আজো ভূতনাথের মনে আছে স্পষ্ট। মনে আছে বৈকি! বড়বাড়ির ধ্বংসস্তুপের সঙ্গে সে-কথাও কি ভোলবার! জীবনের সঙ্গে যারা জড়িয়ে আছে, তাদের ভুললে নিজেকেও ভুলতে হয় যে। সেদিন সেই অল্প-অল্প ভোরের আবছায়াতে জবার সেই স্পষ্ট প্রত্যক্ষ উক্তি যেন আজো কানে শুনতে পাচ্ছে ভূতনাথ!
বাবা নেই!
অনেকেই আজ আর নেই সত্যি। সেদিনকার সে-মানুষগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই নেই আর আজ। কোথায় সব হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। কোথায় ননীলাল। কোথায় বংশী। কোথায় চিন্তা। কোথায় গেল ছুটুকবাবু! কোথায় গেল বিধু সরকার, ইব্রাহিম আর বদরিকাবাবু! আর কোথায়ই বা গেল পটেশ্বরী বৌঠান! বড়বাড়ির সঙ্গে ভূতনাথের জীবনে যে-পরিচ্ছেদের যতি পড়েছিল, সমাপ্তির ছেদ পড়েছিল যেন জবার সঙ্গে-সঙ্গে!
আজো সে-রাস্তাটা দিয়ে চলতে-চলতে ওপর দিকে চাইলে দেখা যায়। দেখা যায় অন্য এক চেহারা। সমস্ত বাড়িটা নতুন রূপ নিয়ে সঁড়িয়ে আছে দুটো রাস্তার ঠিক মোড়ের ওপর। ওপরে জানালা খোলা থাকে। আলো জ্বলে ভেতরে। মাঝে-মাঝে গানের সুর ভেসে আসে। ভেতরে অর্গান বাজিয়ে বুঝি জবারই মেয়ে গান খায়। ঠিক সেই রকমই গলার সুর। খানিক দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। শুনতে ইচ্ছে করে দু’দণ্ড! লোভ হয় ভেতরে ঢোকবার। চলতে-চলতে গানের কথাগুলো যেন তাকে অনুসরণ করে—
তোমারি রাগিণী জীবন-কুঞ্জে
বাজে যেন সদা বাজে গো।
তোমারি আসন হৃদয়-পদ্মে
রাজে যেন সদা রাজে গো।
তব নন্দন-গন্ধ-নন্দিত ফিরি সুন্দর ভুবনে
তবু পদরেণু মাখি লয়ে তনু
সাজে যেন সদা সাজে গো—
জবার মেয়েও ঠিক জবার মতোই গান শিখেছে। আর সুপবিত্র? কিন্তু সে-কথা এখন থাক।
সেদিন বড়বাড়িতে ফিরে সেখানেও আর এক পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ। এ-বাড়িতেও রাজমিস্ত্রী এসেছে দলে দলে। ইটের পাহাড় জমেছে উঠোনের ওপর। চুন সুরকি চালা রয়েছে আস্তাবল বাড়ির সামনে। নোংরা চারদিকে। বালকবাবু বেরিয়ে গেল নাচঘর থেকে নথিপত্র নিয়ে। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতন ক’দিনেই বড়বাড়ি এক অভাবনীয় পরিণতি পেয়েছে।
বংশী এসে দাঁড়ালো—শালাবাবু—কোথায় ছিলেন ক’দিন?
উঠোনের মাঝখান দিয়ে লম্বালম্বি পাঁচিল উঠছে। ওধারে এধারে সুতো পড়েছে। পনেরো ইঞ্চি মোটা দেয়াল। মাঝখানে একটা ছ’ ফুট উচু দরজা। ইটের ওপর বালির কাজ হবে। আর দামু জমাদারের ঘরের দিকটাতেও লম্বা সীমানা টানা হয়েছে। মাঝখানে দেয়াল উঠছে সেখানেও। চারদিকে হৈ-চৈ হট্টগোল।
বংশী বললে—বাবুরা আলাদা হচ্ছে শালাবাবু, হাঁড়িও আলাদা হয়ে গিয়েছে।
ক’দিনের মধ্যে এত পরিবর্তন হয়ে গেল। কুলিরা মাথায় ইটের বোঝা নিয়ে চিৎকার করে—খবরদার—আর সঙ্গে-সঙ্গে কাঠের ভারার ওপর ঝপাং করে শব্দ হয়। ওদিক থেকে একজন মিস্ত্রী সুতো ধরে, আর এ-সীমানায় সে-সুতোর শেষ দিকটা আর একজন টান করে ধরে থাকে। ওলোন ঝুলিয়ে-ঝুলিয়ে পরীক্ষা করে বার-বার। বাঁকা-চোরা না হয়। খাড়াই ইটের পাঁচিল মাথা ছাড়িয়ে উঠবে। ও-বাড়ির লোককে এ-বাড়ির লোক দেখতে না পায়। আস্তাবল বাড়িটাও তিন ভাগ হয়েছে। এক ভাগ হিরণ্যমণির, এক ভাগ কৌস্তুভমণির আর এক ভাগ চূড়ামণির।
বংশী বলে—সব পাল্টে গেল হুজুর—বড়বাড়িতে আর মন টেকে না আমার।
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করে—ছোটমা কেমন আছে বংশী?
–ভালো নেই শালাবাবু।
—একবার দেখা করতাম, অনেকদিন দেখা হয়নি। বংশীর মুখে-চোখে যেন কেমন এক রকমের দ্বিধা ফুটে উঠলো।
ভূতনাথ বললে—আজকে সন্ধ্যেবেলা যাবো’খন, খবর দিয়ে রাখিস বৌঠানকে।
বংশী বললে—কিন্তু দেখা আপনি না-ই করলেন শালাবাবু!
–কেন, শরীর খারাপ?
বংশী বললে—শরীর তো বৌঠানের ক’দিন থেকেই খারাপ চলছে, কাল একেবারে অজ্ঞান হয়ে যায়-যায় অবস্থা হয়ে উঠেছিল।
–কেন? ভূতনাথ কেমন যেন শিউরে উঠলো।
—আজ্ঞে, ক’দিন থেকে কিছু খাচ্ছেন না দাচ্ছেন না, তার ওপর খালি-পেটে ওইগুলো গেলা, ছাইভস্মগুলো পেটে গেলে আর কত সইতে পারে মানুষ, রাত্তিরে চিন্তা আমাকে ডাকতে এসেছে, আমি আবার যাই, বরফ ছিল না বাড়িতে, মেজবাবুর বাড়ি থেকে বেণীর কাছে ধার করে বরফ এনে আবার মাথায় দিই, কিন্তু সে কি থামে, শেষে সেবার যা করেছিলাম, খানিকটা তেঁতুল-গোলা জল গিলিয়ে দিলাম জোর করে, তখন ঘুমোলেন, নইলে সে কি ছটফটানি। হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে গেল, চোখ উল্টে গিয়েছিলো একেবারে।
—তুমি কেন আর ওসব দাও বৌঠানকে?
বংশী বললে—আমি কেন দিতে যাবো শালাবাবু, আমাকে আনতে বললে আমি ‘না’ বলে দেই, কত বকুনি তাই জন্যে আমার ওপর, বলে—তুই আজকাল আমাকে অমান্য করিস, টাকা না থাকলে হাতের সোনার চুড়ি, কানের গয়না খুলে দিতে আসে আজ্ঞে। একে-একে এমনি করে কত দিকে যে কত টাকা-পয়সা ছোটমা খোয়ালে কী বলবো—কোত্থেকে এ-সব আসে বলুন তো শালাবাবু!
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে–ছোটবাবু কিছু বলে না?
—আজ্ঞে ছোটবাবু তো নিজে ও-সব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু পইপই করে বারণ করেছে-মদ যেন কেউ না দেয় ছোটমাকে, ছোটমাও যখন ভালো থাকে, বলে–আমি খেতে চাইলেও দিবিনে আমাকে, কিন্তু এক-এক সময় যা করে ধরে, হাত দুটো ধরে বলে— নিয়ে আয় একটা বোতল, এই শেষবার, আর খাবো না কখখনো। জ্ঞান থাকলে অত ভালো মানুষ, আবার যখন অবুঝ হয় তখন হাতে-পায়ে ধরতে আসে, দেখে কী কষ্ট যে, হয় মনে—খানিক থেমে বংশী আবার বলে—এই তো সেদিন—সেজখুড়ি তো এখন ছোটবাবুর ভাগে, ওই যে রান্না করতে আগে বড়বাড়িতে, তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে মদ আনিয়েছে।
—কে আনলে?
—আজ্ঞে বেণী, এখন তো বেণী মেজবাবুর তরফে, সে কেন আমাদের হয়ে টানবে, পরই তো হলো ওরা। সেই খেয়েই সেদিন ওই কাণ্ড, হাত-পা খিচতে লাগলো, চোখ উল্টে গেল, গায়ে কী শক্তি শালাবাবু, আমি আর চিন্তা দুহাতে ধরে ঠাণ্ডা করতে পারিনে। মুখ দিয়ে গেঁজলা উঠে প্রাণ বেরিয়ে যায় আর কি—তা বেণীকে আমি বললাম খুব, খুব শুনিয়ে দিলাম আজ্ঞে—বললাম, আজ না হয় তোরা আলাদা, কিন্তু নুন তো খেয়েছিস ছোটবাবুর, ছোটবাবু আর মেজবাবু কি আলাদা? এক ভাই-ই তো, মায়ের পেটেরই তো ভাই।
কথা বলতে-বলতে হঠাৎ বংশী বললে—ওই যাঃ—
ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কী?
বংশী বললে—কত কাজ আমার পড়ে আছে আর এদিকে আপনার সঙ্গে গল্প করছি আমি। ছোটবাবু সাবু খাবে আজ, বাজারে যেতে হবে এখুনি।
ভূতনাথ বললে—বাজারে কি আজকাল তুমিই যাও নাকি?
—শুধু কি বাজার? এই এক হাতে সব করতে হয় হুজুর। বাজার করা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, কেউ-ই তো নেই আজ্ঞে, মধুসূদনকাকা সেই যে দেশে গেল আর তো ফিরলো না, আর লোচন তো জানেন পান-বিড়ির দোকান করেছে। বেণী আর শ্যামসুন্দর গিয়েছে ওদের তরফে, আর ছুটুকবাবু সব চাকর তাড়িয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোক রেখেছে–শুধু পুরোনোদের মধ্যে আছে বড়মা’র সিন্ধু। আমাদের রান্না করে সেজখুড়ি, তা রান্নার কাজ ছাড়া সব করতে হয় আমাকে কথা বলতে-বলতে হঠাৎ হাত ধরে টান দিয়ে বংশী বললে চলে আসুন শালাবাবু, শীগগির চলে আসুন।
কেন যে এত ব্যস্ততা বংশীর, ভূতনাথ বুঝতে পারলে না। বললে-কী হলো-বলে এদিক-ওদিক চাইতে লাগলো ভূতনাথ।
–বিধু সরকার মশাই আসছে, সরে আসুন আজ্ঞে এখান থেকে।
–কেন? বিধু সরকার কি করবে আমার?
—চলে আসুন আগে, বলছি—লোক তো ভালো নয় আজ্ঞে। চোরকুঠুরির ধারে এসে বংশী বললে—আপনি কাজে যাবেন তো আজ? আপনার খাবার চাল নিতে বলি তাহলে?
–না, আমার তো ছুটি এখন ক’দিন—বেলায় যাবে কিন্তু বিধু সরকার কি খাতা থেকে নাম কেটে দিয়েছে নাকি আমার?
বংশী বললে—আপনি তত আমাদের তরফে আজ্ঞে, বিধু সরকার কী করতে পারে, কিন্তু লোকটা তো ভালো নয়, পরের নামে মিথ্যে করে রটিয়ে বেড়ায়, আপনার কথা তো সব মেজবাবুকে বলেছে কি না।
–কী বলছে, কী?
—যত সব মিথ্যে কথা হুজুর, সেদিন আপনি বৌঠানের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, মেজবাবু দেখেছে, কিন্তু চিনতে পারে নি আজ্ঞে, আমাকে জিজ্ঞেস করলে কে রে ওখানে? আমি বললাম–আমি। তখন মেজবাবু জিজ্ঞেস করলে-বারান্দা অন্ধকার কেন, —আলো জ্বালা থাকবে সব সময়। তা সে-ব্যাপারের তত সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিধু সরকার মেজবাবুকে আপনার নাম বলে দিয়েছে আজ্ঞে। বলেছে-ওই লোকটা ছোটবউ-এর কাছে রোজ রাত্রে যায়, বাড়ির বউ-এর সঙ্গে মেশে, গাড়িতে তুলে নিয়ে বাইরে যায়। সেই যে আপনি ছোটমা’র সঙ্গে একদিন বাইরে গিয়েছিলেন না?
–তারপর?
—তারপর সেই নিয়ে হুলুস্থুল, মেজবাবু বলে—কোথায় সে। তা ভাগ্যিস আপনি তখন বাড়িতে আসেন নি! মেজমাও তত কম নয়, গিরি বললো, আমি দেখেছি। ছোটমা তখন বললেসে আমার গুরুভাই, আসে আমার কাছে, তাতে হবে কি? বড়মাও টিপ্পনি কাটলো—সে আমি বলতে পারবো না সব হুজুর, মেজমা বড়মা মিলে ছোটমাকে না-হোক কথা শোনালে। কী ঝগড়া ক’দিন, সে-সব কথা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয় হুজুর–তা আপনি এখানে বসুন, আমি একটু বাজার ঘুরে আসছি।
সব শুনে ভূতনাথের কেমন যেন ভয় হতে লাগলো। বললেবংশী, এর পর কি আমার এ-বাড়িতে থাকা ভালো হবে রে?
বংশী চলে যাচ্ছিলো। কথা শুনে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। বললে–সে কি শালাবাবু, সে-ব্যাপার তো মিটে গিয়েছে—এখন তো আমরা আলাদা হয়ে গিয়েছি।
–কিন্তু ছোটবাবু সব শুনেছে তো?
-ছোটবাবু কি আর মানুষ আছে আজ্ঞে, শুয়ে পড়ে আছেন, ধরে খাইয়ে দিতে হয়, আবার ধরে শুইয়ে দিতে হয়, সাতেও নেই পাঁচেও নেই কারো। দুটো হাত আর দুটো পা একেবারে পড়ে গিয়েছে, অসাড়, সে আর মানুষ নামের যুগ্যি নয়, কিন্তু ছোটমা না বললে আমি তো আপনাকে চলে যেতে দিতে পারিনে।
–আজকে একবার ছোটমা’র সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারে। বংশী, একটিবার শুধু।
—তাহলে অনেক রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, তখন।
–আমাকে তুমি ডেকে নিয়ে যাবে, আমি জেগে থাকবে, কেমন?
—সে পরে যা হয় ঠিক করবো, আপনি বসুন, আমি আসছি। পালিয়ে যাবেন না আজ্ঞে—বলে বংশী দুম-দাম করে চলে গেল।
বিছানাটায় চিত হয়ে শুয়ে-শুয়ে ভূতনাথ আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো অনেকক্ষণ। এ-বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হবে ভাবলেই যেন কেমন কষ্ট হয়। এখানে শুধু কি তার আশ্রয়। শুধু কি আশ্রয়েরই লোভ! চারটে দেয়াল আর একটা নিরাপদ ছাদের প্রলোভন। আর খাওয়া! শুধুই কি তাই? আর কিছু নয়? সারাদিন ভূতের মতন পরিশ্রম করে এখানে এসে এই বিছানায় শুয়ে শান্তি পাওয়া যায় কেন? স্পষ্ট করে হয় তো যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না। কিন্তু যদি বৌঠানের আকর্ষণই একমাত্র কারণ হয়, তো বৌঠানই বা তার কে? কিসের সম্পর্ক! কি রকম সম্পর্ক! বৌঠানকে কতবার ভালো করবার চেষ্টা করেছে সে। বৌঠানও তাকে কতবার কত রকমভাবে যা তা বলেছে। বেইমান বলেছে। কিন্তু তবু যেন কোথায় একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। বৌঠানকে সেদিন দু’হাত দিয়ে জাপটে ধরে কি সারা শরীরে রোমাঞ্চ অনুভব করেনি! স্বপ্ন দেখেনি বৌঠানকে! জবা অবশ্য তার নাগালের বাইরে। কোনোদিন জবাকে পাওয়ার স্বপ্নও সে দেখতে সাহস করেনি। কিন্তু বৌঠানের বেলায় কি সেকথা বর্ণে-বর্ণে সত্যি! যাক, ভালোই হলো, সমস্ত প্রলোভন থেকে মুক্ত হয়ে, সমস্ত স্নেহভালোবাসার আশ্রয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে। নতুন করে আবার শুরু হবে তার দিন। নতুন করে দিনযাপন। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে জবার গাওয়া গানটা মনে পড়লো। কোথাও যদি কখনও কোনো অন্যায় করে থাকি, আমায় ক্ষমা কোরো, তুমি আমার বিচার কোরে! তুমি নিজের হাতে আমার বিচার কোরো। সমস্ত নিখিল সংসারে যত লোকের সঙ্গে ভূতনাথ মিশেছে, যাদের ভালোবেসেছে, যারা ভালোবাসেনি, আজ সকলে তার চোখের সামনে ভিড় করে দাঁড়ালো। আন্না, রাধা, হরিদাসী, জবা, বৌঠান—কেউ বাদ গেল না। আমি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম। হয় তো তোমাদের সঙ্গে জীবনে আর দেখা হবে না। কিন্তু আমার বিচার করো তোমরা। আমি যদি দোষ করে থাকি আমায় ক্ষমা করো না—আমায় শাস্তি দিও-সে-শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।
মনে আছে—সেবার মাঘোৎসবে জবা গেয়েছিল–
আমার বিচার কর তুমি তব আপন করে,
দিনের কর্ম আনি তোমার বিচার-ঘরে।
যদি পূজা করি মিছা দেবতার
শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার
যদি পাপ মনে করি অবিচার কাহারো পরে,
আমার বিচার কর তুমি, তব আপন করে।
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ
ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম-বিমুখ
পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণেক তরে,
আমার বিচার কর তুমি, তব আপন করে।
চলে আসবার দিন জবাকে জিজ্ঞেস করেছিল ভূতনাথ–সুপবিত্রকে তো তাড়িয়ে দিলে জবা—আমাকেও কি আসতে বারণ করছে?
সমস্ত বাড়িতে যেন বৈধব্যের মতো এক অকরুণ নিঃসঙ্গতা। জবার সে খর্য যেন হারিয়ে গিয়েছে। সেই কর্মব্যস্ততা, সেই উন্মুখর চাঞ্চল্য নেই চলায়-বলায়। সুবিনয়বাবুর অনুপস্থিতি যেন প্রত্যেক পদপাতে প্রখর হয়ে উঠছে।
জবা এতক্ষণ একটা কথারও জবাব দেয়নি! আপন মনেই বসে ছিল। অত সেলাই-এর আয়োজন, অত প্রতীক্ষা সব যেন তার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। অতিথি ঘরে আসবার আগেই নিবে-যাওয়া প্রদীপের মতো অপার শূন্যতা যেন ছেয়ে ফেলেছে জবাকে। অথচ জবার এ-ব্যবহার যেমন আকস্মিক তেমনি যুক্তিহীন। এই ফাঁকা বাড়িতে কে দেখবে জবাকে! কার সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাবে। কার সেবা করে দিনযাপন করবে সে। সে-প্রশ্নের উত্তর যেন আবার দেবার কথা নয়।
ভূতনাথ নিজেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। ঝিকে ডেকে বলেছে—যতদিন না কিছু ব্যবস্থা হয়, ততদিন তোমায় বাছা দিদিমণির কাছে দিনরাত থাকতে হবে।
রাজী হয়েছে ঝি। বলেছে—দিদিমণির বিয়ের সময় আমাকে নতুন কাপড় একটা দিতে হবে কিন্তু।
ভূতনাথ আরো বলেছে—সে যখন হবে, তখন হবে, এখন একটু সাবধানে থাকবে, দরজা যেন খোল পড়ে না থাকে—দেখছে। তো বাড়িতে কোনো পুরুষমানুষ নেই, নিজের সংসার মনে করে থাকবে, কাজ করবে, দিদিমণির কেউ নেই জানো তো।
জবা এ-ব্যবস্থায় সম্মতিও দেয়নি, প্রতিবাদও করেনি। চুপ করে বোবার মতো সমস্ত শুনেছে কেবল।
সমাজের আচার্য ধর্মদাসবাবু এসেছিলেন। বলে গেলেন—মা, যখনি তোমার কোনো প্রয়োজন হবে, আমাকে খবর দিও, আমি তোমার পিতার মতন—দ্বিধা করে না।
উপদেশ দিয়ে গেলেন—মা, তুমি তো সবই জানো, তোমাকে আর কী বোঝাবো, জীবনের তত্ত্বই হচ্ছে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নতুনকে প্রকাশ করা—সংসারের সঞ্চয় তাই তো প্রতিদিন কেবল ক্ষয় হয়ে যায়। এ-সংসারের শুরু শিশুকে নিয়ে, তারপর সেই সংসারই তাকে একদিন বৃদ্ধ করে ছেড়ে দেয়। তাই উপনিষদের মৈত্রেয়ী বলেছিলেন—যে নাহং অমৃতস্যা কিমহম্ তেন কুৰ্যাম—
রূপচাঁদবাবুও এসেছিলেন। বললেন—আমার মেয়েরা তোমারই বয়সি মা, যদি মনে করে। এখানে কষ্ট হবে, আমার বাড়িতে যেতে পারে। দুটো বাড়িই তোমার রইল, এখন যা ইচ্ছে হয় তোমার।
ভূতনাথ বললে—কিন্তু জবা, সুপবিত্রকে তো তাড়িয়েই দিলে–জীবনটাকে কি এমনি করেই কাটাবে ভেবেছো?
জবা বলেছে—ভূতনাথবাবু, আপনার পায়ে পড়ি, আমাকে একটু একলা থাকতে দিন।
ভূতনাথ জবার ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে গিয়েছে। সুবিনয়বাবুকে যখন ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তখনও এক ফোটা চোখের জল পড়েনি। কথা বলেনি একটাও। কান্না দূরে থাক, নিজেকে এতখানি সংযম দিয়ে বাঁধতে পারবে একথা ভাবাও যায়নি।
সুপবিত্র তবু একবার এসেছিল। শেষকৃত্যের সময় সুপবিত্র সর্বক্ষণ উপস্থিত ছিল একান্তে। কিছু করেনি সে, কিন্তু কোথায় যেন একটা সঙ্কোচ একটা অপরাধ-বোধ ছিল মুখে-চোখে। যখন একে-একে সবাই চলে গিয়েছে, সুপবিত্রও চলে যাচ্ছিলো। যেন আর তার করণীয় কিছুই নেই।
ভূতনাথের কেমন যেন দুঃখ হলো। বললে—আপনিও যাচ্ছেন?
–হ্যাঁ—বলে ততক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে সুপবিত্র।
ভূতনাথ সঙ্গে-সঙ্গে গিয়ে ধরলো। বললে-এ-সময় আপনিও যেন অবুঝ হবেন না। এখন থেকে জবাকে দেখবার লোক কেউ নেই, সেটা ভুলে যাবেন না সুপবিত্রবাবু!
সুপবিত্র একবার থমকে দাঁড়ালো। তারপর আবার চলতে লাগলো পায়ে-পায়ে।
ভূতনাথ আবার বললে–অভিমান করে জবা কি বলেছে, তাই শুনে যদি আপনিও অভিমান করেন, তাহলে কেমন করে চলে বলুন তো?
তখন চারিদিকে বেশ সন্ধ্যে। একে-একে গলির গ্যাসগুলোতে আলো জ্বলা হচ্ছে। সুপবিত্রর মুখ, স্পষ্ট দেখা যায় না। শুধু বললে–এর পরেও আমাকে আসতে বলেন?
ভূতনাথ সান্ত্বনার সুরে বললে—আপনাকে আর কি এমন বলেছে! জবাকে আমি এইটুকু বেলা থেকে জানি, ওর কথায় রাগ করবেন না, ওর স্বভাবই ওইরকম, কী বলে তা নিজেও জানে না। মায়ের ভালোবাসা পায়নি, তার ওপর আট-ন’ বছর পর্যন্ত পাড়াগাঁয়ে মানুষ। আমাকে কতদিন কত কী বলেছে, আমি কি না এসে পেরেছি, না রাগ করেছি।
–রাগ? সুপবিত্র যেন হাসলে একটু। ঠিক হাসি, না অভিমান অন্ধকারে ভালো বোঝা গেল না।—না, রাগ তো করিনি, রাগ করতে যাবে কেন মিছিমিছি ভূতনাথবাবু? অনেকখানি কথা এক সঙ্গে বলে সুপবিত্র যেন হাঁপিয়ে উঠলো।
ভূতনাথ বললে—তা হলে কাল আসছেন তো?
সুপবিত্র বললে—আমার তো আসা নিষেধ।
-এই দেখুন, আপনি নিশ্চয় রাগ করেছেন?
সুপবিত্র বললে—বিশ্বাস করুন ভূতনাথবাবু, আমি রাগ করিনি, সত্যি আমার আসা নিষেধ।
ভূতনাথ বললে—রাগের বশে কী বলেছে জবা, সেইটেই বড় করে দেখছেন কেন সুপবিত্রবাবু। এখনও যে অনেক কিছুর আয়োজন করতে হবে।
সুপবিত্র আবার থমকে দাঁড়ালো। যেন কিছু বলতে গেল। কিন্তু…
-–ও কিন্তু-টিন্তু নয় আর, ওসব ওজর শুনছিনে, আপনি আসুন কাল, আমি সব বিবাদ মিটিয়ে দেবো।
সুপবিত্ৰর চোখ দুটো তখন যেন জ্বলছে। একটা গ্যাসের আলোর তলায় ভূতনাথ তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলে। সুপবিত্র মুখ নিচু করলে। তারপর বললে—আপনি হয় তো শোনেননি, কিন্তু জবার কাছে যে আর যাবার আমার পথও নেই।
—সে কি? সঙ্গে-সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভূতনাথের মনে এল। কিন্তু সুপবিত্র তখন হনহন করে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। বজ্রাহতের মতন ভূতনাথ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ভূতে পাওয়া মানুষের মনকেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল সুপবিত্রর দিকে। তারপর আবার ফিরে এল জবাদের বাড়িতে।
জবা তখনও একমনে বসে আছে উপাসনা ঘরের ভেতর। যেমনভাবে বসেছিল বিকেল থেকে, ঠিক তেমনি ভাবেই। এতটুকু নড়েনি। যে-মানুষের সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে, কাজের মধ্যে ড়ুবে থাকে যে, এ-ঘর থেকে ও-ঘর করে বেড়ায়, কথায় গানে মেতে থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত, তার এই রূপান্তর সত্যিই চোখে ঠেকে। দেয়ালের গায়ে সুবিনয়বাবুর ফটোটা রাজা-রাণীর ছবির নিচে ঝুলছে। সেদিকেও দৃষ্টি নেই জবার। ভূতনাথকে দেখেও যেন দেখতে পায়নি।
ভূতনাথ বললে—সারাদিন কিছু খাওনি জবা, কিছু খেলে হতো।
জবা বললে—আপনি বরং কিছু খান—বলে জবা সত্যিই উঠতে চ্ছিলো।
ভূতনাথ বাধা দিলে। বললে–থাক, তোমায় আর উঠতে হবে না। আমার খাওয়ার বন্দোবস্ত আমি নিজেই করতে পারবো কিন্তু একটা কথা তার আগে তোমায় আমি জিজ্ঞেস করববা জবা?
জবা মুখ তুলে ভূতনাথের চোখে চোখ রাখলো। তবু ভূতনাথের মুখ থেকে কোনো প্রশ্ন না আসাতে বললে–বলুন।
ভূতনাথ বললে—বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল তোমার ভার সুপবিত্রই নেবে—কিন্তু তাকে তো তুমি শেষ পর্যন্ত তাড়িয়েই দিলে!
জবা মুখ নিচু করে বললে—সুপবিত্র জানে কেন তাকে আমি… আর বলতে পারলে না জবা।
ভূতনাথ বললে—কিন্তু সুপবিত্রকে জানালেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তোমার নিজের ভবিষ্যৎ, সুপবিত্রর ভবিষ্যৎ কিছুই কি ভাববে না তুমি?
জবা চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বললে—সুপবিত্রকে আসতে বারণ করে আমিই কি খুব সুখে আছি বলতে চান?
—তুমিও যদি সুখে না থাকো, সুপবিত্রও যদি দুঃখ পায়, তা হলে কেন এ দুর্ভোগ?
জবা বললে—তা কি আমি জানি না ভূতনাথবাবু, জানি, সুপবিত্র বাড়ি যাবার পথে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরবে অনেকক্ষণ, এ–ক’দিন হয় তো ঘুমোয়ই নি মোটে, শুধু কি তাই—আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দেবে হয় তো চিরকাল-তবু ওকে আমি এখানে আসতে বলতে পারি না ভূতনাথবাবু—এখানে আসা ওর উচিত নয়।
–কিন্তু কেন?
জবা কাঁদতে লাগলো। সুবিনয়বাবুর মৃত্যুতে যে কঠিন পাথরের মতো শক্ত হতে পেরেছিল, তার এই শৈথিল্যে কেমন যেন অবাক লাগার কথা।
অনেকক্ষণ পরে ভূতনাথ বললে—আমারই হয়েছে মুশকিল, তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে আমিই কি চলে যেতে পারি?
জবা থেমে বললে—আপনি কিছু ভাববেন না ভূতনাথবাবু, আমি আমার নিজের পথ বেছে নেবে।
ভূতনাথ বললে—কিন্তু পথ বেছে নেওয়ার আগে পর্যন্ত যে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছিনে।
জবা আবার মুখ তুললো। কান্নায় ভারী হয়ে গিয়েছে চোখের পাতা। বললে-ভূতনাথবাবু, আপনার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারবো না।
-ঋণ শোধের কথা না-ই বা তুললে জবা, সংসারে কার ঋণ কে শশাধ করতে পারে, এত বড় অহঙ্কার করবার ক্ষমতা কারই বা. আছে সংসারে।
-না, আজ মনে হয়, কত অন্যায়ই করেছি আপনার ওপর।
-ন্যায়-অন্যায়ের কথা আজ থাক জবা, তোমাকে তো বলেছিলাম একদিন এ-আমার নেশা নয়, কর্তব্য-কর্তব্যই শুধু নয়,. ব্রত। তোমার কোনো উপকার করতে পারলে আমি কৃতার্থ মনে করবো নিজেকে—আমি তো প্রতিদান চাইনি কখনও।
জবা মুখ নিচু করে বললে–কিন্তু ভাগ্য যার বিরূপ, তার কাছে প্রতিদান চাওয়া যে বিড়ম্বনা ভূতনাথবাবু!
-তুমিও শেষে ভাগ্যের কথা তুললে জবা?
-ভাগ্যের বিড়ম্বনা যাকে সইতে হয়েছে সে-ই ভাগ্যের কথা তোলে।
ভূতনাথ বললে-ভেবেছিলাম দুর্ভাগ্যটা বুঝি আমারই একচেটে—কিন্তু সে-কথা থাক, নিজের পথটা তুমি তাড়াতাড়ি বেছে নিলে আমি একটু নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
জবা বললে—আমাকে আর একটু সময় দিন, আমি দু-একদিনের মধ্যেই ঠিক করে ফেলবো।
-সঙ্কল্পটা আমাকে জানাতে তোমার কোনো বাধা আছে?
জবা বললে—আমি হাসপাতালে কাজ করবো।
-কোথায়?
-বাবা যে-হাসপাতাল করে দিয়েছেন বাগবাজারে আমাদের বাড়িতে, সেখানেই ঠিক করে ফেলেছি। শুধু একটু ভেবে দেখছি আর কটা দিন সময় দিন আপনি আমাকে।
ভূতনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—কিন্তু। একটা কথা জিজ্ঞেস করবে তোমাকে স্পষ্ট করে তার উত্তর দেবে তুমি?
-বলুন।
—সুপবিত্রর সঙ্গে বিয়েতে তোমার বাধাটা কোথায়? জবা মুখ তুললো এবার। বড় অসহায়ের মত চাইলো। তারপর আবার মুখ নিচু করে বললে—জানি না, আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা, কিন্তু অনেক সময় মানুষের জীবনে যা ঘটে তাতে তার নিজের কোনো হাত থাকে না, বাবার মৃত্যুর দিনের কথা মনে আছে? আপনারা সবাই ও-ঘরে চলে গেলেন, আমি বাবার কাছে রইলাম–বলে জবা থামলো।
ভূতনাথ বললে—তারপর?
-তারপর কী ঘটলো, সব যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়—সে-স্বপ্ন বলরামপুরের। ক’বছরই বা কাটিয়েছি সেখানে, ঠাকুরদা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন বাবার মুখ দেখবেন না, হিন্দু হয়ে বাবার ব্রাহ্ম হওয়া তিনি ক্ষমা করেননি-মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্ত ক্ষমা করেন নি—কিন্তু তখন আমার নাকি মাত্র দু’মাস বয়েস সেই সময়ে…
ঝি হঠাৎ ঘরে ঢুকলো। বললে—একজন বাবু, এসেছেন দিদিমণি।
ভূতনাথ বললে—কে বাবু?
—তা জানিনে।
ভূতনাথ নিচে গিয়ে দেখলে—ধর্মদাসবাবু। ভূতনাথ বললে— আসুন—ওপরে আসুন।
ধর্মদাসবাবু জিজ্ঞেস করেন—আমার জবা-মা কেমন আছে বাবা?
ধর্মদাসবাবু একবার করে রোজই আসেন, সুবিনয়বাবুর পুরোনো বন্ধু। যখন আসেন অনেক উপদেশ দিয়ে যান। ধর্মদাসবাবু বলেন—পিতা-মাতা সকলের চিরদিন থাকে না মা—কিন্তু পরমআত্মীয়ের মৃত্যুতেই আমরা যথার্থ উপলব্ধি করি যে, যাকেই পিতা বলে ডাকি না কেন, তিনিই আমাদের একমাত্র পিতা—তাই উপনিষদে আছে “পিতা নোহসি’—পিতার মধ্যে পিতারূপে যে-সত্য সেও সেই তিনি—সেই নিরাকার পরম পিতা। মাতার মধ্যে মাতারূপে যে-সত্য সেও সেই তিনি, সেই পরম পিতা। ধর্মদাসবাবু আরো বলেন—সেই পরম পিতাকে উপলব্ধি করো মাসেই পরম সত্যকে গ্রহণ করতে চেষ্টা করো—সেই পরম শুচিকে আপন চিত্তের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করো।
জবা জিজ্ঞেস করে—আমাকে আপনি একটা কথা বুঝিয়ে দিন—যা আমার ভালো লাগে তা সঞ্চয় আর ভোগ করার মধ্যে কোনো কিছু অন্যায় আছে কি?
ধর্মদাসবাবু বলেন—খারাপ তো কিছু নেই মা, যে জিনিষ আমাদের স্পর্শ-দৃষ্টি-শ্রুতি-বোধকে তৃপ্ত করে, তাদের মধ্যে তো নিন্দে করবার কিছু নেই মা, খারাপটা রয়েছে আমারই মধ্যে যে—যখন আমি সব ত্যাগ করে আমাকেই ভরণ করি, তখনই সেটা অশুচিকর হয়ে ওঠে মা-এই স্বার্থপরতার দিকটাই অসত্য, তাই সেটা অপবিত্র। অন্নকে যদি গায়ে মাখি, তবে সেটা অপবিত্র, কিন্তু যদি খাই, তাতে তো অশুচিতা নেই, কারণ গায়ে মাখাটা যে অন্নের সত্য ব্যবহার নয়।
জবা আবার জিজ্ঞেস করে—আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি—অতীতটা সত্য, না বর্তমান সত্য, আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন?
ধর্মদাসবাবু বললেন—এ-কথার উত্তর তত কঠিন নয় মা, যখন তুমি শোক থেকে শোকের উধ্বে উঠবে, তখন বুঝতে পারবে সত্য চিরকালের—সত্যের তো অতীত বর্তমান নেই মা।
জবা বলে—কিন্তু যে-সত্য ঘটে গিয়েছে আমার অজ্ঞাতে, আমার জ্ঞানের অগোচরে, ধরুন আমার যখন বয়েস দু’মাস-সে সত্যকেও কি পরম-সত্য বলে মনে করতে হবে?
ধর্মদাসবাবু বললেন—ওই একই কথা হলো মা, যতদিন আগেই ঘটুক, আর যে বয়েসেই ঘটুক, আমার দিকটা যখন একান্ত হয় তখনই সে অসত্য হয়—এইজন্যেই সে অপবিত্র হয়ে ওঠে, কেননা কেবলমাত্র আমার মধ্যে তো আমি সত্য নই। সেইজন্যে যখন কেবল আমার দিকেই আমি সমস্ত মনটাকে দিই, তখনই আত্মা অসতী হয়ে ওটে, সে শুচিতা হারায়। খানিক থেমে নিয়ে ধর্মদাসবাবু আবার বললেন—আত্মা পতিব্রতা স্ত্রীর মতে—তার সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ আপনার স্বামীকে নিয়ে সত্য হয়, তার স্বামীই তার প্রিয় আত্মা, তার সত্য আত্মা, তার পরম আত্মা—তার সেই স্বামী সম্বন্ধেই উপনিষদ বলেছেন-’এষাস্য পরমাগতিঃ, এষাস্য পরমা সম্পৎ, এবোহস্য পরমো লোকঃ, এমোহস্য পরম আনন্দঃইনিই তার পরম গতি, ইনিই তার পরম সম্পদ, ইনিই তার পরম আশ্রয়, ইনিই তার পরম আনন্দ।
ধর্মদাসবাবু চলে যাবার পরই হঠাৎ জবা উঠলো। উঠে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় খিল বন্ধ করে দিলে।
ভূতনাথ একবার শুধু বললে—কিছু খাবে না জবা?
সে-কথার উত্তরও দিলে না জবা। কিন্তু যেটুকু দেখা গেল, তাতে মনে হলো শরীরের সমস্ত রক্ত যেন তখন জবার মুখে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বিছানায় গিয়ে যেন এখনি সে উপুড় হয়ে কাঁদতেই শুরু করবে!