এক শহরের একটি প্রাচীর-গাত্রে বেশ বড় গোছের একটি ইস্তাহার আঁটা রহিয়াছে
১০০০ টাকা পুরস্কার।
বারবটিয়া প্রতাপ সিংকে
যে-কেহ রাজসকাশে ধরাইয়া দিতে পারিবে
সে এক হাজার টাকা পুরস্কার
পাইবে।
ইস্তাহারের ঠিক পাশেই একটি দারুনির্মিত পায়রার খোপের মত ক্ষুদ্র পানের দোকান। দোকানদার দোকানের মধ্যে বসিয়া পান সাজিতেছে, সম্মুখে দুইজন গ্রাহক দাঁড়াইয়া পান কিনিতেছে।
একজন খরিদ্দার ইস্তাহারটি দেখিয়া দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করিল,–
ইস্তাহারে কী লেখা রয়েছে?
দোকানদার পানের খিলি খরিদ্দারকে দিয়া নীরসকণ্ঠে বলিল,–
লেখা আছে, প্রতাপ বারবটিয়াকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে সে হাজার টাকা ইনাম পাবে।
লোকটি পান চিবাইতে চিবাইতে কিছুক্ষণ বিরাগপুর্ণ নেত্রে ইস্তাহারটি নিরীক্ষণ করিল, তারপর ঘৃণাভরে ইস্তাহারের উপর পানের পিক ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল।
দ্বিতীয় খরিদ্দারটি শীর্ণাকৃতি এবং অপেক্ষাকৃত ভীরু প্রকৃতির। সে পান মুখে দিয়া একবার সতর্কভাবে এদিক ওদিক তাকাইল, তারপর হঠাৎ ইস্তাহারের উপর পিচকারীর বেগে পিক ফেলিয়া দ্রুত প্রস্থান করিল।
দোকানদার একটু গম্ভীর হাসিল। সে আর কেহ নয়, বৃদ্ধ লছমন।
.
আর একটি শহর। একটা তকমাধারী লোক ঢোল পিটাইয়া রাস্তায় রাস্তায় হুলিয়া দিয়া বেড়াইতেছে।
সরকারী পুরস্কার বাড়িয়ে দেওয়া হল— শোনো সবাই দেশের শত্রু সমাজের শত্রু রাজার শত্রু প্রতাপ বারবটিয়াকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে সে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার পাবে
একটা গলির মোড়ে কয়েকজন বালক দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের মধ্যে একজনের হাতে গুলতি। বালক গুলতিতে একটি প্রস্তরখণ্ড বসাইয়া লক্ষ্য স্থির করিয়া ছুঁড়িয়া মারিল। তারপর বালকের দল হৈ হৈ করিতে করিতে ছুটিয়া পলাইল।
তকমাধারী ঘোষক ঘোষণা শেষ করিয়া ঢোলে কাঠি দিতে গিয়া দেখিল ঢোল ফাঁসিয়া গিয়াছে। রাস্তার লোক বিদ্রূপভরে হাসিয়া উঠিল।
চিন্তার জলসত্রে অসমতল দেয়ালে একটি ইস্তাহার আঁটা রহিয়াছে—
১০০০ টাকা
প্রতাপ বারবটিয়াকে যে-কেহ ইত্যাদি।
প্রতাপ দাঁড়াইয়া এক টুকরা কয়লা দিয়া পুরস্কারের অঙ্কের পিছনে আরও কয়েকটা শূন্য যোগ করিয়া দিতেছে। তাহার মুখে মৃদু ব্যঙ্গ-হাসি।
পায়রার বকবকম শব্দ শুনিয়া প্রতাপ ঊর্ধ্বে চক্ষু তুলিল। একটি দীর্ঘ বংশদণ্ডের আগায় কঞ্চির কামানি দিয়া ছত্র রচনা হইয়াছে, তাহার উপর দুটি কপোত। প্রতাপ যে কপোতশিশু দুটি চিন্তাকে উপহার দিয়াছিল, তাহারা আর শিশু নহে, সাবালক ও স-পালক হইয়াছে।
তাহাদের দিকে চাহিয়া প্রতাপের মুখের ব্যঙ্গ হাসি স্নেহে কোমল হইয়া আসিল। এই সময় চিন্তা ঘরের ভিতর হইতে বারান্দায় আসিয়া উদ্বিগ্নস্বরে বলিল,-
ও কি, সদরে দাঁড়িয়ে আছ? কেউ যদি এসে পড়ে! মোতি কোথায়?
প্রতাপ বলিল,-মোতিকে ওদিকে লুকিয়ে রেখেছি, কেউ দেখতে পাবে না।
চিন্তা বলিল,-তবে ওখানে দাঁড়িয়ে কি কাজ? এস, ভেতরে এস, তোমার খাবার দিয়েছি
প্রতাপ আসিয়া বারান্দায় চিন্তার সহিত যোগ দিল, বলিল— চুনি-মুনিকে দেখছিলাম। ওদের যখন বাসা থেকে তুলে এনেছিলাম তখন কে ভেবেছিল ওরা এত কাজে লাগবে।
চিন্তা বলিল,-আমাদের ভাগ্যবিধাতা জানতেন, তাই আগে থেকে আয়োজন করে রেখেছিলেন।
প্রতাপ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল মেঝেয় পিঁড়ি পাতা হইয়াছে, সম্মুখে প্রকাণ্ড পিতলের থালি; থালিতে নানাপ্রকার অন্নব্যঞ্জন সজ্জিত রহিয়াছে : গমের ফুলকা রুটি, শিং দিয়া তুরের ডাল (সজিনার ডাটা (শিং) দিয়া অড়র ডাল); মুঠিয়া পকৌড়া, ধোকড়া, দহিবড়া, শ্রীখণ্ড–আরও কত কি। প্রতাপ সহর্ষে পিঁড়ির উপর বসিল।
ভাগ্যবিধাতা আমার জন্যেও আজ কম আয়োজন করেননি—
প্রতাপ পরম আগ্রহে আহার আরম্ভ করিল, চিন্তা সলজ্জ তৃপ্তির সহিত বসিয়া দেখিতে লাগিল।
রান্না ভাল হয়েছে?
প্রতাপ বলিল, ভাল? অমৃত। সত্যিই বলছি চিন্তা, ডাকাত হবার আগে যদি তোমার রান্না খেতাম তাহলে হয়তো
বলিতে বলিতে সে থামিয়া গেল, তাহার কৌতুক-চটুল মুখ সহসা গম্ভীর হইল। সে হাতের অর্ধভুক্ত ধোকড়া নামাইয়া রাখিল।
চিন্তা বলিল,-কি হল?
প্রতাপ বলিল,-কিছু না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমি এখানে বসে দিব্যি চর্বচোষ্য খাচ্ছি, আর ওরা—ভীম নানা প্রভু তিল–নুন দিয়ে বাজরি রুটি চিবচ্ছে।
চিন্তা ঈষৎ হাসিয়া বলিল,-তা হোক— তুমি খাও।
প্রতাপ বিষণ্নমুখে উঠিবার উপক্রম করিল—
না চিন্তা, এত ভাল খাবার আর আমার গলা দিয়ে নামবে না।
উঠো না, উঠো না। ওদের জন্যেও আমি খাবার তৈরি রেখেছি-তুমি নিয়ে যাবে। ঐ দ্যাখো।
ঘরের কোণে একটি আধমনী চটের থলি আভ্যন্তরিক পরিপূর্ণতায় পেট ফুলাইয়া ধনী মহাজনের মত বসিয়া ছিল, দেখিয়া প্রতাপের মুখ আবার প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। সে কৃতজ্ঞতা-তদগত স্বরে চিন্তাকে বলিল,-
চিন্তা, তুমি একটি আস্ত জলজ্যান্ত দেবী—এতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রতাপ আহারে মন দিল। এই সময় পায়রা দুটি উড়িয়া আসিয়া জানালায় বসিল। চিন্তা একমুঠি শস্য লইয়া মেঝেয় ছড়াইয়া দিল, চুনি-মুনি অমনি নামিয়া আসিয়া দানাগুলি খুঁটিয়া খাইতে লাগিল। কিছুক্ষণ নীরব আহারে কাটিল।
প্রতাপ জিজ্ঞাসা করিল,-খবর কিছু আছে নাকি?
চিন্তা কহিল,-না, নতুন খবর কিছু পাইনি।
আমি বোধ হয় এখন কিছুদিন আর আসতে পারব না। যদি জরুরী খবর কিছু পাও— প্রতাপ অর্থপূর্ণভাবে চুনি-মুনির পানে তাকাইল।
চিন্তা ঘাড় নাড়িয়া বলিল,-হ্যাঁ।
সহসা বাহিরে ড়ুলি বাহকের হুহুম্ শব্দ শোনা গেল। প্রতাপ ও চিন্তা সচকিত মুখ তুলিল।
.
বাহিরে রাস্তার উপর শেঠ গোকুলদাসের ড়ুলি আসিয়া থামিয়াছে। এবার সঙ্গে রক্ষীর সংখ্যা বেশী, কান্তিলাল ও পাঁচজন বন্দুকধারী সিপাহী। হতভাগা প্রতাপ সিং ধরা না পড়া পর্যন্ত মহাজন সম্প্রদায়কে সাবধানে পথ চলিতে হয়।
গোকুলদাস ড়ুলি হইতে মুণ্ড বাহির করিয়া হাঁকিলেন,
ওরে, জল নিয়ে আয়।
ঘরের মধ্যে চিন্তা ও প্রতাপ উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল। চিন্তা পাণ্ডুমুখে প্রতাপের পানে চাহিয়া নিঃশব্দে অধরোষ্ঠের সঙ্কেতে বলিল,-গোকুলদাস।
আকস্মিক বিপদের সম্মুখীন হইয়া প্রতাপের চক্ষু প্রখর হইয়া উঠিল, সে চিন্তাকে কাছে টানিয়া বলিল,-
যাও, ওদের জল দাও গিয়ে, ভয় পেয়ো না। যদি জিজ্ঞাসা করে বোলো ঘুমিয়ে পড়েছিলে—
বাহির হইতে গোকুলদাসের স্বর আসিল
আরে কোথায় গেল পরপওয়ালী হুঁড়িটা? কাজের সময় হাজির থাকে না! কান্তিলাল, দ্যাখ তো ঘরে আছে কিনা।
চিন্তার হাত-পা ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু আর বিলম্ব করিলে সর্বনাশ। সে কোনও ক্রমে মুখে একটু ঘুম-ঘুম ভাব আনিয়া ঘর হইতে বাহির হইল।
কান্তিলাল ঘরের দিকে আসিতেছিল, চিন্তাকে জলের ঘটি লইয়া বাহির হইতে দেখিয়া আর অগ্রসর হইল না। আকর্ণ দন্ত বাহির করিয়া হাসিল, বলিল,-
এই যে ধনী বেরিয়েছেন!
চিন্তা গোকুলদাসের সম্মুখীন হইতেই তিনি বিষাক্ত চক্ষে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন,–
কোথায় ছিলি? সরকারে পগার (মাসিক বেতন) নিস্ না তুই; কাজে হাজির থাকি না কেন?
চিন্তা জড়িতকণ্ঠে বলিল,-ঘুমিয়ে পড়েছিলাম—
গোকুলদাস বিকৃতমুখে বলিলেন, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! কেন? রাত্তিরে ঘুমোস না?
কান্তিলাল চোখ টিপিয়া টিপ্পনি কাটিল,–
রাত্তিরে ঘুম হবে কোত্থেকে শেঠ? রাত্তিরে বোধ হয় নাগর আসে।
কান্তিলালের সহচরেরা এই রসিকতায় হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ঘরের মধ্যে প্রতাপ সবই শুনিতে পাইতেছিল, অসহায়-ক্রোধে তাহার চক্ষু জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতে লাগিল।
গোকুলদাস মুখের কাছে গণ্ডুষ করিয়া জল পান করিলেন, তারপর মুখ মুছিতে মুছিতে বলিলেন,-
ঠিক বলেছিস কান্তিলাল, ছুঁড়ি রাত্তিরে ঘরে নাগর আনে। রাজপুতের মেয়ে আর কত ভাল হবে?
রাজপুতের প্রতি বিদ্বেষ প্রতাপ ঘটিত ব্যাপারের পর হইতে গোকুলদাসের মনে শতগুণ বাড়িয়া গিয়াছিল। তাঁহার এই নীচ অপমানে চিন্তার মুখ একেবারে সাদা হইয়া গেল, কিন্তু সে অধর দংশন করিয়া নীরব রহিল। প্রভুর অনুমোদন পাইয়া কান্তিলাল সোৎসাহে বলিল,-
শুধু রাত্তিরে কেন শেঠ, দিনের বেলাও আনে। এখন হয়তো ঘরের মধ্যে নাগর লুকিয়ে আছে।–উঁকি মেরে দেখে আসব?
ঘরের মধ্যে প্রতাপের সমস্ত শরীর শক্ত হইয়া উঠিল, সে দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করিয়া কোমর হইতে পিস্তল বাহির করিল। যদি ধরা পড়িতেই হয়, ঐ নরপশুটাকে সে আগে শেষ করিবে।
শেঠ কিন্তু আর কালক্ষয় করিলেন না, বলিলেন,
না থাক। রাজপুতনী দশটা নাগর ঘরে আনুক না, আমার তাতে কি? নে ড়ুলি তোল, বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছুতে হবে।
বাহকেরা ড়ুলি তুলিয়া চড়াইয়ের পথে যাত্রা করিল। কান্তিলাল চিন্তার পাশ দিয়া যাইবার সময় খাটো গলায় বলিয়া গেল,-
আমিও এবার একদিন রাত্তিরে আসব
চিন্তা অপমান লাঞ্ছিত মুখে চুপ করিয়া রহিল।
ঘরের মধ্যে প্রতাপ জালবদ্ধ শ্বাপদের মত ছটফট করিতেছিল, কিন্তু ফিরিয়া আসিতেই তাহার দুই কাঁধে হাত রাখিয়া আগুনভরা চোখে চাহিল
চিন্তা। এই সব অপমান তোমাকে সহ্য করতে হয়?
চিন্তা একটা দীর্ঘ কম্পিত নিশ্বাস ফেলিয়া ক্ষণেকের জন্য মুখ নিচু করিল। তারপর পাণ্ডুর হাসিয়া আবার মুখ তুলিল
ও কিছু নয়। কিন্তু তুমি আর দিনের বেলা এস না। আর একটু হলেই আজ
চিন্তা এতক্ষণ কোনও ক্রমে আত্মসংবরণ করিয়াছিল কিন্তু আর পারিল না, হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া সে প্রতাপের বুকের উপর মুখ ঢাকিল। ভয়, অপমান ও সর্বশেষে বিপন্মুক্তির আকস্মিক অব্যাহতি মিলিয়া তাহার স্নায়ুমণ্ডলে যে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহাই দুর্নিবার অশ্রুধারায় বিগলিত হইয়া পড়িল।
.
বিস্তীর্ণ গিরিকান্তারের একটি দৃশ্য। পাহাড়ের ভাগই বেশী। নিরাবরণ পাথরের বিশৃঙ্খল স্তুপ যেন কেহ অবহেলাভরে চারিদিকে ছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়াছে। তাহার ফাঁকে ফাঁকে নিম্নভূমিতে গৈরিক বনানীর নিষ্প্রাণ হরিদাভা।
এই দুর্গম স্থানটিকে দুর্গপ্রকারের মত ঘিরিয়া রাখিয়াছে একটি গিরিচক্র। এই গিরিচক্রের গা বাহিয়া উপরে ওঠা মানুষের দুঃসাধ্য; কিন্তু একস্থানে এই নৈসর্গিক প্রাকারের গায়ে একটি ফাটল আছে। ফাটলটি অতিশয় সঙ্কীর্ণ, কোনও অজ্ঞ আগন্তুক কিন্তু রন্ধ্রপথে প্রবেশ করিয়া এমন কিছু দেখিতে পাইবে না যাহাতে তাহার সন্দেহ হইতে পারে যে এই প্রস্তরবিকীর্ণ জনহীন স্থান প্রতাপ সিং ও তাহার দস্যুদলের আস্তানা। কেবল প্রতাপ ও তাহার মুষ্টিমেয় পার্শ্বচরেরাই ইহার সন্ধান জানে। দেশ জুড়িয়া প্রতাপের শত শত অনুচর আছে, ডাক পাইলেই তাহারা প্রতাপের সঙ্গে যোগ দিবে; কিন্তু তাহারা প্রচ্ছন্ন বিদ্রোহী, প্রতাপের গুপ্ত আস্তানার ঠিকানা জানে না। যাহারা নামকাটা বিদ্রোহী-রাজদণ্ডের ভয়ে যাহাদের লোকসমাজ ছাড়িয়া পলাইতে হইয়াছে তাহারাই প্রতাপের নিত্যসঙ্গী, গোপন ঘাঁটির সন্ধানও কেবল তাহারাই জানে।
সূর্য পাহাড়ের চূড়ার আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে কিন্তু অস্ত যায় নাই। দিবাবসানের প্রাক্কালে এই নিভৃত স্থানে একটি কৌতুককর অভিনয় চলিতেছিল।
তিলু ঝরনায় জল ভরিতে আসিয়াছিল। স্থানটি চারিদিক হইতে বেশ আড়াল করা; যেখানে ঝরনার জল ঝরিয়া পড়িতেছে তাহার চারিপাশে শ্যামল শষ্পের সজীবতা। তিলু কলসে জল ভরিয়া ফিরিবার পথে দেখিল, ভীমভাই একটি প্রস্তরখণ্ডে পিঠ দিয়া দীর্ঘ পদযুগল দ্বারা তিলুর পথ আগুলিয়া বসিয়া আছে। তাহার হাতে একটি বাঁশের এড়ো বাঁশী। ভীমভাইয়ের চাতুরী বুঝিতে তিলুর বাকি রহিল না; সে মুখ টিপিয়া হাসিল, বলিল,-
বাঃ, পা ছড়িয়ে বসে আছ? আমাকে জল নিয়ে যেতে হবে না? রাত্তিরের রান্না এখনও বাকি।
ভীমভাই কপট কোপে চক্ষু পাকাইয়া বলিল,–
পাশে বসো।
তিলুও মনে মনে তাই চায়; এই নবদম্পতি নিভৃতে পরস্পর সঙ্গলাভের বড় একটা সুযোগ পায় না। কিন্তু আজ বিশেষ কোনও কাজ নাই, প্রতাপও বাহিরে গিয়াছে, এই অবকাশে ভীমভাই দলের আর সকলকে এড়াইয়া ঝরনাতলার নির্জনে তিলুকে একলা পাইয়াছে। তিলু ভরা-ঘট নামাইয়া ভীমভাইয়ের পাশে পাথরে ঠেস দিয়া বসিল, পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল,-
আমার দায়-দোষ নেই। প্রতাপভাই যদি জিজ্ঞেস করেন
ভীমভাই তিলুর মাথাটা ধরিয়া নিজের কাঁধের উপর রাখিয়া দিল; তারপর বাঁশী অধরে তুলিয়া তাহাতে ফুঁ দিল। তিলু মুকুলিত-নেত্রে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া রহিল।
নৃত্য-চপল গ্রাম্য সুর, কিন্তু ভীমভাইয়ের ফু বড় মিঠা। শুনিতে শুনিতে তিলুর পা দুটি বাঁশীর তালে তালে নড়িতে লাগিল। ক্রমে তাহার কণ্ঠ হইতে নিদ্রালু পাখির মৃদু কুজনের মত গানের কথাগুলি বাহির হইয়া আসিল
পায়েলা
মোর চপল হল
তব বাঁশীর সুরে—
ঝরনা হইতে বেশ খানিকটা দূরে একটি গুহার মুখ। গুহার ভিতরে অন্ধকার, সম্মুখে একটি বৃহৎ গাছের গুঁড়ি অঙ্গারস্তুপে পরিণত হইয়া স্তিমিতভাবে জ্বলিতেছে। এই অগ্নি ঘিরিয়া তিনটি পুরুষ প্রস্তরখণ্ডের আসনে বসিয়া আছে।
প্রথম, নানাভাই–বেঁটে গজস্কন্ধ মহাবলবান; সে একটা বশার প্রান্তে ভুট্টা গাঁথিয়া তাহাই পোড়াইয়া খাইতেছে। দ্বিতীয়, প্রভু-মধ্যবয়স্ক কিন্তু বলিষ্ঠ পুরুষ; সে করলগ্নকপোলে বসিয়া গম্ভীরচক্ষে আগুনের পানে চাহিয়া আছে। তৃতীয়, পুরন্দর- শ্যামকান্তি যুবা, কর্মঠ, বালকস্বভাব; সে চামড়ার কয়েকটা লম্বা ফালি লইয়া ক্ষিপ্র নিপুণহস্তে ঘোড়ার লাগাম বুনিতেছে। ইহারাই প্রতাপের দল।
প্রভু দিবাস্বপ্ন ভাঙিয়া একবার সহচরদিগের উপর চক্ষু বুলাইল।–
ভীমকে দেখছি না।
বাকি দুইজন চারিদিকে চাহিল; তারপর পুরন্দর গিয়া গুহার মধ্যে উঁকি মারিয়া আসিল।
তিলুবেনও নেই, বোধ হয় জল আনতে গেছে।
হুঁ। কিন্তু ভীম কোথায়?
এই সময়, যেন প্রভুর প্রশ্নের উত্তরে দুর হইতে বাঁশীর নিঃস্বন ভাসিয়া আসিল। কাহারও বুঝিতে বাকি রহিল না ভীমভাই কোথায়। নানা ভুট্টায় কামড় মারিতে গিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। প্রভুর গম্ভীর মুখেও একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল। পুরন্দর লাগাম বুনিতে বুনিতে স্মিতমুখে মাথাটি নাড়িতে লাগিল।
পুরন্দর বলিল,-চোরের মন বোঁচকার দিকে। কিন্তু যাই বল, ভীমভাই খাসা বাঁশী বাজায়; দূর থেকে শুনে সুখ হয় না বলিয়া মিটিমিটি বাকি দুইজনের পানে তাকাইতে লাগিল।
ওদিকে ভীমভাই পূর্ববৎ বাঁশী বাজাইতেছে; তিলুর পায়েলিয়া তাহার সহিত সঙ্গত করিয়া চলিয়াছে। তিলু গাহিতেছে–
পায়েলা মোর চপল হল
তব বাঁশীর সুরে!
শ্যামলিয়া ওগো শ্যামলিয়া
তুমি কত দূরে—
বুকের কাছে— তবু কত দূরে।
ভীমভাই আড়চোখে তিলুর পায়ের দিকে দেখিয়া বাঁশী বাজাইতে বাজাইতেই তাহাকে একটা কনুইয়ের ঠেলা দিল। কনুইয়ের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট, তিলু উঠিয়া ঘাগরি ওড়নি সংবরণপূর্বক গানের তালে তালে নাচিতে আরম্ভ করিল। কাথিয়াবাড় গুজরাতের সব মেয়েরাই নাচিতে জানে, ছেলেবেলা হইতে তাহারা গরবা নাচিতে অভ্যস্ত। এ বিষয়ে তাহাদের কোনও সঙ্কোচ নাই।
তিলু নৃত্যের তালে তালে গাহিল
যে পথে যাই খুঁজে না পাই ঘন কুঞ্জবনে,
সোহাগ ভরে বাঁশী ডাকে অলি গুঞ্জরণে—
ওগো প্রিয়া, তুমি কত দূরে
বুকের মাঝে তবু কত দূরে।
পাহাড়ের যে রন্ধ্রটি দিয়া এই উপত্যকার একমাত্র প্রবেশপথ, সেই পথে প্রতাপ মোতির পৃষ্ঠে প্রবেশ করিল। প্রতাপের কোলের কাছে খাদ্যবস্তুর ঝুলিটা বিরাজ করিতেছে। প্রতাপ মোতিকে দাঁড় করাইয়া একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিল, ক্ষীণ বাঁশীর আওয়াজ তাহার কর্ণে প্রবেশ করিল।
সে ঈষৎ বিস্ময়ে ভ্রূ তুলিল, তারপর আওয়াজ লক্ষ্য করিয়া মোতিকে চালিত করিল।
ঝরনার ধারে ভীমভাইয়ের বাঁশী সমে আসিয়া থামিল। তিলুর নাচও একটি ঘূর্ণিপাকে সমাপ্তি লাভ করিল। সে ভীমের কাছে ফিরিয়া আসিয়া আবার তাহার কাঁধে মাথা রাখিয়া বসিল। দুজনের মনেই তৃপ্তির পরিপূর্ণতা।
তিলু বলিল,-কেমন মজা হল। কেউ জানতে পারল না যে তোমার সঙ্গে আমার চুপি চুপি দেখা হয়েছে।
শূন্য হইতে একটি আওয়াজ অসিল
নাঃ, কেউ জানতে পারল না।
চমকিয়া তিলু ও ভীমভাই দেখিল অনতিদূরে একখণ্ড পাথরের উপর কনুই রাখিয়া প্রভু করলগ্নকপোল দাঁড়াইয়া আছে। তাহার কিছু দূরে বলগা-বয়নরত পুরন্দর দাঁড়াইয়া তখনও গানের তালে তালে মাথাটি নাড়িয়া চলিয়াছে। আর সর্বশেষে নানাভাই, বেদীর মত উচ্চ প্রস্তরের উপর পদ্মাসনে বসিয়া শাঁকালু ভক্ষণরত ভাল্লুকের মত দন্ত বিকশিত করিয়া আছে এবং ভুট্টা খাইতেছে।
ধরা পড়ার লজ্জায় তিলু দুহাতে মুখ ঢাকিল।
এই সময় প্রতাপ আসিয়া উপস্থিত হইতেই সকলে আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরিল।
ভীমভাই বলিল,-সর্দার, বলতে নেই ঝুলিতে কি একটা মহাজন পুরে নিয়ে এলে?
প্রতাপ হাসিয়া বলিল,—না, চিন্তা তোমাদের জন্যে খাবার পাঠিয়েছে।
মুহূর্তমধ্যে ঝুলি লইয়া সকলে বসিয়া গেল। প্রতাপ মোতিকে ঘাসের উপর ছাড়িয়া দিয়া অদূরে একটা পাথরের উপর বসিয়া তাহাদের আহার দেখিতে লাগিল; তিলু তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া পিছনে দাঁড়াইল। প্রভু খাইতে খাইতে একখণ্ড ধোকড়া প্রতাপকে দান করিলে প্রতাপ তাহা নিজে না খাইয়া কাঁধের উপর দিয়া তিলুকে বাড়াইয়া দিল।
তিলু বলিল,-তুমি নিজে খাও না প্রতাপভাই।
প্রতাপ বলিল,-চিন্তা আমাকে অনেক খাইয়েছে। তুমি খাও।
তিলু ধোকড়াতে একটু কামড় দিয়া বলিল,–
চিন্তা বেনকে সেই একবারই দেখেছি। তাকে এখানে নিয়ে আস না কেন প্রতাপভাই? আমরা দুজনে কেমন একসঙ্গে থাকব
প্রতাপ চক্ষু তুলিয়া আকাশের পানে চাহিল। বলিল,-আমারই কি ইচ্ছা করে না। কিন্তু
হঠাৎ থামিয়া গিয়া প্রতাপ শ্যেনদৃষ্টিতে ঊর্ধ্বে চাহিয়া রহিল, তারপর ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল। তিলুও তাহার দেখাদেখি আকাশের পানে চাহিল; ক্রমে সকলের দৃষ্টিও ঊর্ধ্বগামী হইল।
আকাশে একটি সঞ্চরমান কৃষ্ণবিন্দু দেখা দিয়াছে। দেখিতে দেখিতে বিন্দুটি একটি পাখিতে পারিণত হইল। প্রতাপ সঙ্কুচিত চক্ষে দেখিতে দেখিতে অস্ফুটস্বরে বলিল,-
চিন্তার পায়রা! এরি মধ্যে কি খবর পাঠাল চিন্তা?
পারাবত একবার তাহাদের মাথার উপর প্রদক্ষিণ করিয়া প্রতাপের কাঁধের উপর আসিয়া বসিল। তাহার পায়ে একটি কাগজ জড়ানো রহিয়াছে। প্রতাপ পা হইতে চিঠি খুলিয়া লইয়া পায়রাটিকে তিলুর হাতে দিল, তারপর চিঠি খুলিয়া লইয়া পড়িতে লাগিল।
আর সকলে প্রতাপকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছিল। প্রভু প্রশ্ন করিল,–
কী খবর?
পড়িতে পড়িতে প্রতাপের মুখ গম্ভীর হইয়াছিল, সে চিঠি পড়িয়া শুনাইল, তুমি চলে যাবার পরই একটা খবর পেলাম তোমাকে ধরবার জন্য একদল সৈন্য রওনা হয়েছে। তাদের সর্দার তেজ সিং।
প্রভুর ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইয়াছিল; সে মুখের উপর দিয়া একটা হাত চালাইয়া ভাবহীন কণ্ঠে বলিল,-
তেজ সিংকে আমি জানি একটা মানুষের মত মানুষ।
প্রতাপ চিঠিখানি মুড়িতে মুড়িতে ভ্রূবদ্ধ ললাটে আবার আকাশের পানে চাহিল। পশ্চিমদিগন্তে গিরি-মালার অন্তরালে তখন দিবাদীপ্তি প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে।
ড: সুনীতা বন্দোপাধ্যায় এর লেখা “কালজয়ী কাদম্বিনী” বইটি প্রকাশ করার অনুরোধ রইলো।