৩৯. কবির মাস্টারের মৃত্যু

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, কবির মাস্টারের মৃত্যু এ বাড়ির কাউকে তেমন স্পর্শ করল না। রফিক তার নতুন অফিস, নতুন ব্যবসা নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত। ভোরবেলা বেরিয়ে যায় ফেরে। অনেক রাতে। শফিকেরও এই অবস্থা। তার দায়িত্ব দিন-দিন বাড়ছে। সালফিউরিক অ্যাসিড প্লান্টের কাজ এগুচ্ছে দ্রুতগতিতে। শফিকের বেশির ভাগ সময়ই চলে যাচ্ছে সেখানে। যখন বাসায় ফেরে, এমন ক্লান্ত থাকে যে ভাত খেয়ে বিছানায় যেতে-না-যেতেই ঘুমে চোখজড়িয়ে আসে।

দায়িত্ব বেড়েছে নীলুরও। সে একটি প্রমোশন পেয়েছে। অফিসে তার এখন ঘর আলাদা। ঘরের সামনে টুল পেতে এক জন বেয়ারা বসে থাকে। অফিসের নানান সমস্যা নিয়ে তাকে প্রতিদিনই মিটিং করতে হয়। এতসব ঝামেলা তার আগে ছিল না।

হোসেন সাহেবও ব্যস্ত। তিনি একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন, বইটির নাম সহজ হোমিওপ্যাথি যে-সব ডাক্তার গ্রামে চিকিৎসা করেন, বইটি লেখা হচ্ছে তাঁদের উদ্দেশ্য করে। কাজেই লিখতে হচ্ছে খুব সহজ ভাষায়। তিনি জোর দিচ্ছেন কেইস হিস্ট্রিতে। প্রতিটি রোগের জন্যে বেশ কয়েকটা কেইস হিস্ট্রি দিতে হচ্ছে। সে-সব খুঁজে বের করতে সময় নিচ্ছে। বেশ কিছু হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করছেন। তাদের এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই। এতে হোসেন সাহেবের উৎসাহে ভাঁটা পড়ছে না।

মনোয়ারা আগের তুলনায় খানিকটা শান্ত। কাজের একটি মেয়ে রাখা হয়েছে, নাম-নাজমা। তাঁর বেশির ভাগ সময়ই কাটছে নাজমার খুঁত ধরে। এই মেয়েটার কোনো কিছুই তাঁর পছন্দ নয়। নামাটাও অপছন্দ। তাঁর ধারণা, নাজমা হচ্ছে ভদ্রলোকের নাম। কাজের মেয়ের এ-রকম নাম থাকবে কেন? নাজমা মেয়েটির বয়স আঠার-উনিশ। এইটিও তাঁর পছন্দ নয়। এই বয়সের মেয়ে ঘরে রাখা মানে আগুন ঘরে রাখা। কোনো দিন কী-এক ঝামেলা বাধাবে, ছিছি পড়ে যাবে চারদিকে। মনোয়ারার বেশির ভাগ সময় এখন কাটছে কী করে মেয়েটিকে তাড়ানো যায়, এই বুদ্ধির সন্ধ্যানে। তেমন কোনো পথ পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ নাজমা মেয়েটি খুবই কাজের। অতি অল্প সময়েই সে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছে। তবু মনোয়ারা চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। আজ ভোরবেলা তিনি রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, এই, তুই ঘর মুছলি কেন? সকালবেলা পানি দিয়ে ঘর ভাসিয়ে ফেলেছিস।

নাজমা সহজ স্বরে বলল, আপনেই তো কইছিলেন দাদী।

আমি কখন বললাম?

আপনে কইছিলেন সপ্তাহে একদিন ঘর

এ তোর ঘর ধোয়ার নমুনা? পানিতে চারদিক ছয়লাপ।

কই দাদী, পানি তো নাই। শীতের দিনে পানি শুকায় তাড়াতাড়ি।

আসলেই তাই, ইতোমধ্যেই চারদিক শুকনো খটখট করছে। মনোয়ারা কিছুতেই মেয়েটিকে জব্দ করতে পারেন না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন না। তীক্ষ্ণ নজর রাখেন, যদি বেচাল কিছু চোখে পড়ে।

এই, তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

ছাদে গেছিলাম দাদী।

তোকে না বললাম ছাদে যাবি না। ব্যাটাছেলে থাকে।

কাপড় শুকাতে গেছিলাম।

কাপড় শুকাতে সারা দিন লাগে?

গেলাম আর আসলাম দাদী, বেশিক্ষণ তো থাকি নাই।

আবার মুখে-মুখে কথা। তুই কি মনে করিস তোর মতলব আমি বুঝি না? আমি কচি খুকি?

বিশ্বাস করেন। দাদী, আমার কোনো মতলব নাই। তুই কাল সকালেই বিছানা-বালিশ নিয়ে বিদায় হবি। আমার পরিষ্কার কথা।

সত্যি যাইতে বলেন দাদী?

আমি কি তোর সাথে মশকরা করছ? ফাজিল কোথাকার! বড়ো বৌমা আসুক, তোকে আমি আজই বিদায় করব। পাখা উঠেছে!

নীলু এই মেয়েটির বিদায়ের কথা শুনতেই পারে না। নাজমা তাকে অনেকভাবে নিশ্চিন্ত করেছে, নীলু এই সুখ হারাতে রাজি নয়। উল্টো মেয়েটার কাছে তার নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। যে-সংসার তার দেখার কথা, তা দেখছে সংসারের বাইরের এক জন মানুষ। মমতা এবং ভালোবাসা নিয়েই দেখছে। এটা যেন ঠিক নয়, অন্যায়।

আগে সংসারের অনেকখানি দায়িত্ব শারমিন পালন করত। তার দায়িত্বও কমেছে। সে এখন পুরো সময় দিচ্ছে পড়াশোনায়।

ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিসটেন্টশিপের চিঠি এসেছে। ভিসার জন্য আই টুয়েন্টি তারা পাঠিয়েছে, এখনও এসে পৌঁছায় নি। এখন আর সময় নষ্ট করার উপায় নেই। শারমিন রাত-দিন পড়ে। রফিক দেখে, কিছু বলে না। তারা দুজন এমনভাবে জীবন যাপন করে, যেন কেউ কাউকে চেনে না।

এই পরিবারের সব কটি মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল শওকতের একটা চিঠি-কবির মাস্টারের কুলখানি। সবই যেন আসে। সে থাকার ব্যবস্থা গরিবি হালতে করে রেখেছে।

কারোরই যাওয়ার ইচ্ছা নেই। অনিচ্ছার বিষয়টাও তারা চেপে রাখতে চায়। এই ব্যাপারটা নীলুর মন খারাপ করে দিল। এ-রকম কেন হবে? যে-মানুষটি এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্যে গাঢ় ভালবাসা পোষণ করেছেন, তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ করে এরা কেউ সামান্য ত্যাগ স্বীকার কেন করবে না?

এক দিন সে রফিককে কথায়-কথায় জিজ্ঞেস করাল, কবে যাচ্ছ রফিক?

রফিক খুব অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?

মামার কুলখানিতে যাবে না?

মামার কুলখানি তো দূরের কথা, আমার নিজের কুলখানি হলেও যেতে পারব না।

তোমার কি মনে হয় না, যাওয়া উচিত?

না। এসব লোকদেখানো ব্যাপার। মারা গেল ফুরিয়েগেল। আর কী?

তাই বুঝি।

হ্যাঁ, তাই। তা ছাড়া এসব কুলখানি হচ্ছে হিন্দুয়ানি ব্যাপার। হিন্দুরা যেমন মৃত্যুর পর শ্ৰাদ্ধ করে, ওদের দেখাদেখি আমরা কুরি কুলখানি।

ধর্মজ্ঞানও তোমার হয়েছে মনে হয়।

তুমি এমন করে তাকাচ্ছ কেন ভাবী? আমার শতেক ঝামেলা। আমি পারছিনা।

শফিকও যাবে না। সে ছুটির চেষ্টা করেছিল। টলম্যান ছুটি দেয় নি। বলেছে।–অসম্ভব। আগামী দু মাস কোনো ছুটি নেই। সামনের মাস থেকে শুক্রবারেও তোমাকে কাজ করতে হবে।

শফিক মনে হল এতে খুশিই হয়েছে। অন্তত তার না-যাওয়ার একটা কঠিন অজুহাত আছে। ঠিক হল, হোসেন সাহেব সোভােহানকে নিয়ে যাবেন। হোসেন সাহেব শেষ পর্যন্ত যেতে পারলেন না। ঢাকা থেকে গেল শুধু সোভােহান। বাবলুকে সঙ্গে নিয়ে গেল।

কুলখানির দিন রাতে শফিক হঠাৎ বলল, খুব অন্যায় হয়েছে নীলু আমাদের সবার যাওয়া উচিত ছিল। আমার খারাপ লাগছে!

এখন খারাপ লাগলেও তো কিছু করার নেই।

তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। নীলু, ছেলেবেলায় মামার কী পরিমাণ আদর যে আমরা পেয়েছি!

নীলু চুপ করে রইল। সে এ বাড়ির সবার উপর খুব বিরক্ত হয়েছে।

শফিক বলল, আজ অফিসে বসে ভাবছিলাম—কোনো দিন আমাকে আমরা কিছু দিই নি।

তিনি কিছু ফেরত পাবার আশায় নিশ্চয়ই তোমাদের ভালবাসেন নি?

কিন্তু আমাদের একটা দায়িত্ব ছিল।

হ্যাঁ ছিল।

এবার দেখলাম তাঁর স্যুয়েটারটা ছেঁড়া। আমি কি পারতাম না একটা নতুন স্যুয়েটার কিনে মামাকে বলতে-মামা, তোমার জন্যে এনেছি?

নিশ্চয়ই পারতে।

তাহলে কেন এটা বললাম না?

এখন আর এসব চিন্তা করে লাভ নেই। এস, শুয়ে পড়।

তারা বাতি নিভিয়ে দুজনই শুয়ে পড়ল। কিন্তু কেউই ঘুমুতে পারল না। রাত একটার দিকে অদ্ভুত একটা ব্যাপার হল। প্রচণ্ড শব্দে তাদের দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল।

দরজা খুলে দেখা গেল-রফিক। সে থরথর করে কাঁপছে। শফিক বলল, কী হয়েছে রে?

রফিক কাঁপা গলায় বলল, সাংঘাতিক ভয় পেয়েছি। বসার ঘরে হঠাৎ দেখি কবির মামা বসে আছেন। আমাকে দেখে হাসলেন। আমি চিৎকার দিয়ে উঠতেই দেখি কেউ নেই।

দরজা খুলে সবাই বের হয়ে এসেছে। রফিক লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু তার ভয় এখনও কাটে নি। সে মৃদু গলায় বলল, আমি সত্যি দেখেছি, স্পষ্ট দেখলাম। মনের ভুল না।

নীলু বলল, তোমার মনে অপরাধবোধ কাজ করেছিল, তাই এসব দেখছি। যাও, শুয়ে পড়।

ভাবী, আমি সত্যি দেখেছি।

এস, তোমাকে চা বানিয়ে দিচ্ছি। চা খেয়ে ঘুমাও।

মনোয়ারা বললেন, চা না, ওকে এক গ্লাস লবণপানি দাও। এটা খাওয়া দরকার। দেখা না কেমন ঘামিছে।

রফিক ভালোই ভয় পেয়েছে, কারণ তার জ্বর এসে গেল। বেশ ভালো জ্বর-একশ দু পয়েন্ট পীচ। শারমিনকে অনেক রাত পর্যন্ত মাথায় পানি ঢালতে হল। রফিক ক্ষীণস্বরে বলল, কেমন ছেলেমানুষি কাণ্ড করলাম, বল তো। দিনের বেলা সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে।

করলে করবে, তুমি চুপ করে থাক।

আমি কিন্তু সত্যি দেখেছি। বিশ্বাস কর।

তুমি কিছুই দেখ নি। ভাবী যা বলেছে সেটাই সত্যি।

স্পষ্ট দেখলাম শারমিন। কমলা রঙের স্যুয়েটার গায়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

ঠিক আছে, থাক। এখন এসব গল্প করতে হবে না।

তোমার ভয় লাগছে?

না, ভয় লাগছে না। ভয় কেন লাগবে? তাঁকে যদি দেখেই থাক, তাতে ভয়ের কী?

রফিক জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। শারমিন অনেক দিন পর তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে গেল। রফিক বলল, ভয় পেয়ে একটা লাভ হয়েছে। তুমি কাছে এসেছী। কবির মামাকে ধন্যবাদ।

বসার ঘরে বাকি সবাই গোল হয়ে বসে আছে। তাদের কেউই সেই রাতে ঘুমুল না। সবাই যেন কবির মামার উপস্থিতি অনুভব করছে। যেন এক্ষুণি ছায়াময় কোনো জগৎ থেকে তিনি দৃশ্যমান হবেন। এক সময় ভোর হল। গাছে গাছে পাখি ডাকতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *