তৃতীয় পর্ব – ইউরোপান রোলেট
২১. মুক্তির রাজনীতি
এতো বিশ্রী ব্যাপারের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লব বিনা রক্তপাতে সফল হয়েছিল-এসব ব্যাপারে যা হয় আর কী! হাজারো ক্ষতির জন্য যে টেলিভিশনকে শাপ-শাপান্ত করা হয় তাই এর পেছনে তুরুপের তাস হিসেবে কাজে লেগে যায়। ফিলিপাইনেও ক্ষমতার দাপটে যখন বিশেষ সাধারণ জনগোষ্ঠির গোড়া উপড়ে যাবার দশা তখন এই টেলিভিশনের কল্যাণেই ভাল ব্যাবহার করতে বাধ্য হয় ক্ষমতালিন্দুরা। তারপরও সারা দুনিয়া বেশকিছু ধ্বংসযজ্ঞের ন্যাক্কারজনক দৃশ্য দেখতে পেয়েছে।
বেশিরভাগ আফ্রিকানারই অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্য আঁচ করতে পেরে ক্ষমতার পালা বদলের অনেক আগে দেশ থেকে পাততাড়ি গোটায়। দেশটার নতুন প্রশাসন যে তেতো অভিযোগ তুলেছে, সেসব কথা অনুযায়ী তারা মোটেও খালিহাতে বাক্স পেঁটরা গোছায়নি। বিলিয়ন বিলিয়ন র্যান্ড চলে গেছে সুইস আর ডাচ ব্যাঙ্কগুলোর অতল গর্তে। নাটকের শেষ দিকে যে কত রহস্যময় ফ্লাইট দেখা গেল কেপ টাউন বা জোহান্সবার্গ থেকে জুরিখ-আমস্টার্ডামের দিকে উড়ে যেতে তার ইয়ত্তা নেই। পরে স্বাধীনতা দিবসে এমন কথাও প্রকাশ্যে বলাবলি করতে লোকে যে এক আউন্স খাঁটি সোনা বা এক ক্যারেট দ্যুতিময় হীরাও পড়ে নেই সদ্যলুপ্ত দক্ষিণ আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে। কথা একেবারে মিথ্যা নয়। সবচে দুঃখজনক ব্যাপার-খনিকৰ্মীদের উপর তলে তলে গণহত্যা চলেছে শেষদৃশ্যে। হেগে নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বসে কোনো এক রিফিউজি তার বনিয়াদী কণ্ঠে দম্ভোক্তি ছড়িয়েছিল, কিম্বার্লিকে কর্মক্ষম করতে কাফ্রিদের বছর পাঁচেক তো লাগবেই… যদি ওরা কোনোদিন পেরে ওঠে।
অবাক হলেও সত্যি কথা, ডি বিয়ার্স আবার সচল হল এক সময়, নতুন নামে-নতুন মুঠোয় আবদ্ধ হয়ে। না, পাঁচটা বছরও লাগেনি। এই ছোট্ট সময়ের মধ্যেই নতুন জন্ম নেয়া দেশটার আর্থিক চালিকাশক্তিতে পরিণত হল হীরার ভুবনমোহিনী আলো।
এক প্রজন্মের ব্যবধানেই নবীন রিফিউজিরা একত্র হল তাদের গোঁড়া পূর্বপুরুষদের ছত্রছায়ায়-একবিংশ শতাব্দীর একীভূত পরিবেশে। সগর্বে তারা উঠে দাঁড়ায়, সদম্ভে নয়। উঠে দাঁড়ায় পূর্বপুরুষের কর্মোদ্যম আর স্পৃহা নিয়ে, বাদ দেয় বিগতদের গোড়ায় থাকা গলদটুকু। আসলেই, তারা আফ্রিকান ভাষায় কথা বলত না, নিজেদের ঘরেও নয় ।
শতাব্দী পুরনো রুশ বিপ্লবের কথা মনে করে অনেকে ঘড়ির কাঁটা উল্টে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। অন্তত যারা দখলদারদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার সুদী কারবার করেছিল তাদের দাঁত উপড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে বেশ কবার। যথারীতি তাদের এই জিঘাংসা আর নিষ্ফল আক্রোশ প্রবাহিত হয় অপপ্রচারের দিকে। প্রোপাগান্ডা, মহড়া, বয়কটের মাধ্যমে তারা ব্যতিব্যস্ত করতে চায় ওয়ার্ল্ড কাউন্সিলকে। এমনকি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করে শিল্পকেও। উইলহেম স্যামুটের দ্য ভোট্রেকার্স কে ইংরেজি সাহিত্যের একটা মাস্টারপিস হিসেবে প্রদর্শন করা হয়, এমনকি যারা লেখকের সাথে একমত নয় তারাও একাজ করে।
তারপরও অনেকে মনে করত রাজনৈতিক চাপ বাদবাকীদের ফায়দা লোটা যাবে না, পুরনো কারাগার গড়ে তোলা আর সম্ভব নয়। অনেকে বেশ জানতো, ইতিহাসের পাতাগুলো নূতন করে লেখা যায় না। কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় আরো অনেকেই।
এই দু শ্রেণীর আশপাশে গজিয়ে উঠল রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক খেলার পাল্টাপাল্টি চাল।
ডার বান্ড সবচে বড় না হলেও সবার চেয়ে শক্তিমান এবং অবশ্যই সবচে বেশি ধনী। হারানো প্রজাতান্ত্রিক দেশটার সম্পদ লোপাট করার কাজে বান্ডদের একটা নেটওয়ার্ক এবং কয়েকটা হোল্ডিং কোম্পানিই যথেষ্ট ছিল। আর আজ, সময়ের অদ্ভুত নদী বেয়ে চলতে চলতে তাদের বেশিরভাগই পুরোপুরি আইনসম্মত, শুধু আইনসম্মত হলেও হত-বরং শ্রদ্ধার পাত্র।
সুং এ্যারোস্পেসে অন্তত আধ বিলিয়ন বান্ড-মানি খাটছে, বার্ষিক খতিয়ানে কী সুন্দরভাবে পরিমাণটা দেখা যায়! দু হাজার উনষাটে স্যার লরেন্স আরো পঞ্চাশ কোটি গ্রহণ করতে মোটেও কার্পণ্য করেনি-হাজার হলেও তার ছোট্ট নৌবহরে আরো একটু জাঁকজমক বাড়বে।
কিন্তু তার সেই বিখ্যাত ব্যবসাবুদ্ধিও বান্ড এবং সুং এ্যারোস্পেসের শেষ চার্টার্ড মিশনটার সাথে সম্পর্কের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। এম্নিতেই তখন হ্যালি এগিয়ে আসছিল মঙ্গলের দিকে, তার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে ইউনিভার্সকে শেষ সাজে গড়ে নেয়ার কাজে। অন্য সিসটার শিপটার রুটিন অপারেশনে চোখ না পড়ারই কথা।
লন্ডনের লয়েডস অবশ্যই যথারীতি গ্যালাক্সির প্রস্তাবিত রুটিন খতিয়ে দেখেছে, কিন্তু তেমন কোনো ফারাক পড়েনি। সৃষ্টি জগতের চারধারে বাড়দের লোক বসে আছে; অবশ্যই ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোয়।
ব্যাপারটা ইনস্যুরেন্স দালালদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও মহাকাশ আইনবিদদের জন্য পোয়াবারো হয়ে দাঁড়ায়।
২২. ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল
প্রতিনিয়ত লাখ লাখ কিলোমিটার বদলে যাওয়া দূরত্বের দুটো লক্ষ্যে শিপিং লাইন চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর আবার গতীয় দিক দিয়ে প্রতি মুহূর্তেই শত কিলোমিটার হিসাব উড়ে এসে জুড়ে বসে। নিয়মিত কর্মতালিকা থাকার প্রশ্নই নেই। তাই সৌর জগতের আগাগোড়া বদলে মানবজাতির জন্য নতুন খোলনলচে নিতে নিতে যে কেউ বন্দর বা কক্ষপথগুলোয় থেকে থেকে হয়রান হয়ে যেতেই পারে-এতে অবাক হবার কিছু নেই।
সৌভাগ্যক্রমে এই পালাবদলগুলো বেশ কবছর আগে থেকেই হিসাব করে বের করা যায়। তাই নিয়মিত যানগুলোও সুযোগমতো মেরামতি করিয়ে নেয়, ক্রুদের নামিয়ে দেয় একটু আরাম আয়েশে ছুটি কাটানোর কাজে। এবং ভাগ্যক্রমে মাঝেমধ্যে অতি ধরাধরি করে কেউ কেউ ব্যক্তিগত কাজে ভাড়া করে বসতে পারে এসব যাত্রার রথ এবং রথীদের। আগের দিনে ব্যক্তিগত সমুদ্রভ্রমণে জাহাজ ভাড়া করার মতো বিলাস আর কী!
ক্যাপ্টেন এরিক ল্যাপ্লাস যখন জানল যে গ্যানিমিডের বাইরে কাটানোর সেই তিনটা মাস একেবারে জলে যাচ্ছে না তখন খুশি না হয়ে উপায় থাকে না। প্ল্যানেটারি সায়েন্টিফিক ফাউন্ডেশন একটা উদ্যোগ নিয়েছে। বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ ছুঁড়ে ফেরার নতুন মওকা দেবে তারা দিচ্ছে আর্থিক সুবিধা। (এখনো কেউ এটাকে লুসিফারীয় জগৎ বলে না, বৃহস্পতীয় জগই বলে।) তারা বিশেষ দৃষ্টি দেবে অবহেলিত ডজনখানেক ছোট উপগ্রহের দিকে। চাঁদগুলোর কোনো কোনোটা ঠিকমতো সার্ভে করা হয়নি; বাকীগুলো দায়সারাভাবে ঘোরা হয়েছে অতীতে।
মিশনের খবর পাবার সাথে সাথেই রালফ ভ্যান ডার বার্গ সুং শিপিং এজেন্টকে ডেকে এনে অভিযানের আগাপাশতলা জেনে নেয়ার জন্য জেরা শুরু করে দিল।
হ্যাঁ-প্রথমে যাব আইওর দিকে। তারপর ইউরোপার আশপাশদিয়ে একটু উড়ে যাওয়া…
শুধু উড়ে যাওয়া? কত কাছ দিয়ে?
এক মিনিট, ব্যাপারটা বেখাপ্পা। ফ্লাইট প্ল্যানে বিস্তারিত কিছু লেখা নেই। কিন্তু অবশ্যই যানটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে যাবে না।
শেষ আইনে নিষিদ্ধ দূরত্ব ছিল দশ হাজার কিলোমিটার। পনের বছর আগের কথা। যাই হোক, আমি মিশন প্ল্যানেটোলজিস্টের পদে স্বেচ্ছাসেবী হতে চাই। আমার বায়োডাটা পাঠিয়ে দেব…
না-না। সেসবের দরকার নেই, ড, ভ্যান ডার বার্গ। তারা এরই মধ্যে আপনার নাম মনোনয়ন করে আপনাকে অনুরোধের চিন্তাভাবনা করছে।
.
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে–চিরাচরিত রীতি। বুদ্ধি বাড়ার পর মানুষ যখন পেছনে তাকায় (পরে তাকানোর অনেক সময় থাকে। তখন অনেক ভুল চোখে পড়ে। পরে, ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস চার্টারে অনেকগুলো অসঙ্গতি দেখতে পেল। দুজন ক্রু অসুস্থ ছিল, একেবারে হন্তদন্ত হয়ে তাদের বদলে অন্যদের বসানো হয়েছিল তখন। তখন বদলি ক্রু পেয়েই সে আহ্লাদে আটখানা-তাদের কাগজপাতি খুঁজে দেখার জন্য তেমন একটা গা করেনি-অথচ করার কথা ছিল। (অবশ্য আঁতিপাতি করে খুঁজেও কোনো গরমিল পাওয়া যেত না…)
এরপরই কার্গো নিয়ে ভ্যাজাল শুরু। ক্যাপ্টেন হিসেবে শিপের প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখার দায়িত্ব তার এক্তিয়ারেই পড়ে। যে যাই বলুক, খুঁটিনাটি সব আসলে দেখা যায় না-তবু কারণ থাকলে সব দেখতে কোনো আপত্তি নেই তার। কুরা সাধারণত নিখুঁত হয়ে থাকে, অন্তত শারীরিক দিক দিয়ে। তবু লম্বা মিশন বিরক্তিকর হতে পারে, তাই গা-ঝাড়া দেয়ার পানীয় নিয়ে নেয়া হয় সাথে করে। এমিতে পৃথিবীতে পুরো বৈধ হলেও মহাকাশ অভিযানে স্নায়ু উত্তেজক তরল যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই নিয়ম।
সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েড যখন নিজের সন্দেহের কথা তুলল তখন ক্যাপ্টেন তেমন গা করেনি। বলেছে শিপের ক্রোমাটোগ্রাফিক পরীক্ষায় উচ্চ স্তরের ওপিয়াম পাবার আরেক খনি আবিষ্কার করেছে যা চীনা কুরা ব্যবহার করে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু এবার ব্যাপারটা সিরিয়াস-খুবই সিরিয়াস। মহাকাশরথে নেশার আফিম!
কার্গো হোল্ড থ্রি, আইটেম ২/৪৫৬, ক্যাপ্টেন। তালিকায় লেখা আছে, সায়েন্টিফিক এ্যাপারেটাস। কিন্তু ভিতরে বিস্ফোরক ঠাসা।
কী!
অবশ্যই, স্যার। এইযে, ইলেক্ট্রোগ্রাম।
আমি আপনার মতামত নিব এ ব্যাপারে, মি. ফ্লয়েড। দেখেছেন নাকি জিনিসগুলো?।
না, স্যার। একটা সিল করা ক্রু কেসের ভিতরে রাখা আছে। আধ মিটার বাই এক মিটার বাই পাঁচ মিটার… প্রায়। সায়েন্টিফিক টিমের আনা সবচে বড় প্যাক গুলোর অন্যতম। লেবেল আঁটা আছে, সুর-সাবধানে নাড়াচাড়া কন্য। ভুলে যাওয়া যাবে না, বাকী সবকিছুই কিন্তু ভঙ্গুর, সাবধানে নাড়াচাড়া করা উচিত।
ক্যাপ্টেন নিজের ডেস্কের বিশেষায়িত প্রাস্টিক কাঠের গায়ে আঙুল দিয়ে তাল ঠুকতে লাগল। সে অভ্যাসটাকে ঘৃণা করে, আর ছাড়ার চেষ্টা করে অনেক-কিন্তু কাজ হয় না।) এই সামান্য কাজই তাকে চেয়ার থেকে ঠেলে তুলল, তারপর বিগড়ে গেল মন-মগজ আরো! এই গাধাটে কাজ কী করে সে করে একজন স্পেস ক্যাপ্টেন হয়ে! পা দুটোকে চেয়ারের সাথে বেঁধে নিয়ে তাকালো তরুণ ফ্লয়েডের দিকে।
এম্নিতে সে ব্যক্তিগতভাবে ফ্লয়েডের রিপোর্টের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে না। তার নতুন সেকেন্ড অফিসার দারুণ কর্মক্ষম। সে সবচে বড় কথা, কখনোই নিজের ভুবনখ্যাত দাদার কথা তোলে না। ব্যাপারটার এক সরল ব্যাখ্যা থাকতে পারে। হয়তো পরীক্ষণের সময় অন্যান্য কেমিক্যালের সাথে দুর্বল আণবিক বলের সম্পর্ক ধরা পড়েছে, এমন সম্পর্ক অনেকটা টেলিপ্যাথির মতো, হতেই পারে। ফলে সংবেদী পরীক্ষার রেজাল্ট দেখা যাবে একটু ভীতিকর, যদিও বাস্তবে কোনো সমস্যা নেই।
তারা ইচ্ছা করলেই হোন্ডে গিয়ে প্যাকেজ খুলে দেখতে পারে। না, জোর করা ঠিক হবে না। তার উপর বিপদ হওয়া বিচিত্র নয়। সাথে সাথে লিগ্যাল প্রব্লেম হওয়া
খুবই সম্ভব। আইনি জটিলতা বড় খারাপ জিনিস। তারচে খবরটা উপরের সিঁড়িতে পাঠিয়ে দিলেই হল, পরে ঝামেলা নিজের ঘাড়ে পড়বে না। আজ হোক আর কাল, এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলেও কেউ দুষতে পারবে না তখন।
প্লিজ, ড. অ্যান্ডারসনকে একটু ডেকে পাঠান-অন্য কারো কাছে এ নিয়ে কোনো কথা না বলাটাই ভাল।
ভেরি গুড, স্যার। ক্রিস ফ্লয়েড একটা সশ্রদ্ধ কিন্তু অপ্রয়োজনীয় স্যালুট করল, তারপর একেবারে সুড়ৎ করে ভেসে বেরিয়ে গেল ঘরটা থেকে।
সায়েন্টিফিক টিমের লিডার জিরো গ্র্যাভিটিতে মোটেও অভ্যস্ত নয়; বেচারার নড়াচড়া নিতান্ত আড়ষ্ট। আপনার সহজাত প্রতিভা এক্ষেত্রে তেমন কাজে দিচ্ছে না বরং দৃষ্টিকটুভাবে বেশ কবার ক্যাপ্টেনের ডেস্ক আঁকড়ে ধরতে হয়েছে তাকে।
এক্সপ্লোসিভ! অফ কোর্স নট! ম্যানিফেস্টটা দেখতে দিন তো… ২/৪৫৬…
ড. অ্যান্ডারসন তার পোর্টেবল কিবোর্ডে কথাটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ে গেল, পঞ্চম মাত্রার পেনিট্রোমিটার। অর্থাৎ কিনা প্রবেশ-সম্ভাবনা মাপক। পরিমাণ-তিনটি। অবশ্যই-কোন সমস্যা নেই।
এবং ঠিক কী জিনিস এই পেনিট্রোমিটার বা প্রবেশ সম্ভাবনা মাপক? আড়ষ্ট একটা হাসি ঝুলে আছে ক্যাপ্টেনের মুখে।
“স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যানেটারি স্যাম্পলিং ডিভাইস। আপনি শুধু ছেড়ে দিবেন, আর যে কোনো মূল্যে সে চলে যাবে দশ মিটার গভীরে। এমনকি পাথরের উপরিতল হলেও কোনো অসুবিধা নেই। তারপরই একটা পূর্ণ রাসায়নিক বিশ্লেষণ পাঠাবে। শুক্রের বা বুধের দিবা অংশে গবেষণা চালানোর উপযোগী একমাত্র জিনিস। একথা আইওর ক্ষেত্রেও চলবে। সেখানেই আমরা প্রথমটা ফেলতে যাচ্ছি।
ড. অ্যান্ডারসন। শীতল কণ্ঠ ক্যাপ্টেনের, আপনি একজন চমৎকার দক্ষ ভূগোলবিদ হতে পারেন, অবশ্যই আপনি সৌরজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ। কিন্তু, শ্রদ্ধার সাথেই বলছি, আপনি মহাজাগতিক প্রকৌশলের ঘোড়াই জানেন। মরে গেলেও অর্বিট থেকে জিনিসপত্র ছুঁড়তে পারবেন না। সেগুলো বেকুবের মতো ঘুরতেই থাকবে জীবনভর।
সাথে সাথেই বিজ্ঞানীর চেহারায় অপমানের রেখা ফুটে উঠল ।
বেকুবের দলই কাজটা করবে… বলল সে, অবশ্যই। আপনার কথাটা যোগ করা উচিত ছিল।
“একেবারে ঠিক কথা। জিনিসটাকে ছুঁড়ে দেয়া যাবে না, বরং জিনিসটাই ধেয়ে যাবে। এবং তাতে সলিড রকেট ফুয়েল থাকলেই তা সম্ভব। সলিড রকেট ফুয়েলকে সরাসরি বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ মালামাল। এবং এটাই এর ক্লাসিফিকেশন। আমি প্রস্তুতকারকের লিখিত ক্লিয়ারেন্স চাই এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনার গ্যারান্টিও প্রয়োজন। আর যাই হোক, সেফটি সিস্টেম একেবারে পারফেক্ট না হলে চলবে না। যদি না হয় তো মালামাল নামানো ছাড়া অন্য কোনো গতি নেই। এখন, আর কোনো ছোট্ট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে নাতো? আপনারা কি সিসমিক সার্ভের পরিকল্পনা করেছিলেন? আমার বিশ্বাস, ভূ-কম্পন বিষয়ক যন্ত্রপাতির মধ্যে যেগুলো গবেষণায় লাগে সেগুলোতে বেশ খানিকটা করে বিস্ফোরক ঢোকানো থাকে…
ঘণ্টা কয়েক পরে দেখা গেল ফুরিনের দুটো সিলিন্ডারও পাওয়া গেছে কার্গোতে। এগুলো অতি শক্তিশালী লেজার রশিকে হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিধ্বংসী করে রাখে । মানুষের কাছে সর্বভেদী লেজারও ছোঁয়াচে ভয়, এবং যথারীতি বিশুদ্ধ ফুরিন সেই লিস্টেই পড়ে। কিন্তু পেনিট্রোমিটারকে ঠিক জায়গামতো ফেলার জন্য লেসার গাইডেড রকেট ছাড়া তেমন কোনো সস্তা পথ নেই, তাই এটাও উতরে যেতে পারে।
সব প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেয়া হয়েছে-এমন বোঝার পরই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সায়েন্টিফিক টিমের কাছে মাফ চেয়ে নিল। বলল, তার সবটা সতর্কতাই শুধু শিপ ও যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নেয়া হয়েছে, আর বেচারা কী করবে, তাদের এমনভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় যে সহজাত প্রবৃত্তির জোরেই হাজারটা প্রশ্ন করে বসে, খুঁতখুঁতে ভাব যায় না।
সে একটু আশ্বস্ত বোধ করছে, ড. অ্যান্ডারসনের কথা হয়তো সত্যি। কিন্তু এরই মধ্যে মিশন নিয়ে ঘাপলা বসে গেছে মনে। স্পেস ক্যাপ্টেনদের মনকে ঘষে ঘষে এমন করে তোলা হয় যে তারা বাতাস থেকেই বিপদের গন্ধ শুঁকতে জানে।
কিন্তু ঠিক কতটা বেখাপ্পা যে হবে তা সে এখন কল্পনাও করতে পারছে না।
২৩. নরকের আগুন
বিস্ফোরণের আগে সৌরজগতে শুক্রের পর আইওই দোজখের সবচে কাছাকাছি এলাকা ছিল বৃহস্পতি। কিন্তু বৃহস্পতির নবরূপ লুসিফার এখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম নির্বাচিত, অবশ্যই সৌরজগতপতি সূর্যকে হিসাবের বাইরে রাখতে হবে।
লুসিফারের জন্মের পর আইওর ক্ষমতা বেড়ে গেছে কয়েকশো ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে। এখন এর সাথে শুত্রু মোটেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। সালফার আগ্নেয়গিরি আর উষ্ণ প্রসবণগুলো তাদের কার্যক্ষমতা কয়েকগুণ করেছে। আজকাল এর চেহারা দশকে দশকে বদলায় না, বরং বছরখানেক সময়ই যথেষ্ট। ম্যাপ বানানোর কোনো চেষ্টাই করে না এখন আর গ্রহবিদের দল। বরং কয়েকদিন পর পরই অর্বিটাল ফটোগ্রাফ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের। এ থেকে তারা নরক-আগুনের পালা বদল টাইপের সিনেমাও বানাতে পারে ইচ্ছা করলে।
এই মিশনের জন্য লন্ডনের লয়েডস বেশ মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম বাগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু দশ হাজার কিলোমিটার দূর দিয়ে উড়ে যেতে থাকা শিপের জন্য আসলে আইও কোনো হুমকি নয়।
দূর থেকে আসতে থাকা কমলা-হলুদ রঙা গ্রহটাকে দেখে ক্রিস ফ্লয়েড অর্ধশত বছর আগের কথা মনে না করে পারে না। এ পথেই তার দাদু চলেছিল সদর্পে। এখানে, ঠিক এখানেই বিখ্যাত শিপ লিওনভ মিলিত হয়েছিল পরিত্যক্ত ডিসকভারির সাথে। এখানেই ড. চন্দ্রশেখরামপিল্লাই তার পাগলা কম্পিউটারকে জাগিয়ে তোলে দু হাজার দশে। তারপর দু শিপই এল-১ এ ভাসতে থাকা বিশাল কালো মনোলিথের আগাগোড়া দেখে বেড়িয়েছিল।
এখন আর কোনো মনোলিথ নেই। নেই জুপিটার বা বৃহস্পতি বলে কোনো গ্রহ। এই ছোট্ট সূর্যটা ফিনিক্স পাখির মতো বৃহস্পতির ছাই থেকে উত্থিত হয়ে নিজের উপগ্রহজগৎকে পরিণত করেছে এক নতুন সৌরজগতে। শুধু ইউরোপা আর গ্যানিমিডের পরিবেশ এক-আধটু মিলে যায় পৃথিবীর সাথে, তাপমাত্রার দিক দিয়ে। ব্যাপারটা এভাবে কদ্দিন এগুবে তাও কেউ জানে না। জীবন বিকাশে হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ বছর লেগে যেতে পারে, যদি কোটি কোটি বছর না লাগে।
গ্যালাক্সির বিজ্ঞানীদল আশা নিয়ে এল-১ এর দিকে তাকায়। যাওয়াটা মুখের কথা নয়। এখানে চিরকালই বৃহস্পতি-আইওর আগুন নদী বয়ে যেত, এখন লুসিফার তৈরি হওয়ার পর তাড়িতিক প্রবাহটার শক্তি বেড়েছে কয়েকশ গুণ। এমনকি মাঝেমধ্যে শক্তি-তটিনী খালি চোখে বেশ ভালভাবেই দেখা যায় । আয়োনিত সোডিয়ামের বৈশিষ্ট্যধারী উজ্জ্বল হলুদ রেখা। গ্যানিমিডের বিজ্ঞানীদের কী আফসোস, এই অসীম গিগাওয়াট যদি নিয়ে নেয়া যেত। কিন্তু কাজটা করার কোনো বাস্তব উপায় দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম পেনিট্রোমিটারটা ক্রুদের নানা সন্দেহের মুখে বেরিয়ে যায়, তার দু ঘণ্টা পর হাইপোডার্মিক সুচের মতো বিদ্ধ হয় উপগ্রহের গায়ে ।
প্রায় পাঁচ সেকেন্ড টিকে ছিল পরীক্ষা-বাণটা, ডিজাইন করার সময় যেখানে প্রত্যাশিত সময়ের পরিমাণ মাত্র টেনেটুনে আধসেকেন্ড। এবং দশগুণ বেশি টিকে থাকার কারণে লক্ষ লক্ষ অজানা ডাটা পাঠিয়ে গেল অবিরত। আশপাশের প্রতিটি মৌল-যৌগ-উপাদানের নাড়ী-নক্ষত্র মানুষের জানা হয়ে গেল এক পলকে। তারপর, আইওর সর্বগ্রাসী মুখ নিয়ে নিল বাণটাকে, মিশিয়ে দিল নিজের সাথে।
বিজ্ঞানীরা যার পর নাই খুশি। ভ্যান ডার বার্গ আরো এক কাঠি বাড়া। আইও মোটামুটি সহজ লক্ষ্য-এখানে কাজ হবে, এটাই সবার আশা ছিল। কিন্তু ইউরোপা নিয়ে তার সেই ভয়ংকর আবিষ্কার যদি ঠিক হয়ে থাকে তো পরের যন্ত্রটা নিশ্চই ব্যর্থ হবে।
তবু, প্রমাণ হবে না কিছুই। ডজনখানেক শক্তিশালী কারণে জিনিসটা ব্যর্থ হতে পারে। এবং ব্যাপারটা এমন হলে ল্যান্ডিং ছাড়া কোনো গতি থাকবে না।
কাজটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ-শুধু মানুষের আইনে নয়…
২৪. আমি ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন
অ্যাস্ট্রোপোল-তার এই বিশেষ টাইটেল থাকা সত্ত্বেও স্বীকার করে না যে আশাকার অস্তিত্ব থাকতে পারে। ইউ এস এস এ ও একই কথা বলে সব সময়। এবং এই আফ্রিকান দেশটার রাষ্ট্রদূতরা বেশ বিব্রত হন যদি কেউ এ নিয়ে মাতামাতি করতে থাকে।
কিন্তু নিউটনের তৃতীয় সূত্র জগতের আর সবকিছুর সাথে সাথে রাজনীতিতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। জগৎ কাঁপানো সূত্র। বান্ড সব সময়ই তার ভেতরে বেশ কয়েকজন কট্টর দক্ষিণ আফ্রিকা বিরোধী মানুষকে ক্ষমতায় রাখে। সাধারণত তারা আর্থিক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। তবু মাঝেমধ্যেই বাস্তব বিস্ফোরণ আর হত্যাকাণ্ড যে হয়না তা নয়।
বলা বাহুল্য, আফ্রিকানরা ব্যাপারটাকে হাল্কা করে নেয়নি। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তারাও নিজেদের অফিশিয়াল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস গঠন করে। তাদের কাজের ক্ষেত্র যথারীতি স্বাধীন; এর জন্য তেমন একটা জবাবদিহিতা করতে হয় না অপারেটরদের। এবং জ্ঞানী লোকের মতো আফ্রিকানরাও তাই শাকার ব্যাপারে কিছু জানে না। তারা হয়তো সি আই এর সেই বিখ্যাত অস্বীকার নীতিকে নিজেদের আদর্শের ভেতরে নিয়েছে। এ-ও হতে পারে, তা কথা সত্যি।
এক উৎসের মতে, শাকা আসলে একটা কোডওয়ার্ড। তারপর হয়তো এ নাম জনপ্রিয় এবং কার্যকর হয়ে যাবার পর কাজ শুরু হয়ে গেছে সাথে সাথে। একটা বিষয় গোয় ধরার মতো, কেউ কোনোদিন ধরা পড়ার পর বলেনি যে সে শাকার এজেন্ট বা অপারেটর।
এ কথার অন্যরকম ভয় ধরানো ব্যাখ্যাও থেকে যায়, হয়তো তারা ধরা পড়তে জানে না। জিজ্ঞাসাবাদের সম্ভাবনা দেখা যাবার সাথে সাথে নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার মতো মন-মানসিকতা সিক্রৈট এজেন্টের এম্নিতেও থাকে, তার উপর মানসিকভাবে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুললেতো কথাই নেই।
সত্যি যাই হোক না কেন, কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি যে দুশ বছর আগে জীবন দেয়া সামান্য কিন্তু বীর সেই জুলুর নামে সারা দুনিয়ায় এমন শত শত জুলু ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং একইভাবে কাজ উদ্ধারের আশায় জীবন লুটিয়ে দিতে পারে।
সেই উপজাতীয় লোকটাও নিশ্চই ভাবেনি।
২৫. কফিনে মোড়ানো ভুবন
বিস্ফোরণের পর পর এক-দু দশক বৃহস্পতির সেই শ্বাসরুদ্ধকর নিষেধাজ্ঞার কথা মনে করে কখনোই ইউরোপাকে ঘটানো হয়নি। এরপর চীনারা মেঘের উপর দিয়ে দ্রুত উড়ে যায় একবার; শুধু তাদের সেই জিয়াং এর ধ্বংসাবশেষকে একটু চিনতে পারার আশায়।
শিপটাকে তারা পায়নি, কিন্তু তাদের হাতেই প্রথমবারের মতো উপগ্রহটার দিবা ভাগে বরফের আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠা নতুন নতুন মহাদেশের একটা মোটামুটি চিত্র ধরা পড়েছে।
এমনকি একটা নিরেট, দু কিলোমিটার জুড়ে থাকা বস্তুর সন্ধান পেয়েছে সেখানে; ঠিক যেন চীনের দেয়ালের মতো নিরেট। এমন গঠনের কারণেই সেই মনোলিথটার মতো মনে হয় জিনিসটাকে, কিংবা সেই লাখো মনোলিথের জোড়া ভাই-যারা বৃহস্পতি ভেঙে লুসিফার গঠন করেছিল।
যাই হোক, কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। না ছিল বুদ্ধিমত্তার কোনো সংকেত। অবশ্য সুস্থির ভারী মেঘের নিচ থেকে সভ্যতার চিহ্ন দেখতে হলে অন্তত ছ হাজার বছর আগে মানুষ যতটুকু সভ্য ছিল-প্রাণীদের ততটুকু সভ্য হতে হবে। তাহলেই পিরামিড আর রাজমহল দেখে বোঝা সম্ভব। কিন্তু বিপদ দেখা দেয়নি। সুতরাং স্থায়ী সার্ভে স্যাটেলাইট বসানোয় কোনো বাধা ছিল না। বাতাসের ধরন দেখার জন্য দু একটা বেলুন পাঠানোও দোষের নয়। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখে ইউরোপার মধ্যখানে একটা সুন্দর সাগর জেগে উঠছে, চারপাশে জাগছে ভূমি, আর আছে একটা স্থির সূর্য-যেমনটা দেখা যায় বাচ্চাদের টেক্সট বুকে।
এবং, তখন থেকেই শুরু ইউরোপান রোলেট। প্রশাসনের লোকেরা ব্যাপারটাকে নিষ্ঠুর জুয়া খেলা বলেই মনে করে বিজ্ঞানীরা একটু একটু করে কাছে যাচ্ছে, একটু একটু করে সাহস বাড়াচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে ঝুঁকি।
পঞ্চাশটা ঝুঁকিহীন বছর পেরিয়ে আসার পর ব্যাপারটা বেশ বোরিং হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস আশা করে ব্যাপারটা তেম্নি থাকবে, আর তার উপর ড. অ্যান্ডারসনের নিশ্চয়তা তো আছেই।
পার্সোনালি নিতে গেলে, বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, আমি ব্যাপারটাকে একটু অ-বন্ধুসুলভ বলে ধরে নিব। বিশেষত যদি টনখানেক এক্সপ্লোসিভসহ একটা জিনিস হাজার কিলোমিটার গতিতে আমার বুকে নেমে আসে তো কথাই নেই। ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল যে আপনাকে অনুমতি দিয়েছে দেখেশুনে আমি বেশ অবাক হলাম।
ব্যক্তিগতভাবে ড. অ্যান্ডারসনও কম অবাক হয়নি। কিন্তু ব্যাপারটা এসেছে অন্যভাবে। এক শুক্রবারের অলস বিকালে বিশাল সায়েন্টিফিক লিস্টের নিচের দিকে একটু অবহেলা আর অসম্পূর্ণ করে ব্যাপারটাকে তুলে ধরা হয়। তবু চোখ এড়ানোর কথা নয়, কীভাবে এড়ালো আল্লা মালুম।
“আমিও একই কথা বলি, ক্যাপ্টেন। কিন্তু আমাদের কাজকর্ম অনেক শক্ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ঘটছে। এবং আসলে ঐ… কী বলে… ইউরোপানদের দিনযাপনে নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই, তারা যা-ই হোক না কেন। আমরা সি লেভেলের পাঁচ কিলোমিটার উপরে একটা টার্গেটে এইম করব।
ও, বুঝলাম। মাউন্ট জিউস নিয়ে মানুষের কৌতূহলের কোনো শেষ নেই।
জিনিসটা আগাগোড়া রহস্যে মোড়া। এমনকি মাত্র কয়েক বছর আগে সেখানে ছিলই না। বুঝতেই পারছেন, কেন ভূগোলবিদরা এমন পাগল হয়ে গেছে এটা নিয়ে।
এবং আপনাদের ঐ দূতটা নেমে যেতে যেতে পর্বতকে বিশ্লেষণ করবে, এইতো?
ঠিক তাই। আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে না, তবু, আমাকে সমস্ত রিপোর্ট গোপন রাখতে হবে। কোড করা অবস্থায় পাঠাতে হবে পৃথিবীর বুকে। আর কেউ একজন বেশ বড় একটা আবিষ্কারের পথে আছে, সে চায় না প্রকাশনার কাছে হেরে যেতে। আপনার বিশ্বাস হয়, বিজ্ঞানীরা এতো চাপা স্বভাবের হতে পারে…
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস বেশ সহজেই ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারে। যত সময় যাচ্ছে ততই কাপ্তান দেখছে, বেচারা ড. অ্যান্ডারসন মিশন সম্পর্কে খুব একটা জানে না।
আমার শুধু একটাই আশা, ডক্টর-ইউরোপানরা যেন পর্বত বেয়ে উপরে না যায়। আমি তাদের স্থানীয় পর্বতের গায়ে পতাকা এঁটে দেয়ার পথে বিন্দুমাত্র বাঁধা দেখতে চাই না।
.
পেনিট্রোমিটার ছাড়ার পর পরই গ্যালাক্সি জুড়ে কেমন একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি অপ্রতিরোধ্য যে কৌতুকগুলোর চর্চা সর্বক্ষণ চলতেই থাকে, সেসবও কেমন থিতিয়ে এল হঠাৎ! আসলে পোব নামার এই লম্বা দুই ঘণ্টা ক্রুর সবাই একটা কাজের ছুতো পেয়ে উত্তেজনা ভোলার পথ পেল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে কন্ট্রোল রুম আর ব্রিজের দিকে। পনেরমিনিট আগে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সবাইকে সরিয়ে দিল শুধু নতুন স্টুয়ার্ডেস রোজি আর তার আনা চমৎকার কফির টিউবের সেখানে থাকা বৈধ।
সব ঘটে গেল একেবারে ঠিকমতো। বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সাথে সাথে, এ্যারোব্রেকিং প্রযুক্তি চালু হয়ে গেল গতি একটু কমিয়ে আনার লক্ষ্যে। টার্গেটের রাডার ইমেজ দেখেশুনে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাপার কোনো উপায় যেন নেই। বড় হচ্ছে, আরো আরো বড় হচ্ছে। তারপর মাইনাস ওয়ান সেকেন্ডে সব রেকর্ডারের কাজের গতি বেড়ে গেল হাজার গুণ…
কিন্তু রেকর্ড করার মতো কিছুই নেই।
এবার আমি বুঝলাম, বলল ড. অ্যান্ডারসন, বিমর্ষনে, প্রথম রেঞ্জাররা চাঁদের বুকে নিজেদের সবসুদ্ধ ভেঙে পড়ার সময় কী কষ্ট পেয়েছিল।
২৬. রাতের আকাশ
একমাত্র সময়ই সারা সৃষ্টিজগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাত আর দিন একেবারে স্থানীয় হিসাবের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা যায়। এই এলাকায় জোয়ারের সাথে ঘূর্ণনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মানুষ তার ঘরের কোণা ছেড়ে যত দূরেই যাক না কেন, তার সেই চিরাচরিত দিন-রাতের হিসাব কখনো ভুলতে পারবে না।
তাই, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ ইউনিভার্সাল টাইম রাত একটা পচে যখন ব্রিজে দাঁড়ানো তখন পুরো গ্যালাক্সি ঘুমিয়ে কাদা। তারও জেগে থাকার কোনো মানে হয় না। সে বুঝে ওঠার আগেই গ্যালাক্সির ইলেক্ট্রনিক সেন্সর টের পেয়ে যাবে যে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি। তবু, অপ্রত্যাশিতের সাথে লড়ার ক্ষেত্রে মানুষ সব সময় যন্ত্রের চেয়ে এক কাঠি বাড়া-সাইবারনেটিক্সের এক শতাব্দী এ কথাটা প্রমাণ করে বসেছে। আর এখন বা তখন-অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটবেই।
কফি কোথায়? ভাবল চ্যাঙ বিরক্ত হয়ে, রোজির তো দেরি হবার কথা নয়। গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যর্থতায় ক্রু আর বিজ্ঞানীদের মনে যে দক্ষযজ্ঞ চলছে তার কোনো আসর স্টুয়ার্ডের উপরও পড়েনিতো!
প্রথম পেনিট্রোমিটারের ব্যর্থতার পর করণীয় নিয়ে দ্বিতীয় একটা মিটিং বসেছিল। পরের মিটারটা ক্যালিস্টোর জন্য ঠিক করা ছিল, তাতে কী? কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে সেটা এখানে ব্যবহার করলে?
যাই হোক, যোগ করেছিল ড. অ্যান্ডারসন, আমরা কোনোমতে ক্যালিস্টোর উপর ল্যান্ড করতে পারি। সেখানে ভাঙা বরফের টুকরা ছাড়া আর কী পাব?
কোনো দ্বিমত ছিল না। ক্যালিস্টোর জন্য পেন-প্রোবের কোনো দরকার নেই, সেখানে নামা যাবে। এখানে তৃতীয়টা ফেলে দেয়া যায়।
ঘণ্টা কয়েক প্রস্তুতির পর শেষটা নিক্ষেপ করা হল ইউরোপার বুকে; সেটাও পূর্বপুরুষের অদৃশ্য পথ ধরে এগিয়ে গেল নিচের রহস্যঘেরা মেঘের দিকে।
এবার শিপের রেকর্ডার কিছু তথ্য পেল ঠিকই, এক মিলি সেকেন্ডের অর্ধেক সময়ের জন্য! অ্যাক্সিলারেটোমিটার বিশ হাজার জি তেও কাজ করার কথা, সেটা নষ্ট হয়ে যায় এবার। নিশ্চই একটা চোখের পলক পড়ার হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে সব ধসে গেছে।
পরে, সাথে সাথেই পৃথিবীতে খবর পাঠানো হল, জবাব আসার আগে উচ্চ অর্বিট ধরে ঘোরাফেরা করবে তারা। আরো কিছু করার ইচ্ছা তাদের আছে, তবু পৃথিবীর এক-আধটু নির্দেশনা জরুরী।
স্যরি স্যার, দেরি হয়ে গেল। বলল রোজি ম্যাককোলেন। (কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি যে তার হাতের কফির চেয়ে সামান্য বেশি কালো তার গায়ের রঙটা।)
আমি স্যার নিশ্চই অ্যালার্মটা ভুল করে সেট করেছিলাম।
আমাদের দুজনেরই ভাগ্য ভাল। একটু বাঁকা হাসি দিল চ্যাঙ, যে তুমি শিপটা চালাচ্ছ না।
আমার মাথায় ঢোকে না কী করে কেউ এটাকে চালায়… সাথে সাথে বেশ ভদ্রভাবে জবাব দিল সে, …জিনিসটা বড়ই জটিল।
দেখে যতটা মনে হয় আসলে কিন্তু ততটা খারাপ নয়, রোজি। তার উপর বেসিক ট্রেনিং কোর্সে সবকিছু জানিয়ে দেয়ার কথা, তাই নয় কি?
আ… হ্যাঁ। কিন্তু আমি বেশিরভাগই বুঝে উঠতে পারিনি কখনো। অর্বিট আর যত্তসব ফালতু কথা…।
চ্যাঙ বুঝতে পারছে সময় নষ্ট করা ছাড়া লাভের লাভ কিছু হবে না। তার উপর রোজ ঠিক তার টাইপের নয়। যেটা চ্যাঙের সারা জীবনের ভালবাসা, সেটারই মাথামুন্ডু কিছু বোঝে না এবং বুঝতেও চায় না মেয়েটা। এ নিয়ে আফসোসের কী আছে? সবারতো আর এক বিষয়ে আগ্রহ থাকবে না… তবু, মেয়েটা বেশ আকর্ষণীয়। না, বেচারিকে আটকে রাখার কোনো মানে নেই। হয়তো ও ঘুমাতে চাচ্ছে।
বিশ মিনিট পরে, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ নেভিগেশন কনসোলের ব্যাপারগুলো দেখিয়ে কথা শেষ করল: তো, বুঝতেই পারছ, জিনিসটা আসলেই পুরোপুরি অটোম্যাটিক। তোমার শুধু দু-চারটা নম্বর টিপতে হবে, বাকীটা শিপের হাতে ছেড়ে দিলেই হল।
রোজকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে; সারাক্ষণ চেয়ে আছে হাতের ঘড়ির দিকে।
স্যরি। হঠাৎ বুঝতে পারল সেকেন্ড অফিসার, হুঁশ ফিরে পেয়েই বলল, তোমাকে আটকে রাখাটা ঠিক হয়নি।
ও, না! ব্যাপারটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। বলে যান, প্লিজ।
না-না। অবশ্যই নয়। অন্য এক সময় বাকীটা বলব। গুডনাইট রোজি… আর, থ্যাঙ্কস ফর দ্য কফি।
গুডনাইট, স্যার।
স্টুয়ার্ড থার্ড ক্লাস রোজ ম্যাককোলেন ভেসে চলল (খুব একটা দক্ষতার সাথে নয়) খোলা দরজার দিকে। বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে চ্যাঙ ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না।
কিন্তু একটু পরই একেবারে অপরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তার। নারীকণ্ঠ, সন্দেহ নেই, এবং রোজিরই কন্ঠ, কিন্তু কেমন যেন কাঠ কাঠ।
মি. চ্যাঙ, অ্যালার্ম বাটন চাপার কষ্টটা করবেন না। ডিসকানেক্ট করে দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। ল্যান্ডিং কো অর্ডিনেট দেখাচ্ছি, শিপ নামিয়ে নিন।
ধীরে, যেন কোনো দুঃস্বপ্নে চেয়ার ঘোরালো চ্যাঙ। মনে হচ্ছে দৃশ্যটা কোনো শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাকশন মুভির অংশ-সে এখুনি পপকর্ন চিবুতে চিবুতে চেয়ার ছেড়ে উঠবে, তারপর মুভি দেখা বন্ধ করে গ্যালাক্সির পরবর্তী ফ্লাইটের খবর নেবে।
গোলাকার হ্যাঁচওয়ের পাশে রোজি ম্যাককোলেন নামে পরিচিত মেয়েটা ভাসছে দরজার লকিং লিভারে হাত রেখে নিজেকে স্থির করে রেখে। মেয়েটার সবকিছুই যেন বদলে গেল মুহূর্তের মধ্যে। এক পলকেই তাদের পদাধিকারও যেন পাল্টে গেছে। লজ্জাবনত স্টুয়ার্ড, যেম কখনো সরাসরি চ্যাঙের চোখের দিকে চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত সেই কিনা এমন ঠাণ্ডা, নিষ্ঠুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যে চ্যাঙের নিজেকে সেই ইঁদুরের মতো মনে হল যেটা সাপের শিকারে পরিণত হবে জেনেও নড়তে পারছে না, কারণ সাপ তার দৃষ্টি এবং মাথার দোলা দিয়ে সম্মোহিত করে রেখেছে খেয়ে ফেলার ঠিক আগ মুহূর্তটায়। তার হাতের ছোট্ট কিন্তু কার্যকর অস্ত্রটাকে একেবারে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হল, এটা না থাকলেও তার কথা এবং ব্যক্তিত্ব পরিবেশের কর্তৃত্ব নিজের হাতে তুলে নিত। চ্যাঙের কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটা চাইলে এ অস্ত্র ব্যবহার না করেই তাকে নিশ্চিন্তে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
অনন্তর, তার আত্মসম্মান আর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা ঠিক করল, যাই হোক-বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র-মেদিনী। আর কিছু হোক না হোক, কিছুটা সময় বের করে নেয়া যায় ।
রোজ, সে বলল, এবং হঠাৎ বেখাপ্পা নাম উচ্চারণে ঠোঁট কেমন যেন অকেজো হয়ে আসে, কী অদ্ভুত ব্যাপার! এইমাত্র তোমাকে যা বলেছি, কথাগুলো মোটেও সত্য নয়। নিজে নিজে আমার পক্ষে আর যাই করা সম্ভব হোক না কেন, শিপ ল্যান্ড করানো অসম্ভব। সঠিক অর্বিট হিসাব করে বের করতেই ঘণ্টার পর ঘন্টা লেগে যাবার কথা। সেই সাথে সাহায্যকারীর দরকার পড়বে, অন্তত একজন কো পাইলট।
অস্ত্রের মুখ একটুও নড়ল না।
“আমি বোকার হদ্দ নই, মিস্টার চ্যাঙ। পুরনোদিনের রকেটের মতো এ শিপ মোটেও এনার্জি-লিমিটেড নয়। ইউরোপা থেকে উঠে আসার জন্য সেকেন্ডে মাত্র তিন কিলোমিটার স্পিড দরকার। মেইন কম্পিউটার নষ্ট অবস্থায় ল্যান্ড করাটা আপনাদের বেসিক ট্রেনিংয়ের অংশ। আপনি এখন ভালোয় ভালোয় সেটা প্র্যাকটিস করতে পারেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে চাই, ব্যস।
এ ধরনের কাজে, মনটাকে যথাসম্ভব মিষ্টি রাখার চেষ্টা করল চ্যাঙ, নয়তো মিষ্টি কথা বেরুবে না, ব্যর্থতার সম্ভাবনা পঁচিশ পার্সেন্ট। সত্যিকার হারটা আসলে শতকরা দশভাগ, আর ব্যাপারটার চর্চা নেই আমার অনেক বছর হল।
সেক্ষেত্রে, বলল রোজি ম্যাককোলেন, আমার আপনাকে আক্ষরিক অর্থে নির্জীব করে ক্যাপ্টেনের সহায়তা আশা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ব্যাপারটা বিরক্তিকর, কারণ আমরা এই জানালাটা হারাব, আর পরবর্তী সুযোগের জন্য আরো ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হবে। চার মিনিট বাকী।
সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ জানতো, খেল খতম। কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে দোষ নেই।
কো-অর্ডিনেটগুলো দাও…
২৭. রোজি
অ্যাটিচ্যুড কন্ট্রোল জেটের প্রাথমিক ধাক্কার শব্দেই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস জেগে উঠল। শব্দটা তেমন জোরালো নয়, যেন কোনো কাঠঠোকরা দূর থেকে গাছ ঠুকে চলেছে একটু একটু করে। প্রথমেই মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু না-শিপ এগিয়ে যাচ্ছে স্পেসের ভিতর দিয়ে, পরিবর্তন করছে দিক।
সম্ভবত কোনো একদিক একটু বেশি গরম হয়ে যাওয়ায় থামাল কন্ট্রোল সিস্টেম আপনাআপনি ছোটখাট কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিচ্ছে। এমনটা ঘটে খুব কম, এবং ঘটলে ধরে নেয়া হয় অফিসার অন ডিউটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ তাপীয় ইনভেলাপ পরিবর্তনটা তার চোখে পড়ার কথা।
ইন্টারকম বাটনে চাপ দিয়ে জানতে হবে কে এমনটা করছে… মি. চ্যাঙ ব্রিজে আছেন… তার হাত কখনোই কাজটা শেষ করেনি।
ওজনহীনতায় অনেক অনেক দিন কাটানোর পর সাধারণ মাধ্যাকর্ষণের দশভাগের একভাগই বেশ আঘাত হিসেবে আসে। ক্যাপ্টেনের মনে হল ব্যাপারটা বেশ কমিনিট ধরে ঘটছে যদিও এতোক্ষণ লাগার কথা নয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট। কিন্তু সেফটি হার্নেস থেকে গা ছাড়িয়ে নিতে নিতেও ব্যাপারটা থামছে না কেন? এবার বাটনটা পেয়েই সে চেপে ধরল, কিন্তু কোনো জবাব নেই।
জিনিসপত্র এমিতে বেঁধেছেদে রাখা হলেও ওজনহীনতার দিনগুলোতে ব্যাপারটা একটু ঢিলেঢালাভাবে এবং অন্যপথে করা হয়। জিনিসপত্র বেশ ধীরে ধীরে পড়ছে, কিন্তু চমকে যাবার মতো ব্যাপার হল-আসল ড্রাইভ তার মূল জেটটায় প্রজ্বলন ঘটিয়েছে, পূর্ণ শক্তিতে….
সে কেবিনের ছোট্ট জানালায় লাগানো পর্দাটা জোরেসোরে সরিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, তাকায় নক্ষত্রমণ্ডলের দিকে, মোটামুটি জানা আছে ঠিক কোনদিকে শিপের মুখ থাকার কথা-যদি ব্যতিক্রমটা মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ ডিগ্রি হয় তবু দুটো সম্ভাব্য ব্যাপার ধরে নেয়া যায়।
গ্যালাক্সির ভেক্টর বদলে যাবে হয় বাড়ানোর জন্য, নয়তো কমানোর জন্য। ইউরোপায় নামার পথে এগুলোই হওয়ার কথা।
দরজায় বেশ অধৈৰ্য্য টোকা পড়ার শব্দ পেয়ে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারল এক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে কেউ আসার চেষ্টা করছে। চিকন প্যাসেজওয়েতে সেকেন্ড অফিসার ফ্লয়েড আর দুজন ক্রু ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
দ্য ব্রিজ ইজ লভ, স্যার রিপোর্ট করল ফ্লয়েড, রুদ্ধশ্বাসে, ভেতরে যেতে পারছি না। চ্যাঙও কোনো সাড়া দেয়নি। কী হল, জানিনা কিছুই…
ভয় হচ্ছে, আমি বোধহয় জানি। সোজাসাপ্টা জবাব দিল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, কোনো না কোনো পাগল এ কাজ করতই, আজ অথবা কাল। আমরা হাইজ্যান্ড হয়েছি। কিন্তু কেন? যদি জানতে পারতাম!
সে দ্রুত ঘড়িতে চোখ বুলিয়েই একটা ছোট্ট হিসাব কষে নিল।
এই থ্রাস্ট লেভেলে আমরা মিনিট পনেরোর মধ্যে অর্বিট ছেড়ে যাব। দশ মিনিট হলে নিরাপদ হতো। শিপের কোনো ক্ষতি না করে মূল ড্রাইভকে অকেজো করার কোনো উপায় আছে নাকি?
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সেকেন্ড অফিসার যুকে বেশ অসন্তুষ্ট লাগছে, কিন্তু সাথে সাথে জবাব দিয়ে সে সাহায্য করল।
পাম্প মোটর লাইন থেকে সার্কিটগুলো তুলে ফেলা যায়, সেক্ষেত্রে প্রোপ্যাল্যান্ট সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে।
ওদের কাছে যাওয়ার কোনো উপায়?
হু-ডেক থ্রিতে সেগুলো সাজানো।
তাহলে চলুন।
“আরে… তখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্যাকআপ সিস্টেম দায়িত্ব তুলে নিবে। নিরাপত্তার জন্য সেটা ডেক ফাইভের একটা লক করা বাল্কহেডের পেছনে লুকানো থাকে। একটা কাটার দরকার পড়বে, না… সময় মতো শেষ করা সম্ভব নয়।
এই ভয়ই পাচ্ছিল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। গ্যালাক্সির ডিজাইনার মেধাবী লোকগুলো শিপটাকে সব রকমের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানোর পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করেছিল। কিন্তু মানব-শত্রুর হাত থেকে পুরোপুরি বাঁচানো কখনোই সম্ভব নয়।
কোনো বিকল্প?
এখন নেই, যতটুকু বুঝতে পারছি।
তাহলে চলুন, ডেকের দিকে যাই। চ্যাঙ আর তার সাথে যে-ই থাক না কেন, কথা বলার চেষ্টা করতে হবে।
এবং কে হতে পারে? তার নিয়মিত ক্রুদের কারো এমন মতিভ্রম হওয়া অসম্ভব। বাকী থাকে… হু, এখানেই জবাব লুকিয়ে আছে। পাগল বিজ্ঞানীদের অ্যাচিভমেন্টের শেষ চেষ্টা যেমন হয়…
ঠিক, ড. অ্যান্ডারসন নোবেল প্রাইজটা লুফে নেয়ার শেষ চেষ্টা করছে।
ধারণাটা ভেঙে গেল হাঁপাতে থাকা বিজ্ঞানীর কণ্ঠ শুনে, খোদার কসম, ক্যাপ্টেন, কী হল! ফুল থ্রাস্ট চলছে! কোনদিকে যাচ্ছি? উপরে না নিচে?
নিচে। বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, দশ মিনিটের মধ্যে ইউরোপাকে ক্রস করছে এমন একটা অর্বিটে পৌঁছে যাব। একটাই আশা, কন্ট্রোলে যে আছে সে যদি যা করছে তার মানেটা বুঝতে পারে…
তারা এখন ব্রিজে, বন্ধ দুয়ারের অপর পাশে।
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস তার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, সর্বশক্তিতে। দিস ইজ দ্য ক্যাপ্টেন! লেট আস ইন!
সে এরপরই ব্যাপারটা বুঝল, অবশ্যই অমান্য করা হবে এমন কোনো আদেশ জোরগলায় দেয়াটা বোকামী। কিন্তু এমন অবস্থায় সাধারণত একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় অপরাধী, এবং কোনো না কোনো জবাব দিয়ে বসে। ঠিকই, সে জবাব পেল।
বাইরের স্পিকার হিসহিসিয়ে উঠেছে, তারপরই ভেসে এল একটা কণ্ঠ, বোকার মতো কিছু করে বসবেন না, ক্যাপ্টেন। আমার হাতে একটা গান আছে, আর মি. চ্যাঙ আমার আদেশমতোই কাজ করে যাচ্ছেন।
কে রে? ফিসফিস করে উঠল একজন ক্রু, মহিলার কণ্ঠ মনে হল!
অবশ্যই। বলল কাপ্তান। আর সব সন্দেহ ঝেড়ে ফেলা গেলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধা হচ্ছে না।
কী করতে পারি আমরা? তুমি কী আশা কর? এ শিপটা নিয়ে তুমি সম্ভবত বেরিয়ে যেতে পারবে না, জানতো? একটু কর্তৃত্বের সুর ফুটিয়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা তার গলায়।
ইউরোপায় নামতে যাচ্ছি আমরা। আর, আবার কখনো টেক অফ করার ইচ্ছা থাকলে আমাকে থামানোর চেষ্টা করবেন না।
তার রুম পুরোপুরি পরিষ্কার। ত্রিশ মিনিট পর সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েড রিপোের্ট করল। এতোক্ষণে থ্রাস্ট থেমে গেছে, কিন্তু বাকীটা ভবিতব্য। বাঁকা কক্ষপথ ধরে শিপ সোজা ইউরোপায় ঢুকবে। এখন ইঞ্জিন নষ্ট করা সম্ভব-কিন্তু কাজটা আত্মহত্যার শামিল। বরং জিনিসপাতি ঠিকঠাক থাকলে পরে কখনো ওড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
রোজি ম্যাককোলেন! কে বিশ্বাস করবে এ কথা! আপনার কী মনে হয়, ও নেশা-টেশা করেনিতো?
জবাব দিল ফ্লয়েড, না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একাজ করা অসম্ভব। খুব সূক্ষ্মভাবে প্ল্যান করা হয়েছে। শিপের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো লুকানো রেডিও পাওয়া যাবে। সেটা খুঁজে পেলেই বরং ভাল হবে আমাদের জন্য। কু পেতেও পারি…
আপনার কথাবার্তা ঠোলাদের মতো লাগছে। জানেন তো, পুলিশের অজনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এ শব্দ ব্যবহার করা হয়?
যথেষ্ট হয়েছে, ভদ্রমহোদয়গণ! বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। ধৈৰ্য্য টলে যাচ্ছে সবার। তার উপর কেউ কন্ট্রোলের সাথে কথা বলতে পারছে না। সে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো।
আর দু ঘণ্টাও বাকী নেই। বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ব। কেবিনে গেলাম। আমাকে ডেকে নেয়ার একটা সম্ভাবনা আছে এখনো। মি. য়ু, ব্রিজের দিকে দাঁড়ান, প্লিজ। কোনো উন্নতি দেখলে ডাকবেন।
জীবনে কখনো এতো অসহায় অবস্থায় পড়েনি সে। কিন্তু মানুষের জীবনে মাঝেমধ্যে এমন সময় আসে যখন কিছু না করাটাই একমাত্র করণীয় হয়ে দাঁড়ায়।
অফিসারদের কামরা ছেড়ে আসার সময় শুনতে পেল পিছনে কে যেন বলছে, আমার এক টিউব কফি হলেই চলবে। রোজির মতো এত সুন্দর কফি আর কাউকে বানাতে দেখিনি আমি।
হু, সে দারুণ সিরিয়াস। যে কাজই নিক না কেন, সুচারুভাবে করবে…
২৮. কথোপকথন
গ্যালাক্সিতে একজনই আছে যে পুরো ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো হিসেবে নিতে জানে। আমি হয়তো মরতে বসেছি, কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে অমর হয়ে থাকার স্বর্ণদুয়ার খুলে গেল… নিজেকে বলছে ভ্যান ডার বার্গ। যদিও ব্যাপারটা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব একটা কাজের কাজ হবে না, তবু এ ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকতে পারে!
ইউরোপায় আর কোনো গ্রহের সাথে তুলনা করার মতো কিছু নেই। ব্যাপারটা উল্টো হয়ে আসে তার কাছে, ইউরোপার সাথে তুলনা করার মতো আর কোনো গ্রহ-উপগ্রহ নেই…
এটাই তার তত্ত্ব-এবং এখনো ব্যাপারটাকে তত্ত্ব হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করে সে। কিন্তু খবরটা আর গোপন কোনো ব্যাপার নয়। বাইরে বেরুল কীভাবে কথাটা?
সে আঙ্কল পলকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিল, তিনিই কি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন? এমনো হতে পারে, কেউ রুটিনমাফিক তার কম্পিউটারের ডাটা পরীক্ষা করেছে। এমন কিছু হয়ে থাকলে বেচারা বুড়ো বিজ্ঞানীরও বিপদে থাকার কথা। যদি কোনোমতে তাকে সতর্ক করা যেত! কোনো একটা ইমার্জেন্সি ট্রান্সমিটার দিয়ে কমিউনিকেশন অফিসার গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগ করছে, সে জানে। পৃথিবীতেও যে কোনো মুহূর্তে খবরটা পৌঁছে যাবে, এক ঘণ্টারও আগে রওনা হয়ে গেছে সতর্কবাণী…
কাম ইন। নক করার শব্দ পেয়ে সে বলল, ও-হ্যালো! ক্রিস। কী করতে পারি আপনার জন্য?
সেকেন্ড অফিসার ক্রিস ফ্লয়েডকে দেখে সে বেশ অবাক হল। যদি কোনোমতে নামা যায় ইউরোপায়, সে ভাবল মন খারাপ করে, তাহলে প্রত্যাশার চেয়ে ভালোভাবে দেখতে পাবে আশপাশটা।
হ্যালো, ডক্টর। আমাদের মধ্যে আপনিই এ এলাকার বাসিন্দা। যদি কোনো সাহায্য করতে পারেন।
এমন পরিস্থিতিতে কী করে কেউ কাউকে সহায়তা করে কে জানে! ব্রিজের শেষ খবর কী?
নতুন কোনো খবর নেই। য়ু আর জিলিংসকে ছেড়ে এলাম সেখানে। দরজায় একটা স্পিকার লাগানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কেউ কথা বলছে না ভিতরে। স্বাভাবিক। চ্যাঙ নিশ্চই মহাব্যস্ত।
সে কি নিরাপদে নামাতে পারবে?
সেই সেরা। কেউ যদি কাজটা পারে তো সে-ই পারবে। নামা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আবার উঠে আসাটাই আমার চিন্তার কারণ।
গড-এদ্দূর ভাবার দরকার নেই; এখন টিকে যাব, এই যথেষ্ট।
“টিকে যাব তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভুলে যাবেন না, শিপটা অর্বিটাল অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছিল। কোনো বড় চাঁদের বুকে নামানোর কথা কখনো ভাবিনি আমরা। অ্যানাঙ্ক আর ক্যারমের সাথে যোগসূত্র বসানোর কথা মাথায় রাখা হয়েছিল তৈরির সময়, এই যা। তাই আকাশ থেকে ইউরোপার বুকে উতরে যাবার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকে, তাও যদি চ্যাঙ ভাল জায়গার আশায় যথেষ্ট ফুয়েল নষ্ট করে, তাহলে।
কোথায় নামার চেষ্টা করবে জানেন নাকি? প্রশ্ন করল র্যালফ, অতি উৎসাহী সুর যাতে দেখা না দেয় সে ব্যাপারে সতর্ক সে। নিশ্চই লুকাতে পারেনি-কারণ ক্রিস তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে তার দিকে।
এখন বলার কোনো উপায় নেই। আপনিতো জানেন, অ্যারোব্রেকিং শুরুর আগে কিছু বলা যাবে না। আর এই চাঁদটাকে আমাদের চেয়ে অনেক ভাল জানেন আপনি। ঠিক কোথায় নামতে পারে?
একটাই ইন্টারেস্টিং এলাকা আছে। জিউস পর্বত।
সেখানে ল্যান্ড করতে চাওয়ার কারণ কি? শ্রাগ করল র্যালফ।
এ এলাকা নিয়েইতো আমাদের আগ্রহ জাগবে। দু দুটো দামী জিনিস খোয়াতে হল সেখানে।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে আরো অনেক কিছু খোয়াতে হবে। আপনার কোনো আইডিয়া আছে নাকি?
আপনার বোধহয় পুলিশ বেশ পছন্দ.. সরল মনে বলে গেল ভ্যান ডার বার্গ। মজার ব্যাপার তো! একঘণ্টার মধ্যে দুবার কথাটা শুনতে হল আমাকে।
সাথে সাথেই কেবিনের পরিবেশ আমূল বদলে গেল। যেন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের অবস্থা হেরফের হয়েছে কোনোভাবে।
“ওহ্-আমি ঠাট্টা করছিলাম, আসলেই?
যদি হয়েই থাকি, আর যাই হোক কখনো বলবো কি?
এটাতো কোনো জবাব হল না… আরে, অন্য অর্থে এটাই একটা জবাব…
সে পূর্ণদৃষ্টিতে তরুণ অফিসারের দিকে তাকালো-এই প্রথম নয়। তার গঠন গড়ন ঠিক পিতামহের মতো। কে যেন বলেছিল, ক্রিস ফ্লয়েড অন্য একটা শিপ থেকে গ্যালাক্সিতে জয়েন করে অন্য একটা মিশনে। অবশ্য সেই শিপটাও সুং নৌবহরের। ব্যাপারটা উৎসাহজনক। আবার স্পেস অফিসার হিসেবে ফ্লয়েডের কোনো সমালোচনা হয়নি কখনো। কিন্তু সেই দক্ষতার জোরেই অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হওয়া অসম্ভব নয়। রোজি ম্যাককোলেনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। রোজির মতো সে-ও তো মিশনের আগ মুহূর্তে এখানে এসেছিল।
রালফ ভ্যান ডার বা প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে সরলমনা। সে একজন বিজ্ঞানী-আর বিজ্ঞানীরা প্রকৃতিকে সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে, উত্তর লুফে নেয়-মাঝখানে ঝোলাঝোলি তাদের কাছে সবচে অসহ্য বিষয়।
কিন্তু নিজেকে ধোয়া তুলসী পাতা দাবী করে না সে। নিজের বিশ্বাসটাকেই সত্য বলে মনে করে, সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু ঘটনার এমন অদ্ভুত ক্রমবিন্যাস অনেকটা নিউট্রনের বাড়তে থাকা চেইন রিয়্যাকশনের মতো হয়ে যাচ্ছে। সামান্য একটা নিউট্রন বেরিয়ে এসে পরমাণুর নগণ্য নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে ভেঙে দিবে, বেরুবে আরো দুটো নিউট্রন… কিন্তু তারপর? ছোষ্ট্র থেকে শুরু হয়ে ব্যাপারটা প্রলয়ে পরিণত হয়।
ক্রিস ফ্লয়েড কোন পক্ষের এখন এখানে কটা পক্ষ কাজ করছে? বান্ড নিশ্চই জড়িয়ে পড়েছে এর সাথে; অন্তত গোপনীয় কথাটা বেরিয়ে যাবার পর তারা কি আর
জড়িয়ে পারে? স্বয়ং বান্ডের ভিতরেই বোমার স্প্রিন্টারের মতো হাজারটা খুদে কিন্তু শক্তিমান অংশ লুকিয়ে আছে। তারপর বান্ডের বাইরে আরো কত পক্ষ যে আছে এবং থাকতে পারে আল্লা মালুম। রালফ ভ্যান ডার বার্গ যেন কোনো আয়না মহলে আটকে পড়েছে, চারদিকে খণ্ড খণ্ড আয়না আটকানো।
এমন কোনো উপায় নেই যেটা ভেবে সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতে পারে। ক্রিস ফ্লয়েডকে তার কানেকশনগুলোর দোহাইয়ের কারণে বিশ্বাস করা যেতে পারে। আমি সমস্ত টাকা বাজি ধরতে রাজি, ভাবল ভ্যান ডার বার্গ, সে এই মিশনের জন্য অ্যাস্ট্রোপোল থেকে নিয়োগ পেয়েছে, যদ্দিনের জন্যই হোক, অথবাধ্যাৎ, ব্যাপারটা এখন অন্যরকম হতে পারে…
আমি আপনাকে হেল্প করতে পারলেই খুশি হব, ক্রিস। ধীর লয়ে বলে গেল বিজ্ঞানী, যা সন্দেহ করছেন, ঠিক। আমার কিছু থিওরি আছে। কিন্তু সেগুলো এখনো এক্কেবারে বোকার হদ্দদের মতো শোনায়, এখনো…
আসল সত্যি জানতে আধ ঘণ্টাও লাগবে না। সে পর্যন্ত কিছু না বলাই ভাল।
তবে, তার কথা যদি সত্যি না হয় তো এমন কারো সাথে সে মরতে রাজি নয় যারা তাদের সর্বনাশের জন্য তাকেই দায়ী করবে।
২৯. থিতিয়ে পড়া
সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে কুস্তি লড়ে যাচ্ছে তখন এ থেকেই যখন সে অবিশ্বাসের সাথে সাথে স্বস্তির দৃষ্টি দিয়ে দেখল যে গ্যালাক্সি ভালভাবেই ট্রান্সফার অর্বিটে চলে এসেছে। পরের ঘণ্টা দুয়েক শিপটা সৃষ্টিকর্তার হাতে ছিল, অন্তত স্যার আইজ্যাক নিউটনের হাতে; ফাইনাল ব্রেকিং আসার পর ডিসেন্ট ম্যানুভার শুরু না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
সে রোজিকে বোকা বানানোর একটা ছোটখাট চেষ্টা করেছিল, উপগ্রহের সবচে কাছাকাছি এসে ভেক্টর বদলে আবার ঘুরে যাবার চেষ্টা আর কী! সেক্ষেত্রে শিপটা অন্য কোনো স্থিত কক্ষপথে বসে যেত, অন্তত গ্যানিমিড থেকে উদ্ধার শিপ আসার একটা সম্ভাবনা থেকে যেত তখন। কিন্তু এ কাজ করতে গেলে একটা মৌলিক সমস্যা থেকেই যাচ্ছে সব সময়, সেই উদ্ধারপর্যায়ে আর যাই হোক, সে উদ্ধার পাবার জন্য বেঁচে থাকবে না। চ্যাঙ মোটেও কাপুরুষ নয়, তারপরও গাধার মতো মহাকাশ হিরো হবার কোনো ইচ্ছাই তার নেই।
ঘণ্টাখানেক ঘুরেফিরে দেখতে পারলেও একটা সুযোগ নেয়া যেত। কিন্তু সোজাসাপ্টা বলে দেয়া হয়েছে, এক হাতে তাকে পুরোপুরি অজানা এলাকায় তিন হাজার টনের একটা যানকে নামাতে হবে যে যানের ভারী কোথাও নামার কথা নয়। এমনকি পরিচিত চাঁদে হলেও (এবং চাঁদ মহা এবড়োথেবড়ো হলেও সে কাজটা করতে ভয় পেত না।
আপনার ব্রেকিং শুরুর কত মিনিট বাকী?
প্রশ্ন, নাকি আদেশ? সে সম্ভবত স্পেস টেকনোলজির প্রাথমিক সব ব্যাপারই জানে। আর চ্যাঙ তাকে নিয়ে যে বোকাটে ভাবনা ভেবেছিল তা নিয়ে বেশ লজ্জায় পড়তে হল তাকে, মনে মনে।
পাঁচ । আমি কি বাকী শিপকে শক্তি হতে বলব? জাস্ট এ ওয়ার্নিং।
আমিই বলছি। মাইকটা দিন… দিস ইজ দ্য ব্রিজ। উই স্টার্ট ব্রেকিং ইন ফাইভ মিনিটস। রিপিট, ফাইভ মিনিটস। আউট।
ওয়ার্ডরুমে জড়ো হওয়া বিজ্ঞানী আর ক্রুদের কাছে তথ্যটা পুরোপুরি জানা। তাদের একটা সৌভাগ্য আছে বলা যায়, এক্সটার্নাল ভিডিও মনিটরটা বন্ধ করা হয়নি। হয়তো রোজ ভুলে বসেছে। কিংবা হোড়াই পরোয়া করে। এখন, রোজির এই বদান্যতায় তারা বন্দী হিসেবে… আক্ষরিক অর্থেই বন্দী হিসেবে,.. তাদের মৃত্যুদূতকে উঠে আসতে দেখছে।
ব্যাপারটা যেন ফাঁসির আসামীর সাথে তুলনীয়, যমটুপি না পরানো আসামী তার দড়ির ফাঁসের দিকেই চেয়ে থাকবে সারাক্ষণ।
ইউরোপার নতুন চাঁদের মতো ক্ষীণ-বাঁকা তনু মেঘে মেঘে ছাওয়া; ভরে তুলছে রিয়ারভিউ ক্যামেরা। এই অতি ঘন বাষ্পধারে কোনো হাল্কা এলাকা নেই; সবই ঘন মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ল্যান্ডিংটা রাডার নিয়ন্ত্রিত হবে, তাই এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তবে ব্যাপারটা দর্শকদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যারা চর্মচক্ষুর উপর নির্ভর করে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উপগ্রহটাকে আঁতিপাতি করে খুঁজছে যে বিজ্ঞানী তার মতো করে আর কেউ রহস্য-দুনিয়াটার উঠে আসার ব্যাপার লক্ষ্য করছে না; যদিও চোখ খুলে দেখছে সবাই। র্যালফ ভ্যান ডার বার্গ মোলায়েম গদি আঁটা নন গ্র্যাভিটিক চেয়ারে নিজেকে বেল্ট দিয়ে আটকে রেখে বসে আছে। সে এতোই তন্ময় হয়ে ইউরোপার দিকে চেয়ে আছে যে ওজন বাড়ার ব্যাপারটা টেরই পায়নি।
সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যেই তারা ফুল ব্রাস্টে চলে গেল। সব ক্রু যার যার কমসেটে হিসাব কষতে শুরু করে দিল, কিন্তু কারোটাই নেভিগেশনের সাথে যুক্ত নয়। ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস শুধু চূড়ান্ত সময়টার অপেক্ষায় আছে।
এগারো মিনিট। সে বলে উঠল হঠাৎ করে, যদি সে থ্রাস্ট না কমায়-বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে। ধরা যায়, দশ কিলোমিটার উপরে ভেসে থাকবে, তারপর নামবে সোজা। সে কাজে আরো মিনিট পাঁচেক লাগার কথা।
সে আর বাড়তি কথা বলতে চায় না, তবু বলা যেত, সেই পাঁচ মিনিটের শেষ পলটাই সবচে বিপজ্জনক।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে ইউরোপা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের মনেই রহস্যটুকু লুকিয়ে রাখবে; দেখতে দিবে না কাউকে। গ্যালাক্সি যখন স্থির দাঁড়িয়ে আছে, নামবে বরাবর নিচে, তখনো ঘন মেঘে মেঘে নিচের সব এলাকা ডুবে আছে। সাগর-ভূমি সব অদৃশ্য, কুয়াশা-মোড়ানো। তারপর বেশ কয়েকটা যন্ত্রণাময় মুহূর্তের জন্য ক্যামেরাগুলোয় বেরুতে থাকা ল্যান্ডিং গিয়ার ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। এ জিনিস খুব-ই কম ব্যবহার করতে হয়। এখন, বেরুনোর সময় একটু অ্যালার্মের আওয়াজ করার সময় যাত্রীদের একটাই আশা, জিনিসটা যেন ঠিকমতো কাজ করে।
এই মরার মেঘ আর কত গভীর! নিজেকেই প্রশ্ন করল ভ্যান ডার বার্গ, একেবারে নিচে পর্যন্ত যাবে নাতো?
না, মেঘ হাল্কা হচ্ছিল এখন, কেটে যাচ্ছিল ভারী স্তর। এখন মেঘের দলেরা হাল্কা হাল্কা, কোথাও বিভক্ত।
তারপর, অনেকটা হঠাৎ করেই যেন সবার রক্ত ছলকে উঠল। ইউরোপা! মাত্র কয়েক হাজার মিটার নিচে চির রহস্যময়ী নতুন ইউরোপা ভাসছে, সত্যি সত্যি মাত্র কয়েক হাজার মিটার।
অবশ্যই, গঠন পুরোপুরি বদলে গেছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য ভূগোলবিদ হওয়ার দরকার নেই। চার বিলিয়ন বছর আগে, সম্ভবত, প্রাচীন পৃথিবী দেখতে ঠিক এমন ছিল। এবং সেই পৃথিবীতে সমুদ্র-ভূমির কালান্তরী কামড়াকামড়ির শুরু হয়।
কিন্তু এখানে? মাত্র অর্ধশত বছর আগেও না ছিল স্থলভাগ, না জল-শুধু বরফ আর বরফ। আর এখন লুসিফারের দিকে মুখ করা প্রান্তের বরফ গলে গেছে, তরল পানি বাষ্প হয়ে উঠে গেছে উপরদিকে, তৈরি করেছে অথৈ মেঘের স্তর, তারপর ভাসতে ভাসতে রাতের প্রান্তে যেতেই অকল্পনীয় ঠাণ্ডায় চিরদিনের জন্য জমা হয়েছে উল্টো পিঠে। এক মুখ থেকে আরেক মুখে বিলিয়ন বিলিয়ন টন পানি স্থানান্তরিত হওয়াতে এমন ভূমি জেগে উঠেছে যেখানে কোনদিন দূর-সূর্যের ক্ষীণ আলো পড়েনি।
তারপর, কোনো একদিন হয়তো এই ভূমি নরম হবে, ভরে উঠবে নমনীয় জৈবিক সৃষ্টিতে, ফলাবে ফসল । কিন্তু এখন তারা নাঙা। এখন সেখানে শুধু লাভা আর গরম কাদার স্তর। মাঝেমধ্যে নিচ থেকে উঠে আসে শক্ত পাথরের দল।
দেখে পষ্ট বোঝা যায়, এখানে আসলে স্থিরতা বলে কিছু নেই, সত্যিকার শক্ত বলে বড় কিছু নেই উপরিতলে; এখন যেটা ভূমি সেটাই হয়তো আসল সময়ে চিরস্থায়ী সাগরে পরিণত হবে, আর সাগর হবে ভূমি। একেই বলে টেকটোনিক যুগ। ব্যাপারটা বেশ ধাঁধায় ফেলে দেয়, এই এলাকায় কিনা প্রায় মাউন্ট এভারেস্টের মতো একটা পর্বতের উত্থান হয়েছে।
এইতো, সেই পাহাড়, অপ্রত্যাশিত উচ্চতায় জ্বলজ্বল করছে অবিরাম। রালফ ভ্যান ডার বার্গ বুকের কাছে কেমন যেন ব্যথা অনুভব করছে, আর গলার কাছে আটকে আসছে খাস। কোনো যান্ত্রিক-অসম্পূর্ণ চোখে মেঘের আড়াল থেকে লো রেজুলেশনে এক মুহূর্তের জন্য নয়, নিজের চর্মচক্ষুতে মাত্র দু-চার কিলোমিটার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে স্বপ্ন পর্বত! তার স্বপ্ন পর্বত।
সে ভালমতোই জানে এর আকার প্রায় নিখুঁত চতুষ্কোণ, একটা মুখ প্রায় খাড়া। (এই নিচু গ্র্যাভিটিতেও এখানে ওঠাটা বেশ কষ্টকর হবে পর্বতারোহীদের জন্য…) ওদের দিকে ফেরানো মুখটা তুষারাবৃত আর গোড়া ঢেকে আছে মেঘের আড়ালে।
এটা নিয়েই কি এতো রাজা-উজির মারামারি হলো এতোদিন? কে যেন আড়াল থেকে বলে উঠল, দেখেশুনে তো মনে হয় একদম আটপৌরে… যদ্দুর মনে হয় আপনি একবার কোনো একটা… কথা শেষ না করেই রাগে বন্ধ করে দিল কথক।
এখন গ্যালাক্সি ধীরে ধীরে মাউন্ট জিউসের দিকে এগুচ্ছে, চ্যাঙ একটা ল্যান্ডিং সাইটের আশায় দেখছে আশপাশ। আরো মিনিট পাঁচেক ভেসে থাকার মতো প্রোপ্যাল্যান্ট জমা আছে শিপের গায়ে; তার পরও সে নিরাপদে ল্যান্ড করার একটা সুযোগ নিতে পারে, কিন্তু আবার ওঠা সম্ভব হবে না কোনোদিন।
প্রায় শতবছর আগে নিল আর্মস্ট্রং এমনই এক মানসিক অবস্থায় পড়েছিল; আর যাই হোক, তার দিকে নিশ্চই কোনো আগ্নেয়াস্ত্র তাক করা ছিল না সে সময়টায়…
এখন, গত পাঁচটা মিনিট ধরে তার না মনে আছে আগ্নেয়াস্ত্রের কথা, না রোজির কথা। আর আসলেই, মন-মগজ ঢুকে আছে পুরোপুরি কাজের ভিতরে। আক্ষরিক অর্থেই যে বিশাল যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণভার তার হাতে সেটারই এক অংশে পরিণত হয়েছে অবশেষে। মানবিক আবেগ বলতে একটা ব্যাপারই কাজ করছে তার মনে, ভয় নয়-কাজ কাজ আর কাজ। এ কাজের জন্যই সে এতো কষ্টে ট্রেনিং নিয়েছে, এবং জীবনে শেষবার হলেও কাজটা সে করতে চায় নিজের পেশাদারিত্বের প্রমাণসহ।
কিন্তু এখন তাই প্রমাণ করার পালা, পর্বতের পা আর মাত্র কিলোমিটারখানেক দূরে, এবং এখনো সে কোনো ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে পায়নি। নিচে একটুও স্থিত ভূমি নেই। ছোটবড় খাদ আর খানাখন্দে ভরা চারদিক। তার উপর মহা উঁচুনিচু। একটা টেনিস কোর্টের মতো ছোট জায়গাও পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ফুয়েল গজের লাল দাগ ত্রিশ সেকেন্ডে ঠেকে গেছে।
এবং সেখানে, অবশেষে, একটা মোটামুটি সমতল এলাকা দেখা যাচ্ছে… যথেষ্ট সমতল… এই তার শেষ সুযোগ। কত কম সময়ে কত সুন্দর কাজ করতে জানে সে সেই প্রমাণটা এবার দেখাতে হবে।
অনেক কষ্টে সে দানবটাকে এগিয়ে নিল সেদিকে, অস্থির সিলিন্ডারটাকে সামনের পথের দিকে তাক করে নিল। মনে হয় তুষারে মোড়া… তাইতো, তুষার পড়ে আছে উপরে-ব্লাস্টের কারণে তুষার উড়ে যাচ্ছে–কিন্তু নিচে কী?-এবড়োথেবড়ো ভূমি নয়তো?-কাদার স্তরও হতে পারে-না, বরফের মতো দেখাচ্ছে নিশ্চই জমাট কোনো লেক-নিশ্চই-কতোটা পুরু?-কতো পু
গ্যালাক্সির পাঁচ হাজার টন হাতুড়ির আঘাত পড়ল। মূল জেটগুলো আপনজনের মতো আকড়ে ধরল ভূমি। এর উপর ছড়িয়ে পড়ল তেজস্ক্রিয়তার একটা রেখা, ভাঙতে শুরু করল বরফের বিশাল বিশাল আকৃতি, হঠাৎ মুখ উন্মোচিত হওয়া লেকের গায়ে ড্রাইভের আগুন-গরম অংশ লাগায় বরফ পরিণত হল বাষ্পে, বাস্পঝড় উঠল চারদিকে।
একজন দক্ষ এবং সুন্দর ট্রেনিং পাওয়া অফিসার হিসেবে চ্যাঙ সাথে সাথেই, সাড়া দিল, মনের বিবশ ভাবকে মোটেও ধর্তব্যে আনেনি। বাম হাতটা এক ঝটকায় সেফটি লক বার টেনে নিল নিজের দিকে, ডানটা ধরল লাল লিভার, টেনে তুলল উপরদিকে।
অ্যাবোর্ট নির্দেশনায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, প্রোগ্রামটা এই পর্যন্ত ঘুমিয়েই ছিল, জেগে উঠল সাথে সাথে, উল্টে গেল হিসাবের ছক, এবং স্পেসশিপ গ্যালাক্সি জেগে উঠল আকাশের বুকে; আবারও…
৩০. ভাঙা আমার তরী
মরণের মতো আঘাত হয়ে এসেছিল ফুল থ্রাস্টটা; ওয়ার্ডরুমে। আতঙ্কে অস্থির অফিসাররা দেখল তাদের নামার ভূমি মাকড়সা জালের মতো ভেঙে পড়েছে নিচের দিকে; তারা জানে, বাঁচার একটা মাত্র উপায় বাকী আছে, এবং-তাদের জানা মতে গ্যালাক্সিকে চালানোর জন্য সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠ মানুষটি আবারও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ায় একটা শ্বাসকে আসার অনুমতি দেয়া যায়।
কিন্তু আর কততক্ষণ ব্যাপারটা উপভোগ করা যায়? কেউ জানে না। শুধু চ্যাঙই জানে শিপের যথেষ্ট প্রোপ্যাল্যান্ট আছে কি না। কোনো স্থিত কক্ষপথে ওঠা যাবে কি যাবে না….
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাসের চিন্তা অন্য, আগ্নেয়াস্ত্র হাতের সেই উন্মাদটা আবারও হয়ত নামার আদেশ দেবে, সেক্ষেত্রে? এবং পর মুহূর্তেই আবার মনে পড়ে গেল কথাটা, আর যাই হোক, রোজি ম্যাককোলেন আর যাই হোক, পাগল নয়। সে ঠিক ঠিক জানে কী করতে হবে। আফসোস, তাদের জানার সাথে মেয়েটার জানার কোনো মিল নেই।
তারপরই, হঠাৎ বদলে গেল ব্রাস্টের আচরণ।
নাম্বার ফোর থ্রাস্ট এইমাত্র বিকল হয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার রিপোের্ট করল সাথে সাথে, আমি মোটেও অবাক হইনি। সম্ভবত উপরের দিকে…আসলে এ পরিস্থিতিতে বেশিক্ষণ টেকার কথাও নয়।
অবশ্যই, কোনো দিকনির্দেশনার ঠিক ঠিকানা নেই এখন। নিভু নিভু থ্রাস্টটা এখনো কন্ট্রোল প্যানেলের কথা মেনে চলছে, বাইরের দৃশ্য পাগলের মতো উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে, যা হবার কথা… শিপ এগিয়ে যাচ্ছে এখনো, কিন্তু ভূমির সমান্তরালে নয়। পুরো গ্যালাক্সি একটা ব্যালাস্টিক মিসাইলে পরিণত হয়েছে মুহূর্তে, তার টার্গেট অজানা, এবং অজানা ইউরোপার বুকের দিকে লক্ষ্য করা।
আবারো থ্রাস্ট এলোমেলোভাবে শক্তি ছড়াল; মনিটর জুড়ে ভূমি আবার সমান্তরাল হয়ে গেছে।
বিপরীত মনিটরটা বন্ধ করে দিয়েছে চ্যাঙ, আমরা যেন পাগল না হই সেজন্যে… কিন্তু সে কি উচ্চতাটা ধরে রাখতে পারবে… ভদ্রলোক…।
দেখতে থাকা বিজ্ঞানীরা এ কাজের ভাল মন্দ বোঝেনি। বাস্তবকে সরিয়ে রাখলে কী এসে যায়? মনিটরের দৃশ্য পুরোপুরি চলে গেছে, সামনে শুধুই চোখ ধাঁধানো সাদা।
বাড়তি জ্বালানীটাও পুড়িয়ে দিচ্ছে।
এবং, তারপর থ্রাস্ট একেবারে থেমে গেল, মুক্ত পতন হচ্ছে শিপের। থ্রাস্টের তাণ্ডবের সময় বরফের অসীম গুড়া ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের আকাশে, সেগুলো সাথে নিয়েই শিপ নেমে যাচ্ছে নিচে। তারপর যখন পৃথিবীর স্বাভাবিক মাধ্যাকর্ষণের আটভাগের একভাগ আকর্ষণে মহাকাশতরী নিচের দিকে নামছিল, তাকে স্বাগত জানানোর জন্য ইউরোপার কেন্দ্রীয় মহাসাগর মুখব্যাদান করে ছিল প্রবল উৎকণ্ঠায়।
অন্তত চ্যাঙ একটা ভ্যাজাল থেকে বাঁচল, তাকে আর ল্যান্ডিং সাইট খুঁজে বেড়াতে হবে না। এখন থেকে অপারেশনাল সিস্টেম পৃথিবীর কোটি কোটি ভিডিও গেমারের গেম কন্ট্রোলের মতো হবে যারা কখনোই স্পেসে যায়নি, হয়তো কখনো যাবে না।
এখন তার কাজটা বেশ সরল এবং কঠিন, তার উপর এ গেমে গেম ওভারটা খুবই নিষ্ঠুর হওয়ার কথা। নামতে থাকা শিপের জেটগুলোকে শুধু পতনের বিপরীতে চালাতে হবে; জিরো মুমেন্টে জিরো মোমেন্টাম পেলেই খেলোয়াড় এ স্টেজে জিতে যাবে, এগিয়ে যাবে পরের স্টেজের দিকে। সাগরের উপরভাগ ছুঁয়ে দেয়ার মুহূর্তে পতন গতি যেন শুধু শূন্য হয় এটাই যে কোনো দক্ষ খেলোয়াড় (ভিডিওগেমের ক্ষেত্রে) এবং দক্ষ পাইলটের (স্পেস শিপের ক্ষেত্রে) একমাত্র লক্ষ্য। আমেরিকান স্পেসবিশেষজ্ঞরা আগের দিনে এভাবে নামাটাকেই সবচে নিরাপদ এবং নির্ভেজাল মনে করত। কিন্তু সেজন্যে শিপটাকে সেভাবেই ডিজাইন করতে হয়। আর না এর মালিকপক্ষ আমেরিকান, না চালকপক্ষ। কিন্তু সে যদি গত ঘণ্টা কয়েকের দক্ষতার পরও শেষ কাজটায় ব্যর্থ হয় তাহলে কোনো হোম এন্টার্নেইনমেন্ট কম্পিউটার বলবে না, স্যরি-তুমি ক্র্যাশ করেছ। আরেকবার চেষ্টা করবে? অ্যানসার-ইয়েস/নো…
.
সেকেন্ড অফিসার য়ু আর তার দু সহকর্মী ব্রিজের লক করা দরজার বাইরে নিজেরদের উন্নয়ন করা অস্ত্র হাতে ওঁৎ পেতে আছে, এবং এটাই সম্ভবত তাদের জীবনের সবচে বিদঘুঁটে অ্যাসাইনমেন্ট। ভিতরে কী হচ্ছে তা জানানোর জন্য কোনো মনিটর স্ক্রিন নেই, শুধু ওয়ার্ডরুমের মেসেজের উপর নির্ভর করতে হবে। এবং স্পাই মাইকের ভিতর দিয়ে কোনো নির্দেশনা আসছে না; ব্যাপার লক্ষণীয়। রোজি আর চ্যাঙের কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।
টাচডাউনটা চমৎকার হল, শুধু সামান্য একটা ধাক্কা, ব্যস। আরো কমিটার ডুবে গেল গ্যালাক্সি, তারপর ভেসে উঠল আবার… আর ইঞ্জিনের অবস্থান ও ওজনকে ধন্যবাদ, সেগুলো উপরের দিকে বসানো।
এরপরই শ্রোতারা দরজার ওপাশ থেকে হাল্কা কথা শুনতে পায়।
তুমি, ম্যানিয়াক রোজি; আশা করি তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমরা সবাই এখন মৃত।
একটা পিস্তলের আওয়াজ ভেসে এল, তারপর সব চুপচাপ।
একজন নুইয়ে ফেলল মাথা, স্পেস ক্রুকে এমনটা মানায় না। অন্যজন পেছনে। তাকায়, যেন চিৎকার করবে। কিন্তু য়ুর বাধার মুখে কিছু করার নেই।
সেকেন্ড অফিসার য়ু আর তার কলিগরা ধৈর্য ধরল, দাঁতে দাঁত চেপে। তারা জানে, এখন কিছু না কিছু ঘটবেই।
ঠিক তাই, দরজার লকিংবারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে তাদের কোনো একজনকে পেড়ে ফেলতে পারে, সবাইকে নয়-খোলার সাথে সাথে আঘাত হানতে হবে, তিনদিক থেকে।
দরজা খুলে গেল, অতি ধীরে।
“স্যরি, আমি নিশ্চই মিনিটখানেকের জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম…
তারপর, যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষের মতো চুপ করে থাকল সে, সেকেন্ড অফিসার চ্যাঙ।
৩১. প্রখর, দারুণ, অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন
কে জানে কীভাবে মানুষ ডাক্তার হয়! ভাবছে ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস। অন্যদিকে, মানুষ যে কী করে গোরখোদক হয় তাই বা কে জানে? দুজনেরই কিছু না কিছু বিচ্ছিরি কাজ করতে হয় হরহামেশা…
কিছু পেলেন নাকি?
না, স্কিপার। এম্নিতেও আমার সঠিক যন্ত্রপাতি নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তাদের দেখতে হলে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজতে হবে।
একটা রিলে ট্রান্সমিটার থাকার কথা বলেছিল ফ্লয়েড, দেখুনতো। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টও দরকার। নিয়েছেন এসব?
হু-গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগ বসার সাথে সাথে তার পেপারগুলোসহ পাঠিয়ে দিব। কিন্তু সন্দেহ হয়, আমরা কোনোদিনই জানতে পারব না রোজি কে ছিল, অথবা কার ভূমিকায় অভিনয় করছিল, অথবা কেন-আল্লা মাবুদ জানে।
ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস যেন তার মানবিক গুণ খোঁজায় ব্যস্ত, যাই হোক, ওর ব্যবহারে কিছু মানবিক দিক প্রকাশ পেয়েছিল। অ্যাবোর্ট লিভার টানার সময় সে ইচ্ছা করলেই চ্যাঙকে গুলি করতে পারত।
তাতে আমাদের বেশ ভালই হত, মনে হয়। এক ধাক্কায় সবাই শেষ হয়ে যেতাম। জেঙ্কিন্স আর আমি লাশটা রিফিউজ ড্যাম্প দিয়ে ফেলে দেয়ার সময় কী হল বলি…
ডাক্তার আতঙ্কিতভাবে ঠোঁটদুটোকে চেপে ধরল পরস্পরের সাথে।
“আপনার কথাই ঠিক, অবশ্যই। এছাড়া আর কী করার ছিল? যাই হোক, আমরা বাড়তি ওজন বওয়ার ঝামেলায় যাইনি-কয়েক মিনিট ভেসে ছিল শরীরটা-তারপর শিপ থেকে দূরে যায় কিনা তা দেখার জন্য চেয়ে ছিলাম-ঠিক তখনই…
ডাক্তার যেন কথা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে।
কী? ড্যাম ইট!
“পানি থেকে কিছু একটা উঠে এসেছিল। অনেকটা টিয়ার ঠোঁটের মতো; কিন্তু প্রায় শতগুণ বড়। এক ঠোকরেই এটা-রোজিকে-নিয়ে উবে গেল। আমাদের এখানে বেশ ভাল সঙ্গী জুটবে মনে হয়। এমনকি বাইরে শ্বাস নেয়ার সুযোগ থাকলেও আমি সাঁতরানো পছন্দ করি না এমন পরিস্থিতিতে।
ব্রিজ টু ক্যাপ্টেন বলল অফিসার অন ডিউটি, পানিতে বড় ধরনের আলোড়ন দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা থ্রি তে। আপনাকে ছবি দিচ্ছি।
এই জিনিসটাকেই দেখেছিলাম আমরা! কেঁদে উঠল যেন ডাক্তার, তার গলায় ঠাণ্ডা একটা অনুভূতি হচ্ছে, একটাই চাওয়া তার: আশা করি আরো বেশি কিছু পাবার জন্য জিনিসটা উঠে আসেনি।
তারপর হঠাৎ করেই এক বিশাল আকৃতি পানি থেকে ছিটকে উঠল উপরে; পানি আর আকাশের মাঝামাঝি পুরো আকৃতিটা চোখে পড়ল এবার।
পরিচিতিটা এতো বেশি, মিলটা এতো কাছাকাছি যে ডক্টর আর ক্যাপ্টেন একসাথে চিৎকার করে উঠল: ইটস এ শাক!
দৈত্যটা আবার সাগরে ফিরে যেতে যেতে একবারের জন্য শরীর আর টিয়া পাখির ঠোঁটের দিকে দৃষ্টি বুলানোর সুযোগ পাওয়া যায়। একজোড়া বাড়তি ফিন দেখা যাচ্ছে, আর কোনো ফুলকা আছে বলে মনে হল না। কোনো চোখও নেই-কিন্তু তা কী করে সম্ভব? অসম্ভব কেন! ঠোঁটের অন্যপাশে কেমন একটা অংশ দেখা গেল-সেটাই হয়তো ভিন্ন ধরনের কোনো ইন্দ্রিয়।
চিরাচরিত বিবর্তন। বলছে চিকিৎসক, সেই একই ধরনের সমস্যা, একই। ধরনের সমাধান, সব গ্রহে। পৃথিবীর দিকে চোখ ফেরান-ডলফিন, হাঙর আর ইকথায়োসর-সব সামুদ্রিক শিকারীর এই একই বেসিক ডিজাইন থাকতে হয়। কিন্তু ঐ চোয়াল মার্কা ঠোঁটটাই আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে।
জীবটা আবারও জেগে উঠেছে উপরে, কিন্তু এবার ধীরলয়ে এগুচ্ছে, যেন ঐ দানবীয় লম্ফঝম্পের পর বেশ ক্লান্ত এখন। বোঝা যাচ্ছে এর ভিতরে গন্ডগোল হয়েছে কোনো, যেন যন্ত্রণায় লেজ দিয়ে পানিতে আঘাত করছে বারবার, কোনোদিকে যাবার আশায় নয় ।
তারপর হঠাৎ করেই প্রাণীটা শেষ খাবারটা উগড়ে দিয়ে পেট উপরের দিকে তুলে নির্জীব ভেসে থাকল শান্ত পানির উপর।
ও মাই গড! বলল ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস, যেন কোনো সিদ্ধান্তে এসে পড়েছে, আমি জানি কী হল এখন!
পুরোপুরি ভিন্ন জৈবরসায়ন, বলল ডাক্তার, তারপর ভয় পেয়ে যেন চমকে উঠল অনেকটা, অবশেষে রোজি অন্তত একজনকে শিকারে পরিণত করতে পারল।
.
গ্যালিলির সাগরের নামকরণ হয়েছে অবশ্যই ইউরোপার আবিষ্কারকের নামে। অন্য এক দুনিয়ায় ছোট্ট এক সাগরের নাম এখন তার নামে।
সাগরের বয়স একেবারেই কম, মাত্র অর্ধশত বছর। কিন্তু আর সব নবজাতকের মতো সেও নানা বিপত্তি ঘটাতে পারে। ভরসার কথা একটাই, ইউরোপায় এখনো ঝড় তৈরি হবার মতো শক্তিশালী বায়ুমণ্ডল গড়ে ওঠেনি। একটা শান্ত বাতাস ভূমি থেকে সমুদ্রের দিকে বয়ে গেল, যেখানকার আকাশে লুসিফার চির স্থির রূপ নিয়ে বসে আছে, সেদিকে। এখানে, স্থির দুপুরের এলাকাটায় সব সময় পানি সেদ্ধ হয়ে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। এই বায়ুমণ্ডলের চাপে এমন তাপমাত্রায় সহজেই এক কাপ চা বানিয়ে নেয়া যায়।
সৌভাগ্যজনকভাবে, যেখানে সারাক্ষণ এই তাণ্ডব চলছে সেখান থেকে প্রায় হাজার কিলোমিটার দূরে পড়েছে স্পেসশিপটা। এলাকা বেশ শান্ত। সবচে কাছের ভূমি থেকে শত কিলোমিটার দূরেও নয়। সর্বোচ্চ গতিতে সে এই দূরত্বটা এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে পার করে যেতে পারে। কিন্তু এই অদ্ভুতুড়ে পরিবেশে ইউরোপার চিরস্থায়ী মেঘের নিচে পানিতে পড়ে থেকে সামান্য দূরত্বটাকেই কোয়াসারের মতো অসীম বলে মনে হচ্ছে।
এই ল্যান্ডিংটা যদি এমন শুধু সমুদ্রে না হয়ে কোনো কুমারী বেলাভূমিতেও হতো, কী লাভ হতো তাতে।
এখানে আরেকটু আরাম আয়েশ থাকত তখন। স্পেসশিপ ওয়াটারপ্রুফ হলেও পানিতে তেমন আরামদায়ক নয়। শিপটা সমুদ্র উপরিতলে সত্যিকার জাহাজের মতোই ভেসে আছে, কিন্তু সমস্যা হল, প্রতিটি বড় ঢেউয়ের সাথে এদিক-সেদিক দুলছে এবং এ শিপের ত্রুরা কেউ নাবিক নয়। তাই মহাকাশতরীর অর্ধেক সারেংই অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাকীদেরও একই অবস্থায় আসতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।
সব ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট পেয়েই ক্যাপ্টেন ল্যাপ্লাস সবার আগে জানতে চায়, কেউ নৌকা চালাতে জানে কিনা। যে আকার প্রকারেরই হোক না কেন, নৌকা চালাতে জানলেই হল।
ত্রিশজন অ্যাস্ট্রোনট এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে কেউ না কেউ সৌখিন নাবিক হবেই, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পাওয়া গেল পাঁচজনকে, এবং মজার ব্যাপার, একজন সত্যিকার নাবিকও বেরিয়ে গেল সাথে সাথে। পার্সার ফ্র্যাঙ্ক লি আসলে সুং শিপিং লাইনে কাজ শুরু করে, তারপর সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে মহাকাশ তরীতে।
পার্সাররা অ্যাকাউন্টিং মেশিন চালানোয় বেশি পারদর্শী হলেও তাদেরকে অবশ্যই বেসিক সীম্যানশিপ পাশ করতে হয়, তাই তাদের নেভিগেশনাল অপারেশন জানা অবাক করা ব্যাপার নয়। মজার ব্যাপার, ফ্র্যাঙ্ক লিকে অনেক সময় দুশ বছরের পুরনো অ্যাবাকাসও চালাতে হয়েছিল। অবশ্য সে কখনোই তার বিয়ের সময়কার সেই ট্রেনিংয়ের বাস্তব ব্যবহার করতে পারেনি, তার উপর কোথায় বিলিয়ন কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ চীন সাগর আর কোথায় সি অফ গ্যালিলি।
প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কগুলো ভরে ফেলা উচিত বলল সে ক্যাপ্টেনকে, তাহলে আর শিপ উঠা নামা করবে না। বেশ স্থির থাকবে।
শিপে আরো পানি আসতে দেয়াটা কেমন যেন বোকামী বলে মনে হল। আর ক্যাপ্টেনও বেশ ইতস্তত করছিল।
ধরা যাক আমরা আশপাশে ঘুরে বেড়াতে চাই, তখন?
আর কেউ আসল জবাবটা দিল না, তাতে কী এসে যায়?
এবং তারপর বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে সিদ্ধান্ত হল পানির চেয়ে মাটির উপরে থাকাটাই ভাল হবার কথা-যদি যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে।
আবার যে কোনো সময় ট্যাঙ্ক খালি করা যাবে। একাজ করা প্রয়োজনও পড়বে হাল্কা পানিতে যাবার সাথে সাথে। প্রথম সুযোগেই শিপটাকে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়া করানো যাবে, থ্যাঙ্কস গড, আমাদের হাতে ক্ষমতা আছে…
তার কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে গেল সাথে সাথেই। সবাই জানে, কী বোঝাতে চায় সে। অকজিলারি রিয়্যাক্টরটা না থাকলে সবাই এরমধ্যে মারা যেত, লাইফ সাপোের্ট সিস্টেম চালায় ওটাই।
এবং এরই মধ্যে তারা সবাই বেশ ভালভাবে জেনে গেছে, সি অফ গ্যালিলির বুকে পুষ্টির কোনো চিহ্নই নেই। শুধু বিষ আর বিষ, চারদিকে।
গ্যানিমিডের সাথে যোগাযোগের কাজটা সেরে ফেলা হয়েছে, সারা সৃষ্টি জগতের মানুষ জেনে গেছে ওদের কথা। সৌর জগতের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কগুলো এবার তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আর তাতেও কাজ না হলে গ্যালাক্সির কু আর যাত্রীরা অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে মরার সুযোগ পাবে।