তিন
একটু বেলা হয়েছে। কুয়াশা কেটে চড়চড়ে রোদ ফুটেছে।
ট্রেণ এসে ‘মথুরাপুর-রোড’ ষ্টেশনে থামতে বজ্র আর বুলেট লাফিয়ে নীচু প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়লো।
গ্রাম থেকে দূরে ফাঁকা মাঠের উপর স্টেশন–আশে-পাশে দু-তিনটে চালদোকান। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বুলেট আর বজ্র একটা দোকান থেকে কিছু মুড়ি-মুড়কী আর নতুন গুড়ের মোয়া সংগ্রহ করে খেয়ে নিলে।
দারুণ ক্ষুধা পেয়েছিল!
ষ্টেশনের পরেই ফাঁকা মাঠ, এপার-ওপার দেখা যায় না—সীমা-হারা যেন! তার বুক চিরে জেলাবোর্ডের তৈরী চওড়া বেলে মাটির পথ–একেবারে সোজা পূবদিকে গেছে–পথ তেমন আঁকাআঁকা নয়, গ্রাণ্ডট্রাঙ্ক রোডের মত।
সেই পথ ধরে চলেছে দুজনে।
খানিক এসে হাট মাথায় দিয়ে বজ্র বললে–কী ভীষণ পথ। এর শেষ নেই! মাঝে মাঝে দু-একটা শুধু নারকেল গাছ।
বুলেট বললে–অন্য গাছের দরকার নেই আমাদের, পথের কষ্ট লাঘব করতে এ-পথে ঐ গাছ মস্ত সম্বল।
বজ্র বললে–ক-মাইল হাঁটতে হবে আমাদের।
বুলেট বললে–পথ যদি ভুল না হয়, তাহলে প্রায় কুড়ি মাইল। যদি মাঝারি জোরে চলি, তাহলে সন্ধ্যা-নাগাত রায়দীঘির ঘাটে পৌঁছুবো।
বজ্র বললে–তবে এসো বন্ধু, মার্চ্চ অন্।
দুজনের গতি বাড়লো। বুলেট নিজে থেকে বললে–রায়দীঘিতে অন্ধকার নামলে তেমন অসুবিধা হবে না, তার কারণ, ওখানে মণি নদীতে নৌকোয় চড়বো–সারারাত নৌকোয় কেটে যাবে। নদীতে যদি ঝড়-তুফান না হয়, তাহলে সকাল হতেই পৌঁছে যাবে।
দুজনে চলেছে সীমাহারা তেপান্তরের মাঠের উপর দিয়ে। ক্রোশের পর ক্রোশ-ঘণ্টার পর ঘণ্টা গতি তাদের বেশ দ্রুত।
.
শীতের দিন। তার উপর দুজনেই এসব ব্যাপারে অভ্যস্ত, তাই কষ্ট হচ্ছিল না।
পর-পর তিন চারটে ফাঁকা মাঠ পার হয়ে জেলা-বোর্ডের পথ এসে লোকালবোর্ডের পথের সঙ্গে মিশে সরু হয়ে গেছে। এখানে একটা বাঁক আছে। জায়গাটা তেমন ফাঁকা নয়–ঝোঁপ-ঝাড়, জঙ্গল, খুব দূরদূর অন্তর দু-একখানা গ্রামও আছে।
সন্ধ্যা হয়-হয়, বুলেট আর বস্ত্র একটা পল্লীতে এসে পৌঁছুলো। পাঠশালার ছেলে-মেয়েরা সবে ছুটি পেয়ে বগলে পাততাড়ী, হাতে দড়িতে ঝোলানো সের-কালি-ভরা মাটির দোয়াত–হল্লা করে ঘরে ফিরছে। দূরের একটা মন্দির থেকে কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ আর গৃহস্থবাড়ী থেকে শাঁখের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
গরুর পাল নিয়ে একজন রাখাল মাঠের আল দিয়ে চলেছে। তাকে বুলেট জিজ্ঞাসা করলে–বায়দীঘি এখান থেকে কতদূর গো?
সাহেবী-পোষাক পরা দুজন লোক দেখে কিছুক্ষণ বিহ্বল থেকে রাখাল বললে–এজ্ঞে, এই তো, আয়-আয়দীঘি!
বজ্র বললে–এটা ‘আয়দীঘি’। আর ‘রায়দীঘি’ কোথায়? কতদূর?
তাদের বয়স কম দেখে রাখালটার একটু সাহস হলো। হেসে সে বললে–বাবুর যে-গেরামের কথা বলছি, এটা সেই।
বুলেট বুঝলল, রাখালটা ‘র’কে ‘অ’ উচ্চারণ করে। তাই রায় দীঘিকে বলেছে ‘আয়দীঘি’। সে-কথা বজ্রকে বুলেট বুঝিয়ে দিয়ে রাখালকে আবার জিজ্ঞাসা করলে–-আচ্ছা, এটা তো রায়দীঘি, নদী এখান থেকে কমাইল?
রাখাল বললে–মাইল! হুঁ! তা বিশ-পঁচিশ হবে।
–বিশ-পঁচিশ! দারুণ বিস্মিত হয়ে বুলেটকে বজ্র বলে–ও বুলেট, আমরা তাহলে ভুল-পথে এসেছি নাকি!
বুলেট বললে–না, না, তা হতেই পারে না। এই দেখ ম্যাপ, এতে রয়েছে রায়দীঘির পাশেই মণি নদী। এ ভুল বলছে।
বজ্র বললে–তা কি সম্ভব? এরা এখানকার লোক?
তাড়াতাড়ি পথের ধারের একটা বড় গাব-গাছে উঠে পূবদিকে তাকিয়ে বুলেট মহোল্লাসে বলে উঠলো–নদী দেখতে পেয়েছি বজ্র, এখান থেকে বড়জোর দশ মিনিটের পথ!
আশ্বস্ত হয়ে বজ্র বললে–আমি ভারী মুষড়ে পড়েছিলুম রাখালের কথা শুনে।
গাছ থেকে নেমে বুলেট বললে–ওর দোষ নেই, মাইল কাকে বলে, ও জানে না। চ, আর দেরী নয়। সোজা পূবদিকে যেতে হবে।
***
কিছুক্ষণ হলো সন্ধ্যা হয়েছে, আকাশের গায়ে একফালি চাঁদ। সেজন্য মণি নদীর ফাঁকা তীর অন্ধকার নয় তেমন।
বুলেট আর বজ্র পার-ঘাটার কাছে আসতেই বজ্র দেখলো, সুন্দর একটা নৌকো। নৌকোটা পার-ঘাটার কিছু দূরে তীর-ঘেঁষে নোঙ্গর করে আছে? খুশী হয়ে সে বলে উঠলো–গুড লাক! বরাত ভালো! ঘাটে একটা নৌকো বাঁধা!
বুলেটও দেখলে! চমৎকার নৌকো। পালোনা সাদা ধপ ধপ করছে–ছই বেশ ঝকঝকে–যেন পানসী। নৌকোর গলুয়ের উপর বসে দু-তিনজন মাঝি তীরের দিকে চেয়ে আছে, বোধহয় যাত্রীর অপেক্ষা করছে, মাঝে-মাঝে শকাতে তামাক টানছে।
বজ্র বললে–নৌকোর মাঝিরা বোধহয় যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে। এটা ভাড়া করি।
বুলেট বললে–হুঁ। কিন্তু একটা কথা–কোথায় যাচ্ছি, মাঝিদের কাছে সে জায়গার নাম করা নয়। আমাদের যেতে হবে রাজগোতা গায়ে, কিন্তু জগবন্ধুর চকে, যাবো বলে নৌকো ভাড়া করবে।
বজ্র বললে–ঠিক কথা, আমাদের দেখেই এ-অঞ্চলের লোকজনের কৌতূহল হবে ভয়ানক।
মাঝিদের ডাকতে হলো না। বুলেট আর বজ্রকে দেখতে পেয়ে তাদের একজন গলুয়ের উপর থেকে বলে উঠলো––বাবুমশাইরা কি লৌকোয় যাবেন?
বুলেট বললে–হুঁ। আমরা যাবো জগবন্ধুর চকে, সেখানে নিয়ে যাবে?
মাঝি উত্তর দিলে–কেন যাবুনি বাবু? আমরা ভাড়ার পিত্তেশে বসে আছি। এই আমাদের কাজ। যেথা যাতি আজ্ঞা করবেন হুজুর, সেথায়ই যাবে।
বুলেট বললে–কত ভাড়া নেবে?
মাঝি উত্তর দিলে–আজ্ঞে, আপনারা মুটে দুজন, না, আর লোকজন আছে?
বুলেট বললে–না। আমরা দুজনই।
হিসাব করে মাঝি বললে–আজ্ঞে, আপনারা যখন দুজন আছে, তখন ভাড়া দুটাকা দুটাকা-–চার টাকা, আর বখসিস যা দেন, আপনাদের ইচ্ছা। আমরা অন্য লোক তুলবো না।
বুলেট জেনেছিল, রায়দীঘি থেকে জগবন্ধুর চক যেতে পুরো একখানা নৌকো ভাড়া নেয় কম করেও সাত-আট টাকা! পথ কম নয়– পনেরো-ষোল মাইল। কিন্তু এরা নিজে থেকেই চাইছে মোটে চার টাকা! ভালোই।
মাঝিদের সঙ্গে দর-দস্তুর না করে দুজনে নৌকোয় উঠে পড়লো। একটু পরে মাঝিদের একজনকে বুলেট জিজ্ঞাসা করে–জগবন্ধুর চকে যেতে কত সময় লাগবে?
মাঝি উত্তর দিলে–এজ্ঞে, রেতের আঁধার থাকতি-থাকতি-এই বুঝরোবেলায় সেখানে হাজির হব–পথে রোদ্দুর উঠতে দিচ্ছিনে হুজুর।
তামাক খাওয়া শেষ করে পাল খাটাতে-খাটাতে মাঝিদের একজন বজ্রকে জিজ্ঞাসা করলে–বাবুদের জমিদারী এইদিকে বুঝি?
বুলেট উত্তর দিলে–না। আমরা এদিকে বেড়াতে বেরিয়েছি সুন্দরবন দেখতে।
শীতের রাত হু-হুঁ করে উত্তরে হাওয়া বইছে। কিন্তু নদীতে জোর ঢেউ ছিল না–ভাঁটার টান পড়েছে। মাঝিরা ‘বদর’-‘বদর’ বলে নৌকো ছেড়ে দিলে।
***
চাঁদ উঠলেও জ্যোৎস্না ছিল না। অন্ধকারে পৃথিবী আচ্ছন্ন। চারিদিক নির্জন, নিস্তব্ধ। দুটো-একটা পাখীর ডাক বা অন্য নৌকোর মাঝিদের মেঠো সুরের গান ভেসে আসছে মাঝে-মাঝে। নদীর দু-তীরে জঙ্গলগুলো দেখাচ্ছে পাহাড়ের সারির মত। মাঝিদের একজনকে বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–নদীর ধারে যে-সব জঙ্গল দেখছি, ঐ কি সুন্দরবন?
মাঝিদের প্রায় সকলেই দাঁড় টানছিল–একজন শুধু বসেবসে, তামাক খাচ্ছিল। সে বললে–এজ্ঞে, আপুনি যে-জঙ্গল দেখতিছেন, তা সুন্দরবন নয়। সুন্দরবন সুরু হয়েছে আর-কিছু দহিন থেকে। মাঝ-রাত্তির লাগাত আমরা সুন্দরবনের মাঝে গিয়ে পড়বে। আগে এ-তল্লাটটা বেবাক সুন্দরবন ছিল, এখন এদিকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। কোম্পানী আর জমিদার-বাবুরা জঙ্গল হাসিল করে দিয়েছে, তবে বাঘ দুটো-একটা আছে–হাজার হোক, এটা তাদের রাজত্ব তো।
মাঝিটার শেষ-কথায় হেসে বুলেট বললে–এটা বাঘেদের রাজত্ব? তোমরা তাহলে বাঘের প্রজা?
মাঝি উত্তর দিলে–প্রজা বইকি হুজুর! বছরে একবার বাঘেদের রাজা দক্ষিণ-য়কে লজরানা আর পুজো দিয়ে থাকি। তাকে এ-অঞ্চলের হিন্দু-মুছলমান সবাই মানে, মান্য করে।
রাতের সঙ্গে-সঙ্গে হাওয়ার জোর বাড়তে লাগলো। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া! বুলেট আর বজ্র নৌকোর ছইয়ের মধ্যে ঢুকে দরজ…জানালাগুলো সব ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে পাটাতনের উপর বিছানা করে শুয়ে পড়লো।
সারাদিন পরিশ্রম হয়েছে বেশ, খাওয়া-দাওয়া ভালো হয়নি–বিছানায় শুতে-না-শুতেই বজ্র ঘুমিয়ে পড়লো। বুলেটের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল, কিন্তু নৌকোর খোলের ভিতর থেকে পর পর কবার কেমন যেন শব্দ…অদ্ভুত রকমের…যেন গোয়ানির মত…না, চাপা কান্না যেন!…গা ছমছম করে উঠলো। কান পেতে শুনলে। শব্দটা একটানা নয়…দু-পাঁচ সেকেণ্ড থামছে, তারপর আবার। ঘুম ছুটে গেল একেবারে! মনে খটকা। কি যেন নড়া-চড়া করছে…ছটফটানির মাছ? হাঙরের ছানা? না, মানুষ? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! নৌকোর খোলে মানুষ, না কি–টর্চ আর ছোরাখানা নিয়ে নৌকোর পাটাতনের একখানা কাঠ সরিয়ে ফেলে আস্তে-আস্তে নৌকোর তলায় টর্চ্চের আলো ফেলতেই বুলেট দেখে, সেখানে একটা লোক শুয়ে আছে। তার হাত-পা-মুখ কাপড় দিয়ে কষে বাঁধা! ছোরাখানা শক্ত করে ধরে লোকটার খুব কাছে গিয়ে বুলেট তাকে ভালো করে দেখলে। দেখেই বুঝতে পারলো, তাদেরি বয়সী ছেলে! ছেলেটা জেগে আছে। দুচোখে জলের ধারা ঝর-ঝর-ধারে ঝরছে! বুলেট প্রথমে তার মুখ-বাঁধা কাপড়খানা ছোরা দিয়ে কেটে তাকে জিজ্ঞাসা করলে–কি ব্যাপার, বলো তো?
ছেলেটা চাপাগলায় উত্তর দিলে–এরা মাঝি নয়, ডাকাত, বোম্বটে! ভাড়া যাবে বলে নৌকোয় যাত্রী তুলে লোকালয় থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে যথা-সর্ব্বস্ব কেড়ে নেয়–তারপর খুন করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। আমি বুঝতে না পেরে সন্ধ্যার কিছু আগে এদের নৌকোয় চড়েছি। আমার সঙ্গে থলিতে ধান-বিক্রীর টাকা ছিল কিছু, ওরা কি করে জানতে পেরে আমাকে আমাদের গ্রামে পৌঁছে দেবে বলে নৌকোয় তুলে তারপর এই দশা করেছে। তোমরা যখন রায়দীঘির ঘাটে এ-নৌকোয় ওঠো, আমি জানতে পেরেছিলুম, আমার কাণ খোলা ছিল। তোমরা দুজন আছে, আর কাছেই দু-একটা গ্রাম, তাই ওরা এখনও কিছু করেনি। মাঝরাত্রি-নাগাত বড় গাঙে নিয়ে গিয়ে আমাদের সকলের এক দশা করবে! কথাটা শেষ করে ছেলেটা মস্ত নিশ্বাস ফেলে!
ধারাল ছোরা দিয়ে সব বাঁধন কেটে দেবার পর ছেলেটা তার পরিচয় দিলে তার নাম ভীম, এই দিকেই তার বাড়ী, জাতে চাষা কৈবর্ত, গ্রামের মাইনর স্কুলে ছাত্রবৃত্তি পর্যন্ত্য সে পড়েছে, বাড়ীর অবস্থা ভালো, প্রায় তিনশ’ বিঘে খাশ জমি। তাছাড়া মধু আর চালের ব্যবসা। সে আজ জয়নগর হাটে ধান বিক্রী করে ফিরছিল, তারপর এই ঘটনা।
ভীমের মুখে সব কথা শুনে বুলেট কিছুক্ষণ কি ভাবলো! ভেবে বললে–বোম্বটেরা দলে সাত-আটজন, অস্ত্র-শস্ত্রও ওদের আছে নিশ্চয়। ওদের সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না তো! তাই আমি ভাবছি, আস্তে-আস্তে কোন সাড়া-শব্দ না করে অন্ধকারে গা-ঢেকে নৌকোর জানলা দিয়ে টুপটুপ করে নদীতে নেমে পড়ে পালাতে হবে। আমরা দুজনে খুব ভালো সাঁতার জানি। তুমিও জানো নিশ্চয়।
ভীম বললে–এ-নদীতে সাঁতার জানলেও যা, না জানলেও তাই। এতে যেমন ঢেউ, তেমনি বেলে মাছ।
বুলেট বললে–ঢেউ তো কি হয়েছে?, সমুদ্রে সাঁতার কেটেছি, পদ্মাও পার হয়েছি সাঁতরে!
ভীম বললে–বেলে মাছ?
–বেলে মাছ! তা বেলে-মাছ আমাদের কি করবে? বিস্মিত হয়ে বুলেট করলে প্রশ্ন।
ভীম বললে–জলে যাবার সময় ওদের নাম করতে নেই তাই আমরা বলি বেলে মাছ। আসলে ওরা ইংরাজীতে যাদের বলে, ‘ক্রোকোডাইল’।
বুলেটের মুখে হাসি ফুটলো। সে বললে–ও, তাই বলো, কুমীর!
ভীম বললে– ভীষণ বড়-বড়, আর নদী-ভরা। নদীতে লোক পড়লেই রসকরার মত টুক করে গিলে ফেলবে। গাঙ্গও এখানে খুব চও ডা। আর এরা চলেছে গাঙ্গের মাঝ দিয়ে।
বুলেট বললে–একটু আগে মাঝিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল–এদিকে কোথায় পাথর-ভাঙ্গা হাট বলে একটা হাট আছে নাকি। সেখানে কিজন্য সকলে নামবে। আমি ভাবছি, যখন ঐ ঘাটে নৌকো ভিড়বে, আমরা সেই সময় নৌকোর পিছন দিক দিয়ে অন্ধকারে নেমে পড়বে।
ভীম বললে–পাথর-ভাঙ্গার হাট বলে একটা মেছে-হাট এদিকে আছে বটে। সেখানে শেষ-রাত্রে মাছ কেনা-বেচা হয়। আমরা যদি ও-সময় সেখানে পৌঁছে যাই, তাহলে চীৎকার করে হাটের লোকদের ডাকবো-আর যদি হাট বসবার আগে গিয়ে পড়ি, তাহলেও ঘাটে অনেক জেলে-নৌকো সব-সময় বাঁধা থাকে, আমরা তার একটা নিয়ে অন্ধকারে সরে পড়বো। তোমরা তৈরী থেকে–আর তোমার ছোরাখানা আমাকে দাও। জেলে-ডিঙ্গির দড়ি কাটতে হবে।
ভীমের হাতে ছোরাখানা দিয়ে বুলেট বললে–এই কথাই রইলো, আমি এখন উপরে যাই। তুমি যেন ঘুমিয়ে পড়ো না।
ভীম বললে–এ-অবস্থায় মানুষের ঘুম হয় কখনো?
***
মাঝের রাত–চাঁদ অনেকক্ষণ ডুবে গেছে। নদীতে জোয়ার, জোয়ারের জল নদীর দু-পাড়ে আছড়ে-আছড়ে পড়ছে ছলাৎছলাৎ করে। মাঝিরা নদীর মাঝপথ ছেড়ে তীরের দিক লক্ষ্য করে দাঁড় টানতে লাগলো।
বজ্র আর ভীমকে চাপা-গলায় বুলেট বললে–রেডি।
বজ্র ইতিমধ্যে সব-কথা শুনেছে। সেও হয়েছে রেডি।
নীচে থেকে ভীম শব্দ করে জানালো, সে প্রস্তুত।
মাঝ-রাত। হাট এখনও বসেনি। ঘাটে অনেকগুলো জেলে ডিঙি বাঁধা। ছোরা নিয়ে ভীম প্রস্তুত। নৌকোটা তীরে ভিড়লেই অন্ধকারে আস্তে-আস্তে নদীতে নেমে সাঁৎরে গিয়ে প্রথমে যে জেলে-ডিঙি পাবে, সেইটে সে নিয়ে আসবে।
এদের নৌকো ডাঙায় ভিড়লে হয়!
ছইয়ের বাইরে গলুইয়ের উপর ওদের দু-একজন ঘুমিয়ে পড়েছিল–বাকিটা তাদের ডেকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে। একজন নৌকোর দরজা খুলে বুলেট আর বজ্রকে উদ্দেশ করে ডাকলোবাবুরা ঘুমোল না কি গো?
বজ্র কি উত্তর দিতে যাচ্ছিল, বুলেট খপ করে তার মুখে হাত চাপা দিয়ে থামালো, নিজেও চুপ করে রইলো।
আর একবার বোম্বেটেটা ডাকলো–বাবু।
বুলেটের নাম ডাকতে লাগলো—ঘড়-ঘড়-ঘড়–
ওদের একজন হেসে বললে–বড্ড ঘুমোছে। বড় গাঙ্গে নিয়ে গিয়ে একেবারে শেষ-ঘুম পেড়িয়ে দেবো। অন্য মাঝিটা সঙ্গীর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো।
একটু পরে নদীর কিনারায় গিয়ে নৌকোটা ঘ্যাঁস করে লাগলো। নৌকো থামতেই একজন ছাড়া ওদের সবাই গেল নেমে। যে-রইলো…তার ঘুম কিছুতে ভাঙ্গলো না। তার বয়সও ঢের–তাই শীতে সে কোথাও না গিয়ে বুকের কাছে আগুনের মালসা নিয়ে গলুইয়ের ওপর ঘুমোতে লাগলো।
নৌকোর খোলের দিকে মুখ করে বুলেট ডাকলো–ভীম।
ভীম তৈরী ছিল। উত্তর দিলে–হুঁ।
ভীম আস্তে-আস্তে নৌকো থেকে বেরিয়ে নদীতে নেমে নিঃশব্দে সাঁৎরাতে লাগলো। বজ্র আর বুলেট নিজেদের জিনিষপত্র আর ভীমের টাকার থলি নিয়ে তৈরী হয়ে রইলো।
ভীম বেশ চালাক আর চটপটে। অন্ধকার দারুণ হলেও তার ভুল হয়নি।
একটু পরে একটা ছোট্ট জেলে-ডিঙি নিঃশব্দে টেনে এনে ভীম সেটা নৌকোর পিছনে রাখতেই সঙ্গে-সঙ্গে বুলেট আর বজ্র টপ-টপ ডিঙিতে জিনিষপত্র সমেত লাফিয়ে পড়লো। শেষবারে ডিঙিটা দুলে উঠতে ভীম তাল ঠিক রাখতে না পেরে জলে পড়ে গেল-অমনি শব্দ হলো, ঝপ।
সর্ব্বনাশ! নৌকোর গলুইয়ের উপর যে বুড়ো ঘুমোচ্ছিল, জেগে মশাল জ্বেলে ভালো করে সবদিক দেখতেই বুলেটদের উপর নজর পড়লো। বুড়ো হলেও তার দৃষ্টি আর বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ। সে বুঝলো, শিকার পালাচ্ছে! চীৎকার করে সে সঙ্গীদের ডাকতে লাগলো–কে আছিস, ওরে শীঘ্রি আয়, শীঘ্রি আয়, শিকার ভাগে।
ওদের দুজন মাত্র ছিল নদীর তীরে। বাকিরা দুরে কোথায় গেছে। বুড়োর ডাকে তারা লাফ মেরে নৌকোয় উঠে বলে–কোন দিকে? কোন দিকে রে? দাড়ের ঘা মেরে মাথাগুলো ফেটে দাও, সর্দ্দার।
বুড়োটা সর্দ্দার। সে বললে–ওরা নৌকোর মধ্যি নেই। ওই ডিঙি দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর চালাচ্ছে। রমজান, হাতেম–তোমরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ধরো।
সর্দ্দার বলবামাত্র রমজান আর হাতেম একসঙ্গে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুলেটদের ডিঙি লক্ষ্য করে সাঁৎরাতে লাগলো।
মুহূৰ্ত্ত মধ্যে ভীমকে টেনে বুলেট ডিঙিতে তুললো। তাড়াতাড়িতে ভীম যে জেলে-ডিঙিটা জোগাড় করেছে, সেটাতে হাল-দাঁড় কিছু ছিল না, ছিল একটা লগি।
ডিঙিটা লগি দিয়ে বুলেট বাইতে লাগলো প্রাণপণে।
.
রমজান আর হাতেমকে নদীতে নামতে দেখে ভীম বুলেটকে বললে–ওরা আসছে।
বুলেট নির্ভীকভাবে বললে–তাতে ভয়ের কিছু নেই। ওরা দুজন, কাছে এলে ঘুষিতে অমন চার-পাঁচটাকে জখম করে দেব। কিন্তু ওদের দল আসবার আগে আমাদের সরে পড়তে হবে। ভয় পেয়ো না। আর বজ্র, তুমি পিছনদিকে নজর রাখো।
হাল নেই, দাঁড় নেই, একখানা লগি মাত্র সম্বল। নদীতে জোয়ার, সুন্দরবনের নদী, সাগর বেশী দূরে নয়, জোয়ারের সময় নদীর জল ফুলে ফুলে উছলে উছলে ওঠে, এপার থেকে ওপারে ঢেউ চলতে থাকে, ঢেউ বেশ বড়-বড় ভীষণ-আকারের।
ভাঙার কাছে জেলেদের ঘূর্ণি-আটলের ভিড় আর মায়াজালের সার ঠেলে ভেঙে ছিঁড়ে নদীর ওপারে বা দূরে কোথাও তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছুনো অসম্ভব। বুলেট প্রাণপণে চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে পদে-পদে।
হঠাৎ আর্তস্বরে ভীম বলে উঠলো–একজন এসে পড়েছে… খুব কাছে।
পিছন ফিরে বুলেট দেখলো–তাদের ডিঙির চার-পাঁচ হাতের মধ্যে একজন সাঁৎরাচ্ছে। ব্যস্ত হয়ে বজ্র ভীমকে বললে–ছোরাখানা কোথায়?
নিতান্ত অপরাধীর মত ভীম জবাব দিলে–হ্যায়, হায়, আমি সর্ব্বনাশ করেছি। যখন নদীতে পড়ে যাই, হাত থেকে সেটা তখন ছিটকে জলে পড়ে গেছে।
বুলেট তার বলিষ্ঠ হাত দুটো দেখিয়ে ভীমকে বললে–ভয় নেই, আমি খালি-হাতেই ও দুটোকে ঘায়েল করতে পারি। বজ্র, ডিঙি চালাও, আমি ওদের দেখি!
বজ্ৰ ডিঙি চালাতে লাগলো, বুলেট প্রস্তুত।
ওরা দুজন জলে নেমেছে। সর্দ্দার নৌকোর উপর থেকে হুকুম করছে–পাকড়াও, রমজান, পাকড়াও–হাতেম, তুমি ডিঙির উপরে উঠে পড়ো।
রমজান বুলেটদের ডিঙিতে উঠে কোমরের কাপড় থেকে ছোরা বার করতেই বুলেট রমজাননের নাকের উপর সজোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলে। প্রচণ্ড ঘুষি! তাগ অব্যর্থ! বাপ বলে রমজান নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তার নাক ফেটে গেছে। রমজান নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়বার সময় ভালো করে সব দিকে তাকাবার অবসর তার ছিল না, সে তাই পড়লো তারই সঙ্গী হাতেমের ঠিক ঘাড়ের উপর। হাতেম যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো। রমজান স্বপ্নে ভাবতে পারেনি, একটা অল্প বয়সের ছেলের গায়ে এত জোর…বুকে এত সাহস থাকতে পারে! ছোরা দেখে ভয়ে নেতিয়ে না পড়ে ঠিক নাক তেগে ঘুষি মারার সাহস–অসম্ভব ব্যাপার।
রমজান আর তার সঙ্গী হাতেমকে একটু সরে যেতে দেখে বস্ত্র বললে–এদিকে আর এক বিপদ, এখানে নদীর জল গভীর:লগিতে থই পাওয়া যাচ্ছে না। উপায়?
ভীম বললে–সর্ব্বনাশ।
বুলেট কিন্তু দমলো না। তার মস্ত গুণ, কিছুতে সে দমে না। বিশেষ কোন দুর্যোগে বা সঙ্কটে! আর ঠিক ঐ সব সময়ে নানা রকম উপস্থিত বুদ্ধি তার মাথায় উদয় হয়। বুলেট বললে–থাক লগি, ডিঙিবাঁধা দড়িটা আমার কোমরে বেঁধে সাঁতার কেটে আমি ডিঙিটাকে টেনে ওপারে নিয়ে যাবে।
বজ্র বললে–তাকি হয়! নদী কুমীরে ভরা!
বুলেট বললে–সুন্দরবনের নদীতে কুমীর থাকবেই, তাই বলে ভয়ে নদীতে না নেমে ডিঙির উপর নিশ্চেষ্ট বসে থাকলে বোম্বেটের হাতে মরতে হবে। এখন আমাদের অবস্থা ‘রামে বা রাবণে’ হয়ে দাঁড়িয়েছে! চেষ্টা করে দেখা যাক্, কুমীরের মুখ থেকে রক্ষা পেলেও
পেতে পারি।
বুলেট নিজের কোমরে ডিঙি-বাঁধা দড়িটা ফের দিয়ে বেঁধে ঝপ, করে নদীতে লাফিয়ে পড়েই সাঁতার কেটে ডিঙিটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ডিঙি ছাড়লে চলবে না, সুন্দরবনের জল-পথে ভাড়াটে নৌকো বড় একটা পাওয়া যায় না। সে-কথা বুলেট ভালো করে জেনেছে, আর ডিঙিতেই তাদের থাকতে হবে, ডাঙায় ভীষণ বাঘ।
বজ্র বললে–বুলেট, তুমি একলা জলে সঁংরাবে–তা হয় না। আমিও–
বজ্রের কথায় বাধা দিয়ে বুলেট বললে–বোকামি করো না বজ্র, তুমি পিছন দিকে নজর রাখো, জিনিষপত্র সামলাও। আমাদের রিষ্ট-ওয়াচ, আংটি আর ভীমের টাকার লোভ ‘বোম্বটেরা প্রাণ থাকতে ছাড়বে না! তুমি সে-সব রক্ষা করো। তোমার দায়িত্ব বেশী। ভীম তুমি টর্চ্চ দুটোর আলো আমার গায়ে ফেলতে থাকে, আলো দেখলে কুমীর পালাতে পারে।
চাঁদের আলোয় তেমন জোর ছিল না–আকাশ কুয়াশায় ঢাকা, দুজন আরোহী আর জিনিষপত্র সমেত ডিঙিটাকে টানতে টানতে নদীর প্রবল স্রোতের মাঝ দিয়ে বুলেট সাঁতার কেটে চলেছে প্রাণপণে, ভীম তার গায়ে টর্চ্চের আলো ফেলছে; বজ্র পিছন দিকে চেয়ে আছে বোম্বেটেগুলোকে লক্ষ্য করছে।
বুলেটের প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে রমজান যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে-করতে তীরে গিয়ে উঠলো। তার সঙ্গী হাতেমের দেখা নেই, বোধহয় কুমীরে নিয়ে গেছে। সর্দ্দার নৌকোর উপর জ্বলন্ত মশাল হাতে করে ভীষণ হাঁক-ডাক আরম্ভ করেছে। রমজানকে বললে–তুই একটা নেড়ি কুরা, কোন মুবোদ তোর নেই। একটা একফোঁটা ছাওয়াল তোর নাকে ঘুষি কশিয়ে দিলে, আর তুই তার ভয়ে পেলিয়ে এলি! দূর হয়ে যা আমার দল থেকে।
বুলেটের ঘুষিতে রমজাননের নাকের ডগা ভেঙ্গে গিয়েছিল, দারুণ যন্ত্রণায় আর সর্দ্দারের তিরস্কারে সে বিরক্ত হয়ে বললে–তুমি তো আচ্ছা মরদ, যাও না, গিয়ে ছেঁড়াটার একখান ঘুষি খেয়ে এসো। জান লিয়ে আর ফিরতে হবেনি। বাপ! ঘুষি নয়, যেন বাজ!
রমজাননের কথায় তাচ্ছিল্যভরে সর্দ্দার বললে–হ্যাঁঃ! বাজ, না হাতী! এই দেখ, আমি গিয়ে ওদের মাথা কটা এই সড়কি দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে আসি।
সর্দ্দার লোকটার কিছু বয়স হলেও আজও তার বেশ বলবিক্রম আছে।
দলের যারা গ্রামে গেছে, তারা এখনো ফিরে আসছে না, কিন্তু তাদের জন্য অপেক্ষা করতে হলে শিকার পালায়। সর্দ্দার দু-হাতে দুটো ভারী সড়কি নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুলেটদের ডিঙি লক্ষ্য করে দাঁড়া-সাঁতার কেটে চললো!
টাকার থলি, সোনার আংটি, ঘড়ি, দামী-দামী জামা কাপড়ের লোভ ত্যাগ করা অসম্ভব! জালে বহুদিন এমন শিকার পড়েনি।
সর্দ্দার লোকটা ভারী চতুর। সে সাঁতার কাটছে একেবারে নিঃশব্দে। অতর্কিতে গিয়ে বুলেটদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। দূর থেকে সড়কি মেরে মাথাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে টাকা-কড়ি জিনিফ পত্র নিয়ে আসবে।
কুয়াশাভরা আকাশের গায়ে একফালি চাঁদ উঠে মলিন আলো ছড়িয়ে নিবে গেল। গভীর অন্ধকারে চারিদিক ঘেরা। বজ্র পিছন দিকে তাকিয়ে দেখছে, কিন্তু জমাট অন্ধকারে কি দেখবে?
তীর বেশী দূরে নয়–অন্ধকারেও সেটুকু বোঝা যাচ্ছে।
পাল নেই, দাঁড় নেই, লগি থাকা-না-থাকা সমান, একজন লোক সাঁতার কেটে কত তাড়াতাড়ি দু’জন যাত্রী-সমেত ডিঙি টেনে নিয়ে যেতে পারে? তাও এই কন-কনে শীতের-রাতে …উলটো স্রোতে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
বুলেট শুধু নামজাদা বক্সার নয়,…সাঁতারেও কবার ফার্ষ্ট প্রাইজ পেয়েছে।
ডিঙির গতি মন্দ নয়, বুলেট বেশ জোরে সাঁতার কাটছে। বুলেটের গায়ে টর্চ্চের আলো ফেলে ভীম সেই দিকে চেয়ে আছে, মাঝে-মাঝে দু-একটা কুমীর ভুস করে ভেসে ওঠে। বুলেট জল ছিটিয়ে জোরে জোরে সাঁতার কাটছে, তার উপর ঐ টর্চ্চের আলো– দেখে কুমীর সরে যায়।
হঠাৎ বজ্রর কানের কাছ দিয়ে একটা সড়কি সোঁ করে চলে গেল–সঙ্গে-সঙ্গে তাদের ডিঙিটা বিষম জোরে দুলে উঠলো।
পিছন ফিরে বজ্র দেখে, সর্ব্বনাশ!
সর্দ্দার কখন তাদের ডিঙিতে উঠে ভীমের মাথা টিক করে সড়কি মারবার চেষ্টা করছে। দেখে বজ্র নক্ষত্র-বেগে উঠেই সর্দ্দারের সড়কি সমেত হাতখানা খপ করে ধরে জিউজুৎসুর মারাত্মক এক প্যাঁচ কলো তার উপর।
এই বয়সেই বজ্র জিউজুৎসুর প্যাঁচে বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
মোষের মত চেহারা-বোধহয় তিন মণের উপর ভারী জোয়ান সর্দ্দার–বজ্রর প্যাঁচ খেয়ে ছিটকে তিন-চার হাত তফাতে নদীর জলে কপাং করে গিয়ে পড়লো। তার সড়কি রয়ে গেল বজ্রদের ডিঙিতে।
কথায় বলে, চক্ষের পলক… সেই চক্ষের পলকে এ কাণ্ড ঘটে গেল।
সড়কি পেয়ে মহা-উল্লাসে বজ্র বলে উঠলো–ভাগ্য ভালো! একখানা অস্ত্র-লাভ।
বুলেট সব দিকে হুঁশিয়ার, তার নজর সব কিছুতে, সে সব দেখেছে। সে বললে–কিন্তু খুব সাবধান, ওরা দলে পুরু, ঐ ওদের দলের অনেকে ঘাটে এসে গেছে!
ভীম আর বজ্র দেখলো–সত্যই তাই! ওরা অনেকে এসে নদীর পাড়ে জমা হয়েছে, এসে হৈ-হল্লা করছে। ভাবছে, সর্দ্দার যখন জলে নেমেছে, তখন শিকার নিশ্চয় ভাগছে জিনিষপত্র নিয়ে! এবং সর্দ্দার যখন গেছে, তখন ভয় নেই…শিকার যদি ফশকায়, জিনিষপত্র না নিয়ে ফেরবার মানুষ নয় সর্দ্দার। জিনিষপত্র ঠিক সে নিয়ে আসবে।
কিন্তু একটু পরে সর্দ্দার ক্লান্ত ভাবে তাদের কাছে ফিরে গেল।
একটা কুমীর বুলেটকে ধরেছিল আর একটু হলে–বুলেট সাঁ করে সরে গিয়ে খুব জোরে জোরে হাত-পা ছুঁড়ে জল ছিটিয়ে-ছিটিয়ে সাঁতার কাটছে–কুমীর ভয় পেয়ে সরে গেল।
হেরে শুধু-হাতে ফিরে সদ্দার রাগে একেবারে গরগর করছে! লোকজনদের সে বললে–, বাবুদের সে যা ভেবেছিল, তা নয়! খুব ওস্তাদ…জলে সাঁতার কাটতে কাটতে ডিঙি টেনে নিয়ে চলেছে রে…ঘেরাও না করলে ঘায়েল হবে না! দেরী নয়, এখনি সকলে লেগে যা–ছাড়া হবে না ওদের কোনোটাকে।
সদ্দারের কথা শেষ হতে-না-হতে বুলেটদের ডিঙি লক্ষ্য করে দলের একজন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো–পড়ে মহা উৎসাহে বড়-বড় ঢেউয়ের উপর দিয়ে সাঁতার কেটে চললো। সঙ্গে-সঙ্গে ঝড় উঠলো। নদীর ঢেউগুলো উঠলো ফুঁশে…অজগরের মত চক্র তুলে!
তীরের প্রায় কাছাকাছি বুলেটদের ডিঙি এসে পৌঁছেছে, কিন্তু ঝড় আর স্রোতের গতি তাদের ঠিক উল্টো দিকে। বুলেট প্রাণপণ চেষ্টা করেও কিছুতে ডাঙ্গায় আসতে পারছে না। বজ্র একবার পিছন দিকে চেয়ে বলে উঠলো–চটপট বুলেট…ওরা জলে নেমে এদিকে আসছে… অনেকগুলো।
ভীম বললে– তুমি এখানে এলে ভালো হয় বুলেট।
বুলেট বললে–বজ্র আছে, তুমি আছো, একখানা অস্ত্র পেয়েছে, ভয় কি?
ভীমও ভীতু নয়, সে পরিচয় পেয়েছে। ভীম আর বজ্র টর্চ দুটো নিবিয়ে রেখেছে বুলেটের কথায়–তার কারণ, আলোয় ওরা সহজে দেখতে পাবে। ওদের মশালগুলোও ঝড়ে নিবে গেছে।
ভীষণ অন্ধকার, তবু ওরা এসে ডিঙিটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ভীম বুঝলো, বিপদ! কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। সাহস…সাহস…সাহস! রোজ সে ডনবৈঠক করে, কুস্তি করে, লাঠি-খেলাও কিছু জানে! এরা তিনজনঅস্ত্র বলতে ঐ সড়কি আর বাঁশের একখানা লাঠি। ওরা দলে পুরুটের বেশী জোয়ান ওরা, অস্ত্র-শস্ত্রও আছে…তার উপর বাঘের মত, কুমীরের মত হিংস্র। মরণ নিশ্চিত, তবু মরবার আগে একবার যতদূর সাধ্য…
বজ্রকে ভীম বললে–জিনিষগুলোর জন্যই তো! জিনিষগুলো ওদের দিয়ে দিই।
বজ্র বললে–উঁহু, নো সারেণ্ডার! মরি-যদি, বীরের মত মরবো।
বুলেট এ-কথা শুনলো। সে বেশ দূরে। সে বলে উঠলো– তা-ই, বীরের মত মরবো, তবু ওদের কিছু দেবো না।
হঠাৎ এক ঘটনা, একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। ভীম দেখলো, হঠাৎ ওরা কেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। ওদের সর্দ্দারকে ধরে কে নদীর জলে একবার চোবাচ্ছে আবার তুলছে। সদ্দার কি বলতে চায়, বলতে পারছে না।
ভীম এ অঞ্চলের ছেলে, লোককে কুমীরে ধরলে কেমন করে কুমীরকে চুবিয়ে-চুবিয়ে কুমীরে-ধরা লোককে বাঁচাতে হয়, সে দেখেছে! বুঝলল, সর্দ্দারকে কুমীরে ধরেছে নিশ্চয়। একথা মনে হবামাত্র সে মহাখুশী। সে ডাকলো–বজ্র ভাই বলেই পিছনে বরে পানে তাকালো।
কিন্তু কোথায় বজ্ৰ? ডিঙিতে নেই তো৷ কোথায় গেল? চীৎকার করে ডাকলো,–বজ্র…
বুলেটের পা এতক্ষণ পরে মাটিতে ঠেকেছে, ভীমের চীৎকার শুনে সে বললে–কি হয়েছে। বজ্রকে ডাকছো কেন?
ভীম কাঁদ কাঁদ গলায় বললে–বজ্র ডিঙিতে নেই।
বুলেট শিউরে উঠলো, বললে–নেই! তার মানে?
ভীম বললে–বোধহয় কুমীরে নিয়ে গেছে!
বুলেট পাড়ে না উঠে ডিঙিতে ফিরে এসে অধীর কণ্ঠে বললে– কুমীরে নিয়ে গেছে! কোন্ দিকে নিয়ে গেল? কুমীরটাকে দেখতে হবে–দেখলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কুমীরের গাল চিরে বস্ত্রকে বার করবো!
বুলেট জীবনে কখনও এমন চঞ্চল হয়নি। নিজের হাতে টর্চ নিয়ে নদীর জলে আলো ফেলছে, বজ্রকে বা কুমীরটাকে দেখতে। দেখলে কুমীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে! বোম্বেটেগুলোর দিকে তার লক্ষ্য নেই! যদিও তাদের দু’-একজন তখনও চলে যায়নি।
ভীম রীতিমত অভিভূত হয়ে পড়েছে। বুলেট তাকে জিজ্ঞাসা করলে–তুমি টের পেলে না? কোনো সাড়া-শব্দ পাওনি?
ভীম বললে–না, আমি সর্দ্দারের দুর্দশা দেখছিলুম, হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি, বজ্র নেই!
বুলেট একটু আশ্বস্ত হলো, বললে–কোনো শব্দ হয়নি? তাহলে বোধহয় কুমীরে নেয়নি! কুমীরে ধরলে সে নিশ্চয় চীৎকার করত, জলে খুব ঝাপাঝাপি শব্দ হতো! নিতে হলে কুমীরকে ল্যাজের ঝাঁপটা মেরে তাকে জলে ফেলে তারপর গালে ধরতে হবে তো!
বুলেটের কথায় ভীম একটু আশ্বস্ত হলো যেন! কোনো কথা না বলে সে চুপ করে রইলো।
বুলেট ভাবছে, বজ্রকে যদি কুমীরে না নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সে গেল কোথায়?
ঠিক এই সময় নিঃশব্দে কে তাদের ডিঙির পাশে সাঁতার কেটে এসে উপস্থিত।
ভীম ভাবলো, ডাকাতদের কেউ।
বুলেট বললে–কে?
–আমি বজ্র। বজ্র জবাব দিলে মৃদুকণ্ঠে।
–বজ্র! বুলেট আর ভীম একসঙ্গে বলে উঠলো।
বজ্রকে ডিঙির উপর টেনে তুলে বুলেট তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ভীম বললে–তোমাকে তাহলে কুমীরে নিয়ে যায়নি! আমরা তো ভেবে অস্থির।
হেসে বজ্র বললে–না, আমিই কুমীর হয়েছিলুম।
ভীম বললে–তারমানে?
বজ্রর কথার মানে বুলেট বুঝেছিল। সে বললে–তুমিই সর্দ্দারকে চোবাচ্ছিলে?
বজ্র বললে–ভাগ্যিস মাথায় মতলবটা এসে গিয়েছিল।
আরামের নিশ্বাস ফেলে ভীম বললে–একেই বলে বুদ্ধি।
বুলেট লগি ঠেলতে লাগলো।
বুলেট বললে–কিন্তু নির্ভাবনা নয়! আসল ব্যাপার কি, জানতে পারলে আবার ওরা আমাদের পিছু নেবে।
বজ্র বললে–সর্দ্দারটাকে নোনা জল খাইয়ে এ্যায়সা অন্তর-টিপুনি দিয়েছি, আধমরা করে তবে ছেড়েছি! তার জ্ঞান হতে বহুৎ সময় লাগবে। একটু পরে ভাঁটা। ভাঁটার টানে শেষে বে-অফ-বেঙ্গলে না গিয়ে পড়ে!
সকলে হাসতে লাগলো। বুলেট বললে,–যাক, প্রথম বাধা কাটলো। আমাদের ভিকট্রি!
ভীম বললে–প্রথম যুদ্ধ, বলো।
বজ্র বললে–সর্দ্দার বুঝেছিল আমি তাকে ধরেছি, দলের লোককে তাই বলবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু চুবুনির চোটে বাছাধনের মুখে কথা আর সরতে পারেনি!
পাড়ে কাদায় ডিঙি এসে থেমে গেল। নদীতে ভাঁটা আরম্ভ হয়েছে। ডিঙি পাড়ে ভিড়োনো যাবে না। তিনজনে জিনিষপত্র নিয়ে ডিঙি থেকে নেমে পড়লো সেই কাদার মাঝখানে।
ভীম আর বুলেট ডিঙিটাকে টেনে পাড়ের উপর তুলে রাখলো।