০৩.
জগন্নাথকে বলেননি কিকিরা, আড়ালে তারাপদকে বলে দিয়েছিলেন।
পরের দিন শনিবার। বিকেল-বিকেলই এল তারাপদ। চন্দনকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে।
কিকিরা মোটামুটি তৈরি ছিলেন। বললেন, “আমি রেডি। শুধু তোমাদের জন্যে বসে ছিলাম। একটু টি টেকিং করে চলো বেরিয়ে পড়ি। বগলাকে বলি।”
কিকিরাকে যেতে হল না, তারাপদই হাঁক মেরে বলল, “বগলাদা তিন কাপ চা। শুধু চা। একটু তাড়াতাড়ি।”
চন্দন বলল, “আর্টটা নাগাদ ফিরতে হবে, কিকিরা। আমার একটা জরুরি কাজ আছে।”
কিকিরা বললেন, “আগেই ফিরে আসব।”
“আজ আপনি কী দেখতে যাচ্ছেন?”
“শুদ্ধানন্দজির ঘাঁটি। জায়গাটা একবার নিজের চোখে দেখে নেওয়া উচিত।” বলে উঠে গিয়ে একটা কাগজ তুলে আনলেন টেবিল থেকে। ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটা খুলে নিতে নিতে বললেন, “কলকাতার ম্যাপ। বছর বিশ-পঁচিশ আগে ছাপা। রাস্তা থেকে একটা কিনে রেখেছিলুম। এত বড় শহর, কয়েকশো পাড়া, হাজার কয়েক গলি, বাই-গলি, মানে বাই লেন, কে তার হিসেব রাখে গো! আর নামের কত বাহার বাবা! গুমঘর লেন, কর্ক লেন, ঝাঁপতলা বাই লেন…, গুলু ওস্তাগর…নামের ফুলঝুরি। তা এই ম্যাপ থেকে দেখছি–চিতপুর দিয়ে এগোলেই বা ব্র্যান্ড রোড ধরেও আমরা যেতে পারি।”
তারাপদ আর চন্দন ম্যাপ দেখায় গা করল না। ইশারায় বোঝাতে চাইল, ম্যাপের দরকার নেই, জায়গাটা খুঁজে নেওয়া যাবে।
কিকিরা ম্যাপটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, “জগন্নাথের খবর কী?”
“নতুন কিছু নয়, তারাপদ বলল।
“কিছু বলছিল?”
“না, ওই বলছিল–কিকিরা কী করেন? ম্যাজিক দেখান? …আমি বললাম,
এখন আর স্টেজে ম্যাজিক দেখান না, রিয়েল লাইফে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়ান।” বলে তারাপদ ঘসতে লাগল।
কিকিরাও হাসলেন।
চন্দন জগন্নাথের চিঠির ব্যাপারে কাল থেকেই খুঁতখুঁত করছিল।বলল, “আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা ঠাট্টা-তামাশা। কোনো বন্ধু বান্ধব বা জানাশোনা কেউ জগন্নাথের সঙ্গে মজা করেছে।”
তারাপদ বলল, “তা কেমন করে হবে!” বলে কিকিরার দিকে তাকাল, বলল আবার, “চাঁদু একটা জিনিস বুঝছে না। এটা যদি মজা হত, ঠাট্টা হত–জগুদা কাঁঠালতলার গলিতে গিয়ে ওরকম একটা বাড়ি দেখত না। না হয় বাড়িটাই শুধু দেখত, কলকাতায় পুরনো অলিগলিতে অমন বাড়ি নিশ্চয় অনেক আছে। কিন্তু জগুদা কি প্লাস্টিকের বস্তার মধ্যে একটা মানুষকে পুরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে পেত? না কি, ওই যে তিনটে নোক ঢুকছে–তাদের দেখত?…জগুদা মানুষটা ভিতু, গোবেচারা, বোকাসোকা, কিন্তু কিকিরা-স্যার, একটা কথা ঠিক, জগুদা কখনোই মিথ্যে কথা বলবে না এ ব্যাপারে। বলে কী লাভ!”
কিকিরা মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমারও সেরকম মনে হয়। জগন্নাথ সাদাসিধে, সরল ছেলে। ওর কথাবার্তা থেকেই সেটা বোঝা যায়। মিথ্যে কথা জগন্নাথ বলেনি। তবে ও যে ঠিক কী দেখেছে, ভুল দেখেছে চোখে, না। সত্যি-সত্যি যা দেখেছে সেটাই বলছে, সে-ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।”
চন্দন বলল, “কিকিরা, ভয়ের সময় মানুষ অনেক ভুতুড়ে জিনিস দেখে। এটা তার দোষ নয়, আমাদের সকলেরই চোখ মাথা বুদ্ধি ভয়ের সময় স্বাভাবিক। কাজ করতে পারে না। তারাপদকে মর্গের মধ্যে নিয়ে গিয়ে একদিন রেখে দিলেই দেখবেন ওর কী হাল হয়েছে!”
তারাপদ বলল, “চাঁদু, জগুদা ভিতু ঠিকই, কিন্তু সে মিথ্যে কথা বলার লোক নয়।”
চন্দন বলল, “মিথ্যে কথা বলছে জগন্নাথ–তা তো বলিনি। আমি বলছি, চোখে ভুল দেখেছে। একটা সার্বালক মানুষকে ওভাবে মুড়ির ব্যাগে করে ভরে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। অসম্ভব।”
কিকিরা বললেন, “স্যান্ডেল উড, তুমি সাবালক মানুষ বলছ কেন?”
চন্দন তাকাল। কিছু বুঝতে পারল না। বলল, “কেন?”
“ধরো ওটা মানুষ নয়, মানুষ-পুতুল। মানে, মানুষের নকল বা ডামি?”
“ডামি?”
“আর ওটা যে ঠিক সাবালকই ছিল, জগন্নাথ এমন কথাও বলেনি।“
চন্দন তাকিয়ে থাকল। কথা বলল না। ডামি? কথাটা যেন সে ভাবছিল অন্যমনস্কভাবে।
কিকিরা বললেন, “কাপড়চোপড়ের দোকানে, বড়-বড় টেলারিং শপে যে ডামি দেখো তার ওজন কত হে? আজকাল তো আবার শুনি প্লাস্টিকের, পেপার পাল্পের ছাঁচ করে মুখ হাত পা তৈরি হচ্ছে। এতে ফিনিশ ভাল হয়। আর ওজন…? হালকা, একেবারেই হালকা…।”
চন্দন আগে কথাটা ভাবেনি, এখন তার মনে হল, সত্যি তো একটা ডামির আর ওজন কত হবে। নিতান্ত ফাঁপা ফাঁকা বস্তু, ওপরের খোলটাই সব। প্লাস্টিকের ব্যাগে করে ও-জিনিস অনায়াসেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ, ব্যাগের মধ্যে ধরে এমন ডামি হতে হবে। মুড়ি মাথায় করে যারা ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্লাস্টিকের ব্যাগের মাপটা আন্দাজ করলে মনে হয়, সাবালক ছেলেমেয়েকে দাঁড় করানো অবস্থায় তার মধ্যে ঢোকানো মুশকিল। নাবালক বাচ্চাকাচ্চাকে অবশ্য ঢোকানো চলে।
চন্দন এবার একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “ডামির কথা আমি ভাবিনি, কিকিরা, সরি। আপনার তো বেশ মাথায় এসেছে।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “স্যার, আমি সেদিন কোথায় যেন একটা ছবি। দেখছিলাম সিনেমার। একটা ডামিকে পাঁচতলার ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছে।”
কিকিরা বললেন, “একসময় মাটি দিয়ে, ছেঁড়া কাপড়চোপড়, তুলো, কাঠের গুঁড়ো পুরে ডামি করা হত। দিনকাল পালটে গিয়েছে। এখন যা ডামি করে আসল-নকল বোঝা যায় না।”
বগলা চা নিয়ে এসেছিল। চা রেখে দিয়ে চলে গেল।
চায়ের কাপ তুলে নিয়ে তারাপদ বলল, “নিন, চা খেয়ে নিন। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে।”
কিকিরা বললেন, “সন্ধের মুখে-মুখে পৌঁছতে পারলেই ভাল।”
“কেন?”
“লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে হবে প্রেতসিদ্ধর আখড়া। কারও চোখে পড়তে চাই না। তবে আজকাল তো পাঁচটা বাজলেই অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।”
চন্দন চা খাচ্ছিল; বলল, “স্যার, আজ শনিবার। আজ প্রেতসিদ্ধর আখড়ায় গ্যাদারিং বেশিই হতে পারে। তাই নয়?”
কিকিরা মজার গলায় বললেন, “শনিবার বারবেলার পর টাইমটা ভাল। মনে হয়, মক্কেল ভালই হবে। চলো, দেখা যাক কী হয়!”
চা খাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে সামান্য সময় লাগল। তারপর উঠে পড়ল তিনজনে।
.
ট্যাক্সিতে যেতে-যেতে কিকিরা বললেন, “তারাপদ, জগন্নাথের জ্ঞাতিগুষ্ঠি যারা একই বাড়িতে থাকে ওর সঙ্গে, তাদের তুমি চেনো?”
মাথা নাড়ল তারাপদ। বলল, “চেনা বলতে দু’-একজনকে দেখেছি। জগুদার বাড়িতে আমি বার তিন-চার গিয়েছি। তখনই যা দেখেছি। সকলকে নয়, দু-একজনকে চিনি।”
“জগন্নাথ তার জ্ঞাতিদের সম্পর্কে কিছু বলে না?”
“কারও কারও সম্পর্কে বলে।”
“যেমন?”
তারাপদ রাস্তা দেখছিল। কলকাতার রাস্তায় বাতি জ্বলে উঠেছে। আজ খানিকটা মেঘলা রয়েছে। বৃষ্টি হবার আশা অবশ্য নেই। কিন্তু মেঘলার দরুন, ধুলো আর হালকা কুয়াশা মিলে অন্যদিনের তুলনায় ঝাপসা ভাবটা বেশিই হয়েছে আজ।
তারাপদ বলল, “জগুদা কী বলে জানতে চাইছেন?…জগুদার মুখে দু’জনের। কথা বেশি শুনেছি। একজন তার কাকা, জ্ঞাতিসম্পর্কে। পুরো নাম জানি না, জগুদা বলে, কুমারকাকা। অন্যজন জগুদার দাদা হয় সম্পর্কে, বাচ্চুদা। দু’জনেই নচ্ছার টাইপের। জগুদাকে বিরক্ত করে, খোঁচায়, তামাশা করে তাকে নিয়ে। আসলে ওরা জগুদাকে পছন্দ করে না। জগুদাও ওদের দেখতে পারে। না।”
চন্দন বলল, “তুই একদিন একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিলি কলেজ স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে, সেই লোকটা?” বলে চন্দন তারাপদকে ইশারায় যেন বোঝাতে চাইল, ঘাড়ে-গদানে হওয়া একটা লোক কি না!
তারাপদ ভাবল একটু। বলল, “কবে বল তো?”
“আরে সেই যে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নাটক দেখতে গেলাম..”
“ও! না, না, সে তো আমাদের বিল সেকশানের জয়ন্তদা। জয়ন্তকুমার। এ অন্য। এর নাম জানি না। জগুদা বলে কুমার কাকা। আমি ভদ্রলোককে দেখেছি। চোখে চিনি। হিন্দি সিনেমার ফাইটারদের মতন দেখতে। সলিড বডি।”
“বয়েস কত?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
“ক-ত আর! বছর বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশ। দারুণ বডি।”
“ও! আর তোমার ওই বাচ্চুদা?”
“সেটাকে একেবারে পাড়ার গুণ্ডা বদমাশের মতন দেখতে। চেহারা দেখলে আপনি হাসবেন। ল্যাকপ্যাক করছে। তবে স্যার, তার ড্রেস, চোখে গগলস, গলায় রুপোর চেন, মাথার চুল দেখলে বুঝতে পারবেন পাড়ার ঘাঁটিতে তার প্রেস্টিজ আছে। রেসিং সাইকেল নিয়ে ঘোরে। সাইকেলে নাকি ব্রেক নেই, ঘন্টিও নয়।”
চন্দন হেসে ফেলে বলল, “ব্রেকলেস বাচ্চু। …ব্রেক থাকবে না পায়ে ব্রেক মেরে সাইকেল থামাবে, ঘণ্টি থাকবে না–তোর ঘাড়ে পড়তে পড়তে পড়বে না, বেরিয়ে যাবে শাঁ করে, এ-সব হল কায়দা। যার যত কায়দা সে তত বড় হিরো। জানিস?”
জানে তারাপদ।
কিকিরা বললেন, “ব্রেকলেসবার বয়েস কত?”
“জগুদার চেয়ে এক-আধ বছরের বড়। জগুদা যা বলে।
“এরা দু’জন করে কী?”
তারাপদ বলল, “বাচ্চু কিছুই করে না। পাড়ার কাছে কোথায় একটা লন্ড্রি খুলেছিল একবার। বলত, শালকরের দোকান। কিছু শাল ঝেড়ে দিয়ে দোকান বন্ধ করে দেয়। তারপর কিছুদিন ও-পাড়ার কোনো সিনেমা হাউসের টিকিট ব্ল্যাকে নেমেছিল। পুলিশ ওকে ধোলাই দেবার পর সেটাও ছেড়ে দেয়। এখন কী করে জানি না।”
কিকিরা বললেন, “বাঃ! দুটিই রত্ন। কাকা-ভাইপো। বডিবিল্ডার-কুমার আর ব্রেকলেস বাচ্চু! ভেরি গুড।”
চন্দনের খেয়াল হল। বলল, “এখানে নেমে পড়া ভাল।“
তারাপদ সঙ্গে-সঙ্গে ট্যাক্সি থামাতে বলল।
.
খানিকটা আগেই নেমে পড়েছিল তারাপদরা। হাঁটতে লাগল। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করছিল মাঝেসাঝে। উত্তর কলকাতার এই জায়গাটার যেমন কেমন মরা-অবস্থা। আদ্যিকালের এলাকা বলেই বোধ হয় তার আর কোনো শোভা নেই। রাস্তা, দোকান, বাড়িঘর সবই খাপছাড়া, ভাঙাচোরা। পুরনো দিনের গন্ধও বুঝি পাওয়া যায়।
অনেকটা এগিয়ে এসে তারাপদ বলল, “কিকিরা-স্যার, আমরা কি গঙ্গার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?”
কিকিরা মাথা নাড়লেন।
চন্দন বলল, “চিতপুরের এইসব এলাকা এককালে কলকাতার বনেদি পাড়া ছিল, তাই নয় কিকিরা?”
কিকিরা বললেন, “ছিল বই কি!” বলে তারাপদর দিকে মুখ ফেরালেন। বললেন, “তারাপদ, তুমি জগন্নাথের বাবা সম্পর্কে কিছু জানো?”
তারাপদ অবাক হয়ে বলল, “জগুদার বাবা! না, জগুদার বাবা সম্পর্কে কেমন করে জানব! জগুদার বাবা! না, জগুদার মুখে আপনি যা শুনেছেন আমিও তাই শুনেছি। বরং সেদিন আপনার কাছে জগুদা বাবার কথা খানিকটা বলল, আমি অতটাও আগে শুনিনি।”
চন্দন বলল, “যাচ্ছি আমরা প্রেতসিদ্ধকে খুঁজতে, আপনি জগন্নাথের বাবার কথা তুলছেন কেন?”
কিকিরা বললেন, “গাছের শেকড়টা বোধ হয় ওই বাবাতেই ছড়িয়ে আছে। এ যা দেখছ–এগুলো ওপরের ডালপালা।”
“মানে?”
“মানেটা বোঝবার চেষ্টা করো স্যান্ডেল উড! তুমি তো ডাক্তার। একটা লোক এসে তোমায় বলল, তার মাথা ব্যথা করছে, তুমি তখন কী করবে? ব্যথাটা কেন, কী থেকে হচ্ছে জানার চেষ্টা করবে না। এটাও হল সেইরকম। শুদ্ধানন্দ বাবাজি হল পরের ব্যাপার, আগের ব্যাপারটা তো জানতে হবে।”
তারাপদ হঠাৎ বলল, “স্যার, আমরা বোধ হয় এসে গিয়েছি।”
চন্দন দাঁড়িয়ে পড়ল।
ক’দিন আগে পূর্ণিমা গিয়েছে। আজ কোন তিথি কে জানে। এখনো চাঁদ ওঠেনি। কৃষ্ণপক্ষ। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।
কিকিরা ভাল করে দেখলেন। বললেন, “এই গলিটাই মনে হচ্ছে।”
চন্দন বলল, “হ্যাঁ, এই গলি। গাছটাও রয়েছে।”
“তবে এসো,” বলে কিকিরা পা বাড়ালেন।
জগন্নাথ যেমন-যেমন বলেছিল, গলির বাঁ দিকে লম্বা একটানা টিনের চালা, গুদোমখানার মতনই দেখতে। ডান দিকে ঠেলাঅলাদের আস্তানা। সরু গলি, ইট বাঁধানো। ভাঙা ঘরবাড়ি, আগাছা আর স্যাঁতসেঁতে জমিজায়গার এক ঘন গন্ধ রয়েছে। এই গলিতে বাতিও জ্বলে না।
একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, গুদোমখানা বা ঠেলাগাড়ির আস্তানার পেছন দিকের গলি এটা। এই গলি দিয়ে মানুষই কোনোমতে চলতে পারে, আর কিছু করা সম্ভব নয়।
কবেকার এক পুরনো ভাঙা মন্দির, ভেঙে পড়া বাড়ির স্তূপ, গাঁ-গ্রামের মতন শ্যাওড়া আর কুলঝোঁপ, জোনাকি উড়ছিল কয়েকটা।
খানিকটা এগিয়ে কিকিরা বললেন, “ওহে, একসঙ্গে এসো না। পজিশন নিয়ে এগোও।“
চন্দন ঠাট্টা করে বলল, “আমরা কি যুদ্ধে যাচ্ছি, না, ডাকাতি করতে যাচ্ছি যে পজিশন নেব?”
কিকিরা মজার গলায় বললেন, “স্পাইয়িং করতে যাচ্ছি। স্পাইয়িং করার সময় ঘাপটি মেরে যেতে হয়, বুঝলে?”
“বুঝলাম।”
“তোমাদের কাছে টর্চ নেই?”
“না।”
“আমার কাছে আছে। আমি এখন টর্চ জ্বালাব না। নেহাত দরকার না পড়লে জ্বালাবই না। আমি আগে-আগে যাচ্ছি। তোমর পেছন-পেছন এসো। তফাতে থাকবে। কেউ যেন কাউকে চেনো না, এইভাবে আসবে।”
তারাপদ বলল, “ঠিক আছে। আপনি এগিয়ে যান।”
কিকিরা বিশ-পঁচিশ পা এগিয়ে গেলেন। তারাপদ বলল, “চাঁদু, তুই এগো। আমি সবার শেষে।”
সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে চন্দনও পা বাড়াল।
তারাপদ অপেক্ষা করতে লাগল।
সামান্য পরে তারাপদর মনে হল, পেছনে যেন কার পায়ের শব্দ হচ্ছে। আসছে কেউ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখবে কি দেখবে না করেও সে ঘাড় ঘোরাল না। গলি দিয়ে লোকজন আসতেই পারে। কৌতূহল দেখানো উচিত নয়।
তারাপদ খুব আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগল, যেন তার পায়ে চোট রয়েছে, জোরে-জোরে হাঁটতে পারছে না।
শব্দটা ক্রমশই কাছে এসে গেল।
হঠাৎ তারাপদর মনে হল, শ্ৰদ্ধানন্দর কোনো চেলা তাদের ওপর নজর রাখছে না তো? কিন্তু তাই বা কেমন করে হবে। ওরা যে আজ কাঁঠালতলার গলিতে গোয়েন্দাগিরি করতে আসছে এ-কথা অন্য কেউ জানে না। জগুদাও নয়।
তারাপদ ঘাবড়াল না। আগের মতনই হাঁটতে লাগল। সামনে চন্দন রয়েছে, তার আগে কিকিরা। বেমক্কা কিছু ঘটলে তারাপদ চেঁচাবে। তার চিৎকার শুনলে চন্দনরা ছুটে আসবে।
একেবারে ঘাড়ের ওপর কে যেন এসে পড়ল। দাঁড়াল তারাপদ। ঘাড় ঘোরাল।
অন্ধকার এমন নয় যে লোক দেখা যায় না। তারাপদ লোকটাকে দেখল। দেখে অবাক হল। কুচকুচে কালো, নাদুসনুদুস, টাক মাথা বয়স্ক এক ভদ্রলোক। ধুতি-জামা পরা। চোখে চশমা। হন্তদন্তভাবে হাঁটছিল। ঘাড়ে এসে পড়েছে।
তারাপদ ইচ্ছে করেই বলল, “দাদা, একটু সামলে…। ঘাড়ে এসে পড়ছেন যে!”
লোকটি কোনো কথা বলল না। যেন কানেই তুলল না কথাটা। দেখলেও না তারাপদকে। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল। ওর তাড়া দেখে মনে হল, কোনো দিকে খেয়াল রাখার মতন অবস্থা এখন আর মশাইটির নেই। আশ্চর্য!
হাঁটতে-হাঁটতে তারাপদ লোকটিকে দেখছিল। ও কি প্রেতসিদ্ধর কাছে যাচ্ছে? বোধ হয় সেখানেই যাচ্ছে।
গলিটা একেবারে সোজা নয়, ডাইনে-বাঁয়ে বাঁক আছে। লোকটা কোথায় মিলিয়ে গেল।
চন্দন বা কিকিরাকেও দেখতে পাচ্ছিল না তারাপদ। আড়ালে পড়ে গিয়েছে ওরা। খানিকটা এগোতেই বাঁ দিকের এক ভাঙাচোরা একতলা বাড়ির সদর খুলে গেল আচমকা। শব্দ হল। এরকম একটা দরজা এখানে থাকতে পারে কে জানত! দরজার চেহারা দেখলেই ভয় করে। কালো ঝুল যেন। বোঝাই যায় না ওটা দরজা না অন্য কিছু।
দরজা খুলে ঢ্যাঙামতন একটা লোক বেরিয়ে এল। তার পেছন-পেছন এক নেড়ি কুকুর। কুকুরটা ডেকে উঠেছিল। তারাপদর পায়ের কাছে ছুটে আসতে-না-আসতেই ঢ্যাঙা লোকটা ধমক দিল কুকুরটাকে।
তারাপদকে দেখতে-দেখতে লোকটা বলল, “কোন বাড়ি চাই?” ওর গলার স্বর ভাঙা, খসখসে।
তারাপদ ঘাবড়ে গেল। বলল, “এটা কাঁঠালতলার গলি নয়?”
“হ্যাঁ।”
“এখানে শুদ্ধানন্দ গুরুজি?”
“ও!…সিধে হাঁটতে হবে।”
“কতটা?”
“পাঁচ-সাত মিনিট।” বলে লোকটা উলটো দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল। বলল, “ঘন্টা পড়েছে?”
“ঘণ্টা?”
“ঘণ্টা পড়ার পর বাবার ওখানে ঢোকা যায়।”
“ও।”
“প্রথম ঘণ্টাও পড়েনি?”
“শুনিনি।..তবে একজনকে যেতে দেখলাম।”
“আজ শনিবার না? ঘণ্টা পড়ে যাবে।” বলে লোকটা আর দাঁড়াল না। এগিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে দূর থেকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল।