০৫.
এগারোটার কিছু আগেই অফিসে চলে এলাম। চার্লি আজ আর রান্না-টান্না করবার সময় পায়নি; তাই একটা হোটেল থেকেই খেয়ে আসতে হয়েছে।
নিজের চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম কাচের পার্টিসান ওয়ালের ওধারে লতিকা বসে আছে। ফোন-লাগানো রিভলভিং চেয়ারটায় বসতে বসতে লতিকার বাবা, দু-নম্বর মা এবং তার ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ে গেল। বললাম, বাড়ির খবর কী?
লতিকা বিস্বাদ গলায় বলল, কী আর। কালই তো তোমাকে বললাম, বাবা আর সেই মেয়েমানুষটা এসে গেছে।
তোমার মা অজ্ঞান হয়ে যায়নি?
অজ্ঞান হোক আর মরে যাক, এবারআর ওদের তাড়ানো যাবে না। পার্মানেন্টলিই ওরা এসে বসল। যাক গে–তারপর খুব সংক্ষেপে পারিবারিক ঝঞ্জটের কথা শেষ করে লতিকা বলল, তারপর বলো, কাল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেই মহিলার কাছে গিয়ে কী করলে?
লক্ষ্য করলাম, লতিকার চোখ-মুখ আগ্রহে চকচক করছে। সঙ্গে সঙ্গে আমার খেয়াল হল, আরে, অন্য দিন বারোটার আগে অফিসে আসে না সে; আজ এগারোটা বাজতে না বাজতেই এসে বসে আছে। নিশ্চয়ই সেই মহিলাটির বিষয়ে জানবার জন্যে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে। আমার দারুণ মজা লাগছিল। বললাম, প্রথমেই বলে রাখি মহিলাটি বেশ এজেড।
মহিলার বয়স সম্পর্কে আমার মাথা ব্যথা নেই। ওখানে কী হল সেটাই জানতে চাইছি।
বলছি, তার আগে আরেকটা খবর দিয়ে নিই। মহিলা এজেড হলেও তার মেয়েটি তরুণী–তার বয়স ম্যাক্সিমাম টোয়েন্টি থ্রি-টোয়েন্টি ফোর। আমার কাছে তার একটা ফোটো আছে। দেখবে নাকি?
কথা বলতে গেলে মহিলার সঙ্গে; ফোটো নিয়ে এলে তার মেয়ের ব্যাপারটা–এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেল লতিকা।
বুঝতে পারছি ফোটোটা দেখবার খুবই ইচ্ছা লতিকার, কিন্তু তার আত্মমর্যাদা এবং শোভনতাবোধ তাকে বাধা দিচ্ছে। ব্রিফকেস থেকে শমিতার ফোটোটা বের করে কাচের দেয়ালের গোল ফোকর দিয়ে লতিকার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, বেশ সুন্দর, না?
ফোটোটা এক পলক দেখেই আমাকে ফিরিয়ে দিতে দিতে লতিকা বলল, হ্যাঁ। এবার বলো–
মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে আমার যা-যা কথা হয়েছে, সব বলে গেলাম। এমনকী অ্যাডভান্সের কথাটাও বাদ দিলাম না। তবে চার্লিকে যে শমিতার ওপর নজর রাখার জন্য লাগিয়েছি, সেটাই শুধু বললাম না।
সব শুনে লতিকা বলল, অ্যাডভান্স নিয়ে এসেছ। ওই চ্যাপ্টার তো তাহলে ক্লোজড।
আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
ওই মেয়েটাকে শোধরাবার দায়িত্ব নেবে, এই তো?
একজ্যাক্টলি। তুম একেবারে অন্তর্যামী। নাকি থট রিডিং জানো?
আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে লতিকা এবার বলল, মেয়েটা সুন্দর বলে বুঝি এত ইন্টারেস্ট?
তার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেস্ট আরেকজন সম্পর্কে।
কে সে?
কাচের দেয়ালের ওপারে এখন সে বসে আছে।
ফ্ল্যাটারি।
তোমার কি তাই মনে হয়?
লতিকা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। একটু পরে সে বলল, এটা কিন্তু আমাদের প্রফেসান নয়। অ্যাডভান্স নেবার পরই আমরা কিন্তু ক্লায়েন্টের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক কাট অফ করে দিই।
কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে বললাম, কিন্তু ব্যাপারটা কী জানো, আমার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা মানে শমিতাকে ফলো করলে একটা অদ্ভুত সোসাল অ্যাটমসফিয়ারকে ধরতে পারব।
সোসিওলজির ওপর তুমি কোনও বই লিখবে নাকি?
না, মানে সিম্পলি কৌতূহল।
লতিকা আর কিছু বলল না। শমিতার ব্যাপারে তার মনোভাবটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। হে মহান জনগণ, মেয়েটা দারুণ চাপা ধরনের। মেরুপ্রদেশের নদীতে বরফের পাহাড়ের মতো তার খানিকটা দেখা যায়, বাদবাকি সবটাই গোপন। যাই হোক, একটু ভেবে বললাম, আজ বিজনেসের খবর কী?
খুব ভালো। তুমি আসার আগে এক ঘণ্টায় এই-ইলেকসান কর্পোরেশনে পাঁচজন নাম লিখিয়ে গেছে। এর মধ্যে তিনজন এম-এল-এ হতে চায়, দুজন মিউনিসিপ্যাল কমিশনার। অ্যাডভান্স পেয়েছি বারো হাজার টাকা।
ফাইন। আর ডেটেকটিভ কনসার্ন?
দুজন এসেছিল। এক হাজার টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছি। আর পার্সোনালে তিনজন আড়াই হাজার অ্যাডভান্স দিয়েছে।
ফার্স্ট ক্লাস।
আমাদের কথার মধ্যে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন থেকে সমরেশের ফোন এল। আমাকে তার ঘরে যেতে বলছে।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের পিছন দিকের দেয়ালে যে কাঁচ বসানো আছে সেটা দিয়ে দেখলাম একটা লোক সমরেশের মুখোমুখি বসে আছে। খুব সম্ভব তাকে ম্যানেজ করতে পারছে না সমরেশ। লতিকার দিকে ফিরে বললাম, যাই, নতুন ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসি।
এইড-ইলেকসানের ঘরে এসে দেখলাম, সমরেশের সামনে যে বসে আছে তার বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন, জিরাফের মতো গলা, মাথার মাঝখান দিয়ে সিঁথি, মুখটা বোতলের মতো লম্বা, কপালে গালে বসন্তর দাগ, পরনে ফিনফিনে ধুতি আর সিল্কের পাঞ্জাবি, হীরের বোম, হীরের আংটি, চকচকে পাম্প–
লোকটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানা গেল তার নাম ভগবতী চরণ পোদ্দার। ইলেকসানে কনটেস্ট করতে চায়। তার বায়োডাটা প্রভৃতি টুকে নিয়ে আড়াই হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিলাম।
বিদায় নেবার মুখে ভগবতী পোদ্দার জানাল, তার কনস্টিটিউয়েন্সি হুগলী জেলার এক ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনে এবং তার সবচাইতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম হীরাচন্দ আগরওয়াল।
আমার দারুণ মজা লাগল। কালই ময়দার বস্তার মতো বিশাল শরীরের মালিক হীরাচন্দ এসেছিল। আজ এসেছে তারই রাইভ্যাল অস্বাভাবিক লম্বা আর রোগা ভগবতী পোদ্দার।
ভগবতী বলল, ও হীরাচন্দ শালেকে এমন হারান হারাতে হবে যে শালে গিধর একেবারে শুয়ে পড়ে।
বললাম, চিন্তা করবেন না ভগবতীবাবু, শালাকে একেবারে শুইয়েই দেব।
পরে আপনাকে হীরাচন্দের অনেক স্ক্যান্ডাল সাপ্লাই করব। সেগুলোকে কীভাবে কাজ লাগানো যায়, দেখবেন।
নিশ্চয়ই দেখব, স্ক্যান্ডাল খুব কাজে লাগবে। আচ্ছা নমস্কার।
নমস্কার। ভগবতী চলে গেল। আমার পাকস্থলীতে দারুণ একটা হাসি বগবগিয়ে উঠছিল। এতক্ষণে সেটা তোড়ে বেরিয়ে এল। আমার দেখাদেখি সমরেশও হাসছিল। হাসতে হাসতে আমি চেম্বারে ফিরে এলাম।
.
০৬.
ভগবতী চলে যাবার পর তেমন কোনও ঘটনা আর রইল না। ঘণ্টায় একবার করে চা খেতে লাগলাম। সেই সঙ্গে লতিকার সঙ্গে এলোমেলো গল্পও চলছে। এইড-ইলেকসানে আজ যে-রকম অ্যাডভান্স পাওয়া গেছে সেই রকম দিন পনেরো-কুড়ি যদি পাওয়া যায় তাহলেই ওটার গণেশ উল্টে দেওয়া যেতে পারে। তখন ওখানে কী বিজনেস ফাঁদা যাবে তারই নানারকম পরিকল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনওটাই মনে ধরল না। ঠিক করলাম পরে এ সম্বন্ধে ভালো করে ভাবা যাবে।
লতিকার সঙ্গে কথা বলছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার কান ছিল টেলিফোনের দিকে। সেই সকালে চার্লি বেরিয়েছে। এখন সাড়ে চারটে বাজতে চলল অথচ তার কোনও পাত্তাই নেই। একটা ফোন করেও সে শমিতার ব্যাপারটা জানাতে পারত। কোনও কারণে তার সঙ্গে দেখা না হলে কিংবা অন্য কোনও ঝামেলা হলে, সেই খবরটা দিতে কী অসুবিধা ছিল? চার্লির ওপর ক্রমশ আমি বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলাম। ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় আমি তার আশায় বসে আছি। এভাবে কারোকে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয়? ওকে না পাঠিয়ে আমি গেলেই বোধহয় ভালো হত।
হে মহান জনগণ, আরো এক ঘণ্টা পর চার্লির আশা যখন পুরোপুরিই ছেড়ে দিয়েছি তখন তার ফোন এল।
বললাম, কী ব্যাপার চার্লি, কখন তোমার ফোন করার কথা ছিল?
ওধার থেকে চার্লির গলায় ভেসে এল, ফোন করার চান্স পেলে তো করব! পাঁচ ঘণ্টা পর এই তো ফাস্ট চান্স পেলাম। ওহ গড, এ তুমি কার পেছনে আমাকে লাগিয়েছ!
কেন, সে কী করেছে?
কী আর, হোল ক্যালকাটা চরকির মতো আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অলরেডি সাঁইত্রিশ টাকা ট্যাক্সি ফেয়ার দিয়ে ফেলেছি।
তাই নাকি!
ইয়েস লর্ড। এর মধ্যে লাঞ্চ করারও চান্স পাইনি। এর ফাঁকে রাস্তা থেকে দুটো চারশো গ্রামের পাঁউরুটি কিনে নিয়েছিলাম। তোমার এলিজাবেথ টেলরের পেছন ছুটতে ছুটতে ওনলি সে দুটো খেয়েছি।
আমি শব্দ করে হাসলুম, তাহলে বলো বেশ ভালোই এক্সপিরিয়েন্স হচ্ছে।
তা হচ্ছে–চার্লি বলতে লাগল, আর সেই এক্সপিরিয়েন্সের ঠ্যালায় আমার ফ্লেশ আর বোন লুজ হয়ে যাচ্ছে।
তুমি এখন কোথায়?
আলিপুরের এক পেট্রোল পাম্পে। সেখান থেকে ফোন করতে করতে রাস্তার উল্টোদিকের ক্লাবটার ওপর ওয়াচ রাখছি।
ওয়াচ রাখছ! কেন?
তোমার এলিজাবেথ টেলর ওখানে ঢুকেছেন যে। বলতে বলতেই চার্লি ব্যস্ত হয়ে উঠল, তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। এখন লাইন ডিসকানেক্ট করে দিচ্ছি। তুমি অফিসেই থেকো, আমি আবার ফোন করব।
আমি কিছু বলবার আগেই লাইন কেটে গেল। চার্লি মহা ঝামেলায় ফেলে দিল তো; কতক্ষণ এখানে বসে থাকতে হবে কে জানে।
সাড়ে পাঁচটা বাজবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনটে কনসানেই ছুটি হয়ে গিয়েছিল। সমরেশ, রীতেশ-টীতেশরা চলে গেছে। শুধু লতিকা আর আমিই আছি। লতিকাকে বললাম, আমার বেরুতে দেরি হবে। চার্লিকে একটা কাজে পাঠিয়েছে। ও আমাকে ফোন করে ওয়েট করতে বলল। তুমি বসে থেকে কী করবে; বাড়ি চলে যাও।
লতিকা এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা কথাও না বলে চলে গেল।
লতিকা চলে যাবার পর দুঘণ্টায় আরো বার দুই ফোন করল চার্লি। একবার ডায়মণ্ড হারবার রোড থেকে, আরেকবার টালিগঞ্জ থেকে। দুবারই আরো কিছুক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করতে বলে লাইন কেটে দিয়েছে। আমার নাকে বঁড়শি আটকানো। না পারছি এখান থেকে বেরুতে, না ভালো লাগছে এখানে বসে থাকতে। দমবন্ধ মানুষের মতো আমি চেম্বারে আটকে আছি।
রাত সাড়ে আটটার সময় চার্লির শেষ ফোন এল। সে বলল, আর তোমাকে আটকে রাখছি না লর্ড; চলে এসো।
জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাব?
চৌরঙ্গীর একটা বড় হোটেলের নাম করে চার্লি বলল, আমি তার তলায় মেইন এনট্রান্সের কাছে ওয়েট করছি; ওখানে এলেই দেখা হবে।
তিনি কোথায়?
হোটেলের ভিতর।
পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে আমি বিশাল হোটেলটার সামনে চলে এলাম। মেইন এনট্রান্সের কাছে চার্লি অপেক্ষা করছিল। ট্যাক্সি থেকে নামতেই সে দৌড়ে এল।
চার্লির চেহারা দেখে মনে হল সারাদিনে তার ওপর দিয়ে একটা টাইফুন বয়ে গেছে। মুখ আরো ভেঙে গেছে; সারাদিন স্নান হয়নি; চুল উস্কোখুস্কো; চোখ লালচে। নেশা না করেও সে প্রায় উলছিল।
বললাম, সকাল থেকে কী করলে ডিটেলে এবার বলো দেখি।
চার্লি যা বলল, সংক্ষেপে এই রকম। সকালে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে সোজা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চলে যায়। রাস্তায় ঝাড়া দেড়টা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর সে দেখতে পায় শমিতা একটা ফিয়েট গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তখনই একটা ট্যাক্সি ডেকে তাকে ফলো করতে থাকে। তারপর প্রায় গোটা কলকাতা ঘুরে বাইশটা প্রাইভেট ক্লাব, সতেরোটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে গেছে শমিতা। কিন্তু কোথাও দশ-পনেরো মিনিটের বেশি থাকেনি। তার ওপর চোখ রেখে অত কম সময়ে ফোন করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সব জায়গায় টেলিফোন বুথ বা ফোন করার সুবিধা ছিল না। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যখনই সময় পাওয়া গেছে তখনই ফোন করে জানিয়েছে চার্লি। আপাতত শমিতা সামনের এই হোটেলটায় ঢুকেছে। চার্লির ধারণা, এখন বেশ কিছুক্ষণ সে এখানে থাকবে।
চার্লির একটা হাত ধরে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আমার জন্যে তোমার খুবই কষ্ট হল।
নাথিং। চার্লি মাথা নাড়ল, তোমার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি।
আমি আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, অতটা দরকার নেই।
চার্লি বলল, আমার ডিউটি শেষ। তুমি চার্জ বুঝে নাও লর্ড। আমি যাব।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মেয়েটা এই হোটেলের কোথায় আছে জানো?
না। আমার এই চেহারা আর ড্রেস নিয়ে এত বড় হোটেলে ঢুকতে সাহস হয়নি। আমি যা, মানে চোর বলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। তুমি লর্ড ভেতরে ঢুকে তোমার জিনিসটি ডিসকভার করে নাও।
চার্লি চলে যাচ্ছিল; তাকে থামিয়ে বললাম, সেই পঞ্চাশ টাকা থেকে কিছু বেঁচেছে?
পকেট থেকে এক খামচা রেজগি বার করে দ্রুত গুণে ফেলল চার্লি। তারপর বলল, সেভেন্টি টু পয়সে ওনলি।
এখন সোজা বাড়ি ফিরবে তো?
সিওর, অফুলি টায়ার্ড, এখন গিয়ে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচি।
চার্লিকে পাঁচটা টাকা দিয়ে বললাম, যাবার আগে কোনও হোটেলে-টোটেলে খেয়ে নিও। আর আমার জন্যে কিছু রাঁধতে হবে না।
ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে পাঁচ টাকার নোটটা তুলে নিয়ে চুক করে একটু চুমু খেল চার্লি, বলল, থ্যাঙ্ক ইউ লর্ড, থ্যাঙ্ক ইউ। লাইফে কখনও পাঁচ টাকার ডিনার খাইনি। কিন্তু
কী?
এত দামি ডিনার খাব। সেটা জম কতে মেডিসিন লাগবে না?
চার্লির মেডিসিন মানে কালী মার্কা বাংলা মদ। হাসতে হাসতে আরো পাঁচটা টাকা তার হাতে দিয়ে বললাম, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।
চার্লি বলল হা যাও। হোল ডে আমি ডিউটি দিয়েছি; এবার হোল নাইট তুমি ডিউটি লাগাও।
চার্লি চলে গেল। আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম।
.
০৭.
এই হোটেলে আগেও অনেকবার এসেছি এখানকার সব কিছুই আমার চেনা। তবু মেইন এনট্রান্স থেকে কার্পেট মোড়া লম্বা প্যাসেজের ওপর দিয়ে চিন্তা-গ্রস্তের মতো হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, এই চোদ্দতলা এয়ার কন্ডিশন্ড হোটেলের চারশো সুইট, দশ-বারোটা বার, ক্যাজিনো, সাত-আটটা রেস্তোরাঁ, কফি শপ, সুইমিং পুল, ডিনার ক্লাব, বিউটি পার্লার ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে যে বিশাল ব্যাপার–তার মধ্যে শমিতাকে কোথায় খুঁজব? তা ছাড়া শমিতাকে আগে কখনও দেখিনি; ফোটো দেখে তাকে সনাক্ত করতে হবে।
চওড়া প্যাসেজের দুধারে নানা রকম কিউরিও শপ, শাড়ির দোকান, ইন্ডিয়ান হ্যাঁন্ডিক্র্যাফট আর জুয়েলারির দোকান, অসংখ্য শো-উইন্ডোতে বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের বিজ্ঞাপন। আমার দুপাশ দিয়ে বিচিত্র বিচিত্র সাজ-পোশাক পরা পুরুষ এবং মহিলারা ফ্যাসন প্যারেডের মতো ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। এদের বেশির ভাগই বিদেশি ট্যুরিস্ট।
আমি দুধারের দোকান-টোকান দেখছিলাম না। তবে চারপাশের মহিলাদের মুখ লক্ষ্য করছিলাম আর মাঝে মাঝে পকেট থেকে শমিতার ফোটোটা বার করে দেখে নিচ্ছিলাম। ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় রিসেপসান কাউন্টারের কাছে চলে এসেছিলাম। হঠাৎ একটি মেয়ের গলা কানে এল, আমার নাম ধরেই ডাকছে।
ঘাড় ফেরাতেই রিশেপসান কাউন্টারে শিরিনকে দেখতে পেলাম। শিরিন—পুরো নাম শিরিন মার্চেন্ট, বয়স সাতাশ-আটাশ, ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ৩৬-২৫-৩৬ (এটা আমার অনুমান), জাতে পারসি, নিশ্বাস বন্ধ করে দেবার মতো সুন্দরী–এই হোটেলের সে একজন রিসেপসনিস্ট। অনেকবার আসার ফলে ওর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে।
পায়ে পায়ে শিরিনের কাছে চলে এলাম। হঠাৎ মনে হল, এই মেয়েটা শমিতার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে পারে।
শিরিন বলল, গুড ইভনিং মিস্টার সরকার। বলে দারুণ মিষ্টি করে হাসল।
আমিও হাসলাম, গুড ইভনিং
অনেকদিন পর আপনাকে আমাদর হোটেলে দেখলাম।
হ্যাঁ। নানা কাজে আটকে গিয়েছিলাম, আসা হচ্ছিল না। বলে একটু থামলাম। তারপর সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললাম, একটা ব্যাপারে একটু সাহায্য করতে পারেন মিস মার্চেন্ট?
গ্ল্যাডলি। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সারভিস। বলুন কী রকম
ব্যাপারটা স্লাইট ঝামেলার
কী রকম?
আমি এখানে একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছি, এত বড় হোটেলে তাকে কোথায় পাব, বুঝতে পারছি না। এ জন্যে আপনার হেল্প চাই।
শিরিন হেসে ফেলল, এখানে এই মুহূর্তে কয়েক শশা মেয়ে আছে। বোর্ডার ছাড়া তাদের অনেক গেস্টও আছে। তার মধে থেকে কোনও একজনকে খুঁজে বার করা বেশ ডিফিকাল্ট। তবু নামটা বলুন–দেখি চেষ্টা করে।
বললাম, শমিতা সান্যাল। আধঘণ্টা আগে এখানে এসেছে।
আই-ব্রো পেন্সিলে আঁকা সরু ভুরু কুঁচকে গেল শিরিনের, একটু ভেবে সে প্রতিধ্বনি করল, শমিতা সান্যাল!
হ্যাঁ হ্যাঁ-আমার গলায় আগ্রহ ঝকমকিয়ে উঠল।
আধঘণ্টা আগে এক শমিতাকে আমি ভেতরে যেতে দেখেছি, মনে হচ্ছে। তবে সে তো সান্যাল নয়–শি ইজ বোস। এই শমিতা রেগুলার আমাদের হোটেলে আসে।
আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই শিরিন আবার বলে উঠল, আপনি কি সিওর—যাকে খুঁজছেন সে শমিতা সান্যাল?
এক পলক চিন্তা করে নিলাম। মায়ের অর্থাৎ মনোবীণার পদবি যদি সান্যাল হয় মেয়ের পদবিও তাই হওয়া উচিত। আমার কোথায় যেন একটা খটকা লাগল। পরক্ষণে মনে পড়ে গেল, আরে কী আশ্চর্য, শমিতার একটা ফোটোই তো য়েছে আমার পকেটে। শিরিনকে সেটা দেখলেই তো বোস আর সান্যালের জটটা ছাড়িয়ে নেওয়া যায়। পকেট থেকে তাড়াতাড়ি ফোটোটা বার করে শিরিনের সামনে রাখতেই সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, আরে এ-ই তো শমিতা বোস। কিন্তু ব্যাপারটা কী মিস্টার সরকার, যাকে খুঁজতে এসেছেন তার সারনেমটাও জানেন না!
যার মা সান্যাল সে কী করে বোস হয়, ওটা আমার মাথায় আসছিল না। যাই হোক, শিরিনের কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, কাইন্ডলি একটু দেখবেন শমিতা কোথায় আছে–
দেখতে হবে না। ও এখানে রোজ আসে; আমরা ওকে খুব ভালো করেই চিনি। আপনি এক কাজ করুন। ফিফথ ফ্লোরে যে বারটা আছে সেখানে চলে যান। সেখানে ওকে না পেলে সেভেন্থ ফ্লোরে বল রুমে চলে যাবেন। যে-কোনও এক জায়গায় পেয়ে যাবেন। এই হোটেলে ওই দুটো হল ওর ফেভারিট স্পট।
থ্যাঙ্ক ইউ মিস মার্চেন্ট, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। আচ্ছা, চলি—
পা বাড়াতে যাব, শিরিন হঠাৎ ডাকল, মিস্টার সরকার—
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, কিছু বলবেন?
ওই মেয়েটার পেছনে ঘুরছেন-ব্যাপারটা কি খুবই গভীর? বলে ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে হাসল শিরিন।
কোনও রিশেপসানিস্ট ঠিক এভাবে সম্মানিত কাস্টমারের (সব কাস্টমারই সম্মানিত) সঙ্গে কথা বলে না। কিন্তু শিরিনের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ, এক ধরনের হৃদ্যতাই হয়েছে তার সঙ্গে, আমি তাকে খানিকটা প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকি। শিরিন সেই প্রশ্রয়ের কিছুটা সুযোগ নেয়, তবে কখনওই শোভনতার সীমা ছাড়ায় না। যাই হোক, বললাম, বুঝতে পারছি না। তবে আজ থেকে ওয়াইল্ড গুজ চেজ করা শুরু করেছি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে লিস্টে আরেকটা নাম যোগ হল। অ্যান্ড দ্যাট নেম ইজ রাজীব সরকার।
মানে?
মানে এই ওয়াইল্ড গুজটির পেছনে আপনার আগে থেকেই কয়েক ডজন লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি ইনফরমেসন। আচ্ছা, বাই
বাই। বেস্ট অফ লাক। শিরিন হাত নেড়ে হাসল।
.
শিরিনের কথামতো লিফটে করে ফিফথ ফ্লোরের বারে এসে শমিতাকে দেখতে পেলাম না। অতএব সেভেন্থ ফ্লোরের বলরুমে চলে এলাম।
এই হোটেলে আগে এলেও বলরুমে কখনও ঢুকিনি। তবে শুনেছি, বলরুমে এসে নাচের জন্য পার্টনার পাওয়া যায়। অবশ্য সঙ্গী নির্বাচন একতরফা হয় না; একজন আরেকজনকে পছন্দ করা চাই।
বল-রুমটা প্রকাণ্ড–প্রায় তিন সাড়ে তিন হাজার স্কোয়ার ফুট জুড়ে। এখানেও একধারে বার রয়েছে; আরেক ধারে আয়নার মতো পালিশ করা ঝকঝকে মেঝেতে নাচের ব্যবস্থা।
হে মহান জনগণ, স্বৰ্গত লেজার-কিপার ভরতচন্দ্র সরকারের ছেলে আপনাদের রাজীব সরকার সুড়ুৎ করে সেখানে ঢুকে পড়ল।
এক ধারে জমজমাট, মাতালদের আড্ডা। বার-বয়রা ছোটাছুটি করে তাদের ইউস্কি-টুইস্কি সার্ভ করে যাচ্ছিল। আরেক ধারে নাচের জন্যে নির্দিষ্ট ফ্লোরে বিভিন্ন বয়সের বেশ কিছু মত্ত পুরুষ আর মহিলা নেচে যাচ্ছে। উঁচু একটা ডায়াসে মিউজিক হ্যান্ডরা কখনও দ্রুত লয়ে কখনও বা ধীরে ধীরে বাজিয়ে চলেছে। আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে চারদিকের মহিলাদের লক্ষ্য করতে লাগলাম। কিন্তু এত বড় বার-কাম-বল রুমে প্রতিটি মহিলার মুখ দেখা সম্ভব না। টেবলে টেবলে ঘুরে বা নৃত্যরত জোড়া জোড়া নারী পুরুষের কাছে গিয়ে শমিতাকে খুঁজে বার করাও অসম্ভব ব্যাপার।
কী করব যখন ভাবছি সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল বার-এর শেষ মাথায় একটা টেবল থেকে সে-হা সে-ই তো, অর্থাৎ যার ফোটো বুকের ভেতর পুরে নিশি-পাওয়া মানুষের মতো ছুটে বেড়াচ্ছি সেই শমিতা উঠে দাঁড়িয়েছে।
আগুনের একটা হলকার মতো দেখাচ্ছে তাকে। পরনে নাভির নীচে একটা বেলবটুস আর ব্রা। ব্রা-র ওপর কাচের মতো স্বচ্ছ একটা জামা।
সে উঠে দাঁড়াতেই, হে মহান জনগণগোটা বল রুমটায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কিছু একটা ঘটে গেল যেন। নানা টেবল থেকে কয়েক ডজন হাত তার দিকে উঠে আসতে লাগল সেই সঙ্গে অসংখ্য মাতালের জড়ানো কণ্ঠস্বর আমার কানের পর্দায় ধাক্কা দিতে লাগল। ওরা সবাই বলছিল, আমাকে আজ তোমার পার্টনার করে নাও।
শমিতা আগুনের ফুলকির মতো সব হাত ঠেলে ঠেলে নানা টেবলির মধ্য দিয়ে এঁকে বেঁকে টলতে টলতে বলছিল, নো-নো-নো-নট ইউ, ডগস।
প্রথম দেখাটা এভাবে হবে, ভাবতে পারা যায়নি। স্থির পলকহীন আমি তাকিয়েই আছি। আমার চোখে পাতা পড়ছে না।
কিন্তু কে জানত, আমার জন্যে দারুণ রকমের আরো একটা চমক অপেক্ষা করছিল। প্রায় উড়তে উড়তে আর টলতে টলতে শমিতা এক সময় আমার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়াল ঠিকই, তবে স্থিরভাবে নয়। তার পা-মাথা এবং গোটা শরীরটা টলছিল; চোখ আরক্ত; মুখ থেকে হুইস্কির গন্ধ বেরিয়ে আসছে। শমিতা ঢুলু ঢুলু চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, হু ইউ? নেভার সিন বিফোর।
হে মহান ভারতীয় জনগণ, আমার মতো একটি লোক, যে মনুষ্যজাতির যাবতীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে সে পর্যন্ত হকচকিয়ে গেল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে অবশ্য আমি আমার মধ্যে ফিরে এলাম। বললাম, এ স্ট্রেঞ্জার
তাই মনে হচ্ছে। বলেই একুট চুপ করে থাকল শমিতা। তারপর আচমকা আমার একটা হাত ধরে বলল, কাম অন–
অবাক হয়েই জিগ্যেস করলাম, কোথায়?
যেখানে ফ্লোর-ডান্স চলছিল সেই জায়গাটা দেখিয়ে শমিতা বলল, ওখানে। তার পরেই বার-এর সামনে যে সব মাতালেরা বসে ছিল তাদের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই কুকুরগুলোর সঙ্গে রোজ নেচে নেচে ডিসগাস্টেড হয়ে গেছি। আই ওয়ান্ট এ নিউ পার্টনার। উড ইউ জয়েন মি
হে মহান জনগণ, আমি এবার সত্যি সত্যি কাঁচাকলে পড়লাম। স্বীকারোক্তি করতে বাধা নেই, এই সব বিদেশি নাচ-ফাচ, বিদেশি কেন–কোনও রকম নৃত্য-কলাই আমি জানি না। কিন্তু শমিতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে এই সুযোগটা ছাড়া উচিত হবে না। আমার নিয়তি যেন আমাকে বলিয়ে দিল, মোস্ট গ্ল্যাডলি-
শমিতা আমার হাত ধরেই ছিল। জোরে টান দিয়ে আরেকবার বলল, কাম অন
নিশির ডাকের মতো অদৃশ্য কোনও আকর্ষণ ধাক্কা মারতে মারতে আমাকে শমিতার পিছু পিছু ডান্সিং ফ্লোরে ঠেলে নিয়ে চলল।
পিছন থেকে অনেকগুলো মাতালের জড়িত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তারা আমারই উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছে, চিয়ার ইউ লাকি সোয়াইন! অর্থাৎ শমিতা আমাকে নাচের পার্টনার নির্বাচন করায় ওরা অভিনন্দন জানাচ্ছে।
যাই হোক, নাচের জায়গায় এসে আমার গা দিয়ে গলগল করে ঘাম ছুটতে লাগল। বুঝতে পারছি অনভ্যস্ত পা নাচের তালে তালে সঠিক স্টেপ ফেলতে পারছে না। একমাত্র বাঁচোয়া, এখানে কেউ সাদা চোখে নেই। আমার ভুল কেউ ধরতে পারবে না। আশেপাশে যারা নাচছে, ফ্লোর ডান্সে নেহাত আনাড়ি হলেও, বুঝতে পারছি তাদের স্টেপিংও ঠিক হচ্ছে না। এমনকী আমার পার্টনারও এলোমেলো পা ফেলে যাচ্ছে। আসলে নাচবার মতো অবস্থাই নয় শমিতার। এক হাত দিয়ে আমার এটা হাত ধরে, আরেকটা হাতে আমার পিঠটা সাপের মতো বেষ্টন করে সে দুলছিল। ফ্লোর ডান্সের নিয়ম অনুযায়ী আমার একটা হাতও শমিতার কোমরের পাশ দিয়ে শমিতার পিঠটাকে বেড় দিয়ে রেখেছে।
হে মহান জনগণ, এবার আপনাদের কাছে আমার দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিটি করব। নাচের তালে তালে মাখনের স্তূপের মতো শমিতার বিশাল উরু আমার উরুতে বার বার ঠেকে যাচ্ছে। তার ব্রা-টাইপের পাতলা ব্লাউজের ভেতর দিয়ে রুপোর বাটির মতো গোল উদ্ধত বুক দেখতে পাচ্ছিলাম। পৃথিবীর দুর্লভতম, ফলের মতো সে-দুটো আমার বুকে চেপে বসে আছে। শমিতার শরীর থেকে, চুল থেকে অত্যন্ত উগ্র একটা গন্ধ উঠে এসে আমার নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
হে মহান জনগণ, আমি মদ্যপান করি, দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লোক ঠকাই। তবু একটা ব্যাপারে গ্যারান্টি দিতে পারি–আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট ব্রহ্মচারী; মেয়েমানুষের ব্যাপারে আমার ঝামেলা নেই। তামা-তুলসী ছুঁয়ে ও বিষয়ে আমি শপথবাক্য উচ্চারণ করতে পারি।
ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের লাইফে আগে আর কোনও মেয়ে এভাবে উরুতে উরু ঠেকিয়ে কিংবা বুকে বুক চেপে ধরে আমাকে নাচায়নি। কোনও মেয়েকে আমি এভাবে কখনও জড়িয়ে থাকিনি। অবশ্য লতিকা যেদিন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সেদিন তাকে জাপ্টে ধরে রেললাইনের বাইরে টেনে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল আলাদা ব্যাপার। তখন বাঁচানোটাই ছিল বড় কথা, একমাত্র উদ্দেশ্য। কোনও যুবতীর দারুণ লোভনীয় শরীর যে বুকের মধ্যে ধরে আছি–এ কথাটা একবারও মনে হয়নি।
কিন্তু এই মুহূর্তে শমিতার দৃঢ় অথচ কোমল বুকে যখন আমার পাঁজরাকে বিদ্ধ করছে সেই সময় মনে হতে লাগল আমি শালা আর বাঁচব না। হে মহান জনগণ, আজ একটি ফোঁটাও মদ্যপান করিনি তবু মনে হচ্ছে তিন বোতল র হুইস্কি টেনেছি। আমার দম আটকে আসছে। আমি মরে যাব, নির্ঘাৎ মরে যাব।
কতক্ষণ নেচেছিলাম, মনে নেই। এক সময় ক্লান্ত নেশাগ্রস্ত শমিতা ওধারের একটা চেয়ারে গিয়ে নিজের শরীরটাকে ছুঁড়ে দিল। আমিও খুব হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কী করব, বুঝতে পারছি না। আমি কি শমিতার কাছে গিয়ে বসব, না এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওকে লক্ষ্য করতে থাকব?
হঠাৎ জড়ানো গলায় শমিতা ডেকে উঠল, ইউকাম হিয়া–
আবার যখন সুযোগ পাওয়া গেছে, দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। আমি তক্ষুনি শমিতার মুখোমুখি অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।
শমিতা এবার বলল, ইউ হ্যাভ ডান্সড ওয়েল। কনগ্রাচুলেসন্স
থ্যাঙ্কস্।
ড্রিংক চলবে?
আমি মদ্য পান করব, আর শমিতা চুপচাপ শান্তশিষ্ট সুবোধ বালিকাটি হয়ে তাই দেখে যাবে–এটা নিশ্চয়ই হবে না। দুজনের জন্যেই নির্ঘাত ও ড্রিংকের অর্ডার দেবে। কিন্তু আগেই ও বেশ কয়েক পেগ পাকস্থলীতে চালান করে বসে আছে। শমিতার যা অবস্থা তাতে আর ড্রিংক করা ঠিক নয়। কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই একটা বয়কে ডেকে সে দুজনের মতো হুইস্কি দিতে বলল।
দুমিনিটের মধ্যে ড্রিংক এসে গেল। আলুতো করে একটা চুমুক দিয়ে শমিতা বলল, বললেন না তো, আমার কম্প্যানি কী রকম লাগল
বললাম, হেভেনলি—
ফ্ল্যাটারি।
নো। ইটস ট্রু।
থ্যাঙ্কস। তখন বলেছিলেন আপনি এখানে স্ট্রেঞ্জার
আপনার মনে আছে?
আট পেগ হুইস্কি খাবার পর আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বারো পেগের আগে আমার মেমারি বিট্রে করে না। আপনার সঙ্গে যা-যা কথা হয়েছে, সব আমার মনে আছে। শমিতা হাসল।
প্রত্যুত্তরে আমিও হাসলাম। কিন্তু কিছু বললাম না।
শমিতা এবার বলল, ইন ফ্যাক্ট, আপনাকে আজই প্রথম দেখলাম। আপনার সঙ্গে আের দেখা হবে কি
আপনি চাইলেই হবে।
ঢুলু ঢুলু আরক্ত চোখে আমাকে দেখতে দেখতে শমিতা বলল, আমি চাইলে অনেক কিছু হয়, তাই না?
শমিতা ঠিক কী ইঙ্গিত করল বুঝতে পারছি না। খুব সতর্কভাবে বললাম, আমার সেই রকম ধারণা।
তাহলে কাল আবার এখানে আসবেন?
আসব।
যদি পরশু আসতে বলি?
পরশুও আসব।
যদি রোজ আসতে বলি?
রোজই আসব।
আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল শমিতা। হাসতে হাসতে টেবলের ওপর দিয়ে অনেকখানি ঝুঁকে চাপা জড়ানো গলায় বলেছিল, ইউ আর ফিনি; আপনি মরেছেন–
শমিতার এবারের ইঙ্গিতটা বুঝলাম। বললাম, আপনার হাতে মরাটাও প্লেজার।
চোখের পাতা নেশায় প্রায় জুড়ে যাচ্ছিল শমিতার। প্রাণপণে চোখ দুটো মেলে রেখে সে বলল, রিয়ালি!
রিয়ালি।
আপনি তো ফাইন কথা বলেন।
এতে আমার কোনও কৃত্বি নেই। আপনার কম্প্যানিতে যে ম্যাজিক আছে তারই গুণে–
দুজনেরই গেলাস ফাঁকা হয়ে এসেছিল। শমিতা আবার হুইস্কির অর্ডার দিয়ে বলল, আমার দুটো রিকোয়েস্ট রাখবেন
বললাম, গ্ল্যাডলি।
হাতের গেলাসটা দেখিয়ে শমিতা বলল, দিস ইজ নাইন্থ পেগ। টুয়েলথ পেগের পর আমি কমপ্লিটলি আউট হয়ে যাব। তখন এখানকার বার-বয় খাতা সই করাতে আসবে। আমার বারো পেগের সময় আপনার হবে ফোর্থ পেগ। দ্যাট মিনস সব মিলিয়ে হবে ষোল পেগ। আউট হয়ে গেলে তো বুঝতে পারব না; আপনি কাইন্ডলি দেখবেন ওরা বেশি লিখিয়ে নেয় কিনা
দেখব।
বুঝতে পারছিলাম, শমিতা এখানকার নিয়মিত কাস্টমার, নগদ পয়সা দিয়ে সে মদ্যপান করে না। তার হিসেবে খাতা আছে; প্রতিদিন ড্রিংকের পর তাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়। উইক-এন্ডে বা মাসের শেষে শমিতা পেমেন্ট করে দেয়।
শমিতা আবার বলল, আউট হবার পর আমি যেখানে সেখানে পড়ে থাকি। তখন আমায় বাড়িতে যে কেউ তুলে নিয়ে যেতে পারে; মাঝে-মধ্যে নিয়ে যায়ও। আই ডোন্ট মাইন্ড স্লিপিং উইথ এ ম্যান। আমার থার্ড ক্লাস প্যানপেনে মরালিটি নেই। বাট আই কান্ট স্লীপ উইথ ডগস। বার-এর ওদিকটা দেখিয়ে সে বলল, ওই যে ওখানে যারা বসে আছে-মোস্ট অফ দেম আর ডগস। এনি ওয়ে, আমি আউট হয়ে গেলে প্লিজ আমাকে আমার বাড়ি একটু পৌঁছে দেবেন। বাইরে পার্কিং জোনে আমার একটা ফিয়েট গাড়ি আছে। তার নাম্বার হল ডকু-বি এম থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স। অ্যাড্রেস বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। বলেই রাস্তার নম্বরটা জানিয়ে দিল।
এসবের কিছুই দরকার ছিল না। গাড়ির নম্বরটা চার্লি আগেই আমাকে জানিয়ে দিয়েছে; আর ওদের বাড়িতে তো আমি নিজেই গেছি। চুপচাপ সব শুনে বললাম, নিশ্চয়ই পৌঁছে দেব।
থ্যাঙ্কস। ইউ আর রিয়ালি এ জেন্টলম্যান।
বারো পেগ খাবার পর সত্যি সত্যি আউট হয়ে গেল শমিতা। তার চোখ নেশায় পুরোপুরি বুজে গেছে। ঘাড় এলিয়ে পড়েছে; হাত দুটো চেয়ারের হাতার ওপর দিয়ে ঝুলছে ঠিক এই সময় একটা বার-বয় অ্যাকাউন্টের খাতা সই করাতে এল। চট করে খাতাটা চেক করে নিলাম। নাঃ, সঠিক হিসাব অর্থাৎ সোল পেগই লেখা আছে। বয়টা বারকয়েক ডাকাডাকি করার পর চোখ বুজেই আঁকাবাঁকা জড়ানো অক্ষরে সই বসিয়ে দিল শমিতা।
এদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বারটা ফাঁকা হয়ে এসেছিল। ওধারে ফ্লোর ডান্সও থেমে গেছে। যে কটি মাতাল এধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, হঠাৎ তাদের মধ্যে থেকে তিন-চারজন উঠে এল। তারা প্রায় একই সঙ্গে শমিতার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে বলল, অ্যাই শমিতা, ওঠো, তোমাকে পৌঁছে দিই।
আমি তাদের একধারে ঠেলে দিয়ে বললাম, নো
হোয়াট ডু ইউ মিন? চার-পাঁচটা মাতাল প্রায় একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল।
এই অ্যাসাইনমেন্টটা আজ আমি পেয়েছি। আমিই পৌঁছে দেব।
শমিতা ওদের বাদ দিয়ে আজ আমার সঙ্গে নেচেছে, আমাকে হুইস্কি খাইয়েছে–এতে ওরা আদৌ খুশি না। ক্রুদ্ধ বিরক্ত চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে ওরা চলে গেল। আজ ওরা কিছু বলল না কিন্তু ওদের চাউনি-টাউনি বা অ্যাটিচুড আমার ভালো লাগল না। মনে হল পরে ওদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া আছে।
পরের কথা পরে। আমি শমিতাকে টেনে দাঁড় করালাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথাটা আলগা হয়ে আমার কাঁধে ঝুলে পড়ল আর শরীরের সমস্ত ভার এসে পড়ল আমার বুকের ওপর। সেই অবস্থাতেই শমিতার গোটা শরীরটাকে নিজের শরীরের মধ্যে প্রায় লেপ্টে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। রিসেপসান কাউন্টারের কাছে আসতেই শিরিন চোখ দুটো ছুঁচলো করে হাসল। এক পলক চারদিক দেখে নিয়ে চাপা গলায় বলল, কনগ্রাচুলেসন্স। একদিনের পক্ষে প্রগ্রেসটা বেশ ভালোই।
আমিও হাসলাম। হাসতে হাসতেই দ্রুত একবার শিরিনকে চোখ মেরে এগিয়ে গেলাম। তারপর পার্কিং জোন থেকে শমিতার গাড়িটা বার করে চৌরঙ্গীতে চলে এলাম। এখন আমিই ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। আর শমিতা আমার পাশে লক করা দরজায় হেলান দিয়ে পড়ে আছে। তার মাথাটা সামনের দিকে আলগা হয়ে ঝুলছে যেন।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে শমিতাদের বাড়ির সামনে এসে হর্ন বাজাতেই নেপালি দারোয়ান গেট খুলে দিল। গাড়িটা ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাঁদিকের লন আর ডানদিকের টেনিস কোর্টের মাঝামাঝি নুড়ির রাস্তাটায় পার্ক করলাম।
দারোয়ানটা গেট বন্ধ করে ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে চলে এল। তাকে চিনতে পারলাম। কেননা কাল যখন মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে এসছিলাম সে-ই গেট খুলে দিয়েছিল। দারোয়ানটা বোধহয় আমাকে চিনতে পারেনি। চাপা মঙ্গোলিয়ান চোখে একপলক আমাকে দেখে নিয়ে সে বলল, আজ ভি এক নয়া আদমি–
আমি উত্তর দেবার আগে দারোয়ানটা আপন মনে বিড় বিড় করে বলে উঠল, হর রোজ রাতমে এক এক নয়া আদমি ছোটা মেমসবকে লেকে আতা।
ছোট মেমসাব নিশ্চয়ই শমিতা। বুঝতে পারছি নেশায় চুরচুর শমিতাকে প্রতি রাত্রে নতুন নতুন লোক এখানে পৌঁছে দিয়ে যায়। যাই হোক, শমিতার মা মনোবীণা সান্যালের কথা আমার মনে পড়ে গেল। এখানে যখন এসেই পড়েছি মনোবীণার সঙ্গে একবার দেখা করা যেতে পারে। ভদ্রমহিলা তাতে বুঝতে পারবেন ওঁর কাজটা সত্যি সত্যি শুরু করে দিয়েছি। দারোয়ানটাকে জিগ্যেস করলাম, বড়া মেমসাব কোঠিমে হ্যায়?
দারোয়ানটা বলল, বড়া মেমসাব, সাব কোই নেহি হ্যায়, পার্টিমে গিয়া
কখন ফিরবেন? হিন্দিতেই জিগ্যেস করলাম।
মালুম নেহি। দারোয়ানটা ডাইনে-বাঁয়ে দুধারের মাথা নাড়ল।
এবার শমিতাকে দেখিয়ে বললাম, তাহলে একে
দারোয়ানটা আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। সে বুঝিয়ে দিল দুশ্চিন্তার কিছু নেই; রোজ রাতেই শমিতা এই রকম বেহুশ অবস্থায় ফেরে; বাড়িতে বেশির ভাগ দিনই সাহেব বা মেমসাহেব থাকেন না; তাকেই ছোটা মেমহেবকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তার ঘরে রেখে আসতে হয়। তবে একা তার পক্ষে এত বড় জোয়ান আওরতকে নামিয়ে তেতলায় টেনে তোলা খুবই কষ্টকর। তাই যারা শমিতাকে নিয়ে আসে সে তাদের সাহায্য চায়। তার আশা নতুন সাব অর্থাৎ আমিও মেহেরবানী করে সহায়তা করব।
বললাম, জরুর–
দুজনে ধরাধরি করে শমিতাকে তার ঘরে শুইয়ে যখন আবার নীচে লনের কাছে চলে এসেছি। সেই সময় গেটের বাইরে হর্নের শব্দ শোনা গেল। দারোয়ানটা দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিতেই একটা প্রকাণ্ড ঝকঝকে ইমপোর্টেড গাড়ি ভেতরে ঢুকে টেনিস কোর্টের ওধারে পার্ক করল।
এখানে নুড়ির রাস্তায়, টেনিস কোর্টে, সবুজ লনে–মানে চারদিকেই সুদৃশ্য পোস্টের মাথায় মার্কারি ল্যাম্প জ্বলছে। সবকিছুই সূর্যালোকের মতো উজ্জ্বল। আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। চোখে পড়ল দরজা খুলে মনোবীণা সান্যাল আর অরিন্দম সান্যাল গাড়ি থেকে নামছেন। অর্থাৎ পার্টি থেকে ফিরে এলেন। অরিন্দমের গায়ে নিখুঁত ডিনার স্যুট। তার পাশে মনোবীণাকে একটা রঙিন প্রজাপতির মতো দেখাচ্ছিল। ভদ্রমহিলা আজ দারুণ সেজেছেন।
একটু পরে ওঁরা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। কেননা আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দিয়েই ওঁদের বাড়ির দিকে যেতে হবে।
অরিন্দম এবং মনোবীণা দুজনকেই বেশ টিপসি দেখাচ্ছে। দুজনেরই চোখ ফোলা ফোলা এবং ঈষৎ আরক্ত। দুজনেই অল্প অল্প টলছিলেন। অর্থাৎ হে মহান জনগণ, এঁরা যুগলে পার্টি থেকে ভালোরকম নেশাটি করে এসেছেন।
দারোয়ান আমাকে চিনতে পারেনি, কিন্তু অরিন্দম পারলেন। নেশা-জড়ানো লাচে চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, সেই ইনটেরিয়র ডেকরেটর না?
নার্ভগুলোকে বেশ স্টেডি রেখেই বললাম, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার–
এত রাত্রে কী মনে করে? ইনটেরিয়রের কিছু খোঁজখবর নিতে নাকি?
দারোয়ানটা কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি উত্তর দেবার আগেই সে জানিয়ে দিল, এ সাব ছোটা মেমসাবকো লেকে আয়া
ও, আচ্ছা। তাহলে পরোপকারের জন্যে আসা। ভেরি গুড-অরিন্দম সান্যাল আমার মুখের কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করলেন, ওয়াজ শি ড্রাংক?
কী উত্তর দিলে ভদ্রলোক খুশি হবেন বুঝতে না পেরে চোখের কোণ দিয়ে দ্রুত মনোবীণার দিকে তাকালাম। মনোবীণা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। চোখাচোখি হতেই তিনি চোখ টিপলেন। অর্থাৎ যা সত্যি তাই যেন বলি। বললামও। অরিন্দম এবার স্ত্রীর দিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বিরক্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, প্রতিদিন তোমার মেয়ে ড্রিংক করে একেকটা লোকের ঘাড়ে চেপে বাড়ি ফিরছে। চারদিকে কীরকম স্ক্যান্ডাল রটছে জানো—
মনোবীণা খুব আস্তে আস্তে বললেন, স্ক্যান্ডালাররাও ও-রকম রটায়ই তবে
আমার মেয়ের স্ক্যান্ডাল নিয়ে তো খুব চেঁচাচ্ছ। তোমার স্ক্যান্ডলে যে ক্যালকাটার বাতাস পয়জন্ড হয়ে গেছে–সে খবরটা রাখো কি?
তোমার স্ক্যান্ডালও কম নেই।
তার জন্যে ইউইউ আর রেসপন্সিল।
স্পট ইট।
আমি চুপ করেই থাকি, কিন্তু তুমি আমাকে ঘাঁটিও না।
একটু থতিয়ে রইলেন অরিন্দম। তারপর গলার স্বর সামান্য নামিয়ে বললেন, প্রত্যেক মাসে তোমার মেয়ের জন্যে পাঁচ-ছহাজার টাকা মদের বিল দিতে হয়। আই ওন্ট পে ইট এনি মোর
রুক্ষ কর্কশ গলায় অস্বাভাবিক জোর দিয়ে মনোবীণা বললেন, ইউ মাস্ট পে। তোমার সঙ্গে সেই রকম কন্ডিসানই আছে।
আরক্ত চোখে স্ত্রীকে একবারে দেখে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন অরিন্দম।
হে মহান জনগণ, ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি মনোবীণা আর অরিন্দমের সম্পর্কটা দারুণ খারাপ। দুজনের মাঝখানে ঘৃণা-টুণা ছাড়া আর কোনও বস্তু নেই। বিবাহিত নারী-পুরুষ সম্বন্ধে আমার বলার কোনও রাইট নেই; এ বিষয়ে আমি খুবই আনাড়ি এবং অনভিজ্ঞ। তবু এটা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন ঘৃণা অবিশ্বাস ইত্যাদির ওপর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
মনোবীণা সান্যাল বললেন, ডোরাকে কোথায় পেলেন?
আমার মনে পড়ল শমিতার ডাকনাম ডোরা। লক্ষ্য করলাম মনোবীণার কণ্ঠস্বরে একটু আগের সেই উত্তেজনা বা রুক্ষতা নেই। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন। যাই হোক শমিতাকে কোথায় পেয়েছি জানালাম।
মনোবীণা জিগ্যেস করলেন, কী রকম মনে হচ্ছে?
বললাম, আজই তো শুরু করলাম। তবে আমি আশাবাদী।
ধন্যবাদ। মনোবীণা আর দাঁড়ালেন না; আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
এ বাড়ির তিনটি মানুষ–স্বামী, স্ত্রী এবং মেয়ে–তিনজনেই মধ্যরাতে মদ্যপান করে ফেরে। এদের ফ্যামিলি প্যাটার্নটা কেমন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবতে চেষ্টা করলাম। তারপর গেটের বাইরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চলে গেলাম।
এখন আমার ঘড়িতে রাত দেড়টা। হঠাৎ খেয়াল হল চার পেগ হুইস্কি ছাড়া কিছুই পাকস্থলীতে পড়েনি। এত রাতে দোকান-পাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ সব বন্ধ হয়ে গেছে। ওদিকে চার্লিকে রান্না-বান্না করতে বারণ করে দিয়েছি। তার মানে আজকের রাতটা উপোষ দিয়েই কাটাতে হবে। হে মহান জনগণ, এ জন্যে আমার দুঃখ নেই। আপাতত সবচাইতে যা বেশি দরকার তা হল একটা ট্যাক্সি। ওটা না পেলে, এত রাত্রে যখন বাস-ট্রাম-মিনিবাস সবই বন্ধ হয়ে গেছে তখন খালি পেটে এন্টালি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে।
মিনিট তিন-চারেক হাঁটবার পর একটা ট্যাক্সি পেয়েও গেলাম।
.
এন্টালিতে আমার তেতলার সেই ছাদে পৌঁছে দেখলাম চার্লি ঘুমোয়নি। বিছানায় বসে বিড়ি ফুকছে। আমি ঢুকতেই বলল, ডিউটি শেষ হল?
বললাম, আজকের মতো।
খাওয়া হয়েছে?
না। খাবার চান্স পাইনি। বলেই তোয়ালে-ফোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। দশ বারো মিনিট বাদে ফিরে এসে দেখি আমার বিছানার একধারে ছোট টেবলের ওপর প্লেটে করে রুটি আর মাংস সাজানো রয়েছে। এ নিশ্চয়ই চার্লির কাজ। অবাক এবং খুশি হয়ে বললাম, এ সব পেলে কোথায়? রাঁধার কথা তো ছিল না।
চার্লি বলল, তোমার জন্যে কিনে এনে রেখেছি লর্ড। জানতাম যে পাল্লায় পড়েছ আজ আর খাওয়া-টাওয়া জুটবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ চার্লি, থ্যাঙ্ক ইউ–আমি রুটি-মাংসের প্লেটটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম।
.
০৮.
সকালে উঠে আগের দিনের মতোই চার্লিকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে শমিতার ওপর নজর রাখবার জন্যে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে পাঠিয়ে দিলাম এবং তার গতিবিধি লক্ষ্য করে দশটার পর অফিসে ফোন করতে বললাম।
চার্লি চলে গেলে খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো দ্রুত একবার দেখে শেভ-টেভ করে নিলাম। হে মহান জনগণ, গোটা খবর কাগজটা আমার পড়তে ইচ্ছা করে না; আসলে অত ধৈর্যই নেই। মোটামুটি দু-চারটে নিউজ যা আমার প্রফেসানে কাজে লাগতে পারে জানতে পারলেই আমি খুশি। যাই হোক তারপর স্নান-টান সেরে চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে নীচে নামতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল তেতলার ল্যান্ডিং-এর কাছে ডরোথি দাঁড়িয়ে আছে। তক্ষুনি আমি ঘুরে দাঁড়লাম; ওর পাল্লায় পড়লে আর দেখতে হবে না; এই দিনের বেলাতেই এমন সব কাণ্ড করে বসবে যাতে আমার একটা বড় রকমের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু কপালটা খারাপ; ডরোথি আমাকে ঠিক দেখে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচিয়ে উঠল, হেয় রাজীব। তারপরেই একসঙ্গে দু-তিনটে করে সিঁড়ি টপকে টপকে আমার কাছে চলে এল। অগত্যা আমাকে দাঁড়াতেই হল। মনে মনে ভাবলাম আজ আমার বারোটা বাজল।
ডরোথি একটা দারুণ ভলাপচুয়াস সেক্সি মেয়ে। সে বলল, এ কী, আমাকে দেখে তুমি পালাচ্ছ যে!
থতমত খেয়ে বললাম, না না, পালাব কেন?
পালাচ্ছ আর বলছ পালাব কেন?
বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি দেখতে পাইনি।
ডরোথি বলল, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। একটু থেমে বলল, অনেকদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হল। যখনই ছাদে যাই দেখি তোমার ঘরের তালা বন্ধ। খুব বিজি নাকি?
এক্সট্রিমলি–আমি তৎক্ষণাৎ ঘাড় কাত করলাম।
গুড লাক। তোমাকে পেয়ে ভালোই হল। অফিস থেকে আজ ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছি। হোল ডে তোমাকে আর ছাড়ছি না ডার্লিং
আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। বললাম, ডরোথি, আমার একটা খুব জরুরি কাজ আছে। সেটা করতেই হবে।
ডরোথি আমার কাঁধে একটা হাত তুলে দিল। টের পাচ্ছি তার বুকের তীক্ষ্ণ ছুঁচলো অংশটা ছুরির ফলার মতো আমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকে যাচ্ছে।
ঘাড় বাঁকিয়ে চোখের তারা নাচাতে নাচাতে সে বলল, কোনও কথাই শুনছি না। তোমাকে নিয়ে আজ হোল ডে প্রোগ্রাম করব।
ডরোথির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে বললাম, এক কাজ করো; প্লিজ এখন আমাকে ছেড়ে দাও। সাড়ে তিনটের সময় চৌরঙ্গীর ইন্ডিয়ান কাফেতে ফার্স্ট কেবিনটার ওয়েট কোরো; ওখানে তোমার সঙ্গে মিট করব।
প্রমিস?
প্রমিস।
আমি কিছু বুঝবার আগেই প্রকাশ্য দিবালোকে এই খোলা সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ আমাকে জড়িয়ে ধরে গোলে এবং ঠোঁটে একসঙ্গে আট দশটা চুমু খেল ডরোথি। তারপর ছেড়ে দিয়ে নাকের ডগায় আলতো টোকা মেরে বলল, মুখটা মুছে নিও, লিপস্টিকের দাগ লেগে গেছে।
ডরোথির হাত থেকে ছাড়া পেয়ে অফিসে যখন পৌঁছুলাম দশটা বেজে গেছে। আমার আগেই লতিকা এসে গিয়েছিল। সে কাচের দেয়ালের ওপারে বসে আছে।
এয়ার কুলারটা চালানোই ছিল; নিজের রিভলভিং চেয়ারে বসতে বসতে লতিকাকে লক্ষ্য করলাম। সে ঠিক হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে নেই; মোটা খাতার ওপর ঝুঁকে কী হিসেব-টিসেব দেখছে। ডাকলাম, অ্যাই লতিকা-লতিকা বলল, প্লিজ দুমিনিট-ঠিক দুমিনিট পরেই মুখ তুলে বলো, বলো–আজ বিজনেসের খবর কী?
এই তো সবে অফিস খুলল; কোনও খবর নেই।
একটু চুপচাপ। লতিকা আবার হিসেবের খাতায় ঝুঁকল। আমি এবার বললাম, কী হল? আবার হিসেব নিয়ে পড়লে যে?
কী করব?
কই জিগ্যেস করলে না তো কাল অফিস ছুটির পর আমি কোথায় গিয়েছিলাম?
জিগ্যেস করে কী করব। জানি তুমি নিজেই বলবে।
আমার ওপর দারুণ বিশ্বাস দেখছি।
খাতাটা বন্ধ করে এবার সোজা আমার দিকে তাকাল লতিকা। বলল, বিশ্বাস করব না বলছ?
বললাম, আমি তো অনেক কিছু লুকিয়ে রাখতে পারি।
লতিকা একটু হাসল। তারপর বলল, কোথায় গিয়েছিলে বলো
কাল হোটেলে গিয়ে শমিতার সঙ্গে দেখা করার পর থেকে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সব বলে গেলাম; একটা কথাও গোপন করলাম না।
সমস্ত শুনে পলকের জন্যে লতিকার মুখে ছায়া পড়ল। পরক্ষণেই হেসে হেসে সে বলল, কাল রাতটা তাহলে বেশ মজাতেই কাটিয়েছ।
বলছ!
লতিকা কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই পার্সোনাল ডিপার্টমেন্ট থেকে রীতেশ আমার চেম্বারে এল। জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার?
রীতেশ বলল, দাদা, বাইরের এটা লাইন আছে। এক ভদ্রলোক আমাদের হেল্প চান। কিন্তু তার কিছু কন্ডিসান আছে। কী উত্তর দেব, বুঝতে পারছি না। লাইনটা আপনি ধরবেন?
দাও।
রীতেশ ফিরে গিয়ে আমাকে কানেকসান দিয়ে দিল। ফোনটা কানে লাগিয়ে বললাম, কে বলছেন?
ওধার থেকে ভারী মোটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার নাম মণিমোহন মল্লিক আপনাদের ওপর আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব দিতে চাই।
ধন্যবাদ স্যার। বলুন আমাদের কী করতে হবে।
কাজটা গোপনীয়; খুব সাবধানে করতে হবে। আপনাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি কি?
পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে ফোন করে লোকে প্রথমে এই প্রশ্নটাই করে থাকে এবং এক্ষেত্রে আমরা যা-যা বলে থাকি অর্থাৎ গোপনীয়তা রক্ষা করাই আমাদের প্রফেসানের একমাত্র ক্যাপিটাল–ঠিক তাই বললাম।
মণিমোহন মল্লিক বললেন, ভেরি গুড। আমি ঠিক এরকমটাই চাইছিলাম। যাই হোক কাজটার জন্যে আপনার কী রকম রেমুনারেসন নেবেন?
কাজটা কী, না জেনে কী করে বলি–
তা অবশ্য ঠিক। আপনি এক কাজ করুন, আমার এখানে চলে আসুন। ফোনে তো সব কথা হয় না। সামনা-সামনি বসে কাজের ব্যাপারটা আলোচনা করে নেওয়া যাবে, সেই সঙ্গে রেমুনারেসনটাও।
কিন্তু আমরা তো কোথাও যাই না মিস্টার মল্লিক। ক্লায়েন্টনরা আমাদের অফিসে এসেই তাদের কাজ-টাজ বুঝিয়ে দিয়ে যান।
আমার যেতে কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু কাল থেকে ব্লাড প্রেসারটা গোলমাল করছে। ডাক্তার কদিনের রেস্ট নিতে বলেছে। প্লিজ চলে আসুন
যাওয়াটা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। কারণ আমাদের যা প্রফেসান তাতে প্রতি মুহূর্তে ফাঁদে পড়ার ভয়। আমি আবার বললাম, কিন্তু
কিন্তু-টিন্তু নয়, আমি আপনাকে আধ ঘণ্টার মধ্যে এক্সপেক্ট করে রইলাম। আমার ঠিকানা পার্ক অ্যাভেনিউতে-মণিমোহন তাদরে রাস্তার একটা নম্বর বললেন এবং সেইসঙ্গে তাঁর সুইট নম্বরটাও।
হে মহান জনগণ, মহা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। একটু চুপ করে থেকে বললাম, কোনওভাবেই কি ফোনে আপনার কাজের বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে পারেন না?
না। কারণ আপনাকে কিছু মেটিরিয়াল দিতে হবে। সেগুলো হাতে না পেলে কিছুতেই কাজটা শুরু করতে পারবেন না। প্লিজ আর না বলবেন না; আমি ধরেই নিলাম আপনি আসছেন। মণিমোহন লাইনটা কেটে দিলেন।
টেলিফোন নামিয়ে রেখে লতিকার দিকে ফিরতেই দেখি উৎসুকভাবে সে তাকিয়ে আছে। বলল, কী ব্যাপার?
মণিমোহনের কথা বলে জিগ্যেস করলাম, কী করা যায় বলো তো। যাব?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। যা করবার ভেবে-চিন্তে করবে।
খানিকটা সময় দারুণ এক অস্থিরতার মধ্যে কেটে গেল। তারপর কখন যে আমাদের অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরেছি, আর কখন পার্ক অ্যাভেনিউতে চলে এসেছি, মনে নেই।
মণিমোহনের দেওয়া নম্বরটা খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না। এটা একটা নতুন মাল্টি-স্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট হাউস। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে লিফটে করে টেন্থ ফ্লোরের নির্দিষ্ট স্যুইটের সামনে এসে কলিংবেল টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে ভেসে এল, দরজা ভেজানো আছে; ঠেললেই খুলে যাবে। চেনা গলা। কিছুক্ষণ আগে টেলিফোনে এই কণ্ঠস্বরটিই আমি শুনেছি। দরজা ঠেলে ভেতের ঢুকতেই সেই মণিমোহনের গলা আবার শোনা গেল, কাইন্ডলি সামনের প্যাসেজটা দিয়ে রাইট টার্ন নিন, তারপর লেট, দেন এগেন রাইট–তারপর যে ঘরটা পাবেন সেখানকার পর্দা সরালেই আমাকে দেখতে পাবেন।
হে মহান জনগণ, গোটা ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যময়–টেরিফিক রকমের মিস্টিরিয়াস।
যাই হোক লেফট-রাইট করতে করতে এগুতে লাগলাম। যেতে যেতে দুধারে মোট তিনখানা ঘর পড়ল। একটা ঘর দেখে মন হল ফোটো ডেভলপ করার ডার্ক রুম। বাকি দুটোতে খোলা দরজা দিয়ে উঁচু অনেকগুলো স্টিলের ব্ল্যাক দেখতে পেলাম। র্যাকগুলোতে অগণিত ফাইল সাজানো রয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ঘরখানার কাছে এসে পর্দা সরাতেই ঘরের মাঝখানের উঁচু টেবলটায় ক্রস করা দুটো পা চোখে পড়ল। আর সেই পায়ের ফাঁক দিয়ে টেবলটার পিছনে ইজিচেয়ারে মধ্যবয়সি একটি লোককে আধশোয়া অবস্থায় দেখতে পেলাম। নিশ্চয়ই ইনি মণিমোহন মল্লিক।
মণিমোহন আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন। আস্তে আস্তে পা দুটো নামিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, পার্সোনাল অফিস থেকে আসছেন নিশ্চয়ই?
আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় কাত করলাম।
আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। আমিই মণিমোহন, বসুন–
মণিমোহনের ইজিচেয়ারটার ডানপাশেই সোফা-টোফা সাজানো রয়েছে। আমি একটা সোফায় বসে দ্রুত এক পলক তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলাম। চুয়ান্ন-পঞ্চান্নর মতো বয়স। গোল মুখে শক্ত চোয়াল, থ্যাবড়া থুতনি, মোটা নাক। রোমশ ভুরুর তলায় মাঝারি চোখ। সাধারণ বাঙালিদের মতো হাইট, ব্যাকব্রাশ করা চুল। তবে শরীরে যথেষ্ট অনাবশ্যক মেদ রয়েছে। এটা প্রচুর মদ্যপানজনিত।
মণিমোহনের দিকে তাকালে প্রথমেই যা চোখে পড়ে তা হল তার মুখের অস্বাভাবিক লাল রঙ। মনে হয় শরীরের সব রক্ত সেখানে উঠে এসেছে। হয়তো সত্যিই তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
ইজিচেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন মণিমোহন। তারপর বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। কিছু মনে করবেন না।
না না, মনে করব কেন? আমি হাসলাম।
আপনাকে দশ মিনিটের বেশি আটকাব না। কাজের কথা শুরু করা যাক–হে মহান জনগণ, কাজ যা করব তা তো আমি জানিই, তবু অ্যাডভান্সের টাকাটা বাগাতে হলে কিছু ভড়ং-টংও তো করতে হয়; নইলে পার্টিকে ফাসাব কী করে? মুখের ভাবখানা দারুণ সিরিয়াস করে তাকিয়ে রইলাম।
মণিমোহন মল্লিক বলতে লাগলেন, কাজটা হল একটি মেয়েকে সর্বক্ষণ আপনাকে ফলো করতে হবে। আর
তার কথার মাঝখানেই বলে উঠলাম, মেয়েটা কে?
কলকাতা শহরে কয়েক লক্ষ মেয়ে আছে। নাম বললেই কি চিনতে পারবেন? কথাটা ঠিকই বলেছেন মণিমোহন। সুতরাং আমাকে চুপ করে থাকতে হল। মণিমোহন আবার বললেন, আপনাকে সব ডাটা দিয়ে দেব। তার আগে আপনার কাছে কী কাজ চাই শুনে নিন।
ঠিক আছে। বলুন
মেয়েটা একটা দুর্দান্ত ড্রাঙ্কার্ড। এ ব্যাপারে পুরুষদের সে কান কেটে দিতে পারে। হোটেলে, ক্লাবে সব জায়গায় সে ঘুরে বেড়ায়। মাতাল অবস্থায় ওর জামা কাপড়ের ঠিক থাকে না; এর কিছু নুড ছবি আমাকে তুলে দিতে হবে। এছাড়া অনেকে তার এই মাতলামির সুযোগ নেয়; বাড়িতে পৌঁছে দেবার নাম করে নিজের বেডরুমে নিয়ে আসে। এই বেডরুমের কিছু হট ছবিও আমার দরকার।
আমি আপনাদের এই রাজীব সরকার মনুষ্য জাতির যাবতীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকি। নানা টাইপের লোক অদ্ভুত অদ্ভুত অনুরোধ নিয়ে আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে আসে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ন্যুড ছবি কিংবা বেডরুমের রগরগে ঝাঝালো দৃশ্যের শট নেবার দায়িত্ব কেউ আমাকে দেয়নি। আমি ঘামতে লাগলাম। টের পাচ্ছি আমার জামা, গেঞ্জি এবং কোমরের ট্রাউজারটা ভিজে সপসপে হয়ে যাচ্ছে।
মণিমোহন মল্লিকের গলা আবার শোনা গেল, এর জন্যে আপনাকে পনেরো হাজার টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। এবং পাঁচ হাজার অ্যাডভান্স। এ সম্বন্ধে আপনার কিছু বলবার আছে?
হঠাৎ আমি আমার নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। আরে এত ঘামছি কেন? এত নার্ভাসই বা কেন হচ্ছি? আমার কাজ তো অ্যাডভান্স নেওয়া পর্যন্ত। মন থেকে নার্ভাসনেসটাকে ঝেড়ে ফেলে বললাম, না না, ঠিক আছে।
জানতাম, টাকার এই ফিগারটা আপনার অপছন্দ হবে না। সে যাক, আপনার ক্যামেরা আছে?
না।
আমি আপনাকে ক্যামেরা দেব। আর একটা কথা–এই ফোটোগুলো দুমাসের মধ্যে চাই।
ফোটো যখন তুলবই না; দুমাসই বা কী, আর দুঘন্টাই বা কী। আমার কাছে সব সমান। বললাম, তাই পাবেন।
মণিমোহন বললেন, এবার তাহলে কাজটা সারা যাক। যে মেয়েটির ফোটো আপনাকে তুলতে হবে তার সঙ্গে কিন্তু আলাপ করিয়ে দিতে পারব না।
তাকে চিনব কী কবে?
তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
উঁচু টেবলটার ড্রয়ার খুলে একটা ফোটো বার করে টেবলের ওপর রাখলেন মণিমোহন। সেটার দিকে চোখ পড়তেই ফোর ফর্টি ভোল্টের ইলেকট্রিসিটি আমার নার্ভের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। ফোটোটা শমিতার।
মণিমোহনের গলা আবার শোনা গেল, এরা থাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। তবে একে ধরবার জন্যে সেখানে যাবার দরকার নেই। কলকাতার পশ হোটেল আর বড় বড় ক্লাবগুলোতেই ঘুরলেই এর দেখা পাওয়া যাবে। আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।
মণিমোহন মল্লিক উঠে ভেতরের অন্য একটা ঘরে চলে গেলেন। এক মিনিটের মধ্যেই হাতে একটা ক্যামেরা ঝুলিয়ে আবার ফিরে এলেন। ক্যামেরাটা টেবিলের ওপর রেখে সেই ইজিচেয়ারটায় বসতে বসতে বললেন, তাহলে আজ থেকেই কাজটা শুরু করে দিন। ক্যামেরা আর ফোটোটা নিয়ে যান। ও হ্যাঁ, অ্যাডভান্সের টাকাটাই তো দেওয়া হয়নি। সামনের বড় টেবলটার ড্রয়ার খুলে একগাদা একশো টাকার নোট বার করে গুণে গুণে পঞ্চাশটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, এই যে
টাকা, ক্যামেরা এবং ফোটো নিয়ে আমি উঠে পড়লাম।
মণিমোহন আরেকবার আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, সময়ের কথাটা খেয়াল আছে তো? দুমাসের মধ্যে কিন্তু ফোটোগুলো আমার চাই।
বললাম, আমার মনে আছে। একটা কথা জিগ্যেস করব?
অবশ্যই।
ওইসব ফোটো দিয়ে আপনি কী করবেন?
এর উত্তর আমি দেব না। আশা করি আপনার আর কোনও প্রশ্নই নেই। উইশ ইউ এভরি সাকসেস।
লোকটা আমাকে ভদ্রভাবে চলেই যেতে বলছে। বললাম, ধন্যবাদ।
হে মহান জনগণ, রাস্তায় বেরিয়ে দুরমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? মনোবীণা সান্যাল তার মেয়ে অর্থাৎ শমিতাকে শোধরাবার দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন আমার হাতে। এদিকে মল্লিক মশাই আমাকে দিয়েই শমিতার নুড পিকচার আর কিছু বেডরুম সিন তোলাতে চান। হে মহান জনগণ, বুঝতে পারছেন আমি একটা সাঙ্ঘাতিক কাঁচাকলে পড়ে গেছি।
.
০৯.
লতিকা উদ্গ্রীব হয়ে বলে ছিল। আমি অফিসে ফিরতেই জিগ্যেস করল, যেখানে গিয়েছিলে কী হল সেখানে?
মণিমোহনের ক্যামেরাটা টেবিলে রেখে বসতে বসতে বললাম, টেরিফিক ঝামেলার ব্যাপার–
মানে?
আগে অ্যাডভান্সের টাকাটা ধরো। তারপর বলছি। পকেট থেকে সেই পাঁচ হাজার টাকা বার করে লতিকাকে দিতে দিতে বললাম, আমাদের পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টটা এবার ক্লোজ করে দিতে হবে।
এত তাড়াতাড়ি। ছমাসও তো হয়নি ওটা খোলা হয়েছে। বলতে বলতে ক্যামেরাটার দিকে চোখ পড়ল শমিতার, আরে এটা কোথায় পেলে।
যার কাছে গিয়েছিলাম সে দিয়েছে।
অ্যাডভান্সের টাকা দিয়েছে; তার ওপর ক্যামেরাটাও দিল!
আরো একটা জিনিস দিয়েছে।
কী?
একটা ফোটো-পকেট থেকে শমিতার ফোটোটা বের করে কাচের দেয়ালের সেই গোল ফুটোর ভেতর দিয়ে লতিকার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
ফোটোটা দেখে খানিকক্ষণ আগে আমার মতোই চমকে উঠল লতিকা। তার গলার ভেতর থেকে আধফোঁটা গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে এল, সেই মেয়েটা না, মানে শমিতা?
মনোবীণা সান্যাল শমিতার যে ফোটোটা দিয়েছিলে সেটা আগেই তাকে দেখিয়েছিলাম। আমি ঘাড় হেলিয়ে দিয়ে বললাম, ইয়েস ম্যাডাম।
লতিকা বলল, তুমি যেখানে যাচ্ছ সেখান থেকেই ওর ফোটো নিয়ে আসছ। ব্যাপারটা কী বলো তো?
এ বোধহয় হোল ওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে আছে। সে যাক গে, যে কাজের জন্যে গিয়েছিলাম এবার সেটা শোনো।
বলো–লতিকা উৎসুক মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
মণিমোহন মল্লিক আমাকে কী কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, বলে গেলাম। শুনে লতিকার চোখের তারা কপালে উঠে গেল। বলল, এ সব তুমি করবে।
একটি সুন্দর যুবতী মেয়ের নুড ছবি তোলা–কাজটা যাই বলো দারুণ এক্সাইটিং। আমার খুব একটা ইচ্ছে নেই। তবে তুমি যদি পারমিসান দাও–মানে অনেক দিন এক ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। মনোটনি লাগছে; এটা করলে একটু ডাইভার্সিফিকেশন হত। বলে হাসতে লাগলাম।
অসভ্যতা করবে না। দিস ইজ অফুলি ব্যাড। ওই মণিমোহন লোকটার উদ্দেশ্য কী বলো তো?
নিশ্চয়ই মহৎ কিছু নয়। তাহলে এই কাজটায় তোমার আপত্তি আছে?
হ্যাঁ।
জানতাম। সেই জন্যই পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টের গণেশ ওল্টাবার কথাটা আগেই বলেছিলাম। পাঁচ হাজার টাকা অ্যাডভান্স, তার ওপর একটা ক্যামেরা ফাউ। ব্যাপারটা মন্দ হল না, কী বলো?
আমার কথা শেষ হল কি হল না, আচমকা টেলিফোনটা বেজে উঠল। ওটা তুলে নিয়ে কানে লাগাতেই চার্লির গলা ভেসে এল, লর্ড, আমি বলছি
মাঝখানে খানিকটা সময় এমন এক্সাইটমেন্টের মধ্যে কেটেছে যে চার্লির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। যাই হোক জিগ্যেস করলাম, তুমি এখন কোথায়?
সাদার্ন অ্যাভেনিউতে। একটা প্রাইভেট ক্লাবের সামনে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার সেই তিনি পনেরো মিনিট আগে ক্লাবটার ভেতর ঢুকেছেন। মনে হচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন। চট করে চলে এসো–চার্লি জায়গাটা বলে দিল।
ফোনটা ক্রেডেলে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নাঃ, শমিতার হাত থেকে বোধহয় মুক্তি নেই। অলৌকিক কোনও শক্তি প্রচণ্ড নিয়তির মতো যেন চারদিক থেকে আমাকে টানতে শুরু করেছে।
লতিকা অবাক হয়ে গেল। বলল, এ কী! উঠলে যে! কোথায় যাচ্ছ?
একটা প্রাইভেট ক্লাবে। শমিতা সেখানে রয়েছে।
শমিতা!
হ্যাঁ-আমি কাচের দেয়ালটার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বললাম, ভয় নেই; ওইসব ফোটো তুলব না।
তবে যাচ্ছ কেন?
ওর ব্যাপারটা একটু জানতে চাই। মেয়েটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। এ রকম ক্যারেক্টার আগে কখনও দেখিনি।
লক্ষ্য করলাম লতিকার মুখের ওপর একটা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, তোমাকে ফোন করে কে শমিতার খবর দিল?
চার্লি—
লতিকা চার্লিকে চেনে। সে জিগ্যেস করল, ওকে বুঝি শমিতার পেছনে লাগিয়ে রেখেছ?
শমিতার সঙ্গে চার্লিকে যে জুড়ে দিয়েছি–এ কথাটা লতিকাকে বলা হয়নি। তার মানে এই নয় যে ওটা গোপন করতে চেয়েছি। লতিকার কাছে ঢাকা-ঢাকির কোনও ব্যাপারই নেই আমার। একটু থতিয়ে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ। শমিতাকে স্টাডি করতে হলে অলওয়েজ ওর পিছনে লেগে থাকতে হয়।
আমার সেই সময় কোথায়? তাই চার্লিকে লাগিয়ে দিয়েছি। একটু থেমে আবার বলাম, এ ব্যাপারটা তোমাকে জানানো হয়নি, প্লিজ কিছু মনে কোরো না।
লতিকা হাসল, তোমার কাছে আমি এমনই গ্রেটফুল যে কখনও কোনও কারণেই কিছু মনে করব না।
দেখো ওসব কৃতজ্ঞতার-টুতজ্ঞতার কথা বললে আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই।
ঠিক আছে, তুমি আর দেরি কোরো না; বেরিয়ে পড়ো।