৩৯
অনেক চেষ্টা করেও ঝুমকি কল্পনায় শহরটাকে ঠিকমতো সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে নিতে পারে না। সে যায়নি, কখনও যাবে না হয়তো কোনও বিদেশে। সে বড় জোর যাবে কুলু-মানালি, দক্ষিণ ভারত বা ঘাটশীলা। কিংবা কে জানে। কিন্তু বিদেশ তার কপালে লেখা নেই। বাঙালী মেয়েরা সুন্দর মুখ, উচ্চ মেধা কিংবা দুর্দান্ত ভাগ্য থাকলেই মাত্র বিদেশ-টিদেশ যায়। তার কোনওটাই নেই। তবু কেন মনে মনে বারবার লন্ডন শহরটাকে তৈরি করতে চাইছে সে! কেন দেখতে চাইছে তার রাস্তাঘাট? বাড়ি ঘর? দোকানপাট? মিউজিয়াম? আন্ডারগ্রাউন্ড?
এক একদিন কথা বা প্রসঙ্গ একটা কিছুতে এমন মজে যায় যে আর অন্য প্রসঙ্গই উঠতে চায় না। চারুশীলামাসির বাড়িতে সেদিন নেমন্তন্ন করে আনা হয়েছিল রশ্মি রায় নামে একজন বিলেত-ফেরত মহিলাকে। দেখতে ফর্সা-টর্সা, ফিগারও ভাল, মুখখানা তেমন কিছু নয়। কিন্তু চেহারার চেয়েও যেটা বেশি ঝলমল করছিল সেটা হল মেয়েটির বিদ্যা, বুদ্ধি, স্মার্টনেস, পারসোনালিটি। এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ঝুমকি যে, জীবনে এই প্রথম তার দুঃখ হয়েছিল, যে পুরুষমানুষ নয় বলে। পুরুষ হলে সে নির্ঘাৎ রশ্মির প্রেমে পড়ে যেত। পুরুষ না হয়েও কিছু কম পড়েনি। আর সেই সঙ্গে রশ্মির মুখে সেদিন লন্ডনের গল্প শুনে শুনে সেই অচেনা শহরটারও প্রেমে পড়ে গেল সে। লন্ডন শব্দটাই যেন একটা দূরের ঘণ্টাধ্বনি। ওই নামটার মধ্যে কত শিহরণ, কত বিস্ময়।
এক ফাঁকে চারুশীলামাসি তাকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেল।
ঝুমকি, একটা সত্যি কথা বলবে?
কী হয়েছে মাসি?
তুমি তো এই আধুনিক যুগের মেয়ে, আমার চেয়ে অনেক মডার্ন। মেয়েটিকে তোমার কেমন লাগছে বলো তো!
মেয়েটা তো দারুণ মাসি।
দারুণ বলতে কি বলো তো! দেখতে ভাল, না বুদ্ধিমতী?
দেখতেও ভাল, বুদ্ধির তো কথাই নেই।
মুখের ডৌলটা দেখেছো ভাল করে?
দেখেছি। সারাক্ষণ তো চেয়েই আছি। বেশ ডৌল। ঢলঢলে।
বলছো? কিন্তু আমার যেন একটু রুক্ষ-রুক্ষ লাগছে। অবশ্য চটক আছে।
না মাসি, রুক্ষ কেন হবে? একটুও তো রুক্ষ নয়। বরং ভারি মিষ্টি। তবে সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা নয়। বড় টানা চোখ বা টিকোলো নাক তো নয়। এ হল আহ্লাদী চেহারা।
ঠিক বলেছো। বড় বেশী আহ্লাদী। একটু ন্যাকা নাকি? কি মনে হচ্ছে?
ঝুমকি খুব হাসল, তা একটু হতে পারে। বিলেতে থাকলে ওরকম হয়।
আচ্ছা, অহংকারী নয় তো! দেমাক থাকলে মুশকিল।
তা থাক না দেমাক। ওর দেমাক ওর কাছে। আমাদের কি?
আসলে হয়েছে কি জাননা, তোমাকে খুলেই বলি, আমার যে ওই একটা হাবাগঙ্গারাম ভাই আছে, হেমাঙ্গ, ওর সঙ্গে একটা বিয়ের চেষ্টা করছি। ওর তো উদ্যোগী হয়ে বিয়ে দেওয়ার লোক নেই। ব্যাচেলর থাকারই মতলব। তাই আমি রশ্মির সঙ্গে ওকে ট্যাগ করার চেষ্টা করছি। তোমার কি মনে হয়, দুজনকে মানাবে?
ঝুমকি একটু ভাবল। তার মনে হল, চারুমাসি একটু বাড়াবাড়ি করছে। হেমাঙ্গর মুখে কোনও বোকামির ছাপ নেই। দেখতেও বেশ ভাল। লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা এবং তীক্ষ্ণ চেহারা। তবে মুখে একটু কেবলু-কেবলু ভাব আছে ঠিকই। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত বলেই মনে হয় ঝুমকির। সে বলল, বেশ মানাবে মাসি।
চেহারায় মানালেই হবে না, অন্য দিকগুলোও দেখতে হবে। সবার আগে জাত আর গোত্র! কী করে জানা যায় বলো তো!
জাত আর গোত্র কি কোনও বিরাট সমস্যা নাকি? ঝুমকি খুব ভাবল সেদিন। যদি জাত বা গোত্র না ঠিকঠাক হয়, আর যদি দুজনের মধ্যে প্রেম হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে কী হবে? ঝুমকি খুব সরলভাবে জিজ্ঞেস করল, ওদের মধ্যে কি লাভ অ্যাফেয়ার আছে মাসি?
চারুশীলা মুখখানা চোখা করে বলে, তাই তো থাকার কথা। কিন্তু আমার ভাইটাকে তো দেখছে, একদম আনস্মার্ট। প্রেম করতে ভয়ে মরে।
হি হি করে হাসল ঝুমকি, ভয়টা কিসের?
তা ও-ই জানে।
হেমাঙ্গ কাছাকাছি ছিল না। ভাগ্নে আর ভাগ্নীকে নিয়ে অন্য ঘরে গল্প করছিল। পাশাপাশি ওদের কেমন দেখাবে কে জানে। ঝুমকি বলল, আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছেন। উনি পালিয়ে আছেন তখন থেকে।
কী অভদ্রতা হচ্ছে দেখ। ডাকো তো ওকে। ওপরে আছে বোধহয়।
বাড়িটা বিরাট এবং বাড়ির মধ্যে নানারকম খোপ, খোঁদল, বিচিত্র ঘর, বিচিত্রতর বারান্দা। একেই বোধহয় ভুলভুলাইয়া বলে। তিনতলাতেও সেই ধাঁধাঁ। ছেলের জন্য একখানা অদ্ভুত ঘর বানানো হয়েছে। দেয়ালে রঙের বদলে মজাদার সব ছবি। একটা দেয়ালে পুরো একটা কমিকস আঁকা রয়েছে। বিছানার ডিজাইন নৌকোর মতো, টেবিল চেয়ার সবই পশু-পাখির আকৃতির। রঙচঙে সিলিং। ঢুকলেই মনে হয়, বুঝি রূপকথার দেশ। সেই ঘরে দেখা গেল, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে নিয়ে এয়ারগানে টার্গেট প্র্যাকটিস করছে হেমাঙ্গ।
ঝুমকি খুব মৃদুস্বরে বলল, শুনছেন, আপনাকে মাসি ডাকছেন।
হেমাঙ্গ তার ভ্রু কুঞ্চিত মুখ ফিরিয়ে বলল, ডাকছে? কেন বলুন তো!
আপনাদের অতিথি অপেক্ষা করছেন।
হেমাঙ্গ এয়ারগান রেখে উঠে পড়ল। বলল, চারুদিটা একদম যাচ্ছেতাই।
ঝুমকি লোকটাকে ভাল করে দেখল। প্রেমে-পড়া মানুষের মুখ কেমন দেখতে হয় তা ঝুমকি জানে না। এ লোকটার মুখে তেমন কোনও বিশেষ বিলক্ষণ দেখতে পাচ্ছে না সে। একে যত বোকা বলে জাহির করে মাসি, ততটা বোকাও বোধহয় হেমাঙ্গ নয়।
চলুন, বলে হেমাঙ্গ তার আগে আগে হাঁটতে লাগল। সিঁড়ির মুখে এসে হঠাৎ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আপনি কি চাকরি পেয়ে গেছেন?
না তো।
চাকরি কেন করবেন? বাড়িতে খুব অভাব, না কি শখ?
না, শখ নয়। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। বাবা আর কদিন চাকরি করতে পারবেন কে জানে!
ওঃ হ্যাঁ, সেদিন তো বলছিলেন এসব কথা। খুব দরকার কি?
হলে ভাল হত।
অনেক মেয়ে স্বামীর অধীন থাকবে না, পরিবারের অধীন থাকবে না বলে চাকরি চায়।
আমি সেরকম নই।
না হলেই ভাল। যারা চাকরির মধ্যে স্বাধীনতা খোঁজে তারা কেন বোঝে না যে চাকরিটাও অধীনতা?
অধীনতা হলেও তার কতগুলো নিয়মকানুন আর সিকিউরিটি আছে। সংসারি মেয়েদের সেটা থাকে না।
সিকিউরিটি? প্রাইভেট কোম্পানিতে ওসব থাকে না। বিশেষ করে ছোটো ছোটো কনসার্নগুলোয়।
মেয়েরা শখ করে চাকরি করে না। বাধ্য হয়েই করে।
হেমাঙ্গ কথাটা মানতে চাইল না। ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে হঠাৎ তার দিকে মুখোমুখি হয়ে বলল, একটা কথা বলি আপনাকে। চাকরি করতে হয় তো মাস্টারি করুন। অনেক সেফ, অনেক ভাল।
ঝুমকি মৃদু হেসে বলে, স্কুলের চাকরি আরও দুর্লভ। কলকাতায় বা আশে পাশে তো নয়ই, এমন কি আজকাল গাঁয়ের স্কুলে পর্যন্ত মেয়েদের চাকরিতে ভীষণ কম্পিটিশন।
আপনি বি-এড পড়েছেন?
না।
পড়ুন না! রশ্মি রায়ের স্কুলে হয়তো হয়ে যেতে পারে। নাহলেও ক্ষতি নেই। আমার সঙ্গে অনেক স্কুলের চেনাজানা আছে। কম্পিউটার শিখে কী করবেন?
আমার কম্পিউটার খুব ভাল লাগে।
মুশকিলে ফেললেন।
স্কুলের চাকরিতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি তো তার জন্য তৈরি হইনি।
হঠাৎ হেমাঙ্গ বলল, চাকরি করলে মেয়েদের অনেক কিছু হারিয়ে যায়, তা জানেন?
অবাক হয়ে ঝুমকি বলে, কী হারায়?
হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, তা বলব না। বলতে গেলেই দেখি ঝগড়া লেগে যায়। মেয়েরা তো সহজে কিছুই মেনে নেয় না।
ঝুমকি মৃদু হেসে বলে, মানাতে পারলে মানবে না কেন?
হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপেই একটা বিবাদ হোক, আমি তা চাই না। আজ আমার নার্ভাসও লাগছে।
ঝুমকি হেসে বলে, নার্ভাস কেন?
আমার পাগলী দিদিটিকে কতদিন চেনেন?
খুব বেশিদিন নয়।
চিনলে বুঝতেন কেন নার্ভাস। ওই যে মেয়েটি এসেছে ওটির সঙ্গে দিদি আমার একটা মধুর সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছে। আমি সেটা টের পাচ্ছি আর ভিতরে ভিতরে রেগে যাচ্ছি। ও যে কেন এসব কাণ্ড করে কে জানে!
ঝুমকি খুব সাবধানে বলে, রশ্মিদি কিন্তু খুব ভাল মেয়ে।
সে তো বটেই। আমিও জানি। কিন্তু ভাল মেয়ে বলেই কি তার ওপর হামলা করতে হবে? চারুদি ভালই জানে ওর এসব চেষ্টায় কিছু হবে না।
ঝুমকির এ প্রসঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। তাই সে চুপ করে রইল।
হেমাঙ্গ নিজেই বলল, আমি ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করি বলেই একা থাকি। ও যে কেন আমার শান্তিটা নষ্ট করতে চায়।
দুজনে এসে যখন দোতলার মেয়েলি বসার ঘরটায় ঢুকল তখন রশ্মি চা খাচ্ছে আর চারুশীলা তাকে নিজের বোকা ভাইটা সম্পর্কে নানাবিধ বড় বড় কথা বলছে।
রশ্মি হেমাঙ্গকে দেখে মুখ টিপে হেসে বলল, আপনি লন্ডনে কিছুদিন ছিলেন, বলেননি তো!
আজকাল বিলেত যাওয়াটা তো শক্ত ব্যাপার নয়। কে না যাচ্ছে বলুন!
তা অবশ্য ঠিক। আপনাকে এতক্ষণ দেখিনি কেন? কোথায় ছিলেন?
ভাগ্নে-ভাগ্নীদের একটু সঙ্গ দিচ্ছিলাম। এ বাড়িতে তো আপনি ঠিক আমার অতিথি নন, আমার দিদির অতিথি। ও একাই এত কথা বলে যে আমরা কিছু বলার চান্স পাই না।
চারুশীলা হেসে একটা ধমক দিল, অ্যাই মিথুক! কবে আমি বেশী কথা বলি রে?
যে বলে সে টের পায় না। আমরা পাই।
মারব থাপ্পড়! রশ্মি, খবরদার আমার ভাইটিকে বিশ্বাস কেরো না। ভীষণ ফাজিল।
রশ্মি হেসে বলে, আমি ওঁকে একটু জানি। উনি মেয়েদের সামনে খেতে লজ্জা পান, আর-নারী স্বাধীনতার পক্ষপাতী নন।
ঝুমকি মুখ লুকিয়ে হেসে ফেলল।
হেমাঙ্গ একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, সংখ্যালঘুদের প্রোটেকশনের ব্যবস্থা সব সরকারের আছে। আমারও প্রোটেকশন দরকার। আপনারা তিন মহিলা, আমি একা।
সেইজন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন?
খানিকটা সেইজন্যও। আর আমার এ দিদিটির জন্যও। ছেলেবেলা থেকেই লোকের সামনে ও আমাকে নাকাল করে আসছে। জনসমক্ষে তাই ওর কাছাকাছি থাকি না।
তাই বুঝি! আচ্ছা, আপনাকে আমরা কেউ অ্যাটাক করব না। নিশ্চিন্ত হয়ে বসুন।
সন্ধেবেলাটা বেশ কাটছিল ঝুমকির। এক একটা বাড়ির এক এক রকম পরিবেশ। এ বাড়ির পরিবেশ তার বরাবর খুব ভাল লাগে। চারুমাসি হাসিখুশি মজার মানুষ। দারুণ সুন্দরী। সিনেমায় নায়িকার পার্ট করেছেন। সব মিলিয়ে একদম ঝলমল করছেন সবসময়। মন-খারাপ নিয়ে এলে মন ভাল হয়ে যায়। তার চেয়েও ভাল লাগছে রশ্মি রায়কে। ঠাণ্ডা মেজাজের বুদ্ধিমতী মেয়ে। কথা বলে কী সুন্দর! পাশাপাশি যদি নিজেকে তুলনা করে ঝুমকি তাহলে সে কিছুই নয়। না আছে বিচক্ষণতা, না এদের মতো বুদ্ধি, না তেমন ব্যক্তিত্ব।
কিছুক্ষণ কথা-টথা হওয়ার পর চারুমাসি হঠাৎ ঝুমকির দিকে চেয়ে বলে, এই মেয়েটা, তুমি না গান জানো?
গান! বলে ঝুমকি অবাক হয়, কে বলল?
আমি জানি, তুমি নাকি খালি গলায় দারুণ গান গাও।
না, না, বলে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল ঝুমকি। এদের সামনে গান গাইবে কি, বসে থাকতেই তার সংকোচ হচ্ছিল।
শেষ অবধি অবশ্য আপত্তি টিকল না। গাইতে হল। খুব বেছে চিন্তা করে দুটি গান গাইল ঝুমকি। রবীন্দ্রসঙ্গীত। কেউ কিছু বলল না তাকে। কিন্তু গানের পর সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ বাদে রশ্মি বলল, গান জানি না বলে আজ আমার খুব দুঃখ হচ্ছে।
ব্যস, একটুকুই। হয়তো আরও কথা উঠত, তার গান নিয়ে তার আগেই ঝুমকি রশ্মির কাছ ঘেঁষে বসে বলল, আমাকে লন্ডনের কথা একটু বলবেন? আমার খুব বিদেশের কথা শুনতে ভাল লাগে।
রশ্মি একটু হাসল। বলল, বিদেশের কথা শুনতে সবারই ভাল লাগে। গরিব দেশের মানুষদের ওটা একটা এন্টারটেইনমেন্ট।
তারপর ধীরে ধীরে কথায় কথায় লন্ডন শহরটা যেন একটা কুয়াশা ভেদ করে জেগে উঠতে থাকল ঝুমকির চোখের সামনে। সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। তারপর হেমাঙ্গ বলল। তারপর চারুশীলাও। এরা সবাই বিস্তর বিদেশে ঘুরেছেন। ঝুমকির ভারি দুঃখ হচ্ছিল নিজের জন্য। কত পিপাসা তার বুকে। কত ইচ্ছে। এই জীবনে কিছুই ঘটবে না তার।
গত চারদিন সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সে কখনও রশ্মির কথা ভাবছে। কখনও লন্ডনের কথা। মাঝে-মধ্যে হু হু করছে বুকের ভিতরটা আত্মগ্লানিতে। কখনও খুব নির্জীব বোধ করছে সে। মাঝে মাঝে সে ভাবছে, আচ্ছা, এত ছোটো, এত সামান্য হয়ে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় নাকি? আমি তো একটু সুন্দর, একটু মেধাবীও হতে পারতাম! কিংবা আরও স্মার্ট!
অপণা সকাল বেলায় ঝুমকির ঘরে এসে দাঁড়াল। মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, তোর আজকাল কী হয়েছে বল তো! চা খেয়েছিস, এঁটো কাপটা পর্যন্ত বেসিনে রেখে আসিসনি। বাসি কাপড়টা ছেড়ে মেঝেময় ছড়িয়ে রেখেছিস, বাথরুমের বালতিতে রেখে না এলে ঝি ওটা কোনোদিন ধোবে? ঘুম থেকে উঠে বিছানাটা তুলিসনি। তোর হল কি?
মার সঙ্গে ঝুমকির সম্পর্কটা একটু আড়াআড়ির, আবার কখনও একটু ভালবাসাবাসিরও। হয়তো একেই লাভ-হেট রিলেশন বলে।
ঝুমকি তার রোগা করুণ মুখখানা তুলে বলে, আচ্ছা মা, আমি কেমন মেয়ে বলো তো!
ও আবার কি কথা? কেমন মেয়ে আবার কি।
মা, আমি তো একদম গোল্লামাটা একটা মেয়ে, তাই না?
গোল্লা আবার কিসে পেলি?
সব ব্যাপারে। চেহারায় গোল্লা, লেখাপড়ায় গোল্লা, কাজে কর্মে গোল্লা, স্মার্টনেসে গোল্লা। আমাকে নিয়ে কী করবে তুমি?
কম্পিউটারের পরীক্ষায় ফেল করেছিস নাকি?
সে না হয় করব। কিন্তু সে কথা বলছি না। আমি ভাবছি, আমার মতো একটা অপদার্থ মেয়েকে দিয়ে কি হবে! আমার বেঁচে থাকারই কোনও মানে হয় না।
হঠাৎ এত নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিস কেন?
আজকাল আমি মাঝে মাঝে নিজের একটা অ্যাসেসমেন্ট করি। করতে গিয়ে সব ব্যাপারেই দেখি, আমি ভীষণ বাজে। এমনকি বুবকা আর অনুও কত ভাল আমার চেয়ে।
পাঁচটা ছেলেমেয়ে কি সমান হয়?
তা তো হয় না মা। কিন্তু যে খারাপ তার তো নিজের একটু করুণা হবেই। সে তো জানতে চাইবেই যে, সে কেন আর পাঁচজনের মতো ভাল নয়!
অপর্ণা বিছানায় বসে মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, তোর মাথায় মাঝে মাঝে পোকা ঘুরে বেড়ায়। কেন, তোকে কি কেউ খারাপ বলেছে?
মুখের ওপর কি কেউ বলে? বুঝে নিতে হয়।
কার কাছ থেকে কি বুঝলি?
সে আছে।
তুই এত চাপা কেন বল তো! মায়ের কাছে মেয়েরা তো সব খুলে বলে। তুই কখনও কিছু বলিস না। কেন রে? আমাকে মা বলে মনে হয় না তোর?
তুমি খুব ভাল-মা। একটু রাগী, তবু ভাল।
ভাল হয়েই তো মরেছি। ভাল বলেই তো তোরা কেউ গ্রাহ্য করিস না আমাকে।
তা নয় মা। আমার সবসময়ে কথা বলতে ভাল লাগে না।
সে জানি, তোমার বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। কিন্তু এরকম কি ভাল! মানুষ মনের ময়লা কথা দিয়েই তো কাটিয়ে দেয়। কি হয়েছে তোর?
অমনি তুমি দুশ্চিন্তা শুরু করলে নাকি?
মা হলে বুঝবি, সন্তানের জন্য মায়ের বুক কেমন সবসময়ে দুরুদুরু করে।
দুর! দুরুদুরু করার মতো কোনো ঘটনাই নয়।
তাহলে বলতে দোষ কি?
ঝুমকি হেসে ফেলে বলে, কি হয়েছে জানো? আমার একটু পরশ্রীকাতরতা এসেছে।
সেটা আবার কি?
সেদিন চারুশীলামাসির বাড়িতে একটা মেয়েকে দেখলাম, সে বিলেতে জন্মেছে, পড়াশুনা করেছে, এরপর আবার ওখানেই গিয়ে থাকবে।
তা ওরকম তো কতই আছে। আজকাল কত ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে।
তা তো থাকেই। মেয়েটা দেখতেও দারুণ ভাল, লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট, ব্যক্তিত্ব আছে। এত ভাল লাগল মেয়েটাকে। একটুও অহংকার নেই। সোশ্যাল ওয়ার্ক হিসেবে একটা গাঁয়ের স্কুলে পড়ায়। ওই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই কেমন যেন নিজের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
কেন রে ঝুমকি, তুই কিছু খারাপ আছিস?
তা নয় মা। খারাপ কেন থাকবো? বেশ তো আছি। কিন্তু মাঝে মাঝে ভীষণ মনে হয়, আমার আর কিছু গুণ থাকলে বেশ হত। অন্তত দেখতেও যদি সুন্দর হতাম!
তুই কি দেখতে খারাপ? একটু রোগা, এই যা। যার চোখে আছে সেই জানে, তোর মতো মুখচোখ খুব কম মেয়ের আছে।
মায়ের চোখ দিয়ে দেখো না মা। মায়ের চোখ সবসময়ই ভুল দেখে। কোন মায়ের কাছে তার মেয়ে অসুন্দরী বলো তো! আর একটু ক্রিটিক্যালি দেখ তো!
খুব ক্রিটিক্যালি দেখেই বলছি। আমার মতো খুঁটিয়ে তো কেউ কখনও তোকে দেখেনি! যখন আঁতুড়ে ছিলি তখন থেকে তোর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম।
জানি মা। তুমি তোমার প্রথম সন্তানকে দেখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কী দেখলে মা? বেশী ভালবাসা, আদর আর আবেগ থাকলে কি আসল চেহারা চোখে পড়ে?
আচ্ছা, তোর চেহারার সেদিন কেউ কোনও নিন্দে করেছে?
না তো! তাই কেউ করে? চেহারাটাই তুমি ধরছো কেন, আর কোন দিক দিয়েই বা আমি কি হয়েছি বলল তো!
তোকে নিয়ে আর পারি না বাপু। হঠাৎ যে কেন এত শোকতাপ!
মা, আমার খুব ইচ্ছে করে একটা বিদেশী শহরে গিয়ে থাকি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সুন্দর একটা শহর। শীতকালে বরফ পড়বে, বসন্তকালে গাছপালা ফুলে ভরে যাবে, খুব সবুজ হবে মাঠঘাট।
বিদেশে যেতে চাস? তোর বাবা কী বলে জানিস? বলে, আমার ছেলেমেয়েরা কেউ ইউরোপ বা আমেরিকায় গেলে আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হবে।
আমার জন্য বাবার হার্ট অ্যাটাক হবে না মা। আমি কোন গুণে বিদেশ যাবো বলো তো! কে আমাকে নেবে? কেন নেবে?
ও কথা বলিসনি। যদি বিয়ে হয় বিদেশে?
ঝুমকি হেসে ফেলল, তোমার কল্পনারও বলিহারি।
অপর্ণা একটু কাছে ঘেঁষে এল, শোন ঝুমকি, সবসময়ে অত নেগেটিভ চিন্তা করতে নেই। নিজেকে যদি সবসময়ে হ্যাক-ছি করতে থাকিস তাহলে অন্য সবাইও তোকে হ্যাক-ছি করতে শুরু করবে। আমি মনে করি, যে যার নিজের মতোই হয়। তুই কেন অন্যের মতো হতে যাবি। তুই যেমন আছিস তেমনই ভাল।
ভাল তো!
নিশ্চয়ই ভাল। অন্যের মতো হতে যাবি কেন?
তাহলে তুমি কেন সবসময়ে আমাকে বকো আর বলো, তুই অমুকের মতো নোস, তমুকের মতো হলি না, বলো না?
অপর্ণা হেসে বলল, রাগের মাথায় বলি।
রাগের মাথায় সত্যি কথাই তো বলো!
সত্যি হলেও হতে পারে। এই যে আপা বলে মেয়েটা, কী দস্যি বল তো। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি ওর মতো সাহসী হলে বেশ হত। সব মেয়েরই এরকম হওয়া উচিত। আবার ভাবি, দুর! আপার মতো আপা হোক, সবাই কেন হতে যাবে!
আমি ক’দিন যাবৎ কী ভাবছি জানো? এই যে আমি, আমার যা আদর, যা ইস্পর্টান্স তা শুধু তোমার আর বাবার কাছে, বুবকা আর অনুর কাছে। আমার যদি খারাপ কিছু হয় তোমরা গুটিকয় লোক দুঃখ পাবে। যদি আমার ভাল কিছু হয় তাও আনন্দ করবে শুধু তোমরাই। কই, বাইরের জগতে তো আমার কোনও গুরুত্বই নেই। কেউ তো ফিরেও তাকায় না আমার দিকে।
দুর বোকা! কী সব বকছিস? বাইরের জগৎ হল বাইরেরই জগৎ। ভিতর আর বাইরের মধ্যে তফাৎ থাকবে না?
আমার কী মনে হয় জানো মা? শুনলে তুমি হাসবে। আমার মনে হয়, আমার যদি লক্ষ লক্ষ মা-বাবা থাকত, কোটি কোটি ভাই-বোন থাকত তাহলে বেশ হত।
অপর্ণা সত্যিই হেসে ফেলল। বলল, আচ্ছা, তোর মাথায় এমন অদ্ভুত সব কথা আসে কেন রে?
তাহলে আমি কত মানুষের আদরের ঝুমকি হতে পারতাম বলো তো!
আমি তো সাত দিন সাত রাত্তির ধরে বসে ভাবলেও এরকম অদ্ভুত কথা মাথায় আসত না।
আমার মাথায় এরকম অনেক কথা আসে মা। আচ্ছা আমি কি একটু ছিটিয়াল?
তোমরা সবাই একটু ছিটিয়াল। বিশেষ করে তোমার বাবাটি। বাবার কাছ থেকেই পেয়েছো তোমরা।
তুমি যে বাবাকে এত ভালবাসো তা তো বাবা একটু ছিটিয়াল বলেই! নরম্যাল গেরস্থ হলে এত ভালবাসতে পারতে?
অপর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ভালবাসার কথা তুই কী জানিস রে ঝুমকি? ভালবাসার মধ্যেও যে কত কাঁটা, কত জ্বলুনি তা যদি জানতিস!