৩. আজকে বুধবার, অর্থাৎ অরণ্যকাণ্ড
এত ভোরে উঠি না । ঘুম ভাঙল মশারির মধ্যে বালিশের পাশে রাখা টেলিফোনের হ্যাণ্ডসেট বেজে ওঠায় । আগে আমি তুলতুম । ১৯৯৬ সনে আগস্টের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে টেলিফোন ধরতে বেরিয়ে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বলে বিছানায় হ্যান্ডসেট নিয়ে শুই । হাসপাতাল থেকে আসার পর অসময়ের ফোনগুলো রিসিভ করার কাজ সলিলার ওপর বর্তেছিল । কিন্তু ফোনে বাঙালি কবি-সাহিত্যিক অনামাদের গালমন্দ-খিস্তিখেউড় আসতে থাকায় আমিই ধরছি আবার । বাংলা যৌন শব্দগুলো সলিলা জানে না বলে গালমন্দগুলোর মানে বুঝতে না পেরে কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না, ইংরেজিতে বলুন না, ইত্যাদি অনুরোধ করত । ও হিন্দি মারাঠি ইংরেজি খিস্তিখেউড়গুলো জানে । বাংলাগুলো ওকে বুঝিয়েছি, কিন্তু প্রত্যঙ্গ বা ক্রিয়ার গোলমাল করে ফ্যালে । তাছাড়া ছোটোবেলা থেকে শোনেনি বলে কথাগুলোকে ওর খিস্তি মনে হয় না । ফানি মনে হয় । হিন্দি-মারাঠির তুলনায় শ্রাব্য বিকল্প মনে করে । কানাড়া ভাষায় যোনির গালাগাল শব্দ তুলু । মিঠুন চক্রবর্তী আর দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী মধুর একটা বিখ্যাত নাচ আছে বার-বার তুলু-তুলু গেয়ে । মিঠুন দক্ষিণ ভারতে থাকেন ।
সলিলা অ্যারোবিক্স করছিল । আমি হ্যাণ্ডসেট ওঠাইনি দেখে স্পিকার অন করে হ্যালো-হ্যালো করতে থাকলেও সাড়া পাওয়া গেল না । আমিও হ্যাণ্ডসেট কানে দিয়ে বুঝলুম যিনি রিং করছেন তিনি ধরে আছেন, অথচ কথা বলছেন না । মলয় বলছি, বলতেই রেখে দিলেন । সলিলা বলল, ‘এটা সাহিত্যিক-কবি নয়, স্বজনজ্ঞাতি হবে । সাহিত্যিকদের বদলা নেবার পিরিয়ড বোধহয় ওভার হয়ে গেছে, তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে করা তোমার ফোনের বদলি খিস্তিখেউড় যথেষ্ট হয়ে গেছে হয়তো, অবশ্য আবার যদি না তোমার সাম্প্রতি৯ক লেখা চটিয়ে থাকে কাউকে-কাউকে ।’
বার্তাকারীর বার্তাও অনির্ণেয় হতে পারে ।
যান্ত্রিক গোলোযোগে বেজে উঠে থাকে যদি ? অভিপ্রায়হীন বার্তা !
সলিলা নিজের অর্ধসমপাপ্ত ব্যায়াম শুরু করল আবার । আমার ষাঠোর্ধ ভায়রা আর শ্যালিকা মুম্বাইতে বাজনা বাজিয়ে ব্যায়াম করে । কলকাতায়, বুড়োবুড়িদের, বাজনা বাজিয়ে ব্যায়াম করতে শুনিনি । সকালে বাজনা আমার পছন্দ নয় । জানলার বাইরে পলাশ, শিউলি, নিম, বাতাবি, বেল, আমগাছে, পাশে অঞ্জলিদির বাড়িতে, ভোরের অন্ধকার থেকে অনেক পাখি ডাকছে । প্রতিদিন শুনি ।
উঠে, মশারি খুললুম । সলিলা পাট করবে, বিছানা ঠিক করবে ।
পলাশের গাছময় পাখি, ফুলের মধ্যে চোখসুদ্দু ঠোঁট ঢুকিয়ে দিচ্ছে । হলুদ, সম্ভবত ওরিয়ল । ছোট্টো টুনটুনি । দোয়েল, ময়না, শালিখ, একটা নীলডানা অচেনা পাখি । কোকিল ডাকছে, কিন্তু দেখতে পেলুম না ।
গাছে উঠে কচি নিমপাতা পাড়ছে কেউ, বেচবে বোধহয় বাঁশদ্রোণী বাজারে । সলিলা ওটা রেলিশ করে না । তেতো মানে শুক্ত । লালচে শাড়ি মোটা বউ পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ডুমুর পেড়ে নিল প্লাসটিকের বালতিতে । এত ভোরেও পুকুরে স্নান চলছে ।
বিছানায় ফিরে ফিজিওথেরাপি করলুম । পিয়ারলেসে অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির সময়ে ভুল ওষুধে আর্থারাইটিস হয়েছিল । উঠে, দেয়ালে স্লেট টাঙিয়ে এবিসিডি ১২৩৪ অআকখ অভ্যাস করলুম মিনিট কুড়ি, যাতে হাত কাঁপা নিয়ন্ত্রণ হয়, ডা ডি কে দাসের নির্দেশ । উপদেশ দিয়ে স্বর্গগামী হলেন উনি ।
চায়ের জল দুধ গরম বসিয়ে দাঁত ব্রাশ করলুম । সলিলাকে বললুম জলখাবারে ‘আলুপোহা’ বা ‘সাবু-খিচুড়ি’ বানাতে । কাড়ি পাতা হিং ফোড়ন দিয়ে । সঙ্গে চিনেবাদাম ।
টেলিফোন, ‘অতএব ভাবনা’ সম্পাদক শংকর সরকারের । শনিবার দুপুরে আসবেন ।
ভোলা, দুধ দেয়, জানালো, নিচে, সিঁড়ির মুখে আমাদের কলিং বেলের সুইচটা ছিল, কেউ উপড়ে দিয়েছে । বললুম, ‘আজকে দেখলে ? ওটা তো পুজোর সময় ছিলুম না বলে চাঁদা পার্টিরা তারসুদ্দু উপড়ে নিয়ে গেছে’ । ভোলা নিজের নামসইও শেখেনি । মুম্বাইতে যে ছেলেটা দুধ দিত, ক্যালকুলেটার রাখত । যে ছেলেটা পুরনো খবরের কাগজ কিনতে আসত, সেও রাখত ।
কাগজের জন্যে অপেক্ষা করছিলুম । বাংলা কাগজ এড়িয়ে যাই । খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, গণলুঠ, তছরুপ, কারচুপি, আর কত পড়া যায় রোজ-রোজ । কালকের খাস খবরে বলেছিল, শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, অটলবিহারীর হাত থেকে বিড়লা পুরস্কার নেবেন না । কিন্তু আনন্দবাজারে কিছুই বেরোয়নি । টাইমস অফ ইনডিয়াতেও নেই । ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলুম না । বিড়লার পুরস্কার নেয়া যায়, অথচ যে দলটাকে তারা ফাইনান্স করে, তার নেতার হাত থেকে সেটা নেয়া যায় না । তরুণ কবিরা এই জন্যই শঙ্খ ঘোষকে ভয় পান । শঙ্খ বোধহয় জানেন না, তাঁর সম্পর্কে তরুণদের মনে কেমনধারা আতঙ্ক । তারাপদ আচার্য শঙ্খ সম্পর্কে ঠিকমতো বিশ্লেষণ করতে পারেননি । তারাপদর লেখাটাও আতঙ্কপ্রসূত একটি পলিটিকালি কারেক্ট গদ্য । মাল্টি ডিসিপ্লিনারি চিন্তা নেই ।
এখন যেতে হবে ব্যাঙ্কে । পড়া বা লেখার সময় হবে না । ব্যাঙ্কে আমার সই মেলে না । বাপ্পাকে টাকা পাঠাতে হবে এমটি করে । ব্যাঙ্ক অফ বরোদায় তবু কাজ হয় । এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক তো আলঝিমার রুগিরা চালায় । কলকাতায় হেড অফিস মানেই আমাগো দাদারা তাকে ছিবড়ে বানিয়েছেন । আসার সময়ে চাল ডাল ইত্যাদি কেনাকাটা করে নিলুম । সলিলা বইবে কিছুটা । ডাক্তারের নির্দেশে এক-দু কিলোর বেশি বই না, সাধারণত ।
বাড়ি ফিরতে উৎপল ভট্টাচার্যের ফোন । বলল, দু-ঘণ্টা যাবৎ ফোন করছি, রিং হয়েই চলেছে । সন্ধ্যাবেলা আসবে । বাড়িতে কেউ আসলে, কিছুই থাকে না খাওয়াবার, মদ ছাড়া । উৎপল খায় না । কলিম, ধুর্জটি চন্দ, পার্থ, জহরও খায় না । মদ খাই বলে, যারা খায় না, তাদের ভালোলাগে, শ্রদ্ধা হয় ।
সলিলাকে হেল্প করতে চচ্চড়ি কাটতে বসলুম । শাকের শেকড় দেয়া চচ্চড়ি আমার দারুণ লাগে । শেকড়গুলো ছুরি দিয়ে চাঁছলুম । শাকের পাতা কুচোলুম কাঁচি দিয়ে । আলু, বেগুন, শিম, বরবটি, বিন, কুড়ো, রাঙাআলু কেটে রান্নাঘরে দিয়েলুম । চচ্চড়ির জন্যে সর্ষের তেল কিনি । বাদবাকি ফ্লোরা । পাটনায় থাকতে, মা আমের আচারের তেলে চচ্চড়ি রাঁধতেন ।
শিবুর চায়ের দোকানে গুলতানি শুনে উঁকি মেরে দেখলুম, কচি-কচি কচ্ছপ কাটা চলছে । সিপিয়েম আর তৃণমূলের এই বুঁদির কেল্লায় বেতোরুগিরা আইন মানে না । জীবন যাপনটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে আইন অমান্য । একতলার যুবক-যুবতী দম্পতি চাকরিতে বেরিয়ে যাবার পর যে দুজন তরুণী ওদের বাচ্চা সামলায়, তারাও কচ্ছপ-কাটা ভিড়ে পাড়ার তরুণ হুকিং করার চেষ্টায় নিজেদের আলগা করেছে । বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিড়টার কুশীলবদের হরকতগুলো উপভোগ করা গেল । একে ফ্লার্ট করা বলে না । এ একেবারে আসল দাঁতনখের অদৃশ্য ছেঁড়াছিঁড়ি । জানুয়ারির শীতের সন্ধ্যায় অবশ্য প্রতিটি ল্যাম্পপোস্টের তলায় র্যাপার গায়ে পাড়াতুতো প্রেম চলে । প্রেম রিডিফাইনড ।
‘যুক্তাক্ষর’ পত্রিকায় প্রকাশিত ওর কবিতা সম্পর্কে মতামত জানিয়ে শঙ্করনাথ চক্রবর্তীকে চিঠি লিখলুম । রবীন্দ্র গুহকে চিঠি দিলুম গুরগাঁও যাচ্ছি জানিয়ে । ঋতব্রত মিত্রকে ওর কাব্যগ্রন্হের প্রাপ্তি জানালুম । ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর জন্য প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধ চেয়েছে । সময় হবে না, বাইরে যাচ্ছি । কবিতা কপি করলুম ওর জন্য ।
মাইকেল পোলন-এর ‘দি বটানি অব ডিজায়ার’ বইটা পড়ছিলুম ।
সলিলা চান করার তাড়া দিতে উঠতে হল । ভাতও হয়ে গেছে । খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে । আমি চান করতে গেলে ও একতলায় চিঠি আনতে গেল । ট্যাঙ্কের জল বেশ গরম । চিন্তা আরামকে নষ্ট করে ।
আজ চিঠি নেই । বা, চিঠি-দিদিমণি আসেননি ।
এন থিয়স, দ্য গড উইদিন, হয়ে গেছে ‘এনথু’ । কতভাবে বাঙালির পালটে যাওয়া সমাজটাকে টের পাচ্ছি । ডেভিড লেহম্যানের ‘সাইনস অফ টাইমস’ । আরও আছে । প্রেম ব্যাপারটাই তো সৌন্দর্যের ধারণাকে নস্যাৎ করে । একটা চরিত্র যে ইসকুল থেকে, কলেজ থেকে, পরিবার থেকে, চাকরি থেকে এক্সপেলড । বিদঘুটে চরিত্ররা ভয় দেখায় । টেপ চালানো হয়েছে, সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন বলে নাক ফুলিয়ে গম্ভীর । টেপটা গানের বদলে শ্রোতাদের যাচ্ছেতাই গালমন্দ আরম্ভ করল, মহিলাকন্ঠে । রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এলিট গৃহবধু গায়িকারা ফিউনারাল সং করে ফেলেছেন বলে তাঁদের জন্যে চোখা-চোখা । শহরটা আগাপাশতলা উই, কেঁচো, বিছে, আরশোলা, উচ্চিংড়ে, ইঁদুর, ছুঁচো, ভিমরুল, মাছিতে ঠাসা, তারা বাংলায় কথা বলছে । ‘স্যার’ বলতে লজ্জা করে বলে ‘বস’ । অন্ধত্বের চাক্ষুষ প্রমাণ ওর ছড়ি ।
কলিম খান, অরবিন্দ প্রধান এলেন বিকেলে । আজকাল বড় বক্তৃতা দিয়ে ফেলি । কলিমের কাছে সনাতন সূত্রগুলো পাওয়া যায় । ডলি দত্তর ‘নরক’ সংখ্যা দিলেন । ডলি দত্ত নরক সম্পর্কে লেখা চেয়েছেন, বই বার করবেন । অরবিন্দ ওঁর বই দিলেন । নরক সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই ।
ওঁরা যেতে সমীর বসুর পদক্ষেপ পত্রিকার প্রবাসী সংখ্যায় দেবার জন্য লেখাটায় চোখ বোলালুম । শিরোনাম দিয়েছি ‘ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক’ । কাল রেজিস্ট্রি করে দেব । ওঁদের তো আমার মতামত রোচে না, অরবিন্দ বললেনও সে কথাটা । তবে লেখা চাওয়া কেন ?
আজকে আর হুইস্কি খাওয়া যাবে না । ঘুমের ওষুধ খেতে হবে । মদ খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে । আজকাল বড় হাত কাঁপে ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ সম্পর্কে লেখাটা আধখ্যাঁচড়া হয়ে পড়ে আছে তথ্যের অভাবে । গ্যারি স্নাইডার আর সিটি লাইটসে লরেন্স ফেরলিংঘেট্টিকে ই-মেল করেছিলুম । গ্যারি জানিয়েছে ও বব রোজেনথালকে লিখেছে । ববের জবাব না পেলে আর কিছু করার নেই । অশোক চট্টোপাধ্যায়, কাজল সেন, শিমুল আজাদ, অনেকেই চেয়েছেন লেখাটা । উৎপল ভট্টাচার্য এলো । ‘নাটকসমগ্র’ এনেছে গোটা বিশেক । ভালোই । অনেকে চেয়েছেন । ‘আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা’ উৎসর্গ করেছি উৎপলকে । ছাপা, বাঁধাই, গেট আপ ভালো হয়নি বলে ও ক্ষুণ্ণ । ‘পোস্টমডার্ন জীবনানন্দ’ যেটা ‘দিশা’য় বেরিয়েছে গ্রন্হাকারে বের করতে চায় ও । কিন্তু লেখাটায় আরেকটু শাঁস ঢোকাতে হবে । অতএব বৈশাখে হবে না । মে মাসে ফিরলে, তখন । ‘ভালো’ প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটা প্রবন্ধের বইও বের করতে চায় । এঁচোড়ের তরকারি খেয়ে ও থ্রিলড । গিন্সবার্গ সঢম্পর্কে রচনাটা ওর ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় দেব ।
সলিলা রান্নাঘরে ব্যস্ত । এ এক্স এন-এ পামেলা অ্যান্ডারসন লি-র ভি আই পি দেখলুম । সিনেমা ব্যাপারটাই রিডিফাইনড । গল্প নেই, বিশেষ ঘটনা নেই, যৌনতাও নেই । কেবল একজন বিদেশিনীর বুকের মাপের ওপর নির্ভরশীল চলচ্চিত্র । বুকটা প্যাকেজিং করা প্রডাক্ট । পাছার প্যাকেজিংও চলছে । শিল্পা শেট্টি নাকি তিনচার বার নাক পালটিয়েছে । বাপ্পার দেয়া তথ্য ।
ড্রইংরুমেই খাবারের সবকিছু নিয়ে এল সলিলা । খেতে-খেতে চ্যানেল সারফিং চলল । সিংহ হরিণ খাচ্ছে, আমরা রুটি ।
Note : জেগে থাকার জন্যে বেনজেড্রিন, স্বপ্ন দেখার জন্যে মেসকালিন, ঘুমোবার জন্যে পেথিড্রিন ।
একজন মানুষের সৌম্যকান্তি ধ্বংসাবশেষ ! ইনোসেন্স রিক্লেইমস হিম । কেমিকালস অব হুইস্কি কনকক্টস আ কনশাসনেস । ব্লাড বটল্ড ইন পেনিস । উই সিংক ডাউন সফ্টলি ইন আওয়ার ওন প্রবলেমস । দি রাইটিং ওয়েইলস লাইক অ্যান এণ্ডলেসলি এক্সপায়ারিং সোপ্রানো । দি হোপলেস লুজার হোপস টু উইন বাই লুজিং বিগ ।
ঘুমের ওষুধ আর হুইস্কিতে অনেক তফাত ।
মশাল বাহকরা বেরিয়েছে । চৌঠা এপ্রিল ব্রিগেড চলো । থার্ড জেনারেশান ডায়াসপোরা ।
শুভময় সরকারের ‘মল্লার’ পত্রিকার জন্যে লিখতে বসলুম । ভেবে নিয়েছি লেখাটা । নাম দিচ্ছি ‘শহিদ’ । আশা করছি শুভময় আর ওর পাঠকরা ডিসকোর্সের ইমপোর্টটা হজম করতে পারবে ।
শহিদ
লুঙ্গিতে জিভছোলা গুঁজে, দাঁট-ব্রাশ অর্ধেক বাকি রেখে, থানার ডাকবাবু বিপিন নামহাটা, চটকল, মানে এলিজাবেথ জুটমিল, বছর খানেকের বেশি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও, যিনি ভোরবেলা রোঁদের এই বদভ্যাস বজায় রেখেছেন, একদা যে-অভ্যাসে উনি মগ হাতে রেল লাইনের ধারে হাগতে-আসা কুলি ব্যারাকের শ্রমিকদের তোলা জমা দেবার শেষ নোটিস দিতেন, বা মহাজনের হয়ে মজুরদের মাইনের ডিউ স্লিপ কিনে নিতেন, তিনচথুর্তাংশ বা আধা দামে, কেননা সকালবেলায় এই জায়গাটিতে আসতেই হবে যাঁরা বিহার-উড়িষ্যায় নিজের গাঁয়ে ফিরে যাননি, তাঁদের । উনি, বিপিন নামহাটা, রেল লাইনের ধারে পড়ে থাকা শবের কেবল ধড়টুকু দেখে চিনে ফেললেন যে, সেটা হাজিরাবাবু, চটকলের পে ক্লার্ক সত্য আচাজ্জির ।
তাঁর, ডাকবাবুর, আতঙ্কিত চিৎকারে, যাঁরা উদাসীন চাউনি মেলে কয়লা আর ছাইগুঁড়োর ওপরে বসেভ হাগছিলেন, তাঁদের অনেকেই, মগ হাতে বা ফেলে রেখে, ছুটে এলেন । আদপে বিহারি বা উড়িয়া হলেও, তৃতীয় পুরুষে পৌঁছে, এই শ্রমিকেরা হয়ে গেছেন হাইব্রিড বাঙালি । মিল বন্ধ হতে, লালু যাদবের দলের র্যালি, র্যালা, রঙ্গরলিয়াতে অংশগ্রহণ করে যৎসামান্য রোজগারের ধান্দায় বহু শ্রমিক চলে গেছেন বিহারে । কিছু শ্রমিক গমের কাটাই করতে, কুলি ব্যারাকে পরিবারকে রেখে, না রাখলে জবরদখল হয়ে যেতে পারে, চলে গেছেন পাঞ্জাব-হরিয়ানায় । রিকশা চালাতে শহরে, কাছাকাছি শহরগুলোয়, চলে গেছেন অনেকে ।
মিলে লকআউট হবার দুবছর আগে থেকেউ উৎপাদনের গোলমাল চলছিল । গানিং আর স্যাকিং বিভাগ তো কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । কাঁচা পাট কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গুদামে আগুন লাগার পর । পাট হয় উত্তরবঙ্গে । মিলটা হুগলি জেলায় । গুদামগুলো অধিকাংশ মালদহ জেলায় । মালদহ থেকে চোরাচালান হতো বাংলাদেশে । তিনটে পাচাররত ট্রাক ধরা পড়ে যাওয়ায়, গুদামগুলোয়, ফাঁকা অথচ কাগজে-কলমে স্টক ভর্তি গুদামগুলোয়, আগুন ধরাতে হয়েছিল । ভুয়ো স্টক অবশ্য বিমা করা ছিল ।
হাজিরাবাবু সত্য আচাজ্জির কোথাও যাবার ছিল না । দেশ-গাঁ খেয়েছে জিন্না-নেহেরুরা । পাকা গমের গোছা কীভাবে কাটতে হয় জানেন না । খালেদালি মণ্ডলের মতন ফকির বা বাউল সেজে গান গেয়ে ভিকখে করার কৃৎকৌশল জানানেই । প্যাংলা মধ্যবিত্ত চেহারায় রিকশা চালাবার উপায় আর মানসিকতা ছিল না । পার্টিতে ঢুকে রোজগারের হিল্লে খুঁজেছিলেন, পাত্তা পাননি । চটকল বন্ধ বলে ইউনিয়ান নেতারা ওব্দি যে-যার দালালখুরির ফিক্স ডিপোজিট ভাঙিয়ে খাচ্ছেন । ধারে কিনে-কিনে মুদির দোকান দুটোর লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছেন চটকল কর্মীরা ।
এরকম অবস্হায় বেঁচে থাকার একটিমাত্র পথ খোলা ছিল । আত্মহত্যা করা ।
চিৎকার পাড়ার পর ডাকবাবু বিপিন নামহাটা খুঁজে পেলেন মুণ্ডুটা । রেল লাইনের পাশের ডোবায় ।
–তোরা ভোরবেলা থেকে ডোবাটায় ছোঁচাচ্ছিস, কেউ দেখতে পাসনি ?
–ডোবার কাদাঘোলা জলে আর কেউ ছোঁচায় না , আমরা মগ আনি ।
–আরে, এ তো হাজিরাবাবু । শালা জিরো নম্বর মজুরদের থেকে দশ পারসেন্ট খেত ।
–কেউ খুন করেনি তো ? সকলের পোঁদে এমন বাঁস করত ।
–এ শালা লম্বরদার ইউনিয়ানের আর মালিকের খোচর ছিল ।
–বাঞ্চোৎটা নিশ্চই আত্মহত্যা করেছে । আর তো কেউ ধার দিচ্ছিল না । না খেতে পেয়ে মরেছে । অত বাচ্চা পয়দা করার মজা বোঝো এবাএ !
–রাত্তিরের কোনো মেল ট্রেন ছিল মনে হয় । অত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছে মুণ্ডুটা ।
–শেয়াল-শকুন তো আর নেই । নইলে দিত ছেঁড়াছিঁড়ি করে ।
–কেউ হাত-টাত দিসনি লাশে । আমি থানায় গিয়ে খবর দিচ্ছি ।
–আরে এই পাপী লাশ ছোঁয় কেউ ! পচুক রোদ্দুরে ।
একটা মজুর মরলে দুটো মজুরের চাকরি জুটছে । তা থেকে ইউনিয়ান নেতাদের, চটকল মালিকের আর আমারও লাভ ; হাজিরাবাবু সত্য আচার্য, মানে সতে আচাজ্জি, কথাটা ভেবে অবাক হলেন । অবাক হলেন বলে ওনার অবাক লাগছিল । অবাক হলেও মনে-মনে আনন্দ হয় ! কাংগাল চামারটা মরে যেতে, সবাই বলেন, সবাই মানে মজুররা, কাংগালটাকে ফুসলিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে তুলেছিলেন ডাকবাবু বিপিন নামহাটা, তারপর এমন খাকি থার্ড ডিগ্রি, ফোর্থ ডিগ্রি, ফিফথ ডিগ্রি, সিক্সথ ডিগ্রি, সেভেন্হ ডিগ্রি, নাইন্হ ডিগ্রি দিয়েছিলেন বামপন্হী মজুরদরদী সরকার বাহাদুর, যে, থেঁতলে একেবারে মাধ্যমিক পাস । লাশ নাকি পাথর বেঁধে মাঝ-গঙ্গায় এমনভাবে ফেলার ব্যবস্হা করেছিলেন, মাছেরা ওব্দি খুবলে-খাবলে ভাসাতে পারেনি ।
কাংগাল চামারকে নিয়ে এসব গালগল্প কিংবদন্তি মজুররা বিশ্বাস করেন । চটকল মালিক করেন না । চটকলের ম্যানেজমেন্ট কর্মীরা করেন না । যাঁরা কাঁচা পাট মিলকে সরবরাহ করেন সেসব ফড়েরা করেন না । ইউনিয়ান নেতারা করেন না । মন্ত্রী আর আমলারাও করতেন না আগে, কিন্তু সিবিআই তদন্ত করে কয়েকজনকে চার্জশিট দেয়ায়, করতে বাধ্য হয়েছেন । আসলে যা সত্যি তা যদি কারোর ভাল্লাগে তাহলে কেনই বা বিশ্বাস করবে । ভালো না লাগলে তা কী করে সত্য হবে ! মজুরের সত্য তো আর সত্য নয় ; সত্যের মালিকানার জন্যে চাই ক্ষমতা ।
হাজিরাবাবু সতে আচাজ্জি মনে-মনে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না প্রথমটায়, যখন কাংগাল চামার লোপাট হওয়ায় গোলমাল বেধেছিল কুলি ব্যারাকে । যদিও উনি ম্যানেজমেন্ট কর্মী । কিন্তু সিবিআই যখন সত্যিকে আইনত সত্য বলে প্রমাণ করে দিলে, আর কাংগাল চামারের পোস্টে দুটো মজুর রাখার প্রস্তাব নিয়ে এলেন জনাকয় ইউনিয়ান নেতা, তখন পে ক্লার্ক মশায় সত্য আচার্য নিজের আহ্লাদে আহ্লাদিত হয়েছিলেন ।
কাংগাল চামারটা রেগুলার শ্রমিক ছিলেন । ওনার ই বি নম্বর ছিল । ই বি ০০৫৭, কেন না, উনি ছিলেন টানা আট ঘণ্টার মজুর । এখন ওনার জায়গায় দুটো বিনা নম্বরের মজুর রাখা গেল, খালেদালি মণ্ডল আর বৈকুন্ঠ নস্কর । নম্বর দেয়া শ্রমিক হলে তার মাইনে থেকে কাটৌতি করে মিল । কাটৌতি করে মিলের লোকসান সামলান মিল মালিক । রেগুলার শ্রমিক হলে ইউনিয়ানকে চাঁদা দিতে হয় । যা দিনকাল পড়েছে, শ্রমিকেরা এক সঙ্গে অনেকগুলো ইউনিয়ানের সদস্যতা নিয়ে ফ্যালেন । কেউ-কেউ আবার কোনোটারই সদস্য হন না । হাজিরাবাবুকেও দিতে হয় ফি-হপ্তায়, বোনাসের সময় ছাড়া ।
সর্বহারার সংজ্ঞা তো দাদারা পালটে ফেলে তা সংরক্ষিত রেখেছেন কেরানি আর ইসকুল মাস্টারের জন্যে । বিনা নম্বরের শ্রমিক তো শ্রমিকই নয় । দিনের মজুরি ভাউচারে সই করে ক্যাশ দিয়ে দিলেই হল । খালেদালি মণ্ডল পাঁচ ঘণ্টার কাজ করতেন । বৈকুন্ঠ নস্কর তিন ঘণ্টা । হাজিরাবাবু এঁদের দৈনিক মজুরি থেকে পাঁচ-দশ টাকা কেটে নিতেন প্রতিদিন, ইচ অ্যাকর্ডিং টু হিজ এবিলিটি । ইউনিয়ান নেতাদেরও, প্রতিটি চটকলে, বিনা নম্বরের মজুররা, কড়ার অনুযায়ী দ্যান । হাজার হোক কাজটা তো ওনারাই পাইয়ে দিয়েছেন । মজুরি বিলির সময়ে ওনারা টুল পেতে বসে থাকেন । মুখ বুজে দিয়ে দ্যান মজুররা । গাঁইগুঁই করে লাভ নেই । করলে, কাল থেকে অন্য লোক ঢুকে যাবেন ; ঢুকিয়ে দেবেন ওঁয়ারা ।
মালিকের চিন্তা শুধু নম্বরঅলা মজুরদের নিয়ে । বিনা নম্বরের মজুর মালিকের নথিতে থাকেন না । নথিতে যাঁরা থাকেন তাঁদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, ই এস আই, দুর্ঘটনা ভাতা এসবের ঝক্কি পোয়াতে হয় মালিককে । মালিক তো আসলে মালিক নন, মিলটাকে ভাড়া নিয়ে চালান । ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে না পারলে অন্য কাউকে ভাড়া দিয়ে কেটে পড়েন । এভাবে ভাড়াটে বদল হতে-হতে ঝক্কি-ঝামেলা থেকে যায় মিলের খাতায়-কলমে, আর রেগুলার শ্রমিকের ঘাড়ে । রেগুলার শ্রমিক যত কমেন তত সবায়ের মঙ্গল । সতেবাবু মনে করেন, মানে, মনে করতেন আরকি, সরকারেরও মঙ্গল, কেননা শ্রমিক যটা কমবেন, সেই অনুপাতে শ্রমিকদরদি সরকারের দরদও কমবে । দরদের ভার কম ভার নয়, গদি ফসকে যায় ভারের টাল সামলাতে না পারলে ।
হাজিরাবাবু নিজেকে বামপন্হী মনে করেন, মানে করতেন । পঞ্চায়েত নির্বাচনে পার্টির টিকিট পাননি বলে বিক্ষুব্ধ সিপিএম তকমা নিয়ে হেরেছিলেন নিজের কোতলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে । এতে একটা সুবিধে হয়েছে যে, মানে হয়েছিল আরকি, সতেবাবু, আচাজ্জিবাবু, পে-ক্লার্কবাবু, ক্যাশবাবু না বলে, সবাই ওনাকে এখন কমরেড বলে ডাকে । আড়ালে, কাটৌতি কমরেড । ওনার আশেপাশের বাদবাকি কমরেডদের মতন উনিও মার্কস এঙ্গলস লেনিন স্তালিন মাও পড়েননি । রাশিয়ায় ছাপা বিটকেল গন্ধের অনুবাদেও পড়েননি । ওই ইশকুল মাস্টারমশায় জ্ঞান দেবার সময়ে যেটুকু পড়িয়েছিলেন ।
কমরেড নামটা উনি এদান্তি ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলেন । তৃণমূলে দহরম-মহরম করতে শুরু করেছেন একটু-আধটু । তা ওখানে আবার কমরেড চলে না ; লাল রঙ দেখলেই তেলে-বেগুন । না চলুক । বিনা নম্বরের মজুর বাড়ছেন দিনকে দিন । নির্বাচনে খরচ করার মতন রেস্ত চাই । গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ হল রেস্ত, জানেন উনি, মানে জানতেন আরকি । ইউনিয়ানের লোকগুলো ওনাকে খাতির করেন বটে । কিন্তু ওনারা সব কলকাতা-বর্ধমান-ব্যাণ্ডেল-চুঁচড়োর লোক, কোতলবেড়িয়ার নন । আসলে তো ওনারা তো আর মজুর নন, ওনারা নেতা ।
চটকলের মজুরগুলো ইউনিয়ানগুলোকে বলেন এক লম্বর, দোলম্বর, তিন লম্বর, চার লম্বর, এভাবে আটঠারা পর্যন্ত । সদস্যসংখ্যা দিয়ে নির্ণীত নয় ইউনিয়ানের নম্বর । কুলি ব্যারেকে ফেরার পথে যে ইউনিয়ান দপ্তরের সাইনবোর্ড সবচে প্রথমে পড়ে, সেটা এক লম্বর । মিল থেকে যে সাইনবোর্ডটা সবচে দূরে অথচ কুলি ব্যারাকের কাছে সেটা আটঠারা লম্বর । অ্যাতো ইউনিয়ান আত তার অ্যাতো আংরেজি খটমট নাম বাড়ছে দিনকে দিন, যে, নামের বদলে লম্বর মনে রাখা সহজ । তাছাড়া মনে রেখেই বা কী হবে ! সব কটা তো মালিকের চামচা । অনেকে একই সঙ্গে মালিক আর সরকারের চামচা ।
চামচাদের বাদ দেবার জন্যে কিছু মজুর একটা নতুন ইউনিয়ান চালু করতে চাইছেন । সরকার অবশ্য ওনাদের দরখাস্ত মঞ্জুর করেননি । এক লম্বর ইউনিয়ানের নেতা নীরেন মজুমদার আর দুলম্বর ইউনিয়ানের নেতা সুব্রত দাশমুন্সি বলেছেন যে আমরা পশ্চিমবঙ্গকে ডি-ইনডাসট্রিয়ালাইজ হতে দেব, কিন্তু এসব বিকল্পবাজির নামে ডি-ইউনিয়ানাইজ করা চলবে না । চটকল থাকুক বা না থাকুক, ট্রেড ইউনিয়ান না থাকলে নেতা খাবেন কি ? অ্যাঁ ? আগে চটকল না আগে আদর্শ ? অ্যাঁ ? আদর্শের জন্যে প্রাণ যায় যাবে । ওই তো এলটিটিই উলফা জেকেএলএফ আলউমমা সিমি ওনারা তো জান লড়িয়ে দিচ্ছেন আদর্শের জন্যে । ওনারা কি নিজেদের দেশের চটকল আগলে বসে আছেন ? অ্যাঁ ? তবে ? আদর্শের বিকল্প হয় না । তবে হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে আদর্শকে এক থেকে আটঠারা লম্বরে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় । যখন যে আদর্শের সরকার বাহাদুর, তখন সে আদর্শ বেশি তোলা আদায় করবে । তোলা মানে দান । দান মানে কিন্তু তোলা নয়, পার্থক্যটা বুঝতে হবে, না বুঝলে আদর্শকে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না ।
মিলগুলোও তোলা আদায় করে । এলিজাবেথ জুট মিলে কাটৌতি হয় । সব মিলে হয় না তা বলে । যেখানে লম্বরদার ইউনিয়ানদের সঙ্গে মালিকে কাটৌতির চুক্তি হয়েছে, সেখানে হয় । কোন চটকলে কত কাটৌতি হয়, তা লেখা আছে হাজিরাবাবুর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে :-
প্রেমচাঁদ : মাসিক ৯০০ টাকা
তিরুপতি : মাসিক ৮০০ টাকা
শ্রীহনুমান : মাসিক ৩৭৫ টাকা
নর্থব্রুক : মাসিক ১২৫ টাকা
কানোরিয়া : মাসিক ৩৩০ টাকা
শ্রমিকরা তাই লম্বরদারদের ছেড়ে নিজেদে বিকল্প ইউনিয়ান গড়তে চাইছেন । শালা প্রলেতারিয়েত, তোর এত বড় বুকের পাটা ? পাতিবুর্জোয়াদের নেতৃত্ব অস্বীকার করে তুই নিজেই ইউনিয়ান গড়তে চললি ? এ যে কি বিপদ তা সত্য আচার্য জানেন । মিলে চাকরিকরছেন আজ প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল । এলিজাবেথ জুট মিলের দেখাদেখি অন্য মিলগুলোতেও বিকল্প ইউনিয়ানের ভুত শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপেছেন । মিলের শরীর যত খারাপ হয় তত বেশি বিকল্প ইউনিয়ানের সম্ভাবনা । বিকল্প ইউনিয়ানের নামে কোনো সংস্হাকে যাতে রেজিস্ট্রেশান দেয়া না হয়, তাই মন্ত্রীর দরবারে তদবির করেছিলেন এক থেকে আটঠারা লম্বরের সব লম্বরদাররা। দরখাস্ত এখন মাকড়সার জালে । মন্ত্রীরা জানেন মাকড়সার জাল এক রকমের শিল্প, কত যত্নআত্তি করতে হয় তাকে টিকিয়ে রাখতে ।
মন্ত্রী কথা দিয়েছেন । বলেছেন, উনি নিজেও এককালে লম্বরদার ছিলেন । কোনো লম্বরদারের পোঁদের তলা থেকে কুর্সি সরিয়ে নেয়া যে কত বড় বজ্জাতি তা তিনি জানেন । ফলে এলিজাবেথ জুট মিলে সাসপেনশান অব ওয়ার্কের নোটিস নিশুতিরাতে ঝুলে যায়, কিন্তু লম্বরদারদের কুর্সি বজায় থাকে । সাসপেনশান অব ওয়ার্কের নোটিস ঝুললে, মজুররা মাইনে না পেলে, সতে আচাজ্জির উপরি তো গেলই, নিজের চাগরিটা হারাবার ভয়ও চাগিয়ে ওঠে । এসব ভাড়াটে মালিকদের মতিগতি শেয়ার বাজারের ওঠানামার মতন চলে । কখন যে কে ছাঁটাই হয়ে যাবেন ঠিক নেই । পি-এফ এর টাকা কাটে মাইনে থেকে, সরকারে জমা না দিয়ে মালিক নিজে হড়পে নেন । ই এস আই এর টাকা হড়পে নেন । তারপর কেটে পড়েন ভাড়াটে মালিক । মারা টাকায় কোথাও মল বা মাল্টিপ্লেক্স খোলেন। অন্য ভাড়াটে মালিক আসেন । এভাবেই চলতে থাকে । কোন চটকল কতটা হড়পে নিয়েছে সেসব লেখাজোখা আছে হাজিরাবাবুর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ।
চটকলের নাম………..কত টাকা প্রভিডেন্ট ফাণ্ড হড়পেছে……কত টাকা ই এস আই হড়পেছে
অম্বিকা………………২৩৯ লাখ………………………………… -……………………………
মেঘনা………………..৫২৪ লাখ…………………………………২০৫ লাখ…………………..
অ্যাঙ্গাস……………….৭৭৬ লাখ………………………………..৩১৩ লাখ…………………
ভিক্টোরিয়া……………৭২৪ লাখ…………………………………২ লাখ……………………..
নদিয়া…………………২০৯ লাখ……………………………….২০১ লাখ……………….
কাঁকিনাড়া……………..৫৩৮ লাখ……………………………..৪৯ লাখ……………..
ইস্টার্ন…………………..৭০ লাখ……………………………….১৩০ লাখ………..
গৌরীশঙ্কর……………….১০৯ লাখ……………………………১৬৭ লাখ……….
হাওড়া…………………….১৯৩ লাখ…………………………..১৬৭ লাখ……..
বরানগর………………….৫৭৮ লাখ…………………………..২৭৮ লাখ………
ডেল্টা……………………..৮২ লাখ……………………………১৮ লাখ…………..
নৈহাটি…………………….৪০ লাখ……………………………৩ লাখ………….
আগড়পাড়া………………২৯১ লাখ…………………………..১২৭ লাখ………….
শ্যামনগর………………….৬৯৮ লাখ………………………. – ………………..
গৌরীপুর……………………১২৩৬ লাখ……………………..২৫৮ লাখ………
কেলভিন……………………৪৯৪ লাখ………………………….২৫২ লাখ………
টিটাগড়…………………….৭৫১ লাখ………………………….৩৩৬ লাখ……..
নিউ সেন্ট্রাল……………….৭৫২ লাখ…………………………..১২ লাখ……..
নর্থব্রুক…………………….৮৫ লাখ……………………………৬০ লাখ……
বজবজ……………………….২০৭ লাখ…………………………২৬ লাখ……
কামারহাটি……………………২২ লাখ…………………………..৮৪ লাখ…..
অ্যাংলো ইন্ডিয়া……………….২৫ লাখ………………………..১৬ লাখ……………….
কানোরিয়া……………………..৭৭ লাখ………………………..৩৬ লাখ…
হাজিরাবাবু নিজের ডায়েরিটার মলাট দেখলেন । পাঁচ বছর আগের । ওঃ । এই পাঁচ বছরে তো সংখ্যাগুলো নির্ঘাত দ্বিগুণ হয়ে গেছে । তাঁর নিজে, এলিজাবেথ জুট মিলে, উনি জানেন, কোনো হিসেব-নিকেশ নেই এসব খাতে । জেনারাল ম্যানেজারকে জিগ্যাস করেছিলেন একবার । উনি বললেন, ফি নির্বাচনে পার্টি ফাণ্ডে যে দান করা হয়, তা তো এই সব অ্যাকাউন্ট থেকেই বের করতে হয় । হক কথা । মালিক কেনই বা গাঁটের কড়ি খরচ করে এইসব পার্টিগুলোর নির্বাচনী তহবিলে টাকা ঢালবেন । কেন্দ্রে যাঁরা সরকার গড়বেন তাঁদের দিতে হবে, যাতে আয়কর বিক্রয়কর আবগারি করের ঝূঠঝামেলা না পাকায় । যাঁরা রাজ্যে সরকার গড়বেন, তাঁদের না দিলে টিকে থাকা মুশকিল করে দেবেন । তার ওপর আবার নেতাদের খাইখরচ মদ-মাগি আছে ।
হাজিরাবাবু এই বছর দশেক হল রোজনাচা লিখে রাখছেন নিজের ডায়েরিতে, কেননা ওনার দাদুর একটা অনিয়মিত ডায়েরি ওনাকে উৎসাহিত করেছিল । ঠাকুর্দা পুলিশে চাকরি করতেন, সুরাবর্দি সাহেবের পুলিশে, বিশেষ লেখাপড়া করেননি । কিন্তু তাঁর ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭-এ লেখা রোজনামচা পড়ে বেশ গদগদ হয়েছিলেন হাজিরাবাবু, দাদুর ডায়েরির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলেন বিশে ফেব্রুয়ারির খতিয়ান পড়ে ।
সতে আচাজ্জির দাদু লিখেছিলেন :
“অদ্য মনের সুখে মানুষ হত্যা করিলাম। খাঁপুর গ্রামে কতিপয় চাষা এক অদ্ভুত আন্দোলন করিতেছিল । তাহার নাম তেভাগা আন্দোলন । দারোগাবাবু আমাদিগে চিরির বন্দর থানার বাজিতপুরে গত চৌঠা জানুয়ারি কৃষকগণ কর্তৃক পুলিশ হত্যার ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া উত্তপ্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন । জিপে বসিয়া আমরা গুলি ভরিবার সময়ে নির্ণয় লইয়াছিলাম যে চিরির বন্দরে নিহত দারোগাবাবুর আত্মার সদ্গতির উদ্দেশে অদ্য প্রতিশোধ লইব । আমরা ১২১ রাউণ্ড গুলি চালাইয়া মাত্র কুড়িজনকে হত্যা করিলাম, করিতে বাধ্য হইলাম । গাড়ি যাহাতে ভিতরে প্রবেশ না করিতে পারে, সেহেতু গ্রামবাসীগণ গ্রামের কাঁচা রাস্তা কাটিয়া রাখিয়াছিল । তির ধনুক দা বল্লম লইয়া গ্রামবাসীগণ আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে দেখিয়া আমরা গাড়িতে বসিয়াই গুলি চালাইলাম । আমার গুলির টিপ অব্যর্থ বলিয়া আমিই প্রথম গুলি চালাইলাম । থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ম্যাগাজিনে পাঁচটি বুলেট ছিল । চাষাদিগের নেতা চিয়ারসাই শেখ আমার গুলি খাইয়া লুটাইয়া পড়িল । তারপর আমাদের গুলি একে একে ভেদ করিল গুরুচরণ বর্মণ, কোল কামার, হপন মার্ডি, কৈলাস ভূঁইমালিকে । আমি উহাদের শহিদ করিলাম । আমার জন্যই উহারা শহিদ হইল, হয়ত অমরত্ব প্রাপ্ত হইবেক । এতদ্বারা প্রমাণিত হয় যে কোনো মানুষই স্বেচ্ছায় শহিদ হইতে পারে না । তাহাতে অন্যের অবদান থাকে । তাং ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ ।”
দাদুর ডায়েরি বহুবার পড়েছেন হাজিরাবাবু । রোজনামচার এই কুড়ি তারিখের লেখাটা যে কতবার পড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই । সত্যি তো । কোনো লোকই নিজে থেকে শহিদ হন না । শহিদ হতে হলে প্রতিপক্ষ চাই । প্রতিপক্ষ দিয়ে বিচার হয় যে কে শহিদ আর কে শহিদ নন । চিরির বন্দরে দারোগাবাবুর ওভারকোট ফুঁড়ে ওনার বুকে তির ঢুকে গিয়েছিল ; অথচ উনি শহিদ হলেন না, ওনার নামও মনে রাখেন না কেউ । যাঁরা ওনার দিকে তির ছুঁড়েছিলেন, তাঁদের দলের সমিরুদ্দিন মিয়াঁ আর শিবরাম মাঝি ওনার গুলিতে মরে অমর হয়ে গেলেন । কার জন্যে অমর হলেন শুনি ? প্রতিপক্ষের জন্যে । কলকাতা শহরের নর্দমার ধারে-ধারে যে লাল বা কালো বা শাদা মিনি শহিদবেদি আছে, সেগুলো কার কেউ জানে না, কিন্তু সবাই জানে যে ওগুলো হবু-শহিদ বনাম প্রতিপক্ষের খুনোখুনির পরিণাম ।
কাংগাল চামার কিন্তু শহিদ হতে পারেননি । প্রতিপক্ষ পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও হননি উনি শহিদ । একজন নয়, দুজন নয়, পুরো থানার কন্সটেবল আর অফিসাররা ওনাকে কড়িকাঠ থেকে উল্টো টাঙিয়ে এত মার মেরেছিলেন, যে হাড় গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল, মুখ বেঁকে গিয়েছিল । উনি শহিদ হতে পারলেন না, কেননা এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের হাতেই তো শহিদ নির্ণয়ের ভার । শহিদের তকমা দেয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে, তাঁরাই কাংগাল চামারের খুন হবার ঘটনাটা ভুলে যাবার, চেপে দেবার, কেস হাপিশ করার চেষ্টায় মশগুল । লোকে দিনকতক পর ভুলে যাবে যে কাংগাল চামার নামে ছিলেন কেউ । এ এক অদ্ভুত ধাঁধা ।
ধাঁধার এখানেই শেষ নয় । গুরুচরণ বর্মনের নাতি, মানে মেয়ে পার্বতীর ছেলে ভাদু রাজবংশি, এখন ঢাকা-বগুড়া থেকে চিনা বোমাবন্দুক এনে কামতাপুরি আন্দোলন করছেন, ব্যাঙ্ক ডাকাতি করছেন বোমাবন্দুক কেনার জন্যে । উনিও মরলে শহিদ হয়ে যাবেন নিজের রাজবংশি লোকেদের মধ্যে, যদিও যে প্রতিপক্ষ পুলিশ কাংগাল চামারকে খুন করেছেন সেই একই প্রতিপক্ষ ভাদু রাজবংশির । ভাদুর দাদামশায় তেভাগা করেছিলেন । ভাদু করছেন কামতাপুরি । মানুষের পৃথিবীটা এরকম কেন ? ফৌজে যেতে চায় না, ছেলেকে কিংবা ভাইকে ফৌজে পাঠাতে চায় না, অথচ লাল ফৌজের গান গায় । রাস্তায় মিছিল বের করে বিপ্লব চাই বিপ্লব চাই বলে চেঁচায়, অথচ মহাকরণের বাইরে বদলি চায় না ।
হাজিরাবাবু বেশ তোতলা । কথা কম বলেন । কম কথা বলেন বলে ভাবেন বেশি । চটের সুতলির মতন বিনা পাকের ভাবনা ।
চটকলের আধুনিকীকরণের জন্যে কেন্দ্র সরকার এক কোটি টাকা দিয়েছিলেন । সেটা হুণ্ডিতে খাটাতে পাঠিয়েছিলেন মালিক । বলেছিলেন সুদ থেকে শ্রমিকদের মজুরি দিতে হবে । সুদ আর আসল এখন দুটোই আটকে আছে হুণ্ডিতে । ম্যানেজার বলেছেন ক্যাশ টাকা না দিয়ে পে-স্লিপগুলো সস্তায় কিনে নেন কয়েকজন লম্বরদার যাঁরা মহাজনি কারবার করেন । মাইনের দিন মানে মদ খাবার দিন । মিলগেটের বাইরেই মদের দোকান । সেটার লাইসেন্স ওই লম্বরদারদের সবচে ঘাগুর । সবাই জানেন ভেজাল দিশি । তবু কিনতে বাধ্য হন শ্রমিকরা কাছেপিঠে অন্য দোকান নেই । অন্য দোকানের লাইসেন্স দেয়া হয় না । আবগারি কর্তারা সমাজকে সুস্হ রাখার কথা ভাববেন, না কি লাইসেন্স দিয়ে খাঁটি মদ খাইয়ে মারবেন শ্রমিকদের । তাছাড়া, চটকলটার শরীর খারাপ হলে মদের দোকানটারও শরীর খারাপ হয় গো ।
এল;ইজাবেধ চটকল আর খুলবে না । শরীর এত খারাপ যে বাঁচবে না । একের পর এক ভাড়াটে মিলমালিক এসে জুটমিলটাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছেন । বি আই এফ আর, মানে বোর্ড অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল রিকন্সট্রাকশানকে ৯৯৪ কোটি টাকার লোকসান দেখিয়েছে মালিক । আই এফ সি আই এর মিল সমীক্ষার ভিত্তিতে চটকলটাকে বন্ধ করার সুপারিশ করবেন কি না ভাবছেন বি আই এফ আর । কোনো ব্যাঙ্ক কিংবা অর্থলগ্নী সংস্হা মিলটাকে টাকা ধার দিতে চান না । আগেকার দেনাই শোধ করতে পারেননি এখনও । কাটৌতি বাবদ শ্রমিকদের তিন কোটি টাকা মেরে কেটে পড়েছেন আগেকার ভাড়াটে মালিক । তার আগের ভাড়াটে মালিক তো শ্রমিকদের ই এস আই, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্র্যাচুইটি, বোনাস বাবদ দুকোটি টাকা মেরে কেটে পড়েছেন ।
বাঁচার এখন একটাই উপায় । আত্মহত্যা ।
উলুবেড়িয়া স্টেশানে বসে আত্মহত্যার চিঠিটা লিখলেন সত্য আচার্য । কিছু একটা না লিখলে বাড়ির লোকেদের নিয়ে টানাটানি করবে পুলিশ-প্রশাসন । তাঁর মৃত্যুর জন্যে যাঁরা দায়ি তাঁরাই টানাটানি করবেন । একজন তো নয় । অনেক । মিল মালিক, কাঁচা পাটের দালাল, লম্বরদার নেতারা, শ্রমিকরা, অর্থলগ্নী সংস্হা, বি আই এফ আর, রাজ্য সরকার, আদালত, কেন্দ্র সরকার, সবাই, সব্বাই ।
চিরকুটটা পকেটে পুরে, রেল লাইনের ধার বরাবর, হাঁটা দিলেন, কোতলবেড়িয়ার দিকে ।
কোতলবেড়িয়ার পঞ্চায়েত প্রধান, জনাকয় লম্বরদার নেতা, জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক, গ্রামের বউ-বাচ্চায় এত ভিড় জমে গিয়েছিল যে নিত্যযাত্রীবাহী ট্রেনগুলো জ্ঞানান্বেষণের জন্যে গতি কমিয়ে পার হচ্ছিল অঘটনের জায়গাটুকু ।
ওসি আর কয়েকজন কন্সটেবল অপেক্ষা করছিলেন লাশ তোলার ভ্যান রিকশার জন্যে । পঞ্চানন পাইককে খবর দেয়া হয়েছে । ভ্যান এনেছিলেন পঞ্চানন, কিন্তু থানা থেকে কাতাদড়ি আর ঢাকা দেবার তেরপল আনতে ভুলে গিয়েছিলেন । পঞ্চায়েত প্রধান ঘটনার খবর জানিয়ে দিয়েছেন জেলা কমিটিকে । জেলা কমিটি জানিয়ে দিয়েছেন এম পি আর ডি এমকে । হাজিরাবাবু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর হহোয়ায় ব্যাপারটা যাতে রাজনৈতিক না হয়ে ওঠে, তা সামলাতে বলেছেন প্রশাসন ।
কাকগুলোকে কে খবর দিয়েছিলেন কে জানে । নেমন্তন্ন খাবার আশায় সার বেঁধে আসন পেতে বসে গেছেন ইলেকট্রিকের আর টেলিফোনের তারে । একটা কুকুরীও পৌঁছে গেছেন নিজের বাচ্চাগুলোকে কিছু পাইয়ে দেবার আশায় । ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে যাবার পর দুচার কুচি মাংস পড়ে থাকবে নিশ্চই ।
বেঁটে মোটা কালো পঞ্চায়েত প্রধান বললেন, চিরকুট-টিরকুট পেলেন নাকি ?
ওসি তাকালেন কন্সটেবলের দিকে, কেননা মর্গে পাঠাবার আগে প্রতিটি মৃতের পকেট হাতড়ানো আর হাতানোর দায়িত্ব তাঁদের ।
–বুক পকেটে একটা কাগজ আছে শ্যার । অন্য পকেটগুলোয় কিছু নেই ।
–দেখুন’দেখুন । আমি আবার তাড়াহুড়োয় চশমাটা ভুলে এসে্ছি ।
একজন কন্সটেবল বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিলে, ওসি সেটি এগিয়ে দ্যান পঞ্চায়েত প্রধানের দিকে । পঞ্চায়েত প্রধান পড়েন চিঠিটা, প্রথমে মনে-মনে, তারপর চেঁচিয়ে সবাইকে শুনিয়ে, “আমি অদ্য স্বেচ্ছায় শহিদ হইলাম, ইতি শহিদ সত্য আচার্য ।”