আলোকঝারি হয়ে উঠল। ওর মনে হল, গানের-ই আর এক নাম আলোকঝারি। আজ ওর ভেতরে গান ফুলের মতো ফুটেছে। এক্ষুনি এর সুবাস ছড়িয়ে না দিতে পারলে, নিজ-সুবাসেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবে শিলি।

শুরু করল শিলি,

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। উছলে পড়ে আলো।ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো। পাগল হাওয়া বুঝতে নারে ডাক পড়েছে কোথায় তারেফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো। নীল গগনের ললাটখানি চন্দনে আজ মাখা,বাণীবনের হংসমিথুন মেলেছে আজ পাখা।পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায় শশী, ছড়াও কী এ ইন্দ্রপুরীর কোন রমণী বাসরপ্রদীপ জ্বালো।

তারপর অস্থায়ী, অন্তরা হয়ে সঞ্চারী থেকে আভোগে এসে পৌঁছোল শিলি।

গান শেষ হলে, রাজেন বলল, বাঃ।

একটি মাত্র শব্দ। শুধুই বাঃ।

ওই একটি শব্দ দিয়েই যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিল রাজেন। হৃদয়-মথিত শব্দ।

শিলি যখন গান গাইছিল, তখন চাঁদের আলোয় বসে পুতন ভাবছিল, ও একাই জানে, এই গান কার উদ্দেশে গাওয়া। শিলি যে, পুতনকেই ভালোবাসে, পুতনের অপেক্ষাতেই যে, তার সব প্রতীক্ষা, তা রাজেন জানবে কেমন করে? ভালোবাসা তো আর রাতারাতি হয় না।

আর তখন গদাই ভাবছিল, ফুলের বনে কারে ভালো লাগে শিলির, তা ওই কলকাতাইয়া বকাটায় জানব ক্যামনে? কিরণমাসির ছাগল-পুত ওই পুতনেই বা বোঝব ক্যামনে। এই গান গাইল শিলি। হুদা গদার-ই লইগ্যা।

রাজেন ভাবছিল, সম্পূর্ণই অন্য কথা।

ভাবছিল, বড়ো হওয়ার পর থেকে মেয়েদের শরীর নিয়ে অনেক-ই ঘাঁটাঘাটি ছিনিমিনি করল। মেয়েদের ও যেমন বোঝে, তেমন কম লোকেই বোঝে, এমন একটা ধারণা জন্মে গেছিল ওর। ভিলেজ-বিউটি শিলির শরীরটাকেই পেতে চেয়েছিল রাজেন। শিলিকে দেখার পর থেকেই ওকে শারীরিকভাবে পাবার জন্যে তীব্র এক আসক্তি বোধ করছিল। প্রত্যেক শরীরের স্বাদই আলাদা। তাই-ই তৃপ্তি হয় না কিছুতেই। এত পেয়েও তৃপ্তি হয়নি। সবসময়েই মনে হয়েছে, আরও চাই, নতুন চাই। নতুন প্রক্রিয়াতে চাই। অথচ আজ এই আলোকঝারির পায়ের কাছের গন্ডগ্রামের চাঁদ-মাখা সন্ধেবেলা কী যে, ঘটে গেল হঠাৎ ওর মধ্যে। প্রতিসরিত চাঁদের আলোয় শিলির মুখটিকে দেখে রাজেনের মধ্যে প্রেম কাকে বলে, সেই সম্বন্ধে এই প্রথম যেন, এক অনুভব জাগল। এই প্রথম ও জানল কাম শুধু জ্বালাই বাড়ায়, আর প্রেম দেয় স্নিগ্ধতার প্রলেপ। ওর মধ্যে এক আশ্চর্য গভীর শান্তিকে অনুভব করতে লাগল ও। কারও সামনে বসে থাকলেও যে, এত ভালো লাগতে পারে কখনো, সে সম্বন্ধে সত্যিই ওর কোনো ধারণা ছিল না। ওর সামনে কোনো মেয়ে বসে থাকলেই ওর অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে মনে মনে তাকে নিরাবরণ করেই দেখতে ভালোবেসেছে রাজেন এতদিন, কিন্তু আজকের এই শালীন, সুন্দর অনুভূতির শরিক এর আগে সত্যিই কখনো হয়নি। নিজের মধ্যের দুর্বলতায়, নিজের ভঙ্গুরতায়, মুগ্ধতায় বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিল রাজেন ক্রমশ নিশ্চুপে।

এমন সময় শিলি বলল, আর একখানা গান কি গাওয়া যায় না?

বাঙাল, গেঁয়ো মেয়েটির সবকিছুই বড়োমিষ্টি লাগছে রাজেনের। এমনকী ওই দুর্বোধ্য ভাষাও।

রাজেন বলল, ইনডায়রেক্ট ন্যারেশানে কথা কইলে আমি জবাব দিই না সে কথার। তা ছাড়া আমার কি মা-বাবার দেওয়া নাম নেই কোনো?

শিলি হাসল। প্রায়ান্ধকারের মধ্যেও উঠোনে ও দাওয়ার আলোর প্রতিসরণে শিলির দাঁত ঝিকঝিক করে উঠল।

শিলি বলল, আচ্ছা! আবারও কইতাছি, রাজেনদা আর একখানা গান গাইয়া ধন্য করেন আমাগো।

বলেই, হেসে উঠল।

 নরেশ এবং পরেশ দুই ভাই-ই তাদের মেয়ে এবং ভাইঝির হঠাৎ প্রগলভতাতে একটু রুষ্ট হল। কিরণশশী, এই নতুন শিলিকে দূরে বসে বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিল পুতন। এবং হতাশ হয়েছিল গদাই।

আর কথা না বাড়িয়ে, রাজেন হারমোনিয়ামটাকে টেনে নিয়ে শুরু করল :

কী হল আমার সই বলো কী করি।নয়ন লাগিল যাহে, কেমন পাসরি হেরিলে হরিষ চিত, না হেরিলে মরিতৃষিত চাতকী যেন যাকে আশা করি।ঘনমুখ হেরি সুখী দুখী বিনে বারি।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিধুবাবুর এই টপ্পাখানি গাইল রাজেন।

এই গানটি তার ছোটোমামার কাছে তোলা। এপর্যন্ত এই গানটি কয়েকশোবার গেয়েছে একা একা, নিজেকে শোনাবার জন্যে এবং অন্যদের শোনাবার জন্যেই বেশি। কিন্তু এই গানের বাণীর আসল তাৎপর্য ও যেন, এইমুহূর্তে প্রথমবার আবিষ্কার করল। এতদিন টপ্পার কাজের প্রতিই মনোযোগ ছিল বেশি। আজ গানের প্রতিমার শোলার কাজ ছাপিয়ে প্রতিমার পূর্ণ, প্রস্ফুটিত মুখখানি গোচরে এল, মনের অতল গভীরতা স্পর্শ করল রাজেনের জীবনে। গেয়েও যে, এতখানি মগ্ন হওয়া যায়, শুধু শুনেই নয়– এই অভিজ্ঞতাও যেন, জীবনে এই প্রথম হল।

শিলি স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। আরও একঝাঁক হেরন কোয়াক কোয়াক কোয়াক করে ডাকতে ডাকতে চাঁদভাসি রাতের মোহময়তাকে মুহূর্তের জন্যে ছিন্ন করে আলোকঝারির দিক থেকে এসে ময়নামারীর বিলের দিকে চাঁদের আলোয় ভাসতে ভাসতে চলে গেল। গানের পরের নৈঃশব্দ্য তাদের ক্ষণিক অপার্থিব দূরাগত শব্দে যেন গাঢ়তর হল।

অনেকক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলেন।

নৈঃশব্দ্যর চেয়ে বড়োগান আর কিছুই নেই। ভাবছিল রাজেন।

সেই ঐশ্বরিক স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতাকে হঠাৎ ধেবড়ে দিয়ে গদাই তার পাতিহাঁসের গলায় বলল, খাইতে দ্যাও শিলি। ক্ষুধা লাগছে বড়ো। কাল ভোরেই আবার কোকরাঝাড় যাওন লাগব আমার।

পরেশ ও নরেশ দু-জনেই বলল, হ। হ। শিলি। এইবারে আস্তে আস্তে জোগাড়-যন্তর কর।

কিরণশশী মৃদু ভর্ৎসনার স্বরে গদাইকে বললেন, সন্ধ্যাকালেই ক্ষুধা লাগে ক্যান রে তর? তুই কি শিশু?

গদাই উত্তর দিল না। ওকে শিশু বললে ও খুশিই হয়। শিশুর-ই মতো মুখ হাঁ করল। এমন-ই করে যে, যেকোনো সময়েই পোকামাকড় ঢুকে যেতে পারত।

রাজেন ভাবছিল ক্ষুধা ওরও পেয়েছে। কিন্তু এই খিদে ভাতের খিদে নয়, নারীশরীরের খিদেও নয়, এমন-ই এক খিদে, যার বোধ মনে না জাগলে মানুষজন্মই বৃথা। ও মানুষ হয়েই তো জন্মেছিল। জোড়াসাঁকোর রাজেন। আজ ও দ্বিজ হল।

কিরণশশী, হাঁটু মটমটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। গাঁটে গাঁটে বড়োই ব্যথা। ধনেশ পাখির দুর্গন্ধ তেল মালিশ করেন। পরেশ, কিরণশশীর জন্যে ধনেশ পাখি মেরে আনে বন-পাহাড় খুঁজে।

তারপর স্বগতোক্তি করলেন, যাই মাইয়াডারে সাহায্য করি গিয়া। এতগুলান পাত, ও একা সামলাইব কী কইর‍্যা?

হাঁসের ঘরে, সেই কথা শুনে, একটা হাঁসী হিসহিস করে উঠল।

গদাই-এর গলার স্বর শুনেও করে থাকতে পারে।

আর ক-দিন বাদেই সাতববাশেখির মেলা। রাজেনকে নিয়ে পুতন বেরিয়েছে সন্ধের পরে চাঁদের আলোতে সাতবোশেখির মেলার পথটি দেখাতে।

কথা হয়েছে, সেদিন ওরা সকলে মিলে একইসঙ্গে যাবে মেলাতে। পুতন, রাজেন, শিলি, চাঁপা, চামেলি, গদাইও।

পরেশ কাকা পরে যাবেন নিজের সময়মতো সাইকেলে। শিলি এবং অন্যান্য মেয়েরা যাবে গোরুর গাড়িতেই। ছইয়ের নীচে খড় বিছিয়ে, তার ওপর শতরঞ্চি পেতে নেবে। আর রাজেন, পুতন, গদাই ওরা সকলে যাবে হেঁটেই।

সেদিন নানারকম মানুষ যাবে পাহাড়ে। রাজবংশী, অহমিয়া, রাভা, মেচ সব নারীরা। বাঙালিবাবুরাও অনেক। বউ-মেয়ে-আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে ডিমডুমা চা-বাগানের সাঁওতাল কুলিরা। ধুবড়ির ম্যাচ ফ্যাক্টরির বিহারি কুলিরা। মিশ্র মানুষের পায়ের ধুলোয় বন-পাহাড়ের পথপাশের গাছগাছালি ভরে যাবে। গমগম করবে পথ, মানুষের গলার স্বরে। টুঙ-বাগানে, অভিজ্ঞমাত্রই জানেন যে, সেদিন সাইকেল লুকিয়ে রেখে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সাইকেল চুরিও হয়ে যেতে পারে।

পুতন ভাবছিল, এই রাজেন ছেলেটার নিশ্চয়ই কোনো অসুখ করেছে।

দু-তিনদিন হল একেবারেই বদলে গেছে ও। খায় না, হাসে না,খারাপ খারাপ কথা বলে, মেয়েদের দিকে রসের চোখে তাকায় না। আশ্চর্য। ড্রিঙ্কও করতে চায় না। শুধুই সিগারেট। খেয়ে যাচ্ছে, একের পর এক।

ওর চোখে এক দারুণ ঔজ্জ্বল্য এসেছে। বিয়ের পর পর মেয়েদের চোখে যেমন আসে। ওর মনের মধ্যে কী যেন, সব ঘটছে। ভাঙচুর। নদীর পাড় ভাঙার মতো। অথচ যে ভাঙাভাঙির আওয়াজ পাশে দাঁড়ানো মানুষও শুনতে পায় না।

পুতন বলছিল, শৈলেন ডাক্তারের কাছেই রাজেনকে নিয়ে যাবে একবার তামাহাটে। নিদেনপক্ষে শৈলেন ডাক্তারের ছোটোভাইকে খবর দিয়ে আনিয়ে একবার দেখিয়ে নেবে ঠিক করল রাজেনকে। কিছু একটা ব্যামো বাধালে বিপদে পড়বে পুতন-ই।

-কেমন দেখলে?

 পুতন শুধোল।

উঁ?

অন্যমনস্ক গলায়, রাজেন বলল।

-কেমন দেখলে?

পুতন আবারও বলল।

-ভালো। পাখিটা তো?

-আরে না না। পাখি নয়। আলোকঝারি পাহাড়ে যাওয়ার পথটা কেমন দেখলে?

 স্বপ্নোথিতর মতো রাজেন বলল, ওঃ হ্যাঁ। বেশ ভালোই তো! বা : চমৎকার।

আসলে রাজেনের ওপরে এই আলোকঝারি পাহাড়, গঙ্গাধর নদী, এই গ্রাম্য এবং বন্যপ্রকৃতি এক আশ্চর্য অজ্ঞাতপূর্ব, অপ্রতিরোধ্য, প্রভাব বিস্তার করেছে। কলকাতার ছেলে। শিশুকাল থেকেই প্রকৃতির সঙ্গ বলতে কচি বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া আর মাসে একবার দাদু বা মামাদের সঙ্গে গাড়িতে ময়দানে যাওয়াকেই জেনেছে। হর্টিকালচার গার্ডেনেও গেছে অবশ্য বার কয়েক। মামাদের বাগানবাড়িতে।

তারপরেই চা-বাগান।

উত্তরবঙ্গর সৌন্দর্যর তুলনা হয় না কোনো। তবে তা তিস্তার উপত্যকার। ওই চা-বাগানটা একটা ছোটোশহরের লাগোয়া। বড়োজঙ্গল বা নদী কাছাকাছি নেই। সোজা লালমাটির বা পিচের পথ, মাপা-জোকা। তার দু-পাশে সমান মাপের চা-বাগান। সারবদ্ধ কুলি-লাইন। বাবু কোয়ার্টার। অফিসারদের বাংলো। বড়োগাছ বলতে, শেড-ট্রিগুলো। প্রকৃতির মধ্যে যে, অনিয়মের নিয়ম আছে, অবিন্যাসের মধ্যে নিহিত থাকা দারুণ এক বিন্যাস আছে, তা হঠাৎ করে চোখে পড়ে না কারোরই। এখানে এতদিন আসার পরও চোখে পড়েনি রাজেনের। হঠাৎ পড়ল। ওর মনের মধ্যে এই আলোকঝারির আঁচল-ঘেঁষা ছোটোগ্রামের প্রভাব অনিবার্যভাবেই পড়েছে। শিলির এবং রাতপাখিদের গলার স্বর, বাঁশবনের চৈতি-হাওয়ার কান্না, দিনের বেলাতে আলোকঝারির পাতা-ঝরা বনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যাওয়া কোটরা হরিণের লালচে-চমক। জুম-চাষের জন্যে পুড়িয়ে-দেওয়া জঙ্গলের প্রান্তবর্তী খেতের সীমানাতে কালো হয়ে যাওয়া পত্রহীন গাছের ওপরে লাল-কালো ফুলের মতো সার সার বনমুরগিকে বসে থাকতে দেখা– সব-ই ওর জীবনকে এক নতুন ব্যাপ্তি দিয়েছে।

গঙ্গাধর নদী বেয়ে চলে যাওয়া পালতোলা নৌকোর নিঃশব্দ গতি, উদবেড়ালের বালির পারের গর্ত ছেড়ে হঠাৎ জলে লাফিয়ে পড়া, এইসব দৃশ্য-শব্দ-গন্ধ রাজেনকে এক সম্পূর্ণ অনাস্বাদিত জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বাস-ট্রাম-ঘোড়ারগাড়ির কলকাতায় আশৈশব লালিত হয়েছে বলেই, এই ভিড়ের, ধুলোর, ধুয়োর পৃথিবীতে এখনও এমন এক আশ্চর্য জগৎও যে, বেঁচে আছে; তা ওর জানাই ছিল না।

এসব তো আছেই! তার ওপরে শিলি! শিলিকে কতটুকুই বা জেনেছে ও? অথচ তবু, সেই রাতের পর থেকেই, রাজেনের স্বপনে-জাগরণে শুধুমাত্র শিলিই। শিলি ছাড়া আর কেউই নেই। এমনকী বাগবাজারের সোনালি, যার সঙ্গে ওর প্রচন্ড লদকালদকি আছে এবং যে কারণে রাজেনের বাবা সোনালিকে একবার গুম করিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন, সেও মুছে গেছে মন থেকে ওর।

কলকাতার রাজেন ভাবত, ব্যাঙ্কের টাকা, কোম্পানির কাগজ, বাড়ি, ডেইমলার বা ক্যাডিলাক বা রোলস বা মার্সিডিস গাড়িই বুঝি ঐশ্বর্যর একমাত্র সংজ্ঞা। এমন আদিগন্ত আকাশ, এমন সুগন্ধি বাতাস, এমন পাখির স্বর, ফুলের শোভাও যে, কম বড়ো ঐশ্বর্য নয়, তা ও এখানে এসেই জেনেছে। এই দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা, সরল, সোজা, উচ্চাশাহীন, লোভহীন মানুষগুলোর প্রতি ওর এক আশ্চর্য মমত্ববোধ এবং শ্রদ্ধাও জেগেছে।

এখানে এখনও মানুষের পরিচয় বিত্ত দিয়ে নয়। হৃদয়ের মাপ দিয়ে এখনও মানুষের পরিমাপ হয়। পয়সা ছাড়াও অন্য অনেক কিছুই যে আছে, যা নিয়ে মানুষ গর্ব করতে পারে, সে-সম্বন্ধে এখন পুরোপুরিই নিঃসন্দেহ রাজেন।

-বসবে নাকি একটু ওই গুঁড়িটার ওপরে? তুমি দেখছি হাঁফিয়ে গেছ।

 পুতন বলল, রাজেনকে।

রাজেন কথা না বলে, পথের পাশে ঝড়ে-পড়া একটা গাছের গুঁড়ির ওপরে বসল।

 পুতনও বসল পাশে।

হাঁফাচ্ছিল ঠিক-ই রাজেন, কিন্তু সেটা শুধুই চড়াই ওঠার জন্যে নয়।

দৌড় চলছিল বাইরে নয়, তার মনের মধ্যে। প্রচন্ড দৌড়। ওর মূল থেকে, জন্মাবধি যে, পরিবেশের মধ্যে ও বড়ো হয়ে উঠেছে সেই পরিবেশ থেকে ও দ্রুত দৌড়ে আসছিল ভেতরে ভেতরে এই নতুন অনাস্বাদিত পরিবেশ ও জীবনের দিকে।

মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না কোনো মানুষ-ই। কূপমন্ডুকতাকেই সুখ বলে জেনে এসেছে তারা, যুগযুগ ধরে। সহজ সুখের, সম্পদের, পুরুষানুক্রমিকভাবে গড়ে-তোলা বিত্তর, প্রতিপত্তির, নিশ্চিন্তির, নির্ভরতার, একঘেয়ে, থিতু, পরিক্রমাহীন জীবনকেই সবচেয়ে বেশি প্রার্থনার বলে জেনে এসেছিল রাজেন, জীবনের এতগুলো বছর, ওর পূর্বপুরুষদের-ই মতন। আজ হঠাৎ স্বেচ্ছায় ছিন্নমূল হতে চাওয়াতে ওর জীবনের গোড়াতেই টান ধরেছে। জীবনের অনেক ছন্দবদ্ধ ধ্যানধারণার অসারতা বা সার সম্বন্ধেও রাজেনের মনে গভীর সব প্রশ্ন জেগেছে। ওর মধ্যে যে, এত গভীর ভাবনা ভাবার ক্ষমতা ছিল, সে-সম্বন্ধে ওর কোনো ধারণা পর্যন্ত ছিল না আগে।

পুতন কুমারগঞ্জের ছেলে। ওও ওর মূল ছিঁড়ে কূপমন্ডুকতার অন্ধকার ছেড়ে বেরোবার জন্যে বদ্ধপরিকর। অথচ কত ভিন্ন ওদের দুজনের চাওয়া। ওর পাশে বসেও রাজেনের ভেতরে ভেতরে যে কী হচ্ছে, তা বুঝতে পর্যন্ত পারছে না ও।

–জল খাবে নাকি?

পুতন শুধোল রাজেনকে।

রাজেনের মতিগতি, চোখের ভাব বড়ো একটা ভালো লাগছিল না পুতনের। রাজেনের জন্যে ও চিন্তিত হয়ে উঠেছে।

মুখে কথা না বলে, চোখ দিয়ে রাজেন বলল, পরে।

পুতন বলল, প্ল্যানটা কী করলে রাজেন? সময় তো ফুরিয়ে আসছে। তুমি কি সাতববাশেখির মেলার রাতে এই জঙ্গলের মধ্যেই শিলিকে জোর করেই? সেদিন পূর্ণিমা। আলো থাকবে কিন্তু অনেক। বন-পাহাড় হাসবে আলোয় আলোয়। আর একটা কথা। তোমাকে যে, সুখী করতে পেরেছি, তুমি যে, আমার ওপরে সন্তুষ্ট, এ কথাটা কিন্তু চা-বাগানে ফিরে ম্যানেজারবাবুকে ভালো করে বোলো।

রাজেন পূর্ণদৃষ্টি মেলে পুতনের চোখে চাইল।

অনেকক্ষণ ধরে সেই নীরব দৃষ্টি পুতনের চোখের ওপরে স্থির হয়ে রইল।

রাজেন মুখে বলল, নিশ্চয়।

 পুতন আবারও বলল, বলো, রাজেন প্ল্যানটা কী করলে বলো?

পুতনের কথাতে এবারে বিরক্ত হল রাজেন। জিভে টাগরা ঠেকিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত শব্দ করল। বিরক্তিসূচক। তারপর-ই চুপ করে গেল।

উপত্যকা থেকে একটা ময়ূর ডেকে উঠল। তারপর-ই ঝুপ ঝুপ শব্দ করে উড়ে এল ওপরে। কিছুটা এসেই, কী যেন একটা গাছে বসল, মস্ত ল্যাজ ঝুলিয়ে। একটা ময়ূর চৈত্রমাসের পূর্ণচাঁদের ঠিক মধ্যিখানে বসেছে, গাছের ডালে, ক্যালেণ্ডারের ছবিতে যেমন দেখা যায়।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও।

রাজেন মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল সেদিকে। চিড়িয়াখানায় আর মার্বেল প্যালেসে ছাড়া ময়ুর দেখেনি ও কখনো। তার ওপরে সত্যিকারের জংলি ময়ূর। ভাবতেই পারছিল না যে, সত্যিই দেখছে। চাঁদের আলোয়, জঙ্গল-পাহাড়ের সবকিছুর আলো-ছায়া, হাওয়ায় নড়ানড়ি করা পাতার হাতছানি, আলোছায়ার বুটিকাটা গালচে সবকিছুতেই এমন রূপ যে হয়, তা কি রাজেন জানত? আলোকঝারিতে না এলে, না এলে কুমারগঞ্জে। তথাকথিত শিক্ষাহীন, বি.এ. এম.এ ডিগ্রিহীন শিলির মতন মেয়েও যে, হয় তাও কি এই নারীমাংসলোলুপ শহুরে রাজেন জানত? বড়োই রহস্যময় বলে মনে হয়।

অবাক হয়ে, চেয়ে রইল রাজেন। মুগ্ধ চোখে। ঠিক সেই সময়-ই বনের গভীর থেকে করাত চেরার আওয়াজের মতন চিতাবাঘ ডেকে উঠল। সমস্ত বন-পাহাড় যেন, চিরে চিরে গেল সেই ডাকে। সমস্ত গাছের কোটরে, নদী ও পাতার আদ্রতাবাহী অদৃশ্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই আওয়াজ ভরে গেল। ময়ুরটা ভয় পেয়ে ডাল ছেড়ে উড়ল আবার। ঝুপ ঝুপ করে বড়ো বড়ো ডানায় আওয়াজ তুলে। তারপর রাতের বনের গভীরে মিলিয়ে গেল। হঠাৎ ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের মতো।

পুতন বলল, চলো চলো, বাড়ি যাই। বড়োবাঘের কাছে তেমন ভয় নেই। এই চিতাগুলোকে ভরসা নেই। এও তোমার ভাগ্য। সারাজীবন বনে ঘুরেও অনেকের চিতার ডাক শোনা বা চিতাকে দেখার ভাগ্য হয় না। পরেশকাকাকে বলতে হবে, চিতাটার কথা।

রাজেনের ওই জায়গা ছেড়ে ওঠার আদৌ ইচ্ছে ছিল না। ময়ূরের-ই মতো চিতাবাঘও ও শুধু চিড়িয়াখানাতেই দেখেছে। ওর কাছে ময়ূরও যা, চিতাবাঘও তা। আরও বিস্ময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি ছিল ও।

কিন্তু চিতা যে, কী জিনিস, তা পুতনের ভালো করেই জানা ছিল। ও যখন ছোটো তখন তাদের সবচেয়ে ভালো গাই যূথীকে নিয়ে যায় এমন-ই এক চিতাতে, বর্ষার এক বিকেলে। আলোকঝারি পাহাড় আর গ্রামের মাঝের মাঠে চরছিল যূথী। তা ছাড়া, কালকের হাটে শুনেছিল যে, পর্বতডুয়োর দিকে একটি মানুষখেকো চিতা এক মেচ-বুড়োকে নিয়ে গেছে। পুতন হঠাৎ উঠে পড়ে রাজেনের হাত ধরে বলল, চলো চলো আর এখানে থাকা ঠিক নয়।

চোখে ঘোর-লাগা, বিবশ মনের অনিচ্ছুক রাজেন বলল, চলো।

পাহাড় থেকে নামতে নামতে পুতন বলল, তুমি অনেক-ই বদলে গেছ রাজেন। জানলে!

হুঁ।

রাজেন বলল।

–কিন্তু কেন?

–কী জানি!

–সত্যি অনেক-ই বদলে গেছ।

পুতনের কথার কোনো উত্তর দিল না রাজেন।

–শিলিকে ভালো লাগেনি তোমার?

 –হুঁ। একইভাবে বলল রাজেন।

-তবে? তুমি চাও না তাহলে ওকে? নাকি, চাও?

–হুঁ।

–তুমি চাও ওকে?

পা থামিয়ে, মুখ ঘুরিয়ে রাজেনের মুখে চেয়ে শুধোল, পুতন।

রাজেন উত্তর দিল না কোনো।

মনে মনে বলল, চাওয়ার অনেকরকম আছে পুতন। তুমি সেসব বুঝবে না। এম.কম-এ ফাস্ট ক্লাস পেলেই মানুষ যে, সব-ই জানবে বা বুঝবে, তার কোনো মানে নেই। আই-এ এস, আই-পি-এস, সায়ান্টিস্ট, হলেও নয়। ওই সমস্ত বিদ্যা, ডিগ্রি, ওই সমস্ত অর্জন শুধু বাইরে থেকেই দেখা যায়। ডিগ্রির কাগজগুলো পাকিয়ে ঠেসে রাখা যায় আলমারিতে, নিজের গর্বের সঙ্গে; কিন্তু তার বাইরেও অনেক জানা থাকে, তা সেই কৃতীরাও যে, জানবেন-ই, এমন কোনো মানে নেই। এই শিক্ষা, বাইরে থেকে দেখা যায় না, কোনো কলেজ বা ইউনিভার্সিটি দিতে পারে না এ। এমনকী যার মধ্যে এই শিক্ষার উন্মেষ হয়, সেও পূর্বমুহূর্তে জানতে পারে না যে, তার মধ্যে তা আছে বা এল। এইসব শিক্ষা জীবনের শিক্ষা, জীবনে চলতে চলতে পাথরের গায়ের শ্যাওলার মতো জন্মায় এ, জীবন থেকেই পাওয়া। যাকে ভালো বাংলাতে বলে জীবনসঞ্জাত।

এসব বই পড়ে জানার নয়।

রাজেন এতদিন নারীঘটিত ব্যাপারের শারীরিক দিকের চরম করেছে বলেই, হয়তো আজ ও বুঝতে পারছে যে, মেয়েরাও ওর-ই মতো মানুষ-ই। নিছক-ই পুরুষের খেলার বা ভোগের সামগ্রী নয়। এবং পুরুষের চরম আনন্দ বোধ হয় কোনো ঈপ্সিত নারীর মন পাওয়ার-ই মধ্যে শরীর পাওয়ার মধ্যে আদৌ নয়।

বড়োই লজ্জা হয়েছে রাজেনের। এতদিন এ কথাটাই বুঝতে পারেনি?

ছিঃ ছিঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *