গত রাত হাওয়ার রাত ছিল। পালদেম বলেছিল বরফ পড়ার আগে হিমালয় হাওয়াদের পাঠায়। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে বীভৎস আওয়াজ। রাগী জন্তুর গোঙানি। অথচ বৃষ্টি নেই। আকাশ ঘোলাটে। সেখানে চাপ মেঘও নেই। কিন্তু একটি নখ লক্ষ্য হয়েছে। শীত বাড়ছে হু হু করে। কাঠের ঘরে নিরাপদ বিছানায় শুয়েও মনে হচ্ছিল উত্তাপ চাই।
আনন্দ চুপচাপ পড়েছিল। দ্বিতীয়বার ব্যাপারীরা ঘুরে গেল এই গ্রাম থেকে।ওরা অবশ্য তাদের হদিশ পায়নি। কিন্তু তাপল্যাঙের মানুষ কি করে এত টাকা হাতে পেল তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়েছে। পালদেম শেখানো উত্তর বলেছে, চারজনের এক অভিযাত্রীদল এই গ্রামের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের যে টাকা দিয়ে গিয়েছিল তাই দিয়েই কেনাকাটা করছে ওরা। উত্তরটা ওরা কতটা বিশ্বাস করেছে সেটা বোঝা যায়নি। কিন্তু প্রচুর জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো রাখা হয়েছে গ্রামের আর একটি খালি ঘরে। সেইসঙ্গে আছে গৃহপালিত সেইসব জন্তু যা গ্রামবাসীরা ব্যাপারীদের কাছে বিক্রি করেছিল। আজ বিকেলে বন্ধুদের কাছে আনন্দ তার পরিকল্পনা খুলে বলেছে। জয়িতা উৎসাহিত হয়েছে। একটা অবহেলিত, বলা যায় সভ্যতার ছোঁয়াচবর্জিত গ্রামের মানুষদের একত্রিত করে বাঁচার পথ খুঁজে দেওয়া মানে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মানে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া। সারা বছর এরা হয় আধপেটা, নয় অভুক্ত থাকে। সবচেয়ে আগে এদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং সেটা সম্মিলিতভাবে। কেউ কম বা বেশি নয়। রান্না হবে একত্রে। এর ফলে প্রত্যেকের সঙ্গে একটা নিকট সম্পর্ক তৈরি হবে। এ বছরের ব্যবস্থা না হয় সুদীপের আনা টাকায় হয়ে যেতে পারে কোনরকমে, কিন্তু আগামী বছর থেকে নিজেদের জন্যে প্রতিটি মানুষকে কাজ করতে হবে। চাষের ব্যবস্থায় আধুনিক সাহায্য নিতে হবে, ডেয়ারি এবং পোলট্রি ফার্ম পুরো গ্রামের জন্যে তৈরি করতে হবে। আর সেই সব জিনিস দার্জিলিং না থোক গৈরাবাস অথবা মানেভঞ্জনের বাজারে পৌঁছে দিয়ে তার বিনিময়ে দরকারী জিনিস আনতে হবে। এদের নিজস্ব লেখ্যভাষা আছে কিনা জানতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে হিন্দী এবং ইংরেজী শিখতে হবে। অর্থাৎ সুস্থভাবে বাঁচতে হলে একা কিছু করা যাবে না, কাধে কাঁধ মিলিয়ে খাটতে হবে। এই বোধ ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। অবশ্য এর জন্যে বিশ্বাস অর্জন করা দরকার। বিদেশী বিভাষী মানুষকে চট করে কেউ বিশ্বাস করে না। তবু এখন যেন ওরা তাদের সঙ্গে অনেক সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে। ওই যে মেয়েটি যে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে গিয়েও কোন অজ্ঞাত কারণে এখনও মরে যায়নি তার জন্যে কেউ দায়ী করছে না এখনও। মরে গেলে কি হবে তা কে বলতে পারে। যাই হোক, এই গ্রাম ছাড়ার আপাতত কোন ইচ্ছে তার নেই। প্রথম কথা, পুলিশের রাইফেল এত দূরে পৌঁছাবে এমন সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়ত, আকৈশোর যে বাসনা ছিল তা সম্ভব হবে এমন সম্ভাবনা নেই। বাবাও যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন তা একাত্তরেই মুখথুবড়ে পড়েছে। সে ভেবেছিল দেশের যারা শত্রু তাদের আঘাত করার শিক্ষা জনসাধারণকে দিলে তারা উদ্দীপ্ত হবে এগিয়ে আসতে। মনে হয়েছিল, ভারতবর্ষের মানুষ ভেতরে ভেতরে সমস্ত সিস্টেমটার বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে বঞ্চিত হওয়ায় রুষ্ট হয়ে উঠেছে, শুধু তার প্রকাশের দরজা খুলে দিতে পারলেই লাভাস্রোত বইবে। কিন্তু কলকাতায় থাকাকালীন তার কোন প্রতিক্রিয়া সে দেখতে পায়নি। অবশ্য ওরা চলে আসার পর কিছু হয়েছে কিনা তা জানা নেই। হলে অন্তত বি বি সি-র খবরে তার কথা শোনা যেত। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে সে সবই ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত গ্রন্থগুলো পড়ে তার তো মনে হয়েছিল পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিদের হঠাতে বিপ্লব দরকার। বিপ্লবের পরে মানুষকে তার অধিকারের জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লব উদ্দেশ্য নয়, ওই নয়া সমাজ ব্যবস্থাই আসল লক্ষ্য। সেই কাজ তো এখানেও শুরু করা যেতে পারে। এখানে তাদের চোখে কোন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির অস্তিত্ব চোখে পড়ছে না। কাহনকে কোনভাবেই, এমন কি সামান্য জোতদার বলেও ভাবা যাচ্ছে না। এদের শত্রু অজ্ঞতা এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে অশিক্ষার ফসল দারিদ্র্য। কিন্তু এদের পক্ষে সবচেয়ে যে মূল্যবান সম্পদ তা হল রাজনীতির ধোঁয়াটে বিষ এখনও চেপে বসেনি। সামান্য পিছিয়ে নিয়ে গেলে পৃথিবীর আদিম যুগের মানুষের জীবনযাত্রায় এদের পৌঁছে দেওয়া যায়। অতএব এই মাটির ডেলাগুলো নিয়ে স্বপ্নের মূর্তি তৈরি করা যায়। বাধা যা আসবে তা ওদের অজ্ঞতা থেকে। এর মধ্যে আনন্দ কয়েকটি শব্দ শিখে ফেলেছে। এ ব্যাপারে জয়িতা তার থেকে এগিয়ে আছে। ও এখন ভাঙা ভাঙা বাক্য বলতে পারে। ভুল করে কিন্তু সেই ভুলটা ওদের মজা দেয়। নিরাপদ বিছানায় শুয়ে আনন্দ এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করে। কল্যাণটা ফিরে এলেই এরা ওদের অনেক কাছে এসে যাবে।
নিরাপদ বিছানায় শুয়ে জয়িতারও ঘুম আসছিল না। হাওয়া বইছে কিংবা বেড়ে যাওয়া ঠাণ্ডার জন্যে নয় ওর শরীর এবং মনে অস্বস্তি কাজ করছিল। সময় এসে গিয়েছে। কলকাতায় থাকতে এই ব্যাপারটা কোন গুরুত্বই পেত না। সে স্থির করে নিল যে প্রয়োজনে বন্ধুদের বলবে। এই কদিনে তাপল্যাঙের মানুষদের সঙ্গে মিশে সে অনেক কিছু জেনেছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত। এই পাহাড়ি মানুষরা সুদীপ আনন্দর সঙ্গে দূরত্ব রেখেছে, তার সঙ্গে রাখেনি। বোধহয় মেয়েরা খুব চট করেই বিশ্বাস কিংবা আস্থাযযাগ্য হতে পারে। জয়িতা কৌতূহলী হয়েছিল এখানকার মেয়েরা তাদের ওই সমস্যার সমাধান কিভাবে করে তা জানতে। জানার পর শিউরে উঠেছিল। অল্পবয়েসীরা সেই কয়দিন প্রায় ঘরের বাইরে যায় না। স্বেচ্ছাবলী হয়ে সবার আড়ালে থেকে যায়। কার লেখা মনে নেই, জয়িতা পড়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরাও এক সময় ওই একই জীবনযাপন করত। ওই কদিন বিছানায় শুতো না, মাথায় তেল দিত না। তারও আগে ঘর ছেড়ে বের হত না। নিজেদের অশুচি মনে করত। এখনও পুজোপার্বণে বাংলাদেশের মেয়েরা যোগ দিতে চায় না। এ হীনমন্যতা বোধ কি কারণে তা কেউ ভাবেনি। যেন প্রকাশ্যে বললে সেটা অশ্লীলতার পর্যায়ে চলে যাবে। দিন পালটেছে কলকাতায়। এখানকার বয়স্কা মেয়েরা যেভাবে নিজেদের সামলায় তা আদৌ অস্বাস্থ্যকর নয়। বোধহয় সেই কারণেই এদের অসুখবিসুখ অনিবার্য ঘটনা। সে নিজে না হয় কিছুদিন সামলে নিতে পারবে। কল্যাণ যখন গেল তখন তাকেও বিজ্ঞাপিত সাহায্য আনতে বলতে পারত কিন্তু তাই বা কদিন সাহায্যে আসত? একটা উপায় বের করতেই হবে।
ওদিকে সুদীপের নাক ডাকছে। আনন্দ চুপচাপ। সুদীপটাকে জয়িতা আজকাল ঠিক বুঝতে পারছে। সারাক্ষণ এত কি ভাবে? গ্রামের পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার প্রবণতা ওর মধ্যে। কিন্তু এখনও এখানকাব ভাষা শেখার ইচ্ছে ওর নেই। গ্রামটা ছোট। মানুষগুলো সরল। আর যে ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল লেগেছে জয়িতার সেটা হল পুরুষরা মেয়েদের পদানসীন করে রাখে না। বরং বলা যায় মেয়ে পুরুষ সমানতালে কাজ করে, মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সমান অধিকার আছে। শুধু বিবাহের বেলায় তাদের পরিবারের নির্দেশ মানতেই হয়। অথচ বিবাহের আগে যে যৌনাভ্যাস নেই এমন নয়। সেটা সবাই জানেও কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামায় না যতক্ষণ না সন্তানসম্ভবা হচ্ছে কেউ। কিন্তু এখানকার মেয়েদের মধ্যে নানা ব্যাপারে যে সংস্কার তা মূলত অজ্ঞতা থেকেই। এদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে হলে ওই অজ্ঞতা আগে দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত শারীরিক কারণে এদের অনেকেই সন্তানসম্ভবা হতে পারছে না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গলগণ্ড রোগের ব্যাপক শিকার হচ্ছে। এইটে বাদ দিয়েও তাপল্যাঙকে মিনি ভারতবর্ষ ভাবা যায় না। কিন্তু তাপল্যাঙের মানুষগুলো যারা এখনও আধাআদিম যুগে বাস করছে তাদের জীবন বিপ্লব পরবর্তী স্বপ্নের সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়ার অবাধ সুযোগ রয়েছে। ভারতবর্ষে মানুষের জীবনয়াব্রা পালটে যাওয়ার সে স্বপ্ন নকশালরা দেখেছিল, সি পি এম মুখে বললেও কাজে যার উলটো করেছে, চে গুয়েভারা অথবা মাও কিংবা হো চি মিন যে স্বপ্ন দেখতেন সেই কাজ এখানে করা সম্ভব। কয়েক কোটি না হোক কয়েকশ মানুষকে জীবনের স্বাদ এবং স্বাধীনতা পাইয়ে দিয়ে স্বনির্ভর করলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থপূর্ণ হবে। এই ব্যাপারে সে একমত অনন্দের সঙ্গে জয়িতা চোখ বন্ধ করতেই কল্যাণের মুখটা দেখতে পেল। কল্যাণের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। ঝুঁকিটা অবশ্য কাউকে না কাউকে নিতেই হত। কিন্তু কল্যাণ যদি ধরা পড়ে যায়? পুলিশ যদি কল্যাণের পরিচয় জানতে পারে তা হলে মৃত্যুদণ্ড অনিবার্য। জয়িতা জানে কল্যাণ বাঁচতে বড় ভালবাসে। এবং আর একটা জিনিস ইদানীং সে কল্যাণের মধ্যে লক্ষ্য করছিল। তার সঙ্গে ব্যবহারে যেন পরিবর্তন এসেছিল। কিরকম চোখে মাঝে মাঝে তাকাত কল্যাণ। এবং তখনই তার মনে হত সে যে মেয়ে এটা কল্যাণের দৃষ্টিতে এসেছে। ভাল লাগত না, অস্বস্তি বাড়ত। কিন্তু ওইটুকু ছাড়া আর কোন প্রিটেনশন বা বুজরুকি কল্যাণের ছিল না। বরং বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু সামলে নেবার ক্ষমতার অভাব বড় চোখে পড়ত। সেই কল্যাণ দার্জিলিং-এ নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। কিন্তু গোঁছবার পর কতটা বোকামি করল তার ওপর নির্ভর করছে ওর ফিরে আসা। সুদীপটা তো প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, ও শালা ফিরবে না। ঠিক হাওয়া হয়ে যাবে। সুদীপ কল্যাণকে, ঠিক কল্যাণ নয়, ওই ক্লাসটাকেই অবিশ্বাস করে।
হঠাৎ আনন্দ কথা বলল, জয়ী, জেগে আছিস?
জয়িতা নড়ল না। বলল, হুঁ।
আনন্দ বলল, আজ রাত্রে মেয়েটা মরে যাবে। তারপর কি হবে কে জানে?
জয়িতা বলল, আমি কল্যাণের কথা ভাবছি।
আনন্দ বলল, কল্যাণ পালাবে না। ও আসবেই। কাল নয় পরশু। কিন্তু জানিস, আমাদের মধ্যে কেউ যদি ডাক্তার হত তা হলে এখানে আরও ভাল কাজ করতে পারতাম।
জয়িতা প্রশ্ন করল, কল্যাণ ফিরবেই এই বিশ্বাস হল কেন তোর?
আনন্দর হাসি শোনা গেল অন্ধকারে, মধ্যবিত্ত বলে। মধ্যবিত্তরা সব সময় পালায়। কিন্তু বীরত্ব দেখাবার সুযোগ পেলে সেটা মরে না যাওয়া অবধি হাতছাড়া করে না।
ঠিক সেই সময় চিৎকারটা উঠল। যেন কেউ প্রচণ্ড আহত হয়ে কাঁদছে। কান্নাটা গোঙনি বললে কম বলা হয়, কারণ কোন মানুষ অত জোরে গোঙাতে পারে না। এখানে আসার পর আজ দ্বিতীয় রাত ওই গোঙানিটা হচ্ছে। আনন্দ উঠে বসল। বাতাসের দাপট ছাপিয়ে কান্নার শব্দ হচ্ছে। আনন্দ বলল, মানুষের নয়, অসম্ভব। এটাই পালদেমের দান।
জয়িতা বলল, বাইরে বেরিয়ে দেখবি? হেভি ঠাণ্ডা কিন্তু।
দেখব? ইম্পসিবল। পালদেম যাই বলুক এ দানব নয়। দানব বলে কিছু নেই। হিলারী সাহেব পঁচিশ হাজার ফুট উঁচুতে উঠেও কোন জন্তুর হদিশ পাননি। এরা যাই বলুক তার পেছনে কোন সত্যি নেই। আনন্দ উঠে শীতবস্ত্র জড়িয়ে নিচ্ছিল। জয়িতা ওকে অনুসরণ করল। কান্নাটা এখনও একটানা চলছে। ঘরে মোমবাতি জ্বালাল আনন্দ। শিখাটা কাঁপছে। এই সময় সুদীপ মুখ তুলল, কি ব্যাপার? চললি কোথায়?
আনন্দ বলল, একবার দেখব বস্তুটি কি। এত জোরালো গলা কার?
সুদীপ আবার শুয়ে পড়ল, নেই কাজ তো খই বাছ!
ওরা আর কথা বাড়াল না। দরজা থরথর করছিল। কোনমতে সেটা খুলে বাইরে দাঁড়াতে একসঙ্গে ঠাণ্ডা এবং হাওয়ার চাপ পড়ল শরীরে। বাইরে ঘন অন্ধকার নয়, একটা পাতলা আলো আঁধারে মিশে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে। আকাশে মেঘ আছে কিন্তু তার আড়ালে চাঁদও রয়েছে এটা বোঝা যায়। ওরা দুজনই কাঁপছিল। কান্নাটা ভেসে আসছে উত্তরের পাহাড় থেকে। কিছুক্ষণ একটানার পর কিছুক্ষণ যেন জিরিয়ে নিচ্ছিল। সমস্ত তাপল্যাঙ এখন চুপচাপ। কোন প্রাণের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা ঢালু জমি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। আনন্দ বলল, দৌড়ে। দৌড়লে ঠাণ্ডা কম লাগবে। ওরা উত্তরের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতেই পায়ের তলায় বরফ পেল। এর মধ্যে এখানে বরফ পড়তে শুরু করেছে। আর দৌড়োনো যাচ্ছে না। এর পরেই খাড়া পাহাড়। পাহাড়ের ওপরে বরফ ছিলই, এখন তা নেমে এসেছে অনেক নিচে। আর এখানে আসার পরই চিৎকার অথবা কান্না থেমে গেল। ওরা যত এগিয়ে এসেছিল তত স্পষ্ট হচ্ছিল কোন মানুষ নয়, এ আওয়াজ কোন জন্তুর গলা থেকে বের হচ্ছে। সম্ভবত জটি ওদের দেখতে পেয়েছিল এবং সে কারণেই চুপ করেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আনন্দ বলল, না, ফিরে যাই চল।
জয়িতা বিরক্ত হল, এলি কেন? যেন তোর জন্য চিড়িয়াখানার খাঁচায় বসে থাকবে ইয়েতি।
ওরা চুপচাপ এগিয়ে আসছিল। শরীরের যেসব অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে সেখানে কোন সাড়নেই। এখন আর কোন আওয়াজ আসছে না উত্তরের পাহাড় থেকে। সমস্ত চরাচর নিস্তব্ধ। ওরা যখন মাঝামাঝি তখন আনন্দ হাত বাড়িয়ে জয়িতাকে থামতে বলল। গোটা আটেক লোক ওপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসছে নিঃশব্দে। ওদের লক্ষ্য অবশ্যই গ্রাম এবং প্রত্যেকেই সশস্ত্র। ওদের চলাফেরা দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন গোপন মতলব হাসিল করতে ওরা এসেছে। আনন্দরা দাঁড়িয়েছিল একটা বড় পাথরের আড়ালে। পাথরটা হাওয়ার দাপট সামলাচ্ছে। একেই পাতলা অন্ধকার তার ওপর ওরা এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে চট করে আগন্তুকদের দৃষ্টি পড়ার কথা নয়। আনন্দ ফিসফিসিয়ে বলল, লোকগুলো কারা বুঝতে পারছি না।
জয়িতা বগল, আর একটু লক্ষ্য করা যাক।
আটজনের দলটা গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওপাশ থেকে একটা কুকুর ডেকে উঠতেই ওরা থমকে দাঁড়াল। কুকুরটাকে শান্ত হবার সময় দিল। তারপর দলটা দুটো ভাগে দু পাশ দিয়ে এগোতে লাগল। একটা ভাগ চলল কানের মন্দিরের দিকে আর একটা গ্রামের ভেতরে। ওরা যখন আর দৃষ্টির সীমায় রইল না তখন আনন্দ বলল, মনে হচ্ছে পাশের গ্রামের মানুষ। পালদেম এদের কথাই বলছিল। এরা তাপল্যাঙের কোন ক্ষতি করতে এসেছে। গ্রামের লোকদের সতর্ক করে দিতে হবে। চল্।
জয়িতা বলল, দাঁড়া। তাড়াহুড়ো করিস না। আগে দেখা যাক ওরা কি করে।
আনন্দ প্রতিবাদ করল, না। তারপর সামলানো যাবে না।
জয়িতা মাথা নাড়ল, যাবে। আমার কাছে রিভলভার আছে।
আনন্দ এই পরিবেশেও হতভম্ব হয়ে গেল, এতদিন বলিসনি কেন?
জয়িতা বলল, বলার কোন কারণ ঘটেনি তাই। এবার এগিয়ে চল।
হাঁটা শুরু করতে আনন্দ ওর দিকে বারংবার তাকাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, তোরটা পালদেম নিয়ে যেতে পারেনি?
জয়িতা বলল, পারলে আমার কাছে থাকত কি করে!
ঠিক এই সময় একই সঙ্গে দু জায়গায় চিৎকার শুরু হল। মন্দিরের চিৎকার থেমে গেল আচমকা। আর গ্রামের ভেতর থেকে দুটো মানুষ একটা শরীরকে কাঁধে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। মন্দির থেকেও চারটে লোক নেমে এল। সেই চিৎকার চেঁচামেচি এবার সমস্ত তাপল্যাঙে ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক বেরিয়ে আসছে ঘর ছেড়ে।
কিন্তু মাঝরাতে ঘুম আচমকা ভেঙে যাওয়ায় হাওয়ার দাপট এবং শীতের প্রাব্যল্যে মানুষগুলো সচল হবার অনেক আগেই আটটা লোক কাজ সেরে দূরত্ব বাড়িয়েছিল। কি ঘটনা ঘটেছে তাই নিয়ে যখন বোঝাবুঝির পালা চলেছে তখন কয়েকজন তেড়ে আসছিল লোকগুলোকে ধরতে। কিন্তু তারা নিরঞ্জ, সশস্ত্র হানাদারদের সামনে এসে আর এগোতে সাহস পাচ্ছিল না। ঠিক তখন পাহাড়ের ওপাশে যে পথ দিয়ে হানাদাররা ঢুকেছিল সেখানে ঢাক জাতীয় বাজনা বেজে উঠল। বোঝা গেল হানাদাররা একা নয়, তাদের মদত দেবার জন্যে আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। নিজেদের লোক কাজ হাসিল করে ফিরে আসছে দেখে তারা যে উল্লসিত সেটা চিৎকারে বোঝা গেল। আনন্দ বলল, আমরা পালদেমদের সাহায্য করব জয়ী। ওদের কোন দামী জিনিস চুরি যাচ্ছে। তুই আমাকে রিভালভারটা দে। গুলি আছে তো ওতে?
জয়িতা মাথা নাড়ল। তারপর ছুটে গেল খোলা জায়গায় যে পথ দিয়ে আটটা লোক এখন এক হয়ে ছুটে আসছে। প্রথম যে লোকটা ওদের লক্ষ্য করল সে চিৎকার করে উঠতেই দলের বাকিরা এইদিকে তাকাল। ওরা কাউকে কাঁধে ঝুলিয়ে আনছিল। একজনের দুটো হাত বুকের ওপর। বাকি পাঁচজন অস্ত্র ঘুরিয়ে এদের পাহারা দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল। এই সময় দূর থেকে সুদীপের চিৎকার ভেসে এল, জয়ী, সরে যা।
জয়িতা একবার মুখ ঘুরিয়েই ফিরিয়ে নিল। সুদীপ তাদের আস্তানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ চিৎকার করল সেই সময়ে। তার গলার স্বরে হানাদারেরা এবার থমকাল। ওদের হাতের অস্ত্র বলতে যা দেখা গেল তা প্রাগৈতিহাসিক যুগেই ব্যবহার করা হত। দুটি নিরীহ মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে মনে করায় ওরা দ্বিগুণ উৎসাহে তেড়ে এল সেই অস্ত্র উঁচিয়ে। জয়িতা তখন শূন্যে গুলি ছুঁড়ল।
হঠাৎ যেন সমস্ত পৃথিবী কেঁপে উঠল। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দটা বহুগুণ বেড়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো থমকে গেল। পেছনে পাহাড়ের উল্লাসও থেমে গেল। ততক্ষণে সুদীপ ছুটে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জয়িতার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গেল কিন্তু জয়িতা তাকে হাত নেড়ে নিষেধ করল। হানাদাররা সাময়িক স্থবিরতা কাটিয়ে উলটো পথ ধরার চেষ্টা করছিল কিন্তু জয়িতা দ্বিতীয়বার গুলি করতে তারা থেমে গেল। গুলিটা লেগেছে সামনে দাঁড়ানো হানাদারটির পায়ের কাছে মাটিতে। কিছুটা মাটি তার ফলে ছিটকে উঠেছে। ওরা ব্যাপারটা বোঝার পর যেন পাথর হয়ে গেল।
জয়িতা যে উত্তেজিত এবং অত্যন্ত নার্ভাস তা তার গলার স্বরে বোঝা গেল, পালদেমকে ডাক। তার হাত সামনে প্রসারিত, কালো রিভলভারটা সামান্য কাপছে সেই হাতে। দু-দুবার শব্দ হওয়ার পর হানাদাররা এখন পাথরের মত চুপচাপ। সম্ভবত এ জীবনে তারা এমন শব্দ শোনেনি। দুই থেকে তিন দাঁড়ানো অন্য চেহারার মানুষরা যে শব্দ করছে তার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় ওরা কি করবে বুঝতে পারছিল না। শুধু হানাদার নয়, দূরে দাঁড়ানো তাপল্যাঙের মানুষরাও শব্দ শোনার পর বোবা হয়ে গিয়েছিল। এই কদিন যাদের তারা সাধারণ চোখে দেখেছে, প্রতিদিন লক্ষ্য রেখেছে যাতে না পালিয়ে যায় তাদের শক্তিসামর্থ্য সম্পর্কে যে অন্ধ ছিল তা স্পষ্ট হওয়ায় তারাও চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। এই সময় সুদীপ চিৎকার, করল পা-ল-দে-ম। তার সঙ্গে গলা মেলাল আনন্দ। আর এই চিৎকারটা হওয়ামাত্র যার দুটো হাত বুকের ওপর সে আচমকা দৌড়তে শুরু করল। জয়িতা এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। তারপর লোকটার পা লক্ষ্য করে গুলি করল। কিন্তু তার হাত কাঁপছে। গুলি সম্ভবত সাত হাত দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল। মরীয়া হয়ে সে দ্বিতীয়বার গুলি করা মাত্র লোকটা আছাড় খেয়ে পড়ল। কোথাও আর কোন শব্দ নেই। শুধু গুলির শব্দটা মিলিয়ে যাওয়ার পরেও কানে সেঁটে আছে। এবার জয়িতা নিজেই চিৎকার করল, পা-ল-দে-ম!
তারপরে নেই মূর্তিটাকে পেছনের ভিড় ছেড়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। খুব ভীরু পায়ে আসছে পালদেম। যেন তার আসার মোটেই ইচ্ছে নেই। হানাদারদের দলটাকে অনেকটা এড়িয়ে খানিকটা দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। জয়িতা তাকে বলল, লোকগুলোকে মাটিতে বসে পড়তে বপালদেম সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গলা তুলে হুকুমটা জানিয়ে দিতেই পাঁচজন পুতুলের মত মাটিতে বসে পড়ল। তাদের ভূতগ্রস্তর মত দেখাচ্ছিল। কাঁধে মানুষ নিয়ে যে লোক দুটো দাঁড়িয়েছিল তারা সময় নিল। যাকে ওরা কাঁধে তুলেছিল তার মুখ বাঁধা। কিন্তু হাত পা খোলা। তা সত্ত্বেও এই সময় পর্যন্ত কোন প্রতিবাদ করেনি। মাটিতে নামিয়ে দেওয়ার পর মেয়েটি সোজা হয়ে বসল খানিকটা তফাতে। সাতজন লোক তখন বসে দূরে পড়ে থাকা লোকটিকে দেখছে। সম্ভবত শব্দের ক্ষমতা চাক্ষুষ করে আরও কাহিল হয়ে পড়েছে তারা। জয়িতা পালদেমের সামনে এগিয়ে গেল, আমরা তোমাদের বন্ধু। এরা এই গ্রামে কি করতে এসেছিল?
পালদেম বলল, ওরা আমাদের দেবতার মূর্তি চুরি করেছে। ওই যে লোকটা মাটিতে পড়ে আছে। ওর কাছে আছে মূর্তি। আর এরা ওই মেয়েটাকে নিয়ে যেতে এসেছিল।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, এরা কারা?
পাশের পাহাড়ে ওদের গ্রাম। আমাদের শত্রু। বহু বছর ধরে ওদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া। আমাদের দেবতার ওপর ওদের খুব লোভ। আমাদের মেয়েদের ওপরেও। আমরা ফসল তুললে ওরা হানা দেয়। সাধারণত ওরা এসব করে বরফ পড়লে। এবার ওরা আগেই সাহস দেখাল। কথা বলতে বলতে এতক্ষণে পালদেমকে উত্তেজিত দেখাল।
জয়িতা বলল, তুমি কি চাও আমরা তোমাদের ওদের হাত থেকে বাঁচাই?
হ্যাঁ। আমি গ্রামের লোকদের বলছি ওদের বেঁধে ফেলতে।
না। তুমি আমাদের বন্ধু বলে ভাবতে পারেনি। অথচ তোমাদের আবার বলছি, আমরা বন্ধু বলেই মনে করি। তুমি চোরের মত আমাদের সমস্ত অস্ত্র চুরি করেছিলে কিন্তু এটা পারোনি। আর পারোনি বলেই আজ তোমাদের দেবতা এবং গ্রামের মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম। আমি চাই এখনই তুমি আমাদের অস্ত্রগুলো ফেরত দেবে। যাও, চটপট কাজ করো।
পালদেম হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল।
জয়িতা চিৎকার করল, তোমার একার বোকামির জন্যে গ্রামের সমস্ত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা আমি চাই না। এই ছোট্ট অস্ত্র দিয়ে আমরা বেশিক্ষণ লড়তে পারব না। আমি যা বলছি তা প্রত্যেকের ভালোর জন্যই বলছি। সুদীপ ওর সঙ্গে যা।
সুদীপ এগিয়ে যেতেই পালদেমকে নড়তেই হল। ওরা যাচ্ছে ঝরনার দিকে।
দৃশ্যটা এখন এই রকম। লোকগুলো এবং মেয়েটি বসে আছে নির্বাক হয়ে। গ্রামের মানুষগুলো দূরে দাঁড়িয়ে। পেছনে উল্লাস নেই। হাওয়া বইছে। কিন্তু শীত যে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে তা কারও খেয়ালে নেই। আনন্দ এগিয়ে গেল দূরে পড়ে থাকা লোকটার কাছে। পাশে দাঁড়িয়েই সে বুঝতে পারল লোকটা মরেনি। ওর শরীর কাপছে। এমন কি রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। সে লোকটাকে টেনে তুলতেই কোন রকমে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ভয়ে থরথর করে কাপছে সে। গুলি তার গায়ে লাগেনি কিন্তু ভয়ে লোকটা কুঁকড়ে উঠেছে। ওর দুটো হাতে দেবতার সেই মূর্তিটা। সন্তর্পণে সেটি তুলে নিয়ে আনন্দ চিৎকার করল, কাহুন কাহন!
জনতার মাঝখান থেকে কাহুন তার শিষ্যসমেত বেরিয়ে এলেন। তাকেও খুব নার্ভাস মনে হচ্ছিল। আনন্দ তার হাতে মূর্তি দিতে তিনি আশীর্বাদ করলেন। গ্রামের মানুষরা তখন খুশীতে চিৎকার করে উঠল। আনন্দ কাহুনকে বোঝাতে পারল এই লোকগুলোকে বেঁধে ফেলতে হবে, এখনই। কাহুন সেই নির্দেশটা দেওয়ামাত্র কাজ শেষ হয়ে গেল।
আনন্দ এগিয়ে এল জয়িতার কাছে, দু-দুটো গুলি ছুঁড়েছিস কিন্তু একটাও গায়ে লাগেনি। প্লিজ একথা বলিস না যে তুই ইচ্ছে করে গুলি গায়ে লাগাসনি।
জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, গুলি ছোঁড়ায় আমি অভ্যস্ত নই। কিন্তু এই লোকগুলোকে তুই বাঁধতে বললি কেন? এদের শাস্তি দিলে দুই গ্রামের শত্রুতা কোনদিন মিটবে না।
আনন্দ মাথা নাড়ল, ঠিক বলেছিস, তাহলে কি করা যায়?
সেইসময় সুদীপ আর পালদেম ফিরে এল। সুদীপের হাতে একটা বড় টুকরি। কাছে এসে বলল, মালগুলো ঠিক আছে কিনা কে জানে! পাথরের খাঁজে লুকিয়ে রেখেছিল। মেয়েটা কে? ওকে বেঁধেছে কেন? ও তো এই গ্রামের মেয়ে।
পালদেম মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। আনন্দ তার পাশে গিয়ে বলল, ভুল বুঝো না, আমরা কোন শত্রুতা করব না। কিন্তু এগুলো তোমাদের উপকারেই লাগবে।
পালদেম মাথা নাড়ল কিন্তু সহজ হল না। জয়িতা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ওই মেয়েটিকে বেঁধেছ কেন? ওকে তো এরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। ওকে ওই গ্রাম চায়। কিন্তু আমরা ওখানে মেয়ে দেব না। ওকে ওরা মুখ : বেঁধেছিল কিন্তু হাত পা বাঁধেনি। তবু ওরা যখন নিয়ে আসছিল তখন ও কোন প্রতিবাদ করেনি। দোষ আছে ওর। ওর শাস্তি ভয়ানক।
ভয়ানক কেন?
ও বেইমানি করেছে। ওর স্বামী নেই, আত্মীয়স্বজন নেই। স্বভাব মন্দ। ও অন্য গ্রামে গেলে ওর জমি নিয়ে যাবে, এ হতে পারে না।
কেন? গ্রামের কোন ছেলে ওকে বিয়ে করবে না?
না। কেউ যেচে নিজের সর্বনাশ করতে চায় না।
জয়িতা বলল, ঠিক আছে, এখন কোন শাস্তি দিও না। এই দলের মধ্যে কে নেতা তা ওদের জিজ্ঞাসা করো তো!
পালদেম বলল, ওই যে ডানদিকের সবচেয়ে বড় চেহারার লোকটা ওই নেতা।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, ও কি তোমাদের ভাষায় কথা বলে?
হ্যাঁ। কিন্তু লোকটা অত্যন্ত গোঁয়ার।
জয়িতা এগিয়ে গেল লোকটার সামনে। লোকটা মাথা নামিয়ে বসেছিল। জয়িতা সামনে এসে দাঁড়াতে চোখ তুলে তাকাল। লোকটার বয়স তিরিশের নিচে। স্বাস্থ্য যে কোনো পাহাড়িদের চেয়ে ভাল। নাক বেশ উঁচু। চোয়াল শক্ত হল লোকটার। চোখাচোখি হতেই চোখের দৃষ্টি পালটাল। লোকটা সত্যিই গোঁয়ার।
জয়িতা তার অল্প জানা শব্দ ব্যবহার করল, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। পালদেম, এর বাধন খুলে দাও। তুমি আমার সঙ্গে এদিকে এস।
বন্ধুদের উপেক্ষা করে সে সোজা আস্তানার দিকে হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখল পালদেম বাঁধন খুলে দেবার পরও লোকটা নড়ছে না। সে আস্তানার সিঁড়িতে বসে তাকাল। মেঘ সরছে। ঢলে পড়া চাঁদের শরীর থেকে একটু একটু করে জ্যোৎস্না বের হচ্ছে। দুরের লোকগুলোকে ঝাঁপসা দেখাচ্ছে এখান থেকে। এবং সেই ঝাঁপসা অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটি সুগঠিত মানুষ ধীরে পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
লোকটি সামনে এসে দুটো পা ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়াল। তার ভঙ্গিতে এখনও স্বাভাবিকতা আসেনি কিন্তু ধীরে ধীরে যে সে স্বভাব ফিরে পাচ্ছে তা বোঝা যায়। সোকটা অবশ্যই জেদী। ওর তাকানন, শরীর দেখলে এমনি সময় কথা বলতে সাহস পেত না জয়িতা। কিন্তু এখন ক্ষমতার চাবি তার হাতে। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার নাম কি?
লোকটার ঠোঁট একবার কুঁচকে উঠল। তারপর চোখ না সরিয়ে জবাব দিল, রোলেন।
জয়িতা একটু অবাক হল। নামটার মধ্যে বিদেশী গন্ধ। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা এখানে চুরিডাকাতি করতে এসেছ কেন?
রোলেন কোন জবাব দিল না। বুনো শুয়োরের মত মাটিতে পা ঘষল।
জয়িতা সেটা লক্ষ্য করে বলল, তাপল্যাঙের দেবতাকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ কেন?
এরা গতবার আমাদের ফসল লুঠ করে নিয়ে এসেছিল। ওই দেবতাই ওদের সৌভাগ্যের প্রতীক।
তোমরা দুই গ্রামের মানুষ একই ভাষায় কথা বল, পাশাপাশি থাকো, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে লাভ কি? তোমরা কেউই আরামে থাকে না। জয়িতার নিজের কাছেই কথাগুলো জ্ঞান-জ্ঞান শোনাল।
রোলেন হাসল। হোট চোখ গোল মুখ সত্ত্বেও হাসিটা বেশ মোলায়েম। বলল, ওরা এখন বড়লোক। টাকা দিয়ে খচ্চরওয়ালার কাছ থেকে জিনিস কেনে। তোমরা ওদের বড়লোক করে দিয়েছ। বরফ পড়লে আমাদের না খেয়ে থাকতে হয়।
জয়িতা বুঝলো এরা সব খবর রাখে। অথচ দুই গ্রামের মধ্যে মুখ দেখাদেখি সম্পর্ক নেই। সে বলল, আমাদের কাছে তাপল্যাঙের মানুষও যা তোমরাও তাই। আমরা চাই পাহাড়ের মানুষ সুখে থাকুক। তোমাকে একটা অনুরোধ করব, রাখবে?
কি অনুরোধ?
এখন কিছুদিন তোমরা এই গ্রামে হামলা করো না। তোমাদের মোড়ল কে?
কাহুনের কথা আমরা শুনি।
বেশ, তোমাদের কানকে আমাদের কথা বল। আমরা তোমাদের গ্রামেও যেতে পারি। এই গ্রামের মানুষ যেসব সুবিধে পাবে তোমরাও তাই পাবে। শুধু তার বদলে আমাদের কথা শুনতে হবে, রাজী?
রোলেন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আমরা ভেবে দেখব।
ওই মেয়েটাকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ কেন?
ওর শরীরে ভাল বাচ্চা হবে। ওর স্বামীর বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আমাদের গ্রামে স্বাস্থ্যবান মানুষ আছে। তা ছাড়া গ্রামে বাচ্চারও অভাব।
তোমাদের সঙ্গে যেতে ওর ইচ্ছে আছে?
তাই তো মনে হয়।
কিন্তু ওকে নিয়ে গেলে ওর জমিও তো তোমরা দাবী করবে!
তা তো করবই।
আপাতত ওকে এখানে রেখে যাও। তোমরা সবাই যেতে পারো এখন। কিন্তু মনে রেখো এখানে আর হামলা নয়। আমরা তোমাদের সঙ্গে ঝামেলা করতে চাই না। তোমরা তোমাদের গ্রামে ফিরে যাও।
জয়িতার কথাগুলো লোকটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা আমাদের শাস্তি দেবে না?
না। ওরা ফসল চুরি করেছিল বলেই তোমরা এসেছিলে, শোধবোধ হয়ে গেছে।
লোকটা একবার আকাশে লাফিয়ে উঠে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল সঙ্গীদের দিকে। সঙ্গীরা কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠল। জয়িতার নির্দেশে পালদেম ওদের বন্ধন-মুক্ত করে দিলে ওরা পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি বসেছিল চুপচাপ। জয়িতা তাকে বলল, তুমি ঘরে ফিরে যাও।
মেয়েটি মাথা নাড়ল, না, আমি ধরে যাব না।
কোথায় যেতে চাও?
জানি না। গ্রামের কোন পুরুষ আমাকে নেবে না। ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তোমরা বাধা দিলে কেন? আমি এখন কি করব! কেঁদে ফেলল মেয়েটা।
জয়িতা ওর কাঁধে হাত রাখল, তুমি একজন মানুষ। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
ছিটকে সরে গেল মেয়েটি। তারপর চিৎকার করে বলল, আমি একটা মেয়ে। জীবনে যদি একটা সত্যিকারের পুরুষমানুষ না পেলাম তা হলে বেঁচে থেকে লাভ কি।