রোমাঞ্চকর কাহিনীর নায়কের মত কোনো ভূমিকা নেবার আদৌ ইচ্ছে ছিল না গঙ্গানারায়ণের, কিন্তু পাকেচক্ৰে তাকে প্ৰায় সেরকমই হতে হলো। জঙ্গলের আস্তানা থেকে সে দু-একবার বাইরে বেরুবার চেষ্টা করেই বুঝলো, আবহাওয়া অতিশয় উষ্ণ, চাষীদের সঙ্গে নীল কুঠীয়ালদের সংঘর্ষ লাগছে। প্রায়ই। ম্যাকগ্রেগারের চ্যালা-চামুণ্ডারা শিকারী কুকুরের মতন গঙ্গানারায়ণের সন্ধানে চতুর্দিকে শুকে শুকে ফিরছে, গঙ্গানারায়ণের প্রহারে নাকি ম্যাকগ্রেগরের একটি চক্ষু বিষমভাবে জখম হয়েছে, এর প্রতিশোধ তারা নেবেই। গঙ্গানারায়ণের চেহারার বর্ণনা এবং পরিচয় এ তল্লাটে কারুর আর অজানা নেই। কোনো অপরিচিত গ্রামবাসীও গঙ্গানারায়ণকে দেখলে কাছে এসে মিনতি মাখা কণ্ঠে বলেন, বাবু, আপনে শিগগৈর পালান, আপনেরে ধরতি পাল্লি সাহেবরা আপনের কইলজ্জা টাইন্যে ছিঁড়ে ফেলবে!
তারা এই কথা বলে, আবার গঙ্গানারায়ণকে দেখবার জন্যও গ্রামসুদ্ধ লোক ভিড় করে আসে। কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পায়ে। সে ম্যাকগ্রেগরের মতন একজন চরম অত্যাচারী সাহেবের চাবুকের মার ফিরিয়ে দিয়েও এখনো সশরীরে টিকে আছে, এ বিস্ময়ের আবেগ তারা কী করে প্রকাশ করবে, বুঝতে পারে না। আস্তে আস্তে তাদের কাছে গঙ্গানারায়ণ মানুষের বদলে অতিমানুষ হয়ে যায়।
গঙ্গানারায়ণ বুঝতে পারলো জঙ্গলের আস্তানা ছেড়ে বাইরে আসা তার পক্ষে এখন সত্যিই বিপজ্জনক। কলকাতায় সে কিছুতেই পালাবে না। এখানে থেকে আইনের আশ্রয় নেওয়াও সম্ভব নয়, কারণ পুলিসবাহিনীকে ক্রয় করে রেখেছে নীলকুঠীয়ালরা। জঙ্গলের মধ্যেও তারা যে-কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে বলে তোরাপ এবং অন্য সঙ্গী-সাথীরা ভাঙা ইট ও গাছের ডালপালা দিয়ে প্রায় ছোটখাটো একটা দুর্গের মতন বানিয়ে ফেলেছে, গঙ্গানারায়ণের বন্দুক তাদের ভরসা জোগায়।
মাঝে মাঝে রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তার দু-একজন চর পাতিসর অরণ্য ছেড়ে বাইরে যায়, অত্যাশ্চর্য সব সংবাদ সংগ্ৰহ করে তারা ফিরে আসে। কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়াই গ্রামের পর গ্রামের নিরীহ, দুর্বল চাষীরা কোথা থেকে এমন শক্তি পেল কে জানে! এতকাল অত্যাচার সহ্য করবার পর তারা হঠাৎ ঠিক করেছে, এ বৎসর কিছুতেই আর নীল চাষ করবে না। তার জন্য প্ৰাণ যায়, তাও সই। চতুর্দিকে আগুন জ্বলছে। কোন গ্রামে কবে কী ঘটনা ঘটছে, তা গঙ্গানারায়ণের জানা হয়ে যায়।
আহাৰ্য সংগ্রহের জন্যও তোরাপ ও তার সঙ্গীদের যেতে হয় গ্রামে। গ্রামবাসীরা স্বেচ্ছায় তাদের মুষ্টিভিক্ষা দেয়। সে সময় ওরা জঙ্গলের গুপ্ত আখড়া সম্পর্কে গ্রামবাসীদের কী বোঝায় কে জানে, কিন্তু এক নিরুদ্দিষ্ট জমিদারপুত্র বহুদিন পর ফিরে এসে বন্দুক হাতে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে চাষীদের নিয়ে দল গড়েছেন, ইংরেজ এখন তাঁর নামে ভয়ে কাঁপে।। এই সব কাহিনীর সঙ্গে আরো অনেক কল্পনা মেশে। ফলে নানারকম অলৌকিক কাহিনীও ছড়াতে শুরু করে গঙ্গানারায়ণের নামে। অনেকের বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়ে গেল যে গরিবের উদ্ধারের জন্য এই মানুষটি দৈব প্রেরিত।
গঙ্গানারায়ণের নির্দেশে তার চরেরা হিন্দু পেট্রিয়টের কপিও সংগ্রহ করে আনে। লোকের মুখে এর নাম হরিশের কাগজ, অতিশয় দুর্লভ, কিন্তু নিষিদ্ধ গোপন ইস্তাহারের মতন, যার দরকার তার হাতে ঠিক পৌঁছেও যায়। সেই পত্রিকার পৃষ্ঠায় সারা দেশের চিত্রটি দেখতে পায় গঙ্গানারায়ণ। নীল চাষের ফলে বাংলার অনেক জেলা যে একেবারে ছারেখারে যাচ্ছে, সে কথা যুক্তি ও তথ্য দিয়ে সবিস্তারে বুঝিয়ে চলেছেন। হরিশ মুখুজ্যে। সরকারী কর্মচারী ও নীলকর সাহেবরা যোগসাজস করে যে একই সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের এবং সরকারের কীভাবে ক্ষতি করে চলেছে, তার বাস্তব বিবরণ দিচ্ছেন তিনি প্রতি সংখ্যায়। যশোর থেকে শিশিরকুমার ঘোষ নামে এক ব্যক্তিও নীলকরদের অত্যাচার এবং বঞ্চিত চাষীদের জীবনের মর্মদ্ভদ সংবাদ পত্রাকারে পাঠাচ্ছেন হিন্দু পেট্রিয়ট কাগজে। কে এই শিশিরকুমার ঘোষ! সে পরিচয় জানা যায় না, কিন্তু ইনি নিজ উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সত্য ঘটনার বিবরণ সংগ্রহ করে জানিয়ে দিচ্ছেন দেশবাসীকে।
এই পত্রিকা পড়ে গঙ্গানারায়ণ কিছু বিস্মিতও হয়। নীল চাষ সম্পর্কে এই সব ব্যক্তিদের এমন আগ্রহ কেন? নীল চাষের জন্য দুভোগ তো শুধু গ্রামের চাষীদের, এমন কি জমিদাররাও এর সঙ্গে তেমন জড়িত নয়। তাদের কিছু কিছু জমি নীলকরদের ইজারা দিয়ে জমিদাররা এ ব্যাপার থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছে, এখন এই চাষের লাভ-ক্ষতির সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্ক নেই। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তো কিছুই যাবার আসবার কথা নয়। গঙ্গানারায়ণের মনে পড়ে না, গ্রামের কৃষকদের নিয়ে এত রচনা সে আগে কখনো কোনো ইংরেজী কাগজে দেখেছে। হরিশ মুখুজ্যে বা শিশিরকুমার ঘোষের মতন ব্যক্তিদের এত উদ্বেগ কেন নীল চাষীদের অবস্থা সম্পর্কে? যদি হরিশ মুখুজ্যে নামের লোকটির সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয়, গঙ্গানারায়ণ এই প্রশ্নটি করবে। গঙ্গানারায়ণের নিজস্ব একটা দায় আছে, সেইজন্য ওদের ভাগ্যের সঙ্গে সে নিজেকে জড়িয়েছে। কিন্তু সে দায় তাদের জমিদারির কিংবা বংশের ঐতিহ্যের কাছে নয়, সম্পূর্ণই নিজস্ব।
একদিন দ্বিপ্রহরে তোরাপ বন্দুক বন্দুক বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো গোপন আস্তানায়। সে দেখে কয়েকজন সশস্ত্ৰ লোক এসে প্রবেশ করেছে এই জঙ্গলে। নিশ্চয়ই নীলকরদের বাহিনী অথবা পুলিস। এ জঙ্গলে কেউ কেউ শখ করে শিকারের জন্যও আসে বটে কিন্তু বর্তমানের বিপজ্জনক সময়ে কে শিকারের শখ পুষে রাখবে!
তোরাপ ও তার সঙ্গীরা লাঠি নিয়ে গোপন আনাচে কানাচে মুখ লুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলো। গঙ্গানারায়ণ দাঁড়ালো বন্দুক হাতে নিয়ে। তার বক্ষ কম্পিত হচ্ছে। বন্দুক চালিয়ে তাকে মানুষ মারতে হবে? শুধু আত্মরক্ষার জন্য নয়, তার সঙ্গীদের বাঁচাবার জন্য সে অস্ত্ৰ ব্যবহার করতে বাধ্য। তার মুহুর্মুহু মনে হতে লাগলো, এর চেয়ে হৃষীকেশের শাস্ত, স্নিগ্ধ, মনোরম পাহাড়তলীর জীবন কি অনেক শ্রেয় ছিল না??
কিছু দূরে গাছপালার ফাঁকে দেখা গেল তিনটি লোককে। তাদের হাতে লাঠি আছে। কিন্তু বন্দুক রয়েছে কিনা বোঝা গেল না। তোরাপ উত্তেজিত চাপা স্বরে বললো, মারেন, বড়বাবু, হুম্মুন্ধির পাগুলানরে লিকট আইতে দিবেন না! মারেন!
গঙ্গানারায়ণ তবু বন্দুক উঁচিয়ে স্থির হয়ে রইলো।
দূরের দলটির মধ্য থেকে একটি লোক বেশী সামনে এগিয়ে এলো। বলিষ্ঠকায় ব্যক্তিটির গায়ে হলুদ রঙের নিমা, মল্লকচ্ছ দিয়ে ধুতি পরা, হাতে একটি পিতলের গোট দেওয়া লাঠি। সে চেঁচিয়ে বললো, সিংগীবাবু! সিংগীবাবু!
গঙ্গানারায়ণের সঙ্গীরা পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে বিস্ময় বিনিময় করলো। তোরাপ বললো, ও হালায় ফুইন্দাবাঝ, ওডারে শ্যাষ কইর্যে দ্যান।
দূরের লোকটি এবার দু হাত তুলে বললো, আমি সিংগীবাবুর সাথে দ্যাখ্যা করতে আইছি, আমার নাম দিগম্বর বিশ্বাস!
গঙ্গানারায়ণ এবার জোরে উত্তর দিল, তুমি যেই হও, হাতের লাঠিটা ফেলে দাও, তারপর এক এগিয়ে এসো!
লোকটি লাঠিখানাকে আস্তে, খুব সন্তৰ্পণে শুইয়ে দিল মাটিতে, তারপর মুখ তুলে গম্ভীর স্বরে বললো, আমি চৌগাছার দিগম্বর বিশ্বাস, আমার সময় অতি অল্প, দু চারডি কথা কয়ে চলে যাবো। রাজি থাকেন তো বায়রায় আসেন, নচেৎ ফিরে যাই।
গঙ্গানারায়ণ বন্দুক নামিয়ে বললো, আসুন, আপনার বা দিকে একটু ঘুরে আসুন, ওদিকে ঢোকার পথ।
দিগম্বর বিশ্বাসের বয়েস তিরিশের নিচে, মুখখানি তেজোদীপ্ত। যে ভাঙা গৃহটিতে গঙ্গানারায়ণদের আস্তানা, সেখানে প্রবেশ করে সে প্রথমে গঙ্গানারায়ণের দিকে বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চেয়ে রইলো। তারপর বললো, আপনিই সেই লোক! লোকে তা হলে মিছে কথা বলে না। আমি ভেবেছিলাম বুঝি সবই গল্প কথা।
গঙ্গানারায়ণ বললো, আপনি কে? চিনলুম না তো!
দিগম্বর বিশ্বাস বললো, খাড়াইয়া সব কথা হবে না; আপনে বসেন, আমিও বসি। অনেক দূর থানে আসতেছি।
শুকনো পাতা জড়ো করে শয্যা প্ৰস্তুত করা আছে গঙ্গানারায়ণের, সে তার ওপর বসলো। দিগম্বর বিশ্বাস বসলো মাটিতেই খানিকটা দূরত্ব রেখে। অন্যরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়েছে তাদের। দিগম্বর বিশ্বাস তাদের দিকে হাত তুলে বেশ ব্যক্তিত্বসহকারে বললো,এই, তোরা যা করতেছিলি কর। আমার সাথে কয়েকজন লোক আছে, কেউ গিয়া তাদের ডাইক্যে আন। এখোন থিক যা, বাবুর সাথে আমার কথা আছে।
তারপর দিগম্বর বিশ্বাস মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে গঙ্গানারায়ণকে প্ৰণাম জানালো। মুখ তুলে বললো, আমি আপনেরে আগে দেখি নাই। তয় আপনের পিতা রামকমল সিংগীরে দেখছি বাইল্যকালে।
গঙ্গানারায়ণ নীরবে প্রতীক্ষা করতে লাগলো। দিগম্বর বিশ্বাস বললো, আপনে আমারে দেইখ্যে অবাক হইছেন। আমিও কম অবাক হই নাই। হাটে-বাজারে সর্বত্র লোকে কয় যে সিপাহী বিদ্রোহের এক নেতা হিমালয় পাহাড়ে অ্যাতদিন পলাইয়া রাইছিলেন, অখন নীল চাষীগে লইয়া বিদ্রোহ করবার জন্যে এদিকে আসছেন। তিনি আবার জমিদার সিংগবাবুগো বাড়ির এ পোলা!
গঙ্গানারায়ণ এবার হাসলো। সিপাহী বিদ্রোহের নেতা? লোকের কল্পনার দৌড় এতদূর পর্যন্ত গেছে! সিপাহী বিদ্রোহের কথা গঙ্গানারায়ণ জানতোই না, হরিদ্বার হৃষীকেশে সে বিদ্রোহের কোনো তরঙ্গই পৌঁছোয়নি।
-এবার কাজের কথা বলুন!
—হ, কাজের কথা তো আছেই। আমি চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের জন্য আসি নাই। আগে আমার পরিচয়ডা দিয়া লই। আমারে পাঠাইছেন আমার দাদা। তাঁর নাম বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস। তিনি দেবতুল্য মানুষ। তিনি মেহেরপুরের নীলকুঠীর দেওয়ান আছিলেন।
তোরাপ এবং তার সঙ্গীরা একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একথা শুনে তাদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো। নীলকুঠীর দেওয়ান একটি অতিশয় ঘৃণ্য পরিচয়। এই লোকটি তো তা হলে নীলকুঠীর সাহেবদেরই চর।
দিগম্বর বিশ্বাস তাদের উদ্দেশে ধমক দিয়ে বললো, আরো ব্যাটারা, কইলাম তো আছিলেন, এখন নাই। আমিও ছিলাম, ঐ কুঠীর গোমস্থা, ছিলাম, এখন নাই। দাদায় আর আমি চাকরিতে ইস্তফা দিছি। কেন দিছি জানেন? আগে ঐ কুঠার ম্যানেজার ছিলেন ম্যাকফারসন সাহেব। তিনি মানুষ ভালো, ইস্কুল-হাসপাতাল কইরা দিছেন নিজ ব্যয়ে। সব ইংরেজই খারাপ না, ইংরাজগো মইধ্যেও ভদ্দরলোক, ছুটলোক, চোর, ছাচ্চোড় আছে। যত ছুটলোক আর ছ্যাচ্চোড় সাহেবরাই নীলের ব্যবসা করে। অখন মেহেরপুরের কুঠীর ম্যানেজার ইয়ার্ডলি ঐ রকম এক ছুটলোক। দেওয়ান-গোমস্থাগো দিয়া হ্যায় চাষীগো অইত্যাচার করাইতে চায়। চক্ষুর চামড়া নাই, পিশাচ, সাদা পিশাচ, এ দ্যাশের মানুষরে মানুষ বইলা গইনা করে না। রক্ত চুইষা খাইতে চায়। সেই দেইখ্যাই দাদায় আর আমি চাকরিতে ইস্তফা দিছিল।
—বেশ, ভালো কতা। আমার কাচে এসেচেন কেন?
—আপনে ছাড়া আর কেউ পরিত্ৰাতা নাই।
—পরিত্ৰাতা? আমি? আপনি কী বলতে চান খুলে বলুন তো!
—আপনের মতন আমারে পাইলেও মাথা কাটবে নীল বান্দররা। আমার দাদার নামে পুলিসের হুলিয়া। চাকরি ছাড়ার পর চাষীরা আমাগো কাছে আইস্যা ধনা দিত। খালি কন্দে আর কয়, বাঁচান কত্তা, আমাগো বাঁচান! জীব মাত্রেই বাঁচতে চায়। সাহেবের জীবন, জমিদারের জীবন, চাষার জীবন, সবই তো ভগবানের সৃষ্টি। আমরা দুই ভাই চাষীগো কইছি, যদি বাঁচতে চাও, নীলের চাষ দিও না। তোমাগো রক্তে জমি লাল হউক, তবু নীল যানো না হয়! চৌগাছা, মেহেরপুর—এইসব অ্যালাকায় কোনো চাষী এবার নীল চাষ দেয় নাই।
—এরকম কিচু কিচু খবর আমি শুনিচি।
—শুধু আমাগো অ্যালাকা নয়, অইন অ্যালাকাতেও আমরা চাষীগো গিয়া কই, নীল চাষ বন্ধ করে। এই বৎসরেই একটা হ্যাস্তন্যাস্ত হইয়া যাবে।
দিগম্বর বিশ্বাস একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর খানিকটা আবেগের সঙ্গে বললো, এবার আপনের উপর ভরসা!
এই লোকটির সঙ্গে আরও কিছু সময় ধরে কথাবার্তা বলে গঙ্গানারায়ণ বুঝলো,তার অজ্ঞাতসারেই সে একটি বেশ বড় ব্যাপারের কেন্দ্রে এসে গেছে। দিগম্বর বিশ্বাসের মনের জোর আছে, সে একবার যখন এই ব্যাপারে নেমেছে, এর শেষ না দেখে সে ছাড়বে না। ঠিক কোনো স্বার্থে নয়, এক ধরনের আত্মসম্মানবোধেই সে এত দৃঢ়। লোকটির ব্যক্তিত্ব গঙ্গানারায়ণকে বেশ স্পর্শ করে।
দিগম্বর বিশ্বাসের বক্তব্য এই যে, শুধু নীল চাষ বন্ধ রাখলেই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। এই বৎসরের ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতা নীলকর সাহেবদের আছে। কিন্তু তারা উৎপীড়ন, অত্যাচার আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে চাষীদের মনোবল ভেঙে দেবে, পরের বৎসর চাষীরা আবার নীল চাষে বাধ্য হয়ে প্রবৃত্ত হবে। সুতরাং সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিরোধ করা দরকার। বারবার সাহেবদের ওপর পাল্টা আক্রমণ করে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলার মানুষ তাদের জোর জুলুমের বাণিজ্য আর কিছুতেই মেনে নেবে না। গ্রামে গ্রামাঞ্চলে কুঠী স্থাপন করে তারা আর নিরাপদে বাঁচতে পারবে না।
কিন্তু এই পাল্টা আক্রমণের জন্য চাষীদের সংঘবদ্ধ করবে কে? নির্যাতিত, গরিব চাষীরা কখনো কি একযোগে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছে? যোগ্য নেতৃত্ব না থাকলে কার নির্দেশে তারা লড়াই করার জন্য এগিয়ে যাবে? বিশৃঙ্খলভাবে লড়তে গেলে তারা শুধুমার খেয়েই মরবে! দিগম্বর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা চাষীদের বোঝাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সকলে তাদের চেনে না কিংবা বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে ফরাজীরাও নীল চাষীদের লড়াই করার ডাক দিয়েছে। সব দিকে যদি একসঙ্গে শুরু হয়। লড়াই, তবে নীল ব্যবসার ভিত্ ধসে পড়তে পারে। এখন পাকেচক্রে এই নেতৃত্বের ভার গঙ্গানারায়ণের ওপরই বর্তেছে।
ইতিমধ্যেই মাঝে মাঝে এখানে ওখানে সংঘর্ষ বাঁধছে। কুঠীয়ালদের পাইকদের আক্রমণ করছে গ্রামবাসীরা। এক অত্যাচারী আমিনের লাশ ভাসতে দেখা গেছে নদীর জলে। ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন এক সাহেব, দূর থেকে কে তীর নিক্ষেপ করেছে, সে তীর সাহেবের গায়ে না লাগলেও ঘোড়াটি
তীরবিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হয়, সাহেবের পা ভেঙে যায়। গ্রাম-গ্রামান্তরে সমস্ত মানুষের বিশ্বাস, এই সব কীর্তিই গঙ্গানারায়ণের। মধ্যরাতে শোনা যায় দূরে কোথাও গোলাগুলির শব্দ। গৃহস্থরা ঘুম ভেঙে উঠে বসে বলে, ঐ গঙ্গানারায়ণ সিংগী যাচ্ছে সাহেবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আর কিছুদিন পরেই বোধ হয় লোকে গঙ্গানারায়ণের কাল্পনিক মূর্তি গড়িয়ে পুজো করবে!
গঙ্গানারায়ণ বললো, কিন্তু আমি তো এসব কিচুই করিনি।
দিগম্বর বিশ্বাস বললো, আপনের নামে তো রাটেছে। সেইতেই আমাগো লাভ। আপনের নামে এবার মন্তরের মতন কাজ হবে। আপনের ডাক শুইনলে সক্কলডি এক স্থানে এসে খাড়াবে, আপনে হুকুম দিলে এক দিকে ধেয়ে যাবে। লোকে ভাবে আপনের অলৌকিক শক্তি আছে। আপনে হিমালয় পাহাড়ের থনে আইছেন-বোঝলেন না, কুসংস্কারাচ্ছইন্য বদ্ধ জীব সব, তুক-তাক, মন্তর-তন্তর, এই সবের দিকে অন্ধের মতন টান। আপনে সেডারে কামে লাগান। আপনের নামে এত কিছু রটছে, এবার কিছু ঘটান।
গঙ্গানারায়ণের তবু জড়তা কাটে না। যতই হোক সে একজন অন্তর্মুখী মানুষ। এক সঙ্গে এতগুলি মানুষের জীবন-মরণের ঝুঁকি নিয়ে এত বড় একটা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তাকে। এক একবার সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আবার ভেতর থেকে কেউ যেন রাশ টেনে ধরে। তখনি কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সে দিগম্বর বিশ্বাসকে বললো, আরও পরামর্শের জন্যে সেখানেই দিন দু-এক থেকে যেতে।
পরের দিনই একদল গ্রামবাসী এসে উপস্থিত। দূর দূরান্তর থেকে যেমন লোকে কোনো জাগ্রত ঠাকুরের কাছে ধনাদিতে আসে, সেইরকম তারাও এসেছে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন গঙ্গানারায়ণের কাছে তাদের দুঃখের কথা জানাতে। তারা গঙ্গানারায়ণের পায়ের কাছে কেঁদে পড়লো। নীলকুঠীর পাইকরা তাদের গ্রাম থেকে দুটি যুবতী বধূকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে একজন অন্তঃসত্ত্বা। এই অবস্থায় কোনো গৃহবধূর ধর্মনাশ হলে সবংশে নির্বংশ হবার অভিশাপ লাগে। গঙ্গানারায়ণ কি এর প্ৰতিকার করবে না?
তোরাপ ও তার দলবল হই-হুই রই-রই করে উঠলো। বেশ কিছুদিন বনবাসের ফলে তাদের মধ্যে যেন বন্য আদিম শক্তি জেগেছে। তারা আঘাত হানবার জন্য উন্মুখ। ইদানীং নারী হরণের ঘটনা বেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ কুঠীয়ালদের ধারণা, চাষীদের ঘরের লক্ষ্মী কেড়ে নিয়ে গেলে তারা কাঁদতে কাঁদতেই আধমড়া হয়ে যায়। তখন সামান্য অঙ্গুলি হেলনেই তারা গড়িয়ে গড়িয়ে এসে পা চাটে।
দিগম্বর বিশ্বাস গঙ্গানারায়ণকে বললো, চলেন না, একবার শক্তি পরীক্ষা হইয়া যাক।
নানা কোলাহলের মধ্যে গঙ্গানারায়ণ সম্মতি জানাতে বাধ্য হলো।
সেই রাতেই প্ৰায় চল্লিশজন লাঠিধারী কৃষকের একটি দল নিয়ে তারা আক্রমণ করলো একটি নীলকুঠী। এবং প্রথমবারেই তাদের জয় হলো অতি সহজে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেই নীলকুঠীতে হয় বন্দুক ছিল না অথবা চালাবার মতন সম্বিৎ কারুর ছিল না। দুজন সাহেবই ছিল অত্যন্ত নেশাগ্ৰস্ত। গঙ্গানারায়ণকে বিশেষ কিছু করতেই হলো না। বন্দুক হাতে নিয়ে সে শুধু গেল আগে আগে, আর হিংস্র উন্মাদনায় ছুটে এলো চাষীরা তার পিছু পিছু। এর আগে কোনো নীলকুঠী আক্রমণ করার মতন সাহস কেউ দেখায়নি, এরা সোজা গিয়ে ভেঙে ফেললো নীলকুঠার দ্বার। একজন সাহেব কোনোক্রমে পলায়ন করলো, অপর সাহেবটিকে ভূপাতিত করে তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়াল তোরাপ। যুবতী বধু দুটিকে পাওয়া গেল অর্ধমৃত অবস্থায়।
যে-সব ঘটনায় গঙ্গানারায়ণের কোনো অংশ ছিল না, তারও কৃতিত্ব জমা হচ্ছিল গঙ্গানারায়ণের নামে। এবার তার সত্যিকারের একটি জয়-কাহিনী ছড়িয়ে পড়লো দশগুণ হয়ে। গ্ৰাম্য কবিয়ালরা গান বাঁধলো গঙ্গানারায়ণের নামে :
এবার নীলের ক্যাঁতায় আগুন লেগেছে
গঙ্গা সিংগী ঝাঁপিয়ে পড়েছে,
ওরে ওরে নীল হনুমান, দাঁড়া দাঁড়া
গঙ্গা সিংগী দুয়োরে আছে খাড়া।
কর্মযজ্ঞ একবার শুরু হবার পর আর দ্বিধার দোলাচলের সুযোগ রইলো না। গঙ্গানারায়ণ ঘন ঘন বদল করতে লাগলো তার আস্তানা। এবং এক একদিন এক এক গ্রামে সদলবলে ঝটিকার মতন উপস্থিত হয়ে কৃষকদের বিদ্রোহের দীক্ষা দিতে লাগলো। যে দু-চারজন চাষী তাদের জমিতে নীল চাষ করেছিল, সে সব জমি থেকে উপড়ে ফেলা হলো নীল-ফসল। নীলকুঠীর পাইকদের সঙ্গেও সংঘর্ষ হলো কয়েকবার। দিগম্বর বিশ্বাস ঠিকই বলেছিল, তার উপস্থিতিই অলৌকিক শক্তির মতন কাজ করে। যেখানেই সে যায়, সেখানেই জোয়ারের স্রোতের মতন ছুটে আসে চাষীরা, তাদের বিরুদ্ধে নীলকুঠীর পাইকরা কী করবে!
একটি ক্ষেত্রে বন্দুকের গুলি চালাতে হয়েছিল গঙ্গানারায়ণকে। বিপরীত দিক থেকে এক সাহেবও গুলি ছুঁড়েছিল। উভয়পক্ষের কেউই হতাহত হয়নি, তবু তাতেও যেন গঙ্গানারায়ণের অলৌকিক শক্তির আরও বেশী করে প্রকাশ হলো। আকাশ ফাটানো চিৎকারে গঙ্গানারায়ণের নামে জয়ধ্বনি তুললো তার অনুগামীরা।
প্ৰায় মাসাবাধিকাল গঙ্গানারায়ণের জয়যাত্রা অব্যাহত রইলো। মনে হলো যেন সাহেবরা পশ্চাৎ অপসরণ করেছে অনেক আগেই। কোনো জায়গাতেই গঙ্গানারায়ণের দলকে তেমন বড় বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। নীলকর ও পুলিস হাত মিলিয়ে চলে, তেমনও দেখা গেল না। চাষীদের অনেকখানি মনোবল ফিরে এলো। ভিটেমাটি ছেড়ে যারা পলায়ন করেছিল, তারাও আবার ফিরে এলো বাস্তুভূমিতে। বহু বছর পর অনেক চাষী তাদের জমিতে নীলের বদলে আবার ধান চাষের উদ্যোগ শুরু করলো।
এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন ধরা পড়ে গেল গঙ্গানারায়ণ।
কিছু কিছু রায়তের নিজস্ব জমিতে সাহেবরা জোর করে নিজেদের মুনীষ দিয়ে নীল চাষ করেছিল। সেইসব জমি আবার দখলে এনে, নীলের চারা উৎপাটিত করে চাষীদের অধিকার ফেরত দেবার তদারক করছিল গঙ্গানারায়ণ। হঠাৎ এসে পড়লো অশ্বারোহী পুলিস বাহিনী। গত কয়েকদিন কোনো রকম পুলিস বা নীলকুঠীর পাইকদের সাড়া শব্দ না পেয়ে গঙ্গানারায়ণের সাহস বেড়ে গিয়েছিল, সঙ্গে নিজের পুরো দলটি আনেনি, আর দিনের আলোয় এমন ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ানো তার উচিত হয়নি।
পুলিস বাহিনী দূর থেকেই বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করতে করতে আসছে। গঙ্গানারায়ণ দেখলো, ওদের কাছে অনেকগুলি বন্দুক। অসম যুদ্ধ চালিয়ে কোনো লাভ নেই, তাই অনর্থক রক্তপাত এড়াবার জন্য গঙ্গানারায়ণ তার সঙ্গীদের বললো, তোরা সরে পড়, চাষীদের মধ্যে মিশে যা ধীরে ধীরে, আমি দেকচি।
গোঁয়ারের মতন সম্মুখ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হয়ে কিংবা পলায়ন করতে গিয়ে পিছন থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মরলে চাষীদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। তার চেয়ে বরং সসম্মানে আত্মসমর্পণ করা ভালো। এর পর যদি আইনের আশ্রয় নিয়ে লড়াই করা চালিয়ে যাওয়া যায়।
বন্দুক সমেত দক্ষিণ হস্তটি উঁচু করে গঙ্গানারায়ণ এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
পুলিস বাহিনীটি পরিচালনা করছিল গঙ্গানারায়ণেরই স্কুলের সহপাঠী সেই ভগীরথ দারোগা। ঘোড়া থেকে নেমে সে নিজের হাতে গঙ্গানারায়ণের হাত ও কোমরে দড়ি বাঁধলো। দড়ির অগ্রভাগটি নিজের হাতে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সে চুপি চুপি বললো, তোর ভালোর জন্যই তোকে অ্যারেস্ট কলুম রে, গঙ্গা। এছাড়া তোকে বাঁচাবার আর উপায় ছেল না। কলকেতা থেকে আরও ফৌজ আসচে, তোকে দেকা মাত্তরই গুলি করার অডার বেরিয়েচে। এই কটা চাষাভুষো নিয়ে তুই এদের সঙ্গে লড়তে চাস! আমি কালকেতায় তোদের বাড়িতে চিটি লিকে দিইচি। সেখেন থেকে কেউ এসে তোকে জামিনে খালাস করে নেবে। আর যদি কেস লড়তে হয় লড়বে। আর একদিনও বাইরে থাকলে তোকে প্ৰাণে বাঁচানো যেত না!
গঙ্গানারায়ণের মুখখানি ভাবলেশহীন। বাল্যের সহপাঠীর মুখের দিকে সে একবার তাকিয়েও দেখলো না।
সেই রাত্রিটা গঙ্গানারায়ণকে আটক করে রাখা হলো হাজতে। পরদিন বিকেলে এত্তেলা এলো যে তাকে পাঠাতে হবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের তাঁবুতে। খোদ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাকে দেখতে চান।
শৃঙ্খলিত অবস্থায় গঙ্গানারায়ণকে আনা হলো সেখানে। ম্যাজিস্ট্রেটের তাঁবুতে আরও একজন উপস্থিত ছিল। সাহেবের বিশেষ বন্ধু নীলকর ম্যাকগ্রেগর। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর স্বদেশবাসী সুহৃদকে জিজ্ঞেস করলেন, ইজ দিস দা ম্যান?
ম্যাকগ্রেগরের একচক্ষে ঠলি পরানো। চিবুকে এখনো চাবুকের দাগ। সে প্রায় গর্জন করে উঠলো, ইয়েস!
ম্যাজিস্ট্রেট সহস্যে বললেন, বীট হিম।
সঙ্গে সঙ্গে চাবুক নিয়ে ম্যাকগ্রেগর একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো গঙ্গানারায়ণের ওপরে। চাবুকের শব্দে বাতাস শিহরিত হতে লাগলো, আর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব চুমুক দিতে লাগলেন চায়ের পেয়ালায়। খানিকবাদে তিনি বললেন, উহাকে একেবারে প্রাণে মারিও না, ম্যাকগ্রেগর। আমাদের এখানকার দারোগার ও বাল্যবন্ধু। উহাকে একেবারে হত্যা করিলে সে দুঃখ পাইয়া কিছু লিখিয়া ফেলিতে পারে। অবশ্য অচিরাৎ সে দারোগাকে বরখাস্ত করিবার ব্যবস্থা করিতেছি। তাহার পর সেই দারোগার উপরেও কয়েক ঘা মারিয়া হস্তের সুখ মিটাইও।
অচেতন, রক্তাক্ত অবস্থায় গঙ্গানারায়ণ পড়ে রইলো সেখানে।