৩. কর্নেল সেন আবার হেসে

কর্নেল সেন আবার হেসে মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর আর কী? আসলে গল্পটা বেশি বড়ো নয় মোটেই। এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে। বসে বসে সেই যে ঘুমিয়ে পড়লাম, তারপর আর কিছু মনে নেই। এরমধ্যে ওরা জানলা ভেঙে ঢুকে আমাকে মেরে ফেলতে পারত। কিংবা জানলা ভাঙার শব্দে আমি হয়তো জেগে উঠতাম। সেসব কিছুই হয়নি। ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখলাম যে, রীতিমতন সকাল হয়ে গেছে; গল্প এখানেই শেষ। এবার ঘুমোতে যেতে পারো!

মাধবী সবিস্ময়ে বলল, গল্প শেষ মানে? মড়াটার কী হল? নেই?

কর্নেল সেন বললেন, মড়াটা ভূত হয়ে পালায়নি। সেটা তখনও সেখানেই পড়ে আছে। কিন্তু এরপর তো পুলিশ-টুলিশের ব্যাপার। আমি ডাকবাংলোর অভিজ্ঞতার কথা বলব বলেছিলাম। সে-গল্প এখানেই শেষ। ডাকবাংলোয় এ-রকম রোমাঞ্চকর রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা তোমাদের কখনো হয়েছে? ডাকাতের সঙ্গে শেষপর্যন্ত গুলি ছোড়াছুড়ি করতে হয়নি অবশ্য, কিন্তু গোটা রাত অজানা অচেনা এক লোকের মৃতদেহের সঙ্গে একঘরে কাটিয়েছিলাম। ঘরের বাইরে কয়েকজন রহস্যময় নারী-পুরুষ। তারপর আবার আমার ঘুম। এ-রকম রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কি সচরাচর মানুষের হয়? এইটুকুই গল্প। এরপর থানা পুলিশ, আইনের ব্যাপার-তারমধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই।

মাধবী বলল, না মামাবাবু, ওসব চলবে না। তারপর কী হল বলুন।

রঞ্জন বলল, তারপর আর কী? গল্প তো শেষ হয়ে গেছে। এই গল্পের নাম এক রাত্রির অভিজ্ঞতা। তুমি বাচ্চামেয়ের মতন তারপর তারপর জিজ্ঞেস করছ কেন? বাচ্চারাই তো গল্প শেষ হওয়ার পরও জিজ্ঞেস করে তারপর কী হল!

মাধবী এত চটে গেছে যে, চটাস করে এক চড় বসাল স্বামীকে।

আমিও আর ধৈর্য রাখতে পারছিলাম না। কর্নেল সেনকে জিজ্ঞেস করলাম, গল্প তো শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আপনি ওঘর থেকে বেরোলেন কী করে? ওরা তখনও ছিল না বাইরে?

কর্নেল সেন চুরুটের ছাই ঝেড়ে বললেন, আমি অনেকক্ষণ দরজা খুলিনি। তারপর জানলার খড়খড়ি তুলে দেখলাম, দেখতে পেলাম না কাউকে। জিপটাও নেই, তবে আমার গাড়িটা ঠিকই আছে। মনে হল ওরা চলে গেছে।

দিনের আলোয় মৃতদেহটা ভালো করে দেখলাম। লোকটি বিশেষ যন্ত্রণা পেয়ে মরেনি, গুলি লাগার সঙ্গেসঙ্গেই প্রাণ হারিয়েছে। তার মুখেচোখে একটা বিস্ময়ের ছাপ—যেন মৃত্যুর জন্য সে তৈরি ছিল না। রিভলবার বা বন্দুকের গুলি তার গলার কাছ দিয়ে ঢুকে ব্রেনের দিকে চলে গেছে। চেহারা দেখলে মনে হয়, লোকটি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের। টাকাপয়সার জন্য কেউ তাকে খুন করেছে—এমন মনে হয় না। যে-মেয়েটি কাল রাত্তিরে এসেছিল, সে কি সত্যিই এর স্ত্রী?

ডাকবাংলোরই একটা সাদা চাদর দিয়ে মৃতদেহটি ঢেকে দিলাম। তারপর সাবান-টাবান নিয়ে আমি ঢুকলাম বাথরুমে। বাইরে তখনও কোনো সাড়াশব্দ নেই।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দরজা খুললাম। ওরা আশেপাশে লুকিয়ে থাকতেও পারে। হয়তো আমাকে ঘর থেকে বার করার জন্য প্রলোভন দেখাচ্ছে। কিন্তু আমিই-বা কতক্ষণ ঘরের মধ্যে বন্দি থাকব?

তখন সকাল প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি যাচ্ছে টের পাচ্ছি। দিনের আলোয় অতটা ভয় করে না। রিভলবারটা পকেটে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

কেউ কোথাও নেই। বাংলোটার চারপাশ ঘুরে দেখলাম ভালো করে। আর কোনো লুকোনো জায়গা থাকা সম্ভব নয়। রাত্রির আগন্তুকদের তো খুঁজে পাওয়া গেলই না, চৌকিদারটারও কোনো পাত্তা নেই। তার ঘরের দরজাটা খোলা। ভেতরে জিনিসপত্তর পড়ে আছে, কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই কোনোখানে। গতকাল যখন আমি তার ঘরের দরজা ঠেলেছিলাম, তখন দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। অর্থাৎ তার বউ-টউ কেউ ছিল। দু জনেই সকাল বেলা উঠে কোথায় গেল? পালিয়েছে?

কাল সন্ধ্যের পর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। খিদেয় পেট চিনচিন করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার চা খাওয়া অভ্যেস। চায়ের তেষ্টায় মরে যাচ্ছি। কী করব, কিছুই ভেবে পেলাম না।

সবচেয়ে সহজ কাজ ছিল অবশ্য আমার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে আমার গাড়িতে উঠে চম্পট দেওয়া। তাই না?

রঞ্জন বলল, সেটা আপাতত খুব সহজ মনে হলেও আসলে খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পরে ধরা পড়লে অনেক বেশি গুরুতর অভিযোগ–

কর্নেল সেন বললেন, কিন্তু পরে ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তোমরা ডিটেকটিভ বইতে পড়, ছোটোখাটো সূত্র ধরে পুলিশ চটপট এক একজনকে গ্রেফতার করে ফেলে। আসলে কি তাই হয়? শুধু আমাদের দেশে কেন, বিদেশেও সব সময় হয় না। আমি যদি সকাল বেলা উঠে সেই বাংলো থেকে সরে পড়তাম, তাহলে আর আমার খোঁজ পাওয়ার সাধ্য ছিল না কারুর। আমাকেও কোনো ঝামেলায় পড়তে হত না। ওই খুনের কোনো কিনারা হত কি না তাও সন্দেহ। আশেপাশে কত ফাঁকা জায়গা—আততায়ীরা যদি রাত্রির অন্ধকারে ডেডবডিটা সরিয়ে মাঠের মধ্যে কোথাও গভীর গর্ত করে পুঁতে দেয়—কে আর তার খোঁজ পাবে? টাকা দিয়ে চৌকিদারের মুখ বন্ধ করে রাখা যায়। মাঝখান থেকে আমি এসে পড়াতেই সব গন্ডগোল হয়ে গেল।

আমার বয়েস তখন কম, সেইসময়ে ঝামেলা এড়াবার বদলে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াতেই বেশি ঝোঁক চাপে। সুতরাং আমি সকাল বেলা উঠে পালিয়ে যাইনি। তা ছাড়া একটা নিয়ম আছে, তুমি যদি হত্যা বা এই ধরনের ক্রাইম সংঘটিত হতে দেখো, তাহলে সঙ্গেসঙ্গে পুলিশকে সেটা জানানো কর্তব্য। না জানালে আইনের চোখে তুমিও অপরাধী। আজকাল অবশ্য এসব কেউ মানে না—খুনজখম এতবেশি হচ্ছে যে, লোকে দেখলেও চোখ ফিরিয়ে থাকে। কিন্তু আমরা পুরোনো কালের মানুষ, আমাদের এথিকস আলাদা।

বাংলোর ঘরে ফিরে এসে আমি ডেডবডিটা আবার ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম। লোকটির পকেটে কাগজপত্তর কিছু নেই। তার পরিচয় জানবার কোনো চিহ্ন রাখা হয়নি। বুলেটটা তার দেহের ভেতরেই রয়েছে। ঘরের মধ্যে তার ব্যবহৃত একটা জিনিসও নেই।

এই রহস্যটার শেষ না জেনে বাংলা থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। গতরাত্রির সেই মেয়েটির পরিচয় জানবার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিলাম। তা ছাড়া এ-রকম অবস্থায় পড়লে সবারই একটু একটু ডিটেকটিভ হওয়ার সাধ জাগে। ভেবে ভেবেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। লোকটির সঙ্গে কোনো লাগেজ নেই কেন? ডাকবাংলোয় এসে যদি কেউ ওঠে, বিশেষত স্বামী-স্ত্রী—তাদের সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র তো থাকবেই। সেগুলো যদি কেউ সরিয়ে ফেলতে পারে—তা হলে ডেডবডিটাই বা অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখল না কেন; কিংবা ফেলে গিয়েও আবার নিতে আসবে কেন?

ঘর থেকে আবার বাইরে এলাম। কথা বলার মতন একটা লোক পেলে ভালো হত। কিন্তু কেউ নেই ধারে-কাছে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে বটে, কিন্তু আমি তো আর হঠাৎ কোনো গাড়িকে জোর করে থামিয়ে বলতে পারি না-ও মশাই, দেখবেন আসুন, এখানে একটা ডেডবডি পড়ে আছে। সুতরাং আমাকেই থানায় খবর দিতে যেতে হবে। থানা কত দূরে তাও জানি না।

ডাকবাংলোর ঘরের তালাচাবি ঘরের মধ্যেই পড়েছিল। সেগুলোর বদলে আমি আমার নিজের সুটকেসের তালাটা ঘরের দরজায় লাগিয়ে দিলাম। অন্য সব দরজাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ।

গাড়িতে উঠে ডাকবাংলোর কম্পাউণ্ডটা ছাড়াতেই খালের ওপারে সেই ঘরবাড়িগুলোয় কিছু লোকজনের চিহ্ন দেখা গেল। সেখানে গিয়ে থানার খবরটা জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছি, এমন সময় রাস্তার ওপরেই একজন বুড়োমতন লোককে দেখা গেল।

গাড়িতে বসে লোকটিকে ডাকলাম। গ্রাম্য চাষিশ্রেণির মানুষ, মুখে চোখে খুব একটা বুদ্ধির ছাপ নেই। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, থানা কোথায় বলতে পার?

সে হাত তুলে একটা দিক দেখিয়ে দিল।

কত দূরে?

দু-ক্রোশ—তিন ক্রোশ হবে।

দূরত্ব সম্পর্কে গ্রামের লোকদের ধারণা খুবই অস্পষ্ট। তিন ক্রোশ যখন বলছে—তখন অন্তত মাইল দশেকের কম নয়। আমি তাকে বললাম, চলো, আমার সঙ্গে একটু থানায় চলো–

বলেই বুঝতে পারলাম খুব ভুল করেছি। লোকটি ভয়ার্ত সন্দেহ-মাখা চোখে তাকিয়ে আছে হাঁ করে। গ্রামের লোক সাধারণত থানার নাম শুনলেই ভয় পায়-তারপর তাকে বিনা দোষে থানায় যেতে বলা! লোকটি আর কোনো কথা না বলে হনহন করে চলে যাচ্ছিল, আমি তাকে ডেকে বললাম, এই যে, শোনো শোনো-। তোমাকে থানায় যেতে হবে না। একটা কথা শোনো!

পকেট থেকে পাঁচটা টাকা বার করে লোকটির হাতে দিয়ে বললাম, তুমি একটা কাজ করতে পারবে ভাই? আমি যতক্ষণ না ফিরি, তুমি ওই বাংলোটায় একটু অপেক্ষা করতে পারবে? আমার কিছু জিনিসপত্তর রেখে গেলাম–

আমি চাইছিলাম বাংলোটার ওপর কেউ একটু নজর রাখুক। কিন্তু ডেডবডিটার কথা ওকে বলতে পারি না। ওকে ঠিক বোঝানোই মুশকিল। লোকটি বিনা বাক্যব্যয়ে টাকাটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখল, নোটখানা জাল কি না। আমি তাকে বললাম, এখানে একটু থেকো কিন্তু—আমি আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসছি। লোকটি তারও কোনো উত্তর দিল না।

আমি গাড়ি ছাড়ার একটু পরেই পেছনে তাকিয়ে দেখি লোকটা মাঠের ওপর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। ওর বেশ মওকায় পাঁচটা টাকা লাভ হয়ে গেল।

মাধবী খিলখিল করে হেসে উঠল।

কর্নেল সেন বললেন, হাসছ? খুব বোকার মতন কাজ করে ফেলেছিলাম, তাই না? কিন্তু আগের রাত্তিরে ওইরকম একটা অভিজ্ঞতা হওয়ার পর তার পরদিন সব ব্যাপারে মাথা ঠিক রাখা শক্ত।

থানা অবশ্য খুব বেশি দূরে নয়, মাইল পাঁচেকের মধ্যেই, আমার গাড়ি সেখানে থামতেই গেটের সেপাই আমাকে দেখে লম্বা একটা স্যালুট দিল। বুঝলাম, আমার মিলিটারি পোশাকের মহিমা। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, একজন সাব ইনস্পেকটর টেবিলের ওপর পা-তুলে দিয়ে এক মনে শ্যামাসংগীত গাইছে। আমাকে দেখেই তটস্থ হয়ে উঠল। আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বলে উঠল, বসুন স্যার, আমাদের বড়োবাবুকে ডাকছি।

বড়োবাবু এলেন লুঙি পরে। বিশাল বপু। অতসকালেই পান চিবোচ্ছেন। মফসসলে ছোটো থানায় এ-রকমই ঢিলেঢালা ব্যাপার চলে। অন্তত তখনকার দিনে চলত। বড়োবাবু অর্থাৎ ও. সি. আমাকে আপ্যায়ন করে বসালেন। বিগলিতভাবে বললেন, বসুন স্যার, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চা খাবেন তো! ওরে, চা নিয়ে আয়! শিঙাড়া খাবেন? এই সময় গরম গরম শিঙাড়া ভাজে!

আমি বললাম, চা খাওয়ার সময় নেই। আমি একটা খুনের ঘটনার রিপোর্ট করতে এসেছি।

বড়োবাবু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, খুন? আমার এরিয়ায়? একী অসম্ভব কথা!

বড়োবাবু চেঁচামেচি করে থানায় সব্বাইকে ডেকে জড়ো করলেন। তাদের সামনে আমাকে পুরো ঘটনাটা বলতে হল।

মোটমাট থানা থেকে ফিরে আসতে আমার মিনিট পঞ্চাশেক সময় লেগেছিল। বড়োজোর এক ঘণ্টা। দারোগাকে ঘটনার গুরুত্ব কিছুতেই বোঝানো যায় না। বার বার বলতে লাগলেন, তাঁর এরিয়াতে চাষাভুসোরা মাঝে মাঝে খুনোখুনি করে বটে, কিন্তু গত দু-তিন বছরের মধ্যে কোনো ভদ্রলোক খুন হয়নি। আমি শেষকালে একটু রাগের সঙ্গেই বললাম, আগে ডেডবডিটা দেখবেন চলুন—তারপর বিচার করবেন সেটা ভদ্রলোকের কিংবা চাষাভুসোর। আমার কাছে-একটা খুন হয়েছে, সেইটাই বড়োকথা, সেটা ভদ্রলোক কিংবা চাষার তাতে কিছু যায় আসে না।

এর পরেও দারোগা আমাকে চা না খাইয়ে ছাড়বেন না। আমার চা তেষ্টা পেয়েছিল বটে, কিন্তু দেরি করতে ইচ্ছে করছিল না। দারোগাবাবু বললেন, আরে মশাই ডেডবডি তো আর পাখা মেলে উড়ে পালাবে না! চা-টা নষ্ট করবেন কেন?

তারপর দারোগাবাবু গেলেন পোশাক বদলাতে। তাতে লাগল মিনিট দশেক। ফিরে এসে জিব কেটে বললেন, কিন্তু যাব কীসে? আমাদের গাড়িটা তো খারাপ হয়ে পড়ে আছে কাল থেকে! আমি বললাম, চলুন। আমার গাড়িতে চলুন!

ফিরে এসে প্রথমেই আমি একটা পরিবর্তন লক্ষ করলুম। দরজায় আমার তালাটা লাগানো নেই। আমার তালার কোনো চিহ্নই নেই, দরজায় ডাকবাংলোর নিজস্ব ডবল তালা লাগানো। তার চাবি আমার নেই। অর্থাৎ এরমধ্যেই কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে।

আমি দারোগাকে বললাম, তালা ভাঙতে হবে। এই তালার চাবি তো এখন পাওয়া যাবে না।

দারোগাবাবু জানলার খড়খড়ি তুলে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলেন। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার বলে এখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তিনি আমাকে বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, অত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? তালা ভাঙা কি অতসহজ?

দারোগা হাঁক দিলেন, চৌকিদার, এ চৌকিদার!

আশ্চর্যের ব্যাপার, চৌকিদার রামদাস তার ঘর থেকে গুটি গুটি বেরিয়ে এল। আমাকে সে একেবারে গ্রাহ্যই করল না। দারোগার সামনে লম্বা এক সেলাম দিয়ে বলল, জি হুজুর।

আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, সকাল বেলা কোথায় চলে গিয়েছিলে?

কোনো উত্তর না দিয়ে সে হাবার মতন তাকিয়ে রইল। লোকটি অতিধূর্ত, সুবিধেজনকভাবে সেসব কথা কানে শুনতে পায় না। দারোগার ডাক শুনতে পেল, আমি চেঁচিয়ে মরলেও শুনতে পায়নি। এখনও আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না।

আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কাল রাত্তিরে কিছু শুনতে পাওনি? অতবার ডাকলাম তোমাকে

চৌকিদার তাও কোনো উত্তর দেয় না।

দারোগা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বাবুকে চিনতে পারছ না?

চৌকিদার মাথা নেড়ে বলল, না।

কোনোদিন দেখনি?

আজ্ঞে না।

আমি স্তম্ভিত। লোকটা বলে কী! রাগে শরীর জ্বলছিল। কিন্তু এখন বেশি রাগ না দেখানোই ভালো। যথাসম্ভব শান্তভাবে বললাম, কাল রাত্তিরে আমি এখানে ছিলাম, আর তুমি বলছ আমাকে কখনো দেখনি?

আজ্ঞে না হুজুর!

ঠিক আছে। তুমি খুব শয়তান, না? বুঝবে পরে মজা। খাতা নিয়ে এসো। বাংলোর খাতা কোথায়? সেখানে আমি নাম লিখেছি।

দারোগা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। সেসব পরে হবে। এখন দরজা খুলে দাও।

চৌকিদারটার কী স্পর্ধা। সে নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি থাকবেন হুজুর?

দারোগা বললেন, থাকব কি না সে আমি পরে বুঝব। এখন দরজা খোললা তো!

দরজা খোলা হল। মৃতদেহটা সেখানে নেই।

মাধবী চমকে উঠে বলল, নেই? ওর মধ্যেই সরিয়ে ফেলেছে? ইস মামাবাবু, আপনি কেন ডাকবাংলো ছেড়ে চলে গেলেন?

রঞ্জন ধমকে উঠে বলল, বাজে বোকো না! চুপ করে শোনো—ডাকবাংলো ছেড়ে না গেলে পুলিশে খবর দিতেন কী করে?

মামাবাবু বললেন, শুধু যে মৃতদেহটা নেই তাই-ই নয়। কোনো কিছুই নেই। আমার সুটকেস, জামাকাপড় সব উধাও। আমি যে ওই ডাকবাংলোয় একরাত কাটিয়েছি—তার সব চিহ্নও লোপাট করে দিয়েছে। এমনকী, বাথরুমে আমি আমার সাবান টুথব্রাশ রেখে গিয়েছিলাম, সে দিকেও ওরা নজর দিতে ভোলেনি। চেয়ার টেবিল খাট সব ঠিক জায়গায় বসানো। ওরা খুব নিপুণ হাতে কাজ সেরেছে।

দারোগা আমার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে বললেন, কী মশাই, কী ব্যাপার?

আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েছি ঠিকই। সেটাকে সামলে উঠে চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হে রামদাস, মড়াটা কোথায় গেল?

আমি তো কিছু জানি না হুজুর!

কিছু জান না? এখানে একটা খুন হয়নি?

খুন? কী বলছেন হুজুর!

আমার জিনিসপত্তরগুলো কোথায় গেল? আমার সুটকেস?

উত্তর না দিয়ে আবার হাবার মতন তাকিয়ে রইল রামদাস। লোকটা দারুণ অভিনয় করতে পারে। এখন দেখলে মনে হয়, ভাজা মাছটিও উলটে খেতে জানে না।

যাও বাংলোর খাতা নিয়ে এসো।

চৌকিদার দৌড়ে গিয়ে খাতা নিয়ে এল। যা মনে মনে আশঙ্কা করছিলাম, তাই। খাতার একটা পাতা খুব সাবধানে ছিড়ে নেওয়া হয়েছে। সেটা অবশ্য প্রমাণ করা খুব শক্ত নয়, কিন্তু দারোগাকে বোঝাবার ব্যাপারে তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না।

তবু আমি দুর্বলভাবে বললাম, দেখুন এই খাতা দেখে মনে হয়, এখানে ছ-সাত মাসের মধ্যে কোনো ভিজিটার আসেনি। সেটা সম্ভব? লাস্ট এন্ট্রি রয়েছে মার্চ মাসের।

দারোগাটি গম্ভীরভাবে বললেন, ই, সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু খুনের অভিযোগ দায়ের করতে হলে একটা ডেডবডি অন্তত থাকা দরকার। সেটাই তো পাওয়া যাচ্ছে না। একটা ডেডবডি তো আর উধাও হয়ে যেতে পারে না?

এরা এরমধ্যে এসে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

এই দিনের আলোয়? ভেরি আনলাইকলি! ভেরি আনলাইকলি!

আপনি ওই চৌকিদারকে ভালো করে জেরা করুন। ও সব জানে। ওর কাছ থেকে সব বার করা যাবে। কাল রাত্রে এখানে একটা জিপগাড়ি এসেছিল। তাতে একটা মেয়ে এবং আরও কয়েকজন লোক ছিল—চৌকিদার সেসব কথা জানে—ওর ঘরে আলো জ্বলছিল তখন, আমার ডাকে সাড়া দেয়নি–

দারোগাবাবু আকস্মিকভাবে হেসে উঠে বললেন, আর যাই বলুন, আপনার ওই মেয়েটির কথা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। রাতদুপুরে একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে কাঁদবে আবার উধাও হয়ে যাবে—ও নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। ওসব তো গল্পে হয়। পাঁচকড়ি দে-র কী যেন গল্প আছে-না, নীলবসনা সুন্দরী না কী যেন–

আমি দৃঢ়ভাবে বললাম, আমি যা বলছি, তার প্রত্যেকটা কথা সত্যি। এখানে একটা খুন হয়ে গেছে—ব্যাপারটা আপনি হালকাভাবে নেবেন না!

কিন্তু একটা কিছু ভিত্তি তো থাকা দরকার। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে আপনি যাকে দেখেছিলেন, সে হয়তো সত্যি সত্যি মরেনি। কোনো কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারপর জ্ঞান ফিরে পেয়ে চলে গেছে।

আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি একজন ডাক্তার। কে মারা গেছে আর কে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে—এটা একজন ডাক্তার প্রায় খালি চোখেই বলে দিতে পারি। যেমন আপনাকে দেখে আমি বলতে পারি, আপনার ডায়াবেটিস আছে।

দারোগাটি চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ? আপনি দেখেই বুঝতে পারেন? ধরেছেন তো ঠিকই। বছর খানেক হল ডায়াবেটিসে ভুগছি! ভাত, আলু, মিষ্টি—সব বন্ধ। জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল। এখানে ডাক্তার-বদ্যিও তেমন ভালো নেই। বাইচান্স আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েইছে—একটা ভালো ওষুধ বাতলে দেবেন কিন্তু। অন্তত দু-বেলা ভাত যাতে খেতে পারি–যাকগে তাহলে এখন কী করা যায় বলুন তো? আপনার একটা কিছু ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই।

আমি দারোগাবাবুকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললাম, বসুন, দু-একটা কথা বলা যাক। আপনার লোকদের বলুন, চৌকিদারের ওপর যেন নজর রাখে। ওকে পালাতে দেওয়া ঠিক হবে না।

দারোগাবাবু চেয়ারে বসে আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। তারপর আরাম করে সেটাতে টান দিয়ে বললেন, এখানে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করা যাবে না। কাল দুটো স্মাগলিং-এর কেস ধরা পড়েছে। সেখানে এনকোয়ারিতে যেতে হবে। বলুন স্যার কী বলবেন!

আমি বললাম, শুনুন, আপনাকে সকাল বেলা দশ মাইল দূরের থানা থেকে ডেকে এনে কিছুই দেখাতে পারলাম না—এতে মনে হতে পারে যে, আমি আপনার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করছি। কিন্তু আপনার সঙ্গে সেরকম কোনো মধুর সম্পর্ক আমার নয়। তা ছাড়া ঠাট্টা রসিকতা করে এতটা সময় নষ্ট করার মতন সময়ও আমার হাতে নেই। আর এক হতে পারে, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি সব কিছুই ভুল দেখছি, ভুল শুনছি! কিন্তু আপাতত নিজেকে আমার পাগল বলেও মনে হচ্ছে না। আমি জরুরি কাজে পুরুলিয়া যাচ্ছিলাম। সেসব আমার মাথায় উঠে গেছে। এখন এই ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ছি না। আপনি থানায় অতক্ষণ দেরি না করলে বোধ হয় আমরা আসামিদের হাতেনাতে ধরতে পারতাম। আপনি যদি ব্যাপারটায় গুরুত্ব দিতে না চান, তাহলে আমি এখানকার ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারসে যাব।

দারোগা মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, আমার এখন তা হলে কী করা উচিত বলুন তো? আপনার সব কথা যদি সত্যিও হয়, তা হলেও তো মনে হচ্ছে এটা ভৌতিক কারবার। ভূতের সঙ্গে পুলিশ কী করবে? আমি মশাই বামুনের ছেলে, আমি ভূতপ্রেত, ঠাকুরদেবতা সব মানি।

সে আপনি যাই মানুন, এক্ষুনি গোটা বাংলোটা, চৌকিদারের ঘর সার্চ করে দেখুন। এই চৌকিদারকেও কি আপনার ভূত বলে মনে হয়? সে কাল রাত্রে জেগে ছিল, কিন্তু আমার ডাক শুনেও আসেনি। আজ সকালে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।—এখন আবার জলজ্যান্ত হয়ে ফিরে এসে বলছে, কিছুই জানে না। চৌকিদারকে ভালোভাবে জেরা করুন।

তা হলে কি আপনি বলছেন, চৌকিদারই যত নষ্টের গোড়া। ও ব্যাটাই খুন করেছে?

না, সে-কথা আমি বলতে চাইছি না। তবে ও নিশ্চয়ই ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত। ও অনেক কিছু জানে।

দারোগা আড়মোড়া ভেঙে উঠলেন। সঙ্গের লোকদের সার্চ করার হুকুম দিলেন। এবং নিজের কৃতিত্ব দেখাবার জন্য হঠাৎ ঠাস করে এক চড় মারলেন চৌকিদারের গালে। হুংকার দিয়ে বললেন, বল, হারামজাদা! কাল রাত্তিরে কী হয়েছিল, বল।

ডাকবাংলোটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না। চৌকিদারের ঘরেও কিছু নেই। ওরা কাজ করেছে নিখুঁতভাবে। পুলিশের চোখে আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টাও করেছে বেশ ভালোভাবে।

এইসব কিছুর মধ্যেই আমি সেই মেয়েটির অনেকখানি ভূমিকা দেখতে পাচ্ছিলাম। এত তাড়াতাড়ি ঘরদোর পরিষ্কারভাবে গুছিয়ে যাওয়া কোনো পুরুষের কাজ নয়, তা হলে দু একটা ভুল থেকেই যেত। মেয়েরা সাধারণত ভুল করে না। মেয়েটি কি তাহলে সর্বক্ষণ কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে থেকে আমার গতিবিধি লক্ষ করছিল?

চৌকিদারের ঘরের জানলার পাশে একটা ছোট্ট হলদে রুমাল পাওয়া গেল। মেয়েলি রুমাল, লেসের কাজ করা—কিন্তু কোনো নাম-টাম লেখা নেই। দারোগাবাবু ওটাকে পাত্তা দিলেন না। রুমাল-টুমাল থেকে সূত্র খুঁজে বার করা শুধু বইতেই দেখা যায়। বাংলার কম্পাউণ্ডে জিপগাড়ির চাকার দাগ—অন্তত আমার গাড়ি ছাড়া, অন্য গাড়ির চাকার যে-দাগ আছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। দারোগাবাবুর কাছে ওরও কোনো মূল্য নেই।

কিন্তু অপরাধীদের কাজ যতই নিখুঁত হোক, একটা-না একটা ভুল তারা করবেই। এক্ষেত্রেও তারা একটা মারাত্মক ভুল করে গেছে। এ-রকম ছেলেমানুষি ভুলের কথা কল্পনাই করা যায় না।

দারোগাবাবু বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। আমাকে শেষপর্যন্ত পাগলই ভেবে বসেছিলেন হয়তো। তিনি তখন ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত। কিন্তু ফিরতে হলে আমার গাড়িতেই ফিরতে হবে। আসবার সময়ই সেটা কড়ার করে নিয়েছেন। আমার তখন যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। হার স্বীকার করে চলে যাব? দারোগাবাবু তাঁর লোকজনকে চতুর্দিকে খোঁজাখুঁজি করার জন্য খুব হম্বিতম্বি করছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর মুখে সব সময় একটা মৃদু মৃদু হাসি। ওই হাসিটাই আমার অসহ্য লাগছিল।

অক্লান্তভাবে আমি নিজেই চতুর্দিকে খুঁজে দেখছিলাম। ডাকবাংলোর কম্পাউণ্ড ছেড়ে উঠে গেলাম সেই বাঁধটার ওপর। নীচেই খাল। সেই খালের জলে একটা কী যেন কালো মতন জিনিস ভাসছে। দু-তিনটে বাচ্চাছেলে জলের মধ্যে নেমে লাঠি দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে সেই জিনিসটা।

আমি তরতর করে নীচে নেমে গেলাম। তারপরই চেঁচিয়ে ডাকলাম দারোগাবাবুকে।

খালের জলে ভাসছে আমার সুটকেসটা। অপরাধীরা আমার সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলেছিল—ডাকবাংলোতে আমার থাকার প্রমাণ লোপ করবার জন্য। কিন্তু আমার জিনিসপত্রগুলো ওদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই তো সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কোনো একটা দুর্বলতায় ওরা সঙ্গে নিয়ে যায়নি, ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে খালের জলে। খালের জল বেশি নয়, স্রোতও নেই, সুটকেসটা ভেসে যায়নি। গ্রামের ছেলেরা ওই জিনিসটা দেখতে পেয়ে তোলার চেষ্টা করছে মহা উৎসাহে।

মোটা শরীর নিয়ে দারোগাবাবুর নেমে আসতে সময় লাগল। নেমে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন। বললেন, কী ব্যাপার? এটা কী?

আমার সুটকেস! এবার প্রমাণ হল তো, এই বাংলোতে কাল রাত্রে আমি ছিলাম। চৌকিদার আগাগোড়া মিথ্যেকথা বলছে!

দারোগা এর উত্তরে কী বললেন জান? বললেন, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এতেও কিন্তু খুনের ব্যাপারটার কিছুই প্রমাণ হয় না।

শুনেই আমার রাগ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে ছিলাম। এবার আমি প্রায় ধমকেই বললাম, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? খুন-টুন কিছু হয়নি এটাই আপনি প্রমাণ করার জন্য ব্যস্ত! নাকি খুন যে-করেছে, সেই আসামিকে ধরতে চান?

এরা সব শক্তের ভক্ত। ধমক খেয়েই দারোগাটির সুর বদলে গেল। তটস্থ হয়ে বললেন, সে কী বলছেন? খুন হলে খুনিকে ধরব না? একটা মার্ডার কেস ধরতে পারলে আমার প্রমোশন হয়ে যাবে। কতদিন ধরে বদলির চেষ্টা করছি এখান থেকে। খুন হওয়া মানে তো আমার গুড লাক! তবে আমাদের এখানে তো এ-রকম কেস-টেস বিশেষ হয় না

সুটকেসটা তোলা গেল সহজেই। চৌকিদারকে ডাকা হল। দারোগাবাবু তাকে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, তুই যে কিছু জানিস না বললি? এই সাহেবের সুটকেস এখানে এল কী করে?

চৌকিদারের সেই এক উত্তর, আমি কিছু জানি না হুজুর।

জানিস না মানে? তুই বাংলোর চৌকিদার হয়েছিস—আর বাংলো থেকে জিনিসপত্তর উধাও হয়ে খালের জলে ভাসবে?

আমি সকাল বেলা তেল আনতে গিয়েছিলাম। তখন কেউ চুরি করেছে।

তাহলে তখন যে বললি, এই সাহেবকে তুই কখনো দেখিসনি? অ্যাঁ? কী ব্যাপারটা কী? সাহেব তাহলে রাত্তিরে এখানেই ছিলেন?

চৌকিদার আবার চুপ! দারোগা তখন চৌকিদারকে এমন মারতে শুরু করলেন যে, আমাকেই থামাতে হল। আমি বললাম, ওকে এত মেরে কী হবে? মারলে ও কী বলবে?

দারোগা হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, আপনি জানেন না! এরা মার ছাড়া কিছু বোঝে না। এই জমাদার, বাঁধো একে। থানায় চলুক, সেখানে গিয়ে বুঝবে।

খালের ওপাশে তখন রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। যে বাচ্চা ছেলেগুলো সুটকেসটা তোলার চেষ্টা করছিল, তাদের একজনকে ডেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই খোকা, শোননা। সকাল বেলা এখানে একটা জিপ গাড়ি দেখেছ?

ছেলেটি বললে হ্যাঁ। রায়বাবুর জিপ।

রায়বাবু মানে, কোন রায়বাবু?

ছেলেটি আবার বলল, রায়বাবুর জিপগাড়ি।

আমি দারোগাকে বললাম, এই ছেলেটির নাম-টাম জেনে নিন। পরে এর কথা কাজে লাগবে। রায়বাবুর জিপ যে বলছে, রায়বাবু কে? মনে হচ্ছে এখানে প্রায়ই আসে! ওরা চেনে।

দারোগা বললেন, খোঁজ নিতে হবে। খোঁজ নিলেই বেরিয়ে পড়বে।

পরে যখন আদালতে মামলা ওঠে, তখন ওই ছেলেটির সাক্ষী খুব কাজে লেগেছিল। ওই ছেলেটি দেখেছিল, চলন্ত জিপগাড়ি থেকে সুটকেসটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল খালের মধ্যে। এবং সেই জিপগাড়ির মধ্যে যারা ছিল, তাদেরও সে শনাক্ত করেছে।

শুধু তাই নয়, ওইখানে আর একটাও খুব জরুরি খবর পাওয়া গেল। ভিড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে এল সেই বুড়ো। যাকে আমি পাঁচ টাকা দিয়েছিলাম। তোমরা তখন ওকে পাঁচটা টাকা দেবার কথা শুনে হেসেছিলে। ও কিন্তু ওর কাজ ঠিকই করেছে। গ্রামের সরল সাধারণ লোক টাকা নিলে তার বিনিময়ে কাজটা ঠিকই করে! এটা আমার অনেক দিনের অভিজ্ঞতা। লোকটাকে সেই পাঁচ টাকা দিয়েছিলাম বলে খুনের কিনারা করতে সাহায্য হয়েছিল অনেকখানি। দূরে কোনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলোর দিকে লক্ষ রেখেছিল।

সেই বুড়ো লোকটি বলল, সকাল বেলা সে রায়বাবুর জিপ আসতে দেখেছে এখানে। খানিকটা বাদে আবার চলে গেছে। রায়বাবুকেও সে চেনে। রায়বাবু হচ্ছেন পি ডব্লু ডি-র ওভারসিয়ার বাবু।

আমি দারোগার চোখের দিকে তাকালাম। তাঁর চোখ-মুখ এখন চিন্তাসংকুল। তিনি বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। পি ডব্লু ডি অফিসে সুখেন রায় নামে একজন ওভারসিয়ার ভদ্রলোক আছেন বটে। তাঁর একটা জিপগাড়িও আছে। কিন্তু তাঁর জিপে এইসব…

আমি বললাম, চলুন, আর দেরি না করে সেই সুখেন রায়ের কাছে যাওয়া যাক। তার কাছেই সব কিছু জানা যাবে।

একজন কনস্টেবলকে সেখানে পাহারায় রেখে আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার আগে আমি দারোগাবাবুকে বললাম, আপনি আপনার কনস্টেবলকে বলুন যেন চৌকিদার রামদাসকে সে কোনোক্রমেই চোখের আড়াল না করে! কারণ লোকটা বোকা সেজে থাকলেও আসলে অতিধূর্ত। একটু সুযোগ পেলেই আরও হয়তো প্রমাণ লোপ করবার চেষ্টা করবে। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যেই সে ডাকবাংলোর ঘরখানা এমন পরিষ্কার করে ফেলেছিল যে আমিই প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি যে একটা গালগল্প বানিয়ে বলছি না, সেটা দারোগাবাবুকে বিশ্বাস করানোই শক্ত হয়ে উঠেছিল।

গাড়িতে দারোগাবাবুকে বেশ গম্ভীর আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখা গেল। এমনিতে তিনি বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন, কিন্তু গাড়িতে একটাও কথা বললেন না। আমার মনে হল, দারোগাবাবুর চেনাশুনো স্থানীয় লোকেরাই এর সঙ্গে জড়িত, তিনি এ-রকম সন্দেহ করছেন। সেটা অমূলকও নয়। মৃতদেহটা ফেলে যাওয়া এবং আবার ফিরে এসে সেটা সরাবার জন্য ব্যস্ততাতেই সেটা বোঝা যায়। দূর অঞ্চলের লোক হলে হয় আততায়ীরা মৃতদেহটা ফেলেই পালাতো অথবা সঙ্গে করে নিয়ে যেত। কাছাকাছি জায়গার লোক বলেই তারা ঘরদোর পরিষ্কার করে মৃতদেহটা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল খাটের নীচে। অন্যদিকে সব ব্যবস্থা সেরে এসে আবার রাত্রির অন্ধকারে সরিয়ে ফেলবে—এই ছিল প্ল্যান। দূরের লোক হলে তাদের পক্ষে একটা সুবিধে ছিল। তারা সব চিহ্ন বিলোপ করে মৃতদেহটা ফেলে রেখে যদি সরে পড়তে পারত—তাহলে মৃতব্যক্তিটির পরিচয় খুঁজে বার করতে করতেই সময় লেগে যেত বেশ কয়েকদিন। ততদিনে আততায়ীরা পগারপার হওয়ার পক্ষে পেয়ে যেত অনেক সুযোগ। কিন্তু স্থানীয় লোক হলে মৃতদেহটি দেখেই সবাই চিনে ফেলবে! তখনই তার সঙ্গে জড়িত অন্য লোকদের ওপর পড়বে পুলিশের দৃষ্টি।

কর্নেল সেন হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কি, আমার অ্যানালিসিস ঠিক হচ্ছে? রঞ্জন বলল, পারফেক্ট। এরকুল পোয়ারোও ঠিক এইকথাই বলতেন। কর্নেল সেন বললেন, সেইসময়ে আমিও প্রায় ডিটেকটিভ হয়ে উঠেছিলুম। না হয়ে উপায়ও ছিল না। কারণ, আমাদের দারোগাবাবুটি আগাগোড়া একটুও বুদ্ধির পরিচয় দেননি। অথচ রহস্যটার একটা কিনারা না-হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। গ্রাম ট্রামের দিকে আমাদের থানা পুলিশের যা অবস্থা—তাতে সেখানকার মানুষ যে পটাপট খুন করে না কেন, আমি বুঝতে পারি না। একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কেউ খুন করলে, তাকে ধরার সাধ্য পুলিশের নেই। তবে, সৌভাগ্যের বিষয়, আমাদের গ্রামদেশের মানুষেরা সাধারণত শান্ত প্রকৃতির—কথায় কথায় খুনজখম করে না। কখনো রাগের মাথায় হয়তো কারুকে মেরে বসে —সেটা এমনই প্রকাশ্যভাবে হয় যে ধরা পড়তেও দেরি হয় না। জটিল, কুচক্রী ধরনের খুন শহরেই বেশি হয়।

যাইহোক, আমার এ-গল্প শেষ হয়ে এসেছে। এটাও এমন জটিল খুনের কাহিনি নয়। মাঝখান থেকে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম বলে একটু জট পাকিয়ে গিয়েছিল। অভিজ্ঞতাটা আমার পক্ষে হয়েছিল সাংঘাতিক। নইলে, তোমাদের বইতে যেসব খুনের গল্প থাকে, তারমধ্যে কখনো বুদ্ধিমান খুনিরা সুটকেসটা ফেলে যাওয়ার মতো কাঁচা কাজ করে? কিংবা ডিটেকটিভের জন্য এতটা সুবিধে করে দিয়ে যায়? কিন্তু জীবনে বাস্তব ঘটনায় এ-রকম ভুল অনেকবার হয়।

সুটকেসটা ফেলে না গেলে খালের পাশের গ্রামের লোকদের জেরা করার কথা আমাদের মনে আসত না হয়তো। আর তারা নিজে থেকে এগিয়ে এসে যে কিছু বলত না—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্রামের লোককে জেরা করে ওই জিপগাড়িতে ক-জন লোক ছিল এবং তাদের চেহারার বর্ণনাও আমরা পেয়ে গেলাম।

মাধবী জিজ্ঞেস করল, ডাকাতরা সবাই ধরা পড়েছিল শেষ পর্যন্ত? রঞ্জন বলল, তুমি কী করে জানলে এটা ডাকাতদের ব্যাপার? যারা রাত্তির বেলা জিপে করে বন্দুক নিয়ে এসে আক্রমণ করে, তারা ডাকাত ছাড়া কী? আর সেই ডাকাতদলের লিডার হচ্ছে একটা মেয়ে? মেয়ে ডাকাত? এ যে হিন্দি সিনেমা! কর্নেল সেন হাসতে হাসতে বললেন, কিন্তু ডাকাতরা কীসের জন্য ওই বাংলোতে আসবে। কারোর কাছে তো বেশি টাকাপয়সা নেই!

যে-লোকটা খুন হয়েছে, সে হয়তো কোনো ব্যবসায়ী! সঙ্গে অনেক টাকা ছিল।

রঞ্জন বলল, মামাবাবু, আপনি মাধবীর কথা শুনবেন না। যেরকম বলছিলেন সেইরকম বলে যান।

পি ডব্লু ডি অফিসে পৌঁছে সুখেন রায়কে পাওয়া গেল না! দারোগার সঙ্গে ওই অফিসের অনেকেরই চেনা। দারোগাবাবু যে ওখানে খুনের তদন্ত করতে এসেছেন, সে-কথা কেউ বুঝতে পারেনি। তিনিও বুঝতে দেননি। অফিসের লোকেরা দারোগাবাবুকে খাতির করে বসালেন, এমনকী চায়ের অর্ডারও হয়ে গেল। বোঝা গেল দারোগাবাবুটি মাঝে মাঝে ওখানে এমনই আসেন।

কথায় কথায় দারোগাবাবু বললেন, সুখেনকে দেখছি না কেন? সুখেন কোথায়?

অফিসের একজন বলল, সুখেন পাটনায় হেড অফিসে কী একটা ব্যাপারে তদ্বিরে গেছে। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হবে!

দারোগাবাবু উদাসীনভাবে বললেন, তাহলে কী হবে? সুখেনের সঙ্গে এই ভদ্রলোকের একটু দরকার ছিল। সেইজন্যই এসেছিলাম। কাজটা তাহলে হল না! একটা জরুরি বাড়ির প্ল্যান করানো দরকার এনার। সুখেনের কিছু টাকা রোজগার হয়ে যেত। ওহে রণধীর, সুখেন কবে নাগাদ ফিরবে তাও বলতে পার না?

রণধীর নামের কর্মচারীটি বলল, দিন দশেক তো লাগবেই। কীসে গেছে? ট্রেনে? না, ও জিপগাড়িটা নিয়ে গেছে। দারোগাবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন ওঠা যাক তাহলে। কাজ তো হল না।

সেই অফিস থেকে বেরিয়ে এসে দারোগাবাবু বললেন, এবার? এখানেও তো কিছু পাওয়া গেল না।

আমি বললাম, সুখেন রায় কোনো ছুটির দরখাস্ত করে গেছে কি না সেটা আপনার দেখা উচিত ছিল। যদি সে টুরেও গিয়ে থাকে, তাহলে অফিসে তার টুর প্রোগ্রামের একটা রেকর্ড থাকবে—সেগুলো আপনি চেক করে দেখলেন না? একটা লোক তো এমনি এমনি অফিস ছেড়ে আউট স্টেশনে যেতে পারে না?

দারোগার কী করা উচিত, না উচিত সে-সম্পর্কে আমার উপদেশ দেওয়া তিনি এখন আর একটুও পছন্দ করলেন না। ভুরু কুঁচকে তাকালেন আমার দিকে। কিন্তু আমার কথা উপেক্ষা করতেও সাহস পেলেন না। হাজার হোক আমি মিলিটারির লোক। মিলিটারির সম্পর্কে আমার দেশের লোকের বেশ ভয় ও শ্রদ্ধা আছে।

তিনি আমার কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, এইসব মফসসলের ছোটোখাটো অফিসে কি আর সব নিয়মকানুন মানে? আপনাদের স্যার বড়ো বড়ো ব্যাপার

সব কিছু স্ট্রিক্ট। কিন্তু এসব জায়গায় এরা বিনা দরখাস্তে ছুটি নেয়—নিজস্ব দরকারে কোথাও গেলেও সেটা টুর হিসেবে দেখায়—নিজেদের মধ্যে সব কিছু ম্যানেজ করে নেয়।

আমি দৃঢ় গলায় বললাম, তবু আপনার চেক করে দেখা উচিত। আমাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে দারোগাবাবু এবার একা গেলেন। একটু বাদে ফিরে এসে বললেন, না সেসব কিছু নেই। সুখেন ফিরে এসে দরখাস্ত করে দেবে বলে গেছে। এসব এখানে প্রায়ই হয় বলল।

কিন্তু সুখেন রায় যে-জিপগাড়ি নিয়ে পাটনা গেছে, সেই জিপগাড়িই আজ সকাল বেলা বাংলোর সামনে দেখা গেল কী করে?

বোঝাই তো যাচ্ছে, ওই চাষাভুসোরা ভুল দেখেছে। সুখেনের জিপগাড়ি ওখানে মাঝে মাঝে যায় তো—সুখেনের সুপারভিশনেই তো বাংলোটা তৈরি হল। গাঁয়ের লোক তো বেশি গাড়ি-টাড়ি দেখে না—তাই যেকোনো জিপগাড়ি দেখলেই ভাবে সুখেনের গাড়ি।

গ্রামের দু-একজন লোক কিন্তু সুখেনকেও ওই গাড়িতে বসে থাকতে দেখেছে। জিপের পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বসেছিল।

ওই খুনে গুণ্ডাদের দলে সুখেনও থাকবে আপনি ভাবছেন? আমি সুখেনকে চিনি—সে একটা পিঁপড়েও মারতে চায় না।

আমি কোটের পকেট থেকে আমার ডায়েরি বার করে ব্যাপারটা নোট করলাম। তারপর দারোগাবাবুকে বললাম, এবার তাহলে আমাকে পুরো ঘটনাটি আপনাদের ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারসে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে। আমি নিজের চোখে একটা ক্রাইম ঘটতে দেখেছি। ল অ্যাবাইডিং সিটিজেন হিসেবে সেটা কতৃপক্ষকে জানানো আমার কর্তব্য। সুতরাং ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারসে একবার যেতেই হবে আমাকে।

দারোগাবাবু বললেন, তা তো নিশ্চয়ই। অবশ্য আমরাও ওপর মহলে রিপোর্ট পাঠাব। আপনি তো আমাদের জানিয়েছেনই। আমরাও প্রিলিমিনারি ইনভেসটিগেশনের পর ওপর মহলের হাতে কেসটা দিয়ে দেব। তবে মুশকিল হচ্ছে এই, ডেডবডিটারই কোনো ট্রেস পাওয়া গেল না।

আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনারা জানাবেন সে তো ভালো কথাই। আমিও আমার তরফ থেকে জানিয়ে দিয়ে বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। চলুন তাহলে আপনাকে থানায় নামিয়ে দিয়ে ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারসে যাই।

দারোগাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, যাবেন? চলুন! বুঝতেই পারছি, আপনার সন্দেহ কিছুতেই মিটছে না। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন, আমরা যে তদন্ত শুরু করব—তার একটা ভিত্তি কী আছে, আপনার মুখের কথা ছাড়া? বাংলোর চৌকিদারটা অবশ্য একটা কিছু অপকর্ম করেছে ঠিকই—নইলে আপনার সুটকেস খালের জলে পাওয়া যাবে কেন? আপনি তো আর নিজে সেটা ফেলেননি! গ্রামের লোক কি জিপগাড়ি-টাড়ি দেখেছে—সে-কথা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। চৌকিদারের ওই বদমাইশির সঙ্গে তো আর খুনের ব্যাপারটা এক করা যায় না! আচ্ছা এক কাজ করা যাক। যাওয়ার আগে একবার সুখেনের বাড়িটি ঘুরে যাওয়া যাক চলুন। আপনার আপত্তি নেই তো?

ছোট্ট ঘিঞ্জি শহরটির নাম আমি তোমাদের কাছে ইচ্ছে করেই বলছি না। তবে বিহার বা পশ্চিমবাংলার ছোটোখাটো শহর তোমরা দেখেছ নিশ্চয়ই। একইরকম হয়। সুতরাং অনুমান করে নিতে তোমাদের অসুবিধে হবে না।

যেতে যেতে দারোগাবাবু বললেন, সুখেন রায় এখানে বছর দুয়েক হল বদলি হয়ে এসেছে। অত্যন্ত নিরীহ, ভদ্র ছেলে। কোনো সাতে-পাঁচে নেই। লোকজনের উপকার করতে পারলে সুখী হয়। অফিসের কাছেই তার কোয়ার্টার পাওয়ার কথা, কিন্তু কোয়ার্টার খালি নেই বলে বাড়ি ভাড়া করে আছে। এখানে সেরকম কোনো ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না। যে-বাংলোটায় আপনি উঠেছিলেন, সেটা প্র্যাকটিক্যালি সুখেনেরই তৈরি। সুখেনই দেখাশোনা করে বানিয়েছে। চলুন, সুখেন যদি পাটনায় না গিয়ে বাড়িতেই বসে থাকে—আপনি তার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হবেন। সত্যিই ভালো ছেলে।

শহর একটু ছাড়িয়ে সুখেন রায়ের বাড়ি। বাড়িটার চেহারা সত্যিই ভালো নয়। সিমেন্টের দেওয়াল কিন্তু খাপরার ছাদ। তাও বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। সামনে একটু বাগানের মতন। সেই বাগানের এক কোণে একটি জিপগাড়ি দাঁড় করানো।

জিপগাড়িটি আমার আর দারোগাবাবুর এক সঙ্গেই চোখে পড়ল। দারোগা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, সুখেন বাড়িতেই আছে মনে হচ্ছে। পাটনায় যায়নি। ওর এখানে এসে ভালোই হল—ওর কাছ থেকেই সব কিছু জানা যাবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই জিপগাড়িটি কি সুখেন রায়ের নিজের? না অফিসের?

দারোগাবাবু বললেন, অফিসেরই। তবে ও নিজেই সব সময় প্রায় ব্যবহার করে। অফিসের গাড়িটা কেনা হয়েছে, কিন্তু ড্রাইভারের পোস্ট এখনও স্যাংশান করা হয়নি। জানেন তো গভর্নমেন্টের ব্যাপার। সুখেন ছাড়া আর কেউ গাড়ি চালাতে জানে না। তাই গাড়িটি সর্বক্ষণ ওর কাছেই থাকে।

বাগানের গেট খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম, দারোগাবাবু এগিয়ে গেলেন বাড়ির দরজার দিকে। আমি গেলাম জিপটি একটু পরীক্ষা করতে। কাল রাত্তিরে আমি এই জিপটিই যে দেখেছিলাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ডান দিকের মাডগার্ডটা একদম তোবড়ানো। এতক্ষণ আমার মনে ছিল না একথা—এখন দেখামাত্র মনে পড়ল যে কাল রাত্তিরেও আমি এটি লক্ষ করেছিলাম। গ্রামের লোকদের পক্ষেও জিপটি চেনা এইজন্যই সহজ।

দরজা খুলল একটি মেয়ে। আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। জীবনে এ-রকমভাবে চমকে গেছি খুবই কম বার। আর যাই হোক, এখানে এই অবস্থায় মেয়েটিকে আমি দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।

তাকে দেখে আমি অতি কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। এই সেই কাল রাত্রে দেখা মেয়েটি। আজও তার চুলগুলো খোলা। সদ্য স্নান করেছে মনে হয়। একটি কালো রঙের তাঁতের শাড়ি পরে আছে। ভেজা চুলে জ্বলজ্বল করছে টাটকা সিঁদুর।

মেয়েটিকে দিনের বেলা দেখে বুঝলাম, এ-মেয়ে সাধারণ নয়। কাল রাতে ওকে অলৌকিক মনে হয়েছিল। এখন সেরকম কিছু মনে হয় না বটে, কিন্তু ছোট্ট শহরের একজন ওভারসিয়ারের বউ হিসেবে তাকে একদম মানায় না। খুব একটা সুন্দরী বলা যায় না তাকে। কিন্তু তার আঁটসাঁট স্বাস্থ্য ও চোখে-মুখে এমন একটা কিছু আছে, যা পুরুষদের মাথায় আগুন জ্বালায়। এইসব মেয়ে অনেক ঘর ভাঙে।

মেয়েটি আমাকে একদম গ্রাহ্যই করল না। আমাকে সে চিনতে পেরেছে কিংবা জীবনে আগে কখনো দেখেছে, এ-রকম কোনো চিহ্নই নেই তার মুখে। আমার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। দারোগাবাবুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, কী খবর? আসুন, আসুন! অনেকদিন আসেননি এদিকে!

দারোগাবাবু বললেন, এসেছিলাম এদিকে, তাই ভাবলাম তোমাদের এদিকে একবার ঘুরে যাই।

আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি একজন ডাক্তার। এখানে এসেছেন একটি কাজে। আর এ হচ্ছে করবী, আমাদের সুখেন রায়ের মিসেস। করবী খুব ভালো চা বানায়। এপাশে কাজকর্মে এলেই একবার এদের বাড়িতে চায়ের লোভে আসি। কি করবী, এখন একটু চা হবে নাকি? নতুন লোককে সঙ্গে করে এনেছি।

করবী এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেতরে আসুন।

মেয়েটি দরজার একপাশে সরে আমাদের জন্য জায়গা করে দিল। ভেতরে ঢোকার সময় আমি মেয়েটির গা থেকে খুব হালকা ডেটলের গন্ধ পেলাম। আশ্চর্য, এই ডেটলের গন্ধটা কাল রাত থেকে আমাকে পেয়ে বসেছে। এই গ্রামদেশে এত ডেটলের ব্যবহার হয়। মেয়েটি তো একটু আগেই স্নান করেছে, তারপর আবার ডেটল মেখেছে? মেয়েটির কপালে সিঁদুর অথচ কাল রাত্রে মৃতদেহটিকে বলেছিল ওর স্বামী!

বসবার ঘরে একটি চৌকি পাতা, দু-টি চেয়ার ও একটি টেবিল। অনেক রকমের বইপত্তর চারিদিকে ছড়ানো। মফসসলের এ-ধরনের চাকুরিজীবীদের বাড়িতে সাধারণত এত বই দেখা যায় না।

দারোগাবাবু আরাম করে বসলেন চৌকিতে। আমি বসলাম চেয়ারে। দারোগাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সুখেন কোথায়?

করবী বলল, ও তো পরশু পাটনা চলে গেছে।

দারোগাবাবু সবিস্ময়ে বললেন, পাটনা গেছে? জিপ নিয়ে যায়নি? আর অফিস থেকে যে বলল সুখেন পাটনায় দশদিনের টুরে গেছে জিপ নিয়ে?

করবী বলল, না শেষপর্যন্ত নিল না। জিপেই যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যাওয়ার সময় বলল ওর শরীরটা ভালো লাগছে না—অতটা একা ড্রাইভ করতে পারবে না। তাই ট্রেনেই গেল।

দারোগাবাবু বললেন, ইদানীং ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না দেখছি। প্রায়ই ভুগছে, এই বয়েসের ছেলে, এরমধ্যে হার্টের অসুখ যদি হয়।

করবী দৃঢ়স্বরে বলল, না, হার্টের কিছু হয়নি। অনেক সময় উইণ্ডের জন্য ওরকম ব্যথা হয়। আমি বলেছি, এবার পাটনায় ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আসতে।

দারোগাবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, বুঝলেন মশাই, সুখেনের বয়েস বেশি-না— কিন্তু মাঝে মাঝে বুকে এমন ব্যথা হয় যে, দেখলে ভয় লাগে। ব্যথার চোটে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি বার বার বলেছি, ভালোমতন চিকিৎসা না করলে কোনোদিন রাস্তাঘাটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে বেঘোরে মরবে।

তারপর করবীর দিকে ফিরে বললেন, সুখেন আজ বাড়ি থাকলে ইনি ওর বুকটা একটু দেখে দিতে পারতেন। ইনি খুব বড়ো ডাক্তার।

আমি চুপ করে রইলাম। করবীও কোনো কথা বলল না।

দারোগাবাবু চায়ের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন, আমি অবশ্য চায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছি। সকাল বেলা বেশি চা খাওয়া অভ্যেস নেই আমার। করবীর তৈরি বিখ্যাত চা খেতেও আমি প্রলুব্ধ হইনি।

তা ছাড়া, আমার আর সাসপেন্স সহ্য হচ্ছিল না। সেখানে আমরা বসেছিলাম এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি। চা খেতে খেতে বিশ্রম্ভালাপ। সবই আমরা অভিনয় করছিলাম!

দারোগাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, করবী, আজকের কাগজ এসেছে নাকি? কাল নাকি পাটনায় খুব মারামারি হয়েছে-রেডিয়োতে বলছিল

করবী বলল, না, কাগজ তো সেই বিকেল বেলা দেয়।

করবী, সুখেনের কাছ থেকে জিপগাড়িটা কেউ এরমধ্যে ধার নিয়েছিল নাকি?

করবী আশ্চর্য হয়ে বলল, গভর্নমেন্টের জিপগাড়ি-অন্য কেউ ধার নেবে কী করে?

কাল সন্ধ্যেবেলা গ্রামের দু-একজন এই জিপগাড়িটাকে নাকি ঘুরে বেড়াতে দেখেছে।

তা হতেই পারে না!

দারোগাবাবু আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ সবটাই আমার ভুল। করবী আগেই গরম জল বসিয়ে এসেছিল, এবার উঠে গিয়ে চা করে নিয়ে এল। আমি খাব না বলেছিলাম, তবু আমার জন্য এনেছে। হাসিমুখে অনুরোধ জানালো, খান-না এক কাপ, অপূর্ব অভিনয়।

সেই অভিনয় ভেঙে দিয়ে আমি করবীকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে আগে কখনো দেখেছেন?

করবী অবাক হয়ে বলল, আপনাকে না তো!

আমি কিন্তু আপনাকে দেখেছি।

করবী সঙ্গেসঙ্গে মুখের ভাব বদলে ফেলে বলল, তা হতেও পারে। আপনাকেও আমার একটু একটু চেনা লাগছে। আপনি কি রাঁচিতে প্র্যাকটিস করেন? কিংবা ওখানে আমাকে দেখেছেন কখনো? আমরা রাঁচিতে থাকতাম—বিয়ের আগে।

আমি বললাম, না, রাঁচিতে আপনাকে দেখিনি। আপনাকে আমি দেখেছি কাল রাত্তিরে। এখানে যে একটি ডাকবাংলো আছে, সেখানে!

করবী বিমূঢ়ভাবে দারোগাবাবুর মুখের দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে। আস্তে আস্তে বলল, ডাকবাংলোয়? আমাকে? আপনার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে।

না, আমার অতসহজে ভুল হয় না। কিন্তু আমি বাড়ি ছেড়ে ডাকবাংলোয় কেন যাব বলুন তো! আমি তো কাল বাড়ি থেকে একবারও বেরোইনি।

আমি কিন্তু আপনাকে কাল ডাকবাংলোতেই দেখেছি। আপনিও আমাকে দেখেছেন এবং আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। এখন কিছুই মনে পড়ছে না?

করবী এবার দৃঢ়গলায় বলল, নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে। আপনি কী বলতে চান কী? আমি ডাকবাংলোয় যাব কেন? আমার স্বামী বাইরে গেছেন

একজন মহিলার স্বামী বাইরে টুরে গেছেন, আর মহিলাকে যদি রাত্তির বেলা একটি ডাকবাংলোতে দেখা যায়—সেটা নিশ্চয়ই একটি কলঙ্কের অপবাদ। একজনের বাড়িতে বসে এ-রকম অভিযোগ করার মধ্যে চূড়ান্ত অভদ্রতা আছে। কিন্তু এটা তো ভদ্রতা-অভদ্রতার প্রশ্ন নয়। এরমধ্যে একটা খুনের ব্যাপার জড়িত।

কাল রাত্রে করবীর মুখে একটা আতঙ্কের চিহ্ন দেখেছিলাম, আজ সেসব কিছু নেই। বরং একটা তেজি অহংকারী ভাব। আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যেন, আমি একটি ভন্ড প্রতারক, কোনো ভদ্রমহিলার নামে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছি।

কিন্তু আমার পক্ষে উত্তেজিত হওয়া এখন একেবারেই উচিত নয়। আমি নীচু গলায় বললাম, দেখুন, শুধু মিথ্যের বোঝা বাড়িয়ে আর কোনো লাভ নেই। বরং আপনি সব কথা খুলে বলুন, তাহলে আপনাকে আমরা হয়তো কোনো সাহায্য করতে পারি।

করবী বলল, আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি বললাম, হয়তো আপনার স্বামী পাটনায় শেষপর্যন্ত যাননি। তার কোনো বিপদ হয়ে থাকতে পারে।

একথা আপনি বলছেন কেন?

দারোগাবাবু একবারে চুপ। আস্তে আস্তে চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছেন। কথাবার্তা সব আমাকেই বলতে হচ্ছে। আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কাছে কি জিপগাড়িটার চাবি আছে, না আপনার স্বামী নিয়ে গেছেন?

করবী বলল, চাবি নিয়ে যাবে কেন? চাবি আমার কাছেই রেখে গেছে। চা

বিটা একবার দেখাবেন?

কেন বলুন তো?

হয়তো গাড়ির চাবিটা চুরি হয়ে গেছে—কাল কেউ চুরি করে জিপগাড়িটা নিয়ে গিয়েছিল কি না সেটা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার।

না, চুরি হয়নি।

করবী উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে এল। সেটা আমি নিয়ে দারোগাকে বললাম, এটা আপনার কাছে রাখুন।

করবীকে জিজ্ঞেস করলাম, তা হলে আপনি বলছেন গাড়িটা চুরি হয়নি?

না।

আপনি গাড়ি চালাতে জানেন?

না।

এবার আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ধীরেসুস্থে বললাম, একটা ব্যাপার খুব মন দিয়ে শুনুন। কাল রাত্তিরে এই জিপগাড়িটা ডাকবাংলোর কম্পাউণ্ডে ছিল—আমি নিজে দেখেছি। সেটা যদি যথেষ্ট প্রমাণ না হয়—আজ সকালেও এই জিপগাড়িটাকে ডাকবাংলোর কাছে যেতে গ্রামের অনেক লোক দেখেছে, তারা সবাই সাক্ষী দেবে। আপনার স্বামীর অফিসের আর কেউ গাড়ি চালাতে পারে না। তা হলে এই জিপটাকে বাংলো পর্যন্ত কে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? সেটা আপনার জানা উচিত, যেহেতু চাবি আপনার কাছে

করবী তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমাকে এইভাবে জেরা করার কী অধিকার আছে আপনার সেটা জানতে পারি কি?

দারোগাবাবু তখনও একেবারে চুপ। আমি পকেট থেকে নোটবইটা বার করলাম এইবার। কলমটা খুলে বললাম, অধিকারের প্রশ্ন পরে। দারোগাবাবু যতক্ষণ বাধা না দিচ্ছেন, ততক্ষণ আমি কতগুলো প্রশ্ন করে যাব। আপনি উত্তরগুলো ভেবেচিন্তে দেবেন। কারণ সেগুলো আমি লিখে রাখছি। এবং দারোগাবাবু তার সাক্ষী থাকছেন। এবার শুনুন। কাল রাত্রে আমি ডাকবাংলোয় যে-ঘরে ছিলাম, তার খাটের নীচে একটি ডেডবডি ছিল—সেটা কি আপনার স্বামী সুখেন রায়ের? আপনি জানলার বাইরে থেকে বলেছিলেন, আপনারই স্বামীর দেহ–

করবীর সিঁথিতে তখনও সিঁদুর জ্বলজ্বল করছে! আজ সকালেই স্নান করে নতুন করে সিঁদুর লাগিয়েছে। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে তীব্র গলায় বলল, আপনি এইসব উদ্ভট কথা হঠাৎ আমাকে বলতে এসেছেন কেন? আমি আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নই। আপনি অন্য কাকে দেখেছেন বা কোথায় কী দেখে এসেছেন-সে-সম্পর্কে আমি কিছু শুনতেও চাই না।

আমি বললাম, ডেডবডিটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেই ডেডবডিটা আপনি সরাতে গিয়েছিলেন, তাও দেখেছি। এই ঘটনা পুলিশের ওপর মহলে আমাকে জানাতেই হবে। আপনি আমার কথার উত্তর দিতে না চান—সেটা আলাদা কথা। পরে আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবেই।

দারোগাবাবু এতক্ষণ বাদে কথা বললেন। একটি বড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের সিগারেটটি নিভিয়ে ফেললেন চায়ের কাপে। তারপর বললেন, করবী আর কোনো লাভ নেই। দি গেম ইজ আপ! এই ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। তুমি সব কথা অস্বীকার করলে এঁকে পাগল ভাবতে হয়। সেটা উনি মেনে নেবেন কেন? তোমাদের ব্যাড লাক, ইনি মাঝখানে এসে পড়েছেন। আমাকেও তো চাকরি বাঁচাতে হবে। তাও বাঁচাতে পারব কি না জানি না।

করবীর মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। এক ফুয়ে যেন কেউ নিভিয়ে দিল একটা মোমবাতি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। সেটিকে খুব ঘৃণার দৃষ্টি বলা যায় না। দারুণ হতাশা, দারুণ দুঃখ মিশে আছে সেই দৃষ্টিতে। পুরো দু-তিন মিনিট তাকিয়ে রইল আমার চোখে চোখে। শেষপর্যন্ত আমিই চোখ সরিয়ে নিলাম।

খুব অস্ফুটভাবে করবী বলল, আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছে। বিশ্বাস করুন। আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছে।

করবীর প্রতি আমার কোনোরকম দয়া হল না। আমি বিদ্রুপের সুরে বললাম, প্রথমে জানা দরকার, যিনি মারা গেছেন, তিনি আপনার সত্যি সত্যি স্বামী কি না। স্বামী হোক বা যে-ই হোক, আত্মহত্যা করার পক্ষে খুব চমৎকার পরিবেশ বটে। আপনি যখন ডেডবডিটা সরাবার চেষ্টা করেছিলেন, তখন আপনার সঙ্গে অন্য লোক ছিল, তারা কে?

করবী সে-কথার উত্তর না দিয়ে আবার বলল, বিশ্বাস করুন, আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছে।

আমি দারোগার দিকে ফিরে বললাম, সুখেন রায়ের কী রিভলবার ছিল? সেটা আপনার জানার কথা।

দারোগাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না, ছিল না। আমি ডেডবডির গলায় বুলেটের ক্ষত দেখেছি। এবং ডেডবডির কাছে কোনো রিভলবার ছিল না। এটি আত্মহত্যা?

দারোগা বললেন, করবী, আর মিথ্যেকথা বলে এঁকে ভোলাতে পারবে না। বললাম-না, ব্যাড লাক, তোমরা শক্ত মানুষের পাল্লায় পড়েছ। ডেডবডিটা কোথায়?

করবী কোনো কথা না বলে নি:শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। করবীকে এখন কিছুতেই চোখের আড়াল করা যাবে না। এ-মেয়ে অতি সাংঘাতিক, কখন কী করে বসবে, ঠিক নেই। এমনকী আত্মরক্ষার তাগিদে আমি আমার রিভলবারটা পকেটে শক্ত করে ধরে রইলাম। দারোগাবাবুর মুখ-চোখে একটা উদাসীন ভাব। পারতপক্ষে আর আমার দিকে তাকাচ্ছেন না। করবী একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে যেতে লাগল। বসবার ঘরের পরেই বড়োঘর, তার পেছনে আর একটি ছোট্টঘর। সেই ঘরে খাটের ওপরে কফিনের আকারের একটি বড়ো কাঠের বাক্সের মধ্যে শোয়ানো রয়েছে ডেডবডিটা। চিনতে আমার দেরি হল না। একরাত আমি এর সঙ্গে একঘরে কাটিয়েছি। গলায় বুলেট বেঁধা সুখেন রায়ের মৃতদেহ। সেটা যে করবীর স্বামী সুখেন রায়েরই দেহ, অন্য কারুর নয়—সেটা দারোগাবাবুর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। বডিটি আস্তে আস্তে ডিকমপোজ করতে আরম্ভ করেছে। পাছে দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়, তাই ঘরের মেঝেতে অনেকখানি ডেটল ছড়ানো।

আমি স্তম্ভিতভাবে তাকালাম করবীর দিকে। কী বিস্ময়কর এই মেয়েটি! স্বামীর মৃতদেহ ঘরের মধ্যে শোয়ানো। আর মেয়েটি স্নান করে সিঁদুর পরে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে বসেছিল হাসিমুখে। আমি যদি সুর না বদলাতাম তা হলে এখনও হয়তো ওই গল্পই চলত।

করবীর মুখে কিন্তু কোনো ভাবান্তরই নেই, কিংবা তার তখনকার মুখের চেহারার বর্ণনা দিতে পারি, এমন ভাষাজ্ঞান নেই আমার। সে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মৃত স্বামীর মুখের দিকে। তার ঘরসংসার, ভবিষ্যৎ সবই শেষ হয়ে গেল।

একটু বাদে করবী আস্তে আস্তে বলল, ওকে কবর দেবার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। কিন্তু সময় পেলাম না। ওর নিজের দোষেই ও মরেছে। ওর যদি হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে যায়, তার জন্য আমি কী করতে পারি!

দারোগাবাবু বললেন, থাক, এখন ওসব কথা থাক। ডেডবডিও থানায় নিয়ে যেতে হবে। করবী, তুমিও তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে থানায় যেতে হবে।

আমি তৈরিই আছি।

সূরযলাল কোথায়?

আমি জানি না।

সূরযলাল পালিয়ে-টালিয়ে যায়নি তো?

আমি জানি না।

মাধবী হঠাৎ মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠল, দারোগাবাবু আগে থেকে সব জানত তার মানে? সেও কি ওদের সঙ্গে ছিল নাকি?

রঞ্জন বলল, আঃ! এমন বেটপকা কথা বল! সেটা বুঝতে পারছ না এখনও?

 কর্নেল সেন মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললেন, না, দারোগাবাবু ওদের সঙ্গে আসল ক্রাইমের সময় ছিলেন না বটে কিন্তু সবই জানতেন। ওরা সবাই দারোগাবাবুর পরিচিত। ডাকবাংলোর ঘরটায় আমি যখন ডেডবডিটাকে সঙ্গে নিয়ে, দরজা জানলা আটকে রয়েছি তখন ওরা কোনোক্রমেই সুবিধে করতে না পেরে, আমার আগেভাগে থানায় গিয়ে সব জানিয়েছিল—এবং দারোগাবাবুর পরামর্শ নিয়েছিল।

আমি যখন থানায় যাই, তখন দারোগাবাবু ইচ্ছে করে আমার সঙ্গে বেরোতে দেরি করেছেন। যাতে সেইসময় ওরা ডেডবডিটা সরিয়ে সব প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ পায়। সেইজন্যই গাড়ি খারাপ-টারাপ ইত্যাদি ছুতো বার করছিলেন।

আর একটা জিনিসও আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম। ওরা যে খালের জলে আমার সুটকেসটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল—সেটাও নেহাত বোকামি করে নয়। তারমধ্যেও একটা উদ্দেশ্য ছিল। তখন পরিপূর্ণ দিনের আলো, সেইসময় ওরা জিপে করে এসে ডাকবাংলো থেকে সুখেন রায়কে নিয়ে যাবে—এটা কারুর না কারুর চোখে পড়বেই। সুখেনের মৃতদেহটা ওরা জিপের পেছনে এমনভাবে হেলান দিয়ে শুইয়ে এনেছিল যে, কেউ যেন চট করে বুঝতে না পারে যে, সে মরে গেছে। ওই জিপটাও গ্রামের লোকের চেনা। সুতরাং কেউ-না-কেউ আমাদের বলে দিতে পারত সেই কথা। সুটকেসটা ফেলে আসাও আমাদের দেরি করানোর চেষ্টা। ওরা সময়ের সঙ্গে রেস দিচ্ছিল। যেমন করে থােক, আমাদের দেরি করিয়ে দিয়ে ডেডবডিটাকে পুঁতে ফেলতে পারলেই ওরা অনেকটা নিরাপদ হতে পারত। কোনো ডেডবডি পাওয়া না গেলে খুনের অভিযোগ টেকে না। ব্যাপারটা আমার এক রাত্তিরের দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসেও ভাগ্য ওদের প্রতি বিরূপ হয়েছে। রাত্তির বেলা অন্ধকারে ওইরকম গ্রামাঞ্চলে একটা ডেডবডি পুঁতে ফেলা খুব শক্ত নয়—কিন্তু দিনের আলোয় অনেক অসুবিধে। ওরা স্থানীয় মুসলমানদের কবরখানায় একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল—সেই সময়েই আবার একটি মুসলমান শিশুকে সেখানে গোর দেওয়া হচ্ছে। কবরখানায় অনেক লোকজন। এ-রকম আশঙ্কা ওদের মনে একবারও জাগেনি। কবরখানাটা নির্জন পড়ে থাকে সাধারণত। কিন্তু সেদিনই যে একটা বাচ্চাছেলে মারা যাবে আর ঠিক ওই সময়ই তাকে কবর দিতে আনা হবে—এ আর ওরা জানবে কী করে। এত চেষ্টা করেও ওরা শেষরক্ষা করতে পারল না। বাধ্য হয়ে ওদের ফিরে আসতে হয়। শেষপর্যন্ত ওরা নির্ভর করেছিল করবীর অভিনয় ক্ষমতার ওপরে। করবী যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমাদের ফেরত পাঠাতে পারে। স্নান করা সিঁদুর পরা একটি মেয়েকে দেখে কি কল্পনা করা সহজ যে, স্বামীর মৃতদেহ পাশের ঘরে শোয়ানো আছে?

মাধবী বলল, সত্যি বাবা, কল্পনাই করা যায় না। কোনো মেয়ে এ-রকম করতে পারে? আপনি কী করে সন্দেহ করলেন কে জানে!

কর্নেল সেন বললেন, আমি খেপে গিয়েছিলাম বলা যায়। ওরা সবাই মিলে এমন একটা ষড়যন্ত্র করেছিল, যেন আমি একটা পাগল। আগের দিন রাত্তিরে কিছুই ঘটেনি, ঘরের মধ্যে কোনো ডেডবডি ছিল না—সবই যেন আমি বানিয়ে বলছি। তাই আমি শেষ পর্যন্ত না দেখে ছাড়তে চাইনি!

রঞ্জন জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?

কর্নেল সেন বললেন, ডেডবডির কাছে একজন কনস্টেবলকে পাহারায় বসিয়ে দারোগাবাবু করবীকে বললেন, চলো।

করবী সহজভাবে বলল, যাচ্ছি, চলুন। আমি এক গেলাস জল খেয়ে আসি।

আমি কিন্তু করবীকে চোখের আড়াল হওয়ার সুযোগ দিতে চাই না। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় জল আছে? আমি এনে দিচ্ছি, আপনি এখানে দাঁড়ান।

করবী অবাক হয়ে বলল, কেন, আপনি এনে দেবেন কেন?

আমি বললাম, বাড়িতে আর কেউ নেই? আপনার স্বামী চলে গেলে আপনি একা থাকেন?

করবীর বদলে দারোগাবাবু বললেন, একজন ঠিকে ঝি এসে কাজ-টাজ করে দিয়ে যায়, তাই-না? সে বোধ হয় এখন নেই।

করবী বলল, এঘরেই জল আছে। আমি নিজে গড়িয়ে নিচ্ছি।

কলসি থেকে করবী জল গড়ালো আমাদের দিকে পেছন ফিরে। আমি দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বললাম, দাঁড়ান জলটা আগে খাবেন না। আমি আগে দেখব—

করবী পুরো এক মিনিট তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর হেসে উঠল শব্দ করে। হাসতে হাসতে বলল, ও, আপনি ভাবছেন আমি আত্মহত্যা করব? হা-হা-হা–। আপনি কিছু বোঝেন না। আমি মরতে চাই না—আত্মহত্যা করতে চাইলে অনেকদিন আগেই করতাম। ঠিক আছে, আমি জল খাব না—এই নিন দেখুন

করবী জলসুন্ধু গেলাসটা ছুড়ে মারল আমার মুখের দিকে। আমি তাড়াতাড়ি মাথা সরিয়ে নিয়েছিলাম বলে গেলাসটা আমার চোখে লাগেনি, কিন্তু ঘাড়ে লাগল। করবী আমার চোখেই মারতে চেয়েছিল—আমার চোখই তো ওদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী। বড়ো কাঁসার গেলাস, আমার ঘাড়ের কাছে একটু কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল, জলে জামাকাপড় ভিজে গেল।

আমি করবীর চোখে-মুখে হিস্টিরিয়ার চিহ্ন দেখতে পেলাম। দারোগাবাবু তাড়াতাড়ি এসে করবীর হাত চেপে ধরে ধমক দিয়ে বললেন, এই করবী, কী হচ্ছে কী? এখন আর এসব করে কী লাভ হবে! তোমাদের ভরাডুবি হয়েছে। এখন চলো—সূরলাল কোথায়?

করবী খরচোখে তাকিয়ে বলল, সূরযলাল কে, আমি তা জানি না। আপনি কার কথা বলছেন?

দারোগাবাবু একটা ক্লান্ত নিশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন সূরলালকে—ধরা যাক। এমনিতে বড়ো ভালো ছেলে সূরযলাল—এরা ঝোঁকের মাথায় একটা কান্ড করে ফেলেছে—শাস্তি পেতেই হবে—মার্ডার ইজ মার্ডার–

করবী দৃঢ় গলায় বলল, আমার স্বামী আত্মহত্যা করেছে। কেউ তাকে খুন করেনি! এর সঙ্গে সূরযলালের কোনো সম্পর্ক নেই।

ঠিক আছে, এখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি তোমাদের জন্য ভালো উকিল ঠিক করে দেবখন!

করবী কিন্তু কিছুতেই আমাদের সঙ্গে সূরযলালের বাড়িতে যেতে রাজি হল না। একেবারে বেঁকে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, তাকে মেরে ফেললেও সে সূরলালের বাড়িতে যাবে না। অথচ করবীকে একা রেখে যাওয়া কোনোমতেই উচিত নয়। দারোগাবাবু আমাকে বললেন, —তাহলে স্যার, আপনিই একটু থাকুন এখানে, ওকে চোখে চোখে রাখুন!

আমি ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বললাম, আমি আর একা ওর সামনে থাকতে সাহস পাচ্ছি না।

করবী বিচিত্র গলায় হেসে বলল, ভয় নেই, আমি পালাবও না, আত্মহত্যাও করব না। আমি এখানেই থাকব।

দারোগাবাবু এবার আর কোনো খুঁকি নিলেন না—সেপাইকে ডেকে করবীর হাতে দড়ি বাঁধলেন, তারপর সেই অবস্থায় বসিয়ে রাখলেন জিপগাড়িতে। সেপাইটি সেখানে পাহারায় রইল।

সূরযলালকে ধরার জন্য খুব একটা হাঙ্গামা করতে হল না। কাছেই সূরলালের বাড়ি। স্থানীয় অবস্থাপন্ন কাঠের ব্যবসায়ীর ছেলে সে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েস, দোহারা সুন্দর চেহারা। মুখে বেশ একটা সরল সরল ভাব আছে। ঠিক ক্রিমিনাল টাইপ সে নয়, গ্রাম্য বড়োলোকের ছেলে, বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে বখে গেলে যা হয় আর কী!

সূরযলাল যেন আমাদের প্রতীক্ষাতেই ছিল। দাঁড়িয়েছিল দোতলার বারান্দায়। দারোগাবাবু গিয়ে ডাকতেই সে বেরিয়ে এল। পাজামা আর সিল্কের পাঞ্জাবি পরা। ফ্যাকাশেভাবে হেসে বলল, খেল খতম হো গিয়া?

আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন, স্যার। যা হবার সে হোবেই কেউ রুখতে পারবে না। ঠিক কি না?

দারোগাবাবু জিজ্ঞেস করলেন হরিনাথ ফিরেছে? না এখনও পালিয়ে আছে?

সূরযলাল হাতজোড় করে বলল, আমি ওর কথা কিছু জানি না। বিশওয়াস করুন। হরিনাথের কথা জানি না।

ঠিক আছে! সে দেখা যাবে পরে। বুদ্বুরাম কোথায় গেল?

সূরযলালের বাড়ির সামনেই একটা ইউক্যালিপটাস গাছের তলায় মাটিতে একটা লোক বসেছিল। ময়লা, হেঁড়াখোঁড়া খাকি প্যান্ট শার্ট পরা। দারোগাবাবু তাতে ডাকতেই সে হাউমাউ করে কেঁদে এসে বলল, সাহেব, আমি কিছু জানি না। আমি শুধু গাড়ি চালিয়েছিলাম। আমাকে ছেড়ে দিন, ঘরে আমার বালবাচ্ছা আছে!

দারোগাবাবু এক ধমক দিয়ে বললেন, চল ব্যাটা, বাড়ি থেকে জিপটা নিয়ে চল থানায়।

সূরযলালের বাড়ির লোকজন ততক্ষণে নেমে এসে ভিড় করেছে। একটি যুবতী মেয়ে কেঁদে কেঁদে বার বার দারোগাবাবুর হাত জড়িয়ে ধরতে লাগল। সম্ভবত সে সূরযলালের স্ত্রী। মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। এক হিসেবে তাকে করবীর চেয়েও সুন্দরী বলা যায় কিন্তু করবীর মতন মানুষ পাগল করার ক্ষমতা বোধ হয় তার নেই। নইলে তাকে ছেড়ে তার স্বামী করবীর কাছে যাবে কেন? মেয়েটি কেঁদে ধুলোয় গড়াগড়ি দিতে লাগল, কিছুতেই তাকে থামানো যায় না। সূরযলালের মা খুব বুড়ি, তিনি এসে অভিশাপ দিতে লাগলেন আমাদের সবাইকে। সূরযলাল বলল, আর দেরি করছেন কেন দারোগাবাবু, চলেন, চলেন! ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।

তোমরা কখনো কেউ এ-রকম পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই পড়োনি। খুবই অস্বস্তিকর অবস্থা। এতক্ষণ বাদে আমার নিজেকে একটু অপরাধী লাগতে লাগল। এরা সবাই ভাবছে, আমিই ওদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। আমিই এতগুলো সংসার ভেঙে দিচ্ছি। কিন্তু খুনের ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত, তাদের তো শাস্তি পেতেই হবে!

আমি সবাইকে আমার গাড়িতে চাপিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে তুললাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *