আহোঁকে শোলে জিস জা উঠতে থে মীর সে
শব্
বাঁ জাকে সুবহ দেখা মুশত্-এ গুবার পায়া।
(যে জায়গাটিতে মীরের হাহাকারের শিখা লেলিহান ছিল কাল রাতে
আজ ভোরবেলায় সেখানে গিয়ে শুধু একমুঠো ছাই দেখতে পেলাম।)
অবধ অধিকার করে ব্রিটিশ যখন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে কলকাতায় নির্বাসনে পাঠাল, রাগে-ঘৃণায় আমি দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিলুম, মান্টোভাই। অবধের কাছে তো আমি বাইরের মানুষ। তবু মনে হয়েছিল, যেন আমাকেই উৎখাত করা হয়েছে। যে-ব্রিটিশকে একদিন নতুন সভ্যতার দূত মনে হয়েছিল, অবধের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আমি তাদের দাঁত-নখ দেখতে পেলুম। শুধু রাগ আর ঘৃণা নয়, হতাশাও আমাকে গ্রাস করেছিল। এক-একটা রাজ্যকে ধ্বংস করে, নবাবদের নির্বাসনে পাঠিয়ে, ব্রিটিশ কি তা হলে এভাবেই আমাদের তজ্জীবকে গোরে পাঠাবে? বিচারবোধ যে-মানুষের আছে, তার পক্ষে কখনও এই ধ্বংস প্রবৃত্তি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, ভাইজানেরা। অবধের একজনকে চিঠি লিখে আমি এ-কথা জানিয়েও ছিলুম। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর নির্বাসন আমি মেনে নিতে পারি নি। মান্টোভাই, আমার মনে হয়েছিল, ওরা এবার খুব তাড়াতাড়ি আমাদের গ্রাস করবে, গোটা হিন্দুস্থানের মানুষকেই-হিন্দু বা মুসলমান যেই হোক-ওরা নির্বাসনে পাঠাবে; মোহাজির হয়ে এবার পথে পথে ঘুরতে হবে আমাদের।
তখনই আরেকরকম কথাও শোনা যাচ্ছিল। ব্রিটিশরা তো ততদিনে জানিয়েই দিয়েছে, কেল্লা থেকে সরিয়ে মুঘল বংশধরদের কুতুব শাহী-র কাছে কোনও মহলে নিয়ে যাওয়া হবে আর। জাঁহাপনা জাফরের পর বাদশা খেতাব কেউ পাবেন না। ব্রিটিশ যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই সবাইকে মেনে নিতে হবে? শাহজাহানাবাদের অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, পারস্যের শাহেনশা বা রুশের সম্রাট জার এসে এই ফিরিঙ্গিদের তাড়িয়ে দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরব আবার ফিরিয়ে দেবেন। গদর শুরু হওয়ার দুমাস আগে জামা মসজিদের দেওয়ালে কারা যেন একটা কাগজ সেঁটে দিয়ে গিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, পারস্যের শাহ তাঁর নিপীড়িত মুসলমান ভাইদের বাঁচাতে খুব তাড়াতাড়ি এ-দেশে আসবেন। কেল্লার পিরজাদা হাসান আক্সারিও গণনা করে বলেছিলেন, এমন কিছু ঘটতে চলেছে যাতে মুঘল সাম্রাজ্যের ইমান ও নিশান আবার। আকাশে উড়বে। কিন্তু তা যে গদর-সিপাইদের বিদ্রোহ-তা আমরা বুঝতে পারিনি।
তবে হাওয়ায় কত যে গুজব ভাসছিল, ভাইজানেরা। ওইসব গুজব শুনে শুনে মনে হত, আমরা যেন পরিস্থানে বেঁচে আছি। কথাগুলো সবাই এর-ওর কানে ফিসফিস করে বলত। তো একদিন চাঁদনী চকে গুলাম নবির পানের দোকানে পাহাড়গঞ্জের থানেদার মইনুদ্দিন হাসান খানের সঙ্গে দেখা। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলুম, চারদিকে কী সব শুনছি, মিঞা?
-আরে মির্জাসাব, আমার তো দিমাক খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
-এসব গাপবাজি তা হলে সত্যি?
-কী করে বলি, বলুন! তবে তলে তলে কিছু একটা চলছেই, মির্জাসাব।
-চাপাটির ব্যাপারটা কী?
-ওসব তো আমিও শুনেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করিনি, মির্জাসাব। কাল ভোরে হঠাৎ ইন্দ্রপুর গাঁওয়ের চৌকিদার এসে আমাকে একটা চাপাটি দেখাল। সরাই ফারুক খানের চৌকিদার নাকি তাকে চাপাটিটা দিয়েছে। ওইরকম পাঁচটা চাপাটি বানিয়ে কাছাকাছি পাঁচটা গাঁওয়ে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ গাঁওয়ে চৌকিদারকেও জানিয়ে দিতে হবে, তারো যেন পাঁচটা করে চাপাটি বানিয়ে পরের গাঁওগুলিতে পাঠিয়ে দেয়। এ যে কী ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারছি না, মির্জাসাব।
-চাপাটির ভেতরে কেউ কোনও খবর পাঠাচ্ছে নাকি?
-না। চাপাটির ভেতরে তো কিছু নেই। আবার শুনলাম কোথাও কোথাও নাকি খাসির গোস্ত বিলি করা হচ্ছে।
-এ তো জাদুকরের খেলা, মিঞা।
দিনে দিনে সবকিছু কেমন রহস্যময় হয়ে উঠতে লাগল, মান্টোভাই। ফিসফিস করে কথা বেড়ে যেতে লাগল। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হত, কেউ যেন কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। নানা জায়গা থেকে সিপাইদের বিদ্রোহের খবর আসতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশ সিপাইরা নাকি নানারকম সুযোগসুবিধা পায় আর এ-দেশের সিপাইদের সঙ্গে ক্রিতদাসের মতো ব্যবহার করা হয়। এদিকে পলাশির যুদ্ধের একশো বছর হতে আর কয়েক মাস বাকি। শুনলুম, ওয়াহাবিরা নাকি ঘোষণা করেছে ২৩ জুন হিন্দুস্থানের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতেই হবে। শাহজাহানাবাদ এমনিতে শান্ত ছিল, কিন্তু চারদিক থেকে ভেসে আসছিল যুদ্ধ পরিস্থিতির হাওয়া।
১১ মে। দিনটা যেন ওঁৎ পেতে আমাদেরে জন্য অপেক্ষা করছিল ভাইজানেরা। একেবারে চিতা বাঘের মতো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুপুরে কেল্লার দরজা ও দেওয়াল কেঁপে উঠল আর তার প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল শহরের চার কোণে। সে ছিল ভূমিকম্পের চেয়েও ভারী, ভাইজানেরা। মেরঠ থেকে বিদ্রোহী সিপাইরা এসে অধিকার করল শাহজাহানাবাদ। দরিয়াগঞ্জের কাছে রাজঘাট দরজা দিয়ে ওরা শহরে ঢুকেছিল। শহরের রক্ষী –সৈনিকরাও ওদের সঙ্গে হাত মেলাল। শুরু হল হত্যার বীভৎস উৎসব। রক্তে-রক্তে মুছে গেল শাহজাহানাবাদের চেনা মানচিত্র। ব্রিটিশ আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দেখলেই হত্যা করো, তাদের বাড়িঘর লুঠপাট করে জ্বালিয়ে দাও; কিন্তু যে কোনও হত্যাকাণ্ডে শুধু তো শত্রুপক্ষই মরে না, ভাইজানেরা, উলুখাগড়ারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, শাহজাহানাবাদের কত সাধারণ মানুষও যে হারিয়ে গেল, তার কোনও হিসাব নেই।
বিদ্রোহী সিপাইদের নেতা মহম্মদ বখত খান ছিল বেরিলি-র পদাতিক বাহিনীর এক সুবেদার। তার নেতৃত্বে জাঁহাপনা বাহাদুর শাহকে একরকম বন্দিই করে ফেলা হয়েছিল। শুধু সিপাইরা যা করবে সে-ব্যাপারে তাঁকে সম্মতি দিতে হবে। বখত খানের একটাই কথা, আপনিই আবার। হিন্দুস্থানের সম্রাট হবেন জাঁহাপনা। শুধু আমাদের কথা শুনে চলতে হবে। শাহজাদা মির্জা মোগলকেও ওরা তখন পাশে পেয়ে গিয়েছে। সব কিছুতে হ্যাঁ বলা ছাড়া জাঁহাপনার আর কিছুই তখন করার ছিল না। হয়তো তাঁরও লোভ হয়েছিল, এই হাঙ্গাম-হুজ্জোতের মধ্য দিয়ে যদি আবার পুরনো তক্ত ফিরে পাওয়া যায়। নিজের তো কোনও মুরোদ ছিল না। কীই বা করতে পারতেন তিনি? তখন তাঁর বিরাশি বছর বয়স, সারাক্ষণ তো শুয়ে-বসে শুধু ঝিমোন।
জাঁহাপনাকে সামনে রেখে বড় ছেলে মির্জা মোগলই হয়ে উঠল সর্বেসর্বা। শাহজাদা জওয়ান বখত্ হল উজির। কোতোয়ালকে আবার কাজে বহাল করা হল। আর মহম্মদ বখত্ খানের খেতাব কী হল জানেন? সাহের-ই-আলম বাহাদুর। মুঘল দরবারে আগে এমন কোনও পদই ছিল না। জাঁহাপনা যাঁকে সবথেকে বিশ্বাস করতেন, সেই হাকিম আসানুল্লা খানকে ব্রিটিশের গুপ্তচর হিসাবে চিহ্নিত করা হল। একদিন তাঁকে হত্যা করার জন্য তাঁর হাভেলিতে লোকজন চড়াও হল, কিন্তু তখন তিনি কেল্লায় বাদশাহর সঙ্গে; হাভেলিতে না পেয়ে উন্মত্তরা কেল্লায় এসে হাজির হল, বাদশাহ তাঁকে নিজে জড়িয়ে ধরে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু হাকিমসাবের বাড়িতে লুঠপাট করা হল, চিনা ছবির মতো অমন সুন্দর মহল জ্বালিয়ে দেওয়া হল।
মান্টোভাই, জাঁহাপনা জাফর যেমনই হোন, তার তো তজ্জীব ছিল-জাঁহাপনা বাবর থেকে সেই তজ্জীব রচনা শুরু হয়েছিল আর তা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল জাঁহাপনা আকবরের সময়-শুধু ফতেপুর সিক্রির কথা ভাবলে ওই তজ্জীবের সৌন্দর্য আপনি বুঝতে পারবেন-মিঞা তানসেনের গান তো সেই সংস্কৃতির শিখর-জাঁহাপনা জাহাঙ্গীরের তসবিরখানায় এই তৰ্জীবের কত আশ্চর্য ছবিই যে দেখা যেত-মান্টোভাই, এই অসভ্য, বর্বর, সিপাইদের মেনে নেওয়া জাঁহাপনার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কেল্লা যেন ওদের কাছে একটা আস্তাবল মাত্র। মির্জা মোগলকে তিনি একবার বলেছিলেন, এদের নিয়ে তুমি এই সাম্রাজ্য রক্ষা করবে মির্জা? ঘোড়ায় চড়ে ওরা যেখানে – সেখানে ঢুকে পড়ে; ব্রিটিশ অফিসাররা কখনও এমন করতেন না, দিওয়ান-ই-আমের দরজার সামনে ঘোড়া থেকে নেমে খালি পায়ে ঢুকতেন।
-সাম্রাজ্য রাখতে হলে ওদের দরকার জাঁহাপনা।
-এই বেত্তমিজদের? আমি কিছু খবর রাখি না ভাব? বাজারের পর বাজার ওরা লুঠ করছে। ইংরেজরা লুকিয়ে আছে ধুয়ো তুলে যে-কোনও শরিফ আদমির বাড়িতে ঢুকে পড়ছে, আর লুঠতরাজ চালাচ্ছে।
-তাতে আপনার কী জাঁহাপনা? আপনি সম্রাট থাকতে চান না? ওরা তো আপনাকেই সম্রাট বানিয়েছে।
-ছোটলোকদের সম্রাট।
-তবু সম্রাট তো।
হ্যাঁ, মান্টোভাই, আসলে সে এক ওলোটপালটের সময় এসেছিল। আমিও কিছু বুঝতে পারছিলুম না। এ এমন এক অন্ধকার সময়, যখন আপনাকে কোনও একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে : হয় আপনি জাঁহাপনার দিকে, না হলে ব্রিটিশের পক্ষে থাকবেন। আমার মতো মানুষ কি অত সহজে পক্ষ বেছে নিতে পারে? আমি জানতুম, কবি হিসেবে আমার কারুর কাছেই মূল্য নেই; ওরা শুধু প্রয়োজন মতো আমাকে ব্যবহার করবে। আমি তো উলুখাগড়া ছাড়া আর কিছু নই। আমাকে দুদিকই সামলে চলতে হবে। বাদশার কোপ যেন আমার ওপর না-পড়ে; আবার গোরারাও যাতে আমাকে সন্দেহ করতে না-পারে।
তাই ঘরের কোন বেছে নিয়ে আমি লিখতে বসে গেলুম, মান্টোভাই। এইরকম সময়ে একজন কবি কী আর করতে পারে? কয়েক শতাব্দীর সাম্রাজ্য যখন একটা পচাগলা মৃতদেহ, আর। সভ্যতার দূত হিসাবে যারা এসেছে, তাদের কোমরবন্ধে লুকনো ছুরিও যখন দেখতে পাচ্ছি, তখন অক্ষরের সামনে বসে শবসাধনা ছাড়া আমি আর কী করতে পারতাম? আমি দস্তম্বু লিখতে বসে গেলুম। চারপাশে যা দেখছি, যা শুনছি, যেভাবে জীবন কাটছে, সেই কথাগুলোই ফারসি গদ্যে লিখে ফেলতে হবে। সেই রক্তাক্ত অধ্যায়ের নাম আমি দিয়েছিলুম দস্তম্বু-ফুলের তোড়া-ভেবেছিলুম, ও যে রক্তাক্ত ফুলের তোড়া, তা কেউ না কেউ বুঝতে পারবে, কিন্তু পরে বুঝেছিলুম, ইঙ্গিতটুকু কারও মাথাতেই ঢোকেনি। সেজন্য নিজের তারিফও করেছিলুম। মিঞা, এত দিনে এসে তা হলে তুমি ঠারেঠোরে কথা বলার আদবকায়দা শিখেছ। ওটুকু তো শিখতেই হবে, মান্টোভাই। নইলে বিদ্রোহীদের বা গোরাদের গুলি আমার বুকে এসে বিধত।
বাদশাহের দরবারে আমাকে যেতেই হত। কবিতা সংশোধনের কাজ ছাড়াও আমাকে তো বোঝাতে হবে, আমি তাঁদের সঙ্গেই আছি। বিদ্রোহীদের সহায়তায় তার চারমাসের রাজত্বে জাঁহাপনা যে মুদ্রা বাজারে ছাড়লেন, তার গায়ে লেখা শেরটিও আমি লিখে দিয়েছিলুম :
বর জরি আফতাব ও নুকরা-এ-মাহ্
সিক্কা জদ দর জাঁহা বাহাদুর শাহ্
বিদ্রোহীরা জাঁহাপনাকে হিন্দুস্থানের সম্রাট ঘোষণার পর আমি তার উদ্দেশ্যে একটা কসীদাও লিখেছিলুম। জাঁহাপনা একদিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, উস্তাদজি, কী দেখছেন বলুন তো?
-জাঁহাপনা, আবার আপনার দিন ফিরে এসেছে।
-না। প্রদীপ নেভার আগের শিখা আপনি দেখেননি?
-জি জাঁহাপনা।
-আমিই প্রদিপের সেই শিখা। বাদশাহ না বললেও আমি তা জানতুম। আমি তাঁকে সেদিন একটা সের শুনিয়েছিলুম :
হম-নে বহশৎকদহ্-এ বজম্-এ জহাঁ -মেঁ জুঁ শমা
শোলহ্-এ ই-কো অপনা সর ও সামাঁ সমঝাঁ।
(দুনিয়ার এই ভয়ানক উজাড় মজলিশে প্রদীপের মতো আমি
প্রেমের শিখাকেই আমার সর্বস্ব জ্ঞান করলাম।)
-কেয়া বাৎ, কেয়া বাৎ, উস্তাদজি।
মাঝে মাঝে দরবারে গিয়ে নিজের আনুগত্য প্রমাণ করা ছাড়া নিজের কুঠুরিতে বসে আমি দস্তম্ভ লেখার কাজই চালিয়ে যাচ্ছিলুম। আমার মনে হয়েছিল, আমি কার পক্ষে বা বিপক্ষে, এটা জানানোর চেয়েও, এই বয়ানটা রেখে যাওয়া জরুরি। যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ভাবে আমাকে দুর্দশার দিনলিপি লিখে যেতে হবে। আমি জানি, নিরপেক্ষ ভাবে কিছুই করা সম্ভব হয় না। তবু ঘটনার বিবরণ আমি লিখে রাখতে চেয়েছিলুম।
মান্টোভাই, আপনি ক্ষুব্ধ হবেন জানি, তবু ওই ছোটোলোক সিপাহিদের রাজত্ব আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমার তজ্জীব তো আলাদা। আমি না খেয়ে মরে গেলেও কারও তসবিরমহল পুড়িয়ে দিয়ে আসতে পারব না। তসবির তো আমার চোখের-মনের খিদে মিটিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, কেল্লার এক একটি সৌন্দর্য সিপাইরা কীভাবে ধ্বংস করেছে। বিদ্রোহ জিইয়ে রাখার জন্য ওদের তখন দরকার রুটি আর পয়সা। ওরা কত অমূল্য সম্পদ বেঁচে দিয়েছিল। বিদ্রোহের নাম যদি এই বর্বরতা হয়, আমি তাঁকে সমর্থণ করি না। তাই আমি। মনে-প্রাণে চেয়েছিলুম ব্রিটিশ যেন শাহজাহানাবাদ অধিকার করতে পারে। তাতে অন্তত শান্তি ফিরে আসবে।
ধীরে বন্ধু, আপনি অবধ অধিকারের কথা তুলতে চাইছেন তো, মান্টোভাই? আমি মনে-প্রাণে তাঁকে ঘৃণা করি। তবু একফোঁটা আমার বিশ্বাস ছিল, ব্রিটিশ হয়তো এভাবে সব সৌন্দর্যকে শেষ করে দেবে না। ভাবুন মান্টোভাই, সিপাহিরা সব ব্যারাকে থাকে-সে তো জেলখানার মতোই জায়গা-খাওয়া-ঘুম-যৌনখিদের বাইরে আর কিছুই শেষ পর্যন্ত তাদের থাকে না। যে – তজ্জীব নিয়ে ওরা ব্যারাকে আসে, যুদ্ধের প্রস্তুতির নিষ্ঠুরতায় তা-ও একদিন হারিয়ে যায়। সিপাইরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করতে পারে-নগরের পর নগর ধ্বংস করতে পারে-স্বাধীনতা কখনও আনতে পারে না, মান্টোভাই। স্বাধীনতা আনতে পারে একমাত্র পথের মানুষ-তাদের হাতের অস্ত্র বলতে পাথর, গাছের ডাল, বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া দীর্ঘ-দীর্ঘ শতাব্দীর লড়াইয়ের স্মৃতি-নিজের ঘর, নিজের নদী, নিজের জঙ্গল বাঁচানোর লড়াই-স্বাধীনতা তো শুধু মানুষের জন্য নয় মান্টোভাই-ঝরনার স্বাধীনতা, গাছের স্বাধীনতা, পাখির স্বাধীনতা, মাছের স্বাধীনতা-ব্যারাকের সৈনিক কি সেই স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারে? ওদের তো শুধু যুদ্ধই শেখানো হয়েছে স্বাধীনতার লড়াই তো বন্দুক-কামান নিয়ে যুদ্ধের চেয়ে বেশী কিছু।
আমি আজ আপনাদের এতসব কথা বলতে পারছি, কিন্তু তখন তো মুখে কুলুপ এঁটে রাখার সময়। তাই সস্তম্ভ লিখে যাওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না আমার। এদিকে বিদ্রোহী শহর দখল করার পর সরকারের কাছ থেকে পাওয়া পেনশনও বন্ধ হয়ে গেছে। কী করব, বাড়ির এতগুলো লোকের পেটের খাবার কোথা থেকে জোটাব জানি না। ভাবতে ভাবতে আমার শুধু হাসি পেত।
জুজ নাম নহীঁ
সুরৎ আলম্ মুঝে মনজুর
জুজ ওয়াহম্ নহী, হস্তী-এ আশীয়া মেরে আগে।
(পৃথিবী রয়েছে শুধু নামেই,
সবই কল্পনা, সবই অস্তিত্বহীন এখানে।)
দিনগুলি মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছিল। আর আমি ভাবছিলুম, কবে ইংরেজরা শাহজাহানাবাদের দখল নেবে, কবে আমার অবস্থা স্বাভাবিক হবে। বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় নি, সে তো জানেনই মান্টোভাই। মে মাসের এক সোমবার সিপাইরা শাহজাহানাবাদ তাদের হাতের মুঠোয় নিয়েছিল, আর ওই বছরই ১৪ সেপ্টেম্বর, আরেক সোমবার, ইংরেজরা শহর দখল করল। লড়াই চলেছিল ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সেদিনই কেল্লা দখল করল ব্রিটিশ। জাঁহাপনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন সম্রাট হুমায়ুনের কবরে। মান্টোভাই, এ যেন গজলের একটা শের। মরণোন্মুখ সম্রাট শেষ পর্যন্ত আশ্রয় খুঁজে পেলেন কবরে। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে, এই আশ্বাস পেয়ে ক্যাপ্টেন হত্সনের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। তাঁর দুই সন্তান মির্জা মোগল আর মির্জা খিজর সুলতানকে খুনি দরওয়াজার কাছে নিজে হাতে গুলি করে মারলেন। ক্যাপ্টেন হন। জাঁহাপনা তাদের দিকে ফিরেও তাকাননি, তখন শুধু নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। শুনেছিলাম, মির্জা মোগল নাকি মরার আগে বলেছিল, হিন্দু-মুসলমান ভাইয়েরা, মনে রেখো, তোমরা এক হলে অনেক কিছু পেতে পারো। মান্টোভাই সেসব দিনে কী ভয়ানক দৃশ্য দেখেছি। একুশজন শাহজাদাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে চাঁদনি চকে ফেলে রাখা হয়েছে, তাদের নগ্ন শরীরে সামান্য এক টুকরো কাপড়। এই কি মুঘল বংশধরদের প্রাপ্য ছিল? কেল্লার একটা ছোট্ট, অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে জাঁহাপনা আর বেগম জিনত মহলকে। তিনি যেন চিড়িয়াখানার এক জন্তু, গোরারা তখন জাঁহাপনাকে এভাবেই দেখতে যেত। একটা চারপাইয়ের ওপর ময়লা পোশাকে শুয়ে থাকতেন আর বারবার বলতেন বা খুশ হু, বরা খুশ হু। কারও কারও কাছে শুনেছি, দিন-রাত চুপচাপ মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন তিনি, মাঝে মাঝে ঘুমঘোর থেকে জেগে উঠে নিজের লেখা গজল আবৃত্তি করতেন। তারপর একুশ দিন ধরে চলল তাঁর বিচার। শুনেছি, বিচারপর্ব চলার সময়ও তিনি প্রায়শই ঘুমিয়ে থাকতেন। যে কুঠুরিতে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল তারই দেওয়ালে খড়ি দিয়ে তিনি লিখে রেখেছিলেন জীবনের শেষ গজল :
ন কিসি কি আঁখ কা নূর হু, ন কিসি কে দিল
কা করার হুঁ
যো কিসি কে কাম ন আ সকে, ম্যায় উয়ো এক মুশ্ত-এ-গুবার-হুঁ।
কারো চোখের আলো নই, কারও হৃদয়ের শান্তিও না, যে কোনও কাজেই এলনা, আমি সেই একমুঠো ধুলো।
মেরা রঙ্গরূপ বিগড় গয়া, মেরা
য়ার মুক্সে বিছর গয়া
যো চম খিজা সে উগড় গয়া, ম্যায় উসিকি ফসল-এ-বহার-হুঁ।
ঝরে গেছে আমার রং রূপ, ছেড়ে গেছে বন্ধু, যা হেমন্তে শুকিয়ে গেছে, আমি সেই বাগানের ফসল।
ম্যয় নহীঁ
হু নগ্মা-এ-জাঁফজা, মুঝে শুনকে কোই কারগা কেয়া
ম্যায় বড়ে বরোগ কি হুঁ
সদা, ম্যায় বড়ে দুখী কি পুকার হুঁ।
আমি তো প্রাণের সঙ্গিত নই, আমাকে শুনে আর কি হবে, আমি তো বিচ্ছিন্ন এক বিলাপ, বড় দুঃখের এক আর্তনাদ।
মান্টোভাই, ইংরেজরা অধিকারের পর শাহজাহানাবাদকে একটা মৃতপ্রায় পশুর আর্তনাদের মতোই মনে হয়েছিল আমার। যেদিন ওরা শহর দখল করল সেদিনই ব্রিটিশ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল উইলসন দেওয়ান-ই-খাসে নৈশভোজের ব্যবস্থা করল। এক রাতেই দেওয়ান-ই খাসের ইজ্জত ধুলোয় লুটিয়ে গেল। এখনও ভাবলে, জালে আটকা পড়া এক জন্তুর মতো। আমার ভেতরে রাগ ফুঁসে উঠতে থাকে। সব বলব ভাইজানেরা, সব- কীভাবে শাহজাহানাবাদ উজাড় হয়ে গেল। দিল্লিতে পরে থাকা আমরা কিছু মানুষ দোজখের আগুনের ভেতর দিয়ে দিন গুজরান করতে লাগলুম। এই দিনগুলোতেই মির্জা ইউসুফ আমাদের ছেড়ে চলে গেল। মান্টোভাই। আমার এক ভাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি; প্রায় তিরিশ বছর ইউসুফ উন্মাদের জীবন কাটিয়েছে। কিন্তু কারও কোন অসুবিধে কখনও করে নি; নিজের মনে চুপচাপ বসে বিড়বিড় করত, কখনও কখনও কয়েদিনের জন্য হারিয়ে যেত, আবার ফিরে আসত। ব্রিটিশরা। দিল্লি দখলের পর অত্যাচার আর মৃত্যুর ভয়ে অনেকেই তো পালাচ্ছিল, ইউসুফের বিবি মেয়েরাও ওকে একা ফেলে চলে গেল। মান্টোভাই, দস্তম্ভ-তে ইউসুফ মিঞার মৃত্যুর যে কারণ আমি লিখেছিলাম, তা মিথ্যে। আসলে দস্তম্ভ তো আমি লিখেছিলাম ইংরেজদের কাছে পেশ করার জন্য, যাতে এই কিতাব পড়ে ওরা আমাকে খেতাব ও খিলাত দেন, আমার। পেনশনের সুরাহা করেন। সচেতনভাবে দস্তম্ভ-তে আমি এমন কিছু লিখতে চাইনি, যাতে ইংরেজরা আমাকে বিদ্রোহীদের পক্ষের লোক হিসাবে সন্দেহ করতে পারে। তবু কী জানেন, লেখা একসময় লেখকের হাতের বাইরে চলে যায়; লেখা নিজের জীবনের ধর্মেই সত্যের অনেক হালহদিশ তার ভিতর লুকিয়ে রাখে; তাই ব্রিটিশ আমাদের কোন নরকে নিয়ে গেছে, তার ছবিও আপনি দস্তম্ভ-র মধ্যে পাবেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যই হিন্দুস্থানের মুক্তির দূত, হ্যাঁ কথা আমি বারবার দস্তষু-তে লিখেছি, কিন্তু বিদ্রোহ শুরুর পর থেকে পনেরো মাসে শাহজাহানাবাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, আমাদের পোকামাকড়ের মতো বেঁচে থাকার ছবিটাও সেখানে আঁকা আছে।
দস্তম্বু-তে আমি লিখেছিলুম, পাঁচদিন প্রবল জ্বরে ভুগে মির্জা ইউসুফ মারা গেছে। তার বাড়ির চৌকিদার এসে আমাকে খবরটা দিয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ মারা গিয়েছিল ব্রিটিশের গুলিতেই। তখন চারদিকে সবসময় গোলাগুলি চলছে। তারই আওয়াজে উত্তেজিত হয়ে ইউসুফ রাস্তায় বেরিয়ে গিয়েছিল; তারপর ব্রিটিশের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল। মান্টোভাই, আমি জানি, খোদা কখনও আমার এই গুনাহ্ ক্ষমা করবেন না। নিজের গায়ের চামড়া বাঁচাতে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর মিথ্যে খতিয়ান আমি রেখে গেছি আমার লেখায়। দোজখ থেকে আমার কখনও মুক্তি নেই। এবার আমি তার মৃতদেহ নিয়ে কি করি? শাহজাহানাবাদের তখন যা অবস্থা, কফনের একটুকরো কাপড় কোথায় পাব জানি না। শবদেহ পরিস্কার করবে কে, কোথায় পাব কবর খননকারী, ইট-চুনও বা কোথা থেকে আসবে? কোন কবস্থানে শুইয়ে দিয়ে আসব? হিন্দুরা অন্তত যমুনার তীরে গিয়ে মৃতদেহ পুড়িয়ে দিয়ে আসতে পারত। কিন্তু আমরা মুসলমানরা কী করব? রাস্তায় সবময় গুলিগোলা চলছে, ইউসুফকে কবরস্থানে নিয়ে যাবই বা কীভাবে? কয়েকজন প্রতিবেশী পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ছিল কাল্লু আর আমার বাড়ির আরেক নোকর। ওরাই শবদেহ গোসল করাল, কয়েকটুকরো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ইউসুফদের বাড়ির কাছেই মসজিদের জমিতে গর্ত খুঁড়ে ওকে কবর দিল। রক্তের শেষ সম্পর্কটুকুও হারিয়ে গেল, মান্টোভাই।
সে তো হারিয়ে যাওয়ারই সময়। কত লোক পালিয়ে গেছে, কত লোককে শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যারা রয়ে গিয়েছিলুম, তারা ভয় আর আশার কারাগারে বন্দি। যারা চলে গেছে আর যারা রয়ে গেছে, কারও মনের শান্তির জন্যই কোনও মলম তখন ছিলএম। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হত, সবার মুখেই বিবর্ণ মুখোশ পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে মৃত্যু। চাঁদনী চক যেন মৃত্যুর এক উপত্যকা। ব্রিটিশরা যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে, গাছের ডাল থেকে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। চারদিকে গুপ্তচররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো আপনার সঙ্গে আমার কোনও কারনে শত্রুতা ছিল, এই সুযোগে আমি আপনাকে বিদ্রোহীদের দলের লোক বলে ব্রিটিশের হাতে তুলে দিচ্ছি।
মাঝে মাঝে ভাবি আমিও কি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি? করেছি ভাইজানেরা, আজ সে-কথা কবুল করতেই হবে। দস্তম্ভ ফারসি গদ্যের যত উজ্জ্বল নিদর্শনই হোক না কেন, তা একই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতারও দলিল। একটা দুঃসময়ের ছবি আমি এঁকেছিলুম, কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে বিদেশী সাম্রাজ্যের কাছে ছবিটাকে বেচেও দিয়েছি।
জিন্দগী অপনী যব ইস্ শকল্
সে গুজরী গালিব
হম্ ভি কেয়া ইয়াদ করেঁ কে খুদা রখতে থে।
(জীবন যখন এভাবেই কাঁটল গালিব,
ঈশ্বরের কৃপার কথা কীই-বা স্মরণ করব।)