মন ভালো থাকলে বাড়িতে একা থাকা আমার জন্য কোনো সমস্যা নয়। আমার একটা পার্সোনাল কম্পিউটার আছে। ওটাকে পার্টনার বানিয়ে গেম খেলি। আমার কাছে প্রায় একশ গেমের প্রোগ্রাম আছে। কয়েকটা গেম আছে মহাশূন্য অভিযানের ওপর। খেলতে বসলে সময় কীভাবে কাটে টেরও পাওয়া যায় না। এমন উত্তেজনাকর খেলা যে নাওয়া খাওয়া ভুলিয়ে দেয়। মা অবশ্য দুতিন ঘণ্টার বেশি এসব গেম খেলা পছন্দ করে না। নাকি ব্রেনের নার্ভের ওপর চাপ পড়ে, চোখের জন্যও ভালো নয়।
সেদিন আমার কিছুই ভালো লাগছিলো না। ঠিক করলাম শহর থেকে দূরে কোথাও গিয়ে দিনটা কাটাই। ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে শীতের জন্য তৈরি হয়ে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এরকম আমি মাঝে মাঝেই করি। ট্রেনে চেপে উঠে বসি। অচেনা কোনো গ্রামের স্টেশনে হঠাৎ করে নেমে পড়ি। ঘুরতে থাকি উদ্দেশ্যবিহীন। ক্লান্ত হলে রেস্তোরাঁয় বসে হ্যামবার্গার আর কফি খাই। বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। একবার এক জিপসী মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম। জোর করে ওদের তাঁবুতে নিয়ে গেলো। খাওয়ালো। পালকের একটা টুপি উপহার দিলো। নাকি আমাকে দেখে ওর হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের কথা মনে পড়েছিলো।
ভিক্টোরিয়া স্টেশন থেকে পশ্চিমের এক ট্রেনে উঠে বসলাম। সকাল তখন পৌনে দশটা। এ সময় সবাই লন্ডনের দিকে আসে, যায় খুব কম। আমি যে কামরায় বসেছিলাম সেখানে আমি ছাড়া একটা কাপ ছিলো, বসেছে বেশ দূরে। জানালার কাছে বসে ছুটে যাওয়া বিবর্ণ সবুজ মাঠ, ন্যাড়া গাছপালা আর ধূসর নীল আকাশ দেখছিলাম। বুকের ভেতরটা ফাঁকা মনে হচ্ছিলো। যেন এ পৃথিবীতে আমার কেউ অচেনা কোরস্তোরায় বলে জিপসী মেয়ের নেই। এভাবে কোনো অচেনা স্টেশনে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই, মনে হলো কারও কিছু আসবে যাবে না। দিব্যেন্দুর অবহেলা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না।
ভিক্টোরিয়ার পরের স্টেশনে একজন বয়স্ক লোক উঠলো আমার কামরায়। চেহারাটা খুব অমায়িক, চোখ দুটো শিশুর মতো সরল আর কৌতূহলী। আমার কাছে এসে বললো, দয়া করে তোমার কাছে বসার অনুমতি দেবে?
কামরায় এতসব খালি জায়গা থাকতে আমার পাশে কেন বুড়ো বসতে চাইছে বুঝলাম না। চেহারা দেখে অবশ্য সন্দেহজনক কিছু মনে হয় না। তারপরও আমি একা থাকতে চাইছিলাম। অনিচ্ছার সঙ্গে বললাম, দয়া করে বসুন।
গায়ের ওভারকোটটা খুলে ওপরের বাঙ্কে রেখে বুড়ো আমার মুখোমুখি বসলো। বয়স ষাটের মতো হবে, পোশাক পরিচ্ছদে মনে হয় আর্থিক অবস্থা খারাপ নয়, তবে অমনোযোগী। টাইয়ের সঙ্গে যেমন কোটের রঙ ম্যাচ করেনি। তা ছাড়া চেহারাটা খুবই ইনোসেন্ট। এসব দেখার জন্য আমার দশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি। দেখা শেষ হলে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।
একটু পরে আলাপ জমাবার জন্য বুড়ো প্রথমে বললো, আজকের আবহাওয়াটা খুব চমৎকার তাই না ইয়ং ফ্রেন্ড?
হাঁ, এ সময় এত ভালো আবহাওয়া সাধারণত হয় না। দ্রভাবে জবাব দিলাম আমি।
বুড়ো হাসিমুখে বললো, আমার নাম আলফ্রেড। কটনউড যাচ্ছি। তুমি?
আলফ্রেডের বাড়িয়ে দেয়া হাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললাম, আমার নাম নিক।
তুমি কদুর যাবে নিক? হাসিমুখে জানতে চাইলো কৌতূহলী আলফ্রেড।
ওর হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকেও ভদ্রতার খাতিরে সামান্য হাসতে হলো। বললাম, এমনি বেড়াতে বেরিয়েছি।
নিশ্চয় তোমাদের স্কুল এখনও খোলেনি।
আপনি ঠিক ধরেছেন।
কোনো গন্তব্য না থাকলে বেড়াবার জন্য কটনউড জায়গাটা ভারি চমৎকার। ছশ বছরের পুরোনো একটা পাথরের দুর্গ আছে ওখানে।
আপনার বাড়ি বুঝি কটনউডে?
না, না! আঁতকে ওঠার ভান করে আলফ্রেড বললো, আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমি একজন অর্ধসভ্য ইংরেজ?
আলফ্রেডের ইংরেজি উচ্চারণ লন্ডনের আদি বাসিন্দাদের মতো জড়ানো নয়, বরং শিক্ষিত এশিয়ানদের মতো পরিষ্কার। একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনি কি ট্যুরিস্ট, ইউরোপ থেকে এসেছেন? ওর চেহারা অবশ্য পুরোপুরি ইউরোপিয়ান।
আলফ্রেড হেসে বললো, আমার বাড়ি ওয়েলস-এ। লন্ডনে মাসে একবার ঘুরতে আসি। তুমি নিশ্চয় ইন্ডিয়ান?
না, বাংলাদেশের! আমাকে কেউ ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি বললে আমি বিরক্ত বোধ করি।
আ-আ-হ বাংলাদেশ! বুড়ো গদগদ হয়ে ভললো, সেভেন্টি সিক্স-এ আমি ঢাকা গিয়েছিলাম জাপান যাওয়ার পথে। ঢাকায় তিনদিন ছিলাম। ভারি সুন্দর জায়গা, খুব শান্ত আর নিরিবিলি শহর। তুমি কি ঢাকায় থাকো?
না, আমি লন্ডনে থাকি। আমার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের সিলেটে।
আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।
কীভাবে?
তোমার ইংরেজি বলার ধরন দেখে। তুমি একেবারে লন্ডনের লোকদের মতো ইংরেজি বলো। লন্ডনের বাসিন্দা না হলে এটা সম্ভব নয়।
আমি বাংলাও ভালো বলতে পারি।
সেটা যাচাই করা আমার সাধ্যের বাইরে। বলে হা হা করে গলা খুলে হাসলো আলফ্রেড।
আমি টের পাচ্ছিলাম আলফ্রেডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার বুকের ভেতর চেপে থাকা গুমোট ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মনটা হালকা হালকা লাগছে।
আলফ্রেড হাসিমুখে বললো, এবার বলো নিক, তুমি কি আমার সঙ্গে কটনউড যাচ্ছো বেড়াতে? আমি প্রায়ই যাই। দুর্গের পাশে ছোট্ট একটা নদী আছে। নদীর পাশে দুশ বছরের পুরোনো একটা রেস্তোরাঁ আছে। ইচ্ছে করলে নদীতে নৌকা নিয়েও বেড়ানো যায়। যাবে তো?
তুমি যেভাবে লোভ দেখাচ্ছো না গিয়ে উপায় কী!
আলফ্রেড উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পেলে বেড়াতে আমার দারুণ ভালো লাগবে।
ধন্যবাদ আলফ্রেড। তুমি একজন চমৎকার মানুষ।
প্রশংসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ নিক। আমার ভেতর ভালো যদি কিছু থাকে সেটা ওয়েলস-এর আলো বাতাস আর প্রকৃতির জন্য। ওয়েলস-এর লোকেরা সবাই হাসিখুশি, বন্ধুবৎসল। ইংল্যান্ডের লোকদের মতো গোমড়ামুখো অসভ্য নয়।
এটা আমি লক্ষ্য করেছি স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড বা ওয়েলস-এর লোকেরা ইংল্যান্ডের লোকদের সব সময় অসভ্য আর গোমড়ামুখো বলে। ইংল্যান্ডের লোকেরা তাদের বলে অমার্জিত গেঁয়ো। কারও সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করাটা যদিও অভদ্রতা তবু আলফ্রেড এত সরলভাবে কথাটা বললো যে ওকে কিছু বলতে পারলাম না। আলফ্রেড বললল, লন্ডনে তোমার কে আছে?
মা আর সৎ বাবা।
তুমি কি ওদের সঙ্গে থাকো?
আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম। আলফ্রেড বললো, তোমার বাবা নিশ্চয় খুব ভালো লোক। এসব ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের বোর্ডিং-এ পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আমার সৎ বাবা ঠিক বাবার মতো নয়, আমার বন্ধুর মতো। আমাকে ও খুব ভালোবাসে।
তুমিও নিশ্চয় ওকে খুব ভালোবাসো?
হাঁ, ভালোবাসি। ভালোবাসা একতরফা হয় না।
তুমি ভাগ্যবান নিক। তোমার সৎ বাবাও খুব ভাগ্যবান–তোমার মতো ছেলে পেয়েছে।
তোমার নিজের কথা বলো। বাড়িতে কে কে আছে তোমার?
আলফ্রেড ওয়েলস-এর বাসিন্দা বলেই ওকে এভাবে প্রশ্ন করেছিলাম। নইলে এটা নিতান্তই অ-ইংরেজসুলভ প্রশ্ন, যা কোনো দ্ৰ ইংরেজ কাউকে করবে না।
ওয়েলস-এর বাড়িতে আমি একা থাকি। আলফ্রেড-এর মুখের হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা মেশানো ছিলো।
তোমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নেই?
স্ত্রী মারা গেছে। দুই ছেলে আছে, এক ছেলে লন্ডনে, আরেক ছেলে আছে। ব্রাসেলস এ।
লন্ডনে তোমার ছেলের সঙ্গে থাকে না কেন তুমি?
একটু বিরক্ত হয়ে আলফ্রেড বললো, ও এক ইংরেজ মেয়ে বিয়ে করেছে। জানোই তো ইংরেজরা স্বাধীনভাবে থাকতে পছন্দ করে।
আলফ্রেডের কথা শুনে ওর জন্য ভারি মায়া হলো। বললাম, আমাদের বাংলাদেশে, শুধু বাংলাদেশে নয়, এশিয়ার অনেক দেশে বাবা মা বুড়ো হলে ছেলেদের সঙ্গে থাকে। ছেলের বউ বুড়ো বাবা মার যত্ন নেয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলফ্রেড বললো, আমি জানি নিক। রবার্ট যদি ওয়েলস এর মেয়ে বিয়ে করতো তা হলে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম। এ্যান একেবারে খাঁটি ইংরেজ। ও এসব পছন্দ করে না।
শুধু মেয়ের দোষ দিও না। তোমার ছেলেও নিশ্চয় এর জন্য দায়ী?
তা তো বটেই! বলে আলফ্রেড চুপ করে রইলো।
আধ ঘণ্টা পর কটনউড স্টেশন এসে ট্রেন থামলো। ছোট্ট পাহাড়ি জনপদের ভেতর নিরিবিলি স্টেশন–যেমনটি আমি চেয়েছিলাম। আলফ্রেড ওর চেহারা থেকে বিষণ্ণতার কালো ছায়া সরিয়ে ফেলে ব্যস্ত গলায় বললো, জলদি নেমে পড়ো নিক। ট্রেন এখানে মাত্র এক মিনিটের জন্য থামে।
মাত্র আমরা দুজনই ছিলাম কটনউডের যাত্রী। প্লাটফর্মে নামতেই হুশ করে ট্রেনটা ছুটে গেলো। অদ্ভুত এক নিরবতা আমাদের চারপাশে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে গেলো। স্টেশনের এক পাশে লোকালয় অন্যদিকে ধু ধু মাঠ। বেশ দূরে মাঠে একটা গরু হাম্বা বলে ডাকলো। একটা দুটো পাখির ডাক শোনা গেলো। আলফ্রেড উত্তর দিকে আঙুল তুলে দেখালো, ওই যে পাহাড়টা দেখছো, ওটার আড়ালে সেই দুৰ্গটা রয়েছে। আগে চলো এক কাপ চা খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিই। আমার ফ্লাস্কটাও ভরিয়ে নেবো। তারপর দুর্গ অভিযানে বেরোনো যাবে।
আলফ্রেডের কথা শুনে মনে হলো, একটু চা হলে ভালোই লাগবে। ওর সঙ্গে বেরিয়ে এলাম স্টেশন থেকে। স্টেশনের কাছাকাছি রাস্তার দুপাশে কয়েকটা পাকা বাড়ি, ছোট দুটো ডিপার্টমেন্ট শপ, পাশে ক্যাফেও রয়েছে। ক্যাফেতে ঢুকে আলফ্রেড চায়ের অর্ডার দিলো। বললো, আর কিছু খাবে?
আমি মাথা নাড়লাম–না ধন্যবাদ, তুমি ইচ্ছে করলে নিতে পারো।
আলফ্রেড বললো, আমার মতো বুড়োদের অনেক হিসেব করে চলতে হয়। আমি একটার আগে কিছু খাবো না। এখন মাত্র এগারোটা দশ।
চা খেয়ে দুজন বেরিয়ে পড়লাম দুর্গের পথে। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা, পাথরে বাঁধানো। দুপাশে বেশির ভাগ গাছেই পাতা নেই, যেগুলোতে আছে তাও বিবর্ণ, বসন্তের জন্য অপেক্ষা করছে। বসন্তের শুরুতে গাছে গাছে রঙের বন্যা বয়ে যায়। কোনো কোনো গাছ রোজ রঙ বদলায়। বনের ভেতর রঙের ফোয়ারা ছোটে।
চারদিক ঠাণ্ডা, সুনসান। মাঝে মাঝে কনকনে বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো. গাছের শুকনো পাতায় ছোট ছোট ঘূর্ণি তুলে। শীতকালে এসব জায়গায় কোনো পাখি থাকে না। তখনও বরফ পড়েনি বলে পাহাড়ের বনে একটা দুটো পাখি উড়তে দেখা গেলো । আলফ্রেড বললো, বহু বছর পর ইংল্যান্ডের আবহাওয়া আমাদের ওয়েলস-এর মতো মনোরম মনে হচ্ছে।
তার মানে তুমি বলতে চাইছো ক্রিসমাসে তোমাদের ওখানে বরফ পড়ে না?
মাঝে মাঝে পড়ে। তবে ইংল্যান্ডের মতো নোংরা ময়লা বৃষ্টি থাকে না। শীতের শুরুতে এখানকার মতো জঘন্য আবহাওয়া কোথাও খুঁজে পাবে না।
কারও সঙ্গে কথা বলার জন্য আবহাওয়া একটা জনপ্রিয় বিষয়। তা সে ইংল্যান্ডেরই হোক কিংবা স্কটল্যান্ডের কি ওয়েলস-এর, তাতে কিছু যায় আসে না। আলফ্রেডের সঙ্গে কটনউডের পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। ও এক মনে ওয়েলস-এর প্রকৃতির বর্ণনা দিচ্ছিলো। কোন ঋতুতে কী রকম দেখায় গড়গড় বলে যাচ্ছিলো। বুড়ো কথা বলার সঙ্গী পেয়ে ভেতরের সব উচ্ছ্বাস উজাড় করে দিচ্ছে। মানুষ কী নিঃসঙ্গ! আমাকে না পেলে ও নিশ্চয় একা একা হেঁটে বেড়াতো কটনউডের রাস্তায়, নইলে পাব–এ কিংবা রেস্তোরাঁয় বসে ঝিমাতো।
নিজের কথা মনে হলো। আমি আলফ্রেডকে নিঃসঙ্গ ভাবছি, আমি নিজেও কি নিঃসঙ্গ নই? দিব্যেন্দুকে ভেবেছিলাম আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কাল ওর কথা শুনে মনে হলো না ও আমার মতো ভাবে। শীলা, জেন, ভিকি–সবারই নিজেদের আলাদা জগৎ আছে। ওরা কোথায় গেছে আমি জানি না। জানাবার দরকারও মনে করেনি ওরা। ওদের কারও সঙ্গে দেখা হলে এভাবে অচেনা জায়গায় ঘুরতে আসতাম না। আলফ্রেডের সঙ্গে দেখা না হলে আমাকেও কটনউড না হলে অন্য কোথাও একা একা হাঁটতে হতো।
আলফ্রেড কথা থামিয়ে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছিলো–সত্যি দারুণ না! হ্যাঁ সত্যিই দারুণ। ওয়েলেস-এর সব কিছুই দারুণ চমৎকার। এ বিষয়ে ওর সঙ্গে একটু পরপরই আমাকে একমত হতে হচ্ছিলো। মনে মনে বললাম, আলফ্রেড তুমি মানুষটাও চমৎকার।
কটনউডের দুর্গটা খুব বড় নয়। কাছে না এলে বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এখানে এত পুরোনো একটা দুর্গ আছে। দুর্গ দেখতে এসে লক্ষ্য করলাম এখানে কোনো গাইড নেই, পাহারাদার নেই, আশেপাশে লোকজনের কোনো চিহ্ন নেই। এমন তো হওয়ার কথা নয়! লন্ডনের আশে পাশে একশ মাইলের ভেতর অনেকগুলো দুর্গ আর প্রাসাদ আমার দেখা আছে। যেগুলো দু তিনশ বছরের পুরোনো সেগুলো সব চমৎকার টুরিস্ট স্পট আর হোটেল হয়ে গেছে। বেশি পুরোনো যেগুলো পাঁচশো বছর বা তার চেয়ে বেশি, সেগুলো জাদুঘর বানানো হয়েছে। টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। কোনো লর্ড, ডিউক কিংবা রাজার দুর্গ। ভেতরে তাদের আসবাবপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, সব সাজানো আছে। বেশির ভাগের বিবরণও লেখা থাকে। বিশেষ করে মূল্যবান রত্ন যদি হয়, সেগুলো কোত্থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সব কিছু লেখা থাকে। বৃটেনের ইতিহাস জানার জন্য এসব দুর্গ দেখা যে খুব দরকার আমাদের টিচাররা বহুবার বলেছেন। অথচ কটনউডে এরকম একটা দুর্গ এভাবে পড়ে আছে দেখে রীতিমতো অবাক হলাম।
আলফ্রেডকে বললাম, তুমি কি সত্যিই জানো এটা ছশ বছরের পুরোনো দুর্গ।
সংস্কারের অভাবে দুৰ্গটাকে অবশ্য আরও পুরোনো মনে হচ্ছিলো। বাইরের দিকটা কালো গ্রানাইট পাথর দিয়ে বানানো হলেও দেয়ালে ফাটল ধরছে, কোথাও দেয়ালের গায়ে বুনো ঝোঁপ গজিয়ে শুকিয়ে আছে, দরজা জানালার সংখ্যা খুবই কম যদিও, সেখানে শুধু ফোকরই আছে কোনো আড়াল নেই। রীতিমতো হন্টেড ক্যাস্-এর মতো মনে হচ্ছিলো। বুঝি রাত নামলেই কালো বাদুড়েরা চারপাশে উড়বে আর অন্ধকার ফোকর দিয়ে কালো আলখাল্লা পরা কোনো ভ্যাম্পায়ার বেরিয়ে আসবে।
আমার সন্দেহের কথা শুনে আলফ্রেড হাসলোকেন, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! সঠিক সময় যদি জানতে চাও তা হলে বলি, তেরশ আশি সালে বার্গান্ডির ডিউক এ দুৰ্গটা বানিয়েছিলো তাদের জমিদারী রক্ষা করার জন্য। খুবই অত্যাচারী ছিলো বার্গান্ডির জমিদারেরা। কত প্রজাকে যে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতেছে তার কোনো হিসেব নেই। তাদের অত্যাচারের কথা নিয়ে অনেক ব্যালাড লেখা হয়েছে। এই এলাকার পুরোনো লোকেরা এখনও ভ্যালেন্টাইনের মেলার সময় সেসব ব্যালাড গায়।
এভাবে অযত্নে ফেলে রেখেছে কেন? আলফ্রেডকে প্রশ্ন করলাম–এর চেয়ে অনেক কম পুরোনো দুর্গগুলো হয় জাদুঘর নয়তো হোটেল বানানো হয়েছে।
পুরোনো বটে তবে এটার কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব নেই। জমিদাররা শুধু বছরে একবার খাজনা আদায়ের জন্য আসতো। তাদের কর্মচারীরা থাকতো এখানে। স্থাপত্য নির্দশনের কথা যদি বলো সেদিক থেকে এটা আহামরি কিছু নয়। আমাদের ওয়েলস-এ এরকম অনেক দুর্গ এমনি পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই।
আমরা দুজন বসেছিলাম কালো একটা পাথরের বেঞ্চে। হাতব্যাগের পকেট থেকে মোটা একটা পাইপ বের করে ওটার ভেতর তামাক ভরলো আলফ্রেড। তামাকের কৌটোর গায়ে লেখা থ্রি নান। পাইপে আগুন ধরিয়ে ওটা টানলো সে। ওর মুখে গভীর তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়লো। একগাল সুগন্ধি ধোয়া ছেড়ে আলফ্রেড বললো, তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই নিক।
কী প্রস্তাব? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
ওয়েলস-এ আমার একটা চমৎকার বাড়ি আছে। তুমি কি আমার সঙ্গে দুদিনের জন্য সেখানে বেড়াতে যাবে?