যে কালো ঝড়টা অনেক অন্ধকার নিয়ে ছুটে এসেছিল বসু পরিবারের ওপর শেষপর্যন্ত সে দিক পরিবর্তন করল। মলি যদিও ঠিক আগের মতো সহজ নয় তবু কিছুটা স্বচ্ছন্দ। গৌরব তাকে বিস্তারিত বুঝিয়েছে। পুরুষ মানুষদের কথায় মেয়েরা খুব একটা আমল দেয় না যদি না তাদের হৃদয় সায় দেয়। মলি শুনেছিল, বাড়ি ছেড়ে যায়নি কিন্তু কোথাও একটা ফারাক থেকে গিয়েছিল ব্যবহারে। গৌরব এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে চায়নি। সময় সেই ওষুধের নাম যা নিরানব্বই ভাগ ক্ষত সারিয়ে দেয়। কলকাতায় কয়েক সপ্তাহ হয়ে গেল। অথচ গৌরব ঠিক করতে পারছিল না তার কী করা উচিত। আমেরিকা থেকে আসবার সময় ভেবেছিল দেশে কাজের সুযোগ পেলে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাবে। ভারতবর্ষের টাকার কথা ভাবলে নিশ্চয়ই আর্থিক ক্ষতি হবে তার। কিন্তু সেটা আমেরিকার ডলার কলকাতায় নিয়ে এলে। আমেরিকায় এক ডলারে যে সুবিধে পাওয়া যায় ভারতবর্ষে এক টাকাতেও তাই। কিন্তু যেটা সবচেয়ে কাম্য তা হলো কাজের সুযোগ এবং পরিবেশ। অনাবাসী নাগরিক হিসেবে তাকে কি কেউ সেই সুযোগ দেবে? ইদানীং রাস্তাঘাটে ঘুরে তার মনে হয়েছে কাজের ক্ষেত্রে এদেশের মানুষের মনে এখনও সিরিয়াসনেস তৈরি হয়নি। পঞ্চাশভাগ মানুষের যেন কোনো দায় নেই, চল্লিশভাগ করছে দায়সারা ভাবে। কাজকর্ম যা হচ্ছে তা মাত্র দশভাগ মানুষের নিষ্ঠার জন্যেই। রাজনৈতিক দলগুলো এই বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে মদত দিচ্ছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি সত্য হলো সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্ররোচনাকে ব্যবহার করে নিজেকে তাৎক্ষণিক লাভের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। গৌরবের দ্বিধা হচ্ছিল, এই পরিবেশে ঠিক ঠাক কাজ করা সম্ভব হবে কি না।
গৌরবের এই ভাবনাটা বাড়িতে তিন রকমের আবহাওয়া তৈরি করেছিল। মা এবং টনি বনি খুব খুশি। ও এখানে থাকলে এঁদের মন ভালো থাকবে। মা তো বলেই ফেললেন, যা শিখেছিস তা যদি দেশের জন্য খরচ করিস তাহলে একটা ভালো কাজ হয়। তোরা দুই ভাই মিলেমিশে আছিস জানলে মরার সময় শান্তি পাব। বউদি একটু অন্য কথা বলল, যদি এদেশে থাকতে চাও তো কখনও কলকাতায় নয়। কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউন নয়তো দিল্লি বোম্বেতে চাকরি খোঁজো। আরামে থাকবে। আর সৌরভ বলল সম্পূর্ণ উল্টো কথা, খেপেছিস? ভারতবর্ষে চাকরি করবি। সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছে কেন? কথায় কথায় মালিকের খামখেয়ালিপনা আর ইউনিয়নের হুমকি সইতে পারবি না!
মোটরবাইকে চেপে গৌরব এইসব ভাবছিল। হঠাৎ ওর টুলুর কথা মনে পড়ল। সেই ঘটনার পর টুলু আর তার সঙ্গে দেখা করেনি। এমন কি ওর বাড়ি থেকেই কোনো খবর আসেনি। রত্না কেমন আছে জানতে আগ্রহ হলো। সে বাইক ঘোরাল।
মধ্যবিত্ত বাঙালি পাড়াটা সকালবেলায় বেশ আলস্য নিয়েই থাকে। রত্নাদের বাড়িতে যখন গৌরব পৌঁছল তখন ওর বাবা বাজার থেকে ফিরছেন। পক্ককেশ বৃদ্ধ ওকে দেখতে পেয়েই উল্লসিত হলেন, ওঃ। তোমার কথা রোজ ভাবি কিন্তু যেতে পারি না।
গৌরব বিস্মিত হলো, কেন? আমার ঠিকানা।
না না ঠিকানা নয়। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে যাব তা আমার মেয়ের পছন্দ নয়। বলে এতে নাকি তুমি অস্বচ্ছন্দ বোধ করবে। অকপটে বললেন বৃদ্ধ।
ঠিকই বলেছে ও। গৌরব হাসল, বাজার হলো?
হ্যাঁ কিন্তু বাবা, যা সত্য তা স্বীকার না করাটা তো অন্যায়। তাছাড়া তোমার সঙ্গে আমার একটু অন্য কথাও আছে। ওরা প্রায় বাড়ির দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল। গৌরবের মনে হলো বৃদ্ধ একটু একান্তে কোনো কথা বলতে চান। সে অপেক্ষা করল।
রত্নার বাবা বললেন, ব্যাপারটা কি জানো, টুলু খারাপ নয়।
গৌরব বলল, টুলু আমার আত্মীয় কিন্তু ওর মেরুদণ্ডটি মোমের তৈরি।
না-না। পুরনো ভ্যালুস যারা মানে তারা বাপ মায়ের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। ও তো নিজে কখনও রত্নার ওপর অত্যাচার করেনি। আমি বলছিলাম কি, তুমি যদি টুলুকে একবার আমার বাড়িতে আসতে বলো তাহলে খুব ভালো হয়। হাজার হোক ওরা স্বামী-স্ত্রী। নিজেদের মধ্যে কথা বলে একটা পথ খুঁজে নেওয়ার সুযোগ ওদের করে দেওয়া দরকার। কী বলো তুমি? বৃদ্ধ ব্যাকুল চোখে গৌরবের দিকে তাকালেন। গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো। জানতে চাইল, রত্নারও কি একই ইচ্ছে?
-না। সে এসব কিছুই জানে না। এখন তো শাঁখা খুলে ফেলেছে, সিঁদুরও পরে না।
তাহলে আপনি আবার এসব ভাবছেন কেন?
ওই যে বললাম পুরোন ভ্যালুসের কথা। সেটাও তো আমি ছাড়তে পারছি না। জানি ওরা আমার মেয়েকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখে পাগল বানাতে চেয়েছিল। বরপণের টাকা মেটাতে আমার বাড়ি বিক্রি হতে যাচ্ছিল। তবু যে শিশু আসছে তার জন্যে, তার তো একটা পরিচয় দরকার!
মায়ের পরিচয় তো শিশুর অনেকখানি। তাছাড়া এসব ব্যাপার নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? যাদের সমস্যা তারা যদি আপনার মতামত জানতে চায় তাহলে নাহয় বলবেন।
কিন্তু নিজেকে ওভাবে আলাদা করে রাখতে পারি না যে।
এতে আপনি অনর্থক কষ্ট পাচ্ছেন। অপমানের বিষ যে কোনো সম্পর্ককেই মেরে ফেলে মেসোমশাই। যদি সেটা বাঁচে আপনি বাঁচবে। আপনি চেষ্টা করবেন না। রত্না আছে?
হ্যাঁ আছে। এসো এসো। তোমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেই–দ্যাখো।
গৌরব বুঝল বৃদ্ধ তার কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না। ভারতবর্ষে মানুষ যত আধুনিক হোক না কেন কন্যাকে খুশি করার ব্যাপারে জামাই ছাড়া কিছু কি ভাবতে পারে না? নইলে যে অবস্থার মধ্যে রত্না ছিল টুলু যা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিল, তারপর ইনি ওদের পুনর্মিলনের কথা ভাবতেন না।
ওমা গৌরব। হোয়াট এ সারপ্রাইজ। রত্না প্রায় চিৎকার করে উঠল। কেমন আছ?
খুব ভালো। রত্নাকে খুব ঝকমকে দেখাচ্ছিল, তুমি কিন্তু আমার খুব অসময়ে এসেছ!
মানে? গৌরব রসিকতা করল, আমি কি শুধু অসময়েই আসি?
কোথায় আস? এই তো প্রথম এলে! রত্না রসিকতাকে সম্ভবত ধরতে পারল না।
দ্বিতীয়বার।
ওহো। তখন আমি ছিলাম না এখানে। তোমাকে অসময় বললাম তার কারণ আমাকে এখনই স্কুলে যেতে হবে।
ও তাই তো। না না তুমি যাও। তোমাকে দেরি করিয়ে দেবো না।
তুমি কোথায় যাচ্ছ এখান থেকে?
কোথাও না। আমি বেকার তা তো জানোই।
বেশ। তাহলে তোমার জন্যে মিনিট দশেক বসতে পারি কিন্তু সেটা একটা শর্তে।
শর্ত? অবাক হলো গৌরব।
হ্যাঁ। তোমার বাইকে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। তাহলে বাস ধরার ঝামেলা করতে হবে না। নতুন চাকরি, আমি এখন পর্যন্ত একদিনও লেট করিনি।
ও তাই বলো। কিন্তু তুমি বাইকে বসবে?
আপত্তি আছে?
তা নয় তোমার শরীর পারমিট করবে তো?
আচমকা রত্নার মুখে রক্ত জমল, নানা। সেসব অনেক দেরি আছে।
রত্নার বাবা বাজার নিয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলেন। রত্না দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে গলা তুলল, বাবা, ওগুলো যে অবস্থায় আছে তাই থাক, শুধু মঙ্গলাকে বল মাছটাকে কেটে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিতে।
গৌরব বলল, নতুন স্কুল কেমন লাগছে?
ভালো। তাছাড়া ওখানে আমাদের–। রত্নার কথা শেষ হলো না আগেই দরজায় দাঁড়িয়ে ওর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, গৌরব, চা খাবে?
না মেসোমশাই।
আরে বানিয়ে দিতে আমার চার মিনিট লাগবে।
রত্না বলল, বাবা চা খুব বানাতে ভালবাসে। নিজেরও খাওয়া হয়ে যায় ওই ফাঁকে। আর শুনলে তো, চার মিনিট সময়ের ওই হিসাবটা যে কি করে করে!
গৌরব মাথা নাড়ল, না মেসোমশাই। আমি আর রত্না এখনই বেরিয়ে যাব।
তাহলে থাক। তুমি একদিন সময় নিয়ে এসো। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলেন।
গৌরব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, টুলু কি যোগাযোগ করেছিল এর মধ্যে?
রত্না বলল, কেন? তার তো কিছু করার নেই।
রত্নার বাবা বললেন, হয়তো করবে বলে ভাবছে কিন্তু মা বাবার জন্যে সাহস পাচ্ছে না
। রত্না মাথা নাড়ল, ওই সুবোধ বালকটাকে বাদ দিয়ে অন্য কথা বলো।
রত্নার বাবা গৌরবকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সঙ্গে দেখা করেছিল?
গৌরব মাথা নাড়ল, না মেসোমশাই।
হঠাৎ রত্না শক্ত গলায় বলল, গৌরব। আমি মনে করি না তোমার আত্মীয়টি আমার স্বামী। বিয়ের সবকটা স্মারক চিহ্ন আমার শরীর থেকে খুলে ফেলেছি। নাউ আই অ্যাম এ সিঙ্গল লেডি। বিধবা বললে ওই লোকটিকে বেশি সম্মান দেখানো হয়। গৌরব যদি তুমি গল্প করতে চাও করো আমার দেরি হয়ে গেছে, আর অপেক্ষা করতে পারব না।
মেসোমশাইকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গৌরব রাস্তায় নামল। মোটরবাইকের দিকে যাওয়ার সময় সে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ এত খেপে গেলে কেন?
এই এক কথা আর ভালো লাগে না গৌরব। বাবাকে আমি চিনি। যখন ওখানে আমি অত্যাচারিত হচ্ছিলাম তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। আবার এখন মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ স্বামী ছাড়া অন্ধকার। যে নোংরা জীবন আমি পেরিয়ে এসেছি সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। যে লোকটা আমার স্বামী হয়েও নীরবে সেই নোংরামিটাকে সমর্থন করছিল তার মুখদর্শনের কোনো বাসনা আমার নেই। জানি আমাকে নিয়ে এবার গল্প তৈরি হবে কিন্তু আমি আর মানতে বাধ্য নই।
মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে গৌরব বলল, সাবধানে উঠে বসো।
পেছনের সিটে বসে নিজেকে সামলে নিয়ে রত্না জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তোমার মতলবটা কী বলো তো? আমেরিকায় এতকাল থেকেও তুমি কি আবার পুনর্মিলনের বাণী শোনাতে এসেছ?
গলি থেকে বেরিয়ে গৌরব প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, কোন দিকে যাব?
ডান দিকে।
বাইক ঘুরিয়ে গৌরব এবার জবাব দিল, আমেরিকায় থাকলেই যে মানুষের বোধবুদ্ধি ধারালো হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি তোমাকে কোনো বাণী শোনাতে আসি নি। তাহলে সেদিন টুলুদের বাড়িতে তোমাকে সাহায্য করতে যেতাম না।
আই অ্যাম সরি গৌরব। রত্নার গলাটা খাদে নেমে এল, আসলে সবাই আমাকে এমন জ্ঞান দিচ্ছে আজকাল! মাথা ঠাণ্ডা রাখা মুশকিল।
ওটা করো না। আমি বিশ্বাস করি ইকনমিকাল ইন্ডিপেন্ডেস থাকলে যে কোনো মেয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু যা করবে ঠাণ্ডা মাথায় করো।
রত্নার নির্দেশ অনুযায়ী বাইক চালিয়ে ওর স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল গৌরব। রত্না ঘড়ি দেখল, ইস। আর মাত্র তিন মিনিট আছে। থ্যাঙ্কু গৌরব।
ওঃ। চাকরি করছ বটে। গৌরব ঠাট্টা করল।
না হলে। চাকরি চলে গেলে কী হবে ভেবেছ? এর ওপর যতি আজ আসবে না বলে গেছে। এর ক্লাসগুলোর কিছুটা আমাকে সামলাতে হবে। চলি। একদিন বিকেলে এসো।
যতি? কোনো মেয়ের নাম যতি হয়? খুব সাধারণ গলায় প্রশ্নটা করেছিল গৌরব।
কিন্তু রত্না ঠোঁট কামড়াল। ওর মুখটা কেমন হয়ে গেল। গৌরবের মনে হলো কিছু লুকোতে চাইছে রত্না। সে বাইক থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?
আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না।
কেন কী ব্যাপার?
কী করে তোমাকে বলি? ও যে তোমাকে বলতে নিষেধ করেছে।
কে?
রত্না জবাব দিলো না। কিন্তু ঘড়ি দেখল। হঠাৎ মাথায় চমকে উঠল যেন। গৌরব খুব উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞাসা করল, যতি কি জয়তী?
রত্না ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমার ঘটনাটা ওকে বলেছিলাম। আমরা কলেজেই তোমাদের কথাটা আবছা জানতাম। স্কুলে এসে পুরোটা। আসলে এই চাকরি জয়তীর জন্যেই হয়েছে। ওর নিষেধ ছিল তোমাকে ওর কথা বলতে।
কেন? তুমি জানো না কীভাবে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি।
আমাকে কোনো কারণ বলেনি। চলি গৌরব।
দাঁড়াও একটু। ও কোথায় থাকে এখন?
ভবানীপুরে। সাতাশের ডি রমানাথ মল্লিক স্ট্রিটে। রত্না আর দাঁড়াল না। গৌরব খানিকক্ষণ চুপচাপ রইল। স্কুলের ছাত্রীরা যাওয়ার পথে তাকে দেখছে। জয়তী তার আসার খবর পেয়েও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে কেন?
.
বুকের ভেতর প্রচণ্ড অস্বস্তি, গৌরব বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত। যে তার সঙ্গে দেখা করতে চায় না তার সামনে যেচে দাঁড়ানো উচিত হবে কি? নাকি সে রত্নার সঙ্গে আরও কথা বলবে। রত্না নিশ্চয়ই তার ও জয়তীর ব্যাপারে আরও খবর দিতে পারে। জয়তী যদি অন্য কাউকে ভালবাসে এই অবধি ভাবতেই গৌরব অজান্তেই মাথা নাড়ল। না, সে বিশ্বাস করে না এমন ঘটনা। কিন্তু রত্নার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই মুহূর্তে আর ধৈর্য রাখতে পারছিল না গৌরব। আজ যখন জয়তী স্কুলে আসছে না তখন বাড়িতে পাওয়া স্বাভাবিক। বাইক ঘোরাল সে। জয়তী শুধু বাড়ি পাল্টায়নি, স্কুলও বদলেছে। এসব কি শুধু তাকেই এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। কলকাতার রাস্তায় মোটরবাইক চালাতে গেলে যে সতর্কতা দরকার এখন সেটা গৌরবের ছিল না। ফলে দুবার অন্য গাড়ির ড্রাইভারদের কাছে বকুনি শুনতে হলো। একবার তো শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষে অবশ্যম্ভাবী অ্যাকসিডেন্ট থেকে বেঁচে গেল সে। ভবানীপুরের রমানাথ মল্লিক লেন খুব বিখ্যাত রাস্তা নয়। বারো বছরে কলকাতার অনেক রাস্তার নাম পাল্টেছে। কিন্তু খোঁজ করে নির্দিষ্ট রাস্তার সঠিক বাড়িটির সামনে উপস্থিত হয়ে গেল গৌরব। বাইক থেকে নেমে সে বাড়িটাকে দেখল। দোতলা পুরোন ধাঁচের বাড়ি। দরজার গোড়ায় বাচ্চারা খেলছে। দরজাটা বন্ধ।
গৌরব দুবার কড়া নাড়ার পর সেটা খুলল। মাসীমাকে চিনতে কোনো অসুবিধে নেই। বারো বছরেও মহিলা একই রকম আছেন। এমন কি মাথার কোথাও সাদা চুল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঝুঁকে প্রণাম করার মুহূর্তে তিনি চিনতে পারলেন, আরে! গৌরব? তুমি? তুমি কবে এলে বিদেশ থেকে?
গৌরব হাসল, কয়েক সপ্তাহ। এসে অবধি আমি আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই নতুন বাড়ির ঠিকানাটা জানতাম না। আজ রত্নার মুখে জানতে পারলাম।
ওমা! তোমাকে জয়তী লেখেনি বাড়ি বদলের কথা? মাসীমার ঘোর যেন তখনও ভাঙছিল না।
হয়তো লিখেছিল। কিন্তু সে-চিঠি আমি পাই নি।
এসো ভেতরে এসো। দেখলে কাণ্ড, রাস্তায় দাঁড় রেখেছি। দরজা বন্ধ করে প্রথম যে ঘরটায় তিনি প্যাসেজ থেকে উঠলেন সেটি সাদামাঠা। গৌরবকে ঘর দেখিয়ে বললেন,
ওই বাড়ির ভাড়া আর টানা যাচ্ছিল না। এটা একটু সস্তায় পাওয়া গেল। নিচে একটা আর ওপরে দুটো ঘর। তাও জয়তীর একার পক্ষে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ ছোটটা চাকরি পেয়ে গেল।
আরে! প্রণতি চাকরি করছে? গৌরব সত্যি অবাক হলো। বিদেশে যাওয়ার আগে সে কয়েকবার প্রণতিকে দেখেছে। গোলগাল, শান্ত। স্মার্টনেসের খুবই খামতি ছিল ওর মধ্যে। সেই মেয়ে চাকরি করছে?
মাসীমা বললেন, ওকে দেখলে তুমি চিনতে পারবে না। একদম মেমসাহেব হয়ে গেছে।
আপনি কেমন আছেন? জয়তীর কথা মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ হলো গৌরবের।
আমার আর থাকা। উনি বলতেন লোকের ছেলে থাকতে যা করে তোমার মেয়েরা তাই করবে। করছেও। কিন্তু গৌরব, এভাবে ওরা করুক তা আমি কখনও চাই নি। নিজেদের সাধ-আহ্লাদ না মিটিয়ে এই সংসারের বোঝা টেনে যাবে কতকাল। ছেড়ে দাও এসব কথা। তুমি কেমন আছ? বিয়ে করেছ?
শেষ প্রশ্নটিতে চমকে উঠল গৌরব। কখনও প্রকাশ্যে আলোচনা হয়নি কিন্তু মাসীমা যে তাদের সম্পর্কের কথা জানেন না তা নয়। তাহলে? সে মাথা নাড়ল, এখনও সময় পাইনি।
তবে যে শুনলাম তুমি আর এদেশে ফিরবে না। বিয়ে করে ওদেশেই থাকবে।
এই গল্প কে করল আপনার কাছে?
তা মনে নেই বাবা। তুমি তো আর আজ যাওনি আমেরিকায়। তোমার মা-বউদি?
ভালো আছেন। শুনলাম জয়তী যেত আগে, ইদানীং যায় না।
ও। বলেই সম্ভবত খেয়াল হলো, দাঁড়াও জয়তীকে ডাকি।
ও কোথায়?
ছাদে গিয়েছে কাপড় মেলতে। আজ তো স্কুলে যায়নি। আজ দুপুরে– তুমি যাও না ওপরে। জয়তীর মা তাকে পথটা দেখিয়ে দিলেন। বাড়িটা বেশ পুরনো কিন্তু পরিচ্ছন্ন। গৌরব একা ওপরে উঠে এল। নিশ্চয়ই আরও ভাড়াটে রয়েছে কিন্তু এদিকটা বোধহয় একহারা। দোতলার দুটো ঘরের সামনে দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। গৌরব ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ভাড়াটে অনুযায়ী সম্ভবত ছাদ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকগুলো তার ঝুলছে। ভেজা শাড়ির দেওয়াল তৈরি হয়েছে তা থেকে। একটু এগিয়ে গেল গৌরব। এবং জয়তীকে দেখতে পেল। ওর দিকে পেছন ফিরে কাঁচা শাড়ির প্রান্ত তারের বুকে ছুঁড়ে দিলো। বারো বছরে খুব একটা পাল্টায়নি জয়তী। শুধু বয়সের কারণে শরীরে খানিকটা ভার জমেছে। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল গৌরবের। এই মেয়ে যার জন্যে প্রতিটি দিন মনে মনে ভেবেছে সে আর একা নয়। এই মেয়ে যে তার ভালবাসা দিয়ে সমস্ত পতনের হাত থেকে রক্ষা করে এসেছে। গৌরব ছাদের থেকে নড়ছিল না। অন্যমনে কাপড় মেলে জয়তী ঘুরে দাঁড়িয়েই যেন বরফ হয়ে গেল। তার চোখের পলক পড়ছে না, ঠোঁট ঈষৎ বিস্ফারিত। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল জয়তী। তারপর অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুমি?
এলাম। শব্দটা উচ্চারণ করে যেন হালকা হলো গৌরব।
জয়তী কয়েক পা এগিয়ে এল। তার চোখ গৌরবের মুখ থেকে সরছিল না। গৌরব দেখল অজ্ঞাত জয়তী যেন একটু বেশি রুক্ষতা এনে ফেলেছে মুখে শরীরে। জয়তী এই সময় জিজ্ঞাসা করল, তারপর? কেমন আছ? কী উত্তর দেবে গৌরব? ভালো? সে কি সত্যি ভালো ছিল।
আর সে যে ভালো ছিল তা জেনে জয়তী কি সুখী হবে? নাকি বলবে ভালো নেই। ব্যাপারটা কি ন্যাকা লাগবে না? একথা বলে জয়তীর করুণা কুড়োবার চেষ্টা করা হবে না? সে বদলে বলল, তুমি?
এটা আমার প্রশ্নের জবাব হলো না। তুমি যেমন আছ আমি তেমনি আছি।
গৌরবের কথা শেষ হতেই আচমকা কেঁপে উঠল জয়তী। গৌরব সেটা লক্ষ্য করে কাছে এগিয়ে যেতেই ওর মাথা নেমে আসছিল। একহাতে জয়তীর পিঠ জড়িয়ে ধরতেই সে মাথা রাখল গৌরবের কাঁধে। কয়েক মুহূর্তে, যেন অনন্তকাল শব্দমালায় অনেক কথা বলে গেল। তারপরেই চাপা ফোঁপানির শব্দ কানে এল গৌরবের। আর তখনই সে সতর্ক হলো। ভবানীপুরের এমন খোলা ছাদের নাটক দেখতে আশেপাশের অনেক ছাদের মানুষ এখন তৎপর। সে কোনোরকমে বলতে পারল, জয়তী। বি স্টেডি!
শুধু এটুকুতেই কাজ হলো। চট করে মুখ তুলে চোখের তলা আঙুলের ডগায় মুছে নিয়ে জয়তী বলল, সত্যি বুঝতে পারিনি। আমি দুঃখিত।
গৌরব বলল, আমার জন্যে নয়। আশেপাশের ছাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছি আমি।
হঠাৎ ওপরে চলে এলে কী করে? জয়তী যেন কথা ঘোরাতে চাইল।
তোমার মা পাঠিয়ে দিলেন।
প্রণতির সঙ্গে দেখা হয়নি?
না। শুনলাম ও অফিস করছে।
হ্যাঁ। কিন্তু আজ অফিসে যায়নি।
ও। দুই বোনেই যাওনি বলো।
তুমি? জয়তীর মুখে সন্দেহ ফুটল, রত্নার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?
হ্যাঁ। ও বলতে চায়নি। কিন্তু আমি একটা কথা জানতে চাই, তুমি কেন আমার কাছে নিজেকে এমন ভাবে গোপন করতে চেয়েছ?
গোপন? মানুষ অপমানিত হলে হয় আঘাত করে নয় নীরবে সরে যায়। আমি দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। আমার কি সেই স্বাধীনতাটুকুও নেই?
জয়তী এবার গম্ভীর।
আমি তোমাকে অপমান করেছি? বিস্ময় সোচ্চারিত হলে গৌরবের গলায়।
যাক এসব কথা। বাড়িতে এসেছ যখন তখন তোমাকে আর রূঢ় কথা শোনাতে চাই না। নিচে চলো। অসময়ে এসেছ, চা দিলে খাবে? গৌরবের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির ধাপে পা রাখল জয়তী।
গৌরব প্রায় আর্তগলায় জিজ্ঞাসা করল, আমি এবাড়িতে আসি তা তুমি চাওনি?
এসে পড়ার পর এমন প্রশ্নের কী দরকার?
তবু, তবু তুমি উত্তর দাও।
স্থির চোখে তাকিয়ে জয়তী উত্তর দিলো, না।
অজান্তেই শব্দটা ছিটকে এল গৌরবের ঠোঁট থেকে, কেন? গৌরব এগিয়ে এল সিঁড়ির মুখে।
আমি তোমাকে সুখী দেখতে চেয়েছি গৌরব। আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তুমি সুখী হবে না।
এটা তোমার ধারণা।
আমার ধারণা মিথ্যে নয়। হ্যাঁ আমি ইচ্ছে করে বাড়ি পাল্টানোর খবর জানাইনি তোমায়। না, তোমার জন্যে বাড়ি পাল্টাইনি। বাবা চলে যাওয়ার পর আগের স্কুলের টাকায় ওই বাড়ির ভাড়া মিটিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু যখন বাড়ি পাল্টানোই হলো তখন মনে হলো এবার তোমাকে মুক্তি দেওয়া যাক। জয়তী হাসবার চেষ্টা করল।
আমার অপরাধ?
অপরাধের শাস্তি কি মুক্তি? তোমাকে শেষ চিঠি যেটা দিয়েছিলাম সেটা পাওনি?
কোনটা শেষ আমি জানি না। তবে আমি যেটা শেষ পেয়েছি তাতে তুমি লিখেছিলে তোমার পক্ষে আমেরিকায় যাওয়া সম্ভব নয়। তোমার পক্ষে আমাকে বিয়ে করাও অসম্ভব। তাই তোমার জন্যে অপেক্ষা না করে আমি যেন–।
তাহলে তো আমার শেষ চিঠি পেয়েছিলে।
কিন্তু কেন তুমি আমায় উত্তর দাওনি।
দিলে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হত।
ওই চিঠির পর আমি তোমাকে আর কয়েকটা চিঠি লিখেছিলাম।
আমি সেগুলো পাইনি। বোধহয় ততদিনে বাড়ি বদলে ফেলেছি।
কলকাতায় এসে তোমাকে আমি পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছি।
পাগল না হয়ে স্বাভাবিক হলে খুঁজতে না, মানে ধরতে পারতে।
প্লিজ, এভাবে কথার খেলা করো না।
আমি কিছুই করছি না গৌরব।
তুমি আমাকে আর ভালোবাস না জয়তী?
একথা থাক।
না। তোমাকে বলতে হবে। হ্যাঁ, যদি তুমি আর কাউকে পছন্দ করো, স্বচ্ছন্দে বলতে পার। আমি তোমার জীবনে আর কোনো ছায়া ফেলব না।
গৌরব। শাড়ি পাল্টাবার মতো যেমন মেয়েরা পুরুষ পাল্টায় আমি তাদের দলে যে নই তা তুমি এতদিনেও বুঝলে না দেখে খারাপ লাগছে।
আমি তো তাই ভেবে এসেছি এই এতগুলো বছর। তাহলে কেন তুমি আমার সঙ্গে এমন খেলা খেলছ? কি অন্যায় করেছি আমি?
আমি তোমার সঙ্গে খেলছি গৌরব?
আমি তো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
তবু কিছু মনে করলাম না। এবার বলো কতদিন আছ কলকাতায়। বউ নিয়ে এসেছ নাকি বিয়ে করতে এসেছ। শেষেরটা হলে নেমন্তন্ন কোরো না, যেতে পারব না।
শেষেরটাই সত্যি। তবে তোমাকে নেমন্তন্ন খেতে যেতে হবে না, আমার স্ত্রী হয়ে যেতে হবে।
ও। জয়তী আর একবার দেখল, তুমি সত্যি বদলাবে না?
এজন্মে না।
তুমি ভুল করছ।
খুলে বলো।
আমার পক্ষে আর তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
কেন?
কারণ এই সংসার। মারা যাওয়ার আগে বাবা আমায় কথা দিয়ে গিয়েছেন। যদ্দিন মা জীবিত আছেন তদ্দিন কাজটা আমাকে করে যেতে হবে।
এটা কোনো কথা হলো? বিয়ের পরেও তুমি এই বাড়ির দায়িত্ব নিতে পার। তাছাড়া প্রণতি চাকরি করছে। আমি তোমাকে কখনও নিষেধ করব না এই ব্যাপারে।
টাকা দিলেই কি দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায় গৌরব? মায়ের যদি রাতবিরেতে অসুখ হয় আমি জানতেও পারব না। তখন কি আমি দায়িত্ব পালন করছি? আর প্রণতির কথা বলছিলে? আজ আমি অফিসে যাই নি কারণ ওর ভাবী বর আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আসবে। প্রণতির বিয়ে।
গৌরব অবাক হয়ে জয়তীকে দেখল, নিশ্চয়ই বিয়েটা তুমি দিচ্ছ?
আমার সামর্থ আর কতটুকু! ওরা রেজিস্ট্রি করছে। ছেড়ে দাও এসব কথা। কদিন আছ?
তিন মাসের ছুটি নিয়েছিলাম। এখন অন্যরকম ভাবছি।
স্নান করেছ?
মানে?
দেখে তো খুব শুকনো মনে হচ্ছে।
তোমাকেও।
বাঃ, বয়স হচ্ছে না? জয়তী যেন লজ্জা পেল।
আমি যেন এখনও বালক আছি।
আছই তো। এত করে বলছি তবু বুঝছ না।
একটু আগে বড় গলায় বলছিলে না যে মেয়েদের শাড়ি পাল্টানোর কথা। বারো বছরে কোনো সাদা চামড়ার মেয়েকে সুন্দরী ভাবতে পারলাম না।
তোমার চোখে ন্যাবা হয়েছিল।
সেটা আমৃত্যু থাক।
এখানে খেয়ে যাবে?
মানে? চমকে উঠল গৌরব।
দুপুরবেলায় এসেছ না খেয়ে গেলে খারাপ লাগবে।
এই বলছিলে, না এলে খুশি হতে আবার এখন খেয়ে যেতে বলছ।
এসো। জয়তী সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। দোতলায় তখন মাসীমা। জয়তীকে দেখে বললেন, তাড়াতাড়ি কর। ওরা দুটোর মধ্যে এসে যাবে। প্রণতি এল বলে।
এখনও দেরি আছে মা। আর হ্যাঁ, গৌরব খেয়ে যাবে আজ।
ওমা আজ তো কিছুই রান্না হয়নি তেমন!
যা হয়েছে তাই খাবে। দেখুক আমরা কেমন আছি।
কথাটা সম্ভবত মহিলার পছন্দ হলো না। বললেন, বাড়িতে বলেছ কিছু?
না। গৌরব হাত নাড়ল, এই নেমন্তন্ন পাব আগে জানতাম না।
তাহলে তোমার মা খাবার নিয়ে বসে থাকবেন!
প্রথম প্রথম থাকতেন। আমি বলে কয়ে রাজি করিয়েছি দেরি হলে খেয়ে নিতে।
কি জানি বাবা। তুইও যেমন, হুট করে খেতে বললি।
আচ্ছা মা, গৌরব কি তোমার কুটুম?
হঠাৎ ভদ্রমহিলা চমকে তাকালেন। তারপর মুখ ঘুরিয়ে অন্যঘরে চলে গেলেন। গৌরব বলল, জয়তী আজ থাক। অন্য দিন হবে।
জয়তী বলল, তুমি ভুল বুঝছ। মা যা বলছে তা সঙ্কোচ থেকে। তোমার মতো সাহেব মানুষকে খাওয়ানোর মতো আয়োজন আজ বাড়িতে হয় নি বলে সঙ্কোচ। জুতো খোলো। আচ্ছা এঘরে এসো। জয়তীর পিছু পিছু পাশের ঘরটায় ঢুকে গৌরব দুটো খাট দেখতে পেল। আলনা থেকে তোয়ালে এনে গৌরবের হাতে দিলো জয়তী, এসো বাথরুম দেখিয়ে দিই। নিম্নবিত্তের বাথরুম। শাওয়ার পাবে না। চট করে স্নান করে এসো।
খোঁচাগুলো ভালো লাগছে না। কিন্তু তুমি বললে প্রণতির ভাবী বর আসবে সেই সময় আমার উপস্থিতি কি ওদের ভালো লাগবে? খুব সরল গলায় জিজ্ঞাসা করল গৌরব।
মানে?
ওঁরা নিশ্চয় জানতে চাইবে আমি কে?
তোমার কি কোনো পরিচয় নেই?
সেটা কি বাঙালিকুটুমের ভালো লাগবে?
কেমন লাগবে সেটা নিজের চোখেই দেখো।
তোমার এই পরিবর্তনটা কবে থেকে হলো?
পরিবর্তন?
এত ভাবা। তুমি তো এই সামান্য বিষয় নিয়ে এর আগে কখনও চিন্তা করতে না!
গৌরব আর কথা বাড়াল না। জয়তী যতই বিনয় করে থাকুক বাথরুমে গিয়ে একটু অস্বস্তি বোধ করল গৌরব। চৌবাচ্চায় জল ধরা ছিল এবং তার নিচে কাদাটে কিছু জমে আছে। কলকাতার কলের জলে এত নোংরা গোপনে মিশে থাকে। এখানে নিজেদের বাড়িতে বাথরুমগুলো পরিচ্ছন্ন, চৌবাচ্চা রয়েছে ছাদে। জলের অবস্থা খালি চোখে দেখা যায় না। আমেরিকা তাকে দুটো ব্যাপারে আয়েসী করেছে। প্রথমটি ওই বাথরুম টয়লেটের ব্যবহার। কলকাতার মানুষ বাথরুম টয়লেটের অর্ধেকটা জায়গা কার্পেটে মুড়ে রাখার কথা চিন্তা করতে পারবে না। কমোডের ব্যবহারে যে স্বাচ্ছন্দ্য বারো বছরে এসে গিয়েছিল এখানে এসে সেটা প্রচণ্ড ভাবে বোঝা যায়। বাথরুমটা যে ঠাকুরঘরের মতো পবিত্র হয়ে ওঠার জায়গা এবং সেটাকেও সুন্দর এবং শুদ্ধ রাখা দরকার এই বোধ পুরোনপন্থী বাঙালিদের মনে যে কবে আসবে। দ্বিতীয় আরামটা হলো যানবাহনের আরাম যা এখানে কল্পনা করতে যাওয়াও বোকামি। তোয়ালেটা কি কাঁচা ছিল। মুখ মুছতে গিয়ে একটা মেয়েলি গন্ধ নাকে এল। এটি কি জয়তীর নিজস্ব তোয়ালে? সমস্ত শরীরে যেন জয়তীর অস্তিত্ব ছড়িয়ে পড়ল। খুব ভালো লাগছিল গৌরবের। এতদিন পরে জয়তীকে দেখেও তার তো একটুও অনাত্মীয় বলে মনে হচ্ছেনা। জয়তী যতই তাকে কঠোর কথা বলুক, যতই তাকে দূরে সরে যেতে বলুক তবু তার বিশ্বাসের মানুষটা ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। গৌরব এই মুহূর্তে জয়তীর বলা কথাগুলো কোনো বিশ্লেষণ করতে চাইছিল না।
ভাত, ডাল, ভাজা, পোস্ত আর ছোট মাছের ঝোলও যে রান্নার কল্যাণে কিরকম উপাদেয় হয়ে ওঠে তা নতুন করে আবিষ্কার করল গৌরব। মাসীমার সমস্ত কুণ্ঠা সে এর মধ্যেই দূর করতে পেরেছে। খেতে খেতে জয়তী জিজ্ঞাসা করল, তোমার আমেরিকার জীবন সম্পর্কে বলো।
গৌরব বলল, খুব বিপদে ফেললে। ওখানকার জীবন মানে যন্ত্রের মতো চলা। তার বাইরে যা ঘটে তাতে সময় দেবার মতো সময় আমার ছিল না। মাসীমা পরিবেশন করছিলেন। জানতে চাইলেন, ওখানে ভাত, ডাল পেতে না, না?
গৌরব হেসে ফেলল, সব পাওয়া যায় মাসীমা। এই কলকাতার মতো। তবে রেঁধে খেতে হয়। চাপে পড়ে আমাকেও কাজ চালানোর মতো রান্না শিখতে হয়েছে। এখানে এসে তো একদিন বাড়ির সবাইকে খাইয়েছি। বাঙালি যেখানেই যাবে সেই জায়গাটাকেই বাঙলাদেশ করে ছাড়বে।
তোমার কোনো অসুবিধে হতো না?
প্রথম প্রথম হতো। মানিয়ে নিতে যেটুকু সময়। বোম্বে থেকে কলকাতায় আসতে ট্রেনে যে সময় লাগে তার থেকে অনেক কম সময়ে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতায় আসা যায়।
প্রণতিকে দেখে গৌরব অবাক। আজকের আধুনিকতম যুবতীর সাজগোজ ওরশরীরে। চুলগুলোকেও ছেঁটে তুলে রেখেছে কাঁধের ওপরে। কিন্তু গৌরবকে দেখা মাত্র সে চিৎকার করে উঠল, হোয়াট এ সারপ্রাইজ! তুমি কবে এলে?
তোমার বিয়ের গন্ধে গন্ধে চলে এলাম। গৌরব ওকে দেখছিল। জয়তীর থেকে অন্তত বছর পাঁচেকের ছোট মেয়েটির এমন পরিবর্তন? মাসীমা বলেছিলেন কিন্তু চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। দিদি যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু বোন এগিয়ে গেছে অনেক।
প্রণতি হাসল, অ্যাদ্দিন কী করে আমাদের ভুলে ছিলেন মশাই?
গৌরব বলল, তার জন্যে মরমে মরে আছি। কিন্তু তুমি কি কাণ্ড করেছ বলো তো?
কি কাণ্ড?
এই সাজগোজ?
বই-এর মলাট দেখেছেন? রংচঙে না হলে কেউ পাত্তা দেয় না! রবীন্দ্রনাথের বই-এর মতো মলাট ছাপলে আজকাল আর বই বিক্রি হবে না। একসময় কত অ্যাপ্লিকেশন করেছি চাকরির জন্যে, দু-একটা ইন্টারভিউ-ও দিয়েছি কিন্তু পাত্তাই পাইনি। তারপর স্পোকেন ইংলিশ-এ ভর্তি হলাম গ্র্যাজুয়েট হয়ে। কথাবার্তার কায়দা রপ্ত করে নিয়ে চেহারাটাকে পাল্টে ফেললাম সাজগোজের বাহারে। ব্যস, চাকরি জুটে গেল। বড় কোম্পানির রিসেপশনিস্ট। বড় বড় কর্তাদের দেখে দেঁতো হাসি হাসতে হলো। এই সাজগোজ না হলে আবার কোম্পানির প্রেস্টিজ থাকবে না। দুবছরের মধ্যে অফার আসছে অন্য কোম্পানি থেকে। বোঝ ব্যাপারটা!
গৌরব ওর কথা শুনছিল। বলার ধরনটাও পাল্টে গিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তা এই কাণ্ডটা হলো কী করে? ঘটালে না ঘটল?
দুটোই বলতে পার। হেসে উঠল প্রণতি। মাসীমা ওকে তাড়া দিলেন খাওয়া দাওয়া সারতে। প্রণতি ঘাড় বেঁকাল, না মা আজ লাঞ্চ স্কিপ করব।
মানে?
দুপুরে খাব না। হেভি ব্রেকফার্স্ট হয়ে গেছে।
মাসীমা বিরক্ত মুখে চলে গেলেন। জয়তী নিচে। সম্ভবত ঘরটা ঠিকঠাক করে রাখছে অভ্যাগতদের জন্যে। প্রণতি দোতলার ঘরে গৌরবকে নিয়ে এসে বসল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, ছেলেটি তোমার সঙ্গে কাজ করছে?
ওঃ নো। অফিসের ছেলেকে বিয়ে করা যায়? ও আমাদের অফিসে আসত নিজের কোম্পানির হয়ে। আপনার কথা বলুন তো এবার। দিদিকে কবে বিয়ে করছেন?
এমন সাবলীলভাবে প্রশ্নটা করল প্রণতি যে গৌরব থতমত হয়ে গেল। প্রণতি সেটা লক্ষ্য করেই বলল, আমি বুঝি না আপনাদের ব্যাপারটা। আপনি পড়ে রইলেন সেখানে আর ইনি এখানে। দিদির তো বয়স হচ্ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় না। যেন এ সংসারে সব দায় মাথায় নিয়ে বসে আছে। না-না। এবার আপনারা বিয়েটা করে ফেলুন।
গৌরব বলল, আগে তো তোমারটা মিটে যাক, তারপর ভাবা যাবে।
এই সময় বাড়ির বাইরে একটা গাড়ি থামবার শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রণতি বলে উঠল, এসে গেছে।
গৌরব বলল, কী করে বুঝলে?
বাঃ গাড়িটার আওয়াজ আমার চেনা। আপনি নিচে যান গৌরবদা, দিদি একা রয়েছে।
ছেলেটিকে দেখতে বেশ ভালো লাগল। নমস্কার করে বলল, আমি অঙ্গন। প্রণতি আছে? জয়তী বলল, হ্যাঁ। আপনি বসুন। প্রণতি এখনই আসছে। আমি ওর দিদি, জয়তী।
অঙ্গন এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চাইলে জয়তী এক লাফে সরে দাঁড়াল, কি হচ্ছে! না-না। আপনার প্রণাম নেওয়ার বয়সে পৌঁছাই নি।
অঙ্গন সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল, সম্পর্কে আপনি বড়।
জয়তী চট করে গৌরবকে দেখে নিল। সম্পর্ক ঘোষিত হবার আগেই অঙ্গন সম্পর্কের কথা বলছে, কৌতুকটা ঠোঁটে জড়িয়ে গেল। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, বসুন আপনি। আলাপ করিয়ে দিই, আমাদের বন্ধু গৌরব।
গৌরব নমস্কার করতে গিয়ে শুনল ছেলেটি বলছে, ও, আপনিই তো স্টেটসে থাকেন?
থাকতাম। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? গৌরব অবাক।
নিজেদের গল্প তো মানুষ মানুষের কাছেই করে। অঙ্গন হাসল, ইয়ে, মাসীমা কোথায়? ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতাম।
জয়তী একটু অপেক্ষা করতে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গৌরব তখনও অবাক হয়ে দেখছে। এবাড়ির একটি মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয়ে এসেও ছেলেটি মধ্যে কোনো জড়তা নেই। খুব সহজ ভঙ্গি তে কথা বলছে অথচ বাচাল বলে মনে হচ্ছে না। নিজে কখনই এত স্বতঃস্ফূর্ত কথা বলতে পারত না সে।
গৌরব জিজ্ঞাসা করল, প্রণতি বলছিল আপনি যে কোম্পানিতে আছেন তার সঙ্গে ওদের অফিসের বেশ যোগাযোগ রয়েছে।
হ্যাঁ। না হলে তো আলাপই হতো না। প্রণতি আপনাদের কথাও বলেছে আমায়। সত্যি এতদিন এভাবে সম্পর্ক রেখে চলা, মানে দুজনের দিক দিয়েই, বড় একটা দেখা যায় না। অঙ্গন হাসল। জবাবে কোনো কথা খুঁজে পেল না গৌরব। ছেলেটি তার চেয়ে বয়সে ছোট। ও যে কথাগুলো বলল তাতে প্রশংসা না খোঁচা রয়েছে বোধগম্য হচ্ছে না। এই সময় মাসীমাকে নিয়ে ফিরে এল জয়তী। মাসীমার হাতের ট্রে-তে কয়েক প্লেট খাবার এবং চা।
অঙ্গন উঠে দাঁড়াল, কি সর্বনাশ! না না। এত খাবার খেতে পারব না। তাছাড়া এখন তো খাওয়ার সময় নয়। প্রণতি জানে আমি বেনিয়মে খাই না।
মাসীমা এবার একটু নিচু গলায় বললেন, এমন কিছু নয়। প্রথম এলে এবাড়িতে।
জয়তী বলল, আমি আপনার অসুবিধে বুঝতে পারছি। যা ইচ্ছে হয় নিন।
অঙ্গন একটা মিষ্টি তুলে নিয়ে প্লেট ফেরত দিলো। সেটি খেয়ে নিয়ে বলল, আমি কেন এসেছি সেকথা নিশ্চয়ই প্রণতি আপনাদের বলেছে। আমি ও প্রণতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাই যদি আপনারা অনুমতি দেন।
মাসীমাকে বড় মেয়ের দিকে তাকাতে দেখল গৌরব। মাসীমা বললেন, এতো আমার পরম সৌভাগ্য। প্রণতির মুখে তোমার বাড়ির কথা শুনেছি। আমরা একদিন গিয়ে তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অত দেরি তো করা যাবে না মাসীমা। মানে, সময় পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমার মা-বাবা অতসব ফর্মালিটি না মানলেও কিছু মনে করবেন না।
আসল সমস্যাটা প্রণতি আপনাদের বলতে লজ্জা পেয়েছে। আমরা আগামী কালই বিয়ে করতে চাইছি। ইনফ্যাক্ট নোটিস দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
মাসীমার গলা থেকে আর্তনাদের মতো স্বর বেরিয়ে এল, কেন?
প্রণতি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেয় ঘষছে।
অঙ্গন বলল, আসলে আমি ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি গুজরাটে। পরশু সকালের প্লেনে যেতে হবে। অন্তত বছর খানেকের মধ্যে কলকাতায় আসার ছুটি পাব না। তাই কাজটা ফেলে রেখে যেতে চাই না।
এরকম ভাবে বিয়ে হবে? সানাই বাজবে না, মন্ত্র পড়বে না, লোকজন খাবে না? মাসীমা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছিলেন।
অঙ্গন বলল, আমি আপনার সেন্টিমেন্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে সেন্টিমেন্ট তো বড় হতে পারে না।
আমি জানি বাবা, আমাকে মেনে নিতে হবে। মেনে নিলে হয়তো আমি কষ্ট পাব, একাই পাব, না মানলে তোমরা সবাই পাবে। বেশ, যা ভালো বোঝো করো। মাসীমা মাথার ঘোমটা টেনে দিলেন।
প্রণতি কথা বলল। ঘরে ঢোকার পর এই প্রথম সে মুখ খুলল, মা। এভাবে বোলো না। ওর সমস্যাটা তো বুঝতেই পারছ। তাছাড়া সানাই বাজিয়ে মন্ত্র পড়ে লোক খাইয়ে আমার বিয়ে হলো না বলে একটুও আফসোস নেই। বরং ভালই হলো। আমার যা আছে তা দিয়ে শখ মেটাতে পারব আর দিদিটার ওপরও কোনো চাপ পড়ল না।
মাসীমা বললেন, তোরা বসে গল্প কর। আমি আসি।
অঙ্গন বলল, না মাসীমা, আজ আমাদের গল্প করার একটুও সময় নেই। পরশু যাচ্ছি। কাল তো ওসব করেই চলে যাবে। তাই আমি আর প্রণতি একটু কেনাকাটা করতে বেরুবো। নইলে ওখানে গিয়ে খুব বিপদে পড়তে হবে।
প্রণতি বলল, সত্যি কি ঝামেলা। সব একদিনে কিনতে হবে।
মাসীমা কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কখন ফিরবি?
প্রণতি বলল, দেখি। আমরা না হয় রাত্রের খাওয়া শেষ করেই ফিরব। চলো। ওহো, গৌরবদা, চলি। গৌরব মাথা নাড়ল। প্রণতি আর অঙ্গন বেরিয়ে যেতেই মাসীমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। জয়তী অসহায় চোখে একবার গৌরবকে দেখে মাকে জড়িয়ে ধরল, মা, ভেঙে পড়ো না। তুমি তো চাও প্রণতি সুখী হোক। ও যদি এই করে সুখ পায় তাহলে তুমি কেন কাঁদবে? তোমার মতো করে যে সবাই সুখী হবে তা কেন ভাবছ? মাসীমার কানে এসব কথা ঢুকছিল না। জয়তী মাকে ধীরে ধীরে ভেতরে নিয়ে গেল।
গৌরব চুপচাপ বসেছিল। তার চোখের সামনে যে দৃশ্য অভিনীত হলো তাতে কারো ভিলেনের ভূমিকা নেই। প্রণতি ও অঙ্গন তো এমনটা করতেই পারে। নইলে বেচারাদের আগামী এক বছরের মধ্যে বিয়ে হবে না। মাসীমার ভেঙে পড়াটাও খুব স্বাভাবিক। সন্তানের এমনভাবে চলে যাওয়া কোন্ মা চায়! প্রণতি চলে যাওয়ার পর জয়তী ছাড়া কেউ থাকবে না তার। তাহলে সেক্ষেত্রে তার কী ভূমিকা? এখন এই অবস্থায় কোন মুখে সে জয়তীকে বিয়ে করার প্রস্তাব ওঁকে দেবে। কিংবা সেটাকে যদি জীবনের সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে ভদ্রমহিলার যে বাসনা ছোট মেয়ের ক্ষেত্রে অপূর্ণ রইল তা পূর্ণ করার দায় এসে পড়ে। কিন্তু টোপর পরে মন্ত্র উচ্চারণ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসার সাধ তার নেই, জয়তীর আছে বলে মনে হয় না। ওটার জন্যে মন এবং শরীরের একটা বয়স থাকে।
জয়তী ফিরে এল। মুখের মেঘ চকিতে সরাল, তোমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, না?
তোমার মায়ের জন্যে খারাপ লাগছে। গৌরব নড়েচড়ে বসল।
আমারও। কিন্তু কিছু করার নেই। প্রণতিদের সমস্যাটা ভাবতে হবে আগে। আর সত্যি কথা বলতে কি অঙ্গন যদি মায়ের কথায় সম্মত হয়ে মাসখানেক সময় দিত তাহলে আমাদেরই বিপদে পড়তে হতো। মায়ের মাথায় আসবে না সেটা। জয়তী গম্ভীর হলো।
কেন?
বাঃ। তুমি তো দেখছি মায়ের মতো কথা বলছ! আনুষ্ঠানিক বিয়ের খরচ জানো? তার ওপর লোক নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে গেলে আর দেখতে হতো না। কদিন চাকরি করে প্রণতি বড় জোর হাজার চার পাঁচ জমিয়েছে। আমি পারতাম? যেখানে সুযোগ আছে সেখানে গিয়ে হাত পাততে হতো। স্বার্থপরের মতো কথা বলছি হয় তো, কিন্তু এটাই বাস্তব।
তোমার তো এখন দায়িত্ব বেড়ে গেল।
মানে?
প্রণতি যদি বিয়ের পর গুজরাটে চলে যায়, যাচ্ছেই, তখন সংসারেও যেটা কনট্রিবিউট করত সেটা বন্ধ হয়ে যাবে।
হবে। তবে এখন তো আমরা দুজন। কোনোমতে চলে যাবে।
জয়তী, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
বলো।
এখন নয়, আজ নয়। তোমার এর মধ্যে কবে সময় হবে বলো?
সময়? বড় ঝামেলা জানো? এত খাতা দেখতে হচ্ছে। আচ্ছা, পরশু হলে কি তোমার অসুবিধে হবে? ধরো বিকেল তিনটেয়। সেদিন দুটোয় ছুটি হয়ে যাবে আমার।
চমৎকার। তিনটের সময় কোথায় অপেক্ষা করব?
স্কুলের কাছে নয়।
ফ্লুরিস। পার্কস্ট্রিটের সেই রেস্টুরেন্টা মনে আছে? গুড। সেখানেই। আজ তাহলে চলি। মাসীমাকে আর বিরক্ত করব না। ওঁকে বলে দিও। গৌরবকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলো জয়তী। হঠাৎ সে বলল, গৌরব?
গৌরব ঘুরে দাঁড়াল, তার মনে হলো জয়তীকে এখন একটু বয়স্ক দেখাচ্ছে। আর অমনি জয়তী বলল, তোমার বয়স হচ্ছে।
মানে? হেসে ফেলল গৌরব।
তুমি এত ধীরে সুস্থে কথা বলতে না এর আগে।
বারো বছর বড় বেশি সময়। তাই না? এলাম। গৌরব বেরিয়ে এল।
.
টনির ব্যাগ থেকে আচমকা একটা চিঠি আবিষ্কার করে মলি হতবাক। চিঠিতে ওর স্কুলের প্রিন্সিপাল জানিয়েছেন যে তিনি ওর গার্জেনের সঙ্গে কথা বলতে চান। চিঠিটা আজ থেকে দিন সাতেক আগে লেখা। সাতদিন ধরে ওই চিঠি বহন করছে টনি কিন্তু কাউকে জানায়নি। হয়তো ওই চিঠির কথা কেউ জানতেও পারত না সহজে যদি আজ মলি দুপুরে গ্যাসের দোকানে না যেত। ছেলেমেয়েরা স্কুলে বেরিয়ে গেলে গ্যাস ইলেকট্রিক বিল প্রভৃতি বাইরের কাজগুলো মলি নিজেই করে আসে। সারাদিন বাইরের জগতে হাঁটাচলার ওইটুকুনি যা সুযোগ। সেজেগুজে বেরুতে কার না ভালো লাগে। গ্যাসের দোকান থেকে বেরিয়ে সে রিক্সা নিয়ে বস্তির পাশের মাঠ দিয়ে সুপার মার্কেট যাচ্ছিল। হঠাৎ বাঁ দিকে চোখ পড়তেই তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। টনি না?
রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে আর একটু তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হলো সে। গাছের তলায় বই এর ব্যাগ রেখে টনি গুলি খেলছে তিনটে বস্তির ছেলের সঙ্গে। ওদের কারো গায়ে জামা নেই। কেউ ছেঁড়া প্যান্ট পরে রয়েছে। কিন্তু ওরা যেভাবে চেঁচিয়ে কথাবার্তা বলছে তাতে দিব্যি মিশে গেছে টনি। শুধু ওর পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম রয়েছে নইলে ওকে কি মলি আলাদা করে চিনতে পারত! ছেলের স্কুল আরম্ভ হবার কথা সাড়ে আটটায়। অর্থাৎ আড়াই ঘণ্টার বেশি ওর ক্লাস করার কথা। অথচ এই সময় ছেলে কয়েকটা নোংরা ছেলের সঙ্গে বসে গুলি খেলছে। মলির রিকশা যে মাঠের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে ওর হুঁশ পর্যন্ত নেই। গুলি নিয়ে তিনজনের মধ্যে এবার জোর মারপিট লাগল। মলি দেখল যে টনিকে বাড়িতে শিশুর মতো মনে করা হয় সে বিচারকের ভূমিকা নিয়ে ওদের ছাড়িয়ে দিল! এবার ওদের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত বড় সে পকেট থেকে বিড়ি আর দেশলাই বের করল। বুকের যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল মলির। টনি ওদের সঙ্গে বিড়ি খাবে নাকি?
ছেলে তিনটে যখন পালা করে বিড়ি টেনে টনির মুখের সামনে ওটা ধরল তখনই মলি মুঠো করে ধরল ছেলের জামার কলার, এই হচ্ছে? অ্যাঁ! পড়াশোনার জন্যে তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকছি আর তুমি এখানে বসে বিড়ি ফুঁকছ?
মায়ের হাতের টানে এবং চিৎকারে ভয়ে জবুথবু হয়ে গেল উনি। মুখের ওপর মলির হাতের আঘাত খেতে খেতে ককিয়ে উঠল, আমি বিড়ি খাইনি, কখনও খাইনি। সত্যি বলছি মা, কখনও বিড়ি খাইনি। টনি এবার চিৎকার করে কেঁদে ফেলতেই সঙ্গীরা খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসি শুনে কান্নাটাকে প্রায় গিলে ফেলল টনি। কিন্তু তার আগেই মলি তাকে টানতে শুরু করেছে। রিকশায় বসিয়ে তার খেয়াল হলো টনির ব্যাগটার কথা। সে চিৎকার করে ছেলেদের বলল, এই ওর ব্যাগটা দাও তো! ছেলেদের মধ্যে একজন ব্যাগটাকে এনে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, টিফিনটা আজ খাওয়া হলো না।
রিকশা চলতে শুরু করলে মলি চাপা গলায় ফুঁসে উঠল, এইসব হচ্ছে! আমি পরিশ্রম করে তোমাকে টিফিন করে দিচ্ছি আর তুমি এদের সেটা বিলোচ্ছ! উঃ কি শয়তান রে বাবা। তোমার বাবা ভাবছেন ছেলে আমার মন দিয়ে পড়াশোনা করছে, মানুষ হচ্ছে। আর ছেলে বস্তির ছেলের সঙ্গে গুলি খেলছেন। আমাদের ছেলে হয়ে তুই এত নিচ এবং খারাপ হলি কী করে? ছিঃ। টনি মুখ গুঁজে বসেছিল। আর মলির মুখ চলছিল সমানে। চলন্ত রিক্সায় বসে আশেপাশের মানুষজন বা ঘরবাড়ি কোনো কিছুই তার খেয়াল ছিল না। আচমকা এই ধাক্কা যেন তার সমস্ত বোধকে অসাড় করে দিয়েছিল।
বাড়িতে পা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ঘরে পৌঁছে দরজা বন্ধ করে বেধড়ক মারল সে। খাটে মুখ গুঁজে টনি সেই মার খেল চুপচাপ। চিৎকার, যেটা মলির গলা থেকে বের হচ্ছিল শুনতে পেলেন মা। তড়িঘড়ি ছুটে এলেন তিনি দরজায়। ধাক্কা দিতে লাগলেন পাগলের মতো, অ বউমা, কী হয়েছে। ছেলেটাকে স্কুল থেকে টেনে নিয়ে এসে মারছ কেন? অ বউমা।
শেষ পর্যন্ত শাশুড়ির গলা মলির কানে পৌঁছাল। সে দরজা খুলে হনহন করে বাথরুমে চলে গেল। মা ঘরে ঢুকে নাতিকে দেখলেন। টনি খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তিনি খাটে বসে নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন, কী হয়েছে। কী করেছিস তুই! টনি জবাব দিলো না। আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে মা বললেন, ও দাদু আমাকে বল। কী করেছিস যে এমন মার মারল বউমা। ইস্। দেখি আমার কাছে আয়।
আর তখনই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো মলি, থাক আর আদর দেবেন না। ওই ছেলে বংশের নাম ডোবাবে। ছি ছি। ঘেন্নায় আমার শরীর রি রি করছে। ওইটুকুনি পুচকের পেটে এত। আমাদের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছে!
মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, তুমি কিন্তু মুখে যা আসছে তাই বলছ বউমা। কী করেছে টনি আমাকে বলবে তো! ওকে স্কুল থেকে আনতে গেলে কেন?
স্কুল থেকে আনিনি। আপনার নাতি বস্তির ছেলেদের সঙ্গে বসে রোজ গুলি খেলেন। স্কুলে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে বোধহয় ওদের সঙ্গে বসে বিড়ি খাওয়া প্র্যাকটিস করেন।
হঠাৎ টনি ওই অবস্থায় চিৎকার করে উঠল, মিথ্যে কথা। আমি কখনও বিড়ি খাই নি।
চুপ। আবার গলা তোলা হচ্ছে। আস্পর্দা বেড়ে গেছে, না? দাঁড়াও আজ তোমার হচ্ছে।
মলি হন হন করে বাইরে বেরিয়ে এল। রাগত ভঙ্গিতে রিসিভার তুলে সৌরভকে ফোন করল। বেশ কয়েকবার ডায়াল করেও সে শুধু এনগেজড টোন শুনতে পেল। রাগে সশব্দে রিসিভার রেখে দিয়ে সে দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল।
বিকেলের রোদ মরার আগেই বাড়িতে ফিরল গৌরব। জয়তীর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রণতির ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার পর তাতে অস্বস্তির ধুলো জমল। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই তার মনে হলো কোনো গোলমাল হয়েছে। সে ভেবেছিল মা এলে অনুযোগ জানাবে না খাওয়ার জন্যে। জয়তীদের বাড়িতে খেয়ে এসেছে বলে মাকে চমকে দেবে। কিন্তু না মা না বউদি কাউকেও সে দেখতে পাচ্ছিল না। দোতলায় উঠে সে দেখল মলি চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে আছে। চেহারা দেখেই বোঝা গেল ঝড় বয়ে গেছে। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, কী হলো? এমন বিরহিনীর মতো চেহারা কেন? দাদার সঙ্গে আবার লেগেছে।
মলি জবাব দিলো না। ঠোঁট টিপে আকাশের দিকে তাকাল। গৌরব সেটা লক্ষ্য করে বলল, মা কোথায়? এবারও জবাব পেল না। গৌরব আর ঘাটাল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে সে ভেতরে ঢুকতেই মায়ের ঘরে তাকে শায়িত দেখতে পেল। গৌরব কিছু বলার আগে মা জিজ্ঞাসা করলেন, খেয়েছিস? মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই অনুযোগ এল, একটা ফোন করতে পারতিস তো!
গৌরব বলল, ও বাড়িতে ফোন ছিল না। তোমাকে তো বলেছি দুটোর মধ্যে না ফিরলে খেয়ে নেবে। কিন্তু কী হয়েছে বলো তো? বউদি মুখ অন্ধকার করে বসে, তুমি এই সময় শুয়ে আছ!
মলির কাছে তিনি যা শুনেছেন সেই বৃত্তান্ত জানল গৌরব! মা বললেন, বউমা তো আর কিছু আমাকে বলল না। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড ওই টনিটাকেও জিজ্ঞাসা করে আমি কিছু জানতে পারিনি। আমাকে কি তোরা সবাই পরের বাড়ির মানুষ বলে মনে করিস?
এই রে! তুমি আবার এসব গায়ে মাখতে শুরু করলে। হয়তো টনি এমন কিছু করেছে যা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে আর বউদির তাই মনে খুব লেগেছে। একটু সময় যেতে দাও নিশ্চয়ই সব বলবে।
আর কখন বলবে। ছেলেটাকে বাথরুমে বন্ধ করে রেখেছে। আমি খুলে দিতে গেলাম, ঝাঁঝিয়ে উঠল। বলেছে তিনদিন খাবার দেবে না।
দেখছি। তুমি খেয়েছ?
মা জবাব দিলেন না। গৌরব একটু রুক্ষ হলো, কাজটা তুমি ঠিক করোনি। সে আবার ব্যালকনিতে ফিরে এল, বউদি, তোমার সঙ্গে কথা আছে। দুটো।
শেষ শব্দটি শুনে মুখ ফেরাল মলি। কিছু বলল না, কপালে ভাঁজ পড়ল শুধু।
গৌরব বলল, টনি স্কুলে না গিয়ে বস্তির ছেলেদের সঙ্গে গুলি খেলেছে। ব্যাপারটা আমাকেও অবাক করেছে। কেন করেছে জিজ্ঞাসা করেছিলে?
কেন আবার? আমার কপাল পোড়াতে। বংশের জেদ জানো না। অত মার খেয়েও মুখ খুলল না।
টনির ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দেবে? গৌরব হাসল।
মানে?
আমি দেখি কিছু বের করা যায় কি না!
যা ইচ্ছে করো। ওর সঙ্গে কথা বলতেও ইচ্ছে নেই আমার।
গৌরব ঘুরে দাঁড়াতেই মলি জিজ্ঞাসা কর, আর একটা কী কথা বলতে চেয়েছিলে?
ও হ্যাঁ। মায়ের খাওয়া হয়নি। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার পেটেও কিছু পড়েনি।
কথাটা শোনামাত্র মলি উঠল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোথায় চললে হঠাৎ?
মায়ের খাবার আনতে।
তুমি?
আমার বমি বমি লাগছে। মলি দাঁড়াল না।
গৌরব এল বাথরুমের সামনে। এই বাথরুম প্রত্যহ ব্যবহৃত হয় না। অতএব এখানে টনিকে স্বচ্ছন্দে তিনদিন আটকে রাখা যেতে পারে। সে নিঃশব্দে ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলল।
টনি চৌবাচ্চার ওপর বসে আছে। দরজা খুলতেই চমকে মুখ তুলে সে কাকাকে দেখতে পেল। এক মুহূর্তে চোখাচোখি, টনি চট করে চোখ নামিয়ে নিল। গৌরব ডাকল, বেরিয়ে আয়।
টনি গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গৌরব হেসে ফেলল, শুনতে পাচ্ছিস না?
মা বলেছে এখানেই তিনদিন থাকতে।
ঠিক আছে। মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তোমাকে আর আদেশ পালন করতে হবে না। আয় বলছি। শেষের দুটো শব্দ একটু জোরে উচ্চারিত হতেই টনি এগিয়ে এল। গৌরব ওর হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটে বসাল, তোর যদি বিড়ি সিগারেটে টান দেওয়া ইচ্ছে হয়েছিল তাহলে আমাকে বললি না কেন?
আমার কখনও ইচ্ছে হয়েনি। মা ভুল দেখেছে। ওরা বিড়ি খাচ্ছিল। তারপর আমার দিকে বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি খাব কি না। আমি মাথা নেড়ে না বলেছিলাম। কিন্তু মা দেখতে পায়নি। আমাকে মা বিশ্বাস করল না। টনি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল।
ওকে কাঁদতে দিল গৌরব। এবং এর ফাঁকে পেছনের দরজায় মাকে এসে দাঁড়াতে দেখে সে চোখের ইশারায় সরে যেতে বলল। বৃদ্ধা কী বুঝলেন তিনিই জানে, বিষণ্ণ মুখে চলে গেলেন। কান্না কমে এলে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, এবার পরিষ্কার করে বল তো কী হয়েছিল!
জবাব দিলো না টনি। বাঁ হাতের আঙুল বেড কভারে ঘষতে লাগল। সেটা লক্ষ্য করে গৌরব ঠিক করল প্রশ্ন করে উত্তর পেতে হবে। সে জিজ্ঞাসা করল, তুই যাদের সঙ্গে গুলি খেলিস তাদের নাম কী?
টনি ভেজা চোখ তুলল একবার, বাপী, বুড়ো আর মাদা।
মাদা? কী নাম রে?
ওই অবস্থাতেও টনির ঠোঁটে হাসি ফুটল, বস্তিতে আরও খারাপ খারাপ নাম হয়।
তোর সঙ্গে ওদের আলাপ হলো কী ভাবে?
ওরা গুলি খেলছিল। আমি দেখছিলাম। আমাকে খেলতে ডাকল।
তোর তো পকেটে গুলি ছিল না!
ওদের টিফিন খেতে দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে চারটে গুলি দিয়েছিল।
জিতেছিস?
আবার হাসি ফুটল টনির মুখে। পকেট থেকে দুটো গুলি বের করে দেখাল। দেখিয়ে রেখে দিলে খাটের ওপর। গৌরব গুলিগুলোকে দেখল। একটা তুলে নিল, ছেলেবেলায় আমিও গুলি খেলতাম। কিন্তু রোজ হারতাম।
উৎসাহিত গলায় জিজ্ঞাসা করল টনি, সত্যি?
মাথা নাড়ল গৌরব, কিন্তু তুই স্কুলে না গিয়ে গুলি খেলছিস কেন?
স্কুলে যেতে আমার ভালো লাগে না।
কদিন যাচ্ছিস না?
এই সপ্তাহটা।
কিছু হয়েছিল স্কুলে?
হুঁ।
কী হয়েছিল?
হেডমাসাটার মশাই আমাকে মিছিমিছি দোষ দিয়েছিল, আমি নকল করিনি। আবার কান্না ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল টনির গলা থেকে। গৌরব সেটা হতে না দিয়ে চটপট জিজ্ঞাসা করল, হেডমাস্টার মশাই বলেছে তুই নকল করেছিস?
হুঁ। মিথ্যে কথা। কান্নাটাকে গিললো টনি।
কী হয়েছিল বল তো আমাকে?
টনি যা বলল তা এই রকম : সে পরীক্ষার হলে বসে মন দিয়ে লিখছিল। সব কটা উত্তর তার জানা। ওর পাশে সুনীল নামের একটি ছেলে বসেছিল। থেকে থেকে সুনীল তাকে খোঁচাচ্ছিল প্রশ্নের উত্তর জানতে। টনি তাকে বাধ্য হয়ে উত্তর বলে যাচ্ছিল। সুনীল তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ঝুঁকে তার খাতা থেকে কপি করছিল উত্তরগুলো। সে মুখ ফিরিয়ে সুনীলকে জিজ্ঞাসা করছিল কেন সে লিখতে পারছে না নিজে থেকে? আর সেই সময় হেডমাস্টার মশাই রাউন্ডে এসে ওকে কথা বলতে দ্যাখেন। সঙ্গে সঙ্গে চিটিং-এর অভিযোগে তিনি ওর পরীক্ষা বন্ধ করে দেন। সেদিন ছিল শেষ পরীক্ষা। ওর শেষ উত্তর লেখা বাকি ছিল। নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে হেডমাস্টার মশাই খুব বকেন ওকে। কোনো কথা শুনতে চান না। শেষ পর্যন্ত গার্জেনদের ডেকে পাঠিয়ে একটা চিঠি দেন ওর হাতে। ঘটনাটা বলে উনি বলল, কিন্তু বিশ্বাস করো, সুনীল আমারটা কপি করেছে, অথচ ওকে কিছু বলেননি হেডমাস্টার মশাই।
চিঠিটা দাদাকে দিয়েছিস?
নীরবে মাথা নেড়ে না বলল টনি। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কেন?
রাত্রে দিতে গিয়েছিলাম। তখন বাপি মায়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া করছিল। ভয়ে দিতে পারিনি। পরদিন মা এমন গম্ভীর ছিল কাছে যেতেই সাহস পাই নি। স্কুলের সময় হয়ে গেলে আমি জামাকাপড় পরে বেরিয়েছিলাম। হেডমাস্টার মশাই বলে দিয়েছিলেন, গার্জেন না এলে আমাকে ক্লাশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কী করব বুঝতে না পেরে আমি রোজ রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম যতক্ষণ ছুটির সময় না হয়।
আমাকে দেখাসনি কেন?
ভয় করছিল।
চিঠিটা কোথায়?
মায়ের কাছে। মা আজ আমার ব্যাগ থেকে পেয়েছে।
তুই যা বললি তাতে একটাও মিথ্যে নেই তো?
না। বিশ্বাস করো। সব সত্যি।
তোকে আমি বিশ্বাস করছি টনি। কিন্তু কোনো কথা বানিয়ে বললে আমি খুব অপমানিত হব, একথাটা মনে রাখিস। গৌরব উঠল।
আমি বানিয়ে বলছি না কাকু।
গৌরব মায়ের ঘরে ঢুকে দেখল, টেবিলে মিষ্টির প্লেট পড়ে আছে। মলি দাঁড়িয়ে। মা গম্ভীর মুখে বসে আছেন। গৌরব বলল, একজনের কাছ থেকে সব খবর জানলাম। কিন্তু তোমরা করছোটা কি? মা, মিষ্টিগুলো খেয়ে নাও।
মা বললেন, ছেলেটা না খেয়ে আছে আর তুই আমাকে খেতে বলছিস?
টনি বউদি আর আমি এখনই চা জলখাবার খাব।
মলি মুখ ফেরাল, মানে?
গৌরব হাসল, বউদি, টনির কোনো দোষ নেই। তোমরা অসুখের প্রতিক্রিয়া দেখছ কিন্তু কী কারণে অসুখটা হলো তা খুঁজতে চাওনি। আমি কাল স্কুলে যাব। তবে তোমাদের দুজনকেই একটা অনুরোধ করব। টনির ঘটনাটা নিয়ে কালকের আগে আর কথা তুলো না। এমন কি দাদাকেও বলার দরকার নেই। শুনলে ওরও মেজাজ গরম হবে। ছেলেটার ওপর ঝামেলা করবে। অথচ ব্যাপারটা অন্যরকম। তোমাকে বলছি বউদি, টনিকে আমি পুরোপুরি দোষী করতে পারছি না।
কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি–। মলি কথা শেষ করতে পারল না। গৌরব তাকে হাত তুলে থামাল, তুমি যা দেখেছ সেটাও আবার সত্যি আবার যা দ্যাখনি তাও মিথ্যে নয়।
.
টনির সঙ্গে রিকশা থেকে গৌরব যখন স্কুলের সামনে নামল তখন প্রেয়ার সবে শেষ হয়েছে। ছেলেরা যে যার ক্লাসে যাচ্ছে। টনির বন্ধুরা ওঁকে চেঁচিয়ে ডাকতে মুখ নামাল সে। গৌরব বলল, মুখ নামাচ্ছিস কেন? অন্যায় না করলে সবসময় মাথা উঁচু করে থাকবি।
হেডমাস্টার মশাই-এর ঘরের সামনে গিয়ে সে নিজের কার্ড দিল পিওনকে।
পিওন বলল, উনি মিটিং করছেন। ডি.আই. এসেছেন।
ডি. আই. কে?
ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস।
ও, কার্ডটা দাও। বলো মিটিং হয়ে গেলেই যেন আমাকে ডাকেন। কার্ড নিয়ে ভেতরে গেল পিওন। মাস্টারমশাইরা রেজিস্ট্রার নিয়ে ক্লাসে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ টনিকে লক্ষ্য করছিলেন।
গৌরব খুশি হলো, টনি আর মুখ নামাচ্ছে না।
স্কুলটা বড়। সামনে বাগান আছে। ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন কোথাও কোনো শব্দ নেই।
গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তোদের ক্লাস কোন্ দিকে?
টনি আঙুল তুলে একটা দিক দেখিয়ে দিল। গৌরব ভাবল টনির ক্লাস টিচারের সঙ্গে একটু কথা বললে ভালো হতো। ভদ্রলোকের মতামত জানা যেত। একটি ছাত্রের অভ্যেস সম্পর্কে তার ক্লাস টিচারই সবচেয়ে ভালো জানতে পারেন। এই সময় ভেতর থেকে বেল বাজল। পিওন ঘুরে এসে বলল, আপনাকে ডাকছে।
গৌরব টনিকে নিয়ে ঘরে ঢুকল পর্দা সরিয়ে। লম্বা টেবিলের পিছনে যিনি বসে আছেন তিনিই হেডমাস্টারমশাই। পাশে আর এক ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে রয়েছেন। গৌরব নমস্কার করতেই হেডমাস্টারমশাই মাথা ঝুঁকিয়ে কার্ডটাকে তুলে নিলেন, আপনি গৌরব বসু?
আজ্ঞে হাঁ। কার্ডটা আমারই, আমি এর কাকা।
বসুন।
গৌরব বসল। হেডমাস্টারমশাই একবার টনিকে দেখে নিয়ে বললেন, আপনি বিদেশে থাকেন। ওর বাবা মা এল না কেন?
এখন আমি স্বদেশে আছি। তাছাড়া আপনি গার্জেনকে দেখা করতে বলেছেন বলে আমি এলাম। আমার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধা আছে?
না। নেই। বলুন।
আপনি কেন আমাদের ডেকেছেন সেটা জানি না।
হেডমাস্টারমশাই এবার টনির দিকে তাকালেন, তুমি বাড়িতে কিছু বলোনি?
টনি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
হেডমাস্টারমশাই বললেন, এটা খুব সিম্পল কেস। আমার স্কুলের একটা সুনাম আছে। প্রতি বছর এইট্টি পার্সেন্ট ছেলে ফার্স্ট ডিভিশন পায়। তাছাড়া আমি ডিসিপ্লিনে বিশ্বাস করি। আপনাদের ছেলে সেটাকে ভঙ্গ করেছে। পরীক্ষার হলে নকল করাকে আমি অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে মনে করি। ওকে রাসটিকেট করতে পারতাম। তা না করে বলেছি ওকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিচ্ছি, আপনারা অন্য কোথাও ভর্তি করুন।
গৌরব বলল, নকল করাকে কেউ সমর্থন করবে না। কিন্তু আপনি নিশ্চিত ও নকল করেছে?
আমি নিজের চোখে দেখেছি মিস্টার বোস।
আপনি নিজের চোখে ওকে নকল করতে দেখেছেন?
হ্যাঁ। আমি যখন ক্লাস রুমের দরজায় যাই তখন ও সুনীলের খাতার ওপর ঝুঁকে পড়েছিল।
অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন ও সুনীলের খাতা দেখে নকল করছিল?
এজ্যাক্টলি।
সুনীল ছাত্র হিসেবে কেমন?
সেটা কোনো কথা নয়। খারাপ ছাত্ররাও মাঝে মাঝে ভালো উত্তর লেখে।
আপনি ওদের ক্লাসটিচারের সঙ্গে কথা বলেছেন?
কেন?
আপনি কি ওদের দুজনের খাতা কমপেয়ার করেছেন? এ যদি সুনীলের দেখে লেখে তাহলে সুনীল ওর চেয়ে ভালো লিখবে। শেষ প্রশ্নটা অর্ধেক লেখার পর ওর খাতা আপনি কেড়ে নিয়েছিলেন। সুনীল নিশ্চয় সেই প্রশ্নের উত্তরটা পুরো লিখবে। অতএব আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ওদের দুজনের খাতা এনে একটু মিলিয়ে দেখুন।
গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক বললেন, খুব যুক্তিপূর্ণ কথা। ইউ ডু দ্যাট।
অত্যন্ত বিরক্ত হলেও হেডমাস্টার অনুরোধ রাখলেন। দুটো খাতা আনানো হলো। দেখা গেল প্রশ্নের উত্তর টনি যতটুকু লিখেছে পুরো সময় পরীক্ষা নিয়েও সুনীল তা লিখতে পারে নি। গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক খাতা দুটো টেনে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, সুনীল ছেলেটি যে সব বানান ভুল করেছে এ তা করেনি। একটা উত্তর ধরে লেখা আর একটা তাড়াহুড়োর। হেডমাস্টার মশাই আপনি ভুল করেছেন। হেডমাস্টার মশাই ঢোঁক গিললেন, আসলে আমি আচমকা দেখেছিলাম তো–। মানে ডিসিপ্লিন রাখতে গিয়ে–! ঠিক আছে, তুমি কাল থেকে ক্লাসে এস। গৌরব মাথা নাড়ল, না। আপনি ওকে টি সি দিন। কারণ এর পরে ও আপনাকে শ্রদ্ধা করতে পারবে না। আপনাদের খামখেয়ালিতে কত ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে যায় তার খোঁজ আপনারা রাখেন না। চলি। হেডমাস্টার মশাই মুখ নামিয়ে বসেছিলেন। গম্ভীর মুখের ভদ্রলোক বললেন, মিস্টার বোস, আপনাকে একটা অনুরোধ করব। এখন মিড সিজন। কোথাও ওকে ভর্তি করতে পারবেন না। আপনাদের আত্মসম্মানবোধকে আমি শ্রদ্ধা করছি। কিন্তু আমি বলি কি ওকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা অবধি এখানে রাখুন। নতুন ক্লাসে উঠলে টি সি নেবেন। আমি স্কুল ইন্সপেক্টর। ভালো স্কুলে ভর্তি করার প্রব্লেম হবে না তখন। তারপর হেডমাস্টারমশাইকে বললেন, আপনি খুব অন্যায় করেছেন। প্রথমেই খাতা দুটো কমপেয়ার করার দরকার ছিল। সুনীল তো শেষ প্রশ্নটার উত্তর কমপ্লিট করতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন।
আমি একবার ভেবেছিলাম–। হেডমাস্টারমশাই থেমে গেলেন।
ভেবেছিলেন তা করেননি কেন?
আসলে সুনীলকে ঘাঁটাতে চাইনি। ওর বাবা খুব বড় রাজনৈতিক নেতা।
গৌরব বলল, টনি বাইরে যাও। উনি চলে গেলে সে বলল, এখানে আপনার ডিসিপ্লিন কতটা থাকছে হেডমাস্টারমশাই? একটি ছেলের বাবার প্রভাব আছে বলে আপনি নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে অক্ষম হলেন?
হেডমাস্টার মশাই কিছু বলার আগেই ইন্সপেক্টর বললেন, আপনি সুনীলের বাবাকে ডেকে পাঠান কাল। আমি থাকব। যে স্টেপ এর বিরুদ্ধে নিতে গিয়েছিলেন তা সুনীলের বিরুদ্ধে নেবেন। কারণ সে-ই অপরাধী।
.
সন্ধের পরে সৌরভ জিজ্ঞাসা করল, তুই এসব কথা আমায় বলিসনি কেন গোরা?
যেটা আমি ম্যানেজ করতে পারব সেটা তোমাকে বলে বিব্রত করতে চাইনি।
আমি ওই হেডমাস্টার নামে কেস করতাম। ক্রিমিন্যাল!
না। তুমি শুধু টনিকেই বকতে। ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবতে না।
সৌরভ হেসে ফেলল, এই তোর আমার সম্পর্কে অ্যাসেসমেন্ট!
যে কোনো বাবা-মাই তাই করত। লীনাদেবীর খবর কিছু জানো?
না। কেন?
ওঁকে ওর বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছিল, কী হলো কে জানে!
না। আমি ফোনটোন করি নি। লীনার সম্পর্কে ভাবছিস যে বড়?
হ্যাঁ। কলকাতা শহরে একটা মেয়ে স্রেফ একা বাস করছে দেখলে তাকে বাহবা দিতে হয়।
গৌরব উঠল, তুমি আর টনির ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। এ বছর ওখানে থাকুক। সামনের বছর নতুন ক্লাসে উঠলে যদি আবহাওয়া পাল্টায় তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা কোরো।
সৌরভ বলল, আমি একটা ব্যাপার ভাবছিলাম গৌরব। তোর তো আমেরিকায় অনেক বছর হয়ে গেল। ভালো চাকরি করছিস। অত মাইনে এদেশের কোনো চাকরিতে পাওয়া যায় না। তবু তোর কি এখানে সেটেল্ড করতে মন চায় না?
গৌরব বলল, আমি তো কথাটা আগেও বলেছি। তের সপ্তাহ ছুটি নিয়ে আমি এখানে এসেছি নিজেকে পরীক্ষা করতে। বারো বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এখানকার পরিবেশ মানুষজন, কাজের সুযোগ কেমন পাল্টেছে তা দেখে সিদ্ধান্ত নেব। আসলে আমেরিকায় আমি যে চাকরি করি ঠিক সেই কাজ এখানে পাব না। তবে–?
বাধা দিলো সৌরভ, সেই কাজ এখানে নেই বলছিস?
মাথা নাড়ল গৌরব, নামের দিক দিয়ে এক। কিন্তু তফাতটা হলো কেউ একজন অক্ষর চিনে শব্দ বুঝে বাক্য লিখতে শিখেছে। সেও বলছে আমি পড়াশোনা করি। আর যে থিসিস লিখছে তাকেও বলতে হচ্ছে আমি পড়াশোনা করি। টাকাটা আমার কাছে কোনো সমস্যা নয়। মাসে পাঁচ হাজার টাকা পেলে এদেশে দিব্যি ভালো থাকা যায়। দেখি দাদা, আর একটু দেরি আছে। যাওয়ার আগে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
.
গৌরব মাকে বলে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বাইক নিয়ে। এই বাইক চালাতে তার খুব ভালো লাগে। বাইক মানে গতি, গতি হলো জীবন। কিন্তু কলকাতায় রাস্তাঘাট যদি একটু ভালো হতো, গর্তগুলো কেউ যদি রাতারাতি বুজিয়ে দিত, ফুটপাত দুটো আরও একটু ওপাশে সরিয়ে দিত তাহলে ভালো হতো। কয়েকদিন ধরে ভেবে ভেবে সে কি করে কলকাতাকে ভদ্ৰশহর করা যায় তার একটা পরিকল্পনা করেছে। রোজ রাত্রে কাগজে কলমে এই নিয়ে সে মতামত লিখছে। কিন্তু ওই কাগজপত্র নিয়ে কার কাছে যাবে সে ভেবে পাচ্ছে না। শহর সংক্রান্ত ব্যাপারে সাধারণত মেয়রের কথাই শেষ কথা। কিন্তু ক’সপ্তাহের কাগজ পড়ে মনে হচ্ছে মেয়রের ভূমিকা পুতুলের মতো। তিনি নামেই প্রধান কিন্তু তাঁর শহরে বাস-দুর্ঘটনা হলে রাজ্যমন্ত্রী ছুটে যান, শহরের প্রশাসনের ওপর তার কোনো অধিকার নেই। তিনি শুধু পৌরকর আদায় করান। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেই কাজ হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাওয়া এদেশে সহজেই সম্ভব নয়। সুব্রতকে ধরতে হবে। ওর মারফত রাইটার্স বিল্ডিং-এ পৌঁছানো সম্ভব।
নির্জন রাস্তার রকে কাউকে বসে থাকতে দেখল না গৌরব। এর আগে লীনার বাড়িতে আসার সময় সে ছেলেগুলোকে ওখানে দেখেছে। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ধান্দা জুটে গেছে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে বেল টিপল সে। লীনা আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। কারণ এপাশ থেকে বোঝা যায় না ভেতরে আলো জ্বলছে কি না! দ্বিতীয়বার বেল টেপার পর যখন কেউ খুলল না তখন চলে আসার জন্যে পা বাড়াল সে। তারপর কি মনে হতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজাটায় চাপ দিল। গৌরব অবাক, দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার। লীনা কি তাড়াহুড়োয় দরজা বন্ধ না করে গিয়েছে? কিন্তু, না বাইরে থেকে তালা দেওয়া নেই। এটাই সে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। ঘর অন্ধকার করে এই সন্ধে পেরোনো রাতে লীনা কী করতে পারে? সে হাতড়ে হাতড়ে বাইরের ঘরে আলো জ্বালল। তারপর দ্বিতীয় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, লীনা!
ভেতর থেকে কোনো উত্তর এল না। গৌরব ইতস্তত করল। তারপর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আলো জ্বালতেই চিৎকার করে উঠল। লীনা পড়ে আছে বিছানায় চিত হয়ে। তার জামাকাপড় বীভৎসভাবে ছেঁড়া। মুখ ক্ষতবিক্ষত। নিম্নাঙ্গ থেকে রক্তের ধারা নেমেছে। ঘরের জিনিসপত্র, বিছানার চাদর লণ্ডভণ্ড। দৌড়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে সে নিচু হলো। না, প্রাণ আছে। এখনও নিশ্বাস পড়ছে। সোজা হয়ে সামনের ওয়ার্ডরোব থেকে একটা শাড়ি বের করে লীনার শরীরের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে ও একছুটে বাইরে বেরিয়ে এল। এপাড়ায় কোথায় টেলিফোন আছে তার জানা নেই। কিন্তু পথেই একটা থানা দেখেছিল। আর তখনই সে একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পেল। কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছে। দ্রুত বাইক চালিয়ে গাড়িটাকে আটকাল সে। অ্যাম্বুলেনসের ড্রাইভার মাথা নাড়ল, না মশাই, এভাবে পেশেন্ট নিয়ে যেতে পারব না।
কেন? পারব না শুনে উষ্ণ হলো গৌরব।
এটা ট্যাক্সি নাকি যে রাস্তায় ধরে বললেই হয়ে যাবে। আপনি অফিসে যান, রিপোর্ট করুন, অফিস থেকে অর্ডার দিলে চলে আসব।
আর ততক্ষণে যদি পেশেন্ট মারা যায়?
আগে রিপোর্ট করেন নি কেন?
আগে তো জানতাম না। গৌরব নিজেকে সামলালো, সেই আপনাকেই হয়তো এতটা পথ ফিরে গিয়ে আবার আসতে হবে। আপনার পরিশ্রম আর সরকারি তেল বাঁচান। আমি রিপোর্ট করব আপনার অফিসে যাতে আপনি আপনার খাতায় কাজটার কথা লিখতে পারেন।
ড্রাইভার বলল, এভাবে পথ আটকানো বে-আইনি। পেশেন্টের অবস্থা খারাপ বলে যাচ্ছি, চলুন। গৌরব একটু হালকা হয়ে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
ঘরে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্স-এর লোকেরা বেঁকে বসল, এ পুলিশ কেস।
নিশ্চয়ই। পুলিশকে আমরাই রিপোর্ট করব। তার আগে ওঁকে বাঁচান।
লীনাকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো তখন আশেপাশের বাড়ির জানলায় ভিড়, কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। রাস্তায় ধারের রক তখনও খালি। পেশেন্টের অবস্থা দেখেই অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত বেরিয়ে গেল। বাইক নিয়ে প্রথম গৌরব চলে এল থানায়। একজন সাব-ইন্সপেক্টর বসে ছিলেন। সব শুনে বললেন ভিক্টিম আপনার কে হয়?
প্রশ্নটির জন্যে তৈরি ছিল না গৌরব। একটু ভেবে বলল, বন্ধু।
কী রকম বন্ধু যে তাকে গুণ্ডারা রেপ করে? লোকটা হাসল।
এসব প্রশ্নের জবাব আমাকে পরে দিতে দিন। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। সেখানে আমাকে যেতে হবে।
সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, দাঁড়ান। আগে ডায়েরি লিখি। আপনার হদিস দিন।
গৌরব জিজ্ঞাসা করল, একটা টেলিফোন করতে পারি? ওঁকে হাসপাতালে এখন অ্যাটেন্ড করা দরকার। ভদ্রলোক একটু চিন্তা করে ইশারায় টেলিফোন দেখিয়ে দিলেন।
তিনবার ডায়াল করার পর বাড়ির ফোন বাজল। সৌরভ রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো!
দাদা আমি গোরা বলছি। লীনার বাড়িতে এসেছিলাম। এসে দেখি কেউ বা কারা ওর ওপর ভয়ঙ্কর টর্চার করে অজ্ঞান করে ফেলে গেছে। মনে হচ্ছে রেপ কেস। আমি অ্যামবুলেন্সে পিজিতে পাঠিয়ে থানায় এসেছি। এঁরা ডায়েরি নিচ্ছেন। তুমি এখনই পি জি-তে চলে যাও। না, জ্ঞান নেই। কুইক দাদা। সে ফোন রেখে দিল।
আপনার বন্ধু আই মিন বান্ধবীকে আপনার দাদা চেনেন?
প্রথম কথা বান্ধবী বললে ভারতবর্ষে যা মনে হয় উনি আমার তা নন। তাই বন্ধু বলেছি। দাদা চেনেন কারণ লীনা দাদার এক্সকলিগ।
ভদ্রমহিলার ঠিকানা?
নাম-ঠিকানা বয়স জানাল গৌরব। বয়সটা অবশ্যই আন্দাজে।
একা থাকেন কেন?
আর কেউ নেই বলে।
ম্যারেড?
হু। কিন্তু ডিভোর্সি।
এইসব সিঙ্গল মেয়েদের নিয়েই যত বিপদ।
কেন?
আরে মশাই দেশে কোনো মেয়ে একা থাকলেই তাকে নিয়ে কথা ওঠে তার ওপর যদি সে ডিভোর্সি হয় তাহলে তো কথাই নেই। প্রচুর ছেলে বন্ধু ছিল?
আমি জানি না।
আপনি তো নিজেকেও ওঁর বন্ধু বলছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি কাউকে ওর ফ্ল্যাটে দেখি নি। আজ আমি দ্বিতীয়বার ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম অতএব কাউকেই চিনি না।
চাকরি করে?
হ্যাঁ।
ওর কোনো শত্রুর কথা জানেন? এক্স হাজব্যান্ড, বয়ফ্রেন্ড এনিবডি?
না। তবে বাড়িওয়ালা ওঁকে উঠে যেতে বলেছেন।
কেন?
উনি সম্ভবত আর সিঙ্গল লেডিকে ঘর ভাড়া দেবেন না। অবশ্য সেই কথাটা যুক্তি হিসেবে বলেননি। এবার আমি আসতে পারি?
ঘরে জিনিসপত্র যে অবস্থায় ছিল তা আছে?
হ্যাঁ। অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা কোনো কিছু স্পর্শ করে নি।
আপনি?
আমার কথা উঠছে কেন?
উঠছে, কারণ আপনি ওই ঘরে ঢুকেছিলেন। সেন্স নেই বললেন না? ওর একটা স্টেটমেন্ট নেওয়া পর্যন্ত আপনার যাওয়া চলবে না।
বেশ তো, আপনি আমার পাসপোর্ট রেখে দিন।
পাসপোর্ট? মানে?
আমি আমেরিকায় থাকি। ওটা যদি আপনি রেখে দেন তাহলে কখনই ফিরে যেতে পারব না। আমাকে কি আপনি সন্দেহ করছেন? গৌরব পাসপোর্ট টেবিলে রাখল।
পাসপোর্ট নেড়েচেড়ে সাব-ইন্সপেক্টর তখন বললেন, আপনি তো বেশিদিন আসেন নি। ঠিক আছে। আপনার পাসপোর্টের নাম্বার, বাড়ির ঠিকানা রেখে দিচ্ছি। কাল একবার সকালে এখানে আসবেন। আপনি তো হাসপাতালে যাচ্ছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ওখানে দেখা হতে পারে। ভদ্রলোক পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিলেন।
বাইরে বেরিয়ে বাইকে চড়তে চড়তে গৌরবের মনে হলো পুলিশ হিসাবে সাব-ইন্সপেক্টর যা করেছেন তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কোনো অপরাধ হলে পুলিশের কাজই হলো সন্দেহ করা। আমেরিকান পুলিশও তাই করে। কিন্তু তারা প্রথমেই সেটা মুখে প্রকাশ করে না। এইটাই যা তফাত। সে হাসপাতালের দিকে বাইক ছোটাল।
সৌরভ ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল, সঙ্গে মলি। ওকে দেখতে পেয়েই ওরা এগিয়ে এল। সৌরভ বলল, খুব খারাপ অবস্থা। এখনও সেন্স ফেরেনি।
পুলিশ কী বলল?
ডায়েরি নিয়েছে। কাল সকালে যেতে বলেছে।
আমার এসব ভালো লাগছে না। ডাক্তার বলল, অন্তত চারজনের কীর্তি। মার্সিলেস রেপিং। কী ভাবে বেঁচে আছে সেটাই আসল। তুই এর মধ্যে বেশি জড়িয়ে পড়িস না। কি থেকে কি হয় কিছুই বলা যায় না। সৌরভ মুখ ফেরাল গম্ভীরভাবে।
বেশি আর কম বলে কোনো ফারাক করা যায়? কারো বাড়িতে গিয়ে যদি দেখি সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে তাহলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব না? কিন্তু আমি ওঁকে দেখে ভেবেছিলাম মেয়েরা একা সম্মান নিয়ে থাকতে পারে–! কথাটা শেষ করল না গৌরব।
মলি বলল, ছাই পারে। ছেলেরা সেটা হতে দিতে চায় না।
গৌরব এবার অবাক হলো। মলি কি লীনার পক্ষে কথা বলছে?
কী দেখছ অমন করে? মলি জিজ্ঞাসা করল।
মাথা নাড়ল গৌরব, না লীনার সেন্স না ফিরলে জানা যাবে না ওই পাশবিক কাজটা করল কে? ওই লোকগুলোকে গুলি করে মারা উচিত।
কোনোদিন সেটা সম্ভব না। মেয়েদের ওপর যারা অত্যাচার করে তারা চিরকাল বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মলির কথা শেষ হতে না হতেই একজন বেয়ারা গোছের লোক হাঁকল, লীনাদেবীর লোক কেউ আছেন? ভেতরে ডাকছে।
মলি বলল, গোরা, তুমি এস, ও এখানে থাক।
করিডোর পেরিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকল। একজন ডাক্তার দাঁড়িয়েছিলেন। মলি তাকে বলল, আমরা লীনার জন্যে এসেছি।
ও। শুনুন ব্লাড চাই। এখনই। ঘণ্টা পাঁচেকের মধ্যেই অপারেশন করতে হবে। কন্ডিশন ভালো নয়। বলে ডাক্তার একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন, এতে ওঁর ব্লাড গ্রুপ লেখা আছে। অন্তত তিন বোতলের ব্যবস্থা করুন। গৌরব কাগজটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার ব্লাড ব্যাঙ্কে পাওয়া যাবে না?
অ্যাপ্রোচ করুন। ডাক্তার ফিরে যাচ্ছিল এমন সময় সেই সাব-ইন্সপেক্টর এসে দাঁড়ালেন, ডাক্তার, মিসেস লীনা চ্যাটার্জির একটা স্টেটমেন্ট নিতে চাই।
পরশু আসবেন। এখন উনি কথা বলার স্টেজে নেই। ডাক্তার চলে গেলেন।
সাব-ইন্সপেক্টর একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর বললেন স্যাড! খুব স্যাড ঘটনা।
দাদা বউদিকে হাসপাতালে রেখে ব্লাডব্যাঙ্কে চলে এল গৌরব। ব্লাড ডোনারের সার্টিফিকেট না থাকলে রক্ত কিনতে পাওয়া যায় না। একটি লোক এসে বলল, কোনো চিন্তা নেই বাবু, আপনি খোঁজ নিন যে গ্রুপটা চাইছেন তা এখানে আছে কি না ডোনার যোগাড় করতে অসুবিধে হবে না।
ডোনার কোথায় পাবো?
আমার আন্ডারে আছে। মাল্টু ছাড়লেই চলে আসবে।
গৌরব এগিয়ে গেল। এখানে কিছু লোক রক্ত দিয়ে রোজগার করে। ইনি তাদের দালাল। অর্থাৎ হাসপাতালের নিয়ম কিছু লোকের জীবিকার উপায় ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু ব্লাডব্যাঙ্কের ডেস্কে পৌঁছে মাথায় বজ্রপাত হলো। লীনার ব্লাডগ্রুপ এখন স্টকে নেই। ওটা খুব স্বাভাবিক গ্রুপের রক্ত নয়। তিনচারটি ব্লাডব্যঙ্কের সন্ধান দিলেন কর্মচারী যেখানে গৌরব খোঁজ করতে পারে। হনহন করে বেরিয়ে আসছিল সে, লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল, হলো বাবু?
না। এখানে স্টক নেই।
স্টক নেই? শেয়ালের মতো হাসলো, স্যার, ক বোতল দরকার?
তিন।
আসুন আমার সঙ্গে। ওটা অবশ্য আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। তবু ভাই ভাই ব্যাপার।
আরে আমার কোন্ গ্রুপ দরকার না জেনেই বলছেন কেন?
পৃথিবীর যত প্রকারের রক্ত হয় সব স্টকে আছে। তবে কম বেশি। আসুন। প্রায় হতবুদ্ধি গৌরবকে নিয়ে এল লোকটা ব্লাডব্যাঙ্কের পেছনে। জায়গাটা আধা অন্ধকার। লোকটা হাঁকল, মানুদা? অন্ধকার থেকে ভেসে এল, আছি।
তিন বোতল।
একটি সিড়িঙ্গে প্রৌঢ় এগিয়ে এল অন্ধকার ফুঁড়ে, দেখি।
গৌরব তার হাতে কাগজটা তুলে দিলো। আধা আলোতেই কাগজটাকে উল্টেপাল্টে বলল, কপাল ভালো, চার বোতলই আছে। দেড়শ করে পড়বে।
আপনারা কি ব্লাডব্যাঙ্কের লোক? মানে দেবেন কোত্থেকে?
খিক খিক হাসি বাজল, তাহলে ব্লাডব্যাঙ্কেই যান।
গৌরবের গাইড বলল, মানুদা হলো এখানকার বিপদতারণ। আমি যেসব কেসে ফেল করি মানুদা তা টেকআপ করেন। মাল দিয়ে দিন বোতল পেয়ে যাবেন।
অরিজিন্যাল দাম কত?
নাথিং। সিড়িঙ্গে বলল, কিন্তু প্রয়োজনে পাঁচশো হাজার পেয়েছি।
আপনারা রক্ত ব্ল্যাক করছেন?
আপনি সতীপনা করবেন না পেশেন্টকে বাঁচাবেন?
গৌরবের মনে হলো লোকটার চোয়ালে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মারতে। কিন্তু তখনই লোকটা বলল, একটু বেশি পয়সা নিচ্ছি বটে কিন্তু বাবু, মানুষের জানও তো বাঁচাচ্ছি!
নিজেকে কোনোমতে সামলে গৌরব বলল, কিন্তু আপনি যা দেবেন তা জেনুইন কিনা।
সেন্ট পার্সেন্ট। মানুষের জান নিয়ে সরকার খেলা করতে পারে মানুষ তারা নয়। মাল ছাড়ুন। বহুৎ টাইম নিয়ে নিয়েছেন।
আমি ব্ল্যাকে রক্ত কিনব না। লোকটার হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে গৌরব হনহনিয়ে গেটের দিকে চলল। কলকাতা শহরে অনেক ব্লাডব্যাঙ্ক আছে। কোথাও না কোথাও লীনার রক্ত পাওয়া যাবে।
বাইক রেখে দিয়ে ট্যাক্সি নিয়েছিল গৌরব। দেড়ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার সবকটা বড় ব্লাডব্যাঙ্কে ঢুঁ দিয়ে ফেলল, লীনার গ্রুপের রক্ত কারো কাছে নেই। হাতে আর বেশি সময় নেই। রাত হচ্ছে। রাস্তা ফাঁকা। যে কটা জায়গার কথা সে ইতিমধ্যে জেনেছে তার সবকটায় খোঁজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অসহায়ের মতো ট্যাক্সিতে এসে বসল সে। ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাব এবার? গৌরব উত্তর দিতে পারছিল না। হঠাৎ সে বলল, দেখুন ভাই, আমরা এতক্ষণ ব্লাডব্যাঙ্কে ঘুরলাম। বুঝতেই পারছেন একটা অপারেশনের জন্যে এখনই রক্ত দরকার। আর কোনো ব্লাডব্যাঙ্ক আপনার জানা আছে?
লোকটা একটু ভাবল তারপর মাথা নাড়ল, প্রাইভেট ব্লাডব্যাঙ্ক কিছু আছে।
প্রাইভেট মানে?
বাবু মাঝে মাঝে পাড়ায় তাঁবু খাটিয়ে যে রক্তদান করা হয় না তার সব রক্তই কি সরকারি ব্লাডব্যাঙ্কে যায়? কিছু রক্ত মাঝে মাঝে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে বিক্রি হয়ে যায়। আমাদের বস্তির ছেলেরা তো এই করে হাজার টাকা কামালো অথচ ভালো কাজ করছে বলে ওদের ছবি ছাপা হলো কাগজে। ড্রাইভার হাসল, চলুন, ওয়েলেসলিতে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্ক আছে। একবার মাঝ রাত্তিরে দুজন প্যাসেঞ্জার ওখানে গিয়েছিল ব্লাড কিনতে।
ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ঘোরাল। গৌরব কোনো থই পাচ্ছিল না। বড় বড় ব্লাডব্যাঙ্ক যেখানে নেই বলছে সেখানে প্রাইভেট ব্যাঙ্ক দিতে পারবে? আর সেই রক্ত খাঁটি হবে তো? অবশ্য রক্ত খাঁটি কিনা তা পেশেন্টকে দেওয়ার আগে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে নেবে ডাক্তারবাবু। এক্ষেত্রে যেহেতু তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই তাই বিশ্বাস করতেই হবে। ইলিয়ট রোডের মোড়ের কাছে ওয়েলেসলির ওপরেই গাড়ি থামাল লোকটা। তারপর গৌরবকে বলল, সোজা ওই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যান। সামনেই যে দরজা দেখতে পাবেন সেখানেই বেল টিপবেন।
ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে মাটিতে পা রাখল গৌরব। কেউ জিজ্ঞাসা করলে এক্ষেত্রে ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিলেই চলবে। কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দরজার সামনে দাঁড়াল সে। ওটা বন্ধ। কিন্তু ওপরে কোনো নেমপ্লেটও নেই। একটু দ্বিধা নিয়েই বেলের বোতাম টিপল সে।
আধ মিনিট বাদে দরজা খুলল। একজন বৃদ্ধা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বললেন, ইয়েস!
গৌরব ইংরেজিতে বলল, আমি খুব বিপদে পড়ে এসেছি। আমার ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল আপনাদের কাছে রক্ত পাওয়া যেতে পারে। ব্যাপারটা কি সত্যি?
মহিলা হাত বাড়ালেন, গিভ মি দ্য পেপার।
গৌরব চটজলিদ কাগজটা বের করে দিতেই মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। গৌরব রুমালে মুখ মুছল। খুব টেনসন হচ্ছিল তার। এই সময় মহিলা ফিরে এলেন, সরি। এই গ্রুপের ব্লাড মাত্র এক বোতল স্টকে আছে। কালকে নিলে বাকি দুবোতল পাবেন। হান্ড্রেড পার বটল।
অর্থাৎ পঞ্চাশ টাকা কম। কিন্তু এক বোতল নিয়ে গিয়ে কী হবে? সে মাথা নেড়ে নিচে নেমে এল। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, পেলেন না স্যার?
না।
আর কোথায় পাওয়া যায় জানি না।
জেদ চেপে গেল গৌরবের। কলকাতা শহরে অপারেশনের জন্য যদি রোগীর আত্মীয়রা রক্ত যোগাড় না করতে পারে তাহলে কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই? সেই রোগী কি বিনা অপারেশনে মারা যাবে? পি-জিতে ফিরে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ মনে হলো ওই একটা বোতল নিয়ে নিলেই হতো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ঢের ভালো ছিল। সে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে আবার গাড়ি ঘোরাতে বলল।
গৌরব যখন এক বোতল রক্ত নিয়ে হাসপাতালে ঢুকল তখনও মলি আর সৌরভ বসে। ওকে দেখেই ছুটে এল তারা। মলি বলল, উঃ, এতক্ষণ কোথায় ছিলে?
গৌরব ক্লান্ত গলায় বলল, কলকাতা শহরের কোথাও লীনার রক্ত নেই বউদি। শেষে এই এক বোতল মাত্র পেলাম। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। খুলে বলি সব।
সৌরভ বলল, ঠিক আছে। তুই বোস।
মানে? গৌরব চমকে উঠল।
রক্ত যোগাড় হয়ে গিয়েছে।
কী করে? কে করল?
তুই চলে যাওয়ার খানিক বাদেই ডাক্তার বললেন ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে অপারেশনে করতে হবে। আমরা ভাবলাম তুই তার আগে ফিরে আসবি। এলি না। তখন ব্ল্যাডব্যাঙ্কে গিয়ে খোঁজ করলাম। ওই সময় স্থানীয় কিছু লোক সাহায্য করল। রক্তটা ওদের কাছ থেকেই কিনেছি, অপারেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। সৌরভ জানাল।
মানু সাহা?
হ্যাঁ। তুই জানলি কী করে?
কত টাকা নিল? দুশো টাকা করে বোতল।
দাঁতে দাঁত ঘষল গৌরব, চামার!
কী বলছিস?
লোকটা আমাকে দেড়শ বলেছিল।
হ্যাঁ। তখন নাকি আর একটা পার্টি এসে গিয়েছিল। আমাকে ইকনমিক্স বোঝাল। ডিম্যান্ড বাড়লে সাপ্লাই না থাকলে দাম ঊর্ধ্বগামী হবেই। আর পঞ্চাশ টাকার জন্যে অপারেশন বন্ধ রাখা যায় না। ব্ল্যাকে যখন রক্ত কিনছি তখন আর ও নিয়ে দর কষাকষি করে কী লাভ! সৌরভ বলল, ওই বোতলটা দে। ভেতরে দিয়ে আসি। যদি দরকার হয় তো উপকারে লেগে যাবে।
গৌরব বোতলটা দিয়ে দিলো। মলি পাশে দাঁড়িয়েছিল। সৌরভ চলে যেতে গৌরব তাকে বলল, লীনার কপাল দ্যাখো, ব্ল্যাকের রক্তে জীবন বাঁচাতে হচ্ছে।
মলি বলল, এভাবে কথাটা বলছ কেন? আমরা কি জীবনের সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে আছি? মোটেই নয়। গ্যাসের লাইন থেকে স্কুলে ভর্তি, সর্বত্র কোনো না কোনোরকম ঘুষ দিতে হচ্ছে। যারা লীনার ওপর অত্যাচারটা করল, তারা ধরা পড়লেই শান্তি পাব।
গৌরব বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে বউদি। তুমি আর দাদা বাড়ি চলে যাও। নাতিনাতনিদের নিয়ে মা বোধহয় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।
তোমার দাদা মাকে ফোন করে সব বলেছেন। ও হ্যাঁ, খবরের কাগজের লোক এসেছিল।
কেন?
ওরা জানতে পেরেছে আমরা লীনার জন্যে এখানে এসেছি। অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল। তুমি কেন লীনার ফ্ল্যাটে গিয়েছিলে? কাদের সন্দেহ হয়। আমার সঙ্গে আলাপ নেই কেন?
তুমি কী বললে?
যা ঠিক তাই বললাম। কাগজের লোকেরা চলে যাওয়ার পর আবার পুলিশের বড় অফিসাররা এল। তোমার দাদার সঙ্গে কথা বলল।
দাদা-এর মধ্যে জড়ায়নি তো?
তোমার দাদা বলেছে লীনা তার সঙ্গে কাজ করত। সেই সুবাদে একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। তোমার সঙ্গে পরিচয় হবার পর তুমি লীনার বাড়িতে আজ ভদ্রতা করে গিয়ে ঘটনাটা আবিষ্কার করেছ। আমিও বলেছি, একটা মেয়ে একা এই শহরে মাথা উঁচু করে বাস করতে পারবে না এমন কোনো আইন যখন নেই তখন তার কাছে যে কোনো ভদ্রলোক যেতে পারে। মেয়েটি যতক্ষণ ভদ্র আচরণ করছে ততক্ষণ তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার মধ্যে কোনো দোষ নেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই শুধু ছেলে আর মেয়ের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। মলি বলল।
গৌরব অবাক হয়ে মলিকে দেখছিল। এই মলিই কদিন আগে লীনা সম্পর্কে ক্ষিপ্ত হয়ে সৌরভের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চলেছিল। কিন্তু এখন তাকে দেখে সেকথা বোঝার উপায় নেই।
পরদিন সকালের কাগজগুলোয় লীনার ফ্ল্যাটের ছবিসহ খবর ছাপা হলো। চাকরিরতা একা মহিলাকে তার ফ্ল্যাটে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন গুণ্ডা। মহিলা মুমূর্ষপ্রায়। পুলিশ তদন্ত করছেন। কিছু সূত্র পাওয়া গিয়েছে। খবরের কোথাও সৌরভের বা মলির নাম নেই কিন্তু গৌরবের উল্লেখ আছে। মহিলার বন্ধু গৌরব বসু ঘটনাটির পরেই তার ফ্ল্যাটে উপস্থিত হয়ে তৎপর না হলে হয়তো তিনি নিঃশব্দে মারা যেতেন। একই খবর বিভিন্ন কাগজে বিভিন্নভাবে ছাপা। কেউ কেউ লীনার পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছে। এক পুলিশকর্তা বলেছেন লীনা ডিভোর্সি এবং তার কয়েকজন পুরুষবন্ধু ছিল। এদের সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে। বস্তুত, লীনা চ্যাটার্জির জ্ঞান ফিরে এলে বিস্তারিত জানা যাবে।
দুপুরবেলায় হাসপাতালে গিয়ে শুনতে পেল লীনার চেতনা এসেছে। কিন্তু সে এত দুর্বল চিকিৎসকরা কথা বলতে দিচ্ছে না। বিকেলেও দেখা হলো না।