অধ্যায় ৩৯. পবিত্র যুদ্ধগুলো
মানব-ইতিহাসে সহিংসতাগুলোর প্রধান কারণ কি ধর্ম, যেমন অনেকেই প্রস্তাব করেছেন? অবশ্যই ধর্মে সহিংসতা অপরিচিত কোনো বিষয় নয়। অতীতে এটি সহিংসতাকে ব্যবহার করেছিল, আজও এটি সহিংসতাকে ব্যবহার করছে। কিন্তু এটি কি সহিংসতার কারণ’? বহু চিন্তাশীল মানুষ এমনটাই মনে করেন। কেউ কেউ এমনকি আরো প্রস্তাব করেন, পৃথিবী থেকে সহিংসতা নির্মূলের উপায় হচ্ছে ধর্মকে নির্মল করা। কেউ আবার এই যুক্তিটিকে আরো কিছুটা অগ্রসর করেছেন এমন কিছু বলে, যেহেতু ঈশ্বর নিজেই সহিংসতার নির্দেশ দিয়েছেন, যা মানবতার ওপর খুব বড় একটি অভিশাপ, আর মানবতাকে এই অভিশাপ থেকে রক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ঈশ্বরকেই বাতিল করা। খুব শক্তিশালী একটি অভিযোগ, এবং যে-অভিযোগটি আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
আমরা যদি আমাদের এই আলোচনাটি তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম, ইহুদিবাদ, খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের মধ্যে সীমিত রাখি, এই অভিযোগটি বৈধ অনুভূত হয়। ইহুদি ধর্মের আদি ইতিহাসে প্রচুর সহিংসতা আছে। এটি ছাড়া মিশরে দাসত্ব থেকে ইহুদিদের মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হতো না। আর সেই কারণে, এই সহিংসতা আবশ্যিক ছিল কিনা সেই প্রশ্নটি করতে আমাদের এখানে একটু বিরতি নেওয়া উচিত। অন্যদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না, এমন কিছু ইতিহাসে খুব অল্প কয়েকজনই দাবি করেছেন। অবশ্যই সবসময়ের জন্য অশুভ একটি কাজ, কিন্তু মাঝে মাঝে এটি দুটি অশুভ কাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম অশুভ একটি কাজ হতে পারে। দাসপ্রথা অবশ্যই অশুভ। এটি মানুষকে মানুষ নয় বরং পশু হিসাবে বিবেচনা করে, মনিবদের খেয়াল-খুশিমতো যাদেরকে দিয়ে যে-কোনো কিছু করিয়ে নেওয়া যায় এবং মনিবের খেয়ালমতো প্রয়োজনে বাতিল করাও যায়। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষই দাসদের অধিকার এবং মনিবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার জন্যে তাদের যুদ্ধ করার অধিকারকে সমর্থন করবেন। আর ইহুদিরা সেটাই করেছিলেন। তারা তাদের মনিবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, এবং মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এর পরে যা ঘটেছিল সেখানেই সবকিছু আরো জটিল হয়ে উঠেছিল।
খ্রিস্টের জন্মের ১৩০০ বছর আগে ইজরায়েলাইটরা সেই সময়ের কানানে (এখন প্যালেস্টাইন) যে-গোত্রগুলো বসবাস করত, তাদের সাথে যা কিছু করেছিল –তারা বিশ্বাস করতেন এই গোত্রগুলো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছিল –ঊনবিংশ শতকে আদিবাসী আমেরিকানদের সাথে খ্রিস্টান বসতিস্থাপনকারীরা সেই একই কাজ করেছিলেন। পুরো একটি মানবগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত আর ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়াটি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত আধুনিক শব্দটি হচ্ছে, ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা। আর এই ঘটনাগুলোকে আসলে গণহত্যা বলাই সঠিক হবে। আর এই গণহত্যার দায়ভার অবশ্যই বাইবেলের ওপরেই দিতে হবে। ইতিহাসবিদরা হয়তো প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের বসতি গড়তে কতটা সময় লেগেছিল, এবং আসলেই সেটি কতটা সহিংস ছিল এসব বিষয় নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। তবে যে-হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল সে-বিষয়ে বাইবেল খুবই সুস্পষ্ট এবং এটি বলেছে ঈশ্বরের নির্দেশে সেই গণহত্যাগুলো ঘটেছিল। আর যে-বইটিতে এর বিস্তারিত বর্ণনা আছে সেটির নাম জশুয়া। এই বইয়ে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেই বাক্যগুলো, যেমন, ‘তোমরা তাদের পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করবে’ এবং ‘তারা তাদের ধ্বংস করেছিল’ এবং ‘তারা এমন কিছু বাকি রাখেনি যা শ্বাস নেয়’। জশুয়া আমাদের বলছে, তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত ভূমিতে ইজরায়েলের গোত্রগুলোর বসতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল সহিংসতার মাধ্যমে, যার নির্দেশনা দিয়েছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর।
যখন আমরা খ্রিস্টধর্ম নিয়ে আলোচনা করব আমরা দেখব, এই ধর্মটিরও সহিংস একটি সূচনা ছিল, কিন্তু এটি সহিংসতার শিকার ছিল, সহিংসতাকারী ছিল না। শুরুর বছরগুলোয় এই ধর্মটি পার্থিব রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারবে, এমন কোনো প্রত্যাশা করেনি। এমন নয় যে, এই অবস্থান নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষা করতে পেরেছিল। এটি ক্রুশবিদ্ধ এক ঈশ্বরকে উপাসনা করেছিল এবং এর নিজের দুঃখগুলোকে এটি গ্রহণ করে নিয়েছিল। আর এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল যখন সম্রাট কনস্টান্টিন এই ধর্মটি তার ধর্ম হিসাবে গ্রহণ এবং তার স্বার্থে এটি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। এরপর থেকেই চার্চ সহিংসতার একটি স্বাদ অনুভব করতে শুরু করেছিল এবং কীভাবে নিয়ন্ত্রণের একটি উপকরণ হিসাবে এটিকে ব্যবহার করা যায় সেটি শিখেছিল। বহু শতাব্দী ধরে ইহুদিদের বিরুদ্ধে এটি সহিংসতা ব্যবহার করেছে, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার জন্যে ‘ঈশ্বর হত্যাকারী’ হিসাবে তারা তাদের চিহ্নিত করেছিল, এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা যিশুর সারমন অন দ্য মাউন্টে বক্তৃতা দেবার সময় কী বলেছিলেন সেটি ভুলে গিয়েছিল। ক্রুসেডগুলোর সময় এটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রয়োগ করেছিল। ইনকুইজিশন পর্বে এটি ভিন্নমতাবলম্বী অন্য খিস্টানদের হত্যা করেছিল। আর রিফরমেশন আন্দোলন পরবর্তী ধর্মীয় যুদ্ধগুলোয় প্রতিদ্বন্দ্বী খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করেছিল যতদিন-না সমাজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তাদের পারস্পরিক রক্তপিপাসায় এবং এটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
ইসলামের জন্মেও সহিংসতা আছে। যদিও ‘জিহাদ’ বা সংগ্রামের ধারণাটিকে অহিংস উপায়ে বোঝা সম্ভব হতে পারে, এছাড়াও এটিকে ইনফিডেল বা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘটানো সহিংসতাকে যুক্তিযুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। খিস্টানদের মতোই, মুসলমানরা স্বধর্মী বিশ্বাসীদের হত্যা করতে সক্রিয় ছিল, যারা এই ধর্মবিশ্বাসটির একটি ভিন্ন সংস্করণের অনুসারী ছিলেন। খ্রিস্টধর্মে ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টরা যেমন করেছিলেন, শিয়া আর সুন্নীরা পরস্পরকে হত্যা করেছে সেই একই রকম উৎসাহ নিয়ে। এবং তাদের পারস্পরিক ঘৃণা আজও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘর্ষের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি।
সুতরাং প্রশ্ন কিন্তু ইতিহাসে অধিকাংশ সহিংসতার কারণ এটি ছিল কিনা তা নয়, বরং কেন তাহলে বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? আমরা যখন দাসপ্রথা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আমরা লক্ষ করেছিলাম, এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে সহিংসতা একটি বৈধ নৈতিক বিকল্প। এটি হচ্ছে একটি মূলনীতি, যা প্রায় সব জাতিকে তাদের অভ্যন্তরীণ আর বাহ্যিক রাজনীতি পরিচালনা করতে দিকনির্দেশনা দেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর সবচেয়ে খ্রিস্টান জাতি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এবং এছাড়াও এটি পৃথিবীতে সবচেয়ে সহিংস একটি রাষ্ট্র। এটি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে এখনো। এটি সাধারণ নাগরিকদের নিজস্ব অস্ত্র রাখার অধিকার ও তাদের আত্মরক্ষার জন্যে সেগুলোর ব্যবহারে বিশ্বাস করে। এবং এর পরিণতিতে দেশটির বহু হাজার নাগরিক প্রতিবছরই নিহত হন আগ্নেয়াস্ত্রজনিত ঘটনায়। এছাড়াও অন্য বহু জাতির মতো, শক্র থেকে শুধুমাত্র নিজের সুরক্ষা করার মতো পরিস্থিতি ছাড়াও পৃথিবীর অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সময়েও এটি সহিংসতার আশ্রয় নেয়। আমরা যদি এই পরিস্থিতিগুলোয় সহিংসতাকে যুক্তিযুক্ত করতে পারি, তাহলে আমরা কেন বিচলিত হই যখন ধর্ম তার নিজের উদ্দেশ্যপূরণে এটি ব্যবহার করে? আমরা খুবই হিংস্র একটি প্রজাতি। তাহলে ধর্মীয় সহিংসতা আমাদের কেন এত অস্বস্তিতে ভোগায়?
দুটি কারণ আছে। প্রথমত, যখন ধর্ম কোনো একটি দ্বন্দ্বে প্রবেশ করে এটি সেই মিশ্রণে একটি বিষাক্ত উপাদান যুক্ত করে, যা অন্য কোনো সংঘর্ষে সবসময় উপস্থিত থাকে না। এছাড়াও মানুষ সহিংসতা-প্রবণ এর প্রকৃতিতে, কিন্তু যদি তারা নিজেদের প্ররোচিত করতে পারেন, ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তারা সেই কাজটি করছেন, তখন সেই সংঘর্ষে দয়া কিংবা সংযমের সব সুযোগই অপসারিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে স্কটল্যান্ডে ধর্মীয় যুদ্ধবিগ্রহের সেই সময়টিতে, যা ‘দ্য কিলিং টাইম’ নামে পরিচিত, যুদ্ধের একটি স্লোগান ছিল, ‘গড অ্যান্ড নো কোয়ার্টার’, যার মানে কোনো দয়াপ্রদর্শন এবং বন্দি নেওয়া তাদের উচিত হবে না। এই সন্ধ্যার টিভি সংবাদে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলমান গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের উপর বোমাবর্ষণ দেখার সময়, আপনার এমন কিছু শুনতে পাবার সম্ভাবনা আছে, তারা যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছেন, তারা তখন। আল্লাহকে প্রশংসা করেই কিছু বলছেন।
আপনি যদি এই মহাবিশ্বের নৈতিক বিচারকের প্রতি অনুগত হয়ে কিছু করেন তাহলে আপনি অন্যায় কিছু করতে পারেন না। ঈশ্বর ছাড়া আর কিছু না’! আর সে-কারণেই ধর্মীয় উগ্রতাবাদীদের পারস্পরিক সংঘর্ষ বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত থাকতে পারে, যেখানে কোনো পক্ষই বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। আর যখন পুরনো দ্বন্দ্ব নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, এটিকে কখনো। কখনো ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কোনো একটি অজনপ্রিয় গোষ্ঠী একটি উদ্দেশ্য আর আত্মপরিচয়ের ধারণা অর্জন করতে পারে একটি ধর্মবিশ্বাস বা ফেইথ ব্যবহার করে, যা এটিকে বাকি সবার থেকে পৃথক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। এটি বহিরাগতের সেই গৃহহীনতার অনুভূতি থেকে মুক্তি দিতে পারে। এটি তাকে ক্রোধে উন্মত্ত করে তুলতে পারে। এটি তাকে ২০০৫ সালে লন্ডনে জনাকীর্ণ পাতালরেলে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজেকে উড়িয়ে দেবার জন্য একটি কারণ দিতে পারে।
যদি ধর্মীয় সহিংসতার প্রথম কারণটি আমাদের বিতৃষ্ণ করে তুলে থাকে, সেটির কারণ হচ্ছে মানব-সংঘর্ষে এটি অযৌক্তিক একটি মাত্রার তীব্রতা যুক্ত করে, এর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে একটি ভয়ংকর অসংগতি আছে এর কেন্দ্রে। এটি হচ্ছে সেই অসংগতি, বিশ্বাসীদের চেয়ে অবিশ্বাসীরা প্রায়শই অনেক বেশি স্পষ্টভাবেই সেটি দেখতে পারেন। আর এই অসংগতির নাম হচ্ছে ঈশ্বর। অধিকাংশ ধর্মই সেই দাবিটির ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, ঈশ্বর হচ্ছে চূড়ান্ত বাস্তবতা। এবং তিনি তাদের নৈতিক আইনগুলোর রচয়িতা। বিষয়টির উপস্থাপনায় হয়তো তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তারা সবাই ঈশ্বরকে একজন বিশ্বজনীন পিতা হিসাবে দেখেন। মানুষ হচ্ছে ঈশ্বরের সন্তান। যেমন, নিউ টেস্টামেন্ট বলেছে, ঈশ্বরের মধ্যে আমরা বাঁচি, চলাচল করি এবং আমাদের অস্তিত্ব লাভ করি।
কিন্তু যদি আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকি, তাহলে কেন এই ঈশ্বর ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়ে তার বিশ্বজনীন পরিবারের একটি শাখাকে নির্দেশ দিচ্ছেন অন্য একটি শাখাকে বিলুপ্ত করতে? তার ইহুদি সন্তানদের প্রতি ভালোবাসাটিকে তার প্যালেস্টাইনীয় সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমেই বা কেন প্রকাশিত হতে হবে? কেন তিনি পরে তার ইহুদি সন্তানদের পরিত্যাগ করেছিলেন। তার খ্রিস্টীয় সন্তানদের পক্ষ নিয়ে এবং তার নতুন প্রিয়ভাজনদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের বয়োজ্যষ্ঠ ভাইবোনদের নির্যাতন করতে? যারা তাকে এক এবং অদ্বিতীয় হিসাবে উপাসনা করেন, তার সেই মুসলমান সন্তানদের কেন তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, তার বহুঈশ্বরবাদী সন্তানদের নির্যাতন করতে, যারা কিনা তাকে উপাসনা করে বহুসংখ্যক রূপে? ধর্মীয় ইতিহাসে এত সহিংসতা কেন, যা ঘটিয়েছে। সেই গোষ্ঠীগুলো, যারা ঈশ্বরকে তাদের পক্ষে আছেন বলে দাবি করেছেন?
যদি-না আপনি প্রস্তুত থাকেন এমন কিছু বিশ্বাস করতে যে, ঈশ্বর আসলেই কারো প্রতি বেশি পক্ষপাতিত্ব করেছেন, যেমন মানসিকভাবে বিকৃত কোনো স্বেচ্ছাচারী শাসক করে থাকেন, তাহলে এই উভয়সংকট থেকে বের হবার মাত্র দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমটি হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে, আসলেই ঈশ্বর বলে কিছু নেই। যাকে ঈশ্বর বলা হচ্ছে সেটি আসলে একটি মানব-উদ্ভাবন, অন্য অনেককিছুর সাথে এটি মানবজাতির সহিংসতা প্রীতি আর আগন্তুকদের প্রতি ঘৃণাকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করতে ব্যবহার করা হয়েছে। ঈশ্বরকে বাতিল করলে মানব-সহিংসতার সমস্যাটি সমাধান হবে না, তবে এটি সহিংসতার একটি অজুহাতকে অপসারণ করবে।
কিন্তু যদি আপনি ঈশ্বরকে পরিত্যাগ করতে না চান, তাহলে আপনাকে গভীরভাবে বেশকিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। আপনার নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে কোটি হবার সম্ভবনা আসলে বেশি : ঈশ্বর একধরনের নরঘাতী উন্মত্ত চরিত্র, ধর্মগুলো প্রায়শই সেভাবে তাকে অনুধাবন করেছে? অথবা ধর্মই ঈশ্বরকে সম্পূর্ণভাবে ভুল বুঝেছে এবং এর নিজস্ব নিষ্ঠুরতাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বা নির্দেশের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে? আপনি যদি এমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ধর্মই খুব সম্ভবত ঈশ্বরকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে, আর আসলে ঈশ্বর সম্পূর্ণ ভিন্ন সেই হিংস্র দানবীয় একটি চরিত্র থেকে, এর প্রচারকরা মাঝে মাঝেই যেভাবে তাকে উপস্থাপন করে থাকেন, তাহলে আপনাকে একটি সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে নিরীশ্বরবাদের চেয়ে ধর্মই বরং ঈশ্বরের অপেক্ষাকৃত বড় শত্রু। নিরীশ্বরবাদ দাবি করে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকে তিনি হয়তো নিরীশ্বরবাদীদের ঔদ্ধত্যে ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে বরং মজা পাবেন। হুম, নিরশ্বরবাদীরা খুব শীঘ্রই আমার উপস্থিতি বুঝতে পারবে। কিন্তু যদি ঈশ্বর রক্তপিপাসু কোনো দানব না হয়ে থাকেন তাহলে ধর্মীয় শিক্ষকরা, যারা তাকে তেমন একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করেছেন, তাদের আচরণে ঈশ্বরের খুশি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সুতরাং আমরা সেই উপসংহারে আসি, যদিও ধর্মগুলো পৃথিবীর কাছে ঈশ্বরের সত্যিকার প্রকৃতি উন্মোচন করেছে বলে দাবি করে থাকে, কিন্তু বহুক্ষেত্রেই এটি আসলেই ঈশ্বরকে তাদের নিজস্ব নিষ্ঠুরতার ঘন কুয়াশার অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছে।
আমরা ধর্মগ্রন্থে কখনো কখনো সেই ধারণার আভাসগুলো একনজর দেখতে পাই যে, ধর্মই হচ্ছে ঈশ্বরের সবচেয়ে হিংস্রতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা যিশুর শব্দে এটি বর্ণিত হতে দেখেছি, যিনি লক্ষ করেছিলেন, অশুভ কোনো কাজ করতেই শুধুমাত্র ধর্মকে খুব সহজে ব্যবহার করা হয় না, এছাড়াও ভালো অনেক কাজ না করার অজুহাত হিসাবেও এটিকে ব্যবহার করা হয়। আর সেই ধর্ম আসলেই খারাপ, যা-কিনা বাইবেলের গুড সামারিটানের গল্পের সেই যাজক ও তার সহকারীকে রাস্তার ভিন্ন পাশ দিয়ে চলে যেতে প্ররোচিত করে, কারণ ডাকাতের আক্রমণের শিকার হয়ে যে-মানুষটি অসহায় রাস্তায় পড়ে আছে সে ‘তাদের ধর্মের একজন ছিলেন না’!
সুতরাং হ্যাঁ, ধর্ম ইতিহাসে কিছু ভয়াবহ সহিংসতা ঘটিয়েছে এবং এখনো ঘটানো অব্যাহত রেখেছে। এবং হ্যাঁ, এটি ঈশ্বরকে ব্যবহার করেছে তাদের সব অশুভ কর্মকাণ্ডের নায্যতা দিতে। সুতরাং যদি আমরা ঈশ্বর বলতে এই মহাবিশ্বের সেই দয়ালু ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে চাই, তাহলে হয় তার কোনো অস্তিত্ব নেই অথবা ধর্ম তাকে বুঝতে সম্পূর্ণভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। আর যে-কোনো ক্ষেত্রেই, ধর্ম নিয়ে তাই আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আবশ্যিকভাবে কিন্তু এর অর্থ এই না যে, আমাদের উচিত হবে এটিকে পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা। আমরা হয়তো ধর্মের সাথে থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে সেটি করতে হবে সেই বিনম্রতার সাথে, আর এটি যা অশুভ কাজ করেছে এবং এটি যা ভালো কাজ করেছে সেটি স্বীকার করে নিতে হবে। এটি আমাদের ওপর নির্ভর করবে।
কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা ধর্মের রক্তপিপাসু ইতিহাসে এতই বিতৃষ্ণ যে, তারা এটিকে প্রশমন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে দেখব সেটি কীভাবে তারা করেছিলেন।