তৃতীয় অধ্যায় – আসামে ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান ও পশ্চিমবঙ্গের কথা-১৯৬০
‘বঙ্গাল খেদা ভাই, বঙ্গাল খেদা
অসম দেশের পরা বঙ্গাল খেদা,
বিদেশী বঙ্গালে দেশ লুটিলে
ধন সম্পদ সকলো হরিলে।
… … …
মাটি-বারী-ঘর সকলো নিলে
বেপার বণিজ সবাকো খালে,
সোনর অসম হল আলৈ বিলৈ
ভাষা-কৃষ্টি-ধন সব নাশিলে।’
হিতেশ ডেকা রচিত ও ১৯৫৭ সালে আসাম থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত কবিতার কয়েকটি চরণ থেকে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশের মানসলোক সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ সম্ভব। সরাসরি জাতি বৈরিতা খোলাখুলিভাবে, লিখিত আকারে। ভারতের মাটিতে এই বৈরিতা বেদনাদায়ক, উদবেগের কারণও বটে।
আমরা ইতিমধ্যে ১৯৪৮, ১৯৫০ এবং ১৯৫৫ সালে সংঘটিত দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ে অবগত হয়েছি। কিন্তু ১৯৬০ সালে স্বাধীন ভারতের একটি রাজ্য আসামে যা ঘটেছে— তা ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি দাঙ্গাকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে— ফলস্বরূপ জাতিগতভাবে অসমিয়া সমাজকে কলঙ্কিত করেছে, তাঁদের ইতিহাসকে করেছে মসিময়। বস্তুত ১৯৬০ সালে ভাষার নামে আসামের বাঙালি জীবনে যা ঘটে গেছে— তাকে ‘ভয়ানক’, ‘ভয়াবহ’, ‘রক্তাক্ত’, ‘ন্যক্কারজনক’, ‘কলঙ্কময়’, ‘নারকীয়’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করলেও কম করা হবে। বরং বলা উচিত ভারতের ‘কালো অধ্যায়’ যা এদেশের মানুষের সম্মানকে স্বদেশে এবং বিদেশে ভুলুন্ঠিত করেছে।
এসময় বাঙালি সমাজ বিশেষত বাঙালি হিন্দু সমাজের ওপর নজিরবিহীন ব্যাপক হামলা নেমে আসে। এই হামলায় অসমিয়া সমাজের একটি বড়ো অংশ বাঙালি মুসলমানদের একটি অংশ এবং অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর কিছু মানুষও এই হামলায় অংশগ্রহণ করে বলে জানা গেছে। তবে জোর দিয়েই বলা যায় যে, দাঙ্গাহাঙ্গামা চলাকালে কোনো বাঙালি মুসলমানের বাড়ি-ঘর আক্রান্ত হয়েছে— এমন নজির বিরল প্রায়। কোনো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ বা তাঁদের বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন সংবাদও অনুপস্থিত। সুতরাং, ১৯৬০ সালে আসামে বাঙালিরাই যে ‘টার্গেট’ ছিলেন সে-বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আর এসবই হয়েছে ভাষার নামে।
বর্তমান অধ্যায়ে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন বা অভিযানের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে উদবাস্তু উপস্থিতি তথা সেখানকার সরকার, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখার প্রয়াস থাকবে আমাদের বর্তমান অধ্যায়ে।
‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান
কার্যত ১৯৬০ সালের মে মাস থেকেই আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপর সরাসরি হামলা শুরু হয়। ২০ মে গৌহাটিতে তৈল শোধনাগারে কর্মরত বাঙালি জেনারেল ম্যানেজারসহ কতিপয় কর্মচারী-কর্মকর্তাকে আক্রমণ করা হয়। অসমিয়াদের দাবি রিফাইনারি কোম্পানিতে যথেষ্ট সংখ্যক অসমিয়া প্রতিনিধিত্ব নেই। অবস্থা এতটাইগুরুতর আকার ধারণ করে যে, আসাম ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এস এম দত্তকে গৌহাটিতে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এই হামলার ফলে বাঙালি তো বটেই অনসমিয়া অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ইণ্ডিয়ান অয়েল রিফাইনারির চেয়ারম্যান ফিরোজ গান্ধী গৌহাটিতে এবিষয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান:
রিফাইনারির কাজে স্থানীয় লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না— এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রকৃত প্রস্তাবে রিফাইনারির কর্মচারীদের মধ্যে শতকরা ৬৬.৭ জন লোকই আসাম প্রদেশের। উচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বহু আসামবাসীকে কাজ দেওয়া হয়েছে। একজন মহিলা মিস ডেকাও কাজ করছেন। তিনি একজন এম এস সি।১
অসমিয়াদের এই সঙ্কীর্ণচিত্ততা তথা প্রাদেশিকতার বিষয় সম্পর্কে স্থানীয় পত্রিকা যুগশক্তি-তে বলা হল:
সম্প্রতি আসামে তৈল শোধনাগার, রেলওয়ে, ডাক ও তার বিভাগ, আসাম অয়েল কোম্পানি, চা-বাগান ইত্যাদিতে অসমিয়াদিগকে চাকুরিতে নিয়োগের প্রশ্নটি লইয়া জোর আন্দোলন চলিতেছে। এই সমস্ত আন্দোলনে একটি বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাইতেছে যে, শুধুমাত্র অসমিয়াভাষীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্যই দাবী জানান হইতেছে। আসামের অধিবাসী অন্য ভাষাভাষী যাঁহারা আছেন। তাঁহাদের জন্য আন্দোলনকারীদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। আন্দোলনকারীদের পক্ষ হইতে তৈল শোধনাগারের ব্যাপার নিয়া শ্রীফিরোজ গান্ধীর নিকট যে ডেপুটেশন পাঠানো হইয়াছিল, তাঁহারা আসামের অনসমিয়াভাষীদের চাকুরি লাভের অধিকার পর্যন্ত অস্বীকার করিয়াছেন। আমরা দুঃখের সহিত লক্ষ করিতেছি যে, আসামের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও সর্বপ্রকার ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়া এই ধরণের সঙ্কীর্ণচিত্ততাকে প্রশ্রয় দিতেছেন। অথচ আসামে তৈল শোধনাগার স্থাপনের দাবীতে রাজ্যব্যাপী যে আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে শুধু অসমিয়া ভাষী নয়, আসামের বঙ্গভাষী ও অন্যান্য ভাষাভাষীরাও অকুন্ঠচিত্তে পূর্ণোদ্যোমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিল। সেইদিন অনসমিয়াদের সহায়তা গ্রহণ করিতে অবশ্য অসমিয়াভাষী নেতৃবৃন্দ কোনোরূপ সংঙ্কোচবোধ করেন নাই। কিন্তু সেই তৈল শোধনাগারেই আসামবাসী বাঙালি ও অন্যান্য অনসমিয়াভাষীদিগকে চাকুরির ক্ষেত্রে কোণঠাসা করিবার জন্য তাঁহারাই তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন।২
জুন মাসে আরও হামলা-আক্রমণের সংবাদ পাওয়া যায়। ‘আসাম কোন পথে’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হল:
…অসমিয়াকে আসামের রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে সম্প্রতি আসাম উপত্যকার সর্বত্র যে উগ্র বাঙালি বিদ্বেষ জাগাইয়া তোলা হইয়াছে, তাহার পরিণাম ভাবিয়া আমরা শঙ্কাবোধ না করিয়া পারিতেছি না। গৌহাটিতে দেশবাণী-সম্পাদক শ্রীবিশ্বপ্রসাদ বসুকে হীন আক্রমণ, ঢেকিয়াজুলিতে বাঙালি নির্যাতন, আসাম অয়েল রিফাইনারির বাঙালি জেনারেল ম্যানেজার শ্রী এস কে মল্লিক, আই সি এস ও তাঁহার সহকর্মীগণের উপর অত্যাচার, বিদ্যালয়াদি হইতে বাঙালি ছেলে-মেয়েদিগকে জোর করিয়া বাহিরে আনিয়া মিছিল ও সভায় নিয়া অসদাচরণাদি হইতে শুরু করিয়া ইদানিং নাজিরা স্টেশনে গাড়ি আটকাইয়া স্ত্রী-পুরুষ-শিশুনির্বিশেষে নির্যাতন, মরিয়ানী স্টেশনে হামলা, নওগাঁও-য়ে বাঙালিদের দোকান লুটপাট, ডিব্রুগড়ে বলপ্রয়োগ ইত্যাদি ঘটনার বিবরণ হইতে বাঙালি বিরোধী অভিযানের স্বরূপ কিছুটামাত্র বুঝিতে পারা যায়। এই ধরণের অত্যাচারের বিস্তৃত বিবরণ নানা কারণে সংবাদপত্রাদিতে প্রকাশ করা হইতেছে না। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র হইতে যে সমস্ত সংবাদ আসিতেছে তাহাতে জানা যায় যে, আসাম উপত্যকার সর্বত্র বাঙালি অধিবাসীদের ধন-মান-প্রাণ আজ বিপন্ন। দুর্বৃত্তদের অত্যাচারে সেখানকার বাঙালিদের মনোবল একেবারে ভাঙিয়া পড়া খুবই স্বাভাবিক।
সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়:
…স্বাধীন ভারতে কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে শুধুমাত্র তাঁহাদের মাতৃভাষা বা নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য অন্যভাষাভাষী সম্প্রদায়ের আক্রমণের লক্ষ্য হইতে হইবে, ইহা অনেকেরই কল্পনারও অতীত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আসাম রাজ্যে বাঙালিদের ধন-প্রাণ ও সম্মান শুধু সেই অপরাধেই বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছে এবং এই ধরণের ন্যক্কারজনক কার্যে উসকানি দিতেছেন অসমিয়াভাষী কতিপয় রাজনৈতিক ও শিক্ষাব্রতী নেতারা, যাহাদের কিছুটা শিক্ষাদীক্ষা ও কান্ডজ্ঞান আছে বলিয়াই আমাদের ধারণা ছিল।৩
আসাম সরকার কতিপয় এলাকাকে ‘Disturbed Areas’ হিসেবে ঘোষণা করে এক ফরমান জারি করেন। ২৩ জুন শিলং থেকে জারিকৃত ফরমান বিষয়ে পত্রিকা জানাল:
A notification in the Assam Gazette extraordinary published here this evening declares Jowai Sub-division of the United Khasi and Jaintia Hills district and Karimganj and Silchar Sub-division of the Cachar district as ‘disturbed areas’ for a period of one year from today under the Assam Disturbed Areas Act of 1955. The notification says that gangs of hostiles are moving about in these areas to create disorder and disturb peace and tranquility of these areas. The Government Assam after careful consideration of all facts and circumstances is satisfied that in order to make adequate provisions for suppression of disorder and maintenance of public order and communications in disturbed areas, and for protection of life and property of loyal citizens it has become necessary to declare those areas as disturbed areas.৪
জুন মাসেই আসামে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটলে সরকার পার্বত্য অঞ্চলের বেশকিছু অংশে এবং সমতলের করিমগঞ্জ ও শিলচরে উল্লিখিত ফরমান জারি করতে পারেন— তা সহজেই অনুমেয়।
এ মাসেই তিনসুকিয়া থেকে মরিয়ানী পর্যন্ত মেল সার্ভিস সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। মেল ভ্যানের সর্টারদের ওপর হামলাও চালানো হল। সংবাদে বলা হল— মেল ট্রেন সার্ভিস ২৩ জুন থেকে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আসাম রাজ্যে সরকারি ভাষাকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি যে বিক্ষোভ, অরাজকতা দেখা দেয় তারই জেরে দাঙ্গাকারীরা রেলওয়ের অনসমিয়া সটার্রদের ওপর হামলা পরিচালনা করে। দলে দলে হাঙ্গামাকারীরা রেলগাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে, প্রকাশ্য দিবালোকে তারা এই হামলা চালায়। তারা মারপিট করে, চিঠিপত্র তছনছ করে ছিঁড়ে ফেলে। দুষ্কৃতিকারীরা ৫/১০ মিনিট অন্তর শিকল টেনে ট্রেন থামিয়ে লাঠি, ইট-পাটকেল, ছুরি প্রভৃতি নিয়ে অনসমিয়া যাত্রীদের আক্রমণ করে। এসব ঘটনা তিনসুকিয়া ও মরিয়ানী স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানেই ব্যাপক আকারে সংঘটিত হয়। রীতিমতো অরাজক অবস্থা।৫
প্রকৃত অর্থে জুন মাসে বাঙালিদের ওপর হামলা-আক্রমণ ক্রমশ ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনে পরিণত হয়। এসময় আসামের ডিব্রুগড়, নওগাঁ, শিবসাগর, শিমূলগুড়ি, তিনসুকিয়া প্রভৃতি স্থান থেকে বাঙালিদের ওপর হামলার খবর পাওয়া যায়। অভিযোগে বলা হয় ৫ জুন থেকে ডিব্রুগড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়। অসমিয়া যুবকেরা ৫ জুন স্কুলে ধর্মঘটের নাম করে বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। ২২ জুন শহরে হরতাল পালনের দিন বাঙালি বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করে। এদিন বহু বাঙালি ব্যবসায়ীর দোকানের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলা হয়। এমনকী সাধনা ঔষধালয় ও অন্যান্য বাঙালি ওষুধের দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়। অনেক বাঙালির মিষ্টি ও তরকারির দোকানও লুন্ঠিত হয়। এদিন উদবাস্তু কলোনি ও বড়োবাড়ি রেলওয়ে কলোনিতে হামলা চালানো হয়। দু-জন বাঙালি যুবককে ছুরিকাঘাতের বিবরণ পাওয়া যায়।৬
‘রেলওয়ে মেল সার্ভিসের কর্মীগণ প্রাণের ভয়ে লাইনে ওঠেননি। …শিবসাগর জেলার মরিয়ানী— তিনসুকিয়া লাইনে বড়োহাট পর্যন্ত সমুদয় লাইন এক শ্রেণীর অসমিয়া হাঙ্গামাকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই দাঙ্গাকারী লুটেরার দল স্টেশন ছাড়ার পরই বিপদ সঙ্কেত চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে যাত্রী বগিগুলিতে উঠে পড়ে। তাদের হাতে থাকে লোহা বা কাঠের ডাণ্ডা, দু-মুখো ধারালো ছোরা, রেলের ছোটো-বড়ো পাথর। তারা উঠেই বলে ‘কোত যাব’? এই প্রশ্নের উত্তরে যাত্রীরা যে মুহূর্তে বাংলা ভাষায় উত্তর দেয়, আর তখনই কান, হাত, ঘাড় বা চুল ধরে টেনে হিচড়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে আনা হয়। তারপর তাদের ওপর চলে অত্যাচার। তাদের নির্যাতনের হাত থেকে শিশু-বৃদ্ধ-নারী এমনকী চিকিৎসাধীন রোগী পর্যন্ত ছাড়া পাননি। যুবতী মেয়েদের গলায়, গায়ে হাত গিয়ে শ্লীলতাহানিসহ তাদের ওপর নির্যাতন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পুলিশ নেই, প্রহরা নেই, কোনোপ্রকার রক্ষা ব্যবস্থাও নেই কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ট্রেনে। মেল-ভ্যানে উঠে বাঙালি কর্মচারীদের কান ধরে নীচে নামিয়ে গালাগালি করা, কারো কাছে বাংলা বই পাওয়া গেলে তা টেনে ছিঁড়ে তাতে থুতু ছিটিয়ে পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্যও অনুপস্থিত ছিল না। নামডয়ালী, মেজেঙ্গা, চাপরাই, লাখোয়া, নাকাচারী, মাহুতগাঁও প্রভৃতি ছোটো-মাঝারি রেলস্টেশনে অসমিয়া হাঙ্গামাকারীদের অত্যাচার ছিল লাগামছাড়া।’৭
বাঙালিদের ওপর এই ভয়াবহ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হন। করিমগঞ্জ শহরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী আসাম উপত্যকার বিভিন্ন অংশে অসমিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বাঙালিদের ওপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদে করিমগঞ্জ শহরে ধর্মঘট পালিত হয়। এল পি স্কুল ও কিণ্ডারগার্টেনের ছেলে-মেয়েরাও এদিন ক্লাসে যোগ দেয়নি।
পরে রেবা দেব-এর সভানেত্রীত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় করিমগঞ্জ ছাত্র সংহতির সভাপতি রবিজিৎ চৌধুরী, সম্পাদক ললিত শুক্ল, সতু রায়, ছন্দা বর্ধন, ব্যোমকেশ বিশ্বাস, সুব্রত সেন ও কামাখ্যা চক্রবর্তী বক্তৃতা করেন। তাঁরা আসাম উপত্যকায় বসবাসরত বাঙালিদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেন।৮
কমিউনিস্ট পার্টিও এই গুণ্ডামির নিন্দা জানায়। আসাম রাজ্য কমিউনিস্ট পার্টি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে জানায়, ‘রাজ্যের ভাষার জন্য আন্দোলনসহ সর্বপ্রকার ন্যায্য দাবির আন্দোলনই নাগরিকদের করার অধিকার আছে বলে পার্টি মনে করে। কিন্তু আমরা তীব্রভাবে গুণ্ডামি এবং অরাজকতার নিন্দা না করে পারি না। কারণ এর ফলে ইতিপূর্বেই অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং আসামের সুনামে কলঙ্ক স্পর্শ করেছে।’
কাউন্সিল আশা প্রকাশ করে যে, ‘আসামের যুক্তিবাদী প্রত্যেকটি নর-নারী রাজ্যের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে শান্তি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার কাজে উদ্যোগী হবেন।’৯
আসাম উপত্যকার অধিকাংশ এলাকায় অরাজকতা এবং অনসমিয়া অধিবাসীদের বিশেষ করে বাঙালিদের ওপর নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধনির্বিশেষে জঘন্য অত্যাচার চলতে থাকায় শিলচর বার অ্যাসোশিয়েশন ২৭ জুন ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শিবসাগর, কামরূপ ও লক্ষ্মিমপুর জেলাসহ আসামের অধিকাংশ অঞ্চলে রাজ্য সরকার আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এবং অন্তত সাময়িকভাবে আসামের শাসনব্যবস্থা বাতিলের অনুরোধ জানানো হয়।’১০
কাছাড়ের অন্যতম ‘প্রবীণ আইনজীবী ও আসাম সাহিত্যসভার কাছাড় শাখার সভাপতি যোগেন্দ্র দত্ত বলপূর্বক অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ও সংঘবদ্ধ গুণ্ডামির প্রতিবাদে সভাপতি ও সদস্য পদে ইস্তফা দেন।’ কাছাড় সদর থেকে ২৮ মাইল দূরবর্তী কালাইনে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। উদ্যোক্তাদের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় বক্তাগণ আসাম উপত্যকায় গুণ্ডামির প্রতিবাদ জানান। বক্তাগণ বলেন, ভাষা সমস্যা সম্পর্কে প্রয়োজন হলে কাছাড় জেলা থেকে নির্বাচিত সকল বিধানসভা সদস্যের পদত্যাগ করা উচিত।১১
এদিকে ‘মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’, করিমগঞ্জ ‘বার অ্যাসোসিয়েশন’, ‘পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘প্রজাসমাজতন্ত্রী দলে’র কর্ম সচিবগণ সমবেতভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতি ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, স্বরাস্ট্র সচিব গোবিন্দবল্লভ পন্থ, আসামের রাজ্যপাল নাগেশ ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহার নিকট এক তারবার্তা প্রেরণ করে। তারবার্তায় বলা হল: ‘রাজ্যভাষা প্রশ্নে আসামের উপত্যকা অঞ্চলের বহুস্থানে ছুরিকাঘাত, লুঠপাট ও অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপকভাবে গুণ্ডামি ও অরাজকতা চলছে এবং তার ফলে অনসমিয়া অধিবাসীদের বিশেষত বাঙালিদের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে উঠেছে।’ তারবার্তায় আরও বলা হয়, ‘রেলওয়ে ও আর এম এস কর্মচারীরা, আয়কর কর্মচারীরা এবং ডিব্রুগড়ের বিমান কর্মচারীরা গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন এবং স্ত্রী-পুরুষ ও বয়সনির্বিশেষে যাত্রীদের লাঞ্ছনা করা হয়েছে। অবস্থার আরও অবনতি হবার পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয়।’১২
করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এম এল এ রণেন্দ্রমোহন দাস মুখ্যমন্ত্রী চালিহার নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বলেন, ‘আসামের অনসমিয়া অধিবাসীদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আসাম উপত্যকায় অবিলম্বে গুণ্ডামি বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।’
জুন মাসেই দাঙ্গাহাঙ্গামা, অরাজকতা চরম আকার নেয়। সংবাদপত্রে বলা হল: বহু ভাষাভাষী আসামে একমাত্র ‘অসমিয়া’-কে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবিতে আসাম উপত্যকায় তা ‘আদায়ের’ পরিপূরক হিসেবে নগর, পল্লি, রাস্তা, হাট, বাজার, ট্রেনে নিরীহ বাঙালি নর-নারীনির্বিশেষের উপর এক শ্রেণীর অসমিয়ার অবাধ আক্রমণের ফলে অরাজকতা দেখা দিয়েছে। শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে এইপ্রকার আক্রমণ, প্রহার ও মর্মান্তিক লাঞ্ছনার বিবিধ করুণ কাহিনি নিয়তই নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে।১৩
লোকসভা সদস্য দ্বারিকানাথ তেওয়ারী ও নিবারণচন্দ্র লস্কর, জেলা কংগ্রেস সভাপতি নন্দকিশোর সিংহ, গৌরীশঙ্কর রায় প্রমুখ নেতৃবর্গ মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহার নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় আসাম উপত্যকা তথা কাছাড়ে কল্পনাতীত অবাঞ্ছিত কার্যকলাপ কঠোর হাতে দমনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান।১৪
এ সময় এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে বাঙালি বিরোধী উসকানি কতটা প্রবল ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল মতলিব মজুমদারকে তেজপুর থেকে জনৈক বাঙালির ১০ জুন লেখা একটি চিঠি থেকে। চিঠিতে লেখা হয়:
আসামে বাঙ্গালীরা অসমীয়া ভাইগণ কতৃক জর্জরিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত। অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করিবার জন্য অসমীয়া ভাইরা বাঙ্গালীদের প্রতি জঘন্য ব্যবহার করিতেছেন। এই সহরের অনেক প্রবীণ শ্রদ্ধেয় অসমীয়া ভদ্রলোক বাঙ্গালীদিগের বিরুদ্ধে অসমীয়া ছেলেদের খেপাইয়া তুলিতেছেন। হাটে, মাঠে বাঙ্গালীদিগকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। তেজপুরের একজন শ্রদ্ধেয় উকিল রাজ্যভাষা অসমীয়া করিতে প্রয়োজন হইলে ‘বাঙ্গালীর রক্ত দ্বারা স্নান করিব’ বলিয়াছেন। এই সবের কি কোন প্রতিকার নাই।১৫
পঞ্চান্ন বছরেরও পূর্বের লেখা চিঠি থেকে উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদ সমাজজীবনের কত গভীরে পৌঁছেছিল তা মনে করলেও শিউরে উঠতে হয়। আজও কী ভারত তথা পৃথিবীর মানুষ কুৎসিত এই কদর্যতা থেকে মুক্ত?
নারীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে করিমগঞ্জের সকল সম্প্রদায়ের পাঁচ হাজারেরও অধিক মহিলা করিমগঞ্জ শহরের ব্যাঙ্ক ভবনে ২৯ জুন বিকাল পাঁচটায় এক সভায় মিলিত হন। সভায় সভানেত্রীত্ব করেন সুনীতিবালা দাস। বক্তব্য রাখেন—অঞ্জনা দত্ত, বাসন্তী দেব, কল্পনা দাশগুপ্ত, সুপ্রভা আদিত্য, সুপ্রীতি দেব রায়, ছন্দা বর্ধন ও দীপ্তি ভট্টাচার্য। বক্তাগণ নারী লাঞ্ছনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘চালিহা মন্ত্রিসভা এ সম্পর্কে নীরব ও নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।’ …আসামে অবিলম্বে বাঙালিদের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে বলা হয় যে, অন্যথায় বাঙালিরা এই অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে আবশ্যকীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হবেন।১৬
২৮ জুন কলকাতার বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের প্যাকেট দুর্বৃত্তরা বিমান অফিস থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে পুড়িয়ে দেয়। সংবাদপত্রে বলা হয়:
The burning of packets of Calcutta newspapers at Jalukbari yesterday was the culmination of the people’s dissatisfaction and disgust at the vicious tirade these Bengali-owned papers have been indulging in for about a fortnight against the popular demand for declaring Assamese as the State language of Assam. …About a hundred public men and student leaders today sent a telegram to the chief Minister of Assam drawing his attention to the provocating language used by the calcutta papers.১৭
৩০ জুন গৌহাটি শহরে সকালের দিকে বিক্ষিপ্ত আক্রমণে ৬ জন আহত হয়। পরে আরও ১০জন আহত হওয়ায় গৌহাটি শহরে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। শহরে ১৪৪ ধারা জারি এবং পরে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। ঘোষণায় বলা হয় এই আদেশ গৌহাটিতে শান্তি ফিরে না আসা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।১৮
অপরদিকে The Assam Tribune গৌহাটি থেকে ৩০ জুন এ সম্পর্কে জানাল:
..Following six strong assaults in the town today with mounting tension on State language agitation section 144 was imposed in the limits of Gauhati town late this evening. Closely following on the declaration of section 144 in Gauhati town, police vans went round proclaiming imposition of carfew in the town from 9.30 PM to 5 AM. Among the assaulted persons was one senior officer of the Indian Refineries Limited, who received bleeding injuries on the head and body and was attended to in the local civil hospital.
… … সংবাদে আরও বলা হল:
Meanwhile, reports are pouring in here from all parts of Assam stating that the anti-Assamese propaganda was condemned at meeting held at different places of the State. There was also a move to boycott a number of Calcutta papers that launched the anti-Assamese tirade systematically for the last few days.১৯
অন্যদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পত্রিকা স্বাধীনতা জানাল: ৩০ জুন শহরের কয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে মারপিট হওয়ার ফলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং গৌহাটি শহরের চৌহদ্দির মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এরপরই রাত সাড়ে ন-টা থেকে সকাল পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে বলেও সরকারি ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়।২০
সান্ধ্য আইন জারি করা হলেও ১ জুলাই তারিখেই তা প্রত্যাহার করা হয়। ‘The carfew order clamped down on Gauhati and its suburbs last night was lifted this afternoon by the District Magistrate of Kamrup.’২১
এসময় কমিউনিস্ট পার্টি দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ে এক বিবৃতি প্রচার করে। বিবৃতিতে বলা হয়: ‘আসামের রাজ্যভাষা সম্পর্কিত বিক্ষোভের ফলে রাজ্যের কয়েকটি স্থানে অবাঞ্ছনীয় ও অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে, এসকল কাজের দ্বারা আসামের সুনাম বিনষ্ট হয়েছে। রাজ্যের জনসাধারণের প্রত্যেকটি অংশের ন্যায্য দাবী, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য রাজ্যভাষা ও অন্যান্য প্রশ্নে সর্বপ্রকার বৈধ আন্দোলন করার নিরঙ্কুশ অধিকার আছে। পোস্টার ও হ্যাণ্ডবিলের মাধ্যমে যে সকল আইন বিরুদ্ধ, হিংসাত্মক কাজ ও গুণ্ডামি চলছে কমিউনিস্ট পার্টি কঠোর ভাষায় তার নিন্দা করছে।… … বাঙ্গালীর উপর যে অত্যাচার চালানো হয়েছে—তাতে পার্টি ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই ধরণের উগ্র প্রাদেশিকতার মূলে কায়েমি স্বার্থের উসকানি রয়েছে বলেও পার্টি সন্দেহ প্রকাশ করে।… …এ জাতীয় কাজের দ্বারা আসামের জনসাধারণের ঐক্য ও মিলিত জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে উঠেছে, এবং মেহনতি মানুষই সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’২২
৩০ জুন ডিব্রুগড় থেকে পাঠানো সংবাদে সেখানে ব্যাপক হাঙ্গামার কথা জানা যায়। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ডগুলি ভেঙে ফেলা হয়। ডিব্রুগড় শহরে সন্ধ্যার পর কোনো বাঙালির বাইরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ‘বাংলাভাষা ধ্বংস হোক’, ‘যারা বাংলায় কথা বলে তারা দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি ধ্বনি দেওয়া হত। গ্রেহেমবাজার সদর রাস্তায় ক্ষিতীশচন্দ্র সেন, বকরিটুলি বস্তিতে রমেশ দে ও তার স্ত্রী-পুত্রসহ ছ-জনকে হাত-পা বেঁধে অত্যাচার ও তার ঘর লুট করা হয় বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। রেলওয়ে কারখানার পিছনে কদমনী অ্যাপ্রেন্টিস হোস্টেলে প্রায় ৭০ জন বাঙালি বাস করতেন, তাদের ওপরও আক্রমণ চালানো হয়। এদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গোলাঘাট, দৈ গ্রূংহাট, তিতাবর, বড়োবাড়ি রেলকলোনি, দক্ষিণ হেঙ্গেরা প্রভৃতি এলাকার বাঙালিরাও হামলার শিকার হন বলে জানা যায়।২৩
২ জুলাই শিলং শহরে মারপিট ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে পুলিশ কয়েকজন ছাত্রসহ ১৯ জনকে গ্রেফতার করে। ১৪ জন আহতকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়। এদিকে গৌহাটি থেকে প্রায় এক মাইল দূরে শিলপুখুরিতে রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রায় ৪০০ জনের এক জনতা— যাদের অধিকাংশই ছাত্র, মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বাঙালি বিরোধী ধ্বনি দিতে দিতে হামলা চালায়। এলাকার নারী-পুরুষ-শিশুর কান্নার রোল, বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে এলাকা কম্পিত হলেও কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। হাঙ্গামার এক পর্যায়ে পুলিশ এসে লাঠি চার্জ করে। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হওয়ায় ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপার অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে শিলং ও শিলপুখুরি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।২৪
৪ জুলাই গৌহাটিতে স্থানীয় কলেজ হোস্টেল সন্নিকটে অগ্নিসংযোগের ফলে উত্তেজনা চরম আকার নেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ফলে, রঞ্জিত বড়োপূজারি নামের এক অসমিয়া ছাত্র নিহত ও ৭ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে দু-জনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা যায়।
গুলি বর্ষণের পর ক্রুদ্ধ জনতা ডেপুটি কমিশনার পি এল সোম-এর বাংলো প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। জানা যায়, জনতার মধ্য থেকে কোনো একজন শ্রীসোমকে ছুরিকাঘাত করে এবং তিনি আহত হন। এই সংবাদে ট্রেজারি পুলিশ গার্ডরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে রক্তাক্ত ডেপুটি কমিশনারকে হাসপাতালে নিয়ে যান।২৫
এ দিনই এক বিরাট সভায় রঞ্জিত বড়োপূজারির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ এবং পুলিশের গুলি চালানোর নিন্দা জানানো হয়। হাঙ্গামা গৌহাটি ছাড়াও কামরূপ, বৈহাটা, গোরেশ্বর প্রভৃতি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গুলি চালানোর বিষয়টি জনমনে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে সংবাদপত্রে বলা হল:
One Youngman— a student of second year I A class of Cotton College was killed and six others received bullet injuries when the police opend fire in an indiscriminate manner at the Cotton College Hostel this morning. Tension mounted suddenly and 24-hours curfew was clamped down on Gauhati with immediate effect.
The army has been requisitioned to keep law and order in the town and they are moving into Gauhati from Shillong today, it is learnt from official sources.
Victims of Police firing
Dead: Ranjit Borpujari, 2nd year art student (Mess II) of Sibsagar.
Injured: 1. Amit Bhattacharjee, 4th year B A, 2. Netradhar Das, 2nd year I Sc, 3. Tilak Hazarika, 2nd year science, 4. Bhupendranath Sharma, 4th year B A, 5. Rudra Gohain, 4th year B Sc, 6. Amar Hazarika, 4th year B Sc …
A demand for a judicial inquiry into the police firing in Gauhati this morning killing one college student and injuring six others has been voiced by all sections of the people.২৬
গৌহাটি থেকে কমিউনিস্ট পার্টি, প্রজাসমাজতন্ত্রী দল এবং কংগ্রেস এক যুক্ত বিবৃতিতে রাজ্যে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান। তাঁরা ‘রাজ্যে অসমিয়া ভাষাকেই সরকারি ভাষা বলে ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, ‘এটা শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক উপায়েই লাভ করা যায়।’ তাঁরা আবেদনে বলেন, ‘কিন্তু ইহা খুবই দুঃখের যে এই সরকারি ভাষার প্রশ্ন লইয়া আসামের কোনো কোনো স্থানে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটিয়াছে। ফলে, কোনো কোনো জায়গায় বিশেষ করিয়া শিলং, শিবসাগর, মরিয়ানী, লামডিং এবং গৌহাটিতে কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছে। এই কারণে রাজ্যের জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে শান্তি সংহতির বিঘ্ন ঘটিয়াছে।’ তাঁরা বলেন:
কোনো কোনো সংবাদপত্র অতিরঞ্জিত এবং প্ররোচনামূলক সংবাদ পরিবশেন করায় উত্তেজনা বেশি বৃদ্ধি পাইয়াছে। …আমরা সংবাদপত্রগুলিকে ভুল ও অতিরঞ্জিত সংবাদে উত্তেজিত না হইতে আবেদন জানাইতেছি। সর্বোপরি আমরা দেশের মঙ্গল ও উন্নতি চাই এবং শান্তিতে বাস করিতে চাই।’
তাঁরা বলেন,
এই অবস্থায়, অপ্রত্যাশিত এবং অবাঞ্ছিত ঘটনাবলীর জন্য আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে হতাশা জন্মাইবার আশঙ্কা রহিয়াছে। অতএব, আমরা আসামের জনসাধারণের নিকট, বিশেষ করিয়া ছাত্র ও যুবকদের নিকট রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতে… … আবেদন জানাইতেছি।২৭
আসলে ‘গৌহাটিতে দেশবাণী পত্রিকা সম্পাদক বিশ্বপ্রসাদ বসু-র প্রকাশ্য রাস্তায় আক্রান্ত ও প্রহৃত হওয়া, আসাম অয়েল রিফাইনারির বাঙালি জেনারেল ম্যানেজার এস কে মল্লিক, আই সি এস ও তাঁর সহকর্মীগণের উপর অত্যাচার, বিদ্যালয়াদি থেকে বাঙালি ছেলে-মেয়েদের জোর করে বাইরে বের করে এনে মিছিল ও সভায় নিয়ে অসদাচরণ, নাজিরা স্টেশনে গাড়ি আটকিয়ে স্ত্রী-পুরুষ-শিশুনির্বিশেষে নির্যাতন, মরিয়ানী স্টেশনে হামলা, নওগাঁওয়ে বাঙালির দোকান লুটপাট, ডিব্রুগড়ে বলপ্রয়োগ, বাংলা ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড মুছে ফেলে দেওয়া, সংবাদদাতাদের সংবাদ না প্রেরণ করার জন্য ভয়-প্রীতি প্রদর্শন, বাঙালি দোকান লুট-পাট ইত্যাদি ঘটনার বিবরণ থেকে বাঙালি-বাংলা বিরোধী অভিযানের স্বরূপ বুঝা যায়।’২৮
গৌহাটিতে ৪ জুলাই পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে শহরের পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। যদিও চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছিল। পরদিন ৫ জুলাই জনসাধারণের জরুরি কাজ সম্পন্ন করার জন্য সান্ধ্য আইন সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। বেসামরিক কতৃপক্ষকে সহায়তার জন্য শহরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা ৪ জুলাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে এদিন ‘গৌহাটিতে পুলিশের গুলিবর্ষণে একজন ছাত্র নিহত এবং ন-জন আহত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, কয়েকদিন যাবৎ গৌহাটিতে আইন-শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য অবনতি হওয়ায় তিনি মর্মাহত। …পরিস্থিতি এরূপ খারাপের দিকে যায় যে, পুলিশের পক্ষে ৪ জুলাই গুলিবর্ষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। …এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেক্টার জেনারেল এবং ডেপুটি কমিশনার জনতার আক্রমণে আহত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আসামে বসবাসকারী বিভিন্ন শ্রেণির লোকেদের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতিসাধনের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’২৯ এ বিষয়ে তিনি সংবাদপত্রগুলিকেও সাহায্যের আহ্বান জানান।
এরপরও আসাম উপত্যকায় শান্তি ফিরে আসেনি। এসময় গৌহাটি থেকে পাঁচ মাইল দূরে নারাঙ্গী রেলস্টেশন প্রায় একশো জন দূর্বৃত্ত আক্রমণ করে বলে জানা যায়। আক্রমণে দু-জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। স্টেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টারের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বকো থানা থেকে গৌহাটি পুলিশকে দ্রুত সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করা হয়। গৌহাটিতে গুলিবর্ষণের পর উত্তর কামরূপ এলাকায় দাঙ্গাহাঙ্গামার বিস্তার ঘটে। রঙ্গিয়া এবং নলবাড়ির পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য স্পেশাল ট্রেনে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী পাঠানো হয়।
আমিনগাঁও থেকে কোনো ট্রেন আসেনি বা তদভিমুখে ট্রেন যায়নি। বনগাইগাঁও এসে আপ আসাম লিঙ্ক এক্সপ্রেস ট্রেনটি থেমে যায়। কোনো কোনো স্টেশনের কর্মচারীরা স্টেশন ঘর বন্ধ করে প্রাণভয়ে স্থান ত্যাগ করে।৩০
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমিনগাঁও রেল কলোনিতে পরিত্যক্ত কয়েকটি বাড়িতে দূর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। …‘সকাল সাড়ে আটটায় গৌহাটির কুমারপাড়াতে বসবাসকারী মানুষের ওপর আক্রমণ চালানো হয় এবং দোকানপাট, বাড়িঘর সব লুন্ঠিত হয়। এমনকি এক পর্যায়ে পুলিশবাহিনীও আক্রান্ত হয়। হামলায় পুলিশের একটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সকাল সাড়ে ন-টার মধ্যে শহরের বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ এবং আক্রমণ শুরু হয়।’
সংবাদদাতা জানান, ‘সকাল দশটায় এই মর্মে সংবাদ পাওয়া যায় যে, হাঙ্গামাকারীরা পেট্রোলের টিন নিয়ে গৃহাদিতে অগ্নিসংযোগের ষড়যন্ত্র করছে। এক ঘণ্টা পর দূর্বৃত্ত দল ডনবস্কো স্কুলের সম্মুখে সমবেত হয়ে বহু গৃহে অগ্নিসংযোগ করে। সংঘবদ্ধ জনতা শহরের বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয়ে সকল যান চলাচলে বাধা দেয়। হাঙ্গামাকারীরা রেল স্টেশন, রেল কলোনি এবং অন্যান্য সরকারি ভবনের দিকে মারমুখী হয়ে রওনা হয়। সকাল এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময় অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’৩১
১৯৬০ সালের জুন এবং জুলাই মাসে বাঙালি বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, আসামের কোনো কোনো স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছুই ছিল না। পলাশবাড়ির যুগান্তর এবং অমৃতবাজার পত্রিকা এজেন্টকে সোমবার রাতে অর্থাৎ ৪ জুলাই রাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পরে তাঁর মৃতদেহ গৌহাটিতে নিয়ে আসা হয়। পলাশবাড়িতে উত্তেজনা বিরাজ করায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হয়।৩২
রাজধানী শিলংয়ের দাঙ্গা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ৬ জুলাই সকাল থেকে সেনাবাহিনী টহল দেওয়া শুরু করে, সঙ্গে পুলিশও ছিল। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারির কথা ঘোষণা করা হয়। এদিন ছুরিকাঘাতের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে। ‘উসকানিমূলক’ মুদ্রিত ও সাইক্লোস্টাইল প্রচার পুস্তিকাও বিলি করতে দেখা যায়। সরকারি মহল থেকে বলা হয়, ‘পরিস্থিতি শান্ত বলে মনে হলেও জনসাধারণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই শান্ত বলা যেতে পারে না।’৩৩
নওগাঁওয়ে বেশ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার পর সেখানে ৬ জুলাই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এদিন প্রেসনোটে জানানো হয়, আমিনগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে আরও কয়েকটি গৃহে আগুন লাগানো হয়েছে।
এদিন গৌহাটির ডেপুটি কমিশনার প্রচারিত এক প্রেসনোটে বলা হয় যে: ‘হাঙ্গামা সংক্রান্ত সংবাদগুলি তারযোগে সংবাদপত্রে প্রেরণের সময় ‘চেক’ করা হবে। প্রেসনোটে আরও বলা হয় যে, সংবাদপত্রগুলি যাতে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশ না করতে পারে তার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এরূপ কোনো সংবাদই প্রকাশ করতে দেওয়া হবে না।’৩৪
৬ জুলাই অপর এক সংবাদে বলা হয়: ‘গৌহাটি থেকে আরম্ভ করে বঙ্গাইগাঁও এবং রঙ্গিয়া থেকে তেজপুর পর্যন্ত আড়াইশো মাইলজুড়ে গৃহে ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচার, নরহত্যা, গুম, ট্রেন উলটে দেবার চেষ্টা, নিরীহ রেলযাত্রী ও কর্মচারীদের মারপিটসহ এক সন্ত্রাসের বিভীষিকা ‘গুণ্ডারাজ’ কায়েম করা হয়েছে।’৩৫
এদিন আসাম প্রত্যাগত ভোরের ট্রেনটি আলিপুরদুয়ার জংশনে থামলে ট্রেনের কামরা থেকে ট্রেনের গার্ড নরেন সরকার, ইঞ্জিন চালক কে জি সান্যালের রক্তাপ্লুত সংজ্ঞাহীন দেহ স্টেশনে নামানো হয় এবং জংশন রেলওয়ে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা যায়।
পান্ডু রেলওয়ে ডাক্তারের ছুরিকাঘাতে মৃত্যু এবং তার স্ত্রীর শ্লীলতাহানির সংবাদ পাওয়া যায় ৫ জুলাই রাতে। সংবাদে বলা হয়: ‘চিকিৎসা সাহায্যের জন্য রেলওয়ে ডাক্তার এ দত্ত তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে পান্ডু যাওয়ার পথে ছুরিকাহত হন এবং তাঁর স্ত্রীর বুকের ওপর চেপে বসে দূর্বৃত্ত দল ধারালো ছোরার সাহায্যে তাঁর ‘স্তনভাগ’ কেটে নেওয়া হয়। ডাক্তার দত্তের স্ত্রীকে পান্ডু রেলওয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বলে জানা যায়। এই ঘটনার পর ৫ জুলাই আসামের দিকে যাবার এবং আসার সমুদয় ট্রেন বন্ধ থাকে। অদ্য ভোর রাতে অর্থাৎ ৬ জুলাই সেনা পাহারায় একটি ট্রেন রঙ্গিয়া—আমিনগাঁও হয়ে আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশনে পৌঁছোয়। এদিন হাজারের অধিক বাঙালি পরিবার নতুন উদবাস্তুর ছাড়পত্র নিয়ে স্টেশনে নামে। এদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত পরিবার যারা গোরেশ্বর স্টেশনের নিকটবর্তী উদবাস্তু পল্লিতে বসবাস করতেন।’
‘৪ জুলাই থেকে গোরেশ্বর, টিহু, বাইহাটা, কেন্দুকোণা এবং চ্যাংশারি— এই স্টেশন পাঁচটি সম্পূর্ণরূপে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রাণের ভয়ে, ওইসব স্টেশনের স্টেশনমাস্টার, সহকারী স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারীগণ আলিপুরদুয়ার চলে আসেন এবং জংশন স্টেশনে আশ্রয় গ্রহণ করেন।’৩৬
সংবাদে আরও জানা যায়: ‘আমিনগাঁও রেল-স্টিমার খালাসিদের তিনটি বস্তি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে, বস্তিবাসীগণ নি:স্ব, অসহায় হয়ে পড়েন। রঙ্গিয়া কলোনি ও বাজার লুটের চেষ্টা হয় কিন্তু তা সফল হয়নি। ৪ জুলাই সন্ধ্যায় হাঙ্গামাকারীরা গোরেশ্বর স্টেশন সংলগ্ন ১২/১৩টি গ্রামে পেট্রোল, কেরোসিন তেল ঢেলে দিনের বেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামগুলি থেকে আর্তচিৎকার, নারী-শিশুর কান্না ধ্বনিত হয়। জানা যায়, ‘হাঙ্গামাকারীদের পুরোভাগে মুসলিম লিগের কুখ্যাত গুণ্ডারা ছিল। তারা অসমিয়াদের সঙ্গে যোগ দিয়ে হাঙ্গামা জিইয়ে রাখছে। দূর্বৃত্ত দল গ্রামসমূহের নিরস্ত্র বাসিন্দাদের সর্বস্ব লুট করার সময় পাঁচটি গাদা বন্দুক থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ২৫/৩০ জন আহত হয়। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে অনেক মহিলাও আছেন। অনেককে গুম করা হয়েছে বলেও জানা যায়।’৩৭
সংবাদে উল্লেখ করা হয় যে, গোরেশ্বর স্টেশন নিকটবর্তী বেগমবস্তি, চিল্কিরঝাড়, কাকতিঘাট ও হাজলপাড়া সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ওই এলাকায় ৩০০০ বাড়িঘর অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। সংবাদে আরও বলা হয়, ‘এত বড়ো অগ্নিকান্ড সমগ্র আসামে কোনোদিন হয়েছে বলে কেউ জানে না। …ক্ষতির পরিমাণ ১৪/১৫ লক্ষ টাকার কম নয়।’৩৮
‘৫ জুলাই সকাল ছ-টায় ‘৭আপ ‘‘সাউথ ব্যাঙ্ক এক্সপ্রেস’’ লামডিং সেকশনের চাপারমুখ ও হোজাই স্টেশনের মধ্যবর্তী বিরতিহীন লউপানি স্টেশনে পৌঁছুলে অসমিয়া ছাত্র ও গুণ্ডাদল চেন টেনে ট্রেন থামায় এবং স্টেশনে অপেক্ষমান গুণ্ডাদল ভ্রমণরত বাঙালি যাত্রীদের ওপর হামলা চালায়।’ হামলায় নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউই তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি।
এদিন গৌহাটির শিলপুখুরিতে এক বাঙালি সরকারি কর্মচারীর গৃহে ১৪৪ ধারা জারির মধ্যেই রাত সাড়ে আটটার দিকে শতাধিক দূর্বৃত্ত দরজা ভেঙে গৃহে প্রবেশ করে লুটপাট-ভাঙচুর চালায়। বিশিষ্ট ভদ্রলোক গৃহস্বামী ও তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের বেদম মারধর করা হয়। এই দূর্বৃত্ত দল কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে হামলা করে। আহত সরকারি কর্মচারী ও তার পরিবারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই রাতে ‘নোয়াখালি কলোনি’ উদবাস্তুদের ওপরও হামলা চালানো হয়। এই হামলায় হামলাকারীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশের সহায়তা লাভ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।৩৯
‘৫ জুলাই বেলা বারোটা নাগাদ আমিনগাঁওয়ের বাঙালি অধিবাসীদের গৃহসমূহে এবং ব্রহ্মপুত্রের উপর সেতু নির্মাণরত ‘হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন’ কোম্পানির অফিসগুলিতে অগ্নিসংযোগ করে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন বিকালের দিকে পলাশবাড়িতে হাঙ্গামা শুরু হলে পলাশবাড়ি থানার বাঙালি অফিসার-ইন-চার্জকে ছুরিকাহত করা হয় এবং পরদিন সকালে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপূর্বে ৪ জুলাই পলাশবাড়ির এক ডাক্তারখানার কম্পাউণ্ডারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর দেহ ময়না তদন্তের জন্য গৌহাটি সিভিল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এদিন দূর্বৃত্ত রা রঙ্গিয়ার নিকটবর্তী স্থানে ট্রেন থামিয়ে তিনজন বাঙালি তরুণীকে ট্রেন থেকে জোর করে নামিয়ে নিয়ে চলে যায়। হতভাগী তরুণীদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।’৪০
‘৫ জুলাই রাত দশটায় নারাঙ্গী রেলস্টেশনের বাঙালি কর্মচারীদের ওপর অসমিয়ারা বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। আক্রমণে দু-জন বাঙালি নিহত এবং চারজন গুরুতর আহত হন। পরদিন বেলা সাড়ে বারোটার সময় বাঙালি দু-জনের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য গৌহাটিতে নিয়ে আসা হয়। ওইদিন গৌহাটি থেকে ১০ মাইল দূরবর্তী রামপুরস্থ কেন্দ্রীয় খাদি বোর্ডের একজন বাঙালি এবং একজন বিহারি কর্মচারীকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়।’৪১
৪ জুলাই আসাম সরকারের প্রচারিত প্রেসনোটে সর্বপ্রথম স্বীকার করা হয় যে, ২৭ জুন থেকে গৌহাটির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। প্রেসনোটে বলা হয়:
‘… … ৩০ জুন অবস্থা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকায় এবং কয়েকটি বিক্ষিপ্ত মারপিটের ঘটনা ঘটায় ডেপুটি কমিশনার ১৪৪ ধারা জারি করেন। কার্ফুও জারি করা হয়। ওই দু-টি আদেশ থাকা সত্ত্বেও প্রায় একশো লোকের এক জনতা কুকুমতা রেল ফায়ার সাব-স্টেশনে কর্মীদের মারপিট করা হয় এবং টেলিফোন রিসিভার অপসরণ করে। রাত দশটায় তৈল শোধনাগারের একজন কর্মীর বাড়িতে ইটপাটকেল ছোড়ে। চাঁদমারীতে একদল লোক বেআইনিভাবে একজনকে আটক করে রাখে, পানবাজারে আর এক ব্যক্তি প্রহৃত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জনতা এক বাড়িতে ঢুকে তিন ব্যক্তিকে মারপিট করে।… … পান্ডুঘাট বাজারে জনৈক চিকিৎসক ছুরিকাহত হন। হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে প্রহার করা হয়। একজন পুলিশ কনেস্টবলও প্রহৃত হন। উজানবাজার স্টিমারঘাটে এবং বিলপাহাড়ে একজন প্রহৃত হয়।’৪২
সরকারের এই প্রেসনোট একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট, সত্যের অপলাপমাত্র। প্রকৃত সত্য থেকে সরকারি বিবৃতি যে কতটা দূরে তা ইতিমধ্যে বর্ণিত তথ্য থেকে স্পষ্ট।
আসাম প্রত্যাগত বিমান যাত্রীকে উদ্ধৃত করে বিমানঘঁটিস্থ সংবাদদাতা কলকাতায় জানালেন:
‘৬ জুলাই রাতে তেজপুরে কমপক্ষে পঞ্চাশটি গৃহে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মীভূত করা হয়। দু-জন বাঙালিকে পাথর নিক্ষেপ ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত একজনের নাম গোপাল দে। তেজপুরের বাঙালিদের স্কুলেও গত রাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৭ জুলাই সকালে পান্ডুতে বাঙালি অধ্যুষিত রেলকলোনিতে অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে একজন পাঞ্জাবী যাত্রী উল্লেখ করেন।’৪৩
‘৬ জুলাই ইণ্ডিয়ান এয়ার লাইনস-এর শিলং এবং গৌহাটি থেকে বরাবর বিমান বন্দরগামী যাত্রী বোঝাই ভ্যানগুলিকে পথিমধ্যে থামিয়ে অসমিয়াগণ বাঙালি যাত্রীদের তালিকা চান এবং ভ্যানচালক ও এয়াল লাইনস কর্মচারীদের নাজেহাল করা হয়। ৭ জুলাই থেকে ভ্যানগুলিকে সেনাবাহিনীর প্রহরাধীনে বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়। জনৈক বাঙালি যাত্রী জানান, তেজপুরে এক বাঙালি ব্যবসায়ীর নতুন গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও বাড়িতে বৃষ্টির মতো প্রস্তর নিক্ষেপ করা হয় এবং তারপরই শতাধিক লোক তার বাড়িতে দরজা ভেঙে প্রবেশ করে ব্যবসায়ীর সর্বস্ব লুট এবং নারী পুরুষ-শিশুদের বেদম প্রহার করে। দূর্বৃত্তরা মহিলাদের দেহ থেকে অলঙ্কার ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের শ্লীলতাহানি করে। এখানেই শেষ নয়—উন্মত্ত জনতা বাসিন্দাদের বাইরে বের করে দিয়ে গৃহে আগুন ধরিয়ে দেয়। দূর্বৃত্তরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে এদিন অসংখ্য বাঙালির গৃহে আগুন দেয়।’৪৪
জুলাই মাসেও দাঙ্গাহাঙ্গামা প্রশমিত হওয়ার কোনো লক্ষণ না মেলায় উদবিগ্ন সংবাদপত্রসেবী এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে জানালেন:
…সম্প্রতি একমাত্র অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যভাষা করিবার দাবি উপলক্ষ্যে সেই পুরাতন চক্রান্ত আজ একেবারে সংহার মূর্তি লইয়া দেখা দিয়াছে। আমরা এতদিন ধৈর্য ধরিয়া অপেক্ষা করিতেছিলাম এবং আশা করিতেছিলাম মুখ্যমন্ত্রী চালিহা এবং তাঁর গভর্নমেন্ট বাঙ্গালী ও অসমীয়াদিগকে অন্তত শান্তি ও শৃঙ্খলার দিক হইতে রক্ষা করিবেন। কিন্তু আজ স্পষ্টতই প্রমাণিত হইতেছে যে, শ্রীচালিহার গভর্নমেন্ট পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা এই অরাজকতা দমনে একেবারেই ব্যর্থ হইয়াছেন। সেই ব্যর্থতার পরিচয় কেবল কার্ফু ঘোষণা ও মিলিটারি ডাকিবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে। সারা আসাম উপত্যকাব্যাপী অরাজকতার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান আসাম সরকারকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাইতেছে।
আসামের রাজনৈতিক দলগুলির আচরণও কপটতার দ্বারা আচ্ছন্ন। তাঁরা মুখে কিছু কিছু শান্তির বুলি আওড়াইতেছেন। কিন্তু যেখানে মানবতা লাঞ্ছিত, যেখানে স্ত্রীলোকেরা ধর্ষিত, যেখানে গৃহ ও সম্পত্তি অগ্নিদগ্ধ এবং যেখানে ট্রেন থামাইয়া যাত্রীদিগকে হতাহত ও থানা আক্রমণ করিয়া অফিসারকে খুন করা হইয়াছে কিংবা যেখানে একমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধেই নিধনযজ্ঞ শুরু হইয়াছে, সেখানে আসামের বিভিন্ন পার্টির এই বর্বরতা প্রতিরোধ করিবার জন্য যেভাবে অগ্রসর হওয়া উচিত ছিল, সেই প্রাথমিক কর্তব্য তাঁরা সততার সঙ্গে পালন করেন নাই।
… … ১৯৪৬-৪৭ সালে মুসলিম গুণ্ডামি এবং ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালী হিন্দুর হত্যাকান্ডের পর স্বাধীন ভারতবর্ষের আর কোন রাজ্যে এমন বীভৎস ঘটনার অবতারণা হয় নাই। অথচ আসামের নেতারা বলিয়া আসিয়াছেন যে, ‘কোন কোন স্থানে সামান্য গোলযোগ হইয়াছে এবং কলিকাতার কাগজগুলি অতিরঞ্জিত বিবরণ ছাপিতেছে! কিন্তু আসাম সরকারের নূতনতম প্রেসনোটে যতটুকু স্বীকার করা হইয়াছে, তাহাতেই প্রমাণ হইতেছে যে, আসল ঘটনা ও অবস্থা ইহার চেয়ে দশগুণ বেশী ভয়াবহ ও মর্মান্তিক।৪৫
অপরদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম মুখ্যস্থান করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যুগশক্তি পত্রিকায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হল:
সঙ্কীর্ণচেতা অপরিণামদর্শী অসমীয়াভাষী নেতৃত্বাভিমানী ব্যক্তিগণ এবং গৌহাটি ও যোরহাটের সংবাদপত্রগুলি যখন অসমীয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষারূপে ঘোষণার দাবী জানাইয়া ব্যাপক আন্দোলন করার নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান আরম্ভ করিয়াছিলেন তখন হয়ত তাহারাও কল্পনা করিতে পারেন নাই যে, শিক্ষিত-অশিক্ষিতনির্বিশেষে অসমীয়াভাষী জনতার এরূপ বিরাট অংশ বর্বরতা ও পাশবিকতায় হিংস্র পশুসমাজকেও এভাবে হার মানাইতে পারিবে। আসাম উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ও গৌহাটি সহরে এখন যে তান্ডব অনুষ্ঠিত হইতেছে— তাহার জন্য উপরিউক্ত নেতৃবৃন্দ ও সংবাদপত্রসমূহ দায়ী নহেন— একথা তাহারা বুকে হাত দিয়া বলিতে পারিবেন কি? আমরা, বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া ভাবিতেছি— কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট, প্রজাসমাজতন্ত্রী ও অন্যান্য রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠানের অসমীয়াভাষী নেতাদের মধ্যে কি এমন একজনও নাই যিনি প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে উঠিয়া মানবতার খাতিরে এবং সমগ্র আসাম তথা ভারতের স্বার্থ ও কল্যাণের দিক বিবেচনা করিয়া উচ্ছৃঙ্খল অসমীয়া জনতাকে পাশবিক উন্মত্ততার পথ হইতে ফিরাইয়া আনিবার জন্য সাহসিকতার সহিত অগ্রসর হইতে পারেন? এরূপ প্রচেষ্টা সফল হউক আর নাই হউক, তাহাতে অন্তত এইটুকু বলা যাইত যে দুরপনেয় কলঙ্ক কালিমায় অনুলিপ্ত অসমীয়া নেতৃত্বের মধ্যেও শুভবুদ্ধি ও সৎ প্রেরণার আলোকরশ্মি বর্তমান রহিয়াছে। কিন্তু তাহার তো কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাইতেছে না।৪৬
উপরিউক্ত দুটি মানবিক আবেদনও অসমিয়া সমাজে কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। ফলে, শান্তি সুদূর পরাহত।
৭ জুলাই তারিখেও সংবাদে বলা হল: ‘আসামের হাঙ্গামা পরিস্থিতি রাজ্য সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।’ সংবাদে আরও বলা হয়, কামরূপের হাঙ্গামা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং তা গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বরপেটা থেকে পাঁচ মাইল দূরে মান্দিয়ায় পূর্ববঙ্গের উদবাস্তুদের একটি গ্রামের ষাটটি গৃহ অসমিয়া দূর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছে বলে জানা যায়। আগুনে চারজন স্ত্রীলোকসহ বহু মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। অসংখ্য মানুষ গ্রাম ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে পথে নামে। নওগাঁর বাঙালিরা রেলস্টেশনে এবং হরিবাগানে আশ্রয় নিচ্ছেন বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। আরও জানা যায় ৭ জুলাই নওগাঁর ৩১ জন বাঙালি দূর্বৃত্ত দলের ছুরিকাঘাতে আহত হন এবং এদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা গুরুতর। তিনসুকিয়ায় ৩ জন টেলিফোন কর্মীকে দূর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করে এবং তাদের ঘরবাড়ি লুট করে।৪৭
এদিন কাপরূপের ডেপুটি কমিশনার প্রচারিত প্রেসনোটে বলা হয়: ‘কামরূপ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলের অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। তামুলপুর গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধনসম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়। তামুলপুর ও গোরেশ্বর অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছশো গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গোরেশ্বরে একজন স্ত্রীলোকের মৃত্যু হয়। উপদ্রুত অঞ্চল থেকে পলায়মান প্রায় তিনশো উদবাস্তু রঙ্গিয়া রেলস্টেশনে আশ্রয়গ্রহণ করেছেন। সরকার তাদের জন্য দু-টি বাড়ি দখল করে সাময়িকভাবে সাহায্য দিচ্ছেন। রঙ্গিয়া শহরের উপকন্ঠে দুটি গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। লোটিবাড়ি এবং সেঙ্গামারী গ্রামেও কয়েকটি গৃহে দূর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয়। রঙ্গিয়া শহরে ১৪৪ ধারা জারি এবং সেখান থেকে অন্যান্য উপদ্রুত অঞ্চলে সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণ করা হয়েছে। বরপেটা মহকুমার মন্দিরা গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিত্যক্ত কয়েকটি গৃহে গত রাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।’৪৮
প্রেসনোটে আরও বলা হয়: ‘৭ জুলাই সকালে মালিগাঁও রেলওয়ে কলোনিতে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। … … কয়েকটি গৃহে তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয় এবং ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৪১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গৌহাটি মহকুমার দিশপুর এবং বেলতলা এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকটি গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই অঞ্চলের প্রায় দুশো লোক গৌহাটি রেলষ্টেশনে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। উলুবাড়ি থেকেও অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া গেছে। পলাশবাড়ি, চারগাঁও এবং বকো এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হয়েছে।’৪৯
বুধবার রাতে অর্থাৎ ৬ জুলাই রাতে আসাম সরকার যে প্রেসনোট প্রকাশ করেছিলেন— তা ছিল এরকম:
‘… গৌহাটির অবস্থা অপেক্ষাকৃত শান্ত। তিনটি মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। গৌহাটির নিকটবর্তী নারাঙ্গীতে বড়ো ধরনের এক সংঘর্ষে একজন নিহত এবং দু-জন আহত হয়। দিশপুর, খানাপাড়া ও আমিনগাঁও-য়ে কয়েকটি গৃহে অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া গেছে। গৌহাটির উত্তরতীরে নলবাড়ি বারামা অঞ্চল থেকেও সংঘর্ষের সংবাদ পাওয়া গেছে। রঙ্গিয়াতেও গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পলাশবাড়িতে একটি ঘটনায় একজনকে আহত অবস্থায় গৌহাটিতে আনা হয়েছে। তেজপুরের ‘বেঙ্গলি হাই স্কুল ভবন’টিতে অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া গেছে। শিবপুর, কাছাড় ও গোয়ালপাড়ায় উত্তেজনা থাকলেও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়নি।’৫০
নওগাঁ জেলার চাপারমুখ রেলস্টেশনে ৭ জুলাই সন্ধ্যায় হাঙ্গামাকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। ‘কামরূপ জেলার গোরেশ্বর, মহাজনপাড়া এবং সিলসাকো এলাকা থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি প্রাণভয়ে গৃহত্যাগ করেছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে প্রায় তিন হাজার নর-নারীর নিকটবর্তী অরণ্যাঞ্চলে আত্মগোপন করার সংবাদ পাওয়া যায়। হাঙ্গামার একদিন পর পুলিশ উত্তর কামরূপের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পাঁচটি মৃতদেহ উদ্ধার করে।’৫১
শিলচর থেকে যুগান্তর পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধি ৮ জুলাই জানান, ‘গতকাল রাত দেড়টায় হোজাইয়ের (নওগাঁ জেলা) পাঁচ মাইল দূরে দু-হাজার বাঙালি অধ্যুষিত রাজআলী গ্রামে লুটতরাজ, অত্যাচার নারী-নির্যাতন এবং বিক্ষিপ্ত অগ্নিসংযোগের পর সমগ্র গ্রামটিতেই আগুন ধরিয়ে ভস্মীভূত করা হয়। নওগাঁ, কামরূপ, যমুনামুখ, লাওপানি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কাতারে কাতারে আশ্রয়চ্যুত নর-নারী, শিশু, বৃদ্ধ আশ্রয়ের আশায় হোজাই শহরে জড় হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়।… নওগাঁতে দু-ব্যক্তি বন্দুকের গুলিতে ও একজন ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। খরমপট্টি এলাকায় একটি চালা ঘরেও আগুন লাগানো হয়।’৫২
‘দাঙ্গাপীড়িত অসহায় মানুষের আর্তনাদের কথা, পলায়নপর মানুষের কথা, অসমিয়াদের হিংস্রতার কথা, তান্ডবের কথা, বাঙালিদের অসহায়ত্বের কথা জানা গেল সেদিনের সংবাদপত্রে। সংবাদপত্র জানাল: … কোলের শিশুকে মাতা হুড়োহুড়ির মধ্যে কোথায় যে ফেলে এসেছে, তার কোনো সংবাদ নেই। হোজাই শহরে একত্রে এত বাঙালি নর-নারীকে সমূলে ধ্বংস করতে হাজার হাজার অসমিয়া চতুর্দিক থেকে উল্লাসে ছুটে চলেছে। ভয়ার্ত ও পলায়নরত নর-নারীকে পথে-ঘাটে ক্ষিপ্ত কুকুরকে যেমন লোকে তাড়া করে, তেমনি তাড়া করে মাথায় ডাণ্ডা মেরে হত্যা করার করুণ কাহিনিও পাওয়া গেছে। সরকারি শাসনব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। নওগাঁর বিরাট অঞ্চল জুড়ে এক ব্যাপক নরহত্যা, অগ্নিদাহ, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, হরণ ও ধর্ষণের তান্ডব চলছে বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।’৫৩
স্বাধীন ভারতের একটি রাজ্য আসামের এই মানবতাবিরোধী কলঙ্কময় অধ্যায়কে মানুষ খুব সহজে ভুলে যাবে বলে মনে হয় না। অর্ধ শতাব্দীর পরও তো মানুষ শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সেদিনের মানুষের ত্যাগের কথা, ভাষার কথা।
‘গোয়ালপাড়া মহকুমাতেও হাঙ্গামার বিস্তার ঘটে। সেখানকার উদবাস্তুদের বহুসংখ্যক গৃহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দরং জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে দোকানের পর দোকানে অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া গেছে। নওগাঁ জেলার কোলিয়ারা, পুরানি গুদাম ও মারিগাঁওতে অগ্নিসংযোগের সংবাদ জানা গেছে। পান্ডু এবং লামডিংয়ের মধ্যে ট্রেন চলাচল এখনও ব্যাহত হচ্ছে।’৫৪
১০ জুলাই যোরহাটে পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সেখানে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েকটি ছুরিকাহতের সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদে জানা যায়, আসাম সরকার তেজপুর, নওগাঁ যোরহাট, বঙ্গাইগাঁও, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি, ডিব্রুগড় এবং কামরূপে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েছেন। রেলওয়ে কতৃপক্ষের অনুরোধে সামরিক কতৃপক্ষ লামডিং মরিয়ানি এবং তিনসুকিয়াতেও সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।৫৫
দাঙ্গা পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার লক্ষ্যে ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন ১০ জুলাই গৌহাটি এসে পৌঁছোন। এদিকে কামরূপের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে কলকাতার সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। গৌহাটির যুগান্তর প্রতিনিধির ওপর যে নির্দেশ জারি করা হয়েছিল তা ছিল এরকম:
যেহেতু অমৃত বাজার পত্রিকা, যুগান্তর, হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড ও আনন্দবাজার পত্রিকা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতামূলক মনোভাব ছড়াইতেছে অথবা ছড়াইবার চেষ্টা করিতেছে এবং যেহেতু আসাম রাজ্যসরকার সরকারি গেজেট মারফত এই নোটিশ জারি করিতেছেন যে, উপরিউক্ত সংবাদপত্রগুলির প্রচারে শান্তি বিঘ্নিত হইতে পারে, অতএব আমি কামরূপের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী জি সি ফুকন, আমার উপর ৯৯এ এবং ১৪৪ অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার বলে কামরূপ জেলায় উক্ত সংবাদপত্রগুলির প্রচার এই শর্তসাপেক্ষে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিতেছি যে, প্রচারের পূর্বে সংবাদপত্রগুলিকে গৌহাটির জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা তাঁহার অনুমোদিত প্রতিনিধি কিংবা বরপেটার এস ডি ও-কে দেখাইয়া উক্ত অফিসারের অনুমোদন লাভ করিতে হইবে। এই আদেশ অবিলম্বেই বলবৎ হইবে এবং পুনর্নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উহা চালু থাকিবে।৫৬
আসাম সরকার ১১ জুলাই প্রকাশিত এক প্রেসনোটে জানান যে: ‘শিবসাগর জেলার অবস্থা গত চব্বিশ ঘণ্টায় গুরুতর অবনতির দিকে গেছে। যোরহাট, শিবসাগর শহর ও গোলাঘাটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সারা জেলা থেকেই অগ্নিসংযোগ ও মারপিটের সংবাদ পাওয়া গেছে। যোরহাটে ১০ জুলাই থেকেই ২৪ ঘণ্টাব্যাপী সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। গোলাঘাট মহকুমার হাঙ্গামায় ১ ব্যক্তি নিহত ৩৮ ব্যক্তি আহত হওয়ার কথা জানা যায়। লিথুবাড়ির হাঙ্গামায় ২ব্যক্তি নিহত ও ৮ ব্যক্তি আহত হয়। শহরতলি অঞ্চল থেকেও কয়েকটি অগ্নিসংযোগের সংবাদ জানা গেছে।’৫৭
আসাম সরকার এদিন সমগ্র রাজ্যজুড়ে রেললাইনের দু-পাশে পাঁচ মাইল স্থান জুড়ে ‘উপদ্রুত অঞ্চল’ হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ সালের আর্মড ফোর্সের (আসাম ও মণিপুর) স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টস-এর ৩ নম্বর ধারা বলে এই ঘোষণা করা হয়।
পরিস্থিতি কতটা নাজুক হলে সরকার এই আইন জারি করেন-তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু তারপরও অবস্থার তেমন কোনো হেরফের ঘটেনি।
গোরেশ্বরে একজন মৃত্যুপথযাত্রী বাঙালি বার বার জল চেয়েও একফোটা জল পাননি—বরং তাকে শুনতে হয়েছিল— ‘পানি নিদিম মুখক মূতি দিম।’ একজন বাঙালি পর্যটক আসামে আটকে পড়েছিলেন। কপর্দক শূন্য অবস্থায় পদ্রব্রজে বিভিন্ন জনপদ ঘুরে অবশেষে পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছে তিনি একথা জানান। তিনি আরও জানান, বরপেটা টাউনের এক বিশিষ্ট স্বর্ণালঙ্কার ব্যবসায়ীর বাড়িতে ৬ জুলাই সন্ধ্যায় ১০ জন দূর্বৃত্ত জোর করে প্রবেশ করে। বাড়িতে ঢুকেই ব্যবসায়ীর উনিশ বছরের বিবাহিতা কন্যাকে মা-বাবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা তার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। ব্যবসায়ী কন্যার মর্মভেদী চিৎকার ক্ষণকাল পরেই চিরকালের জন্য থেমে যায়। এরপরই তারা লুটপাট চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, নগদ অর্থ ইত্যাদি নিয়ে চলে যায়। এই আক্রান্ত, পর্যুদস্ত পরিবারের অবশিষ্ট সদস্য আসাম থেকে পালিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশনে একটি সরকারি ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করেন।৫৮
এ সময় অসমিয়ারা প্রকাশ্যত বাঙালিদের বলছিল— ‘উলাই যা’ অর্থাৎ বেরিয়ে যা। কার্যত আসাম ছেড়ে চলে যা, নইলে প্রাণ দাও। অসমিয়াদের মুখে আরও শোনা যায়, বাঙালি মেয়ে বিয়ে করার কথা। বিশিষ্ট রাজনীতিক, ভাষা সৈনিক রথীন্দ্রনাথ সেন (১৯১২-১৯৯৪) জুলাই মাসে হাঙ্গামা চলাকালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আসাম পরিস্থিতির বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি এক পর্যায়ে বলেন, ‘হাঙ্গামাকারীদের মুখের বুলিই হচ্ছে ‘‘বঙ্গালী ছওয়ালীক বিয়া করিম।’’… বাঙালিরা কোনো অসমিয়ার নিকট থেকেই কোনোরকম সাহায্য পাচ্ছেন না, যে ঘটনা নোয়াখালিতেও ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে আসামের ঘটনা নোয়াখালির দাঙ্গাকেও ছাড়িয়ে গেছে।’৫৯
৯ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে দশটায় বালিজান নর্থ চা-বাগানে প্রায় পাঁচশো অসমিয়া কুঠার, দা, বিষাক্ত তিরধনুক, বল্লম ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে উক্ত চা-বাগানের বাঙালি কর্মচারীদের আক্রমণ করে এবং তাদের যথাসর্বস্ব লুট করে। অনেক কর্মচারী জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করে। এই হামলায় ৪ জন নিহত এবং ৩৫ জন আহত হয়। পুলিশ স্টেশনে বার বার ফোন করেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। আশপাশের ভীত-সন্ত্রস্ত বাঙালিরাও স্বগৃহ ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহরের পথে রওয়ানা হন।৬০
১০ জুলাই গভীর রাতে তিনসুকিয়া শহরের নিকটবর্তী শিবপুর চা-বাগান প্রায় হাজার লোকের এক সশস্ত্র জনতা দ্বারা আক্রান্ত হয়। দূর্বৃত্তরা বাঙালিদের দোকানপাট লুট ও গৃহে অগ্নিসংযোগ করে। পানিতলা এলাকাও একদল সশস্ত্র দূর্বৃত্ত আক্রমণ করে এবং সেখানকার বসতবাড়ি ভস্মীভূত করে, সংবাদে বলা হল: ‘… উপদ্রুত এলাকা থেকে দলে দলে লোক পায়ে হেঁটে তিনসুকিয়া থানা প্রাঙ্গণে সমবেত হচ্ছেন। আশপাশের সমস্ত চা-বাগানের বাঙালি কর্মচারীরা প্রাণের ভয়ে তিনসুকিয়া শহরে আশ্রয় নিচ্ছেন। কিন্তু তিনসুকিয়া শহরও নিরাপদ নয়। দূর্বৃত্ত দল শহর আক্রমণের সুযোগ খুঁজছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা শহরে হানা দিতে পারে।’৬১
সংবাদে আরও বলা হল: ‘আজ (১২ জুলাই) উত্তর আসামের শিবসাগর ও লখিমপুর জেলায় দ্বিতীয় পর্যায়ে বাঙালি বিতাড়ন আরম্ভ হয়েছে। …দাঙ্গাহাঙ্গামা ক্রমশঃ অভ্যন্তরভাগের উত্তর লখিমপুর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। যোরহাট শহরে সান্ধ্য আইন এবং গোলাঘাট ও শিবসাগর অঞ্চলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। উত্তর আসাম রেলস্টেশনের কর্মচারীদের মারধর করা হচ্ছে। এসব স্টেশনের কর্মচারীরা প্রাণভয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছে। ১০ জুলাই থেকে এসব স্টেশনের কাজকর্ম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। নাকাচারী স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার গুরুতর রূপে আহত হন। …শিবসাগর কলেজের ব্যায়াম শিক্ষক ছুরিকাহত হয়েছেন। টিটাবাজার, সিন্নামারা খারিকাটিয়া এবং মিমানুগুড়ির প্রায় ২৫০ জন উদবাস্তু মরিয়ানী কালীবাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। মরিয়ানীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রায় ২০০ জন উদবাস্তু চাকিটিঙ্গ রেলস্টেশনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। টিটাবারের বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের শিক্ষক গুরুতরভাবে আহত হওয়ার সংবাদও পাওয়া যায়।’৬২
গৌহাটি থেকে চোদ্দো মাইল দূরে পলাশবাড়ি থানার অন্তর্গত সোদিলপুর থেকেও বেদনাদায়ক সংবাদ পাওয়া গেল। এখানেই বাস করতেন তিনপুরুষের কাঠ ব্যবসায়ী ননীগোপাল সূর ও তার পরিবার। গত ৫ জুলাই সন্ধ্যা প্রায় সাতটায় দু-শয়ের মতো অসমিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এক জনতা ননীগোপাল-এর বাড়ি ঘেরাও করে এবং জনতার একটি অংশ দরজা ভেঙে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে। দুর্বৃত্তরা প্রথমে লুট এবং তারপরই ননীগোপাল এবং তার আঠারো বছরের পুত্রকে নৃশংসভাবে খুন করে। এই হৃদয়বিদারক সংবাদ জানালেন ননীগোপাল সূর-এর বিধবা স্ত্রী দমদম বিমান বন্দরে গত ১৪ জুলাই ১৯৬০-এ। এদিন শ্রীমতী সূর তাঁর অপর সন্তানদের নিয়ে গৌহাটি থেকে দমদম পৌঁছোন।৬৩
আসাম উপত্যকায় বাঙালিদের ওপর নারকীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে ১১ জুলাই করিমগঞ্জ ছাত্র ও যুব সংগ্রাম পরিষদ-এর আহ্বানে করিমগঞ্জে এক সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন বিকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত এক জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদক অসীম সেন। সভায় বক্তব্য রাখেন— নিশীথরঞ্জন দাস, রবিজিৎ ও নৃপতি চৌধুরী। হরতাল সম্পর্কে সংবাদপত্র জানাল:
‘…সমস্ত দোকানপাট, স্টেট ট্রান্সপোর্টসহ সর্ববিধ যানবাহন, স্কুল-কলেজ, সরকারি সমস্ত অফিস, আদালত, এমনকি সরকারি ট্রেজারি, স্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। রাস্তায় কোনো সাইকেল পর্যন্ত চলে নাই। রাস্তার কিনারের সাধারণ পানবিড়ির দোকান ইত্যাদি বন্ধ ছিল। এই ধরনের হরতাল করিমগঞ্জে ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। আসামে অনুষ্ঠিত নারকীয় ঘটনাবলীর প্রতিবাদে এই হরতাল প্রতিপালিত হয়। সরকারি অফিস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে একদল যুবক-যুবতী শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করেন।৬৪
১২ জুলাই বদরপুরেও অনুরূপ প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। জুলাই মাসেই কাছাড়ের একদল জনপ্রতিনিধি কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ড এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে আসাম উপত্যকার দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ে অবহিত এবং এ বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে এক স্মারকলিপি প্রদানে দিল্লি পৌঁছোন। জনপ্রতিনিধিদলে কাছাড় লোকসভা ও রাজ্যসভার কংগ্রেস সদস্য— সুরেশচন্দ্র দেব, দ্বারিকানাথ তেওয়ারি, নিবারণচন্দ্র লস্কর এবং এম এল এ জ্যোৎস্না চন্দ, নন্দ কিশোর সিংহ ও প্রজা সমাজতন্ত্রীদলের এম এল এ বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর সঙ্গে আসামের পরিস্থিতি নিয়ে ৬৫ মিনিট আলোচনা করেন। এ সময় তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করেন।৬৫
প্রতিনিধি দলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, আইনমন্ত্রী অশোক সেন এবং রেলমন্ত্রী জগজীবন রামের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু ফল থাকল সেই অধরাই।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি দাঙ্গা পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও বিষয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য ১৩ জুলাই শিলচর পৌঁছোন। এদিন বিকালে এবং পরদিন সকালে শ্রীরেড্ডি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আসাম পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কংগ্রেস সভাপতি শিলচর নর্মাল স্কুল এবং গভর্নমেন্ট স্কুলে আসাম থেকে আগত বাঙালি উদবাস্তু ক্যাম্পগুলি পরিদর্শন করেন।
১৪ জুলাই সকালে সার্কিট হাউসে বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নগেন্দ্রচন্দ্র শ্যাম, রথীন্দ্রনাথ দত্ত, পরেশচন্দ্র চৌধুরী এবং আলতাফ হোসেন মজুমদার শ্রীরেড্ডির সঙ্গে আসাম উপত্যকা তথা সার্বিক দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। সকাল সাড়ে আটটায় ‘দাঙ্গাপ্রপীড়িতগণের সেবা ও নিরাপত্তা বিধান কমিটি-র সদস্যগণের সঙ্গেও তিনি কথা বলেন। সকাল ন-টা থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। আলোচনা স্থায়ী হয় আধ ঘণ্টা। এরপর স্থানীয় কংগ্রেসসেবীদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
শ্রীরেড্ডি তাঁর পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি সফর বাতিল করে শিলচরেই ওই দু-টি স্থানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেন। করিমগঞ্জ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলার পূর্বে তিনি লামডিং থেকে আগত লামডিং কংগ্রেস সম্পাদক এবং সেখানকার হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক কবীন্দ্র দাসের সঙ্গে আলোচনা করেন। লামডিং-এ আগত উদবাস্তুদের সাহায্যদান এবং গৌহাটি থেকে হোজাই শহরের নিকট পর্যন্ত রেললাইনের দু-দিকের বাঙালিদের কীভাবে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে— তার বিবরণ তুলে ধরে কংগ্রেস সভাপতিকে ওই অঞ্চল পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। কিন্তু সময়াভাবে এ যাত্রায় যাওয়া সম্ভব হবে না বলে শ্রীরেড্ডি প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে দেন।৬৬
এরপর কংগ্রেস সভাপতি পর্যায়ক্রমে করিমগঞ্জ প্রতিনিধি দল, ছাত্র প্রতিনিধি এবং মহিলা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পৃথকভাবে দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন।
কংগ্রেস সভাপতির অবস্থান কালেই শিলচরের বাসিন্দা সুরেন্দ্রকুমার নন্দী-র জ্যেষ্ঠপুত্র সত্যব্রত নন্দী শিবসাগর থেকে আট মাইল দূরে রাজমাই বাগানে দূর্বৃত্তদের হাতে ১১ জুলাই নিহত হন। এই সংবাদ ১৩ জুলাই টেলিগ্রামযোগে শিলচর পৌঁছুলে শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে। সত্যব্রত কেন্দ্রীয় আবগারি বিভাগের কর্মচারী ছিলেন।
শিলচরে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের এক প্রতিনিধিদল কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসাম উপত্যাকায় কর্মরত বাঙালি কর্মচারি-কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার দাবি জানান। ‘শ্রীরেড্ডি সত্যব্রত নন্দীর এই শোচনীয় মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, সরকারি কর্মচারীগণের নিরাপত্তাবিধানের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।’৬৭
জাতীয় কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে আসাম কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মাও কাছাড়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। কিন্তু কাছাড়ের মানুষ সিদ্ধিনাথ শর্মাকে গ্রহণ করেননি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তাঁরা মনে করেন, দাঙ্গার সঙ্গে সিদ্ধিনাথ শর্মার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। ঘটনা বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছোয় কিন্তু শেষপর্যন্ত আসাম কংগ্রেস সভাপতি কাছাড়ে আর আসতে পারেননি, ছাত্র-জনতা তাঁকে আসতে দেননি। এ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করে শিলচরের সংবাদপত্রে বলা হল: ‘…কাছাড়ের লোক মনে করেন যে, আসামের বর্তমান বাঙালি নিধনের পশ্চাতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতৃবর্গের প্রকাশ্য এবং গোপন সমর্থন রয়েছে; শ্রীরেড্ডির আসাম আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আসাম কংগ্রেস নেতৃবর্গ এই হত্যাকান্ড, লুন্ঠন, নারীধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জ্ঞাপন করার প্রয়োজন বোধ করেন নাই বা উন্মত্ত জনতাকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্য কোনোই চেষ্টা করেন নাই। এই অবস্থায় আসামে যখন আগুন জ্বলছে সেই সময়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজ কর্তব্যসাধন না করে কাছাড় পরিদর্শনে আসা শ্রীসিদ্ধিনাথ শর্মার পক্ষে নিতান্ত মূঢ়তার কাজ বলেই জনগণ মনে করতে থাকেন।’৬৮
শ্রীরেড্ডি ১৪ জুলাই শিলচরে দাঁড়িয়ে আসামে যা ঘটেছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন:
…‘অবস্থা এখন আয়ত্তের ভিতরে আসিতেছে। …ভাষা সমস্যা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারা কঠিন কাজ নয়।’
কংগ্রেস সভাপতি ১৪ জুলাই দ্বিপ্রহরে শিলচর ত্যাগ করে বিমানযোগে নয়াদিল্লির পথে কলকাতা রওয়ানা হন।
কংগ্রেস সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি আসাম ভ্রমণকালে যেসব অভিমত প্রদান করেন— সে সম্পর্কে জনমনে বেশকিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। আমরা জনগণের প্রশ্নের বিশেষ কয়েকটি দিকের প্রতি দৃষ্টি দেব। ‘…কংগ্রেস সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি পাঁচদিন আসাম ভ্রমণের পর শিলচরে, কলকাতায় এবং দিল্লীতে যেসব অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে অত্যাচারিতের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন অপেক্ষা আসামের কংগ্রেসী সরকারকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টাই প্রবল হয়ে উঠেছে। নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নিজ দলীয় লোকদের ত্রুটি লঘু করে দেখাবার এই প্রচেষ্টা সমস্যা সমাধানের পথে সহায়ক হবে না— একথা আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি বলে দুঃখিত। ‘গুণ্ডারাজের অতর্কিত আক্রমণের মুখে প্রাদেশিক মন্ত্রীমন্ডলী হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ২/৩ দিনের মধ্যেই সামলিয়ে নিয়ে কর্তব্যে মনোযোগ দিয়েছিলেন’— একথা বলে শ্রীরেড্ডি আসামের মন্ত্রীমন্ডলীর অপরাধকে লঘু করতে পারবেন না।
… যারা উৎসাদিত হয়েছে তাদের সম্পত্তি খুব বেশি ছিল না, কাজেই সম্পত্তি নষ্টের পরিমাণ অধিক নয়, রেড্ডির এই উক্তির প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা আমরা প্রয়োজন মনে করি। গৌহাটি থেকে হোজাইয়ের কাছাকাছি যমুনামুখ, নারাঙ্গী, যুগীজান প্রভৃতি বাজারগুলি ধ্বংস করা হয়েছে। নওগাঁ শহরের বাঙালি বাজার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব দোকানে ২/৪শো টাকা আরম্ভ করে ৪০/৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্যের দ্রব্য সামগ্রী মজুত ছিল। ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতির পরিমাণ বহু লক্ষ টাকার ঊর্দ্ধে তো বটেই কোটি টাকাতে পৌঁছুনোও অসম্ভব নয়।৬৯
এরপর কংগ্রেস সভাপতি মহোদয় কী বলবেন? আমরা পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত আরও তথ্যাদি সভাপতি মহোদয়, আসাম সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকারের অবগতির জন্য তুলে ধরব।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তিনদিনের আসাম সফরে ১৭ জুলাই রবিবার সকাল ন-টায় কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ও এম পি নিবারণচন্দ্র লস্করসহ গৌহাটির তেজপুর বিমানবন্দর পৌঁছান। প্রধানমন্ত্রী নেহরু এখান থেকেই হেলিকপ্টারযোগে নওগাঁর দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চল এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দরং জেলার উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শনে রওয়ানা হন। জওহরলাল নেহরু নওগাঁর বেশ কয়েকটি উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন এবং জনসমাবেশে ভাষণ শেষে দুপুরে গৌহাটি ফিরে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। ইন্দিরা গান্ধী দরং জেলার উপদ্রুত অঞ্চল পরিভ্রমণ শেষে সন্ধ্যায় গৌহাটি ফিরে আসেন।
প্রধানমন্ত্রী নেহরু গৌহাটিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভায় যোগ দিয়ে নিজ দলীয় সদস্যদের তিরস্কার করে বলেন: ‘তিন সপ্তাহ পূর্বে যখন অবাধে সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বর অত্যাচার চলছিল, তখন কংগ্রেসকর্মীরা কী করছিলেন? তাঁরা কি ভয় পেয়ে পালিয়েছিলেন?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি অভিযোগ পেয়েছেন যে, এখানকার কংগ্রেসকর্মীগণ নিজ সংগঠনের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এমনকী আসাম সরকারের বিরুদ্ধেও কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তির ফলে সভায় গোলযোগ দেখা দেয়। এক পর্যায়ে শ্রীনেহরু সভাস্থল ত্যাগ করে জর্জকোর্ট প্রাঙ্গণের জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।
গৌহাটির জজকোর্ট প্রাঙ্গণের বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেন, ‘নওগাঁয়ে উদবাস্তু শিবিরগুলি পরিদর্শন করেছি এবং আমি বহু বাড়িঘর ভস্মীভূত দেখেছি। এই ধরনের কাজ আসামের পক্ষে ভালো নয়।’৭০
নেহরু বলেন: ‘জনসাধারণের আশু কাজ হল, যেসব শরণার্থী গৃহহীন হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি তাঁদের নিজেদের দেশে নতুন ধরনের ‘উদবাস্তু’ দেখতে পেয়ে দুঃখানুভব করছেন। আমাদের দেশে এটা কতকটা নতুন ধরনের, আমাদের নিজেদের লোকেরাই উদবাস্তু হচ্ছেন, তাঁরা গৃহহীন হয়েছেন এবং পাহারায় তাঁদেরকে ক্যাম্পে রাখা হচ্ছে।’৭১
ভাষা সম্পর্কে নেহরু বলেন: ‘অসমিয়াই রাজ্যভাষা হওয়া উচিত। কিন্তু লাঠির সাহায্যে জনসাধারণকে গৃহহীন করে আপনারা অসমিয়াকে রাজ্যভাষা হিসাবে পাবেন না। ভাষা একটা চারা গাছের মতো, কালক্রমে এটা যাতে একটি পূর্ণবৃক্ষরূপে বেড়ে উঠতে পারে, তারজন্য গাছটিকে সযত্নে পালন করতে হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন: ‘…এবারকার গোলযোগের ফলে ভারতের মধ্যে ও বাইরে আসামের জনগণের ও সরকারের সুনামে কলঙ্কলেপিত হয়েছে, আসাম যেন প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি মানসিক সঙ্কীর্ণতাজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।’৭২
বিশিষ্ট রাজনীতিক শিলচরের সতীন্দ্রমোহন দেব এবং করিমগঞ্জের রণেন্দ্রমোহন দাস অসুস্থ থাকায় শিলং-এ গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। তবে তাঁরা দু-জনে প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি দাঙ্গাহাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই মূল্যবান বলে আমাদের মনে হয়েছে। কালের সাক্ষী চিঠিটির বয়ান ছিল এরকম: ‘…বর্তমান অশান্তির মূলে আসাম কংগ্রেসের উপদলীয় চক্রান্ত রয়েছে। শ্রীদেবেশ্বর শর্ম্মাকে মন্ত্রীমন্ডলী থেকে অপসারণের পরই এই চক্রান্ত বীভৎস আকার ধারণ করে। পি.এস.পি. এবং কমিউনিস্ট দল কংগ্রেসকে অপদস্ত করার চেষ্টা করছেন— কতিপয় কংগ্রেসী সদস্যও এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। জন-সাধারণের কাছ থেকে সস্তা বাহবা কুড়াবার জন্য বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছেন। যে কোন প্রকারে আসাম থেকে বাঙালি বিতাড়নের জন্য প্রচার কাজ চালিয়েছিলেন। জন-সাধারণকে এ কাজে উসকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেকার সমস্যার সমাধান হবে এবং জমি পাওয়া যাবে— এই আশাই দূর্বৃত্তদের প্রলুব্ধ করেছে। তেল শোধনাগারের হাঙ্গামার মূলেও— এই কারণই রয়েছে। বর্তমান মন্ত্রীমন্ডলীর অব্যবস্থিতচিত্ততা পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।
ভাষা সমস্যা সম্পর্কে দ্রুত মত পরিবর্তন ও নীতি পরিবর্তন, গৌহাটির গুলি চালনার জন্য তদন্ত কমিশন নিয়োগ, অনসমিয়া সরকারি কর্মচারীদের অকস্মাৎ বদলি করে দেওয়া, আসামের সংবাদপত্রগুলির দোষ না দেখে শুধু কলকাতার সংবাদপত্রগুলির ওপর দোষারোপ, সময়মতো গুণ্ডামি দমন না করা প্রভৃতি বর্তমান জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য গুণ্ডাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। অবিলম্বে আসাম প্রদেশে কিছুকালের জন্য রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন।’৭৩
চিঠিটিকে আসাম দাঙ্গাহাঙ্গামার কারণ এবং দাঙ্গা প্রশমনে জন-মনে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে করণীয় বিষয়গুলির দিক চিহ্নবাহী রূপরেখা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
আসাম পরিস্থিতি বিষয়ে কাছাড়ের মতামত প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর লক্ষ্যে করিমগঞ্জ ও শিলচরের প্রতিনিধিবৃন্দ ১৭ জুলাই শিলং রওয়ানা হন এবং ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। এ সময় করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে বলা হয়:
এক. ‘প্রধানমন্ত্রীর আসাম ভ্রমণের ফলে দুর্গত মানবের মনে আস্থা ফিরে আসবে। কোথায় আশ্রয় পাওয়া যাবে এতদিন ধরে এই সমস্ত হতভাগ্য মানুষেরা তা জানতেন না।
দুই. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বাঙালিদের তাড়াবার জন্য এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। ভাষা একটা অজুহাত মাত্র। আসাম উপত্যকার ছ-টি জেলায় যে দশ লক্ষ বাঙালি বাস করেন— তারা অসমিয়া ভাষার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনেই যোগদান করেননি। কাছাড়ের বাঙালিরা এবং পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীগণই অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং যতদিন পর্যন্ত একটা সর্বসম্মত সমাধান সম্ভব না হয়—ততদিন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য দাবি জানানো হচ্ছে।
তিন. ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বাঙালিদের ধনসম্পত্তি লুট করা হয়েছে। তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, বাঙালি মেয়েদের ওপর বলাৎকার চলছে এবং বাঙালিদের খুন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত হাজার হাজার বাঙালি উৎসাদিত হয়েছেন। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে এবং টেলিগ্রাফ চলাচলে কড়াকড়ি নিয়ন্ত্রণের ফলে দূর গ্রামাঞ্চলে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাসকারী বাঙালিরা কি অবস্থায় আছেন তা আজও জানা সম্ভবপর নয়। যেটুকু সামান্য সংবাদ প্রতিদিন বের হয়ে আসছে তাতেই আসামের নারকীয় অবস্থার আভাস পাওয়া যায়। এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য, ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য এবং বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তিবিশেষ ও সরকারি প্রশাসন বিভাগ এ ব্যাপারে কি অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা জানার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন নিযুক্ত করা প্রয়োজন।
চার. ভাষা সমস্যা সম্পর্কে প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রস্তাব কাছাড়ের এবং পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিনিধিগণ একযোগেই প্রত্যাখ্যান করেছেন। আসাম বিধান পরিষদের আগামী অধিবেশনে যাতে ভাষা বিল আনা না হয়— সে-বিষয়ে প্রাদেশিক সরকারকে প্রধানমন্ত্রী উপদেশ প্রদান করবেন— এটাই আমরা আশা করি। প্রদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে পরই এ বিষয়ে আলোচনা চলতে পারে এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে।
পাঁচ. গভর্নমেন্ট ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সাহায্য দেবেন এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সরকারি প্রশাসনযন্ত্র যেখানে গুণ্ডারাজের সহায়ক হয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় কি? পুনরায় অনুরূপ ঘটনা ঘটবে না—উদবাস্তুরা সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হবেন কি করে?
ছয়. সংখ্যালঘুর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সংবিধানে ব্যবস্থা আছে—কিন্তু সেই স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নতুনভাবে চিন্তা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য কেবল আসামে নয়—সর্বত্র কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সাত. গত লোকগণনায় বঙ্গভাষাভাষীর সংখ্যা কমাবার জন্য নানারকম কারসাজি হয়েছিল। রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনও এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। আগামী লোকগণনার সময় বঙ্গভাষাভাষীর সংখ্যা যাতে ঠিক ঠিক মতো দেখানো হয়, তার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথা পার্বত্য জাতিসহ সকল সংখ্যালঘুর অবস্থা শোচনীয় হবে।
আট. কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট সবল হাতে ন্যায় বিচার এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা না করলে এই প্রদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।
আসাম প্রাদেশিক কংগ্রেসের ভিতরে ঘুণ ঢুকেছে এবং তাই-ই রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ-ই এই অবস্থার একমাত্র প্রতিকার।’৭৪
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, কংগ্রেস সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি এবং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আসাম পরিভ্রমণের পরও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি।
এ সময়ে চা-বাগানগুলিতে হামলা তীব্রতর করা হয়। এই হামলায় ইউরোপীয় চা বাগানগুলিতে ছাড় দিয়ে কেবল বাঙালি এবং মাড়োয়ারি মালিকানাধীন বাগানগুলিতে ব্যাপক হামলার সংবাদ পাওয়া যায়। সান্ধ্য-আইন দু-ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার জন্য প্রত্যাহার করা মাত্র বাঙালিদের গৃহে লুট, অগ্নিসংযোগ করার সংবাদও পাওয়া গেছে।
গৌহাটি থেকে ছাব্বিশ মাইল দূরে ঘুমটাই নামক চা-বাগানে ১৪ জুলাই হামলা চালানো হয়। অসমিয়াদের এই হামলায় বাগান-চিকিৎসক ডা. শ্রীঘটক এবং গুদাম সহকারী গোপাল ভট্টাচার্যকে ছুরিকাহত করা হয়। বেশ কয়েকটি গৃহ অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। লীলাবাড়িতে কয়েকশো বাঙালি জঙ্গলে আত্মগোপন করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। ১৩ জুলাই ডিব্রুগড় থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটি চা-বাগানের বাঙালি আবগারি ইনস্পেক্টরকে হত্যা করা হয়। এদিন ডিব্রুগড় থেকে ডিগবয়ের পথে চা-বাগানের চারজনের এক বাঙালি পরিবারকে হত্যা করা হয় বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।’৭৫
‘ধুবড়ি শহরে ১৫ আগস্ট রাতে কয়েকজনকে মারধর ও দু-জনকে ছুরিকাঘাত করায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এবং ১৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর কয়েকজনকে ছুরিকাঘাত করা হলে শহরে সান্ধ্য-আইন জারি করা হয়। আহতদের একজন সরোজ দাশগুপ্তকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু ঘটে।’৭৬
অজিতপ্রসাদ জৈন-এর নেতৃত্বে এক সংসদীয় প্রতিনিধিদল আসাম উপত্যকার দাঙ্গা দুর্গত এলাকা পরিভ্রমণ শেষে ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় শিলচর পৌঁছোন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় মহিলা, দাঙ্গাপীড়িত সাহায্য ও নিরাপত্তা বিধান কমিটি সদস্য, কাছাড় জেলা প্রজা সমাজতন্ত্রী দলীয় সদস্য এবং কাছাড় জেলার তিনটি জেলা কংগ্রেস প্রতিনিধিদলের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ে আলোচনা করেন।
পরদিন সকালে পুনরায় কয়েকজন মহিলা প্রতিনিধি, কাছাড় জেলা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সাংবাদিককের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা যায়। এ দিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি স্মারকলিপিও সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে প্রদান করা হয়। সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আসামের বাঙালি ও কাছাড়বাসীর অবস্থা সম্পর্কে মঈনুল হক চৌধুরীর সঙ্গেও বিস্তৃত আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে প্রতিনিধিদল শিলচরের কয়েকটি উদবাস্তু ক্যাম্প পরিদর্শন এবং ক্যাম্পে বসবাসরত শরণার্থীদের সঙ্গে সাহায্য ও পুনর্বাসন বিষয়ে কথা বলেন। প্রতিনিধিদলটি দুপুরে খাওয়ার পর বিমানযোগে গৌহাটি এবং সেখান থেকে সেদিন সন্ধ্যাতে শিলং পৌঁছোন।৭৭
আসামে নারীর লাঞ্ছনায় উদবিগ্ন শিলং-এর ৪২৬ জন মহিলার স্বাক্ষরযুক্ত এক স্মারকলিপি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু বরাবর পাঠানো হয়। লক্ষ্য নারী লাঞ্ছনার প্রতিবিধান। স্মারকলিপিতে মহিলারা জানালেন:
যে দেশে নারীর সতীত্বের কোনো মূল্য নেই, সে-দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং গদি আঁকড়ে থাকার কী সার্থকতা আছে? ভাষা আন্দোলনের নাম করে সুপরিকল্পিত উপায় এই বর্বর অত্যাচার করা হয়েছে। ভস্মীভূত গৃহ পুনরায় নির্মিত হতে পারে, ভগ্নগৃহ পুনরায় মেরামত হতে পারে, কিন্তু যে নারীর সতীত্ব গেছে তা দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিহত হতভাগ্যদের প্রাণের মতোই পুনরুদ্ধার হওয়ার নয়। যদি আসামের এই নারকীয় বর্বরতার পরেও ভারতের সংবিধান অনুযায়ী আসামে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ করা না হয়— তাহলে কি অবস্থায় তা প্রযুক্ত হবে, দেশবাসী তা জানতে চান।
নারী জাতির অবমাননা করে রাবণ ও কৌরবদের কী পরিণতি হয়েছিল তা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আসামের বাঙালি নারীদের ওপর তদপেক্ষা সহস্রগুণ বেশি অত্যাচার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি এর প্রতিকার করবেন, আমরা সেটাই প্রার্থনা করছি।৭৮
হাইলাকান্দির মানুষ বাঙালিদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের সকল অনুষ্ঠান বর্জন করেন। ছাত্র ইউনিয়ন দিনটিকে ‘শোকদিবস’ হিসেবে পালন করে। প্রতিবারের মতো এদিন সকালে শোভাযাত্রা বের হয়নি। সকাল থেকেই ছাত্র-যুবকেরা সাধারণ মানুষকে কালো ব্যাজ পরিয়ে দেওয়া শুরু করেন। অনেকে কালো ব্যাজ বিতরণও করেন। মহকুমাশাসক সকাল সাড়ে আটটায় কাছারি প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে গুটি কয়েক সরকারি কর্মচারী ছাড়া আর কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এমন কী স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বও অনুষ্ঠানে ছিলেন না। সরকারি ভবন ছাড়া সন্ধ্যায় আর কোথাও আলোকসজ্জা করা হয়নি। কোনো খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়নি।
এদিন বিকাল চারটায় হাইলাকান্দি টাউন হলে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট আইনজীবী হরসুন্দর চক্রবর্তী। সভায় বক্তব্য রাখেন সর্বশ্রী-বিভূতি ভট্টাচার্য, হরিদাস দেব, অমিয়কুমার নন্দী, ঊষা ভট্টাচার্য, শক্তিধর চৌধুরী, অরিজিৎ দত্ত রায়, মহিমচন্দ্র দাশ, নবেন্দু দত্ত, নৃপেন্দ্রকুমার চৌধুরী প্রমুখ। সভাপতি সভার প্রারম্ভে ‘আসামের হাঙ্গামায় নিহত ব্যক্তিগণের উদ্দেশে শহিদবেদীতে মাল্যদান করেন এবং তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে দু-মিনিটকাল নীরবতা পালন করেন।’ উপস্থিত জনতাও শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রদান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। সভার বক্তাগণ আসাম উপত্যকায় সংঘটিত দাঙ্গার তীব্র নিন্দা জানান। এদিন গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল— ১. ‘আসামের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ, ২. হাঙ্গামা সম্পর্কে উর্ধ্বতন বিচারবিভাগীয় তদন্ত, ৩. দাঙ্গাহাঙ্গামায় নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, ৪. হাঙ্গামাকারীদের প্রতি কঠোর শাস্তিবিধান ও উপদ্রুত অঞ্চলে পাইকারি জরিমানা ধার্য, ৫. আসাম থেকে উৎখাত বাঙালিগণ যাতে স্ব স্ব বাসস্থানে স্ত্রী-পুত্র, ধনসম্পত্তি নিয়ে নিরুপদ্রবে বাস করতে পারেন তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা এবং এই ব্যবস্থা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত উদবাস্তু ক্যাম্পগুলি চালু রাখা।’৭৯
কাছাড়ে উদবাস্তু আগমন:
আসাম উপত্যকার অত্যাচারিত, বিতাড়িত, লাঞ্ছিত বাঙালি শরণার্থীরা কেবল আসাম উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তরবঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গ নয়— বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা কাছাড়েও প্রাণরক্ষার্থে হাজারে হাজারে উদবাস্তু উপস্থিত হয়েছিলেন। স্থানীয় মানুষ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। গড়ে উঠেছিল সারি সারি শরণার্থী শিবির।
হাইলাকান্দি শহরেও উদবাস্তুরা আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রথম থেকেই শহরের গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, হরকিশোর হাই স্কুল এবং ইন্দ্রকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে আশ্রয় শিবির খোলা হয়। ক্যাম্পগুলি পরিচালিত হয় স্থানীয় ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজসেবী কর্মীদের যৌথ প্রচেষ্টায়। এ সব ক্যাম্পে ৬৫০ জন এবং আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ২৫০ জন উদবাস্তু আশ্রয় গ্রহণ করেন।৮০
আগস্ট মাসেও প্রতিদিন এই শহরে ২৫/৩০টি করে বাঙালি পরিবার আসাম উপত্যকা থেকে পালিয়ে এসেছেন। মানুষের ভিড় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদবিগ্ন হাইলাকান্দির মানুষ বিচলিত হয়েছেন, কিন্তু মানুষের পাশ থেকে সরে যাননি। ঠাঁই দিয়েছেন হেথা হোথা বা নিজ বাসঘরে।
এদিকে শিলচরে উদবাস্তু উপস্থিতির সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলে। ‘শিলচরের ১৭টি উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ২০ আগস্ট পর্যন্ত উদ্বাস্তু সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,৬৬০ জন। সংবাদে বলা হয়, সম্প্রতি প্রতিদিন ১৫০ জন নতুন উদ্বাস্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে শিলচরে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। অনেক উদ্বাস্তু, শিলচরে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের গৃহেও আশ্রয়গ্রহণ করছেন।’৮১
আসাম উপত্যকা থেকে শিলচরে আগত উদবাস্তুদের সেবার জন্য শিলচরে গঠিত হল ‘মহিলা রিলিফ কমিটি’। ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব মানুষের সেবায় এই কমিটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। কমিটির সভানেত্রী ছিলেন শ্রীমতী বীণা দত্ত। সহযোগী ছিলেন— লীনা গুপ্তা, সুরুচি পুরকায়স্থ, উমা চৌধুরী, মুকুল দেব, আশা দত্ত, পুষ্প মিত্র, লক্ষ্মী গুপ্তা, শান্তি ভট্টাচার্য, গায়ত্রী চৌধুরী, শিবানী বিশ্বাস, অনুরূপা বিশ্বাস প্রমুখ। আর্তজনের সেবায় নিয়োজিত এসব মহিলা সেদিন দিনরাত এক করেছিলেন, বিশেষত মহিলা ও শিশুদের সেবায়।৮২
‘ভারত সেবাশ্রম সংঘ’ও আর্ত মানবতার সেবায় কাছাড় জেলায় আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পৌরসভার পক্ষ থেকেও শিলচরের ১৭টি ক্যাম্পের নিত্যপানীয় জল সরবরাহ এবং পায়খানাসহ ক্যাম্পের সার্বিক পরিচ্ছন্নতার প্রতিও যত্নবান ছিলেন পৌরসভার কর্মীগণ। স্থানীয় বেসরকারি ও সরকারি ডাক্তারগণও আর্তমানবতার সেবায় দিনরাত কাজ করেছিলেন।
ভারত সেবাশ্রম সংঘ-এর পক্ষ থেকে নরসিংহ স্কুল, টাউন স্কুল এবং অভয়াচরণ পাঠশালা— এই তিনটি ক্যাম্পে ২৭০টি পরিবারের ৭৮৫ জন উদবাস্তুর মধ্যে বাসন,কাপড়সহ অন্যান্য সাহায্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়।৮৩
আসাম উপত্যকায় অত্যাচারিত বাঙালি— যাঁরা জান ও মান বাঁচাতে শিলচর ছুটে এসেছিলেন, তাঁরা আসাম সরকারের পুলিশ বাহিনীর হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হলেন ১৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে। এদিন শিলচরের বিভিন্ন উদবাস্তু ক্যাম্পের নারী উদবাস্তুগণ তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলি পূরণে ডেপুটি কমিশনারের বাংলোর সম্মুখে ধরনায় বসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, আর তাতেই চালিহা সরকারের ক্ষিপ্ত আমলার পুলিশবাহিনী উদবাস্তুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলায় অনেকে আহত হন। অনেককে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়।
উদবাস্তুদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় শিলচরের ‘মহিলা রিলিফ কমিটি’। এ সম্পর্কে জনশক্তি পত্রিকায় বলা হল: ‘শিলচরের ডেপুটি কমিশনারের বাসভবনের সম্মুখে ১৪ অক্টোবর তারিখে বাস্তুহারা নর-নারীর উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে যে অত্যাচার চালিয়েছিল সে-সম্পর্কে শিলচর মহিলা রিলিফ কমিটির দশজন সদস্যার এক ডেপুটেশন ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন এবং সপ্তাহে ছ-টাকা হারে ক্যাশ ডোল দান, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অবিলম্বে মুক্তি দান এবং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের দাবি জানান। ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত মহিলা রিলিফ কমিটির সভায় উদবাস্তুগণকে নিজ নিজ গ্রামে অবিলম্বে পুনর্বাসন, পূর্বে প্রদত্ত হারে ক্যাশ-ডোল দান, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে অবিলম্বে তাদের মুক্তিদান, লাঠি চালনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদিগের শাস্তিদান, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং উদ্বাস্তুদের অস্থায়ী ক্যাম্পে সরিয়ে অবিলম্বে শিলচরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়।’৮৪
উপর্যুক্ত বিষয়টি আসাম রাজ্য পরিষদে উত্থাপিত হয়। কমিউনিস্ট সদস্য গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ও তাঁর অপর চার সহযোগীর উত্থাপিত ঘটনার ওপর মুলতুবি প্রস্তাবের নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা ১৭ অক্টোবর পরিষদে জানান, ‘নারী উদ্বাস্তুগণ তাদের দাবি পেশ করতে জেলা কর্তার বাংলোর দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে পুলিশের বাধা পান। তখন নিরীহ পুলিশের ওপর উদ্বাস্তু জনতার কেউ কেউ ইট পাটকেল নিক্ষেপ করলে তাদের ২৪ জন এবং উদ্বাস্তুদের ১৭ জন আহত হয়। জনতা মারমুখী হয়ে উঠছে মনে করেই পুলিশ ‘মৃদু’ লাঠি চালনা করে। এ সম্পর্কে ধৃত ২৬ জনকে জামিন দেওয়া হয়নি।’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘৫০০ লোকের জনতা জেলা কর্তার বাংলো প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে সেখানে অনশন করতে উদ্যত হয়। গোলযোগ আশঙ্কা করে জেলা কর্তার ভবন প্রাঙ্গণ সুরক্ষিত করতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। … অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও আয়ত্তের মধ্যে রয়েছে—মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর স্পিকার মুলতুবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে দেন।৮৫
এ সময় সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, ভাষা-দাঙ্গার ফলে কাছাড়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আসাম সরকার তা স্বীকার করছেন না। কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার বি দোয়ারা এ সম্পর্কে এক প্রেসনোটে জানান যে:
‘ভাষার হাঙ্গামার সময়ে কাছাড়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে তা সত্য নয়। ভাষা সংক্রান্ত হাঙ্গামায় কাছাড় জেলায় কারো মৃত্যু হয়নি। আসামের ভাষা সংক্রান্ত হাঙ্গামার জন্য যে এগারো হাজার নর-নারী কাছাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল—তাদের মধ্যে জ্বর, আমাশয় ও বার্ধক্যের জন্য ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।’৮৬
সরকারি ভাষ্য থেকে দু-টি বিষয় পরিষ্কার— এক. কাছাড় জেলায় এগারো হাজার শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল এবং দুই. পঁচিশজন শরণার্থীর মৃত্যু সংবাদ স্বীকার করা। তবে একথা আমরা জানি যে, এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে কাছাড়ে বসবাসরত আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুজনের বাড়িতে যারা আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন— তাঁদের গণনার মধ্যে আনা হয়নি। আর তা ছাড়া আসাম সরকারের প্রবণতায় ছিল শরণার্থী সংখ্যা কম করে দেখানো। সুতরাং, কাছাড়ে আশ্রয়গ্রহণকারী উদবাস্তুর প্রকৃত সংখ্যা যে অনেক বেশি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লামডিং-এ উদবাস্তু
লামডিং-এ বিপুল সংখ্যায় বাঙালি উদবাস্তু আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি এই সংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, উদবাস্তুদের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে করিমগঞ্জ বাজারের কতিপয় ব্যবসায়ী বাজার থেকে চার হাজার টাকা মূল্যের চাল, ডাল, তেল, চিনি, রোগীর পথ্য সাগু, বার্লি, শিশুখাদ্য, দুধ ইত্যাদি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহিতমোহন দাস-এর নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবী লামডিং রওয়ানা দেন। এদিকে শিলচর থেকে আর্ত-সাহায্য সমিতির সম্পাদক ধীরেন্দ্রমোহন দেবও লামডিং-এ অবস্থানরত ছিন্নমূল মানুষের সেবায় সকলকে এগিয়ে আসার আবেদন জানান।’৮৭
আসলে লামডিং-এ উদবাস্তু সংখ্যা কত ছিল? কোথা থেকেই বা এসেছিলেন তাঁরা? এসব তথ্য পাওয়া যায় লামডিং উদ্বাস্তু সাহায্য সমিতির সভাপতি শ্রীকালীপ্রসন্ন দাস-এর এক বিবৃতি থেকে। কালীপ্রসন্ন জানান: …. ‘লামডিং-এ ৫ জুলাই আসাম দাঙ্গায় উৎপীড়িতদের জন্য ক্যাম্প খোলা হয়। তারপর থেকে অক্টোবরের প্রায় শেষাবধি পর্যন্ত আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে উৎপীড়িত হয়ে এসেছিলেন : নওগাঁর মোট ১,৩১৯টি পরিবার, শিবসাগর জেলা থেকে ৮০১টি পরিবার, কামরূপ থেকে ৩৮৬টি পরিবার, লখিমপুর থেকে ৯৫টি পরিবার এবং অন্যান্য স্থান থেকে আরও ৯৫টি পরিবার আসেন। লামডিং ক্যাম্পে সর্বমোট ১৪,৩০০ জন উদবাস্তুর নাম রেজিষ্টার করা হয়। এর মধ্যে ১,৬০১টি পরিবার কাছাড়ের ক্যাম্পসমূহে এসে আশ্রয়গ্রহণ করেন। পশ্চিমবঙ্গে যান ২০২টি পরিবার এবং ৮৭৫টি পরিবার যমুনামুখ, জাগিরোড, চাপারমুখ প্রভৃতি স্থানে ফিরে যান।’৮৮
কালীপ্রসন্ন দাস জানান, লামডিং-এ আগত বাস্তুহারাদের সেবার জন্য সরকারি সাহায্য ছাড়াও শিলচরের ভাষাপীড়িত সাহায্য কমিটি, করিমগঞ্জ মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, মালিগাঁও যুব সমিতি, হাইলাকান্দি ছাত্রগণ এবং সহৃদয় জনসাধারণের কাছ থেকে সাহায্যে পাওয়া গেছে।
আসাম রাজ্য বিধানসভায় দাঙ্গা প্রসঙ্গ
আসাম রাজ্য বিধানসভায় ১৯৬০ সালের ৭ অক্টোবর দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা এক বিবৃতি প্রদান করেন। ভাষা আর চাকরির অভাবই দাঙ্গার কারণ বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন। তিনি বলেন: ‘একদিকে ভাষা নিয়ে উত্তেজনা, অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে, অফিসে ও বেসরকারি সংস্থাসমূহে স্থানীয় অধিবাসীদের উপযুক্তসংখ্যক কর্মসংস্থানের অভাবের জন্যই আসামে ব্যাপক দাঙ্গাহাঙ্গামা সংঘটিত হয়। এই দাঙ্গার পেছনে নানা স্থানের নানা কারণ যুক্ত হয়েছিল, আর গোলযোগ ছিল বহু ব্যাপক। সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও শিলং-এ অনুষ্ঠিত এই বহু ব্যাপক ও অবাঞ্ছিত গোলযোগ বিশেষ নিন্দনীয়। এর ফলে ৪০ জনের জীবনহানি ঘটেছে এবং প্রায় ৫২ হাজার ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করেন যে, ‘গোলযোগ যে এমন বহু ব্যাপক হবে, সেকথা আগে কেউ ভাবতে পারেননি বা এর জন্য প্রস্তুত হওয়ারও সময় পাওয়া যায়নি। তবু পুলিশের যেটুকু সাহায্য পাওয়া গেছে, তাই দিয়েই সরকার গুণ্ডা ও গুণ্ডামি দমনের ব্যবস্থা করেন।’৮৯
মুখ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতি যে সত্যনির্ভর নয়— তা আমরা পরবর্তীতে প্রমাণ করব। সরকারিভাবে দাঙ্গায় নিহতদের নামের তালিকা ছিল এরকম: গোয়ালাপাড়া— বেশকুন্ডু সাহা, ধুবড়ি—সরোজ দাশগুপ্ত, কামরূপ—তারিণী দেবনাথ, অতুলচন্দ্র দাস, ধরণীকুমার দেবনাথ, গণেশ দেবনাথ, বরদাসুন্দরী সাহা, মহিম দাস, রসিক দাস, সুমিত্রা দাস্যা, গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী, দেবেন্দ্রকুমার মালী, রণজিৎ বড়োপূজারি, ননীগোপাল সূর, ভানুগোপাল সূর, ব্রজেন্দ্র চৌধুরি এবং শনাক্ত করা যায়নি এমন এক ব্যক্তি।
নওগাঁ— শিশির নাগ, নিখিল কুন্ডু, সুধীর কুমার দাস, সুরেন্দ্র সরকার এবং হাফিজউদ্দিন (?)। মঙ্গল দৈ— রামজয় সরকার। যোরহাট— প্রিয়নাথ দে, কালাচাঁদ পাল এবং রতীশচন্দ্র ঘোষ। শিবসাগর—সত্যব্রত নন্দী, মতিলাল শীলশর্মা, মোহন বাঁশি, যতীন শর্মা, কান্দু কর এবং গিরিন্দ্রচন্দ্র দে, গোলাঘাট—সন্তোষচন্দ্র দাস। ডিব্রুগড়— মন্টু দাস, কুমারী প্রণতি দাস, মোহিতমোহন ভট্টাচার্য এবং গগনচন্দ্র ভট্টাচার্য।৯০
২২ অক্টোবর আসাম বিধানসভায় দাঙ্গাহাঙ্গামা বিষয়ক বিতর্কে অংশ নিয়ে দেবেশ্বর শর্মা বলেন যে : ইহা অতীব শোকাবহ যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অনেক নির্দোষ বাঙালি যাঁহারা অসমিয়া ভাষার বিরোধিতা করেন নাই— তাঁহারাও এই হাঙ্গামায় ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন। গোলযোগের কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শ্রীশর্মা বলেন যে, ভাষার প্রশ্নই যে মূল কারণ সে-সম্পর্কে সন্দেহ নাই। হাঙ্গামা গোড়াতে দমন করা হয় নাই এবং ইহাকে প্রসারিত হইতে দেওয়া হইয়াছিল।
….শ্রীফণী বরা বলেন যে: … ‘এই হাঙ্গামায় তরুণের দলকে ব্যবহার করা হয়েছে।’… শ্রীযুক্তা জ্যোৎস্না চন্দ বলেন যে, ‘মে মাসের গোড়ার দিকে এই রাজ্যের কয়েকটি ঘটনার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি তাঁকে যথাসময়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে অনুরোধ করেছিলেন। আসামের এই দাঙ্গার জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কার্যকারী ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য তিনি সরকারকে অনুরোধ করে ভাষণ শেষ করেন। বিরোধী দলীয় নেতা হরেশ্বর গোস্বামী বলেন যে, হতাশা ও প্ররোচনা এই দাঙ্গায় যথেষ্ট ইন্ধন জুগিয়েছে। রামপ্রসাদ চৌবে বলেন যে, দাঙ্গা আসামের সুনামে কলঙ্ক লেপন করেছে। যেসব ঘটনা ঘটেছে তার জন্য কোথাও যথেষ্ট অনুতাপ লক্ষিত হয়নি’।৯১
এ দিন হীরালাল পাটোয়ারী, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী প্রুমখও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন।
আসাম বিধানসভায় ২৬ অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য তরুণ সেন ডেকার এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ বলেন: ‘ভাষা সম্পর্কিত হাঙ্গামার সময় ৬ জুলাই রাত থেকে ৭ জুলাই সকালের মধ্যে বরপেটা মহকুমার মান্ডিয়া গ্রামে জনৈকা অশক্ত ও অসুস্থ বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে মারা হয় এবং ৪২টি পরিবারের বাসগৃহ অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। এ ছাড়া দুষ্কৃতকারীরা একই গ্রামে ৩০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর বাসগৃহে লুটপাট চালায়। বরপেটা থেকে মান্ডিয়ার দূরত্ব মাত্র সাত মাইল। কিন্তু তারপরও পুলিশ ৮ জুলাই সকালে এসব দুষ্কর্মের সংবাদ পায় বলে শ্রী আহমদ জানান। …. মান্ডিয়ার ঘটনা সম্পর্কে ১৫ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফকরুদ্দীন আহমদ আরও জানান, ভাষা সম্পর্কিত হাঙ্গামার কারণে যাঁরা উদবাস্তু হয়েছেন— তাঁদের পুনর্বাসনের সকল ব্যয় এ পর্যন্ত রাজ্য সরকারই বহন করেছেন। তিনি আরও জানান, ভাষা সম্পর্কিত হাঙ্গামার সঙ্গে জড়িত যে-সকল ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়— তাদের মধ্যে ৩, ৯৮৪ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।৯২
মুখ্যমন্ত্রীর ৭ অক্টোবরের বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, ভাষা সম্পর্কিত হাঙ্গামায় সর্বমোট ৪,৩৮২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অর্থাৎ অক্টোবরের শেষাশেষি আটক ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়াল ৩৯৮ জন।
দিল্লিতে আসাম দাঙ্গা
আসামের দাঙ্গাহাঙ্গামার বিষয়টি দিল্লিতে কংগ্রেস সংসদীয় দলের নির্বাহী কমিটিতে আলোচিত হয়। ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় শ্রী নেহরু যে বক্তব্য রাখেন তা ছিল সত্যের অপলাপ মাত্র। সংবাদপত্রে বলা হল:
Sri Nehru gave a more realistic and sympathetic account today of the recent disturbances in Assam at the postponed meeting of the Executive Committee of the Congress Parliamentary Party.
He said that there was no mob violence on large scale at any time during the period of disturbances. There were only stray incidents organized mostly by a handful of agitated students or anti social elements.
The prime Minister said at no time there was a concerted drive to oust the Bengali population from Assam. Infact, he said, most of the refugees belonged to the lower strata of society who had recently gone to Assam and got frightened because their huts had been put on fire by miscreants. Comparatively a large number of Bengalis were given protection by Assamese neighbours and friends.”৯৩
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রী নেহরুর এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি জাতির প্রতি তাঁর এই বক্তব্য, মন্তব্য পক্ষপাতদুষ্ট, একপেশে যা বেদনাদায়ক।
আসামের দু-জন সদস্য— পি সি বড়ুয়া এবং ডি বসুমাতারিও এই সভায় বক্তব্য রাখেন। সংবাদপত্রে এ সম্পর্কে জানানো হল:
Two Assam members Sr. P C Barua and Sr. D Basumatari said that the Assamese were prepared to go to any limit to request ‘the Bengali speaking Assamese’ to come back to their homes. Though there was some frustration in the State because the services were controlled by Bengali officers and the Assamese language didnot have opportunities of development, they felt that there could be no justification for what had happened in the State.৯৪
আসামের দাঙ্গাহাঙ্গামার বিষয়টি লোকসভাতে বেশ গুরুত্ব সহকারেই স্থান করে নিল। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা সদস্যগণ এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১ সেপ্টেম্বর লোকসভায় ‘আসাম হাঙ্গামা’ বিষয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়।
আসামের পরিস্থিতি এবং সে সম্পর্কে পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদলের রিপোর্টের উপর তিনদিনব্যাপী বিতর্কের সূচনা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু আজ লোকসভায় প্রায় নব্বই মিনিট কাল বক্তৃতা করেন। সংবাদপত্রে বলা হল: ‘আসামের অভূতপূর্ব ও মর্মান্তিক ঘটনাবলীর সময় দায়িত্ব পালনে নিদারুণ ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ও আসাম সরকার আজ লোকসভায় কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হন।
উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে আজ দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আসাম বিতর্ক সুরু হয়। আলোচনাকালে সদস্যদের ক্ষোভ ও বেদনা যদিও চাপা থাকেনি, তথাপি আলোচনার মধ্যে বিদ্বেষ বা রুক্ষতা বিশেষ প্রকাশ পায়নি। আলোচনাকালে পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সহসভাপতি শ্রীঅতুল্য ঘোষ ও শ্রীত্রিদিব চৌধুরী (আর এস পি) ও প্রজা সমাজতন্ত্রী নেতা আচার্য কৃপালনীর বক্তৃতা সর্ববেক্ষা উল্লেখযোগ্য, অকপট ও নির্ভীক হয়েছিল। শ্রী হীরেন মুখোপাধ্যায় ও শ্রীচপলাকান্ত ভট্টাচার্যও আজ আলোচনায় যোগ দেন। আসামের সদস্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শ্রী পি সি বড়ুয়া (কং)। আসামের হাঙ্গামা সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি অগ্রাহ্য করায় বিরোধী দলভুক্ত এবং পশ্চিমবঙ্গের সদস্যদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়।’
প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিদানের পর বক্তৃতা করতে উঠে কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর সহকারী নেতা শ্রী হীরেন মুখোপাধ্যায় হাঙ্গামা সম্পর্কে অবিলম্বে বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বলেন যে, যে নিরাপত্তাবোধ পেলে আসামত্যাগীরা আসামে ফিরে যেতে পারে, বিচারবিভাগীয় তদন্ত ব্যতীত সেই নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন যে, হাঙ্গামার সময় রাজ্য সরকার তাঁদের কর্তব্য পালনের দায়িত্ব জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন বলে মনে হয়। কেন্দ্রীয় সরকারও যে কারণেই হউক— এ বিষয়ে ‘সম্পূর্ণ ঔদাসীন্য’ প্রদর্শন করেন। আসামে যে সকল বীভৎস ঘটনা ঘটেছে— তা শুধু আসামের পক্ষে নয়, আমাদের সকলের পক্ষেই লজ্জার বিষয়। অসমিয়া ভাষার নামে, কিন্তু আসলে গভীরতর রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য, এই বীভৎস ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ‘‘আমাদের ভারতীয়তার বিনাশের আশঙ্কার আভাস’’ ফুটে উঠেছে।৯৫
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আসাম হাঙ্গামার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি নাকচ করে দিয়ে সেদিন লোকসভায় জানিয়েছিলেন:
… that such a step at this juncture would lead to harmful consequences and come in the way of the ‘healing process’, … the tasks to which they should address themselves now were rehabilitation of the refugees, the improvement and the toning up of the administration in Assam and the punishment in a speedy way of the evil-doers and male factors. Nehru …. commended the policy statement of the Assam Government issued two days ago and said that it reflected the determination of that Government to undo the wrongs that had been committed by the people of the State. He also expressed his general agreement with the report of the Ajit Prasad Jain deligation.৯৬
অন্যদিকে কলকাতার সংবাদপত্র যুগান্তর-এ বলা হল একটু ভিন্নভাবে: ‘অসমিয়াদের সাম্প্রতিক গুণ্ডামির বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহরু সরাসরি অগ্রাহ্য করেছেন। কারণ তাঁর মতে বর্তমানে এই ধরনের ব্যবস্থায় ক্ষতিই হবে— আসামের ‘রোগ নিরাময়ে’ বাধা সৃষ্টি করবে। এক সময় দিল্লির শাসন কর্ণধারগণ আসামে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন করবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু পরে তাঁরা ভেবে দেখেন যে, তা করলে অসমিয়ারা বড়োই মনমরা ও গোঁসা হবে। তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন আর ঘটানো যাবে না। তাই কেন্দ্রীয় কর্তাদের হঠাৎ ‘বদলে গেল মতটা, পালটে গেল পথটা।’
নেহরুজির মতে এখন আসামের রোগ নিরাময়ের আসল দাওয়াই হচ্ছে— গুণ্ডামির তদন্ত নয়, গুণ্ডাদের অত্যাচারে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, ঋণ ও খয়রাতি দিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। আসামের শাসনব্যবস্থাকে ‘চাঙ্গা’ করে তোলা এবং দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি-বিধানের চেষ্টা করা।
শ্রীঅজিতপ্রসাদ জৈন-এর নায়কতায় যে পার্লামেন্টারি দল আসামের গুণ্ডামির তদন্ত করতে গিয়েছিলেন— তাঁদের রিপোর্টের নেহরুজি খুব তারিফ করেছেন। …. দু-দিন আগে আসাম সরকার যে নীতিঘটিত বিবৃতি দিয়েছেন, পন্ডিতজি তারও তারিফ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী অতঃপর পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের এক শ্রেণির সংবাদপত্রের মনোভাবকে ধিক্কার দিয়ে বলেন যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অবশ্য তিনি খর্ব করতে চান না, তবে যদি কোনো সংবাদপত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উস্কে তোলার চেষ্টা করে—তাহলে তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে—সে-সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেন।৯৭
৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নেহরু লোকসভায় শেষপর্যন্ত আসাম হাঙ্গামার বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি মেনে নেন। এ সম্পর্কে সংবাদপত্রে বলা হল:
Prime Minister Nehru reiterated in the Loksabha to-day that there should be quick local inquiries in Assam to get at the culprits responsible for the recent happenings there. These inquiries would presumably be judicial. But that did not necessarily mean that they would all be conducted by High Court Judges. District Judges might conduct them.
Winding up the three-day debate on Assam. Sri Nehru also reiterated that there should be another inquiry at the appropriate time to go into the deeper causes for the disturbances. Any inquiry into the deeper causes could not be held in the present atmosphere of Assam and Bengal, as such an inquiry would be vitiated by the existing too much of passion.৯৮
এ বিষয়ে বাংলা সংবাদপত্র জানাল: ‘ভারত সরকার আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচার-বিভাগীয় তদন্তের দাবি স্বীকার করে নেন। তবে এই তদন্ত তিন প্রকারের না হলেও অন্তত দু-প্রকারের হবে। প্রথম ধরনের তদন্ত হবে অপরাধীদের বের করে তাদের শাস্তি দেবার জন্য আঞ্চলিক ভিত্তিতে যুগপৎ কয়েক স্থানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত।
দ্বিতীয় ধরনের তদন্ত হবে পরে যথোপযুক্ত সময়ে—আসামের গোলযোগের গভীরে নিহিত মূল কারণগুলি অনুসন্ধান ও তার প্রতিকারের উপায় উদ্ভাবনের জন্য সামগ্রিক আকারের বিচার-বিভাগীয় তদন্ত। প্রয়োজন হলে তৃতীয় আর এক ধরনের তদন্ত অনুষ্ঠানের বিষয়ও চিন্তা করা হবে; আসামের শোচনীয় ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির দায়িত্ব নিরূপণের জন্য। ….
আসামের খাসিয়া নেতা শ্রীহাইনিউটা হুবারের বক্তৃতায় আজ সর্বাধিক জোরাল হয়। তিনি আসামের বাংলা ভাষাভাষি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ সমর্থন প্রসঙ্গে আসামে আধিপত্যকামী দাঙ্গাবাজরা যে নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে তার লোকহর্ষক বিবরণ দেন এবং আসামের উপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, অসমিয়াকে রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকার করে নেওয়ার পরিবর্তে তিনি বরং আসাম ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাকে স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু দিন।’’ তিনি হাঙ্গামা সম্পর্কে বলেন, এটা শুধু আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নই নয়— এটা দেশের ভেতরে ও বিদেশে ভারতের সুনাম ও সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশ্ন।’৯৯
আসামের হাঙ্গামা বিষয়ে রাজ্যসভাতেও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্ডিত পন্থ তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই আসাম রাজ্য সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সংবাদপত্রে এ বিষয়ে বলা হল:
The Home Minister, Pandit Pant, told the Rajya Sabha today that vigorous and energetic steps were being taken by the Assam Government to bring about amity and goodwill among the various communities of Assam and to restore confidence among the minorities of the State and rehabilitate refugees.
Initiating a debate on the Assam disturbances, Pandit Pant said that already and Aditional Chief Secretary had been appointed by the Assam Government to go round to find out which of the officials failed to act impartially or energitically during the occurences and hesitated to respond to the call of duty at a critical juncture. …
Among those who took part in it included two members of the States Reorganization Commission, Dr. H N Kunzru and Sri K M Panikkar. Dr. Kunzru was in favour of a high level probe by a Commission which could examine the highest authorities of the State and find out how the incidents were allowed to take place. …
Sri Panikkar’s main point was that Assam was a polyglot and multi-lingual State where no single language had that pre-eminence which would enable it to be considered a state language. He said that the problem to be dealt with now was to create a sense of Assamese unity and identity not merely based on ‘the sons-of-the soil doctrine’ but all people who lived in Assam ১০০
আমরা জেনেছি যে: ‘…. লোকসভা ও রাজ্যসভার বিতর্কে… আসামের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত সরকার জুন মাসেই অবহিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্ডিত পন্থ এ ব্যাপারে আসাম সরকারের সাথে পত্রাদির আদান-প্রদানও করেন। কিন্তু তবুও অবলীলাক্রমে নারকীয় ঘটনাবলী অনুষ্ঠিত হল। মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা, রাজ্যপাল জেনারেল নাগেশ এবং অর্থমন্ত্রী শ্রীফকরুদ্দীন আলি আহমদ নাকি জানান যে, অবস্থা আয়ত্তের মধ্যেই আছে! তাঁদের শ্রীমুখ নি:সৃত বাণী শুনেই কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চিত হয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেন। অথচ যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারকে সম্পূর্ণ ভুল খবর দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন, সেই ব্যক্তিদের প্রশংসায় শ্রীনেহরু ও শ্রীপন্থ এখন একেবারে পঞ্চ-মুখ হয়ে উঠেছেন—এ এক বিস্ময়কর ব্যাপার।’১০১
উপরিউক্ত সম্পাদকীয় মন্তব্যের সঙ্গে সবাই সহমত পোষণ করবেন— এমন দাবি কেউ করবেন না, তবে অধিকাংশ সচেতন, সত্যনিষ্ঠ মানুষই যে একমত হবেন; সে-বিষয়ে আমরা নি:সন্দেহ। আসলে প্রথমাবধি কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে অসাধারণ মিল লক্ষ করা গেছে। দু-পক্ষই কথা বলেছেন এক সুরে, এক লয়ে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্র অযাজিতভাবেই রাজ্যের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একথা মনে করার কারণ রয়েছে যে, কেন্দ্র যেন রাজ্য সরকারকে রক্ষা করতেই সদা তৎপর। কিন্তু কেন? রাজ্য নির্বাচন বৈতরণী পার হওয়া? কিন্তু সবার উপরে তো মানুষ সত্য— সেকথা সবাই কি ভুলেই গেলেন? এটাই কি আসামের প্রকৃত রূপ? আমরা তো মনে করি না । সেখানে মানুষ তো আছেন-ই। কিন্তু স্বর বড়োই ম্রিয়মাণ, অসহায়ত্ব তাঁদের চোখে-মুখে।
‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযান: পশ্চিমবঙ্গে প্রতিক্রিয়া
১৯৬০ সালে আসামে বাঙালিদের ওপর অমানবিক,নারকীয় হামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার হাজার বাঙালি তাঁদের বসতবাড়ি, ঘরদোর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, জমিজিরেট সবকিছু ফেলে রেখে কেবল জীবন ও মান বাঁচাতে নানাপথে পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। আসাম উপত্যকায় সংঘটিত ঘটনার সংবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিশেষত বাঙালি সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গ আসামের লাগোয়া প্রতিবেশী। আর তা ছাড়া এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি জাতিভুক্ত। সুতরাং, প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া ছিল স্বাভাবিক। আমরা এ বিষয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরব বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
২ জুলাই ‘পশ্চিমবঙ্গ পুনর্গঠন সংযুক্ত পরিষদ’-এর উদ্যোগে কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন রণদেব চৌধুরী। সভায় বলা হয় যে:
আসামে সংখ্যালঘিষ্ঠদের ভাষা অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করা এবং সংঘবদ্ধভাবে বাঙালিদের ওপর আক্রমণের অপপ্রয়াস থেকে এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে, আসামের বঙ্গভাষী ও পাহাড়িয়া অঞ্চলসমূহকে পশ্চিমবঙ্গভুক্ত না করা পর্যন্ত এই অত্যাচার বন্ধ হবে না।
সভাপতি রণদেব চৌধুরী তাঁর ভাষণে বলেন: আসামে বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার চলছে, তা ‘গুরুতর পরিস্থিতি’। তিনি বলেন, ‘মুখ্যত আসাম দ্বিভাষী রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষা এবং বাঙালিদের প্রতি যদি অন্যায় আক্রমণ চলতে থাকে, তবে আসামের বঙ্গ ভাষাভাষী অঞ্চলের পশ্চিমবঙ্গভুক্তির জন্য জোর আন্দোলন চালানো আবশ্যক।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক শ্রেণীর অসমিয়া সেখানকার বাঙালিদের ব্যাবসা-বাণিজ্য-চাকুরি থেকে উৎখাত এবং বাংলাভাষীর ন্যায্য দাবিগুলি দাবিয়ে দেবার জন্যই এধরনের নিপীড়ন শুরু করেছেন।১০২
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আসামে বাঙালির ওপর আক্রমণাত্মক ঘটনা ‘দুঃখ ও লজ্জাকর’। তিনি বলেন, আসামে অসমিয়া ভাষা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা নয়, সেখানে অসমিয়া, বাংলা ও পাহাড়িয়া ভাষাভাষির সংখ্যা প্রায় সমান সমান।’ তিনি আরও বলেন যে, আসাম বিধানসভার বিরোধী দলীয় নেতা হরেশ্বর গোস্বামীর খোলা চিঠি মারফত সাম্প্রতিক ঘটনার যে তথ্য পরিবেশন করেছেন— তা গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আসামে আইন-শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনো ঘটনা ঘটে নাই বলে শ্রী গোস্বামী যে তথ্য দিয়েছেন— তা সত্যকে গোপন করার প্রয়াস …। শ্রী হরেশ্বর গোস্বামী আসামে অসমিয়াদের সংখ্যা শতকরা ৬০ জন বলে যে তথ্য দিয়েছেন— তা ‘বিকৃত ও উদ্দেশ্যমূলক বলে শ্রীঠাকুর মনে করেন।’ সভায় অধ্যক্ষ জে কে চৌধুরী, ডা. ভূপাল বসু প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে আসামে যে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে—সে-বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ কামনা করে এক তারবার্তা প্রেরিত হয়। একইভাবে অপর দু-টি তারবার্তা যথাক্রমে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ-এর নিকট প্রেরিত হয়।
প্রেরিত তারবার্তায় বলা হয়: ‘আসামের বিভিন্ন স্থান থেকে উদবেগজনক সংবাদ আসছে। বাঙালিরা দলে দলে আসাম ত্যাগ করছে। আপনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করি।’১০৩
এদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আসামের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষপর্যন্ত ‘পুলিশবাহিনীকে বেতারের সাহায্যে আসামের উপদ্রুত অঞ্চলের সংবাদ সংগ্রহের নির্দেশ দেন’ খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ।
৯ জুলাই কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদে বলা হয়: ‘সমগ্র আসাম রাজ্যে যেভাবে বাঙালিদের ওপর অমানুষিক বর্বর অত্যাচার চলছে, বাঙালি নারীর মর্যাদা যেভাবে লুন্ঠিত হচ্ছে, তার প্রতিবাদে মহানগরীর ক্ষুব্ধ যুবশক্তি শনিবার সন্ধ্যায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সমবেত হয়ে দৃপ্তকন্ঠে অবিলম্বে আসামে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রবর্তনের দাবি জানানো হয়। এই মহতী সভায় বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের, দুর্গতদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করার এবং কলকাতা ও উত্তরবঙ্গে বাঙালি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রস্তুত করে আসামে বাঙালি নির্যাতনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ সক্রিয় ব্যবস্থা অবলম্বনের দাবি করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।’১০৪
সভাপতি শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আসাম সরকারের ক্লীবতা আর অক্ষমতায় আজ আসামের মর্যাদা অবলুণ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সময়মতো প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের দাবি না করায় ধিক্কারযোগ্য। কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী পন্ডিতজি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থজি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলে নিন্দনীয়। আসামের এই বর্বরতার প্রতিবাদ করে দৃঢ় আত্মশক্তিতে বাংলা ভাষার দাবিকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’১০৫
সভায় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: ‘আসামের অত্যাচার নোয়াখালির ইতিহাসকেও ম্লান করে দিয়েছে। আসামে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত। ভুয়া সেন্সাস রিপোর্ট তৈরি করে বাঙালিদের সংখ্যা কমানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার চিরদিনই বাংলার বিরোধী শক্তি। এই কেন্দ্রীয় সরকারকে সক্রিয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য তৎপর করতে হলে বিপুল শক্তি সহযোগে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’১০৬
অপর আর এক সংবাদপত্রে উপর্যুক্ত সভা সম্পর্কে বলা হয়: ‘আজ জনাকীর্ণ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কলকাতার বিক্ষুব্ধ ও বেদনাহত নাগরিকবৃন্দ আসামে সরকারি ভাষা নিরূপণের ব্যাপারে বাংলাভাষী নরনারীদের উপর বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। সভায় বিপুল উত্তেজনার মধ্যে আসামে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। …
সমাগত জনতা কেবল নিছক বক্তৃতা শুনতে অস্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে এই অন্যায় ও মনুষ্যত্ব বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত নেতৃত্বের দাবি করে মুহুর্মুহু বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
আসামে এই সুপরিকল্পিত অত্যাচারের প্রতিবাদে এই সভায় হলে তিলার্ধ স্থান ফাঁকা ছিল না। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতির ভাষণে বলেন যে, আসামে সংঘবদ্ধভাবে বাঙালিদের যে হত্যা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনে ব্যর্থ হওয়ার জন্য আসাম ও কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গবাসীর ধিক্কারের পাত্র হয়ে উঠেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা দেশবাসীর আস্থা হারিয়েছেন। …
বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতার প্রারম্ভে অনধিক ১০টি ধারা সংবলিত এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সভায় সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। প্রস্তাবের অন্যতম কয়েকটি ধারা ছিল এরকম:
এক. পশ্চিমবঙ্গবাসী এই অন্যায় পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছে;
দুই. পশ্চিমবঙ্গবাসী মনে করে এই নিষ্ঠুর নির্যাতনের পশ্চাতে সুপরিকল্পিত সরকারি ও বেসরকারি সমর্থন আছে;
তিন. আসামের পুলিশ নিষ্ক্রিয়ভাবে দর্শকের ভূমিকা অবলম্বন করছে;
চার. নির্যাতিত ব্যক্তিদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দান করা হউক;
পাঁচ. উপদ্রুত অঞ্চলের বাঙালিরা আত্মরক্ষার জন্য সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের সংঘটিত করুন:
ছয়. কলকাতায় এবং উত্তরবঙ্গে যুবকগণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হউন এবং সর্বভারতীয় ঐক্য নষ্ট না করে বাঙালি নর-নারীর ধন-মান, জীবন ও আত্মসম্মান রক্ষার জন্য যথাসম্ভব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হউক।’
বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে বলেন: ‘শুধুমাত্র আবেদন-নিবেদনের দ্বারা এর প্রতিকার সম্ভব নয়। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালিকে আবার তার বৈপ্লবিক যুগে ফিরে যেতে হবে। বাঙালি যুবক সম্প্রদায়কে সংগঠিত হয়ে তাদের মা-বোনদের মান-সম্মান বজায় রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।’১০৭
জনতার তীব্র চিৎকার ও আনন্দধ্বনির মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, এম এল এ আসামে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তন এবং একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করবার জন্য দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করলে দু-টি প্রস্তাবই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অন্যথায় শ্রীরায় বাংলাকে ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠন করবার আহ্বান জানান। সভায় চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, রথীন্দ্রনাথ সেন ও মনোজ বসু প্রস্তাব সমর্থন করে বক্তৃতা করেন।’১০৮
জুলাই মাসে পশ্চিবঙ্গের কংগ্রেস সম্পাদক বিজয় সিং নাহার, এম. এল. এ., শঙ্কর দাস ব্যানার্জি, এম. এল. এ. এবং শৈলকুমার মুখার্জি আসাম পরিস্থিতি সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করার জন্য শুভেচ্ছা মিশনে, শিলং ও গৌহাটির বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে কংগ্রেস নেতৃত্ব ক্ষতিগ্রস্ত নর-নারী, সরকারি অফিসারবৃন্দ, মন্ত্রিসভার সদস্য, কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ এবং রাজ্যপালের সঙ্গে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। তাঁরা শিলং-এ অবস্থানরত কংগ্রেস সভাপতি শ্রী রেড্ডির সঙ্গেও কথা বলেন। কংগ্রেস নেতৃবর্গ কলকাতায় ফিরে ১১ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন:‘আসাম সরকার প্রারম্ভেই সেখানকার পরিস্থিতি কঠোরহাতে দমন কিংবা হাঙ্গামায় যারা প্ররোচনা দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলে আমরা মনে করি।’
তাঁরা বলেন: ‘আজ পর্যন্ত সেখানে প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্টে কিংবা সিকিউরিটি অ্যাক্টে একজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁরা একথাও বলেন যে, হাঙ্গামার সঙ্গে জড়িত সমস্ত বড়ো বড়ো পান্ডা এখনও চরে বেড়াচ্ছে দেখে আমরা বিস্মিত। নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘আসামে হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়েছে প্রায় এক মাস পূর্বে এবং তা ক্রমে ক্রমে সমগ্র উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছে। … পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু আসামে দূর্বৃত্তদের গুণ্ডামিতে আবার ছিন্নমূল হয়েছে। অসংখ্য ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়েছে দেখে আমরা বিচলিত। তাঁরা বলেন, নওগাঁ, যোরহাট, শিবসাগর ও ডিব্রুগড় জেলায় ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা অত্যধিক। তাঁরা বলেন, আসামের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র সেখানকার বাংলাভাষী মানুষের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে যে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে সে-বিষয়ে আমরা নি:সন্দেহ।’
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ শিলং-এ অবস্থানকালে লক্ষ করেন যে: ‘আসামের ঘটনা সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে আসাম সরকার টেলিগ্রাম আইনের ৯৯ ধারা এবং ফৌজদারি বিধির ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। এই আদেশ যে সম্পূর্ণ বেআইনি তা তাঁরা আসাম সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এই আইনের ফলে কলকাতার কোনো সংবাদপত্র আসামে প্রবেশাধিকার পাবে না এবং তার ফল হবে অবাঞ্ছনীয়।’
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মনে করেন: ‘আসামে হাঙ্গামা বাঁধার অন্যতম সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত ছাত্রের দেহ গৌহাটি শহর থেকে প্রথমে ১২ মাইল দূরবর্তী নিকট আত্মীয়ের বাড়ি এবং তারপর সেখান থেকে ২৩০ মাইল দূববর্তী শিবসাগরে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া। এই সুদীর্ঘ পদযাত্রায় জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ফলে অসমিয়া ছাত্রমৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমগ্র এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শুভেচ্ছা মিশন নেতৃবৃন্দ মনে করেন, এর পেছনে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠনের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কার্যত বাঙালিদের আসাম থেকে বিতাড়নের জন্যই এই ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। কংগ্রেস নেতৃত্ব সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেন যে, আসাম সরকার এই আন্দোলন দমনে যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।’১০৯
আসামের ঘটনায় উদবিগ্ন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় জানালেন:
আসাম পরিদর্শনান্তে পশ্চিমবঙ্গ শুভেচ্ছা মিশনের সদস্যগণ যে বিবৃতি প্রচার করিয়াছেন, তৎপ্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। সদস্যগণ বলিয়াছেন, এই মর্মান্তিক ঘটনার পশ্চাতে বহুদিন যাবৎ এক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযানে উসকানি দিতেছে। ইহার অর্থ এই যে, সাময়িকভাবে এই আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাসপ্রাপ্ত হইলেও যেকোনো সময়ে উহা পুনরায় জ্বলিয়া উঠিতে পারে। আপনি নিজে আসাম পরিদর্শন করুন। সুবিচার করুন। সমগ্র বাংলা আজ শোকাচ্ছন্ন। ১১০
আসামের হাঙ্গামা বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় এক বিবৃতিতে জানান: ‘আসাম থেকে বাঙালি বিতাড়ন সংবিধান বিরোধী ও কলঙ্কজনক। ডা. রায় অসমিয়াদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, ‘তাঁরা যেন ভুলে না যান সংবিধান প্রদত্ত অধিকার বলে যেকোনো ভারতীয় নাগরিক দেশের যেকোনো জায়গায় বসবাস করতে পারেন।’ ডা. রায় আরও বলেন, ‘আমি কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে আসামস্থিত বঙ্গভাষাভাষী অঞ্চলকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করবার জন্য বহু চিঠিপত্র, তারবার্তা ও প্রতিনিধিদলের আবেদনপত্র পেয়েছি। কিন্তু এই ব্যবস্থা অবলম্বন করলে বাঙালিগণ ভারতের একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকবে। বাঙালি চিরকালই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে। সুতরাং, আজ যদি এই প্রস্তাবিত ব্যবস্থা অনুসারে বাঙালি নিজের কর্ম-পরিসর সঙ্কুচিত করে, তবে বুঝতে হবে সত্যই আজ তাঁদের দুর্দিন উপস্থিত হয়েছে। সে-কারণে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে কেবল বাঙালিদের জন্যই— এরূপ সংকীর্ণ মনোভাব গ্রহণ না করাই শ্রেয়।’
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে আরও বলেন: ‘শ্রী শঙ্করদাস ব্যানার্জি প্রমুখ ব্যক্তি তাঁদের শুভেচ্ছা সফরের শেষে যে বক্তব্য পেশ করেছেন-তা থেকে এটা সহজেই প্রকট হয়ে পড়েছে যে, অসমিয়াগণ আসাম থেকে বাঙালিদের তাড়াবার জন্য এক সুপরিকল্পিত নীতি গ্রহণ করেছেন এবং ‘আসাম কেবল অসমিয়াদের জন্য’ এরূপ নীতি নিয়েই চলছেন। এর ফলে আসামে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য অনসমিয়ারও নিরাপত্তার অভাববোধ করছেন। এরূপ ঘটনা বাংলা দেশে অবাঙালিদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অত্যাসন্ন করে তুলতে পারে এবং অন্যান্য রাজ্যেও অসমিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাব জাগিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত সমস্ত অবাঙালি নিশ্চিত থাকতে পারেন, সরকার তাঁদের নিরাপত্তা বিধান করবে।’ …
ডা. রায় বলেন, তিনি কেন্দ্রীয় এবং আসাম সরকারের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে সেখানে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য এবং আসামে বসবাসকারী বাঙালিদের রক্ষায় সচেষ্ট আছেন।’১১১ আসামে বাঙালি নির্যাতন ও হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় ও দল নির্বিশেষে সকল মানুষ ১৬ জুলাই ‘শোক দিবস ও সর্বাত্মক হরতাল’ পালন করেন। ব্যতিক্রম ছিল কংগ্রেস। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস মুখপত্র দিনটিকে ‘আসাম শোক দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। কলকাতার সংবাদপত্র এদিনের সভার বর্ণনা দিয়ে জানাল: ‘… আসামে বাঙালি নিধন ও নিপীড়নে শোকাচ্ছন্ন, ক্ষুব্ধ এবং আবেগ উদবেলিত কলকাতা মহানগরী ও শহরতলিতে অদ্যকার শান্তিপূর্ণ হরতাল দীর্ঘকাল স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। সকল শ্রেণির নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় এইরূপ শান্তিপূর্ণ এবং সর্বাত্মক হরতাল ইতিপূর্বে খুব কমই দেখা গিয়াছে। এই হরতাল-ধর্মঘটের ফলে বৃহত্তর কলকাতার সমস্ত কর্মস্রোত আজ যেন নিশ্চল হইয়া গিয়াছিল। সমস্ত প্রকার যানবাহন চলাচল, হাট-বাজার, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, অফিস-আদালত সব কিছুই এইদিন বন্ধ ছিল।
আসামে অসহায় বাঙালিদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার এবং আসাম ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ অদ্যকার শান্তিপূর্ণ হরতাল এবং নিপীড়িত বাঙালি সমাজের প্রতি সমবেদনায় শোক-দিবস উদযাপন বহু সংগ্রামের ঐতিহ্যমন্ডিত মহানগরীকে নতুন মর্যাদা দিয়াছে।
হরতাল শেষে দেশবন্ধু পার্ক, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার এবং ময়দানে আয়োজিত তিনটি বৃহৎ জনসভায় শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য নগরবাসীদের প্রতি অভিনন্দন এবং আসামে বাঙালি নির্যাতনের প্রতিকারের দাবি জানানো হয়। … শহরের প্রধান প্রধান রাস্তায় ও মোড়ে কমিউনিস্ট, ফরওয়ার্ড ব্লক, প্রজা সোশ্যালিস্ট প্রভৃতি বামপন্থীদল, জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, সংযুক্ত পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ সমাজসেবা সমিতি প্রভৃতি বহু সংস্থার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকগণ দলীয় পতাকাসহ পথসভা ও শান্তি সংরক্ষণের কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
সারা শহরে এই সকল দলের পতাকায় ছাইয়া যায়। একমাত্র লক্ষণীয় ব্যতিক্রম ছিল কংগ্রেস পতাকা। কোনো কংগ্রেসকর্মীকে এই শান্তি অভিযানে যোগ দিতে দেখা যায় নাই। … (তবে) ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ও জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এই হরতালে সমর্থন জানায়। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস এই দিনকে ‘আসাম শোক দিবস’ হিসেবে উদযাপনের জন্য সকলকে অনুরোধ করেন। …
বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সকলকে তৎপর থাকিতে আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন জ্যোতি বসু, ত্রিদিব চৌধুরী, হেমন্ত বসু, লীলা রায়, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, অধ্যাপক নির্মল ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ত্রিপুরারী চক্রবর্তী, অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ ঘোষ, রেণু চক্রবর্তী, বিদ্যুৎ বসু, সমর গুহ, মাখন পাল, অধ্যাপক হরিপদ ভারতী, রামপ্রসাদ দাস, ডা. গণি, মনোজ বসু, সুকমল ঘোষ, মিহিরলাল গাঙ্গুলী, সত্যেন বসু, নেপাল রায় প্রমুখ। এ দিনটিকে অরন্ধন দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।’১১২
আসামের ঘটনায় উদবিগ্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ২ সেপ্টেম্বর এক নব ইতিহাস রচনা করল। সংবাদে বলা হল: ‘… সকল পক্ষের মিলিত কন্ঠের ঐক্যবদ্ধ দাবির এক অভূতপূর্ব ইতিহাস রচনা করে। আজ জরুরি অধিবেশনে আসামের ঘটনা সম্পর্কে বিশেষ প্রস্তাবটি সর্মসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে ছ-দফা ঐক্যবদ্ধ দাবির কথা বলা হয়— যেখানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত ছিল অন্যতম। বিধানসভায় বিশেষ প্রস্তাবটি উত্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় বলেন, আসাম থেকে যাঁরা চলে এসেছেন— তাঁরা যাতে ফিরে যেতে পারেন— সেই অবস্থা বা পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য তদন্ত আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আসামের বাঙালিদের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করতে হবে যে, হাঙ্গামার কারণ অনুসন্ধান করা হবে এবং সম্ভব হলে সেই কারণগুলি দূর করা হবে। এই তদন্তে হয়তো সময় লাগতে পারে, কিন্তু তদন্তের নীতিগ্রহণ করতে হবে।’১১৩
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা সদস্য প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের নেতা হরিদাস মিত্র ছ-দিনব্যাপী আসাম উপত্যকার দুর্গত এলাকা পরিভ্রমণ শেষে সেখানকার প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে কলকাতার সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। আমরা জানি, আসাম এবং কেন্দ্রীয় সরকার আসামে শান্তি ফিরে এসেছে, উদবাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ঢাক-ঢোল পেটানো হলেও কিন্তু তা যে কতটা অসার তার প্রমাণ মিলবে এম এল এ হরিদাস মিত্রের বর্ণনায়। সংবাদপত্রে বলা হল:
আসামের গৌহাটি, গোরেশ্বর, নওগাঁ প্রভৃতি এলাকায় বিভিন্ন উপদ্রুত স্থানগুলি পরিদর্শন ও তথাকার বিশিষ্ট বাঙালি ও অসমিয়াদের সহিত আলোচনা করিয়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, সেখানে পুনর্বাসনের অনুকূল আবহাওয়া কোনোদিক দিয়াই সৃষ্টি হয় নাই। … সমগ্র বাঙালি সমাজ অত্যন্ত আতঙ্কিত হইয়া অসহায় অনিশ্চয়তার মধ্যে কাল কাটাইতেছে…।
বিশ্ব বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রগণ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে গিয়া তথাকার স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রদের সহিত কয়েকদিন পূর্ব হইতে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হইয়া তাহাদের কার্যসূচি প্রস্তুত করে। গ্রামাঞ্চলে যেখানে উচ্চ বিদ্যালয়গুলি রহিয়াছে, সেখানেই বা তার আশপাশে নারকীয় তান্ডব চলিয়াছে। শিবসাগর এলাকার পল্লি অঞ্চলে জনৈক অসমিয়া অধ্যাপক দাঙ্গাকারী ছাত্রদলের নেতৃত্ব করেন।
আসাম সরকারের বিবৃতিতে সমগ্র আসামে ছ-টি নারী ধর্ষণের কথা স্বীকৃত হইয়াছে। কিন্তু একমাত্র গোরেশ্বর এলাকায়ই পাঁচটি নারী ধর্ষিতা হইয়াছে। ইহা ছাড়া নওগাঁর গাটাঙ্গা সোনালি বাড়িতে তিনটি এবং যোরহাট শহরে অন্তত তিনটি এবং অন্যান্য স্থানেও কয়েকটি অনুরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে। গোরেশ্বর এবং গাটাঙ্গায় দুই ব্যক্তিকে তাহাদের স্ত্রীদের সামনে হত্যা করিয়া স্ত্রীদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়। সোনালীবাড়িতে একটি যুবতী নারীকে উলঙ্গ করিয়া জোর করিয়া লরিতে তুলিয়া দেখান হয় এবং পরে চলন্ত লরি হইতে লাথি মারিয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। ইহার কোনো ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত অপরাধীর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করা হয় নাই। … জোর করিয়া আসামের সমস্ত সরকারি ক্যাম্প বন্ধ করা হইয়াছে। …
যে সকল সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হাঙ্গামায় সংশ্লিষ্ট বলিয়া অভিযোগ আছে, তাহাদিগকেই পুনর্বাসন রিলিফ অফিসার নিযুক্ত করা হইয়াছে। ইহারা অনেকক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের সহিত নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেছেন, তাহা আমি নিজেও গোরেশ্বর অঞ্চলে দেখিয়াছি।১১৪
বিশিষ্ট ব্যারিস্টার এন সি চ্যাটার্জিও আসামের দাঙ্গা দুর্গত এলাকার পাঁচ শতাধিক মাইল সফর শেষে কলকাতায় ফিরে সাংবাদিকদের সামনে তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তিনি জানান: ‘ব্যাপক অগ্নিকান্ডে ও পরিকল্পিত অত্যাচারে ক্ষতিগ্রস্ত ও গৃহচ্যুত বাঙালিদের পুনর্বাসন অতিশয় শ্লথ গতিতে চলছে; ভয়াবহ ধ্বংসসাধনের পাঁচ মাস পরেও যেসব হতভাগ্য স্ব স্ব গৃহে ফিরে গেছে— তাঁদের পুনর্বসতি হয়নি এবং কতৃপক্ষ এমনভাবে এ কাজে অগ্রসর হচ্ছেন যে, তা খুব নরম করে বললেও বলতে হয় শোচনীয়। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অশোককুমার সেন গতবার আসাম পরিদর্শনের পর পুনর্বাসনের অগ্রগতির যে প্রশংসা করেন তা লোকের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীসেন সম্ভবত সরকারি বিবরণের ওপর নির্ভর করেই তাঁর অভিমত প্রদান করেছিলেন। তিনি যদি গ্রামগুলিতে যেতেন তবে তাঁর ধারণা অন্যরূপ হত।’
তিনি বলেন: ‘শতকরা দশটির বেশি গৃহ পুননির্মিত হয়নি। ব্যারিস্টার চ্যাটার্জি আরও বলেন, গভর্নমেন্ট যদি বাস্তবিকই পুনর্বাসন চান, তবে দুর্গতদের যে টুকুই সাহায্য দেওয়া হবে তা যেন এক সঙ্গেই দেওয়া হয়। কত লোকের বিরুদ্ধে দাঙ্গায় অংশগ্রহণের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের পুনর্বাসন ঋণ দেওয়া হচ্ছে দেখে আমি বিস্মিত। অনেক ছোটো ছোটো ব্যবসায়ী নিজ নিজ গ্রামে ফিরে আসেন, কিন্তু দাঙ্গার পূর্বে তাঁরা যেসব দোকানঘর ব্যবসার জন্য ব্যবহার করতেন— সেসব দোকানঘর তাঁদের ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না।
শ্রী চ্যাটার্জি বলেন: ‘উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করতে না পারা আসামের অধিবাসীদের পক্ষে লজ্জাজনক। কেন্দ্রীয় সরকার এ সম্পর্কে কোনো বলিষ্ঠ ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে এসব লোকের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। যে সব গৃহ ধ্বংস হয়েছে, সেগুলির পুনর্নির্মাণের ভার সেনা বাহিনীর হাতে অর্পণ করা উচিত। এ পর্যন্ত শতকরা দশটির বেশি গৃহ পুনর্নির্মিত হয়নি এবং নিতান্ত ছাপড়া জাতীয় ঘরই করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এই উদ্বাস্তু সমস্যাকে সর্বভারতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করবার জন্য কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টকে অনুরোধ জানান। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আসামে থেকে পুনর্বাসনের তত্ত্বাবধান করা উচিত।’
শ্রী এন সি চ্যাটার্জি বলেন, আসামে যে দাঙ্গা হয়েছে তা ইচ্ছাকৃত ও পূর্বপরিকল্পিত; এর অভিসন্ধি হল অসমিয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা শতকরা সত্তর ভাগে ফাঁপিয়ে তোলা। রাজ্য-পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে কোনো ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করতে হলে ওই ভাষা রাজ্যের শতকরা সত্তরজন অধিবাসীর ভাষা হওয়া চাই। বঙ্গভাষাভাষীদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজ্য ছাড়া করা ও তাদেরকে নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই বাঙালিদের লক্ষ করে গুণ্ডামি চালানো হয়েছিল। এর আরও উদ্দেশ্য ছিল— বঙ্গভাষাভাষীদের মধ্যে এমন ভীতির সঞ্চার করা যাতে তারা বঙ্গভাষী বলে আদমশুমারিতে নিজেদের পরিচয় না দেয়; তাহলে বাংলা ভাষা আসাম রাজ্যের অতিরিক্ত রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতিলাভের সকল সম্ভাবনা দূরীভূত হবে।
শ্রী চ্যাটার্জি বলেন, ‘অতি যত্নের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকগণের যেসব মৌলিক অধিকার সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে, আসাম রাজ্যে তা ধুলায় লুটিয়ে দেওয়া হয়েছে।’১১৫
স্বল্প পরিসরে বর্ণিত তথ্য থেকে একথা স্পষ্ট যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিশেষত বাঙালি জনগোষ্ঠী ভীষণভাবেই মর্মজ্বালায় জর্জরিত হয়েছেন। তাঁদের হৃদয় যন্ত্রণা, উদবেগ, উৎকন্ঠার বহি:প্রকাশ ঘটেছে বর্ণিত সভাগুলিতে। শ্রী এন সি চ্যাটার্জি তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসাম তথা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পথের দিশা দেখিয়েছিলেন—কিন্তু তাঁরা সে-পথ মাড়াননি। মানুষ নয়— রাজনীতিই সত্য।
পশ্চিমবঙ্গে আসাম উদবাস্তু
একই দেশের অধিবাসী তাঁরা। গণতন্ত্র ও অহিংসমন্ত্রে দীক্ষিত ভারতের মানুষ। কিন্তু জাতি হিসেবে বাঙালি হওয়ার অপরাধে (!) আসামে তাঁরা নিষ্ঠুর হামলার শিকারে পরিণত হন। নারী-শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী— এমনকী অন্তঃসত্ত্বা মায়েরাও দূর্বৃত্তদের হামলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি। গ্রামের পর গ্রাম, দোকান, ঘরদোর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান সব আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারদিকে বাঙালিরা হয়েছেন আক্রান্ত, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অসংখ্য নারী-পুরুষ, মৃত্যু ঘটেছে বহু মানুষের। বাঁচার তাগিদে, সম্ভ্রম রক্ষার্থে দিশেহারা এসব মানুষ গ্রাম থেকে গ্রামে, শহরে ছুটে বেড়িয়েছেন। তাঁরা গেছেন শিলচর, হাইলাকান্দি অথবা লামডিং-এ যে কথা আমরা ইতিমধ্যে উল্লেখ করেছি। আবার কেউ ছুটেছেন উত্তরবঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে। আসমের উদবাস্তু বাঙালি যাঁরা আশ্রয়ের সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসেন তাঁদের কিছু কথা আমরা তুলে ধরব বর্তমান আলোচনায়। জুলাই মাসের গোড়া থেকেই শত শত হাজারে হাজারে আক্রান্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার স্টেশনে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সব শরণার্থীরা তাদের ওপর আক্রমণের লোমহর্ষক কাহিনি বর্ণনা করেন। তাঁরা একাধিক সুনির্দিষ্ট ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, ‘৮ জুলাই বেলা বারোটার সময় ‘টাঙ্গাইল কেশরী লাঠিয়াল’ ধরণী কাপালিককে গুলী করে হত্যা করে—যার সুনাম ছিল বাঙালিদের রক্ষা কর্তা হিসেবে।
তাঁরা বলেন: ‘এদিন সকালে জনা পঞ্চাশ মুসলমান ও অসমিয়া মিলিতভাবে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ট্যাংগরবাড়ে গ্রামে হামলা চালায়। কিন্তু লাঠিয়াল ধরণী কাপালিক গ্রামের মানুষের সহায়তায় দূর্বৃত্তদের হটিয়ে দেন। কিন্তু ওইদিন বিকালেই প্রায় পাঁচ শতাধিক দুষ্কৃতিকারী ট্রাকে করে বন্দুক, লাঠি, ছোরা ইত্যাদি নিয়ে গ্রামটিতে চড়াও হয় এবং লুঠতরাজ, গৃহদাহ অবলীলায় চলে। তাঁরা বলেন, গোরেশ্বর, ট্যাংগরবাড়ে, খাগরাবাড়ি, কৌন্ডিকর ও রঙ্গিয়ার কয়েকটি স্থানে উল্লসিত দূর্বৃত্তদল চাঁদ তারা খচিত পাকিস্তানি পতাকা উড্ডয়ন করে এবং ‘আল্লা- হো-আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে শ্মশান পল্লিতে আলোড়নের সৃষ্টি করে।’১১৬
সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, আসামের কামরূপ ও গোয়ালপাড়া জেলা থেকে আটশো বাঙালি উদ্বাস্তু ৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার পৌঁছোন এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই এসেছেন আহত অবস্থায়। সংবাদে আরও বলা হয় দু-হাজার উদবাস্তু পথিমধ্যে রয়েছেন।১১৭
এ দিন সংবাদে আরও বলা হয়, নশো জনের একটি দল জলপাইগুড়ি ও আলিপুর ডুয়ার্সে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বেশ কিছু মানুষ উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা হয়েছেন বলেও জানা যায়।১১৮
এদিকে ৮ জুলাই শিলিগুড়িতে ছ-শো জন এবং আলিপুরদুয়ারে পাঁচ-শো জন উদবাস্তু এসে পৌঁছোন। কোচবিহারেও বেশ কিছু মানুষ এসে পৌঁছেছেন। এ বিষয়ে সংবাদে বলা হয়: ‘আমিনগাঁও থেকে বিশেষ ট্রেনযোগে যে পাঁচ শত বাঙালি আলিপুরদুয়ার আজ পৌঁছেছে— তাঁদের মধ্যে আহত ৮ জন রেলকর্মীও আছেন। গুলি ও ছোরায় আহত এই রেলকর্মীদের রেলওয়ে হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। গতকাল ও আগের দিন আলিপুরদুয়ার স্টেশনে আসাম থেকে পনেরোশো বাঙালি উদ্বাস্তু এসেছেন। এই দু-হাজার বাস্তুত্যাগী বাঙালিকে আলিপুরদুয়ার স্থানীয় বিদ্যালয়ে স্থান দেওয়া হয়েছে। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। সংবাদে আরও জানা যায় যে, শিলিগুড়িতে আজ রাতে আরও দুশো বাঙালি উদ্বাস্তু এসে পৌঁছুবে।’১১৯
পশ্চিমবঙ্গে উদবাস্তু আসার বিরাম নেই। এই নি:স্ব, নিরুপায়, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলোর কথা জানানো হল এভাবে:
আবার উদবাস্তুদের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। পূর্বপাকিস্তান হইতে আগত বাঙালি উদবাস্তু নহে; ভারত সীমান্তগত আসাম রাজ্যের বাসিন্দা বাঙালি উদবাস্তু, ইহাদের একমাত্র অপরাধ ইহারা বাঙালি এবং বাংলা ভাষায় কথা বলে।
এ জায়গাটা আসাম সীমান্ত হইতে ২০ মাইল দূরে, এখানে আসিয়া ভীত সন্ত্রস্ত নিরূপায় বাঙালি পরিবারগুলি সমবেত হইতেছে; ইহারা আহত এবং প্রতিকারহীন মানসিক যন্ত্রণায় কাতর। ইহাদের একান্ত অবাঞ্ছিত আগমনের স্রোত এখানে রুদ্ধ হইবে—এমন লক্ষণ চোখে পড়ে না। দুর্গত মানুষের এই মিছিল অশেষ মনে করিয়াই রেল-কতৃপক্ষ বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। আসাম হইতে স্বাভাবিক ট্রেন চলাচল বন্ধ হইয়া গিয়াছে—তাহাও আজ ছয়-সাত দিন। তথাপি এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার উদবাস্তু আসিয়া পড়িয়াছে।
সরকার তিনটি ক্যাম্প খুলিয়াছেন: তপসিখাতা, সালসাবাড়ি ও জয়ন্তীতে। কিন্তু এই তিনটি শিবিরে কতজনের স্থান সংকুলান হইবে? এগারোশোর বেশি নহে। সরকার আরও ক্যাম্প খুলিবেন শোনা যাইতেছে। কিন্তু ততদিনে আরও শত শত উদ্বাস্তু আসিয়া পড়িবে এমন লক্ষণ সুস্পষ্ট। তাহাদের কি গতি হইবে? এখন দুই হাজার উদবাস্তু স্টেশনে আশ্রয় লইয়াছে। তাহার পর? কতদিন তাহারা সপরিবারে সকল লজ্জা, দুঃখকষ্ট কাটাইয়া লোকের এই আনাগোনার ভিড়ে ভাঙা সংসার গুছাইবে। এখনও ইহাদের চোখের জল শুকায় নাই, ভয় কাটে নাই; ঝড়ে পড়া পাখির মতো নিরুপায় কাঁপিতেছে। আহতদের দেখিলে বুঝা যায় আসামে কি তান্ডব চলিতেছে। স্থানীয় রেল হাসপাতাল ও সরকারি হাসপাতালের শয্যায় ইহাদের আশ্রয়। অনেকে গুলিতে আহত হইয়াছে। রেল হাসপাতালে আহতদের মধ্যে আছেন একজন স্টেশন মাস্টার, দুইজন অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, একজন গার্ড, একজন ড্রাইভার, একজন ফায়ারম্যান ও একজন ব্রেকম্যান। ইহারা সকলেই বাঙালি এবং বাঙালি বলিয়াই এরূপ বেপরোয়া মার খাইয়াছে। ইহাদের একজনের নাম শ্রীক্ষেত্রমোহন দাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, কেন্দুকোনা স্টেশনে—তাঁহাকে অসমিয়া গুণ্ডারা এমন নিদারুণভাবে মারে যে তাহারা ইহাকে মৃত মনে করিয়া পথপ্রান্তে ফেলিয়া যায়।১২০
সারা বাংলা বাস্তুহারা সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ও এম এল এ হরিদাস মিত্র ৬ জুলাই আলিপুর ডুয়ার্স জংশন স্টেশনে পৌঁছে উদবাস্তুদের অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার খবরাখবর নেন।
পরে এম এল এ শ্রী মিত্র এক বিবৃতিতে বলেন: ‘গত ৬ জুলাই বেলা ১২টার সময় আলিপুর ডুয়ার্স জংশন স্টেশনে পৌঁছায়। স্টেশন প্ল্যাটফর্মে আসামের সর্বহারা প্রায় আটশো নারী-পুরুষকে অত্যন্ত অসহায় অবস্থার মধ্যে দেখি। তাদের মধ্যে কেউ লাঠি, কেউ বা ছোরা, কেউ লোহার ডাণ্ডা বা বল্লমের আঘাতে এবং কয়েকজন বন্দুকের গুলিতে আহত হয়েছেন। … নির্যাতিত প্রায় সকলেই লোয়ার আসাম থেকে এসেছেন এবং অধিকাংশ বাঙালি উদবাস্তু পরিবার—যাদের কলোনি, ঘর-বাড়ি, দোকান-পসার জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।
নারী ধর্ষণ, হত্যা, লুঠ, অগ্নিসংযোগের যেসব ঘৃণ্য কাহিনি শুনেছি, তা আধুনিক ইতিহাসের যে-কোনো ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেছে। নলবাড়ি, তিহু, বৈহাটী, চান্দাসরি, চান্দুকোনা, পাটিলদাহ, যোগড়পার, রঙ্গিয়া, আমিনগাঁও প্রভৃতি জায়গাগুলো এই নারকীয় অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল ছিল। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে গোরেশ্বর এলাকার নিকটবর্তী কাঁকিঘাট, হাজলপাড়া প্রভৃতি সামান্য দু-একস্থান ব্যতীত আর কোনো জায়গার লোক আলিপুরদুয়ার স্টেশনে তখন পর্যন্ত আসতে পারেনি বা আসতে দেওয়া হয়নি।
কার্যত নদীর ওপারের সমস্ত আসাম ভূভাগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। আজ ডাউন ১০ খানি ট্রেনের মধ্যে মাত্র ২ খানি সামরিক বাহিনী পাহারায় নদীর এপারে যাওয়া-আসা করছিল। প্রতিদিন ট্রেন বোঝাই হয়ে সর্বহারা বাঙালি এসে আলিপুরদুয়ার স্টেশনে হাজির হচ্ছিল। … ৯ জুলাই আলিপুরদুয়ার স্টেশন প্ল্যাটফর্মে প্রায় ১২০০ আশ্রয়প্রার্থী ছিলেন। ৮ জুলাই থেকে সরকারি ব্যবস্থায় আলিপুরদুয়ার স্টেশন থেকে ২ হাজারের কিছু বেশি লোককে পলাশবাড়ি, জয়ন্তী তপসীঘাটা এবং শিলিগুড়ির অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে সরানো হচ্ছিল।১২১
১১ জুলাই শিলিগুড়ি থেকে যুগান্তর প্রতিনিধি আলিপুরদুয়ারে ৭ হাজারেরও অধিক উদবাস্তু আসার খবর জানান। আসামের গোরেশ্বর, রঙ্গিয়া ও অন্যান্য মধ্যবর্তী রেলস্টেশনে হাজার হাজার উদবাস্তু ট্রেনের অপেক্ষায় জড়ো হয়েছে। গতকাল ১৬০০ উদবাস্তু আসে। আলিপুরদুয়ারে উদবাস্তুর সংখ্যা ৭ হাজারের অধিক হওয়ায় সরকারি সাহায্য ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। … ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ স্থির করেছেন যে, আমিনগাঁও থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত শরণাগতের উদ্ধারকার্যে যে বিশেষ ট্রেন চালানো হচ্ছে— ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও তা চালু থাকবে।১২২
জলপাইগুড়ি থেকে ২৩ জুলাই প্রেরিত সংবাদে বলা হয়: ‘প্রায় ৪ হাজার পাঁচশো বাস্তুত্যাগী বাঙালিকে জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন স্থানে নির্মিত শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আলিপুরদুয়ারে প্রতিদিন বহুসংখ্যক উদ্বাস্তু এসে পৌঁছোচ্ছে। নবাগত উদ্বাস্তুদের ভিড় এক কঠিন সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলে জানা যায়। আসামের বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য আলিপুরদুয়ারে ভারপ্রাপ্ত স্পেশাল অফিসার এম সি মুখার্জি জানান যে, এই সমস্যার সমাধান দু-প্রকারের হতে পারে: আসাম থেকে উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ করে দেওয়া, অথবা উদ্বাস্তুদের অন্য কোনো জেলায় প্রেরণ করা। …
বৃষ্টিপাতের জন্য আলিপুরদুয়ারের বিভিন্ন শিবিরে স্যাঁতসেতে ও কাদামাটিতে উদ্বাস্তুদের অনেকে শ্বাসরোগ ও পেটের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই সঙ্কট এড়াবার জন্য তপসীঘাটার শিবির তুলে দেওয়া হয়েছে। এই শিবিরের ৫৫০ জন উদবাস্তু ও আলিপুরদুয়ার রেলওয়ে স্টেশনের আরও ৩০০ জন উদবাস্তুকে মাদারীহাটের নতুন শিবিরে স্থান দেওয়া হয়েছে। ফলাকাটায় উদ্বাস্তুদের ছ-টি স্কুলগৃহে ও একটি মন্দিরে স্থান দেওয়া হয়েছে।১২৩
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণমন্ত্রী কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ৩ আগস্ট জানান: ‘আজ সকাল পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮৫ জন বাঙালি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছেন। তাদের মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলায় ১০ হাজার ৫৯২ জন, দার্জিলিং জেলায় ১ হাজার ৪২ জন, কোচবিহারে ৮০০ জন, পেট্রাপোলে ৩৮৪ জন এবং শিয়ালদহ স্টেশনে ২৬৭ জন অবস্থান করছেন।
তিনি আরও বলেন যে, এ সকল শরণার্থীদের ‘অনাথ’ বলে ঘোষণা করে রাজ্য সরকার তাদের ডোল দিচ্ছেন। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাথাপিছু ১৮ টাকা ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য মাথাপিছু ১০ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া শরণার্থীদের কাপড়, জামা, গুড়া দুধ, ওষুধ ইত্যাদি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।’১২৪
১৯৬০ সালে, অক্টোবর মাসের শেষদিকে পশ্চিমবঙ্গে আসামবাসী বাঙালি শরণার্থীদের সামগ্রিক উপস্থিতির বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়। ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে সর্বমোট শরণার্থী সংখ্যা ৫৩ হাজার ৯১৫ জন বলা হলেও সর্বশেষ সংবাদে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী সংখ্যা ৫৬ হাজার ৩০৪ জন এবং … পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এ বাবদ মোট ব্যয় ৩৪ লক্ষ বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।১২৫
বেসরকারি সূত্রে অবশ্য শরণার্থীসংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে বলে মত প্রকাশ করা হয়। কারণ এই হিসেব কেবল ক্যাম্পে অবস্থানকারী শরণার্থীদের। কিন্তু এর বাইরে বহু মানুষ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কোথায় শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল এবং কোথায় কত শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার একটি খতিয়ান আমরা তুলে ধরব: জলপাইগুড়িতে ২৬ হাজার ১৮ জন, দার্জিলিং জেলায় ৫ হাজার ১১ জন, কোচবিহারে ৫ হাজার ৬৭ জন, শিয়ালদহে ১৭ হাজার ৬৯৭ জন এবং পশ্চিম দিনাজপুরে ১২২ জন আশ্রয় গ্রহণ করেন।
জলপাইগুড়িতে আসাম শরণার্থীদের জন্য তেরোটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে সালসালাবাড়িতে ১৫৯ জন, কোহিনুরে ৫৪৬ জন, সোনাপুরে ৩৪৫ জন, মাদারিহাটে ৪৩২ জন ও ফলাকাটা ক্যাম্পে ২,৩৬২ জন শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া হয়। তা ছাড়া মাল, ওদলাবাড়ি, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, ধুকিমারি, হুচুমুডাঙা, ধুবামারি ও লাটাগুড়িতে ৭,১৫৮ জন শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেন। দার্জিলিং জেলায় ছ-টি ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাম্পগুলির মধ্যে শিলিগুড়ি খাদ্যগুদামে ৫২ জন, মাবিগড়াঘাটে ৭০ জন, পগভোগরাহাটে ৯০০ জন, আমবাড়ি জুনিয়র হাইস্কুলে ৫৮১ জন, বেংডুবিতে ১০৫৫ জন এবং রানীডাঙায় ৩,৪৭২ জনকে স্থান দেওয়া হয়।
কোচবিহার জেলায় দশটি শিবির স্থাপন করা হয়, এর মধ্যে চাকচাকাতে ২০৮ জন, দেওয়ান হাটে ৩৩৭ জন, চিলারয় গড় ১-এ ৫৫ জন, চিলারয় গড় ২-এ ২৪৪ জন এবং চিলারয় গড় ৩-এ ১৮২ জন। পুণ্ডিবাড়ি-১-এ ১৯৭ জন পুণ্ডিবাড়ি-২-এ ২৭২ জন, বক্সিরহাটে ২৭০ জন, কামাটকুমবাড়িতে ২২৩ জন ও গোসানিবাড়িতে ২৪৮ জন আশ্রয় লাভ করেন।
২৪ পরগনার পেট্রাপোলে ৭১২ জন, নদীয়ার ধুবুলিয়া ক্যাম্পে ২, ১৪৫ জন এবং হুগলির উত্তরপাড়ায় ১১ জনকে আশ্রয় দেওয়া হয়।১২৬
এই বিপুল সংখ্যায় উদবাস্তু ভিড় পশ্চিমবঙ্গের জন্য নানা দুর্ভোগ বয়ে আনে। এর ওপর আসাম সরকারের অসহযোগী মনোভাব বিষয়টিকে আরও জটিল করে তোলে। বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করে জনশক্তি জানাল:
আসামের ভাষার দাঙ্গার ফলে যে হাজার হাজার বাঙ্গালী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয়প্রার্থী হইয়াছেন; আসামে নিরাপত্তার উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টি না হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের ক্যাম্পে বসবাসকারী এই সকল বাঙ্গালী আশ্রয়প্রার্থী ফিরিয়া যাইবার ভরসা পাইতেছেন না। ইহার উপর আবার আসাম সরকার আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা কম করিয়া দেখাইবার যে প্রয়াস পাইতেছেন তাহাতে সমস্যার জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাইতেছে। আসামের অর্থসচিব ফকরুদ্দীন আলি আহম্মদ এক বিবৃতি দিয়া বলিয়াছেন যে, আসাম সরকারের হিসাব মতো বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে আসামের উদ্বাস্তুর সংখ্যা আট হাজারের বেশী হইবে না। ফকরুদ্দীনের এই উক্তির উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় বলিতেছেন যে, আসামে দাঙ্গা দুর্গতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে, কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশের ফলেই সম্ভবত আসাম সরকার পশ্চিমবঙ্গে আসামাগত আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কম করিয়া দেখাইতেছেন।
এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের পুনর্বাসন মন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন বলিয়াছেন যে:
তিনি নিশ্চিতরূপেই বিশ্বাস করেন যে, কোন আইন করিয়া আসামের অভ্যন্তরীণ চিত্র বদলাইয়া দেওয়া যাইবে না। বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়ত একদিন হইবে, কিন্তু তাহাতে বিশেষ সুফল পাওয়া যাইবে না। …
ডা. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বলিয়াছেন যে, আসামে বর্তমানে যে শান্তি বিরাজ করিতেছে তাহা কবরের শান্তি। আসামে বাঙ্গালীদিগকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হইয়াই থাকিতে হইবে। তিনি মনে করেন যে, আসামের এই অবস্থার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থই দায়ী।১২৭
দুই রাজ্যের মধ্যে এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন আশ্রিত শরণার্থীদের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ছাড়া কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। অন্যদিকে আসামের শাসকশ্রেণীর কাছে মানবিক বিষয়টি বরাবরই থেকেছে উপেক্ষিত—যা ভারতে গণতন্ত্রের প্রতি চরম আঘাত বলেই আমাদের মনে হয়েছে।
গোরেশ্বর হাঙ্গামা তদন্তে গঠিত কমিশনে কতিপয় সাক্ষীর বয়ান ও আইনজীবীর সওয়ালজবাব
আসাম সরকার ১৯৬০ সালের ৫ ডিসেম্বর আসাম গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় এই ঘোষণা করেন যে, আসাম হাইকোর্টের বিচারপতি গোপালজি মেহরোত্রাকে নিয়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনকে ৪ জুলাই থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে সংঘটিত দাঙ্গা ও অগ্নিকান্ডের তদন্ত করবার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। এই কমিশনই নিম্নলিখিত গ্রামগুলির ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করবেন। গ্রামগুলি: সোনাকুড়িয়া, সেরাফুলি, গোমালাচক, মোহিরিপাড়া, রামগাঁও, রামহাপার, রুনামারি, ২নং বকুলগুড়ি, সজলপাড়া, সিলকিবার, রাজারখাট (বেটনা), গোরেশ্বর, বোরিগাঁও, রামপুরসুনি, পুরানাওকাটিয়া, বেতাগাঁও, সুয়াগপুর, কুমারীকাটা, সিঙ্গিমারি, বেলচাটি, গোসাইগাঁও, বড়োসুখের খাট ও নালিতাবাড়ি গ্রাম। এ সকল স্থানে যে— সকল ঘটনা ঘটেছে— সেগুলি সম্পর্কে সন্দেহ অপনোদনের জন্য তদন্ত কমিশনকে আদেশ দেওয়া হয়েছে।১২৮
আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, উপরিউক্ত তদন্ত কমিশন কেবল ৪ জুলাই থেকে ৭ জুলাইয়ের মধ্যে সংঘটিত দাঙ্গা ও অগ্নিকান্ডেরই তদন্ত করবেন এবং নির্দিষ্ট গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করে। অথচ কয়েক মাস জুড়ে এবং সমগ্র আসাম উপত্যকাব্যাপী এই দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এমনকী কাছাড় জেলাও দাঙ্গাহাঙ্গামা কবলিত এলাকা বলে সরকারি দলিলে উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন পক্ষ অবলম্বনকারী আইনজীবী যাঁরা সেদিন তদন্ত কমিশনে যুক্ত ছিলেন— রাজ্যপক্ষ: এম এম লাহিড়ী, অ্যাডভোকেট জেলারেল, আর সি চৌধুরী, এবং জে পি ভট্টাচার্য। গৌহাটি জেলা কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে: শ্রীনারায়ণ গোস্বামী, শ্রীপুলকানন্দ দাস, শ্রীকনকেশ্বর শর্মা, শ্রীসুরেশচন্দ্র বরদলৈ, এম ডি. সুলায়মান এবং শ্রীলক্ষ্মীধর বরা; গোরেশ্বর নাগরিক সংঘের পক্ষে শ্রীবাহারুল ইসলাম, শ্রীমহেন্দ্রনাথ ডেকা, শ্রীবলরাম কালিতা, শ্রীকালীপ্রসাদ শর্মা, শ্রীতরুণচন্দ্র শর্মা, অ্যাডভোকেট, শ্রীগোলাপচন্দ্র শর্মা, মোক্তার, শ্রীরমেশচন্দ্র চৌধুরী, শ্রীধরেন্দ্র মাল্লা চৌধুরী, শ্রীদেবকান্ত মজুমদার এবং শ্রীগিরিন্দ্র চন্দ্র চৌধুরী। নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতির পক্ষে এন সি চ্যাটার্জি, বার অ্যাট ল, শ্রীবঙ্কিম দত্ত, শ্রীপবিত্রকুমার গুপ্ত, শ্রীরমণীকান্ত বোস, শ্রীভূপেন্দ্রশঙ্কর গুহ, শ্রীকালীপদ সেন, শ্রীকিরণময় লাহিড়ী, অ্যাডভোকেট; ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে শ্রীসিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, বার অ্যাট ল, শ্রীএস. মুখার্জি, বার অ্যাট ল, শ্রীসত্যেন্দ্রকিশোর ঘোষ, শ্রীকালীকৃষ্ণ ব্যানার্জি, শ্রীনগেন্দ্রমোহন গাঙ্গুলি, শ্রীদেবপ্রসাদ সেন, শ্রীনীরেন্দ্রমোহন লাহিড়ী, অ্যাডভোকেট এবং শ্রীনীতিশ চক্রবর্তী, উকিল।
সে সময় তদন্ত কমিশনে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন:
ভবানীপ্রসাদ দাস (সাময়িকভাবে বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা)
দাঙ্গাহাঙ্গামাকালে ভবানীপ্রসাদ দাস তামুলপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। সাক্ষীদানকালে এই পুলিশ কর্মকর্তা সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন। আইনজীবী সব্যসাচী মুখার্জি এবং বঙ্কিমচন্দ্র দত্ত সাক্ষীকে জেরা করেন। সব্যসাচী মুখার্জির জেরার উত্তরে সাক্ষী ভবানীপ্রসাদ জানান যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাঙ্গামা ঘটে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন।
আইনজীবী পুলিশ কর্মকর্তাকে ১৪ জন কনস্টেবল এবং ৩ জন কর্মকর্তা নিয়ে ৪ জুলাই রাতে গোরেশ্বরে কী করছিলেন জিজ্ঞাসা করলে ভবানীপ্রসাদ জানান, ‘… তাঁহারা বাংলাভাষী জনসাধারণের অর্ধদগ্ধ গৃহ ও সম্পত্তি এবং রেলকর্মীবিহীন স্টেশনে যেসব সরকারি সম্পত্তি ছিল তাহাই পাহারা দিতেছিলেন।’১২৯
আর কে শ্রীবাস্তব
১৯৬১ সালের ৯ জানুয়ারি তদন্ত কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে আসাম সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব বলেন, ‘মাটিকার’ নামক উপন্যাসে আসাম থেকে বাঙালি বিতাড়নের যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, গোরেশ্বরের দাঙ্গা সেই অনুযায়ীই পরিচালিত হয় বলে তিনি মনে করেন। শ্রীবাস্তব বলেন: প্রথমে কিছু লোক হাঙ্গামা বাঁধানোর মতলব না করলে এই হাঙ্গামা হত না— এমন মনে করা যেতে পারে বটে, কিন্তু সরকারের হাতে যে সমস্ত প্রমাণপত্র আছে, তাতে এরূপ মনে করার কোনো কারণ নেই। কৌঁসুলি কে. কে. ব্যানার্জী সাক্ষীকে জেরাকালে বলেন যে, ৬ জুলাই রঙ্গিয়ায় বেসামরিক কতৃপক্ষের সঙ্গে সেনাবাহিনী অসহযোগিতা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাক্ষী বলেন, এমন অভিযোগ মারাত্মক। তিনি বলেন, হাঙ্গামার প্রাক্কালে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে হাঙ্গামার কোনো আভাস আসাম সরকার পাননি। শ্রীবাস্তব কৌঁসুলির প্রশ্নের উত্তরে আরও জানান, হাঙ্গামার পূর্বে আসামে নিবারক নিরোধ আইন বা আসাম শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হয়নি। তিনি স্বীকার করেন যে, ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাস থেকে গৌহাটি ও কামরূপ জেলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্টজনেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, ১১ জুন থেকে শিবসাগর এবং লখিমপুর জেলায় দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়।১৩০
বি আর পাব্বি
১৯৬০ সালের জুলাই মাসে গোরেশ্বর অঞ্চল ও অন্যান্য স্থানে যখন ব্যাপকভাবে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলছে— সে সময়ে বি আর পাব্বি কামরূপ জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে সাক্ষী জানান, ‘জুলাই মাসে হাঙ্গামার পরে রঙ্গিয়া পরিদর্শনকালে তাঁর ধারণা হয় যে, রঙ্গিয়া সার্কেলের পুলিশ কর্মচারীগণ কিছুই করেন নাই। তিনি বলেন, হাঙ্গামা শুরু হতে পারে এমন আশঙ্কা স্পষ্ট প্রতীয়মান হওয়ায় প্রত্যেক থানা অঞ্চলে গুণ্ডা প্রকৃতির লোকদের নামের একটি তালিকা প্রস্তুত করার জন্য ১৯৬০ সালের ২০ জুন তারিখে যে সার্কুলার জারি করেছিলাম, তদনুযায়ী রঙ্গিয়া সার্কেলের পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল এস এম লাহিড়ির এক প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষী জানান ১৯৬০ সালে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সর্বপ্রথম তিনি কামরূপ জেলায় হাঙ্গামা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। কারণ ইতিমধ্যেই উত্তর আসামে হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়। ১৮ জুন তিনি শিলং-এ চিফ সেক্রেটারি ও ইনস্পেকটর জেনারেল অব পুলিশের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং উক্ত বৈঠকে অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। …. ৪ জুলাই রাত প্রায় আটটার সময় মালিগাঁওয়ের রেলওয়ে কন্ট্রোল থেকে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরে ট্রেন আটক করে ওইসব ট্রেনের ওপর আক্রমণের সংবাদ পাওয়া যায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একদল (এক প্লাটুন) সৈন্য দিয়ে ওই এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’১৩১
লালা বি কে দে, ডিআইজি. (রেঞ্জ অ্যাণ্ড বর্ডার)
ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল অব পুলিশ লালা বি কে দে কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে বলেন: ‘… তিনি গৌহাটিতে ৪ জুলাই রাতে কামরূপ জেলার অন্তর্গত ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরবর্তী অঞ্চলে হাঙ্গামা শুরু হওয়ার প্রাথমিক সংবাদ পান। ওই সংবাদে বলা হয় যে, কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশনে হাঙ্গামা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, রঙ্গিয়া ও অপর স্টেশনে অবস্থানরত ট্রেনগুলির ওপর আক্রমণ হয়েছে এবং গোরেশ্বরে হাঙ্গামা চলছে। লালা দে বলেন, বিশেষ সরকারি কাজে এ সময় তিনি গৌহাটিতে অবস্থান করছিলেন।
রাজ্য সরকারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেনারেল এস এম লাহিড়ীর এক প্রশ্নের উত্তরে লালা দে জানান, আসামের ইনস্পেকটর জেনারেল অব পুলিশ গৌহাটি শহরে কিছু হাঙ্গামার আশঙ্কা করায় তাঁকে ১৯৬০ সালের ২৮ জুন গৌহাটি প্রেরণ করা হয়। তিনি বলেন যে ২৮ জুন সকালে ঝালুকবাড়িতে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কলকাতার সংবাদপত্র ভস্মীভূত করা হয় এবং তখন থেকে হাঙ্গামার সূত্রপাত। ৪ জুলাই গুরুতর হাঙ্গামা হওয়ায় শেষপর্যন্ত পুলিশ গুলি চালায়। লালা দে বলেন, ৪ জুলাই রাতে শিলং থেকে গৌহাটিতে একদল সেনা এসে পৌঁছোয়। ওই দল থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্যকে (এক প্লাটুন) জনৈক ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ৪ জুলাই ট্রেনযোগে উত্তর তীরবর্তী এলাকায় প্রেরণ করা হয়। পরদিন হাঙ্গামা সম্পর্কে আরও সংবাদ গৌহাটিতে পৌঁছোয়। উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট রঙ্গিয়া থেকে ডেপুটি কমিশনারকে টেলিফোনে জানান যে, তিনি উত্তর তীরে গুরুতর হাঙ্গামার আশঙ্কা করছেন। ৫ জুলাই এক বৈঠকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়। বৈঠকে সাক্ষী দে, ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ও সেনাদলের কম্যাণ্ডিং অফিসার উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টকে উত্তর তীরে প্রেরণ করা হবে এবং উক্ত এলাকার সামগ্রিক দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকবে। অ্যাডিশনাল সুপারের সঙ্গে একদল সেনা ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একদল সদস্যকেও প্রেরণ করা হয়। সুপার তাঁর বাহিনী নিয়ে ট্রেনযোগে উত্তর তীরে রওনা হন। ৬ জুলাই সকালে জনৈক ভদ্রলোক তাঁকে টেলিফোনে জানান যে, গোরেশ্বরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, হত্যাকান্ডসহ অতিগুরুতর হাঙ্গামা ঘটেছে। গোরেশ্বর নাগরিক সংঘের কৌঁসলি বি ইসলাম এবং নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির আইনজীবী বঙ্কিম দত্ত, সাক্ষী লালা বি কে দে-কে জেরা করেন।’১৩২
আই কে দাস (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কামরূপ)
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টে=ট আই কে দাস তদন্ত কমিশনে জানান: ‘….৪ জুলাই গৌহাটিতে গুলি চালনার অব্যবহিত পরই জনগণ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। আইনজীবী বি. ইসলামের জেরার উত্তরে শ্রীদাস জানান যে, গৌহাটিতে পুলিশের গুলি চালনার কিছুক্ষণ পরই এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, গুলি চালনার ফলে কয়েক জন অসমিয়া ছাত্র নিহত হয়েছে। এই সংবাদে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সাক্ষী বলেন, উন্মত্ত লোকজন ট্রাক ও বাসে গোরেশ্বরে যায় এবং হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষের আইনজীবী সব্যসাচী মুখার্জির জেরার উত্তরে শ্রীদাস বলেন, পূর্বে যদি সংবাদ পাওয়া যেত এবং যথাসময়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত, তাহলে গোরেশ্বরের ন্যায় ঘটনা ঘটতে পারত না।’১৩৩
হেমচন্দ্র সরকার (সাধারণ গ্রামবাসী)
হেমচন্দ্র সরকার কমিশনে বলেন: ‘এক সশস্ত্র জনতা ৪ জুলাই রাত প্রায় দেড়টা কিংবা দুটোর সময় সিলকিঝাড় গ্রাম আক্রমণ করে। হাঙ্গামাকারী জনতা আল্লা-হো-আকবর প্রভৃতি ধ্বনি করতে থাকে। তারা কতকগুলি গৃহে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। সাক্ষী বলেন, আমি ওই রাতে সপরিবারে জঙ্গলে আশ্রয় নিই। পরদিন সকালে জঙ্গলের নিকটবর্তী এক বাংলাভাষীর বাড়িতে আসি। কিন্তু পরে পুনরায় সন্ধ্যায় জঙ্গলে ফিরে যাই। সেদিন ৫ জুলাই। ৬ জুলাই সকাল দশটার দিকে বাড়িতে রান্নাবান্নার সময় পশ্চিম দিক থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখি। খাওয়াদাওয়া ফেলে রেখে আবারও জঙ্গলে আশ্রয় নিই। দাঙ্গাকারী জনতা আমার গৃহে লুটতরাজ করে পরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আমার বাড়িতে ডাকঘর ছিল, সেটিও জ্বালিয়ে দেয়। জঙ্গল থেকে ফিরে এসে দেখি সব দাউদাউ করে জ্বলছে— শুধু আমার বাড়ি না, প্রায় পুরো সিলকিঝাড় গ্রামই জ্বলছিল। সিলকিঝাড়ের ২৪৮টি মতো গৃহ এ সময় ভস্মীভূত হয়।’১৩৪
যতীন্দ্রমোহন সরকার (সাধারণ নাগরিক)
যতীন্দ্রমোহন সরকার কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে বলেন: ‘গত ৪ জুলাই প্রাতঃকালে হাঙ্গামাকারীরা নওকাটা বাজারে আক্রমণ করে এবং বঙ্গভাষাভাষী সকল ব্যবসায়ীর সব ক-টি দোকান লুন্ঠিত হয়। তিনি বলেন, বঙ্গভাষী বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ী গুরুতররূপে আহত হন।
সাক্ষী সরকার বলেন, ৫ জুলাই লাঠি, জঙ্গ, বর্শা, বন্দুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রায় হাজারের মতো লোক পুবনওকাটা গ্রাম আক্রমণ করে। আক্রমণকারীরা ওই গ্রামের বঙ্গভাষী অধিবাসীদের সমস্ত গৃহ ভস্মীভূত করে। তারা বিদ্যালয় গৃহ ও কালী মন্দিরটিতেও আগুন ধরিয়ে দেয়।১৩৫
নীরোদবালা দেবনাথ (গৃহিণী)
ধরণী দেবনাথ-এর মা প্রত্যক্ষদর্শী নীরোদবালা দেবনাথ কমিশনে গোরেশ্বরের রাসমামা গ্রামের নারীনির্যাতনের বিষয়টি সবিস্তারে তুলে ধরেন। দাঙ্গাকারীরা নীরোদবালার ছেলে ধরণী দেবনাথকে একসময় গুলি করে হত্যা করে। সাক্ষী নিরোদবালা অশ্রুসিক্ত নয়নে কমিশন সমীপে বলেন, ‘সেটা জুলাই মাস, দূর্বৃত্তদের আক্রমণের ভয়ে আমরা পাটখেতে লুকিয়ে ছিলাম। কোলের ছেলে-সহ আমার পুত্রবধূ ও অপর দুই নারীও সেখানে ছিল। দূর্বৃত্তরা আমাদের কাছে পৌঁছে যায় এবং তারা আমার পুত্রবধূ ও অপর দুই নারীকে জোর করে কিছুদূর টেনে নিয়ে গিয়ে তাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। এ সময় আমার ছেলের বউয়ের দেড় বছরের সন্তানকে দূর্বৃত্তরা দূরে ছুঁড়ে ফেলে। এই অত্যাচারে আমাদের সঙ্গী একজন নারী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নারীদের ওপর যারা সেদিন পাশবিক অত্যাচার চালায়, সাক্ষী কমিশনে তাদের নাম উল্লেখ করেন। নীরোদবালা বলেন, আমরা গ্রামে ফিরে এসে দেখলাম আমাদের সব কিছু ভস্মীভূত হয়েছে।’১৩৬
ডা. সুধাংশুশেখর সরকার
ডা. সুধাংশুশেখর সরকার কমিশন সমীপে সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, ‘২০ জুন গোরেশ্বর অঞ্চলের ঝাড়গাঁ স্কুলের এক সভায় আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিঢিরB সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মা জানান, দেশ বর্তমানে অভ্যন্তরীণ শত্রু ও বহি:শত্রুর আক্রমণের সম্মুখীন। শ্রীশর্মা চিনকে বহি:শত্রু এবং অনসমিয়াদের আসামের সরকারি ভাষার বিরোধিতাকে তিনি অভ্যন্তরীণ শত্রুর আক্রমণ বলে ব্যাখ্যা দেন। তিনি দেশকে রক্ষা করতে হলে অভ্যন্তরীণ শত্রুকে বাধা দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন। ডা. সরকার কমিশনে আরও বলেন যে, সভায় তামুলপুরের প্রোজেক্ট অফিসারও অনুরূপ উক্তি করেন।
ডা. সরকার আরও বলেন, সভায় প্রায় দু-শো লোক উপস্থিত ছিলেন। এসব লোকের মধ্যে কেবল আমি ও স্কুলের শিক্ষক গজেন্দ্রচন্দ্র নাগ বাঙালি ছিলাম। তিনি বলেন, সাধারণত সকল সভাতেই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হত। কিন্তু এই সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি— তিনি স্বেচ্ছায় সভায় গিয়েছিলেন। ডা. সরকার আরও বলেন, ঝাড়গাঁ স্কুলে অনুষ্ঠিত সভাশেষে ওইদিন রাতে শ্রীশর্মা শুকলাই ডাকবাংলোতে আর একটি সভা আহ্বান করেন। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে বিভিন্ন অসমিয়াভাষীর গৃহে বৈঠক বসে।’১৩৭
গজেন্দ্রচন্দ্র নাগ, স্কুলশিক্ষক
গজেন্দ্রচন্দ্র নাগ কমিশনে সাক্ষ্যপ্রদানকালে বলেন, দুষ্কৃতিকারীদের ভয়ে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ পুলিশের কাছে তাঁদের নাম বলতে সাহসী হননি। তামুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ভবানীপ্রসাদ দাস তাদের নাম প্রকাশ করতে নিষেধ করেন। ভবানীপ্রসাদ একথাও বলেন যে, তাদের যখন এখানেই বাস করতে হবে— তখন দূর্বৃত্তদের নাম প্রকাশ করে কেবল তিক্ততাই সৃষ্টি হবে এবং নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কয়েক দিন পর আসাম কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মা যখন এই এলাকা পরিভ্রমণে আসেন, তখন তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি ওই একই উপদেশ দেন।১৩৮
সত্যপ্রভা দাস, ধাত্রী
ধাত্রী সত্যপ্রভা দাস গাদলাপাড়া চিকিৎসালয়ে কর্মরতা ছিলেন। কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে তিনি বলেন, ১৯৬০ সালের ৬ জুলাই বেলা ৯টার সময় স্থানীয় স্কুলের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক ও হিন্দি শিক্ষকের নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ লোকের এক জনতা তাঁর গৃহে চড়াও হয় এবং চিৎকার করে বলতে থাকে: ‘মেয়েলোকটা কোথায় গেল? এক্ষুনি তাকে মেখলা ও চাদর পরতে হবে, নচেৎ তাকে শেষ করে ফেলা হবে। গাদলাপাড়া চিকিৎসালয়ের ভারপ্রাপ্ত ডা. চন্দ্রকান্ত ডেকা নিজেই তাঁর কক্ষে ঢুকে পড়ে চিৎকার করে বলেন, ‘এখানে থাকতে হলে তোমাকে মেখলা ও চাদর পরতেই হবে।’ সত্যপ্রভা বলেন, আমার কাছে কোনো মেখলা বা চাদর ছিল না। তাই আমি আমার শাড়ি ছিঁড়ে মেখলা ও চাদর তৈরি করি। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষের আইনজীবী ডি পি সেন-এর এক প্রশ্নের জবাবে শ্রীমতী দাস বলেন যে, গত ৫ জুলাই তারিখে তিনি গাদলাপাড়া চিকিৎসালয় মাঠে ১০/১২টি বাস ও ট্রাক দেখেন। কিন্তু পরদিন ভোরে ওইসব যানবাহনের একটিও সেখানে ছিল না। তিনি বলেন, ৫ জুলাই বাসে করে বহু লোককে সেখানে আসতে দেখেন। ওইসব গাড়ি চলাচলে ডা. ডেকা নিজে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এই আন্দোলন সম্পর্কে সব বৈঠক ডা. ডেকার বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। তিনি বলেন, আমি নিজে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি। তিনি আরও বলেন, বাংলাভাষীদের গৃহ থেকে যেসব মালামাল লুট করা হয়, তার সবটাই ওই চিকিৎসালয়ের গুদামে রাখা হয়। ডা. ডেকা এই হাঙ্গামার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীমতী দাস বলেন, হাঙ্গামা শেষ হয়ে যাবার পরও ডা. ডেকা তাঁকে কোয়ার্টারে থাকতে বাধ্য করেছিলেন।’১৩৯
শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতি
শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত কমিশনে তাঁর সাক্ষ্যে বলেন: ‘…. আসামে গত দাঙ্গার বহুবিধ কারণ ছিল, তন্মধ্যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণই প্রধান। অসমিয়াভাষী নেতাগণ তাঁদের আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে বঙ্গভাষীদের আসাম থেকে বিতাড়িত করতে চান। দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই অসমিয়াদের মধ্যে এই মনোভাব ক্রিয়াশীল ছিল। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অসমিয়া নেতৃত্ব তাঁদের লোকদের প্ররোচিত করতে সর্বতোভাবে সচেষ্ট হন। শ্রীদাশগুপ্ত কমিশনকে জানান … কীভাবে আক্রমণ করা হবে বা চলবে তার বিবরণ শ্রীহিতেশ ডেকা রচিত ও শ্রীলোহিতচন্দ্র ডেকা প্রকাশিত ‘মাটীকার’ নামক গ্রন্থে লেখা আছে। বঙ্গভাষীরা যাতে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে না পারে, তার ছক বা পরিকল্পনা লিখিত আছে ‘আশীর্বাদ’ নামক অপর একটি গ্রন্থে। শ্রীদাশগুপ্ত বলেন, প্রকৃত দাঙ্গা শুরু হবার তিন মাস পূর্ব থেকেই অসমিয়া ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্রগুলি বঙ্গভাষী বা বাঙালিবিরোধী প্রচারে নেমে পড়ে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মচারী এবং পুলিশ অফিসারদের একটি বড়ো অংশ বঙ্গভাষীদের বিরুদ্ধে অসমিয়াভাষীদের উসকে দেবার কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত ছিলেন। আসাম মন্ত্রীমন্ডলীতেও উপদলীয় কোন্দল ছিল।
দাশগুপ্ত বলেন, সরকার যদি হাঙ্গামা দমনের জন্য যথোচিত ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই গ্রহণ করতেন, তাহলে দাঙ্গাহাঙ্গামা এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারত না। তিনি কমিশনকে জানান, হাঙ্গামা পূর্বপরিকল্পিত এবং এজন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পুলিশ অফিসারদের একটি অংশ দায়ী। শ্রীদাশগুপ্ত বলেন, গোরেশ্বর অঞ্চলের বঙ্গভাষী জনগণ পুলিশ বিভাগের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, দাঙ্গার জন্য যে-সকল ব্যক্তি দায়ী তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। এমনকী বর্তমানে তাদের কয়েক জনকে সরকার থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে এবং তারা সম্মানিত ব্যক্তির ন্যায় সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আইনজীবী বি ইসলামের জেরার উত্তরে শ্রীদাশগুপ্ত বলেন, গোরেশ্বর হাঙ্গামার সঙ্গে রাজ্যের অন্যান্য অংশে সংঘটিত হাঙ্গামার সম্পর্ক ছিল।’১৪০
এস এম দত্ত, প্রাক্তন আইজিপি, আসাম সরকার
পুলিশ বিভাগে অত্যন্ত অভিজ্ঞ আইজিপি এস এম দত্ত কমিশনে সাক্ষ্যপ্রদানকালে বলেন যে: ‘ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, প্রশাসনিক কারণ ও এসব কারণের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং এই পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা— এ সবই একই সূত্রে গ্রথিত। কার্যত সমগ্র ঘটনাবলীই একই শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সুতরাং গোরেশ্বরের ঘটনাকে পৃথক করে দেখলে ভুল হবে।
শ্রীদত্ত কমিশনে জানান, মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহাকে অপদস্থ করার জন্য এবং দলীয় মতবিরোধের ফলে কতিপয় কংগ্রেসি নেতা ভাষাকে সামনে রেখে এই আন্দোলন সৃষ্টি করেন। পি এস পি এবং আর সি পি আই এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
শ্রীদত্ত মনে করেন, ২২ এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস-এর ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবের পর বিশেষত কংগ্রেসিদের আর কোনো আন্দোলন করার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলেন, কেবল প্রশাসনের অংশ নয়, পুলিশ বিভাগের কোনো কোনো মহলও প্রভাবিত হয়। পুলিশ যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করত, তবে হাঙ্গামা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল।
শ্রীদত্ত বলেন, ঘটনা বা ঘটনার বিপদ সম্পর্কে গোয়েন্দাকর্মীদের কাছ থেকে কোনো রিপোর্টই তিনি পাননি। কিন্তু তারপরও ১৯৬০ সালের ১ জুন তিনি একটি সার্কুলার জারি করেন। হাঙ্গামা প্রতিরোধের জন্য জেলার পুলিশ অফিসারগণ কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন সে-সম্পর্কে সার্কুলারে বিস্তারিতভাবে বলা হয় বা নির্দেশ দেওয়া হয়। কী ধরনের গোলমাল হতে পারে তা অনুমান করেই তিনি ওই সার্কুলার জারি করেন। এরপরই তাঁর মনে হয় যে, যদিও জুনের প্রথমভাগে উত্তর আসামে গোলমাল দেখা দিয়েছে, কিন্তু জুলাই মাসে গ্রীষ্মের ছুটির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুললে কার্যত আসামের প্রধান শহর গৌহাটিই এই ঝড়ের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াবে। তাই অভ্যন্তরীণ বিপদ আশঙ্কা করে পাকিস্তান সীমান্ত খালি রাখার ঝুঁকি নিয়েও জেলায় অতিরিক্ত বাহিনী পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
আসন্ন গোলযোগ সম্পর্কে অধীন অফিসারদের তিনি আর যে-সমস্ত নির্দেশ দিয়েছিলেন, কমিশন সমীপে সেসব পেশ করেন। রাজ্যে গোলমালের আশঙ্কা করে বহুপূর্বেই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে যে সমস্ত বার্তা পাঠান, তাও তিনি কমিশনে উপস্থাপন করেন। ১৪১
এস জে দাস, পুনর্বাসন কমিশনার, আসাম
এস জে দাস কমিশনে সাক্ষ্যদানকালে স্বীকার করেন যে, ‘হাঙ্গামায় সর্বস্বান্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার যে সমস্ত নির্দেশ দিয়েছেন তা যথাযথভাবে পালিত হয়নি।’
এন সি চ্যাটার্জির সওয়াল জবাব, ফেব্রুয়ারি ১১, ১৯৬১
কমিশনে ব্যারিষ্টার বিশিষ্ট আইনজীবী এন সি চ্যাটার্জি নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী সমিতির পক্ষে সওয়াল করতে উঠে কমিশন প্রধান বিচারপতি গোপালজি মেহরোত্রা সমীপে এদিন বলেন: ‘… স্থানীয় কতৃপক্ষের পক্ষ থেকে কেবল নিষ্ক্রিয়তা, দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বলতাই দেখানো হয়নি, বরং তাঁরা ইচ্ছাপূর্বক দেখেও দেখেননি এবং জনতার উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে যতটা বলপ্রয়োগ করতে পারতেন, তাও করেননি। তিনি এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, যেসব স্থানে হত্যাকান্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুঠতরাজের ঘটনা ঘটেছে, পুলিশ সেসব স্থানে নিষ্ক্রিয় থাকে এবং হত্যাকান্ডের সহানুভূতিহীন দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। এন সি চ্যাটার্জি বলেন, ‘‘ গোরেশ্বর এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত কতৃপক্ষ নিজেদের উক্তি দ্বারাই নিন্দার্হ হয়েছেন। কারণ, আমরা প্রমাণ করতে পারি যে, কয়েক হাজার উচ্ছৃঙ্খল জনতার কাছে মাত্র জনা ছ-য়েক সশস্ত্র পুলিশ কর্মচারী এসে উপস্থিত হলেই তারা ইতস্তত ছুটতে থাকে এবং অদৃশ্য হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, গোরেশ্বর হত্যাকান্ড যে ৪ জুলাই তারিখে গৌহাটিতে পুলিশের গুলি চালনার ফলে সংঘটিত আকস্মিক ঘটনা নয়—তা তিনি প্রমাণ করবেন। তিনি এরূপ অভিমতও প্রকাশ করেন যে, কতৃপক্ষ যে আসন্ন হাঙ্গামার বিন্দুবিসর্গও জানতেন না এবং আকস্মিক পরিস্থিতির মধ্যে কলঙ্কজনক এই ব্যাপক শোকাবহ ঘটনা দমন বা প্রতিরোধের পক্ষে কোনোরূপ কলঙ্কজনক এই ব্যাপক শোকাবহ ঘটনা ছিল না— একথা বলা বিভ্রান্তিকর। শ্রীচ্যাটর্জি নথিভুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখান যে, পুলিশ আসন্ন ঝড়ের বিষয় সম্পূর্ণরূপে অবগত ছিল, কিন্তু তথাপি তারা ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি। তিনি বলেন, রঙ্গিয়ার সার্কেল পুলিশ ইনসপেক্টর ও তামুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার কর্তব্যচ্যুতির জন্য বিশেষভাবে দায়ী। গোরেশ্বরে হাঙ্গামা ঘটবার সম্ভাবনা সম্পর্কে ৪ জুলাই তারিখ রাতে গৌহাটিতে যে রেডিয়োগ্রাম বার্তা পাওয়া গিয়েছিল, তৎসম্পর্কে যথোপযুক্তরূপে অবহিত হলে এই বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটত না এবং তদন্ত কমিশনেরও প্রয়োজন হত না। এ প্রসঙ্গে নথিভুক্ত সাক্ষ্যের কিছু অংশ কমিশনে পাঠ করে শোনান তিনি।
শ্রীচ্যাটার্জি বলেন, রঙ্গিয়ার সার্কেল পুলিশ ইনসপেক্টর তাঁর কুকার্য ঢাকবার জন্যে সরকারি দলিলের বিকৃতি সাধন এবং জাল কাগজপত্র প্রস্তুত করেন।
এন সি চ্যাটার্জি কমিশন প্রধান বিচারপতি গোপালজি মেহরোত্রার উদ্দেশ্যে বলেন যে, ভবিষ্যৎ বংশধরগণ তাঁর সম্মুখে উত্থাপিত এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্তকে একটি ঐতিহাসিক দলিলরূপে বিবেচনা করবে। এই দলিল বর্তমান ভারতের কোনো কোনো অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, ভাষাবিরোধ ও অন্যান্য সর্বপ্রকার বিভেদমূলক প্রবণতার চিরতরে অবসান ঘটাবে। … তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, কমিশনের রিপোর্টে যে সমস্ত ব্যক্তি বিভেদমূলক মনোভাব প্রচারের জন্য দয়ার অযোগ্য, তারা যতই উচ্চপদস্থ হোক না কেন, তাদের প্রতি কোনোরূপ করুণা প্রদর্শন করা হবে না এবং যারা ক্ষমার অযোগ্য, তাদের ক্ষমা করা হবে না।
শ্রীচ্যাটার্জি বলেন, তিনি কলকাতা ও ঢাকা দাঙ্গা তদন্ত কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং র্যাডক্লিফ কমিশনের সমক্ষে আসাম কংগ্রেসের পক্ষ সমর্থন করেছেন। কিন্তু মেহরোত্রা কমিশন সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন। তিনি বলেন, আসামের হত্যাকান্ডের ফলে ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিমূল টলে গেছে এবং সংবিধানের ভাষাগত সংখ্যালঘুগণকে যে-রক্ষাকবচ ও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা অর্থহীন হয়ে পড়েছে।’১৪২
তদন্ত কমিশনে দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১২ ফ্রেব্রুয়ারি এন সি চ্যাটার্জি তাঁর বক্তব্য পেশ করতে উঠে বলেন: ‘গোরেশ্বরের শোচনীয় দাঙ্গাহাঙ্গামা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন নেতৃবর্গ এবং অসমিয়াভাষী মালিকদের সংবাদপত্র দীর্ঘকাল ধরেই সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাভাষী অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ প্রচার করেছে, তারই পরিণতি গোরেশ্বরের হাঙ্গামা।
শ্রীচ্যাটার্জি বলেন, ‘আসাম কেবল অসমিয়াভাষীদেরই রাজ্য। এ ছাড়া অন্য আর সকলেই অসমিয়াদের দয়ার উপর নির্ভর করে বাস করবে— এই মনোবৃত্তির ফলই হল দাঙ্গা-হাঙ্গামার মূল। তিনি বলেন, এই মনোবৃত্তি ভারতীয় সংবিধানের মৌলনীতির পরিপন্থী। গৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, পূর্ব থেকেই বেশ ধীরস্থিরভাবে পরিকল্পনা করেই এসব হাঙ্গামা অনুষ্ঠিত হয়।
দাঙ্গায় বিপন্নদের ক্ষতিপূরণদানের যেসব কথাবার্তা হয়েছে, শ্রীচ্যাটার্জি বলেন, এসব মামুলি বুলি ছাড়া কিছু নয়। কারণ, ক্ষতিপূরণদানের বিষয়ে যে সকল সরকারি কর্মচারী সরকারের নির্দেশ কার্যে পরিণত করেনি, সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেননি। সরকারের পক্ষে এই দুর্বলতা বিশেষ নিন্দনীয়।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বক্তৃতার অংশবিশেষ পাঠ করে শ্রীচ্যাটার্জি দেখান যে, ১৯৪৭ সালেও অসমিয়া ভিন্ন আসামের অন্যান্য ভাষাভাষী অধিবাসীগণকে সমান নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করাই আসাম সরকারের ঘোষিত নীতি ছিল। ‘ডোমিসাইল’ আইনই এর প্রমাণ। বিদেশে গিয়ে সেখানকার নাগরিক অধিকার অর্জন সম্পর্কে যেসব আইন আছে, এই ডোমিসাইল আইন তার চাইতেও কঠোর। ভূমিস্বত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলি এবং অন্যান্য অনেক ব্যবস্থায়ও অসমিয়াভাষী এবং অন্যান্য ভাষাভাষীদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। এসব কারণে পৃথিবীর যেকোনো সরকারই নিন্দনীয় হতে বাধ্য।
এই মনোভাব এবং আসামের মোট জনসংখ্যার অন্তত শতকরা ৭০ জন অসমিয়াভাষী অধিবাসী দেখাবার মনোভাব নিয়ে লোকগণনার কাজ পরিচালনা করা এবং বাংলাভাষীরা আসামের স্বার্থের পরিপন্থী এই ধারণা থেকেই আসামে গত জুলাই মাসে মারণযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। জ্বলন্ত প্রমাণ দিয়ে শ্রী চ্যাটার্জি ৪ জুলাই তারিখটিকে আসামের ‘কলঙ্কজনক সোমবার’ বলে বর্ণনা করেন এবং প্রমাণ দেখিয়ে বলেন যে, আকস্মিকভাবে এই সকল হাঙ্গামা হয়েছে বলে যা বলা হয়, তা সম্পূর্ণ বানানো কথা। গত ২০ মে, ১৯৬০ তারিখে গৌহাটিতে তেল শোধনাগারের জেনারেল ম্যানেজারকে মারধর করার পর থেকে এই শ্রেণির ঘটনা চলতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত ৪ জুলাই এর চরম অবস্থা দেখা দেয়।’
শ্রীচ্যাটার্জি বলেন: ‘৩ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা এক বিবৃতিতে বলেন যে, ভাষাগত সংখ্যালঘু কতৃক অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা বলে অনুমোদন না করা পর্যন্ত সরকার অসমিয়া ভাষাকে আসামের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা না করাই সঙ্গত মনে করেন। এরপরই বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের জন্য ভাষা সমস্যাকে সুবিধাজনক অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা সমস্যা সম্পর্কে শ্রী চালিহা যে মনোভাব পোষণ করেন, তজ্জন্য তাঁকে বাংলাভাষীদের পক্ষভুক্ত করে দেখান হয়। আরও কারণ শ্রীচালিহা কাছাড়ের অন্তর্গত বদরপুর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। মুখ্যমন্ত্রীকে নাজেহাল করবার উদ্দেশ্যে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীগণ তাঁকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন এবং বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে প্রচারের তীব্রতাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’ শ্রীচ্যাটার্জি বলেন, ‘গত ১ জুন তারিখের পুলিশ ইনসপেক্টর জেনারেলের সার্কুলার এবং বিভিন্ন ধরণের আরও কয়েকটি সার্কুলার থেকে জানা যায় যে, কতৃপক্ষ বিপদের আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু তবুও হিংসাত্মক কার্যকলাপ যখন শুরু হয় তখন তাঁরা এর প্রতিবিধানের জন্য কনিষ্ঠাঙ্গুলটি পর্যন্ত উঠালেন না।
পুনর্বাসন বিষয়ে শ্রী চ্যাটার্জি বলেন যে, কামরূপের ডেপুটি কমিশনার পুনর্বাসন সম্পর্কিত যাবতীয় সার্কুলারই ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করেননি। প্রথমদিকে যেসব নির্দেশ দেওয়া হয়, তার একটিতে বলা হয় যে, পুনর্বাসনের কাজ তত্ত্বাবধান করার জন্য সার্বক্ষণিক একজন অফিসার নিযুক্ত করতে হবে। কিন্তু এই নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেককেই পঞ্চাশ টাকা করে খয়রাতি সাহায্য দেওয়ার যে নির্দেশ ছিল-তাও পালিত হয়নি এবং ঋণের টাকাও কিছু কিছু করে কিস্তিতে দেওয়া হয়। কিন্তু ঋণের টাকা একসঙ্গে দেওয়া উচিত। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কর্তব্য।’১৪৩
ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থশংকর রায়
সিদ্ধার্থশংকর রায় কমিশনে সওয়াল-জবাবের শুরুতেই বলেন, গোরেশ্বরের হাঙ্গামা নিরোধ কিংবা দমনকল্পে কতৃপক্ষ যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন কি না, তা নির্ধারণকল্পে পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল থেকে শুরু করে তামুলপুর থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সাব-ইনস্পেকটর পর্যন্ত ১৮ জন পুলিশ কর্মচারীর আচরণ বিচার করে দেখতে হবে। তিনি বলেন, কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণের সময় যে বারোটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তাও বিবেচনা করে দেখতে হবে। শ্রীরায় বলেন, ‘আশীর্বাদ’ নামক পুস্তকটি আসামের শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের ‘আশীর্বাদ’ লাভ করেছে। কারণ তিনি স্কুলের ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক করার জন্য বইটি সুপারিশ করেছিলেন। শ্রীরায় বইটির অংশবিশেষ ইংরেজিতে অনুবাদ কমিশন সম্মুখে পাঠ করেন।
তিনি সাক্ষ্যপ্রমাণ উদ্ধৃত করে বলেন যে, ‘গোরেশ্বর অঞ্চলে বিপদের আশঙ্কা করে ৪ জুলাই প্রাতে রঙ্গিয়া সার্কেলের পুলিশ ইনস্পেকটর যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চিঠি প্রেরণ করেন, গৌহাটি কতৃপক্ষ তার প্রতি যথোচিত মনোযোগ দেননি। কামরূপের ডেপুটি কমিশনার একথা স্বীকার করেছেন যে, ওই গুরুত্বপূর্ণ দলিলের প্রতি মনোযোগ দিলে হয়তো গোরেশ্বরের শোচনীয় ঘটনাবলী নাও ঘটতে পারত।’১৪৪
এরপরই কমিশনের কাজ এদিনের মতো সমাপ্ত এবং পরদিন কমিশনের কাজ যথারীতি শুরু হয়। সেদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১। কমিশন সম্মুখে বক্তব্য পেশ করতে উঠে সিদ্ধার্থশংকর রায় বলেন যে, ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা সম্পর্কিত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একমাত্র এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় যে, এসব হাঙ্গামা পূর্বপরিকল্পিত। তিনি বলেন, ভারতীয় দন্ডবিধিতে বলা হয়েছে যে, কোনো বিষয় পূর্বপরিকল্পিত প্রমাণ করবার পক্ষে কার্য এবং আচরণ সংক্রান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণই যথেষ্ট বলে গণ্য করতে হবে। শ্রীরায় গতকাল কমিশনের কাছে অফিসারদের নাম উল্লেখ করেছিলেন। আজ তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করে তিনি বলেন যে, রঙ্গিয়া সার্কেলের পুলিশ এমনভাবে কাজ করেছেন যে, এরজন্য সমগ্র সার্কেলই নিন্দনীয় হয়েছে। তিনি বলেন, রঙ্গিয়া সার্কেলের পুলিশ ইনস্পেকটর এবং তামুলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী প্রধানত কর্তব্য কাজে অবহেলা করার অপরাধে দোষী। সরকারি কর্মচারীগণ যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে প্রমাণিত যে, সার্কেল ইনস্পেকটর হাঙ্গামা দমনের জন্য সময়মতো কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করেননি। সেই অবস্থায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর যা করা সম্ভব ছিল, তিনি তাও করেননি।
সাক্ষ্যপ্রমাণ ও কমিশনের সমক্ষে উপস্থাপিত দলিলপত্র বিশ্লেষণ করে শ্রীরায় দেখান যে, নিজের দুষ্কর্ম ঢাকবার জন্য সার্কেল ইনস্পেকটর সরকারি দলিলপত্র রদবদল করেছেন। তিনি একথাও বলেন যে, এক বিরাট মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে ৫/৬ জন সশস্ত্র লোকই যথেষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী হাঙ্গামা করতে উদ্যত জনতাকে থামাবার কোনো চেষ্টাই করেননি। তিনি বলেন, গোরেশ্বর অঞ্চলে হাঙ্গামার আশঙ্কা সম্পর্কে গৌহাটিতে যেসব সংবাদ সে সময় পাওয়া যায়, তার প্রতিও যথোচিত মনোযোগ দেওয়া হয়নি এবং উক্ত এলাকায় যে সকল অফিসারকে পাঠানো হয়, তাঁদেরকেও যথোচিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি। শ্রীরায় সদরের তদানীন্তন ডেপুটি পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন যে, তিনি ৪ জুলাই সন্ধ্যায় গোরেশ্বরের দাঙ্গাহাঙ্গামা সম্পর্কে যে-সংবাদ পান, তা যথাস্থানে প্রেরণ না করে গর্হিত কাজ করেছেন।
সিদ্ধার্থশংকর রায় বলেন: ‘৪ জুলাই রঙ্গিয়ায় প্রেরিত ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীহেম বরার আচরণ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। গোরেশ্বর অঞ্চলের দাঙ্গাহাঙ্গামা কোন ধরনের সে-সম্পর্কে তাঁর সম্যক ধারণা ছিল এবং তাঁকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। তথাপি তিনি সময়মতো সেনাবাহিনীর সহায়তা গ্রহণের ব্যবস্থা করেননি। প্রকৃত প্রস্তাবে গোরেশ্বর অঞ্চলের হাঙ্গামা রোধের জন্য কোনো সময়ই সেনাবাহিনী তলব করা হয়নি, বরং এই বাহিনীকে কয়েক মাইল দূরে নলবাড়িতে রিজার্ভ রাখা হয়।
শ্রীরায় পুলিশ ইনস্পেকটর জেনারেল এস এম দত্ত-এর আচরণ সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন যে, শ্রীদত্ত সার্কুলার জারি করা ছাড়া আর কিছু করেছেন বলে দেখা যাচ্ছে না। … শ্রীরায় কামরূপের ডেপুটি কমিশনারকে কর্তব্য কার্যে অবহেলা করার জন্য দায়ী করেন। তিনি বলেন, সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট যে, যদি যথাসময়ে ব্যবস্থা অবলম্বিত হত, তাহলে হাঙ্গামা রোধ করা সম্ভব ছিল।’১৪৫
সিদ্ধার্থশংকর রায় কমিশনে তৃতীয় বারের মতো জবাবি বক্তৃতা দিতে উঠে পুলিশ দাঙ্গা-হাঙ্গামা সম্পর্কিত মামলাগুলির তদন্ত করতে গিয়ে সেগুলিকে কেমন হালকাভাবে নেওয়া হয়েছে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরে বলেন: ‘গোরেশ্বরের হাঙ্গামা সংক্রান্ত ১৯২টি অভিযোগের তদন্ত করেছেন পুলিশ অফিসারগণ। এর মধ্যে ১৩৫টি মামলার ‘খতমি রিপোর্ট’ দাখিল করা হয়েছে। কেবল ৫টি মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। আর ৫২টি মামলা সম্পর্কে এখনও তদন্ত চলছে।
শ্রীরায় প্রমাণপত্র তুলে ধরে কমিশনে জানান যে, ‘এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত অনেক স্থানে হাঙ্গামার একমাস পরও সেখানে পুলিশ যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ দুষ্কৃতিকারীদের নাম বলা সত্ত্বেও তাদের অভিযুক্ত করা হয়নি। কারণ স্বরূপ তদন্তকারী অফিসারগণ বলেছেন, উক্ত ব্যক্তিগণ দাঙ্গাকারী জনতার মধ্যে থাকলেও হাতেকলমে আগুন লাগাতে কেউ তাদের দেখেননি।’
শ্রীরায় আরও বলেন যে, ‘দুষ্কৃতকারীদের অপরাধ প্রমাণের জন্য বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষাভাষী নিরপেক্ষ ব্যক্তিগণ সাক্ষ্যদানের জন্য এগিয়ে আসলেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। আবার কোনো কোনো তদন্তকারী অফিসার তাঁদের সাক্ষ্যে বলেছেন যে, তাঁদের উপরস্থ অফিসারদের নির্দেশমতো তাঁরা খতমি রিপোর্ট দাখিল করেছেন।’
শ্রীরায় এ পি জৈন-এর নেতৃত্বে পরিচালিত সংসদীয় প্রতিনিধিদলের মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, ‘প্রয়োজন হলে অন্য রাজ্য থেকে অফিসার আনাতে হবে।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘যে-সকল মামলায় খতমি রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে পুনরায় ওই সব মামলার দায়ের করা প্রয়োজন।’
সিদ্ধার্থশংকর রায় বলেন, ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা যে পূর্বপরিকল্পিত, তার সমর্থক বহু উপাদান কমিশন কতৃক গৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণের মধ্যেই রয়েছে। তিনি বলেন, দূর্বৃত্তরা বাস ও লরিতে ইতস্তত ঘুরে বেড়িয়েছে, গৃহদাহের জন্য পেট্রোল ব্যবহার করেছে এবং অগম্য সুদূর পল্লী অঞ্চলে কেবল বাংলাভাষীদের গৃহ খুঁজে বের করে তাতে আগুন দেওয়া হয়েছে। কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই এসব কাজের জন্য অর্থ সাহায্য করেছে। বহু মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত কয়েকটি অঞ্চলের দুষ্কার্যের নায়ক ছিল এই দূর্বৃত্তদল। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, এসব হাঙ্গামা পূর্বপরিকল্পিত।’
পুনর্বাসন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীরায় বলেন যে, ‘সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে কামরূপের ডেপুটি কমিশনার ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য দায়ী ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সরকারি নির্দেশের প্রতি অবজ্ঞায় প্রদর্শন করেছেন। সরকারি নির্দেশ পালনের চাইতে তা লঙ্ঘন করেই তার প্রতি বেশি সম্মান প্রদর্শিত হয়েছে। শ্রীরায় বলেন, গোরেশ্বর হাঙ্গামায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ কোনো অন্যায় না করেও দ্বিতীয় বার গৃহহীন হয়েছেন। কিন্তু এঁদের প্রতি পশুর অনুরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। যাদের ওপর পুনর্বাসনের ভার দেওয়া হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বিষয়ে আসাম কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মার মনোভাব থেকেই পুনর্বাসনের ভারপ্রাপ্তদের মনোভাব বুঝা যায়। যে সকল দুষ্কৃতকারী এখনও মুক্ত রয়েছে এবং যারা এখনও পর্যন্ত গোরেশ্বর অঞ্চলের লোকজনকে শাসাচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা তদন্ত কমিশন অবশ্যই করবেন বলে শ্রীরায় আশা প্রকাশ করেন। কারণ, উক্ত দুর্বৃত্তদের শাস্তি না হলে ক্ষতিগ্রস্তদের মনে নিরাপত্তার ভাব জাগবে না।
শ্রীরায় বলেন, গোরেশ্বর হাঙ্গামা সম্পর্কিত মামলাসমূহের বিচারার্থে যে সকল স্পেশাল কোর্ট গঠিত হবে, সেসব কোর্টের বিচারপতি বাংলা কিংবা অসমিয়া ভাষাভাষীদের মধ্য থেকে নেওয়া সঙ্গত হবে না। অবশ্য একথা বলার অর্থ এই নয় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলা কিংবা অসমিয়াভাষী কোনো বিচারপতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে সক্ষম হবেন না। তাঁর এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য এই যে, তিনি মনে করেন ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করাই কেবল কর্তব্য নয়, ন্যায়বিচার হচ্ছে বলে যাতে সাধারণ লোকেরও মনে হয়, সেই ব্যবস্থা করাও কর্তব্য।১৪৬
গোরেশ্বর নাগরিক সংঘের আইনজীবী বাহারুল ইসলাম-এর সওয়াল-জবাব
বাহারুল ইসলাম তদন্ত কমিশনে বলেন, ‘দাঙ্গার মূলকারণ দূর করতে না পারলে পুনরায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। তিনি বলেন, গোরেশ্বর অঞ্চলের পুলিশ সততার সঙ্গে তাঁদের কর্তব্য পালন করেননি। তিনি কমিশনে একথাও বলেন যে, দাঙ্গায় বিপন্নদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা সন্তোষজনক হয়নি এবং সরকারের নির্দেশ অমান্য করে কিস্তিবন্দি করে পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ করা টাকা দেওয়া হয়েছে।’১৪৭
স্বল্প পরিসরে বর্ণিত কতিপয় সাক্ষীর বয়ান এবং আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব থেকে ১৯৬০ সালের জুলাই মাসে গোরেশ্বর ও তার আশেপাশে সংঘটিত দাঙ্গাহাঙ্গামার মৌল বিষয়গুলি স্পষ্ট হয়েছে। এই হাঙ্গামা যে পূর্বপরিকল্পিত তা প্রমাণিত। দাঙ্গাহাঙ্গামা সংঘটনে আসামের সরকারি প্রশাসনের একাংশ, পুলিশবাহিনীর একটি অংশ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যোগসাজশ ছিল বলে মনে করার কারণ বর্তমান। দাঙ্গারোধে দুর্গত মানুষের পুনর্বাসনে আসাম সরকার যে পুরোপুরি ব্যর্থ তাও প্রমাণিত।
আসাম হাইকোর্টের বিচারপতি গোপালজি মেহরোত্রা কমিশন রিপোর্ট ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। মোটা দাগে বর্ণিত তথ্যেরই প্রতিধ্বনি করেছেন কমিশন, সত্য প্রকাশিত হয়েছে।
হাঙ্গামার স্বরূপ সন্ধান ও নেপথ্য ষড়যন্ত্র
কেন এই হাঙ্গামা? এর অন্তরালে কারা সক্রিয় ছিলেন? কেন এই তৎপরতা? রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা কী ছিল? কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ, না কি সমষ্টিগত? সরকারি প্রশাসনের ভূমিকা?— এসব প্রশ্ন উঠতে পারে, উঠেছেও, সমকালেই। মতামতও দিয়েছেন সেই ক্রান্তিকালে, জুলাই মাসে, ১৯৬০ সালে।
সংবাদমাধ্যম কোনো রাখঢাক না করে স্পষ্টতই সেদিন জানাল, ‘আসামের সন্ত্রাসের রাজত্বকালে কংগ্রেসি নেতারাও সমাজবিরোধীদের দুষ্কার্যে ইন্ধন যুগিয়েছেন। কংগ্রেসী-সহ বহু রাজনৈতিক নেতা কতৃপক্ষকে গৌহাটি থেকে কারফিউ তুলে নিতে বাধ্য করেছিলেন এবং কারফিউ প্রত্যাহৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অবাধে হিংসাত্মক কার্য শুরু হয়ে যায়। … অনুসন্ধান করলে এটাও দেখা যাবে যে, আসামের সবগুলি দলের তথাকথিত নেতারা অসমিয়া ভাষার দাবি নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন এবং তাদের সকলেই ছাত্রদের প্রকাশ্যে হিংসাত্মক কাজে প্ররোচনা দিয়েছিলেন। … আসামের রাজনৈতিক নেতাদের সকলেই এই বাঙালি উৎসাদনের জন্য দায়ী।
কলকাতার হত্যাকান্ডের পিছনেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। আসামের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডও এরূপ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আসামে অসমিয়ারাই সর্বেসর্বা হবে— এই উদ্দেশ্যের অন্তরায় হল আসামপ্রবাসী বাঙালিগণ। ভাষা প্রশ্নের অজুহাতে তাই বাঙালি উৎসাদনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারি পদস্থ কর্মচারীরাও সরকারি কর্তব্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে তাঁরা বিদ্বেষমূলক মনোভাবের বশবর্তী ছিলেন। সরকারি ও বেসরকারি সকলেই একটি বিষয়ে একতাবদ্ধ হয়েছেন এবং তা হল আসামে বাঙালিদের দমন করতে হবে।’১৪৮
জুলাই মাসে আসাম সফররত প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর কাছে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন রাখা হয়। প্রশ্ন না বলে বরং অভিযোগ বলাই সঙ্গত। অভিযোগগুলো গুরুতর সন্দেহ নেই। অভিযোগে বলা হল:
এক. ইহা কি সত্য যে, আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, মাদ্রাজের বর্তমান রাজ্যপাল শ্রীবিষ্ণুরাম মেধী কয়েক মাস পূর্বে আসামে আসিয়া কামরূপ, নওগাঁ ও গোয়ালপাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন এবং অসমীয়া নেতাদের লইয়া কতকগুলি বৈঠক করেন? সেই বৈঠকগুলির উদ্দেশ্য কী ছিল? রাজ্যপাল হিসেবে এই ধরণের রাজনৈতিক বৈঠকে যোগ দেওয়া কি শ্রীমেধীর পক্ষে সঙ্গত হইয়াছে?
দুই. ইহা কি সত্য যে, আসামে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের নেতা, আজীবন বাঙালিবিদ্বেষী প্রচারক ৭০ বৎসরের বৃদ্ধ শ্রীঅম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী এই হাঙ্গামার পূর্বে গৌহাটিস্থ দি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকা অফিসের সন্নিকটস্থ তাঁহার বাড়িতে উগ্রপন্থী বাঙালি বিদ্বেষী অসমীয়া নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রদের লইয়া ঘন ঘন গোপন বৈঠকে মিলিত হইয়াছিলেন? এইসব বৈঠকে কী কী আলোচনা হইয়াছিল?
তিন. অম্বিকাগিরির প্ররোচনায় দি আসাম ট্রিবিউন পত্রিকার বাঙালি সাংবাদিক ও কর্মীদের উপর আক্রমণের উদ্যোগ হইয়াছিল কি না? ইহা কি সত্য যে, আসাম ট্রিবিউন-এর সম্পাদক পূর্বাহ্নেই বাঙালি কর্মীদের সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন যে, তাঁহার পক্ষে বাঙালি কর্মীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নহে? তিনি কেন ইহা বলিয়াছিলেন?
চার…. শিলচরে গোলযোগ না হওয়া সত্ত্বেও কারফিউ জারি করিয়া কি প্রধানমন্ত্রীকে ইহা বোঝানো হইবে যে, কাছাড়ে বাঙালিরা অসমিয়াদের বিরুদ্ধে হাঙ্গামা করিয়াছে?
পাঁচ. প্রধানমন্ত্রীর আসাম যাত্রার সংবাদ পাইবার পর রাজ্যপাল শ্রীনাগেশ উপদ্রুত অঞ্চল সফর করেন। ইতিপূর্বে তিনি কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নাই কেন? আসামের মন্ত্রীগণ কি তাঁহাকে প্রকৃত ঘটনার বিবরণ জানিতে দেন নাই?১৪৯
আমরা আরও জেনেছি, … আসামের বর্তমান ঘটনাবলি এক দীর্ঘ, একটানা, ক্রূর ও গূঢ় চক্রান্তের পরিণতি। একদিকে দ্বিধাবিভক্ত ও আত্মকলহে মগ্ন আসাম কংগ্রেস, অন্যদিকে আসামের রাজ্যগত সমস্যা সম্পর্কে কমিউনিস্ট, পিএসপি, আরসিপিআই প্রভৃতি দলের অস্পষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন নীতি এবং সর্বোপরি জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অসমিয়া নেতৃবৃন্দের প্রায়শই ‘বঙ্গাল খেদাবই লাগে’-র আশ্রয়গ্রহণ এই শোচনীয় ঘটনাবলীর জন্য প্রধানত দায়ী।
আসাম মন্ত্রীসভা থেকে দেবেশ্বর শর্মার বিদায়গ্রহণে আসামের কংগ্রেস রাজনীতি পঙ্কিলতার নতুন গতি লাভ করে। শ্রীবিমলাপ্রসাদ চালিহাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে অপসারণের জন্য তিনি শুধু কংগ্রেসের মধ্যেই উপদল সৃষ্টি করে ক্ষান্ত হননি— কংগ্রেসবিরোধীদেরও ভাষা ও বেকারসমস্যার নামে মিলিত করার প্রয়াস পান।
১৯৬০ সালের প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু পান্ডুতে ব্রহ্মপুত্রের ওপর সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গেলে তাঁর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বলশেভিক পার্টির জনৈক প্রাক্তন সদস্যের নামে লেখা ওই স্মারকলিপিতে আসামের বেকারসমস্যার তীব্রতার এবং অসমিয়াকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ওই স্মারকলিপিই হল বাঙালি উৎসাদনের দ্বিতীয় স্তর।
একদিকে যেমন রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রেল কতৃপক্ষ নিশ্চেষ্ট, তেমনি অন্যদিকে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, পিএসপি ও আরসিপিআই নেতারা বাঙালিবিরোধী অভিযানে মুখর। জুন মাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শিবসাগর, তিনসুকিয়া, মরিয়ানি, শিমুলগুড়ি প্রভৃতি আরসিপিআই অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি ‘বাঙালির রক্ত চাই’, ‘বাঙালির মুন্ডু চাই’ পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ কাউকেই গ্রেফতার করেনি বা কোনো রাজনৈতিক নেতাও এই আত্মঘাতী পথের নিন্দা জানাননি। … আসামের আরসিপিআই-এর ক্যাডারবাহিনী এ সময় বাঙালিবিরোধী প্রচারপত্র ও পুস্তিকা রচনা ও প্রচারে ব্যস্ত। এদের সঙ্গে যোগ দেন অসমিয়া, কংগ্রেস, পিএসপি ও কমিউনিস্ট কর্মীরা।’১৫০
এ বিষয়ে আরও তথ্য আমাদের হাতে এসেছে যা চমকে দেবার মতো। নিরপেক্ষ জানিয়েছেন, … মে এবং জুন মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ফাইলে লিখিতভাবে রিপোর্ট পাওয়া যাবে, যে-রিপোর্টে এই আসন্ন বিপদের বার্তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সে-রিপোর্ট জুনের শেষ সপ্তাহে এবং জুলাইয়ের প্রথমভাগে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসঞ্জীব রেড্ডি যেকথা বলেছেন— আসামের এই হাঙ্গামা অতর্কিতে দেখা দিয়েছিল এবং গভর্নমেন্ট প্রথম কয়েক দিন স্বভাবতই অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিলেন, একথা সম্পূর্ণ অসত্য। কীভাবে আসামে নরহত্যা, হাঙ্গামা ও গৃহদাহের পর্ব প্রস্তুত করা হচ্ছে, কারা এই প্রস্তুতির পিছনে আছেন এবং সম্ভাব্য কোন সময়ে এই হাঙ্গামা প্রকাশ্যভাবে আরম্ভ হবে— এর কোনোটাই আসাম সরকারের অজ্ঞাত ছিল না এবং কেন্দ্রীয় সরকারেরও নয়। … প্রধানমন্ত্রীর যদি সৎসাহস থাকে, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আসাম সম্পর্কিত কাগজপত্র তিনি লোকচক্ষুর সম্মুখে উদঘাটন করুন। এই অভিযোগ বর্ণে বর্ণে সত্য প্রমাণিত হবে।১৫১
এই অভিযোগের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র কোনো প্রতিবাদ করেছেন— এমন তথ্য আমাদের চোখে পড়েনি। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের এই লুকোচুরিতে আমরা হতবাক, বিস্ময়ে বিমূঢ়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভি কে. কৃষ্ণমেনন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আসাম হাঙ্গামা সম্পর্কে যে-রিপোর্ট পেশ করেছিলেন—তাও ছিল পক্ষপাতদুষ্ট, দুরভিসন্ধিপূর্ণ।
প্রশাসনিক অফিসারদের ঈর্ষা এবং বাঙালি-বিদ্বেষ, ক্ষমতার অবাঞ্ছিত লোভ এবং খুদে অফিসারদের ঊর্ধ্বারোহণের চেষ্টা বর্তমান হাঙ্গামার পিছনে বড়ো রকমের ভূমিকা নিয়েছে। হাঙ্গামার পূর্বে কিছুকাল আসামের পুলিশ বিভাগের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন আইজিপি এস এম দত্ত। ফলশ্রুতিতে বেশ কিছু পুলিশ অফিসারের পদোন্নতি আটকে যায়, অনেককে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়। এসব কারণে পুলিশ বিভাগের মধ্যে থেকেও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা অন্তর্ঘাতমূলক কাজের প্রশ্রয় দিয়েছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরোক্ষে সহায়তাও করেছেন। এ বিষয়ও সত্য যে, পদচ্যুত মন্ত্রী দেবেশ্বর শর্মার মতো বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিও বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁর দপ্তর বহুপূর্বেই অবগত হয়েছিলেন।’১৫২
‘নিখিল ভারত ব্যক্তি স্বাধীনতা ইউনিয়ন’-এর প্রেসিডেন্ট আইনবিদ এন সি চ্যাটার্জিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু ১৬ জুলাই তারিখে লেখা এক চিঠিতে জানান, এই নিন্দনীয় ঘটনার নেতৃত্ব গ্রহণ করে পিএসপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক গ্রূপ। বহু কংগ্রেসি এই হাঙ্গামায় হয় যোগ দিয়েছিল, নয়তো দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছিল।১৫৩
আমাদের বিশ্বাস, এ সব তথ্যের মধ্য দিয়ে ঘটনার মূল বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে এবং প্রকৃত সত্যে পৌঁছানো যাবে।
তথ্যনির্দেশ
১. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, শিলচর, ১ জুন, ১৯৬০
২. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), বিধুভূষণ চৌধুরী সম্পাদিত, করিমগঞ্জ, ১০ জুন, ১৯৬০
৩. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৪ জুন, ১৯৬০
৪. The Assam Tribune, Gauhati, June 24, 1960
৫. যুগান্তর, কলকাতা, ২৬ জুন, ১৯৬০
৬. প্রাগুক্ত
৭. যুগান্তর, কলকাতা, ২৯ জুন, ১৯৬০ এবং জনশক্তি, শিলচর ২৯ জুন, ১৯৬০
৮. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ২৪ জুন, ১৯৬০
৯. যুগান্তর, কলকাতা, ২৬ জুন, ১৯৬০
১০. যুগান্তর, ২৯ জুন, ১৯৬০ এবং জনশক্তি, শিলচর, ২৯ জুন, ১৯৬০
১১. প্রাগুক্ত
১২. প্রাগুক্ত
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. প্রাগুক্ত
১৫. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ২৯ জুন, ১৯৬০
১৬. যুগান্তর, কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬০ এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১ জুলাই, ১৯৬০
১৭. The Assam Tribune, Gauhati, June 30, 1960
১৮. দৈনিক বসুমতী কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬০
১৯. The Assam Tribune, Gauhati, July 1, 1960
২০. স্বাধীনতা, কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬০.
২১. The Assam Tribune, Gauhati, July 2, 1960
২২. স্বাধীনতা, কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬০
২৩. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ জুলাই, ১৯৬০
২৪. স্বাধীনতা ও যুগান্তর, কলকাতা, ৪ জুলাই, ১৯৬০
২৫. স্বাধীনতা, কলকাতা, ৫ জুলাই ১৯৬০
২৬. The Assam Tribune, Gauhati, July 5, 1960
২৭. স্বাধীনতা, কলকাতা, ৫ জুলাই, ১৯৬০
২৮. যুগান্তর, কলকাতা, ৫ জুলাই, ১৯৬০
২৯. যুগান্তর এবং স্বাধীনতা, কলকাতা, ৬ জুলাই, ১৯৬০
৩০. যুগান্তর, কলকাতা, ৬ জুলাই, ১৯৬০
৩১. প্রাগুক্ত
৩২. যুগান্তর, কলকাতা, ৭ জুলাই, ১৯৬০
৩৩. প্রাগুক্ত
৩৪. যুগান্তর, কলকাতা, ৭ জুলাই, ১৯৬০
৩৫. প্রাগুক্ত
৩৬. প্রাগুক্ত
৩৭. প্রাগুক্ত
৩৮. প্রাগুক্ত
৩৯. প্রাগুক্ত
৪০. প্রাগুক্ত
৪১. প্রাগুক্ত
৪২. প্রাগুক্ত
৪৩. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ জুলাই, ১৯৬০
৪৪. প্রাগুক্ত
৪৫. প্রাগুক্ত
৪৬. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), বিধুভূষণ চৌধুরী সম্পাদিত, করিমগঞ্জ, ৮ জুলাই, ১৯৬০
৪৭. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ জুলাই, ১৯৬০
৪৮. প্রাগুক্ত
৪৯. প্রাগুক্ত
৫০. প্রাগুক্ত
৫১. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ জুলাই, ১৯৬০
৫২. প্রাগুক্ত
৫৩. প্রাগুক্ত
৫৪. যুগান্তর, কলকাতা, ১০ জুলাই, ১৯৬০
৫৫. যুগান্তর, কলকাতা, ১১ জুলাই, ১৯৬০
৫৬. যুগান্তর, কলকাতা, ১২ জুলাই, ১৯৬০
৫৭. প্রাগুক্ত
৫৮. যুগান্তর, কলকাতা, ১৩ জুলাই, ১৯৬০
৫৯. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ জুলাই, ১৯৬০
৬০. যুগান্তর, কলকাতা, ১৪ জুলাহ,B ১৯৬০
৬১. প্রাগুক্ত
৬২. প্রাগুক্ত
৬৩. যুগান্তর, কলকাতা, ১৫ জুলাই, ১৯৬০
৬৪. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ১৫ জুলাই, ১৯৬০
৬৫. প্রাগুক্ত
৬৬. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), নীরেন্দ্রনাথ দেব সম্পাদিত, শিলচর, ২০ জুলাই, ১৯৬০
৬৭. প্রাগুক্ত
৬৮. প্রাগুক্ত
৬৯. প্রাগুক্ত
৭০. প্রাগুক্ত
৭১. যুগান্তর, কলকাতা, ১৮জুলাই, ১৯৬০
৭২. জনশক্তি, শিলচর, ২০ জুলাই, ১৯৬০
৭৩. প্রাগুক্ত
৭৪. প্রাগুক্ত
৭৫. যুগান্তর, ১৮ জুলাই, ১৯৬০
৭৬. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ২৪ আগস্ট, ১৯৬০
৭৭. প্রাগুক্ত
৭৮. প্রাগুক্ত
৭৯. প্রাগুক্ত
৮০. প্রাগুক্ত
৮১. প্রাগুক্ত
৮২. জনশক্তি, শিলচর, ৩১ আগস্ট, ১৯৬০
৮৩. জনশক্তি, শিলচর, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৮৪. জনশক্তি, শিলচর, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৮৫. প্রাগুক্ত
৮৬. জনশক্তি, শিলচর, ২৯ নভেম্বর, ১৯৬০
৮৭. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক) করিমগঞ্জ, ১৫ জুলাই, ১৯৬০
৮৮. জনশক্তি, শিলচর, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৮৯. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ অক্টোবর, ১৯৬০
৯০. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ১৪ অক্টোবর, ১৯৬০
৯১. জনশক্তি, শিলচর, ২৬ অক্টোবর, ১৯৬০
৯২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ অক্টোবর, ১৯৬০
৯৩. The Assam Tribune, Gauhati, August 1, 1960
৯৪. প্রাগুক্ত
৯৫. যুগান্তর, কলকাতা, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৯৬. The Assam Tribune, Gauhati, September 2, 1960
৯৭. যুগান্তর, কলকাতা, ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
৯৮. The Assam Tribune, Gauhati, September 4, 1960
৯৯. যুগান্তর, কলকাতা, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
১০০. The Assam Tribune, Gauhati, September 8, 1960
১০১. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
১০২. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ জুলাই, ১৯৬০
১০৩. যুগান্তর, কলকাতা , ৮ জুলাই, ১৯৬০
১০৪. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১০ জুলাহ,B ১৯৬০
১০৫. প্রাগুক্ত
১০৬. প্রাগুক্ত
১০৭. যুগান্তর, কলকাতা, ১০ জুলাই, ১৯৬০
১০৮. প্রাগুক্ত
১০৯. যুগান্তর, কলকাতা, ১২ জুলাই, ১৯৬০
১১০. যুগান্তর, কলকাতা, ১৩ জুলাই, ১৯৬০
১১১. প্রাগুক্ত
১১২. যুগান্তর, কলকাতা, ১৭ জুলাই, ১৯৬০
১১৩. যুগান্তর, কলকাতা, ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
১১৪. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০
১১৫. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ৪ জানুয়ারি, ১৯৬১
১১৬. যুগান্তর, কলকাতা, ১২ জুলাই, ১৯৬০
১১৭. যুগান্তর, কলকাতা, ৭ জুলাই, ১৯৬০
১১৮. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ৮ জুলাই, ১৯৬০
১১৯. যুগান্তর, কলকাতা, ৯ জুলাই, ১৯৬০
১২০. যুগান্তর, কলকাতা, ১১ জুলাই, ১৯৬০
১২১. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১২ জুলাই, ১৯৬০
১২২. যুগান্তর, কলকাতা, ১৩ জুলাই, ১৯৬০
১২৩. যুগান্তর, কলকাতা, ২৫ জুলাই, ১৯৬০
১২৪. যুগান্তর, কলকাতা, ৪ আগস্ট, ১৯৬০
১২৫. যুগান্তর, কলকাতা, ৩১ অক্টোবর, ১৯৬০
১২৬. প্রাগুক্ত
১২৭. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১২৮. জনশক্তি (সাপ্তাহিক), শিলচর, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৬০
১২৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১২ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩২. প্রাগুক্ত
১৩৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৭ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৮ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩৬. প্রাগুক্ত
১৩৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৩৮. প্রাগুক্ত
১৩৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৬১
১৪০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১২ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৩ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪৪. প্রাগুক্ত
১৪৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৫ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৭ ফেব্রুয়ারি , ১৯৬১
১৪৮. যুগান্তর, কলকাতা, ১৮ জুলাই, ১৯৬০
১৪৯. প্রাগুক্ত
১৫০. যুগান্তর, কলকাতা, ২৭ জুলাই, ১৯৬০
১৫১. নিরপেক্ষ, ‘আসামের ঘটনায় কৃষ্ণমেনন ও শ্রীনাগেশের ভূমিকা’, যুগান্তর, কলকাতা, ২৫ জুলাই, ১৯৬০
১৫২. প্রাগুক্ত
১৫৩. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২৯ জুলাই, ১৯৬০