1 of 3

৩৯. এত কলকব্জা কখনও দেখেনি সুবলভাই

॥ ৩৯ ॥

এত কলকব্জা কখনো দেখেনি সুবলভাই। তার ছেলেবেলায় রেল পাতা হয়নি এদিকটায়। মোটরগাড়ি চলত না। স্টিমার ছিল না। কলের কাপড় বিলেত থেকে তখনো এত দূর এসে পেছোয়নি। দিনকালে এসব হল কী? তাজব কাণ্ড সব। সুবলভাই যতবার খোকাবাবুদের সেডান গাড়িখানাকে লাল ধুলো উড়িয়ে রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখে, তওবার সব কাজ ফেলে ছুটে আসে রাস্তায়। এই প্রায় নব্বই বছর বয়সে তার ভেতরটা আবার ছোট্ট ছেলের মতো আকুপাঁকু করে। তাজ্জব! তাজ্জব!

চৌধূরিবাড়ির এগারোজন মালীর মধ্যে সুবলভাই একজন। ঠিক একজন তাকে বলা যায় না। বলতে গেলে সে হল হেড মালী। মাইনে পনেরো টাকা, খোরপোশ। শুরু করেছিল তিন টাকায়। তার চোখে ছানি পড়েনি। শরীরটা পুরোনো গাছের মতোই শক্ত পোক্ত এবং গাঁটবহুল। চামড়ায়। কিছু কুঞ্চন এবং পুরুভাব এলেও কাঠামোটা সোজা এবং সহজ। সুবলভাই এখনো চমৎকার মাটি কোপাতে পারে, আগাছা নিডোয়। তার হাতে গাছ বাডেও চমৎকার।

শ্যামকান্ত বলতেন, তুই বেটা, গাছের সঙ্গে কথা বলিস। গাছের কথাও তুই বুঝতে পারিস। পারিস না?

সুবলভাইয়ের এটাও তাজ্জব লাগত। কথাটা ঠিকই। সে গাছের কথা বুঝতে পারে। গাছ ও তার কথা বোঝে। কিন্তু সেটা আর কারো জানার কথাই নয়। শ্যামকান্ত সেটা টের পেয়েছিলেন কেমন করে?

আজকাল হর কমপাউনডারের সঙ্গে প্রায়ই তার প্রাণের কথা হয়। হর কমপাউনডার আজকাল জিন-পরী, ভূত-প্রেত নিয়ে কারবার করে। তার ওপর সুবলভাইয়ের অগাধ আস্থা। এই একটা জ্ঞানী লোক। যতদিন কমপাউনডারি করত ততদিন খুব চুপচাপ মানুষ ছিল হর। আজকাল তেমনি একটু বকবক করে। তবে কাউকে শোনানোর জন্য নয়। নিজেই বকে, নিজেই শোনে। সুবলভাইয়ের বিশ্বাস, হরনাথ আসলে একা একা ভূতপ্রেতের সঙ্গেই কথাবার্তা বলে। যেমন সে সারাদিন বলে গাছপালার সঙ্গে।

ওই যে হরনাথ একটা কাঠচাঁপা গাছের ছায়ায় বসে একা বকবক করছে, সুবলভাই জানে হরনাথের এখন কথা চলছে কোনো আত্মার সঙ্গে। কোনো কূট বিষয় নিয়েই আলোচনা চলছে বোধহয়। হরনাথের কপালে তিনটি ভাঁজ।

দোলনচাঁপার গোড়া উসকে দিতে দিতে সুবলভাইয়ের একটু তামাক খেতে ইচ্ছে হল। এবারে গরমটা পড়েছে জব্বর।

কলকে সেজে নিয়ে সে এসে হরনাথের পাশে বসল জুৎ করে।

হর, কেমন বোঝো?

ভাল বুঝছি না।

হলটা কী?

দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। এসটেট লাটে উঠল বলে।

কিছু শুনেছো নাকি?

শুনেছি।

কী শুনছো?

রাজেন মোক্তারের ছেলে কর্তাকে কী বলছে জানো?

না। কী করে জানবো?

বলেছে খরচ কমাতে।

তা কমাক না।

খরচ কমানোর জন্য কী করতে বলেছে জানো?

বলো শুনি।

বলেছে, যে সব অপাগণ্ডকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন সেগুলোকে ঝেঁটিয়ে তাড়ান।

বসে আর খায় কে?

কেন, আমি নতুন মহুৰী পবেশ ঘোষ আমাকে কাল আড়ালে ডেকে বলল, এবার ডেরিডাণ্ডা তোলো হে। নোটিশ পড়ে গেছে।

চোখ কপালে তুলে সুলভই বলে, তোমাকে তাড়াবে?

তা নয়তো কি? এতকাল এসটেটের কাজ করে শেষে বুড়ো বয়সে বিদয় হতে হচ্ছে। তোমাদের দিন ফুরিয়েছে। নিশ্চিন্তে থেকো না।

বলো কী?

শচীন বলেছ, কর্মচারী এত বেশী রাখা চলবে না। মরা-হাজা বাগানের জন্য এগারোজন মালী, এ হল বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিছি।

সুবলভাই খুবই আশ্চর্য হয়ে যায়। তাড়াবে! তার মানেটা কী? সেই কবে শিশু বয়সে এক জ্ঞাতি কাকার হাত ধরে খুব ভয়ে ভয়ে দেউড়ি পেরিয়ে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। বগলে একটি পুঁটুলিতে দু-একটা জামাকাপড়। সেই থেকে টানা এই বাড়ির চৌহদ্দিতে রয়ে গেছে সে। সত্তর আশি বছর ধরে। শ্যামকান্তর চেয়েও সে বয়সে বড় ছিল। এ বাড়ি ছাড়া তার যে আর কোথাও কোনো আশ্রয় ছিল তা আজ আর মনেও পড়ে না।

সুবলভাইয়ের কথাটা বিশ্বাস হল না। জিজ্ঞেস করল, কর্তাবাবা কী বলে?

কর্তাবাবারও তাই মত। খরচ কমাতে হবে। মেয়ের বিয়ে এসে যাচ্ছে। তার খরচ আছে। কিছু মামলা মোকদ্দমা লাগবে, তারও খরচ আছে।

কথাটা মাথায় সেঁধোয় না সুবলভাইয়ের। নব্বুই বছর ধরে তার মগজ কেবল গাছপালা আর মাটির গুণাগুণ নিয়ে ভেবেছে। আজকাল মাথায় একটু কুয়াশার মতো কী যেন জমে থাকে। বুদ্ধি খেলতে চায় না। পুরোনো কথা মনে পড়তে চায় না। কুলে নিজের ছেলের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়।

হুঁকোয় একটা আলগা টান দিয়ে সে বলে, জমিদারের মেয়ের বিয়ে কি ঝি-চাকরের মাইনের জন্য আটকায়? কর্তাবাবুর আর সব মেয়েদের বিয়ে হয়নি? তার জন্য ক’টা কর্মচারীর চাকরি গেছে?

সে তো তুমি বললে। শচীনকে সে কথা কে বোঝাবে! সে হল হা-ঘরে ছোটো নজরের লোক। জমিদারের উঁচু নজর সে পাবে কোথায়? যত সব ছোটোলোকী কারবার।

চিন্তিত সুবলভাই হুঁকোয় ঘনঘন টান মারে। তারপর একটু কেশে নিয়ে বলে, গত মাসেও কাছারি থেকে জনা দুইকে বিদেয় দেওয়া হল। এরকম চললে এ তত ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে।

হরনাথ একটু রাগত স্বরে বলে, তাতে শালা শচীনের কী? সে মাসের শেষে পুরো তনখা টানবে। কর্তাবাবার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে টোপর মাথায় দিয়ে!

সুবলভাই উদাস দৃষ্টিতে পুকুরের ধারে বাঁধা হরিণটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, কর্তাবাবার নজর ছোটো হয়ে যাচ্ছে। শচীনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া মানে মেয়েটাকে একদম জলে ফেলে দেওয়া।

কর্তাবাবা যদি নিজের বুদ্ধিতে চলত তাহলে সে একরকম ছিল। এ হল আমাদের মনু ঠাকরোনের বুদ্ধি। শচীন একটা পাত্র! ছিঃ ছিঃ!

আমি যাবো কোথায় বলো তো!

কেন, যাবে কেন? ব্রহ্মপুত্রের জলে ডুবে মরবে। আমিও তাই করব ঠিক করেছি। তিন কুলে কেউ নেই, দেশ গাঁ কবে হেজেমেজে গেছে। বুড়ো বয়সে তো ভিক্ষে করতে পারব না।

সুবলভাই হাঁ করে দম নেয় একটু! থেলো হুঁকোর আগুন মিইয়ে গেছে।

কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষটা বিশেষ চাপা থাকছে না।

কয়েকদিন আগে শচীন একটা লিস্ট করে হেমকান্তর হাতে দিয়ে গেছে।

সেই লিস্টে জনা পনেরো কর্মচারীর নাম আছে। শচীন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, এই জনা পনেরো লোক এসটেটের লায়াবিলিটি। অকর্মণ্য, বয়স্ক, ফাঁকিবাজ বা রোগগ্রস্ত বলে এদের দিয়ে তেমন কাজ আদায় হচ্ছে না বা হওয়ার আশাও নেই। হেমকান্তর বৈষয়িক অবস্থা যা তাতে এইসব অপোগণ্ডকে পোষা একটা বিরাট ক্ষতি। এই দয়ালু বিলাসিতার ভার বইবার মতো জোর হেমকান্তর এসটেটের নেই।

হেমকান্ত লিস্টটা দেখেছেন। যে পনেরোজনের নাম আছে তাদের মধ্যে কয়েকজন খুব প্রাচীন আমলের লোক। তাঁর বাবা শ্যামকান্ত এদের চাকরি দিয়েছিলেন। এছাড়া বেতনভুক্ত সকলকেই হেমকান্ত বহুদিন ধরে চেনেন জানেন। এদের ঠিক কর্মচারী বলে মনে হত না তাঁর। যেন এক যৌথ পরিবারেরই লোক। কিন্তু শচীন বাজে কথা বলেনি। এত সব কর্মচারীকে পুষে তাঁর আর লাভ নেই!

তবু ছেলে কনককান্তিকে ডেকে এক সন্ধ্যায় লিস্টটা তার হাতে দিয়ে বললেন, দেখ তো, শচীন এই সব কর্মচারীকে বরখাস্ত করতে বলেছে। কাজটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।

কনককান্তি লিস্টটা এক ঝলক দেখেই বাপের হাতে ফেরৎ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, কাজটা ঠিক হবে না কেন? জমিদারী মানে তো খয়রাতি কারবার নয়। শচীন বুদ্ধিমান ছেলে, ঠিক পরামর্শ দিয়েছে।

হেমকান্ত দুর্বল গলায় বলেন, সেটা মানছি। কিন্তু এদের গতিটা কী হবে ভেবে দেখেছো?

সেটা কি আমাদের ভাববার কথা?

বাবার আমল থেকে আছে কয়েকজন। এদের অনেকেই এখানে সপরিবারে বাস করে। যাওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই।

সে দায় তো আমাদের নয়।

কয়েকজনের যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। শুনছি এখন সব এসটেট থেকেই কর্মচারী ছাঁটাই হচ্ছে। নতুন কাজ কেউ পাচ্ছে না। এরা সব যে না খেতে পেয়ে মরবে।

কনককান্তি বিনীত গলায় বলল, জমিদারীর আয় চিরকাল এইসব পোষার জন্য বারো আনা উড়ে যায়। আপনাকে এখন তো আয়ের দিকটা দেখতেই হবে। গত দুদিন আমিও শচীনের সঙ্গে বসে কাগজপত্র দেখেছি। অবস্থা ভাল ঠেকছে না। সে গেল একটা দিক। এদিকে কর্মচারীরা তো প্রায় বসে বসে মাইনে নিচ্ছে। এসটেট দেখার লোক নেই, আদায় উসুল নেই, ওদের কাজটাই বা কী?

এ কথায় হেমকান্ত একটু লজ্জা পেলেন। প্রকারান্তরে এ তাঁর অপারগতার প্রতি ইঙ্গিত। তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, সে অবশ্য ঠিক কথা। তবু প্রথা বলেও একটা জিনিস আছে।

প্রথা আঁকড়ে থাকতে গেলে যে নীলামে চড়াতে হবে সব কিছু। দিনকাল বদলে যাচ্ছে, পুরোনো প্রথা আঁকড়ে থাকলে চলবে কেন? আমি তো জমিদার বাড়ির ছেলে। ব্রাহ্মণ সন্তান, তবু আমি তো ব্যবসা করতে নেমেছি।

হেমকান্তর মনটা সায় দিচ্ছে না। তবে তিনি কনকের সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না। ওরা সব সময়ে ঠিক কথাই বলে। ওদের কথায় যুক্তির কোনো অভাব নেই। তিনি বললেন, আচ্ছা। ঠিক আছে।

কনককান্তি তবু চলে গেল না। একটু অপেক্ষা করে হঠাৎ বলল, একটা কথা বাবা।

বলো।

শচীনের লিস্টে আমাদের পুরুতমশাইয়ের নাম নেই। কিন্তু আমি মনে করি ওঁর নামটা সবার আগে লেখা উচিত ছিল।

পুরুত মশাই! হেমকান্ত শশব্যস্তে বললেন, তার আবার কী হল?

কনককান্তি মৃদু হেসে বলল, সকাল সন্ধেয় দুবার ঘণ্টা নাড়ার জন্য একটা লোককে তার বিশাল পরিবারশুদ্ধ দিনের পর দিন প্রতিপালনের কোনো অর্থই হয় না।

হেমকান্ত কথা বললেন না। চেয়ে রইলেন।

কনককান্তি বলল, ওদের খানিকটা জমি দেওয়া আছে বয়রায়। চাষবাসও করান জানি। এখানকার চাকরি গেলে একেবারে না খেয়ে মরবেন না। আমার পরামর্শ হল, নগদ কিছু টাকা দিয়ে ওঁদেরও উচ্ছেদ করে দিন। মাস মাইনের পুরুত ঠিক করুন। তাতে ঝামেলা আর খরচ দুই-ই কমে যাবে।

হেমকান্ত কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রস্তাবটা এমন কিছু সাংঘাতিক নয়। কিন্তু মনু — মনু কোথায় যাবে?

কনককান্তি যেন হেমকান্তর মনের কথা শুনতে পেল। একটু ইতস্তত করে বলল, মনুপিসির কথা অবশ্য আমাদের আলাদা করে ভাবতে হবে। উনি আমাদের যথেষ্ট সেবা করেছেন। ওঁর জন্য বরং পাঁচ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিন।

হেমকান্ত ভারী অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। নতুন একটা যুগের পাগলা হাওয়া এসে তাঁর ঘরের সব কিছু ওলট-পালট করে দিতে চাইছে। সম্ভবত এ থেকে তাঁর নিস্তার নেই। অলস অকর্মার যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন তার জন্য কিছু গুনোগার তো তাঁর দেওয়ারই কথা। সবচেয়ে বড় গুনোগার কি মনুকে হারানো?

কনককান্তি মৃদুস্বরে বলল, এসটেটের অবস্থার জন্য আপনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন বলে শুনেছি। কিন্তু দোষ আপনার নয়। ওয়ারলড ওয়ারের পর যে ডিপ্রেসনটা এসেছে সেটাকে কাটানো খুব মুশকিল। আদায় উসুল ঠিকমতো হলে ততটা চিন্তার কিছু ছিল না। কিন্তু আপনি অনেক খাজনা মাপ করে দিয়েছেন। আমি বলি কি, শচীনকে শুধু উকিল হিসেবে নয়, ম্যানেজার হিসেবেই রাখুন। শক্ত লোক। আদায় উসুল ঠিকমতো করতে পারবে। ওকালতিও করুক।

আমিও তো তাই চাই। সবচেয়ে ভাল হত তোমাদের দুই ভাইয়ের কেউ এসে আমার কাছে থাকলে।

সেটা তো সম্ভব নয়।

দেখি, শচীনের সঙ্গে কথা বলব। এ লোকগুলোকে তাহলে বিদেয় দেওয়াই সাব্যস্ত হল?

আমি তাই বলি। তবে আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন। কনক চলে যাওয়ার পর হেমকান্ত খানিকটা অস্থির সময় কাটালেন। রাতে ভাল ঘুম হল না।

বাহুল্য কর্মচারীদের বিদায় দেওয়াই যদি সিদ্ধান্ত হয় তবে মনুর বাবাকেও রাখা চলে না। পাকে-প্রকারে একথাটাই তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে কনক। হেমকান্ত যদি শক্ত মানুষ হতেন তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ছেলের পরামর্শ চাইতেন না। কিংবা ছেলের পরামর্শ যাই হোক সেটাকে গ্রাহ্য করতেন না। কিন্তু সেই দৃঢ়তা হেমকান্ত নিজের ভিতর খুঁজে পান না।

পরদিন বিকেলে হেমকান্ত নিঃশব্দে নিজের একটেরে কুঞ্জবনটিতে এসে বসলেন। মনুর সঙ্গে একটু পরামর্শ করা দরকার। কিন্তু কনককান্তি আসায় তিনি আড়ালেও মনুর সঙ্গে দেখা করার সাহস পাচ্ছেন না।

ভাঙা গাড়ির পাদানিতে বসে হেমকান্ত শচীনের লিস্টটা বের করে আর একবার দেখলেন। এক একটা নাম, এক একটা মানুষ। এক একটা মানুষকে ঘিরে কত স্মৃতি। এই যে নব্বই বছর বয়সের সুবলভাই। এই বাগানের কাজ করতে করতে হাড়ে ঘুণ ধরিয়ে ফেলল। ওর দুটো ছেলেকেও ঢুকিয়েছিল কাজে। পশ্চিমে একটা কেয়াঝোপ ছিল। তার নীচে আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে সুবলের এক ছেলেকে সাপে কামড়ায়। বাঁচেনি। কতকাল আগেকার কথা।

কিংবা হর কমপাউনডার। মেয়ের শোকে মাথাটা কেমন হয়ে গেল। আর কাজকর্ম করতে রিল না। কিন্তু নীরবে এক বদ্ধ খুপরির মধ্যে বসে বছরের পর বছর ওষুধ তৈরি করে গেছে। কখনো নালিশ জানায়নি। আর্জি জানায়নি।

এদের তো কনক ঠিক চিনবে না। শচীন তো আরো নয়। এদের কাছে এসটেট মানেই আয়পয়। কিন্তু হেমকান্ত ঠিক সে-রকম শিক্ষা লাভ করেননি। তাঁর কাছে একটা এসটেট মানেই অনেকগুলি মানুষের ভাগ্য। অনেকগুলি মানুষের হৃদ্যতা, আত্মীয়তা। এক মস্ত যৌথ পরিবার। তিনি মহালে যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। কিন্তু জানেন, আজও কোনো মহালে গিয়ে হাজির হলে মানুষ কত খুশি হয়, ছুটে আসে। বউবাচ্চা সমেত এসে প্রণাম করে, দক্ষিণা দেয়। ইদানীং তারা পেরে উঠছে না, কী করবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিস্টটা পকেটে ঢুকিয়ে চোখ তুলতেই চমকে উঠলেন হেমকান্ত। পা থেকে মাথা অবধি শিউরে উঠল তাঁর।

অদূরে এক মহানিমের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাঁকে তীক্ষ্ন চোখে লক্ষ করছে মনু।

হেমকান্ত মৃদু হেসে বললেন, এসো।

রঙ্গময়ী এগিয়ে এসে বলে, তুমি এখানে যে হঠাৎ!

কয়েকদিন আসিনি। বাড়িতে ওরা সব এসেছে।

আজ কী মনে করে?

এমনি। মনটা ভাল নেই। এসো মনু, দুটো কথা বলি।

রঙ্গময়ী মাথা নেড়ে বলে, আজ এখানে এসে ভাল কাজ করোনি।

কেন বলো তো!

এখানে আজ একটা নাটক হওয়ার কথা আছে।

নাটক? হেমকান্ত আকাশ থেকে পড়েন, কিসের নাটক?

নাটকটি ব্যবস্থা করেছে তোমার বড় বউমা চপলা।

তাই নাকি? কী ব্যাপারটা খুলে বলো তো?

শুনেছি তোমার মেয়ের সঙ্গে নাকি আজ শচীনের মুখোমুখি হবে।

তার মানে?

তুমি সেকেলে মানুষ, তায় ঘরকুনো। সব বুঝবে না।

আমাকে তুমি নির্বোধ বলে ভাবলেও আমি ততটা নই। কী ব্যাপার বলো তো?

বিশাখা শচীনকে বিয়ে করতে চায় না, সে তো জানোই।

জানি বইকি। মেয়েটা বোকা।

চপলা ঠিক করেছে দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। দুজনেই কথাটথা কইবে। যদি তাতে মেয়ের মন গলে।

হেমকান্ত একটু রাগের স্বরে বলেন, এসবের কী দরকার ছিল?

শহুরে কায়দা। আমি তো খারাপ কিছু দেখি না।

আমি দেখি। এ পরিবারে এখনো পাত্ররা পাত্রী দেখে না। আর এ তো আরো নির্লজ্জ ঘটনা।

রঙ্গময়ী মৃদু স্বরে বলে, তোমার সব তাতে মাথা ঘামানোর কী দরকার? শচীনকে বিয়ে করার ব্যাপারে মেয়েকে কি রাজি করাতে পেরেছো?

ধৈর্য ধরলে রাজি হত।

সেটা অনিশ্চিত ব্যাপার। তুমি পারোনি।

চপলা পারবে?

পারবে কিনা জানি না। কিন্তু এটাও একটা চেষ্টা। তোমার তো চেষ্টাই নেই।

তবু ঘটনাটা আমার ভাল লাগছে না মনু।

তোমার মুখে কথাটা মানায় না।

কেন মানায় না মনু?

আমার সঙ্গে তুমি কথা বলো কোন লজ্জায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *