সাহেবের কুঠি থেকে বেরিয়ে পালকি পর্যন্ত সঠিকভাবে হেঁটে এলো গঙ্গানারায়ণ। তারপরই সে সংজ্ঞা হারালো, পালকির মধ্যে এক পা বাড়িয়েই পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। তার সঙ্গীরা উৎকণ্ঠিত হয়ে ডাকাডাকি করতে লাগলো তাকে, কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। তখন বেহারিরা পালকি তুলে নিয়ে ছুটলো জোর কদমে।
এ স্থল থেকে নদীর ঘাট প্রায় অর্ধ ক্রোশ দূর, এই পথটুকু অচৈতন্য হয়েই রইলো গঙ্গানারায়ণ। বজরার সন্নিকটে নদীতীরে বহু প্ৰজা তখনো বসেছিল জামালুদিন শেখের সংবাদ জানার প্রত্যাশায়, গঙ্গানারায়ণকে পালকি থেকে ধরাধরি করে নামাতে দেখে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে হৈ হৈ রৈরৈ শুরু করলো। তাদের সকলেরই ধারণা হলো যে সাহেব কুঠিতে গিয়ে গঙ্গানারায়ণ প্রহৃত হয়েছে। দুশমন সাহেবরা কারুকেই রেয়াৎ করে না। বহুকালাবধি সংস্কারের জন্য সাধারণ প্ৰজারা জমিদারকে পিতৃতুল্য মনে করে, কিংবা তার চেয়েও অনেকখানি বেশী, সেই জমিদারের সম্মানহানি তাদের কাছে অকল্পনীয়। তাদের রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠলো, চিৎকার উঠতে লাগলো। উচ্চগ্রামে, কয়েকজন মাটিতে লাঠি ঠুকতে লাগলো। সক্রোধে।
গঙ্গানারায়ণকে এনে শোওয়ানো হলো বজরার মধ্যে তার খাস কামরায়। অতি ব্যস্ত হয়ে তার সঙ্গী কর্মচারীরা তাৎক্ষণিক কর্তব্য বিষয়ে শুরু করে দিল বিতণ্ডা। কেউ বললো, গঙ্গানারায়ণকে এখনই বজরা থেকে সরিয়ে ওপরের জমিদারি কুঠিতে নিয়ে যাওয়া হোক। সেখানে একজন কবিরাজ থাকেন, যিনি এক সময় গঙ্গানারায়ণের পিতার চিকিৎসা করেছেন। কেউ বললো, গঙ্গানারায়ণকে সরাবার দরকার নেই, কুঠিতে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। সেই কবিরাজকেই আনানো হোক। আবার কেউ বললো, এই বিদেশ বিভূয়ে উত্তম চিকিৎসার ব্যবস্থা সম্ভব হবে না। সুতরাং কালবিলম্ব না করে এখনই বজরার মুখ ঘুরিয়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেওয়া উচিত।
খাজাঞ্চি অক্ষয় সেন বৈদ্যবংশ সস্তুত বলে কিছু কিছু চিকিৎসা বিদ্যা জানেন, তিনি গঙ্গানারায়ণের নাড়ি ধরে বসে রইলেন। তাঁরও মত, এখানে অপেক্ষা না করে। বরং কলকাতার উদ্দেশেই যাত্রা করা ভালো, অন্তত কৃষ্ণনগর পর্যন্ত পৌঁছালেও সেখানে অ্যালোপাথিক ডাক্তার পাওয়া যাবে।
একটু পরেই গঙ্গানারায়ণ চোখ মেললো এবং উঠে বসলো। তাকে ঘিরে রয়েছে কর্মচারীদের ভীত চকিত মুখ, আর বাইরে প্রজাদের তুমুল কলরব। সে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলোকী ব্যাপার, আমি কী করে এখানে এলুম? অতি চ্যাঁচামেচি কিসের?
বৃদ্ধ খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, আপনি কতা বলবেন না। বিশ্রাম নিন।
গঙ্গানারায়ণ পালঙ্ক থেকে নেমে শরীরের আড়মোড়া ভেঙে বললো, কই, আমি তো অসুস্থ বোধ কচ্চি নাকো? আমি নীলকুঠিতে গেসলুম, তারপর কী হলো?
একজন কর্মচারী বললো, হুজুর, আপনি সাহেবের সঙ্গে কতা কইতে গেসলেন।
গঙ্গানারায়ণ বললো, হ্যাঁ। কিন্তু সে সাহেব আমার সঙ্গে কতা কইলে না, একেবারে বর্বর, নেশাখোর…কিন্তু তারপর…তারপর তো আর কিচু মনে পড়ে না।
—আপনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন–এখুন শুয়ে থাকুন। বরং-একটু পরে জোয়ার এলেই আমরা নৌকো ছেড়ে দেবো।
—জ্ঞান হারিয়ে ফেলিচিলুম? কেন! আমার তো কখনো এমন হয় না।
—হুজুর, সাহেব আপনার মান রাখেননি।
—হাঁ, সে কত মনে আচে, আমার খুব রাগ হয়েছেল, তা বলে জ্ঞান হারাবো? এ যে বড় আশ্চর্যের কতা!
দুদ্দাড় করে কয়েকজন লাঠিয়াল প্ৰজা বজরার ওপর উঠে এসে কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো, হুজুরের জইন্যে আমরা জান দিমু। পাঁচখানা গাঁয়ে লাইঠ্যালরা হুজুরের থনে আইস্যা খাড়াবে-হুজুর, একবার কন, আমরা সাহেবগুলার ঘেটি ভাইঙ্গা দিমু।
খাজাঞ্চিবাবু ওদের দেখে খিঁচিয়ে উঠে বললেন, আ মোলো, এই হারামজাদাগুলো একেবারে ওপরে ভুঞ্জয়। যা, যা, নীচে যা। আম্পৰ্থ দেকা, ছোটলোকগুলো আজকাল যেন একেবারে মাতায় উঠতে চায়।
সে তিরস্কার অগ্রাহ্য করেও প্রজারা বলতে লাগলো, আমাগো হুজুরের শরীলে হাত দিছে, হ্যার বদলা আমরা নিমু। হুজুরের লাইগ্যা আমরা হকলডি এককাট্টা হইয়া নীলকুঠি লাল কইরা দিতাম পারি।
গঙ্গানারায়ণ হাত তুলে বললো, তোমরা শান্ত হও। আমায় মেরেচে? কে বললে আমায় মেরেচে? আমার মনে নেই তো? হ্যাঁরে ভুজঙ্গ, তুই তো গেসলি আমার সঙ্গে। আমায় সত্যিই কেউ মেরেচে?
ভুজঙ্গ বললো, আজ্ঞে না হুজুর, আমি সব সময় আপনার পাশে ডাঁড়িয়ে চিলুম।
খাজাঞ্চি বললেন, হুজুরের গায়ে হাত দেবে, এমন সাধ্য কার আচে! এই ছোটলোকগুলোর ঘটে এক রাত্তি বুদ্ধি নেই–
গঙ্গানারায়ণ বললো, তবে, জামালুদ্দীন শেখের কোনো খবর আমি পাইনি-ওরা স্বীকার পেলে না-বললে জামালুদ্দীন শেখকে ওরা চেনে না।
প্ৰজারা আবার বললো যে, জামালুদ্দীন শেখ নিজে তার বিবি হানিফার খোঁজ নেবার জন্য নীলকুঠিতে গিয়েছিল, সেখান থেকে সে ফেরেনি! হানিফা বিবিকে রাতের বেলা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে গোলক দাস—এদের দুজনকেই ওরা কেউ বেরুতে দেখেনি কুঠি থেকে। নদীর পানিতে ওদের লাশও ভেসে ওঠেনি। সুতরাং কুঠির মধ্যেই মাটির নীচের গারদে নিশ্চয়ই আটক করে রাখা হয়েছে ওদের। জামালুদ্দীন আর হানিফা বিবিকে ওরা জোর করে ছাড়িয়ে আনবেই এবং সেই সঙ্গে হুজুরের প্রতি অপমানের প্রতিশোধ নেবে। তাদের কথা শুনে দয়া হয়েছিল বলেই তো হুজুর ঐ বাঘের গুহায় গিয়ে পা দিয়েছিলেন।
প্ৰজারা সমস্বরে আরও সব উত্তেজক কথা বলতে যাচ্ছিল, খাজাঞ্চি প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে তাদের থামিয়ে দিলেন। মুখ্য আর গোয়ার লোকগুলো কোমল, উদারহৃদয় জমিদার গঙ্গানারায়ণকে বিপদে ফেলতে চায়। সাহেবদের সঙ্গে লড়বে! ছিঃ! পিপড়ের পাখা ওঠে। মরণের তরে। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি মফস্বলে একটি ইংরেজের গায়ে হাত দিলে অমনি কলকেতা থেকে কামান বন্দুক নিয়ে রাশি রাশি ইংরেজ সৈন্য ছুটে আসবে, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। জমিদারের বজরায় বসে সাহেবদের বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারণ করাও অতি গৰ্হিত। হুজুর, কানে আঙুল দিন, এসব কিছু শুনবেন না।
খাজাঞ্চি সেই প্রজার দলকে কুকুর-ছাগলের মতন তাড়াবার ভঙ্গি করে বললো, দূর হ! বেরো! আভি নিকাল! হুজুর অসুস্থ, তেনার সামনে এসে হল্লা করিস, তোদের এত সাহস! নাম আগে, নাম বজরা থেকে, তারপর তোরা যা খুশী করগে যা। হুজুর তোদের হয়ে কতা কইতে গোসলেন, এই তোদের সাত পুরুষের ভাগ্যি! আজ রাতেই বজরা ঘোরাবো।
গঙ্গানারায়ণ এবার খাজাঞ্চিকে বাধা দিয়ে বললো, সেনমশাই, ওরা আমার প্রজা, বিপদে পড়ে আমার কাচে এয়েচে, এখন ওদের তাড়িয়ে দেওয়া কি উচিত কর্ম হয়? আশ্রিতকে রক্ষণ করাই তো আমাদের ধর্ম!
খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, ওরা আপনার প্রজার যোগ্য কী ব্যবহার করেচে? জমিদারের কাচে এয়েচে, কোনো এক ব্যাটাও কি নজরানা এনেচে? জমিদারের সামনে নজরানা না রেখে মুখ খোলার সাহস দেখায়! ছোটলোকগুলোর আজকাল বড় বেশী বাড়ি বেড়েচে।
তখন প্ৰজারা লজ্জিতভাবে বলে উঠলো যে, এখন তাদের পেটে অন্ন নেই, অনেকের বাড়ি ঘর পুড়ে গেছে, তাই কোনো নজরানা আনতে পারেনি। আবার, সুদিন যদি আসে, তখন তারা নিশ্চয়ই জমিদারকে নজরানা দিয়ে সম্মান দেখাবে।
একজন একটু বেশী ভাব দিয়ে বললো যে, হুজুর, এ বছর আমাদের চোখের পানিই আপনার নজরানা, আমাদের ফেলে যাবেন না।
খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, এখেনে বসে থেকেই বা আপনার লাভ কী? আপনি তো একবার চেষ্টা করে দেকালেন। নীলকুঠির সাহেব যদি আপনার কতায় কান না দেয়, তাহলেও সে সাহেবকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। নীলচাষের আইন তো আপনাকে বুঝিয়ে বলিচি! নীলকররা পত্তনী জমি নিয়ে যে চাষ করে, তার নাম এলাকা চাষী, সেখানে জমিদারের কোনোরকম কতা কওয়ার এক্তিয়ার নেই। এখেনকের প্রজারা এখন নীলকরদের ভূমিদাস, নীলকরদের ইচ্ছে অনুযায়ী ওদের মরণ বাঁচন! আপনি এর মধ্যে থেকে কী করবেন?
গঙ্গানারায়ণ উষ্ণ হয়ে বললো, সেনমশাই, আপনি বলতে চান যে এর কোনোরকম প্ৰতিকার নেই? এই নিরীহ মানুষগুলান শুধু শুধু মরবো?
খাজাঞ্চি এতক্ষণে একটু হাসলেন। এই বৃদ্ধ তাঁর জীবনে দেখেছেন অনেক উত্থান পতন। জমিদারের ছেলে প্ৰজার দুঃখ দেখে বিচলিত হয়, এটা তাঁর কাছেও একটা নতুন অভিজ্ঞতা। গঙ্গানারায়ণের রক্ত এখনো চঞ্চল, তাই নিজের ভালোমন্দ বোঝার সময় এখনো আসেনি।
খাজাঞ্চি বললেন, হুজুর, যুদ্ধে যে জেতে সে কি অমনি অমনি কিচু ছাড়ে? আমরা পরাধীন জাতি, আমরা কি আর বড়মুখ করে অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে পারি? সাহেবদের দয়ার ছিটে ফোঁটা পেয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। আপনি শুনেচেন নিশ্চয় যে বাংলার জন্য একজন ছোটলাট নিযুক্ত হয়েচেন এ বচর। বড়লাট তো সিমলেতেই বসে থাকেন, রাজধানী কলকাতায় কদিনই বা আর আসেন। এখন ছোটলাট হলদি সাহেব যদি দয়া করেন।
গঙ্গানারায়ণ বললো, লেফটেনাণ্ট গভর্নর হ্যালিডে। তিনি কী করবেন?
খাজাঞ্চি বললেন, শুনিচি ছোটলাট দেশের অবস্থা স্বচক্ষে দেখবার জন্য সফরে বেরিয়েচেন। একদিন না একদিন এদিকপানেও আসবেন। প্ৰজারা তখন দলবেঁধে গিয়ে তেনার পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়াক। তিনি যদি কিছু সুরাহা করেন তবেই এদের বাঁচোয়া। আপনি কী করবেন? দেশের দণ্ডমুণ্ডের মালিক তো জমিদাররা নয় এখন, সাহেবরা হলো গে মালিক। আমার পরামর্শ যদি শোনেন হুজুর, ইদিকে আপনার যে বাকি জমি এখুনো পত্তনি দেওয়া হয়নি, তাও নীলকরদের হাতে তুলে দিন। তাহলে শাস্তিতে থাকবেন। আখের চাষ এখুন মাতায় থাকুক।
গঙ্গানারায়ণ বললো, হ্যালিডে সাহেব ইন্দিকে কখন আসবেন, তার ঠিক কী! জামালুদ্দীন শেখ আর হানিফা বিবিকে যে গুম করে রেকেচে, তার একটা ব্যবস্থা কত্তে হবে না? তাদের যদি এর মধ্যে মেরে ফেলে?
—মেরে ফেললে আর আপনি কী উপায়ে আটকাবেন? কতায় বলে, মুখ্যার মরণ গাছের আগায়। ঐ জামালুদ্দীন শেখটাকে আমি চিনি তো, ব্যাটা কাঠগোঁয়ার, ওর মরণ তো এমন আঘটাতেই বাঁধা ছেল! বিবিকে ধরে নিয়ে গ্যাচে, সেজন্য। ওর এত টনক নড়াবার কী দরকার ছেলে? সাধ করে কেউ বাঘের গুহায় পা দেয়? জোয়ান মদ, বেঁচে থাকলে একটার বদলে ও আমন আরও দশটা বিবি শাদী কত্তে পাত্তো না? বলুন?
—আপনি বলেন কী, সেনমশাই? ওর বউকে ধরে নিয়ে গেলে ও তার সন্ধান করতে যাবে না? চুপ করে ঘরে বসে থাকবে জোয়ান মন্দ হয়ে?
—তাই যদি কত্তো তো ও হতভাগা বেঁচে যেতে পাত্তো। বরং উচিত ছেল আর একটা খাপসুরৎ মেয়েকে শাদী করে কিছুদিন পর তাকেও নীলকুঠিতে পাটিয়ে দেওয়া।
—ঘরের বউকে জোর করে টেনে নিয়ে যায়—এত বড় অন্যায় নিয়ে আপনার মাস্করা আমার ভালো লাগচে না, সেনমশাই!
—যদি আমার কতাকে মাস্করা বলে মনে হয়, তবে ক্ষমা করবেন হুজুর। কিন্তু এর মধ্যে অন্যায়টা আপনি দেকালেন কোতায়? আমাদের এই এতবড় দেশটাকে পছন্দ হয়েচে বলেই তো সাহেবরা কেড়ে নিয়েচে। আর একটা সুন্দরী মাগীকে পছন্দ হলে তাকে ওরা কেড়ে নিতে পারবে না? বীরভোগ্য বসুন্ধরা আর স্ত্রীলোকরা হলোগে বীর্যশুল্কা। আমাদের শাস্ত্রকাররা এই কতা বলে গ্যাচেন। খুঁজে দেখুন, ওদের মুসলমানী শাস্ত্রেও নিশ্চয় এমন কতা আচে, খৃষ্টানী শাস্ত্ৰেও আচে।
—শাস্ত্ৰ আলোচনা এখন থাক। প্রজাদের বলুন, কালই আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে ওদের বিষয় নিয়ে দরবার কত্তে যাবো।
প্ৰজারা জয়ধ্বনি করে উঠলো।
খাজাঞ্চি বিরস মুখে বললেন, আপনি আজ অসুস্থ হয়ে পড়েচিলেন। এরপর যদি আপনাকে কঠিন ব্যামোয় ধরে তবে কলকাতায় গিয়ে কত্তামার কাচে আমরা কী করে মুখ দ্যাকাবো? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাচে গিয়ে আপনি কী করবেন? প্রজাদের মুখেই তো শুনেচেন যে এই নীলকুঠির কুঠিয়াল সাহেব। আর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একেবারে প্রাণের দোসর। সেই সাহেব এ সাহেবের কুঠিতে এসে নিত্য খানা খান। তিনি কি এনার নামে কোনো নালিশ শুনবেন? শুধু শুধু আপনার মুখ নষ্ট হবে।
গঙ্গানারায়ণ গম্ভীরভাবে বললো, নীলকররা রায়তদের দিয়ে জোর করে নীলচাষে বাধ্য করতে পারে বটে, আইনের সে রকম ফাঁক রয়ে গ্যাচে, কিন্তু প্ৰজাদের ঘর থেকে বউ কেড়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা গুম খুন করার কোনো অধিকার তাদের নেই। ইংরেজ সরকারের যত দোষই থাকুক, তারা যেসব আইন করে, তার সুযোগ নিতে পারে সকলেই। গরীব নিরীহ লোকগুলো সেইসব আইনের খবর রাকে না। বলে কি যে যা খুশী পার পেয়ে যাবে? এই ম্যাকগ্রেগরকে আমি শাস্তি দেওয়াবোই।
—আইনের কতাই যখন তুললেন, হুজুর, তখুন। আমি বলি যে আপনি সব দিক ভেবে দ্যাকেননি। আপনি ভালোমতনই জানেন যে, গুম, আটক, খুন বা ঘর বাড়ি পোড়ানো—এসব হোলো গে ফৌজদারি মামলা—মফস্বলে কোনো সাদা চামড়ার মানুষের নামেই ফৌজদারি মামলা আনা যায় না। কোনো আদালতে সে মামলা নেয় না। ম্যাজিস্ট্রেটও আপনার কতা শুনে হাঁকিয়ে দেবে। এর সুরাহা কত্তে হলে আপনাকে মামলা দায়ের কত্তে হবে কলকেতার সুপ্রিম কোটে। ঐ জামালুদ্দীনের বুড়ো বাপকে আপনি সঙ্গে নিয়ে চলুন, তারপর কলকেতায় ওকে দিয়ে মামলা ঠোকাবেন। আপনার যদি ইচ্ছে হয়, খরচ পত্তির আপনি দেবেন।
—আর ততদিনে যদি জামালুদ্দীন শেখ আর হানিফা বিবি বেঁচে না থাকে? প্রমাণ লোপ করার জন্য যদি ওরা ওদের দুজনকে খুন করে জলে ভাসিয়ে দ্যায়?
—তা হলে আর কী হবে? এমন হাজার হাজার মাচে, তার সঙ্গে আরও দুটি প্রাণী যোগ হবে। একটু থেমে, একটু কেশে এবার বৃদ্ধ সেনমশাই কুণ্ঠিতভাবে বললেন, আমার কতা আপনার কাছে তিক্ত বোধ হতে পারে হুজুর, কিন্তু আমি বলচি আপনাকে যুক্তির কতা। মিচিমিচি দুটো ভাবের কতা আপনাকে শুনিয়ে তো কোনো লাভ নেই। ঐ হানিফা বিবিকে সাহেব ছুয়েচে, এরপর তাকে ঐ মোছলমানরা কেউ কি আর ঘরে ঠাঁই দেবে? ওদের জিজ্ঞেস করে দেকুন না? এমন কি ঐ জামালুদ্দীন শেখও দিত না। হানিফা বিবিকে ছাড়িয়ে আনা হলো গে ভাবের কতা। ঐ একটি মেয়েমানুষের জন্য হাজার হাজার মানুষের ওপর আবার অত্যাচার হবে।
গঙ্গানারায়ণ বললো, আপনার যুক্তি এখন আপনার কাচেই থাক। কাল সকালে ম্যাজিস্ট্রেটের কাচে আমায় যেতেই হবে। এটা আমার দায়।
—আপনার কিসের দায়?
—কিসের তা জানি না। তবু আমার বুকে একটা ভার চেপে আচে।
—শরীর এখন ভালো আচে আমার। কেন তখন অমন মাতা ঘুরে গেল বুঝচি না।
—হুজুর, আপনি শুনেচেন বোধহয়, নদীয়ার কমিশনার সাহেব সুখচরের জমিদার নীলকণ্ঠ রায়কে আটক করে রেখেছেল এই চোতমাসে। লোকে বলে, নীলকণ্ঠ রায়কে জোর করে ঘোড়ার দানা খাওয়ানো হয়েছেল সাহেবের হুকুমে!
—ও সব কথা আর থাক। আপনাকে বললাম যে, এটা আমার দায়।
প্ৰজাদের উদ্দেশ্য করে গঙ্গানারায়ণ বললো, তোমরা সব এখন যাও। রাত হয়েচে। এইসব কথা আর এখুন। পাঁচ কান করো না। এইসব কতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঘোঁট পাকিয়েও এখুন কোনো সুফল হবে না। কাল সকালে আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাচে যাবো, যদি আমার সঙ্গে তোমার কেউ কেউ যেতে চাও, তা হলে যাবে।
প্ৰজারা আবার আনন্দে সরব হয়ে উঠলো। এত দুঃখের মধ্যেও তাদের এইটুকুই সান্ত্বনা যে তাদের জমিদার তাদের সমব্যাথী হয়েছেন। নায়েব-গোমস্তা-খাজাঞ্চীর কথায় কান না দিয়ে তাদের কথায় গুরুত্ব দিয়েছেন।
প্রজারা তখনও যেতে চায় না, গঙ্গানারায়ণ বারবার বুঝিয়ে বললো তাদের। তারপর এক সময় সে খাবার ঘরে চলে এলো।
মেঝেতে মখমলের আসন পাতা, সামনে রূপোর থালায় যুঁই ফুল রঙের আতপ চালের ভাত ও দশ বারো রকমের ব্যঞ্জন সাজানো। জননী বিম্ববতীর নির্দেশে সফরে বেরুবার সময় পাঁচক ভূত্যের একটি ছোটখাটো দল গঙ্গানারায়ণকে সঙ্গে আনতে হয়। গঙ্গানারায়ণ স্বল্পাহারী, তবু প্ৰধান রসুইকর দুযোধন প্রতিদিন দুবেলা নানা প্রকারের ব্যঞ্জন পাক করবেই। হস্ত মুখ প্ৰক্ষালনের সময় গঙ্গানারায়ণ তার ডান হাতের তিনটি অঙ্গুরীয় খুলে বাম হাতের আঙুলে পরলো। ডান হাতে অঙ্গুরীয় পরে থাকা অবস্থায় খাদ্য গ্ৰহণ করা গঙ্গানারায়ণদের পরিবারে নিষিদ্ধ। কয়েক পুরুষ আগে এই পরিবারের একজন কতা নাকি অন্ন গ্রহণের সময় হঠাৎ একটি আলগা অঙ্গুরীও উন্দরসাৎ করে ফেলেছিলেন এবং আসনে বসে থাকা অবস্থাতেই তিনি মারা যান।
প্রথম গ্রাস অন্ন মুখে তুলেই গঙ্গানারায়ণ বুঝতে পারলো যে আজ তার আহারে একেবারেই রুচি নেই। অথচ একটু আগেই প্রজাদের সঙ্গে কথা বলবার সময় সে বেশ ক্ষুধা বোধ করছিল। এখনো তার ক্ষুধা আছে এবং স্বাভাবিক নিয়মেই এ সময়ে তার ক্ষুধার উদ্রেক হওয়া উচিত, তবু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না কেন? বিভিন্ন ব্যঞ্জন সে চেখে দেখলো, সবগুলিই যেন বিস্বাদ। নদী থেকে ধরা টাটকা কালবোস মাছের সৃপ, বৃহদাকার গলদা চিংড়ি ভাজা, ঐচোড়ের তরকারি যা দুযোধনের রন্ধনগুণে পাঠার মাংসের মতন মনে হয়, এর কিছুই একটুকরোর বেশী মুখে দিতে পারলো না গঙ্গানারায়ণ। এমনকি এক পাথরবাটি ভরা উষ্ণ দুধ, যা প্রতিদিন খাদ্যের শেষে পান করে সে, তাতেও ওষ্ঠ ছোঁয়ানো মাত্র সে যেন পুরোনো ঘূতের গন্ধ পেল, তার প্রায় বমি এসে গেল। গঙ্গানারায়ণ বুঝলো, রন্ধনের কোনো দোষ নয়, তার জিহ্বাই কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করতে চাইছে না, এরকম ব্যাপার গঙ্গানারায়ণের অভিজ্ঞতায় আগে কখনো হয়নি। সে বিমূঢ় বোধ করলো।
গঙ্গানারায়ণকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে খাজাঞ্চিমশাই বললেন, কিচুই খেলেন না তো হুজুর। আমি তখুনি দেকেই বুঝিচি, আপনার শরীর গতিক ভালো নয়। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আজই কলকাতার দিকে রওনা দিলে ভালো হয়।
গঙ্গানারায়ণ মুখ তুলে বললো, আমার শরীরে আর কোনো রকম অসুবিধা বোধ কচ্চি না খাজাঞ্চিমশাই, শুধু খেতেই যেন ইচ্ছে কচ্চে না।
খাজাঞ্চি বললেন, পিত্ত, কফ, বায়ু কুপিত হলে অনেক সময় বুজতে পারা যায় না। আমার কাচে মকরধ্বজ রয়েচে, একটু তুলসীপাতার রস আর মধুর সহিত মেড়ে যদি খেয়ে নেন—
পাত্র ত্যাগ করে উঠে পড়লো গঙ্গানারায়ণ। খাজাঞ্চির দেওয়া ওষুধ খেয়ে নিল বিনা আপত্তিতে। তারপর নিজের কক্ষে গিয়ে গবাক্ষের পাশে বসে চেয়ে রইলো নদীর দিকে। আজ কোন তিথি কে জানে, সন্ধ্যার দিকে আকাশ অন্ধকার ছিল, এখন বেশ জ্যোমা ফুটেছে। নদীর তরঙ্গে লুটোপুটি খেয়ে খেলা করছে শিশু চাঁদ। গঙ্গানারায়ণ অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো সেদিকে, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শয্যায় আশ্রয় নিল।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার নিদ্রা এলো না। অপরাহ্নে ম্যাকগ্রেগরের রাঢ় ব্যবহার আর অসহায় প্রজাদের দুঃখের কথা অনবরত ঘুরতে লাগলো তার মাথায়। সকলের কথা শুনে যা বোধ হচ্ছে, এ জেলার ম্যাজিস্ট্রেটও এক অমার্জিত ইংরেজ। সে কী রকম ব্যবহার করবে তার ঠিক নেই, তবু প্রজাদের কাছে কথা দিয়েছে, গঙ্গানারায়ণকে একবার যেতেই হবে তার কাছে। ইরেজের হাত থেকে জামালুদ্দীন শেখ আর হানিফা বিবিকে ছাড়িয়ে আনার সাধ্য তার নেই, কিন্তু সর্বপ্রকার চেষ্টা তাকে করতেই হবে। চেষ্টার নামই পুরুষকার।
একসময় গঙ্গানারায়ণ টের পেল যে তার সর্বশরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, মস্তিষ্কের মধ্যে যেন বয়ে যাচ্ছে একটা প্রবল ঝঞ্ছা। অথচ এ ঠিক জ্বর আসার অনুভূতি নয়, শরীরে কোনো অবশ ভাব নেই, শরীর যেন আর শয্যায় থাকতে চাইছে না।
এ অবস্থায় নিদ্রা আসা অসম্ভব, গঙ্গানারায়ণ উঠে বসলো। এ কী হলো তার? নীলকুঠিতেও কিছুক্ষণের জন্য তার বোধশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিল, সে দাঁড়িয়েই ছিল, অথচ সেই সময়টুকুর কথা তার কিছুই মনে নেই। তারপর পালকিতে ওঠার সময় সে সম্পূর্ণই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো, এ রকম তো তার কখনো হয়নি আগে!
ঘাড়ে মাথায় জল ছেটালে উপকার হতে পারে ভেবে সে তাই করলো,তারপর মুক্ত বায়ু সেবনের উদ্দেশ্যে সে উঠে এলো বজরার ছাদে।
রাত্ৰি কত প্রহর এখন কে জানে। বজরার সকলেই এখন ঘুমন্ত। বজরার সঙ্গে বাঁধা ছোট পিনিসটির ছাদে জ্বলছে একটা মশাল, তার কাছেই দুজন লোক পরস্পরের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে বসে আছে। পাশে রাখা দুটি ধারালো বশ। কোনো সন্দেহ নেই যে প্রহরী দুজনও নিদ্ৰাপ্লুত।
নরম, শীতল বার্তাসে বেশ খানিকটা আরাম পেয়ে ছাদের ওপর পায়চারি করতে লাগলো গঙ্গানারায়ণ। একটু পরেই সে স্থান কাল সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলো।
যেন এখানে কোনো নদী নেই, বজরা নেই, কোনো মানুষ নেই। গঙ্গানারায়ণ সম্পূর্ণ একা, সে কোনো সীমাহীন স্থলে ঘুরছে। হঠাৎ হঠাৎ তার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎচমকের মতো এসে যাচ্ছে এক একটি স্মৃতির টুকরো, সেগুলিও তার অচেনা। সে যেন শিশু হয়ে শুয়ে আছে কোনো জননীর কোলে, কিন্তু সেই জননীকে সে চেনে না-সোঁ ফুলের মালা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।–তার অঙ্গে রাজবেশ-সে ড়ুবে যাচ্ছে কোন কাল সমুদ্রে, শুধু হাত দুটি উচ্চে তোলা-পরমুহূর্তেই যেন সে আবার শুয়ে আছে নগ্নগাত্রে কোনো মন্দিরের চাতালে।
সে মুখ তুলে তাকালো আকাশের দিকে। লঘু মেঘ ও কিছুটা নীল রং মেশা জ্যোৎস্নাভিরা অনন্ত গগনের দিকে চেয়ে সে যেন সত্যিই সন্ধান পেয়ে গেল অসীমের, তার নিশ্বাস পড়তে লাগলো ঘন ঘন, তার মুখের চেহারা এখন অন্যরকম।
একটা শব্দ পেয়ে গঙ্গানারায়ণ তাকালো নদীর ঘাটের দিকে। সেখানে কয়েকটি মানুষ জলে নেমে মুখ প্ৰক্ষালন করছে আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছে গুন গুন করে। গঙ্গানারায়ণ ওদের দিকে তাকালো বটে কিন্তু কিছু যেন দেখলো না, কিছু গ্রাহ্য করলো না, সে আবার মুখ ফেরালো আকাশের দিকে তৃষ্ণার্তের মতন।
একটু পরেই আবার ঠিক স্বপ্নচালিতের মতন গঙ্গানারায়ণ নেমে এলো ছাদ থেকে, কিন্তু নিজের কক্ষের দিকে গেল না। বজরার সিঁড়ি তুলে রাখা হয়েছে, তীরের বেশ সন্নিকটেই নোঙর করা বজরা, গঙ্গানারায়ণ গলুইয়ের কাছে এসে এক লফে চলে এলো তীরে। নদীর ঘাটের কাছে যেখানে লোকগুলি ছিল, সে সেদিকে এগিয়ে গেল দ্রুত পদে।
লোকগুলি তখন গোল হয়ে বসেছে। একজন বয়স্ক ব্যক্তি একটা বড় পাত্ৰ ভর্তি ভেজানো চিঁড়ে ও আখের গুড় মাখছে, তার থেকে এক একটা মণ্ড তুলে তুলে দিচ্ছে অন্যদের হাতে। গঙ্গানারায়ণ সেখানে বসে পড়ে হাত বাড়ালো। বয়স্ক লোকটি কোনো প্রশ্ন না করে গঙ্গানারায়ণের হাতেও তুলে দিল একটা মণ্ড। গঙ্গানারায়ণ সাগ্রহে সেটা সবখানি এক সঙ্গে ভরে দিল মুখের মধ্যে। ঠিক যেন অমৃতের স্বাদ পেল। লোভীর মতন সে হাত বাড়িয়ে দিল আবার।
বয়স্ক লোকটি এবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে বাপু?
গঙ্গানারায়ণ কোনো উত্তর দিল না। সে হাত বাড়িয়েই রইলো। সেই লোকটি বললো, অতিথি নারায়ণ, তুমি যদি তৃপ্ত হও তো যত খুশী লাও। আমরা অতি দরিদ্র, আমাদের কাছে লুণ্ঠনযোগ্য ধনসম্পদ কিছুই নেই।
দলটিতে বয়স্ক নারী পুরুষই বেশী, তিনজন যুবক ও একটি শিশুও রয়েছে, এরা তীর্থযাত্রী। আহার শেষ করার পর ওরা যখন আবার যাত্রা শুরু করলো, তখন গঙ্গানারায়ণ নিঃশব্দে অনুসরণ করতে লাগলো ওদের। সাধারণত রাত্রে পথ চলার রীতি নেই। কিন্তু বিদেশী তীর্থযাত্রীরা এ অঞ্চলে এসে শুনেছে যে নীলকরদের অত্যাচারে এখানে ত্রাসের রাজত্ব চলছে। অধিকাংশ প্রজাই গৃহছাড়া। সেইজন্য তীর্থযাত্রীরাও যত দ্রুত সম্ভব এ এলাকা পার হয়ে যেতে চায়।
গঙ্গানারায়ণ মিশে গেল ওদের দলে। ক্রমশ সে চলে যেতে লাগলো তার বজরা থেকে অনেক দূরে। তীর্থযাত্রীরা প্ৰথমে তাকে কোনো দস্যদলের প্রতিনিধি মনে করেছিল, তার সঙ্গে কোনো অস্ত্ৰ না থাকলেও তাকে ওরা ঘটাতে সাহস করেনি। ভোরের আলোয় গঙ্গানারায়ণকে দেখে ওরা আরও অবাক হলো। গঙ্গানারায়ণের সবঙ্গে তার পারিবারিক আভিজাত্যের ছাপ পরিস্ফুট। তার পরিধানে চিকন সিল্কের ঢিলে কুর্তা ও শেরওয়ানি, কণ্ঠে স্বর্ণের মফচেন, বাঁ হাতের আঙুলে পাঁচটি বিভিন্ন মূল্যবান রত্ন সমন্বিত অঙ্গুরীয়। তার মুখে অদ্ভুত বিষাদ ও ঔদাসীন্য মাখানো। তীর্থযাত্রীদের নেতা সকালবেলা তাকে জিজ্ঞেস করলো, মহাশয় আপনি কোথায় চলেছেন? কোথায় আপনার নিবাস? আমরা অতি সাধারণ মানুষ, আপনি আমাদের সঙ্গী হলেন কেন?
গঙ্গানারায়ণ বললো, আমাকে আপনাদের দলে স্থান দিন। আমি পথ চিনি না।
গঙ্গানারায়ণ কি কাপুরুষ? সে কি পলাতক হতে চাইছে? প্রজাদের মুখপাত্র হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবার কথা ছিল তার, সে কি ভীরুর মতন রাত্রির অন্ধকারে দেশান্তরে চলে যাচ্ছে? এসব কিছুই মনে নেই গঙ্গানারায়ণের। তার সমস্ত বন্ধন টুটে গেছে, কোনো কিছু সম্বন্ধেই সে আর কোনো দায় বোধ করে না।
একটানা বহুদিন বহু রাত ঐ তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে কাটিয়ে বহু পথ পরিক্রমা করে সে এসে পৌঁছোলো প্ৰয়াগের ত্ৰিবেণী সঙ্গমে। যাত্রীদলের গন্তব্য এই প্ৰয়াগই, এখানে তারা পুণ্য স্নান করতে এসেছে। অতি প্ৰত্যুষে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন নদীর পবিত্র সঙ্গমে অনেকবার ড়ুব দেবার পর গঙ্গানারায়ণ যেন পুনজীবন প্রাপ্ত হলো। তার মস্তিষ্কের শূন্যতাবোধ কেটে গেছে। তার সারা শরীর কাঁপছে, এ কম্পন শীত বোধের জন্য নয়, অন্য এক উপলব্ধির উত্তেজনায়। সিক্ত বসনে পাড়ে উঠে এসে ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়লো, প্ৰয়াগের থেকে কাশী খুব বেশী দূর নয়, এবার তাকে যেতে হবে সেখানে। তার নিয়তিই তাকে এখানে টেনে এনেছে।
তীর্থযাত্রী দলের সংশ্রব ত্যাগ করে সে একই রওনা দিল বারানসীর দিকে।