উদ্ধার
লেগান, জেনআর… আবহাওয়া বিজ্ঞানে তার অবদান অনস্বীকার্য। এই লোকটিকে নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা লেগান কন্ট্রোভার্সি নামে সুপরিচিত। কারণ এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তারই অবহেলার দরুন হ্যারি সেলডনকে পড়তে হয়েছিল ভয়াবহ বিপদে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঘটনাটা কী আসলেই লেগানের বোকামী নাকি সে কারো সাথে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে কাজটা করেছিল। এটা নিয়ে যে তর্ক শুরু হয় তা আজও চলছে। বিস্তারিত গবেষণা করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। তবে লেগানের বিরুদ্ধে যে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠে তাই পরবর্তী কয়েক বছরের ভেতর তার পেশাগত এবং সামাজিক জীবন পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়..
—-এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা
.
২৫.
দিনের শেষে জেনআর লেগানকে খুঁজে পেলো ডর্স। তার উদ্বিগ্ন সম্ভাষণের জবাবে লোকটা শুধু সামান্য একটু মাথা নাড়ল
কেমন আছে সে? অধৈর্য সুরে জিজ্ঞেস করল ডর্স।
লেগান কম্পিউটারে কাজ করছিল। বলল, কে কেমন আছে?
আমার গ্রন্থাগার কোর্সের ছাত্র, ড. সেলডন। আপনার সাথে আপারসাইডে গিয়েছিল। কোনো সাহায্য করতে পেরেছে?
কীবোর্ড থেকে হাত সরালো লেগান, হ্যালিকনের ওই লোক? কোনো কাজেই আসেনি, শুধু ঘুরে বেড়িয়েছে। কী যে দেখেছে ও-ই জানে। ওকে কেন পাঠিয়েছিলেন আপনি?
নিজেই গিয়েছে, কেন, আমি বলতে পারব না। এখন কোথায় সে?
কাঁধ নাড়ল লেগান। আমি কী করে বলব? আছে কোথাও।
আপনার সাথে নিচে নামার পর কোথায় যাবে বলেছে কিছু?
আমাদের সাথে নিচে নামেনি।
তাহলে কখন নেমেছে?
জানি না। খেয়াল করিনি। প্রচুর কাজ ছিল। দুদিন আগে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। যা আমার হিসেবে ছিল না, যন্ত্রপাতিগুলো সব উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে দেয়। আশা করছিলাম হয়তো খানিকটা দিনের আলো ফুটবে, কিন্তু হয়নি। এখন আমি বোঝার চেষ্টা করছি কেন এমন হলো। কিন্তু আপনি এসে বিরক্ত করা শুরু করলেন।
তার মানে আপনি তাকে নিচে নামতে দেখেননি।
দেখুন ওর কথা আমার মনেই ছিল না। বোকা লোকটা ঠিকমতো তৈরি হয়েও আসেনি। জানতাম ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারবে না। তাই একটা সোয়েটার দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও শরীরের নিচের অংশের কোনো উপকার হতোনা। এলিভেটর চালানো শিখিয়ে বলেছিলাম যে খুব বেশি সমস্যা হলে যেন সে একাই নিচে নেমে আসে, তারপর এলিভেটর আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উপরে উঠে যাবে। আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। খুব সহজ ব্যাপার। আমি নিশ্চিত যে ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে সে নিচে চলে এসেছে।
কিন্তু আপনি জানেন না ঠিক কখন সে নিচে নেমে এসেছে?
না, জানি না। বললাম তো ব্যস্ত ছিলাম। তবে আমরা যখন নামি তাকে আশেপাশে কোথাও দেখিনি। কোনো সন্দেহ নেই আমাদের আগেই চলে এসেছে।
অন্য কেউ তাকে নিচে নামতে দেখেছে?
ক্লজিয়া দেখে থাকতে পারে। সেলডনের সাথে কিছুক্ষণ ছিল সে। ওকেই জিজ্ঞেস করছেননা কেন?
ক্লজিয়াকে তার কোয়ার্টারেই পেল ডর্স। এইমাত্র গোসল করে বেরিয়েছে।
উপরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বলল সে।
আপারসাইডে হ্যারি সেলডনের সাথে ছিলে তুমি? জিজ্ঞেস করল ডর্স।
ভুরু খানিকটা বাঁকা করে জবাব দিল ক্লজিয়া। হ্যাঁ, কিছুক্ষণ ছিলাম; উপরে যে গাছপালা রয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন করছিল। চমৎকার মানুষ। সবকিছুর ব্যাপারেই কৌতূহলী। লেগান ডাকার আগ পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি ওর প্রশ্নের জবাব দিতে। লেগানও বেশ খেপেছিল, কারণ কোনো কিছুই তার আশা অনুযায়ী হচ্ছিল না-
বাধা দিল ডর্স, তাহলে তুমি হ্যারিকে নিচে নামতে দেখোনি?
লেগান ডাক দেওয়ার পর তাকে আর একবারও দেখিনি। আমরা যখন আসি তখন সে উপরে ছিল না।
কিন্তু আমি তাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
ক্লজিয়াকে অস্থির দেখালো। তাই নাকি? আশেপাশেই কোথাও আছে। নিশ্চয়ই।
না, নিচে কোথাও নেই। ডর্স বলল, তার উদ্বেগ বাড়ছে। যদি এখনো উপরেই থেকে যায়?
অসম্ভব। ছিল না। তাছাড়া আমরা চলে আসার আগে আশেপাশে ওকে খুঁজেছি। লেগান শিখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে নিচে নামতে হবে। তাছাড়া সেলডনের পরনে ঠাণ্ডা ঠেকানোর মতো পোশাকও ছিল না। লেগান বলেছিল কষ্ট হলে আমাদের জন্য অপেক্ষা। করার দরকার নেই। নিশ্চয় শীতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই আমাদের আগেই চলে এসেছে।
কিন্তু কেউ তাকে নামতে দেখেনি। মারাত্মক কোনো সমস্যা হয়েছিল উপরে?
কিছুই না। অন্তত আমি যতক্ষণ ওর সাথে ছিলাম। বেশ খোশমেজাজেই ছিল শুধু ঠাণ্ডা বাদে।
কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ডর্স। কেউ যখন তাকে নামতে দেখেনি তাহলে এখনো সে উপরেই আছে। আমাদের গিয়ে একবার দেখা উচিত।
নার্ভাস হয়ে পড়েছে ক্লজিয়া, বললাম তো আমরা নামার আগে ওর খোঁজ করেছি। পাইনি।
চলো গিয়ে খুঁজে দেখি।
কিন্তু আমি আপনাকে উপরে নিয়ে যেতে পারব না। আমি একজন শিক্ষানবীশ আর আপারসাইডের গম্বুজের দরজা খোলার কম্বিনেশন আমার কাছে নেই। ড. লেগানের কাছে যেতে হবে আপনাকে।
.
২৬.
ডর্স ভেনাবিলি ভালো করেই জানে যে লেগান এখন কিছুতেই উপরে যেতে চাইবে না। জোর খাটাতে হবে।
প্রথমে সে গ্রন্থাগার এবং ডাইনিং এরিয়াগুলো খুঁজে দেখল। তারপর সেলডনের কামরায় যোগাযোগ করল, সবশেষে সরাসরি তার কামরার দরজায় নক করল। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ফ্লোর ম্যানেজারকে দরজা খুলতে বাধ্য করল। সেলডন ভিতরে নেই। গত কয়েক সপ্তাহে সেলডনের সাথে যাদের পরিচয় হয়েছে তাদের সবাইকে জিজ্ঞেস করল। কেউ খোঁজ দিতে পারল না।
বেশ, লেগানকে এবার আপারসাইডে যেতে বাধ্য করতে হবে যত রাতই হোক। সহজে রাজী হবে না। আর উপরে ভোলা প্রকৃতিতে যেখানে হালকা বৃষ্টি প্রবল। তুষারপাতে পরিণত হচ্ছে সেখানে তর্ক করে কতক্ষণ সময় নষ্ট করতে পারবে।
হঠাৎ একটা চিন্তা এলো মাথায়, দ্রুত ছুটে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট কম্পিউটারের কাছে যেখানে শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং শিক্ষকদের দৈনিক কর্মকাণ্ডের যাবতীয় তথ্য থাকে।
কীবোর্ডের উপর ঝড়ের বেগে হাত চালালো সে, কিছুক্ষণের ভিতরেই পেয়ে গেল যা খুঁজছে।
তিনজনের ঘোড়া পাওয়া গেল। ক্যাম্পাসের অন্যপ্রান্তে থাকে। ছোট একটা বায়ুন ভাড়া করল ডর্স। নিজেই চালিয়ে পৌঁছে গেল সেখানে। তিনজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে পেলেই হবে।
ভাগ্য তার পক্ষে। প্রথম দরজায় নক করতেই সাড়া পেল। দরজার মাথায় একটা অনুসন্ধানী বাতি জ্বলে উঠল। নিজের আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার ঢোকালো সে। দরজা খুলে একটা মোটাসোটা গোলগাল লোক বেরিয়ে এল, শরীরের উর্ধ্বাংশে কোনো পোশাক নেই। মাথার চুল এলোমেলো। সম্ভবত ডিনারের আগমুহূর্তে হাতমুখ ধুচ্ছিল।
দুঃখিত, লোকটা বলল, আপনি অসময়ে এসেছেন। কী করতে পারি আপনার জন্য, ড. ভেনাবিলি?
আপনি রোজেন বেনাস্ট্রা, চীফ সিসমোলজিস্ট? এক নিঃশ্বাসে জিজ্ঞেস করল ডর্স।
হ্যাঁ।
এটা একটা ইমার্জেন্সি। আপারসাইডের গত কয়েক ঘণ্টার সিসমোলজিক্যাল রেকর্ড দেখতে চাই।
কেন? কিছুই তো হয়নি। হলে জানতাম। সিসমোগ্রাফ আমাদের জানিয়ে দিত।
আমি বায়ুমণ্ডলের কোনো সমস্যার কথা বলছি না।
আমিও না। ওই কারণে সিসমোগ্রাফের প্রয়োজন হয় না। আমি বলছি সূক্ষ্ম কোনো চিড় বা ফাটলের কথা। সেরকম কিছু নেই আজকে।
সেইসবও না। দয়া করে আমাকে সিসমোগ্রাফের কাছে নিয়ে যান, কষ্ট করে একটু বুঝিয়ে দিন ওটা কী তথ্য জানাচ্ছে। এটা একজনের জীবন মরণের প্রশ্ন।
আমাকে একটা ডিনারে যেতে হবে
আমি বলছি জীবন মরণ প্রশ্ন।
বুঝতে পারছি না- ডর্সের আগুনঝরা দৃষ্টির সামনে হোঁচট খেল বেনাস্ট্রা। মুখ মুছে শার্ট চাপালো গায়ে। ম্যাসেজ রিপ্লাই যন্ত্রে দ্রুত একটা ম্যাসেজ লিখে রওয়ানা দিল।
ডর্সের নির্দয় ধাক্কার চোটে প্রায় দৌড়াতে হলো বেনাস্ট্রাকে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট সিসমোলজী বিল্ডিং-এর দিকে যাচ্ছে তারা। সিসমোলজীর ব্যাপারে ডর্সের কোনো ধারণাই নেই। বলল, নিচে? আমরা নিচে নামছি?
অবশ্যই। আবাসিক লেভেলের নিচে। ভূ-ত্বকের অনেক গভীরে জমাট বাঁধা শিলাস্তরে সিসমোগ্রাফ বসানো হয়। নাগরিক জীবনের ঝাট এবং কৃত্রিম কম্পন থেকে অনেক দূরে।
কিন্তু এত নিচ থেকে আপারসাইডে কী ঘটছে সেটা আপনারা কীভাবে বুঝেন?
গম্বুজের অপেক্ষাকৃত পাতলা জায়গাগুলোতে চাপঅনুভবক্ষম যন্ত্র বসানো আছে। তারের সাহায্যে সেগুলো আবার সিসমোগ্রাফের সাথে যুক্ত। ছোট একটা পাথর গড়িয়ে গেলেও যে দাগ তৈরি হবে আমাদের ইন্ডিকেটর সেটাও স্ক্রীনে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। প্রবল বাতাসে-
ঠিক আছে, ঠিক আছে। অধৈর্য সুরে বাধা দিল ডর্স। সে লেকচার শুনতে আসেনি। যন্ত্র কী পারে আর পারে না এটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। আপনি মানুষের পায়ের চিহ্ন ডিটেক্ট করতে পারবেন?
পায়ের চিহ্ন? বেনাস্ট্রাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো। আপারসাইডে সেটা অস্বাভাবিক।
পুরোপুরি স্বাভাবিক। আজকে দুপুরেই একদল ভূ-তাত্ত্বিক আপারসাইডে গিয়েছিল।
ও, তারপরেও সম্ভাবনা কম। খুঁজে বের করা খুব মুশকিল।
আপনি একটু কষ্ট করলে মোটেই মুশকিল হবে না, আমি সেটাই চাই।
ডর্সের কণ্ঠে আদেশের সুর লক্ষ্য করে প্রতিবাদ করার ইচ্ছা হলেও কিছু বলল না বেনাস্ট্রা। একটা বোতাম চাপল। সাথে সাথে জীবন্ত হয়ে উঠল কম্পিউটার স্ক্রন।
স্ক্রীনের সর্বডানে বড়োসড় একটা আলোর বিন্দু তৈরি হলো। সেই বিন্দু থেকে একটা সরলরেখা আড়াআড়িভাবে এগোতে লাগল বামদিকে। সরল রেখাটা দেখে মনে হলো জ্যান্ত কোনো সরীসৃপ। গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে। ডর্স প্রায় সম্মোহিত হয়ে গেল।
একেবারে শান্ত, বলল বেনাস্ট্রা। আপনি যা দেখছেন সেটা বায়ুর চাপের পরিবর্তন, বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। যন্ত্রপাতিগুলোর মৃদু কম্পন। এছাড়া তো আর কিছু নেই।
ঠিক আছে, কয়েক ঘণ্টা আগের কী অবস্থা? এই ধরুন, আপনি কী আজকে পনেরোশ ঘণ্টার রেকর্ড বের করে দেখাতে পারবেন। রেকর্ড রাখেন তো নিশ্চয়ই?।
কম্পিউটারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল বেনাস্ট্রা। এক দুই সেকেন্ড মনে হলো স্ক্রীনে একটা যুদ্ধ চলছে। তারপর ধীরে ধীরে সব শান্ত হলো। স্ক্রীনে আবার একটা সরলরেখা ফুটে উঠল।
সেন্সর ম্যাক্সিমামে রাখা আছে। বিড় বিড় করে বেনাস্ট্রা বলল। সরলরেখাটা যতই ডানদিকে এগোচ্ছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই।
এগুলো কী? জিজ্ঞেস করল ডর্স। বলুন আমাকে।
যেহেতু আপনি জানিয়েছেন আপারসাইডে মানুষ গিয়েছিল আজকে, কাজেই ধরে নেওয়া যায় এগুলো পায়ের চিহ্ন ওজনের তারতম্য, জুতার ছাপ। আপনি না জানালে আমাকে হয়তো অনুমান করে নিতে হত। এগুলোকে সাধারণত আমরা চিহ্নিত করে থাকি বিপজ্জনক নয় এমন কম্পন হিসেবে।
কতজন মানুষ ছিল আপনি বলতে পারবেন?
শুধু চোখে দেখে বলা যাবে না। বুঝতেই পারছেন এখানে আমরা বেশ কয়েকটি ঘটনার সম্মিলিত সামগ্রিক ফলাফল পাই।
বলছেন শুধু চোখে দেখে কিছু বোঝা যাবে না। এই কম্পিউটার দিয়ে সামগ্রিক ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রতিটি উপাদান পৃথক করা যাবে?
সন্দেহ আছে। এগুলো সব মিনিমাল ইফেক্ট এবং আপনাকে শব্দের কথাও মাথায় রাখতে হবে। ফলাফল যা পাওয়া যাবে সেটা নির্ভরশীল নাও হতে পারে।
বেশ, আপনি সময়টাকে তাহলে আরেকটু এগিয়ে নিন। পায়ের চিহ্নগুলো কতদূর গেছে দেখা দরকার। ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে এগিয়ে যেতে পারবেন।
করলেও শুধু একটা সাদা রেখা দেখা যাবে। একটা কাজ অবশ্য করা যায়। আমি পনেরো মিনিট এগিয়ে যেতে পারি। দ্রুত ফলাফল দেখে নিয়ে আবার পনেরো মিনিট এগিয়ে যাব। কী বলেন?
চমৎকার। তাই করুন।
দুজনেই গভীর মনোযোগে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। বেনাস্ট্রা বলল, কিছু নেই। দেখেছেন?
আবার একটা সরল রেখা ফুটে উঠল আর শুধু হেচকি উঠার মতো শব্দ।
পায়ের ছাপগুলো কখন থেমেছে?
দু ঘন্টা আগে। একটু কম বেশি হতে পারে।
আর যখন থেমেছে তখন কী আগের চেয়ে পায়ের ছাপের পরিমাণ কম ছিল।
রেগে উঠল বেনাস্ট্রা। বলতে পারব না। আমার মনে হয় না সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেও সঠিকভাবে নির্ণয় করা যাবে।
ঠোঁটদুটো পরস্পরের সাথে শক্তভাবে চেপে ধরল ডর্স। যন্ত্রটার নাম যেন কী বলেছিলেন–চাপ অনুভবক্ষম যন্ত্র–ওগুলোই পরীক্ষা করে দেখছেন–ভূ-তাত্ত্বিকদের যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে যেটা বসানো আছে?
হ্যাঁ, সেটাই। আপনি কী বাকিগুলোও একটা একটা করে দেখতে বলছেন? বেনাস্ট্রার কণ্ঠে অবিশ্বাস।
না, এটাই দেখতে থাকেন। একজন হয়তো দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিল এবং সে হয়তো আপনার যন্ত্রের কাছে ফিরে এসেছিল।
মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল বেনাস্ট্রা।
স্ক্রীনে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে ডর্স ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করল।
এটা কী? একই সাথে আঙ্গুল দিয়েও দেখিয়ে দিল।
জানি না। শব্দ হতে পারে।
না। একটা ধারাবাহিকতা আছে। একজন মানুষের পায়ের ছাপ হতে পারে?
নিশ্চয়ই, আবার একডজন অন্য বস্তুও হতে পারে।
পায়ের ছাপগুলোর সময় ধরেই আসছে, তাই না? তারপর একটু বিরতি নিয়ে বলল, একটু সামনে এগোন।
কথামতো কাজ করল বেনাস্ট্রা আর স্ক্রীন স্থির হওয়ার পর ডর্স বলল একটু অসমান এবং ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে, তাই না?
হয়তো। মাপা যাবে।
দরকার নেই। আপনি নিজেই দেখছেন অসমান ভাবটা বড়ো হচ্ছে। পায়ের ছাপটা চাপঅনুভবক্ষম যন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। আবার সামনে বাড়ন। দেখুন কখন। থেমেছে।
খানিক বিরতির পর বেনাস্ট্রা বলল, বিশ থেকে পঁচিশ মিনিট আগে থেমেছে। এরপর কিছুটা সতর্ক ভঙ্গিতে, এগুলো যাইহোক না কেন।
ওগুলো পায়ের ছাপ। পাহাড় প্রমাণ দৃঢ়তার সাথে বলল ডর্স। আমি আর আপনি যখন এখানে সময় নষ্ট করছি তখন উপরে একটা মানুষ ঠাণ্ডায় জমে অসহায়ের মতো মারা যাচ্ছে। আপনার কিছু বলার দরকার নেই। শুধু আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের জেনআর লেগানের সাথে যোগাযোগ করুন। আপনাকে বলেছি জীবন মরণ প্রশ্ন, ওকেও তাই বলুন।
ম্যাসেজ প্ল্যাটফর্মে লেগানের হলোগ্রাফ ফুটে উঠতে তিন মিনিটের বেশি সময় লাগল। রাতের খাবার ফেলে উঠে আসতে হয়েছে লোকটাকে। হাতে একটা। ন্যাপকিন। তেল লেগে নিচের ঠোঁট চকচক করছে।
লম্বা মুখে কড়া বিপদ সংকেত। জীবন মরণ? এটা আবার কী কথা? কে আপনি? এরপর সে ডর্সকে দেখতে পেল। কারণ লেগানের স্ক্রীনে যেন তার ছবি ফুটে উঠে সেজন্য ডর্স বেনাস্ট্রার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখেই লেগান বলল। আবার আপনি, কী মুশকিল।
মুশকিলের কিছু নেই। বলল ডর্স। রোজেন বেনাস্ট্রার সাথে কথা বলেছি আমি। উনি চীফ সিসমোলজিস্ট। আপনারা নেমে আসার পর উনি সিসমোগ্রাফ থেকে একজন মানুষের পায়ের চিহ্ন বের করেছেন। সেই মানুষটা এখনো আপারসাইডে রয়ে গেছে। সে আর কেউ নয়, আমার ছাত্র হ্যারি সেলডন, যে আপনার সাথে। আপারসাইডে গিয়েছিল এবং আপনার দায়িত্ব ছিল তার দিকে লক্ষ্য রাখা। কোনো সন্দেহ নেই সে এখন ভয়ংকর বিপদে আছে।
এখন আপনি আমাকে উপরে নিয়ে যাবেন, যন্ত্রপাতি যা প্রয়োজন সব নেবেন সাথে। এই মুহূর্তে আমার কথামতো কাজ না করলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে যাব, যদি প্রয়োজন হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের কাছে যাব। যেভাবেই হোক আমাকে উপরে যেতেই হবে এবং আপনার দেরীর কারণে যদি হ্যারি সেলডনের কোনো ক্ষতি হয় তার জন্য দায়ী থাকবেন আপনি। এমন ব্যবস্থা করব যেন কর্তব্যে অবহেলার জন্য আপনাকে দায়িত্বশীল পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। যেভাবে পারি আমি আপনার মান-মর্যাদা, একাডেমিক ক্যারিয়ার সব ধ্বংস করে দেব। যদি সে মারা যায় তাহলে আপনাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করব। আমি কিন্তু আপনাকে আগেই বলেছি যে সে মারা যাচ্ছে।
হিংস্র শ্বাপদের মতো বেনাস্ট্রার দিকে ঘুরল লেগান, আপনি কী ডিটেক্ট।
কিন্তু বাধা দিল ডর্স। সে যা ডিটেক্ট করেছে আমাকে সেটা বলেছে আর আমি আপনাকে বলেছি। ওর উপর কোনো চোটপাট দেখাবেন না। আপনি আসছেন? এখনি?
আপনার কোনো ভুল হচ্ছে না তো? ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল লেগান। জানেন তো নিশ্চয়ই, আপনার ভুল হলে যে হুমকিগুলো আমাকে দিয়েছেন সেগুলো আপনার বেলায়ও ঘটতে পারে।
জানি, কিন্তু নরহত্যা করে কেউ পার পায় না, বলল ডর্স। আমার একটা সুযোগ নিতে কোনো আপত্তি নেই। ভুল সিদ্ধান্ত হলে তার জন্য আমি জবাবদিহি করতে প্রস্তুত। কিন্তু আপনি কী খুনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে পারবেন?
রাগে লাল হয়ে উঠল লেগান-এর চেহারা। আমি আসছি কিন্তু যদি দেখা যায় যে। তোমার ছাত্র আমাদের আগেই ফিরে এসে গম্বুজের নিচে কোথাও ফুর্তি করছে, তখন আমার কাছ থেকে তুমি কোনো দয়া পাবে না।
.
২৭.
তিনজন নিঃশব্দে এলিভেটরে চড়ল। ডিনারের মাত্র অর্ধেকটা শেষ করতে পেরেছিল লেগান। তারপর কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই স্ত্রীকে হতবিহ্বল অবস্থায় ফেলে রেখে চলে আসতে হয়। বেনাস্ট্রা কিছুই খায়নি এবং বোধহয় কোন বান্ধবীকে হতাশ করতে হয়েছে সেও কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে আসতে পারেনি। ডর্স ভেনাবিলিও কিছু খায়নি এবং তিনজনের ভেতর তাকেই বেশি চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তার এক হাতে একটা থারমাল কম্বল অন্যহাতে দুটো ফটোনিক ফাউন্ট।
আপারসাইডের প্রবেশ পথে পৌঁছে আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার ঢোকালো লেগান। দরজা খুলে গেল। ঠাণ্ডা বাতাস সুচের মতো এসে আঘাত করল তিনজনকে। গুঙিয়ে উঠল বেনাস্ট্রা। কেউই প্রয়োজনীয় গরম পোশাক পরে আসেনি। পুরুষ দুজনের অবশ্য বেশিক্ষণ এখানে থাকার ইচ্ছা নেই।
বরফ পড়ছে। ডর্স বলল।
জবাব দিল লেগান, হালকা তুষারপাত। তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। মানুষ মরে যাওয়ার মতো কিছু না।
নির্ভর করছে কতক্ষণ এখানে থাকবে তার উপর, তাই না, ভেঁজা তুষার দিয়ে শরীর ঢেকে রাখলে কোনো লাভ হবে না।
স্বীকার করল লেগান। বেশ, কোথায় সে? বিতৃষ্ণা নিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে তাকালো। পেছনে প্রবেশপথের হালকা আলোতে অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে।
ড. বেনাস্ট্রা, আপনি কম্বলটা রাখুন। আর আপনি ড. লেগান, দরজাটা বন্ধ করুন। দেখবেন, আমরা যেন আবার আটকে না যাই।
সেরকম কোনো সিস্টেম নেই। আমাদের কী আপনি বোকা ভেবেছেন?
তা ভাবিনি, কিন্তু আপনারা বাইরে কাউকে ফেলে রেখে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারেন যেন সে আর গম্বুজের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরতে না পারে।
বাইরে যদি কেউ থাকে, কোথায় সে। দেখান আমাকে।
যেকোনো জায়গাতেই পড়ে থাকতে পারে। দুই হাত তুলল ডর্স। দুকজিতে ফটোনিক ফাউন্টগুলো বাঁধা। ঘুরে ঘুরে আলো ছড়াচ্ছে।
পুরো এলাকাটা খুঁজে দেখা সম্ভব নয়। অদ্ভুত সুরে বিড়বিড় করল বেনাস্ট্রা।
ফাউন্টগুলোর আলো গোলাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পানির চেয়ে একটু ঘন তুষারের কণাগুলো এমনভাবে চিকচিক করছে যেন ঝক বাধা মৌমাছি। ফলে দৃষ্টিসীমা আরো সংকুচিত হয়ে পড়ল।
পায়ের ছাপগুলো আরো প্রকট হচ্ছে এখন। বলল ডর্স। সে নিশ্চয়ই চাপঅনুভবক্ষম যন্ত্রের দিকে এগিয়েছে। যন্ত্রটা কোথায়?
আমি জানি না। খেঁকিয়ে উঠল লেগান।
ড. বেনাস্ট্রা?
কিন্তু বেনাস্ট্রা আরো বেশি দ্বিধান্বিত। আমিও ঠিক জানি না। সত্যি কথা বলতে কী, আগে কখনো উপরে আসিনি। যন্ত্রটা বসানো হয় আমার জন্মেরও আগে। কম্পিউটারের মেমোরীতে আছে, কিন্তু আমরা কখনো জানার চেষ্টা করিনি। ঠাণ্ডা লাগছে আমার, বুঝতে পারছি না আপনাদের কী উপকারে আসব।
আপনাকে বেশিক্ষণ এখানে থাকতে হবে না, দৃঢ় গলায় বলল ডর্স। আসুন। আমার সাথে। প্রবেশপথ ঘিরে চক্কর দেব, ধীরে ধীরে চক্করটা বড়ো করব।
তুষারপাতের কারণে ভালোভাবে দেখা যাবে না। বলল লেগান।
জানি, নইলে এতক্ষণে তো খুঁজেই পেতাম। কোনো সন্দেহ নেই। যাইহোক, কয়েক মিনিটের বেশি লাগবে না। এই সময়ে আমরা মরে যাব না নিশ্চয়ই। প্রচণ্ড আত্ববিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে।
হাঁটা শুরু করল সে, হাত দুটো চার পাশে ঘোরাচ্ছে, চেষ্টা করছে যত বেশি দূর সম্ভব আলো ছড়িয়ে দেওয়ার, চোখ দুটোকে আরো বেশি তীক্ষ্ণ করে রেখেছে তুষারপাতের ভেতর দিয়ে গাঢ় অন্ধকার একটা বস্তু দেখার আশায়।
বেনাস্ট্রাই প্রথম দেখতে পেল, আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, ওটা কী?
ফাউন্টগুলো দ্রুত ঘোরালো ডর্স। মোচাকৃতির দুটো আলোর রেখা বেনাস্ট্রার নির্দেশিত স্থানটাকে আলোকিত করে তুলল। দৌড়ালো ডর্স, বাকি দুজন অনুসরণ করল তাকে।
সেলডনকে খুঁজে পেয়েছে তারা, এলোমেলোভাবে পড়ে আছেন, ভিজে জবুথবু অবস্থা। দরজা থেকে দশ মিটার আর মেটিওরোলজিক্যাল যন্ত্রপাতি থেকে মাত্র পাঁচ মিটার দূরে। ডর্স হার্টবিট পাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দরকার ছিল না। কারণ ডর্সের স্পর্শ পেয়েই চোখ খুলে গুঙিয়ে উঠলেন সেলডন।
কম্বলটা দিনতো, ড. বেনাস্ট্রা, ডর্সের কণ্ঠে পরিপূর্ণ স্বস্তি। কম্বলটা বরফের উপর বিছিয়ে বাকি দুজনকে বলল, ওকে তুলে এখানে শুইয়ে দিন, আমি পেচিয়ে নিচ্ছি। তারপর নিচে নিয়ে যাব।
এলিভেটরে ঢোকার পর কম্বলের ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরনো শুরু হলো। কারণ থারমাল কম্বলের তাপমাত্রা বাড়ছে। আস্তে আস্তে সেলডনের দেহ উষ্ণ হচ্ছে।
ওকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর, ডর্স বলল, ড. লেগান, আপনি একজন ডাক্তার নিয়ে আসবেন–সবচেয়ে ভালো ডাক্তার এবং যেন সাথে সাথেই আসে। ড. সেলডনের যদি কোনো ক্ষতি না হয় তাহলে আমি সব ভুলে যাব। কিন্তু সেজন্য তাকে পরিপূর্ণ সুস্থ হতে হবে। মনে রাখবেন-
লেকচার শোনাতে হবে না। ঠাণ্ডা গলায় বলল লেগান। ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত এবং ক্ষতিপূরণের জন্য তৈরি। আসলে প্রথম ভুলটা হয়েছে ওকে আসার অনুমতি দেওয়াটা।
কম্বলের একপ্রান্ত কিছুটা সরে গেল, শোনা গেল একটা দুর্বল নিচু কণ্ঠস্বর।
উনি কিছু বলছেন, বলল বেনাস্ট্রা।
হ্যাঁ শুনেছি। বলল ডর্স। উনি বলেছেন, কী হয়েছে?
হাজার দুঃশ্চিন্তা থাকা সত্ত্বেও হেসে ফেলল ডর্স। কারণ কথাটা তার কাছে খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
.
২৮.
ডাক্তারকে বেশ উৎফুল্ল দেখালো।
ঠাণ্ডায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো রোগী আমি আগে দেখিনি। ব্যাখ্যা করলেন তিনি। ট্র্যান্টরে এমন ঘটনা একেবারেই নেই।
হতে পারে, ততোধিক ঠাণ্ডা গলায় বলল ডর্স। আপনি এমন একটা দুর্লভ সুযোগ পেয়েছেন বলে আমিও খুশি। কিন্তু তার অর্থ কী এই দাঁড়ায় যে আপনি আসলে জানেন না ড. সেলডনের চিকিৎসা কীভাবে করতে হবে?
ডাক্তার বয়স্ক মানুষ, পুরো মাথাটাই চকচকে টাক, ধূসর গোঁফ। রেগে গেলেন তিনি। অবশ্যই আমি জানি কীভাবে কী করতে হবে। এক্সপোজার-এর ঘটনা ট্র্যান্টরে না ঘটলেও অন্যান্য বিশ্বে এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর আমি এই বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনাও করেছি।
প্রথমে একটা এন্টি ভাইরাস সিরাম দিয়ে তারপর মাইক্রোওয়েভ র্যাপিং দিয়ে সেলডনের পুরো শরীর মুড়ে দেওয়া হলো।
এতেই চলবে। ডাক্তার বললেন, আউটার ওয়ার্ল্ডগুলোতে ওরা হাসপাতালে আরো অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে, কিন্তু ট্র্যান্টরে সেইরকম ব্যবস্থা নেই। অবশ্য খুব মারাত্মক কোনো ক্ষতিও হয়নি, কাজেই আমি যা দিয়েছি তাই যথেষ্ট।
সেলডনের মারাত্মক কোনো শারীরিক ক্ষতি হয়নি। ডর্সের ধারণা আউটওয়ার্ল্ডার বলেই তিনি দ্রুত সেরে উঠছেন। অন্ধকার, ঠাণ্ডা, তুষারপাত এগুলো তার কাছে নিশ্চয়ই নতুন নয়। একই পরিস্থিতিতে পড়লে একজন ট্র্যান্টরিয়ান মারাই যেত। শারীরিক ক্ষতির কারণে যতটা না তার চেয়ে বেশি মানসিক আঘাতের কারণে।
অবশ্য নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না। কারণ ডর্স নিজেও ট্র্যান্টরিয়ান নয়।
ভাবনা চিন্তাগুলো বাদ দিয়ে একটা চেয়ার এনে সেলডনের বিছানার কাছে বসল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল।
.
২৯.
পরদিন সকালে চোখ খুলেই ডর্সকে দেখতে পেলেন সেলডন। তার বিছানার পাশে বসে একটা বুক-ফিল্ম দেখছে, নোট নিচ্ছে মাঝে মাঝে।
প্রায় স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি, এখনো আছো, ডর্স?
বুক-ফিল্মটা নামিয়ে রাখল ডর্স, তোমাকে একা রেখে তো যাওয়া যায় না। আমি আর কাউকে বিশ্বাসও করিনা।
মনে হচ্ছে যতবার চোখ খুলেছি ততবারই তোমাকে দেখেছি। সারাক্ষণই এখানে ছিলে?
হ্যাঁ।
কিন্তু তোমার ক্লাস?
আমার একজন সহকারী আছে, ওই সামলে নিতে পারবে কিছুদিন।
সামনে ঝুঁকে সেলডনের একটা হাত ধরল ডর্স, তিনি যে বিব্রত বোধ করছেন তা বুঝতে পেরে (হাজার হোক তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন) আবার সরিয়ে নিল।
হ্যারি, কী হয়েছিল? যা ভয় পেয়েছিলাম।
আমি একটা স্বীকারোক্তি দিতে চাই। বললেন সেলডন।
কীসের স্বীকারোক্তি, হ্যারি?
আমি ভেবেছিলাম তুমি এমন কারো সাথে হাত মিলিয়েছ যারা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে-
ষড়যন্ত্র? ডর্সকে দেখে মনে হলো বমি করে ফেলবে।
মানে ভেবেছিলাম যে হয়তো তুমিই আমাকে প্ররোচিত করে কৌশলে আপারসাইডে পাঠিয়েছ যেন আমি কিছু সময়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় জুরিসডিকশনের বাইরে চলে যাই আর ইম্পেরিয়াল ফোর্স সহজেই আমাকে বন্দী করে নিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু তুমি আপারসাইডের যে অংশে গিয়েছ তা বিশ্ববিদ্যালয় জুরিসডিকশনেরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ ট্র্যান্টরে সেক্টরিয়াল জুরিসডিকশন ধরা হয় ভূ-কেন্দ্র থেকে আকাশ পর্যন্ত।
আমি জানতাম না। কিন্তু কাজের কথা বলে তুমি আমার সাথে গেলে না। প্রচণ্ড আতঙ্কে ভেবেছিলাম তুমি ইচ্ছা করেই আমাকে একা ছেড়ে দিয়েছ। ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। তুমিই আমাকে উদ্ধার করে এনেছ। আর কেউ তো চিন্তাও করেনি।
ওরা সবাই ব্যস্ত ছিল, সতর্কভাবে বলল ডর্স। ভেবেছিল তুমি আগেই চলে এসেছ। এমন ভাবাটাই স্বাভাবিক।
ক্লজিয়াও তাই ভেবেছিল?
শিক্ষানবীশ মেয়েটা? হ্যাঁ সেও ভেবেছিল।
বেশ, তারপরেও এটা একটা ষড়যন্ত্র, তবে তুমি অবশ্যই কোনোভাবে তাতে জড়িত ছিলে না।
না, হ্যারি, দোষ আমার। তোমাকে একা যেতে দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি। আমার কাজ তোমাকে রক্ষা করা। তুমি পথ হারিয়ে বিপদে পড়েছিলে সেজন্য আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব না।
দাঁড়াও দাঁড়াও, বিরক্ত হলেন সেলডন। আমি পথ হারাইনি। আমাকে কী মনে করো তুমি?
আমি জানতে চাই তুমি এটাকে কী বলবে। বাকিরা যখন ফিরে আসে তুমি আশেপাশে কোথাও ছিলে না। এমনকি রাত নামার আগে প্রবেশ পথ বা তার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারনি।
কিন্তু তার মানে এই না যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঘটনা অন্যরকম। তোমাকে তো বলেছি আমি ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি এবং তার কারণও আছে।
বেশ, আমাকে বলো কী হয়েছিল।
খুলে বললেন সেলডন। খুটিনাটি ব্যাখ্যা দিতে একটুও বেগ পেতে হলো না। কারণ পুরো ঘটনাই তার মনে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো গেঁথে আছে।
ভুরু কুঁচকে সব শুনল ডর্স। অসম্ভব। জেট-ডাউন। তুমি নিশ্চিত?
অবশ্যই। তোমার কী মনে হয় আমি দিবাস্বপ্ন দেখছিলাম?
কিন্তু ইম্পেরিয়াল ফোর্স এখানে আসতে পারবে না। ক্যাম্পাসে সৈন্য পাঠিয়ে তোমাকে গ্রেফতার করতে গেলে যে সমস্যা আপারসাইডেও একই সমস্যা।
তাহলে এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে?
ঠিক বলতে পারছি না। তবে আমার না যাওয়াটাই যত নষ্টের গোড়া আর এজন্য হামিন প্রচণ্ড রাগ করবে।
ওকে না জানালেই হলো। সব তো ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে।
জানাতেই হবে, ডর্স গম্ভীর। ঘটনা হয়তো এখনো শেষ হয়নি।
.
৩০.
সেদিন সন্ধ্যায় জেনআর লেগান তাকে দেখতে এলো। ডিনারের পর লোকটা একবার ডর্স একবার সেলডনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল, কথা শুরু করার পায়তারা কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে না পেরে অস্বস্তি বোধ করছে। বাকি দুজন তাকে সাহায্য না করে বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত শুরু করল, আপনি কেমন আছেন দেখতে এলাম, সেলডন।
ভালো আছি, সেলডন বললেন, শুধু ঘুম পাচ্ছে। সম্ভবত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আরো কয়েকদিন এইরকম ঘুম ঘুম ভাব সহ্য করতে হবে। বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, হাসলেন সেলডন, তবে কোনো অসুবিধা নেই।
লম্বা দম নিল লেগান, ছাড়ল ধীরে ধীরে। ইতস্তত করছে। তারপর এমনভাবে কথা বলল যেন কেউ তাকে অন্যায়ভাবে কথা বলতে বাধ্য করছে, বেশি সময় নেব না। বুঝতে পারছি আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। যা ঘটেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। চট করে অনুমান করা উচিত হয়নি যে আপনি আমাদের আগেই চলে এসেছেন। যেহেতু আপনি এখানে নবাগত, আমার আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। হাজার হোক আমিই তো আপনাকে আপারসাইডে নিয়ে যেতে রাজী হয়েছিলাম। আশা করি আপনি… আমাকে ক্ষমা করবেন। এই কথাগুলোই বলতে এসেছিলাম।
হাই তুললেন সেলডন, হাত দিয়ে হাই তোলা আড়াল করলেন, মাফ করবেন।–যেহেতু ভালোয় ভালোয় বিপদ কেটে গেছে তখন আর মনের ভিতর কষ্ট পুষে রাখার দরকার নেই। আসলে আপনাকে দোষ দেওয়াটাও ঠিক হবে না। আমারই বরং বোকার মতো সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া উচিত হয়নি, আর যা ঘটেছে।
বাধা দিল ডর্স। হয়েছে, হ্যারি, আর কথা না। বিশ্রাম নাও। এবার আমি ড. লেগানের সাথে কিছু কথা বলতে চাই। প্রথম কথা ড, লেগান, আমি নিশ্চিত আপনি। বুঝতে পেরেছেন এই ঘটনা আপনার কতখানি ক্ষতি করতে পারে। যেহেতু আগেই বলেছিলাম যদি কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়া ড. সেলডন সুস্থ হয়ে উঠেন তাহলে ব্যাপারটা বেশিদূর গড়াবে না। তাই বোধহয় হতে যাচ্ছে, কাজেই আপনি দুঃশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে পারেন–অন্তত এই মুহূর্তের জন্য। আমি কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই আশা করি ঠিক ঠিক জবাব দেবেন।
চেষ্টা করব, ড. ভেনাবিলি, কাষ্ঠ গলায় জবাব দিল লেগান।
আপনারা যখন আপারসাইডে ছিলেন তখন কী অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল?
আপনি তো জানেনই ঘটেছিল। ড. সেলডনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি আর সেইজন্য ক্ষমাও চেয়েছি।
সেটার কথা জিজ্ঞেস করিনি। অন্য কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা?
না, কিছুই না। কিছুই না।
ডর্সের কথা শুনে ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। মনে হলো সে তার বক্তব্যের সত্যমিথ্যা যাচাই করতে চাইছে। সে কী ভাবছে যে পুরো ঘটনাটাই তার কল্পনা। প্রতিবাদ করতে চাইলেন। কিন্তু ডর্স শান্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলতেই আর এগোলেন না, থেমে গেলেন। ডর্সের হাত তোলাটা একটা কারণ, আরেকটা কারণ তিনি আসলেই প্রচণ্ড ক্লান্ত, ঘুমে চোখ বুজে আসছে। আশা করলেন লেগান আর বেশিক্ষণ থাকবে না।
আপনি নিশ্চিত? ডর্স বলল। বাইরে থেকে কোনো বাধা আসেনি?
অবশ্যই। ও হ্যাঁ
বলুন, ড. লেগান।
একটা জেট-ডাউন চোখে পড়েছিল।
আপনার কাছে সেটা অস্বাভাবিক মনে হয়নি?
না।
কেন?
আপনি কী জেরা করছেন, ড, ভেনাবিলি। এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না।
আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, ড, লেগান, কিন্তু ড. সেলডনের ব্যর্থ অভিযানের সাথে এই প্রশ্নগুলোর সম্পর্ক আছে। হতে পারে পুরো ঘটনাটাই আমার ধারণার চেয়েও জটিল।
কোন দিক দিয়ে? লেগানের কণ্ঠে উম্মা প্রকাশ পেল। আপনি কী নতুন কোনো বিষয়ে দোষারোপ করার চেষ্টা করছেন এবং চাইছেন আমি যেন আবার ক্ষমা প্রার্থনা করি? সেক্ষেত্রে আশা করব আপনি এই অপমানজনক অভিযোগ প্রত্যাহার করবেন।
করব না, যতক্ষণ না ব্যাখ্যা করতে পারছেন আপারসাইডে একটা জেট-ডাউন দেখেও আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি কেন?
কারণ, ট্র্যান্টরের অনেক মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশনের জেট-ডাউন আছে। সরাসরি মেঘমণ্ডল পর্যবেক্ষণের কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়। আমাদের স্টেশনে অবশ্য এই জিনিস নেই।
কেন নেই? অত্যন্ত দরকারী একটা জিনিস।
অবশ্যই। কিন্তু আমরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করি না বা কিছু গোপন রাখিনা। আমরা গবেষণা করে যা পাই তা অন্য স্টেশনগুলোকে জানাই। অন্য স্টেশনগুলোও তাদের প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের জানায়। এভাবেই একেকটা স্টেশন এক এক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠে। নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা বা একে অন্যের নকল করা বোকামী। আমাদের জেট-ডাউন নেই। কিন্তু এর জন্য যে অর্থ এবং লোকবল ব্যয় করতে হতো সেটা আমরা মেসনিক রিফ্ল্যাকটোমিটার-এর জন্য ব্যয় করতে পারি। অন্য কোনো স্টেশন আবার দ্বিতীয়টার উপর খরচ না করে প্রথমটার উপর খরচ করে। যদিও ট্র্যান্টরের সেক্টরগুলোর ভেতর প্রচণ্ড বিদ্বেষ এবং মর্যাদার রেষারেষি রয়েছে কিন্তু বিজ্ঞানের বেলায় সবাই সম্মিলিত আর এটাই আমাদের এক সূত্রে বেঁধে রেখেছে। আশা করি সেটা আপনিও জানেন। লেগানের কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল।
জানি। কিন্তু ঠিক যেদিন আপনি আপনার স্টেশন ব্যবহার করতে গেলেন সেইদিনই কেউ একটা জেট-ডাউন পাঠালো। একেবারে আপনার স্টেশনের কাছেই। এটা কী দৈব ঘটনা?
মোটেই দৈব ঘটনা নয়। আগেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা ঠিক কোনদিন আপারসাইডে যাব। হয়তো অন্য কোনো স্টেশন ভেবে দেখল–এরকম ভাবাটাও অযৌক্তিক কিছু না যে তারাও সেদিন ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতি দেখার জন্য জেট-ডাউন পাঠাবে। এতে প্রাপ্ত ফলাফল আরো বেশি কার্যকরী হয়।
হঠাৎ তোতা গলায় বললেন সেলডন, ওরা তাহলে শুধু বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের জন্য গিয়েছিল? আবার একটা হাই তুললেন।
হ্যাঁ, লেগান বলল। আর কী করতে যাবে?
চোখ পিটপিট করছে ডর্স, সে যখন খুব দ্রুত চিন্তা-ভাবনা করে তখন এইরকম করে। এবার বুঝতে পেরেছি। এই জেট-ডাউনটা কোন স্টেশন থেকে এসেছিল?
মাথা নাড়ল লেগান। আমি কী করে বলব?
প্রতিটা জেটডাউনের গায়ে নিশ্চয়ই নিজস্ব স্টেশনের মার্কিং থাকে?
থাকে, কিন্তু আমি তো দেখার চেষ্টা করিনি। নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ওরা ওদের কাজ করছিল। ওরা রিপোর্ট করলে জানতে পারব কোন স্টেশন থেকে এসেছিল।
যদি রিপোর্ট না করে?
তাহলে বুঝতে হবে যন্ত্রপাতি ঠিকমতো কাজ করেনি। প্রায়ই এমন ঘটে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করল সে। শেষ হয়েছে?
এক মিনিট। এই জেট-ডাউন কোন স্টেশন থেকে আসতে পারে?
জেট-ডাউন আছে এমন যেকোনো স্টেশনের হতে পারে। মাত্র এক দিনের নোটিশে গ্রহের যেকোনো জায়গা থেকে পুরোপুরি সুসজ্জিত অবস্থায় আমাদের কাছে চলে আসতে পারবে।
কোন স্টেশনের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?
বলা কঠিন : হেস্টিলোনিয়া, ওয়ি, জাগ্ৰেথ, নর্থ ডেমিনো। আমার মতে এই চারটা থেকে যেকোনো একটার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়াও কমপক্ষে আরো চল্লিশটা স্টেশনের জেট-ডাউন আছে, সেগুলোর যেকোনো একটা থেকেও আসতে পারে।
আর মাত্র একটা প্রশ্ন। যখন ঘোষণা করেছিলেন যে আপনি সহকর্মীদের নিয়ে। আপারসাইডে যাবেন তখন কী গণিতবিদ হ্যারি সেলডনের নাম বলেছিলেন?
ভান নয়, সত্যি সত্যি নিখাদ বিস্ময়ের ছাপ পড়ল লেগানের চেহারায়, চোখে রাগের আভাষ। নাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কে আগ্রহী হবে?
বেশ, ডর্স বলল। তাহলে আসল ঘটনা হচ্ছে ড. সেলডন একটা জেট-ডাউন দেখে ভীত হয়ে পড়েন। কেন, আমি জানি না আর তিনিও পরিস্কার মনে করতে পারছেন না। তিনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। আপনাদের কাছে ফিরে আসার কথা মনে ছিল না বা সাহস পাননি–ভোরের আলো ফোঁটার আগ পর্যন্ত। কিন্তু অন্ধকারে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। এইজন্য আপনাকে কেউ দোষ দিতে পারবে না। কাজেই আমরা দুজনেই ঘটনাটা ভুলে যেতে পারি। ঠিক আছে?
ঠিক আছে। লেগান বলল। তারপর চলে গেল।
দাঁড়ালো ডর্স। সেলডন ঘুমিয়ে পড়েছেন। না জাগিয়েই তার পা থেকে স্লিপার জোড়া খুলল ডর্স। পা দুটো সোজা করে বিছানায় ঠিকভাবে শুইয়ে দিল। শরীর ঢেকে দিল চাদর দিয়ে। তারপর পাশে বসে ভাবতে লাগল।
লেগান যা বলেছে তার কতখানি সত্য। এটা কি আসলেই কোনো ষড়যন্ত্র। জানে না সে।
.
মাইকোজেন
মাইকোজেন–… প্রাগৈতিহাসিক ট্র্যান্টরের একটি সেক্টর … যারা নিজস্ব অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের মাঝে নিজেদের কবর দিয়ে রেখেছিল। ট্র্যান্টরের ইতিহাসে মাইকোজেনের উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান নেই, তারা ছিল কিছুটা আত্মমগ্ন, স্বেচ্ছায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা
.
৩১.
জেগে উঠলেন সেলডন। চোখ মেলেই দেখলেন একটা নতুন মুখ তার উপর ঝুঁকে আছে। নিদ্রাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করছেন। মানুষটাকে চিনতে পেরেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, হামিন?
এক চিলতে হাসি দিল হামিন। আমার কথা মনে আছে তাহলে।
আপনার সাথে মাত্র একদিন ছিলাম, তাও দুইমাস আগে, কিন্তু ঠিকই মনে আছে। আপনি তাহলে ধরা পড়েননি, বা-
যেমন দেখছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনার সামনে, অক্ষত। কিন্তু চট করে একবার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ডর্সের দিকে তাকালো হামিন, এখানে আসাটা আমার জন্য খুব একটা সহজ হয়নি।
আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। সেলডন বললেন। যদি কিছু মনে না করেন- বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাথরুম দেখালেন তিনি।
নিশ্চয়ই। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। নাস্তা করুন। তারপর কথা বলব।
হামিন বা ডর্স, কেউই তার সাথে নাস্তার টেবিলে বসল না। কোনো কথাও বলছে না দুজন। হামিন একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটা বুক-ফিল্ম দেখছে। ডর্স কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে হাতের নখগুলো খুটিয়ে দেখল, তারপর একটা মাইক্রোকম্পিউটার বের করে স্টাইলাস দিয়ে নোট নিতে লাগল।
গভীর চিন্তা নিয়ে ওদেরকে দেখছেন সেলডন এবং নিজেও কোনো আলোচনা শুরু করলেন না। অসুস্থ রোগীর পাশে নীরব থাকা বোধহয় ট্র্যান্টরের নিয়ম। সত্যি কথা বলতে কী তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ বোধ করছেন, তবে ওরা বোধহয় সেটা বুঝতে পারেনি।
নাস্তা শেষ করে এক গ্লাস দুধ খেলেন তিনি (দুধ খেতে এখন আর খারাপ লাগে না। এর বিদঘুঁটে স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন)। তারপর কথা শুরু করল হামিন।
আপনি কেমন আছেন, সেলডন? জিজ্ঞেস করল সে।
চমৎকার, হামিন। পুরোপুরি সুস্থ।
শুনে খুশী হলাম। শুকনো গলায় বলল হামিন। পুরো ঘটনার জন্য ডর্স ভেনাবিলি দায়ী।
ভুরু কুঁচকালেন সেলডন। না, আপারসাইডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি।
কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার উচিত ছিল যেকোনো মূল্যে আপনার সাথে যাওয়া।
আমিই যেতে মানা করেছিলাম।
জবাব দিল ডর্স। কথাটা ঠিক না, হ্যারি। মিথ্যে কথা বলে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে না।
রেগে উঠলেন সেলডন। কিন্তু সবার প্রবল বাধা উপেক্ষা করে ডর্স ঠিকই আপারসাইডে গিয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে সেই আমার জীবন বাঁচিয়েছে। এই সত্যি কথাটা কী আপনি জানেন, হামিন?
আবারও বাধা দিল ডর্স, বিব্রত বোধ করছে সে, প্লীজ, হ্যারি। চ্যাটার হামিন ঠিকই বলছে। আমার উচিত ছিল হয় তোমাকে আপারসাইডে যাওয়া থেকে বিরত রাখা আর নয়তো তোমার সাথে যাওয়া। পরে যা করেছি তার জন্য সে যথেষ্ট প্রশংসাও করেছে।
যাইহোক, হামিন বলল, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বরং আপারসাইডে কী ঘটেছিল শোনা যাক, সেলডন।
সাবধানী দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে সেলডন বললেন, এখানে কথা বলা নিরাপদ?
সামান্য একটু হাসল হামিন। ডর্স এই কামরার চারপাশে ফিল্ড ডিস্টর্সন বসিয়েছে। আমি শতকরা একশ ভাগ নিশ্চিত যে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ইম্পেরিয়াল এজেন্ট থাকেও এটা ভেদ করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। আপনি খুব বেশি সন্দেহ করেন, সেলডন।
অথচ অতিরিক্ত সন্দেহ করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, বললেন সেলডন। সেদিন পার্কে আপনার কথা শোনার পর থেকেই মানুষকে আপনি খুব সহজেই প্রভাবিত করে ফেলতে পারেন, হামিন। অর্ধেক শুনেই আমি ডেমারজেলকে ভয় পেতে শুরু করি, এমনকি ছায়া দেখেও মনে হয় ডেমারজেল আমাকে ধরার জন্য ছুটে আসছে।
মাঝে মাঝে আমারও ওরকম মনে হয়। গম্ভীর সুরে জবাব দিল হামিন।
যদি সত্যিও হয়, আমি বুঝতেও পারব না যে ডেমারজেলের হাতে ধরা পড়েছি। লোকটা কেমন দেখতে?
সেটা কোনো ব্যাপার না। ডেমারজেল না চাইলে আপনি তাকে কখনোই দেখতে পারবেন না। কিন্তু যখন দেখবেন তখন সব শেষ হয়ে যাবে, অন্তত আমার তাই ধারণা এবং আমাদের তা ঠেকাতেই হবে। বরং জেট-ডাউনটার কথা শোনা যাক।
যা বললাম, হামিন। আপনি আমার ভেতরে ডেমারজেলের ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। জেট-ডাউনটা দেখার সাথে সাথে ধরে নেই ওটা আমাকে ধরার জন্যই এসেছে, কারণ বোকার মতো আপারসাইডে গিয়ে আমি স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ বেষ্টনির বাইরে চলে গিয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম যে আমাকে হয়তো কৌশলে আপারসাইডে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করা হয়েছিল যেন সহজেই বন্দি করা যায়।
অন্য দিকে, লেগান- ডর্স বলার চেষ্টা করল।
লেগান কি গতরাতে এখানে এসেছিল? দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
হ্যাঁ, তোমার মনে নেই?
আবছা। আসলে অতিরিক্ত ক্লান্ত ছিলাম। গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো স্মৃতিতে কেমন ধূসর হয়ে গেছে।
যাইহোক, লেগান বলেছে, জেট-ডাউনটা অন্য কোনো স্টেশন থেকে মেটিওরোলজিক্যাল সার্ভের জন্য এসেছিল। একেবারেই সাধারণ এবং ওটার কাছ থেকে বিপদের কোনো ভয়ই ছিল না।
কি? হোঁচট খেলেন সেলডন। আমি বিশ্বাস করি না।
প্রশ্ন হচ্ছে, হামিন বলল, আপনি কেন বিশ্বাস করেন না? জেট-ডাউনটার মাঝে কি এমন ছিল যা দেখে আপনি বিপদের ভয় পেয়েছিলেন? নির্দিষ্ট কিছু?।
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ ভাবলেন সেলডন। ওটার গতিবিধি। এমনভাবে উড়ছিল তাতে পরিস্কার বোঝা যায় যে জেট-ডাউনটা কিছু অনুসন্ধান করছে। তাছাড়া মেঘস্তরের নিচ দিয়ে বা মেঘের আড়ালে আবডালে উড়ার মাঝেও একটা সুনির্দিষ্ট ছক ছিল।
আপনার ব্যক্তিগত কোনো দুঃস্বপ্নের কারণে এমন হয়েছে বোধহয়। জেট ডাউনটাকে দেখে সম্ভবত ভেবেছিলেন অদ্ভুত কোনো প্রাণী। কিন্তু আসলে তো তা ছিল না। ছিল শুধুই একটা জেট-ডাউন, আর মেটিওরোলজিক্যাল ভেসেল হলে তো বিপদের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
আমার সেইরকম মনে হয়নি। কাষ্ঠ গলায় বললেন সেলডন।
সেটা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আসল ব্যাপার তো আমরা কেউই জানি না। আপনি এবং লেগান যা বলেছেন তা শুধুই আপনাদের অনুমান।
পুরোটাই এইরকম নির্দোষ ঘটনা আমার বিশ্বাস হয় না।
বেশ সবচেয়ে খারাপটাই চিন্তা করা যাক। ধরা যাক আপনাকেই খুঁজছিল। এখন। যারাই জেট-ডাউনটাকে পাঠাক না কেন তারা কীভাবে জানল যে আপনাকে। আপারসাইডে পাওয়া যাবে?
অনেকক্ষণ পর আলোচনায় যোগ দিল ডর্স। ড, লেগানকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম–হ্যারি সেলডন যে তার দলের সাথে আপারসাইডে যাবে কাউকে জানিয়েছে। কী না? স্বাভাবিকভাবে জানানোর কোনো কারণও নেই। লেগানের বক্তব্যও ছিল ঠিক। এরকমই। এবং তার আচরণ আমার কাছে নিখুঁত মনে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করেছি।
ওকে এত সহজে বিশ্বাস করো না। চিন্তিত গলায় বলল হামিন। সে জড়িত থাকলে তো অস্বীকার করবেই। নিজেকেই জিজ্ঞেস করে দেখ কেন সে সেলডনকে আপারসাইডে যাওয়ার অনুমতি দিল। প্রথমে রাজী হয়নি। তারপর তেমন হৈ চৈ না করেই রাজী হয়ে গেল। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা তার স্বভাববিরুদ্ধ।
ভুরু কুঁচকালো ডর্স। এভাবে চিন্তা করলে ধরে নেওয়া যায় ঘটনাটা লেগানই সাজিয়েছে। অন্তত হ্যারির যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য চট করে রাজী হয়ে গেছে। হয়তো নিজের বুদ্ধিতে করেনি, পিছনে যারা মূল হোতা তারাই ওকে বলে দিয়েছে। আরো বলা যায় যে সে অল্পবয়সী শিক্ষানবীশ, ক্লজিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছিল হ্যারিকে যেন সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে। কারণ লেগান বারবার বলছিল ইচ্ছে হলে হ্যারি আগেই নিচে চলে আসতে পারে। যত্ন করে এলিভেটর চালানোও শিখিয়ে দিয়েছিল। আর ফিরে আসার সময় হ্যারিকে না দেখে লেগান কিন্তু প্রায় নিশ্চিত ছিল যে হ্যারি ওদের আগেই চলে এসেছে কোনো কারণে। আগে ভাগেই সব। পরিকল্পনা করে রেখেছিল। তাই তো খোঁজাখুঁজি করে সময় নষ্ট করতে চায়নি কারণ সে তো জানতই হ্যারিকে পাওয়া যাবে না।
মনোযোগ দিয়ে শুনছিল হামিন। বলল, লেগানের বিরুদ্ধে একটা নিদ্রি অভিযোগ দাঁড় করিয়েছ তুমি। তবে এটাও এত সহজে মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। যত যাইহোক সে কিন্তু তোমাকে নিয়ে ঠিকই আপারসাইডে গিয়েছিল।
কারণ আমরা এখান থেকেই পায়ের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলাম। চীফ সিসমোলজিস্ট এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে পারবে।
বেশ, সেলডনকে যখন পাওয়া গেল তখন লেগানের চেহারা কেমন হয়েছিল। বিস্মিত, হতবাক। মানে তাকে দেখে কী তোমার মনে হয়েছিল যে নিজের পরিকল্পিত অবহেলার কারণে যাকে সে এখানে ফেলে গেছে তার তো এখানে থাকার কথা না। সে কী ভাবছিল যে, ওরা কেন সেলডনকে বন্দী করতে পারেনি।
অনেকক্ষণ ভাবল ডর্স। তারপর বলল, লেগান অবশ্যই অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমি জানি না এই বিস্ময় কি পরিস্থিতির কারণে নাকি তার স্বাভাবিক আচরণ পুরোটাই অভিনয়।
তোমার জানার কথাও না।
ওরা যখন কথা বলছিল সেলডন তখন একবার ডর্সের মুখের দিকে একবার হামিনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এবার কথা বললেন তিনি। আমার মনে হয় না লেগান এই ঘটনার সাথে জড়িত।
তার দিকে ঘুরল হামিন, কেন?
প্রথম কারণ, সেটা আপনি নিজেও জানেন। সে আমাকে সাথে নিতে চায়নি। পুরো একটা দিন লেগেছে তাকে রাজী করাতে, এবং আমার মতে সে রাজী হয়েছে শুধু একটা কারণে। আমি একজন গণিতবিদ। ভেবেছিল আমি তাকে গবেষণায় সাহায্য করতে পারব। যদি তার উপর নির্দেশ থাকত যে আমাকে যে ভাবেই হোক আপারসাইডে নিয়ে যেতে হবে তাহলে খুব বেশি তোষামোদ করার দরকার ছিল না।
আপনি একজন গণিতবিদ বলেই সে রাজী হয়েছে এটা কোনো যুক্তির কথা হলো? সে আপনার কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে?
না, চায়নি। যদিও বলেছিল যে পরে প্রয়োজন হতে পারে। আসলে সে পুরোপুরি নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। ভেবেছিল খানিকটা সূর্যের আলো পাওয়া যাবে। কিন্তু দিনটা ছিল মেঘলা, তার ধারণা ছিল যন্ত্রপাতিগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। কিন্তু সেগুলো সবই ঠিক ছিল। যার কারণে বিরক্ত এবং রেগে উঠে আমার কথা বেমালুম ভুলে যায়। ক্লজিয়া কিছুক্ষণ ছিল আমার সাথে। পরে যতই ভেবেছি ততই পরিস্কার বুঝতে পেরেছি যে আমাকে বিপদে ফেলার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। আমারই কৌতূহল ছিল। আপারসাইডের উদ্ভিদ এবং চাষাবাদ নিয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম। আমিই বরং তাকে বাকিদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে আনি। আর লেগান যখন তাকে কাজের জন্য ডাক দেয় আমি তখনো সবার দৃষ্টিসীমার ভেতর ছিলাম। আমি নিজেই ঘুরতে ঘুরতে বাকি সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
তারপরেও, বলল হামিন, ঐ শিপ যদি আপনার খোঁজে এসে থাকে তাহলে ওটার ভেতরে যারা ছিল তারা জানত আপনাকে ওখানে পাওয়া যাবে। কীভাবে জানল–যদি লেগান না জানায়?
অমি যাকে সন্দেহ করছি, সেলডন বললেন, সে আমার বয়সী একজন সাইকোলজিস্ট নাম লিসাং রাণ্ডা।
রাণ্ডা? ডর্স কলল। বিশ্বাস করি না। ওকে আমি ভালো করেই চিনি। রাণ্ডা কোনোদিনও সম্রাটের পক্ষে কাজ করবে না। সে আপাদমস্তক এ্যান্টি-ইম্পেরিয়ালিস্ট।
হয়তো সেইরকমই ভান করে। সত্যি কথা বলতে কী সে ইম্পেরিয়াল এজেন্ট হলে তাকে অন্য সবার থেকে বেশি প্রমাণ করতে হবে যে সে আসলে এ্যান্টি ইমপেরিয়ালিস্ট।
কিন্তু সে মারামারি হানাহানি পছন্দ করে না। তার ভেতর রাগ বলতে কিছু নেই। শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ। নরম সুরে নিজের মতামত প্রকাশ করে। আমি বিশ্বাস করি। এগুলোর কোনোটাই ছলচাতুরী নয়।
কিন্তু তারপরেও, ডর্স, বোঝানোর সুরে বললেন সেলডন, রাণ্ডাই আমাকে মেটিওরোলজিক্যাল প্রজেক্টের কথা বলেছে, লেগানকে সে-ই রাজী করিয়েছে। আমার জন্য এত কিছু কেন করল সে।
হয়তো তোমার ভালোর জন্যই। রাণ্ডা তোমাকে পছন্দ করে। ভেবেছিল মেটিওরোলজী তোমার সাইকোহিস্টোরিক্যাল ডেভেলপম্যান্টে সাহায্য করবে। এটা কী অস্বাভাবিক কিছু?
আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। শান্ত সুরে বলল হামিন। রাণ্ডা আপনাকে যখন মেটিওরোলজিক্যাল প্রজেক্টের কথা জানায় এবং যখন আপনি প্রকৃতপক্ষে আপারসাইডে যান–এই দুটো ঘটনার মাঝে সময়ের ব্যবধান অনেকখানি। রাণ্ডা নির্দোষ হলে কথাটা তার গোপন রাখার কোনো কারণ নেই। সে বন্ধুবৎসল ভালোমানুষ এবং নিপাট ভদ্রলোক হলে
রাণ্ডা ঠিক তাই। ডর্স বলল।
তাহলে অনেক বন্ধুকেই সে কথাটা বলেছে। অর্থাৎ আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না আসল ইনফর্মার কে। সত্যি বলতে কী আরেকটা পয়েন্ট আমাদের বিবেচনা করতে হবে। ধরা যাক রাণ্ডা এ্যান্টি ইমপেরিয়ালিস্ট। তার মানে এই না যে সে এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কার এজেন্ট? কার পক্ষে কাজ করছে?
ভীষণ অবাক হলেন সেলডন। সম্রাট ছাড়া আর কার পক্ষ নিয়ে কাজ করতে পারে? ডেমারজেলের মতো ক্ষমতাশালী আর কে আছে?
হাত তুলল হামিন। সেলডন, ট্র্যান্টরের রাজনীতি সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না। ঘুরল ডর্সের দিকে। ড. লেগান যে চারটা সেক্টরের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন সেগুলো আরেকবার বল তো শুনি।
হেস্টেলোনিয়া, ওয়ি, জাহেথ এবং নর্থ ডেমিনো।
তুমি তাকে প্রশ্ন করোনি এর মধ্য থেকে কোনটার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি?
না, শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম জেট-ডাউনটা কোত্থেকে এসেছে এই ব্যাপারে তার কোনো অনুমান আছে কী না।
আর আপনি- সেলডনের দিকে ঘুরল হামিন–জেট-ডাউনের গায়ে কোনো মার্কিংস বা ইনসিগনিয়া দেখেছেন নিশ্চয়ই।
ক্ষোভের সাথে বলতে চাইলেন সেলডন যে ভেসেলটা প্রায় সারাক্ষণই মেঘের আড়ালে ছিল। ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এলেও খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। আর তিনি তখন পালানোতেই ব্যস্ত ছিলেন, অন্য কিছু দেখার সময় ছিল কই। কিন্তু বললেন না। হামিন তো এগুলো জানেই।
বরং স্বাভাবিক গলায় বললেন, না, আমি কিছুই দেখিনি।
ডর্স বলল, জেট-ডাউনটা যদি অপহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে আসে তাহলে নিশ্চয়ই পরিচয় গোপন করার জন্য ইনসিগনিয়াগুলো ঢেকে রেখেছিল।
যুক্তি তো তাই বলে। হামিন বলল। কিন্তু অনেক সময় যুক্তি খাটালেও লাভ হয় না। যাইহোক, সেলডন যেহেতু ভেসেলটার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছে না আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। আমার ধারণা : ওয়ি।
হোয়াই? প্রতিধ্বনি করলেন যেন সেলডন (তিনি ধরে নিলেন হামিন আসলে জানতে চাইছে হোয়াই বা কেন), আমার ধারণা ওই শিপে যারাই থাকুক না কেন তারা আমাকে নিতে এসেছিল আমার সাইকোহিস্টোরিক্যাল নলেজের জন্য।
না, না, তর্জনী খাড়া করল হামিন, যেন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছে। ও-য়ি। ট্র্যান্টরের একটা সেক্টরের নাম। বিশেষ একটা সেক্টর। তিন হাজার বছর বা তারও কিছু বেশি সময় ধরে এই সেক্টর শাসন করছে একই পরিবার। বংশ পরম্পরায় তারাই ওই প্রদেশের মেয়র। পাঁচশ বছর আগে হাউজ অব ওয়ি থেকে দুজন সম্রাট হয়েছিল একজন সম্রাজ্ঞী হয়েছিল। তাদের কেউই তেমন সফল হয়নি বা সেইরকম কোনো অবদান রাখতে পারেনি। কিন্তু ওয়ির মেয়ররা এখনো ভুলতে পারে না যে তারা একটা সময় সিংহাসনে বসেছিল।
যদিও তারা রুলিং হাউজের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়ায়নি কখনো। আবার হাত মিলিয়েও চলেনি। দুএকটা গৃহযুদ্ধের সময় ওয়ি অদ্ভুত নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। যথেষ্ট হিসাব করে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয় যেন গৃহযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং নিজেরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। অবশ্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি এবং এখনো করে যাচ্ছে।
ওয়ির বর্তমান মেয়র যোগ্য লোক। বৃদ্ধ হলেও তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কমেনি। ক্লীয়নের যদি কিছু হয়ে যায়। এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও–ক্লীয়নের বালক পুত্রের। চেয়ে তারই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ওয়ির মেয়র নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আপনি তার জন্য সাইন্টিফিক প্রফেটের কাজ করবেন। স্বাভাবিকভাবেই সে ক্লীয়নকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আপনাকে দিয়ে প্রচার করাবে যে ওয়ি একহাজার বছর এর মধ্যে গ্যালাক্সিতে নিয়ে আসবে শান্তি এবং সমৃদ্ধি। অবশ্যই ক্ষমতা দখলের পর আপনার আর কোনো গুরুত্ব থাকবে না। তখন ক্লীয়নের পিছু পিছু আপনাকেও পরপারে পাঠিয়ে দেবে।
নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘর জুড়ে। কথা বলে সেলডনই ভাঙলেন সেটা। কিন্তু আমরা জানি না ওয়ির মেয়র আসলেই দায়ী কি না?
না, জানি না। জানি না ওয়ি ছাড়া অন্য কোনো পক্ষ জড়িত কি না। হয়তো লেগানের কথাই ঠিক। জেট-ডাউনটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতেই এসেছিল। কিন্তু সাইকোহিস্টোরীর কথা ছড়িয়ে পড়তে পারে ছড়িয়ে পড়েছে অবশ্যই তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ট্র্যান্টরের ক্ষমতালোভী ছোট বড়ো সকলেই আপনাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে।
এখন তাহলে কী করব? জিজ্ঞেস করল ডর্স।
আসল প্রশ্ন এটাই। কী করব? কী যেন চিন্তা করল হামিন। তারপর বলল, সেলডনকে এখানে নিয়ে আসাটা বোধহয় ভুল হয়েছে। একজন অধ্যাপকের লুকিয়ে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আদর্শ জায়গা। কিন্তু স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বড়ো এবং অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে। সমস্যা এখানেই। আমার মতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পারলে আজকেই–সেলডনকে এখান থেকে আরো ভালো কোনো জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু
কিন্তু? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
কিন্তু আমি জানি না কোথায়।
কম্পিউটার থেকে গেজেটিয়ার বের করে র্যানডম বাছাই পদ্ধতিতে বের করে নিলেই হয়।
না, সেটা ঠিক হবে না। দেখা যাবে এমন জায়গা বের করেছি যেখানে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। আরো যুক্তি এবং বুদ্ধি খাটাতে হবে। বের করতেই হবে, যেভাবেই হোক।
.
৩২.
সেলডনের কোয়ার্টারেই একসাথে লাঞ্চ করল সবাই। পুরো সময়টাতে ডর্স আর সেলডন এটা সেটা নিয়ে দুএকটা কথা বললেও হামিন ছিল একেবারেই চুপচাপ। খাওয়াদাওয়া করল খুব সামান্য। লম্বাটে মুখ (সেলডনের মতে এই কারণেই তাকে বয়সের চাইতেও অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়)। আরো বেশি গম্ভীর এবং বিষণ্ণ।
সেলডন কল্পনা করলেন হামিন মানশ্চক্ষে বিশাল ব্র্যান্টরের ভৌগোলিক মানচিত্র তন্নতন্ন করে খুঁজছে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কাজটা যে কত কঠিন সেই সম্বন্ধে খানিকটা ধারণাও পেলেন।
তার নিজের গ্রহ হ্যালিকন আয়তনে ট্র্যান্টরের চাইতে বড়ো এবং একটা মহাসাগরও আছে। হ্যালিকনের ল্যান্ড সারফেস আয়তনে ট্র্যান্টরের চেয়ে দশ পার্সেন্ট বেশি কিন্তু হ্যালিকনের জনসংখ্যা তুলনামূলভাবে কম, শুধু সারফেসের উপরে হ্যাঁলিকনিয়ান শহরগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়ানো; আর ট্র্যান্টর পুরোটা মিলেই একটা শহর। যেখানে হ্যালিকন মাত্র বিশটা প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত সেখানে ট্র্যান্টর বিভক্ত আটশ বিভাগে এবং এই আটশ বিভাগের প্রতিটিরই আবার রয়েছে নিজস্ব জটিল উপবিভাগ।
বেশ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই কথা বললেন সেলডন, হামিন, সবচেয়ে ভালো হয় যারা আমার সম্ভাব্য ক্ষমতা ব্যবহার করতে চায় তাদের মধ্যে থেকে যে সবচেয়ে সৎ এবং আন্তরিক তার হাতে আমাকে তুলে দিন। সে-ই তখন আমাকে বাকি সবার হাত থেকে রক্ষা করবে।
হামিনের জবাব শুনে বোঝা গেল সেলডনের বক্তব্য সে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। তার কোনো দরকার নেই, সেলডন। আমি জানি কে সবচেয়ে বেশি সৎ এবং আন্তরিক। তেমন একজন এরই মধ্যে আপনাকে বন্ধু হিসাবে পেয়েছে।
হাসলেন সেলডন। আপনি কী নিজেকে ওয়ির মেয়র এবং সমগ্র গ্যালাক্সির সম্রাটের সাথে তুলনা করছেন।
অবস্থানের কথা বিবেচনা করলে জবাব হচ্ছে না। কিন্তু যদি আপনাকে হাতে রাখার কথা বলেন তাহলে আমি ওদের বিপক্ষে। ওরা সবাই চায় আপনাকে ব্যবহার করে নিজেদের সম্পদ এবং ক্ষমতা বাড়াতে। আর আমার শুধু একটাই লক্ষ্য গ্যালাক্সির কল্যাণ।
আমার ধারণা, শুকনো গলায় বললেন সেলডন, আপনার প্রত্যেক প্রতিদ্বন্দ্বী তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে ঠিক এই জবাবই দেবে যে তারাও গ্যালাক্সির মঙ্গল চায়।
হ্যাঁ, ঠিক এই জবাবই দেবে, হামিন বলল, কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে একজনের সাথে আপনার দেখা হয়েছে। সম্রাটের সাথে। সে সরাসরিই বলেছে যে। আপনার কাল্পনিক ভবিষ্যদ্বাণী ব্যবহার করে নিজের ডাইন্যাস্টিকে আরো সুসংহত করতে চায়। আমি তো সেইরকম কিছু করতে বলিনি। শুধু বলেছি যেভাবেই হোক সাইকোহিস্টোরি আরো নিখুঁত করে তুলবেন যেন গাণিতিকভাবে প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, এমনকি সেটা শুধু স্ট্যাটিস্টিক্যাল হলেও চলবে।
ঠিকই বলেছেন, আঘো হাসির সাথে বললেন সেলডন।
বেশ, আপনার কাজের কী খবর? কোনো অগ্রগতি?
সেলডন রাগলেন না বা হাসলেন না। শান্ত সুরে বললেন, অগ্রগতি? দুই মাসেরও কম সময়ে? হামিন, এটা এমন একটা কাজ যার জন্য আমার সারাজীবন গবেষণা করে যেতে হবে। আমার পরে আরো বারোটি প্রজন্ম তাদের সারাজীবন উৎসর্গ করার পরেও যেকোনো অগ্রগতি হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আমি চূড়ান্ত সমাধান বা এমন কোনো পথ যার সাহায্যে হয়তো সমাধানে পৌঁছানো যাবে এধরনের কিছু জানতে চাইছি না। আপনি বহুবার বলেছেন সাইকোহিস্টোরি সম্ভব কিন্তু অবাস্তব। আমি জানতে চাইছি সেটাকে বাস্তব করে তোলার কোনো তথ্য আপনি পেয়েছেন?
না।
আমার একটা প্রশ্ন, ডর্স বলল। গণিতের ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তাই আশা করছি প্রশ্নটা শুনে তোমরা আমাকে বোকা ভাববে না। একটা বিষয় কীভাবে সম্ভব এবং অবাস্তব হয়? তোমার মুখেই শুনেছি, তাত্ত্বিকভাবে এটা সম্ভব যে তুমি একজন একজন করে এম্পায়ার-এর প্রত্যেকটা মানুষের সাথে দেখা করতে পারবে। কিন্তু এটা অবাস্তব এই কারণে যে তার জন্য লক্ষ লক্ষ বছর দরকার এবং তুমি ততদিন বাঁচবে না। তুমি কীভাবে জানো যে সাইকোহিস্টোরী এইরকমই একটা বিষয়, সম্ভব কিন্তু, অবাস্তব।
তুমি চাও আমি ব্যাখ্যা করে বলি? আক্রমণের সুরে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
এত জোরে মাথা নাড়ল ডর্স যে তার কোঁকড়ানো চুলগুলো কপালের উপর ছড়িয়ে পড়ল।
সত্যি কথা বলতে কী, হামিন বলল, আমিও চাই।
গণিত বাদ দিয়ে? সেলডনের ঠোঁটে চোখে পড়ে কী পড়ে না এই ধরনের একটা হাসি।
হ্যাঁ। হামিন বলল।
বেশ- একটু ভেবে নিলেন সেলডন ঠিক কীভাবে বাকি দুজন সহজে বুঝবে। তারপর শুরু করলেন, মহাবিশ্বের খুঁটিনাটি কয়েকটা বিষয় যদি বুঝতে চাও তাহলে ব্যাপারটাকে এভাবে আমরা সহজ করে নিতে পারি যদি যে বস্তু বা বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার জন্য প্রয়োজন সেগুলো নিয়ে কথা বলব অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো থাকবে আলোচনার বাইরে। ধরো, একটা বস্তু কীভাবে উপর থেকে নিচে পড়বে তা বের করতে চাও। তখন ভাবার দরকার নেই যে বস্তুটি কী নতুন না পুরনো, লাল না সবুজ, বস্তুটার গায়ে কোনো সুগন্ধ আছে কী নেই। জটিল কোনো বিষয়ের এভাবে সরলীকরণকে তুমি বলতে পার মডেল বা সিমুলেশন এবং এটাকে কম্পিউটারে বাস্তবের অনুরূপ করে ফুটিয়ে তোলা যাবে অথবা গাণিতিক সমীকরণে প্রকাশ করা যাবে। রিলেটিভিস্টিক গ্র্যাভিটেশনের সুপ্রাচীন তত্ত্ব বিবেচনা করলে-
সাথে সাথে বাধা দিল ডর্স, গাণিতিক বিশ্লেষণ ব্যবহার করবে না বলেছিল। এখন সুপ্রাচীন বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না।
না, না। সুপ্রাচীন বলতে বুঝাতে চাইছি যে এটার ব্যবহার চলে আসছে যখন থেকে আমরা আমাদের ইতিহাস লেখা শুরু করেছি তারও বহু আগে থেকে। কবে কখন এর উৎপত্তি হয়েছিল তার কোনো রেকর্ড নেই। চাকা বা আগুন আবিষ্কারের ইতিহাসের মতো এর ইতিহাসও হারিয়ে গেছে অতীতের গর্ভে। যাইহোক এই তত্ত্ব নিজেই একটা প্ল্যানেটরি সিস্টেম, একটা দ্বৈত সূর্য এবং আরো অনেক বিষয়ের বিশদ বর্ণনা। এর সাহায্যে আমরা পিকটোরিয়াল সিমুলেশনের দ্বিমাত্রিক বা আরো জটিল ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফ তৈরি করতে পারি। কোনো বিষয় সরাসরি আত্মস্থ করা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু এই ধরনের সরল সিমুলেশনের সাহায্যে যেকোনো বিষয়ই সহজে অনুধাবনযোগ্য হয়ে উঠে। সত্যি কথা বলতে কী গ্র্যাভিটেশনাল ইকুয়েশন ছাড়া প্ল্যানেটরি মিশন এবং সেলেস্টিয়াল মেকানিক্স বিষয়ে আমাদের জানাটা হবে ভাসাভাসা।
এখন একটা বিষয়ে তুমি যতই জানার চেষ্টা করবে বা একটা বিষয় যতই জটিল হতে থাকবে ততই তোমার প্রয়োজন হবে বিস্তারিত সমীকরণ, বড়ো বড়ো প্রোগ্রামিং এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকবে কম্পিউটারাইজড সিমুলেশনে যা অনুধাবন করা আরো অনেক বেশি কঠিন।
আপনি সিমুলেশন-এর সিমুলেশন তৈরি করতে পারেন, বলল হামিন। ফলে আরো অনেক বেশি সহজ হবে।
সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই বাদ দিতে হবে যার ফলে আপনার সিমুলেশন কোনো কাজেই আসবে না। সর্বাধিক সম্ভাব্য সিমুলেশন মূল বিষয়ের তুলনায় অনেক দ্রুত জটিল হয়ে উঠে। এক হাজার বছর আগেই এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে এমন কোনো সিমুলেশন তৈরি করা অসম্ভব যার সাহায্যে খুঁটিনাটি সকল জটিলতাসহ মহাবিশ্বকে উপস্থাপন করা যাবে। সম্ভব হবে যদি সেই সিমুলেশন হয় মহাবিশ্বেরই সমান।
অন্য কথায় বলা যায় মহাবিশ্বের সামগ্রিক ধারণা পেতে হলে পুরোটা মহাবিশ্বই দেখতে হবে। এখন কেউ যদি সামগ্রিক ধারণার জন্য মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের সিমুলেশন তৈরি করে সেগুলোকে একত্র করার চেষ্টা করে তখন দেখা যাবে যে আংশিক সিমুলেশন-এর সংখ্যা এত বেশি, সেগুলো একত্র করতে অনেক বছর লাগবে। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বে যে জ্ঞান ছড়িয়ে আছে তার সবটুকু সংগ্রহ করা অসম্ভব।
আমি কিছুটা বুঝতে পারছি, ডর্স বলল, কণ্ঠে উত্তেজনা।
তুলনামূলকভাবে সরল কিছু বিষয়কে সিমুলেট করা সহজ। কিন্তু বিষয়বস্তু যতই জটিল হতে থাকে সিমুলেট করা ততই কঠিন এবং এক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু ঠিক কী পরিমাণ জটিল হলে সিমুলেট করা অসম্ভব? আমি গত শতাব্দীতে আবিষ্কৃত কিন্তু খুব একটা প্রসার লাভ করেনি এমন একটা গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে গ্যালাক্টিক সোসাইটি যে রকম জটিল তার চেয়ে সরল কোনো সিমুলেশন দিয়ে এটাকে প্রকাশ করা যাবে না। ফলাফল হিসেবে পেয়েছি ভবিষ্যতের ঘটনাবলী পরিসংখ্যানিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যাবে। অর্থাৎ, ঠিক এটাই ঘটবে নির্দিষ্ট করে সেরকম কিছু না বলে বরং ভবিষ্যতে ঘটতে পারে সেরকম অনেকগুলো বিকল্প ঘটনার একটা সেট তৈরি করে দিতে পারব।
সেক্ষেত্রে গ্যালাক্টিক সোসাইটির সিমুলেশন তৈরি করা যখন সম্ভব, তৈরি করলেই হয়। অবাস্তব কেন? হামিন বলল।
আমি প্রমাণ করেছি যে গ্যালাক্টিক সোসাইটি পুরোটা অনুধাবন করতে হয়তো অসীম সময়ের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যদি এক বিলিয়ন বছর লাগে সেটাতো অবাস্তবই হবে। এক বিলিয়ন বছর এবং অসীম সময় দুটোই আমার কাছে সমান।
এত সময় লাগবে? এক বিলিয়ন বছর?
ঠিক হিসাবনিকাশ করে এখনো বের করিনি। আমার ধারণা এরচেয়ে কম হবে না।
তবে আপনি নিশ্চিত নন?
বের করার চেষ্টা করছি।
সফল হতে পারেননি?
সফল হতে পারিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার কোনো কাজে আসেনি? প্রশ্নটা করার সময় আড়চোখে ডর্সের দিকে তাকালো হামিন।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন সেলডন, কোনো লাভই হয়নি।
ডর্সও কোনো সাহায্য করতে পারেনি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডর্স। এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। হ্যারিকে শুধু পরামর্শ দিতে পারি। তাতে যদি কোনো কাজ না হয় আমার কী করার আছে?
উঠে দাঁড়ালো হামিন। বেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে আর কোনো লাভ হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হ্যারিকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
জামার হাতায় টান দিয়ে তাকে থামালেন সেলডন। আমার একটা পরিকল্পনা আছে।
চোখ সামান্য ছোট করে তার দিকে তাকালো হামিন। দেখে মনে হতে পারে সে হয় অবাক হয়েছে নয়তো সন্দেহ করছে। পরিকল্পনা আবার কখন করলেন? এখন?
না, আপারসাইডে যাওয়ার আগে থেকেই মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল। দুর্ঘটনার কারণে ভুলে গিয়েছিলাম। গ্রন্থাগারের কথা শুনে এখন আবার মনে পড়ল।
আবার বসল হামিন। বলুন আপনার পরিকল্পনা। গাণিতিক ব্যাখ্যা বাদ দিয়ে।
গণিতের ছিটেফোঁটাও নেই। গ্রন্থাগারে ইতিহাস পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে গ্যালাক্টিক সোসাইটি অতীতে ছিল আরো কম জটিল। বারো হাজার বছর আগে, যখন গ্যালাক্টিক এম্পায়ার মাত্র বেড়ে উঠতে শুরু করেছে সেই সময় গ্যালাক্সিতে দশ মিলিয়ন বসতি গ্রহ ছিল। বিশ হাজার বছর আগে প্রি-ইম্পেরিয়াল। কিংডমের অন্তর্গত ছিল মাত্র দশ হাজার বসতি গ্রহ। আরো সুদূর অতীতে সমাজ ব্যবস্থা কতখানি সংকুচিত ছিল আমরা জানি না। হয়তো সীমাবদ্ধ ছিল মাত্র একটা গ্রহে। এইরকম একটা কিংবদন্তীর কথা আপনি নিজেই বলেছিলেন, হামিন।
বলতে চাইছেন কম জটিল গ্যালাক্টিক সোসাইটি নিয়ে কাজ করলে আপনি দ্রুত সাইকোহিস্টোরি ডেভেলপ করতে পারবেন।
আমি সেইরকমই আশা করি।
ধরা যাক, হঠাৎ প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে বলল ডর্স, তুমি অতীতের কোনো এক সময়ের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে সাইকোহিস্টোরি তৈরি করলে। তারপর প্রি-ইম্পেরিয়াল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এম্পায়ার গড়ে উঠার এক হাজার বছর পরে কী হবে ভবিষ্যদ্বাণী করলে। তারপর আসল পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে দেখে নিতে পারবে তোমার ফলাফল কতখানি সঠিক।
গ্যালাক্টিক ইরার ১০০০ সালে কী পরিস্থিতি ছিল, আপনি তা আগেই জেনে নিতে পারবেন। ঠাণ্ডা গলায় বলল হামিন। এই বিবেচনায় আপনার পর্যবেক্ষণ নিরপেক্ষ হবে না। অবচেতনভাবেই আপনি জানা ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবেন। সমীকরণের উপাদানগুলো এমনভাবে নির্বাচন করবেন যেন জানা ঘটনাটাই ফলাফল হিসেবে পান।
আমার তা মনে হয় না, ডর্স বলল। ১০০০ জি. ই.-এর পরিস্থিতি আমরা পরিস্কার কিছুই জানি না। খুঁজে বের করে নিতে হবে। যত যাইহোক সেটা এগারো হাজার বছর আগের কথা।
সেলডনের চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। ১০০০ জি. ই.-এর পরিস্থিতি আমরা পরিষ্কার জানি না, তোমার এই কথার অর্থ কী? কম্পিউটার আছে, তাই না, ডর্স?
অবশ্যই।
মেমোরী স্টোরেজ ইউনিট আছে, আছে মানুষের নিজ চোখে দেখা এবং শোনা ঘটনার রেকর্ড। বর্তমান ১২, ০২০ জি. ই.-এর সব রেকর্ড যেমন আছে তেমনি ১০০০ জি. ই.-এর রেকর্ডও থাকতে বাধ্য।
কাগজে কলমে তোমার মন্তব্য ঠিকই আছে। কিন্তু বাস্তবে তুমি বারবার যে কথাটা বল সেটারই পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে। ১০০০ জি. ই.-এর সমস্ত রেকর্ড রাখা সম্ভব কিন্তু সেটা রাখতেই হবে এমন আশা করাটা অবাস্তব।
বুঝলাম। কিন্তু এই কথাটা তো আমি শুধু গাণিতিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছি। ঐতিহাসিক রেকর্ডের ক্ষেত্রে যে এটা প্রযোজ্য হবে তা তো বলিনি।
রেকর্ড দীর্ঘ সময় টিকিয়ে রাখা যায় না, হ্যারি। আত্মরক্ষার সুরে বলল ডর্স। মেমোরী ব্যাঙ্কস বিভিন্ন কারণে সময়ের সাথে সাথে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যে রেকর্ড দীর্ঘকাল কোনো কাজে ব্যবহৃত হয় না সেটা এমনিতেই হারিয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে যে ইম্পেরিয়াল গ্রন্থাগারের এক তৃতীয়াংশ রেকর্ডই আবর্জনা। শুধু চিরাচরিত প্রথার কারণেই আমরা সেগুলো সংরক্ষণ করছি। অন্য গ্রন্থাগারগুলো এত বেশি প্রথা মেনে চলে না। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে আমরা প্রতি দশ বছর পর ৪ অপ্রয়োজনীয় রেকর্ডগুলো ধ্বংস করে ফেলি।
স্বাভাবিকভাবেই, বহু রেকর্ড বারবার প্রয়োজন হয় এবং বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন গ্রহে। সেগুলো ডুপ্লিকেট করা হয়–সরকারি বা বেকারি পর্যায়ে–ফলে হাজার হাজার বছর সেগুলো টিকে থাকে। এই কারণেই গ্যালাকিক ইতিহাসের অনেক ঘটনাই আমরা জানি যদিও সেগুলো সংঘটিত হয়েছিল প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগে। তারও আগের অতীতের খোঁজখবর করলে দেখা যাবে যে তখন রেকর্ড আরো কম সংরক্ষণ করা হতো।
বিশ্বাস করতে পারছি না, বললেন সেলডন। আমার মতে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার সাথে সাথে রেকর্ডগুলোর নতুন কপি তৈরি করা উচিত। তোমরা কীভাবে জ্ঞান নষ্ট করে ফেললো?
যে জ্ঞান কেউ চায় না, তা সব সময়ই অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান। ডর্স বলল। তুমি চিন্তা করতে পারো, অব্যবহৃত ডাটা সংরক্ষণ করে রাখতে কী পরিমাণ শ্রম এবং শক্তি ব্যয় করতে হয়? সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তা শুধু বাড়তেই থাকে।
এই কথাটা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে থাকে যে, তোমরা যে তথ্যগুলো বোকার মতো নষ্ট করে ফেলো সেগুলো যেকোনো মুহূর্তে যে কারো প্রয়োজন হতে পারে।
একটা নির্দিষ্ট তথ্য হাজার বছরে একবার প্রয়োজন হতে পারে। যেকোনো সময় যে কারো কাজে আসবে এই কথা ভেবে সেগুলো সংরক্ষণ করা হতো অত্যন্ত ব্যয়বহুলভাবে, এমনকি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। গ্র্যাভিটেশন-এর সু প্রাচীন কিছু সমীকরণের কথা বলেছ তুমি এবং আমাদের বুঝিয়েছ ঐগুলো সুপ্রাচীন শুধু এই কারণে যে ওগুলোর উৎপত্তির ইতিহাস সুদূর অতীতের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কেন এমন হলো? কেন তোমরা গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীরা প্রাচীন অতীতে সমীকরণগুলো আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথে সংরক্ষণ করে রাখোনি?
এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে সেলডন বললেন, তো, হামিন এই ছিল আমার পরিকল্পনা। অনেক দূর অতীতে যখন সমাজব্যবস্থা আরো ছোট ছিলো সেই সময়কে ভিত্তি করে কার্যকরী সাইকোহিস্টোরি তৈরি করা সম্ভব হতো। কিন্তু যা শুনলাম তাতে সেই আশাও শেষ।
মাইকোজেন সেক্টরে যাওয়া যায়, ডর্স বলল হাসিমুখে।
ঝট করে তার দিকে তাকালো হামিন, ঠিক বলেছ এবং ওটাই হবে সেলডনের। জন্য উপযুক্ত জায়গা। আগেই মনে করা উচিত ছিল।
মাইকোজেন সেক্টর, পালাক্রমে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটার। পুনরাবৃত্তি করলেন সেলডন। মাইকোজেন সেক্টর কী এবং কোথায়?
হ্যারি, প্লীজ। পরে বলব। এখন অনেক কাজ করতে হবে। আজ রাতেই আপনি এখান থেকে চলে যাচ্ছেন।
.
৩৩.
জোর করে সেলডনকে বিছানায় পাঠালো ডর্স বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হবে আলো নিভে যাওয়া আর পুনরায় আলো জ্বলে উঠার মধ্যবর্তী সময়ে, রাতের অন্ধকারকে কাজে লাগিয়ে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সবাই ঘুমিয়ে থাকবে।
তুমি কী আবারো মেঝেতে ঘুমাবে? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
কাঁধ নাড়ল ডর্স, বিছানায় শুধু একজন শুতে পারবে। আমরা দুজন এক সাথে শুলে কারোরই বিশ্রাম হবে না।
এক মুহূর্ত তার দিকে কেমন ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সেলডন। তারপর বললেন, এবার তাহলে আমি মেঝেতে ঘুমাব।
না, তুমি বিছানাতেই ঘুমাবে। কারণ একটা ভয়ংকর বিপদ থেকে আমি নই তুমি বেঁচে ফিরে এসেছ।
আলো কমিয়ে শুয়ে পড়লেন দুজন। তুলনামূলকভাবে নীরব বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্র্যান্টরের অন্তহীন যান্ত্রিক গুঞ্জন বড় বেশি কানে লাগে। ঘুম আসছে না দেখে কথা। শুরু করলেন সেলডন।
আমার কারণে তোমার অনেক ক্ষতি হচ্ছে, ডর্স। ঠিক মতো কাজ করতে পারছ না। যাইহোক, আমি দুঃখিত, তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে।
তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ না। ডর্স বলল। আমি তোমার সাথে যাচ্ছি। হামিন ছুটির ব্যবস্থা করে দেবে।
আমি তো তোমাকে এত ঝামেলা করতে বলিনি।
তুমি বলোনি। হামিন বলেছে। তোমাকে আমার সব রকম বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্তত আপারসাইডে যে বিপদে পড়েছিলে তার কিছুটা ক্ষতিপূরণ তো হওয়া দরকার।
আমি তো বলেছি ওই ব্যাপারে তোমার নিজেকে দোষী ভাবার দরকার নেই।–তবে এটা ঠিক যে তুমি পাশে থাকলে আমি বেশ স্বস্তি পাই। যদি বুঝতাম যে এতে তোমার কাজের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না…
কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, মোলায়েম সুরে বলল ডর্স। হ্যারি, দয়া করে একটু ঘুমাও।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন সেলডন। তারপর ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, হামিন ঠিকঠাক মতো সব ব্যবস্থা করতে পারবে, ডর্স?
সে অসাধারণ এক মানুষ, ডর্স বলল। সব জায়গাতেই তার যোগাযোগ আছে। আমি নিশ্চিত সে যখন বলেছে আমার জন্য অনির্দিষ্টকালের ছুটির ব্যবস্থা করে দেবে, তখন অবশ্যই পারবে। মানুষকে সে খুব সহজে প্রভাবিত করতে পারে।
আমি জানি, বললেন সেলডন। মাঝে মাঝে আমার খুব অবাক লাগে যে সে আসলে আমার কাছে কী চায়।
মুখে যা বলেছে ঠিক তাই চায়। সে হচ্ছে কড়া আদর্শবাদী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ।
এমনভাবে বলছ যেন ওকে খুব ভালো করেই চেন তুমি, ডর্স।
অবশ্যই চিনি।
খুব ঘনিষ্ঠভাবে?
অদ্ভুত একটা শব্দ করল ডর্স। ঠিক বুঝতে পারছি না কী বলতে চাইছ। তবে ধরে নিচ্ছি সবচেয়ে নিকৃষ্টটাই বোঝাতে চাইছ। উত্তর হলো–না, ঐরকম ঘনিষ্ঠভাবে চিনি না। যাইহোক এটা নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?
দুঃখিত। আমি আসলে চাইনি না জেনে অন্য কারো ব্যক্তিগত-
সম্পত্তি? আরো বেশি অপমানজনক কথা। কথা বন্ধ করে চুপচাপ ঘুমাও।
আবারও দুঃখিত, ডর্স। কিন্তু, ঘুম আসছে না। ঠিক আছে, অন্য বিষয়ে কথা বলি। তুমি কিন্তু এখনো আমাকে বলোনি মাইকোজেন সেক্টর কী? ওখানে যাওয়াটা আমার জন্য ভালো হবে কেন? জায়গাটা কেমন?
খুব ছোট একটা সেক্টর। আমার যতদূর মনে পড়ে জনসংখ্যা প্রায় দুই মিলিয়ন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, মাইকোজেনিয়ানরা প্রাথমিক যুগের বেশ কিছু প্রথা অন্ধের মতো অনুসরণ করে। সবারই ধারণা ওদের কাছে এমন কিছু রেকর্ড আছে যা অন্য কারো কাছে নেই। ওখানে গেলে হয়তো প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগের উপর তোমার প্রস্তাবিত গবেষণাটা করতে পারবে। প্রাথমিক যুগের ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনা করছিলাম তখনই ওই সেক্টরের নামটা মাথায় আসে।
তুমি ওদের রেকর্ড কখনো দেখেছ?
না, আমার জানামতে কেউই দেখেনি।
তুমি কী তাহলে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে যে রেকর্ডগুলো এখনো আছে?
আসলেই আমি বলতে পারব না। কিন্তু ওরকম ভাবাটা অন্যায়। যেহেতু ওরা বেশ জোর দিয়েই বলে যে ওদের কাছে রেকর্ড আছে, তাহলে নিশ্চয়ই আছে। যাইহোক আমরা তো ওখানে যাচ্ছিই, সত্য মিথ্যা তখনই জানা যাবে। মাইকোজেনিয়ানরা নিজেদের ঘরের খবর কাউকে জানায় না। এবার ঘুমাও, হ্যারি-
কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমিয়ে পড়লেন সেলডন।
.
৩৪.
ঠিক ০৩০০ ঘণ্টায় ঘর ছেড়ে বেরুলেন দুজন। সেলডন আচরণে বুঝিয়ে দিলেন যে ডর্সকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। কারণ এই গ্রহ সে খুব ভালোভাবে চেনে–দুবছর হলো এখানে থাকছে, আর সে হামিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (কতখানি ঘনিষ্ঠ? প্রশ্নটা তাকে এখনো খুঁচিয়ে মারছে)।
তাদের পরনে হুডওয়ালা ঢোলা আলখাল্লা। হুডগুলো মাথার সাথে এঁটে বসেছে। পোশাকগুলো তৈরি হয়েছে এমনভাবে যেন আলো প্রতিফলিত হয়। কয়েক বছর আগে ফ্যাশনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনপ্রিয় ছিল (বিশেষ করে তরুণদের মাঝে)। তবে। খুব অল্প সময়ের জন্য। এখন এই পোশাক দেখে সবাই হাসবে। তবে এতে তাদের শরীর খুব ভালোভাবেই ঢাকা পড়েছে এবং কেউ দেখলে চিনতে পারবে না।
হতে পারে আপারসাইডের ঘটনা পুরোপুরি নির্দোষ একটা ঘটনা, বেরনোর আগে হামিন বলেছিল। হয়তো আপনাকে ধরার জন্য কোনো এজেন্ট এখানে। আসেনি, সেলডন। তবে সবচেয়ে খারাপটার জন্য প্রস্তুত থাকাই ভালো।
আপনি আমাদের সাথে আসছেন না? উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সেলডন।
আপনাদের সাথে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু নিজেকে টার্গেটে পরিণত করতে না চাইলে বেশিদিন কাজে গরহাজির থাকা অনুচিত হবে। বুঝতে পেরেছেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন সেলডন। বুঝেছেন তিনি।
ডর্স তাকে নিয়ে একটা এক্সপ্রেস কারে চড়লো। আরো অল্প কয়েকজন যাত্রী আগে থেকেই চড়ে বসে আছে (ভোর তিনটার সময় এত যাত্রী এক্সপ্রেস ওয়েতে কী করছে ভেবে পেলেন না সেলডন–তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। শুধু তারা দুজন হলে কেউ দেখে ফেললে সন্দেহ করত)।
এটা একটা মনোরেইল। ইলেকক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের সাহায্যে চলে।
বাইরের দৃশ্যাবলী দেখছেন সেলডন। সারি সারি ঘর-বাড়ি পেরিয়ে ছুটে চলেছে এক্সপ্রেস ওয়ে। দু-একটা ভবন বাদে সবগুলোরই উচ্চতা কম। অবশ্য তিনি জানেন যে উচ্চতা কম হলেও গভীরতা অনেক অনেক বেশি। যেখানে দশ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের পুরোটাই একটা শহর সেখানে চল্লিশ বিলিয়ন মানুষের জন্যও জায়গাটা অনেক বড়ো হয়ে যায়। তখন আর ঘনবসতি বা বহুতল ভবন তৈরি করার প্রয়োজন হয় না। কাজেই প্রচুর ফাঁকা জায়গা চোখে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। দেখে মনে হলো শস্যের ক্ষেত–তবে কয়েকটা জায়গা দেখে পরিস্কার বোঝা গেল যে ওগুলো পার্ক। এছাড়াও প্রচুর কাঠামো চোখে পড়ল, সেগুলো যে কী জিনিস তিনি বুঝতে পারলেন না। কলকারখানা? অফিস-আদালত? কে জানে? সিলিন্ডার আকৃতির একটা বিশাল কাঠামো দেখে ধরে নিলেন এখানে বোধহয় পানি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ট্র্যান্টরে বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। ওরা বোধহয় আপারসাইড থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে। তারপর সেটাকে বিশুদ্ধ করে সংরক্ষণ করে। যতই ভাবলেন ততই নিশ্চিত হলেন।
তবে বেশিক্ষণ দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো না।
এখানেই নামতে হবে আমাদের। ফিস ফিস করে বলল ডর্স। উঠে দাঁড়ালো সে, হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকেও দাঁড় করিয়ে দিল।
এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে নেমে শক্ত মেঝেতে পা রাখলেন তারা। ডর্স দিক নির্দেশক চিহ্নগুলো দেখছে মনোযোগ দিয়ে।
অগণিত দিক নির্দেশনা দেখে চমকে গেলেন সেলডন। বেশিরভাগই প্রতীক এবং সংকেতের সাহায্যে যা বুঝতে স্থানীয় ব্র্যান্টরিয়ানদের নিঃসন্দেহে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু তার কাছে সবই অপরিচিত।
এইদিকে যেতে হবে, ডর্স বলল।
কোন দিকে? কীভাবে বুঝলে তুমি?
ঐ যে দেখ। দুটো ডানা আর একটা তীর চিহ্ন।
দুটো ডানা? ওহ্। তার কাছে মনে হলো চিহ্নটা উল্টোভাবে লেখা w-এর মতো, আবার একটু খেয়াল করতেই পাখির ডানার মতোও মনে হলো।
শব্দ ব্যবহার করে না কেন ওরা? তিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
কারণ বিভিন্ন গ্রহে বিভিন্ন রকম শব্দ ব্যবহার করা হয়। এখানে যে জিনিসটাকে বলা হয় এয়ার জেট, সিনাতে সেটাকে বলা হয় সোয়ার, অন্য কোনো গ্রহে হয়তো বলা হয় সুপ। দুই ডানা এবং একটা তীর চিহ্ন হচ্ছে এয়ার ভেসেল বোঝানোর জন্য গ্যালাক্টিক প্রতীক এবং সবাই এটা বুঝতে পারে।-তোমরা হ্যালিকনে প্রতীক ব্যবহার করো না?
খুব বেশি না। হ্যালিকন নিজের নিয়মেই চলে। আমরা দৃঢ়ভাবে আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি আঁকড়ে রাখি, কারণ শক্তিশালী প্রতিবেশীরা সব সময় আমাদের দমিয়ে রাখতে চায়।
এখানেই তোমার সাইকোহিস্টোরি কাজে লাগাতে পারো। প্রমাণ করে দেখাতে পারো যে হাজারো বাচনভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও সর্বজনীন কিছু প্রতাঁকের সাহায্যে গ্যালাক্সী এক সূত্রে বেঁধে রাখা যাবে।
এতে কোনো লাভ হবে না। ডর্সের পিছু পিছু তিনি আধো অন্ধকার করিডর দিয়ে হাঁটছেন, সেই সাথে ভাবছেন ট্র্যান্টরে অপরাধের হার কেমন এবং এটা কী সবচেয়ে। অপ্রাপ্রবণ এলাকাগুলোর একটা। একটা বিষয়ের জন্য তুমি হাজারো নিয়ম তৈরি করতে পারো কিন্তু কোনো সর্বজনীনতা তৈরি করতে পারবে না। এ থেকেই তুমি বুঝতে পারবে কেন বলেছিলাম যেকোনো সিস্টেমকেই অর চেয়ে কম জটিল মডেল দিয়ে উপস্থাপনা যায় না। ডর্স, আমরা কী কোনো এয়ার-জেট স্টেশনে যাচ্ছি?
তার দিকে ঘুরল। মুখে আমুদে হাসি। তোমাকে আমি এয়ার জেট-এর প্রতীক দেখিয়েছি। তোমার কী ধারণা আমরা গলফ খেলতে যাচ্ছি? তুমিও কী ট্র্যান্টরিয়ানদের মতো এয়ার-জেট-এ চড়তে ভয় পাও?
না, না। হ্যালিকনে আব্রা প্রায় সময়ই এয়ার-জেট ব্যবহার করি। আসলে হমিন যখন আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসে তখন কমার্শিয়াল এয়ার ট্রাভেল এড়িয়ে গিয়েছিল কারণ সে মনে করেছিল হয়তো আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটা গোপন রাখা যেত না।
কারণ, প্রতিপক্ষ তখন জানত তুমি কোথায় আছ এবং কোথায় যাবে। হয়তো এখন ব্রা জানে না তুমি কোথায়। আর তাছাড়া আমরা একটা গোপন পোর্ট থেকে ব্যক্তিগত এয়ার জেট-এ চড়ব।
চালাবে কে?
সম্ভবত হামিনেরই এক বন্ধু।
ওকে বিশ্বাস করা যাবে? তোমার কী ধারণা?
যেহেতু হামিনের বন্ধু, সেহেতু অবশ্যই বিশ্বাস করা যায়।
হামিনের উপর তোমার অগাধ বিশ্বাস। তিক্ত গলায় বললেন সেলডন।
কারণ আছে। সেলডনের গলার স্বরের পরিবর্তন আমলেই নিল না ডর্স। ও সবার সেরা।
সেলডনের তিক্ততা আরো বেড়ে গেল।
ওই যে, এয়ার-জেট।
ছোট বাহন, অদ্ভুত আকৃতির ডানা। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বেটে মতো একটা লোক, পরনে উজ্জ্বল এবং বহুরঙা ট্র্যান্টরিয়ান পোশাক।
আমরা সাইকো। ডর্স বলল।
এবং আমি ইতিহাস। লোকটা জবাব দিল।
এয়ার জেট-এর ভিতরে ঢুকল সবাই।
পাস ওয়ার্ডের আইডিয়াটা কার? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
হামিন। ডর্স জবাব দিল।
নাক দিয়ে বিদঘুঁটে শব্দ করলেন সেলডন। হামিনের যে সেন্স অব হিউমার আছে আমি চিন্তাই করিনি। সবসময় এত গম্ভীর হয়ে থাকে।
ডর্স হাসল।
.
সানমাস্টার
সানমাস্টার ফোরটিন… প্রাচীন ট্রাক্টরের মাইকোজেন সেক্টরের শাসনকর্তা… আত্মকেন্দ্রিক এই সেক্টরে অন্যান্য শাসনকর্তার মতোই এই লোকটির ব্যাপারেও তেমন কোনো তথ্য নেই। ইতিহাসে সানমাস্টার ফোরটিন-এর নাম শুধু এই কারণেই উল্লেখ করা হয়েছে, হ্যারি সেলডন যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেই সময়েরই একটা ঘটনায় তার কিছুটা ভূমিকা ছিল…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা
.
৩৫.
পাইলট কম্পার্টমেন্টটা অত্যধিক ছোট। পিছনে মাত্র দুজন মানুষ বসার ব্যবস্থা। গদিমোড়া আসনে বসে সেলডন টের পেলেন জালের মতো এক ধরনের কাপড় তার পা, কোমর এবং বুক পেচিয়ে আসনের সাথে বেঁধে ফেলছে। মাথার উপর থেকে একটা হুড নেমে এসে তার কপাল এবং কান পর্যন্ত বেঁধে ফেলল। নিজেকে মনে হলো বন্দী। কষ্ট করে বাদিকে ঘুরলেন। খুব সামান্যই ঘুরতে পারলেন দেখলেন ডর্সও একইরকমভাবে বন্দী হয়ে পড়েছে।
পাইলট নিজের আসনে বসে প্রথমে যন্ত্রপাতিগুলো দেখে নিল তারপর বলল, আমি এনডর লেভনিয়ান, আপনাদের সেবায় নিয়োজিত। সিট বেল্ট দিয়ে এভাবে বেঁধে রাখার কারণ হচ্ছে উড়াল দেওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগবে। উপরে উঠার পর বাধন খুলে দেওয়া হবে। আপনাদের নাম আমাকে জানাতে হবে না। জেনে কোনো লাভ নেই।
চমৎকার ভঙ্গিতে হাসল পাইলট। হাসির সাথে অসংখ্য ভাজ পড়ল মুখে। বন্ধুরা, আপনারা ভয় পাবেন না তো?
আমি একজন আউটওয়ার্ল্ডার এবং এয়ার জেট চড়ে অভ্যস্ত। হালকা সুরে ডর্স বলল।
আমিও। তাচ্ছিল্যের সুরে জানালেন সেলডন।
চমৎকার। তবে এটা ঠিক আপনাদের সাধারণ এয়ার জেট-এর মতো না এবং সম্ভবত কখনো রাতে ফ্লাই করেননি। যাইহোক আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।
পাইলটেরও পুরো শরীর বেল্ট দিয়ে আটকানো তবে হাতদুটো পুরোপুরি বাঁধনমুক্ত।
খুব হালকাভাবে জেট-এর ভিতরে গমগম একটা শব্দ তৈরি হলো। ধীরে ধীরে সেটা বাড়ছে। যদিও অসহ্য হয়ে ওঠেনি, তবে হতে কতক্ষণ। তাই সেলডন ঝাঁকুনি দিয়ে শব্দটা কান থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাতে শুধু একটাই লাভ হলো যে হুডটা আরো শক্তভাবে চেপে বসল মাথার সাথে।
জেটটা তারপর এক লাফ দিয়ে উড়া শুরু করল (বর্ণনা দেওয়ার জন্য সেলডনের কাছে মনে হলো এটাই উপযুক্ত শব্দ) এবং সেলডনের মনে হলো কে যেন তাকে প্রচণ্ড শক্তিতে সিটের সাথে ঠেসে ধরেছে।
পাইলটের সামনে যে উইন্ডশীল্ড আছে সেটা দিয়ে সেলডন যে দৃশ্য দেখলেন তাতে তার আতঙ্ক বেড়ে গেল শতগুণ। চোখের সামনে শুধু নিরেট দেয়াল, খাড়া উঠে গেছে। তারপর দেয়ালের গায়ে গোলাকার একটা প্রবেশমুখ তৈরি হলো। ঠিক এইরকমই একটা প্রবেশমুখ দিয়ে তিনি আর হামিন প্রথম দিন ইম্পেরিয়াল সেক্টর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। যদিও শুধু জেট-এর ঢোকার জন্য প্রবেশমুখটা যথেষ্ট বড়ো কিন্তু জেট-এর ডানাদুটো যে সেখান দিয়ে ঢুকবে না তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যতদূর সম্ভব ডানদিকে মাথা ঘোরালেন সেলডন। সময়মতোই ঘুরিয়েছিলেন। কারণ তাকিয়েই দেখলেন যে ডানদিকের ডানাটা খসে পড়ে গেল।
প্রবেশমুখ দিয়ে জেটটা ঢুকে পড়ল অনায়াসে। ইলেকক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড সেটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। আলোকিত টানেলের ভিতর দিয়ে নিখুঁত গতিতে ছুটে চলেছে জেট। হঠাৎ হঠাৎ ঝাঁকুনি লাগছে। সেলডনের ধারণা মাঝে মাঝে দু একটা বিচ্ছিন্ন ম্যাগনেট রয়েছে। তাই এরকম হচ্ছে।
তারপর, মাত্র দশ মিনিট পর এয়ার জেট টানেল ছেড়ে বেরিয়ে এল উন্মুক্ত বায়ুমণ্ডলে, রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল সব দৃশ্যপট।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড থেকে বেরিয়ে জেট-এর গতি কমে গেল খানিকটা। দম বন্ধ করে বসে রইলেন সেলডন।
কিছুক্ষণ পরেই শরীরের সব বাঁধন খুলে গেল একসাথে।
কেমন আছেন, বন্ধুরা? পাইলটের উৎফুল্ল কণ্ঠ শোনা গেল।
ঠিক বুঝতে পারছি না, বললেন সেলডন। ঘুরলেন ডর্সের দিকে। তুমি ঠিক আছ?
হ্যাঁ। ডর্স জবাব দিল। আমার ধারণা মি. লেভনিয়ান দেখতে চেয়েছিলেন আমরা আউটওয়াল্টার কী না। তাই না মি. লেভনিয়ান?
অনেকেই এক্সাইটমেন্ট পছন্দ করে, বলল লেভনিয়ান। আপনারা করেন না?
করি, তবে তারও একটা সীমা থাকে। ডর্স বলল।
সেলডন সম্মতি জানালেন, সব বুদ্ধিমান মানুষই এটা মেনে চলে।
না থেমেই আবার বললেন, নিশ্চয়ই আপনার কাছেও এত বেশি আনন্দদায়ক হতো না যদি ডানাগুলো বিচ্ছিন্ন না করা যেতো।
নাহ। আমি তো বলেছি যে এটা কোনো সাধারণ এয়ার জেট নয়। এর ডানাগুলো সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড। এগুলো জেট-এর গতি, তাপমাত্রা, বাতাসের বেগ এইরকম আরো অনেক কিছুর সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রয়োজনে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এগুলোর দৈর্ঘ্য প্রস্থ কমে বা বাড়ে বা এমনকি সম্পূর্ণ আকৃতিটাই পাল্টে ফেলতে পারে।
সেলডনের জানালায় একটা শব্দ হলো। বৃষ্টি পড়ছে। তিনি বললেন।
সবসময়ই পড়ে।
বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। হ্যালিকন বা অন্য কোনো গ্রহ হলে আলো চোখে পড়ত। শুধু ট্রান্টরে–অন্ধকার।
সম্পূর্ণ অন্ধকার নয় অবশ্য। কারণ এক জায়গায় বীকন লাইট চোখে পড়ল। সম্ভবত সতর্ক করে দেওয়ার জন্য যে ঐ জায়গায় আপারসাইড অনেক উঁচু।
সবসময়ের মতোই সেলডনের অস্বস্তি টের পেল ডর্স। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাতে হাত বুলিয়ে বলল, দুঃশ্চিন্তা করো না, হ্যারি। আমি নিশ্চিত পাইলট জানে সে কী করছে।
আমিও নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি, তবে সে যদি আমাদের জানাতো তাহলে আরো ভালো হতো। কথাগুলো বেশ জোরেই বললেন যেন যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সে শুনতে পারে।
আমার কোনো আপত্তি নেই, পাইলট বলল, শুরুতেই বলি যে আমরা উপরে উঠছি। আর কয়েক মিনিট পরেই মেঘের স্তর পেরিয়ে যাব। ওখানে বৃষ্টি থাকবে না এমনকি আমরা তারাও দেখতে পারব।
নিখুঁত সময়ের হিসাব কারণ পালকের মতো পাতলা মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা দুটো তারা দেখা যাচ্ছে এখন। পাইলট যখন কেবিনের আলোগুলো নিভিয়ে দিল বাইরের আকাশে তখন দেখা গেল অসংখ্য উজ্জ্বল তারার মেলা। শুধু ভেতরের যন্ত্রপাতি থেকে বিচ্ছুরিত আলো বাইরের সীমাহীন উজ্জ্বলতার সাথে নিষ্ফল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
প্রায় দুই বছর পরে আমি তারা দেখার সুযোগ পেলাম। ডর্স বলল, কী চমৎকার, তাই না? কত উজ্জ্বল আর অগণিত।
আসলে ট্র্যান্টর অন্যান্য গ্রহগুলোর তুলনায় গ্যালাক্সি কেন্দ্রের অনেক কাছাকাছি অবস্থিত। মন্তব্য করল পাইলট।
হ্যালিকন গ্যালাক্সির এমন এক অংশে অবস্থিত যেখানে আকাশে কখনোই অগণিত তারা চোখে পরে না। আর তাই মহাবিশ্বের দুর্লভ সৌন্দর্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সেলডন।
একেবারে নীরব, কোনো শব্দ নেই। ডর্স বলল।
ঠিক বলেছ, সেলডন বললেন। এই জেট-এর শক্তির উৎস কী, মি. লেভনিয়ান?
মাইক্রোফিউশন মোটর আর গ্যাস।
জানতাম না যে আমরা মাইক্রোফিউশন মোটর তৈরি করেছি। যদিও নাম শুনেছি-
এরকম অল্প কয়েকটাই তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর সবই ট্র্যান্টরে এবং শুধু সরকারের প্রথম শ্রেণীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ব্যবহার করে।
এই জেট-এর ভাড়া নিশ্চয়ই অনেক বেশি? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
অত্যধিক বেশি।
এজন্য মি. হামিনকে কত খরচ করতে হবে?
মি. হামিনকে কোনো কিছুই খরচ করতে হবে না। যে কোম্পানী এই জেট-এর মালিক, মি. হামিন সেই কোম্পানীর খুব ভালো একজন বন্ধু।।
হুম্ জাতীয় একটা শব্দ করলেন সেলডন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এইরকম মাইক্রোফিউশন এয়ার-জেট বেশি বেশি তৈরি হচ্ছে না কেন?
প্রথম কারণ খরচ অনেক বেশি পড়ে। তাছাড়া যে কয়টা আছে তাতেই কাজ চলে যায়।
বড় জেট তৈরি করে আরো বেশি কাজে লাগাতে পারেন।
হয়তো, কিন্তু কোম্পানী বড়ো এয়ার জেট-এর জন্য উপযুক্ত মাইক্রোফিউশন ইঞ্জিন এখনো তৈরি করতে পারেনি।
কারিগরি অগ্রগতি বা প্রযুক্তিকে আরো উন্নত করার আকাঙ্ক্ষা যে একেবারেই শেষ হয়ে গেছে সেই সম্বন্ধে হামিনের অভিযোগের কথা মনে পড়ল সেলডনের। অবক্ষয়, বিড়বিড় করে বললেন তিনি।
কী? ডর্স জিজ্ঞেস করল।
কিছু না। হামিন একটা কথা বলেছিল সেটাই চিন্তা করছিলাম।
বাইরে তারাগুলোর দিকে তাকালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কী পশ্চিম দিকে যাচ্ছি, মি. লেভনিয়ান?
হ্যাঁ, কীভাবে বুঝলেন?
আমার ধারণা পূর্ব দিকে যেতে থাকলে এতক্ষণে আমরা ভোর হওয়া দেখতে পেতাম।
তবে ভোর হওয়া চোখে পড়ল ঠিকই এবং সেই সাথে সূর্যের আলো সত্যিকার নির্ভেজাল সূর্যের আলো–কেবিনের দেয়ালগুলো আলোর বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মাত্র কয়েক মুহূর্ত দেখার সুযোগ হলো, কারণ জেট নিচে নামছে, আবার মেঘের ভিতরে ঢুকে গেল। নীল আর সোনালি রং অদৃশ্য হয়ে এখন চারপাশে বিবর্ণ ধূসর রং। ডর্স আর সেলডন হতাশা চেপে রাখতে না পেরে প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল।
মেঘের স্তর পেরিয়ে আরো নামতেই আপারসাইডের সারফেস চোখে পড়ল। এই অংশে শক্ত গুঁড়িওয়ালা গাছ এবং তৃণভূমি গড়ে উঠেছে। বেশ ভালোভাবেই বিস্তৃত। ক্লজিয়া এগুলোর কথাই বলেছিল।
এবারও খুব বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ হলো না। নিচে একটা প্রবেশ মুখ দেখা যাচ্ছে, মাথায় লেখা মাইকোজেন।
.
৩৬.
জেট পোর্টটাকে সেলডনের কাছে মনে হলো পরিত্যক্ত। পাইলটের কাজ শেষ। দেরী করল না। ডর্স আর সেলডনের সাথে হাত মিলিয়ে জেট নিয়ে দ্রুত উড়াল দিল। ঝপ করে ঢুকে পড়ল আরেকটা প্রবেশ মুখে।
মনে হচ্ছে অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বসার জন্য বেঞ্চ আছে যেখানে একসাথে কয়েকজন মানুষ বসতে পারবে। কিন্তু সেলডন আর ডর্স ভেনাবিলি ছাড়া অন্য কোনো মানুষ নেই। আয়তকার পোর্ট, দেয়াল দিয়ে ঘেরা, সেই দেয়ালগুলোতে নিঃসন্দেহে অসংখ্য টানেল আছে যা দিয়ে অসংখ্য জেট যাওয়া-আসা করে। কিন্তু কোথাও কোনো জেট নেই। তাদেরকে নিয়ে আসা জেটটা চলে যাওয়ার পর আর কোনো জেট আসেনি।
একটা মানুষও নেই। একেবারেই জনশূন্য।
নৈঃশব্দ এবং একাকীত্ব অসহ্য ঠেকল সেলডনের কাছে। ডর্সের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আমরা কী করব? তোমার কোনো পরিকল্পনা আছে?
মাথা নাড়ল ডর্স। হামিন বলেছে সানমাস্টার ফোরটিন আমাদের সাথে দেখা করবে। এছাড়া আর কিছু জানি না।
সানমাস্টার ফোরটিন? এটা আবার কী?
একজন মানুষ কোনো সন্দেহ নেই। নাম শুনে অবশ্য বলতে পারছি না পুরুষ না মহিলা।
অদ্ভুত নাম।
নির্ভর করবে শ্রোতার উপর। কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি এমন অনেকেই নাম শুনে আমাকে পুরুষ মনে করত।
ওরা নিশ্চয়ই বোকা ছিল, মৃদু হেসে বললেন সেলডন।
মোটেই না। নাম দিয়ে তো আর পুরুষ মহিলা বোঝা যায় না। কাজেই ওদের অনুমান ঠিকই আছে। আমি শুনেছি অনেক গ্রহেই ডর্স নামটা পুরুষদের নাম হিসেবে বেশ প্রচলিত।
আমি কখনো শুনিনি।
তার কারণ তুমি আসলে ঠিক গ্যালাক্টিক ট্রাভেলার নও। হ্যারি নামটা বেশ প্রচলিত অথচ আমি এক মহিলাকে চিনতাম যার নাম ছিল হেরি। উচ্চারণ একরকম হলেও বানান ভিন্ন। যতদূর জানি মাইকোজেনে একেকটি পরিবারের জন্য শুধু একটি নামই নির্দিষ্ট করা থাকে। অর্থাৎ একটি পরিবারের সব সদস্যের নামই হবে একরকম, পরিবারের সদস্যদের চিহ্নিত করার জন্য সেই নামের সাথে ধারাবাহিকভাবে নাম্বার যুক্ত করা হয়। পূর্বপুরুষদের নামের সাথে যে পর্যন্ত নাম্বার দেওয়া হয় বংশধরদের নামের সাথে ধারাবাহিকভাবে তার পরের নাম্বার যোগ হয়। এবং এভাবেই চলতে থাকে।
কিন্তু সানমাস্টার নামটা একটু বেশিই অদ্ভুত।
তুমি বোধহয় বলতে চাও যে নামটা বেশ খানিকটা দাম্ভিক, তাই না? সিনাতে ডর্স নামটা অনেক প্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ বসন্তের উপহার।
কারণ বসন্তকালে তোমার জন্ম হয়েছে।
না, আমি যখন ভূমিষ্ঠ হই সিনাতে তখন ঘাম ঝরানো গ্রীষ্মকাল। কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজনদের কাছে মনে হয়েছে এই নামটাই ভালো হবে।
তাহলে বলা যায়, সম্ভবত সানমাস্টার
ভরাট এবং কঠিন একটা কষ্ঠস্বর শোনা গেল, ওটা আমার নাম, ট্রাইবসমেন।
চমকে উঠলেন সেলডন। বা দিকে তাকিয়ে একটা গ্রাউন্ড কার দেখতে পেলেন। কখন এসেছে টেরই পাননি। গাড়িটার আকৃতি বাক্সের মতো এবং বেশ প্রাচীন। দেখতে অনেকটা ডেলিভারি ওয়াগনের মতো। ভেতরে চালকের আসনে বৃদ্ধ এক লোক বসে আছে। যথেষ্ট লম্বা এবং বৃদ্ধ হলেও দেহ কাঠামো এখনো সবল। রাজকীয় ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নামল সে।
পরনে বিশাল হাতাওয়ালা সাদা আলখাল্লা। হাতাগুলো কব্জির কাছে আটকানো। পায়ে স্যান্ডেল। মাথা পুরোপুরি কামানো দেখে মনে হয় ওই মাথায় কোনোদিন চুল গজায়নি। গভীর চোখ দিয়ে তাদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বাগতম, ট্রাইবসমেন। লোকটা বলল।
কৃত্রিম ভদ্রতার সাথে সেলডন বললেন, অভিনন্দন, স্যার। তারপর সত্যিকার বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভিতরে আসলেন কীভাবে?
যে পথ দিয়ে আসতে হয় সেই পথ দিয়ে। আমি ঢোকার পর প্রবেশ পথটা আবার বন্ধ হয়ে গেছে। আপনাদের মনোযোগ ছিল অন্যদিকে।
হ্যাঁ, আমরা খেয়াল করিনি। অবশ্য এখানে কী হবে বা কার দেখা পাব সেটা তো আমরা জানি না। সত্যি কথা বলতে কী এখনো জানি না।
ট্রাইবসম্যান চ্যাটার হামিন আমার সহকর্মী ব্রাদারদের জানায় যে দুজন ট্রাইবস সদস্য এখানে আসছে। আপনাদের সাহায্য করার অনুরোধ জানিয়েছে সে।
হামিনের সাথে আপনার পরিচয় আছে তাহলে।
হ্যাঁ। সে আমাদের একজন সেবক। আমাদের এত সেবা করেছে যে এখন সময়। এসেছে বিনিময়ে তাকে কিছু দেওয়ার। মাইকোজেনে বাইরে থেকে খুব কম মানুষ। আসে, এখান থেকেও খুব কমই বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া, কোনো অসুবিধা যেন না হয়। সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এখানে আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।
আমরা কৃতজ্ঞ, সানমাস্টার ফোরটিন। কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে ডর্স বলল।
সান মাস্টার রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালেন। ট্রাইবসদের নিয়ম আমি জানি। তিনি বললেন। জানি যে ওই সমাজে মেয়েরা অনুমতি ছাড়াই পুরুষদের মাঝে কথা বলতে পারে। তাই আমি বিরক্ত হইনি। কিন্তু অন্য ব্রাদাররা নিয়মটা জানে না। তাই ওদের সামনে সতর্ক থাকতে হবে।
তাই নাকি? সানমাস্টারের রাগ বোঝা না গেলেও ডর্স রাগ গোপন করল না।
হ্যাঁ। আর যখন আপনাদের সাথে একা থাকব তখন আমার নামের সাথে যে পরিচয়সূচক সংখ্যা আছে সেটা বলার দরকার নেই। শুধু সানমাস্টার বললেই হবে।–এখন দয়া করে আমার সাথে আসুন। এই জায়গাটা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক নয় কারণ এখানে ট্রাইবস সমাজের নিদর্শন প্রকট।
স্বস্তি আমাদের সবারই প্রয়োজন, বললেন সেলডন, বোধহয় প্রয়োজনের চেয়ে খানিকটা জোরেই বললেন, এবং এখান থেকে এক পাও নড়ব না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি নিশ্চয়তা দিচ্ছেন যে আমাদেরকে বল প্রয়োগ করে আপনার পছন্দমতো প্রথা মেনে চলতে বাধ্য করা হবে না। আমাদের সমাজে যেকোনো মেয়ে পুরুষদের মতোই স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে। আপনি যদি আমাদের নিরাপত্তা দিতে রাজী হয়ে থাকেন তাহলে শারীরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি মানসিক নিরাপত্তাও দিতে হবে।
আপনি বেশ সাহসী, মসৃণ সুরে বললেন সানমাস্টার। আপনার নাম?
আমি হ্যালিকনের হ্যারি সেলডন। আমার সঙ্গিনী সিনার ডর্স ভেনাবিলি।
সেলডন যখন নিজের নাম বললেন সানমাস্টার মাথা নুইয়ে সম্মান দেখালেন, কিন্তু ডর্সের নাম শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। ট্রাইবসম্যান হামিনকে কথা দিয়েছি যে আমি আপনাদের সব রকম সহায়তা করব। তাই আপনার সঙ্গিনীকে। বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য যা করতে পারি করব। এই অশালীন আচরণ যদি সে করতেই থাকে আমি দেখব এর জন্য তাকে যেন দোষী সাব্যস্ত করা না হয় তবে একটা ব্যাপার আপনাদের নিশ্চিত করতেই হবে।
এবং কথা শেষ করেই সে চোখের ইশারায় দেখালো, প্রথমে সেলডনের মাথা এবং তারপরে ডর্সের মাথার দিকে।
বুঝলাম না। বললেন সেলডন।
আপনাদের চুল?
চুল আবার কী দোষ করল।
ওগুলো দেখানো চলবে না।
তার মানে আমাদেরকে আপনার মতো মাথা কামিয়ে ফেলতে হবে?
আমার মাথা কামানো নয়, ট্রাইবসম্যান সেলডন। বয়ঃসন্ধিকালে কৃত্রিম উপায়ে আমার শরীরে লোম গজানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিয়মটা আমাদের সমাজের নারী পুরুষ সকলেই মেনে চলে।
এই কাজ আমি কখনোই করতে দেব না।
ট্রাইবসম্যান, আমি আপনাদের মাথা কামাতে বলছি না বা লোমনাশক ওষুধ ব্যবহার করতে বলছি না, শুধু ঢেকে রাখতে বলছি।
কীভাবে?
স্কিনক্যাপ আছে আমার সাথে। এটার সাহায্যে চুল ভুরু সব ঢেকে রাখা যাবে। যখন আমাদের মাঝে থাকবেন তখন ওগুলো পড়ে রাখবেন। এবং ট্রাইবসম্যান সেলডন, আপনি প্রতিদিন শেভ করবেন।
কিন্তু কেন এই নিয়ম মানতে হবে?
কারণ আমাদের কাছে মাথার চুল ঘৃণ্য এবং অশ্লীল।
নিশ্চয়ই আপনি এবং আপনার সমাজের লোকেরা জানে যে এটা অন্য সবার কাছেই স্বাভাবিক। গ্যালাক্সির বাকি সবার কাছেই চুল সৌন্দর্যের লক্ষণ।
জানি। আমি এবং এই সমাজের আরো কয়েকজন আছে যাদের সাথে ট্রাইবসম্যানদের অনবরত দেখা হয়। ফলে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু যারা অভ্যস্ত না তাদেরকে তো আমরা এইরকম অশ্লীল দৃশ্য দেখতে দিতে পারি না।
ঠিক আছে, সানমাস্টার। কিন্তু একটা কথা জানতে চাই, যেহেতু আপনারা চুল নিয়েই জন্মান, আমরা সবাই, এবং বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত সেগুলো দেখিয়েই বেড়ান, তারপর সেগুলো ফেলে দেওয়ার মানে কী? শুধুই কি প্রথা নাকি এর পিছনে অন্য কোনো যুক্তি আছে?
গর্বিত সুরে জবাব দিলেন বৃদ্ধ মাইকোজেনিয়ান, এভাবেই আমরা শিশুদের বোঝাই যে তোমরা এখন বড়ো হয়েছ এবং এভাবেই সে বুঝতে পারে নিজের আসল পরিচয় এবং কখনো ভুলে না যে সে ছাড়া বাকি সবাই ট্রাইবসম্যান।
প্রতিউত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না তিনি (এবং সত্যি কথা বলতে কী সেলডন কী জবাব দেবেন ভেবে পেলেন না) বরং আলখাল্লার পকেট থেকে বিভিন্ন রংয়ের অনেকগুলো পাতলা প্লাস্টিকের বস্তু বের করে আনলেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাকি দুজনের মুখের দিকে। বস্তুগুলো একটা একটা করে তাদের মুখের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছেন।
গায়ের রংয়ের সাথে মিলতে হবে। তিনি বললেন। যেন কেউ বুঝতে না পারে আপনারা স্কিনক্যাপ পড়ে রেখেছেন।
শেষ পর্যন্ত একটা বেছে সেলডনকে দিলেন। দেখিয়ে দিলেন কীভাবে পড়তে হবে।
পড়ে নিন, ট্রাইবসম্যান সেলডন। প্রথম প্রথম সমস্যা হবে। তবে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
জিনিসটা মাথায় দিলেন সেলডন। কিন্তু পিছন দিকের চুলগুলো ঢাকতে গিয়ে পিছলে যেতে লাগল বারবার।
ভুরুর উপর থেকে শুরু করুন। সানমাস্টার বললেন। আঙ্গুল নাড়ানো দেখে মনে হলো সাহায্য করতে প্রচণ্ড আগ্রহী।
হাসি চেপে সেলডন বললেন, আপনি পরিয়ে দেবেন?
পিছিয়ে গেলেন সানমাস্টার, খানিকটা আঁঝের সাথে বললেন, অসম্ভব; তাহলে আপনার চুলে আমার হাত লাগবে।
সানমাস্টারের পরামর্শ শুনে শুনে জিনিসটা শেষ পর্যন্ত মাথায় আটকাতে পারলেন সেলডন। এখানে সেখানে কয়েক গোছা চুল বেরিয়ে ছিল। সেগুলোও ঢেকে ফেললেন ভালো করে। পুরো প্রক্রিয়াটাই এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল ডর্স, এবার কোনো সমস্যা ছাড়াই সেও ক্যাপটা মাথায় আটকে নিল।
খুলব কীভাবে? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
যেকোনো একটা প্রান্ত ধরে টান দিলেই খুলে আসবে। চুল ছোট করে রাখলে খোলা এবং লাগানো দুটোই সহজ হবে।
আমি বরং কষ্ট করেই লাগাবো আর খুলব। তারপর ডর্সের দিকে ঘুরে নিচু স্বরে বললেন, তোমাকে এখনো চমৎকার লাগছে, ডর্স, তবে একটু অন্যরকম।
সাময়িক পরিবর্তন এবং তুমি চুলহীন আমার সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
আরো নিচু গলায় ফিসফিস করে সেলডন বললেন, তোমার এই চেহারার সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার মতো দীর্ঘদিন এখানে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
সানমাস্টার লক্ষ্য করলেও ট্রাইবসম্যানদের ফিসফিসানি শোনার কোনো চেষ্টা করলেন না। বিরক্ত সুরে বললেন, চলুন, আপনাদের আমি মাইকোজেন এ নিয়ে যাব।
.
৩৭.
বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি ট্র্যান্টরে আছি। ফিসফিস করে ডর্স বলল।
তার মানে তুমি এইধরনের কিছু আগে দেখনি? বললেন সেলডন।
ট্র্যান্টরে আমি বাস করছি দুই বছর ধরে। বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই একটা জায়গায় অবশ্য গিয়েছি। শুনেছি অনেক কিছু। কিন্তু
এইধরনের কিছু দেখিনি বা শুনিনি। সব একরকম, কোনো পার্থক্য নেই।
নিখুঁতভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন সানমাস্টার। কোনো দ্বিধাগ্রস্ততা নেই। রাস্তায় আরো অনেক গাড়ি। চালকের আসনে কেশহীন মানুষ, আলো পড়ে তাদের টাকমাথাগুলো চক চক করছে।
রাস্তার দুই পাশেই সারি সারি ঘর-বাড়ি। প্রতিটি বাড়িই তিনতলা এবং দেখতে ঠিক একইরকম। কোনো চমকদার কারুকার্য নেই, একেবারেই সাদামাটা। প্রতিটি বাড়ির রংই ধূসর।
একঘেয়ে, ডর্স বলল, ভীষণ একঘেয়ে।
সাম্যবাদ, ফিসফিস করে বললেন সেলডন। আমার ধারণা এখানে সবাই সমান। ধনী-গরীব বা উঁচু-নীচু ভেদাভেদ নেই।
পায়ে চলার জন্য অনেকগুলো ফুটপাথ থাকলেও কোনো চলমান করিডর নেই। কাছাকাছি এক্সপ্রেস ওয়েরও কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
আমার ধারণা ধূসর পোশাকের মানুষগুলো মেয়ে। ডর্স বলল।
বোঝা মুশকিল। ঢোলা আলখাল্লা সব ঢেকে রেখেছে। ন্যাড়া মাথাগুলো সব একরকম।
ধূসর পোশাক সব সময় জোড়ায় জোড়ায় বা কোনো সাদা পোশাকের সাথে হাঁটছে। সাদা পোশাকের মানুষগুলো অনেকেই একা হাঁটছে আর সানমাস্টারের পোশাকও সাদা।
বোধহয় ঠিকই বলেছ, গলা চড়ালেন সেলডন, সানমাস্টার, আমি কৌতূহলী-
যদি কৌতূহল হয় তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, তবে প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
আমরা সম্ভবত একটা আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প এলাকাগুলো কোন দিকে?
আমাদের সমাজ পুরোপুরি কৃষিভিত্তিক। কোথায় থাকেন, এগুলো জানেন না।
আপনি জানেন আমি একজন আউটওয়াল্টার, কঠিন সুরে বললেন সেলডন। ট্র্যান্টরে এসেছি মাত্র দুইমাস।
তারপরেও জানা উচিত।
এখন পর্যন্ত একটা ফার্মও চোখে পড়ল না কেন?
সব আরো নিচের লেভেলে। সংক্ষেপে জবাব দিলেন সানমাস্টার।
তাহলে এটা কী মাইকোজেন-এর সম্পূর্ণ আবাসিক লেভেল?
এটা এবং আরো কয়েকটা আছে। যেমন দেখছেন আমরা ঠিক তাই। এখানে সবাই সমান। কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রত্যেক ব্রাদার তার পরিবারকে নিয়ে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এখানে কেউ কারো চেয়ে বড়ো নয়, ছোট নয়।
ডর্সের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ দিয়ে ঢাকা একটা ভুরু বাঁকা করলেন সেলডন। বললেন, কিন্তু কারো পরনে ধূসর পোশাক, কারো পরনে সাদা।
কারণ তাদের কেউ ব্রাদার, কেউ সিস্টার।
আর আমরা?
আপনারা ট্রাইবসম্যান এবং অতিথি। আপনি এবং আপনার–একটু দ্বিধা করলেন সানমাস্টার, তারপর বললেন, সঙ্গিনীকে মাইকোজেনিয়ান সমাজের সব রীতিনীতি মেনে চলতে হবে না। তবে আপনাকে সাদা পোশাক এবং আপনার সঙ্গিনীকে ধূসর পোশাক পরতে হবে। আমরা যেমন বাড়িতে থাকি সেইরকমই একটা অতিথি ভবনে আপনাদের থাকতে দেওয়া হবে।
সবার জন্য সমান সুযোগ, চমৎকার নীতি, কিন্তু আপনাদের সংখ্যা বাড়লে কী করেন? তখন কী আরো ভাগ বাটোয়ারা করতে হয়?
আমাদের সংখ্যা কখনো বাড়ে না। সেরকম হলে আমাদের জায়গা বাড়াতে হবে যা আশেপাশের ট্রাইবসম্যানরা করতে দেবে না। তাছাড়া সংখ্যায় বেশি হলে আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে।
কিন্তু যদি-
বাধা দিলেন সানমাস্টার। যথেষ্ট হয়েছে, ট্রাইবসম্যান সেলডন। আগেই তো বলেছি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। বন্ধু ট্রাইবসম্যান হামিনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আপনাদের আমরা নিরাপদে রাখব যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের জীবনযাপন প্রণালী ব্যাহত হচ্ছে। কৌতূহলী হতে পারবেন কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো আমরা পছন্দ করব না।
তার বলার সুরে এমন কিছু ছিল যে সেলডন আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। হামিন আসলে সাহায্য করতে গিয়ে আরো বেশি ঝামেলা তৈরি করে ফেলেছে।
সেলডন তো শুধু নিরাপত্তা চান না। তার তথ্যেরও প্রয়োজন। আর তথ্য যদি নাই পাওয়া যায় তাহলে এখানে তিনি থাকবেন না।
.
৩৮.
বরাদ্দকৃত কোয়ার্টার দেখে হতাশ এবং বিরক্ত হলেন সেলডন। এতে একটা পৃথক রান্নাঘর, পৃথক ছোট একটা বাথরুম আছে। দুটো বিছানা, কাপড় রাখার দুটো ক্লজেট, একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার। মোট কথা দুজন মানুষ যদি ছোট একটা ঘরে ঠাসাঠাসি করে থাকতে চায় তাহলে যা যা প্রয়োজন তার সবই আছে। এখানে।
সিনাতে আমরা এইরকম পৃথক রান্নাঘর এবং বাথরুম ব্যবহার করতাম, হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ডর্স বলল।
আমাদের ছিল না, সেলডন বললেন। হ্যালিকন ছোট গ্রহ হতে পারে কিন্তু আমি অত্যাধুনিক শহরে বাস করেছি। কমিউনিটি কিচেন আর বাথরুম। আর এটা হচ্ছে অপচয়। কেউ যদি অল্প কয়েকদিনের জন্য হোটেলে থাকতে চায় তখন এইধরনের ব্যবস্থা আশা করতে পারে, কিন্তু পুরো সেক্টরই যদি এইরকম হয়, চিন্তা করে দেখ কী পরিমাণ রান্নাঘর আর বাথরুম তৈরি করতে হবে–সবই আবার একই ডিজাইনের।
বোধহয় এটাই সাম্যবাদ। ভালো ঘর বা উন্নত সেবা পাওয়ার জন্য কোনো প্রতিযোগিতা নেই। সবার জন্য সমান সুযোগ।
প্রাইভেসীও থাকবে না। তাতে অবশ্য আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু তোমার হতে পারে এবং আমি চাই না তোমার চেয়ে বেশি সুযোগ নিতে। ওদেরকে পরিস্কার বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের আলাদা দুটো কামরা প্রয়োজন। পাশাপাশি হলেও ক্ষতি নেই তবে আলাদা হতে হবে।
আমার মনে হয় না কাজ হবে। স্থান সংকুলান একটা বড়ো সমস্যা আর আমার ধারণা ওরা আমাদেরকে যে পরিমাণ সুযোগ দিয়েছে তাতে নিজেরাই অবাক হয়ে গেছে। এভাবেই থাকতে হবে, হ্যারি। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। আমি লজ্জাবতী নারী নই, তুমি সুযোগ সন্ধানী তরুণ আমার তা মনে হয় না।
আমার জন্যই তোমাকে এই অসুবিধায় পড়তে হয়েছে।
তাতে কী? বেশ অ্যাডভেঞ্চার হচ্ছে।
ঠিক আছে। তুমি কোন বিছানাটা নেবে? ওইটা নাও। বাথরুমের কাছাকাছি। বলেই সেলডন অন্য বিছানাটায় বসে পড়লেন। একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। যতক্ষণ এখানে থাকছি ততক্ষণ আমরা ট্রাইবসপিওপিল, তুমি, আমি এমনকি হামিনও। যেহেতু আমরা অন্য ট্রাইবের মানুষ তাই ওদের কোনো ব্যাপারই আমাদের মাথা ব্যথা না। কিন্তু আমার মাথা ব্যথা। সেজন্যই আমি এখানে এসেছি। ওরা যা জানে তার কিছু আমি জানতে চাই।
অথবা ভাবছ যে ওরা জানে, জাত ইতিহাসবিদের মতো সন্দেহ নিয়ে ডর্স বলল। ওদের এমন কিছু কিংবদন্তী আছে যার উৎপত্তি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগেরও আগে। তবে আমার মনে হয় না সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
কিংবদন্তীগুলো কী নিয়ে সেটা না জেনে আমরা কিছুই বলতে পারি না। ওদের কোনো রেকর্ডই কী অন্য কারো কাছে নেই।
আমি অন্তত জানি না। এই মানুষগুলো অত্যধিক আত্মকেন্দ্রিক। নিজস্ব ধ্যান ধারণার ব্যাপারে এরা পুরোপুরি উন্মাদ। হামিন যে ওদের সামাজিক বাধা অতিক্রম করে আমাদের এখানে নিয়ে আসতে পেরেছে তা অসাধারণ একটা ব্যাপার–সত্যি অসাধারণ।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন সেলডন। কোনো না কোনো পথ তো আছেই। মাইকোজেন যে কৃষিভিত্তিক সমাজ এটা আমি জানি না দেখে সানমাস্টার অবাক হয়েছিলেন–রেগে গিয়েছিলেন। তার মানে কিছু কিছু জিনিস ওরা গোপন রাখতে চায় না।
এটা আসলেই গোপনীয় কিছু না, ধারণা করা হয় যে মাইকোজেন অতি প্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ ছত্রাক উৎপাদনকারী। মানুষের মুখে এগুলো শুনেছি। আমি তো আর প্রাচীন ভাষার বিশেষজ্ঞ নই, কাজেই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না। যাইহোক, এরা সব ধরনের মাইক্রোফুড উৎপাদন করে অবশ্যই ছত্রাক, সেই সাথে শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া, বহুকোষী ফাঙ্গাস এবং আরো অনেক। কিছু।
এটা তো নতুন কিছু না। সব গ্রহেরই নিজস্ব মাইক্রোকালচার আছে। আমাদের হ্যালিকনেও কিছু আছে।
কিন্তু মাইকোজেনের মতো কারোরই নেই। এটাই তাদের বিশেষত্ব। ওরা এমন এক কৌশলে কাজ করে যা তাদের সেক্টরের নামের মতোই প্রাচীন চাষ পদ্ধতি, প্রয়োজনীয় আবহাওয়া সবই গোপন। পদ্ধতিটা যে কী সেটা কেউই জানে না।
ওদের নিজস্ব?
কিছুটা। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে ওদের খাবারে প্রোটিনের মাত্রা অনেক বেশি এবং ওরা সূক্ষ্ম এক ধরনের ফ্লেভার ব্যবহার করে। ফলে স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ। এইরকম সুস্বাদু খাবার আর কোনো গ্রহ তৈরি করতে পারে না। উৎপাদনের পরিমাণ খুব সামান্য এবং দাম আকাশছোঁয়া। আমি কখনো খাইনি।
প্রধান গ্রাহক হচ্ছে ইম্পেরিয়াল কর্মকর্তারা এবং অন্যান্য গ্রহের পয়সাওয়ালা ব্যক্তিরা। এটার উপরেই মাইকোজেন-এর অর্থনীতি নির্ভর করে, তাই ওরা চায় সবাই জানুক যে ওরাই মূল্যবান খাদ্যের একমাত্র উৎপাদক। এটা অন্তত গোপন কিছু না।
মাইকোজেন তাহলে ধনী।
ওরা গরীব না, তবে আমার ধারণা ওরা ধনসম্পদের পিছনেও দৌড়ায় না, ওরা চায় নিরাপত্তা। ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট ওদেরকে রক্ষা করে কারণ এত উঁচুমানের সুস্বাদু খাবার মাইকোজেন ছাড়া আর কেউ তাদেরকে দিতে পারবে না, বিনিময়ে মাইকোজেন তাদের অদ্ভুত জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে, প্রতিবেশীদের বিরোধিতার মুখেও টিকে থাকতে পারে।
চারপাশে তাকালো ডর্স। এরা পুরোপুরি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে। কোনো হলোভিশন নেই, বুক-ফিল্ম নেই।
শেলফের তাকে একটা দেখেছি, বললেন সেলডন। হাত বাড়িয়ে তাক থেকে বুক-ফিল্মটা নামালেন। লেবেল দেখে নাক কুঁচকে বললেন, রান্নার বই।
ডর্স বুক-ফিল্মটাকে চালু করার চেষ্টা করল। পদ্ধতিটা তার কাছে অপরিচিত হলেও একটু চেষ্টা করতেই স্ক্রন আলোকিত করে তুলতে পারল। অল্প কয়েকটা রেসিপি। বেশিরভাগই হচ্ছে খাদ্য নিয়ে দর্শন।
বুক-ফিল্মটা বন্ধ করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সে। এটা মনে হচ্ছে সিঙ্গল ইউনিট। ভিতরের মাইক্রোকার্ড বের করে আরেকটা ঢোকানোর কোনো সিস্টেম আমি দেখছি না। এটা আসলেই অপচয়।
বোধহয় ওরা ধরে নিয়েছে যে এই একটা বইই সবার প্রয়োজন। দুটো বিছানার মাঝে টেবিল, তার কোণায় আরেকটা বস্তু ছিল। সেটা হাতে নিলেন সেলডন, এটা সম্ভবত স্পিকার, শুধু কোনো স্ক্রন নেই।
সম্ভবত ওরা শুধু কণ্ঠস্বর শোনাই যথেষ্ট মনে করে।
বুঝতে পারছি না এটা কীভাবে চালু হবে। সেলডন বস্তুটাকে বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। তুমি এই জিনিস কখনো দেখেছ?
যাদুঘরে একবার দেখেছিলাম, তবে এই জিনিসটাই কি না ঠিক বুঝতে পারছি না। মাইকোজেন সম্ভবত অতি সুপ্রাচীন নিয়ম কানুন মেনে চলে। বোধহয় এভাবেই তারা নিজেদেরকে ট্রাইবস সমাজ থেকে পৃথক করে রাখে। প্রাচীন এবং অদ্ভুত প্রথার কারণে কেউই তাদেরকে সহজে মেনে নিতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমার মতে এটা এক ধরনের নোংরামী।
সেলডন এখনো যন্ত্রটা নাড়ছেন, বললেন, ওপস! চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো কিছু শুনছি না।
ভুরু কুঁচকে ডর্স টেবিল থেকে সিলিন্ডার আকৃতির আরেকটা বস্তু তুলে কানে লাগালো। এটাতে কথা শোনা যাচ্ছে। নাও, শোনো। জিনিসটা সেলডনের হাতে দিল সে।
কানে দিয়েই চিৎকার করলেন সেলডন, আউচ! শুনলেন, তারপর আবার বললেন, হ্যাঁ, কানে ব্যথা পেয়েছি। আপনি আমার কথা শুনতে পারছেন। হ্যাঁ, এটা আমাদের কামরা।-না নাম্বার জানি না। ডর্স তুমি জানো?
স্পিকারে একটা নাম্বার লেখা আছে। জিজ্ঞেস করে দেখো ওটাতে কাজ হবে কি না।
হতে পারে, গলায় সন্দেহ নিয়ে বললেন সেলডন। তারপর স্পিকারে বললেন, এই যন্ত্রে যে নাম্বার লেখা আছে তা হলো ডি এল. টি–৩৬৪৮-এ। কাজ হবে?–বেশ, এই যন্ত্রটা আমি কীভাবে ব্যবহার করব, এবং রান্নাঘরের যন্ত্রপাতিগুলো কীভাবে কাজ করে?–যেভাবে কাজ করার কথা সেভাবেই করে। তার মানে কী?–শুনুন আমি… আমি একজন ট্রাইবসম্যান, আপনাদের সম্মানিত অতিথি। আমি জানি না এগুলো কীভাবে কাজ করার কথা।–হ্যাঁ, বাচনভঙ্গির জন্য আমি দুঃখিত এবং শুনে খুশি হলাম যে আপনি কণ্ঠ শুনেই ট্রাইবসম্যান চিনতে পারেন। আমার নাম হ্যারি সেলডন।
খানিকক্ষণের বিরতি, সেলডন যেন বহু পরিশ্রমে ক্লান্ত এমন মুখ করে ডর্সের দিকে তাকালো, রেকর্ডে আমার নাম আছে কী না দেখছে এবং খুব সম্ভবত পাবে না।–ওহ্, পেয়েছেন? চমৎকার! বেশ, আপনি আমাকে কিছু তথ্য দিতে পারবেন?–হ্যাঁ–হা–হা–মাইকোজেন-এর বাইরে কারো সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা। যাবে? ওহ, তাহলে সানমাস্টারের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে?–বেশ, তাহলে তার সহকারী, বা এইড যেই আছে তার সাথে যোগাযোগের উপায়?–আহ্ হাহ।–ধন্যবাদ।
স্পিকার বন্ধ করলেন তিনি। আমাদেরকে সব দেখিয়ে দেওয়ার জন্য কাউকে পাঠাবে তবে কখন পাঠাবে তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। মাইকোজেন-এর বাইরে যোগাযোগ করা যাবে না, অন্তত এটা দিয়ে। আর সানমাস্টার ফোরটিন-এর সাথে দেখা করতে হলে অনেক বাধা টপকে যেতে হবে। এই সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেও কিছু ব্যতিক্রমও আছে।
ঘড়ি দেখলেন সেলডন। যাইহোক, ডর্স, রান্নার বই দেখার কোনো ইচ্ছা আমার নেই এবং জরুরি কাজ নিয়ে বসার আগ্রহ তো আরো নেই। আমার ঘড়ি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় দেখাচ্ছে, কাজেই বলতে পারছি না এখন ঘুমানোর সময় কী না আর এই মুহূর্তে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথাও নেই। আমরা প্রায় সারারাতই জেগে। ছিলাম, এখন আমি ঘুমাতে চাই।
ঠিকই বলেছ, আমিও ক্লান্ত।
ধন্যবাদ। আর ঘুম থেকে উঠে আমি ওদের মাইক্রোফুড প্ল্যানটেশনে একবার যেতে চাই।
অবাক হলো ডর্স। সত্যি যেতে চাও?
আসলে তেমন আগ্রহ নেই, কিন্তু এটা নিয়েই ওরা গর্বিত এবং হয়তো এই বিষয়ে কথা বলতে আগ্রহী হবে। আর একবার কথা বলা শুরু করলে তখন হয়তো ওদের মুখ থেকে কিংবদন্তীর কথা বের করে আনতে পারব, বিশেষ করে এই কাজে আমি বেশ দক্ষ।
আশা করি, সন্দেহের সুরে বলল ডর্স, কিন্তু আমার মনে হয় না মাইকোজেনিয়ানরা এত সহজে ফাঁদে পা দেবে।
দেখা যাক কী হয়, হাসি মুখে বললেন সেলডন। ওদের রেকর্ডগুলো আমাকে পেতেই হবে।
.
৩৯.
পরেরদিন সকালে কলিং ডিভাইসটা আবার চালু করলেন সেলডন। রেগে আছেন তিনি। কারণ প্রচণ্ড ক্ষুধা।
সানমাস্টার ফোরটিন-এর সাথে যোগাযোগের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো। অন্য লোকটা সাফ জানিয়ে দিল যে সানমাস্টারকে এখন বিরক্ত করা যাবে না।
কেন? খিটখিটে মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
সেটা আপনার জানার দরকার নেই। ঠাণ্ডা গলায় জবাব শোনা গেল। আমাদেরকে এখানে বন্দী করে রাখার জন্য আনা হয়নি, একইরকম ঠাণ্ডা গলায় বললেন সেলডন, এবং না খাইয়ে মেরে ফেলার জন্যও আনা হয়নি।
আমি জানি যে আপনাদের একটা রান্নাঘর আছে এবং সেখানে প্রচুর খাবার দাবাড় আছে।
হ্যাঁ, আছে। কিন্তু আমি জানি না রান্নাঘরের যন্ত্রপাতিগুলো কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, কীভাবে রান্না করতে হবে। আপনারা কীভাবে খান, কাঁচা, ভাজি করে, সিদ্ধ করে নাকি রোস্ট বানিয়ে…?
বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই সাধারণ ব্যপারগুলো আপনারা জানেন না।
ডর্স এতক্ষণ পায়চারী করছিল আর ওদের ঝগড়া শুনছিল। ডিভাইসটা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো সে কিন্তু বাধা দিলেন সেলডন। ফিসফিস করে বললেন, মেয়ে মানুষের গলা পেলে লোকটা সাথে সাথে রিসিভার রেখে দেবে।
তারপর আরো দৃঢ় গলায় অপর প্রান্তের লোকটাকে বললেন, আপনি কী বিশ্বাস করেন বা না করেন সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আপনি এখানে কাউকে পাঠান–এমন কাউকে যে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে নইলে সানমাস্টারের সাথে তো আমার দেখা হবেই, তখন এর জন্য আপনাকে চড়া মূল্য দিতে হবে।
কিন্তু আরো দুই ঘণ্টা লাগল সেই কেউ একজন এসে পৌঁছাতে (এই সময়টাতে সেলডন পাগলামীর শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন আর তাকে শান্ত করতে গিয়ে ডর্সেরও প্রায় পাগল হওয়ার দশা)।
যে এসেছে সে অল্প বয়সের তরুণ, ন্যাড়া মাথায় অনেকগুলো তিল। হাতে অনেকগুলো পাত্র। কথা বলতে গিয়েও হঠাৎ অস্বস্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল, ট্রাইবসম্যান, বলল সে, বলার সুরে রাগ প্রকাশ পেল, আপনার স্কিন ক্যাপটা ঠিকমতো পরা হয়নি।
আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না সেলডন। তাতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
ডর্স এগিয়ে এল, আমি ঠিক করে দিচ্ছি, হ্যারি। ডানদিকে সামান্য উঠে আছে।
তারপর সেলডন গজগজ করে বললেন, এবার ঘুরতে পার। তোমার নাম কী?
আমার নাম গ্রেক্লাউড ফাইভ, আমতা আমতা করে বলল মাইকোজেনিয়ান, সতর্ক চোখে তাকালো সেলডনের দিকে। আমি একজন শিক্ষানবীশ। আপনাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। আবার একটু ইতস্তত করল। বাড়িতে তৈরি। পরিবারের মেয়েরা তৈরি করেছে, ট্রাইবসম্যান।
পাত্রগুলো সে নামিয়ে রাখল টেবিলের উপর। একরাশ সন্দেহ নিয়ে গন্ধ শুঁকলেন সেলডন। বিস্ময় নিয়ে তাকালেন ডর্সের দিকে। গন্ধটা বেশ ভালো।
মাথা নাড়ল ডর্স। ঠিকই বলেছ। আমিও বেশ সুগন্ধ পাচ্ছি।
খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আপনাদের রান্নাঘরে গরম করার পাত্র আছে। বলল গ্রেক্লাউড।
যা দরকার খুঁজে সব বের করে আনল ডর্স। গলা পর্যন্ত ঠেসে খাওয়ার পরই সেলডন শান্ত হলেন।
ডর্স বুঝতে পারছে যে মাইকোজেনিয়ান তরুণ একজন মহিলার সামনে সহজ হতে পারছে না এবং আরো অস্বস্তি বোধ করবে মহিলা যদি তার সাথে কথা বলে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও থালাবাসন, খাবারের পাত্রগুলো নিয়ে গেল পরিস্কার করার জন্য।
সেলডন তরুণকে স্থানীয় সময় জিজ্ঞেস করলেন এবং লজ্জিত স্বরে বললেন, তুমি বলতে চাও এখন মাঝরাত?
অবশ্যই, ট্রাইবসম্যান, গ্রেক্লাউড বলল, সেজন্যই আপনাদের প্রয়োজন মেটাতে এত দেরী হয়েছে।
সেলডন এবার বুঝতে পারলেন কেন সানমাস্টারকে এখন বিরক্ত করা যাবে না। আর তাদের খাবার আনার জন্য গ্রেক্লাউডকে কী ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। আমি দুঃখিত, তিনি বললেন। আমরা তো ট্রাইবসপিওপিল। রান্নাঘর কীভাবে ব্যবহার করতে হয় বা কীভাবে রান্না করতে হয় সেটা আমরা জানি না। সকালে তুমি এমন কাউকে পাঠাতে পারবে যে আমাদের বুঝিয়ে দেবে।
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব যেন দুজন সিস্টারকে সকালে পাঠাতে পারি। মেয়েদের উপস্থিতিতে আপনার সমস্যা হবে, সেজন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু রান্নাবান্নার ব্যাপারগুলো ওরাই ভালো বলতে পারবে।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডর্স বলল (পুরুষতান্ত্রিক মাইকোজেনিয়ান সমাজে মেয়েদের অবস্থান কোথায় সেটা মনে পড়ার আগেই) তাই ভালো, গ্রেক্লাউড। সিস্টারদের সাথে দেখা হলে আমরাও খুশী হব।
অস্বস্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো গ্রেক্লাউড, কিছু বলল না।
সেলডন ধরে নিলেন যেকোনো মাইকোজেনিয়ান তরুণ নীতিগতভাবেই মেয়েরা কী বলেছে সেটা না শোনার ভান করবে বা শুনবেই না। তাই তিনি নিজেই ডর্সের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। সেটাই ভালো হবে, গ্রেক্লাউড। সিস্টারদের সাথে দেখা হলে আমরাও খুশী হব।
তরুণ এবার সহজ হলো। সকাল হলেই ওদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেব।
গ্রেক্লাউড চলে যাওয়ার পর সেলডন সন্তুষ্টির সুরে বললেন, এই সিস্টারদেরই আমাদের প্রয়োজন।
তাই? কেন, হ্যারি?
ওদেরকে যদি আমরা মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেই তাহলে ওরা কৃতজ্ঞ হয়েই নিজেদের কিংবদন্তীর কথা আমাদের জানাবে।
যদি ওরা জানে তবেই তো বলবে, সন্দেহের গলায় বলল ডর্স। আমার মনে হয় না মাইকোজেনিয়ান পুরুষরা এখানকার মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দেয়।
.
৪০.
সিস্টাররা এলো আরো ছয় ঘণ্টা পরে। ডর্স আর সেলডন এই সময়টাতে আরো খানিকটা ঘুমিয়ে নিলেন। আশা করছেন এতে হয়তো তাদের দেহ ঘড়ি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
সিস্টাররা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল নববধূর মতো লাজুকভাবে, পা টিপে টিপে। তাদের গাউন (মাইকোজেনে এগুলোকে বলা হয় কার্টলেস) ধূসর রঙের মখমল দিয়ে তৈরি তার মাঝে আরো গাঢ় ধূসর সুতার বুনন দিয়ে ডিজাইন তৈরি করা। হয়েছে। কার্টলেসগুলো দেখতে কিন্তু খারাপ না, তবে এগুলো মানুষের দৈহিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো খুব নিখুঁতভাবে ঢেকে রাখে।
এবং অবশ্যই ওদের মস্তক কেশহীন, মুখে কোনো প্রসাধনী নেই। ডর্সের চোখের। কোণে নীল রঙ এবং ঠোঁটে হালকা লাল রঙের দিকে আড়চোখে তাকালো ওরা।
সেলডন ভেবেই পাচ্ছেন না যে এই সিস্টাররা আসলেই সিস্টার কী না সেটা কীভাবে বুঝবেন।
উত্তরটা সাথে সাথেই পেয়ে গেলেন। যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক না কেন কণ্ঠস্বর লুকাবে কীভাবে। দুজনেই পাখির মতো কিচিরমিচির করে উঠল। সানমাস্টারের গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং গ্রেক্লাউডের ভীত কণ্ঠস্বরের কথা মনে করে সেলডন ধরে নিলেন যে মেয়েরা সম্ভবত সুরেলা কণ্ঠস্বর এবং সামাজিক আচার ব্যবহার নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করতে বাধ্য হয়, যেহেতু তারা যে মেয়ে তা অন্য কোনো উপায়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
আমি রেইনড্রপ ফরটি থ্রী, পাখিদের একজন কিচির মিচির করে বলল, আর ও হচ্ছে আমার ছোট বোন।
দুই নম্বর পাখিও এবার কিচিরমিচির শুরু করল, রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ। রেইনড্রপ গোত্রের ভেতর আমরাই সবচেয়ে বড়ো। খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটা।
তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, গম্ভীর গলায় বলল ডর্স। কিন্তু তোমাদেরকে আমি কী বলে ডাকব? শুধু রেইনড্রপ?
না, বেইনড্রপ ফরটি থ্রী জবাব দিল। যখন দুজনেই থাকব তখন পুরো নাম বলতে হবে।
শুধু ফরটি থ্রী এবং ফরটি ফাইভ বললে কেমন কয়, লেডীজ? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।
মেয়ে দুটো আড়চোখে একবার তাকালো কোনো জবাব দিল না।
আমি ওদেরকে সামলাচ্ছি, হ্যারি। মৃদু গলায় বলল ডর্স।
পিছিয়ে গেলেন সেলডন। সম্ভবত মেয়েগুলো অবিবাহিত এবং পুরুষদের সাথে কথা বলা তাদের জন্য নিষেধ। দুজনের ভেতর বয়সে যে বড়ো সে বেশি গম্ভীর এবং অনেক বেশি নীতিপরায়ণ। তবে মাত্র কয়েকটা কথা শুনে এবং দ্রুত কয়েকবার তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে বলাটা কঠিন, অবশ্য মন বলছে তার অনুমান ঠিকই আছে।
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, সিস্টার, ডর্স বলল, আমরা ট্রাইবসপিওপিলরা তোমাদের এই রান্নাঘরের যন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে জানি না।
তার মানে আপনি রান্না করতে পারেন না? রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ-এর দৃষ্টিতে বিস্ময় এবং মুরুব্বীসূচক সমালোচনা। রেইনড্রপ ফরটি থ্রী কোনোমতে হাসি গোপন করল (সেলডন নিশ্চিত হলেন যে দুজনের ব্যাপারে তার প্রথম ধারণা ঠিকই আছে)।
ডর্স বলল, এক সময় আমার একটা রান্নাঘর ছিল, কিন্তু এটার মতো ছিল না। তাছাড়া তোমাদের খাবারগুলো কী, এগুলো কীভাবে রান্না করতে হয় আমি জানি লো।
খুব সহজ, রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ বলল। আমরা দেখিয়ে দেব।
আমরা চমৎকার লাঞ্চ তৈরি করে দেব, বলল রেইনড্রপ ফরটি থ্রী। আপনাদের… দুজনের জন্যই। শেষ কথাটা বলার সময় ইতস্তত করল। একজন পুরুষের উপস্থিতি সহজে মেনে নেওয়াতে অভ্যস্ত নয় সে।
কিছু যদি মনে করো, ডর্স বলল, তোমাদের সাথে আমিও রান্নাঘরে থাকব এবং খুব খুশী হব যদি আমাকে সব বুঝিয়ে দাও। প্রতিদিন নিশ্চয়ই তিনবেলা করে আসা তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
আমরা সব দেখিয়ে দেব, গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে রেইনড্রপ ফরটি থ্রী তাকে আশ্বস্ত করল। প্রথমে একটু সমস্যা হবে যেহেতু আপনি অভ্যস্ত না।
আমি চেষ্টা করব, সুন্দর এক টুকরা হাসি উপহার দিয়ে ডর্স বলল।
রান্নাঘরে চলে গেল তিনজন। ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে সেলডন ভাবতে লাগলেন কোন পরিকল্পনাটা কাজে লাগবে।