৩. অসহায় মেয়েদের জন্যে

অসহায় মেয়েদের জন্যে লিটনের সবসময় মায়া হয়। এজন্যে জীবনে কম ঝামেলা পোয়াতে হয়নি তাকে। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখে তার অসহায় বলে মনে হচ্ছিল না। হলিড়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে করার চেষ্টা করল। ওরা যখন মতিলালের বাড়িতে ঢুকে লোকটার সঙ্গে কথা বলছিল তখন ওই মেয়েটা বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজায় কায়দা করে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুরা যাকে বলে খাব-খাব চেহারা, মেয়েটাকে তখন সেইরকম দেখাচ্ছিল। ওর শরীরে পোশাকও ছিল খুব অল্প। পুলিশ আসার আগে মেয়েটা পিস্তল আনতে ঘরে ঢুকেছিল এবং তারপর আর পাত্তা পাওয়া যায়নি। থাপা বলেছিল, ও জানলা দিয়ে পালিয়েছে। কেন পালাল? ওর যদি কোনও দোষ না থাকে তাহলে পালাতে গেল কেন? তারপর রাস্তায় গুরুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটাও অদ্ভুত ব্যাপার। আচ্ছা, ওরা ওই মতিলালের ঘরে যাওয়ার আগে মেয়েটা অত অল্প পোশাক পরে বেডরুমে কী করছিল? মতিলাল যদিও বলেছে মেয়েটা তার শালি হয়, তবু হঠাই লিটনের মনে হল সে মেয়েটাকে যতটা অসহায় বলে মনে করছে ততটা ও নয়। হয়তো সম্পূর্ণ উলটো। হয়তো গুরুকে ফাঁদে ফেলার জন্যে মেয়েটাকে ব্যবহার করছে কেউ! গুরুকে সাবধান করে দিতে হবে। এতটা পথ রাত্তিরবেলায় গুরুর পেছনে বাইকে বসে এসেছিল বলে গুরুর একটু দুর্বলতা হতেই পারে। কিন্তু সে নিজে কখনও কোনও মেয়ের শরীরের প্রতি দুর্বল হয়নি। অসহায় বলে সাহায্য করতে গিয়ে ধাক্কা খেলেও ওই বদনাম কেউ দিতে পারবে না। গুরুর সব ভালো, শুধু।

হলিডে হোটেলটা বেশ কেতাদুরস্ত। রিসেপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে রণতুঙ্গার খবরও জানা যায় কিন্তু সেটা করা ঠিক হবে না। রিসেপশনিস্ট তার মুখ মনে রাখবে। পুলিশ যদি কখনও জিজ্ঞাসা করে তাহলে বর্ণনা দিয়ে দেবে। লিটন রিসেপশনের সামনে দিয়ে এমন গম্ভীরভাবে হেঁটে গেল যেন সে এই হোটেলেই থাকে। ভাগ্যিস কাউন্টারে এখন কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে, তাই রিসেপশনিস্ট তাকে খেয়াল করল না।

দোতলায় উঠে সে একটা বেয়ারাকে দেখতে পেল। লোকটা কার্পেট পরিষ্কার করছে। ক্লিনার চালিয়ে। লিটন জিজ্ঞাসা করল, এতে ভালো পরিষ্কার হয়?

একরকম হয়।

তা হলে একটা কিনতে হবে।

 লোকটা মাথা নাড়ল, না সাহেব। এর চেয়ে ঝাড়ুই ভালো। এতে মন ভরে না।

তুমি অনেকদিন এখানে আছ?

হ্যাঁ। একেবারে গোড়া থেকে।

তা হলে তো অনেক লোককে চেন।

 তা চিনি না! সব ফিল্মস্টারকে চিনি। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে আমার ছবি আছে।

বাঃ। আচ্ছা, এখানে এক ভদ্রলোক আছেন, খুব মোটাসোটা, মিস্টার রণতুঙ্গা!

খুব মোটা?

 খুব।

হ্যাঁ-হ্যাঁ। দুশো ছয় নম্বর ঘর।

লিটন হেসে এগিয়ে গেল। লোকটা আবার মেশিন চালু করল।

দুশো ছয় নম্বরের সামনে পৌঁছে লিটন দেখল দরজা বন্ধ। লোকটা ঘরেও থাকতে পারে। করিডোরে এখন কেউ নেই। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও ঠিক নয়। গুরু বলেছে হয় লোকটাকে। বাইরে রাস্তায় পেলে ক্যামেরা ছিনতাই করতে নয় ও ঘরে না থাকলে ভেতরে ঢুকে ওটা হাতিয়ে নিতে। এখন লোকটা ঘরে আছে কি না সে বুঝবে কী করে?

হঠাৎ ছেলেমানুষি বুদ্ধি মাথায় এল। সে জোরে জোরে দুবার দরজায় শব্দ করে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেল। ওই ঘরের দরজা যদি কেউ খোলে তাহলে সে কিছু জানে না এমন ভাব করে নিচে নেমে যাবে। লিটন লক্ষ করল কেউ দরজা খুলল না।

এইসব দরজায় ল্যাচ-কি লাগানো, বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কেউ আছে কি না। কিন্তু ওই শব্দ কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। হয় লোকটা খুবই ঘোড়েল, ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, নয় ঘরেই নেই। পরক্ষণেই খেয়াল হল লোকটা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকবে কেন? এমন কোনও ঘটনা তো ঘটেনি যে ও কাউকে ধরার জন্যে অমন করতে যাবে। তার চেয়ে সরাসরি গিয়ে নক করাই ভালো। লোকটা, রণতুঙ্গা না কী যেন নাম, দরজা খুললে বলবে, সরি, রুম ভুল হয়ে গিয়েছে। অবশ্য গুরু তাকে বলেনি এভাবে দরজা নক করতে। তাকে বলা হয়েছে লোকটা বাইরে বের হলে ফলো করে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে, নয় ও ঘরে না থাকলে। লিটন মাথা নাড়ল। ধরা যাক লোকটা সে আসার আগেই বেরিয়ে গেছে। কাউকে জিজ্ঞাসা না করলে সেটা জানা যাবে না। আর জিজ্ঞাসা করলে সাক্ষি থেকে যাবে। লিটন এগিয়ে গেল। নিজেকে বোঝাল, কখনও কখনও পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখনই সেইরকম। অবস্থা। সে দরজায় নক করল। পরপর তিনবার। একমাত্র মড়ার মতো ঘুমিয়ে না থাকলে ধরে নেওয়া যেতে পারে লোকটা ঘরে নেই। দ্বিতীয়বার নক করল সে। তারপর দুপাশে তাকিয়ে নিল। হোটেলে যারা আছে তারা দুপুরের এই সময়টায় নিশ্চয়ই বেড়াতে বেরিয়েছে। কর্মচারীদের বিশ্রামের সময় এখন। অতএব তার পোয়া বারো। সে পকেট থেকে একটা রিঙ বের করল। চাবি, ছুরি থেকে কী নেই ওই রিং-এ। এক নজরে তাকিয়ে সরু শক্ত মুখ বেঁকানো একটা তার বের করল লিটন। তারপর চাবির গর্তে ঢোকাল। তার গুরু অনেক ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত একথা সে মানে। কিন্তু কোনও-কোনও ব্যাপারে তার নিজের যে হাতযশ আছে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পেলে সে গর্বিত হয়। দুটো আঙুলের মাঝখানের তারটা যখন গর্তের ভেতর ঘুরছিল তখন তার চোখ হোটেলের করিডোরে পাক খাচ্ছিল। যদিও কার্পেট পাতা তবু কেউ এদিকে আসছে বুঝতে পারলেই তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে।

মৃদু শব্দ হল এবং দরজাটা খুলে গেল। চটপট তারটা বের করে রিঙ পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে দুপাশে দেখে নিয়ে দরজার পাল্লায় চাপ দিতেই সেটা খুলে গেল। ঘর এখন অন্ধকার। তার মানে লোকটা ঘরে নেই। এখন লোকটা সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে বের হলে ঘরে ঢুকে কোনও লাভ হবে না। নিঃশব্দে দরজা ভেজিয়ে দিতেই লকটা আওয়াজ করল। ভেতর থেকে খুলতে কোনও অসুবিধে নেই। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে ঘরটাকে দেখার চেষ্টা করল। তারপর দেওয়াল হাতড়ে সুইচ খুঁজে পেয়ে আলো জ্বালাল।

ধক করে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছিল তার। একরাশ আলো আঁপিয়ে পড়তেই ও লোকটাকে দেখতে পেল। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখদুটো বিস্ফারিত। দুটো হাত দুদিকে ছড়ানো। এত মোটা মানুষ সে আগে দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। লোকটা মরে গেছে। লিটন থরথর করে কেঁপে উঠল। নিশ্চয়ই মরে গেছে। মৃতরাই ওইভাবে তাকিয়ে থাকে। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। লোকটার গলায় সরু কিছু চেপে বসার ছাপ। এমনভাবে বসেছিল যে গলার। ওপরে গোল হয়ে কেটেছে এবং রক্ত উপচে পড়ে গলা লাল হয়ে গেছে। লোকটাকে কেউ খুন করেছে এবং সেটা বেশিক্ষণ আগে নয়।

প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে গেল লিটন। গ্যাংটকের এই আবহাওয়াতে বন্ধ ঘরেও কারও ঘাম হয় না, কিন্তু ওর কপালের চামড়া চকচক করে উঠল। কেউ লোকটাকে খুন করে গেছে, এখনই এই ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া উচিত। দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই তার ক্যামেরার কথা মনে এল। লিটন দাঁড়াল। খাটের ওপর কিছু নেই। টেবিলের এক পাশে পড়ে রয়েছে ক্যামেরাটা। মৃতদেহের পাশ কাটিয়ে সে চলে এল কাছে। হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হল তাকে।

ক্যামেরাটা খোলা পড়ে আছে। যে এসেছিল সে ফিল্মটা নিয়ে চলে গেছে।

পাশের টয়লেটের দরজাটা আধ-ভেজানো। লিটনের কেমন সন্দেহ হল। কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলতেই ভেতরটা দেখতে পাওয়া গেল। কেউ নেই। ওর মনে হয়েছিল সে আসতে আততায়ী ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে। এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল ঝনঝনিয়ে। শব্দটা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল লিটন। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। ধীরে-ধীরে নব ঘোরাল লিটন। দরজা ঈষৎ ফঁক করে করিডোরের কিছুটা দেখতে পেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও কাউকে যাওয়া আসা করতে না দেখে বাইরে পা রেখে দরজাটা চেপে দেওয়া মাত্র সেই লোকটাকে মেশিন নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখল। লিটনের মনে হল তার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে। লোকটা মেশিন থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, দেখা হয়েছে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লিটন।

আমার কাছে একদম ঠিকঠাক খবর পাবেন। লোকটা আবার মেশিন চালু করতেই লিটন হাঁটতে লাগল। নিচে এসে দেখল রিসেপশন ফাঁকা। রিসেপশনিস্ট টেলিফোন কানে নিয়ে অপেক্ষা করছে। সে কোনদিকে না তাকিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল।

এখন কী করা যায়? খবরটা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি গুরুকে দেওয়া দরকার। তিনটের আগে গুরুকে হোটেলে পাওয়া যাবে না। সেই মেয়েটা শুয়ে আছে ওখানে। তাছাড়া, আততায়ী যদি কাছাকাছি থাকে, যদি তার নজরে পড়ে সে ওই ঘরে ঢুকেছিল তাহলে নিশ্চয়ই এখন তাকে অনুসরণ করবে। সেক্ষেত্রে নিজের হোটেল চিনিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। লিটন উলটোদিকে হাঁটতে লাগল। এইরকম একটা বিপদ থেকে এমন সুন্দর বেরিয়ে আসা মানে তার কার্যক্ষমতা আরও বেড়েছে। গুরুর কাছে এই নিয়ে পরে গর্ব করতে পারবে। বারংবার পেছনে তাকাচ্ছিল লিটন। লোকজন হাঁটছে। তাদের মধ্যে যে কেউ একজন হত্যাকারী হতে পারে। ও হঠাৎ রাস্তা পালটাল। চোরা সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগল। এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে লিটন আচমকা একটা ছোটখাটো রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল।

একটা চেয়ারে বসে সে ডবল ডিমের অমলেটের হুকুম দিতেই সামনের চেয়ারে আওয়াজ হল। লিটন চমকে তাকাতে প্রদীপ বলল, একটা নয়, দুটো দিতে বল।

আরে, গুরু তুমি? কোনওমতে নিজেকে সামলে লিটন হাঁকল, একটা নয়, দুটো অমলেট।

হোটেল থেকে বেরিয়ে দৌড়চ্ছিলি কেন?

তুমি কী করে দেখলে?

 আমি ওই রাস্তা দিয়ে আসছিলাম, হঠাৎ তোকে দেখতে পেলাম। ফিল্ম এনেছিস?

না। প্রদীপের কথায় বিশ্বাস হল না লিটনের। সে যাতে বিপদে না পড়ে সেইজন্যে পেছনে ছিল গুরু, এরকম ধারণা হল তার।

গুরু, লোকটা খতম হয়ে গেছে?

 সে কি? অবাক হয়ে গেল প্রদীপ।

চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে নিচু গলায় লিটন সমস্ত ঘটনা বলে গেল।

তারপর মন্তব্য করল, আমাদের আগে আর কেউ ওই ফিল্মের ধান্দায় গিয়ে লোকটাকে খুন করে এসেছে।

ওই ঘরে ঢুকতে তোকে কে-কে দেখেছে?

কেউ দ্যাখেনি।

ভালো করে ভেবে দ্যাখ।

 কার্পেট ক্লিনারের কথা বেমালুম ভুলতে চাইল লিটন, আমি ঠিক বলছি।

যদি কেউ দেখে তা হলে তোর উচিত এক্ষুনি দার্জিলিং-এ ফিরে যাওয়া।

দার্জিলিং-এ? লিটন বিচলিত হল।

হ্যাঁ। সেখান থেকে আজ রওনা হয়েছিস, রাতের মধ্যে ফিরে গেলে ওখানে কেউ জানতে পারবে না তুই এখানে এসেছিলি। এখানকার পুলিশ তোর বর্ণনা পেলেও কিছু করতে পারবে না।

লিটন সজোরে মাথা নাড়ল, দূর। তোমাকে এখানে একা ফেলে আমি যেতে পারি না। প্রদীপ লিটনের দিকে তাকাল। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। লিটন কিছু একটা চেপে যাচ্ছে এখানে। থেকে যাওয়ার লোভে। সেই দৃষ্টির সামনে লিটন ক্রমশ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল। হঠাৎ সে বলে বসল, এমন কিছু ব্যাপার নয়।

একটা লোক খুন হয়েছে। তার কাছে গতকাল আমি গিয়েছিলাম আজ তুই তার ঘরে ঢুকেছিলি। অতএব খুব সামান্য ব্যাপারও পরে বড় হয়ে উঠতে পারে।

আমি যখন ওর ঘর থেকে বের হই তখন একটা বুড়ো আমাকে দেখেছিল। লোকটা হোটেলের কার্পেট পরিষ্কার করে মেশিন দিয়ে। কিন্তু ওর কোনও সন্দেহ হয়নি। লিটন বলল, তা ছাড়া, ও বেশি কথা বলে। আমার বর্ণনাও ঠিকঠাক করতে পারবে না। তারপরই মনে পড়ে গেল কথাটা, গুরু, আমি যখন ওই ঘর থেকে চলে আসছিলাম সেইসময় হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠেছিল।

টেলিফোন?

হ্যাঁ। কেউ ওই লোকটাকে ফোন করেছিল।

্না করলে তুই তাড়াতাড়ি বের হতিস না।

 তার মানে? লিটনের কপালে ভাঁজ পড়ল।

ওটা আমিই করেছিলাম।

খাওয়া শেষ হয়ে গেলে প্রদীপ বলল, ব্যাপারটা এবার গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। এই রণতুঙ্গা লোকটার কোনও শত্রুর এখানে থাকার কথা নয়। ও বেড়াতে এসেছিল।

লিটন মাথা নাড়ল, আরে এটা তো সহজ ব্যাপার। ফিল্মটার জন্যে খুন হয়েছে লোকটা।

হ্যাঁ। ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্য কত মূল্যবান যে তার জন্যে একটা লোককে খুন করা যায়? তা ছাড়া, এখানকার ট্যুরিস্ট ব্যুরো বলছে কেউ কখনও ব্ল্যাক লেপার্ডের কথা শোনেনি।

ব্ল্যাক লেপার্ড?

হ্যাঁ, কালো চিতা। যার ছবি তোলার জন্যে লোকটা মরে গেল। তার মানে আমরা ছাড়াও আরও একটা দল গ্যাংটকে এসেছে ওই ছবিগুলোর সন্ধানে। ব্যাপারটা দার্জিলিং-এ জানানো দরকার। প্রদীপ ঘড়ি দেখল।

চারটে নাগাদ ট্যুরিস্ট বাসগুলো সাধারণত ফিরে আসে। আজ দুপুরের পর থেকেই এখানে ঠান্ডাটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। ঠান্ডা বাড়লে রাস্তায় লোক কমে যায়। প্রদীপ আর লিটন বাইক নিয়ে স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। একটার পর একটা বাস ফিরছে। প্রদীপ যাত্রীদের লক্ষ করছিল। লোকটাকে দেখেই বোঝা যাবে যে মিলিটারিতে ছিল একসময়। মুখগুলো খুঁটিয়ে দেখে হতাশ হচ্ছিল সে।

কিছুক্ষণ আগে দার্জিলিং-এ টেলিফোন করেছে সে। একটা ব্যাপার তাকে কিছুটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রণতুঙ্গার খুন হওয়ার খবরটা পেয়ে ভদ্রলোক কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। শুধু বললেন, তোমার এখনও অনেক কাজ বাকি। ওই হোটেলের কাছাকাছি যেও না। আমি চাই না কোনও ঝামেলায় তুমি জড়িয়ে পড়ো।

প্রদীপ বলেছিল, মনে হচ্ছে আমার কোনও অ্যান্টি পার্টি এখানে কাজ করছে।

হতে পারে। এখনও একজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।

তাহলে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা?

তুমি পাবে।

খটকা লাগছে দুটো জায়গায়। রণতুঙ্গার ছবি অন্য লোক নিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে কথার খেলাপ করছেন না ভদ্রলোক। উনি ইচ্ছে করলে টাকার অঙ্ক কমিয়ে দিতে পারতেন। হঠাৎ এই উদারতার মানে কী? দ্বিতীয়ত, এস. কে. শর্মা এখন শিলিগুড়িতে। আজ রাত্রে দার্জিলিং মেল ধরবে লোকটা। তার কাছে ছবি আছে। তাকে ধরলে দুজন ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বের করা বাকি! আর উনি বললেন একজনের কথা। শর্মার দায়িত্ব কি উনি অন্য কাউকে দিচ্ছেন? দিয়ে থাকলে তো তাকে ওঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা নয়। প্রদীপ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

এইসময় এভারেস্ট ট্যুরিজমের একটা বাস ফিরে এল। যাত্রীরা নামছে। হঠাৎ প্রদীপের নজর পড়ল একজনের ওপর। লম্বা, মেদহীন শরীর। পরনে গরম স্যুট। বয়স হলেও সেটা বোঝা যায় না। গোঁফ বলে দিচ্ছে মানুষটি সাধারণ কাজকর্ম কখনও করেননি। কাঁধ থেকে চামড়ার স্ট্র্যাপে ক্যামেরা ঝুলছে। বাস থেকে নেমে গটগট করে হাঁটতে লাগলেন ভদ্রলোক।

প্রদীপ লিটনকে বলল, আমি এখন যার সঙ্গে কথা বলব তুই তাকে ফলো করে দেখে আসবি কোন হোটেলে উঠেছে এবং কতদিন সেখানে থাকার কথা। কাজটা সাবধানে করবি। লিটনের জবাবের জন্যে অপেক্ষা না করেই প্রদীপ এগিয়ে গেল।

পিছন থেকেই বোঝা গেল এই বয়সেও ভদ্রলোক ভালো শক্তি রাখেন। প্রদীপ একেবারে কাছে পৌঁছে বিনীত স্বরে বলল, এক্সকিউজ মি।

ভদ্রলোক দাঁড়ালেন, গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়েস।

 আমার নাম প্রদীপ গুরুং। কলকাতার একটা সংবাদপত্রের লোকাল করেসপন্ডেন্ট।

আচ্ছা।

আমি বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত। আপনি গতকাল সিকিম-টিবেট বর্ডারে গিয়েছিলেন। আবার আজও সেখানে গেলেন। এই ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল, আমি গতকাল গিয়েছিলাম আপনি কী করে জানলেন?

 এটা আমি জেনেছি। আসলে আমি ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের সম্পর্কে কৌতূহলী। ব্ল্যাক লেপার্ড?

হ্যাঁ। গতকাল তো আপনারা ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছেন।

 কে দেখেছে জানি না, কিন্তু আমি তো দেখিনি।

স্যার, আমি শুনেছি গতকাল একটা ট্যুরিস্টবাসের যাত্রীরা ওখানে ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং। দৃশ্য দেখেছেন। ওই অঞ্চলে ব্ল্যাক লেপার্ড আছে বলে কেউ কখনও শোনেনি। বুঝতেই পারছেন খবরটা খুব চাঞ্চল্য তৈরি করবে।

ইয়ং ম্যান! আপনাকে ওই ব্ল্যাক লেপার্ডের গল্পটা যে শুনিয়েছে তার বাসে আমি ছিলাম না এটুকুই শুধু বলতে পারি।

গতকাল আপনি যে বাসে ছিলেন তাতে আরও দুজন ফটোগ্রাফার ছিলেন?

হ্যাঁ। এই খবরটা ঠিক। কারণ ওই দুজন ছাড়া কারও হাতে ক্যামেরা দেখিনি।

একজন বয়স্কা বিদেশিনী ছিলেন?

হ্যাঁ। বর্ডারে যাওয়ার জন্যে তার কথা চেকপোস্টে বলতে হয়েছিল।

 আর আপনি বলছেন ওখানে কোনও ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেননি?

না।

 আপনি কোনও ছবি তোলেননি?

হ্যাঁ। ছবি তুলেছি। সেই ছবির রোল শেষ করতে আজ আবার ওই স্পটে গিয়েছিলাম। ওটা প্রিন্ট না করা পর্যন্ত আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় কী ছবি তুলেছি। শুধু আপনাকে বলতে পারি, গতকাল ওখানে একটা মার্ডার হয়েছিল।

মার্ডার?

হ্যাঁ। ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না।

সঙ্গে-সঙ্গে প্রদীপের দুটো পা কনকন করে উঠল। তার মনে পড়ল রণতুঙ্গা তাকে দেখে পুলিশ কি না জানতে চেয়েছিল। সেই মেমসাহেব পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। সে দেখল ভদ্রলোক রাস্তার বাঁকে চলে গেছেন এবং তার কিছুটা পেছনে লিটন হাঁটছে।

মোটরবাইকের কাছে ফিরে এসে সমস্ত ব্যাপারটা নতুন করে ভাবতে চাইল প্রদীপ। সে প্রথমে চন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিল যে ওই ট্যুরিস্ট বাস চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। লোকটা একবারও তাকে বলেনি যে ব্ল্যাক লেপার্ড দেখেছে। বরং ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে সে গিয়েছিল বিদেশিনী মহিলা লিসার কাছে। লিসাও একবারও বলেননি ব্ল্যাক লেপার্ডের কথা। কিন্তু তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। ওঁর কাছ থেকে যায় রণতুঙ্গার কাছে। রণতুঙ্গা পুলিশের ভয়ে ভীত ছিল কিন্তু ব্ল্যাক লেপার্ড শব্দ দুটো ওর মুখ থেকেও শুনতে পায়নি। সে। বরং রণতুঙ্গা এমন কিছুর ছবি তুলেছিল যা সে নিজে খবরের কাগজে ছাপতে চায়। আর এই সব মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রদীপ ধরেই নিয়েছিল এঁরা ব্ল্যাক লেপার্ড দেখে এসেছেন। ওঁদের ওই ব্যাপারে সরাসরি প্রশ্ন করার কথা একবারও তার মাথায় আসেনি।

মোটরবাইক চালু করে ট্যুরিস্ট লজে চলে এল প্রদীপ। গিয়ে শুনল লিসা দুপুরে বেড়াতে বেরিয়েছেন, একাই। ভদ্রমহিলার দেখা পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হল অনেকক্ষণ। লিসা যখন ফিরছেন তখন তার হাতে একটা বড় প্যাকেট। প্রদীপ হাসল, গুড আফটারনুন ম্যাডাম।

হ্যালো! তুমি আবার এখানে?

আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।

আমি তো তোমাকে বলেছি এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। আমি বিদেশি। আগামীকাল চলে যাব। কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি।

আপনাকে আমি কোনও ঝামেলায় ফেলতে চাই না ম্যাডাম।

 লিসা একটু আশ্বস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পুলিশ কী বলেছে?

পুলিশের সঙ্গে আমার কথা হয়নি ম্যাডাম। আচ্ছা, আপনি ঠিক কী দেখেছিলেন? অনুগ্রহ করে ব্যাপারটা খুলে বলুন।

ভদ্রমহিলাকে একটু চিন্তিত দেখাল। তারপর বললেন, যখন খুন করা হয় তখন আমি নিচু হয়ে আমার জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম বাসে বসে। গুলির শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি একটা লোক মাটিতে পড়ে আছে আর একজন অস্ত্র উঁচিয়ে একটি মেয়েকে জিপে তুলছে। আমাদের বাসটা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় লোকটা এমন চিৎকার করে ওঠে যে ড্রাইভার আবার স্পিড তুলে বেরিয়ে যায়। জিপের মুখ আমাদের বিপরীত দিকে ছিল।

লোকটা অথবা মেয়েটিকে আপনার মনে আছে?

না। লোকটার মাথায় টুপি ছিল, মুখে মাফলার। মেয়েটির মাথা নিচু থাকায় দেখতে পাইনি তবে ওর চুলে অনেক কিছু জড়ানো ছিল।

কী সেগুলো?

সম্ভবত সাদা পুঁতি। মুক্তোও হতে পারে। দূর থেকে দেখা।

 তারপর আপনারা কী করলেন?

ড্রাইভার চিৎকার করে বলল, এসব অঞ্চলে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে তাই কেউ যেন উত্তেজিত হবেন না। কিন্তু লোকটা নিজেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল।

কী কারণে মনে হল?

লোকটা অত্যন্ত দ্রুত বাসটাকে নিয়ে গেল পরের পুলিশ ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করে তবে যেন ঠান্ডা হল।

আপনাদের বাসের কেউ-কেউ যে ওই ঘটনার ছবি তুলেছিল তা আপনি জানতেন?

পুলিশ ক্যাম্পে যাওয়ার পরে ফটোগ্রাফাররা এ নিয়ে কথা বলছিল।

আপনি কবে ফিরে যাচ্ছেন ম্যাডাম?

আগামীকাল সকালে।

অনেক ধন্যবাদ।

ট্যুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে প্রদীপ সোজা ভাটিখানায় চলে এল। এসে দেখল ভাটিখানা বন্ধ। কিন্তু বেশ কয়েকজন ভাটিখানা খোলার জন্যে হইচই করছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগে ভাটিখানার ভেতরে একটা খুন হয়ে গেছে। আততায়ীকে ধরা যায়নি। পুলিশ এসে মৃতদেহ সরিয়ে ভাটিখানা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছে আজকের মতো।

প্রদীপের বুকের ভেতর কেউ যেন ড্রাম বাজাতে লাগল। সে জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে?

মানে?

যে খুন হয়েছে সে কি ড্রাইভার?

হ্যাঁ। ওর নাম চন্দ্রনাথ। আজ এখানে মাতাল হয়ে গিয়ে কী সব বলছিল। অনেকে বলছে ওই কথাগুলো বলার জন্যেই নাকি ওকে প্রাণটা দিতে হল।

ভদ্রলোকের মুখটা মনে পড়ল প্রদীপের। পুলিশ অফিসার থাপা ওকে পাঠিয়েছিল যার কাছে তার মুখ খুব সৌম্য। তিনি মূল্যবান ফটোগ্রাফ সঞ্চয় করেন। বর্ডারে ব্ল্যাক লেপার্ডের মেটিং দৃশ্যের ছবি তোলা তিন ক্যামেরাম্যানের কাছে তাকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সেদিন সকালে ঘটনাটা ঘটেছিল সেইদিন বিকেলেই খবরটা পেয়ে গেছেন ভদ্রলোক। তাঁর কাছে রণতুঙ্গার খবর পাঠানোর কিছু সময়ের মধ্যেই লোকটা খুন হয়ে গেছে এবং ওর ফিল্ম চুরি হয়েছে। দ্বিতীয় যে খবরটা সে দিয়েছিল, দার্জিলিং মেলের যাত্রী এস. কে. শর্মার এখন কী অবস্থা তা সে জানে না। কিন্তু মাতাল অবস্থায় মুখ খোলার জন্যে ড্রাইভার চন্দ্রনাথকে চলে যেতে হল। প্রদীপ একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে টুরিস্ট লজে ফোন করল। লিসা লাইনে এলে সে বলল, ম্যাডাম, একটু আগে আপনার সঙ্গে কথা বলেছি। আপনি আগামীকাল কখন নামছেন? লিসা বললেন, আর্লি মর্নিং-এ। আমি বাগডোগরা থেকে প্লেন ধরব।

একটু রিস্কি হয়ে যাবে ম্যাডাম। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি যে করেই হোক এখনই গ্যাংটক থেকে চলে যান। একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে নিন। হয়তো রাস্তায় সন্ধে নামবে তবু এখনই রওনা হলে শিলিগুড়িতে সাতটা আটটার মধ্যে পৌঁছতে পারবেন। ওখানে ভালো হোটেল আছে। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে সকালের প্লেন ধীরেসুস্থে ধরতে পারবেন।

বাট হোয়াই? এরা তো বলছে সবাই ভোরে রওনা হয়ে প্লেন ধরতে পারে।

আপনি বলেছেন কোনও ঝামেলায় জড়াতে চান না, তাই। আমার অনুরোধ রাখুন। রিসিভার রেখে দিল প্রদীপ। ওই বাসে আর কে-কে যাত্রী ছিলেন তা ওর জানা নেই। কিন্তু এই ভদ্রমহিলা যদি তার অনুরোধ রাখেন তাহলে ওঁর ভালো হবে।

গতকালের ব্ল্যাক লেপার্ডের ঘটনাটা বানানো। ধরা যাক দার্জিলিং-এর ভদ্রলোক ভুল খবর পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনজন ফটোগ্রাফারের অস্তিত্ব তার জানা ছিল। আর ভদ্রলোক যদি সত্যি ব্ল্যাক লেপার্ডের ছবির আশায় তাকে পাঠাতেন তাহলে রণতুঙ্গা খুন হতো না। চন্দ্রনাথের খুন হওয়াটাকে কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ বলে চালানো যেতে পারে। কিন্তু রণতুঙ্গা?

অর্থাৎ এই মুহূর্তে গ্যাংটকে আর-একটি হত্যাকারী দল সক্রিয় আছে। এই দলটা আজই এসে পৌঁছেছে এখানে অথবা তারা এখানকারই লোক। উলটো করে ভাবলে এমন দাঁড়ায়, গতকাল যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তার ছবি ট্যুরিস্ট বাসের তিনজন ফটোগ্রাফার তুলেছিল বলে ভদ্রলোক খবর পেয়েছিলেন। অবশ্যই ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর স্বার্থ আছে তাই তিনি চান না ছবিগুলো অন্য কারও হাতে যাক। এত তাড়াতাড়ি প্রিন্ট করা সম্ভব নয় তাই তিনি তড়িঘড়ি প্রদীপকে পাঠিয়েছিলেন উদ্ধার করতে। কিন্তু সেখানেও তো একটা ঝুঁকি ছিল। রণতুঙ্গার বদলে ওই মিলিটারি অফিসারের সঙ্গে প্রথমে দেখা হলে প্রদীপ জেনে যেত, ব্ল্যাক লেপার্ড নয়, ওঁরা। হত্যাকাণ্ডের ছবি তুলেছিলেন। তবু তিনি এই ঝুঁকি নিলেন কেন?

প্রদীপ চারপাশে তাকাল। সন্দেহজনক কোনও কিছু চোখে পড়ল না। কিন্তু সে এখন নিশ্চিন্ত তাকে কেউ বা কারা লক্ষ করে যাচ্ছে। ভদ্রলোক তার সঙ্গে এমন একটা খেলা খেললেন কেন? থাপা জানে এই ঘটনাটা?

প্রশ্নগুলো ছোবল মারছিল মনে।

হোটেলে ফিরে এল সে। লাউঞ্জে বসছিল লিটন। এখানে আর কেউ নেই। ওর পাশে চেয়ার টেনে বসতেই লিটন বলল, মেয়েটা এখনও ঘুমোচ্ছে।

ভদ্রলোকের নাম কী?

কাপুর। সানশাইন হোটেলে উঠেছেন।

কতদিনের বুকিং?

পরশু দুপুরে ওঁর নেমে যাওয়ার কথা। সোজা হোটেলেই ঢুকে গেছেন।

তোকে এখনই শিলিগুড়িতে যেতে হবে।

লিটন অবাক হল, সে কি? কেন?

সমস্ত হিসেব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমার আশংকা হচ্ছে এস. কে. শর্মা নামে যে ফটোগ্রাফার আজ দার্জিলিং মেল ধরতে নেমে গিয়েছে সে ফিল্ম নিতে বাধা দিতে গেলে জীবন্ত ফিরে যেতে পারবে না কলকাতায়।

কে খুন করবে তাকে?

যে রণতুঙ্গাকে খুন করেছে। ট্যুরিস্টবাসের ড্রাইভারটাকেও সেই খুন করিয়েছে বলে এখন অনুমান করছি। কিন্তু এসব এখনও অনুমান। যদি শর্মার কিছু হয়ে যায় তাহলে আর ব্যাপারটা অনুমান হয়ে থাকবে না। সেটা জানার জন্যে আমি তোকে শিলিগুড়িতে যেতে বলছি। প্রদীপ ঘড়ি দেখল। তারপর মাথা নাড়ল, মুশকিল হল, তুই যখন শিলিগুড়িতে পৌঁছবি তখন দার্জিলিং মেল ছেড়ে দেবে। ট্রেনে যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে তোর পক্ষেও জানা সম্ভব নয়। কী করা যায়?

তুমি যা বলবে তাই করব!

হঠাৎ প্রদীপ মতলবটা ভাবতে পারল। হাত তুলে বলল, তোকে যেতে হবে না। কিন্তু আজ তুই আর হোটেল থেকে বের হবি না। পুলিশ নিশ্চয়ই এতক্ষণে তোর বর্ণনা পেয়ে গেছে।

তখনই শিলিগুড়িতে ছুটতে হচ্ছে না বলে খুশি হল লিটন। বলল, কিন্তু আমি কোন ঘরে থাকব? ওখানে তো এখনও মেয়েটা ঘুমোচ্ছে।

সন্ধে হলেই আমরা হোটেল চেঞ্জ করব।

 তার মানে? এই হোটেল কী দোষ করল?

 আমরা কোথায় আছি সেটা আমি কাউকে জানাতে চাই না।

কে জেনেছে?

যারা খুন করছে তারা অন্ধ নয়।

তা হলে?

তুই এখানেই বিশ্রাম নে। আমি মেয়েটাকে তুলি।

প্রদীপ উঠল। লিটন মাথা নাড়ল। তার গুরুর সব ভালো শুধু মহিলা সংক্রান্ত ব্যাপারটা বাদ দিলেই–। হঠাৎ তার নজরে এল একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়িয়েছে হোটেলের দরজায়। একজন অফিসার জুতোর শব্দ তুলে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পুলিশ কি তার বর্ণনা পেয়ে এখানে খোঁজ করতে এসেছে? কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না লিটন। রণতুঙ্গার ঘরে সে কোনও হাতের ছাপ রেখে আসেনি। কিন্তু পুলিশ যদি একবার ধরে! এখান থেকে হুট করে উঠে গেলে সবাই সন্দেহ করবে। ও মাথা নিচু করে বসে রইল।

পুলিশ অফিসার রিসেপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলছে। হোটেলের রেজিস্ট্রার দেখল ভদ্রলোক। তারপর বেরিয়ে গিয়ে জিপে উঠে বসল। লিটন দেখল রিসেপশনিস্ট তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে সহজ হতে চেষ্টা করল।

রিসেপশনিস্ট সামনে এসে বলল, মিস্টার গুরুং কি বাইরে গেছেন?

লিটন কোনওমতে মাথা নাড়ল, না।

একটা খুব খারাপ খবর আছে। উনি যে ভদ্রলোকের খোঁজ করছিলেন সেই মিস্টার শর্মা শিলিগুড়িতে যাওয়ার পথে কালীঝোরার কাছে অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন। উনি যে ট্যাক্সিতে যাচ্ছিলেন তার ড্রাইভারও বেঁচে নেই। এইমাত্র পুলিশ এসে বলে গেল। ভদ্রলোকের পকেটে আমাদের হোটেলের রশিদ পাওয়া গিয়েছে বলে পুলিশ খোঁজ করতে এসেছিল। মিস্টার গুরুংকে বলে দেবেন উনি যে ভদ্রলোকের খোঁজ করছিলেন সেকথা আমি পুলিশকে বলিনি! কী দরকার ঝামেলা বাড়ানোর। রিসেপশনিস্ট হাসল। লিটনের ধড়ে প্রাণ আসতে-আসতেও থমকে গেল যেন। সে বলল, ধন্যবাদ।

রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন?

আমি? কেন? এখানেই। লিটন বলল।

এখানে মিস্টার গুরুং একটা ডাবলবেড রুম নিয়েছেন। ওখানে ওঁরা দুজন আছেন। তৃতীয় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হোটেলের আইন অনুযায়ী সেখানে থাকতে পারে না।

লিটন হাত নাড়ল, না, না, ওই ঘরে আমরা দুজনেই থাকব।

তাহলে ওই মহিলা?

ওঁর রাত্রে এখানে থাকার কথা নয়। দাঁড়ান, আমি দেখছি। উঠে পড়ল লিটন। দ্রুত ওপরে চলে এসে দেখল ঘরের দরজা ভেজানো। সে নক করতেই মেয়েলি গলা ভেসে এল, ভেতরে আসুন।

দরজা ঠেলতেই সুজাতার পিঠ দেখতে পেল লিটন। আয়নার সামনে বসে চুল ঠিক করছে। মেয়েটা সুন্দরী। শরীরটরীর আছে। মনে-মনে বলল সে। ঘরে প্রদীপ নেই। বাথরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে একটু স্বস্তি হল লিটনের। সে বলল, রেডি?

হ্যাঁ। এক মিনিট।

 সন্ধে নামার আগেই তো তোমাকে যেতে হবে।

 কোথায়? হাত থেমে গেল সুজাতার।

 মানে? কোথায় যাব আমি?

সেটা তো তুমিই জানো। দার্জিলিং থেকে গ্যাংটকে আসার সময় ভাবোনি?

না তো! কাল রাত্রে মনে হয়েছিল দার্জিলিং থেকে চলে না এলে আমি বিপদে পড়ব। আর সেটা পড়ব আপনাদের জন্যে। পুলিশ নিশ্চয়ই এখনও আমাকে খুঁজছে।

আমাদের জন্যে মানে? লিটন মেয়েটার পরিবর্তন দেখে অবাক।

 হ্যাঁ মশাই। পিস্তলটাকে বাঁচাতে গিয়েই তো আমার এই হেনস্থা।

কে বলেছিল বাঁচাতে? রেগে গেল লিটন। আমি ওসব জানি না। হোটেল থেকে বলেছে এই ঘরে তিনজন থাকা যাবে না। তা ছাড়া, তোমাকে আমরা কখনও দেখিনি, চিনিও না, তোমাকে এই ঘরে থাকতে দেব কেন?

ঠিক আছে। আপনার বন্ধু যদি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলেন চলে যেতে তাহলে আমি চলে যাব। সুজাতা কথা শেষ করতেই প্রদীপ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। শেষ কথাটা তার কানে গিয়েছিল।

লিটন বলল, রিসেপশনিস্ট বলেছে এক ঘরে তিনজন থাকা যাবে না।

আমরা সেটা থাকছি না।

অথচ এ এমনভাবে কথা বলছে যেন পিস্তলটা বাঁচানোর জন্যে।

লিটনকে থামিয়ে দিল প্রদীপ, পিস্তলটা বাঁচানোর জন্যে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ লিটন। যন্ত্রটা এখন খুবই দামি হয়ে উঠেছে।

সঙ্গে-সঙ্গে লিটনের মনে পড়ে গেল, গুরু খুব জরুরি কথা আছে।

 বলে ফ্যাল। চুল আঁচড়াচ্ছিল প্রদীপ।

 ভদ্রলোক দার্জিলিং মেলে ওঠার চান্স পেলেন না।

 হোয়াট? ঘুরে দাঁড়াল প্রদীপ। ওর চোখ বিস্ফারিত।

একটু আগে, কথাটা বলতে গিয়েই সুজাতার উপস্থিতির জন্যে থমকে গেল লিটন। প্রদীপ এগিয়ে এল, আমি সুজাতাকে বিশ্বাস করছি।

কী করে? তুমি তো ওকে চেনোই না।

পাঁচ ঘণ্টার রাস্তায় পেছনে বসে থাকা একটা মেয়ের ব্যবহারে যদি তাকে না চিনতে পারি তা হলে! কী হয়েছে?

কালীঝোরার কাছে একটা অ্যাকসিডেন্টে ভদ্রলোক এবং তার ট্যাক্সির ড্রাইভার মারা গিয়েছে। একটু আগে পুলিশ এসেছিল হোটেলে খোঁজ খবর নিতে।

এই হোটেলের কথা পুলিশ জানল কী করে?

হোটেলের বিল মিটিয়ে রশিদ নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। সেটা ওঁর পকেটে ছিল। রিসেপশনিস্ট আমাকে বলল, তুমি যে ভদ্রলোকের খোঁজ করেছ সেটা সে পুলিশকে জানায়নি। কেস খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে গুরু।

প্রদীপ ঠোঁট কামড়াল। এই আশংকাই তার হচ্ছিল। সে যে দুটো খবর দার্জিলিং-এ পাঠিয়েছে তাদের জীবিত থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। হয়তো সে এখন যেখানে-যেখানে যাচ্ছে সেখানেও ওরা হাজির হচ্ছে। ওই দৃশের সাক্ষি বুঝলে তাকেও সরিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন মহান ফটোগ্রাফস গ্রাহক। কিন্তু ভদ্রলোক কোনও প্রমাণ রাখেননি। দার্জিলিং-এ ফিরে গিয়ে সে ওঁকে কোনওভাবেই অভিযুক্ত করতে পারবে না। ভদ্রলোক তাকে ক্রমাগত সুতো ছেড়ে যাচ্ছেন। তাকে অভিনয় করতে হবে যতক্ষণ পঞ্চাশ হাজার হাতে না পাওয়া যায়। কিন্তু, তৃতীয় ব্যক্তির হদিশ পেলে কি উনি তাকেও পৃথিবীতে থাকতে দেবেন? প্রদীপের শিরদাঁড়া কনকন করে উঠল।

গুরু। লিটন ডাকল। প্রদীপ অন্যমনস্কভাবে তাকাল।

সন্ধে হয়ে আসছে। তুমি বলেছিলে হোটেল চেঞ্জ করবে।

বলেছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কোনও লাভ হবে না। ওই মোটর বাইকটাকে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর ওটা সঙ্গে থাকলেই আমাকে পেতে কারও অসুবিধে হবে না। লিটন, আমি এখানে এসেছি সুজাতাকে নিয়ে। ও যতক্ষণ থাকছে ততক্ষণ লোকে একটা ধারণা মনে রাখবে। মহিলা সঙ্গে থাকলে পুলিশও নরম ভাবে। আমরা আগামীকাল ভোরে এখান থেকে বেরিয়ে যাব। কিন্তু আজ আমি কাপুরের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে কথা বলেছি। যদি ওরা আমাদের ওপর নজর রাখে তা হলে কাপুরের অস্তিত্ব জেনে যাবে। আর ওই ভদ্রলোক যেমন মুখের ওপর কথা বলেন তাতে ওদের পক্ষে জানা অসম্ভব হবে না যে উনিই তৃতীয় ফটোগ্রাফার। তারপর কাপুরের মৃত্যু তো স্বাভাবিক ঘটনা। আর কাপুর মারা গেলেই ওরা আমার জন্যে আসবে। তুই এক কাজ কর। পকেট থেকে কয়েকটা একালো টাকার নোট বের করে লিটনকে দিল প্রদীপ, সোজা সানশাইন হোটেলে চলে যা। চেষ্টা কর কাপুরের কাছাকাছি ঘর নিতে। কাপুর। তোকে দ্যাখেনি। লোকটার ওপর নজর রাখতে হবে তোকে। রণতুঙ্গার মতো ওর অবস্থা যাতে না হয় সেটা তুই দেখবি। ঠিক আছে?

তুমি এখানে থাকবে?

 আমরা থাকব।

কাল তোমার সঙ্গে কীভাবে দেখা হবে।

আমি সানশাইন হোটেলে তোর সঙ্গে দেখা করব।

যদি কাপুর বাইরে বের হয়?

তুই ওকে কভার করার চেষ্টা করবি।

লিটন উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগোল। তারপর ঘুরে দাঁড়াল সুজাতার দিকে, আমি এখনও তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু গুরুর যদি কিছু হয় আমি তোমাকে ছাড়ব না। লিটন আর দাঁড়াল না। দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল।

প্রদীপ হেসে ফেলল, বাঃ। চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে। বেড়াতে যাবে নাকি?

ঠাট্টা করছেন?

মোটেই না।

আমি গতকাল থেকে এই পোশাক পরে আছি। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে।

 ঠিক-ঠিক। আমার উচিত তোমাকে একটা ভালো পোশাক কিনে দেওয়া। প্রদীপ বলল।

কেন? উচিত কেন?

কারণ এখন থেকে সবাই জানবে আমরা স্বামী-স্ত্রী।

কী বলছেন আপনি? উঠে দাঁড়াল সুজাতা।

উত্তেজিত হয়ো না। এই হোটেলে আজ ভোরে আমরা একই বাইকে চেপে এসেছি। ওই সম্পর্কটা লোকে জানলে সহজে বিশ্বাস করবে। আর বিশ্বাস করলে গ্যাংটকে যতক্ষণ আছি। একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। গ্যাংটক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, তুমি যদি ইচ্ছে করো, আমরা কেউ কখনও কাউকে চিনব না। ঠিক আছে?

কিন্তু

শোনো। এখন যদি পুলিশ এসে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার আইডেন্টিটি কী, তুমি কী বলতে পারবে? একা মেয়ে অনাত্মীয়া পুরুষের সঙ্গে একঘরে আছে যাকে কাল রাত্রের আগে দ্যাখোনি সেটা পুলিশকে জানালে ওরা তোমাকে সম্মান করবে? আমরা স্বামী-স্ত্রী জানলে ওদের অনেক কৌতূহল থেমে যাবে। ঠান্ডা পড়ছে। ওভারকোটটা পরে নাও।

বাইরে যাওয়ার দরকার কী?

কোথাও বেড়াতে এসে স্বামী-স্ত্রী চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকে না। মিনিট দেড়েকের মধ্যে ওরা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে এল। রিসেপশনের কাছে পৌঁছে প্রদীপ গলা তুলে বলল, ডার্লিং, এক মিনিট, প্লিজ। তারপর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, অনেক ধন্যবাদ।

খুব স্যাড ব্যাপার!

খুব-উ-ব। ওঁর সঙ্গে একটা ব্যবসার ব্যাপারে কথা বলার ইচ্ছে ছিল, হল না। ও হ্যাঁ, আমার ভাইকে আপনি ভুল বুঝছেন। ওর মাথা সম্পূর্ণ নর্মাল নয়। ডাবল-বেড রুমে দাদা বউদির সঙ্গে দেওরের থাকা উচিত নয় এটা চট করে ও বুঝতে পারে না।

তাই বলুন। ওঁর কথাবার্তা—

 একটু অ্যাবনর্মাল। যাক গে, আমরা দুজনেই ওই ঘরে থাকব।

তাহলে ওঁর জন্যে।

আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকেন এখানে। তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। একা রাত্রে হোটেলে থাকতে দিতে রাজি নই আমি। নর্মাল নয় তো! প্রদীপ বেরিয়ে এল। দরজার বাইরে তার বাইক রয়েছে। ওকে সেদিকে যেতে দেখে সুজাতা বলল, আচ্ছা, এখন ওটা ব্যবহার না করলে অসুবিধে হবে?

না। চলো, হাঁটি। আর শোনো, সবার সামনে তুমি আমাকে আপনি বলবে না। সুজাতার কনুই জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল প্রদীপ। ঠিক তখনই সে আবিষ্কার করল মেয়েটি স্মার্ট। সাধারণ মেয়ের মতো লাজুক নয়। অবশ্য সেটা যে নয় তার প্রমাণ সুজাতা এর আগে অনেকবার দিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করল, খুব হিন্দি ছবি দেখো? হেসে মাথা নাড়ল সুজাতা, খুউব।

ফেবারিট হিরোইন কে? শ্রীদেবী?

না। পূজা ভাট।

প্রদীপ চোখ বড় করল। এখন সন্ধের অন্ধকার নেমেছে সবে। রাস্তায় মানুষের ভিড় কমছে। যদি কেউ অথবা কারা তাকে লক্ষ রাখে তা হলে এখন নিশ্চয়ই একটু ফাঁপরে পড়েছে। বউ নিয়ে বেড়াতে এসে কেউ গোলমাল চায় না।

একটা বড় পোশাকের দোকানে ঢুকল ওরা। ঢোকার আগে প্রদীপ দেখে নিল দোকানের পাশে একটা এস টি ডি করার সেন্টার আছে। শালোয়ার কামিজ এবং মোটা পুলওভার দেখাতে বলল সে সেলসম্যানকে। তারপর সুজাতার দিকে তাকিয়ে হাসল, ডার্লিং তুমি পছন্দ করো, আমি এক মিনিট ঘুরে আসছি। উজ্জ্বল কোনও রং নিলে ভালো লাগবে।

সুজাতা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। মেয়েটা যেন এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।

দোকানের পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে নিল প্রদীপ। সন্দেহ করা যেতে পারে এমন কাউকে দেখা গেল না। এস টি ডি সেন্টারে ঢুকে সে বুথের দরজা ভেজালো। আজ অন্তত পাঁচবার ডায়াল করতে হল। তারপর ভদ্রলোকের গলা পাওয়া গেল, হ্যালো।

বলে যাও।

আমি এখনও তৃতীয় ফটোগ্রাফারকে খুঁজে পাইনি।

বড্ড বেশি সময় নিচ্ছ। এমন হতে পারে লোকটা গ্যাংটক থেকে নেমে গেছে। এবং সেটা হলে আমি কথা রাখতে বাধ্য নই।

না স্যার। রণতুঙ্গা মারা যাওয়ার আগে বলেছিল লোকটা তিনদিন গ্যাংটকে থাকবে।

 কথাটা আগে বলোনি তুমি।

 খেয়াল ছিল না স্যার।

রণতুঙ্গা আর কী বলেছিল?

তেমন কিছু বের করতে পারিনি ওর পেট থেকে। শুধু বলে গেছে কোনও ব্ল্যাক লেপার্ড সে দ্যাখোনি। ইন ফ্যাক্ট ওই ট্যুরিস্টবাসটার ড্রাইভারও একই কথা বলেছে।

ওদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। তিন নম্বর লোকটার ব্যাপারে কোনও ক্ল পেয়েছ? কাউকে জিজ্ঞাসা করেছ?

হ্যাঁ স্যার। আজ বিকেলে যারাই ট্যুরিস্ট বাস থেকে নেমেছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। এক বৃদ্ধ ট্যুরিস্টকে সন্দেহ হচ্ছে। ভদ্রলোক গতকালও বর্ডারে গিয়েছিলেন।

বৃদ্ধ? কীরকম বৃদ্ধ?

বছর পঁচাত্তর বয়স। বেঁটে ফরসা, গুজরাতি হবে।

 কোন হোটেলে উঠেছে?

এখনও বের করতে পারিনি। মনে হয় আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছে।

ফাউন্ড হিম অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। তুমি তাহলে আজ বিকেলে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছ? ভালো। আচ্ছা, তুমি কি একা গিয়েছ গ্যাংটকে?

সত্যি কথা বলব স্যার?

সেটাই আমি পছন্দ করি।

একটি মেয়েকে আমি পছন্দ করতাম। শি ওয়াজ মাই গার্ল ফ্রেন্ড!

 ওয়াজ?

আমি গত সপ্তাহে সই করে ওকে বিয়ে করেছি।

ও। তাই বলো। আমি তোমার কাছে কাল সকালের মধ্যে খবর চাই।

 ও কে স্যার। শর্মাটা হাতছাড়া হয়ে গেল।

যে পাখি উড়ে যায় তার জন্যে বোকারাই চিন্তা করে। আসল শিকারি যে সে গাছে বসা পাখির দিকে তাকায়। গুড নাইট।

রিসিভার নামিয়ে রেখে লোকাল টেলিফোনে ট্যুরিস্ট লজে ফোন করল প্রদীপ। খোঁজ নিয়ে জানল লিসা হঠাই শিলিগুড়িতে চলে গিয়েছেন। সে মনে-মনে প্রার্থনা করল ভদ্রমহিলার যেন পথে কোনও দুর্ঘটনা না হয়।

দোকানেই পোশাক পরিবর্তন করাল সে সুজাতাকে। ক্লোক রুমে গিয়ে সেটা পরে আসার পর সুজাতাকে একদম অন্যরকম দেখাচ্ছিল। পুরোনো পোশাকটা দোকানদারকে দিয়ে প্রদীপ অনুরোধ করল হোটেলে পৌঁছে দিতে। তারপর সুজাতার বাজু ধরে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে প্রদীপ বলল, এরকম একজন বান্ধবী আমি খুব চাইতাম।

চাইতেন। এখন চান না।

না পেয়ে-পেয়ে চাওয়াটা ভুলে গিয়েছি।

আপনি মেয়েদের মন রেখে বেশ কথা বলতে পারেন।

ঈশ্বরের দিব্যি, এই মুহূর্তে ওটা করছি না। তবে তোমার ব্যাপারে আমি বুঝতেই পারছ, নিরাসক্ত। এখনও পর্যন্ত দুর্নাম দিতে পারবে না আশা করি।

কারণটা জানতে পারি?

 আমার মনে হয় তুমি মতিলালের বান্ধবী।

কীসে এটা মনে হল?

গতরাত্রে তুমি যে পোশাক এবং ভঙ্গিতে ওর বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলে সেটা স্বাভাবিক ছিল না। তাছাড়া থাপা ওর ঘরে ঢুকে কোন মেয়েলি পোশাক দেখেছিল তা জানি না।

না। আমি ওঁর প্রেমিকা নই। জামাইবাবু কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারেন না। বলতে পারেন, গতকাল আমার মতিভ্রম হয়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল জামাইবাবুর বাড়ির কর্তৃত্ব আমি পেতে পারি। সেটা করতে গিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সুজাতা অকপটে বলল।

প্রদীপ আর কথা বাড়াল না। এতটা পথ তারা হাঁটল কিন্তু কোনও সন্দেহভাজন মানুষকে সে দেখতে পায়নি। কেউ তাদের অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছিল না। সুজাতার হাত ধরে সে চুপচাপ হেঁটে ফিরছিল। কালকে তৃতীয় ফটোগ্রাফারের নাম জানাতে হবে। সেটা জানালে ভদ্রলোক আর ফিরে যেতে পারবেন না। এবং এইসব জানার জন্যে তাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না।

কী ভাবছেন? হঠাৎ সুজাতা জিজ্ঞাসা করল।

 অ্যাঁ। কিছু না।

আমি জানি আপনি আমাকে খুব খারাপ ভাবছেন।

 আমি নিজে এত খারাপ যে অন্য কাউকে তার চেয়ে বেশি ভাবতে পারি না।

ওরা ফিরে এল হোটেলে। দরজা খুলতেই ব্যাপারটা নজরে এল। সমস্ত জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। কেউ যেন ঘরটাকে তছনছ করে খুঁজে গেছে কিছু। সুজাতা প্রদীপের দিকে তাকাল, আপনার পিস্তল? ওটা নিয়ে কি বেরিয়েছিলেন?

না। সঙ্গে নিয়ে শহরের রাস্তায় হাঁটা বোকামি। ওর কোনও লাইসেন্স নেই। পুলিশ যদি ওটা সমেত আমায় ধরে তাহলে আর দেখতে হবে না। কথা বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে গেল প্রদীপ। ফিরে এসে বলল, যারা কিছু বেআইনি ভাবে খুঁজতে আসে তারা কেন যে ভাবে জিনিসটা আইনসঙ্গতভাবে রেখে দেওয়া হবে! কী রকম বোকামি। তুমি বসো, আমি একটা নালিশ জানিয়ে আসি। প্রদীপ বেরিয়ে গেল।

রিসেপশনে পৌঁছানো মাত্র একজন পুলিশ অফিসারকে দেখতে পেল প্রদীপ। হোটেলে ঢুকছেন। সে কিছু বলার আগেই অফিসার রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রদীপ গুরুং কত নম্বর রুমে আছে?

প্রদীপ বলল, আমার নাম প্রদীপ গুরুং।

আচ্ছা! লোকটা তাকে আপাদমস্তক দেখে নিল, এখানে কেন এসেছেন?

 বেড়াতে। সেইসঙ্গে একটু কাজও ছিল।

কী কাজ?

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে।

লোকটা হকচকিয়ে গেল, আপনি মুখ্যমন্ত্রীকে চেনেন?

নিশ্চয়ই। শিলিগুড়িতে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।

মুখ্যমন্ত্রী এখন দিল্লিতে।

জানি। সেই জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

অফিসারকে একটু ইতস্তত করতে দেখা গেল, মিস্টার গুরুং, দার্জিলিং পুলিশ আপনার সম্পর্কে একটা খবর পাঠিয়েছে। আপনি বেআইনি অস্ত্র ক্যারি করছেন।

আপনি আমাকে এবং আমার ঘর সার্চ করতে পারেন।

বুঝতেই পারছেন, এটা আমার ডিউটির মধ্যে পড়ে। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বেশ ভদ্রভাবে তিনি প্রদীপের দেহ তল্লাশি করলেন।

প্রদীপ হাসল, আপনি এখানে আছেন, খুব ভালো হল। আমি রিসেপশনে এসেছিলাম একটা কমপ্লেন করতে। আমরা যখন ছিলাম না তখন কেউ বা কারা এসে আমার ঘর লণ্ডভণ্ড করে গেছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না কিছু হারিয়েছি কি না।

 সে কি? এরকম ঘটনা তো কখনও এখানে ঘটেনি। রিসেপশনিস্ট বলে উঠল। ওরা দুজনে এগিয়ে যেতে প্রদীপ সঙ্গ নিল। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। নক করতে সুজাতা খুলল। ঘরে ঢুকে অফিসার বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে আপনার কোনও শত্রু আছে?

আমার জ্ঞানত ছিল না।

আপনি যদি ডায়েরি করতে চান তাহলে আমার সঙ্গে থানায় আসতে পারেন।

 যতক্ষণ কী হারিয়েছে বুঝতে না পারছি ততক্ষণ ডায়েরি করে কোনও লাভ নেই।

মিস্টার গুরুং, আপনি কি সত্যি মুখ্যমন্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা করবেন?

সেইরকম ইচ্ছে আছে।

দার্জিলিং পুলিশ আমাকে যা জানিয়েছে তাতে আপনাকে আমি এখানে থাকতে দিতে পারি না। মুশকিল হল মুখ্যমন্ত্রীর নাম বলে আপনি বিপাকে ফেলে দিয়েছেন। ইনি আপনার স্ত্রী?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আপনারা গত সপ্তাহে বিয়ে করেছেন শুনলাম?

 খবরটা ঠিক পেয়েছেন। এবং খুব দ্রুত।

মানে?

এ খবর কারও জানার কথা নয়। দার্জিলিং-এর পুলিশ অফিসার থাপার তো নয়ই। আমি কিছুক্ষণ আগে দার্জিলিং-এর এক বন্ধুকে টেলিফোন করে খবরটা দিই। বন্ধু দেখছি এরই মধ্যে থাপার কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছেন।

পুলিশকে এভাবেই দ্রুত কাজ করতে হয়। ঠিক আছে, আপনারা বিশ্রাম নিন। প্রয়োজন হলে আমি যোগাযোগ করব। ও হ্যাঁ, আপনি তাহলে ডায়েরি করবেন না?

আপাতত না।

ওঁরা চলে গেলেন। সুজাতা বলল, আমি ভয়ে কাঁপছিলাম।

কেন?

হঠাৎ পুলিশকে এঘরে দেখে।

ডিনারের অর্ডার দিল প্রদীপ। সেই সঙ্গে একটা ব্র্যান্ডির বোতল। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি ব্র্যান্ডি খাও?

না।

 হুইস্কি?

আমি মদ খাই না।

 আমি খেলে তোমার আপত্তি আছে?

আমার আপত্তি আপনি শুনবেন কেন?

ইনডাইরেক্ট কথা বলো না। আমার আজ রাত্রে ঘুম দরকার। ব্র্যান্ডি না খেলে ঘুম হবে না।

তাহলে তো চুকেই গেল। আমার পোশাক দোকান থেকে এসেছে কি?

খোঁজ নিল প্রদীপ। না দোকান থেকে কোনও প্যাকেট পাঠায়নি। সুজাতা বিপাকে পড়ল। নতুন শালোয়ার কামিজ পরে রাত্রে শোওয়া অস্বস্তিকর। প্রদীপ বলল, এক কাজ করো। কিছুক্ষণ বাদে আমি বেঘোরে ঘুমাব। তখন জামাকাপড় ছেড়ে তুমি কম্বলের তলায় ঢুকে যেও। ভোরবেলায় উঠে আবার ওসব পরে নিও। এখন দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। লোকটা বোধহয় পাঠাতে ভুলে গিয়েছে।

রাত বাড়ছিল, সেই সঙ্গে ঠান্ডাও। সুজাতার রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। টেবিলে ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে বসেছিল প্রদীপ। এই মুহূর্তে ভাবনায় ডুবেছিল সে। ব্ল্যাক লেপার্ড নয়, একটি খুন হয়ে গেছে ওই বর্ডারে। একটি মানুষকে খুন করে তার সঙ্গিনী মহিলাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওখান থেকে। এই খুনের ছবি বা সাক্ষি কেউ থাকুক তা ভদ্রলোক চান না। ওই অবধি ঠিক আছে।

কিন্তু কয়েকটা প্রশ্ন আসছে পরপর। যে মানুষটা খুন হয়েছে সে এত জায়গা থাকতে ওই বর্ডারে একজন মহিলাকে নিয়ে কেন গিয়েছিল? মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? ওরা কীসে গিয়েছিল? যদি নিজস্ব কোনও ট্রান্সপোর্টে গিয়ে থাকে সেটা এখন কোথায়? যারা খুন করতে গিয়েছিল তারা কি জানত ওরা ওখানে যাবে? খুন করার সময় মেয়েটির ক্ষতি কেন করেনি? মৃত লোকটার শরীর কি পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে? যদি যায় তাহলে কেন পুলিশ পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কিছু দেখতে পায়নি? এইসব প্রশ্নের উত্তর তার জানা দরকার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেই ভদ্রলোকের স্বার্থ!

মাথা ঝিমঝিম করছিল। একটু-একটু করে ভাবা আর সম্ভব হচ্ছিল না ব্র্যান্ডির প্রভাবে।

আপনি কি ওখানে সারারাত বসে থাকবেন? সুজাতার গলা ভেসে এল।

পাশ ফিরল প্রদীপ। মেয়েটা বসে আছে খাটের ওপর। সে বলল, কী অসুবিধে করছি?

আপনি না ঘুমানো পর্যন্ত আমি শুতে পারছি না।

 কে নিযেধ করল?

আমাকে এই পোশাক ছাড়তে হবে।

 ও। আমি তাকাচ্ছি না, তুমি আমার পেছনে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করো।

অসম্ভব। এভাবে পারা যায় না।

আশ্চর্য! তুমি পোশাক ছাড়ার পর আমার খাট থেকে পাঁচ ফুট দূরের একটা খাটে কম্বলের তলায় জন্মদিনের পোশাকে শুয়ে থাকতে পারবে অথচ–। আমি জেগে থাকলে তোমার লজ্জা আর ঘুমালে নয়? আমি যদি জোর দেখাই তাহলে তুমি বাধা দিতে পারবে? প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ঠিক আছে, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। দয়া করে যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো।

না। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। বলতে-বলতে ব্র্যান্ডির বোতলে চোখ পড়ল সুজাতার, ইস, এর মধ্যে কতখানি খেয়ে ফেলেছেন? কী করেছেন আপনি?

কেন? আমি কি মাতলামি করছি?

আপনি বসুন। বসুন বলছি। সুজাতা এমনভাবে ধমকে উঠল যে প্রদীপ নিঃশব্দে বসে পড়ল।

নিজেকে আপনি খুব সাধুপুরুষ বলে মনে করেন, তাই না?

এত বড় সম্মান লিটনও আমাকে দেবে না।

হ্যাঁ, করেন। নইলে কাল থেকে এমন ব্যবহার করছেন, যেন আমি পাঁচ বছরের মেয়ে। সুজাতা রাগত গলায় বলল, আমাকে স্ত্রী সাজিয়ে আপনার লাভ হতে পারে কিন্তু আমার কোন উপকার হল? আপনি আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছেন আমার আপত্তি আছে কি না? আপনারা যা ইচ্ছে হচ্ছে তাই আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। আপনি আমাকে বাজে মেয়েছেলে ছাড়া কিছু মনে করেন না।

সুজাতা। তুমি কীরকম মেয়ে আমি জানি না। তবে না জেনে তুমিও একটা বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছ। আমি একটা কাজ নিয়ে এখানে এসেছিলাম। শর্ত ছিল কাজটা করতে পারলে যে টাকা পাব তা দিয়ে আমি দার্জিলিং-এর একটা অনাথ আশ্রমের শিশুদের উপকার করতে পারব। এখানে এসে ক্রমশ জানতে পারলাম আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আমাকে দিয়ে কয়েকটা খারাপ কাজ করিয়ে শেষপর্যন্ত আমাকেই সরিয়ে ফেলবে ওরা। এমন হতে পারে আমি আর গ্যাংটক থেকে ফিরে যেতে পারব না। অতএব, বুঝতেই পারছ, আমাকে এখন অনেক ভেবে পা ফেলতে হবে। শত্রুপক্ষ আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

আমি এ ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারি না?

জানি না। যদি প্রয়োজন হয় বলব।

 আমরা যেভাবে এসেছিলাম সেইভাবে আজই এখান থেকে চলে গেলে কেমন হয়?

না। আমি কখনও হেরে পালাইনি। আমাকে শেষ দেখা দেখতে হবে।

 বেশ। এটা করতে হলে রাত জেগে ব্র্যান্ডি খেয়ে কী লাভ?

তুমি বুঝবে না। প্রদীপ আবার গ্লাসে ব্র্যান্ডি ঢালল।

সঙ্গে-সঙ্গে মুখের চেহারা বদলে গেল সুজাতার। কোনও কিছুর পরোয়া না করে সে। পোশাক খুলতে লাগল। এতটা আশা করেনি প্রদীপ। একটার পর একটা পোশাক খুলে বিবস্ত্রা সুজাতা চলে গেল তার খাটের কাছে। প্রদীপের মনে হল তার দুটো চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে। পোশাক পরা অবস্থায় যাকে খুব সাধারণ মনে হয়েছিল পোশাক সরতেই সে যেন আগুনের শিখা হয়ে গেল। এমন রূপ সে কখনও দেখেনি।

সুজাতা এখন কম্বলের তলায়। মাত্র কয়েক ফুট দূরে বসে আছে প্রদীপ। ইচ্ছে করলেই। সে পৌঁছে যেতে পারে আগুনের কাছে। প্রদীপ উঠে দাঁড়াল। ব্র্যান্ডির গ্লাসটাকে টেবিলে রাখল। পৃথিবীতে এখন একটুও শব্দ বাজছে না। অন্তত এই বন্ধ ঘরে সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।

প্রদীপ নিজের খাটে বসে জুতো খুলল। গরম জামাগুলো সরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল খাটে। সঙ্গে সঙ্গে তার অন্যরকম আরাম হল। ওই মেয়েটি কে? যাকে কেন্দ্র করেই হয়তো হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গেছে; এই প্রশ্নটি হঠাৎই সব ছাপিয়ে মাথায় ঢুকে পড়ল। এইরকম ভাবতেই তার স্নায়ু শিথিল হয়ে এল। ব্র্যান্ডির প্রভাবে এক গভীর ঘুমের ঢেউ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল দ্রুত। এবং এইসময় তার কানে কান্নার শব্দ পৌঁছাল। নিস্তব্ধ রাত্রে খুব নিচু স্বরের কান্নাকেও এড়িয়ে থাকা যায় না। অনেক কষ্টে ঘুমের ঢেউকে সরিয়ে চোখ মেলল সে। তারপর পাশের বিছানার দিকে তাকাল। কান্নাটা আসছে কম্বলের নিচ থেকে। প্রদীপ কোনওমতে উঠল। সুজাতার খাটের একপাশে গিয়ে বসল সে, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

কান্নাটা একটু কমল, সামান্যই।

প্রদীপ বলল, তোমাকে অপমান করার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। আমি সেটা করিওনি।

মুখ দেখা যাচ্ছে না, সুজাতার গলা শোনা গেল, আমি কাল কী করব? কোথায় যাব? আমার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। প্রদীপের মনে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হল সে বুঝতে পারল না। কম্বলের প্রান্ত ঈষৎ সরিয়ে সে হাত ঢুকিয়ে সুজাতাকে টেনে নিল কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *