৩. কালা জাহাঙ্গীর এবং স্মার্ট ফোন

৩. কালা জাহাঙ্গীর এবং স্মার্ট ফোন

ফারিহা ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে গাড়িটার গতি কমাল, তারপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, বাম পাশে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। কেন সে এই অফিসটার সামনে ব্রেক কষল সে জানে না, আবার এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যাবে নাকি গাড়িটা পুরোপুরি থামাবে ফারিহা ঠিক বুঝতে পারল না। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত ফারিহা গাড়িটা রাস্তার পাশে এনে পুরোপুরি থামাল। চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিনটা বন্ধ করার সাথে সাথে সাত-আট বছরের একটা ছেলে হাতে বেশ কয়েকটা বেলুন নিয়ে গাড়ির জানালায় মুখ লাগিয়ে বলল, “আপা, দুইটা বেলুন কিনেন না!”

ফারিহা বলল, “আমি বেলুন দিয়ে কী করব?”

“খেলবেন।”

ফারিহা হেসে ফেলল এবং সাথে সাথে বুঝে গেল হাসাটা ঠিক হয় নাই। এখন তাকে বেলুন কিনতেই হবে। মুখ গম্ভীর করে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়ালে বেলুন না কিনে উদ্ধার পাওয়ার সুযোগ ছিল। ফারিহাকে হাসতে দেখে ছেলেটা উৎসাহ পেল, বলল, “আপনি খেলতে না চাইলে বাচ্চারে খেলতে দিবেন।”

“আমার বাসায় কোনো বাচ্চা নাই। “

“তাহলে বেলুনগুলা কিনে বাসায় নিয়ে ফাটাবেন। বেলুন ফাটাতে অনেক মজা। অনেক শব্দ হয়।

ফারিহা এবারে ছেলেটাকে ভালো করে দেখল, পকেটের পয়সা দিয়ে বেলুন কিনে সেটা ফাটানোর বুদ্ধি এর আগে তাকে কেউ দেয় নাই। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নাই এটা বেলুনের একটা ব্যবহার হতেই পারে।

ছেলেটা হাসি হাসি মুখে বলল, “আমার যখন অনেক টাকা-পয়সা হবে তখন আমি অনেকগুলো বেলুন কিনে ঠাস ঠাস করে সবগুলো ফাটামু।”

ফারিহা কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“জুয়েল।”

“তোমার কি বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে? নাকি তুমি বোকা টাইপ?”

জুয়েল নামের ছেলেটা কয়েক সেকেন্ড ফারিহার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে।”

“কেমন করে জানো?”

“আপনে পরীক্ষা করে দেখেন।”

“ঠিক আছে আমি পরীক্ষা করে দেখি। যদি পরীক্ষায় পাস করো তাহলে তোমার সবগুলো বেলুন আমি কিনে নিব। “

“খোদার কসম?”

“কসম কাটার দরকার নাই। আমার মুখের কথায় বিশ্বাস করলেই হবে।”

“ঠিক আছে। আমার বুদ্ধির পরীক্ষা নেন।”

“তোমাকে একটা কাজ করতে দিব। তুমি যদি কাজটা ঠিক করে করতে পারো তাহলে বুঝব তুমি বুদ্ধির পরীক্ষায় পাস করেছো।”

“বলেন আপা, কী করতে হবে বলেন।” ছেলেটা উৎসাহী হয়ে উঠল।

ফারিহা দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসটা দেখিয়ে বলল, “ঐ যে অফিসটা দেখো, তুমি তোমার বেলুনগুলো নিয়ে এই অফিসে ঢুকবে। দেখবে ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া একটা মহিলা বসে আছে। তাকে একটা বেলুন দিয়ে বলবে– আপা, এইটা আপনার গিফট।”

“জে, বলব।”

“দেখবে তার সামনে কেউ বসে তার সাথে কথা বলছে কি না ৷ যদি কোনো মানুষ থাকে তাকেও একটা বেলুন গিফট দেবে। দিয়ে বলবে, স্যার, আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। খুবই জরুরি কথা। তারপরে তাকে জরুরি কথাগুলো বলবে। যদি ঠিকভাবে কথাগুলো বলে আসতে পার আমি তোমার সবগুলো বেলুন কিনে নিব।”

“কী কথা বলতে হবে? মা-বাবা তুলে গালি?”

“না না না” ফারিহা আঁতকে উঠে বলল, “কোনো গালাগাল না, খুবই ভদ্রভাবে কথা বলবে। পারবে না?”

“কী বলতে হবে বলেন।”

ফারিহা তখন কী বলতে হবে সেটা শিখিয়ে দিল। একবার ছেলেটাকে দিয়ে প্র্যাকটিস করাল। তারপর তাকে মিশনে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে তার গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

জুয়েল যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে অফিসের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দেয়। সত্যি সত্যি কড়া লিপস্টিক লাগানো একজন মহিলা বসে আছে এবং একজন বয়স্ক মানুষ তার সামনে বসে কথা বলছে। জুয়েল দরজার দাঁড়িয়ে বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”

রিসেপশনিস্ট মহিলাটা বিরক্ত হয়ে বলল, “না-না-, আমি কোনো বেলুন কিনব না।”

“বেলুন কিনতে হবে না ম্যাডাম, আমি একটা কাজে এসেছি।”

“কী কাজ?”

“ভিতরে এসে বলি?”

“ঠিক আছে, আসো।”

জুয়েল ভিতরে ঢুকে একটা বেলুন আলাদা করে রিসেপশনিস্ট মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নেন ম্যাডাম। আপনার জন্য গিফট।”

রিসেপশনিস্ট মহিলা অবাক হয়ে বলল, “গিফট? আমার জন্য?”

“সবার জন্য ম্যাডাম।” বলে আরেকটা বেলুন আলাদা করে বয়স্ক মানুষটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এইটা আপনার জন্য।”

বয়স্ক মানুষটা অবাক হয়ে বললেন, “আমার জন্য?”

“জে। আপনার জন্য একটা মেসেজও আছে।”

“মেসেজ আছে? আমার জন্য?”

“জে।” তারপর তোতা পাখির মতো মুখস্থ বলতে শুরু করল, “এই ডিটেকটিভ কোম্পানিটা তৈরি করেছিলেন একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার হাসান। সরফরাজ কাফী নামে একজন ভুয়া মানুষ সেই কোম্পানিটা দখল করে নিয়েছে। এরা আপনার কুনো কাজ করে দিতে পারবে না, শুধু শুধু আপনার টাকা নষ্ট হবে।”

রিসেপশনিস্ট মেয়েটা তার চেয়ারে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “এই ছেলে থামো! থামো! কী বলছো তুমি এইসব!”

জুয়েল একটুও বিচলিত হলো না, ঠান্ডা গলায় বলল, “সত্যি কথা বলেছি ম্যাডাম। আমার কথা বিশ্বাস না করলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।”

“বের হও– বের হও এখান থেকে।

“জি ম্যাডাম। গুড আফটারনুন।” বলে সে এবাউট টার্ন করে রীতিমতো লেফট-রাইট করতে করতে বের হয়ে এলো।

গাড়িতে হেলান দিয়ে থাকা ফারিহা জুয়েলকে বের হতে দেখে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “কী হলো? পেরেছো বলতে?”

জুয়েল দাঁত বের করে হাসল, বলল, “জি আপা। বলছি। কুনো ভুল হয় নাই।”

“বেয়াদবি করো নাই তো?”

“জে না আপা।”

“গুড। এখন বলো তোমার সবগুলো বেলুন কত?”

জুয়েল হিসাব করে দাম বলল। ফারিহা দাম মিটিয়ে বেলুনগুলো হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সবগুলো আবার জুয়েলের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”

জুয়েল শঙ্কিত সুখে বলল, “আপনি বেলুন নিবেন না?”

“নিলাম তো!”

“তাহলে?”

“তুমি বেলুন ফাটাতে চেয়েছিলে, এগুলো নিয়ে ফাটাও।

জুয়েল চকচকে চোখে বলল, “খোদার কসম?”

“আমি কসম কাটতে পারব না। আমার কথা এমনিতেই বিশ্বাস করতে হবে।”

“ঠিক আছে আপা।” বলে বেলুনগুলো নিয়ে ছুটে যেতে গিয়ে থেমে গেল। ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপা, যদি আমি ঢেলা মেরে এই অফিসের সব জানালা গুঁড়া করে দিই তাহলে আমারে কত দেবেন?”

“কিচ্ছু দিব না। সেইটা হবে বদকাজ। তুমি কি বদ?”

জুয়েল কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর মুখ কালো করে বলল, “জি আপা।”

ফারিহা মুখ শক্ত করে বলল, “বদ মানুষের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। বুঝেছো?”

জুয়েল কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক তখনই আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির দরজা খুলে একজন বয়স্ক মানুষ এদিক-সেদিক তাকায় এবং হঠাৎ করে বেলুন হাতে জুয়েলকে ফারিহার সাথে দেখে দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। জুয়েল কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, তারপর তার কী মনে হলো কে জানে, বেলুনগুলো হাতে ধরে আনন্দে একটা চিৎকার করে ছুটে যেতে থাকে।

বয়স্ক মানুষটা ফারিহার কাছে এসে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “ম্যাডাম, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“করেন।”

“এই ছেলেটাকে আপনি চিনেন?”

“একটু আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।”

“সে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো সত্যি?”

“সে ভিতরে ঠিক কী বলেছে তো আমি জানি না কিন্তু যেগুলো বলার কথা সেগুলো বলে থাকলে সত্যি কথা বলেছে।”

বয়স্ক মানুষটা মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম। মনে হচ্ছে এই কোম্পানিটার সমস্যা আছে। এদেরকে কোনো কেস দিলে টাকা নষ্ট হবে।”

“কেন? কী করেছে এরা?”

“আমি একটা কেস নিয়ে গেছি কিন্তু। এরা আমার কোনো কথা শোনার আগে শুধু টাকার কথা বলে। শুধু অ্যাডভান্স পেমেন্টের কথা বলে।”

ফারিহা কোনো কথা বলল না, চুপ করে রইল। বয়স্ক মানুষটা আবার বলল, “আমাকে দিয়ে একটা কাগজ সাইন করিয়ে নিতে চাইছিল।”

ফারিহা জিজ্ঞেস করল, “কী কাগজ?”

সেই কাগজে লেখা, “যদি তারা কেস সলভ করতে না পারে তাহলে তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব নাই। তারা কোনো টাকা ফেরত দিবে না।”

ফারিহা এবারেও কোনো কথা বলল না। বয়স্ক মানুষটা বলল, “আমি যখন জিজ্ঞাস করলাম এই কোম্পানিতে শাহরিয়ার সাহেব নাই কেন, ঠিক করে উত্তর দেয় না। আঁ উঁ করে।

বয়স্ক মানুষটা এবারে আসল কথায় চলে এলো, জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি শাহরিয়ার সাহেবকে চিনেন?”

ফারিহা বলল, “হ্যাঁ, শাহরিয়ার আমার বন্ধু।”

“আমাকে উনার কাছে নিয়ে যাবেন? উনাকে আমার কেসটা দিতে চাই।”

ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। সেটা সম্ভব হবে না। শাহরিয়ার ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিয়েছে।”

“ছেড়ে দিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। সরফরাজ কাফী তার কোম্পানিটা দখল করে নেওয়ার পর শাহরিয়ার ডিটেকটিভ কাজ করে না।”

“সে কী!” বয়স্ক মানুষটাকে বিভ্রান্ত দেখাল। বলল, “তাহলে আমরা কার কাছে যাব?”

ফারিহা মাথা নাড়ল, “জানি না। খোঁজ দিয়ে দেখেন। আরও প্রাইভেট ডিটেকটিভ নিশ্চয়ই আছে।”

“নাই।”

“আপনার কেসটা কী আমি জানি না। পুলিশের কাছে যেতে পারেন।”

বয়স্ক মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না। পুলিশের কাছে যাওয়া যাবে না। এখন কী করি বলেন দেখি!”

ফারিহা টের পেল বয়স্ক মানুষটা তার সমস্যাটাকে এখন ফারিহার সমস্যা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সে এই প্যাঁচের মাঝে পড়তে চায় না। তাই উদাস মুখে বলল, “দেখেন চিন্তা করে কী করা যায়।”

“আপনি কি শাহরিয়ার সাহেবের ঠিকানাটা দিতে পারেন? আমি তাহলে গিয়ে একটু দেখা করতাম।”

ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। সেটা ঠিক হবে না। শাহরিয়ার একেবারে চায় না। আমার ওপর খুবই রাগ হবে। তাছাড়া–”

“তা ছাড়া কী?”

“আপনাকে আমি সরফরাজ কাফী থেকে সরিয়ে এনেছি। এখন যদি শাহরিয়ারের কাছে নিয়ে যাই তাহলে মনে হবে আমি বুঝি শাহরিয়ারের কাছে ক্লায়েন্ট নেওয়ার জন্য সরফরাজ কাফীর অফিসে গেছি। সেটা খুবই খারাপ হবে!”

বুড়ো মানুষটাকে কেমন যেন হতাশ দেখাল। মাথা চুলকে বলল, “তাহলে শাহরিয়ার সাহেবের সাথে দেখা করার কোনো উপায় নাই? আমি খুবই বিপদের মাঝে আছি। বলতে পারেন প্রায় জীবন-মরণ সমস্যা।”

ফারিহার মানুষটার জন্য একটু মায়া হলো। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমি শাহরিয়ারের সাথে আপনার দেখা করিয়ে দিতে পারি, কিন্তু কোনোভাবেই তাকে কিন্তু বলতে পারবেন না যে আমি দেখা করার ব্যবস্থা করেছি।”

“বলব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।’

“ঠিক আছে। আজকে বিকালবেলা শাহরিয়ারের সাথে আমার দেখা হবে গুলশানের একটা কাফেতে। আমি আপনাকে কাফের ঠিকানাটা দিয়ে দেব। সেখানে ঠিক বিকাল পাঁচটার সময় আসবেন।”

“আসব। অবশ্যই আসব।”

“আমাকে খুঁজে বের করবেন। আমার সাথে শাহরিয়ার থাকবে। আমাকে না চেনার ভান করে শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে তাকে চিনে ফেলার ভান করবেন। তাকে মাঝে মাঝে টেলিভিশনে দেখিয়েছে তাই তাকে চিনে ফেলা এমন কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। “

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।’

“তখন তার সাথে আপনার যেসব কথা বলার দরকার সেগুলো বলতে পারেন। ‘

“গুড। থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”

“মনে থাকবে তো? আপনি যে আমাকে চেনেন সেটা যেন কোনোভাবেই শাহরিয়ার বুঝতে না পারে।”

“বুঝবে না। একদম বুঝবে না। আমি বুঝতেই দেব না।”

ফারিহা তখন কাফেটার ঠিকানা দিল। গাড়িতে ওঠার সময় দেখল একটু দূরে জুয়েলকে ঘিরে ছোট ছোট বাচ্চাদের বেশ বড় ভিড়। মনে হলো বেলুন ফাটানো নিয়ে সে এখন ছোট একটি ব্যবসাতে নেমে গেছে। ছেলেটি যথেষ্ট করিৎকর্মা।

বিকালবেলা ছোটাচ্চু কাফেতে বসে বিস্বাদ একটা কফিতে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষা করছে। তখন ফারিহা এসে ঢুকল। ছোটাচ্চু কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলল, “এসেছো শেষ পর্যন্ত?”

ফারিহা বসতে বসতে বলল, “আসব না কেন?”

“তুমি না আসলে আমাকে এই তিতা-বিদঘুঁটে কফিটা খেয়ে যেতে হতো। ইয়াক থুঃ!”

ফারিহা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যদি তেতো কফি ভালো না লাগে তাহলে সেটা খাও কেন?”

“তাহলে কী খাব?”

“যেটা খেতে ভালো লাগে। এখানে কত রকম কেক আছে, ক্রিমরোল আছে, আইসক্রিম আছে।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “আমি একলা বসে বসে কেক খাব? কখনো শুনেছো একজন মানুষ একলা বসে বসে কেক খাচ্ছে?”

“তাহলে কিছু খাবে না। বসে থাকবে।”

“তুমি কখনো শুনেছো একজন মানুষ একটা কাফেতে এসে একলা একলা বসে আছে? শুনেছো?”

ফারিহা এবারে হাল ছেড়ে দিল। বলল, “ঠিক আছে, তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। এখন আমি এসেছি। তুমি আর একলা নাই। কী খাবে বলো।”

“সবকিছু। কেক, ক্রিমরোল, আইসক্রিম, কফি। তুমি কী খাবে?”

ফারিহা বলল, “শুধু কফি।

“কফি একটা খাওয়ার জিনিস হলো?”

“কফি যদি খাওয়ার জিনিস না হয় তাহলে শুধু কফি খাওয়ার জন্য মানুষজন কাফে বানায় কেন?”

“মানুষের কি মাথার ঠিক আছে? মানুষ কী না করে! মার্ডার করার জন্য বোমা বানায়। সেই তুলনায় কাফে তো কিছুই না!”

ফারিহা চোখ বড় বড় করে বলল, “বুঝলে শাহরিয়ার, তোমার মনে হয় মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যতই তোমার কথা শুনি ততই অবাক হই।”

ছোটাচ্চু মাথা নেড়ে বলল, “তুমি তো এখন আমাকে পাত্তা দিচ্ছ না। একদিন দেখবে মানুষ টিকিট কিনে আমার কথা শুনতে আসবে!

ফারিহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, সেই দিনের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকব। এখন তুমি বসে থাকো, আমি তোমার জন্য খাবার অর্ডার দিই।“

“গুড।”

ফারিহা খাবার অর্ডার দিয়ে এলো। একজন প্লেটে করে টেবিলে খাবার দিয়ে যায়। ছোটাচ্চু খুবই তৃপ্তি করে খেতে খেতে মাঝে মাঝে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে এবং মুখ বিকৃত করে বলছে, “ইয়াক, থুঃ! মানুষ এটা খায় কেমন করে?”

ফারিহা সাবধানে ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা বেজে গেছে। বয়স্ক মানুষটার এখন চলে আসার কথা। ঠিকভাবে শাহরিয়ারকে চেনার এবং তাকে না চেনার অভিনয়টুকু করতে পারলে রক্ষা।

ঠিক দশ মিনিট পর ফারিহা বয়স্ক মানুষটাকে ঢুকতে দেখল। মানুষটা কাফের ভেতর বসে থাকা মানুষগুলোকে লক্ষ করে। এই কাফেটা কমবয়সী মানুষের প্রিয় জায়গা। তাই কমবয়সী অনেকেই বসে বসে গল্পগুজব করছে। বয়স্ক মানুষটাকে একটুখানি বিভ্রান্ত দেখা গেল, তখন হঠাৎ করে ফারিহা এবং ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। তারপর লম্বা পায়ে তাদের দিকে হেঁটে আসতে থাকল।

ফারিহা না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। চোখের কোনা দিয়ে দেখল বয়স্ক মানুষটা হেঁটে হেঁটে ফারিহা আর ছোটাচ্চুর টেবিলটার ঠিক আগের টেবিলে থেমে গেল। সেখানেও ফারিহার বয়সী এক মহিলা একজন মানুষকে নিয়ে বসে কফি খাচ্ছে।

ফারিহার হৃৎপিণ্ড হঠাৎ থেমে যায়। সে শুনল বয়স্ক মানুষটা পাশের টেবিলে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আপনি শাহরিয়ার সাহেব না? বিখ্যাত ডিটেকটিভ শাহরিয়ার? দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির ফাউন্ডার?”

বয়স্ক মানুষটা ফারিহার চেহারা ভুলে গিয়ে পাশের টেবিলের মহিলাকে ফারিহা মনে করেছে। কী সর্বনাশ!

পাশের টেবিলের মানুষটার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং লম্বা চুল, চোখে কালো চশমা। সে মেঘ স্বরে বলল, “আমি শাহরিয়ার সাহেব না!”

“অফকোর্স, আপনি শাহরিয়ার সাহেব। আমি আপনাকে টেলিভিশনে দেখেছি।”

খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মানুষটা বলল, “আপনি কিছু একটা ভুল করেছেন। আমার নাম শাহরিয়ার না।“

বয়স্ক মানুষটা এবারে একটুখানি বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তখন টেবিলে বসে থাকা মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আপনি যে বললেন আপনি শাহরিয়ার সাহেবকে নিয়ে বসবেন?”

মহিলা বলল, “আপনাকে আমি মোটেই কিছু বলি নাই। আপনার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নাই। আপনি কে? কী জন্যে এসেছেন?”

ছোটাচ্চু কান খাড়া করে আলোচনাটা শুনছে। নিজের অজান্তেই তিন চার চুমুক কালো তিতকুটে বিস্বাদ কফি খেয়ে ফেলেছে টের পর্যন্ত পায় নাই। বয়স্ক মানুষটার কথা শুনে ছোটাচ্চু এত অবাক হয়েছে যে সেটি আর বলার মতো নয়। মাথা ঘুরিয়ে ফারিহার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কী হচ্ছে এখানে?”

ফারিহা না শোনার ভান করে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু আবার জিজ্ঞেস করল, “ফারিহা, কী হচ্ছে এখানে? ইনি কে? এখানে আমার খোঁজ করছেন কেন?”

ফারিহা উদাস গলায় বলল, “তুমি ডিটেকটিভ। তুমি খুঁজে বের করো।”

‘ডিটেকটিভ’ শব্দটি শুনে বয়স্ক মানুষটা ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, ফারিহাকে দেখল এবং হঠাৎ করে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। মুখ কাঁচুমাচু করে পাশের টেবিলের মহিলাকে বলল, “সরি! ভুল হয়ে গেছে।”

তারপর ফারিহাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে আরও কাঁচুমাচু হয়ে ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেবকে চিনে ফেলার অ্যাকটিংটা কি আবার করব?”

ফারিহা বলল, “না, আর করতে হবে না। একবারই বেশি হয়ে গেছে।” ছোটাচ্চু বলল, “আমি শাহরিয়ার। আপনি আমাকে খুঁজছিলেন?”

“জি, খুঁজছিলাম। একটু বসি?”

“বসেন।”

বয়স্ক মানুষটা ছোটাচ্চুর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল। তারপর একবার ফারিহার দিকে আরেকবার ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসল। বলল, “বয়স হয়ে গিয়েছে তাই ব্রেনটা আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে। কোনো কাজ আর ঠিকমতো করতে পারি না। সব উল্টা- পাল্টা হয়ে যায়। এই ম্যাডামের বদলে ঐ ম্যাডামের কাছে চলে গিয়েছিলাম।”

ছোটাচ্চু চোখ ছোট ছোট করে ফারিহার দিকে তাকাল, বলল, “তুমি এখন আমার জন্য ক্লায়েন্ট খুঁজে বের করার কাজে লেগেছো?”

ফারিহা বলল, “মোটেই না! উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখো আমি তোমার ঠিকানা দিয়েছি কি না।”

বয়স্ক মানুষ জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “দেন নাই। ম্যাডাম দেন নাই। আমি অনেক অনুরোধ করেছি বলে এখানে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার সাথে দেখা হলো কোথায়?”

“আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি অফিসের সামনে।”

ছোটাচ্চু কেমন যেন চমকে উঠল, ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি রেগুলার ঐখানে ক্লায়েন্ট খুঁজতে যাও?”

ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্।”

“তাহলে?”

“ভাগাতে যাই।’

বয়স্ক মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “ম্যাডাম নিজে কিছুই বলেন নাই। ছোট একটা ছেলে বেলুন নিয়ে–”

ছোটাচ্চু দুই হাতে তার মাথার চুল খামচে ধরে বলেন, “থাক থাক আমি আর শুনতে চাই না। শুনতে চাই না। “

ফারিহা বলল, “সেইটাই ভালো। তুমি বরং উনার কেসটা শোনো হেল্প করতে পারলে হেল্প করো, না পারলে বলে দাও পারবে না।” বয়স্ক মানুষটা বলল, “জি, জি, আমার কেসটা শুনেন।” ছোটাচ্চু বলল, “আমি কেস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

“প্লিজ, প্লিজ, শুধু আমার কেসটা নেন। এই শেষ।”

ফারিহা বলল, “নেবে কি নেবে না সেটা পরে হবে। আগে শুনে নাও।”

ছোটাচ্চু লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে বলেন।”

বয়স্ক ভদ্রলোক তখন সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসে বলতে শুরু করল, “আমার নাম এমদাদ হোসেন। রিটায়ার্ড ব্যাংকার। অনেক দিন মিডল ইস্টে কাজ করে গত বছর ফিরে এসেছি। তিন ছেলে-মেয়ে, বড় ছেলে কানাডা, মেয়ে বিয়ে হয়ে আমেরিকা। ছোট ছেলে কলেজে পড়ে। দেশে আমাদের সাথে থাকে। সমস্যাটা আমার এই ছেলেকে নিয়ে। যখন মিডল ইস্টে ছিলাম তার মা আদর দিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে নষ্ট করেছে। পুরোপুরি বখে গেছে। লেখাপড়া করে না। ফালতু কিছু বন্ধু আছে, তাদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। যখন বাসায় থাকে, ঘরের ভেতর দরজা বন্ধ করে ফেসবুক করে।

এমদাদ হোসেন নামের রিটায়ার্ড ব্যাংকার একটা নিশ্বাস ফেলে থামল। ফারিহা বলল, “অনেক পুরানো গল্প। সব ফ্যামিলির এই রকম গল্প আছে।”

এমদাদ সাহেব বলল, “আমার অবস্থা একটু জটিল। আমার ছেলে কয়দিন আগে আমার কাছে এসে বলেছে তাকে একটা নূতন মোবাইল ফোন কিনে দিতে হবে। তা না হলে বন্ধুদের সামনে সে নাকি মুখ দেখাতে পারবে না। ফোনের দাম পঁচাত্তর হাজার টাকা। বুঝেছেন? পঁ-চা-ও-র হাজার টাকা!”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “বুঝেছি।”

“খোদার ইচ্ছায় টাকা-পয়সার আমার সমস্যা নাই, তাই বলে আমি আমার কলেজে পড়া ছেলেকে পঁচাত্তর হাজার টাকার ফোন কিনে দেব? নেভার!

ফারিহা বলল, “আমার ছেলে হলে আমিও দিতাম না।”

“ছেলের তখন খুব রাগ। আমার ওয়াইফ আবার তার পক্ষে ওকালতি করে, বলে ছেলে একটা শখ করেছে তাকে কিনে দাও না, কী আর হবে। আমি রাজি হই না, তখন কি হলো জানেন?”

“কী হলো?”

“একদিন রাতে ছেলে আর বাড়ি ফিরে আসে না। দরজার নিচে একটা চিরকুট। চিরকুটে কি লেখা জানেন?

“কী লেখা?”

এমদাদ সাহেব তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিয়ে বলল, “আপনি নিজেই পড়ে দেখেন।”

কাগজটা হাতে নিয়ে প্রথমে ছোটাচ্চু, তারপর ফারিহা পড়ল। সেখানে লেখা :

আমি শীর্ষ সন্ত্রাসি কালা জাহাঙ্গীর।
আপনার ছেলেরে আমি হাইজেক করসি। যদি পচাত্তর হাজার টাকা না দেন আপনার ছেলেরে মার্ডার করমু। খামের ভিতর পচাত্তর হাজার টাকা ভরে সিঁড়ির উপরে রাখেন। না হলে আপনার ছেলে ফিনিস। হা হা হা।

ফারিহা বলল, “অনেক বানান ভুল।”

ছোটাচ্চু বলল, “আপনি সন্দেহ করছেন এইটা আপনার ছেলে নিজেই লিখেছে?”

“তা না হলে কে লিখবে? কালা জাহাঙ্গীরের আর কাজ নাই? তাও চাইবে ঠিক পঁচাত্তর হাজার টাকা? এক টাকা কমও না, বেশিও না?”

“হাতের লেখা কী আপনার ছেলের?”

“একটু আঁকাবাঁকা করে লিখেছে, যেন বুঝতে না পারি। কিন্তু বোঝা যায় তারই হাতের লেখা।”

“আপনার ওয়াইফ কী বলেন?”

“এইটাই আমার মূল সমস্যা। ছেলেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর কিডন্যাপ করে নিয়েছে, এরকম কিছু হলে একজন মায়ের নার্ভাস ব্রেক ডাউন হওয়ার কথা, মাতম করার কথা। কিন্তু সে ভালোই আছে। কোনো দুশ্চিন্তা নাই। মাঝে মাঝে আমাকে বলে টাকাটা দিয়ে দিতে, এর বেশি কিছু না।’

“আপনি টাকা দিবেন না?”

“নেভার। পঁচাত্তর হাজার টাকা ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে আকাশে উড়িয়ে দেব কিন্তু ফোন কেনার জন্য ছেলেকে দিব না।”

ছোটাচ্চু তার তিতকুটে কালো কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, “আপনি আমার কাছে কী চান, আমি কী করব?”

“আমার ছেলেটা কোথায় বের করে দেবেন। আমি কান ধরে টেনে বাসায় এনে–”

বাসায় এসে কী করবে সেটা বলার আগেই ছোটাচ্চু বলল, “আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রীই জানেন সে কোথায় আছে। তাকে জিজ্ঞেস করেন।“

“অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। সে বলে যে সে জানে না।“

“আপনার স্ত্রী যদি না বলেন তাহলে তো মুশকিল।”

এমদাদ সাহেব বলল, “প্লিজ আপনি আমার বাসায় এসে আমার ওয়াইফের সাথে একটু কথা বলেন। আমার ধারণা আপনি তার সাথে কথা বলে বের করে ফেলতে পারবেন। প্লিজ! প্লিজ!” বলে এমদাদ সাহেব তিতফুটে কফিসহ ছোটাচ্চুর হাত ধরে ফেলল।

ছোটাচ্চু সাবধানে নিজের হাতকে ছুটিয়ে বলল, “আপনার টেলিফোন নম্বরটা রেখে যান, আমি একটু চিন্তা করে দেখি।”

এমদাদ সাহেব ধরা গলায় বলল, “ছেলেটা পুরোপুরি নষ্ট হবার আগে একটু চেষ্টা করতে চাই।”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি বুঝতে পারছি। তবু আমাকে একটু চিন্তা করতে দেন। আমি আসলে কেস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

এমদাদ সাহেব আরও কিছুক্ষণ অনুনয়-বিনুনয় করে শেষ পর্যন্ত তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ছোটাচ্চুর হাতে দিয়ে চলে গেল। ছোটাচ্চু তখন সরু চোখে ফারিহার দিকে তাকাল। বলল, “তুমি ঠিক কী শুরু করেছো ফারিহা?”

ফারিহা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আমি ঠিক জানি না ৷ যখনই এক রাস্তা দিয়ে যাই অফিসটা চোখে পড়ে, মাথাটা কেমন যেন গরম হয়ে যায়! মনে হয় অফিসটা গিয়ে জ্বালিয়ে দিই।”

ছোটাচ্চু নরম গলায় বলল, “প্লিজ ফারিহা, এই সরফরাজ কাফীর কথা ভুলে যাও। আমার যদি মাথা গরম না হয় তোমার কেন মাথা গরম হবে?”

ফারিহা কোনো কথা বলল না। মুখ শক্ত করে বসে রইল।

.

রাত্রি-বেলা সব বাচ্চাকাচ্চা দাদির (কিংবা নানির) ঘরে বসে হুটোপুটি করছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। বাচ্চারা তাদের হুটোপুটি থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। একজন বলল, “ছোটাচ্চু, কোনো কিছু আনো নাই?”

“কী আনব?”

“কেক। আইসক্রিম।”

আরেকজন বলল, “ফ্রায়েড চিকেন? পিৎজা?”

আরেকজন বলল, “ছোটাচ্চু এখন কেমন করে আনবে? মনে নাই ছোটব্বু এখন বেকার।

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। আমি এখন বেকার। এখন তোরা সবাই মিলে ছোটাচ্চু রক্ষা কমিটি তৈরি কর। তারপর আমার জন্য চাঁদা তুলে প্রত্যেকদিন আমার হাত খরচের টাকা তুলে দিবি।”

ছোটাচ্চুর কথা শুনে সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল। শুধু একজন বলল, “উঁহু। আগে ছোটাচ্চু কেসের পিছনে ছুটত। এখন কেসগুলো ছোটাচ্চুর পিছনে ছুটে। ছোটাচ্চু উল্টা কেস নিতে চায় না ৷ তাই না ছোটাচ্চু?”

ছোটাচ্চু কোনো কথা বলল না।

একজন ছোটাচ্চুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি ছোটাচ্চু।”

“মাঝে মাঝে সত্যি।”

“আজকে কোনো কেস পেয়েছো ছোটাচ্চু?”

“পেয়েছি। নিব কি না বুঝতে পারছি না।”

“কী কেস ছোটাচ্চু? ডাবল মার্ডার?”

“নাহ। একটা ছেলেকে কালা জাহাঙ্গীর কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে। বলছে টাকা না দিলে মার্ডার করে ফেলবে।”

“সর্বনাশ!” এবারে সবাই এসে ছোটাচ্চুকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন বলল, “কত বড় ছেলে ছোটাচ্চু? সত্যি মার্ডার করে ফেলবে? কীভাবে মার্ডার করবে? ডেডবডি কী করবে?”

ছোটাচ্চু বলল, “ছেলেটার বাবা মনে করে ভুয়া কেস। নতুন মোবাইল কেনার জন্য ছেলে নিজেই লুকিয়ে আছে।”

বাচ্চাগুলো এবারে হতাশ হলো। মাথা নেড়ে বলল, “ধুর। মার্ডার কেস না হলে কেস নিও না ছোটাচ্চু।”

বাচ্চাগুলো আবার হুটোপুটিতে ফিরে গেলে টুনি ছোটাচ্চুর কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “ছোটাচ্চু।”

“উঁ।”

“তুমি কেসটা নিবে, প্লিজ!”

“কেন?”

“বুদ্ধির কেস আমার খুব ভালো লাগে। তুমি সবার সাথে কথা বলবে। তখন বের হয়ে আসবে কে কী করেছে।

“তুই কেমন করে জানিস?”

“সবসময় এরকম হয় না?”

“হয় নাকি?”

“হয় ছোটাচ্চু। প্লিজ কেসটা নাও!”

ছোটাচ্চু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে।”

টুনটুনি খুশিতে হাততালি দিয়ে বলল, “তুমি যখন সবার ইন্টারভিউ নেবে তখন আমাকে নিয়ে যাবে, প্লিজ!”

“তুই কী করবি?”

“দেখব। তুমি কীভাবে ইন্টারভিউ করো। প্লিজ ছোটাচ্চু প্লিজ! কতদিন আমি তোমার সাথে কোনো কেস করি না! আগে কত কেস করতাম মনে আছে?”

ছোটাচ্চু আবার একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে টুনি। বিকালবেলা রেডি থাকিস।”

.

পরদিন বিকালবেলা ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে এমদাদ সাহেবের বাসায় হাজির হলো। পুরনো একটা দোতলা বাসা, বাসার সামনে গাছপালা। আজকাল এরকম বাসা দেখা যায় না, সবসময় বিশাল সাত তলা বিল্ডিংয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়। বাসার সামনে নুড়ি বিছানো রাস্তা এবং সেখানে সত্যিকারের গাড়ি বারান্দাও আছে। ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে স্কুটারে করে এসেছে, তাই গাড়ি বারান্দাটা কোনো কাজে লাগল না।

বাসার সামনে পুরোনো আমলের দরজার পাশে পুরোনো আমলের কলিংবেল এবং সেটাতে চাপ দিতেই পুরোনো আমলের একটা শব্দ হলো। কিছুক্ষণ পর মোটাসোটা একজন কাজের মহিলা দরজা খুলে কেমন যেন চোখ পাকিয়ে তাকাল। বোঝাই যাচ্ছে এই বাসায় অনেক দিন ধরে কাজ করছে তাই বাসার মাঝে কেমন যেন একটা মাতবরি করার অধিকার জন্মে গেছে। মোটামুটি কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চান?”

ছোটাচ্চু বলল, “এমদাদ সাহেবকে বলেন শাহরিয়ার হাসান এসেছেন। ওনার সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে এসেছি।”

এরকম সময়ে সাধারণত অতিথিকে ডেকে ভেতরে বসানো হয় কিন্তু মোটাসোটা মহিলা তার কোনো লক্ষণ দেখাল না। দরজাটা ঠিক মুখের ওপর বন্ধ করে দিল না কিন্তু চোখে-মুখে একটা বিতৃষ্ণার ভাব ফুটিয়ে তাদেরকে দাঁড়া করিয়ে রেখে ভিতরে ঢুকে গেল।

ভেতরে খবর যাওয়া মাত্রই এমদাদ সাহেব প্রায় ছুটে এসে তাদের দুইজনকে ভিতরে নিয়ে এসে বসাল। বাসা খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না, ট্রাফিক জ্যামে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না এই সব ভদ্রতার কথা বলতে লাগল।

ছোটাচ্চু সারা রাস্তা গজরগজর করতে করতে এসেছে কিন্তু এখন খুবই ভদ্রভাবে বলল তাদের আসতে কোনোই অসুবিধা হয় নাই।

মোটাসোটা মহিলা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, টুনি ভেবেছিল এমদাদ সাহেবের যত্নআত্তি দেখে এই মহিলা হয়তো তার ব্যবহারের জন্য একটু অপ্রস্তুত হবে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। বরং মনে হলো সে ছোটাচ্চু এবং টুনির উপরে আরেকটু বিরক্ত হয়ে উঠল।

এমদাদ সাহেব ছোটাচ্চুর সাথে টুনিকে দেখে একটু অবাক হয়েছে, তাই ছোটাচ্চুকে বানিয়ে একটু ব্যাখ্যা দিতে হলো, নাচের ক্লাস থেকে বাসায় নেওয়ার কেউ নাই, তাই ছোটাচ্চু তাকে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এমদাদ সাহেব জানতে চাইল, বড়দের কথাবার্তা শুনে সে বিরক্ত হয়ে যাবে কি না, ইচ্ছা করলে টুনি ভিতরে গিয়ে টেলিভিশন দেখতে পারে।

টুনি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল সে সাথে গল্প বই নিয়ে এসেছে। কাউকে বিরক্ত না করে এবং নিজে বিরক্ত না হয়ে সে যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটাতে পারবে।

টুনি তার ব্যাগ খুলে একটা মোটা ভূতের বই বের করে পড়ার ভান করে কান খাড়া করে সবার কথাবার্তা শুনতে আরম্ভ করল।

ছোটাচ্চু পকেট থেকে একটা ছোট নোট বই আর পেন্সিল বের করে এমদাদ সাহেবকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। প্রথমে ছোটখাটো তথ্য, তারপর ঠিক কীভাবে কী ঘটেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন। টুনি বেশ অবাক হয়ে দেখল ছোটাচ্চু আজকাল খুবই গুছিয়ে প্রশ্ন করা শিখে গেছে। একই প্রশ্ন কয়েকভাবে জিজ্ঞেস করে সেখান থেকে প্রশ্নের আসল উত্তরটা বের করে নেয়। ছোটাচ্চু যতক্ষণ প্রশ্ন করেছে টুনি ততক্ষণ তার বইয়ে মাথা গুঁজে রেখেছে কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করে দেখল দরজার অন্য পাশে কাজের মহিলা এবং আরেকজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে। এই ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই এমদাদ সাহেবের স্ত্রী। ছেলে কিডন্যাপ হয়ে যাওয়ার পরেও যার কোনো দুশ্চিন্তা নাই।

এমদাদ সাহেবের সাথে দশ পনেরো মিনিট কথা বলে ছোটাচ্চু বলল এখন সে এমদাদ সাহেবের স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চায়। এমদাদ সাহেব তার স্ত্রীকে ডেকে আনতে গেল, মনে হলো চাপা গলায় একটু কথা কাটাকাটি হলো। তারপর এমদাদ সাহেবের স্ত্রী এবং তার পিছু পিছু কাজের মহিলাটা ভিতরে ঢুকে। এমদাদ সাহেবের স্ত্রী সোফায় বসল, মোটাসোটা মহিলা ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে গেল, বোঝা গেল এবারে সে এখান থেকে নড়বে না।

ছোটাচ্চু এমদাদ সাহেবের স্ত্রীকে বলল, “আমি আসলে আপনার সাথে একা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

এমদাদ সাহেবের স্ত্রী ছোটাচ্চুকে প্রায় একটা ধমক দিয়ে বলল, “একা কথা বলার কী আছে? যা বলার আছে সবার সামনে বলে ফেলেন।”

ছোটাচ্চু ধমক খেয়ে একটু বিরক্ত হলো, তাই এবারে প্রশ্ন করার মাঝে আর সূক্ষ্ম কারুকাজে গেল না, সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলে কোথায় আছে আপনি জানেন?”

ভদ্রমহিলা একটু থতমত খেয়ে বলল, “না, জানি না।“

“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি জানেন।”

ভদ্রমহিলা এবারে ছ্যাঁৎ করে উঠল, বলল, “না, আমি জানি না।” ছোটাচ্চু এবারে কাজের মহিলার দিকে ঘুরে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই জানেন।”

কাজের মহিলা কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ, আপনি। বলেন দেখি কোথায় আছে?”

“আমি–আমি–আমি কেমন করে বলব?”

“মনে করেন যখন ছেলেটাকে পাওয়া যাবে তখন যদি দেখা যায় আপনি আসলে জানতেন সে কোথায় আছে, তখন আপনি ঝামেলায় পড়বেন। এই বাসায় আপনার চাকরি থাকবে না। পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে।”

“পু-পু-পুলিশ? পুলিশ কেন?”

“একটা ছেলেকে কালা জাহাঙ্গীর হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে, আর পুলিশ জানবে না?”

মোটাসোটা মহিলাকে এবারে যথেষ্ট নার্ভাস দেখা গেল, এমদাদ সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “বেগম সাহেব? কী বলে এইগুলো সত্যি নাকি? আমি কী –“

এমদাদ সাহেবের স্ত্রী তাকে কথা শেষ করতে দিল না। একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ!”

কাজের মহিলা চুপ করে গেল। ছোটাচ্চু তখন আরও দুই-চারটা প্রশ্ন করে শেষ করে দিল। এমদাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা এখন যাই। শুধু যাবার আগে আপনার ছেলের ঘরটা একটু দেখে যাই।”

কাজের মহিলা হঠাৎ কেমন যেন অস্থির হয়ে বলল, “আপনারা একটু দাঁড়ান, ছোট সাহেবের ঘরটা একটু পরিষ্কার করে দেই। খুবই ময়লা হয়ে আছে।”

ছোটাচ্চু বলল, “না, না। পরিষ্কার করবেন না। ঘরটা যেরকম আছে সেরকমই দেখতে চাই।”

এমদাদ সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আসেন আমার সাথে।”

এমদাদ সাহেবের পিছু পিছু ছোটাচ্চু ভিতরে যেতে শুরু করল। মাঝপথে থেমে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই আসবি?”

টুনি ভান করল তার যাওয়ার ইচ্ছা নেই, কিন্তু ভদ্রতা করে শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হয়েছে। সে বই বন্ধ করে তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে।

এমদাদ সাহেবের বাসাটা অনেক পুরোনো। দোতলা বাসার উপরের তলায় একটা ঘরে তার ছেলে থাকে। থাকার মতো আর কোনো ঘর নেই। এমদাদ সাহেব ঘরের ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকল। ষোলো-সতেরো বছরের একটা ছেলের ঘর যেরকম হওয়ার কথা, ঘরটা ঠিক সেরকম। দেওয়ালে বিদেশি হেভি মেটাল গায়কের পোস্টার। টেবিলে বইপত্র ছড়ানো। বিছানায় জামা-কাপড় পড়ে আছে। টুনি লক্ষ করল টেবিলের নিচে একটা প্লেট এবং দুটো বাটি। প্লেটে উচ্ছিষ্ট খাবার। একটা পানির বোতল। ছোটাচ্চু বাথরুমে উঁকি দিল। পিছু পিছু টুনিও ঢুকল, বাথরুমের বেসিন ভেজা। গ্লাসে একটা টুথপেস্ট, টুথব্রাশ। টুনি হাত দিয়ে দেখল টুথব্রাশটা ভেজা, এটা আজকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘরে ঢুকলে যে কেউ বলতে পারবে এখানে একজন মানুষ থাকে। সেই মানুষটা কে সেটা আন্দাজ করতে হলে আইনস্টাইন হতে হবে না। শুধু তা-ই না, মানুষটা এই মুহূর্তে কোথায় লুকিয়ে আছে সেইটাও অনুমান করা যায়। এমদাদ সাহেবের স্ত্রী আর তাদের কাজের মহিলাটা ঘরে ঢুকেই যেভাবে একটা আলমারির সামনে পজিশন নিয়েছে সেটা দেখেই বোঝা যায় এর ভেতরেই ছেলেটা ঘাপটি মেরে আছে। এমদাদ সাহেব নিজে এটা কেন বুঝতে পারে নাই টুনি অনুমান করতে পারল না। কাউকে কোনোভাবে বিরক্ত না করে ছেলেটাকে কীভাবে বের করা যায় টুনি একটু চিন্তা করল। তারপর সে খটাশ করে তার ঘাড়ে একটা চাটি মারল। যথেষ্ট জোরে এবং যথেষ্ট শব্দ করে। তারপর হাতটা চোখের সামনে এনে বলল, “সর্বনাশ!”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “সর্বনাশ? কী সর্বনাশ?”

টুনি বলল, “মশা!”

“মশা আবার সর্বনাশ হলো কীভাবে? বাংলাদেশ মানে মশা। মশা মানে হলো বাংলাদেশ।”

“এডিস মশা।”

“তাই নাকি?”

টুনি তার আঙুল থেকে কাল্পনিক মশাটা নিচে ফেলে বলল, “পত্রিকায় দেখো নাই নতুন ডেঙ্গু এসেছে?”

“এসেছে নাকি?”

“হ্যাঁ। হাফ ডেঙ্গু, হাফ চিকুনগুনিয়া, হাফ ম্যালেরিয়া।”

“তাই নাকি?”

টুনি বলল, “হ্যাঁ, ছোটাচ্চু, খুবই ডেঞ্জারাস। মশা কামড় দেওয়ার সাথে সাথে জ্বর, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, আর প্লাটিলেট ঝপ করে অর্ধেক এডিস মশা খুবই ডেঞ্জারাস।”

“তুই এডিস মশা চিনিস?”

“চিনব না কেন? দেখতে চিতাবাঘের মতো।” কথা শেষ করেই টুনি ছোটাচ্চুর গালে চটাশ করে একটা চড় মেরে দিল- বলল, “এই দেখো, আরেকটা।”

ছোটাচ্চু অবশ্য কিছুই দেখল না। গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “পরের বার আমার গালে মশা মারার আগে আমাকে একটু ওয়ার্নিং দিস।

“ঠিক আছে। দিব।” বলে টুনি এদিক-সেদিক এডিস মশা খুঁজতে থাকে।

এমদাদ সাহেব, তার স্ত্রী এবং কাজের মহিলা একটুখানি বিস্ময় নিয়ে টুনির কাজকর্ম লক্ষ করছিল। টুনি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই রুমে তো ছয়-সাত দিন থেকে কেউ থাকে না, সেই জন্য এডিস মশা এভাবে বেড়েছে। মনে হয় কমোডের পানিতে লার্ভা হয়েছে।”

এই রুমে কেউ থাকে না কথাটা এমদাদ সাহেবের স্ত্রী এবং কাজের মহিলার খুব পছন্দ হলো। তারা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। টুনি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাসায় কি মশার কয়েল আছে? এখানে একটা মশার কয়েল জ্বালিয়ে দেই?”

এমদাদ সাহেবের ছেলে খুঁজে বের করা থেকে হঠাৎ করে মশার কয়েল জ্বালানো কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল কেউই সেটা ভালো করে বুঝতে পারল না ৷

টুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “আছে? আছে মশার কয়েল? আমি এই ঘরে জ্বালিয়ে দিয়ে যাই?”

ছোটাচ্চু বলল, “তোর মশার কয়েল জ্বালাতে হবে না। আয় আমরা এখন যাই।’

সবাই ঘর থেকে একে একে বের হয়ে আসতে থাকে। টুনি আরও একবার চেষ্টা করল, “আছে মশার কয়েল? একটা হলেই হবে। “

কাজের মহিলা বলল, “আছে।”

“আমাকে দিবেন প্লিজ!”

এমদাদ সাহেবের স্ত্রী বলল, “এইভাবে চাইছে মেয়েটা, দিয়ে দাও একটা, জ্বালিয়ে দিক।”

কাজেই বাসার কাজের মহিলা নিচে নেমে এসে টুনিকে একটা মশার কয়েল দিল। টুনি সেই মশার কয়েল নিয়ে ছেলেটার রুমে গেল এবং মশার কয়েল জ্বালিয়ে নিচে ফিরে এলো। তবে একটা মশার কয়েল জ্বালাতে যেটুকু সময় লাগার কথা তার থেকে সময় যে বেশি লেগেছে সেটা ছোটাচ্চু ছাড়া আর কেউ লক্ষ করল না।

নিচে নেমে আসার পর ছোটখাটো ভদ্রতায় কথা শেষ করে যখন ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ অত্যন্ত বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। সবাই শুনল দোতলায় ছেলের ঘরে কেউ একজন দুম দুম করে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তার সাথে একজনের চিৎকার এবং বিকট কাশির শব্দ শোনা গেল।

এমদাদ সাহেবের স্ত্রী এবং কাজের মহিলা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। এমদাদ সাহেব চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “কী হচ্ছে?”

টুনি বলল, “আমি তো আপনার ছেলের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে এসেছি, সে মনে হয় বের হওয়ার চেষ্টা করছে।”

এমদাদ সাহেব চোখ কপালে তুলে বলল, “আমার ছেলে? সে বের হতে চাইছে? সে তার ঘরেই আছে?”

“মনে হয়।”

“সে এখন বের হতে চাইছে কেন?”

“ঘরের ভেতর মশার কয়েল জ্বালিয়ে এসেছিলাম। মনে হয় সেই জন্য।”

“একটা মশার কয়েল জ্বালালে সে বের হতে চাইবে কেন?”

টুনি অপরাধীর মতো বলল, “একটা জ্বালাইনি তো– চল্লিশটা জ্বালিয়েছি।”

এমদাদ সাহেব অবাক হয়ে বলল, “চল্লিশটা মশার কয়েল তুমি কোথায় পেয়েছো? তুমি তো একটা কয়েল নিয়ে গেছো।”

টুনি লাজুক মুখে বলল, “ঐ একটাকে বিশ টুকরা করে দুই পাশে জ্বালিয়ে দিয়েছি। চল্লিশটা হয়ে গেছে।”

এমদাদ সাহেব অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু বলল, “মনে হয় দরজাটা খুলে আপনার ছেলেকে বের করে আনা দরকার। ঘরটা মনে হয় এতক্ষণে গ্যাস চেম্বার হয়ে গেছে।”

এমদাদ সাহেব বলল, “আমি যাচ্ছি। দরজা খুলে নিয়ে আসছি। আজকে দেখা যাবে কত ধানে কত চাল! সোনার চান্দের শরীরে কত কেজি মাংস আর কত কেজি হাড্ডি!”

এমদাদ সাহেব ছেলেকে ধরে আনতে যাওয়ার পর ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকাল, বলল, “এডিস মশার কথাটা ভুয়া?”

টুনি অপরাধীর মতো মথা নাড়ল ৷

“এই কায়দা না করে সোজাসুজি বললে কী হতো?”

টুনি এমদাদ সাহেবের স্ত্রী আর কাজের মহিলাকে দেখিয়ে বলল, “ওনারা দুইজন যেভাবে গার্ড দিচ্ছিলেন তাই বলতে সাহস পাই নাই।”

এরকম সময় এমদাদ সাহেব তার ছেলের কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে ঘরে নিয়ে আসে। সবাই শুনল হুঙ্কার দিয়ে এমদাদ সাহেব বলল, “কালা জাহাঙ্গীর হাইজ্যাক করেছে? কালা জাহাঙ্গীর? পঁচাত্তর হাজার টাকার জন্য কালা জাহাঙ্গীর তোকে হাইজ্যাক করেছে? পঁচাত্তর টাকার জন্যও তোকে কেউ হাইজ্যাক করবে না। বুঝেছিস তুই?”

ছোটাচ্চু বুঝতে পারল এখন এখানে থাকাটা তাদের জন্য মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, দরজার দিকে এগুতে এগুতে বলল, “আমরা এখন যাই?”

“এক সেকেন্ড–” বলে এমদাদ সাহেব এক হাতে ছেলের কান ধরে রেখে অন্য হাতে প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে বলল, “আপনার ফি। “

ছোটাচ্চু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কিন্তু আমরা তো ফি নিয়ে কোনো কথা বলি নাই।”

“আমি জানি। ভদ্রলোকেরা কখনো ফি নিয়ে কথা বলে না। শুধু শুনে রাখেন, কালা জাহাঙ্গীরকে টাকা দিতে হচ্ছে না আপনাকে দিতে পারছি সেইটাই আমার আনন্দ।”

“কিন্তু–”

“কোনো কিন্তু নাই। আপনার সাথে আরেক দিন কথা বলব। আজকে আমার এই মহা কামেল ছেলে আর তার মা আর খালার সাথে কথা বলার দিন। শুধু শেষ একটা কথা শুনে যান।”

ছোটাচ্চু বলল, “কী কথা?”

এমদাদ সাহেব ফিসফিস করে বলল, “শুধু আপনার এই ভাতিঝি থেকে সাবধান। সে মনে হয় আপনাকেও দুই চারবার বিক্রি করে ফেলতে পারবে।

ছোটাচ্চু হাসি গোপন করে বলল, “আমি জানি।”

টুনি না শোনার ভান করে উদাস মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *