এক একটা গান হঠাৎ এমনভাবে মাথায় গেঁথে যায় যে কিছুতেই আর যেতে চায় না। গানের কলিগুলোর অর্থটাও সবসময় প্রাসঙ্গিক থাকে না, সুরের বিশেষত্বও এমন কিছু নয়, তবু চলতে ফিরতে যখন তখন সেই গান গুঞ্জরণ তোলে।
লারেন্স লোয়েল লেকচার হল থেকে বেরিয়ে অতীন হাঁটতে লাগলো অন্যমনস্কভাবে। শীতও নেই, গরমও নেই, চমৎকার বসন্তকালের মতন হাওয়া। জিন্স আর ইজিপশিয়ান কটনের একটা শার্ট পরে আছে অতীন, এই শার্টটা কয়েকদিন আগে শর্মিলা তাকে উপহার দিয়েছে, ভারি মোলায়েম। চতুর্দিকে অজস্র ফুল, অনেক গাছের পাতায় সোনালি রং ধরেছে। হাঁটতে হাঁটতে অতীন আপন মনে গুন গুন করে গাইছে, হেথায় তোমায় মানাইছে না গো, ইক্কেবারে মানাইছে না গো! তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা, রাঙা মাটির দেশে যা…। এরই মধ্যে পথ-চলতি কেউ কেউ অতীনের দিকে চেয়ে বলছে, হাই! অতীনও যন্ত্রের মতন উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, হাই!
সায়েন্স সেন্টারের পাশ দিয়ে অতীন এগোলো হাভার্ড ইয়ার্ডের দিকে। অ্যাপলটন চ্যাপেলের পাশে একটা ছোট্ট দোকানে নানারকম আইসক্রিম পাওয়া যায়। অতীন বেছে বেছে দু’প্যাকেট আইসক্রিম কিনলো, কাগজের প্যাকেটে আইসক্রিম এমনই ফ্রোজেন অবস্থায় থাকে যে নিয়ে যেতে যেতে গলে যাবার সম্ভাবনা নেই। দোকানের কাউন্টারে পয়সা দিতে দিতেও অতীন মনে মনে গাইছে, হেথায় তোমায় মানাইছে না গো, ইক্কেবারে মানাইছে না গো.। এই গানটার বাকি কথাগুলো অতীন জানে না, তার জানার দরকারও নেই।
তারপর সে বাসে চেপে পৌঁছে গেল শর্মিলার বাড়িতে।
সদর দরজা বন্ধ। এইসব বাড়িতে বাইরের লোক হুট করে ভেতরে ঢুকতে পারে না। শর্মিলার নাম লেখা লেটার বক্সের ওপরের বোতামটা টিপতেই শর্মিলার গলা শোনা গেল, হু
অতীন বললো, তোমার যম! দা বস্টন স্ট্র্যাংগলার!
তিনতলা থেকেই শর্মিলা একটা বোতাম টিপে খুলে দিল সদর দরজা। অতীন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। এখন বিকেল সাড়ে ছটা, সন্ধে হবে আটটার পর। এই সময়টায় শর্মিলার মামাতো বোন সুমি বাড়িতে থাকে না। যদিও সুমি এখন অনেকটা মেনে নিয়েছে অতীনকে, তবু অতীন ওকে এড়িয়ে চলে।
এ বাড়ির লিফটটা আদ্যিকালের, মাঝে মাঝে হঠাৎ ঝনঝন শব্দ করে কেপে ওঠে। বয়েস হয়েছে, বিশ্রাম চাইছে। কিন্তু একেবারে অকেজো না হলে লিফটটাকে বদলানো হবে না, এইসব অ্যান্টিক জিনিসের আলাদা মযাদা আছে। লিফটের দরজাটা বন্ধ করতেই একটা সুন্দর পারফিউমের গন্ধ পাওয়া গেল। এ বাড়িটাতে মেয়েরাই বেশি থাকে, তাই প্রায় সারা বাড়িতেই মেয়েলি গন্ধ। বন্ধ লিফটের মধ্যে অতীন বেশ জোরে জোরে গেয়ে উঠলো, হেথায় তোমায় মানাইছে না গো…।
শর্মিলার ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করা। অতীন ভেতরে এসে শর্মিলাকে দেখতে পেল। শব্দ পেয়ে পাশের বাথরুম থেকে শর্মিলা বললো, একটু বসো, প্লীজ, আমি টপ করে স্নানটা সেরে নিই।
এক ঘরের অ্যাপার্টমেন্ট, সঙ্গে ছোট রান্নাঘর আর বাথরুম। অতীনের চেয়ে শর্মিলাদের ভাড়া বেশি দিতে হয়, কারণ ওরা দু’জন থাকে। অতীন রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে আইসক্রিমের বাক্স দুটো ঢুকিয়ে রাখলো। একটা বড় কোকাকোলার বোতল থেকে খানিকটা চুমুক দিয়ে রেখে দিল আবার। সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমের দরজার কাছে এসে বললো, তুমি তাড়াতাড়ি করো, তারপর আমিও স্নান করবো।
পাশাপাশি দুটো খাট, অতীন কক্ষনো সুমির খাটে বসে না। এই খাটদুটো দেখলে অতীনের কলকাতার বাড়ির ফুলদির ঘরটা মনে পড়ে। ফুলদি আর মুন্নি এইরকম পাশাপাশি খাটে শুত। অতীনের নিজের ঘরটায় এখন কে থাকে, টুনটুনি?
দেয়ালে ঝোলানো টেলিফোনটা বেজে উঠলো। অতীন ধরতে পারবে না। সে যে এখন শর্মিলার ঘরে এসে বসে আছে, তা কারুকে জানানো চলে না। শর্মিলা কী অবস্থায় আছে, এখন কি বেরুতে পারবে? এখানে অনেকে বাথরুমেও একটা টেলিফোন রাখে, শর্মিলার অবশ্য নেই। টিভি-টা খোলা, শব্দ নেই, মহাকাশের দৃশ্য নিয়ে বোধহয় কোনো সিনেমা চলছে।
একটা হাউস-কোট গায়ে চাপিয়ে ভিজে চুল নিয়ে বেরিয়ে এলো শর্মিলা। রিসিভারটা হুক থেকে নামিয়ে দু’একটা কথা শুনেই সে তে হাত চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বললো, মার্থা! ওকে এখানে আসতে বলবো!
অতীন মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। মার্থার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে শর্মিলার। মাঝে মাঝে মাথাকে এ ঘরে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হয়, মার্থার বাড়িতেও ওরা দু’জনে একসঙ্গে যায়। মার্থার কোনো ছেলে বন্ধু নেই বলে শর্মিলার খুব দুশ্চিন্তা, সে প্রায়ই তার চেনাশুনো ছেলেদের সঙ্গে মার্থার আলাপ করিয়ে দেয়।
ফোনটা রেখে শর্মিলা বললো, ওকে শনিবার আসতে বলেছি। তুমি স্নান করবে বললে, যাও, চলে যাও। আমার হয়ে গেছে। একটা গোলাপি রঙের তোয়ালে আছে, সেটা ব্যবহার করো।
শার্টটা খুলে ফেলে অতীন বাথরুমের দরজার কাছে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। একজন সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছে, আর একজন স্নান করতে যাচ্ছে, এই অবস্থায় কি চুমু খাওয়া চলে?
ঠোঁটে হাসি টিপে শর্মিলা মাথা নাড়িয়ে বললো, না, মোটেই চলে না!
অতীন প্রায় দৌড়ে এসে শর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি কিছু জানো না। যারা হিসেব করে চুমু খায়, তারা অতি বদ লোক হয়।
এরপর অতীনের স্নান করতে যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছিল, শর্মিলা জোর করে তাকে ঠেলে পাঠালো। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে অতীন চিৎকার করে গাইতে লাগলো, হেথায় তোমায় মানাইছে না গো, ইক্কেবারে মানাইছে না গো!
শর্মিলা দ্রুত চুল আঁচড়ে নিল, পোশাক বদলালো। এত ছোট অ্যাপার্টমেন্টের এই একটা প্রধান অসুবিধে, ঘরে অন্য কেউ থাকলে জামা-কাপড় পাল্টানো যায় না। শর্মিলা অন্য কোনো মেয়ের সামনেও এসব পারে না, এমনকি অতীন থাকলেও সে লজ্জা পায়। অতীনের বাড়িতে জলের একটু অসুবিধে আছে, তাই সে এখানে এলেই স্নান করে নেয়।
বাথরুম থেকে প্যান্টের বেল্ট আটকাতে আটকাতে বেরিয়ে এসে অতীন দেখলো শর্মিলা অতি মনোযোগ দিয়ে টিভির দিকে চেয়ে আছে। তার দু’চোখে বিস্ময়।
অতীন বললো, কী ব্যাপার, এখন তুমি সিনেমা দেখছো? শর্মিলা বললো, সিনেমা নয়। এসো, দেখবে এসো, মানুষ চাঁদে গাড়ি চালাচ্ছে। লাইভ দেখাচ্ছে।
অতীন টিভির সাউন্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে শর্মিলার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, স্কট আর আরউইন, সত্যি একটা গাড়ি চালাচ্ছে! আমি আগে দেখে ভেবেছিলাম সায়েন্স ফিকশান।
–কী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে! পাশে ঐ যে পাহাড় মতন, ওর নাম মাউন্ট হেডলি! চাঁদের পাহাড়!
–এটা অ্যাপিনাইন এরিয়া। একটা জিনিস লক্ষ করছো, গাড়িটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। না, চাঁদের গ্র্যাভিটি…
শর্মিলা পাশ ফিরে তীব্র আবেগময় মুখে বললো, বাবলু, দ্যাখো, আমার সারা শরীরে রোমাঞ্চ হচ্ছে, দ্যাখো, দ্যাখো! মানুষের এই সাংঘাতিক কীর্তি, আজ সারা পৃথিবীতে একটা উৎসব হওয়া উচিত ছিল না? মানুষ, আমাদেরই মতন মানুষ, চাঁদে নেমে এরকম একটা কাণ্ড করছে, এত বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট, জানো, খানিকটা আগে টিভি-তে দেখাচ্ছিল ফুটবল খেলার মাঠে কী ভিড়! আজ মুভি হাউজ, থিয়েটার, কনসার্ট হলেও লোক যাবে, কত লোক এখন বসে বসে খাচ্ছে, এত বড় একটা ব্যাপার গ্রাহ্যই করছে না।
হঠাৎ উঠে গিয়ে শর্মিলা জানলার পর্দা সরিয়ে আকাশের চাঁদ দেখার চেষ্টা করলো।
অতীন অবশ্য শর্মিলার মতন অতটা উত্তেজিত বোধ করছে না। এর আগেই নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা দিয়েছে, এরপর আমেরিকানরা চাঁদে গাড়ি পাঠাবে, বাড়ি বানাবে এগুলো যেন স্বতঃসিদ্ধ। বিজ্ঞানের অগ্রগতির এক একটা স্তর। অর্থাৎ সে এই চন্দ্রাভিযানের রোমান্টিক দিকটা না ভেবে বাস্তব দিকটাই দেখছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য চাঁদে শুধু রকেট পাঠাবার বদলে প্রচুর ঝুঁকি ও অর্থব্যয় করে মানুষ পাঠানো, সোভিয়েত ইউনিয়ানের সঙ্গে টক্কর দিয়ে খানিকটা আমেরিকান হুজুগেপনাও মনে হয় তার।
শর্মিলার কাঁধে হাত দিয়ে সেও জানলার পাশে দাঁড়ালো। এখান থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। বাইরে এখনও দিনের আলো।
অতীন বললো, চলো আমরা একটু পরে বেরিয়ে একটা পার্কে গিয়ে বসি। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবো।
শর্মিলা বললো, ওরা চাঁদে ঘুরছে, আর সঙ্গে সঙ্গে টিভি-তে সেই ছবি চলে আসছে, এটাও একটা অদ্ভুত কাণ্ড না?
অতীন বললো, নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা দিয়েই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিল তোমার মনে আছে? তখন আরও বেশি অবাক হয়েছিলাম।
টিভি-তে চাঁদের দৃশ্য মুছে গিয়ে শুরু হলো বিজ্ঞাপন। আমেরিকানরা চাঁদে মানুষ পাঠাক বা যাই-ই করুক, সাবান ও তেল বিক্রি করা তার চেয়ে কম জরুরি নয়।
শর্মিলা বললো, চলো, আমরা চট করে খানিকটা ডিনার খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আজ ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
কিছু কিছু খাবার রান্না করাই ছিল, নুডুলসের সঙ্গে কর্ন বিফ, মাইওনেজ স্যালাড। সেগুলো প্লেটে সাজাতে সাজাতে শর্মিলা জিজ্ঞেস করলো, এই অ্যামন্ড দেওয়া আইসক্রিম তুমি এনেছো? তোমার ঠিক মনে আছে তো! এটা আমার খুব ফেভারিট!
অতীন বললো, আমায় আইসক্রিম দিও না, তোমার আর সুমির জন্য এনেছি।
–তুমি খাবে না কেন? আরো অনেক আছে, সুমির জন্যও থাকবে!
–আমি আইসক্রিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ভেবে দেখলাম, আইসক্রিম খাওয়াটা মেয়েদেরই মানায়।
–মানায় আবার কী! যার যেটা ভালো লাগে! একটু খাও, প্লীজ!
–আমাকে আলাদা করে দিও না, সত্যি আমার আর আইসক্রিম ভালো লাগে না, তোমার থেকে একটুখানি টেস্ট করবো।
–বাবলু, তুমি কিন্তু রোগা হয়ে যাচ্ছো, তোমার ডায়েটিং করার দরকার নেই! খাবার টেবিলে বসার বদলে দু’জনে প্লেট হাতে ফিরে এলো বিছানায়। শর্মিলা টিভি-তে আরও চন্দ্র-দৃশ্য দেখতে চায়। পাশাপাশি গা ঠেকিয়ে বসলো দু’জনে। শর্মিলার সারা মুখে একটা ভালোলাগার আবেশ ছড়ানো।
একটু পরে অতীন বললো, পরশু আমাকে একবার নিউ ইয়র্কে যেতে হবে।
শর্মিলা বললো, কেন? সিদ্ধার্থ বুঝি কোনো পার্টি দিচ্ছে?
–না, আমার বাবার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে আসছে, তাকে রিসিভ করতে হবে এয়ারপোর্টে।
–বেড়াতে আসছে, না পড়তে-টড়তে?
–পড়তে। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে।
–ভার্জিনিয়া মেরিল্যান্ড? নিউ ইয়র্ক থেকে সোজা সেখানে চলে যাবে? যাবার পথে যদি বস্টন-কেমব্রিজ ঘুরে যেতে চায়, তা হলে আমাদের এখানে থাকতে পারে। দুটো খাট জোড়া দিলে তিনজন শোওয়ার কোনো অসুবিধে হয় না।
–ঠিক আছে, তাকে বলে দেখবো!
–সোমবার ছুটি। লং উইক এন্ড। তোমার সঙ্গে আমিও তো নিউ ইয়র্ক ঘুরে আসতে পারি?
শর্মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে, সামান্য একটু দ্বিধা করে অতীন বললো, তুমি যাবে? হ্যাঁ, চলো!
অতীনের কণ্ঠস্বরের সেই একটুখানি কাঁপুনিও শর্মিলা ঠিক বুঝে ফেললো। সে সরলভাবে হাসতে হাসতে বললো, কী ব্যাপার বলো তো, তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও না? সিদ্ধার্থর সঙ্গে অন্য কিছু প্ল্যান করেছো বুঝি?
অতীন বললো, না, সেসব কিছু নেই। তুমি চলো, তুমি গেলে ভালোই হবে!
–মেয়েটির নাম কী? কী পড়তে আসছে?
–অলি চৌধুরী। ইংলিশের ছাত্রী ছিল, এখানে অন্য কিছু পড়বে কি না জানি না?
–বাঃ বেশ সুন্দর নাম তো। অলি! আগে এরকম নাম শুনিনি। ভালোই হবে, মেরিল্যান্ড তো বেশি দূর নয়, আমাদের এখানে মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করতে পারবে!
একটু পরে বাইরে বেরিয়ে একটা পার্কের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শর্মিলার হঠাৎ মনে পড়লো, এই সপ্তাহান্তের ছুটিতে ওয়াশিংটন ডি সি থেকে তার মামা আসছেন এখানে। তিনি যদিও হাভার্ডের একটা গেস্ট হাউসে উঠবেন, তবু এই সময় শর্মিলার বাইরে যাওয়াটা ভালো। দেখায় না।
অতীনই শর্মিলাকে জোর করতে লাগলো নিউ ইয়র্কে যাবার জন্য। আন্তরিকভাবে। তার মনে হচ্ছে, শর্মিলা তার সঙ্গে থাকলে ভালোই হবে, প্রথমেই সে একা অলির মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না।
কিন্তু শর্মিলা তার মামাকে বেশ ভয় পায়। তিনি মস্ত বড় পণ্ডিত এবং খুবই রাসভারি মানুষ। দেশে থাকতে তিনি কট্টর কংগ্রেসী ছিলেন।
পরিষ্কার আকাশে এখন চাঁদ দেখা যাচ্ছে। পূর্ণিমার কাছাকাছি গোল চাঁদ। সে দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে শর্মিলা অতীনের একটা হাত নিজের গালে চুঁইয়ে বললো, আজ আমার কী দারুণ ভালো লাগছে, বাবলু!
তারপর অনেকক্ষণ দু’জনে কোনো কথা বললো না।
শুক্রবার রাত দশটার বাস ধরলো অতীন। সাত ঘণ্টার জার্নি, ভোরের আগেই পৌঁছে যাবে। যাবার আগেও সে শর্মিলাকে ফোন করে আর একবার অনুরোধ জানিয়েছিল তার সঙ্গে নিউ ইয়র্ক যাবার জন্য, কিন্তু শর্মিলার উপায় নেই।
সিগারেট টানার সুবিধের জন্য গ্রে হাউন্ড বাসের একেবারে পেছন দিকে জানলার ধারে বসেছে বাবলু। ছাড়ার একটু পরেই ভেতরের আলো নিবিয়ে দেওয়া হলো। নাইট জার্নিতে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে নেয়। মসৃণ রাস্তা, একটুও ঝাঁকুনি নেই। এ দেশের লোকেরা কেউ চলন্ত বাসে চেঁচিয়ে গল্প করে না। কথাই বলে না প্রায়। শুধু মাঝখানের দু’পাশের দুটি সীটে দু’জোড়া। প্রেমিক-প্রেমিকা ফিস ফিস করে কথা বলছে, খিল খিল করে হাসছে আর চুমু খাচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সাত খুন মাপ, ওরা আরও জোরে শব্দ করলেও বিরক্তি প্রকাশ করবে না কেউ।
বাবলুর পাশেই বসে আছে দুটি কালো যুবক। তাদের সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ শুকেই বোঝা যাচ্ছে, ওতে গাঁজা মেশানো আছে। ম্যারুয়ানা অর্থাৎ গাঁজা এখানে সাংঘাতিক বেআইনী, পুলিস একবার হাতে নাতে ধরতে পারলে পাঁচ-সাত বছর জেল দিয়ে দেবে, তবু এরা বেপরোয়া।
যুবক দুটি অতীনের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করছিল বাস চলতে আরম্ভ করার আগে। থেকেই। অতীন উৎসাহ দেখায়নি, হু-হাঁ করে এড়িয়ে গেছে। অতীন জানে, এ দেশের কালো মানুষ, আগে যাদের বলা হত নিগ্রো, তাদের অভিযোগ আছে যে ভারতীয়রা তাদের সঙ্গে বিশেষ মেশে না, সাদাদের তোষামোদ করতেই ভালোবাসে। অভিযোগটা সঠিক হলেও এখন দু’জন গাঁজাখোর কালো যুবকের সঙ্গে যে অতীনকে বন্ধুত্ব করতেই হবে তার কোনো মানে নেই। তার তো এই সময় কারুর সঙ্গে কথা না বলারও ইচ্ছে হতে পারে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে অতীন বাইরে তাকিয়ে আছে। ধোঁয়া রঙের কাঁচ, বাসের ভেতরে আলো জ্বললে বাইরের কিছু দেখা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া প্রান্তর। মাইলের পর মাইল একটাও মানুষ কিংবা বাড়ি-ঘর চোখে পড়ে না। সাধারণ কথায়। লোকে বলে, যন্ত্রসভ্যতার দেশ আমেরিকা। কিন্তু রাত্তিরবেলা এই নিঝুম প্রান্তরগুলি দেখলে মনে হয় যেন আদিম পৃথিবী। কোথাও কোথাও গাছপালাও প্রচুর।
রাস্তাটা কোথাও বাঁক নিলে দেখা যায় সামনে অনেক দূর পর্যন্ত লাল আলোর মিছিল। সামনের গাড়িগুলোর ব্যাক লাইট, আলোর মিছিলের মতনই মনে হয়। দিনের বেলার চেয়েও রাত্রে এইসব হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি যেন বেশি চলে। এ রাস্তায় পাশাপাশি পাঁচ ছ’খানা গাড়ি অনায়াসে এক দিকে যেতে পারে। এ দেশের রাস্তাগুলো নিখুঁত শিল্পের মতন।
অতীনের চোখে ঘুমের নাম-গন্ধ নেই। বাইরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক এক সময় তার মনে হচ্ছে, বাসের গতির সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে একজন কেউ যেন ছুটছে রাস্তা দিয়ে। অসম্ভব ব্যাপার! গ্রে হাউন্ড বাস ঠিক ঘণ্টায় পঞ্চান্ন মাইল গতিতে যায়। চোখের ভুল তো অবশ্যই, অতীন সজাগ হলে আর মূর্তিটাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে আসছে। বাসটার কোনো একটা অংশের ছায়া রাস্তায় পড়লে এরকম দেখাতে পারে। ছায়া নয়, মানুষেরই মতন। আরও একটু পরে অতীন চিনতে পারলো, সেই মানুষটা আসলে সে নিজে। ছাই রঙের প্যান্টের ওপর সাদা ফুল শার্ট পরা, হাত দুটো গোটানো। জলপাইগুড়িতে মাঠের মধ্যে সেই মূর্তিমান উপদ্রবটিকে গুলি করার পর কি অতীন এত জোরে ছুটেছিল?
সে-দিন ছোটার সময় অতীন মনে মনে শুধু একটাই কথা বলছিল বার বার, কেউ তাকে ধরতে পারবে না! কেউ তাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু পুলিস তাকে ঠিক ধরলো জামসেদপুরে এসে!
কৌশিক তাকে জামসেদপুরে নিয়ে যাবার বদলে যদি হাজারিরাগ কিংবা ডাল্টনগঞ্জে নিয়ে যেত, তা হলে হয়তো সে ধরা পড়তো না। মানিকদা, তপন যেমন ধরা পড়েনি। তা হলে অতীনের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। সে বিপ্লবের কাজে এগিয়ে যেতে পারতো অনেকখানি, এই ধনতন্ত্রের দেশে তাকে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হতো না। জামসেদপুরে গেলে শর্মিলার সঙ্গেও দেখা হতো না তার।
না, না, শর্মিলার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক হওয়ার জন্য সে একটুও অনুতপ্ত নয়! শর্মিলার মতন এমন সরল অথচ সাহসী এবং খাঁটি মেয়ের বন্ধুত্ব পাওয়া দুর্লভ ভাগ্যের ব্যাপার। ঠিক সময়ে শর্মিলার কাছে আশ্রয় না পেলে তার হয়তো মাথার গোলমাল হয়ে যেতে পারতো! এরকম কারুর কারুর হয়েছে। নিউ জার্সিতে একটি ছেলেকে দেখেছিল অতীন, পাগলাটে পাগলাটে ভাব, সে নাকি যাদবপুরের গোপাল সেনকে খুন করার সময় সেই দলে ছিল! নিজেকে সে আর জাস্টিফাই করতে পারছে না, তাই যুক্তিবোধটাই বিসর্জন দিচ্ছে। শর্মিলা অতীনকে বাঁচিয়েছে। এখানে এসেও প্রথম প্রথম ঠিক চাকরি না পেয়ে মদ খাওয়ার দারুণ ঝোঁক চেপে গিয়েছিল অতীনের, টাইম স্কোয়ারে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বেলেল্লা করতেও তীব্র ইচ্ছে করতো এক এক সময়, শর্মিলা এসে না পড়লে সে হয়তো তলিয়ে যেতে পারতো।
শর্মিলাকে অলির কথা বলা হলো না এখনো। অলির নামটা শুধু বলেছে, আর কিছু না। ঠিক কী করে যে বলা যায়, সেটাই অতীনের মনে আসছে না। অতীন নিউ ইয়র্কে অলি নামে একটা মেয়েকে রিসিভ করতে যাচ্ছে শুনে শর্মিলা কী সুন্দর বললো, অলিকে কেমব্রিজে নিয়ে আসতে। মেয়েটার মনের মধ্যে একটুও মালিন্য নেই।
রাস্তার ছুটন্ত ছায়ামূর্তিটি এবারে জানলার কাঁচে টকটক শব্দ করলো। অতীন জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? কী চাও?
ছায়ামূর্তি বললো, আমি কলকাতার বাবলু। প্রতাপ মজুমদারের ছেলে। তুই অ্যামেরিকার অতীন, তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? পুরোপুরি অ্যামেরিকান হয়ে গেছিস?
অতীন বললো, কেন চিনতে পারবো না? আমি কি কিছু ভুলে গেছি নাকি?
বাবলু বললো, হ্যাঁ ভুলে গেছিস! কৌশিককে মনে আছে?
–নিশ্চয়ই মনে আছে। আমি একটু আগেই কৌশিকের কথা ভাবছিলাম।
–তুই কি খবর রাখিস যে কৌশিক মারা গেছে?
–অ্যাঁ? না, না, বাজে কথা, অসম্ভব। অলি চিঠিতে জানিয়েছে যে কৌশিক ভালো আছে।
–অলি? কোন্ অলি? তোর বাবার এক বন্ধুর মেয়ে, সামান্য একটু চেনা, তাই না? অলি তোর নিজের কেউ না!
–শর্মিলাকে ঐভাবে বলেছি, পরে সব বলবো। কিছুই লুকোবো না। শর্মিলা আমার কাছে কিছু গোপন করে না, আমার ওপর ও দারুণ নির্ভর করে থাকে, আমি কি ওর সঙ্গে এ ব্যাপার নিয়ে লুকোচুরি করতে পারি? তা হলে আমাদের সম্পর্কটা কোনোদিন খাঁটি হবে না। না, আমি শর্মিলাকে এক সময় বলবো, ঠিকই বলবো!
–আর অলিকে বুঝি কিছু বলবি না? এয়ারপোর্টে অলিকে রিসিভ করে তারপর তাকে তাড়াতাড়ি মেরিল্যান্ড পাঠিয়ে দিবি, যাতে সে শর্মিলার কথা কিছু জানতে না পারে!
–ধ্যাৎ, এইভাবে ক’দিন গোপন রাখা যাবে? অলিকেও বলবো শর্মিলার কথা। অলি আমার বন্ধু, সে বন্ধুই থাকবে। এ দেশে তার যা যা সাহায্য লাগে নিশ্চয়ই করবো। কিন্তু আমি কি অলিকে কোনোদিন বিয়ে করার কথা বলেছি? সেরকম কোনো কথা হয়নি। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব, সেটা থাকবে!
–সব কথা বুঝি মুখে বলতে হয়? অলির একজন গানের মাস্টার, তারপর একজন ইংরিজির অধ্যাপক, এদের অলি ছাড়িয়ে দিয়েছিল শুধু তুই জোর করেছিলি বলে। আর সেই যে সেবার, মেমারি থেকে কৃষ্ণনগর যাবার সময়, ফেরি পেরিয়ে সন্ধেবেলা গঙ্গার ধারে, একটু পরে চলন্ত রিকশায় তুই অলিকে কী বলেছিলি রে অতীন?
–বাবলু, ওসব কথা রাখ। তুই কৌশিক সম্পর্কে কী বললি? স্বীকার কর যে ওটা বাজে কথা?
–অর্থাৎ তুই এখন অলির কথা মনে আনতে চাস না, তাই কৌশিকের কথা আবার টেনে আনছিস!
–গেট লস্ট, বাবলু!
অতীন উঠে দাঁড়ালো। তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। এই বাসের মধ্যে বাথরুম আছে, সে সেখানে ঢুকে পড়লো, পাশের ছেলেদুটোর গাঁজার ধোঁয়াতেই কি তার মনে এইসব উল্টো পাল্টা চিন্তা আসছে? সে ঘাড়ে মাথায় জল দিল। শরীরটা সত্যি বেশ দুর্বল লাগছে। শরীরটা যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসছে, সবঙ্গে একটা চোর চোর ভাব। যেন সে একটা অন্যায় করে। কোথাও পালাচ্ছে। পালাচ্ছে, না সে একটা অন্যায় করতে যাচ্ছে?
ফিরে এসে আবার সে রাস্তায় সেই ছায়াটা দেখতে পেল। ছায়াটা তার সঙ্গে দৌড়তেই লাগলো সারাক্ষণ।
সিদ্ধার্থ বলেই দিয়েছিল, অত সকালে সে অতীনকে নিতে আসতে পারবে না। সিদ্ধার্থ এখন বাড়ি নিয়েছে ব্রুকলিন-এ, ঠিকানা খুঁজে যেতে অতীনের অসুবিধে নেই। তবে নিউ ইয়র্কের গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশানটা এত বিশাল যে অতীন এখনো খানিকটা দিশেহারা হয়ে যায়। চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষের ভিড়ে এ জায়গাটা গমগম করে।
সারা রাত অতীনের ঘুম হয়নি, সে প্রথমেই বড় এক কাপ কালো কফি খেল। তারপর একটু খুঁজে নেমে গেল সাবওয়ে স্টেশানে। তার কাঁধে ঝোলানো শুধু একটি ব্যাগ।
সিদ্ধার্থদের বিল্ডিং-এর সদর দরজা খুলে বেরুচ্ছিল একজন মধ্যবয়স্ক লোক, অতীন সেই সুযোগে দরজার পাল্লাটা ধরে ভেতরে ঢুকে গেল। এরকম নিয়ম নয়, লোকটি শুধু একবার তাকালো অতীনের দিকে, মুখে কিছু বললো না। সম্ভবত এ বাড়িতে বেশ কিছু ভারতীয় বা পাকিস্তানী থাকে, অতীনের মতন চেহারা দেখতে লোকটি অভ্যস্ত।
লিফটে অতীন উঠে এলো আটতলায়। ঠিক পাশেই সিদ্ধার্থর অ্যাপার্টমেন্টের নম্বর। দু’তিনবার বেল দেবার পর দরজা খুললো একটি শ্বেতাঙ্গিনী যুবতী। মাথা ভর্তি অবিন্যস্ত সোনালি চুল, ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে মুছে গেছে, পরনে একটা সিল্কের ড্রেসিং গাউন। ঘুম-মাখা মুখেও আললে হাসি হেসে সে বললো, হাই! ইউ মাস্ট বী টিনটিন ফ্রম কেমব্রিজ? কাম অন ইন। ইয়োর ফ্রেন্ড ইজ স্টিল অ্যাপি।
বিস্ময় প্রকাশ করার কোনো নিয়ম নেই। সিদ্ধার্থ অতীনকে ঘুণাক্ষরেও জানায়নি যে সে একটি সাদা মেয়ের সঙ্গে লিভিং টুগেদার করছে। কিংবা এই মেয়েটিকে কি এক রাত্তিরের জন্য এনেছে নাকি?
অতীনও হাই বলে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলো। ভোরের দিকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, অতীনের কাছে কোনো গরম জামা নেই, ঘরের ভেতরে এসে আরাম লাগলো তার।
মেয়েটি কফির জল চড়িয়ে দিয়ে এসে বললো, হোয়াই ডোচ ইউ সীট ডাউন, বী কমফর্টেবল!
যেন এ বাড়ির সে-ই গৃহিণী, অতিথিকে অভ্যর্থনা করছে। সিদ্ধার্থর সঙ্গে এক অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে ছিল অতীন বেশ কিছুদিন, এখন নিজেকে সত্যিই তার বাইরের লোক মনে হচ্ছে।
একটি বেশ রাগী রাগী বাঙালী মেয়ের সঙ্গে এক সময় খুব ভাব হয়েছিল সিদ্ধার্থর, নীপা না কী যেন নাম, সে কোথায় গেল? অবশ্য সিদ্ধার্থ অতীনকে অনেকবার ঠাট্টা করে বলেছে, এ দেশে এসে এ দেশের কোনো মেয়ের সঙ্গে মিশলি ‘না, এখানকার সোসাইটি কত পারমিসিভ তা বুঝলি না, ট্যাকে করে একটা বাঙালী প্রেমিকা নিয়ে এলি?
মেয়েটি বললো, টিনটিন, আই অ্যাম সুজান।
তারপর করমর্দনের বদলে সে তার গালটা এগিয়ে দিল। অতীন তার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঠোনা মারলো। সঙ্গে সঙ্গে সে যেন সুজানের শরীরে ভাটফুলের গন্ধ পেল। উত্তর বাংলার জঙ্গলে সে ভাট ফুলের গন্ধ পেয়েছে অনেকবার, কেমন যেন যৌন গন্ধ বলে মনে হয়।
বেডরুমের দরজাটা অর্ধেকটা খোলা, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে সিদ্ধার্থ। পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া। আগেকার দিন হলে অতীন সিদ্ধার্থর ঠ্যাং ধরে টেনে নামাতে বিছানা থেকে, কিন্তু অপিরিচিত শ্বেতাঙ্গিনীর সামনে সে আড়ষ্ট বোধ করছে।
অতীনের উল্টো দিকের সোফায় পা মুড়ে বসলো সুজান। তার উরুর কাছে উঠে গেল ড্রেসিং গাউন, বুকেরও অনেকটা দেখা যাচ্ছে, এ সব কিছুই না, সোজা তাকিয়ে কথা বলতে দোষ নেই, তবু অতীন ওয়াল পেপার দেখার ভঙ্গি করে বললো, ওকে ডাকবে না?
সুজান বললো, কাল আমরা আড়াইটের সময় একটা পার্টি থেকে ফিরেছি। তোমার বন্ধু খুবই ক্লান্ত, ন’টার আগে জাগাতে বারণ করেছে, আমরা দু’জনে ততক্ষণ কফি খেতে খেতে গল্প করি না?
সকালে অন্তত চার পাঁচ কাপ কফি খাওয়া অ্যামেরিকানদের অভ্যেস। অতীন এক কাপের বেশি খায় না, তবু সে এখানে আর এক কাপ নিল। নিছক কথা চালাবার জন্যই সুজান বললো, সিড বলছিল, তোমরা দু’জনে অনেক দিনের বন্ধু। তুমি নাকি খুব বড় স্কলার, টিনটিন? হাভার্ডে রিসার্চ করো।
টিনটিন নামটাতে আপত্তি করে কোনো লাভ নেই। গতকাল রাত্রে সিদ্ধার্থ নিশ্চয়ই অনেকবার অতীনের নামটা মুখস্থ করাবার চেষ্টা করেছে সুজানকে। এরা অতীন বলতে পারে না, সেই জন্যই টিনটিন, আর সিদ্ধার্থ হয়েছে সিড। সুজানকে সুজাতা বললে ওর কেমন লাগতো!
অতীন সুজান সম্পর্কে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলো না, সেটা ভালো দেখায় না। সে সুজানকেই একতরফা কথা বলতে দিল। এরই মধ্যে সুজান জানালো যে সে হিন্দুদের জন্মান্তরবাদ খুব পছন্দ করে।
ন’টা বাজবার খানিক আগেই নিজে থেকে বিছানা থেকে উঠে এলো সিদ্ধার্থ। সুজানকে হুকুমের সুরে বললো, দাও দাও, আমার কফি দাও।
অতীনের সঙ্গে প্রথমে একটাও কথা না বলে সে আবার শোবার ঘরে গিয়ে হাতে করে একটা চাবি নিয়ে এলো। সেটা অতীনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এই নে। তুই ছ’তলার ছ’শো বত্রিশ নম্বরে চলে যা। তোর জন্য আমি একটা ফাঁকা অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করে রেখেছি।
অতীন চাবিটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
সিদ্ধার্থ শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় বললো, তুই দুপুরে ঘুমাবি তো? আমিও আর একবার ঘুমিয়ে নেবো। সুজান লাঞ্চ তৈরি করে তোকে ডাকবে। ঐ অ্যাপার্টমেন্টটা একজন ইস্ট পাকিস্তানের ছেলের, সে কলকাতায় চলে গেছে, বাংলাদেশ নিয়ে যুদ্ধ করবে, চাবিটা দিয়ে গেছে আমাকে। দেশ থেকে তোর যে মেয়ে বন্ধু আসছে, তার সঙ্গে তুই ওখানে কয়েকদিন থেকে যেতেও পারিস। সুজান তোকে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে দিয়ে আসবে? যদি কিছু গুছিয়ে টুছিয়ে দিতে হয়, ডার্লিং, উইল ইউ প্লীজ।
অতীন শুকনো গলায় বললো, নো থ্যাঙ্কস। আই উইল ম্যানেজ।
নিচে এসে অতীন ভাবলো, বন্ধুদের ওপর যখন-তখন রাগ করার কোনো মানে হয় না। সিদ্ধার্থ তার সঙ্গে ভালো করে কথা না বলে প্রায় ঠেলেই যেন অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিল। সিদ্ধার্থটা এইরকমই। হয়তো সুজান বিষয়ে এক্ষুনি সে কিছু আলোচনা করতে চায় না।
ইস্ট পাকিস্তানী ছেলেটির ঘরে প্রচুর বই। অধিকাংশই বাংলা। এত বাংলা বই একসঙ্গে অতীন বহুদিন দেখেনি। অনেক বাংলা গানের রেকর্ডও রয়েছে। ঘরের মাঝখানে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অতীন। এ দেশে এটা খুবই স্বাভাবিক, কেউ বাইরে গেলে তার অ্যাপার্টমেন্টটা চেনাশুনো কারুকে ব্যবহার করতে দিয়ে যায়। কিন্তু অতীন আগে কখনো এরকমভাবে থাকেনি। তার অস্বস্তি লাগছে। কোনো জিনিস হারিয়েন্টারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে কে দায়ী হবে? সিদ্ধার্থটা সুজানকে এই ঘরে রাখতে পারতো না?
একটা টেলিফোন করা দরকার। শর্মিলা বারবার বলে দিয়েছে পৌঁছেই একটা খবর দিতে। সিদ্ধার্থর ঘর থেকে অতীন ফোন করবে ভেবেছিল। কিন্তু সিদ্ধার্থ তো তাকে সময়ই দিল না। অচেনা লোকের ঘর থেকে কি ফোন করা যায়? পয়সাটা দেওয়া যাবে কী করে? বাইরে বেরিয়ে রাস্তা থেকে টেলিফোন করতে হবে? না, এ ঘর থেকেও কালেক্ট কল করা যেতে পারে। এরকম তো হয়ই, পকেটে খুচরো পয়সা না থাকলে লোকে রাস্তা থেকেও কালেক্ট কল করে।
শর্মিলাই ফোন ধরলো। অতীন কিছু বলার আগেই শর্মিলা খুশীর উত্তেজনার সঙ্গে বললো, এই জানো, কী হয়েছে? তুমি চলে যাবার একটু পরেই বড়মামা ফোনে জানালেন, ওঁর শরীর খারাপ হয়েছে, উনি ট্রিপ ক্যানসেল করেছেন। তা হলে তো আমি নিউ ইয়র্ক ঘুরে আসতেই পারি! ইস, তোমার সঙ্গেই যেতে পারতুম, সারা রাত একসঙ্গে, কী ভালো লাগতো,! আজ আসবো? এই ধরো এগারোটার বাসে? সুমি একলা থাকবে বলছে। বাবলু, আমি আসবো?
অতীন দু তিন মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা করলো, তারপর হেসে বললো, হ্যাঁ এসো! তুমি চলে এসো!