বিলেত থেকে ফ্লোটিলা কোম্পানি এসে জাহাজ চালাতে শুরু করে দিয়েছে। এই কোম্পানির জাহাজে যাত্রীরা চলাচলে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তাদের আর ফেরানো মুশকিল হবে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী জাহাজ প্রস্তুত হয়ে পড়ে আছে, আর দেরি করা যায় না, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে যথেষ্ট।
কথা ছিল, প্রথমবারের যাত্রায় জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ শুধু অন্তরঙ্গ সুহৃদ অক্ষয় চৌধুরী আর রবিকে সঙ্গে নেবেন। আগের দিন রাত্রে জ্ঞানদানন্দিনী হঠাৎ জেদ ধরলেন, তিনিও যাবেন। অত দূরের পথ পাড়ি দিচ্ছে ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব স্টিমার, এই অভিযানের উত্তেজনার আঁচ থেকে তিনি দূরে থাকতে চান না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৃদু আপত্তি তুলে বলেছিলেন, জাহাজটির সব কলকব্জা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, অত দূরের পথ পাড়ি দিতে পারবে কি না এখনও ঠিক বলা যায় না, পথে কোনও বিপদ ঘটতে পারে, মেজবউঠান না হয় এর পরের বার যাবেন। বিপদের সম্ভাবনার কথা শুনে জ্ঞানদানন্দিনীর উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। তিনি একা মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড ঘুরে এসেছেন, তিনি ডরাবেন এই সামান্য নদীপথকে। তার ছেলেমেয়ে সুরেন আর ইন্দিরাও নেচে উঠেছে, ওদেরও বাদ দেওয়া যাবে না।
শুক্রবার ভোরবেলা দুখানি ঘোড়ার গাড়ি যাত্রা শুরু করল জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে। এখনও শহর ভালো করে জাগেনি। দুটি একটি দোকান খুলতে শুরু করেছে। চিৎপুরের রাস্তায়, কেউ কেউ দোকানের সম্মুখ অংশটুকু ঝাঁট দিচ্ছে। গ্যাসের বাতিগুলি নেবানো হয়নি। তার ওপর পড়েছে সূর্য-রশ্মি, শিষ দিতে দিতে চলে গেল একটি ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি, তাতে যাত্রীর সংখ্যা যৎসামান্য। একটি দোকানের পাটাতনের ওপর বসে আছেন এক বৃদ্ধ, তাঁর দাড়ির রং লাল, চোখে চশমা, নিবিষ্টভাবে পাঠ করছেন একটি ফারসি কেতাব। সামনের মসজিদের সিঁড়ির ওপর হাত পেতে দাঁড়িয়ে এক অন্ধ ভিখারি সকলের আগে শুরু করে দিয়েছে তার জীবিকার অন্বেষণ।
প্রথম গাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী, দ্বিতীয় গাড়িতে অক্ষয়বাবু ও রবির পাশে দুই কিশোর-কিশোরী। অক্ষয়বাবুর মুখে লম্বা চুরুট, প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে এক গেলাস জল পান করার আগেই তিনি চুরুট ধরিয়ে ফেলেন। সেই চুরুটের ছাই তাঁর জামায় খসে খসে পড়ে, তিনি খেয়াল করেন না। মে মাসের গরমেও সুরেন পরে এসেছে কোটপ্যান্ট, বারো বছর বয়েসেই তার মধ্যে একটা ভারিক্কী ভাব এসেছে। ইন্দিরা পরে আছে একটি গোলাপি রঙের ফ্রক, এখনও সে শাড়িতে ঠিক অভ্যস্ত হয়নি।
খানিক পরেই গাড়ি দুটি গঙ্গার ধারে কয়লাঘাটে এসে উপস্থিত হল। গাড়ি থেকে নামতে না-নামতেই তীৰ্থস্থানের পাণ্ডাএদের মতন ওদের ঘিরে ধরল মাঝিরা। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা, সিন্ধের কামিজ ও কোঁচানো ধুতি পরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখলেই বোঝা যায় তিনি এই দলটির নেতা, মাঝিরা তাকেই ঘিরে ধরে তারস্বরে নিজের নিজের নৌকোর গুণাগুণ জানাতে লাগল। ভিড় এড়িয়ে সুরেন আর ইন্দিরাকে নিয়ে রবি নেমে এল ঘাটের সিঁড়িতে, সামনে অনেকগুলি ছইওয়ালা নৌকো দুলছে। গঙ্গা-স্নানের পুণ্য অর্জনের জন্য কোমর জলে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছে বেশ কিছু মানুষ। ইন্দিরা বলল, রবিকা, নৌকোগুলোকে মোচার খোলার মতন মনে হয় না?
রবি বলল, তোর তাই মনে হল? ভালো করে দেখ তা বিবি, ছইওয়ালা নৌকোগুলোকে দৈত্যদের পায়ের বড় মাপের চটিজুতার মতন দেখায় না? উপমাটা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল ইন্দিরা।
শেষ পর্যন্ত একটা নৌকো ঠিক হল। ছাইয়ের বাইরে, জ্ঞানদানন্দিনীকে মাঝখানে বসিয়ে তাঁকে ঘিরে রইল অন্যরা। একখানা জমকালো ঘি রঙের বেনারসি শাড়ি পরে এসেছেন জ্ঞানদানন্দিনী, মাথার মস্ত বড় খোপায় হীরের ফুল, তাঁর স্বর্ণাভ মুখে এসে পড়েছে। রোদের রেখা, তাঁকে দেখাচ্ছে রাজেন্দ্রানীর মতন। অন্য নৌকোর যাত্রীরা পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাকে দেখে হাঁ হয়ে যাচ্ছে। কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী দিনের বেলা নৌকোর খোলা জায়গায় বসে না, কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর ভ্ৰীক্ষেপ নেই।
এক একটি স্টিমার যাবার সময় বিশাল বিশাল ঢেউ ওঠে, নৌকোটি যাত্ৰীসমেত একবার ওপরে ওঠে একবার নীচে নামে, সুরেনের মুখ আড়ষ্ট, ইন্দিরা ভয় পেয়ে রবির জানু চেপে ধরে। জ্ঞানদানন্দিনী হাসতে হাসতে বললেন, তোদের এত ভয় কিসের, সাতার শিখেছিস না? তা হলে ভয় কী?
অক্ষয় চৌধুরী বিড়বিড় করে বললেন, আমি যে কেন ছাই সাঁতারটাও শিখিনি। পুকুর-টুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করাও আমার পছন্দ নয়।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবি দু’জনেই সাঁতারে দক্ষ। অক্ষয়চন্দ্ৰকে আরও ভয় দেখাবার জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বললেন, জোয়ারের টান দেখেছেন? আপনাকে উদ্ধার করার সুযোগই পাব না। পড়া মাত্র ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অক্ষয়চন্দ্ৰ চোখ কপালে তুলে বললেন, ও কি ও কি, ও জ্যোতিবাবুমশাই, একখানা জাহাজ যে সোজা এদিকে আসছে, আমাদের গুড়িয়ে দেবে?
জ্যোতিরিন্দ্র পেছন ফিরে দেখেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওই তো আমার সরোজিনী! ওরে রাখা রাখ, থাম থামা!
মাঝিরা বলল, ভয় পাবেন না কত্তা, আমরা ঠিক জাহাজ ধরিয়ে দেব!
কয়লাঘাটে জেটি নেই বলে “সরোজিনী।” তীরে ভিড়তে পারেনি, মাঝগঙ্গায় ছিল। ধপধপে সাদা রং করা হয়েছে অর্ণবপোতটিকে, তার দু’পাশে বাধা দুটি জীবনতরী। নৌকোটি সেই জাহাজের এক পাশে ভিড়ল, ওপর থেকে নামিয়ে দেওয়া হল দড়ির সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে কিশোর-কিশোরী দুটি উঠে গেল অনায়াসে। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী উঠবেন কী করে? তিনি অবশ্য কিছুতেই পিছ-পা নন। আচল জড়িয়ে নিলেন কোমরে, জুতো খুলে ফেলে তাঁর স্থলপদ্মের মতন কোমল পা রাখলেন সিঁড়িতে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবি তাঁকে ধরে রইল দুদিকে। তিনি মুচকি হেসে বললেন, এক সময় আমি গাছে চড়তে পারতাম, তা জানো না বুঝি?
এর পর বেশ সাবলীলভাবেই তিনি উঠে গেলেন ডেকে। অক্ষয়চন্দ্রকে ওপরে তোলাই বরং কষ্টকর হল। তিনি বারবার সভয়ে বলতে লাগলেন, পড়ে যাব, পড়ে যাব, ওরে বাবা, সিঁড়িটা দোলে যে!
জাহাজটির নীচের তলা সাধারণ যাত্রীদের জন্য। ওপর তলায় রয়েছে তিনটি ক্যাবিন ও প্রশস্ত ডেক, এ যাত্রায় সম্পূর্ণ ওপর তলাটিই মালিকদের জন্য সংরক্ষিত। ডেকের ওপর রয়েছে কয়েকটি বড় বড় রঙিন ছাতা ও অনেকগুলি চেয়ার। আগের রাতেই কয়েকজন ভৃত্য ও পাচককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরা সবাই ওপর তলার ডেকে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার একটু পরেই ভৃত্যরা গরম গরম নিমকি ও চা নিয়ে এল।
জাহাজ চলতে শুরু করতেই ঝাপটা মারল প্ৰবল বাতাস। আর যেন বাতাসের বেগ বেশি প্রবল। পোশাক সামলে রাখাই অসম্ভব হয়ে পড়ল, ধুতি ফুলে ওঠে, জামা ওপরের দিকে উঠে যায়। সবচেয়ে অসুবিধেয় পড়লেন জ্ঞানদানন্দিনী, তিনি প্ৰাণপণে শাড়ি সামলাচ্ছেন, এর মধ্যে তাঁর খোপা খুলে গিয়ে চুলগুলি দাপাদাপি করতে লাগল নাগিনীর মতন। অক্ষয়বাবুর মুখের চুরুট উড়ে গিয়ে পড়ল জলে। এই সব কিছুই প্রবল কৌতুকের, হেসে একেবারে গড়গড়ি দিতে লাগল সবাই।
এই আমোদে আর একজন যোগ দিতে পারত, কিন্তু সে নেই। এই জাহাজটিকে মনের মতন সাজাবার যার বড় সাধ ছিল, সে নেই। স্বামীর এই দুঃসাহসিক উদ্যোগে যে হতে চেয়েছিল, সে কোথায় হারিয়ে গেছে। কাদম্বরীর মৃত্যু হয়েছে ঠিক এক মাস আগে, এর মধ্যেই যেন তাঁর স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সকলের মন থেকে। কাদম্বরীর নামও কেউ উচ্চারণ করছে না একবারও।
জাহাজের খালাসিরা মালিকপক্ষের এই দলটিকে দেখে বুঝতেই পারবে না, এক মাস আগে কত বড় একটা শোকের ঝড় বয়ে গেছে এই পরিবারে। এঁরা অ্যারিস্টোক্র্যাট, বাইরের লোকেদের সামনে এঁরা কখনও শোক দুঃখের প্রকাশ ঘটান না। সাধারণ মানুষদের সামনে কোনও আবেগ বা উচ্ছ্বাস দেখানোও অভিজাতদের স্বভাব নয়, এরা সব সময় অঞ্চল। জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কেও এঁদের মূল্যবোধ পৃথক । মৃত্যু তো একটি অমোঘ ঘটনা, যা কিছুতেই ফেরানো যায় না, তা নিয়ে অনর্থক দিনের পর দিন হা হতাশ করে চলে নিতান্ত পাঁচপেঁচি ধরনের লোকেরা ।
একটি মৃত্যুর জন্য অন্য সব কিছু থেমেও থাকতে পারে না।
জাহাজের ব্যবসায়ে অতি গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। মাত্র সাত হাজার টাকায় নিলামে ডেকে এই জাহাজের খোলটি কিনে ভেবেছিলেন বুঝি খুব সস্তায় পেয়েছেন। কিন্তু মেরামতি করাতে গিয়ে দেখলেন, ঢাকের দায়ে মনসা বিকোনোর মতন অবস্থা। এর মধ্যেই লক্ষাধিক মুদ্রা ব্যয় হয়ে গেছে। আরও কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, কিন্তু বিলম্ব করার আর উপায় নেই। কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুতে কয়েক দিনের জন্য সব ছেদ পড়েছিল, আরও দিন নষ্ট হলে সমস্ত উদ্যোগটিই পণ্ড হয়ে যাবে।
কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেললাইন পাতা হয়েছে, এখন খুলনা থেকে বরিশাল পর্যন্ত যাত্রী ও মালবহনের চাহিদা অত্যন্ত বেড়ে গেছে, এই জলপথে জাহাজ চালালে প্রচুর লাভ হবার কথা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হিসাবটা ঠিকই ছিল, কিন্তু এর মধ্যে একটা বিলিতি কোম্পানি এসে পড়ল। এখন প্রতিযোগিতায় সেই বিলিতি ফ্লোটিলা কোম্পানিকে হঠিয়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। একখানা জাহাজে হবে না, সেই জন্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আরও চারখানা জাহাজ কেনার জন্য বায়না দিয়েছেন। তার প্রায় সর্বস্ব এখন এই ব্যবসায়ে নিয়োজিত।
এক হাতে মাথায় চুল চেপে ধরে ডেকের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে রবি। চলন্ত জাহাজ থেকে গঙ্গাতীরে শোভা অতি অপরূপ। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে স্নানের ঘাট, গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ এসে মিশেছে ঘাটে, গ্রামের মেয়েরা কলসি কাঁখে জল নেবার জন্য জলে নামছে শাড়ি ভিজিয়ে, বাচ্চারা দাপাদাপি করছে হাঁটু জলে-কাদায়, পাশেই একটা ভাঙা মন্দির, তার চাতালে বসে আছে একতারা হাতে এক বৈরাগী। কোথাও পরপর কয়েকটি গাছপালা ছায়া কুটির, নিশ্চিন্তে ঘাস খেয়ে চলেছে গরু, কোথাও একদল নারীপুরুষ কোমরে হাত দিয়ে কোন্দল করছে, কিন্তু এ সবই নিঃশব্দ ছবি। জাহাজের ইঞ্জিনের প্রবল ধক-ধক শব্দে অন্য সব শব্দ চাপা পড়ে যায়।
তটরেখায় মনুষ্য বসতির তুলনায় ফাঁকা জায়গাই বেশি। এক এক জায়গায় শুধু নিঃস্ব প্রান্তর, আবার কোথাও অসংখ্য গাছ জড়ামড়ি করে আছে। যেন নিবিড় বন। রবি এইসব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। রবি এইসব দৃশ্য দেখছে না। এমন হয়, মানুষ কোনও বস্তুর দিকে চেয়ে থাকে, দেখে অন্য কিছু। স্থান ও কালের মধ্যে বিভ্রম ঘটে।
এই গঙ্গার দু তীরের রূপ রবি আগেও দেখেছে। নৌকোয়, বিকেলের পড়ন্ত আলোয়। সে নৌকোতে থাকতেন কাদম্বরী, আলগা সাজ, দীপ্তিময়ী মুখ, চোখ দুটি বিস্ময় মুগ্ধ। গাছপালার প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। মাঝে মাঝে হঠাৎ বলতেন, দেখো, দেখো, রবি, একটা গাছ কতখানি জলের ওপর ঝুঁকে আছে, যেন নদীকে কোনও গোপন কথা জানাচ্ছে কানে কানে। সেই কাদম্বরী আর নেই, তা কি হতে পারে? রবি যেন কাদম্বরীর চোখ দিয়েই এখন দেখছে তীরের বৃক্ষরাজি। যেন ওইসব গাছের আড়ালে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যাবে মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি। উদগত অশ্রু বাষ্প হয়ে আটকে আছে তার গলার কাছে, চিলের তীক্ষ্ণ স্বরের মতন বুকের মধ্যে যে চিৎকার করে ডাকছে, নতুন বউঠান, নতুন বউঠান!
জ্ঞানদানন্দিনী রবির পাশে এসে দাঁড়ালেন। আবার খোঁপা বেঁধে আধ-ঘোমটা দিয়েছেন মাথায়। রবি অনেকক্ষণ কোনও কথা বলছে না দেখে তিনি কিছু একটা বুঝেছেন। রৰির বাহু ছুঁয়ে তিনি বললেন, ভারি সুন্দর লাগছে। তাই না রবি?
রবি মুখ ফেরাল। হাসল জোর করে ।
জ্ঞানদানন্দিনী জিজ্ঞেস করলেন, ওই যে অনেক পালতোলা নৌকো, একই রকম দেখতে উল্টো দিকে যাচ্ছে, মানুষ ভর্তি, ওরা কোথায় যাচ্ছে? এদিকে কোনও মেলা টেলা আছে নাকি?
রবি বলল, না, ওগুলো অফিসের পানসি, আজকাল অনেক মানুষ দূর দূর থেকে এইসব পানসিতে চেপে কলকাতায় অফিস করতে যায়।
জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, আর ওই যে বড় বড় থুমবো থুমবো জিনিসগুলো, ওগুলো বুঝি গাধাবোট?
রবি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জামাল।
জ্ঞানদানন্দিনী আবার বললেন, রবি, তোমাকে কিন্তু এই যাত্রার বিবরণ লিখতে হবে। সেই যে আগে একবার ইওরোপ যাবার সময় জাহাজের কথা লিখেছিল!
সুরেন আর ইন্দিরা ডেকের আনাচে-কানাচে ঘুরছিল। এই সময় ইন্দিরা এসে বলল, মা, আমরা একবার নীচে যাব? পুরো জাহাজটা দেখে আসব?
জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, যাও, রবিকাকার সঙ্গে যাও। রবি, তুমি ওদের একটু ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনো।
জ্ঞানদানন্দিনী চোখের ইঙ্গিতও করলেন। বাধ্য ছেলের মতন রবি ভাইপো-ভাইঝি দু’জনকে নিয়ে নেমে গেল নিচে। বাতাসের উৎপাতে অক্ষয়চন্দ্র আগেই নীচে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে বসেছেন। ওপরে চুরুট টানার আরাম নেই। এখানকার ডেক এখন ফাঁকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একা ক্যাবিনে ঢুকে শুয়ে পড়েছেন। জ্ঞানদানন্দিনী ধীর পায়ে সেই ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন।
দুগ্ধ-শুভ্র বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ । গ্রিক দেবতার মতন রূপবান এই যুবার মুখখানি শুধু বিমর্ষ। চক্ষু দুটি খোলা, শূন্য দৃষ্টি। জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতেও তিনি কোনও কথা বললেন না।
জ্ঞানদানন্দিনীও বললেন না কিছু। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও উপস্থিতির উত্তাপ দিতে লাগলেন দেবরকে। নিঃশব্দে কাটল কয়েক মিনিট। তারপর তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কপালে তাঁর নরম হাতখানি রাখতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, এ কী হয়ে গেল, মেজ বউঠান! ও কেন চলে গেল। আমায় আগে কিছু জানায়নি, কোনও ইঙ্গিত দেয়নি, আমি ভাবতাম, ও আপন মনে থাকে। হঠাৎ.কেন… সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকায়…
জ্ঞানদানন্দিনী সঙ্গে সঙ্গে কিছু উত্তর দিলেন না। তিনি তাঁর এই সমবয়েসী, প্রিয় দেবরটিকে আরও কিছুক্ষণ বিলাপ করতে দিলেন। ওর মধ্যে যা আছে সব মুক্ত করে দিক। একজনকে তো সব বলতে হবে, ওর যে আর কেউ নেই। খানিক বাদে তিনি মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, ও ভুল করেছে। ও নিজের সর্বনাশ করেছে। ও আমাদের পরিবারে আরও বিপর্যয় ঘটাতে পারত। চলে গিয়ে বরং বেঁচেছে!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উঠে বসলেন, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভ্রাতৃজায়ার মুখের দিকে। দুর্গ প্রতিমার মতন সেই মুখ, প্রায় জোড়া ভুরু, গভীর দুটি চোখ, তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ কপোল, ঈষৎ হাসি মাখানো রক্তিমাভ দুই ওষ্ঠ। এই রমণী স্থির যৌবনা।
জ্ঞানদানন্দিনী দু’হাত বাড়িয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মুখখানি টেনে এনে চেপে ধরলেন তাঁর বুকে। বাঁধভাঙা বন্যার মতন চোখের জলে জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ ভেজাতে লাগলেন সেই কোমল আশ্রয়।
জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর মাথায় চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলতে লাগলেন, আমি তোমাকে কিছুতেই ভেঙে পড়তে দেব না, নতুন। যে-গেছে সে তো গেছেই, আমি তো আছি তোমার জন্য! তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার মেজদাদা দূরে দূরে থাকেন, বড়দাদা আপনভোলা মানুষ, বাবামশাই সবচেয়ে বেশি ভরসা রাখেন তোমার ওপর, সমাজের দায়িত্ব তোমাকে দিয়েছেন, তা ছাড়া এখন তুমি যে-কাজে নেমেছ, সাহেবদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তোমাকে জয়ী হতেই হবে। আমি সৰ্বক্ষণ আছি তোমার পাশে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কান্না থামাতে পারছেন না। এক মাস পরে এই প্ৰথমে তিনি শিশুর মতন কাঁদছেন। জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর থুটনি ধরে মুখটা উঁচু করলেন, অতি যত্নের আঙুল দিয়ে মুছে দিতে লাগলেন অশ্রু’। দু’জনের দৃষ্টিতে একই বাসনার সেতুবন্ধন।
একটু পরে অক্ষয়চন্দ্ৰ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে ধুপ ধাপ করতে করতে উঠে এলেন ওপরের ডেকে। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ও জ্যোতিবাবুমশাই, সর্বনেশে কাণ্ড, এ জাহাজে কাপ্তান নেই, এ যে কর্ণধারহীন তরণী, আমরা কি নিরুদ্দেশে যাচ্ছি নাকি? ও জ্যোতিবাবুমশাই…
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেকে সংযত করে দ্রুত বেরিয়ে এলেন ক্যাবিন থেকে। রবিরাও ওপরে উঠে আসছে, তাদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলেন, সত্যিই এ জাহাজের ক্যাপ্টেন পলাতক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজের কপালে একটা চাপড় মারলেন।
এ জাহাজের ক্যাপ্টেন বা কমান্ডার একজন ফরাসি। সে কাজে অতি দক্ষ। ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক ভাগ্যান্বেষীই ভারতে আসে জীবিকার সন্ধানে। ভারত অতুল সম্পদ আর সম্ভাবনার দেশ। ঝাঁকে ঝাঁকে শ্বেতাঙ্গরা এদেশে এসে কিছু না-কিছু চাকরি পেয়ে যায়। ফরাসিদের প্রতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কিছুটা দুর্বলতা আছে। একসময় তাদের বাড়িতে একজন ফরাসিকে রাঁধুনি হিসেবে রাখা হয়েছিল। সে যেমন ভালো ভালো রান্না খাওয়াত ; তেমন ফরাসি ভাষাও শেখাত। জাহাজের জন্য যে ফরাসিটিকে রাখা হয়েছে, সে অনেক রকম কাজ জানে, জাহাজের যে-কোনও কলকব্জা মেরামত করে ফেলতে পারে। অনেক গুণের মধ্যে লোকটির একটি মাত্র দোষ, মাসে একবার সে সাঙ্ঘাতিক মাতাল হয়। তখন আর তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না, অন্তত দুদিনের আগে তার নেশাও কাটে না। আজ সরোজিনীর সত্যিকারের যাত্রা শুরু হবে, এই আনন্দে নিশ্চয়ই সে গতকাল রাতে কোনও পানশালায় গিয়ে প্রচুর মদ্যপান করে অজ্ঞান হয়ে আছে।
এখন আর ফেরা যায় না। অথচ সকলেরই মুখ শুকিয়ে গেছে ভয়ে। ক্যাপ্টেন ছাড়া জাহাজ তো দিশাহারা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অন্যান্য কর্মচারিদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। কয়েকজন তাকে আশ্বাস দিল যে তারা ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে কাজ শিখে নিয়েছে, তারা অনায়াসে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
করুণাময় পরমব্ৰহ্মাকে স্মরণ করে জ্যোতিরিন্দ্র বললেন, তা হলে চলুক!
ইঞ্জিনে গর্জন তুলে, ধূম উদগিরণ করতে করতে নদীর বুক ধরে এগিয়ে চলল। এই অর্ণবপোত। দ্বিপ্রহর নির্বিঘ্নে পার হল বটে, কিন্তু বিকেলে দিকে শুরু হয়ে গেল মহা কোলাহল। সকলের গলা ছাপিয়ে কে যেন ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করতে লাগল, এই এই, রাখি রাখ, থাম থামা!
ডেক থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নদীর মাঝখানে একটি কালো রঙের লোহার বয়া ছুটে আসছে জাহাজটির দিকে। অর্থাৎ জাহাজটিই গোঁয়ারের মতন সেই স্থির বয়াটির প্রতি সোজা ধেয়ে চলেছে। কিছুতেই জাহাজের মুখ ঘোরানো যাচ্ছে না। ওই লোহার বয়াটির ওপর যেন বসে আছেন নিয়তি ঠাকুরুন, একবার ধাক্কা মারলেই সব শেষ। সকলের চক্ষু কপালে উঠেছে, ভয়ে কণ্ঠ এমন শুষ্ক হয়ে গেছে যে চিৎকার করতেও পারছে না। দেখতে দেখতে সত্যিই প্ৰবল জোরে একটি সংঘর্ষ হল বিয়াটির সঙ্গে। দুলে উঠল জাহাজ, ঝনঝন শব্দে পড়ল পেয়ালা-পিরিচ, অক্ষয়চন্দ্র রেলিং আঁকড়ে ধরেও সামলাতে পারলেন না, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ডেকে, সুরেন আর ইন্দিরা রবিকে চেপে ধরে আছে।
এর পর বুঝি সলিল-সমাধি। জাহাজটি থারথার করে কাঁপছে বটে। কিন্তু এখনও হেলে পড়েনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আগে থেকেই ছিলেন ইঞ্জিন ঘরে। খানিক বাদে ফিরে এসে বললেন, খুব বড় রকম একটা বিপদ এড়ানো গেছে। জাহাজের খোল ফুটো হয়নি, তবে এই ধাক্কায় ইঞ্জিনের জোড় খুলে গেছে দু’এক জায়গায়। সে সব আবার জোড়া লাগিয়ে কালকেই আবার যাত্রা শুরু করা যাবে। আপাতত এখানেই নোঙর ফেলা হল।
গঙ্গা এখানে বেশ চওড়া, গোধুলিবেলায় দুই তীর অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বাতাস আর প্রবল নয়, এখন মধুর। সন্ধ্যাকালটি গান-বাজনা করে নিশ্চিন্ত আনন্দে কাটানো যায়। বিকেলের জলখাবার এল, মোহনভোগ, গরম লুচি, পাতলা ক্ষির। তার পর এল সুরার পাত্র। অক্ষয়চন্দ্র একঢার পর একটা চুরুট টেনে ছোটদের নানারকম গল্প শোনাচ্ছেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সিগারেট ধরিয়েছেন। অক্ষয়চন্দ্রের অনেক অনুরোধেও রবি সুরার পাত্র নেয়নি, ধূমপানেও তার রুচি নেই। পশ্চিম গগনে এখন সূর্যাস্তের ঘনঘটা। রবি সেদিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সে ফিরে গেছে মোরান সাহেবের বাগানবাড়িতে। এক একদিন জ্যোতিদাদা থাকতেন না, রবি আর কাদম্বরী নদীর ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখত। এখনও যেননতুন বউঠান ঠিক তার পাশেই বসে আছেন। রবি হাত বাড়ালেই সূর্যাস্ত দেখত। এখনও যেন নতুন বউঠান ঠিক তার পাশেই বসে আছেন। রবি হাত বাড়াসেই ছুঁতে পারবে। একদিন এইরকম সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে কাদম্বরী রবিকে ভানু বলে ডেকেছিলেন, ডেকে অনুরোধ করেছিলেন, ভানু, তুমি একটা গান শোনাও, নতুন গান। রবি তৎক্ষণাৎ বানাতে বানাতে গেয়েছিল, মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম শ্যাম সমান…’।
ঘোর ভাঙিয়ে দিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, কী ভাবছি, রবি? শোনো, আজ সারা দিন যা যা হল, তুমি আজ রাত্তিরেই লিখে ফেলবে। আমরা সবাই শুনব।
অক্ষয়চন্দ্র বললেন, দেবী, আজ আমরা আর একটু হলেই স্বখাত সলিলে ডুবিতে বসেছিলাম। লেখাটেখা সব মাথায় উঠত। খবরের কাগজে চার লাইন খবর বেরুত!
জ্ঞানদানন্দিনী হাসতে হাসতে বললেন, মাত্র চার লাইন! এত বড় একটা জাহাজ।
অক্ষয়চন্দ্র বললেন, তা ছাড়া আর কি! এরকম কত অহরহ জাহাজডুবি হচ্ছে! জ্যোতিবাবুমশাই বিখ্যাত ব্যক্তি, তাঁর নামটি ছাপা হত, আমরা সবাই ‘অন্যান্য’!
অক্ষয়চন্দ্র বললেন, ওরকম কত গ্ৰন্থকার আছে। আজকাল তো যে দু’পাতা লেখাপড়া শেখে, সে-ই কাব্যরচনা শুরু করে। না, না, রবি, তুমি রাগ করো না, তোমার কবিতা খারাপ বলছি না, তবে এখনও তো তোমার বই কেউ কেনে না, বিশেষ কেউ তোমার নাম জানে না।
অক্ষয়চন্দ্রের কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে কুটিকুটি।
জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, চৌধুরীমশাই, কাগজে না হয় না-ই ছাপা হত, কিন্তু আমরা সবাই মিলে মরলে আমাদের চেনা মানুষেরা কী বলত? মৃত্যুর পরে আমাদের সম্পর্কে কে কী বলে, তা খুব জানতে ইচ্ছে করে।
অক্ষয়চন্দ্র বললেন, আমি মানুষ চিনি। কে কী ভাবে তা বুঝি! বলব। আগে নিজের সম্পর্কে বলি! আমার গৃহিণী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলতেন, গেছে, আপদ গেছে। অনেক দিন ধরেই আমার বিধবা হয়ে আবার বিয়ে করার বাসনা ছিল, এবার সেই সাধ মেটানো যাবে! জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, ওমা, কী খারাপ কথা! দাঁড়ান, আপনার স্ত্রীকে আমি বলে দেব!
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, আমার সম্পর্কে বন্ধু-বান্ধবরা কী বলত? অক্ষয়চন্দ্র বললেন, খুব দুঃখ করত সবাই। আপনি যে দেদার খচর করেন, সবাইকে খাওয়ান। দুঃখ করবে না। হা-হুতাশ করে সবাই বলত, আহা, অত বড় মানুষটা চলে গেল। ওর বেশ দেমাক ছিল বটে, নাকটাও উঁচু।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উঁচু গলায় হেসে বললেন, বটে, বটে, আমার সম্পর্কে এই আপনার ধারণা? আর রবি সম্পর্কে?
অক্ষয়চন্দ্র বললেন, রবি সম্পর্কে বলত, আহা, অমন মহদাশয় মানুষটি চলে গেল। এমনটি আর হবে না! না হলেই বা ক্ষতি কী! সময় হয়েছে চলে গেছে! কী যে সব পদ্য লিখত, ধোঁয়া ধোঁয়া, ভাবালুতায় ভরা-
জ্ঞানদানন্দিনী বললেন, আমার সম্বন্ধে? আমার সম্বন্ধে?
অক্ষয়চন্দ্ৰ ভুরু তুলে বললেন, দেবী, শুনে রাগ করবেন না তো! জ্যোতিরিন্দ্ৰনাথ বললেন, তোমার যা কথা… তা শুনে কেউ রাগ করতে পারে? বল, বল…
অক্ষয়চন্দ্ৰ ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, আপনার জন্য কত মানুষ যে কেঁদে ভাসাত, তার ঠিক নেই। কেঁদে গড়াগড়ি দিতে দিতে বলত, ইন্দ্রপতন হয়ে গেল গো! দোষে গুণে মিলিয়ে মানুষটা ছিল-যেমন তেমন হোক তবু তো ঘরটা জুড়ে ছিল! আহা কত দয়া ছিল, আবার মেজাজ হলে একসঙ্গে তিনটে ব্যাটাছেলের মুণ্ডু নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলতে পারত… মেয়ে তো নয়, রায়বাঘিনী, এমন অসময়ে সংসার শূন্য করে কি যেতে হয়…
হাসির কলরোল ছাপিয়ে গেল অন্যসব শব্দ। হাসি আর থামতেই চায় না। মৃত্যু নিয়ে বিশুদ্ধ কৌতুক।
হঠাৎ একসঙ্গে চুপ করে গেলেন সবাই। এঁরা সবাই বেঁচে আছেন বলেই মৃত্যু নিয়ে এমন রঙ্গ করতে পারছেন। কিন্তু একজন সত্যি সত্যি নেই। এক অভিমানিনী অনিবারণীয়ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে, এই আসরে যার উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সকলেরই যেন মনে পড়ল সেই অভিমানিনীর মুখ, কিন্তু তার সম্পর্কে কেউ একটি কথাও উচ্চারণ করল না।