৩. অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড

অধ্যায় ১১

অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড।

এটা ছাড়া বর্ণনা করার মত করার মত অন্য কোন উপমা মাথায় আসছে না আমার।

সিনেমাটার একটা দৃশ্যে দেখা যায় জেনিফার কনলি, রাসেল ক্রো’র অফিসে ঢুকে দেখে অনেকগুলো কাগজ দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রেখে সুতো দিয়ে একটার সাথে অন্যটার যোগাযোগ দেখানো হয়েছে। বাবার রান্নাঘরের টেবিলটার বিপরীতদিকের দেয়ালেরও একই অবস্থা।

“এগুলো কি?” বাবাকে আরেকটা কাগজ দেয়ালে লাগাতে দেখে বললাম।

উনি ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত। চেহারাটা লাল হয়ে আছে।

“এসবের মানে কি? কি করছেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“অবাক লাগছে?” বড় করে হেসে বললেন তিনি, “দারুণ দেখাচ্ছে?”

ঠিক দারুণ শব্দটা মাথায় ঘুরছে না আমার এখন। বরং পাগলামি বলা যায়। “কতক্ষণ ধরে এগুলো করছেন আপনি?”

“তোমার সাথে শেষবার দেখা হওয়ার পর থেকে।”

“ঘুমাননি?”

“না,” একটা বড় কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন তিনি।

“কয় কাপ কফি শেষ করেছেন?”

“অনেক, অনেক কাপ,” হাত দিয়ে মুখের চারপাশটা মুছে জবাব দিলেন, “কিন্তু থামা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। মনে হচ্ছে বড় কিছু আবিষ্কারের পথে আছি।”

আমাকে বসার জন্যে ইশারা করলেন তিনি।

তার কাছ থেকে দুই মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে ফ্রিজ থেকে ইসাবেলের তৈরি করা একটা বারিটো বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করতে ঢুকিয়ে দিলাম। ওটা গরম হতে হতে দেড় মিনিটের মত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নিলাম। পরে আর সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এরপর বারিটোটা বের করে টেবিলে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।

“তুমি তৈরি?” কথা বলার সময়ও তার পুরো শরীর কাঁপছে উত্তেজনায়।

“হ্যাঁ।”

“কতক্ষণ সময় পাচ্ছি আমি?”

চিন্তা করলাম কিছুক্ষণ। মা এবং ফ্ল্যাশড্রাইভভটা খোঁজার ব্যাপারে একটা কানাগলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সিডনি ওয়েন আমার মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছেন না, আর ডেভিড সুলিভান মৃত। এ মুহূর্তে করার মত কিছু নেই আমার হাতে।

“বন্ধ করার সময় হলে আমি আপনাকে বলব।”

“ঠিক আছে,” চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললেন তিনি। “তো, তোমাকে যেমন বলেছিলাম, ডিটেক্টিভরা ডায়রির পাতাগুলো তারিখ অনুযায়ি সাজাতে ভুল করেছিলেন। পাতাগুলো কে সাজিয়েছিল জানি না, কিন্তু ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর ব্যাপারে তার কোন ধারণাই ছিল না। এর একটা কারণ অবশ্য হতে পারে, ডায়রির লেখাগুলোতে কোন তারিখ উল্লেখ করেনি মেয়েটা।”

আমি মাথা নাড়লাম।

“জেনিফারকে কে খুন করেছে সে-ব্যাপারে আমি তিনটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট দাঁড় করিয়েছি। প্রথমটায়, এমন কেউ ওকে খুন করেছে যাকে সে আগে ব্ল্যাকমেইল করেছিল। দ্বিতীয়টায়, বর্তমানে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে এমন কেউ। আর তৃতীয়টায়, জেনিফারের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে যাচ্ছে এমন কারো হাতে খুন হয়েছে মেয়েটি। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”

বারিটোতে একটা বড় কামড় বসিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।

“এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার যে, ওর হাতে আগে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়া কেউ খুনটা করেছে। মানে, মেয়েটার বয়স ছিল কম আর খুব বেশি টাকাও দাবি করেনি সে কারো কাছ থেকে। একজনের কাছে দ্বিতীয়বার ফিরেও যায়নি সে। ঐ গর্দভ উইঙ্গেলবেরি কিন্তু স্বীকার করেছিল, টাকা না দেয়া সত্ত্বেও ছবিগুলো তাকে দিয়ে দিয়েছিল জেনিফার?”

“আমি এ ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত হতে পারছি না। কেউ কেউ তো রাগ পুষেও রাখতে পারে।”

“তা রাখতে পারে, কিন্তু মেয়েটার ডায়রি মোতাবেক বেশিরভাগ লোকই চুপচাপ মেনে নিয়েছিল ঘটনা। দুইশ ডলার দিয়েই মিটমাট করে ফেলেছে তারা ব্যাপারটা। আর মনে হয় না পরবর্তি জীবনে কখনও পরকিয়া করার সাহস হয়েছে তাদের। সে হিসেবে জেনিফার নিউবার কিন্তু অনেক বিয়ে ভেঙে যাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছে।”

আমি মৃদু হেসে উঠলাম।

“আরেকটা জিনিস, এদের মধ্যে কেউ যদি মেরেও ফেলে জেনিফারকে, তাহলে দু-দিন আটকে রাখার মানে কি?”

এতক্ষণে ধরতে পারছি বাবা কি বোঝাতে চাচ্ছেন। বললাম, “আর যৌন নির্যাতনেরও কোন প্রমাণ মেলেনি, তার মানে ঐ সময়টুকু তাকে অক্ষত অবস্থায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল কোন কারণে।”

“আমি মনে করি জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল ওকে।”

“যে ছবিগুলো তুলেছিল সে, ওগুলোর জন্যে?”

“ঠিক।”

“তাহলে ছবিগুলো দিয়ে দিল না কেন ও? মানে, ওগুলো দিয়ে দিলে তো কোন ক্ষতি হত না।”

“হ্যাঁ, কিন্তু এমন কি হতে পারে না, এবারের ঘটনাটা হয়ত পরকিয়া সংক্রান্ত ছিল না? হয়ত বিপজ্জনক কোন কিছুর সাথে জড়িয়ে গেছিল মেয়েটা।”

“আপনি কি ওর পুরো ডায়রিটা পড়েছেন?” জিজ্ঞেস করলাম। “ও কি কোথাও অমন কোন ইঙ্গিত দিয়েছিল? মাদক, অস্ত্র কিংবা কোন মাফিয়া চক্রের ব্যাপারে কিছু লিখেছিল?”

“না, কিন্তু ডায়রির অনেকগুলো পাতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেউ ছিঁড়ে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি ওগুলো।”

“তারমানে, ডায়রির যে পাতাগুলো দরকার আমাদের ওগুলো এই কাগজের গাট্টির মধ্যে থাকার সম্ভাবনা কম?”

“হ্যাঁ।”

“বিশেষ ভরসা পেলাম না কথাটা শুনে।”

“আসলে এ মুহূর্তে আমাদের হাতে যা আছে সেগুলো দিয়েই কাজ চালাতে হবে আর আশা করতে যেন কিছু একটা চোখে পড়ে যায়।”

“আর সেজন্যেই অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড-এর মত করে দেয়ালটা সাজিয়েছেন আপনি?”

“হ্যাঁ,” হেসে বললেন বাবা। “দয়া করে ওভাবে বল না তো।”

“দেখে প্রথমে ওটার কথাই মাথায় এসেছে আমার।”

আবার হেসে উঠলেন তিনি, এরপর বললেন, “অবশ্য সিনেমার কথা বলে ভালোই করেছ। কারণ অনেকগুলো সিনেমার সাহায্য নিয়েই তারিখ অনুযায়ি সাজিয়েছি আমি পাতাগুলো। ডায়রিটা পড়ে আমার মনে হয়েছে শেষ দিকে যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের তখনও ব্ল্যাকমেইল করেনি জেনিফার, পরের জন্যে জমিয়ে রেখেছিল।”

রান্নাঘরের দেয়ালের দিকে তাকালাম আবার। ডায়রির পাতাগুলো তিনটা, চারটা করে একসাথে লাগিয়ে দেয়ালের সাথে আটকানো আছে, একবারে অতটুকু করেই লিখেছিল জেনিফার। প্রায় চল্লিশটার মতন হবে কমপক্ষে।

“ডায়রিতে কতবার লিখেছিল জেনিফার?”

“আশিবারের মত। কিন্তু যেগুলোতে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়া কিংবা হতে যাওয়া কারো সম্পর্কে কিছু লেখা আছে কেবল ওগুলোই দেয়ালে লাগিয়েছি আমি।”

“আর সুতোগুলো?”

“অনেক ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তির কথা একাধিক বার লিখেছে জেনিফার। এই যেমন এই লোকটা, যাকে জেনিফার ফোর্থ অ্যান্ড লেক্স’ বলে ডাকত, তার কথা লেখা আছে ডায়রির তৃতীয় এবং সপ্তম এন্ট্রিতে। প্রথমবার ছবি তুলেছিল জেনিফার এবং পরের বার ওকে টাকা দিয়েছিল লোকটা। তাই ওদুটো সুতো দিয়ে জোড়া দিয়ে দিয়েছি।”

“লাল আর নীল রঙের কাগজগুলো কি নির্দেশ করছে?”

“লাল দিয়ে বোঝানো হয়েছে এসব ঘটনার ক্ষেত্রে টাকা পেয়েছিল জেনিফার আর নীলগুলো নির্দেশ করছে যেগুলোতে টাকা পায়নি।”

“সবুজগুলো?”

“সবুজগুলোতে প্রতিটি ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আর ওখানে উল্লেখিত ব্যক্তি সম্পর্কে আর কোথায় কোথায় লিখেছে জেনিফার সেটা টুকে রেখেছি।”

“ওয়াও, বেশ খেটেছেন দেখছি। আপনাকে আগে কখনো এতটা-”

“গুছিয়ে কাজ করতে দেখনি, তাই তো? জানি আমি। এবার বুঝলে তো, কত বুদ্ধি আমার মাথায়?।”

“এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করা বাকি,” বললাম আমি। “তো, কতজন লোক টাকা দিয়ে দিয়েছিল?”

“সাতাশজন ওর দাবি মিটিয়ে দিয়েছিল। চারজন বলেছে ও একটা ঠগ, আর নয়জন সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।”

“কোন মহিলাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল ও?”

“প্রথমদিকে করেনি। কিন্তু পরে কয়েকজনকে করেছে। জেনিফারের মতে মহিলাদের নাকি কান্না সহ্য হত না ওর। পুরুষেরা টাকা দিয়ে ব্যাপারটা তাৎক্ষনিক মিটিয়ে ফেলত। কিন্তু মহিলারা অপরাধবোধ থেকে ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করত কেন পরকিয়া করতে বাধ্য হয়েছিল তারা। আর সেটা জেনিফারের ভালো লাগত না।”

“অবশ্য ডায়রির অনেকগুলো পাতা নেই আমাদের কাছে। ওখানে আরো অনেকের সম্পর্কে তথ্য থাকতে পারে।”

“ঠিক।”

“আচ্ছা। আপনি যে ক্রমানুযায়ি সাজিয়েছেন ডায়রির এন্ট্রিগুলো, ডিটেক্টিভরা কি ভিন্নভাবে সাজিয়েছিলেন?”

“খুব একটা ভিন্নভাবে না, কিন্তু হ্যাঁ, বেশ কয়েক জায়গায় পরিবর্তন করেছি আমি। ডিটেক্টিভারা যেভাবে পাতাগুলো সাজিয়েছিলেন তা অন্য একজায়গায় লিখে রেখেছি, যাতে পরে গোছাতে সমস্যা না হয়। আমার ধারণা ডায়রির ব্যাপারটাতে অতটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি তখন। কারণ বেশ কয়েকটা তথ্য ওনাদের চোখ এড়িয়ে গেছিল।”

“মেগান আর বয়ফ্রেন্ডের দেখা সিনেমাগুলো থেকে ধারণা নিয়ে আপনি ঠিকভাবে সাজিয়েছেন এন্ট্রিগুলো?”

“শুধু যে সিনেমাগুলো থেকে সাহায্য নিয়েছি তা নয়। মেগান আর ডেরিকের অ্যানিভার্সেরগুলো, জেনিফার আর জেমসের সম্পর্ক, এগুলো থেকেও ধারণা পেয়েছি।”

না হেসে পারলাম না। “দাঁড়ান,” আমি বললাম। “এই জেমসটা আবার কে?”

“জেনিফারের বয়ফ্রেন্ড।”

আবারও হাসলাম। কথাটা শুনে ভালো লাগছে।

“ওর ব্যাপারে পড়িনি আমি। আর মেগানও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওর কথা উল্লেখ করেনি।”

“ছেলেটা ডেরিকের কাজিন। জেমসের সাথে জেনিফারের সম্পর্কটা ছিল দু-মাসের। এরপর জেমস আর তার পরিবার সাউথ আফ্রিকায় চলে যায়।”

“তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াচ্ছে, জেনিফার এবং মেগান চাচাত বোন ছিল এবং তাদের সম্পর্ক হয়েছিল ডেরিক এবং জেমস নামের দুই চাচাত ভাইয়ের সাথে।”

“হ্যাঁ।”

“জেমসকে কখনো সন্দেহ করা হয়নি?”

“ও তো সাউথ আফ্রিকায় ছিল তখন।”

“আচ্ছা।”

এসময় উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে একটা সুদি বের করে দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরের চার মিনিট রান্নাঘরের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বাবার সাজানো কাগজগুলো দেখতে লাগলাম। আমার আগ্রহ ছোট সবুজ রঙের কাগজগুলো আর ওতে লেখা মূল ঘটনার সারসংক্ষেপের ওপর। ক্রমানুসারে পড়তে লাগলাম :

কে অ্যান্ড ফাস্ট
লোকটার পরনে স্যট এবং লাল টাই।
গাড়ি পর্যন্ত পিছু নেয়, এক মহিলাকে চুমু খাওয়ারত অবস্থায় ছবি তোলে।
মেগান আর ডেরিক কারাটে কিড সিনেমা দেখতে যায়

এইচ অ্যান্ড নিউ ইয়র্ক
মহিলার পরনে কালো স্কার্ট
লোকটার সাথে দেখা করে একটা মোটেলে
ডেরিক জেনিফারকে জেমসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়
চারজন মিলে রিভেঞ্জ অব দ্য নার্ডস দেখতে যায়।

রিজ অ্যান্ড ফোর্থ
সাদা টি-শার্ট এবং জিন্স পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক
দু-জন কমবয়সি মেয়ের সাথে দেখা করে
জেনিফারকে ছবি তুলতে দেখে চিৎকার করে ওঠে
পালিয়ে যায়
ব্ল্যাকমেইল করে না
জেনিফার আর জেমসের প্রথম ডেট।
পার্পল রেইন সিনেমাটা দেখে
জেনিফারের প্রথম চুমু!

হেসে উঠে বললাম, “জেনিফারের প্রথম চুমু লেখার পর আশ্চর্যবোধক চিহ্নটা দেয়া কি খুবই জরুরি ছিল?”

“মেয়েটার জীবনে ওটা অনেক বড় একটা ঘটনা,” বাবা বড় করে হেসে বললেন।

“আপনার প্রথম চুমুর স্মৃতি কার সাথে?”

“জেনি, ফিফথ গ্রেড।”

কথা বলতে বলতে যেন সেই দিনটায় ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার?”।

“আমার সাথে প্রমে যাওয়ার জন্যে যে মেয়েটাকে ঠিক করেছিলেন আপনি…আপনার কলিগের মেয়ে।”

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কী যেন নাম ছিল মেয়েটার? জিল?”

“হ্যাঁ, জিল রুটেন।”

“মার্গারেট রুটেনের মেয়ে। অতোটা সুন্দরি ছিল না মেয়েটা,” বাবা হেসে বললেন। “দুঃখিত সে ব্যাপারে।”

“চেষ্টা যে করেছিলেন সেটাই অনেক।”

এক সহকর্মির মেয়েকে রাত তিনটায় এক ঘন্টার জন্যে অচেনা এক ছেলের প্রম ডেট হতে রাজি করানোটা নিশ্চয়ই সহজ কাজ ছিল না।

“মার্গারেট ওর মেয়ের বিয়ের কিছু ছবি পোস্ট করেছিল ফেসবুকে। অনেক সুন্দর লাগছিল তখন জিলকে। আসলে ছোটবেলায় সবার চেহারা অমনই থাকে।”

এইটুকু বলে বাবা কিছুক্ষণের বলে রান্নাঘর থেকে উধাও হয়ে গেলেন।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা মোল বাজছে।

কিছুক্ষণ পরে বড় একটা স্যুটকেস হাতে ফিরে এলেন তিনি। এরপর ওটা খুলে ওয়াশিংটন ডিসির ভাঁজ করে রাখা একটা ম্যাপ বের করলেন। লিভিংরুমের দেয়াল থেকে দুটো বাঁধানো ছবি নামিয়ে ওখানে ম্যাপটা সেঁটে দিলেন টেপ দিয়ে।

এবার সবুজ রঙের একটা পিন হাতে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দশ সেকেন্ড পর পিনটা বসিয়ে দিলেন ম্যাপের ওপর। বললেন, “এখানেই পাওয়া গেছিল জেনিফার নিউবারের মৃতদেহ, এরপরে পিনের বাক্স থেকে আরো কয়েকটা সবুজ পিন নিয়ে ম্যাপের ওপর বসিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন, “এটা হচ্ছে স্কুল, যেখানে শেষ দেখা গেছিল ওকে…এটা ওর বাবার বাসা…আর এটা ওর মার বাসা।”

এরপর আমার হাতে পিনের বাক্সটা দিয়ে রান্নাঘরে টেবিলটার কাছে চলেন।

“আমার মনে এভাবে কল্পনা করতে সহজ হবে যে, কোন কোন জায়গায় ছবিগুলো তুলেছিলো মেয়েটা।”

“চেষ্ট করে দেখা যেতে পারে।”

এরপরে বাবা জেনিফারের ডায়রি দেখে দেখে রাস্তার ঠিকানাগুলো বলতে লাগলেন রান্নাঘর থেকে আর আমি কয়েক রঙের পিন দিয়ে সেগুলো ম্যাপের ওপর চিহ্নিত করতে থাকলাম। কয়েক রঙের পিন ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হল কোন কোন ব্ল্যাকমেইল থেকে মেয়েটা টাকা পেয়েছিল আর কোনটা থেকে পায়নি সেগুলো পৃথক করা। আর যেগুলো সম্পর্কে জানা যায়নি সেগুলোও অন্য রঙের একটা পিন দিয়ে নির্দেশ করার ব্যবস্থা করলাম। ওয়াশিংটন ডিসির বেশিরভাগ রাস্তাই সংখ্যার নামে নামকরণ করা হয়েছে। ওগুলো বাদে বড় যে নামগুলো ছিল সেগুলোকে জেনিফার ছোট করে নিয়েছে সুবিধামত।

লেক্সিংটন হয়ে গেছে লেক্স।

ম্যানচেস্টার হয়ে গেছে ম্যান।

ম্যাসাচুসেটস হয়ে গেছে ম্যাট।

সবশেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল :

সেকেন্ড অ্যান্ড আর (2nd and R)। লাল। টাকা দিয়েছিল।

থার্ড অ্যান্ড এইচ (3rd and H)। লাল।

ডি অ্যান্ড ম্যাস (D and Mas)। লাল।

এইচ অ্যান্ড নর্থ ক্যাপিটাল (H and North capital)। হলুদ। জানা যায়নি।

সেভেনথ অ্যান্ড কেনটাকি (7th and Kentucky)। লাল।

জি অ্যান্ড ম্যান (G and Man)। হলুদ।

প্রাইমাউথ অ্যান্ড প্রুস (Plymouth and Spruce)। নীল। টাকা দেয়নি।

সেকেন্ড অ্যান্ড লেক্স (2nd and Lex)। লাল।

“সেকেন্ড অ্যান্ড লেক্সে কি আছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“উইলমোর মোটেল। অবৈধ সম্পর্কের জন্যে বেশ উর্বর জায়গা মনে হচ্ছে।”

আরো ঠিকানা বলতে থাকলেন বাবা।

দশটা।

পনেরটা।

এভাবে একসময় পুরো চার ফিটের ম্যাপটা লাল, নীল এবং হলুদ পিনে ভরে উঠল।

শেষ পাঁচটা জোরে জোরে বললেন তিনি :

এল অ্যান্ড থার্টিনথ (L and 13th)। লাল।

এস অ্যান্ড ম্যান (S and Man)। হলুদ।

থার্ড অ্যান্ড কেন্টাকি (3rd and Kentucky)। লাল।

ফোর্থ অ্যান্ড এ (4th and A)। নীল।

ফোর্থ অ্যান্ড কন্সটিটিউশন (4th and Constitution)। হলুদ।

“সবগুলো শেষ?” জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ,” হেঁটে এসে বললেন তিনি।

এরপর দু-জন মিলে ম্যাপের দিকে দেখতে লাগলাম এতক্ষণ কাজ করার ফলাফল।

“উইলমোরে পাঁচটা পিন,” বললাম।

মাথা নেড়ে সায় জানালেন বাবা, “হ্যাঁ, তবে ওখানকার সবাই টাকা দিয়ে দিয়েছিল।”

“তাই তো দেখছি।”

“হলুদগুলোর প্রতি মনোযোগ দেই আমরা।”

“কিন্তু আপনার কি মনে হয় না যে একদম শেষটা, মানে ফোর্থ এবং কন্সটিটিউশনের কারণেই মারা গেছিল মেয়েটা?”

“হতে পারে। ওখানে কিন্তু এক মহিলাকে ব্ল্যাকমেইল করছিল জেনিফার।”

“সেই মহিলা হয়ত কোন লোককে টাকা দিয়েছিল জেনিফারকে মেরে ফেলার জন্যে কিংবা নিজেই হয়ত করেছিল কাজটা। শারীরিক দিক দিয়ে দূর্বল ছিল মেয়েটা।”

তিনি একবার কাঁধ ঝাঁকালেন ঠিকই তবে চেহারা দেখে মনে হল না। আমার কথা মনে ধরেছে তার।

“তাহলে নয়টা হলুদ পিন দেখতে পাচ্ছি,” আঙুল দিয়ে ওগুলো নির্দেশ করতে করতে বললেন বাবা। আট নম্বরটার কাছে গিয়ে থামলেন, শেষের দিক থেকে দ্বিতীয়।

“এস অ্যান্ড ম্যান।”

“আমরা কি জানি সেখানে কি আছে? কোথায় গেছিল তারা?”

রান্নাঘরের দেয়াল থেকে ঐদিনের এন্ট্রির সাথে লাগানো সবুজ প্যাডের কাগজটা খুলে নিয়ে আসলেন তিনি।

এরপর আমার হাতে ওটা দিলেন পড়ার জন্যে :

এস অ্যান্ড ম্যান।

স্যুট পরিহিত লোকটা ক্যাপিটাল বিল্ডিং থেকে বের হল।

জেনিফারের মতে তিনি একজন কংগ্রেস সদস্য।

এক ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করেন।

মেগান এবং ডেরিকের সাথে নাইটমেয়ার অন এম স্ট্রিট সিনেমাটা দেখতে যায়।

সবুজ কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। কী যেন একটা অন্যরকম মনে হচ্ছে, কিন্তু ধরতে পারছি না।

একজন কংগ্রেস সদস্য?

এটা একটা বড় ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু মন সায় জানাল না সে ব্যাপারে।

রাস্তাটা!

এস এবং ম্যান (S and Man)।

এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার এভিনিউ।

কিছু সময়ের জন্যে মনে হল কী যেন একটা চোখে পড়ি পড়ি করেও ধরা পড়ছে না। ওখানে বাবার সাথে বেশ কয়েকবার গেছি আমি। পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণীয় বেশ কয়েকটা জিনিস আছে সেখানে।

কিন্তু এস অ্যান্ড ম্যানের ব্যাপারটায় এমন লাগছে কেন?

“শিট, হঠাৎ করে বলে উঠলাম।

“কি?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“এস এবং ম্যান (S and Man)।”

“হ্যাঁ, কি হয়েছে?”

“শব্দ তিনটা।”

“মানে? কি বলতে চাচ্ছ?” বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।

“S and Man এটুকু একসাথে উচ্চারণ করুন।”

“ওহ্ ঈশ্বর!” চিৎকার করে উঠলেন তিনি, “স্যান্ডম্যান!”

“এটাই,” আমিও একই স্বরে বললাম। “এটাই প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান।”

*

অধ্যায় ১২

“তোমার কি আসলেও মনে হচ্ছে এটাই?” বাবা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন। “এই স্যান্ডম্যান প্রজেক্টের ব্যাপারেই কি সিডনি ওয়েন কথা বলেছিলেন?”

“চিন্তা করে দেখুন একবার,” আমি বললাম। “ম্যাগি আমাদের কি বলে সাবধান করেছিল, মনে আছে? মি. ওয়েন মাঝে মাঝে কিছু শব্দ শুনে আবার পুরনো আমলে ফিরে যান। অসংলগ্ন আচরণ করা শুরু করেন?”

“হ্যাঁ, তো?”

আমি পকেট থেকে ফোন বের করে ঐদিনের রেকর্ডিংটা খুঁজতে লাগলাম। যে মুহূর্তটা শুনতে চাচ্ছি ওখানে পৌঁছুতে কিছুক্ষণ লাগল।

এরপর প্লে করলাম :

আমি : আপনি ঐ সাদা ঘরটার ব্যাপারে কিছু জানেন? ওটার অবস্থান কোথায় হতে পারে এ ব্যাপারে কোন ধারণা আছে?

মি. ওয়েন : এলেনার সাথে প্রায় এক যুগ ধরে কথা হয় না আমার। শেষবার তার সাথে কথা হয়েছিল ৯/১১-এর ঐ ঘটনার পর। তখন প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান নিয়ে ব্যস্ত ছিল ও।

আমি : প্রজেক্ট স্যান্ডম্যানটা আবার কি?

মি. ওয়েন : (অনেক জোরে তোমরা কারা? প্রেসিডেন্ট রিগ্যান পাঠিয়েছে তোমাদেরকে? কেউ একজন রাশিয়ানদের হাতে সব তথ্য পাচার করে দিচ্ছে। ঐ বিশ্বাসঘাতককে ধরতে হবে আমাদের। না-হলে পাশার ছক পাল্টে যাবে।

আমি : মি. ওয়েন…লম্বা করে শ্বাস নিন। আমরা আপনার স্টাডিতে বসে আছি। এটা ২০১৫ সাল।

মি. ওয়েন : তোমরা কারা? রিগ্যানকে বলবে, হারামিটাকে ধরার জন্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি আমি।

বাবা : মি. ওয়েন…[জোরে সিডনি।

বন্ধ করে দিলাম।

“ঠিক বলেছ তুমি,” বাবা বললেন। “প্রজেক্ট স্যান্ডমান, এটুকু শোনার পরেই ওরকম করা শুরু করেছিলেন উনি।”

আমিও সায় জানালাম। “একদম রিগ্যানের আমলে পাঠিয়ে দিয়েছে।”

“মানে, আশির দশকের সময়টা।”

“আর জেনিফার নিউবার খুন হয় ১৯৮৫ সালে।”

বাবা একবার জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন, “ঐ সময়েই কিন্তু তোমার মা চলে গেছিলেন।”

এ কথা আমার মাথায় আসেনি আগে। “তাই তো।”

“জেনিফার নিউবার খুন হয় ১৯৮৫ সালের ১২ই জানুয়ারি। তার চারদিন পরে তোমার মার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল আমার।”

মার সাথে আমার শেষ দেখা হয় ষষ্ঠ জন্মদিনের দিন, কিন্তু ওটা জেনিফারের মৃত্যুর একমাস আগের ঘটনা। এরপরেই কাজের কথা বলে চলে গেছিলেন তিনি।

আর দেখা পায়নি তার কখনো।

“১৬ই জানুয়ারি, ১৯৮৫,” বাবা বললেন, “তোমার মা বাসায় এসে বাক্সগুলো গুছিয়ে আমাকে বলে, সে চলে যাচ্ছে। আরো বলে, পরে ফোন করে একটা ঠিকানা দিলে সেই ঠিকানায় বাক্সগুলো পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু কোন ঠিকানা পাইনি আমি।”

“মিলে যাচ্ছে সবকিছু।”

ওনার চোখদুটো কপালে উঠে গেল।

দৌড়ে গিয়ে দেয়াল থেকে এস অ্যান্ড ম্যান (S-and-Man) লেখা ডায়রির এন্ট্রিটুকু খুলে নিয়ে এলেন। এরপর জোরে জোরে পড়া শুরু করলেন :

“তাকে ক্যাপিটাল বিল্ডিং থেকে অনুসরণ করা শুরু করি আমি। স্যুট পরা আরো কয়েকজন লোকের সাথে ছিলেন তিনি। টেলিভিশনের লোকজনও ছিল। ভিডিও করছিল এমন একজন লোককে জিজ্ঞেস করি, কি হচ্ছে সেখানে। জবাবে সে বলে প্রথমবারের মত নির্বাচিত হওয়া কংগ্রেস সদস্যদের সাক্ষাৎকারের কাজ চলছে। একজন কংগ্রেস সদস্য! দেখতে মোটামুটি ভালোই তিনি। কিন্তু বারবার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন, এজন্যেই তাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেই আমি।”

“এরপর এক পাতা নেই,” পড়ার মাঝখানেই বললেন বাবা। “কিংবা দুই পাতাও হতে পারে, কে জানে? এরপর আবার শুরু হয়েছে।”

“…সাবওয়েতে উঠে পড়লেন তিনি। আমি জানি তাকে অনুসরণ করা উচিত হচ্ছে না, কিন্তু থামতেও পারছি না। থার্ড অ্যান্ড এইচে নেমে তিন চারটা দোকান ঘুরে দেখলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ পিছু নিয়ে থাকলে তার চোখে ধুলো দেয়ার জন্যে অমনটা করছেন। কিন্তু খোল বছরের একটা মেয়েকে নিশ্চয়ই চোখে পড়বে না তার। শেষ দোকানটায় ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ পরে এক সুন্দরি মহিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

আমি লেন্সের জুম বাড়িয়ে দিয়ে মহিলার চেহারার কয়েকটা ছবি নিলাম। ইশ! আমার চোখ যদি ওনার মত হত! উজ্জ্বল সবুজ রঙের!”

“এটাই তোমার মা,” বাবা বললেন।

আমিও সায় জানিয়ে তাকে বললাম, “পড়তে থাকুন।”

“আমি আশা করেছিলাম, লোকটা মহিলাকে একটা চুমু দেবে, কিন্তু সে-রকমটা করলেন না তিনি। তারা বোধহয় পরকিয়া করছে না, কিন্তু কোন একটা ব্যাপার তো আছেই। দু-জনেই একটু পর পর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখছেন। এরপর হেঁটে তিন ব্লক দূরে এস অ্যান্ড ম্যানের (S and Man) কাছে একটা অফিস বিল্ডিঙে পৌঁছে গেলেন তারা। ডজনখানেক ছবি তুললাম। এই ছবিগুলো থেকে দুইশ ডলারের অনেক বেশি কামাই করতে যাচ্ছি আমি।”

“স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম,” আমি বললাম।

“হতে পারে,” বাবাও সায় দিলেন।

“হতে পারে মানে কি? এই কংগ্রেস সদস্যও নিশ্চয়ই জড়িত ছিলেন এসবের সাথে। তিনিই হয়ত টাকার যোগান দিচ্ছিলেন অথবা তথ্য পাচার করছিলেন।”

“তোমার মা একজন সিআইএ এজেন্ট ছিলেন। যেকোন ব্যাপারে তারা দেখা করতেই পারে।”

“আরো কয়েকটা পাতা থাকলে ভালো হত। এর পরে কি ঘটেছিল জানা যেত।”

“আমার ধারণা তাদের দ্বিতীয়বার অনুসরণ করেছিল জেনিফার। সে কি খুঁজে পেয়েছিল তা আমরা কোনদিন জানতে পারব বলে মনে হয় না।”

“যা-ই খুঁজে পাক না কেন, খুন হবার জন্যে ওটুকুই যথেষ্ট ছিল।”

.

তদন্তের রিপোর্টগুলোতে একটা জিনিস কিছুক্ষণ দেখে বাবাকে আমার ধারণাটুকু খুলে বললাম :

“কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওনাদের দুজনকে একসাথে দেখতে পাওয়ার কথা ছিল না কারো। কিন্তু জেনিফার তাদের ছবি তুলে ফেলে। কংগ্রেস সদস্যকে ব্ল্যাকমেইল করার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু এবারে লোভি হয়ে ওঠে সে। হয়ত কয়েক হাজার ডলার দাবি করে বসে। লোকটা তাকে বলে দু-দিন পরে টাকা হাতে পাবে সে। কিংবা এক দু-সপ্তাহের কথাও বলতে পারে। জেনিফার ধৈর্যশীল। আর তার হাতে অফুরন্ত সময়। তাই ঐ সময়ের মাঝে আরো কয়েকজনকে ব্ল্যাকমেইল করে সে।

যখন তাকে টাকা দেয় না কংগ্রেস সদস্য তখন হুমকি দেয় সে। বলে, ছবিগুলো খবরের কাগজ কিংবা অন্য কোন অফিসে পাঠিয়ে দেবে। কংগ্রেস সদস্য আর মহিলাটা সিদ্ধান্ত নেয়, জেনিফার বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে তাদের কাজে। জেনিফারকে টাকা দিয়ে দিলেও পরবর্তিতে আবার ঝামেলা করতে পারে সে। এখানেই মার অভিজ্ঞতা কাজে আসে। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বিশেষজ্ঞ একজন। অন্যদের কাছ থেকে জবাব আদায় করাই তার পেশা।”

একটু আগে তদন্ত রিপোর্টে জেনিফারের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনটা পড়ে দেখেছি আমি। রক্তপরীক্ষাও করা হয়েছিল।

“ল্যাবে জেনিফারের রক্তে অল্প পরিমাণ এলএসডি ড্রাগের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, বাবাকে বললাম।

বাবার মুখ হা-হয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্যে। এরপর বললেন, “মেয়েটাকে টর্চার করেছিল তোমার মা। এজন্যেই দু-দিন যাবত নিখোঁজ ছিল সে। তোমার সাথে যা করেছে ওটা ঐ মেয়েটার সাথেও করেছিল।”

তা ঠিক, কিন্তু একটা বড় পার্থক্য আছে।

আমাকে মেরে ফেলেননি তিনি।

.

ধাঁধার আরেকটা উত্তর মেলাতে হবে।

ফোন তুলে ইনগ্রিডের নম্বরে ডায়াল করলাম। কোন জবাব না পেয়ে আবারো ফোন করলাম। চার বার রিং হবার পর জড়ানো স্বরে উত্তর ভেসে আসল ওপাশ থেকে, “হ্যালো।”

“কি খবর, জান।”

“আমি আশা করিনি, আজ ফোন করবে তুমি।”

“তোমার মার শরীর এখন কেমন?”

“কালকের মতই। তাকে স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে যেতে হবে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন এক সময় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি।”

“যাক, শুনে ভাল লাগছে,” এটুকু বলে থামলাম, এরপর বললাম, “কিন্তু সে জন্যে ফোন দেইনি আমি।”

ফোনের এপাশ থেকেও বুঝতে পারলাম, সোজা হয়ে বসছে ও, “কোন সমস্যা? ল্যাসির কিছু হয়েছে?”

“না, ওরকম কিছু না। সবাই ঠিকই আছে,” জোরে একবার শ্বাস নিলাম, “আমি এটা জানার জন্যে ফোন করেছি, জেনিফার নিউবারের

কেসের ব্যাপারে কে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে তোমাকে?”

জোরে হাসির আওয়াজ ভেসে আসলো, “ঐ কেসটার ব্যাপারে তোমাকেও জড়িয়েছে নাকি তোমার বাবা?”

“হ্যাঁ।”

“আমি তো তাকে বলেছিলাম, এটার মীমাংসা হয়ে গেছে। যাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল সে-ই খুনি। পরে তাকে গুলি করে মেরে ফেলে তার স্ত্রী।”

“হ্যাঁ, জানি আমি। কিন্তু এখন অত বিস্তারিত কিছু বলার সময় নয়। আমাকে বল, তোমাকে এই কেসটা নিয়ে কাজ করতে বলেছে কে?”

আমার গলার একাগ্রতাটুক ধরতে পারল ও, “আমার ক্যাপ্টেন।”

“কিন্তু এটা তো তার আওতার মধ্যে পড়ে না। ওয়াশিংটন ডিসিতে হয়েছিল খুনটা।”

“আমাকে বেশি কিছু বলেননি তিনি। শুধু বলেছিলেন অন্য সব কেস বাদ দিয়ে এটার ওপর নজর দিতে হবে। কেসটার সমাধান হয়ে গেছিল আগেই, তবুও কয়েক সপ্তাহ এটা নিয়ে যদি ঘাঁটাঘাটি করি আমি, তাহলে নাকি তার খুব সুবিধা হবে।”

“আমি চাই তুমি বের কর, কে তাকে এই কেসটা নিয়ে কাজ করতে বলেছে।”

“ঠিক আছে। তাকে কাল ফোন দেব আমি।”

“না। আমার এখনই জানা দরকার।” আগে কোনদিন ওকে এরকম কিছু করতে বলিনি।

“কি ব্যাপার বল তো?”

“আমি ঘুমিয়ে পড়ার পরে বাবা সব কিছু বলবেন তোমাকে। আমার হাতে আর মাত্র চার মিনিট সময় আছে। দয়া করে কাজটা কর, ইনগ্রিড। আমার জন্যে।”

“ঠিক আছে। কিন্তু কথা দাও তোমার বাবা ফোন করে সব কিছু খুলে বলবে আমাকে।”

“কথা দিলাম।”

ফোন কেটে গেল।

বাবা আর আমি পরস্পরের দিকে তাকালাম একবার।

এরপর ঘড়ি দেখলাম।

তিনটা ছাপ্পান্ন।

তিনটা সাতান্ন।

তিনটা আটান্ন।

বাবা বললেন, “তোমার বোধহয় শুয়ে পড়া-”

আমার ফোন বেজে উঠল। ধরে স্পিকার চালু করে দিলাম।

“পেয়েছ তাকে?”

“হ্যাঁ। এতরাতে ঘুম থেকে জাগানোয় খুশি হননি মোটেও। জিজ্ঞেস করেছি, কে তাকে কেসটা নিয়ে কাজ করতে বলেছিল।”

“কি বললেন?”

“সরাসরি বলতে পারেননি। তার বস, ভার্জিনিয়া পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে নাকি অর্ডার পেয়েছিলেন।”

“ধুর।”

“চিন্তার কোন কারণ নেই। ক্যাপ্টেনকে দিয়ে তার বসকে ফোন করিয়েছি আমি।”

“করেছেন তিনি?”

“হ্যাঁ। তার বদলে আমাকে আরো কিছু কাজ করতে হবে অবশ্য। তবে ফোনটা করেছিলেন তিনি।”

“ভার্জিনিয়া পুলিশ কমিশনারকে কে এই কেসটা নিয়ে কাজ করতে বলেছে?”

“প্রেসিডেন্ট সুলিভান।”

.

পরদিন ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি ইনগ্রিড বসে আছে বাবার সাথে। ল্যাসি ওর কোলে আর মারডক চেয়ারের নিচে।

আমাকে দেখে লাফিয়ে উঠল ইনগ্রিড। ল্যাসি বেচারা মাটিতে পড়ে গেল।

“হেনরি,” বলে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল সে।

অনেকক্ষণ ওকে ধরে রাখলাম শক্ত করে। ওকে কতটা মিস করছিলাম এই কয়দিন সেটা কেবল আমিই জানি।

“তুমি এখানে কি করছ?” জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমি গতরাতে ঘুমুতে যাবার পর তোমার বাবা ফোন করে সব খুলে বলেন আমাকে। তখনই পরের ফ্লাইটটাতে বুকিং দেই আমি।”

“তোমাকে ছাড়া ওদিকটা সামলাতে পারবেন তো তোমার বাবা?”

“হ্যাঁ। মা’কে আজ বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আর আমার ফুপিও আছেন ওখানে। কাল এমনিতেও চলে আসতাম আমি। তাছাড়া তোমাকে ছাড়া থাকতে আর ভালো লাগছিল না।”

একটা লম্বা চুমু খেলাম আমরা।

“গোটা ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান, তোমার মা, ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।”

“কিন্তু বিশ্বাস করছ তো?”

“হ্যাঁ, তোমার বাবা আমাকে সব বুঝিয়ে বলার পর বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।”

“আর প্রেসিডেন্ট সুলিভানের ব্যাপারটা?”

“ওনার সাথে এসবের সম্পর্ক কি তা ঠিক জানি না, কিন্তু উনিই এই কেসের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছেন। ওনার কারণেই সব বের হয়ে এসেছে।”

“তাকে ফোন করব আমি।”

“পাবে বলে মনে হয় না। এখন রাশিয়ায় এক কনফারেন্সে ব্যস্ত তিনি,” বাবা বললেন।

ফোন বের করে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত নম্বরে কল করলাম। কেউ ধরল না। একবার ভাবলাম ভয়েস মেসেজ পাঠাই : “কি খবর সুলিভান? আমার গার্লফ্রেন্ডকে হঠাৎ করে তিরিশ বছরের পুরনো একটা কেস নিয়ে কাজ করতে বললেন কেন? যার সাথে আবার আমার মা’ও জড়িত।” কিন্তু কিছু না বলেই কেটে দিলাম। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে নিয়ে ইনগ্রিড আর বাবার সাথে টেবিলে বসলাম আমি।

“তো, কিছু কাজ এগিয়ে রেখেছি আমরা,” বাবা বললেন। “১৯৮৫ সালের সব কংগ্রেস সদস্যদের একটা তালিকা বানিয়েছি। আর জেনিফারের লেখা অনুযায়ি, শুধুমাত্র প্রথমবার নির্বাচিত সদস্যদের নাম লিখেছি ওতে।”

“কতজন হয়েছে?”

“সাতাশ।”

“তাদের কারো সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন?”

“হ্যাঁ। অনেকে চলে গেছে এখান থেকে, অনেকে মারা গেছে আর অনেকে দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে।”

“কয়েকজনকে ইতিমধ্যেই তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছি আমরা,” ইনগ্রিড বলল। “এই যেমন যাদের চেহারা আর শারীরিক গঠন জেনিফারর বর্ণনার সাথে মেলে না।”

“কয়জন বাকি আছে শেষ পর্যন্ত?”

“বারো জন।”

“ভালো কাজ দেখিয়েছো দু-জন মিলে। প্রায় ত্রিশ কোটি থেকে বারোজনে নেমে এসেছে সংখ্যাটা। এদের কেউই খুন করেছে জেনিফারকে।”

“হ্যাঁ। কিন্তু তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো দেশ জুড়ে। আরকানসাস, কলোরাডো, আইওয়া। আর এতদিন আগের তাদের সবার অ্যালিবাই সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখাও সম্ভব নয় এখন। প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনাটা।”

“আমি একটা জিনিস বুঝছি না, তখনকার ডিটেক্টিভরা এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়নি কেন? রিপোর্টে লেখা আছে, জেনিফারের বর্ণনা দেয়া মাত্র তিনজন ব্যক্তিকে সনাক্ত করতে পেরেছিল তারা। কিন্তু একজন কংগ্রেস সদস্যকে খুঁজে বের করা তো তুলনামূলক সোজা কাজ।”

“আমি নিশ্চিত তারা সেটা করত, যদি না উইঙ্গেলবেরি অত তাড়াতাড়ি সবকিছু স্বীকার করে না নিত। জেনিফার খুন হবার দু-সপ্তাহের মাথায় স্বীকারোক্তি দেয় সে। এরপর নিজেও মাথায় গুলি লেগে মারা যায়।”

ইনগ্রিড ঠিকই বলেছে। উইঙ্গেলবেরির সবকিছু স্বীকার করে নেয়ার পর কেসটা নিয়ে আর কাজ করা দরকার বলে মনে করেনি ডিটেক্টিভরা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বললাম, “আমাদের ছবিগুলো খুঁজে বের করতে হবে।”

ইনগ্রিড আর বাবা দু-জনেই আমার দিকে তাকালেন।

“ছবিগুলো?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“মেয়েটাকে দু-দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর মেরে ফেলা হয়। তার মানে, ছবিগুলো তাদের দেয়নি সে।”

বাবা সায় দিলেন আমার কথায়।

“কিন্তু কেন?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল। “মেয়েটা তো ওর ব্ল্যাকমেইলের শিকার সবাইকেই ছবি দিয়ে দিত। এমনকি যারা ওকে টাকা দিত না তাদেরকেও ফেরত দিয়ে দিত ছবিগুলো।”

“হয়ত লোভি হয়ে উঠেছিল সে। গাড়ি কেনার জন্যে টাকার দরকার ছিল তার। এবার হয়ত অনেক বেশি টাকা দাবি করেছিল।”

“হ্যাঁ। কিন্তু ওকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার সাথে সাথেই তো টাকার কথা ভুলে ছবিগুলো কোথায় আছে বলে দিত।”

যুক্তি আছে কথায়।

আমার সাথে যা করা হয়েছে, সেরকমটা যদি জেনিফারের সাথেও করা হয়ে থাকে, তেইশ ঘন্টার দুঃস্বপ্ন, তাহলে মুখ খুলতে বাধ্য মেয়েটা।

একটাই ব্যাখা আছে এর।

“তার কাছে হয়ত ছিলই না ছবিগুলো,” আমি বললাম। “সে হয়ত এমন কাউকে ছবিগুলো দিয়েছিল যার ক্ষতির কথা ভেবে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল।”

তিনজনই একে অপরের তাকাতে লাগলাম। মাত্র দু-জন মানুষকে ছবিগুলো দিয়ে থাকতে পারে জেনিফার।

মেগান।

অথবা ওর ভাই।

*

অধ্যায় ১৩

“তোকে মোটেও এড়িয়ে চলছি না আমি,” ল্যাসিকে বললাম।

মিয়াও।

“তোর যদি আমার ব্যবহারে ওরকম মনে হয়ে থাকে তাহলে আমি দুঃখিত। পরে না-হয় সুতো দিয়ে কিছুক্ষণ খেলব আমরা।”

মিয়াও।

“তোকে খেলার লোভ দেখিয়ে লাভ হবে না?”

আমি ল্যাসির সামনে একটা সুতো দোলানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগলাম। ওর ছোট মাথাটা দুলতে লাগল সামনে পেছনে। এরপর অদৃশ্য সুতোটার উদ্দেশ্যে থাবা দিল সে।

মিয়াও।

“আমি জানি তুই এই জিনিসটার কাছে অসহায়।”

মিয়াও।

“আসলেও এটা একটা অসুখ।”

উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসারটার কাছে গেলাম।

এখন তিনটা দুই বাজছে।

“এই জিনিসটা তোকে আগামি মাসে জন্মদিন উপলক্ষে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন দিলেও কোন ক্ষতি নেই।”

লাফিয়ে উঠে বসল ও বিছানায়।

“চোখ বন্ধ কর।”

কথা শুনল ও।

আমাজন ডট কমের বাক্সটা থেকে জিনিসগুলো বের করলাম। তিনদিন আগে ডেলিভারি দিয়ে গেছে ওরা। কিন্তু আমি ল্যাসির জন্মদিনের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। হাতদুটো পিঠের পেছনে নিয়ে গেলাম।

“এখন চোখ খুলতে পারিস।”

খুলল ও।

পেছন থেকে হাত সামনে নিয়ে এসে ঝুনঝুনি লাগানো চারটা বলের একটা প্যাকেট দেখালাম ওকে। চারটা চার রঙের।

মিয়াও।

“নাহ্, এটা স্বপ্ন না। সত্যিই ঘটছে,” এই বলে ওর সামনে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিলাম বিছানার ওপর। “সবগুলোই তোর।”

চারটা বলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ও। চোখ ভিজে উঠছে আস্তে আস্তে।

“কাঁদছিস নাকি?”

মিয়াও।

“তাই? অ্যালার্জির কারণে চোখে পানি এসে গেছে? কিসে অ্যালার্জি তোর শুনি।”

উত্তর দিল না।

“খোল ওটা।”

নেটের প্যাকেটটা খামচি দিয়ে ছিঁড়ে ফেললে বলগুলো মেঝেতে পড়ে গেল। পুরো ঘর ওগুলোর মিহি শব্দে ভরে উঠেছে।

ল্যাসি লাফ দিয়ে নেমে প্রথমে নীল বলটার কাছে ছুটে গেল, এরপর থেমে লালটার কাছে। এরপর সবুজ। এরপর আবার হলুদ। চারটা নিয়ে একই সাথে খেলতে চাচ্ছে সে।

হঠাৎ জোরে একটা শব্দ হয়ে আমার ঘরের দরজাটা অর্ধেক খুলে গেল। মারডক ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে।

এই সময় আমার মনে পড়ল কেন আসলে আগামি মাসে অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার পর ল্যাসিকে বলগুলো দিতে চেয়েছিলাম আমি।

মারডক।

বলগুলো দেখলে ল্যাসি খুশিতে পাগলের মত আচরণ শুরু করে আর মারডক হয়ে যায় বদ্ধ উন্মাদ।

“ভুলেও ওকাজ করিস না,” মারডকের উদ্দেশ্যে বললাম।

আমাকে পাত্তাও দিল না ও।

নীল রঙের বলটা ওর বিশাল মুখে নিয়ে গিলে ফেলল একেবারে।

এরপর সবুজটা।

এরপর হলুদ।

এরপর লাল।

এই ঘটনাকেই ল্যাসি পরবর্তি জীবনে ‘মারডক কাণ্ড’ বলে উল্লেখ করবে।

যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল মারডক। ল্যাসির চোয়াল ঝুলে পড়েছে। অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাল ও।

মিয়াও।

“ওর সাথে চিল্লাচিল্লি করতে পারব না আমি।”

বড় একটা শ্বাস নিয়ে বিছানার নিচে ঢুকে গেল ও।

.

“এটাই ও,” বাবা বললেন। “এটাই জেনিফারের ভাই।”

আমি কম্পিউটার স্ক্রিনের ছবিগুলোর দিকে তাকালাম। মার্কাস নিউবারের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, ওজন একটু বাড়তির দিকে এবং মাথা টাক হতে শুরু করেছে। তার লিংকড ইন প্রোফাইল অনুযায়ি, মার্কাস তিন সন্তানের বাবা আর একটা অটোমোবাইল কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। ডেলওয়ার সিটিতে বসবাস করেন তিনি।

“ইনগ্রিডের সাথে কথা হয়েছে? জিজ্ঞেস করলাম। “ও কি যোগাযোগ করেছে তার সাথে?”।

জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বাবা বললেন, “সারাদিনে ওর সাথে কথা হয়নি আমার।”

“মেগানের ব্যাপারে কি হল? তাকে খুঁজে পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ। তবে তাকে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন কাজ ছিল। বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন করেছে মেয়েটা। কিন্তু তদন্ত রিপোর্টে ওর যে একটা পুরনো ছবি ছিল সেটার সাথে গুগলের ইমেজ সার্চের একটা ছবির মিল খুঁজে পেয়েছি।”

ব্রাউজারে আরেকটা পৃথক ট্যাবে ক্লিক করলেন তিনি। ওটা মেগান নিউবারের (এখন যার নাম মেগান ক্লেইন) ফেসবুক পেজ।

প্রোফাইল পিকচারে ক্লিক করে বড় করলেন বাবা।

বেশ আকর্ষণীয় চল্লিশোর্ধ এক মহিলার ছবি ভেসে উঠল। বাদামি চুল আর বাদামি চোখ।

আরো তিনটা ছবি দেখালেন বাবা। কোন স্বামী কিংবা সন্তান নেই। তবে একটা বড় লোমশ কুকুর আছে অবশ্য।

“এটা বোধহয় গোল্ডেন ডুডল জাতের কুকুর,” বাবা বললেন।

“কুকুরের জাতের ওপর পিএইচডি করেছেন নাকি?”

“না,” হেসে বললেন বাবা। “আমার প্রতিবেশীদের একটা আছে ওরকম কুকুর। ডুডল ওর নাম। মারডকের বন্ধু।”

“ওনারা গোল্ডেন ডুডল জাতের কুকুরটার নাম রেখেছে ডুডল?”

মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনি।

দু-জনেই হেসে উঠলাম, এরপর শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মেগান থাকেন কোথায়?”

“আশেপাশেই কোথাও। আমি নিশ্চিত ইনগ্রিডের ওকে খুঁজে বের করতে সমস্যা হবে না।”

ইনগ্রিডের কথা মনে হতে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম যে ওর কোন মেসেজ এসেছে কিনা।

ফোনের স্ক্রিন ফাঁকা। কোন মেসেজ বা কল আসেনি।

তার মানে, প্রেসিডেন্টও ফোন করেননি।

পুতিনের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত।

বড় করে একটা হাই তুললেন বাবা। এরপর আমাকে বললেন, অনেক ক্লান্ত বোধ করছেন, তাই এখন শুতে যাবেন। ইনগ্রিড যদি মেসেজ কিংবা ফোন দিয়ে কিছু জানায় তাহলে সাথে সাথে তাকে জানাতে বলে গেলেন।

আমি বললাম যে জানাব।

রান্নাঘরে ঢুকে দেখি সব চকচক করছে। তার মানে ইসাবেল এসেছিল গতকাল।

আঙুলগুলো একবার ফুটিয়ে ফ্রিজ খুললাম।

লাসানিয়া!

“ইয়েস!”

দুটো বড় অংশ কেটে নিয়ে গরম করতে দিলাম। এরপর আমার ঘরে গিয়ে বিছানার নিচে উঁকি মারলাম চাদর তুলে।

ল্যাসি কাত হয়ে শুয়ে আছে।

ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লেজ ধরে টেনে বের করলাম ওকে। একবার নড়লও না ও।

ওর পালস দেখলাম।

নাহ্, এখনও জীবিত।

“তোকে খুশি করার মত একটা জিনিস আছে আমার কাছে।”

মিয়াও।

“নাহ্, মারডককে কুচি কুচি করে কেটে হাঁসদের খাইয়ে দেইনি।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।

“তোর জন্যে লাসানিয়ার বড় একটা অংশ গরম করতে দিয়েছি।”

নাক দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করল ও।

“আমি জানি তোর লাসানিয়া খেতে অনেক ভালো লাগে।”

মিয়াও।

“গারফিল্ডটা আবার কে?”

মিয়াও।

“সত্যিই জানি না আমি,” দাঁড়িয়ে উঠে বললাম। “যাই হোক, ক্ষিধে পেলে আমার সাথে এসে খেতে পারিস এখন।”

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

এক মিনিট পর, আমি বড় এক বাটি লাসানিয়া আর দুধের বোতল নিয়ে টেবিলে বসে আছি। টেবিলের নিচে আরেকটা ছোট বাটিতে ল্যাসির জন্যে লাসানিয়া আর ওর প্লেট ভর্তি করে দুধ রাখা।

ল্যাপটপ খুলে গুগল আর্থে লগইন করলাম। ইনগ্রিডকে নিয়ে আলাস্কা যাওয়ার পরিকল্পনা করার আগে প্রতিদিন দশ মিনিট করে গুগল আর্থে সেখানকার ভৌগলিক অবস্থা দেখতাম আমি।

ডাউনটাউন ডিসির ম্যাপটা বের করলাম। এরপর মাউস দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশেপাশের জায়গাগুলো দেখতে লাগলাম। এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের মোড়টার কাছে এসে থেমে গেলাম।

রিয়াল টাইম ইমেজ চালু করে জুম করে দেখতে লাগলাম রাস্তাটা। মোড়টা অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর অফিসের কেন্দ্রস্থল।

মোড়ের একপাশে একটা গ্যাস স্টেশন, একটা অফিস বিল্ডিং আর অন্য পাশে আরেকটা অফিস বিল্ডিং এবং একটা ওয়েন্ডি’স ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।

এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের অন্য বিল্ডিংগুলোতে নজর বোলানো আরম্ভ করলাম। চিন্তা করতে লাগলাম সম্ভাব্য কোন বিল্ডিংটাতে ঢুকেছিলেন আমার মা এবং সেই কংগ্রেস সদস্য। গত ত্রিশ বছরে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে জায়গাটার। নতুন নতুন কোম্পানি এসেছে, পুরনোগুলো চলে গেছে।

এটা কি সম্ভব, এই বিল্ডিংগুলোর কোন একটাতে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের হেড কোয়ার্টার অবস্থিত? ১৯৮৫ সালে হয়ত সেখানেই ছিল, কিন্তু এখন নিশ্চয়ই ওখান থেকে জায়গা বদল করা হয়েছে। হোয়াইট হাউজের দুই মাইলের মধ্যে থেকে তো নিশ্চয়ই একটা অবৈধ প্রোগ্রাম পরিচালনা করবে না? তাই না?

নাহ্, স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের হেড কোয়ার্টার মিশিগানে-যেখানে আমাকে খুঁজে পাওয়া গেছিল। কিংবা আরো কাছে কোথাও। কানাডাতেও হতে পারে।

একটা শব্দ শুনে টেবিলের নিচে তাকালাম।

ল্যাসি পাথরের মূর্তির মত বসে আছে সেখানে। হতাশ চোখে তাকিয়ে আছে লাসানিয়ার বাটির দিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পনের রাউন্ড বক্সিং খেলে এসেছে এতক্ষণ।

ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ওর জন্যে আরেক প্যাকেট বল অর্ডার করেছি আমি। আর আগামি সপ্তাহেই আমাদের বাড়িতে ফেরত যেতে পারব আমরা।

এ কথা শুনে একটু খুশি হয়ে উঠল ও। অল্প অল্প করে কামড় বসাতে লাগল লাসানিয়ার বাটিতে।

আমাজনে ওর বল অর্ডার করে গুগলে গিয়ে ‘গারফিল্ড’ লিখে সার্চ দিলাম। উইকিপিডিয়ায় ঢুকে কয়েকটা স্যাম্পল কমিক স্ট্রিপ পড়লাম গারফিল্ড কমিক্সের। গারফিল্ড হচ্ছে একটা কমলা রঙের বিড়াল যার লাসানিয়া দেখলে হুঁশ থাকে না। এ সংক্রান্ত মজার মজার কয়েকটা কৌতুকও আছে।

“বুঝতে পেরেছি, গারফিল্ডের সাথে লাসানিয়ার কি সম্পর্ক, ল্যাসিকে বললাম।

হাসল ও।

তিনটা আটান্নর সময় ল্যাসিকে নিয়ে বিছানায় চলে গেলাম। বালিশে মাথা দিতেই কিছু একটা কোঁচকানোর আওয়াজ কানে আসল।

জেগে ওঠার সময় খেয়াল করিনি নিশ্চয়ই।

বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা সাদা খাম বের করে আনলাম। ওটার ওপর হেনরি লিখে দিয়েছে কেউ। ইসাবেলের হাতের লেখা চিনতে অসুবিধা হল না। আমি ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় নিশ্চয়ই ওটা ওখানে রেখে দিয়েছিল সে।

খুলে ভেতরে কাগজটা বের করলাম। বড় একটা সাদা কাগজ। ওপরে লেখা ‘ডিএনএ টেস্টিং ল্যাব অব আমেরিকা।

বাবা যেদিন ইনগ্রিডকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেছিলেন সেদিন তার ঘরে ঢুকে চিরুনি থেকে কয়েকটা চুল সংগ্রহ করি আমি। এরপর আমার নিজের কতগুলো চুল তুলে নেই। সেগুলোই একটা খামে ভরে বাগানে একটা ঝোপের মধ্যে রেখে দেই ইসাবেলের জন্যে।

কাগজটায় লেখা শব্দগুলো পড়ে বড় করে একবার ঢোক গিলোম।

সেখানে লেখা : পিতৃত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

*

অধ্যায় ১৪

আমার বাবা আমার আসল বাবা নন। আমার বাবা আমার আসল বাবা নন। আমার বাবা আমার আসল বাবা নন। এই ছয়টি শব্দই বারবার আমার মাথায় ঘুরছে। এগুলো ছাড়া যেন আমার শব্দ ভান্ডারে অন্য কোন শব্দ নেই।

আমার…

বাবা…

আমার…

আসল…

বাবা নন!

নাইটস্ট্যান্ডের ঘড়িটার দিকে তাকালাম।

তিনটা পাঁচ।

গত পাঁচ মিনিট ধরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই ছয়টা শব্দই ভাবছি।

ল্যাসির দিকে তাকালাম, আমার বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে ও। ওকে কথাটা বলতে চাই আমি। বলতে চাই, অন্য ঘরে যে লোকটা আছেন তিনি আমার বাবা নন। তিনি একজন ঠগ। অচেনা এক লোক।

“বিছানা থেকে নামবে না নাকি আজকে?”

আওয়াজ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকালাম। এক লোক দাঁড়িয়ে আছে আমার ঘরের দরজায়। ধূসর চুল, চশমা নেমে এসেছে নাকের ওপর, ফ্লানেলের শার্ট আর খাকি হাফপ্যান্ট।

“হ্যাঁ, নামব। এই কয়েকটা জিনিস চিন্তা করছিলাম।”

“তোমার জন্যে খাবার তৈরি করে রেখেছি আমি।”

হেসে মাথা নেড়ে বললাম, “বাহ। এক মিনিটের মধ্যে আসছি।”

ল্যাসিকে আমার বুকের ওপর থেকে নামিয়ে রেখে পরবর্তি পাঁচ মিনিট ধরে ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করলাম। আমার জীবনের দীর্ঘতম গোসল। অবশেষে যখন কাপড় চোপড় গায়ে চাপালাম তখন তিনটা পনের বাজছে।

আমার দিনের এক চতুর্থাংশ শেষ হয়ে গেছে।

বাবা, দুঃখিত, রিচার্ড নামের লোটা টেবিলে আমার জন্যে খাবার সাজিয়ে রেখেছে।

স্প্যাগেটি, গার্লিক ব্রেড আর একজগ ভর্তি দুধ। তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। চোখ বড় বড় করে। রাগে ফুঁসে উঠছি ভেতর ভেতর।

তারপর হঠাৎ করে আমার নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতে লাগল। এই মানুষটার ওপর কীভাবে রাগ করব আমি। তিনি হয়ত আমার জন্মগত পিতা নন, তবুও তিনিই তো আমার বাবা। তাই না?

মনে হচ্ছে সব বলে দেই।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বসবে না তুমি-”

তার কথার মাঝখানেই দরজাটা খুলে গেল। ইনগ্রিড ভেতরে ঢুকল হাঁপাতে হাঁপাতে।

“আপনারা বিশ্বাসই করবেন না,” ও বলল।

.

দশ দিনের মধ্যে প্রথমবারের মত ঘুম ভেঙে হেনরিকে পাশে পেল ইনগ্রিড। ওর পাশে ঘুমোতে খুব ভাল লাগছিল। ওর দেহের উত্তাপ এরকমভাবে অনুভব করেনি সে কতদিন! বুকের ওপর তাকিয়ে দেখে ল্যাসি ঘুমিয়ে আছে সেখানে। উঠে বসে ওকে হেনরির বুকে শুইয়ে দিল সে।

এরপরে ওদের দুজনের মাথায়ই আলতো করে চুমু দিয়ে বিছানা থেকে উঠে কাপড় পরে নিল। জিনস আর ধুসর রঙের টপ। হোমিসাইড ডিটেক্টিভ ইনগ্রিড।

দশ মাইল দূরের আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যাবার পথে ফোনে বাবার সাথে কথা বলা শুরু করল সে। ওর মাকে কেবলই রিলিজ দেয়া হয়েছে হাসপাতাল থেকে আর তিনি তাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। ইনগ্রিডের মায়ের শরীর এখন কিছুটা ভালো। তবে কথা বলার সময় হলেই মুষড়ে পড়ছেন। একটা শব্দ উচ্চারণ করতে হলেও অনেক কষ্ট করতে হয় তাকে। বিকেলবেলা স্পিচ থেরাপিস্টের সাথে তার প্রথম বৈঠক। ইনগ্রিড ওর মা’র সাথেও কিছুক্ষণ আলাপ করল। বলল, আর কিছুদিনের মধ্যেই আবার আগের মত জোর গলায় ওদের সাথে কথা বলতে পারবেন তিনি।

ও পাশ থেকে তার মা-ও জড়ানো গলায় কিছু বললেন। তবে কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে অসুবিধা হল না ইনগ্রিডের। সে বলল, “আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি।”

দশ মিনিট পরে আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পার্কিংলটে গাড়ি থামাল।

ক্যাপ্টেনের অফিসে যাওয়ার পথে কম করে হলেও পনের জন ওর কাছে ওর মার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইল। প্রত্যেককেই একই উত্তর দিল সে : মার শরীর এখন কিছুটা ভালো। হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে। ইনগ্রিডকে আগে কখনো এতগুলো মানুষের আলিঙ্গন সহ্য করতে হয়নি।

ক্যাপ্টেনের অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শব্দ করে হাফ ছাড়ল। ক্যাপ্টেন জেমস মার্শাল তার ডেস্কের পেছনে বসে আছেন। উঁচা-লম্বা সুদর্শন একজন মানুষ। ছোট করে আর্মি স্টাইলে ছাটানো চুল।

“আর একটা লোকও যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে-” ।

“তোমার মার শরীর এখন কেমন?” বড় করে হেসে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপ্টেন।

ইনগ্রিড হাত নেড়ে তাকে চুপ করিয়ে দিল। “আর হ্যাঁ, দু-রাত আগে ভোর চারটার সময় ফোন করে ঘুম থেকে টেনে তোলার জন্যে আবারো ধন্যবাদ। আমার স্ত্রীও ব্যাপক খুশি হয়েছেন ব্যাপারটাতে।”

“আপনি একজন পুলিশ ক্যাপ্টেন। রাত-বিরাতে ফোন পেতে পেতে আপনার এতদিনে অভ্যাস হয়ে যাবার কথা।”

“কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ল্যান্ডলাইনে তো ফোন আসার কথা নয়।”

“আমি কি আসলেই ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিলাম নাকি?” ইনগ্রিড হেসে জিজ্ঞেস করল।

“তা না-হলে কি?”

“দুঃখিত সেজন্যে।”

“মনে থাকে যেন, আমার স্ত্রীর আগামি চ্যারিটি পার্টিতে আসছ তুমি।”

“অবশ্যই যাব।”

“ওহ, আরেকট কথা। আমি তোমার কাছে একশ ডলার পাই। ন্যাশনাল টিকেটটার পেছনে অতই খরচ হয়েছিল আমার।”

“কিসের ন্যাশনাল টিকেট?”

“ভার্জিনিয়া পুলিশ কমিশনারকে ভোর চারটায় ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে প্রশ্ন করার মাওল।”

ইনগ্রিড ওর ওয়ালেট থেকে একটা একশ ডলারের নোট বের করে ডেস্কের ওপর রেখে বলল, “আমার বাবা দু-দিন আগে দিয়েছিলেন আমাকে এই টাকাটা। কিছু জিনিস কেনার জন্যে।”

মার্শাল হেসে উঠলেন।

ইনগ্রিড মনে মনে আশা করছিল, ক্যাপ্টেন হয়ত টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবেন, কিন্তু তিনি ওটা ভাঁজ করে নিজের ওয়ালেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।

“তাহলে?” তিনি বললেন, “তুমি কি ছুটি থেকে একেবারে ফিরে এসেছ? নাকি আবার আটলান্টা চলে যাবে?”

“নাহ। আর ছুটি কাটাতে ইচ্ছে করছে না। আপনাকে জেনিফারের কেসটার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানাতে এসেছি। ওটা নিয়েই কাজ করব আমি।”

“ফোন কলটার সাথে এর কোন সম্পর্ক আছে নাকি?”

“হ্যাঁ।”

এরপরের তিরিশ মিনিট সে মার্শালকে সব কিছু খুলে বলল। লোকটাকে ইনগ্রিড প্রায় দশ বছর যাবত চেনে। সে যখন নতুন জয়েন করেছিল তখন তিনিই ওর প্রথম পার্টনার ছিলেন। দু-বছর পর সার্জেন্ট পদে প্রমোশন হয় তার। আর কিছুদিন আগে ওদের ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পান। ইনগ্রিড জানে মার্শালকে সবকিছু খুলে বলাটা নিরাপদ। কথা ফাঁস হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

“বিশ্বাসই হয় না,” তিনি বললেন।

“আমি জানি।”

“এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে যে, ঐ কংগ্রেস সদস্যদের মধ্যে কারও মেয়েটার খুন হবার সাথে কোন সম্পর্ক আছে।”

“হ্যাঁ।”

“এজন্যেই কি সুলিভান কেসটার পেছনে লেগেছে? স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম বন্ধ করার জন্যে?”

“হতে পারে। তার কাছে হয়ত তথ্য ছিল, হেনরির মা খুনের সাথে জড়িত। এজন্যেই তিনি চেয়েছেন আমার হাতে কেসটা পড়ুক। তাহলে এসব কিছু বের হয়ে আসবে।”।

“তাহলে সরাসরি তোমাকে ফোন করলেন না কেন? কিংবা হেনরিকে করলেও তো হত। ওর সাথে তো তার ভালো যোগাযোগ আছে। তাই না?”

“হেনরির জন্যে বিষয়টা একটু স্পর্শকাতর। আর আমি যদি আলাদাভাবে কেসটা নিয়ে কাজ করে হেনরির মা সম্পর্কে কিছু জানতে পারি তাহলে প্রেসিডেন্টের কাছে থাকা তথ্যগুলো কতটুকু সঠিক তাও যাচাই হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা। তাহলে এখন কি করতে চাও তুমি?”

ইনগ্রিড তাকে বলল, ওদের ধারণা জেনিফারের তোলা ছবিগুলো এখনও কোন নিরাপদ জায়গাতেই আছে। হয়ত তার চাচাত বোন মেগান কিংবা ভাই মার্কাসের কাছে।

“এটা একটু অতিকল্পনা হয়ে যাচ্ছে না? তিরিশ বছর আগের ঘটনার কথা বলছি আমরা।”

“এটাই আমাদের একমাত্র আশা।”

“ঠিক আছে। আমার কাছে কি সাহায্য চাও তুমি?”

“একা কাজ করতে পারব না আমি,” ইনগ্রিড বলল। “বিলিকে দরকার আমার।”

মার্শাল একটা লম্বা শ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু কেউ যদি এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবে আমাদের মধ্যে কোন আলোচনা হয়নি এ নিয়ে।”

“কিসের আলোচনা?”

.

হাত উঁচু করে ওকে থামার ইঙ্গিত দিলাম।

“তোমার কি মনে হয় প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে কথাটা সত্যি?” জিজ্ঞেস করলাম। “মানে, সুলিভান তোমাকে কেসটার কাজে লাগিয়েছে কারণ তার কাছে মার জড়িত থাকার ব্যাপারে তথ্য ছিল?”

“হতেও পারে,” ইনগ্রিড বলল, “ভেবে দেখ একবার, তুমি প্রেসিডেন্টকে ফোন করে তোমার অপহরণ হবার ঘটনা সব জানিয়েছিলে। এরপর এটাও বলেছিলে, তোমার কাছ থেকে একটা ফ্ল্যাশড্রাইভভের অবস্থান জানতে চেয়েছেন তিনি। যেটা তার মতে প্রেসিডেন্ট তোমাকে দিয়েছেন। আসলে ওরকম কোন ফ্ল্যাশড্রাইভভ তোমাকে দেননি প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এতে হয়ত তোমার মার ব্যাপারে আরো খোঁজ নিতে গিয়ে তিরিশ বছরের পুরনো এই খুনের সাথে তার জড়িত থাকার ব্যাপারে কোন তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। আর সেটা যাচাই করে দেখার জন্যে একটা উপায়ই এসেছে তার মাথায়। সেজন্যেই ভার্জিনিয়ার পুলিশ কমিশনারকে দিয়ে আমার ক্যাপ্টেনকে ফোন করিয়েছেন যাতে আমাকে কেসটা দেয়া হয়।”

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

“প্রেসিডেন্ট সুলিভান তোমাকে কলব্যাক করেছে এখনও?”

“না।”

“তিনি এখনও রাশিয়ায়,” বাবা বললেন। “আমেরিকা-রাশিয়ার আরেকটি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তা বন্ধ করার চেষ্টায় আছেন।”

হঠাৎ করে আমার মনে হল, সামনে বসে থাকা লোকটা আমার আসল পিতা নন। জোর করে দূরে ঠেলে দিলাম চিন্তাটা।

ইনগ্রিডকে বললাম, “এরপর?”

.

“ক্যাপ্টেন রাজি হয়ে গেছেন এত সহজে?” বিলি জিজ্ঞেস করল প্যাসেঞ্জার সিট থেকে।

“হ্যাঁ। কিন্তু কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, সাসপেন্ড থাকা অবস্থায় কিভাবে একটা কেসে কাজ করছ তুমি, তখন এ ব্যাপারে সবকিছু অস্বীকার করবেন তিনি।”

“তাহলে আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও।”

ইনগ্রিড পাশে ফিরে বিলির দিকে তাকিয়ে দেখল, সে আসলেই মজা করছে কিনা। হ্যাঁ, মজাই করছে।

ও যখন বিলির বাসায় যায় তখন উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল বিলি। খুশিতে কেঁদেই ফেলেছিল প্রায়। গত আধঘন্টা যাবত ইনগ্রিড ওকে কেসটার আদ্যোপান্ত খুলে বলেছে।

“তাহলে, কার বাসায় আগে যাব আমরা?”

“মেগানের। শহরের উত্তরদিকে একঘন্টার দূরত্বে তার বাসা। এরপরে আমরা ডেলওয়ারে গিয়ে খুঁজে দেখব ভাইটাকে পাওয়া যায় কিনা।”

“আর এই কাজ তোমার পক্ষে একা করা সম্ভব ছিল না, কারণ?”

“কারণ তুমি একটা গর্দভ আর তোমার কাছে অনেকে খুব সহজেই মুখ খোলে। যেটা আমাকে দেখলে করে না।” কথাটা সত্যি, কিন্তু এর সাথে ইনগ্রিডের সুন্দর চেহারার একটা যোগসাজশ আছে। ইনগ্রিড যত ভালোমতই চেষ্টা করুক না কেন, মহিলাদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে কেন যেন প্রতিযোগি ভাবেন তারা। মুখ খোলে না। আর পুরুষদের ব্যাপারটা তো আরো জঘন্য। ওর সাথে লাইন মারার তালে থাকে বেশিরভাগ। বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে সবকিছু। সরাসরি কোন জবাব পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। কিন্তু বিলির ব্যাপারটা অন্যরকম। হাসিখুশি চেহারার ছেলেটার সামনে সবাই আন্তরিকভাবে কথা বলা শুরু করে। এমনটা আগে কারো ক্ষেত্রে দেখেনি ও।

“আমি বলে কথা,” বড় করে হেসে বলল বিলি। ওর ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে।

“আর তোমাকে মিস করছিলাম কাজে।”

“আহ্‌-হা ।”

ইনগ্রিড আসলেই মিস করছিল ওকে।

বিলি ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত। গতানুগতিকের চেয়ে অনেক বেশি সুদর্শন। ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা ওর জন্যে পাগল বলতে গেলে। তাদের সবার সাথেই ইতিমধ্যে একবার করে ডেট করা হয়ে গেছে বিলির। কিন্তু ইনগ্রিডের চোখে ছেলেটা ছোট ভাইয়ের মত। কথায় কথায় ওকে বডি স্প্রে ব্যবহার করার কথা মনে করিয়ে দেয় সে। হেনরিও পছন্দ করে ছেলেটাকে। যে দু-বার দেখা হয়েছে দু-জনের, খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে নিয়েছে।

বিশ মিনিট পর একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে গাড়ি পার্ক করল ইনগ্রিড। মেগান ক্লেইনের নম্বরে ফোন করল। তিনবার রিং হবার পর ফোন ধরল মেগান। ইনগ্রিড নিজের পরিচয় দিয়ে বলল কিছু প্রশ্ন আছে। তার। জিজ্ঞেস করল ওদের সময় দিতে পারবেন কিনা তিনি।

পারবেন।

“আপনি কি এখন বাসাতেই আছেন?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল। যদিও উত্তরটা তার জানা। পার্কিংলটে মেগানের নিশান আলটিমা গাড়িটা দেখেছে সে।

“হ্যাঁ।”

“আমরা বাইরেই আছি। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে আপনার দরজার সামনে পৌঁছে যাব।”

ইনগ্রিড আর বিলি যখন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছুল তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মেগান।

ওদের দুজনের সাথে হাত মেলালেন তিনি।

“এটা কি জেনিফার সম্পর্কিত কিছু?” মেগান জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু ওর খুনি তো তিরিশ বছর আগেই ধরা পড়েছিল।”

“জি, ঠিক বলেছেন। তবে অন্য কিছু ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আমরা।”

“ঠিক আছে। যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করব,” বিলির দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।

“আমাদের আসলেই খুব সুবিধে হবে তাহলে,” বিলি হেসে বলল।

মেগান ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।

“সবকিছু একদম আউলিয়ে আছে,” তিনি বললেন, “কিছুদিন ধরেই ডিভোর্স হয়েছে আমার, তাই কিছু জিনিস বের করতে হবে বাসা থেকে।”

ইনগ্রিড ব্যাপারটা না খেয়াল করে পারল না যে ইচ্ছে করে ডিভোর্স শব্দটা জোরে বললেন তিনি। বিলির প্রতি একটা অদৃশ্য ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে রাখলেন যে, জায়গা খালি আছে তার জীবনে।

ওরা কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করায় দু-জনেই না করে দিল। লিভিংরুমে গিয়ে বসল তিনজনে। এটা সেটার ব্যাপারে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ইনগ্রিড কাজের কথা তুলল, “জেনিফার, মানে আপনার চাচাত বোন, সে তো টাকার জন্যে অন্যদের ব্ল্যাকমেইল করছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ। আমি ওকে আগেই সাবধান করে বলেছিলাম, খারাপ কিছু ঘটতে পারে,” লম্বা করে একটা শ্বাস নিলেন তিনি, “আর ঘটেছিল।”

“সে যে ছবিগুলো তুলেছিল ওগুলোর কি হল?”

“যাদের ছবি তাদেরকেই ফেরত দিয়ে দিত ও। টাকা পাক আর না পাক। আর আমাকে এটাও বলেছিল, এক ছবি এক কপিই প্রিন্ট করত ও। বাড়তি ছবি দিয়ে ওর কিছু করার ছিল না।”

“তাহলে আপনাকে কখনো কোন ছবি দেয়নি সে? কয়েকদিনের জন্যে হলেও?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

“না।”

“কখনোই না?”

“কখনোই না।”

“হয়ত আপনার ঘরে কিংবা আপনার কোন আসবাবের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আপনাকে কিছু বলেনি সে?” ইনগ্রিড বলল।

“তা হতে পারে। কিন্তু ওরকম হলেও এতদিনে ছবিগুলো পেয়ে যেতাম আমি,” ঘরের অন্য পাশে রাখা বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। “দু-বার ডিভোর্স হয়েছে আমার আর চারবার বাসা পাল্টেছি। এতদিনে পেয়েই যেতাম কোন লুকোনো ছবি থাকলে।”

“আপনার পুরনো বাসায়?”

“সেটার ব্যাপারে বলতে পারব না। তবে সেটা অসম্ভব কিছু না। আমাদের সাথে বেশ কয়েক সপ্তাহ ছিল জেনিফার। তাছাড়া যেকোন সময়ে আমাদের বাসায় আসতে পারত ও। মা-বাবা একটা চাবি বানিয়ে দিয়েছিলেন ওকে যখন ওর বয়স দশ বছর ছিল।”

“আপনার বাবা-মা কি এখনও ওখানেই থাকেন?”

“না, ছয় বছর আগে ফ্লোরিডায় চলে গেছেন তারা।”

“এখন যারা থাকেন তাদের চেনেন আপনি?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

“সেরকমভাবে চিনি না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন তিনি। তবে আপনারা চাইলে খোঁজ নিয়ে দেখতে সমস্যা হবে না।”

ইনগ্রিড কষ্ট করে হাসি চাপল। সে যদি একা আসত তাহলে মেগান হয়ত এতটা সহযোগিতা করতেন না। কিন্তু বিলি আসাতে কোনকিছুতেই না বলছেন না।

“খুব ভালো হয় তাহলে,” বিলি বলল।

মেগান বলল, ফোন করে খবর নিয়ে ওদের জানাবে। বিলি তার একটা কার্ড দিলে হাসিমুখে সেটা নিলেন তিনি। আরো কিছু টুকটাক কথা বার্তা বলে ডেলওয়ারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল ওরা।

প্রায় একঘন্টা লাগল ওখানে পৌঁছুতে।

যাবার পথে পুরোটা রাস্তাই ঘুমিয়ে কাটাল বিলি আর ইনগ্রিড ক্লাসিক রক রেডিও শুনতে লাগল। বিলির চরম অপছন্দ রক গান। হিপহপ পছন্দ করে ও।

বিকেল চারটা পঁয়ত্রিশ নাগাদ একটা বাণিজ্যিক এলাকায় গাড়ি পার্ক করল ও। আমেরিকা অটো কর্পোরেশন। সেক্রেটারিকে মার্কাস নিউবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে একটা ছোট হলওয়ে পেরিয়ে তার অফিস রুমে নিয়ে আসল ওদের। মার্কাস নিউবার ফোনে কথা বলছিলেন। ইন্টারনেটে যে মানুষটার ছবি দেখেছিল ইনগ্রিড তার সাথে তেমন কোন পার্থক্য খুঁজে পেল না। টাক মাথা, একটু বেশিই স্বাস্থ্যবান। সাদা রঙের একটা পোলো শার্ট তার পরনে।

মার্কাস ফোনে কথা বলা শেষ করা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল ওরা।

অবশেষে ফোন রেখে ইনগ্রিডের দিকে তাকালেন তিনি, “আপনারা কি আইআরএস থেকে এসেছেন?”।

ইনগ্রিড আর বিলি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল।

“না, আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি আমরা, ইনগ্রিড বলল।

“ওহ্! বেশি গতিতে গাড়ি চালিয়েছি নাকি আমি?”

“জি না, আপনার বোনের কেসটার ব্যাপারে একটু দরকার ছিল।”

তার মুখটা কালো হয়ে গেল।

“সে তো ওয়াশিংটনে ডিসিতে খুন হয়েছিল। আলেক্সান্দ্রিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক? তাছাড়া খুনিকে তো পেয়েছিল ওরা। পরে তার স্ত্রী গুলি করে মেরেছে তাকে। একদম ন্যায়বিচার হয়েছিল।”

তাকেও মেগানের মত একই কথা বলল ইনগ্রিড, “অন্য কিছু ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি আমরা।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওদের বসতে ইশারা করল মার্কাস।

ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি এটা আগে থেকেই জানতেন, আপনার বোন ব্ল্যাকমেইল করছিল অনেককে?”

“না, পুলিশ আমাদের বলার পরে জেনেছি।”

“আমাদের বলতে?”

“আমি আর আমার মা।”

“কোথায় তিনি এখন?”

“আগের বাসাতেই।”

“আবার বিয়ে করেছেন?”

“না, কিন্তু একজন থাকে তার সাথে।”

“তাহলে আপনার বোন কখনোই আপনাকে ছবিগুলো দেখায়নি?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

“না।”

“আপনার কোন জিনিসপত্রের মধ্যে তো লুকিয়ে রাখতে পারে। কিংবা তার নিজের জিনিসপত্রের মাঝে।”

“পুলিশের লোকজন ওর জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাপক ঘাটাঘাটি করেছিল তখন। আর আমার জিনিস পত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।”

“তার ডায়রিতে লেখা, আপনি নাকি প্রায়ই ওটা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন?”

“আপনাদের কাছে ওর ডায়রিটা আছে?”

“ক্রাইম-সিনে ডায়রির কয়েকটা পাতা পাওয়া গেছিল।”

“ওহ, আচ্ছা,” এটুকু বলে বড় করে একবার শ্বাস নিলেন, এরপর বললেন, “আমি কি ঐ ডায়রির পাতাগুলো পেতে পারি? এতদিন পরে ওর গলার আওয়াজ শুনতে ভালোই লাগবে।”

“আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব,” ইনগ্রিড বলল। এরপর আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি ওনার ডায়রি পড়তেন?”

“না,” মৃদু হেসে বললেন তিনি। “কিন্তু ওটার খোঁজ করতেন মাঝে মাঝে?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

“তা বলতে পারেন, কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিলেন মার্কাস। “প্রথমবার একদম হঠাৎ করেই চোখের সামনে পড়ে গেছিল ওটা। ওর গোলাপি রঙের কেঁচিটা খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিলাম। অল্প কিছু দূর পড়েছিলাম।”

“তারমানে, একটু হলেও পড়েছিলেন?” স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরেই বলে ফেলল ইনগ্রিড।

“শুধু ওকে খেপিয়ে তোলার জন্যে।”

ইনগ্রিড মাথা নাড়ল জবাবে।

মার্কাস বলতে থাকলেন, “স্কুল থেকে আসার পরে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পল নামের একটা ছেলেকে কেন চুমু দিতে চায় ও। ভয় পেয়ে গেছিল বেচারি।”

“এরপরে নিশ্চয়ই আরো ভালো করে লুকিয়ে রাখতেন তিনি ওটা?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। তবে আরো পাঁচ ছয়বার ওটা খুঁজে পেয়েছিলাম আমি।”

“এরপর?”

“এরপর আর কক্ষনো খুঁজে পাইনি।”

“এটা কবেকার কথা?”

“ও মারা যাবার আগের বছরের এপ্রিলে শেষ দেখেছিলাম ডায়রিটা, যতদূর মনে পড়ছে।”

“ঐ সময়ের আশেপাশেই ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে সে।”

“ঠিক,” মার্কাস বললেন, “কারণ ওটা সম্পর্কে কিছু পড়িনি আমি ডায়রিতে।”

“হয় ওটা সবসময় নিজের কাছে রাখত জেনিফার, বিলি বলল।

“নয়তো ভালো দেখে একটা লুকোনোর জায়গা পেয়ে গেছিল সে,” ডায়রিতে যা পড়েছিল সেটা মনে করে বলল ইনগ্রিড।

“হ্যাঁ, এটা ডায়রিতে লিখেছিল মেয়েটা,” বাবা পাশ থেকে জোরে বলে উঠলেন। “লোকজনকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করার আগে দিয়ে লিখেছিল, ডায়রিটা লুকোনোর জন্যে আদর্শ একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে সে।”

“জানি আমি,” ইনগ্রিড বলল। “আসলেই জায়গাটা কোন কিছু লুকোনোর জন্যে একদম আদর্শ স্থান।”

“আপনি কি জানেন, তিনি কোথায় লুকিয়ে রাখতেন ডায়রিটা?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

“নাহ্,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন মার্কাস। “আমি অনেক ভালো করে খুঁজে দেখেছিলাম। প্রায় বিশ বার পুরো বাড়িতে চক্কর লগিয়েছিলাম।”

“আপনার ঘরে, বিলি আস্তে করে হেসে বলল।

“কি?” জিজ্ঞেস করলেন মার্কাস।

“আপনার নিজের ঘরে খুঁজে দেখেছিলেন কখনো?”

ওনার চোখগুলো কপালে উঠে গেল, “আমার ঘরে?”

“আমি নিশ্চিত ওখানেই লুকিয়েছিলেন তিনি। নিজের ঘরে খুঁজে দেখার কথা তো কখনো মনে হয়নি আপনার, তাই না?”

“না, তা হয়নি।”

“চলুন তাহলে,” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ইনগ্রিড।

“কোথায়?”

“আপনার মা’র বাসায়।”

.

মার্কাসের সাদা টয়োটা গাড়িটাকে প্রায় ষাট মাইল অনুসরণ করে ওয়াশিংটন ডিসি তে তার মা’র বাসায় পৌঁছুল ইনগ্রিড আর বিলি। একটা পুরনো আবাসিক এলাকায় বাসাটা।

জেনিফারের মা তাদের সাথে দরজার সামনে দেখা করলেন। খুব একটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না তার শারীরিক অবস্থা। কম বয়সে মেয়েকে হারানোর বেদনা থেকেই কিনা, চেহারা ভেঙে পড়েছে একেবারে। চুল সব একদম সাদা। হয়ত মেয়েকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া বিপজ্জনক শখটার জন্যে নিজেকেই দায়ি করেন তিনি। প্রতিটা নিশ্বাস নিতে কষ্ট করতে হচ্ছে তাকে।

“এসবের মানে কি?” বুকের ওপর হাত রেখে জিজ্ঞেস করলে তিনি।

মার্কাস তাকে এক কোণায় নিয়ে আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ভেতরে চলে গেলেন তিনি। গোটা সময়ে আর তার দেখা পাওয়া যায়নি।

“আসুন আমার সাথে,” এই বললে ওদের বাসার ভেতরে নিয়ে গেল মার্কাস। একটা সরু হলওয়ে আর লিভিংরুম পার হয়ে অবশেষে একটা ঘরের সামনে এসে বললেন, “এটাই ছিল আমার ঘর।”

ঘরের মাঝখানটাতে একটা বিছানা। দেয়াল ঘেষে একটা ড্রেসার, বুকশেলফ আর একটা ছোট টেবিল রাখা।

“খুব একটা পরিবর্তন হয়নি,” তিনি বললেন। “একই বিছানা, একই ড্রেসার, একই টেবিল। দেয়ালে অবশ্য কিছু পোস্টার লাগানো ছিল, ওগুলো তুলে ফেলা হয়েছে পরে। বাকি সব একদম আগের মতই।”

“আপনি যদি জেনিফারের জায়গায় হতেন আর আপনাকে এ ঘরে একটা ডায়রি লুকিয়ে রাখতে বলা হত, তাহলে কোথায় লুকোতেন সেটা?” বিলি জিজ্ঞেস করল।

জবাবে শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন মার্কাস। এরপর তিনজন মিলে খোঁজা শুরু করল গোটা ঘরে। ক্লোজেট, বিছানা, আসবাব পত্রের নিচে, কার্পেট উঠিয়ে সবজায়গায় দেখা হল। ছাদে আলগা ফুটো আছে কিনা তা-ও পরীক্ষা করে দেখল বিলি। প্রতিটা কোণায় কোণায় খুঁজেও কিছু চোখে পড়ল না।

বিশ মিনিট পরে তিনজন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল।

“কিছুই নেই এখানে,” মার্কাস বললেন।

“যাই হোক, ধন্যবাদ আপনাকে,” লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল ইনগ্রিড।

“দাঁড়ান, বিলি বলল এ সময়, “বুকশেলফও কি আগেরটাই আছে?” মার্কাস মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

“আর বইগুলো?”

আবারো মাথা নাড়লেন তিনি, “হ্যাঁ, একটা এনসাইক্লোপিডিয়ার সেট। ওগুলো এখান থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করিনি। এখনকার দিনে সব কিছু তো ইন্টারনেট থেকেই জানা যায়।”

ইনগ্রিড বুকশেলফটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। ছাব্বিশটা বইয়ের সেট। ইংরেজি প্রতিটা অক্ষরের জন্যে একটা বই। কোনটা চিকন, আবার কোনটা অনেক মোটা। ইনগ্রিড একটা একটা করে বইগুলো নামাতে লাগল। বিলিও সাহায্য করতে লাগল ওকে। ‘V’ লেখা বইটা শেলফ থেকে বের করে খুলল ওটা।

ইনগ্রিডকে দেখাল। কাগজ কেটে একটা প্রকোষ্ঠ বানান হয়েছে। একদম ডায়রির মাপের। বিলি মার্কাসকে দেখাল বইটা।

“ওখানে দেখার কথা মাথায়ই আসেনি কখনো,” তিনি বললেন। “সামনে কখনো দেখতাম সেই সম্ভাবনাও কম।”

কিন্তু জেনিফারের ডায়রি লুকিয়ে রাখার জায়গা আবিষ্কারের উচ্ছ্বাসটা কিছুক্ষনের মধ্যেই উবে গেল। খালি ওটা, কিছুই নেই।

বেশ খানিকক্ষণ সবাই চুপ করে থাকার পরে হঠাৎ মার্কাস বলে উঠলেন, “ববের ওখানে।”

বিলি আর ইনগ্রিড ওনার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল।

“বব আর মা’র মধ্যে যখন ডিভোর্স হয়েছিল তখন নতুন বাসায় ওঠার পর একদম এই এনসাইক্লোপিডিয়ার সেটটাই কিনেছিলেন তিনি। এমনকি ও বাসায় আমাদের ঘরগুলোও এখানকার মত করে সাজানো হয়েছিল, যাতে আমাদের মানিয়ে নিতে সহজ হয়।”

“তার মানে বলতে চাচ্ছেন যে, আপনার সত্বাবার বাসায় হুবহু এরকম দেখতে আরেকটা এনসাইক্লোপিডিয়ার সেট আছে?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে বলল মার্কাস।

তিনজনের মাথাতেই একই জিনিস ঘুরছে এখন। জেনিফার যদি এ বাসায় এনসাইক্লোপিডিয়ার মাঝে ডায়রিটা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে, তাহলে ওখানেও একই কাজ করতে অসুবিধে কোথায়?

.

বব তার নতুন স্ত্রীর সাথে শহরের বাইরে গেছেন একটা কাজে, কিন্তু মার্কাসের কাছে বাসার বাড়তি চাবি আছে।

তিনি ঠিক কথাই বলছিলেন, ববের বাসায় তার ঘরটা একদম আগের ঘরটার আদলে তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখানে মার্কাসের ঘর থেকে এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো স্টাডিতে নিয়ে গেছেন বব।

ইনগ্রিড ‘V’ লেখা বইটা শেলফ থেকে বের করে খুলল ওটা।

এরপর মার্কাস আর বব দু-জনকেই দেখিয়ে মাথা ঝাঁকাল। কাগজ কেটে কোন প্রকোষ্ঠ বানানো হয়নি।

.

“ওটার ভেতরে ডায়রি লুকানোর জায়গা বানায়নি মেয়েটা?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

“না,” ইনগ্রিড বলল। “অন্তত ‘V’ লেখা বইটার ভেতরে কিছু ছিল না।” এরপর ব্যাগের চেইন খুলে ভেতর থেকে একট বই করল ও। কিন্তু ‘ডি’-তে ডায়রি,” হেসে বলল।

আমি হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম, “ছবিগুলো ছিল ভেতরে?”

ইনগ্রিড মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে আমার হাতে তুলে দিল বইটা। কম করে হলেও দুই ইঞ্চি মোটা এনসাইক্লোপিডিয়াটা। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে মোটা বই।

“আগেই সাবধান করে দিচ্ছি,” ইনগ্রিড বলল, “ভেতরের ছবিগুলো হয়ত ভালো লাগবে না তোমাদের।”

“আমার মনে হয় না এতদিন যা ঘটেছে তার চেয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে।”

“তোমার জন্যে হয়ত না,” বাবার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করে বলল ইনগ্রিড।

বইটা খুলে ফেললাম আমি। আয়তাকার একটা প্রকোষ্ঠ বানানো হয়েছে কাগজ কেটে। অনায়াসে একটা ডায়রি ঢুকিয়ে রাখা যাবে ওটাতে। কিন্তু এখন ও জায়গার রাখা আছে চার বাই ছয় ইঞ্চির অনেকগুলো ছবি। প্রথম ছবিটা তুলে দেখতে লাগলাম। তিরিশ বছরের পুরনো, অনেকটাই মলিন হয়ে এসেছে রঙ। ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক লোক এবং মা হেঁটে যাচ্ছে। তাদের এরপরের ছবিগুলো একটা সরু গলিতে, চুম্বনরত অবস্থায়।

তিনি আসলেই পরকিয়া করছিলেন।

আমি লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ছবিগুলো বাবার হাতে দিয়ে দিলাম। তিনি হয়ত ঘটনাটা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, যখন ইনগ্রিড তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। বুঝতে পেরেছিলেন, কি দেখতে হতে পারে তাকে।

প্রতিটা ছবি দেখার পর তার নিঃশ্বাস আগের চেয়ে ভারি হতে লাগল।

“আমি দুঃখিত, ইনগ্রিড বলল। “ছবিগুলো দেখার পর মনে হয়েছে, ওগুলো না খুঁজে পেলেই ভালো হত।”

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় একটা মাথায় আসল আমার। মার সাথে এই লোকটার সম্পর্ক তো আমার জন্মের আগে থেকেই থাকতে পারে?

ছবির লোকটার দিকে তাকালাম। উনি আমার বাবাও হতে পারেন।

ছবিগুলো আবার আমার হাতে নিলাম। এর আগেরবার অত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। নিজের মাকে অন্য একটা লোকের সাথে চুম্বনরত অবস্থায় দেখার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু এবার ভালোমত দেখলাম।

এক পাশ থেকে তোলা হয়েছে ছবিটা, কিন্তু তবুও পরিস্কার বুঝতে পারলাম। এ লোকটা কংগ্রেসের সদস্য নন। একজন সিনেটর তিনি।

সিনেটর ডেভিড সুলিভান।

“ওহ্ ঈশ্বর,” নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে গেল কথাটা।

“কি হল?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

ইন্টারনেটে দেখা ডেভিড সুলিভানের কথা মনে করলাম। ওনার চোখের মণিগুলো ধূসরাভ, ওনার ছেলের মতন। আর একদম আমার মত।

প্রেসিডেন্ট সুলিভান হয়ত আমার ভাই!

*

অধ্যায় ১৫

ইনগ্রিড আর বাবা দু-জনের আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন, আগের কথাটা ব্যাখা করে বলব।

বাবার দিকে তাকালাম। কি বলব তাকে আমি? তাকে কি এটা বলব : আমি জানি আপনি কেবলই আবিষ্কার করেছেন, আপনার স্ত্রীর অন্য একজন লোকের সাথে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এটাই বোধহয় আপনাকে জানানোর মোক্ষম সময় যে, আমি জেনে গেছি আপনি আমার আসল বাবা নন।

কিন্তু সেটা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। বরং এটা বললাম, “আপনারা কি জানেন ছবির লোকটা কে?”

ইনগ্রিড মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “বিলি আর আমি তাকে আমাদের তালিকার কংগ্রেস সদস্যদের সাথে মিলিয়ে দেখেছি। কিন্তু কারো সাথে ওনার চেহারার কোন মিল নেই।”

“এর কারণ তিনি কংগ্রেস সদস্য ছিলেন না, উনি ছিলেন একজন সিনেটর। ছবির লোকটা ডেভিড সুলিভান, প্রেসিডেন্টের বাবা।”

“প্রেসিডেন্টের বাবা?” ইনগ্রিড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এরপর একটা ছবি তুলে নিয়ে বলল, “তুমি নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ,” আমি বললাম। “উনি আর আমার মা স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে একসাথে কাজ করতেন।”

ওকে ডেভিড সুলিভানের জীবন বৃত্তান্ত খুলে বললাম। ওনার চাকরি জীবন, অপহরণ, সিনেটর পদে নির্বাচনে এবং টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনায় মৃত্যু, কিছুই বাদ দিলাম না।

“তারা একসাথে চাকরি করত!” বাবা বললেন। “তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের বিয়ের পুরোটা সময়ই তার সাথে সম্পর্ক ছিল তোমার মার।”

“হতে পারে,” বললাম তাকে, যদিও আমি প্রায় নিশ্চিত সে ব্যাপারে। এমনকি তাদের বিয়ের আগে থেকেই হয়ত ডেভিড সুলিভানের সাথে সম্পর্ক ছিল মা’র।

“তোমার কি মনে হয়, প্রেসিডেন্ট এটা জানে?”

“বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা একটা ব্যাখ্যা হতে পারে, কেন তিনি তোমাকে এই কেসটার কাজ দিতে বলেছিলেন। হয়ত তার বাবা তাকে আগেই জানিয়েছিলেন।”

“কি জানিয়েছিলেন? তারা একটা বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে টর্চার করে মেরে ফেলেছিলেন?”

বাবা একটা গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “জেনিফারের মৃত্যুর পর ডেভিড সুলিভান তার পরিবারের সাথেই ছিলেন, কিন্তু তোমার মা কিন্তু চলে গেছিলেন আমাদের ছেড়ে।

“আপনার ধারণা এতে করে মা’র দোষ প্রমাণিত হচ্ছে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। “আপনার ধারণা এটাই প্রমাণ করে, মা খুন করেছেন জেনিফারকে?”

মা’কে যতই ঘৃণা করি না কেন আমি, আমার সাথে উনি যা-ই করে থাকুক না কেন-মনের মধ্যে এখনও একটা সুপ্ত আশা আছে, তিনি হয়ত অতটাও খারাপ নন যতটা সবাই ধারণা করে। মোল বছরের এক মেয়েকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারেন না তিনি। এটা আমার পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর যে, আমার ডিএনএ এর অর্ধেকটা এসেছে এমন একটা মানুষের কাছ থেকে যার পক্ষে এরকম কিছু করা সম্ভব। ভাবতেও তো খারাপ লাগছে।

“আসলে, তোমার মা আর সিনেটর ডেভিড সুলিভান, দু-জনেরই কিন্তু হারাবার অনেক কিছু ছিল,” ইনগ্রিড বলল। “দু-জনেই বিবাহিত ছিলেন, সন্তানও ছিল। সম্পর্কটার কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে কর্মক্ষেত্রেও অনেক প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হত তাদেরকে।”

“আর এসব প্রশ্নের কোন একটার জবাব খুঁজতে গেলে হয়ত অবৈধ স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের কাহিনী বের হয়ে আসত,” আমি বললাম।

“ঠিক, আমিও সেটাই ভাবছিলাম,” ইনগ্রিড বলল।

“তারমানে, জেনিফার যখন তাদের ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করেছিল তখন তার এ ব্যাপারে ধারণাও ছিল না, তার নতুন শিকারদের কতকিছু হারানোর ভয় আছে। ওকে টাকা দিয়ে দিলেও তারা এ ভরসা পাবেন না যে, পরবর্তিতে কোন ছবি প্রকাশ হবে না।”

“এজন্যেই তাকে অপহরণ করে ছবিগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে তারা?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

“কিন্তু মেয়েটা ছবিগুলো তার ভাইয়ের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল,” বাবা বললেন। “মার্কাসের যাতে কোণ ক্ষতি না হয় এজন্যে মুখ খোলেনি সে।”

“তো, জেনিফার কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানালে তার শরীরে কম্পাউন্ড-২৩ ইনজেক্ট করা হয়,” আমি বললাম। “তেইশ ঘন্টা দুঃস্বপ্ন দেখার পর সে হয়ত মুখ খুলবে এমন আশায়। বলে দেবে, ছবিগুলো কোথায় আছে।”

কিন্তু সে তা করেনি। তখনও বেশ শক্ত ছিল। এরপর ওর মাথায় শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি মেরে পার্কে ফেলে রেখে যায় তারা,” ইনগ্রিড যোগ করল।

“খুনের পর তারা সম্পর্কটা চুকিয়ে ফেলেন আর মা এখান থেকে হন্ডুরাসে তিন বছরের জন্যে চলে যান। যখন তিনি ফেরত আসেন ততদিনে সব কিছু মিটে গেছে।”

“তিনি স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের পরিচালনা কেন্দ্রটা অন্য কোথাও নিয়ে যান। মিশিগান কিংবা আরো দূরে কোথাও।”

আমি সায় দিলাম।

“তাহলে এসবের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন। “তোমাকে কেন অপহরণ করল? আর ফ্ল্যাশড্রাইভের ব্যাপারটাই বা কি?”

পুরো জিনিসটা বুঝতে আমার তিরিশ সেকেন্ড লাগল, “সিডনি ওয়েনের সাথে কথা বলার সময় তিনি আমাদের জানান, মার সাথে তার শেষবার যোগাযোগ হয়েছিল ৯/১১-এর ঐ ঘটনার সময়।”

“হ্যাঁ, সিনেটরের মৃত্যুর পরপর,” ইনগ্রিড বলল।

“তার স্ত্রীও মারা গেছিলেন। ফলে তাদের যাবতিয় সম্পত্তির মালিক হয় তাদের একমাত্র সন্তান।”

“কনর সুলিভান,” বাবা বললেন।

“আমার ধারণা, ওসব সম্পত্তির মধ্যে হয়ত কোন সেফ ডিপোজিট বক্সে কিংবা অন্য কোথাও লুকানো আছে একটা-”

“ফ্ল্যাশড্রাইভভ,” ইনগ্রিড বলল।

হাসলাম আমি।

“প্রেসিডেন্টের কাছে হয়ত ফ্ল্যাশড্রাইভটা আছে কিন্তু সেটা সম্পর্কে হয়ত কোন ধারণাই নেই তার।

“কিন্তু ওটাতে আছে কি?”

আমি জানি কি আছে ফ্ল্যাড্রইভটাতে। বাবা ঠিকই বলেছিলেন।

“আমার মা’র স্বীকারোক্তি,” বললাম আমি। “তিনিই খুন করেছেন জেনিফার নিউবারকে।”

এতদিনে যা যা জেনেছি সবকিছু একসাথে চিন্তা করতে লাগলাম। মা’র ফাইল, মি. ওয়েনের সাথে সাক্ষাৎকার, আমার অপহরণ, জেনিফারের খুন, ডেভিড সুলিভানের মৃত্যু, প্রেসিডেন্টের সম্পৃক্ততা।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বললাম, “আমার ধারণা এভাবে হয়েছিল সবকিছু, ডেভিড সুলিভান আর আমার মা বেশ আগে থেকেই স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে কাজ করতেন আর সেখান থেকেই তাদের সম্পর্কের শুরু, বাবার দিকে না তাকানোর চেষ্টা করলাম।

“এরপর ডেভিড সুলিভান যখন রাশিয়ান ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ফেরত আসলেন তখন পুরনো সম্পর্কটা আবার জাগিয়ে তোলেন। ইতিমধ্যে তিনি একজন সিনেটর হয়ে গেছেন, তাই সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে বিরাট ক্ষতি হত তার। কিন্তু জেনিফার যখন তাদের ব্ল্যাকমেইলের জন্যে ছবি দেখাল তখন এর চেয়েও অনেক বড় একটা ব্যাপার ঝুঁকিতে পড়ে যায়, যেটা তাদের দুজনেরই বিপদ ডেকে আনত। তা হচ্ছে স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের বিষয়টা ফাঁস হয়ে যাওয়া, যেটা নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছিলেন গোপনে গোপনে।

“তারা জেনিফারকে জানায়, তার দাবি করা টাকা মিটিয়ে দেয়া হবে। হয়ত এবার অনেক বেশি চেয়েছিল মেয়েটা, দশ কিংবা বিশ হাজার। এক সপ্তাহ পরে তাকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে কোথাও আটকে রেখে ছবিগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু মেয়েটা তার ভাইয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছু বলেনি।

“মা রেগে গিয়ে কিছু একটা দিয়ে তার মাথার পেছনে বাড়ি মারেন। হয়ত তাকে মেরে ফেলার উদ্দ্যেশ্য ছিল না তার, কিন্তু দুর্ঘটনাবশত মারা যায় জেনিফার। এমনও হতে পারে, সে সময় হয়ত ডেভিড সুলিভান সেখানে উপস্থিতই ছিলেন না। কিন্তু জেনিফারের মৃতদেহ লুকোতে সাহায্যের দরকার হয় মা’র। আর সেটা করতে রাজি হন ডেভিড, কিন্তু এক শর্তে। মা’কে এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিতে হবে যে, মেয়েটার মৃত্যুর জন্যে একমাত্র তিনি নিজেই দায়ি। এই স্বীকারোক্তিটা হয়ত ভিডিও ক্যামেরায় টেপ করেন ডেভিড সুলিভান।

“এরপর জেনিফারের মৃতদেহের একটা ব্যবস্থা করে তারা সিদ্ধান্ত নেন সম্পর্কটা চুকিয়ে ফেলার। এর দু-দিন পর মা বাসায় এসে কিছু জিনিস নিয়ে হন্ডুরাসের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান তিন বছরের জন্যে। ডেভিড সুলিভান মার স্বীকারোক্তিটা ভিডিও টেপ কিংবা তার কম্পিউটারে কোন এক জায়গায় রেখে দেন। দু-সপ্তাহ পরে চেজ উইঙ্গেলবেরি নামে একজন গ্রেফতার হয় জেনিফারকে খুনের দায়ে। বারো ঘন্টার টানা জিজ্ঞাসাবাদ সহ্য করতে না পেরে মিথ্যে স্বীকারোক্তি দেয় সে। পরদিন তাকে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে তার স্ত্রী। কিন্তু সুলিভান স্বীকারোক্তিটা রেখে দেন তার কাছে এই ভেবে যে, পরে যদি কোনদিন ছবিগুলো ফাঁস হয়ে যায় তখন কাজে লাগবে সেটা। ফ্ল্যাশড্রাইভভ আবিষ্কৃত হয় ৯০-এর দশকে, কিন্তু সিআইএ’র কাছে এই প্রযুক্তি তার অনেক আগে থেকেই ছিল। তিনি স্বীকারোক্তিটা একটা ফ্ল্যাশড্রাইভে ভরে রাখেন। এরপর তার আর তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর সব সম্পত্তির মালিক হন তাদের একমাত্র ছেলে।

“আমার মা ততদিনে ফেরত এসেছেন আমেরিকায়। সিডনি ওয়েনকে ফোন করে প্রজেক্ট স্যান্ডম্যান’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে দেখেন, তিনি সে সম্পর্কে কিছু জানেন কিনা। কিন্তু ওটা সম্পর্কে কিছুই শোনেননি তিনি। তখন মা অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন কনর সুলিভানের হাতে ফ্ল্যাশড্রাইভটা পড়বে। তাহলে গ্রেফতার হত হবে তাকে। কিন্তু ওরকম কিছুই ঘটে না। তাই কাজ চালিয়ে যেতেন থাকেন তিনি। সিআইএ’র তৎকালীন পরিচালকের মতে ২০০৭ সালে এক সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় মেরে ফেলেন তিনি, এরপরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সিআইএ’র সব গোমড় ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দেন। তারপরই নিখোঁজ হয়ে যান।

“কনর সুলিভান ২০১২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এতদিনে পালিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন মা। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসতে চান তিনি, কিন্তু জেনিফারের খুনের ব্যাপারটা তার মাথার ওপর খড়গের মত ঝুলছে। এসময় হয়ত তিনি কোনভাবে খবর পান, আমার আর প্রেসিডেন্টের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক আছে, যেহেতু কয়েকবার আমার বাসায় এসেছেন তিনি। ফলে তিনি ভাবেন প্রেসিডেন্টের আমার সাথে যোগাযোগ করার উদ্দেশ্য হল ফ্ল্যাশড্রাইভটার ভেতরে কি আছে তা আমাকে জানানো। কেউ একজন হয়ত তাকে এ সম্পর্কে ভুল তথ্য দেন যে, ফ্ল্যাশড্রইভটা আমাকে দিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট, কিন্তু সেই কেউ একজনটা কে তা জানি না আমি।

“আমি আর ইনগ্রিড যে আলাস্কা ঘুরতে যাচ্ছি এটা মা জেনে যান। তিনি আগে যে চাকরি করতেন তার পক্ষে এসব তথ্য বের করা তেমন একটা কঠিন কাজ নয়। আমার ক্রেডিট কার্ড ট্র্যাক করেই তা করা সম্ভব খুব সহজে। তিনি বুঝতে পারেন, এটাই মোক্ষম সুযোগ আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার। আমরা প্লেনে ওঠার পর ল্যাসি আর ইনগ্রিডকে অচেতন করে আমাকে মিশিগান কিংবা অন্য কোথাও অপহরণ করে নিয়ে যান। যেখানে আমার জীবনের সবচেয়ে ফালতু তেইশ ঘন্টাব্যাপি দুঃস্বপ্নটা দেখি আমি, মানে দেখতে বাধ্য করা হয়, জোরে একবার শ্বাস নিলাম এ পর্যায়ে, “কিন্তু তাকে কিছুই বলতে পারি না আমি কারণ ফ্ল্যাশড্রাইভভটা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই আমার। ততক্ষণে আমার বাসায় লোক পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তল্লাশি চালানোর জন্যে।”

মিয়াও।

ল্যাসির দিকে তাকালাম। “আর হ্যাঁ, ল্যাসির বলগুলো চুরি করার জন্যে ।”

বলতে থাকলাম, “পরদিন সকালে এক কৃষকের টমেটো ক্ষেতে পাওয়া যায় আমাকে। কয়েকদিন পর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিআইএ’র পরিচালক, রেড আর ইনগ্রিড। ফলে প্রেসিডেন্ট জানতে পারেন, আমি এমন একটা ফ্ল্যাশড়াইভভের খোঁজ করছি যেটা তিনি আমাকে দিয়েছেন। আসলে আমাকে কিছুই দেননি তিনি। তার বাবার সম্পত্তির মধ্যে কোন ফ্ল্যাড্রাইভভের কথাও জানা নেই তার। কিন্তু ডেভিড সলিনের বলা একটা কথা হয়ত মনে পড়ে যায় কনরের। ১৯৮৫ সালে খুন হওয়া এক মেয়ের কথা। হয়ত তার বাবা এটা তাকে বলে যান যে, আমার মা খুন করেছিলেন মেয়েটাকে। তখন তিনি ধারণা করেন, এই ঘটনার মাধ্যমেই আমরা সকলে একে অপরের সাথে যুক্ত। তাই পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে এমন ব্যবস্থা নিতে বলেন যাতে ইনগ্রিডের হাতে কেসটা পড়ে। তিনি জানতেন, ইনগ্রিড যদি কেসটা পুনঃতদন্ত করে আমার মার সম্পৃক্ততা খুঁজে পায় তাহলে আমি সেটা অবশ্যই জানতে পারব।”

সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাবা, ইনগ্রিড, ল্যাসি, মারডক।

কিছুক্ষণ পর বাবা বললেন “আমার ধারণা ঠিকই বলছ তুমি,।”

“আমারও তাই ধারণা,” ইনগ্রিড বলল।

মিয়াও।

সবাই একমত।

“তাহলে এখন পরবর্তি পদক্ষেপ কি?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল।

“প্রেসিডেন্ট সুলিভানের সাথে কথা বলতে হবে আমাদের,” আমি বললাম। “আমার ধারণা তার কাছেই কোথাও ফ্ল্যাশড্রাইভটা আছে। কিন্তু সেটা জানেন না তিনি।”

“কিন্তু তিনি এখন রাশিয়ায়,” বাবা বললেন।

“জানি আমরা, আমি আর ইনগ্রিড একই সাথে জবাব দিলাম।

.

পরের তিনদিন ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে দৌড় লাগালাম, কিন্তু প্রতিবারই বাবা আর ইনগ্রিড মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল।

ফোন করেননি প্রেসিডেন্ট।

আমার জেগে থাকার সময়টুকু এটা সেটা বলে কাটানোর চেষ্টা করি আমরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যায় বেশিরভাগ সময় ফোনটার দিকেই তাকিয়ে আছি।

চতুর্থ দিনে হাল ছেড়ে দিলাম আমরা।

“আমাদের বোধহয় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দেয়া উচিত, ইনগ্রিড বলল। “ফ্ল্যাশড্রাইভভে কি আছে এটা জানতে পেরেও কতটা উপকার হবে আমাদের সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে আমার।”

ওর কোথায় যুক্তি আছে। আমার মা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পলাতক আগামিদের একজন। একসময় হয়ত দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি, কিন্তু এখন দেশের সব বড় বড় সংস্থাগুলো তাকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেশের বাইরেও অন্তত ডজনখানেক গোয়েন্দা সংস্থার পলাতক আগামি তালিকার একদম ওপরের দিকে তার নাম। এমন তো আর হবে না যে, তিরিশ বছরের পুরনো একটা খুনের ঘটনা প্রকাশ পাবার কারণে তাকে খোঁজার গতি বাড়িয়ে দেবে সংস্থাগুলো।

নাকি হবে অমনটা?

একজন সন্দেহজনক আগামিকে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন সময়ে মেরে ফেলা এক কথা আর ঠাণ্ডা মাথায় ষোল বছরের একটা মেয়েকে মেরে ফেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ঘটনা।

আর জেনিফারের পরিবারের কথাও চিনতে করতে হবে : মেগান, মার্কাস আর তার মা। তাদেরকে দ্বিতীয়বার সেই কষ্টের স্মৃতির পুণরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সেটা কি ঠিক হবে?

না।

অবশ্যই না। আর যেহেতু প্রেসিডেন্ট সুলিভান আমাকে ফোন করছেন, তারমানে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তার হাতে। তিনি এ মুহূর্তে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টায় ব্যস্ত।

তবে একটা আশা এখনও কাজ করছে আমার মনে, আমরা যদি ফ্ল্যাশড্রাইভটার অবস্থান জানতে পারি তাহলে মা হয়ত যোগাযোগ করবেন আমার সাথে।

ইনগ্রিডের দিকে তাকিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগলাম। সর্বোচ্চ বিশ হাজার ঘন্টা এক ঘন্টা একসাথে কাটাতে পারব আমরা। তা-ও যদি এটা ধরে নেই, নব্বই বছর বাঁচব আমি আর আমার জেগে থাকার প্রতিটি মিনিট ওর সাথে কাটবে। কিন্তু আমি যদি একজন স্বাভাবিক মানুষ হতাম, হেনরি বিনসে না ভুগতাম, তাহলে সংখ্যাটা হত তিন লক্ষ ঘন্টা।

ওকে এখনও এটা বলিনি, সুখি একটা পরিবার গড়তে চাই আমি। বাবা হতে চাই।

“তোমার কি মনে হয় হেনরি?” ইনগ্রিড জিজ্ঞেস করল। “এই কেসটা পেছনে ফেলে নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠা উচিত না আমাদের?”

“হ্যাঁ,” মিথ্যে বললাম আমি।

.

ঘটনাটা যখন ঘটল তখন ল্যাসি আমার কোলে। পর দিনই আলেক্সান্দ্রিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যাবার কথা আমাদের।

তিনটা বত্রিশ বাজছে।

বাবা ঘুমুচ্ছেন। ইনগ্রিড দাঁত ব্রাশ করে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের দুজনের সাথে আমার অ্যাপার্টমেন্টের কন্ট্রাক্টরের দেখা করার কথা আগামিকাল সকাল সাড়ে সাতটায়। সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন তিনি।

“কালকে বাসায় ফিরে যেতে পারবি শুনে কেমন লাগছে?” ল্যাসিকে জিজ্ঞেস করলাম।

মিয়াও।

“হ্যাঁ, ওখানে যাওয়া মাত্র তোর বলগুলো হাতে পাবি।”

মিয়াও।

“মারডকের জন্যে একটা রেখে যেতে চাস? বাহ্, তোর তো ভাল উন্নতি হয়েছে দেখছি।”

“মিয়াও।

“ওহ্, এসিড দিয়ে ভরতে চাস ওটাকে?” না হেসে পারলাম না। “আমি তো ভেবেছিলাম ও তোর ভালো বন্ধু।”

“মিয়াও।”

“এই রজারটা আবার কে?”

ইনগ্রিড এসময় ঘুমোনোর কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকল। লম্বা একটা চুমুর পর বলল, “আমার শুয়ে পড়তে হবে এখন। তোমার বাবার সাথে কাল সকালে গিয়ে সবকিছু বুঝে নেব। তাহলে আগামিকাল তুমি ঘুম থেকে ওঠার পর ওখানে চলে যেতে পারব আমরা। আর আমি তাড়াতাড়ি গাড়ি চালালে ওখানে গিয়ে অনেক কিছু করার সুযোগও পেতে পার,” ব্রু নাচিয়ে কথাগুলো বলল।

“ব্যাপারটা কল্পনা করতেও ভাল লাগছে আমার।”

হেসে আমাকে আরেকবার চুমু দিয়ে শোবার ঘরে চলে গেল ও।

আধ সেকেন্ড পর ল্যাসিও আমার কোল থেকে নেমে ও পথে হাটা দিল। নিশ্চয়ই ইনগ্রিডের বুকের ওপর গিয়ে ঘুমোবে বদটা।

ফ্রিজ থেকে একটা সুদি বের করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম। এস স্ট্রিট এবং ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের গুগল আর্থের ইমেজটা বের করলাম।

“আপনারা দু-জন যাচ্ছিলেন কোথায়?” জোরেই বললাম কথাটা।

স্মুদি খেতে খেতে এস স্ট্রিটটা ভালোমত দেখতে লাগলাম জুম করে। এরপরে আবার ম্যানচেস্টার এভিনিউয়ের ওপর দিয়ে মাউস ঘুরিয়ে ঐ রাস্তাটা দেখা শুরু করলাম। রাস্তাটার মাঝের দিকে দুইতলা ছোট একটা বিল্ডিং আছে। ওটার বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা : Overseas Private Investment Corporation,

আবার সামনের দিকে দেখলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছুই আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারল না।

ব্রাউজারটা বন্ধ করে গেম অব থ্রোন্স চালু করলাম। প্রায় দু-সপ্তাহ ধরে সিরিজটা দেখা হচ্ছে না আমার। এখনো তিন নম্বর সিজনের প্রথম পর্বে আমি। প্লে বাটনে চাপ দিলাম। এক মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম মনোযোগ নেই আমার।

এখনও ম্যানচেস্টার অ্যাভিনিউয়ের ঐ বিল্ডিংটা নিয়েই ভাবছি।

Overseas Private Investment Corporation

এই নামটা কেন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

গেম অব থ্রোন্স বন্ধ করে গুগলে কোম্পানিটার নামে সার্চ দিলাম।

কোন ওয়েব পেজ দেখাল না।

অদ্ভুত।

আমি ‘ডিসি বিজনেস’ ওয়েবসাইটটায় ঢুকে Overseas Private Investment Corporation লিখে সার্চ দিলাম আবার। কোম্পানিটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত।

এটুকুই লেখা ওখানে।

গভীর একটা শ্বাস নিলাম।

১৯৭৩।

১৯৭৩।

এই সালেই প্রজেক্ট এমকে আলট্রা বন্ধ হয়ে যায় আর স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম চালু হয়।

এই বিল্ডিঙেই কি তাহলে যাচ্ছিলেন ডেভিড সুলিভান আর আমার মা? এখানেই কি স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের হেডকোয়ার্টার?

তাহলে কি আমরা ভুল ধারণা করেছিলাম? ওটা সরানোই হয়নি ওখান। থেকে? এর ভেতরেই কি সাদা ঘরটা? এখানেই কি বন্দি করে রাখা হয়েছিল আমাকে?

না।

হতেই পারে না এটা।

তাহলে কেন Overseas Private Investment Corporation শব্দগুলো বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আমার?

এই নামটা কি আগে কখনো শুনেছি আমি? হয়ত অবচেতনভাবে?

এরকমটা আগেও হয়েছে আমার সাথে। ইনগ্রিড হয়ত আমার ঘুমের মধ্যে কিছু একটা বলেছে আর পরের দিন সেটা মনে পড়ছে আমার। কিংবা ল্যাসির সাথে আমার মারামারির বিষয়টা। ওকে স্বপ্নের মধ্যেই আক্রমন করেছিলাম আমি। জবাবে নখ দিয়ে খামচে দেয় ও আমাকে আর সেটা আমার স্বপ্নের অংশ হয়ে যায়।

আমার স্বপ্ন।

আমার দুঃস্বপ্ন!

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম।

“শিট!”

এটা আগেও ভেবেছিলাম, ওর নামটা কোথা থেকে পেয়েছিলাম স্বপ্নে। অবচেতন মনে কিভাবে এমন একটা নামে ডাকার সিদ্ধান্ত নেই ওকে, যেটা আগে কখনো শুনিইনি আমি?

কিন্তু তখন একটু অন্যভাবে বানান করি আমি নামটা। C-এর জায়গায় K কল্পনা করি।

OPIK

আসলে সেটা হবে OPIC।

Overseas Private Investment Corporation

আমার স্বপ্নের ছোট্ট এস্কিমো ছেলেটা। ওপিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *