এই সন্ধ্যার কথা আজো ভুলতে পারেনি জরিনা। এই সন্ধ্যা তার জীবনে একটা স্বপ্ন জাগরণের মাঝপথে একক বেদনাময় একটি অনুভূতি হয়ে আছে। যে অনুভূতি জন নিয়েছিল সেই সন্ধ্যায় সেই পাখি, সেই জানু, সেই কণ্ঠস্বর আর কোনদিন ফিরে এলো না। জীবনের দূর–সমুদ্রে সরে যেতে যেতে সেই সন্ধ্যা তার স্মরণে আসে ইস্কুলে পড়া নাম ভুলে যাওয়া এক ইংরেজি কবিতার ঝোড়ো রাত্রিতে বাতিঘরের মতো।
এই সন্ধ্যার কথা প্রথম বড় করে মনে পড়েছিল কলকাতার বাসায় চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। তখন নূরুন্নাহারের বিয়ে দিয়েছেন সাদেক। জরিনা তখন সবে এগোরোয় পড়েছে। আর রোকসানা সংসারে এসেছে সপ্তাহ খানেক হলো।
প্রথম রাতে শোবার ব্যবস্থা হল আলাদা ঘরে। পাশের কামরায়। মা মারা যাবার পর এই তিন বছর সে ছিল সাদেকের কাছে। আজ তার মন ভীষণ ম্লান হয়ে গেল। ক্ষুব্ধতা নয়, বিষণ্ণতা। বিষণ্ণতায় ম্লান হয়ে সে খাবার টেবিলে বসে রইলো অনেকক্ষণ। তখন রোকসানা তার পাশে এসে দাঁড়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল খানিক। বলল, ঘুম পাচ্ছে?
এক মুহূর্তে তার বিষণ্ণতার মেঘ কেটে গেল। হঠাৎ একটা খুশির ঝাঁপটায় মন হয়ে উঠল রেশমি। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জরিনা বলল, না।
না! এত রাত অবধি জেগে থাকো নাকি তুমি? ছিঃ। আজ থেকে ঠিক দশটার সময় ঘুমুতে যাবে, কেমন?
তারপর বড়ো খাটে রোকসানা আর জরিনা গিয়ে শুলো। রোকসানা কত কী বলল, শুধোল– জরিনা যতক্ষণ পারলো উত্তর দিল তার। এই নতুন মানুষটার গাত্রবাস কেমন ছড়ানো ছড়ানো, আবছা। কোনদিন যাকে জানতো না, আজ সে ঠিক তার পাশাপাশি। জরিনা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল কখন। ঘুমুতে ঘুমুতে মনে পড়লো, হাসপাতালে শেষ দিন যখন সে গিয়েছিল তখন মা তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আচমকা ডান হাত মার পেটের ওপর পড়ে গিয়েছিল– কেমন উঁচু আর শক্ত, তাল তাল। লজ্জায় সরিয়ে আনতে পারেনি। কাঁধ গলা আড়ষ্ট হয়ে এসেছিল তার। আর সেই অবস্থায় মার কাঁধের ওপর মুখ রেখে ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ, মনে করতে পারছে না এমনি কী একটা হারিয়ে ফেলা সুগন্ধ পেয়েছিল জরিনা।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে জরিনা প্রথমটা মনে করবার চেষ্টা করে কোথায় আছে সে? তার নতুন শোবার ব্যবস্থার কথা মনে পড়ে একটু একটু করে। তারপর ডানে বামে হাত। বুলিয়ে দেখে ফাঁকা। একা সে শুয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্যে ভয় করে তার। কিন্তু তা এক মুহূর্তের জন্যই। জানালা দিয়ে আবছা আলো এসে পড়েছে ঘরে। আর তার ভয় করে না। ভয়ের বদলে আক্রোশ জন্ম নেয়। আস্তে আস্তে উঠে চুপ করে বসে থাকে জরিনা।
তারপর বিছানা থেকে নেবে এসে দরোজার ফাঁক দিয়ে ও–ঘরে উঁকি দেয়। কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল এখানে ওখানে কুয়াশার মতো আলোর পোচ। দরোজা একটু ঠেলতেই শব্দ করে ওঠে। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জরিনা। বুকের ভেতর চিব ঢিব করতে থাকে। আবার উঁকি দেয়। একটু পরে আঁধার সয়ে এলে তার চোখে পড়ে সাদেক আর রোকসানা পাশাপাশি শুয়ে আছে। অনেকটা মিউজিয়মে দেখা মমির মতো। রোকসানার একটা হাত সাদেকের বুকের ওপর বিছিয়ে আছে, এলানো চুলের গভীরে তার মুখ ডুবে আছে। আর সাদেক আধো পাশ ফিরে শুয়ে আছেন রোকসানার দিকে মুখ করে।
মুখ ফিরিয়ে নিল জরিনা। সারা গা শিরশির করে উঠলো জুরে পাওয়ার মতো। কুটি কুটি করে ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো রোকসানার পরনে খয়েরি শাড়িটা। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তাকে। কী দরকার ছিল রাতের বেলায় তাকে অত আদর করবার? কেন তাকে সে ঠকালো? দরোজা থেকে ফিরে এসে ঘরের মাঝখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো জরিনা। রোকসানাকে নিজের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী, অনেক দূরের মনে হলো তার। বাষ্পের মত ফুঁপিয়ে ওঠা করুণায় কান্নায়, আজ রাতেই মরে যাওয়ার ইচ্ছায় সে এ লশে মাথা রাখলো।
.
পরদিন ভো।রবেলায় নাশতার টেবিলে দুজনের কারো দিকে তাকাল না জরিনা। কোনো কথা বলল না। কেবল চায়ের পেয়ালটা নিজের দিকে টেনে নিল। আলীজাহ্ বসেছিল তার পাশে। সে বলল, ও–কী! বিস্কুট ডিম এগুলো খাবে কে?
সাদেক রোকসানাকে বললেন, দাও, ওকে এগিয়ে দাও।
রোকসানা দুটো প্লেট এগিয়ে দিল। সবাই ব্যস্ত হলো নাস্তায়।
হঠাৎ রোকসানা চোখ তুলে দেখে জরিনা কিছুই ছোঁয়নি। চায়ের পেয়ালা দুহাতে ধরে আছে। শুধালো, যাচ্ছো না যে!
খাবো না।
জরিনা চায়ের দিকে তাকিয়ে উত্তর করে। আরো জোরে চেপে ধরে পেয়ালাটা। গরম লাগে হাতে। তবু কিছুই মনে হয় না। ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে বলে ওঠে, খাবো না, না, না। কিন্তু চিৎকার করতেও প্রবৃত্তি হয় না তার। সে বুঝতে দেবে না কী তার হয়েছে, বুঝতে দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেবে না রোকসানার।
হাতের তালু অবশ হয়ে আসে।
সাদেক বলেন, আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে, অসুখ করেনি তো?
আলীজাহ্, জরিনার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, না–না। আমি বুঝেছি। সেই রবিনসন ক্রুসোর ছবিওয়ালা বাক্সের বিস্কুট চাই জরিনার। তাই না? দুপুরে এনে দেব।
সাদেক উঠে যেতে যেতে বলেন, উঁহু, মনে হচ্ছে অসুখ–বিসুখ। তুমি বেরুবার সময় ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেও, আলী।
সেদিন ও স্কুলেও যায়নি। বিকেলে নামলো বৃষ্টি। তখন ঈঠে এলো ছাদে। বড় বড় গাছ দোলানো, আকাশ নেভানো বৃষ্টি। কেবল দিগন্তের কাছে বলয়ের মতো এক ফালি উজ্জ্বলতা। আর বাতাস। নিম গাছের বড় ডালটায় দুটো কাক ভিজে ভিজে সারা হচ্ছে। আর চারদিক থেকে কী একটা আয়োজন যেন ক্রমেই উত্তাল হয়ে উঠছে। জরিনাব মনে হলো, এই তার আপন পৃথিবী। কতকাল ধরে সে অপেক্ষা করছে এমনি একটি বৃষ্টির–যে বৃষ্টি তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে আসে ছাদে, যে বৃষ্টিতে ভেজা যায়, যে বৃষ্টির আড়ালে সাদেক, রোকসানা, আলীজাহ্ সবাই দূরে সরে যায়।
চিলেকোঠার দরোজায় দাঁড়িয়ে তখন মনে পড়লো সেই চড়ুই দেখা, বাবার জানুতে মাথা এলানো সন্ধ্যাটার কথা। মনে হলো আজকের জরিনা থেকে অবিকল একটা শরীর, একটা নিখুঁত প্রতিচ্ছবি, আলাদা হয়ে গেছে এক সময়ে। তাকে সে চিরদিনের মতো রেখে এসেছে সেদিনের সেই সন্ধ্যায়।
জরিনা চিলেকোঠার বাইরে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াল বর্শার মতো তীক্ষ্ণ আর ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে। সারা শরীর কন্টকিত হয়ে উঠলো ঠাণ্ডায়। চামড়ার কোমলতা ফেটে ফেটে পড়তে চাইলো বৃষ্টির আঘাতে। প্রথমে তীব্র ব্যথা, তারপর সেই ব্যথা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বার পর আর কোনো বোধ তার রইলো না। একরোখা সে দাঁড়িয়ে রইলো বৃষ্টির আঘাতের ভেতরে। একটা হিংস্র শক্তি যেন আজ তার ভেতরে জন্ম নিয়েছে। আর কোনো কিছু তাকে এখন ফেরাতে পারবে না। সে এখানেই থাকবে।
সেদিন রাতে খাওয়া শেষ হলে পর জরিনা সোজা তার নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু পরেই রোকসানার পায়ের শব্দ কানে আসতেই জোর করে চোখ বুজে নিঃসাড় হয়ে। থাকলো। শব্দ শুনে বুঝতে পারলো রোকসানা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার লোভ হলো চোখ মেলে তাকে দ্যাখে। কিন্তু না, চোখ সে খুলবে না।
চোখ মেলে দ্যাখে রোকসানা বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে গেছে। জরিনা নিঃশ্বাস ফেলল।
পরদিন রাতেও ঠিক তেমনি। রোকসানা এসে ফিরে গেল তবু চোখ খুলল না জরিনা। ঘুমের ভান করে বালিশে মাথা ডুবিয়ে পড়ে রইলো।
কিন্তু কালকের মতো আজ ঘুম এলো না সহজে। শুয়ে শুয়ে সে শুনতে পেল সাদেক ও ঘরে এসে হাই তুললেন, কথা বললেন রোকসানার সঙ্গে। একবার জরিনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, তখন বুক শুকিয়ে গেলো জরিনার। তারপর তিনি শুয়ে পড়লেন। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ সরু একফালি আলো এসে পড়ছিল, টুক করে তা অন্ধকার হয়ে গেল।
আলীজাহ্ বার থেকে ফিরলো বেশ খানিকটা রাতে। বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল, খুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো জরিনা।
আলীচাচা।
স্–স্–স। বাবা ঘুমিয়েছে?
জরিনা ফিসফিস করে বলে ঘাড় কাত করে, হু! সবাই।
যা ঘুমোগে–জেগে থাকে না। বলতে বলতে আলীজাহ্ নিজের কামরায় চলে যায়। তার কালো ট্রাউজার অন্ধকারে একটু পরেই যায় মিলিয়ে, কিন্তু শাদা শার্ট বারান্দার শেষ মোড় অবধি দেখা যায়। জরিনা ঘরে ফিরে যায় না। পা টিপে টিপে এগোয়।
আলীজাহ্ মুখ ফেরাতেই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে জরিনা।
উঁহু, কী দুষ্টুমি হচ্ছে রাত দুপুরে।
না, ঘুম পাচ্ছে না।
বোস তাহলে।
আলীজাহ্ খুব করে জরিনার মাথার চুলগুলো নেড়ে দেয়। তারপর শার্ট খুলে আলনায় ছুঁড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে বলে, অ্যাকটিং দেখবি?
অ্যাকটিং করে এলে, না আলীচাচা?
রিহার্সেল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখব। উঁহু অত কাছে এসো না, আমার ভয় করে।
আলীজাহ্ একবার তার সম্মুখে এসে তারপর দুহাত পেছনে বেঁধে পিছিয়ে যায় কয়েক পা। জরিনা অবাক হয়ে বড় বড় চোখ মেলে অপেক্ষা করে। দৃষ্টি স্থিরনিবন্ধ হয়ে থাকে আলীজাহ্ দীর্ঘ দেহের ওপর। আরো দীর্ঘ, আরো দূর মনে মনে হয় হঠাৎ তাকে। হাতের পেশী দৃঢ় হয়ে ওঠে, চাপটা হয়ে প্রায় সেঁটে যায় দুপাজরায়। তীক্ষ্ণ নাসারেখার দুপাশে হাড় ফুটে উঠতে চায় নিঃশ্বাসরে র আবেগে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে ঘুরে আলীজাহ্ হেসে বলে, সম্রাট শাহজাহান। সিংহাসনের লোভে ছেলেরা তাকে বন্দি করে রেখেছে আগ্রা ফোর্টে। বুড়ো হয়ে গেছেন, প্যারালিসিসে এব.দক অবশ, সেই তখন–
সঙ্গে সঙ্গে আলীজাহ্ শরীরে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দেয়। কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে আসে শরীর, ডান হাত আর ডান পা সেই শরীর থেকে ঝুলতে থাকে অর্কিড লতার মতো। আর ছুরির মতো জ্বলতে থাকে দুচোখ। কাঁপতে থাকে চোয়াল। আলীজাহ্ দারুণ আক্রোশে সারা মেঝেয় তার দেহ টেনে টেনে চলতে থাকে। সংলাপ বলে। তার কিছুই কানে যায় না জরিনার। সে শুধু আলীজাহ্কে দেখে। আলীজাহ্ তার কাছে এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায়। তখন অস্পষ্ট হয়ে আসে যেন তার মুখ! জরিনার মনে হয় সম্রাট শাহজাহান–দি এমপেরর হু বিলটু তাজমহল– তার সমুখে অতীত থেকে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্রাট তাকে অবলোকন করছেন ক্লান্ত দুচোখের পাতা তুলে। হয়ত চিনতে পারলেন না। কিংবা এতই তিনি আত্মমগ্ন যে তার উপস্থিতি তিনি অনুভব করতেও পারলেন না। জরিনা কাঠ হয়ে বসে রইলো। সম্রাট তখন পঙ্গু শরীরটাকে টেনে টেনে দূরে সরে গেলেন।
আলীজাহ্ স্পিংয়ের মতো শরীরটাকে ছেড়ে দিযে ডান হাত দুবার ঝেড়ে সমুখে এলো হাসি মুখে! তখন জরিনার শাদা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যেন এতক্ষণ তার হৃদস্পন্দন, তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে ছিল। বলল, ইস, এত সুন্দর তুমি করতে পারো।
তাই নাকি?
সত্যি।
হয়েছে হয়েছে। খেয়েছিস?
নিচে খাবার টেবিলে আলীজাহ্ উল্টোদিকে বসে টেবিলে থুতনি লাগিয়ে বসে থাকে জরিনা। আলীজাহ্ খেতে খেতে বলে, শাহজাহান কিন্তু ভাত খেত না। পোলাও দুবেলা পোলাও, রোস্ট, এইসব। বাদশাহ ছিল কিনা। আসল বাদশাহ, থিয়েটারের না।
জরিনা খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসিতে ভেঙ্গে পড়তে চায়।
আহ, পানির গ্লাসটা ফেলে দিবি যে।
জরিনা তখন থামে। পানির কথা ওঠায় গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখে। তারপর নিজেই ঢকঢক করে খানিকটা পানি খেয়ে নেয়। একটু হাসে। সারাটা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনোখানে কোনো শব্দ নেই। শুধু রাত। জরিনার মনে হচ্ছে যেন আজ হঠাৎ একটা ভারী খুশির খবর মিলেছে তার। আজ যা খুশি সে তাই করতে পারে।
শোবার ঘরে ঘড়িতে একটা বাজার ঘন্টা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেল।
আলীজাহ্ হাত ধুয়ে বলে, একটা বাজলো না দেড়টা?–মেলা রাত হয়েছে তো। চল চল।
চোখ তো টেনে আসছে, তবু বসে আছিস!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে দুজন। এতক্ষণে ঘুম পাচ্ছে জরিনার। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠবার সময় কেবলি পিছিয়ে পড়ছে সে। আলীজাহ্ তাকে কোলে তুলে নেয়। জরিনা তার গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। তখন জরিনার আর কোন অনুভব থাকে না এই অতিবাহনের। মনে হয় এমনি করে দোতলা ছাড়িয়ে, সব দালান ছাড়িয়ে, ক্রমাগত সে কোমল একটা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। আলীজাহ্ গলা আরো ভাল করে জড়িয়ে ধরে সে।
.
এরপর থেকে এমন হলো, রোজ রাতে জেগে থাকতো জরিনা যতক্ষণ না আলীজাহ্ ফিরে আসে। তারপর দুজনে মিলে খাবার টেবিলে গল্প। জরিনার সমস্ত দিনের হাজার কথা আর কাজ, ভাবনা সব বলা চাই আলীজাকে। যে কথা সে বলতে পারে না সারাটা দিন আর যে কথা বলা যায় না তা নির্ভয়ে বলা যায় একমাত্র আলীজাকে। দিনের বেলায় যা চাপা থাকে, বিরূপ পৃথিবী থেকে যা সযতে লুকিয়ে রাখে জরিনা, রাতের এই মুহূর্তগুলোয় তা বেরিয়ে আসে আকাশের এই অত নক্ষত্রের মতো একে একে, ছোট ছোট, জ্বলন্ত। জরিনা অনুভব করতে পারে একটা নিবিড় যোগসূত্র। আলীজাহ্ তার কাছে একান্ত হয়ে ওঠে। কাউকে জানায় না সে রাতের এই মুহূর্তগুলোর কথা। সাদেক, রোকসানা কাউকে না। এ তার একান্ত, নিজস্ব।
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন দুজনে খাবার টেবিলে, মুখোমুখি। মাথার ওপর জ্বলছে বালব। আলীজাহ্ যখন মুখ নিচু করে খেতে থাকে তার ছায়া এগিয়ে এসে পড়ে টেবিলের মাঝামাঝি। জরিনা একেকদিন, তখন সমুখে ঝুঁকে পড়ে নিজের ছায়া দিয়ে স্পর্শ করতে চায় ঐ ছায়াটাকে–আর কথা বলে। যেন রাত্রির নিবিড় থেকে উঠে এসে তারা দুজন একটা গোপন ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়েছে। জরিনার তখন মনে হয়, এই টেবিলে এসে মুখোমুখি বসার মুহূর্তে, এখন থেকে যতক্ষণ তারা এখানে বসে থাকবে–এই বসে থাকা, এই ছোট ছোট হাসি, এই কথা, এই উষ্ণতা এটাই বাস্তব, আর সারাটা দিন, দিনের চলাচলে সমস্ত কিছুই স্বপ্ন মরে থাকা।
.
আলীজাহ্ সেদিন রাতে ফিরে এসেই বলে, কাল এক জায়গায় যাবি?
কোথায় আলীচাচা?
গেলেই দেখতে পাবি।
বলো না।
বলছি, বলছি। পাখাটা ছেড়ে দিই আগে, যা গরম পড়ছে আমার এক বান্ধবীর জন্মদিন কাল। পার্টি হবে। তোকে নিয়ে যাবো। যাবি?
হ্যাঁ। ঘাড় কাত করে জরিনা সম্মতি জানায়। পাখার বাতাসে মাথার চুল ফিনফিন করে উড়তে থাকে। মনটাও তার অমনি দ্রুত সচল হয়ে ওঠে। ছাদের ওপর একেকদিন দমকা বাতাসের মুখে জামা–কাপড় পেছনে পত পত করে উড়িয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চায়, তেমনি অস্থির এখন তার কল্পনা। দুচোখে সে স্পষ্ট দেখতে পায় এক অজানা বিরাট বাড়ির সমুখে বাড়ির রঙ নিশ্চয়ই শাদা– সবুজ ঘাস চুলের মতো করে ছাঁটা লনে পার্টি হচ্ছে। বাবার সঙ্গে সে কয়েকবার কয়েকটা পার্টিতে গেছে। কিন্তু সে সব পার্টি ছিল অন্য রকম। সব ব্যস্তসমস্ত মানুষ শেরোয়ানি পবে, স্যুট পরে ভিড় জমাতো। অদ্ভুত ব্যস্ততা, যেন তাড়া খেয়ে ফিরছে সবাই। আর শক্ত শক্ত কথার ছড়াছড়ি, মুখ কঠিন করে, কপালে ভাঁজ তুলে গম্ভীর সব আলোচনা। একটুও ভালো লাগত না জরিনার।
জরিনা যেন জানে, যদিও সে কোনদিন কোন জন্মদিনের পার্টিতে যায়নি–এখানে থাকবে না ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। থাকবে আলো, রঙিন বাতি আর সুখী, সুগন্ধ ছড়ানো মানুষ যেমন সে ছবিতে দেখেছে। এমন কি খুব ধূসর করে মনে পড়ল সেই কয়েকটা মহিলার মুখ যারা নূরু আপাব বিয়েতে এসেছিল এপাড় ওপাড়া থেকে যাদের কয়েকজনকে কী ভালো লেগেছিল জরিনার। তার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো তাদের কথা মনে করে। সে ভাবলো কাল পার্টিতে তারাও হয়ত আসবে। আবার সে দেখতে পাবে ওদের।
একটু পরে হঠাৎ দপ করে সব নিভে গেল। খাবার টেবিলে ম্লান মুখে সে বসে রইল খানিক। তারপর চিবুক তুলে আলীজাহ্ দিকে তাকালো। আলীজাহ্ কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে শংকার ছায়া মেশানো কণ্ঠে শুধালো, কী হয়েছে?
মাঝে মাঝে এমনি নিভে যেতে সে দেখেছে জরিনাকে। জরিনা মাথা নাড়ে। মুখে বলে, কাল কখন যাবে?
বিকেলে। বিকেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়।
আলীজাহ্ হালকা গলায় উত্তর করে, এবং চোখে প্রশ্ন নিয়ে তবু তাকিয়ে থাকে জরিনার দিকে।
একটু পরে জরিনাই প্রশ্ন করে, আচ্ছা আলীচাচা, জন্মদিন কেন?
প্রশ্নটা চট করে আলীজাহ্ বুঝতে পারে না। পরে বলে, বয়স একটা বছর বাড়লো সেই কথাটা মনে রাখবার জন্যে। যেমন তুই দিনে দিনে বড় হচ্ছিস, একদিন আর ছোট থাকবি না, তেমনি।
তাহলে সবাই কেন যাবে?
এ প্রশ্নটাও আলীজাহ্ বুঝতে পারে না। জরিনার দিকে গভীর চোখে খানিক তাকিয়ে থাকে। খুব আস্তে একটু পরে উত্তর করে, তুই আমি সবাই যাবো, সারাটা জীবন যেন তার সুন্দর করে কাটে, এই ইচ্ছে নিয়ে।
তবু তার মনে হলো যেন যথেষ্ট বলা হলো না। তাই সে আবার গোড়া থেকে শুরু করলো, যে মাসের যে তারিখে জন্ম, সেই মাস সেই তারিখ প্রত্যেক বছরে ফিরে আসে। তার মানে আমরা এক বছর বড় হই, একটা বছর পেরিয়ে আসি। এমনি করে সারা জীবন।
আলীজাহ্ নিজের কাছেই কথাগুলোর অর্থ খুব স্পষ্ট হয় না। সে ভাবতে থাকে আর কী বলা যেতে পারে। জরিনা অন্যমনস্ক হয়ে শুধোয়, তারপর একদিন মরে যাবে, না? জন্মদিনে কেউ মরে যায় না আলীচাচা?
আলীজাহ্ চকিতে চোখ তুলে তাকে দেখে নেয়, পরে দ্রুত সারামুখে হাসি ছড়িয়ে বলে, ও, এইকথা। এইসব ভাবছিলি এতক্ষণ? মানুষ তো মরে যায়ই, জন্মদিনেও মরে যায়। জন্মদিনে যারা মরে তারা ভাগ্যবান।
কেন?
হঠাৎ বিব্রত হয়ে পড়ে। তাইতো? কেন? বলে, মানে, তাদের আর ভাঙ্গতি হিসেব করতে হয় না। শুধু বছরের হিসেব, তাই। চট করে বলে দেয়া যায় এত বছর বয়সে উনি মারা গেলেন। আর অন্যদের কত অসুবিধে। বলতে হবে, কত বছর, কত মাস, কদিন। তাই না?
তুমি কাউকে মরে যেতে দেখেছ, আলীচাচা?
দেখেছি।
কাকে?
আলীজাহ্ মনে পড়ে জরিনার মার কথা। বলে, তুমি চিনবে না। কেন?
জরিনা আবার থুতনি টেবিলে নামিয়ে আনতে আনতে বলে, এমনি। মা যখন মরে গেল আমি ইস্কুলে। আমি দেখিও নি। আবছা আবছা জরিনার মনে পড়ে শাদা চার দেয়াল হাসপাতালের কামরা আর মার শরীরে টেনে দেয়া ভারী চাঁদরটার কথা।
কেমন করে মরে যায় আলীচাচা?
অসুখে।
তারপর?
তারপর– মরে যায়। আত্মা আকাশে চলে যায়।
জরিনা একটু ওপরে তাকায়। পরে চোখ নামিয়ে এনে শুধোয়, কেমন করে? তুমি তো দেখেছ বলো না।
সব কিছু হারিয়ে যেতে থাকে তখন এই আলো, গাছ, মানুষ–সব কিছু। সবচেয়ে বড়ো যে হারিয়ে ফেলা, সেটাই জীবন। যখন সময় হয়, তখন মানুষের মন খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সব কিছু দেখতে চায়, ধরতে চায়, ধরে রাখতে চায়, কিন্তু পারে না। আস্তে আস্তে আকাশের আলো সন্ধ্যের মতো হয়ে আসে। বৃষ্টি হলে যেমন দূরের সব কিছু ঝাঁপসা হয়ে যায়, তেমনি সব ঝাঁপসা হয়ে মিশে যায়। কাউকে দেখতে পায় না। বুকের ভেতরে নিঃশ্বাস কাঁপতে থাকে। আঙুলের ডগা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। তখন খুব ক্লান্ত লাগে। তখন আর কিছু মনে থাকে না। তখন মানুষ মরে যায়।
জরিনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়, মানুষ মরে না গিয়ে বেঁচে থাকতে পারে না? একটা চারদিক বন্ধ বড় কাঁচের বেলুন যদি সে পেত, তাহলে তার ভেতরে গিয়ে বসে থাকত, উঠে যেত আকাশের অনেক ওপরে। তাহলে হয়ত সে কোনদিন মরে যেত না। বহুদিন অনেকদিন সে বেঁচে থাকতে পারতো।
আলীজাহ্ উঠে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো তার চুলে আঙুল দিয়ে ব্রাশ করে, নাড়া দিয়ে বলে, চল, আমার ঘরে যাবি। আজ ঘুমুলে চলবে না। নতুন রেকর্ড এনেছি, শুনবি চল।
আলীজাহ্ ওর মনের মেঘ দূর করতে চায়। সিঁড়ির নিচে এসে বলে, দুটো করে সিঁড়ি একবারে। পারবি?
খু–ব।
দেখি তাহলে। কুইক। হ্যাঁ, ওয়ান–টু থ্রি।
ওপরে উঠে জরিনা হাঁপাতে থাকে। হাতের পিঠ দিয়ে নাক ঘষে দম নিয়ে হেসে ফেলে।
নিচে আলীজাহ্ দিকে তাকিয়ে বা হাত নেড়ে বলে, তুমি কিন্তু তিনটে করে আসবে।
এসো।
আলীজাহ্ উঠতে থাকে। ভান করে, যেন তার খুব কষ্ট হচ্ছে। জরিনা আবার হেসে ওঠে।
.
বাড়িটা ঠিক যেমন ভেবেছিল তেমনি শাদা। সমুখে লন। আর মানুষ। আর বাতি খুব কম, এখানে ওখানে। তবু মনে হয়, কোথাও আলোর অভাব নেই এতটুকু।
জরিনা আর আলীজাহ্ যখন গাড়ি থেকে নামলো তখন প্রায় সবাই এসে গেছে। জরিনার পরনে শাদা সাটিনের কামিজ। কদিন আগে চুল ট্রিম করা হয়েছে কাঁধ অবধি; মাথার ওপরে একটা লাল টেপ বো করে বাঁধা। বেরুবার আগে আলীজাহ্ চেয়ারে বসে তাকে দুহাটুর মধ্যে এনে কপালের ওপরে ছোট ছোট চুলগুলো টেনে দিয়েছে, ঝালরের মত এখন তারা চুমু খেয়ে আছে তার চওড়া কপাল। জরিনার চোখ আবেগে উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ, আলীজাহ্ নিবিড় প্রীতিতে মন নির্ভয়।
লনের মাঝামাঝি চেরা–সিঁথি পথ গেছে বারান্দার দিকে। গাড়ি থেকে নেমে আলীজাহ্ জরিনাকে হাত ধরে নামালো। তারপর কাঁধে তার বিশাল করতল রেখে বলল, স্মিত মুখে, নিচু গলায়, এখানে।
জরিনা আলীজাহ্ দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফেরাল সমুখে। সমুখে এক দম্পতি–তারাও যাচ্ছিল বাবান্দার দিকে, পরস্পর নিবিড় হয়ে। লোকটার বাঁ হাতে মহিলাটির মুঠো। আর তার খোঁপার বন্ধনমূলে চাঁদের মতো আধখানা বেরিয়ে আছে শাদা ফুলের মালা।
জরিনার ভালো লাগল তার চলার ছন্দ। সে একবার চোর–চোখে তাকাল আলীজাহ্ দিকে। আস্তে আস্তে কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল আলীজাহ্ করতল। তারপর মুঠো করে ধরলো। আলীজাহ্ তর্জনী আর মধ্যমা।
বারান্দার সিঁড়ির ওপরে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল– জরিনা তাকে দূরে থেকেই দেখেছিল দীর্ঘ, ফর্সা, লাল উজ্জ্বল পাড়হীন শাড়ি পড়া, সে আলীজাকে দেখে সুন্দর একটা ভঙ্গিতে এক ধাপ নেমে এসে কলকণ্ঠে বলে উঠল, আসুন, ইস, এত দেরি। তারপর জরিনাকে দেখে, জরিনার চিবুক স্পর্শ করে বলল, ঝুঁকে পড়ে, কী নাম?
জরিনা আবছা গলায় উত্তর করল তার। মেয়েটি মুখ সরিয়ে নিতেই জরিনার এক মুহূর্তের মেঘ কেটে গেল অন্ধকার ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে ওঠার মত। যে লাল শাড়ির ঔজ্জ্বল্য খুব কাছাকাছি এসে তার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন। করেছিল তা অপসারিত হলো। সে তখন সম্পূর্ণ করে তাকে দেখল, মুগ্ধ হলো।
আলীজাহ্ বললো, এরই জন্মদিন। বুঝলি?
জানি।
আলীজাহ্ তাকে নিয়ে এগিয়ে গেল আরো ভিড়ের ভেতর। আলীজাহ্ উপস্থিতিতে হঠাৎ যেন মৌমাছি হয়ে উঠল সবাই। জরিনা তাকিয়ে দেখে। তার গর্ব হয়। তার আলীচাচা, এ যেন তারই অহংকার। আলীজাহ্ আঙুল ধরে নিবিড় হয়ে সে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
এত সুন্দর মানুষের ভিড়। কাপড়ের, ফুলের, শাড়ির গন্ধ। আর মানুষের গাত্রসৌরভ। আর কণ্ঠস্বর। আর আলো। তার আশ্চর্য লাগে। স্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো মুহূর্তের মতো মনে হয়।
জরিনাকে গিয়ে আলীজাহ্ নিয়ে বসল একটা সোফায়। আলীচাচাকেও আজ তার কী দীর্ঘ মনে হচ্ছে। চারদিকের এত কোলাহল, গতি, কথা, কিছুই তার চোখে পড়ছে না। কিছুই সে শুনছে না, নিতে পারছে না আলাদা করে কোনো কিছুই। সব কিছু এক হয়ে তার মনের ভেতরে এঁকে যাচ্ছে একটি মাত্র ছবি।
পাশ থেকে নরোম একটা হাতের স্পর্শে জরিনা তাকিয়ে দেখল যার জন্মদিন সেই লাল শাড়ি পরা মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ সে বারান্দা আর ড্রইং রুমের একোণ থেকে ওকোণ অবধি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কখন এসে দাঁড়াল তার পেছনে? মেয়েটি গ্রীবা বাঁকিয়ে সুরেলা গলায় শুধালো, কেমন?
জরিনা কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। ও তাকে এতখানি মুগ্ধ করেছে যে ওর সমুখে কেমন ভেতর থেকে সব কিছু সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
আলীজাহ্ তার কনুইয়ে ঠেলা দিয়ে বলল, যা না।
বাবা, আপনি যা কথক মানুষ আর তার ভাইঝি এমন?
তাহলে তুমি ওকে চিনতেই পারো নি। আলীজাহ্ বলল জরিনার দিকে মুখ আধো নামিয়ে, আমার সঙ্গে যা গল্প করে তুমি যদি শুনতে।
হবে না। আপনারই ভাইঝি তো।
বাহ্, আগেও দোষ পরেও দোষ। বেশ তো।
মেয়েটি কাঁচভাঙ্গার অনুকরণে হেসে উঠলো কথা শুনে।
ঠিক তখন কারা দুজন এদিকে আসছিল আলীজাহ্কে দেখে, আলীজাহ্ উঠে দাঁড়াল। কথা বলতে লাগল। নাটকের কথা, ফিল্মের কথা, অনেকের কথা, যাদের জরিনা চেনে না।
জন্মদিন–মেয়েটি তখন তার পাশে এসে বসলো। জরিনাকে কাছে টেনে নিয়ে, এত ভাল লাগল তার তখন, সে বললো, লক্ষ্মী মেয়ে তুমি, কী পড় বললে না? কোন স্কুলে?
স্কুলের নাম বলল জরিনা। হঠাৎ হালকা হয়ে গেল তার বুকের ভয়টুকু। সে কথা বলতে লাগল –অনর্গল, দ্রুত, চোখ হাত নেড়ে, নাচিয়ে?
বাহ, চাচার কাছে থেকে তুমিও বেশ কথা বলতে শিখেছ। চাচা তোমাকে অ্যাকটিং শেখাবে না?
আমি শিখব না। ভালো লাগে না।
তাহলে কী শিখবে? হোয়াট ইউল বি?
আলীজাহ্ কথা বলতে বলতে দূরে সরে যাচ্ছে। জরিনা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে দেখে উত্তর করল, আপনি পারেন?
কী?
অ্যাকটিং।
একটুকুও না।
আলীচাচা এত সুন্দর করতে পারে।
তুমি দেখেছ?
ক–ত।
আলীজাহ্ আরো দূরে সরে গেছে। ঠাৎ জরিনা প্রশ্ন কবে, আপনার জন্মদিন আবার কবে হবে?
ওমা কেন?
মেয়েটি বিস্ময়ে ঠোঁট গোল করে আনে। চোখের মণি একটা সুন্দর ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকে।
আমি আসবো।
তুমি এমনি আসবে। রোজ আসবে, কেমন?
জরিনার লজ্জা কবে। ঘাড় কাৎ করে উত্তর দেয়। একটু পরে মেয়েটি বলে, তুমি বসো, আমি এই আসছি।
কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যায় আর আসে না। মনটা প্রথমে উদগ্রীব হয়ে থাকে, পরে আস্তে আস্তে আস্তে নিভে যায়। তখন ম্লান চোখে দৃষ্টি করে ইতস্তত।
আলীজাহ্ও নেই।
একটু পরে জরিনা উঠে দাঁড়ায়। এদিকে ওদিকে তাকাতে থাকে। একটা ছোট্ট দলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো চোখে পড়ে না। জরিনা এগোয়, এতক্ষণে আলীজাকে সে দেখতে পেয়েছে।
দূরে, বারান্দার একেবারে শেষ মাথায়, কয়েকটা সবুজ পাতা গাছের সঙ্গে পিঠ ছুঁইয়ে আলীজা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সমুখে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তিনজন মহিলা। কী কথা বলছে কে জানে। এতদূরে থেকে ওদের হাসি ছড়ানো মুখ শুধু চোখে পড়ে। আলীজাহ্ ঝুঁকে পড়ে ডান হাতের তর্জনী দুলিয়ে একজনকে অনেকক্ষণ ধরে কী যেন বলছে। বলা শেষ হলো। হেসে উঠল সবাই।
জরিনা আরো একটু কাছে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সব। হঠাৎ নিজেকে খুব ছোট মনে হলো তার। আলীজাহ্ ওপর রাগ হলো। রাগ হলো ওই তিনটে মহিলার ওপর। মনে হলো, এক্ষুণি সে যদি চিৎকার করে উঠতে পারত না, চিৎকার নয়–এখন যদি ফিট হয়ে যেতে পারত, তাহলে খুব শাস্তি হতো ওদের। কিন্তু বহুবার জরিনা দেখেছে, যা চাওয়া যায় তা হয় না।
তাই কিছু বলবে না সে ওদের। সরে এসে এদিকের একটা থামের আড়ালে নিজেকে ঢেকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল জরিনা। দাঁড়িয়ে পা সমুখে টেনে কোমর থেকে গোড়ালি অবধি একটা টান টান আবছা ধনুক সৃষ্টি করে রইলো।