৩. ইসাবেলার জীবন

গত কয়েক সপ্তাহে ইসাবেলার জীবন পূর্ণ করে তোলা আনন্দের খানিকটা নিয়ে লন্ডন ছাড়ল মাইকেল।

ভাইকে হিথ্রোতে নামিয়ে দিল ইসাবেলা। “মনে হচ্ছে আমাদেরকে সবসময় গুডবাই বলতে হবে, মিকি।” ফিসফিস করে জানাল মাইকেলকে, ‘তোমাকে অনেক মিস করব।”

“বিয়রে সময় দেখা হবে।”

“এর আগে তো বোধহয়। বাপ্তিস্মের প্রোগ্রামই হয়ে যাবে।” উত্তর দিতেই বোনকে হাত দিয়ে ধরল মাইকেল।

“এটা তো আগে বলনি।”

“ওর স্ত্রীর কারণে।” ব্যাখ্যা দিল বেলা। “জানুয়ারির শেষেই আমরা স্পেন চলে যাবো। রামোন চায় ওর সন্তান যেন ওখানেই জন্ম নেয়। স্প্যানিশ আইনানুযায়ী পেয়ে যাবে।”

“যেখানেই থাকো আমাকে সবসময় সবকিছু জানাবে ঠিক আছে?”

মাথা নাড়ল বেলা। “যদি প্রয়োজন হয় সবার আগে তোমাকেই জানাব।”

ডিপারচার হলের দরজা থেকে বোনকে কিস্ ছুঁড়ে দিল মাইকেল। ভাই চলে যেতেই কেমন একা একা বোধ করল বেলা।

 মালাগা উপকূল থেকে কয়েক মাইল দূরের ছোট্ট জেলে গ্রামে অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করল রামোন। দোতলা বাড়িটার চওড়া ছাদে দাঁড়ালে পাইনের মাথার উপর দিয়ে দেখা যাবে দূরের নীল ভূমধ্যসাগর। দিনের বেলা রামোন যখন ব্যাংকে থাকে, ছাদের এক কোণায় নিরাপদে বিকিনি পড়ে শুয়ে নিজের থিসিসের শেষ অংশ নিয়ে কাজ করে বেলা। আফ্রিকাতে জন্ম নেয়াই সূর্য তার বেশ পছন্দের, যা লন্ডনে থাকতে মোটেই পেত না।

লন্ডনের মতো এখানেও যখন তখন ব্যাংকের কাজে বাইরে যেতে হয় রামোন’কে। ওকে যেতে দিতে একটুও মন চায় না। কিন্তু যখন দু’জনে একসাথে থাকে, স্বপ্নের মতো কেটে যায় মুহূর্ত! মালাগা’তে ব্যাংকের ডিউটি বেশ হালকা হওয়াতে মাঝে মাঝেই পুরো সন্ধ্যা ডুব মেরে সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়ায় বেলা’কে নিয়ে। স্বাদ নেয় স্থানীয় সামুদ্রিক খাবার আর দেশীয় ওয়াইনের।

পুরোপুরি সেরে গেছে রামোনের জখম। “এক্সপার্ট নার্স পেয়েছিলাম আসলে।” বেলাকে জানিয়েছে ঠাট্টার সুরে। শুধু রয়ে গেছে বুকের উপর আর পিঠের একটা জায়গাতে এক জোড়া দাগ। রোদে পুড়ে মেহগনির মতো হয়ে গেছে ছেলেটার গায়ের রঙ। আর এর বিপরীতে চোখগুলো দেখায় হালকা সবুজ।

রামোনের অনুপস্থিতি আদ্রা’র সঙ্গ পায় বেলা। ন্যানির চমৎকার বিকল্প হয়ে উঠেছে আদ্রা অলিভারেস।

চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের আদ্রা শুকনা হলেও শারীরিকভাবে বেশ শক্তিশালী। অল্প কয়েকটা রূপালি চুল থাকলেও মাথার পেছনে খোঁপা হয় ক্রিকেট বল সাইজের। কালো বর্ণের চেহারাতে একই সাথে দয়ালু আর রসিক ভাব। বাদামি রঙা চার কোণা হাতদুটো ঘরের কাজ করতে গেলে হয়ে উঠে বেজায় শক্তিশালী। অন্যদিকে রান্না করা কিংবা বেলা’র কাপড় ইস্ত্রি করার সময় হালকা আর উজ্জ্বল। আবার একই সাথে ইসাবেলা’র পিঠে হাত বুলিয়ে দেবার সময়, পেটে অলিভ অয়েল মেসেজ করার সময় এতটা নরম আর আরামদায়ক হয়ে উঠে যে অবাকই লাগে।

ইসাবেলা’কে স্প্যানিশ সেখানের দায়িত্বও নিয়েছে আদ্রা। আর বেলার উন্নতি দেখে তো রামোন নিজেই অবাক হয়ে গেছে। মাসখানেকের ভেতর স্থানীয় সংবাদপত্র পড়ার পাশাপাশি প্লাম্বার, টেলিভিশন রিপেয়ার ম্যান কিংবা বাজারের মুদি দোকানদারদের সাথে ঝগড়ার সময় আদ্রা’কে সাহায্য করার পুরোপুরি পাকা হয়ে গেছে বেলা।

ইসাবেলা’র পরিবার নিয়ে জানতে চাইলে নিজের কথা কিছুই বলে না আদ্রা। বেলা ভেবেছিল হয়ত স্থানীয়-ই হবে। কিন্তু একদিন সকালবেলা পোস্ট বক্সে নিজেদের মেইলের সাথে দেখেছে হাভানা, কিউবার স্ট্যাম্প লাগানো। আদ্রার চিঠি।

 “তোমার স্বামী কিংবা পরিবারের কেউ কি লিখেছে আদ্রা? কিউবা থেকে তোমাকে কে লিখে?” জানতে চাইতেই রূঢ়ভাবে আদ্রা বলে উঠল, “আমার বান্ধবী লিখেছে সিনোরা। স্বামী তো কবেই মরে গেছে।” দিনের বাকি সময়টুকু জুড়ে কেমন যেন মৌন হয়ে রইল। সপ্তাহের শেষ নাগাদ গিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হল। তাই কিউবা বিষয়ে আর কোনো কথা তুলল না বেলা।

ইসাবেলা’র ডেলিভারীর সময় কাছে চলে এসেছে। তাই আদ্রা আর বেলা। মিলে শিশুদের পোশাক সংগ্রহের কাজে লেগে গেল। একেবারে সবার আগে এ উদ্যোগ নিয়েছে মাইকেল। জোহানেসবার্গ থেকে উৎকৃষ্টমানের তুলা দিয়ে তৈরি বালিশের কাভার, দোলনার চাদর আর উলের বেবি জ্যাকেট এসে পৌঁছেছে এয়ারমেইলে। এছাড়া প্রতিদিন মিনি’তে চড়ে ঘণ্টাখানেক লাগবে এরকম দূরত্বে যতগুলো বেবি শপ আছে সব কয়টা ঘুরে বিশাল কালেকশন বানিয়ে ফেলল বেলা। সাহায্য করল আদ্রা।

বিজনেস ট্রিপ থেকে ফেরার পথে প্রায় এটা সেটা নিয়ে আসে রামোন। মাঝে মাঝে কাপড়ের সাইজ টিন এজারদের মতো হয়ে গেলেও ভুল ধরিয়ে দেয় না মুগ্ধ বেলা। একবার তো এমন একটা প্রাম নিয়ে এলো যে এটার ধারণ ক্ষমতা, চকচকে রঙ দেখে মনে হল রোলস রয়েসের ওয়ার্কশপে তৈরি হয়েছে। নিজের দাদীমা’র বিয়ের পোশাক থেকে নেয়া অ্যান্টিক লেস্ দিয়ে বানানো সিল্কের বাপ্তিম্মের রোব উপহার দিল আদ্রা। ইসাবেলা এতটাই আপ্লুত হয়ে গেল যে রীতিমতো কেঁদে ফেলল। বারে বারে মনে পড়ল ওয়েল্টেভ্রেদেনের কথা, বাবা কিংবা নানা’র সাথে কথা বলার সময় বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করতে হয় যেন রামোন কিংবা সন্তানের কথা মুখ ফসকে বের হয়ে না যায়। সকলে ভাবছে থিসিসের কাজে কিংবা ছুটি কাটাতেই স্পেন গেছে বেলা।

 এর মাঝে বার কয়েক রামোনের কথা মতো ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটা জায়গায় গেছে বেলা। প্রতিবার কোনো একটা খাম কিংবা ছোট প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরে আসত। তেল আবিবে গেলে নিজের দক্ষিণ আফ্রিকান পাসপোর্ট ব্যবহার করে। কিন্তু বেনগাজী আর কায়রোতে ব্যবহার করে ব্রিটিশ পাসপোর্ট। একদিন কিংবা এক রাতের এসব ট্রিপে কিছুই ঘটে না বলা চলে। কিন্তু বেরির জন্য শপিং করার প্রচুর সুযোগ পাওয়া যায়। একবার তো বেনাগাজী থেকে ফেরার সপ্তাহখানেক পর কর্নেল মুয়ামার গাদ্দাফী সামরিক অভ্যুত্থান করে পতন ঘটান রাজা প্রথম ইদ্রিশের রাজতন্ত্র। নিজের আর শিশু’র নিরাপত্তার কথা ভেবে, স্বস্তি পায় বেলা। তাই বাচ্চার জন্ম না হওয়া পর্যন্ত এরকম আর কোনো কাজ দেয়া হবে না বেলাকে বলে প্রমিজ করে রামোন। এ সমস্ত কাজ কি ব্যাংক নাকি তার জীবনের অন্ধকার দিকের সাথে জড়িত সন্দেহ করলেও কখনো কিছু জানতে চায় না বেলা।

 সপ্তাহে একবার রামোনের ঠিক করে দেয়া ক্লিনিকে যায় চেক আপের জন্য। সবসময় সাথে যায় আদ্রা। গাইনোকোলজিস্ট বেশ ভদ্র আর অভিজাত।

 “সবকিছুই চমৎকারভাবে এগোচ্ছে সিনোরা। প্রকৃতি তার কাজ করে যাচ্ছে আর সন্তান জন্মদানের জন্য আপনিও বেশ তরুণ আর স্বাস্থ্যবান।

“ছেলে হবে তো?”

“হ্যাঁ। খুব সুন্দর স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।”

প্রাক্তন মুরিশ রাজপ্রাসাদকে ঘষামাজা করে তৈরি হয়েছে এই ক্লিনিক। আধুনিক সব ব্যবস্থা আর যন্ত্রপাতিও আছে।

একবার চেক আপের পর পর্দা ঘেরা কিউবিকলে ইসাবেলা যখন ড্রেস পড়ছে, ওয়েটিং রুমে আদ্রা আর ডাক্তারের কথোপকথন শুনে ফেলে। স্প্যানিশ এতদিনে এতটাই রপ্ত করে ফেলেছে যে দুজনের আলাপ শুনে বেশ টেকনিক্যাল আর স্পেসিফিক মনে হল। ঠিক যেন একই পেশার দু’জন মানুষ কথা বলছে। অবাক হয়ে গেল বেলা।

বাসায় ফেরার সময় অন্যান্য রাবের মতই সমুদ্রের দিকে মুখ করে থাকা রেস্টোরেন্টে বসে আইসক্রীম আর চকলেট সস্ অর্ডার করল বেলা। তারপর আদ্রার কাছে জানতে চাইল,

“তোমাকে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে শুনেছি। নিশ্চয় কখনো নার্স ছিলে, তাই না। তুমি তো অনেক কিছু জানো-টেকনিক্যাল শব্দগুলো যে বলছিলে।”

আরো একবার সেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখাল আদ্রা।

“আমি তো একটা হাঁদা। এসব কিভাবে জানব।” ককভাবে উত্তর দিয়েই একেবারে ভোম মেরে গেল আদ্রা।

ডাক্তারের কথা মতো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ডেলিভারী হবে। তাই এর আগেই থিসিস শেষ করতে চায় বেলা। মার্চের শেষ দিনে ফাইনাল পেইজ টাইপ করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিল। চিন্তা হল এই ভেবে কেমন হল পুরো গবেষণা। পাঠিয়ে দেয়ার পর মনে হতে লাগল আরো কী কী সংশোধন করা যেত।

 যাই হোক এক সপ্তাহের ভেতর ফোন আসল ইউনিভার্সিটি থেকে। ফ্যাকাল্টি এক্সামিনারদের সামনে থিসিস নিয়ে ভাইভা দেবার জন্য ডাকা হল বেলাকে।

 “উনারা পছন্দ করেছেন; অন্তত বিরক্ত তো হননি।” উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল বেলা।

ডেলিভারী ডেট থাকা সত্ত্বেও তিনদিনের জন্য লন্ডন উড়ে গেল। যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও ভাল হয়েছে ভাইভা কিন্তু মালাগা’তে আসতে আসতে জান বের হবার দশা।

“যতটা সম্ভব দ্রুত জানাবার প্রমিজ করেছেন উনারা? কিন্তু মনে হচ্ছে সব ভালোই হবে-” রামোনকে জানাল বেলা।

চাঁদের আলোয় শুয়ে আছে দু’জনে; এমন সময় শুরু হল প্রসব বেদনা।

চুপচাপ শুয়ে শুয়ে নিশ্চিত হতে চাইল বেলা। বুঝতে পারল সময় হয়ে গেছে। রামোন’কে জাগাতেই তড়িঘড়ি পাজামা পরে ছুটল নিচ তলায় আদ্রা’কে ডাকতে।

ইসাবেলা’র স্যুটকেস তৈরিই ছিল। তিনজনে মিলে উঠে বসল মিনি’তে। পেছনের সিটে ইসাবেলা’কে শুইয়ে দিয়ে ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে গাড়ি ছোটাল মোন।

 বাচ্চা বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনো সমস্যা হল না। দ্রুত আর প্রাকৃতিকভাবেই সাঙ্গ হল সবকিছু।

বহুকষ্টে একটা কনুই’র উপর ভর দিয়ে উঠে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিল ঘামে ভেজা চুল। কী হয়েছে? ছেলে?”

জানতে চাইল উদ্বিগ্ন বেলা। চকচকে লাল ছোট্ট দেহটা তুলে ধরলেন ডাক্তার।

 চোখ দুটোকে শক্ত করে বন্ধ রেখেছে ছোট্ট মানুষটা। মুখটা বেগুনি হয়ে আছে। ঘন, কালো চুলগুলো লেপ্টে আছে মাথার সাথে। নিজের হাতের বুড়ো আঙুলের সমান সন্তানের পুরুষাঙ্গ দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল বেলা, “ছেলে! ছেলে আর একজন কোর্টনি!”

সন্তানের মুখ দেখার সাথে সাথে, ওকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে নিজের ভেতরের মাতৃত্ব ভাব টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই অনুভূতি; এত শক্তি! বুকের মাঝে চিনচিন করে উঠল আদিম এক ব্যথা।

বাবা’র মতই সুন্দর হয়েছে ছেলেটা। এ সুন্দর কিছু আর কখনো স্পর্শ করেনি বেলা। প্রথম কয়েকদিন তো চোখই ফেরাতে পারে না। রাতের বেলাতেও প্রায় ঘুম ভেঙে দোলনার কাছে গিয়ে দেখে আসে চাঁদের আলোয় ওই ছোট্টমুখখানা। অথবা দুধ খাওয়াবার সময় গোলাপি মুঠি খুলে দেখে ছোট্ট ছোট্ট আঙুলগুলো।

 “ও আমার। শুধু আমার।” বারে বারে নিজেকেই যেন শোনায় বেলা; কিছুতেই কাটতে চায় না এই ঘোর।

ক্লিনিকের রৌদ্রস্নাত বড় সড় ঘরটাতে প্রথম তিনদিনের বেশিরভাগটাই ওদের সাথে কাটালো রামোন। বেলার মতো তারও প্রায় একই অবস্থা। দু’জনে মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নাম নিয়ে। আর বিস্তর গবেষণা, কাটছাট শেষে বেলার দিক থেকে ঠিক হল শাসা আর শন আর রামোনের পক্ষ থেকে ঠিক হল হুয়েশা আর ম্যাহন। অবশেষে বাচ্চার নাম ঠিক করা হল নিকোলাস মিগেল রামোন ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো। মাইকেলকে সংক্ষিপ্ত করে ইসাবেলার ইচ্ছে মিগেল রাখা হল।

চতুর্থ দিনে রামোনের সাথে ক্লিনিকে এলো কালো স্যুট পরিহিত তিনজন অসম্ভব ভদ্রলোক। সবার হাতেই ব্রিফকেস। একজন অ্যাটনী, একজন স্টেট রেজিস্টার অফিসের কর্মকর্তা আর তৃতীয় জন হল স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট।

প্রত্যক্ষদশী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অ্যাডপশন পেপারে সাইন করল বেলা। নিকোলাসের গার্জিয়ান হিসেবে মেনে নিল মারকুইস ডি সান্তি য়াগো-ই-মাচাদা’কে। রামোন’কে পিতা হিসেবে দেখিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট দিল রেজিস্ট্রার।

অবশেষে মাতা-পুত্রের সুস্থ জীবন কামনা করে বিশাল বড় গ্লাসে শেরী পান করে বিদায় নিল তিন ভদ্রলোক। এতক্ষণে ইসাবেলা’কে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল রামোন।

“তোমার ছেলের পদবী নিশ্চিত হয়ে গেল। ফিসফিসিয়ে বলল রামোন।

 “আমাদের ছেলে।” ওকে কিস্ করল বেলা।

ক্লিনিক থেকে তিনজনে মিলে বাসায় ফিরতেই ফুল ভর্তি রোল নিয়ে আদ্রা’কে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে; ওদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। ইসাবেলা চাইল নিজেই নিকি’কে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠবে।

কিন্তু নিয়ে নিল আদ্রা। “ও ভিজে গেছে। আমি চেঞ্জ করে দিচ্ছি।” নিজেকে ইসাবেলার মনে হল যেন এক সিংহী মা, যার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে ছোট্ট শাবক।

পরবর্তী দিনগুলোতে দেখা গেল অনুচ্চ এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল এই দুই নারীর মাঝে। ইসাবেলা জানে যে শিশু লালন-পালনে আদ্রা সিদ্ধহস্ত। তারপরেও নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। তাই নিকি সবকিছু একাই করতে চায়।

নিকি’র চেহারায় ধীরে ধীর ফুটে উঠল পিচু রঙা আভা। ঘন কালো চুলগুলোও কোকড়া হয়ে গেল। প্রথমবার চোখ মেলতেই দেখা গেল ঠিক বাবার মতো সবুজ চোখ পেয়েছে। ইসাবেলা’র মনে হলো এটাই বোধহয় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মিরাকল।

দুধ খাওয়াতে গিয়ে ছেলেকে শোনায়, “তুমি ঠিক বাবার মতই সুন্দর হয়েছ, সোনা। একমাত্র এই কাজটাতেই ভাগ বসাতে পারে না আদ্রা।

য়েক মাসের মাঝেই সবার বেশ প্রিয় হয়ে উঠল ইসাবেলা। ওর সৌন্দর্য, সদয় আচরণ, গর্ভাবস্থা আর ভাষা শেখার দারুণ আগ্রহ দেখে বেজায় খুশি দোকানদাররা।

তাই, প্রায় দশদিনের দিন নিকি’কে প্র্যামে বসিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে আনল বেলা। এও মজা হল যে ফ্ল্যাটে ফিরল একগাদা প্রশংসা আর অসংখ্য উপহার নিয়ে।

ইস্টার ডে’তে বাড়িতে ফোন করার পর চিৎকার করে উঠলেন নানা : “স্পেনে এত কিসের জরুরি কাজ যে ওয়েল্টেভ্রেদেনে বাসায় ফিরতে পারছ না?”

“ওহ নানা, আই লাভ ইউ অল। কিন্তু এখন যে কিছুতেই সম্ভব না।”

“ইয়াং লেডি, তোমাকে আমি ভালই চিনি। জানি কোনো অ-কাজ নিয়ে তুমি ব্যস্ত; ট্রাউজার তাই না?”

“নানা, তুমি এত বাজে বকো না। কিভাবে ভাবলে আমি এমন করব?”

“বিশ বছরের অভিজ্ঞতা।” সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বললেন, “আর কোন ঝামেলা বাড়িয়ো না, বাছা।”

“প্রমিজ করছি, করব না।” পেটের কাছে ছেলেকে ধরে মিষ্টি স্বরে জানাল ইসাবেলা। মনে হল, আহারে যদি তোমাকে বলতে পারতাম। ছোট্ট মানুষটা তো এখনো ট্রাউজার পরতে পারে না।

“থিসিস কেমন হচ্ছে?” জানতে চাইল বাবা। এরই মাঝে যে শেষ করে ফেলেছে, বলতে পারল না বেলা। কারণ স্পেনে থাকার এটাই তো অজুহাত।

 “প্রায় শেষ।” নিকি আসার পর থেকে এ ব্যাপারে কিছুই ভাবেনি বেলা।

“ঠিক আছে। গুড লাক্।” এরপর খানিক চুপ থেকে শাসা জানালেন, “মনে আছে তুমি আমার কাছে কী প্রমিজ করেছ?”

“কোনটা?” না বোঝার ভান করল বেলা। ভেতরে ভেতরে খানিকটা অনুতপ্তও হলো। ভালোভাবেই জানে যে বাবা কিসের কথা বলছেন।

“প্রমিজ করেছিলে যে কখনো কোনো সমস্যায় পড়লে একা একা কিছু করবে না, আমার কাছে আসবে।

“হ্যাঁ, মনে আছে।”

“তুমি ঠিক আছে তত বেলা, মাই বেবি?”

 “আমি ঠিক আছি, বাবা, জাস্ট ফাইন।”

 মেয়ের কণ্ঠস্বরে আনন্দের ঝিলিক শুনে নিশ্চিত হলেন শাসা।

“হ্যাপি ইস্টার, আমার ছোট্ট বেবি।”

মাইকেলের সাথে টানা পয়তাল্লিশ মিনিট কথা হল। এমনকি নিকি পর্যন্ত ফোনে শুনিয়ে দিল নিজের খলবলে আওয়াজ।

“বাসায় কবে ফিরবে, বেলা?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।

“জুনের ভেতরেই রামোনের ডির্ভোস নিশ্চিত হয়ে যাবে। স্পেনে সিভিল ম্যারেজ সেরে ওয়েল্টেভ্রেদেনের গির্জায় বিয়ে করব। তুমি কিন্তু দু’জায়গাতেই থাকবে।”

“বাধা দেয়ার চেষ্টা করে দেখ।” বোনকে চ্যালেঞ্জ করল মাইকেল।

***

টেবিলের পাশে নিকি’র প্র্যাম রেখে পছন্দের সী-সাইড রেস্টোরেন্টে ডিনার করল সবাই মিলে।

ওদের সাথে আদ্রাও ছিল। এতদিনে বেলা’র ছোট্ট পরিবারের অংশ হয়ে গেছে এই নারী। রামোনর হাত ধরে হাঁটছে বেলা। এতটা খুশি আর কখনো বোধ করেনি জীবনে।

বাসায় পৌঁছাতেই চেঞ্জ করার জন্য নিকি’কে নিয়ে গেল আব্রা। এই বার আর ক্ষেপে গেল না বেলা।

সামনের বেডরুমের জানালা আটকে রামোনের কাছে এলো বেলা।

নিকি জন্ম নেবার পরেও তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। তুমি তো জানই যে আমি কাঁচের মতো ঠুনকো নই। ভেঙে পড়ব না।”

মিটি মিটি হেসে ভালই উপভোগ করছে রামোন। জানে অনেকদিন ওর আদর থেকে বঞ্চিত মেয়েটা।

“আমার মনে হয় তুমি সবকিছু ভুলেই গেছ।” রামোনের পিঠে ধাক্কা দিল বেলা, “চলো তোমাকে মনে করিয়ে দেই।”

“তুমি আবার ব্যথা পাবে না তো।” বেলার জন্য সত্যি উদ্বিগ্ন হল রামোন।

“যদি কেউ ব্যথা পায় তো সে হবে তুমি দোস্ত। নাও এবার সিটবেল্ট বাঁধা। টেক-অফের জন্য প্রস্তুতি নাও।”

একটু পর। বন্ধ রুমে ঘর্মাক্ত অবস্থায় পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজনে। রামোন বলতে বাধ্য হল, “আগামী সপ্তাহে চার দিনের জন্য আমাকে বাইরে যেতে হবে।”

তাড়াতাড়ি উঠে বসল বেলা। “ওহ্ রামোন এত জলদি!” প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনে হল একটু বেশি দখলদারি করছে বেলা। তাই নতমুখে জানতে চাইল, “প্রতিদিন ফোন করবে, ঠিক আছে?”

 “চেষ্টা করব এর চেয়েও বেশি কিছু করতে। আমি প্যারিসে যাচ্ছি, দেখি তোমাকেও নিয়ে যাওয়া যায় কিনা। লাজারে’তে একসাথে ডিনার করব দু’জনে।”

 “বেশ মজা হবে, কিন্তু নিকি?”

“আদ্রা সামলাবে। নিকিও ভাল থাকবে তাই-আদ্রাও খুশি হবে।”

“আমি আসলে …” দ্বিধায় পড়ে গেল বেলা।

“মাত্র তো এক রাতের জন্য। তাছাড়া তোমারও পুরস্কার পাওনা রয়েছে।”

“ওহ্ মাই ডার্লিং।” মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। “তোমার সাথে থাকতে পারলে আমারও ভাল লাগবে। ঠিকই বলেছ, আদ্রা আর নিকি আমাকে ছাড়া এক রাত ঠিকই কাটিয়ে দিতে পারবে। তুমি ডাকলেই আমি চলে আসব।”

***

“প্রায় এক মাস হয়ে গেছে যে মেয়েটার ডেলিভারী হয়েছে।” তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠলেন জেনারেল জোসেফ সিসেরো। তাহলে আর দেরি কিসের? এখন থামাও এ অপারেশন। খরচ সবকিছুকে ছাড়িয়েই যাচ্ছে। কেবল!”

 “জেনারেলের নিশ্চয় মনে আছে যে নিজের ফান্ড থেকেই খরচ মেটাচ্ছি আমি। ডিপার্টমেন্টের বাজেট থেকে নয়।” আলতো করে মনে করিয়ে দিল রামোন।

কাশি দিয়ে মুখের সামনে পত্রিকা মেলে ধরলেন সিসেরো। দুজনে পাশাপাশি বসে আছেন প্যারিস মেট্রোর সেকেন্ড ক্লাস কোচে। কনকর্ড স্টেশন থেকে উঠে রামোনের পাশে বসেছেন সিসেরো। পরস্পরকে চিনতে পারার কোনো ভাবই ফুটল না চেহারায়। আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলে ট্রেন ছোটার আওয়াজে কিছু শুনতেও পারবে না আড়ি পাতার দল। দুজনে চোখের সামনে পত্রিকা মেলে কথা বলছে” শর্ট মিটিং এর জন্য প্রায়শই তারা এমন করে থাকে।

 “আমি যে শুধু রুবলের হিসাব করছি তা নয়। প্রায় এক বছর ধরে এ প্রজেক্টের পেছনে লেগে থেকে ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য কাজের অপূরণীয় ক্ষতি করছ।”

 লোকটাকে রোগ যে কতটা কাবু করে ফেলেছে দেখে অবাক হচ্ছে রামোন। প্রতিবার দেখলে মনে হয় স্বাস্থ্য আগের চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আর মাত্র কয়েক মাস আছে হাতে।

“এই কয়েক মাসের কাজ সামনের বছরগুলোতে কিংবা দশকগুলোতেও বলা যায় ফিরে আসবে অসাধারণ ফলাফল নিয়ে।”

 “কাজ।” নাক সিটকালে সিসেরো। “এটা যদি কাজ হয় তাহলে মজা লোটা কোনটা মারকুইস? আর তাহলে মাসের পর মাস ধরে ইস্তফা টানতেও বা দ্বিধা করছ কেন?”

 “যদি এই মেয়েটা আমাদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে থাকে তাহলে অপারেশনের পরবর্তী পর্যায়ে যাবার আগে অবশ্য ওকে সময় দিতে হবে বাচ্চাটার সাথে ভাব করার জন্য।”

“কবে হবে সেটা?” জানতে চাইলেন সিসেরো।

“হয়েও গেছে ইতিমধ্যে। ফসল তোলার জন্য প্রস্তুত। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। শুধু এই শেষ দৃশ্যেও আপনার সহযোগিতা দরকার। এ কারণেই এই মিটিং এর জন্য প্যারিসকে বেছে নিয়েছি।”

মাথা নাড়লেন সিসেরো। “চালিয়ে যাও।”

এরপর পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলে চলল রামোন। কোনো মন্তব্য ছাড়াই শুনলেন সিসেরো। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে অপূর্ব হয়েছে প্ল্যানটা।

“ঠিক আছে।” অবশেষে জানালেন জেনারেল। “তোমাকে আগে বাড়ার অনুমোদন দেয়া হলো। আর অনুরোধ করেছ তাই শেষটার দেখভাল করব।”

বাস্টিলে ট্রেন পৌঁছাতেই কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন সিসেরো।

 দরজা খুলে যেতেই একবারও পিছনে না তাকিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলেন

***

রামোন যেদিন চলে গেল সেদিনই সন্ধ্যায় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোটিশ এলো বেলা’র কাছে।

ইসাবেলা কোর্টনিকে ডক্টর অব ফিলোসফী ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয়েছে।

সাথে সাথেই ওয়েল্টেভ্রেদেনে ফোন করল বেলা। মালাগা আর কেপ টাউনের সময়ের পার্থক্য খুব বেশি না। মাত্রই পোলো মাঠ থেকে ফিরেছেন

নিচ তলার স্টাডিতে মেয়ের ফোন ধরেই চিৎকার করে উঠলেন, “সন অফ আ গান!” বাবার উচ্ছ্বাস টের পেল বেলা। “ওরা তোমাকে কবে টুপি পরাবে ডার্লিং?”

“জুন-জুলাইয়ের আগে না। ততদিন পর্যন্ত থাকতে হবে।” এই বাহানাই মনে মনে খুঁজছিল বেলা।

“অবশ্যই।” সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন শাসা। “আমি’ও আসব তখন।”

 “ওহ ড্যাডি, কতটা দূর!”

“বাজে কথা বলো না ড, কোর্টনি। আমি এটা কোনো মতেই মিস্ করতে চাইনা। তোমার দাদীও হয়ত আসতে চাইবেন সঙ্গে।” অদ্ভুত হলেও বেলা ভাবল যাক এই সুযোগে রামোন আর নিকি’র সাথে ওদের দেখা করিয়ে দেওয়া যাবে।

এই মুহূর্তে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে রামোনের সঙ্গেই বেশি অভিপ্রেত হলেও সে রাতে কিংবা পরের দিনও ফোন করল না ছেলেটা। বৃহস্পতিবার সকাল হতে হতে তো চিন্তায় পাগল হবার দশা।

অবশেষে যখন ফোন বেজে উঠল তখন রসুনের কোয়া নিয়ে রান্নাঘরে ঝগড়া করছে বেলা আর আদ্রা।

 “রামোন ডার্লিং, আমি তো চিন্তায় অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি ফোন করোনি কেন?”

 “অ্যায়াম সরি বেলা।” ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে গলে গেল বেলা।

“তুমি কি এখনো আমাকে ভালবাসো?”

 “প্যারিসে এসো, প্রমাণ দিচ্ছি।”

 “কখন?”

“এখনি। এয়ার ফ্রান্স’র এগারোটার ফ্লাইটে তোমার জন্য রিজার্ভেশন দিয়েছি। এয়ারপোর্টে টিকেট পেয়ে যাবে। দুটোর মধ্যে পৌঁছে যাবে এখানে।”

“তোমার সাথে কোথায় দেখা করব?”

 “প্লাজা এথেনী’তে স্যুট বুক করেছি আমাদের জন্য।”

 “তুমি আমাকে নষ্ট করে ফেলছ রামোন ডার্লিং?”

 “এর কম কিছুও তোমার প্রাপ্য নয়।”

তৎক্ষণাৎ তৈরি হয়ে বের হয়ে এলো বেলা। কিন্তু এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট চল্লিশ মিনিট ডিলে হলো। ব্যাগেজ পেতে দেরি হওয়ায় বিকেল পাঁচটারও পরে রাজসিক প্লাজা অ্যাথনী’র সামনে এসে পৌঁছাল বেলা’র ট্যাক্সি।

 মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখবে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রামোন। কিন্তু না, কেউ নেই। রিসেপশন ডেস্কের উল্টো দিকে সোনালি কারুকাজ করা আর্মচেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে খেয়াল না করেই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল বেলা।

“আপনাদের গেস্ট মারকুইস ডি সান্তিয়াগো ই মাচাদো’র স্ত্রী আমি।”

“এক মিনিট, ম্যাডাম।” লিস্ট চেক করে কিছুই পেল না উর্দিধারী ক্লার্ক। তারপর কী ভেবে দ্বিতীয়বার চেক করল।

“আমি দুঃখিত, মারকুইসা। মারকুইস এখানে নেই।”

 “হয়তো উনি মঁসিয়ে মাচাদো নামে রেজিস্টার করেছেন।

“না। এই নামেও কেউ নেই এখানে।”

দ্বিধায় পড়ে গেল ইসাবেলা। “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আজ সকালেও তো কথা বলেছিলাম।”

“ঠিক আছে, আমি আবার চেক করছি।” বুকিং ক্লার্কের সাথে কথা বলে সাথে সাথে ফিরে এলো লোকটা। “আপনার হাজব্যান্ড এখানে নেই আর কোনো রিজার্ভেশনও দেননি।

 “হয়ত ওর দেরি হচ্ছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা, “কোনো রুম পাওয়া যাবে?”

 “হোটেলের সব রুম বুকড় হয়ে গেছে।” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাত জড়ো করল লোকটা, “এখন বসন্ত। বুঝতে পারছেন মারকুইসা। প্যারিস পর্যটকের ভিড়ে ভরে গেছে।”

“ও নিশ্চয় আসবে।” জোর করে হাসতে চাইল ইসাবেলা “আমি যদি গ্যালরিতে অপেক্ষা করি, কিছু হবে?”

“মোটেই না, মারকুইসা। ওয়েটার আপনাকে কফি এনে দিবে। স্টোরে ব্যাগেজের দিকে খেয়াল রাখবে পোর্টার।”

বেলা লম্বা গ্যালারির দিকে এগোতেই আর্মচেয়ার থেকে উঠে বসল সে ভদ্রলোক। কিন্তু নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে থাকা ইসাবেলা খেয়ালই করল না অসুস্থের মতো হাঁটতে থাকা লোকটাকে। রাস্তায় নেমে ডোরম্যানের এনে দেয়া ট্যাক্সিতে চড়ে গ্রেনেল চলে এলেন সিসেরো। শেষ ব্লক হেঁটে পৌঁছে গেলেন সোভিয়েত অ্যামব্যাসিতে। নাইট ডেস্কের গার্ড দেখা মাত্র চিনতে পারল জেনারেলকে।

দ্বিতীয় তলার মিলিটারি অ্যাটাশে’র অফিস থেকে মালাগা’তে ফোন করলেন সিসেরো।

“মেয়েটা হোটেলে পৌঁছে গেছে।” খসখসে কণ্ঠে জানালেন অপর পার্শ্বের শ্রোতাকে। আগামীকাল দুপুরের আগে ফিরতে পারবে না। পরিকল্পনা মতো কাজ শুরু করে দাও।”

সাতটার খানিক আগে গ্যালারিতে ইসাবেলার কাছে এলো দ্বাররক্ষী।

“আপনার জন্য ভালো একটা সংবাদ এনেছি মারকুইসা। একটা রুম খালি হয়েছে। আপনার ব্যাগজেও পাঠিয়ে দিয়েছি উপরে।”

একশ ফ্রাংক টিপস্ দিয়ে রুমে ঢুকেই মালাগাতে ফোন করল বেলা। আশা করেছিল রামোন হয়ত আদ্রার কাছে কোনো মেসেজ রাখবে; কিন্তু না, ঘটনা তার চেয়েও ভয়াবহ। একশ বার রিং হলেও কোনো উত্তর এলো না। ভয় পেয়ে গেল বেলা। রাতে আরো দু’বার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না।

 “ফোন বোধহয় কাজ করছে না। নিজেকে বোঝাতে চাইলেও সারারাত একটুও ঘুমোত পারল না।

সকালে এয়ারলাইন রিজার্ভেশন অফিস খোলার সাথে সাথেই মালাগার ফ্লাইটে সিট বুক করে নিয়ে দুপুরেরও পরে নিজ অ্যাপার্টমন্টে পৌঁছে গেল বেলা।

ট্যাক্সি থেকে নেমে ব্যাগটাকে কোনোমতে হেঁটে হেঁচড়ে সদর দরজার কাছে এসে থামল। দুশ্চিন্তা আর ক্লান্তিতে অবসন্ন হাতে কাঁপতে কাঁপতে চাবি ঢোকাল তালা’তে।

 ভূতের বাড়ির মতো নির্জন হয়ে আছে পুরো অ্যাপার্টমেন্ট। খোলা দরজা দিয়ে শুনতে পেল নিজের গলার আওয়াজ।

“আদ্রা, আমি ফিরে এসেছি। কোথায় তুমি?”

আত্রা’র রুমের দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরেও চোখ বুলালো বেলা। ধুপধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের বেডরুমের সামনে গিয়ে দেখে হাট করে খুলে রয়েছে দরজা। নিকির দোলনাটা থাকলেও দেখল না আর টেডি বিয়ারগুলো উধাও।

ছাদের দরজাতে গিয়েও দেখে এলো। নেই নিকির প্র্যাম।

 “আদ্রা!” অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল বেলা, “তুমি কোথায়?”

দৌড়ে অন্য রুমগুলোতেও কেবল ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে লাগল, “নিকি! মাই বেবি! ওহ্ গড় প্লিজ। তুমি নিকি’কে কোথায় নিয়ে গেছ?”

আবারো বেডরুমে নিকির শূন্য দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা।

 “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না? কী হয়েছে সবার?”

কী মনে হতেই নিকি’র ড্রয়ার খুলতেই কেঁপে উঠল সারা গা। ন্যাপি, ভেস্ট, জ্যাকেট কিছু নেই।

“হাসপাতাল!” ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিজেকেই শোনাল, “নিশ্চয় কিছু হয়েছে ওর!”

 দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে টেলিফোনে হাত দিয়েই জমে গেল বেলা। টেপ দিয়ে একটা খাম আটকে রাখা হয়েছে যন্ত্রটার ক্রেডলে। ধপ করে রিসিভার ফেলে দিয়ে খামটা খুলল বেলা। হাত এতটাই কাঁপছে যে নোটের লেখা প্রায় কিছুই পড়তে পারছে না।

যাই হোক রামোনের হাতের লেখা দেখার সাথে সাথে চিনতে পারলেও স্বস্তি উড়ে গেল পড়তে গিয়ে :

“নিকোলাস আমার কাছেই আছে। কিছু সময়ের জন্য নিরাপদে থাকবে। তুমি যদি আবার ওকে দেখতে চাও, তাহলে বিনা বাক্য ব্যয়ে নিচের নির্দেশগুলো অনুসরণ করো। মালাগা’তে কারো সাথে কিছু বলবে না। এখনি ফ্ল্যাট ছেড়ে লন্ডন চলে যাও।

কাদোগান স্কোয়ারেই তোমার সাথে যোগাযোগ করা হবে। কাউকেই বলবে না যে কী ঘটেছে, এমনকি তোমার ভাই মাইকেলকে’ও না। সবকিছু অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ। হয়ত কখনো আর ওকে দেখবেই না। এই নোটটাও নষ্ট করে ফেলল।

 বেলা’র মনে হল কোমরের কাছ থেকে সবকিছু অবশ হয়ে গেছে। দেয়ালের সাথে ঘসে ঘসে টাইলসের মেঝেতে বসে পড়ল অথবের মত। বারে বারে পড়ল হাতের নোট; কিন্তু মাথা যেন কাজ করছে না।

কোলের উপর কাগজের টুকরাটাকে ফেলে দিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল ওপাশেরে দেয়ালের দিকে।

 জানে না কতক্ষণ বসে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহুকষ্টে টেনে তুলল নিজেকে। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। আরো একবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা এগিয়ে গেল বেডরুমে রামোনের কার্বাডের দিকে। দরজা খুলতেই দেখতে পেল খালি কার্বাড। এমনকি কোট হ্যাঁঙ্গারগুলোও নেই, চেস্ট অব ড্রয়ারের কাছে গিয়েও দেখা গেল সব শূন্য। কিছুই রেখে যায়নি রামোন।

আবারো নিকির দোলনার কাছে ফিরে এলো বেলা। বোমা বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তির মতো দিকবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে মেয়েটা। ছেলের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ওহ্ নিকি, বাছা আমার, ওরা তোমার সাথে কী করছে?”

 হঠাৎ করেই দোলনার কাঠের বার আর বেবি ম্যাট্রেসের ফাঁক গলে কিছু একটা পড়ে গেল মাটিতে। মনে হল বেদীর সামনে থেকে প্রসাদ নিচ্ছে; এমনভাবে হাঁটু গেড়ে বসে নিকি’র উলের নরম জুতায় মুখ ডুবিয়ে দিল বেলা, প্রাণ ভরে গন্ধ নিল ছোট্ট দেহটার। এতটা কাদল যে নিঃশেষ হয়ে গেল সব শক্তি। ততক্ষণে ছাদ গলে বেডরুমেও নেমে এলো অন্ধকার। কোনোমতে বিছানায় উঠেই ঘুমিয়ে পড়ল বেলা। গালের কাছে ধরে রইল উলের ছোট্ট জুতাটা।

ঘুম থেকে জেগে উঠেও দেখল অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। বহুক্ষণ পর্যন্ত বুঝতেই পারল না কোথায় আছে, কী হয়েছে। এরপর চেতনা ফিরে পেতেই ধড়মড় করে উঠে বসল।

বিছানার পাশের টেবিলে পড়ে আছে রামোনের নোট। হাতে নিয়ে আবারো পড়ল। তারপরেও মনে হল কিছুই বুঝতে পারছে না।

“রামোন, মাই ডার্লিং, কেন আমাদের সাথে এমন করছ?” ফিসফিস করে বলে উঠলেও বাধ্য মেয়ের মতো বাথরুমে গিয়ে টয়লেট বোলের উপর ছোট্ট ছোট্ট কুচি করে ফেলল পুরো কাগজ। তারপর ফ্লাশ করে দিল। জানে যা পড়েছে মাথা থেকে তা কখনোই যাবে না, তাই এই ভয়ংকর কাগজটা সাথে রাখার কোনো প্রয়োজন কিংবা ইচ্ছে কিছুই নেই।

 গোসল করে কাপড় পরে টোস্ট আর কফি বানাল। সবকিছুই বড় বেশি বিস্বাদ লাগল মুখের ভেতরে।

এরপর তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল পুরো ফ্ল্যাট। আদ্রার রুম থেকে শুরু করল। কাপড়, কসমেটিকস, অয়েন্টমেন্ট এমনকি বিছানার চাদরের উপর আদ্রা অলিঙারেসের একটা চুলও পাওয়া গেল না। সব নিশানা উধাও।

লিভিং রুম আর রান্নাঘরেরও একই অবস্থা।

আবারো উঠে বেডরুমে গেল বেলা। রামোনের কার্ডের পিছনে স্টিলের একটা ওয়াল সে আছে। খুলতেই দেখা গেল একটাও ডকুমেন্টস নেই। নিকির বার্থ সাটিফিকেট আর অ্যাডপশন পেপারসও গায়েব।

বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়ে পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করতে চাইল বেলা। এই পাগলামির পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে! সম্ভাব্য সব অ্যাংগেল থেকেই ভাবতে চাইল ঠাণ্ডা মাথায়।

কিন্তু ঘুরে ফিরে মন শুধু একটাই উপসংহারে আসছে; রামোন কোনো গভীর সমস্যায় পড়েছে। তাই বাধ্য হয়েছে নিকি’কে নিয়ে সরে পড়তে। তাই ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ দু’জনের নিরাপত্তার জন্য রামোনের কথা মানতেই হবে বেলাকে।

 অ্যাপার্টমেন্টে ছেড়ে নিচের রাস্তায় নেমে এলো বেলা। ওপারে একটা বেকারি শপ আছে আর বেকারস্ এর স্ত্রীর সাথে গত কয়েক মাসে ভালই খাতির হয়ে গেছে। দোকানের শাটার টানছিলেন মহিলা। এমন সময় এগিয়ে গেল বেলা।

 “হ্যাঁ, আপনি বৃহস্পতিবারে চলে যাবার পর আদ্রা নিকোলাসকে এ্যামে করে বীচের দিকে নিয়ে গিয়েছিল আর দোকান বন্ধ করার আগেই দেখেছি। ফিরে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্টেও যেতে দেখেছি কিন্তু তারপর আর দেখিনি।”

 অ্যাপার্টমেন্টে ব্লকের আশেপাশে আরো কয়েকজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলেও সকলে একই কথা জানালো। কয়েকজনে ওদেরকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেখলেও এরপর আর দেখেনি। একমাত্র বাকি রইল পার্কের কর্ণারের জুতা পালিশওয়ালা। এই লোকটার কাছেই রামোন সব সময় জুতা পালিশ করাতো, মুক্ত হস্তে টিপসও দিত। বেলাও বেশ পছন্দ করে।

 “হাই, সিনোরা” বেলা’কে দেখে হাসল লোকটা। জানালো, “বৃহস্পতিবারে আমি অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করি। সিনেমা আর আর্কেড থাকে। দশটার সময় মারকুইসকে দেখেছি। দু’জন লোককে নিয়ে এসেছেন, সাথে বড় একটা কালো গাড়ি। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে সবাই উপরে উঠে গেছে।

“অন্য লোকগুলো দেখতে কেমন ছিল চিকো? তুমি চেনো? আগে কখনন দেখেছ?”

“না। তবে বেশ কঠিন চেহারা পুলিশের মত। এরা এত ঝামেলা করে, তাই আমি পুলিশধ পছন্দ করি না। সবাই মিলে উপরে গিয়েও একটু পরেই নেমে এসেছে। সঙ্গে আদ্রা। আদ্রা’র কোলে নিকো বেবি। গাড়িতে উঠে সবাই একসাথে চলে গেছে। এরপর আর দেখিনি ওদেরকে।”

পুলিশ ছিল, তার মানে ইসাবেলা’র সন্দেহই সত্যি। রামোন বাধ্য হয়ে এসব করেছে। বুঝতে পারল রামোনের কথামতো কাজ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তাই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসে তাড়াতাড়ি প্যাক আপ শুরু করে দিল। ম্যাটারনিটি ক্লথসগুলো মেঝেতে ফেলে রেখে ভালো কাপড়গুলো দুটো সুটকেসে ভরে নিল।

কসমেটিকস্ এর ড্রয়ার খুলতেই দেখল নিকির জন্মের পর থেকে তোলা ছবিসহ মোটাসোটা অ্যালবামটা নেই। এমনকি লেগেটিভগুলো’ও নিয়ে গেছে ওরা। ভাবতেই দুলে উঠল সারা পৃথিবী যে ওর কাছে সন্তানের কোন চিহ্নই রইল না। কোনো ছবি, রেকর্ড, ব্যবহারী জিনিস, কিছু না; শুধু উলের জুতাটা কেমন করে যেন পেয়ে গেছে।

পেটমোটা স্যুটকেস দুটো নিয়ে নিচে নেমে তুলে ফেলল মিনি’র পেছনে। তারপর রাস্তা পার হয়ে গেল বেকার’পত্নীর দিকে।

“যদি আমার হাজব্যান্ড ফিরে এসে আমার কথা জানতে চায়, বলবেন যে লন্ডনে চলে গেছি।”

“আর নিকো? আপনি ঠিক আছেন তো সিনোরা?” মহিলার সহৃদয়তা দেখে হাসল বেলা,

“নিকো আমার হাসব্যান্ডের কাছেই আছে। শীঘ্রিই লন্ডনে ওদের সাথে দেখা হবে। ভাল থাকবেন সিনোরা।”

***

উত্তর দিকে যাত্রা মনে হলো আর কখনো শেষই হবে না। গত কয়েকদিন মাথার ভেতর শুরু নিকোলাসের খেলার দৃশ্যই ঘুরছে; মনে পড়ে যাচ্ছে ছেলের সাথে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলো। পাগল হতে বুঝি আর দেরি নেই।

ক্রস-চ্যানেল ফেরিতে স্যালুনের হৈ-হট্টগোল এড়াতে ডে’কে উঠে গেল বেলা। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতল বাতাস আর নিজের বিষণ্ণতায় কাঁপতে কাঁপতে অবশেষে নেমে এলো নিচে উইমেনস টয়লেটে। দুধের ভারে ব্যথা হয়ে আছে স্তন। তাই বাড়তি অংশ একস্ট্রা পাম্প করে ফেলে দিতে হল, যা নিকি’র পাওনা ছিল।

 “ওহ নিকি, নিকি?” নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের মুখ মনে করার চেষ্টা করল বেলা। এখনো স্পষ্ট অনুভব করে শিশু শরীরের সেই ঘ্রাণ আর ওম।

 বহুকষ্টে অবশেষে নিজেকে সামলে মনে করিয়ে দিল, “এখন কিছুতেই ভেঙে পড়া চলবে না। নিকি’র জন্য আমাকে শক্ত হতেই হবে। সুতরাং আর কোনো কান্না নয়।”

 বৃষ্টির মাঝে কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে পৌঁছাল বেলা। লাগেজ খুলতে খুলতে মনে হল বাবার কাছে করা প্রমিজের কথা। আর কী যে হল, হাতের ড্রেস ছুঁড়ে ফেলে দুদ্দাড় করে দৌড় দিল ড্রইং রুমে।

“আমি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে একটা ইন্টারন্যাশনাল কল করতে চাই।”

রাত হয়ে যাওয়াতেও মাত্র দশ মিনিটেরও কম সময়ে লাইন পাওয়া গেল। ওপাশে পরিচারকদের কেউ একজন ফোন তুলতেই আর বাবাকে চাইতে পারল না হতভম্ব বেলা। এটা সে কী করতে যাচ্ছিল। মনে পড়ে গেল রামোনের হুমকি। “অবাধ্য হলে নিকি’র পরিণাম হবে ভয়াবহ।”

কোনো কথা না বলেই ক্রেড়লে রিসিভার নামিয়ে রাখল বেলা।

পাঁচ দিন কেটে গেল। কিছুই ঘটল না। আশায় আশায় ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, ফোনের আশপাশ থেকেই সরলো না। কিন্তু হাউজকীপার ছাড়া আর কারো সাথেই কথাও বলে না। শুধু বই পড়ে আর টিভি দেখে। যদিও তাকিয়ে থাকাই সার হয়। নিজের ব্যথা ছাড়া বাকি সবকিছুই এখন অর্থহীন।

 কিছুই খেতে ইচ্ছে না করাতে তিন দিনের ভেতর বুকের দুধ শুকিয়ে গেল। ওজন কমতে লাগল হু হু করে। তার সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় একটি অংশ চুলগুলো শুকিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। আয়নায় নিজেকে দেখতে একটুও ভাল লাগে না। চোখের চারপাশে গভীর দাগ, সোনালি দেহত্বক এখন হলুদ হয়ে দেখায় ম্যালেরিয়া রোগীর মত।

শাস্তির মতো মনে হচ্ছে এই অপেক্ষার পালা। একেকটা ঘণ্টা যেন অনন্ত কাল। অবশেষে ষষ্ঠ দিনে বেজে উঠল ফোন। দ্বিতীয় রিং’র সাথে সাথেই ছো মেরে কানে দিতেই শুনল মধ্য ইউরোপীয় এক নারীর স্বর।

 “আমার কাছে রামোনের একটা মেসেজ আছে। এখনি বাসা থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রয়্যাল হাসপাতাল জংশনে চলে যান। ওয়েস্ট মিনিস্টার পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। এরপর কেউ একজন এসে “লাল গোলাপ : নাম ধরে ডেকে জানাবে বাকি নিদের্শনা। এবারে কী শুনেছেন বলুন।”

এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বস বলে গেল ইসাবেলা। “গুড” বলেই কানেকশন কেটে দিল নারী কণ্ঠ।

টেমস এর উপর দিয়ে একশ গজও যায়নি; এমন সময় ছোট্ট একটা ভ্যান ওর পাশে চলে এলো। ধীরে ধীরে চলতে লাগল একই দিকে। একটু পরে পেছনের দরজা খুলতেই দেখা গেল গ্রে ওভারঅল পরে বসে আছে এক মাঝ বয়সী রমণী।

“লাল গোলাপ” কণ্ঠ শুনেই বেলা চিনে নারীকে। “উঠে বসো!”

দ্রুত ভ্যানে উঠে মহিলার বিপরীত দিকে বসে পড়ল বেলা। চলতে শুরু করল ভ্যান।

জানালা বিহীন ভ্যানটার অন্য কোন দরজাও নেই। কেবল মাথার উপরে ভেন্টিলেটর ছাড়া। তাই টার্ন আর স্টপ গুনে গুনে কোথায় যাচ্ছে আন্দাজ করতে চাইলেও একটু পরেই ক্ষান্ত দিল সে চেষ্টায়।

“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?” বিপরীত পাশে বসা নারীকে প্রশ্ন করতেই উত্তরে শুনল, “একদম চুপ।” তাই করল বেলা। হাতঘড়িতে তেইশ মিনিট কেটে গেছে এমন সময় আবার থেমে গেল ভ্যান। বাইরে থেকে খুলে গেল পেছনের দরজা।

একটা পার্কিং গ্যারেজে এসে থেমেছে ভ্যান। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল জায়গাটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গ্রে ওভারঅল পরিহিত নারী হাত ধরে বেলা’কে নামতে সাহায্য করল। স্পর্শেই এই রমণীর শক্তি টের পেয়ে বিস্মিত হয়ে গেল বেলা। ঠিক যেন একটা গরিলা’র থাবা। মাংসল কাঁধ নিয়ে টাওয়ারের মতো উঁচু হয়ে আছে ওর মাথার উপরে। হাত ধরা অবস্থাতেই ওকে ভ্যানের বিপরীত দিকের লিফটে নিয়ে গেল। চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল বেলা। ডজনখানেক আরো অন্যান্য ভেহিকেল দেখা গেল যেগুলোর অন্তত দু’টোতে ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট লাগানো আছে।

 লিফটের দরজা খুলে যেতেই ইসাবেলা ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কন্ট্রোল প্যানেলের আলো দেখে বোঝা গেল ওর সন্দেহই সঠিক। বেসমেন্ট লেভেল-২। থার্ড ফ্লোরের বোতামে চাপ দিল গরিলা। নিঃশব্দে দু’জনে উঠে এলো লেভেল-থ্রি’তে। খালি করিডোরের দু’পাশের সবক’টি দরজাই আটকানো।

একেবারে শেষ মাথার দরজাটা খুলে বের হয়ে এলো আরেক স্লাভিক নারী। একই রকম গ্রে ওভারঅল পরনে। ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল ছোট্ট একটা লেকচার রুমে, কিংবা বলা যায় মুভি থিয়েটার। উঁচু মঞ্চের দিকে মুখ করে পাতা হয়েছে দুই সারি ইজি চেয়ার, দূরের দেয়ালের সাথে লাগানো হয়েছে পর্দা।

সামনের সারির মাঝখানে ইসাবেলা’কে বসিয়ে দেয়া হলো।

নরম প্লাস্টিকের চেয়ারে ডুবে গেল যেন। দুই নারী এবার ইসাবেলার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। এরপরই মঞ্চের ডানদিকের ছোট দরজাটা খুলে গিয়ে ভেতরে এলেন এক পুরুষ।

ভদ্রলোক অসুস্থ মানুষের মতো আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করছেন। চুলগুলো সব সাদা, প্রায় হলুদও বলা চলে, লেপ্টে আছে কানে-কপালে। বয়স আর রোগের ভারে লোকটাকে এতটাই কাবু মনে হল যে খারাপই লাগল; আলো পড়ল চোখের উপর।

বিতৃষ্ণার ঝাঁকি খেয়েই মনে পড়ে গেল ওই চোখ জোড়া। একবার কৃষ্ণ সাগরে বাবার সাথে চার্টার করা ফিশিং বোটে গিয়েছিল বেলা। মরিশাসের দ্বীপে বাবা’র বঁড়শিতে গেঁথে যায় দানবীয় এক হাঙর। দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর তীরে তোলা হয়েছিল প্রাণীটাকে। রেইলের কাছে ঝুঁকে হাঙরের চোখ দেখেছিল বেলা। মায়া মমতাহীন কালো চোখ দুটোতে কোনো পিউপিল ছিল না। শুধু দুইটা গর্ত যেন নরকের অতল তল পর্যন্ত চলে গেছে। ঠিক সেরকম দুটো চোখ এখন তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

নিঃশ্বাস আটকে বসে রইল বেলা। অবশেষে কথা বললেন লোকটা। নিচু আর ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠস্বর শুনে কিছুটা অবাকই হলো। সামনে ঝুঁকে এলো শব্দগুলো ভালভাবে শোনার জন্য।

“ইসাবেলা কোর্টনি, এখন হতে যোগাযোগ করার জন্য এই নামটা আর কখনোই ব্যবহার করব না। তুমি নিজে এবং অন্যরাও তোমাকে সম্বোধন করবে লাল গোলাপ নামে। বুঝতে পেরেছো?”

মাথা নাড়ল বেলা। হাতে ধরা সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মেঘের মধ্য দিয়ে আবারো কথা বললেন লোকটা। জানালেন,

“তোমার জন্য একটা মেসেজ এনেছি। ভিডিও টেপ রেকর্ডিং।” এরপর মঞ্চ থেকে নেমে সারির একেবারে শেষ চেয়ারে, বেলা থেকে দূরে গিয়ে বসে পড়লেন।

মাথার উপরের বাতিগুলোর আলো কমে গেল। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের খানিকটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আলো জ্বলে উঠল পর্দায়। সাদা টাইলসের একটা রুমে দৃশ্য দেখা গেল-হতে পারে কোনো ল্যাবরেটরি কিংবা অপারেশন থিয়েটার।

 রুমের মাঝখানে একটা টেবিল টেবিলের উপর কাঁচের অ্যাকুয়ারিয়াম টাইপের ট্যাঙ্ক। উপরের কয়েক ইঞ্চি বাদে পুরো ট্যাঙ্কটাই পানিতে ভর্তি। টেবিলের উপরে ট্যাংকের পাশে একটা ইলেকট্রনিক কেবিনেট আর কিছু যন্ত্রপাতি। শুধু পোর্টেবল অক্সিজেন সিলিন্ডার আর মাস্ক দুটোকে চিনতে পারল বেলা। মাস্কুটা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে দুধের বাচ্চা কিংবা খুব ছোট ছেলে মেয়ের জন্য তৈরি।

 টেবিলে ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে এক লোক। ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পরনে সাদা ল্যাবরেটরি কোট। এবারে ক্যামেরার দিকে তাকাতেই দেখা গেল মুখে’ও সার্জিক্যোল মাস্ক পরে আছে।

পূর্ব ইউরোপীয় টানে যান্ত্রিক স্বরে কথা শুরু করল লোকটা। মনে হলো পর্দার ভেতর থেকেও সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকিয়েই কথা বলছে। “তোমাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল মালাগা কিংবা অন্য কোথাও কারো সাথে কথা না বলতে। ইচ্ছে করেই তা অমান্য করেছ।”

একদৃষ্টিতে বেলা’কে দেখছে লোকটা।

 “আমি দুঃখিত। এতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, আসতে উঠিৎ-”

“চুপ!” পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল এক নারী। কাঁধের উপর হাত দিয়ে এত জোরে চাপ দিল যে নখ বসে গেল মাংসের ভেতর।

ওদিকে পর্দায় এখনো কথা বলছে লোকটা। “তোমাকে সাবধান করা হয়েছিল যে অবাধ্যতার কারণে তোমার ছেলের পরিণাম হবে ভয়াবহ। তাই এ ধরনের অবাধ্যতা কী ধরনের পরিণাম নিয়ে আসতে পারে তার একটা নমুনা এখনি দেখতে পাবে।”

কাউকে ইশারা করতেই পর্দায় দেখা গেল এগিয়ে এসেছে আরেক জন নারী কিংবা পুরুষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কারণ শুধু চোখ দুটো ছাড়া বাকি সব ঢাকা মাস্ক আর ক্যাপ দিয়ে “ইনি একজন ডাক্তার। পুরো ব্যাপারটাই তিনি মনিটর করবেন।”

দ্বিতীয় লোকটার হাতে একটা পুটুলি দেখা যাচ্ছে। ট্যাঙ্কের পাশে টেবিলের উপর পুটুলিটা’কে রাখতেই কাপড় ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা পা। দক্ষ হাতে দ্রুত শিশ্যুটার সব কাপড় চোপড় খুলে নিল ডাক্তার। টেবিলের উপর শুয়ে শুন্যে হাত পা ছুঁড়তে লাগল নিকি।

মুখের ভেতর এক হাতের সবকটা আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে কামড়ে ধরল বেলা; নিজেকে সামলাতে চাইল যেন আবার চিৎকার করে কেঁদে না উঠে।

নিকি’র নগ্ন বুকের উপর দুটো কালো সাংশন কাপ লাগিয়ে দিল ডাক্তার। কাপের পাতলা দুটো তার নিয়ে এরপর লাগানো হলো ইলেকট্রনিক কেবিনেট। সুইচ অন্ করে দেয়ার পর প্রথম জন একঘেয়ে গলায় বলে উঠল : “বাচ্চাটার নিঃশ্বাস আর হার্টবিট রেকর্ড করা হবে।”

ডাক্তার মাথা নাড়তেই এভাবে প্রথম লোকটা গিয়ে দাঁড়াল ক্যামেরার সামনে।

“তুমি হচ্ছ লাল গোলাপ” কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে নামের উপর জোর দিল লোকটা।” ভবিষ্যতে এই নাম ধরে তোমাকে যা যা করতে বলা হবে, তুমি তাই করবে।”

এরপর নিচু হয়ে এক হাতে নিকি’র দুই গোড়ালি ধরে তুলে ফেলে, আবার জানালো, “এবারে দেখ অবাধ্যতার পরিণাম।”

নিকি’কে ধরে দোলাতে দোলাতে মাথা নিয়ে পানিতে চুবিয়ে দিল লোকটা। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল নিকি’র খিলখিল আওয়াজ। ভিডিও ক্যামেরা জুম করতেই দেখা গেল পানির নিচে ছোট্ট মাথা।

উন্মাদের মতো চিৎকার করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে চাইল ইসাবেলা। পেছন থেকে দুই নারী কাঁধ চেপে আবার ওকে জোর করে বসিয়ে দিল।

 ওদিকে পর্দার লোকটার হাতের মধ্যে যুদ্ধ করছে নিকি। নাকের থেকে উঠে আসছে রুপালি বুদবুদ। ফুলে কালো হয়ে গেল চেহারা।

তখনো সমানে চিৎকার করছে ইসাবেলা এমন সময় পর্দার মাস্ক পরিহিত ডাক্তার হার্ট মনিটরের দিকে তাকিয়েই স্প্যানিশে চিৎকার করে উঠলঃ “থামোয় যথেষ্ট হয়েছে কমরেড়!”

সাথে সাথে নিকি’কে ট্যাঙ্ক থেকে তুলে ফেলল প্রথমজন। নিকি’র নাক মুখ থেকে গলগল করে পানি বেরিয়ে এলো। বহুক্ষণ পর্যন্ত একটাও শব্দ করতে পারল না ছোট্ট শরীরটা।

এরপর ডাক্তার ওর ভেজা মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিয়ে বুকে চাপ দিল নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার জন্য। মিনিট খানেকের মধ্যে ইলেকট্রনিক মনিটরের রিড আউট নরম্যাল হয়ে গেল। নিকি আবার হাত পা ছুঁড়তে লাগল। ভয় পেয়ে মুখের মাক্স ধরে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে।

মাস্ক সরিয়ে নিয়ে টেবিলের কাছ থেকে চলে গেল ডাক্তার। প্রথম লোকটাকে মাথা নেড়ে ইশারা দিতেই আবারো নিকি’র গোড়ালি ধরে ট্যাঙ্কের উপর নিয়ে গেল লোকটা। কী ঘটবে বুঝে গেল নিকি। জোরে কেঁদে উঠে, ছুঁড়তে চাইল।

“হি ইজ মাই সন!” কেঁদে উঠল ইসাবেলা, “আপনি থামুন ওর সাথে এরকম কেন করছেন!”

 আবারো ছোট্ট মাথাটাকে পানিতে চুবিয়ে দিল প্রথম লোকটা। প্রাণপণে লড়াই করছে নিকি। আবারো রঙ হারালো ওর চেহারা।

চিৎকার করে উঠল ইসাবেল, “থামুন। যা যা বলবেন আমি সব করব, শুধু আমার ছোট্ট বাবুটাকে কষ্ট দেবেন না। প্লিজ! প্লিজ!”

আরো একবার ডাক্তারের তীঃ স্বর শুনে নিকি’কে উপরে তুলে ফেলল লোকটা। এবারে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে ছোট্ট দেহটা। বমি মেশানো পানি বেরিয়ে এলো খোলা মুখ থেকে। ফুলে যাওয়া নাক থেকে গড়িয়ে পড়ল রুপালি সিকনি।

খুব দ্রুত হাতে কাজ শুরু করল ডাক্তার। বোঝাই যাচ্ছে যে কোন কারণে ভয় পাচ্ছেন। ক্যামেরার দিকে মুখ তুলে সরাসরি ইসাবেলার দিকে তাকালো প্রথম লোকটা।

“আরেকটু হলেই হিসেবের গড়বড় হয়ে যাচ্ছিল। সেফটি লিমিট ক্রস হয়ে গেছে।” এরপর ডাক্তারসহ দু’জনে মিলে খানিক আলাপ সেরে নিলেও কিছুই বুঝল না ইসাবেলা। তারপর আবারো কথা বলে উঠল প্রথম জন, “আজ তাহলে এটুকুই থাক। আশা করছি আর কখনো দেখার প্রয়োজন পড়বে না তোমার। অ্যানেশথেসিয়া ছাড়াই বাচ্চাটার একের পর এক অঙ্গ কেটে ফেলা কিংবা ক্যামেরার সামনে গলা টিপে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না। তারপরেও সবকিছু নির্ভর করবে তোমার উপর। তুমি আমাদের সাথে কতটা সহযোগিতা করবে তার উপর।”

ঝাপসা হতে হতে খালি হয়ে, গেল পর্দা। ইসাবেলার ফোপানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেল না অন্ধকার থিয়েটারের ভেতরে। এভাবেই কেটে গেল বহুক্ষণ। এরপর আস্তে আস্তে থেমে গেল সব শব্দ। বাতি জ্বলে উঠতেই ইসাবেলা’র কাছে এলেন জোসেফ সিসেরো।

“এহেন কাজে আমরা কেউই আসলে কোনো আনন্দ খুঁজে পাইনা। তাই ভব্যিষৎতেও চেষ্টা করব যাতে পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে চলা যায়।”

“কেমন করে এটা পারলেন!” ভগ্ন হৃদয়ে বলে উঠল বেলা, “ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে কোনো মানুষ কিভাবে এমনটা করতে পারে?”

“আমি আবারো বলছি, এতে আমরা কোনো আনন্দ পাই না। তুমি নিজেই অপরাধী, লাল গোলাপ। তোমার অবাধ্যতার কারণেই কষ্ট পেয়েছে তোমার ছেলে।”

“কষ্ট! একটা অবুঝ শিশুর উপর নির্যাতন করে একে কষ্ট বলছেন…?”

 “সামলাও নিজেকে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিসেরো’র গলা।

 ‘সন্তানের খাতিরে নিজের অবাধ্যতা কমাও।”

“আমি দুঃখিত।” অপোবদনে জানাল ইসাবেলা। “আর কখনো এরকম করব না। শুধু নিকি’কে আর আঘাত করবেন না, প্লিজ।”

“তুমি যদি সহযোগিতা করো, তাহলে ওর কিচ্ছু হবে না। দক্ষ সিস্টার ওর দেখা শোনা করছেন। এতটা যত্ন পাবে যা হয়ত তুমিও দিতে পারতে না। পরবর্তীতে সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হবারও সুযোগ পাবে যা কেবল তরুণেরা স্বপ্নেই দেখে।”

 হাঁ করে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা, “এমনভাবে কথা বলছেন যেন ওকে আমার কাছ থেকে চিরতরের জন্য নিয়ে গেছেন। যেন আমি আমার সন্তানকে আ র কখনো দেখতে পারব না।”

কাশি দিয়ে মাথা নাড়লেন সিসেরো, “ব্যাপারটা তা নয়’ লাল গোলাপ। ছেলের কাছে যাবার সুযোগও তোমাকে দেয়া হবে। শুরুতে নিয়মিত সব খবর পাবে। ভিডিও রেকর্ডিং এর মাধ্যমে দেখবে ও কিভাবে বড় হয়ে উঠছে, একা একা বসতে পারে, হামাগুড়ি দিতে পারে, হাঁটতে শিখবে।”

“ওহ্! না! এভাবে তো মাসের পর মাস লেগে যাবে। এতদিন তো ওকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেন না।”

এমনভাবে কথা বলে চলল সিসেরো, যেন বেলা কিছুই বলেনি, “এরপর প্রতি বছর ওর সাথে কিছু সময় কাটাতে পারবে। এমনো হতে পারে যে তোমার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে ছেলের সাথে হলিডে কাটাবার সুযোগও দেয়া হবে-দিন এমনকি সপ্তাহ’ও কাটাতে পারবে ছেলের সঙ্গে।”

“না!” আবারো ফোঁপাতে লাগল বেলা।

“কে জানে কোন একদিন হয়ত সব বাধা তুলে নেয়া হবে। যখন তখন ছেলেকে কাছে পাবে। তবে এসব কিছুর জন্য তোমাকে অর্জন করতে হবে আমাদের বিশ্বাস আর কৃতজ্ঞতা।”

 “কে আপনারা?” আস্তে করে জানতে চাইল ইসাবেলা, “রামোন মাচাদো’ই বা কে? ভেবেছিলাম বুঝি ওকে চিনি অথচ সেটা একটু’ও সত্যি না। কোথায় রামোন? ও’ ও কি এই দানবীয় কাজের অংশ…?” গলা ধরে গেল। শেষ করতে পারল না বেলা।

“এ জাতীয় চিন্তা মাথা থেকে বের করে দাও। আর আমরা কে এর উত্তরও খুঁজতে যেও না।” সাবধান করে দিলেন সিসেরো। “রামোন মাচাদো’ও আমাদের হাতের মুঠোয়। ওর কাছ থেকে কোনো সাহায্যের আশা করো না। সন্তান তার’ও; একই নির্দেশ পালন করতে তোমার মতই বাধ্য সে।

“আমাকে কী করতে হবে?” শান্ত ভঙ্গিতে জানতে চাইল বেলা। তপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিসেরো। যাক আর কোনো সম্ভাবনা নেই যে এই মেয়ে কোনোদিন মাথা তুলবে কিংবা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। মনোবিজ্ঞানীর রিপোর্টও তাই বলে; তারপরেও ক্ষীণ যে দুশ্চিন্তা ছিল তা আজ কেটে গেল। যেভাবে তাকে বঁড়শিতে গাঁথা হয়েছে তা কখনো ছিঁড়বে না। বাচ্চাটা যদি মারাও যায়, আরেকটাকে ধরে এনে ভিডিও গেম খেলা যাবে। ওদের ইশারাতেই এখন নাচবে মেয়েটা।

 “সবার প্রথমে তোমার ডক্টরেট প্রাপ্তিতে অভিনন্দন জানাচ্ছি, লাল গোলাপ। আমাদের জন্য কাজ করতে এখন আরো সুবিধা হবে তোমার।”

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এরকম ভয়ংকর মানসিক যাতনার পর হঠাৎ করে একথা শুনে মনে হলো তাল হারিয়ে ফেলবে। যাই হোক বুঝতে পারল মন দিয়ে শুনতে হবে লোকটার কথা।

“অনুপস্থিত অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী গ্রহণের ব্যবস্থা করে যত দ্রুত সম্ভব কেপটাউন তোমার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে, বুঝতে পেরেছ?”

মাথা নাড়ল বেলা। “বাড়িতে ফিরে পারিবারিক সব কাজে আগ্রহ দেখাবে। বিশেষ করে বাবার কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলবে। সব কিছুতেই ওনার সহাযযাগিতা করব। বিশেষ করে আর্মামেন্টস করপোরেশনের হেড হিসেবে যে দায়িত্ব তিনি পালন করছেন। এর পাশাপাশি যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়বে।”

“আমার বাবা আত্মনির্ভরশীল একজন মানুষ। আমাকে উনার কোনো প্রয়োজন নেই।”

 “ভুল বলছ। তোমার বাবা খুব একা আর অসুখী একজন মানুষ। তোমার দাদীমা আর তুমি ছাড়া আর কোনো রমণীর সাথেই উনার দীর্ঘমেয়াদে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আর এই প্রয়োজন মেটাবে তুমি।”

 “আপনি চান আমি নিজের বাবাকে ব্যবহার করব?” ভীত স্বস্ত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বেলা।

“যদি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে চাও।” মোলায়েম স্বরে একমত হলেই সিসেরো। “তোমার বাবার কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু তুমি যদি সাহায্য না করো, ছেলের মুখ আর কোনোদিন দেখবে না।”

হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল ইসাবেলা।

“তার মানে বাবার কাছ থেকে তথ্য এনে আপনাকে দিতে হবে তাই তো?”

“তুমি তো বেশ তাড়াতাড়ি সবকিছু শিখে ফেলো। যাই হক, এটুকুই যথেষ্ট না। দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনালিস্ট রেজিমের ভেতর বাবার যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও গড়ে তুলবে।”

মাথা নাড়ল বেলা, “আমি তো রাজনীতির কিছুই বুঝি না।”

 “উঁহু-হু বোঝ?” বেলা’কে থামিয়ে দিলেন সিসেরো।

“পলিটিক্যাল থিওরীর উপর তোমার ডক্টরেট আছে। ক্ষমতার সিঁড়ি বাবা-ই দেখিয়ে দেবেন তোমাকে।”

 আবারো মাথা নাড়ল বেলা। “রাজনীতিতে বাবার অবস্থান তো আগের মতো শক্ত নেই। অতীতের কিছু ভুলের জন্য এখানে কূটনৈতিক হিসেবেও আসতে হয়েছে।”

“লন্ডনে যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখানোর বদলে গেছে এ চিত্র। এর প্রমাণ হল আর্মসকোর’এ এত বড় পদ পাওয়া। আমাদের ধারণা শীঘ্রিই দলেও ডাক পাবেন। জোর সম্ভাবনা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যেই কেবিনেটে আবো একবার সদস্য হবার সুযোগ পাবেন। আর তাকে কাজে লাগিয়ে, লাল গোলাপ তুমি হয়ত বছর বিশেকের মধ্যেই সরকারের মন্ত্রী হয়ে যাবে।”

“বিশ বছর!” অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠল ইসাবেলা, “এত বছর ধরে আমাকে আপনার দাস হয়ে থাকতে হবে?”

“তুমি এখনো বুঝতে পারোনি?” এবারে অবাক হলেন সিসেরো, “শোন, লাল গোলাপ, তুমি, তোমার পুত্র, রামোন মাচাদো, তোমরা সকলেই আমাদের সম্পত্তি।”

বহুক্ষণ ধরে কালো পর্দাটার দিকে দৃষ্টিহীনের মতো তাকিয়ে রইল ইসাবেলা।

অবশেষে নীরবতা ভাঙ্গলেন সিসেরো। প্রায় বিনয়ীর সুরে জানালেন, “এখন তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে। যেখান থেকে এসেছিলে, সেখানে। নির্দেশগুলো মেনে চলো। আখেরে মা-ছেলে দুজনেরই লাভ হবে।”

পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নারী ইসাবেলা’কে ধরে দাঁড় করিয়ে নিয়ে গেল দরজার দিকে।

 মেয়েরা বেরিয়ে যেতেই লেকচার থিয়েটারের পাশের দরজাটা খুলে ভেতরে এলো রামোন। “তুমি দেখেছ সবকিছু?” সিসেরোর প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল মাচাদো।

“ভালোভাবেই চলছে সবকিছু। এই অপারেশন থেকে মনে হচ্ছে বেশ লাভ হবে। বাচ্চাটা কেমন আছে?”

“একেবারে সুস্থ। নার্স ওকে নিয়ে হাভানাতে পৌঁছে গেছে।”

আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়লেন সিসেরো।

হয়ত…মনে মনে ভাবলেন, সারা জীবনের সাধনার ধন ডিপার্টমেন্টের ভার দক্ষ হাতেই দিয়ে যেতে পারব।

***

অ্যাম্বার জয় বুঝি এবার হেরেই গেল। মাঠের সবার ভেতর ছড়িয়ে গেল প্রত্যাশা আর টেনশন।

প্রশিক্ষিত কুকুর দিয়ে শিকার করা পাখি ফিরিয়ে আনার সাউথ আফ্রিকার রিট্রিভার চ্যাম্পিয়নশীপের আসর বসেছে ওয়েল্টেভেদেন এস্টেটের পশ্চিমে কাবোনকেল বার্গের পাদদেশে। দুই দিন শেষে এখন টিকে আছে অবশিষ্ট চারটি কুকুর।

এবারই হয়ত বুনো হাঁস ব্যবহার করার শেষ সুযোগ পাওয়া গেল; মনে মনে ভাবলেন শাসা কোর্টনি। এ মাসের শেষ দিক থেকেই এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে ডিপার্টমেন্ট অব নেচার কনজারভেশন। এরপর থেকে বাধ্য হয়ে তাই ঘুঘু কিংবা গিনি ফাউল ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এই পাখিগুরো পানির উপর তেমন ভাসতে পারে না।

যাই হোক আসরে মন দিলেন শাসা কোর্টনি। এবার ওয়েন্টেত্রেদেন কাপের আশার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী হল এই বিশার হলুদ ল্যাব্রাডার কুকুরটা। গত দুদিনে একবারও পরাজিত না হওয়া অ্যাম্বার জয়ের আজ ভাগ্যটাই খারাপ। খাঁচা থেকে বের হয়েই বাঁধের কিনারে উড়ে গেল বুনো হাঁস। এবারে গুলি করার দায়িত্ব গ্যারি আর শাসা কোর্টনি’র। বুনো হাঁস বাম দিকে গ্যারির নিশানায় যেতেই পরিষ্কারভাবে মেরে ফেলল গ্যারি। পাখি ভজ করে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পানিতে নেমে গেল পাখিটা।

জাজ অ্যাম্বার জয়ের নাম্বার ধরে ডাক দিতেই কুকুরটাকে পাঠিয়ে দিল মালিক বান্টি চার্লস। বাঁধের দেয়ালের কাছে ভিড় করে এলো উৎসুক জনতা। কুকুরটাকে পানির কাছে নিয়ে যেতেই সাঁতরে চলে গেল বুনো হাঁসটা যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেখানে।

কিন্তু মাঝে মাঝে পানির নিচে ডুব দিলেও প্রতিবারেই খালি চোয়াল নিয়ে ফিরে আসছে কুকুরটা। হতাশায় নাচানাচি করছে বান্টি চার্লস। কাঙিক্ষত জায়গাটা থেকে খানিকটা সরে’ও গেছে কুকুরটা। তবে হুইসল দিয়ে এটাকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনারও উপায় নেই। তাহলে পয়েন্ট হারাবে মালিক। এদিকে সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বারে বারে স্টপ ওয়াচ দেখছেন তিন বিচারক। তিন মিনিটেরও বেশি সময় ধরে পানিতে আছে অ্যাম্বার জয়।

উদ্বিগ্ন মুখে লাইনের পরবর্তী কুকুর আর মালিকের দিকে তাকালো বান্টি চার্লস। তার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ওয়েল্টেভেদেন থেকে আসা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম আর ড্যান্ডি ল্যাস। এদের চেয়ে মাত্র দশ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও এবার বুঝি আর পারল না অ্যাম্বার জয়।

ওদিকে সেনটেইন কোর্টনি নিজেও বেশ টেনশনে আছেন। মাত্র কিছুদিন আগেই যোগ দিয়েছেন এ খেলাতে; তাই বান্টির মতো ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু বেশ যত্নে গড়ে তুলেছেন ড্যান্ডি ল্যাসকে। অত্যন্ত গভীর কিংবা ঠাণ্ডা পানিও কোনো বাধাই নয় এই হিরোইনের কাছে। বাতাসের পালকের হালকা গন্ধকেও ঠিকই শুঁকে নেয় ড্যান্ডির নাক। এছাড়া সেনটেইন আর ড্যান্ডির মাঝের সম্পর্ক তো প্রায় টেলিপ্যাথির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

চুপচাপ। শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছেন সেনটেইন কোর্টনি। যা ঠিকই টের পেয়েছে ড্যান্ডি ল্যাস। মৃদু শব্দ কিংবা জোরে গর্জন, যে কোনো ক্ষেত্রেই সাথে সাথে খেলা থেকে বের করে দেয়া হবে। তাই অ্যাম্বার জয়ের নাকানি চুবানি দেখে বহুকষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে ড্যান্ডি ল্যাস। কিন্তু আগ্রহ আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তখন আসবে তার টান। কয়েক সেকেন্ড পর পরই সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে ছুটে যাওয়ার অনুমতি চাইছে।

 গান-লাইন থেকে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শাসা কোর্টনি। বরাবরের মতই প্রশংসায় মুগ্ধ হলেন শাসা। গত নিউ ইয়ারস ডে’তে সত্ত্বর পূর্ণ করা সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম এখনো দেখতে ঠিক টিন এজ ছেলেদের মত। পরিহিত উলের পোশাক ভেদ করেও ফুটে বের হচ্ছে অনিন্দ্য দেহ সৌষ্ঠব।

শাসা’র জন্মের আগেই ফ্রান্সের যুদ্ধে মারা গেছেন শাসা’র বাবা। তখন থেকেই একা হাতে ছেলেকে বড় করে তুলেছেন সেনটেইন। মরুভূমির বুকে একাকী খুঁজে পেয়েছেন প্রথম হীরা, যা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হানি খনি। ত্রিশ বছর ধরে এই খনি সামলে গড়ে তুলেছেন এক অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য যা আজকের কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। শাসা আর তার পরে গ্যারি কোর্টনি এখন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেলেও এখনো নিয়মিত বোর্ডের সভায় আসেন সেনটেইন। সকলে অত্যন্ত মনোযোগ আর শ্রদ্ধা নিয়ে মেনে চলে তার প্রতিটি বাক্য।

শাসা থেকে শুরু করে গ্যারি’র ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত সকলেই এক বাক্যে মানতে বাধ্য তার প্রতিটি আদেশ।

বয়স কেড়ে নিতে পারেনি তার সৌন্দর্য; বরঞ্চ এক অন্যরকম মহিমা। লেপন করে দিয়েছে। গর্বিত গাল, বুদ্ধিদ্বীপ্ত উন্নত কপাল। কালো জোড়া চোখ; যা এখন যদি হয় নিষ্ঠুর শিকারীর মতন, পর মুহূর্তেই তা ভরে উঠে কৌতুক আর প্রজ্ঞায়।

বিচারকদের একজন হুইসেল দিতেই অসন্তুষ্টিতে ঝুলে পড়ল বান্টি চার্লসের কাঁধ। ব্যর্থ হওয়াতে তুলে আনা হল অ্যাম্বার জয়’কে।

এরই মাঝে প্রস্তুত হয়ে গেছে ড্যান্ডি ল্যাস। আগ্রহের চোটে রীতিমতো কাঁপছে। জানে এরপর কাকে ডাকা হবে।

কুকুরটার দিকে না তাকিয়েও নিজের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে মনে হল পশুটাকে শান্ত করে রেখেছেন সেনটেইন। ইচ্ছে করে দেরি করছেন বিচারকেরা, একে অন্যের সাথে পরামর্শ করার ভান করছেন, নোট লিখছেন; আদতে ড্যান্ডি লেসের ধৈর্য পরীক্ষা করছেন। যে কোনো ধরনের শব্দ করলেই বাদ্য দিয়ে দেয়া হবে কুকুরটাকে।

বাস্টার্ড! মনে মনে ক্ষেপে উঠলেন সেনটেইন।

অবশেষে নোট বুক থেকে চোখ তুলে তাকালেন সিনিয়র জাজ।

“থ্যাঙ্ক ইউ, নাম্বার থ্রি।” জাজের চিৎকার শুনে চেঁচিয়ে উঠলেন সেনটেইন; “যা!” সোনালি বর্শার মতো করে ছুটে গেল ড্যান্ডি ল্যাস।

পানির কাছে এসে সামনের পাগুলোকে ভাজ করে লাফ দিল ড্যান্ডি। গর্বে সেনটেইন কোর্টনির বুক ভরে গেল একেই বলে চ্যাম্পিয়ন।

কিন্তু একটু পরেই ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হবার জোগাড়। অ্যাম্বার জয়ের মতো একই ভুল করতে যাচ্ছে ড্যান্ডি। হয়ত অতিরিক্ত দেরি হওয়াতেই জায়গাটা ভুলে গেছে কুকুরটা।

একবারের জন্য মনে হল হুইসল বাজিয়ে ড্যান্ডিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবেন, তাতে কিছু পয়েন্ট খোয়া গেলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু এরই মাঝে বিজয়ের ভাবনায় বিভোর সেনটেইন দাঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মতো মুখ করে।

পানির মাঝে ঘুরপাক খেতে খেতে তীরে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকাল ড্যান্ডি ল্যাস।

ইচ্ছে করেই নিজের বাম হাত’কে কোমরের কাছের পকেটে ঢোকালেন– সেনটেইন। ঈগলের মতো শ্যেন দৃষ্টিঅলা বিচারকদের কেউই বুঝতে পারল না এই ইশারা; কিন্তু শাসা’র চোখ এড়ালো না।

“এই বুড়ী আর বদলাবে না। মনে মনে হাসলেন শাসা। যুদ্ধে জেতার জন্য যে কোনো অস্ত্র ব্যবহারে প্রস্তুত।”

ওদিকে পানির মধ্যে সাথে সাথে বাম দিকে ঘুরে গেল ড্যান্ডি ল্যাস। স্রোতের বিপরীতে অত্যন্ত পরিশ্রম করে এগোতে এগোতেই গন্ধ পেয়ে নাক উঁচু করে ফেলল পশুটা। বুনো হাসের রক্তের গন্ধ পেয়েই মাথা ডুবিয়ে দিল ঠাণ্ডা বাদামি রঙা পানির ভেতরে।

অন্যদিকে তীরের দর্শকেরা হাত তালি দিয়ে উঠল। আবারো মাথা তুলল ড্যান্ডি, কান দুটো লেপ্টে গেছে মাথার সাথে, দাঁতের ফাঁকে ঝুলছে বুনো হাঁস।

তীরে উঠে একটুও গা ঝাড়া দিল না ড্যান্ডি; এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে দৌড়ে এলো ডেলিভারী পৌঁছে দিতে।

ড্যান্ডি মায়ের সামনে এসে এমনভাবে বসে গেল যে দেখে শাসা’র চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কেমন অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এই নারী আর কুকুরটার মাঝে।

 ড্যান্ডি’র মুখ থেকে বুনো হাঁসের মৃতদেহটা নিয়ে বিচারকদের কাছে। গেলেন সেনটেইন। পাখা সরিয়ে খুব সাবধানে “দাঁতের দাগ দেখা যায় কিনা খুঁজে দেখলেন বিচারকেরা। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেনটেইন, যতক্ষণ পর্যন্ত না শুনলেন, “ধন্যবাদ, নাম্বার থ্রি।”

***

সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম শুধু যে প্রতিযোগীতার জন্য ভেন্যু ঠিক করে দিয়েছেন তাই না, প্রাইজ গিভিং সেরেমনির’র হোস্টেজ’ও তিনিই।

এস্টেটের মেইন পোলো ফিল্ডের উপর পাঁচশো অতিথি বসার মতো তবু টানানো হল। ওয়েল্টে ভ্রেদেরনর রান্নাঘর থেকে এলো সুস্বাদু, মুখরোচক সব খাবার। বিজয়ীকে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দিতে রাজি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জন ভরসটার।

ভারউড কেবিনেটের একটা অংশের সদস্য থাকাকালীন, জন ভরসটারের ক্ষমতায় আরোহণের বিরোধিতা করেছিলেন শাসা কোর্টনি। ফল হিসেবে লন্ডনে চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু পুত্রের হারানো জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য নিজের দক্ষতা আর ক্ষমতা দিয়ে লড়ে গেছেন সেনটেইন। এমনকি শাসা’র আর্মসকোরের নিয়োগ প্রাপ্তির পেছনেও কাজ করেছে সেনটেইনের হার না মানা মনোভাব, অক্লান্ত পরিশ্রম আর রাজনৈতিক আর আর্থিক প্রভাব।

 ভেবে দেখেছেন, কোর্টনিদের জন্য নতুন স্বর্ণযুগের সূচনা করবে এস্টেটে জন ভরস্টারের আগমন। ক্ষমতাবানদের প্রায় প্রত্যেকেই আজ এখানে। উপস্থিত। এদের কেউই সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকম’কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবার সাহস না করলেও শাসা লন্ডনে থাকাকালীন অনেকেই বেশ শীতল আচরণ দেখিয়েছে। ভিড়ের মাঝে এদের দেখে তাই চিনে রাখলেন সেনটেইন।

কাকতালীয়ভাবে তাঁর আত্মতৃপ্তি যেন টের পেয়ে গেলেন সাউথ আফ্রিকান কেনেল ইউনিয়নের সভাপতি। মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করলেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে প্রতিযোগিতা সম্পর্কে খানিক আলোচনার পর বিজয়ীদেরকে একে একে ডাকলেন সামনে আসার জন্য। সবার শেষে টেবিলের মাঝখানে পড়ে রইল সবচেয়ে লম্বা আর সুন্দর কারুকার্য করা রুপার ট্রফিটা।

“এখন আসরের চ্যাম্পিয়নকে ডাকার সময় হয়েছে।” তাঁবু’র চারপাশে চোখ বুলিয়ে পরিবারসহ একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে তাকালেন সভাপতি।

 লেডিস অ্যাস্ত জেন্টলম্যান, আসুন সবাই, ওয়েল্টেভ্রেদেনের ড্যান্ডি ল্যাস আর মিসেস সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস’কে স্বাগত জানাই।”

ড্যান্ডি ল্যাসের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল ইসাবেলা, এবারে কুকুরটাকে এগিয়ে দিল দাদীমার দিকে। হাততালি দিয়ে উঠল সমস্ত দর্শক।

ড্যান্ডির শরীরে কোর্টনিদের পারিবারিক চিহ্ন রুপার ডায়মন্ডের নকশা করা ফিটেও ব্লাঙ্কে। সেনটেইনের সাথে সাথে এগিয়ে গেল মঞ্চের দিকে। দেখে হাসতে হাসতে হাত তালি দিল দর্শকের দল।

 মঞ্চের উপর প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে মনিবের নির্দেশে ডান পা বাড়িয়ে দিতেই হট্টগোলে ফেটে পড়ল জনতা। জন ভরসটার নিজেও খানিক নিচু হয়ে আদর করে দিলেন ড্যান্ডি ল্যাসকে।

এবারে রুপার বিশাল ট্রফিটা সেনটেইনের হাতে দিয়ে হাসলেন প্রধান মন্ত্রী। নিষ্ঠুর ক্ষমতা আর গ্রানাইটের মতো মনোবলের অধিকারী বিখ্যাত মানুষটার বালক সুলভ হাসির সাথে ঝিলিক দিয়ে উঠল তাঁর নীল চোখ জোড়া।

 সেনটেইনের সাথে হ্যান্ডশেক করার সময় খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, “এরকম নিরবচ্ছিন্ন সফলতা তোমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে না সেনটেইন?”

“আমরা বরঞ্চ একে টিকিয়েই রাখতে চাই, আংকেল জন।” নিশ্চয়তা দিলেন সেনটেইন।

এরপর সেনটেইনকে অভর্থনা জানিয়ে খানিক বক্তৃতা দিয়ে তাঁবুর নিচে ঘুরে ঘুরে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর এগিয়ে গেলেন একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সেনটেইনের দিকে।

“তোমার বিজয় উদ্যাপনের জন্য আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারলে ভালই লাগত, সেনটেইন।” হাতঘড়ির দিকে তাকালেন প্রধানমন্ত্রী।

 “এরই মাঝে আপনি আমাদেরকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, কিন্তু যাবার আগে আমার নাতনীর সাথে দেখা করবেন না?” কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ইসাবেলাকে ডাকলেন সেনটেইন। “শাসা লন্ডনে থাকাকালীন হোস্টেজের দায়িত্ব পালন করেছে আমার নাতনী ইসাবেলা।”

ইসাবেলা সামনে এগিয়ে আসতেই প্রধানমন্ত্রীর বুলডগ মার্কা চেহারাটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেন সেনটেইন। জানেন ত্রিশ বছর ধরে সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করলেও ইসাবেলা কোর্টনি’কে দেখে স্থির থাকতে পারবেন না। কোনো পুরুষ। চোখে আগ্রহ ফুটে উঠলেও কেমন করে ভ্রুকুটি করে তা আড়াল করলেন প্রধানমন্ত্রী, এর সবই দেখলেন সেনটেইন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার ইসাবেলা’র আগ্রহটা হঠাৎ হলেও মুগ্ধ হয়েছেন শাসা আর সেনটেইন। আর তারপরই নাতনীকে সাথে নিয়ে খুব সাবধানে এই মিটিং এর প্ল্যান করেছেন।

“ও ঠিকই পারবে।” শাসার ভবিষ্যৎ বাণী শুনেও মাথা নেড়েছিলেন সেনটেইন।

“বেলা অনেক বদলে গেছে। তোমার সাথে লন্ডনে যাবার পরেই কিছু একটা হয়েছে নয়ত যে মেয়েটা আগে ছিল বখে যাওয়া আর

“ওহ্! মা মেয়ের স্বপক্ষে বলতে চাইলেন শাসা।

“কিন্তু ফিরে এসেছে এক পরিণত নারী। তার চেয়েও বেশি। কেমন ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে গেছে। কিছু একটা নিশ্চিত ঘটেছে।” দ্বিধায় পড়ে গেলেন সেনটেইন। “জীবন নিয়ে এখন আর রোমান্টিক কিছুভাবে না; ঠিক যেন ভয়ংকর কোনো আঘাত পেয়ে ঘৃণা করা শিখে গেছে। সংকটে পড়ে জেনে গেছে নিজের কঠিন ভবিষৎ।”

 “তুমি তো কখনো এমন উদ্ভট সব কল্পনায় বিশ্বাস করতে না।” মাকে থামাতে চাইলেন শাসা।

“আমার কথা মনে রেখো, বেলা নিজের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলেছে আর আমাদের মতই শক্ত আর নির্দয় হয়েই নিজেকে প্রমাণ করে দেখাবে।”

“তোমার মতো এত বজ্রকঠিন নয় নিশ্চয়ই?”

“মাকে নিয়ে মজা করলেন শাসা।”

“সময় হলে দেখবে আমার কথাই সত্যি হয়েছে শাসা কোর্টনি। নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলেন সেনটেইন। মায়ের এই আত্মপ্রত্যয় ভালোই চেনেন শাসা। “ও অনেক দূর যাবে শাসা-এতটা, যতটা হয়ত তুমি আর আমি কেবল স্বপ্নই দেখেছি। যাই হোক, আমি আমার সাধ্যমতো ওকে সাহায্য করব।”

আর এখন নাতনীর মাঝে সেই ঋজুতাই দেখতে পেলেন সেনটেইন।

“তো ইংল্যান্ডের শীতকাল কেমন লাগল তোমার?” ইসাবেলার কাছে জানতে চাইলেন ভরসটার। মনে মনে আশা করলেন চপল কোনো উত্তর শুনবেন। কিন্তু চমককৃত হয়ে গেলেন বেলার জবাব শুনে বুঝতে পারলেন এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে অদম্য মেধা। গলার স্বর নামিয়ে খানিক আলোচনা সেরে নিলেন বেলার সাথে। এরপর আবারো তাগাদা নিলেন সেনটেইন, “এই তো কদিন আগে মাত্র লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল থিওরীর উপরে ডক্টরেট করেছে ইসাবেলা।”

 “ওহ! তাই নাকি। তো আমাদের মাঝে আরেকজন হেলেন সুজমান আসছেন!” মাথা নেড়ে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্টের একমাত্র নারী সদস্যের কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী।

হেসে ফেলল ইসাবেলা। তার সেই বিখ্যাত যৌনাবেদনময়ী হাসি। যা দেখে সবচেয়ে কঠিন নারী বিদ্বেষী’ও টলে উঠতে বাধ্য।

“সম্ভবত। হাউজে একটা আসন পাওয়া আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেও হতে পারে। কিন্তু সে তো এখনো বহু দূর। তাছাড়া আমার বাবা আর দাদীমা’র নীতিতেই বিশ্বাসী আমি, প্রধানমন্ত্রী। তার মানে মেয়েটা কনজারভেটিভ! এবারে আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ভরসটারের নীল চোখ।

 “দুনিয়া বদলাচ্ছে। মিঃ প্রাইম মিনিস্টার। কোনো একদিন হয়ত আপনার কেবিনেট মেম্বারও হবে নারী, তাই না?” আলতো করে আগুনে ঘি ঢাললেন সেনটেইন।

হেসে ফেললেন ভরসটার। দ্রুত আবার ইংরেজ থেকে আফ্রিকান হয়ে গেলেন।

“ডক্টর কোর্টনি নিজেও সে দিন’কে বহু দূর হিসেবে ভাবছে। যাই হোক আমাদের মতো বুড়োদের ভিড়ে এমন সুন্দর মুখ দেখতে খারাপ লাগবে না।”

 ভাষার এই পরিবর্তন অনেকটা ইচ্ছাকত। কেননা আফ্রিকান ভাষা জানা ব্যতীত রাজনৈতিক উচ্ছাকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভবই বলা চলে।

কিন্তু এই পরীক্ষাও উৎরে গেল ইসাবেলা। ওর নিখুঁত ব্যাকরণ, শব্দ ভাণ্ডার আর সুললিত কণ্ঠস্বর শুনে যে কেউ মুগ্ধ হবে।

এবারে আনন্দ নিয়েই হাসলেন ভরসটার। আরো খানিক কথা বলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেনটেইনকে জানালেন, “এবারে আমাকে যেতে হবে। আরেকটা ফাংশন আছে।”

তারপর ইসাবেলাকে বললেন, ‘আবার দেখা হবে ডা. কোর্টনি।

গাড়ি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে এগিয়ে দিলেন শাসা আর সেনটেইন।

ফিরে আসতেই দেখা গেল ইসাবেলার চারপাশে পুরুষদের ভিড় জমে গেছে।

“দেখ কাণ্ড! বেলাকে দেখে সবকটা কুকুর ছানার মতো হাপাচ্ছে। মনে মনে হাসি চেপে নাতনীর দিকে তাকালেন সেনটেইন। সাথে সাথে দাদীর দিকে এগিয়ে এলো ইসাবেলা। আদর করে ওর হাত ধরলেন সেনটেইন। “ওয়েল ডান, বাছা, আংকেল জন তো খুবই খুশি। আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কী বল?

***

ওয়েল্টেভ্রেদেনের মেইন ডাইনিং রুমের লম্বা টেবিলটাতে ডিনার করতে বসেছে পুরো কোর্টনি পরিবার। চারপাশ সুরভিত করে রেখেছে মোমাবাতি আর একগাদা হলুদ গোলাপ।

এহেন পারিবারিক সন্ধ্যায় সরাচর যা হয়, পুরুষেরা কালো টাই আর নারীরা লম্বা ড্রেস পরে এসেছে।

 শুধু শন্ অনুপস্থিত। শ’কেও ডেকেছিলেন সেনটেইন; কিন্তু শিকার অভিযানে ক্লায়েন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অপারগতা জানিয়েছে শন।

জ্যেষ্ঠ পৌত্রকে বেশ মিস করছেন সেনটেইন। তিন ভাইয়ের মধ্যে শন হচ্ছে সবচেয়ে সুদর্শন আর স্বভাবে’ও বন্য। নিজের চারপাশে সবর্দা বিপদ আর উত্তেজনার বাতাবরণ তৈরি করে রাখে শন্। আর এ কারণে মাঝে মাঝেই শত শত ডলার গুণতে হয় কোর্টনি পরিবারকে। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ না করলেও সেনটেইনের একমাত্র চিন্তা কবে না ছেলেটা এমন এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে যে, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া সত্যিই কঠিন হবে। যাই হোক জোর মাথা থেকে এ জাতীয় চিন্তা সরিয়ে দিলেন সেনটেইন।

আজ রাত শুধুই আনন্দের।

লম্বা টেবিলটার একেবারে মাঝখানে আলো ছড়াচ্ছে রুপার ট্রফি। অজস্র ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রমের যথার্থ ফসল এই ট্রথি।

টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা শাসা রুপার চামচ দিয়ে ক্রিস্টালের গ্লাসে টুং টাং করে ভাঙ্গলের নীরবতা। স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন বক্তৃতা-এতটা সহজ আর বুদ্ধিদ্বীপ্ত, কৌতুকে ভরা থাকে এ অংশ যে ক্ষণিকের মধ্যেই হাসির হল্লার সাথে সাথে গভীর চিন্তা করতেও বাধ্য হয় সকলে।

পুত্রের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে অন্যদের দিকে তাকালেন সেনটেইন।

ডান দিকে বসে আছে কোর্টনি সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, গ্যারি। ছোটবেলায় মায়োপিয়া আর প্যাজমা’তে ভুগতে থাকা ছেলেটা তার কিংবা অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই আত্মবিশ্বাসের জোরে আজ কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান হয়ে গেছে। বহন করে চলেছে পারিবারিক সৌভাগ্যের বিশাল দায়িত্ব। মাথার উপর মুরগির ঝুরির মতো চূড়া হয়ে আছে কালো ঘন চুল। মোমবাতির আলোতে চমকাচ্ছে চোখের চশমা। গ্যারির সাথে হাসছে পুরো ডাইনিং রুম।

এরপর ওর স্ত্রীর দিকে নজর দিলেন সেনটেইন। টেবিলের ওদিকে শাসার পাশে বসে আছে হোলি। গ্যারি’র চেয়ে না হলেও প্রায় দশ বছরের বড়। এই বিয়ে আটকানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন সেনটেইন। কিন্তু সফল হতে পারেন নি। এখন স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তখন ভুল করেছিলেন। নয়ত এখন মেয়েটাকে আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কেননা গ্যারির স্ত্রী হিসেবে নিজেকে পারফেক্ট প্রমাণ করেছে হোলি।

সেনটেইন কিংবা অন্য কেউ যা পারেনি, গ্যারি’র সেসব গুণ’কে যথাযথভাবে মর্যাদা গিয়েছে হোলি আর সেগুলো বিকশিত হতে সাহায্যও করেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে গ্যারির সফলতার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ওর স্ত্রী। পত্নীর সাহস। সহযোগিতা আর ভালোবাসা পেয়ে তিন পুত্র আর এক কন্যার জনক হয়েছে গ্যারি।

কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হেড অফিস, স্টক একচেঞ্জ সবই জোহানেস বার্গে হওয়াতে পরিবারসহ সেখানেই থাকে গ্যারি। কিন্তু সেনটেইনের ধারণা হোলিই তাদেরকে উনার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। গ্যারি’র মতো করে সন্তানদেরকেও নিজের ছত্রছায়ায় রেখে গাইড করতে চান সেনটেইন। তাই বুঝতে পারলেন পার হতে হবে হোলি নামাক বৈতরুণী। লম্বা টেবিলের ওপাশে বসে থাকা হোলি’র দিকে তাকিয়ে হাসলেন উষ্ণতা,মেশানো প্রশ্রয়ের হাসি। নীল আর বেগুনি দু’চোখে দুই রঙ নিয়ে হাসি ফিরিয়ে দিল হোলি।

এই ফাঁকে শাসা কিছু একটা বলে ফেললেন যা শোনেননি সেনটেইন। হঠাৎ করেই প্রত্যেকে তার দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়া শুরু করল। হাসি মুখে প্রশংসা হজম করে নিলেন সেনটেইন; আবারো কথা বলতে লাগলেন শাসা।

মায়ের সকল গুণ আর পূর্ব বীরত্বের সাত কাহন শোনাতে লাগলেন। বাকিরাও বহুবার শোনা কাহিনী এত মনোযোগ দিয়ে শুনছে যেন আগে আর জানত না।

আর এসব কিছুর ভিড়ে উশখুশ করছে কেবল একজন।

সেনটেইনের আত্মতৃপ্তির মাঝে বিরক্তি উৎপাদন করার সাহস কেবল একজনেরই আছে। নাতী-নাতনীদের মাঝে এই একজনের প্রতিই তেমন কোনো টান অনুভব করেন না সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস। ছেলেটার চরিত্রের এমন কিছু গভীরতা, এমন গোপনীয় কয়েকটা দিক আছে যা তিনি আজও ঠাওর করতে পারেননি। বিরক্তি তাই বেড়েই যাচ্ছে দিনকে দিন।

তারা’র কাছ থেকে মাইকেলকে সরিয়ে রাখতে ব্যর্থ হওয়াটাও এর আরেকটা কারণ। তারা-ওই মার্কসিস্ট, বিপথগামী, বিশ্বাসঘাতকটার নাম মনে আসার সাথে সাথে পেটের মাঝে পাক খেয়ে উঠল ঘৃণা।

 এতটাই তীব্র যে হঠাৎ করেই চোখ তুলে দাদী’র দিকে তাকালো মাইকেল আর সেনটেইনের কালো চোখ জোড়াতে তীব্র ঘৃণা টের পেয়ে সাথে সাথে প্রায় অপরাধীর ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নিল।

সেনটেইনের নিষেধ সত্ত্বেও পুত্রের পছন্দের পেশায় তাকে প্রতিষ্ঠা লাভে সাহায্য করার জন্য গোল্ডেন সিটি মেইলে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছেন শাসা। যাই হোক মাত্র ডেপুটি এডিটর অব্দি পৌঁছেছে মাইকেল। শাসা’র কনজারভেটিভ মতাদর্শের কেবল বাম দিকেই ঘেষছে। তাই সরকারই শুধু নয় বরঞ্চ শিল্পপতিরাও এর পিছনে লেগেছে। এর আগে তিন বার নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়াতে মেইলের আর্থিক লোকসান নিয়ে গ্যারি আর সম্মান হারিয়ে বেজায় ক্ষেপে আছেন সেনটেইন।

মাইকেলের সুন্দর মুখখানা দেখে তিক্ত স্বাদ এলো মনের ভেতর। ভাবলেন এই ছেলে আসলে সত্যিকারের কোর্টনি নয়।

আগন্তুক আর পরাজিতদের জন্য মাইকেলের দরদ দেখে তাই ক্ষুব্ধ সেনটেইন। কত বড় সাহস যে বেলাকেও দলে ভেড়াতে চায়। দু’ ভাইবোনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একত্রে বণর্বাদের র‍্যালিতে যাবার কথা ভালই জানেন সেনটেইন।

ভাগ্য ভালো যে সময় মতো সব সামলাতে পেরেছেন। লোথার ডি লা রে’র সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পর সাউথ আফ্রিকান ইন্টেলিজেন্সের জন্য আন্ডারকাভার হিসেবে কিছু কাছ করেছিল বেলা। সেই লোথার এখন সংসদের সদস্য আর ল’ অ্যান্ড অর্ডার মিনিস্ট্রির ডেপুটি মিনিস্টার।

ব্যক্তিগতভাবে লোথারকে ডেকে পাঠিয়েছেন সেনটেইন। তাকে আশ্বস্তও করেছে ছেলেটা; জানিয়েছে, “র্যালিতে ওর উপস্থিতির স্বপক্ষে সবকিছু লিখে রাখব ইসাবেলা’র ফাইলে। ওতো আগেও আমাদের জন্য কাজ করেছে। কিন্তু মাইকেলের ব্যাপারে কিছু প্রমিজ করতে পারব না। এরই মাঝে ওর ফাইলে বহু কালো দাগ জমে গেছে।

অবশেষে শেষ করেছেন শাসা। সকলে আবার উৎসুক ভঙ্গিতে তাকাল সেনটেইনের দিকে। বক্তা হিসেবে পুত্রের চেয়েও এক কাঠি সরেস হলেও আজ সকলে আশা হত হল সেনটেইনের কথা শুনে।

সরাসরি নিজের দর্শন তুলে ধরার চেয়ে অন্যদের প্রশংসাই আজ বেশি করে করলেন। গ্যারি’র আর্থিক সাফল্য, ইসাবেলা’র অ্যাকাডেমিক অর্জন, জুলুল্যান্ডের উপকূলে কোর্টনি লাক্সারী হোটেলের জন্য হোলিসহ সকলেই দাদীমা’র প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল। এমনকি মাইকেল’ও বাদ গেল না। নতুন বই প্রকাশের জন্য তাকেও বাহবা দিলেন সেনটেইন।

এরপর সকলকেই উঠে দাঁড়িয়ে পরিবারের সাফল্য কামনা করে টোস্ট করার আদেশ দিতেই বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ালো প্রত্যেকে। শাসা এসে মা’র হাত ধরে নিয়ে গেলেন ড্রইং রুমে।

ইসাবেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তাড়াতাড়ি ওর পাশে চলে এলো মাইকেল। বোনের হাত ধরে জানালো, তোমাকে অনেক মিস্ করেছি বেলা। আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন? রামোন আর নিকি, বেলা’র অভিব্যক্তি বদলে যেতেই সচকিত হলো মাইকেল।

“কিছু হয়েছে?”

“এখন না, নিকি” তাড়াতাড়ি ভাইকে সাবধান করে দিল বেলা। নিকি চলে যাবার পর প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে এই প্রথম কথা বলছে দু’জনে। আজ সকালে ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর পর থেকেও মাইকেলকে এড়িয়ে চলছে বেলা।

“নিশ্চয় কিছু হয়েছে, আমাকে বলছ না।” চাপ দিল মাইকেল।

“চুপ! মুখ হাসি হাসি করে রাখো! কোনো ঝামেলা করো না। আমি পরে তোমার রুমে আসব।” ভাইয়ের হাতে চাপ দিয়ে দুজনে মিলে হাসতে হাসতে ড্রয়িং রুমে চলে গেল বেলা আর মাইকেল।

 প্রথাগতভাবে ফায়ার প্লেসের দিকে মুখ করে রাখা লম্বা সোফাটাতে বসলেন সেনটেইন।

 “আজ রাতে আমার সাথে মেয়েরা বসবে।” ঘোষণা করলেন কোর্টনি সম্রাজ্ঞী। হোলিকে ডেকে নিজের পাশে বসিয়ে আরেক পাশে বসার জন্য ডাকলেন বেলাকে।

 যুক্তি ছাড়া খুব কমই কোনো কাজ করেন সেনটেইন। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পরিচারকেরা কফি দিয়ে যাবার পর বের করলেন নিজের তুরুপের তাস।

 “আমি অনেক দিন ধরেই এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম হোলি।” সকলে মনোযোগ দিল এদিকে। “আর এর জন্য তোমার জন্মদিনের চেয়ে আর ভালো কিইবা হতে পারে। নিজের গলা থেকে হাজার ক্যারেটের চেয়ে বেশি নিখুঁত হলুদ হীরের হার খুলে হোলি’র দিকে তাকালেন; কালো চোখে দেখা গেল সত্যিকারের অশ্রু বিন্দু। “এত চমৎকার একটা হার অসম্ভব সুন্দরী কারো গলাতেই কেবল শোভা পাবার যোগ্য।” মূর্তির মতো বসে থাকা হোলির গলায় হার পরিয়ে দিলেন সেনটেইন। দশ বছর ধরে একটা একটা করে পছন্দের হীরে জমিয়ে, লন্ডনের গ্যারাজ থেকে প্লাটিনাম আর নকশার পর সৃষ্টি করেছেন এই অসাধারণ অলংকার।

বিস্ময়ে থ বনে গেল সকলে। সবাই জানে সেনটেইনের কাছে এই নেকলেসের কতটা গুরুত্ব আছে।

ডান হাত দিয়ে নিজের গলায় বসে থাকা নেকলেসটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না হোলি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সেনটেইনের দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরল দাদী শ্বাশুড়িকে। একে অন্যকে ধরে বসে রইল দুই নারী, এরপর আস্তে করে হোলিই প্রথম কথা বলল,

“ধন্যবাদ, নানা।” সেনটেইনের একেবারে কাছের মানুষেরাই কেবল এতদিন এ নামে সমোধন করত; হোলি এর আগে কখনোই এই ডাক ব্যবহার না করাতে সেনটেইন চোখ বন্ধ করে হোলি’র সোনালি চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। কেউই তাই তার চোখে সন্তুষ্টির আভা আর ঠোঁটে বিজয়ীর হাসিটা দেখতে পেল না।

***

ইসাবেলা’র স্যুইটে অপেক্ষা করছে ন্যানি।

 “একটা’র বেশি বাজে। আমি তো বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করো না

বুড়ি!” চিৎকার করে উঠল বেলা।

“পঁচিশ বছর ধরেই তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। কাছে এসে বেলার ড্রেস খুলে দিল ন্যানি।

“আমার একটুও ভাল লাগে না।”

“আমার তো লাগে। তোমাকে নিজ হাতে গোসল না করানো পর্যন্ত আমার একটুও শান্তি হয় না।”

“এখন! রাত একটায় গোসল!” ফেরার পর থেকে ন্যানি’র সামনে কখনোই নিজেকে নিরাভরণ করেনি বেলা। কিন্তু এই বুড়ির ঈগলের মতো চোখ এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। সন্তান ধারণের যে কোনো তুচ্ছ চিহ্নও এই শকুনির চোখ এড়াবে না।

বুঝতে পারল ওর আচরণে ন্যানি সন্দেহ করছে। তাই কাটাবার জন্য বলে উঠল, “এখন তুমি যাও তো ন্যানি, গিয়ে বস্মি’র বিছানা গরম করো।”

শোকের চোটে বধির হয়ে গেল ন্যানি, “কে তোমাকে এসব বলে?”

“ওয়েল্টেভ্রেদেনে কী হচ্ছে না হচ্ছে তুমি একাই সেসব খবর রাখো না, বুঝলে? ভালোভাবেই জানি বম্মি বুড়াটা তোমার পেছনে লেগে আছে আর তুমি’ও তাকে নিয়ে খেলছ।”

“হু, হু, ভদ্র মেয়েরা এসব আজে-বাজে কথা বলে না। “ দরজার দিকে যেতে যেতে বলে উঠল ন্যানি আর স্বস্তির শ্বাস ফেলল বেলা।

দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে মেক-আপ তুলে সিল্কের বাথরোব পরে নিল। রোবের বেল্ট লাগাতে লাগাতে হাত রাখল দরজার হ্যান্ডেলে।

“মিকি’কে আমি কী বলব?” তিনদিন আগে হলেও উত্তরটা নিয়ে এত ভাবতে হত না; কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। প্যাকেটটা এসে গেছে। লন্ডন ছাড়ার আগের দিন জো সিসেরোর সাথে শেষ কথা হয়েছিল।

“লাল গোলাপ, তোমাকে তোমার কনট্যাক্ট এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। শুধু এমারজেন্সি হলেই ব্যবহার করবে। হফম্যান,

C/o ম্যাসন এজেন্সি, ১০ ব্লাশিং লেন, সোহো। মুখস্থ করে নাও কোথাও লিখে রেখো না।”

 “ঠিক আছে।” ফ্যাসফ্যাসে গলাটা শুনে সবসময় আতঙ্কে জমে যায় বেলা।

“বাড়িতে ফিরে ওয়েল্টেলেদেন থেকে দূরে ছদ্মনামে একটা পোস্ট অফিস বক্স খুলবে। তারপর লোহোর ঠিকানায় আমাকে নাম্বার পাঠিয়ে দেবে ঠিক আছে?”

 ওয়েল্টেভ্রেদেনে পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই ক্যাম্পস বে’তে এলে গিয়েছিল গাড়ি চালিয়ে। বহু দূরে হওয়াতে স্টাফরা কেউই তাকে চেনেনি। মিসেস রোজ কোহেন নামে বক্স ভাড়া করে সিসেরোকে নাম্বার পাঠিয়ে দিয়েছে।

মধ্য কেপ টাউনের নিজের অফিস সেনটেইন হাউজ থেকে ফেরার সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্স চেক্ করে আসে বেলা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাক্সটা খালি পড়ে থাকলেও রুটিনের একটুও নড়চড় হয় না।

নিকি’র কোনো খবর না পেয়ে ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছে বেলা। প্রতিদিনের জীবনে মনে হচ্ছে কেবল অভিনয় করে যাচ্ছে। যদিও নিজের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে শাসার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে তারপরেও যতটা ভেবে ছিল ততটা লাঘব হচ্ছে না এ যন্ত্রণার ভার।

হেসে, খেলে, নানা আর পুরনো বন্ধুদের সাথে দিন কাটালেও কিছুতেই কাটতে চায় না একাকী দীর্ঘ রাত। একেক বার মাঝরাতে মনে হয় বাবার কাছে গিয়ে সব খুলে বলে; কিন্তু দিনের বেলা মনে পড়ে : “বাবা’ই বা কি করতে পারবে? আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না।” মনে পড়ে যায় পানির নিচে নিকি’র নাক থেকে বেরিয়ে আসা রুপালি বুদবুদগুলোর কথা। আর অদ্ভুত ব্যাপার হলো সময়ের সাথে সাথে আরো বেড়ে যাচ্ছে এই বেদনা মনে হচ্ছে সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

আর এরপরই শুনতে পেল যে মাইকেল জোহানেসবার্গ থেকে ওয়েন্ট্রেদ্রেদেন আসছে। একমাত্র ওর সাথেই সবকিছু শেয়ার করতে পারবে বেলা। জানে মিকি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

মাইকেলের আসার আগের শুক্রবারে আবারো ক্যাম্পস বে’তে বক্স চেক করতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় ছয়টা বেজে যাওয়াতে পোস্ট অফিসের মেইন বিল্ডিং ছুটি হয়ে গিয়েছিল। এক জোড়া টিন এজার হলে থাকলেও ইসাবেলাকে দেখে অপরাধীর ভঙ্গিতে দূরে সরে গিয়েছে ছেলে-মেয়ে দুটো। যাই হোক, কখনো কারো সামনে নিজের বক্স খোলে না বেলা।

পঞ্চম সারির নিজের বক্সের ছোট্ট স্টিলের দরজার তালাতে চাবি ঢুকাতেই কেঁপে উঠল সারা শরীর।

 সবসময়কার মতো এবারেও খালিই দেখবে ভেবেছিল। নিঃশ্বাস আটকে মরে যাবার জোগাড় হলো।

মোটা বাদামি খামটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই কাঁধের ঝোলা ব্যাগে রেখে দিল বেলা। আর তারপর প্রায় চোরের মতো করে হেঁটে হেঁটে চলে এলো পার্ক করে রাখা মিনির কাছে। হাত এতত কাঁপছে যে গাড়ির দরজাও খুলতে পারছে না।

পাম গাছের সারির নিচে সৈকতের উপরে পার্ক করল গাড়ি। এই সময়ে বী প্রায় পুরোটাই খালি।

গাড়ির সব জানালা নামিয়ে দরজাগুলো লক করে বাদামি খামটাকে বের করে কোলের উপর রাখল বেলা।

ট্রাফালগার স্কোয়ার পোস্ট অফিসের স্ট্যাম্প লাগানো খামটা খুলতেও যেন ভয় হচ্ছে। না জানি ভেতরে কী আছে! ফিরতি ঠিকানার জায়গায় কিছুই লেখা নেই। দেরি করার জন্যই ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে পেননাইফ বের করে চোখা মাথা দিয়ে খুলে ফেলল খামের মুখ।

 রঙিন একটা ছবি গড়িয়ে পড়তেই কেঁপে উঠল বুক। নিকি!

একটা বাগানের লনে নীল ব্লাঙ্কেটের উপর শুধু একটা ন্যাপকিন গায়ে দিয়ে বসে আছে নিকি! কারো সাহায্য ছাড়াই বসে আছে, বয়স প্রায় সাত মাস হয়ে গেছে। ফোলা ফোলা গাল, লম্বা ঘন কালো-কোকড়া চুল, এমেরাল্ডের মতো সবুজ চোখ জোড়া নিয়ে হাসছে নিকি। “ওহ্ ঈশ্বর! কী সুন্দর হয়েছে দেখতে!” আলোর সামনে ছবিটাকে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখল বেলা, “এত বড় হয়ে গেছে যে একা একাই বসতে পারে, আমার ছোট্ট বাবাটা?”

ছবিটার উপর হাত বুলাতেই মনে হলো আঙুলের ছাপ পড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাই কাপড় দিয়ে মুছে ফেলল।

ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল বুকের ভেতর, “ওহ মাই বেবি!”

আটলান্টিকের দিগন্তে পাল্টে যেতে বসেছে সূর্য। নিজেকে বহুকষ্টে সামলালো বেলা। ছবিটাকে খামের ভেতরে ঢুকাতে গিয়ে দেখল বাকি কাগজগুলোকে।

প্রথমটা থেকে বোঝা গেল কোনো শিশু ক্লিনিকের মেডিকেল রেজিস্টার কপি’র ফটোকপি। নাম আর ঠিকানা গাঢ় কালি দিয়ে ঢেকে রেখে শুধু নিকি’র নাম, ডেথ অব বার্থ আর ক্লিনিকে উইকলি ভিজিটের রেকর্ড লেখা আছে। জানা গেল চার মাসের সময় নিক্রির প্রথম দুটো দাঁত দেখা গেছে আর ওজন প্রায় ষোল কিলো।

ভাঁজ করা দ্বিতীয় কাগজটা খুলতেই চিনতে পেল আদ্রা’র গোটা গোটা হাতের লেখা।

সিনোরিটা বেলা,
দিনকে দিন নিকি বেশ শক্ত-পোক্ত আর বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে। আর রাগ তো একেবারে ক্ষাপা মোষের মত। আর আমি যত জোরে দৌড়াতে পারি নিকি ঠিক ততটা গতিতে হাত আর হাঁটু দিয়ে হামাগুড়ি দেয়; হয়ত কিছু দিনের মাঝেই হাঁটতে শুরু করবে।
ওর মুখের প্রথম কথা ছিল “মাম্মা”; আপনি কত সুন্দর, প্রতিদিন আমি ওকে সেই গল্প শোনাই; এও বলি যে একদিন ঠিকই ওর কাছে আসবেন। এখন হয়তো বুঝতে পারে না, তবে ভবিষ্যতে বুঝবে।
আপনার কথা প্রায় মনে হয়, সিনোরিটা। বিশ্বাস করুন, আমি নিজের জীবন দিয়েই নিকি’র সেবা-যত্ন করব। প্লিজ, এমন কিছু করবেন না। যা ও’কে বিপদে ফেলবে।
বিশ্বস্ত
আদ্রা অলিভারেস

শেষ লাইনটা পড়ে যেন বুকের হাড়ে ছুরির খোঁচা খেল বেলা। বুঝে গেল কাউকে বলা যাবে না ওর কষ্ট, বাবা, নানা কিংবা মাইকেল, কাউকে না।

আবারো দ্বিধা ভরে নিজ বেডরুমের হাতলে হাত রাখল বেলা। “তোমাকে মিথ্যে বলার জন্য দুঃখিত মিকি। হয়ত কোনদিন সত্যিটা জানাতে পারব।”

এত বড় বাড়িটা একেবারে ভূতের বাড়ির মতই নিঝুম হয়ে আছে। পারশিয়ান কার্পেটের উপর দিয়ে খালি পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে এলো বেলা। রুমে ঢুকতেই দেখল বিছানায় বসে বই পড়ছে মাইকেল। বোনকে দেখে বেড় সাইড টেবিলে বই রেখে চাদর সরিয়ে দিল বসার জন্য

 ভাইয়ের পাশে উঠে বসল বেলা। কিছু একটা টের পেল মাইকেল। জানতে চাইল, “আমাকে বলল, বেলা।

আদ্রা’র সাবধান বাণী মনে পড়া সত্ত্বেও নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না ইসাবেলা। রামোন আর নিকি’র অস্তিত্ব তো মাইকেল জানে। ইচ্ছে হচ্ছে ভাইকে সব খুলে বলতে।

কিন্তু ভিডিওতে দেখা নিকি’র মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চুপসে গেল বেলা। ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে কেবল জানালো, “নিকি মারা গেছে।”

সাথে সাথে কোনো উত্তর দিল না মাইকেল।

“সত্যি।” মনে মনে নিজেকে বোঝাল বেলা, “নিকি আমাদের মাঝে আর নেই।” কিন্তু কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই এমনটা করছে বেলা।

“কিভাবে?” মাইকেলের প্রশ্নটা তো প্রথমে বুঝতেই পারল না।

“খাওয়াতে গিয়ে দেখি যে ঠাণ্ডা হয়ে আছে।”

বোনের দিকে তাকিয়ে কেঁপে উঠল মাইকেল, “ওহ্ ঈশ্বর! কী বলছ বেলা? কী ভয়ংকর!”

বাস্তবটা তার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর আর ভয়ংকর; কিন্তু মাইকেলকে তা বলার কোনো উপায় নেই।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কেটে যাবার পর মাইকেল আবারো জানতে চাইল, “রামোন? ও কোথায়? ওর তো এখন তোমার পাশে থাকার কথা ছিল।”

“রামোন” নামটা আউরাতে গিয়ে কণ্ঠের ভয় লুকাতে চাইল বেলা।” নিকি চলে যাবার পর রামোন পুরোপুরি বদলে যায়। আমাকেই দোষারোপ করে সবকিছুর জন্য। নিকি’র সাথে সাথে আমার জন্য ওর ভালোবাসাও মরে গেছে।” বহুদিন ধরে জমিয়ে রাখা কান্না এবারে বেরিয়ে এলো অঝোর ধারায়। “নিকি নেই, রামোন নেই। আমি আর কোনোদিন ওদেরকে দেখব না।”

 বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিকি। এরকম একটা নির্ভার আশ্রয়ই প্রয়োজন ছিল।

 বহুক্ষণ বাদে কথা বলতে পারল মাইকেল। ভালোবাসার, যন্ত্রণা, আশা; একাকীত্ব আর সবশেষে মৃত্যু নিয়ে অনেক সুন্দর সব কথা শোনাল মাইকেল।

ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল বেলা।

ভোরের আগে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখে যে একইভাবে বসে আছে মাইকেল; যেন বেলার ঘুম না তুটে যায়।

“থ্যাঙ্ক ইউ, মিকি। আমি যে কতটা একা ছিলাম।”

“আমি জানি বেলা। জানি একাকীত্ব কাকে বলে।” বুঝতে পারল এবারে ভাইকে সান্ত্বনা দেয়ার পালা এসেছে। বেলা তাই বলে উঠল, “তোমার নতুন বইয়ের কথা বলো মিকি। আমি আসলে এখনো পড়ি নি। সরি।”

 “আমি রালেই তাবাকা’র সাথে কথা বলেছি।” হঠাৎ করে মাইকেলের মুখে নামটা শুনে অবাক হয়ে গেল বেলা।

“কোথায়? কোথায় দেখা করেছ?”

মাথা নাড়ল মাইকেল। “আমি দেখা করি নি। ফোনে খানিক কথা বলেছি। মনে হয় অন্য কোন দেশ থেকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু শীঘ্রিই দেশে ফিরবেন। ছায়ার মতই বর্ডার পারাপার করেন।”

“দেখা করার ব্যবস্থা করেছ?”

 “হ্যাঁ, নিজের কথা রাখতে জানেন লোকটা।”

“সাবধানে, মিকি। প্রমিজ করো যে নিজের খেয়াল রাখবে। উনি অনেক ভয়ংকর।”

“চিন্তা করো না।” বোনকে আশ্বস্ত করল মাইকেল। “আমি তো শন কিংবা গ্যারির মতো হিরো নই। প্রমিজ করছি সাবধানে থাকব।”

***

জোহানেসবার্গ টু-ডারবান মেইন হাইওয়ের পাশের একটা রেস্টোরেন্টে গাড়ি। থামাল মাইকেল কোর্টনি।

 ইগনিশন সুইচটা বন্ধ করলেও খানিক সময় লাগত পুরোপুরি স্তব্ধ হতে। সতুর হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়া গাড়িটা আরো দুই বছর আগে বিক্রি করে দেয়া উচিত ছিল।

ডেপুটি এডিটর হিসেবে প্রতি বারো মাসে নতুন লাক্সারী কার পাবার কথা থাকলেও পুরনো ভাঙ্গা-চোড়া ভ্যানিয়ান্টের মায়া কিছুতেই ছাড়তে পারে না মাইকেল।

কার পার্কের অন্য গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকে দেয়া বর্ণনার সাথে মেলাতে চাইল। না, কাক্ষিত গাড়িটা নেই। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল বিশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে। তাই সিগারেট ধরিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে রইল।

নিজের গাড়ি আর ঘড়ির কথা ভাবতে গিয়ে মনে মনে হেসে ফেলল মাইকেল। কোর্টনি পরিবারের মধ্যেও আসলেই বেমানান। নানা থেকে শুরু করে বেলা সকলেই কেবল পার্থিব সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত। নানা প্রতি বছর নতুন মডেলের ডেইমলার কেনে; বাবা ক্লাসিক কার বিশেষ করে রেসিং গাড়ি কিনে ভর্তি করে ফেলেছে গ্যারাজ। গ্যারি ফেরারি, ম্যাজেরাতি আর শন্ নিজের টা-গাই ইমেজ রক্ষার জন্য চালায় ফোর হুইল ড্রাইভ হান্টিং ভেহিকেল। এমনকি বেলা’র গাড়িও নতুন ভ্যালিয়ান্টের ডাবল দামি হবে।

“বস্তু”, ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ভাবল মাইকেল, “সবাই কেবল বস্তুটাকেই দেখে, ব্যক্তিকে নয়। এটাই এদেশের প্রধান অসুস্থতা।”

গাড়ির পাশের জানালায় টোকা দেয়ার শব্দ শুনে আশা নিয়ে তাকাল মাইকেল।

কিন্তু কেউ কোথাও নেই।

অবাক হয়ে গেলেও আবার এগিয়ে এলো ছোট্ট কালো একটা হাত।

জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথা বের করে দিল মাইকেল। ছেঁড়াফাড়া শাটস গায়ে। খালি পায়ে দাঁড়িয়ে হাসছে বছর পাঁচ কি ছয়েকের একটা কৃষাঙ্গ শিশু। নাকের নিচে সর্দি শুকিয়ে থাকলেও হাসিতে একেবারে ঝলমল করছে চারপাশ।

“প্লিজ” ভিখারীর মতো হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, “আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। প্লিজ এক সেন্ট দিন!”

মাইকেল দরজা খুলতেই অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সরে গেল বাচ্চাটা। সিটের উপর থেকে নিজের কার্ডিগান নিয়ে ছেলেটার মাথায় পরিয়ে দিল মাইকেল।

দেখা গেল পা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে কার্ডিগান। জানতে চাইল, “কোথায় থাকো তুমি?”

শ্বেতাঙ্গ একজনের এই ব্যবহার পেয়ে আর তার মুখে নিজের ভাষা ‘জোসা’ শুনে মুগ্ধ হয়ে গেল শিশুটা। ছয় বছর আগে যখন থেকে মনে হয়েছে যে আপন ভাষা ব্যতীত কারো কাছে পৌঁছানো অসম্ভব তখন থেকে এ ভাষা শিখছে মাইকেল। এখন সে জোসা আর জুলু দু’ভাষাতেই অনর্গল কথা বলতে পারে।

 “ড্রেস ফার্মে থাকি, নকোসী।” এলোমেলো ভাবে গড়ে উঠা এ শহরটাতে না হলেও এক মিলিয়ন কৃষাঙ্গ বাস করে। প্রতিদিন বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে উইটওয়াটার স্ট্রান্ডের শ্বেতাঙ্গ এলাকায় যায় শ্রমিকের কাজ করার জন্য।

বৃহত্তর জোহানেসবার্গের বাণিজ্যিক আর খনি সমৃদ্ধ এই এলাকার চারপাশে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট শহর ড্রেকস্ ফার্ম, সোয়েটো আর আলেকজান্দ্রিয়া, সেখানে কেবল কৃষাঙ্গ উপজাতি গোষ্ঠীগুলোই বাস করে।

‘শেষবার কখন খেয়েছে?” বাচ্চাটার কাছে নম্রভাবে জানতে চাইল মাইকেল।

“গতকাল সকালে।”

নিজের ওয়ালেট খুলে পাঁচ অঙ্কের একটা ব্যাংক নোট বের করল মাইকেল। বাচ্চার ছোট্ট চোখ জোড়া একেবারে বিস্ময়ে থ।

মাইকেল হাত বাড়িয়ে দিতেই নোটটা ছোঁ মেরে নিয়ে হাচোড়-পাচোড় করে দৌড় লাগালো ছোট্ট ছেলেটা। ধন্যবাদ দিতেও দাঁড়াল না; ভয় পেল পাছে না যাতে ওর এই উপহার আবার ফিরিয়ে নেয় শ্বেতাঙ্গ লোকটা।

হা হা করে হেসে ফেলল মাইকেল আর তারপরই প্রচণ্ড রাগও হল। আধুনিক এই বিশ্বের আর কোনো দেশ কি আছে সেখানে ছোট্ট শিশুরাও রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়? মনে ছেয়ে গেল হতাশা।

“একটু যদি কিছু করতে পারতাম!” অনুতপ্ত হয়ে ভাবতে গিয়ে এত জোরে সিগারেটে টান দিল যে পুরো এক ইঞ্চি পরিমাণ ছাই গড়িয়ে পড়ল। সাথে টাইয়ের উপর আগুনের ফুলকি বানিয়ে দিল ছোট একটা ফুটো।

এ সময়ে মেইন হাইওয়ে থেকে কারপার্কের দিকে মোড় নিল ছোট্ট নীল একটা ডেলিভারী-ভ্যান। এটাই সেই গাড়ি।

নির্দেশ মতো নিজের গাড়ির লাইট জ্বালালো মাইকেল। ভ্যানটা সোজা চলে এলো মাইকেলের গাড়ির সামনে। ভ্যালিয়ান্ট থেকে নেমে দরজা লক করে ভ্যানের দিকে এগোল মাইকেল। পেছনের খোলা দরজা দিয়ে উঠে বসল ভেতরে। ভ্যানের ভেতরে ভর্তি হয়ে আছে ঝুড়ি ভর্তি কাঁচা মাংসের প্যাকেট আর মৃত ভেড়া।

 “এদিকে আসুন।” জুল ভাষায় ডাইভার নির্দেশ দিতেই ঝুলিয়ে রাখা ভেড়ার নিচ দিয়ে এসে দুটো মাংসের ঝুড়ির মাঝখানে বসে পড়ল মাইকেল। ইন্সপেকশনের সময় তাই ধরা পড়ার ভয় নেই।

“ব্যস, আর কোনো ঝামেলা হবে না।” জুলু ভাষায় নিশ্চয়তা দিল ড্রাইভার। “এই ভ্যানকে কেউ কখনো থামায় না।”

গাড়ি চলতেই নোংরা, আঘোয়া মেঝেতে বসে পড়ল মাইকেল। এ ধরনের নাটকীয় সাবধানতাগুলো বিরক্তিকর হলেও গুরুত্বপূর্ণ। টাউনশিপ ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলের সাথে আলোচনা আর লোকাল পুলিশ স্টেশনের পারমিশন ছাড়া কৃষাঙ্গ শহরে যেতে পারে না কোনো শ্বেতাঙ্গ।

সাধারণভাবে এ ধরনের পারমিশন জোগাড় করা কঠিন না হলেও মাইকেল কোর্টনি বিখ্যাত পরিবারের সন্তান হওয়াতে ফ্যাকড়াটা বেঁধেছে। এছাড়াও পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের আওতায় তিন বার নিষিদ্ধ হয়ে মোটা অংকের ফাইল গুনেছে সে আর তার সংবাদপত্র।

কোনো রকম বাধা ছাড়াই ড্রেকস্ ফার্মের মেইন গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কেল নীল ভ্যান। আফ্রিকান লুডু খেলাতে ব্যস্ত কৃষাঙ্গ গার্ডেরা একবার চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত।

“আপনি এবার সামনে আসতে পারেন।” ড্রাইভারের কথা শুনে মাংসের ঝুড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে ক্যাবের প্যাসেঞ্জার সিটে চলে এলো মাইকেল।

এই শহরতলীগুলো ওকে সবসময়ই বিস্মিত করে। মনে হয় যেন কোন ভিনগ্রহে চলে এসেছে।

১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো পা রেখেছিল ড্রেকস্ ফার্মে; যেখান থেকে ফিরে গিয়ে লিখেছে “রেজ” সিরিজ। সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি প্রাপ্তি আর পাবলিকেশন কন্ট্রোল অ্যাক্টের হাতে নিষিদ্ধ হওয়া উভয়েরই শুরু তখন থেকে।

স্মৃতি মনে করতে করতে চারপাশ দেখতে লাগল মাইকেল। শহরতলীর প্রাচীন অংশটা দিয়ে এগিয়ে চলেছে নীল ভ্যান। আশপাশে গলির পর গলি, ভাঙ্গা চোড়া দালান, পলেস্তারা ওঠা বস্তির দেয়াল, লাল মরচে পড়া করোগেটেড টিনের ছাদ।

চিকন রাস্তাটার মাঝে মাঝেই উঁচু নিচু গর্ত। চড়ে বেড়ানো মুরগিগুলো বিষ্টাতে ভর্তি হয়ে আছে চারপাশ। দুর্গন্ধে টেকা দায়। আবর্জনা পঁচা গন্ধের সাথে মিশে গেছে খোলা ড্রেন আর মাটির টয়লেটের গন্ধ।

সরকারের স্বাস্থ্য পরিদর্শক বহু আগেই ড্রেকস্ ফার্মের পুরাতন অংশের সাফ সুতরো করার আশা ছেড়ে দিয়েছে। কোনো একদিন বুলডোজার এসে সব গুঁড়িয়ে দেবে আর মেইলের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হবে ভয়ংকর মেশিনটার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা কৃষাঙ্গ পরিবারগুলোর ছবি। ডার্ক স্যুট পরিহিত কোনো সিভিল সার্ভেন্ট স্টেট টেলিভিশন নেটওয়াকে জানাবে “স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে তৈরি নতুন আরামদায়ক বাংলোর” কথা। সেদিনটার কথা কল্পনা করেই রাগে ফুঁসতে লাগল মাইকেল।

এরপর ভ্যান নতুন অংশে ঢুকতেই ফ্রান্সের সামরিক সমাধি ক্ষেত্রের কথা মনে পড়ে গেল। বৃক্ষহীন প্রান্তরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছাই রঙা করোগেটেড অ্যাসবেস্টস ছাদ লাগানো হাজার হাজার ইটের বাক্স।

 তারপরেও, কেমন করে যেন নিজেদের রঙচটা জীবনের খানিকটা রঙের ছোঁয়া নিয়ে এসেছে এলাকার কৃষাঙ্গ অধিবাসীরা। এখানে-সেখানে লাগানো গোলাপি আকাশী নীল আর জমকালো কমলা, আফ্রিকার উজ্জ্বল রঙ প্রীতিকেই মনে করিয়ে দেয়। এরকমই একটা বাড়িতে উত্তরের নেডেবল উপজাতির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সুদৃশ্য জ্যামিতিক নকশা দেখতে পেল মাইকেল।

সামনের ছোট্ট বাগানটাতে ফুটে আছে বাড়ির বাসিন্দার ব্যক্তিত্ব। কোনটাতে একেবারে রুক্ষ ধূলিমলিন মাটি; কোনটাতে ভূট্টা গাছের সাথে সাথে দুধ দেয়া ছাগলও চড়ে বেড়াচ্ছে। কোনোটাতে আবার জিরেনিয়াম লতা: আরেকটাতে তো আগাছা ভরা বাগানে ভয়ংকর দর্শন কুকুর গার্ডও চোখে পড়ল।

কোনো কোনো প্লট কংক্রিটের দেয়াল গেঁথে কিংবা পুরনো ট্রাকের পেইন্ট করা টায়ার ঝুলিয়ে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সীমানা বানিয়েছে। বেশির ভাগ কুটিরের আবার বাড়তি অংশ বানানো হয়েছে আত্মীয়-স্বজনদের আশ্রয় দেয়ার জন্য। আবার বাতিল জিনিস রাখার কাজও দিব্যি চলে যাচ্ছে।

 এখানকার এই মানুষগুলোকেই নিজের শ্রেণি কিংবা জাতির চেয়েও বেশি ভালবাসে মাইকেল। এদের জন্যই হাহাকার করে ওর হৃদয়। মুগ্ধ হয় এদের সামর্থ্য, সহিষ্ণুতা আর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা দেখে।

কালো ল্যাব্রাডর কুকুর ছানার মতো সর্বত্র খেলে বেড়াচ্ছে শিশুদের দল।

মাইকেলের শ্বেতাঙ্গ চেহারা দেখে ধীর গতিতে এগোনো ভ্যানের পাশে পাশে দৌড়াতে থাকে কিশোর-কিশোরীর দল। “সুইটি! সুইটি!” মাইকেল’ও তৈরি হয়ে এসেছে পকেট ভর্তি সুগার ক্যান্ডি মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় জানালা দিয়ে। তরুণেরা প্রতিদিন শহরে কাজ করতে গেলেও বৃদ্ধ, বেকার আর মায়েদের দল এখানেই রয়ে যায়।

মোড়ে মোড়ে দল পাকিয়ে আড্ডা দিতে থাকা টিনএজারদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায় মাইকেল। ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে, জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগেই এ মুখগুলো জেনে যায় ভালো কিছুর প্রত্যাশা করা ওদের সাজে না।

আর আছে গৃহকর্ম কিংবা ভেজা কাপড় দড়িতে ঝুলিয়ে দিতে ব্যস্ত নারীরা। কালো উঠানে তেপায়া পাত্রে তৈরি করছে ভূট্টার পরিজ। ধূলা আর চুনার ধোয়া একত্রে মিশে দীর্ঘস্থায়ী মেঘ জমে থাকে শহরতলীর উপরে।

চারপাশের এত দৈন্য দশা আর দারিদ্রতা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি কোণা থেকে কানে ভেসে আসছে হাসি আর গানের শব্দ। উজ্জ্বল আর আনন্দমাখা হাসি দিয়েই একে অন্যকে অভ্যর্থনা জানায় সকলে। প্রাণখোলা এই আফ্রিকান হাসিমুখ দেখে অন্তর আর্দ্র হয়ে উঠে বেদনার ভারে।

মাইকেলের মনে হয়, গানই মূল প্রেরণাশক্তি জাগায় এই কৃষাঙ্গদের মাঝে। নিজেকে ওদেরই একজন ভাবতে ভালবাসে; বয়স, জাতি কিংবা সেক্স নয়, এদের প্রত্যেকেই তার বড় আপন।

“আমি তোমাদের জন্য কী করব বলল তো?” ফিসফিস করে নিজের কাছেই উত্তর জানাতে চায় মাইকেল। আমি যাই চেষ্টা করেছি ব্যর্থ হয়েছি। মরুভূমির বুকে বাতাসে চিৎকারের মতই হারিয়ে গেছে আমার সব প্রচেষ্টা।

একটা যদি কোনো রাস্তা খুঁজে পেতাম!”

হঠাৎ করেই গাড়ি উপরে যেতেই নিজের আসনে সিধে হয়ে বসল মাইকেল।

এগারো বছর আগে এখানকার ঘাসের জমিতে ছাগল চড়ে বেড়াতে দেখেছিল।

“নবস পাহাড়।” ওর বিস্ময় দেখে মিটিমিটি হাসছে ভ্যানের ড্রাইভার। “সুন্দর, না?”

যাত্রাপথের হাজারো কাটা অতিক্রম করে কেবল স্থির সংকল্প আর ধৈর্যের কল্যাণে একজন মানুষ যে কোথায় পৌঁছে যায় কল্পনা, করা যায় না। ড্রেকস ফার্মের এ অংশে বাস করে তেমনই কৃষাঙ্গ ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল আর সফল অপরাধী। যে বাড়ি তারা এখানে বানিয়েছে তা অনায়াসে শ্বেতাঙ্গদের স্যান্ডটন, লা লুসিয়া কিংবা কনস্টানশিয়ার মতো অভিজাত পাড়ার শোভা বর্ধন করতে পারত।

“দেখুন!” গর্বিত ভঙ্গিতে একের পর এক বাড়ি চেনাতে লাগল ভ্যানের ড্রাইভার। “বড় বড় জানালাঅলা গোলাপি বাড়িটাতে থাকেন জোশিয়া জুবু। সিংহের এমন হাড় বিক্রি করে যা আপনাকে ব্যবসা কিংবা আর্থিক কাজে সফলতা এনে দেবে। চোখের জন্য শকুনের চর্বির মলম। নতুন চারটা ক্যাডিলাক মোটর গাড়ির মালিক এই কবিরাজের ছেলেরা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে।”

“আমাকেও তো তাহলে সিংহের হাড় নিয়ে যেতে হবে।”

মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। গত চার বছরে মেইলে’র কারণে এত ক্ষতি হয়েছে যে বেজায় ক্ষেপে আছে নানা আর গ্যারি।

“এবারে ওই সবুজ ছাদ আর উঁচু দেয়ালঅলা বাড়িটা দেখুন। এখানে পিটার গোনিয়ামা বাস করে। উনার উপজাতির লোকেরা ক্যানাবিস উৎপন্ন করে। পাহাড়ের গোপন জায়গায় এগুলোর চাষ করে ট্রাকে করে পাঠিয়ে দেয় কেপ টাউন, ডারবান আর জোহানেসবার্গ। উনার আছে এত এত টাকা আর পঁচিশ জন স্ত্রী।”

পুরনো এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা ছেড়ে ভ্যান এবার উঠে এলো মসৃণ নীল অ্যাসফাল্ট লাগানো বুলেভাদের উপর।

এরপর হঠাৎ করে বিলাসবহুল এক ম্যানশনের স্টিলের গেইটের সামনে এসে থেমে গেল গাড়ি। নিঃশব্দে ইলেকট্রিক গেইট খুলে যেতে ভেতরে সবুজ লনে ঢুকে গেল ভ্যান। পেছনে বন্ধ হয়ে গেল গেইট। মাঝখানে পাথরের ঝরণাঅলা একটা সুইমিং পুল দেখা যাচ্ছে। ওভারঅল পরিহিত দুই কুষাঙ্গ মালি কাজ করছে বাগানে।

হাল আমলের নকশা করা বিল্ডিংটাতে প্লেট-গ্লাস, পিকচার-উইনডো আর কাঠের কাজ সবই আছে। ড্রাইভার মূল চত্বরে গাড়ি পার্ক করতেই মাইকেলকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি।

“মাইকেল!” রালেই তাবাকার সম্ভাষণ শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল মাইকেল। লন্ডনে শেষ মিটিং এর চেয়ে সবকিছুই আলাদা মনে হল। রালেই’র মতো এত সুপুরুষ আর কখনো দেখেনি।

“সু-স্বাগতম।” চারপাশে চোখ বুলিয়ে–কুঁচকালো মাইকেল।

“এখানেও আপনি বেশ ঠাট-বাট নিয়েই চলেন দেখছি রালেই; নট ব্যাড!”

“এগুলোর কিছুই আমার নয়।” মাথা নাড়লেন রালেই। “পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই আমার নিজের নয়।”

“তাহলে কার?”

 “প্রশ্ন, শুধু প্রশ্ন।” খানিকটা তিরস্কারের সুরে বলে উঠলেন তাবাকা।

“ভুলে যাবেন না আমি একজন সাংবাদিক। প্রশ্ন আমার হাড়-মজ্জায় মিশে গেছে।” পরিবেশ হালকা করতে চাইল মাইকেল

“ঠিক আছে। যে নারীর সাথে এখন আপনার দেখা হবে তার জন্য এই বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে ট্রান্স আফ্রিকা ফাউন্ডেশন অব আমেরিকা।”

“ট্রান্স আফ্রিকা-আমেরিকান সিভিল রাইটস গ্রুপ?” সবিস্ময়ে জানতে চাইল মাইকেল, “এটি কি শিকাগোর কৃষাঙ্গ ইভানজেলিস্ট ধর্মেপ্রচারক ডা. রোন্ডাল চালান?”– “আপনি তো সব খবরই রাখেন। মাইকেলের হাত ধরে খোলা আঙ্গিনাতে নিয়ে গেলেন তাবাকা।

“না হলেও এর মূল্য অর্ধ মিলিয়ন ডলারস।” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে কাঁধ আঁকিয়ে প্রসঙ্গ বদল করলেন রালেই, “আমি আপনাকে বর্ণবাদের সন্তানদেরকে দেখানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মাইকেল; কিন্তু তার আগে চলুন জাতির মাতা’র সাথে দেখা করি।”

উজ্জ্বল রঙা মাশরুমের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে বীচ আমবেলা। সাদা প্লাস্টিকের টেবিলের চারপাশে বসে কোকাকোলা খেতে খেতে ট্রানজিস্টর থেকে জ্যাজ মিউজিক শুনছে আট থেকে নয় বছর বয়সী ডজনখানেক কৃষাঙ্গ ছেলে। সকলেরই গায়ের হলুদ রঙা টি-শার্টের বুকে গামা অ্যাথলেটিক ক্লাব” লেখা। মাইকেলকে দেখে কেউই উঠে না দাঁড়ালেও কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।

মূল দালানের কাঁচের দরজা খুলে মাইকেলকে লিভিং রুমে নিয়ে গেলেন তাবাকা। দেয়ালে কারুকার্য করা কাঠের মুখোশ, পাথরের মেঝেতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি কার্পেট।

“কোন ড্রিংক নেবেন মাইকেল? কফি অথবা চা?”

মাথা নাড়ল মাইকেল। “না; কিন্তু সিগারেট খেলে কিছু মনে করবেন?”

“আপনার অভ্যাস আমার মনে আছে।” হেসে ফেললেন তাবাকা। “ঠিক আছে; কিন্তু দুঃখিত কোনো দিয়াশলাই দিতে পারব না।”

হাতে লাইটার নিয়ে বড়সড় রুমটার উপরের দিকে তাকালো মাইকেল।

সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেন এক নারী। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাইকেল। খুব ভালো করেই চেনে এ মুখ। ব্ল্যাক ইভিটা, জাতির মাতা নামেই সকলে তাঁকে চেনে। যাই হোক এই নারীর দৈহিক সৌন্দর্য আর রাজকীয় উপস্থিতি ফুটিয়ে তোলার সাধ্য কোনো ফটোগ্রাফের নেই।

“ভিক্টোরিয়া গামা” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাকা, “ইনি মাইকেল কোর্টনি, যার কথা তোমাকে বলেছিলাম।”

“ইয়েস” সায় দিলেন ভিকি গামা। “আমি মাইকেল কোর্টনিকে ভালোভাবেই চিনি।”

স্থির আত্মপ্রত্যয় নিয়ে মাইকেলের কাছে এগিয়ে এলেন ভিক্টোরিয়া। পরনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের উজ্জ্বল সবুজ, হলুদ আর কালো কাফতান; মাথায় জড়ানো পান্না সবুজ পাগড়ি; উনার ট্রেডমার্ক’ই হলো এই পাগড়ি আর কাফতান।

 মাইকেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন গাঢ় বাদামি রঙা হাত, দেহত্বক ঠিক ভেলভেটের মতই মসৃণ।

“আপনার মা আমার স্বামীর দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন।” নরম স্বরে মাইকেলকে জানালেন ভিকি। “আমার মতই তিনিও মোজেস গামা’কে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন। আপনার মা সত্যিই অসাধারণ, আমাদেরই একজন।”

“কেমন আছেন তারা?” মাইকেলকে সোফার কাছে নিয়ে যাবার পর বসতে বসতে জানতে চাইরৈন ভিকি গামা, “বহু বছর দেখা হয়নি উনার সাথে। এখনো ইংল্যান্ডেই আছেন? আর মোজেসের পুত্র-বেনজামিন?”

“হ্যাঁ, ওরা এখনো লন্ডনে থাকে।” জানাল মাইকেল। “এই তো কয়েকদিন আগেও আমার সাথে দেখা হয়েছিল। বেনজামিন তো বেশ বড় হয়ে গেছে। লিড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

“ইস যদি কখনো আবার আফ্রিকাতে ফিরে আসত”? বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবে খানিকক্ষণ গল্প করলেন দুজনে। অবশেষে জানতে চাইলেন,

“তো আপনি আমার সন্তানদেরকে দেখতে চেয়েছেন? বণর্বাদের সন্তানদেরকে?”

ভীষণ রকমভাবে কেঁপে উঠল মাইকেল। নিজের আটিকেলের জন্য ঠিক এই টাইটেলটাই ভেবে রেখেছে মনে মনে।

 “ইয়েস, মিসেস গামা, আমি আপনার সন্তানদের সাথে দেখা করতে চাই।”

“প্লিজ আমাকে ভিকি নামে ডাকবেন। আমরা একই পরিবারের মাইকেল। আশা করছি আমাদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাগুলোও একই?”

“হ্যাঁ, অনেক বিষয়েই আমাদের বেশ মিল, ভিকি।”

আবারো মাইকেলকে সঙ্গে নিয়ে খোলা চত্বরে চলে এলেন ভিকি গামা। চারপাশের ছেলেদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাইকেলের সাথে।

“উনি আমাদের বন্ধু। তাই সহজভাবে সবকিছু খুলে বলবে, যা যা জানতে চাইবেন সবকিছুর উত্তর দিবে।” সংক্ষিপ্ত নির্দেশও দিয়ে দিলেন ভিকি।

নিজের জ্যাকেট আর টাই ছুঁড়ে ফেলে একটা ছাতার নিচে বসে পড়ল মাইকেল। চারপাশ ঘিরে ধরল ছেলেরা। মাইকেলের মুখে নিজেদের ভাষা শুনে অভিভূত ছেলেগুলো কলকল স্বরে কথা বলতে লাগল; কোনো রকম নোটপ্যাড ব্যবহার করারও প্রয়োজন বোধ করল না মাইকেল জানে কখনোই ভুলবে না এসব শব্দ; তরুণ কণ্ঠ।

কারো কারো গল্প বেশ মজার। কারোটা ভয়াবহ বেদনার। শার্শভিলের সেই দিনে শিশু অবস্থায় মায়ের পিঠের সাথে বাধা ছিল একটা ছেলে। মায়ের বুক ভেদ করে চলে যাওয়া বুলেটটা ওর এক পাও গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। অন্যরা ওকে “খোঁড়া পিট” বলে ক্ষ্যাপায়। শুনতে শুনতে মনে হল কেঁদে ফেলবে মাইকেল।

চোখের পলকে কেটে গেল পুরো বিকেল। ছেলেদের কেউ কেউ উলঙ্গ হয়ে পুলে নেমে গেল সাঁতার কাটতে।

ভিকি গামার পাশে বসে পুরো দৃশ্যই দেখলেন রালেই তাবাকা। মাইকেলের অবস্থা দেখে ভিকিকে জানালেন, “উনাকে আজ রাতে এখানেই রেখে দাও।” মাথা নাড়লেন ভিকি। রালেই বলে চললেন, “উনি ছেলে পছন্দ করেন। কেউ আছে নাকি?”

নরম হয়ে হাসলেন ভিকি। “উনি যেটা ইচ্ছে বেছে নিতে পারেন। আমার ছেলেরা যা বলব তাই করবে।”

উঠে দাঁড়িয়ে মাইকেলের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন ভিকি গামা।

“আপনি এখানে থেকেই আর্টিকেল লিখুন না? আজ রাতে আমাদের সাথেই থাকুন। উপরে আমার টাইপ রাইটার আছে, ব্যবহার করতে পারবেন। আগামী কালটাও কাটিয়ে যান। ছেলেরা তো আপনাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে…”

টাইপরাইটারের উপর উড়ে চলেছে মাইকেলের আঙুল। যেন তৈরিই ছিল এমনভাবে আপনা থেকেই মাথায় চলে আসছে একের পর এক লাইন। হৃদয়ের গভীর থেকেই অনুভব করল এর শক্তি। সত্যিই ভালো হয়েছে। লেখাটা। পৃথিবীকে জানাতে হবে এই “ছেলেমেয়েদের কথা।

আর্টিকেল লেখা শেষ হতেই উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপতে শুরু করল মাইকেল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখা গেল প্রায় মধ্যরাত; অথচ জানে বাকি রাত একটুও ঘুম হবে না। শ্যাম্পেনের মতই রক্তে নাচন তুলেছে এই গল্প।

হঠাৎ করেই দজায় মৃদু টোকা শুনে অবাক হয়ে গেল মাইকেল। তাপরেও নরম স্বরে বলে উঠল, “দরজা খোলা আছে। ভেতরে এসো!” এক জোড়া নীল সকার শর্টস পরিহিত ছেলেটা বেডরুমে ঢুকে এগিয়ে এলো মাইকেলের দিকে।

 “আমি আপনার টাইপ করার শব্দ শুনেছি। ভাবলাম হয়ত চা খেতে পছন্দ করেন।”

বিকেলের সুইমিং পুলে, মাইকেলের দেখা সবচেয়ে সুদর্শন ছেলেটা এখন দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। নিজের বয়স ষোল বলে জানালো ছেলেটা কালো একটা বিড়ালের মতই যেন নিমন্ত্রণ করছে।

“থ্যাঙ্ক ইউ।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর দিল মাইকেল, “ভালই লাগবে তাহলে।”

 “কী লিখছেন আপনি?” চেয়ারের পেছনে এসে মাইকেলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল ছেলেটা, “এটাই আপনাকে বলেছিলাম আজকে?”

“হ্যাঁ।” ফিসফিস করে উঠল মাইকেল। মাইকেলের কাঁধে হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে লাজুকভাবে হেসে ফেলল।

“আই লাইক ইউ।”

***

ভোরভেলায় পুলের পাশে বসে মাইকেলের আর্টিকেল শুনলেন রালেই তাবাকা। শেষ হতে বহুক্ষণ পর্যন্ত কেউই কোনো কথা বলতে পারল না।

 “আপনি আসলে এক অসাধারণ জিনিয়াস।” অবশেষে জানালেন তাবাকা, “আমি আর কখনো এতটা শক্তিশালী কোনো লেখা পড়িনি। এটা কি ছাপাবেন?”

“এই দেশে না।” একমত হলো মাইকেল। “লন্ডনের গার্ডিয়ান আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদেরকে এ লেখা দেয়ার জন্য।”

“তবে তো বেশ ভাল হয়।” খুশি হলেন রালেই। “অত্যন্ত ধন্যবাদ। যত শীঘি পারেন পুরোটা শেষ করুন। অন্তত আজকের রাতটাও এখানে থাকুন। সাবজেক্টের কাছাকাছি থাকলে হাত খুলে লিখতে পারেন দেখছি!”

***

কী কারণে যে ঘুমটা ভেঙে গেল মাইকেল নিজেও জানে না। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল পাশে শুয়ে থাকা ছেলেটার উষ্ণ দেহ। ঘুমের ভেতরেই নড়ে উঠল ছেলেটা। হাত তুলে দিল মাইকেলের বুকে।

এরপরই আবারো শব্দটা শোনা যেতেই ঘুমন্ত ছেলেটার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল মাইকেল। নিচের তলা কিংবা বহু দূর থেকে ভয়ংকর কষ্ট পেয়ে কেউ আর্তনাদ করছে। আস্তে করে আন্ডারপ্যান্ট পরে নিঃশব্দে বেডরুম থেকে বের হয়ে প্যাসেজওয়েতে এলো মাইকেল। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করল।

আবারো অসম্ভব তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন আর্তনাদ করে উঠতেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল মাইকেল। কিন্তু নিচ পর্যন্ত যাবার আগেই শোনা গেল তাবাকা’র গলা।

“মাইকেল, কী করছেন ওখানে?” রালেই’র তীব্র চিৎকার শুনে থতমতো খেয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে থেমে গেল মাইকেল।

“শব্দ শুনলাম, ঠিক যেন-”

“কিছু না। আপনার রুমে চলে যান মাইকেল।”

 “কিন্তু মনে হচ্ছে”

“আপনার রুমে যান।”

 তাবাকা নরম স্বরে জানালেও উনার কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যে অগ্রাহ্য করতে পারল না মাইকেল। ঘুরে আবার নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে তাবাকা আবার মাইকেলের হাত ধরে জানালেন, “মাঝে মাঝে রাতে চেনা শব্দ’ও অচেনা মনে হয়। আপনি কিছুই শোনেন নি মাইকেল। হতে পারে বিড়াল কিংবা বাতাস। সকালে কথা হবে। এখন ঘুমোতে যান।”

মাইকেল রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ না করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন তাবাকা। তারপর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে খুলে ফেললেন দরজা।

টাইলস্ করা মেঝের ঠিক মাঝখানে অর্ধ অনাবৃত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জাতির মাতা, ভিক্টোরিয়া গামা। কোমর পর্যন্ত নিরাভরণ থাকাতে ফুটে রয়েছে সুদৃশ্য স্তন।

অথচ করছেন অত্যন্ত পৈশাচিক এক আচরণ। এক হাতে ভয়ংকর আফ্রিকান গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুক, আরেক হাতে জিনের গ্লাস। পেছনে সিংকের উপর রাখা বোতল।

রান্না ঘরে ভিকির সাথে গামা অ্যাথলেটিকস ক্লাবের আরো দুই সদস্যও আছে। মাত্র কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়া ছেলেগুলোও কোমর পর্যন্ত অনাবৃত। রান্নাঘরের লম্বা টেবিলটার উপর শোয় আরেকটা দেহকে দু’পাশে থেকে আটকে রেখেছে দু’জনে।

বোঝা গেল বেশ অনেকক্ষণ ধরেই চলছে এই ধোলাই পর্ব। চাবুকের আঘাতে মাংস থেকে রক্ত ঝরছে কৃষাঙ্গ দেহ থেকে। শুয়ে থাকা লোকটার দেহের নিচে রক্ত জমে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে টাইলসের মেঝেতে।

“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?” হিসহিস করে উঠলেন তাবাকা, “বাড়িতে সাংবাদিক আছে খেয়াল নেই?”

“ও একটা পুলিশ স্পাই।” ঘোৎ ঘোৎ করে উঠলেন ভিকি। “বিশ্বাসঘাতক–টাকে আমি শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব।”

“তুমি আবারো মদ খেয়েছ?” ভিকির হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে মারলেন তাবাকা। “গা গরম না করে এসব কাজে আনন্দ পাও না, না?”

ধকধক করে জ্বলছে ভিকির চোখ, হাতের চাবুক তুললেন রালেইকে মারবেন বলে।

কিন্তু কোনো কষ্ট ছাড়াই তার কব্জি ধরে চাবুকটাকে খসিয়ে সিঙ্কের উপর ফেলে দিলেন তাবাকা।

“একে সরাও এখান থেকে।” ইশারায় টেবিলের উপর শুয়ে তাকা রক্তাক্ত দেহটাকে দেখালেন রালেই। “এরপর পুরো জায়গা পরিষ্কার করে ফেলে। শ্বেতাঙ্গ লোকটা যতদিন আছে, এমন আর কিছু যেন না দেখি বাড়ির ভেতরে। বুঝতে পেরেছ?”

কাৎরাতে থাকা লোকটাকে টেবিল থেকে তুলে ধরে ধরে দরজার দিকে নিয়ে গেল ভিকি’র দুই বডিগার্ড।

এবারে ভিকি’র দিকে নজর দিলেন তাবাকা। “তোমার নামের সাথে কতবড় সম্মান জড়িয়ে আছে জানো না? এরকম যা তা কাজ করলে আমি নিজের হাতে তোমাকে খুন করব। এখন যাও, রুমে যাও।”

মদ খাওয়া সত্ত্বেও বেশ দৃঢ় ভঙ্গিতেই রুম ছেড়ে চলে গেলেন ভিকি। এভাবে যদি মিডিয়ার কাছে নিজের ইমেজটাকেও ধরে রাখতে পারে!

মাত্র কয়েক বছরেই এতটা বদলে গেছে ভিকি। মোজেস গামার সাথে বিয়ের সময় এই বহ্নি শিখাই ছিল স্বামী আর লড়াইয়ের প্রতি নিবেদিত। এরপরই আমেরিকার বামগুলো তাকে খুঁজে পেয়ে দেদারসে অর্থ আর প্রশংসা বিলোতে থাকে।

তখন থেকেই শুরু হয়েছে অধঃপতন। লড়াইটা যদিও কম ভয়াবহ নয় আর রক্তের নদী বিনা স্বাধীনতা পাওয়া যায় না; তারপরেও ভিকি গামা এখন যেন আনন্দ লাভেই বেশি ব্যস্ত থাকে; তাই খুব সাবধানে ভেবে বের করার সময় হয়েছে যে এই নারীকে নিয়ে কী করা যায়।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *