আলি কেনানের সম্প্রসারণশীল কল্পনা ঝর্ণাধারার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে করতে আরম্ভ করেছে। তার আকাঙ্খ অনেক। আপাততঃ সে গুটিকয় খুচরো কাজে মনোযোগ দিতে আরম্ভ করেছে। ফুলতলির বাঁধানো কবরের পাশে একতলা বাঁশের ঘরটি নাম মাত্র মূল্যে ভাড়া নিয়ে তাতে পার্টিশন লাগিয়ে একটা হুজরাখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। পার্টিশনের অপর পাশে কুকুর ছানাসহ ছেলেটি ঘুমোয়। এই সমস্ত কাজে খরচ করবার মতো টাকা আলি কেনানের হাতে আছে। উদ্যোগী মানুষকে সবাই সাহায্য করতে আসে। মহল্লার মানুষেরা ইতিমধ্যে নানা ব্যাপারে তার কাজে হাত লাগাতে ছুটে এসেছে। এলাকায় আলি কেনান আসার পর থেকে দৈনন্দিন জীবন যাপনের একঘেঁয়েমির মধ্যে একটা নতুন হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে ।
আলি কেনান নতুন ভাড়া করা ঘরটিতে অভ্যাগতদের বসবার সুবিধের জন্য হোগলার চাটাই পেতে রেখেছে। ননান মানুষ এখন তার কাছে আসে। তারা সেখানে এসে অপেক্ষা করে। সে আনুমানিক সকাল আটটা পর্যন্ত হুজরাখানার মধ্যে কাটায়। আবার সন্ধ্যেবেলাও ঘণ্টা খানেক সেখানে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থাকে। তখন সে তার নিজের মুখোমুখি হয়। একান্ত একাকিত্বের পরিমণ্ডলের মধ্যে নিজের শক্তি সামর্থ্য অনুভব করতে থাকে। আলি কেনানের এই জীবনের স্বাদটাই আলাদা। এখন সে আর কোনো সম্রাটের সঙ্গেও ওই জীবন বিনিময় করতে রাজি হবে না। স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, চারদিকে অবারিত স্বাধীনতা। নিজেকে তার সব কিছুর নিয়ন্তা বলে মনে হয়। যতো একাকী হয় ততোই অনুভব করে সে ঈশ্বরের মতো শক্তিমান। নানা জাতের মানুষ এসে হোগলার চাটাইতে বসে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করে। সংসারে রোগ শোক আছে। আছে আশা ভঙ্গের বেদনা। আল্লাহতায়ালা মাটি দিয়ে গড়েছেন মানুষ। আর সে মানুষ বড়ো দুর্বল। প্রতি মুহূর্তে কারো কাছ থেকে ভরসা আদায় করে তাকে বাঁচতে হয়। জীবন সংগ্রামে কাতর মানুষ কোথায় পাবে সর্বক্ষণ জীবনের বোঝা বইবার প্রেরণা। আলি কেনান স্বেচ্ছায় মরণশীল মানুষের বোঝা হাল্কা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাই মানুষ আলি কেনানের কাছে আসে।
কেউ এসে বলে, তার ছেলেটি বড়ো হয়েছে, কিন্তু এখনো বিছানায় প্রস্রাব করে। বাবার দোয়া চাই।
কেউ পেটের শুল বেদনার প্রতিকার প্রার্থনা করে।
কোনো মা চোখের জলে মিনতি জানায়, তার মেয়েটি অত্যন্ত অভাগী। তিন বছর স্বামীর ঘর করেছে, এখন স্বামী নিচ্ছে না। সহায়হীনা বিধবাকে ভরণ পোষণ জোগাতে হচ্ছে। বাবা যদি এর একটা বিহিত না করেন বিধবার দাঁড়াবার স্থান নেই।
আলি কেনান সকলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। কিন্তু তারপর তার মুখ দিয়ে অশ্লীল অশ্রাব্য গালাগালির তুবড়ি ছুটতে থাকে :
‘খানকি মাগি, শাউরের পো’ এই সব মধুর শব্দ তার মুখ দিয়ে অবলীলায় বেরিয়ে আসতে থাকে। একেক সময়ে তার বাহ্য জ্ঞান লোপ পাবার দশা হয়। তখন কারো পাছায় লাথি মারে। কাউকে চুল ধরে ওঠ বোস করায়। কোনো মহিলাকে একটা পাউরুটির টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে বলে,
নে মাগি এইড্যা খা। যে বালক বিছানায় প্রস্রাব করে তাকে একটা গ্লাসে ডান হাত ডুবিয়ে পানিটা মুখের কাছে ধরে বলে, নে বানচোত এই পানি খা। আবার বিছানায় মুতলে শালা লেওড়া কাইট্যা ফেলুম মনে রাখিস। বিচিত্র রকমের মানুষ আসে। আলি কেনান তাদের রোগ শোকের বিচিত্র বিধান দেয়।
সামান্য সময়ের মধ্যে চারপাশে গুজব রটে যায় যে, আলি কেনানের রোগ সারাবার আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে। খবর যতো ছড়ায়, ততো অধিক হারে মানুষ তার কাছে আসে। আগে তার কাছে বস্তির মানুষ, কাজের বেটি, রিকশাঅলা এই সব নিম্নশ্রেণীর মানুষ আসতো। এখন দ্রঘরের মানুষ, বিশেষ করে মেয়েছেলেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। এইসব মহিলা দেখলে তার খুব আনন্দ হয়। আবার পাশাপাশি ঘৃণার একটি কৃষ্ণ রেখাও সাপের মতো এঁকে এঁকে মনের মধ্যে জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে তার বলতে ইচ্ছে করে,
মাগিরা ব্যারাম সারাইবার কালে আলি কেনান আর মজা করার সময় অন্য মানুষ। এই সব রঙিন মাংসের পুতুল লাথি দিয়ে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। আলি কেনান নিজেকে নিজের ভেতর ধারণ করতে পারে না। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সে অধিকতরো অশ্লীল বাগধারা প্রয়োগ করতে থাকে। অর্থী প্রার্থীরা বিনা প্রতিবাদে তীক্ষ্ণ চোখা গালাগাল হজম করে। এমন কেউ থাকাও বিচিত্র নয় যে প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে এসব ভক্তিভরে শুনলে অর্ধেক রোগ নিরাময় হয়ে যাবে । একবার একজন জোয়ান মানুষ আলি কেনানের কানে কানে স্ত্রীর বিশ্বাসভংগের অভিযোগ করে। আলি কেনান হুঙ্কার দিয়ে বলে, শালা তর হাতিয়ারে জোর নাই। কবিলা তরে কেয়ার করবো কেরে? হের হাউস নাই? পুরুষের ছ গুণ। মাইয়া মানুষের ন গুণ। এই রকম নানা কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ গরম দরবেশ হিসেবে আলি কেনানের নাম ফেটে যায়।
আলি কেনানের কাণ্ড জ্ঞানটি ভীষণ ধারালো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সে অনুভব করে, চারদিকে তার প্রভাব যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত কর্মকাণ্ড একটা শক্ত ব্যবস্থাপনার মধ্যে বাঁধতে না পারলে যে কোনো মুহূর্তে চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। পাছায় লাথি মারা, ডান হাত ডুবিয়ে পানি পড়া এসব করে অধিকদূর যাওয়া সম্ভব নয়। ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত রুচির মানুষেরা তার কাছে আসতে আরম্ভ করেছে। তাদের চাহিদা, পছন্দ এবং রুচি মোতাবেক অনেক কিছু পাল্টাতে হবে। সে বেশ কিছুদিন মাথা খেলিয়ে একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলো। নিজের ভাবনার চমৎকারিত্বে আলি কেনান নিজেই চমকে ওঠে।
ফুলতলিতে একটা মসজিদ আছে। দুতিন জন মানুষ মাত্র নিয়মিত নামাজ কালাম পড়ে। একমাত্র শুক্রবারেই মসজিদে অল্পস্বল্প লোক সমাগম হয়। ফুলতলি গরিব মহল্লা, তাই মসজিদটিও গরিব । নিয়মিত আজান প্রচারের জন্য এক জোড়া মাইক লাগানোর সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন মুয়াজ্জিন সাহেব পাখির ডাকের মতো চিহি স্বরে, পাঁচবেলা আযান ধ্বনি উচ্চারণ করেন। সে আওয়াজ মুয়াজ্জিন সাহেব নিজের কানে শুনতে পান কিনা সন্দেহ আছে। মুয়াজ্জিন সাহেব শুকনা পাতলা মানুষ। তার গলার আওয়াজটিও অতিশয় ক্ষীণ। শুক্রবারে জুমার নামাজে ইমামতি করার দায়িত্বও তার। সে হিসেব করলো,
তাকে মুয়াজ্জিন সাহেব না বলে ইমাম সাহেব বলাই সঙ্গত। শুক্রবারে মহল্লার সর্দার সাহেব নিজে জুমার নামাজ আদায় করতে আসেন। কোনো কারণে সর্দার সাহেবের আসা বিলম্বিত হলে তার জন্য সমস্ত মুসল্লিকে অপেক্ষা করতে হয়। সর্দার সাহেবের পূর্বপুরুষেরা এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। সে কারণে সর্দার সাহেব নিজেই মসজিদের মোতওয়াল্লি। তাঁর অহংকারের অন্ত নেই। কিন্তু ইমাম সাহেবকে মাইনেটা ঠিকমতো দিয়ে উঠতে পারেন না। মাঝে মাঝে পাঁচ সাত মাস বাকি পড়ে থাকে। দেশের বাড়িতে ইমাম সাহেবের বিবি এবং বাল-বাচ্চারা আছে। তাদের দিন যে কেমন করে কাটে একমাত্র ইমাম সাহেবই বলতে পারেন। তিনি সব সময়ে আল্লাহর শোকর গুজার করেন। মাইনের কথা উঠালেই সর্দার সাহেব তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এনিয়ে তাকে কখনো উচ্চ বাচ্য করতে দেখা যায়নি। এই মসজিদের চাকুরি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা তার মনে স্বপ্নেও উদয় হয়নি। অথচ ইমাম সাহেব সিকি মাওলানা কিংবা আধা মাওলানা নন। তিনি হাম্মাদিয়া ওহাবী মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাশ করেছেন। একেবারে পাক্কা সার্টিফিকেট আছে।
আলি কেনানের মাথায় খেলে গেলো মসজিদের ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটা ব্যবস্থায় আসতে পারলে তার লাভ এবং ইমাম সাহেবেরও লাভ। আলি কেনান আরবী ফাঁসির বিন্দু বিসর্গ জানে না। তাবিজ কবজ না দিলে আর চলছে না। তা ছাড়া শরিয়তের বিষয়ে সে একেবারে অজ্ঞ। এই পেশায় যখন চলে এসেছে, কখন কি ঘাপলা লাগে বলা তো যায় না। সুতরাং এরকম একজন মানুষ হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ভালো। বিপদে আপদে কাজে আসতে পারে।
আলি কেনান তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে অনুভব করতে পারে, নিয়মিত খেতে না পেরে তার চেহারা এমন শুঁটকি হয়ে আছে। মাস কাবারি টাকা দিলে আরবীতে তাবিজ-কবজ লিখে দেরে এটা সে ধারণাই করে নিয়েছিলো। তবু মনে একটা খটকা ছিলো। এই জাতের মানুষ মিনমিনে হলেও অহংকারী হয়। তাই প্রস্তাবটা সরাসরি পাঠায়নি। তার বদলে এক সন্ধ্যেয় মিলাদ পড়ার দাওয়াত করলো।
ইমাম সাহেব প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন, কিনা মনে মনে দোটানায় ছিলেন। তিনি লোকমুখে শুনেছেন আলি কেনান অনেক শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবার করে। নিজের চোখেও দেখেছেন। ইমাম সাহেব নিজে ওহাবী তরিকার মানুষ। কবর নিয়ে হৈ চৈ এসব মোটেও পছন্দ করেন না। তার যদি ক্ষমতা থাকতো এবং মহল্লার মানুষের সমর্থন পাওয়া যেতো, তাহলে কবে আলি কেনানকে ফুলতলি ছাড়া করতেন। পাঁচ মাস কাজ করে এক মাসের মাইনে পাননা যেখানে-সেখানে ধর্ম কাজ করার উৎসাহ আপনা থেকেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাই প্রতি শুক্রবার আলি কেনানের শরা, শরিয়ত বিরোধী কাজ কারবারের কথা তুলবেন, তুলবেন মনে করেও তুলতে পারেননি। তার মনেও একটা শংকা ছিলো। আলি কেনান অল্প দিনের মধ্যে ফুলতলি এলাকার সামাজিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তার ওখানে প্রতি বৃহস্পতিবার গান বাজনা হয়। ওতে মহল্লার অনেক তরুণ যোগ দিতে আরম্ভ কওেছে। সর্দার সাহেবের বড়ো ছেলে এসব ব্যাপারে আলি কেনানের ডানহাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইমাম সাহেব লোকমুখে শুনেছেন স্বয়ং সর্দার সাহেব নাকি একবার গোটা রাত ওখানে গান বাজনা শুনেছেন। আলি কেনান মানুষটাকে ইমাম সাহেব মনে মনে ঘৃণা এবং ঈর্ষা করেন। ঘৃণা করেন এ কারণে যে তার মধ্যে একটা শয়তানি শক্তি আছে। এরই মধ্যে ফুলতলির অনেক তরুণ তার খপ্পরে পড়তে আরম্ভ করেছে। আলি কেনান তাদের শরিয়ত বিরোধী কাজে উৎসাহ যোগায়। ইমাম সাহেব দশ বছর ধরে এই মহল্লায় বসবাস করছেন। নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হলে তিনি আজান দেন। মৃত্যু হলে জানাজা পড়ান। এমনকি মৃত্যুর পূর্বে তিনি ফুলতলির নরনারীদের জীবনের শেষ তওবাও পাঠ করান। ভাগ্যের কি পরিহাস ইমাম সাহেবকে কেউ গেরাহ্যের মধ্যে আনে না। ছোটো বাচ্চারাও তাকে নিয়ে নানা তামাশা করে। অথচ এই আলি কেনান কদিন হলো এসেছে, বড়ো জোর ছ মাস । মহল্লার মানুষদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই ইমাম সাহেব আলি কেনানকে ঈর্ষা না করে পারেন না।
ইমাম সাহেব জ্ঞানতঃ ঈর্ষা করতে চান না। কিন্তু আল্লাহ তো তাকে মার্টির মানুষ করে পয়দা করেছেন। তবু ইমাম সাহেবের কোনো আফসোস নেই। খোদ রসুল করিমই তো বলে গিয়েছেন, আখেরি জামানায় ফেতনা এবং গোমরাহির শক্তি সতুর গুণ বেড়ে যাবে। এসবই ছিলো আলি কেনানের মিলাদের দাওয়াত গ্রহণ করবার দ্বিধা দ্বন্দ্বের আসল কারণ। সরাসরি দাওয়াত কবুল না করতেও তার মন চাইছিলো না। আলি কেনান দাওয়াতের সঙ্গে নগদ পঞ্চাশটি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আস্ত একটি গরু পাওয়া যেতো। ঐ তুচ্ছ টাকাকটিই গোল বাধালো । ইমাম সাহেব গোটা মাসে আজান দিয়ে এবং শুক্রবারে ইমামতি করে মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকা পান। কোনো কোনো সময় পঁয়ত্রিশ মাস অপেক্ষা করেও টাকাটা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। ইমাম সাহেব চিন্তা করলেন,
আমি এই পঞ্চাশটি টাকা ছাড়ি কেনো? যদি ছেড়েও দেই তা হলো আমার কি লাভ? এখন লোকে পাঁচ সাত টাকা পেলে মিলাদ পড়ে। হাতে হাতে পঞ্চাশ টাকা পাওয়া গেলে বায়তুল মোকাররমের ইমাম সাহেবও চলে আসতে পারেন। তিনি আরো ভাবলেন, আমি তো আল্লাহর নামে হেদায়েত করবো। ওতে তো দোষের কিছু নেই। গোমরাহির পথে কেউ গেলে তাকে তো আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনাও নায়েবে রসুলদের একটা দায়িত্ব। অতএব ইমাম সাহেব দাওয়াত কবুল করলেন। ইমাম সাহেব মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন, তিনি শরিয়ত বিরোধী কাজ কর্মের কঠোর নিন্দা করবেন। আলি কেনানের নাম নেবেন না। তবু আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে ছাড়বেন না, আলি কেনানই এলাকায় যুবকদের কুপথে যাওয়ার ইন্ধন জোগাচ্ছে। কিন্তু সেদিন এশার নামাজের পর মিলাদ পড়তে এসে কোনো কথাই তিনি মুখ থেকে বের করলেন না। আলি কেনানের প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে একটা চড়ই পাখি বলে মনে হতে লাগলো। তাই তিনি শরিয়ত খেলাপ, কবর আজাব ওসবের ধার দিয়েও গেলেন না। কেবল কোরান তেলাওয়াত করলেন এবং দরুদ শরীফ পড়লেন। তারপর মোনাজাত করে ফেললেন।
নামাজ শেষ হয়ে গেলে আলি কেনান স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ফুলতলির সমবেত মানুষদের কাছে জানতে চাইলো,
এ্যাই তরা ইমাম সাবরে চিনোস।
অনেকে মাথা ঝুলিয়ে বললো,
হ্যাঁ তারা ইমাম সাহেবকে চিনে বটে। তিনি মসজিদে পচবেলা আজান দেন, শুক্রবার ইমামতি করেন এবং কেউ কখনো মারা গেলে জানাজার নামাজ পড়ান। এবার আলি কেনান ভীষণ রেগে গেলো।
শালা তরা বলদ ছিলি আর সারা জীবন বলদই থাকবি। খাঁটি মানুষ চেনার তাকতনি আল্লাহ তগো দিছে। বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে খোয়াবে দ্যাহা দিয়া কইছেন,
তুই ইমাম সাবরে ডাইক্যা মিলাদ পড়া। হের লাইগ্যা মিলাদ পড়াইলাম। আমার কারবার দেল কোরান লইয়া। পাতা কোরান ভাইজ্যা যারা খায়, হেগোরে আমি ধর্মের দারোগা-পুলিশ মনে করি। কিন্তু বাবাজান বু আলি কলন্দর আমারে কইছেন,
ইমাম সাহেবের দিলে আল্লাহর খাঁটি নূর আছে। আলি কেনানের কথা শুনে মহল্লার সমস্ত মানুষ ইমাম সাহেবের দিকে তাকায়। তাদের কেউ কেউ ইমাম সাহেবের চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডলে অন্তরের জ্যোতির প্রতিফলন দেখতে পায় ।
আলি কেনানের প্রতি ইমাম সাহেবের রাগ বিদ্বেষ তো রইলোই না বরং তাকে আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত উঁচু মর্যাদার একজন বুজর্গ ব্যক্তি বলে ধরে নিলেন। এতোদিন তিনি অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ধর্মের পথে চলে আসছেন।
ইমাম সাহেব জীবনে কখনো আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কাল রাখতে ভুল করেননি। দুবেলা আহার জুটুক বা না জুটুক তিনি ফুলতলির মানুষদের হেদায়েত করে আসছেন। কিন্তু ফুলতলির মানুষ তাকে অবহেলা এবং অবজ্ঞার অধিক কিছু দিয়েছে। তার তো সে কথা মনে পড়ে না। আজ আলি কেনানের মুখে তার যে একটা নতুন পরিচয় ফুলতলির মানুষদের কাছে প্রচারিত হলো, কুদরতী ইলাহির এটাও একটা দৃষ্টান্ত বটে। তিনি মনে করলেন,
ওহাবী তরিকার মানুষ হওয়ায় মারেফাতকে এতোকাল কোনো দাম দেননি। আলি কেনানকে তিনি মন্দলোক ভেবে আসছিলেন, এটাও তার মনের একটা সংস্কার মাত্র। অন্তরে মারেফতি এলেমের পবিত্র জ্যোতি না থাকলে আলি কেনান তাঁকে এমনভাবে চিনলেন কি করে! অতএব মাসিক পঞ্চাশ টাকা মাইনেয় আলি কেনানের আস্তানায় তাবিজ লেখার কাজটি কবুল করতে তার কোনো আপত্তি হলো না। বরঞ্চ এটাকে আল্লাহতালার বিশেষ রহমত বলে ধরে নিলেন।
আলি কেনান চারদিক থেকে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। ফুলতলির সর্দার সাহেব এখন তার আস্তানায় নিত্য যাতায়াত করেন। ইমাম সাহেব এককোণায় বসে জল চৌকির ওপর কাগজ রেখে ডানদিক থেকে গুটি গুটি হরফে সুরা আয়াত লিখে লাল সুতো দিয়ে পেঁচিয়ে তাবিজ বানিয়ে রাখেন। আলি কেনান সে সব তাবিজ মক্কেলদের দিয়ে বলে, গলায় ঝুলিয়ে রাখবি। অবস্থা ভেদে তামা কিংবা পিতলের খোল ব্যবহার করতে বলে। বিবাহিত পুরুষ মানুষ হলে বিধান দেয়, বিবির সঙ্গে সহবাস করার সময় খুলে রাখবি। মেয়ে মানুষদের বলে, হায়েজ নেফাজের সময় খুলে পানিতে ভিজিয়ে রাখবি। গোছল করে পাক পবিত্র না হয়ে পরবিনে। তাহলে ক্ষেতি হবে।
আজকাল আলি কেনান দু চারটে আরবী শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছে। ইমাম সাহেবের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার পর কিছু কিছু আরবী বুলি তার কণ্ঠে আপনা আপনি উঠে আসছে। একথা সে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে তার ভেতরে ইমাম সাহেবের প্রভাব ক্রিয়া করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার সাধ হয় গভর্ণর সাহেবকে ডেকে বর্তমান অবস্থাটা দেখায়। সেটি তো আর সম্ভব নয়! কখনো কখনো ভোলার কথা মনে পড়ে। তখন তার প্রাণটা ছাত করে উঠে। কি জানি কেমন আছে তার বুড়ো বাপ বুড়ো মা। বাঘের মতো ছয় ছয়টি ভাই, তারা কোথায় কি অবস্থায় আছে? হয়তো তারা জেল খানায় ঘানি টানছে। কিন্তু কি করতে পারে আলি কেনান? নতুন করে জীবন নির্মাণ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে সে বাঁধা পড়ে গেছে। ছেড়ে দিয়ে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে এখন সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। আলি কেনানের একদল নতুন ভক্ত জুটেছে। তারা তার মতো লাল সালুর লুঙ্গি এবং আজানুলম্বিত আলখেল্লা পরে। গলায় বড়ো বড়ো কাঠের মালা ঝোলায় এবং বগলের পাশে দিয়ে পেঁচিয়ে লোহার শিকল কোমর অবধি দোলায়। আলি কেনান এই ভক্ত সম্প্রদায়কে তার কল্পনার সন্তান মনে করে। অবশ্য ভক্তদের অতীত নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা চালু আছে। মোট সাতজনের মধ্যে দুজন জেল খাটা দাগী আসামী। একজন সমকামী। একজন সংসারে পোড় খাওয়া একেবারে হতাশ মানুষ। সর্বক্ষেত্রে মার খেয়ে আলি কেনানের আস্তানায় মুখ্যত দুবেলা অন্ন সংস্থানের জন্যই পড়ে আছে। বাকি দুটি ফুলতলিরই অল্প বয়স্ক কিশোর। তাদের মা বাবা আছে, আছে ঘরবাড়ি। সংসারের কোনো জটিলতা তাদের জীবন স্পর্শ করেনি। তারা আস্তানায় এসেছে লোকে সচরাচর পায়না, পাওয়া যায় না তেমনি অলৌকিক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।
এই সাত জনের দলটি নিয়ে আলি কেনান শুক্রবার দিন খুব সকাল বেলা বেরিয়ে পড়ে। কুকুর ছানাটির তাদের সঙ্গে যায়। রাস্তা দিয়ে গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে বিচিত্র পোশাক পরে মিছিল করে যাওয়ার সময় শহরের মানুষ তাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। তারা গান গায় :
তোমরা দেইখাছো কোথায়?
শুকনা ডালে জবা ফুলে
ভ্রমর মধু খায়।
পরান পদ্মের গহীন তলে
মধুর রসের ধারা
সেইখানেতে শুরুরে ভাই
মারেফাতের পাড়া।…
ফুলতলি পেরিয়ে বাংলা বাজার রোড ধরে এ রাস্তা সে রাস্তা অতিক্রম করে আস্ত মিছিলটি হাইকোর্টে এসে থামে। হাইকোর্টের মাজার জমজমাট থাকে। এই মাজারের আভিজাত্য আছে। এখানে অনেক লোক আসে গাড়িতে চড়ে। তারা দান খয়রাতও করে। সে জন্য অন্য মাজারের তুলনায় এখানে গরিব গোরবা ফকির ফোকরার ভীড় বেশি। মাজারে আলি কেনানেরা অনেকক্ষণ গান বাজনা করে। তাদের গান মানুষের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করে। দলের দুজনের কণ্ঠ খুব মিষ্টি। আলি কেনান বেছে বেছে সেসব গানই নির্বাচন করে, যেগুলো মানুষের অনুভব শক্তিকে ধাক্কা দিতে পারে। লোকজন চারপাশে ভীড় করে। গান বাজনার পর বাবার মাজার সালাম করে। দুপুর গড়িয়ে গেলে আবার পথে নামে।
এভাবে হেঁটে হেঁটে তারা নিমবাগান অবধি আসে। নিমবাগানের মাজারটিতে ঢুকে বোঁচকা বুচকি খুলে কিছু খেয়ে নেয়। খাওয়া দাওয়ার পাঠ সারা হলে আমগাছটির ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে এবং গাঁজা টানে। তখন আলি কেনানের মনে জগৎ জীবনের নানা রহস্য ভীড় করতে থাকে।
এই জগৎ কি? এখানে এলাম কেননা এবং যাবো কোথায়? এই সমস্ত সূক্ষ বিষয়ও তার মনে ছায়া ফেলে। যাহোক বিশ্রাম পর্ব শেষ হলে শেষ গন্তব্য স্থল মিরপুরের শাহ আলি বাবার মাজারের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
শাহ আলি বাবার মাজারে আলি কেনানের অসীম প্রতিপত্তি। তার কারণ অন্য কিছু নয় তার দলটির গান। আলি কেনানের দলটি বাস্তবিকই সুন্দর গায়। গানের তো নিজস্ব ক্ষমতা আছে। হিন্দুরা গানকে স্বয়ং ভগবান মনে করে। বাংলাদেশের এতো পীরফকির বুজর্গের মাজার, ভক্তবৃন্দদের গানের শক্তিতেই তার বেশির ভাগ টিকে আছে। গানের রস না থাকলে মাজারগুলো মরুভূমি হয়ে যেতো। সেখানে মানুষ যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখা দিতো না। প্রতি শুক্রবারে বাবার মাজারে গান বাজনার আসর বসে। আলি কেনানের দলের মধ্যে জেলফেরত একজন দাগী আসামী এবং ফুলতলির কিশোরদের একজন, তারা বেবাক পরিবেশ ভাপিয়ে তোলে কণ্ঠের উত্তাপে। জেলফেরত লোকটির নাম কালাম। তার গলাটি একটু ভারী। আর অন্যদিকে কিশোরটির কণ্ঠস্বর বাঁশির মতো। আলি কেনানের দল বেছে বেছে সে সকল গানই গায় যেগুলো মানুষকে কাঁদায়, ভাবায় এবং চিন্তার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। আলি কেনান কান পাকা মানুষ। দূর দূরান্তে যেখানেই ভাল গান শুনতে পায় কথাগুলো যত্নসহকারে কপি করে নিয়ে আসে। আল্লাহ আলি কেনানকে অনেক দিয়েছে। তবু আল্লাহর বিরুদ্ধে তার একটি নালিশ আছে। আল্লাহ তাকে গানের গলাটি দেননি।
আলি কেনানের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। মাজারে ঘুরে ঘুরে নানা কিসিমের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটতে থাকে। ওদের কেউ স্বভাব ভিখিরি। কেউ মস্তান, লুচ্চা, বদমায়েশ সব ধরনের মানুষই মাজারে থাকে। মাজারে অবস্থান করে এমন দু তিনটা জাত খানকির সঙ্গেও তার চেনাজানা হয়েছে। এখানে সংসার বিরাগি স্বর্গ পাগল মানুষ সে দেখেছে। দেখেছে ধর্মপ্রাণ মানুষ। ধর্মকর্মের ধার ধারে না মেয়ে মানুষ নিয়ে অবৈধ ব্যবসা চালায়, তেমন মানুষও মাজারে থাকে। কেউ আপত্তি করে না। অন্ধ নুলা বোবা খঞ্জ পাপীতাপী সকলকে মাজার সমান মেহে আদরে লালন করে। মাজারের ছায়া অনেক দূর প্রসারিত। এখানে সবাই আশ্রয় পায়।
পয়লা দেখলে মনে হতে পারে মাজারে যে সকল মানুষ দেখা যায় তারা জন্মের পর থেকেই এখানে বসবাস করছে। কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে মাজারে বসবাস করে একথা সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি আরেক দল মানুষ আছে যারা ভাসমান। এক মাজার থেকে অন্য মাজারে ছুটে ছুটে বেড়ায়। যে মেয়েটি বট গাছের ছায়ায় রেহেলে একটি কোরান শরীফ খুলে বসে থাকতো, দেখা গেলো একদিন হঠাৎ সে উধাও। হয়তো চট্টগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী কিংবা আমানত শাহের মাজারে একই ভাবে রেহেলে কোরান নিয়ে বসে রয়েছে চুপচাপ। চুপচাপ বসে আছে এ কারণে যে সে কোরান পড়তে জানে না। হয়তো একমাস কি দুমাস পর আবার মিরপুরের মাজারে হাজির হলো। অনেক তরতাজা, কারণ গায়ে নতুন হাওয়া লেগেছে। কেউ যদি জিগগেস করে, কই গেছিলি ফাতেমা খাতুন? ফাতেমা খাতুন ফোকলা দাঁতে হেসে জবাব দেবে, মুই গিছিলাম বাজী মস্তান (বায়েজিদ বোস্তামী)। যে অন্ধটির চোটপাটে প্রতিদিন মিরপুর মাজারে শায়িত বাবার ঘুম ভেঙে যাবার দশা হয় এক সকালে দেখা গেলো সেও নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি। পনেরোদিন বাদে দেখা গেলো সিলেটে শাহজালাল বাবার মাজারে মনের সুখে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।
মাজারে যারা থাকে, তাদের সকলের না হলেও অনেকেরই, আলাদা একটি ভূগোল থাকে। মিরপুরের মাজার থেকে মানুষ খুলনায় খানজাহান আলীর মাজারে যায়, সেখান থেকেও মানুষ আসে রাজশাহীর শাহ মখদুমের মাজারে। আবার শাহ মখদুমের মাজার থেকে মানুষ আসে হয়তো চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডার। কেননা যে তারা মাজারে মাজারে ঘুরাফেরা করে তা নিজেরাও বলতে পারে না। এটা একটা নেশার মতো। যাকে একবার পেয়েছে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকতে দেবে না। এই নেশা যাদের মনে অপেক্ষাকৃত গাঢ় তারা দেশের সীমানা অতিক্রম করে চলে যায় দূরে আরো দূরে। দিনে রাতে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে বলে,
আল্লাহ নিজামুদ্দিন আউলিয়া, বখতিয়ার কাকির মাজার জিয়ারত করার সুযোগ দেও। এমনও মানুষ আছে যারা একবেলা খেয়ে পয়সা জমায় হিন্দুস্থানের সুলতান খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর রওজা শরীফ জেয়ারত করার জন্য।
আলি কেনানের প্রখর কাণ্ডজ্ঞান তাকে মাজারের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থাপনার দিকটির প্রতি অধিক মনোযোগী করে তুলেছে। এই জিনিসগুলো সে অতি সহজে বুঝতে পারে। মাজারের অনেক কিছু সে বুঝে না, বুঝতে চায় না। এক একটি মাজার বছরে লক্ষ লক্ষ টাকায় নিলাম হয়। হাট বাজার ঘাটের মতো। যে সর্বোচ্চ অর্থ প্রদান করতে পারে সে বছরের সমস্ত টাকা পয়সা আদায় করার দায়িত্ব পেয়ে যায়। এদিক দিয়ে দেখলে একেকটা মাজার অন্য দশটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাইতে আলাদা নয়। তফাৎ শুধু এটুকু যে অন্য ব্যবসায়ে মূলধন মারা যাওয়ার ঝুঁকি আছে, মাজার ব্যবসায়ে তা নেই। মাজারে মানুষ আসবেই। মানুষ আসবে কারণ সে দুর্বল অসহায় এবং উচ্চাকাঙ্খী।
সারা দিন মাজারের দান বাক্সে যতো টাকা পড়ে, সন্ধ্যেবেলা সে টাকা নিলামকার মহাজনের বাড়িতে চলে যায়। যতো লোক রক্ষণাবেক্ষণে থাকে সব মাইনে করা কর্মচারী। জিলিপি, রসগোল্লা, আগরবাতি, মোমবাতি, গোলাপজল যতো মাজারে আসে সব পিছনের দরজা দিয়ে ঘুরে আবার দোকানে চলে যায়। একেক দিনের মধ্যে এক সের মিষ্টি যে কতোবার কেনা বেচা হয় কেউ হিসেব রাখতে পারে না। কেবল বিক্রির অর্থটাই জমা হয় মহাজনের সিন্দুকে। প্রতিটি মাজার নিজের নিয়ম কানুনে চলে। এখানে সরকারের আইন বিশেষ কাজ করে না। গাঁজা, চরস, সিদ্ধি এসব অবাধে কেনাবেচা হয়। পুলিশের খপ্পরে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। সে কারণে তাদের নিলামকারকে চড়াহারে কমিশন দিতে হয়।
আলি কেনান দেখেছে মাজারে শায়িত মহাপুরুষদের বংশধরদের মধ্যে মাজারের দখল নেয়ার জন্য কি তীব্র প্রতিযোগিতা। এক শরিকের মুরিদ আরেক শরিককে বাগিয়ে নিতে কোনো রকমের বিবেক দংশন অনুভব করে না। খুন জখম হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। মামলা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। বছরের পর বছর চলতে থাকে। এই সমস্ত কাহিনী মানুষ জানে, তবু তারা মাজারে আসে। স্বর্গবাসী পুরুষের মুক্ত চেতনার সঙ্গে পৃথিবীর শকুনিদের লোভ লালসা এক করে না দেখার আশ্চর্য ক্ষমতা মানুষের আছে। তাই তারা মাজারে আসে।
গভর্ণর হাউজে থাকার সময় আলি কেনান খুব নিকট থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছে। এই লাইনে আসার পর থেকে তার মনে হতে থাকে ওইখানে এই মাজারে সেই দ্বন্দ্বটি কম নয়। তবে সূক্ষ এবং ঘেরাটোপের আড়ালে ঢাকা থাকে।
শাহ আলী বাবার মাজারে আলি কেনান প্রতি শুক্রবার দলবল নিয়ে গান বাজনা করতো। সঙ্গীতের একটা নিজস্ব দাহিকা শক্তি আছে। যারা শুনে বাহবা দেয়, তাদের যেমন সংসার যন্ত্রণা ভুলিয়ে রাখে, তেমনি যারা গায়, বাজায় তাদেরও সব ভুলতে বাধ্য করে। আলি কেনান নিজেকে এই সম্মোহন থেকে মুক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতো। কিন্তু সফল হতে পারেনি। তার জীবনের এটা একটি দুর্বলতার দিক। এমনও হয়েছে, কোন্ দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে গেছে, টেরও পায়নি।
বিরাট বট গাছটির বাঁধানো চত্বরে আলি কেনানের দলটি গান করতো। সাধারণত এ জায়গায় কাউকে গান করতে দেয়া হয় না। আলি কেনানের দলটি খুব। ভাল গায় বলে এই বিরল সুযোগ পেয়েছে। অজগর সাপের মতো বট গাছের শেকড়ে হেলান দিয়ে একটা বুড়ো মানুষ বসে থাকে। বয়স বোধকরি সত্ত্বর পঁচাতুর হবে। এখনো শক্ত সমর্থ আছে। বগলে দুটো লাঠি ভর দিয়ে বুড়োকে চলাফেরা করতে হয়। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক বারমাস বুড়ো শেকড়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কারো কাছে কিছু একটা সাধারণত দাবি করে না। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অনেক সময় টাকা, আধুলি সিকিটা এনামেলের প্লেটে দিয়ে যায়। লোকটাকে দেখলেই মনে হবে বট গাছটির মতই প্রাচীন এবং একাকী।
ধীরে ধীরে এই মানুষটির সঙ্গে আলি কেনানের পরিচয় জমে ওঠে। আলি কেনান ভীষণ অহংকারী এবং উদ্ধৃত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু বুড়োর মুখোমুখি দাঁড়ালে বিচলিত বোধ না করে পারে না। তার উগ্র স্বভাবটি আপনাআপনি সংযত হয়ে আসে। দুজনের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে অবশ্য দীর্ঘ সময় লেগেছে। একদিন বুড়ো আলি কেনানকে জিজ্ঞেস করে,
অ মিয়া তোমরা হগলে দিনরাতই এই শিকলের বোঝা কেমন কইরা বও?
আলি কেনান একটুও না ভেবে জবাব দিলো,
এইডা আমাগো চিন্ন। বুড়ো ফের জিজ্ঞেস করে,
কীয়ের চিন্ন?
আলি কেনান বলে, বু আলি কলন্দর তরিকার চিন্ন। বুড়োর মুখে রসিকতা ঝিলিক দিয়ে ওঠে :
বু আলি কলন্দরের কতা থাউক, তরিকা কারে কয় হেইডা বোঝনি?
আলি কেনান সত্যি সত্যি লা জওয়াব হয়ে যায়। বুড়োর কাছেই প্রথম জানতে পারে তরিকার অর্থ হলো পথ। ঢাকা শহরে যতগুলো রাস্তা, লেন, বাইলেন আছে ইসলাম ধর্মের ততোগুলো তরিকা আছে। সব নদী যেমন সাগরে গিয়ে মিশে, তেমনি সব তরিকা আমাদের দ্বীনের নবী মুহম্মদের মধ্যে মিশে গিয়েছে। তিন লাখ সতুর হাজার পয়গম্বরের সর্দার আমাদের নবী। আর সমস্ত আউলিয়া কুলের সর্দার। হলেন হজরত আব্দুল কাদির জিলানি। হযরত আবদুল কাদির জিলানির দুই কাঁধের ওপর স্থাপিত আমাদের দ্বীনের নবীর কদম মোবারক এবং তামাম আউলিয়া কুলের কাঁধের ওপর চরণ রেখেছেন হযরত আবদুল কাদির জিলানি। বেবাক হিন্দুস্থানে যত আউলিয়া বুজুর্গ আছেন, তাদের সর্দার হলেন হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। তিনি গরিব গোবরার দোস্ত এবং হিন্দুস্তানের সম্রাট। এই যে শাহ আলী বাবার মাজার দেখতে আছো তিনিও খাজা বাবার সিলসিলার বুজুর্গ।
এসব কথা আলি কেনান রূপকথার গল্পের মতো শুনে। সব কথা তার বিশ্বাস হতে চায় না। তবু বুড়োর বলার ধরনের মধ্যে এমন একটা ভঙ্গী আছে, সেখানে সম্ভব অসম্ভব বাস্তব অবাস্তবের মধ্যবর্তী সীমারেখা হারিয়ে যায়। তার মনে এক আধটু ভাবান্তর আসে। মাঝে মাঝে মন ছুঁড়ে একটা প্রশ্ন জাগ্রত হয় :
মানবজীবন- এর কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? গরম বালুতে পানি পড়লে যেমন হারিয়ে যায়, তেমনি কোনো কিছুই তার মনে স্থায়ী হয় না। গত্বাঁধা পথে জীবন চলতে থাকে। মানুষ জন এলে তাবিজ দেয়। কুকুর ছানাটি নিয়ে আদায়ে বের হয়। আজকাল টাকা পয়সার তাগাদায় তার বের না হলেও চলে। তথাপি সে নিয়ম ভঙ্গ করে না। সম্প্রতি আলি কেনানের মধ্যেও একটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। বাইরে তার প্রকাশটি খুব স্পষ্ট নয়।
ফুলতলি মসজিদের ইমাম এবং শাহ আলি বাবার মাজারের বুড়োর কাছে সে অনেক কিছু শিখেছে। মাঝে মাঝে চোখ বুজে চিন্তা করে। তখন তার মনে হয়, সে সোজা কিংবা বাঁকা যে কোনো পথে যাক না কেনো, সর্বক্ষণ একটা ইতিহাসের ধারাকেই বহন করে নিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলেও সে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। একটা না একটা ধারা এসে টেনে নিয়ে যায়। সে দরবেশের অভিনয় করছে, কিন্তু তার মধ্য দিয়েও সমস্ত দরবেশের সাধনার ধারা পাহাড়ী নদীর মতো ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে আছড়ে পড়ে তাকে গ্রাস করে ফলেতে চাইছে। দুনিয়াটা বড়ো আশ্চর্য জায়গা।
ইমাম সাহেবের কাছ থেকে সে শরিয়তের নানা বিষয়ের বিস্তর সংবাদ সংগ্রহ করেছে। আর বুড়ো স্থূল জগতের মধ্যে যে আরেকটা সূক্ষ্ম জগৎ আছে সে বিষয়ে তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। আলি কেনানের গ্রহণশীলতার তুলনা নেই। সে যা শুনতে চায়, তাই-ই শুনে। তার সবকিছুই কঠোর প্রয়োজনের নিগরে বাঁধা, তার বাইরে একচুল যেতেও তার মন প্রস্তুত নয়। সে বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব কারো কাছে আত্ম সমর্পণ করে বসেনি। সে যে ধর্মকর্ম-এসব বিষয়ে অধিক জানে না, একথা জানান দিতে আত্মসম্মানে বাধে। হাজার হোক জানাশোনার সঙ্গে কর্তৃত্বের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তো আছে। তাই দৈনন্দিন আলাপে সালাপে যতোটুকু জানতে পেরেছে, তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট। তার প্রয়োজন ছাড়া কোনো বিষয়ে সে বেশি শিখতে চায় না। বেশী শেখার বিপদ আছে। তাহলে তাকে হয়তো ইমাম সাহেব কিংবা বুড়োর মতো হতে হবে। সে ধরনের জীবন সে গ্রহণ করতে পারে না। জীবনকে পাকা সুপুরির মতো সবসময় একটা নীরেট বস্তু হিসেবে দেখে। সে চরের মানুষ। দাপটের সঙ্গে বাঁচাই তার আবাল্যের স্বভাব। ‘মারো অথবা মরে যাও’ এই হলো তার কাছে জীবনের সংজ্ঞা। এই বাঁচার কি আনন্দ, কি সুখ বুড়ো কিংবা ইমাম সাহেব তা জানেন না। আলি কেনান অনেক তত্ত্বকথা শুনেছে বটে, কিন্তু বাস্তব কাজে অবহেলা করেনি। ফুলতলির আবাসস্থলটিতে কিছু কিছু সংস্কারের কাজ সে করে ফেলেছে। হুজরা খানার সংলগ্ন ফাঁকা জায়গাটিতে আরো দুটি নতুন ঘর উঠিয়ে নিয়েছে। দুজন মেয়ে মানুষ, মা ও মেয়ে তার আস্তানায় এসে জুটেছে। সে অবাক হয়ে ভাবে তার যা প্রয়োজন আল্লাহ নিজে তা পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ যে রহমানুর রহিম বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। তাকে ঘিরে ফুলতলিতে যে কর্মচক্র সৃষ্টি হয়েছে, মাঝে মাঝে তার মধ্যে নিজেকে বন্দি বলে মনে করে। এতো ছলাকলা এতো কলকৌশল এসবের কি কোনো প্রয়োজন আছে? একটাইতো জীবন! একভাবে না একভাবে কাটিয়ে দেয়া যায়। যতো লাল সালুর আলখেল্লা পরুক দাড়ি গোঁফ বড়ো করে রাখুক, আলি কেনান জোয়ান মানুষ। একটি মেয়ে মানুষের অভাবও সে তীব্রভাবে অনুভব করে।
তার অভাবগুলোও যে তীব্র। একেবারে জমাট বাঁধা। কিছুতেই অন্যবস্তু দিয়ে পূরণ করা যায় না। ভোলা থেকে সেই পুরোনো বউটিকে ফিরিয়ে আনার কথাও তার মনে এসেছে। সেটা অসম্ভব মনে করে তাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়েছে। সাপের পুরোনো খোলসের মতো সেই জীবন সে ফেলে এসেছে। কাঁচা ঘরের কড়ি বরগা যেমন পাকা ঘরের কোনো কাজে আসে না, তেমনি ভোলার জীবনের কোনো কিছুই তার আর কাজে আসবে না।
একদিন হুজরাখানা থেকে বেরিয়ে আচমকা আলি কেনান চমকে ওঠে। তখনও লোকজন আসতে শুরু করেনি। আলি কেনান দেখে দুজন মেয়েমানুষ হোগলার ওপর বসে আছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স চল্লিশ টল্লিশ হবে। মুখে কয়েকটি গুটি বসন্তের দাগ। শরীরের বাঁধুনি এখনো বেশ শক্ত। অন্য মেয়েটির বয়স আঠারো থেকে বিশের মধ্যে। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা না হলেও মোটামুটি সুন্দরী বলা চলে। গরিব ঘরের মেয়ে ঠিকমত খেতে পরতে পারলে গায়ের রং যে আরো খোলতাই হবে তাতে সন্দেহ নেই। আলি কেনান তার স্বভাবসিদ্ধ কর্কশ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো,
এ্যাই তোরা কি চাস? তবু তার গলার স্বর বুঝি একটু কাঁপলো। রয়স্কা মেয়ে মানুষটি তার পায়ের ওপর আছার খেয়ে বললো,
বাবা আমারে বাঁচান। আলি কেনান এই মুহূর্তটিতে বাবা ডাকটি শুনতে চাইছিলো না।
সে বললো,
মাগি তামাসা রাখ। কি অইছে হেইডা ক।
মেয়ে মানুষটি কেঁদে কুটে অনেকক্ষণ কসরত করে যা বললো, তার সারমর্ম এরকম :
মেয়েকে নিয়ে সে বস্তিতে থাকে। সোয়ামী চটকলে চাকুরী করতো। বছর দুই হলো মারা গিয়েছে। তারপর থেকে মা মেয়ে এই বস্তিতে ডেরা পেতে আছে। মা মেয়ে দুজনই পরের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটায়। এই পেটের মেয়েই এখন তার কাল হয়েছে। মেয়ের কারণে, তাদের দিকে বস্তির খারাপ মানুষদের দৃষ্টি পড়েছে। গত রাতে আট দশজন মানুষ তার মেয়েকে লুট করে নিয়ে যাওয়ার জন্য হানা দিয়েছিলো। তারা তাকে জানে মেরে ফেলবে বলে ভয়ও দেখিয়েছে। বহু কষ্টে ঘরের পেছনের বেড়া ভেঙে চুপিচুপি আর একটা ঘরে গিয়ে রাত কাটিয়েছে। এখন বস্তির কেউ আর তাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। বেহুদা পরের জন্য নিজের বিপদ ডেকে আনতে কে রাজী হবে! বাবা দয়া করে আশ্রয় না দিলে এই সংসারে তাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
আলি কেনান আবার চীৎকার দিলো,
মাগি তর লাঙ ঢুকাইবার স্বভাব আছে? কহন যায়না মাগিগো লগে শয়তান ঘুইরা বেড়ায়।
জবাবে মেয়ে মনুষটা বললো, বাবা চইদ্দ বছর বয়সের সময় আমার বিয়া অইছে। আপন খসম ছাড়া অন্য কুনু বেডা মাইনসের চউকে চউকে চাইয়া কতা কই নাই। সে আবার আলি কেনানের পায়ের ওপর আছার খেয়ে বলতে থাকলো,
বাবা আমি একা অইলে কুনু ভাবনা আছিল না। পেডের মাইয়াডি গলার কাড়া। হেরে থুইয়া মরবার চাইলেও পারি না। আপনে আমাগোরে উদ্ধার করেন বাবা। এবার আলি কেনানের মেজাজ একটু নরোম হয়।
সে জিগগেস করে,
রাঁধবার পারবি?
হ বাবা পারুম, মেয়ে মানুষটি জবাব দেয়।
এই কুত্তার বাচ্চারে গোসল করাইয়া রং মাখাইবার পারবি?
হ বাবা হগলডি পারুম। কেবল আমার পোড়া কপাইল্যা মাইয়াডারে বাঁচান।
তুই হগলডি পারবি? আলি কেনান অনেকটা ফিস ফিস করে জিগগেস করে। মেয়ে মানুষটি ঘাড় কাৎ করে।
আলি কেনান রাজি হয়ে গেলো। যা অই খালি ঘরটাতে থাক গিয়া। খবরদার লাঙলুঙ ঢুকাইলে শাউয়ার মধ্যে তাজা আঙরা হান্দাইয়া দিমু। সেদিন সন্ধ্যে থেকে আলি কেনান নারীর হাতের রান্না খাওয়া আরম্ভ করলো।
মেয়েমানুষ দুটি আস্তানায় আসার পর থেকে আলি কেনানের উড়ু উড়ু ভাবটি অনেক কমেছে। সে অনুভব করে মাটির সঙ্গে শেকড়ের যোগ যেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিজেকে অকারণে পূর্বের চাইতে অনেক ভারী বলে মনে হতে থাকে। মেয়ে মানুষটি অকৃপণ অনুরাগে তার সেবাযত্ন করে। প্রতিদিন দুবার করে ভেতরের ঘর, বাইরের ঘর ঝাট দেয়। হুজরাখানা পয় পরিষ্কার রাখে। আলি কেনানের সারা গায়ে সাবান মেখে গোসল করায়। গোসলের পর গা মুছিয়ে দেয়। গা মোছা সারা হলে সারা গায়ে মাথায় শর্ষের তেল দিয়ে মালিশ করে। যতোই দিন যাচ্ছে, মেয়ে মানুষটি আলি কেনানের জীবনের বাইরের অংশে অধিকার প্রসারিত করছে এবং আলি কেনানও ক্রমশ মেয়ে মানুষটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে আত্মসমর্পন করতে থাকে। তার মেয়েটি কচিত ঘরের বের হয়। বাটনা বাটে, তরকারি কুটে, রান্নাসহ ভিতরের সব কাজ করে। আলি কেনান তার হাতের রান্নার তারিফ করে। সে সকাল বিকেল খাওয়ার পর আলি কেনানের জন্য চমন বাহার দিয়ে পান বানিয়ে পাঠায়। আলি কেনানের কাছে সে পান খুব মিঠে মনে হয়।
এখনো আলি কেনান ভক্তদের নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুড়ি আর খঞ্জনি বাজিয়ে মাজার পরিক্রমায় বের হয়। কুকুর ছানাটিও তাদের সঙ্গে যায়। হাইকোর্টের মাজার সালাম করে নিমবাগান মাজারে এসে খাওয়া দাওয়া সারে। সে দিন গাঁজায় দম দিয়ে আলি কেনানের মনে হলো তার জীবনে এতো সুখ রাখবার কোনো জায়গাই নেই। ভক্তদের নির্দেশ দিলো,
এ্যাই কালাম, এ্যাই বশির গানে টান দে। ভাব আইবার লাগছে। তখন সবকিছুর দুঃখ ভুলে গিয়ে তারা গাইতে লাগলো :
জলিল ও জব্বার বাবা
জলিল ও জব্বার
তোমার প্রেমেতে হলো
দুনিয়া গুলজার।
পেয়ে তোমার প্রেমের মধু
কুল ছাড়িল কুল বধু
অসাধু হইল সাধু
প্রেমেতে তোমার।
আলি কেনান জানতো না যে সে একটা বড়ো ধরনের ভুল করে বসে আছে। তখনো শুক্রবারের জুম্মার নামাজ শেষ হয়নি। নামাজের সময় গান বাজনা। স্বভাবতই মুসুল্লিদের কেউ কেউ ভীষণ ক্ষেপে উঠেছিলো। মাজারের খাদেমও এই রকম একটা সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলো। নিমবাগানের মাজারটির পেছনে কোনো জমকালো ইতিহাস নেই। কোন্ সাধু পুরুষের দেহাবশেষের ওপর এই মাজার জন্ম নিলো, তার নামটিও আশ পাশের মানুষ ভালো করে বলতে পারে না। খাদেম অবশ্য ইদানিং একটা লম্বা চওড়া সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন- হজরত আমজাদ আলি শাহ খোরাসানি (রাঃ) এর মাজার। এই খোরাসানি বাবা সম্পর্কে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করলে খাদেম একটা দীর্ঘ বৃত্তান্ত শুনিয়ে দিয়ে থাকেন। কাহিনীটি বার আউলিয়ার চরিত কথা নামক পুস্তক থেকে সংগ্রহ করে, স্থান বিশেষে সম্পাদনা করে খোরাসানি বাবার নামে চালিয়ে থাকেন। খাদেমের মতে হজরত খোরাসানি বাবা বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর পরই সুদূর খোরাসান থেকে আপন পীরের নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই বাংলা মুলুকে আসেন এবং এইখানে দেহ রক্ষা করেছেন। বাবার দুয়েকটা কেরামতির কথাও অবস্থা বুঝে প্রকাশ করেন। কেউ বলে,
বাবাজান কুমীরের পিঠে সওয়ার হয়ে এসেছিলেন। আবার কারো মতে, একটা মানুষ খেকো বাঘ পিঠে করে তাঁকে বয়ে এনেছিলো।
এই নিমবাগানের মাজারের খাদেমের শত্রুর অভাব ছিলো না। তাদের কেউ বলতো, একটা মামুলি কবরের ওপর এই মাজার উঠেছে। আবার কেউ কেউ খাদেমের বিগত জীবন নিয়ে নানা কথা উত্থাপন করতো। সেসব খুব একটা ধর্তব্যের ব্যাপার নয়। খোরাসানি বাবা এখানে দেহ রক্ষা করেছেন কিনা সেটাও বড়ো কথা নয়। আসল ব্যাপার হলো মানুষের মনে অচলা ভক্তি আছে, সেই ভক্তি কোথাও নিবেদন করতে হবে। মানুষের ভক্তি এবং খাদেমের অক্লান্ত প্রয়াসে এই সুন্দর মাজারটি এই নিমবাগানের মাটি খুঁড়ে জন্মাতে পেরেছে। মানুষের জীবনে সমস্যা আছে, আছে দুঃখ ও শোক। তারা যাতে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পারে সে জন্য মাজারের পেছনে একটা জমাট ইতিহাসও চাই। এই খাদেমের কৃতিত্ব হলো সেই ইতিহাসটি লোকগ্রাহ্য করে তুলতে পেরেছেন।
খাদেমকে কেউ নিয়োগ করেনি। তিনি স্বয়ং নিযুক্ত হয়েছেন। মাজারের কোনো কমিটি নেই। তিনি একাই সব। সবেতো মাজারের জন্ম হলো। এতো তাড়াতাড়ি কমিটি আসবে কোত্থেকে? অবশ্য তাঁর নিযুক্তির দাবির পেছনে একটা স্বপ্ন নির্দেশের কথা বলে থাকেন।
খাদেম এই আলি কেনান মানুষটিকে শুরু থেকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছেন। তাদের পোশাক আশাকের জেল্লা, সঙ্গী সাথী এবং সংঘবদ্ধতা খাদেমের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তিনি মনে মনে চাইতেন আলি কেনান যেনো এই মাজারে না আসে। তার একটা আশঙ্কা ছিলো কোনোদিন আলি কেনানেরা যদি মাজার দখল করে বসে। যদি তাকে তাড়িয়ে দেয়, সে বড়ো দুঃখের ব্যাপার হবে। তিনি অকূলে পড়ে যাবেন। আবার মুখ ফুটে তিনি নাও করতে পারছিলেন না, অলি আল্লার ভক্ত আসবে, সেখানে খাদেম বাধা দেওয়ার কে? তাই তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন, যদি কোনো দিন সুযোগ পাওয়া যায়।
আজকে না চাইতেই সেই সুযোগটা হাতের কাছে এসে গেলো। আলি কেনানের অপরাধ সে নামাজের সময় গান গেয়েছে। তাতে মুসুল্লিদের নামাজের ব্যাঘাত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দলেবলে সে গাঁজা খেয়েছে। তৃতীয়তঃ সবচেয়ে গর্হিত অপরাধ যেটা সে করেছে, ধর্মস্থানে কুকুর নিয়ে প্রবেশ করেছে। কুকুর আমাদের রসুলের জানের দুশমন। মুসল্লিরা প্রচণ্ড রকম ক্ষিপ্ত হয়ে আলি কেনান এবং তার দলবলকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিলো। আলি কেনানের মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিলো। আলি কেনান ক্ষিপ্ত মুসল্লিদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলো কুকুর খুব খারাপ জানোয়ার। কিন্তু মাঝে মাঝে ভালো কুকুরও পাওয়া যায়। যেমন আসহাবে কাফের সঙ্গে একটা কুকুর ছিলো। ক্রুদ্ধ মুসুল্লিরা তার কথা কানে তুলেনি। তারা। কুকুরটিকেও এমন মার দিয়েছে পেছনের পা দুটো একেবারে জখম হয়ে গেছে।
আলি কেনানের সমস্ত রাগ কুকুরটার ওপর পড়ে। সে ধরে নিয়েছে কুকুরটার কারণেই তার এতো লাঞ্ছনা। তাই কুকুরটার পেটে একটা লাথি দিয়ে রিকশায় উঠে বসলো। তাদের সকলের মিরপুরের মাজারে যাওয়া বন্ধ রেখে ফুলতলিতে ফিরে আসতে হলো।
আসার সময় নিমবাগানের খাদেমের দিকে তর্জনী প্রসারিত করে বললো, খানকির পুত মনে রাখিস, তরে একদিন দেইখ্যা লমু।
অতি সংকটেও আলি কেনান কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসে না। সে তার ভক্তদের বলে:
এই কালাম, এই হাফিজ এই কতা ফুলতলির মানুষদের কইয়া লাভ নাই। মনে থাকবে? শিষ্যেরা মাথা ঝাঁকায়।
সেই রাতে মেয়ে মানুষটি পরম যত্নে তার সেবা শুশ্রূষা করে। গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে সারা শরীরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করে। শরীরের জখমী জায়গাগুলোতে ডাক্তারের দেয়া মলম লাগিয়ে দেয়। আলি কেনান ডান হাতটা নাড়াতে পারছিলো না। মেয়ে মানুষটি নিজের হাতে গ্লাস পাকিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়।
ক্লান্তিতে আলি কেনানের চোখ বুজে আসছিলো। মাঝরাতে কি একটা স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে এখনো মেয়ে মানুষটি তার বিছানার পাশে বসে আছে। চোখের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। আধো আলো আধো অন্ধকারে মেয়ে মানুষটিকে তার চোখে একটি অনুচ্চ ঝোঁপের মতো মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর আকাঙ্খ দুলে উঠলো। সে ফিস ফিস করে জিগগেস করে,
এই তর নাম কি করে? মেয়ে মানুষটিও ফিস ফিস করে জবাব দেয়,
আমার নাম ছমিরন। অতি কষ্টে জখমি হাতটা বাড়িয়ে ছমিরনকে তার দিকে আকর্ষণ করে। ছমিরন যেনো সে জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সে আলি কেনানের শরীরের সঙ্গে কাদার মতো লেপ্টে থাকে। সেদিন থেকে ছমিরন এবং আলি কেনানের মধ্যে একটা গোপন শারীরিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলো।