৩৯-৪০. বাসনা যদি তীব্র হয়

বাসনা যদি তীব্র হয় এবং উৎসাহ প্রবল তাহলে কোনও বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। নতুন চেহারার নিরাময় নির্মাণের কাজ তাই দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। মূলত ডাক্তার তামাং বেশি সময় দিচ্ছিলেন। নতুন বাড়ির প্ল্যান তৈরি করিয়ে অনুমতি নেওয়া থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগ করার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। এতকাল নিরাময়ের যে চেহারার সঙ্গে স্থানীয় মানুষ পরিচিত ছিল সেটা বদলে যেতে লাগল। এলিজাবেথ রোজ সকালে একবার আসেন, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন, তারপর নিজের কাজে চলে যান। নব-নিরাময়ের পরিচালনা সমিতিতে তিনি নিজেকে যুক্ত করেননি। দুই ডাক্তারের সঙ্গে স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যানকে রাখার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের নাগরিক নন বসেই নিজেকে সরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতাকে সমিতিতে নেওয়ার ব্যাপারে ডাক্তার তামাংয়ের আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত পরিচালন সমিতি গঠিত হয়েছে দুই ডাক্তার, চার্চের ফাদার এবং স্থানীয় দুই ব্যক্তিকে নিয়ে যাঁদের বিরুদ্ধে কারও কিছু অভিযোগ নেই।

কী কারণে নিরাময়ের চেহারা বদলে যাচ্ছে সেটা প্রচারিত হয়েছিল। আর তারপরেই অভিনব ঘটনা ঘটল। প্রথমে দুজন স্থানীয় পাহাড়ি মানুষ এগিয়ে এল। তখন সকালবেলা। এলিজাবেথ নিরাময়ে এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ওরা এসে নমস্কার করে সামনে দাঁড়াল। একজন বিনীত গলায় বলল, আমরা কাজ করতে চাই।

ডাক্তার জানতে চাইলেন, কী কাজ করবে তোমরা?

আপনারা আমাদের উপকারের জন্যে হাসপাতাল বানাচ্ছেন শুনলাম। আমাদের জন্যে যখন হচ্ছে তখন আমরা চুপচাপ বসে থাকব কেন?

ডাক্তার বললেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু ভাই, আপনারা কী বাড়ি বানাবার কাজ এর আগে করেছেন? করলে কন্ট্রাকটারকে আপনাদের কথা বলতে পারি।

দ্বিতীয়জন বলল, না, আমরা একাজ কখনও করিনি।

সেক্ষেত্রে তো কন্ট্রাকটার রাজি হবেন না। আমরা ওঁর ওপর দায়িত্ব দিয়েছি বাড়ি তৈরি করার জন্যে। উনি অভিজ্ঞ লোক ছাড়া নেবেন কেন?

প্রথমজন বলল, ইট বইতে অভিজ্ঞতা লাগে নাকি? আমরা মিস্ত্রির কাজ চাইছি না, হেল্পার হয়ে কাজ করতে চাই।

এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কী কাজ করেন?

দ্বিতীয়জন হাসল, আমরা দুজনে আগে সরকারি চাকরি করতাম এখন রিটায়ার করেছি। হেল্পার হিসেবে যাদের নেওয়া হবে তারা তো টাকা ছাড়া কাজ করবে না। আমরা বাড়িতে বসে আছি, নিজেদের হাসপাতালের জন্য কাজ করতে ভাল লাগবে।

এলিজাবেথ মন দিয়ে শুনছিলেন। এই কয়েক মাসে তিনি স্থানীয় ভাষা অনেকটাই বুঝতে পারছেন, বলতে পারেন না স্বচ্ছন্দভঙ্গিতে। এখন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি কাজ করে টাকা নেবেন না?

লোক দুটো একসঙ্গে প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। দ্বিতীয়জন বলল, আমাদের জন্যে হাসপাতাল তৈরি করছেন আপনারা, শহরের হাসপাতালের মতো নয়, আর আমরা চুপচাপ বসে থাকব? আমাদের জন্যে হাসপাতাল হচ্ছে আমরা তাই কাজ করব, কোনও টাকাপয়সা আপনাদের দিতে হবে না।

এলিজাবেথ ডাক্তারের দিকে তাকাল। এরকম প্রস্তাব যে অযাচিতভাবে আসবে তা ডাক্তার কল্পনাও করেননি। তিনি এক পা এগোলেন, আপনারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করবেন?

হ্যাঁ, যতদিন শরীর পারবে করব।

এলিজাবেথ ওদের সঙ্গে করমর্দন করলেন, আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনারা যাতে কাজ করতে পারেন সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগী হব।

লোক দুটো নমস্কার করে চলে যাওয়ার আগে বলে গেল ওরা আবার এসে খবর নেবে কবে কাজ শুরু করতে হবে। ওরা ওপরে উঠে যাচ্ছিল, সেদিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার।

এলিজাবেথ হাসলেন, অদ্ভুত কেন বলছেন? আপনার নিরাময়ের ব্লাড ব্যাঙ্কে যেসব স্থানীয় মানুষ ডোনেট করে তারা কেউ কি পয়সা নিয়েছে?

ডাক্তার মাথা নাড়লেন, না নেয়নি। কিন্তু রক্ত দিয়ে ওরা ভাবে যে একটা ভাল কাজ করল, মানুষের প্রাণ বাঁচাল। মারা যাওয়ার পর ঈশ্বর এই ভাল কাজটার কথা মনে রেখে স্বর্গে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু দিনের পর দিন একটা পয়সা না নিয়ে কেউ পরিশ্রম করতে আসবে, এটা আমি ভাবতে পারিনি।

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন লাগছে?

ভাল। মানুষের ওপর বিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে।

এইসময় সায়ন বেরিয়ে এল নিরাময় থেকে। এখন তাকে বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে। তার পরনে প্যান্ট, পুলওভার, মাফলার এবং স্নিকার।

এলিজাবেথ বললেন, গুড মর্নিং সায়ন।

গুড মর্নিং। আপনি কেমন আছেন?

 খুব ভাল। জানো, এইমাত্র দুজন স্থানীয় মানুষ নিরাময়ের জন্যে ভলান্টারি সার্ভিস দেবে বলে জানিয়ে গেল। এলিজাবেথ হাসলেন।

বাঃ। বাড়ি তৈরির কাজ কবে শুরু হবে?

ডাক্তার বললেন, আর দিন পাঁচেক পরেই। তুমি কোথাও যাচ্ছ?

আমার আর ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

তোমাকে তো বলেছি, একটু হাঁটাহাটি করতে পারো। ডাক্তার এলিজাবেথের দিকে তাকালেন, আচ্ছা। আমাকে একটু শহরে যেতে হবে।

এলিজাবেথ মাথা নাড়তে ডাক্তার ভেতরে ঢুকে গেলেন। এলিজাবেথ হাঁটা শুরু করলে সায়ন তাঁর সঙ্গী হল। এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, এখন শরীরে কী কী অসুবিধে হচ্ছে?

সায়ন মাথা নাড়ল, তেমন কোনও অসুবিধে নেই। মাঝে মাঝে ক্লান্তি লাগে।

ওপর থেকে দুজন মানুষ নেমে আসছিল। তাদের একজন সায়নকে দেখে মাথা নাড়ল, যিশু মহান।

সায়ন বলল, যিশু মহান।

ওরা দাঁড়াল না কিন্তু সায়ন দাঁড়িয়ে গেল। সামনেই মিস্টার ব্রাউনের বাড়ি। বাড়ির সব দরজা জানলা বম্ব। আশ্চর্য, ভুটো কোথাও নেই। নিজের অসুস্থতার কারণে ভুটোর কথা ভুলেও গিয়েছিল সে। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেন মিস্টার ব্রাউন। এই পথ দিয়ে যারাই যাওয়া আসা করত তাদের যিশুর গুণকীর্তন করে কুশল জিজ্ঞাসা করতেন তিনি। আজ সেই মানুষটা পৃথিবীর কোথাও নেই।

সায়নের দৃষ্টি অনুসরণ করে এলিজাবেথ আন্দাজ করলেন, ওঁর ছেলেরা কেউ আসেনি বলে মনে হচ্ছে।

সায়ন তাকাল শুনছিলাম মিস্টার ব্রাউনের ছেলেরা এই বাড়ি বিক্রি করে দেবে। এটা তো নিরাময়ের খুব কাছে, এখানে মিস্টার ব্রাউনের নামে ডিসপেন্সারি করা যায় না? করলে খুব ভাল হত।

নিশ্চয়ই ভাল হত। হাঁটতে আরম্ভ করলেন এলিজাবেথ, আমি জানি না ওরা কত দাম চাইবে। নতুন নিরাময় তৈরি করতে যে খরচ হচ্ছে তা সামলে এই বাড়ি কিনে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা জানি না।

রাস্তাটা মাঝে মাঝে খাড়াই উঠে গেছে। দুপাশের বাড়িগুলোর সামনে বাচ্চারা, মেয়েরা দাঁড়িয়েছিল। এলিজাবেথ যে তাদের বেশ পরিচিত তা হাসিতে বোঝা যাচ্ছিল। সায়ন সেই বাড়িটার সামনে পৌঁছোতেই দেখতে পেল এক মহিলা এগিয়ে আসছে। একেবারে সামনে এসে হাতজোড় করে বলল, আপনি আমার কাছে ভগবান। আপনার দয়ায় আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। বলতে বলতে গলা ধরে এল তার।

সায়ন প্রতিবাদ করল, ছি ছি। আপনি এসব কথা বলবেন না। আমি ভগবান হতে পারি? আমি সাধারণ মানুষ। অসুখ বাড়লে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। আপনি রাজি না হয়ে ভুল করছিলেন। নিয়ে গিয়েছিলেন বলেই আপনার ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে।

মহিলা মাথা নাড়লেন। ওটা হাসপাতাল নয়, নরকে যাওয়ার স্টেশন। দশজন গেলে আটজন ফেরে না। আমার আগের বাচ্চাও ফেরেনি। কিন্তু আমাদের আর চিন্তা নেই। এই মেমসাহেব শুনছি আমাদের জন্যেই হাসপাতাল বানাচ্ছেন। কথাটা কি সত্যি মেমসাহেব?

এলিজাবেথ হাসলেন, আপনি ঠিক শুনেছেন।

ইতিমধ্যে ওদের ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল। একজন জিজ্ঞাসা করল, ওখানে গেলে আমাদের কত টাকা দিতে হবে?

এলিজাবেথ বললেন, কাউকে কোনও টাকা দিতে হবে না। কিন্তু প্রত্যেককে একটা কার্ড করাতে হবে আগে থেকে। তার জন্যে লাগবে একটা টাকা। সেই কার্ড দেখালে হাসপাতালে ভর্তি করে নেওয়া হবে। তবে হ্যাঁ, আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব চিকিৎসা করার তা করা হবে। বুঝতেই পারছেন, আমাদের ক্ষমতা বেশি নয়।

মহিলা হাত তুলে সায়নকে দেখাল, উনি থাকবেন তো?

এলিজাবেথ মাথা নাড়লেন, নিশ্চয়ই থাকবে।

ভিড় ছাড়িয়ে চার্চের কাছে উঠে এসে এলিজাবেথ বললেন, সায়ন আমি শুনেছিলাম এবং দেখলাম, এখানকার সাধারণ মানুষ তোমাকে খুব ভালবাসে। কেউ কেউ নাকি তোমার মধ্যে ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পায়। তুমি নিশ্চয়ই জানো।

সায়ন হাসল, হ্যাঁ, একদিন কিছু শহরের গুণ্ডা নিরাময়ের ওপর হামলা করতে এসেছিল, আমি বাধা দিতে চেয়েছিলাম। তাই দেখে অনেকেই আমাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু আমার মধ্যে ঈশ্বরের ছায়া যারা দেখতে পায় তাদের কী করে বোঝাই অসুস্থ হলে আমার শরীরে কোনও শক্তি থাকে না।

ঠিক। হয়তো কোনও প্রচার, কোনও গুজব তোমাকে নিয়ে ছড়িয়েছিল এবং কেউ কেউ সেটাকে বিশ্বাস করে বসে আছে। কিন্তু আমি বলছিলাম…

এলিজাবেথ থেমে গেলেন। চার্চের ভেতর থেকে ফাদার বেরিয়ে আসছেন। তাঁর পেছনে দুজন লোক। তারা ফাদারকে কোনও কিছু অনুনয় করে বলে যাচ্ছেন হাঁটতে হাঁটতে আর ফাদার ক্রমাগত মাথা নাড়ছেন। এদের দেখতে পেয়ে ফাদার বললেন, গুড মর্নিং, কেমন আছেন আপনি? কেমন আছ সায়ন? ওরা দুজনেই গুড মর্নিং বলে জানিয়ে দিল ভাল আছে। ফাদার বললেন, ডক্টর তামাং ফোন করেছিলেন। চেয়ারম্যান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমাদের উদ্যোগকে সমর্থন করবেন। এটা খুব ভাল খবর।

এলিজাবেথ বললেন, ওঁর সমর্থন পেয়ে মনের জোর বেড়ে গেছে।

ফাদার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার সঙ্গে চেয়ারম্যানের পরিচয় আছে?

এলিজাবেথ মাথা নাড়লেন, না। তবে শুনেছি আমার বিরুদ্ধে কেউ কেউ ওঁকে কিছু বলেছেন। আসলে বিদেশি বলে অনেকেই আমাকে সন্দেহের চোখে দ্যাখেন।

এইসময় লোক দুটোর একজন নিচু গলায় কিছু বলতে ফাদার ঘুরে দাঁড়ালেন, দেখুন, আপনাদের আমি অনেকবার বলেছি এ ব্যাপারে চার্চের কিছু করার নেই।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, তাহলে আমরা মরে যাব ফাদার।

এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

ফাদার বললেন, এরা দুই ভাই। বাড়ি বাঁধা রেখে কারও কাছে টাকা ধার করেছিল এবং যথারীতি সেটা শোধ করতে পারেনি। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে সেই লোক বাড়ির দখল নিতে চাইছে। ওদের তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছে। ওরা পার্টি অফিসে গিয়েছিল। তারা বলেছে এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। এখন আমার কাছে এসে অনুরোধ করছে যেন চার্চ থেকে ওদের সাহায্য করি।

সায়ন চুপচাপ শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, আপনারা টাকা ধার নিয়েছিলেন কেন?

লোক দুটো পরস্পরের দিকে তাকাল। ওদের একজন ফাদারের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় কিছু জিজ্ঞাসা করতেই ফাদার মাথা নাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা প্রায় দৌড়ে এসে সায়নের পায়ের ওপর পড়ে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। এমন বিব্রত সায়ন কখনও হয়নি। সে চেষ্টা করেও লোকটাকে ছাড়াতে পারছে না। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় লোকটিও যোগ দিয়েছে। ওরা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, আমাদের কেউ নেই। যার কেউ না থাকে তার ভগবান থাকে। আমার ছেলেটার পেটে ক্যানসার হয়েছিল। তাকে সারাবার জন্যে আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম, ভেলোর গিয়েছিলাম। চিকিৎসার জন্যে বাড়ি বাঁধা রেখে টাকা ধার করতে হয়েছিল। কিন্তু ছেলেটা বাঁচল না আর এখন বাড়ি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আপনাকে মা মেরি নিজের হাতে আশীর্বাদ করেছেন। আপনি চাইলে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি আমাদের লাথি মারুন তবু আপনার কৃপা আমরা চাই।

ফাদার খুব ধমক লাগালেন তবু লোক দুটো সায়নের পা ছাড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত সায়ন রুক্ষ গলায় বলল, আপনারা যদি সরে না দাঁড়ান তাহলে আমি রাগ করব।

এবার যেন ভয় পেয়েই ওরা সরে দাঁড়াল কিন্তু দুজনের হাত বুকের ওপর নমস্কারের ভঙ্গিতে রয়েছে, মাথা নিচু, গলায় চাপা কান্নার সুর। সায়ন দেখল এলিজাবেথ তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। সে গম্ভীর গলায় বলল, আমি মা মেরির আশীর্বাদ পেয়েছি কিনা তা জানি না। অন্তত আমি টের পাইনি। তা ছাড়া তিনি খৃস্টানদের আরাধ্য, খামোকা হিন্দু ছেলেকে আশীর্বাদ করতে যাবেন কেন? আপনাদের কি লক্ষ্মী, নারায়ণ, শিব, দুর্গা আশীর্বাদ করেন?

এমন কথা ওরা কখনও শোনেনি। এই নামগুলো এলিজাবেথেরও অজানা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা?

ফাদার বললেন, হিন্দুদের দেবদেবী।

সায়ন আবার জিজ্ঞাসা করল, আপনি যদি শোনেন কোনও কালীমন্দিরে গিয়ে পুজো দিলে বা কোনও মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করলে আপনার সমস্যার সমাধান হবে তাহলে কি সেটা করবেন?

প্রথমজন বলল, কখনও করিনি কিন্তু–

আমি তো খ্রিস্টান নই। আমার কাছে সাহায্য চাইছেন কেন?

মাদার মেরির সবাই সন্তান।

তাহলে মাদার মেরির কাছে গিয়ে প্রার্থনা করুন।

আমরা করেছি। কিন্তু আমরা অত্যন্ত সাধারণ লোক, তিনি শুনতে পাননি।

 তিনি কোনওদিন শুনতে পাবেন না। আপনারা সমস্যা তৈরি করবেন আর তাঁকে যদি সেই সমস্যার সমাধান করে যেতে হয় তাহলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন। আপনাদের সমস্যার সমাধান আপনাদেরই করতে হবে।

কী ভাবে?

কাজ করে। যে মানুষ কাজ না করে শুধু প্রার্থনা করে সমস্যার সমাধান চান তাকে যিশু, মেরি, ভগবান, আল্লা কেউ পছন্দ করেন বলে আমার মনে হয় না। এই দেখুন, ফাদার প্রার্থনা করেন, আপনাদের উপাসনার সময় পরিচালনা করেন কিন্তু কারও কোনও বিপদ হয়েছে জানতে পারলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাতের পর রাত জেগে সেবা করেন মৃত্যুপথযাত্রীকে। লোক দুটো পরস্পরের দিকে তাকাল।

দ্বিতীয়জন বলল, আপনাদের সাধুরা তো শুধু ভগবানের পুজো করে, কাজকর্ম করে না।

সায়ন মাথা নাড়ল, তারা কোনওদিন ভগবানের কাছে পৌঁছোতে পারে না।

প্রথমজন বলল, কিন্তু আমরা কী কাজ করলে বাড়িটাকে বাঁচাতে পারব?

এবার ফাদার বললেন, বাড়িটার বিনিময়ে ওরা ষাট হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। দিনরাত কাজ করলেও ওরা তিন বছরের মধ্যে টাকাটা জমিয়ে শোধ করতে পারবে না।

আপনাদের আরও ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই আছে? সায়ন জিজ্ঞাসা করল।

 হ্যাঁ। তাই তো আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয়জন বলল।

দেখুন, এই সমস্যার সুন্দর সমাধান আছে। আপনারা যদি কারও কাছে ষাট হাজার টাকা ধার করে বাড়ি ছাড়িয়ে নেন তাহলে আগামী তিন বছর কঠিন পরিশ্রম করে টাকাটা শোধ করতে পারেন, তারপরে সুদও দিতে হতে পারে। এই তিন বছর আপনাদের ছেলেমেয়েদের সব দিক থেকে বঞ্চিত করতে বাধ্য হবেন আপনারা। ঠিক তো? তাই বাড়িটার মায়া ছেড়ে দিন। আপনারা আর একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখানে চলে যান। পরিশ্রম করুন। যা রোজগার করবেন তার সিকিভাগ জমান বাকিটা পরিবারের সবার জন্যে খরচ করুন। ওই সিকিভাগ জমানো টাকায় দশ বছর পরে দেখবেন আপনাদের নিজেদের জন্যে বাড়ি কিনতে পারবেন। সায়ন হাসল।

প্রথমজন মন দিয়ে শুনছিল, বলল, এ কেমন কথা। এই বাড়ি আমাদের ঠাকুরদা কিনেছিল। পৈতৃক বাড়ি হাতছাড়া হয়ে গেলে তাকে অপমান করা হবে। ওই বাড়ির সঙ্গে আমাদের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

আপনাদের ঠাকুরদা যার কাছ থেকে কিনেছিলেন সেটা তো তারও পৈতৃক বাড়ি ছিল। তিনি যার কাছে কিনেছিলেন–হয়তো কেনেননি, জমি পড়ে ছিল, বাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। এই পৃথিবীর সমস্ত জমি এক অর্থে আমাদের পৈতৃক জমি। ভবিষ্যতে যে জমিতে আপনারা বাড়ি বানাবেন সেটাও পৈতৃক জমিতেই তৈরি হবে। আমার কথা শুনুন, আপনারা সর্বনাশ থেকে বেঁচে যাবেন। এতে মা মেরি খুশি হবেন। সায়ন বলল।

আপনি বলছেন?

হ্যাঁ।

ওরা বেশ ধন্দে পড়েছে বোঝা গেল। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে গেল। ফাদার হাত বাড়ালেন, থ্যাঙ্ক ইউ সায়ন, তুমি আমাকে অন্তত একটা সমস্যা থেকে রক্ষা করলে। কিন্তু তুমি এ কী কথা বললে? খ্রিস্টানরা যাঁকে আরাধনা করে তিনি তোমাকে আশীর্বাদ করবেন না বলতে পারলে?

সায়ন হাসল, আপনি যদি মার্জনা করেন তো একটা কথা বলব।

নিশ্চয়ই।

কলকাতায় কোনও রাজনৈতিক সভায় কম্যুনিস্টরা যখন বক্তৃতা করে তখন এমন এমন শব্দ বলে যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। ওই শব্দগুলো শুনলেই নেতাদের বিদেশি বিদেশি বলে ভাবতে শুরু করে তারা। ওই শব্দগুলো কম্যুনিজমের তত্ত্বের কথা। ইদানীং ইংরেজির বাংলা অনুবাদ হয়েছে সেগুলো। আজন্ম যা শোনেনি এখন সেটা শুনলে হজম করা মুশকিল। তাই কম্যুনিস্ট নেতারা সেই সব নির্বাচিত শব্দ ব্যবহার না করে তার অর্থ জনসাধারণের পরিচিত শব্দে বুঝিয়ে বললে অনেক বেশি কাজ দিত। তেমনই এখানকার অনেক মানুষ আমার সম্পর্কে যখন ভুল বিশ্বাস লালন করে তখন দেখেছি আমি হিন্দু বললে তারা হকচকিয়ে যায়। পৃথিবীতে যেন একটাই নিয়ম, যিশু মা মেরি খ্রিস্টানদের আশীর্বাদ করবেন, আল্লা মুসলমানদের আর হিন্দুদের দেবদেবী হিন্দুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।

ফাদার বললেন, চমৎকার। তোমার সঙ্গে আমি একমত। কিন্তু এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হল না। তুমি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করো না মা মেরি শুধু খ্রিস্টানদের কথাই ভাবেন!

সায়ন ফাদারের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নাড়ল।

তার অর্থ বুঝতে না পেরে ফাদার আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল?

আমার কথা আপনার পছন্দ হবে না ফাদার।

সেটা আমার ব্যাপার, তুমি স্বচ্ছন্দে বলতে পারো।

দেখুন, মৃত্যুর পর কেউ বেঁচে থাকে না। মৃত্যুর আগে তিনি যে উপদেশ দিয়ে যান সেটাই বেঁচে থাকে। সেই উপদেশে মানুষ যদি তার পথ খুঁজে পায় তাহলে তাঁকে স্মরণ করে। অর্থাৎ মানুষই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যুর পরে কোথাও যখন তাঁর অস্তিত্ব নেই তখন তিনি কী করে মানুষের কথা ভাববেন? আমাদের হিন্দুদের দেবদেবীরা কল্পনায় তৈরি, কোথাও তাঁদের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু তবু কিছু মানুষ নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে তাঁদেরই শরণাপন্ন হন আর ভাবেন অলৌকিক কিছু হয়ে যাবে। এইসব অন্ধদের চোখ কোনওদিন খুলবে না। কিন্তু গৌতম বুদ্ধ, যিশু খ্রিস্ট অথবা মা মেরি পৃথিবীতে ছিলেন। আমি জানি না মা মেরি কোনও অলৌকিক কাণ্ড করেছেন কি না। তবে যেহেতু তিনি অলৌকিক উপায়ে যিশুকে গর্ভে ধারণ করে জন্ম দিয়েছেন তাই তাঁকে মাদারের সম্মান দেওয়া হয়েছে। যিশু মানুষকে ভালবেসেছিলেন। ভালবাসতে বলেছিলেন। মানুষের উপকার করতে চেয়েছিলেন এবং এই কারণে তাঁকে যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর শরীর মাটিতে মিশে যাওয়ার পর তাঁর অস্তিত্ব শুধু তাঁর বাণীতে, করে যাওয়া কাজে। এখন তাঁর মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলে তিনি কী করে শুনতে পাবেন? কিন্তু তবু মানুষ তাই করছে। যেভাবে শিবদুর্গার সামনে হিন্দুরা করে।

ফাদার একটু গম্ভীর হলেন, তার মানে তুমি গির্জার বিরুদ্ধে?

 শুধু গির্জা বলছেন কেন, মন্দিরের কথাও বলুন। আমি এর বিরুদ্ধে নই। কারণ এইসব উপাসনালয় মানুষকে একত্রিত করে, শৃঙ্খলাপরায়ণ করে। তাদের একটা মানসিক অবলম্বন দেয়। এই পর্যন্ত।

তার মানে তুমি ঈশ্বরের প্রতি অনুগত নও?

সায়ন হাসল, তিনি কোথায় আছেন জানি না, কীভাবে অনুগত হব? ঈশ্বরকে তো আমরাই সৃষ্টি করেছি। ভাবুন তো ফাদার, পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণী সৃষ্ট হয়েছে শুধু বিবর্তনের মাধ্যমে এমনকী মানুষও। তখন কি ঈশ্বর এখানে ঘুরে বেড়াতেন? বাঘ ভাল্লুক অথবা হরিণরা কি তাঁর মহিমা প্রচার করত? আপনি বিবেকানন্দের লেখা পড়েছেন ফাদার?

ফাদার মাথা নেড়ে না বললেন।

এই যে ইনি, আমেরিকা থেকে এখানে এসে থেকে গেলেন। এঁর জন্যে শুনেছি পাহাড়ি গ্রামগুলোর মানুষ একটু ভালভাবে বাঁচতে পারছে, এর জন্যে নিরাময় নতুন চেহারা নিচ্ছে, এঁর এই কাজটাই হল ঈশ্বরের কাজ।

ফাদার হাসলেন, আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারতাম। কিন্তু সেই তর্কের মীমাংসা হত না। আবার মজার কথা হল, আমাদের দুজনের লক্ষ্য একই। সাধারণ মানুষ অন্ধকারে চলার সময় একটা আলোর সাহায্য চায়। মনের আলোয় পথ দেখার শক্তি তো সবার থাকে না। আচ্ছা, অনেক দেরি করিয়ে দিলাম। চলি।

ফাদার চলে গেলে বিস্মিত এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, তুমি এত কথা শিখলে কী করে?

আমি তো শিখিনি কিছু। অসুস্থ হওয়ার পর বই পড়েছি আর ভেবেছি। আমি যা বললাম তা অনেক মানুষ আগেই বলে গেছেন। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, তুমি মন দিয়ে যে কাজটা করবে তার মধ্যেই ঈশ্বর থাকবেন। এই কথাটা আমার খুব ভাল লেগেছে।

ওরা আবার হাঁটা শুরু করল। দূর থেকে দেখা গেল এলিজাবেথের বাড়ির সামনে একটা ছোটখাটো জটলা। বিষ্ণুপ্ৰসাদ আর ম্যাথুজ তাদের কিছু বোঝাচ্ছে। ওরা দূর থেকে এলিজাবেথকে দেখতে পেয়ে চুপ করে গেল। কাছে গিয়ে এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

লোকগুলো সঙ্গে সঙ্গে হাঁ হাঁ করে উঠল। একসঙ্গে সবাই কথা বলায় কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। এলিজাবেথ একটুও বিরক্ত হলেন না। বিষ্ণুপ্ৰসাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে থামিয়ে এলিজাবেথ ভাঙা ভাঙা ভাষায় বললেন, না। তুমি বলবে না। আমি ওর মুখ থেকে শুনতে চাই। হ্যাঁ ভাই কী হয়েছে?

এবার সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে অদ্ভুত গলায় বলল, আমার ভাই কোনও দোষ করেনি। ও এতদিন জ্বরে ভুগছিল। মাদাম তাকে ওষুধ দিয়েছিলেন। আজ সকালে পুলিশ এসে তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছে।

এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন ধরেছে কিছু বলেছে?

না। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তো শাসিয়েছে আমাদেরও ধরবে।

তোমরা থানায় গিয়েছিলে?

না।

কেন?

সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে হতাশাজনক শব্দ তুলল। লোকটা বলল, থানায় গেলে ওরা আমাদের সঙ্গে কথাই বলবে না।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, আমি ওদের বলেছিলাম পঞ্চায়েতের কাছে যেতে। প্রধান থানায় গেলে পুলিশ নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলবে।

লোকটা বলল, প্রধান তো এখন বেশির ভাগ সময় শহরে থাকে। থানা থেকে আমরা তার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম সে নেই।

এলিজাবেথ ম্যাথুজকে ডাকলেন, তুমি গিয়ে কথা বলবে?

ম্যাথুজ ঘাড় নাড়ল, তার যেতে আপত্তি নেই। এইসময় সিমি ওপর থেকে নেমে আসছিল। এত লোকজন, উত্তেজনা এ সবের তোয়াক্কা না করে সায়নকে দেখতে পেয়ে সে ছুটে এসে হাত জড়িয়ে ধরল, আরেব্বাস, তুমি, ওঃ, কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম। শুনেছিলাম তুমি নাকি আবার অসুস্থ হয়েছিলে?

সায়ন ওর এই উত্তাপে একটু লজ্জা পেয়ে বলল, আমার অসুস্থতা তো মেঘ কিংবা রোদের মতন, কখন কে থাকবে বলা যায় না।

ম্যাথুজ লোকগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সায়ন তাকে দাঁড়াতে বলল। তারপর এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি ওদের সঙ্গে যেতে পারি?

স্বচ্ছন্দে। কিন্তু থানা তো অনেক দূরে। তোমার কষ্ট হবে না?

না। আর একটা কথা, আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই।

বাঃ, খুব ভাল কথা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলব। এলিজাবেথ বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

সিমি উচ্ছ্বসিত হল, তুমি সত্যি কাজ করবে?

হ্যাঁ। আমি কিছু করতে চাই।

খুব খুশি হলাম। তোমাকে সব সময় দেখা যাবে।

এত খুশি হচ্ছ অথচ আমাকে দেখতে নিরাময়ে যাওনি!

কী করে যাব? ওখানে গেলেই মানুষটার কথা মনে পড়ে যায়। এত কষ্ট হয় যে কী বলব। তার ওপর ভুটোটা এখন আমার কাছে আছে। ওকে দেখতে হয়।

ভুটো তোমার কাছে আছে?

 হ্যাঁ। একজন এসে বলল ভুটো নাকি মিস্টার ব্রাউনের কবরের পাশে চুপচাপ বসে আছে। শুনে আমি গিয়ে নিয়ে এলাম।

সিমির আরও কথা বলার ইচ্ছে ছিল কিন্তু লোকগুলো অসহিষ্ণু হয়ে ওঠায় ম্যাথুজ নিচু গলায় তাড়া দিল। অতএব সায়নকে বিদায় নিতে হল। লোকগুলো আগে আগে হাঁটছিল। পেছনে ম্যাথুজ আর সায়ন। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে যাওয়ায় পৃথিবীটা ছায়াচ্ছন্ন। এখন পথ শুধু নীচে নেমে যাচ্ছে। শরীরের ওজন পেছনের দিকে রাখলে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না হাঁটতে।

সায়ন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ব্যবসা বন্ধ করে তোমার অসুবিধে হচ্ছে না?

আমি ব্যবসা বন্ধ করিনি। যে দামে মাল কিনি তার সঙ্গে খরচ যোগ করে কেজিতে দু টাকা লাভ রেখে বিক্রি করি গ্রামে গ্রামে।

তাহলে তো তোমার লাভ খুব কম হচ্ছে!

হ্যাঁ, কিন্তু আমি খুশি। ম্যাডাম আমাকে শিখিয়েছেন অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে। কারও উপকার করলে যে আনন্দ হয় তা টাকা জমিয়ে পাওয়া যায় না।

সায়ন কিছু বলল না। ম্যাথুজ কসাই। গোরুর মাংস বিক্রি করে। ওর মনে মাঝখানে নির্লিপ্তি এসেছিল। কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু লোকটাকে তার ভাল লাগে। সিমিকে পছন্দ করত ম্যাথুজ। সিমি করত না। এখন ওদের সম্পর্কটা কীরকম জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ হল।

ওরা নিরাময়ের সামনে দিয়ে হেঁটে এল। সায়ন দেখল ডাক্তার তামাংয়ের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে প্রসঙ্গ ঘোরাল, আচ্ছা, পুলিশ কেন ছেলেটাকে ধরেছে?

আমি জানি না। তবে ছেলেটাকে ভাল বলে মনে হয়। ও যে অসুস্থ ছিল, মাদাম ওষুধ দিয়েছেন, এ সবই সত্যি। ম্যাথুজ বলল।

কী নাম ছেলেটার?

 সূরজ।

বাজারের পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা নীচে নেমে গিয়েছে সেটা ধরে একটু এগোলেই পুলিশ স্টেশন। বাইরে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ও দুটো না থাকলে থানা বলে বোঝার উপায় নেই। ওরা সিঁড়ির কাছে পৌঁছোতে ভেতর থেকে একজন সেপাই বেরিয়ে এল, কী চাই?

লোকগুলো ওদের দিকে তাকাতে ম্যাথুজ বলল, বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলব।

বড়বাবু থানায় নেই। কী কথা আমাকে বলো।

তোমাকে বলে কী হবে? বড়বাবু কখন আসবেন?

তোমরা কোথাকার লোক? অ্যাঁ? তোমরা চাইলেই বড়বাবুর সময় আছে তোমাদের সঙ্গে দেখা করার? সেপাই শব্দ করে হাসতেই ভেতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তিনি একজন অফিসার, কী হয়েছে?

সেপাই বলল, এরা বড়বাবু ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলবে না।

অফিসার বললেন, অ। আপনারা তাহলে বাড়ি চলে যান। এখানে ভিড় বাড়াবেন না। যান, চটপট।

এবার লোকগুলোকে পিছিয়ে যেতে দেখে সায়ন এগিয়ে গেল, নমস্কার। বড়বাবু যখন নেই তখন আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি কি?

আপনার পরিচয়?

আমার নাম সায়ন রায়।

নামটা খুব চেনা লাগছে। কিন্তু বাঙালি হয়ে এদের সঙ্গে কী করে এলেন?

আমি ওদের সঙ্গেই আছি।

বলুন।

আজ সকালে পাহাড়ের ওপরের গ্রাম থেকে আপনারা সূরজ নামের একটি ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে। ছেলেটির অপরাধ কী?

ও, এই ব্যাপার। গতকাল চেয়ারম্যানের কনভয়ের বিরুদ্ধে যারা বিক্ষোভ দেখিয়ে ছিল তার মধ্যে ছেলেটি ছিল। ওরা পাথর ছুঁড়েছিল।

আপনাদের খবর ভুল। ছেলেটি অসুস্থ ছিল, বাড়ি থেকে বের হয়নি।

আপনি গিয়ে দেখেছিলেন?

না। কিন্তু সাক্ষী আছে।

তাদের আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে বলবেন। এবার চলে যান।

কিন্তু অফিসার, এরা গরিব মানুষ, আদালত এদের কাছে অনেক দূরের পথ। সূরজ নিরপরাধ। আপনারা ভুল করে ওকে ধরে নিয়ে এসেছেন।

অসম্ভব। ওর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। আপনারা একটা সমাজবিরোধীর হয়ে ওকালতি করতে দলবেঁধে থানায় এসেছেন? চিৎকার করলেন অফিসার। আর সেই চিৎকার শুনে আরও কিছু পুলিশ লাঠি হাতে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে।

এই সময় সূরজের দাদা সজোরে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল অফিসারের সামনে, আমার ভাই ভাল ছেলে, ও কোনও অন্যায় করেনি।

তার ছুটে আসার ভঙ্গিতে ভয় পেয়ে অফিসার জোরে ধাক্কা দিতেই লোকটা ছিটকে পড়ে গেল একপাশে। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সেপাইটা লাফিয়ে নেমে এসে লাঠি চালাতে লাগল ওর ওপর, মারনে আয়া? শালা পুলিশ অফিসারকো মারনে আয়া! এতনা হিম্মত?

সায়ন চিৎকার করে ছুটে গেল লোকটাকে বাঁচাতে। এবার লাঠির আঘাত পড়ল তার কাঁধে, কপালে। সঙ্গে সঙ্গে রক্ত নামল গালে। রক্ত দেখে সেপাইটা থেমে গেল। সায়ন বাঁ হাত দিয়ে রক্ত মুছতেই অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হল। সেপাইটা লাঠি ফেলে লুটিয়ে পড়ল সায়নের সামনে। তার কান্নাকে প্রায় আর্তনাদের মতো শোনাল। সেই অবস্থায় লোকটি কেবলই প্রার্থনা করে যাচ্ছে যেন তাকে ক্ষমা করা হয়। অফিসার এগিয়ে গেলেন তার কাছে, এই, তুমি এসব কী বলছ? কী হয়েছে?

লোকটি মাথা তুলল, আমি মহাপাপ করেছি। না জেনে আমি ভগবানের গায়ে হাত তুলেছি। উনি মানুষ নন, আমি দেখলাম সমস্ত শরীরে রক্ত মেখে স্বয়ং যিশু মহারাজ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

অফিসার ঘুরে তাকালেন, আপনি কি নিরাময়ে থাকেন? মা মেরি তো আপনাকেই আশীর্বাদ করেছিলেন। এঃ, আগে বলবেন তো! আসুন, আসুন, আপনাকে ফার্স্ট এইড দেওয়া দরকার। ভেতরে চলুন।

সূরজের দাদা উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। রুমালে কপালের রক্ত মুছে শান্ত গলায় সায়ন বলল, সূরজকে ছেড়ে দিন। ও কোনও দোষ করেনি।

.

৪০.

মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। যাঁরা কাজ করেন তাঁদের ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল ধরিয়ে দিলে সেটা শুধরে নেওয়ার নাম মনুষ্যত্ব। থানার দ্বিতীয় অফিসার এইসব কথা বলে সূরজকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি আরও উদ্যোগী হয়ে সায়নের কপালে ব্যান্ডেড লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

যেসব খবরে মানুষ বিস্মিত হয়, বিশ্বাস করতে পারে না অথচ অবিশ্বাস করলে মন খচ খচ করে সেইসব খবর হাওয়ারা দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে দেয়। ফলে থানার সামনের প্রাঙ্গণে ভিড় জমছিল, গল্প ডালপালা মেলছিল।

থানার ভেতরে চেয়ারে বসিয়ে সেকেন্ড অফিসার বিনীত গলায় বললেন, না, না, আমি কোনও আপত্তি শুনব না, আপনাকে এক কাপ কফি খেতেই হবে।

সায়ন মাথা নাড়ল, আমাকে ডাক্তার কফি খেতে নিষেধ করেছেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোন অসুখের জন্যে আমি নিরাময়ে এসেছি।

শুনেছি। কিন্তু আপনার সম্পর্কে যা কানে আসে তাতে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারিনি। অবশ্য বড়বাবু বলেন, যিশুখ্রিস্টকে লোকে পেরেক ঠুকে মেরে ফেলেছিল, বুদ্ধদেবকেও অসুখের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে, আমাদের রামকৃষ্ণদেবও গলার ক্যানসারে মারা যান, এগুলো থেকে তাঁরা ইচ্ছে করলেই মুক্তি পেতে পারতেন কিন্তু মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে করেননি। সেকেন্ড অফিসার হাসলেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, এবার সত্যি কথাটা বলুন তো, সূরজকে কেন ধরেছিলেন।

সবই তো আপনার জানা আছে স্যার, কেন জিজ্ঞাসা করে লজ্জা দিচ্ছেন!

 আমি কিছুই জানি না।

গতকাল চেয়ারম্যানের কনভয়ের সামনে কিছু লোক বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। দিনকে দিন ওঁর বিরোধী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ক্ষমতায় থাকলে এমন হয়। কেউ কেউ হয়তো দু-একটা পাথর ছুঁড়েছিল। আমাদের ওপর হুকুম হল তাদের খুঁজে বের করতে হবে। চেয়ারম্যানের লোকজন যে লিস্ট দিয়েছিল তার মধ্যে সূরজের নাম ছিল। অফিসার মাথা নাড়লেন।

কিন্তু সূরজ বেশ কয়েকদিন অসুস্থতার কারণে বাড়ি থেকে বের হয়নি। আপনারা ভুল করে একই নামের আর একজনকে ধরে আনেননি তো?

হতে পারে। ওই যে বললাম যে কাজ করে তার ভুল হতেই পারে। আমরা যদি কাজ না করে থানায় বসে এফ এম শুনতাম তাহলে আমাদের কোনও ভুল হত না। আপনি এসেছেন, আমি নিজের দায়িত্বে ওকে ছেড়ে দিয়েছি, যদি বিপদ হয় তাহলে আপনার শরণ নেব। অফিসার হাত জোড় কবলেন।

বিপদ হবে কেন?

যতই আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কর্মচারী হই এখানে চেয়ারম্যানকে মানতেই হয়।

তিনি অন্যায় করলেও মানতে হবে?

ছোটখাটো অন্যায়কে অন্যায় বলে ধরা হয় না।

কিন্তু উনি তো এই জেলার একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান। বাংলায় যাকে বলা হয় পৌরাধিপতি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ওঁর সমমর্যাদার অনেক চেয়ারম্যান আছেন। তাঁদের ছোটখাটো অন্যায়কেও কি আপনারা অন্যায় বলে ধরেন না?

দুর! কার সঙ্গে কার তুলনা করছেন? মেদিনীপুর বাঁকুড়া বা জলপাইগুড়ির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কি আমাদের পুলিশমন্ত্রী বৈঠক করতে ছোটেন? মুখ্যমন্ত্রী কি তাদের সময় দিয়ে ধন্য হন? আমাদের অনেক মন্ত্রী এখানে এসে ওঁর দেখাই পান না কারণ উনি খুব ব্যস্ত। কুচবিহারের চেয়ারম্যানের এই সাহস হবে? অফিসার হাসলেন, উনি রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে যে আবেদন করেছিলেন তা অন্য কেউ করলে দেশদ্রোহিতার অপরাধে জেলে যেতে হত। উনি নিজেকে শুধু দলের বা পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে ভাবেন না, নিজেকে তামাম পাহাড়ি জাতির চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা করেছেন।

তাহলে বিক্ষোভ হচ্ছে কেন?

যারা সঙ্গে থেকেও কিছু পায়নি অথবা যারা ওর মত পছন্দ করছে না এই দুটো দল কেন চুপ করে বসে থাকবে! অফিসার কথা শেষ করতে একজন সেপাই এসে তার কানে কানে কিছু বলল।

অফিসার মাথা নাড়ল, না, আপনাকে এমনি যেতে দেওয়া যায় না। পাবলিক ছিঁড়ে খাবে। আমাদের জিপ আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক।

জিপে এত লোক ধরবে?

এত লোক মানে?

আমরা আট দশজন এখানে এসেছিলাম।

ও। সবাইকে নিয়ে ফিরতে চান?

হ্যাঁ। সেটাই তো স্বাভাবিক।

ও। তাহলে কষ্ট করে ভ্যানে বসে যেতে হবে।

আপনি আমাদের উপকার করছেন, কষ্ট হবে কেন?

মিনিট তিনেকের মধ্যে ওরা সবাই ভ্যানের ভেতর উঠে বসল। বাইরে তখন বিপুল জনতা। সবাই সায়নকে দেখতে চায়। ভ্যানের গায়ে কিল চড় পড়ল, সবাই তাকে একবার স্পর্শ করতে চায়।

কিন্তু পুলিশের ভ্যানের চেহারায় একধরনের ভীতিপ্রদ ব্যাপার আছে, যা সাধারণ গাড়ির মধ্যে নেই। ভ্যান এগোতে আরম্ভ করলে পথ খুলে গেল।

সায়ন সূরজকে দেখল। ওর দাদাকে জড়িয়ে ধরে ভ্যানের এক কোণে বসে আছে। সূরজের দাদা মার খেয়েছে খুব। পরে সেপাইটি ওর হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে কফি খাইয়েছে। সায়ন দেখল সূরজ ছেলেটা আর পাঁচজন পাহাড়ি ছেলের মতো নয়। ও যে অসুস্থ ছিল তা চেহারায় পরিষ্কার কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিত্ব স্পষ্ট।

চলন্ত ভ্যানে ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎ সূরজের দাদা চিৎকার করে উঠল, তখন থেকে বলছি চুপ করে থাক। তোর মায়ের কথা, আমাদের কথা একবার ভাব। উনি না গেলে পুলিশ তোর সবকটা হাড় ভেঙে টুকরো করে দিত, মনে রাখিস! গায়ে এক ফোঁটা জোর নেই মুখে বড় বড় কথা।

সবাই ওদের দিকে তাকাল। সায়ন ম্যাথুজকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

ভ্যান এখন ওপরের দিকে উঠছে বলে ব্যালান্স রাখা মুশকিল হচ্ছিল। তবু ম্যাথুজ হাসল, ছেড়ে দাও, যত সব ছেলেমানুষি।

তবু আগ্রহী হল সায়ন, কী রকম?

সূরজ ওর দাদার ওপর খুব রেগে গেছে। সে চায়নি পুলিশের হাত থেকে এভাবে মুক্তি পেতে। আসলে, মারটার খেয়ে বের হলে পাঁচজনের চোখে বীর হয়ে যেত, ওর দাদার জন্যে সেটা হল না, তাই আফসোস।

ও কি রাজনীতি করে?

আমি জানি না। শুনিনি।

তাহলে?

ম্যাথুজ জবাব না দিয়ে ডাকল, এই সূরজ, এদিকে এসো।

ওর দাদা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, যা। গিয়ে ওঁর পা ধরে কৃতজ্ঞতা জানা। লোকে অন্তত জানুক তুই বেইমান নোস।

সূরজ যেন বাধ্য হয়ে উঠে এল। ম্যাথুজ তাকে বসার জায়গা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি রাজনীতি করতে?

রাজনীতি মানে কী? সূরজ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল।

কোনও পার্টির হয়ে কাজ করা, বিক্ষোভ দেখানো। ম্যাথুজ বলল।

তাহলে আমি কখনও রাজনীতি করিনি। সূরজ জবাব দিল।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, মনে হচ্ছে তোমার রাজনীতি সম্পর্কে অন্য ধারণা আছে?

না। কথাটাকে কেন রাজনীতি বলা হয় তাই আমি বুঝতে পারি না। রাজা নেই অথচ রাজনীতি আছে। অদ্ভুত।

তাহলে শব্দটা ঠিক কী হওয়া উচিত?

জননীতি।

বাঃ। তুমি এসব নিয়ে খুব ভাব? সায়ন অবাক হল।

সূরজ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, আমি ভাবি। একা থাকলেই এইসব ভাবনা আমার মাথায় আসে। আমি কাউকে বলি না। যখন আন্দোলন হয়েছিল তখন আমি ছোট ছিলাম। শুনেছি অনেক মানুষ মারা গিয়েছে সেসময়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না কেন তখন আন্দোলন হয়েছিল? আন্দোলন হওয়ার আগে এবং এখন, কী এমন পার্থক্য হয়েছে? চেয়ারম্যান মাঝে মাঝে মিথ্যে স্তোক দিতেন, আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হব। আমার ওঁকে দুটো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কেন হব? কীভাবে হব?

সায়ন ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়েছিল। সাধারণ চেহারার এই তরুণ সম্ভবত পড়াশুনা বেশি করেনি। কিন্তু মূল প্রশ্নটি ওর মনে এসে গেছে। কেন হব? কীভাবে হব? পাহাড়ের মানুষদের মনে যত বিক্ষোভ জমা হোক, ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ঘোষণা করা অসম্ভব ব্যাপার। একমাত্র ভারত সরকার যদি দয়া করে তাদের স্বাধীনতা দিয়ে দেয় তাহলেই এরা স্বাধীন হতে পারে। যেভাবে একজন পৌরপিতাকে প্রায় মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান দিয়ে চলেছে রাজ্য সরকার তাতে তেমন ঘটনা ঘটা অসম্ভব নয়। এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলেই ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন ভারতের জন্ম দিয়ে গিয়েছিল!

তুমি কখনও রাজনীতি বা জননীতি করনি, তোমার শরীরও সুস্থ নয়, তোমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, তুমি কেন জেলে যেতে চাইছিলে? যে কাজটা তুমি করোনি তার দায়িত্ব নিতে মিথ্যে কথা বলতে চেয়েছিলে কেন? সায়ন ওর কাঁধে হাত রাখল।

সূরজ মাথা নিচু করল। তারপর নিচু গলায় বলল, আমি কখনও পাথর ছুঁড়তে পারতাম না। কিন্তু কেউ একজন ছুঁড়েছিল। তার জায়গায় জেলে গেলে সে বেঁচে যেত, আমার নাম হত, সবাই চিনত।

কিন্তু তোমাকে ওরা অ্যারেস্ট করতে গেল কেন? পার্টি থেকে তোমার নাম পাঠিয়েছিল কেন? পুলিশ আমাকে এই কথা বলেছে।

কাল দুজন পার্টির লোক গ্রামে এসেছিল। কারা কারা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তার খোঁজ নিচ্ছিল। আমি ঘরের বাইরে একা বসেছিলাম। ওদের একজন এসে আমার সঙ্গে কথা বলছিল। আমি তখন তাকে বলেছি যে পাথর ছুঁড়েছে তার মনে নিশ্চয়ই জ্বালা আছে। বোধহয় সেটা শুনেই ওরা পুলিশের কাছে আমার নাম বলেছে।

ভ্যানটা থেমে যেতে একজন সেপাই দরজা খুলে দিল। একে একে ওরা নেমে দাঁড়াতেই দেখতে পেল পিলপিল করে মানুষ ছুটে আসছে। গ্রামের মানুষরা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সূরজ ফিরে এসেছে এত তাড়াতাড়ি। লাঠির ঘায়ে ফুলে যাওয়া মুখ নিয়ে সূরজের দাদা চিৎকার করে বলতে লাগল কার অনুগ্রহে তার ভাই এত তাড়াতাড়ি মুক্তি পেল! কার মুখে রক্ত দেখে মারমুখো সেপাইটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগল জনতা। সূরজের দাদা যখন বলল, উনাকে মা মেরি আশীর্বাদ করেছেন বলে শুনেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ বুঝলাম সেই আশীর্বাদ না পেলে হিংস্র সেপাইটাকে বশ করা যেত না।

এইসময় পুলিশ ভ্যান মুখ ঘুরিয়ে নীচের দিকে চলে গেল। সায়নের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। আবার এক নাটক। সে যা নয় তাই এরা তাকে করে দিতে চাইছে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল। জনতা শব্দ করে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে নমস্কার করতে লাগল। তাদের সঙ্গে যোগ দিল সূরজের দাদাও।

সায়ন চিৎকার করল, আপনারা সবাই উঠে দাঁড়ান। আমি আপনাদের মতোই একজন মানুষ। আমার মধ্যে কোনও অলৌকিক ক্ষমতা নেই।

মানুষগুলো গুঞ্জন করল কিন্তু কেউ নড়ল না। সায়ন অসহায় চোখে ম্যাথুজের দিকে তাকাল। তার পাশে দাঁড়িয়ে ম্যাথুজ মিটিমিটি হাসছিল। সূরজ আর একটু পেছনে। ম্যাথুজ এবার চিৎকার করল, আপনারা যদি এভাবে বিব্রত করেন তাহলে সায়ন হয়তো কলকাতায় চলে যাবে। আপনারা তাই চান?

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ উঠল। সূরজের দাদা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, না। আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকুন।

ম্যাথুজ বলল, তাহলে আপনারা যে যার কাজে চলে যান।

কিন্তু কেউ গেল না। ভিড় করে সায়নকে দেখতে লাগল। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এগিয়ে এসে সায়নের হাত ধরল, বাবা, আমি রাত্রে ঘুমোতে পারি না। রাত নামলেই আমার কাশি শুরু হয়ে যায়। বুক ব্যথায় ভরে আছে। তুমি আমার ঘুমের ব্যবস্থা করে দাও।

সায়ন মাথা নাড়ল, আপনি ডাক্তার দেখান।

ম্যাথুজ সায়নকে হাত ধরে নিয়ে হাঁটতে লাগল। জনতা কী করবে বুঝতে পারছিল না। খানিকটা নীচে নামার পর নির্জন জায়গা দেখে ম্যাথুজ দাঁড়াল। কী ব্যাপার বলো তো? এরা তোমাকে ভগবানের দূত বলে ভাবছে কেন?

আমি জানি না। এরা আমাকে পাগল করে দেবে! সায়ন বিরক্ত হল।

তুমি এসবে বিশ্বাস কর?

একদম না। মনের জোর যাদের নেই তারাই অলোকিকত্বে বিশ্বাস করে।

তার মানে তুমি বলবে মানুষ মরে গেলে আর বাঁচে না?

আশ্চর্য। মরে যাওয়ার পর কী করে বাঁচবে?

তা হলে যিশুর পুনর্জাগরণ হয়নি?

দ্যাখো, এক্ষেত্রে যিশুকে যখন সমাধি দেওয়া হয়েছিল তখন তাঁর শরীরে প্রাণ ছিল। কোনও অদ্ভুত উপায়ে তিনি শক্তি পেয়েছিলেন উঠে আসার।

না। যিশুর শরীরে প্রাণ ছিল না।

সেটা যাঁরা পরীক্ষা করেছেন তাঁরা সাক্ষী দিতে আসবেন না। যিশুর পিঠে কুঁজ ছিল, তিনি দেখতে বেশ কুৎসিত ছিলেন। এরকম মত চালু আছে। কিন্তু আমরা যে যিশুর মূর্তি দেখি তিনি সুন্দরের প্রতীক। যিশু হিসেবে একে দেখতেই আমাদের ভাল লাগে। কুৎসিত চেহারায় যিশু পৃথিবীর মানুষকে ভালবেসেছিলেন, ভালবাসতে বলেছেন। মানুষকে সেবা করেছেন। সুন্দর চেহারার যিশুও তাই করেছেন। যিশুকে সুন্দর ভেবে নিলে ক্ষতি কী! উল্টে লাভ অনেক। তেমনি মৃত্যুর পরেও তিনি মাটির নীচ থেকে উঠে এসে কাজ করেছেন, কুষ্ঠরোগীকে স্পর্শ করে তাকে রোগমুক্ত করেছেন এসব জানলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। এই কারণেই অলৌকিকত্ব ওঁর উপর আরোপ করা হয়েছে।

হিন্দুদের দেবদেবীরা–।

থামিয়ে দিল সায়ন। হিন্দুদের দেবদেবীরা যা খুশি করতে পারেন কারণ তাঁদের জন্ম ভক্তদের কল্পনায়। বাস্তবে তাঁরা কোথাও ছিলেন না, নেই। কিন্তু তার পরে যেসব সাধক বা অবতারের কথা বলা হয়েছে তাঁদেরও একই পথে বিখ্যাত করার জন্যে সাধারণ মানুষ অলৌকিকত্ব খুঁজতে চেয়েছে এবং বুদ্ধিমানরা সেটা পূর্ণ করেছে। কিন্তু বিবেকানন্দ কোনও অলৌকিক ম্যাজিক দেখাননি। তাঁকে রামকৃষ্ণদেব মা কালীকে দর্শন করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছিল। যেভাবে মরুভূমির মরীচিকাকে মানুষ জল হিসেবে কল্পনা করে। নইলে বাকি জীবনে তিনি কেন যুক্তির বাইরে কথা বললেন না? কেন গলায় স্পর্শ করে রামকৃষ্ণদেবের ক্যানসার সারালেন না?

ওরা কেউ লক্ষ করেনি এর মধ্যে সূরজ এসে ওদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ সে এগিয়ে এসে সায়নের হাত ধরল, আমরা আজ থেকে বন্ধু হতে পারি?

নিশ্চয়ই। সায়ন হাসল। তারপর ম্যাথুজকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো আজ থানায় আমার সঙ্গে ছিলে। সেপাইটা প্রথমে ওর দাদাকে মারছিল। আমি বাধা দিতে গিয়ে আমাকেও কয়েক ঘা মেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেই সময় তুমি কি আমার মধ্যে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করেছ?

না। দেখিনি। শুধু তোমার কপালে রক্ত ছিল।

সায়নের মনে পড়ল কলকাতায় যাওয়ার সময় চোরাকারবারি দলের নেতা তার রক্ত দেখার পর একদম বদলে দিয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, আর কেউ কি কিছু দেখেছে?

না। কেউ দেখেছে বলে জানায়নি। সেপাইটার কান্নাকাটি থেকে বোঝা গিয়েছিল সে দেবদূতকে দেখেছে।

ব্যাস? সঙ্গে সঙ্গে সবাই বিশ্বাস করে ফেলল আমি দেবদূত?

আমি জানি না। লোকে এর আগে শুনেছে তুমি মা মেরির আশীর্বাদ পেয়েছ। নিরাময়ের ওপর হামলা করতে এসে পার্টির ছেলেরা তোমাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে। শুনেছি তুমি নাকি একটি মৃত্যুপথযাত্রী শিশুর মাকে কথা দিয়েছিলে বলে সে মারা যায়নি। তাই সেপাইটার কথা শুনে সবাই বিশ্বাস করে ফেলল। ম্যাথুজ বলল।

তোমার নিজের কী মনে হয়?

আমি এসব ঠিক বুঝতে পারি না। ম্যাথুজ হাসল। সায়ন সূরজের দিকে তাকাল, তুমি বিশ্বাস করো?

সূরজ বলল, আমি তো নিজের চোখে এসব দেখিনি। তবে একটা কথা, ওই সেপাইটা ঠিক কী দেখেছিল? কিছু না দেখলে ওর ওইরকম পরিবর্তন হবে কেন? আবার ও যা দেখেছে তা অন্য কেউ দেখতে পেল না কেন?

এইসব প্রশ্নের উত্তর সায়নের নিজেরই জানা নেই। সে আর কথা বাড়াল। ওরা হাঁটতে লাগল। কিন্তু সায়ন বুঝতে পারছিল তার অস্বস্তি ক্রমশ বাড়ছে। সে যা নয় তাই এই মানুষগুলো দেখছে কী করে?

.

নিরাময়ে ফিরে এল সায়ন। আসার পথে এলিজাবেথের বাড়িতে গিয়ে দরজায় তালা ঝুলতে দেখেছে। অর্থাৎ সিমিও সেখানে নেই।

ডাক্তার তামাং-এর গাড়ি চলে গিয়েছে। নিরাময়ের পাশের জমিতে কিছু লোক ফিতে নিয়ে মাপজোক করছে। সায়ন গেট পেরিয়ে ঢুকতেই হঠাৎ বড়বাহাদুর তাকে হাতজোড় করে নমস্কার করল। সায়ন অবাক। এই বয়স্ক মানুষটি কখনই এই আচরণ করেনি। সে জিজ্ঞাসাবাদ করল। কী হল?

বড়বাহাদুর সজোরে মাথা নাড়ল, কিছু হয়নি।

তা হলে হঠাৎ নমস্কার করছ কেন? প্রায় ধমকে উঠল সায়ন।

পেছন থেকে ডাক্তার আঙ্কলের গলা ভেসে এল, সায়ন, এদিকে এসো। বড়বাহাদুর তোমাকে নমস্কার করেছে কারণ ওর পক্ষে ওটা করাই স্বাভাবিক।

আমি বুঝতে পারলাম না।

আজ থানায় নাকি তোমাকে ঘিরে কিছু ঘটেছে এবং সেই খবর এখানেও পৌঁছেছে। এলিজাবেথ তোমার জন্যে অফিসরুমে অপেক্ষা করছে।

ডাক্তারের সঙ্গে অফিসঘরে ঢুকতেই এলিজাবেথ হাসলেন, ধন্যবাদ।

কেন?

বাঃ, তুমি থানায় গিয়ে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনলে, তাই!

আমি আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম।

আচ্ছা! এলিজাবেথ মাথা দোলাল।

ডাক্তার বললেন, মনে হচ্ছে তুমি খুব ডিস্টার্বড!

হ্যাঁ। আমি যা নই তাই আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এলিজাবেথ জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে ক্ষতি কী হয়েছে?

কী বলছেন? যা আমি বিশ্বাস করি না–।

হাত তুলে থামিয়ে দিলেন এলিজাবেথ, তোমাকে বিশ্বাস করতে কেউ বলেনি। তুমি তোমার মতো থাকো।

হ্যাঁ, কিন্তু এরা আমাকে থাকতে দিচ্ছে না।

ডাক্তার বললেন, তুমি যখন কলকাতায় গিয়েছিল তখনও কি এমন সমস্যা হয়েছিল?

না। কলকাতায় হয়নি। তবে যাওয়ার পথে ট্রেনে একজন সমাজবিরোধীর ব্যবহার আচমকা বদলে যায় আমার মুখে রক্ত দেখে। অবশ্য তার সঙ্গে অলৌকিক কোনও ব্যাপার নাও থাকতে পারে।

তুমি এখন বেশ সুস্থ। নিয়মিত ওষুধ খেলে এবং প্রয়োজনের সময় রক্ত পেলে কিছুকাল কোনও সমস্যা হবে না। এখানে যখন সমস্যায় পড়েছ তখন তুমি কলকাতায় ফিরে যেতে পারে।

অসম্ভব।

কেন?

কলকাতায় আমি থাকতে পারব না। আপনি কি আমাকে নিরাময় থেকে চলে যেতে বলছেন? সোজাসুজি প্রশ্ন করল সায়ন।

ডাক্তার হাসলেন, এ কথা তোমার মনে হল কেন? হ্যাঁ, আমি যদি নিরাময় বন্ধ করে দিতাম তা হলে তোমাকে তাই বলতে বাধ্য হতাম। তুমি এখন অনেকটা ভাল আছ। এখানকার লোকজন তোমাকে নানান সমস্যায় ফেলছে। কলকাতায় গেলে এই সমস্যাগুলো তোমাকে বিব্রত করত না।

কিন্তু কলকাতায় গিয়ে দেখলাম নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ওখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। নিজের স্বার্থ ঠিক রাখার জন্যে সবাই মরিয়া। কলকাতার মানুষ কেন বেঁচে আছে তা তারাই জানে না। ওখানে থাকতে হলে আমাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকতে হবে। এখানে ওই অলৌকিক ব্যাপারটা যদি না থাকত। সায়ন চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ফেলল।

এলিজাবেথ চুপচাপ শুনছিলেন। এবার বললেন, তুমি আমার কথা শোনো।

বলুন।

এখানকার মানুষ যে কোনও কারণেই হোক তোমাকে শ্রদ্ধা করে। এই ব্যাপারটাকে তুমি কাজে লাগাও।

কী ভাবে?

তোমার মধ্যে কোনও অলৌকিক ব্যাপার আছে কি নই তা নিয়ে ওর মাথা ঘামাক। তোমার কী দরকার সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর? ওরা যদি তাই বিশ্বাস করে খুশি হয়, হোক। তোমার এই জনপ্রিয়তাকে তুমি কাজে লাগাও। আমি এখানকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখেছি এখনও কুসংস্কার বা অন্ধ ধারণা থেকে এরা মুক্ত নয়। বেঁচে থাকার সামান্য সুযোগ যে এদের পাওয়া উচিত সে ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই। আমরা বললে যে কাজ হচ্ছে তা খুবই সামান্য। তুমি বললে অনেক দ্রুত হবে। তুমি বলেছিলে আমার সঙ্গে এদের জন্য কিছু করতে চাও। তাই তো?

সায়ন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা প্রতারণা হবে না?

সাধারণ মানুষের উপকার করতে যদি অভিনয়ের প্রয়োজন হয় তা হলে তাকে কিছুতেই প্রতারণা বলা যাবে না।

সায়ন সোজা হয়ে বসল, আমি জানি এখানকার গরিব গ্রামের মানুষদের ভালর জন্যে আপনি অনেক কাজ করছেন। কিন্তু কাজগুলো কী সে ব্যাপারে আমার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই।

এলিজাবেথ বলল, তুমি নিশ্চয়ই আজ খুব ক্লান্ত। কাল সকালে যদি আমার ওখানে চলে আসো তবে এ ব্যাপারে আমরা কথা বলতে পারি।

বেশ। আমি সকাল-সকাল চলে যাব।

এলিজাবেথকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই কঙ্কাবতীকে বারান্দায় দেখতে পেল সে। অদ্ভুত চোখে কঙ্কাবতী তার দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ন হাসল, কী খবর?

কঙ্কাবতী জবাব না দিয়ে মাথা দোলাল।

তোমার কি শরীর খারাপ?

না।

তাহলে এইভাবে কথা বলছ কেন?

কঙ্কাবতী মুখ নামাল। তারপর অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আমি কতদিনে একদম ভাল হয়ে যাব?

সায়ন আবার হাসল, নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে। তোমার অসুখ তেমন মারাত্মক জায়গায় পৌঁছোয়নি। ডাক্তার আঙ্কল তো তোমাকে স্কুলে যাওয়ার মতো তৈরি করে দিয়েছেন। এ নিয়ে চিন্তা করছ কেন?

কঙ্কাবতী মুখ নামিয়ে থাকল, কথা বলল না।

 সায়ন এক পা এগোল, তোমার নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে?

এবার কঙ্কাবতী মুখ তুলল, আমি কাল চলে যাব।

কোথায়?

মায়ের কাছে। মা তো এখন ডক্টর তামাং-এর কাছে কাজ করছে। এখানে হাসপাতাল হয়ে গেলে মায়ের চাকরি এখানে হবে। এখন আমার কোনও কষ্ট নেই, তাই মা আমাকে নিয়ে যাবে।

হ্যাঁ। মিছিমিছি এখানে থাকলে ওঁদেরও তো অসুবিধা।

সায়নের মনে হল কথাটা ঠিক। ডাক্তার আঙ্কল এতদিন ওকে এখানে রেখে চিকিৎসা করেছেন কোনও অর্থ না নিয়ে। সেটা দেওয়ার সামর্থ ওদের ছিল না। শরীর যখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে তখন কেন উনি ওকে রাখবেন? এসব ঠিক কথা কিন্তু সায়নের ভাল লাগছিল না। এই মেয়েটা কি ওই দরিদ্র পরিবেশে গিয়ে সুস্থ থেকে লড়াই করতে পারে?

তারপরেই খেয়াল হল কঙ্কাবতীর দেখা চাইলেই পাওয়া যাবে না। এটা মনে হওয়ামাত্র অন্য রকম কষ্ট তৈরি হল।

তুমি বললে আমার অসুখ সেরে যাবে। ধীরে ধীরে বলল কঙ্কাবতী।

আমি বললে অসুখ সারবে? আমি কি ডাক্তার?

ডাক্তাররা তো সবসময় অসুখ সারাতে পারে না।

তা হলে আমি কী করে পারব?

এই সময় মিসেস অ্যান্টনিকে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসে তিনি সায়নের হাত ধরলেন, এ কী শুনলাম? তুমি নাকি আগামীকাল এখান থেকে চলে যাবে?

কে বলল? অবাক হল সায়ন।

বড়বাহাদুর। মিসেস অ্যান্টনি বললেন, ও তোমাদের কথা শুনেছে।

চলে যাওয়ার কথা হয়নি। আমি সকালবেলায় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করতে যাব। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই।

তা হলে তো হয়ে গেল। অত দূরে গিয়ে কাজ করলে তুমি রোজ এখানে ফিরে আসতে পারবে? অসম্ভব। আচ্ছা; তোমার এসব করার কী দরকার। এই সেদিন কলকাতা থেকে ওরকম অসুস্থ হয়ে ফিরে এলে। আবার অসুখ ডেকে না আনলেই নয়? মিসেস অ্যান্টনি উত্তেজিত।

বিছানায় শুয়ে মরে যাওয়ার থেকে কাজ করতে করতে যাওয়া ভাল।

অ। তা হলে আমাদের কী হবে?

 মানে?

তুমি কাছে আছ বলে মনে জোর পাই। এই মেয়েটা কাল মায়ের কাছে চলে যাবে। ওকে বলেছি কোনও ভয় নেই, সায়ন আছে, কিছু হলে ওকে ডাকবি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

সায়ন হাত ছাড়িয়ে নিল, কী যা তা বলছেন?

তুমি আর কতদিন অস্বীকার করবে? আজ থানায় যে ঘটনা ঘটেছে তা আমরা শুনেছি। খোদ বড়বাবু এসেছিলেন তোমার সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চাইতে। মিসেস অ্যান্টনি জানালেন।

সেকী। থানার বড়বাবু এসেছিলেন এ কথা ডাক্তার আমায় বললেন না তো?

উনি ভেতরে ঢোকেননি। বড়বাহাদূরের মুখে তুমি নেই শুনে ফিরে গেছেন। ডক্টর সাহেবের হয়তো মনে ছিল না। সে যাই হোক, পৃথিবীতে এমন ঘটনা কখনও সখনও ঘটে। যেশাস তোমাকে নির্বাচিত করেছেন। তাঁর আশীর্বাদ তিনি তোমার মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সেই তুমি আমাদের কাছের মানুষ। তুমি চলে গেলে আমরা অসহায় হয়ে যাব। মিসেস অ্যান্টনি বললেন।

আমি এখন কোথাও যাওয়ার কথা ভাবিনি।

সত্যি। আঃ। কী আনন্দ হল কথাটা শুনে। আবার হাত জড়িয়ে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন মৃদু। তারপরই মিসেস অ্যান্টনি উল্লসিত হলেন, দ্যাখো, দ্যাখো, আমার সমস্ত শরীরে কী রকম কাঁটা ফুটে উঠেছে। সায়ন হাত সরিয়ে নিতে প্রৌঢ়া এগিয়ে গিয়ে কঙ্কাবতীকে জড়িয়ে ধরলেন, তুই আর মন খারাপ করিস না রে। সায়ন তো এখানেই থাকবে।

হঠাৎ কঙ্কাবতী বলল, আমি মন খারাপ করেছি তা কে বলল?

সায়নের জন্যে তোর মন খারাপ হয়নি?

না। কিছুদিন আগে আমি একজনকে চিঠি লিখেছিলাম। সেই চিঠি গতকাল ফেরত এসেছে। যাকে লিখেছিলাম তিনি নেই। কঙ্কাবতী বলল।

মিসেস অ্যান্টনি জিজ্ঞাসা করল, কে?

একজন মানুষ যিনি আমাকে–! একজন লেখক! গলা বুজে এল তার।

সায়ন অবাক হল, নেই মানে? মারা গিয়েছেন?

জানি না। তিনি ওই ঠিকানায় নেই। আর আমাকে বলেছিলেন ওটাই একমাত্র যোগাযোগের ঠিকানা। সেখানে নেই মানে আর যোগাযোগ করা যাবে না। আমি যে কেন লিখতে গেলাম।

সায়ন বলল, আমি একসময় তোমাকে বলেছিলাম ওঁকে চিঠি লিখতে তখন তুমি রাজি হওনি। তা হলে পরে লিখলে কেন?

তখন আমি অসুস্থ ছিলাম। সে-অবস্থায় ওঁকে বিব্রত করতে চাইনি। একটু সুস্থ হলে মনে হয়েছিল এত বড় ঘটনাটা ওঁকে জানানো দরকার।

তুমি ওঁর নাম বলোনি। উনি যখন একজন বিখ্যাত লেখক তখন চেষ্টা করলেই জানা যাবে কোথায় রয়েছেন।

সেই চেষ্টাটা আমি করতে চাই না। শক্ত গলায় বলল কঙ্কাবতী।

মিসেস অ্যান্টনি আবার সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন।

সায়ন জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওঁকে খুব ভালবাসতে?

কঙ্কাবতী জবাব দিল না, হাসল।

সায়ন এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কঙ্কাবতী জিজ্ঞাসা করল, আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি।

সায়ন বলল, তুমিও তো উত্তর দাওনি।

আমার উত্তরটা তুমি জানো। কিন্তু তুমি নাকি ইচ্ছে করলে আমাকে সারিয়ে দিতে পারো। পারো না?

কঙ্কাবতী, বিশ্বাস করো, এসব মিথ্যে, বানান। আমার মধ্যে কোনওরকম অলৌকিক ক্ষমতা নেই। ওরা যে কেন এসব বলছে আমি জানি না। একেবারে ভেতর থেকে কথাগুলো বলল সায়ন।

তাই?

হ্যাঁ। আমি তোমার বন্ধু। তুমি আমাকে বন্ধু ভাব না!

কঙ্কাবতী তাকাল। তারপর কোনও জবাব না দিয়ে দ্রুত ফিরে গেল তার ঘরের দিকে।

নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সায়নের মনে হল এলিজাবেথের কথাটাই ঠিক। তাকে অভিনয় করতে হবে। সে অভিনয় করলে যদি মানুষ খুশি হয় তা হলে তার সেটাই করা উচিত। কিন্তু কঙ্কাবতীকে সে বুঝতে পারছে না। আর ওর চলে যাওয়ার দৃশ্যটা যত মনে আসছে বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে যাদের নামে প্রবাদ আছে তাদের কোনও বন্ধু ছিল না। কেউ তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। তা হলে কি সারিয়ে দেওয়ার অনুরোধটা ভান ছিল? কঙ্কাবতী অভিনয় করেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *