অনুর অফিস ঠিকঠাক। গাইবান্ধা ট্যুরের সেই রাতের ঘটনা নিয়ে অনু বা আলতাফ হোসেন কেউ আর কোনো কথা বলেনি। পরদিন ভোরেই জরুরি কাজের কথা বলে গাইবান্ধা থেকে ঢাকা ফিরে আসেন আলতাফ হোসেন। ট্যুরের বাকি দিনগুলো পুরো টিমের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে অনুর কাঁধেই। ঢাকায় ফিরে আবার অফিস করা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় ভুগছিল অনু। সে জানে, কেউই হেরে যেতে পছন্দ করে না। যে মানুষ জয়ী হবার যোগ্য নয়, সেও পরাজয় মেনে নিতে পারে না। আর পরিস্থিতি তাকে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য করলেও, সে সারাজীবন বুকের ভেতর লালন করতে থাকে তীব্র প্রতিশোধ স্পৃহা। চেতনে-অবচেতনে অপেক্ষায় থাকে সুযোগের।
এই কথা জানে বলেই অনুর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল খুব। যদিও অনুর মনের আরেকটি অংশ তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে, আলতাফ হোসেন প্রকৃতপক্ষে এমন মানুষ নন। দু’দুটো বছর একসাথে কত কাজ করেছে তারা, ঢাকার বাইরে দীর্ঘ সময়ের জন্য কত ফিল্ডওয়ার্কে গিয়েছে। কিন্তু কই, আগে কখনোই তো এমন কিছু করেননি আলতাফ হোসেন! তাহলে হঠাৎ করে এমন কী হয়েছে তার? সম্ভবত এ কারণেই এমন ভয়ানক ঘটনার পরও আলতাফ হোসেন সম্পর্কে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারছিল না অনু। এটি তার নিজের চিন্তার কোনো দুর্বলতা কি-না কে জানে!
আলতাফ হোসেনও অবশ্য অনুকে আর ঘাটালেন না। বরং যতটা সম্ভব এড়িয়েই চলেন। খুব প্রয়োজন না হলে তাদের মধ্যে কথাবার্তাও তেমন হয় না। তবে বিষয়টি যে অফিসের অনেকের নজর এড়ায়নি, অনু তা বুঝতে পারছিল। সেদিন ডাটা এনালাইসিস স্পেশালিস্ট শাহানা আপা অনুকে ডেকে বললেন, ঘটনা কী বলেন তো অনু?
অনু অবাক গলায় বলল, কী ঘটনা আপা?
না মানে আলতাফ সাহেব হঠাৎ অফিসে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন, খেয়াল করেছেন?
অনু খানিকটা তটস্থ গলায় বলল, কই, না তো আপা?
আপনার বস, আর আপনি খেয়াল না করলে হবে? এটা কোনো কথা হলো অনু? জিজ্ঞেস করেন, জিজ্ঞেস করেন। বসের ভালো-মন্দের খেয়াল রাখাও কিন্তু এক ধরনের অফিসিয়াল রেসপন্সিবিলিটিই অনু।
উনার ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ও তো হতে পারে আপা। ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করা কী ঠিক হবে?
শাহানা আপা হাসতে হাসতে বললেন, ব্যক্তিগত বিষয় তো ব্যক্তিরাই জানবে। জিজ্ঞেস করবে, তাই না? আপনার কি মনে হয় আপনি ব্যক্তি না?
অনু কোনো জবাব দেয়নি আর। তবে বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিকটুও হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন সেদিন অনুকে একটা ইনফরমেশন দেয়ার জন্য আলতাফ হোসেন ফোন করলেন অনুর মুখোমুখি ডেস্কে বসা হাসানের ইন্টারকমে। হাসান ফোন রেখে বলল, আলতাফ ভাইয়ের সাথে আপনার কোনো ঝামেলা হয়নি তো?
অনু কী একটা জরুরি কাজ করছিল। ঝট করে মুখ তুলে বলল, কেন?
না মানে আমাকে ফোন দিয়ে বললেন আমি যেন আপনাকে জানিয়ে দেই যে কালকের মিটিংটা দুপুর তিনটার বদলে সকাল সাড়ে নটায় এগিয়ে আনা হয়েছে।
অনু আবার কাজে ডুবে যেতে যেতে নির্বিকার গলায় বলল, ওহ্! আমার ইন্টারকমটা ঝামেলা করছে, এই জন্য সম্ভবত আপনাকে ফোন দিয়েছিলেন।
অনু যা-ই বলুক, বিষয়টা অফিসে সবার নজরে পড়ছে। এই নিয়ে আড়ালে আবডালে ফিসফিসানিও শুরু হয়েছে। আজ অফিস শেষে অনু যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল, তখন হাসান এসে দাঁড়ালো অনুর পাশে। তারপর বলল, বাসায় যাবেন তো?
অনু বলল, হু।
আপনার বাসা তো মোহাম্মদপুরের দিকটাতে?
জি।
আমার ছোটখালার বাসা মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে। খালা অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। যাব যাব করেও যাওয়া হচ্ছিল না বহুদিন। আজ। ভাবছি যাব। চলুন একসাথে যাওয়া যাক।
অনু ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে মৃদু হেসে বলল, আমি তো হাসান ভাই এখন সরাসরি ওদিকে যাব না। একটা কাজ আছে বসুন্ধরা সিটিতে। ওখান থেকে কাজটা সেরে বাসায় যাব।
সমস্যা নেই, আমার সাথে বাইক আছে, চলুন বসুন্ধরা হয়েই যাই। আপনার কাজ শেষ হলে বাসায় পৌঁছে দিলাম।
অনু চাইছিল না হাসানের সাথে যেতে। এমনিতেই অফিসে নানান ফিসফাস। এর মধ্যে হাসানের সাথে বাইকে যাওয়া নিয়ে আবার কি হয় কে জানে! তাছাড়া বিষয়টি আলতাফ হোসেনেরও চোখ এড়ানোর কথা নয়। কিন্তু এখন কী করবে সে? হাসান বলল, অফিস ছুটির এই সময়ে রাস্তায় যা জ্যাম। আবার বাস পেতেও রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। তাছাড়া আপনি যতক্ষণে বাস পেয়ে জ্যাম ঠেলে বসুন্ধরা যাবেন, ততক্ষণে বসুন্ধরা বন্ধই হয়ে যাবে।
অনুর যে বসুন্ধরায় কোনো কাজ নেই, তা নয়। তবে সেটি আজ না করলেও চলতো। হাসানকে এড়ানোর জন্যই সে হুট করে বলে ফেলেছে। যদিও অনেক দিন থেকেই সে যাবে ভাবছিল। কিন্তু নানা কারণেই যাওয়া হচ্ছিল না। বসুন্ধরা সিটির পাশেই তোহা ইকরামের অফিস। অনুর কলেজ জীবনের বান্ধবী অদিতির হাজবেন্ড তোহা। বছর সাতেক আগে চাকরি ছেড়ে আইটি বিজনেস শুরু করেছিল সে। সেই বিজনেস এখন মোটামুটি বড় হয়েছে। তোহা আর অদিতির সাথে ভালো একটা যোগাযোগই ছিল অনুর। কিন্তু নানান ব্যস্ততায় সেই যোগাযোগ অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। সপ্তাহ কয়েক আগে হঠাৎ দুজনের সাথে দেখা অনুর। কথায় কথায় তোহা বলছিল, নতুন একটি বিজনেস ভেঞ্চার শুরু করছে সে। এই নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অফিস গোছানোও প্রায় শেষ। এখন লোক নিয়োগ চলছে।
কথাটা খট করে কানে আটকে গিয়েছিল অনুর। অনু আসলে বুঝতে পারছিল, যত দ্রুত সম্ভব, নতুন একটা চাকরির ব্যবস্থা করা খুব জরুরি তার। এই অফিসে এভাবে আর বেশিদিন টিকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তোহাকে তাই দিন কয়েক আগে নিজ থেকেই ফোন করেছিল অনু। যদিও নিজের চাকরির কথা বলেনি সে। বলেছিল, তার এক বন্ধুর কথা। তোহা হা-না কিছু বলেনি। বলেছিল একদিন অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে।
তো আজ যাই, কাল যাই করেও আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি অনুর। কোথায় যেন একটা বাধো বাধো ঠেকছিল তার। একে তো বান্ধবীর হাজবেন্ড, তার ওপর সে তো আসলে নিজের চাকরির কথাই বলবে। এই দুই মিলিয়ে অনু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। কিন্তু দিন দিন অফিসের যা অবস্থা, তাতে মনে হয়
এই সংকোচ আর বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে সে। হাসান আবারো তাড়া দিলো অনুকে, কোনো সমস্যা?
অনু খানিকটা থতমত খাওয়া গলায় বলল, না, কোনো সমস্যা না।
হাসান বলল, চলুন তাহলে।
অনু কী করবে বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে বলল, একটু ফোন করে দেখি, যার সাথে দেখা করব, উনি আছেন কি-না?
অনু পরপর দু’বার ফোন করলো। কিন্তু ও পাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো না। হাসান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনু বলল, আজ মনে হয় আর ওদিকে যাওয়া হবে না। উনি ফোন ধরছেন না।
এমনও তো হতে পারে যে আমরা যেতে যেতে উনি ফোন করলেন?
অনু একবার সে কথাও ভাবলো। কিন্তু তারপর আবার মত বদলালো। বলল, নাহ্, আজ থাক। এমন জরুরি কিছু নয়। অন্য কোনোদিনও যাওয়া যাবে।
চলুন তাহলে। আর কোনো কাজ তো নেই, না-কি?
অনু মাথা নাড়লো। হাসানের সাথে বাইকে উঠতে অনুর একটুও ইচ্ছে করছিল না। আজকাল তার আর পুরুষ মানুষ সহ্য হয় না। তা সে যে-ই হোক না কেন। অনু তার নিজের একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছে, সুস্থ স্বাভাবিক একজন তরুণী মেয়ে হিসেবে একজন পুরুষের প্রতি যে সহজাত আকর্ষণ বা শরীরী স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা থাকার কথা, তা তার নেই। বরং পুরুষের আশেপাশে গেলেই সবসময় একটা তীব্র আতঙ্ক আর গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয় তার। অনু জানে না এটি তার জন্য খারাপ না ভালো। কিন্তু ব্যাপারটি লক্ষ করে সে কিছুটা অবাকই হলো। তার সবসময়ই কেন যেন মনে হয়, পুরুষ মানুষ মানেই তার জীবনে আরো কিছু ঝামেলা, আরো কিছু দুঃসহ অভিজ্ঞতা, ভয়াল স্মৃতি। এই অভিজ্ঞতা সে আর বাড়াতে চায় না। তার ইচ্ছে করছে হাসানের মুখের উপর বলে দিতে যে সে হাসানের সাথে যাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে এটি মোটেই ঠিক হবে না। অনু উঠল। তবে মাঝখানে যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা রেখেই বসলো সে। হাসান বাইক স্টার্ট দিয়েই বলল, আপনার বসতে কী কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
অনু সামান্য শক্ত গলায় বলল, নাহ্, ঠিক আছি। আপনি যান, সাবধানে চালাবেন।
ঢাকা শহরে বাইকে চড়ার অভিজ্ঞতা খুব একটা নেই অনুর। অফিস শেষ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের ভিড়, হৈ চৈ আর ঘামে ভেজা মানুষের গায়ের গন্ধে নাক মুখ চেপে বাড়ি ফেরাই তার অভ্যাস। কিন্তু আজ বাইকটা যেন একটানে ফুড়ত করেই তাদের নিয়ে এলো বিজয় সরণিতে। খোলা হাওয়ায় কী যে ভালো লাগছিল অনুর! বিজয় সরণির সিগন্যাল পেরিয়ে তারা সোজা ঢুকে গেল ক্রিসেন্ট লেকের পাশের সুন্দর, চওড়া রাস্তাটাতে। কিন্তু রাস্তার মুখেই অঘটনটা ঘটলো। রাস্তায় পড়ে থাকা কিছুতে বাইকের সামনের চাকাটা ফুটো হয়ে হাওয়া বেরিয়ে যাওয়ায় থপথপ শব্দ হতে লাগল চাকায়। হাসান তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করছিল চালিয়ে নিতে। কিন্তু শেষ অব্দি নিয়ন্ত্রণ রাখাই কঠিন হয়ে গেল। ফলে থামতেই হলো তাকে। সে করুণ মুখ করে তাকালো অনুর দিকে। অনুর ভেতরে ভেতরে কেন যেন একটা অশনি ডাকছিল। হাসানকে অবশ্য তা বুঝতে দিলো না অনু। সে বলল, এখন কী হবে?
হাসান হাসলো, কী আর হবে? এটা তো কাঁধে করে আমাদের দু’জনকে অনেকদূর নিয়ে এলো, এবার আমাদের পালা। চলুন, দু’জন মিলে ওকে কাঁধে তুলে নেই।
অনু জবাব দিলো না। ক্রিসেন্ট লেকের এই জায়গাটা ফাঁকা, অন্ধকার। তবে কাছাকাছি লোকজন না থাকলেও খানিক দূরেই লোকজন আর আলো দেখা যাচ্ছে।
হাসান বলল, আপনার উপকার করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তো বিপদেই ফেলে দিলাম দেখছি। এই রাস্তায় না চলে বাস, না রিকশা। একমাত্র সিএনজিই যা পাওয়া যেতে পারে। তবে খালি সিএনজি পাওয়ার সম্ভাবনা এখন নেই বললেই চলে।
অনু বলল, কিন্তু এটা কীভাবে নিবেন? তাছাড়া এটা সারাতেও তো হবে!
হুম। সেটাই ভাবছি। কিছুটা যেতে পারলে একটা উপায় হতো। কাছেই মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্প, ওখানেই সারানোর ব্যবস্থা আছে।
সে তো পায়ে হাঁটা অনেকটা পথ!
আর তো উপায় দেখছি না!
অনু আর কথা বাড়ালো না। হাসান বাইক ঠেলে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। পাশে অনুও। খানিকটা পথ দুজনই চুপচাপ হাঁটলো। তারপর হাসান হঠাৎ বলল, একটা কথা বলি?
অনু কিছু ভাবছিল। আচমকা হাসানের প্রশ্ন শুনে বুঝতে খানিক সময় লাগল তার। সে মুখ ঘুরিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, জি, বলুন?
আপনার কী কখনো মনে হয় না যে আপনি আপনার নিজের জীবনটা যাপন করছেন না?
তাহলে কার জীবন যাপন করছি?
অন্য কারো, যাকে আপনি চেনেন না।
যাকে চিনি না, তার জীবন কি করে যাপন করব?
এমন হয়, আমরা অনেকেই করি। ধরুন, আমি। আমার কাউকে কিছু একটা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বা কিছু একটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু নানা কারণেই সেটা আমি বলতে পারছি না বা করতে পারছি না। এই না পারাটা কিন্তু আমি না, অন্য কেউ। এখন এই দশার ভেতর দিয়ে যদি আমাকে দিনের পর দিন যেতে হয়, তাহলে একটা সময় গিয়ে আমি কিন্তু আর আমি থাকব না, আমি হয়ে যাব অন্য কেউ।
অন্য কেউ হবেন কেন? আপনি যদি কিছু বলতে না পারেন, বা করতে পারেন, মানে যা আপনি চান, তাহলে সেই না পারাটাই তো আপনি।
উঁহু। আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারছি না। ধরুন, আমি অন্যদের বলতে পারছি, বা একইরকম অন্য কাজটি করতে পারছি। কিন্তু পার্টিকুলার কারো ক্ষেত্রে বা কোনো একটি কাজের ক্ষেত্রে এসে আমি আটকে যাচ্ছি। তখন আমি আমার মতো না, অন্য একটা মানুষের মতো বিহেভ করছি। আমি তখনকার কথা বলছি…।
তখন আপনাকে বুঝতে হবে, ওই পার্টিকুলার মানুষ বা কাজের ক্ষেত্রে আপনার কোনো দুর্বলতা আছে।
আমার কি তখন সেই দুর্বলতাটা কাটিয়ে উঠে তাকে আমার কথাটা বলা উচিত?
অনুর হঠাৎ মনে হলো, হাসান কি তাকে ইঙ্গিতে বিশেষ কিছু বলতে চাইছে? সে কি আকারে ইঙ্গিতে তার কাছে বিশেষ কোনো কথা বলার অনুমতি চাইছে? অনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এটা সম্পূর্ণই আপনার ব্যাপার। অনেক সময় হয়তো দুর্বলতাটা থাকাই উচিত। সেই কাজটি না করা বা কথাটি না বলাই ভালো।
মানে অন্য মানুষ হয়ে বাঁচাটা?
হয়তো।
হাসান কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর আবার বলল, আপনি হয়তো ভেবেছেন, আমি আপনাকে কোনো বিশেষ কথা বলতে চাই। হয়তো এক্ষেত্রে আমার কোনো দুর্বলতা আছে। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। আমি আপনাকে আমার জন্য কোনো বিশেষ কথা বলতে চাইনি। আমি আপনার জন্যই আপনাকে একটা বিশেষ কথা বলতে চেয়েছি।
হাসানের কথা শুনে অনু সামান্য দমে গেল। সে মনে মনে যা ভাবছিল, হাসান তা ঠিক ঠিক ধরে ফেলল। বিষয়টা তার জন্য খানিক বিব্রতকর। হাসানই বলল, এই যে ধরুন, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু আপনার সাথে সাথে মনে হলো আমি হয়তো আপনাকে প্রেমের অফার করব, বা এই ধরনের কিছুই বলব, তাই তো?
অনু এবারো জবাব দিলো না। হাসান আবার বলল, এই যে সবসময় আপনার মাথায় ঘুরছে যে, যে-কোনো পুরুষই হয় আপনাকে প্রেমের অফার দেবে, না হয় এই ধরনের আপত্তিকর কিছু একটা বলবে। এটা কেন মনে হয় আপনার? না-কি সব মেয়েরই এমন মনে হয়? সব মেয়েই কী ভাবে যে তার আশেপাশের সব পুরুষই সবসময় কেবল সুযোগ খোঁজে? প্রেম বা অন্যকিছুর?
হাসান একটু থেমে আবার বলল, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি? অন্যভাবে নেবেন না, হতে পারে খুব অনিন্দ্য রূপবতী, বা অতি উচ্চ মোগ্যতাসম্পন্ন কোনো মেয়ের ক্ষেত্রে এটা হয়তো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সব মেয়ের ক্ষেত্রে তো এমনটা হবার কথা নয়। সব মেয়ের ক্ষেত্রেই তো পুরুষের এমনটা করার কথা নয়! আর আপনার ক্ষেত্রে তো আরো কম হবার কথা।
অনু আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনার কথার একটা অংশ ঠিক হাসান ভাই, আরেকটা অংশ ঠিক নয়। যেই অংশটা ঠিক, সেটি হচ্ছে, হ্যাঁ, আমার এমন মনে হয় যে যে-কোনো পুরুষই যখন আমার সম্পর্কে জানে, শোনে, তখন তার একটাই উদ্দেশ্য থাকে। আর সেই উদ্দেশ্যটি আমি বুঝি। বুঝি মানে, এটা কেবল আমার অনুমান নয়। এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝ। আর দ্বিতীয় যেটি আপনি বললেন, সেটি ভুল। খুব রূপবতী বা অতি উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো মেয়েকে অ্যাপ্রোচ করার আগে সেই পুরুষ মানুষটাকে আরো অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। তার নিজের যোগ্যতা, তার এস্টাবলিশমেন্ট, তার এমন আর কী কী রয়েছে যা দেখিয়ে সে মেয়েটার সামনে সমান সমান দাঁড়াতে পারবে? এই সব কিছু নিয়ে তাকে ভাবতে হয়। তাছাড়া সে জানে যে মেয়েটা মোটেই সহজলভ্য নয়।
তার মানে, আপনার ধারণা আপনি সহজলভ্য বলেই এমন মনে হয়। আপনার?
অনুর চোয়াল যেন একটু শক্ত হলো। সে বলল, আমি মোটেও সহজলভ্য নই হাসান ভাই। এমনকি আমি আমাকে কোনোভাবেই সহজলভ্য ভাবিও না। সমস্যা হচ্ছে, আমার ভাবায় আসলে কিছু যায় আসে না। কারণ আমি যে। সমাজে বাস করি, সেই সমাজের ভাবনায়, সেই সমাজের পুরুষের ধারণায় আমি সহজলভ্য। আমার যে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা, তা পুরুষকে এটা ভাবতে উৎসাহিত করে যে সে চাইলেই আমাকে পেতে পারে। খারাপভাবে বললে, আমাকে ব্যবহার করতে পারে। আমি জানি, আমি এমন কোনো রূপবতী বা যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়ে নই যে, জগতের সকল পুরুষ এসে আমার চারপাশে মৌমাছির মতো গুনগুন করতে থাকবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার চারপাশটা অনেকটা তেমনই। আমার চারপাশে সবসময়ই অসংখ্য পুরুষ এসে গুনগুন না হলেও ভনভন করতে থাকে, এর কারণ কী জানেন?
কী?
এর কারণ আমি একা, অরক্ষিত। এই সমাজের এবং পুরুষের ধারণা, একটি মেয়েকে জন্মের পর অবশ্যই তার বাবার পরিচয়ে বা আশ্রয়ে তাকে থাকতে হবে। বড় হতে হবে, কেবল তাহলেই সে নিরাপদ। আর বাবা যদি নাও থাকেন, তার মাথার উপর বড় একটি ভাই হলেও থাকতে হবে। অর্থাৎ একজন পুরুষের আইডেন্টিটিতে তাকে থাকতে হবে। যে তাকে রক্ষা করবে, ছায়া দেবে। তারপর আসবে স্বামী, বিয়ের পর থেকে বাদবাকি জীবন তাকে স্বামীর পরিচয় নিয়ে থাকতে হবে। স্বামীর মৃত্যুর পর আবার সন্তানের পরিচয়। এবং মনে রাখতে হবে, সেই সন্তান মেয়ে হলে কিন্তু চলবে না। হতে হবে ছেলে সন্তান। অর্থাৎ সবক্ষেত্রে নারীর একজন পুরুষের আইডেন্টিটি লাগবে, রক্ষাকর্তা লাগবে, তার নিজের নিরাপত্তার জন্য।
অনু সামান্য থামলো। ব্যাগটা বাঁ কাঁধ থেকে ডান কাঁধে নিতে নিতে সে আবার বলল, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তার নিরাপত্তা কেন দরকার? বা একটা মেয়ে অনিরাপদ কেন হবে? মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে পুরুষকে নারীর রক্ষাকর্তা হিসেবে দরকার হয়, আবার সেই পুরুষের কারণেই কিন্তু সে অনিরাপদ। আমরা এনজিওর ভাষায় যাকে বলি ভালনারেবল, বিপদাপন্ন। কারণ পুরুষ তাকে ধান, চাল, আটা, গম, গয়না কিংবা আর সকল ভোগ্যপণ্যের মতোই মনে করে। এমনকি তাদের কাছে নারী হতে পারে মাঠের ফসলের মতোও। ধরুন, পাশাপাশি অনেকগুলো ফসলের মাঠ। প্রতিটি ফসলের মাঠেই দারুণ ফসল ফলেছে। সেই মাঠগুলোর চারপাশে সুন্দর করে বেড়া দেয়া, সেই মাঠগুলোর প্রত্যেকটিরই একজন করে সবল রক্ষাকর্তা রয়েছেন। আর তার ঠিক পাশেই আরো একটি ফসলের মাঠ। কিন্তু সেই মাঠটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত, এর কোনো বেড়া নেই, কোনো রক্ষাকর্তাও নেই। এমনকি এই মাঠের ফসল আর সকল মাঠগুলোর মতো অমন হৃষ্টপুষ্ট বা আকর্ষণীয়ও নয়, বরং কিছুটা অপরিপুষ্টই। কিন্তু তারপরও দেখবেন সকলের দৃষ্টি এই মাঠটির দিকেই। তা সে গরু, ছাগল, মহিষ বলেন, আর চোর বা মানুষই বলেন। সকলেই চাইবে মুফতে যদি কিছু নিয়ে নেয়া যায়। বিষয়টা এমন নয় যে তারা বাকি মাঠগুলোর ফসল চায় না। সেগুলো বরং আরো বেশিই চায়, কিন্তু সাহস হয় না। কারণ, সেগুলো যে সহজলভ্য নয়। সেখানে যে রক্ষাকর্তা আছে। সমস্যা হচ্ছে আমার কোনো পুরুষ রক্ষাকর্তা বা আইডেন্টিটি নেই। না বাবা, ভাই, না স্বামী। ফলে আমি অনেকটা পরিচয়হীন, অরক্ষিত। আর যেহেতু আমি মেয়ে, সেহেতু তাদের কাছে আমি অবশ্যই ভোগ্যপণ্য। এখন যে ভোগ্যপণ্যের রক্ষাকর্তা নেই, তা সে যতই সস্তা হোক, কমদামি, কম উপাদেয় হোক, অন্যরা তো তা এটো করতে চাইবেই, চাইবে না?
অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও আটকালো। বলল, এইজন্যই আমার চারপাশটা এমন। যখনই কেউ জানে এই বয়সেও আমার বিয়ে হয়নি, অথচ আমার ছোট দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বাচ্চাও আছে একজনের, আমার বাবা নেই, ঠিক তখনই তাদের আমাকে সহজলভ্য মনে হয়। মনে হয়, আমাকে চাইলেই পাওয়া যাবে। বা আমি আমার নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আরো কত কী যে তারা ভাবে। একজন পুরুষ মানুষ হিসেবে আপনার তো এসব অজানা থাকার কথা নয়!
হাসান সাথে সাথেই জবাব দিলো না। অনেকটা পথ হাঁটলো চুপচাপ। তারপর বলল, আপনার ধারণা আপনার চারপাশের সব পুরুষই কোনো না। কোনোভাবে আপনার প্রতি এই একই ধারণা পোষণ করেন?
হয়তো না, তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহুদিন এর ভিন্ন কাউকে আমি পাইনি।
আপনার কি মনে হয় না যে আপনার ভাবনাও এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী। আপনি কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। আমি তখন যেটা বলছিলাম, একই ঘটনা ঘটতে ঘটতে, সবাইকেই আপনি এখন ওই একইভাবে ভাবা শুরু করে দেন। সেটা একদম প্রথম থেকেই। আপনি ধরেই নেন যে পুরুষ মানুষ মানেই এমন। কিংবা যে কারো যে-কোনো আচরণেরই একটা ফিক্সড ইন্টারপ্রেটেশন আপনি দাঁড় করিয়ে ফেলেন?
কী জানি! এগুলো নিয়ে আজকাল আর আমার ভাবতে ভালো লাগে না। হাসান ভাই।
আপনার কেন মনে হয়, কেউই আপনাকে সত্যিকারের ভালোবাসে না? কেন সবাই আপনাকে অন্যরকমভাবে পেতে চায়? সুযোগ নিতে চায়? এটা কি ঠিক বলুন?
অনু হাসলো, আজ থাক হাসান ভাই। এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো। লাগছে না।
হাসান তারপরও বলল, কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আপনার এই তিক্ত সব অভিজ্ঞতার কারণে একদম ফিক্সড যে ভাবনাটা আপনার মাথায় গেঁথে গেছে, সেই ভাবনাটাই আপনার সত্যিকারের অনেক বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষীকেই তাদের প্রাপ্য সুযোগ বা জায়গাটা আপনাকে দিতে দেয়নি! অনেকটা ঠগ বাছতে গা উজার হয়ে যাওয়ার মতোই তারাও আর সকল লম্পট, সুযোগ সন্ধানী পুরুষের সাথেই ভেসে গেছে?
কথাটা অনু বিশ্বাস করে না। তার কাছে পুরুষ মানুষ মানেই এক গা। ঘিনঘিনে আতঙ্কের নাম। হ্যাঁ হতে পারে, এই এত এত সব পুরুষের মাঝেও কোনো একজন হয়তো সত্যি সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিল। কেউ কেউ হয়তো সত্যি সত্যিই তার বন্ধু হতেই চেয়েছিল। কিন্তু অনু তা বুঝবে কী করে! যেখানেই সে বিশ্বাস করেছে, সেখানেই সুযোগ পেতেই ফস্ করে ফণা তুলেছে বিষাক্ত সাপ। হাসানের কথার আর কোনো জবাব দিলো না অনু। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে এসে তারা বিহারি ক্যাম্পে বাইক সারালো। শেষমেশ বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেই দেরিই হলো অনুর। গেটের সামনে অনুকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে গিয়েও হাসান হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। তারপর বলল, একটা কথা বলি?
অনু জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালো। হাসান মৃদু হাসলো। তারপর বলল, আপনার ধারণা ঠিক ছিল, আমি আসলে আপনাকে বিশেষ কিছুই বলতে চেয়েছিলাম। আর তা আমার জন্যই।
অনু এবারও কথা বলল না। তার কেবল মনে হচ্ছে দোতলার জানালাটার ফাঁক দিয়ে সেই ভয়ংকর মানুষটা শিকারি চিতার মতো ওঁত পেতে আছে। যে কোনো মুহূর্তে তীক্ষ্ণ নখর বাগিয়ে সে অনুর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অনু অনেক চেষ্টা করেও হাসানের কথায় মনোযোগ দিতে পারছে না। তার ভয় হচ্ছে, ভীষণ। ভয়। হাসান আবারো বলল, আমি আপনাকে আমায় বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু আপনি কি আমার প্রতি আপনার অবিশ্বাসটা একটু কমাতে পারবেন?
অনু বিড়বিড় করে বলল, আজ যাই হাসান ভাই, এই নিয়ে আরেকদিন কথা বলি?
হাসানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অনু ত্রস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। হাসান আহত এবং অবাক দৃষ্টি মেলে অনুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল।
*
পরপর বেশ কয়েকদিন আর বাসা থেকে বের হলো না অয়ন। বাইরে যাওয়ার। সেই আগ্রহটাও যেন হঠাৎ কোথায় উবে গেল। নুহা ছাড়া তার কাছের বন্ধু বলতে রনি আর মাসুদ। ওরা একবার এসেও ছিল। কিন্তু অয়ন আর বের হয়নি। নুহাকে নিয়ে সারাক্ষণ মাথার ভেতর যে একটা স্পষ্ট অস্থিরতা, সেই অস্থিরতাটা কাটাতে চাইছিল অয়ন। সেদিনের পর নুহার সাথে আর কথা হয়নি তার। নুহা অবশ্য ফোনও দেয়নি। বার কয়েক ফোন দিতে ইচ্ছে হয়েছিল অয়নের। কিন্তু নিজেকে বহু কষ্টে সামলেছে সে। আজ দুপুরটা যেন একটু কেমন। সকাল থেকেই আকাশজুড়ে মেঘ, বৃষ্টিটা নামলো দুপুরে, সাথে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। অয়নের ঘুম পেয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখে নুহার ফোন। অয়ন অবশ্য তাড়াহুড়া করলো না। হাত-মুখ ধুয়ে সামান্য কিছু খেলো। তারপর। নুহাকে ফোন দিলো। নুহার গলায় কেমন বিষাদ, তোর কোনো খবর নেই কেন অয়ন?
অয়ন হাসলো, কে বলল খবর নেই?
এই যে, এতদিন হয়ে গেল একটা ফোন অব্দি দিলি না?
তুই ব্যস্ত থাকবি ভেবে দেইনি।
ব্যস্ত থাকব বলে ফোন দিবি না? এটা কেমন কথা?
আচ্ছা, তুই কেমন আছিস?
এমনিতে ভালো, যদিও পড়াশোনার বারটা বাজিয়ে এই অসময়ে এলাম। তারপরও এভাবে সবাইকে তো আর কখনো একসাথে পেতাম না। সব খালা, মামা, কাজিনরা এসেছে। এত মজা অনেকদিন হয়নি।
তাহলে তো বেশ আছিস।
জানি না অয়ন, সব ঠিকই আছে। কিন্তু তারপরও আমার কিছু ভালো লাগছে না।
কেন?
কী জানি কেন?
অয়ন চুপ করে রইল, নুহাও। তারপর নুহা যেন সসংকোচে বলল, তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অয়ন।
অয়নের বুকের ভেতর আচমকা জল ছলকে উঠল, তাই?
হুম। তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে অয়ন।
কী কথা?
গোপন কিছু কথা।
বল?
এভাবে ফোনে না, আগে আসি, তারপর বলব। কত কথা যে জমেছে!
অয়ন অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে রাখতে। কিন্তু কতটুকু পারছে নিশ্চিত নয়। সে বলল, কবে ফিরবি?
কালই তো ফেরার কথা। কিন্তু কাল হয়তো হবে না।
আচ্ছা।
তুই ভালো আছিস? আর সব ভালো?
হ্যাঁ, ভালো।
কোচিংয়ে যাচ্ছিস?
উঁহু।
শরীর খারাপ করছে আবার?
নাহ্, শরীর ঠিক আছে।
মন খারাপ?
অয়ন কতকিছু বলবে ভেবেও শেষে বলল, নাহ্।
অয়ন?
বল।
আমার না সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
এমন সবারই করে।
তোরও?
খুব।
কোথায় যেতে ইচ্ছে করে?
তা তো জানি না, তবে দূরে কোথাও, অচেনা কোথাও।
তখন কাউকে সাথে নিতে ইচ্ছে করে না? মনে হয় না, ওই মানুষটা যদি তখন পাশে থাকত?
অয়নের খুব মন চাইছিল বলতে। কিন্তু সে বলল। তবে নুহার জন্য বুকের ভেতরটা আবার কেমন করতে লাগল। উত্তরে হিম হাওয়ার মতো একটা বুক হুহু করা শূন্যতা। নুহা কী বলবে তাকে? এভাবে এত স্পষ্ট করে আগে কখনো নুহা তাকে কিছু বলেনি। আচ্ছা, নুহা যদি তাকে তেমন কিছুই বলে, সে কী করবে তখন? অয়ন জানে, এই সময়টা ভীষণ ভুলের সময়। এই যে যখন তখন মন কেমন করে ওঠে, বুকের ভেতর কী জানি কী থম মেরে থাকে, গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কষ্ট, এই সময়টা ভীষণ খারাপ। তার এখন কত কত বিপদ! কী না কী অসুখ হয়েছে, ঘরভর্তি নানান অশান্তি, সামনে আরো কত ঝড় ঝঞ্ঝা অপেক্ষা করছে, কে জানে? এই সময়টা এইসব অনুভূতি, কষ্ট, কান্নাকে প্রশ্রয় দেয়ার সময় নয়। তাকে বড় হতে হবে, অনেক বড়। কত কত দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু এতকিছু ভেবেও অয়ন মুহূর্তের জন্যও নিজেকে স্থির করতে পারল না। এ ক’দিনের প্রাণান্ত চেষ্টায় নিজেক যতটুকু স্থির করতে পেরেছিল অয়ন, আজ এই মুহূর্তটুকু কী অবলীলায়ই না তাকে তার চেয়ে শতগুণ এলোমেলো করে দিলো। চোখের মতো শান্ত নদী যেমন হঠাৎ ঝড়ে উন্মাতাল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমন।
অয়ন বলল, হুম, করে।
কাকে? আমায় বলবি?
বলব।
বল?
এখন না। যেদিন দেখা হবে, তুই যেদিন বলবি, সেদিন।
নুহা হাসলো, আমি বললে তারপর বলবি, তাই না?
অয়নও হাসলো, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় নুহা।
কেন? আমায় মিস করিস?
নাহ্, আমি আমাকেই মিস করি।
কী কথা! নিজেকে কি কেউ মিস করে?
হ্যাঁ করে।
কীভাবে?
যখন কোনো কারণে নিজেকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হয় সে অন্য কারো কাছে রয়ে গেছে।
তুই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিস না?
অয়ন কথা বলল না। নুহাই আবার বলল, দেখিস, আবার পুরোপুরি নিখোঁজ হয়ে যাস না, একবার হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া কিন্তু খুব কঠিন।
এইজন্যই হারিয়ে যেতে দিতে নেই, সেদিন একটা কবিতার লাইন পড়লাম, কোথায় যাবে, তোমার মানুষ রেখে? মানুষ কেন হারিয়ে গেলে শেষে, মানুষ পাওয়া শেখে?
বাহ্, সুন্দর তো!
অয়ন হাসলো, হ্যাঁ সুন্দর। হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমরা নিজের মানুষটাকে চিনতে পারি না।
নুহার কী যেন হলো, সে ভীষণ আনমনা হয়ে গেল। তারপর বলল, আজ রাখি অয়ন। এসেই দেখা হচ্ছে।
.
শুক্রবার অনুর অফিস নেই। আকাশ কিছুটা মেঘলা। সে মেঘলা দুপুরে অয়নকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ঢুকতেই হাতের ডান দিকে স্বচ্ছ জলের লেক। ফুরফুরে হাওয়া বইছে, সেই হাওয়ায় লেকের জলে মৃদু অথচ শরীর ঝলমল করা ঢেউ। অয়ন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জলের উপর ঝুলে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের দিকে, এই ফুলের নাম কী আপু?
হিজল।
হিজল?
হু, হিজল। সুন্দর না নামটা?
হ্যাঁ, সুন্দর। কিন্তু…।
কিন্তু কী?
খেয়াল করেছিস, নামের মধ্যেও জল আছে? হিজল।
অনু কিছুক্ষণ চুপ করে হিজল ফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, জলের কাছে থাকে বলেই হয়তো এই নাম।
অয়ন হাসলো, ফুলটা কিন্তু সুন্দর, তাই না আপু?
হ্যাঁ, আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল।
এই ফুল তোর প্রিয় কেন আপু? এই ফুল তো সচরাচর দেখাও যায় না। তাছাড়া সবার তো অন্য সব ফুল প্রিয় হয়। গোলাপ, রজনীগন্ধা এইসব।
তা তো জানি না, তোর কী ফুল প্রিয়?
অয়ন খানিক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল, এটা তো কখনো ভাবিনি আপু?
তার মানে তোর কোনো প্রিয় ফুল নেই?
আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আলাদা করে কখনো তো ভাবিনি।
এই বিষয়টি অনুর মনে গেঁথে রইল। এমনকি হয় না যে-কোনো কোনো মানুষ আমাদের খুব প্রিয়। খুব আলগোছে, অগোচরে সে আমাদের বুকের ভেতর গেঁথে রয়। কিন্তু আমরা কখনোই তাকে টের পাই না। বুঝতে পারি না। হয় এমন? তার নিজেরও কী এমন কেউ রয়েছে?
অনুর আগে মাঝেমধ্যে মাহফুজের কথা মনে পড়ত। কিন্তু আজকাল বহুদিন আর মনে পড়ে না। না-কি পড়ে, কিন্তু সে টের পায় না বা ইচ্ছে করেই পেতে চায় না? মাহফুজের সাথে তার কলেজে পরিচয়। অয়নের মতোই অনুর সামনেও তখন এইচএসসি পরীক্ষা। মাহফুজ তার বান্ধবী লতার ভাই। সে। তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। প্রায়ই কলেজ শেষে লতাকে নিতে আসতো সে। দেখতে তেমন সুদর্শন না হলেও কী সুন্দর করে যে হাসতো মাহফুজ! কথায় কথায় বাচ্চাদের মতো হেসে গড়িয়ে পড়ত। সেই মাহফুজের সাথে নিজের অজান্তেই একটা সম্পর্ক হয়ে গেল অনুর। কী নাম সেই সম্পর্কের? ভালোবাসা? প্রেম? বন্ধুত্ব? না-কি অন্য কিছু?
মাহফুজের সাথে অনুর সম্পর্কটা আসলেই অদ্ভুত! অনু সেই তখন থেকেই জানতো, তার জীবনটা আর আট দশটা সাধারণ মেয়ের মতো নয়। তার মাথার ওপর পাহাড় সমান বোঝা। তাকে কোনো ভুল করলে চলবে না। ওই বয়সের যে তরল আবেগ, তাতে ভেসে গেলে চলবে না। সে তাই নিজের পায়ের তলায় যেন একখানা ভারি পাথর রেখে তাতে শক্ত করে নিজেকে বেঁধে রেখেছিল। যেন সে ভুল করেও কখনো উড়ে যেতে গেলে, বা ভেসে যেতে গেলে ওই পাথরে টান লেগে আবার ফিরে আসতে পারে।
মাহফুজ একদিন অনুকে বলল, লতার সাথে তোমার পার্থক্য কী জানো?
অনু বলেছিল, হুম, জানি।
মাহফুজ কিছুটা অবাক হয়ে বলেছিল, কী?
লতা চুল খুলে রাখে আর আমি বেঁধে।
মাহফুজ হেসে ফেলল, এটা কিছু হলো?
কেন হবে না? আপনিই তো পার্থক্যের কথা বললেন। এটা কি পার্থক্য নয়?
নিশ্চয়ই পার্থক্য। কিন্তু আমি এই পার্থক্যের কথা বলিনি। আরো গুরুতর কোনো পার্থক্যের কথা বলছিলাম।
আপনার ধারণা, এটা কোনো গুরুতর পার্থক্য নয়?
এটা গুরুতর পার্থক্য হলো কী করে?
অনু হাসলো, জবাব দিলো না। মাহফুজ বলল, বলবে না?
আজ না, অন্য কোনো দিন।
আচ্ছা, তাহলে আমি কী পার্থক্যের কথা বলেছি, সেটা শুনবে?
কী?
লতা আমার বোন, তুমি নও।
সে তো আরো কত মেয়েই আপনার বোন নয়।
কিন্তু সেই সব মেয়েদের বোন ভাবতে তো আমার কষ্ট হয় না।
আমাকে বোন ভাবতে কষ্ট হয়?
হুম, হয়।
তাহলে আর কি, খালাটালা কিছু একটা ভেবে ফেলেন।
অনু হাসলো। মাহফুজ চুপ করে রইল। অনু বলল, ভেতরে ভেতরে আমি মা-খালা টাইপই বুঝছেন? আমার কথা শুনে মনে হয় না, এই বয়সের কোনো মেয়ে এমন বড়দের মতো আঁতেল আঁতেল কথা বলে?
আমার তাতে সমস্যা নেই।
অনুর সাথে সেদিন আর কথা এগোয়নি মাহফুজের। তবে তাদের প্রায় রোজই দেখা হতো কলেজ শেষে। মাঝেমধ্যে লতা না আসলেও মাহফুজ ঠিক আসতো। সেদিন মাহফুজের সাথে খানিক হাঁটতে, রাস্তার পাশে বসে গল্প করতে অনুর বেশ লাগত!
অনুর সাহসও যেন একটু একটু বাড়ছিল। হয়তো ওই বয়সটাই এমন। সকল কিছু জেনে বুঝেও কী এক অমোঘ মোহে ভুল করাতেই আনন্দ! প্রবল ভয়, সংশয়, দ্বিধার মধ্যেও কোথায় যেন একটা চাপা আনন্দ, উত্তেজনা। অনেকটা নেশার মতো। এই নেশা কাটানোর কোনো উপায় ওই বয়সটার জানা নেই। এক মন কেমন করা বিকেলে টিউশন থেকে বের হয়ে অনু দেখলো মাহফুজ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার হাতে হিজল ফুলের মালা। অনুর সেদিন কী যে লজ্জা লাগছিল! মাহফুজ জোর করেই তাকে রিকশায় তুললো। তারপর বলল, ফুলটা খোঁপায় বাঁধবে?
অনু বলল, না।
কেন?
আমার এসব ভালো লাগে না।
ভালো লাগে না কেন? তোমার মাথাভর্তি চুল। কত বড় একটা খোঁপা, এমন কারো আছে?
নেই?
না, নেই।
আছে, কিন্তু আপনি দেখতে পান না।
দেখতে চাইও না। আচ্ছা, তুমি কিন্তু আমাকে এখনো বলেনি।
কী?
ওই যে সেই চুল বেঁধে রাখা আর ভোলা রাখার পার্থক্যটা?
অনু জবাব দেয়নি। মাহফুজ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে অনুর খোঁপা খুলে দিলো। তারা তখন মিরপুর বেড়িবাঁধের ওপর হুডতোলা রিকশায়। থইথই জলের বুকের ভেতর থেকে ভেসে আসা হুহু করা হাওয়ায় অনুর চুল উড়ছিল। মাহফুজ সেই চুলের ভেতর নাক ডুবিয়ে যেন শুষে নিতে থাকল জনম জনমের সুবাস। অনুর নিজেকে মনে হচ্ছিল পলকা তুলোর মতো, শুভ্র মেঘের মতো, যেন সেও ভেসে যাচ্ছে ঠিকানাবিহীন। এই ভেসে যাওয়া রোধ করার সাধ্য তার নেই। এ এক অপ্রতিরোধ্য, অবশ্যম্ভাবী যাত্রা। মাহফুজ একহাতে তাকে আগলে রাখল। অনুর মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তটুকু কখনোই শেষ না হোক। এ এক অন্তহীন অনুভূতি হয়ে বেঁচে থাক।
সেই রাতটা খুব অস্থিরতায় কাটলো অনুর। তার পরের কয়েকটা দিনও। বুকের ভেতর এক বেপরোয়া পাখির অবিরাম ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ। সেই শব্দ দ্বিধার, সংকোচের, অনিশ্চয়তার, ভয়ের আবার একই সাথে তীব্র ভালো লাগারও। কী করবে সে?
অনু নিজের সাথে বোঝাঁপড়ার জন্য সময় নিলো। মাহফুজের সাথে যোগাযোগটাও কমিয়ে দিলো অনেকটা। অবশ্য সামনে এইচএসসি পরীক্ষার অজুহাতটা তার যুক্তিসঙ্গতই ছিল! ফলে দীর্ঘ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। মাহফুজের ততদিনে চাতকপ্রায় অহর্নিশি অবস্থা। সেই সময়টাতে কী মাহফুজের জন্য অনুর কষ্ট হয়নি? একটুও না? অনু জানতো, সে তার ওই সময়কার অনুভূতির কথা কাউকে বলতে পারবে না, বোঝাতে পারবে না। মাহফুজকে তো নয়ই। মাহফুজের ধারণা, কষ্টটা কেবল তার একার হয়েছে। যেহেতু দূরত্বের সীমানাটা বেঁধে দিয়েছিল অনুই। কিন্তু সে কী কখনোই জানতো যে, রোজ রাতে একা একা কাঁদত অনু! কতবার যে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে মাহফুজের বুকের ভেতর গিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছে তার! কিন্তু অনু কী তা পারে? পারে না। তার চারপাশ জুড়ে অজস্র অদৃশ্য শৃঙ্খল। সে চাইলেই সেসব শৃঙ্খল রেখে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু জগতে সকলেই যদি পালাতে চায়, তবে রুখে দাঁড়াবে কে?
মাহফুজের মায়ের আচমকা ক্যান্সার ধরা পড়লো। ততদিনে মাস্টার্স শেষ হয়ে গেল মাহফুজের। ভালো চাকরিও পেয়ে গেল সে। এই সময়ে শুরু হলো তার বিয়ের জন্য তোড়জোড়। মেয়ে দেখা শুরু হয়ে গেল। অনুর তখন প্রবল জীবন যুদ্ধের সময়। স্কুলপড়ুয়া ছোট কিশোরী দুই বোন, ছোট ভাই, মা। তার ওপর নিজের পড়াশোনা। এ যেন এক হালহীন, পালহীন ডিঙ্গি নৌকায় অসীম, অথৈ সমুদ্রে অনিশ্চিত যাত্রা। মাহফুজ বিয়ের কথা বলতেই অনু দিশেহারা বোধ করতে লাগল। সে জানে তার কাছে কোনো উত্তরই নেই। না কিংবা হা, কোনোটাই না। কিন্তু একটা উত্তর তো তাকে দিতেই হবে! অনু অবশ্য ততদিনে বুঝে গিয়েছিল, খুব স্বাভাবিক একটা বিয়ে তার জন্য কঠিন। এর আগেও যে তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসেনি তা নয়। কিন্তু শেষ অব্দি কেউই আর শ্বশুরবাড়ির বোঝা বয়ে বেড়ানোর দায়িত্ব নিতে চায় না। শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক, আর্থিক সুবিধা, ঘর গোছানোর বায়না, বউয়ের গয়না কিংবা নিদেনপক্ষে উপহারস্বরূপ বড় কিছুর চাহিদা না হয় মহত্ত্ব বা উদারতা দেখিয়ে ছেড়ে দেয়া যায়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির দায় বয়ে নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এটি যেমন সম্মানজনক কিছু নয়, তেমনি লাভজনক কিছুও না।
মাহফুজ সব শুনে বলেছিল, আমি মা-বাবাকে রাজি করাবো।
অনু জানতো, তাকে মেনে নেয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু তার পরিবার, এতগুলো ভাই-বোনের দায়-দায়িত্ব কেউ মেনে নেবে না। সে ম্লান হেসে বলেছিল, শুধু শুধু চাপ নিও না।
তুমি দেখো, আমি রাজি করিয়েই ফেলব। মাহফুজ একগুঁয়ের মতো বলল।
অনু শান্ত গলায় বলল, তুমি না হয় রাজি করাবে। কিন্তু তোমাকে কে রাজি করাবে?
অনুর কথায় মাহফুজ থমকে যাওয়া গলায় বলল, মানে?
মানে আজ এই মুহূর্তে তোমার মনে হচ্ছে, তুমি আমার জন্য সবকিছু করতে পারো। কিন্তু এই মনে হওয়াটা তোমার বেশিদিন থাকবে না।
তুমি জানো না অনু, থাকবে। অবশ্যই থাকবে।
অনু আগের চেয়েও শান্ত গলায়, ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, থাকবে না। আমি জানি।
মাহফুজ অনুকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলো। কাঁদলোও হাউমাউ করে। কিন্তু অনুকে টলানো গেল না। সন্ধ্যার ম্লান হয়ে আসা আলোয় অনু আলতো করে হাত রাখলো মাহফুজের গালে। তারপর বলল, এই যে আমার জন্য এমন করে কাঁদছ। এই যে আমাকে এমন করে চাইছ। আমি চাই এই কান্নাটা সারা জীবন থাকুক, এই চাওয়াটাও।
মাহফুজ ভেজা চোখ মেলে তাকালো। সে বিভ্রান্ত বোধ করছে। অনু বলল, পেয়ে গেলে চাওয়াটা আর থাকে না। কে জানে, হয়তো পাওয়াটাও না। আমার কী মনে হয় জানো?
কী?
পুরোপুরি পেয়ে যাওয়া মানে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলা।
মাহফুজ আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
অনু বলল, এই যে তোমাকে এত পেতে ইচ্ছে করে, এর চেয়ে তীব্র কিছু আর নেই এ জগতে। কিন্তু জানো কি, পেয়ে যাওয়ার পর পেতে চাওয়ার এই তীব্র ইচ্ছাটা আর থাকে না। তোমারও থাকবে না। আজকের এই মুহূর্তটাকে তখন মনে হবে জীবনের সবচেয়ে যুক্তিহীন, সবচেয়ে ভুল একটি মুহূর্ত। এই তীব্র চাওয়ার অনুভূতিগুলো তখন ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকবে। মরে যেতে যেতে একসময় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন সবকিছু কেবল অভ্যাস হয়ে থাকে, অনুভূতি না।
অনু একটু থামলো। তারপর আবার বলল, আমি চাই না তুমি আমার অভ্যাস হয়ে যাও, আমি চাই তুমি আমার অনুভূতি হয়েই থাকো।
তখন সূর্যের শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে যাচ্ছিল দিগন্তে। সেই আভাটুকুর দিকে তাকিয়ে অনুর যেন মনে হলো সে তার বুকের বা দিকটার ভার বহন করতে পারছে না।
আচ্ছা, মাহফুজ কি সত্যি সত্যিই রয়ে গেছে? কিন্তু অনুর তো মাহফুজকে মনে পড়ে না। অথচ সে-ই তো বলেছিল, যা পাওয়া হয় না, বরং তা-ই চিরকাল রয়ে যায়। মাহফুজকে তো তার পাওয়া হয়নি। কিন্তু সে কী আসলেই কোথাও রয়ে গেছে? না-কি যাবজ্জীবন নির্বাসন হয়ে গেছে হৃদয়ের? এই যে কত কত মানুষ চেনা হয় না, জানা হয় না, তাতে তো হৃদয়ের কোনো দোষ হয় না। কিন্তু কোনো একজনকে ভুলে থাকলে, না চিনলে যাবজ্জীবন নির্বাসন হয়ে যায় হৃদয়ের, কী অদ্ভুত!
অনু অয়নের হাত ধরে দীর্ঘসময় হাঁটলো। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, অয়নের অসুখ, তার নিজের জীবন, চারপাশের অসংখ্য সংকট, সব ছাপিয়েও এই পুরোটা সময় অনুর মাথায় গেঁথে রইল ওই এক প্রশ্নই। মাহফুজ কি তাহলে সত্যি সত্যিই কোথাও রয়ে গেছে, তার বুকের ভেতর? অবচেতনে, অজান্তে, অভিমানে? অয়নের বুঝতে না পারা প্রিয় কোনো ফুলের মতো, প্রিয় কোনো স্পর্শ বা অনুভূতির মতো? কে জানে, হয়তো কোনো তুমুল মন খারাপের দিনে, দুঃসহ মুহূর্তে সে প্রগাঢ় মমতায় চোখের পাতায়, বুকের ভেতর অনুভূতির, স্মৃতির আলতো স্পর্শ রেখে ফিসফিস করে বলে যাবে, আমি আছি, আমি আছি। তুমি একা নও।
*
দুপুর পড়ে যেতে বোটানিকাল গার্ডেন থেকে বের হয়ে এলো অনু আর অয়ন। অয়ন বলল, এখন কি করবি আপু?
বাসায় চলে যাবি?
তোর ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছা কেন? আমি তো তোর জন্যই ঘুরতে এলাম।
ইশ! আমি কি বলেছি না-কি যে আমার বোটানিকাল গার্ডেন যেতে খুব ইচ্ছে করছে?
না, তা বলিসনি। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো, তোর ভালো লাগবে।
এটা ভালো লাগার মতো কোনো জায়গা হলো?
কি জানি! আমার তো খুব ভালো লাগল।
সত্যি কথা কী জানিস? আসার আগে আমার মনে হয়নি যে ভালো লাগবে। কিন্তু আসার পর ভালো লেগে গেছে।
সত্যি সত্যি বলছিস তো? না-কি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?
তোকে খুশি করে আমার কি লাভ?
তাও একটা কথা।
অনু আর অয়ন কিছুক্ষণ পার্কের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। অনু ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কী করবে! অয়নকে একদম সময় দিতে পারছে না সে। অথচ সে খুব করে চাইছে, আরো কিছুটা বেশি সময় অয়নের কাছে কাছে থাকতে। যতটা সম্ভব আরো কিছুটা আনন্দময় সময় তাকে উপহার দিতে, কিন্তু পারছে কই?
একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, অয়নের পরিণতিটা যেন সবাই কোনো না কোনোভাবে মেনেই নিয়েছে। না নিয়ে উপায়ও বা কী? জগতে জন্ম আর মৃত্যুর চেয়ে বড় অসহায়ত্ব আর মানুষের কী আছে! তবে মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা আসলেই বিস্ময়কর। যে-কোনো পরিস্থিতিতেই সে শেষ অব্দি খাপ খাইয়ে নেয়। কত সহজে মানুষ তার প্রিয়তম মানুষের মৃত্যুকে মেনে নেয়। দিন কয়েকের কান্না, মন খারাপ, কষ্ট ভুলে আবার রোজকার কাজ, আড্ডা, নতুন নতুন স্বপ্নে ডুবে যায় সে। আসলে এমন না হলে মানুষ বেঁচে থাকতেও পারত না। মানুষের বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় শক্তি কী তাহলে মৃত্যু কিংবা স্মৃতি ভুলে থাকার ক্ষমতা?
.
অয়নকে নিয়ে বাড়িতে আজকাল খুব একটা কথাবার্তাও হয় না কারো মধ্যে। কিন্তু সবাইই জানে, তাদের সকলের মাথার ভেতর, বুকের ভেতর ক্রমাগত বয়ে যাচ্ছে তীব্র যন্ত্রণার সকরুণ এক নদী। সেই নদীর ঢেউয়ের শব্দ, পাড় ভাঙার শব্দ তারা যতটা পারছে পরস্পরের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে। আর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেদের প্রস্তুত করে চলেছে এক অনিবার্য অসহায়ত্ব মেনে নিতে।
অনু হঠাৎ বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয় অয়ন?
কি কাজ?
চল, আমরা ভালো কোথাও খেতে যাই।
কোথায়?
ধর সেদিনকার মতো কোনো ছাদখোলা রেস্টুরেন্টে?
আবার যদি বৃষ্টি নামে?
ধুর বোকা, রোজ রোজ বৃষ্টি হয় না-কি?
তাও ঠিক, আচ্ছা চল।
আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়?
অয়ন এবার আর প্রশ্ন করলো না। সে মাথা তুলে তাকালো। অনু ঝলমলে মুখে বলল, ধর, নুহাকে একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?
নুহাকে? অয়ন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়েও সতর্ক হয়ে গেল। বড়পু কি তাকে নিয়ে আবারও কোনো মজা করবে?
হুম, ধর নুহার বাসার সামনে গিয়ে তুই ওকে ফোন দিলি। তারপর আমরা তিনজন মিলে খেতে চলে গেলাম।
অয়ন বেশ কিছুক্ষণ অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বোঝার চেষ্টা করছে অনুর উদ্দেশ্য। কিন্তু তেমন কিছুই না পেয়ে আরো বিভ্রান্ত হয়ে গেল যেন। অনু বলল, আইডিয়াটা কেমন?
অয়ন বলল, নুহা ঢাকায় নেই আপু।
কই গেছে?
ওর নানু বাড়ি।
নানু বাড়ি কই?
কুমিল্লা।
চল, ওর নানুবাড়ির ঠিকানা বের করে চলে যাই।
অয়ন হাসলো। অনু রিকশা নিলো। রিকশায় উঠতে উঠতে অয়নের হঠাৎ মনে হলো, অনু আপু যা করছে তা কি স্বাভাবিক? সে কি আগেও তার সাথে এমন করতো? না-কি বড়’পু আলাদা করেই তার মন ভালো করতে চাইছে? কিন্তু তার মন তো খারাপ না, আর খারাপ হলেই কি? এসব খেয়াল করার সময় কী বড়পুর আছে? আগে তো কখনো ছিল না। এইসব নানা কিছু অয়নের বুকের ভেতর কোথায় যেন অস্বস্তির কাঁটা হয়ে খোঁচাতে লাগল।
অয়ন বলল, রেগে যাবি না তো আপু, একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম?
রাগবো কেন, বল?
আমার কি হয়েছে বলবি?
তোর আবার কি হবে?
তুই আমার কাছে লুকাস না আপু, আমি কিন্তু জানি।
অনু চট করে অয়নের মুখের দিকে মুখ ফেরালো, তুই কি জানিস?
বড় চাচি বলেছিল, আমার কী বড় অসুখ না-কি হয়েছে, আর তা নিয়ে মা ফোনে কাঁদছিল।
মায়েদের কাছে সন্তানের সব অসুখই বড় অসুখ অয়ন। আর তুই তো মায়ের আরো বেশি আগ্লাদের। তিন মেয়ের পর একটামাত্র ছেলে। বুঝতেই পারছিস। ছোটবেলায় একবার তোর আঙুল কেটে গেল। এই এতটুকু নখের সমান কাটা। সেই নিয়ে সারা বাড়িতে কী হুলস্থুল! মা চিৎকার করে রাজ্যের লোক জড় করে ফেলেছিল। মায়ের কান্না শুনে সবাই ভেবেছিল তোর আস্ত হাতখানাই বুঝি কেটে পড়ে গেছে!
তারপর?
তারপর আর কি? তোর সেই ওই সামান্য আঙুল কাটার জন্য তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হলো। ডাক্তার তো দেখে হেসেই গড়াগড়ি।
অয়ন খানিক চুপ করে রইল, তারপর কী ভেবে আবার সেই একই কথা বলল, আমার যদি তেমন বড় কোনো অসুখই হয়ে থাকে, তবে সেটা আমাকে বলে দিলেই কি ভালো না আপু? তাহলে ধর চিকিৎসাগুলো কী কী, কখন, কোথায় করাতে হবে, এসবই আমি জানতে পারতাম। কত টাকা লাগবে তাও। সামনে আমার পরীক্ষা। এখন থেকেই যদি বিষয়গুলো আমি স্পষ্ট করে জানতে পারতাম, তাহলে প্রস্তুতির জন্য ভালো হতো। পরীক্ষারও প্রস্তুতি, ট্রিটমেন্টেরও। ধর, ইমার্জেন্সি হলে এখনই টিচারস, ফ্রেন্ডস, সিনিয়রদের ইনফর্ম করা দরকার তাই না? পরীক্ষা আরো কাছে চলে এলে কিন্তু ফান্ড কালেকশন নিয়েও ঝামেলা হবে আপু।
তেমন কিছু হলে তো আমিই বলতাম।
সে জন্যই আমার অবাক লাগছে, তোরা কেউই আমাকে কিছু বলিস না। কেমন একটা লুকিয়ে রাখার মতো ব্যাপার। কিন্তু আমি তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।
কি বুঝতে পারিস?
এই যে, আমার কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তোরা কেউই তা আমাকে জানাতে চাস না।
আর কী কী বুঝিস?
আর কী কী বুঝি মানে?
তোকে যে আমরা সবাই পাগলের মতো ভালোবাসি এটা বুঝিস?
অয়ন এই কথার জবাব দিলো না, চুপ করে রইল। অনুর ইচ্ছে করছিল দু’হাতে অয়নকে বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে। তার বুকের ভেতর মেঘ জমে জমে কালো অন্ধকার হয়ে যাওয়া যে আকাশ মুখ ভার করে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে, সেই আকাশটাকে ভাসিয়ে দিতে। অনু অবশ্য তার কিছুই করলো না। সে বসে রইল চুপচাপ। তারপর কিছুক্ষণ আগের ইচ্ছেটা তার আচমকা মরে গেল। সে রিকশাওয়ালাকে ডেকে রিকশা ঘুরিয়ে নিতে বলল। আজ আর তার অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে বরং সে বাসায় গিয়ে অয়নকে পাশে নিয়ে খানিক বসে থাকবে।
.
বাসায় ঢোকার গলিটার কিছু আগে শামীমের সাথে দেখা হয়ে গেল অনুর। শামীমের কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। সিরিয়াস টাইপ কবি-সাহিত্যিকরা এই ধরনের ঝোলা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনুকে দেখে সে রিকশার সামনে এসে দাঁড়ালো। অনু রিকশা থেকে নামতেই সালাম দিয়ে বলল, ভাগ্য ভালো, আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল আপু।
অনু বলল, ভাগ্য ভালোর কী হলো শামীম? আমরা তো একই বাসায়ই থাকি!
না মানে আপনি এত ব্যস্ত থাকেন যে বাসায় তো দেখাই হয় না। আমি যখন থাকি, তখন আপনি থাকেন না। আপনি যখন থাকেন, তখন আমি থাকি না। একই বাসায় থাকি, অথচ দু’জনের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। একটু যে প্ল্যান পরিকল্পনা করব, নিজের আইডিয়া শেয়ার করব সেই উপায়ও নেই।
বাসায় যাবে এখন?
না আপু। অয়ন বোধহয় বলেছে, একটা বিজনেস প্ল্যান নিয়ে খুব খাটছি। দেখি আল্লাহ যদি এবার মুখের দিকে ফিরে তাকায়।
বইয়ের বিজনেস?
জি আপু।
ভেবে-চিন্তে করছ তো শামীম?
শামীম অসহায় ভঙ্গিতে বলল, কী করব আপু? কম তো ভাবনা-চিন্তা করলাম না! তাছাড়া এর চেয়ে কম পুঁজিতে এর চেয়ে ভালো বিজনেস আর নেই আপু। এখন অন্যদের ব্যবসার অবস্থা বিবেচনায় নিলে হয়তো ভুলই করছি। কিন্তু আপু, আমার মনে হয় ব্যবসাটা আসলে নিজের কাছে।
তাহলে আর কী! তুমি যখন সব বুঝে শুনেই নামছ, তখন আমার আর কী বলার আছে?
শামীম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে আপু। ওই কথাটার জন্যই আসলে আমি আপনাকে খুঁজছিলাম।
কী কথা শামীম?
না মানে, আপনি তো সবই জানেন। তনু মনে হয় বলেছেও আপনাকে। আমার বলতে খুব লজ্জা করছে আপু। এই লজ্জাতেই এতদিনেও সামনে আসতে পারছি না। কিন্তু অনেক ভেবে দেখলাম, আপনি আমার আপন বোনের মতো। আমার নিজের বড় বোন থাকলে তার কাছে বলতাম না? বোনের কাছে। আবার লজ্জা কী?
অনু বুঝতে পারছে শামীম কী বলবে। এমন সহজ সরল সাদাসিধে চেহারার আড়ালেও যে এমন একটা মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে, তা শামীমকে না দেখলে সে হয়তো বুঝতেই পারত না।
শামীম বলল, বিজনেসটা বলতে গেলে একদম বিনা পুঁজিতেই শুরু করছি আপু। বেশিরভাগ পুঁজি আমার বন্ধুরাই দিবে। তারা বলেছেও যে আমার কিছু না দিলেও হবে। কিন্তু তাও আপু, চোখের লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। ওরা হয়তো কিছুই বলবে না। তাও খুব ছোট হয়ে যাচ্ছি সবার কাছে। নিজে কিছু টাকা দিতে না পারলে নিজের অধিকারটা ঠিক খাটানো যায় না আপু। বুঝতেই পারছেন, আসলে…।
শামীমের কথা শেষ হবার আগেই অনু বলল, এসব আলোচনা রাস্তায় কেন শামীম? বাসায় চলো, বাসায় বসে কথা বলি?
শামীম লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি খুবই সরি আপু। কিন্তু আপু হয়েছে কী আমাকে এখনই জরুরি একটা কাজে বেরুতে হবে। আর কখন ফিরব জানি না। তাই অভদ্রের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়েই এইসব বললাম।
অনু বলল, না না ঠিক আছে। তুমি তাহলে কাজ সেরে আসো? পরে বাসায় বসে কথা বলি?
শামীম একান্ত বাধ্যগত কিশোরের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো। তারপর কিছুটা দূর গিয়ে আবার ফেরত আসলো। তারপর মাথা চুলকে বিগলিত গলায় বলল, কীভাবে যে বলি আপু, আপনার কাছে শ’দুয়েক টাকা হবে?
অনু ব্যাগ খুলে একটা পাঁচ’শ টাকার নোট বের করলো। শামীম টাকাটা নিতে নিতে বলল, অবশ্য অয়ন গিয়ে যদি বাসা থেকে একটু মানিব্যাগটা এনে দিতে পারত, তাহলে আর এটা লাগত না আপু।
অনু বলল, না না, সমস্যা নেই। তুমি যাও।
শামীম চলে যেতে গিয়েও আবার ফিরে তাকালো। তারপর বলল, রাতেই ফেরত দিয়ে দিবো আপু।
.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। বাসার গেটের কাছে এসে রিকশা থেকে নামতে নামতেই কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হলো অনুর। রিকশার ভাড়া মেটানো, দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠা, বাইরের পোশাক ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়া, এই পুরোটা সময় ধরেই সেই অস্বস্তিটা আঁকড়ে ধরে রইল তাকে। অয়নের সাথে অনেক রাত পর্যন্ত এটা-ওটা গল্প করলো অনু। কিন্তু সেই গল্পটা জুড়েও কোথাও যেন অস্বস্তির অনুভূতিটা থেকেই গেল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আলমারি থেকে অয়নের রিপোর্টগুলো আবার বের করে নেড়েচেড়ে দেখলো অনু। কিন্তু বুঝতে পারল না তেমন কিছুই। তার কেন যেন মনে হলো, এই রিপোর্টগুলোর কোথাও কোনো ভুল আছে। অন্য কোথাও, অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে সে আরো একবার নিয়ে যেতে চায় অয়নকে।
সেই রাতে অয়নকে নিয়ে কী সুন্দর একটা স্বপ্ন যে অনু দেখলো! বিশাল একটা মাঠ। মাঠভর্তি অসংখ্য ছোট ছোট শিশু ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদের মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার রঙিন বেলুন। কিছু কিছু বেলুন উড়ে যাচ্ছে অনেক উঁচুতে। কিছু কিছু বেলুন আরো খানিক নিচ দিয়ে। কিছু আবার একদম হাতের নাগালে। রং-বেরঙের বেলুনে ছেয়ে যাওয়া আকাশটিকে স্বপ্নের মতোই লাগছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই অসংখ্য শিশুর মধ্যে অয়নও রয়েছে। কোকড়া চুলের ছোট্ট ফুটফুটে অয়ন। সে হঠাৎ খেলা ছেড়ে দৌড়ে অনুর দিকে ছুটে আসলো। তার মুখ ভার। চোখ টলমল করছে জলে। অনু হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে অয়নের ফোলা ফোলা গালগুলো চেপে ধরে বলল, কী হয়েছে অয়ন সোনার? মন খারাপ?
অয়ন মুখে জবাব দিলো না। তবে উপর নিচ করে মাথা ঝাঁকালো। তার ঠোঁট জোড়া ফুলে ফুলে উঠছে। অনু অয়নের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কেউ বকেছে?
ছোট্ট অয়ন আবারো মাথা ঝাঁকালো। এবার বা থেকে ডানে। অনু বলল, তাহলে? মেরেছে কেউ?
অয়ন আবারো ডানে বায়ে মাথা ঝাঁকালো। অনু বলল, তাহলে?
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো। তারপর আঙুল তুলে দেখালো, তার ঠিক মাথার ওপর, অনেক উঁচুতে বিশাল একটা বেলুন উড়ে যাচ্ছে। অনু অয়নকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল, অয়ন সোনার ওই বেলুনটা চাই?
অয়ন এবার ওপর নিচ মাথা নাড়লো। অনু বলল, অয়ন সোনা ডাকলেই কিন্তু বেলুনটা তার কাছে চলে আসবে। অয়ন কী তাকে ডাকবে?
অয়ন খানিক মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীরে আকাশের দিকে মুখ তুলে স্পষ্ট আদুরে গলায় ডাকলো, আসো, আসো, আসো।
অয়ন অবাক হয়ে দেখলো বেলুনটা ধীরে ধীরে নেমে আসছে। অনু তাকিয়ে আছে অয়নের মুখের দিকে। অয়নের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বুঝি স্বর্গ নেমে আসছে।
.
অনুর ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে। এত ভোরে মা ছাড়া সাধারণত আর কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। অনু দ্রুত রেডি হয়ে অয়নের রিপোর্টগুলো ব্যাগে ঢোকালো। অফিসের আগে আজ একবার পিজি হাসপাতালে যাবে সে। সেখানে পরিচিত এক বড় আপু আছে। তার সাথে অয়নের বিষয়ে আরো একবার কথা বলতে চায় অনু। তবে এই সময়টায় রাস্তায় যে জ্যাম থাকে, তাতে মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ হয়ে গুলশানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নির্ঘাত অফিসে দেরি হয়ে যাবে তার। অনু অবশ্য সব বুঝেশুনেই বের হচ্ছে। যা হয় হবে, আজ আরো একবার অয়নের রিপোর্টগুলো দেখিয়েই নিতে চায় সে।
কাঁধের ব্যাগ আর অয়নের রিপোর্টগুলো নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই থমকে গেল অনু। ড্রইংরুমে অয়নের মাথার কাছে বসে আছেন মা। নিচে মেঝেতে জায়নামাজ পাতা। জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের মৃদু আলো আসছে। সেই আলোয় কেমন অন্যরকম একটা দৃশ্য চোখের সামনে। নামাজের সাদা কাপড় পরা সালমা বেগম বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে অয়নের মাথায়, বুকে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছেন। অয়ন ঘুমিয়ে আছে শান্ত, সমাহিত, নিঃস্পন্দন। অনুর বুকের ভেতরটা আচমকা ধ্বক করে উঠল। অয়নের দিকে ছুটে যেতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো অনু। অয়ন ঘুমিয়ে আছে, খুব শান্ত ভঙ্গিতে ধীরে অয়নের বুক ওঠানামা করছে। অনু সামান্য দাঁড়িয়ে থেকে আবার হেঁটে মূল দরজায় কাছে গেল। পায়ে জুতা গলিয়ে দরজা খুলতে যাবে, এই সময়ে সালমা। বেগম ডাকলেন, অনু, একটু শোনতো মা।
অনু জুতো পায়েই দু’কদম এগিয়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। সালমা বেগম টেবিলের উপর থেকে একটা পত্রিকা তুলে নিয়ে অনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। অনু চোখেমুখে রাজ্যের প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটিয়ে পত্রিকাটা নিলো। কিন্তু সে বুঝতে পারল না, এই পত্রিকা দিয়ে সে কী করবে? তাছাড়া এ বাড়িতে পত্রিকাও রাখা হয় না। এত সকালে আজকের পত্রিকাই বা মা কই পেল? পত্রিকা জুড়ে নানান খবর। সেইসব খবরের কোনটি মা তাকে দেখতে বলছে? মাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে অনু থমকে গেল। তার চোখ আটকে গেছে নিচের দিকের চার আর পাঁচ নম্বর কলামে। সেখানে একটি সংবাদ, সাবেক ছাত্রনেতা জায়েদ মল্লিক খুন।
খবরটা দেখে বুঝতে খানিক সময় লাগল অনুর। সে কেমন একটা ঘোরগ্রস্ত ভঙ্গিতে মায়ের পাশে বসলো। তারপর সময় নিয়ে খবরটা পড়লো, সাবেক ছাত্রনেতা জায়েদ মল্লিকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত মঙ্গলবার থেকেই নিখোঁজ ছিলেন সাবেক এই ছাত্রনেতা। পুলিশের কাছে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সন্ধ্যায় তার লাশ উদ্ধার করা হয় রায়েরবাজার বদ্ধভূমির পেছনে বসিলার একটি পরিত্যক্ত জলাশয় থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, নিখোঁজ হবার দিনই খুন করা হয় তাকে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা জায়েদকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু কে বা কারা এই খুনের সাথে যুক্ত থাকতে পারে, সে বিষয়ে পরিবার বা পুলিশের তরফ থেকে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে বিরোধীদলের ধারণা রাজনৈতিকভাবে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই বর্তমান সরকারের মদদে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং বিচারের দাবিতে তারা আগামীকাল ঢাকা শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ ও অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করেছে। যদিও ক্ষমতাসীন দলের তরফে তাদের মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, জায়েদ মল্লিক ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাতে সে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছে।
খবরটা পড়া শেষ হলেও অনু উঠল না। সে স্থির, স্তব্ধ বসে রইল। এই ঘটনায় কী তার খুশি হওয়া উচিত? অনুর জীবনের ভয়াবহ নারকীয় এক অভিজ্ঞতার নাম এই জায়েদ মল্লিক। সেক্ষেত্রে জায়েদের এমন মৃত্যুতে তার খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু কেন যেন অনু খুশি হতে পারল না। বরং তার ভয় করছে, তীব্র ভয়। সে সংবাদটা আরো বার দুই পড়লো। তারপর মাকে বলল, এই পত্রিকা তুমি কই পেয়েছ?
শামীম আনলো।
শামীম! ও কখন এসেছে?
এই তো, কিছুক্ষণ আগে। আমি নামাজ শেষ করে কোরআন শরিফ পড়ছিলাম, এই সময়েই কলিংবেল বাজলো।
পত্রিকাটা শামীম তোমাকে দিল?
না, ও দেয়নি। ঘরে ঢুকে হাতের ব্যাগ আর পত্রিকাটা টেবিলের ওপর রেখে জুতা খুলছিল। আমি কী মনে করে নিলাম।
অনু আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সালমা বেগম বললেন, আমার খুব ভয় করছে অনু।
অনু কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তারপর সালমা বেগমের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ভয় পেয়ো না মা। নতুন করে আমাদের আর ভয়ের কী আছে বলো? অনুর কণ্ঠজুড়ে আড়ষ্টতা।
সালমা বেগম আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই অনু বলল, আমি যাচ্ছি, দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিও। আর পরিচিত কেউ না হলে দরজা খুলো না। অয়নেরও আজ বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।
অনু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে নামলো। কলাপসিবল গেট খুলে সে যখন বাড়ির বাইরে এলো, তখনো রাস্তাটা ভীষণ ফাঁকা। কিছু কাক এখানে সেখানে ছোটাছুটি করছে। কা কা শব্দে চিড়ে দিচ্ছে ভোরের নৈঃশব্দ্য। অনু রাস্তা ধরে সামনে হেঁটে যেতে গিয়েও কেন যেন থেমে দাঁড়ালো। তারপর আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দোতলার সেই জানালাটার দিকে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, জানালাটা আজ খোলা নেই। বছরের পর বছর অতন্দ্র প্রহরীর মতো সারাক্ষণ খোলা থাকা সেই জানালাটা আজ বন্ধ! অনু স্থির চোখে দীর্ঘসময় জানালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হলো, গতকাল সন্ধ্যায় রিকশা থেকে নামার পর থেকে যে তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতিটা তার হচ্ছিল, আজ ঠিক এই মুহূর্তে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতির কারণটা সে স্পষ্ট ধরতে পেরেছে। সম্ভবত শেষ কয়েকদিন ধরে জানালাটা এমন বন্ধই ছিল। কিন্তু কোনো কারণে অনু তা খেয়াল করেনি। অবশ্য পারতপক্ষে কখনো ওই জানালাটার দিকে তাকায়ও না অনু। তবে গতকাল সন্ধ্যায় বাড়িতে ঢোকার মুখে এই হঠাৎ বন্ধ জানালাটার কারণে অবচেতনেই হয়তো একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিজের ভেতরে বয়ে বেড়াচ্ছিল অনু। অনু আরো কিছুটা সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওই জানালাটার ওপাশে এই মুহূর্তে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কোনো লাল টকটকে চোখ কিংবা সিগারেটের ধোঁয়াও নেই। জানালাটা শূন্য। কিন্তু তারপরও সেই শূন্য জানালাটা দেখেই অনুর ঘাড়ের কাছটা কেমন শিরশির করে উঠল।
*
কয়েকটা দিন অয়নকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হলো অনুর। আরো একদফা ডাক্তার দেখানো হলো তাকে। এবার দেখলেন পিজির হেমাটোলজি অ্যান্ড ওনকোলজি বিভাগের নামকরা এক ডাক্তার। নতুন করে আবারো একগাদা টেস্ট দিলেন তিনি। কিন্তু তাতে ফলাফলে উনিশ বিশ কিছু হলো না। অনু জানে না কেন, তার মনে এবার সুক্ষ্ম অথচ তীব্র একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। কেন যেন মনে হয়েছিল, কোনো একটা অলৌকিক ঘটনা এবার ঘটবে। হয়তো শেষ কিছুদিনের স্বপ্নগুলোই এর কারণ। প্রায় নিয়মিতই নানারকম স্বপ্ন দেখেছে সে। সেইসব স্বপ্নজুড়ে যেন একটা সুস্পষ্ট শুভ বার্তা থাকত। এসবে যে অনু বিশ্বাস করে, এমন নয়। কিন্তু ভয়াবহ বিপদে কত বড় বড় অবিশ্বাসীকেও যে তুমুল বিশ্বাসী আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে উঠতে দেখেছে অনু, তার হিসাব নেই। অয়নের সেই প্রথম রিপোর্ট থেকেই অনু নিজেকে রোজ কত কিছু বুঝিয়েছে, কত কত ভাবে শক্ত করেছে, কিন্তু তাতে ওই সামান্য কিছু সময়ের জন্যই কেবল নিজেকে স্থির রাখতে পেরেছে সে। তারপর কোনো এক ঝড়ো হাওয়ায় মুহূর্তেই আবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।
পরদিন অয়নের রিপোর্টগুলো নিয়ে অনু যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। অয়ন বসেছিল খাটে। তারপাশে বেনু আর মা। অনু ঘরে ঢুকতেই তিনজোড়া চোখ একসাথে অনুর দিকে তাকালো। অনু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, আজকাল সবাই মিলে খুব গল্প হয়, না?
বেনু আর মা অনুর দিকে মুখ তুলে তাকালো, কিন্তু কথা বলল না কেউ। তবে তাদের চোখভর্তি রাজ্যের জিজ্ঞাসা। অনু অয়নের কাছে এসে কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, কোল্ড এলার্জিটা ভালোই আছে, বুঝেছিস? এখন থেকে একটু পানি-টানি এড়িয়ে চলিস, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
সালমা বেগম কী বুঝলেন কে জানে! তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, কী বলছিস তুই? কী বলছিস? সত্যি?
অনু মায়ের দিকে ফিরে বলল, মা, বাইরে আজও বৃষ্টি হচ্ছে। দেখেছ, ভিজে কী অবস্থা! তুমি কি আমাকে একটু গরম পানি করে দিতে পারবে? এখুনি গোসল না করে ফেললে আমারও ঠান্ডা বসে যাবে।
অনু কুসুম গরম পানিতে গোসল করলো। তারপর মা আর বোনেদের সাথে লম্বা সময় নিয়ে কথা বলল। শেষ কিছুদিনে এই ঘরে অয়নের পরিস্থিতি কোনো না কোনোভাবে মেনে নিয়ে যে এক ধরনের স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছিল, আজ তা আবার এলোমেলো হয়ে গেল। এই এলোমেলো অবস্থা আড়াল করে রাখবার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই সবাই করলো। কিন্তু সেই চেষ্টাটাই যেন সবচেয়ে প্রকটভাবে সবকিছু প্রকাশ করে দিতে থাকল। রাতে খাবার টেবিলে এসে অনু আবিষ্কার করলো কেউই খেতে আসেনি। সে মা আর বোনদের ডাকলো। কিন্তু কেউই তার ডাকে কোনো সাড়া দিলো না। তনু আর বেনু অন্ধকার ঘরে বালিশে মুখ খুঁজে পড়ে আছে। সালমা বেগম একবার জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে বসে যাচ্ছেন, আবার পরক্ষণেই জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে গিয়ে ভাগ্যকে শাপশাপান্ত করছেন। আবার খানিক বাদেই জায়নামাজে উবু হয়ে বসে কেঁদে কেটে আল্লাহর কাছে তার সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইছেন। খানিক আগে করা আচরণের জন্য করজোড়ে ক্ষমাও চাইছেন।
অনু কিছুক্ষণ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সালমা বেগমের তখন পাগলপ্রায় অবস্থা। অনু মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে শান্ত এবং অনুচ্চ গলায় বলল, তুমি কি চাও মা? তুমি কি চাও, অয়ন সব জেনে যাক?
সালমা বেগম জবাব দিলেন না, তবে তার কান্না থামলো। তিনি ধীরে জায়নামাজে লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার দু’হাতে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
অনু খাবারের টেবিলে এসে অয়নকে ডাকলো। অয়ন বলল, ক্ষিদে নেই আপু।
অনু বলল, না থাকলেও আমার সাথে একটু খা। আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
আর কেউ খাবে না?
এখন না, পরে খাবে।
পরে খাবে কেন?
অনু জবাব দিলো না। সে দু’টো প্লেট ধুয়ে ভাত বাড়লো। অয়ন চেয়ারে বসতে বসতে বলল, মা কাঁদছে, তাই না?
রোজই কাঁদে।
রোজ কাঁদে?
হু, আমি মার সাথে এক ঘরে থাকি, আমি জানি।
কেন কাঁদে?
অনু প্লেটে তরকারি বেড়ে দিতে দিতে বলল, মায়েদের কাঁদার কারণ লাগে না। পান থেকে চুন খসলেই তারা কাঁদে। দেখিস না, তনু যখন তখন কাঁদে।
এই জন্যই তুই কাঁদিস না?
হুম।
সত্যি সত্যিই কাঁদিস না?
না।
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অনু ভাতের প্লেট টেনে নিয়ে ভাত মাখছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এই টেবিলে, প্লেটে, খাবারে তার কোনো মনোযোগ আছে। সে ভাত মাখছে আনমনা ভঙ্গিতে। প্রথম নলা ভাত মুখে দিয়েই ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফেলল অনু। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে বললেও শেষ পর্যন্ত কিছুই খেতে পারল না সে। ভাতের নলা মুখে দেয়া মাত্র পেট গুলিয়ে বমি চলে আসছিল তার। অয়ন বলল, শরীর খারাপ লাগছে আপু?
অয়নের দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্টা করলো অনু। কিন্তু পারল না। বেসিনে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলো। অয়ন ছুটে গিয়ে দু’হাতে অনুর মাথা চেপে ধরলো। তারপর চিৎকার করে মাকে ডাকলো। সালমা বেগম শুনতে পেলেন। কি-না বোঝা গেল না। তবে অনু মুখ তুলে চোখের ইশারায় অয়নকে ডাকতে নিষেধ করলো। তারপর আঁজলা ভরে মুখে পানি ছিটিয়ে বলল, গ্যাস্ট্রিকটা একদম বসে গেছে, বুঝলি?
তুই খুব অনিয়ম করিস আপু।
অনু কথা বলল না। অয়ন বলল, এত অনিয়ম আর রাত দিন খাটাখাটনি করিস, দেখিস একদিন আমার মতো তুইও একটা বড় অসুখ বাধাবি।
অনু তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে অয়নের খাটে এসে বসলো। তারপর বলল, সবচেয়ে বড় অসুখ কী জানিস?
কী?
এই যে আমি বমি করতেই তুই অমন করে ছুটে গেলি, ওটা।
ওটা অসুখ হবে কেন?
ওটাই আসল অসুখ। এই অসুখ হচ্ছে একজন ভালো না থাকলে তার কারণে অন্যদেরও ভালো না থাকার অসুখ। এই অসুখের নাম কি বলতে পারবি?
অয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অনু বলল, এই অসুখের নাম মায়া। মানুষ তার খুব কাছের মানুষের জন্য বুকের ভেতর মায়া পুষে রাখে। সেই মায়া খুব কষ্ট দেয় অয়ন। এ অসুখ সবচেয়ে বড় অসুখ, সবচেয়ে কষ্টের অসুখ।
অয়নের হাতে কলম। সে সাদা একটা কাগজে কী সব আঁকিবুকি করছিল। অনু বলল, আমাদের কাছের মানুষেরা খারাপ থাকলে আমরাও ভালো থাকি না। আমাদের নিজেদেরও তখন খুব অসুখী লাগে। অসুখ মানে তো যেখানে সুখ নেই, তাই না? তো এটাও তো অসুখই। অসুখ না?
তুই আজকাল প্রায়ই কেমন জটিল জটিল সব কথা বলিস আপু, আমার শুনতে ভালো লাগে না।
অনু অয়নের আরো কিছুটা কাছে এসে বসলো। তারপর অয়নের হাত থেকে কলমটা নিয়ে অয়নের হাতের তালুতে কিছু একটা লিখতে লিখতে বলল, মানুষ যত বড় হয়, তত জটিল হয়ে যায়। কারণ, বড় হবার সাথে সাথে তাকে জটিল একটা পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হয়। আর এই জটিল পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হতে সে নিজেও একসময় নিজের অজান্তেই জটিল হয়ে যায়।
অয়ন তাকিয়ে আছে তার হাতের তালুর দিকে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে অনু লিখে দিয়েছে, অয়ন।
অনু মৃদু হাসলো, ছোটবেলায় এভাবে লিখে দিতাম। তখন নামের সাথে লাল রঙের কলম দিয়ে ফুলও এঁকে দিতে হতো, না দিলে খুব কাঁদতি।
তাহলে এখন যে ফুল এঁকে দিলি না?
এখন তো আর কাঁদিস না, তাছাড়া লাল রঙের কলমও তো নেই।
অয়ন পেনবক্স থেকে একটা লাল রঙের কলম বের করে অনুকে দিলো। অনু বলল, এটা তো জেল পেন, বলপয়েন্ট নেই?
অয়ন বলল, নাহ্, লাল এই একটাই আছে।
অনু খানিক ঝুঁকে অয়নের নামের চারপাশে লালরঙের ফুল এঁকে দিলো। তারপর আরো কী কী সব কথা বলল তারা। তারপর অনু উঠে দাঁড়াতে যেতেই অয়ন হঠাৎ তার হাতের তালুটা অনুর সামনে মেলে ধরলো, দেখ আপু।
অনু তাকালো। লাল জেলপেনে আঁকা ফুলগুলোর লাল রং অয়নের সারা হাতের তালুতে ছড়িয়ে গেছে। ফুলগুলোকে এখন আর আলাদা করে বোঝ যাচ্ছে না। কেবল কালো বল পয়েন্টের কালিতে লেখা অয়নের নামটা বোঝা যাচ্ছে। আর চারপাশে লেপ্টে থাকা লাল রং দেখে মনে হচ্ছে টকটকে তাজা রক্তের ভেতর অয়নের নামটা লেখা!
অনু আঁতকে ওঠা গলায় বলল, এ কী!
অয়ন ম্লান হেসে বলল, জেলপেনের কালি তো, লেপ্টে গেল।
অনু তার ওড়নার কোণাটা পানিতে ভিজিয়ে অয়নের হাতের লেপ্টে যাওয়া কালিগুলো মুছে দিতে লাগল। কিন্তু মুছতে গিয়ে দেখা গেল, অয়নের নামটাও কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। খুবই তুচ্ছ একটি বিষয়, অথচ অনুর মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেল। সে আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ অয়নের পাশে বসে রইল।
গভীর রাতে কিছুর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অনুর। এমনিতেও আজকাল তার ঘুম হয় খুব সামান্য। যেটুকুও হয় তাতে আজেবাজে স্বপ্নই বেশি থাকে। অনু। মুখ তুলে ঘুম জড়ানো গলায় ডাকলো, মা।
অন্ধকারে কোনো জবাব এলো না। অনু বিছানা হাতড়ে দেখলো মা নেই। সে বিছানা থেকে নামলো। তারপর পা টিপে টিপে সন্তর্পণে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সালমা বেগম অয়নের বিছানার পাশে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ছেন। রুকু থেকে সেজদাহ, সেজদাহ থেকে মোনাজাত, কী শান্ত এবং গভীর সমর্পণের ভঙ্গি! অনু চুপচাপ আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো, কিন্তু ঘুম আর এলো না। পরপর কয়েকদিন অফিসে দেরি হয়ে গেছে, আজও যদি ঘুমটা ঠিকঠাক না হয়, তাহলে অফিসে খুব ঝামেলায় পড়ে যাবে সে। অনু চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। খানিকটা তন্দ্রার মতো লেগেও এসেছিল বোধহয়। এই সময় আবার ঘুম ভেঙে গেল তার। কিন্তু চোখ মেলে তাকালো না। সে। চোখ বন্ধ করেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। সেই নিঃশ্বাসের সাথে সাথে মায়াময় এক সুবাসে যেন অবশ হয়ে যেতে চাইল শরীর আর মন। বুকের ভেতর পাখির ভেজা পালকের স্পর্শের মতো ছুঁয়ে দিলো কেউ, এই ঘ্রাণটা যে কী চেনা অনুর! কী যে আপন! কখনো বোঝাতে পারবে না অনু।
মায়ের আঁচলটা তার মুখের উপর এসে পড়েছে। সে চোখ বন্ধ করে সেই আচলের ঘ্রাণ শুষে নিতে থাকল। সালমা বেগম অন্ধকারেই অনুর বুকে মাথায় বার দুই দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন। তারপর সামান্য ঝুঁকে অনুর কপালে আলতো করে ঠোঁট চুঁইয়ে চুমু খেলেন। অনু কোনো এক ব্যাখ্যাহীন উপায়েই যেন টের পেয়ে গেল সালমা বেগমের চোখ, গাল, চিবুক কান্নার জলে ভেজা। তিনি উঠে দাঁড়াতেই অনু মায়ের আঁচলটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে রাখলো। সালমা বেগম ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মতো গলায় বললেন, ঘুমাসনি?
অনু অস্পষ্ট গলায় বলল, উঁহু।
খারাপ লাগছে?
হুম।
ভয় লাগছে?
হুম।
সালমা বেগম আবার বসে পড়লেন। তারপর অনুর মাথাটা নিজের কোলের ভেতর টেনে নিয়ে অনুর গালে, কপালে, মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। অনুর আচমকা মনে হলো, সে আজ থেকে ত্রিশ বা তারও বেশি বছর আগের অনু হয়ে গেছে। এই যে মায়ের স্পর্শ, এই যে আঁচলের ঘ্রাণ, এই যে অদ্ভুত ওম, এসব তার চেনা। খুব খুব চেনা। কিন্তু কতকাল এসব সে ভুলে গিয়েছিল। প্রায় শূন্য চরাচরের প্রবল খরতাপে রুক্ষ্ম হয়ে যাওয়া কোনো এক নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল তার বুকের ভেতর। অনুর কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু সে একটুও কাঁদতে পারছিল না। এই কাঁদতে না পারাটা যে কী ভীষণ কষ্টের, কী যন্ত্রণার!
.
নুহা এলো প্রায় পনেরো দিন বাদে। অয়ন কোনো এক রহস্যময় কারণে নুহার দিকে তাকাতে পারছে না। তার বুক ধুকফুক করছে। নুহা বলল, কেমন ছিলি অয়ন?
হ্যাঁ ভালো। তুই? অয়ন নুহার দিকে তাকালো না। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কী শূন্য ধূসর আকাশ! একটা চিল একা একা উড়ছে। তারা বসে আছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পেছনের বেঞ্চিটাতে। খটখটে নির্জন দুপুর।
তোর জন্য একটা গিফট আছে।
অয়ন মুখ তুলে তাকালো। নুহা তার ব্যাগের ভেতর থেকে সুন্দর একটা প্যাকেট বের করে দিলো। সাথে নীল রঙের পেনবক্স। অয়ন প্যাকেটটা খুললো, একটা চমৎকার নোট বুক। সে নোটবুকটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল, খুব সুন্দর।
আদিল ভাইয়া দুটা দিয়েছে, একটা তোকে, একটা আমাকে।
আদিল ভাইয়া কে?
বড় খাঁলার ছেলে, সেদিন না তোকে বললাম! খুব হাসায় জানিস?
আমাকে চেনে?
কেন চিনবে না? আমি সবাইকেই তোর কথা বলি।
কী বলিস?
অত কী মনে থাকে? তবে আমাদের সব কথাই বলি। তুই যে একবার ভুলে আমার পিঙ্ক কালারের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সারাদিন ঘুরলি, সেটা শুনে বড়খালা হাসতে হাসতে শেষ।
অয়ন হাসলো, নুহাও। একটা বাদামওয়ালা এলো, নুহা কুড়ি টাকার বাদাম কিনলো। তারপর বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, তোকে বলেছিলাম আমার মন খারাপ, মনে আছে?
আছে।
মজার ব্যপার কি জানিস, এখন আমার মন ভালো।
কেন?
জানি না, তবে আমার ধারণা তোর সাথে থাকলে আমার মন ভালো থাকে। আচ্ছা, তোরও কী এমন হয়?
আমার উল্টোটা হয়।
উল্টোটা?
হুম।
কেন?
জানি না কেন, তবে আজকাল তোর সাথে থাকলে আমার মন খারাপ হয়।
আগে হতো না?
নাহ্।
আর আমার সাথে না থাকলে?
না থাকলে আরো বেশি খারাপ হয়।
কী অদ্ভুত কথা! আমার সাথে থাকলে তোর মন খারাপ হবে কেন?
অয়ন ম্লান হাসলো, জানি না নুহা, মন খারাপ হওয়াটা মনে হয় অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
তোর হয়েছে কী বল তো?
সেটা তো তোর বলার কথা।
আগে তোর কী হয়েছে শুনি?
নাহ্। তোর আগে বলার কথা।
নুহা দীর্ঘসময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, তোর হাতটা একটু দিবি অয়ন? ধরবো?
নুহা কতবার অয়নের হাত ধরেছে। কিন্তু অয়নের কখনো এমন হয়নি। অয়নের মনে হচ্ছে তার হাত কাঁপছে। নুহা ধরতেই তার হাত জলের মতো মিশে যাবে। সে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। নুহা হাত বাড়িয়ে অয়নের হাত মুঠোয় নিয়ে নিলো। তারপর শক্ত করে চেপে ধরলো। অয়নেরও ইচ্ছে করছে শক্ত করে নুহার হাতটা ধরতে। কিন্তু কেন যেন সে তার হাতে শক্তি পাচ্ছে না। অয়ন চুপচাপ বসে রইল। নুহাও। দীর্ঘ নৈঃশব্দ্যের স্পন্দিত সময়। কী মনে হতেই অয়ন আচমকা নুহার দিকে তাকালো। নুহা কাঁদছে। তার দু’চোখের কোল গড়িয়ে দু’ফোঁটা জল নামছে। অয়ন কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। তবে সে তার হাতের মুঠোয় নুহার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। অয়নের বুকের ভেতর একটা সুবাসের নদী তিরতির করে সুবাস আর শিহরণ ছড়িয়ে বয়ে যেতে থাকল। এই যে খটখটে দুপুর, ধূসর আকাশ, ওই যে নিঃসঙ্গ চিল, রোদের ভেতর গাছের ছায়া, এ সকলই কেমন মায়াময় হয়ে উঠল। অয়ন ডাকলো, নুহা?
নুহা চোখ তুলে তাকালো না। তবে ফিসফিসে গলায় বলল, হুম।
কী হয়েছে, আমায় বল?
আমি একটা ভুল করে ফেলেছি অয়ন।
অয়ন কেঁপে ওঠা গলায় বলল, কী ভুল?
এই ভুলের কথা আমি কাউকে বলতে পারব না।
আমাকেও না?
না।
অয়ন আর কিছু বলল না, তবে নুহার হাতের ভেতর তার হাতটা কি খানিক শিথিল হয়ে গেল? নুহা আরো কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর ফিসফিস করেই বলল, আমি অমন মেয়ে নই অয়ন। কিন্তু ভালোবাসলে মানুষ বোধহয় অন্য কেউ হয়ে যায়, আমিও অন্য কেউ হয়ে গিয়েছিলাম।
অয়ন বসে আছে। কুয়াশায় ডুবে থাকা দিগন্ত বিস্তৃত শূন্য মাঠের বুক চিরে হারিয়ে যাওয়া মেঠো পথের মতো কী যেন কী তার বুক চিরে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে। অয়ন তা ধরতে পারছে না। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
নুহা বলল, আদিল ভাইয়া মানুষটাই অমন অয়ন, ভালো না বেসে থাকা যায় না। মুহূর্তেই কেমন ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। সেই ঘোর থেকে আর বের হওয়া যায় না।
অয়নের কানের পাশ দিয়ে চুলের ভেতর থেকে একটা উষ্ণ ঘামের স্রোত নেমে এলো। মনে হচ্ছে ভেঙে যাওয়া মাটির মূর্তির মতো সেও অজস্র টুকরো হয়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। তারপর ক্রমশ মিশে যেতে থাকবে ধুলোয়। নুহার হাতের ভেতর তার হাতখানা অসাড় হয়ে পড়ে রইল। সে বিড়বিড় করে বলল, কতটুকু ভালোবাসিস?
অয়নের কথা কী কান্নার মতো শোনালো? নুহা অবশ্য সেই কান্না শুনতে পেল না। সে বলল, আমি তোকে বোঝাতে পারব না অয়ন। আমার ইচ্ছে হয়, মানুষটাকে নিয়ে আমি দূরে কোথাও চলে যাই। অচেনা অজানা কোথাও।
অয়ন খানিক চুপ করে রইল। নুহা নিঃশব্দে কাঁদছে। অয়ন সঁতসেঁতে গলায় বলল, এমন করে ভালোবাসলে তো চলে যাওয়া যায়ই।
যায় না অয়ন, আমাদের সময়টা খুব ভুল।
মানুষটা তো ভুল নয়।
নাহ্ অয়ন, মানুষটা ভুল নয়। কেবল সময়টাই ভুল।
ভুল কেন?
আদিল ভাইয়া এবার যে দেশে এলো, সেটা আসলে ওর বিয়ের জন্যই। সবকিছু ঠিকঠাক, এনগেজমেন্ট অব্দি হয়ে গেছে। আমি কী করব অয়ন?
নুহা কাঁদছে। অয়নও কাঁদছে। তবে অয়নের কান্নাটা দেখা যাচ্ছে না। অয়নের মাথার ওপর সেই ধূসর আকাশ, গাছের ছায়া, একাকী চিল। কিন্তু অয়ন তার কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে এই খটখটে রোদের দুপুরে একটা গাঢ় কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে নেমে আসছে। সেই চাদরে সে ক্রমশই ঢেকে যাচ্ছে।
.
অনু অফিসে ঢুকতেই হাসান বলল, আপনার ফোন এসেছিল কয়েকবার। আলতাফ সাহেব ডেকেছেন।
জরুরি কিছু?
তা তো বলেননি। তবে পরপর কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। হেড অফিস থেকে লোক এসেছে।
অনু বহুদিন পর আলতাফ হোসেনে রুমে ঢুকলো। আলতাফ হোসেনের রুমের সাজসজ্জা কিছুটা বদলেছে। একটি বড় আলমারি এবং বুক শেলফ ছিল ডান দিকের দেয়ালজুড়ে। সে দুটো সরিয়ে সেখানে আলাদা করে মুখোমুখি দুই সেট সোফা বসানো হয়েছে। অনু ঘরে ঢুকেই কিছুটা চমকে গেল। সেই সোফায় আলতাফ হোসেনের সাথে হেড অফিসের দু’জন বড় কর্মকর্তা বসে রয়েছেন। এর মধ্যে মান্নান সাহেব অনুকে চেনেন। অন্যজনকে অনু চিনলেও তিনি অনুকে। চেনেন না। অনু ঘরে ঢুকতেই মান্নান সাহেব হাসিমুখে বললেন, কী খবর অনু?
অনু সালাম দিয়ে বলল, এই তো স্যার, ভালো।
মান্নান সাহেব হাতের ইশারায় ফাঁকা একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসুন।
অনু ইতস্তত ভঙ্গিতে চেয়ারটাতে বসলো। মান্নান সাহেব বললেন, আজ বৃহস্পতিবার, আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন?
না স্যার। ভুলে যাব কেন?
আজ সকাল ন’টা থেকে একটা মিটিং ছিল অনু।
অনুর বড়োসড়ো একটা ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। সে কিছু বলতে গিয়েও আবার থমকে গেল। প্রতি মাসের শেষ বৃহস্পতিবার হেড অফিস থেকে বড় কর্তারা আসেন। সেদিন অফিসের প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেকেই পুরো মাসের আলাদা আলাদা রিপোর্ট দিতে হয়। নানান ধরনের প্রেজেন্টেশন দিতে হয়। বিষয়টি অনু একদমই ভুলে গিয়েছিল। গত কয়েকদিন নতুন করে আবার অয়নের ডাক্তার, টেস্ট, রিপোর্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিষয়টি তার মাথায়ই ছিল না। তাছাড়া প্রতিবার বিষয়টি সরাসরি আলতাফ হোসেনের তত্ত্বাবধানেই হয়। কিন্তু এবার তার আর আলতাফ হোসেনের মধ্যে যোগাযোগহীনতার কারণেই। হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক এ বিষয়ে আলতাফ হোসেনও তাকে কিছু বলেননি। অনু কি বলবে ভেবে পেল না। মান্নান সাহেব বললেন, আপনি কি রোজই এভাবে লেট করে অফিসে আসেন?
অনু সন্ত্রস্ত গলায় বলায়, না স্যার।
আপনার অ্যাটেন্ডেন্স রিপোর্ট কিন্তু তা-ই বলছে অনু। এ সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই হয় লেট করে এসেছেন, না হয় আর্লি বেরিয়েছেন, এভাবে অফিস চলে অনু?
অনু বলার জন্য আতিপাতি করে খুঁজেও যুতসই কোনো কারণ বের করতে পারল না। সে যে রোজ অফিসে দেরি করে এসেছে বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু সে কথা এখানে বলে কোনো লাভও নেই। আর অয়নের কথাটা অনু অফিসে জানাতেও চায় না। জানালে হয়তো সবাই কিছুটা সহানুভূতির চোখে তাকে দেখবে। তারপর দিন দুই বাদে আবার যেই সেই। অয়নের বেঁচে থাকার বাদবাকি সময়টাতে অফিস বরং এটাকে তার কাজের ক্ষেত্রে একটা বড় দুর্বলতা হিসেবেই দেখবে। এর আগেও এমন হয়েছে, এডমিনের নায়লা তার বাচ্চা হবার সময় অফিসের নিয়মানুসারেই মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিল। মাঝখানে তার বাচ্চার কিছু গুরুতর জটিলতাও দেখা দিয়েছিল। এই সময়ে অফিস নায়লার পদে অন্য একজনকে খণ্ডকালীন হিসেবে নিয়োগ দিলেও নায়লা ছুটি শেষে ফিরে এসে আর জয়েন করতে পারেনি। অফিস ম্যানেজমেন্ট ধরেই নিয়েছিল যে নায়লার পক্ষে ঘর, সংসার, অসুস্থ বাচ্চা, এই সবকিছু সামলে আর আগের মতো অফিসকে সেবা বা সময় দেয়া সম্ভব হবে না।
অনু এই বাস্তবতাটা জানে। জানে বলেই এই দুর্বলতাটা সে প্রকাশ করতে চায় না। তাছাড়া অয়নকে নিয়ে কারো সহানুভূতি কুড়াতেও ভালো লাগে না অনুর। বিষয়টি যদি এমন হতো যে অয়নের কথা বললে অয়ন সুস্থ হয়ে যেত, তাহলে সম্ভাব্য সকল কিছুই করত সে।
মান্নান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এর আগেও আপনাকে নিয়ে নানান সমস্যা হয়েছে অনু। বাট দ্য ফ্যাক্ট ইজ, আপনি আলতাফ ভাইয়ের মতো একজন ভালো বস পেয়েছেন। হি অলয়েজ ডিফেন্ডস ইউ।
অনু মুখ তুলে আলতাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। আলতাফ হোসেন অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। মান্নান সাহেব বললেন, আপনি কতটুকু বোঝেন আমি জানি না, অফিসে আপনার যে রেসপন্সিবিলিটি, সেটা খুব সেনসিটিভ আর ইম্পর্টেন্ট। এখানে আমরা টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট এক্সপেক্ট করি। প্রোপার কনসেন্ট্রেশন আর ডেডিকেশন না থাকলে এটা অফিসের জন্য খুবই ডিফিকাল্ট টু হ্যাঁন্ডেল। কি বলেন আলতাফ সাহেব?
আলতাফ হোসেন মৃদু মাথা নাড়লেন কেবল। মান্নান সাহেব আবারো বললেন, এর আগে আমাদের গাইবান্ধা ফিল্ডের ডাটা নিয়ে ম্যাসিভ ঝামেলা হয়েছিল। আলতাফ সাহেব সবার এগেইনস্টে গিয়ে আপনার জন্য ফাইট দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা তো ওনার একার এখতিয়ারও নয় অনু।
অনু মাথা নিচু করে বসে আছে। সে বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। আলতাফ হোসেন অনুচ্চ গলায় বললেন, মান্নান ভাই, আমার মনে হয় এটা ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো আছিই। আপনি টেনশন নিয়েন না। তাছাড়া ওনার ছোট ভাইটা অসুস্থও। এইজন্যই একটু ঝামেলা হচ্ছে। বাট এটা থাকবে না।
সবারই কম বেশি সমস্যা থাকে আলতাফ সাহেব। এখন ফ্যামিলি বা পারসোনাল লাইফ যদি প্রফেশনাল লাইফ হ্যাঁম্পার করে, তাহলে সেটা তো সমস্যাই। ওয়েল, যদি বাসায় কোনো সমস্যা থাকে, উনি ছুটি নিতে পারেন অফিস থেকে। সমস্যা কাটালে না হয় আবার অফিস শুরু করবেন। তাছাড়া এটা তো আর আনন্দ বা বিনোদনের কাজও নয়। প্রচণ্ড প্রেসারের কাজ। মাঝেমধ্যে প্রেসারের কাজে রিলিফ বা রিক্রিয়েশনেরও দরকার হয়।
আলতাফ হোসেন অনুর দিকে তাকালেন, আপনি কি কিছু দিনের জন্য ছুটি নিতে চান অনু?
এই ভয়টাই অনু করছিল। সে জানে, এই ছুটিটা নেয়া মানে একভাবে তার চাকরিটা হারানোই। সে মাথা তুলে বলল, আমি খুবই সরি স্যার। আশা করছি। সামনে আর এমন কিছু হবে না।
মান্নান সাহেব আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন অনু? এমন তো হতেই পারে, সবার আগে তো আমরা মানুষ। আমাদের পারসোনাল, ফ্যামিলি লাইফকে তো আমরা চাইলেই আর পুরোপুরি ইগনোর। করতে পারি না, তাই না? বেটার আপনি কিছুদিনের জন্য লম্বা একটা ছুটি নিন।
অনু অনেকটা বেপরোয়া ভঙ্গিতেই বলল, আমার ছুটির দরকার হবে না স্যার। আমি আমার রেসপন্সিবিলিটিটা হান্ড্রেড পার্সেন্টই পালন করব। আই প্রমিজ।
.
সেদিন আর তেমন কথা এগুলো না, তবে দুই দিনের মাথায় আলতাফ হোসেন আবার ডাকলেন অনুকে। অনু ঘরে ঢুকতেই তিনি অনুর সামনে একটা কাগজ রাখলেন। অনু মৃদু গলায় বলল, কী এটা?
আপনার ওপর অনেক প্রেশার যাচ্ছে দেখেই আপনার একজন এক্সট্রা সহযোগী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উনার নাম তামান্না। নেক্সট মাসের প্রথম থেকে উনি আপনার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবেই কাজ করবেন।
অনু কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো। যে মেয়েটাকে তার সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করেছে। সিভিতে দেখা যাচ্ছে এর আগে একাধিক বেসরকারি অর্গানাইজেশনে কাজও করেছে সে। এই মেয়ে কেন তার সহযোগী হিসেবে কাজ করবে অনু ঠিক বুঝতে পারল না। যদিও দু’জনের বেতন কাঠামো প্রায় সমান। অনু শান্ত কণ্ঠে বলল, উনি কি আমার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জয়েন করছেন?
আলতাফ হোসেন শশব্যস্ত হয়ে বললেন, তা কেন? এখানে স্পষ্ট লেখাই আছে উনি আপনার সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন।
অনু মৃদু হাসলো, এতগুলো টাকা দিয়ে অফিস কেন অতিরিক্ত একজনকে পুষবে? তাও আমার এসিসটেন্ট হিসেবে? তাছাড়া উনি আমার চেয়ে অনেক বেটার অপশন।
সবসময় কী আমরা বেটার অপশনটাই খুঁজি অনু?
অনু এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। সে ফিরে গেল আগের প্রসঙ্গেই, বিষয়টি যদি এমন হয় আলতাফ ভাই যে নেক্সট কয়েক মাস উনি আমার সাথে থেকে আসলে আমার দায়িত্ব আর কাজগুলো আমার কাছ থেকে বুঝে নেবেন, তাহলে সেটি আমাকে আগেভাগেই জানিয়ে দেয়াই ভালো। কারণ আপনি জানেন, চাকরি ছাড়া একদিনও আমি চলতে পারব না। এখানে চাকরি না থাকলে আমাকে অন্য কোথাও খুঁজতে হবে। একটু আগেভাগে জানিয়ে দিলে বিষয়টা আমার জন্য কিছুটা ভালো হতো আলতাফ ভাই।
আপনি যা ভাবছেন, তা নয় অনু।
না হলে তো ভালোই। কিন্তু আলতাফ ভাই, আমার মনে হয় আপনিও বুঝতে পারছেন বিষয়টা।
না অনু, একদমই তা নয়। হ্যাঁ হেড অফিস তেমন কিছুই চাইছিল। কিন্তু আমরা জানিয়েছি যে আপনাকে রিপ্লেস করাটা অফিসের জন্যই ক্ষতির। কারণ, আপনার মতো করে পুরো বিষয়টি দুম করে কারো পক্ষে বুঝে নেয়া এখনই সম্ভব হবে না।
আমিও তো তাই বললাম ভাইয়া।
নাহ, আপনি ভাবছেন, আগামী দুই তিন মাসের মধ্যে আপনার সাথে থেকে থেকে আপনার কাজ বুঝে নেয়ার জন্য তামান্নাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারপর আপনার জায়গায় তাকে পারমানেন্টলি নেয়া হবে, বিষয়টি এমন নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
অনু আর কথা বাড়ালো না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি তাহলে উঠছি ভাইয়া?
আলতাফ হোসেন কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। অনু উঠে দরজার কাছ অব্দি গেল। এই সময়ে আলতাফ হোসেন ডাকলেন, একটু শুনবেন অনু?
অনু ধীরে ঘুরে দাঁড়ালো, জি?
আলতাফ হোসেনও উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু সাথে সাথেই কিছু বললেন না। খানিক নীরব থেকে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ওই দিনের জন্য আমি সরি অনু।
অনু কোনো কথা বলল না। আলতাফ হোসেন আরো কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমি জানি আমি যেটা করেছি তার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন অনু, ওইদিন আমার কি হয়েছিল আমি জানি না। আমি অত জঘন্য মানুষ নই অনু।
অনু যেমন দাঁড়িয়ে ছিল তেমন দাঁড়িয়েই রইল। আলতাফ হোসেন বললেন, আপনি আরেকটু বসবেন অনু?
অনু বসলো না, তবে সামান্য এগিয়ে এসে বলল, বলুন।
আলতাফ হোসেন বললেন, এই অফিসে আমি কাজ করি আজ আঠারো বছর। এই আঠারো বছরে কোনো নারী এমপ্লয়ি আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি, করতে পারবেও না অনু।
অনু ঠান্ডা গলায় বলল, কেউ তো করেওনি আলতাফ ভাই, এমনকি আমিও করিনি। করেছি?
আলতাফ হোসেন বিধ্বস্ত গলায় বললেন, আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু অনু…।
অনু আলতাফ হোসেনের কথা শেষ করতে দিলো না। সে বলল, আমি রেপড হলেও সম্ভবত অভিযোগ করতে পারতাম না আলতাফ ভাই। সেই সাহস বা অবস্থান আমার নেই। বেশিরভাগ মেয়েরই থাকে না। আর সেখানে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় নিরাপদে ফিরে এসে কেন অভিযোগ করব?
আলতাফ হোসেন কিছু বলতে চাইছিলেন। তার আগেই অনু আবার বলল, বরং একটা থ্যাঙ্কস আপনার প্রাপ্য।
আলতাফ হোসেন বিভ্রান্ত গলায় বললেন, থ্যাঙ্কস?
অনু বলল, সব মেয়েদের জন্য সব অভিযোগ করাটা সবসময় সহজ না আলতাফ ভাই। সেটা আপনিও যেমন জানেন, আমিও জানি। আর আমার মতো কারো জন্য অভিযোগ করাটা বরং আরো কঠিন। তার ওপর আপনি আমার বস।
অনু থেমে যেন সামান্য হাসলো। তার গলায় কিছুটা শ্লেষ আমি তো বরং ভয়েই ছিলাম যে আপনিই না আবার অফিসে এসে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করে বসেন! সেটা করলে আমার আর কোনো উপায় থাকত না আলতাফ ভাই। আমাদের মতো মেয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটা যত সহজ, আমাদের পক্ষে সেই অভিযোগ খণ্ডানো ঠিক ততটাই কঠিন। কারণ আমাদের পায়ের নিচে মাটি নেই। তাই সবাই আগেভাগেই ধরে নেয় যে সমস্যাটা আমাদেরই। সো আপনি তেমন কিছু করলে সেটা আমার জন্য খুব বিপদ হয়ে যেত। তা যে করেননি, এইজন্যই আপনাকে থ্যাঙ্কস।
অনু, আপনাকে আমার কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু এই অফিসে নয়, অন্য কোথাও। প্লিজ অনু।
অনু আলতাফ হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণায় কী অতি সূক্ষ্ম হাসির আভাস? আলতাফ হোসেন বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন, যে-কোনো রেস্টুরেন্টে? আপনি যেখানে বলবেন, সেখানেই। এমনকি আপনি চাইলে আপনার বাসায়ও হতে পারে।
অনু কথা বলল না, দীর্ঘসময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, আমি জানি আপনি কী বলবেন আলতাফ ভাই।
আলতাফ হোসেন চমকে ওঠা গলায় বললেন, কী জানেন আপনি?
আপনার ওয়াইফের একটা পরকীয়া সম্পর্ক আছে, এই নিয়ে আপনি মানসিকভাবে প্রচণ্ডরকম ডিপ্রেসড। আপনি চেষ্টা করেছিলেন সম্পর্কটা রিভাইভ করতে কিন্তু সেটাও পারেননি। আবার বাচ্চাদের কারণে সেপারেশনেও যেতে পারছেন না। শুধু বাচ্চাদের কারণেই এই অসুস্থ সম্পর্কটা মেনে নিতে আপনি বাধ্য হচ্ছেন, এই তো? আর এইসব কিছু নিয়ে আপনি ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণায় আছেন। জীবন নিয়ে আপনি যখন ভয়াবহ অতিষ্ঠ, ঠিক সেই সময়ে আমাকে দেখে আপনার মনে হলো আপনি এতদিন যাকে খুঁজেছেন, যার কাছে একটু হলেও শান্তি খুঁজে পেতে পারেন, আশ্রয় খুঁজে পেতে পারেন, সে আমি? তাই তো?
আলতাফ হোসেন কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু অনু থামল না। সে ধীর এবং স্থির গলায় বলল, তারপর ধরুন, সবকিছু মিলিয়েই ওই দিন আপনি মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ছিলেন। তার ওপর অতিরিক্ত মদ খাওয়ার কারণে আপনার হিতাহিত জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। এখন আপনার প্রচণ্ড গিল্টি ফিলিংস হচ্ছে। আপনি আসলে ওইরকম মানুষ নন, আপনি অন্যরকম একজন মানুষ।
অনু, আপনি এখন বিষয়টি নিয়ে আমাকে মক করছেন, আগে তো আমার কথাটা শুনুন…
আরো আছে? আপনি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসেন, বিয়ে করতে চান। লুকিয়ে-চুরিয়ে নয়। একদম প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিয়েই বিয়ে করতে চান, এই তো বলবেন?
আলতাফ হোসেন এবার যেন খানিকটা অসহিষ্ণুই হয়ে গেলেন, আমার কথাটা তো আপনি শুনবেন অনু?
অনু শান্ত গলায় বলল, যে কথাগুলো আপনি জানেন, সেই একই কথা আপনার বারবার শুনতে ইচ্ছে হয় আলতাফ ভাই?
আপনি কী করে এত নিশ্চিত হলেন যে আমি আপনাকে এই কথাগুলোই বলব?
কারণ, ঠিক এই কথাগুলোই আপনি এর আগেও অনেকজনকে বলেছেন। কেউ কেউ আপনার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে, কেউ কেউ দেয়নি।
আপনি কিন্তু এবার বাউন্ডারি ক্রস করছেন অনু।
আমি জানি আলতাফ ভাই, কিন্তু কী করব বলুন? সারাজীবন নানারকম ভয়ে সীমা অতিক্রম করতে পারিনি কখনো। কতরকম ভয় যে সারাক্ষণ ঘিরে রাখে! এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে চাকরির ভয়, চাকরি হারালে খাবো কী? এখন তো অ্যাটলিস্ট চাকরির ভয়টা নাই। তো, বাউন্ডারি ক্রস করতে আর ভয় কী?
অনু, খুব সহজ, সাধারণ একটা বিষয়কে আপনি শুধু শুধু জটিল করছেন।
আমার জগতটাই জটিল আলতাফ ভাই। অনু হাসলো।
আলতাফ হোসেন বললেন, এগুলো আপনাকে কে বলেছে, বলবেন?
কে বলেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভুল কিছু বলেছি কি-না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
অবশ্যই আপনি ভুল অনেক কিছুই বলেছেন। আমার স্ত্রীকে নিয়ে আপনি যে নোংরা কথাগুলো বলেছেন সেটা তার জন্য অসম্মানজনক। আপনি আমার অপরাধের জন্য তাকে অসম্মান করতে পারেন না।
অনু সামান্য সামনে এগিয়ে এলো। তারপর টেবিলের ওপর থেকে স্বচ্ছ পেপারওয়েটটা হাতে তুলে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। অনুর আচরণে কেমন একটা বেপরোয়া কিন্তু শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন ভাব। সে বলল, আপনি নিজেও জানেন, আমি মিথ্যা কিছু বলিনি। শুধুমাত্র সিম্প্যাথি ক্যারি করার জন্য আপনার স্ত্রীকে নিয়ে এই নোংরা জঘন্য কথাগুলো আপনিই অন্য মেয়েদেরকে বলে বেড়ান। এখন শুধু শুধু কেন ভান করছেন? নায়লা আপুর কথা মনে আছে আলতাফ ভাই? এখানে অ্যাডমিনে জব করতেন? প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন, হাজবেন্ডের তখনো চাকরি-বাকরি কিছু নেই। ফলে এখানকার চাকরিটাই ছিল তার একমাত্র অবলম্বন। এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তার। আর তার সেই অসহায়ত্বের সুযোগটাই আপনি নিতে চাইছিলেন, মনে আছে?
আলতাফ হোসেন এবার রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, আপনি বুঝতে পারছেন, আপনি কি বলছেন?
জি, পারছি। নায়লা আপুকে ফাঁদে ফেলতে না পেরে সেই প্রতিশোধটা আপনি কীভাবে নিয়েছিলেন, মনে আছে? প্রেগন্যান্সির সময় সে ম্যাটারিনিটি লিভে গেলে আপনি নানান কারণ দেখিয়ে তার টেম্পোরারি রিপ্লেসমেন্টের। বদলে পারমানেন্টলি একজনকে নিয়ে নিলেন। মনে আছে আপনার? নায়লা আপু তখন তার বাচ্চার অসুস্থতা নিয়ে ভয়াবহ বিপদে। হাতে একটা পয়সা নেই, বাচ্চার দুধ কেনার টাকা নেই। সেই সময় আপনি তার চাকরিটাও কেড়ে নিলেন। আপনার মনে আছে আলতাফ ভাই?
অনু মুহূর্তখানেক বিরতি নিয়ে আবার বলল, শুধু শুধু একটা মিথ্যে ঢাকতে কেন হাজারটা মিথ্যে বলছেন? এসব কথা কম বেশি, আগে পরে সবাইই জানে আলতাফ ভাই। আমিও অনেক দেরিতেই জেনেছি। আসলে আমাদের তো নানান ভয় থাকে, ওই ভয় থেকে আমরা বের হতে পারি না। আর পারি না বলেই এগুলো সহজে প্রকাশ্যে আসে না। হয় আমরা চুপচাপ সয়ে যাই, না হয় সরে যাই। নায়লা আপুও সরেই গিয়েছিল। আরো কতজন চুপচাপ সয়ে গিয়েছিল কিংবা তার মতোই সরে গিয়েছিল কে জানে!
আলতাফ হোসেন এবার আর কথা বলার চেষ্টা করলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন যেমন ছিলেন তেমনই। অনু হাতের পেপারওয়েটটা টেবিলের ওপর রেখে দিতে দিতে বলল, আমার ক্ষমতা থাকলে আমি আপনার চেহারাটা প্রকাশ্যে উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু সেই ক্ষমতা আমার নেই। আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কেউ আমার পক্ষে এসে কথাও বলবে না। অভিযোগও করবে না। আমাকেও চুপচাপ সরেই যেতে হবে আলতাফ ভাই।
অনু সামান্য থেমে হঠাৎ উষ্ণ গলায় বলল, আপনি কী একটু আমার কাছে আসবেন আলতাফ ভাই? আপনাকে আমি একটা জরুরি কথা বলব, ভীষণ জরুরি।
আলতাফ হোসেন যুগপৎ ভীত এবং কৌতূহলী দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকালেন, কী কথা?
ভয় পাচ্ছেন? আপনি ভালো করেই জানেন, আপনার কোনো ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই।
আপনি বলুন।
অনু হাসলো, আপনার অফিসে, আপনার ঘরে বসে আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন, কী হাস্যকর না আলতাফ ভাই? লোকে শুনলে কী বলবে বলুন?
আলতাফ হোসেন তাও এগুলেন না। অনুই আবার বলল, কথাটা শোনা আপনার খুব জরুরি আলতাফ ভাই।
আলতাফ হোসেন দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে টেবিলের পাশ ঘেঁষে বের হয়ে দু’পা সামনে এসে দাঁড়ালেন। অনুও সামান্য সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর হঠাৎ করেই সেই নিস্তব্ধতা চিড়ে বিকট শব্দে আলতাফ হোসেনের চোখের চশমাটা ছিটকে গিয়ে পড়লো দূরে মেঝেতে। চশমার ভাঙা কাঁচগুলো ছড়িয়ে পড়লো চারধারে।
আলতাফ হোসেন একদম শেষ মুহূর্তে ঘটনা যতক্ষণে আঁচ করতে পেরেছিলেন, ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। তিনি চকিতে একবার তার চশমাটা ধরে রাখতে চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। চশমা ছিটকে পড়েছে। কয়েক হাত দূরে। আলতাফ হোসেন একহাতে নিজের গাল চেপে ধরে হতভম্ব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে অনু তার গালে চড় বসাতে পারে! তিনি দীর্ঘসময় বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইলেন। অনু তাকে ধাতস্ত হওয়ার সময় দিলো। কিন্তু চশমাবিহীন আলতাফ হোসেন অনুকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন না। তিনি দেখতে পেলেন একটা অস্পষ্ট অবয়বের মতো। তবে আলতাফ হোসেন স্পষ্ট টের পাচ্ছেন, চশমার ফ্রেমের আঘাতে তার নাকের উপরের অংশ সামান্য কেটে গেছে। সেই কাটা অংশ থেকে সরু প্রস্রবনের মতো রক্তের ধারা নেমে আসছে। অনু টেবিলের টিবক্সটা আলতাফ হোসেনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিলাম আলতাফ ভাই।