৩. কলকাতায় ট্রাম দেখা

কলকাতায় এলে ট্রাম দেখা যায়। চলন্ত ট্রামগাড়ি দেখতে খুব ভাল লাগে আশার। রঈস মানুষের গাড়ি ট্রাম লাইন ছেড়ে অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায় ঢুকল। দুপাশে রেডিও চলছে। লোকজন রাস্তায় উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরছে। কিন্তু রঈস মানুষটির ওপর তাঁর আস্থা তখন পুরোপুরি। বাগানবাড়িতে যে ওইরকম ভদ্রতা করেছে সে কেন এখানে এসে ছোট হবে? সামনের গাড়িটা থেমে গেছে। গাড়ির ড্রাইভার নেমে এসে জানাল তিন-তিনটে গাড়ি ওই গলিতে ঢুকলে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাবু শুধু আশাজীর গাড়িটাকেই যেতে বলেছেন। এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে কমলা তার হাত আঁকড়ে ধরলেও সেটা গ্রাহ্য করলেন না আশা। অতএব তার গাড়ি এবার গলিতে ঢুকল। সম্ভবত মহিলা বলেই গাড়ির আরোহীদের জন্যে কৌতূহলী হয়ে উঠল পথচারীরা। নানা মন্তব্য এবং সেই সঙ্গে কিছু সিটি ভেসে আসতেই আশা কুঁকড়ে গেলেন। কোনো মাতালের গলায় চিৎকার উঠল, যব সে বালম ঘর আয়ে, জিয়ারা মচল যায়ে। আর তখনই সামনের গাড়িটা থমকে গেল। যে বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে সেটি দোতলা। গাড়ির শব্দ পেয়ে কয়েকটি অল্পবয়সী মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এসেও আবার ফিরে গেল চুপচাপ। রঈস মানুষটি এগিয়ে এলেন নিজের গাড়ি ছেড়ে, নেমে আসুন। আমরা পৌঁছে গিয়েছি।

কিন্তু–! আশা ততক্ষণে এখানে আসার জন্যে প্রায় আফসোসের স্তরে পৌঁছে গিয়েছেন।

 আপনি আমার সঙ্গে এসেছেন যখন তখন আপনার অসম্মান হবে না। সিটি গান অথবা চিৎকার এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। বড় বড় মন্দিরের সামনে পৌঁছালেও তো ঝামেলায় পড়তে হয়। আসুন।

কমলাকে ইশারা করে তিনি গাড়ি থেকে নামতেই রঈস মানুষটি বাড়ির ভেতর এগিয়ে গেলেন। যেসব মেয়ে একটু আগে বাইরে ছুটে গিয়েছিল তাদের দেখতে পেলেন নীচের বারান্দায়। যেন ওদের দেখেই সবাই এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রঈস মানুষ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছিলেন। হঠাৎ তরতর করে ওপর থেকে একজন নেমে এল, নমস্তে বাবুসাহাব। আরেব্বাস, আপনি আসবেন। অথচ আমরা কোনো খবর পাইনি।

হ্যাঁ। হঠাৎ চলে এলাম।

আমি এইমাত্র খবর পেয়ে ছুটে এলাম। মুশকিল হল গোলাপবালা–। লোকটা কথা শেষ করতে দ্বিধা করল।

আমি গোলাপবালার কাছে আসিনি। মীনাজী আছেন? রঈস মানুষ প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ হ্যাঁ। আছে, কিন্তু এঁরা?

আমার মেহমান।

লোকটি ওদের পরপর কয়েকটা বন্ধ ঘরের সামনে দিয়ে নিয়ে এল একটি ছাদে। সেখানেই তাদের বসার ব্যবস্থা করে সে গেল সম্ভবত খবর দিতে। হঠাৎ আশা আবিষ্কার করলেন আশেপাশের অনেক জায়গায় নূপুর বাজছে এবং সেই সঙ্গে রাগাশ্রয়ী হিন্দি সিনেমার গান। রঈস মানুষটি কোনো কথা না বলে ছাদে পায়চারি করছেন। আশা বসে আছেন চুপচাপ, পেছনে কমলা দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ওপাশের দরজা খুলে গেল। আশা দেখলেন একটি দীর্ঘাঙ্গী মহিলা, যার বয়স এত স্বল্প আলোয় বোঝা মুশকিল, এগিয়ে আসতে আসতে থমকে গেলেন। মহিলার পরনে সালোয়ার পাঞ্জাবি, চুল লম্বা বেণীতে সংযত। মহিলার গায়ের রঙ অসম্ভব ফর্সা। রঈস মানুষটি ঘুরে দাঁড়িয়ে মহিলাকে দেখতে পেয়েই দ্রুত এগিয়ে এলেন। তিনি কিছু বলার আগেই মহিলার ধরা গলা শোনা গেল, কী ব্যাপার? শুনলাম আপনি আমার কাছে এসেছেন?

হ্যাঁ। এভাবে খবর না দিয়ে আসার জন্যে দুঃখিত। আপনি কি ব্যস্ত?

না না। ভাবছিলাম এবার শুয়ে পড়লেই হয়।

এত তাড়াতাড়ি? আপনার রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে?

আমি তো দিনে একবার খাই। আর এখন তো শোওয়া ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই। এরা?

এঁর জন্যেই আপনাকে বিরক্ত করলাম। আমরা কি এখানে বসব?

হ্যাঁ। মহিলা একটি ছোট মোড়া টেনে নিয়ে নিজে বসলেন, ঘরে এবাড়ির তিনটে বাচ্চা শুয়ে আছে। এখন তো আমার বেশি ঘরের দরকার নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না চারপাশের এত ঝরনা, নদী ছেড়ে আপনারা একটা মজা ডোবার কাছে কেন এলেন?

রঈস মানুষটি হাসলেন, ধরুন, আপনার সঙ্গে গল্প করতে।

তা ভাল। বাঙালিদের একটা খুব মজার অভ্যেস।

আপনিও তো বাঙালি হয়ে গিয়েছেন।

না না। আমি পাক্কা হিন্দুস্থানী। যা দিলাম তার থেকে বেশি নিলাম।

কী দিয়েছেন তা জানি, কী নিয়েছেন?

 বিষ। মনে, শরীরে। বলেই হাসলেন, আপনি, না তুমিই বলছি, অনেক ছোট, তুমি কিছু মনে কর না। কী করো তুমি? ওঁর সঙ্গে এখানে কেন? তুমি যদি ভদ্রঘরের মেয়ে হও তাহলে বলি এখানে তোমাদের কেউ আসে না। মহিলার কথায় কোনো ঝাঁঝ নেই।

আশা প্রথম কথা বললেন, আপনাকে দেখতে।

মীনাজী সজোরে হেসে উঠলেন, ওমা! আমার মতো একটা বুড়িকে দেখার কী আছে।

আশা বললেন, ওর সঙ্গে আমার আজকেই পরিচয়। উনি হঠাৎ আপনার কথা বলতে আমরা এখানে চলে এলাম।

আমার কথা? একজন বৃদ্ধা বাঈ-এর আর কী কথা থাকতে পারে?

রঈস মানুষ এবার কথা বললেন, মীনাজী, ওঁর পরিচয় দিচ্ছি। উনি আজ কলকাতায় এসেছেন সারা বাংলা সঙ্গীত সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে। আপনি তো জানেন আমি কোনো সম্মেলনে রস উপভোগ করতে পারি না। তাই ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাগানবাড়িতে। কোনোরকম অসম্মান করিনি তবু উনি আমাকে নাচ দেখাতে অস্বীকার করেছেন। কোনো ব্যক্তিমানুষের সামনে উনি নাচেন না! ঈশ্বরকে দর্শক হিসেবে কল্পনা করে উনি খুশি হন। তখনই আপনার প্রসঙ্গ উঠল।

তুমি নাচো? বাঃ। মীনাজী কথার মাঝখানে বাধা দিল, কোন্ নাচ?

ভরতনাট্যম। আশা নিচু গলায় জানালেন।

কার কাছে শিখেছ?

আমি শেখা শুরু করেছিলাম তাতার কাছে।

তাতা? পাণ্ডানুল্লুরের তাতা? প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মীনাজী।

আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনি চলে যাওয়ার পর আরও দুজনকে গুরু হিসেবে পেয়েছি।

মীনাজী উত্তেজিত ভঙ্গিতে মোড়া থেকে উঠে কাছে এলেন, তুমি তাতার কাছে শিখেছ! আহা কী ভাগ্যবতী তুমি। কী নাম তোমার?

আশা দেখলেন, তাঁর কাছে এগিয়ে আসা মানুষটির বেশ বয়স হয়েছে। মুখে অজস্র ভাঁজ। কোনোভাবেই সত্তরের নীচে নয়। তিনি নিজের নাম বললেন। তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া হল না। কারণ তখন মীনাজী যেন তাতার কথাতেই বিভোর। মীনাজী বললেন, মানুষটিকে আমি শুধু চোখে দেখেছি, তুমি কী ভাগ্যবতী। তারপরেই গুনগুনিয়ে উঠলেন একটি পদ, যা আশার খুব চেনা। নিজের অগোচরেই আশা তাতে গলা মেলালেন। খুবই নিচু গলায় একটু সুরের সেতু তৈরি হতেই মীনাজীর পায়ে তাল ফুটল। হঠাৎ থেমে গিয়ে মীনাজী বলে উঠলেন, এই মেয়ে, তোমার গল্প শুনি।

আশা হেসে উঠলেন, আমার কোনো গল্প নেই।

তুমি কি শুধু নাচ নিয়েই থাকো?

 এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে দিলেন না রঈস মানুষটি। তিনি বললেন, মীনাজী, আপনার স্মরণশক্তি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। আপনার কী মনে পড়ছে না আশার কথা? আপনিই তো একদিন বলেছিলেন ওর কথা। আপনার স্বামী–! হঠাৎ মাথা নিচু হয়ে গেল মীনাজীর। সেটা লক্ষ্য করে রঈস মানুষ বললেন, তিন বছর আগে আশাদেবী যখন এই শহরে নাচ দেখাতে এসেছিলেন তখন খবরের কাগজে ওর ছবি বেরিয়েছিল। সেটা দেখার পর আপনি ওর কথা আমাকে বলেছিলেন। আপনার কি মনে পড়ছে না?

হঠাৎ চেহারা পাল্টে গেল বৃদ্ধার। কঠোর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন নিয়ে এসেছেন ওকে?

রঈস মানুষটি শান্ত গলায় জবাব দিলেন, আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হওয়া দরকার।

এবার আশা প্রশ্ন না করে পারলেন না, একথা কি সত্যি, যিনি আমাকে প্রথম নাচ সম্পর্কে আগ্রহী করেছিলেন তিনি আপনার স্বামী? ওঁর কথাটা শোনার পর আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

মীনাজী মুখ তুললেন, কেন?

কারণ আমি খুব ছোটবেলা থেকে আমার শিক্ষককে দেখেছি। তিনি ছিলেন বাউণ্ডুলে প্রকৃতির। গ্রামের বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন ইচ্ছেমতন। তাঁর পরিবারের কাউকেই আমি দেখিনি। গ্রামের মানুষরা তাঁকে বলত পাগলা মাস্টার। সত্যি বলতে কী তিনি সব সময় স্বাভাবিক ছিলেন না।

মীনাজী চোখ বন্ধ করলেন, আচ্ছা, তোমার প্রথম পাঠের দিনগুলোর কথা মনে আছে? তিনি কি তোমাকে দুটো হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলতেন? আর তুমি যখন সেই রকম করতে তখন তিনি কি ভরতনাট্যমের ইতিহাস শোনাতেন? প্রথম দিকে কি তোমার খুব খারাপ লাগত? পরে কী তুমি একটু একটু করে সেই রস গ্রহণ করতে পেরেছিলে?

হ্যাঁ। এবার আশা সোজা হয়ে বসলেন, আপনি কী করে জানলেন?

প্রত্যেকের মানুষের কিছু নিজস্ব অভ্যেস থাকে। অবস্থা পরিবর্তিত হলেও তার কিছুটা না কিছুটা কোথাও থেকে যায়। যদি কোনো মানুষকে আপন করে নাও তাহলে সেই অভ্যেসগুলোকে চিনে নিতে পারবেই।

আশা তখন প্রায় আত্মবিস্মৃত, আপনি আমার কথা জানলেন কী করে?

উনি জানিয়েছিলেন। হঠাৎ লিখলেন একটি ছাত্রী পেয়েছি। খুব রোগা, মাঝেমাঝেই ভোগে কিন্তু মনে হচ্ছে জিনিস আছে। তার বেশ কিছুদিন পরে লিখলেন, উচ্চশিক্ষার্থে ছাত্রীটিকে বিদেশ পাঠাতে গৃহশিক্ষকের যা অবস্থা হয় এখন আমার তাই। সে গেছে তাতার কাছে। আমার বিশ্বাস এই মেয়ে একদিন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হবে। ব্যস এইটুকু। তোমার নাম ছিল চিঠিতে। যেবার তোমার ছবি কাগজে ছাপা হল তখনই ওর চিঠি বের করে মিলিয়ে নিলাম। আশা নামটা ও বড় ভালবাসত।

তিনি আপনাকে এত গুছিয়ে চিঠি লিখতেন?

হ্যাঁ। কারণ তাঁর বাউণ্ডুলেপনাটাই সাজানো ছিল। কথাগুলো বলেই আচমকা একটা কান্নার শব্দ ছিটকে এল মীনাজীর গলা থেকে। খোলা আকাশের তলায় ওই রাত্রে সবাই যখন নিশ্চুপ তখন নিচের রাস্তায় হুল্লোড়ের শব্দ, আশেপাশে হারমোনিয়ামের আওয়াজ আর সেই সঙ্গে সুরেলা গলায় গান ছড়িয়ে পড়ছে।

আশা অনেক পিছিয়ে গিয়ে মানুষটির মুখ মনে করার চেষ্টা করলেন। নাঃ, কিছুতেই মিলছে না। শিক্ষককে দেখে কখনই মনে হতো না তিনি বিবাহিত। তিনি আচরণ করতেন সেটা তাঁর ভান। আশা জানেন না ঠিক কোন সুবাদে শিক্ষক ওই গ্রামে বসবাসের সুযোগ পেয়েছিলেন। চিন্তাটা কখনই মাথায় আসেনি। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো! এই বৃদ্ধা অন্য কারো সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন না তো! কিন্তু তা কী করে হবে। ওঁর বর্ণনার সঙ্গে নিজের স্মৃতির কোনো অমিল খুঁজে পাচ্ছেন না। আশা বললেন, আমার খুব খারাপ লাগছে এভাবে এসে আপনার স্মৃতিকে আহত করতে। আসলে আমি চেয়েছিলাম–।

কথা থামিয়ে দিলেন মীনাজী, না, না। সঙ্কোচ কোরো না, আমার খুব ভাল লাগছে। অনেক, অনেকদিন পরে তার কথা আমি আলোচনা করছি। এই কথা বলার সময় তো আমি তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পাচ্ছি।

আপনি ওঁর বিবাহিতা স্ত্রী? আচমকা প্রশ্নটি না করে পারেননি আশা।

বিবাহ বলতে তুমি কী বোঝ? মন্ত্র, পূজা এবং আত্মীয় প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য?

না। তবে প্রচলিত মত তাই।

সে-বিয়ে আমাদের হয়নি। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় বিয়ে আমাদের হয়েছিল। আমরা পরস্পর সততার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে ভালবাসার মন্ত্রে বিবাহিত হয়েছিলাম। কথাগুলো বলতে বলতে মীনাজী কী কেঁপে উঠলেন! লজ্জা কী তাঁকে এই বয়সেও অধিকার করতে চাইল! তারপর দ্রুত সেই অবস্থাকে অতিক্রম করে বললেন, উনি এসেছিলেন আমার দিদিমার কাছে নাচ শিখতে। ব্রাহ্মণের ছেলে নাচ শিখতে আসাটা আমাদের সবাইকে অবাক করেছিল। নাচ আমাদের একত্রিত করেছিল। দেবদাসীর মেয়ের সংসারী হবার স্বাধীনতা আজ সমাজ করে দিয়েছে। সেই সময় সমাজ যেমন লাল চোখ দেখাত তেমনি আমাদের পরিবারের সংস্কারে বাধত। ঈশ্বরকে মন দিয়ে শরীরটাকে বিলিয়ে দিতে হত জমিদার বা অর্থবানদের কাছে। জীবনকে ওইভাবে মেনে নিয়েছিলেন আমার মা-দিদিমারা। ভালবাসার জোয়ার সম্ভবত সমুদ্রের ঢেউকে হার মানায়। তাই সব কিছু বিস্মরিত হয়ে যখন আমি তাকে গ্রহণ করেছি এবং তিনি আমাকে নিয়ে সংসার এবং নাচের জগতে পা বাড়াতে চাইছেন তখনই প্রবল আপত্তি উঠল। আমার পরিবার তাদের ভবিষ্যতের আয়ের উৎসটিকে হারাতে চাইল না। আর ওঁর পরিবার সম্মান হারানোর ভয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হল না। প্রায় বলপ্রয়োগ করে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হবেন যদি তিনি আমার সেবা থেকে বঞ্চিত হন। তিনি আমার নৃত্য সম্পর্কে অত্যন্ত আগ্রহী। এর অন্যথা হলে আমার ওপর ভয়ঙ্কর অভিশাপ নেমে আসবে। এ ধরনের বিয়ে করার যে চেষ্টা করেছে সে তার স্বামীকে হারিয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই। কিন্তু এ সব কথা আমাকে পাখি-পড়ার মতো বোঝানো হলেও আমি জানি সেই সব ব্যক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যাঁরা আমাকে ভোগ করার জন্যে অপেক্ষা করেছিলেন। আর তার ব্রাহ্মণ পিতামাতা যতই ঈশ্বরভক্ত হন, দেবদাসীর মেয়েকে ঘরের বউ করার উদারতা দেখাতে রাজি হচ্ছিলেন না। তবু যখন তিনি প্রচণ্ড জেদ দেখাচ্ছেন তখন তাকে পরিবারের সমস্ত উত্তরাধিকারত্ব থেকে বঞ্চিত করা হল। মীনাজী হাসলেন। এই স্বল্প আলোয় সেই হাসির বিষণ্ণতা আশার মন ছুঁয়ে গেল। মীনাজী বললেন, তারপরের গল্প তো খুব ছোট্ট। এক রাত্রে আমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হল মন্দিরে, দেবাদিদেব মহাদেবের সামনে। তাঞ্জোরের মহারাজের নাকি চারশো দেবদাসী ছিল। তারা থাকতো শিবের মন্দিরের গায়ে বাসা বেঁধে। রাজা তাদের সব রকম কর থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন, জমি দিয়েছিলেন। তখন সেই দেবদাসীরা অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। তারা সাধারণজীবনে এবং সামাজিক কাজে অংশ নিতে পারত। ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত বলে একজন দেবদাসী কখনই বৈধব্যের দুর্ভাগ্য বহন করত না। যদিও তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতেন রাজা অথবা তারপরে কোনো ধনী পুরুষ, কিন্তু যে-কোনো অনুষ্ঠানে তাদের ব্যবহার করত সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু তারপরে একজন ধনী নয় সংখ্যা বাড়তে লাগল দেবদাসীর রক্ষকদের। সেক্ষেত্রে তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের কোনো বালাই ছিল না। আমার মাকে শুনেছি এক সময় আক্ষেপ করতে, এর চেয়ে একটি সাধারণ গণিকা অনেক স্বাধীন জীবন যাপন করে, কারণ সে নিজের পছন্দ প্রয়োগ করতে পারে। অথচ আমার দীক্ষার দিনে মা কিন্তু নিজে উদ্যোগী হলেন। এ বড় বিচিত্র মানসিকতা। ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গিত হয়ে গেলে দেবদাসীকে ভোগ করতে কোনো ধনীর আপত্তি নেই। সেই রাত্রে তিনি উন্মাদের মতো বাধা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু অর্থবান এবং ধর্মাত্মা ব্যক্তিরা যখন একত্রিত হয় তখন একক শক্তি অসহায় হয়ে পড়ে। তার পরে, আমি একজন দেবদাসী, আমার শরীরে কামুকের বিচরণ আর মনে চাপিয়ে দেওয়া হল ঈশ্বরের প্রেম। তিনি চলে গেলেন নিরুদ্দেশে। সেই সময় আমি প্রায় উন্মাদিনী। নাচ ভুলে গেলাম। দেবদাসীর পক্ষে যা কিনা মারাত্মক অপরাধ। আর সব দরজা চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে বুঝতে পারার পর আমার ধনী অভিভাবকের এক শহুরে বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

আশা জিজ্ঞেস না করে পারলেন না, কী করে?

মনের জোরে। যখন সবাই ভেবেছে পাখি পোষ মেনেছে, তখনই তো উড়ে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। মায়ের কথাটা মনে বারংবার বাজত। যদি শরীর আর মন নির্ধারিত পুরুষকে দিতে না পারি তাহলে স্বাধীনভাবে বাঁচব না কেন? আমার অভিভাবকের বন্ধুটি ছিলেন লক্ষৌয়ের এক জমিদার। তিনি আমার মনের কথা বুঝেছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন লক্ষ্ণৌতে। আজ বলতে দ্বিধা নেই ওই মানুষটি সত্যি আমার বন্ধু ছিলেন। তিনি আমাকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। আমাকে নাচ শিখতে সুযোগ দিয়েছিলেন নতুন করে। এবং আমি আবিষ্কার করলাম বাঈজীর বিশেষ সম্মান আছে। শুধু নৃত্যগানের মাধ্যমে পুরুষদের মনোরঞ্জন করেই সে তার ব্যবসা চালাতে পারত তখন। একজন বাঈজীকে শুধু টাকার জোরে কখনই দখল করা যেত না। ঈশ্বরকে পুতুল করে দাঁড় করিয়ে আমাকে কামুকের লালসা মেটাতে হত না। তবে নদীতে নেমে যদি কেউ শরীরে জল না ছোঁয়াতে চায় তবে উন্মাদ বলেই ভাবতে হবে। কিন্তু ও-ব্যাপারে আমার মর্জি ছিল শেষ কথা। আমার রক্ষক অনেক চেষ্টার পর তার খবর এনে দিলেন। তিনি তখন তোমাদের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার জন্যে আমি ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হত, যে-জায়গাটা আমরা এক সময় তৈরি করেছিলাম সেই জায়গা যদি নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে চিঠি দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তার উত্তর এল। দেখলাম তিনি আমার সব খবর জানেন। আর তারপরে ওই চিঠি দেওয়া নেওয়াই হল আমাদের একমাত্র সেতুবন্ধন। তিনি তার সব কথা আমাকে জানাতেন কিন্তু আমি আমার ব্যবসার জীবনের কথা ওকে লিখতে পারতাম না। আমার বাঈজীর জীবন সম্পর্কে তার কী ধারণা ছিল তা কখনই তিনি জানাননি।

লক্ষ্ণৌ থেকে আমি এলাম কলকাতায়। এই বউবাজার স্ট্রিটের বাঈজী পাড়ার তখন বেশ ইজ্জত ছিল। আমার নাচের প্রশংসা তখন এই মহলে মুখে মুখে ছড়িয়েছিল। সঙ্গীতের কোনো জাত নেই। কলকাতায় যেসব গুণী শিল্পী অনুষ্ঠান করতে আসতেন তাঁদের কেউ কেউ আমার নাচ দেখতে অথবা কথা বলতে এখানে আসতেন। আমি ভালই ছিলাম। বেশ ভালই ছিলাম।

কিন্তু মানুষের রুচি যখন নিম্নগামী হয় তখন কোনো বাধা তাকে আটকাতে পারে না। অপসংস্কৃতির ঢেউ লাগতে শুরু করল এ পাড়ায়। শাস্ত্রীয় নৃত্যগীতের বদলে চটুল নাচগান চাইতে শুরু করল নবীন খদ্দেররা। শুধু আমরা কয়েক ঘর পড়ে রইলাম আমাদের সম্পত্তি নিয়ে। আর সেই সঙ্গে বাঈজীদের সঙ্গে সাধারণ স্বৈরিণীর ব্যবধানও কমে যেতে লাগল দ্রুত।

যেন চোখ বন্ধ করে ওই অবক্ষয়ের ছবিটা দেখতে লাগলেন মীনাজী। আবিষ্ট হয়ে শুনছিলেন আশা। এবার সচেতন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি আত্মহত্যা করলেন কেন?

এখানে এসেছিলেন। আমাকে না জানিয়ে। হয়তো আর ধৈর্য ধরতে পারেননি। এসে পৌঁছেছিলেন দুপুরে। তখন তো আমাদের বিশ্রামের সময়। দারোয়ান তাঁকে প্রথমে ঢুকতে দেয়নি। কারণ তার পোশাকসম্মানজনক ছিল না। মীনাক্ষী যে মীনাজী হয়ে গেছে তা তিনি জানতেন না। যাহোক, আমার ঘরে এসে তিনি ছেলেমানুষ হয়ে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু তিনি জড়িয়ে ধরামাত্র আমি শিউরে উঠলাম। কত পুরুষ তো ওই কাজ করল কখনই তেমন অনুভূতি হয়নি। আমি অনেক চেষ্টায় তাঁকে সংযত করলাম। তিনি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি জানতাম তা আর সম্ভব নয়। সকালের শেফালির শরীরে রোদ পড়লে তাকে আর বিকেলে ফিরে পাওয়া যায় না। তিনি কোনো আপত্তি শুনতে নারাজ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমার নাচ দেখতে চাইলেন। কথা বলতে বলতে মীনাজী উঠে দাঁড়ালেন। আর তার পরে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য দেখলেন আশা। কোনো প্রস্তুতি নেই, এমন কী পায়ে নূপুর পর্যন্ত নেই। কিন্তু সম্মোহিতের মতো নাচ শুরু করলেন মীনাজী। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, হঠাৎ কেঁপে উঠলেন আশা। এ সেই নাচ। যে নাচের কথা শিক্ষক বলতেন। যে নাচের গল্প তাতার কাছে তিনি শুনেছিলেন। শব্দহীন শারীরিক সঞ্চালনে যে ছবি মূর্ত হয়ে ওঠে পলকে। এই জরাগ্রস্ত শরীরেও মীনাজী নিজেকে প্রকাশ করলেন। ক্রমশ মোহিনীরূপের শেষ ধাপে পৌঁছে গেলেন মীনাজী। আর তারপরে সেই ছাদের ওপর বসে কান্নায় কেঁপে উঠলেন। আশা উঠে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। মীনাজী কান্না জড়ানো গলায় বললেন, তিনি চলে গেলেন। আচমকা। আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না। আমার নাচে তিনি কী দেখেছিলেন জানি না। কিন্তু–। যাহোক, আমি চিঠি দিলাম তাঁকে। চিঠি ফিরে এল। টেলিগ্রাম করলাম পোস্টমাস্টারকে। তিনি জানালেন আত্মহত্যার ঘটনাটা। কেন ওভাবে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া আমি জানি না। কী অপরাধ করেছিলাম আমি নাচ দেখিয়ে? নিজেকে যেন ধিক্কার দিচ্ছিলেন মীনাজী। তারপর হঠাৎ আশাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি জানো? আত্মহত্যার আগে তিনি কী কিছু বলেছিলেন?

মাথা নেড়েছিলেন আশা নীরবে। না।

বোঝা যাচ্ছিল মীনাজীর শরীর বেশ খারাপ হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। তিনি আশার অঙ্গ স্পর্শ করলেন কাঙালের মতো, তুমি তাকে দেখেছ। তোমার সম্পর্কে তাঁর অনেক বড় আশা ছিল। আজ বেঁচে থাকলে তিনি খুশি হতেন। শোনো, ঈশ্বর আছেন। তাকে সামনে রেখে নাচা মানে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা। কিন্তু সে প্রতারণা বরং ঢের ভাল। রক্তমাংসের মানুষকে ভালবেসে মোহিনী হওয়া যায়, শিল্পী নয়।

রঈস মানুষটি উদ্যোগী না হলে এখানে আসা যেত না, তিনি ব্যস্ত হলেন বলেই শেষ পর্যন্ত ওই বাড়ি ছেড়ে গেস্ট হাউসে পৌঁছাতে পারলেন আশা। বুকের ভেতরে অসম্ভব এক ভার তখন। তিনি বিদায় নেবার সময় রঈস মানুষটিকে বললেন, আমাকে একটা কথা দেবেন?

বলুন।

কালকের অনুষ্ঠানে ওঁকে নিয়ে আপনি আসবেন?

 হাসলেন মানুষটি। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না উনি কোথাও বের হন না। আর আমার কথা তো আগেই বলেছি। হাজার মানুষের ভিড়ে আমি নাচ দেখতে যাই না। তাছাড়া আজ যে নাচ দেখলাম তার স্মৃতি কিছুদিন স্মরণে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

গৌহাটির হোটেলে এখন মধ্যরাত। আশা মনে মনে স্থির করলেন, এবার কলকাতায় ফিরে এসে ওই মানুষটির খোঁজ করতে হবে। একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন সেই রাতে ছাদে যে নাচ দেখেছিলেন, তার স্মৃতি যদি এখনও অটুট থাকে তাহলে আশা সেটি সক্ষমতার সঙ্গে অতিক্রম করতে পারছে কিনা! তিনি জানেন পারবেন! তারপরেই তাঁর খেয়াল হল অনেক সময় চলে গিয়েছে। আজ সেই মানুষটি অথবা মীনাজী পৃথিবীর পরিবেশে আছেন কি না তা জানা নেই। হঠাৎ তাঁর সমস্ত শরীরে কাঁপুনি এল। জীবনের কোনো ব্যাকরণ নেই কেন?

আলারিপ্পু, যতিসভরম, সবদম, ভরণম, অভিনয় পদম এবং তিল্লানা। ব্যাকরণ মানতেই হয় যে কোনো শিল্পীকে, কারণ তাতে একটি নির্দিষ্ট পথ পেতে সুবিধে হয়। তাছাড়া প্রতিটি সৃষ্টির একা নিজস্ব চরিত্র থাকে এবং সেই চরিত্র ব্যাকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হলে বিক্ষিপ্ত, এলেমেলো হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই বিভক্ত পর্বের মধ্যে থেকেও ভরতনাট্যম শিল্পী নিজেকে আলাদা করতে পারেন অন্য শিল্পীর থেকে। সেখানে তার অবাধ স্বাধীনতা। সৃষ্টিশীল শিল্পী নিজেকে প্রকাশ করেন বিশিষ্টভাবে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার না করে। ভরতনাট্যম, কথাকলি কিংবা মোহিনী আট্টমে বিষয় খুঁজে নিয়ে তা পরিস্ফুট করাই শিল্পীর সাধনা।

ভরতনাট্যমে নিয়োজিত হয়েও আশা মাঝে মাঝেই মোহিনী আট্টমে নিজেকে খুঁজতে চেয়েছে। সাধারণত পৌরাণিক কাহিনি নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও কেরালার মানুষের সামাজিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্য এবং ভগবান বিষ্ণুর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এই নাচে ফুটে ওঠে। আসলে মোহিনী আট্টমে পৌরাণিক কাহিনির মাধ্যমে রক্ত মাংসের মানুষের প্রেম ভালবাসার কথা বলা হয়ে থাকে। ঈশ্বরের প্রতি আর্তি আর প্রেমিকের প্রতি আকাঙ্ক্ষায় প্রেম আর পূজা একাকার। মোহিনী আট্টমের মোহিনী কে? রূপকথা কিংবা লোককথার মোহিনী কে? রূপকথার কিংবা লোককথার যে সব সুন্দরীদের নাম শোনা যায়। তাদেরই একজন? আশা ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন গুরুর কাছে। তিনি বলেছিলেন, সেরকম কোনো ব্যাপার নয়। মালাবারে এই শিল্পের উৎপত্তি। নায়ারদের সঙ্গে নামবুদ্রি ব্রাহ্মণদের বৈবাহিক সম্পর্ক সুবিদিত। এক নায়ার রাজকন্যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল নামবুদ্রির সঙ্গে। কন্যা তাদের পারিবারিক মন্দিরে পূজা করত। সেই মন্দিরের আরাধ্য দেবতা বিষ্ণুর আর এক রূপ পদ্মনাভ। প্রতি রাতে সেই কন্যা সখীদের নিয়ে জঙ্গলের পথ বেয়ে পদ্মনাভের পূজা করতে মন্দিরে যেতেন। সেই মন্দিরে কন্যার পিতার নির্বাচিত নামবুদ্রি পুরোহিতদের সমাগম হত যাতে সুপাত্র নির্বাচন করা সম্ভব হয়। কিন্তু রাজকন্যার ইচ্ছে ছিল না এইভাবে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে। সে সেই পুরুষদের কাছে আত্মনিবেদন করতে পারে যাকে শ্রদ্ধা করা যায় এবং যে তাকে মমতার চোখে দেখবে। একই জীবিকার একজন পুরুষের দ্বারা সেটা কী সম্ভব। এই কারণেই অনেক নামবুদ্রি যুবক ব্যর্থ মনে ফিরে গেল। কিন্তু রাজকন্যা তবু প্রতি সন্ধ্যায় জঙ্গল পেরিয়ে মন্দিরে যান পদ্মনাভের পূজা করতে। সখীদের জ্বালানো প্রদীপের আলোয় একদিন রাজকন্যার শরীর রোমাঞ্চিত হল। পদ্মনাভের মূর্তির সামনে একনিষ্ঠ হয়ে বসে সে মূর্তির চোখে এক নবীন জ্যোতি দেখতে পেল। যেন তাঁর চোখে জীবনের দীপ্তি চলকে উঠেছে। শিহরিত রাজকন্যার সমস্ত অন্তর সেই মূর্তির ভেতরে জীবন্ত হয়ে ওঠা এক সত্তার কাছে নিবেদিত হয়ে গেল। ওই মূর্তিতে প্রাণ আছে বলে সে নিশ্চিত হল। কিন্তু কী করে ওই পাথরের মূর্তি ছেড়ে তিনি রক্তমাংসের চেহারা নেবেন? সে দিনটি কবে আসবে! রাজকন্যা উতলা হয়ে পড়ে। প্রতিদিন যে মন্ত্র সে পদ্মনাভের সামনে বসে উচ্চারণ করে তা তো পর্যাপ্ত নয়। এই ধরাবাঁধা মন্ত্রে অতিরিক্ত কিছু পাওয়া যায় না। কী করে সে ঈশ্বরকে তার কাছে নিয়ে আসবে? সে নাচ শুরু করল পদ্মনাভের সামনে। মুখ এবং শরীরকে ব্যবহার করল তার আকাঙ্ক্ষায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে? প্রতি রাতে সে নৃত্যের মাধ্যমে যে আর্তি ফুটিয়ে তুলছিল তা মোহিনীরূপ ধারণ করছিল। এবং এই নৃত্য থেকেই মোহিনী আট্টমের উৎপত্তি। ভগবান পদ্মনাভের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টায় কোনো পাপ নেই। ঈশ্বরের পদতলে নিজেকে সমর্পণ করার সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম হিসেবে নৃত্যকে নির্বাচন করেছিল রাজকন্যা। শুধু ঈশ্বরের পাথরে মূর্তির সামনে পা মুড়ে বসে থাকতে তার তৃপ্তি ছিল না। তাই সে পাগলের মতো প্রতি রাত্রে নেচে যেত ঈশ্বরের সামনে। এইভাবে দেবতাকে প্রিয় করার চেষ্টায় সে নিজেকে নিবেদন করেছিল এই ভেবে তার প্রভুকে সে নৃত্যের মাধ্যমে স্পর্শ করেছে। মোহিনী আট্টমের শুরু হয়েছিল এইভাবেই। আশার কাছে এই গল্প অন্য উৎসাহ তৈরি করেছিল। পদ্মনাভ নয়, নটরাজের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করতে বলেছিলেন তাতা। কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়, সেই পাথরের মূর্তির সঙ্গেই তার সংযোগ। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি সেই রাজকন্যার মতো পাথরের চোখে কোনো দ্যুতি দেখতে পাননি। মোহিনী আট্টমকে বলা যেতে পারে। ভরতনাট্যম কিংবা কথাকলির একটি প্রশাখা কিংবা দুই-এর মিশ্রণ। আবার এই নৃত্যে কেরালার। লোকনৃত্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মোহিনী আট্টমে গল্প আছে কিন্তু তা শুধু অলঙ্কারের মতো। অন্য নৃত্যে কাহিনিকে পরিস্ফুটন মূল ভূমিকা নেয়। মোহিনী আট্টমে শিল্পী শরীরের মাধ্যমে গল্প শুরু করে ধীরে ধীরে এক অতীন্দ্রিয় জগতে পৌঁছে যান। তখন সমস্ত জাগতিক আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ভালবাসায় সম্মোহিত। সেই ভালবাসায় কোনো নির্দিষ্ট গল্প নেই, শুধু অনুভূতির বিভিন্ন প্রকাশ ফুটে ওঠে মুদ্রায়। যেমন সাংকেতিক ভাষায় লক্ষ পাতার বই-এর গল্প দশ লাইনে বলা যায়।

ভরতনাট্যমের শাস্ত্রীয় রীতিতে নয়, মোহিনী আট্টমের সরল সমর্পণে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা বারংবার মনে হতে লাগল আশার, গৌহাটি থেকে ফিরে যাওয়ার পথে। পৃথিবীর সমস্ত বড় শহরে কত ঘোরাঘুরি হল নাচের কারণে কিন্তু কখনই এই অনুভূতি মনে আসেনি। তার স্মৃতি এত প্রকট যে সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে পাণ্ডানুল্লুরের কোথায় কী রয়েছে। ওই স্মৃতির কারণেই এত বছর সেখানে যায়নি আশা। আজ যখন যাচ্ছে তখন কেন ব্যাকরণের বেড়াকে মেনে নেওয়া, মোহিনী আট্রামেই নিজেকে প্রকাশ করা উচিত। ভরতনাট্যমে বাঁ কিংবা ডান অথবা মাথার ওপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় কিন্তু মোহিনী আট্টমে একমাত্র সামনের আরাধ্য দেবতার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। অর্থাৎ দৃষ্টি হবে একমুখী। শিল্পের সমস্ত কৌশল ত্যাগ করে, ব্যাকরণের সমস্ত আগল সরিয়ে রেখে সম্মোহিত শিল্পী ভালবাসায় মজে যান মোহিনী আট্টমে। হয়তো শাস্ত্র একে উঁচু মানের শিল্প বলে স্বীকৃতি দেবে না, নাই দিক।

পাণ্ডানুল্লুরে যাওয়ার ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। ডিল্যাক্স বাস দ্রুতগতিতে পাণ্ডানুল্লুরের ওপর। দিয়ে ছুটে যায়। ইচ্ছে করলে নিজের গাড়ি নিয়েও আশা আরামে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন ট্রেনেই যাবেন। ঠিক যেভাবে প্রথম দিন কাকার সঙ্গে মধ্যরাতে স্টেশনে নেমে গরুর গাড়িতে চেপে ভোরবেলায় গ্রামে পৌঁছেছিলেন ঠিক সেইভাবেই আজ যাবেন। মিস্টার আয়ার অবাক। এত কষ্ট আশা কেন সহ্য করতে চাইছে খামোকা, তাই তাঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। তিনি বোঝাবার চেষ্টা করতে গেলে আশা বললেন, অনেকদিন তো ট্রেনে চাপিনি। যা বলছি তা আমি ভেবেই বলছি। এ এমন উত্তর যার সঙ্গে তর্ক করা চলে না।

তিরিশ বছর আগে যে সময় ট্রেন চলত এখন সেই সময়ে চলবে এমন আশা করা যায় না। যে গতিতে চলত তারও পরিবর্তন হয়েছে অনেক। হিসাবে দেখা গেল পাণ্ডানুল্লুরে পৌঁছতে সকালের বদলে দুপুর গড়িয়ে যাবে। একটু দ্বিধায় পড়েছিলেন আশা কিন্তু তবু তিনি ট্রেনেই যাবেন স্থির করলেন। সকালে স্টেশনে এসে দ্রুত প্রথম শ্রেণির কামরায় উঠে বসলেন তিনি। বসেই মনে হল কাকার সঙ্গে যেদিন গিয়েছিলেন সেদিন উঠেছিলেন তৃতীয় শ্রেণির কামরায়। যদিও তখন খুব বেশি ভিড় হত না। দ্রুতগতির ট্রেন, রাতের মতো শোওয়ার দরকার নেই, অতএব কুপেতে কমলা, শাস্ত্রীজী এবং শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী ছিলেন। মিস্টার আয়ার বাদ্যযন্ত্র এবং নাচের পোশাক ও সেই সংক্রান্ত বাক্সগুলো ঠিকঠাক রাখছিলেন। ওড়নায় মুখ ঢেকে জানলায় এমন ভঙ্গিতে বসেছিলেন আশা যে প্ল্যাটফর্মের মানুষেরা তাকে চিনতে পারছিল না। অলস চোখে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। হয়তো কিছুই দেখছিলেন না কিংবা তাঁর মন কিছুতে ব্যস্ত ছিল।

হঠাৎ কমলা তাকে প্রশ্ন করল শরবত খাওয়ার ইচ্ছে আছে কিনা? তিনি মুখ ফিরিয়ে অসম্মতি জানিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালেন। অনেক বেশি হকার, যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে খুব। বাজারের চিৎকারকেও সম্ভবত হার মানায়। হঠাৎ একটি পরিবারের দিকে তার নজর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল শরীরে। মাথা থেকে পায়ের ডগা পর্যন্ত শিরশির করে উঠল। তার চোখ ছোট হয়ে এল। তিনজন মানুষ। একটি বছর বারোর ছেলে, বছর সতের-আঠারোর মেয়ে এবং শীর্ণ, আধপাকা দাড়ি লম্বা শরীরের প্রৌঢ়। বসার জায়গার সন্ধানে ওরা প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছে। সম্ভবত যাত্রী বোঝাই এই ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওরা উঠতে পারছে না। পোশাক দেখে দ্বিতীয় শ্রেণি না ভাবার কোনো কারণ নেই। আশা সোজা হয়ে বসলেন। মনের ভেতরে বাতাস জোরালো হয়েছে। ওরা ক্রমশ চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে, তিনি শেষ পর্যন্ত কমলাকে ডাকলেন জানালার পাশে, ওই যে ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে ভদ্রলোক যাচ্ছেন ওদের ডেকে আন এখানে। কমলা অবাক! আশাকে এমন গলায় কথা বলতে সে অনেকদিন শোনেনি। কিন্তু সে দ্রুত কুপ থেকে বেরিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াল। তিনটি মানুষ অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে কামরাগুলোর দিকে। কমলা প্ল্যাটফর্মে নেমে প্রৌঢ়র সামনে দাঁড়াল, আপনি একটু আসবেন?

প্রৌঢ়ের কপালে ভাঁজ পড়ল, আমি?

 হ্যাঁ, আপনারা তিনজনেই।

কেন? কী ব্যাপার? প্রৌঢ়ের কথা শেষ হবার আগেই কমলা ফিরল। বড় মেয়েটি বলল, বাবা ট্রেন এখনই ছেড়ে দেবে। উনি কে?

আমি চিনি না মা। প্রৌঢ়কে উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল।

বালক বলল, চলো না, ডাকছে যখন ওখানে জায়গা পাওয়া যেতে পারে।

ওরা কামরার সামনে এগিয়ে এসে দেখল কমলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রৌঢ় ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন কামরাটি প্রথম শ্রেণির! তিনি উঠতে ইতস্তত করছিলেন। কমলা বলল, তাড়াতাড়ি উঠে আসুন, ট্রেন এখনই ছাড়বে। ওর কথা শেষ হওয়ামাত্র বালক উঠে পড়ল কামরায়। তারপর মেয়েটি। অতএব প্রৌঢ়ের না উঠে উপায় রইল না। প্রৌঢ় বললেন, কিন্তু আমাদের টিকিট তো সেকেন্ড ক্লাসের।

সে চিন্তা আপনার নয়। আপনি, আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কমলা এগিয়ে গেল কুপের দিকে।

সেই মুহূর্তে মিস্টার আয়ার কুপের দরজায় দাঁড়িয়ে বলছিলেন, আমরা কি ফেরার সময় ট্রেনেই ফিরব? তাহলে স্টেশনে নেমে ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে শেষ মুহূর্তে খুব অসুবিধে হয়।

আশা বললেন, ফেরার সময় আমরা ট্রেনেই ফিরব। আপনি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করবেন। তাঁর চোখ আর একবার প্ল্যাটফর্মের দিকে গেল। সবে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যাত্রীদের ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকির মধ্যে আবার ট্রেন থেমে গেল। সম্ভবত কেউ চেন টেনেছে। আর তখনই কমলাকে দেখে সরে দাঁড়ালেন কুপের দরজা থেকে মিস্টার আয়ার। কমলা বলল, ওঁরা এসেছেন।

মুখ না ফিরিয়ে আশা জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বলেছিস?

আজ্ঞে না। তবে ওঁদের সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট।

মিস্টার আয়ারকে বল সেটার ব্যবস্থা করতে।

এবার বালক কমলার পাশে। সে সন্দিগ্ধ প্রৌঢ়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা ভেতরে গিয়ে বসুন। ওখানে জায়গা রয়েছে। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু আমাদের কেন ডেকেছেন তাই বুঝতে পারছি না। সে কথার জবাব না দিয়ে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে থাকা মিস্টার আয়ারকে কমলা বলল, আপনাকে ওদের তিনজনের টিকিট সেকেন্ড ক্লাস থেকে ফার্স্ট ক্লাসে পাল্টে দিতে বললেন উনি। তোমরা যাও, ভেতরে যাও।

প্রথমে বালক তারপরে তরুণী এবং সবশেষে প্রৌঢ় কুপেতে ঢুকল। ছোট কুপেতে বড়জোর আটজন মানুষ মোটামুটি বসতে পারে। শাস্ত্রীজীর পাশে বসে শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী এঁদের দেখছিলেন। কমলা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে। আয়ার সাহেব চলে গেছেন সম্ভবত চেকারের কাছে।

ছেলেমেয়ে বসেছে দেখে প্রৌঢ় শাস্ত্রীজীকে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন কিছু, এই সময় আশা মুখ ফেরালেন, দাঁড়িয়ে কেন, বসো।

ওড়না সরে গেছে, সেই মুখের দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ় চমকে উঠলেন। তার চোখ চকিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রবল বিস্ময়ে তিনি উচ্চারণ করলেন, আশা!

যাক চিনতে পেরেছ তাহলে। এরা কী তোমার ছেলেমেয়ে। সুন্দর হয়েছে তো। তা এদের মা কোথায়? তিনি সঙ্গে নেই কেন? অনেকদিন বাদে অন্য রকম গলায় বলা কথাগুলো নিজের কানেই বেসুরো শোনাল।

আমাদের মা নেই। তরুণী শক্তমুখে উত্তরটা দিল প্রৌঢ়ের হয়ে।

সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেলেন আশা। এটা তিনি আশা করেননি। যে তরল গলায় কথা বলে সময়টাকে পার করবেন ভেবেছিলেন, তা যেন ধরে রাখা যাচ্ছে না।

ততক্ষণে বালক প্রশ্ন করেছে, আপনি কে?

এবার প্রৌঢ় জবাব দিলেন, উনি আশা রাও।

সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বলে ফেলল, আমি তাই ভাবছিলাম। ওঃ আপনার কথা বাবার কাছে অনেক শুনেছি। আপনি আমাদের না ডাকলে আজ ট্রেনে উঠতেই পারতাম না।

তোমরা যাচ্ছ কোথায়।

 আমার মামার বাড়িতে। আপনি?

 পাণ্ডানুল্লুরে।

 ওখানে কি আপনার নাচের প্রোগ্রাম আছে?

না, ঠিক তা নয়–। আশা দেখলেন ট্রেন আবার ছেড়েছে। প্রৌঢ় বসেছেন একবারে কোনায়। মানুষটি একদম চুপচাপ, মুখ নীচের দিকে। এই সময় মিস্টার আয়ার এসে বললেন, আপনাদের টিকিট দিন।

কেন? প্রৌঢ় মুখ তুললেন।

সেকেন্ড ক্লাস টিকিটটা চাই ফার্স্ট ক্লাসে কনভার্ট করতে।

আমরা পরের স্টেশনে নেমে যাব।

একটা স্টেশন যাওয়াও তো বেআইনি। দিন।

প্রায় বাধ্য হয়ে প্রৌঢ় টিকিটগুলো দিয়ে দিলেন। মিস্টার আয়ার চলে যাওয়ার পর আশার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। মিছিমিছি।

আশা বললেন, ওরা আরাম করে যাচ্ছে তাতে তোমার আপত্তি কেন? তুমি খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছ কিন্তু। শরীর খারাপ?

না। বয়স হচ্ছে। প্রৌঢ় ম্লান হাসলেন।

মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাবার এমন অবস্থা। তরুণী বলল। মেয়েটি একটু বেশি কথা বলে মনে হল আশার। হঠাৎ বালক বলল, আমার দিদিও খুব ভাল নাচে, জানেন? সঙ্গে সঙ্গে তরুণী প্রতিবাদ করে উঠল, এ মা, ছি ছি। ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেন না।

তুমি কী নাচ শেখ?

একটু-আধটু।

একটু-আধটু করে তো নাচ শেখা যায় না।

তরুণী মাথা নিচু করল, আমি বাবার কাছেই শিখি।

হঠাৎ প্রৌঢ় বললেন, অনেককাল পরে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি।

তরুণী বলল, আমি তো প্রায়ই বাবাকে বলি আপনার কাছে নিয়ে যেতে।

তোমার বাবা কী বলেন?

 বাবা সময়ই পান না। মাকেও নিয়ে যাননি।

তোমার মা আমার কাছে যেতে চেয়েছিলেন? চমকে উঠলেন আশা।

হ্যাঁ। মা-ও নাচত। খুব বড় শিল্পী হতো মা যদি না অ্যাকসিডেন্টে অন্ধ হয়ে যেত।

তোমার মা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল? আশা কোনো কূল পাচ্ছিলেন না।

হ্যাঁ। বাবা মাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। সেখানে মায়ের নাচ ছিল। ফেরার সময়, গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করে। বাবারও হাত ভেঙে গিয়েছিল। অন্ধ হয়ে কি আর নাচা যায় বলুন? তখন ভাই মাত্র তিন বছরের।

তোমার মায়ের শেষে কী হয়েছিল?

হার্ট অ্যাটাক।

পরের স্টেশন এসে গেল। দ্রুতগতির ট্রেন অনেক ছোট স্টেশনে না দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে আনল। মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে এগিয়ে দিল, একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

না বলতে গিয়েও মত পাল্টালেন আশা। কলম নিয়ে লিখলেন, আশা রাও। তারপর সামান্য ভেবে জুড়লেন, আধাআধি নয়, পুরোপুরি। লেখাটা পড়ে মেয়েটি কি বুঝল সেই জানে, হেসে উঠল খুশিতে। তারপর তার বাবাকে দেখাল। সেটা দেখে প্রৌঢ়ের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।

দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গেলেন আশা, যদি পারো তাহলে সময় করে একদিন এসো তোমরা।

মেয়েটি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, আপনার জন্যে আমরা আরামে এলাম।

ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ প্রৌঢ় ঘুরে দাঁড়ালেন, কী দরকার ছিল?

আমি জানি না। আশা হাসলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিজেদের কুপেতে ফিরে এলেন। জানালার পাশের আসনে বসে তিনি বাইরে তাকালেন। অনেক অনেক বছর সময় পেরিয়ে গেছে এতকাল যেন তাঁর মনেই ছিল না। তাঁর নাচ শিখতে যাওয়া, মায়ের মৃত্যু, তাতার মৃতমুখ অথবা তীর্থ– এসব চোখের সামনে ধরা ছিল। আজ তীর্থের শীর্ণ শরীর, জীর্ণ মুখ দেখে হঠাৎ তাঁর মনে হল নিজেরও বয়স হয়েছে। যেটা একটু একটু করে জানান দিচ্ছিল সেটা সটান চলে এল সামনে। মেয়েটি এবং বালককে তীর্থের সঙ্গে দেখে মনে কোনো জ্বালা আসেনি। আসলে তীর্থকে একদিন প্রত্যাখ্যান করার জন্যে যে বিষণ্ণতা পরবর্তীকালে বুকের পাঁজরে মেঘের মতো জড়িয়েছিল তা আজ উধাও হয়ে গেল। নিজের নাম, বৈভব এবং স্বীকৃতি তাঁকে তো কৃচ্ছ্রসাধনায় আবদ্ধ রাখেনি। নাচকে বিক্রি করতে চাওয়ায় তীর্থকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজ সেই নাচ তাঁকে দুহাত ভরে দিয়েছে। বদলে তীর্থর অবস্থা আরও ধূলিধূসর। প্রতি মুহূর্তে তিনি সেই ব্যাপারে তির্যক সংলাপ আশংকা করেছিলেন। অথচ মানুষটি কিছুই মুখে বলল না। সময় বড় বিচিত্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এমন কী ভালবাসাকেও অনেক মোড়ক পরিয়ে দেয়। কিন্তু মেরে ফেলতে পারে কী! আশা চট করে মুখ ফিরিয়ে কমলাকে খুঁজলেন। বললেন, মাথা ধরেছে।

.

দ্রুতগতির ট্রেন খোঁড়াতে আরম্ভ করলে প্যাসেঞ্জারকেও হার মানায়। নির্দিষ্ট স্টেশনে যখন ওরা নামতে পারল তখন বিকেল ঘন। মিস্টার আয়ার হিসেব করে দেখলেন আশার বাসনামতে এখান থেকে গরুর গাড়িতে চাপলে পৌঁছতে মধ্যরাত হওয়া বিচিত্র নয়। বরং লোকাল ট্রেন ধরে পাণ্ডানুল্লুরে পৌঁছে যাওয়া অনেক সহজ। কিন্তু তিনি জানেন ইস্পাতকে বেঁকিয়ে নেওয়ার চেয়ে আশাকে বোঝানো অনেক বেশি কষ্টকর। মিস্টার আয়ার খোঁজ-খবর করতে স্টেশনের বাইরে এসে পুলকিত হলেন। গরুর গাড়ির কোনো পাত্তা নেই। সে সব যান অনেক বছর আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন রিকশা এবং অটোর বাজার। একটু দূরের যাত্রীর জন্যে ট্যাক্সি গণ্ডায় গণ্ডায়। দুটি ট্যাক্সির সঙ্গে কথা বলে স্থির করলেন তিনি। ওরা পাণ্ডানুল্লুরে অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না তাদের কাজ শেষ হয়। লোক দুটো খুব মজা পাচ্ছিল। এখান থেকে আজকাল কেউ পাণ্ডানুল্লুরে যায় না। সেখানে পৌঁছে যাওয়ার জন্যে রেললাইনও পাতা হয়েছে। অবশ্য বড় গাড়ি যায় না এই যা।

মিস্টার আয়ার ফিরে এলেন ওয়েটিং রুমে। তিনি ব্যবস্থার কথা বলার আগেই আশা বললেন, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমার যতদূর মনে হচ্ছে মাঝরাতের আগে পৌঁছতে পারব না। আজকাল ট্রেনের ওপর আর নির্ভর করা যায় না দেখছি। কিন্তু অন্তত আটটার মধ্যে পৌঁছতে চাই।

দুভাবে যাওয়া যায়। লোকাল ট্রেনে চেপে ওখানে। সময় তাতে ঠিক নাও থাকতে পারে। অথবা ট্যাক্সিতে।

তাই চলুন। যে জন্যে আসা তাই যদি না হয়! আমাকে রাত বাড়বার আগেই পৌঁছতে হবে ওখানে।

স্টেশনের বাইরে এসে চারপাশে কিছু খুঁজে হতাশ গলায় আশা বললেন, ইস! সব কীরকম বদলে গিয়েছে। সেই দোকানগুলোও নেই। একটা গরুর গাড়িও দেখছি না।

মিস্টার আয়ার খুশি হলেন। এসব নিজে বুঝে নিলে পরে ব্যাখ্যা দিতে হয় না। কিন্তু ততক্ষণে রটে গিয়েছে খবরটা। ভিড় জমতে শুরু করেছে। সবাই আশা রাওকে দেখতে চায়। এই পথে সেই কিশোরী যখন কাকার হাত ধরে প্রথম পাণ্ডানুল্লুরে গিয়েছিল, তখন কেউ ভুলেও মুখ তুলে তাকায়নি। হঠাৎ আশার খুব ভাল লাগল। একজন বৃদ্ধকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি এখানে কতদিন আছেন? বৃদ্ধ বললেন, আমি এখানেই জন্মেছি মা।

আশা বললেন, তাহলে আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে এখান থেকে এককালে গরুর গাড়ি ছাড়তো।

সে তো অনেক আগের কথা। বৃদ্ধ হাসলেন।

অনেক আগের! ফিসফিসিয়ে বললেন আশা। এই সময় মিস্টার আয়ার মৃদু গলায় মনে করিয়ে দিলেন যে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আশা গাড়িতে উঠে বসলেন। ভিড় কাটিয়ে দুটো গাড়ি ছুটল পাণ্ডানুল্লুরের পথে। এখন রাস্তা চমৎকার। সন্ধের অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীর পথে। এই সময়টা বড় বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। অনেক আগের দিনগুলো কেন যে মানুষের মনে এমন জীবন্ত হয়ে থাকে! আজ যদি তীর্থকে না দেখতেন তাহলে একটি উজ্জ্বল পুরুষের ছবি চোখের সামনে ধরা থাকত যে তাকে প্রথম ভালবাসার কথা বলেছিল। পরবর্তীকালে সফল পেশাদারী শিল্পী হবার পর মাঝেমাঝেই তো অনুতাপ হয়েছে। আর সব কিছু সেই উজ্জ্বল পুরুষকে ঘিরে। যে কারণে মোহিনী আট্টম নাচতে গিয়েও নটরাজের বদলে সেই পুরুষকে কল্পনা করতেন নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মুহূর্তে অথচ আজ মনে হচ্ছে সব নিঃশেষ হয়ে গেল।

হঠাৎ যেন একটা নাড়া খেয়ে সোজা হয়ে বসলেন আশা। এ গাড়িতে তিনি আর কমলা। সামনের গাড়িতে ওরা যাচ্ছে তিনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন, পাণ্ডানুল্লুর আর কতদূর?

ড্রাইভার বলল, আর মিনিট পাঁচেক।

মাত্র সাতটা পনেরো ঘড়িতে। সময় ঠিক আছে। আজ তাতার জন্মশতবার্ষিকী হচ্ছে এখানে অনাড়ম্বরভাবে। সেই অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে না। আশা মন স্থির করে নিলেন। যখন ড্রাইভার বলল, আমরা এসে গেছি, ওইটে বাসস্ট্যান্ড, তখন তিনি থামাতে বললেন ট্যাক্সি। ওঁদের থেমে যেতে দেখে সামনের গাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। মিস্টার আয়ার এগিয়ে এলে তিনি বললেন, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো তাতার জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানটি কোথায় হচ্ছে?

এখন রাস্তায় লোক নেই বললেই চলে। বাসস্ট্যান্ড বলেই কিছু দোকানপাট খোলা। মিস্টার আয়ার সেখান থেকে ঘুরে এসে বললেন, ওরা বলল, তাতার বাড়ির সামনেই স্টেজ বেঁধে হচ্ছে।

মুখ ঘুরিয়ে জায়গাটাকে দেখলেন তিনি। এ কেমন ব্যাপার! কিছুই যেন পরিচিত মনে হচ্ছে না। এখান থেকে তাতার বাড়িতে পৌঁছে যেতে তিনি কি একা পারবেন না? আশা বললেন, আপনি ওঁদের নিয়ে সোজা চলে যান মঞ্চের কাছে। কাউকে বলবেন না আমি এসেছি।

আপনি? মিস্টার আয়ার না জিজ্ঞাসা করে পারলেন না।

আমি কমলাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি ওখানে।

কিন্তু এই রাত্রে কি আপনি পথ চিনতে পারবেন?

এই গ্রাম আমার হাতের রেখার মতো চেনা।

অত্যন্ত অনিচ্ছা নিয়ে মিস্টার আয়ার, শাস্ত্রীজী এবং শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মীকে নিয়ে চলে গেলেন। আন্দাজে রাস্তা চিনে বেশ নির্জন অন্ধকারে পৌঁছে গেলেন আশা। কমলাকে বললেন, সাজসজ্জার জিনিসপত্র নামাতে। তারপর ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন তাতার বাড়ি খুঁজে নিয়ে যেখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে সেই মঞ্চের কাছাকাছি থাকতে যাতে ডাকলেই পাওয়া যায়।

পাহাড়ের এই দিকটায় মানুষজন নেই। কিংবা যারা ছিল তারা অনুষ্ঠান দেখতে চলে গিয়েছে। নানা তার ঠাকুর্দার জন্মশতবার্ষিকীতে ঠিক কী ধরনের অনুষ্ঠান করছে তা জানা নেই। হঠাৎ মনে হল জায়গাটা তার খুব চেনা। বড় ভূমিকম্প না হলে পাহাড় বড় একটা বদলায় না। সেই পাথরটা এখনও যেন স্তব্ধ হয়ে রয়ে গেছে, অন্ধকারেও চিনতে পারলেন আশা। এইখানে তাকে নিয়ে এসেছিলেন তাতা। বলেছিলেন পাথরের যে জড়ত্ব তারও একটা অভিব্যক্তি আছে। ঠোঁট কামড়ালেন তিনি। তাহলে সময় সব কিছু পাল্টে দিতে পারে না। কোথাও না কোথাও প্রত্যেকের নিজের জায়গা থেকে যায়।

সেই পাথরের আড়ালে পোশাক পরিবর্তন করলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী। পৃথিবীর খুব বড় প্রেক্ষাগৃহের ড্রেসিংরুমের আরাম যাঁর জানা তিনি কিন্তু একটুও অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করলেন না খোলা আকাশের নিচে তারার আলোয় দাঁড়িয়ে। তারপর সেই অন্ধকারেই কমলাকে বললেন, এবার আমাকে সাজিয়ে দিতে হবে যে! কমলা বিব্রত গলায় জিজ্ঞাসা করল, বড় অন্ধকার। দেখব কী করে?

আশা বললেন, দেখার দরকার নেই।

 রাতের কোনো বিস্মিত পাখি মাথার ওপরে পাক দিয়ে ফিরে এসে বসল কাছের একটি পাথরে। মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করল। আকাশ হয়ে উঠল নীল, মেঘ শূন্য। কমলা বলল, আমি জানি না কীরকম সাজ হল!

আশা উত্তর দিলেন না। কারণ একটু একটু করে তার হৃদয় নৃত্যের জন্যে প্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কমলা তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলে তিনি পা বাড়ালেন। সেই গাছটা নজরে এল। যে সামান্য বাতাসে পাতা নাড়াত, ঝড় উঠলে ডাল দোলাত। শরীরের ওই দোলার হেরফেরে দুরকম ভাব ফুটিয়ে তোলা যায়–এই শিক্ষা তো তিনি এখানেই পেয়েছিলেন। তারপরেই তিনি জেনেছিলেন দেখা এবং অদেখার বাইরে আর একটা জগৎ আছে, যা সৃষ্টি করতে জানলেই শিল্পী হয়ে ওঠা যায়। ওই গাছ যা কখনই পারবে না। কিন্তু পথ চিনিয়ে দেবার জন্য তো ওর কাছে তার চিরজীবনের কৃতজ্ঞতা।

দূর থেকে মৃদঙ্গের আওয়াজ ভেসে আসছিল। অনুষ্ঠানমঞ্চের আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে কয়েক হাজার মানুষকে দেখা যাচ্ছে নিমগ্ন হয়ে বসে থাকতে। আশা সন্তর্পণে জনতার শেষে এসে দাঁড়ালেন। মঞ্চের পেছনে তাতার একটি ছবি রাখা আছে। মঞ্চ জুড়ে লেখা গুরুর গুরু। এই মাত্র কোনো শিল্পীর নাচ শেষ হল। দর্শকরা হাততালি সম্বর্ধনা জানাচ্ছে। আশা চাপা গলায় বললেন, ওরা কোথায়?

কমলা বিব্রত হয়ে উত্তর দিল, এই ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ট্যাক্সি দুটোকে ওপাশে দেখেছি। যদি সেখানে থাকে তাহলে মঞ্চে আসতে বল।

ততক্ষণে এক প্রৌঢ় মঞ্চে এসেছেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বিনীত গলায় বলছেন, ভরতনাট্যমের মহাগুরুর আজ জন্মশতবার্ষিকী। রক্তসূত্রে তিনি আমার পিতামহ। এখনও এই গ্রামে তাঁর নৃত্যধারা যে বজায় আছে তার প্রমাণ আপনারা পেলেন। এই অনুষ্ঠানে আপনারা যে এসেছেন তাতে আমার পিতামহের আত্মাই সম্মানিত হয়েছে। আপনাদের মধ্যে যাঁরা আমার পিতামহকে চিনতেন তাঁরা যদি ওঁর সম্পর্কে কিছু বলতে চান তাহলে মঞ্চে আসতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হল।

নানা! আশা চমকে উঠলেন। সেই জেদী কিশোর আজ শান্ত প্রৌঢ়। নৃত্য সম্পর্কে আগ্রহ না থাকায় তাতা একে তেমন পছন্দ করতেন না। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রণাম তো ওই জানাল! ভিড়ের পাশ দিয়ে যতটা সম্ভব নজর এড়িয়ে আশা মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। শেষ দিকে তার সাজ দেখে কেউ কেউ বিস্মিত হয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছিল। দুপাশে উইংসের ধার ঘেঁষে যেমন মঞ্চে পৌঁছনো যায়, তেমনি সামনের দিকে একটি ছোট সিঁড়ি রাখা আছে ওপরে ওঠার জন্যে। আশা সেইটে ব্যবহার করতেই সমস্ত গুঞ্জন একসঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। নানা চমকে তাকালেন এগিয়ে আসা মূর্তিটির দিকে। মঞ্চে সোজা এগিয়ে গেলেন আশা ছবিটির দিকে। দর্শকরা এখন বাকরহিত। তারপর নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানালেন আশা তাতার ছবিকে। অপ্রস্তুত নানা কয়েক পা এগিয়ে থেমে গেলেন। তিনি লক্ষ করলেন প্রণামটি সাষ্টাঙ্গে নয়। কিন্তু এই অচেনা রমণীকে চিনতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এই সময় আশা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার করতেই তিনি বিস্ময়ে বলে উঠলেন, আশা!

আশা ততক্ষণে মাইকের সামনে এসে বিনীত গলায় উচ্চারণ করলেন, আমি আশা রাও।

সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র-গর্জনের আওয়াজও হার মানল। বিস্ময় এবং আনন্দ ছিটকে উঠল দর্শকদের গলা থেকে। সেটাকে কিছুটা কমে আসতে দিয়ে আশা বললেন, তাতা আমার গুরু। তাতা আমার সমস্ত বোধ, ভাবনার জন্মদাতা। তাতা যদি গুরু তবে মহাগুরু নটরাজ। আমি বলি পরম গুরু। আমার স্বামী।

এই সময় নানা এগিয়ে এলেন, আমি ভাবতে পারছি না, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে আপনি এসেছেন। আজই কাগজে পড়লাম আপনি গৌহাটিতে। আর আপনি অত বড় সরকারি খেতাব প্রত্যাখান করেছেন।

বাঁ হাত তুলে তাকে শান্ত করল আশা, বিচলিত হবেন না। যা ছিল আমাদের কর্তব্য তা আপনি করেছেন। ফলে কোনো অপরাধ আপনাকে স্পর্শ করবে না। আজ তাতার জন্মশতবার্ষিকী, আমি যদি না আসতাম তাহলে সমস্ত শরীরে বিষরক্ত বয়ে যেত এরপর। চোখ বন্ধ করলেন আশা। তাঁর শরীরে কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল। মাইকের সামনে পৌঁছে নানা বললেন, আমি আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার ঠাকুরদার কাছে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ভরতনাট্টম শিল্পী এককালে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁকে আমি আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি জবাবে আমাকে চিনতে পারছিলেন না বলে লিখলেও আসবেন বলে সম্মতি দিয়েছিলেন। অপমানিত বোধ করায় আমি আর যোগাযোগ করিনি। কিন্তু তিনি এসেছেন। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছেছেন। আমি কৃতজ্ঞ।

 মাথা নাড়লেন আশা। বড় সাজানো কথা বলা হচ্ছে আমার সঙ্গে। এই গ্রাম এই মাটি আমাকে নবীন জন্ম দিয়েছে। ওই বৃদ্ধ অশক্ত শরীরে আমাকে জাগ্রত করেছিলেন। আজ সমস্ত আত্মীয়স্বজন যখন হারিয়ে গিয়েছে তখন তাঁর দেওয়া নাচ আমাকে ঘিরে রেখেছে। তিনি আমার স্বামী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন নটরাজকে। স্বীকার করছি, কখনই ওই সিদ্ধান্ত আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারিনি যদিও অবজ্ঞা করিনি। যখন আমি মঞ্চে নাচি আমার শরীর সেই নৃত্য পরিবেশন করে। যখন আমি মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসি তখন আমার হৃদয়ে নাচ শুরু হয়। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এসবই তাতারই দান। এখন আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি আমার গুরুপ্রণাম শুরু করছি।

এই সময় মঞ্চের একধারে এসে বসলেন শাস্ত্রীজী সঙ্গে শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী। আশা তাদের দিকে তাকাতেই যেন ইশারা লক্ষ্য করলেন। তিনি এগিয়ে গেলেন মঞ্চের ধারে। বিনীত গলায় বিজয়লক্ষ্মী বললেন, আপনার মেকআপ ঠিকঠাক নেই।

না-ই থাক। আপনি সেই গানটি ধরুন। ভরণম-এ ঈশ্বরের প্রতি যে আর্তি ফুটেছে—

 আপনি কি প্রথম থেকে শুরু করবেন না?

না। অভিনয় অংশই আমার শরীরে-মনে আসুক।

শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী খুশি হলেন না। শাস্ত্রীজিও। মুখ দেখে বুঝতে পারলেন আশা। তারপর বললেন, থাক। শুরু থেকেই হোক। আদি থেকে অন্ত।

তাতার মুখ মনে করলেন আশা। ধীরে নিজেকে অতিক্রম করলেন। শরীরে স্পন্দন এল। এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ নাচটি তিনি শুরু করলেন। একে একে ভরতনাট্যমের একটির পর একটি দরজা অতিক্রম করতে লাগলেন তিনি। পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া এই শরীরটা যেন তাতার বয়ে-আনা মশালের দায়িত্ব নিয়ে এখন অনন্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অভিনয় পর্বে এসে তিনি কী একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন; ভরতনাট্যমের শিল্পী হয়ে ঐ মুহূর্তে মোহিনী আট্টমের সেই রাজকুমারীর মতো তাঁর নজরের মধ্যে আর এক নবীন দৃষ্টির উদয় হয়েছিল কি? কার দিকে তিনি অমন সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে নেচে চলেছিলেন? ডান কিংবা বাম নয়, মুখোমুখি কী কারো দর্শন পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন? ভরণমের বিখ্যাত গান যখন বিজয়লক্ষ্মীর গলায় গীত হল, তখন তিনি আত্মহারা। সমস্ত শরীরে তখন ভূমিকম্প। অনেক হয়েছে তোমার লীলাখেলা। আর কতকাল এভাবে অপেক্ষায় রাখবে তুমি হে বধির সুন্দর, হে আমার প্রভু। তোমার স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আর বিলম্ব সইতে পারি না। তোমার প্রতি বিশ্বস্ত এই হৃদয়কে যন্ত্রণা দিয়ে কী সুখ পাচ্ছ? হে প্রভু, হে আমার প্রাণ, কেন এগিয়ে আসতে এত দ্বিধা? কেন নিজেকে এমন আড়ালে রাখা? এই বিরহযন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারি না যে।

হঠাৎ সমস্ত শরীরে উত্তাল কান্না ছড়িয়ে পড়ল। তার প্রকাশ এল মুখ-চোখে। দর্শকরা শঙ্কায়িত হলেন। আবেগের সংক্রমণ বড় মারাত্মক। তারা এক অদ্বিতীয় শিল্পীকে দেখতে পেলেন। আর শিল্পীর চোখের সামনে তখন নটরাজ নয়, তাতা নয়, সবাইকে সরিয়ে একটি উজ্জ্বল সহাস্যমুখ বলছে, আমি তোমাকে ভালবাসি। যেন নিজেকে শক্ত ডাল থেকে ছিঁড়ে নেবার মতো নাচ থামিয়ে ভেঙে পড়লেন তিনি। দর্শকরা ভাবল আশা মিশে গিয়েছিলেন আরাধনায়।

.

ইন্দিরা মার্গের সমস্ত যানবাহন এখন নীরব। কোথাও কোনো শব্দ নেই। ব্যালকনির চেয়ারে বসেছিলেন আশা। সেই রাত্রে অনেক অনুরোধ এড়িয়ে তিনি চলে এসেছিলেন তাতার গ্রাম থেকে। নিজেকে সেদিন অপবিত্র মনে হয়েছিল বলে নাচ থামিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও সেই অনুভূতির কথা কেউ জানতে পারেনি।

আজ এই মধ্যরাত্রে নিদ্রাহীন আকাশের তলায় বসে দুই সন্তানের পিতা শীর্ণ মানুষটির মুখ মনে করলেন আশা। দেবতার মন্দিরে যে নাচ পরিবেশন করতে হয় সেখানে কেন মানুষের মুখ আসে মনের সামনে? সে কোন মানুষ? একা নিঃসঙ্গ মহিলা এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন প্রহরের পর প্রহর। সামনে বহু পথ পড়ে আছে কার ছায়া নিয়ে তিনি হাঁটবেন? ঈশ্বর না মানুষের!

[কপিলা বাৎস্যায়নের ইন্ডিয়ান ক্লাসিকাল ড্যান্স, মার্গ পত্রিকা এবং অশোক চ্যাটার্জির ড্যান্স অফ দি গোল্ডেন হল বই তিনটির কাছে আমি ঋণী। বস্তুত আশা রাও একজন জীবন্ত শিল্পীর ছায়ায় গড়া, কিন্তু কোনোমতেই তাঁর জীবনী নয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *