তৃতীয় অধ্যায়
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাংলায় আগমন
যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে ইংরেজগণ শতাধিক বৎসরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধ্য সাধনার ব্যবসায়ী থেকে শাসকে পরিণত হয়েছিল, সাড়ে পাঁচশত বৎসরব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসনের মূলোৎপাটন করে এ দেশবাসীকে গোলামীর শৃখলে আবদ্ধ করেছিল, তাদের এ দেশে আগমন ও পরবর্তী কার্যকলাপ আমাদের ভালো করে জেনে রাখা দরকার।
বোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৫৯৯ খৃঃ) কতিপয় ব্যবসায়ী সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জন্ম হয়। রাণী এলিজাবেথের অনুমোদনক্রমে তারা ভারতের সাথে ব্যবসা শুরু করে। ১৬১২ খৃষ্টাব্দে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে সনদ লাভ করে এ কোম্পানী সর্বপ্রথম সুরাট বন্দরে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে।
প্রথম প্রথম তাদেরকে খুব ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে চলতে হয় বলে ব্যবসা বাণিজ্যে বেশী সুবিধা করতে পারে না। ১৬৪৪ সালে বাদশাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে তাঁর কন্যা আগুনে দগ্ধিভূত হয়। তার চিকিৎসার জন্যে সুরাটের ইংরেজ-কুঠির অধ্যক্ষ কর্তৃক প্রেরিত সুদক্ষ সার্জন ডাঃ গ্যাব্রিল বাউটন তাকে নিরাময় করেন। তাঁর প্রতি বাদশাহ শাহজাহান অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং বাউটনের অনুরোধে ইংরেজ বণিকগণ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ১৬৪৪ সালে তারা যখন বাদশাহর ফরমানসহ বাংলায় উপস্থিত হয়, তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার সুবাদার ছিলেন যুবরাজ মুহাম্মদ শাহসুজা।
কোম্পানীর পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, শাহ সুজার পরিবারের জনৈক সদস্যের চিকিৎসার ভার ডাঃ বাউটনের উপর অর্পিত হয় এবং এখানেও তিনি চিকিৎসয় সুনাম অর্জন করেন। অতএব শাহ সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা সালামীর বিনিময়ে ইংরেজদেরকে বাংলায় অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ দান করেন। বাদশাহ শাহজাহান ও তদীয় পুত্র ইংরেজদের প্রতি যে চরম উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন সেই উদারতা ও অনুগ্রহ প্রদর্শনকে অকৃতজ্ঞ ইংরেজ বণিকগণ পরবর্তীকালে মোগল সাম্রাজ্যের ও বাংলা বিহারের স্বাধীনতার মৃত্যুপরোয়ানা হিসাবে ব্যবহার করে।
শাহ সুজার ফরমানবলে ইংরেজ বণিকগণ হুগলীতে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে এবং পাটনায় এজেন্সি স্থাপন করে।
মীর জুমলা থেকে সিরাজদ্দৌলা
শাহ সুজার পর আওরংজেবের সেনাপতি মীর জুমলা বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। বিচক্ষণ মীর জুমলা ইংরেজদের গতিবিধির প্রতি তিক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতেন। একবার পাটনা থেকে হুগলীগামী কয়েকখানি মাল বোঝাই নৌকা মীর জুমলা আটক করেন। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হুগলীর ইংরেজ কুঠিয়াল জনৈক মুসলমানের মাল বোঝাই নৌকা আটক করে পণ্যদ্রব্যাদি হস্তগত করে। তার এ ঔদ্ধত্যের জন্যে মীর জুমলা হুগলীর কুঠি অধিকার করার আদেশ জারী করেন। কুঠিয়াল বেগতিক দেখে আটক নৌকা ও মালপত্র মালিককে ফেরৎ দিয়ে মীর জুমলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
নবাব শায়েস্তা খান
মীর জুমলার পর শায়েষ্তা খান বাংলার নবাব সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। শায়েস্তা খানের জন্যে ইংরেজগণ সর্বত্র সন্ত্রস্ত থাকতো। তাদের ঔদ্ধত্যের জন্যে শায়েস্তা খান পূর্ববর্তী ফরমানগুলি বাতিল করে দেন। তারা তাদের আচরণের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী হলে এবং সততার সাথে ব্যবসা করার প্রতিশ্রুতি দিলে পূর্বতন ফরমানগুলি পুনর্বহালা করা হয়। অতঃপর শায়েস্তা খান বাংলা ত্যাগ করেন।
ফিদা খান ও যুবরাজ মুহাম্মদ আজম
শায়েস্তা খানের পর ফিদা খান ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র যুবজার মুহাম্মদ আজম পর পর বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ১৬৭৮ সালে মুহাম্মদ আজম সুবাদার নিযুক্ত হওয়ার পর কোম্পানী তাদের হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্যে মুহাম্মদ আজমকে একুশ হাজার টাকা ঘুষ প্রদান করে। সম্রাট আওরংজেত তা জানতে পেরে তাকে পদচ্যুত করে পুনরায় শায়েস্তা খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। এ সময়ে ইংরেজদের ঔদ্ধতা চরমে পৌঁছে। আকবর নামক জনৈক ব্যক্তি সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ইংরেজগণ তাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। শায়েস্তা খান এ ষড়যন্ত্র জানতে পেরে পাটনা কুঠির অধিনায়ক মিঃ পিকককে কারারুদ্ধ করেন। কোম্পানীর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লন্ডন থেকে ক্যাপ্টেন নিকলসনের নেতৃত্বে কয়েকখানি যুদ্ধ জাহাজ ভারতে প্রেরণ করা হয় এবং চট্টগ্রাম অধিকারের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ক্যাপ্টেন নিকলসন বিফল মনোরথ হন। ইংরেজদের এহেন দুরভিসদ্ধির জন্যে নবাব শায়েস্তা খান তাদেরকে সুতানটি থেকে বিতাড়িত করেন। ১৬৮৭ সালে কাশিমবাজার কুঠির প্রধান জব চার্ণক নবাব প্রদত্ত সকল শর্ত স্বীকার করে নিলে পুনরায় তাদেরকে ব্যবসায় অনুমতি দেয়া হয়। নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলি জব চার্ণক কর্তৃক মেনে নেয়ার কথা ইংলন্ডে পৌঁছলে কোম্পানীর কর্মকর্তাগণ এটাকে অবমাননাকর মনে করে। অতঃপর তারা ক্যাপ্টেন হীথ নামক একজন দুর্দান্ত নাবিকের পরিচালনাধীনে ‘ডিফেন্স’ নামক একটি রণতরী বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে ভারতে প্রেরণ করে। হীথ সুতানটি পৌঁছে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্য কোম্পানীর লোকজনসহ বালেশ্বর গমন করে। এখানে তারা জনগণের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে এবং তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। অতঃপর হীথ বালেশ্বর থেকে চট্টগ্রাম গমন করে আরাকান রাজের সাহায্য প্রার্থনা করে। এখানেও সে ব্যর্থ হয় এবং নিরাশ হয়ে মাদ্রাজ চলে যায়। তাদের এসব দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্র জানতে পেরে বাদশাহ আওরংজেব ইংরেজদের মসলিপট্টম ও ভিজেগাপট্টমের বাণিজ্য কুঠিসমূহ বাজেয়াপ্ত করেন। এভঅবে কোম্পানী তাদের দুষ্কৃতির জন্যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
সুবাদার ইব্রাহীম খান
শায়েস্তা খানের পর অল্পদিনের জন্যে খানে জাহান বাংলার সুবাদার হন এবং ১৬৮৯ সালে ইব্রাহীম খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। এ দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারকল্পে কোম্পানীর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয়। অতঃপর উড়িষ্যার বন্দী ইংরেজদেরকে মুক্তিদান করে জব চার্ণককে পুনরায় বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। জব চার্ণক পলায়ন করে মাদ্রাজ অবস্থান করছিল। ধূর্ত জব চার্ণক অনুমতি পাওয়া মাত্র ১৬৯১ সালে ইংরেজ বণিকদেরকে নিয়ে বাংলায় প্রত্যাবর্তণ করে এবং কোলকাতা নগরীর পত্তন করে নিজেদেরকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে যে, এর সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজগণ বাংলা তথা সমগ্র ভারতভূমিতে তাদের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদ অক্ষুণ্ণ রাখে।
এ সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্ব অভিযোগ উত্থাপিত হয়। কনস্টান্টিনোপলের শায়খুল ইসলাম বাদশাহ আওরংজেবকে জানান যে, ইংরেজরা ভারত থেকে যে বিপুল পরিমাণ যবক্ষার সংগ্রহ করে তা ইউরোপে রপ্তানী করা হয় এবং তাই দিয়ে গোলাবারুদ তৈরী করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। আওরংজেব যবক্ষার ক্রয় নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু গোপনে তারা যবক্ষার পাচার করতে থাকে। অতঃপর ইউরোপীয়দের সাথে ব্যবসা নিষিদ্ধ করে বাদশাহ আওরংজেব এক ফরমান জারী করেন। হুগলী কুঠির অধ্যক্ষ বাংলার সুবাদারেরপৃপাপ্রার্থী হলে তিনি এ নিষেধাজ্ঞার কঠোরতা হ্রাস করে দেন।
সুবাদার আজিমুশশান
ইব্রাহীম খানের অযোগ্যতার কারণে সম্রাট আওরংজেব তাঁর স্থলে স্বীয় পৌত্র আজিমুশশানকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন।
আজিমুশশান ছিলেন অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও অর্থলোভী। তার সুযোগে ইংরেজগণ তাঁকে প্রভূত পরিমাণে উপঢৌকনাদি নজর দিয়ে সুতানটি বাণিজ্যকুঠি সুরক্ষিত করার অনুমতি লাভ করে। তারপর পুনরায় ষোল হাজার টাকা নজরানা ও মূল্যবান উপহাদারিদ দিয়ে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা গ্রাম তিনটি লাভ করে।
১৭০৭ সালে আওরংজেবের মৃত্যুর পর আজিমুশশানের পিতা বাহাদুর মাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহন করেন। ফলে পুনরায় আজিমুশশান বাংলা,বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদার নিযুক্ত হন। অযোগ্য, অকর্মণ্য ও আরামপ্রিয় সুবাদারকে রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে মুর্শিদ কুলী খানকে দেওয়ান নিযুক্ত করে বাংলায় পাঠানো হয়।
মুর্শিদ কুলী খান
বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে ফরোখশিয়ার কর্তৃক আজিমুশশান নিহত হন এবং ফরোখশিয়ার মুর্শিদ কুলী খানকেই বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করেন। মুর্শিদ কুলী খান ইংরেজদের হাতের পুতুল সাজার অথবা অর্থদ্বারা বশীভূত হবার পাত্র ছিলেন না। অতএব তাঁর কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভে ইংরেজগণ ব্যর্থ হয়। অবস্থঅ বেগতিক দেখে তারা সম্রাটের নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। তাদের মধ্যে হ্যাটিল্টন নামে একজন সুদক্ষ চিকিৎসক ছিল। বাংলার সুবাদার ছিলেন ইংরেজদের প্রতি বিরাগভাজন। তাঁর মতের বিরুদ্ধে কিছু করতে সম্রাট ছিলেন নারাজ। কিন্তু এখানে একটি প্রেমঘটিত নাটকের সূত্রপাত হয় যার ফলে ইংরেজদের ভাগ্য হয় অত্যন্ত সুপ্রসন্ন।
উদয়পুরের মহারাণা সিংহের এক পরম রূপসী কন্যার প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন যুবক সম্রাট ফরেখশিয়ার। বিবাহ স্থিরীকৃত হওয়ার পর হঠাৎ তিনি ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হন। বিবাহ অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত হয়ে যায়। কোন চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যাটিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায়ই কোন ফল হয় না। অবশেষে সম্রাট হ্যামিল্টনের চিকিৎসাধীন হন। তাঁর চিকিৎসায় সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পর মহারাণার কন্যার কন্যার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
প্রিয়তমাকে লাভ করার পর সম্রাট ফরোখশিয়ার ডাঃ হ্যামিল্টনের প্রতি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েন এবং ইংরেজ বণিকদিগকে কোলকাতার দক্ষিণে হুগলী নদীর উভয় তীরবর্তী আটত্রিশটি গ্রাম দান করেন। তার নামমাত্র বার্ষিক খাজনা র্নিধারিত হয় মাত্র আট হাজার একশ’ একুশ টাকা। সম্রাটের নিকটে এতকিছু লাভ করার পরও মুর্শিদ কুলি খানের ভয়ে তারা বিশেষ কোন সুবিধা করতে পারেনি।
সুজাউদ্দীন
১৭২৫ সালে মুর্শিদ কুলীর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দীন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাদারের পদ অলংকৃত করেন। তাঁর আমলে ইংরেজরা ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ উন্নতি করে এবং তাদের ঔদ্ধত্যও বহুগুণে বেড়ে যায়। হুগলীর ফৌজদার একবার ন্যায়সংগত কারণে ইংরেজদের একটি মাল বোঝাই নৌকা আটক করেন। একথা জানতে পেরে ইংরেজরা একদল সৈন্য পাঠিয়ে প্রহরীদের কাছ থেকে নৌকা কেড়ে নিয়ে যায়। তাদের এ ঔদ্ধত্যের জন্যে সুবাদার জানতে পেরে তাড়াতাড়ি অপরাধ স্বীকার করে মোটা রকমের জরিমান দিয়ে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এভাবে তারা রক্ষা পায়।
সরফরাজ খান
সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সরফরাজ খান সুবাদার নিযুক্ত হন। নাদির শাহের ভারত আক্রমণ তাঁর সময়ে হয়েছিল।
আলীবর্দী খান
সরফরাজ খান ছিলেন অযোগ্য ও দুর্বলচিত্ত। তাঁর সেনাপতি আলীবর্দী খানের সংগে সংঘর্ষে নিহত হন এবং আলীবর্দী খান ১৭৪১ সালে বাংলার সুবাদার হন।
আলীবর্দী খানের সময় বার বার বাংলার উপর আক্রমণ চলে বর্গী দস্যুদের। তাদের দৌরাত্ম্য থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে তিনি কয়েকবার ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করেন। দেশের আর্থিক উন্নতিকল্পে তিনি ব্যবসা বাণিজ্যে উৎসাহ দান করতেন।
বহু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা সত্ত্বেও বর্গীদস্যুরা একবার প্রবেশ করে লুঠতরাজ ও হত্যাকান্ড চালায়। জলপথে আগমনকারী বর্গীদস্যুদের দমন করার জন্যে আলীবর্দী খান ইংরেজদের সাহায্য সহযোগীতার প্রয়োজনবোধ করছিলেন। কারণ নৌশক্তি বলতে বাংলার কিছুই ছিলনা। পক্ষান্তরে ইংরেজদের ছিল শক্তিশালী নৌবহর। আলীবর্দীর প্রধান সেনাপতি একবার ইংরেজদের মতো ক্রমবর্ধমান এক অশুভ শক্তিকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পরামর্শ দেন। তদুত্তরে বৃদ্ধ আলীবর্দী বলেন যে, একদিকে বর্গীরা স্থলপথে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। আবার ইংরেজদের ক্ষুব্ধ করলে তারা সমুদ্রপথে আগুন জ্বালাবে যা নির্বাপিত করার ক্ষমতা বাংলার নেই। আলীবর্দীর বার্ধক্য এবং পরিস্থিতির নাজুকতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা পাকাপোক্ত হয়ে বসে এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠালাভের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার পরিসমাপ্তি ঘটে পনেরো বৎসর পরে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে।
সিরাজদ্দৌলা
সতেরোশত ছাপ্পান্ন খৃষ্টাব্দে সুদীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থাকার পর আলীবর্দী মৃত্যুবরণ করেন এবং সিরাজদ্দৌলা তাঁর উত্তরাধিকারী হন। তাঁর সিংহাসন আরোহণের পর আলীবর্দী-কন্যা ঘেসেটি বেগম ও তাঁর দৌহিত্র পুর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জং-এর সকল ষড়যন্ত্র তিনি দক্ষতার সাথে বানচাল করে দেন। আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌলার সিংহাসন আরোহণ করার সাথে সাথেই ঘেসেটি বেগম বিশ হাজার সৈন্যকে তাঁর দলে ভিড়াতে সক্ষম হন এবং মুর্শিদাবাদ অভিমুখে রওয়ানা হন। সিরাজদ্দৌলা ক্ষিপ্রতার সাথে ঘেসেটি বেগমের সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন ও বেগমকে রাজপ্রসাদে বন্দী করেন। অপরদিকে শওকত জং নিজেকে বাংলার সুবাদার বলে ঘোষণা করলে যুদ্ধে সিরাদ্দৌলা কর্তৃক নিহত হন।
ঘেসেটি বেগম ও শওকত জং-এর বিদ্রোহে নওয়াজেশ মুহাম্মদের দেওয়ান রাজবল্লভ ইন্ধন যোগাচ্ছিল। সিরাজদ্দৌলা তা জানতে পেরে রাজবল্লভের কাছে হিসাবপত্র তলব করেন। ঢাকার শাসনকর্তা নওয়াজেশ মুহাম্মদের অধীনে দেওয়ান হিসাবে রাজস্ব আদায়ের ভার তার উপরে ছিল। আদায়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছিল বলে হিসাব দিতে অপারগ হওয়ায় নবাব সিরাজদ্দৌলা রাজবল্লভের ঢাকাস্থ ধনসম্পদ আটক করার আদেশ জারী করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজভল্লভের পুত্র কৃষ্ণবল্লভ আদায়কৃত রাজস্ব ও অবৈধভাবে অর্জিত যাবতীয় ধনসম্পদ সহ গঙ্গাস্নানের ভান করে পালিয়ে গিয়ে ১৭৫৬ সালে কোলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। সিরাজদ্দৌলা ধনরত্মসহ পলাতক কৃষ্ণবল্লভকে তাঁর হাতে অর্পণ করার জন্যে কোলকাতার গভর্ণর মিঃ ড্রেককে আদেশ করেন। ভারতের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ধনকুবের ও রাজ্যের মধ্যে অতি প্রভাবশালী হিন্দুপ্রধান মাহতাব চাঁদ প্রমুখ অন্যান্য হিন্দু বণিক ও বেনিয়াদের পরামর্শে ড্রেক সিরাজদ্দৌলার আদেশ পালন করতে অস্বীকার করে। তারপর অকৃতজ্ঞ ক্ষমতালিপ্সু ইংরেজগণ ও তাদের দালাল হিন্দু প্রধানগণ সিরাজদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে চিরদিরে জন্যে মুসলিম শাসন বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে তা চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয় –পলাশীর ময়দানে। পলাশীর যুদ্ধ, তার পটভূমি ও সিরাজদ্দৌলার পতন সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে আমাদের জানা দরকার তৎকালে বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা কি ছিল।